বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত
বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত
মূল উর্দু : আল্লামা শাহ্ হোসেইন গার্দেজী
অনুবাদ ও টিকা : সুন্নী ফাউন্ডেশন, ঢাকাটেক্সট রেডীঃ মুহাম্মদ আব্দুল খালেক
সুন্নী ফাউন্ডেশনের পক্ষে
অনুবাদকের কথা
আল্লামা শাহ হোসাইন গার্দেজীর লিখিত উর্দু গ্রন্থ "হাক্বায়েক্বে তেহরীকে বালাকোট" বাংলায় অনুদিত হয়ে "বালাকোট আন্দোলনের হাকিকত" নাম ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করলো। এটি একটি সমালোচনা মূলক ইতিহাস গ্রন্থ। বালাকোট আন্দোলন তথা ভারতীয় ওহাবী আন্দোলনের প্রথম সারির ইতিহাস লেখকদের লেখায় নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি বিবৃত হয়েছে মাত্র। তাদের লেখার ফাঁক ফোকর দিয়ে যেসব সত্যকথা তাদের একান্ত অজান্তে বা অবচেতনায় বেরিয়ে এসেছে-এগুলোকে সম্বল করেই আল্লামা শাহ হোসেইন গার্দেজী "হাক্বায়েকে তেহরীকে বালাকোট" গ্রন্থটি বিন্যস্ত করেছেন। তৃতীয় কোন নতুনকথা বা নতুন থিওরী এতে স্থান পায়নি। তিনি ঐ পুরাতন গ্রন্থের উদ্ধৃতিগুলোর উপর কেবল মতামত পেশ করেছেন। কোন নিরপেক্ষ পাঠক তাঁর মতামত গ্রহণ করা না করার এখতিয়ার অবশ্যই রাখেন- কিন্তু উদ্ধৃতিগুলো অস্বীকার করতে পারবেন না কোন মতেই- যেহেতু মূল বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর এতে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লামা শাহ হোসেইন গার্দেজীর লেখার উপর পাঁচজন মনিষীর অভিমতও সংযোজিত হয়েছে। কাজেই পাঠকগণের বিচার বিশ্লেষণ করতে সহজ হবে বলে অনুবাদকের ধারণা।
গ্রন্থখানা সুখপাঠ্য ও রসাত্মকবোধক ইতিহাস বলে বিবেচিত হওয়ায় "সুন্নী ফাউন্ডেশন" বিশ্বস্ততার সাথে এর বাংলা অনুবাদ করে সুধী ও গবেষকদের খেদমতে পেশ করার ইচ্ছা পোষণ করেছে। আশা করি- এতে নিরপেক্ষ চিন্তাশীল গবেষক ও ইতিহাসবিদদের চিন্তা চেতনায় নতুন বিপ্লবের সৃষ্টি হবে এবং ইতিহাস পুনর্বিন্যাসে সহায়ক হবে। অপরদিকে স্থবির চিন্তাধারার কিছু কিছু লোকের কাছে এটা "অপ্রিয় সত্য বিষতুল্য" -এর মতই প্রথম প্রথম মনে হতে পারে। পরে অবশ্য সহনীয় হয়ে যাবে। আশা করি পাঠকগণ নিরপেক্ষ নির্দলীয় দৃষ্টিতে বইটির বিশ্লেষণ করবেন।
সুন্নী ফাউন্ডেশনের পক্ষে
অনুবাদক
___________________________________
হযরত পীর মুহাম্মদ করমশাহ আল আযহারী সাহেব বিচারক, শরয়ী আদালত, পাকিস্তান-এর
অভিমত
বিগত দেড় দুশো বৎসরের মধ্যে উপমহাদেশে রাজনীতি, ধর্মনীতি ও সংস্কারের নামে এমন কতগুলো আন্দোলন জন্ম নিয়েছে- যারা উপমহাদেশের ইতিহাসে নিজ নিজ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। সৈয়দ আহমদ বেরলভী এবং শাহ ইসমাঈল দেহলভীর কথিত "সংস্কার ও জিহাদ আন্দোলন" টিও উক্ত চেইনেরই একটি উল্লেখযোগ্য কড়া। এই আন্দোলন সম্পর্কে অতীতে অনেক কিছু লেখালেখি হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে। কিন্তু একটি কথা খুবই পরিস্কার যে, মুসলিহাত এবং অন্ধ ভক্তি - এই দুইটি জিনিস ঐতিহাসিকদের একটি শ্রেণীকে এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক প্রকৃত তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে- ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক- একেবারেই পঙ্গু করে রেখেছে। তাই এ ক্ষেত্রে একটি জিনিস খুবই প্রয়োজন ছিল যে, কোন সাহসী পুরুষ অগ্রসর হয়ে ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার সুন্দর চেহারা থেকে ধুলাবালির জঞ্জালগুলো পরিস্কার করে দিক, অথবা অপারগতার পর্দা সরিয়ে দিক।
আমার আনন্দ এজন্য যে, এই সৌভাগ্য আল্লামা শাহ হোসেইন গার্দেজীর হিস্যায় পড়েছে। তিনি বালাকোট আন্দোলন (১৮২৩-১৮৩১ ইং) এবং এর হোতাদের সম্পর্কে প্রকৃত সত্য ঘটনাগুলোকে যেভাবে সাধারণের দৃষ্টিতে আনয়ন করার চেষ্টা করেছেন- তা সত্যিই প্রশংসারযোগ্য। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি চিত্তাকর্ষক এবং প্রামাণিক - যাতে মতভেদের কোন অবকাশ নেই। বালাকোটের কথিত আন্দোলনের প্রকৃত স্বরূপ জানার জন্য নওজোয়ান আল্লামা শাহ হোসেইন গার্দেজীর "বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত" গ্রন্থটি খুবই ফলদায়ক প্রমাণিত হবে এবং সত্য কথা হলো এই যে, এই গ্রন্থটি পাঠ করা ব্যতীত বালাকোট আন্দোলনের প্রকৃত তথ্য পর্যন্ত পৌঁছানো শুধু কঠিনই নয়- বরং অসম্ভবও বটে।
মুসলিহাত ও অন্ধ ভক্তির মোটা মোটা পর্দায় গোপন করে রাখা প্রকৃত তথ্যকে আলো ও ভাষা দান করে আল্লামা গার্দেজী প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- গ্রন্থখানা জ্ঞানী সমাজে পরিপূর্ণভাবে সমাদৃত হবে। আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করি - তিনি যেন আপন প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর তোফায়লে আল্লামা গার্দেজীকে মহান পুরস্কারে ভূষিত করেন এবং তাঁর ইলম ও কলমে অজস্র বরকত দান করেন। আমিন ছুম্মা আমীন।
- (পীর) মুহাম্মদ করমশাহ আল-আযহারী।
____________________________
হাকীম নাসির উদ্দীন নদভী, ফাজেলে নদওয়াতুল উলামা লক্ষ্মৌ, ভারত- এর
অভিমত
আমাদের অন্তরঙ্গ মেহেরবান ও সম্মানীত ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা শাহ হোসেইন গার্দেজী সাহেব "বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত" নামক যে কিতাবখানা প্রণয়ন করেছেন- তা ভাষার চিত্তাকর্ষনে, বর্ণনার সৌন্দর্যে এবং তথ্যের হৃদয়গ্রাহিতায় অতুলনীয়। এ গ্রন্থে ঐ সমস্ত ঐতিহাসিক প্রকৃত তথ্যগুলো বিশুদ্ধতার সাথে জনগণের দৃষ্টিতে নিয়ে আসা হয়েছে- যার উপর এতদিন পর্দা ফেলে রাখা হয়েছিল। এতে একথাও প্রমাণ করা হয়েছে যে, ইসমাঈল দেহলভী ও সৈয়দ আহমদ বেরলভীর অন্ধ ভক্তরা কথিত স্বাধীনতার আন্দোলনের এই দুই মুজাহিদকে যেভাবে ইংরেজ বিরোধী যোদ্ধা বলে প্রচারণা চালিয়েছে, প্রকৃত তথ্য তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দুজন কথিত নামকরা মুজাহিদ ইংরেজের বিরুদ্ধে কখনও যুদ্ধ ময়দানে অবতীর্ণ হননি বরং ইংরেজদের ইশারা ও ইঙ্গিতেই শিখ এবং সীমান্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন : যুদ্ধের শুরুতে, মাঝে এবং শেষে, এ দুজন ছিলেন ইংরেজের বন্ধু- শত্রু নয়।
আলোচ্য গ্রন্থে সবচেয়ে বড় যে কাজটি হয়েছে, তা হচ্ছে- বর্তমান যুগের (১৯৫৬) একজন নামধাম বিহীন তথাকথিত ঐতিহাসিক গোলাম রসুল মেহের- এর ইতিহাস বিকৃতির মুখোশ পুরাপুরিভাবে উন্মোচিত করা হয়েছে এবং সভ্য দুনিয়াকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই কথিত ইতিহাসবিদ আপন প্রশংসিত জনদেরকে কিভাবে খ্যাতি ও মর্যাদার উচ্চাসনে এবং মহান শাহাদাতের উচ্চমার্গে পৌঁছিয়ে দেয়ার কসরত করেছেন এবং ইতিহাসে কি কি বিকৃতি অত্যন্ত চতুরতার সাথে সম্পন্ন করার প্রয়াস পেয়েছেন।
হযরত গার্দেজী গভীর ঐতিহাসিক গবেষণার মাধ্যমে একথাও প্রমাণ করেছেন যে, সৈয়দ আহমদ বেরেলী ইলমের দৌলত থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিল এবং সাথে সাথে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা হতেও বিলকুল অন্ধ ছিল। কম ইলমও কম বুদ্ধি প্রমাণিত হওয়ার পর সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর কৃত অপরাধ অনেকটাই হাল্কা হয়ে যায় এবং সব দোষে দোষী সাব্যস্ত হন ইসমাঈল দেহলভী। কেননা, এই ইসমাঈল দেহলভী বিভ্রান্তিকর চিন্তাধারায় নিমগ্ন ছিল এবং ভ্রান্ত দলের মধ্যেই শিক্ষা প্রাপ্ত হয়েছিল। জাহিলিয়াতের এই উৎকর্ষতার ফলেই ইসমাঈল দেহলভী নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমকক্ষ আরো নবী সৃষ্টি হওয়া সম্ভব (ইমকানে নজির) নামক নূতন থিওরী আবিষ্কার করেছিল। (এর ফলেই পরবর্তীকালে কাশেম নানুতুবী ও গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নূতন নবী আগমনের সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত করে দেয়- অনুবাদক)।
ইংরেজের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদানকারী সুন্নী আলেম আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী (রহঃ) এ মাসআলায় (পরবর্তী নবীর আগমন সম্ভব) ইসমাঈল দেহলভীর মোকাবিলায় এসে দাঁড়ান এবং "ইমতিনাউন নজির" গ্রন্থ লিখে চিরদিনের জন্য ইসমাঈল দেহলভীর মুখ বন্ধ করে দেন। অদ্যাবধি আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর (রহঃ) উক্ত কিতাবের মোকাবেলায় কেউ দাঁড়াতে সাহস করেনি।
ইসমাঈল দেহলভী অজ্ঞতার দ্বারা নবুয়তের যে দরজা খুলেছিল, আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী (রহঃ) অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, ছরওয়ারে কায়েনাত ফখরে মাউজুদাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর মত বা সমকক্ষ (মাছিল ও নাজির) বিশ্বজগতে দ্বিতীয় কেউ হওয়া মূলত-ই অসম্ভব ব্যাপার।
হাকীম নাসির উদ্দীন নদভী লক্ষ্মৌ
___________________________________
খাজা রাদী হায়দার
কায়েদে আযম একাডেমী, করাচী-এর
অভিমত
"বালাকোট আন্দোলন" ইতিহাসের পাতায় যাকে কথিত "আযাদী আন্দোলন" নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে- তা নিজের নামের মধ্যে খুবই আকর্ষণ এবং রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। আকর্ষণী বলছি এই জন্য যে, যে যুগে (১৮২৩-১৮৩১) এই আন্দোলনটি দৃশ্য পটে আসে, সে যুগটি ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য এক বিরাট পরীক্ষার নিকৃষ্টতম যুগ। সে যুগে মানুষের মানসিক অবস্থা এতই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, তারা প্রত্যেক চকচকে জিনিসকেই স্বর্ণ মনে করতো (বালাকোট আন্দোলনকে খাঁটি মনে করতো)। চকচকে ঐ সভ্যতাকে তারা ধর্মও মিল্লাতের নামে ঔষধের ন্যায় শুধু শিশিতে ঢেলেই ক্ষান্ত হতো না- বরং উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সুযোগ সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে তা গলাধঃকরণও করে ফেলতো। এই কারণেই বালাকোট আন্দোলনের ন্যায় এধরনের আন্দোলনগুলোতে ঐ যুগের মুসলমানরা- শুধু সাধারণ মানুষ নয় বরং চিন্তাশীল ব্যক্তিরাও- পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই ব্যক্তি স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে সম্পৃক্ত হয়ে যেতো। পরে ভুল ধরা পড়লে হয়তো ঐ আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক ছেদ করতো- নয়তো নীরব হয়ে যেতো। এই ইতস্ততঃ অবস্থা চলছিল মুসলমানদের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম- অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত। এরপর আস্তে আস্তে গন্তব্য স্থল নির্ধারিত হতে লাগলো। ঐ বালাকোট আন্দোলনকে রহস্যঘেরা বলছি এ কারণে যে, ঐ আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এবং সব দিকগুলো আজও গোপন পর্দায় আবৃত রয়ে গেছে।
বালাকোট আন্দোলনের উপর এ পর্যন্ত অনেক কিছুই লেখা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, কিন্তু এই বিষয়ের উপর এযাবৎ লিখিত কোন গ্রন্থই পূংখানুপূংক্ষরূপে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়নি- বরং ঐগুলোতে কেবল আবেগপূর্ণ লেখারই প্রাধান্য দেখা যায়। মাওলানা জাফর থানেশ্বরীর লিখিত সাওয়ানিহে আহমদী নামক জীবনী গ্রন্থ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি সিলেবাসভূক্ত ইতিহাসের বইগুলোতে একতরফাভাবে- একই কথা লিখা হচ্ছে। এমতাবস্থায় ইতিহাসের লুকায়িত প্রকৃত তথ্যগুলো জনগণের সামনে উপস্থাপন করার দুঃসাহস করা বিপদ ডেকে আনারই শামিল।
বালাকোট আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত কোন ব্যক্তি বা ঘটনা পাকিস্তান আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তির সাথে পরোক্ষভাবেও কোন সম্পর্ক নেই। কাজেই পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তির সাথে সম্পর্কহীন এই বালাকোট আন্দোলনের একটি সমূহচিত্র তুলে ধরা এবং এর কুফল ও গোপন রহস্যগুলোকে চিহ্নিত করা স্বদেশ বিরোধীতা নয়- বরং সুস্থ ইতিহাস চর্চারই অঙ্গ বলে বিবেচিত।
অভিজ্ঞতা একথারই সাক্ষী দেয় যে, যেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার স্থান আবেগ, উচ্ছাস এবং অনুমান দখল করে নেয়- সেখানে পথহারা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।
অত্র গ্রন্থকার মাওলানা শাহ হোসেইন গার্দেজী অনুসন্ধান ও তাহকীক করে "বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত" গ্রন্থে ঐ আন্দোলনের এমন অনেক নূতন দিক উন্মোচিত করেছেন- যেগুলো পুরাতন প্রথাগত চিন্তা ধারাকে সম্পূর্ণ খন্ডন করে দেয়। "বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত" গ্রন্থটি যদিও প্রশংসিত গ্রন্থকারের জন্য (হোসেইন গার্দেজী) আগুনে পা রাখার শামিল- কিন্তু মার্জিত ও শিক্ষিত সমাজে তার এই মহৎ প্রচেষ্টাকে সম্মানের চোখেই দেখা হবে।
প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসের অসীম জটিলতার সমাধান শুধু কয়েকটি নিবন্ধ বা কিছু গ্রন্থ লিখেই শেষ করা যায় না। শতাব্দী ব্যাপী সৃষ্ট গলদ চিন্তাধারার মূল্যেৎপাটন করার জন্য যুগপৎ দীর্ঘ মেয়াদী প্রচেষ্টার প্রয়োজন। বালাকোট আন্দোলন এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা- যাকে ইচ্ছাকৃতভাবে রূহানীরূপ দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। মাওলানা শাহ হোসেইন গার্দেজী ঐ রুহানী পর্দার অন্তরালে ঝুঁকে দেখার দুঃসাহস (সৎসাহস) করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- তাঁর এই কর্মে নির্ভরতার ঐ ইমারতে প্রচন্ড ধাক্কা লাগবে- যার ভিত্তি রচিত হয়েছিল প্রতারণা ও প্রবঞ্চণার ইটের গাঁথুনীর উপর। তাঁর এই গবেষণামূলক কর্মে হৈ চৈ পড়ে যেতে পারে এবং সাম্প্রদায়িকতার আগুনে বাতাস দেয়ার সেই প্রথাগত অভিযোগও উত্থাপিত হতে পারে- কিন্তু মাওলানা শাহ হোসেইন গার্দেজীর এই কীর্তি সর্বদা ইজতিহাদ ও গবেষণা রূপ ধারণকারী বলে বিবেচিত হবে।
- খাজা রাদী হায়দার।
___________________________________
আল্লামা ইকবাল কলেজ করাচী-এর অধ্যাপক মুনিবুর রহমান- এর
অভিমত
মাওলানা শাহ হোসেইন গার্দেজীর লিখিত "হাকায়েকে তাহরীকে বালাকোট" গ্রন্থ আমার আমার নজরে এসেছে। মাশাআল্লাহ- গ্রন্থকার সাহিত্যিকদের মতই লেখার অধিকারী। তাঁর লেখার মধ্যে আছে সরল ভাষার প্রয়োগ, চলমানতা, শালীনতা ও চিত্তাকর্ষক সামগ্রীর সমাহার। মনে হয়- যেন তিনি এই বিষয়ে প্রাপ্ত ও প্রকাশিত সব ঐতিহাসিক উপাদানগুলোর উপর দীর্ঘ সময় ব্যয় করে চোখ বুলিয়ে সেগুলো অধ্যয়ন করেছেন। এটি তাঁর একক কৃতিত্ব যে, একটি ঐতিহাসিক ও গবেষণামূলক বিষয়কে তিনি এমন আকর্ষণীয় পদ্ধতি ও নিজস্ব প্রকাশ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন যে, পাঠক মাত্রই তা পাঠ না করে থাকতে পারেন না। যে কোন লেখক এবং নিবন্ধকারের এটিই সবচেয়ে কৃতিত্ব যে, ভুলেও যদি কোন পাঠকের দৃষ্টি এই লেখার উপর পতিত হয়, তাহলে সে এ লেখায় চোখ না বুলিয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারবে না।
আমার গোচরীভূত এই গ্রন্থখানা যতটুকু আমি পাঠ করেছি, তার সবগুলো উদ্ধৃতিই সূত্র সহ উল্লেখ করা হয়েছে এবং সূত্রগুলোর উৎস হচ্ছে ঐ সব গ্রন্থকারের গ্রন্থ ও নিবন্ধ- যাঁরা বালাকোট আন্দোলনের নেতাদের প্রতি ছিলেন চরম ভক্ত, নিকটস্থ, এবং জনসাধারণের কাছে ইতিহাসবিদ হিসাবেও পরিচিত।
অত্র গ্রন্থে গ্রন্থকার গার্দেজীর যতটুকু কৃতিত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা হচ্ছে- নিবন্ধ পদ্ধতিতে ঘটনাবলীর ক্রম বর্ণনা, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও ঘটনার এক বাস্তব চিত্র উদঘাটন, সংঘটিত ঘটনাবলীর গভীরে লুকায়িত প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ, ভাসা ভাসা মুখের পিছনে গোপনীয় ও লুকায়িত চেহারার উম্মোচন, উদ্ধৃত অংশের উপর নিজস্ব ভূমিকা বর্ণনা ও ঘটনাবলী হতে প্রাপ্ত কলাকৌশল বর্ণনা করা। মনে হয়- যেন তিনি চরম ভক্তদের মূল চেহারার উপর হতে মেক-আপের প্রলেপগুলো তুলে দূরে নিক্ষেপ করে ফেলে দিয়েছেন- যাতে গাদ ফেলে দেয়ার পর যে প্রকৃত চিত্রগুলো ভেসে উঠে- সেগুলো যেন পাঠকের সামনে পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠে এবং যাতে করে পাঠকরা বালাকোটের ঘটনার প্রথাগত চিত্রগুলো মন থেকে দূর করে প্রকৃত চিত্রগুলো মনের পাথরে অংকিত করে নিতে পারেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- গ্রন্থকারের মিশন এবং আসল উদ্দেশ্যও তাই এবং তিনি একাজে যথেষ্ঠ কামিয়াব হয়েছেন।
আমি গ্রন্থকারের এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা না করে পারছি না যে, তিনি আলোচ্য লেখক ও ব্যক্তিবর্গের চিন্তাধারার সাথে দ্বিমত পোষণ করা সত্ত্বেও ভাষার লালিত ও শালীনতার দামান হাত ছাড়া করেন নি। তিনি ব্যক্তি সম্মানের প্রতি কড়া দৃষ্টি রেখেছেন, লেখকগণের উদ্ধৃতি উল্লেখ করার সময় ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন এবং নিজ গবেষণা ও অনুসন্ধান পদ্ধতি বহাল রেখেছেন। এ ধরনের বিষয়ে গবেষণাকারীদের এই ধরনের পদ্ধতিই অনুসরণ করা উচিত।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস- এই গ্রন্থখানি সত্য অনুসন্ধানের দিকে পাঠককে আকৃষ্ট করবে। যদি তাই হয়- তাহলে গ্রন্থকারের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হবে বলে আশা করি। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত সকলকে এমন অন্তর্চক্ষু দান করুন- যা প্রকৃত তথ্যগুলোকে হাজারো পর্দার অন্তরাল থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয় এবং যাতে প্রপাগান্ডা, বাহ্যিক চাকচিক্যময় প্রতারণা এবং ভাষা ও ভঙ্গিমার চাকচিক্যতা দেখে যাদুগ্রস্থ না হয়ে পড়ে।
- অধ্যক্ষ মুনিবুর রহমান করাচী
___________________________________
করাচীর আবদুল্লাহ হারুন কলেজের অধ্যাপক
মুহাম্মদ আফজাল জাওহার- এর
অভিমত
ইংরেজরা যখন উপমহাদেশে তাদের অবস্থান দৃঢ় করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল- তখন সর্বপ্রথম যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন- তিনি ছিলেন মহীশুরের সুলতান হায়দার আলী (১৭৮২ খৃঃ)। সুলতান হায়দার আলীর মৃত্যুতে ইংরেজরা আনন্দে ঘি দ্বারা চেরাগ জ্বালিয়েছিল। কিন্তু হায়দার আলীর সুযোগ্য পুত্র টিপু সুলতান যোগ্য পিতার মিশনকে জীবিত রেখেছিলেন এবং সাত বৎসর পর্যন্ত তাদেরকে অস্থির করে রেখেছিলেন। অতঃপর নিজের লোকদের বিশ্বাস ঘাতকতায় তাঁকে ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছিল।
দূর্ভাগ্যক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যেসব আন্দোলনের উল্লেখ করা হয়ে থাকে- সেগুলোর মধ্যে বালাকোট আন্দোলনকে শীর্ষে স্থান দেয়া হয়। অথচ এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতারাই সীমান্তের মুসলমান ও শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইংরেজ শাসনের শিকড়কে আরও মজবুত করে দিয়েছিল। একশত বৎসরের চেয়েও বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল- এই আন্দোলনকে এখনও ইসলামী ইতিহাস বলেই উপস্থাপন করা হচ্ছে।
মাওলানা শাহ হোসেইন গার্দেজীর "হাকায়েকে তাহরীকে বালাকোট" আমার জানামতে ঐ বিষয় বস্তুর উপর প্রথম গ্রন্থ- যার মধ্যে বালাকোট আন্দোলনের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত করা হয়েছে। মাওলানা গার্দেজী অনেক পরিশ্রম করে এই গ্রন্থটিকে সাজিয়েছেন। এই গ্রন্থটি উপমহাদেশের ইতিহাসে বিপ্লবাত্মক অবদান রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবির চিন্তাধারা এই গ্রন্থের মাধ্যমে হয়তো প্রভাবিত হবে। এমন কি- তাদের মনবেদনার কারণও হতে পারে। কিন্তু সত্য সব সময়ই তিক্ত হয়ে থাকে। মাওলানা শাহ হোসেইন গার্দেজী এই তিক্ত সত্যকে বড়ি বানিয়ে পেশ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এবং মাওলানা এই মিশনে যথেষ্ঠ কামিয়াব হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
- অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আফজল জাওহার
____________________________________
বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত
সূচীপত্র
বিষয়
১। মনিষীদের অভিমত
২। লেখকের কথা
৩। সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জন্ম ও শিক্ষা
৪। জীবিকার সন্ধানে
৫। কথিত বাইয়াত ও খিলাফত
৬। সলফে সালেহীদের উপর মর্যাদার দাবী
৭। মুরিদানের সংখ্যা ও উহার হাকীকত
৮। দাওয়াতের দৃশ্য
৯। নজরানার ঝলক
১০। মাযার সমূহে উপস্থিতি
১১। বিধবা বিবাহ
১২। হজ্বের ঘোষণা
১৩। ইংরেজদের সাথে গোপন সম্পর্ক
১৪। গোলাম রসুলের একটি সন্দেহের অপনোদন
১৫। শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ
১৬। আমিরুল মোমেনীন হওয়ার ঘটনা
১৭। আমিরুল মোমেনীন অস্বীকারকারী বিদ্রোহী
১৮। কথিত ইসলামী হুকুমতের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহী
১৯। আকায়েদগত মত বিরোধ
২০। কাজীগণের জঘন্য কাজ
২১। মুসলমানের বিরুদ্ধে জিহাদ
২২। পাল্টা আঘাত
২৩। শিখ মুসলিম ঐক্য জোট গঠন
২৪। বালাকোট যুদ্ধ
২৫। সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মৃতদেহ নদীতে নিক্ষিপ্ত হলো
২৬। ইমাম মেহদী হওয়ার দাবী
২৭। আকাশে তশরীফ নিয়ে গেছেন
২৮। সৈয়দ সাহেবের মূর্তি তৈরী এবং মূর্তি পূজা
২৯। তার ভবিষ্যৎবাণী সমূহের প্রকৃত অবস্থা
৩০। পরবর্তী খলিফাগণের অনৈসলামিক কর্মকান্ড
৩১। ইতিহাস রচনায় স্থূল ধারণা
৩২। গ্রন্থ পঞ্জী ও সূত্র
____________________________________
লেখকের কথা
করাচী মুসলিম ল'কলেজের কাছাকাছি আমার বাড়ী হওয়ার সুবাদে ছাত্রদের সাথে আমার দিবারাত্রি দেখা সাক্ষাৎ হতো। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান এবং ইসলামী আন্দোলনের উপর আলাপ আলোচনা হতো। ঐগুলোর উত্থান পতন, সফলতা ও ব্যর্থতার কারণ এবং পরিবেশের উপর বিতর্ক চলতো। এ প্রসঙ্গে "সৈয়দ আহমদ শহীদ"- এর জিহাদী আন্দোলন সম্পর্কেও আলোচনা এসে যেতো। যেহেতু- জিহাদী আন্দোলন সম্বন্ধে আমার জ্ঞান খুব পর্যাপ্ত ছিলনা- শুধু সিলেবাস বা পাঠ্য পুস্তক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এজন্য বাজার থেকে প্রাপ্ত উপাদান সমূহ (বইপত্র) সংগ্রহ করেছি। ঐ গুলোর মধ্যে মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ আলী বেরলভী, মাওলানা মুহাম্মদ জাফর থানেশ্বরী, মির্জা হায়রাত দেহলভী, মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী এবং জনাব গোলাম রসুল মেহের- এর লিখিত পুস্তকও ছিল। (এরা সবাই সৈয়দ সাহেবের আপন লোক- অনুবাদক) তদুপরি আঞ্জুমানে তরক্বী- উর্দু করাচী, লিয়াকত লাইব্রেরী করাচী, রেযা লাইব্রেরী করাচী- এর বই পুস্তক থেকেও উপকৃত হয়েছি।
উল্লেখিত বই পত্রগুলো অধ্যায়নকালে ঐ গুলোর উদ্ধৃতি সমূহ পরস্পর মিলিয়ে দেখতাম। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী লেখকদের কথার মধ্যে সামঞ্জস্য করতাম। এভাবে প্রকৃত ঘটনা পর্যন্ত পৌঁছে সেগুলো উদঘাটন করতাম। আমার পূর্ব ধারণার মধ্যে পরিবর্তন আসতে লাগলো। পূর্বে আমি সৈয়দ আহমদকে বেরলভী মুজাহিদ এবং তার আন্দোলনকে জিহাদ ধারণা করতাম এবং তার বিরুদ্ধে একটি শব্দও শুনতে রাজী ছিলাম না। কিন্তু এখন প্রকৃত ঘটনা আমার পূর্ববর্তী ধারণাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত করে দিয়েছে এবং অমূলক ধারণাগুলো দূরিভূত হয়ে যাচ্ছে।
অতঃপর এই চিন্তা করে আমি কথাগুলোকে সাজগোজ করেছি। চিন্তা করে দেখলাম- এই বালাকোট আন্দোলন তো আর কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সম্পৃক্ত নয়। এটি একটি ইতিহাসের ঘটনা মাত্র। কেউ যদি ত্রয়োদশ হিজরী শতাব্দীর কোন ইতিহাসের ঘটনার বিষয়ে নিজস্ব ধ্যান-ধারনা পেশ করেন, তাহলে আমার ইসলামী জ্ঞান গবেষণা মোতাবেক তাঁর ইসলাম ও ঈমানে কোনরূপ ব্যঘাত ঘটবে না এবং তা হওয়াও উচিত নয়।
বালাকোট আন্দোলন বিষয়ে আমাদের শালীনতা বজায় রাখা, ভবিষ্যৎ পরিণাম সম্পর্কে বিচক্ষণতার সাথে চিন্তা ভাবনা ও অনুসন্ধান করা খুবই প্রয়োজন। একথা সত্য যে, যুগ যুগ ধরে এই আন্দোলনকে জিহাদী আন্দোলন বলে ধারণা দেয়া হচ্ছে এবং তার প্রচার ও তাবলীগ করা হচ্ছে। এই বিষয়ে যত বই পুস্তকই লিখা হয়ে থাকুক না কেন এবং যত সম্মানিত ব্যক্তিই এটিকে জিহাদ বলে স্বীকার করুন না কেন- প্রকৃত ঘটনা কিন্তু লুকায়িত থাকে নি। শেষ পর্যন্ত সত্য ঘটনা মানুষকে মাটির সংস্পর্শে টেনে নিয়ে এসেছে।
তবুও আফসোসের সাথেই বলতে হচ্ছে যে, আমরা সিলেবাসের বইতে যা কিছু পড়ছি- সৈয়দ আহমদ বেরলভী কিন্তু সে রকম নন। আমাদের কলমধারীরা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর চিন্তাধারার সাথে একমত হওয়ার কারণেই বালাকোট আন্দোলনকে খামাখা জিহাদী আন্দোলন নামে আখ্যায়িত করেছেন। হিন্দুস্থানের ইসলামী কর্মকান্ড ও ইতিহাসের উপর লিখিত প্রত্যেকটি নিবন্ধেই তারা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর আলোচনাকে জরুরী মনে করেছেন।
১৮৫৭ ঈসায়ী সালের আযাদী আন্দোলন (সিপাহী বিদ্রোহ), খেলাফত আন্দোলন এবং পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি হিসাবেও তারা সৈয়দ আহমদের নাম উল্লেখ করে থাকেন। অথচ পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও ঘটনা তাদের ঐ ধারণার সমর্থন করে না। কতই না ভাল হতো- যদি তারা ভেবে দেখতেন যে, আকাশ সবসময় মেঘাচ্ছন্ন থাকেনা। একদিন না একদিন আকাশ মেঘমুক্ত হবেই। তখন দৃষ্টিসম্পন্ন চোখগুলো প্রকৃত ঘটনা দেখতে পাবে।
জনাব গোলাম রসুল মেহের ইতিহাসবিদ হওয়ার সাথে সাথে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর প্রতিও চরম ভক্তির আবেগ পোষণ করেন। এই ভক্তি বহাল রাখার জন্য তিনি উদ্ভট কল্পনা ও মিথ্যা লিখার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারেননি। তিনি বালাকোট আন্দোলনের চারিত্রিক দূর্বল দিকগুলোকেও জিহাদের পাগড়ী পরিয়ে দিয়েছেন। জনাব মেহের সাহেব সৈয়দ আহমদ বেরলভীর একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ভাবমূর্তি তৈরী করে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করেছেন। এই ভাবমূর্তিকে দিল ও দেমাগে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে অতি সুক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করে তিনি এটিকে সিলেবাসের অন্তর্ভূক্ত করে দিয়েছেন- যার পরিণতিতে প্রত্যেক স্কুল পড়ুয়াই এখন সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ হিসেবে উপাধি প্রদান করা জরুরী মনে করছে।
আমার এই ক্ষুদ্র গ্রন্থে জনাব মেহের সাহেবের সত্য গোপন ও বাতিল প্রকাশের সকল তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয় এবং এর উপর পর্যালোচনাও অসম্ভব। তথাপি আমি তার বিরাট অপতৎপরতার মুখোশ উন্মোচন অবশ্যই করে দিয়েছি। আমার আশ্চর্য লাগে- একজন মুসলমান কি করে নিজস্ব মতবাদ সংরক্ষণের জন্য ইসলামী মর্যাদাকে পদদলিত করতে পারে এবং আমিত্বের চিন্তায় কি করে পরকালের ভয় ভুলে যেতে পারে?
অত্র গ্রন্থে বালাকোট আন্দোলনের নেতার (সৈয়দ আহমদ) কার্যকলাপগুলোকেই কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপে পেশ করা হয়েছে এবং অন্যান্য হযরতগণের আলোচনা এসেছে প্রাসঙ্গিক হিসাবে। যদি আল্লাহ পাকের তৌফিক আমার অবস্থার উপর শামিল হয়ে যায়- তাহলে শাহ ইসমাঈল দেহলভীর উপরও নিজের জানা কথাগুলো লিখিত আকারে পেশ করবো- যা "হাক্বায়েক-ই তাহরীকে বালাকোট" এর দ্বিতীয় খন্ড বলে গণ্য হবে।
এটা অকৃতজ্ঞতার কাজ হবে- যদি এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা শাহ ওসী আহমদ মোহাদ্দেস সুরতী সাহেবের নাতী খাজা রাদী হায়দরের শুকরিয়া আদায় না করি। তিনি আমার অনুরোধক্রমে এই পান্ডুলিপিখানা দেখে দিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আমাকে কৃতার্থ করেছেন। এছাড়া মাওলানা সৈয়দ সেকান্দর শাহ গোলড়ুভী, মাওলানা শাহ তুরাবুল হক কাদেরী, মাওলানা মুহাম্মদ রফিক যাহেদ চিশতি, জনাব গুল মুহাম্মদ ফয়জী এবং হাজী আহমদ মুজাহীদ প্রমুখের সহযোগিতা পেয়েছি। তাঁদের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।
পরিশেষে হযরত মাওলানা পীর মুহাম্মদ করম শাহ আযহারী, আফজাল জাওহার এবং প্রখ্যাত সাহিত্যিক খাজা রাদী হায়দার প্রমুখের শুকরিয়া আদায় করার প্রয়োজন মনে করছি- যাঁরা "হাক্বায়েক-ই তাহরীকে বালাকোট" গ্রন্থের উপর মূল্যবান অভিমত পেশ করে আমার গবেষণা কর্মের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করেছেন।
শাহ হোসেইন গার্দেজী
১০ই সফর, ১৪০২ হিজরী
মোতাবিক ১৯৮২ ঈসায়ী
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জন্ম ও শিক্ষা
(১২০১-১২৪৬ হিজরী, ১৭৮৭-১৮৩১ খৃষ্টাব্দ = ৪৬ বৎসর)
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জন্ম হয় রায়বেরেলীর এক সৈয়দ পরিবারে পহেলা মহররম ১২০১ হিজরীতে (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৩৮৭)। বুযুর্গ পিতা সৈয়দ মুহাম্মদ ইরফান প্রথমে ছেলের নাম রাখেন মীর আহমদ। (গোলাম মেহেরের সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮৩)। কিন্তু পরবর্তীতে সৈয়দ আহমদ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
তার খান্দান ইলম ও ইরফানের সুবাদে আশে পাশের এলাকায় সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিল। সৈয়দ আহমদের দাদার দাদা শাহ ইলমুল্লাহ এক প্রসিদ্ধ কামেল বুযুর্গ ছিলেন।
শিক্ষাঃ "সৈয়দ সাহেবের বয়স যখন চার বৎসর চার মাস হয়, তখন হিন্দুস্তানের শরীফ খান্দানের রেওয়াজ মোতাবেক তাকে মক্তবে ভর্তি করা হয়" (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৩৮৭)।
কিন্তু পড়া শুনায় তার মনোযোগ একেবারেই ছিল না। এ প্রসঙ্গে তার ভক্ত ও সমকালীন ব্যক্তিত্ব মির্জা হায়রত দেহলভী লিখেছেন-
বুযুর্গ সৈয়দ সাহেব বাল্যকালে অস্বাভাবিক নীরবতার কারণে নিম্নমানের নির্বোধ বোকা হিসাবে প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। লোকজনের ধারণা জন্মেছিল যে, তাকে শিক্ষা দেয়া বৃথা। তার দ্বারা কিছু হবে না। আমি (মির্জা) তার মেধা বা স্মরণ শক্তির ব্যাপারে কোন রায় দিতে পারবনা। শুধু এতটুকু লিখাই যথেষ্ট মনে করি যে, সৈয়দের বাল্যকালে কেন- পড়ার প্রতি ছিল একদম উদাসীন (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়্যেবা পৃঃ ৩৮৯)।
কারিমা পান্দেনামা
সৈয়দ সাহেবের অমনোযোগিতা ও উদাসীনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, কারিমা কিতাবের প্রথম পংক্তি (কারিমা বে বখ্শা বর হালে মা) -যা ছিল নিরেট দোয়া বা মুনাজাত- তাও বুযুর্গ সৈয়দ আহমদ সাহেব তিন দিনে মুখস্ত করেছিলেন। এর উপরও মজার ব্যাপার হলো- কখনও কখনও তিনি "কারিমা" শব্দটি ভুলে যেতেন এবং কখনও "বর হালে মা" ভুলে বসতেন এবং তা একদম মন থেকেই মুছে যেতো (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৩৯০)।
এতদসত্ত্বেও বুযুর্গ পিতামাতা ও ওস্তাদের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল- হয়তো বা সৈয়দ সাহেব বিদ্যার অলঙ্কারে কোন এক দিন সজ্জিত হয়ে যেতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে মির্জা হায়রত নিজের ভাষায় লিখেছেন-
"সৈয়দ আহমদ যখন একটি বাক্যকে কয়েক ঘন্টা ধরে জপতে থাকতো- তখন কিছুমাত্র মুখস্ত হতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- পরদিনই তা মন থেকে পুনরায় লাপাত্তা হয়ে যেতো। অবস্থা যখন এমন দাঁড়ালো- তখন পিতামাতা ও মিয়াজীর সাবধান বাণী উচ্চারিত হতে লাগলো। ঘরের ধমক চোখ রাঙ্গানী অতিক্রম করে- কখনও মারপিটের পর্যায়ে চলে যেতো। এতেও পিতামাতার ইচ্ছা পূরণ হলো না। তারা যখন দেখলেন যে, কুদরতীভাবেই তার ঘিলুতে তালা লেগে গেছে এবং কোন প্রকার ধমকেই সে পড়তে পারছে না- তখন বাধ্য হয়ে তারা তাকে লেখাপড়া থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসলেন" (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়্যেবা পৃঃ ৩৯১)।
সৈয়দ সাহেবের এই জন্মগত মেধাহীনতায় যখন পিতামাতা এবং ওস্তাদগণ অপরাধ ও ক্লান্ত হয়ে গেলেন- তখন সৈয়দ সাহেবের খোলামেলা ছুটি মিলে গেল। তিনি এখন খেলাধুলা ও উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরাফেরা করে দিন কাটাতে লাগলেন।
এ ব্যাপারে মির্জা হায়রত লিখেছেন -
"পিতামাতা তাকে একেবারেই স্বাধীন করে দিলেন এবং তার ইচ্ছার উপর তাকে এভাবে ছেড়ে দিলেন যে, তার মনে যা চায়- তাই করুক" (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৩৯১)।
পাঠ্য জীবনের এই তিন বৎসরের ইতস্ততার মধ্যে সৈয়দ সাহেব কি অর্জন করলেন- তার বর্ণনা আপন ভাগিনার মুখেই শুনুন-
"তিন বৎসরের এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কোরআনে হাকীমের মাত্র কয়েকটি সূরা পড়েছিলেন এবং হরুফে হেজা লিখা শিখেছিলেন" (সৈয়দ মুহাম্মদ আলীর মাখজানে আহমদী পৃঃ ১২)।
সৈয়দ সাহেবের বিদ্যা শিক্ষার এই ছিল কাহিনী। একে অনারবীয় অনুমান ও রং চং মাখিয়ে কিসের থেকে কি বানিয়ে দিল। (তাকে উম্মীর মর্যাদা দেয়া হলো)। সৈয়দ সাহেব মূলতঃ দুষ্ট ছিলেন না এবং এমন মেধাবীও ছিলেন না যে, দুষ্টামী বুদ্ধি মাথায় গজাবে। অন্যের হাসি তামাশাও তিনি বুঝতেন না। তিনি মানুষের ঘরে বিনা বাধায় চলে যেতেন- যেরূপ সাধারণতঃ বড় বয়সের অবুঝ ছেলেরা করে থাকে। তার অবুঝের কারণে মহিলারাও বাধা দিত না। বরং তাকে দিয়ে লাকড়ী ইত্যাদি জিনিস আনিয়ে নিত। তার বড় ভাইয়েরা এবং খান্দানের লোকেরা তার এই আচরণকে আহম্মকী মনে করে তাকে বাধা দিতেন। পিতামাতা তার এই অতিরিক্ত অবুঝের কারণে চিন্তিত থাকতেন।
এ প্রসঙ্গে মির্জা হায়রত দেহলভী লিখেছেন-
"সৈয়দ সাহেবের বুযুর্গ পিতামাতা, চাচা- প্রমুখগণের এ ব্যাপারে কোন চিন্তা ভাবনাই ছিল না যে, এই ছেলে বড় হয়ে আমাদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারবে। বরং তাদের চিন্তা ছিল একটাই- "আমরা যে সুনাম অর্জন করেছি এবং আমাদের পূর্ববর্তী মুরুব্বিরা শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রে যে সম্মান অর্জন করে গেছেন, তার অথর্বতার কারণে না জানি তা চির বিদায় হয়ে যায়" (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৩৯০)।
সৈয়দ সাহেব এই অথর্ব অবস্থায় নিজ জীবনের ১৭টি মনজিল (বৎসর) অতিক্রম করলেন এবং কবির ভাষায় বলতে হয়-
মেযাজে তু আজ হালে তিফলী না গাশত।
অর্থঃ তোমার মেজাজ হতে তো এ পর্যন্ত বালখিল্লতাই গেলনা (শেখ সাদী)।
অর্থাৎ শেখ সাদীর উক্তি মোতাবেক তাকে এখনও নিজ অভ্যাসে ও চালচলনে সেই চার বৎসর চার মাস চার দিনের বয়সের শিশুর মতই মনে হচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যেই তার বুযুর্গ পিতা জনাব সৈয়দ মুহাম্মদ ইরফান নশ্বর জগত ত্যাগ করে চলে গেলেন।
জনাব গোলাম রসুল মেহের ভক্তি ও শ্রদ্ধার কারণে সৈয়দ সাহেবকে কাফিয়া ও মেশকাত পর্যন্ত লেখাপড়া আলেম বানানোর প্রচেষ্টায় নিজ কলিজা পানি করে ফেলেছেন। কিন্তু অগত্যা শেষ পর্যন্ত এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন-
"আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও সৈয়দ সাহেবের তবিয়ত বিদ্যার্জনের দিকে ফিরেনি। তিন বৎসর লাগাতার মক্তবে যাতায়াত করতে থাকেন, কিন্তু এই সময়ে কোরআন হাকীমের মাত্র কয়েকটি সূরা হিফজ করতে সক্ষম হন এবং আরবী বর্ণমালা ছাড়া বাক্য লিখতে সক্ষম ছিলেন না। তার বড় ভাই সৈয়দ ইবরাহিম ও সৈয়দ ইসহাক বারবার পড়ার তাকিদ দিতেন। কিন্তু মনে হয়- বুযুর্গ পিতা এই তাকিদকে গুণ্যফল বলেই মনে করে নিয়েছিলেন।" (গোলাম রসুল মেহেরের সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬১)।
সৈয়দ সাহেবের শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপারে জনাব মেহের সাহেবের যে গবেষণা ছিল- তা তিনি নিজেই হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে লিখেছেন এভাবে- "নিশ্চিত যে, বিদ্যা শিক্ষার ব্যাপারে হয়তো চেষ্টার কোন ত্রুটিই হয় নি।" (গোলাম রসুল মেহেরের সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬১)।
জনাব মেহের সাহেবের গবেষণা ও অনুসন্ধানের স্বরূপ ও তার উক্তি- "কোন ত্রুটিই করা হয়নি" দ্বারাই সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ভক্তি যে "অন্য এক বস্তু"! পিতামাতার চেষ্টা সব নিষ্ফল হয়েছিল।
জীবিকার সন্ধানে
পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আনুমানিক দুবৎসর পর (১৯ বৎসর বয়সে) সৈয়দ আহমদ সাহেব জীবিকার অনুসন্ধানে লাক্ষ্মৌ গমন করেন। উনিশ বৎসর বয়সে তিনি প্রথমবারের মত লাক্ষ্মৌ আগমন করেন। লাক্ষ্মৌ ছিলো শিয়া-সুন্নী মতবিরোধের প্রাণ কেন্দ্র।
জনাব মির্জা হায়রতের ভাষায়-
এযাবৎ শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বের বিষয়ে সৈয়দ সাহেবের পূর্ণ জ্ঞান ছিল না। তিনি জানতেন-ই না যে, শিয়াদের ধর্মীয় মূলনীতিগুলো কি এবং সুন্নীদের ধর্মীয় আকিদার মূল -নীতি কি? কেবল দুচারটি কথা জানা ছিল- যা সাধারণ লেখাপড়া জানা প্রত্যেকেই জানে। বেচারা অধিকাংশ ধর্মীয় মার-প্যাঁচ সম্পর্কেই অজ্ঞ ছিলেন" (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৩৪৮)।
সৈয়দ সাহেবের অজ্ঞতা এবং বুদ্ধিহীনতার ব্যাপারে মির্জা হায়রতের নিম্মোক্ত বাক্যগুলো আর একবার পড়ুন এবং চিন্তা করুন।
"যখন সৈয়দ সাহেব চাকুরীর জন্য জনৈক আমিরের কাছে গেলেন, তখন উক্ত আমীর প্রথম প্রশ্ন করলেন- আপনি খারেজী, না কি শিয়িয়ানে আলী? এই দুটি শব্দ ছিল সৈয়দ সাহেবের নিকট বিলকুল নতুন। খারেজী নামটি তিনি কখনও শোনেন নি। শিয়া শব্দটি সম্পর্কে যদিও পূর্ব পরিচিতি ছিল- কিন্তু শিয়িয়ানে আলী শব্দটি এযাবৎ তার কানে পৌঁছেনি। তিনি পেরেশান হয়ে পড়লেন যে, আমীর সাহেব যে প্রশ্ন করেছেন- তার অর্থ কি হবে- এটা তো তার জানা নেই" (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৩৯৬)।
সৈয়দ সাহেবের এই লাক্ষ্মৌ সফরটি ইলম অনুসন্ধানের সফর ছিল না এবং বিদ্যার সাথে এর কোন সম্পর্কও ছিল না। এটা ছিল খাঁটি জীবিকা অন্বেষণের সফর। সৈয়দ সাহেবের সঙ্গী সাথীরা মেহনত ও পরিশ্রম করে রাত্রির খাওয়ার বুটী যোগাড় করতো। সৈয়দ সাহেবের ঐ সময়ের অবস্থা কি ছিল- সে সম্পর্কে তার ভাগিনা সৈয়দ মুহাম্মদ আলী- যিনি বয়সে ছিলেন তার চেয়ে বড়- তিনি লিখেন-
"লাক্ষ্মৌর এক শরীফ ব্যক্তি সৈয়দ সাহেবের জন্য দু'বেলার খানা নিজ ঘর থেকে নির্ধারিত করেন। সৈয়দ সাহেব বন্ধুদের সাথে গিয়ে নিজের দু'বেলার নির্ধারিত খানা নিয়ে আসতেন" (সৈয়দ মুহাম্মদ আলীর মাখজানে আহমদী পৃঃ ১৩)।
শাহ আব্দুল আজিজের দরবারে উপস্থিতি
"লাক্ষৌতে দীর্ঘ দিন অবস্থান করার পরও তার উপযুক্ত কোন চাকুরী পাওয়া গেলনা। তিনি দিল্লীর দিকে ছুটলেন। সে সময় তার বয়স হয়েছিল ২০ বৎসর। গরীব ও দারিদ্র্য অবস্থার কারণে তিনি অতি কষ্টে দিল্লীতে পৌঁছলেন। দিল্লীতে তিনি এমন অবস্থায় পৌঁছলেন যে, চেহারায় ধূলাবালু, চুলে ধূলা বালি, কাপড় ময়লা ও ফাটা এবং পা ছিল জুতার জন্য আকুল" (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৪০৫)।
উপরন্তু দিল্লীতে তার জানা শুনা কেউ ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দেস দেহলভীর মাদ্রাসায় আশ্রয় নিলেন এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলেন।
ঐ যুগে শুধু সৈয়দ সাহেব একাই দারিদ্রতায় নিষ্পেষিত ছিলেন না, বরং অধিকাংশ শিক্ষার্থী মুসলমানই এই দারিদ্রতার হাতে নিষ্পেষিত ছিলেন। হযরত শাহ আব্দুল আজিজ হিন্দুস্তানের এক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর সুখ্যাতি হিন্দুস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করেছিল। সুতরাং শিক্ষার্থীরা সব সময় চন্দ্রের বৃত্তের মত তাঁকে ঘিরে রাখতো। সৈয়দ আহমদ সাহেব যখন শাহ আব্দুল আজিজের এ অবস্থা দেখলেন- তখন তারও ইলম শিক্ষা করার আগ্রহ জাগলো। এ প্রসঙ্গে মির্জা হায়রত লিখেছেন-
"সৈয়দ আহমদের ইচ্ছা ছিল যে, কোনমতে লেখাপড়া শিক্ষা করে আমি সম্মানিত ফাজেল হবো। কিন্তু মনের গতির কি করবেন? মন তো এদিকে মোটেই ঝুকছেনা" (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৪০৬)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেব যদি সম্মানিত ফাজেলও হয়ে যেতেন- তাহলে এটা তো জরুরী নয় যে, তিনি শাহ আব্দুল আজিজের মত হবেন। কেননা- কবি বলেন-
ইঁ ছায়াদাত বজোরে বাজু নিস্ত,
তা না বখ্শীদ খোদায়ে বখ্শীদ।
অর্থঃ এই সৌভাগ্য তো বাহুর জোরে অর্জিত হয় না, যে পর্য্যন্ত না দাতা আল্লাহ তায়ালা বখশীষ করেন।
অনুমান করা যায়- সৈয়দ সাহেব সরল অন্তঃকরণ ও মিসকিন স্বভাবের কারণেই শাহ সাহেবের দরবার পর্য্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন এবং শাহ্ সাহেবের নিকট কোন কিতাব পড়া শুরু করেছিলেন- কিন্তু নিষ্ফল।
এ প্রসঙ্গে মির্জা হায়রত লিখেছেন-
"একমাস পর্যন্ত শাহ সাহেব তাকে পড়ালেন, কিন্তু কোন ফল হলো না। সৈয়দ আহমদের মনও তিক্ত হয়ে উঠলো এবং শাহ আব্দুল আজিজও বলে চললেন। ফল হলো এই যে, সৈয়দ আহমদ যখন কিতাব নিয়ে বসতেন, তখন চোখে শরষে ফুল দেখতেন - যেমন অধিকাংশ দূর্বল মেধার ছাত্রদেরই এ অবস্থা হয়ে থাকে" (মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তাইয়েবা পৃঃ ৪০৮)।
মির্জা হায়রত আরও লিখেছেন-
"হাজার ধরনের চেষ্টা করা হয়েছিল যে, সৈয়দ আহমদের কিছু শিক্ষালাভ হোক, কিন্তু তার মন লেখা পড়ায় একেবারেই বসে নি" (প্রাগুক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৪০৯)।
সৈয়দ আহমদ সাহেবের মেধাশুন্যতা ও অমনোযোগিতার কারণে শাহ আব্দুল আজিজ যখন হতাশ হয়ে গেলেন- তখন তাকে সাধারণ দরস খানায় শামিল হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো- যা সপ্তাহে দুবার অনুষ্ঠিত হতো।
এ প্রসঙ্গে মির্জা হায়রত দেহলভীর সাক্ষ্য নিম্নরূপ -
"অতঃপর শাহ আব্দুল আজিজ সাহেব তাকে এই অনুমতি প্রদান করলেন যে- দরসে কোরআন ও দরসে হাদিসের সময় যেন তিনি তথায় উপস্থিত থাকেন" (ঐ ৪০৯)।
অর্থাৎ শাহ সাহেব তাকে "মর্দে বে মুরাদ" বা মুরোদহীন পুরুষ মনে করে তার থেকে অবসর নিলেন এবং মূল্যবান সময়কে অপচয় করা থেকে বাঁচিয়ে নিলেন। বিদ্যা শিক্ষার এই দ্বিতীয় সুযোগটিও সৈয়দ সাহেব নিজের মেধাশূন্যতার কারণে হারালেন। চিরদিনের জন্য তিনি ব-কলম রয়ে গেলেন। ভবিষ্যতে সৈয়দ সাহেব অন্য কিছু হতে পারেন, কিন্তু অক্ষতা ও মূর্খতার কলঙ্ক মোচন করতে পারেন নি।
সৈয়দ সাহেবের অন্যান্য জীবনী লেখকরা মির্জা হায়রত দেহলভীর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে লিখেছেন যে, "সৈয়দ সাহেব শাহ আব্দুল কাদেরের খেদমতে ছিলেন- শাহ আব্দুল আজিজ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন নি।"
মন্তব্যঃ তাহলে দেখা যায় যে, শাহ আব্দুল আজিজের নিকট থেকে তরিকতের ফায়দা হাসিল করার কাহিনীটিই সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মনগড়া। সৈয়দ আহমদ সাহেব জীবিকার অন্বেষণেই দিল্লী এসেছিলেন এবং এসেই জীবিকার পরিবর্তে বিদ্যার্জনে মনোনিবেশ করলেন। ফল হলো- না এদিকের- না ওদিকের। নিম দরুঁ ও নিম বরুঁ-র অবস্থাও সৃষ্টি হলো না। তথাপিও এমন একটি কাজ তার দ্বারা হয়েছে- যা তার জন্য ভবিষ্যতের সম্মান ও সুখ্যাতি বয়ে এনেছিল। তা হলো- শাহ আব্দুল আজিজের নিকট কথিত বাইআত হওয়ার সৌভাগ্য। শাহ আব্দুল আজিজের নামধাম হিন্দুস্তানের মাদ্রাসা ও খানকা সমূহ নতুন করে পরিচয়ের মুখাপেক্ষী ছিল না। তাই সৈয়দ সাহেব ও তার অনুগামী বন্ধুরা এই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে কার্পণ্য করেন নি!
পীরের বিরুদ্ধে মুর্তি পূজার অপবাদ ও বেয়াদবী!
সৈয়দ আহমদ সাহেব পীরের দরবারে (শাহ আব্দুল আজিজ) তাদের ভাষ্যমতে তাসাউফের মনজিল সমূহ (স্তর) অতিক্রম করতে ছিলেন। শাহ আব্দুল আজিজ সাহেব যখন "তাসাববুরে শেখ বা পীরের ধ্যান" করার কথা বললেন- তখন সৈয়দ আহমদ সাহেব বলে উঠলেন- "আমি এটা করতে পারবো না। কেননা, পীরের ধ্যান করা আর মূর্তি পূজা করার মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। মূর্তি পূজা হচ্ছে জঘন্যতম কুফরী ও শির্ক।"
তার কথা শুনে শাহ আব্দুল আজিজ (রহঃ) পারস্য কবি হাফেজ মুসলেহ উদ্দীন সিরাজীর নিম্মোক্ত কবিতাংশটি পড়লেন-
"বে মায় সাজজাদা রঙ্গীন কুন গরত পীরে মুগাঁ গোয়েদ,
কে ছালেক বে খবর না বুয়াদ জে রাহ ও রসমে মনজিলহা।
অর্থঃ যদি কামিল পীর নির্দেশ করেন- তাহলে তুমি নামাযের মোছল্লাটিও শরাবের দ্বারা রঙ্গীন করে নাও- কেননা খোদার পথের পথচারী ঐ পথ ও পথের যাবতীয় রুছম ও স্তর সম্পর্কে বে-খবর নন। (হাফেজ সিরাজী)
এ কবিতা শুনে সৈয়দ আহমদ সাহেব বললেন- আপনি যা নির্দেশ দিবেন, তাই করবো। কিন্তু পীরের অবর্তমানে পীরের ধ্যান করা, তার কাছ থেকে রূহানী সাহায্য ও তাওয়াজ্জুহ চাওয়া তো মূর্তি পূজা এবং প্রকাশ্য শির্ক। আমি কখনও একাজ করবো না।" (সৈয়দ মুহাম্মদ আলীর মাখজানে আহমদী পৃঃ ১৯)।
পারস্য কবির ভাষায় বলতে হয়-
তারাছছুম কেহ্ না রছি বে কা'বা আয় আ'রাবী;
কে-ইঁ রাহ্ কেহ্ তু মি রভী বে তুর্কিস্তান আস্ত।
অর্থঃ হে আরবের যাযাবর! আফসোস! তুমি কা'বায় পৌঁছতে কখনো সক্ষম হবে না- কেননা, তুমি যেপথ ধরেছো- তা তো তুর্কিস্তান গামী।
মন্তব্যঃ স্মরণ করা যেতে পারে - ইনি ঐ সৈয়দ সাহেব এরূপ উক্তি করছেন- যিনি কোরআন হাদিসের কয়েকটি সূরা ব্যতীত নাজেরা কোরআনও পড়তে পারতেন না, যিনি কারিমা পান্দেনামা কিতাবের প্রথম পংক্তি "কারিমা বেবখ্শা বর হালে মা" তিন দিনে মুখস্ত করেছিলেন- তাও আবার ভুলে যেতেন, যাকে ইলম শিক্ষা দিতে শাহ আব্দুল আজিজ অপারগ হয়ে গিয়েছিলেন, যিনি শিয়িয়ানে আলী'র অর্থটুকু পর্যন্ত জানতেন না। আর আজ তিনি বলছেন- পীরের ধ্যান করা হলো মূর্তি পূজা ও প্রকাশ্য শির্ক? আশ্চর্য লাগে যে, তিনি আপন পীরের বিরুদ্ধেই মূর্তি পূজার অপবাদ দিচ্ছেন!
কবির ভাষায় বলতে হয়-
"চুঁ কুফর আজ কা'বা বরখিজাদ- কুজা মানাদ মুসলমানী"
অর্থঃ কা'বা ঘর থেকেই যদি কুফরীর গন্ধ পাওয়া যায়, তাহলে মুসলমানিত্ব থাকে কোথায়?
আর এমন পীরের বিরুদ্ধে মুর্তি পূজার অপবাদ দেয়া হচ্ছে - যার হলকায়ে ইলম ও ইরফানের চর্চা হিন্দুস্তানের সীমানা অতিক্রম করে গিয়েছিল এবং এই পীরের ধ্যানকে মূর্তি পূজা ও প্রকাশ্য শির্ক বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে- যা সহস্র বছর ধরে জমিনের বুকে আল্লাহওয়ালাগণের আমল ছিল। এখন আপনি ইচ্ছা করলে জ্ঞানান্ধ সৈয়দ আহমদের কথা গ্রহণ করতে পারেন- আর ইচ্ছা করলে শাহ্ আব্দুল আজিজ থেকে শুরু করে শেখ আব্দুল কাদের জিলানী, খাজা মঈনুদ্দিন আজমেরী, মুজাদ্দেদে আলফেসানী ও বাহাউদ্দিন নকশবন্দ- এর উপর মূর্তি পূজা ও প্রকাশ্য শির্ক- এর অপবাদ আরোপ করতে পারেন। আর যদি ইচ্ছা করেন- তাহলে এই মতামতকে সৈয়দ আহমদের বিদ্যাহীতা ও প্রতারণাও সাব্যস্থ করতে পারেন। দ্বিতীয় পন্থাটিই বেশি সহজ মনে হয়।
পীরের ধ্যান করা সম্পর্কে দেওবন্দের মুরুব্বীগণের অভিমত
"তাসাব্বুরে শেখ" (পীরের ধ্যান) সম্পর্কে এতক্ষন সৈয়দ আহমদের ধ্যান ধারণা শুনার পর এবার দেওবন্দের মুরুব্বী মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহীর কথাও শুনুন। ইনি সৈয়দ আহমদ সাহেবের সিলসিলার খলিফাদের নিকট একজন বুযুর্গ ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। তাহলে চিত্রের এপিঠ ওপিঠ উভয় দিকই সামনে এসে যাবে। মাওলানা আশরাফ আলী থানবী আরওয়াহে সালাসা পুস্তকের ২৯০ পৃষ্ঠায় লিখেন–
"একদিন হযরত গাঙ্গুহী রহমাতুল্লাহি আলাইহি খুব জোশের হালাতে ছিলেন এবং তাসাব্বুরে শেখ প্রসঙ্গটি তার সামনে উত্থাপিত হয়েছিল। তিনি জোশে এসে বললেন- বলবো? লোকেরা আরজ করলো- বলুন। পূনঃ তিনি বললেন- বলবো? এবারও লোকেরা বললো- বলুন। আবারও তিনি বললেন- বলবো? লোকেরা বললো- বলুন। এবার তিনি বলতে লাগলেন- "পূর্ণ তিন বৎসর হযরত ইমদাদের (পীরের) চেহারা আমার অন্তরে ছিল- আমি (এ সময়ে) তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে কিছুই করিনি।" পুনরায় তিনি জোশে এসে গেলেন- বললেন, বলব কি? আরজ করা হলো- হযরত! অবশ্যই বলুন। তিনি বলতে লাগলেন - "বিগত কয়েক বৎসর ধরে হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কলবে ছিলেন এবং (ঐ সময়ে) আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া কোন কাজই করিনি" (আরওয়াহে সালাসা - আশরাফ আলী থানবী পৃঃ ২৯০)।
মন্তব্যঃ রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী "তাসাব্বুরে শেখ" চর্চা করতেন। এমন কি- "তাসাব্বুরে রাসুল" এর দ্বারাও তিনি উপকৃত হতেন। পূর্ণ তিন বৎসর পর্যন্ত নিজ তরিকতের পীর হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ ও কয়েক বৎসর পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কলবে ছিলেন।
সৈয়দ সাহেবের গবেষণা অনুযায়ী দেখা যায়- মাওলানা গাঙ্গুহী সাহেব মূর্তি পূজক ও প্রকাশ্য কাফির হয়ে গেছেন। ফারসী প্রবাদে আছে-
"নিম হেকিম খাতরায়ে জান,
নিম মোল্লা খাতরায়ে ঈমান।"
অর্থঃ "ঠুনকো কবিরাজ হলো- জীবনের জন্য বিপদজনক
কিন্তু- নিম মোল্লা হলো ঈমানের জন্য বিপদজনক।"
আমি (গার্দেজী) এ প্রবাদটি আপনাদেরকে শুনানোর উদ্দেশ্যে বলছি- শুধু শেখ সাদীর ভাষায় এতটুকু আরজ করাই আমার উদ্দেশ্য-
"চু শামা" আয পায় ইলম বায়েদ গোদাখ্ত,
কেহ্ বে ইলম না তাওয়া খোদারা শেনাখ্ত।"
অর্থঃ বিদ্যা অর্জনের জন্য তুমি শামা'র মত জ্বলতে থাকো, কেননা, বিদ্যাহীন ব্যক্তি খোদার সঠিক পরিচয় লাভ করতে পারে না।
আমি বিচার আচারের যোগ্যতা রাখিনা সত্য- কিন্তু কারিমা পান্দেনামার মত প্রাথমিক স্তরের বিদ্যা হতেও অন্ধ সৈয়দ সাহেব এবং খাতামুল মোহাদ্দেসীন শাহ আব্দুল আজিজের মাকাম ও মর্তবার মধ্যে পার্থক্য করা এবং বুঝার ক্ষমতা অবশ্যই আমার আছে।
যদি পীরের সাথে সৈয়দ সাহেবের উক্ত বাক বিতণ্ডা সত্য হয়ে থাকে এবং অবশ্যই সত্য, কেননা, বর্ণনাকারী হচ্ছে স্বয়ং ইসমাইল দেহলভী- তাহলে বলতে হয় যে, সৈয়দ সাহেবের খেলাফত লাভ করার কাহিনীটি একটি কাল্পনিক গল্প হতে পারে- কিন্তু সত্য ঘটনা হতে পারে না। মূর্তি তৈরী ও মূর্তি ভাঙ্গার মধ্যে যেমন কোন মিল নেই, আগুন আর পানির মধ্যে যেমন কোন মিল নেই, তদ্রুপ পীর আর মুরীদের গতিপথের মধ্যেও কোন মিল পাওয়া যায় না। পীরের ভ্রমণ হচ্ছে আকাশ পথে, আর কথিত মুরীদের ইতস্ততঃ ভ্রমণ হচ্ছে মরুভূমির চোরা বালিতে। সৈয়দ সাহেব যেহেতু লেখাপড়া থেকে বিলকুল অন্ধ ছিলেন- তাই তাবলীগ ও হেদায়াতের দ্বারা মানুষকে প্রভাবিত করার কোন ইলমী যোগ্যতাই তার ছিল না।
এ প্রসঙ্গে শেখ ইকরাম লিখেছেন-
"ওয়াজ ও তাবলীগের ক্ষেত্রে সৈয়দ সাহেবের অতটুকু যোগ্যতা ছিল না- যা ছিল শাহ ইসমাঈল শহীদের" (শেখ ইকরামের লিখিত মৌজে কাউছার পৃঃ ১৭)।
[কোন ব্যক্তি যদি সম্পূর্ণ বিদ্যাহীন হয় এবং প্রচার ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে যদি কোন যোগ্যতাই তার না থাকে- তা হলে সে দ্বীন ও ইসলামকে জীবিত করবে কি ভাবে? অর্থাৎ মোজাদ্দিদ দাবী করবে কি ভাবে? সুতরাং তাকে মুজাদ্দিদ বলা আর কলা গাছকে তালগাছ বলা একই কথা- অনুবাদক।]
বিগত দিনের সলফে সালেহীনদের উপর প্রাধান্যের দাবী
সৈয়দ সাহেবের এই ধারণাও ছিল যে, তিনি বর্তমান ও অতীতের সমস্ত আউলিয়ায়ে কেরামের চাইতে বেশি কামেল ও মর্যাদাবান ছিলেন। তিনি অধিকাংশ সময় একথাও প্রকাশ করতেন যে, তিনি দিল্লীর মাশায়েখগণেরও উর্ধ্বে। কোন কোন সময় আপন মুক্তাছড়ানো জবানীতে আপন কথিত পীর শাহ আব্দুল আজিজ (রহঃ)- এর উপরও প্রাধান্যের কথা আলোচনা করতেন এবং উদাহরণ পেশ করতেন।
মাওলানা জাফর থানেশ্বরীর মুখেই একথা শুনুন। তিনি লিখেন, সৈয়দ সাহেব নিজে একথা বলেছেন-
"আমি একদিন মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজের দরবারে হাজির ছিলাম। ঐ সময় তাঁর পাশে বসা মৌলভী রশিদ উদ্দিন খান কথা বলতেছিলেন। আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত একান্ত সাক্ষাতের অপেক্ষায় দালানে পায়চারী করতে লাগলাম। ভাবলাম- মৌলভী রশিদ উদ্দীন খান সাহেব চলে যাওয়ার পর আমি একান্তে মাওলানা হুজুরের কাছে কিছু কথা বলবো। এই পায়চারী অবস্থায়ই আমার প্রতি এই এলহাম হলো- "তুমি যদি বান্দাদের কাছে কোন জিনিস প্রার্থনা কর, তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করবো না।"
সৈয়দ সাহেবের উক্ত উক্তির বিষয়ে মাওলানা মুর্তাদা খানের গবেষণা শুনুন। তিনি বলেন- "সৈয়দ সাহেবের উক্ত এলহাম দ্বারা বুঝা যায়- ঐ সময়ে সৈয়দ সাহেবের মর্ত্তবা শাহ আব্দুল আজিজ (রহঃ) থেকেও বেশী ছিল" (মাওলানা জাফর থানেশ্বরীর সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১২১)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেবের উক্ত এলহামের দাবীর দ্বারা তো একথা স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে, সৈয়দ সাহেবের মর্ত্তবা সত্যিই শাহ আব্দুল আজিজের উপরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু হযরত শাহ আব্দুল আজিজের আচরণ ও কথার ধরনে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে, তাঁর নিকট মৌলভী রশিদ উদ্দিনের মর্ত্তবা সৈয়দ সাহেবের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে ছিল। কেননা, শাহ সাহেব মৌলভী রশিদ উদ্দিন খানকে নিজের কাছে বসিয়ে রেখেছিলেন এবং সৈয়দ সাহেবকে বারান্দায় পায়চারী করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বারান্দায় পায়চারী করতে করতে যখন সৈয়দ সাহেব কাতর হয়ে পড়লেন, তখনই তার উপর এলহাম হয়ে গেল। সৈয়দ সাহেবের উপর নিজের প্রশস্তিমূলক এলহাম হতে লাগলো। তখন যদি তার এই এলহামের বিষয়ে শাহ সাহেবের কাছেও আসতো, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি সৈয়দ সাহেবের ইজ্জত করতেন। কিন্তু শাহ আব্দুল আজিজ সাহেব তার নিকট একজন আলেমে দ্বীনের উপস্থিতিতে সৈয়দ সাহেবকে নিজের কাছে বসানো ভাল মনে করেন নি।
হযরত কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহঃ) এর চেয়ে বড় হওয়ার দাবী
সৈয়দ সাহেবের ভাগিনা জনাব সৈয়দ মুহাম্মদ আলী লিখেছেন-
"একদিন মোরাকাবা হালাতে খাজা বখতিয়ার কাকী (রহঃ) এবং সকল আত্মার সাথে সৈয়দ সাহেবের মোলাকাত হলো। তিনি মোরাকাবার মধ্যে দেখতে পেলেন- একটি নূরানী ছাতা খাজা সাহেবের মাথার উপর ছায়া বিস্তার করে আছে। এ সময় সৈয়দ সাহেবকে এটাও দেখানো হলো যে, তার নিজের মাথায় দুটি নূরের ছাতা ছায়া বিস্তার করে আছে" (সৈয়দ মুহাম্মদ আলীর মাখজানে আহমদী পৃঃ ২৫)।
মন্তব্যঃ খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহঃ)- যাঁর থেকে মাশায়েখগণের একটি বিশাল জগত ফয়েজ লাভ করেছেন- এমন জলিলুল ক্বদর হাস্তীকে কিভাবে নীচে নামিয়ে সৈয়দ আহমদ নিজের প্রশংসা ও গুণগান নিজে করলেন? উহ্! মোরাকাবার মত পবিত্র জিনিসকেও কিভাবে নিজের আত্ম প্রচারের হাতিয়ারে পরিণত করা হলো।
দিল্লীর মাশায়েখগণের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী
নিজের বুযুর্গী ও বড়ত্বের ডিগবাজী খাওয়া ছিল সৈয়দ সাহেবের শখের বিষয়। এজন্যই তিনি বলতেন-
"যখন আমি মোরাকাবা ও মোয়ামালার জগতে দিল্লীর মাশায়েখগণের রূহগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলাম, তখন নিজেকে দিল্লীর সমস্ত মাশায়েখগণের চেয়েও পূর্ণতম এবং উত্তম পেলাম" (সৈয়দ মুহাম্মদ আলীর মাখজানে আহমদী পৃঃ ২৫)।
[সৈয়দ মুহাম্মদ আলী ছিলেন ভাগিনা ও পক্ষীয় লোক- অনুবাদক।]
এই হলো মজ্জুবের ভেকধারী সৈয়দ সাহেবের ধোঁকা ও প্রতারণার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। বাইশজন খাজার আস্তানা বলে প্রসিদ্ধ- দিল্লীতে চির নিদ্রায় শুয়ে আছেন- খাজা কুতুব উদ্দিন, খাজা নিযাম উদ্দীন, খাজা বাকী বিল্লাহ, শাহ গোলাম আলী, শাহ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী, শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী- ছাড়াও বেশুমার জলিলুল ক্বদর বুযুর্গানে দ্বীন মনিষীবৃন্দ। তাঁদের পদধূলীর সমকক্ষতা দাবী করার যোগ্যতাও নেই যেই সৈয়দ সাহেবের এবং যিনি নিজ পীর শাহ আব্দুল আজিজের উপরও শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতে পারেন- তিনি কি করে অন্য মারেফত পন্থী বুযুর্গগণের সম্মান প্রদর্শন করবেন?
তাকে নিয়ে মাশায়েখগণের মধ্যে রূহানী বাক বিতণ্ডা
"একদিন হযরত শেখ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এবং খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ- এর পবিত্র রুহ সৈয়দ সাহেবের বিশেষ হালের উপর দৃষ্টিপাত করলেন এবং এক মাস পর্যন্ত উভয় রূহ্-ই আপোষে মিলে সৈয়দ সাহেবের উপর এক প্রহর পর্যন্ত তাওয়াজজুহ্ দিলেন। এতে করে উভয় খান্দানেরই নিসবত (রূহানী সম্পর্ক) সৈয়দ সাহেবের হাসিল হয়ে গেল" (মাওলানা জাফর থানেশ্বরীর সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ৬৫)।
মন্তব্যঃ এই বর্ণনা দ্বারা সৈয়দ সাহেবের সজাগ অবস্থায় সংঘটিত উক্ত ঘটনাটি দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, খোদার মকবুল বান্দাগণের ইন্তিকালের পরেও তাদের রুহানী সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার ব্যাপারে সৈয়দ সাহেব নিজেই স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে তার ছিলছিলাভূক্ত লোকদের (আওর মোহাম্মদীয়া ত্বরিকা) চিন্তা করা উচিৎ যে, ইন্তিকালপ্রাপ্ত বুযুর্গগণের রুহ মোবারক হতে সাহায্য গ্রহণের পর সৈয়দ সাহেবের ইসলামী আক্বিদার মধ্যে কোন পরিবর্তন এসেছিল কিনা? না কি- আসে নাই? যদি এসে থাকে, তাহলে সৈয়দ সাহেবের উপর বদ আক্বিদার ফতোয়া জারী করতে হবে। আর যদি তাঁর এই আক্বিদা শুদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তাদের তওবা করে নিজেদের আক্বিদা সৈয়দ সাহেবের মত ঠিক করে নেয়া উচিৎ।
উক্ত আকিদা শুদ্ধ কি অশুদ্ধ যাই হোক- আমরা পীর এবং মুরীদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবো না। কিন্তু আশ্চর্য না হয়ে পারিনা যে, ঐ পবিত্র রুহদ্বয় শেষ পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের মত লোককে নিজেদের তাওয়াজ্জুহ্ দানের জন্য বেছে নিলেন কেন এবং তাঁর পীর হযরত শাহ আব্দুল আজিজের মত বুযুর্গ ব্যক্তিকে তাঁদের তাওয়াজ্জুহ্ থেকে বাদ দিলেন কেন? অথচ তিনি জাহেরী ও বাতেনী দিক দিয়ে শুধু মোকাম্মিলই ছিলেন না, বরং অধিকতর কামেল ছিলেন এবং তাঁর ফয়েজ রেছানীর সুখ্যাতির সুর পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ জুড়ে বেজে উঠেছিল। এমন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে ঐ পবিত্র রুহদ্বয় এমন এক বেচারাকে বেছে নিলেন- যিনি কোরআনে পাকের কয়েকটি সূরা ছাড়া পূর্ণ কোরআন দেখে দেখেও পড়তে পারতেন না। একেই বলে আহাম্মকী।
তথাকথিত একটি স্বপ্ন ও বড়ত্বের দাবী
"সৈয়দ সাহেব একদিন বেলায়াতের সম্রাট হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু এবং হযরত সাইয়েদাতুন্নিছা ফাতেমা জাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা-কে স্বপ্ন যোগে দেখতে পেলেন। হযরত আলী তাকে নিজের হাতে গোসল করালেন এবং নিজের হাতে সৈয়দ সাহেবের শরীর খুব করে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দিলেন- যেরূপ মা-বাপ ছোট্ট সন্তানকে গোসলের সময় শরীর পরিস্কার করে থাকেন এবং হযরত ফাতেমা- রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা তাকে উত্তম লেবাছ পরিধান করিয়ে দিলেন" (সৈয়দ মুহাম্মদ আলীর মাখজানে আহমদী পৃঃ ২৪)।
উক্ত স্বপ্নের মধ্যে প্রত্যেক পাঠকই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনুভব করে থাকেন-
(১) সৈয়দ সাহেবের প্রত্যেক মুরীদই ঐ স্বপ্নকে সত্য বলে মনে করেন এবং সৈয়দ সাহেবের বুযুর্গীর প্রমাণ স্বরূপ পেশ করে থাকেন।
(২) সৈয়দ সাহেব উক্ত লজ্জাজনক ও চরিত্র বিধ্বংসী স্বপ্নটি আপন মুরিদানের সামনে নিজের মহত্ব ও বুযুর্গীর প্রমাণ স্বরূপ পেশ করতে গিয়ে একটুও লজ্জাবোধ করলেন না।
(৩) নিজের উলঙ্গ অবস্থায় তিনি হযরত আলী ও হযরত ফাতেমাকে দেখলেন। হযরত আলী (রাঃ) তাকে এমনভাবে গোসল করালেন- যেমন মা-বাপ নিজ ছোট্ট সন্তানকে গোসল করান এবং তিনি সৈয়দ সাহেবের শরীর ঘসে মেজে খুব পরিস্কার করে দেন।
(৪) ২৫ বৎসরের এই যুবক অবোধ শিশুকে ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা উত্তম লেবাছ পরিধান করালেন। মনে হয়- সৈয়দ সাহেব সাত দিনের মধ্যেই নির্লজ্জতার সমস্ত মনজিল অতিক্রম করে এই অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। পারসী কবিতায় আছে-
"বে-হায়া বাশ, ওয়া হারচেহ্ খাহি কুন্"
অর্থঃ তুমি লজ্জাহীন হয়ে গেছো। এখন যা মনে চায় তাই করতে পারো।
আসল কথা হলো- নিজের বুযুর্গী ও বড়ত্ব সম্পর্কে সৈয়দ সাহেবের ভুল ধারণা ছিল। এজন্যই তিনি মুরিদদের কাছে এমন কথা বলতে পেরেছিলেন যে, যখন হযরত আলী রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু গোসল করাচ্ছিলেন এবং হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা যখন উত্তম লেবাছ পরিধান করিয়ে দিচ্ছিলেন- তখন নিশ্চয়ই এ কথায় তার বুযুর্গী বৃদ্ধি পাবে এবং মুরিদদের মনে উত্তম ধারণা বৃদ্ধি পাবে। এই ধারণায় তিনি লজ্জার বিষয়টি আদতেই ভুলে গিয়েছিলেন।
মুরিদানের সংখ্যা ও প্রকৃত হাকীকত
সৈয়দ সাহেবের জীবনী পাঠে মনে হয়- তার গ্রহণযোগ্যতার এমন উপঢৌকন অর্জিত হয়েছিল- যা শেষ যুগে অন্য কারও ভাগ্যে জোটে নি। গল্প আর বর্ণনার গুজব মানুষকে অবাক করে দেয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- সৈয়দ সাহেব মুসলমানদের আক্বিদা ও আমল দুরস্ত করতে মাঠে নামার পর যে শহর বা গ্রামে যেতেন - সেখানকার হাজার হাজার বাসিন্দা শির্ক ও বিদ্আত হতে তওবা করে তার হাতে তরিকতের বাইআত হতেন। শুধু তাই নয়- বরং কোন কোন গ্রামচুক্তি মানুষ তার মুরীদ হয়ে যেতো।
কিন্তু যখন দেখি- "সৈয়দ সাহেব শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ভারতের সীমানা পেরিয়ে সীমান্ত প্রদেশের পথে রওয়ানা দেওয়ার সময় প্রকাশ্য ঘোষণা ও শত শত ঢাক ঢোল পিটিয়েও পাঁচশো লোকের বেশী সফর সঙ্গী যোগাড় করতে পারলেন না- তখনই আমাদের আশ্চর্যের সীমা থাকে না।
শাহ ওয়ালিউল্লাহর খান্দান মুশরিক ও বিদআতী ছিল
আর একটি কথায় বড়ই আশ্চর্য লাগে। তা হলো- মুসলমান হয়ে শির্ক থেকে তওবা করা। শির্ক করে মুশরিকরা এবং তারাই শির্ক থেকে তওবা করে মুসলমান হতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে- সৈয়দ সাহেবের কারামতী হাতে মুসলমানরাই শির্ক থেকে তওবা করছে; তাও আবার - স্বয়ং শাহ ওয়ালি উল্লাহর খান্দানের লোকেরাই! কি আশ্চর্য!
এ প্রসঙ্গে মাওলানা থানেশ্বরীর জবানীতে শুনুন। তিনি লিখেছেন-
"সৈয়দ সাহেব দিল্লী থেকে রওয়ানা দিয়ে সর্বপ্রথম কসবা 'ফলতে' নামক স্থানে পৌঁছলেন- যেখানে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও শাহ আহলুল্লাহর আত্মীয় স্বজনরা বসবাস করতো। ঐ খান্দানের ছোট বড়, পুরুষ মহিলা, আযাদ গোলাম- সবাই তার হাতে বাইআত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করলো এবং প্রত্যেক প্রকারের "শির্ক ও বিদ্আত"- হতে তওবা করে খাঁটি তাওহীদপন্থী ও সুন্নাতের পাবন্দ হয়ে গেলো"। (মাওলানা জাফর থানেশ্বরীকৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ৮৫)।
মন্তব্যঃ এখন প্রশ্ন হলো- শাহ ওয়ালি উল্লাহর খান্দানের লোকেরা কি তাঁর ইন্তিকালের অব্যবহিত পরে সত্যিই মুশরিক হয়ে গিয়েছিল- যাদের কোন স্বাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য হয় না? তারপর সৈয়দ সাহেবের হাজার হাজার লাখ লাখ মুরিদের কল্প কাহিনীটি আর একবার পড়ুন এবং মিথ্যা ও ফেরেববাজীর পরিমাণ নিজেরাই আন্দাজ করে নিন।
গোটা হিন্দুস্থানে মুরিদের ঢল
দিল্লীতে অবস্থানকালে এই অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে-
(১) অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে, দূর দূরান্ত হতে শত শত আলিম -ওলামা, ফাজিল ফুজলা, মুমেনীন, মুমিনাত- দলে দলে এসে বাইআত গ্রহণ করে ধন্য হতে লাগলো।"
(২) মুজাফফর নগর, মিহারী, সাহারানপুর, গড় মুক্তিরু রামপুর, বেরেলী, শাহজাহানপুর-প্রভৃতি এলাকার সমস্ত শহর ও কসবা ভ্রমণ করে সৈয়দ সাহেব অসংখ্য লোককে সত্য পথে আনয়ন করলেন এবং বাইআত করায়ে ধন্য করলেন"। (মাওলানা জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ৮০)।
(৩) "লক্ষ্মৌর ফিরিঙ্গী মহলের প্রায় সমস্ত উলামায়ে-ই সৈয়দ সাহেবের হাতে বাইআত হয়ে ধন্য হলেন" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ১০৬)।
(৪) "দশ বার দিন পর্যন্ত এলাহাবাদে তিনি অবস্থান করলেন। ঐ সময় হাজার হাজার লোক তার বাইআত গ্রহণ করে ধন্য হলো।" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ১২২)।
(৫) "বেনারসে একমাস অবস্থান করলেন। এই সময়ের মধ্যে প্রায় পনের হাজার লোক তার বাইআত গ্রহণ করে ধন্য হলো।" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ১২৩)।
(৬) "কানপুরে হাজার হাজার মানুষ তার মুরিদ হয়ে ধন্য হলো" (প্রাগুক্ত পৃঃ ১২৬)।
(৭) "কসবা মাছাওয়ান -এর অধিবাসী নারী পুরুষ সবাই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ধন্য হয়" (প্রাগুক্ত পৃঃ ১২৬)।
(৮) "দাউ-এ অবস্থানকালে ঐ রাতে হাজার হাজার নরনারী এসে তার মুরীদ হয়ে ধন্য হলো" (প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩০)।
(৯) "ডিগডিগী অবস্থানকালেও অনেক লোক এসে তার মুরিদ হয়ে গেলো" (প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩১)।
(১০) "এখানে (এলাহাবাদে) হাজার হাজার লোক তার মুরিদ হয়ে গেলো" (প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩২)।
(১১) "এখানেও (মির্জাপুরে) হাজার হাজার লোক বাইআত হয়ে ধন্য হলো" (প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩২)।
(১২) "(আজিমাবাদে) হাজার হাজার লোক শির্ক ও বিদ্আত হতে তওবা করে তার হাতে বাইআত হয়ে গেলো" (প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩৫)।
(১৩) "(শিপুরে) বহু লোক তার হাতে বাইআতের দ্বারা ভাগ্যবান হলেন" (ঐ পৃঃ ১৩৫)।
(১৪) এখানেও (কলিকাতায়) বাইআত গ্রহণকারী মানুষের ভিড়ে হযরতের একটুও ফুরসত ছিলনা" (ঐ পৃঃ ১৩৫)।
(১৫) "কলিকাতার শহরে বাইআত গ্রহণকারীদের এত আধিক্য ছিল যে, পাঁচশ ও একহাজার লোককে এক জায়গায় জমায়েত করে সাত আটটি পাগড়ী ফেলে দিয়ে বাইআত গ্রহণকারীদেরকে বলা হতো যে, এই পাগড়ীর কোন একটি কোনায় ধরে বাইআত করুন। সৈয়দ সাহেব ঐ পাগড়ী সমূহের অন্য প্রান্ত ধরে বাইআতের বাক্যগুলো উচ্চস্বরে তালকীন করতেন। এই অবস্থা সারাদিন চলতো" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ১৪৩)।
(১৬) কোলকাতা ও আশে পাশের এলাকায় তার মুরিদের সংখ্যা এত বেড়ে গেলো যে, কেউ যদি কোন কারণে তার কাছে মুরিদ হওয়ার সুযোগ না পেতো, তা হলে তাকে বেরাদরী ও আত্মীয়তা থেকে বের করে দেয়া হতো। এই কারণেও বাইআতকারীদের সংখ্যা আরও বহুগুণে বেড়ে যায়" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ১৫১)। [মনে হয় ঐ সময় সব মুসলমানই মুশরিক ছিল- অনুবাদক।]
আরবের অবস্থা
এই অবস্থা ছিল হিন্দুস্তানের শির্কের। লোকেরা দলে দলে এসে শির্ক ও বিদআত থেকে তওবা করে সৈয়দ সাহেবের মুরীদের দলভূক্ত হয়ে যায়। এবার আরবের অবস্থাটাও দেখে নিন।
(১৭) "আরব মুল্লুকেরও বহুলোক সৈয়দ সাহেবের হাতে বাইআত হয়ে ফয়েজ লাভ করেছেন (জাফর থানেশ্বরীকৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৫১)।
(১৮) মক্কা মোকাররমায় হাজার হাজার আলেম ও সাধারণ মানুষ- যারা আশেপাশের এলাকা থেকে হজ্ব করতে এসেছিলেন- তারাও তার বাইআত গ্রহণ করে মর্যাদাবান হয়ে যান" (ঐ পৃঃ ১৬০)।
(১৯) হজ্বের পরে ফিরতি পথে বোম্বাইতেও হাজার হাজার মানুষ তার বাইআত গ্রহণ করে ফয়েজ প্রাপ্ত হন (ঐ পৃঃ ১৬০)।
সীমান্ত প্রদেশে
(২০) তিনি বিনির ও সোয়াতে প্রচুর সফর করেন। উক্ত এলাকাদ্বয়ের প্রায় সকলেই তার বাইআতের আওতায় শামিল হয়ে যায়। (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩২৭)।
(২১) "হাসত নগরে লোকেরা এত অধিক পরিমাণে বাইআতের জন্য এসে জমায়েত হলো যে, এক এক করে বাইআত করানো কঠিন হয়ে পড়লো" (ঐ পৃঃ ৩২৭)।
(২২) "বরমীকোট , থানা চকদারাহ- এসব এলাকায় আম- খাস লোকের মধ্যে অধিক সংখ্যক লোকের থেকে তিনি বাইআত করে ছিলেন" (ঐ পৃঃ ৩৯৪)।
(২৩) "(কাশ্মীর) সংলগ্ন কাগান এলাকার বহু লোক তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন" (জাফর থানেশ্বরীকৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ২৫২)।
জ্বীন জাতির বাইআত
জীবনীকারগণ সৈয়দ সাহেবের প্রশংসা ও গুণগানে এত বাড়াবাড়ি ও সীমা লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন যে, লাখ লাখ জ্বিনকেও সৈয়দ সাহেবের মুরীদ করে ছেড়েছেন। জাফর থানেশ্বরীকৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৬০)।
মন্তব্যঃ জানিনা- লক্ষ লক্ষ ফেরেস্তারা সৈয়দ সাহেবের নিকট তরিকতের বাইআত গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করলেন না কেন? না কি- সৈয়দ সাহেবের জীবনী লেখকরা জেনে শুনেই তাদেরকে বঞ্চিত রেখেছেন। তদুপরি- যখন জ্বীনেরা বাইআত গ্রহণ করছিলো- তখন কোন্ কোন্ ব্যক্তিরা তাদেরকে দেখেছিল? প্রবল ধারণা হয়- প্রথম প্রথম তাঁরা গণনা করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু জ্বীনদের আধিক্য দেখে হিসাব করতে অপারগ হয়েই মনে হয় তারা লক্ষ লক্ষ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। লক্ষ লক্ষ জ্বীনের বাইআত গ্রহণ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের বাইআত গ্রহণের ধাঁধা সৃষ্টি কোন অংশে কম নয়।
দাওয়াত খাওয়ার দৃশ্য
সৈয়দ সাহেবের ভক্ত ও মুরীদানরা অকারণে অন্য পীর সাহেবদের সমালোচনা করে বলে থাকে যে, তাঁরা নাকি মুরিদ ও মু'তাক্বিদগণের বাড়ীতে বেশী বেশী দাওয়াত খান এবং নজরানা আদায় করে থাকেন। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের দিবারাত্রির হাদীয়ার প্রতি যদি দৃষ্টিপাত করা যায়- তাহলে দেখা যাবে - তিনি দাওয়াত খাওয়া ও নজরানা আদায় করার ক্ষেত্রে সকলকেই টেক্কা মেরেছিলেন। প্রথমে তার দাওয়াত খাওয়ার কিঞ্চিত দৃশ্য দেখা যাক এবং পরে নজরানা আদায়ের খেলাও দেখে নিন।
জাঁকজমকপূর্ণ দাওয়াত সমূহ
"(বুড্ডানা শহরে) বেশীর ভাগ খানা পাকানো হতো- মাওলানা আবদুল হাইয়ের ওখানে। উনি প্রত্যেক দিন চরম জাঁকজমকপূর্ণ খানা তৈরী করতেন। (তিনি ছিলেন ইসমাইল দেহেলভীর ভগ্নিপতি)।
সৈয়দ সাহেব যদি এতে বাধা দিতেন- তাহলে মাওলানা হাই সাহেব বলতো- হুজুর। আপনার সামান্য আরামের জন্য যদি ঘরও বিক্রি করতে হয়, তাহলেও সেটাকে আমি সৌভাগ্য মনে করবো" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১২৭)।
মন্তব্যঃ মাওলানা আবদুল হাই সাহেব একজন আলেম হয়েও জাঁকজমকপূর্ণ খানা তৈরী করে অপব্যয়ের অপরাধে লিপ্ত হয়েছিলেন। কুরআন হাকীমে তো অপব্যয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এখানে যেহেতু পীর আর মুরিদের ব্যাপার, তাই আমরা খানার ব্যাপারে অধিক কিছু বলবো না।
পীরজাদাগণের ন্যায় সফর
সৈয়দ সাহেব যখন হিন্দুস্তানের বিভিন্ন শহরের উদ্দেশ্যে সফরে বের হতেন- তখন সাধারণতঃ পীরজাদাগণের ন্যায়ই পন্থা অবলম্বন করতেন। আমরা তো এমন উপযুক্ত নই যে, এ ব্যাপারে কিছু মন্তব্য করি। গোলাম রসুল মেহের সাহেবই এ ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতার কথা এভাবে বর্ণনা করেছেন–
"এই সফর সমূহ দৃশ্যতঃ পীর সাহেবান ও পীরজাদাগণের ন্যায়ই ছিলো - অর্থাৎ সৈয়দ সাহেব নিজের কাফেলা নিয়ে শহরে বন্দরে, গ্রামে ও গঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন। প্রত্যেক স্থানে দাওয়াতও হতো"। অন্যত্র লিখেছেন- "সৈয়দ সাহেবের সাধারণ নিয়ম ঐ ধরনেরই ছিলো- যে ধারায় অভ্যস্থ ছিলেন পীরজাদাগণ" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১২৮)।
মন্তব্যঃ উপরোক্ত বক্তব্য শুনে যদি আপনি মন্তব্য করেন যে- সৈয়দ সাহেবের কাফেলা খানার দাওয়াতের তালাশেই ঘরে ঘরে গ্রামে-গঞ্জে ফিরছিলেন- তা হলেও বাড়িয়ে বলা হবেনা।
আযিমুশশান দাওয়াত
"মুর্শিদাবাদের দেওয়ান গোলাম মুর্তাদা সৈয়দ সাহেবের কাফেলাকে থামিয়ে বারবার অনুরোধ করলেন এবং বললেন- "আমার জন্মস্থান (কুহনায়) চলুন"। যে বাংলোতে সৈয়দ সাহেবের থাকার ব্যবস্থা করা হলো- তার সাজানী ও মেরামত বাবদই তখনকার দিনের ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। বাংলোর বাইরে বিরাট বাজার বসানো হলো এবং একথা ঘোষণা করে দেয়া হলো যে, সৈয়দ সাহেবের সঙ্গীসাথীরা যা কিছু খরিদ করবেন- তার খরিদমূল্যের একটি হিসাব যেন রাখা হয়। আমি (মূর্তাদা) নিজে ঐ মূল্য পরিশোধ করে দেবো" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২২৯)।
মন্তব্যঃ উক্ত আয়োজনকে যদি অপব্যয় না বলা হয়- তাহলে এমন কোন্ ব্যয় আছে- যাকে অপব্যয়ের নিকৃষ্ট নামে অভিহিত করা যাবে? মনে হয়- সৈয়দ সাহেবের দরবেশী আর শাহ ইসমাঈল দেহলভীর কাফের বানানোর কলম ঐ সময় শুকিয়ে গিয়েছিল। তা না হলে তারা নিশ্চয়ই এই অপব্যয় ও বিদআতী কর্মকান্ডকে তিন অক্ষর বিশিষ্ট কাফ-ফা-রা- (কাফের) নামে অভিহিত করতেন। যারা মিলাদুন্নবীর জলসা- জুলুসের খরচকে অপব্যয় বলে নবী প্রেমিক মুসলমানকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যায়িত করছে- তারা সৈয়দ সাহেবেরই খাস ভক্ত গোলাম মুর্তাদার উপর ঐ তিনটি অক্ষর কেন প্রয়োগ করছেন না?
পোলাওর মধ্যে ঘিয়ের আধিক্য
"(বোম্বাই শহরে) প্রত্যেহ জাঁকজমকপূর্ণ দাওয়াত সমূহ হতো। পোলাওর মধ্যে ঘিয়ের পরিমাণ ছিল বেশী"। (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২২৯)।
মন্তব্যঃ অন্যের উপর দোষারোপকারী সৈয়দ সাহেবের গুণগ্রাহীরা সৈয়দ সাহেবের দাওয়াতের এই কাহিনী পাঠ করেও যদি চিন্তা না করেন- তা হলে আফসোস করা ছাড়া আর কিইবা করা যায়?
দাওয়াতের প্রাচুর্য
"খাওয়ার দাওয়াত বিভিন্ন লোকদের তরফ থেকে একের পর এক আসতে লাগলো। সৈয়দ সাহেব মুসল্লিদেরকে ত্রিশ ত্রিশ বা চল্লিশ চল্লিশ জনের দলে বন্টন করে দিতেন এবং দাওয়াতকারীদের পালা নির্ধারিত করে দিতেন- যেন কোন দাওয়াতকারীর কোন প্রকারের অভিযোগ না থাকে। তিনি চারসাদ্দা শহরে আনুমানিক দু'সপ্তাহ অবস্থান করেন। উভয় বেলা মুসল্লিদের বিভিন্ন গ্রুপ দাওয়াতকারীদের ওখানে গিয়ে খানা খেয়ে আসতো" (গোলাম রসুলের লিখিত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩২৭)।
মনে হয়- সৈয়দ সাহেব সদলবলে মুজাহেদীনকে নিয়ে দাওয়াত খাওয়ার জন্য বড় নিমন্ত্রণ প্রিয় ছিলেন।
দরগাহ্তে খানার দাওয়াত
"মাগরিবের সময় তিনি চমকনি পৌঁছলেন- যেখানে শেখ ওমর নামক এক বুযুর্গের মাযার ছিল। তার আওলাদের মধ্যে এক মহিলা উক্ত মাযারের মোতাওয়াল্লিয়াহ ছিলেন। উক্ত মহিলা পুরা লস্করের জন্য খানা পাকালেন। ঐ খানার মধ্যে খিচুড়ি, গোস্ত এবং তন্দুরী রুটিও ছিল।" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬৬২)।
মন্তব্যঃ খানার দাওয়াত - তাও-আবার এক মাযারের মোতাওয়াল্লি মহিলার পক্ষ হতে এবং দরগাহের মধ্যেই। এই ধরনের খানার দাওয়াতে তাদের কারও আপত্তি ছিল না। [অথচ মাযারের পয়সায় জেয়াফত খাওয়া তাদের মতেই হারাম ও বিদ্আত- অনুবাদক।]
দাওয়াত এবং নজরানা
"সৈয়দ আবদুল কাইয়ুম জাঁকজমক করে তাকে দাওয়াত দিলেন। অন্যান্য হাদিয়া ছাড়াও একটি মহিষ সৈয়দ সাহেবকে নজরানা হিসাবে দিলেন। ঐ মহিষটি অসম্ভব রকমের ঢিলাঢালা এবং এমন মোটাতাজা ছিল- মনে হয় যেন একটা হাতীর বাচ্চা" (গোলাম রসুল কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩৯৫)।
ধোঙ্গল সিং- কর্তৃক দাওয়াত
জনাব গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"সাহারানপুর তহসীলদার ধোঙ্গল সিংও সৈয়দ সাহেবকে দাওয়াত করলেন"। (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১২৮)।
মন্তব্যঃ যদি মনে কোন কষ্ট না নেন- তাহলে এতটুকুই আরজ করবো যে, সৈয়দ সাহেবের দাওয়াতের বাখান বয়ান করাই মেহের সাহেবের আসল উদ্দেশ্য- চাই দাওয়াতকারী কাফের হোক- আর মুসলমান।
ইংরেজ সৈন্যদের দাওয়াত
"ইংরেজ সিপাহীরা খানার দাওয়াত গ্রহণ করার জন্য অনুনয় করলে সৈয়দ সাহেব বললেন- এই শর্তে দাওয়াত মঞ্জুর করা হলো যে, আমি যা বলবো- তা পাকাতে হবে। সিপাহীরা তা মেনে নিল" (গোলাম রসুল মেহেরের সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১২৮)। [মন্তব্য নিস্প্রয়োজন। শুধু এতটুকুই বলবো-সৈয়দ সাহেব ইংরেজ সৈন্যদের কত প্রিয়জন ছিলেন- অনুবাদক।]
ইংরেজের রক্ষিতা বিবির আমন্ত্রণ
"কানপুরের এক ইংরেজ সাহেবের মুসলমান স্ত্রী (রক্ষিতা) নিজ জামাতা মির্জা আবদুল কুদ্দুসকে রায় বেরেলী পাঠিয়ে সৈয়দ সাহেবকে ডেকে আনলেন" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ১৫৯)।
"সৈয়দ সাহেব গঙ্গা অতিক্রম করে ইংরেজ সাহেবের মুসলমান স্ত্রীর ঘরে তশরীফ নিয়ে গেলেন" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৬০)।
মন্তব্যঃ ইংরেজরা ঐ সময় অনেক মুসলমান মহিলাকে স্ত্রীর মত ব্যবহার করতো। এই কানপুরী মহিলাও ইংরেজ সাহেবের এমনই একজন রক্ষিতা ছিল- যার ঘরে সৈয়দ সাহেবের শুভাগমন হয়েছিল।
ইংরেজ কর্তৃক নিমন্ত্রণ
সৈয়দ সাহেবের ভাগিনা সৈয়দ মুহাম্মদ আলী লিখেছেন-
"যখন এশার নামায হয়ে গেলো - তখন দিদ্ বানু আরজ করলো যে, কিছু মশাল আমাদের দিকেই আসছে। এমন সময় দেখা গেল- একজন ইংরেজ সাহেব ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন ধরনের খানা নিয়ে আমাদের নৌকার কাছে এসে দাঁড়ালো এবং জিজ্ঞাসা করলো- পাদরী সাহেব কোথায় আছেন? সৈয়দ সাহেব নৌকা থেকে নিজেই জবাব দিলেন যে, আমি এখানেই আছি। আপনি তশরীফ নিয়ে আসুন। ইংরেজ সাহেব তৎক্ষণাৎ ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন এবং নিজের হেট মাথা থেকে নামিয়ে নৌকায় সৈয়দ সাহেবের কাছে এসে হাজির হলেন। মেজাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর সে নিবেদন করলো- আমি আমার চাকর বাকরদেরকে আপনার কাফেলার আগমনের খোঁজখবর নেয়ার জন্য মোতায়েন করে রেখেছিলাম। আজ খবর পেলাম যে, আপনি আপনার কাফেলা সহ এদিকে আসছেন। এই সুসংবাদ শুনে আমি উপস্থিত যা কিছু তৈরী করেছি- তাই আপনার খেদমতে পেশ করেছি।" (সৈয়দ মুহাম্মদ আলীকৃত মাখজানে আহমদী পৃঃ ২৭)।[সৈয়দ সাহেব ছিলেন ইংরেজদের নিকট পাদরী এবং তাদের গুরু- অনুবাদক]
জিনাখোর ইংরেজের নিমন্ত্রণ গ্রহণ
"এক ইংরেজ সাহেবের মুসলমান স্ত্রী (রক্ষিতা) দাওয়াত করার উদ্দেশ্যে সৈয়দ সাহেবের কাফেলা থামালো। সৈয়দ সাহেব উক্ত মহিলার দাওয়াত কবুল করতে অস্বীকৃতি জানালেন। এরপর ইংরেজ সাহেব নিজে আসলো এবং আরজ করলো- ওর দাওয়াত না নিয়ে থাকেন, কিন্তু আমার দাওয়াত গ্রহণ করতে তো আপত্তি থাকার কথা নয়। এ কথার পর তিনি ইংরেজ সাহেবের দাওয়াত কবুল করলেন" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১৫০)। [মুসলমান স্ত্রী রাখা হারাম- সুতরাং জিনাখোর- অনুবাদক]
এক ইংরেজ মহিলার নিমন্ত্রণ গ্রহণ
"বাইআত গ্রহণকারীদের মধ্যে মিনডুদ নামের এক ইংরেজ সাহেবের স্ত্রীও ছিল। ঐ মহিলা বাইআত হওয়ার পর সাত দিন পর্যন্ত দুবেলা সৈয়দ সাহেবকে দাওয়াত করেছিল এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সহ এক আলীশান ঘর তাঁকে থাকার জন্য হাদিয়া স্বরূপ দিয়েছিল" (মাওলানা জাফর থানেশ্বরীকৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১২৬)।
ইংরেজ কোম্পানীর উকিলের দাওয়াত
সৈয়দ সাহেব কলকাতায় থাকাকালীন মুন্সী আমিনুদ্দীন আহমদের ঘরে অবস্থান করতেন। উক্ত মুন্সী সাহেব কে ছিলেন - সে সম্পর্কে গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"এই মুন্সী আমিনুদ্দীন আহমদ- যিনি ছিলেন বাংলার উচু খান্দানের লোক-কলকাতায় যাকে উচ্চমানের ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসাবে গণ্য করা হতো। ইংরেজ কোম্পানীতে তিনি উকিলের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কোম্পানীর পুরা এলাকার যত মোকদ্দমা কলকাতার কেন্দ্রীয় সরকার বরাবরে আসতো- সবগুলোই মুন্সী সাহেবের মাধ্যমে ফাইল করা হতো" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১০৫)।
মন্তব্যঃ ইংরেজ সাহেবগণের, তাদের স্ত্রীগণের এবং কর্মচারী ও কর্মকর্তাগনের এই বিপুল সংখ্যক দাওয়াত সৈয়দ সাহেবের ইংরেজ প্রীতিরই ইঙ্গিত বহন করে। তা না হলে তাদের তথা কথিত পাদরী সৈয়দ সাহেবকে দাওয়াত করার অন্য কোন প্রয়োজন ছিলনা। ইংরেজরা যখন সৈয়দ সাহেবের ব্যাপারে ভীতও ছিল না এবং সৈয়দ সাহেব নিজেই যখন পরিস্কার ভাষায় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ইংরেজ সরকারের সাথে আমার কোনরূপ শত্রুতা নেই, অপর দিকে সৈয়দ সাহেবের খানার দাওয়াত গ্রহণ - ইত্যাদি ঘটনার দ্বারা ইংরেজদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতাই প্রমাণ করছে। [ইংরেজ বিরোধী হলে তিনি এত দাওয়াত পেতেন না -অনুবাদক।]
মহারাজার রাজকীয় দাওয়াত
"গোয়ালিয়রের মহারাজার পক্ষ হতে মেহমানদারীর পূর্ণ ইনতিজাম করা হয়েছিল। কয়েকবার হিন্দু রায়েরা দাওয়াত করেছিল। একটি দাওয়াতের বিবরণ বর্ণনাকারীগণ এভাবে দিয়েছেন- "মিরাটী পদ্ধতির খানা তৈরী করা হয়েছিল- শিরনাম, পরেঠা, পোলাও, মিতনাজিন, ক্বালবা, ফিরনী, ইয়াকুতি কাবাব, পছেন্দে, মোরগ বিরানী- ইত্যাদি প্রস্তুত করা হয়। সৈয়দ সাহেব এবং বোলন্দ মর্তবার সাথী সঙ্গীদের হাত হিন্দু রায় সাহেবরা ধৌত করে দিয়েছিলেন। খাওয়া দাওয়ার পর যেসব পান পেশ করা হয়- তা ছিল জরী পাতায় মোড়ানো। অনেক উপঢৌকন পান পাত্রে রেখে নজরানা দেয়ার জন্য আনা হয়েছিল। ঐ গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মূল্যবান একটি মুতিহার এবং দুটি চোগা। ঐ চোগার উপর জরীরের উত্তম কারুকার্য করা হয়েছিল" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৭৪)।
মন্তব্যঃ হিন্দু রাজা ও রায় সাহেবরা কোন্ ইসলাম ও কোন জিহাদের আনন্দে সৈয়দ সাহেবের উদ্দেশ্যে এমন আজিমুশশান দাওয়াতের ব্যবস্থা করেছিল? ইহার উদ্দেশ্যে অন্য কিছু একটা ছিল। আর ঐ উদ্দেশ্য এমনও হতে পারে যে, মহারাজাদের জন্য ইংরেজ সরকারের সন্তুষ্টির প্রয়োজন ছিল। ঐ সন্তুষ্টি অর্জন করা এপথেই হয়তো সম্ভব হয়েছিল। (এটা রাজনৈতিক চানক্য কৌশল এবং এক প্রকারের ঘুষও বটে- অনুবাদক)।
সৈয়দ সাহেবও খুব মজা করেই এসব দাওয়াত খেতেন। সৈয়দ সাহেবের সংশ্লিষ্ট মুরিদানগণ আপাততঃ প্রথমে আপন পীরের দাওয়াতের দৃশ্যটা দেখে নিন। পরে অন্যের সমালোচনা করুন।
নজরানার ঝলকানীর নমুনা
সৈয়দ সাহেব জীবিকার্জনের ক্ষেত্রে খুবই টানা পোড়নে ছিলেন। জীবিকার অনুসন্ধানে প্রথমে তিনি রায়বেরেলী থেকে ১৯ বৎসর বয়সেই লাক্ষ্মৌ সফর করেন। কিন্তু সফল হতে পারেন নি। এক খানদানী লোক তাকে দুবেলা খাবার দিতেন। সৈয়দ সাহেব নিজে গিয়ে উক্ত খানা নিয়ে আসতেন। এ হলো তার প্রাথমিক অবস্থা।
যখন কিছু সংখ্যক ওহাবী পছন্দ লোক তাদের মতলব হাসিল করার জন্য সৈয়দ সাহেবের বেলায়েতের প্রচার প্রপাগান্ডা শুরু করলো, তখন নজরানার ঢল শুরু হয়ে গেল। তাতে সৈয়দ সাহেব নিজে এবং সংশ্লিষ্টরা সফলতা লাভ করতে লাগলেন। নজরানা, চাঁদা ও সদকা ছাড়া অন্য কোন স্থায়ী ও যুক্তিসঙ্গত আমদানী তাদের ছিল না। খাদ্যের অভাবের সময় তারা এই প্রতীক্ষায় থাকতেন যে, কোনখান থেকে দাওয়াত সাওয়াত ও নজরানা আসবে। যখন হতাশা আসতো- তখন লেনদেন করে কোন রকমে চলতেন।
এ প্রসঙ্গে গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"সৈয়দ সাহেব তার এক বন্ধু শাহমীর- এর নিকট থেকে দুশো টাকা ধার করলেন। যখন নজরানার টাকা আসলো- তখন পরিশোধ করে দিলেন।" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১২৩)।
কিন্তু যখন তিনি আপন পিতৃ ভূমিতে গেলেন- তখন নজরানায় ঘাটতি দেখা দিল। সময় অতি কষ্টে কাটতে লাগলো। এ প্রসঙ্গে মাওলানা জাফর থানেশ্বরী লিখেছেন-
"পিতৃভূমিতে (রায় বেরেলী) যাওয়ার পর দৈনিক নজর নেয়াজের আমদানী বন্ধ হয়ে গেল" (মাওলানা জাফর থানেশ্বরীকৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ৯৩)।
মন্তব্যঃ এর কারণ ছিল- হয়তো এলাকাবাসীরা তার বেলায়াত স্বীকার করতো না, অথবা এ সম্পর্কে অজানা ছিল এবং পূর্বের মতই তাকে বোকা মনে করতো।
এছাড়াও সৈয়দ সাহেব বিভিন্ন সময়ে মানুষের নিকট থেকে এই আশায় কর্জ নিতেন যে, হয়তো নজরানা অথবা চাঁদা পাওয়া যাবে। সে সময় কর্জ শোধ করা যাবে। জনাব গোলাম রসুল মেহের বর্ণনা করেন-
বিভিন্ন যানবাহন ও বহনকারীদের মজুরী বাইশ টাকা বাকী ছিল। এ সময় মানুষ থেকে কিছু নজরানা এসেছিল। তা থেকে উক্ত বাইশ টাকা পরিশোধ করে তিনি অতিরিক্ত তিন টাকা তাদেরকে বখশিশ দিলেন"। (গোলাম রসুল মেহেরকৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১৮৫)।
কার্পেট নজরানা
সৈয়দ সাহেব শুধু টাকা পয়সার নজরানাই নিতেন না বরং যাই পেতেন- নিয়ে নিতেন। গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"শেখ (গোলাম আলী) সাহেব বিশ প্রকারের হাদিয়া ছাড়াও একটি মূল্যবান কার্পেট সৈয়দ সাহেবের খেদমতে পেশ করেন" (উক্ত গ্রন্থ ১৫৭ পৃঃ)।
একটু পরেই পূণঃ লিখেছেন-
"নজর হিসাবে মূল্যবান পারছে সৈয়দ সাহেবের খেদমতে এসে গেল"। (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ১৫৮)।
সম্ভবতঃ ঐ যুগে সৈয়দ সাহেব ছাড়া অন্য কেউ সাহায্য পাওয়ার বেশী উপযুক্ত ছিল না- তাই।
মহিষ নজরানা
"কারুত (সিন্ধু) সৈয়দ চৌরান শাহ নামে এক উল্লেখযোগ্য বুযুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। সৈয়দ সাহেবের নির্দেশক্রমে সৈয়দ হামিদুদ্দীন ও সৈয়দ আওলাদ হাসান নামের দু'ব্যক্তি উক্ত বুযুর্গের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। উক্ত বুযুর্গ ব্যক্তি সৈয়দ সাহেবের সাথে মোলাকাতের উদ্দেশ্যে। এসেছিলেন। তিনি নজরানা হিসাবে সৈয়দ সাহেবকে একটি বড় মহিষ দিলেন।" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৮৪)।
মন্তব্যঃ যিনি পারছে কবুল করতে অস্বীকার করেন না- তিনি এতবড় মহিষকে ছেড়ে দেবেন কি করে? যদি বিশুদ্ধ আকিদাপন্থী কোন মুসলমান সৈয়দ সাহেব ও তার সঙ্গী সাথীদের বাতিল আক্বিদা সম্পর্কে না জেনে কোন নজরানা পেশ করতো - তাহলে তা বিনা দ্বিধায় তারা কবুল করে নিতেন। (যেমন এ ক্ষেত্রে হয়েছে) কিন্তু শুদ্ধ আক্বিদাপন্থী কোন মুসলমান যদি এই মহিষটিই হযরত শেখ আব্দুল কাদের জিলানী, খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী অথবা হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দের মাযার শরীফের কোন বাসিন্দাকে দান করে দিতেন, তাহলে গাইরুল্লাহর নামে দেওয়ার অপরাধে তা বোধ হয় হারাম ঘোষণা করা হতো। এখন সৈয়দ সাহেবের খেদমতে পেশ করার কারণে উক্ত মহিষটি আর হারাম রইলো না। মনে হয়- যেন সৈয়দ সাহেব গাইরুল্লাহ নন। গাইরুল্লাহ কেবল শেখ জিলানী প্রমুখ অলি আল্লাহগণ।
আওলাদ নজরানা
নজরানা সীমা অতিক্রম করে চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। মহিষের চেয়েও বড় নজরানা এখন পেশ করা হচ্ছে। পড়ুন এবং কপাল চাপড়াতে থাকুন। জাফর থানেশ্বরীর ভাষায় -
"সবচেয়ে আশ্চর্য তোহফা- যা শেখ ফরজন্দ আলী সাহেব নিয়ে এসেছিলেন- তা ছিল- আমজাদ নামের এক নওজোয়ান ছেলে। ফরজন্দ আলী সাহেব আপন পুত্রকে হযরত ইব্রাহীম খলিলুল্লাহর ন্যায় আল্লাহর রাস্তায় মান্নত করে সৈয়দ সাহেবের হাতে হাওয়ালা করে দিলেন" (জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৬৮)।
মন্তব্যঃ সুধী পাঠক, আপনি কি খেয়াল করেছেন যে, একদিকে মহিষ ও বকরী সৈয়দ সাহেব ব্যতিত অন্য কোন বুযুর্গকে নজরানা দিলে তা গাইরুল্লাহর সাথে সম্পর্কের অজুহাতে হারাম হয়ে যায়, আর যদি সৈয়দ সাহেবকে নিজের বেটাও নজরানা দেয়া হয়, তাহলে তা শুধু ব্যক্তির বুযুর্গী ও মহত্ত্বের দলীলই নয়- বরং ইব্রাহীম খলিলুল্লাহর মতই হয়ে যায়। নাউযু বিল্লাহ !
গরম গরম হালুয়ার দোয়া
আফসোস হয় ঐ বালাম বাউরী দোয়ার প্রতি- যা হালুয়া খোরীর জন্য করা হয়। কিন্তু আশ্চর্য লাগে- সৈয়দ আহমদ সাহেবও দেখি হালুয়া নজরানা আসার জন্য দোয়া করেছেন। এক দিন সাথীরা সৈয়দ সাহেবের কাছে আরজ করলো- আপনি দোয়া করুন- যেন কোথাও হতে খানা আসে। এ প্রসঙ্গে মাওলানা জাফর থানেশ্বরীর মুখেই শুনুনঃ-
"সৈয়দ সাহেব হালুয়ার জন্য দোয়া করে একটি কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তার মাথার কাছে এসে তাকে জাগ্রত করতে লাগলো। তিনি মুখ খুলে দেখলেন- এক ব্যক্তি সত্যি সত্যি গরম গরম হালুয়া নিয়ে হাজির হয়েছে" (মাওলানা জাফর থানেশ্বরীকৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ৬৯)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেব এমন মোস্তাজাবুদ দাওয়াত ছিলেন যে, মানুষ সহ হালুয়া হঠাৎ করেই এসে গেলো। কতই না ভাল হতো- যদি তিনি সীমান্ত প্রদেশের সুন্নী- মুসলমানদেরকে কতল করার পূর্বে এরূপ দোয়া করে দিতেন। তাহলে তো আর মুসলমানদের মধ্যে এমন খুন-খারাবী করার প্রয়োজন হতো না।
এক দারোগার নজরানা
"সোয়ে নদীর অপর পাড় থেকে দু'ব্যক্তির আওয়াজ ভেসে আসলো- "নৌকা পাঠিয়ে দাও"। সৈয়দ সাহেব নিজেই মসজিদ থেকে বের হয়ে আসলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন- আপনারা কে? জানা গেলো- সৈয়দ সাহেবেরই জনৈক মুরিদ সৈয়দ ইয়াছিন নজরানা হিসাবে কিছু টাকা পাঠিয়েছে। সৈয়দ ইয়াছিন ছিল তোপখানার দারোগা। নৌকা পাঠানো হলো। ঐ দুব্যক্তি আসলো এবং টাকাগুলো সৈয়দ সাহেবের খেদমতে পেশ করলো" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১৩৫)।
বুদ্ধরামের হাদিয়া
পেশোয়ারে বুদ্ধরাম নামে এক প্রসিদ্ধ হিন্দু শেঠ ছিল। সে সৈয়দ সাহেবের খেদমতে এসে নগদ টাকা ছাড়াও আঙ্গুর, আনার, পেস্তা, বাদাম, নাশপাতি এবং বহির টুকড়ী ও থলে নজরানা হিসাবে পেশ করলো" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬৫২)।
হরিরামের হাদিয়া
"হরিরাম কাশ্মীরী গাজীয়াবাদে (পেশোয়ার) তহশীলদার ছিল। সে অত্যন্ত নেয়াজমন্দ হিসাবে উপস্থিত হয়ে শিরনী ছাড়াও কিছু নজরানা হাদিয়া হিসাবে পেশ করলো" (গোলাম রসুল কৃত ঐ পৃঃ ১২৬)।
শেখ গোলাম আলীর নজরানা
যেসব লোকেরা উলামা ও মাশায়েখগণের নজরানা গ্রহণ বিষয়ে সমালোচনায় সোচ্ছার- সৈয়দ সাহেবের এই "নজরানা বিজয়ের" ব্যাপারে তারা মুখে তালা লাগিয়ে আছেন কেন? সৈয়দ সাহেবের নজরানার বিরাট এক ফিরিস্তি আছে। আমরা উক্ত স্তুপ থেকে খরকুটা স্বরূপ সামান্য কিছু পেশ করছি-, পড়ুন।
"শেখ গোলাম আলী এলাহাবাদী সাহেব এভাবে যেসব নজরানা পেশ করেছেন- তা একত্রে বিশ হাজার টাকার কম হবে না" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ পৃঃ ১৯১)।
মন্তব্যঃ উক্ত বিশ হাজার টাকা ১৮২৪ খৃষ্টাব্দের টাকা- এখনকার নয়। এতবড় অংকের হাদিয়া নজরানা হিসাবে সৈয়দ সাহেবকে দেয়া হতো। বড়ই আফসোস হয় ঐ সমস্ত লোকদের প্রতি- যারা চার আনা গ্রহণকারীদেরকে সব সময় অভিযোগের নিশানা বানিয়ে রাখে- অথচ বিশ হাজার টাকা গ্রহণকারীদের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকে।
(উল্লেখ্য যে সৈয়দ সাহেব ১৮১৬-২০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত হজ্বের বাহানা করে সৌদী আরবে গিয়ে ওহাবী সংশ্রবে কিছুকাল থেকে ওহাবী খেলাফত নামা নিয়ে দেশে ফিরে ১৮২৩-১৮২৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত শির্ক বিদ্আতের ধুয়া তুলে সারা ভারত চষে বেড়িয়েছেন। ১৮২৬ খৃঃ পেশোয়ার গিয়ে সেখানকার মুসলমানদের সাথে ১০টি লড়াই করেছেন। অবশেষে ১৮৩১ খৃঃ পাঠানদের হাতে বালাকোটে নিহত হন। শিখরা ছিল উপলক্ষ্য মাত্র- সামনে বিস্তারিত দেখুন- অনুবাদক)
ইংরেজ কর্মচারীর নজরানা
"বাইআত গ্রহণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন দারোগা মুহাম্মদ রহম ও মুহাম্মদ তকী কসাই। এই তকী কসাই ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে গোস্ত সরবরাহকারী ছিল। সে শিরনী এবং নগদ অর্থে অনেক খাঞ্চাপূর্ণ নজরানা পেশ করতো" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১২৬)।
দুই'শ টাকার নজরানা
"মৌলভী কারামত আলী, ছদর আমীন, শেখ মুহাম্মদ তকী, বস্তী মিয়া, রনজিৎ খান- এরা সবাই দুই দুই'শ করে টাকা নজরানা হিসাবে পেশ করেছিল। কিল্লার ম্যাগাজিনের খালাসীরা পর্যন্ত দুই দুই'শ টাকা করে নজরানা পেশ করেছিল " (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ১২৬)।
মুরগী এবং ডিমের নজরানা
"সৈয়দ সাহেবের ওখানে নিয়ম ছিল- যে সমস্ত লোক তার মোলাকাতের জন্য আসতো- তারা তোহ্ফা হিসাবে কেউ আনতো মুরগী, কেউ নিয়ে আসতো সের দু'শের মধু অথবা ঘি। কেউ আবার চাউল অথবা মুরগীর ডিমও নিয়ে আসতো। সৈয়দ সাহেব এসব জিনিস ভালভাবে হেফাজত করে নিজের বাবুর্চী খানায় রেখে দিতেন" (মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী কৃত সিরতে সৈয়দ আহমদ শহীদ প্রথম খণ্ড পৃঃ ৫৪)।
মন্তব্যঃ অর্থাৎ- সৈয়দ সাহেব সব রকমের হাদিয়াই গ্রহণ করতেন। তার মধ্যে নগদ টাকা, কার্পেট, কাপড়, আঙ্গুর, আনার, পেস্তা, বাদাম, নাশপাতি, চাউল, ডিম, মুরগী, হালুয়া, শিরনী, মধু, ঘি, মহিষ, - এমন কি- ছেলে সন্তান পর্যন্ত হাদিয়ার অন্তর্ভূক্ত ছিল। কিন্তু সমস্ত সমালোচনার ভাগ পড়ে গিয়ে সৈয়দ সাহেবের বিরোধীদের উপর।
মাযার সমূহে উপস্থিতি
সৈয়দ সাহেব মাকবারা, মাযার এবং পবিত্র স্থান সমূহের যিয়ারত করতেন এবং ঐ গুলো থেকে ফয়েজ-বরকত লাভ করার উদ্দেশ্যে সফর করতেন। মাযার সমূহে গিয়ে মোরাকাবাও করতেন। এতে বুঝা যায়- আল্লাহওয়ালাদের মৃত্যুর পর পূণঃ জীবিত হওয়ারও তিনি মোনকের ছিলেন না। তা না হলে মোরাকাবার কি অর্থ হতে পারে?
সৈয়দ সাহেবের এই "কবর প্রীতি" শাহ ইসমাঈল দেহলভীর মন ও মেজাজের বিপরীত ছিল। সে এই প্রথার পক্ষে ছিল না। এজন্যই হজ্বের সফরের সময় (১৮১৬-২০ খৃঃ) সে মদিনা মোনাওয়ারায় গমন করেনি। বরং এর অনেক পূর্বেই সে আপন বড় চাচা হযরত মাওলানা শাহ্ আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে এই বলে গোমরাহীর ফতোয়া জারী করেছিল যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাজির নাজির হওয়ার আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলেন। এই মাসয়ালার ব্যাপারে সে আপন পীর সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধেও অনুরূপ ফতোয়া দিয়েছিল কিনা- অথবা তাকে নিষেধ করেছিল কিনা- তা অবশ্য জানা যায় নি। সৈয়দ সাহেবের জীবনীতে নিম্নে বর্ণিত পবিত্র মাযার ও পবিত্র স্থান সমূহ যিয়ারতের উল্লেখ পাওয়া যায়।
(১) হুজুর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম- এর রওযা যিয়ারতঃ
জাফর থানেশ্বরী বলেন-
"সৈয়দ সাহেবের অনেকবার পবিত্র রওযা মোবারকে প্রবেশ করার এভাবে সুযোগ হয়েছিল যে, দু'ঘন্টা পর্যন্ত সৈয়দ সাহেব রওযা মোবারকে মোরাকাবায় বসা ছিলেন" (জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৫৮)।
(২) হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম- এর মাযার যিয়ারত
"জিদ্দায় ঐ স্থানটিও তিনি যিয়ারত করেছিলেন- যা হযরত হাওয়া আলাইহাস সালামের নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে" (গোলাম রসুল মেহেরের সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২২১)।
(৩) উম্মুল মোমেনিন হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রাঃ) - এর মাযার
"সৈয়দ সাহেব জান্নাতুল মোয়াল্লায় (মক্কা) প্রবেশ করে উম্মুল মোমেনিন হযরত খাদিজাতুল কোবরা রাদিয়াল্লাহু আনহার মাযারে অনেকক্ষণ পর্যন্ত দোয়ায় মশগুল ছিলেন" (মাওঃ গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২২১)।
(৪) উম্মুল মোমেনিন হযরত মায়মুনা (রাঃ) এর মাযার
"ওয়াদিয়ে ফাতেমায় উম্মুল মোমেনিন হযরত মায়মুনা রাদিআল্লাহু আনহার মাযার শরীফ অবস্থিত। রাত্র দ্বিপ্রহরে সৈয়দ সাহেব কিছু সঙ্গীসাথী নিয়ে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে তথায় তশরীফ নিয়ে যান" (জাফর থানেশ্বরীর সাওয়ানিহ পৃঃ ১৫৬)।
(৫) হযরত আবু ওবায়দা এবং শেখ ইয়ামেনী (রাঃ)- এর মাযার
"ওয়াদিয়ে ছোগরায় অবস্থিত হযরত শেখ আব্দুর রহীম ইয়ামেনী (রহঃ) এবং হযরত আবু ওবায়দা ইবনুল হারিছ (রাঃ) এর মাযার শরীফ যিয়ারত করার সৌভাগ্য লাভ করেন। হযরত আবু ওবায়দা জঙ্গে বদরে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ঐ স্থানে শহীদ হয়েছিলেন" (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৫৭)।
(৬) হযরত খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহঃ) - এর মাযার
"সৈয়দ সাহেব হযরত খাজায়ে খাজেগান খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী (কুঃছিঃ) এর মাযার শরীফে মোরাকাবায়ে বসেছিলেন" (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ৬৫)।
(৭) হযরত সৈয়দ ইদরুছ -এর মাযার
"এডেন বন্দরে পৌছার পর সৈয়দ সাহেব হযরত সৈয়দ ইদরুছ-এর মাযার শরীফ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে তশরীফ নিয়ে গেলেন। এডেন শহরেই ঐ মাযার শরীফ অবস্থিত"। (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৪৯)।
(৮) হযরত আখুন্দ দারভিজা -এর মাযার
"সৈয়দ সাহেব পেশোয়ার থেকে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে আখুন্দ দারভিজার মাযার শরীফে ফাতেহা পাঠ করেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬৫৮)।
(৯) হযরত পীর বাবার মাযার
"তুরছকের রাস্তায় বাচা নামক স্থান। ঐখানে তিনি সৈয়দ আলী তিরমিজি গাউসে বুনির (মশহুর নাম পীরবাবা) মাযার যিয়ারত করেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ- গোলাম রসুল পৃঃ ৪০০)।
(১০) হযরত সৈয়দ আব্দুল ওহাব তিরমিজির মাযার
"বাচা হতে তিনি শালবান্ডি গমন করেন। তথায় তিনি সৈয়দ আব্দুল ওহাব তিরমিজির (ওরফে আবদুল বাবা) মাযারে ফাতেহা পাঠ করেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪০১)।
(১১) হযরত হামজা (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবীগণের মাযার
"সৈয়দ সাহেব একে একে হেরেমে মদিনার সমস্ত নিদর্শনের যিয়ারত করেন। যেমন- জান্নাতুল বাকী, ছাইয়েদুনা হামজাহ, ওহুদ পাহাড়, মসজিদে ক্বিবলাতাইন, মসজিদে ক্বোবা, বীরে খাতাম ইত্যাদি" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২২৭)।
(১২) হোদায়বিয়ার ময়দান
"তিনি হোদায়বিয়াতে থামলেন- যেখানে "বাইআতে রিদ্ওয়ান" অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে তিনি সঙ্গীদেরকে নিয়ে অনেকক্ষণ দোয়ায় মশগুল ছিলেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২২১)।
(১৩) হযরত শাহ ইলমুল্লাহ বেরলভীর মাযার
"সৈয়দ সাহেব তার পূর্ব পুরুষ সৈয়দ ইলমুল্লাহ শাহ-এর মাযারে গিয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত দোয়ায় মশগুল ছিলেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১৩৬)।
মন্তব্যঃ এত মাযার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সৈয়দ সাহেবের সফরকে সৈয়দ ভক্তরা হারাম বা শির্ক বলেনা- কিন্তু অন্যান্যদের বেলায় চট করে কুফরী ফতোয়া দিয়ে বসে- অনুবাদক।
বিধবা নারীদের দ্বিতীয় বিবাহ
বিধবা নারীদের দ্বিতীয় বিবাহের প্রথা চালু করাকে সৈয়দ সাহেবের ইসলামী খেদমতের মধ্যে এই বলে অন্তর্ভূক্ত করা হয় যে, ঐ সময়ে মুসলমান নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় বিবাহকে দোষনীয় মনে করা হতো। সৈয়দ সাহেব দ্বিতীয় বিবাহের সুন্নাত প্রথাকে পূণর্জীবিত করেছেন।
কিন্তু সৈয়দ সাহেবের মুখে তখনই বিধবা বিবাহের কথা উচ্চারিত হয়েছিল- যখন তার বড় ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাকের ইন্তিকাল হয়েছিল এবং তার যুবতী স্ত্রী সৈয়দা ওয়ালিয়া বিধবা হয়েছিলেন। সৈয়দ সাহেব তাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলেন। সৈয়দ মুহাম্মদ ইছহাক যেহেতু বিদ্বান এবং ধীশক্তিমান ছিলেন- সেহেতু সৈয়দা ওয়ালিয়া নির্বোধ সৈয়দ সাহেবের প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
সৈয়দ সাহেবের জীবনীকাররা সৈয়দা ওয়ালিয়ার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরোপ করেন যে, তিনি দ্বিতীয় বিবাহকে দোষনীয় মনে করতেন। তবুও সৈয়দ সাহেব লাগাতার দু তিন মাস চেষ্টার পর বড় ভাইয়ের জোয়ান বিধবা স্ত্রীর উপর তীর নিক্ষেপ করতে সক্ষম হলেন" [সৈয়দ মুহাম্মদ আলী (ভাগিনা) কৃত মাখযানে আহমদী পৃঃ ৪৫]।
মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর সত্যায়িত এবং হাশিয়া সম্বলিত গ্রন্থ "আরওয়াহে ছালাছায়" এই বিবাহ সম্পর্কে লিখিত আছে যে, "সৈয়দ সাহেব নতুন বিবাহ করেছিলেন। নামাযে আসতে তার কিছু বিলম্ব হতো। মৌলভী আব্দুল হাই সাহেব (মুরিদ) চুপ মেরে গেলেন এই মনে করে যে, নতুন বিবাহের কারণে হয়তো ঘটনা ক্রমে একটু বিলম্ব হয়ে গেছে। পরদিন আবার ঐ রকম বিলম্বই হয়ে গেলো। এমন বিলম্ব হলো যে, প্রথম তাকবীরে তাহরিমা ছুটে গেল। মৌলভী আব্দুল হাই সালাম ফিরায়ে বললো- "আল্লাহর ইবাদত চলবে- নাকি বিবাহের ফূর্তি"? (আশরাফ আলী থানবীর আরওয়াহে ছালাছায় পৃঃ ১৪২)।
অর্থাৎ- উক্ত শাদীতে সৈয়দ সাহেব এতই মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, খাস মুরীদ মৌলভী আব্দুল হাইকে নামায সম্বন্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হলো। সৈয়দ সাহেব এই জীর্ণ সুন্নাত পূণর্জীবিত করার পর শাহ ইসমাঈল আপন বিধবা বোন সৈয়দা রোকেয়াকে জোর করে মাওলানা আব্দুল হাই বুড্ডানবীর কাছে বিবাহ দিয়ে দিলেন (সৈয়দ মুহাম্মদ আলী কৃত মাখজানে আহমদী পৃঃ ৪৫)।
কথিত আছে- সৈয়দ সাহেব কর্তৃক বিধবা ভাবীকে বিবাহ করা এবং ইসমাঈল দেহলভীর বিধবা বোনকে দ্বিতীয় বিবাহ দেয়ার ফলে পুরা হিন্দুস্তানের চেহারাই নাকি পাল্টে গিয়েছিল। হাজার হাজার বিধবা নারীর বিবাহ হয়ে গেল। কথা সত্য হলেও হতে পারে। কিন্তু তৎকালীন পরিবেশ ও কতিপয় ঘটনা এই দাবীর সত্যতা প্রমাণ করে না। বরং- খোদ চেরাগের নীচেই অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। যেমনঃ
সৈয়দ সাহেবের বিবি ছিলেন তিনজন। যথা (১) সৈয়দা ওয়ালিয়াহ্ (২) সৈয়দা জোহরা (৩) সৈয়দা ফাতেমা। সৈয়দ সাহেবের বালাকোটে মৃত্যুর পর হিন্দুস্তানী এই তিন বিবির অবস্থা দেখুন। তারা পরে কোন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি।
(১) সৈয়দা ওয়ালিয়াহঃ সৈয়দ সাহেবের ১৬ বৎসর পরে ১৮৪৬ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি।
(২) সৈয়দা জোহরাঃ সৈয়দ সাহেবের ৩২ বৎসর পর ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনিও দ্বিতীয়বার বিবাহ বসেন নি।
(৩) সৈয়দা ফাতেমাঃ সৈয়দ সাহেবের মৃত্যুর ৬৯ বৎসর পর ১৯০০ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ইসমাঈলী শিয়া খান্দানের মেয়ে ছিলেন এবং দ্বিতীয় বিবাহ বসতে নারাজ ছিলেন। (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮২২-৮২৪)।
সৈয়দ সাহেবের দুই কন্যা সন্তানের অবস্থা
(১) সৈয়দা সায়েরাঃ স্বামী সৈয়দ ইসমাঈল ইবনে ইসহাক- মৃত্যু ২০শে অক্টোবর ১৮৬২ খৃষ্টাব্দ। এর ২১ বৎসর পর ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দের ২৬শে মে বিধবা অবস্থায়ই সায়েরা ইনতিকাল করেন। (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৮২৪)।
(২) সৈয়দা হাজেরাঃ স্বামীর নাম সৈয়দ মুহাম্মদ ইউসুফ- মৃত্যু ১৮৫০ খৃঃ ২৫ শে আগষ্ট। ইহার ৯ বৎসর পর সৈয়দা হাজেরা ১৮৫৯ খৃঃ ২রা নভেম্বর বিধবা অবস্থায়ই মারা যান। (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৮২৪)।
মন্তব্যঃ কলমধারী ভক্তদের "মৃত সুন্নাত জীবিত করা ও হাজার হাজার মহিলাদের দ্বিতীয় বিবাহের" প্রপাগন্ডার মুখোশ এবার খুলে গেল। যেখানে সৈয়দ সাহেবের নিজের ঘরেরই এই অবস্থা অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহ তারা অপছন্দ করতেন- সেখানে অন্যান্য মহিলাদের অবস্থা যে কি হতে পারে - তা সহজেই অনুমেয়। ফারসী কবির ভাষায়-
"কিয়াস কুন জে গুলিস্তানে শান বাহার মোজা"
অর্থাৎঃ "আমার ফুল বাগানের সৌন্দর্য দেখেই অনুমান করে নাও- আমার যৌবন বসন্ত কালের অবস্থা কি ছিল"।
সৈয়দ সাহেবের অনুসারীদের ঘরের খবর
১। "মাওলানা আব্দুল হাই বুড্ডানবীর দুই বিবি ছিল। একজনের নাম সৈয়দা রোকাইয়া- যিনি ইসমাঈল দেহলভীর বিধবা বোন ছিলেন। অন্যজন হাই সাহেবের আপন চাচাতো বোন। তারা উভয়েই স্বামী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিবাহ করেন নি" (গোলাম রসুলের গ্রন্থ জামায়াতে মুজাহেদীন পৃঃ ১১৬)।
২। সৈয়দ সাহেবের খাস মুরিদ মাওলানা জাফর আলী নকভী ১৮৭১ খৃঃ মারা যান। তার দুই বিধবা বিবি বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেও জীবিত ছিলেন (জামায়াতে মুজাহেদীন পৃঃ ২১২)।
স্বামী মারা যাওয়ার পর এই বিবিগণ প্রায় ৩৫ বৎসর বৈধব্য জীবন যাপন করেন।
৩। ইসমাঈল দেহলভীর বিধবা স্ত্রী সৈয়দা কুলসুমের দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্কে জীবনীকারগণ চুপ রয়েছেন।
এছাড়াও সৈয়দ সাহেবের বেশুমার খলিফাগণের মৃত্যুর পর তাদের বিধবা বিবিগণ দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। এখানে এসে মৃত সুন্নাত জিন্দা করার আন্দোলনে কোন প্রকারের নড়াচড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
পেশোয়ারে বিধবা বিবাহ
(গোলযোগের অন্যতম কারণ)
কিন্তু যখন সীমান্ত প্রদেশ- পেশোয়ারের মুসলমান মহিলাদের বিষয়ে প্রশ্ন আসে- তখন দেখা যায় যে, বিধবাদের ব্যাপারটি তো আলাদা কথা, স্বয়ং কুমারী মেয়েদেরকেও ধরে ধরে জোর জবরদস্তি করে বিবাহের সুন্নাত আদায় করা হতো। বিধবা নারীদের ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার হুমকী দেয়া হতো। সৈয়দ সাহেবের খাস মুরিদ এবং পেশোয়ার শহরের কাজী সাহেবের নির্দেশ দেখুন -
"মৌলভী মাযহার আলী (কাজী) এই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, পেশোয়ার মুল্লুকে যত বিধবা মহিলা রয়েছে- তিনদিনের মধ্যে তাদের বিবাহ হতে হবে। তা না হলে যে ঘরে বিধবা মহিলা পাওয়া যাবে- সে ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হবে" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮২)।
মন্তব্যঃ ইসলামী ন্যায় বিচারের বিধানে আপন- পর, আমির ও গরীবের মধ্যে কোন পার্থক্য করা যায় না। শাসকের পরিবার পরিজন এবং প্রজাদের পরিবার পরিজনের মধ্যে একই নিয়মে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সৈয়দ সাহেবের তিনজন বিধবা বিবি যথাক্রমে ১৬ বৎসর, ৩২ বৎসর ও ৬৯ বৎসর বিনা বিবাহে বিধবা রয়ে গেলেন। দুই বিধবা মেয়ে যথাক্রমে ২১ বৎসর ও ৯ বৎসর বিধবা রয়ে গেলেন। কিন্তু দ্বীনি জজবা সম্পন্ন কোন কাজী বা মুজাহিদ তাদের ঘরে আগুন লাগানোর ঘোষণাটি পর্যন্ত দিলেন না। (পেশোয়ারের সুন্নী বিধবা মহিলাদের ঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘোষণা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ- অনুবাদক)।
জয়পুরের ঢৌঁক এলাকার নওয়াব সৈয়দ সাহেবের খাস ভক্ত আমির খানের পক্ষ হতে জায়গীর প্রাপ্তির ঘোষণা ছাড়া এখানে বিধবা বিবাহের প্রচার করতে কাউকেই দেখা যায় নি। এর পিছনে কারণ কি? উর্দু কবির ভাষায় বলতে হয়-
"উছ্ ঘর কো আগ লাগ গেয়ী
ঘর কে চেরাগ ছে"।
অর্থাৎ "ঐ ঘরে লাগিল আগুন- ঘরের চেরাগে"।
হজ্বের ঘোষণা ১৮১৬-২০ ইং
সৈয়দ সাহেব পীর সাহেবদের মত বিভিন্ন অঞ্চল সফর করতে লাগলেন। তার প্রতি মানুষের অনাগ্রহ প্রত্যক্ষ করে তিনি বিনা পয়সায় হজ্ব করানোর ঘোষণা করে দিলেন। জীবনী লেখকদের কথা মোতাবেক হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ সৈয়দ সাহেবের দলে ভিড়ে গেলো। কিন্তু বিনা খরচে হজ্বে গমনকারীর সংখ্যা সাড়ে সাতশোর বেশী হলো না। তবুও চাঁদা আদায়ের একটি উত্তম সুযোগ তো পেয়ে গেলেন সৈয়দ সাহেব। বিনা পয়সায় হজ্ব করানোর সুবাদে লক্ষ লক্ষ খয়রাতি টাকা জমে গেল। এই সুযোগে তিনি নিজের বিবিগণ এবং খান্দানের অন্যান্য লোকদেরকেও বিনা খরচে হজ্ব করিয়ে নিলেন। কিছু কিছু লোককে বিনা পয়সায় হজ্বের সৌভাগ্য দেয়ার লক্ষ্যে জোর করে হজ্বে নিয়ে গেলেন। তাঁর উচিৎ ছিল- আমির উমারা লোকদেরকে সাথে নিয়ে যাওয়া- যাদের উপর হজ্ব ফরজ হয়েছিল। তা না করে তিনি তাদের থেকে চাঁদা আদায় করাই যথেষ্ট মনে করলেন। আর সাথে নিয়ে গেলেন এমন লোককে-যাদের উপর হজ্বই ফরজ হয়নি।
সৈয়দ সাহেব জাল স্বর্ণ প্রস্তুতকারী ছিলেন (কিমিয়াগর)
সৈয়দ সাহেব স্বর্ণ উপার্জনের উদ্দেশ্যে মক্কা মোকাররমার মত পবিত্র স্থানেও কিমিয়াগীরি করতে ছিলেন। এ প্রসঙ্গে মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর বক্তব্য শুনুন। তিনি বলেন-
"মক্কা মোয়াজ্জমায় সৈয়দ শেখ নামের এক বুযুর্গ ব্যক্তি সৈয়দ সাহেবের খলিফা ছিলেন। তিনি ভাল বুযুর্গ ছিলেন। যখন আমি (গাঙ্গুহী) তার সাথে সাক্ষাৎ করলাম- তিনি আমাকে বললেন- আমরা সৈয়দ সাহেবের সাথে নকল স্বর্ণ তৈরী করেছি। আপনিও এই বিদ্যা শিখে নিন" (মৌলভী আশেক এলাহী মিরাটীকৃত তাজকিরাতুর রশীদ পৃঃ ২৮৫)।
মন্তব্যঃ কিমিয়াগিরী করা শরিয়ত সম্মত কি-না, তা সৈয়দ সাহেবের ভক্ত উলামারাই বলতে পারবেন। কিন্তু প্রকাশ্যতঃ ইহা একটি ধোঁকাবাজী কাজ। তাও আবার মক্কা শরীফের মুসলমানদের সাথে।
হেরেম শরীফের মুয়াজ্জিন হচ্ছে "রাজীম"
"সৈয়দ সাহেব কাফেলা নিয়ে মক্কা মোকাররমায় পৌঁছলেন এবং দিবা রাত্রি বাইতুল্লাহর ছায়ায় কাটাতে লাগলেন। মৌলভী আব্দুল হক নিউতুনবী নামে সৈয়দ সাহেবের এক অল্পশিক্ষিত ও উগ্র মেজাজের মুরিদ ছিল। মাওলানা আব্দুল ফাত্তাহ গুলশানআবাদী লিখেছেন যে, ঐ মৌলভী সাহেব হেরেম শরীফের জনৈক মোয়াজ্জিনকে "রাজীম" বলে গালি দিয়েছিল। ঘটনাটি ছিল এরূপঃ ফজরের আযানের পূর্বে হেরেমে মক্কার সীমানায় অবস্থিত বিভিন্ন মসজিদের মিনারায় মুয়াজ্জিনগণ বুলন্দ আওয়াজে দরূদ ও সালাম পাঠ করতেন। মৌলভী আব্দুল হক তাদেরকে লক্ষ্য করেই "রাজীম" গালি দিয়েছিল। "শয়তানির রাজীম" অর্থ বিতাড়িত শয়তান" (মাওলানা আব্দুল ফাত্তাহ গুলশান আবাদী কৃত তোহ্ফায়ে মোহাম্মদীয়া পৃঃ ১১৮)।
মন্তব্যঃ বুলন্দ আওয়াজে দরূদ ও সালাম পাঠকারীকে এখনও সৈয়দ সাহেবের অনুসারীরা "রাজীম" উপাধি দিয়ে থাকে। উক্ত মৌলভী আব্দুল হকের বিরুদ্ধে যখন ওহাবীয়তের অভিযোগ আনা হলো- তখন মৌলানা আব্দুল হাই বুড্ডানবী (ইসমাঈল দেহলভীর ভগ্নিপতি) কৌশল করে তাকে খালাস করে দিলেন। (উল্লেখ্য যে, ঐ সময়ে ১৮১৬-২০ খৃঃ মক্কা ও হিজাযে তুর্কী সুন্নী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই আযানের পূর্বে মক্কা শরীফে দরূদ ও সালাম পাঠের রেওয়াজ ছিল- অনুবাদক)।
মসজিদে হারামে পৃথক জামায়াত
সৈয়দ সাহেব প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নিজের একটি পৃথক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করতে চেষ্টিত ছিলেন। হেরেম শরীফেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মাওলানা গোলাম রসুল মেহের সাহেব বর্ণনা করেছেন যে, সৈয়দ সাহেব নিজ মুরিদগণকে (৭৫০ জন) নির্দেশ দিলেন-
"যখন অন্যরা নামায শেষ করবে- তখন নিজেদের পৃথক জামাত সহ নামাযে দাঁড়াবে" (গোলাম রসুল মেহের সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২২২)।
মন্তব্যঃ এই ঘটনার কারণ যাই হোক- সঙ্গত কারণ ছাড়া প্রথম জামাত তরক করা অধিক ছাওয়াব থেকে নিশ্চয়ই বঞ্চিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রথম জামাত তরক করেছে। অথবা এই কারণেও হতে পারে- হেরেম শরীফের ইমামের সুন্নী আকিদা সৈয়দ সাহেবের আহকামের পরিপন্থী ছিল। এই কারণেই প্রথম জামাত ইচ্ছাকৃত ভাবে তরক করেছিলেন। ঐ সময়ে পবিত্র হেজাযে তুর্কী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা ছিলেন আকিদায় সুন্নী ও হানাফী। এজন্য এই কারণটিই অধিক যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়।
হেরেমবাসীগণ বিদ্আতপন্থী
সৈয়দ সাহেব পাঞ্জেতার (পেশোয়ার) থেকে যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার সময় নিজ বিবিগণের উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত অসিয়ত করেছিলেন-
"যদি এই যুদ্ধে আমার হায়াতের পেয়ালা পূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে তোমাদের হেরেম শরীফ চলে যাওয়াই উত্তম হবে। অন্য কোন স্থানে বাসস্থান বানাবেনা।" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৭০৫)।
এতে মনে হয় সৈয়দ সাহেব তার মৃত্যুর পর বিবিদের দ্বিতীয় বিবাহে রাজী ছিলেন না।
তা না হলে বলতেন- আমার মৃত্যুর পর তোমরা তোমরা দ্বিতীয় বিবাহ করে নিও এবং স্বামীদের সাথেই দেশে বসবাস করো। অথবা তার অসিয়তের এ অর্থও হতে পারে- তোমরা হেরেম শরীফে গিয়ে সে দেশের লোকের সাথে বিবাহ করে নিও। সৈয়দ সাহেব অন্যের বিধবা নারীদের জবরদস্তি বিবাহের ব্যবস্থা করলেও নিজের ব্যাপারে মুসলিহাত পছন্দ ছিলেন।
হারামাঈন শরীফাইনের প্রতি ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও হারামাইনের বাসিন্দাদেরকে বিদা্তপন্থী বলতে তিনি একটুও ইতস্ততঃ করেন নি। তিনি বলেছেন -
"এটা এমন এক পবিত্র জায়গা- যেখানে দ্বীন অক্ষত থাকা উচিত ছিল। কিন্তু বিদ্আত থেকে ঐ জায়গাও মুক্ত নয়" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬৬৬)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেবের মতে উক্ত পবিত্র ভূমি এজন্যই বিদআত হতে মুক্ত ছিল না যে, তখন সেখানকার বাসিন্দারা ছিল সুন্নী ও হানাফী মুসলমান এবং শাসন ছিল তুর্কী খিলাফতের। পরে (১৯৩১ খৃঃ) সউদী বাদশাহ জোর জবর করে তাদেরকে "নজদী" বানিয়ে নিয়েছে।
ইংরেজদের সাথে গোপন সম্পর্ক
সৈয়দ সাহেব হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করে (১৮২০ খৃঃ) পাঞ্জাবের শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। ঐ সময়ে তিনি ইংরেজদের প্রশাসনের অধীনে থেকেই জেহাদের জন্য চাঁদা আদায় ও লোক সংগ্রহের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু ইংরেজরা তার কাজে কোন কোন বাধা সৃষ্টি করেনি।
এতেই প্রমাণিত হয় যে, ইংরেজরা সৈয়দ সাহেবের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত হয়েও নিশ্চিত ছিল যে, যা কিছু হচ্ছে- তা আমাদের বিরুদ্ধে নয়। তা না হলে নিজেদের প্রশাসনের মধ্যে সৈয়দ সাহেবের চাঁদা আদায়, অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহ করার নীরব অনুমোদন দেয়া ইংরেজদের মত ধুরন্দর ও চালাক জাতির পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিলনা। ইংরেজ কোম্পানী তখনও এদেশে প্রায় নবাগতের মতই ছিল। তারা ধীরে ধীরে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজে ব্যস্ত ছিল। এমতাবস্থায় সৈয়দ সাহেবের সাথে গোপন আঁতাত না থাকলে এ কাজের নীরব অনুমোদন দিতে পারেন না। প্রকৃত অবস্থা হলো এই যে, শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদের প্রস্তুতির পূর্বেই ইংরেজদের সাথে সৈয়দ সাহেবের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক তখন থেকেই গড়ে উঠেছিল- যখন সৈয়দ সাহেব জয়পুরের টোকের নওয়াব আমির খানের সৈন্যবাহিনীতে চাকুরী করতেন (১৮০৯-১৮১৬ খৃঃ)। মির্জা হায়রত দেহলভীর লেখনীতেই শুনুন-
"সৈয়দ সাহেব ১২৩১ হিজরী মোতাবেক ১৮১৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত আমির খানের অধীনে চাকুরীরত ছিলেন। (ঐ বৎসরই তিনি হজ্বে গমন করেন এবং ৪ বৎসর আরবে অবস্থান করেন- অনুবাদক)। চাকুরী কালীন (৮বৎসর) সময়ে সৈয়দ সাহেব একটি সুনামের কাজ সম্পাদন করেন। তিনি ইংরেজ কোম্পানী সরকার ও আমির খানের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি করে আপোষ করিয়েছিলেন। সৈয়দ সাহেবের মাধ্যমেই ইংরেজ সরকার যে শহরগুলো আমির খানের অধীনে ছেড়ে দিয়ে তাকে নওয়াব খেতাবে ভূষিত করেছিল, সেগুলোতেই অদ্যাবধি (হায়রাত দেহলভীর যুগ) নওয়াবের উত্তরাধিকারীরা শাসন পরিচালনা করে আসছে। সৈয়দ সাহেবের কুট কৌশলের দরুনই এই আপোষ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। লর্ড হেস্টিংস? (লর্ড ইলিজন) (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিযুক্ত গভর্ণর) সৈয়দ সাহেবের এই অনুপম খেদমতের দরুন তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন। ইংরেজ ও আমির খানের মধ্যে যুদ্ধের সময় উভয় সৈন্য বাহিনীর মধ্যখানে তাবু তৈরী করে ঐ তাঁবুতে তিন ব্যক্তির মধ্যে গোপন চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল। ঐ তিন ব্যক্তি ছিলেন, আমির খান, লর্ড হেস্টিংস (লর্ড ইলিজন) এবং সৈয়দ সাহেব।
সৈয়দ সাহেব অতি কষ্টে আমির খানকে টোপে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সৈয়দ সাহেব নওয়াব আমির খানকে বুঝিয়ে ছিলেন যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা, যুদ্ধ বিগ্রহ করা আপনার পক্ষে সম্ভব হলেও আপনার পরবর্তী বংশধরদের জন্য হবে বিষতুল্য। ইংরেজরা যেভাবে দিনে দিনে উন্নিত করে চলছে এবং ভারতীয় সব সম্প্রদায় একের পর এক অবনতির শিকার হচ্ছে- আপনার পরে আপনার সৈন্য বাহিনীকে কে সামাল দিবে এবং আজিমুশশান ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে কে তাদেরকে যুদ্ধ ময়দানে সংগঠিত করবে? সৈয়দ সাহেবের একথার গুরুত্ব আমির খান সম্যক উপলব্ধি করলেন এবং একথার উপর রাজী হয়ে গেলেন যে, বেঁচে থাকার জন্য তাকে মুল্লুকের কিছু অংশ ছেড়ে দিতে হবে। আমির খান যুগপৎভাবে প্রত্যেক রিয়াসত এবং ইংরেজদের নাকে ফুঁ দিতে সক্ষম হলেন। (সকলকে তিনি বুঝাতে সক্ষম হলেন)। শেষ পর্যন্ত অনেক আলাপ আলোচনার পর সৈয়দ সাহেবের কুট কৌশলে প্রত্যেক রেয়াসত বা রাজ্য থেকে কিছু কিছু অংশ দিয়ে আমির খান সাহেবের সাথে ইংরেজ সরকার চুক্তি সম্পাদন করলো। যেমন জয়পুরের টোক ভূপালের সরঞ্জ এবং বিভিন্ন, রিয়াসতের কিছু কিছু পরগনা দিয়ে গর্জনকারী ব্যাঘ্রকে পিঞ্জিরায় আবদ্ধ করা হলো। (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ৪২১)।
মন্তব্যঃ এ ভাবে সৈয়দ সাহেব আমির খানের মত ঘোর ইংরেজ বিরোধী জয়পুরের শাসককে টৌকের 'নওয়াব' বানিয়ে ইংরেজদের পিঞ্জিয়ার মধ্যে আবদ্ধ করে দিলেন। ইংরেজ কোম্পানী সরকার সৈয়দ সাহেবের এই খেদমতে খুবই তুষ্ট ছিলেন। এজন্যই শিখদের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের জেহাদের প্রস্তুতিমূলক কাজে তারা তাকে কোন বাধাই দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ সাহেবের সমসাময়িক, মুরিদ, ভক্ত ও জীবনীকারক- মাওলানা জাফর থানেশ্বরী তার সাওয়ানিহে আহমদী গ্রন্থে লিখেছেন-
"ঐ সময় প্রত্যেক শহর, প্রত্যেক কসবা ও প্রত্যেক গ্রামে বৃটিশ ইন্ডিয়ার শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। হিন্দুস্তানে প্রকাশ্যভাবে শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার ওয়াজ চলছিল। সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা করে এলাহাবাদের উজিরে আযম শেখ গোলাম আলীর মাধ্যমে উত্তর পশ্চিম জিলা সমূহের তৎকালীন লেপটেন্যান্ট গভর্নর বাহাদুরকে শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদের প্রস্তুতির কথা পূর্বেই জানিয়ে রাখা হয়েছিল (যাতে পাঞ্জাবে ও পেশোয়ারে যাতায়াতে কোন অসুবিধা না হয়)। গোলাম আলী সাহেবের পত্রের জবাবে লেফটেন্যান্ট গভর্নর সাহেব এই কথা লিখে পাঠালেন যে, "যতক্ষণ পর্যন্ত ইংরেজ প্রশাসনে কোন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হবে- ততক্ষণ আমরা এই প্রস্তুতির প্রতিরোধ করবো না।" (জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৬৮)।
মির্জা হায়রাত দেহলভীও একই ধরনের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন যে-
"সৈয়দ সাহেব প্রকাশ্যভাবেই নিজের মুরিদ ও অনুসারীদেরকে প্রত্যেক শহরে-বন্দরে শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদের ওয়াজ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। অধিকাংশ শহরেই ওয়াজ হতে লাগলো। মানুষের মনে জেহাদের আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলো। এখন তা প্রকাশ্যরূপ পরিগ্রহ করলো। দলে দলে লোক সৈয়দ সাহেবের কাছে আসতে লাগলো। মাওলানা ইসমাঈল শহীদের পরামর্শক্রমে সৈয়দ সাহেব এলাহাবাদের উজিরে আজম শেখ গোলাম আলীর মাধ্যমে উত্তর পশ্চিম জেলা সমূহের লেফটেন্যান্ট গভর্নর- এর কাছে সংবাদ পাঠালেন যে, আমরা কেবল পাঞ্জাবের শিখ রাজার বিরুদ্ধেই জেহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। এই বিষয়ে ইংরেজ সরকারের কোন আপত্তি নেই। লেফটেন্যান্ট গভর্নর পরিষ্কার ভাষায় লিখে পাঠালেন যে, আমাদের প্রশাসনে কোন প্রকারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হলে আমরা এ সম্পর্কে মাথা ঘামাবো না এবং আমরা এই জেহাদ প্রস্তুতির কাজে কোন প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করবোনা" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ৪৩৯)।
এ প্রসঙ্গে শেখ ইকরাম লিখেছেন-
"ইংরেজ সরকার এই সময়ে সৈয়দ সাহেবের ঐ প্রকাশ্য জেহাদের প্রস্তুতির ব্যাপারে কোন প্রকারের বাঁধা সৃষ্টি করেনি" (শেখ মোঃ ইকরাম কৃত মৌজে কাওছার পৃঃ ১৮)।
মাওলানা ফজলে হোসাইন বিহারী (আহলে হাদীস নেতা) লিখেছেন-
"শাহ ইসমাঈল আপন পীর সৈয়দ আহমদ সাহেবকে জেহাদের ইমাম স্বীকার করে মুসলমানের একটি দল নিয়ে জেহাদের উদ্দেশ্যে পাঞ্জতার (পেশোয়ার) পৌঁছলেন। ইংরেজ গভর্ণম্যান্ট তার এই ইচ্ছায় কোন প্রকারের বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন নি" (ফজলে হোসাইন বিহারী আহলে হাদীস নেতা কৃত আল-হায়াত বাদাল মামাত পৃঃ ২০৩)।
মন্তব্যঃ উপরোক্ত চারটি উক্তি হতে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে, ইংরেজ সরকার খুশী মনেই অনুমতি দিয়েছিলো যে, ইংরেজ সরকারের প্রশাসনিক এলাকায় শিখদের বিরুদ্ধে চাঁদ
আদায় ও লোক সংগ্রহ করা যেতে পারে। ইংরেজদের সাথে যদি সৈয়দ সাহেবের পুরাতন সম্পর্ক না থাকতো অথবা সৈয়দ সাহেবের ইংরেজ বিরোধীতার যদি সামান্যতম সম্ভাবনাও থাকতো- তাহলে তারা কখনো এরূপ জেহাদের প্রস্তুতির অনুমতি দিত না। মূলতঃ ইংরেজদের সাথে সৈয়দ সাহেবের বন্ধুত্বের এমন শক্ত ও দৃঢ় বন্ধন ছিল যে, তার বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ করা সত্ত্বেও ইংরেজ প্রশাসনে তার প্রতি কোন কর্ণপাতই করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (সম্প্রতি মৃত) লিখেছেন-
"পাটনার আজিমাবাদের কিছু শিয়া ইংরেজ শাসকের কাছে নালিশ করেছিল যে, এই সৈয়দ সাহেব- যিনি এত লোক লস্কর নিয়ে এখানে আগমন করেছেন- আমরা শুনেছি যে, তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে জেহাদ করা এবং তারা বলছে যে, ইংরেজের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করবো। আজিমাবাদের স্থানীয় প্রশাসক এই কথাকে পক্ষপাতদুষ্ট ও হিংসা প্রণোদিত বলে উল্লেখ করে তাদেরকে এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে, আগামীতে যেন এরূপ ফাসাদ সৃষ্টিকারী কথা আর বলা না হয়" (মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী কৃত সিরাত সৈয়দ আহমদ শহীদ প্রথম খণ্ড পৃঃ ২৪২)।
মন্তব্যঃ অভিযোগ করা সত্ত্বেও ইংরেজ প্রশাসকের এই অভিযোগকে রদ করে দিলেন এবং সতর্ক করে দিলেন যে, ভবিষ্যতেও যেন সৈয়দ সাহেবের শানে এধরনের বেয়াদবীমূলক উক্তি করা না হয়। একদিন তো খোদ স্থানীয় প্রশাসক সাহেবই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সৈয়দ সাহেবের জেহাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বসলেন। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ কি জবাব দিলেন- শুনুন-
"যখন ভয়ংকর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো- তখন (আজিমাবাদ) জেলার প্রশাসন এ ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠলো এবং তাদের এ ধারণা হলো যে, কখন জানি আমাদের রাজত্বেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং এ ধরনের বাধা বিপত্তি এসে যায়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে জেলা প্রশাসন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নোট লিখলেন। সেখান থেকে পরিস্কার জবাব আসলো- এদের পথে কখনও বাধ সেধোঁনা। আমাদের বিরুদ্ধে এসব মুসলমানের কোন যুদ্ধ নেই। এরা চায় শিখদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ৪৩০)।
মন্তব্যঃ উপরোক্ত এবারত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, সৈয়দ সাহেব উর্ধ্বতন প্রশাসনকে পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছিলেন যে, এই যুদ্ধ প্রস্তুতি আপনাদের বিরুদ্ধে নয়- বরং শিখদের বিরুদ্ধে। তা না হলে উর্ধ্বতন প্রশাসন কি করে একথা বলতে পারলো যে, মুসলমানদের এই যুদ্ধ আমাদের বিরুদ্ধে নয়। দেড়শো বৎসর পর আজ (১৯৮২ ইং) কিছু কিছু লোক সৈয়দ সাহেবের শানে ইংরেজ দুশমনির এই কল্পিত অপবাদ (?) দিতে পরকালের ভয় একটুও অনুভব করছে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি- ইংরেজ হুকুমতের সাথে সৈয়দ সাহেবের এত হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা ছিল যে, যেখানেই শিখদের সাথে শত্রুতার কথা প্রচার করা হতো।
এ প্রসঙ্গে আহলে হাদীসপন্থী মৌলভী আব্দুর রহীম সাদেকপুরী লিখেছেন-
"বরাবরই সৈয়দ সাহেবের এই অভ্যাস ছিল যে, একদিকে তিনি মানুষকে শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদে উদ্বুদ্ধ করতেন- অন্য দিকে ইংরেজদের শান্তি প্রিয়তার কথা উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধাচরণ থেকে মানুষকে বিরত রাখতেন।" (আবদুর রহিম সাদেকপুরী কৃত আদ দোররুল মানছুর পৃঃ ২৫২)।
মন্তব্যঃ উপরোক্ত এবারতই বলে দিচ্ছে যে, ঐ সময় মানুষ ইংরেজ বিরোধী জেহাদের জন্য মনে প্রাণে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু সৈয়দ সাহেব কৌশলে আপন প্রিয় ইংরেজ হুকুমতের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি শিখদের দিকে ফিরিয়ে রাখছিলেন- যাতে করে হিন্দুস্থানে তাদের ক্ষমতা দৃঢ় করতে সহজ হয়। যেসব লোক সৈয়দ সাহেবকে ইংরেজ দুশমন বলে প্রচার করছে- তারা সৈয়দ সাহেবের দুশমন হলেও হতে পারেন- কিন্তু দোস্ত হবার দাবী সম্ভবতঃ করতে পারবেন না। কারণ, সৈয়দ সাহেব মূলতঃ ছিলেন ইংরেজদের বন্ধু। কিন্তু এরা সৈয়দ সাহেবক দুশমন রূপে দাঁড় করাতে চৈষ্টা করে। সৈয়দ সাহেবের দ্বিতীয় খলিফা শাহ ইসমাঈল দেহলভী- যিনি ছিলেন সৈয়দ সাহেবের এক থালা ও একই লোকমার সাথী- তিনি সৈয়দ সাহেবকে অনুসরণ করে ইংরেজদেরকে কত ভালবাসতেন, তার কিঞ্চিৎ বর্ণনা মাওলানা জাফর থানেশ্বরীর লিখনীতে দেখুন-
"এটিও বিশ্বস্ত বর্ণনা যে, কলিকাতায় অবস্থানকালে একদিন যখন মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল শহীদ ওয়াজ করতেছিলেন- তখন মজলিসের একজন প্রশ্নকারী মাওলানার কাছে এই ফতোয়া জানতে চাইলেন যে, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ করা দুরস্ত আছে কিনা? জবাবে মাওলানা ইসমাঈল বললেন- এমন সরল ও নিরপেক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে কোন প্রকারের জেহাদই দুরস্ত নেই।" (জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৭১)।
মির্জা হায়রাত দেহলভীও অনুরূপভাবে লিখেছেন-
"কোলকাতায় যখন মাওলানা ইসমাঈল সাহেব জিহাদের ওয়াজ শুরু করলেন এবং শিখদের অত্যাচারের কাহিনী উপস্থাপন করতে লাগলেন- তখন একজন প্রশ্ন করলো- আপনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদের ফতোয়া দিচ্ছেন না কেন? তিনি জবাব দিলেন- "এদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা কোন প্রকারেই ওয়াজিব নয়। কারণ, একদিকে আমরা তাদের প্রজা, অপর দিকে তারা আমাদের ধর্মীয় আবশ্যকীয় কাজে হস্তক্ষেপ করছেনা। তাদের রাজত্বে আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। বরং তাদের উপর কেউ হামলা করলে তা প্রতিহত করাই মুসলমানদের উপর ফরজ। নিজ সরকারের উপর আঁচর লাগতে না দেয়া আমাদের উপর ফরজ।" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ৪২৩)।
মন্তব্যঃ উপরোক্ত আলোচনায় পরিস্কার ইঙ্গিত রয়েছে যে, ঐ সময়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদের প্রয়োজন ছিল এবং মানুষ এই অপেক্ষায় ছিলো যে, কেউ যেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এজন্যই একজন দূরদর্শী লোক ইংরেজদের উদীয়মান শক্তির দিকে শাহ ইসমাঈলের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ঐ প্রশ্নটি করেছিল। শাহ ইসমাঈল লোকটির আসল ইংগিত ও উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেই এইভাবে জবাব দিলেন যে, ইংরেজ হুকুমতের বিরুদ্ধে কেউ হামলা করলে মুসলমানদের উপর ফরজ হয়ে যাবে- তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। এখন দেখুন- ইংরেজ হুকুমতের প্রতি কত দরদ ও মুহাব্বাত, যে জন্য তিনি ইংরেজদের সাহায্য করাকে মুসলমানদের উপর ফরজ বলে সাব্যস্ত করলেন। এখন ইংরেজ প্রেমিক ইসমাঈল বুযুর্গের বিরুদ্ধে যদি কোন মুসলমান ইংরেজ বিরোধীতার অপবাদ দেয়, তাহলে নিশ্চয়ই তার মৃত আত্মার কষ্ট পাওয়ারই কথা। [সৈয়দ আহমদ ও ইসমাঈল উভয়েই ছিলেন ইংরেজদের খয়েরখা দালাল- অনুবাদক]।
জনাব শেখ ইকরাম লিখেছেন-
"যখন তিনি (সৈয়দ সাহেব) শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিলেন- তখন কোন এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করলো- আপনি এত দূরে শিখদের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন? যে ইংরেজরা এই দেশের শাসক হয়ে বসে আছে, তারা কি মুসলমান ও ইসলামের দুশমন নয়? নিজের ঘরে ও নিজের দেশে থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে হিন্দুস্থান মুক্ত করুন। এখানে লক্ষ লক্ষ লোক আপনাদের সাথী ও মদদগার হয়ে যাবে। সৈয়দ সাহেব জবাব দিলেন-। "ইংরেজ সরকার যদিও ইসলামের অস্বীকারকারী, কিন্তু তারা মুসলমানের উপর কোন অত্যাচার করছেনা, সীমাও ছাড়িয়ে যাচ্ছেনা এবং তাদেরকে মাজহাবী অত্যাবশ্যকীয় কাজে এবং প্রয়োজনীয় ইবাদতে বাধাও দিচ্ছেনা" (শেখ মুহাম্মদ ইকরাম কৃত মৌজে কাউছার পৃঃ ২০)।
মন্তব্যঃ কত পরিস্কার প্রশ্ন এবং কত পরিস্কার জবাব। এরপরও যদি কেউ সৈয়দ সাহেবকে ইংরেজ বিরোধী বলে অভিহিত করে, তাহলে তাকে পাগলই বলতে হবে।
মনজুর নোমানীর সম্পাদনায় লক্ষ্মৌ হতে প্রকাশিত মাসিক আল-কোরআন পত্রিকার স্বীকৃতিমূলক বিবৃতিও শুনে নিন। তিনি লিখেছেন-
"বহুল প্রচারিত কথা হলো এই যে, তিনি (সৈয়দ সাহেব) ইংরেজদের বিরোধীতার কথা কখনও ঘোষণা করেননি বরং কোলকাতা বা পাটনায় ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করার কথাই প্রচার করেছেন। একথাও মশহুর হয়েছে যে, ইংরেজরা কোন কোন সময় তাকে সাহায্যও করেছেন" (মাসিক আল ফোরআন শহীদ সংখ্যা পৃঃ ১৩৫৫ পৃঃ ৭৬)।
মন্তব্যঃ মনজুর নোমানীর স্বীকৃতি দ্বারা পরিস্কার হয়ে গেল যে, "মানুষের মুখ খোদার ঢোল" প্রবাদটি স্বীকার করতে তিনি খুব ইতস্ততঃ ভাব দেখাচ্ছেন। উক্ত ঘটনাটি যেমন মশহুর, তেমনিভাবে সত্যও বটে। যদি এমন পরিস্কার সত্যটি কারো বুঝে না আসে- তা হলে আমরা কেবল আল্লাহর কাছে তার দেমাগের সুস্থতার জন্যই দোয়া করতে পারি।
মাওলানা জাফর থানেশ্বরী সৈয়দ সাহেবের ইংরেজ সেবাদাসের ভূমিকা এভাবে অঙ্কন করেছেন-
"ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার কোন ইচ্ছা সৈয়দ সাহেবের একেবারেই ছিলনা। এতেও কোন সন্দেহ নেই যে, ইংরেজ সরকার যদি ঐ সময় সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধে থাকতো, তাহলে হিন্দুস্থান থেকে কোন সাহায্যই সৈয়দ সাহেবের কাছে পেশোয়ারে পৌঁছতে পারতোনা। অধিকন্তু ঐ সময় ইংরেজ সরকারের একান্ত ইচ্ছা ছিল যে, শিখদের শক্তি কমে যাক" (জাফর থানেশ্বরী রচিত সাওয়ানেহে আহমদী পৃঃ ১৩৯)।
মন্তব্যঃ মাওলানা জাফর থানেশ্বরী প্রকৃত ঘটনা আরও উজ্জ্বল করে দিলেন যে, ইংরেজদের ইচ্ছা ছিল শিখদের খর্ব করা। এজন্যই তারা সৈয়দ সাহেবকে তাদের প্রশাসনিক এলাকায় শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য নগদ টাকা, অস্ত্র ও মানুষ- স্বাধীনভাবে যোগাড় করার সুযোগ দিয়েছিল। ইংরেজরা তাকে একাজে বাধাও দেয়নি এবং বাধার সৃষ্টিও করেনি- বরং উল্টো আর্থিক সাহায্য করেছিলো। যখন এই মুজাহিদরা শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সীমান্ত প্রদেশে প্রবেশ করে- তখন তাদের বিবি বাচ্চা ও সম্পত্তির পূর্ণ হেফাজত করেছিল। পরবর্তী সময়ে হিন্দুস্থান থেকে যে সমস্ত সম্পত্তি যে সমস্ত আর্থিক সাহায্য ও জনশক্তি যোগান দেয়া হতো - তাতেও তারা কোন প্রকারের বাধার সৃষ্টি করেনি। সৈয়দ সাহেব সীমান্ত প্রদেশে গিয়ে যদি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণাই দিত- তাহলে ইংরেজরা নিশ্চয়ই তাদের বিবি বাচ্চাদের গ্রেফতার করতো এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতো, তাদের আত্মীয় স্বজনকে কষ্ট দিত। কিন্তু এরূপ এ্যাকশান এদিক থেকে হয়নি এবং ওদিক থেকেও ইংরেজ বিরোধী জেহাদী কার্যক্রম কখনও পরিলক্ষিত হয়নি।
দেওবন্দের মাওলানা মুহাম্মদ মিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিও দেখে নিন- তাহলে সত্য গ্রহণের তাওফীক আল্লাহ দিতেও পারেন। মাওলানা লিখেছেন-
"যতক্ষণ পর্যন্ত এই আন্দোলনের সম্পর্ক ইংরেজদের আধিপত্যের সাথে এতটুকু ছিল যে, সৈন্য ভর্তি করা হতো আর পূঁজি পাচার করা হতো- কিন্তু ইংরেজ সরকারের কোন পদস্থ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাই এদিকে দৃষ্টি দিতনা, বরং ইংরেজরা এ ব্যাপারে সাহায্যই করতো।" (মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া কৃত উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাঝি ২য় খণ্ড পৃঃ ২৪১)।
দেওবন্দী চিন্তাধারার এর চেয়েও বড় সাক্ষ্য দেখুন। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সভাপতি ও দেওবন্দী শাইখুল হাদীস মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী লিখেছেন- "যখন শিখদের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের জেহাদের ইচ্ছা হলো- তখন ইংরেজরা সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এবং যুদ্ধের প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহে সৈয়দ সাহেবকে সহযোগিতা প্রদান করলো।" (হোসাইন আহমদ মাদানী রচিত নকশে হায়াত ২য় খণ্ড পৃঃ ১২)।
মন্তব্যঃ দেওবন্দী শাইখুল হাদীসের উপরোক্ত বিবরণ কি মিথ্যা? তিনি কি সত্য গোপন করেছেন? প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কি তিনি বেখবর ছিলেন? এগুলো এবং এই ধরনের অন্যান্য কতগুলো প্রশ্নও তখনই মনে জাগে- যখন সৈয়দ সাহেবের জেহাদকে শিখদের পরিবর্তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়।
ঐ সময় ইংরেজদের দৃষ্টিতে ছিল শিখ এবং মুসলমানদের দুটি বড় শক্তি- যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছিল জান নিয়ে খেলা করারই সমতুল্য। তাই ইংরেজরা অত্যন্ত চতুরতার সাথে সৈয়দ সাহেবের কাজে সহায়তা করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল- স্থানীয় দুইটি শক্তি পরস্পর লড়াই করে হয় নিঃশেষ হয়ে যাবে, না হয় কমপক্ষে শক্তিহীন হয়ে পড়বে। যদি একটি শক্তি খতম হয়ে যায়, তাহলে এককভাবে দ্বিতীয় শক্তিটিকে পদানত করার জন্য তারা কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারবে। আর যদি উভয় শক্তিই কমজোর হয়ে যায়, তবুও লাভ ইংরেজ সরকারেরই হবে। ওহাবী মুসলমানরা ইংরেজদের চক্রান্তে পড়ে শিখদের বিরুদ্ধে টক্কর লাগানোর পর নিজেদের মধ্যে ধর্মীয় কোন্দলে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সীমান্তের স্থানীয় ও ভারত হতে আগত মুসলমানরা পরস্পরের বিরুদ্ধে ধর্মীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে বালাকোটের ময়দানে তারা নিজেদের ইতিহাসকে খতম করে দেয়। (সুচতুর ইংরেজরা মধ্যখান থেকে লাভবান হয়ে যায়- অনুবাদক)। এখন ইংরেজদের সামনে শুধু শিখ শক্তি রয়ে গেল। ইংরেজরা শিখদের সাথে প্রথমে সীমান্ত চুক্তি করে নিল। পরে অন্য এক চুক্তি স্বাক্ষর করে তার উপর দখলদারিত্ব কায়েম করলো। এই দখলদারিত্ব সোয়াশো বছর পর্যন্ত কায়েম ছিল। সৈয়দ সাহেবের আন্দোলনে ইংরেজদের তাৎক্ষণিক উপকার হয়েছিল একটি- তাহলো- মুসলমান ও শিখদের দৃষ্টি ইংরেজদের পরিবর্তে পরস্পরের প্রতি নিবিষ্ট হয়েছিল এবং এই সুযোগে ইংরেজদের পা শক্ত হবার সুযোগ পেয়ে গেলো।
গোমর ফাঁস
সত্যকে গোপন করতে চাইলেও গোপন থাকে না। একদিন না একদিন অবশ্যই তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। সৈয়দ সাহেব মুসলিহাত মনে করে ইংরেজদের সাথে তার সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা গোপন করতে চেয়েছিলেন- কিন্তু সফল হতে পারেন নি। সৈয়দ সাহেব যেখানেই গিয়েছেন, যাওয়ার পূর্বেই সেখানে তার ইংরেজ প্রীতির খবর পৌঁছে যেতো। মেহের সাহেব নিজেই একথা স্বীকার করে ফেলেছেন। জনাব গোলাম রসুল সাহেবের ভাষায়-
"কারুতে (সিন্ধু) সৈয়দ চৌরান শাহ নামে এক বিশিষ্ট বুযুর্গ ছিলেন। সৈয়দ সাহেবের নির্দেশক্রমে সৈয়দ হামিদুদ্দিন ও সৈয়দ আওলাদ হাসান তাঁর সাথে দেখা করলেন। ঐ বুযুর্গ সৈয়দ সাহেবের সাথে দেখা করতে এসে বড় ধরনের একটি মহিষ তাঁকে উপঢৌকন দিলেন। ঐ বুযুর্গ ব্যক্তি থেকেই জানা গেল যে, মানুষের সাধারণ ধারণা হলো- সৈয়দ সাহেব ইংরেজদের গুপ্তচর। এজন্যই তারা ভয় পায়।" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৮৪)।
মন্তব্যঃ সাধারণ লোকের মধ্যে যে ধারণাটি জন্মেছিল- নিশ্চয়ই তার কোন ভিত্তি ছিল। সে ভিত্তিমূলটি সৈয়দ সাহেব আপন মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছিলেন। কিন্তু সিন্ধুর ন্যায় সীমান্ত প্রদেশের লোকেরাও শেষ পর্যন্ত সে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হয়েছিলেন। এ সম্বন্ধে গোলাম রসুল মেহের সাহেব লিখেছেন যে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা একে অপরকে বলতো-
"ইংরেজরা তাকে (সৈয়দ সাহেবকে) তোমাদের মুল্লুকের অবস্থা জানার জন্যই গুপ্তচর বানিয়ে পাঠিয়েছে" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৮৪)।
সৈয়দ সাহেব মিয়াঁজী মহিউদ্দীন চিশতীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বোখারার বাদশাহর নিকট সাহায্যের আশায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের ইংরেজ প্রীতির সংবাদ ওখানেও পৌঁছে গিয়েছিল। এজন্য তাঁরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।
গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"জানা গিয়েছে যে, ওখানকার (বোখারার) দরবারী লোকেরা ভুল তথ্য পরিবেশন করে বাদশাহকে বিষিয়ে তুলেছিল। ভুল তথ্যটি ছিল এই "সৈয়দ সাহেব জেহাদ করার জন্য আসেনি- বরং ইংরেজরা মধ্য এশিয়ায় নিজেদের জাল বিস্তার মানসেই সৈয়দ সাহেবকে গুপ্তচর হিসেবে পাঠিয়েছে। সুতরাং তাকে সাহায্য করা উচিত হবে না। (গোলাম রসুল মেহের কৃত জামায়াতে মুজাহেদীন পৃঃ ১৮৮)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেব পরে নিজেই বোখারা গিয়েছিলেন। তার যাওয়ার পূর্বেই তার ইংরেজ প্রীতির সংবাদ ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। জনসাধারণের এই সন্দেহের ক্ষেত্রে তারা কি সত্য ছিল- নাকি মিথ্যা? এ ব্যাপারে মুহাম্মদ ইসমাঈল পানিপথী লিখেছেন-
"যখন সৈয়দ সাহেব জেহাদের উদ্দেশ্যে সিন্দু প্রদেশ ও সীমান্ত প্রদেশে প্রবেশ করলেন (ঐ প্রদেশ তখনও ইংরেজদের দখলে আসেনি), তখন তার সম্পর্কে ব্যাপকভাবে এই সন্দেহ ছড়িয়ে পড়লো যে, ইনি ইংরেজদের গুপ্তচর। এই সন্দেহের কারণ হলো- ইংরেজদের সাথে সৈয়দ সাহেবের চমৎকার ও মধূর সম্পর্ক ছিল" (হাশিয়ায়ে মাকালাতে স্যার সৈয়দ আহমদ- ষোড়শ খন্ড পৃঃ ২৫৩)।
মন্তব্যঃ উল্লেখিত উক্তিগুলো থেকে পরিস্কার বুঝা যায়- ইংরেজদের সাথে সৈয়দ সাহেবের আঁতাত কোন গোপন বিষয় ছিল না। সিন্ধু এবং সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানদের সন্দেহ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
আজকাল যারা সৈয়দ সাহেবকে ইংরেজদের দুশমন বলে প্রমাণ করার জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করছেন- তারা মিথ্যা তোহমতের দ্বারাই কাজ নিচ্ছেন। তাদের উচিত- হৃদয় দ্বারা এই সত্যটিকে স্বীকার করে নেয়া যে, সৈয়দ সাহেব ইংরেজদের বন্ধু ছিলেন এবং তিনি কখনও ইংরেজদের বিরুদ্ধে শত্রুতা খরিদ করে নেননি।
গোলাম রসুলের একটি সন্দেহ ও তার অপনোদন
সৈয়দ সাহেবের জীবনী লেখকদের মধ্যে জনাব গোলাম রসুল মেহের সাহেবই প্রথম এই বিষয়টি উত্থাপন করেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে সৈয়দ সাহেব ইংরেজদের বিরুদ্ধেই জেহাদ করতে ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। শিখরা ঘটনাচক্রে সামনের কাতারে এসে গেছে। এখন মুশকিল হয়ে গেলো একটি বিষয়। তা হচ্ছে- যেসব জীবনীকার সৈয়দ সাহেবের যুগের খুব কাছাকাছি ছিলেন এবং বিশ্বস্ত ও একনিষ্ঠ সেবকও ছিলেন, তারা সবাই বলছেন- সৈয়দ সাহেব শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্যই ইলহাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাদের লেখনিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন কার্যক্রমের অকাট্য বর্ণনাও নেই। এ প্রসঙ্গে আমরা সৈয়দ সাহেবের যুগের নিকটবর্তী জীবনীকারদের গ্রন্থ হতে অকাট্য ও অখন্ডনীয় প্রমাণ পেশ করেছি। কিন্তু জনাব গোলাম রসুল মেহের সাহেব মির্জা হায়রাত দেহলভী ও মাওলানা জাফর থানেশ্বরীর বিরুদ্ধে এই বলে তথ্য পরিবর্তনের অভিযোগ করেছেন যে, তারা উভয়েই নাকি ইংরেজদের দ্বারা দমে গিয়েছিলেন। এই অভিযোগের জবাব দেয়া আমরা খুবই জরুরী মনে করছি।
গোলাম রসুলের দুইটি অভিযোগ
(১) "জাফর থানেশ্বরীর সাওয়ানিহে আহমদী গ্রন্থটি সৈয়দ সাহেব সম্পর্কে দুইটি দুঃখজনক অসত্য বর্ণনা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলে ধরেছেন। একঃ সৈয়দ সাহেব ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাননি। দুইঃ তিনি শুধুমাত্র শিখদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২০)।
(২) মির্জা হায়রত দেহলভীর হায়াতে তৈয়্যেবা গ্রন্থটি সম্পর্কে তার মন্তব্য হলো- "এই গ্রন্থটি ইতিহাস নয়- কাহিনী। এর কয়েকটি ঘটনা ও অবস্থা পরিস্কারভাবে এমন মনে হয় যে, মির্জা সাহেব নিজেই এগুলো তৈরি করেছেন।" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৭)।
জবাবঃ সৈয়দ সাহেবের জবনী লেখক মাওলানা জাফর থানেশ্বরী ও মির্জা হায়রত দেহলভী- উভয়েই সৈয়দ সাহেবের যুগের এবং কাছাকাছির লোক ছিলেন এবং প্রকাশিত সূত্র ও তথ্যের ক্ষেত্রে এ দুটি গ্রন্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গোলাম রসুলের কাছে ও তার চিন্তাধারার লোকদের কাছে নাকি হাতের লেখা 'সিনা গেজেট'- এর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি মওজুদ আছে। ঐ পাণ্ডুলিপির একটি সংক্ষিপ্ত সূচীপত্র 'সৈয়দ আহমদ শহীদ' গ্রন্থের সূচনায় তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু জ্ঞানী ও সুক্ষ্মদর্শীদের নিকট গোলাম রসুল মেহের সাহেবের কথিত আমানতদারীর স্বরূপ অতি পরিস্কার। এজন্যই তার মনের গহীনে লুক্কায়িত "দাফিনায়ে ছিনা" -র কোন মূল্যই নেই। [সিনা গেজেট- এর উদ্ধৃতি তিনি লুকিয়ে রেখেছেন -অনুবাদক।]
হায়াতে তৈয়্যেবা গ্রন্থের মূল্যায়ন
সাওয়ানিহে আহমদী ও হায়াতে তৈয়্যেবা নামক প্রকাশিত গ্রন্থ দুখানার বিরুদ্ধে মেহের সাহেবের তোহমতবাজী এবং খুঁত ধরার কারণ হলো- এতে পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যই সৈয়দ সাহেবের উপর ইলহাম হয়েছিল। কিন্তু এটা মেহের সাহেবের গবেষণার খেলাফ। তার মতে- সৈয়দ সাহেব ইংরেজদের বিরুদ্ধেই জেহাদ করার ইচ্ছা পোষণ করতেন (যদিও বাস্তবে তা ঘটেনি)। তার মতে মির্জা হায়রাত ও জাফর থানেশ্বরী ইংরেজদের খয়েরখা ও সহযোগী ছিলেন। এজন্য তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই সৈয়দ সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তিত করে ফেলেছেন। গোলাম রসুলের এ দাবী যদি সত্য হতো- তাহলে তো মির্জা হায়রাত দেহলভীর ইংরেজ বিরোধীতার কোন কারণ ছিলনা। অথচ মির্জা সাহেবের উক্ত গ্রন্থেই ইংরেজ ঐতিহাসিক ডঃ হান্টার সাহেবের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিযোগটি এই-
"ডঃ হান্টার সাহেবের লেখায় প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে তার অজ্ঞতা, খেয়ালী পোলাও পাকানো (কল্পিত কাহিনী) এবং একটি বিষয়ে তার কল্পিত রায় ঘোষণায় পুরা অবস্থাই প্রকাশ হয়ে গেছে" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ৪২১)।
মির্জা হায়রাত অন্যত্র ডঃ হান্টারের সমালোচনা করেছেন এভাবে-
"ডঃ হান্টারের ২১৮ পৃষ্ঠার পুস্তকটি (দি ইন্ডয়ান মুসলমানস) ভুল তথ্যের স্তুপের দ্বারা যেমন পরিপূর্ণ- তেমনিভাবে অযথা রায় ঘোষণা ও অসত্য যুক্তি প্রদর্শন প্রত্যেক স্থানেই ঝলক মেরে উঠেছে। হায়, যদি সামান্য বিচার বিবেচনাও থাকতো, তাহলে তিনি মজলুম মুসলমানদেরকে এভাবে তোহমত দিতে পারতেন না" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ৪২২)।
মন্তব্যঃ যদি মির্জা হায়রাত দেহলভী ইংরেজদের ভয়ে ভীত হতেন - তাহলে ডঃ হান্টার এবং তার "হিন্দুস্থানের মুসলমান" নামক গ্রন্থের বিরুদ্ধে তিনি এমন পরিস্কার ভাষায় তিরস্কার ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন না। যিনি এমন কাজ করতে পারেন- তার পক্ষে শিখদের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের জেহাদকে নির্দিষ্ট করার অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। গোলাম রসুল সাহেবের ধারণা মতে যদি ঘটনা এরূপই হতো- তাহলে মির্জা সাহেব অবশ্যই তা বর্ণনা করতেন। কেননা, মির্জা সাহেব উক্ত গ্রন্থে একথাও উল্লেখ করেছেন যে, আমি পরকালের ভয় সামনে রেখেই এই গ্রন্থ রচনা করেছি। তিনি বলেন-
"আমি চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই এই গ্রন্থটি লিখেছি এবং এ কথাও আমার বিবেকে রেখেছি যে, একদিন প্রতিশোধ গ্রহণকারী সৃষ্টিকর্তার সামনে হাজির হয়ে আমার লেখার জন্য আমাকে জওয়াবদিহি করতে হবে। এজন্য আমার উপর ফরজ- আমি যা কিছু লিখবো, ঈমান ও শুদ্ধ নিয়তেই ইনসাফ করে লিখবো" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ৪৩৫)।
এতকিছু দেখে শুনেও গোলাম রসুল সাহেব মির্জা হায়রতকে বড় মিথ্যাবাদী এবং তার গ্রন্থকে কল্প-কাহিনী সাব্যস্থ করেছেন। মির্জা সাহেবের ঘোষণার মত এমন কোন ঘোষণা গোলাম রসুল মেহেরের তাবৎ গ্রন্থের মধ্যেও নেই। মির্জা হায়রাত সাহেবের ইংরেজ বিরোধীতার আর একটি প্রমাণ হলো- তিনি ঐসব মুসলমানদের বিরুদ্ধে অশ্রুপাত করেছেন- যারা ইংরেজদের লেখার উপর বিশ্বাস ও নির্ভর করেছে। তিনি লিখেন-
"সবচেয়ে বেশি আফসোস হয় ঐ সব লোকের উপর- যারা নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে'- অপরদিকে সাথে সাথে একথাও বিশ্বাস করে যে, "কুরআন শরীফে মিথ্যার সম্ভাবনা হলেও হতে পারে- কিন্তু ইংরেজদের হাতের লেখায় কোন মিথ্যা থাকতে পারে না"। খোদা তাদের প্রতি করুণা করুন এবং তাদেরকে সত্য পথের সন্ধান দিন" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ৪২৯)।
মন্তব্যঃ মির্জা হায়রাত দেহলভী সম্পর্কে গোলাম রসুলের কটুক্তি ও তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনয়ন করা যে, "মির্জা সাহেব ইংরেজদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সৈয়দ সাহেবের জেহাদকে শিখদের বিরুদ্ধে সীমিত করে দিয়েছেন- আসলে কিন্তু সৈয়দ সাহেবের ইচ্ছা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা"- এই অভিযোগ আমার মতে বে-ইনসাফের শামিল। দেখুন, মির্জা হায়রাত দেহলভী ডঃ হান্টার এবং তার জাতিকে অসভ্য ও অভদ্র বলেও উক্তি করেছেন। তিনি লিখেছেন -
"যে মুসলমানদের কৃতিত্ব এমন আশ্চর্যজনক এবং অতুলনীয়- সেই জাতি সম্পর্কে হান্টার এবং পাশ্চাত্যের বিদ্ধান ব্যক্তিরা অভদ্র শব্দ ব্যবহার করেছে। আফসোস, এসব উক্তি দ্বারা শুধু বক্তার নয় বরং গোটা ইংরেজ জাতির সভ্যতা ও ভদ্রতার স্বরুপই ধরা পড়ে" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৪০২)।
মন্তব্যঃ যে ব্যক্তি ডঃ হান্টারের মত আই, সি, এস, অফিসারকে অভদ্র বলতে পারেন, সৈয়দ সাহেবের জেহাদ যদি ইংরেজ বিরোধী হয়ে থাকতো- তাহলে তিনি তা প্রকাশ করতে ভয় পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু গোলাম রসুল সাহেব সেই মির্জাকেই বলছেন মিথ্যাবাদী এবং তার গ্রন্থকে বলছেন কল্প কাহিনী। কোন সঠিক জওয়াব না দিতে পারলেই মানুষ এধরনের উক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।
থানেশ্বরীর সাওয়ানিহে আহমদী সম্পর্কে অভিযোগ
মাওলানা জাফর থানেশ্বরী ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তার ব্যক্তিত্ব ও গুরুত্ব সম্পর্কে মাওলানা মাসউদ আলম নদভী পয়ামে 'শাহজাহানপুরী- শাহাদাতগাহে বালাকোট' গ্রন্থে লিখেছেন-
"সৈয়দ সাহেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইনিই (থানেশ্বরী) এমন একজন জিম্মাদার বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছিলেন- যার সম্পর্কে বলা যায় যে, ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহে তিনিই একমাত্র শরিক হয়ে ছিলেন।"
মাওলানা নদভী আরও লিখেছেন যে, "থানেশ্বরী সাহেব সমস্ত বিপদে আপদে ও কঠিন পরীক্ষায় অনড় ছিলেন এবং ঐ ক্ষেত্রে তিনি সাহাবাগণের যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।" (পয়ামে'শাহজাহানপুরী-শাহাদাতগাহে বালাকোট' পৃঃ ৩০৮)।
গোলাম রসুল মেহের সাহেবও জাফর থানেশ্বরীর ব্যক্তিত্ব ও সততার স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন -
"মৌলভী মুহাম্মদ জাফর থানেশ্বরী ছিলেন সৈয়দ সাহেবের খাস ভক্ত দলের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই সম্পর্কের কারণে তাঁকে ভয়ঙ্কর কষ্ট পোহাতে হয়েছিল। তিনি নিজ বাড়ী ঘর বিলিয়ে দিয়েছিলেন এবং প্রায় ১৮ বৎসর কাল (১৮৬৫-৮৩) কালাপানিতে নির্বাসিত হয়েছিলেন। তার এই মহান ত্যাগের সামনে সকল লোকের মাথা সসম্মানে নত হয়ে যাওয়া উচিৎ" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৪৬)।
হোসাইন আহমদ মাদানী লিখেছেন-
"মৌলভী জাফর থানেশ্বরী হযরত সৈয়দ সাহেবের নির্ভরযোগ্য জীবনীকার ছিলেন"
(হোসাইন আহম্মদ মাদানী কৃত নকশে হায়াত পৃঃ ৪১৮)।
মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী লিখেছেন-
"জাফর থানেশ্বরীর লিখিত সাওয়ানিহে আহমদী এবং তাওয়ারীখে আজিবা সৈয়দ সাহেবের জীবনী বিষয়ে উর্দু কি পহেলী কিতাবের মতই সর্বজন প্রিয় ও প্রসিদ্ধ। এগুলোর দ্বারাই সৈয়দ সাহেবের ঘটনাবলীর যথেষ্ঠ প্রচার হয়েছে" (আবুল হাসান আলী নদভী কৃত সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ উদ্ধৃতি- শাহাদাতগাহে বালাকোট)
সাওয়ানিহে আহমদী গ্রন্থ রচনার ভূমিকায় মাওলানা জাফর থানেশ্বরী নিজে লিখেছেন-
"আমি এই সাওয়ানিহে আহমদী গ্রন্থ রচনায় এমন সত্যবাদী লেখকদের অনেক লেখার সাহায্য নিয়েছি- যারা ঘটনাবলী নিজের চোখে দেখেছেন। আমার দৃষ্টিতে অত্র সাওয়ানিহ গ্রন্থের কোন বর্ণনার মধ্যে মিথ্যা কিংবা বাড়াবাড়ি বা অতিশয়োক্তির আশ্রয় গ্রহণ করা হয় নি" (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৫)।
মন্তব্যঃ
(১) মাওলানা মাসউদ আলম নদভী মাওলানা থানেশ্বরীর অনড় ভূমিকাকে সাহাবা যুগের সাথে তুলনা করেছেন।
(২) গোলাম রসুল মেহের নিজেই বলেছেন যে, থানেশ্বরীর দৃঢ়তা ও অনড় অবিচল কার্যক্রমের সামনে সকলের মাথা শ্রদ্ধায় অবনত হওয়া উচিৎ।
(৩) মাওলানা মাদানী ও মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী থানেশ্বরীকে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
(৪) মাওলানা থানেশ্বরী নিজেই লিখেছেন যে, সাওয়ানিহ গ্রন্থে তিনি মিথ্যা কিংবা অতিশয়োক্তির মোটেই আশ্রয় নেন নি, বরং সৈয়দ সাহেবের সাথী কর্মীদের লেখা থেকেই তিনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
এতদসত্ত্বেও কোন কোন লেখক (যেমন মেহের সাহেব) তাঁর বিরুদ্ধে এই অপবাদ দিয়েছে যে, তিনি নাকি সাওয়ানিহ গ্রন্থে অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন- "সৈয়দ সাহেবের আসল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা" কিন্তু থানেশ্বরী সাহেব বলেছেন- কেবল শিখদের বিরুদ্ধেই তিনি যুদ্ধ করেছেন। এই সমালোচনাটি গোলাম রসুল মেহের নিজেই করেছেন- অথচ একটু আগে তিনিই থানেশ্বরীর লেখার প্রশংসামূলক উক্তি করেছেন। তার কারণ হলো- গোলাম রসুলের বানাওটি গবেষণার সাথে থানেশ্বরীর গবেষণা ও বর্ণনা খাপ খাচ্ছেনা। শুধু এ কারণেই মাওলানা থানেশ্বরীর লেখার বিরুদ্ধে তার এই অপবাদ ও মিথ্যা অভিযোগ এবং থানেশ্বরীর ইংরেজ প্রীতির আবিস্কার। এছাড়া তার করার কি আছে? মাওলানা থানেশ্বরী তার দ্বিতীয় গ্রন্থ তাওয়ারিখে আজিবার মধ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং তাদের চুরি ও সিনাজুরীর কথা এভাবে উল্লেখ করেছেন-
"ইয়াগিস্তান অঞ্চলে সুন্নী পাঠানদের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের ভয়ঙ্কর যুদ্ধটি ছিল ইংরেজদের পীড়াপীড়িতেই" (তাওয়ারিখে আজিবা পৃঃ ৬২)। [দেখা যাচ্ছে ইংরেজদের ইশারাতেই সৈয়দ সাহেব সুন্নী পাঠানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল- অনুবাদক।]
ইংরেজ যুগে লিখিত এবং প্রকাশিত মাওলানা থানেশ্বরীর গ্রন্থে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনয়ন করা একতারই প্রমাণ বহন করে যে, তিনি ইংরেজদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না। তিনি আরও লিখেছেন -
"চাম্ব এলাকার পার্বত্য অঞ্চলে সুন্নী পাঠানদের বিরুদ্ধে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে নিরীহ মানুষকে অপদস্থ করার অপকর্মে অনুতপ্ত হয়ে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ইলিজন সাহেব হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন" (তাওয়ারিখে আজিবা পৃঃ ৬৪)।
মন্তব্যঃ আমার (গার্দেজী) ধারণা মতে যে ব্যক্তি ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের সামনে এমন শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে পারেন- তিনি কখনও ইংরেজদের সাথে আপোষ করতে পারেন না। এমন লোকের বিরুদ্ধে ইংরেজ প্রীতি, সত্যগোপন, অপব্যাখ্যা- ইত্যাদি অপবাদ দেয়াকে গোলাম রসুল মেহেরের "অকারণে হাত পা নাড়া চাড়া" বলা যেতে পারে।
শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ
(পেশোয়ার গমনের কারণ)
সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব ইংরেজদের ইশারা-ইঙ্গিতে ও সাহায্যে শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ভারতের ইংরেজ এবং পাঞ্জাবের শিখদের মধ্যে ঐ সময় সীমান্ত চুক্তি বহাল ছিল। তাই হিন্দুস্থানের এলাকা থেকে পাঞ্জাবের শিখদের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের হামলা করা সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী সম্ভব ছিল না। সেজন্য তিনি সিন্ধু ও বেলুচিস্তান হয়ে পেশোয়ারে পাঠানদের মুল্লুকে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে গিয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করলেন। সৈয়দ সাহেব নিজের এক ফার্সী চিঠিতে লিখেছেন-
"মোয়ামালাই খাকচার কাশশামছি ফি রাবিয়াতিন নাহারি হোয়েদা ওয়া আশকারা আস্ত কেহ্, বে জেহাদে আহলে ইনাদ্ কাওমে শিখ মামুরম"। (মাওলানা থানেশ্বরী কৃত মকতুবাতে আহমদী পৃঃ ২৩৬)।
অর্থঃ "এই অধমের অবস্থা মধ্যাহ্ন গগণের সূর্যের ন্যায় একেবারেই পরিস্কার যে, আমি মুসলিম বিদ্বেষী শিখ জাতির বিরুদ্ধেই জেহাদ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি" (মাওলানা জাফর থানেশ্বরী কৃত মকতুবাতে আহমদী পৃঃ ২৩৬)।
মন্তব্যঃ কার পক্ষ থেকে তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন- সেকথা চিঠিতে উল্লেখ করেন নি কেন? এছাড়া একবার আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতেও নাকি ইলহাম হয়েছিল- শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য। সৈয়দ আহমদ সাহেবের উক্ত ভাষ্য ফার্সী ভাষায় নিম্নরূপ লিখা হয়েছে-
"আম্মা বয়ানে ইলহাম - পছ আজ ফকির আজ পরদায়ে গায়েব ব-বিশারাতে রাব্বানী ব-ইসতিসালে কুফফারে দারাজ মুয়িয়াঁ মুরাদ আস্ত" (মকতুবাতে আহমদী পৃঃ ১৮০)।
অর্থঃ আমার প্রতি অবতীর্ণ ইলহামের বর্ণনা এই যে, ফকিরের প্রতি গোপন পর্দার অন্তরাল থেকে- "লম্বা গোঁফ বিশিষ্ট কাফেরদেরকে খতম করার জন্য রাব্বানী সুসংবাদ ও নির্দেশ আসলো" (মাওলানা জাফর থানেশ্বরী কৃত মকতুবাতে আহমদী পৃঃ ১৮০)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেবের প্রতি নাজিলকৃত ইলহাম বলছে যে, লম্বা গোঁফ বিশিষ্ট শিখদেরকে উৎখাত করার জন্যই তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন। এটা তো সৈয়দ সাহেবের নিজস্ব বর্ণনা- যার মধ্যে অপব্যাখ্যা করা বা সন্দেহ করার কোন সুযোগ নেই এবং উল্লেখিত এবারতের মধ্যে কোন প্রকারের পরিবর্তনের অভিযোগও আজ পর্যন্ত কেউ করেনি। সৈয়দ সাহেবের ভক্ত ও মুরিদানরাও একথাই বলেন যে, সৈয়দ সাহেব শিখ বিরোধী ছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধেই জেহাদ করার ইচ্ছা পোষণ করতেন। এজন্যই তিনি সীমান্ত প্রদেশে গিয়েছিলেন। [ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য কোন প্রকার ইলহাম হয়নি- অনুবাদক]।
এপ্রসঙ্গে মাওলানা জাফর থানেশ্বরী লিখেছেন-
"জেহাদের উদ্দেশ্যে সফরে বের হওয়ার পূর্বে তাঁর প্রতি এক ইলহাম হয়েছিল যে, পাঞ্জাব রাজ্য তার হাতে জয় হয়ে পেশোয়ার থেকে সুতলেজ নদী পর্যন্ত গোটা এলাকা হিন্দুস্তানের ঈর্ষান্বিতও সুশোভিত বাগিচায় পরিণত হবে। সুতরাং তার বারবার বিজয়ের ভবিষ্যৎ বাণী সম্পর্কে তার প্রত্যেক মুরীদই ওয়াকেফহাল ছিলেন" (জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৭২)।
মন্তব্যঃ তৎকালে শিখদের রাজত্ব পাঞ্জাব থেকে সুতলেজ নদী পর্যন্তই বিস্তৃত ছিল। সুতরাং ইলহামে রাব্বানীও পরিস্কার একথাই বলছে যে, সৈয়দ সাহেবের জেহাদ কেবল শিখদের বিরুদ্ধেই ছিল- ইংরেজদের বিরুদ্ধে নয়। হিন্দুস্তানের ইংরেজ হুকুমাত ঐ ইলহামের মধ্যে ছিল না। অধিকন্তু সৈয়দ সাহেবের মুরিদরাও এই ইলহাম সম্পর্কে অবগত ছিল। কাজেই যারা একথা দাবী করে যে, সৈয়দ সাহেব ইংরেজ বিরোধী ছিলেন- তারা সৈয়দ সাহেবের ইলহাম ও রূহানী মর্যাদাকেই অবিশ্বাস করছেন। [তার মূল বাসনা ছিল পাঞ্জাব ও পেশোয়ার দখল করে তথায় রাজত্ব করা- অনুবাদক]।
আরও শুনুন- সৈয়দ সাহেবের নির্দেশ -
"যেহেতু ইংরেজ সরকার ক্ষমতায় আছেন এবং মুসলমান প্রজাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ইংরেজ সরকারের নিরপেক্ষতা রয়েছে- সুতরাং এমতাবস্থায় আমাদের শরীয়তের জেহাদের শর্তসমূহ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিপন্থী। এজন্যই পাঞ্জাবের জালিমশাহী শিখদের বিরুদ্ধেই কেবল জিহাদ করতে হবে- কেননা এরা অত্যন্ত অত্যাচারী এবং শরীয়তী আইন কানুন চালু রাখার পথে এরা বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে" (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১২৫)।
শিখ জেনারেল এন্টোরা ও সৈয়দ সাহেবের প্রতিনিধির মধ্যে কথাবার্তাঃ
মৌলভী খায়রুদ্দীন সৈয়দ সাহেবের বিশেষ দূত হিসাবে শিখ বাহিনীর খৃষ্টান অধিকর্তা জেনারেল এন্টোরার সাথে মোলাকাত করতে গিয়ে কথাবার্তার এক পর্যায়ে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করেন। তন্মধ্যে একটি ছিল শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা প্রসঙ্গে।
মাওলানা জাফর থানেশ্বরী সেই কথোপকথন এভাবে লিখেছেন -
জেনারেল এন্টোরাঃ আপনার ধারণা ও বিশ্বাস মোতাবেক শিখরা কাফের। একইভাবে আমরা খৃষ্টানরাও কি কাফের? না-কি, কোন পার্থক্য আছে?
মৌলভী খায়রুদ্দীনঃ কুফরীর ক্ষেত্রে শিখ ও খৃষ্টান উভয়েই এক পর্যায়ের।
এন্টোরাঃ হিন্দুস্তানে খলিফা সাহেবের (সৈয়দ সাহেবের) লক্ষ লক্ষ মুরিদ, বড় বড় জমিদার ও নওয়াব রয়েছেন এবং বর্তমানে হিন্দুস্থান নাছারাদের দখলে রয়েছে। সুতরাং শিখ ও খৃষ্টান যখন কুফরীর ক্ষেত্রে এক সমান- তাহলে সৈয়দ সাহেব লক্ষ লক্ষ মুরিদ একত্রিত করে ঘরে বসেই কেন ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ করছেন না? অযথা কেন তিনি এত দূর দারাজের পথ অতিক্রম করে মেহনত ও কষ্ট করে এখানে শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে আসলেন?
মৌলভী খায়রুদ্দীনঃ ইংরেজ সরকার আমাদের কোন ধর্মীয় ফারায়েজ আদায় করতে বাধা দিচ্ছে না। প্রত্যেক ধর্মীয় কাজে আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন। এর বিপরীতে শিখরা লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে অবনত ও অপদস্থ অবস্থায় রেখে উচ্চস্বরে আযান পর্যন্ত দিতে নিষেধ করে দিয়েছে। যদি কোন মুসলমান কোরবানীর ঈদে গরু কোরবানী করে- তাহলে খালসা (শিখ) সৈন্যরা তাকে হত্যা করে। এই কারণেই খলিফা সাহেব ইংরেজের পরিবর্তে শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে এসেছেন"। (জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ২৬১)
মন্তব্যঃ মৌলভী খায়রুদ্দীন সাহেবের এই বিবৃতি ও এই জবাব ঐ যুগের ছিল- যখন সৈয়দ সাহেব সীমান্ত প্রদেশে অবস্থানরত ছিলেন। খায়রুদ্দীন সাহেবের উক্তি কত পরিস্কার যে, সৈয়দ সাহেব শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতেই কেবল সীমান্তে এসেছেন- অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। ইংরেজরা ন্যায়পরায়ণ শাসক। তারা মুসলমানদের ধর্মের ব্যাপারে কোন রূপ হস্তক্ষেপ করে না। তারা মুসলমানদের প্রকাশ্য ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। জানিনা, আজকাল কিছু লেখক কেন সৈয়দ সাহেবকে ইংরেজ বিদ্বেষী মনে করেন? অথচ- সৈয়দ সাহেব ছিলেন শিখ বিদ্বেষী। মৌলভী খায়রুদ্দীন ও জেনারেল এন্টোরার মধ্যকার সাক্ষাৎকার ও তদসংশ্লিষ্ট আলোচ্য বিষয়গুলো মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী ও গোলাম রসুল মেহের সাহেব তাদের লেখনীতে বেমালুম গায়েব করে ফেলেছেন। সৈয়দ সাহেবের ইনতিকালের শোয়াশো বছর পর তাদের নিজস্ব তৈরী কল্প কাহিনীগুলো এই সাক্ষাৎকারের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করেই সম্ভবত তারা অনেক কষ্ট, পরিশ্রম ও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সত্য গোপনের এ কাজটুকু করেছেন। সত্যি, ফার্সী ভাষার নিম্ন প্রবাদ বাক্যই এক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
"পীরাঁ নমি পরান্দ-
মুরিদাঁ হামী পরান্দ"
অর্থঃ পীরেরা যা পারেনা- মুরিদরা তাই পারে"।
এবার শুনুন সৈয়দ সাহেবের দ্বিতীয় খলিফা শাহ ইসমাঈলের বাণী। তিনি একথা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে,
"ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ফরজ নয় এবং তাদের সাথে আমাদের কোন শত্রুতাও নেই। আমরা শুধু আমাদের মুসলমান ভাইদের পক্ষে শিখদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করছি" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৩২)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেবের প্রতি ইলহাম হয়েছিল শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য, আর সোয়াশো বছর অবধি লোকেরাও এ কথাই বলে আসছে। কিন্তু ১২৫ বছর পর (১৯৫৬ ইং) হঠাৎ করে গোলাম রসুল মেহের সাহেবের উপর ইলহাম হলো- "সৈয়দ সাহেব ইংরেজ বিরোধী ছিলেন এবং তিনি তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার ইচ্ছা পোষণ করতেন"। অথচ ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি অক্ষরও সৈয়দ সাহেব বা ইসমাঈল দেহলভী থেকে বর্ণিত হয়নি। ফার্সী প্রবাদে বলে -
"গর নাবীনাদ বরোজ সিপরা চশম্,
চশমায়ে আফতাব রা চে গুনাহ্?"
অর্থঃ "অন্ধ চোখে যদি দিনের বেলায় সূর্যালোক না দেখে, তাহলে সূর্যের আলোর দোষ কোথায়?"।
সৈয়দ সাহেবের শিখ বিরোধী জেহাদে সীমান্ত বাসীদের সমর্থন
সৈয়দ সাহেব যখন শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সীমান্ত প্রদেশে গেলেন- তথাকার উলামারা, পাঠান খানেরা এবং জনসাধারণরা জানমাল দিয়ে তার সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। কেননা, সীমান্তবাসীরা ছিল বড় যুদ্ধবাজ জাতি, কিন্তু নিপীড়িত- এবং অনেক দিন থেকেই তারা শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের খেলা করে আসছিল। সৈয়দ সাহেবও ওখানে গিয়ে তাদের বুলিই আওড়াচ্ছিলেন এবং মুখে আল্লাহ্ রাসুলের নামই নিচ্ছিলেন। এজন্যই তার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সীমান্ত মুসলমানদের স্বভাবসিদ্ধ রীতি ছিল। সৈয়দ সাহেবের প্রতি তাদের ভক্তির বর্ণনা গোলাম রসুল সাহেবও এভাবে বর্ণনা করেছেন -
"চারসাদ্দায় সৈয়দ সাহেব উটের উপর আরোহী ছিলেন। উটের পিঠে ঝালর বিশিষ্ট গদী ছিল। বর্ণনাকারীদের বর্ণনা মোতাবেক সাক্ষাৎকারীরা উক্ত গদীর সুতা খুলে খুলে তাবাররুক হিসাবে নিয়ে যেতো। এমন কি- উটের লেজের পশম পর্যন্ত রক্ষা পেতো না। আর যাদের ভাগ্যে গদী বা লেজের পশমের অংশ জুটতো না- তারা উটের পদচিহ্নের মাটি তুলে তুলে মাথায় ও চোখে মালিশ করতো" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩২৫)।
পর্যালোচনাঃ সীমান্তের সোজা সরল মুসলমানরা কিভাবে সৈয়দ সাহেবের ফাঁদে আটকিয়ে গেলো! উটের গদীর সুতা কি জিনিস- তারা উটের লেজের পশম এবং পায়ের নীচের মাটি পর্যাপ্ত তাবাররুক হিসাবে হেফাজত করতো। জান কোরবান করার জন্য তারা পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো। এই বেচারাদের কি একথা জানা ছিল যে, তারা নিজেদের কবর নিজেরাই রচনা করছে? মৃত্যর সামানা তারা নিজেরাই তৈরী করে নিচ্ছে? নিজেদের আস্তিনের ভিতরেই তারা সাপ লালন পালন করছে?
ফার্সী প্রবাদ বাক্যে আছে-
আকিবাত গিরগ জাদা গিরগ শাওয়াদ
গরচে বা মরদম বুযর্গ শাওয়াদ।
অর্থাৎঃ....................
কিন্তু সীমান্তবাসীরা এতসব করেছিল শুধু ইসলামের দোহাইতে ভুলে। তাদের অন্তরের ফুল বাগিচায় বাবুলের কাটা ছিল না। তাদের দেমাগের লিপিতে ছিল ইসলামের পূরাতন দিনের নকশা অঙ্কিত। তারা তাদের পুরাতন ইসলামী আকিদার উপর ছিল মজবুত ও দৃঢ়। কোন নতুন আয়নার প্রয়োজন ছিলো না তাদের। সৈয়দ সাহেব নিজের ইলহাম মোতাবেক শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে সীমান্তে এসেছিলেন। কিন্তু এগুলো ছিল মৌখিক জমা খরচের মত। প্রকৃতপক্ষে তিনি শিখদের চেয়ে বেশি যুদ্ধ করেছিলেন সুন্নী মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে তিনি ধর্মীয় বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছিলেন এবং অগণিত মুসলমানকে তিনি তরবারীর নীচে এনে ছেড়েছিলেন (কতল করেছিলেন)। যাদের সহযোগিতা তিনি নিতে গিয়েছিলেন- তাদের বিরুদ্ধেই তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে গেলেন। [একেই বলে নিমক হারামী- অনুবাদক]।
শিখদের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের প্রথম আক্রমণ ছিল আকুড়ায় ২০শে সেপ্টেম্বর ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে এবং সর্বশেষে যুদ্ধ হয়েছিল বালাকোট ময়দানে ৬ই মে ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে। মধ্যখানের এই সাড়ে চার বছরের মধ্যে ছোট বড় মিলিয়ে সৈয়দ সাহেব ১৫টি যুদ্ধ সংঘটিত করেছেন। এর মধ্যে শিখদের বিরুদ্ধে ছিল ৫টি যুদ্ধ। অবশিষ্ট ১০টি যুদ্ধই ছিল পাঠান মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ঐ পাঁচটির মধ্যেও যুদ্ধ হয়েছিল মাত্র ১টি। বাকী ৪টি ছিল শুধু রাত্রিকালীন আক্রমণ। ঐ পাঁচটির মধ্যে মাত্র ১টিতে (শীদু শরীফের যুদ্ধ) সৈয়দ সাহেব নিজে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বাকী ৪টিতে কমান্ডার ছিলেন নিম্নরূপ (শিখদের বিরুদ্ধে)।
(১) আকুড়া যুদ্ধ- কমান্ডার ছিলেন আল্লা বখ্শ মুরাইন। (১৮২৬ ইং)
(২) ডমগোলা যুদ্ধ- কমান্ডার ছিলেন শাহ ইসমাঈল দেহলভী।
(৩) শানকিয়ারী যুদ্ধ- কমান্ডার ছিলেন শাহ ইসমাঈল দেহলভী।
(৪) মুজাফফরাবাদ (কাশ্মীর) - কমান্ডার ছিলেন মৌলভী খায়রুদ্দীন শেরকুয়ী।
বেচারা সীমান্তের মুসলমানরা ইসলামের নামে সৈয়দ সাহেবের পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল। আকুড়ার যুদ্ধে (১৮২৬ ইং) মোট নয়শত মুজাহিদ অংশ গ্রহণ করেছিল। এদের বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে জনাব গোলাম রসুল নিজেই উল্লেখ করেছেন -
"নয়শত মুজাহিদের মধ্যে মাত্র একশত ছত্রিশ জন ছিল ভারতীয়। কান্দাহারের (কাবুল) ছিল প্রায় আশি জন। বাদ বাকী সবাই ছিল সীমান্ত এলাকার" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩৩৪)।
মন্তব্যঃ এরপরেও সীমান্ত এলাকার পাঠান মুসলমানের ইসলামী প্রেরণায় কোন সন্দেহের অবকাশ আছে কি? তারা ইসলামের নামের উপর নিজেদের অধিকাংশ লোককেই সৈয়দ সাহেবের খেদমতে হাজির করে দিয়েছিলো। কিন্তু গোলাম রসুল মেহেরের খামিরা কোন্ মাটি দ্বারা তৈরী হয়েছিল- তা খোদাই ভাল জানেন। মেহের সাহেব সব ক্ষেত্রেই সত্যকে গোপন করতে এবং অপবাদের মাধ্যমে নিজের কাজ উদ্ধার করতে প্রয়াস পান। যে যুদ্ধে বিজয় দেখেন, তার বিজয়মালা পরিধান করান ভারতীয় ওহাবী মুজাহিদদের গলায়। আর যে যুদ্ধে পরাজয় দেখেন, সে পরাজয়ের শিকল পরান সীমান্তের সুন্নী পাঠান মুসলমানদের পায়ে। হে আল্লাহ, আমাদেরকে সত্য অনুসরণ ও অসত্য বর্জনের পথ বাতলিয়ে দিন।
শীদু শরীফের যুদ্ধ (১৮২৭ ইং)
এখন শুনুন সবে ধন নীলমণি- এর মত যুদ্ধের কথা- যাতে সৈয়দ সাহেব স্বশরীরে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ঐ যুদ্ধের নাম হলো "জঙ্গে শীদু" । শিখদের বিরুদ্ধে ছিল এই যুদ্ধ।
সীমান্ত মুসলমানদের ইসলামপ্রীতি ও শিখ বিরোধীতার উজ্জ্বল প্রমাণ এর চেয়ে বেশী আর কি হতে পারে যে, অল্প সময়ের মধ্যেই এক লক্ষ মুসলমান সৈয়দ সাহেবের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে গেলো।
স্বয়ং গোলাম রসুল মেহেরের জবানীতেই শুনুন। তিনি লিখেছেন-
"দুই মাসের মধ্যেই আশি হাজার সীমান্ত মুসলমান জেহাদের জন্য সংগৃহীত হয়ে গেলো। পেশোয়ারের সর্দারদের সৈন্য ছিল এর বাইরে। তাদের সংখ্যা ছিল বিশ হাজারের মত" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩৬৫)।
এত সংখ্যক সৈন্য কেন এবং কিভাবে সংগৃহীত হলো- সে সম্পর্কেও গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"আশি হাজার সৈন্য সংগ্রহে সবচেয়ে বেশী অবদান ছিল ফতেহ্ খান পাঞ্জেতারী, আশরাফ খান এবং খাভী খানের" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৩৬৫)।
মন্তব্যঃ উপরোক্ত বর্ণনায় প্রমাণিত হয় যে, সীমান্তের মুসলমানরা শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রেরণায় ছিল উদগ্রীব এবং উল্লেখিত তিন সর্দারের আহ্বান শুনার সাথে সাথেই তারা প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো। মাত্র দুই মাসের সময়ের মধ্যে একলক্ষ সীমান্ত মুসলমান একত্রিত হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। শীদু নামক স্থানে (১৮২৭ ইং) উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলো। শিখ সৈন্যদের ব্যাপারে গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"শিখ সৈন্যদের সংখ্যা ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজারের কম ছিল না" (প্রাগুক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৩৬৬)। অর্থাৎ শিখ সৈন্যের সংখ্যা মুসলমানদের এক তৃতীয়াংশেরও কম ছিল। যুদ্ধ শুরু হলো। সৈয়দ সাহেব হাতীতে চড়ে সৈন্যবাহিনীর পিছনে ছিলেন (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৩৭৮)। প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হলো। নেতৃত্বের অপরিণামদর্শীতা, বক্র দর্শন ও অযোগ্যতার কারণে মুসলমানরা লজ্জাজনকভাবে পরাজয় বরণ করলো। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজার শিখ সৈন্যের মোকাবেলা করতে গিয়ে একলক্ষ মুসলমান হস্তী বাহিনী যুদ্ধ ময়দান থেকে এমনভাবে পলায়ন করলো যে, একজন অন্যজনকে পায়ের নীচে মাড়িয়ে পলায়ন করতে লাগলো। সৈয়দ সাহেবের হাতীকে তীব্র বেগে চালানোর প্রচেষ্টা করা হলো। কিন্তু তার সম্ভুক গতির কারণে সৈয়দ সাহেব হাতী থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে পলায়ন করলেন অথবা তাকে পলায়ন করতে বাধ্য করা হয়েছিল (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩৭৯)।
এভাবে সমস্ত সৈন্যবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। এপ্রসঙ্গে গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"হিন্দুস্তানি গাজীরাও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়লো। কিছু সংখ্যক সৈয়দ সাহেবের সাথে ছিল। আর এক দল ছিল ইসমাঈল দেহলভীর সাথে। তৃতীয় এক দল বিচ্ছিন্ন হয়ে আকুড়ায় পৌঁছে গেলো। (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৩৭৯)।
মন্তব্যঃ অর্থাৎ শীদুর যুদ্ধে (১৮২৭ ইং) সৈয়দ সাহেব ও তার সঙ্গীরা শিখদের ভয়ে এত ভীত হয়ে পড়েছিলো যে, প্রত্যেকেই প্রাণের ভয়ে পলায়ন করছিল। কারও প্রতি কেউ নজর দিতে পারে নি। স্বয়ং ইসমাঈল দেহলভী আপন পীরকে ছেড়ে পেশোয়ারের দিকে পলায়ন করলো। মনে হয়- সবচেয়ে বেশী ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন সৈয়দ সাহেব নিজে। কেননা, তার অবস্থা ছিল এই যে- তিনি যুদ্ধ ময়দান থেকে প্রথমে হাতী, তারপর দ্রুতগতি সম্পন্ন ঘোড়ায় চড়ে নদী পার হওয়ার উদ্দেশ্যে ছার নামক গ্রামে গেলেন। সেখানে ব্যর্থ হয়ে নাগুমা ও সোয়াত নদীর সঙ্গমস্থলে পৌঁছলেন। তাড়াহুড়ার মধ্যে ঘোড়া থেকে নদীতে পড়ে গেলেন। কোন রকমে নদী সাঁতরিয়ে ওপারে উঠে ভাবড়া স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখান থেকে ডাগেয়ী, গোজরগড়হি, মোহেবছোরখ ঢেড়ী এবং বাগ-এর রাস্তা ধরে তিনি চোংগলী নামক স্থানে পৌঁছেন। চোংগলী ছিল সুরক্ষিত স্থান। সৈয়দ সাহেব শিখদের ভয়ে ভীত হয়ে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে চোংগলী গিয়ে অবস্থান নিলেন। [সৈয়দ সাহেব তার প্রথম যুদ্ধেই নাস্তানাবুদ হয়ে গেলেন। এই যুদ্ধের পরেই তাকে আমিরুল মোমেনীন বানানো হয়- অনুবাদক]।
এই ছিল শীদু শরীফের যুদ্ধের কাহিনী- যে কাহিনী অত্যন্ত রং লাগিয়ে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এটা যদি প্রকৃত জেহাদ হয়ে থাকে- তাহলে জেহাদের ময়দান হতে পলায়নের শাস্তি সম্পর্কে কুরআন ও হাদীস অনুসন্ধান করতে হবে।
গোলাম রসুল মেহের সাহেব এই যুদ্ধ পরাজয়ের কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন সীমান্তবাসী পাঠান সুন্নী মুসলমানদের বিশ্বাস ঘাতকতাকে। অপর দিকে তিনি সৈয়দ সাহেবের সঙ্গী ভারতীয় ওহাবী সিপাহীদের কাপড়ও সাদা রাখার কসরত করেছেন। এই পরাজয়ের পরেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিল।
আমিরুল মোমেনীন হওয়ার ঘটনা–১৮২৭খৃঃ
(পাঠান সর্দারদের সাথে সংঘাতের সূত্রপাত)
প্রথম সমাবেশঃ হিন্ড
শিখদের বিরুদ্ধে শীদুর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ১৮২৭ খৃঃ মোতাবেক ১২৪২ হিজরী ১২ জমাদিউল আউয়াল তারিখে হিন্ড নামক স্থানে হিন্দুস্থানী মুজাহিদীন, উলামা ও স্থানীয় পাঠান সর্দারগণের এক মহা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সমাবেশে একজন আমিরের নেতৃত্বে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান হয়। কে বা কারা এই প্রস্তাব করেছিল- ভারতীয় মুজাহেদীনদের পক্ষ হতে, না কি সীমান্তের পাঠান মুসলমানদের পক্ষ হতে- তা অবশ্য সঠিকভাবে জানা যায় নি। তবে বদ্ধমূল ধারণা এই যে, এই প্রস্তাব এসেছিল ইসমাঈল দেহলভীর পক্ষ হতে। যাই হোক- ঐ সমাবেশেই সৈয়দ সাহেবকে "আমিরুল মোমেনীন" উপাধি দেয়া হয়।
এভাবে তিনি আমিরুল মোমেনীনের নামও সর্বস্ব উপাধি পেয়ে গেলেন- কিন্তু তার আমিরিয়ত শুধু নামে ছিল। ইসলামী হুকুমাতে মুসলমানদের আমিরুল মোমেনীনের যে মর্যাদা ও ক্ষমতা থাকার কথা- সেই সার্বভৌম ক্ষমতা সৈয়দ সাহেবের ছিল না এবং ঐরূপ ক্ষমতা তাঁকে দেয়াও হয় নি। বরং সৈয়দ সাহেবকে শুধু যুদ্ধ প্রস্তুতির আমির বানানো হয়েছিল - রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম আমির নয়। সৈয়দ সাহেবের একনিষ্ঠ ভক্ত গোলাম রসুল মেহেরও ১২৫ বৎসর পর একথার স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন-
"এই সত্যকে ঠিক ঠিক ভাবে আর একবার স্মরনে রাখতে হবে যে, ইমাম বা আমিরিয়ত উপাধি প্রদানের মাধ্যমে সৈয়দ সাহেবকে শুধুমাত্র যুদ্ধ প্রস্তুতি ও কার্যক্রম সংগঠিত করারই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। পাঠান খান ও সর্দারদের রাষ্ট্রীয় পরিচালনার ক্ষমতার সাথে সৈয়দ সাহেবের কোন সম্পর্কই ছিল না। তিনি শুধু ওয়াজ ও বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষের মনে যুদ্ধ জেহাদের উত্তেজনা সৃষ্টির ক্ষমতা পেয়েছিলেন। পাঠানদেরকে ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করার ক্ষমতা তাঁকে দেয়া হয়েছিল। যেসব পাঠান সর্দার তাঁর কাছে বাইআত হয়েছিলেন- প্রয়োজন মোতাবেক তাদের থেকে তিনি সাহায্য সহযোগিতা চাওয়ার অধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আর যুদ্ধের ময়দানে সকল সৈন্য তার কমান্ড মান্য করতে বাধ্য ছিল। কিন্তু যুদ্ধ ময়দান থেকে ফেরত আসার পর সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন। বর্তমান যুগের সাধারণ পরিভাষায় এভাবে বুঝতে হবে - যুদ্ধের উদ্দেশ্যে সমস্ত উপায় উপকরণ ও শক্তিকে এক জায়গায় সমন্বিত করার লক্ষ্যে এক প্রকারের কনফেডারেশন সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর অর্থ হলো- জনসাধারণ ও খান সর্দারদের ঐক্যজোট করা হয়েছিল- যার সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন সৈয়দ সাহেব " (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩৫৪)।
পর্যালোচনাঃ গোলাম রসুল মেহেরের উপরোক্ত সত্য বর্ণনা অনুযায়ী সৈয়দ সাহেবের ক্ষমতা ও এখতিয়ার যখন এতই সীমিত ছিল- তাহলে আমিরুল মোমেনীন উপাধির পরিবর্তে 'আমিরুল হরব' উপাধি গ্রহণ করাই যুক্তিসঙ্গত ছিল। সীমিত ক্ষমতার ক্ষেত্রে এতবড় আমিরুল মোমেনীন লকব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও উদ্দেশ্যমূলক ব্যাপার। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর লিখিত 'শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ ও তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা' দেখুন- অনুবাদক]
আমিরুল মোমেনীন লকবের অতীত ইতিহাস জানার পর এই জোড়াতালি দেওয়া উপাধির সম্পর্কে অজ্ঞ মুসলমানেরা বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে থাকতে পারে না। জনাব মেহের সাহেব লিখেছেন-
"ভারতীয় গাজীরা প্রথম থেকেই তাকে আমিরুল মোমেনীন বলতো। সীমান্তবাসীরা উপাধি দিয়েছিল সৈয়দ বাদশাহ আর শিখরা পরিভাষা ব্যবহার করতো শুধু খলিফা " (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩৫৩)।
মন্তব্যঃ হিন্দুস্থানী গাজীরা সৈয়দ সাহেবকে আমিরুল মোমেনীন কেন বলতো? তিনি কি এ সময় মুসলমানের কোন এলাকার আমির ছিলেন? ইহা এমন একটি প্রশ্ন- যার কোন উত্তর নেই। তা সত্ত্বেও শাহ ইসমাঈল দেহলভী সৈয়দ সাহেবের নামের সাথে আমিরুল মোমেনীন শব্দটি অনেক পূর্বেই জুড়ে দিয়েছিল। [আসলে তিনি ছিলেন আমিরুল ওয়াহাবিয়্যীন- অনুবাদক]। এখন নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাকে আমিরুল মোমেনীন বানানোর প্রচেষ্টায় সে উঠে পড়ে লেগে যায় এবং হিন্ডের এই সমাবেশটি ছিল সেই ষড়যন্ত্রেরই একটি অব্যাহত ধারা।
দ্বিতীয় সমাবেশ (পাঞ্জেতার) ১৮২৯ খৃঃ
শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি যখন সৈয়দ সাহেব হারিয়ে ফেললেন- তখন যুদ্ধের গতি ফিরিয়ে দিলেন মুসলমানদের দিকে। তিনি যেই মিশন ও উদ্দেশ্য নিয়ে হিন্দুস্থান থেকে এসেছিলেন- সেই মিশন ও উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে দিলেন।
সৈয়দ সাহেব নিজেই এই পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেছেন এভাবে-
তিনি বলেন- "জেহাদ তখনই আসমানী সাহায্য লাভের উপলক্ষ্য হতে পারে- যখন সবাই প্রকৃত অর্থে মুসলমান হয়ে যায়। তারা যা কিছু করে, খোদার সন্তুষ্টির জন্যই করে থাকে। এই অবস্থায় এসেই তারা আমিরের আনুগত্যের হাকিকত সম্পর্কে অবগত হতে পারে। এই পর্যায়ে এসে তারা বিদআত (পরিত্যাজ্য বিষয়) এবং আমিরের অবাধ্যতা হতে পাক হয়ে আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ও আমিরের আনুগত্যের হক্ব আদায় করতে সক্ষম হয়ে থাকে" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৫৯)।
মন্তব্যঃ এবার দেখা যাচ্ছে- সৈয়দ সাহেব শিখদের থেকে দৃষ্টি মুসলমানদের দিকে ফিরিয়ে তাদেরকে প্রকৃত মুসলমান বানানোর (অথবা কাফের বানানোর) আন্দোলনের দিকে মনোনিবেশ করলেন। এখান থেকেই শুরু হলো মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির খেলা। মুসলমানরা সুন্নী ও ওহাবী- এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়লো এবং ইসলামী উম্মাহর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। সৈয়দ সাহেবের অনুসারী- যাদেরকে ঐ সময়েই ওহাবী বলা হতো, তারা আজ দেড়শো বৎসর পরেও সুন্নী মুসলমানদেরকে কাফির মনে করে তাদেরকে পূণঃ মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টায় অদ্যাবধি লিপ্ত রয়েছে। কতইনা উত্তম হতো- যদি তারা নিজেদেরকে সংশোধন করে কাফেরদেরকে মুসলমান বানানোর জন্য নিজেদের শক্তি ব্যয় করতো। [তারা বর্তমানে তাবলীগ জামাত নাম দিয়ে মসজিদে গিয়ে মুসলমানকে পূণঃ মুসলমানী করাচ্ছে- অনুবাদক]
সৈয়দ সাহেবকে আমিরুল মোমেনীন বানানোর আন্দোলনক কার্যকর করার লক্ষ্যে ১২৪৪ হিজরী পহেলা শাবান- মোতাবেক ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে পাঞ্জেতার নামক স্থানে দ্বিতীয় মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়। এই সমাবেশে সৈয়দ সাহেবের চিন্তাধারার সাথে সংশ্লিষ্ট ওলামা ও পাঠান সর্দাররা যোগদান করে। এবার শাহ ইসমাঈল দেহলভীর প্রচেষ্টা সফল হলো। এই সমাবেশেই উপস্থিত লোকেরা সৈয়দ সাহেবের হাতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বাইআত গ্রহণ করলো। এই দ্বিতীয় বাইআত গ্রহণ করার পর সৈয়দ সাহেবের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার কথা উল্লেখ করে গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন- "এখন মাত্র একটি প্রশ্ন বাকী রয়ে গেলো। তা হলো এই- শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বাইআতের পর সৈয়দ সাহেবের শাসন ক্ষমতার মধ্যে কোন উন্নতি হয়েছিল কিনা? এর উত্তর হলো- না, হয়নি। ইমামতের বাইআতের মাধ্যমে সৈয়দ সাহেবকে শুধু জিহাদ পরিচালনার জন্যই মনোনীত করা হয়েছিল। কিন্তু শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বাইআতের মাধ্যমে এখন তিনি শরিয়াত নির্দেশনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলেন মাত্র। শাসন ক্ষমতার (খেলাফত) মালিক তিনি হতে পারেন নি।" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৪৬)। [এ ক্ষেত্রে তাঁকে আমিরে শরিয়াত বলা যেতে পারে- অনুবাদক]
মন্তব্যঃ গোলাম রসুলের ভাষ্য মতে- সৈয়দ সাহেবের সার্বভৌম ক্ষমতা ছিল না। প্রত্যেক সর্দার ও আমিরগণ নিজ নিজ এলাকার শাসনকর্তা ছিলেন। সৈয়দ সাহেব শুধুমাত্র শরিয়তের ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান হয়েছিলেন। তিনি নিজের অনুসারী সর্দারদের এলাকাকেই কেবল ইসলামী হুকুমাতের আওতাধীন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ- তাঁর কর্তৃত্ব ছিল শুধু একজন প্রধান কাজীর ন্যায়। এই হজবরল অবস্থায় তাঁকে আমিরুল মোমেনীন ঘোষণা করা- হয় তামাশা- না হয় অতি ভক্তির বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কি বলা যায়? যাই হোক- সৈয়দ সাহেবের কলমী ভক্তরা এটাকেই ইসলামী হুকুমত নামে আখ্যায়িত করেছেন। প্রকৃত চিত্র হলো "কাজিউল কোজাত"।(শরিয়তের প্রধান কাজী হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দাবী করা কতটুকু ন্যায় সঙ্গত - তা পাঠকরাই বিবেচনা করে দেখবেন। ভৌগলিক অঞ্চলের কর্তৃত্ব ছাড়া আমিরুল মোমেনীন হওয়া হাস্যকর ব্যাপার - অনুবাদক)।
আমিরুল মোমেনীন অস্বীকারকারী ব্যক্তি বিদ্রোহী ও মুরতাদ
শাহ ইসমাঈল একথা জানতো যে, সীমান্তের মুসলমানরা আক্বিদাগত পার্থক্যের কারণে একদিন আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তাই ভবিষ্যৎ বিরোধীতা বন্ধ করার লক্ষ্যে তিনি পাঞ্জেতারের দ্বিতীয় সমাবেশে উপস্থিত পক্ষীয় উলামাদের নিকট থেকে আগেই নিম্নলিখিত ফতোয়া আদায় করে নিয়েছিলেন।
ফতোয়াঃ
১। সৈয়দ সাহেবের ইমামত প্রতিষ্ঠিত হবার পর ইমামের নির্দেশ অস্বীকার ও অমান্য করা মস্ত বড় গুনাহ এবং ঘৃণিত অপরাধ।
২। বিরুদ্ধবাদীদের বিদ্রোহ যদি এই পর্যায়ে চলে যায় যে, যুদ্ধ করা ছাড়া ইহার মুলোৎপাটন করা সম্ভব নয় - তাহলে এই বিদ্রোহী ও বিরুদ্ধবাদীদের শায়েস্তা করার জন্য তলোয়ার উন্মুক্ত করা সকল মুসলমানের উপর ফরজ হয়ে যাবে এবং এই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ইমামের নির্দেশ তাদের কার্যকর করতে হবে।
৩। এই বিদ্রোহ দমনের যুদ্ধে ইমামের পক্ষীয় কোন লস্কর মারা গেলে তাকে শহীদ ও নাজাত প্রাপ্ত বলে গণ্য করা হবে এবং বিদ্রোহীদের কেউ মারা পড়লে তাকে মরদুদ ও জাহান্নামী বলে ধরে নিতে হবে। তাদের অবস্থা হবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফাসিক- তথা জ্বিনাকারী ও চোরদের চেয়েও জঘন্য। কারণ ফাসিকদের জানাযা পড়া ওয়াজিব, কিন্তু এই বিদ্রোহী বিরুদ্ধবাদীদের জানাযার নামাজ পড়া জায়েজ নয় " (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৬৩)।
পর্যালোচনাঃ "কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি সৈয়দ সাহেবের বিরোধীতা করে, তার স্বঘোষিত ইসলামী হুকুমাতের বিরুদ্ধে কেউ যদি সমালোচনা করে, তার নিযুক্ত কোন কাজীর জুলুম অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যদি কেউ তলোয়ার হাতে নেয়- এই অবস্থায় কেউ মারা গেলে তার জানাযা পড়া তাদের মতে জায়েজ নেই। আল্লাহর নিকট সে মরদুদ বলে গণ্য হবে। আর সৈয়দ সাহেবের সহযোগী কেউ কতল হলে সে শহীদ বলে গণ্য হবে এবং আল্লাহর দরবারে নাজাত প্রাপ্ত বলে সাব্যস্ত হবে।" এই হলো ফতোয়ার সারাংশ।
সৈয়দ সাহেব আমিরুল মোমেনীন ঘোষিত হওয়ার পর লোকদের কাছে একাধিক পত্র লিখিয়েছেন। এক পত্রে তিনি লিখেছেন-
"ঐ ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে মকবুল বলে গণ্য- যে আমার এই (আমিরুল মোমেনীন) পদবীকে স্বীকার করবে। আর যে এই পদবী অস্বীকার করবে, সে হবে আল্লাহর দরবারে মরদুদ" (জাফর থানেশ্বরী কৃত মকতুবাতে আহমদী ২৪১)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব এমন কোন্ আমিরুল মোমেনীন হয়ে গেলেন যে, হক্ব ও বাতিল, জান্নাতী ও জাহান্নামী, মকবুল ও মরদুদ হওয়ার নিয়ম নীতির পাল্লাটাই সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে গেলো? সাথে সাথে ওহাবী আন্দোলনের বিরোধিতাকারী সীমান্ত সুন্নী উলামা, মুসলমান ও পাঠান সর্দারগণ মরদুদ হয়ে গেলেন? তা-ও আবার সৈয়দ সাহেবের নিকট নয়- বরং আল্লাহর নিকট। হযরত আব্দুল গফুর আখুন্দ সোয়াতী এবং হযরত খাজা শাহ সোলায়মান তিউনেশিয়া-যাদের ইলেম ও মর্যাদা, পৃথিবীর প্রতি তাঁদের অনাসক্তি ও পরহেজগারীর কাহিনী পৃথিবীময় প্রসিদ্ধ এবং এক বিরাট সীমান্ত অঞ্চল যাদের ফয়েজ লাভে ধন্য হয়েছে- তাঁদের মত বুযুর্গ ব্যক্তিরা সৈয়দ সাহেবের বিরোধীতা করে খোদার দরবার হতে মরদুদ হয়ে গেলেন? এই কথা চিন্তা করতেও প্রাণ বের হয়ে যায়। সৈয়দ সাহেব এসব পাক পবিত্র বুযুর্গ ব্যক্তিগণকে মরদুদ বলার পরিবর্তে যদি নিজের দুষ্ট আত্মার সংশোধন করে নিতেন- তাহলে বড়ই উত্তম হতো। [সীমান্তবাসীরা তাকে ত্যাগ করার এটাও একটি বড় কারণ- অনুবাদক]
সৈয়দ সাহেব যখন ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য আমিরুল মোমেনীন ঘোষিত হলেন- তখন মানুষ জনকে তার বাইআত গ্রহণের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হলো। কিন্তু একাজে সাফল্য অর্জিত হলোনা। এ প্রসঙ্গে মুন্সী মুহাম্মদ হোসাইন বিজনূরী লিখেছেন-
"যখন পাঞ্জাবের কোন ধনী মুসলমান অথবা উলামাগণ তার প্রতি আকৃষ্ট হলো না- তখনই সৈয়দ সাহেব তাদের বিরুদ্ধে কুফরী ফতোয়া জারী করে বসলেন। এই কুফরী ফতোয়া জারী করার ফলে সমগ্র পাঞ্জাববাসী ধনী মুসলমান ও উলামাগণ সৈয়দ সাহেবের প্রতি নারাজ হয়ে গেলেন। শুধু তাই নয়- তারা প্রতিবাদ করে লিখলেন- তুমি ওহাবী হয়ে গেছো, তোমার নিকট বাইআত হওয়া দুরস্ত নয়" (মুন্সী মুহাম্মদ হোসাইন মাহমুদ কৃত ফরিয়াদে মুসলেমীন পৃঃ ৯৮)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেবের বাইআত অস্বীকারকারী মুসলমানগণের ভাগ্যে কাফের, বিদ্রোহী, মুরতাদ ও মুনাফিক- এ ধরনের বেশুমার উপাধি জুটেছে।
উদাহরণস্বরূপ- মৌলভী কুতুবুদ্দীন নংগর হারভীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সে ইসমাঈল জনী ও দৌলত জনী গোত্র সমূহে গমন করে তাদেরকে বললো "তোমরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে মনে কর- অথচ একথা তোমাদের জানা নেই যে, যে ব্যক্তি ইমামের বাইআত করা ছাড়া মৃত্যুবরণ করে, সে জাহেলিয়াতের কুফরী মৃত্যুবরণ করে? অথচ ইমাম (সৈয়দ আহমদ) তোমাদের মাঝেই উপস্থিত আছেন" (সূত্রঃ গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৫০৩)। [এর তিন বৎসর পর তারা তাকে বালাকোটে হত্যা করে- অনুবাদক]।
মন্তব্যঃ কোন্ এলাকায় সৈয়দ সাহেবের ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল- যেখানে তিনি ইসলামী শাসন চালু করেছিলেন? সৈয়দ সাহেবের বাইআত গ্রহণের ব্যাপারে কুরআনের কোন অকাট্য দলীল আছে কি- যার অস্বীকার করলে একজন মুসলমান কাফের হয়ে যাবে? অথচ ঐ ব্যক্তি কালেমা ও নামায পড়েন, যাকাত দেন, হজ্ব করেন, রমযানের রোযা রাখেন এবং ইসলামী বিধিবিধান পালনের জন্য মানুষকে তাকিদও করেন? এই যদি হয় আমিরুল মোমেনীন হওয়ার মাপকাঠি ও পন্থা- তাহলে তো প্রত্যেক মুসলিম শাসকেরই এই এখতেয়ার এসে যায় যে, যে কেউ তার বাইআত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে, তাকে আমিরুল মোমেনীন বলে স্বীকার করবে না- তাকেই তিনি কাফের ঘোষণা করতে পারবেন এবং দুনিয়া থেকে কাফের সনদ নিয়েই তাকে কবরে যেতে হবে?
খাইবার গিরিপথের বাসিন্দাগণ বিদ্রোহী ও মুরতাদ
সীমান্ত প্রদেশের মুসলিম দুররানী সর্দারদের সাথে সৈয়দ সাহেবের বিরোধ ছিল। এই বিরোধীতা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ালো। সৈয়দ সাহেব মোজাহেদীনের একটি দলকে খাইবার বাসীদের নিকট সাহায্য লাভ করার জন্য প্রেরণ করলেন। এই প্রতিনিধি দলের নেতা ছিল সৈয়দ সাহেবের আপন ভাগিনা সৈয়দ আহমদ (মুহাম্মদ) আলী। সৈয়দ সাহেব একটি লিখিত ঘোষণাপত্রও তার কাছে দিয়ে দেন। উক্ত ঘোষণাপত্রের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গোলাম রাসুল মেহের লিখেছেন-
ঘোষণাপত্র
"মুজাহেদীনদের সাহায্য করা ও তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা ঈমান ও আনুগত্যের স্বাক্ষর। তাদের থেকে পৃথক থাকা মুনাফেকী ও ফাসাদের আলামত। বিদ্রোহ ও অবাধ্যতার সীমা এতটুকু প্রসারিত হয়ে গেছে যে, এই বিদ্রোহী ও অবাধ্যদের খতম করা ছাড়া জেহাদ করা সম্ভব নয়। সুতরাং এই মোনাফেকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তোমরা প্রস্তুত হয়ে যাও এবং এই কাজকে জেহাদের উচ্চ মরতবা মনে করো" (সূত্রঃ গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৫০)।
মন্তব্যঃ অর্থাৎ- দুররানী সর্দারগণ এবং সীমান্তের অধিকাংশ মুসলমানই মুনাফিক ও বিদ্রোহী মুরতাদ। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে আপনারা- খাইবার গিরিপথের বাসিন্দারা- আমার সাহায্যে এগিয়ে আসুন এবং দুররানী মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকে জেহাদের উচ্চ মরতবা মনে করুন।
এবার খাইবার গিরিপথ বাসিন্দাদের জবাবও শুনে নিন এবং চিন্তা করে দেখুন- সীমান্ত প্রদেশে সৈয়দ সাহেব ব্যতিত আর কে মুসলমান ছিল? গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"আরবাব বাহরাম খান এবং সৈয়দ আহমদ (মুহাম্মদ) আলীর পক্ষ হতে মৌলভী নাসিরউদ্দীন মঙ্গোরী খাইবার থেকে এই সংবাদ নিয়ে আসলেন যে, প্রথমে খাইবারবাসীগণ মুজাহেদীনদের সাহায্যের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল- কিন্তু তারপর তাদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরেছে। তারা এখন দুররানী সর্দারদের পক্ষপাতী হয়ে গেছে " (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৫৪)।
মন্তব্যঃ দুররানী সর্দার এবং সীমান্ত মুসলমানরা তো পূর্বেই মুনাফিক মুরতাদ ও বিদ্রোহী উপাধি পেয়ে গেছে। বাকী ছিল খাইবারের লোকেরা। এখন তারাও সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মোনাফিক ও মুরতাদে পরিণত হয়ে গেলো। কেননা, সৈয়দ সাহেব তো পূর্বেই ঘোষণাপত্র দিয়েছেন যে, মুজাহেদীনদের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া মুনাফেকীর আলামত। [এমতাবস্থায় তারা সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তা দোষের হবে কেন?- অনুবাদক]।
সর্দার পায়েন্দাখানের উপর কুফরী ফতোয়া
সর্দার পায়েন্দা খান ছিলেন হাজারা জিলার প্রতাপশালী সর্দার। তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে গোলাম রসুল মেহেরও স্বীকৃতিমূলক নিম্নোক্ত উক্তি করেছেন-
"খান সাহেব নিঃসন্দেহে একজন বাহাদুর, উচ্চ সাহসী এবং বিচক্ষণ সর্দার ছিলেন। তাঁর বাহাদুরী ও উচ্চাশার প্রমাণ এর চেয়ে অধিক আর কি হতে পারে যে, যেখানে সব সর্দারেরা শিখদের ব্যাপারে দমে গিয়েছিল- সেখানে তিনি শত সহস্র বিপদ ও পেরেশানী সত্ত্বেও শিখদের মোকাবেলায় দস্তুরমত দৃঢ়ভাবে টিকে ছিলেন " (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৫৬৪১)।
গোলাম রসুলের স্বীকৃতি মতে এমন গুণের অধিকারী ব্যক্তি- পায়েন্দা খান যখন সৈয়দ সাহেবের বাইআত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন- তখনই তার উপর কুফরী ফতোয়া দেয়া হলো।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুরাদ আলী লিখেছেন-
"সর্দার পায়েন্দাখান সৈয়দ সাহেবের বাইআত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। সুতরাং সৈয়দ সাহেব পায়েন্দা খানের প্রতি বিরূপ হয়ে গেলেন" (সৈয়দ মুরাদ আলী কৃত তারিখে তানাওলিয়া পৃঃ ৪৯)।
এই বদশুমানীর ফলাফল সম্পর্কেও সৈয়দ মুরাদ আলী লিখেছেন-
"সৈয়দ সাহেব পায়েন্দা খান সম্পর্কে কুফরী ফতোয়া দিয়ে মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী ও মোজাহেদীনকে নিয়ে ছারবোলন্দখান, মদদখান ও পায়েন্দাখানের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৫০)।
সর্দার খাবিখানের উপর মোনাফেকীর ফতোয়া
সর্দার খাবিখান প্রথমে সৈয়দ সাহেবের ভক্ত ও পক্ষীয় ছিলেন। গোলাম রসুলের ভাষায়-
"খাবিখান সীমান্ত এলাকার একজন আত্মমর্যাদাশীল বীর পুরুষ সর্দার ছিলেন। সৈয়দ সাহেবের প্রতি একনিষ্ঠতার প্রতিযোগিতার সৌভাগ্য তিনি লাভ করেছিলেন- তাকে মেহমান বানিয়ে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং ওখানেই জেহাদের নেতৃত্বের বাইআত তাঁর হাতে করেছিলেন। (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৮৭)।
সৈয়দ সাহেবের ওহাবী আক্বিদা প্রকাশের ফলে এই খাবিখানই যখন তার বিরুদ্ধে চলে গেলেন- তখন তার বিরুদ্ধে ঐ গোলাম রসুল মেহের সাহেবই নিম্নোক্ত অপবাদ দিয়ে বসলেন-
"খাবিখানের স্বভাব ছিল জিদে ভরা এবং তিনি ছিলেন আত্মগরিমায় পূর্ণ। তিনি ইসলামী প্রথার উপর পাঠানী প্রথাকে প্রাধান্য দিতেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৭৮)।
যাই হোক– সৈয়দ সাহেবের ভক্ত মৌলানা জাফর থানেশ্বরী খাবিখান সম্পর্কে লিখেছেন-
"এই মুনাফিকও (খাবিখান) মুসলমানের গুলির আঘাতে খতম হয়ে গেলো। শাহ ইসমাঈল এই মুনাফিকের জানাযার নামায পড়াতে অস্বীকার করলেন। কিন্তু স্থানীয় মোল্লারা দুনিয়ার লালসায় পড়ে রাত্রির অন্ধকারে তার উপর জানাযার নামায পড়ে তাকে চুপিসারে দাফন করে দিল" (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ২৪৩)।
মন্তব্যঃ সর্দার পায়েন্দাখান ও সর্দার খাবিখানের মধ্যে তাদের মতে এই দোষ ছিল যে, তাঁরা সৈয়দ সাহেবের কাছে মুরিদ হননি বরং তার ওহাবী আক্বিদার কারণে তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। আর এই আক্বিদাগত বিরোধীতার কারণেই তাদের ভাগ্যে কাফের ও মুনাফিকের উপাধি জুটেছিল- ইসলামী প্রথার উপর আফগানী প্রথার প্রাধান্যের অপবাদ জুটেছিল। যেসব উলামারা হানাফী সুন্নী খাবিখানের জানাযার নামায পড়েছিলেন- তাদের ভাগ্যে জুটেছিল দুনিয়াদারীর লোভ লালসার অপবাদ।
দলে ভাঙ্গনঃ
তথাকথিত ইসলামী হুকুমাতের মধ্যে প্রথম দলীয় বিদ্রোহ
মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভী ছিলেন শাহ আব্দুল আজিজের শাগরিদ এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভীর খাস ভক্ত। সৈয়দ সাহেব হিন্দুস্থান থেকে সীমান্তে যাওয়ার পর মৌলভী মাহবুব আলী দিল্লীর মুসলমানদের মধ্যে জেহাদের প্রচার করতে থাকেন। যেসব লোক তিনি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন- তাদেরকে নিয়ে তিনি পাঞ্জেতারে (১৮২৯ খৃঃ) সৈয়দ সাহেবের খেদমতে উপস্থিত করে দেন। দিল্লী থেকে এখানে এসে তিনি দেখেন- জেহাদের যেই চিত্র সৈয়দ সাহেবের চিঠি পত্রের মাধ্যমে ফুটে উঠতো, তার কিছুই বাস্তবে নেই। মুজাহেদীনদের অবস্থাও ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক বলে মনে হলো না। তাই মৌলভী মাহবুব আলী সাহেব সৈয়দ সাহেবের খেদমতে নিম্ন লিখিত আপত্তি উত্থাপন করলেন -
১। আপনার আমিরুল মোমেনীন উপাধি ধারণ করা শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে দুরস্ত হয়নি।
২। আপনার নিজস্ব বাবুর্চিখানা পৃথক। আপনি মোজাহেদীন থেকে উত্তম খাদ্য খেয়ে থাকেন। অপরদিকে বেচারা মুজাহেদীনরা গমের চাক্কী পিষে ও ঘাস ছাছা-ছোলা করে- কিন্তু তাদের ভাগ্যে জুটে মাত্র পোয়া পরিমাণ খাদ্য।
৩। আপনি পোষাক পরিধান করেন উন্নত মানের এবং রুচিসম্মত, কিন্তু মোজাহেদীনরা তা পাচ্ছে না।
মৌলভী মাহবুব আলী সাহেবের অভিযোগের উত্তরে সৈয়দ সাহেব বলেন-
(১) "যদি আমার আমিরুল মোমেনীন হওয়া না দুরস্ত হয়- তাহলে আপনিই আমিরুল মোমেনীন হয়ে যান।"
(২) দ্বিতীয় অভিযোগের জবাব- সৈয়দ সাহেবের পক্ষে পরবর্তীকালে মাওলানা আবুল হাসান আলী (সম্প্রতি মৃত) দিয়েছেন এভাবে-
"সৈয়দ সাহেবের ওখানে নিয়ম ছিল- ঐ মুল্লুকের যে সমস্ত লোক তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতো- তারা নজরানা হিসাবে কেউ আনতো দুটি মোরগ, কেউ নিয়ে আসতো সের দু'সের মধু বা ঘি। কেউ চাউল, কেউ মুরগীর ডিম নিয়ে আসতো। কোন মেহমান অসময়ে এসে গেলে তিনি ঐ নজরানা হতে মুরগী, চাউল, ডিম ইত্যাদি- যা কিছু পেতেন- মেহমানদের জন্য রান্না করতেন, তাদেরকে খাওয়াতেন এবং নিজেও ঐ খানায় শরিক হতেন" (মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী কৃত সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৫৪)
(৩) তৃতীয় আপত্তির জবাব- সৈয়দ সাহেব দেননি। পরবর্তীকালে ১২৫ বৎসর পর (১৯৫৬ ইং) তাঁর পক্ষে মৌলভী গোলাম রসুল এ অভিযোগের উত্তরে লিখেছেন-
"উন্নত ও রুচিসম্মত পোশাকের অভিযোগটি একেবারে অযথা- কেননা, সবাই জানেন- সৈয়দ সাহেব পূর্বের রীতি অনুযায়ী মামুলী পোষাকই পরিধান করতেন" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৩৩)
মন্তব্যঃ মাওলানা নদভী সাহেব মুরগী, ডিম ও ঘি ইত্যাদি খাদ্যের মধ্যে অন্য মেহমানদের সাথে সৈয়দ সাহেবের শরিক হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। অবশ্য তা ছিল মেহমান নাওয়াজী। বুঝা গেল- মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভীর অভিযোগটি ভিত্তিহীন ছিল না। কেননা, মাহবুব আলী সাহেব ছিলেন স্পষ্টবাদী। তিনি যে জিনিসকে সত্য বলে মনে করতেন- বিনা বাধায় তা মুখে উচ্চারণ করে ফেলতেন। এজন্য প্রবল ধারণা- মৌলভী মাহবুব আলী সাহেবের অভিযোগ ছিল সত্য এবং অকন্ডনীয়। প্রকারান্তরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাওলানা নদভী সাহেবও তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন- তবে মেহমানদের সাথে।
তৃতীয় জবাবে গোলাম রসুল মেহের যে মিথ্যাচার করেছেন- তা স্পষ্ট। মৌলভী মাহবুব আলী একেবারে অন্ধ ছিলেন না। তাঁর চোখ ছিল দুটি। তিনি ঐ দু-চোখেই দেখতেন। তিনি তাঁবুতে সৈয়দ সাহেবের কাছেই থাকতেন। বরং বসবাসের তাঁবুও কাছাকাছিই ছিল। অপর পক্ষে গোলাম রসুল মেহের তার অনেক পরে এই সেদিন জন্ম গ্রহণ করেছেন। মেহের সাহেবের 'আমির পূজার' কাজটি সতর্কতার সাথে করা উচিৎ ছিল। তবুও আমরা মেহের সাহেবের 'অযথা' উক্তিটির অন্তঃসারশূন্য ব্যাখ্যার ব্যাপারে তার পূর্বসূরী মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীর কিছু উক্তি পাঠকদের খেদমতে বিবেচনার জন্য পেশ করছি। [তিনি তৃতীয় প্রশ্নের জবাব আমতা আমতা করে এভাবে লিখেছেন- অনুবাদক]।
নদভী সাহেব বলেন- "দ্বিতীয় অভিযোগটি (মূলে তৃতীয়) মৌলভী মাহবুব আলী এনেছেন সৈয়দ সাহেবের পোশাক আষাকের উপর। প্রকৃত অবস্থা হলো- এলাহাবাদের উজিরে আযম শেখ গোলাম আলী সাহেব সেলাই করা পোশাকের গাট্টিকে গাট্টি খাস করে সৈয়দ সাহেবের জন্য প্রেরণ করতেন। জুতা জোড়াও ওখান থেকে আসতো। তিনি নিজে তৈরি করতেন না। এভাবেই মুরিদানদের পক্ষ হতে হরেক রকমের খানা এবং শত শত নয়- বরং হাজার হাজার টাকা শুধু ওনার খরচ বহনের জন্যই আসতো। এই টাকা তিনি নিজের মর্জি মাফিক যেখানে মনে চাইতো- সেখানেই খরচ করতেন " (মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী কৃত সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ ২য় খন্ড পৃঃ ৫৫)।
মন্তব্যঃ এবার মাওলানা নদভী সাহেবের উপরোক্ত মন্তব্য দ্বারা বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সৈয়দ সাহেব উন্নত ও রুচিসম্মত পোশাকই পরিধান করতেন। (গোলাম রাসুলের কথা বাতিল প্রমাণিত হয়ে গেলো)। মাওলানা নদভী সাহেব শুধু ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, এগুলো তিনি নিজে তৈরি করতেন না- বরং এলাহাবাদের উজির গোলাম আলী সাহেব তার জন্য প্রেরণ করতেন- হাদিয়া স্বরূপ। প্রমাণিত হলো- মাহবুব আলী সাহেবের দাবি ছিল সত্য। মাওলানা আশরাফ আলী থানবী সাহেবের তাসদীক কৃত ও হাশিয়া সম্বলিত গ্রন্থ "আরওয়াহে ছালাছায়" সৈয়দ আহমদ বেরলভীর উক্তি এভাবে লেখা আছে- "আমি প্রতিদিন কাপড় চোপড় বদল করি"। (সূত্রঃ আরওয়াহে ছালাছা পৃঃ ১৪২)
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেব নিত্য নতুন পোশাক বদলের কথা নিজেই স্বীকার করেছেন- অথচ মেহের সাহেব বলছেন "এই অপবাদ অযথা, কেননা সবাই জানেন যে, সৈয়দ সাহেব পূর্বের ন্যায়ই মামুলি লেবাছ পরিধান করতেন "। বুঝা গেল মেহের সাহেবের দাবি মিথ্যা।
মেহের সাহেব এখন (১৯৮২ ইং) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। তা না হলে আমরা তাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতাম- মিথ্যাচার করা কি কোন মুসলমানের পক্ষে শোভা পায়?
মুজাহেদীনদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ
মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভী সৈয়দ আহমদ ছাড়াও মোজাহেদীনদের কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছেন- "তোমরা যা কিছু করছো- তা জেহাদ নয়। কাজেই তোমরা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাও।"
এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী মুজাহেদীনদের উদ্দেশ্যে মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভীর সতর্কবাণী এভাবে উল্লেখ করেছেন-
"তোমাদের উপর নিজ নিজ স্ত্রী, সন্তান ও পিতা-মাতার হক্ব রয়েছে। তোমরা এখানে কেন বসে আছ? মুজাহেদীনরা বললো- জেহাদ করার জন্য। মৌলভী মাহবুব আলী বললেন- জেহাদ কোথায়? কোন্ কাফেরের সাথে তোমরা মোকাবেলা করছো? কোন্ মুল্লুকে তোমাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমরা শুধু খানা পাকানো এবং রান্নাবাড়া করার চিন্তায় মশগুল আছো। জেহাদ বাহানা মাত্র। তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই বরবাদ" (মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী কৃত সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬৫)।
মন্তব্যঃ "জেহাদের শুধু বাহানা মাত্র, তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাতে উভয়ই বরবাদ"- এই উচ্চারণগুলো, ইসমাঈল দেহলভী ও সৈয়দ আহমদের প্রতিপক্ষ শাহ মাখছুছুল্লাহ দেহলভী বা শাহ মুহাম্মদ মুছার কোন মুরিদ বা শাগরিদের নয়- বরং স্বয়ং শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভীর সুযোগ্য শাগরিদ এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভীর একনিষ্ঠ ভক্ত মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভীরই উক্তি- যিনি বালাকোটের সমস্ত ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন।
[উল্লেখ্য যে, শাহ মাখছুছুল্লাহও শাহ মুহাম্মদ মুছা ছিলেন শাহ রফিউদ্দীন দেহলভীর ছেলে এবং ইসমাঈল দেহলভীর জেঠাতো ভাই। তাঁরা উভয়ে ১২৪০ হিজরীতে দিল্লীর জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত এক বিরাট বাহাছে ১৩ টি বিষয়ে ইসমাঈল দেহলভীকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন।" (ওহাবী মযহাব গ্রন্থে বিস্তারিত বিবরণ আছে- অনুবাদক।]
জেহাদ হতে পলায়নঃ
(মুজাহেদীন দুই ভাগে বিভক্ত)
মৌলভী মাহবুব আলীর কথার আছর মুজাহেদীনদের মধ্যে হতে লাগলো। পরস্পর তারা তর্ক বিতর্ক করতে লাগলো। ফলে মুজাহেদীন দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়লো। সৈয়দ সাহেব মৌলভী মাহবুব আলীকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মৌলভী মাহবুব আলী ছিলেন ইসলামী জ্ঞানে পরিপক্ক। এ জন্য সৈয়দ সাহেবের নসিহতপূর্ণ কথায় কোন কাজ হলো না। একদিন বুকে সাহস নিয়ে মৌলভী হাসান আলী রামপুরী সৈয়দ সাহেবের পক্ষে মৌলভী মাহবুব আলীর সাথে জেহাদের মাসায়ালা নিয়ে নিম্নোক্ত আলোচনা করলেন-
মৌলভী হাসান আলী রামপুরীঃ আচ্ছা! কোন্ দলীলের ভিত্তিতে এখানে গাজীদের অবস্থান করাকে আপনি অযথা বলছেন?
মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভীঃ আপনারা এখানে জেহাদের কি কাজ করছেন? কোন্ কাফেরদের বিরুদ্ধে আপনাদের এই জেহাদ?
মৌলভী হাসান আলীঃ শুধু যুদ্ধ করার নামই জেহাদ নয়। যুদ্ধ হলো মারামারি কাটাকাটি করা। এটা ঘটে মাঝে মধ্যে। জেহাদ অর্থ হলো- আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করা। এখানে (সীমান্তে) মুজাহেদীনরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। আপনি তাদের এ কাজকে অযথা বলছেন? যদি কোন দিন কাফেরদের বিরুদ্ধে মোকাবেলার সুযোগ এসে যায়- আর আপনি থাকেন দিল্লীতে- তাহলে কোন্ কারামাতের বলে আপনি এখানে পৌঁছবেন?
"মৌলভী হাসান আলীর একথা শুনে মৌলভী মাহবুব আলী লা-জওয়াব বনে গেলেন"
(সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৩৪)
মন্তব্যঃ মৌলভী হাসান আলী রামপুরীর এই সামান্য কথায়ই মৌলভী মাহবুব আলী লা-জওয়াব হয়ে গেলেন? না কি- গোলাম রসুল মেহের সাহেবের কলম তাকে লা-জওয়াব বানিয়ে ছাড়লো? তা বুঝা গেল না। যাই হোক- মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভীর পরাজয়ের বিষয়টি বুঝে না আসারই কথা। তার অভিযোগগুলোর বাস্তবতা প্রত্যক্ষ দর্শনের পরেই প্রমাণিত হয়েছে এবং এগুলোর ভিত্তিও ছিল বাস্তব ঘটনার উপর। তার প্রশ্নের জবাব যেমন সৈয়দ সাহেব দিতে পারেন নি- তেমনিভাবে তার সহযোগীরাও দিতে পারে নি। মৌলভী হাসান আলী রামপুরীর জেহাদের ব্যাখ্যাটি ব্যাপক অর্থে করে মোজাহেদীনদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলোকে এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া ও লুকানোর চেষ্টা করার বিষয়টি এমন কোন কঠিন প্রশ্ন ছিল না- যার জবাব মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভী দিতে অক্ষম ছিলেন। যেহেতু ঘটনাবলীর লেখকরা ছিলেন সৈয়দ সাহেবের পক্ষীয় ও জান কোরবান- এজন্যই সত্য ঘটনাগুলো চাপা পড়ে গেছে। তারা তাকে লা-জওয়াব বানিয়ে দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও ইঙ্গিত এবং আলামতে বুঝা যায় যে, তর্ক বিতর্কের পরেও মৌলভী হাসান আলী রামপুরী মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভীকে কোন উপযুক্ত উত্তর দিতে পারেন নি। এজন্যই মৌলভী মাহবুব আলী নিজ গ্রুপ নিয়ে সীমান্ত প্রদেশ থেকে দিল্লীতে চলে আসেন এবং আজীবন সৈয়দ সাহেবের এই তথাকথিত জেহাদের বিরোধীতা করতে থাকেন। তাঁর দিল্লী ফিরে আসার ঘটনাটিকেই সৈয়দ সাহেবের সংশ্লিষ্টরা "পলায়ন" নামে আখ্যায়িত করেছে। সাথে সাথে তারা এ ধারণা সৃষ্টি করতেও চেষ্টা করেছে যে, "শাহ ইসমাঈল দেহলভী হাজারা জেলা হতে ফিরে আসার পূর্বেই মৌলভী মাহবুব আলী সঙ্গীসাথী নিয়ে রাত্রের অন্ধকারে দিল্লীর উদ্দেশ্যে পলায়ন করেছেন- কেননা তিনি জেহাদের মাসয়ালার ব্যাপারে ইসমাঈল দেহলভীর সাথে বাহাছ করতে ভয় পেতেন"। আমরা শুধু এতটুকুই বলবো-
"চুঁ কলম দর দস্তে গাদ্দার বুয়াদ-
লা-জুরুম মনছুর বরদারে বুয়াদ।"
অর্থঃ "কলম যদি গাদ্দারের হাতে উঠে, তাহলে মানসুরও পাপিষ্টে পরিণত হয়ে যায়।"
সত্য কথা হলো এই- মৌলভী মাহবুব আলী ছিলেন একজন আলেম। তিনি দিল্লী থেকে সীমান্তে এসেছিলেন শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার নিয়মে। মোজাহেদীনদের বিরুদ্ধে তাঁর এই অভিযোগ ছিল না যে, তোমরা কেন যুদ্ধ করছো? বরং অভিযোগ ছিল- তোমরা জেহাদ করছো না কেন? শুধু বসে বসে সীমান্তবাসীদের বিরুদ্ধে আইন কানুন করছো? তোমাদের আমিরুল মোমেনীন আরাম আয়াশের শিকার হয়ে গেছে? কাফেরদের বিরুদ্ধে যখন যুদ্ধ করছো না- এই অবস্থায় এখানে বসে বসে দিন কাটানো অনর্থক। নিজ নিজ ঘরে তোমরা ফিরে যাও। এই ছিল তার অভিযোগ। মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভীর এই পরিস্কার কথাগুলোকে সৈয়দ সাহেবের কলমী ভক্তরা এমন ঘোলাটে করে ফেলেছে যে, মৌলভী সাহেবের ধর্মবিশ্বাসকেও তারা সন্দেহজনক করে তুলেছে- অথচ তিনি ছিলেন সৈয়দ সাহেবের হাম-আকিদা ও হাম- মাশরাবের লোক। মৌলভী মাহবুব আলীর এই স্পষ্টবাদিতা এবং তাঁর বিরোধী গ্রুপের গলদ প্রচারণার অসারতা চিহ্নিত করার অপরাধে সৈয়দ সাহেবের কলমী ভক্তরা তাঁকে অযথা সমালোচনার শিকারে পরিণত করেছে। যেমনঃ
১। মাওলানা জাফর থানেশ্বরী লিখেছেন- "মৌলভী মাহবুব আলী নফস ও শয়তানের প্রতিনিধিত্ব নিয়েছেন। নফসে আম্মারা ও শয়তান তার দিলকে শক্ত করে দিয়েছে। দিল্লীর পোলাও কোর্মায় হাত বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি হিন্দুস্থানে ফিরে গেছেন- ইত্যাদি" (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ২৩৬)
২। জনাব গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন- "মৌলভী মাহবুব আলী টং মেজাজের বুযর্গ ছিলেন, মনে হয় শাহজাহানবাদের (দিল্লীর) ঠাণ্ডা পোলাও (পানিভাত) তাঁর স্মরণে পড়ে গিয়েছিল" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৩৪)
৩। মির্জা হায়রাত দেহলভী লিখেছেন- "তিনি ছিলেন অহংকারী ও অল্প বুদ্ধির লোক, স্বজনপ্রীতি ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির লোক, মুসলমান জাতিকে ধ্বংসকারী- ইত্যাদি।
মন্তব্যঃ মৌলভী মাহবুব আলীর অভিযোগের দ্বারা সৈয়দ আহমদের ইসলামী হুকুমাতের স্বরূপ উদঘাটিত হয়ে উদঘাটিত হয়ে গিয়েছিল। সৈয়দ সাহেব ও মোজাহেদীনদের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল বাদশাহ ও প্রজার সম্পর্ক- একথাও জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। জানা কথা- এই প্রকৃতির হুকুমাতের সাথে ঐ দিনের সত্যিকারের ইসলামী হুকুমাতের কি সম্পর্ক থাকতে পারে- যার ভিত্তি রচনা করেছিলেন স্বয়ং নবী করিম সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা মুনাওয়ারায় এবং যার আমিরুল মোমেনীন ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীন (রাঃ)?
(আসল কথা হলো- সৈয়দ সাহেবের দলেই বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল তার দূর্নীতির কারণে। তাই একটি দল মৌলভী মাহবুব আলী দেহলভীর নেতৃত্বে তাকে ত্যাগ করে দিল্লীতে ফিরে আসে। এরাও কিন্তু সুন্নী ছিল না- অনুবাদক।)
সৈয়দ সাহেবের আক্বিদা ফাঁসঃ
(বিরোধীতার প্রথম কারণ)
সীমান্ত প্রদেশবাসী মুসলমানগণ সৈয়দ সাহেবের আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলেন না। এমন কি- সৈয়দ সাহেবের বিশেষ আক্বিদা সম্পর্কেও তারা প্রথমে জ্ঞাত ছিলেন না। তাঁরা সৈয়দ সাহেবকে নিজেদের মতই হানাফী সুন্নী মুসলমান বলে ধারণা করেছিলেন। এই কারণেই শুরুতে তারা সৈয়দ সাহেবকে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিলেন এবং জান- মাল কোরবানী করতেও তারা দ্বিধা বোধ করেন নি। কিন্তু সৈয়দ সাহেব ও তার সঙ্গীরা- সীমান্তবাসী মুসলমানদের এই ত্যাগ তিতীক্ষার দ্বারা ভূল সিদ্ধান্ত করেছিল যে, বোধহয় তারা আমাদের একই আক্বিদাপন্থী এবং একই খেয়ালের লোক হয়ে গেছে। যখনই সৈয়দ সাহেব ও তার সঙ্গীদের বিশেষ আক্বিদার প্রচার ও কার্যকলাপ শুরু হয়ে গেলো- তখনই এক এক করে সীমান্ত মুসলমানরা তাদের থেকে সরে যেতে লাগলো। সৈয়দ সাহেব অন্যান্য ওহাবী মোজাহেদীন থেকে কিছুটা মোসলেহাত পছন্দ ছিলেন- তাই তিনি তাৎক্ষণিকভাবে আক্বিদাগত বিরোধ কাঁধে নিতে চাইলেন না। কিন্তু শাহ ইসমাঈল ও তার অনুসারীরা সময়ের চাহিদা পিছনে ফেলে দিয়ে বিশেষ আক্বিদাকে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উপরেও প্রাধান্য দিতে লাগলো। ফলে পরবর্তীকালে জেহাদের গতি শিখদের পরিবর্তে মুসলমানদের দিকে ফিরে গেলো। ফল হলো এই- উভয় পক্ষেরই বেশুমার প্রাণ নষ্ট হলো। (উল্লেখযোগ্য যে, সৈয়দ সাহেবের দলে শিয়া, সুন্নী ও আহলে হাদীসের লোক অন্তর্ভূক্ত ছিল - অনুবাদক) সৈয়দ সাহেব যে হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং তাদের ভাষ্যমতে যেটা ছিল ইসলামী হুকুমাত - ঐ হুকুমাতের বিরোধীতার মূল কারণই ছিল আক্বিদাগত ঝগড়া বিবাদ ও মতপার্থক্য। (কিন্তু সব দোষ চাপানো হয়েছে সুন্নী পাঠানদের উপর- অনুবাদক।)
সোয়াতের পীর সাহেবের ফতোয়া
হযরত মাওলানা শেখ আব্দুল গফুর আখুন্দ (সোয়াত) ছিলেন দুররানী সর্দারদের পীর। শুরুতে তিনিও সৈয়দ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু মুজাহেদীনদের ওহাবীয়ানা কার্যক্রম দেখে তিনি তাদের প্রতি রুষ্ট হন এবং ওহাবী মুজাহেদীনদের বিরুদ্ধে গোমরাহীর ফতোয়া জারী করেন। তাঁর সমর্থক উলামাদের মধ্যে মাওলানা মিয়া নাসিরুদ্দীন আহমদ ওরফে কিসসাখানী মোল্লা, হযরত মাওলানা হাফেজ দারাজ পেশোয়ারী- শারেহে বুখারী এবং মোল্লা আযীম আখুন্দজাদা- প্রমুখ উলামা ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। ঐ সমস্ত নামী-দামী উলামাদের ফতোয়ার পাশাপাশি হিন্দুস্তান থেকেও একটি ফতোয়া পৌঁছে গেলো। ঐ ফতোয়াটি পেশোয়ারের ধনাঢ্য ব্যক্তি সুলতান মুহাম্মদ খানের নিকট সংরক্ষিত ছিল। এই ফতোয়া সম্পর্কে জনাব গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
দিল্লীর ফতোয়া
"এক সাক্ষাৎকারের সময় সুলতান মুহাম্মদ খান একটি ফতোয়া বা স্মারকলিপি পেটরা থেকে বের করে সৈয়দ সাহেবের খেদমতে পেশ করলেন। এতে অনেক মোহরাঙ্কিত স্বাক্ষর ছিল। স্মারকলিপিতে সম্বোধন করা হয়েছিল ছিমনার খান সর্দারগণকে।
ফতোয়া বা স্মারক নামার বিষয় ছিল এরূপ-
"সৈয়দ আহমদ কিছু আলেমকে নিজের দলে ভিড়িয়ে কিছু সংখ্যক লোকের একটি দল নিয়ে আফগানিস্তান গিয়েছে। তারা জাহেরীভাবে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার দাবি করছে। কিন্তু এটা তাদের প্রতারণা। এরা তোমাদের ও আমাদের আকায়েদের দুশমন। এরা একটি নতুন ধর্ম বের করেছে। কোন ওলী বুযুর্গকে এরা মানে না- সবাইকে খারাপ বলে। ইংরেজরা তোমাদের মুল্লুকের অবস্থা যাচাই করার জন্য এদেরকে গুপ্তচর বানিয়ে পাঠিয়েছে। তাদের কথায় তোমরা পড়বে না অসম্ভব নয় যে, তোমাদের মুল্লুক এরা ছিনিয়ে নিবে। যেভাবেই হোক- এদেরকে শেষ করে দাও। এ ব্যাপারে যদি গাফলতি করো অথবা বিলম্ব করো- তাহলে পস্তাতে হবে এবং লজ্জা ছাড়া আর কিছুই পাবে না" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬৫৯)।
মন্তব্যঃ জনাব মেহের সাহেব হিন্দুস্তানী ফতোয়ার উপর মোহরাঙ্কিত স্বাক্ষরের কথা তো উল্লেখ করেছেন- কিন্তু কার কার দস্তখত ছিল- তা গোপন করে গেছেন। ফতোয়ার পটভূমিকা জানার জন্য তাদের নামোল্লেখ প্রয়োজন ছিল। তা না করে তিনি বললেন- "ইহা পাঞ্জাবের রনজিৎ সিং- এর কারসাজি হতে পারে। এই বলে তিনি ফতোয়ার গতি পরিবর্তন করার এবং সত্য গোপন করার চেষ্টা করেছেন- তার গ্রন্থে। কিন্তু মেহের সাহেবের অন্য একটি লেখায় পরিস্ফুট হচ্ছে যে, এই ফতোয়াটি হিন্দুস্থান (দিল্লী) থেকেই এসেছে- পাঞ্জাব থেকে নয়। যখন সীমান্তের মুসলমানেরা সৈয়দ সাহেবের সিপাহীদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করতে আরম্ভ করলো- তখন সৈয়দ সাহেব কতিপয় লোককে এর কারণ জানার জন্য প্রেরণ করলেন। সীমান্ত সুন্নী মুসলমানরা যে কারণ বলেছেন- গোলাম রসুল মেহের সাহেব তা নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করেছেন-
"আমাদের কাছে সুলতান মুহাম্মদ (পেশোয়ার)- এর পত্র এসেছিল যে, হিন্দুস্তানের উলামাগণ হিন্দুস্থানী গাজীদেরকে বদ আক্বিদার লোক এবং ইংরেজদের গুপ্তচর বলে সাব্যস্ত করেছেন। উক্ত ফতোয়ায় আরোও বলা হয়েছে- এরা তোমাদের মুল্লুক ছিনিয়ে ইংরেজদের হাতে তুলে দেবে এবং দ্বীন ও মাযহাবকেও এরা খারাপ করে ফেলবে" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৯০০)।
মন্তব্যঃ আমার (শাহ হোসেইন গার্দেজী) ধারণায় এই ফতোয়া দিল্লীর শাহ ওয়ালিউল্লাহর খান্দানের লোকদের তরফ থেকে এসেছিল। কারণ ঐ সময় ১৮৩১ খৃঃ) শাহ রফিউদ্দীনের দুই ছেলে- শাহ মাখছুছুল্লাহ দেহলভী (মৃত্যু ১৮৬৫ খৃঃ), শাহ মুহাম্মদ মুছা (মৃত্যু ১৮৪৩ খৃঃ) এবং মাওলানা রশিদ উদ্দীন খান দেহলভী (মৃত্যু ১৮৪৩)- তারা তিন জনই জীবিত ছিলেন। তাঁরা ১২৪০ হিজরী ২৯ শে রবিউস সানী মোতাবেক ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত এক বাহাসে ইসমাঈল দেহলভী ও তার ভগ্নিপতি মাওলানা আব্দুল হাই বুড্ডানভীকে তাদের ওহাবী আকায়েদের কারণে চরমভাবে পরাস্ত করেছিলেন। হিন্দুস্তানী (দিল্লী) ফতোয়ায় যেসব তথ্য দেয়া হয়েছিল- সে সম্পর্কে দিল্লীবাসীরাই বিশুদ্ধভাবে অবগত ছিলেন। রনজিত সিং-এর অধীনস্থ পাঞ্জাবের কোন উলামা সৈয়দ সাহেবের বদ আক্বিদার বিষয়ে তখন পর্যন্ত বিস্তারিত ও বিশদভাবে কিছুই অবগত ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে থানেশ্বরী বলেন- "আমার হিন্দুস্থান অবস্থান কাল পর্যন্ত (১৮৬৫ খৃঃ) গোটা পাঞ্জাবে দশজন ওহাবী মুসলমানও ছিল না" (তাওয়ারিখে আজিবা পৃঃ ১৮৪)।
[সুতরাং তখনকার পাঞ্জাবের সুন্নী উলামারা সৈয়দ সাহেবের আক্বিদা সম্পর্কে অবগত থাকার কথা নয় এবং তাদের ফতোয়াও ওটা হতে পারে না - অনুবাদক।]
মন্তব্যঃ ১৮৩১ খৃঃ বালাকোটের হত্যাযজ্ঞের ৩৫ বৎসর পরে মাওলানা থানেশ্বরী বোম্বাই হয়ে আন্দামানে দিপান্তরে যান। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের অপরাধে তাঁকে ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে আন্দামানে ১৮ বৎসরের জন্য নির্বাসন দেয়া হয়। ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে সৈয়দ ভক্ত মাওলানা থানেশ্বরী বোম্বাই হয়ে আন্দামানে রওয়ানা হন। অর্থাৎ হিন্দুস্থানী ফতোয়া প্রকাশিত হওয়ার ৩৫ বৎসর পর তিনি নির্বাসিত হন। সেই সময়েই (১৮৬৫ খৃঃ) যদি সারা পাঞ্জাবে মাত্র ১০ জন ওহাবী পাওয়া যায়- তাহলে এর ৩৫ বৎসর পূর্বে (১৮৩১ ইং) ফতোয়া জারীর সময় সম্ভবতঃ একজন ওহাবীর অস্তিত্বও থাকার কথা নয়। পাঞ্জাবে শুধু সুন্নীই ছিল। সুতরাং "এই ফতোয়া রনজিত সিং- এর কারসাজি হতে পারে" - গোলাম রসুল মেহেরের এই মন্তব্য সত্যের অপলাপ বলেই মনে হয়। [কেননা, তখন পর্যন্ত পাঞ্জাবের সুন্নী উলামাগণ সৈয়দ আহমদের ওহাবী আক্বিদা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সুতরাং সৈয়দ আহমদের বিরুদ্ধে তাদের ফতোয়া দানের প্রশ্নই আসে না - অনুবাদক।]
তদুপরি- হিন্দুস্থানী ফতোয়ায় যেসব কথার উল্লেখ রয়েছে- তা আগাগোড়া বাস্তব ঘটনার সাথে হুবহু মিলে যায়। ওহাবী মতবাদ সম্পর্কে এত ওয়াকিফহাল হওয়া পাঞ্জাবী উলামাদের পক্ষে তখন পর্যন্ত সম্ভব ছিল না। দিল্লীর উলামাগণই এ বিষয়ে পূর্ণ ওয়াকিফহাল ছিলেন। বিশেষতঃ দিল্লীর সুন্নী উলামাদের মধ্যে মাওলানা রশিদ উদ্দীন খান দেহলভী, মাওলানা মুছা দেহলভী, মাওলানা মাখছুছুল্লাহ, মাওলানা কারিমুল্লাহ ও মাওলানা মুহাম্মদ শরীফ ছিলেন অন্যতম।
[এরাই ১২৪০ হিজরী মোতাবেক ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত এক বাহাছে ইসমাঈল দেহলভীকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে ছিলেন। সুতরাং ইসমাঈল দেহলভী ও তার সঙ্গীদের আক্বিদা সম্পর্কে উনারাই বেশি জ্ঞাত ছিলেন। কাজেই ফতোয়াটি রনজিত সিং-এর কারসাজি নয়- বরং দিল্লীর উলামাদের পক্ষ হতেই সীমান্তে গিয়েছিল বলে আমার প্রবল ধারণা। মেহের সাহেব ইচ্ছা করেই সূত্র গোপন করেছেন- কারণ দিল্লীর ফতোয়ার গুরুত্ব ছিল তখনকার দিনে অপরিসীম- অনুবাদক।]
সীমান্তের সুলতান মুহাম্মদ খানের কাছে প্রেরিত হিন্দুস্থানী ফতোয়াটি পাঠ করার পর সৈয়দ সাহেব ঐসব উলামাদেরকে গোমরাহ বলেন নি- যাদের মোহরাঙ্কিত দস্তখত ছিল ঐ ফতোয়ায়। কেননা, দস্তখত এমন লোকদের ছিল- যাদেরকে সৈয়দ সাহেব বিজ্ঞ আলেম বলে জানতেন এবং মানতেন। তা না হলে- তিনি ফতোয়াদাতাদের সমালোচনা অবশ্যই করতেন। ঐ ফতোয়া কাউকে না দেখানোর তাকিদ করার মধ্যেও এ কথার ইঙ্গিত ছিল যে, মোজাহেদীনদের মধ্যে যেহেতু সুন্নী হানাফী আক্বায়েদের লোকও কিছু রয়েছে- সুতরাং ফতোয়া প্রকাশ হলে তারা সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য দাঙ্গা- হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে পারেন।
কাকতালীয় মুজাহিদ বাহিনী
মতভেদের কারণ
মোজাহেদীনদের মধ্যে আক্বিদাগত মত পার্থক্যের কথা বর্ণনা করে- শেখ ইকরাম লিখেছেন-
"কোন কোন সরল ও পুরানা ধ্যান-ধারণা ব্যক্তিত্ববান লোকদের নিকট সৈয়দ সাহেবের কিছু সঙ্গীদের চালচলন ও আক্বিদা সম্পর্কে খটকা ও সন্দেহ ছিল। এর পরিণতি হলো এই- পেশোয়ারের পাঠান সর্দার ও উলামাগণ মিলে মোজাহেদীনদের বিরুদ্ধে ঐক্যজোট গঠন করে ফেললো। মোজাহেদীনগণকে ইসলাম থেকে খারিজ এবং তাদেরকে কতল করা ওয়াজিব বলে ফতোয়া দেয়া হলো" (শেখ ইকরাম কৃত মৌজে কাউছার পৃঃ ৩২)।
মন্তব্যঃ শেখ ইকরামের এই উদ্ধৃতির দ্বারা পরিস্কার হয়ে গেলো যে, "মুজাহিদ বাহিনীকে কতল করা ওয়াজিব"- পাঠান উলামাদের কর্তৃক এই ফতোয়া দেয়া হয়েছিল আক্বিদাগত পার্থক্যের কারণেই। এখন ইকরাম সাহেবের ভাষ্যমতে কিছু সরল ও পুরানা ধ্যান-ধারণার লোকদের নিকট মুজাহেদীনদের আকায়েদ সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হলো কি কারণে? কিছুতো একটা হবেই। তা না হলে "ওয়াজিবুল কতল" -এর মত এত কঠিন ফতোয়া দেয়া হলো কেন? কতল করার ফতোয়া হলো শেষ ব্যবস্থা। সীমান্তের অধিকাংশ উলামারাই সৈয়দ সাহেবের বিরোধী ছিলেন এবং এই বিরোধ ছিল আক্বিদাগত কারণে।
সীমান্ত উলামাদের আক্বিদায় মোজাহেদীনদের আপত্তিঃ
অপরদিকে সীমান্তের উলামায়ে ইসলামের আক্বিদা ও রীতিনীতি ওহাবী মুজাহেদীনদের নিকট অপছন্দনীয় ছিল। জনাব গোলাম রসুল মেহের বলেন-
"সামাজিক সকল কাজকর্মের রশি ছিল মোল্লাদের হাতে। মোল্লাদের আক্বিদা ও আমল ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৫৮)।
মন্তব্যঃ গোলাম রসুলের ভাষ্য মতে সীমান্ত এলাকার উলামাদের আক্বিদা ও আমল উভয়ই ছিল অত্যন্ত নাজুক এবং না-দোরস্ত। আকিদাগত না দোরস্তির কারণ হলো- তারা ছিলেন হানাফী সুন্নী এবং হানাফী ফিকাহর উপর কঠোর আমলকারী। আমলের ক্ষেত্রে অবনতির অভিযোগটি আমার (গার্দেজী) বুঝে আসে না। কারণ, বাস্তব অবস্থা হলো- পাকভারত উপমহাদেশের বর্তমান আলেম উলামাদের মধ্যে এখনও সীমান্ত এলাকার উলামাদের আমল অনেক ভাল এবং পূর্বে আরো ভাল ছিল। আমার মনে হয়- সীমান্ত উলামাদের হয়তো একটাই দোষ ছিল। আর সেটা এত বড় ছিল যে, তাদের সমস্ত নেক ও ভাল কাজ এতে বরবাদ হয়ে গেছে। সে দোষটি ছিল- তাঁরা সৈয়দ আহমদকে আমিরুল মোমেনীন বলে স্বীকার করেন নি। যদি তারা ওহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ সাহেবের নেতৃত্ব স্বীকার করে নিতেন- তাহলে তাঁদের মধ্যে সমস্ত নেক আমলই এসে যেতো- মেহের সাহেবদের মতে। কিন্তু ঐ সব উলামারা নিজেদের অবশ্য পালনীয় কাজই করেছেন। সেজন্যই ওহাবী মতবাদে দীক্ষিত লোকদের নিকট আজও তাঁরা "গাদ্দার" হিসাবে পরিগণিত হয়ে আছেন। ওহাবী মুজাহেদীনদের বিরোধীতায় সীমান্ত এলাকার সুন্নী উলামায়ে কেরামদের মধ্যমনি ছিলেন সোয়াতের পীর আল্লামা শেখ আব্দুল গফুর আখুন্দ। তিনিই ওহাবী মুজাহেদীনদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরী লিখেছেন-
"আখুন্দ সাহেব সোয়াত এলাকার বিখ্যাত পীর ও আলেম ছিলেন। তিনি প্রথমে (না বুঝে) সৈয়দ আহমদ বেরলভীর ভক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন সৈয়দ সাহেবের উপর ওহাবীয়তের অভিযোগ আনা হলো- তখন তিনি শুধু তাকে পরিত্যাগই করলেন না, বরং অন্যান্যদের দেখাদেখি সৈয়দ সাহেবের বিরোধীতায় শিখ ও পাঠানদের সাথেও তিনি মিলে গেলেন" (মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরী কৃত 'মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান' পৃঃ ৭৬)।
মন্তব্যঃ মোদ্দা কথা হলো- কাসুরী সাহেবের মতে সৈয়দ সাহেবের বিরোধীতায় আখুন্দ সাহেব পাঠান ও শিখদের সাথে ঐক্যজোট করে নিলেন। অথচ প্রথম দিকে তিনি ছিলেন সৈয়দ সাহেবের সাথে সংশ্লিষ্ট। মুহাম্মদ আলী কাসুরীর বর্ণনার সমর্থন পাওয়া যায় গোলাম রসুল মেহেরের নিম্নোক্ত ভাষ্যেও-
"আখুন্দ আব্দুল গফুর- যিনি পরবর্তী সময়ে সোয়াতের আখুন্দ সাহেব নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন- তিনি সে সময় হিন্ড-এর নিকটবর্তী বিকি এলাকায় সিন্দু নদীর কিনারায় এক গুহাতে থাকতেন। তিনি সেখানে চিল্লাকাশিতে একাধারে ১২ বৎসর কাটিয়ে দিয়েছিলেন। কোঠা নামক এলাকার মোল্লা সাহেবের সাথে আখুন্দ সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি সৈয়দ সাহেবের কাছেও আসা যাওয়া করতেন" (মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৮৬)।
মন্তব্যঃ প্রথম প্রথম সোয়াতের আখুন্দ সাহেব না বুঝে সৈয়দ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু যখন ওহাবীয়তের ঘটনা প্রকাশ হয়ে গেল, গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে গেলো- তখনই আখুন্দ সাহেব তার থেকে শুধু পৃথকই হলেন না- বরং বিরোধীতায় উঠে পড়ে লেগে গেলেন। তাঁর বিরোধীতার কারণে তাঁর মুরিদান উলামা, পাঠান খান এবং জনসাধারণও প্রকাশ্যভাবে সামনে এগিয়ে আসলেন। যেই মুসলমান শাসক খাবিখানের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেব প্রথম যুদ্ধ করেছিলেন- তিনিও আখুন্দ সাহেবেরই দিলসিলা ভূক্ত ছিলেন। মাওলানা আব্দুল হাকীম শরফ ক্বাদেরী লিখেছেন যে,
"শহীদ খাবিখান হযরত মাওলানা আব্দুল গফুর আখুন্দ সাহেবের মুখলিছ মুরিদ ছিলেন" (মাওলানা আব্দুল হাকিম শরফ ক্বাদেরী কৃত তাজকিরায়ে আকাবিরে আহলে সুন্নাত পৃঃ ২৪৮)।
জনাব গোলাম রসুল মেহের সাহেবও এ কথার স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন-
"দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও রিয়াজাতের কারণে আখুন্দ আব্দুল গফুরের সাথে খাবিখানের ভক্তির সম্পর্ক ছিল। সোয়াতের আখুন্দ সাহেব ঐ সময়ে বিকি নামক স্থানে অবস্থান করতেন এবং খাবিখানের সাথে ছিল তাঁর গভীর সম্পর্ক" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৮৬)।
মন্তব্যঃ এই কারণেই যখন পীর আব্দুল গফুর আখুন্দ সাহেব ওহাবী মতবাদের কার্যকলাপের দরুন সৈয়দ সাহেব ও তার সঙ্গী মোজাহেদীনদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগে গেলেন- তখন তাঁর মুরিদানরাও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন এবং ওহাবী মতবাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ও বল্লমের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। খাবিখান এই যুদ্ধে ওহাবী মুজাহেদীনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যান।
অনুরূপভাবে পেশোয়ারের সুলতান মুহাম্মদ খানও যখন মুজাহেদীনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন- তিনিও ওহাবী আক্বিদার সাথে মতভেদের কথা দুটি বাক্যে এভাবে বর্ণনা করেছেন- মুহাম্মদ খান বলেন-
"জেহাদের ধুয়া ছিল প্রতারণার কৌশল মাত্র। তোমাদের আক্বিদা হচ্ছে খারাপ এবং নিয়ত হচ্ছে বাতুল। জাহেরীভাবে তোমরা ফকির সেজে বসে আছ- কিন্তু তোমাদের অন্তরে আছে রাজ্য শাসনের লোভ। আমরা আল্লাহর নামে কোমর শক্ত করে বেঁধে নিলাম তোমাদেরকে কতল করার জন্য- যাতে এই জমিন তোমাদের অস্তিত্ব থেকে পাক পবিত্র হয়ে যায়" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬১৪)।
মন্তব্যঃ উপরোক্ত বর্ণনা সমূহ দ্বারা পরিস্কার বুঝা যায় যে, সীমান্তের মুসলমানেরা সৈয়দ সাহেব ও তার মুজাহিদ বাহিনীর বিরোধীতা করেছিল- তাদের ওহাবী মতবাদের কারণেই এবং পাঠানদেরকে কাফির ও মুশরিক আখ্যা দেয়ার কারণে। সীমান্তবাসীদের সাথে সৈয়দ সাহেবের যুদ্ধ ছিল আক্বিদাগত যুদ্ধ। সীমান্তের উলামা ও জনসাধারণ সৈয়দ সাহেব ও তার মুজাহিদ বাহিনীর ওহাবী কার্যক্রমের প্রতি বিরূপ ছিলেন। এই আগুনই শেষ পর্যন্ত মুজাহিদ বাহিনীকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"বে-খবর সরলপ্রাণ পাঠানদের ধর্মীয় রশি মোল্লাদের হাতে। মোল্লারা গোপনে গোপনে সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা শুরু করেছিল এবং পাঠান জনসাধারণকে ইসলামের নামে প্রকৃত ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে ছিল" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬৬৯)।
মন্তব্যঃ মেহের সাহেব অবশেষে স্বীকার করে নিলেন যে, সীমান্তের আলেমরাই সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধীতার অভিযোগ আনয়ন করেছিলেন এবং সরলপ্রাণ পাঠানদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু মোল্লাদের কথা বাদই দিলাম- সোয়াতের পীর আব্দুল গফুর আখুন্দ সাহেবের মত এমন আবেদ ও জাহেদ মানুষ সৈয়দ সাহেবের বিরোধীতা করেছিলেন কেন? তিনি কি ইসলামের উন্নতি চাইতেন না? ইসলামের নামেই তো তিনি প্রথমে সৈয়দ সাহেবের সহযোগিতায় নেমে এসেছিলেন। পরে সৈয়দ সাহেব ও তার মুজাহিদ বাহিনীর ওহাবী আক্বিদা দেখেই তো তাঁরা সরে গেলেন। এখন যদি গোলাম রসুল মেহেরের উপরের উক্তিটিকে উল্টিয়ে এভাবে বলা হয় যে- 'সৈয়দ সাহেবই মুজাহিদদেরকে ইসলামের নামে প্রকৃত ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন, তাদেরকে তিনি কাফের ও মুশরিক সাব্যস্থ করেছিলেন এবং যুদ্ধ লাগিয়ে উভয় পক্ষের হাজারো জীবনের রক্তের নদী প্রবাহিত করেছিলেন, তাহলে সমস্ত ওহাবীদের গায়েই আগুন লেগে যাবে।
লেখকদের এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেখে বড়ই দুঃখ হয়। তারা একজন আলেমে দ্বীন, আধ্যাত্মিক নিরাসক্ত সিদ্ধ পুরুষ এবং ইসলামের সেবককে প্রকৃত ইসলাম বিরোধী সাব্যস্ত করছেন- অপর দিকে (ওহাবী মুজাহিদদের দিকে) চোখ বন্ধ করে রাখছেন। এটা ইতিহাসের অনুসন্ধানীদের জন্য শোভা পায় না।
ওহাবী মুজাহেদীনদের চরিত্রের উদাহরণ দিতে গিয়ে মির্জা হায়রাত দেহলভী লিখেছেন-
"মামুলী বিষয়েও তাদের পক্ষ হতে কুফরী ফতোয়া হয়ে যাওয়া কোন ব্যাপারই ছিল না" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮১)।
মন্তব্যঃ মির্জা হায়রাত দেহলভী ছিলেন মুজাহেদীনদের আপন ঘরের লোকদের মত। মোজাহেদীন সম্পর্কে তার এই সাক্ষ্য অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। সুন্নীদের মামুলি ত্রুটির ক্ষেত্রেও মুজাহেদীনদের যখন এই অভ্যাস ছিল যে, তারা একবারেই সব তীর নিক্ষেপ করে দিতেন- তখন এর বিরুদ্ধে যদি বেচারা পাঠান সুন্নী মুসলমানরা কোন পাল্টা জবাব দিতে এগিয়ে আসেন- তাহলে তাদেরকে ইসলামের দুশমন উপাধি দেয়া কতটুকু দ্বীনদারীর কাজ হবে?
সৈয়দ সাহেবের কথিত ইসলামী হুকুমাতের একটি অবদানের কথা শুনুন। মুজাহিদীনরা সুন্নী হানাফী মুসলমানদের জীবন কত দূর্বিসহ করে তুলেছিল- তার একটি চিত্র শেখ ইকরাম সাহেব এভাবে অঙ্কন করেছেন-
"কোন এক ঘটনায় ওহাবী মুজাহেদীনদের নেতৃস্থানীয় এক কাজী সৈয়দ মুহাম্মদ হিব্বান- এর একটি ফতোয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল। কাজী সাহেব ফতোয়া দিয়েছিলেন- "যারা আল্লাহ রাসূলের বিরোধীতা করে বাপ দাদার প্রথা ও রসুমের উপর চলে- তারা কার্যতঃ কাফির "। কোন একজন প্রতিবাদ করে বললেন- 'মুনিয়াতুল মোসল্লী' নামক নির্ভরযোগ্য ফিকাহর কিতাবে লিখা আছে যে, "আহলে রসুমকে কাফের বলা যাবেনা।" তার এই কথার জবাবে মুজাহেদীনরা তাকে ঘুষি মারতে লাগলো। তাদের নেতা কাজী সাহেব এই প্রতিবাদকারীকে আটকিয়ে রেখে তাকে পুনরায় কালেমা পড়তে বাধ্য করে মুসলমান বানিয়ে পরে ছেড়ে দিলেন" (মৌজে কাউছার- শেখ ইকরাম পৃঃ ৩১)।
মন্তব্যঃ পূর্বেই বিভিন্ন হাওয়ালা দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে যে, সৈয়দ সাহেব ও তার সঙ্গী মোজাহেদীনরা শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিবর্তে মুসলমানদেরকে কাফের ও মুশরিক বানানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এর কুদরতি ফলাফল এই হয়েছিল যে, সীমান্তের উলামা, সর্দার ও জনসাধারণ ঐক্যবদ্ধভাবে সৈয়দ সাহেব ও তার মুজাহিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন। এটাকেই লেখকরা পাঠানদের গাদ্দারী বলে উল্লেখ করে থাকে।
কাজীদের কুকীর্তি
(বিরোধীতার দ্বিতীয় কারণ) মোজাহিদদের চরিত্র স্খলন
মুজাহিদ বাহিনীর সাথে সীমান্তবাসীদের বিরোধের দ্বিতীয় কারণ হলো- কাজীদের কুকীর্তি ও আপত্তিকর কার্যকলাপ। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে (সৈয়দ সাহেবের ভক্ত ও মুরিদানদের লেখনী হতে) অনেক প্রমাণ মউজুদ আছে। যারা এই মুজাহিদদের সাথে আক্বিদাগত বিরোধীতা পোষণ করতেন- সে সব সুন্নীদের কোন লেখাই আমাদের কাছে নেই। যদি থাকতো- তাহলে এই দিকটি আরোও পরিস্কার হয়ে যেতো। সৈয়দ সাহেবের ভক্ত জীবনীকারদের লেখায় তার দোষ ত্রুটিগুলোকে গোপন করা এবং প্রকৃত অবস্থা থেকে চোখ বুঝে থাকা সত্ত্বেও তাদের লেখনীতেই কিছু কিছু সত্য ঘটনাও লেখা হয়েছে। তাদের লেখনী হতেই আমরা এমন কিছু পেশ করবো- যাতে সত্য প্রকাশ পায় এবং বাতিল চিহ্নিত হয়ে যায়। সীমান্ত এলাকায় মুজাহিদীনদের কুকীর্তি সকলের কাছেই স্পষ্ট ছিল। তাই জনগণের মুখে মুখেই এগুলো আলোচিত হতো।
মুজাহিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে ওলামাদের নিম্নোক্ত অভিযোগ ছিল-
১। "মুজাহিদরা ছিল নফসপুজারী এবং জৈব লালসার অনুসন্ধানী।
২। তারা ছিল জালেম ও সীমা লঙ্ঘনকারী। শরীয়তসম্মত কোন কারণ ছাড়াই তারা মুসলমানদের জানমালের উপর হস্ত চালনা করতো।
৩। তারা আফগান ও পাঠান মেয়েদেরকে জোর করে হিন্দুস্তানি মুজাহিদদের হাতে তুলে দিতো" (মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ ৬৬০)।
উপরোক্ত তিনটি মারাত্মক অভিযোগ স্থানীয় উলামায়ে ইসলামের মুখে উচ্চারিত হয়েছে- যারা সাধারণতঃ অনেক যাচাই বাছাই ও চিন্তা ভাবনা করে কথা বলেন। প্রথম প্রথম এই উলামারাই সরল বিশ্বাসে মুজাহেদীনদের সমর্থন ও সাহায্য করেছিলেন। এজন্য তাদের কথাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ওজনদার বলে মনে হয়। এখন আমরা উলামাদের উপরোক্ত অভিযোগগুলোর সত্যাসত্য যাচাই করবো- সৈয়দ সাহেবেরই অনুসারী লেখকদের লেখার দ্বারা। তাহলে হাকিকত আরও খুলে যাবে।
প্রথমেই মির্জা হায়রাত দেহলভীর কথা ধরা যাক। তিনি ছিলেন সৈয়দ সাহেবের খাস ভক্ত। তিনি সৈয়দ সাহেব কর্তৃক নিযুক্ত কাজীদের এলেম ও আমল সম্পর্কে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছেন-
"প্রতিটি ছোট ছোট জিলা, কসবা ও গ্রামে গ্রামে এক একজন শাসক সৈয়দ সাহেব কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিল। ঐ বেচারারা শাসন করবে কি- শরীয়তের নামে উল্টা-সিধা নতুন নতুন আইন বেচারা গরীব কৃষকদের উপর জারী করতো। গরীব কৃষকরা এর বিরুদ্ধে টু শব্দ করতে পারতো না। খাওয়া দাওয়া, উঠা-বসা, বিবাহ শাদী- সব কিছুই তাদের জন্য হারাম হয়ে গিয়েছিল। না ছিল কোন পরিচালক, না ছিল কোন বিচারক" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮১)।
মির্জা হায়রাত দেহলভীর বর্ণিত এই চিত্র কি বলে? আর মেহের সাহেবের বর্ণনা কি বলে? মেহের সাহেব সীমান্ত ওলামায়ে ইসলামকে সমস্ত অনিষ্টের মূল বলে অভিযুক্ত করেছেন এবং সৈয়দ সাহেব কর্তৃক নিযুক্ত কাজী ও শাসকদের কুকীর্তিগুলোকে দৃষ্টির আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেছেন। একজন ঐতিহাসিকের এই নির্লজ্জ কর্মধারার যতই তিরস্কার করা হোক- তা খুবই নগণ্য। শুনুন! মেহের সাহেব সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধবাদী সীমান্ত উলামাদেরকে উলামায়ে "ছু" বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তাদের বিরোধিতার কারণ এভাবে চিত্রিত করেছেন-
(১) সীমান্ত উলামারা পূর্বে নিজেদের রুজী রোজগারের জন্য মুসলমানদের থেকে ওশর আদায় করতো- এখন সৈয়দ সাহেব আদায় করছেন। এতে তাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে।
(২) সীমান্ত প্রদেশে কোন মুসলমান মারা গেলে তার কাফফারা হানাফী মাযহাব মতে আদায় করে ওলামারা নিয়ে নিতে। এতে অনেক টাকা তারা পেতো। কিন্তু সৈয়দ সাহেব এসে তা বন্ধ করে দেন।
মন্তব্যঃ গোলাম মেহের সাহেব খুবই দুরদর্শী লোক। তিনি দেখলেন- সীমান্ত উলামাদের ওহাবী বিরোধীতা এমন একটি বিষয়- যা গোপন করে রাখা সম্ভব হবে না। তাই তিনি বিরোধীতার আসল বিষয়বস্তু তাদের 'জুলুম ও বাতিল আক্বিদা' হতে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে উলামাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত লাগার বিষয়টিকে সামনে তুলে ধরলেন এবং সৈয়দ সাহেবক সাধু সাজালেন। পরবর্তী প্রজন্মরা মনে করলো- সত্যিই তো। মেহের সাহেব একজন মুসলমান। মুসলমান কি মিথ্যা বলতে পারেন- না লিখতে পারেন? তাই তারা যা পেল, তাই গলাধঃকরণ করে নিলো। একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, মেহের সাহেব ওলামায়ে "ছু" বলে যাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন- তাদের মধ্যে রয়েছে- সোয়াতের বিখ্যাত পীর মাওলানা আব্দুল গফুর আখুন্দ সাহেব, হযরত খাজা শাহ সোলায়মান তিউনেশিয়া, হযরত মাওলানা নাসির আহমদ কিসসাখানী, মোল্লা আজীম আখুন্দ- প্রমূখ মনিষীবৃন্দ। তাদের তাকওয়া পরহেজগারী, পার্থিব অনাসক্তি, ইলম ও মারেফত ছিল সর্বজন স্বীকৃত। সুতরাং মেহের সাহেবের উপরোক্ত বানোয়াট এবং সত্যের অপলাপ মাত্র। যাই হোক- উনারা তো ওহাবী কর্তৃক অভিযুক্ত বুযুর্গ ব্যক্তি। এবার ওহাবীদের সমর্থিত আপনজনদের সাক্ষ্য লক্ষ্য করুন। তারা কি বলে- শুনুন এবং শেষে উভয় কথার মধ্যে সমন্বয় করার কষ্টটুকু স্বীকার করুন।
মির্জা হায়রাত দেহলভী সাহেব ওহাবী মৌলভী, কাজী ও শাসকদের সম্পর্কে বলেন-
"সারা পেশোয়ারে বিপদের ঘনঘটা শুরু হয়ে গেল। রাজ্যের শাসনভার মসজিদের এমন সব মোল্লাদের হাতে দেয়া হলো- যাদের সাথী সঙ্গীরা মসজিদে যাতায়াতকারী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এমন লোকদের হাতে এখন রাজ্যের শাসনভার ন্যস্ত করা হলো।" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮২)।
আরও শুনুন! শেখ ইকরাম ওহাবী শাসকদের গুণাবলী সম্পর্কে কি লিখেছেন-
"এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সৈয়দ সাহেবের কোন কোন সাথী সঙ্গীর আচরণ সমমর্মিতামূলক ও সমজদারমূলক ছিল না বরং তারা শীঘ্রই বিজয়ীর কঠোরতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল" (মৌজে কাউছার পৃঃ ৩১)।
এখন শুনুন বিজয়ের কঠোরতার কাহিনী। মির্জা হায়রাত দেহলভী তাদের অত্যাচার ও জুলুমের একটি চিত্র এভাবে তুলে ধরেছেন-
(মুজাহিদ বাহিনীর) কাজী মৌলভী মাযহাব আলী এই ঘোষণা দিলেন- পেশোয়ারে যত বিধবা মহিলা রয়েছে- "তিন দিনের মধ্যে তাদের দ্বিতীয় বিবাহ দেওয়া অত্যাবশ্যক। তা না হলে যে ঘরে কোন বিধবা মহিলা পাওয়া যাবে, সে ঘরকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হবে" (মির্জা হায়রাত দেহলভী কৃত হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮২)।
মন্তব্যঃ এই হলো ইকরাম সাহেবের বিজয়সূলভ জুলুমের বর্ণনার খানিক চিত্র - যা মির্জা হায়রাত দেহলভীর কলমে ফুটে উঠেছে। এই বিধবা সমস্যাটির সমাধান কি বুঝাপড়া ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে করা যেতো না? ন্যায় বিচারের কি এটাই নিয়ম যে, কোন বিধবা মহিলা দ্বিতীয় বিবাহে অনিচ্ছুক হলে তার ঘর জ্বালিয়ে দিতে হবে? কোরআন সুন্নাহর কোথাও কি এ ধরনের নির্দেশ আছে? এর পরিবর্তে যদি মুজাহিদরা এই ঘোষণা করতো যে, যারা নামায পড়বে না- তাদেরকে কঠোর সাজা দেয়া হবে- তা হলে তা সমর্থন করা যেতো।
আরাম আয়েশের পূজারী ও মহিলা লিপ্সুক ওহাবী মোজাহিদরা দ্বিতীয় বিবাহের আড়ালে কি খেলা খেলেছিলো- তার কিঞ্চিত বর্ণনা তাদের নিজেদের লোকের মুখেই শুনুন। মির্জা হায়রাত দেহলভী তার হায়াতে তৈয়্যেবায় উল্লেখ করেছেন-
"সৈয়দ সাহেব শত শত গাজীকে বিভিন্ন পদে নিযুক্ত করেছিলেন- যেন তারা মুহাম্মদী শরাহ মোতাবেক কাজ পরিচালনা করেন। কিন্তু তাদের বাড়াবাড়ি সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তারা কোন কোন সময় নওজোয়ান মহিলাদেরকে তাদের সাথে বিবাহ বসতে বাধ্য করতো। কোন কোন সময় এমনও দেখা গেছে যে, সাধারণভাবে দু-তিনজন কুমারী মেয়ে একসাথে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে- আর মুজাহেদীনদের মধ্যে কোন একজন গিয়ে তাদেরকে ধরে নিয়ে এসে মসজিদে গিয়ে বিবাহ পড়ায়ে নিল"। (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮০)।
মন্তব্যঃ নিশ্চয়ই এখন পাঠকগণ মৌলভী মাযহার আলী সাহেবের ঘোষণার তাৎপর্য বুঝতে পেরেছেন। বিধবা বিবাহের কি ইহাই শরীয়তী বিধান? তাদের কুকীর্তি আরও শুনুন এবং ওহাবী মুজাহিদীনদের উপর লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা পড়ুন। মির্জা হায়রাত দেহলভী হায়াতে তৈয়্যেবায় উল্লেখ করেছেন-
"কোন নওজোয়ান বিধবা মহিলা চান না যে, তার দ্বিতীয় বিবাহ হোক। কিন্তু মুজাহিদ সাহেব জোর দিয়ে বলছেন- না, দ্বিতীয় বিবাহ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত মা- বাপ বাধ্য হয়ে নিজেদের নওজোয়ান মেয়েকে মুজাহিদদের হাওয়ালা করে দিতেন। এছাড়া তাদের অন্য কোন উপায় ছিল না" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮১)।
মন্তব্যঃ স্মরণ রাখা দরকার - এরা সেই মুজাহিদ- যারা শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ভারত থেকে সীমান্ত প্রদেশে এসেছিলো। আর এখানে এসে তারা পাঠান মুসলমান মেয়েদেরকে জোর করে বিবাহ করে নাফসকে লালসার জেহাদের ট্রেনিং দিচ্ছে। [সৈয়দ বাহিনীর এই চারিদিক লালসাই তাদের বিরুদ্ধে পাঠান সুন্নী মুসলমানদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল- অনুবাদক]।
মুজাহিদদের মিথ্যাচারিতা
গোলাম রসুল মেহের সাহেব মুজাহিদদের মিথ্যাচারিতার বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন- "একবার মিনারা খোর্দ থেকে নির্দেশ আসলো- ওশরের জিনিস আদায় করুন। এলাকার রিসালদার সাহেব মোস্তাকিম খান ও সুলতান খানকে ওশর আদায় করতে পাঠিয়ে দিলেন। তারা ওশরের জিনিস গাড়িতে উঠালেন। নাশতা করে তারা রওনা দেবেন- এমন সময় কারোও কাছে চিনি চাইলেন। সে বললো- চিনি নেই, গুড় আছে- এখনই এনে দিচ্ছি। মোস্তাকিম খান ও সুলতান খানের প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠলো। অসন্তোষের সুরে তারা রিসালদারের কাছে গিয়ে গ্রামের লোকদের বিরুদ্ধে উল্টা সিধা অনেক কথা বললেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬০৩)।
দেখুনঃ এই ছিল সৈয়দ সাহেবের ওহাবী মুজাহিদদের আমলের অবস্থা। আর দোষ দিচ্ছে সীমান্ত উলামাদের উপর এই বলে যে, তাদের এলম ও আমল শুদ্ধ ছিল না, তারা দুনিয়াপূজারী ছিলেন- ইত্যাদি।
মুজাহিদদের অধিকাংশই ছিল খারাপ চরিত্রের লোক
ভারতীয় মুজাহিদরা কেমন লোক ছিল- সৈয়দ সাহেবের ভক্ত মির্জা হায়রাত দেহলভীর মুখেই শুনুন। তিনি বলেন-
"মুজাহিদদের মধ্যে সব ধরনের লোকই ছিল। মন্দ লোকও ছিল এবং ভাল লোকও ছিল বরং অনুমান করা হয়েছে যে, মন্দ লোকের সংখ্যাই ছিল বেশি এবং ভাল লোকের সংখ্যা ছিল কম" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮০)।
মন্তব্যঃ এই উক্তিটি মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদীর ভক্তের নয়-বরং সৈয়দ সাহেব ও ইসমাঈল দেহলভীর ভক্তের উক্তি। জনাব গোলাম রসুল মেহের এ ধরনের সমস্ত সত্য ঘটনাকে হজম করে গেছেন- যাতে মুজাহিদদের আচরণের অপর দিকটি (ভাল দিক) সামনে এসে যেতে পারে। এখন প্রশ্ন জাগে- সৈয়দ সাহেব মুজাহিদদের এ ধরনের জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন ও শরিয়ত বিরোধী কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত ছিলেন কিনা? এ প্রসঙ্গে শেখ ইকরাম লিখেছেন-
"কাজীদের ব্যাপারে স্থানীয় লোকেরা ছিল অসন্তুষ্ট। তাদের বিরুদ্ধে এ সমস্ত অভিযোগ সৈয়দ সাহেব পর্যন্ত পৌঁছতো। উদাহরণস্বরূপ- যখন তিনি ডাগেয়ী অঞ্চলে গিয়েছিলেন- তখন মৌলভী খায়রুদ্দীন শেরকুয়ী নিজে তাঁকে বললেন- যে গ্রামেই আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে- সেখানকার লোকদেরকেই কাজীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে দেখেছি। কাজীরা কোন কোন সময় সাধারণ অপরাধের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জরিমানা আদায় করে।" (শেখ ইকরাম - মৌজে কাউছার পৃঃ ৩২)।
গোলাম রসুল মেহেরও একথা স্বীকার করে লিখেছেন-
"সৈয়দ সাহেব যখন গড়হি আমানজনি থেকে ডাগেয়ী পৌঁছলেন- তখন মৌলভী খায়রুদ্দীন শেরকুয়ী আসলেন এবং আরজ করলেন- যে গ্রামে আমি গিয়েছি, সেখানকার লোকদেরকে অভিযোগকারী পেয়েছি। কাজীরা কাজীরা সাধারণ অপরাধে অধিক জরিমানা আদায় করে থাকে" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬৬৪)।
মন্তব্যঃ উপরোক্ত দুইটি মন্তব্যের দ্বারা একথা পরিস্কার হয়ে গেলো যে, সীমান্তের মুসলমানরা ওহাবী মোজাহেদীনের তথাকথিত ইসলামী হুকুমাতের ব্যাপারে খুবই বিরক্ত ছিল এবং তাদের অভিযোগ ছিল সত্য। কেননা, মৌলভী খায়রুদ্দীন শেরকুয়ী স্বয়ং কাজীদের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। সৈয়দ সাহেব নিজেও ওহাবী মুজাহেদীনের অপকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো- সৈয়দ সাহেব তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন- কিনা? নাকি- নিজের লোক বলে তাদেরকে ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখেছিলেন? এ প্রসঙ্গে মির্জা হায়রাত দেহলভীর মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হায়াতে তৈয়্যেবায় লিখেছেন-
"গজবের বিষয় ছিল এই যে, ঐ সমস্ত কাজী ও শাসকদের উপর এমন কোন কর্তৃপক্ষ ছিল না যে, জনসাধারণ তাদের অভিযোগ ও আপীল উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করবে। ঐ সব অপদার্থ লোকদের ফায়সালাকেই চুড়ান্ত বলে মনে করা হতো এবং জনগণও মেনে নিতে বাধ্য হতো। তাদের লিখিত রায় রদরহিতযোগ্য বা সংশোধনযোগ্য ছিল না" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮১)।
মন্তব্যঃ মির্জা সাহেব সৈয়দ সাহেবের প্রতি মহব্বতের জোশে কাজীদের অপকর্মের কারণে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার উপরোক্ত মন্তব্যেই বুঝা যাচ্ছে যে, কাজীরা ছিলো লাগামহীন উটের ন্যায়- তাদের কার্যক্রমের তদারকী করার মত কোন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষই ছিল না- কাজীদের সাজা দেয়া তো দূরের কথা। মির্জা হায়রাত দেহলভী আরও লিখেছেন-
"সৈয়দ সাহেবের কোন সাথীকে প্রকাশ্যে কখনও সাজা দেয়া হতো না- অথচ অধিকাংশ সময়েই তাদের দ্বারা অবৈধ কার্যকলাপ সংঘটিত হতো" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮০)।
মন্তব্যঃ বেচারা সীমান্তবাসীরা সৈয়দ সাহেবকে লক্ষ বার বুঝাবার চেষ্টা করেছে এবং দরখাস্তও করেছে- কিন্তু সৈয়দ সাহেব তাতে কর্ণপাত করেননি। বরং উল্টো সীমান্তবাসীকেই শাস্তি দেয়া হতো। মির্জা হায়রাত দেহলভীর ভাষায় শুনুন-
"সৈয়দ সাহেবের খেদমতে অভিযোগের দরখাস্তসমূহ পেশ করা হতো সত্য- কিন্তু এ সম্পর্কে কোন যোগ-জিজ্ঞাসা করা হতো না। তাঁর বিশ্বাস ছিল - শরিয়তের নির্দেশের পাবন্দী করতে যেহেতু সীমান্তবাসীরা অভ্যস্থ ছিল না এবং এখন তাদের পাবন্দী করতে হচ্ছে- কাজেই তারা আমাদের লোকদের উপর স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৮২)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেব সীমান্তের মুসলমানদের ক্ষতস্থানে ঔষধ না লাগিয়ে বরং কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছেন এবং উল্টা তাদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করেছেন। এই হলো সৈয়দ সাহেবের কথিত ইসলামী হুকুমাতের চিত্র এবং কাজীদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। বিবরণগুলোও সৈয়দ সাহেবের ভক্তদেরই লিখিত। সৈয়দ সাহেব ও তার ওহাবী মোজাহেদীনদের সাথে পাঠানদের বিরোধীতার কারণ ছিল- তাদের ওহাবী আক্বিদা এবং কাজীদের অত্যাচার ও অপকর্ম" পাঠকগণ এ বিষয়গুলো অবলোকন করেছেন। আমরা এর উপর কোন মন্তব্য করতে চাই না। কথা পরিষ্কার- কিন্তু সত্য কবুল করার নেক তৌফিক তো নেক বখতদেরই হয়ে থাকে।
সীমান্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু
সৈয়দ সাহেবের উপর আল্লাহর পক্ষ হতে ইলহাম হয়েছিল- শুধু শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য। (ইংরেজ বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়- অনুবাদক)। একথা আপনারা সংক্ষিপ্তভাবে ইতিপূর্বেও জেনেছেন। অথচ ১২৫ বৎসর পরে (১৯৫৬ ইং) এসে গোলাম রসুল মেহেরের উপর ইলহাম হলো- সৈয়দ সাহেব ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন- যদিও তা সংগঠিত হয় নি। কিন্তু বাস্তব ঘটনা বলছে-সৈয়দ সাহেব যুদ্ধ করেছেন সীমান্তের হানাফী সুন্নী মুসলমানদের বিরুদ্ধে। শিখদেরকে কাবু করতে না পেরে সৈয়দ সাহেব অবশেষে হানাফী সুন্নী পাঠান মুসলমানদের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। তাদের মধ্যে তার মতে ইসলামী শক্তি না দেখে তিনি বললেন-
"আসমানী সাহায্য অবতীর্ণ হওয়ার জন্য জেহাদ তখনই উপলক্ষ্য হতে পারে- যখন সব মুসলমান সত্যিকার অর্থে মুসলমান হয়ে যায়। তারা যা করবে- খোদার রেজামন্দির জন্যই করবে। এই অবস্থায় পৌঁছেই তারা ইমামের আনুগত্যের আসল হাক্বিকত বুঝতে সক্ষম হয়। এই অবস্থায় এসেই তারা বিদআত, নিষিদ্ধ কাজ এবং ইমামের বিরোধীতা থেকে পাক পবিত্র হয়ে আল্লাহ, আল্লাহর রাসুল এবং নেতার আনুগত্যের হক্ব আদায় করতে সক্ষম হয়। এই পর্যায়ে আসতে পারলেই কেবল কাজ কারবার ও জেহাদ- ইত্যাদি সঠিক ও সুন্দর হয়ে ইস্পিত ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হবে" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩৬০)।
মন্তব্যঃ উপরের কথার সারমর্ম হলো- সৈয়দ সাহেবের সীমান্ত প্রদেশে আগমনের পূর্বে তথাকার মুসলমানেরা "প্রকৃত মুসলমান" ছিল না। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা কিছুই করেনি, বরঞ্চ তারা ছিল বেদআতী ও গোমরাহ। যাই হোক- এগুলো হলো অভিযোগ। প্রকৃত কথা হলো- ইমামের আনুগত্য অর্থাৎ সৈয়দ সাহেবের আনুগত্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তাই তাদের ভাগ্যে জুটেছিল "তারা প্রকৃত মুসলমান নয়" "বিদ্আতী" ও "গোমরাহ" ইত্যাদি উপাধি। সীমান্তের সুন্নী হানাফী মুসলমানরা সব সময়ই তাদের পূর্বসূরীদের অনুসৃত ইসলামী মহাসড়কে পরিচালিত ছিল। তারা কিভাবে নতুন ওহাবী আক্বিদা গ্রহণ করতে পারে- এবং সৈয়দ সাহেবের তাবেদার কিভাবে হতে পারে? এজন্যই সৈয়দ সাহেবের পক্ষ হতে তাদের ভাগ্যে জুটেছিল কাফের, মুনাফিক ও বিদ্রোহী- মুরতাদ ইত্যাদি উপাধি।
সর্দার মীর আলম বাজুড়ীর নিকট লিখিত এক পত্রে সৈয়দ সাহেব পেশোয়ারবাসীকে মুনাফিক বলে এভাবে উল্লেখ করেছেন-
"মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ওয়াজিব। কেননা, মোকাদ্দামাতুল ওয়াজিবে ওয়াজিবুন" অর্থাৎ ওয়াজিব মূলক কাজের পূর্বপ্রস্তুতিও ওয়াজিব। ("শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পূর্বে মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাও ওয়াজিব") এই সূত্র অনুযায়ী পাঠানদের বিরুদ্ধে প্রথমে জেহাদ করা ওয়াজিব। এই জন্যই এই অধম (সৈয়দ আহমদ) প্রকৃত মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে পেশোয়ার শহর ও আশ পাশের বদকার মুনাফিকদের নাপাকী পাকপবিত্র করার দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে পাঞ্জেতার পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছি" (জাফর থানেশ্বরী সংকলিত মকতুবাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ১৩৫)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেবের পত্র ও সূত্র অনুযায়ী পেশোয়ার ও আশপাশের কথিত এই মুনাফিক ছিলেন ঐ সমস্ত বুযুর্গ মুসলমান- যারা সৈয়দ সাহেব ও তার ওহাবী আক্বিদার বিরোধী ছিলেন এবং যারা ছিলেন হযরত মাওলানা হাফেজ দারাজ পেশোয়ারী ও মোল্লা আজীম আখুন্দ জাদার মত ব্যক্তি ও তাদের ফতোয়ার অনুসারী।
পেশোয়ারী মুসলমানদের সম্পর্কে শাহ ইসমাঈল দেহলভীও একপত্রে লিখেছে-
"এখানে দুটি বিষয় বিবেচ্য"-
একঃ ফাসাদ সৃষ্টিকারী ও বিরুদ্ধবাদীদের মুরতাদ হয়ে যাওয়ার প্রমাণ করা, তাদেরকে হত্যা করার বৈধতার রাস্তা বের করা ও তাদের সম্পদকে গাজীদের জন্য জায়েজ বলে সাব্যস্ত করা। তাদের প্রকৃত বিদ্রোহী হওয়া ও মুরতাদ হয়ে যাওয়ার উপর এই সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল নয়। (বরং যে কোন উপায়ে এসব অভিযোগ দাঁড় করা)।
দুইঃ দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- এসব অভিযোগ দাঁড় করানোর পিছনে কোন উপযুক্ত কারণ আছে কিনা- নাকি অন্য কিছু। কেননা, কোন কোন ব্যক্তির কাছে এদের মুরতাদ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে এবং কোন কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিদ্রোহের আলামত বা অন্য কিছুও পাওয়া গিয়েছে। প্রথম পন্থাটি যদিও আমাদের বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করার বিষয়- তবুও আমরা এই ফাসাদ সৃষ্টিকারীদেরকে অন্যান্য আসমানী কিতাবধারী কাফেরদের মতই মনে করি" (জাফর থানেশ্বরী সংকলিত মকতুবাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৪১)।
মন্তব্যঃ ইসমাঈল দেহলভী যাদেরকে প্রকৃত মুরতাদ ও কাফের বললেন- তারা কে? এরা হচ্ছেন সীমান্ত প্রদেশের বেচারা হানাফী সুন্নী মুসলমান গোষ্ঠী। তারা সৈয়দ সাহেবের ওহাবী আক্বিদা গ্রহণ করে তাঁর তাবেদার হননি বলেই মুরতাদ ও কাফেরের তমগা পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন।
সৈয়দ সাহেব সুন্নী হানাফী মুসলমানদেরকে এত ভয় পেতেন যে, তিনি দূর দূরান্তের পাঠান সর্দারগণকে উপদেশ দিতেন যে, এই কলেমাগো মুনাফিকদেরকে প্রথমে উচ্ছেদ করে দাও। তিনি কালাতের আমিরকে লিখলেন-
"উত্তম কাজ হবে- সর্ব প্রথমেই মুনাফিকদের শিকড় উপড়িয়ে ফেলার চুড়ান্ত প্রচেষ্টা করা। যখন জনাবে ওয়ালার (আপনার) আশপাশের এলাকায় এই বদকার মুনাফিকদের অস্তিত্ব খতম হয়ে যাবে- তখন আপনি ধীরে সুস্থে ও এতমিনানের সাথে আসল উদ্দেশ্যের দিকে মনোযোগী হতে পারবেন। সুতরাং এই সময়ের দাবী হচ্ছে- এই মুনাফিকদের ফেতনা ফ্যাসাদ খতম করার জন্য আপনি চুড়ান্ত চেষ্টা করবেন" (মকতুবাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৭)।
মন্তব্যঃ অর্থাৎ- শিখদের চেয়েও বেশি খতরনাক দুশমন হচ্ছে সুন্নী হানাফী মুসলমানগণ। প্রথমে এদেরকে খতম করতে হবে। পরে শিখদের প্রতি মনোযোগ দেয়া যাবে। ভ্রাতৃ হত্যার নাপাক উদাহরণ এর চাইতে অধিক আর কি হতে পারে? জাফর থানেশ্বরী কর্তৃক সংকলিত সৈয়দ সাহেবের চিঠি পত্রের এবারত আর একটু শুনুন-
"যেহেতু মুনাফিক, গাদ্দার ও ফাসাদ সৃষ্টিকারীরা বিদ্রোহী কাফেরদের (শিখ) সাহায্য করার জন্য কোমর নেমেছে এবং আমার মুজাহিদ বাহিনীর সাথে বিরোধীতা করছে- এজন্য তাদের কানমলা দেয়া এবং এদের কুফরীও ফ্যাসাদের বিরুদ্ধে জেহাদ অভিযান পরিচালনা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। এজন্য আমি সমস্ত মুনাফিককে কিফুরদার (স্থানের নাম) পর্যন্ত হাঁকিয়ে নিয়ে যেতে মুজাহেদীনকে উৎসাহিত করেছি। এরপর এই অধম নিজের সত্যিকার একনিষ্ঠ মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে কুফর ও অবাধ্যতা নিপাত করতে লাহোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। কেননা, আমার মূল লক্ষ্য হলো পাঞ্জাবের শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা" (মকতুবাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৫৬ ও ৫৭)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেব প্রথমে মুসলমান মুনাফিকদের খতম করতে চান- পরে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ভাল কথা- সৈয়দ সাহেবের এই আন্দোলনের সাথে রাসূলের আদর্শের সম্পর্ক আছে কি? বেচারা সীমান্ত মুসলমানগণ সৈয়দ সাহেবের ওয়াহাবিয়ানা স্বভাবের কারণে তার আমিরগীরী গ্রহণ করেন নি। তার তো উচিৎ ছিল- প্রথমে নিজের ঈমানের চিকিৎসা করা। তা না করে তিনি উল্টা সীমান্তের মুসলমানদেরকেই রোগী মনে করে বসলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর ব্যবস্থাপত্র দিলেন- কতল করার। শেষ পর্যন্ত সীমান্তের মুসলমানরাও সৈয়দ সাহেবের রোগ নির্ণয় করে ব্যবস্থাপত্র দিলেন- তাকে হত্যা করার।
মনে রাখা দরকার, সৈয়দ সাহেবের প্রতি ইলহাম হয়েছিল- শুধু শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য। সম্ভবতঃ তিনি মুসলমানদেরকেই শিখ মনে করে বসেছিলেন এবং শিখদের চেয়ে বেশি যুদ্ধ করেছিলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধেই। জানিনা- এতে খোদায়ী ইলহামের অবমাননা করা হয়েছিল কিনা। কিন্তু এতে সৈয়দ সাহেবের আত্মার শান্তি তো হয়েছিল- অবশ্যই।
সীমান্তবাসীদের বিরুদ্ধে প্রথাগত ইসলামের অপবাদ
সৈয়দ সাহেব সীমান্তবাসী মুসলমানদের আক্বিদা বিশ্বাসের মুসলমানদের আক্বিদা বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। তাদের কোন কার্যকলাপই সৈয়দ সাহেবের পছন্দনীয় ছিল না। এ প্রসঙ্গে জনাব গোলাম রসুল লিখেছেন-
"এখানে এসে প্রায় দু'বৎসর পর্যন্ত এক এক গোত্র ও সমাজের লোকদের আচার আচরণ ও রেওয়াজ দেখার পর সৈয়দ সাহেব বুঝতে পারলেন যে, তাদের ইসলাম হচ্ছে প্রথাগত ইসলাম"। আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মেহের সাহেব নিজের মতামত প্রকাশ করে বললেন "সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া সীমান্তবাসীরা নিশ্চিতরূপে নাম সর্বম্ব মুসলমান ছিলো। আমলের ক্ষেত্রে তাদের পূরা জিন্দেগীই ছিলো জাহেলিয়াতের অপবিত্রতায় পরিপূর্ণ" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৫৮)।
পর্যালোচনাঃ সৈয়দ সাহেবের দুই বৎসরের পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল ছিল এই যে, সীমান্তবাসী মুসলমানদের ইসলাম ছিল প্রথাগত। কিন্তু জনাব মেহের সাহেবের পর্যবেক্ষণ এই ছিল যে, তারা নামে মাত্র মুসলমান এবং তাদের জিন্দেগী ছিল জাহেলিয়াতের অপবিত্রতা দ্বারা পরিপূর্ণ। অথচ সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানরা সমগ্র উপমহাদেশের অন্যান্য মুসলমানদের চেয়ে আজও এক ধাপ উন্নত ধর্মীয় পজিশনের অধিকারী। ইসলামের প্রতি তাদের প্রবল অনুরাগ ও জীবন উৎসর্গের প্রেরণার কারণেই আজ তিন বৎসর পর্যন্ত (১৯৭৯-১৯৮২ ইং) রাশিয়ার মত পরাশক্তিও তাদের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে (আফগান যুদ্ধে)। সৈয়দ সাহেব বেচারা তো রাশিয়ার তুলনায় খড় কুটাও ছিলেন না। তিনি শুধু আক্বিদাগত পার্থক্যের কারণেই তাদেরকে প্রথাগত মুসলমান বলে অপবাদ দিচ্ছেন। এই সীমান্ত মুসলমানরাই শিখদেরকে পরাস্ত করার পর ইংরেজদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। আজও (নব্বই এর দশকে) তারা ধর্মীয় কারণেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। আল্লাহর শুকরিয়া- তারা তখনও উত্তম মুসলমান ছিলেন এবং আজও আছেন। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের মতে উচ্চ স্তরের? তৎকালীন তথাকথিত ইসলাম ওয়ালারাই ছিলো ইংরেজদের তল্পী বাহক। ইংরেজদের ক্ষমতাকে প্রসারিত ও দীর্ঘাস্থায়ী করার ক্ষেত্রে ছিল তাদের বিশেষ অবদান।
প্রথাগত তাওহীদী কালেমা
সীমান্তের পাঞ্জেতারের শাসক ফতেহ্ খান এমন এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন- যিনি সৈয়দ সাহেবের পতনোন্মুখ অবস্থায় তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং ফতেহ্ খানের রাজধানী পাঞ্জেতারে বসেই সৈয়দ সাহেব আমিরুল মোমেনীন- ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। এমন একনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত পাখতুন মোসলমান নেতা ও তার স্বগোত্রীয়দেরকে সৈয়দ সাহেব চার বৎসর বন্ধুত্বের পর বলেছিলেন-
"আপনার কালেমা তাওহীদ পাঠ করেন শুধু অভ্যাসও প্রথাগত কারণে" (মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৭০২)।
মন্তব্যঃ এই ফতোয়াটি কেন জারী করা হলো? এ কারণে যে, সৈয়দ সাহেবের অত্যাচারী শাসন ও মুসলিম হত্যার হুকুমতকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে ফতেহ খান শেষ পর্যন্ত অপারগ হয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় সীমান্ত মুসলমানদের প্রতি সৈয়দ সাহেবের ঘৃণা নাজুক রূপ ধারণ করেছিল। সৈয়দ সাহেব তার ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ করে ঘোষণা করেছিলেন-
"এ সমস্ত লোকদের প্রতি আমার এমন ঘৃণা জম্মেছে- যেমন ঘৃণা জম্মে কারও নিজের বমির প্রতি। তাদের দেশে অবস্থান করার প্রতিও আমি বমির মতই ঘৃণা বোধ করছি" (সৈয়দ আহমদ শহীদ ৭০১)।
মন্তব্যঃ এক মুসলমানের প্রতি আর এক মুসলমানের বমি সদৃশ ঘৃণা করা ইসলামী মূলনীতি ও মেজাজের পরিপন্থী কাজ। সৈয়দ সাহেবের উক্ত ঘোষণাটি হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক ও বিরোধী। [একে একে সমস্ত পাঠান সর্দার ও পাঠান মুসলমান সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। তখন তার এই আক্ষেপ- অনুবাদক]।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে ১০টি যুদ্ধ
সীমান্ত মুসলমানদের প্রতি সৈয়দ সাহেব ও তার দলের দৃষ্টিভঙ্গির এক স্তুপ থেকে শুধু কয়েকটি উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে। উপরন্তু সৈয়দ সাহেব তাদেরকে কাফির মুনাফিক অভিধায় আখ্যায়িত করেছিলেন। এর পূর্বে শাহ ইসমাঈল দিল্লীবাসীদেরকেও ইসলামত্যাগী বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিল (১৮২৫ খৃঃ)। (এ কারণে ১২৪০হিজরী- মোতাবেক ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর জামে মসজিদে তার চাচাতো ভাই শাহ মাখসূসুল্লাহ ও শাহ মুছার সাথে বিরাট বাহাছ হয়েছিল- এতে ইসমাঈল দেহলভী পরাস্ত হয়ে পলায়ন করেছিল। ওহাবী মাযহাব গ্রন্থটি দেখুন- অনুবাদক)।
সৈয়দ সাহেব সীমান্ত মুসলমানদেরকে শিখদের চেয়েও বেশি খতরনাক ও ভয়ঙ্কর বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে ১০টি যুদ্ধ করেছিলেন। যথাঃ-
(১) উসমান জাঈদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (২) হিন্ড প্রথম যুদ্ধ (৩) জিদা যুদ্ধ (৪) হিন্ড ২য় যুদ্ধ (৫) কানিরড়ী যুদ্ধ (৬) খিলাবাট যুদ্ধ (৭) মরদান যুদ্ধ (৮) মাইয়ারের যুদ্ধ (৯) ছুতরবাঈ যুদ্ধ (১০) ফুলুড়া যুদ্ধ।
এসব এলাকার মুসলমানরা সৈয়দ সাহেবের মতে কলেমাগো, কাফির ও মুনাফিক ছিলেন। এজন্যই তাদের বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধ হয়েছিলো। এই ১০ টি যুদ্ধে মুসলমান ও ইসলামী শক্তি খুবই দূর্বল হয়ে পড়েছিল। অপর দিকে এই যুদ্ধসমূহ ইংরেজ আধিপত্যকে শক্তিশালী হতে বা শক্তিশালী করতে সুযোগ করে দিয়েছিল। দুঃখ হয়- সে সব কলেমাগো মুসলমানদের জন্য- যারা বলে থাকেন যে, "সৈয়দ সাহেবের আন্দোলনের মাধ্যমেই ইসলাম ও মুসলমানরা শক্তিশালী হয়েছিল, ইসলামের দ্বিতীয় জাগরণ হয়েছিল এবং এই জাগরণের ফলেই পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল"। যেই সৈয়দ সাহেব ও তার সাথীরা মুসলমানকে কাফিরে পরিণত করেছে, তাদেরকে হত্যা করেছে এবং ইংরেজ আধিপত্যের ক্ষেত্র সমতলভাবে তৈরি করেছে- সেই সৈয়দ সাহেবকেই আজ ইসলামী পূণর্জাগরণের পতাকাবাহী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে? অদূরদর্শী ও অপরিপক্ক প্রত্যেক লেখকই সমস্ত ইসলামী আন্দোলনের রাখী বন্ধন "সৈয়দ সাহেবদের মুসলিম হত্যার তরবারি ধারণকারীদের হাতে বাধার চিন্তায় মশগুল আছেন বলে মনে হয়। কিন্তু যারা সত্যদর্শী চোখের অধিকারী- তারা সকলেই মুসলিম হত্যাকারী উক্ত আন্দোলনের উত্থান ও পতনের সম্পর্কে সম্যক অবহিত রয়েছেন।
জনাব গোলাম রসুল মেহের উসমান জাঈ যুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের যুদ্ধ পারদর্শিতা প্রসঙ্গে লিখেছেন-
"সৈয়দ সাহেব নিজে কামান টেনে এক উঁচু জায়গায় নিয়ে আসেন এবং কামান ফিট করে মির্জা হোসেইন বেগকে এই নির্দেশ দেন- গোলা নিক্ষেপ করো। প্রথম গোলাতেই দুশো শত্রু উড়ে গেলো" (গোলাম রসুল মেহেরের সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৫৩)।
মন্তব্যঃ এক গোলার আঘাতেই দুশো মুসলমানকে খতমকারী সৈয়দ সাহেব কি ইসলামের সেবক হতে পারেন?
জিদা যুদ্ধের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে গোলাম রসুল লিখেছেন-
"এই অভিযানে ইয়ার মুহাম্মদ খানের তিনশত অনুসারী নিহত হয়" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৫২৭)।
মাইয়ার যুদ্ধ প্রসঙ্গে মেহের সাহেব আরও লিখেছেন-
"গাজী মুজাহিদদের সর্বমোট আটাইশটি লাশ পাওয়া যায়। তাদেরকে দুটি কবরে দাফন করা হয়। অপর দিকে দুররানী পাঠানদের পক্ষে লাশ পড়েছিল আশিটি। এদের দাফনের ব্যবস্থা হয়েছিল স্থানীয় লোকদের দ্বারা" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬২৬)।
মন্তব্যঃ এই হচ্ছেন হচ্ছেন মুসলিম হত্যাকারী সৈয়দ আহমদ সাহেব- যাকে পাক ভারত উপমহাদেশের ইসলামী আন্দোলনের নায়ক বলা হয়ে থাকে এবং যিনি শত শত মুসলমানদের রক্ত পান করে "আদমখোর" হয়েছিলেন। [সীমান্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে ১০টি যুদ্ধের বিবরণ ইতিহাসে দেখুন-অনুবাদক।]
যুদ্ধরত মুসলমানদের মালকে গনিমতের মাল গণ্য করা
সৈয়দ সাহেব স্বঘোষিত আমিরুল মোমেনীন হয়ে পাঠান মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অর্জিত বা লুন্ঠিত সম্পদকে "গনিমতের মাল" বলে গণ্য করতেন এবং তা ঘোষণায়ও প্রকাশ করতেন। গোলাম রসুল মেহের নিজেও তার গ্রন্থের একাধিক স্থানে এই পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। যেমন-
"মাওলানা ইসমাঈল দেহলভী গনিমতের মাল একত্রিত করলেন"- "গনিমতের মালের মধ্যে ইয়ার মুহাম্মদ খানের কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও পাওয়া গিয়েছিল"- "যখন গনিমতের সব মাল পাঞ্জেতার পৌঁছে গেলো"- ইত্যাদি (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ যথাক্রমে ৫২৭, ৫২৯ ও ৫৩০)।
মন্তব্যঃ উক্ত গ্রন্থের তিন পৃষ্ঠায় এই পরিভাষা ব্যবহারের দ্বারা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে, সৈয়দ সাহেব সীমান্তের মুসলমানগণকে কাফের মনে করতেন। তা না হলে তিনি "গনিমতের মাল" -এই পরিভাষা ব্যবহার করতেন না। (কেননা, যুদ্ধক্ষেত্রে কাফেরদের পরিত্যক্ত মালকেই গনিমতের মাল বলা হয়- অনুবাদক)।
মুসলমানদের পরাজয়ের সংবাদে
দু'রাকআত শোকরানার নামায আদায়
সৈয়দ সাহেব শিখদের পরাজয়ে এত খুশি হতেন না- যেরূপ খুশী হতেন মুসলমানদের পরাজয়ে। কারণ, আকুড়ার যুদ্ধে শিখদেরকে পরাজিত করার পর তিনি শোকরানা নামায আদায় করেন নি এবং অপর চারটি যুদ্ধেও এরূপ করেন নি।
কিন্তু জিদা যুদ্ধে যখন সীমান্তের মুসলমানদের পরাজয়ের সংবাদ সৈয়দ সাহেবের কাছে পৌঁছলো- "তখন তিনি দু'রাকআত শোকরানার নামায আদায় করলেন"। এ প্রসঙ্গে গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"পাঞ্জেতার পৌঁছেই সৈয়দ সাহেব জিদা যুদ্ধ জয়ের শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে গিয়ে দু'রাকআত শোকরানা নামায আদায় করলেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৫৩)।
মন্তব্যঃ নিশ্চয়ই সৈয়দ সাহেব জিদা যুদ্ধে পাঠানদের পরাজয়ে এবং নিজের বিজয়ে আনন্দিত হয়েছিলেন। তা না হলে তিনি এরূপ করতেন না। স্মরণ রাখা দরকার- তিনি ঐ সৈয়দ সাহেব- যাকে আল্লাহর পক্ষ হতে শুধু শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার ইলহাম হয়েছিল। এখন যখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি তাদেরকে পরাস্ত করলেন, তখনই শুকরিয়ার নামায আদায় করলেন। মনে হয়- সৈয়দ সাহেবকে আমিরুল মোমেনীন উপাধি দানকারীদের অনুসন্ধানী চক্ষু বিলকুল অন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং তারা সৈয়দ সাহেবের সব কাজকেই প্রেমাস্পদের কাজ সাব্যস্ত করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতেন।
পাল্টা আঘাত
সৈয়দ সাহেব ও তার মুজাহিদ বাহিনী যখন সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোললেন, তাদের জীবন বিপন্ন করে তোললেন, তাদেরকে মুনাফিক ও কাফের ঘোষণা করলেন- তখন তারা সৈয়দ সাহেবের রাত্রিকালীন গুপ্ত অভিযান পরিচালনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মুজাহেদীনদের উপর রাত্রিকালীন হামলা পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো এবং এতে তারা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করলো। অগণিত মুজাহিদীন নিহত হলো। এখন সৈয়দ সাহেবের ইসলামের কথা স্মরণ হলো। তিনি বিচলিত হয়ে উচ্চারণ করলেন-
"সুলতান মুহাম্মদ খানের (পেশোয়ার) প্রতি আফসোস হয়। তিনি নিজে সব কিছু আমাকে খুলে বললেন এবং ওজর পেশ করে বললেন যে, ভুল হয়ে গেছে, "আমাকে ক্ষমা করে দিন"। এরপর (মোজাহেদীনদের বিরুদ্ধে) সেই পুরানা মিথ্যা অপবাদকেই (নারী ঘটিত) পূঁজি করে সুলতান মুহাম্মদ খান শত শত মুসলমানের রক্ত অবৈধভাবে ধরালো।" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৭০০)।
[উল্লেখ্য, সুলতান মুহাম্মদ খান পূর্বে এক যুদ্ধে সৈয়দ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিল। ভুল স্বীকার করায় তাকে পুনরায় পেশোয়ারের শাসনভার দেয়া হয়েছিল। তিনি মুজাহিদ বাহিনীর শতশত লোককে নারী কেলেঙ্কারির কারণে হত্যা করেন- অনুবাদক।]
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেব যেভাবে নিজের লোকদেরকে মুসলমান বলেছেন- সেভাবে যদি সীমান্তের পাঠানদেরকেও মুসলমান মনে করতেন, তাহলে কতই না ভাল হতো। তাদেরকে যদি তিনি অবৈধভাবে খুন না করতেন, তাহলে আজ এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতনা। কিন্তু সৈয়দ সাহেব এক গোলার আঘাতে দু'শ লোককে উড়িয়ে দিয়ে আনন্দ অনুভব করছেন, তাদের মাল সম্পদকে গনিমতের মাল মনে করছেন, তাদের মৃত দেহের নামাযে জানাযা পড়াকে তিনি হারাম মনে করছেন। শত হলেও তারা তো মুসলমানই ছিলেন। এখন যখন নিজের লোক মারা পড়লো- তখনই তিনি বলে উঠলেন- অবৈধ রক্তপাত। তিনি একথাও বলেছেন-
"সুলতান মুহাম্মদ খানের সৈন্যরা গাজীদের লাশের সাথে এমন সব আচরণ করেছে যা- কোন কাফেরের পক্ষ হতেও আশা করা যায় না"। (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৭০২)।
পর্যালোচনাঃ সৈয়দ সাহেব তো নিজেই সীমান্ত মুসলমানকে কলেমাগো কাফির, মুনাফিক- কাফির, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি বানিয়ে ছেড়েছেন এবং কাফেরের মতই তাদের সাথে ব্যবহার করেছেন। এখন তাদের পাল্টা জবাবী কার্যক্রমে তিনি কেন মনক্ষুণ্ণ হয়ে গেলেন? জনাব গোলাম রসুল মেহের সাহেবও একজন গবেষক হয়ে অনুরূপভাবেই মনক্ষুণ্ণ হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহান 'শাহাদাতগাহে কারবালা' শব্দও এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বিগত দিনগুলোতে যখন সীমান্ত মুসলমানদের রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছিল, যখন তাদের বিধবা স্ত্রীদেরকে জোর জবরদস্তি বিবাহ করা হচ্ছিল, তাদের মাল সম্পদ যখন লুটে নেয়া হচ্ছিল, কারো কানের দুল পর্যন্ত ছিল না- তখন তো তাঁর কারবালার কথা স্মরণ হয়নি। বরং তারা সকলেই তখন খুশি হয়েছিলেন যে, হাঁ, ইসলাম জারী হয়েছে এবং হচ্ছে। আর এখন- যখন সীমান্তবাসীরা রাত্রিকালীন আক্রমণ চালাতে শুরু করলো- তখনই অবৈধ হয়ে গেলো, সীমান্তের জমীন কারবালা ও মহান শাহাদাতগাহে পরিণত হয়ে গেলো? সীমান্তবাসীদের এ ধরনের কার্যক্রম অবশ্যই আপত্তিকর ছিল। কিন্তু এর সূচনাকারী তো সৈয়দ সাহেবই ছিলেন। তিনিই তো দশটি যুদ্ধে অবৈধভাবে অগণিত মুসলমানের রক্ত ঝরিয়ে ছিলেন। যে অপরাধ সৈয়দ সাহেবের- সে একই অপরাধ সীমান্তবাসীদেরও হয়েছে। এ অবস্থায় সৈয়দ সাহেব খুশী হওয়া সত্ত্বেও কি করে ইসলাম ও মুসলমানের হিতাকাঙ্গী হলেন- আর সীমান্তবাসীরা হয়ে গেলো ইসলামের দুশমন? (ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হবেই- এতে মনক্ষুণ্ণ হওয়ার কি আছে?- অনুবাদক)।
শিখ-মুসলিম ঐক্যজোট গঠন ও তার কারণ
সীমান্তের মুসলমানগণ এবং পাঞ্জাবের শিখ জাতি ছিল পরস্পর চির শত্রু। দীর্ঘদিন ধরে তারা পরস্পরের রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করছিল। সীমান্তের পায়েন্দাখান সব সময় শিখদের রক্ত ঝরাচ্ছিলেন। শিখরা তার ভয়ে ছিল ভীত ও সন্ত্রস্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও সৈয়দ সাহেব ও মুজাহিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে শিখদের সাথে ঐক্যজোট গঠন করেছিলেন। অন্যান্য পাঠান সর্দাররাও প্রথম প্রথম সৈয়দ সাহেবের পক্ষে থাকলেও শেষের দিকে তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগে যায় এবং এক পর্যায়ে তার দলকে খতম করার জন্য চিরদিনের শত্রু শিখদের সাথে আঁতাত ও ঐক্যজোট করতে বাধ্য হন। এর পিছনে নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে। সেগুলো কি? পূর্বে এসব কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে একটি ছিল- সীমান্তবাসীদের উপর মুজাহিদ বাহিনীর জুলুমও অত্যাচার। দ্বিতীয় কারণ ছিল- ওহাবী সুন্নী দ্বন্দ্ব- তথা ধর্মীয় বিভেদ। "সীমান্ত পাঠানদের জানের শত্রু ছিল শিখ- কিন্তু ঈমানের শত্রু ছিল সৈয়দ সাহেবের মুজাহিদ বাহিনী।" পাঠানদের নিকট জানের চেয়ে ঈমানের মূল্য ছিল অনেক বেশি। তাই তারা ঈমান রক্ষার্থে ঈমানের শত্রুকে খতম করার জন্য প্রানের শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে ছিল।
[এ প্রসঙ্গে বালাকোট যুদ্ধের সমসাময়িক ও সৈয়দ সাহেবের সমর্থক আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদের অভিমত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাঁর অভিমতটি প্রথমেই পেশ করা হল। এতে ক্রমিক সামান্য ভঙ্গ করেছে - অনুবাদক।]
স্যার সৈয়দ আহমদ দেহলভীর অভিমত
মুহাম্মদ ইসমাঈল পানিপথী কৃত মালাকাতে স্যার সৈয়দ ৯ম খন্ড পৃঃ ১৩৯-তে সুন্নী ওহাবী দ্বন্দ্বের কারণে সীমান্ত পাঠানরা প্রানের শত্রু শিখদের সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল- বলে স্যার সৈয়দ উল্লেখ করেছেন। তার উর্দু এবারতের অনুবাদ নিম্নে দেওয়া হল।
"ভারতের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত সীমান্ত প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে যেসব উপজাতি বাস করতো, তারা ছিল হানাফী ও সুন্নী মুসলমান। তারা ছিল সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও ইসমাঈল দেহলভীর আক্বিদার ঘোর বিরোধী। এই কারণে এই ওহাবীরা পাহাড়ি পাঠান সুন্নীদেরকে একথার উপর কখনো রাজী করাতে পারেনি যে, "তারা যেন মুজাহিদদের আক্বিদার বিষয়গুলোকে ভাল বলে মনে করে"। পাঠান সুন্নী মুসলমানরা পাঞ্জাবের শিখ শাসকদের জুলুম ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। শুধু এই কারণেই তারা ওহাবীদের শিখ বিরোধী আক্রমণ পরিকল্পনায় প্রথমে শরিক হয়েছিল। কিন্তু পাঠানরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে খুবই কঠোর ছিল। এই ধর্মীয় ও আক্বিদাগত বিরোধের কারণেই পাঠানরা শেষ পর্যন্ত ওহাবীদের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করে শিখদের সাথে ঐক্যজোট করতে বাধ্য হয়েছিল। মৌলভী মুহাম্মদ ইসমাঈল দেহলভী সাহেব ও সৈয়দ সাহেবকে তারা শহীদ করে ফেলে" (মাক্বালাতে স্যার সৈয়দ ৯ম খন্ড পৃঃ ১৩৯ ও ১৪০)।
মন্তব্যঃ স্যার সৈয়্যদের স্বীকৃতি মতে সৈয়দ আহমদ বেরলভী, ইসমাঈল দেহলভী ও তার সঙ্গীরা আক্বিদায় ছিল ওহাবী, আর পাঠানরা ছিল সুন্নী হানাফী। এই বিরোধের কারণেই পাঠানরা শেষ পর্যন্ত ঈমানী শত্রু থেকে বাঁচার জন্য জানের শত্রুর সাথে হাত মিলাতে বাধ্য হয়েছিল- অনুবাদক।
ঐক্যের কারণ ও ফুলুড়ার যুদ্ধ
(পায়েন্দাখান ও হরিসিং-এর চুক্তি)
সীমান্তের মুসলমান এবং শিখ জাতি দীর্ঘকাল থেকে পরস্পরের রক্ত প্রবাহিত করে আসছিল। সর্দার পায়েন্দাখান ছিলেন বীর পুরুষ এবং ভয়ঙ্কর প্রভাবশালী সর্দার। তিনি সব সময় শিখদেরকে নাস্তানাবুদ করে রাখতেন। পায়েন্দাখানের তনুল এলাকার প্রতি শ্যান দৃষ্টি নিক্ষেপ করার সাহস শিখরা কখনই করতে পারে নি। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুরাদ আলী (আলীগড়ি) উল্লেখ করেছেন-
"শিখ এলাকা মাঁশহারা ও সিনকারী প্রভৃতি অঞ্চলের উপর সর্দার পায়েন্দাখান কয়েকবার আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন। শিখদের প্রচুর সৈন্যসামন্ত থাকা সত্ত্বেও রাত্রিকালীন উক্ত অভিযানে পায়েন্দাখানের বিরুদ্ধে কেউই মোকাবেলা করতে হিম্মত করেনি। পায়েন্দাখানের নাম শুনলেই শিখ রাজা-প্রজা সকলেরই হৃদ কম্পন শুরু হয়ে যেত। আল্লাহ্ তায়ালা পায়েন্দাখানকে এতই ভয়ঙ্কর প্রভাব দান করেছিলেন।"
(সৈয়দ মুরাদ আলী আলীগড়ি কৃত তারিখে তানাওলিয়া পৃঃ ৪৮)।
জনাব গোলাম রসুল মেহেরও পায়েন্দাখানের বাহাদুরীর প্রশংসা করে লিখেছেন-
"খান সাহেব উচ্চসাহসী এবং সুবিবেচক শাসক ছিলেন। তাঁর বীরত্ব, বাহাদুরী ও দৃঢ়তার বড় প্রমাণ এর চেয়ে বেশি আর কি হতে পারে যে, যখন সমস্ত পাঠান সর্দাররা শিখদের বিরুদ্ধে দমে গিয়েছিল- তখনও পায়েন্দাখান শত সহস্র বিপদ ও পেরেশানী সত্ত্বেও শিখদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন"। (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ শহীদ পৃঃ ৫৪১)।
এমন একজন পাঠান সর্দারের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেব যখন কুফরী ফতোয়া দিয়ে বসলেন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাকে যুদ্ধে পরাজিত করলেন- তখনই পায়েন্দাখান পুরাতন শত্রু শিখদের সাথে ঐক্য করতে বাধ্য হলেন।
শিখ- পাঠান ঐক্যের ধরণ সম্পর্কে সৈয়দ মুরাদ আলী লিখেছেন-
"সর্দার পায়েন্দাখান শিখ নেতা সর্দার হরিসিংহকে নিম্নোক্ত পত্র লিখেন- "খলিফা সৈয়দ আহমদ আমার রাজ্য ছিনিয়ে নিয়েছে। আপনি আমার বাহিনীর সাহায্যার্থে সৈন্য প্রেরণ করুন। আমি চিরদিন আপনার কাছে বাধ্যগত হয়ে থাকবো"। শিখ সেনাপতি সর্দার হরিসিং পায়েন্দাখানের পত্রের জবাবে লিখলো- "আমি সৈন্য প্রেরণ করতে প্রস্তুত রয়েছি- কিন্তু একটি শর্তে। তা হচ্ছে- আপনার ছেলে জাহাঁদার খানকে আমার খাছে প্রতিভূ হিসাবে রাখতে হবে- যেন উভয়ের মধ্যে বিশ্বাস থাকে"।
কথামত সর্দার পায়েন্দাখান নিজ ছেলে জাহাঁদার খানকে সর্দার হরিসিং- এর নিকট প্রতিভূ রাখলেন। হরিসিং-এর সৈন্যরা পায়েন্দাখানের সাহায্যার্থে অগ্রসর হলো। ফুলুড়া নামক স্থানে সৈয়দ সাহেবের বাহিনীর সাথে শিখ- পায়েন্দাখানের সম্মিলিত বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়।" (সৈয়দ মুরাদ আলী কৃত তারিখে তানাওলিয়া পৃঃ ৫১, ৫২, ৫৩)।
জনাব গোলাম রসুল মেহেরও একথা স্বীকার করে লিখেছেন-
"কোন কোন বর্ণনা মতে ফুলুড়ায় মুজাহিদীনদের অগ্রাভিযানের সংবাদ সর্দার পায়েন্দাখান পাঞ্জাবের মাশহারায় পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন (সাহায্য পাওয়ার লক্ষ্যে)"।
(গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৫৬৮)।
মন্তব্যঃ গোলাম রসুলের স্বীকৃতিই প্রমাণ করছে যে, সৈয়দ সাহেবের ফুলুড়া আক্রমণের উপলক্ষ্যেই শিখ ও মুসলমানরা ঐক্যজোট গঠন করেছিল। সৈয়দ সাহেবের মুসলিম নির্যাতনমূলক শাসন ও ওহাবী হুকুমাতের কাহিনী হাজারাবাসী সুন্নী মুসলমানদের কানেও পৌঁছে গিয়েছিল। তদুপরি সোয়াতের শেখ আব্দুল গফুর আখুন্দ- এর খলিফা, মুরিদান এবং হযরত হাফেজ দারাজ পেশোয়ারীর ছাত্রদের এক বিরাট অংশ হাজারাতেই বিদ্যমান ছিল। তাই এ সমস্ত ভক্তরা স্থানীয় মুসলমানদেরকে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে সম্যক অবহিত করেছিল। এতে করে স্থানীয় লোকেরা সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধে চলে যায়। [সৈয়দ সাহেব পায়েন্দাখানের এলাকা ফুলুড়া ও তনুল আক্রমণ করার ফলেই শিখ পাঠান ঐক্যজোট হয়েছিল- অনুবাদক]।
ফুলুড়ার যুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের আপন ভাগিনা সৈয়দ আহমদ (মুহাম্মদ) আলী বেরেলভী সেনাধ্যক্ষ ছিল। এই যুদ্ধে সৈয়দ সাহেবের মুজাহিদ বাহিনী চুড়ান্তভাবে পরাস্ত হয়। সামান্য কিছু ছাড়া বাকি সব সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে স্তুপীকৃত হয়ে যায়।
বালাকোট–যুদ্ধ (৬ই মে ১৮৩১ ইঃ)
পটভূমিকাঃ
পেশোয়ার থেকে কাশ্মীরের পথে বালাকোট একটি সুরক্ষিত এলাকা। চতুর্দিকে উঁচু পাহাড় দ্বারা বালাকোট বেষ্টিত। সুতরাং এটি একটি সুদৃঢ় দূর্গের ন্যায় ছিল। সীমান্ত এলাকায় ৫ বৎসর অবস্থান ও রাজত্বকালে সৈয়দ সাহেব, ইসমাঈল দেহলভী, মুজাহিদ বাহিনীর কাজী ও কর্মচারীরা পাঠানদের কিছু কুমারী ও বিধবা মহিলাকে জোর করে বিবাহ করেছিল। এ নিয়ে ভারতীয় ও পাঠানদের মধ্যে বিরাট দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সৈয়দ আহমদ সাহেব একটি পাঠান বালিকাকে জোর করে বিবাহ করেন। তার গর্ভে এক কন্যা সন্তান হয়। এই বিয়ে নিয়ে সৈয়দ সাহেবের সাথে আফগান উপজাতীয়দের মনকষাকষি চরম আকার ধারণ করে। এই দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত সৈয়দ বাহিনীর পরাজয় তরান্বিত করে। ফুলুড়ার যুদ্ধে সৈয়দ বাহিনী চরমভাবে পর্যুদস্ত হয় এবং তার অসংখ্য ওহাবী সৈন্য নিহত হয়। বিভিন্ন যুদ্ধে আফগান সীমান্তবাসীদের হাতে মার খেতে খেতে মুজাহিদ বাহিনী কিছু নিহত হয় আর কিছু দল ত্যাগ করে মৌলভী মাহবুব আলীর নেতৃত্বে হিন্দুস্থানের দিকে পলায়ন করে। শেষ পর্যন্ত এক লাখের মধ্যে মাত্র হাজার- বারশো মুজাহিদ সৈয়দ সাহেবের সাথে থেকে যায়। এ অবস্থা দেখে সৈয়দ সাহেব ঐ এলাকা ত্যাগ করে কাশ্মীরে আশ্রয় নেয়ার উদ্দেশ্যে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য বাহিনী নিয়ে রাতের অন্ধকারে বালাকোটের পথে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে পলায়ন করেন। সামনে শিখ সর্দার শের সিং-এর বিশ হাজার সৈন্য বাহিনী এবং পিছনে পাঠান আফগান সীমান্তবাসীদের ধাওয়ার মধ্যখানে বালাকোটে চুড়ান্ত ঘটনা সংঘটিত হয় ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়। (দেখুন- ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী লিখিত ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তক "শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা পৃঃ ৭৮-৮৬ - অনুবাদক।)
এবার শাহ হোসেইন গার্দেজীর পুস্তকের অনুবাদ শুরু
বালাকোট হচ্ছে সৈয়দ সাহেবের ১৫টি যুদ্ধের মধ্যে শেষ যুদ্ধ- যেখানে তিনি আপন ক্ষুদ্র বাহিনী সহ নিহত হন (মতান্তরে আসমানে তশরীফ নিয়ে যান)। বালাকোট এবং আশপাশের মুসলমানরাও সৈয়দ সাহেবের ওহাবীয়ানা কার্যক্রমে অতিষ্ট হয়ে শিখদের সাথে ঐক্যজোট করেছিল। জনাব গোলাম রসুল সাহেব এই ঐক্যজোট সম্পর্কে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছেন-
"শিখদের সাথে ছিল তাদের প্রভাব বলয়ের হাজার হাজার মুসলমান। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল প্রকৃতপক্ষে শিখদের অনুগত।" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৭৫০, ৭৫২)।
শুধু তাই নয়- বাস্তব অবস্থা ছিল এই যে, সৈয়দ সাহেবের কাশ্মীরে যাওয়ার পথের সন্ধানও দিয়েছিল জনৈক মুসলমান। এই পথে পূর্ব হতেই শিখরা ওঁৎ পেতে বসছিল- তাদের বিজয় হয়েছিল এভাবেই। গোলাম রসুল মেহের ঐ মুসলমানের নামও এভাবে উল্লেখ করেছেন-
"মির্জা আহমদ বেগ-এর সঙ্গীদের কোন একজন বা স্থানীয় কোন মিথ্যাবাদী কলেমাগো মুসলমানই শিখদেরকে সৈয়দ সাহেবের এই গোপন পথের সন্ধান দিয়েছিল"। (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৭৫১)।
আর একটু অনুসন্ধানের জন্য মাওলানা জাফর থানেশ্বরীর উক্তি শুনে নিন। তিনি বলেন-
"এ সময়ে (কাশ্মীরে যাওয়ার পথে) কোন পাঞ্জাবী অথবা স্থানীয় বিদাতী গার্ড দুনিয়ার লালসায় পড়ে গোপনে রাজা শের সিং-এর নিকট গিয়ে সৈয়দ সাহেবের গমন পথের বিস্তারিত বিবরণ তার কাছে ফাঁস করে দেয়। শুধু তাই নয়- সে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ঐ গমন পথও পরিস্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছিল" (জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ২৮৪)।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী লিখেছেন-
"একদিন মুজাহিদীনদের ক্যাম্পে সীমান্ত এলাকার একজন মুসলমান আসলো। মুজাহেদীনরা জানতে পারল যে, ঐ লোকটি শিখদের নিয়োজিত গুপ্তচর ছিল" (সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪১৫)।
মির্জা হায়রাত দেহলভী আর একটু শক্ত ভাষায় বলেছেন-
"উপজাতীয় বজ্জাত লোকেরা টাকার লোভে মুসলমান হয়েও শিখদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ছিল।" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২৯১)।
মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী পাঠানদের তীব্র সমালোচনা করে লিখেছেন-
"১৮৩১ খৃষ্টাব্দে বালাকোটের ময়দানে হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ এবং তাঁর সাথীদেরকে শহীদ করা হয়েছে। স্বাধীন উপজাতীয় গোত্রের কিছু লোকেরা হিন্দুস্থানী মুজাহিদ বাহিনীকে লুণ্ঠন করেছে, পিষ্ট করেছে এবং হত্যা পর্যন্ত করেছে।" (কাবুলে সাত বছর পৃঃ ১৬)।
মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরী পাঠানদের তীব্র সমালোচনা করে লিখেছেন-
"পাঠানদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সৈয়দ সাহেব ও তাঁর সাথীরা হরিসিং-দের হাতে বালাকোট ময়দানে নৃশংসভাবে শহীদ হয়েছেন" (মুহাম্মদ আলী কাসুরী কৃত মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ১১৮)।
মাওলানা ফজলে হোসাইন বিহারী পাঠানদের বিরুদ্ধে এভাবে বিষোদগার করেছেন-
"শিখরা যখন দেখল যে, অচিরেই মুসলমানরা সমগ্র পাঞ্জাব কব্জা করে নিবে- তখন তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। আর এই বিশ্বাসঘাতক সীমান্তবাসীরা যুদ্ধ অবস্থায়ই বিশ্বাস ভঙ্গ করল। এতেই মুসলমানদের পরাজয় ঘটল।" (ফজলে হোসাইন বিহারী কৃত আল-হায়াত বাদাল মামাত পৃঃ ২০৪)।
পর্যালোচনাঃ সৈয়দ সাহেবের ভারতীয় জীবনী লেখকরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, বালাকোট যুদ্ধে শিখ ও সীমান্ত মুসলমানেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। কেন মুসলমানরা শিখদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন? সীমান্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছিল দুইটি শক্তি। একটি হলো মারেজান বা প্রাণের শত্রু, অপরটি হলো- মারে ঈমান বা ঈমানের শত্রু। পাঠান মুসলমানরা প্রাণের শত্রু (শিখদের) দ্বারা ঈমানের শত্রুকে (ওহাবী মুজাহিদ বাহিনীকে) খতম করার জন্যই ঐক্যজোট করেছিল। ৬ইং মার্চ ১৮৩১ ইং শুক্রবার বালাকোট ময়দানে ঘোরতর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধে সৈয়দ সাহেব সঙ্গী-সাথী সহ চির নিদ্রায় শায়িত হন।
সৈয়দ সাহেব তো কবরে চলে গেছেন- কিন্তু তার কুফরী ফ্যাক্টরী তথা মুজাহিদ বাহিনী কর্তৃক মুসলমানকে দ্বিধা-বিভক্ত করণের আন্দোলনের জের এখনও অব্যাহত রয়েছে। মুসলমানরা এখনও হাতাহাতি করছে। কোন কোন সময় বুক মারা থেকে গর্দান মারা পর্যন্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। যেহেতু এই বিষবৃক্ষের চারা সৈয়দ সাহেবের নিজের হাতেই লাগানো হয়েছে- কাজেই এহেন উত্তম কাজের প্রতিফলও তাদের ভোগ করতে হচ্ছে। কিন্তু আফসোস হয় ঐ সমস্ত মুসলমানের জন্য- যারা আজও সৈয়দ সাহেবের মুসলিম হত্যার ঐ আন্দোলনকেই পাক ভারতে "ইসলামী পূনর্জাগরণের মহান আন্দোলন" বলে মনে করছে। তাঁরা যদি সৈয়দ সাহেবের জীবনীর উপর সত্যিকারের গবেষণামূলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন- তাহলে কতই না ভাল হতো। [ ভারতে ওহাবী- সুন্নী- দ্বন্দ্বের মূল হোতা ছিলেন সৈয়দ সাহেব ও ইসমাঈল দেহলভী- তারাই ওহাবী মতবাদের আমদানিকারক- অনুবাদক।]
লাশ কুনহার নদীতে নিক্ষেপ করা হলো
বর্তমানে লাশ কোথায়?
সৈয়দ সাহেবের নিহত লাশ কোথায় দাফন করা হয়েছিল- একারণৈ তিন জায়গায় সৈয়দ সাহেবের লাশ দাফনের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথাঃ (১) বালাকোট (২) তিলহাট্টা (৩) গড়হি হাবিবুল্লাহ।
বালাকোটের কবরঃ ৬ইং মে ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে পাঞ্জাবের বালাকোট ময়দানে শিখ ও সুন্নী পাঠান মুসলমানদের যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সৈয়দ আহমদ সাহেব নিহত হন। শিখ জেনারেল শের সিং-তাঁর মৃত দেহ সনাক্ত করে বালাকোটে কুনহার নদীর তীরে দাফন করে দেয়। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ সাহেবের ভারতীয় ভক্ত জীবনী লেখক গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন-
"এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধের ময়দানে অনুসন্ধান করে একটি লাশ সম্পর্কে বলা হল যে, এটি সৈয়দ সাহেবের লাশ বলে মনে হয়। লাশের সাথে মাথা ছিল না। মাথা তালাশ করে লাশের সাথে মিলানো হল। পরিচিত লোকেরা স্বীকার করল যে, হ্যাঁ, এটি সৈয়দ সাহেবেরই লাশ ও মাথা। অতঃপর মর্যাদার সাথে উক্ত লাশকে দাফন করা হল। শের সিং সৈন্য নিয়ে চলে গেল। কিন্তু নহঙ্গ শিখদের একটি দল পিছনে রয়ে গেল। যখন রাত হয়ে গেল- তখন ঐ আকালী শিখরা উল্লেখিত লাশকে কবর থেকে বের করে নদীতে ফেলে দিল। অতঃপর তারা আপন ব্যারাকে ফিরে গেল।" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮০৫)।
মন্তব্যঃ উপরের অভিমতের দ্বারা পরিস্কার হয়ে গেল যে, বালাকোটের কথিত কবর সৈয়দ সাহেবের লাশ থেকে খালী। ওহাবী ভক্তরা খামাখা এই শূন্য কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে তথায় সফর করছে এবং সেখানে দাঁড়িয়ে দোয়া প্রার্থনা করছে।
মেহের সাহেব আরও বলেন-
"যা হোক বালাকোটের যে কবরকে বর্তমানে সৈয়দ সাহেবের কবর বলা হয়ে থাকে- সে সম্পর্কে বেশীকে বেশী এতটুকু বলা যেতে পারে যে, হয়তো এই কবরে অথবা আশেপাশে কোথাও সৈয়দ সাহেব দাফন হয়েছিলেন। এক দিন এক রাত- মতান্তরে দু দিন দু রাত ঐ কবরে দাফন অবস্থায় লাশ ছিল। এরপর তাঁর লাশ ঐ কবর থেকে বের করে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং কবর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮০৬)।
মন্তব্যঃ গোলাম রসুল মেহেরের কথিত বর্তমান কবরে সৈয়দ সাহেবের লাশ একদিন বা দুদিন থাকার ব্যাপারেও সন্দেহ রয়ে গেছে। তাওয়ারিখে হাজারার লেখক মাহতাব সিং কানপুরীও গোলাম রসুলের অনুরূপ ধারণা পোষণ করে উল্লেখ করেছে যে, "শিখ জেনারেল শের সিং চলে যাওয়ার পর মহন সিং ও লক্ষী সিং পরস্পর পরামর্শক্রমে বলল-যতক্ষণ সৈয়দ সাহেব জীবিত থাকবে, ততদিন এই রাজ্যে গোলমাল লেগেই থাকবে। এখন যদি কবর চিহ্নিত থাকে, তবে অনেক মুসলমানরাই তার কবর পূজা শুরু করে দেবে এবং তাঁর কারামত উজ্জ্বল করে তুলবে। অতএব তার লাশকে কবর থেকে তুলে নিয়ে কুনহার নদীতে নিক্ষেপ করাই উত্তম হবে। ঐখানে আটজন নহঙ্গ শিখ দাঁড়ানো ছিল। মহন সিংহ ও লক্ষী শিং তাদের প্রত্যেককে পাঁচটি করে টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে বলল- এটি সাওয়াবের কাজ, তোমরা খলিফা সাহেবের লাশ কবর থেকে তুলে পাশের নদীতে ফেলে দাও। নির্দেশ মোতাবেক নহঙ্গ শিখরা সাথে সাথে সৈয়দ সাহেবের লাশ কবর থেকে তুলে তলোয়ার দিয়ে অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো পৃথক করে নদীতে ফেলে দিল।" (মাহতাব সিং কানপুরী কৃত তাওয়ারিখে হাজারার উদ্ধৃতি- সৈয়দ আহমদ শহীদ)।
মন্তব্যঃ কি বীভৎস চিত্র! গোলাম রসুল মেহেরের বিবৃতিতে অঙ্গচ্ছেদের উল্লেখ নেই। কিন্তু মাহতাব সিং কানপুরীর বিবরণীতে অঙ্গচ্ছেদের কথাও উল্লেখ আছে। কিন্তু বালাকোটের মূল কবরে যে লাশ নেই, এটা উভয় লেখকের গ্রন্থেই উল্লেখ রয়েছে।
মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীর অভিমত
"সৈয়দ সাহেবের কবরের স্থান সম্পর্কে সমস্ত বর্ণনা ও বিবৃতিগুলোকে একসাথে করলে যে কথাটি যুক্তিসঙ্গত বলে মেনে নেয়া যায়, তা হচ্ছে- সৈয়দ সাহেবের দেহ এবং মাথা মোবারক এক সাথে করে যে কবরে দাফন করা হয়েছে- তা হচ্ছে কুনহার নদীর নিকটবর্তী কোন একটি স্থান- যা তাঁর নামেই পরিচিত হয়েছে। তারপর লাশ ঐ কবর হতে উত্তোলন করে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছে"। (নদভী কৃত সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৪৯)।
মন্তব্যঃ এটি মাওলানা নদভীর শরিয়তী স্বাক্ষ্য। এর পর লোকদের এই ধারণা ত্যাগ করা উচিত যে- সৈয়দ সাহেবের কবর বালাকোটেই অবস্থিত এবং এটিই সত্যিকারের কবর। বরং গোলাম রসুল মেহেরের আর একটি ভাষ্য মতে জানা যায় যে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের কবরের কোন চিহ্নই ছিল না। এমন কি নওয়াব উজির উদ্দৌলার নিজ গ্রন্থ "ওয়াসায়া উজির" রচনাকালেও সৈয়দ সাহেবের কবরের কোনই চিহ্ন ছিল না। বালাকোট ঘটনার বাষট্টি বছর পর বর্তমান কবরটি তৈরি করা হয়। এ সম্পর্কে মেহের সাহেবের উক্তি শুনুন-
"খান আরসালান খানের ভ্রাতুষ্পুত্র খান আজম খান ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে (৬২ বছর পর) ইংরেজ আমলে সিদাহ মাঁশহারা অঞ্চলের নায়েব তহসীলদার নিযুক্ত হয়ে আসেন। তিনি এসে সৈয়দ সাহেব ও ইসমাঈল দেহলভীর কবরের অনুসন্ধান করার ইচ্ছা করলেন। খান আজম খান ছিলেন সৈয়দ সাহেবের একান্ত ভক্ত ও সদাসঙ্গীর খান্দানের লোক। তিনি বয়স্ক ও বৃদ্ধ লোকদেরকে একত্রিত করে পূর্ণ যাচাই বাছাই করেন। কমবেশী ষাট বছর পর তিনি উক্ত কবরগুলো সনাক্ত করেন" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮০৭)।
সুধী পাঠক, বালাকোট কবরের পর্যালোচনা করতে গিয়ে জনাব গোলাম রসুলের নিজের উদ্ধৃতিটি পড়ুন- যেন ঘরের স্বাক্ষ্য শুনে সত্য গ্রহণ করতে সহজতর হয়।
"যা হোক- বর্তমান কবরটি বাষট্টি বছর পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন থাকার পর তৈরি হয়েছে। তাই নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না যে, বর্তমান কবরটি ঠিক ঐ জায়গাতেই তৈরি হয়েছে- যেখানে প্রথমে কবর দেয়া হয়েছিল। আর যদি সত্যি সত্যি ঐ জায়গাতেই তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমান কবরটিকে কায়েম মোকাম বা স্মৃতিসৌধ মনে করতে হবে। কেননা, এখানে সৈয়দ সাহেবের লাশ একদিন বা দুদিন দাফন অবস্থায় ছিল।"
(সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮০৭)।
তিলহাট্টা ও গড়হি হাবিবুল্লাহর কথিত কবর
তিলহাট্টা ও গড়হি হাবিবুল্লাহ নামক দুই স্থানে সৈয়দ সাহেবের দুটি কবর আছে বলে প্রসিদ্ধি আছে। জীবনী লেখকগণ বলেছেন যে, সৈয়দ সাহেবের লাশ যখন শিখেরা কুনহার নদীতে ভাসিয়ে দেয়- তখন তিলহাট্টার লোকেরা সৈয়দ সাহেবের শরীরের সন্ধান পেয়ে অজানা স্থানে সেটি দাফন করে দেয়। অনুরূপভাবে গড়হি হাবিবুল্লাহর লোকেরা মাথা পেয়ে কুনহার নদীর তীরে সেটা পুঁতে রাখে। এ প্রসঙ্গে গোলাম রসুল মেহেরের দীর্ঘ উদ্ধৃতিটি পাঠ করুন। তিনি বলেন-
"লাশ নদীতে পড়েই ভাসতে ভাসতে তিলহাট্টাতে পৌঁছে। বালাকোট থেকে নয় মাইল দক্ষিণে কুনহার নদীর পূর্ব তীরে এই তিলহাট্টা গ্রামটি অবস্থিত। শরীর এবং মাথা পূর্বেই পৃথক ছিল। নদীতে যখন নিক্ষেপ করা হয়- তখনও পৃথক পৃথক ছিল। তিলহাট্টা গ্রামের বাসিন্দারা শরীরটি পেয়ে পাশের কোন একটি অজানা ক্ষেতের মধ্যে দাফন করে রেখে দেয়। আমি (গোলাম রসুল) যতদূর সম্ভব বিভিন্ন বন্ধু বান্ধবদের জিজ্ঞেস করেছি- কিন্তু ঐ দাফনের স্থানটি বের করা সম্ভব হয়নি। সৈয়দ সাহেবের কথিত মাথাটিও ভাসতে ভাসতে আরও দক্ষিণে এসে গড়হি হাবিবুল্লাহ খান গ্রামের কাছে ঐ জায়গায় পৌঁছে- যেখানে বর্তমানে পুল তৈরি করা হয়েছে। গড়হি হাবিবুল্লাহর লোকদের মধ্যে একটি কাহিনী প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে- যার থেকে স্থানীয় আজব কাহিনীর রংঢং বাদ দিলে ঘটনা মোটামুটি এরূপ দাঁড়ায়- "মাথাটি ভাসতে ভাসতে যখন গড়হির কাছে এসে পূর্ব তীরে আটকিয়ে রায়, এক বুড়ি পানি আনতে গিয়ে মাথাটি দেখে স্থানীয় খান সর্দারকে সংবাদ দেয়। খান সর্দার দৌঁড়িয়ে এসে মাথাটি নদী হতে উদ্ধার করে নদীর কিনারায়ই দাফন করে ফেলে। দাফনের এই স্থানটি কুনহার নদীর পুল পার হয়ে পূর্ব তীরে বাম হাতে দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমে মাথার কবরটি ছিল অতি ছোট আকারের এবং পরিস্কার বুঝা যেত যে, এটি শুধু মাথার কবর। ঐ ছোট্ট কবরে লাল শালু পরা ছিল। গড়হি হাবিবুল্লাহ খান গ্রামের লোকেরা প্রায় সময়ই ফজরের নামাজের পর এখানে এসে ফাতেহা ও দোয়া পাঠ করত। বর্তমানে (১৯৫৬ ইং) পুরা কবরটি সিমেন্ট দ্বারা পাকা করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে এই কবরকে "কুতুব বাবা গাজীর কবর" বলা হয়। (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮০৫ ও ৮০৬)।
মন্তব্যঃ গোলাম রসুল মেহেরের উপরোক্ত উদ্ধৃতি দ্বারা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে, তিলহাট্টা ও গড়হি হাবিবুল্লাহর কবর দুটি সম্পূর্ণ মনগড়া ও কৃত্রিম কবর। আর মেহের সাহেবও প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করে ফেলেছেন মে, "স্থানীয় বিভিন্ন বন্ধু বান্ধবদেরকে জিজ্ঞেস করেও প্রকৃত কবরের অনুসন্ধান করতে পারিনি।" তিলহাট্টার কবরটি যে সম্পূর্ণ মনগড়া- একথাটি তাঁর বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীও সন্দেহ প্রকাশ করে নিম্নোক্ত বিবৃতি লিখেছেন-
মাওলানা নদভীর সন্দেহমূলক অভিমত
"লাশ এবং মাথা- পৃথক পৃথক ভাবে ভাসতে ভাসতে কোথায় পৌঁছে গেল। উক্ত লাশ ও মাথা পৃথক দুই স্থানে দাফন করা হয়েছিল। সম্ভবতঃ এমনও হতে পারে যে, তাঁর মাথাটি গড়হি হাবিবুল্লাহ খান গ্রামের ঐ স্থানে দাফন করা হয়েছে- যা বর্তমানে মাথার কবর হিসাবে মশহুর হয়ে আছে এবং লাশটি আরও উজানে উত্তর দিকে তিলহাট্টা গ্রামে দাফন করা হয়ে থাকতে পারে- যেটাকে তাঁর কবর বলা হয়ে থাকে"।
(নদভী কৃত সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৪৯)।
মন্তব্যঃ "সম্ভবতঃ" এবং "হতে পারে"- শব্দ দুটি দ্বারাই মাওলানা নদভীর সন্দেহের প্রমাণ পাওয়া যায়- অর্থাৎ- তিনি এ ব্যাপারে পুরাপুরি সন্দিহান। তিনিও ঐ দুই স্থানকে নিশ্চিতভাবে সৈয়দ সাহেবের কবর বলে স্বীকার করতে নারাজ। এর দ্বারা একটি বিষয় পরিষ্কার দিবালোকের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে যে- এ দুটি কবর সাজানো হয়েছে। এর নিশ্চয়তা মূলক কোন প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আর পাওয়া যাবেই বা কি করে? কে জানত যে- নদীতে ভেসে আসা ঐ পৃথক লাশ এবং পৃথক মাথাটি নিশ্চয়ই সৈয়দ সাহেবের? তিলহাট্টা ও গড়হি হাবিবুল্লাহ খানের লোকেরা কি করে নিশ্চিতভাবে অবহিত হল যে- উহাই সৈয়দ সাহেবের লাশ ও মাথা? [এতটুকু বলা যায়- গড়হি হাবিবুল্লাহতে একটি মাথার কবর এবং তিলহাট্টিতে একটি অজানা দেহের কবর আছে- অনুবাদক]
ইমাম মাহদী হওয়ার উদ্ভট দাবিঃ
ইমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদীসের সহায়তায় অবৈধ ফায়দা লুটার জন্য অতীতে কয়েকজন লোক মাহদী হওয়ার দাবি করেছিল। নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি এবং দীর্ঘায়িত করার খাহেশে ওরা মাহদী সেজেছিল অথবা তাদেরকে সাজানো হয়েছিল। সৈয়দ সাহেবকেও অনুরূপভাবে তার অনুসারীরা তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রতিশ্রুত মাহদী বলত এবং বিশ্বাসও করত। মাওলানা জাফর থানেশ্বরী এ প্রসঙ্গে ইসমাঈল দেহলভীর কারসাজির কথা উল্লেখ করে লিখেছেন-
"যখন মাওলানা ইসমাঈল শহীদের প্রথম দৃষ্টি সৈয়দ সাহেবের চেহারায় পড়ল- তখন সে বলে উঠলো- "এই বুযুর্গ যদি নিজেকে মাহদী বলেও দাবি করলেও আমি বিনা দ্বিধায় তাঁর হাতে বাইআত করে নেব" (মাওলানা জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ৩০১)।
মন্তব্যঃ মাওলানা ইসমাঈল কোন সাধারণ ঘরের লোক ছিল না। সে সৈয়দ সাহেবের আন্দোলনের চালিকাশক্তি বা প্রাণ পুরুষ ছিল। "তিনি মাহদী দাবি করলেও আমি বিনা দ্বিধায় তাঁর হাতে বাইআত হয়ে যাব" তার এই উক্তি - কৌশল ও দূরদর্শিতা বিবর্জিত ছিল না। শাহ ইসমাঈল সত্যিই তাকে মাহদী বলে বিশ্বাস করত। প্রমাণস্বরূপ- সীমান্তের উলামাদের পক্ষ হতে মুজাহেদীনদের ব্যাপারে যেসব অভিযোগ ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল- "মাওলানা ইসমাঈল দেহলভী ও অন্যান্য কিছু লোকেরা সৈয়দ সাহেবকে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী ঘোষণা করেছিল" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৬০৬)। সীমান্তের উলামাদের এই অভিযোগটি অর্থহীন বা ভিত্তিহীন ছিল না। কেননা, ঐ দেশের আলেম সমাজ সৈয়দ সাহেবকে এবং মুজাহিদ বাহিনীকে অতি নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তাঁদের অভিযোগের পক্ষে মির্জা হায়রাত দেহলভীর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি সমর্থন দিচ্ছে। মির্জা সাহেব বলেন-
"শাহ ইসমাঈলের আরবী সাহিত্যের জ্ঞান এবং অন্যান্য বিদ্যায় তার পান্ডিত্য তাকে সাধারণভাবে এমন উপযুক্ত বানিয়েছিল যে, তার পীরকে মাহদী উপাধি দান করা এবং নিজে তাকে মাহদী বলে স্বীকার করার ক্ষেত্রে ঐ বিদ্যাগুলো সহায়ক হয়েছিল এবং মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল" (হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ২০৯)।
মন্তব্যঃ মির্জা হায়রাতের কথায় পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে- ইসমাঈল দেহলভী নিজের বিদ্যার প্রভাবে সৈয়দ সাহেবের প্রতিশ্রুত মাহদী হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে প্রচার ও তাবলীগ করত এবং অনেক লোককে নিজের দলভূক্ত করে নিয়েছিল। ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত লোকেরা সৈয়দ সাহেবকে ইমাম মাহদী বলে বিশ্বাস করত।
মাহদী হওয়ার ব্যাপারে শেখ ইকরামের মন্তব্য হল-
"সৈয়দ সাহেবের অনেক ভক্ত- যারা তাকে মাহদী বলে বিশ্বাস করত- তার নিহত হওয়ার পর মনে করত যে, তিনি অদৃশ্য হয়ে রয়েছেন" (মউতে কাওছার পৃঃ ৩৩)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেবকে ইমাম মাহদী বলে দবিদার ও বিশ্বাসীরা সুন্নী মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী ও আল্লামা ফজলে রাসুল বদায়ুনীর মুরিদ ও মোতাক্বিদ ছিল না- বরং তারা ছিল সৈয়দ সাহেবেরই নিমকখোর, নিত্যসঙ্গী ও সাথী। (অর্থাৎ এই অপবাদ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই- অনুবাদক)।
আর এক ভক্ত জাফর থানেশ্বরীর অভিমত
"যদি এই বুযর্গহাস্তিকে (সৈয়দ আহমদ) ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ও মধ্যবর্তী ইমাম মাহদী বলা হয়, তাহলে তা অতিশয়োক্তি হবে না" (মাওলানা জাফর থানেশ্বরী কৃত সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ৫১)।
মন্তব্যঃ গোলাম রসুল মেহের, শেখ ইকরাম, মির্জা হায়রাত ও জাফর থানেশ্বরী প্রমুখ ভক্তদের লেখায় শব্দের হেরফের থাকলেও উদ্দেশ্যের মধ্যে ঐক্য রয়েছে- অর্থাৎ তিনি প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী ছিলেন। (বর্তমানে সৈয়দ সাহেবের বাঙ্গালী অনুসারীরা মাহদী শব্দ বাদ দিয়ে শুধু মুজাদ্দিদ বলে। কেননা, ইমাম মাহদী বললে মহা ফ্যাসাদ লেগে যাবে এবং সামাল দিতে কষ্ট হবে- অনুবাদক)
কবি হেকিম মোমেন খান দেহলভীর বিশ্বাস
দিল্লীর হেকিম মোমেন খান সৈয়দ সাহেবের বড় ভক্ত এবং সমসাময়িক কবি ছিলেন। সৈয়দ- পূঁজায় তিনি তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু হযরত মাওলানা ফজলে হক্ব খায়রাবাদীর প্রতিও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। [কেননা, ফজলে হক খায়রাবাদী ছিলেন সুন্নী এবং সৈয়দ আহমদ ও ইসমাঈল দেহলভীর সমালোচক - অনুবাদক] ভক্তির বন্যায় তিনি এতই অবগাহী ছিলেন যে, সৈয়দ সাহেবকে তিনি প্রতিশ্রুত মাহদী বলে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর এক মর্সিয়া কবিতায় তিনি এ কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। যেমন-
"তু কেঁউ না ছফহায়ে আলম পে সালে ওয়াগা
খুরুজে মাহ্দী কুফফার ছুজ্ কলক তফঙ্গ।" (আবজাদী হিসাব)
মন্তব্যঃ এটা দৃঢ় সত্য যে, সৈয়দ সাহেবের মুরিদ ও মুতাক্বিদদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ তাকে মাহদী মনে করত। এই বিশ্বাসের উপরই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এখন আমরা এই মাহদী সাজা বা সাজানেওয়ালাদের পরিণতি (গোমরাহ বা বেদ্বীন হওয়া) সম্পর্কে ফয়সালা করার ভার পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিয়ে সৈয়দ সাহেবের আকাশে তাশরীফ নিয়ে যাওয়ার কাহিনী আলোচনা করব।
আসমানে উত্থিত হওয়ার কল্পকাহিনী
হাদীস মোতাবেক হযরত ইমাম মাহ্দী শেষ জামানায় জন্মগ্রহণ করবেন এবং আদল ও ইনসাফপূর্ণ হুকুমত কায়েম করবেন ও দাজ্জালকে খতম করবেন। এ ব্যাপারে শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস হল- তিনি কোন এক পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করে আছেন এবং কিয়ামতের পূর্বে পূনঃ আত্মপ্রকাশ করবেন। কিন্তু সৈয়দ আহমদ বেরলভীর ভক্তরা আর এক কদম অগ্রসর হয়ে বলছে- "তিনি আকাশে তাশরীফ নিয়ে গেছেন এবং অচিরেই প্রত্যাবর্তন করবেন"। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ-ভক্ত লেখকদের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি পাঠকদের উপহার দেয়া হল।
মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরীর অভিমত
"মুজাহিদ বাহিনীর কাছে প্রচার করা হল- সৈয়দ সাহেব শহীদ হননি- বরং যুদ্ধরত অবস্থায়ই তাকে আকাশে তুলে নেয়া হয়েছে। তিনি পুনরায় ধরার বুকে তাশরীফ নিয়ে আসবেন; আর এই মুজাহিদ বাহিনী হবে তার "আসহাবে সুফফা" এবং এদেরকে নিয়েই তিনি পুনরায় হিন্দুস্তান জয় করবেন" (মুহাম্মদ আলী কাসুরী লিখিত মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ১১৪)। [হিন্দুস্তান তো তার ইলহামভূক্ত স্থান নয়- সুতরাং তা জয় করার প্রশ্নই আসে না- অনুবাদক]
মির্জা হায়রাত দেহলভীর অভিমত
"মুজাহিদ বাহিনী জানতে পারল যে, সৈয়দ সাহেবকে স্বশরীরে আকাশে তুলে নেয়া হয়েছে এবং তিনি পুনরায় (ধরাধামে) তাশরীফ নিয়ে আসবেন" (মির্জা লিখিত গ্রন্থ হায়াতে তৈয়্যেবা পৃঃ ৪৪৩)।
মন্তব্যঃ আকাশে তুলে নেয়ার কল্পকাহিনীটি এতই প্রচার পেয়েছিল যে, মির্জা হায়রাত সাহেব তা লেখার লোভ সামলাতে পারেন নি। তাঁর লেখার সারমর্ম হচ্ছে- তিনি যুদ্ধাবস্থায়ই সকলের আগোচরে আকাশে চলে গেছেন এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ন্যায় পুনরায় জমীনে ফিরে আসবেন।
খাস খলিফা মৌলভী বেলায়েত আলী
আজিমাবাদীর অভিমত
(সাদেকপুরী জামাতের পুরোধা)
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর চারজন বিখ্যাত খলিফা ছিলেন। তারা হলেন- বেলায়েত আলী, এনায়েত আলী, জাফর আলী ও কারামত আলী। মৌলভী বেলায়েত আলী মির্জা হায়রাতকে হার মানিয়ে সৈয়দ সাহেবকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উপর আর একটু ফজিলত দিয়ে বর্ণনা করেন-
"আমাদের হযরতের খেলাফতকে কেউ যেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের খিলাফতের মত সাধারণ মনে না করেন। কারণ আকাশে চলে যাওয়ার পর হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কারো সাথে দেখা দেননি এবং তাঁর আগমনও হবে দীর্ঘদিন পরে। কিন্তু এখানের ক্ষেত্রে অধিকাংশ লোকেরা যখনই ইচ্ছা করে- সামান্য চেষ্টা করলেই সৈয়দ সাহেবের সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হতে পারে এবং ইনশা আল্লাহ কিছু সময়ের মধ্যেই উজ্জ্বল দিবাকরের ন্যায় তিনি আত্মপ্রকাশ করে বিশ্ব জগতকে হেদায়াতের নূর দিয়ে নূরান্বিত করে দেবেন" (মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী কৃত সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ ৪৪৪ পৃষ্ঠায় বেলায়েত আলীর উদ্ধৃতি)।
মন্তব্যঃ অর্থাৎ- হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উপর সৈয়দ সাহেবের বৈশিষ্ট্য হল- তিনি আকাশে গোপন থাকা অবস্থায়ও মাঝে মাঝে মানুষের সাথে মোলাকাত করেন- কিন্তু হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এরূপ করেন না। সৈয়দ সাহেবের অন্তর্ধান ও পূনঃ প্রত্যাবর্তন বিষয়ে সৈয়দ সাহেবের অধিকাংশ ভক্ত ও মুরীদদেরই এই সিদ্ধান্ত ছিল যে, তিনি বালাকোট ময়দানে নিহত হননি- বরং আত্মগোপন করে রয়েছেন এবং অচিরেই তাঁর আত্মপ্রকাশ হবে।
(সৈয়দ আহমদ বেরলভীর অনুসারীরা এখনও একথা প্রচার করে বেড়ায় যে, হযরত ইমাম মাহদীর আত্মপ্রকাশের সময় হয়ে গেছে। তাদের বিভিন্ন বাংলা বইয়ে সন তারিখ দিয়ে মাহদীর আগমনের প্রচার করা হচ্ছে, বায়তুল মোকাররমে বিক্রি করা হচ্ছে এবং আমার কাছেও এমন দুটি বই আছে। হয়তো এই মাহদীর কথাই তারা আকারে ইঙ্গিতে প্রচার করছে- যেহেতু তাদের হৃদয় বাধা রয়েছে বালাকোটের অনুসারীদের সাথে- অনুবাদক।)
মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরীর আরও অভিমত
"জামাতে মুজাহিদীনের মধ্যে অধিকাংশ দৃঢ় বিশ্বাসীদেরই ধারণা ছিল যে, সৈয়দ সাহেব পুনরায় তাশরীফ আনবেন এবং এই পৃথিবীকে নাস্তিক্যবাদ, প্রকৃতিবাদ, কুফর ও শিয়া মতবাদ থেকে পাক পবিত্র করবেন। মুজাহিদ বাহিনীতে একটি গ্রুপ ছিল খুবই দ্বীনদার ও পরহেজগার। তারা সব সময় বিনীতভাবে এই দোয়া করত- হে আল্লাহ! আমাদের পরীক্ষার কাল শেষ হোক এবং সৈয়দ সাহেব দ্বিতীয়বার তাশরীফ নিয়ে আসুক। অতঃপর আমি (কাসুরী) তথায় যখন পৌঁছলাম- তখন কয়েকজন দৃঢ় আক্বিদার (ওহাবী) মুসলমান আমার কাছে তাদের স্বপ্নের কথা বলল। সৈয়দ সাহেব স্বপ্নে তাদেরকে বলেছিলেন- "এখন আমি আত্মপ্রকাশ করবে"। এরূপ স্বপ্ন বেশি বেশি করে প্রচার করা হত এবং মুজাহিদ প্রশাসনের পক্ষ হতে এসব লোকের মাধ্যমে হিন্দুস্থান ও ইয়াগিস্তানের সরল বিশ্বাসী অশিক্ষিত জাহেল লোকদের থেকে ফায়দা লুটার জন্য পূর্ণ কোশেশ করা হত। ঐ সব জাহেল লোকেরা মনে করত যে, ততক্ষণ পর্যন্ত সৈয়দ সাহেব তাশরীফ না আনবেন- ততক্ষণ পর্যন্ত জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করা অর্থহীন। সৈয়দ সাহেবের সাথে ফেরেস্তাদের একটি যুদ্ধবাজ বাহিনী থাকবে এবং বিজয় ও খোদায়ী সাহায্য তাদের পদচুম্বন করবে"। (মুহাম্মদ আলী কাসুরী রচিত মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ১১৮)।
মন্তব্যঃ মিথ্যাচারেরও একটা সীমা থাকা চাই। ফেরেস্তাদের যুদ্ধবাজ দল সাথে আসবে- একথা বলার পরেও তাদের ঈমানের কোন হানি হল না এবং কাসুরী সাহেবদের ফতোয়াও কোন প্রকার প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল না? বরং উৎসাহ করে কাসুরী সাহেব বললেল- তারা খুবই দ্বীনদার পরহেজগার ছিল। এই স্বজনপ্রীতি কেন? আরও কিছু অভিমত শুনুন-
শেখ ইকরামের অভিমত
হাজারা জিলার গেজেটিয়ারের বর্ণনা মোতাবেক দেখা যায় যে, ভারতীয় মুজাহিদীনরা বালাকোটের পর এই ঘোষণা দিয়ে পুণরায় একত্রিত হল যে, "সৈয়দ সাহেব যুদ্ধে শহীদ হননি- বরং অতিসত্বর আত্মপ্রকাশ করবেন" (শেখ ইকরাম -মৌজে কাউছার পৃঃ ৫১)। (এই লোকগুলো ছিল এনায়েত আলী ও বেলায়েত আলী নামক সৈয়দ সাহেবের খলিফা দ্বয়ের অনুসারী সাদেকপুরী জামাতের দল। দেখুন- মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির শাহ ওয়ালিউল্লাহ গ্রন্থের পরিশিষ্ট ৪৩ পৃঃ ১৯৭- অনুবাদক)।
আবুল হাসান আলী নদভীর অভিমত
"একটি বড় দল- যার মধ্যে ছিল সীমান্তের উপজাতি, সাদেকপুরবাসী এবং তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ- তারা ছিল সৈয়দ সাহেবের অন্তরর্ধানের পক্ষীয়, তাঁর আত্মপ্রকাশের প্রতীক্ষারত এবং তাঁর পথ পানে চাতক পাখি সদৃশ" (সিরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪৪৩)।
গোলাম রসুল মেহেরের অভিমত
"সৈয়দ সাহেবের শাহাদাতের পর তাঁর ভক্তবৃন্দের একটি দল তাঁর অন্তর্ধানের মাসয়ালাটি দাঁড় করিয়ে ফেলল এবং বহুদিন পর্যন্ত এই আক্বিদার প্রচার অতি নিখুঁতভাবে চালিয়ে গেল" (গোলাম রসুল রচিত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮১০)।
মন্তব্যঃ অর্থাৎ- সৈয়দ সাহেবের কথিত অন্তর্ধানের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে প্রচার করা হতো এবং মানুষকে এর স্বপক্ষে আহবানও করা হতো। সাদেকপুরের কেন্দ্রে যত লোক জমা হতো- তাদেরকে দস্তুরমত একথা শিক্ষা দেয়া হতো যে, সৈয়দ সাহেবের আত্মপ্রকাশ অতি নিকটে। তিনিই বর্তমান যুগের ইমাম" (গোলাম রসুলের রচিত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮১৪)।
(এই দলের নেতা ছিলেন- সৈয়দ সাহেবের খলিফা বেলায়েত আলী ও এনায়েত আলী ভ্রাতৃদ্বয়। তারা সাদেকপুরী জামাত নামে পরিচিত- অনুবাদক)।
সৈয়দ সাহেবের নিজ খান্দানের অভিমত
সৈয়দ সাহেবের নিজ খান্দানের লোকদের ধারণাও অনুরূপ ছিল। মাওলানা জাফর থানেশ্বরী তার সাওয়ানিহে আহমদী গ্রন্থের ২৯০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
"সৈয়দ সাহেবের অধিকাংশ আত্মীয়রা এবং কাফেলার সাথীরা তার অন্তর্ধানের ব্যাপারে বিশ্বাসী ছিল অর্থাৎ তিনি নিহত হননি।" (সাওয়ানিহ পৃঃ ২৯০)।
মৌলভী ইয়াহ্ইয়া আলী আজিমাবাদীর কবিতা
সৈয়দ সাহেবের নিহত বা অন্তর্ধানের পর তাঁর সাথে পূণঃ সাক্ষাতের আশায় মৌলভী ইয়াহ্ইয়া আলী আজিমাবাদী নিম্নোক্ত কবিতাংশ আঁকতেন-
"এতনা পয়গাম দরদ্ কা কাহনা -যব সাবা কুয়ে ইয়ারছে গুজরে,
কৌনছি রাত আপ আয়েঙ্গে- দিন বহুত ইন্তেজার মে গুজরে।"
হে প্রভাত সমীর, যখন তুমি আমার বন্ধুর নিকট দিয়ে বয়ে যাবে,
তখন আমার এ পয়গাম পৌঁছিয়ে দিও-
"কোন্ রাত প্রহরে তুমি আসবে হে বন্ধু,
আমার দিন যে তোমার প্রতীক্ষায় কাটছে।"
খাস মুরীদ জাফর থানেশ্বরীর অভিমত
"আমার প্রিয় মুর্শিদের বেঁচে থাকা ও পূণঃ আত্মপ্রকাশের বিষয়ে আমার এমন দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে- যেমন নিশ্চয়তা রয়েছে নিজের মৃত্যুর বিষয়টি" (গোলাম রসুল মেহের কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ- থানেশ্বরীর উদ্ধৃতি- পৃঃ ৪৪৫)।
একই গ্রন্থের ৪৪৫ পৃষ্ঠায় থানেশ্বরীর আর একটি হচ্ছে-
১৩০২ হিজরীতে (১৮৮৫ ইং) সৈয়দ সাহেবের সাথে "মৌলভী হায়দার আলী সাহেব এবং তার ছেলের সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল (৫৬ বৎসর পর)। কদমবুছি করার সৌভাগ্য লাভ করার পর মৌলভী হায়দার আলী কিছুদিন পরই ইন্তিকাল করেন এবং তাঁর ছেলে এখনও (১৮৮৭ ইং) জীবিত আছেন" (উক্ত গ্রন্থ পৃঃ ৪৪৫)।
আকাবেরীনে দেওবন্ধ- এর অভিমত
(অন্তর্ধান বিষয়ে)
মৌলভী মুজাফফর হোসাইন কান্দুলুভী বলতেন-
"আমি সৈয়দ সাহেবের নিকট এমন দশটি কথা শুনেছি- যার নয়টিই পূরণ হয়েছে- শুধু বাকি আছে তার অন্তর্ধান ও পূনঃ আত্মপ্রকাশের বিষয়টি।"
মুন্সী মুহাম্মদ ইবরাহিম নামের এক ব্যক্তি মাওলানা গাঙ্গুহীর মজলিসে একবার বলেছিল- "সম্ভবতঃ সৈয়দ সাহেব এখনও জীবিত রয়েছেন"। একথা শুনে গাঙ্গুহী সাহেব বলে উঠলেন- "শুধু সম্ভব নয়- বরং সম্ভবতর" (আশরাফ আলী থানবী কৃত আরওয়াহে ছালাছা পৃঃ ১৪১)।
মন্তব্যঃ মনে হয়- মাওলানা কান্দলুভী ও মাওলানা গাঙ্গুহী উভয়েই সৈয়দ সাহেবের যুদ্ধ ময়দান হতে গায়েব হয়ে যাওয়া এবং পূনঃ আবির্ভাবের বিষয়ে মজবুত আক্বিদা পোষণ করতেন- না হলে এত জোর দিয়ে বলতেন না। এই ইসলামী অপরাধের মধ্যে যেহেতু রথী মহারথীরা জড়িত রয়েছেন- তাই মুখে সীল মেরে দিলাম। (বাতাসেই ধর্মের ঢোল বাজে- অনুবাদক)।
সৈয়দ সাহেবের মূর্তি তৈরি ও মূর্তিপূজা
মানুষের পরিচিত হয় তার সঙ্গী ও বন্ধু-বান্ধবদের দ্বারা। সৈয়দ সাহেবের নিত্য সঙ্গীরা কোন্ শ্রেণীর ও কোন্ চরিত্রের লোক ছিল- তার পরিমাপ করা যায়- (তাঁর জীবনের পরিণতি যা হবার- তাই হয়েছে) তারা তাঁকে আকাশে উত্তোলন করিয়েছে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম থেকে তাঁকে উত্তম বানিয়েছে এবং প্রতিশ্রুত মাহদী বানিয়েছে। সবচেয়ে নিকৃষ্টতম যে কাজটি তারা করেছে, তা হলো- সৈয়দ সাহেবের মূর্তি তৈরি করে সরলমনা মুসলমানদের থেকে সোনা দানা আদায় করে নিজেদের পরকালকে বিনষ্ট করেছে। এ ব্যাপারে ডব্লিউ হান্টার সহ সৈয়দ সাহেবের ভক্ত ও অনুরক্ত এবং নিরপেক্ষ লেখকদের উদ্ধৃতি পাঠকদের কাছে পেশ করা হল।
হান্টারের অভিমত
"এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইমাম সাহেবের (সৈয়দ সাহেব) আত্মগোপন করে থাকার কারামত সম্পর্কে অনুসন্ধান ও গবেষণা করা কারামত থেকে খালী ছিল না। এক ভক্তপ্রাণ মুবাল্লিগ...... একহাজার লোক সাথে নিয়ে সীমান্ত প্রদেশের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।...... সে দৃঢ় আশা পোষণ করল যে, পাহাড়ি এলাকার ঐ গুহা পর্যন্ত সে পৌঁছবে। সেখানে খোদা তায়ালা ইমাম সাহেবকে গোপন করে রেখেছেন বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। যখন সে ঐ খানকার দরজার ভিতরে পৌঁছল, তখন আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেল যে, ঘাসে ভরা তিনটি মানবীয় মূর্তি সেখানে আছে। এ অবস্থা দেখে মুবাল্লিগ সাহেব সেখান থেকে চলে এসে মুরিদানদেরকে পত্র লিখে জানালেন যে, মোল্লা কাদের নামের জনৈক ব্যক্তি ইমামের মূর্তি তৈরি করেছে, কিন্তু কাউকে দেখাবার পূর্বে সে এ ওয়াদা আদায় করে নিচ্ছে যে, সে ইমাম সাহেবের সাথে হাত মিলাতে পারবে না এবং কথা বলার চেষ্টাও করতে পারবে না। কেননা- এরূপ করলে ইমাম সাহেব চৌদ্দ বছরের জন্য হারিয়ে যাবেন। অনেক দিন পর্যন্ত সন্তোষজনক কোন উত্তর না পেয়ে একদিন লোকদের মধ্যে ইমাম সাহেবের সাথে মোসাফাহা করার ইচ্ছা জাগল। কিন্তু মোল্লা কাদের তাদেরকে এই বলে ভয় দেখালেন যে, যদি এরূপ করা হয়, তাহলে ইমাম সাহেবের খাদেম (যিনি তাঁর পাশে দাঁড়ানো আছেন) পিস্তল মেরে দেবেন। যাই হোক- লোকেরা ভিতরে গিয়ে দেখতে পেল- বকরীর চামড়ার ঘাস ভর্তি করে কিছু কাঠের টুকরা ও পশমের সাহায্যে মানুষের মূর্তির রূপ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে যোগ জিজ্ঞাসা শুরু করায় মোল্লা কাদের জওয়াব দিল- সবই ঠিক আছে। ইমাম সাহেব নিজেই মোজেজা স্বরূপ নিজেকে ঘাসে ভরা একটি মূর্তির আকৃতি ধারণ করে মানুষের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছেন"
(ডাঃ সাদেক হোসাইন অনূদিত উর্দু গ্রন্থ- "হামারে হিন্দুস্থানী মুসলমান" পৃঃ ৭৬)। হান্টার সাহেব ছাড়াও মুসলমান লেখকরা এ কথার স্বীকৃতি দিয়েছেন। দেখুন-
চাক্ষুস সাক্ষীর পত্র
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার সাহেব বিস্তারিতভাবে এই সত্য ও তথ্যটি তুলে ধরেছেন- যা সৈয়দ সাহেবের মুরিদ ও ভক্তরা ইসলামের পবিত্র নামকে কলঙ্কিত করার লক্ষ্যে করেছে। কিন্তু হিন্দুস্তানের দেশীয় একজন বিখ্যাত আলেম মাওলানা সৈয়দ আশরাফ আলী গুলশানাবাদী আপন গ্রন্থ- তোহ্ফায়ে মুহাম্মদীয়াতে একজন চাক্ষুস দর্শকের পত্র উদ্ধৃত করেছেন। আমরা উক্ত পত্রটি "মিন ও আন" অর্থাৎ হুবহু সূত্র সহ উদ্ধৃত করছি- যাতে সংঘটিত সত্যটি বিশুদ্ধভাবে পরিস্কার হয়ে যায়।
তোহফায়ে মুহাম্মদীয়ার সূত্রে
জয়নুল আবেদীনের খোলা চিঠিঃ
সালামুন আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। বাদ আরজ -
"আমি এই অধম (জয়নুল) মৌলভী বেলায়েত আলীর খেদমত করার বরকতে বিদ্আতী কাজকর্মগুলো দ্বীন ও ঈমানের কাজে শামিল করাকে গর্হিত কাজ বলে মনে করি এবং এসব বিদ্আতকে দূর করা সুন্নাত বলে মনে করি। এতদসত্ত্বেও মাওলানা ও মুর্শেদেনা বেলায়েত আলী (সাদেকপুরী) সাহেবের অচিন্তনীয় সততা ও বুদ্ধিমত্তার উপর ভরসা করে সুনির্দিষ্ট মঞ্জিলের (বালাকোট) দিকে রওয়ানা দিলাম।
যখন সেখানে পৌঁছলাম, সেখানকার কোন কাজকর্ম, চলা বলা -যা ইমামে হুমামের (সৈয়দ সাহেবের) শানের উপযুক্ত হতে পারে- এমন কিছুই দেখতে পেলাম না এবং শুনতেও পেলাম না। বরং করিমুল্লা মেওয়াতী- যে মিথ্যাবাদী কাছেম পানিপথীর প্রতারণার শিকার হয়েছিল- সে (করিমুল্লাহ) মোল্লা কাদেরের পক্ষ হতে আমাদের কাফেলায় এসে একথা প্রকাশ করল যে, সৈয়দ আহমদ আমিরুল মোমেনীন নাকি বলেছেন যে, (মোল্লা কাদেরের ভাষায়)-
"শেখ ওয়ালিউদ্দিন মুহাম্মদ এমন মরদুদ হয়ে গেছে যে, যদি রনজিৎ সিং কবর হতে উঠে এসে তওবা করে, তাহলে তার তওবা কবুল হলেও হতে পারে, কিন্তু শেখ ওয়ালিউদ্দিনের তওবা কখনও কবুল হবে না"। (মোল্লা কাদের মূর্তি তৈরিকারী এবং কাছেম ও করিমুল্লাহ তার দোসর- অনুবাদক)।
সৈয়দ সাহেব নাকি একথাও বলেছেন যে, "মুসলমান হওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। এই যুগে আল্লাহ তায়ালা একমাত্র কাছেমকেই মুসলমান করে রেখেছেন। জয়নাল আবেদীন (আমি) খুবই ভাল লোক। সে নিজের জানমাল সবকিছু কাছেমের নিকট সোপর্দ করে দিয়েছে। এনায়েত আলীর (খলিফা) উপর সৈয়দ সাহেব খুব অসন্তুষ্ট- কেননা, সে তার সমস্ত মাল দৌলত কাছেমের নিকট সোপর্দ করেনি।"
এমনি ধরনের সৈয়দ সাহেবের আরও অনেক (প্রতারণামূলক) কথা করিমুল্লাহ মোল্লা কাদেরের পক্ষ হতে আমাদেরকে শুনাল- যা সাগরের তুলনায় এক বিন্দু হবে। আমি এত কথা এই খোলা চিঠিতে লিখতে অক্ষম। করিমুল্লাহর প্রতারণামূলক কথা শুনে অবাক লাগত। আমি কাছেম পানিপথীকে বলতাম- যে ব্যক্তি আম্বিয়ায়ে কেরামের চরিত্র নিজের রহমতপূর্ণ চরিত্রে ও আমলে ধারণ করেন- তিনি এমন শক্ত কথা কি করে বলতে পারেন- তা আমার বুঝে আসে না। এজন্য আমি খুবই অসস্থিবোধ করছি। আমার কথা শুনে প্রতারক কাছেম জওয়াব দিল- "হযরতজী এখন খুবই জজবা হালাতে আছেন" কাছেম আরও বলল- জনৈক জমিরুদ্দীন ইমাম সৈয়দ আহমদের নামের একটি জাল সীলমোহর তৈরি করে হিন্দুস্থানে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। এবং সংবাদ দিল যে, ইমামে হুমাম সৈয়দ আহমদ সাহেব নিজের নামের ঐ জাল সীলটি তলব করেছেন। কাছেম পানিপথী এসে ঐ জাল সীলটি জমিরুদ্দীন থেকে উদ্ধার করে করিমুল্লাহ মেওয়াতির মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কয়েকদিন পর করিমুল্লাহ মেওয়াতি ঐ সীলটি নিয়ে এসে বলল- সৈয়দ সাহেব বলেছেন - "আমার পক্ষ হতে জায়গায় জায়গায় চিঠি পাঠাও এবং এই সীল মোহরটি তাতে ব্যবহার করো।"
মোল্লা কাদের, মিথ্যুক কাছেম পানিপথী ও প্রতারণার শিকার করিমুল্লাহ মেওয়াতি- এই তিন প্রতারকের এসব সন্দেহজনক কাজ কারবার দেখে আমি অধম (জয়নাল) বললাম- ইমাম সৈয়দ আহমদের এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকার ব্যাপারে মানুষের মনে সন্দেহ রয়েছে। এ জন্য চিঠি লেখা, চিঠির মধ্যে সৈয়দ সাহেবের সীল ব্যবহার করা আমার আকলের বাইরে মনে হচ্ছে- কেননা, এতে লোকসান ছাড়া লাভের কিছু আশা করা যায় না। এর দুদিন পর আবার করিমুল্লাহ মেওয়াতি এসে আমাকে বলল- ইমাম অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছেন- "জয়নুল আবেদীন কি আমাকে আকল শিক্ষা দিচ্ছে?" করিমুল্লাহ আরও বলল- মোল্লা কাদের বলেছে যে, ইবনে আব্বাস এবং ইবনে খোযায়মা নামের দুজন সাহাবী জঙ্গে বদর অথবা জঙ্গে ওহুদ থেকে গায়েব হয়ে গিয়ে জমিনের নিচে থেকে হেদায়াতের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এখন- ইমামে হুমামের আত্মপ্রকাশের সময় ঘনিয়ে আসছে- তাই তাঁরা দুজন শাহগর্দা পাহাড়ের উপর পাথরের নিচ থেকে বের হয়ে এসেছেন এবং ইমামে হুমামের (সৈয়দ আহমদ) সান্নিধ্যে বালাকোটের গুহায় বসে আছেন। (আসলে ঐ দুইটি ছিল মূর্তি) মোল্লা কাদের আরও বলেছে- জ্বীনের বাদশাহকে মহাচীন হতে তলব করা হয়েছে। তার সিংহাসনে বসে ইমামে হুমাম সৈয়দ সাহেব এই যুগের অন্যান্য আউলিয়ায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালামের মত হাওয়ায় সফর করে বেড়াচ্ছেন। কোরবানী ঈদের প্রথম দিকে মোল্লা কাদের এরূপ কথা বলত- "পয়গাম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে অন্যান্য ওলীরা ইমামে হুমাম সৈয়দ আহমদ সাহেবের কাছে এসেছিলেন এবং বলে গিয়েছেন- "তৈরি হও, কাফের সৈন্যরা বালাকোট ময়দানে এসেছে"। তাঁদের কথার জবাবে সৈয়দ সাহেব বললেন- "আমি খোদার নির্দেশ ছাড়া উঠব না"। শেষ পর্যন্ত পয়গাম্বর আলাইহিস সালাম নিজে বললেন- উঠো। ইমামে হুমাম জওয়াব দিলেন- "অধমের এই এখতিয়ার নেই"।
জয়নুল আবেদীন বলেন- মোল্লা কাদেরই সৈয়দ সাহেবের এই মূর্তিটি তৈরি করিয়েছে। মূর্তি দেখানোর পূর্বে সে সকলের নিকট থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিত যে, তোমরা কখনও মোসাফাহা ও কথাবার্তা বলার ইচ্ছা করতে পারবে না- শুধু দেখে আসবে। যদি এরূপ করো, তাহলে ইমামে হুমাম পুনরায় চৌদ্দ বছরের জন্য গায়েব হয়ে যাবেন। সকল যিয়ারতকারী ও দর্শনার্থীরা মনের আকর্ষণে ঐ প্রাণহীন মূর্তিটি দেখে নিত এবং সালাম করত- যদিও সালামের উত্তর পেত না। মোসাফাহা করার ইচ্ছা কখনও করত না । এভাবে যখন কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেল- মানুষের মনে সন্দেহ জাগতে লাগল। তারা করমর্দন করার ইচ্ছা করল। মোল্লা কাদের তাদেরকে এই বলে ভয় দেখাতে লাগল যে, বিনা অনুমতিতে করমর্দন করতে গেলে পাশের দুজন খাদেম (মূর্তি) যথাক্রমে মিয়া চিশতী ও মিয়া আব্দুল্লাহ থাপ্পর মেরে তাদেরকে মেরে ফেলবে। মোল্লা কাদের যখন দেখল যে, তার ভীতিপ্রদর্শন কোন কাজে আসছে না, লোকেরা করমর্দন না করে ছাড়বে না- অতঃপর মূর্তির জারি-জুরি সব ফাঁস হয়ে যাবে- তখন সে চালাকি করে বলতে লাগল- ইমামে হুমাম সৈয়দ সাহেব বলেছেন- "মানুষ আমার দর্শন পেয়েও যখন করমর্দন ও কথা বলা ছাড়া শান্তি পাচ্ছে না এবং এই নেয়ামত প্রাপ্তির শুকরিয়া আদায় করছে না- তখন আল্লাহ তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে গেছেন। এরপর হতে আমি যতক্ষণ প্রকাশ্য কাফেলার সামনে না আসব- ততক্ষণ পর্যন্ত কারো সাথে দেখাই করব না।" এই ঘটনার পর থেকে এই মূর্তির দর্শন আর কারো ভাগ্যে জুটেনি।
জয়নুল আবেদীন বলেন- যাহোক- "এর কিছু দিন পর কান্দাহার থেকে মোল্লা তোরাব ও তার সাথে দু একজন বুজুর্গ ব্যক্তি বালাকোটে এসে মোল্লা কাদেরকে অনেক লোভ দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে আটকিয়ে ফেলেন। মোল্লা কাদের শেষ পর্যন্ত তাদেরকে মূর্তিটির নিকটে নিয়ে গেল। তারা ভাল করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলেন যে, ঐ মূর্তিটি আসলে একটি ছাগলের চামড়া। এই চামড়ার ভিতরে ঘাস ভর্তি করে কাঠ ও পশম ইত্যাদি দিয়ে এই মূর্তিটি বানানো হয়েছে। আমি অধম (জয়নাল) এ বিষয়ে মিথ্যুক কাছেম পানিপথীকে জিজ্ঞেস করি। সে বলল- হ্যাঁ ঘটনা সত্য। তবে এটাও ইমামে হুমামের কারামত ছিল। তিনি দর্শকদের দৃষ্টিতে এইভাবেই ধরা দিয়েছিলেন। তার কথার পর মোল্লা কাদের বলতে লাগল- হযরত আমার উপর নাখোশ হয়েছেন এবং আমার ঘরে আসা যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে মাঝে মধ্যে মিয়া চিশতীর (খাদেম) বাড়িতে কখনও কখনও তিনি আসেন"।
জয়নাল আরও বলেন-
এই একটি কারিশমা (চমক) হলো তাদের গোমরাহী, শির্ক ও বিদআতের প্রমাণ। এই ফকির (জয়নাল) ঐ প্রাণহীন মূর্তিটি দেখে দেশে এসে পত্র লিখি। ঐ পত্রে আমি অনেক ভক্তি ও শ্রদ্ধা হযরতের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছিলাম। পরবর্তীতে এখন তাদের গোমরাহী ও মিথ্যা অপবাদ দিবালোকের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল হয়ে গেছে। মিথ্যার পরে সত্যের আগমন হয়েছে- মিথ্যা ধরা পড়েছে। এজন্য নিজেকে তাদের গোমরাহী ও মিথ্যা প্রতারণা থেকে নিজেকে রক্ষা করেছি"। (খোলাচিঠি সমাপ্ত)।
(মাওলানা সৈয়দ আশরাফ আলী গুলশানাবাদী রচিত তোহফায়ে মুহাম্মদীয়া ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ পৃষ্ঠায় উক্ত খোলা চিঠি মুদ্রিত আছে)।
(ডব্লিউ হান্টার মুসলমানদের দুশমন ছিল। তার কথা সত্য হলেও দলীল হিসাবে কেউ মানতে চাইবে না। কিন্তু মাওলানা সৈয়দ আশরাফ আলী গুলশানাবাদী সূত্রে তোহফায়ে মুহাম্মদীয়ায় প্রকাশিত জয়নুল আবেদীনের চিঠি ও চাক্ষুস সাক্ষ্য তো হুবহু হান্টারের সাথে মিলে যাচ্ছে। মোল্লা কাদের মূর্তি তৈরি করেছিল তিনটি। কাছেম পানিপথী ছিল তার মুখপাত্র- আর করিমুল্লাহ ছিল তাদের প্রতারণার শিকার এবং একজন কর্মচারী) [এই তিনজন ছিল মূর্তি তৈরির নায়ক ও প্রতারক- অনুবাদক]
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের স্বীকৃতি
মাওলানা আবুল কালাম আযাদ সৈয়দ সাহেবের মূর্তি বানানোর বাস্তব ঘটনার স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন-
"কয়েকজন চালাক ও দুনিয়া পূজারী ব্যক্তি নিজস্ব ব্যক্তি স্বার্থে বাস্তবিকই একটি মূর্তি তৈরি করেছিল" (আব্দুর রাজ্জাক কৃত আবুল কালাম কি কাহানী খোদ্ উনকি জবানী পৃঃ ৩৫৭)।
মন্তব্যঃ মাওলানা আবুল কালাম আযাদ সাহেব মূর্তি তৈরির ঘটনাকে সত্য বলে স্বীকার করেও সৈয়দ সাহেবের ভক্তবৃন্দকে কলঙ্ক মুক্ত করার জন্য কিছু 'চালাক ও দুনিয়া পূজারীর কাজ' বলে তাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। কিন্তু মাওলানা আশরাফ আলী গুলশানাবাদী কর্তৃক জয়নুল আবেদীনের খোলা চিঠি। প্রকাশের মাধ্যমে পরিস্কার হয়ে গেছে যে, এ কাজটি সৈয়দ সাহেবের ভক্তরাই করেছিল। তারাই চালাক ও দুনিয়া পূজারী।
প্রকৃত তথ্য গোপন করার নিকৃষ্টতম উদাহরণঃ জনাব গোলাম রসুল মেহের প্রকৃত তথ্য গোপনে সিদ্ধহস্ত হয়েও তার গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে স্বীকার করতে বাধ্য হয়ে লিখেছেন-
"একটি কাহিনী এরূপ বলা হয়ে থাকে যে, মৌলভী মুহাম্মদ কাছেম পানিপথী কাগান উপত্যকার কোন একটি অন্ধকার গুহায় তিনটি মূর্তি তৈরি করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। তার মধ্যে মধ্যখানের মূর্তিটি সৈয়দ আহমদের এবং বাকি দুটি মূর্তির একটি খাস খাদেম আব্দুল্লাহর এবং অপরটি মিয়াজী চিশতীর বলে বলা হতো। মাঝে মধ্যে গাজীদেরকে গুহার মুখে নিয়ে গিয়ে দূর হতে দেখানো হতো। তারা শান্ত হয়ে ফিরে আসত। মিয়া জয়নুল আবেদীন (খোলা চিঠির লেখক) সীমান্তে পৌঁছে উক্ত তিনটি মূর্তির নিকটে গিয়ে দেখার পর জালিয়াতির রহস্য ফাঁস হয়ে যায়। তিনি সীমান্ত প্রদেশ থেকে দেশে ফিরে আসলেন এবং জীবনভর মৌলভী মুহাম্মদ কাছেমকে মিথ্যুক কাছেম (কাছেম কাজ্জাব) বলে উল্লেখ করতেন। আমি (মেহের) ঐ কাহিনীর সত্য মিথ্যা সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে পারব না। শুধু এতটুকু জানি যে, মৌলভী মুহাম্মদ কাছেম ছিল সৈয়দ সাহেবের খাস মুরীদ। তাঁর ভাই ও পিতা যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়েছিলেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৮১৪)।
মূল্যায়নঃ এখানে মেহের সাহেব চতুরতার সাথে প্রকৃত ঘটনাকে কাহিনী নাম দিয়ে অপরাধ হালকা করার অপচেষ্টা করেছেন। মূলতঃ মেহের সাহেব মুজাহিদীনকে এমন সব মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন- যা তাদের প্রাপ্য ছিল না। এজন্যই তিনি তাদের শরয়ী ত্রুটিগুলোকে শব্দের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। মেহের সাহেবের প্রিয়জন ছাড়া যদি অন্য কেউ মুসলমানকে কাফির বলতেন, তাদেরকে বিনা দোষে হত্যা করতেন, তাদের বিধবা স্ত্রীদেরকে জবরদস্তি বিবাহ করতেন, তাদেরকে মুনাফিক ও বিদ্রোহী মুরতাদ সাব্যস্থ করতেন অথবা তাদের মাল সম্পদকে গনিমতের মাল বলতেন- তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মেহের সাহেব এবং তার সম আক্বিদাপন্থী লোকেরা ঐ ব্যক্তিকে ইসলাম বহির্ভূত বলে ঘোষণা করতেন, খোদার দরবারের অভিশপ্ত বলতেন। যেহেতু উল্লেখিত সবগুলো অন্যায় কাজ জনাব মেহের সাহেবের প্রিয় পাত্র সৈয়দ সাহেব ও তাঁর সঙ্গীরা আঞ্জাম দিয়েছে- এজন্য মেহের সাহেব অপব্যাখ্যা করে সৈয়দ সাহেবক আমিরুল মোমেনীন এবং তার সঙ্গীদেরকে উন্নত ধরনের মুসলমান প্রমাণ করার জন্য কোন প্রকার ইতস্ততঃ করেন নি। (এখন দুইজন মুসলমান লেখক এবং একজন খৃষ্টান লেখক স্বীকার করেছেন যে, সৈয়দ আহমদের মূর্তি সত্যিই তৈরি করে তারা ব্যবসা করেছিল- অনুবাদক)।
সৈয়দ সাহেবের ভবিষ্যৎ বাণীর স্বরূপ উদঘাটন
সৈয়দ সাহেবের উপর নাকি ইলহাম হতো। তিনি নিজের ইলহাম সম্পর্কে বারবার বক্তৃতায় ও লেখনীতে উল্লেখ করতেন এবং লোকদেরকে "সবুজ বাঘ" দেখাতেন। সরলপ্রাণ মুসলমানেরা তাঁর খোশ বয়ান ও মনোমুগ্ধকর কথার ঘুরপাকে পড়ে যেত। তারা সৈয়দ সাহেবের পিছে পিছে ঘুরত। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের ঐসব ভবিষ্যৎবাণীর কোন একটিও পূর্ণ হয় নি। যেমন -
(১) সৈয়দ সাহেবের ছোট বিবির কাছে বালাকোট যুদ্ধের পূর্বে তার নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যাওয়ার ভবিষ্যৎবাণী তিনি করেছিলেন" (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ২৯০)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেবের আত্মগোপনের ভবিষ্যৎবাণীটি কালের গতিই বাতিল প্রমাণ করেছে। তবুও দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার খলিফারা এটার মিথ্যা প্রচার করেছিলেন। যা হোক- এই প্রকাশ্য বৈপরীত্বের মধ্যে একটিকে অবশ্যই মানতে হবে। হয়- সৈয়দ সাহেব মিথ্যাবাদী- না হয় তার খলিফাগণ। (খলিফা ছিলেন বেলায়েত আলী, এনায়েত আলী, আঃ করিম, রহমতুল্লাহ ও নেয়ামত উল্লাহ গং)।
(২) অধিকাংশ গ্রন্থকারের লেখনীতে পরিস্কার হয়ে গেছে যে, পাঞ্জাব বিজয়ের ব্যাপারে কথিত ইলহামের উপর তাঁর এতই আস্থা ছিল যে, তিনি ঐ ইলহামকে সরাসরি নির্ভূল ও সংঘটিত ব্যাপার- বলে বারবার ঘোষণা করেছিলেন। তিনি প্রায় পত্রেই উল্লেখ করতেন যে, উক্ত ইলহামের মধ্যে শয়তানের কোন দখল ছিল না এবং নাফসানীয়াতও ছিল না। তিনি বলতেন- অবশ্যই পাঞ্জাব আমার হাতে বিজিত হবে এবং এই বিজয়ের পূর্বে আমার মৃত্যু হবে না।" (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ২৯১)
মন্তব্যঃ পাঞ্জাব বিজয় সম্পর্কিত ইলহামটি এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তাঁর দাবি মতে এতে শয়তানের প্রতারণার কোন দখল ছিল না, নাফসানীয়াতের বিন্দুমাত্র লেশ ছিল না এবং এই বিজয়ের পূর্বে তার মউতও আসবে না। শিখ পাঞ্জাব বিজয় তো দূরের কথা- তিনি সীমান্ত প্রদেশও জয় করতে পারেন নি। এর পূর্বেই তাঁকে মাল সামানা নিয়ে আসমানে পাড়ি দিতে হয়েছিল। এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ইলহাম যখন মিথ্যায় পর্যবসিত হয়ে গেল এবং মিথ্যা প্রমাণের জন্য অন্য কোন সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজনও নেই- তাহলে কি সৈয়দ সাহেবকও মিথ্যাবাদী (কাজ্জাব) বলা যাবে- না কি যাবে না? গবেষক লেখক ও সৈয়দ সাহেবের প্রসংশাকারীদের এ বিষয়ে চিন্তা করা উচিৎ।
(৩) সৈয়দ সাহেব আপন বোনের (সৈয়দ মুহাম্মদ ইয়াকুবের মাতা) নিকট থেকে বিদায় নেয়ার সময় বলেছিলেন-
"বোন, আমি তোমাকে খোদার হাতে সোপর্দ করে গেলাম। তুমি একথা মনে রেখো- যতক্ষণ পর্যন্ত হিন্দুস্থানের শির্ক, ইরানের শিয়া মতবাদ, চীনের কুফরী এবং আফগানিস্তানের মুনাফেকী আমার হাতে খতম না হবে এবং প্রত্যেকটি মৃত সুন্নাত পূনর্জীবিত না হবে- ততক্ষণ আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত আমাকে তুলে নিবেন না। এই ঘটনাগুলো ঘটার পূর্বে কেউ যদি আমার মৃত্যু সংবাদ তোমাকে পৌঁছায় এবং হলফ করেও যদি বলে যে, সৈয়দ সাহেব আমার সামনে ইন্তিকাল করেছেন অথবা নিহত হয়েছেন- তাহলে তুমি তার কথা কখনও বিশ্বাস করো না। কেননা, আমার রব আমার সাথে অঙ্গীকার করেছেন যে, এগুলো আমার হাতে পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে মৃত্যু দিবেন না" (সাওয়ানিহে আহমদী পৃঃ ১৭১)।
মন্তব্যঃ হিন্দুস্থানের শির্কও খতম হয়নি, ইরানের শিয়া মতবাদও ধ্বংস হয়নি। চীনের কুফরী এবং আফগানিস্তানের মোনাফেকীও লোপ পায় নি। এর পূর্বেই সৈয়দ সাহেব নিজে খতম হয়ে গেছেন। সৈয়দ সাহেব যে বলেছেন- "আল্লাহ আমার সাথে দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন"- এ কথার দুটি সুরত হতে পারে। হয় সরাসরি ওয়াদা করেছেন- নয়তো কোন ফেরেস্তার মাধ্যমে আশ্বাস দিয়েছেন। যদি ঘটনা এরূপই হতো- তাহলে ওয়াদা নিশ্চয়ই পূর্ণ হতো। বুঝা গেল- ওয়াদাই হয়নি। আর ওয়াদা হয়ে থাকলে আল্লাহ ঐ ওয়াদার খেলাফ করেছেন। নাউযু বিল্লাহ! এটা কি আদৌ সম্ভব? এভাবে সৈয়দ সাহেবের এই ভবিষ্যৎবাণীটিও মিথ্যা প্রমাণিত হলো এবং তিনিও মিথ্যুকদের দলভুক্ত হয়ে গেলেন।
পরবর্তী খলিফাদের অনৈসলামী কার্যকলাপ
সৈয়দ সাহেব নিহত হওয়ার পর তার পরবর্তী খলিফাগণ গদীনশীন হয়। তারা প্রথমে সৈয়দ সাহেবের আকাশে উত্তোলনের কথা প্রচার করে। পরে মূর্তি তৈরি করে আত্মগোপন কাহিনীর নাটক সাজায়। সরলপ্রাণ মুসলমানকে প্রতারণা করে তারা বলতে থাকে- হুজুর পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করে আছেন। উপযুক্ত সময়ে তিনি পূণঃ আত্মপ্রকাশ করবেন। এই কথা বলে খলিফারা সোনা দানা লুটতে থাকে। এভাবে পরবর্তী খলিফা পূর্ববর্তী খলিফার সাথে টেক্কা দিয়ে দু'কদম অগ্রবর্তী হয়ে যায়। [বেলায়েত আলী আজিমাবাদী ছিল প্রথম খলিফা। দ্বিতীয় খলিফা তার ভাই এনায়েত আলী আজিমাবাদী- অনুবাদক]।
পরবর্তী খলিফাঃ নেয়ামত উল্লাহ শহীদ ও রহমতুল্লাহ গাজীর কার্যকলাপ
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মৃত্যুর পর গোপনে পালাক্রমে খলিফা নিযুক্ত হতে থাকে। এদের মধ্যে নেয়ামত উল্লাহ ও রহমতুল্লাহ দুই ভাই ছিলেন। মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া এই দুই আমিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তিনি বলেন- "খলিফা মাওলানা আব্দুল করিমের মৃত্যুর পর মাওলানা আব্দুল্লাহর দুই নাতী- যথাক্রমে নেয়ামত উল্লাহ ও রহমতুল্লাহ পরপর খলিফা ও আমির নিযুক্ত হন। নেয়ামত উল্লাহ খানকে অজ্ঞাত কোন মুসলমান হত্যা করে ফেললে তার ভাই রহমতুল্লাহ আমির ও খলিফা নিযুক্ত হন। মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া তার লিখিত "উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাঝি" গ্রন্থের ৩য় খন্ড ৭৩ পৃষ্ঠায় আমির নেয়ামত উল্লাহর প্রশংসামূলক প্রশস্তি গাইলেও তার আসল কুকীর্তিগুলো অন্যান্য জীবনীকারগণ তাদের গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে আহলে হাদিসপন্থী লেখক মুহাম্মদ আলী কাসুরী তার রচিত "মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তানের ১০৮ পৃষ্ঠায় কি লিখেছেন- তা দেখুন-
"যখন আমি (কাসুরী) সীমান্ত প্রদেশ সফর করলাম- তখন এই জামাতের আমির ছিল নেয়ামতুল্লাহ খান। আমির নেয়ামতুল্লাহ ছিল স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ সুন্দর চেহারা, লম্বা দেহ, যুবক, কথায় রুচিশীল ও দৃঢ়। সে ছিল খুবই চতুর ও মানুষ চেনার ওস্তাদ। তার ভাষণ খুবই হৃদয়গ্রাহী ছিল। কাটছাঁট দাঁড়ি ও মাথায় পরিচ্ছন্ন রুমাল ব্যবহার করত। পোশাক আষাকের ক্ষেত্রে পাটনা ও ইউপির প্রাচীন লম্বা কুর্তা ও বুটিদার ছদরিয়া পরিধান করত। মাথায় সর্বদা পাগড়ি ও হাতে সুন্দর ছড়ি থাকত। মুসলমান আমির উমারাদের মত সে মহিলাপ্রিয় ছিল। তিনজন ছিল বিবাহিতা স্ত্রী। দশ বারোজন সুন্দরী যুবতী ছিল খেদমতগার হিসাবে"। (মুহাম্মদ আলী কাসুরী কৃত মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিন্তাল পৃঃ ১০৮)।
[এগুলো ছিল সৈয়দ সাহেবের পরবর্তী খলিফাদের কান্ড কীর্তি। সাধারণ মুজাহিদদের অবস্থা কি হতে পারে? অনুমান করেই তা বুঝা যায় অনুবাদক]
বায়তুল মাল সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার
বালাকোটের মুজাহিদ বাহিনীর গোপন আন্দোলন সৈয়দ সাহেবের মৃত্যুর পরও চলমান ছিল। তারা (একটি গ্রুপ) আমিরুল মোজাহেদীন (সংক্ষেপে আমির) পদ সৃষ্টি করে গোপনে গোপনে আন্দোলন চাঙ্গা করে রেখেছিল। এই আমির ছিল মুজাহেদীনদের বাইতুলমাল প্রধান। এই বাইতুলমালের যথেচ্ছ ব্যবহারের একটি বাস্তব চিত্র মুহাম্মদ আলী কাসুরী তার গ্রন্থে বিবৃত করেছেন। এবার শুনুন উদ্ধৃতি-
"ইমারতের মধ্যে মুজাহেদীনদের বাইতুলমাল ছিল। ইহার চাবি থাকত আমির সাহেবের হাতে। বাইতুলমাল সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার কারো ছিল না। আমি (কাসুরী) শুনেছি- কিছু বেআদব লোক বাইতুলমাল যথেচ্ছ ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন তোলার দুঃসাহস করেছিল। এই ধৃষ্টতার জওয়াব দেয়া হত এভাবে- "রাতে আমির সাহেবের উমেদাররা তাদেরকে গোপনে খতম করে দিত। তাদের ব্যাপারে কেউ কোন কিছুই বলতে পারত না" (মুহাম্মদ আলী কাসুরী কৃত মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ১০৯)।
মন্তব্যঃ তথা কথিত ইসলামী হুকুমাতের এই ছিল বাইতুলমাল খন্ড চিত্র। নেয়ামতুল্লাহ ছিলেন আমিরুল মুজাহেদীন। আমির পদে সমাসীন হয়ে তিনি অনেক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন। জেনানা ও জওহর- উভয়টিই ছিল তার করায়ত্বে।
আমির সাহেবের অধীনস্থ ইসলাম হত্যাকারী সৈন্যবাহিনী
আমিরুল মোজাহেদীন নেয়ামত উল্লাহ ইসলাম ও মুসলমানের খেদমত কিভাবে করেছিল- মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরী তার "মোশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান" নামক গ্রন্থে লিখেছেন -
"মুজাহেদীনদের মধ্যে পৃথকভাবে কিছু লোক নিজ নিজ কাজ করত। তারা নিজেদের খানা নিজেরাই রান্না করত। তাদের ছাড়াও বিশেষ এক শ্রেণীর মুজাহিদ ছিল- যারা ছিল আমির সাহেবের পার্শচর এবং পক্ষপুটে আশ্রিত। তাদের বিশেষ খেদমতের প্রতিদানে আমির সাহেব সব সময় তাদেরকে উপহার উপঢৌকন দিয়ে সম্মানিত করতেন। এদের মধ্যেও আবার আমির সাহেবের কিছু খাস খাদেম ও প্রাণ উৎসর্গিত লোক ছিল। এই শ্রেণীর লোকেরা আমির সাহেবের ইশারা ও ইঙ্গিতে যে কোন অন্যায় করতে সদা প্রস্তুত ছিল। উদাহরণ স্বরূপ- আমির সাহেবের কোন উপপত্নী গর্ভবতী হয়ে পড়লে সন্তান জন্মের পর তারা ঐ সন্তানকে আমির সাহেবের নির্দেশে চুপে চুপে নদীতে ফেলে দিত। আমির সাহেবের অভ্যাস ছিল- এসব উপ-পত্মীকে সব সময় পরিবর্তন করা। যে উপপত্নীকে এভাবে সরিয়ে দেয়া হতো- তাকে ঐসব খাস খাদেমদের কারুর কাছে বিয়ে হত এবং ঐ স্বামীকে উপযুক্ত মাসিক ভাতা ও উপঢৌকন দেয়া হত। আর একটি কাজ বড়ই গর্হিত ছিল। ঐসব খাদেমাদের মধ্যে যদি কোন খাদেমা অস্বাভাবিক সুন্দরী হত- তাহলে তাকে অন্য খাদেমের কাছে বিয়ে দেয়ার পরও সে আমির সাহেবের সুদৃষ্টির কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হত" (মুহাম্মদ আলী কাসুরী রচিত মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ১১০)।
মন্তব্যঃ মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরী ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী হওয়া ছাড়াও আক্বিদায় ছিলেন আহলে হাদীস বা চরমপন্থী ওহাবী। তার পিতা মৌলভী আব্দুল কাদেরও ছিলেন বিখ্যাত আহলে হাদীস নেতা। এজন্য মুহাম্মদ আলী কাসুরীর স্বহস্ত লিখিত এসব কুকীর্তির ঘটনার মাধ্যমে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর আন্দোলনের সঠিক চিত্র বুঝতে খুবই সহায়ক হবে। আমরা এখানে আমিরুল মোজাহেদীন নেয়ামত উল্লাহ খানের কুকীর্তির পর্যালোচনা করব না। কারণ ব্যাপারটি দিবালোকের মতই উজ্জ্বল। আমাদের দুঃখ হয় শুধু ঐসব লেখকদের জন্য- যারা প্রকৃত ঘটনা জেনে শুনেও মুসলিহাতের খাতিরে এসব সত্য ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
নারী প্রাপ্তিতে আমিরের আনন্দ এবং মুহাম্মদ আলী কাসুরীর উদ্বেগ প্রকাশ
মুজাহিদ আন্দোলনের নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর বিবি ছিল তিনজন। এছাড়া তার মুজাহিদ বাহিনীর লোকদেরও একাধিক বিবি ছিল। সৈয়দ সাহেবের পরবর্তী বাহিনীর খলিফা আমির নেয়ামত উল্লাহর বিষয়ে জেনেছেন যে- তার বিবাহিতা স্ত্রীর সংখ্যা ছিল তিন এবং উপপত্নীর সংখ্যা ছিল দশ বারোজন। অনুরূপভাবে লোকদেরকে তার হাতের মুঠায় ও অধীনস্থ করে রাখার জন্য একাধিক বিবাহের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ আলী কাসুরীর চাক্ষুষ দেখা দীর্ঘ বিবৃতিটি নিচে উল্লেখ করা হল।
"আমির নেয়ামতুল্লাহ সাহেব মুজাহিদ মৌলভী মুহাম্মদ মুছাকে হাত করার জন্য প্রথমে একটি সুন্দরী যুবতীর সাথে বিবাহের ব্যবস্থা করেন। এর কয়েকমাস পরেই আর একটি সুন্দরী যুবতীর সাথে তার বিবাহের ব্যবস্থা করেন। এখন তার স্ত্রী হল দু'জন। আমি (কাসুরী) যখন উক্ত এলাকা সফর করি- তখন তার ছোট বিবির ঘরে একটি ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। মৌলভী মুহাম্মদ মুছা সাহেব এখন পুরোপুরি সংসারী হয়ে গেছেন। আমির নেয়ামতুল্লাহ তার জন্য যুক্তিসঙ্গত ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
মৌলভী মুছা সাহেবকে দৃশ্যতঃ আমির সাহেবের এই ব্যবহারে মূগ্ধ বলে মনে হল।
(মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ)।
এই মৌলভী মুহাম্মদ মুছা সাহেবের সাথে যখন কাসুরী সাহেবের আলাপচারিতা হয়- তখনই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে পড়ে। মৌলভী মুছা সাহেব প্রথমেই আমির নেয়ামতুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগের এক দাস্তান পেশ করলেন। আমীরের খারাপ আচরণ, নারীদের প্রতি তার আসক্তি, জিহাদের প্রতি তার অনীহা, জামাতের ফান্ডের ব্যক্তিগত ব্যবহার, অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বাইতুলমালের যথেচ্ছ ব্যবহার- ইত্যাদি সব কিছু বলে গেলেন। তিনি একথাও বললেন-
"আমি একথা মনে করে লজ্জাবোধ করি যে, আমি পাঞ্জাবে এই আমির ব্যক্তির পক্ষে কতই না মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করেছিলাম এবং জামাতের কাল্পনিক অবদানের কাহিনী বলে মানুষকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলাম। এরপর এখানে (সীমান্তে) এসে মনে হল- আমি পাঞ্জাবে ঘুমের ঘোরে ছিলাম। এখন যখন চোখ খুলে দেখলাম- এক ভয়ঙ্কর চিত্র সামনে দেখতে পেলাম। মুজাহেদীন দল নৈতিক ক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের বাস্তব আমলী শক্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। মুজাহেদীনদের দুটি শ্রেণী রয়েছে। এক অংশ হচ্ছে খোশহাল শ্রেণী- যারা আমিরুল মোজাহেদীনের সাথে সংশ্লিষ্ট। এরা অত্যন্ত উশৃঙ্খল, বদস্বভাব ও আত্মকেন্দ্রিক। এদের কাজ হচ্ছে- শুধু হালুয়া রুটি রোজগার করা। দ্বিতীয় অংশটি হচ্ছে সাধারণ শ্রেণীর। এরা পশুর মত জীবন যাপন করছে। এদের জীবন ধারণের মত খাদ্য সংগ্রহ করতেও কষ্ট হচ্ছে। তেলে ভাজা মশুরের ডাল আর জবের রুটি হচ্ছে এদের খাদ্য। এদেরকে ধর্মের আফিম গলাধঃকরণ করিয়ে খরগোশের নিদ্রায় অভিভূত করে রাখা হয়েছে।"
(কাসুরীর গ্রন্থ- মোশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ১৪ ও ১১৩)।
মন্তব্যঃ এই গোপন তথ্যটি সৈয়দ আহমদ সাহেবের জামাতের প্রাণ উৎসর্গকারীদের জবাবে ও কলমে কাগজের পাতায় লিখা হয়েছে। মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদীর (সুন্নী) ভক্তদের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে অভিযোগের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনা হত। সৈয়দ সাহেবের আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ কাসুরী সাহেব ও মৌলভী মুছা সাহেব এসব তথ্য লিখেছেন। মৌলভী মুছার আরও দাস্তান কাসুরীর কলমে শুনুন-
"আমিরুল মোজাহেদীন নেয়ামতুল্লাহ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আমাকে (মৌলভী মুছাকে) দুটি বিবাহ করিয়ে দিয়েছেন। উভয় বিবিই অতি সুন্দরী এবং যুবতী। প্রত্যেক দিক দিয়েই তারা অতি উত্তম বিবি। এখন এই দুই বিবির বদৌলতে দুনিয়াবী জিন্দেগীর প্রতি আমার মনের এমন আকর্ষণ হয়েছে যে, আমিরুল মোজাহেদীনের বিরুদ্ধে আমি ঠোঁট নাড়তে পারছি না। কেননা এই লোকটি এমন নীতিহীন যে, কোন ব্যক্তি সামান্য বিদ্রোহের ভাব দেখলেই সাথে সাথে তাকে হত্যা করে দেয়া হয়। আমার এই চিন্তা যে, যদি আমি এভাবে নিহত হয়ে যাই- তাহলে আমার বিবি বাচ্চারা কি করবে?" (উক্তগ্রন্থ পৃঃ ১১৪)।
মন্তব্যঃ সৈয়দ সাহেব ও জামাতে মুজাহিদীনের ভক্ত ও প্রেমিক জনাব গোলাম রসুল মেহের তার গ্রন্থে (সৈয়দ আহমদ শহীদ) এসব কথা হজম করে ফেলেছেন। তার মতে সীমান্তের মুসলমানরা সৈয়দ সাহেবের আক্বিদার বিরোধীতা করে ইসলামের চৌহদ্দী হতে খারিজ হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের এসব কেলেঙ্কারির হোতা, হত্যাকারী, সম্পদখোর, হালুয়া খোর এবং মুসলিম মিল্লাতের দুশমন উত্তরাধিকারীরা আক্বিদা-বিশ্বাসে ওহাবী হওয়ার কারণে এসব ঘটনার সত্যতা তার মনে কোন রূপ দাগ কাটতে পারেনি। সৈয়দ সাহেব ও তার মুজাহিদ বাহিনীর কান্ড ক্রিয়া ও স্বভাব চরিত্রের সাথে হুজুর আলাইহিস সালামের উত্তম আদর্শের কি সম্পর্ক আছে? আমিরুল মুজাহেদীন নেয়ামতুল্লাহ খান রাজা অন্দের ভোগবিলাস এবং চেঙ্গিস খানের জুলুম বর্বরতাকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। উচিৎ ছিল- তাদের সমালোচনা করা ও নিন্দা করা- কিন্তু ওহাবী হওয়ার সূত্রেই এসব কুকীর্তি ঢেকে রাখা ও তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরপরেও এসব লেখকরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে মনে করেন এবং শরিয়তপন্থী ব্যক্তিবর্গকে দোষী সাব্যস্ত করেন। অনুতাপের বিন্দুমাত্রও তাদের জিন্দেগীতে দেখা যাচ্ছে না। এই না দেখাটাও হয়তো আমিরুল মোমেনীন ও তার মুজাহিদ বাহিনীর আমিরেরই একটি কারামত।
আমিরুল মোজাহেদীনের সমালোচনা করা কুফর
ইসলামের দৃষ্টিতে আমির ও জনগণের মধ্যে কেহই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের জামায়াতে মুজাহেদীনের আমিরের স্থান সকল সমালোচনার উর্ধ্বে। মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরী এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন-
"বাইআত করাবার সময় মানুষকে আমিরের প্রতি আনুগত্য, গোপনীয়তা রক্ষা করা, মুজাহেদীন সদস্যদেরকে ভাই মনে করা এবং মুজাহিদ বহির্ভূত সকলকে তুচ্ছ মনে করা অথবা নিদেন পক্ষে অপর মনে করার অঙ্গীকার নেয়া হত। আমীরের আনুগত্যের অর্থ ছিল- আমিরের ব্যক্তিত্বকে সর্ব প্রকারের সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করা, তার দোষ ত্রুটিগুলোকে ভাল মনে করা এবং তার বিরুদ্ধে কোন খারাপ বাক্য মুখে উচ্চারণ না করা। কেননা, আমিরের আনুগত্য অস্বীকার করলে বাইআত ভঙ্গ বলে গণ্য হয় এবং বাইআত ভঙ্গ করা কুফর ও ধর্মত্যাগের সমান অপরাধ" (মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ৯৯)।
মন্তব্যঃ অন্য মুসলমানকে নিজের চেয়ে অধম মনে করা এবং আমিরের বিরুদ্ধে বৈধ সমালোচনাকে কুফর বলা ও মনে করা ইসলামী আইনের সরাসরি পরিপন্থী। কিন্তু বালাকোট আন্দোলনের সমর্থক জনাব গোলাম রসুল মেহের এবং তার মতাবলম্বী অন্যান্য লেখকরা দেখেও না দেখার ভান করেছেন এবং এই ইসলামী সীমারেখা পদদলিত করাকে বৈধ মনে করেছেন।
ওহাবী মোজাহেদীন এবং কমিউনিষ্ট
মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরী ওহাবী মোজাহেদীন ও কমিউনিস্টদের মধ্যে কিছু সামঞ্জস্য উল্লেখপূর্বক লিখেছেন-
"এই মুজাহিদ বাহিনীর প্রধান চরিত্র (আমির) হিন্দুস্থানের কেন্দ্রগুলোকে ভীত ও সন্ত্রস্ত রাখার জন্য যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- এত বড় আমানতদার ও একনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি (আমির) জামাতের পক্ষে অবিশ্বাস্য রকম মিথ্যা প্রচারণা চালাতেন। মনে হয় যেন মানুষ পরস্পর বিরোধী দ্বৈতবাদের পুতুল মাত্র। আমি এই দ্বৈতবাদ ভাল ভাল কমিউনিস্ট কর্মীদের মধ্যেও দেখেছি। কিন্তু আমি চিন্তা করে আশ্চর্য হয়ে যাই- একজন আমানতদার, একনিষ্ঠ ও আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি মানুষ (আমির) কি করে এই জামাতের জন্য মিথ্যা প্রচারণা করতে একটুও ইতস্ততঃ করছে না- বরং এই মিথ্যাচারকে সে প্রকৃত সাওয়াবের কাজ মনে করছে?" (মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ১২১)।
মন্তব্যঃ আমরা এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করব না। চাক্ষুস স্বাক্ষী- তাও আবার আহলে হাদীস। তিনি বলছেন, ওহাবী মুজাহেদীনরা কম্যুনিষ্টদের মত জামাতের পক্ষে আশ্চর্যজনক মিথ্যা প্রচারণা চালাত। মিথ্যা বলা এবং উহা প্রচার করা ডবল অপরাধ। কিন্তু ওহাবী ভক্তরা (মুহাম্মদ আলী কাসুরী ও মেহের) এসব দেখেও- না দেখার ভান করলে আমরা তাকে "এক দরবেশের বিরুদ্ধে আর এক দরবেশের বিষোদগার" ছাড়া আর কি বলতে পারি?। মিথ্যা বলা, মিথ্যা লেখা ও অপবাদ দেয়া ওহাবীদের স্বভাব- অনুবাদক)।
আমিরুল মোজাহেদীনের আয়ের উৎস
ইদানিংকালে সৈয়দ সাহেবের ভক্তরা (দেওবন্দ) খুব জোরেশোরে মুসলমান আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখগণের নজর নেয়াজের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে এবং তাদেরকে তীব্র সমালোচনার পাত্রে পরিণত করছে। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের নজরানার প্রতি তাদের দৃষ্টি পড়ছে না। অনুরূপভাবে মুজাহেদীনদের প্রতিটি দোষ তাদের দৃষ্টিতে সুন্দর বলে মনে হচ্ছে। আমিরুল মোজাহেদীনের ব্যাপারে স্যাপারটি তো আসলেই আলাদা জিনিস। মুহাম্মদ আলী কাসুরী সাহেব আমিরের আয়ের উৎস সম্পর্কে লিখেছেন-
"হিন্দুস্থানের স্থানে স্থানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এগুলো ছিল দৃশ্যতঃ লেখা পড়ার কেন্দ্র। মাদ্রাসা ও খয়রাতী চাঁদা নির্ভরশীল অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে যথেষ্ঠ চাঁদা একত্রিত করা হত। এই চাঁদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সীমান্তের ওপারে জেহাদের নামে আমিরুল মোজাহেদীনের কাছে গোপনে পৌঁছে যেত।"
(মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ১১৯)।
মন্তব্যঃ যাকাত ও সদকার টাকা- যা ইয়াতিম ও মিসকিন ছাত্রদের নামে ওহাবী মৌলভী সাহেবরা আদায় করত- তার একটি অংশ জেহাদের বাহানা করে সীমান্তে আমিরুল মোজাহেদীনের কাছে প্রেরণ করা হত। ঐ খয়রাতী চাঁদা হতেই আমিরুল মোজাহেদীন (নেয়ামত উল্লাহ) নারীদের শখ পূর্ণ করতেন। দশ বারোজন উপপত্নীকে বিনা বিবাহে নিজের ভোগে ব্যবহার করতেন। বাইতুল মাল অবৈধভাবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীকে নদীতে ডুবিয়ে মারা হত। এসব মাদ্রাসায় সাহায্য করা কি আদৌ দুরস্ত হবে? বিশেষ করে- যেসব প্রতিষ্ঠান উল্লেখিত কাজে খয়রাতি চাঁদা ব্যবহার করে?
আমির রহমতুল্লাহ গাজীর পরিচয়
আমির নেয়াম উল্লাহর পর আমির রহমতুল্লাহর পরিচয় দিতে গিয়ে মুহাম্মদ আলী কাসুরী চাক্ষুস দেখা বিবরণ এভাবে দিচ্ছেন-
"রহমতুল্লাহ তার ভাই নেয়ামতুল্লাহর মতই বদ-স্বভাব, ভবঘুরে, উচ্ছন্ন মেজাজের যুবক ছিল। আমির নেয়ামতুল্লাহর স্বভাব যদি নারী কেলেঙ্কারির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তাহলে তার ভাই রহমতুল্লাহ ছিল নওজোয়ান ছেলেদের মহব্বতে দুনিয়া সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বেখবর। কখনও যদি তার টাকা পয়সার প্রয়োজন হত এবং আমির নেয়ামতুল্লাহ তা দিতে অস্বীকার করত- তাহলে দলের মধ্যে দস্তুর মত হাঙ্গামা শুরু হয়ে যেত। রহমতুল্লাহ আপন বড় ভাই নেয়াম উল্লাহকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করত এবং টাকা আদায় করেই ছাড়ত। আমরা তাদের এই যুদ্ধে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু করার কিছুই ছিল না। আমি কয়েকবার আমির নেয়ামতুল্লাহকে বলেছি যে, রহমতুল্লাহর জন্য উল্লেখযোগ্য ভাতা নির্ধারণ করা হোক- কিন্তু আমির সাহেব বলতেন, সে উশৃঙ্খল ও উচ্ছন্ন হয়ে গেছে। কোন ভাতাই তার দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ঠ হবে না। আল্লাহই ভাল জানেন- এটা বাহানা ছিল- না কি প্রকৃত ঘটনা" (গোলাম রসুল মেহের কৃত জামায়াতে মুজাহেদীন সূত্রে কাসুরীর বিবৃতি পৃঃ ৫১০)।
মন্তব্যঃ এই ছিল সৈয়দ সাহেবের পরবর্তী দুই খলিফার কান্ডকীর্তি। এদেরকেই ভক্তি করে মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া একজনকে বলেছে শহীদ, আর একজনকে বলেছে গাজী। শহীদ আর গাজী যদি এমন দুশ্চরিত্র ও দুষ্কর্মের নাম হয়ে থাকে- তাহলে অভিধানে শহীদ ও গাজী শব্দের বর্তমান অর্থের পরিধি আরও বাড়াতে হবে বৈ কি?
[উল্লেখ্য, সৈয়দ আহমদের মৃত্যু নিয়ে দূ'দল হয়ে গিয়েছিল। একটি দল হয়েছিল বেলায়েত আলী ও এনায়েত আলী নামক দুই খলিফার অধীন। এরা বিশ্বাস করত- সৈয়দ সাহেব মৃত্যুবরণ করেন নি বরং আত্মগোপন করে পর্বত গুহায় অথবা আকাশে লুকিয়ে আছেন। সময় মত ইমাম মাহদী হয়ে আত্মপ্রকাশ করবেন। এদেরকে সাদেকপুরী জামাত বলা হয়। আর একটি দল ছিল দিল্লী জামাত। এদের নেতা ছিলেন জাফর থানেশ্বরী, মির্জা হায়রাত দেহলভী, নজীর হোসাইন বিহারী দেহলভী, মৌলভী মাহবুব আলী। এরা সৈয়দ সাহেবের মৃত্যু হয়েছে বলে বিশ্বাস করত। (দেখুন- ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী রচিত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা -পরিশষ্ট ৪০ পৃঃ ১৯৭- অনুবাদক)।
সাহেবজাদা বরকতুল্লাহ
কথিত নেয়ামতুল্লাহ শহীদ ও রহমতুল্লাহ গাজীর পর সাহেবজাদা বরকতুল্লাহ-এর পরিচয় জানা দরকার। তাহলে আপনারা জানতে পারবেন- "এই ঘরানা ছিল সৌরজগতের কেন্দ্রবিন্দু সূর্য সদৃশ- যাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য গ্রহ নবরত্নের মত শোভাবর্ধনকারী।" তার সম্পর্কে মৌলভী মুহাম্মদ আলী কাসুরী লিখেছেন-
"আমির নেয়ামত উল্লাহর ছেলে সন্তানদের মধ্যে বড় ছেলে বরকত উল্লাহ ছিল ঐ সময় মাত্র ৯ বৎসরের বালক। সে ছিল খুবসুরত এবং চরিত্র ছিল বিকৃত। সবসময় দু তিনজন বাউন্ডেলে যুবক তার সাথে থাকত। এজন্য বরকতুল্লাহর উচ্ছন্ন হওয়া ছিল একান্ত স্বাভাবিক" (মুশাহাদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান পৃঃ ১১১)
মন্তব্যঃ এই ছিল সাদেকপুরী বেলায়েত আলী, এনায়েত আলী দলের খলিফা আব্দুল করিম, নেয়ামত উল্লাহ, রহমতুল্লাহ, বরকতুল্লাহ- প্রমূখ মনিষীদের কর্মকাণ্ড। এরাই শহীদ গাজী- ইত্যাদি লকব পেয়েছিল। এরা তরিকায়ে মুহাম্মদীয়ার খলিফা ছিল এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মুরিদ অথবা খলিফাদের মুরিদ ছিল। এরপরও যদি লোকেরা বালাকোট আন্দোলনকে ইসলামী আন্দোলন বলে- তাহলে সত্য গোপনের উদাহরণ এর চেয়ে বড় আর কিছু হতে পারে না। মুহাম্মদ আলী কাসুরী নেয়ামত উল্লাহ ও রহমতুল্লাহর ওখানে ছিলেন এবং স্বচক্ষে সব দেখে শুনে বিবেকের তাড়নায় তা লিপিবদ্ধ করেছেন। যারা না দেখে না শুনে অন্ধ বিশ্বাসে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন- তাদের জন্য এই চাক্ষুস প্রমাণ কাজে লাগাতে পারে- যদি তারা নিরপেক্ষ হন।
গোলাম রসুলের ইতিহাসে অনুমান ও আন্দাজের ছড়াছড়ি
ইসলামের ইতিহাসে বেশুমার লেখক এমন ছিলেন- যারা ইতিহাস বিকৃতির জন্য সুপরিচিত। তারা অনেক পবিত্র লোকের কীর্তি পরিবর্তন ও বিকৃত করে দিয়েছে। এর পরিবর্তে ইসলামের কলঙ্ক স্বরূপ কিছু লোককে পবিত্র সাজিয়ে তুলে ধরেছে। একটি উপমা প্রসিদ্ধ আছে যে, "মিথ্যাবাদীর স্মৃতি শক্তি কমে যায়।" তারা হাজারো চেষ্টা করলেও তাদের অজান্তেই তাদের মুখ থেকে আসল কথা এক সময় বের হয়ে আসে।
জনাব গোলাম রসুল মেহের সাহেবকে ইতিহাস বিকৃতকারীদের কাতারে শামিল করা যায়। তিনি অতি দুরদর্শিতা ও অতি সাবধানতার সাথে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে "সংস্কারক" এবং তার "মুসলিম হত্যার আন্দোলনকে" মুসলমানদের সংস্কারবাদী আন্দোলন বানিয়ে ছেড়েছেন। মেহের সাহেবের ইতিহাস গ্রন্থে এই নিজস্ব চিন্তাধারার সংমিশ্রণ প্রক্রিয়াটি খুবই আফসোসের বিষয় এবং তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় কালো অধ্যায়। তিনি কাহিনীকে বলেন প্রকৃত ঘটনা এবং প্রকৃত ঘটনাকে বলেন কাহিনী। তিনি নিজের অজান্তেই এর স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু স্বীকার করলে কি হবে- তিনি যে ভক্তির জিঞ্জিরে পায়ে বেড়ি বাঁধা! তিনি যে মুজাহিদদের অন্ধ ভক্ত তার লেখনীতেই শুনুন-
"আমি সদা সর্বদা মুজাহেদীনদের শান ও মান রক্ষা করার পক্ষে- যদিও ঘটনাগুলো পূর্ববর্তী লেখকদের বর্ণনা ও ব্যাখ্যার বিপরীতই হোক না কেন! (ডাঃ খান বাহাদুর পন্নী রচিত" ইফাদাতে মেহের পৃঃ ২৩১)।
মন্তব্যঃ মেহের সাহেব সর্ব অবস্থায়ই মুজাহেদীনদের মান সম্মান রক্ষা করার পক্ষপাতী, যদিও তারা ঐ সম্মানের অধিকারী নয়। এইরূপ অন্ধভক্তিও পক্ষপাতিত্ব ইতিহাসে সত্যকে গোপন করতে এবং বিশ্বস্ততার বিপক্ষে যেতে লেখককে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। সত্য গোপনের এমন একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনি নিজেই লিখেছেন-
"আমার মনে একটি আফসোস রয়ে গেল। আমি আপনার (ডাঃ খান বাহাদুর পন্নীর) গ্রন্থের ঐ খন্ডটি দেখতে পারিনি- যেটি সরকারি দলিল হিসাবে গণ্য। আপনি গোপন সরকারি দলিল থেকে পুরোপুরি সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন- এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি একটি কথা আরজ করতে চাই। তা হচ্ছে- অনেক সময় এই সরকারী গোপনীয় তথ্যগুলোও ভূল বুঝাবুঝির কারণ হয়ে দাঁড়ায়" (মেহের সাহেবের উক্তি- ইফাদাতে মেহের গ্রন্থ পৃঃ ১০৩)।
মন্তব্যঃ আজ পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীর গবেষকরাই একথার উপর একমত যে, সরকারি দলিল দস্তাবিজের চেয়ে বড় প্রমাণ আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু মেহের সাহেবের মতে- "কোন কোন সময় সরকারি দলিল দস্তাবিজও ভূল বুঝাবুঝির কারণ হয়ে দাঁড়ায়"। মনে হয় মেহের সাহেব- "কোন কোন সময়ে বা ক্ষেত্রে" এই শর্তটি জুড়ে দিয়ে বুঝাতে চাচ্ছেন যে, সৈয়দ সাহেবের ক্ষেত্রেই ঐ সব সরকারি দলিল দস্তাবেজই ভূল বুঝাবুঝির জন্ম দিয়েছে। অন্য ব্যাপারে ঐগুলো নির্ভরযোগ্য হতে পারে।
মেহের সাহেবের এই ধরনের উক্তির পর কোন নিরপেক্ষ সত্যপন্থীরা কি তাঁকে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক বলে স্বীকার করে নিতে পারেন? সৈয়দ সাহেবের ব্যাপারে মেহের সাহেব নিজেই অনেক কাহিনী তৈরি করেছেন এবং এগুলোর উপর রং লাগিয়েছেন। তিনি নিজের অনুমানের মাধ্যমে অনেক অতিরিক্ত কথা বাড়িয়ে বলেছেন। তিনি তাঁর লিখিত "সৈয়দ আহমদ শহীদ" গ্রন্থে কয়েক জায়গায় মনগড়া ইতিহাস রচনা সম্পর্কে নিজেই স্বীকার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ নিম্নে কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করা হল- "সৈয়দ আহমদ শহীদ" গ্রন্থে হতে। উদাহরণস্বরূপ-
(১) ডিম গোলা ও শানকিয়ারী যুদ্ধগুলো পাঠান মুসলমানদের বিরুদ্ধে কি কারণে ঘটল- সে সম্পর্কে তথ্যাবলী ভান্ডারে হঠাৎ করে শুন্যতা দেখা দিয়েছে। কোন তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা অনুমান করে লেখা ছাড়া গত্যন্তর নেই" (গোলাম রসুল কৃত সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৪২৪)।
মন্তব্যঃ ইতিহাস রচনায় অনুমান বলতে কিছু আছে কি? এখানে তো অতীতের সংঘটিত ঘটনাবলীই লিখা হয়- অন্য কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে ঐ দু'টি যুদ্ধ হয়েছিল শিখদের বিরুদ্ধে।
(২) "হারামাইন শরীফাইন (মক্কা-মদিনা) হতে ফেরত আসার পর (১৮২০ খৃঃ) সৈয়দ সাহেব মনে প্রাণে জেহাদের জন্য মশগুল হয়ে গেলেন। এই জেহাদের জন্যই তিনি আপন মূল্যবান জীবনটি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। ঐ সময়ে তাঁর ব্যতিব্যস্ত কাজের ফিরিস্তি অবশ্য আমার কাছে নেই। তবে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তাঁর পক্ষীয় আহবায়করা শহরে বন্দরে ও গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে হয়তো দাওয়াতী কাজ করত" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৩৪)।
আশ্চর্য লাগে- এই ঘুরা ফেরার কোন ফিরিস্তি মেহের সাহেবের জানা না থাকলেও তিনি এক্বিন ও নিশ্চয়তার সাথে কি করে বললেন যে, হয়তো তারা শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে গিয়ে দাওয়াতের কাজ করত? ব্যাপারটি যেহেতু সৈয়দ সাহেবের- তাই না দেখেই বিশ্বাস করা জনাব মেহের সাহেবের নিকট প্রকৃত ঈমান ও ইসলাম।
(৩) "দাওয়াতকারীগণের নেতা ও মুখপাত্র ছিলেন ইসমাঈল দেহলভী ও আব্দুল হাই। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তারা হয়তো আক্বিদা ও আমল সংশোধন করার ওয়াজই করতেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৩৪)।
মন্তব্যঃ এই যে, "হয়তো ওয়াজ করতেন বা করে থাকবেন" পরিভাষাটি জনাব মেহের সাহেব ব্যবহার করেছেন - ইতিহাসে তো এরকম সন্দেহজনক পরিভাষার কোন স্থান নেই। ইতিহাস হলো অতীতের সত্য ঘটনার চিত্র। এখানে অনুমান করে কিছু বলার সুযোগ নেই। পক্ষপাতিত্ব আর কাকে বলে?
(৪) "আমার দৃঢ় বিশ্বাস- টঙ্কের আমির নওয়াব আমির খান সাহেবই যুদ্ধের অস্ত্র-সস্ত্র ও মাল মসলা ছাড়াও বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থও হয়তো সৈয়দ সাহেবের খেদমতে হাদিয়া ও নজরানা হিসাবে প্রেরণ করে থাকবেন" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২৭৬)।
মন্তব্যঃ ইংরেজ কোম্পানী বাহাদুরের কাছে টঙ্কের নওয়াব আমির খানকে উপস্থিত করে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে রাজ্যের কিছু অংশ ফিরে পাওয়ার যে চুক্তি হয়েছিল- সেই কুটনৈতিক ব্যবস্থা করেছিলেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার চাকুরী জীবনে। এই কাজের পুরস্কার স্বরূপ টঙ্কের নওয়াব আমির খান সৈয়দ সাহেবকে পাঠান ও শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বিপুল পরিমাণে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করেছিল। জনাব গোলাম রসুল এই সাহায্যের কথা অনুমান করে লিখেছেন। এর প্রমাণ হলো- একবার বলছেন আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আবার বলছেন- "হয়তো অস্ত্রসস্ত্র ও নগদ অর্থ পাঠিয়ে থাকবেন"। তার এই কথা দুটি পরস্পর বিরোধী। উভয় কথার অর্থই ভিন্ন। কিন্তু এখানে যে প্রেম ও ভক্তির ব্যাপার স্যাপার! শুনেছি- প্রেম ও ভক্তি উভয়টিই মানুষকে অন্ধ করে ফেলে (কোন ত্রুটিই চোখে ধরা পড়ে না)।
(৫) "পাঞ্জাবের শিখ হুকুমত সৈয়দ সাহেবের মত কপর্দকহীন একজন জাগ্রত ব্যক্তিকে কি রূপে সহ্য করতে পারে? তবুও পূর্ণ নিশ্চয়তা ও দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যে, তাদের মধ্যে পেরেশানি ও অস্থিরতা দেখা দিয়ে থাকবে" (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ৩৩৩)।
মন্তব্যঃ "এই- নিশ্চয়তা, দৃঢ়তা এবং অস্থিরতা দেখা দিয়ে থাকবে" শব্দগুলো বিবেচনার বিষয়। এগুলো জনাব মেহের সাহেবের অন্তর্দৃষ্টিশুণ্য জ্ঞানেরই পরিচয় বহন করে।"
(৬) "সৈয়দ সাহেবের পুরা ইসলামী বাহিনীর মধ্যে মাত্র একটি হাতীই ছিল। তাই এটাকে দর্শনীয় মনে হচ্ছিল। সীমান্তের পাঠান সর্দার ইয়ার মুহাম্মদ খান সম্ভবতঃ শিখদেরকে বলে দিতে পারে যে, সৈয়দ সাহেব হাতীর উপর আরোহী ছিলেন" (সৈয়দ আহমদ পৃঃ ৩৭৯)।
(৭) "মদিনা মোনাওয়ারায় কয়েকটি দর্শনীয় জেয়ারতগাহ রয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- সৈয়দ সাহেব ঐ সমস্ত স্থানে গিয়ে থাকবেন"। (সৈয়দ আহমদ শহীদ পৃঃ ২২৭)।
মন্তব্যঃ ঐ সমস্ত পবিত্র স্থান সমূহে সৈয়দ সাহেব গিয়েছিলেন বলে গোলাম রসুল সাহেব আমতা আমতা করে অনুমান ভিত্তিক নিশ্চয়তা দিচ্ছেন- কিন্তু পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না। কেননা "পৌঁছে থাকবেন" শব্দটিই সন্দেহজনক ভাব প্রকাশ করছে।
[বিঃদ্রঃ মূল লেখক (হোসেইন গার্দেজী) গোলাম রসুল সাহেবের সৈয়দ আহমদ শহীদ গ্রন্থ হতে নির্বাচিত ১৬ টি সন্দেহজনক অনুমান ভিত্তিক উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছেন। পূর্বাপর সূত্র না জানার কারণে বাকি ৯টি উদ্ধৃতির মর্ম সঠিকভাবে উদ্ধার করা সম্ভবপর হয় নি। গোলাম রসুলের মূল গ্রন্থটিও আমার কাছে নেই। তাই ঐ ৯টি উদ্ধৃতির অনুবাদ বাকি রয়ে গেল এবং এগুলো তত প্রয়োজনীয়ও নয়- অনুবাদক]
অনুবাদ সমাপ্ত
১লা রজব শনিবার ১৪২১ হিজরী
৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০০০ ইং
১৫ ই আশ্বিন ১৪০৭ বাংলা
রাত ৯-৩০ মিনিট
অনুবাদ ও প্রকাশকঃ
সুন্নী ফাউন্ডেশন
মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭।
বালাকোট আন্দোলনের হাক্বিকত গ্রন্থ রচনায় গার্দেজী সাহেব যেসব গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছেন ও উদ্ধৃতি দিয়েছেন ঐ গুলোর তালিকাঃ
সহায়ক গ্রন্থসমূহঃ
লেখক/গ্রন্থ/প্রবন্ধ
১। মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী- সীরতে সৈয়দ আহমদ শহীদ ২য় খন্ড
২। মাওলানা আশ্রাফ আলী থানবী-
আরওয়াহে ছালাছা
৩। মাওলানা আবুল ফাত্তাহ্ আশরাফ আলী-
তোহ্ফায়ে মুহাম্মদীয়া
৪। পয়ামে শাহজাহানপুরী পত্রিকা-
শাহাদাতগাহে বালাকোট
৫। মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী-
নকশে হায়াত
৬। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার-
হামারে হিন্দুস্থানী মুসলমান
৭। শেখ মুহাম্মদ ইকরাম-
মৌজে কাওছার
৮। ডাঃ শের বাহাদুর খান-
ইফাদাতে মেহের
৯। মাওলানা আশেক এলাহী মিরাটী-
তাজকিরাতুর রশীদ
১০। মাওলানা আব্দুল হাকিম শরফ কাদেরী-
তাজকিরায়ে আকাবিরে আহলে সুন্নাত
১১। মাওলানা আব্দুর রহিম সাদেকপুরী-
আদ-দোররুল মানছুর
১২। মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক মালিহাবাদী-
আবুল কালাম কি কাহানী খোদ উনকি জবানী
১৩। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী-
কাবুল মে সাত সাল (ভূমিকা)
১৪। গোলাম রসুল মেহের-
সৈয়দ আহমদ শহীদ
১৫। গোলাম রসুল মেহের-
জামায়াতে মুজাহেদীন
১৬। মাওলানা ফজলে হোসাইন বিহারী-
আল-হায়াত বা'দাল মামাতো
১৭। ইসমাঈল পানিপথী-
মাকালাতে স্যার সৈয়দ
১৮। মাওলানা জাফর থানেশ্বরী-
সাওয়ানিহে আহমদী
১৯। মাওলানা জাফর থানেশ্বরী-
তাওয়ারিখে আজিবাহ
২০। মাওলানা জাফর থানেশ্বরী-
মাকতুবাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ
২১। মুন্সী মুহাম্মদ হোসাইন-
ফরিয়াদে মুসলিমীন
২২। মাওলানা মুহাম্মদ আলী কাসুরী-
মুশাহিদাতে কাবুল ও ইয়াগিস্তান
২৩। মাওলানা মুহাম্মদ আলী বেরলভী-
মাখজানে আহমদী
২৪। মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া-
উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাঝি
২৫। সৈয়দ মুরাদ আলী আলীগড়ি-
তারিখে তানাওলিয়া
২৬। মির্জা হায়রাত দেহলভী-
হায়াতে সৈয়দ আহমদ
_______________________________
Comments
Post a Comment