শানে রেসালাত ও ভ্রান্ত মওদূদীবাদ

শানে রেসালাত ও ভ্রান্ত মওদূদীবাদ

–কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

এ নিবন্ধে রাহমাতুল্লিল আলামীন, শফিউল মোযনেবীন, সাইয়েদুল মুরসালীন, নূর নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রেসালতের শান তথা মান-মর্যাদা এবং সমসাময়িককালের মওদূদী মতবাদের এতদসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। দয়ালু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সহায় হোন, আমিন! সুম্মা আমিন!!

মহান আল্লাহ তা’লা আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূলকুলশ্রেষ্ঠ করে বিশ্বজগতের জন্যে তাঁরই অনুপম করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে তিনি তাঁকে যে সকল বিশেষ গুণাবলীতে ভূষিত করেছেন, তা-ই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রেসালতের শানস্বরূপ বিবেচিত।


কলেমার দাবি

মুসলমানদের কলেমা বা ঈমানের বাক্যটি হলো-

لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللّٰهِ

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর-রাসূলুল্লাহ

অর্থাৎ, আল্লাহ্ পাক ছাড়া আর কোনো উপাস্য প্রভু নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁরই প্রেরিত পয়গম্বর। যখন আমরা কলেমার প্রথম অংশটি পাঠ করি, তখন বাক্যটি আমাদের কাছে একটি দাবি পেশ করে থাকে। আল্লাহ্ পাকের উলুহিয়্যাত তথা প্রভুত্বে বিশ্বাস করতে হলে তাঁর সীফাত (গুণাবলী)-এ বিশ্বাস স্থাপন করাটা শর্ত। অর্থাৎ, তিনি যে খালেক (স্রষ্টা), মালেক, রিযিকদাতা, চিরঞ্জীব সত্তা, দয়ালু, দাতা, অনন্ত-অসীম, কাহহার (রুদ্র রূপধারী) ইত্যাদি গুণাবলীর অধিকারী তা কলেমা পাঠ করার সময় বিশ্বাস করে নেয়াটা কলেমারই দাবি। অতঃপর আরবী “ওয়া” (এবং) অক্ষরটি ব্যবহার ছাড়াই বাক্যের দ্বিতীয় অংশ জুড়ে দেয়া হয়েছে। এর দ্বারা ওর গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় অংশটি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রেসালতে বিশ্বাস সংক্রান্ত । এ ক্ষেত্রেও আমাদেরকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সীফাত বা গুণাবলীতে বিশ্বাস করতে হবে। অর্থাৎ, তিনি যে আল্লাহর পক্ষ হতে নূর (জ্যোতি), শাহেদ (হাযের-নাযের), রউফুর রহীম, শাফায়াতে কুবরার ও মাকামে মাহমুদের অধিকারী, আল্লাহ্ পাকের দান-ফযলের বণ্টনকারী, সকল মানবীয় ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে, তাতে বিশ্বাস স্থাপন করাটাও কলেমার দাবি। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) এ সকল গুণে বিশ্বাস না করলে কলেমা-বাক্য সার্থক হবে না। ফলস্বরূপ, ঈমানও পূর্ণ হবে না। আরেক কথায়, কুফর বা অবিশ্বাস অন্তরে বিরাজ করবে।


রাসূলে আকরাম-এর সুউচ্চ শান-মান

মহান আল্লাহ্ পাক কুরআন মজিদে এরশাদ ফরমান-

قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ ٱللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ

”নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহের পক্ষ হতে একটি নূর (জ্যোতি) এবং স্পষ্ট কিতাব” (আল কুরআন, ৫:১৫)। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ পাক কুরআন মজীদকে “কিতাব” বলেছেন এবং আরেকটি “নূরের” কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা, আরবী ’ওয়া’ অক্ষরটি অর্থাৎ “এবং” শব্দটি উভয় শব্দের মাঝখানে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই “নূর” বলতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই বোঝানো হয়েছে (খোদার ভাষায় নবীর মর্যাদা ৩৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য: ১৯৮৪ সংস্করণ)। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) স্বয়ং এ ব্যাপারে আরো খোলাসা বয়ান দিয়েছেন-

انا نور من نور الله وكل الخلائق من نورى

”আমি নূর আল্লাহর নূর হতে; আর আমার নূর হতে সকল সৃষ্টির উৎপত্তি” (আল হাদীস)। মহান আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান-

يٰأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ إِنَّآ أَرْسَلْنَٰكَ شَٰهِداً وَمُبَشِّراً وَنَذِيراً وَدَاعِياً إِلَى ٱللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجاً مُّنِيراً

”হে নবী! নিশ্চয় আমি আপনাকে শাহেদ/সাক্ষী (হাযের-নাযের), সুসংবাদদাতা, (আখেরাতের) ভীতি প্রদর্শনকারী, আমারই অনুমতিক্রমে আমার দিকে (মানুষদেরকে) আহ্বানকারী ও প্রোজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে প্রেরণ করেছি।” (আল কুরআন, ৩৩:৪৫-৬)

এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে যে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দরবারে সাক্ষ্যদাতা। সাক্ষ্য দেবার যোগ্যতা তাঁরই আছে, যিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সকল বিষয় প্রত্যক্ষ করেন এবং অবগত হন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে হাজের নাযের তা এ আয়াতে প্রতিভাত হয়।

মহান আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান-

وَمَا هُوَ عَلَى ٱلْغَيْبِ بِضَنِينٍ

”এই নবী গায়ব প্রকাশের ক্ষেত্রে কৃপণ নন” (সূরা তাকভীর, ২৪)। মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী আশরাফী (رحمة الله) এই আয়াতে করিমার ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “এ কথা বলা তখনই সম্ভবপর, যখন হুযুর আলাইহিস সালাত ওয়াস্ সালাম গায়বী এলমের (অদৃশ্য জ্ঞানের) অধিকারী হয়ে জনগণের কাছে তা ব্যক্ত করেন। ‘মা’ আলিমুত্ তানযীল’ নামক তাফসীর গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে নিম্নরূপ – হুযুর আলাইহিস সালাম অদৃশ্য বিষয়, আসমানী খবর, তাঁর কাছে প্রকাশিত অন্যান্য খবর ও কাহিনীসমূহ প্রকাশ করার ব্যাপারে কৃপণ নন। অর্থাৎ, হুযুর আলাইহিস্ সালাম অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন, তবে তা তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে কোনো রূপ কার্পণ্য করেন না, বরং তোমাদেরকে জানিয়ে দেন ও সেগুলোর সংবাদ দেন। গণক ও ভবিষ্যতবেত্তারা যে রকম খবর গোপন করে রাখেন, সে রকম তিনি গোপন করেন না (মা’আলিমুত্ তানযিল)। তাফসীরে খাযেন গ্রন্থে এ আয়াতের তাফসীরে উল্লিখিত আছে – অর্থাৎ, এ আয়াতে এ কথাই বোঝানো হয়েছে যে, হুযুর আলাইহিস্ সালামের কাছে অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ আসে। তিনি তা তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করেন না। বরং তোমাদেরকে জানিয়ে দেন (তাফসীরে খাযেন)। এ আয়াত ও এর ভাষ্য থেকে বোঝা গেল যে, হুযুর আলাইহিস্ সালাম লোকদেরকে এলমে গায়ব শিক্ষা দেন। বলা বাহুল্য যে, যিনি নিজে জানেন, তিনি-ই শিখিয়ে থাকেন”। (মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী আশরাফী রহ: প্রণীত জা’আল হক, ইলমে গায়ব অধ্যায়)।

মহান আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ করেছেন –

لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ

”নিশ্চয় তোমাদের কাছে তাশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে সেই রাসূল, যাঁর কাছে তোমাদের দুঃখকষ্ট অত্যন্ত বেদনাদায়ক, যিনি তোমাদের উপকার একান্তভাবে কামনাকারী এবং যিনি মু’মিনদের প্রতি পূর্ণ দয়াবান” (সূরা তওবা, ১২৮)।

উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে আল্লামা মুহাম্মদ আসলাম লিখেছেন, ”এতে আল্লাহ্ তা’লা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সৌন্দর্যময় আদর্শের কথাটা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ, তিনি মানব সন্তানদেরকে কষ্টের মধ্যে দেখতে চান না। তাদেরকে সমস্যাদি ও বিভিন্ন কষ্টে ও মুসীবতসমূহে দেখা মাহবুব-এ খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে বড়ই বেদনার কারণ হয়। তিনি সর্বদা তাদের মঙ্গলকামী এবং তাদের হিতার্থে চেষ্টারত থাকেন। প্রকৃত মঙ্গল হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর প্রকৃত মুসীবত আল্লাহর অসন্তুটি। এ জন্যেই বিশ্ববিখ্যাত হেদায়াতকারী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষদেরকে হেদায়তের রাস্তা দেখাতে এবং তার ওপর পরিচালিত করতে এবং মুসীবত থেকে রক্ষা করতে সর্বদা চেষ্টারত ছিলেন। নিশ্চয়ই সরকারে মদীনা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গুণ ’রউফুন’এবং ’রাহীম’ (দয়ালু ও অতি দয়াবান) মুমিনদের জন্যে সব সময়ই প্রকাশিত রয়েছে” (খোদার ভাষায় নবীর মর্যাদা, ২৭ পৃষ্ঠা, অনুবাদক- মওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান)।

মহান আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান-

وَمَا نَقَمُوۤاْ إِلاَّ أَنْ أَغْنَاهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُ

”আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ অনুগ্রহে মু’মিনদেরকে ধনবান করেছেন” (সূরা তওবা, ৭৪)।

আয়াতটির ব্যাখ্যায় মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী আশরাফী (رحمة الله) লিখেছেন, “এই আয়াত হতে প্রমাণিত হলো যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে ধনশালী করেন। যিনি নিজে ধন-সম্পদের মালিক তিনিই তো অপরকে ধনশালী করতে পারেন। এ আয়াতের মধ্যে ’ফাদলিহী’ শব্দটির মধ্যে “হু” সর্বনামটি “রাসূলে পাক”-এর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা, সর্বনাম সাধারণতঃ নিকটতম বিশেষ্যের পরিবর্তেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ” (সালতানাত-ই-মুস্তফা, ২৭ পৃষ্ঠা)।

রাসূলে আকরাম (ﷺ) এ প্রসঙ্গে এরশাদ ফরমান –

وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَاللَّهُ يُعْطِي

”নিশ্চয়ই আমি বণ্টনকারী, আল্লাহ্ তা’লা দাতা (সহীহ বুখারী, ৭১: বই নং ৩, হাদীস নং ১৩)।

হাদীসটির ব্যাখ্যায় মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী আশরাফী (رحمة الله) লিখেছেন – ”এ থেকে বোঝা গেল, আল্লাহ যখনই কাউকে কিছু দান করেন তা হুযুরের (ﷺ) বণ্টনের মাধ্যমেই পাওয়া যায়। এই হাদীসের মধ্যে আল্লাহর দান ও হুযুরের বণ্টন কোনো শর্তসাপেক্ষ নয়। সময়ের সীমারেখা, দানের স্বরূপ ও দানগ্রহীতার গুণ কোনো কিছুরই উল্লেখ করা হয় নাই – মোট কথা, আল্লাহ যা দান করেন হুযুর তা-ই বণ্টন করেন। আল্লাহ প্রত্যেক জিনিস-ই দান করেন, সুতরাং হুযুরও প্রত্যেক জিনিস-ই বণ্টন করেন। প্রত্যেক জিনিস বণ্টন সে ব্যক্তি-ই করতে পারেন যাঁকে প্রত্যেক জিনিসের মালিক বানানো হয়েছে। এটাই হুযুরের মালিকানা ও অধিকার” (সালতানাত-ই-মুস্তফা, ৩৭ পৃষ্ঠা)।

মহান আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান –

وَمِنَ ٱلْلَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَىٰ أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَاماً مَّحْمُوداً

”এবং রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ (নামায) কায়েম করবেন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। অতি শিগগিরই আপনার প্রতিপালক আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে” (সূরা বনী ইসরাঈল, ৭৯)।

আয়াতটির ব্যাখ্যায় মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী আশরাফী (رحمة الله) লিখেছেন, ”এতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুইটি বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। একটি দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি আখিরাতে। দুনিয়ায় তাঁর বিশেষ গুণ তাহাজ্জুদের নামায পড়া, আর আখিরাতে ‘মাকামে মাহমুদে’ (প্রশংসিত স্থানে) উপনীত হওয়া। ….কিয়ামতের ময়দানে হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাকামে মাহমুদে উপনীত হওয়া তাঁর আখেরাতের বিশেষত্ব। এটি এমন পবিত্র স্থান যেখানে উপনীত হয়ে হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার জন্য শাফায়াতে কুবরা (মহানতম ও সর্বপ্রথম সুপারিশ) করবেন। পূর্বাপর সকল নবীর উম্মত শাফায়তকারীর খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরবেন। প্রত্যেক নবীর কাছ থেকেই উত্তর আসবে اذْهَبُوا إِلَى غَيْرِي ‘ইযহাবূ ইলা গায়রী’, অর্থাৎ, ‘অন্যের কাছে যাও’। শেষ পর্যন্ত তারা হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ’মাকামে মাহমুদে’ পাবে। আঁ-হযরত-এর এই উচ্চ মর্যাদা দেখে শত্রু-মিত্র সবাই তাঁর প্রশংসা করবে। এ জন্যেই এটিকে ’মাকামে মাহমুদ’ বলে। অর্থাৎ, প্রশংসিত স্থান। আযান প্রদানকারী এবং শ্রবণকারী প্রত্যেকের প্রতি আদেশ রয়েছে তারা যেন আল্লাহর কাছে হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মাকামে মাহমুদ প্রদানের জন্যে দোয়া করেন, কেননা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি আমার জন্যে এ দু’আ করবে, আমি তার জন্যে শাফায়াত করবো” (শানে হাবীবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১২৪-৫)।

মহান রাব্বুল আলামীন এরশাদ ফরমান-

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

”অবশ্যই রাসুলুল্লাহ-এর মধ্যে তোমাদের জন্যে রয়েছে সুন্দরতম অনুকরণীয় আদর্শ” (সূরা আহযাব, ২১)।

আয়াতটির ব্যাখ্যায় মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী আশরাফী (رحمة الله) লিখেছেন, “এখানে মুসলমানদেরকে এই হেদায়াত করা হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহ থেকে কোনো পুরস্কারের আশা রেখে থাকো, আর কিয়ামতে কল্যাণের আশা করে থাকো, তবে আমার ‘মাহবুব’-এর পবিত্র জীবনকে তোমাদের জীবন গঠনের নমুনা করে নাও এবং তাঁর পূর্ণ অনুসরণ কর। মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র সত্তা তোমাদের জন্যে খোদায়ী কুদরতেরই নমুনা। একজন কারিগর যেমন কোনো নমুনার ওপর তার অলঙ্কারকে কারুকার্যমণ্ডিত করে, তেমনিভাবে আল্লাহও আপন মাহবুব-এর মহান সত্তার ওপর স্বীয় গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তদ্রুপ, যেভাবে দোকানের নমুনা একটি-ই হয়, আর বাজারে দর্শক অনেকেই হয়, তেমনি এই মহান সত্তাও কুদরতের কারখানার একমাত্র নমুনা; যে ব্যক্তি তাঁর কামালিয়তের (পূর্ণতার) অস্বীকার করবে, সে মূলতঃ রব তা’লার কামালের (পূর্ণতার)-ই অস্বীকার করবে’। (শানে হাবীবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৬৯-৭৩)।

উপরন্তু, মহাভ্রান্ত আক্বীদাসম্পন্ন লোকদের কথানুযায়ী যদি “সুন্দরতম অনুকরণীয় আদর্শ” সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবীয় ভুলক্রটিয্ক্তু হতেন, তাহলে তাঁকে অনুসরণ করার যথার্থতা কোথায় থাকতো? ওহাবী-কাওমী ও মওদূদীপন্থীদের মতানুসারে রাব্বুল আলামীন খোদা তা’লাই নাকি ত্রুটিযুক্ত সাধারণ মানুষ হিসেবে রাসূলকে (ﷺ) পাঠিয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ)! অথচ উপরোক্ত আয়াত-ই তাদের অপযুক্তিকে সমূলে উৎপাটিত করেছে।


মহাভ্রান্ত মওদূদীবাদ

জামাআতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটির প্রবর্তক এবং ধর্মীয় গুরু আবুল আ’লা মুওদুদী বহু বই লিখেছে। কিন্তু ইসলামের আবরণে এ সব বইপত্রে বহু ইসলাম-বিধ্বংসী বদ-আক্বীদা সন্নিবেশিত হয়েছে। জামাআতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা জেনে কিংবা না জেনে বদ আক্বীদার গ্রন্থগুলোকে ইসলামী বইপত্র হিসেবে প্রচার করছেন। এতে মুসলিম সমাজে গোমরাহী ও ফিতনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা সংক্ষেপে এখানে কিছু মওদূদীবাদের ভ্রান্ত ধ্যানধারণা ও তার দলিলভিত্তিক খণ্ডন উপস্থাপন করবো। আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহায় হোন, আমিন।


বদ আক্বীদা-১

মওদূদী তার কৃত “তাফহীমূল কুরআন” নামক তাফসীর গ্রন্থে সুরা নসর-এর وَٱسْتَغْفِرْهُ ‘ওয়াসতাগফিরহু’ আয়াতটির ব্যাখ্যায় লিখেছে, “অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো।” তাঁর কাছে কাতর-কণ্ঠে এই দোয়া করো যে, তোমাকে যে কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা সম্পন্ন করার ব্যাপারে তোমার দ্বারা যে ভুল-ত্রুটি হয়েছে কিংবা তাতে যে অসম্পূর্ণতা ও দুর্বলতা রয়ে গিয়েছে, তা যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।” (জুন ২৭, ১৯৭৫ ইং সংস্করণ; অনুবাদ- মৌঃ আবদুর রহীম; প্রকাশক – মাহবুব প্রকাশনী; তাফহীমূল কুরআন ১৯৮৯ সংস্করণেও বিদ্যমান) – নাউযুবিল্লাহে মিন যালিকা!

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সেটা কী? সেটা হলো রেসালত প্রচার-প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব। মওদূদী এ দায়িত্ব পালনে নূর-নবীর (ﷺ) ভুলত্রুটি আবিষ্কার করেছে। আরেক কথায়, মওদূদীর মতানুযায়ী রেসালাত প্রচার-প্রতিষ্ঠার কাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাকি ভুলত্রুটি হয়েছে এবং তাতে নাকি অসম্পূর্ণতা ও দুর্বলতাও রয়ে গিয়েছে। শত-সহস্র ধিক, এই বদ আক্বীদাধারীর প্রতি! মহান আল্লাহ্ পাক তার এ অপযুক্তির খণ্ডনে এরশাদ করেছেন-

ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ

”আজ তোমাদের দ্বীন ইসলামকে তোমাদেরই জন্যে পরিপূর্ণ করলাম (সূরা মায়েদা, ৪ নং আয়াত)।

দ্বীন যদি পরিপূর্ণ অবস্থায় আমাদের কাছে পৌঁছে থাকে, তাহলে আমাদের প্রশ্ন হলো রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন করে তাঁর দায়িত্বে ভুলত্রুটি করলেন? কেননা, তাঁর রেসালত প্রচার-প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের দ্বারা পূর্ণাঙ্গ দ্বীনপ্রাপ্তির প্রশ্নটি। যেহেতু আল্লাহ তা’লা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, দ্বীন ইসলাম পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় আমাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে, সেহেতু মহান প্রভুর এ সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয় তাঁর প্রতি অর্পিত ঐশী দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে সম্পন্ন করেছেন।

বিদায় হজ্জের সময় যখন উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কি তাঁর প্রতি অর্পিত দায়িত্ব তথা ঐশী প্রত্যাদেশ পৌঁছানোর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম ইতিবাচক জবাব দেয়ার পরে তিনি আল্লাহ তা’লাকে সাক্ষী থাকতে অনুরোধ করেন। সাহাবীমণ্ডলীর (رضي الله عنه) সাক্ষ্যের মোকাবেলায় মওদূদী ও তার অনুসারীরা বলছে, তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনে ভুলত্রুটি করেছিলেন। এ ধরনের আক্বীদা-বিশ্বাস মুরতাদ (ধর্মচ্যুত)-দেরই হয়ে থাকে।

রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে সূরা নসরের যে আয়াতটিতে আল্লাহ পাক ‘এস্তেগফার’ করতে বলেছেন, সেটি কুরআনের তাফসীরকারকবৃন্দ ব্যাখ্যা করেছেন। ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (رحمة الله) তাঁর তাফসীরে কানযুল ঈমান গ্রন্থে লিখেছেন: “আল্লাহর কাছে সুপারিশ করুন আপনার উম্মতের জন্যে।” এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সুরা নিসার ৬৩-৬৪ আয়াতে হুযুর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে ওই একই ‘এস্তেগফার’ শব্দটি ব্যবহার করে গুনাহগার উম্মতের জন্যে শাফায়াত তথা সুপারিশ করতে বলা হয়েছে। তাই এই আয়াত দ্বারা (পূর্বোক্ত) সুরা নসরের আয়াতটির তাফসীর করতে হবে। এক্ষণে আমরা সুরা নসরের ধারাবাহিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করি, যাতে সম্পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায়: আল্লাহর নামে আরম্ভ- যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, এবং আপনি মানুষদেরকে আল্লাহর (ইসলাম) ধর্মে দলে দলে প্রবেশ করতে দেখবেন; অতঃপর আপনি প্রতিপালকের প্রশংসাকারী অবস্থায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চান (ওই সব দলে দলে ইসলাম ধর্মে প্রবেশকারী মানুষের জন্যে)। নিশ্চয় তিনি পরম তাওবা কবুলকারী (তাফসীরে কানযুল ঈমান)। কুরআন মজীদের তাফসীর সব সময় আক্ষরিক নয়, বরং প্রসঙ্গনির্ভর । মওদূদী সাহেব মনগড়া তাফসীর করে হাদীস মোতাবেক গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছে।


বদ আক্বিদা-২

মওদূদী তার “লন্ডনের ভাষণ” নামের বইটিতে বলেছে, “রাসূল না অতি মানব, না মানবীয় দুর্বলতা থেকে মুক্ত। তিনি যেমন খোদার ধনভাণ্ডারের মালিক নন, তেমনি খোদার অদৃশ্য জ্ঞানেরও অধিকারী নন বলে সর্বজ্ঞও নন। তিনি অপরের কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে অক্ষম।” (১১ পৃষ্ঠা, আখতার ফরুক অনূদিত ও জুলকারনাইন পাবলিকেশন কর্তৃক প্রকাশিত; অক্টোবর ১৯৭৬ সংস্করণ; বি:দ্র: এ ভাষণটি ১৯৭৬ সালের এপ্রিলে লন্ডনে ইউরোপীয় ইসলামী পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত তিন মাসব্যাপী ’ইসলামী সম্মেলনে’ প্রেরিত হয়। এ লিখিত ভাষণটি পাঠ করে শোনায় অধ্যাপক গোলাম আযম)।

এ নিবন্ধের প্রারম্ভে শানে রেসালতের যে দলিলাদি পেশ করেছি, তার মধ্যে মওদূদীর এ বদ আক্বীদার খণ্ডন আছে। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারো কল্যাণ করতে পারেন না মর্মে মওদূদীর গোমরাহীপূর্ণ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে আল্লাহ্ তা’লার বাণী উদ্ধৃত করা যথোচিত মনে করি। আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান-

وَمَآ أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

”হে রাসূল! আপনাকে আমি সমগ্র বিশ্ব-জগতের জন্যে আমার করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছি” (সূরা আম্বিয়া, ১০৭ আয়াত)। কুরআনের পরিপন্থী কোনো আক্বিদা ইসলামী আক্বিদা হতে পারে কি?


বদ আক্বিদা-৩

“ খেলাফত ও রাজতন্ত্র” নামক পুস্তকে মওদূদী লিখেছে, “হযরত ওসমান (رضي الله عنه)-এর নীতির (মওদূদীর মতে ৩য় খলীফা হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু নাকি স্বজনপ্রীতিমূলক নীতি গ্রহণ করেছিলেন – নাউযুবিল্লাহ) এদিকটি নিঃসন্দেহে ভুল ছিল। আর ভুল কাজ ভুলই- তা যে কেউই করুক না কেন। ভাষার মারপ্যাঁচে তাকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করা বুদ্ধিবৃত্তি ও ইনসাফের দাবি নয় এবং কোনো সাহাবীর ভুলকে ভুল বলে স্বীকার না করা দ্বীনেরও দাবি হতে পারে না” (পৃষ্ঠা ১০৬, জুন ৮৯ সংস্কারণ, গোলাম সোবহান সিদ্দিকী অনূদিত ও আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত)।

হযরত ওসমান (رضي الله عنه)-এর খেলাফত সম্পর্কে মন্তব্য করতে যেয়ে মওদূদী উপরোক্ত কথা বলেছে। অথচ সাহাবীদের সমালোচনা করা নিষেধ। হাদীসে এরশাদ হয়েছে-

اذا ظهر الفتن او قال البدع وسب اصحابي فليظهر العالم علمه فمن لم يفعل ذلك فعليه لعنة الله والملئكة والناس اجمعين لا يقبل الله منه صرفا ولاعدلا

”যখন ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং আমার সাহাবীদেরকে সমালোচনা করা হবে, তখন যেন জ্ঞান শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেম সত্য প্রকাশ করে। যদি সে এ কাজ না করে, তবে তার ওপর আল্লাহ্ তা’লা, ফেরেশতাকুল ও মানবজাতির লা’নত তথা অভিসম্পত! আল্লাহ পাক তার কোনো (নেক) কাজ কিংবা ন্যায়-নিষ্ঠাই আর কবুল করবেন না” (মিরক্বাত শরহে মিশক্বাত, বাবু মানাক্বেব আস্ সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)। যদি শুধুমাত্র সাহাবীদের সমালোচকদের জবাব না দেয়ার জন্যে কোনো ব্যক্তির ওপর লা’নত/অভিসম্পাত পড়তে পারে, তাহলে সমালোচকদের ওপর কেমন লা’নত পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। আমরা মওদূদীর এ হঠকারী মতবাদ হতে আল্লাহর দরবারে পানাহ চাই, আমিন!


বদ আক্বিদা-৪

মওদূদীর রচিত “ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা” নামক পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে, “প্রত্যেকটি কাজে এবং প্রত্যেকটি হুকুমের ব্যাপারেই কেবলমাত্র আল্লাহর খোঁজ নিতে হবে। নিজের মন ও বিবেক বুদ্ধি কী বলে, বাপ দাদারা কী বলে বা কী করে গিয়েছেন, পরিবার, বংশ ও আত্মীয়গণের মত কী, জনাব মৌলভী আর জনাব পীর কেবলা কী বলছেন, অমুক সাহেবের হুকুম কী কিংবা অমুক সাহেবের মত কী – এই সব মাত্রই দেখবে না এবং সে দিকে মাত্রই ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। . . . . কারণ হুকুম দেয়ার ক্ষমতা তো কেবল মাত্র আল্লাহ তা’লার – إِنِ ٱلْحُكْمُ إِلاَّ للَّهِ – আল্লাহর হুকুম ছাড়া মানুষ অন্য কারও হুকুম মানতে পারে না [আল-ক্বুরআন, ১২:৪০]।” (পৃষ্ঠা ৫৫, এপ্রিল ৯০ সংস্করণ, মৌঃ আব্দুর রহীম কর্তৃক অনূদিত এবং আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত)। এ বদ আক্বিদা দ্বারা মওদূদী শানে বেলায়াতের ওপর আঘাত হেনেছে (নোট: শানে সাহাবায়ে কেরাম ও শানে বেলায়াত হুযুর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানের ওপরই প্রতিষ্ঠিত; তাই এখানে প্রসঙ্গটি আলোচিত হলো)। তার ব্যবহৃত আয়াতটি লক্ষণীয়। এ আয়াতটি-ই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর বিরুদ্ধে শিরকের ফতোওয়া জারি করার সময় খারেজীরা ব্যবহার করেছিল। অথচ মহান আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান-

يَا أَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلأَمْرِ مِنْكُمْ

”আল্লাহকে মান্য করো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মান্য করো এবং তোমাদের মধ্যে যাঁরা (ধর্ম বিষয়ে) আদেশদাতা (বুযূর্গানে দ্বীন) আছেন তাঁদেরকেও মান্য করো” (সূরা নিসা, ৫৯ আয়াত)। আয়াতটি ব্যক্ত করে যে, পীর-বুযূর্গ ও হক্কানী উলামায়ে কেরামের কথাও মান্য করতে হবে। কিন্তু মওদূদী তাঁদেরকে মান্য করতে নিষেধ করছে। এটা আল-কুরআনের বিরোধিতা নয় কি? খোদার ওপর খোদকারী নয় কি? মওদূদী কি মুফাসসির? এই যদি হয় তাফসীরের নমুনা, তাহলে এ ব্যাখ্যা কি বিচ্যুতির দ্বার উন্মোচিত করবে না? বিষয়টি পাঠকবৃন্দের বিবেচনায় রাখলাম।


বদ আক্বিদা-৫

সর্বশেষে “জামাতে ইসলামের পঞ্চাশ বছর” শীর্ষক সেমিনারে গোলাম আযমের উপস্থাপিত বক্তব্য দিয়ে মওদূদীবাদের গোমরাহীপূর্ণ কতিপয় আক্বিদার খণ্ডন সুসম্পন্ন করতে চাই। ঘটনাটি ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখের, যা ১লা অক্টোবর তারিখের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। খবরটি নিম্নরূপ:

”জামাতে ইসলামীর নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম বলেছেন, নবী গবেষণা করে কিছু দেন না, আল্লাহ স্বয়ং নবীদের মাধ্যমে তাঁর বাণী দেন। কিন্তু বিভিন্ন যুগের চিন্তাবিদরা সে যুগের বাস্তবতা অনুসারে পথ দেখান। তেমনি মওদূদী কুরআনকে আসল রূপ দেন। গতকাল সোমবার বিকেলে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী রিসার্চ একাডেমীর এক সেমিনারে তিনি প্রধান অতিধি হিসেবে বক্তৃতা করছিলেন” (গোলাম আযম বলেছেন নবী গবেষণা করে কিছু দেন না শীর্ষক খবর, দৈনিক আজকের কাগজ ২য় পৃষ্ঠা, তাং ১/১০/১৯৯১ ইং)।

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! ভাষার মারপ্যাঁচে কীভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খাটো করা হয়েছে তা লক্ষ্য করেছেন কি? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গবেষণা করে আল্লাহর বাণী দেন নি, কেবলমাত্র কুরআনের কাঁচামাল সরবরাহ করেছেন। কিন্তু মওদূদী কুরআনকে পূর্ণাঙ্গ করেছে – নাউযুবিল্লাহি মিন যালিকা! হুযুর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এখানে খাটোই করা হয় নি শুধু, মওদূদীর চেয়ে নিকৃষ্ট প্রতীয়মান করার অপচেষ্টাও চালানো হয়েছে। আর এটাই হলো মুরতাদী কারবার! মহান আল্লাহ্ পাক এর খণ্ডনে এরশাদ ফরমান-

ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ

”আজ তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন (ধর্ম)-কে পরিপূর্ণ করে দিলাম (সূরা মায়েদা, ৩ আয়াত)। নূর নবী-ই (ﷺ) আল কুরআনের আসল রূপ দিয়েছেন। এতে বিন্দু মাত্র অবিশ্বাস রিসালাতে অবিশ্বাসেরই শামিল, যার ফলশ্রুতি স্রেফ বে-ঈমানী!


শেষ কথা

এ নিবন্ধের প্রারম্ভে কলেমার দাবি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। কলেমার তথা ইসলামী বিশ্বাসের দুইটি স্তম্ভ তৌহিদ ও রেসালতে বিশ্বাস স্থাপন করা অবশ্যকর্তব্য। রেসালাতের বৈশিষ্ট্য রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সুউচ্চ শান-মান ও মর্যাদাকে সযত্নে অন্তরে ধারণ করাই ঈমানের পূর্বশর্ত।

এমতাবস্থায় মওদূদী কর্তৃক নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রেসালতের দায়িত্বে ভুলত্রুটি সংঘটনের অপব্যাখ্যা প্রদান চরম ফিতনাবাজী ছাড়া আর কিছু নয়! জামাতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা অনেকেই মওদূদীর এ গোমরাহী সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। কিন্তু তারা অপযুক্তি পেশ করে থাকেন যে, মওদূদীর আক্বীদা অনুসরণ না করে শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক দর্শন অনুসরণ করা বৈধ। আমাদের জবাব হলো, ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। অতএব, যিনি ইসলামী সমাজের ইমাম বা নেতা হবেন, তাকেও সর্বক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ হতে হবে। বদ-আক্বীদাসম্পন্ন কাউকে ইমাম বানানো যাবে না। মওদূদী এ শর্ত পূরণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তাই তাকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা অবৈধ। উপরন্তু, জামাত মওদূদীর ভ্রান্ত বইপত্র সম্পর্কে এখনো তওবা করে নি। বইগুলো পুড়িয়েও ফেলে নি। এমতাবস্থায় জামাতকে মওদূদীবাদী আখ্যা দেয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। আর নিশ্চয়ই মওদূদী মহাভ্রান্ত আক্বীদাধারী ব্যক্তি। আল্লাহ পাক তার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়াসীলায় আমাদেরকে মওদূদীবাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন এবং নাজাত দান করুন, আমীন।

*সমাপ্ত*

________________

Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা