শায়খ নাছির উদ্দিন আলবানী প্রসঙ্গে কিছু কথা

শায়খ নাছীরুদ্দীন আলবানী প্রসঙ্গে কিছু কথা

আরব বিশ্বে ও বর্তমান দুনিয়ায় কথিত আহলে হাদীস মতবাদ বিস্তারের রূপকার শায়খ নাছীরুদ্দীন আলবানী (মৃত ১৯৯৯ ইং)। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীসকে বিকৃত করে মুসলমানদেরকে বিব্রত করার মূল নায়ক তিনি। তিনিই সহীহ হাদীসকে যয়ীফ, আর যয়ীফ হাদীসকে সহীহ্ বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার মূলমন্ত্র শিখিয়েছেন কথিত আহলে হাদীসদেরকে। চির মীমাংসিত বিষয়ে উস্কানীমূলক বক্তব্য তিনিই সূচনা করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আকাবিরগণের প্রতি বেআদবীমূলক আচরণ। হানাফী মাযহাবের দলীল হিসেবে কোনো হাদীস পাওয়া মাত্রই মনগড়া যুক্তি তর্কের মাধ্যমে দুর্বল হাদীসের তালিকায় ফেলে দেয়াই তার প্রধান পেশা। তার জীবনী শীর্ষক কয়েক খ-ে বই প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু কার নিকট তিনি পড়ালেখা করেছেন এর কোন বিবরণ কোথাও উল্লেখ নেই। আমাদের উস্তাদ ড. আনিস তাহের ইন্দোনেশী মদীনা ইউনিভার্সিটির ক্লাসে আলবানীর জীবনী শীর্ষক দু’সপ্তাহ ব্যাপী আলোচনা পেশ করেছেন, এতেও তিনি শায়খ আলবানীর শিক্ষা ডিগ্রি বিষয়ক কিছুই বলতে পারেন নি। আমরা তার জীবনী গ্রন্থে যা পেয়েছি, তারই লিখিত বই “সিফাতুসসালাত” এবং “সালাতুত তারাবীহ” গ্রন্থ দু’টির অনুবাদক আলবানীর জীবনীতে লিখেন, তিনি তার পিতার পেশা, ঘড়ি মেরামতের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।” অতএব কোনো মাদরাসায় ভর্তি হয়ে তার পড়া লেখার সুযোগ কোথায়? কোথায় তার এ সময়? তবে আমাদের উস্তাদ ড. আনিস সাহেব বলেছেন যে, শায়খ আলবানী নিজে নিজে প্রচুর অধ্যয়ন, গবেষণা করতেন। অবশ্য আমরা জানি যারা নিজে নিজে গবেষণায় অবতীর্ণ হয়, তারাই পথভ্রষ্ট হয়, হয় তাদের মাধ্যমে জনগণ বিভ্রান্ত। এ ধরনের পথভ্রষ্ট বিদ্যানগণের তালিকা এ জগতে বিস্তর লম্বা, কাহিনী তাদের অনেক হৃদয় বিদারক। মনগড়া মতবাদ ছড়িয়ে হঠাৎ আজগুবি চমক সৃষ্টি করাই হয় তাদের মূল টার্গেট। তাইতো শায়খ আলবানীর গবেষণায় অজ্ঞতা, বাড়াবাড়ি, দুর্বলতা, ভুলভ্রান্তি, স্ববিরোধিতা ও কল্পনাপ্রসূত মনগড়া মতবাদে ভরপুর। এ সবের বিশাল সূচী আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। আর রচিত হচ্ছে তার অমার্জিত ভুলত্রুটির দাস্তান শীর্ষক অসংখ্য বই পুস্তক। এ পরিসরে আরব অনারবের অনুস্মরণীয় কয়েক জনের মতামত অতি সংক্ষেপে উপস্থাপনের প্রয়াস পাবো।
আরবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, অসংখ্য গ্রন্থের নির্ভরযোগ্য গবেষক, আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা তাঁর রচিত “আসারুল হাদীস” নামক কিতাবের ৫১নং পৃষ্ঠায় লিখেন-
مع أن ھذا الرجل لیس لہ من الشیوخ إلا شیخ واحد من علماء حلب بالإجازۃ لابالتلقی والأخذ والمصاحبۃ والملازمۃ
এছাড়া এই ব্যক্তির তো কোন শিক্ষক নেই। সিরিয়ার হালবের জনৈক ব্যক্তি তাকে হাদীস চর্চার মাত্র অনুমতি দিয়েছেন। তবে তার কাছেও আলবানী নিয়মিতভাবে পড়ালেখা করেননি।
বিশ্ব বরেণ্য মুহাদ্দিস মাও.হাবীবুর রহমান আ’যমী (রহ.) তাঁর গ্রন্থ الألبانی شذوذہ وأخطاؤہ (শায়খ আলবানীর ভুলভ্রান্তি ও বিচিত্র মতবাদের দাস্তান) এর ভূমিকায় লিখেন-
وﷲ لایعرف ما یعرف آحاد الطلبۃ الذین یشتغلون بدراسۃ الحدیث فی عامۃ مدارسنا �
আল্লাহর কসম! সেই শায়খ আলবানী হাদীস সম্পর্কে এতটুকু জ্ঞানও রাখেনা, যা আমাদের সাধারণ মাদরাসাগুলোতে অধ্যয়নরত ছাত্ররা জানে।
অতঃপর আ’যমী (রহ.) উক্ত কিতাবে তিন খ- ব্যাপী শায়খ আলবানীর জ্ঞানের পরিধি ও তার ভুলভ্রান্তি এবং বিচিত্র মতবাদগুলোর আশ্চর্য চিত্র উদ্ধৃতি সহকারে উপস্থাপন করেছেন।
এছাড়া শায়খ আলবানীর গবেষণা প্রায়ই বিরোধপূর্ণ ও সংঘর্ষমুখী হওয়ায় আরবের বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামগণ তা চিহ্নিত করেছেন। স্বতন্ত্র বই পুস্তক লিখে এসব বিষয়ে মুসলমানদেরকে শায়খ আলবানীর গবেষণামূলক মতামত গ্রহণ করার প্রতি সতর্ক করেছেন। আরবের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শায়খ হাসান বিন আলী আস সাক্কাফ প্রণীত “তানাকুযাতুল আলবানী” বা আলবানীর গবেষণায় বিরোধপূর্ণ বর্ণনা শীর্ষক দু’খ-ের বইটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (দারুল ইমাম নববী ওমান থেকে প্রকাশিত।) এতে তিনি শায়খ আলবানীর অসংখ্য হাদীস তুলে ধরেছেন, যেসব হাদীসের ক্ষেত্রে শায়খ আলবানী তারই রচিত একেক কিতাবে একেক ধরনের মতামত পেশ করেছেন। একই হাদীসকে তিনি কোথাও সহীহ আবার কোথাও দুর্বল ইত্যাদি স্ববিরোধী মতামত দেদারসে লিখে গেছেন। শায়খ হাসান তার উল্লেখিত দু’খ- বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, শায়খ আলবানীর স্ববিরোধী মতামত ও ভুলত্রুটির ফিরিস্তি লেখকের নিকট হাজার হাজার জমা রয়েছে, যা পরবর্তী খ- গুলোতে অবিলম্বে প্রকাশ করা হবে। এভাবে আরবের বিজ্ঞ আলেম শায়খ মাহমুদ সাঈদ মামদূহ প্রণীত ৬ ভলিয়মে লিখিত বিশাল কিতাব:
التعریف باوھام من قسم السنن الی صحیح وضعیف
(যে সুনান-হাদীসের কিতাব সমূহকে সহীহ্ ও দুর্বল দু’ভাগ করেছেন তার ভুলভ্রান্তির পরিচয়)
শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে সিদ্দীক আল গুমারী কর্তৃক প্রণীত-
القول المقنع فی الردعلی الألبانی المبتدع
(নতুন মতবাদের প্রবর্তক আলবানীর সন্তুষ্টজনক প্রতিউত্তর)
উস্তাদ বদরুদ্দীন হাসান দিয়াব দামেশকী প্রণীত-
انوار المصابیح علی ظلمات الألبانی فی صلاح التراویح
(তারাবীর নামায প্রসঙ্গে আলবানীর ভ্রান্তি নির্বাপক আলোক রশ্মি)
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায প্রণীত-
أین یضع المصلی یدہ فی الصلاۃ بعد الرفع من الرکوع
(রুকু থেকে উঠার পর নামাযী আবার কোথায় হাত বাঁধবে?)
শায়খ ইসমাঈল বিন আনসারী প্রণীত-
تصحیح صلاۃ التراویح عشرین رکعۃ والرد علی الالبانی فی تضعیفہ

(২০ রাকআত তারাবীর বিশুদ্ধ হাদীসকে আলবানী দুর্বল বলার প্রতি উত্তর)
শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) প্রণীত-
کلمات فی کشف اباطیل وافتراءات (আলবানীর বাতিল মতবাদ ও মিথ্যা অপবাদের উন্মোচনে কিছু কথা)
শায়খ হাসান সাক্কাফ প্রণীত-
صحیح صفۃ صلاۃ النبیﷺ (রাসূল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশুদ্ধ নামায পদ্ধতি)
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আদ দুবাইশ প্রণীত-
تنبیہ القاریئ علی تقویۃ ماضعفہ الالبانی (আলবানী অভিহিত দুর্বল হাদীস শক্তিশালী হিসেবে সতর্ক সংকেত)
শায়খ আবু উমর হাই ইবনে সালেম আল হাই প্রণীত-
النصیحۃ فی بیان الاحادیث التی تراجع عنھا الالبانی فی الصحیحۃ (যে সব সহীহ হাদীসকে আলবানী দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন সেগুলোতে পুণর্বিবেচনার উপদেশ)
শায়খ ইবনে আব্দুল্লাহ আত তুয়াইজারী প্রণীত-
التنبیھات علی رسالۃ الالبانی فی الصلاۃ (আলবানীর নামায বিষয়ক কিতাবের প্রতি সতর্কবাণী)
ডক্টর মুহাম্মদ সাঈদ রামাদান আল বুয়াইতী প্রণীত-
اللامذھبیۃ اخطر بدعۃ تُھدّد الشریعۃ الاسلامیۃ (লা মাযহাবী মতবাদ মারাত্মক বিপদজনক বিদআতী দল ইসলামী শরীয়তের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি)
এবং শায়খ আতিয়্যা মুহাম্মদ সালিম প্রণীত-
التراویح اکثر من الف عام (এক হাজার বছরে তারাবীর ইতিহাস) প্রমুখ লেখকগণ তাদের রচনাবলীতে শায়খ আলবানীর ভুলভ্রান্তি ও স্ববিরোধী মতবাদের চিত্র তুলে ধরেছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন হাতে কলমে ধরে ধরে, শায়খ আলবানীর বই ও পৃষ্ঠা নাম্বার চিহ্নিত করে। এতে করে পরিস্কারভাবে প্রমাণ হয় যে, হাদীস গবেষণার ক্ষেত্রে শায়খ আলবানীর কোনো নিয়মনীতি নেই। নেই এ বিষয়ে তার কোন গতিমতি। আছে শুধু তার মনগড়া তন্ত্রমন্ত্র আর উলামায়ে কিরামকে আক্রমণের হাতিয়ার। এছাড়া বিরোধিতা ও বাড়াবাড়ির বিদ্যায় তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্ত। হাদীস গবেষণার নামে যা করেছেন অধিকাংশই শুভংকরের ফাঁকি, বিচিত্র মতবাদ ছড়ানোর উপকরণ মাত্র।

আরবের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস শায়খ মাহমুদ সাঈদ মামদূহ প্রণীত কিতাব تنبیہ المسلم إلی تعدی الألبانی علی صحیح مسلم (সতর্ক হে মুসলিম! আলবানীর বাড়াবাড়ির জালে সহীহ মুসলিম) এর ২০৬ নং পৃষ্ঠায় লিখেন- قد وقفت علی اوہام وأخطاء للألبانی ـ وکفی تعدیہ- علی الصحیح আমি আলবানীর কাল্পনিক কর্মকা- ও ভুলত্রুটির ফিরিস্তি অবগত হয়েছি। বিশেষ করে সহীহ্ হাদীসের কিতাব প্রসঙ্গে বাড়াবাড়ির বিষয়টি তার কর্মকাণ্ডের পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট।
উক্ত বইয়ের ২০৫নং পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন,
أقول ھذا بمناسبۃ عادۃ الألبانی مع مخالفیہ،فإنہ إذاوجد مخالفالہ قام وقعدوأرعد وتوعد، وإذاتصفحتَ کتبہ تجد مصداق ذلک، فتراہ یقول لأحدہم، ‘أشل اللّہ یدک وقطع لسانک’، ویکاد أن یتہم صاحبا لہ ‘بالشرک الأکبر’، وثالثا یتھمہ: ‘بالکذب’، وانہ :’أفاک کذاب’ثم نبزہ بلقبہ ـ وقد جاء النص بالنھی عنہ ورمی کثیرا من علماء المسلمین بالبدعۃ ـ وما أعظمھا من فریۃ ـرغم إقرارہ أن الامام احمد یقول بقول المرمی بالبدعۃ!!.ویتہم شہید عصرنا ‘بکفریات’، ویتھم مخالفا لہ’بمکر،خبث، نفاق، کذب، ضلال….إلخ’والقائمۃ طویلۃ والألفاظ کثیرۃ ولاداعی لإعادتھا ـ

আলবানী তার মতাদর্শের বিপরীত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, প্রসঙ্গত উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করি। আলবানী যখনি কাউকে তার প্রতিপক্ষ বা ভিন্ন মতাদর্শের মনে করেন, তখন দেখতে পাবেন, তিনি বইয়ের পর বই আর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তাকে সমালোচনা করে লিখেই যাচ্ছেন। তার আক্রমণের স্বরূপ হিসেবে দেখবেন তিনি প্রথিতযশা বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম ও মহামনিষীদের ধ্বংস হওয়ার কামনা করেন, তাঁদেরকে মুশরিক, মিথ্যুক, প্রতারক, বিদআতী আখ্যায়িত করতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করেন না। যুগশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণকে আলবানী প্রতিপক্ষ মনে করলে, তাঁদেরকে কাফির, চক্রান্তকারী, দুষ্ট, মুনাফিক, পথভ্রষ্ট ইত্যাদি অপবাদ দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। এতে তার পাষাণ আত্মা তিলমাত্র কাঁপে না। তার ভয়ঙ্কর ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের শীর্ষ তালিকায় ইমাম আহমদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) কেও বিদআতী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের আচরণ তার দু’একটি ঘটনা নয়; বরং এসব বর্ণনা করে শেষ করার ওপারে।

এভাবে আক্বাইদ বিষয়েও অনেক ক্ষেত্রে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মান্যবর উলামায়ে কিরাম এমনকি সৌদী আরবের উলামায়ে কিরামদেরকেও তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন পদে পদে। তাদের অবহেলার সুযোগে শায়খ আলবানী মতানৈক্য, বিভ্রান্তি ও উগ্রতার বীজ রোপে দিয়েছেন আরব মরুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাড়ি তার সিরিয়ার আলবেনিয়া নামক স্থানে। তার পিতা নূহ নাজাতী একজন আদর্শ মানব, হানাফী মাযহাবের শীর্ষ পর্যায়ের আলেম ছিলেন। ছেলের বিতর্কজনিত আচরণে পিতার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। ত্যাজ্যপুত্র হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তিনি কোনোভাবে নাজাত লাভ করেন। আর জনগণ মুক্তি পায় শায়খ আলবানীকে সিরিয়া থেকে বাহির করে। আর শায়খ আলবানী চেপে বসে সৌদী জনতার ঘাড়ে। রাজতন্ত্রের ভয়ে আতঙ্কিত আলেম সমাজের মাঝে তার নতুন মতবাদ ছড়াতে আরো দারুন সুযোগ এসে যায়। তবে এক পর্যায়ে তাদের ঘুম ভাঙ্গে। সবাই সোচ্চার হয় তাদের দীর্ঘকালের শায়খ-আলবানীর বিরুদ্ধে। ১৯৯১ খৃস্টাব্দে সরকারী নির্দেশে শায়খ ২৪ঘণ্টার মধ্যে পবিত্র আরবভূমি ছেড়ে জর্ডান যেয়ে আত্মরক্ষা পায়। আমরণ তিনি সেখানেই ছিলেন। আরবের সচেতন উলামায়ে কিরাম কিন্তু এক পর্যায়ে জেগে উঠেছিলেন, হয়েছিলেন প্রতিবাদ মুখর। (আল ইত্তেজাহাতুল হাদীসিয়্যা, শায়খ মাহমূদ সাঈদ মামদূহ)
উদাহরণস্বরূপ শুধু একটি বিষয় লিখেই এ পরিসরের ইতি টানতে যাচ্ছি। কুরআন হাদীসে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত এবং মুসলিম বিশ্বের চির মীমাংসিত একটি বিষয় হলো, মহিলাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা পর্দার অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু শায়খ আলবানী শুধু এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র বই রচনা করেন। ঘোষণা দেন পর্দা হিসেবে মহিলারা তাদের মুখমণ্ডল ঢাকতে হবে তা কুরআন হাদীসে মোটেও নেই। তবে আরবের উলামাগণ এ বিষয়ে নিরব থাকেন নি। শুধু এরই প্রতি উত্তরে প্রায় দু’ডজন বই লিখেছেন তারা। তন্মধ্যে আরবের স্থায়ী ইফতা বোর্ডের সহ-সভাপতি শায়খ মুহাম্মদ ছালেহ ইবনে উসাইমীন লিখেছেন, “রিসালাতুল হিজাব” শীর্ষক ছোট একটি বই।(মাকতাবাতুল মা’আরিফ, রিয়াদ থেকে প্রকাশিত) এতে তিনি আল কুরআনের ১০ টি আয়াত, পবিত্র হাদীস থেকে ১০ টি প্রমাণ এবং ১০ টি ক্বিয়াসের আলোকে প্রমাণ করেছেন যে, মহিলাদের মুখমণ্ডল পর্দা হিসেবে ঢাকা ফরয। আর শায়খ আলবানী তো একটি প্রমাণও খুঁজে পাচ্ছেন না! এর রহস্য কী? কী তার মতলব? কোথায় তার টার্গেট? আশা করি সম্মানিত পাঠকগণই তা বিবেচনা করবেন।
বলাবাহুল্য বর্তমান বাংলাদেশেও কিছু লোক শায়খ আলবানীর জালে শিকার হচ্ছে। তারা শায়খ আলবানীর বাড়াবাড়ি, অশ্লীলতা, গোঁড়ামী, ভুলত্রুটির দাস্তান, বিচিত্র আদর্শ ও বিভ্রান্তিকর মতবাদকে পূঁজি করে গোটা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছে। অথচ শায়খ আলবানীর এসব বিচিত্র মতবাদের আইওয়াশ ও সিটিস্কেনের লক্ষ্যে শুধু সৌদী আরব থেকেই শতাধিক বই পুস্তক রচনা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এসব ক্ষেত্রে আমাদের আহলে হাদীস ভাইয়েরা চোখ বন্ধ করে রাখে। আর লুফে নেয় শুধু তার বিচিত্র মতাদর্শ ও শিষ্টাচার বহির্ভূত দিকগুলো। তাইতো শায়খ আলবানীর শিষ্য ও অনুসারীগণ বাড়াবাড়ি ও অশ্লীলতায় আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে।

বলাবাহুল্য, হিন্দুস্তানে ইসলাম আগমনের সূচনা থেকেই মুসলমানগণ হানাফী মাযহাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ইংরেজ হুকুমত প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালেও মুসলমানদের মধ্যে কোন ধর্মীয় মতানৈক্য ছিল না। অবশেষে হিজরী ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটে যারা দাউদে যাহেরী, ইবনে হাযাম, ইবনে তাইমিয়্যাহ, মুহা. ইবনে আব্দুল ওহহাব নজদী ও ক্বাজী শাওকানীর কেবল বৈচিত্র্যময় মতাদর্শগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমস্ত মুসলমানদের সঙ্গে বিরোধ এবং হানাফী মাযহাব ও অন্যান্য মাযহাব অবলম্বীদের সঙ্গে মতানৈক্য, অযথা বিরুদ্ধাচরণ, অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ ও তাদেরকে নির্মূল করার গভীর ষড়যন্ত্রে মরিয়া হয়ে উঠে। বিশেষ করে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ও হানাফীদেরকে কাফির, মুশরিক, মুনাফিক কবরপূজারী ইত্যাদি শব্দে অপবাদ দেয়া যেন তাদের ঠিকাদারী ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যবসায় পরিণত হয়। আর তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তি হলো শায়খ নাছীরুদ্দীন আলবানী। তিনিই তাদের পুরুধা। আহলে হাদীস ভাইয়েরা সেই আলবানীর মাযহাবই মানেন। শায়খ আলবানীই তাদের ইমাম।
উল্লেখ্য যে, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইবনুল ক্বাইয়্যিম ও মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাব (রহ.) ছিলেন সমকালীন ইসলামী চিন্তাবিদ , যুগশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ও অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থপ্রণেতা। সাথে সাথে তাঁরা ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের মুক্বাল্লিদ ও অনুসারী। যদিও তাদের মধ্যে কিছু বিতর্কিত বিষয়ও ছিল। তাদেরকে আমরা শ্রদ্ধা করি। মোটেও সমালোচনা করছি না। কারও সমালোচনা সমীচীন মনে করি না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান লা-মাযহাবী ভাইয়েরা তাদের গুণগত বিষয়গুলো উপেক্ষা করে কেবল বিতর্কিত বিষয়গুলো অবলম্বন করতঃ মুসলমানদের মধ্যে ফিৎনা-ফাসাদ ও মতানৈক্যের যোগান দিচ্ছে। এমনিভাবে তাদের সীমিত জ্ঞানে হানাফীদের বিশেষ করে দেওবন্দী উলামায়ে কিরামের মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু উপলব্ধি করতে পারলেই অতিরঞ্জিত ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ইবনে তাইমিয়্যার পুরো জীবনই ছিল জিহাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ। তাতারীদের মোকাবিলায় জিহাদ করে তিনি কারাবরণও করেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে লা-মাযহাবী হিসেবে যারা পরিচিত, আহলে হাদীস আন্দোলন নামে যারা বই লিখছে তারা কি ইবনে তাইমিয়ার আদর্শ যথাযথভাবে অনুসরণ করছে? বরং তারা সর্বদা জালিম সরকার আর নাস্তিকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এবং তাদের সঙ্গে আঁতাত করে আপন স্বার্থ উদ্ধারের পন্থাই অবলম্বন করে চলছে। ভারতবর্ষে মুসলমানদের চিরশত্রু জালিম সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ অবৈধ প্রমাণের অপচেষ্টায় “ আল-ইক্বতেছাদ-ফী মাসাইলিল জিহাদ” নামক অমূলক গ্রন্থ লিখার মুচলেকা ও চুক্তিপত্র লা-মাযহাবী আলিম মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভীর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছিল। হিন্দুস্তানে মুসলিম ও নাস্তিকদের মাঝেতো যুদ্ধ-জিহাদ বরাবরই চলে আসছে। বাংলাদেশেও কাদিয়ানী, বেরলভী, এন জি ও, এবং বিভিন্ন ফিৎনা ফাসাদ ও নাস্তিকতার বিরুদ্ধে প্রায়ই শরীয়ত সম্মত প্রতিবাদ হয়ে থাকে। এতে কোন লা-মাযহাবীদের নাম মাত্র ভূমিকা কি ছিল? বা আছে? এ সকল প্রশ্নের জবাব একটাই, আর তা হল “না”। অনুরূপ ভাবে তামাম বিশ্বের ইয়াহুদী-খৃস্টানরা যখন আফগান, ফিলিস্তিন , ইরাক তথা সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানদের উপর বে-নযীর নির্যাতন আর মুসলিম নিধনের গভীর ষড়যন্ত্রে মরিয়া হয়ে উঠেছে তখন ইবনে তাইমিয়্যার তথাকথিত অনুসারী লা-মাযহাবীদের ভূমিকা রহস্যজনক; বরং, তারা এবং তাদের ঠাকুরগণ ও তাদের ভক্তবৃন্দরা সম্ভাব্য সকল উপায়ে হানাদারদের ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে। এ দেশে বিভিন্ন মিশনের নামে আমাদের ঈমান-আক্বীদা ঠিক করা তথা আমাদেরকে মুসলমান বানানোর অভিনয় করছে। অথচ ইসলাম বিরোধী অপকর্মের বৈধভাবে প্রতিবাদ করা আহলে হক্বের একটি পরিচয়। কুরআন-হাদীসের অসংখ্য স্থানে এর প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাহলে কি লা-মাযহাবীরা এসব থেকে গা ঢাকা দিয়ে ইবনে তাইমিয়্যার অনুসারী ও আহলে হক্বের দাবির অনধিকার চর্চার স্পর্ধা দেখাচ্ছে না? সাথে সাথে আরও ভাবনার বিষয় যে, তাদের বই-পুস্তকের শিরোনাম ”আহলে হাদীস আন্দোলন”। আন্দোলন মানে কোন্ আন্দোলন? মুক্তির আন্দোলন? নাকি সরলমনা মুসলমানদেরকে বিপথগামী ও ভ্রষ্ট করার আন্দোলন?

বর্তমানে তারা আরো ভয়ঙ্কর পথে এগুচ্ছে। তাদের কেউ কেউ আবার জিহাদের নামে সন্ত্রাস , বোমাবাজী, ও আত্মঘাতী হামলার আশ্রয় নিয়ে এদেশের মুসলমানদের দীর্ঘ কালের সুনাম ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা করছে।জিহাদকে তার বিকৃত অর্থে প্রয়োগ করে কলুষিত করছে। এগুচ্ছে ইসলামের শক্রদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে। ঠেলে দিচ্ছে মুসলমানদেরকে ভয়াবহ মরণ ফাঁদে।

শায়েখ রফিকুল ইসলাম আল মাদানী
লিসান্স – (হাদীস) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা শরীফ।

(কপিকৃত)

Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা