নবী করীম (ﷺ) এর চাচা আবু তালেবের নাজাত সম্পর্কে বর্ণনা
নবী করীম (ﷺ) এর চাচা আবু তালেবের নাজাত সম্পর্কে বর্ণনা
____________________
اَلْـبَـيَـانُ النَّـجِيْـحُ
فِـىْ نِـجَاةِ عَمِّ النَّبِـيِّﷺ
নবী করীম (ﷺ) এর চাচা আবু তালেবের নাজাত সম্পর্কে বর্ণনা
রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (মা.জি.আ.)
অধ্যক্ষ- ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মুঈনীয়া কামিল মাদ্রাসা
অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম আনচারী
গ্রন্থকারের কথা
____________________
গ্রন্থকারের কথা
الحمدلله رب العلمين والصلواة والسلام على رحمة للعلمين كاشف المكروبين شفيع المذنبين سيدنا ومولانا محمد وعلى اله واصحابه أجمعين .
হযরাত ওলামায়ে কেরামদের মধ্য হইতে কেহ হুজুর (ﷺ) এর মাতা-পিতা ও তাঁহার চাচা আবু তালেবকেও মুক্তিপ্রাপ্ত এবং মুমিন বলিয়াছেন। অতএব, আল্লামা শামী, আয়াজ ও মুহাক্কেক মোহাদ্দেস আবদুল হক দেহলভী (رحمة الله) প্রমূখ হুজুর (ﷺ) এর মাতা-পিতা মুক্তিপ্রাপ্ত হওয়াকে স্বীকৃত এবং মুফ্তাবিহী কাউল (যাহার উপর ফত্ওয়া হইয়াছে) বলিয়াছেন। কিন্তু খাজা আবু তালেবের মাসয়ালার ব্যাপারে মতভেদ রহিয়াছে, কেহ নাজাত প্রাপ্ত বলিয়াছেন, আবার কেহ জাহান্নামী বলিয়াছেন। এ কারণে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে একদল আবু তালেবের ঈমান না থাকা এবং জাহান্নামী হওয়ার উপর অতি কঠোরতার সহিত সামর্থ্য দিতেছেন। অন্য একদল ওলামায়ে কেরাম মুমিন ও নাজাতপ্রাপ্ত হওয়ার প্রমাণ করিতেছেন। আবার কেহ কিছু না বলিয়া চুপও রহিয়াছেন। উক্ত মাসয়ালা নিয়ে ওলামায়ে কেরাম পরস্পর একে অপরের সহিত বিবাদ করিতে দেখা গিয়াছে বিধায় আমার কোন কোন বন্ধু আমাকে অনুরোধ করিয়াছেন যে, উক্ত মাসয়ালার মধ্যে সত্যের নিশ্চয়তা কি রহিয়াছে তাহা একটি পুস্তকাকৃতিতে লিখিয়া দেওয়া হউক। সেই অনুরোধ পালন করতে যাইয়া নগণ্যের ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অসম্পূর্ণ প্রতিপাদন দ্বারা যাহা কিছু দৃষ্টিগোচর হইয়াছে তাহা দুই চারটি বর্ণ সম্মিলিত এই ছোট কিতাবটি দর্শকবৃন্দের খেদমতে পেশ করিতেছি।
গ্রন্থকার
মুহাম্মদ আজিজুল হক আল্-কাদেরী
আবু তালেবের ঈমান গ্রহণ সম্পর্কে ইমামগণের বর্ণনা
____________________
আবু তালেবের ঈমান গ্রহণ সম্পর্কে ইমামগণের বর্ণনা
নবী করীম (ﷺ) এর চাচা আবু তালেবের ঈমান গ্রহণ সম্পর্কে ইমামগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেন। যেমন:
❏ ইমাম আহমদ ইবনে যীনি দহলান (رحمة الله) হুজুর (ﷺ) এর সম্মানিত মাতা-পিতা ও চাচা আবু তালেবের ঈমান সম্পর্কে ‘কাউলুল জলী’ নামে একটি রিসালা লিখিয়াছেন, অতঃপর তিনি বলিয়াছেন, আল্লামা মুহাম্মদ বিন রাসূল বরযঞ্জী উক্ত মাসয়ালার উপর একটি রিসালা লিখিয়াছেন, যাহার মধ্যে হুজুর (ﷺ) এর চাচা আবু তালেব নাজাতপ্রাপ্ত হওয়াকে বহু শক্তভাবে ছাবেত করিয়াছেন এবং উহার উপর ওলামাগণের বাণী ও কোরআন হাদীসের এই রকম দলিল এবং প্রমাণাদি কায়েম করিয়াছেন, যাহা বিন্দু পরিমাণও চিন্তা করিলে দৃঢ়বিশ্বাস হইয়া যাইবে যে, আবু তালেব নিশ্চয় নাজাতপ্রাপ্ত। আবার সঙ্গে সঙ্গে ইহাও স্পষ্ট হইয়া যাইবে যে, আবু তালেব জাহান্নামী হওয়ার উপর যেই প্রমাণসমূহ বর্ণিত হইয়াছে উহার ছহীহ অর্থ এই রকম, যাহার মোখালিফতির মূল স্পষ্ট হইয়া যায়।
❏ ইমাম ইবনে যীনি দহলান (رحمة الله) বলিয়াছেন, আল্লামা বরযঞ্জী (رحمة الله) প্রথমে অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা আবু তালেবের ঈমান ছাবেত করিয়াছেন। অতঃপর তাহার নাজাত ছাবেত করিয়া বলিতেছেন,
الاسلام علانية والا يمان فى القلب .
অর্থাৎ- ইসলাম প্রকাশ্য এবং ঈমান অন্তরে বিরাজমান। কখনো ইহারা উভয় একত্রিত হইয়া যায়। যেমন, সেই ব্যক্তি যাহার তাছদীকে কলবী (আন্তরিক বিশ্বাস) রহিয়াছে এবং শাহাদাতাঈনের স্বীকৃতিও মুখে রহিয়াছে। আবার কখনো ইসলাম ঈমান হইতে পৃথকও হইয়া যায়। যেমন, মোনাফেক শাহাদাতাঈনের স্বীকার মুখেও করে এবং প্রকাশ্য ভাবে ইসলামী হুকুমসমূহের অনুসারীও হয়। কিন্তু অন্তরে ইসলামকে বিশ্বাস করে না বরং মিথ্যা প্রতিপাদন করে। আবার কখনো ঈমান ইসলাম হইতে পৃথক হয়। যেমন, বহু ইয়াহুদী ওলামা, যাহারা অন্তরে বিশ্বাস করিত কিন্তু শত্র“তার কারণে না শাহদাতাঈনকে স্বীকার করিত না শরীয়াতের হুকুম সমূহের অনুসারী ছিল, আর না হুজুর (ﷺ) এর অনুসরণ ও অনুকরণ করিত।
❏ আল্লাহ তায়ালা সেই সমস্ত লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ করেন,
يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ
অর্থাৎ- তাহারা নবী (ﷺ)কে তাহাদের ছেলেদের মত চিনিত। কিন্তু শত্র“তামূলক রিসালাত স্বীকার করিত না এবং অন্তরের মধ্যে তাঁহার রিসালাতের দাবীর তাছদীক রাখিত। অতঃপর এই ধরণের লোক গোপনীয়তায় মুমিন ও স্পষ্টতায় শত্র“তার কারণে মিথ্যা প্রতিপাদনকারী। তাহারা শত্র“তামূলক স্পষ্টতাকে মিথ্যা প্রতিপাদন করার কারণে তাহাদের অপ্রকাশ্য ঈমান কোন উপকারী হইবে না।
হ্যাঁ! যাহারা এই ধরণের লোক হইবে যে, অন্তরে বিশ্বাসী হইবে ও শত্র“তাবিহীন কোন যুক্তিসম্মত ওজর বা আপত্তির কারণে প্রকাশ্য হুকুম সমূহের অনুসরণ না করিবে এবং মুখে শাহাদাতাঈনকেও স্বীকার না করিবে, তাহা হইলে সেই সমস্ত লোকজন প্রতি দিবসের দিন গোপনীয় ঈমান দ্বারা খোদার দরবারে উপকৃত ও লাভবান হইবে। কিন্তু তাহাদের সহিত প্রকাশ্য মোয়ামিলা কাফেরদের ন্যায় হইবে এবং পার্থিব হুকুম অনুযায়ী তাহাদের নাম কাফের হইবে। তদ্রূপ ঐতিহাসিকগণ আবু তালেবের ঈমানও যাহা অন্তরে বিদ্যমান ছিল ছাবেত করিয়াছেন।
❏ হযরত শাহ্ মোহাক্কেক আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলভীর “মা ছবাতা মিনাচ্ছুন্না” নামক কিতাবের মধ্যে উল্লেখ আছে,
وارملة وهذا البيت من قصيدة ابى طالب ذكرها ابن اسحاق بطولها وله فى مدحه صلّى الله عليه وسلّم قصائد اخر وكفالته وحمايته صلّى الله عليه وسلّم وتعقبه الحافظا بن حجران ابن اسحاق ذكر ان انشاد ابى طالب بهذا الشعر كان بعد البعث ومعرفة ابى طالب بنبوته جاء فى كثير من الاخبار .
অর্থাৎ- কবিতার এই পংক্তি আবু তালেবের কছিদার অংশ বিশেষ, যাহা ইবনে ইসহাক দীর্ঘায়িতাকারে যিকির করিয়াছেন এবং হুজুর (ﷺ) এর প্রশংসা, তাঁহাকে পালিত করা এবং তাঁহাকে সহায়তা করার ব্যাপারেও তাহার অন্যান্য কছিদা রহিয়াছে।
❏ হাফেজ ইবনে হাযার (رحمة الله) তাঁহার অনুসরণ করিতে যাইয়া বলিয়াছেন যে, ইবনে ইসহাক বলিয়াছেন, আবু তালেবের এই শে’র (কবিতা) পড়া, হুজুর (ﷺ) এর দুনিয়াতে তশরীফ আনয়নের পরে ছিল এবং আবু তালেব তাঁহার নুবুওয়াতের পরিচয় লাভ করার ব্যাপারে বহু হাদীস শরীফ বর্ণিত হইয়াছে।
❏ উপরোলেখিত বক্তব্যগুলি মন্তব্যস্বরূপ। আবু তালেবের ঈমান সম্পর্কে স্পষ্টাকারে হাদীস ও আছার মওজুদ রহিয়াছে, যেমন বর্ণিত আছে,
ان العباس رضى الله عنه اخبر النبى صلّى الله عليه وسلّم باسلام ابى طالب بعد ما رجع النبى صلّى الله عليه وسلّم عنه، (حاشيه بخارى-جلد ২০، صفحه ৯১৭০)
অর্থাৎ- হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) হুজুর (ﷺ) আবু তালেবের নিকট হইতে চলিয়া যাওয়ার পরে তাহার (আবু তালেবের) ঈমান সম্পর্কে হুজুর (ﷺ)কে সংবাদ দিয়াছেন। বোখারীর টিকা দ্বিতীয় খণ্ডের ৯১৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
প্রমাণিত হইল যে, ঈমান না আনার রেওয়ায়েত মৃত্যুর পূর্বে আর ঈমান আনার রেওয়ায়েত মৃত্যুর সময় বর্ণিত হইয়াছে। অতএব, এখন কোন তায়ারুজ ও প্রতিবাদ রহিল না।
ফত্ওয়া কাজীখান সম্মিলিত ফত্ওয়া সিরাজী ২য় খণ্ডের ৪১৪ পৃষ্ঠায়ও তদ্রূপ উল্লেখ রহিয়াছে।
আবু তালেব নবী করীম (ﷺ)কে ভালবাসাটাই হচ্ছে নাজাতের অন্যতম প্রমাণ
____________________
আবু তালেব নবী করীম (ﷺ)কে ভালবাসাটাই হচ্ছে নাজাতের অন্যতম প্রমাণ
❏ ‘নিব্রাছ’ নামক কিতাবের ৫২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
وابو طالب والد على رضى الله عنه كان يحب النبى صلى الله عليه وسلّم ويحفظ ولكن مات على الكفر كما فى صحيح البخارى ومسلم خلافا للشيعة .
অর্থাৎ- হযরত আলী (رضي الله عنه)’র পিতা আবু তালেব নবী করিম (ﷺ)কে ভালবাসিতেন এবং তাঁহার নিরাপত্তার প্রতি লক্ষ্য রাখিতেন ও যত্ন বা রক্ষণাবেক্ষণ করিতেন। কিন্তু সে (আবু তালেব) ঈমানহীন মৃত্যুবরণ করিয়াছে। যেমন- ছহীহ বোখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখ রহিয়াছে। ইহা শিয়াদের খেলাফ (অর্থাৎ বিপরীত)
❏ সেই কিতাবের উল্লেখিত পৃষ্ঠায় টিকা বা হাশিয়াস্বরূপ বলিয়াছেন যে,
قوله كان يحب النبى صلّى الله عليه وسلّم وكل كان يحب النبى صلّى الله عليه وسلّم فهو مؤمن فينتج انه كان مؤمنا وهو الحق الصريح كما اقرها السيد محمد بن رسول البرزنجى والف فى هذه المسئلة واحمد بن زينى دحلان وكذا الشعرانى والقرطبى وكثير من الاولياء واول من اعترف به جميع اهل البيت عليهم السلام كما فى جامع الا صول ومدارج النبوة واليه يميل الشيخ الدهلوى كما يفهم من مدارج البنوة وفى تاريخ ابن هشام انه امن وعمدة الرسائل فى هذه المسئلة اسن المطالب فى نجاة ابى طالب ’’وقول الجلى‘‘ فى نجاة عم النبى صلّى الله عليه وسلّم الا ولى فى اللسان العربية والثانية فى الهندية فتدبر .
অর্থাৎ- “নিবরাছের” গ্রন্থকারের বাণী:
كان يحب النبى صلّى الله عليه وسلّم .
অর্থাৎ- “তিনি (আবু তালেব) নবী করীম (ﷺ)কে ভালবাসিতেন।” প্রত্যেক যেই ব্যক্তি নবী করিম (ﷺ)কে ভালবাসে সেই ব্যক্তি মুমিন। ফলত, তিনি মুমিন ছিলেন উহাই সত্য ও প্রত্যক্ষ। যেমন,
➡ছৈয়দ মোহাম্মদ ইবনে রাসূল বরযঞ্জী উহাকে স্বীকৃতি দিয়াছেন এবং তিনি এই বিষয়ের উপর একটি রিসালাও লিখিয়াছেন।
➡আহমদ ইবনে যীনি দহলানও উহার স্বীকৃতি দিয়াছেন, তদ্রুপ স্বীকৃতি দিয়াছেন।
➡শা’রানী, কুরতুবী ও অধিকাংশ অলীগণ (رحمة الله) এবং উল্লেখিত মণীষীগণ তাঁহাকে হুজুর (ﷺ) এর পরিবারস্থগণের অন্তর্ভূক্ত বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। যেমন- জামেয়ুল উসূল ও মাদারিজুন্নুবুওয়াতের মধ্যে উল্লেখ আছে।
➡শেখ মোহাক্কেক আবদুল হক দেহলভী (رحمة الله) সেই দিকে অভিপ্সা করিয়াছেন। যেমন মাদারিজুন্নুবুয়াত হইতে বোধগম্য হইতেছে।
➡তারীখে ইবনে হিশামের ভিতরে বর্ণিত আছে যে, তিনি ঈমান আনিয়াছেন এবং এই মাসয়ালার উপর ‘‘আছনাল মাতালেব ফী নেজাতে আবী তালেব” ও ‘কাউলুল জলী ফী নেজাতে আম্মিন্নবী’ (ﷺ) নামক দুইটি রিসালা লিখা হইয়াছে। রিসালাদ্বয়ের মধ্যে প্রথমটি আরবী এবং দ্বিতীয়টি হিন্দী ভাষায় রচনা করা হইয়াছে।
সুতরাং আপনি নিজেই বিবেচনা করুন।
বুখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনা এবং নবীর সুপারিশ হইবে মর্মে উক্তি দ্বারা প্রমাণিত আবু তালেব মু'মিন ছিলেন
____________________
বুখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনা এবং নবীর সুপারিশ হইবে মর্মে উক্তি দ্বারা প্রমাণিত আবু তালেব মু’মিন ছিলেন
❏ নিবরাছের গ্রন্থকারের বাণী, كما فى صحيح البخارى ومسلم (যেমন ছহীহ বোখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখ আছে।) উহা অযথার্থ ও ত্র“টিপূর্ণ। কেননা, উক্ত কিতাবের মধ্যে এই রকম আছে যে, তিনি দ্বীনে আবদিল মোত্তালিবের উপর ছিলেন এবং তিনি (আবদুল মোত্তালিব) মুমিন ছিলেন। যেমন আল্লামা ছুয়ূতী (رحمة الله) উহা স্বীকার করিয়াছেন এবং অধিক ওলামা, ফোজলা, আউলিয়া, মোহাদ্দেসীনগণ ও ফোকাহগণ তাঁহার সম্বন্ধে অনেক প্রবন্ধ সংকলন করিয়াছেন। যাহা কাহারো কাছে লুক্কায়িত নয়।
❏ তথাপি বোখারীর মধ্যে ইহাই আসিয়াছে যাহা তিনি মুমিন হওয়াকে নিদর্শিত ও প্রমাণিত করে। উহা এই যে,
ان النبى صلّى الله عليه وسلّم قال لعله شفاعتى وفى رواية انه كان يحفظك وينصرك الخ فهل بنفعه ذالك قال نعم الحديث .
অর্থাৎ- নবী করিম (ﷺ) ফরমাইয়াছেন, উহা সম্ভবত আমার সুপারিশ হইবে। অন্য বর্ণনায় আছে যে, তিনি (আবু তালেব) আপনাকে (নবীকে) রক্ষণা ও সাহায্য করিতেন ইত্যাদি। উহা কি তাহার উপকারে আসিবে? হুজুর (ﷺ) প্রত্যুত্তরে হ্যাঁ বলিলেন। আল-হাদিস।
ইহা এই কথার উপর নিদর্শিত করিতেছে যে, তিনি মুমিন ছিলেন। তিনি যদি মুমিন না হইতেন সুপারিশ কি করিয়া হইতে পারে?
❏ কাফেরদের ব্যাপারে আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত ইরশাদ করিয়াছেন,
لاتنفعهم شفاعة الشافعين وفى مقام اخر لايخفف عنهم العذاب ولاهم ينصرون .
অর্থাৎ- সুপারিশকারীগণের সুপারিশ তাহাদের (কাফেরদের) উপকারে আসিবে না।
❏ অন্যত্রে বলা হইয়াছে, তাহাদের হইতে যন্ত্রণা ও পীড়ন লঘু করা যাইবে না এবং কাহারো পক্ষ হইতে তাহারা সাহায্যকৃতও হইবে না।
তথাপিও হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ তাহাকে আধিক্য করিবে। অতঃপর তাহার শাস্তি লঘু হইয়া যাইবে। আরও জ্ঞাত হওয়া যায় যে, আল্লাহর সহিত কেহ বহুত্ত্ববাদী করিলে আল্লাহ্ তায়ালা সেই ব্যক্তিকে ক্ষমা করিবেন না। মুশরিককে যখন ক্ষমা করা যাইবে না তখন সেই মুশরিক সুপারিশের অধিকারী হইবে না। কেননা, যে কোন যন্ত্রনা পাপের পরিবর্তে হইয়া থাকে। সেই অন্যায় বা পাপ যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমা করা হয় না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই শাস্তিকেও তুলিয়া লওয়া হয় না যাহা অন্যায়ের মোকাবিলায় গঠিত হয়। আবার যখন বহুত্ববাদীকে ক্ষমা করা হয় না। তখন ইহা বিশ্বস্ত হয় যে, সুপারিশকারীগণের সুপারিশ তাহাকে উপকৃত করিবে না।
الشافعين
(আশ্শাফিয়ীনা) ইহা বহুবচন এবং لام (লাম) হরফ দিয়া সজ্জিত করা হইয়াছে। অতঃপর উহা সাধারণের উপকার দিবে, যাহাতে সমস্ত সুপারিশকারীগণ প্রবিষ্ট ও অন্তর্ভূক্ত হইতে পারে। সুতরাং নবী করিম (ﷺ) এর সুপারিশ সুপারিশকারীগণের সুপারিশের অন্তর্ভূক্ত হইবে। কেননা তিনি হুজুর (ﷺ) এর পুণ্যাত্মা ও সত্যবাদী। অতঃপর অন্য সুপারিশকারীগণের সুপারিশ যেমন কাফেরদেরকে উপকৃত করিবেনা তদ্রূপ নবী করিম (ﷺ) এর সুপারিশও তাহাদের উপকারে আসিবে না। অথচ হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ আবু তালেবকে উপকৃত করিবে। যেমন ছহীহ বোখারী ও মুসলিমের মধ্যে বর্ণিত আছে। অতএব, তাহার শাস্তি লঘু করা হইবে। যেমন হাদীসের কিতাবসমূহে বর্ণিত রহিয়াছে। সুতরাং বুঝা গেল, তিনি মুমিন ছিলেন।
হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) আবু তালেবের ঈমান গ্রহণের উপর অন্যতম সাক্ষী
____________________
হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) আবু তালেবের ঈমান গ্রহণের উপর অন্যতম সাক্ষী
❏ শরহে আকায়েদে নছফীর টিকা বা প্রান্তস্থিত নোটে উল্লেখ আছে,
অনুবাদঃ এবং কোন কোন বর্ণনায় আসিয়াছে যে, আবু তালেব বলিয়াছে হে ভ্রাতুষ্পুত্র (নবী) খোদার শপথ নিয়ে বলিতেছি যে, মানুষেরা যদি আমাকে মৃত্যুর বিনয় ও ভয়ের কারণে উহা (কলিমা) বলিয়াছে, এই রকম বলার ভয় না হইত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমি উহা আপনার সম্মুখে বলিয়া দিতাম এবং তাহার মৃত্যু যখন সন্নিকটে হয় তখন হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) তাহার দিকে তাকাইলে দেখিতে পান যে, তিনি (আবু তালেব) তাহার ওষ্ঠাদ্বয়কে আন্দোলিত করিতেছেন, তখন আব্বাস (رضي الله عنه) তাহার (আবু তালেবের) ওষ্ঠাধারের পার্শ্বে কর্ণ রাখিলেন এবং শুনিলেন যে, তিনি (আবু তালেব) ঈমানের অনুজ্ঞা বলিতেছে। তিনি আব্বাস (رضي الله عنه) খোদার শপথ নিয়া বলিতেছেন, হে আমার ভাইপো! আপনি যেই কলমা পড়িবার জন্য আমার ভাই আবু তালেবকে আদেশ করিয়াছেন উহা তিনি পড়িয়াছেন এবং পড়িবার সময় আমি শুনিয়াছি। তদ্রূপ ইবনে ইসহাকের বর্ণনায়ও আসিয়াছে যে, তিনি (আবু তালেব) মৃত্যু সন্নিকট হইলে ইসলাম গ্রহণ করিয়া নেন। শরহে আকায়েদে নছফীর ১১২পৃঃ দ্রষ্টব্য।
❏ মাদারিজুন্নুবুয়াতের মধ্যে উল্লেখ আছে,
অর্থাৎ- ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় আসিয়াছে যে, তিনি (আবু তালেব) মৃত্যুর সন্নিকটে ইসলাম গ্রহণ করিয়াছেন এবং ইবনে ইসহাক বলিয়াছেন, তাঁহার মৃত্যু যখন সন্নিকট হইয়াছে, হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) তাঁহার দিকে অবলোকন করিলেন ও দেখিলেন যে, তিনি তাঁহার ওষ্ঠাদ্বয়কে আন্দোলিত করিতেছেন। অতঃপর আব্বাস (رضي الله عنه) তাঁহার দিকে কর্ণ রাখিলেন এবং তিনি (আব্বাস) হুজুর (ﷺ)কে বলিলেন, হে আমার ভাইপো! খোদার শপথ নিয়া বলিতেছি যে, আপনি আমার ভাইকে যেই কলমার আদেশ করিয়াছেন, সে বিশ্বস্ত সূত্রে উহা পড়িয়াছে।
❏ ‘মা ছাবাতা মিনাচ্ছুন্না’র মধ্যে উল্লেখ আছে,
وان الحشوية تزعم انه مات كافرا واستدل لدعواه بما لادلالة فيه انتهى كذا فى المذاهب .
‘মাছাবাতা মিনাচ্ছুন্নাহ’ নামক কিতাবের মধ্যে উল্লেখ আছে যে, হাশভিয়া ফিরকার (যাহারা বাজে কথা বলে ও প্রলাপ করে) ধারণা অনুযায়ী তিনি কুফরি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। তাহাদের এই কুধারণার উপর সেই যুক্তি পেশ করিতেছে, যাহাতে কোন নিদর্শন বলিতে নাই এবং ইহাই চূড়ান্ত।
❏ যেমন ‘মাজহাবে’র মধ্যে উল্লেখ রহিয়াছে। ইহাও বর্ণিত হইয়াছে যে,
فلما تقار من ابى طالب الموت نظر العباس اليه يحرك سفتيه فاصغى اليه باذنه فقال يا ابن اخى والله لقد قال اخى الكلمة التى امرته بها فقال صلى الله عليه وسلّم لم اسمع كذا فى رواية ابن اسحاق انه اسلم عند الموت .
অর্থাৎ- আবু তালেবের মৃত্যু যখন সন্নিকটে হয় হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) তাঁহার দিকে অবলোকন করিলেন, সেই সময় তিনি (আবু তালেব) তাঁহার ওষ্ঠদ্বয়কে আন্দোলিত করিতেছেন। অতঃপর হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) আপন কর্ণকে তাঁহার (আবু তালেবের) দিকে বাঁকা করিলেন এবং বলিলেন হে আমার ভাইপো! (নবী) খোদার শপথ নিয়া বলিতেছি যে, আপনি আমার ভাইকে যেই কলমা পড়িবার আদেশ করিয়াছেন সে উহা নিশ্চয়ই পড়িয়াছে। অতঃপর হুজুর করিম (ﷺ) বলিলেন, আমি শুনি নাই। তদ্রূপ ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় আসিয়াছে যে, তিনি (আবু তালেব) মৃত্যুর সন্নিকটে ইসলাম গ্রহণ করিয়াছেন।
রাসূল (ﷺ) তাঁর সম্মানিত মাতা-পিতা ও চাচাকে
পুনর্জীবিত করিয়া ঈমান গ্রহণ করানোর বর্ণনা
____________________
রাসূল (ﷺ) তাঁর সম্মানিত মাতা-পিতা ও চাচাকে
পুনর্জীবিত করিয়া ঈমান গ্রহণ করানোর বর্ণনা
❏ “আখবারুল আখয়ার” নামক গ্রন্থের অনুবাদ “আনোয়ারে ছুফিয়ায়” হযরত ছৈয়দ মাহমুদ গীসুদরাজ (رضي الله عنه) এর উন্মত্তাবস্থার (حالات) মধ্যে বর্ণিত আছে, তিনি (গীসুদরাজ রা.) বলিয়াছেন, তাফসীরে উম্মুল মায়ানীর মধ্যে লিখিয়াছেন, রাসূল করিম (ﷺ) বিদায় হজ্জ্বের মধ্যে হযরত আলীকে (رضي الله عنه) কোন একটি যুক্তি সিদ্ধতার জন্য পাঠাইয়াছিলেন। যখন হযরত আলী (رضي الله عنه) সেই যুক্তি সিদ্ধতা হইতে আবর্তিত হইলেন, তখন রাসূলে খোদা (ﷺ) ফরমাইয়াছেন যে, হে আলী! গতকল্য আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে কোন মাহাত্ম্য দ্বারা বিশিষ্ট ও যথাযথ করিয়াছেন তাহা তোমার জ্ঞাত আছে কি? তিনি (আলী) উত্তর করিলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ্! গতকল্য আপনাকে কোন মর্যাদা দ্বারা বিশিষ্ট করা হইয়াছে তাহা আমি শুনি নাই। হুজুর (ﷺ) ফরমাইয়াছেন, গতকল্য আমি একটি পরিষদ করিয়াছি এবং আবু তালেব ও আমার আম্মা-আব্বার রেহাই দেওয়ার জন্য মিনতি করিয়াছি, তখন রাজাজ্ঞা হইল, রায় আমার (আল্লাহ্র) উপর স্থগিত রহিয়াছে। যেই ব্যক্তি আমার একত্ত্বতা ও তোমার নবুয়াতের উপর ঈমান আনে না এবং প্রতিমাসমূহকে রহিত ও বাতিল বলেনা তাহাকে স্বর্গের অন্তর্ভূক্ত করিব না। অতঃপর তুমি (নবী) তামুজ উপত্যকার উপর যাও এবং তোমার আম্মা-আব্বা ও আবু তালেবকে ডাক দাও, তাঁহারা জীবিত হইয়া তোমার সামনে আসিবে। অতঃপর তাহাদিগকে ইসলামের আমন্ত্রণ জানাইবে এবং তাঁহারা ঈমান নিয়া আসিবে। অতএব, আমি সেই রকমই করিয়াছি এবং আমি একটা উঁচু স্থানে যাইয়া আওয়াজ দিয়াছি, হে আম্মাজান! হে আব্বাজান! হে চাচাজান! অতঃপর তাঁহারা তিনজনই মাটির ভিতর হইতে প্রকাশ হইয়া আমার উপর ঈমান নিয়া আসিয়াছেন এবং শাস্তি হইতে নাজাত পাইয়াছেন। ২৮৭পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
❏ হযরত নিজামুদ্দীন মাহবুবে ইলাহী (رحمة الله) এর মলফুজাত ‘রাহাতুল মুহিব্বীনে’র তরজুমার মধ্যে উল্লেখ আছে। তিনি বলিয়াছেন যে, হুজুর (ﷺ) এর চাচা আবু তালেব সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা আরম্ভ হইয়াছে। সুতরাং তিনি (মাহবুবে ইলাহী) বলিয়াছেন, আবু তালেব কিয়ামতের দিন নরকে যাইবে না। কোন এক সময় হযরত খাজা খিজির (عليه السلام)-এর সহিত হযরত খাজা শফিক বলখি (رحمة الله)-এর মোলাকাত হইয়াছে। তখন তিনি (শফিক বলখি) খাজা খিজির হইতে ভীতূ ও বিস্ময়কর কয়েকটি প্রশ্ন করিয়াছেন। মোটামুটি ইহাও একটি ছিল যে, আমি (বলখি) শুনিয়াছি, কিয়ামতের দিন আবু তালেব জাহান্নামে যাইবেনা, তিনি (খিজির) ইহাকে সত্য বলিয়া আখ্যায়িত করিলেন। আমি (খিজির) মর্যাদাসম্পন্ন নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর কল্যাণকর রসনা হইতে শুনিয়াছি, তিনি বলিয়াছেন যে, আবু তালেব কিয়ামতের দিন বেহেশতে যাইবে। খাজা শফিক বলখি আরজ করিলেন, ইহার উপর কি যুক্তি রহিয়াছে? খাজা খিজির (عليه السلام) বলিলেন, প্রথম যুক্তি হইল তিনি (আবু তালেব) যখন দুনিয়া হইতে ঈমানসহকারে মৃত্যুবরণ করিয়াছেন সেই দিন হইতে পিশাচ (শয়তান) বিষন্ন হইয়া গিয়াছে। তাঁহার গোত্রের লোকজন যখন শয়তান হইতে বিষন্নতার কারণ জিজ্ঞাসা করিল তখন সে বলিল তিনি (আবু তালেব) যখন দুনিয়া হইতে ঈমান সহকারে বিদায় নিয়াছেন এবং কেয়ামতের দিন বেহেশতে প্রবেশ করিবে সেহেতু আমি দুঃখিত ও বিষন্ন হইয়াছি।
দ্বিতীয় যুক্তি হইল এই যে, আমি নবী (ﷺ) হইতে একবার শুনিয়াছিলাম, যখন শেষকালে সর্দার ঈসা (عليه السلام) দুনিয়াতে অবতরণ করিবেন, তখন আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত তাঁহাকে এই অলৌকিক ঘটনা বা মু’জিযা প্রাচুর্য করিবেন সে যেই কোন মৃত ব্যক্তিকে কবরের উপর যাইয়া আওয়াজ দিবেন সেই মৃত ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ জীবিত হইয়া যাইবে। অতঃপর তিনি (ঈসা) আমার চাচা আবু তালেবের সমাধির উপর আসিয়া আওয়াজ দিবেন এবং আল্লাহ তায়ালা তাহাকে জীবিত করিবেন। অতএব, তিনি ইসলাম গ্রহণ করিয়া মর্যাদাবান হইবেন এবং বলিবেন,
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
অতঃপর খাজা সাহেব বলিলেন হুজুর (ﷺ) তাহার ব্যাপারে অনেক শ্রম ও উদ্যম করিয়াছেন যাহার সৌভাগ্য তাঁহাকে জীবিত করিয়া ঈমান যোগে বেহেশতে পাঠাইবেন। ১১৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
❏ হযরতুল আল্লামা কেবলা মুফ্তি আমীমুল ইহসান মোজাদ্দেদী বরকতী (رحمة الله) ছিরতে হাবীবে ইলার হাশিয়া বা প্রান্তস্থিত নোটে লিখিতেছেন যে ছরদার আবু তালেবের কুফর ও ঈমানের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। ছহীহাঈনের বর্ণনা হইতে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি মুসলমান হন নাই। ৩৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
কিন্তু সীরতে ইবনে হিশামের মধ্যে ইবনে ইসহাকের বর্ণনানুযায়ী ঈমানের সহিত মৃত্যুবরণ করার উল্লেখ রহিয়াছে। ১৪৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
❏ ছহীহাঈনের বর্ণনাকে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যেব তাঁহার আব্বা হইতে মুরসাল হিসাবে রেওয়ায়েত করিয়াছেন, যাহা মোহাদ্দেসীনগণের মতে ছহীহ ও বিশুদ্ধ এবং ইবনে ইসহাকের সনদে (স্বীকারপত্রে) এনকেতা (কর্তন) রহিয়াছে। যদিও অন্যান্য হাদিস বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য হয় উহা ও মুরসালে কবী (বলবান)। যথোচিত সনদের (স্বীকারপত্রের) শক্তি ও গুণ ছহীহাঈনের বর্ণনার প্রাধান্য চাহিতেছে কিন্তু শরীয়্যতের রীতিনীতি হইল, ’’الاسلام يعلو ولا يعلى‘‘ অর্থাৎ ইসলাম জয়ী ও প্রায় নিশ্চিত হয় এবং পরাজিত ও প্রতিভাবিত হয় না। যখন তাঁহার (ইবনে ইসহাকের) স্বীকারপত্রে কর্তন ব্যতীত অন্য কোন প্রত্যক্ষ ত্র“টি নাই তখন আবু তালেবের ঈমানের উপর অনুজ্ঞা করা হইবে, আল্লাহই অধিক জানেন।
❏ আবদুল্লাহিল এমাদির পক্ষ হইতে তারীখে তবরী’র অনুবাদ তারীখে ইসলামের মধ্যে উল্লেখ আছে, হযরত খাদীজাতুল কোবরা (رضي الله عنه) এর ওফাতের তিনদিন পরে ছিয়াশি বছর বয়সে এবং দুর্বল মতানুযায়ী নব্বই বছর বয়সে আবু তালেব মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। নবী করিম (ﷺ)কে সংবাদ দেওয়া হইলে তাঁহার পবিত্র অন্তরে এই দুর্ঘটনার নতুন সূচনা জাগে ও শক্ত হৃদয়গ্রাহী হইয়া তশরীফ নিয়া আসিলেন এবং তাঁহার (আবু তালেবের) ললাট-দেহের ডান পার্শ্বে যাইয়া চারিবার ও বামপার্শ্বে তিনবার হাত ফিরাইয়া ফরমাইলেন, হে আমার চাচা! ছোটবেলায় আপনি আমাকে লালন-পালন করিয়াছেন, যখন পিতৃহীন হইয়াছি আপনি আমার জেমানত করিয়াছেন এবং বড় হওয়ার পরে দয়া ও সহায়তা করিয়াছেন। তাই আমার পক্ষ হইতে আল্লাহ্ তায়ালা আপনাকে সুপ্রতিফল দান করুক। শবাধারের সম্মুখে সম্মুখে চলিয়া আবু তালেবের সামনে আসিতেন এবং সম্বোধন করিয়া বলিতেন যে, সদ্ব্যবহারের প্রতিফল আপনার হাতে আগমন করুক এবং সুপ্রতিদান অর্জন হউক। তিনি (নবী) ইহা ও ফরমাইয়াছেন যে, উক্ত বিপদদ্বয়ের অবতারণ এই উম্মতদের উপর হইয়াছে। উক্ত বিপদদ্বয় অর্থাৎ খাদিজা ও আবু তালেবের মৃত্যুর মধ্য হইতে কোনটি দ্বারা হুজুর (ﷺ) স্পর্শকাতর হইয়াছেন তাহা জ্ঞাত নাই। প্রাগুক্ত, ৪৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
❏ হযরত মৌলানা আবদুর রব ইবনে শেখ মোহাম্মদ আবদুল খালেক হানাফী, কাদেরী, কোরাইশী তাঁহার গর্ভের সামগ্রী কিতাব: দরকুল মাআরেব’ফী মানাকেবে আছদিল্লাহিল গালেবে’র মধ্যে লিখিত আছে যে ইমাম আবদুল ওহাব শারানী ‘কাশফুল গুম্মাহ’ ২য় খন্ডের ২৫৬ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন, হুজুর (ﷺ) যখন শেষকালে হেদায়ত করিলেন তখন তাঁহার (আবু তালেবের) ওষ্ঠদ্বয় আন্দোলিত করিলেন। সেই সময় হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) তাঁহার মুখের নিকটে কর্ণ লাগাইলেন। অতঃপর বলিলেন হে আমার ভাইপো! আমি খোদার শপথ করিয়া বলিতেছি যে, আপনি আমার ভাই আবু তালেবের পক্ষ হইতে যেই কলমা চাহিয়াছিলেন সে তাহা বলিয়াছে। হুজুর (ﷺ) ফরমাইলেন, الحمدلله الذى هداك ياعم (হে চাচা যে খোদা আপনাকে পথ প্রদর্শিত করিয়াছেন আমি সেই খোদার প্রশংসা করিতেছি। এতদ্যতীত অধিকাংশ জ্ঞানীগণ তাহার মুখ হইতে কলমা বাহির হওয়ার উপর মত দিয়াছেন।
❏ হুজুর (ﷺ) হইতে ইহাও বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আমার সহিত চারি ব্যক্তি সম্পর্কে চুক্তি বা ওয়াদা করিয়াছেন। ইহারা আমার আম্মাজান, আব্বাজান, চাচাজান এবং অপর একজন ভাই যিনি জাহেলিয়্যাত বা অন্ধকার যুগে সৃষ্ট হইয়াছিল। উপরোক্ত উক্তিসমূহ হইতে সঠিকভাবে জ্ঞাত হওয়া যায় যে নবী করিম (ﷺ) এর চাচা আবু তালেব মুক্ত, তাঁহার গুনাহ মাফ করা হইয়াছে।
মুসলিম শরীফে আবু তালেবের জন্য হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ সম্পর্কে পরিচ্ছেদ
____________________
মুসলিম শরীফে আবু তালেবের জন্য হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ সম্পর্কে পরিচ্ছেদ
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) মুসলিম শরীফে’র মধ্যে,
بَاب شَفَاعَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِأَبِي طَالِبٍ وَالتَّخْفِيفِ عَنْهُ بِسَبَبِهِ .
আবু তালেবের জন্য নবী (ﷺ) এর সুপারিশ এবং নবী (ﷺ) এর ওয়াছিলায় তাঁহার (আবু তালেবের) শাস্তি লঘু হইয়া যাওয়া সম্বন্ধে পরিচ্ছেদ করিয়া একটি পরিচ্ছেদ বাঁধিয়াছেন।
প্রতীয়মান হইল যে হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ আবু তালেবের ভাগ্যে জুটিবে এবং সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিও লঘু হইয়া যাইবে। অথচ কোরআন করিম বলিয়াছে,
ولا تنفعهم شفاعة الشافعين
তাহাদিগকে সুপারিশকারীগণের সুপারিশ উপকার দিবেনা। (আল্-আয়াত)
ইহা সত্ত্বেও পাপীদের পক্ষ সমর্থনকারী রাসূল (ﷺ) এর সুপারিশ তাঁহার (আবু তালেবের) কাজে আসিবে, যেহেতু তিনি আন্তরিক প্রমাণকারী ছিলেন।
বিভিন্ন ছহীহ হাদিস দ্বারা আবু তালেব সম্পর্কে আলোচনা
____________________
বিভিন্ন ছহীহ হাদিস দ্বারা আবু তালেব সম্পর্কে আলোচনা
❏ ছহীহ হাদিসে আসিয়াছে,
عَنْ عَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ اِنَّهُ قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ هَلْ نَفَعْتَ أَبَا طَالِبٍ بِشَيْءٍ فَإِنَّهُ كَانَ يَحُوطُكَ وَيَغْضَبُ لَكَ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ نَعَمْ هُوَ فِي ضَحْضَاحٍ مِنْ نَارٍ وَلَوْلَا أَنَا لَكَانَ فِي الدَّرَكِ الْأَسْفَلِ مِنْ النَّارِ .
অর্থাৎ- হযরত আব্বাস ইবনে আবদিল মোত্তালিব হইতে বর্ণিত আছে, তিনি অনুনয় সহকারে বলিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি কি আবু তালেবকে কোন কিছু দ্বারা উপকৃত করিয়াছেন? তিনি যেহেতু আপনাকে সদয় ও রক্ষণাবেক্ষণ করিতেন, হুজুর (ﷺ) প্রত্যুত্তরে বলিলেন হ্যাঁ! তিনি (আবু তালেব) জাহান্নামের সর্বোপর ভিত্তিতে রহিয়াছেন এবং আমি যদি না হইতাম তাহা হইলে তিনি নিশ্চয় জাহান্নামের নিম্নস্তরে থাকিতেন।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ الْحَارِثِ قَالَ سَمِعْتُ الْعَبَّاسَ يَقُولُ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ إِنَّ أَبَا طَالِبٍ كَانَ يَحُوطُكَ وَيَنْصُرُكَ ويغضب لك فَهَلْ نَفَعَهُ ذَلِكَ قَالَ نَعَمْ وَجَدْتُهُ فِي غَمَرَاتٍ مِنْ النَّارِ فَأَخْرَجْتُهُ إِلَى ضَحْضَاحٍ .
❏ অর্থাৎ- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারেছ (رضي الله عنه) হইতে বর্ণনা করা হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) ইহা বলিতে আমি শুনিয়াছি যে, আমি (আব্বাস) অনুনয়স্বরূপ বলিলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! আবু তালেব আপনার রক্ষণাবেক্ষণ করিতেন, আপনাকে সাহায্য করিতেন ও শত্র“দের কবল হইতে হেফাজত করিতেন। অতঃপর উহা কি তাঁহাকে উপকৃত করিবে? হুজুর (ﷺ) বলিলেন হ্যাঁ! আমি তাঁহাকে জাহান্নামের অধিক কষ্টের মধ্যে পাইয়াছি, তৎপর আমি তাঁহাকে সর্বোপরি ভিত্তিতে বাহির করিয়া দিয়াছি।
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذُكِرَ عِنْدَهُ عَمُّهُ أَبُو طَالِبٍ فَقَالَ لَعَلَّهُ تَنْفَعُهُ شَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُجْعَلَ فِي ضَحْضَاحٍ مِنْ النَّارِ يَبْلُغُ كَعْبَيْهِ يَغْلِي مِنْهُ دِمَاغُهُ .
❏ অর্থাৎ-হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) হইতে বর্ণিত আছে যে, হুজুর (ﷺ) ফরমাইয়াছেন, নরকবাসীদের মধ্যে শাস্তির পারগতায় আবু তালেব সহজতর হইবে এবং এমতাবস্থায় তিনি এমন দুইটি পাদুকা পরিধান করিবেন যাহা দ্বারা তাঁহার মস্তিষ্ক স্ফুটন মারিবে।
❏ শারেহীনগণ (ব্যাখ্যাকারী) বলিয়াছেন, হুজুর (ﷺ) এর সহিত তাঁহার স্বাভাবিক ও দৈহিক মুহাব্বত থাকার কারণে তিনি হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশের অধিকারী হইবে এবং তাঁহাকে অনুগ্রহ করা হুজুর (ﷺ) এর দরবারে গৃহীত ছিল। হুজুর করিম (ﷺ) ফরমাইয়াছেন- ’عم الرجل صنوابيه‘ (মানুষের চাচা তাহাদের পিতার পরিবর্তে হইয়া থাকে।) সত্যিই ইহা হইতেও আমাদের দাওয়ার (দাবীর) অটলতা প্রমাণ হইতেছে।
দ্বিতীয়তঃ এইখানে শুধু মুহাব্বতে তাবয়ী (স্বাভাবিক মুহাব্বত) যাহা আপন ছেলেদের উপর মাতা-পিতার হইয়া থাকে উদ্দেশ্য নয় বরং উক্ত মুহাব্বত হচ্ছে মুহাব্বতে ঈমানী (ধর্মীয় মুহাব্বত) এবং মুহাব্বতে এরফানীর (আধ্যাত্মিক মুহাব্বত) উদ্দেশ্য ও বিরাজমান। কেননা, পিতা-মাতা ও ছেলেদের মধ্যে যেই মাত্র স্বাভাবিক মুহাব্বত হইয়া থাকে সেই মুহাব্বত দ্বারা পরকালে কোন উপকার হইবে না। অথচ এইখানে উহার বিপরীত, অর্থাৎ পরকালে উপকার হওয়া।
তৃতীয়তঃ আমরা যদি শুধু স্বাভাবিক মুহাব্বতকেও গ্রহণ করিয়া নিই তাহাতে কোন ক্ষতি নাই। বরং মোহাদ্দেসীন কেরাম হুজুর (ﷺ) এর সহিত স্বাভাবিক মুহাব্বতকেও ঈমানের মে’য়ার (নিদান) স্বীকৃতি দিয়াছেন এবং এই স্বাভাবিক মুহাব্বত হুজুর (ﷺ) এর সহিত প্রত্যেক মুমিনকে তাহার প্রাণ, ধন-সম্পদ এবং ছেলে-মেয়ে হইতেও অধিক হওয়া দরকার। ইহার উপর খোদার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা যাইতেছে যে, এই স্বাভাবিক মুহাব্বতের ব্যাপারে আবু তালেব তুলনাবিহীন। যাহা কাহারো নিকট লুকায়িত নয়।
❏ “নিবরাছ” নামক কিতাবের গ্রন্থকার ও অন্যান্য মনিষীগণ শিয়া ফেরকার বিদ্রোহী হইয়া যেই অস্বীকার করিয়াছেন তাহারা মূলত সে সমস্ত লোকদিগকে অস্বীকার করিয়াছেন যাহারা উক্ত মসয়ালাকে নিশ্চিত প্রস্তাব দিয়া উহাকে দ্বীনের প্রয়োজন সমূহের মধ্যে আনয়ন করিতেছে। যেমন- শিয়াগণ করিতেছে। ইহা নয় যে, তাহাদের এই কথা আহলে সুন্নতের পরিপন্থায়। যেহেতু আবু তালেবকে নরকী ও জাহান্নামী কাফের বলা ইহা হুজুর (ﷺ)কে কষ্ট দেওয়া ব্যতীত আর কিছু নয়।
হ্যাঁ! উক্ত মাসয়ালার মধ্যে যদি মোখালেফীনগণ সন্তোষ না হয় তখন চুপ থাকা আবশ্যক হইবে। অন্যথায় উহা দ্বারা যদি হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র অন্তরে কষ্ট পৌঁছে তখন পুরা জীবনের সমস্ত আমল বিনষ্ট হইয়া যাইবে।
বন্ধুগণ! আপনারা দেখুন,
❏ “তাফসীরে বায়ানুল কোরআনের” মুছান্নিফ আশরাফ আলী থানভী সাহেব উক্ত কিতাবের ৮ম খন্ডের ১১৪পৃষ্ঠায় ’انك لاتهدى الخ‘ ‘ইন্নাকা লা তাহদী আল-আখের’ আয়াত প্রসঙ্গে লেখিতেছেন, তাফসীরে ‘রূহুল মায়ানীর’ মুফাচ্ছির বলিয়াছেন যে, অনর্থক উক্ত মাসয়ালার উপর সমালোচনা করা অথবা তাহাকে (আবু তালেবকে) খারাপ বলা ইহা অবশ্যই মহা মনিষীগণকে কষ্ট দেওয়া এবং হুজুর (ﷺ)কে কষ্ট দেওয়ার সম্ভাবনাও বিদ্যমান রহিয়াছে। অতঃপর সেই সমস্ত সমালোচনা হইতে বাঁচিয়া থাকা ভাল হইবে।
❏ তাফসীর ‘সাভী’,৩য় খণ্ডের ১৩৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
قيل انه احى واسلم ثم مات ونقل هذا القول عن بعض الصوفية .
অর্থাৎ- কেহ কেহ বলিয়াছেন, তিনি (আবু তালেব) মৃত্যুর পরে জীবিত হইয়া ইসলাম গ্রহণ করিয়াছেন। অতঃপর ইন্তেকাল করিয়াছেন। ‘সাভী’ তাফসীরের তফসীরকার এই উক্তিকে কোন কোন ছুফী হইতেও বর্ণনা করিয়াছেন।
❏ তাফসীরে ‘রূহুল বায়ানে’ উল্লেখ আছে:
وقد جاء فى بعض الروايات ان النبى صلّى الله عليه وسلّم لما عاذ من حجة الوداع احى الله له ابويه وعمه فا منوا به، صفحه ৯৪২، جلد:২
অর্থাৎ- কোন কোন বর্ণনায় আসিয়াছে, নবী করিম (ﷺ) যখন বিদায় হজ্জে প্রার্থনা করিয়াছেন তখন আল্লাহ্ তায়ালা তাঁহার সামনে তাঁহার (নবীর) মাতা-পিতা ও চাচাকে জীবিত করিয়াছেন, অতঃপর তাঁহারা সকলে নবীর উপর ঈমান আনিয়াছেন। তাফসীরে রূহুল বায়ান ২য় খণ্ডের ৯৪২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
روى ان الله تعالى احى له صلّى الله عليه وسلّم اباه وامه وعمه ابا طالب وجده عبد المطلب. روح البيان، جلد: ১، صفحه: ১৪৭
وفى كلام القرطبى قد احى الله تعالى على يديه جماعة من الموتى فاذاثبت ذالك فما يمنع ابويه بعد احيائهما ويكون زيادة فى كرامته وفضيلته ولو لم يكن احياء ابويه نافعا لايمانهما وتصديقهما لما احى كما ان ردالشمس لو لم يكن نافعا فى بقاء الوقت لم ترد والله اعلم انتهى .
❏ অর্থাৎ- বর্ণনা করা হইয়াছে যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাঁহার (নবীর) সামনে তাঁহার পিতা, মাতা, চাচা আবু তালেব ও দাদা আবদুল মোত্তালিবকে জীবিত করিয়াছেন। (রূহুল বয়ান, ১ম খণ্ডের ১৪৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)
❏ এবং ইমাম কুরতুবীর বর্ণনায় এই রকম আছে যে, আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত নবী করীম (ﷺ) এর সামনে এক জামায়াত মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করিয়াছেন। অতঃপর উহা যখন প্রমাণিত হইল তখন তাঁহার মাতা-পিতাকে জীবিত করার পরে তাঁহাদের ঈমানকে কে অথবা কোন বস্তু অস্বীকার করিবে? অর্থাৎ তাহাদের ঈমানকে কেহ অস্বীকার করিতে পারিবেনা এবং ইহা তাঁহার (নবীর) কারামত ও ফজীলতের মধ্যে অতিরিক্ত হইবে। তাঁহার মাতা-পিতাকে জীবিত করা যদি তাঁহাদের ঈমানের ও বিশ্বাসের জন্য উপকারী না হয় তাহা হইলে আল্লাহ তায়ালা তাঁহাদেরকে জীবিত করিতেন না। যেমন: সূর্যকে ফিরাইয়া আনা, সময় বাকী থাকার মধ্যে যদি উহা উপকারী না হয় পুনরায় ফিরিতনা। আল্লাহই চূড়ান্তের অধিক জ্ঞানী।
অধম (লেখক) বলিতেছেন: আমরা হুজুর (ﷺ) এর মাতা-পিতার ঈমান সম্বন্ধে সন্তোষজনক কথা বলিয়াছি আর তাঁহার চাচা আবু তালেব এবং দাদা আবদুল মোত্তালিবকে জীবিত করার পরে তাঁহাদের ঈমান সম্বন্ধেও তদ্রুপ। (রূহুল বয়ান ১/৯৭১, সূরা তাওবা)
❏ অতঃপর সাহেবে রূহুল বয়ান আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানীর উক্তিকে বর্ণনা করিতে যাইয়া একটি সন্দেহকে দূর করিয়াছেন।
قال الحافظ ابن حجر فالظن باله صلّى الله عليه وسلّم يعنى الذين ماتواقبل البعثة انهم يطيعون عند الامتحان اكراما للنبى عليه السلام لتقر عينه ونرجوا ان يدخل عبد المطلب الجنة فى جماعة من يدخلها طائعا الا اباطالب فانه ادرك البعثة ولم يؤمن به بعد ان طلب منه الايمان انتهى كلامه، ولعله لم يذهب الٰى مسئلة الا حياء ولذا قال ما قال فى حق ابى طالب .
অর্থাৎ- ইবনে হাজার (رحمة الله) বলিয়াছেন, হুজুর (ﷺ) এর বংশধর সম্পর্কে ধারণা করা অর্থাৎ যাহারা তাঁহার (নবীর) আগমনের পূর্বে মৃত্যুবরণ করিয়াছেন তাঁহারা পরীক্ষার সময় (কিয়ামতের দিন) হুজুরের সম্মানার্থে তাঁহার অনুসরণ করিবেন, যাহাতে তাঁহার চক্ষু মোবারক ঠান্ডা হয় এবং আমরা আশারাখি যে, আবু তালেব ব্যতীত যাহারা খুশি হইয়া বেহেশতে ঢুকিবেন তাঁহাদের সহিত আবদুল মোত্তালিব বেহেশতে প্রবেশ করিবেন। কেননা, তিনি (আবু তালেব) হুজুর (ﷺ) এর আগমণকে পাইয়াছেন এবং তাঁহার (নবীর) নিকট হইতে ঈমানের সন্ধান করিবার পরে তিনি তাঁহার (নবীর) উপর ঈমান আনেন নাই। (ইবনে হাজারের উক্তি শেষ) সাহেবে রূহুল বয়ান বলিতেছেন, আবু তালেবকে জীবিত করার মাসয়ালার দিকে সম্ভবত তিনি (ইবনে হাজার) যান নাই ও সেই দিকে লক্ষ্য করেন নাই। সুতরাং আবু তালেব সম্পর্কে যাহা বলিবার ছিল তিনি তাহা বলিয়াছেন।
(আমাকে আদি দিনের অতীতের করুণা হইতে বঞ্চিত করিওনা, গোপনীয়তার মধ্যে ভাল রহিয়াছে না খারাপ উহা সম্বন্ধে তুমি কি জান?) ১ম খণ্ডের ৯৬২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
❏ তাফসীরে মাওয়াহিবুর রহমানে ১১ পারা সূরা তাওবার ৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ইমাম কুরতুবী (رحمة الله) বলিয়াছেন, তাঁহার মাতা-পিতা জীবিত হইয়া যাওয়া যুক্তি বা শরীয়তের পক্ষ হইতে কোন প্রকারের বাধা নাই। আরও বলিয়াছেন আমি ইহাও শুনিয়াছি যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাঁহার চাচা আবু তালেবকে জীবিত করিয়াছেন এবং তিনি (আবু তালেব) তাঁহার (নবীর) উপর ঈমান আনিয়াছেন।
❏ তাফসীরে রূহুল বয়ানের তাফসীরকার বলিয়াছেন:
وكان عيسى عليه السلام يحيى الموتى وكذالك نبينا عليه السلام احى الله على يديه جماعة من الموتى .
অর্থাৎ- ঈসা আলাইহিস সালাম মৃতদেরকে জীবিত করিতেন। তদ্রূপ আমাদের নবী (ﷺ)ও। যেহেতু আল্লাহ্ তায়ালা তাঁহার সামনে এক জাময়াত মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করিয়াছেন।
জীবিত করার মাসয়ালাকে যদি আমরা হুজুর (ﷺ) এর মোজেযা মানিয়া নিই তাহাতে কি দোষ বা অসুবিধা রহিয়াছে? ইহা কি যুক্তিগত অসম্ভব? কখনো নয় বরং কোন মৃত্যুকে জীবিত করিয়া ইসলাম দ্বারা সম্মানিত করা ইহা হুজুর (ﷺ) এর একটি ক্ষুদ্র মোজেযা মাত্র। কেন হবেনা। যখন নবীর গোলামদের পক্ষ হইতে এই ধরনের শত শত কারামত প্রকাশ হইয়াছে যেমন হুজুর গাউছে পাক (رضي الله عنه)-এর একটি প্রকাশ্য ঘটনা, একজন মুসলমান ও একজন ঈসাইর মধ্যে ঝগড়া হইয়াছে, সেই ঝগড়া মিমাংসা করিবার জন্য তিনি (গাউছে পাক) একজন মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করিয়াছেন এবং ইসলাম গ্রহণ করাইয়াছেন। তাফরীহুল খাতের ইত্যাদি কিতাব দ্রষ্টব্য।
আবু তালেব ঈমানের সহিত মর্যাদাবান ছিলেন
____________________
আবু তালেব ঈমানের সহিত মর্যাদাবান ছিলেন
‘আল কাউলুল জলী’র মুছান্নিফ আল্লামা বরযঞ্জি হইতে মুহাদ্দিছ ও মুতাকালিমের পদ্ধতি ছাবেত করিয়াছেন যে, হযরত আবু তালেব ঈমানের সহিত মর্যাদাবান ছিলেন। কেননা, শুধু অন্তরে বিশ্বাস করার নামই ঈমান এবং তাহা আবু তালেব হইতে পাওয়া গিয়াছে। যদিও তিনি কাফেরদের ভয়ে ঈমানকে প্রকাশ্যমুখে স্বীকার করেন নাই যেহেতু আল কাউলুল জলী’র মুছান্নিফ লিখিতেছেন: প্রকাশ্য বশ্যতা করার যেই বাধাসমূহ রহিয়াছে উহার মধ্যে একটি অনাচারীর ভয়। যদি ইসলাম প্রকাশ করা যায় অথবা ইসলামের অনুসরণ করা যায় তখন অনাচারীগণ তাঁহাকে শহীদ করিয়া দিবে অথবা তাঁহাকে এই ধরণের কষ্ট দিবে যাহা তিনি সহ্য করিতে পারিবেন না অথবা সন্তান-সন্ততি কিংবা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কাহারো সহিত এই রকম কার্যকলাপ করিবে। অতএব, এই রকম মানুষের পক্ষে ইসলামকে গোপন করা জায়েয আছে।
قال الزجاج ان ابا طالب قال عند موته يا معشر بن عبد مناف اطيعوا محمدا وصدقوه تفلحوا وتر شدوا فقال عليه السلام ياعم تامرهم بالنصح لانفسهم وتدعها لنفسك قال فما تريد يا ابن اخى قال اريد منك كلمة واحدة فانك فى اخر يوم من ايام الدنيا ان تقول لا الٰه الّا الله اشهدلك بها عند الله تعالى قال يا ابن اخى قد علمت انك صادق ولكن اكره ان يقال ضرع عند الموت ولو لا ان يكون عليك وعلٰى بنى ابيك غضاضة وسبة بعدى لقلتها ولا قررت بها عينك عند الفراق لما ارى من شدة وجدك ونصحك ولكن سوف اموت علٰى ملة الا شياخ عبد المطلب وهاشم وعبد مناف هكذا فى التفسير الكبير.
❏ অর্থাৎ- যুজাজ (رحمة الله) বলিয়াছেন যে, আবু তালেব তাঁহার মৃত্যুর সময় বলিয়াছেন, হে আবদে মোনাফের বংশধর! তোমরা মুহাম্মদ (ﷺ) এর অনুসরণ কর এবং তাঁহাকে অন্তরে বিশ্বাস কর, তাহাতে তোমরা সফলকাম ও পথ প্রদর্শিত হইবে। অতঃপর হুজুর করিম (ﷺ) বলিলেন, হে চাচা! আপনি তাহাদিগকে তাহাদের কল্যাণের জন্য উপদেশমূলক হুকুম করিতেছেন এবং আপনি নিজের জন্য উহা ছাড়িয়া দিতেছেন।
আবু তালেব বলিলেন, অতঃপর হে ভাতিজা! আপনি কি ইচ্ছা করিতেছেন? নবী করিম (ﷺ) উত্তরে বলিলেন, আমি আপনার পক্ষ হইতে একটি কলমা আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই ইহার স্বীকৃতি চাহিতেছি। উক্ত কলমার মাধ্যমে আমি খোদার দরবারে আপনার জন্য সুপারিশমূলক সাক্ষী দিব। যেহেতু আপনি ইহকালীন জীবনের শেষ দিনে পৌঁছিয়াছেন। আবু তালেব বলিলেন, হে ভাতিজা! আমি নিশ্চয় জানিয়া নিয়াছি যে, আপনি সত্য, কিন্তু মৃত্যুকালে সে বিনয় বা নীচতা স্বীকার করিয়া এই রকম বলাকে আমি ঘৃণা করিতেছি এবং আমার পরে আপনার ও আপনার বাপের বংশগণের উপর অসম্মানি ও গালি-গালাজের ভয় না হইত তাহা হইলে আমি উহা অবশ্যই বলিতাম এবং নিশ্চয় আপনার অত্যাধিক প্রেম ও উপদেশ দেখিতেছি বিচ্ছেদের সময় আপনার চক্ষু মোবারককে ঠান্ডা করিতাম, কিন্তু আমি অচিরেই মুরব্বিগণের অর্থাৎ আবদুল মোত্তালিব, হাশেম ও আবদে মোনাফের ধর্মের উপর মৃত্যুবরণ করিব! এই রকম তাফসীরে কবীরে উল্লেখ রহিয়াছে। বরং কোন জালেম যদি তাহাকে কুফুরী কলমাও প্রকাশ করিবার জন্য বাধ্য করে তখন কুফুরী কলমা উচ্চারণ করা তাহার জন্য জায়েয হইবে।
❏ উহার প্রমাণ আল্লাহ তায়ালার বাণী:
إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (سورة النحل: ১০৬)
কিন্তু যাহাকে কুফুরী কলমার উপর বাধ্য করা হয় এমতাবস্থায় তাহার অন্তরে ঈমানের সহিত শান্ত হয়। আর কিন্তু যাহার বক্ষকে কুফুরীর জন্য খুলিয়া দিয়াছে, অতঃপর তাহাদের উপর খোদার পক্ষ হইতে অভিশাপ অবতরণীয় এবং তাহাদের জন্য রহিয়াছে কষ্টদায়ক শাস্তি।
আবু তালেবের ইসলাম প্রকাশ না করার কারণ হুজুর (ﷺ) কষ্ট পাওয়ার ভয়
____________________
আবু তালেবের ইসলাম প্রকাশ না করার কারণ হুজুর (ﷺ) কষ্ট পাওয়ার ভয়
হযরত আবু তালেবের ইসলাম প্রকাশ করার মধ্যে বাধা হওয়া তাঁহার ভাতিজা হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) কষ্ট পাওয়ার ভয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল। কেননা, তিনি হুজুর (ﷺ) এর সহায়তার মধ্যে উৎসাহী সচেষ্ট ছিলেন, আর যে কোন কষ্টকে হুজুর (ﷺ) এর পক্ষ হইতে দূর করিতেন। যাহাতে তিনি (নবী) তাঁহার খোদার তৌহিদের তাবলীগ করিতে পারেন। যেহেতু আবু তালেবের সহায়তা ও পক্ষপাতিত্বের লক্ষ্যে কাফেরগণ মুহাম্মদ (ﷺ)কে কষ্ট দেওয়া হইতে বিরত থাকিত। কেননা, কোরাইশের সর্দারি ও ব্যক্তিত্ব হযরত আবদুল মোত্তালিবের পরে হযরত আবু তালেবের জন্য গৃহীত ছিল। আবু তালেব কোরাইশের হুকুমের উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তাঁহার সহায়তা কাফেরদের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল। কেননা, তাহারা হযরত আবু তালেবকে তাহাদের দ্বীন ধর্মের উপর বলিয়া জানিত। যদি তাহারা অবগত হইতে পারিত যে, আবু তালেব মুসলমান এবং হুজুর (ﷺ) এর অনুসারী হইয়া গিয়াছেন তখন তাহারা কখনো তাঁহার রক্ষণা ও সহায়তাকে কবুল করিত না, বরং তাঁহার সহিত লড়িত আর কষ্ট দিত। হুজুর (ﷺ) এর সহিত আবু তালেবের কি ধরণের মুহাব্বত ও বিশ্বাস ছিল তাহা ঐতিহাসিকগণের নিকট আদৌ গুপ্ত নহে।
তাবরানীর ‘আল-কাবীরে’র মধ্যে একটি হাদিস বর্ণিত আছে, হুজুর (ﷺ) ফরমাইয়েছেন, যেই ব্যক্তি সত্যান্তরে জানিয়া নিয়াছে যে, আল্লাহ্ আমার প্রভু এবং আমি তাঁহার রাসূল, তখন আল্লাহ্ পাক তাহার সমস্ত মাংসকে আগুনের জন্য হারাম করিয়া দিবেন। দ্বিতীয় একটি হাদীসে আসিয়াছে, আমার (নবীর) সুপারিশ মুশরিক ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট পৌঁছিবে। যখন ইহা প্রমাণিত হইল যে, সুপারিশ আবু তালেবকে উপকৃত করিবে, তখন অবশ্যই মানিয়া নিতে হইবে যে, আবু তালেব মুশরিক ছিলেন না। ইহাই সত্য এবং সুস্পষ্ট।
❏ আল্লামা কেরানী (رحمة الله) ‘শরহে তানকীছে’র মধ্যে আবু তালেবের নিম্নলিখিত শের সম্বন্ধে:
وقد علموا ان ابننا لا مكذب
لدينا ولا يعربى لقول الاباطل
(কোরাইশগণ জানিয়া নিয়াছে যে, আমাদের ছেলে মুহাম্মদ (ﷺ) না ধর্মের মিথ্যাবাদী, আর না কোন মিথ্যা কথার প্রতি আগ্রহী ও নতি স্বীকারকারী)।
বিরুদ্ধাচারীদের প্রশ্নাদির উত্তর লিখিতেছেন যাহা তিনি (আবু তালেব) কোন অবস্থায় বলিয়াছিলেন, তাহা হইতে আবু তালেবের আন্তরিক বিশ্বাস ও মুখে স্বীকার করা উভয় পাওয়া যাইতেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে ইহাও জানা হইতেছে যে, তিনি (আবু তালেব) প্রকাশ্য এবং গুপ্ত উভয় দিক দিয়া মুসলমান ছিলেন।
কিন্তু কিছু ছহীহ আপত্তি থাকার কারণে সম্পূর্ণরূপে আপন ঈমানকে প্রকাশ করিতেন না। আর,
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ الخ الاية
অর্থাৎ- তুমি যাহাকে ভালবাসিতেছ তাহার জন্য হেদায়ত সৃষ্টি করা তোমার কাম নয়।
এই আয়াতের অবতারণা আবু তালেব সম্পর্কে হইয়াছে এবং ইহাই সমস্ত তাফসীরকারগণের মত।
❏ আল্লামা বরযঞ্জী (رحمة الله) বলিতেছেন আশ্চর্যের বিষয় যে, যাহারা উক্ত আয়াতকে আবু তালেবের কুফুরীর জন্য যুক্তি বা দলীল বানাইয়াছে এবং ইহা ধারণা করিয়াছে যে, সেই আয়াত শরীফ আবু তালেবের ব্যাপারে অবতীর্ণ হওয়া আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী সময়ে তাঁহাকে হেদায়ত করার বিপরীত নয়।
❏ তাফসীরে কবীর ৫ম খণ্ডের ১১২৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে:
هذه الاية لادلالة فى ظاهرها على كفر ابى طالب .
অর্থাৎ- এই আয়াতের বহির্ভাগে আবু তালেবের কুফরীর উপর কোন নিদর্শন নাই।
উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ হইতে কেহ কেহ আবু তালেবকে জাহান্নামী প্রমাণ করিতেছেন।
❏ হযরত আলী (رضي الله عنه) হইতে বর্ণিত আছে, তিনি বলিয়াছেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) আপনার পথভ্রষ্ট চাচা মরিয়া গিয়াছে, হুজুর (ﷺ) ফরমাইয়াছেন হে আলী! তুমি যাও এবং তাঁহাকে গোসল দিয়া দাফন কর। আল্লাহ্ তাঁহাকে রহমত এবং ক্ষমা করুক। ইহা হইতে প্রতীয়মান হইল যে, আবু তালেব মুসলমান হওয়ার জ্ঞান যদি হুজুর (ﷺ) এর নিকট থাকিত তিনি (ﷺ) জানাযায় কেন শরীক হন নাই এবং হযরত আলীকে (رضي الله عنه) পথভ্রষ্ট শব্দ হইতে কেন বাধা দেন নাই?
❏ আল্লামা বরযঞ্জী (رحمة الله) উত্তর দিতে যাইয়া বলিতেছেন যে তখনকার সময় জানাযার নামাজ মশরু (আইনানুযায়ী) হয় নাই। অর্থাৎ এখনকাররূপে জানাযার নামায আইনানুযায়ী হয় নাই। না হয় আসল জানাযার নামায হুজুর (ﷺ) এর এই দোয়া করা যে আল্লাহ্পাক তাহাকে মাগফেরাত ও রহমত করুক এবং তিনি (ﷺ) বোকা কোরাইশদের সমাবেশে হওয়ার কারণে তাশরীফ নেন নাই যাহাতে কোন রকমের বিবাদ ঘটিতে না পারে। আর হযরত আলী (رضي الله عنه) সম্ভবত বোকা কোরাইশদের মাদারাতের জন্য গোমরা শব্দটি বলিয়াছেন। (মাদারাত: অর্থ যেই অন্যায়ের প্রভাব ধর্মীয় অথবা পার্থিব চেলাহ ও সুস্থতার উপর)
❏ আল্লামা কুরতুবী (رحمة الله) মাদারাত শব্দের সংজ্ঞা বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিয়াছেন:
المدارات بذل الدنيا لصلاح الدنيا اوالذين اولصلاهما جميعًا .
অর্থাৎ- পার্থিবের অথবা ধর্মের কিংবা পার্থিব ও ধর্ম উভয়ের সুস্থতার জন্য পার্থিব ব্যয় করাকে মাদারাত বলে। এই মোয়ামেলা আইনানুযায়ী প্রশংসিত। মাদারাতের বিপরীত মাদাহানাত (ধোঁকা দেওয়া অথবা মোনাফেকী করা)।
❏ আল্লামা কুরতুবী (رحمة الله) বলিয়াছেন:
المداهنة بذل الدين لصلاح الدنيا .
অর্থাৎ- পার্থিবের সুস্থতার জন্য ধর্মকে ব্যয় করার নাম মাদাহানাত। ইহা কিন্তু আইনানুযায়ী নিষিদ্ধ। হুজুর করিম (ﷺ) নিষেধ করেন নাই এবং আবু তালেবের জন্য রহমত ও বখশিশের দোয়া করা তিনি মুমিন হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ।
বোখারী এবং মুসলিম শরীফের রেওয়ায়েত দ্বারাও কেহ কেহ আবু তালেবের কুফর ছাবেত করিতেছে এবং বলিতেছে যে, সেই যদি মু’মিন হইত তখন আগুনে থাকিত কেন এবং হযরত রাসূল করিম (ﷺ) সে আগুনে থাকিবে কেন ফরমাইয়াছেন? অতএব বুঝা গেল, সহায়তা ইত্যাদি গোত্রের প্রতিলক্ষে ছিল এবং উহা দ্বারা কোন উপকার হইবেনা।
❏ আল্লামা বরযঞ্জী (رحمة الله) উত্তরে বলিতেছেন, মূল হাদীসগুলো হইতে ইহা প্রমাণিত হইতেছে যে, আবু তালেবের নাজাত হইবে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা খবর দিয়েছেন কাফেরগণের শাস্তির মধ্যে না লঘু করা হইবে আর না তাহারা দোযখ হইতে বাহির হইবে, আর না সুপারিশকারীগণের উপকারী হইবে এবং ইহা ও প্রমাণ হইয়াছে যে, জহীম দোযখের সেই স্তর, যেই স্তরে পাপী মুমিনদিগকে আজাব দেওয়া হইবে। আর জহীম ইহা জাহান্নামের অত্যুচ্চ স্তর এবং কাফের অপেক্ষা পাপীদের আজাবও কম হইবে। অতঃপর হাদীস দ্বারা যখন প্রমাণিত হইল সে সমস্ত জাহান্নামীদের অপেক্ষা শাস্তির মধ্যে আবু তালেবের মোটামুটি কম হইবে, তখন আমরা বিশ্বস্তভাবে বলিতে পারি যে, পাপী মুমিনগণ হইতেও তাঁহার আজাব কম হইবে। অন্যথায় হুজুর (ﷺ)-এর বাণী কিভাবে অকপট হইবে যে, জাহান্নামীদের মধ্যে আবু তালেব অতি কম আজাবের মধ্যে। যদি অপ্রাকৃত অথবা কাল্পনিক মানাও যায় যে আবু তালেব কাফের এবং সবসময় আগুনে থাকিবে তখন অবশ্যই মানিয়া নিতে হইবে যে, গুনাহগার মুমিন অপেক্ষা কাফেরের আজাব কম হইবে। অথচ এই ধরণের বক্তব্য কেহ বলেন নাই।
অতএব, উপরোক্ত তকরীর হইতে সুন্দররূপে প্রমাণিত হইল যে, আবু তালেব মুমিন ছিলেন এবং পরিশেষে মুক্তি পাইবেন। আর হাদীসসমূহ হইতে ইহাও প্রমাণিত হয় যে, জহীমের স্তরে পাপীদের পাঠাইয়া দেওয়া হইবে। কেননা, ইহা পাপী মুমিনদেরকে আজাব করিবার স্তর এবং আবু তালেবও সেই স্তরে থাকিবে। যখন মুমিনদেরকে উহা (জহীম) হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হইবে তখন তাঁহার (আবু তালেবের) অবশিষ্ট থাকা বেফায়দা (উপকারহীন) হইবে।
অতএব, আবশ্যকীয় হইল যে, জহীম হইতে অন্যান্য মুমিনদেরকে যেমন বাহির করা হইবে তদ্রূপ আবু তালেবকে সর্বোত্তমভাবে বাহির করা হইবে। কারণ ইহা (আবু তালেব) তাহাদের চেয়ে খুব কম আজাবের মধ্যে ছিল।
❏ আল্লামা জরযঞ্জী (رحمة الله) বলিয়াছেন এই প্রমাণাদি নেহায়ত বা প্রাচুর্য ছহীহ ও বিশুদ্ধ এবং হুজুর (ﷺ) ফরমাইয়াছেন:
شفاعتى لا هل الكبائر
অর্থাৎ- আহলে কবায়েরের (যাহারা কবিরা গুনাহ করে) জন্য আমার সুপারিশ হইবে। উক্ত হাদীসে ’لام‘ (লাম) اختصاص (বিশেষত্ব) এর জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। বরং আহলে কবায়ের হইতে কাফের ও মুশরিক পরিত্যক্ত হইবে এবং কোরআন করিম বলিতেছে:
لَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ
অর্থাৎ- সুপারিশকারীগণের সুপারিশ তাহাদেরকে উপকৃত করিবেনা। الشَّافِعِينَ (আশশাফিয়ীন)কে লাম দ্বারা সজ্জিত করার কারণে উমুম অর্থাৎ সাধারণের উপকার দিবে। যাহা দ্বারা মা’লুম হইল যে, কাফের এবং মুশরিকদের ব্যাপারে সুপারিশ উপকারী হইবে না। অথচ মুসলিম শরীফের হাদীসে আছে, আবু তালেবের জন্য সুপারিশ উপকারী হইবে। অতএব জানা গেল, তিনি গুনাহগার ছিলেন, কিন্তু কাফের ছিলেন না। পাপীদেরকে দোযখ হইতে বাহির করিয়া বেহেশতে প্রবেশ করা যাইবে। সুতরাং পরিণাম ইহা হইবে যে, আবু তালেবও দোযখ হইতে বাহির হইয়া জান্নাতে প্রবিষ্ট হইবে।
❏ হুজুর (ﷺ) ফরমাইয়াছেন কিয়ামতের দিন আমার আম্মা, আব্বা ও চাচা আবু তালেব এবং সেই ভাই যিনি জাহেলিয়্যাত যুগে ছিল তাহাদের জন্য সুপারিশ করিব। আবু নাঈম বলিতেছেন, ইহা হুজুর (ﷺ) এর দুধভাই ছিল।
আর যেই সমস্ত হাদীসের মধ্যে আবু তালেবকে আগুনে বলা গিয়াছে সেই ব্যাপারে আল্লামা বরযঞ্জী (رحمة الله) বলিতেছেন, ‘নার’ (আগুন) শব্দ দ্বারা আবু তালেবকে সবসময় নারী বলা ইহা বড় ভুল হইবে। কেননা, কোন কোন মুমিনের ব্যাপারে শুধুমাত্র একটি গুনাহর কারণে আগুনে প্রবিষ্ট হওয়ার হুকুম লাগা যায়। ‘নার’ এমন একটি জাতিবাচক বিশেষ্য যাহা জাহান্নামের সমস্ত স্তরকে যুক্ত করে। ‘নারে’ (আগুনে) প্রবেশকারী শুধু কাফের হওয়া আবশ্যকীয় নয়, অন্যথায় ‘আক’ (ভাল কাজে বাধা সৃষ্টিকারী) এবং ‘গাল’ (চোর) ইত্যাদিকেও এই রকম বলিতে হইবে। অথচ এই ধরনের উক্তি কোন ওলামা হইতে বর্ণিত নাই। কিন্তু হ্যাঁ! এই রকম প্রশ্ন হইতে পারে যে আবু তালেবকে যখন নির্দোষ স্থির করা হইয়াছে আবার আজাব দেওয়ার কি কারণ রহিয়াছে? হৃদপিন্ডের বিশ্বাস ইহাই যাহা তাঁহার ভিতরে হাছেল ছিল। দ্বিতীয় অন্যান্য হুকুম সমূহ তাঁহার জীবদ্দশায় অবতীর্ণ হয় নাই।
তাঁহার আজাব হওয়ার উত্তর এই যে, শাহাদাতাঈন ছাড়িয়া দেওয়ার কারণে অথবা কাহাকেও কষ্ট দেওয়ার কারণে অথবা বান্দার প্রাপ্য ঋণ দেওয়ার অথবা আত্মসাৎ করণের উপর আজাব হইবে। শাহাদাতাঈন উচ্চারণ করাকে ছাড়িয়া দেওয়ার কারণ সত্য প্রমাণ হইতেছে না। কেননা, সেই ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা রহিয়াছে, অন্যান্য কারণসমূহ অবশ্যই সত্য।
❏ হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) বলিয়াছেন, আবু তালেব শেষকালে ওষ্ঠাধর আন্দোলিত করিতে আমি দেখিয়াছি। উক্ত হাদীসের সনদ অবশ্য দুর্বল (জঈফ) কিন্তু দুররে মোখতারের মধ্যে উল্লেখ আছে যে, যদি কাহারো ইসলাম দুর্বল রেওয়ায়েত দ্বারাও প্রমাণিত হয় তখন তাহাকে মুসলমান বলা যাইবে।
واعلم انه لا يفتى بكفر مسلم امكن حمل كلامه على محل حسن او كان فى كفره خلاف ولو كان ذالك رواية ضعيفة كما حرره فى البحر وعزاه فى الاشباه الى الصغرى وايضا اذا كان فى المسئلة وجوه توجب الكفر وواحد يمنعه فعلى المفتى الميل لما يمنعه ثم لو نيته ذالك فمسلم والالم ينفعه حمل المفتى على خلافه . (شامى، جلد: ৪، صفحه: ২৩ باب المرتد)
অর্থাৎ, ইহা জানিয়া রাখ যে, যাহার কালাম সৎ উদ্দেশ্যের উপর উপেক্ষা করা সম্ভব হয় অথবা তাহার কুফুরীর মধ্যে ওলামাদের মতানৈক্য হয়, সেই মুসলমানকে কাফের বলা যাইবেনা, যদিও এই মতানৈক্য দুর্বল রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত হয়। সুতরাং ‘বাহরুর রায়েক’ কিতাবের মধ্যে উহাকে খুব সুন্দর করিয়া লিখিয়াছেন এবং ‘আশবাহ’ কিতাবের মধ্যে মতানৈক্যর মুখাবয়বে (ছুরতে) কুফরীর ফত্ওয়া না দেওয়াকে ফত্ওয়া ‘ছোগরার’ দিকে সন্ধিবদ্ধ করিয়াছেন। আর যখন একটি মুখাবয়বের মধ্যে আবশ্যক হওয়ার কয়েকটি কারণ ও যুক্তি হয় কুফরী বিষয়ক একটি মাত্র যুক্তি হয়, তখন কুফরী বিঘ্নকর যুদ্ধির দিকে অগ্রসর হওয়া মুফতির উপর প্রয়োজন অতঃপর তাহার নিয়্যতে সেই কুফরী বিষ্কয়কর কারণ না হয়, তখন মুফতি সাহেব উহার বিপরীত উদ্দেশ্য করাতে কোন উপকার হইবেনা।
আরও সম্ভব, আবু তালেব তখন ইহা বুঝিয়াছেন যে, আবু জেহেল এবং ইবনে উমাইয়ার সামনে কলমা না পড়া যুক্তিসিদ্ধতার সদৃশ। তাহারা চলিয়া যাওয়ার পরে কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি (আবু তালেব) কলমার সহিত ওষ্ঠাধর আন্দোলিত করিয়াছেন।
হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ কাফেরদের জন্য নয় অথচ আবু তালেবের জন্য
____________________
হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ কাফেরদের জন্য নয় অথচ আবু তালেবের জন্য
❏ হুজুরের সুপারিশ করার প্রমাণ রয়েছে
কোন কোন আলেম এক ধরনের সুপারিশকে নবী করীম (ﷺ) এর যথাযথ স্থিরীকৃত করিয়াছেন এবং কাফেরদের ব্যাপারে বর্ণনা করিতেছেন, আর উহার দৃষ্টান্ত আবু তালেবের আজাব লঘু হওয়াকে সম্মুখ করিতেছেন।
উপরোক্ত উক্তির উত্তর এই যে, প্রথমত, এই আপত্তিটি ‘হুজুর (ﷺ) ফরমাইয়াছেন আমার সুপারিশ আহলে কবায়েরের (যাহারা কবিরা গুনাহ করে) জন্য হইবে’ সেই হাদিসের বিপরীত। দ্বিতীয়ত, রেওয়ায়েত আছে, মুশরিকের জন্য আমার কোন সুপারিশ নাই।
এই উক্তি সেই সমস্ত লোকদের কাল্পনিক, যাহারা আবু তালেবকে কাফের বলিতেছেন। অথচ আবু তালেবের জন্য ঈমান এবং সুপারিশও রহিয়াছে। হুজুর করীম (ﷺ) এর সুপারিশ দোষ এবং পাপ হিসেবে কুফর হিসেবে নয়।
উপরোলেখিত কারণসমূহ ব্যতীত যে সমস্ত ব্যক্তিগণ এই প্রকারের সুপারিশকে নবী করীম (ﷺ) এর সাথে যথাযথ করিয়াছে তাহারা আবু তালেবের ব্যাপারে ব্যতীত অন্য কাহারো কোন ব্যাপার পেশ করিতে পারিতেছেনা। কিছু বলিতে পারার কেহ থাকিলে বলিয়া দিন, আমরা অন্তর্দৃষ্টি ও উৎকণ্ঠা করি।
হ্যাঁ, ইহা ভিন্ন কথা যে, কোফ্ফার অর্থ প্রকাশ্য কোফ্ফার হউক, যদি কোফ্ফার অর্থ প্রকাশ্য কোফ্ফার অনুমান করা না যায়, তখন ’ان الله لا يغفر ان يشرك به‘ (নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালার সহিত শিরক করা হইলে তিনি উহা ক্ষমা করিবেন না।) বিশিষ্ট হওয়া আবশ্যকীয় হইবে। অর্থাৎ আবু তালেব উহা হইতে মুস্তাসনা বা প্রকৃষ্ঠ হইবে। অথচ উহার কথক কেহ নাই।
❏ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (رحمة الله) বলেন,
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيْمِ .
অর্থাৎ- নবী করীম (ﷺ) এবং মুমিনদের পক্ষে মুশরিকগণ যে জাহান্নামী ইহার স্পষ্ট প্রমাণ হওয়ার পরে তাহাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা প্রযোজ্য নহে, যদিও তাহারা (মুশরিকগণ) আত্মীয়-স্বজন হইয়া থাকে। এই আয়াতের শানে নুযুল আবু তালেব সম্পর্কে বলিয়াছেন।
❏ আল্লামা ছৈয়দ জাফর বরযঞ্জী (رحمة الله) উহার উত্তরে বলিতেছেন, এই হাদিসসমূহ উক্ত আয়াত শরীফ নাযিল হওয়ার কারণ বলিয়াছে আমি উহার অনুসন্ধান করার পরে সেই ব্যাপারে তিনটি কারণ আমার জ্ঞাত হয়।
প্রথমত, উল্লেখিত আয়াত আবু তালেব সম্পর্কে অবতীর্ণ হইয়াছে। দ্বিতীয়, হুজুর (ﷺ) এর আব্বা ও আম্মাজান সম্পর্কে অবতীর্ণ হইয়াছে এবং তৃতীয়ত, মুমিনগণের সেই সমস্ত পিতামহ ও আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে অবতীর্ণ হইয়াছে, যাহারা কুফরী অবস্থায় মরিয়া গিয়াছে। তাহাদের আওলাদগণ তাহাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিতেন।
অতঃপর উল্লেখিত তিনটি কারণের মধ্য হইতে প্রতিপাদন (তাহ্কীক) করার পরে মা’লুম হইয়াছে যে, প্রথম কারণে রুয়াতের (হাদীস বর্ণনাকারী) প্রমাণ রহিয়াছে। দ্বিতীয়ত, সম্পূর্ণ দূর্বল এবং তৃতীয়ত, ছহীহ। উহার কারণ এই যে, উল্লেখিত আয়াত মদনী, যাহা তবুকের যুদ্ধের পরে মদীনা শরীফে অবতীর্ণ হইয়াছে এবং আবু তালেব আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে ওফাত পাইয়াছেন।
❏ ইমাম আহমদ, তিরমিজী, নাছায়ী, আবু ইয়ালা ইবনে আবী শাইবা, তায়ালীসি, ইবনে জরীর, ইবনুল মুনজির, ইবনে আবী হাতেম এবং আবুশ শেখ (رحمة الله) ছহীহ সনদ সহকারে রেওয়ায়েত করিয়াছেন যে, হযরত আলী (رضي الله عنه) বলিয়াছেন, আমি একজন লোককে দেখিয়াছি যে, তাঁহার মাতা-পিতার জন্য ক্ষমা চাহিতেছে, সেই লোকটি উত্তরমূলক আমাকে বলিল, হযরত ইব্রাহিম (عليه السلام) কি তাঁহার পিতার জন্য ক্ষমা চান নাই? হযরত আলী (رضي الله عنه) বলিতেছেন যে, এই ঘটনাটি আমি হুজুর করিম (ﷺ) এর খেদমতে পেশ করিয়াছি, তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।
❏ আল্লামা বরযঞ্জী (رحمة الله) বলিয়াছেন, এই বর্ণনাটি প্রাচুর্য ছহীহ, হাকেম ও ইহার শুদ্ধি করিয়াছেন এবং এই রকম ইবনে জরীর ও ইবনে আবী হাতেম ছহীহ রেওয়ায়েত দ্বারা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, মানুষেরা তাহাদের মুশরিক মাতা-পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিতেন। তখন অত্র আয়াত করিমা অবতীর্ণ হয়।
জ্ঞাত হওয়া গেল যে, মানুষের মধ্যে যেই ব্যাপার পরিচিত আছে তাহা শুদ্ধ নয়। যেহেতু -
❏ সাহেবে রূহুল বয়ান বলিয়াছেন,
وان كانت مشهورة بين الناس لكن الصواب خلافه .
অর্থাৎ- যদিও মানুষের মধ্যে সেই ব্যাপারটি প্রকাশ্য হয়, কিন্তু সত্য উহার বিপরীত।
❏ আল্লামা বরযঞ্জী (رحمة الله) বলিয়াছেন, যখন হুজুর করীম (ﷺ) আবু তালেবের নিকট কলমা তৈয়্যবা পেশ করিলেন এবং তিনি (আবু তালেব) আবু জেহেল প্রমুখের প্রতিলক্ষ্যে ইহা বলিয়া দিয়াছেন যে, আমি আবদুল মোত্তালিবের রীতি-নীতির মধ্যে আছি। তখন হুজুর করীম (ﷺ) বলিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে নিষেধ করা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আবু তালেবের জন্য ক্ষমা চাহিতে থাকিব। মুসলমানগণ যখন ইহা শুনিয়াছেন যে, হুজুর (ﷺ) তাঁহার চাচার জন্য ক্ষমা চাহিতেছেন, তখন তাঁহারা ও তাহাদের মুশরিক পিতামহ এবং আত্মীয় স্বজনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন, তৎসময় এই আয়াত করিমা অবতীর্ণ হয়।
❏ হাদীস বর্ণনাকারী হইতে যখন শানে নুযুল জিজ্ঞাসা করা হইল তখন তিনি কথাকে ইহার উপর সংক্ষিপ্ত করিয়াছেন যে, হযরত নবী করীম (ﷺ) ফরমাইয়াছিলেন আমাকে যতক্ষণ পর্যন্ত নিষেধ করা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আবু তালেবের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিতে থাকিব এবং পূর্বের বাক্য ছাড়িয়া দিয়াছেন। আবু তালেবের জপন হওয়াতে শ্রোতাগণ বুঝিয়াছেন যে, এই অবতারণা আবু তালেব সম্পর্কে হইয়াছে। অথচ তাহারা যাহা বুঝিয়াছেন প্রকৃতপক্ষে এই রকম ছিলনা।
وان كانت مشهورة بين الناس لكن الصواب خلافه . (روح البيان)
অর্থাৎ- যদিও মানুষের মধ্যে প্রকাশ্য হয় কিন্তু সত্য উহার বিপরীত। (রূহুল বয়ান দ্রষ্টব্য)।
সব চাইতে বড় প্রমাণ ইহা যে, আয়াত করিমা মদনী, (মদীনা শরীফে অবতীর্ণ হইয়াছে) আবু তালেবের ওফাতের ১২ বছর পরে অবতীর্ণ হইয়াছে।
❏ তাফসীরে কবিরের মধ্যে উল্লেখ আছে;
قال الواحدى وقد استبعده الحسين بن الفضل لان هذه السورة من اخر القران نزول ووفاة ابى طالب كانت بمكة فى اول الاسلام .
অর্থাৎ- ইমাম ওয়াহেদী (رحمة الله) বলিয়াছেন, হোছাইন ইবনে ফজল উহাকে দূরে মনে করিয়াছেন। কেননা, অবতারণ হিসেবে এই সূরাটি কোরআন শরীফের সর্বশেষ সূরা এবং আবু তালেবের ওফাত ইসলামের প্রথম যুগে মক্কায় হইয়াছিল। যদি কেহ বলে যে, ছহীহাঈনের (বুখারী ও মুসলিম শরীফের) মধ্যে উল্লেখিত আয়াত আবু তালেব সম্বন্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলিয়াছেন এবং সুনান অর্থাৎ তিরমিযী ও নাসায়ী ইত্যাদি হাদিসের কিতাবের মধ্যে মুসলমানদের মুশরিক পিতামহ সম্বন্ধে অবতীর্ণ হওয়া ফরমাইয়াছেন। যেহেতু ছহীহাইনের তরজীহ (গুরুত্ব) হইবে। ইহার প্রতি উত্তরে আরজ করা যাইবে যে, ছহীহাঈনের তরজীহ একচ্ছত্র হিসাবে নয়, বরং কোন সময় ছহীহাঈনের উপর অন্য কিতাবের ঊর্ধ্বতনও হয়। যেমন উহাকে উসূল গবেষক আলেমগণ স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন।
❏ ‘তাফসীরে খাযায়েনুল এরফানের মধ্যে আছে, হাদীস মীমাংসাকারীগণ ছহীহাঈনের হাদীসকে শক্ত জয়ীফ বলিয়াছেন এবং জয়ীফ হাদীস দ্বারা কুফর রূপীয় বৃহৎ মাসআলা ছাবেত হয়না।
❏ আবার কেহ কেহ ولا تسئل عن اصحاب الجحيم (এবং তুমি জাহান্নামীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হইবেনা) এই আয়াতে করিমার শানে নুযুল আবু তালেব সম্পর্কে বলিয়াছেন। ইহা সম্পূর্ণ ভুল এবং ইহার কোন প্রমাণ নাই, বরং স্পষ্টভাবে আসিয়াছে যে, এই আয়াতে করিমাটি ইয়াহুদ সম্পর্কে অবতীর্ণ হইয়াছে।
❏ হযরত আবু হাব্বান বলিতেছেন, আয়াতের পরিচালন এবং প্রাধান্য ও উহার প্রমাণ করিতেছে।
❏ আল্লামা ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (رحمة الله) বলিতেছেন:
نهى عن السوال عن احوال الكفرة وهذه الرواية بعيدة لانه عليه الصلواة والسلام كان عالما بكفرهم وكان عالما بان الكافر معذب فمع هذا العلم كيف يمكن ان يقول ليت شعرى .
অর্থাৎ- কাফেরদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হইতে যে নিষেধ করা হইয়াছে এই বর্ণনাটি অযৌক্তিক। কেননা, নবী করীম (ﷺ) তাহাদের কুফরী সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং ইহা সম্পর্কেও জ্ঞানী ছিলেন যে, কাফেরকে আজাব দেওয়া হইবে। অতঃপর এই জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তিনি যদি ‘আমি জানিতাম’ ইহা বলা কি করিয়া সম্ভব হইবে?
আবু তালেব হুজুর (ﷺ) এর চক্ষু মোবারকের শৈত্য ছিলেন। সুতরাং যেই ব্যক্তি তাঁহাকে কষ্ট দিবে সে হুজুর (ﷺ)কে কষ্ট দিবে এবং রাসূল (ﷺ)কে কষ্ট দেওয়া হারাম।
❏ আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করিতেছেন:
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ رَسُولَ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ .
অর্থাৎ- যাহারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দিবে তাহাদের জন্য কঠিন শাস্তি রহিয়াছে।
❏ তাফসীর রূহুল বয়ানে আছে:
ان الذين يوذون الله ورسوله لعنهم الله فى الدنيا والاخرة واعد لهم عذابا مهينا .
অর্থাৎ- নিশ্চয় যাহারা আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসূল (ﷺ)কে কষ্ট দিবে আল্লাহ্ তায়ালা তাহাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে অভিশপ্ত করিবেন এবং তাহাদের জন্য অপমানজনক শাস্তি তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছেন।
❏ তাফসীরে রূহুল বায়ানে আছে,
سئل القاضى ابوبكر بن العربى احد الائمة المالكية عن رجل قال ان اباء النبى عليه السلام فى النار.
অর্থাৎ- মালেকী মাজহাবের একজন ইমাম কাজী আবু বকর ইবনে আরবীকে এক ব্যক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হইয়াছে যে, সে বলিয়াছে নবীর পিতামহ নিশ্চয় জাহান্নামে গিয়াছেন, অতঃপর তিনি (আবু বকর ইবনে আরবী) উত্তর দিলেন যে, সে মালাউন (অভিশপ্ত), কেননা আল্লাহ তায়ালা বলিতেছেন, নিশ্চয় যাহারা আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসূল (ﷺ)কে কষ্ট দেয় আল্লাহ্ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে তাহাদের অভিশপ্ত করিয়াছেন।
❏ আর হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে,
لا تؤذوا الاحياء بسبب الاموات .
(অর্থাৎ- মৃত ব্যক্তিদের কারণে জীবিত ব্যক্তিদেরকে কষ্ট দিওনা।)
ইমাম আহমদ ইবনে হোছাইন মৌচেলী হানাফী, আল্লামা আজহুরী, আল্লামা তালমানী এবং আল্লামা আবু তাহের প্রমুখ বলিয়াছেন যে, আবু তালেবের সহিত ঈর্ষা রাখা কুফরী, ইহা সম্পর্কে যদি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার প্রয়োজন হয়, ‘আল-কাউলুল জলী’ ইত্যাদি কিতাব দেখিয়া নিন।
কোন আরেফগণ এই পর্যন্ত বলিয়াছেন যে আহলে কশফের (যাহারা অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা প্রত্যেক কিছু দেখিতে পান) মতে আবু তালেবের ঈমান এই রকম নিশ্চিত যে, যাহাতে সন্দেহের কোন অবকাশও নাই।
কেহ বলিতেছেন যে, ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمة الله) ‘ফিকহে আকবর’ কিতাবের মধ্যে ফরমাইয়াছেন, আবু তালেব কুফরীর উপর মরিয়াছেন, সুতরাং তাঁহাকে মুমিন বলা ঠিক হইবেনা।
উত্তর এই যে,
❏ হযরত মৌলানা গোলাম কাদের (رحمة الله) ‘নূরে রব্বানী’ কিতাবের মধ্যে লিখিতেছেন, মৌলানা আবদুল আজিজ পড়হারী ‘কাউছারুন্নবী’ কিতাবের মধ্যে লিখিয়াছেন, ইমাম আজমের ‘ফিকহে আকবর’ ভিন্ন এবং মাশহুর ‘ফিকহে আকবর’ দ্বিতীয় অন্যজনের লিখিত কিতাব। যেই কিতাবটি মশহুর তাহা ত্র“টিপূর্ণ।
তাফসীরে নাঈমীর মধ্যে আছে, ফিকহে আকবরের নুসখা (গ্রন্থ) সমূহের ব্যাপারে মতভেদ রহিয়াছে। কোন নুসখায় আছে তিনি কুফরীর উপর মরিয়াছেন, আবার কোন নুসখায় রহিয়াছে কুফরীর উপর মরেন নাই। আবার কোন কোন নুসখার মধ্যে এই মাসআলাটি একেবারেই নাই। অতঃপর মৌলভী অকীল আহমদ সিকান্দরপুরী সাহেব ফিকহে আকবরের অতি ছহীহ নুসখা হায়দরাবাদ হইতে সংগ্রহ করিয়া ছাপাইয়াছেন ও প্রমাণ করিয়াছেন যে, ইহা শুদ্ধ এবং অন্যান্যগুলো ত্র“টিপূর্ণ আর সেই সমস্ত নুসখার মধ্যে এই মাসআলার চিহ্নও নাই। আর যদি ছহীহ মানিয়াও নেওয়া যায় তখন বলা যাইবে যে, এই মাসআলা ইজতেহাদী (প্রচেষ্টা করিয়া মাসআলা বাহির করা) অথবা তাকলিদী (অনুসরণীয়) নয়, যাহার কারণে সেই মাসয়ালার মধ্যে ইমাম সাহেবের তাকলীদ করা ওয়াজিব হইবে এবং ইহা ঐতিহাসিক ঘটনা।
যদি উহার বিপরীত ছাবেত হইয়া যায় তখন উহাকে গ্রহণ করা যাইবে, যেমন য়াযীদ মালাউন ও মুশরিকদের শিশু ইত্যাদির মাসআলা, তাফসীরে নাঈমীর ভিতরে এই রকম বর্ণনা হইয়াছে।
আবু তালেবের মৃত্যুর পর হুজুর (ﷺ) হযরত আলীকে তাকে গোসল ও দাফন করার নির্দেশ
____________________
আবু তালেবের মৃত্যুর পর হুজুর (ﷺ) হযরত আলীকে তাকে গোসল ও দাফন করার নির্দেশ
❏ আবু দাউদ ও নাছায়ী ইত্যাদি হাদীসের কিতাবে উল্লেখ আছে:
عن على رضى الله عنه انه قال لما مات ابو طالب اخبرت النبى صلى الله عليه وسلّم بموته فبكى وقال اذهب فغسله وكفنه .... غفرالله له ورحمه .
অর্থাৎ- হযরত আলী (رضي الله عنه) হইতে বর্ণিত হাদীসে তিনি বলিয়াছেন, আবু তালেব যখন মৃত্যুবরণ করিয়াছেন তখন আমি নবীর (ﷺ) খেদমতে তাঁহার মৃত্যুর সংবাদ দিলাম। অতঃপর তিনি (নবী) ক্রন্দন করিলেন এবং বলিলেন (আলী!) তুমি যাইয়া তাঁহাকে গোসল দিয়া দাফন করিয়া আস। আল্লাহ্ তাঁহাকে ক্ষমা এবং দয়া করুক।
হুজুর করীম (ﷺ) আবু তালেবের মৃত্যুর উপর মাতম করিয়াছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ইহাও ফরমাইয়াছেন, আল্লাহপাক তাঁহাকে ক্ষমা এবং রহম করুক।
যদি কেহ বলে, হুজুর (ﷺ) তাঁহার চাচার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা ইহা সদ্ব্যবহার ও পারিতোষিক হিসেবে ছিল। অতঃপর ইহার উত্তর এই হইবে যে, ক্ষমা করা বা না করা পারিতোষিকতার সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই। কেননা, ক্ষমার পরিধি শুধু ঈমানের উপরই রহিয়াছে। যদি কোন ছেলে তাহার বেঈমান বাপের উপর যতই মাতম, শোকপ্রকাশ, দুঃখপ্রকাশ ও সদ্ব্যবহার এবং দোয়া করে উহা দ্বারা কি হইবে? অর্থাৎ তাহার ক্ষমা হইতে পারে?
সূরা মোমতাহিনার আয়াত হইতে স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে প্রকাশ হইতেছে যে, মুশরিকের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত নয় এবং সূরা তাওবার আয়াতে এই নস (প্রকাশমান) স্পষ্ট বর্ণনা হইয়াছে যে, মুশরিকদের জন্য ক্ষমার দোয়া করা উচিত নয়, সেই মুশরিক যতই আত্মীয় ও ব্লাড সম্পর্কীয় হোক না কেন। মুশরিকদের ক্ষমা না হওয়া যখন নিশ্চিতরূপে ছাবেত হইয়া গেল, তখন নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) ও সমস্ত মুসলমানদের পক্ষে উচিত নয় যে, জীবিত হোক অথবা মৃত হোক সেই মুশরিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কেননা, এই রকম করার মধ্যে খোদা যে মুশরিকদের মুক্তি না দেওয়ার উপর ওয়াদা করিয়াছেন এবং যাহা সম্পূর্ণ নিশ্চিত, উহার উপর সন্দেহ আসিয়া যায়। হ্যাঁ, তবে মুশরিকদের জন্য ভাল দোয়া করা যাহাতে ঈমান নিয়া আসে, যাহা তাহাদের সহিত আসল মুহাব্বত এবং দয়া তাহা করার মধ্যে কোন বাধা নাই।
❏ মিশকাত শরীফের শরাহ মিরকাত ৭ম খণ্ডের ৫৩৪ পৃষ্ঠায় হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতি আহমদ এয়ার খান নঈমী (رحمة الله) বলিয়াছেন যে, আবু তালেবের ঈমান সম্পর্কে ওলামায়ে আহলে সুন্নাতের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। আল্লামা সৈয়দ আহমদ জিনী দহলান (رحمة الله) ‘আছনাল মাতালেব ফী ঈমানে আবী তালেব’ নামক একটি কিতাব লিখিয়াছেন এবং উক্ত কিতাবে তাঁহার (আবু তালেবের) ঈমান ছাবেত করিয়াছেন।
❏ তাফসীরে রূহুল বয়ানের তাফসীরকার আল্লামা ইসমাঈল হক্কী হানাফী (رحمة الله) বলিয়াছেন যে, তিনি (আবু তালেব) আইনানুযায়ী মুমিন ছিলেন না। যেহেতু তিনি প্রকাশ্যভাবে কলমা পড়েন নাই। কিন্তু খোদার সান্নিধ্যে মুমিন ছিলেন। সেই মহামনীষীদের মতে আবু তালেবের এই শাস্তি কোন কোন পাপী মুসলমানদের শাস্তির ন্যায় বৈপত্তিক শাস্তি হইবে এবং তাহাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালার রহমতের সেই মুষ্ঠ দ্বারা দোযখ হইতে বাহির করা হইবে, সুপারিশ শেষ হইয়া যাওয়ার পরে জাহান্নামীদের হইতে সেই পরিপুর্ণ মুষ্ঠ জান্নাতে ঢালিবেন।
সর্বসাধারণ ওলামা বলিতেছেন, তাঁহার ঈমানের প্রমাণ নাই। কিন্তু খেয়াল রাখিতে হইবে যে, কেহ তাহার উপর বিদ্রূপ ও প্রগলভতা না করিবে। তিনি হুজুর (ﷺ) এর বড় খাদেম ছিলেন, হুজুর (ﷺ)কে তাঁহার সঙ্গে নিয়া শুইতেন এবং হুজুরের হেতু মক্কার কাফেরদের হাতে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়াছেন। সম্ভবত তাঁহার উপর বিদ্রূপ করার কারণে হুজুরের কষ্ট হইবে। যদিও আইনানুযায়ী মুসলমান হন নাই, কিন্তু তিনি হুজুরের অনেক খেদমত করিয়াছেন। এমনকি হুজুর (ﷺ) তাঁহার পিতৃহীনতার কাল আব্দুল মোত্তালিবের পরে আবু তালেবের নিকট অতিক্রম করিয়াছেন।
❏ আল্লাহ্ তায়ালা বলিয়াছেন,
الم يجدك يتيما فاوى .
(আল্লাহ্ কি তোমাকে পিতৃহীন অবস্থায় পান নাই? অতঃপর তোমাকে আশ্রয় দান করিয়াছেন) সেই আয়াতের পরিণামে তাঁহার আজাব হইবে।
❏ উক্ত কিতাবের ৪২০ পৃষ্ঠায় হযরত হাকীমুল উম্মত (رحمة الله) একটি মনোরম রসিকতা বর্ণনা করিয়াছেন যে, হুজুর (ﷺ) এর চতুর্থ সুপারিশ সেই সমস্ত লোকদের জন্য হইবে, যাহারা দুনিয়ার মধ্যে শরীয়তানুযায়ী মুমিন ছিলেন না, কিন্তু খোদার সান্নিধ্যে মুমিন ছিলেন। অন্যথায় আইনানুযায়ী মুমিন একেবারে নগণ্য হইতে নগণ্য ও প্রথম তিন সুপারিশ দ্বারা জাহান্নাম হইতে মুক্তিপ্রাপ্ত হইয়াছে। সুতরাং এখন সেই লোকদের জন্য সুপারিশ হইবে যাহারা আইনানুযায়ী মুমিন ছিলেন না, কিন্তু আল্লাহর সান্নিধ্যে মুমিন ছিলেন। তিনি (হাকীমুল উম্মত) বলিয়াছেন, যাহাদের অন্তরে ঈমান ছিল কিন্তু মুখে উহা স্বীকার করে নাই সেই সমস্ত মানুষ খোদার সান্নিধ্যে মুমিন এবং আইনানুযায়ী মুমিন নয়। যেমন আবু তালেব ইত্যাদি, তাঁহাদেরকে শরীয়তে ছাতের (গোপনকারী) বলে এবং যাহার মুখে ঈমান ও অন্তরে কুফর তাহাকে মোনাফেক বলে। আর যাহারা অন্তর ও মুখ উভয় দিক দিয়া মুমিন হয় তাঁহাদেরকে অকৃত্রিম ও খাঁটি মুমিন এবং যাহারা অন্তর ও মুখ উভয় দিক দিয়া কাফের হয় তাহাদিগকে মোজাহের (যাহারা প্রকাশ্যভাবে ঈমানকে অস্বীকার করে) বলা হয়।
অতঃপর হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশের মধ্যে মোনাফিকগণ অথবা অন্যান্য একত্বতার আকীদা পোষণকারী কাফেরগণ অন্তর্ভূক্ত হইবেনা। শুধু ছাতেরীন অর্থাৎ যাহারা ঈমানকে অন্তরে গোপন করিয়া রাখে তাহারাই হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশের অন্তর্ভূক্ত হইবে। হ্যাঁ, অকপট মুমিন এবং অন্তরে যাহারা ঈমানকে গোপন করিয়া রাখে তাহাদের এই পার্থক্য যে, অকপট মুমিনগণ হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ এবং হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র হস্তদ্বয় দ্বারা বাহির হইবে আর ছাতেরীনগণ হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ দ্বারা বাহির হইবে, কিন্তু হুজুর (ﷺ) এর হাত মোবারক দ্বারা বাহির হইবেনা। যেহেতু ইহা তাহারা দুনিয়ার মধ্যে হুজুর (ﷺ) এর শরীয়তানুযায়ী মুমিন না হওয়ার পরিণাম।
দেখুন! তাফসীরে নাঈমীর ৭ম পারার ২২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, আবু তালেবের ঈমানের ব্যাপারে অনেক মতভেদ রহিয়াছে। কিন্তু খেয়াল রাখিতে হইবে, যাহাতে সম্মানের সহিত তাঁহার স্মরণ করা যায়। কেননা, তাঁহার সহিত বেয়াদবী করিলে হুজুর করীম (ﷺ) এর অসন্তুষ্টির সম্ভাবনা রহিয়াছে। যেহেতু আবু তালেব হুজুর করিম (ﷺ) এর আব্বাজানের ন্যায়, চাচা ও হুজুর (ﷺ) এর প্রতিপালনকারী ও তাঁহার (আবু তালেব) পবিত্রীকৃত স্ত্রী হযরত ফাতিমা বিনতে আছদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা অর্থাৎ শেরে খোদা হযরত আলীর (رضي الله عنه) মাতা হুজুর করীম (ﷺ) এর আম্মাজানের মত যে, হুজুর (ﷺ) তাঁহার বক্ষে প্রতিপালিত হইয়াছেন। অতঃপর আবু তালেবের ব্যাপারকে খোদার দিকে সমর্পণ কর।
❏ তাফরীহুল আজকিয়া ২য় খণ্ডের ৫৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, কোন বিস্ময়কর নয় যে, হুজুর (ﷺ) তাঁহার মাতা-পিতাকে যেই রকম জীবিত করাইয়া ঈমানদার করিয়াছেন, সেই রকম তাঁহার চাচাকেও মৃত্যুর পরে মুসলমান করিয়াছেন। যেমন মখদুম শেখ সা’দ (رحمة الله) ‘মজমা’ নামক কিতাবের মধ্যে উম্মুল মায়ানী হইতে এবং সবয়ে ছনাবেল শরীফ কিতাবের মধ্যে মজমা হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, মে’রাজ শরীফের পরে হুজুর করীম (ﷺ) তাঁহার আম্মাজান, আব্বাজান এবং চাচাজান আবু তালেবকে ক্ষমা করাইয়াছেন। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁহাদেরকে জীবিত করিয়াছেন। অতঃপর তাঁহারা তিন জনই মুসলমান হইয়া আপন স্থানে চলিয়া গিয়াছেন এবং হুজুর (ﷺ) এর আম্মা-আব্বার ঈমানের মধ্যে মোতাআখ্খেরীন অর্থাৎ পরবর্তী মোহাদ্দেসীনগণের কোন সন্দেহ নাই। উহা ব্যতীত সম্ভব যে, আবু তালেবের অন্তর হুজুর (ﷺ) এর আশীর্বাদে ঈমানের আলো দ্বারা আলোকিত হইয়াছে এবং কাফেরদের ভয়ে প্রকাশ্যভাবে ঈমান আনেন নাই। রূহের মৃত্যুর সময় আবু তালেব হুজুর (ﷺ) এর সত্যবাদীতার উপর কয়েকটি শে’র পড়িয়াছেন উহা কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে। যেমন: একটি শে’র:
لقد علمته بان دين محمد
من خير اد يان البرية دينا .
অর্থাৎ, উহা আমি অবশ্যই জানিয়া নিয়াছি যে, ধর্ম হিসেবে মুহাম্মদ (ﷺ) এর ধর্ম; প্রত্যেক সৃষ্টিজীবের ধর্ম হইতে শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম।
اللهم انا نعوذبك من غضبه وايذ ائه صلّى الله عليه وسلّم .
والله اعلم بالصواب .
وصلّى اللهُ علَى محمد واله واصحابه اجمعين .
সমাপ্ত
Comments
Post a Comment