লোম'আতুল এ'তেক্বা'দ

মূল: ইমাম মুওয়াফফাক্বউদ্দীন আবূ কুদা’মা মাক্বদেসী হাম্বলী (রহ:)

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


[Bengali translation of Imaam Muwaffaq al-Deen’s booklet “Lum’at ul-I’tiqaad” with Abu Muhammad Ibraheem’s English commentary]


[উৎসর্গ: পীর ও মুর্শীদ সৈয়দ মওলানা এ,জেড,এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব ক্বেবলা (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র পুণ্যস্মৃতিতে…..]


বঙ্গানুবাদকের আরজ


ইসলামী ঐতিহ্যবাহী বইপত্রের মধ্যে বড়পীর গাউসুল আযম হযরত মহিউদ্দীন আবদুল ক্বাদের জিলানী সাহেব ক্বেবলা (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র শিষ্য ইমাম মুওয়াফফাক্বউদ্দীন আবূ কুদা’মা (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র ’লোম’আতুল এ’তেক্বা’দ’ পুস্তিকাটি অন্যতম। এটা ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেশ করেছে। নও-মুসলিম আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীম (সাবেক এ, স্যান্ডার্স) বইটি ইংরেজিতে ভাষান্তর করেন এবং নিজের নোট যুক্ত করেন। তিনি এর নাম দেন ‘সুন্নী আক্বীদাহ-বিশ্বাস।’ আমি অনলাইনে আরবী সংস্করণ সংগ্রহ করে দুটোর সমন্বয়ে পুস্তিকাটির বাংলা অনুবাদকর্মে প্রবৃত্ত হলাম। মহান আল্লাহ পাক সামর্থ্য দান করুন, আমীন।


সূচিপত্র


আল্লাহতা’লার মোতাশা’বিহাহ বৈশিষ্ট্যাবলী


১.১ আল্লাহ কল্পনার অতীত

১.২ আল্লাহতা’লার ইস্তিওয়া

১.৩ আল্লাহতা’লার জ্ঞান

১.৪ আল্লাহর গুণাবলীর পক্ষে সাক্ষ্য

১.৫ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)’এর মাযহাব

১.৬ ইমাম শাফেঈ (রহ:)’র মাযহাব

১.৭ বেদআত সম্পর্কে প্রিয়নবী (দ:)’র সতর্কবাণী

১.৮ বেদআত সম্পর্কে হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)’এর সতর্কবাণী

১.৯ বেদআত সম্পর্কে উমর বিন আবদীল আযীয (রহ:)’এর ভাষ্য

১.১০ ইমাম আল-আওযাঈ (রহ:) ও আল্লাহর সত্য সম্পর্কে আন্তরিকতা

১.১১ আল-আদরামী (রহ:) কর্তৃক জনৈক মো’তাযেলীর রদ

১.১২ মোতাশাবিহাহ সম্পর্কে আল-ক্বুরআন

১.১৩ মোতাশাবিহাহ সম্পর্কে আহাদীস

১.১৪ মোতাশাবিহাহ সম্পর্কে ঘোষণা


আল্লাহতা’লার কালাম/বচন


২.১ ক্বুরআন হতে প্রমাণ

২.২ আহাদীস হতে প্রমাণ


আল্লাহতা’লার অক্ষরবিশিষ্ট বচন


৩.১ আল-ক্বুরআন

৩.২ আল-মুক্বাত্তা’আত

৩.৩ এতদ্বিষয়ে অনুবাদকের মন্তব্য


পরকালে আল্লাহকে দেখা সংক্রান্ত


৪.১ ক্বুরআন হতে প্রমাণ

৪.২ আহাদীস হতে প্রমাণ


আল্লাহর ঐশী ডিক্রি ও তাক্বদীর


৫.১ ক্বদর/তাক্বদীর সম্পর্কে ক্বুরআনী দলিল

৫.২ ক্বদর/তাক্বদীর সম্পর্কে আসার/বাণী হতে দলিল

৫.৩ বদ কর্মের জন্যে তাক্বদীরকে অজুহাত না করা


ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি


৬.১ ক্বুরআন হতে দলিল

৬.২ আহাদীস হতে দলিল


অদৃশ্যের প্রতি ঈমান/বিশ্বাস


৭.১ আল-ইসরা ওয়াল-মি’রাজ

৭.২ পয়গম্বর মূসা (আ:) ও আযরাঈল (আ:)

৭.৩ ক্বেয়ামতের আলামত

৭.৪ ক্ববরের শান্তি ও শাস্তি

৭.৫ মীযান

৭.৬ আল-হাউজ

৭.৭ পুল-সিরা’ত

৭.৮ প্রিয়নবী (দ:)’র শাফাআত/সুপারিশ

৭.৯ বেহেশত ও দোযখ


মহানবী (দ:) ও তাঁর সাহাবাবৃন্দের (রা:) অধিকার


৮.১ প্রিয়নবী (দ:)’র মক্বাম/উচ্চমর্যাদা

৮.২ সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দ ও তাঁদের মাহাত্ম্য

৮.৩ সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন বেহেশতী সাহাবী (রা:)

৮.৪ কোনো মুসলমানের প্রতি তাকফির উচ্চারণ না করা

৮.৫ সাহাবায়ে কেরাম (রা:)’এর প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য

৮.৬ ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের মাতামণ্ডলী

৮.৭ ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের মামা

৮.৮ শাসক, ইমাম বা আমীরের প্রতি আনুগত্য

৮.৯ বেদআতীদের থেকে নিজেকে আলাদা রাখা

৮.১০ মাযহাবের অনুসরণ

৮.১১ সমাপনী দুআ


প্রথম অধ্যায়: আল্লাহতা’লার মোতাশা’বিহাহ বৈশিষ্ট্যাবলী


১.১ আল্লাহ কল্পনার অতীত


আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি অত্যন্ত দয়াময় ও করুণাশীল। তাঁরই জন্যে সমস্ত প্রশংসা বিহিত। সকল ভাষাতেই তাঁর প্রশংসা হয়েছে এবং সকল জমানাতেই তাঁর এবাদত জারি রয়েছে। তিনি জানেন না এমন কোনো কিছুই নেই। তিনি এক বিষয়ের ওপরে অন্য বিষয় দ্বারা মশগুল নন (মানে সমস্ত বিষয়-ই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত)। তাঁর কোনো সাযুজ্য, সমকক্ষ বা অংশীদার নেই; তাঁর স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিও নেই। তাঁর বিধান সমস্ত বান্দার প্রতি জারি হয়েছে (বিশ্বাস করুক বা না-ই করুক)। গভীর চিন্তাভাবনার আলোকে মস্তিষ্ক দ্বারা তাঁকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়; কল্পনায়ও তাঁকে ধারণ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন:


لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْبَصِيرُ


অর্থ: তাঁর (আল্লাহর) মতো কিছুই নেই; এবং তিনি-ই শোনেন, দেখেন। (আল-ক্বুরআন, ৪২:১১; নূরুল এরফান)


১.২ আল্লাহতা’লার ইস্তিওয়া


আল্লাহরই অধিকারে রয়েছে সবচেয়ে সুন্দরতম নামগুলো ও সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যাবলী (সূরা শুরা’, ৪২:১১)।


ٱلرَّحْمَـٰنُ عَلَى ٱلْعَرْشِ ٱسْتَوَىٰ لَهُ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ ٱلثَّرَىٰ وَإِن تَجْهَرْ بِٱلْقَوْلِ فَإِنَّهُ يَعْلَمُ ٱلسِّرَّ وَأَخْفَى


অর্থ: তিনি পরম করুণাময়, তিনি আরশের ওপর ইস্তিওয়া’ করেন (সমাসীন হন), যেমনই তাঁর মর্যাদার জন্যে শোভা পায়। তাঁরই, যা কিছু জমিনে, যা কিছু সেগুলোর মধ্যখানে রয়েছে এবং যা কিছু ভেজা মাটির নিচে রয়েছে। আর যদি তুমি উচ্চকণ্ঠে বলো, তবে তিনি তো গোপন রহস্য জানেন এবং তা-ও (জানেন), যা তদপেক্ষাও অধিক গোপন। (সূরা তোয়াহা, ৫-৭ আয়াত; নূরুল এরফান)


[অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: ক্বুরআন পাকে আনুমানিক আট বার ইস্তিওয়া’ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে; দেখুন - ২:২৯; ৭:৫৪; ১০:৩; ১৩:২; ২০:৫; ২৫:৫৯; ৩২:৪ ও ৫৭:৪। সর্বপ্রথম ও শীর্ষস্থানীয় তাফসীরবিদ এবং মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র চাচাতো ভাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এতদসংক্রান্ত আয়াতগুলো সম্পর্কে বলেন: “এগুলো মুতাশাবিহাহ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো ব্যাখ্যা করা যায় না এবং ব্যাখ্যা করা হবেও না” (তানউইরুল মিক্ববা’স, ২০:৫)। ইস্তিওয়া’ সম্পর্কে হুযূরের (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) পুতঃপবিত্র স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: “আল-কায়েফ তথা কেন-কীভাবে (প্রশ্নটি) এখানে উপলব্ধির অতীত; আর ইস্তিওয়া’ অজ্ঞাত (বিষয়) নয়। এটাকে গ্রহণ করা ওয়া’জিব/বাধ্যতামূলক এবং পুরোপুরি অস্বীকার করা কুফর/অবিশ্বাস।” এই রওয়ায়াত/বর্ণনাটির সহীহ সনদ বিদ্যমান এবং ইমাম মালেক (রহমতুল্লাহে আলাইহে)-ও কেউ একজনের করা ইস্তিওয়া’র প্রকৃতিসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে এটার ( মানে সনদের) উল্লেখ করেছেন। এর বিবরণ পাওয়া যায় বড় পীর গাউসুল আযম শায়খ আবদুল ক্বাদির জিলানী সাহেব ক্বেবলা (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর রচিত ‘আল-গুনিয়া’ পুস্তকের ‘আক্বায়েদ-উল-ফির্ক্ব-উল-ইসলামীয়্যা’ অধ্যায়ে, ১ম খণ্ড, ১২৪ পৃষ্ঠা; ইবনে হাজর (রহ:)’এর ‘ফাতহুল বারী’, ১৩:৪০৬-৪০৭; ‘লিসা’ন-উল-আরবী’, ৩য় খণ্ড, ৪৪৬ পৃষ্ঠা; আল-বায়হাক্বী (রহ:) কৃত ‘আল-আসমা ওয়াস্ সিফা’ত’, ৪০৮ পৃষ্ঠা; আর এটাকে সহীহ শ্রেণিভুক্ত করেছেন ইমাম যাহাবী (রহ:) নিজ ‘মুখতাসার আল-’উলুও’ শীর্ষক পুস্তকের ১৪১ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ১৩১। ইমাম আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: “আল্লাহতা’লা যদি কোনো স্থানে অবস্থান করতেন এবং আরশ তৈরি করার আগে কোথাও যদি তাঁর বসার ও বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন হতো, তাহলে ‘তিনি কোথায় ছিলেন’ মর্মে প্রশ্ন তাঁর প্রতি প্রযোজ্য হতো, যেটা একেবারেই অসম্ভব...আমরা (আহলে সুন্নাত ওয়া জামাআত) দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করি যে, আল্লাহতা’লা তাঁর আরশের ওপর প্রতিষ্ঠিত, আর এতে তাঁর কোনো হাজত/প্রয়োজন বা এস্তেক্বরার/স্থায়িত্ব দরকার নেই। কেননা তিনি-ই আরশ ও তাঁর সৃষ্টির (মানে আসমান-জমিন ইত্যাদির) সংরক্ষণকারী, সেগুলোর কোনোটির প্রতি চাহিদা/মুখাপেক্ষিতা ব্যতিরেকেই” (আল-ওয়াসিয়্যা)। ইমাম শাফেঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ইস্তিওয়া’ সম্পর্কে বলেন: “ক্বুরআনের এই আয়াতটি মুতাশাবিহাহ হতে (নিঃসৃত), যেটা সম্পর্কে উত্তর দিতে গেলে কেউ হতবুদ্ধি হবেন; আর এ ধরনের অনুরূপ আয়াতের ব্যাপারেও একই কথা বলা চলে” (ইমাম শাফেঈ, আল-ফিক্বহুল আকবর’, ১৭ পৃষ্ঠা)। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর বেসাল শরীফের পূর্ব-মুহূর্তে বলেন: “আল্লাহতা’লার সিফাত/গুণাবলী সংক্রান্ত তথ্য কোনো প্রকার অস্বীকৃতি বা সেগুলোর প্রতি মনুষ্য আকৃতি-প্রকৃতি আরোপ ছাড়াই গ্রহণ করতে হবে” (এটা শায়খ আবদুল ক্বাদের জিলানী রহমতুল্লাহে আলাইহে’র রচিত ‘আল-গুনিয়া’ পুস্তকের ‘আক্বায়েদ-উল-ফির্ক্ব-উল-ইসলামীয়্যা’ অধ্যায়, ১ম খণ্ড, ১২৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত)। বড়পীর হযরত অবদুল ক্বাদের জিলানী সাহেব ক্বেবলা (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ইস্তিওয়া’ সম্পর্কে বলেন: “ইস্তিওয়া’র বৈশিষ্ট্য কোনো প্রকার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া প্রকাশ করা উচিৎ। কেননা অবশ্যঅবশ্য এটা হলো আরশের ওপর (পবিত্র) সত্তার ইস্তিওয়া’। এর অর্থ ওর ওপরে বসা বা শারীরিক সংস্পর্শ নয়, যেমনটি দাবি করেছিলো মোজাসসিমাহ ও কারা’মিয়্যাহ (মনুষ্য আকৃতি-প্রকৃতি আরোপকারী) গোষ্ঠী; আর এর অর্থ নয় উচ্চমর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বও, যেমনটি দাবি করেছিলো আশ’আরিয়্যা; এর অর্থ নয় নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য, যেমনটি বলেছিলো মো’তাযেলা সম্প্রদায়। এটা স্রেফ এই কারণে যে, শরীয়ত আমাদেরকে ওই মোতাবেক নির্দেশ দেয়নি; আর ওই সব ব্যাখ্যা হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রহমতুল্লাহে আলাইহিম আজমাঈন), তাবেঈন (রহমতুল্লাহে আলাইহিম), পুণ্যবান সালাফবৃন্দ বা মোহাদ্দেসীনবৃন্দ হতে আসেনি” (প্রাগুক্ত গুনিয়া)। ইবনে কাসীর এই সম্পর্কে নিজ তাফসীরগ্রন্থে বলেন, “সবচেয়ে নিরাপদ পথ হচ্ছে সালাফবৃন্দের, যা কোনো রকম ‘কেন-কীভাবে’ প্রশ্ন উত্থাপন, অর্থের বিকৃতি, আল্লাহর সিফাতের প্রতি সাযুজ্য দেখিয়ে মনুষ্য আকৃতি-প্রকৃতি আরোপ, বা সেগুলোর (সিফাতের) অস্বীকার কিংবা সেগুলোর প্রতি সাদৃশ্য আরোপ ব্যতিরেকেই ক্বুরআন ও সুন্নাহর ওপর নির্ভরশীল” (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৭:৫৪ ও ২০:৫)। বস্তুতঃ ইস্তিওয়া’র অনেক অর্থ বিরাজমান: স্থায়ী হওয়া, ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠা লাভ, উচ্চমর্যাদায় আসীন হওয়া, এবং এমন কী নিত্যদিনের আরবী ভাষায় এ কথা বলা যে খাবার রান্না হয়েছে এবং তা খাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। আমরা হয়তো আরবীতে ’ইস্তিওয়া’ শব্দটির মানে জানি, কিন্তু তা আল্লাহর প্রতি প্রয়োগের সময়ে শব্দটির বাস্তবতা আমরা জানি বলে দাবি করলে সেটার ‘কেন-কীভাবে’ বোঝার দাবি-ই করা হবে, আর এটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। এই বইয়ের অন্যান্য স্থানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আমাদেরকে ইস্তিওয়া’ সেভাবেই গ্রহণ করতে হবে, যেমনটি আল্লাহতা’লা উদ্দেশ্য করেছেন। আমাদের মনুষ্য বিচার-বুদ্ধি এ (ঐশী) জ্ঞান উপলব্ধি করতে অক্ষম। তাই হাম্বলী মাযহাবে এই জ্ঞান আল্লাহর প্রতি ন্যস্ত করা হয়েছে; এটা তাফউয়ীদ/নিঃশর্ত হুকুম।]


১.৩ আল্লাহতা’লার জ্ঞান


আল্লাহতা’লা আপন জ্ঞান-প্রজ্ঞা দ্বারা সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন; আর তিনি তাঁর সৃষ্টিকুলকে নিজ ক্ষমতা ও বিধিবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করছেন; তাঁরই অফুরন্ত করুণাধারা ও জ্ঞানের মাধ্যমে সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। (এর প্রমাণ নিচে প্রদত্ত হলো):


يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ


অর্থ: (আল্লাহতা’লা) জানেন যা কিছু তাদের সম্মুখে রয়েছে এবং যা কিছু তাদের পেছনে। আর তারা পায় না তাঁর জ্ঞান থেকে, কিন্তু যতোটুকু তিনি চান। [সূরা বাক্বারা, ২৫৫ নং আয়াত]


১.৪ আহলে সুন্নাহ ও আল্লাহর গুণাবলীর পক্ষে সাক্ষ্য


আল-ক্বুরআনে নিহিত বিবরণের মাধ্যমে আল্লাহতা’লা নিজেকে বর্ণনা করেছেন; আর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র পবিত্র বচনেও তা বর্ণিত হয়েছে। আল-ক্বুরআন ও মনোনীত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর সহীহ/বিশুদ্ধ হাদীস শরীফে উল্লেখিত পরম করুণাময়ের গুণাবলীতে বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়া’জিব তথা অবশ্য কর্তব্য।


এসব সিফা’ত পূর্ণ সমর্পিত হয়ে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করতে হবে; রদ বা প্রত্যাখ্যান, তা’উয়ীল তথা ভিন্নতর ব্যাখ্যাকরণ, তাশবীহ বা সাযুজ্য নির্ধারণ অথবা আল্লাহতা’লা তাঁর সৃষ্টিকুলের তামসীল তথা উপমায় মর্মে দাবি উত্থাপনের মতো কর্মগুলো পরিত্যাগ করেই তা করতে হবে। অতঃপর যা কিছু দৃশ্যতঃ দুরূহ/দ্ব্যর্থবোধক, সেসব সিফা’তে বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের জন্যে ওয়া’জিব, সেগুলোর অর্থ প্রত্যাখ্যান ব্যতিরেকেই [অনুবাদকের নোট: এর মানে কোনোক্রমেই এটা নয় যে, মোতাশা’বেহাহ তথা ঐশী রহস্যময় গুণাবলীর কয়েকটির অর্থ কারো দ্বারা গ্রহণ করা হলেই তিনি এ মর্মে বিশ্বাস পোষণ করেন যে আল্লাহতা’লার আকৃতি, অবস্থান বা এমন কী শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গও বিদ্যমান। এ কথা বলার মানে হলো আল্লাহতা’লার শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে এমনটি বিশ্বাস করা। আমরা এ ধরনের আক্বীদা থেকে আল্লাহর মাঝে আশ্রয় প্রার্থনা করি। উপরন্তু, আমরা ফিতনা ও অন্যদের মিথ্যে দোষারোপ থেকেও আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, আমীন]। আমাদেরকে এর জ্ঞান এরই বর্ণনাকারীর প্রতি ন্যস্ত করতে হবে, এর কর্তৃত্বকে এরই প্রেরণকারীর প্রতি আরোপ করতে হবে এবং এভাবে সেসব পুণ্যাত্মার পথ অনুসরণ করতে হবে যাঁরা জ্ঞানের রাজ্যে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত। এঁদের সম্পর্কে আল্লাহ এরশাদ করেন: 


وَٱلرَّاسِخُونَ فِي ٱلْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا   


অর্থ: আর পরিপক্ক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা বলে, ‘আমরা সেটার ওপর ঈমান এনেছি; সবই আমাদের রব্বের কাছ থেকে (নিঃসৃত)। [সূরা আলে ইমরান, ৭ নং আয়াত]


অপর পক্ষে, মোতাশা’বেহাহ/দ্ব্যর্থবোধক আয়াতগুলোকে যারা ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিতে চায়, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ঘোষণা করেন:


 فَأَمَّا الَّذِينَ في قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ٱبْتِغَاءَ ٱلْفِتْنَةِ وَٱبْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلاَّ ٱللَّهُ 


অর্থ: ওই সব লোক, যাদের অন্তরগুলোতে বক্রতা রয়েছে, তারা একাধিক অর্থের সম্ভাবনাময় আয়াতগুলোর পেছনে ছুটে থাকে পথভ্রষ্টতা চাওয়ার ও এর ব্যাখ্যা তালাশ করার উদ্দেশ্যে; আর এর সঠিক ব্যাখ্যা আল্লাহরই জানা আছে। [সূরা আলে ইমরান, ৭ আয়াত]


আল্লাহতা’লা তাঁর মোতাশা’বেহাহ আয়াতগুলোর অর্থ তালাশের রীতিকে পথভ্রষ্টতার চিহ্নগুলোর একটি হিসেবে নির্ধারণ করেছেন [অনুবাদকের নোট: ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সূরা আলে এমরানের ৭ম এই আয়াতখানি পাঠ করে বলেন - ‏ قَالَتْ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ فَإِذَا رَأَيْتُمُ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ سَمَّى اللَّهُ فَاحْذَرُوهُمْ ‏" - যখন তোমরা দেখতে পাবে সেসব লোককে যারা ক্বুরআন মজীদে মোতাশা’বেহাহ আয়াতগুলোর পিছু নিচ্ছে, (তখন জেনো) আল্লাহ তাদেরই নাম এতে (ক্বুরআনে) উল্লেখ করেছেন। অতএব, তাদেরকে এড়িয়ে চলো (সুনানে আবী দাউদ, কিতাব আস্ সুন্নাহ, হাদীস নং ৪৫৯৮; আলবানী এটাকে সহীহ বলেছে]। আর আল্লাহতা’লা এই রীতিকে ফিতনা সৃষ্টির সাথেও সংশ্লিষ্ট করেছেন। এ কারণেই আল্লাহ এ রীতিকে দূষণীয় বলেছেন। তিনি ওই ধরনের লোকেদেরকে তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু হতে পর্দা দ্বারা আড়াল করে দিয়েছেন এবং তাদের অন্বেষণের চেষ্টা হতে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। এটা পরিদৃষ্ট হয় তাঁরই কালামে পাকে:


وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلاَّ ٱللَّهُ


অর্থ: আর এর সঠিক ব্যাখ্যা আল্লাহরই জানা আছে। [সূরা আলে ইমরান, ৭ আয়াত]


১.৫ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)’এর মাযহাব  


মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র আহাদীস ঘোষণা করে: 


إن الله ينزل إلى سماء الدنيا


অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহতা’লা সর্বনিম্ন আসমানে নেমে আসেন।” [মুসনাদে ইমাম আহমদ (রহ:): হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, হাদীস নং ৯৫৯২; সহীহ আল-বুখারী, ৩য় খণ্ড, কিতা’ব আল-তাহাজ্জুদ, হাদীস নং ১১৪৫; এবং সহীহ মুসলিম, ৩য় খণ্ড, কিতা’বু সালা’ত আল-মুসা’ফিরীন, হাদীস নং ৭৫৮; সহীহ শ্রেণিভুক্ত]


অথবা,


إن الله يرى في القيامة   


অর্থ: “নিশ্চয় ক্বেয়ামতের দিন আল্লাহকে দেখা যাবে।” 


ইমাম আবূ ‘আবদীল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এগুলোর ব্যাখ্যায় বলেন: 


“এই আহাদীসের সাথে যা কিছু অনুরূপ বা সাযুজ্যপূর্ণ, তাতে আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং কোনো কারণ জানতে না চেয়ে তা সত্যায়ন করতে হবে; আর তাতে কোনো অর্থারোপও করা চলবে না [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: ولا معنى অর্থারোপ ব্যতিরেকে - যার মানে বাহ্যিক অর্থ ছাড়া অন্য কোনো অর্থ প্রয়োগ না করা; বাহ্যিক অর্থের সীমা এমন পর্যায়ে লঙ্ঘন না করা, যার দরুন খোদাতা’লার আকার-আকৃতি আছে মর্মে ধারণা জন্মে। আমরা আল-ক্বুরআনে বর্ণিত আল্লাহ পাকের ‘হাত’, ‘মুখমণ্ডল’ শীর্ষক মোতাশা’বেহাহ গুণাবলী সম্পর্কে দৃঢ় ঘোষণা দেই এবং সেগুলো যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকতে দেই। আমরা সেগুলোর এমন অর্থ করি না যা’তে আল্লাহর হাত মানে তাঁরই ক্ষমতা, অথবা আল্লাহর মুখ মানে তাঁরই রেযামন্দি/সন্তুষ্টি বোঝায়। বাস্তবতা হলো, একমাত্র আল্লাহতা’লা-ই সেগুলোর অর্থ ও কারণ জানেন। এই ধরনের বিষয়ে কল্পনাপ্রসূত ধর্মতত্ত্বচর্চার ফলশ্রুতি হতে পারে সম্ভাব্য ঈমানহীনতা, আর এতে কেউ হয় আল্লাহর আকার-আকৃতিতে বিশ্বাসী হয়ে যেতে পারে, নয়তো একেবারেই আল্লাহতা’লার গুণাবলীকে অস্বীকার করে বসতে পারে। কারো নাজাতের ক্ষেত্রে দুটো অবস্থান-ই ভীষণ বিপজ্জনক। আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল-জামাআতের পথই মধ্যম পন্থা, নিরাপদ উপায়। আর তা হলো, আল-ক্বুরআন ও সুন্নাহ’তে উল্লেখিত আল্লাহর গুণাবলী মেনে নেয়া এবং সেগুলোকে আল্লাহর প্রতি আরোপ করা]। অধিকন্তু, সেগুলো সম্পর্কে আমরা কোনো কিছু বলি না (যা বলা উচিৎ নয়) [অনুবাদকের নোট: আল-ক্বুরআন ও আহাদীসে যা বর্ণিত হয়েছে, তা-ই আমাদের পুনর্ব্যক্ত করা উচিৎ এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, যুক্তিতর্ক, প্রশ্ন ইত্যাদি এড়িয়ে চলা আবশ্যক]। আমরা জানি, রাসূলে খোদা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক আমাদের কাছে যা বর্ণিত হয়েছে, তা ধ্রুব সত্য। তিনি যা বলেছেন, তা আমরা খণ্ডন করি না (মানে এতে আমাদের এখতেয়ার নেই)। আল্লাহতা’লা নিজের সম্পর্কে যা বর্ণনা করেছেন (ক্বুরআন মজীদে), সীমা লঙ্ঘন করে তার অতিরিক্ত কোনো বিবরণও আমরা দেই না। কেননা আল্লাহতা’লা এরশাদ করেছেন: 


 لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْبَصِيرُ                


অর্থ: আল্লাহর মতো কিছুই নেই; এবং তিনি-ই শোনেন, দেখেন। [সূরা শুরা’, ১১ নং আয়াত]


আমরা শুধু তিনি যা (এখানে) বলেছেন, তা-ই ব্যক্ত করি এবং তিনি যেভাবে নিজেকে বর্ণনা করেছেন, সেভাবেই তাঁকে বর্ণনা করি; আর আমরা এতে সীমা লঙ্ঘন করি না, তাঁর গুণাবলীর বিবরণ প্রদানে বাড়িয়েও বলি না। আমরা আল-ক্বুরআন এবং এর মোহকামা’ত ও মোতাশা’বেহা’ত আয়াতগুলোতে বিশ্বাস করি। আল্লাহতা’লার গুণাবলীর মধ্য হতে কোনোটি আমরা পরিত্যাগ করি না, এমন কী কেউ তাঁর গুণাবলীর কোনোটির প্রতি মূল অর্থের অতিরিক্ত নেতিবাচক দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনা প্রদান করলেও নয় [অনুবাদকের নোট: যেমনটি করে থাকে যুক্তিতর্কবাগীশ লোকেরা (আহলে হাদীস/সালাফী, ওহাবী/মওদূদীবর্গ)। তারা কিছু ভুয়া হাম্বলীর বানানো নেতিবাচক দ্যোতনার অজুহাত দেখিয়ে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)’এর মাযহাবকে আল্লাহর আকৃতির প্রবক্তা বলে প্রমাণের অপচেষ্টায় মিথ্যে যুক্তি পেশ করে থাকে। এ কথা সত্য যে, হাম্বলী মাযহাব আল্লাহর হাতের মতো ক্বুরআনে বর্ণিত গুণাবলী সম্পর্কে দৃঢ় ঘোষণা দেয়; কিন্তু তাঁর (মানুষের অনুরূপ) হাত আছে মর্মে বিশ্বাস পোষণ করা তাঁর শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে মর্মে ভ্রান্ত ধারণা পোষণেরই নামান্তর হবে। সৃষ্টিকুলের অস্তিত্বের আগে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলে কিছুই ছিলো না; আর আল্লাহতা’লা হলেন চিরন্তন সত্তা; তিনি অনাদি ও অনন্ত। তাঁর গুণাবলীও অনাদি, অনন্ত। আল্লাহর গুণাবলীর প্রতি এ ধরনের অর্থারোপের অভিযোগ উত্থাপন করা জঘন্য একটি ব্যাপার। প্রকৃত হাম্বলীবৃন্দ এ রকম কোনো অর্থারোপ কখনো করেননি। এগুলো ওই যুক্তিতর্কবাগীশ লোকদের বিপজ্জনক বানোয়াট যুক্তি]। আমরা আল-ক্বুরআন ও আহাদীসে ব্যক্ত বাণী হতে আগে বেড়ে যাই না এবং এসব গুণের কী কারণ তা-ও জানি না। আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আমাদের প্রতি ক্বুরআন মজীদে বিবৃত বাণীতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করি।” [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহে আলাইহে]


১.৬ ইমাম শাফেঈ (রহ:)’র মাযহাব


ইমাম আবূ আবদিল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস্ শাফেঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন:


آمنت بالله وبما جاء عن الله، على مراد الله، وآمنت برسول الله، وبما جاء عن رسول الله على مراد رسول الله 


অর্থ: “আমি ঈমান আনি তথা বিশ্বাস স্থাপন করি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের কাছে এসেছে তাঁর কাছ থেকে, যেভাবে তিনি তা উদ্দেশ্য করেছেন; আর আমি ঈমান আনি তথা বিশ্বাস স্থাপন করি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতিও এবং যা আমাদের কাছে এসেছে তাঁর কাছ থেকে, যেভাবে তিনি তা উদ্দেশ্য করেছেন।” [অনুবাদকের নোট: ইমাম শাফেঈ (রহ:)’র এই বক্তব্যটি একটি দলিল এ মর্মে যে, আল্লাহতা’লার সিফাত তথা গুণাবলীর ক্রিয়াপদ্ধতি ও অর্থ সম্পর্কে আমরা জানি না। হাত, মুখমণ্ডল শব্দগুলোর ভাষাগত অর্থ হয়তো আমরা জানতে পারি এবং সেগুলোর যাহের তথা বাহ্যিক দিক গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু আল্লাহতা’লা তাঁর মোতাশা’বেহাহ দ্বারা কী বা কেন বুঝিয়েছেন, তা আমরা জানি না; আর আমরা তা জানতেও প্রশ্ন করি না। কেননা আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন:  إِنَّ ٱللَّهَ لاَ يَسْتَحْى أَن يَضْرِبَ مَثَلاً مَّا بَعُوضَةً فَمَا فَوْقَهَا فَأَمَّا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ فَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ ٱلْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ وَأَمَّا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَيَقُولُونَ مَاذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِهَـٰذَا مَثَلاً يُضِلُّ بِهِ كَثِيراً وَيَهْدِي بِهِ كَثِيراً وَمَا يُضِلُّ بِهِ إِلاَّ ٱلْفَٰسِقِينَ - অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ যে কোনো জিনিসের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করতে লজ্জাবোধ করেন না - মশা হোক কিংবা তদপেক্ষা বড় কিছু। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তারা তো জানে যে এটা তাদের রব্বের পক্ষ থেকে সত্য। বাকি রইলো কাফিরবর্গ; তারা বলে, ‘এ ধরনের উপমায় আল্লাহর উদ্দেশ্য কী?’ (বস্তুতঃ) আল্লাহ তা দ্বারা অনেককে গোমরাহ করেন এবং অনেককে হেদায়াত করেন; আর তা দ্বারা তাদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন, যারা অবাধ্য (সূরা বাক্বারা, ২৬ আয়াত)। আল্লাহতা’লার গুণাবলীর গুপ্ত রহস্য সম্পর্কে কারো যদি জানা থাকতো, তাহলে তাঁরা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-ই হতেন। কিন্তু যেহেতু তাঁদের কাছ থেকে এতদসংক্রান্ত কোনো বিবরণ আমাদের কাছে আসেনি, সেহেতু সেগুলো যেভাবে আছে সেভাবেই গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই; আর আমরা সেসব (ঐশী) জ্ঞান-প্রজ্ঞা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি ন্যস্ত করি, ঠিক যেমনটি তাঁরা উদ্দেশ্য করেছেন। অধিকন্তু, ইমাম শাফেঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র ওপরের বক্তব্য ও সূরা বাক্বারায় বর্ণিত এর প্রেক্ষাপট অতিশয় ক্ষুদ্র ফলের কথা বিবৃত করে; এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লার ঐশী গুণাবলীর বিষয়টি নিয়ে ঝগড়া করার চরম পরিণতি সম্পর্কে একবার ভাবুন। আল্লাহ যদি কাউকে স্রেফ মোতাশা’বেহাহ ফলের অর্থ তালাশের কারণে পথভ্রষ্ট করেন, তাহলে যে ব্যক্তি তাঁর মোতাশা’বেহাহ গুণাবলীর অর্থ তালাশ করে তার অবস্থা কী হবে? এই আলোচনার আলোকে বলা যায়, আল্লাহর সিফাতসমূহ যেভাবে বর্ণিত হয়ে এসেছে, সেভাবেই গ্রহণ করা সবচেয়ে নিরাপদ; আর এর অর্থ তালাশ পরিহার করা এবং সেগুলো আল্লাহর প্রতি ন্যস্ত করা অতীব জরুরি]


এই পথই (প্রাথমিক যুগের) পুণ্যাত্মা সালাফ আস্ সালেহীন ও (পরবর্তী যুগের) খালাফ প্রজন্মের ইমামবৃন্দ গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে ঐশীগ্রন্থ ক্বুরআন মজীদ ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)‘এর সুন্নাহ যে প্রামাণিক দলিলাদি উপস্থাপন করেছে, তাউয়ীল তথা ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়ে সেগুলোর বিরোধিতা না করে তাঁরা সর্বসম্মতভাবে তা-ই সমর্থন করেছিলেন। নিশ্চয় প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে আদেশ মান্য করতে বলেছেন (তাঁরই আহাদীস পাক দ্বারা, যা আশীর্বাদধন্য সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন); সেগুলোর হেদায়াতের জ্যোতিকে আঁকড়ে ধরেই আমাদের তা করতে হবে।


১.৭ বেদআত সম্পর্কে প্রিয়নবী (দ:)’র সতর্কবাণী  


রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) নব উদ্ভাবিত/প্রচলনকৃত বিষয়াদি সম্পর্কে আমাদেরকে সতর্ক করেছিলেন এবং তিনি জানিয়েছিলেন যে এগুলো গোমরাহী তথা পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়। এটা নিম্নবর্ণিত হাদীস শরীফে দৃশ্যমান: 


عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي، عضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة، وكل بدعة ضلالة     

   

অর্থ: তোমাদের প্রতি বিধেয় হলো আমার সুন্নাহ (রীতিনীতি) এবং সঠিক পথে পরিচালিত খলীফাবৃন্দের সুন্নাহ-ও;  তোমাদের মাঢ়ির দাঁত দ্বারা তা কামড়ে ধরো (নওয়া’জিয্) এবং (আক্বীদা-বিশ্বাস ও অনুশীলনে) নতুন প্রচলনকৃত বিষয়াদি সম্পর্কে সতর্ক থেকো; (কেননা) নিশ্চয় প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বেদআত, আর প্রতিটি বেদআত-ই পথভ্রষ্টতা। [মুসনাদে ইমাম আহমদ (রহ:), হযরত এরবা’দ ইবনে  সা’রিয়া (রা:) হতে বর্ণিত, হাদীস নং ১৭১৪৫; সুনানে আবী দাউদ (রহ:), ‘কিতা’বুস্ সুন্নাহ,’ হাদীস নং ৪৬০৭; ইমাম নববী (রহ:)’র ‘চল্লিশটি হাদীস’, হাদীস নং ২৮; এবং এটা সহীহ শ্রেণিভুক্ত] {অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: এখানে ব্যবহৃত “সঠিক পথে পরিচালিত” কথাটি অতীতকালকে উদ্দেশ্য করেনি, যেহেতু উল্লেখিত খুলাফাবৃন্দ সর্বদাই সঠিক পথে পরিচালিত এবং তাঁদের বেসাল শরীফ-ই হয়েছে হেদায়াত ভিন্ন অন্য কোনো কিছুর ওপর নয়। শ্রদ্ধাপূর্ণ ও যথাযোগ্য অনুবাদ হবে “যাঁরা সঠিক পথ গ্রহণ করেছিলেন।” এটা আমি সহজবোধ্য করার জন্যে ছেড়ে দিয়েছি}   


১.৮ বেদআত সম্পর্কে হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)’এর সতর্কবাণী


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন:


اتبعوا ولا تبتدعوا فقد كفيتم


অর্থ: (সুন্নাহর) আনুগত্য করো এবং নতুন (রীতিনীতি) প্রচলন কোরো না; নিশ্চয় ইতোমধ্যেই তোমাদেরকে পর্যাপ্ত বিধান করা হয়েছে। [অনুবাদকের নোট: এই বিবরণটি বিদ্যমান আল-বায়হাক্বী (রহ:)’র ‘আল-মাদখাল,’ নং ৩৮৭-৩৮৮ পুস্তকে। আমাদেরকে ইতোমধ্যেই পর্যাপ্ত দেয়া হয়েছে, কেননা আল্লাহতা’লা দ্বীন-ইসলামকে পরিপূর্ণ ও নিখুঁত করেছেন। এমতাবস্থায় ধর্মকে আরো উন্নততর করার জন্যে কোনো কিছু যোগ করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন:  ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلإِسْلٰمَ دِيناً  - অর্থাৎ, আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম (সূরা মা’ইদাহ্, ৩ নং আয়াত)। এই আয়াতটি স্পষ্ট ব্যক্ত করে যে আমাদের আক্বীদা-বিশ্বাসের মৌলনীতি ও আমলের রীতি পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও সঠিক পথে পরিচালিত খলীফাবৃন্দের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) দ্বারা প্রদর্শন করা হয়েছে। অতএব, এই (সুন্নী) সম্প্রদায়ের আক্বীদা-বিশ্বাসে নতুন কিছু যোগ করার নেই, আর আমলের ক্ষেত্রেও নতুন কোনো অনুশীলনী যোগ করার নেই। তবে যেসব সামাজিক প্রথা ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী নয়, সেগুলো ততোক্ষণ পর্যন্ত অনুমতিপ্রাপ্ত হবে, যতোক্ষণ ধর্মীয় আচারে পরিণত করা না হয়; যদি তা মানুষের ওপর জোর-জুলুম করে চাপিয়ে দেয়া হয়, অথবা সামাজিক অবহেলা, আবেগী ব্ল্যাকমেইলিং কিংবা কথিত ‘মোনাফেক্ব’বর্গকে খোঁজার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যেমনটি বর্তমান যুগের কিছু লোক করে থাকে, তাহলে ওই সামাজিক প্রথা ‘বিদআতে সাইয়্যেয়াহ’ তথা মন্দ বেদআতে পরিণত হবে। এর মানে এ কথা বলা নয় যে, একটি সামাজিক প্রথা গোটা-ই কোনো এক লোকের গোমরাহীর কারণে মন্দ বেদআতে পরিণত হবে; তবে এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক হতে হবে এবং তার উদ্দেশ্য/নিয়্যত সম্পর্কে প্রশ্ন করতে হবে। আল্লাহতা’লা নিয়্যত অনুযায়ী মানুষকে পুরস্কৃত করেন, যা সূরা হাদীদের ২৭ নং আয়াতে পরিদৃষ্ট হয়, আর আল্লাহর সুন্নাহ/রীতিনীতি কখনোই পরিবর্তিত হয় না। বিষয়টি সম্পর্কে এই বইয়ের শেষে সংযোজনীও দেখুন]   


১.৯ বেদআত সম্পর্কে উমর বিন আবদীল আযীয (রহ:)’এর ভাষ্য


খলীফা উমর ইবনে আবদীল আযীয বিন মারওয়ান আল-ক্বুরাইশী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু; জন্মগ্রহণ করেন ও বেড়ে ওঠেন মদীনায়; খেলাফতপ্রাপ্ত হন ৯৯ হিজরী সালে) [ওপরের বক্তব্যের কাছাকাছি অর্থ সম্পর্কে] বলেন:


وقال عمر بن عبد العزيز (رضي الله عنه) كلاما معناه: قف حيث وقف القوم فإنهم عن علم وقفوا، وببصر نافذ كفوا، ولهم (الضمير هنا عائد على ”القوم”) على كشفها كانوا أقوا، وبالفضل لو كان فيها أحرى، فلئن قلتم: حدث بعدهم، فما أحدثه إلا من خالف هديهم ورغب عن سنتهم، ولقد وضفوا منه ما يشفي وتكلموا منه بما يكفي، فما فوقهم محسر، وما دونهم مقصر. لقد قصر عنهم قوم فجفوا وتجاوزهم آخرون فغلوا وإنهم فيما بين ذلك لعلى هدى مستقيم  


অর্থ: থামো (সেখানে), যেখানে জ্ঞানীগুণীজন (মানে সালাফ আস্ সালেহীন/প্রাথমিক যুগের পুণ্যবান মুসলমানবৃন্দ) তাঁদের জ্ঞানের কারণে থেমেছেন এ কথা ভালোভাবে জেনে যে, তাঁরা ওই জ্ঞান কখনোই ভেদ করতে সক্ষম নন। তাঁদের সে ধরনের কর্তৃত্ব থাকলে ওই জ্ঞান তাঁদের কাছে প্রকাশ ও উন্মুক্ত করা হতো একমাত্র এই কারণে যে, তাঁরা (তাঁদের রব্বের) কাছে সর্বাধিক অনুগ্রহপ্রাপ্ত; আর নিশ্চয় তাঁরাই তাঁদের দলের মাঝে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য/আস্থাভাজন ও খাঁটি। তাঁদের পরে লিপিবদ্ধ দ্বীন ও মিল্লাত-বিষয়ক যে কোনো নতুন বিষয় সেসব লোকদেরই দ্বারা বানানো তথা পরিবেশিত হয়েছে, যারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল-জামাআতের প্রাথমিক যুগের বিদ্বানবৃন্দের হেদায়াতপূর্ণ পথ ও মতের সম্পূর্ণ খেলাফ। ঐতিহ্যবাহী সুন্নী পথের পরিপন্থী আরেকটি পথ তারা বেছে নিয়েছে [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আল্লাহতা’লা ক্বুরআন মজীদে ওই ধরনের লোকদের সম্পর্কে ঘোষণা করেন - وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ ٱلْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَآءَتْ مَصِيراً - অর্থ: এবং যে ব্যক্তি রাসূলের বিরোধিতা করে এর পরে যে, সঠিক পথ তার সম্মুখে সুস্পষ্ট হয়েছে আর (সে) মুসলমানদের পথ থেকে আলাদা পথে চলে, আমি (খোদাতা’লা) তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দেবো এবং তাকে দোযখে প্রবেশ করাবো; আর (তা) প্রত্যাবর্তন করার কতোই মন্দ স্থান (সূরা নিসা’, ১১৫ আয়াত)! আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ থেকে রক্ষা করুন এবং সুন্নী পথের ওপর অটল রাখুন, আমীন]। নিশ্চয় আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল-জামাআতের বিজ্ঞ উলামাবৃন্দ এই আশীর্বাদপূর্ণ দলটি সম্পর্কে নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন এবং পর্যাপ্ত বলেছেন [অনুবাদকের নোট: আরবীতে ‘তারা/তাদের’ সর্বনামগুলো এখানে হেদায়াতপ্রাপ্ত পুণ্যাত্মাদের পাশাপাশি বাতিলপন্থীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। তাই আমি পুণ্যাত্মাদের বোঝাতে ‘আহলুস্ সুন্নাত ওয়া জামাআত’ শব্দটি ব্যবহার করেছি]। এগুলোর সীমা যা কিছু লঙ্ঘন করে, তা আহলে সুন্নাত ওয়া জামাআত হতে নয়; আর যা কিছু এগুলোর চেয়ে ঘাটতিপূর্ণ, তা স্রেফ গাফিলতি/অবহেলা; এর ফলশ্রুতিতে ওই লোকেরা আহলুস সুন্নাহ হতে ঘাটতিপূর্ণ হয়েছে। অনুরূপভাবে, যারা সীমা লঙ্ঘন করেছে, তারাও আহলুস্ সুন্নাহ হতে খারিজ/বের হয়ে গিয়েছে। অথচ প্রাথমিক যুগের প্রজন্মগুলো - অর্থাৎ, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে’ তাবেঈন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) - হেদায়াত তথা সঠিক পথ তথা মধ্যম রাস্তার ওপর অটল, অবিচল ছিলেন, যে রাস্তাটি ঘাটতিপূর্ণ লোকদের ও সীমা লঙ্ঘনকারীদের মাঝখানে অবস্থিত। [অনুবাদকের নোট: ইমাম আবূ ক্বুদা’মাহ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর লেখা “আল-বুরহা’ন ফী বয়া’নিল ক্বুরআন” গ্রন্থেও এ সম্পর্কে উল্লেখ করেন। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) নিজ “ফাদলুল্ ইলম-উস্-সালাফ” পুস্তকেও এ সম্পর্কে বিবৃত করেন]


১.১০ ইমাম আবূ উমর আল-আওযাঈ (রহ:) ও আল্লাহর সত্য সম্পর্কে আন্তরিকতা


ইমাম আবূ উমর আল-আওযাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন:


عليك بآثار من سلف وإن رفضك الناس،  وإياك وآراء الرجال،  وإن زخرفوه لك بالقول   

       

অর্থ: সালাফ আস্ সালেহীন হতে আসা’রি (বাণী) বর্ণনা তোমার মেনে চলা বাধ্যতামূলক, যদিও মানুষ তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে; আর নানা লোকের নানা মত সম্পর্কে সাবধান, যদিও তারা নিজেদের অলঙ্কৃত বাণী দ্বারা তোমাকে চমক লাগাতে চায়। [আল-বায়হাক্বী, ‘আল-মাদখাল,’ নং ২২৮]


১.১১  আল-আদরামী (রহ:) কর্তৃক জনৈক মো’তাযেলীর রদ


শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদির্ রাহমা’ন আল-আদরামী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) জনৈক মো’তাযেলী [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: মো’তাযেলা মতবাদে বিশ্বাসী লোকদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো ক্বুরআন মজীদকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আত সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেন যে ওই ধরনের ব্যক্তিবর্গ আল্লাহতা’লার চিরন্তন বাণীতে অবিশ্বাস করেছে। এ বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে] ব্যক্তিকে [অনুবাদকের নোট: তার নাম আহমদ বিন আবী দাউদ, যে ক্বুরআনকে সৃষ্টি বলে দাবি করার এই জঘন্যতম বেদআতের প্রচলন করেছিলো] বলেন:


وقال محمد بن عبد الرحمن الأدرمي لرجل تكلم ببدعة ودعا الناس إليها: هل علمها رسول الله صلى الله عليه وسلم وأبو بكر وعمر وعثمان وعلي، أو لم يعلموها؟ قال لم يعلموها، قال: فشيء لم يعلمه هؤلاء أعلمته أنت؟ قال الرجل: فإني أقول: قد علموها، قال: أفوسعهم أن لا يتكلموا به، ولا يدعوا الناس إليه، أم لم يسعهم؟ قال: بلى وسعهم، قال فشيء وسع رسول الله صلى الله عليه وسلم وخلفاءه لا يسعك أنت؟ فانقطع الرجل. فقال الخليفة ء وكان حاضرا ء: لا وسع الله على من لم يسعه ما وسعهم.

وهكذا من لم يسعه ما وسع رسول الله صلى الله عليه وسلم وأصحابه والتابعين لهم بإحسان والأئمة من بعدهم والراسخين في العلم من تلاوة آيات الصفات وقراءة أخبارها ولإمرارها كما جاءت، فلا وسع الله عليه


অর্থ: তুমি একটি বিদআতের প্রচলন করেছো এবং মানুষকে সেটার দিকে আহ্বান করছো (যার দরুন সেটার প্রসার করছো)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর, উসমান ও আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) কি এই বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন? নাকি জানতেন না?


লোকটি উত্তর দেয়: “তাঁরা এই বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন না।”


শায়খ আদরামী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) আরো প্রশ্ন করেন: তাহলে তুমি এমন বিষয় সম্পর্কে জানো যা তাঁরা জানতেন না?


লোকটি জবাব দেয়: “নিশ্চয় আমি স্রেফ বলি, তাঁরা অবশ্যই জানতেন।” [অনুবাদকের নোট: অনুমানমূলক ধর্মতত্ত্ব]


শায়খ আদরামী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) প্রত্যুত্তর দেন: অতএব, এটা তাঁদের জন্যে যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা এ সম্পর্কে কিছু বলেননি? তাঁরা মানুষকে এতে বিশ্বাস স্থাপনের জন্যেও আহ্বান করেননি। নাকি তাঁদের জন্যে এটা যথেষ্ট ছিলো না?


ওই বেদআতী লোকটি এরপর উত্তর দেয়: “না, এটা তাঁদের জন্যে পর্যাপ্ত ছিলো।”


হযরত আদরামী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) সিদ্ধান্ত দেন: অতএব, এই বিষয়টি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) জন্যে যথেষ্ট হলেও তোমার জন্যে যথেষ্ট নয় কি?”


এমতাবস্থায় ওই লোকটি নিরুত্তর হয়ে যায়। এ কথা শুনে খলীফা (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: “আল্লাহতা’লা সেই ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত না দিন, যে সালাফ আস্ সালেহীনের জন্যে যথেষ্ট বিষয়কে যথেষ্ট বিবেচনা করে না। আর যে ব্যক্তির জন্যে পর্যাপ্ত হয় না সে বিষয়, যেটা পর্যাপ্ত হয়েছিলো  মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন), তাবেঈন ও তৎপরবর্তী সময়ে আগত সত্যপন্থী পুণ্যবান ইমামমণ্ডলী (রহমতুল্লাহে আলাইহিম আজমাঈন)’র জন্যে, যাঁদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ছিলো দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত এবং যাঁরা (পূর্ববর্তীদের) পথ পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ-অনুকরণ করেছিলেন, যিনি আল্লাহর মোতাশা’বেহাহ গুণাবলীর বর্ণনামূলক আয়াত পাঠ করেছিলেন এবং সেগুলোর তথ্য অধ্যয়ন করেছিলেন আর সেগুলো যেভাবে আছে সেভাবেই গ্রহণ করেছিলেন; এমতাবস্থায় ওই বিষয়টি যে ব্যক্তির জন্যে যথেষ্ট নয়, আল্লাহ পাক যেনো তার জন্যে যথেষ্ট না দেন।”


১.১২ মোতাশাবিহাহ গুণাবলী সম্পর্কে আল-ক্বুরআন হতে প্রমাণ    


আল্লাহতা’লার গুণাবলী সম্পর্কে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা তাঁর বাণীতে (ক্বুরআন মজীদে) বিবৃত হয় নিম্নরূপে:


 وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو ٱلْجَلاَلِ وَٱلإِكْرَامِ   


অর্থ: এবং চিরস্থায়ী হচ্ছেন আপনার রব্বের সত্তা, যিনি মহামহিম ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। [আল-ক্বুরআন, ৫৫:২৭; নূরুল এরফান]


  بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ


অর্থ: বরং তাঁর (আল্লাহর) হাত প্রশ্বস্ত। [আল-ক্বুরআন, ৫:৬৪; নূরুল এরফান]


হযরত ঈসা (আলাইহিস্ সালাম)’র ভবিষ্যৎ বক্তব্য সম্পর্কে আল্লাহ আমাদেরকে জানান:


 تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلاَ أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ  


অর্থ: আপনি জানেন যা আমার অন্তরে রয়েছে এবং আমি জানি না যা আপনার জ্ঞানে রয়েছে। [আল-ক্বুরআন, ৫:১১৬; নূরুল এরফান]


وَجَآءَ رَبُّكَ


অর্থ: এবং আপনার রব্বের নির্দেশ আসবে। [আল-ক্বুরআন, ৮৯:২২; নূরুল এরফান]


কালামুল্লাহ শরীফ:


 هَلْ يَنظُرُونَ إِلاَّ أَن يَأْتِيَهُمُ ٱللَّهُ


অর্থ: কিসের প্রতীক্ষায় রয়েছে? কিন্তু এরই যে আল্লাহর শাস্তি আসবে। [আল-ক্বুরআন, ২:২১০; নূরুল এরফান]


আল্লাহ বলেন:


رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ 


অর্থ: আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। [আল-ক্বুরআন, ৫:১১৯; নূরুল এরফান]


আল্লাহ এরশাদ করেন:


  يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ


অর্থ: (তারা) আল্লাহর প্রিয়পাত্র, আল্লাহও তাদের কাছে প্রিয়। [আল-ক্বুরআন, ৫:৫৪; নূরুল এরফান]


আল্লাহ অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে বলেন:


 غَضِبَ ٱللَّهُ عَلَيْهِم


অর্থ: তাদের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ রয়েছে। [আল-ক্বুরআন, ৫৮:১৪; নূরুল এরফান]


তিনি ঘোষণা করেন:


ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ ٱتَّبَعُواْ مَآ أَسْخَطَ ٱللَّهَ


অর্থ: তারা এমন সব কথার অনুসারী হয়েছে, যা’তে আল্লাহর অসন্তুষ্টি রয়েছে। [আল-ক্বুরআন, ৪৭:২৮; নুরুল এরফান]


আল্লাহর বাণী:


وَلَـٰكِن كَرِهَ ٱللَّهُ ٱنبِعَاثَهُمْ


অর্থ: কিন্তু আল্লাহরই কাছে তাদের অভিযাত্রা মনঃপুত হলো না। [আল-ক্বুরআন, ৯:৪৬; নূরুল এরফান]


১.১৩ মোতাশাবিহাহ গুণাবলী সম্পর্কে আহাদীস হতে প্রমাণ


সুন্নাহ-ভিত্তিক প্রমাণাদি নিম্নরূপ:


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেন - 


ينزل ربنا تبارك وتعالى كل ليلة إلى سماء الدنيا 


অর্থ: আমাদের রব্ব (আল্লাহতা’লা) প্রতি রাতে এ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। [হযরত আবূ হোরায়রাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে ইমাম আহমদ রহমতুল্লাহে আলাইহে কর্তৃক তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণিত; হাদীস নং ৯৫৯২]


আরেকটি বর্ণনায় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেন -


يعجب ربك من الشاب ليست له صبوة 


অর্থ: তোমার প্রভু ছেলেমানুষি বা বোকামি বিহীন যুবকের প্রতি মুগ্ধ (মানে খুশি)। [হযরত উক্ববাহ ইবনে আমির আল-জুহামী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত ও ‘মুসনাদে ইমাম আহমদ (রহ:)’ গ্রন্থে উদ্ধৃত; ১৭৩৭১ নং হাদীস]


হুযূরে পূর নূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আরো ফরমান -


يضحك الله إلى رجلين قتل أحدهما الآخر ثم يدخلان الجنة


অর্থ: আল্লাহ দু জন ব্যক্তির প্রতি হাসেন, যারা একে অপরকে হত্যা করেছিলো; অতঃপর দু জন-ই জান্নাতে প্রবেশ করে। [হযরত আবূ হোরায়রাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত ও ‘মুসনাদে ইমামে আহমদ (রহ:)’ পুস্তকে উদ্ধৃত, হাদীস নং ৭৩২৬; সহীহ আল-বুখারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ‘কিতাবুল জ্বিহাদ,’ হাদীস নং ২৮২৬; এ হাদীসের এসনাদ সহীহ]


১.১৪ আহলে সুন্নাত ও মোতাশাবিহাহ সম্পর্কে ঘোষণা


আমরা (সুন্নী জামাআত) আল্লাহর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ/উপমাময় সহীহ রওয়ায়াত/বিবরণগুলোতে বিশ্বাস করি এবং সেগুলো অস্বীকার করি না; নাকচও করি না; তাউয়ীল তথা ভিন্নতর এমন ব্যাখ্যাও দেই না, যা সেগুলোর যাহেরী/বাহ্যিক অর্থের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। [অনুবাদক শায়খ আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: দ্বীন-মাযহাব ও আল্লাহতা’লার গুণাবলীর প্রসঙ্গে যে কোনো আলোচনায় ‘যাহের’ শব্দটির সবচয়ে যুৎসই অনুবাদ হচ্ছে বাহ্যতঃ বা বাহ্যিক; যার মানে যখনই কোনো শব্দ একাধিক অর্থ বহন করবে, তৎক্ষণাৎ সেটার প্রাথমিক বাহ্যিক অর্থটি গৃহীত হবে। তবে শব্দটির সম্ভাব্য অন্য রকম প্রয়োগ (মু’আওয়াল)-ও হতে পারে যা ব্যবহৃত নয়, আর প্রামাণিকতার ঘাটতির কারণে সেটা ’যাহের।’ সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মাবৃন্দ) আল্লাহতা’লার গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী সম্পর্কে ভিন্নতর ব্যাখ্যা পরিত্যাগ করেছিলেন স্রেফ এই কারণেই। এর মানে কিন্তু এই নয় যে ওই গুণাবলী (শুধু) আক্ষরিক অর্থে বিরাজমান।


ইমাম মুওয়াফফাক্বউদ্দীন আবূ ক্বুদা’মাহ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: “যাহের শব্দটির মানে হচ্ছে ওর প্রকাশ/অভিব্যক্তির ভিত্তিতে যা উপলুব্ধ হয়; যার সাথে আরেকটি অর্থের সম্ভাব্যতা থাকে - যে দুটো অর্থের কোনো একটি অপরটির ওপরে প্রাধান্য পায় (রওদাতুন্ না’যির, ২:২৫)।“ হযরত ইমাম (রহ:) আরো বলেন, “সালাফ আস্ সালেহীনের মাযহাব/পথ হচ্ছে আল্লাহতা’লার মোবারক নাম ও গুণাবলীতে বিশ্বাস স্থাপন, যেগুলো দ্বারা তিনি তাঁর ঐশীবাণীতে নিজেকে বর্ণনা করেছেন; অধিকন্তু, তাঁদের মাযহাব হচ্ছে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণীর অনুসরণ - কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন ব্যতিরেকেই; সীমালঙ্ঘন না করেই; আর যাহেরী অর্থের সাথে সাংঘর্ষিক ভিন্নতর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না আরোপ করেই। আল্লাহতা’লার গুণাবলীর সাথে সৃষ্টিকুলের গুণাবলীর কোনো রকম সাদৃশ্য প্রদান চলে না….মুহাদ্দেসীন/হাদীসবিদ উলামাবৃন্দ এগুলো যেভাবে পেয়েছেন, সেভাবেই (আমাদের কাছে) হস্তান্তর করেছেন। সালাফ-মণ্ডলী জানতেন বক্তা (খোদাতা’লা) সত্যবাদী, যাঁর সত্যবাদিতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। তাঁরা তাঁকে বিশ্বাস করেছিলেন; আর তাঁরা ওই অর্থের বাস্তবতা (حقيقتاً معناها) সম্পর্কে জানতেন না। এভাবে তাঁরা যা জানতেন না, সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকতেন” (‘যামউত্ তা’উয়ীল’)।


আল-খাত্তাবী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: “আল্লাহতা’লার সিফা’ত তথা গুণাবলী সম্পর্কে সালাফ আস্ সালেহীনের মাযহাব/পথ ছিলো, সেগুলো যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই ঘোষণা করা, সেগুলোর যাহের/বাহ্যিক অর্থ অনুযায়ী; পক্ষান্তরে, বিনা প্রশ্নে সৃষ্টিকুলের সাথে যে কোনো ধরনের সাযুজ্য নাকচ করেই।” (ইমাম যাহাবী কৃত ‘মুখতাসারুল-উলুউ’, ২৫৭ পৃষ্ঠা/নং-৩১১; ইমাম আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-আসমা’ওয়াস্ সিফা’ত’, ২য় খণ্ড, ১৯৮ পৃষ্ঠা)


আল-খা’তিব আল-বাগদা’দী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন, “আল্লাহতা’লার সিফা’ত সংক্রান্ত বাণী ও সহীহ আহাদীস তথা সুন্নাহ’তে বর্ণিত যা কিছু এসেছে, সেসব বিষয়ে সালাফ আস্ সালেহীনের পথ ছিলো সেগুলোর যাহের/বাহ্যিক অর্থ অনুযায়ী গ্রহণ করা।” (‘আল-কালা’ম ’আলাস্ সিফা’ত’, ১২-২০ পৃষ্ঠা) 


ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ) বলেন, “আমাদের মাযহাব অনুযায়ী, হাদীসসমূহকে সেগুলোর যাহের তথা বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করতে হবে, যেভাবে সেগুলো আমাদের নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর কাছ থেকে এসেছে; আর সেগুলোর ব্যাপারে যুক্তিতর্ক করা (মন্দ) বেদআত/ধর্মের মধ্যে নতুন প্রচলন। আবারো বলছি, হাদীসসমূহের যাহেরী অর্থে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, আর আমরা কারো সাথে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবো না।” (ইমাম আহমদ কৃত ‘উসূল-উস্-সুন্নাহ’, দেখুন সংযোজনী-১, ১১২ পৃষ্ঠা)। 


এসব বিষয় আবারো তুলে ধরা হলো নিচে:


১/ আল্লাহতা’লার সিফা’ত তথা গুণাবলী সেগুলোর যাহের তথা বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করতে হবে।

২/ আল্লাহতা’লার গুণাবলীর রূপক অর্থ হয়তো থাকা সম্ভব, তবে সেগুলো স্রেফ আল্লাহরই জানা। অধিকন্তু, হাম্বলী মাযহাবে সেগুলোর সম্ভাব্য অর্থ নিয়ে আলোচনা বা ধারণা করার অবকাশ নেই; সেগুলোকে এমনি ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

৩/ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কখনোই আল্লাহতা’লার যাবতীয় সিফাত সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেননি, কেননা সেগুলো তাঁর নুবুওয়্যতের মিশনের সাথে প্রাসঙ্গিক ছিলো না; যেমনিভাবে তা ছিলো না মানবজাতির পরিত্রাণের সাথেও; কারণ আল্লাহতা’লা আমাদেরকে তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না। 

৪/ প্রামাণ্য দলিলের অভাবে এটা গতানুগতিকভাবে যাহের/বাহ্যিক; তবে এটাকে আক্ষরিকতা (কোনোক্রমেই) বলা যাবে না, যা (মনুষ্য) আকার-আকৃতি নির্দেশ করে।

৫/ প্রামাণ্য দলিলের অভাবে এগুলোকে কেউই যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নন।

৬/ আমাদেরকে সর্বান্তকরণে এগুলোতে বিশ্বাস করতে হবে, আর তা কোনো প্রকার মনুষ্য আকৃতির সাদৃশ্য (তাশবীহ) ছাড়াই। 

৭/ আল্লাহতা’লার গুণাবলীকে তামসীল তথা তাঁর সৃষ্টিকুলের সাথে তুলনা বা উপমা দেয়া যাবে না।

৮/ সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মাবৃন্দ) যদিও শব্দটির অর্থ জানতেন, তবুও তাঁরা ওই অর্থের বাস্তবতা সম্পর্কে জানতেন না। তাই তাঁরা নিশ্চুপ ছিলেন।

৯/ এসব বিষয়ে নিশ্চুপ থাকার মাহাত্ম্য (বিদ্যমান)।

১০/ এগুলো সম্পর্কে কেন ও কীভাবে প্রশ্ন করা, অথবা তর্ক-বিতর্ক করা আমাদের জন্যে নিষেধ; কেননা এটা মস্ত (মন্দ) বেদআত।


বর্তমানকালের অনেক গোষ্ঠীগত লেখনীতে পাঠকবৃন্দ হয়তো এমনটি পেতে পারেন, যা’তে আল্লাহতা’লার গুণাবলীকে যাহেরী/বাহ্যিক অর্থে গ্রহণকারী ব্যক্তি আল্লাহর মনুষ্য আকারবিশিষ্ট ধারণার বশবর্তী বলে সাব্যস্ত হয়ে থাকেন। তবে ঘটনা সব সময় তা নয় এবং এ ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে কারোরই তাড়াহুড়ো করা উচিৎ নয়। ইমাম গাজ্জালী (رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ) বলেন, “অন্যান্যরা...সকল আলঙ্কারিক ব্যাখ্যা-ই নিষেধ করেছেন। এঁদের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ) অন্যতম, যিনি এমন কী আল্লাহতা’লার কথারও রূপক ব্যাখ্যা দিতে মানা করেছিলেন….হযরত ইমামের ব্যাপারে প্রত্যেককে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে তিনি জানতেন ‘আল্লাহতা’লার আরশে সমাসীন’ হওয়ার অর্থের মধ্যে বিশ্রাম অন্তর্ভুক্ত নয়, ঠিক যেমনটি তাঁরই ‘অবতরণ’ করার মধ্যে শারীরিক চলাচল অন্তর্ভূত নয়। বরঞ্চ হযরত ইমাম আলঙ্কারিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বারণ করেছিলেন জনস্বার্থে আলোচনার দ্বারকে রুদ্ধ করতেই; কেননা একবার ওই দ্বার উন্মুক্ত হলে মতপার্থক্য/বিভেদ ব্যাপকতর হবে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, যা মধ্যম পন্থার সীমা লঙ্ঘন করবে। আর মধ্যম পন্থার সীমা অতিক্রম যেহেতু সীমাহীন, সেহেতু আলঙ্কারিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণে কোনো ক্ষতি-ই নেই। (হযরত ইমামের) এই আচরণটির সমর্থন পাওয়া যায় সালাফ-মণ্ডলীর কাছ থেকে, যাঁরা বলতেন, ‘এ ধরনের বিষয়কে সেভাবেই গ্রহণ করো, যেভাবে এসেছে’ (মানে যাহেরী অর্থে)। আর সেগুলোকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর দিকেই ফিরিয়ে দিতে হবে।” (দেখুন ইমাম গাজ্জালী রচিত ‘এহইয়াও উলূমিদ্দীন’ ও ইমাম নক্বীব মিসরী’র ‘উমদাতুস্ সালেক’/Reliance of the Traveler-Shaykh Nuh Ha Mim Keller, ৮৫৩-৮৫৫ পৃষ্ঠা)।”]            

   

আল্লাহ (سبحانه وتعالى)‘র গুণাবলীর সাথে সৃষ্টিকুলের বৈশিষ্ট্যাবলীর কোনো সাদৃশ্য আমরা স্থাপন করি না। এসব হাদীস ব্যাখ্যাকালে হাতের নড়াচড়া, মুখাবয়বের অভিব্যক্তি দ্বারা কোনো প্রকার সাযুজ্যও আমরা দেখাই না। আর আমরা জানি, কোনো কিছুই আল্লাহতা’লার সদৃশ নয়; কেননা তিনি এরশাদ ফরমান:


 لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْبَصِيرُ


অর্থ: তাঁর (আল্লাহর) মতো কিছুই নেই; এবং তিনি-ই শোনেন, দেখেন। [সূরা আশ্ শূ-রা-, ১১ নং আয়াত; নূরুল এরফান]


আপনারা যে কোনো কিছু অথবা যাবতীয় কিছু মস্তিষ্কে কল্পনা করতে পারেন, বা কল্পনা করবেন, কিংবা কেউ (ইতিপূর্বে) চিন্তা করেছেন, এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা তা হতে (একেবারে) ভিন্ন। [অনুবাদক শায়খ আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আমাদের কল্পনা, চিন্তা, ধারণাগুলো নিজেরাই সৃষ্ট; তাহলে সৃষ্ট নন স্রষ্টাকে কীভাবে কেউ কল্পনা করতে সক্ষম?]


আল্লাহতা’লা তাঁর ঐশীগ্রন্থে আরো ফরমান:


 ٱلرَّحْمَـٰنُ عَلَى ٱلْعَرْشِ ٱسْتَوَىٰ


অর্থ: তিনি পরম করুণাময়, তিনি আরশের ওপর ইস্তিওয়া করেন (সমাসীন হন)...। [সূরা তোয়াহা, ৫ নং আয়াত, নূরুল এরফান]


অন্যত্র তিনি ঘোষণা করেন:


ءَأَمِنتُمْ مَّن فِي ٱلسَّمَآءِ


অর্থ: তোমরা কি নির্ভীক হয়ে গেছো তাঁরই সাথে, যাঁর বাদশাহী আসমানে রয়েছে। [সূরা মুলক, ১৬ নং আয়াত; নূরুল এরফান]


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেন:


رَبُّنَا اللَّهُ الَّذِي فِي السَّمَاءِ تَقَدَّسَ


অর্থ: আমাদের প্রভু আল্লাহ যিনি আসমানে; আপনার নাম (মোবারক) পবিত্র। [সুনানে আবী দাউদ, (كتاب الطب), হাদীস নং ৩৮৯২]


রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) জনৈকা জারিয়া দাসীকে জিজ্ঞেস করেন:


وقال للجارية: أين الله؟ قالت: في السماء. قال: أعتقها فإنها مؤمنة 


অর্থ: “আল্লাহ কোথায়?” [অনুবাদক শায়খ আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এ প্রশ্নটি করেছিলেন ওই জারিয়া দাসীর ঈমানদারি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে এবং কোনো বিষয়কে তুলে ধরার খাতিরে। ইতোমধ্যে মুসলমান হয়েছেন এমন কারো ঈমান নির্ণয় করার জন্যে এ প্রশ্নটি অন্য কারোরই প্রয়োগ করা উচিৎ হবে না! কোনো ব্যক্তির ঈমানদারি নির্ণয়ের জন্যে এ ধরনের প্রশ্ন করাকে শর্ত হিসেবে কোনো সালাফ আস্ সালেহীন তথা সাহাবা (রা:), তাবেঈন, তাবে’ তাবেঈন কিংবা দ্বীন-মাযহাব ও মিল্লাতের ইমামবৃন্দ আরোপ করেননি; কেননা যে ব্যক্তি শাহাদাহ পাঠ করেছেন, তাঁকে মুসলমান বিবেচনা করা হয়।]   


ওই জারিয়া দাসী উত্তর দেন: “আসমানে।” এ উত্তর শুনে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর মালিককে বলেন: “তাকে মুক্ত করে দাও, কেননা নিশ্চয় সে মো’মেনাহ তথা ঈমানদার নারী।” [ইমাম মালেক (রহমতুল্লাহে আলাইহে) প্রণীত ‘আল-মুওয়াত্তা’, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ১৫১১; সহীহ মুসলিম, ৩য় খণ্ড, ‘কিতাব আল-মসজিদ’, হাদীস নং ৫৩৭; ‘সুনানে আবী দাউদ’, ‘কিতাব আল-সালাহ’, হাদীস নং ৯৩০] [অনুবাদক শায়খ আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: এ হাদীসের ব্যাপারে হাম্বলী দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এর অর্থের মধ্যে ডুব দেয়ার দিকে পরিচালিত করে এমন আলোচনা পরিহার করে এতে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। আমরা এ কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করি এবং এটা যেভাবে আছে সেভাবেই ছেড়ে দেই; আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো জানেন।]     


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) একবার প্রশ্ন করেন হুসেইন নামের এক ব্যক্তির প্রতি [অনুবাদক শায়খ আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: তাঁর নাম হুসেইন ইবনে উবায়দ আল-জাযারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আহলে বায়তের আশীর্বাদধন্য ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সাথে তাঁকে তালগোল পাকানো চলবে না। ইমাম আবূ ক্বুদা’মা (রহমতুল্লাহে আলাইহে)-ও নিজ ‘আল-উলূও’ পুস্তকের ১৯ পরিচ্ছেদে এ কথা উল্লেখ করেন।]:


 وقال النبي صلى الله عليه وسلم لحصين: كم إلها تعبد؟ قال: سبعة، ستة في الأرض وواحدا في السماء. قال من لرغبتك ورهبتك؟ قال الذي في السماء، قال فاترك الستة واعبد الذي في السماء، وأنا أعلمك دعوتين، فأسلم، وعلمه النبي صلى الله عليه وسلم أن يقول: اللهم ألهمني رشدي، وقني شر نفسي


অর্থ: “তুমি কতোগুলো উপাস্যের অর্চনা করো?” হযরত হুসেইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উত্তর দেন: “সাত জন! ছয় জন জমিনে আর একজন আসমানে!” হুজূর পূর নূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এরপর তাঁকে আরেকটি প্রশ্ন করেন: “তুমি ভয় পেলে অথবা তোমার কোনো প্রয়োজন পূরণের সময় কার শরণাপন্ন হও?” তিনি উত্তর দেন: “যিনি আসমানে আছেন তাঁর (শরণাপন্ন হই)।” এমতাবস্থায় প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেন: “ছয় জনকে পরিত্যাগ করো এবং যিনি আসমানে আছেন তাঁরই এবাদত-বন্দেগী করো; আর আমি তোমাকে দুটো দুআ শিখিয়ে দেবো।” এতদশ্রবণে হযরত হুসেইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে নিম্নের দুআটি শিক্ষা করেন: “হে আল্লাহ, আমাকে ঐশী অনুপ্রেরণা ও সঠিক পথপ্রদর্শন করুন এবং আমার নফস তথা কৃপ্রবৃত্তির মন্দ হতে রক্ষা করুন। “ [সুনানে তিরমিযী, ‘কিতাব-উদ-দা’আওয়াহ’, হাদীস নং ৩৪৮৩]


পূর্ববর্তী (ঐশী) গ্রন্থগুলোতে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও আসহাবে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-মণ্ডলীর আলামত/চিহ্ন সম্পর্কে বলা হয়েছে:


أنهم يسجدون بالأرض ويزعمون أن إلههم في السماء.


অর্থ: নিশ্চয় তাঁরা দুনিয়ার বুকে (আল্লাহর প্রতি) সেজদা করেন (মানে সালাত আদায় করেন) এবং তাঁরা বলেন তাঁদের ইলাহ/মা’বূদ আসমানে অবস্থান করেন। [অনুবাদক শায়খ আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আল্লাহর আসমানে অবস্থানের এ কথাটি বাইবেলের জবুর/গীতসংহিতা পুস্তকের ৫৭ অধ্যায়ে কাব্যাকারে ব্যক্ত হয়]


ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর ‘সুনান’ পুস্তকে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি এরশাদ করেন:


إن ما بين سماء إلى سماء مسيرة كذا وكذا …


অর্থ: নিশ্চয় এক আসমান থেকে আরেক আসমানের মাঝে দূরত্ব এতো এতোখানি...। 


অতঃপর তিনি উল্লেখ করেন:


وفوق ذلك العرش، والله سبحانه فوق ذلك


অর্থ: এবং ওর ওপরে আরশ (প্রতিষ্ঠিত); আর মহাপবিত্র আল্লাহ পাক ওর ওপরে (সমাসীন)। [ইমাম আহমদ কৃত ‘মুসনাদ’; হযরত আব্বাস বিন আবদিল মুত্তালিব (রা:) বর্ণিত, হাদীস নং- ১৭৭০; ‘সুনানে আবী দাউদ’, ‘কিতাবুস্ সুন্নাহ’, হাদীস নং- ৪৭২৩; ৪৭২৪; ৪৭২৫; ‘সুনানে তিরমিযী,’ ‘কিতাবুত্ তাফসীরিল্ ক্বুরআন’, হাদীস নং ৩৩২০; ‘সুনানে ইবনে মাজাহ,’ ‘কিতাবুল্ মুক্বাদ্দামাহ’, হাদীস নং ১৯৩] 

         

এগুলো এবং অনুরূপ অন্যান্য বিবরণ সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মাবৃন্দ) কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে (যেভাবে বর্ণনায় এসেছে সেভাবেই)। তাঁরা এগুলো প্রত্যাখ্যান করেননি, খণ্ডনও করেননি; আর ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিতেও সচেষ্ট হননি। অধিকন্তু, তাঁরা এগুলোকে মনুষ্য আকৃতি বা সাযুজ্য দিতেও প্রবৃত্ত হননি।


ইমাম মালিক (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে জিজ্ঞেস করা হয়:


يا أبا عبد الله ((  ٱلرَّحْمَـٰنُ عَلَى ٱلْعَرْشِ ٱسْتَوَىٰ ))، كيف استوى؟ 


অর্থ: হে আবূ আব্দিল্লাহ! ক্বুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ আরশে ইস্তিওয়া করেছেন’ [সূরা তোয়াহা: ৫ আয়াত]; প্রশ্ন হলো, কীভাবে ইস্তিওয়া করেছেন?’


ইমাম মালিক (رحمة الله عليه) উত্তরে বলেন:


فقال: الاستواء غير مجهول، والكيف غير معقول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة .


অর্থ: আল-ইস্তিওয়া (সংজ্ঞাটি) জ্ঞাত (পরিভাষাগতভাবে); কিন্তু ‘আল-কায়ফ’ তথা কীভাবে (সংঘটিত), তা অবোধগম্য। এতে বিশ্বাস স্থাপন বাধ্যতামূলক; আর এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা বেদআত/মন্দ উদ্ভাবন।


ثم أمر بالرجل فأخرج.


অতঃপর তিনি (প্রশ্নকর্তা) লোকটিকে বের হয়ে যাবার জন্যে আদেশ করেন। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: ইতিপূর্বে বইয়ে ইস্তিওয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে]   


দ্বিতীয় অধ্যায়


আল্লাহতা’লার কালাম/বচন  


২.১ ক্বুরআন হতে প্রমাণ


আল্লাহ পাকের গুণাবলীর মধ্যে একটি এই যে, তিনি كلام قديم তথা চিরন্তন বচন দ্বারা নিজ ভাব প্রকাশ করে থাকেন। তিনি তা শোনার জন্যে আপন সৃষ্টিকুল হতে যাঁকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। পয়গম্বর মূসা (عليه السلام) আল্লাহর ওই বাণী কোনো মাধ্যম ছাড়াই শ্রবণ করেছিলেন। হযরত জিবরীল আমিন (عليه السلام)-ও তা (একইভাবে) শ্রবণ করেন; আল্লাহতা’লা ফেরেশতাকুল ও আম্বিয়াবৃন্দের (আ:) মাঝে যাঁকে যাঁকে অনুমতি দেন, তাঁরাও আল্লাহর বাণী শ্রবণ করেন। আখেরাতে নিশ্চয়ই আল্লাহতা’লা মু’মিনদের সাথে কথা বলবেন এবং তাঁরাও তাঁর সাথে কথা বলবেন। আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতিও দেবেন। আল-ক্বুরআনে তিনি এরশাদ ফরমান:


وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَكْلِيماً 


অর্থ: আর আল্লাহতা’লা (পয়গম্বর) মূসার সাথে প্রকৃত অর্থে (মানে সরাসরি) কথা বলেছেন। [আল-ক্বুরআন, ৪:১৬৪]


তিনি অন্যত্র ঘোষণা করেন:


يٰمُوسَىٰ إِنِّي ٱصْطَفَيْتُكَ عَلَى ٱلنَّاسِ بِرِسَالاَتِي وَبِكَلاَمِي


অর্থ: হে মূসা! আমি তোমাকে লোকদের থেকে মনোনীত করে নিয়েছি স্বীয় রিসালাত (-এর বাণীসমূহ) এবং স্বীয় বাক্যালাপ দ্বারা। [আল-ক্বুরআন, ৭:১৪৪]


আল্লাহ আরো বলেন:


تِلْكَ ٱلرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ مِّنْهُمْ مَّن كَلَّمَ ٱللَّهُ


অর্থ: এঁরা রাসূল...তাঁদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন। [আল-ক্বুরআন, ২:২৫৩]


অপর এক আয়াতে তিনি এরশাদ ফরমান:


 وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ ٱللَّهُ إِلاَّ وَحْياً أَوْ مِن وَرَآءِ حِجَابٍ


অর্থ: কোনো মানুষের শোভা পায় না যে, আল্লাহ তাঁর সাথে কথা বলবেন, কিন্তু ওহী রূপে, কিংবা এভাবে যে ওই মানুষ মহত্ত্বের পর্দার অন্তরালে থাকবে। [আল-ক্বুরআন, ৪২:৫১]


আল্লাহ পাক অক্ষরসহ ভাষণ দেন এবং তাঁর কণ্ঠস্বরও শ্রুত হয়। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: এই অধ্যায় ও পরবর্তী অধ্যায় দুটো সমাপনী বক্তব্যসহ পাঠ করা গুরুত্বপূর্ণ]


আল্লাহ ঘোষণা করেন:


 فَلَمَّآ أَتَاهَا نُودِيَ يٰمُوسَىٰ (١١) إِنِّيۤ أَنَاْ رَبُّكَ فَٱخْلَعْ نَعْلَيْكَ إِنَّكَ بِٱلْوَادِ ٱلْمُقَدَّسِ طُوًى (١٢)


অর্থ: অতঃপর যখন আগুনের কাছে আসলো, আহ্বান করা হলো, ‘হে মূসা! নিশ্চয় আমি তোমার রব্ব। সুতরাং তুমি আপন জুতা খুলে ফেলো; নিশ্চয় তুমি পবিত্র উপত্যকা ‘তুওয়া’-এর মধ্যে এসেছো।’ [আল-ক্বুরআন, ২০:১১-১২]


আল্লাহ এরশাদ করেন:


إِنَّنِيۤ أَنَا ٱللَّهُ لاۤ إِلَـٰهَ إِلاۤ أَنَاْ فَٱعْبُدْنِي


অর্থ: নিশ্চয় আমি-ই হলাম ‘আল্লাহ,’ আমি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। সুতরাং তুমি আমার বন্দেগী করো। [আল-ক্বুরআন, ২০:১৪]


আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এ কথা বলা জায়েয নেই।


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন: 


إذا تكلم الله بالوحي سمع صوته أهل السماء


অর্থ: আল্লাহতা’লা যখনই ওহী দ্বারা কথা বলেন, তৎক্ষণাৎ আসমানের অধিবাসী (তথা ফেরেশতাকুল) তা শ্রবণ করেন।


ওই সাহাবী (রা:) এ কথা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন।


২.২ আহাদীস হতে প্রমাণ


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আনীস্ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন মহানবী (صلى الله عليه وسلم) হতে; নিশ্চয় তিনি বলেন:


يحشر الله الخلائق يوم القيامة عراة حفاة غرلا بهما فيناديهم بصوت يسمعه من بعد كما يسمعه من قرب : أنا الملك أنا الديان


অর্থ: আল্লাহতা’লা তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে পুনরুত্থান দিবসে বিবস্ত্র, খালি পা, খৎনাবিহীন ও দুনিয়ার সম্পদ ছাড়াই জড়ো করবেন, আর তিনি তাদেরকে আপন কণ্ঠস্বরে আহ্বান করবেন। তাঁর ওই আহ্বান দূর হতে ও কাছ থেকে শ্রুত হবে। তিনি তাদেরকে বলবেন, “আমি মালিক, আমি-ই বিচারক।” [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: দেখুন ইমাম আহমদ (রহ:)’এর ‘মুসনাদ’; হযরত হামযা বিন ‘আমর আসলামী (রা:) বর্ণিত; হাদীস নং -১৬০৪২; ইমাম বুখারী (রহ:) কৃত ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’, ১২৮ পৃষ্ঠা; হাদীস নং - ৯৭০ (হাসান এসনাদ-সহ); আরো দেখুন গাউসুল আযম বড় পীর শায়খ আবদুল ক্বাদির জিলানী (رحمة الله عليه) প্রণীত ‘আল-গুনিয়াতুত্তালেবীন,’ ১ম খণ্ড, ১৩১ পৃষ্ঠা। ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) এই হাদীসটি সম্পর্কে বলেন: “এটা প্রমাণ করে যে আল্লাহর কণ্ঠস্বর/আওয়াজ তাঁর সৃষ্টিকুলের মতো নয়; কেননা তাঁর কণ্ঠস্বর কাছে যেমন স্পষ্ট শোনা যায়, তেমনি দূরেও শোনা যায়; আর ফেরেশতাকুল তা শ্রবণে বিমুগ্ধ হন/সম্বিৎ হারান। দেখুন ‘খালক্ব আফ’আল আল-’এবা’দ’]


কিছু কিছু হাদীসে বিবৃত হয় যে, পয়গম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম) যে রাতে (তুর পাহাড়ে) জ্বলন্ত ঝোপ দেখতে পান, তখন তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন; এমতাবস্থায় তাঁর রব্ব তাঁকে ডেকে বলেন, “ওহে মূসা!” তিনি দ্রুত উত্তর দেন এবং ওই কণ্ঠস্বর তাঁর প্রতি সদয় হন। পয়গম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম) দৃঢ়তার সাথে উত্তর দেন:


لبيك لبيك، أسمع صوتك ولا أرى مكانك، فأين أنت؟


অর্থ: “আমি আপনার খেদমতে উপস্থিত। আপনার কণ্ঠস্বর আমি শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু আপনি কোথায় অবস্থিত তা দেখতে পাচ্ছি না। আপনি কোথায়?”


আল্লাহ উত্তর দেন:


أنا فوقك وأمامك وعن يمينك وعن شمالك


অর্থ: আমি তোমার (মাথার) ওপরে, পেছনে, ডানে ও বামে। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আল্লাহতা’লা সব কিছুকে পরিবেষ্টন করেন]


পয়গম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম) তৎক্ষণাৎ অনুধাবন করেন যে, এই গুণাবলী আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্যে বিহিত নয়। অতঃপর তিনি বলেন:


كذلك أنت يا إلهي، أفكلامك أسمع، أم كلام رسولك؟ 


অর্থ: আপনি হন এমনই আমার প্রভু। (তবে) আমি কি আপনার বচন শুনতে পেয়েছি, না আপনার রাসূলের? 


আল্লাহ পাক উত্তর দেন:


بل كلامي يا موسى


অর্থ: বরঞ্চ এটা আমারই কালাম/বচন, হে মূসা।


এতে প্রমাণিত হয় যে, পয়গম্বর মূসা (عليه السلام) আল্লাহর কথা শুনতে পেয়েছিলেন।


তৃতীয় অধ্যায়


আহলুস্ সুন্নাতের দৃষ্টিতে আল্লাহতা’লার অক্ষরবিশিষ্ট বচন  


৩.১ আল-ক্বুরআন


আল্লাহতা’লার কালাম/বচন হতেই মহিমান্বিত আল-ক্বুরআন (আগত); আর এটা তাঁরই স্পষ্ট কিতাব/ঐশীগ্রন্থ, শক্তিশালী রজ্জু, সহজ-সরল পথ; এটা জগতপ্রভুর তরফ হতেই অবতীর্ণ ঐশী অনুপ্রেরণা। সত্যের আত্মা (জিবরীল আমিন) স্পষ্ট আরবী ভাষায় (প্রদত্ত) এই বাণীসহ অবতীর্ণ হন আম্বিয়াকুল শিরোমণি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে। এই ঐশীবাণী প্রকাশিত, সৃষ্ট নয় [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه) তাঁর ‘উসূলুস্ সুন্নাহ’ পুস্তিকায় বলেন: “ক্বুরআন মজীদ হচ্ছে আল্লাহতা’লার ভাষণ/বাণী, এটা সৃষ্ট নয় এবং এটা যে সৃষ্ট নয়, সে কথাটি বলার ক্ষেত্রে কারো উচিৎ নয় দুর্বলতা প্রদর্শন করা। নিশ্চয় আল্লাহর এই কালাম/বাণী তাঁর থেকে পৃথক নয় এবং এর কোনো কিছুই সৃষ্ট নয়। অতএব, সেসব লোকের যুক্তিতর্ক সম্পর্কে সতর্ক হও, যারা এ বিষয়ে নতুন কিছু প্রচলন করে (ক্বুরআনের প্রকৃতি সম্পর্কে এমন কথা বলে, যা ইতিপূর্বে কখনোই বলা হয়নি); নিশ্চয় আল্লাহতা’লার কালাম সৃষ্ট নয়।” আমি হযরত ইমামের কৃত ‘উসূলুস্ সুন্নাহ’ পুস্তিকাটিরও ভাষান্তর করেছি, যা এ বইয়ের শেষে সংযুক্ত। ইমাম আবূ বকর আজুরী (رحمة الله عليه) নিজ ‘কিতা’বুশ্ শরীয়াহ’ গ্রন্থে বলেন, মুহাম্মদ ইবনে হুসাইন (রা:) হতে বর্ণিত: “নিশ্চয় আল-ক্বুরআন আল্লাহরই বচন এবং এটা সৃষ্ট নয়। এর কারণ হলো, এটা আল্লাহর জ্ঞান হতে (আগত), আর আল্লাহর জ্ঞান সৃষ্টি করা যায় না।” হযরত ইমাম আজুরী (رحمة الله عليه) নিম্নের আয়াতটিও উদ্ধৃত করেন - قُلْ يٰأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعاً ٱلَّذِي لَهُ مُلْكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلأَرْضِ لاۤ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ يُحْيِـي وَيُمِيتُ فَآمِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِ ٱلنَّبِيِّ ٱلأُمِّيِّ ٱلَّذِي يُؤْمِنُ بِٱللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَٱتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ - হে রাসূল, আপনি বলুন: ’হে মানবকুল! আমি তোমাদের সবার প্রতি ওই আল্লাহর রাসূল যে, আসমান ও জমিনের বাদশাহী একমাত্র তাঁরই; তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই; তিনি-ই জীবিত করেন ও মৃত্যু ঘটান; সুতরাং ঈমান আনো আল্লাহ ও তাঁর উম্মী নবী ও অদৃশ্যের সংবাদদানকারী রাসূলের প্রতি (মানে আল্লাহ কর্তৃক সরাসরি শিক্ষাদানকৃত রাসূলের প্রতি), যিনি আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহের প্রতি ঈমান আনেন, এবং তাঁরই গোলামী করো, তবেই তোমরা পথ পাবে’ (আল-ক্বুরআন, ৭:১৫৮)। হযরত ইমাম আজুরী এরপর বলেন, “এটা আল-ক্বুরআন” (‘কিতা’বুশ শরীয়াহ’, ২১৪ পৃষ্ঠা)]। ক্বুরআন মজীদ আল্লাহ হতে (আগত) এবং তাঁর কাছেই হবে আমাদের প্রত্যাবর্তন [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: ইমাম মুয়াফফাক্বউদ্দীন (رحمة الله عليه)’এর এই কথাটির ভিত্তি হলো নিম্নের দলিল - وَلَيُسْرَى عَلَى كِتَابِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فِي لَيْلَةٍ فَلاَ يَبْقَى فِي الأَرْضِ مِنْهُ آيَةٌ - কিতাবুল্লাহ তথা ক্বুরআন মজীদ আল্লাহর কাছে এক রাতে প্রত্যাবর্তন করবে এবং দুনিয়ায় আর এর একটি আয়াতও অবশিষ্ট থাকবে না (ইবনে মাজাহ, ৪০৪৯)]


আল-ক্বুরআনে অন্তর্ভুক্ত আছে স্পষ্ট (মোহকামা’ত) সূরা, আয়াত, অক্ষর ও শব্দগুলো। যে ব্যক্তি শুদ্ধভাবে ক্বুরআন তেলাওয়াত করেন, তিনি প্রতিটি অক্ষরের জন্যে দশটি করে ‘হাসানা’হ’ পুরস্কার লাভ করেন। এর সূচনা হয়েছে ‘সুরাতুল ফা’তিহা’ দ্বারা, আর পরিসমাপ্তি ঘটেছে ‘সুরাতুন্ না’স’-এর মাধ্যমে। আল-ক্বুরআন বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভক্ত। এটা জিহ্বা দ্বারা তেলাওয়াতকৃত এবং অন্তরে হেফযকৃত; আর এটা কানে শ্রুত এবং দুটো মলাটের মাঝে (পুস্তকাকারে) লিপিবদ্ধ ও সংকলিত।


এতে ধারণ করা হয়েছে ‘মোহকামা’ত’‘মোতাশা’বেহাত’ আয়াত সমগ্র;


[অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আহমদ ফন ডেনফা (জার্মান পণ্ডিত) তাঁর বইয়ে ক্বুরআন মজীদের এসব সংজ্ঞা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন; তাই আমি তাঁর ওই প্রকাশনাকে ব্যাখ্যার কাজে ব্যবহার করবো। তাঁর রচিত ‘উলূমুল ক্বুরআন’ পুস্তকের ৭৯ পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন: “মোহকামা’ত (একবচনাত্মক - মোহকামা)-এর উৎপত্তি মূলশব্দ ‘উহকিমা’ হতে, যার মানে দুটো বিষয়ের মধ্যে বেছে নেয়া। এটা الإسم الفعلي তথা বহুবচনে ভাববিশেষ্য, যার অর্থ বিচারিক রায়, সিদ্ধান্ত; আর পারিভাষিকভাবে বোঝায় আল-ক্বুরআনে স্পষ্টভাবে স্থিরীকৃত সমস্ত আয়াতে করীমা, বিশেষ করে যেগুলো ঐশী বিধানগত; তবে অন্যান্য স্পষ্ট সংজ্ঞাও এতে অন্তর্ভুক্ত, যেমন - সত্য ও মিথ্যের মধ্যকার বিষয়াদি। ‘আম’ তথা সার্বিক মোহকামা’ত বলতে এটাই বোঝায়। 


‘মোতাশা’বেহাত’ (একবচনাত্মক - মোতাশাবেহা)-এর উৎপত্তি মূলশব্দ ‘ইশতাবাহা’ হতে, যার মানে ‘সন্দেহজনক হওয়া।’ এটাও বহুবচনে ভাববিশেষ্য, যার অর্থ অনিশ্চিত বা সন্দেহজনক/দ্ব্যর্থবোধক বিষয়াদি। পারিভাষিকভাবে এর মানে হলো আল-ক্বুরআনের সে সমস্ত আয়াতে করীমা, যেগুলো অস্পষ্ট অর্থবোধক বা যেগুলোর ব্যাপারে পুরোপুরি সর্বসম্মতি হয়নি, অথচ যেগুলোর দুই বা ততোধিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে।


মোহকামা’তের উদাহরণ: 


 يٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُوۤاْ إِذَا تَدَايَنتُم بِدَيْنٍ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى فَٱكْتُبُوهُ وَلْيَكْتُب بَّيْنَكُمْ كَاتِبٌ بِٱلْعَدْلِ


অর্থ: হে ঈমানদারবর্গ! যখন তোমরা একটা নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত কোনো ঋণের লেনদেন করো, তখন তা লিখে নাও এবং উচিৎ যেনো তোমাদের মধ্যে কোনো লেখক ঠিক ঠিক লিখে…(আল-ক্বুরআন, ২:২৮২)।


মোতাশা’বেহাতের উদাহরণ:


ٱلرَّحْمَـٰنُ عَلَى ٱلْعَرْشِ ٱسْتَوَىٰ


অর্থ: তিনি পরম করুণাময়, তিনি আরশের ওপর ইস্তিওয়া করেন (সমাসীন হন)..(আল-ক্বুরআন, ২০:৫)।


মোহকামা’ত ও মোতাশা’বেহাত সম্পর্কে ক্বুরআন:


ক্বুরআন মজীদ নিজের সম্পর্কে বলে যে, এতে দু ধরনের আয়াত বিদ্যমান, যার দুটোই কিতাবের মৌল উপাদান এবং এ দুটো উপাদানকেই অবশ্যঅবশ্য গ্রহণ করতে হবে, যেমনটি এরশাদ হয়েছে:


 هُوَ ٱلَّذِيۤ أَنزَلَ عَلَيْكَ ٱلْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ ٱلْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ في قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ٱبْتِغَاءَ ٱلْفِتْنَةِ وَٱبْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلاَّ ٱللَّهُ وَٱلرَّاسِخُونَ فِي ٱلْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلاَّ أُوْلُواْ ٱلأَلْبَابِ


অর্থ: তিনি-ই হন যিনি আপনার প্রতি এ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, এর কতেক আয়াত সুস্পষ্ট অর্থবোধক; সেগুলো কিতাবের মূল এবং অন্যগুলো হচ্ছে ওই সব আয়াত, যেগুলোর মধ্যে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে। ওই সব লোক, যাদের অন্তরসমূহে বক্রতা রয়েছে, তারাই ফিতনা ও ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে একাধিক অর্থের সম্ভাবনাময় আয়াতগুলোর অনুসরণ করে; এবং এর সঠিক ব্যাখ্যা আল্লাহরই জানা আছে। আর পরিপক্ক জ্ঞানসম্পন্ন লোকেরা বলে, ‘আমরা সেটার প্রতি ঈমান এনেছি; সবই আমাদের রব্বের কাছ থেকে’, এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ছাড়া কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না (আল-ক্বুরআন, ৩:৭)।


নিচে মোহকামা’ত ও মোতাশা’বেহাত সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হলো:


মোহকামা’ত:


১/ এমন বিষয় যার সম্পর্কে জ্ঞান কাঙ্ক্ষিত;

২/ এমন বিষয় যার মাত্র একটি মাত্রা/দিক;

৩/ এমন বিষয় যার মানে-মতলব যথেষ্ট, ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।


মোতাশা’বেহাত:


১/ এমন বিষয় যা কেবল আল্লাহ-ই জানেন;

২/  এমন বিষয় যার একাধিক মাত্রা আছে;

৩/ এমন বিষয় যার আরো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন।


অতঃপর হালা’ল ও হারা’ম, শাস্তি, উত্তরাধিকার, শপথ ও হুমকি ইত্যাদি বিষয়ক ক্বুরআনী আয়াতগুলো হচ্ছে মোহকামা’ত আয়াত; পক্ষান্তরে, আল্লাহর গুণাবলী, পুনরুত্থানের আসল প্রকৃতি, শেষ বিচার ও পারলৌকিক জীবন ইত্যাদি হচ্ছে মোতাশা’বেহাত আয়াত। সূত্র: আহমদ ফন ডেনফা কৃত ‘উলূমুল ক্বুরআন, ৭৯ পৃষ্ঠা]  


ক্বরআন মজীদে রয়েছে নাসিখ (রহিতকারী) ও মানসূখ (রহিতকৃত) আয়াতসমূহ;


[অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আহমদ ফন ডেনফা রহিতকারী ও রহিতকৃত আয়াতগুলো সম্পর্কে বলেন: “আরবী ‘নাসিখ’ ও ’মানসূখ’ দুটো শব্দেরই মূল শব্দ ‘নাসাখা, যার অর্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বিলোপ,’ ‘বদল,’ ‘প্রত্যাহার,’ ‘রহিত।’ ‘নাসিখ’ শব্দটি (কর্তৃকারক) বোঝায় ‘রহিতকরণ’, আর ’মানসূখ’ (কর্মবাচ্যমূলক) অর্থ ‘রহিতকৃত।’ পারিভাষিকভাবে এসব শব্দ ক্বুরআনী বিধানের এমন কিছু নির্দিষ্ট অংশকে উদ্দেশ্য করে, যেগুলোকে অন্যান্য অংশ দ্বারা রহিত করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে রহিতকৃত অংশকে বলা হয় ‘মানসূখ;’ আর রহিতকারী অংশকে ‘নাসিখ।’ ‘নাসখ তথা রহিতকরণের উসূল তথা নীতিমালা খোদ ক্বুরআন মজীদেই উদ্ধৃত হয়েছে এবং তা পরবর্তীকালে সূচিত ঐতিহাসিক কোনো ঘটনা নয়; এরশাদ হয়েছে:


 مَا نَنسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِّنْهَا أَوْ مِثْلِهَا أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ


অর্থ: যখন আমি কোনো আয়াত রহিত করে দেই কিংবা বিস্মৃত করি, তখন এর চেয়ে উত্তম কিংবা এর মতো (কোনো আয়াত) নিয়ে আসবো। তোমার কি খবর নেই যে, আল্লাহ সব কিছু করতে পারেন? (২:১৬) অনুগ্রহ করে আহমদ ফন ডেনফা’র ‘উলূমুল ক্বুরআন’ বইটির ১০২ পৃষ্ঠাও পাঠ করুন।]  


ক্বুরআন মজীদে বিদ্যমান আম (সার্বিক) ও খাস (সুনির্দিষ্ট) আয়াতসমূহ;


[অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আল-ক্বুরআনের কিছু আয়াতের সার্বিক প্রয়োগ চলে, যথা - সকল মানবের জন্যে প্রযোজ্য, কিংবা সকল মুসলিমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (আম)। অন্যান্য আয়াত স্রেফ বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রয়োগকৃত (খাস)। উদাহরণস্বরূপ:


كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَةُ ٱلْمَوْتِ


অর্থ: প্রত্যেক (প্রাণ)-কে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। (৩:১৮৫) 


“( মসজিদে এ’তেক্বাফের সময়) কোনো স্ত্রী-সহবাস, মন্দ-কর্ম বা কলহ-বিবাদ নেই।” (২:১৮৭-এর মর্মার্থ)


يُوصِيكُمُ ٱللَّهُ فِيۤ أَوْلَٰدِكُمْ 


অর্থ: আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তোমাদের সন্তানদের (উত্তরাধিকার) সম্পর্কে। (৪:১১)


অধিকন্তু, কেউ ‘আম/সার্বিক আয়াতগুলো’ ও ‘খাস/সুনির্দিষ্ট’ আয়াতগুলোর মাঝে পার্থক্যও করতে পারেন। যথা -


 وَللَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلْبَيْتِ مَنِ ٱسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً


অর্থ: এবং আল্লাহর জন্যে মানবকুলের প্রতি ওই ঘরের হজ্জ্ব করা (ফরয), যে সেটা পর্যন্ত যেতে পারে। (৩:৯৭)

 

‘খাস’ তথা সুনির্দিষ্ট অর্থের আবার কিছু রকমফের আছে, যা’তে সাধারণতঃ শর্ত বা সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ:


 وَرَبَائِبُكُمُ ٱلَّٰتِي فِي حُجُورِكُمْ مِّن نِّسَآئِكُمُ ٱلَّٰتِي دَخَلْتُمْ بِهِنَّ


অর্থ: (হারাম) তোমাদের সৎ-কন্যারা যারা তোমাদের কোলে রয়েছে - ওই সব স্ত্রী থেকে (পয়দা), যাদের সাথে তোমরা সহবাস করেছো। (৪:২৩)


كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ ٱلْمَوْتُ إِن تَرَكَ خَيْراً ٱلْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَٱلأَقْرَبِينَ


অর্থ: তোমাদের প্রতি ফরয করা হয়েছে, যখন তোমাদের মধ্যে কারো কাছে মৃত্যু উপস্থিত হয়, যদি সে কোনো ধনসম্পদ রেখে যায়, যেনো অসীয়ত/উইল করে যায় -আপন পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্যে। (২:১৮০)


 هُوَ أَذًى فَٱعْتَزِلُواْ ٱلنِّسَآءَ فِي ٱلْمَحِيضِ وَلاَ تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطْهُرْنَ 


অর্থ: (বলুন) সেটা অশুচিতা; সুতরাং (তোমরা) স্ত্রীদের কাছ থেকে পৃথক থাকো রজঃস্রাবের দিনগুলোতে এবং তাদের কাছে যেয়ো না যতোক্ষণ না পবিত্র হয়ে যায়। (২:২২২)। আহমদ ফন ডেনফা’র ‘উলূমুল ক্বুরআন’ গ্রন্থের ৮১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]


ক্বুরআন মজীদে রয়েছে আমর (আদেশ) ও নাহী (নিষেধ)। আল্লাহতা’লা ফরমান:


لاَّ يَأْتِيهِ ٱلْبَاطِلُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ


অর্থ: সেটার প্রতি মিথ্যের রাহা/পথ নেই, না সেটার অগ্র থেকে, না পশ্চাৎ থেকে; নাযিলকৃত প্রজ্ঞাময়, সমস্ত প্রশংসায় প্রশংসিতের। [আল-ক্বুরআন ৪১:৪২]


আল্লাহতা’লা আরো ফরমান: 


قُل لَّئِنِ ٱجْتَمَعَتِ ٱلإِنْسُ وَٱلْجِنُّ عَلَىٰ أَن يَأْتُواْ بِمِثْلِ هَـٰذَا ٱلْقُرْآنِ لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيراً


অর্থ: (হে রাসূল) বলুন, ‘যদি মানুষ ও জ্বিন্ সবাই এ কথার ওপর একমত হয়ে যায় যে, এ ক্বুরআনের অনুরূপ (কিছু) নিয়ে আসবে, তবে এর অনুরূপ (কিছু) আনতে পারবে না, যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়।’ [আল-ক্বুরআন, ১৭:৮৮; নূরুল এরফান]


এটা (সকল মানবজাতির প্রতি) আরবীতে (পেশকৃত) একটা ঐশী শাস্ত্রলিপি, যা’তে আল্লাহতা’লা (অবিশ্বাসীদের উদ্ধৃত করে) বলেন:


وَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لَن نُّؤْمِنَ بِهَـٰذَا ٱلْقُرْآنِ


অর্থ: এবং কাফিরবর্গ বল্লো, ‘আমরা কখনো ঈমান আনবো না এ ক্বুরআনের প্রতি।’ [আল-ক্বুরআন, ৩৪:৩১]


আল্লাহ জ্ঞাত করেন কুফফারদের কেউ কেউ বলেছিলো:


إِنْ هَـٰذَآ إِلاَّ قَوْلُ ٱلْبَشَرِ


অর্থ: ‘এটা (ক্বুরআন) তো নয়, কিন্তু মানুষের উক্তি।’ [আল-ক্বুরআন, ৭৪:২৫]


আল্লাহ পাক তাদের কুফরীর প্রত্যুত্তর দেন:


سَأُصْلِيهِ سَقَرَ


অর্থ: অবিলম্বে আমি তাকে দোযখে ছুঁড়ে ফেলবো। [আল-ক্বুরআন, ৭৪:২৬]


আল্লাহতা’লা পবিত্র ক্বুরআনকে কাব্যগ্রন্থ যারা বলেছিলো, তাদের সম্পর্কে বলেন:


 وَمَا عَلَّمْنَاهُ ٱلشِّعْرَ وَمَا يَنبَغِي لَهُ إِنْ هُوَ إِلاَّ ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُّبِينٌ


অর্থ: এবং আমি তাঁকে (রাসূলকে) কাব্য রচনা করা শেখাই নি এবং না তা শোভা পায় তাঁর মর্যাদার জন্যে। তা তো নয়, কিন্তু উপদেশ ও সুস্পষ্ট ক্বুরআন-ই। [আল-ক্বুরআন, ৩৬:৬৯]


আল্লাহতা’লা (এখানে) ক্বুরআন মজীদ যে কোনো প্রকার কাব্য নয়, সে কথা দ্বারা কাব্য হওয়ার (অমূলক) ধারণাটি নাকচ করে দিয়েছেন এবং এটাকে (তাঁরই স্পষ্ট কালামের) ক্বেরআত/পাঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি সমঝদারবৃন্দকে দৃষ্টান্ত দ্বারা এ মর্মে জানিয়েছেন যে ক্বুরআন মজীদ একটি আরবী শাস্ত্রলিপি, যার মধ্যে রয়েছে বাক্যমালা (كلمات), অক্ষরসমূহ (حروف) ও আয়াত (آيات)। অতএব, কেউই ক্বুরআন মজীদকে পদ্য আখ্যা দিতে পারে না।


আল্লাহর বাণী সম্পর্কে তিনি এরশাদ ফরমান:


 وَإِن كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُواْ بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ


অর্থ: এবং যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ হয় তাতে (মানে আল-ক্বুরআনে), যা আমি স্বীয় খাস্ বান্দার প্রতি নাযিল করেছি, তবে সেটার মতো একটা সূরা নিয়ে এসো। [আল-ক্বুরআন, ২:২৩]


আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে কারো পক্ষেই মহিমান্বিত ক্বুরআন মজীদের অনুরূপ কিছু পেশ করা সম্ভব নয়, যা তাদের সীমিত বুদ্ধির জ্ঞান বা সমঝদারি দ্বারা উপলব্ধিরও অতীত। 


আল্লাহ (سبحانه وتعالى) ঘোষণা করেন: 


 وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا بَيِّنَاتٍ قَالَ ٱلَّذِينَ لاَ يَرْجُونَ لِقَآءَنَا ٱئْتِ بِقُرْآنٍ غَيْرِ هَـٰذَآ أَوْ بَدِّلْهُ قُلْ مَا يَكُونُ لِيۤ أَنْ أُبَدِّلَهُ مِن تِلْقَآءِ نَفْسِيۤ


অর্থ: এবং যখন তাদের কাছে আমার সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ পাঠ করা হয়, তখন যারা আমার সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না, তারা বলতে থাকে, ‘এটা ছাড়া অন্য একটা ক্বুরআন নিয়ে আসুন, অথবা সেটাকে বদলে ফেলুন।’ (হে রাসূল) আপনি বলুন, ‘আমার জন্যে শোভা পায় না যে, আমি তা নিজ পক্ষ থেকে বদলে ফেলবো।’ [আল-ক্বুরআন, ১০:১৫]


অতঃপর আল্লাহতা’লা প্রমাণ করেছেন যে ক্বুরআন মজীদ আয়াত দ্বারা গঠিত - এমনই নিদর্শনসমূহ যা তাদের (মনুষ্যকুলের) প্রতি পঠিত হয়ে থাকে। 


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:


بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ وَمَا يَجْحَدُ بِآيَاتِنَآ إِلاَّ ٱلظَّالِمُونَ


অর্থ: বরং ওটা সুস্পষ্ট নিদর্শন তাদের অন্তরের মধ্যে, যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে; এবং আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে না, কিন্তু অত্যাচারীবর্গ। [আল-ক্বুরআন, ২৯:৪৯]


তিনি আরো ফরমান:


إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ ــ فِي كِتَابٍ مَّكْنُونٍ ــ لاَّ يَمَسُّهُ إِلاَّ ٱلْمُطَهَّرُونَ



অর্থ: নিশ্চয় এটা সম্মানিত ক্বুরআন; সংরক্ষিত লিপিতে। সেটাকে যেনো স্পর্শ না করে, কিন্তু অযূ-সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ। [আল-ক্বুরআন, ৫৬:৭৭-৭৯]


লক্ষ্য করুন, আল্লাহতা’লা কীভাবে এর প্রতি ক্বসম/শপথ করেছেন।


আল-মুক্বাত্তা’আত 


[অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আল-মুক্বাত্তা’আত হচ্ছে সংক্ষিপ্ত অক্ষরসমূহ, যা মুতাশা’বিহাত-এর গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ। এগুলোর অর্থ অজ্ঞাত। এই শব্দটির মূল ক্বাতা’আ, যার মানে কর্তিত বস্তু; এবং এর দ্বারা সংক্ষিপ্তও বোঝায়। পারিভাষিকভাবে আল-ক্বুরআনের বেশ কিছু সূরা‘র শুরুতে প্রাপ্ত সংক্ষিপ্ত সুনির্দিষ্ট অক্ষরসমূহের ব্যবহারে শব্দটি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। ক্বুরআন মজীদের ২৯টি সূরার প্রারম্ভে এ ধরনের ১৪টি অক্ষর বিভিন্ন সমাহারে দৃশ্যমান। নিচে সেগুলোর গঠন ও বিন্যাসের তালিকা দেয়া হলো: আলিফ লাম রা: ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৫। আলিফ লাম মিম: ২, ৩, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২। আলিফ লাম মিম রা’: ১৩। আলিফ লাম মিম সাদ: ৭। হা মিম: ৪০, ৪১, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬। সাদ: ৩৮। তা সিন: ২৭। তা সিন মিম: ২৬,২৮। তা হা: ২০। ক্বাফ: ৫০। কাফ হা এয়া ‘আইন সাদ: ১৯। নুন: ৬৮। এয়া সিন: ৩৬। বইয়ের প্রাগুক্ত ৮৩ পৃষ্ঠা দেখুন]         

  

অতঃপর আল্লাহতা’লা ফরমান:


كۤهيعۤصۤ


কা-হা-ইয়া-আইন-সোয়াদ। [সুরা মরিয়ম, আয়াত নং ১]


আল্লাহ পাক আরো ফরমান:


 حـمۤ ــ  عۤسۤقۤ


হা’-মিম-আইন-সিন-ক্বা’ফ। [সূরা শূরা’, আয়াত ১-২]


আল্লাহ পাক ২৯টি সূরাহ’তে এই সংক্ষিপ্ত অক্ষরগুলো শব্দের অগ্রে যুক্ত করেছেন। 


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ ফরমান:


من قرأ القرآن فأعربه فله بكل حرف منه عشر حسنات ، ومن قرأه ولحن فيه فله بكل حرف حسنة 


অর্থ: যে ব্যক্তি ক্বুরআন মজীদ শুদ্ধ উচ্চারণে তেলাওয়াত করে, তার জন্যে প্রতিটি অক্ষরের জন্যে দশটি হাসানাহ রয়েছে; আর যে ব্যক্তি ভুলভাবে তেলাওয়াত করে তার জন্যে প্রতিটি অক্ষরে একটি হাসানাহ রয়েছে[ইমাম আবূ ক্বুদা’মাহ (رحمة الله عليه) এই হাদীসটিকে নিজের ‘আল-মুগনী’ পুস্তকে হাসান সহীহ বলে উল্লেখ করেন]


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) আরো ফরমান:


اقرأوا القرآن قبل أن يأتي قوم يقيمون حروفه إقامة السهم لا يجاوز تراقيهم يتعجلون أجره ولا يتأجلونه


অর্থ: ক্বুরআন পাঠ করো সেসব লোকের আগমনের আগে, যারা এর অক্ষরগুলো নিখুঁতভাবে তেলাওয়াত করবে, কিন্তু এটা তাদের কণ্ঠনালির নিচে প্রবেশ করবে না। তারা এর পুরস্কার পাওয়ার জন্যে ছুটবে, কিন্তু তারা এ থেকে কিছুই লাভ করবে না। [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه) কৃত ‘মুসনাদ’, আবূ মা’লেক সাহল বিন সা’আদ আস-সা’ঈদী হতে বর্ণিত, হাদীস নং ২২৮৬৫; সুনানে আবী দাউদ, ‘কিতাবুস্ সালাহ’, হাদীস নং ৮৩১; আর এই হাদীসটি ‘হাসান’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে]


সর্ব-হযরত আবূ বকর ও উমর (رضي الله عنهما) দু জন-ই বলেন: 


إعراب القرآن أحب إلينا من حفظ بعض حروفه


অর্থ: যথাযথভাবে ক্বুরআন পাঠ করা আমাদের কাছে এর অক্ষরসমূহ মুখস্থ করার চেয়েও পছন্দনীয় বা প্রিয়।


হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন:


من كفر بحرف منه فقد كفر به كله


অর্থ: (সতর্ক হও এ মর্মে), যে ব্যক্তি ক্বুরআন মজীদের একটি অক্ষরের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে, সে এর পুরোটুকুতেই অবিশ্বাস পোষণ করে।


ক্বুরআন পাকের সূরাহ ও আয়াত এবং বাক্যমালা ও অক্ষরসমূহের ব্যাপারে মুসলমানবৃন্দ ঐকমত্য পোষণ করেন।


যে ব্যক্তি ক্বুরআন শরীফের কোনো সূরাহ, বা বাক্য, কিংবা শব্দ, অথবা অক্ষর অস্বীকার করে, তার নিশ্চিত কাফের/অবিশ্বাসী হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানদের মাঝে কোনো মতানৈক্যই নেই।


এসব অখণ্ডনীয় প্রামাণ্য দলিল হতে আমরা এ-ও দেখতে পাই যে, আল্লাহর কালাম/বাণী তথা ক্বুরআন মজীদ বিভিন্ন অক্ষরের সমষ্টি।


এই বিষয়ে অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের মন্তব্য:


ক্বুরআন মজীদ সৃষ্ট বস্তু বলে যারা দাবি করে, তাদের বিরুদ্ধে আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল-জামাআত ঐক্যবদ্ধ। আল-ক্বুরআন আল্লাহতা’লার অসৃষ্ট বাণীস্বরূপ বিরাজমান; আর যে ব্যক্তি এর বিপরীত কিছু দাবি করে, সে উলামামণ্ডলীর সর্বসম্মতি অনুসারে কুফর/অবিশ্বাস করে কাফেরে পরিণত হয়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه)’এর আসা’র/বাণীবিষয়ক মাযহাব এ মর্মে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহতা’লা বাক্য ও অক্ষরসহ কথা বলেছেন, যখন তিনি ব্যক্ত করেছেন ‘আলিফ লা’ম, মীম।’ ইমাম ইবনে ক্বুদামাহ (رحمة الله عليه) এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে ক্বুরআন মজীদ ও আসা’র হতে পর্যাপ্ত দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করেন। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহতা’লা আক্ষরিক অর্থেই কথা বলেছেন, তবে তাতে তাঁর জিহ্বা বা কণ্ঠ কিংবা স্বরযন্ত্রের প্রয়োজন হয়নি। আল্লাহতা’লা তাঁর সৃষ্টিকুলের মতো কথা বলার চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর বাণী এমন গুণ নয় যা তাঁর থেকে পৃথক, যেমনটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه) স্পষ্ট ভাষায় আপন ‘উসূলুস্ সুন্নাহ’ পুস্তকে বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহর কালাম/বাণী তাঁর থেকে পৃথক নয়।” এই বিষয়ে তর্কবিতর্ক করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। তবে এখানে গুরুত্বারোপ করা দরকার যে, সুন্নী মুসলমানদের ঈমানের মূল দাবি হলো এ কথা বলা - ক্বুরআনে করীম হচ্ছে আল্লাহর বাণী এবং এটা সৃষ্ট নয়। 


চতুর্থ অধ্যায়


পরকালে আল্লাহকে দেখা সংক্রান্ত


৪.১ ক্বুরআন হতে প্রমাণ


ঈমানদার মুসলমানবৃন্দ আখেরাত তথা পরকালে আল্লাহতা’লাকে নিজ চোখে দেখতে পাবেন এবং তাঁর সাক্ষাৎ লাভের অনুমতিও পাবেন; আর তাঁরা তাঁর সাথে কথা বলবেন এবং তিনিও তাঁদের সাথে কথা বলবেন। সৌভাগ্যবান ঈমানদার মুসলমানদের সম্পর্কে আল্লাহতা’লা তাঁর ক্বুরআন মজীদে ঘোষণা করেন: 


وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ ــ إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٌ


অর্থ: কিছু মুখমণ্ডল সেদিন তরুতাজা হবে; আপন রব্বকে দেখবে। [আল-ক্বুরআন, ৭৫:২২-২৩]


অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: 


 كَلاَّ إِنَّهُمْ عَن رَّبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوبُونَ


অর্থ: হাঁ, হাঁ, নিশ্চয় ওই দিন তারা আপন রব্বের সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত। [আল-ক্বুরআন, ৮৩:১৫]


যেহেতু আল্লাহতা’লা রাগান্বিত অবস্থায় তাদেরকে পর্দাবৃত করে তাঁর দর্শন হতে বঞ্চিত করেছেন, সেহেতু এরই বিপরীতে ঈমানদার মুসলমানবৃন্দ তাঁকে সন্তুষ্টির এক হালত-অবস্থায় দেখতে পাবেন। নতুবা এই দুটো পক্ষের মাঝে কোনো পার্থক্যই থাকছে না।


৪.২ আহাদীস হতে প্রমাণ


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ করেন: 


إنكم ترون ربكم كما ترون هذا القمر لا تضامون في رؤيته


অর্থ: অবশ্যঅবশ্য তোমরা তোমাদের প্রভু আল্লাহতা’লাকে দেখতে পাবে, যেভাবে (এই) চাঁদকে দেখতে পাচ্ছো। তাঁর দর্শন লাভে তোমাদের কোনো সমস্যাই হবে না। [সহীহ বুখারী, ২য় খণ্ড, ‘কিতা’ব মুওয়া’ক্বীব আস্ সালা’হ’, হাদীস নং ৫৭৩; সহীহ মুসলিম, ৩য় খণ্ড, ‘কিতা’ব আল-মসজিদ’, হাদীস নং ৬৩৩; সুনানে আবী দাউদ, ‘কিতা’ব আস্ সুন্নাহ’, হাদীস নং ৪৭২৯, পৃষ্ঠা ৭১৭; ‘সুনানে তিরমিযী, ‘কিতা’ব সিফাত আল-জান্নাহ,’ হাদীস নং ২৫৫৪, এবং এ হাদীসটি সহীহ শ্রেণিভুক্ত]


তুলনাটি দর্শন তথা দেখার জন্যে এবং (তা) দৃষ্টিশক্তি দ্বারা। তবে এটাকে কোনোক্রমেই দৃষ্টিশক্তি দ্বারা দর্শনের জন্যে একটি তুলনা হিসেবে বোঝা উচিৎ নয়। কেননা আল্লাহতা’লার কোনো তুলনা নেই, সাদৃশ্যও নেই। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: চাঁদকে আল্লাহর সাথে তুলনা করা যায় না]


পঞ্চম অধ্যায়


আল্লাহর ঐশী ডিক্রি ও তাক্বদীর (القضاء والقدر) 


আল্লাহতা’লার গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে তাঁর যা ইচ্ছে তা করার বিষয়টি। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কোনো কিছুই করা যায় না; আর এমন কোনো কিছুই নেই যা তাঁর ইচ্ছার বাইরে যেতে পারে। তাঁর ঐশী ডিক্রির বাইরে যেতে সক্ষম এমন কোনো কিছু সমগ্র জগতেই নেই। তাঁর নির্দেশনা ছাড়া কোনো কিছুই ঘটে না। তাঁর দ্বারা কারো জন্যে ইতোমধ্যে কৃত ঐশী ডিক্রি হতে সে ফিরতে বা সরে আসতে পারবে না।


সংরক্ষিত কিতাব তথা লিপিতে (লওহে মাহফুযে) যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তা অতিক্রম করা সম্ভব নয়। আল্লাহতা’লা নিজ সৃষ্টিকুল কী করেছে এবং কী করবে, তাদের সব ক্রিয়াই পূর্বনির্ধারিত করেছেন। তিনি যদি তাদেরকে নিষ্পাপ ডিক্রি করে থাকেন, তাহলে তারা কখনোই তাঁর বিরোধিতা করবে না; আর তিনি যদি এরাদা/ইচ্ছে করে থাকেন যে তারা সবাই তাঁরই অনুগত হবে, তাহলে তারা অবশ্যই তা হবে। তিনি-ই সমগ্র সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের কর্মকেও। তিনি তাদের রিযক্বের ব্যবস্থা করেছেন এবং হায়াত/জিন্দেগীর সময়কালও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাঁর অশেষ রহমত/করুণা দ্বারা তিনি ইচ্ছে করলে যে কাউকে হেদায়াত/সৎ পথপ্রদর্শন করতে পারেন। আর তাঁরই অফুরন্ত হেকমত/জ্ঞান-প্রজ্ঞা দ্বারা তিনি যাকে ইচ্ছে পথভ্রষ্ট করতে পারেন।


৫.১ ক্বদর/তাক্বদীর সম্পর্কে ক্বুরআনী দলিল


আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামে ঘোষণা করেন:


لاَ يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ 


অর্থ: তাঁকে প্রশ্ন করা যায় না ওই বিষয়ে, যা তিনি করেন এবং তাদের সবাইকে প্রশ্ন করা হবে। [আল-ক্বুরআন, ২১:২৩]


তিনি আরো এরশাদ ফরমান:


إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ


অর্থ: নিশ্চয় আমি প্রত্যেক বস্তুকে একটা নির্ধারিত পরিমাপে সৃষ্টি করেছি। [আল-ক্বুরআন, ৫৪:৪৯]


আল্লাহতা’লা আরো ঘোষণা করেন: 


وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيراً


অর্থ: তিনি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করে সঠিক পরিমাণে রেখেছেন। [আল-ক্বুরআন, ২৫:২]


আল্লাহতা’লা ফরমান: 


 مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي ٱلأَرْضِ وَلاَ فِيۤ أَنفُسِكُمْ إِلاَّ فِي كِتَٰبٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَآ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٌ


অর্থ: পৌঁছে না কোনো মুসীবত পৃথিবীতে এবং না তোমাদের নিজেদের প্রাণগুলোতে, কিন্তু একটা কিতাবের মধ্যে রয়েছে, এরই পূর্বে যে, সেটাকে আমি সৃষ্টি করি। [আল-ক্বুরআন, ৫৭:২২]    

        

আল্লাহতা’লা আরো ঘোষণা করেন: 


 فَمَن يُرِدِ ٱللَّهُ أَن يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلإِسْلَٰمِ وَمَن يُرِدْ أَن يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقاً حَرَجاً


অর্থ: এবং যাকে আল্লাহ সৎপথ দেখাতে চান তার বক্ষদেশকে ইসলামের জন্যে প্রশ্বস্ত করে দেন, আর যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান তার বক্ষকে সংকীর্ণ, অত্যন্ত সংকোচিত করে দেন। [আল-ক্বুরআন, ৬:১২৫]


৫.২ ক্বদর/তাক্বদীর সম্পর্কে আসার/বাণী হতে দলিল


হযরত উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে হযরত জিবরীল আমিন ফেরেশতা (عليه السلام) প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে প্রশ্ন করেন - ما الإيمان؟ - “ঈমান কী?” তিনি উত্তর দেন - قال : أن تؤمن بالله وملائكته وكتبه ورسله واليوم الآخر وبالقدر خَيره وشره - “ঈমান হচ্ছে আল্লাহতে বিশ্বাস, তাঁর ফেরেশতাকুল, ঐশীগ্রন্থাবলী, রাসূলবৃন্দ, শেষ বিচার দিবস ও তাক্বদীরের ভালো ও মন্দ পরিণতিতে বিশ্বাস।” ফেরেশ্তা জিবরীল (عليه السلام) প্রত্যুত্তরে বলেন - صدقت - “আপনি সত্য বলেছেন।” [সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, ‘কিতা’বুল ঈমান’, হাদীস নং ৫০; সহীহ মুসলিম, ‘কিতা’বুল ঈমান’, হাদীস নং ১; ইমাম নববী (رحمة الله عليه) কৃত ‘হাদীসে আরবাঈন’ (৪০টি হাদীস), ২ নং হাদীস] 


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) আরো এরশাদ ফরমান:


آمنت بالقدر خَيره وشره وحلوه ومره


অর্থ: আমি বিশ্বাস করি ক্বদর তথা তাক্বদীরে, এর ভালাই ও মন্দে, এর মিষ্ট ও তিক্ত (ফলাফলে)। [মুসলিম শরীফ]


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁর নাতি ইমাম হাসান বিন আলী (رضي الله عنه)’কে অনেক দুআ শিক্ষা দিয়েছিলেন, যিনি সেগুলোর মধ্য হতে নিম্নের দুআটি ‘বিতরের’ নামাযের ‘ক্বুনুত’ দুআ’তে সদ্ব্যবহার করেন:


وقني شر ما قضيت


অর্থ: আপনি (হে আল্লাহ) ঐশী ডিক্রি হিসেবে যা কিছু মন্দ রেখেছেন, তা হতে আমায় রক্ষা করুন। [সুনানে আবী দাউদ, ‘কিতা’বুস্ সালা’হ,’ হাদীস নং ১৪২৫; সুনানে তিরমিযী, ‘কিতা’বুস্ সালা’হ, হাদীস নং ৪৬৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, ‘কিতা’বুল ইক্বা’মাতিস্ সালা’হ,’ হাদীস নং ১১৭৮]


৫.৩ বদ কর্মের জন্যে তাক্বদীরকে অজুহাত না করা


আল্লাহতা’লার ঐশী বিচার ও ডিক্রিকে তাঁর আদেশ পরিত্যাগে এবং তাঁর নিষেধকে এড়িয়ে চলতে আমরা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করি না। বরঞ্চ আমাদের বিশ্বাস করতে হবে এ কথা জেনে যে, আল্লাহ তাঁরই ওহী (ঐশীবাণী) নাযেল করে এবং তাঁর রাসূলবৃন্দকে প্রেরণ করে আমাদের ওপর প্রমাণ আরোপ করেছেন। তিনি ক্বুরআন মজীদে ঘোষণা করেন:


 رُّسُلاً مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلاَّ يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ ٱلرُّسُلِ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزاً حَكِيماً


অর্থ: রাসূলবৃন্দকে (প্রেরণ করেছি) সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী করে, যাতে রাসূলবৃন্দের পরে আল্লাহর কাছে মানুষের কোনো অভিযোগের অবকাশ না থাকে; এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [আল-ক্বুরআন, ৪:১৬৫]


আমাদের জানা উচিৎ, আল্লাহতা’লা কোনো আদেশ পালনের বা নিষেধ পরিহারের সামর্থ্যবান ছাড়া আর কারো প্রতি সেগুলো আরোপ করেন নি। তিনি কাউকে অবাধ্যতার পথে যেতে বাধ্য করেন নি, ঠিক যেমনটি তিনি কাউকে বাধ্যতা পরিত্যাগেও বাধ্য করেন নি। তিনি এরশাদ ফরমান:


لاَ يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا


অর্থ: আল্লাহ কোনো আত্মার ওপর বোঝা অর্পণ করেন না, কিন্তু তার সাধ্য পরিমাণ। [আল-ক্বুরআন, ২:২৮৬]


আল্লাহ পাক আরো ঘোষণা করেন:


فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسْتَطَعْتُمْ


অর্থ: সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো যে পর্যন্ত সম্ভব হয়! [আল-ক্বুরআন, ৬৪:১৬]


আল্লাহতা’লা আরো ফরমান:


ٱلْيَوْمَ تُجْزَىٰ كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَـسَبَتْ لاَ ظُلْمَ ٱلْيَوْمَ إِنَّ ٱللَّهَ سَرِيعُ ٱلْحِسَابِ


অর্থ: আজ প্রত্যেক সত্তা আপন কৃতকর্মের প্রতিফল লাভ করবে। আজ কারো প্রতি জুলূম হবে না (আল্লাহ কখনোই অন্যায়কারী নন)। [আল-ক্বুরআন, ৪০:১৭]


আল্লাহ (এ আয়াতে) পরিস্ফুট করেন যে কর্মসমূহ ও এর প্রতিফল বান্দার নিজস্ব (আল্লাহকে কখনোই দোষারোপ করা যাবে না)। উত্তম কাজের জন্যে বান্দাকে আরো উত্তম প্রতিদান দেয়া হবে। তবে তার মন্দকর্মের জন্যে তাকে সমপরিমাণ শাস্তি দেয়া হবে। বিষয় যা-ই হোক না কেন, তা আল্লাহতা’লার ক্বাযা ও ক্বদর (ঐশী ডিক্রি ও নিয়তি) দ্বারা বিধান করা হবে।


ষষ্ঠ অধ্যায়


আহলুস সুন্নাহের দৃষ্টিতে ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি


৬.১ ক্বুরআন মজীদ থেকে প্রমাণ


ঈমান (প্রকৃত বিশ্বাস)‘এর অন্তর্ভুক্ত জিহ্বার সাক্ষ্যসম্বলিত একটি বিবৃতি, হাত-পা দ্বারা (তথা শারীরিকভাবে) সংঘটিত কর্ম ও অন্তর দ্বারা পোষণকৃত দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয়। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায়, আর একইভাবে অবাধ্যতা দ্বারা তা হ্রাস পায়। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এই ব্যাপারে মাযহাবের ইমামবৃন্দের মাঝে মতপার্থক্য বিদ্যমান। হানাফী মাযহাবের ইমামবৃন্দের সিদ্ধান্ত প্রণিধানযোগ্য, যা আল্লামা হুসাইন হিলমী ইশীক্ব তুর্কী (রহ:) রচিত ও আমাদের অনূদিত ’ওহাবীদের প্রতি নসীহত’ বইটিতে বিধৃত হয়েছে (২ নং অধ্যায় দ্রষ্টব্য)]


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:


وَمَآ أُمِرُوۤاْ إِلاَّ لِيَعْبُدُواْ ٱللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلاَةَ وَيُؤْتُواْ ٱلزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ ٱلقَيِّمَةِ


অর্থ: এবং ওই সব লোককে তো এ আদেশই দেয়া হয়েছে যেনো তারা আল্লাহর এবাদত করে শুধু তাঁরই প্রতি বিশ্বাস রেখে এক তরফা হয়ে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দেয়। আর এটা হচ্ছে সরল দ্বীন/প্রকৃত ধর্ম। [আল-ক্বুরআন, ৯৮:৫]


আল্লাহতা’লা তাঁর এবাদত-বন্দেগীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন অন্তরের খুলূসীয়ত/নিষ্ঠা ও সালা’ত (তথা পাঁচ ওয়াক্ত নামায) প্রতিষ্ঠা এবং যাকাত প্রদানকে, যা দ্বীনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে।


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ ফরমান:


الإيمان بضع وسبعون شعبة، أعلاها شهادة أن لا إله إلا الله، وأدناها إماطة الأذى عن الطريق .


অর্থ: ঈমানের রয়েছে সত্তরটিরও বেশি শাখা, যার সবচেয়ে উচ্চটি হচ্ছে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য মা’বূদ নেই’ মর্মে সাক্ষ্য দান; আর সবচেয়ে নিচের শাখাটি হচ্ছে (মানুষের) পথের ওপর থেকে ক্ষতিকর বস্তু অপসারণ। [সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, ‘কিতা’বুল ঈমান’, হাদীস নং ৯; সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, ‘কিতাবুল ঈমান,’ হাদীস নং ৩৫]


অতএব, মহানবী (صلى الله عليه وسلم) কথা ও আমলকে ঈমান হতে নিঃসৃত বলে নির্দেশিত করেছেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: হানাফী ফেক্বাহবিদমণ্ডলী হাম্বলী এই এজতেহাদী সিদ্ধান্তের সাথে একমত নন। ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’ গ্রন্থে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি নেই। সুন্নী উলামাবৃন্দ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه)’এর এই কথাকে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন তিনি হ্রাসবৃদ্ধি বলতে সুন্নী দৃষ্টিভঙ্গির খেলাফ কিছু বোঝান নি। দেখুন ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’ ২য় অধ্যায়]


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:


فَزَادَتْهُمْ إِيمَاناً 


অর্থ: সুতরাং ওই সব লোক যারা ঈমানদার, তাদের ঈমানকে তা উন্নতি দিয়েছে। [আল-ক্বুরআন, ৯:১২৪; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله عليه) প্রণীত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’। মুফতী সাহেবের ব্যবহৃত ‘ঈমানের উন্নতি’ শব্দচয়নটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটাই সঠিক ব্যাখ্যা]


আল্লাহতা’লা আরো ঘোষণা করেন:


 لِيَزْدَادُوۤاْ إِيمَٰناً


অর্থ: যাতে তাদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। [আল-ক্বুরআন, ৪৮:৪]


৬.২ আহাদীস হতে প্রমাণ


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বলেন:


يخرج من النار من قال لا إله إلا الله وفي قلبه مثقال برة أو خردلة أو ذرة من الإيمان


অর্থ: যে ব্যক্তি বলে, আল্লাহ ছাড়া এবাদত-বন্দেগীর যোগ্য আর কেউ নেই; আর সরিষা বীজ কিংবা এমন কী অনু পরিমাণও ঈমান অন্তরে পোষণ করে, সে অবশেষে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবে। [মুসনাদে ইমাম আহমদ, হাদীস নং ১২৭৭২; সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, ‘কিতাবুল ঈমান’, হাদীস নং ৪৪; সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, ‘কিতাবুল ঈমান’, হাদীস নং ১৯৩; সুনানে তিরমিযী, ‘কিতাবুস্ সিফাত আল-জাহান্নাম’, হাদীস নং ২৫৯৩; এটা সহীহ হাদীসের শ্রেণিভুক্ত]


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) আমাদেরকে স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে ঈমানের উঁচু ও নিচু বিভিন্ন স্তর বিদ্যমান।


সপ্তম অধ্যায়


আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে ‘গায়ব’/অদৃশ্যের প্রতি ঈমান


[অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আল-গায়ব বলতে অদৃশ্যকে উদ্দেশ্য করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি, আম্বিয়া (عليهم السلام)’মণ্ডলী অদৃশ্য জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত। তাঁরা বাকি সৃষ্টিকুল হতে অধিকতর জ্ঞানী, এমন কী ফেরেশতাকুল হতেও বেশি জ্ঞানী, যেমন - হযরত আদম (عليه السلام)’এর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, সর্বশেষ নবী (صلى الله عليه وسلم) সমগ্র সৃষ্টিকুলের মাঝে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী। তিনি কতোখানি জানেন তা নিয়ে মতভেদ করা উচিৎ নয়, কেননা এটা গায়ব-সংক্রান্ত বিষয়। আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কিতাবে ঘোষণা করেন - عَٰلِمُ ٱلْغَيْبِ فَلاَ يُظْهِرُ عَلَىٰ غَيْبِهِ أَحَداً ـ إِلاَّ مَنِ ٱرْتَضَىٰ مِن رَّسُولٍ - অর্থাৎ, “অদৃশ্যের জ্ঞাতা, সুতরাং আপন অদৃশ্যের ওপর কাউকে ক্ষমতাবান করেন না - আপন মনোনীত রাসূলবৃন্দ ব্যতিরেকে” (আল-ক্বুরআন, ৭২:২৬-২৭)। পাকিস্তানী বিচারক/জাস্টিস করম শাহ বলেন, “আমাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহতা’লা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর অন্তরকে অদৃশ্য জ্ঞান দ্বারা পরিপূর্ণ করেছেন। তবে আল্লাহর অদৃশ্য জ্ঞান আর রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর অদৃশ্য জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এটা তাঁর নিজস্ব নয়, বরং খোদাপ্রদত্ত; আর এটা (খোদার জ্ঞানের মতো) অসীম নয়। কিন্তু বাকি সৃষ্টিকুলের সামনে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর অদৃশ্য জ্ঞান এমনই এক মহাসাগর যার গভীরতা অনুসন্ধান করে জানা হয়নি; আর যার সৈকতসমূহ পর্যন্ত পৌঁছুনো সম্ভব হয়নি” (’জিয়াউল ক্বুরআন, ১ম খণ্ড, ৩০১ পৃষ্ঠা)। যারা এই বিষয়ে মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর গায়বী এলম’কে অস্বীকার করে, অথবা প্রশ্নবিদ্ধ করে, কিংবা হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে, তারা নিঃসন্দেহে (ধর্মীয়ভাবে) কপট লোক, যেমনটি পরিদৃষ্ট হয় সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, ‘কিতাবুল ইলমে হাদীস,’ ৯০ নং হাদীসে (حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ كَثِيرٍ، قَالَ أَخْبَرَنَا سُفْيَانُ، عَنِ ابْنِ أَبِي خَالِدٍ، عَنْ قَيْسِ بْنِ أَبِي حَازِمٍ، عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ الأَنْصَارِيِّ، قَالَ قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ، لاَ أَكَادُ أُدْرِكُ الصَّلاَةَ مِمَّا يُطَوِّلُ بِنَا فُلاَنٌ، فَمَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فِي مَوْعِظَةٍ أَشَدَّ غَضَبًا مِنْ يَوْمِئِذٍ فَقَالَ 

"‏ أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّكُمْ مُنَفِّرُونَ، فَمَنْ صَلَّى بِالنَّاسِ فَلْيُخَفِّفْ، فَإِنَّ فِيهِمُ الْمَرِيضَ وَالضَّعِيفَ وَذَا الْحَاجَةِ ‏"‏‏.‏

)]  


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) আমাদের যা যা জানিয়েছেন, তার সব কিছুতে ঈমান/দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা ওয়া’জিব (অবশ্য কর্তব্য)। এ কথাই বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং তাঁর দ্বারা পৌঁছুনো হয়েছে - যার (সত্যতা) আমরা প্রত্যক্ষ করেছি (আমাদের জিন্দেগীতে) এবং যা রয়েছে আমাদের কাছ থেকে অদৃশ্য। আমরা জানি, এটা সত্যি একটা বাস্তবতা ও ধ্রুব সত্য, আমরা তা বুঝি বা না-ই বুঝি, কিংবা না-ই জানি। আমরা যদি এ সম্পর্কে না-ও জানি, তবুও আমরা এর প্রকৃত অর্থ হতে বিচ্যুত হই না।


৭.১ আল-ইসরা ওয়াল-মি’রাজ (অত্যাশ্চর্য রাতের ভ্রমণ)


উপমাস্বরূপ পেশ করা যায় ‘আল-ইসরা’ ওয়াল মি’রাজ‘-সম্পর্কিত হাদীসটি। এটা সংঘটিত হয়েছিলো যখন প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ছিলেন জাগ্রত অবস্থায়, ঘুমন্ত অবস্থায় নয়। বিষয়টি এই বাস্তবতা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, ক্বুরাইশ গোত্র এটাকে অস্বীকার করেছিলো এবং বড় ধরনের মিথ্যে হিসেবে নিয়েছিলো; অথচ তারা কখনোই স্বপ্নকে অস্বীকার করেনি। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: রাত্রিকালীন ভ্রমণ বলতে বোঝায় মক্কা শরীফ হতে তাঁর অত্যাশ্চর্য ঊর্ধ্বাকাশ যাত্রা, যা দ্বারা তিনি জেরুসালেমে পৌঁছেন আর সেখান থেকে আসমানের সর্বোচ্চ শিখরে গমন করেন। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ওই স্থানে আল্লাহকে দেখেন। অধিকাংশ আলেম-উলামা একমত যে, এটা ইসলামী ক্যালেন্ডার সালের রজব মাসের ২৭ তারিখে হয়েছিলো। এই ঘটনা সম্পর্কে ক্বুরআন মজীদের আয়াত ও অসংখ্য মুতাওয়াতের (জনশ্রুত) হাদীস হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)‘কে এ ভ্রমণে নেয়া হয়েছিলো জাগ্রতাবস্থায় এবং স্বশরীরে। আলেম-উলামা এই বিষয়ে সর্বসম্মত। কাকে, কখন, কোথায়, কেন এবং কীভাবে - এসব বিষয়ে ক্বুরআন মজীদ একেবারে স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছে, যেমনটি আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:


سُبْحَانَ ٱلَّذِى أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ ٱلْمَسْجِدِ ٱلْحَرَامِ إِلَىٰ ٱلْمَسْجِدِ ٱلأَقْصَا ٱلَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَآ إِنَّهُ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلبَصِيرُ


অর্থ: পবিত্রতা তাঁরই জন্যে, যিনি আপন বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই; নিশ্চয় তিনি শুনেন, দেখেন (আল-ক্বুরআন, ১৭:১; নূরুল এরফান)। এখানে উল্লেখিত হয়েছে যে, ‘আবদ’ (বান্দা) শব্দটি ক্বুরআন মজীদে স্রেফ তখনই ব্যবহৃত হয়, যখন রূহ/আত্মা ওর শরীরের সাথে যুক্ত থাকে। দেখুন - ইমাম ইবনে জারীর তাবারী কৃত ‘জামেউল বয়ান’ ১৫:১৬-১৭; সূরাহ ৯৬, আয়াত ৯-১০ এবং সূরাহ ৭২, আয়াত ১৯। আহাদীসে দেখা যায়, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে হযরত জিবরীল (আলাইহিস্ সালাম) ঘুম থেকে জাগান এবং মসজিদে হারাম শরীফ হতে নিয়ে গিয়ে যমযম পানি দ্বারা তাঁর ‘সীনা চাক’ তথা হৃদযন্ত্র ধৌত করেন। অতঃপর একটি সাদা ঘোড়া অবতীর্ণ হয়, যার নাম ‘আল-বুরা’ক্ব; এর অর্থ ‘বিজলি।’ বুরা’ক্ব তাঁকে বিজলির বেগে জেরুসালেমে নিয়ে যায়, যেখানে মসজিদে আক্বসায় তিনি ইমাম হিসেবে সকল পয়গাম্বর (عليهم السلام)’কে সাথে নিয়ে একটি জামা’আতে নামায পড়ান। সেখান থেকে তাঁকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়, আর তার সফরসঙ্গি হন হযরত জিবরীল ফেরেশতা (আলাইহিস্ সালাম); তাঁরা প্রতিটি আসমান পার হতে থাকেন এবং সেখানে নবী-রাসূলবৃন্দের (عليهم السلام) সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে। অতঃপর ফেরেশতাদের কা’বাহ (বায়তুল মামুর)’তে তাঁকে তুলে নেয়া হয়, যেখানে তিনি তাঁদেরকে ‘তাওয়াফ’ করতে এবং বিভিন্ন ভঙ্গিতে প্রার্থনা করতে দেখেন। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘সিদরাতুল মুনতাহা’য়, ওই স্থানের পরে হযরত জিবরীল ফেরেশতা (আলাইহিস্ সালাম) আর সামনে অগ্রসর হতে পারেননি। ওই স্থানেরও ঊর্ধ্বে গমন করে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) আল্লাহর দর্শন লাভ করেন। দেখুন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর ‘উসূল-উস্-সুন্নাহ’ গ্রন্থটি, যেখানে তিনি বলেন: “নিশ্চয় মহানবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁর প্রভু খোদাতা’লাকে দেখেছিলেন, আর এটা তাঁর কাছ থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং এটা সহীহ।” তাঁকে দেখানো হয় বেহেশত ও দোযখ এবং এর সাথে সাথে ভবিষ্যত ঘটনাবলীও। মে’রাজ রজনীতে তিনি প্রাপ্ত হন শরীয়তের জ্ঞান, কীভাবে নামায-রোযা ইত্যাদি এবাদত-বন্দেগী করতে হয় তাও। তিনি আরো প্রাপ্ত হন বিশাল মাত্রার অদৃশ্য জ্ঞান। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) দুনিয়াতে ফিরে এলে তাঁর বিছানা তখনো উষ্ণ পান। পার্থিব সময় অনুযায়ী এক মুহূর্তে এই ঘটনাটি ঘটেছিলো। ক্বুরাইশ গোত্র এটা অস্বীকার করেছিলো, যেমনটি ইমাম ক্বুদা’মাহ (رحمة الله عليه) যথার্থভাবে উল্লেখ করেছেন; ক্বুরাইশ গোত্র এটা অস্বীকার করতো না যদি এটা স্বপ্নে হতো, কেননা যে কেউ স্বপ্নে ব্যাখ্যাতীত অনেক কিছু দেখতে পারেন। ক্বুরাইশদের দ্বারা এটা অস্বীকারের বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) জাগ্রতাবস্থায়ই মে’রাজ সংঘটিত হওয়ার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, স্বপ্নে নয়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي الله عنه) কোনো রকম সন্দেহ ছাড়াই তাঁকে বিশ্বাস করেন। এই কারণে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) তাঁকে ‘আল-সিদ্দীক্ব’ উপাধি দেন।]               


৭.২ পয়গম্বর মূসা (আ:) ও আযরাঈল (আ:)


গায়েবী বিষয়গুলোর আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিলো, যখন মৃত্যুদূত আযরাঈল (عليه السلام) পয়গাম্বর মূসা (عليه السلام)’এর রূহ কবজ করতে এসেছিলেন। হযরত মূসা (عليه السلام) তাঁকে ঘুষি মারলে তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এমতাবস্থায় ফেরেশতা (আ:) তাঁর রব্বের কাছে প্রত্যাবর্তন করেন এবং আল্লাহতা’লা তাঁর চোখ প্রত্যর্পণ করেন। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: ফেরেশতা পয়গাম্বর মূসা (عليه السلام)’এর কাছে মানুষের সুরতে আবির্ভূত হন। এই হাদীসটি সহীহ এবং এটা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه)’এর কৃত ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ ৮৬১৬ নং হাদীস, আর এর বর্ণনাকারী হলেন সাহাবী হযরত আবূ হোরায়রাহ (رضي الله عنه)। এই হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে সহীহ বুখারী, ৩য় খণ্ড, ‘কিতাবুল জানায়েয’ অধ্যায়েও; হাদীস নং ১৩৩৯ - حَدَّثَنَا مَحْمُودٌ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، أَخْبَرَنَا مَعْمَرٌ، عَنِ ابْنِ طَاوُسٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ ‏"‏ أُرْسِلَ مَلَكُ الْمَوْتِ إِلَى مُوسَى ـ عَلَيْهِمَا السَّلاَمُ ـ فَلَمَّا جَاءَهُ صَكَّهُ فَرَجَعَ إِلَى رَبِّهِ فَقَالَ أَرْسَلْتَنِي إِلَى عَبْدٍ لاَ يُرِيدُ الْمَوْتَ‏.‏ فَرَدَّ اللَّهُ عَلَيْهِ عَيْنَهُ وَقَالَ ارْجِعْ فَقُلْ لَهُ يَضَعُ يَدَهُ عَلَى مَتْنِ ثَوْرٍ، فَلَهُ بِكُلِّ مَا غَطَّتْ بِهِ يَدُهُ بِكُلِّ شَعْرَةٍ سَنَةٌ‏.‏ قَالَ أَىْ رَبِّ، ثُمَّ مَاذَا قَالَ ثُمَّ الْمَوْتُ‏.‏ قَالَ فَالآنَ‏.‏ فَسَأَلَ اللَّهَ أَنْ يُدْنِيَهُ مِنَ الأَرْضِ الْمُقَدَّسَةِ رَمْيَةً بِحَجَرٍ ‏"‏‏.‏ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ فَلَوْ كُنْتُ ثَمَّ لأَرَيْتُكُمْ قَبْرَهُ إِلَى جَانِبِ الطَّرِيقِ عِنْدَ الْكَثِيبِ الأَحْمَرِ ‏"‏‏ 


৭.৩ ক্বেয়ামতের আলামত  


আরেকটি নজির হচ্ছে ক্বেয়ামতের আলামত। যেমন:


(ক) দাজ্জালের আবির্ভাব [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: মসীহের মিথ্যে দাবিদার দাজ্জাল, যে পূর্বদিক থেকে আবির্ভূত হবে। আহাদীসে তার সম্পর্কে বিবরণে বলা হয়েছে, সে এক চোখবিশিষ্ট হবে এবং ‘কাফের’ (অবিশ্বাসী) শব্দটি তার কপালে লেখা থাকবে। সে গোটা দুনিয়াবাসীকে নিজের মতবাদের দিকে ডাকবে প্রথমতঃ এ কথা বলে যে তাঁদের রাজা সে-ই; অতঃপর সে নিজেকে তাঁদের পয়গাম্বর এবং সবশেষে তাঁদের খোদা দাবি করবে। তাকে আবহাওয়া পরিবর্তন, মৃতের পুনরুজ্জীবন ইত্যাদি ক্ষমতা দেয়া হবে, যা দ্বারা সে মানুষকে বিভ্রান্ত ও ভোলাতে সক্ষম হবে। সে কিছু সংখ্যক ঈমানদারের সাথে লড়াই করে তাঁদের শহীদ করবে এবং চল্লিশ দিনে দুনিয়া দখল করে নেবে। তবে সে মক্কা মোয়াযযমা বা মদীনা মোনাওয়ারায় প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না। সে সিরিয়ায় গমন করলে হযরত ঈসা (عليه السلام) আসমান থেকে নেমে এসে তাকে হত্যা করবেন। দাজ্জাল সম্পর্কে যথাযথ ও বিস্তারিত তথ্যের জন্যে পড়ুন জনাব আহমদ টমসনের ‘Dajjal: The Antichrist’ বইটি এবং ইবনে কাসীরের ইংরেজিতে অনূদিত ‘Book of the End: Great Trials and Tribulations’ গ্রন্থের ৭৭-১৩১ পৃষ্ঠা]


(খ) মরিয়ম-তনয় ঈসা (عليه السلام)’এর আসমান থেকে অবতরণ ও দাজ্জালকে হত্যা। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: পয়গাম্বর ঈসা মসীহ (عليه السلام)’কে কখনোই ক্রুশবিদ্ধ করা হয় নি, যেমনটি আল্লাহতা’লা ক্বুরআন মজীদে জানান - وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا ٱلْمَسِيحَ عِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ ٱللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَـٰكِن شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ ٱخْتَلَفُواْ فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِّنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلاَّ ٱتِّبَاعَ ٱلظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِيناً ـ بَل رَّفَعَهُ ٱللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزاً حَكِيماً - এবং তাদের এ উক্তির কারণে, ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মরিয়ম-তনয় ঈসা মসীহকে শহীদ করেছি’ আর প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এটাই যে, তাঁরা তাঁকে না হত্যা করেছে এবং না তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে; বরং তাদের জন্যে তাঁরই সদৃশ একটা তৈরি করে দেয়া হয়েছে; এবং ওই সব লোক, যারা তাঁর সম্পর্কে মতভেদ করছে, নিশ্চয় তারা তাঁর ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে পড়ে রয়েছে; তাদের এ সম্পর্কে কোনো খবরই নেই, কিন্তু এ ধারণারই অনুসরণ মাত্র; এবং নিঃসন্দেহে তারা তাঁকে হত্যা করে নি; বরং আল্লাহ তাঁকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় (আল-ক্বুরআন, ৪:১৫৭-১৫৮)। এ সব আয়াতে পরিস্ফুট হয় যে, আল্লাহ তাঁকে শত্রুদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং তাঁরই সদৃশ অন্য কাউকে তাঁরই স্থলে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিলো। ক্বুরআনের তাফসীরবিদমণ্ডলীর মাঝে ওই ক্রুশবিদ্ধ ব্যক্তি সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে; কেউ কেউ বলেছেন সে এয়াহুদা (জুডাস্); কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেছেন সে রোমান বাহিনীর কোনো সৈনিক; আবার কারো কারো মতে ওই ব্যক্তি ঈসা (عليه السلام)’এরই কোনো শিষ্য, যিনি স্বেচ্ছায় এ পরিণতি বরণ করেন। তবে আল্লাহতা’লা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, হযরত ঈসা (عليه السلام) শহীদ হন নি, ক্রুশবিদ্ধও হন নি। অতএব, তিনি আসমানে অবস্থান করছেন এবং দুনিয়াতে ফিরবেন দাজ্জালকে হত্যার জন্যে; তিনি পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন, বিয়ে-শাদী করবেন এবং তাঁর সন্তানাদিও হবে। তিরমিযী শরীফে লিপিবদ্ধ একটি হাদীসে বিবৃত হয়, তাঁকে মদীনায় অবস্থিত প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর রওয়া শরীফের পাশে সমাহিত করা হবে। এতে এই বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, তিনি এই উম্মতে মুহাম্মদী (صلى الله عليه وسلم)’এরই একজন। আল্লাহতা’লা আরো বলেন - وَإِن مِّنْ أَهْلِ ٱلْكِتَابِ إِلاَّ لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ - কোনো কিতাবী (ইহুদী ও খৃষ্টান) এমন নেই, যে তার (নিজের) মৃত্যুর পূর্বে তার (ঈসার) প্রতি ঈমান আনবে না (আল-ক্বুরআন, ৪:১৫৯]। অতএব, হযরত ঈসা (عليه السلام) ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের বিলোপ সাধন করবেন এবং স্রেফ দ্বীন-ইসলাম অবশিষ্ট থাকবে। এই বিষয়ে আরো জানতে পড়ুন - ইবনে কাসীর প্রণীত ‘Book of the End: Great Trials and Tribulations’ ইংরেজি সংস্করণ, ১৪২-১৭৮ পৃষ্ঠা]        


(গ) এয়া’জূজ ও মা’জূজের আবির্ভাব। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: একটি গোত্র (ইতিপূর্বে) দুনিয়াতে ভীষণ ফিতনা সৃষ্টি করেছিলো। হযরত যুলক্বারনাইন (عليه السلام) তাদেরকে টোপ দিয়ে দুটো পাহাড়ের মাঝখানে নিতে পেরেছিলেন এবং তিনি লোহা ও গলিত তামার সংমিশ্রণে একটি বিশালাকৃতির দেয়াল নির্মাণ করেছিলেন, যার দরুন তারা সেখানে আটকা পড়ে গিয়েছে - যতোদিন আল্লাহ তাদেরকে সেখানে আটকে রাখার ডিক্রি/বিধান করেছেন। হযরত ঈসা (عليه السلام) দাজ্জালকে হত্যার পর তারা সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হবে এবং অনেক আরবীয় মানুষকে হত্যা করবে; আর দুনিয়ার বুকে (আবারো) বড় ধরনের ফিতনা সৃষ্টি করবে - যতোক্ষণ না হযরত ঈসা (عليه السلام) তাদের বিরুদ্ধে দুআ করবেন। অতঃপর আল্লাহ তাদের মধ্যে এমন এক প্লেগ মহামারি দেবেন যা তাদেরকে এক রাতেই ধ্বংস করে দেবে। এ ঘটনার পরে তাদের মরদেহ প্রাণিকুল ভক্ষণ করবে। তাদের সম্পর্কে আল-ক্বুরআনে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। দেখুন - সূরা কাহাফ ১৮:৮৫-৯৯ আয়াত। তবে তাদের বর্ণনা অসংখ্য হাদীসে এসেছে, সংখ্যাধিক্যের কারণে যা উদ্ধৃত করা দুষ্কর। বিস্তারিত জানতে দেখুন ইবনে কাসীরের ‘Book of the End: Great Trials and Tribulations’ ইংরেজি সংস্করণ, ১৫২-১৬০ পৃষ্ঠা] 


(ঘ) ‘দা’ব্বাত’-এর আবির্ভাব। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: দা’ব্বাত তথা জন্তুটির কথা সূরা নমল (২৭), ৮২ নং আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। এই প্রাণি দুনিয়ার শেষ সময়ে আগমন করবে এবং মানুষের সাথে আলাপের সময় তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করবে। কিন্তু আহাদীসে এই প্রাণি সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয় নি] 


(ঙ) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় হবে। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: হযরত আবূ হোরায়রাহ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহানবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ ফরমান - حَدَّثَنِي إِسْحَاقُ، أَخْبَرَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، أَخْبَرَنَا مَعْمَرٌ، عَنْ هَمَّامٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا، فَإِذَا طَلَعَتْ وَرَآهَا النَّاسُ آمَنُوا أَجْمَعُونَ، وَذَلِكَ حِينَ لاَ يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا» ثُمَّ قَرَأَ الآيَةَ - “প্রলয় ততোক্ষণ আসবে না, যতোক্ষণ পর্যন্ত না সূর্য পশ্চিম দিক হতে উদিত হবে। লোকেরা যখন তা দেখবে, তখন তারা বিশ্বাস করবে (ঈমান আনবে); কিন্তু ওই বিশ্বাস আর তখন তাদের কোনো উপকারে আসবে না।” এটা তিনি সূরা আনআমের ১৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন। দেখুন - সহীহ বুখারী, কিতা’বুত্ তাফসীর, হাদীস নং ৪৬৩৬; সহীহ মুসলিম, কিতা’বুল ঈমান, ১৫৭]


এ ছাড়াও রয়েছে বিশুদ্ধ আহাদীসে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়াদি।


৭.৪ ক্ববরের সুখ-শান্তি ও শাস্তি


ক্ববরের শাস্তি ও সুখ-শান্তি এক বাস্তবতা! [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه) বলেন, “কেউই ক্ববরের আযাব/শাস্তিকে অস্বীকার করেন না কেবল গোমরাহ/পথভ্রষ্ট ব্যক্তি ছাড়া, যে অন্যদেরকেও বিচ্যুত করে থাকে” (সা’লিহ বিন আহমদ - رحمة الله عليه - হতে বর্ণিত, ‘তাবাক্বা’তুল হানা’বিলাহ’, ১:৬২, ১:১৭৪)। আমরা দেখতে পাই যে যারা ক্ববরের আযাব অস্বীকার করে, তারা এতদসংক্রান্ত হাদীসগুলো মুতাওয়া’তির/সর্বজনশ্রুত নয় বলে দাবি করে থাকে। তবে ক্ববরের শাস্তি সম্পর্কে আল-ক্বুরআনে প্রায় সাত বার উল্লেখ করা হয়েছে; যথা - সূরা আনআম ৬:৯০-৯৩; সূরা তওবা ৯:৯৯-১০১; সূরা সাজদাহ ৩২:২১; সূরা সূরা গা’ফির ৪০:৪০-৪৬; সূরা তূর ৫২: ৪২-৪৮; সূরা ওয়া’ক্বিআহ ৫৬:৮৩-৯৫; এবং সূরা তাকা’সুর ১০২:১-৪। ক্বুরআন মজীদ যেহেতু মুতাওয়া’তির, সেহেতু ক্ববরের শাস্তিসম্পর্কিত তথ্যও তাই; হাদীসের রেফারেন্স ছাড়াই এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত। আহলুস্ সুন্নাতে ওয়াল জামা’আত এই বিষয়ে একমত; অতএব, যে ব্যক্তি ক্ববর আযাব অস্বীকার করবে সে ক্বুরআনী দলিল প্রত্যাখ্যানকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে]


বস্তুতঃ প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ক্ববরের শাস্তি হতে পানাহ চেয়েছিলেন। তিনি আমাদেরকে প্রতিটি সালা’ত তথা নামাযে এ থেকে আশ্রয় চাইতে আদেশ করেছিলেন। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: যদিও মহানবী - صلى الله عليه وسلم - পাপ, দোযখের আগুন ও ক্ববরের শাস্তি হতে আশ্রয় চেয়েছিলেন, তবুও এটা তাঁর একটা শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। আহলুস্ সুন্নাত ওয়া জামাআতের আক্বীদাহ-বিশ্বাস হলো, আম্বিয়া (عليهم السلام) নিষ্পাপ ও ভুল-ভ্রান্তি হতে মুক্ত। সুন্নী মুসলমান সম্প্রদায় বিশ্বাস করেন পয়গাম্বর-বৃন্দ (عليهم السلام) ও ঐশীবাণী খোদায়ীভাবে হেফাযত-প্রাপ্ত; আর আম্বিয়া (عليهم السلام)’মণ্ডলী ছোট-বড় সকল গুনাহ হতে মুক্ত। ক্বুরআন মজীদ বা আসা’র/আহাদীসে যখনই বাহ্যতঃ তাঁদের কোনো বৈপরীত্য দেখা যায়, (তৎক্ষণাৎ বুঝতে হবে) সেটা আল্লাহতা’লার এরাদা/চূড়ান্ত ইচ্ছা এবং আমাদেরকে শরীয়ত প্রদর্শনে খোদায়ী হেকমত বা প্রজ্ঞা]  


ক্ববরের পরীক্ষা ও শাস্তির বিষয়টি সত্য! মুনকা‘র ও না’কির ফেরেশতা দু জনের প্রশ্নোত্তর নেয়াও সত্য! [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: দু জন ফেরেশতা মৃতদেরকে ক্ববরে দাফনের পরে তিনটি প্রশ্ন করবেন: ১/ তোমার রব্ব/প্রভু কে? ২/ তোমার দ্বীন/ধর্ম কী? এবং ৩/ তোমার নবী (দ:) কে? প্রকৃত ঈমানদার-ব্যক্তি সহজে এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে সক্ষম হবেন; কিন্তু মোনাফেক্ব/যিনদিক্ব ও কুফফার-বর্গ বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের কারণে ভুল উত্তর দেবে]


আর মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের ব্যাপারটিও সত্য! - وذلك حين ينفخ إسرافيل عليه السلام في الصور - আর যখন ইসরাফীল (عليهم السلام) ‘সূর’ (শিঙ্গা)’তে ফুঁ দেবেন, সেই সময় সম্পর্কে আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:


 وَنُفِخَ فِي ٱلصُّورِ فَإِذَا هُم مِّنَ ٱلأَجْدَاثِ إِلَىٰ رَبِّهِمْ يَنسِلُونَ 


অর্থ: এবং ফুৎকার দেয়া হবে শিঙ্গায়, তখনই তারা ক্ববরগুলো থেকে আপন রব্বের প্রতি ছুটে আসবে। [সূরা এয়াসীন, ৫১ আয়াত]


শেষ বিচার দিবসে মনুষ্যজাতিকে খালি পা, বিবস্ত্র, খতনা-বিহীন ও সহায়-সম্পদহীন অবস্থায় সমবেত করা হবে। তাঁরা ওই সমাবেশ স্থানে অপেক্ষারত থাকবেন যতোক্ষণ না আমাদের হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) তাঁদের জন্যে শাফাআত/সুপারিশ করবেন। আল্লাহতা’লা তাঁদের হিসেব নেবেন এবং মীযান তথা পাল্লা উঁচু করা হবে। মানুষের কৃত আমল/কর্মগুলো যে আমলনামা/কর্মলিপিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো, সেগুলো তাঁদের কর্ম অনুসারে তাঁদেরই ডান হাত বা বাম হাতে প্রদান করা হবে। আল্লাহতা’লা আল-ক্বুরআনে বলেন:


فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَـٰبَهُ بِيَمِينِهِ ـ فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَاباً يَسِيراً ـ وَيَنقَلِبُ إِلَىٰ أَهْلِهِ مَسْرُوراً ـ وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَٰبَهُ وَرَآءَ ظَهْرِهِ ـ فَسَوْفَ يَدْعُواْ ثُبُوراً ـ وَيَصْلَىٰ سَعِيراً ـ 


অর্থ: অতঃপর ওই ব্যক্তি, যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, অতিসত্বর তার থেকে সহজ হিসাব গ্রহণ করা হবে। এবং আপন পরিবার-পরিজনের প্রতি আনন্দিত অবস্থায় ফিরবে। এবং ওই ব্যক্তি, যার কর্মলিপি তার পিঠের পেছন দিকে দেয়া হবে; ওই ব্যক্তি অচিরেই মৃত্যু প্রার্থনা করবে; এবং প্রজ্জ্বলিত আগুনে প্রবেশ করবে। [সূরা ইনশিক্বা’ক্ব, ৭-১২ আয়াত]


৭.৫ মীযান


الميزان له كفتان ولسان توزن به الأعمال


আর মীযানের রয়েছে দুটো পাল্লা ও একটি জিহ্বা, যা দ্বারা সমস্ত আমল/কর্মের ওজন করা হবে। আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: 


 فَمَن ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُوْلَـٰئِكَ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ ـ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فأُوْلَـٰئِكَ ٱلَّذِينَ خَسِرُوۤاْ أَنفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ


অর্থ: সুতরাং যাদের পাল্লা ভারী হবে (সৎকর্মে), তারাই সফলকাম হবে। এবং যাদের পাল্লা হাল্কা হবে, তারাই ওই সব লোক যারা আপন প্রাণসমূহকে ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে, সর্বদা দোযখেই অবস্থান করবে। [আল-ক্বুরআন, ২৩:১০২-১০৩]


৭.৬ আল-হাউজ  


পুনরুত্থান দিবসে আমাদের প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর অধিকারে থাকবে আল-হাউজ (নামের একখানি হ্রদ)। এর পানি হবে দুধ হতেও সাদা এবং মধু হতেও মিষ্টি। এর পান-পাত্রের সংখ্যা হবে আকাশের তারকার মতোই অগণিত। যে কেউ এর পানি পান করলে আর কখনোই তৃষ্ণার্ত হবেন না।


৭.৭ পুল-সিরা’ত  

  

সিরা’ত তথা (জাহান্নামের ওপরে) সেতু একটি বাস্তবতা। আবরার তথা পুণ্যবান ব্যক্তিবৃন্দ সেটার ওপর দিয়ে পার হয়ে যাবেন; কিন্তু ফাজির তথা মন্দ লোকেরা তা হতে (জাহান্নামে) পতিত হবে। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: দোযখের ওপরে অবস্থিত এই সেতুটি দিয়ে সবাইকে চেষ্টা করে পার হতে হবে। আল্লাহতা’লা সূরা মরিয়ম ১৯:৭১ আয়াতে এই সেতুটি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। এটাকে ‘একটি চুলের চেয়েও চিকন ও তরবারির চেয়েও ধারালো’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে] 


৭.৮ প্রিয়নবী (দ:)’র শাফাআত/সুপারিশ


আমাদের রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) তাঁর উম্মতের সে সব মুসলমানদের জন্যে শাফাআত করবেন, যারা কবীরাহ তথা বড় বড় গুনাহ সংঘটনের দায়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। ওই নির্দিষ্ট লোকেরা দোযখের আগুনে ভস্মিভূত ও অঙ্গার হবার পরই শাফাআত-প্রাপ্ত হবে। মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সুপারিশ দ্বারা অবশেষে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। অন্যান্য পয়গাম্বর (عليهم السلام), ঈমানদারবৃন্দ ও ফেরেশতামণ্ডলী-ও অন্যদের জন্যে সুপারিশ করবেন। তবে আল্লাহ বলেন:


وَلاَ يَشْفَعُونَ إِلاَّ لِمَنِ ٱرْتَضَىٰ وَهُمْ مِّنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ


অর্থ: আর তারা সুপারিশ করে না, কিন্তু তারই পক্ষে যাকে তিনি (আল্লাহ) পছন্দ করেন এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। [আল-ক্বুরআন, ২১:২৮]


সুপারিশকারীদের সুপারিশ দ্বারা কুফফারবর্গ উপকৃত হবে না।


৭.৯ বেহেশত ও দোযখ   


বেহেশ্ত ও দোযখ আল্লাহতা’লারই এমন দুটো সৃষ্টি যা কখনোই বিলীন হবে না। বেহেশ্ত তাঁরই বন্ধু (আউলিয়া)’দের বাসস্থান; আর জাহান্নামের আগুন তাঁর শত্রুদের চিরস্থায়ী আবাস। বেহেশ্তবাসী চিরকাল তাতে বসবাস করবেন; তবে আল্লাহতা’লা মুজরিমীন তথা বদকার লোকদের সম্পর্কে ঘোষণা করেন:


إِنَّ ٱلْمُجْرِمِينَ فِي عَذَابِ جَهَنَّمَ خَالِدُونَ ـ لاَ يُفَتَّرُ عَنْهُمْ وَهُمْ فِيهِ مُبْلِسُونَ


অর্থ: নিশ্চয় অপরাধী জাহান্নামের শাস্তিতে স্থায়ীভাবে থাকবে। তা তাদের ওপর থেকে কখনো হ্রাস করা হবে না এবং তারা তাতে হতাশ হয়ে থাকবে। [আল-ক্বুরআন, ৪৩:৭৪-৭৫]


মওত তথা মৃত্যুকে একটি সুন্দর মেষশাবকের সুরতে আনা হবে; অতঃপর সেটাকে বেহেশ্ত ও দোযখের মাঝখানে জবাই করা হবে। এরপর বলা হবে: 


يا أهل الجنة خلود ولا موت ويا أهل النار خلود ولا موت 


অর্থ: হে জান্নাতবাসী মানুষ, এতে মৃত্যুহীন হয়ে বেঁচে থাকো; আর ওহে জাহান্নামবাসী লোকেরা, এতে মৃত্যুহীন হয়ে বেঁচে থাকো। [ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمة الله عليه) কৃত ‘মুসনাদ’; হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; হাদীস নং ১১০৬৬]


অষ্টম অধ্যায়


আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে মহানবী (দ:) ও তাঁর সাহাবাবৃন্দের (রা:) অধিকার


৮.১ প্রিয়নবী (দ:)’র মক্বাম/উচ্চমর্যাদা


হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) হলেন আল্লাহর পয়গাম্বর ও খাতেমুন্নাবিয়ীন। অর্থাৎ, তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না; তিনিই সবশেষ পয়গাম্বর! সমস্ত নবী-রাসূলের সৈয়দ/প্রধান তিনি। আল্লাহতা’লার এবাদত-বন্দেগীকারীর ঈমান/আক্বীদা-বিশ্বাস ততোক্ষণ সহীহ বা শুদ্ধ তথা পরিপূর্ণ হবে না, যতোক্ষণ না সে তাঁর রেসালাতে বিশ্বাস করবে। পুনরুত্থান দিবসে তাঁর সুপারিশ ছাড়া মনুষ্যজাতির বিচার করা হবে না; আর তাঁর উম্মতের আগে কোনো উম্মত-ই বেহেশ্তে প্রবেশ করতে পারবেন না। তিনি - صاحب لواء الحمد والمقام المحمود والحوض المورود - খোদাতা’লার প্রশংসার পতাকা বহনকারী, মাক্বামে মাহমূদের ও আল-হাউজের অধিকারী [পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আল-হাউজ আলোচিত হয়েছে]। তিনি আম্বিয়াকুলের (عليهم السلام) ইমাম ও তাঁদের সর্বপ্রথম বক্তা ও তাঁদের (সবার আগে/ওপরে) শাফাআত করার মর্য়াদার অধিকারী।


৮.২ সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দ ও তাঁদের মাহাত্ম্য


রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)‘এর উম্মত হচ্ছে অন্যান্য সকল উম্মতের চেয়ে সেরা (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ)। তাঁর আসহাবে কেরাম (رضي الله عنهم)-ও অন্যান্য সকল পয়গাম্বর (عليهم السلام)’এর সাহাবাবৃন্দের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। তাঁর সাহাবা (رضي الله عنهم)’এর মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي الله عنه); এরপর হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه); এরপর হযরত উসমান যিন্নূরাইন (رضي الله عنه); এরপর হযরত আলী মুরতাজা (رضي الله عنه) - আল্লাহতা’লা তাঁদের সবার প্রতি রাজি আছেন। আমরা এটা জানি, কেননা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: 


روى عبد الله بن عمر رضي الله عنهما قال:  كنا نقول والنبي صلى الله عليه وسلم حي: أفضل هذه الأمة بعد نبيها أبو بكر ثم عمر ثم عثمان ثم علي فيبلغ ذلك النبي صلى الله عليه وسلم فلا ينكره . 


আমরা এ কথা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর (যাহেরী) হায়াতে জিন্দেগীতে বলতাম: “প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর পরে এই উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন হয়রত আবূ বকর (رضي الله عنه); এরপর হয়রত উমর (رضي الله عنه); এরপর হযরত উসমান (رضي الله عنه); এরপর হযরত আলী (رضي الله عنه)।” রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) কখনোই এ কথাকে নিষেধ করেননি। [আল-বুখারী (رحمة الله عليه) কৃত ‘মানা’ক্বিব, ৩৪৬৮; সুনানে আবী দাউদ (رحمة الله عليه), কিতা’বুস্ সুন্নাহ, ৪৬২৭, ৪৬২৮, ৪৬২৯; ইবনে মাজাহ (عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي عضوا عليها بالنواجذ), ‘মোক্বাদ্দমা’, ১০৬; সুনানে তিরমিযী (رحمة الله عليه), ‘মানা’ক্বিব’, ৩৭০৭ এবং ইমাম আহমদ (رحمة الله عليه), ১:১১৪; ইমাম তিরমিযী (رحمة الله عليه) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন]


হযরত আলী (رضي الله عنه) হতে সহীহ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেন:


" خير هذه الأمة بعد نبيها أبو بكر ثم عمر ولو شئت سميت الثالث ". 


অর্থ: প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর পরে এই উম্মতের মাঝে সেরা হলেন হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه); অতঃপর সেরা হলেন হযরত উমর (رضي الله عنه); আর আমি যদি চাইতাম, তবে তৃতীয় জনের (নাম) উল্লেখ করতাম।


ইমাম আবূ দারদা (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেন নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) হতে, যিনি বলেন: 


ما طلعت الشمس ولا غربت بعد النبيين والمرسلين على أفضل من أبي بكر .


অর্থ: আম্বিয়া ও রাসূলবৃন্দ (عليهم السلام)’এর পরে সূর্য আর কারো প্রতি এমনভাবে উদয় হয়নি এবং অস্তও যায়নি, যেমনটি হয়েছে শ্রেষ্ঠত্বসম্পন্ন আবূ বকরের ওপর। 


 আল্লাহতা’লার সৃষ্টি মাঝে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর পরে হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)-ই খেলাফত পাওয়ার হক্বদার; এটা তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব ও অগ্রগণ্য হওয়ার বা প্রাধান্যের কারণে। আর এটা পরিলক্ষিত হয়েছে এই বাস্তবতার আলোকে যে, রাসূল (صلى الله عليه وسلم) তাঁকে সকল সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم)’এর আদায়কৃত নামাযে ইমামতি করার জন্যে সামনে দিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্ব ও তাঁর প্রতি আনুগত্যের পক্ষে সাহাবা-মণ্ডলী (رضي الله عنهم)’এর ইজমা’ তথা সর্বসম্মতি বিদ্যমান। আর নিশ্চয় আল্লাহতা’লা তাঁদেরকে কখনোই পথভ্রষ্টতার ওপর একমত হতে দেন নি। [একটি হাদীসে এসেছে: আমার উম্মত গোমরাহীর ওপর একমত হবে না - "لا تجتمع أمتي على ضلالة"]


হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي الله عنه)’এর পরে সবচেয়ে যোগ্য হলেন হয়রত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه), তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব ও হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)’এর প্রতি আপন অঙ্গীকারের কারণে; অতঃপর হলেন হযরত উসমান (رضي الله عنه), শুওয়ারা (ইসলামী রাষ্ট্রের পরামর্শক-সভা) কর্তৃক তাঁকে অগ্রগণ্য বিবেচনার কারণে; অতঃপর হলেন হযরত আলী (رضي الله عنه), তাঁরই শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে মানুষের ঐকমত্যের কারণে। এঁরাই হলেন সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দ, যাঁদেরকে অনুসরণ করার জন্যে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন: 


عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي عضوا عليها بالنواجذ.


অর্থ: আমার সুন্নাহ (রীতিনীতি) ও আমার পরে আগত সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দের সুন্নাহ অনুসরণ করা তোমাদের জন্যে অবশ্যকর্তব্য; তাঁদেরকে তোমরা নিজেদের পেষণদন্ত দ্বারা আঁকড়ে ধরো। [ইমাম আহমদ (رحمة الله عليه) কৃত ‘মুসনাদ’, হযরত ‘এরবা’য ইবনে সা’রিয়াহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, হাদীস নং ১৭১৪৫; সুনানে আবী দাউদ (رحمة الله عليه), ‘কিতাবুস্ সুন্নাহ’, হাদীস নং ৪৬০৭; ইমাম নববী (رحمة الله عليه) রচিত ‘চল্লিশটি হাদীসের সংকলন’, হাদীস নং ২৮; এটা সহীহ শ্রেণিভুক্ত]


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ ফরমান:


الخلافة من بعدي ثلاثون سنة.


অর্থ: আমার পরে খেলাফত (শাসনকাল) স্থায়ী হবে ত্রিশ বছর। [মুসনাদে ইমাম আহমদ (رحمة الله عليه), হযরত সাফিনা আবী আবদির রহমান (রা:) বর্ণিত, হাদীস নং ২১৯১৯; সুনানে আবী দাউদ (رحمة الله عليه), ‘কিতাবুস্ সুন্নাহ’, হাদীস নং ৪৬৪৬ ও ৪৬৪৭; সুনানে তিরমিযী (رحمة الله عليه), ’কিতাবুল ফিতান’, ২২২৬; এই হাদীসটি হাসান শ্রেণিভুক্ত]


(হাদীসে উল্লেখিত) খেলাফতটি হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর শাসনকাল দ্বারা শেষ হয়েছিলো। 


৮.৩ সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন বেহেশতী সাহাবী (রা:)


আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, দশজন সাহাবা (رضي الله عنهم)’কে বেহেশত-প্রাপ্তির সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছিলো। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁদের সম্পর্কে ঘোষণা করেন: 


"‏ أَبُو بَكْرٍ فِي الْجَنَّةِ وَعُمَرُ فِي الْجَنَّةِ وَعُثْمَانُ فِي الْجَنَّةِ وَعَلِيٌّ فِي الْجَنَّةِ وَطَلْحَةُ فِي الْجَنَّةِ وَالزُّبَيْرُ فِي الْجَنَّةِ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عَوْفٍ فِي الْجَنَّةِ وَسَعْدٌ فِي الْجَنَّةِ وَسَعِيدٌ فِي الْجَنَّةِ وَأَبُو عُبَيْدَةَ بْنُ الْجَرَّاحِ فِي الْجَنَّةِ ‏"‏ ‏.‏


অর্থ: আবূ বকর জান্নাতী, উমর জান্নাতী, উসমান জান্নাতী, আলী জান্নাতী, তালহাহ জান্নাতী, যুবায়র জান্নাতী, আবদুর রহমান বিন আউফ জান্নাতী, সা’আদ জান্নাতী, সাঈদ জান্নাতী এবং আবূ উবায়দাহ বিন জারা’হ জান্নাতী। [মুসনাদে আহমদ বিন হাম্বল (رحمة الله عليه), হযরত সাঈদ বিন যায়দ বিন আমর বিন নুফায়েল (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, হাদীস নং ১৬৭৫; সুনানে তিরমিযী (رحمة الله عليه), ‘কিতা’বুল মানা’ক্বিব’, হাদীস নং ৩৭৪৭ (আমরা শেষোক্ত রেফারেন্সটি ব্যবহার করেছি - বঙ্গানুবাদক]


প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) অন্যান্য যাঁদের সম্পর্কে বেহেশতের সুসংবাদ দিয়েছেন, আমরা তাঁর সেই বাণীর প্রতিও সাক্ষ্য প্রদান করছি [বঙ্গানুবাদকের নোট: ড: জি, এফ, হাদ্দাদের লেখা ও আমার অনূদিত ‘মহানবী (দ:)’এর অদৃশ্য জ্ঞান’ শীর্ষক বইয়ে ওই সৌভাগ্যবান সাহাবা (রা:)’বৃন্দের পুরো তালিকা প্রদান করা হয়েছে]। 


রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ ফরমান: 


الحسن والحسين سيدا شباب أهل الجنة.


অর্থ: (সর্ব-ইমাম) হাসান ও হুসাইন হচ্ছে বেহেশতবাসী যুবকদের দুই সরদার/প্রধান। [মুসনাদে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمة الله عليه), হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; হাদীস নং ১০৯৯৯]


নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) হযরত সা’বিত বিন ক্বায়স (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেন:


 إنه من أهل الجنة.


অর্থ: নিশ্চয় সে জান্নাতবাসীদের মধ্য হতে (একজন)। [মুসনাদে ইমাম আহমদ (رحمة الله عليه), ১২৪৮০; সহীহ বুখারী (رحمة الله عليه), ৬ষ্ঠ খণ্ড, ‘কিতা’বুল মানা’ক্বিব’, হাদীস ৩৬১৩; সহীহ মুসলিম (رحمة الله عليه), ১ম খণ্ড, ‘কিতা’বুল ঈমান’, হাদীস ১১৯]


আমরা আহলে ক্বিবলা (মুসলমান)’দের মধ্যে এ ছাড়া আর কাউকে বেহেশতী বা দোযখী বিবেচনা করি না (যেহেতু বিষয়টি অজ্ঞাত) [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: আমরা এটা জানি যে, কেউ হয়তো বেশির ভাগ জীবন ঈমানদার হিসেবে কাটানোর পর শেষ মুহূর্তে বে-ঈমান হয়ে যেতে পারে এবং আল্লাহকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যেতে পারে। এটা পরিদৃষ্ট হয় মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর হাদীসে, যেখানে তিনি বলেন: “আল্লাহর ক্বসম...তোমাদের মধ্যে কেউ বেহেশতবাসীদের আমল/পুণ্যকর্ম করবে, যতোক্ষণ না সেটা থেকে সে এক হাত দূরত্বে পৌঁছোয়; অতঃপর (খোদায়ী) বিধি তাঁর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং সে জাহান্নামী ব্যক্তির (মন্দ)-কর্ম সংঘটন করবে, আর তাতে সে প্রবেশ করবে। অনুরূপভাবে, তোমাদের মধ্যে কেউ জাহান্নামীদের (মন্দ)-কর্ম সংঘটন করবে, যতোক্ষণ না তা হতে তার এক হাত পরিমাণ দূরত্ব থাকবে; এমতাবস্থায় ঐশী বিধান তার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং সে বেহেশতবাসীর কোনো (সৎ)-কর্ম করবে; আর ফলশ্রুতিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” দেখুন ইমাম নববী (رحمة الله عليه)’এর হাদীসে আরবাঈন, হাদীস নং ৪; আরবী উদ্ধৃতি - فَوَالَّذِي لَا إِلَهَ غَيْرُهُ إِنَّ أَحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ الْجَنَّةِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا إِلَّا ذِرَاعٌ فَيَسْبِقُ عَلَيْهِ الْكِتَابُ فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ النَّارِ فَيَدْخُلُهَا وَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ النَّارِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا إِلَّا ذِرَاعٌ فَيَسْبِقُ عَلَيْهِ الْكِتَابُ فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَيَدْخُلُهَا]


৮.৪ কোনো মুসলমানের প্রতি তাকফির উচ্চারণ না করা   


আমরা কোনো পাপের জন্যে আহলে ক্বিবলা (মুসলমান)’দের প্রতি তাকফির (অবিশ্বাসের ফতোয়া) আরোপ করি না; কোনো মন্দকর্মের কারণে মানুষদেরকে ইসলাম হতে খারিজও করে দেই না। আমরা একমত যে, হজ্জ্ব ও জ্বেহাদ যে কোনো ধার্মিক/নেককার ও অধার্মিক ইমামের অধীনে বৈধ; আর আমরা হজ্জ্ব ও জ্বিহাদ এবাদত দুটোকে প্রত্যেক ইমামের অধীনে সর্বকালে বহাল হিসেবে বিবেচনা করি, চাই তাঁরা ধার্মিক হোন বা অধার্মিক (মানে এই দুটো রহিত হয়নি)। তাঁদের ইমামতিতে জুমুআ’র নামায আদায় জায়েয।


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ফরমান:


"‏ ثَلاَثَةٌ مِنْ أَصْلِ الإِيمَانِ ‏:‏ الْكَفُّ عَمَّنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَلاَ تُكَفِّرْهُ بِذَنْبٍ وَلاَ تُخْرِجْهُ مِنَ الإِسْلاَمِ بِعَمَلٍ، وَالْجِهَادُ مَاضٍ مُنْذُ بَعَثَنِيَ اللَّهُ إِلَى أَنْ يُقَاتِلَ آخِرُ أُمَّتِي الدَّجَّالَ لاَ يُبْطِلُهُ جَوْرُ جَائِرٍ وَلاَ عَدْلُ عَادِلٍ، وَالإِيمَانُ بِالأَقْدَارِ ‏"‏ ‏.‏


 অর্থ: তিনটি বিষয় ঈমানের মূল হতে নিঃসৃত। প্রথমতঃ এমন মানুষের ক্ষতি না করা, যে বলে - ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।’ দ্বিতীয়তঃ (হয়তো কৃত) কোনো পাপের জন্যে কারো প্রতি তাকফির ঘোষণা না করা, কোনো ভুল কাজের জন্যে কাউকে ইসলাম থেকে খারিজও না করা। জ্বিহাদ চিরস্থায়ী, কেননা আল্লাহতা’লা এটা আমার (ও আমার উম্মতের) প্রতি অনুমতি দিয়েছেন, যতােক্ষণ না আমার উম্মতের শেষাংশ দাজ্জালের বিরুদ্ধে জ্বেহাদ করবে। এটা কোনো অত্যাচারী শাসক বা ন্যায়-বিচারালয়ে বাতিল তথা রহিত হবে না। তৃতীয়তঃ ক্বদর/তাক্বদীরে বিশ্বাস/ঈমান স্থাপন। [সুনানে আবী দাউদ (رحمة الله عليه), ‘কিতাবুল জ্বিহাদ’, হাদীস নং ২৫৩২]


৮.৫ সাহাবায়ে কেরাম (রা:)’এর প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য


রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর সাহাবা (رضي الله عنهم)’বৃন্দের প্রতি অনুগত হওয়া এবং তাঁদেরকে ভালোবাসা সুন্নাহ হতে নিঃসৃত। সদা-সর্বদা তাঁদের ধার্মিকতা সম্পর্কে উল্লেখ করা, আল্লাহর করুণা তাঁদের প্রতি প্রার্থনা করা, তাঁদের জন্যে মাগফেরাত কামনা করা, তাঁদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা হতে বিরত থাকা এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব, মা’রেফাত/গোপন রহস্য ও উৎকর্ষের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা (অত্যাবশ্যক)। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:


 وَٱلَّذِينَ جَآءُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغْفِرْ لَنَا وَلإِخْوَانِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلإِيمَانِ وَلاَ تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلاًّ لِّلَّذِينَ آمَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ


অর্থ: এবং ওই সব লোক, যারা তাদের পরে এসেছে তারা আরয করে, ‘হে আমাদের রব্ব! আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের ভাইদেরকেও, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে আর আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের দিক থেকে হিংসা-বিদ্বেষ (প্রোথিত) না রাখুন! হে আমাদের রব্ব! নিশ্চয় আপনি অতি দয়ার্দ্র, দয়াময়। [আল-ক্বুরআন, ৫৯:১০; নূরুল এরফান]


আল্লাহ পাক আরো ঘোষণা করেন:


 مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلْكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيْنَهُمْ


অর্থ: মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল; এবং তাঁর সঙ্গে যারা আছে, (তারা) কাফেরবর্গের প্রতি কঠোর এবং (নিজেদের) পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। [আল-ক্বুরআন, ৪৮:২৯]


মহানবী (صلى الله عليه وسلم) বলেন:


"‏ لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِي، فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ ‏"‏‏.


অর্থ: আমার সাহাবাদের সমালোচনা কোরো না; যদি তোমাদের মধ্যে কেউ ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও দান করে, তবুও তা তাঁদের এক মুদ্দ, এমন কী অর্ধ মুদ্দেরও সমান হবে না। [সহীহ বুখারী (رحمة الله عليه), ৭ম খণ্ড, ‘কিতাবে ফযায়েলে সাহাবা’, হাদীস নং ৩৬৭৩; সহীহ মুসলিম (رحمة الله عليه), ৮ম খণ্ড, কিতাবে ফযায়েলে সাহাবা, হাদীস নং ২৫৪১]


৮.৬ ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের মাতা-মণ্ডলী


আল্লাহর দরবারে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর পবিত্র বিবি সাহেবা (رضي الله عنهم)’এর প্রতি রাজি থাকার প্রার্থনা করা সুন্নাত, কেননা তাঁরা ঈমানদারবৃন্দের মাতা-মণ্ডলী। তাঁরা সকল ধরনের মন্দ হতে ধার্মিকতা দ্বারা পুতঃপবিত্র। তাঁদের মধ্যে সেরা হচ্ছেন মা খাদিজা (رضي الله عنها), যিনি খুওয়ালিদের কন্যা; অতঃপর হচ্ছেন মা আয়েশাহ (رضي الله عنها), যিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي الله عنه)’এর কন্যা; আল্লাহ পাক তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত মিথ্যে অভিযোগ হতে তাঁকে ক্ষালন করেন নিজ পবিত্র গ্রন্থে। এঁরাই হলেন প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর পবিত্র স্ত্রীবৃন্দ যাঁরা এ জগতে এবং পরবর্তী জগতে তাঁর সহধর্মিণী। অতএব, যে ব্যক্তি হযরত আয়েশা (رضي الله عنها)’কে ওই বিষয়ে অভিযুক্ত করে যা হতে আল্লাহ তাঁকে ক্ষালন করেছেন, সে নিশ্চয় মহান আল্লাহতে অবিশ্বাস করেছে। [আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: মোনাফেক্ব-বর্গ হয়রত আয়েশা (رضي الله عنها)’এর বিরুদ্ধে পতিপরায়ণা না হওয়ার অভিযোগ আনে; তারা গুজব ছড়িয়ে অনেক দুঃখকষ্টের কারণ সৃষ্টি করে; অতঃপর আল্লাহতা’লা আয়াত নাযেল করে হযরত আয়েশা (رضي الله عنها)’কে মিথ্যে অভিযোগ থেকে মুক্ত করেন। যে ব্যক্তি তাঁকে কোনো মন্দকর্মের জন্যে দোষারোপ করবে, সে আল্লাহর প্রতি কুফর সংঘটন করবে]


৮.৭ ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের মামা


হযরত মু‘য়াবিয়া (رضي الله عنه) হচ্ছেন ঈমানদারবৃন্দের মামা ও কাতেবে ওহী (ঐশীবাণী লিপিবদ্ধকারী); আর তিনি মুসলমানদের খলীফাবৃন্দের একজন। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: তাঁর নাম মু’য়াবিয়া বিন আবী সুফিয়ান (رضي الله عنه)। এখানে তাঁর নাম উল্লেখিত হয়েছে, কারণ তিনি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর স্ত্রী হযরত উম্মে হাবীবাহ (رضي الله عنها)’এর ভাই। তিনি মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। খলীফা উমর (رضي الله عنه) তাঁর গুণগত শ্রেষ্ঠত্ব মূল্যায়ন করে তাঁকে শা’ম অঞ্চলের কর্তৃত্ব দান করেন। তিনি ওহী লেখকদের একজন, যিনি ৩৭ হিজরী সালে মুসলমানদের খলীফা পদে অধিষ্ঠিত হন]  


৮.৮ শাসক, ইমাম বা আমীরের প্রতি আনুগত্য 


ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের শাসক ও নেতৃবৃন্দের (আমীর-মণ্ডলী) আদেশ-নিষেধ শোনা ও তা মান্য করা সুন্নাত, চাই তাঁরা হোন ধার্মিক বা অধার্মিক; তবে শর্ত থাকে যে তাঁরা মানুষকে আল্লাহতা’লার প্রতি অবাধ্যতার দিকে আহ্বানকারী যেনো না হন। নিশ্চয় আল্লাহতা’লার প্রতি অবাধ্যতা যেখানে বিরাজমান, সেসব ক্ষেত্রে কারো প্রতি বাধ্যতা প্রদর্শন যথোচিৎ নয়। যে ব্যক্তিকে খেলাফতের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং যাঁর প্রতি মানুষের সর্বসম্মতি থাকে, আর মানুষ যাঁর প্রতি সন্তুষ্টও থাকেন, অথবা যদি তিনি আপন তরবারি দ্বারা খেলাফতের দায়িত্ব নিতে তাঁদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও ‘আমীরুল মো’মেনীন’ (তথা ঈমানদারবৃন্দের শাসক) খেতাব ধারণও করেন, তবুও তাঁকে মান্য করা ওয়া’জিব (অবশ্যকর্তব্য); আর তাঁর বিরোধিতা করা, বিদ্রোহ করা এবং এতদুদ্দেশ্যে  মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করা একেবারেই হারা’ম।


৮.৯ বেদআতীদের থেকে নিজেকে আলাদা রাখা


বেদআতী তথা ধর্মে নতুন রীতি বা প্রথা প্রচলনকারীদের সাহচর্য হতে নিজেকে আলাদা রাখা সুন্নাত। সকল ধরনের বিতর্ক, ধর্মীয় বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি, বেদআতীদের বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি, তাদের ভাষণ শ্রবণ, ইত্যাদি ত্যাগ করাও সুন্নাত। দ্বীনের মধ্যে প্রতিটি নতুন অনুশীলিত প্রথাই বেদআত। (আমাদের) এই গোটা বইয়ে উল্লেখিত কোনো একটি বৈশিষ্ট্য ধারণকারী ব্যক্তি, যে ইসলামের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছে, সে অবশ্যই একজন বেদআতী। যেমন -


(১) الرافضة - রাফেযী। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: তারা নিজেদেরকে ‘শিয়া’ খেতাব দিয়েছে; তারা বহু উপদলে বিভক্ত যা সংখ্যাধিক্যের কারণে বর্ণনা করা দুষ্কর। তাদের মতবাদে অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি বিরাজমান, তবে যেগুলো সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর সেগুলো নিম্নরূপ:

(ক) হযরত আলী (رضي الله عنه)-ই হলেন রক্তমাংসে আল্লাহ মর্মে বিশ্বাস;

(খ) তাদের সকল ইমামের রয়েছে ঐশী মক্বাম/মর্যাদা;

(গ) ক্বেয়ামত দিবসে ঈমানদারবৃন্দ কর্তৃক আল্লাহকে দেখার বিষয়টি অস্বীকার, যা বিভিন্ন আয়াতে করীমার অস্বীকার। কেননা সেগুলোতে স্পষ্ট বিবৃত হয়েছে ওই দিন ঈমানদারবৃন্দ আল্লাহকে দেখতে পাবেন;

(ঘ) সূরা তওবার শেষ আয়াতগুলো অস্বীকারের দাবি, যা’তে ব্যক্ত হয় যে সেগুলো বিকৃত হয়েছে তথা পরিবর্তিত হয়েছে;

(ঙ) হযরত আলী (رضي الله عنه) মহানবী (صلى الله عليه وسلم) হতে উত্তম এবং ক্বুরআন মজীদ হযরত রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর স্থলে হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর পাওয়া উচিৎ ছিলো মর্মে দাবি উত্থাপন;

(চ) সাহাবাহ (رضي الله عنهم)’এর মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার এবং রাসূল (صلى الله عليه وسلم) কর্তৃক হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)’কে খেলাফত দানের বিষয়টি অস্বীকারও; একইভাবে সর্ব-হযরত উমর ও উসমান (رضي الله عنهما)’কে খলীফা নির্বাচনের বিষয়টিও অস্বীকার।

(ছ) সর্ব-হযরত আবূ বকর ও উমর (رضي الله عنهما)’এর প্রতি লা’নত প্রদান ও তিরস্কার; আর তাঁদেরকে কাফের সাব্যস্তকরণ;

(জ) আশারায়ে মোশশারা তথা দশজন বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবা (رضي الله عنهم)’এর কারো কারো প্রতি তিরস্কার, তাকফির ও গুপ্তহত্যা, যা’তে দাবি করা হয় যে আল্লাহ আর এখন তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট নন। অথচ রাসূল (صلى الله عليه وسلم) তাঁদেরকে বেহেশতের গ্যারান্টী দিয়েছিলেন, আর এর সাথে ভিন্নমত পোষণ তাঁকে মিথ্যেবাদী বলারই সামিল;

(ঝ) হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنها)’কে আহলে বায়ত/নবী-পরিবারসদস্য হিসেবে অস্বীকার; স্বয়ং আল্লাহ তাঁকে যে অভিযোগ থেকে ক্ষালন করেছেন, তা উত্থাপন করে তাঁকে মহা অসভ্যতা ও পতিপরায়ণহীনতার দোষে অভিযুক্তকরণ, যা প্রকারান্তরে আল্লাহকেই মিথ্যুক সাব্যস্তকরণ;

(ঞ) ওয়াক্তিয়া দুটো নামায ত্যাগ।

রাফেযীদের উপরোক্ত আক্বীদা-বিশ্বাস তাদেরকে অবিশ্বাসীতে পরিণত করে বলে ইমামমণ্ডলী সর্বসম্মত হয়েছেন। শিয়াদের সম্পর্কে আরো স্পষ্ট জানতে ইমাম ইবনে জাওযী সাহেবের ‘তালবীসে ইবলীস’ (শয়তানের ধোকা) বইটি পড়ুন]


(২) الجهمية - জাহমিয়্যাহ। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: এই দলের প্রবর্তক জাহম ইবনে সাফওয়ান। তাই তার অনুসারীদের বলা হয় জাহমী অথবা জাহমিয়্যাহ। তাদের ভ্রান্তিগুলো নিম্নরূপ:

(ক) আল্লাহতা’লার গুণাবলী তারা নাকচপূর্বক অস্বীকার করে;

(খ) পরকালে আল্লাহর দর্শন তারা অস্বীকার করে;

(গ) তারা আহলে সুন্নাতের হাম্বলী মাযহাবভুক্ত নির্ভরযোগ্য ইমাম-আল্লামাকে আক্ষরিক অর্থ গ্রহণকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে;

(ঘ) তারা দাবি করে আল-ক্বুরআন সৃষ্ট;

(ঙ) তারা ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি অস্বীকার করে (এতে মাযহাবের ইমামবৃন্দের মাঝে মতপার্থক্য বিরাজমান-বঙ্গানুবাদক);

(চ) তারা বিশ্বাস করে আল্লাহ মানুষকে বলপ্রয়োগে কর্ম সংঘটনে বাধ্য করেন (জাবর)]

 

(৩) الخوارج - খারেজী। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: এ দলটি ইসলাম থেকে খারিজ তথা বের হয়ে গেছে। খাওয়া’রিজ শব্দটির মূল হচ্ছে ‘খারাজা’ যার মানে বেরিয়ে যাওয়া। আমরা এমন একটি হাদীস সম্পর্কে জানি যা খায়ো’রিজ গোষ্ঠীর উৎপত্তির ঐতিহাসিক পটভূমি বিবৃত করে। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) একবার গনীমতের মালামাল বণ্টনকালে যুল-খোয়াইসারা তামীমী নামের এক নজদ এলাকার বাসিন্দা তাঁর বণ্টনের প্রতি আপত্তি উত্থাপন করে। সে তাঁকে বণ্টনে ইনসাফ করতে বলে। এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) তাকে হত্যা করার জন্যে রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর অনুমতি চান; কিন্তু তিনি তাঁকে বারণ করেন। তিনি সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم)’বৃন্দকে জানান, ওই লোকের বংশে একটি গোত্র আবির্ভূত হবে যারা ক্বুরআন মজীদ তেলাওয়াত করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালির নিচে যাবে না (মানে এর মর্মবাণী তাদের অন্তরে প্রবেশ করবে না)। তারা ধর্ম থেকে বেরিয়ে যাবে যেমনিভাবে কোনো তীর শিকারের প্রাণিকে ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তারা হাদীসের এই ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর খেলাফত আমলে আবির্ভূত হয়, যখনই তিনি হযরত মু’য়াবিয়া (رضي الله عنه)’এর সাথে ৩৭ হিজরী সালে সিফফীনের যুদ্ধে সালিশ মেনে নেন। তারা খলীফা আলী (رضي الله عنه)’এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে এই দাবি তুলে যে, তিনি আল্লাহর বিধান মান্য করেন নি (বরং সালিশ মেনে নাকি শির্ক করেছেন! - বঙ্গানুবাদক)। এখানে এক মন্দ প্রবণতা দেখা যায় যে, আল্লাহ যাঁদেরকে কর্তৃত্ব দান করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ইবনে মু’জাম নামের এক খারেজী লোক হযরত আলী (رضي الله عنه)’কে শহীদ করেছিলো। খারেজীদের তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তারা আমীর বা ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকে বাধ্যতামূলক (ওয়া’জিব) মনে করে, যদি তারা তাঁকে পাপী বিবেচনা করে (যেমনিভাবে নজদী লোকটি প্রিয়নবী - صلى الله عليه وسلم -এর প্রতি ইনসাফ না করার আপত্তি করেছিলো এবং তারই উত্তরসূরীরা ইমামে আলী - رضي الله عنه - এবং আমীরে মু’য়াবিয়া - رضي الله عنه -এর বিরুদ্ধে শির্কের অভিযোগ উত্থাপন করে বিদ্রোহ করেছিলো); দ্বিতীয়তঃ তারা কবীরা গুনাহ/মহাপাপ সংঘটনকারীকে কাফের তথা অবিশ্বাসী ধারণা করে এবং ওই ধরনের ব্যক্তিকে হত্যা, তার মালামাল হরণ ও তার পরিবার-সদস্যদের দাস-দাসী হিসেবে বন্দী করাকে জায়েয বিবেচনা করে; এবং তৃতীয়তঃ খারেজীরা মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর শাফাআতকে অস্বীকার করে। তাদের মধ্যে চরমপন্থী একটি দল সূরা ইঊসুফকে ক্বুরআন মজীদের অংশ হিসেবে অস্বীকার করে এ কথা বলে যে, এটা একটা প্রেম কাহিনি যা ক্বুরআন মজীদে ঢুকানো হয়েছে (পরবর্তীকালে)]


(৪) القدرية - ক্বদরীয়া। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: এই দলটি মো’তাযেলা গোষ্ঠী হতে ছুটে আসা একটি উপদল। তারা তাক্বদীর তথা ঐশী নিয়তির বিধান অস্বীকার করে। শয়তান তাদেরকে ধোকা দিয়েছে এই ধারণা পোষণ করতে যে, আল্লাহতা’লা তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করেন নি এবং তিনি জানেন না তাঁর বান্দা কী করবে, যতোক্ষণ না বান্দা তা সংঘটন করে। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) আমাদের আগাম জানিয়েছেন যে তারা এই উম্মতের জাদুকর হবে]


(৫) المرجئة - মুর্জিয়া। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: এই দলটি বিশ্বাস করে না যে ঈমান/কলেমা-বাক্য জিহ্বা দ্বারা সমর্থন ও ধর্মীয় বিধি-বিধান শারীরিকভাবে অনুশীলনের সমষ্টি নয়। তারা মনে করে, কেউ ইসলাম ধর্মের সব কিছু পরিত্যাগ করলেও সে ঈমানদার থাকবে। তারা শরীয়তের মুখ্য অংশগুলো ত্যাগ করেছিলো; যেমন - হাদ্দ বা শাস্তি]      


(৬) المعتزلة - মো’তাযেলাহ। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: এই দলটি নিজেদেরকে ‘আহলুল্ আদল ওয়াত্ তওহীদ’ বলে সম্বোধন করে। তারা আল্লাহতা’লার কালাম/বচন সৃষ্ট নয় মর্মে আক্বীদা-বিশ্বাসকে অস্বীকার করেছিলো; আর তারা আখেরাতে ঈমানদার মুসলমানদের আল্লাহকে দেখার বিষয়টির সমর্থনে বর্ণিত আয়াতগুলোকেও সরাসরি অস্বীকার করেছিলো। তারা মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর শাফাআতকেও অস্বীকার করেছিলো]


(৭) الكرامية - কারা’মীয়াহ। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: তারা মুর্জিয়া গোষ্ঠীর মতো একই ধারণা পোষণ করে। আর তারা আল্লাহতা’লার সিফাত/গুণাবলীকে একেবারেই আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে]


(৮) الكلابية - কালা’বীয়াহ। [অনুবাদক আবূ মুহাম্মদ ইবরাহীমের নোট: এই দলটি আবদুল্লাহ বিন সাঈদ বিন কুল্লাব নামের এক ব্যক্তির অনুসারী, যারা দাবি করেছিলো আল্লাহর সমস্ত সিফাত একটাই এবং সেগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই]  


এছাড়া অনুরূপ দল-উপদল, যারা পথভ্রষ্ট ও বেদআত সংঘটনকারী। আমরা আল্লাহর কাছে এ সমস্ত বেদআতী দল-উপদল হতে আশ্রয় চাই।


৮.১০ মাযহাবের অনুসরণ           

    

وأما بالنسبة إلى إمام في فروع الدين ، كالطوائف الأربع فليس بمذموم ،  فإن الاختلاف في الفروع رحمة ، والمختلفون فيه  محمودون في اختلافهم ، مثابون في اجتهادهم واختلافهم رحمة واسعة واتفاقهم حجة قاطعة .

  

ধর্মের বিভিন্ন শাখার ক্ষেত্রে ফেক্বাহ’র চার মাযহাবের মতো কোনো নির্দিষ্ট (মুজতাহিদ) ইমামের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়াকে দূষণীয় বিবেচনা করা অনুচিৎ এই বাস্তবতার আলোকে যে, ফেক্বাহ-বিদ্যাশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় মতপার্থক্য আল্লাহতা’লারই একটা করুণা; আর ফেক্বাহ’র ক্ষেত্রে মুজতাহিদ আলেম-উলামার মতভেদের জন্যে তাঁরা প্রশংসিত এবং তাঁদের কৃত ইজতেহাদ তথা গবেষণার জন্যে তাঁরা পুরস্কৃতও। বস্তুতঃ তাঁদের মতপার্থক্য এক মহা (খোদায়ী) করুণা, আর তাঁদের এতদসংক্রান্ত ঐকমত্য এক অকাট্য প্রমাণ।


৮.১১ সমাপনী দুআ


আমরা আল্লাহর দরবারে এই প্রার্থনা করি যেনো তিনি আমাদেরকে বেদআত ও ফিতনা হতে রক্ষা করেন; আর তিনি যেনো আমাদেরকে ইসলাম ও সুন্নাতের ওপর চির অটল-অবিচল রাখেন; এবং এ ইহ-কালীন জীবনে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর প্রকৃত অনুসারীদের মাঝে আমাদের ঠাঁই দেন; আর পরকালে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর সাথে হাশরে তাঁরই সাহচর্যে থাকার তৌফীক্ব তথা সামর্থ্য আল্লাহ পাক যেনো আপন রহমত তথা করুণায় ও ফযল তথা অনুগ্রহে দান করুন, আমীন।


আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পথ ও মতের ওপর লেখা এই বইটির এখানেই সমাপ্তি। সমস্ত প্রশংসা এক, অদ্বিতীয় আল্লাহতা’লার প্রতি। অফুরন্ত সালাত ও সালাম জানাই আমাদের প্রিয়নবী ও তাঁর আহলে বায়ত এবং আসহাব (رضي الله عنهم)’বৃন্দের প্রতি, আমীন।


                              *সমাপ্ত*   


 


    

 


  





 





          

            


  


      












 

Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা