ইজহারে হক্ব
ইজহারে হক্ব
লেখকঃ অধ্যক্ষ শেখ মুহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব
ভূমিকা
____________________
ভূমিকা
তরিকা হচ্ছে আউলিয়ায়ে কেরাম রাহিমাহুমুল্লাহু তা’য়ালা কর্তৃক আল্লাহর হাবীবের মাধ্যমে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার সঠিক পথ প্রদর্শনের উসিলা বা মাধ্যম। যা ওলীকুল শিরোমণি গাউছুল আ’জম হযরত শায়খ সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ চার তরিকার ইমামগণ কোরআন-সুন্নাহর আলোকে প্রবর্তন করে সহজ পন্থায় সাহাবায়ে কেরাম রেদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈনের অনুকরণে বিশ্বের মুসলমানগণকে সুন্নাতে রাসূলের ধারায় আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সহজভাবে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে এসেছেন।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সিলসিলায় তরিকার ইমামগণের মাধ্যমে পৃথিবীর স্থানে স্থানে প্রতিনিয়ত তারা ফুয়ুজাত ও কামালাত বিতরণ করছেন। এই ধারাবাহিকতায় ভারতবর্ষে বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ দেহলভী আলাইহির রহমত, ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত, চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম আহমদ রেজা খাঁন আলাইহির রহমত তাদের মধ্যস্থতায় তরিকতের বিশুদ্ধ সিলসিলা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাঁদের দ্বারাই পুরো ভারতবর্ষে ইলমে হাদিস ও তরিকতের ধারা সঠিক পন্থায় আজও প্রবাহমান রয়েছে।
সৈয়দ আহমদ বেরলভী- হযরত শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত-এর মুরিদ হওয়ার দাবিদার হয়েও তরিকতের এ সুমহান ফুয়ুজাতের বাগানের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সেই আগুনের তাপদাহ উপমহাদেশ তথা ভারত, পাকিস্তান, বাংলা সহ এমনকি সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঈমান-আক্বিদার উপর মারাত্মক আঘাত হেনেছে। সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তার প্রধান সহযোগী ইসমাঈল দেহলভী গং তাদের পীর ও মুর্শিদ সর্বজনমান্য হযরত শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত-এর নীতি তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা থেকে বিচ্যুত হয়ে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদীর ভ্রান্ত আক্বিদা প্রচারে ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের দালাল হিসেবে কাজ করেছে।
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত বা বাণী ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামক বিতর্কিত কিতাব এবং তারই প্রধান সহযোগী মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত অন্য বিতর্কিত কিতাব ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ এবং উভয় বিতর্কিত কিতাবের পূর্ণ সমর্থক কেরামত আলী জৈনপুরীর লিখিত ‘জখিরায়ে কেরামত’ এবং তারই অধঃস্তন সিলসিলার ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন পুস্তকাদি এর প্রমাণ বহন করে।
তারা ঐ সমস্ত কিতাবাদীর দ্বারা তাদের ভ্রান্ত মতবাদগুলোকে প্রচার চালাচ্ছে। সঠিক ইতিহাসকে বিকৃত করে অসত্য, অবাস্তব কথাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে সঠিক ইতিহাস বলে অপপ্রচার করছে।
সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও ইসমাঈল দেহলভীর অন্ধভক্তরা তথাকথিত বালাকোট আন্দোলনের দুই ব্যক্তিকে যেভাবে ইংরেজবিরোধী মুজাহিদ বলে অপপ্রচার চালিয়েছে, প্রকৃত ইতিহাস এবং বাস্তবতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ কথিত মুজাহিদদ্বয় ইংরেজের বিরুদ্ধে কখনও যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হননি বরং ইংরেজের মদদে সীমান্তের পাঠান মুসলমান ও ভারতীয় শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন।
সম্প্রতি ‘চেতনায় বালাকোট উজ্জ্বীবন পরিষদ’ ফুলতলী ভবন ১৯/এ নয়া পল্টন ঢাকা- ১০০০ এর প্রকাশনায় ‘চেতনায় বালাকোট সম্মেলন স্মারক ২০১০ ইংরেজি প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত স্মারকে সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও ইসমাঈল দেহলভীকে ইংরেজবিরোধী মুজাহিদ হিসেবে সাজানো হয়েছে যা প্রকৃত ইতিহাসের পরিপন্থী। ফলে সুন্নি জনগণের পক্ষ থেকে উক্ত স্মারকের জবাব লেখার বারবার অনুরোধ আসতেছিল।
একটি ডাহা মিথ্যা ইতিহাসের উপর প্রলেপ দিয়ে প্রকৃত সত্য ইতিহাস হিসেবে এবং ভ্রান্ত আক্বিদাগুলোকে ইসলামী সঠিক আক্বিদা হিসেবে সরলপ্রাণ মুসলমানগণের নিকট প্রচার চালিয়ে তাদেরকে বিপথগামী করার পায়তারা চালাচ্ছে। তাই বিবেকের তাড়নায় ও ঈমানী বলে উজ্জীবিত হয়ে তাদের মিথ্যা ইতিহাসের প্রলেপ সরিয়ে প্রকৃতরূপ মুসলমানদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমার এ পুস্তকে। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম সুহৃদয় পাঠকমহলে। আশা করি বইটি পাঠ করে সঠিক রাস্তার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হবেন।
এ পুস্তকখানা লেখায় আমাকে সহযোগিতা করেছেন সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক পীরে তরিকত মাওলানা শেখ সিরাজুল ইসলাম আল-কাদেরী, উপাধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা শেখ শিব্বির আহমদ (ছাহেবজাদায়ে সিরাজনগরী), আরবি প্রভাষক, মাওলানা শেখ জুবাইর আহমদ রহমতাবাদী, চুনারুঘাট। বিশেষ করে বইটিকে নজরে সানি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ফরায়েজিকান্দি কামিল মাদ্রাসার সম্মানিত সাবেক উপাধ্যক্ষ মাওলানা স. উ. ম. আব্দুস সামাদ। বইটি পাঠ করে যদি কেউ উপকৃত হয় তাহলে আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব।
দোয়া করি আল্লাহ যেন তাদের শ্রম ও প্রকাশকের মাকসুদ কবুল করেন। পরিশেষে পাঠকদের নিকট আরজ যদি কোথাও তথ্যগত কোন ভুল ধরা পরে তাহলে আমাদেরকে জানালে কৃতজ্ঞ থাকব এবং পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করে নেব। বইটি প্রকাশে যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন আল্লাহ যেন সংশ্লিষ্ট সকলের নেক মাকসুদ কবুল করেন। আমিন।
অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
১০/০৮/২০১০ইং
প্রকাশকের কথা
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহীল কারীম
আক্বিদা হচ্ছে ধর্মের মূলভিত্তি। আক্বিদার ব্যাপারে আপসের কোন প্রশ্নই আসে না। সঠিক আক্বিদা গ্রহণ করা আর বাতিল বা ভ্রান্ত আক্বিদা পরিহার করার প্রয়োজনীয়তা খুবই জরুরি ও অনস্বীকার্য। আমলের ক্ষেত্রে অবহেলা করলে পাপ হবে কিন্তু আক্বিদার ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করলে খোদাদ্রোহী ও ঈমান হারা বেঈমান হবার আশঙ্খা খুব বেশি। তাই আমি মনে করি ঈমান আক্বিদা বিশুদ্ধ ও সঠিক করার প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক।
ফিতনা ফাসাদের এই যুগে সহিহ শুদ্ধ ঈমান-আক্বিদা নিয়ে টিকে থাকা বড়ই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭২টি বাতিল দলের ব্যাপক অপতৎপরতার ফলে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আমাদের সিলেট অঞ্চলে গোলাবী ওহাবীদের আক্রমণ উল্লেখযোগ্য। বাইরের শত্রুর মোকাবেলা করা সম্ভব কিন্তু ঘরের শত্রুর মোকাবেলা করা সত্যিই দুরূহ। তাদের ষড়যন্ত্র থেকে ঈমান-আক্বিদা হেফাজত করা খুবই কঠিন।
আমাদের এ সংকটকালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক বাংলার আ’লা হযরত পীরে তরিকত রাহনুমায়ে শরিয়ত উস্তাযুল উলামা সুলতানুল মোনাজিরীন হযরতুল আল্লামা অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব কিবলা যে সাহসী কলম ধরেছেন ‘ইজহারে হক্ব’ বই লিখে তাঁর তুলনা বিরল। আমার একান্ত বিশ্বাস তাঁর দলিলভিত্তিক প্রমাণাদি ও ক্ষুরধার লেখনি এবং তেজস্বী বক্তব্যে অগণিত মানুষ পাবে খাঁটি সুন্নিয়তের দিক নির্দেশনা এবং আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশিত প্রকৃত ইসলামী জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।
-প্রকাশকদ্বয়
কতিপয় সমর্থিত উলামা-মাশায়েখ
____________________
কতিপয় সমর্থিত উলামা-মাশায়েখ
অভিমত
আলহামদুলিল্লাহ ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিহী আম্মা বা’দ- ইজহারে হক্ব পুস্তকখানা বর্তমান সময়ে নেহায়েত গুরুত্ববহ। বর্তমানে সাধারণ সুন্নি মুসলমান সহজলভ্য পীর মুরীদি ও ধর্মীয় দুর্বলতার কারণে প্রায়ই প্রতারণার শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি ৬ই মে ২০১০ইং সাল তারিখে বালাকোট চেতনায় উজ্জীবিত পরিষদ, ফুলতলী ভবন ১৯/এ, নয়া পল্টন, ঢাকা-১০০০-এর প্রকাশনা, চেতনায় বালাকোট সম্মেলন স্মারক-২০১০ প্রকাশিত হয়েছে।
উক্ত পুস্তকের ১১ পৃষ্ঠায় স্বাক্ষরদাতা ওলামা মাশায়েখ-এর তালিকায় আমার কাছে জিজ্ঞেস করা কিংবা মতামত নেয়া ছাড়া, দুই একজনের পরেই আমার নাম লিখে দেওয়া হয়েছে। আমি সেখানে স্বাক্ষর করা তো দূরের কথা, কারো মাধ্যমে হলেও আমার নাম লিখার অনুমতিও নেওয়া হয়নি। সুতরাং আমার নাম দেখে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য আমি সর্বস্তরের সুন্নি মুসলমানদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। তাদের লিখিত পুস্তকের মুখ্যব্যক্তি বালাকোটের মূলনায়ক সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী গং-এর আক্বিদাহ সম্পূর্ণ বাতিল। মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব নজদীর সমূদয় বাতিল আক্বিদাহ তারা দু’জনই ভারতবর্ষে প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। ইজহারে হক্ব পুস্তকখানা সুন্নি মুসলমানদের ঈমান রক্ষায় বড়ই সহায়ক হবে।
আমি উক্ত পুস্তকের লেখক আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা. জি. আ.) এর দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
ইমামে আহলে সুন্নাত কাযী মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম হাশেমী
চেয়ারম্যান, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বাংলাদেশ।
বাংলা পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ জামেয়া আহমদীয়া সুন্নিয়া বহুমুখী কামিল মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস উস্তাযুল আসাতিযাহ শেরে মিল্লাত হযরতুল হাজ্জ আল্লামা মুহাম্মদ উবায়দুল হক নঈমী সাহেব (দামাত বারকাতুহুমুল আলীয়া)’র
অভিমত
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহীল কারীম
ওহাবী মতবাদের খণ্ডনে সবিস্তারে দলিলভিত্তিক লিখিত পুস্তক ‘ইজহারে হক’ তথ্য ও তত্ত্ব নির্ভর প্রামাণ্য গ্রন্থ। বইটির লেখক সুনামধন্য বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন অধ্যক্ষ আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব। তিনি বইটি ভ্রান্ত ওহাবী মতবাদের খণ্ডন ও এর প্রচার প্রসারকারী সৈয়দ আহমদ বেরলভীর সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। লেখক সফল ও সার্থকভাবে এই কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বইটি পাঠে, পাঠকগণ আশা করি এ সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। মহান আল্লাহ তাঁর এই মহান খেদমতকে কবুল করুন এবং বিনিময়ে সুস্থাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ প্রদান করুন। আমিন।
মুফতি মুহাম্মদ ওবায়দুল হক নঈমী
শায়খুল হাদিস
জামেয়া আহমদীয়া সুন্নিয়া বহুমুখী কামিল মাদ্রাসা
ষোলশহর, চট্টগ্রাম।
এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ জামেয়া আহমদীয়া সুন্নিয়া আলীয়া-এর প্রধান ফকীহ, বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ হযরতুল হাজ্জ আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ অয়িছর রহমান সাহেব (দামাত বারকাতুহুমুল আলীয়া)’র
অভিমত
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহীল কারীম
বর্তমান সময়ে সুন্নি উলামায়ে কেরামদের সাহসিপুরুষ হযরতুল আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব কর্তৃক লিখিত ‘ইজহারে হক্ব’ পুস্তকখানা প্রকাশিত হবে জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এটি একখানা অতুলনীয় পুস্তক যাহাতে সুন্নি নামধারী একদল বাতিলের মুখোশ উন্মোচন হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে তারা তাদের যে সিলসিলার দোহাই দিচ্ছে সারাবিশ্বের সুন্নি উলামা মাশায়েখগণের নিকট তাদের ভ্রান্ততা স্পষ্ট যাহা ইতিহাস প্রমাণ করেছে। এ বিষয়ে তরজুমানে আহলে সুন্নাত-এ ও বিস্তারিত বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবাইকে হক ও সত্য গ্রহণ করে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমার বিশ্বাস সিরাজনগরী সাহেবের উক্ত গ্রন্থটি হক এবং বাতিলের চুলছেড়া দলিলভিত্তিক বিশ্লেষণ হকপন্থী সুন্নি উলামায়ে কেরামদের জন্য ইহা পাথেয় হিসেবে কাজ করবে। মহান আল্লাহ তার নেক প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। আমিন।
সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান
প্রধান মুফতি,
জামেয়া আহমদীয়া সুন্নিয়া আলীয়া
বহুমুখী কামিল মাদ্রাসা
চট্টগ্রাম।
এশিয়া মহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদীয়া সুন্নিয়া বহুমুখী কামিল মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস আহলে সুন্নাত সম্মেলন সংস্থা (ও.এ.সি) বাংলাদেশের সভাপতি উস্তাযুল উলামা হযরতুল হাজ্জ আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ মোহাম্মদ ছোলায়মান আনছারী সাহেব (দামাত বারাকাতুহুমুল আলীয়া)’র
অভিমত
নামাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহীল কারীম
পীরে তরিকত আল্লামা ছাহেব কিবলা সিরাজনগরী কর্তৃক বিরচিত ‘ইজহারে হক্ব’ একখানি প্রামাণ্য পুস্তক হিসেবে সুন্নি উলামায়ে কেরামের নিকট অমূল্য পুস্তক হিসেবে গণ্য হবে। বইটি প্রকাশিত হবে জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। ভ্রান্ত ওহাবী মতবাদের ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান নায়ক সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তার অনুসারিদের দলিলভিত্তিক খণ্ডনই এর প্রতিপাদ্য বিষয়। আমি বইটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি এবং সাথে সাথে লেকখের সুস্থাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমিন।
আলহাজ্ব হাফেজ মোহাম্মদ ছোলায়মান আনছারী
শায়খুল হাদিস
জামেয়া আহমদীয়া সুন্নিয়া বহুমুখী কামিল মাদ্রাসা
ষোলশহর, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদীয়া সুন্নিয়া বহুমুখী কামিল মাদ্রাসার ফকীহ, বিশিষ্ট লেখক গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ হযরতুল হাজ্জ আল্লামা কাজী মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াজেদ সাহেব (দামাত বারকাতুহুমুল আলীয়া)’র
অভিমত
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহীল কারীম
ভারত উপমহাদেশে ওহাবী আন্দোলনের প্রবক্তা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডনে সম্প্রতি লিখিত আল্লামা সিরাজনগরী সাহেবের ‘ইজহারে হক্ব’ বইখানা প্রকাশ পাচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত। লেখক অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর ভ্রান্ত মতবাদের দলিলভিত্তিক খণ্ডন করেছেন। যা অত্যন্ত সাহসি এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এটি সুন্নি সাধারণের নিকট অতি প্রয়োজনীয় পুস্তক হিসেবে সমাদ্রিত হবে বলে মনে করি। আমি এই বইটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি। মহান রাব্বুল ইজ্জত তাঁর এই প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। বিনিময়ে তাঁর দারাজাত বৃদ্ধি করুন। এই কামনায়-
কাজী মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াজেদ
ফকীহ
জামেয়া আহমদীয়া সুন্নিয়া আলীয়া
বহুমুখী কামিল মাদ্রাসা
ষোলশহর, চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সম্মানিত চেয়ারম্যান বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন সুন্নি জামায়াতের অতন্দ্র প্রহরী বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক কলমসৈনিক হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান সাহেব (মা.জি.আ.)-এর
অভিমত
পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা অধ্যক্ষ শেখ মুহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব মুদ্দাজিল্লুহুল আলী কর্তৃক লিখিত ‘ইজহারে হক্ব একটি অতি প্রামাণ্য পুস্তক। এ পুস্তকে বহু সময়োচিত সমস্যার সুচিন্তিত ও গবেষণালব্ধ সমাধান দেয়া হয়েছে। পুস্তকটি নিঃসন্দেহে সুন্নি জামায়াতের জন্য অমূল্য সম্পদ এবং অসুন্নিদের জন্য সঠিক পথের দিশাদাতা।
আমি সম্মানিত লেখকের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু আর পুস্তকখানার বহুল প্রচার কামনা করছি। আমীন।
আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান
চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মহাসচিব, জাতীয় ঈদেমিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন কমিটির সদস্যসচিব, পীরে তরিকত হযরতুল হাজ্জ আল্লামা আলহাজ্ব মাওলানা সৈয়দ মছিহুদৌলা (মা.জি.আ.) সাহেবের
অভিমত
বাংলাদেশ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সভাপতি মুনাজিরে আহলে সুন্নাত পীরে তরিকত অধ্যক্ষ আল্লামা শেখ মুহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব মুদ্দাজিল্লুহুল আলীর লিখিত ইজহারে হক্ব একটি প্রামাণ্য পুস্তক, যা সমাজে মিথ্যা ইতিহাসে ভরপুর পুস্তকের কবর রচনা করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ পুস্তকে বহু সময়োপযোগী বিষয়ের সপ্রমাণ আলোচনা করা হয়েছে। আমি লেখক মহোদয়ের সুস্বাস্থ্য ও বইখানার বহুল প্রচার কামনা করছি। আমীন।
আলহাজ্ব সৈয়দ মছিহুদৌলা
কেন্দ্রীয় মহাসচিব
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বাংলাদেশ
পীরে তরিকত রাহনুমায়ে শরিয়ত খতিবে আহলে সুন্নাত শেরে মিল্লাত বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের যুগ্ম মহাসচিব হযরতুল হাজ্ব আল্লামা মাওলানা আবুল কাশে নূরী সাহেব (দামাত বারকাতুহুমুল আলীয়া)’র
অভিমত
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহীল কারীম
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুলতানুল মোনাজিরীন বিশিষ্ট গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ, সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ, ইসলামী ফ্রন্টের সম্মানিত সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য, পীরে তরিকত আল্লামা ছাহেব কিবলা সিরাজনগরী কর্তৃক লিখিত ‘ইজহারে হক্ব’ পুস্তকখানা সুন্নি উলামায়ে কেরামের নিকট অমূল্য পুস্তক হিসেবে গণ্য হবে। বইটি প্রকাশিত হবে জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। ভ্রান্ত ওহাবী মতবাদের ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান নায়ক সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তার অনুাসারিদের দলিলভিত্তিক খণ্ডনই এর প্রতিপাদ্য বিষয়। আমি বইটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমিন।
মুহাম্মদ আবুল কাশেম নূরী
যুগ্ম মহাসচিব
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট।
কতিপয় সমর্থিত উলামা-মাশায়েখ
চেতনায় বালাকোট সম্মেলন স্মারক ২০১০ ইংরেজি সনে প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে সুন্নি উলামায়ে কেরামগণের অনুরোধে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বাইদ বনাম বাতিল আক্বাইদের মধ্যে তুলনা করে কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলিল- আদিল্লার মাধ্যমে সুন্নি জামায়াতের সঠিক আক্বাইদ গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে ওহাবী জামায়াতের অগ্রদূত মাওলানা ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত কিতাব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’। যা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত এবং মাওলানা ইসমাঈল দেহলভী লিখিয়াছেন। সাথে সাথে মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী তদীয় ‘জখিরায়ে কেরামত’ নামক কিতাবে তার পীর ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত বলেও সার্টিফাই করেছেন।
সেই ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ ও ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবদ্বয়ের বাতিল আক্বিদা খণ্ডনে লিখিত ‘ইজহারে হক্ব’ পুস্তকখানা যারা সমর্থন করেছেন সে সমস্ত উলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখে এজামগণের স্বাক্ষর-
১. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা আব্দুল বারী জিহাদী
জেহাদীয়া মোজাদ্দেদীয়া দরবার শরীফ, লাকসাম, কুমিল্লা।
২. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ জাহান শাহ মোজাদ্দেদী আল আবেদী ইমামে রাব্বানী দরবার শরীফ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।
৩. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মাওলানা মোহাম্মদ আফজাল হোসেন রংপুরী মুহাদ্দিস, বড় রংপুর কারামতিয়া কামিল মাদ্রাসা ,কোলকোন্দ দরবার শরীফ, রংপুর ও পিএইচডি, গবেষক ই.বি কুষ্টিয়া
৪. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ মাসউদ হোসাইন আলকাদেরী নির্বাহী মহাসচিব, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বাংলাদেশ।
৫. পীরে তরিকত ফকির মাওলানা সৈয়দ মুসলিম উদ্দিন সাহেব ফকিরবাড়ি দরবার শরীফ, ১০/বি মিরপুর, ঢাকা-১২১৬
৬. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মুফতি মোহাম্মদ আব্দুর রব আলকাদেরী মোহাম্মদপুর ও বিঘা দরবার শরীফ, চাঁদপুর।
৭. হযরতুল আল্লামা মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন অধ্যক্ষ, রামপুর আদর্শ সিনিয়র মাদ্রাসা, কামরাঙ্গা, চাঁদপুর।
৮. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মুফতি গিয়াস উদ্দিন দিনারপুরী প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক: দিনারপুর ফুলতলী বাজার সুন্নিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও (ইজপুর) দিনারপুর দরবার শরীফ, নবীগঞ্জ।
৯. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মাওলানা আফছার আহমদ তালুকদার অধ্যক্ষ, হাজী আলিম উল্লাহ আলীয়া মাদ্রাসা সভাপতি: বাংলাদেশ জমিয়তুল মুদাররেসীন, চুনারুঘাট উপজেলা।
১০. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মাওলানা ইউনুছ আহমদ আনছারী আনছারীয়া দরবার শরীফ, মাধবপুর, হবিগঞ্জ।
১১. বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মাওলানা শেখ সিরাজুল ইসলাম আলকাদেরী কাদেরিয়া খানকা শরীফ, শানখলা (ইমামবাড়ি), চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ।
১২. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মাওলানা মোল্লা শাহীদ আহমদ অধ্যক্ষ, সাতগাও সামাদিয়া আলীয়া মাদ্রাসা বাদে আলীশা গাউছিয়া দরবার শরীফ, শ্রীমঙ্গল।
১৩. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মাওলানা মুফতি শেখ শিব্বির আহমদ ছাহেবজাদায়ে সিরাজনগরী উপাধ্যক্ষ, সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসা, মৌলভীবাজার।
১৪. হযরতুল আল্লামা মাওলানা ফারুক আহমদ দিনারপুরী সহকারী অধ্যাপক, সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসা, শ্রীমঙ্গল।
১৫. বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মাওলানা শেখ জুবাইর আহমদ রহমতাবাদী আরবি প্রভাষক, সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসা, শ্রীমঙ্গল।
১৬. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মাওলানা মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম সহকারী অধ্যাপক, হাজী আলিম উল্লাহ আলীয়া মাদ্রাসা, চুনারুঘাট, সৈয়দপুর দরবার শরীফ, হবিগঞ্জ।
১৭. হযরতুল আল্লামা মাওলানা শেখ মুশাহিদ আলী আরবি প্রভাষক, হাজী আলিম উল্লাহ আলীয়া মাদ্রাসা, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ।
১৮. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা আলী মুহাম্মদ চৌধুরী সুপার গোগাউড়া মাদ্রাসা, চুনারুঘাট হবিগঞ্জ। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জমিয়তুল মুদার্রেসীন, হবিগঞ্জ। গোগাউড়া দরবার শরীফ, চুনারুঘাট।
১৯. পীরে তরিকত হযরত মাওলানা পীরজাদা শাহ আলা উদ্দিন ফারুকী কালাইকুনী প্রতিষ্ঠাতা, গাউছিয়া জালালিয়া দারুচ্ছুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসা ও গাউছিয়া দরবার শরীফ, রাজনগর, মৌলভীবাজার।
২০. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা জালাল আহমদ আখঞ্জী আখঞ্জী দরবার শরীফ, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ।
২১. হযরতুল আল্লামা মাওলানা আহমদ আলী হেলালী ভাইস প্রিন্সিপাল, শেখ ফজিলতুননেছা ফাজিল মাদ্রাসা, ওসমানীনগর সিলেট।
২২. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মাওলানা মোহাম্মদ রিয়াজুল করিম আল-কাদেরী কচুয়া দরবার শরীফ, নাসিরনগর, বি-বাড়িয়া।
২৩. বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক হযরত মাওলানা মোহাম্মদ এমদাদুল হক প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
২৪. হযরতুল আল্লামা মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল-কাদেরী সুপার, তৈয়বিয়া তাহেরিয়া হেলিমিয়া ছুন্নীয়া মাদ্রাসা, মইয়ারচর, সিলেট।
২৫. বিশিষ্ট গবেষক হযরতুল আল্লামা মাওলানা কমরুদ্দিন প্রাক্তন আরবি প্রভাষক, সিংছাপইড় আলীয়া মাদ্রাসা, ছাতক, সুনামগঞ্জ।
২৬. পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা মুফতি উবায়দুল মোস্তফা নক্সবেন্দীয়া দরবার শরীফ, বি-বাড়িয়া।
২৭. পীরে তরিকত শাহ সুফি আলহাজ্ব গাজী এম এ ওয়াহিদ সাবুরী সভাপতি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, কুমিল্লা
২৮ হযরত মাওলানা মোহাম্মদ নুরুল আবছার চৌধুরী বিজয়পুরী আরবি প্রভাষক, সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসা, শ্রীমঙ্গল।
২৯. মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম মাধবপুর, হবিগঞ্জ।
৩০. হযরতুল আল্লামা হামিদুর রহমান চৌধুরী আরবি প্রভাষক, দারুচ্ছুন্নাহ ফাজিল মাদ্রাসা, হবিগঞ্জ।
৩১. পীরে তরিকত হযরত মাওলানা আব্দুল গফুর রাজাপুরী গাউছিয়া করিমিয়া দরবার শরীফ, রাজাপুর, শ্রীমঙ্গল।
৩২. পীরে তরিকত হাফেজ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বাবরকপুর দরবার শরীফ, বালাগঞ্জ, সিলেট।
৩৩. হযরত মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ মুছলিম খাঁন প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, ফয়জানে মদিনা হাফিজিয়া মাদ্রাসা, চুনারুঘাট।
৩৪. মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ সুপার, শাহজালাল সুন্নিয়া দাখিল মাদ্রাসা, হিলালপুর, বাহুবল।
৩৫. পীরে তরিকত মাওলানা মুফতি ছালেহ আহমদ তালুকদার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক: গাউছিয়া কুতুবিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা, ঝুড়িয়া বড়বাড়ি, চুনারুঘাট।
৩৬. মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল গফুর সিদ্দেকী পূর্ব টিলাপাড়া, ওসমানীনগর, সিলেট।
৩৭. হাফেজ মোহাম্মদ মিছবাহ উদ্দিন চৌধুরী শিবগঞ্জ, সোনারপাড়া, নবারন ৮৮, সিলেট।
৩৮. হযরত মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ মুশাররফ হোসেন বড় কুর্মা, বিশ্বনাথ, সিলেট।
৩৯. হযরত মাওলানা কাজী মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম সিদ্দেকী প্রিন্সিপাল, সোনার মদিনা জি. কে. এস. সুন্নিয়া একাডেমী, শায়েস্তগঞ্জ।
৪০. হযরত মাওলানা মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন তালুকদার সহসুপার, দক্ষিণ সাঙ্গর মুহিউস সুন্নাহ নেছারীয়া দাখিল মাদ্রাসা, বানিয়াচং।
৪১. হযরত মাওলানা শেখ মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সুপার, বড়চেগ সুন্নিয়া দাখিল মাদ্রাসা, শমসেরনগর, মৌলভীবাজার।
৪২. পীরে তরিকত হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল মালিক আবেদী লক্ষ্মীপুর দরবার শরীফ, লালাবাজার, সিলেট।
৪৩. মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল কাদির সহ-সুপার, গোগাউড়া দাখিল মাদ্রাসা, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ।
৪৪. পীরে তরিকত হযরত মাওলানা মোস্তাক আহমদ কাদেরী আল ওয়ায়েসী কচুয়া দরবার শরীফ, নাসিরনগর বি-বাড়িয়া।
৪৫. পীরে তরিকত হযরত মাওলানা জিয়াউল হক আলকাদেরী কচুয়া দরবার শরীফ, নাসিরনগর।
৪৬. পীরে তরিকত আল্লামা কাজী আলাউদ্দিন আহমদ দাতমন্ডল মিরানীয়া দরবার শরীফ, নাসিরনগর, বি বাড়িয়া।
______
সৈয়দ আহমদ বেরলভী প্রসঙ্গে
____________________
সৈয়দ আহমদ বেরলভী প্রসঙ্গে
সম্প্রতি ‘বালাকোট চেতনায় উজ্জীবন পরিষদ’ ফুলতলী ভবন ১৯/এ নয়াপল্টন ঢাকা’ এর প্রকাশনায় চেতনায় বালাকোট সম্মেলন, স্মারক ২০১০ ইংরেজি বাজারে বের হয়েছে।
উক্ত স্মারকে উপমহাদেশের ওহাবী আন্দোলনের প্রচারক সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ও অগ্রপথিক, আমিরুল মো’মিনীন, ইমামুত তরিকত ও মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন লিখকের প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে।
এছাড়া সৈয়দ আহমদ বেরলভী প্রবর্তিত তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া নামে একটি ওহাবী তরিকাকে খাঁটি ইসলামী আন্দোলনরূপে সাজিয়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে।
তাই হক্ব প্রচারের মানসে উক্ত সৈয়দ আহমদ বেরলভীর পরিচয়, আক্বিদা ও তার আন্দোলনের হাকিকত সম্পর্কে মুসলিমসমাজকে অবহিত করা প্রয়োজন মনে করে লিখতে বাধ্য হলাম। এরই পাশাপাশি তার আন্দোলনের আজীবন সঙ্গী ও প্রধান খলিফা ইসমাইল দেহলভী এবং বাংলা ও আসামের প্রসিদ্ধ খলিফা কেরামত আলী জৈনপুরী এর লিখিত কিতাবাদী থেকে বিতর্কিত ও ভ্রান্ত আক্বিদাগুলো উল্লেখপূর্বক সঠিক ইসলামী আক্বিদা মুসলিমপাঠক সমাজের কাছে উপস্থাপন করলাম। পাঠকসমাজ উলামায়ে কেরামগণের খেদমতে আরজ যদি কোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে কোন জায়গায় ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হয় আমাকে অবহিত করলে তা সংশোধন করে নেব। আল্লাহ যেন তাঁর (হাবীব যিনি মহামানব নূরের নবী) যার তুল্য সৃষ্টির মধ্যে কেহই নেই তাঁর উসিলায় আমাদেরকে জান্নাতবাসী করেন। আমীন। ইয়া রাব্বাল আলামীন।
শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী।
_________
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জন্ম ও পরিচয়
____________________
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর পরিচয়
সৈয়দ আহমদ বেরলভী ১২০১ হিজরি সফর মাসের ৬ তারিখ মোতাবেক ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ নভেম্বর ভারতের রায় বেরেলীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ ইরফান।
‘চার বছর বয়সে তাকে মক্তবে পাঠানো হল। কিন্তু বহু চেষ্টা তদবির সত্ত্বেও তার প্রকৃতি, স্বভাবকে ধাবিত করা গেল না। পুথিগত বিদ্যায় তার কোন উন্নতি হল না।’ (ঈমান যখন জাগল, কৃত আবুল হাসান আলী নদভী)
সৈয়দ আহমদ একজন বেশ হৃষ্টপুষ্ট স্বাস্থ্যবান বালক ছিলেন। তার দৈহিক শক্তি ছিল বেশি কিন্তু লেখা-পড়ায় কোন মনোযোগ ছিল না। তিনি কৈশোরে আশেপাশের গ্রামে কিংবা সাম নদীর তীঁরে সমবয়সীদের সঙ্গে শুধু ঘুরে বেড়াতেন এবং কাবাডি খেলা, মল্লক্রীড়া, সাতার ও ঘোড় দৌড়ে প্রচুর আনন্দ পেতেন। এভাবে তার সতের বছর কেটে গেল। কিন্তু তার কিতাবী শিক্ষালাভ কিছুই হল না, সতের বছর বয়সে তার পিতার মৃত্যু হয়, তার দু’তিন বৎসর পর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে এই গেঁয়ো তরুণ চাকুরী যোগাড়ের উদ্দেশ্যে লৌক্ষ্মতে শহর উপস্থিত হলেন। (আব্দুল মওদুদ চেতনায় বালাকোট স্মারক ২০১০ ইং পৃষ্ঠা-১৭)
লৌক্ষ্মতে দীর্ঘদিন অবস্থান করার পরও তার উপযুক্ত কোন চাকরি পাওয়া গেল না। তিনি দিল্লির দিকে ছুটলেন সে সময় তার বয়স হয়েছিল ২০ বৎসর। গরিব ও দরিদ্র অবস্থার কারণে তিনি অতিকষ্টে দিল্লিতে পৌঁছলেন। (মির্জা হায়রত দেহলভী, হায়াতে তাইয়েবা ৪০৫ পৃষ্ঠা
অনেকখানি রাস্তা পায়ে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে সৈয়দ আহমদ- শাহ আব্দুল আজিজ আলাইহির রহমত এর দরবারে এসে জোর গলায় জানালেন- আসসালামু আলাইকুম। বিশ বৎসরের যুবকের মুখে এই বলিষ্ট সম্ভাষণ ‘আদাব ও তসলিমাত’ অভ্যস্ত শহরে ভদ্র শ্রেণীর কানে খুবই অদ্ভুত শোনালেন। (চেতনায় বালাকোট স্মারক ২০১০ইং পৃষ্ঠা- ১৭))
উপরন্তু দিল্লিতে তার জানাশোনা কেউ ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভীর মাদ্রাসায় আশ্রয় নিলেন এবং তাঁর সাথে সাক্ষাত করলেন। হযরত শাহ আব্দুল আজিজ রাদিয়াল্লাহু আনহু হিন্দুস্তানের এক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর সুখ্যাতি হিন্দুস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে ছিল। সুতরাং শিক্ষার্থীরা সবসময় চন্দ্রের বৃত্তের মত তাঁকে ঘিরে রাখতো। সৈয়দ আহমদ তাহার এই অবস্থা দেখে ইলিম শিক্ষার আগ্রহ জাগল।
এ প্রসঙ্গে মির্জা হায়রত লিখেছেন- সৈয়দ আহমদের ইচ্ছা ছিল যে, কোন মতে লেখাপড়া শিক্ষা করে আমি সম্মানিত হব। কিন্তু মনের গতি কি করবেন, মনতো এদিকে মোটেই ঝুঁকছে না। (মির্জা হায়রত দেহলভী, হায়াতে তাইয়েবা ৪০৬ পৃষ্ঠা
মির্জা হায়রত আরো লিখেছেন-
একমাস পর্যন্ত শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে পড়ালেন কিন্তু ফল হল না। হাজার চেষ্টা করা হয়ে ছিল যে, সৈয়দ আহমদের কিছু শিক্ষালাভ হোক কিন্তু পড়া-লেখায় তার মন একেবারেই ঠিকে না। (হায়াতে তাইয়েবা- ৪০৯ পৃষ্ঠা)
কোন কোন জীবনীলেখক তার সম্পর্কে বলেছেন সৈয়দ সাহেব শাহ আব্দুল কাদির দেহলভীর খেদমতে ছিলেন ও তাঁর নিকট লেখা-পড়া করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট মুরিদ হয়ে তার নিকট থেকে তরিকতের তা’লিম নিতেন। এভাবে দু’বৎসর কাটালেন।
একদিনের ঘটনা, সৈয়দ আহমদ বেরলভী- শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভীর দরবারে ছিলেন। শাহ আব্দুল আজিজ আলাইহির রহমত যখন তাসাব্বুরে শায়খ বা পীরের ধ্যান করার কথা বললেন, তখন সৈয়দ আহমদ বলে উঠলেন, আমি এটা করতে পারব না। কেননা পীরের ধ্যান করা আর মূর্তিপূজার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। মূর্তিপূজা হচ্ছে জঘন্যতম কুফুরি ও শিরিক। রূহানী সাহায্য ও তাওয়াজ্জুহ চাওয়াতো মূর্তিপূজা এবং প্রকাশ্য শিরিক। আমি কখনো এ কাজ করব না। (মাও: মুহাম্মদ আলী বেরলভী মাহজানে আহমদী- ১৯ পৃষ্ঠা)
অনুরূপ চেতনায় বালাকোট স্মারক ২০১০ইং ১৮ পৃষ্ঠায় আব্দুল মওদুদ তার নিবন্ধে উল্লেখ করেন-
‘ছুফী সাধনা অনুযায়ী শাহ আব্দুল আজিজ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর মুরীদ সৈয়দ আহমদকে শিক্ষা দিলেন যে, পীর, মুর্শিদের চিন্তায় মনের এতখানি একাগ্রতা আনতে হবে যে, তার ব্যক্তিত্বের মধ্যেই নিজেকে বিলীন করে দিতে হবে। সৈয়দ আহমদ আপত্তি তুলে প্রমাণ চাইলেন যে, এ পদ্ধতি কেন পৌত্তলিকতার পর্যায়ে পড়বে না? এরপর থেকে সৈয়দ আহমদকে অধ্যয়ন করতে না দিয়ে স্বাধীন এবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকতে দেওয়া হয়।’
মোদ্দাকথা হলো- সৈয়দ আহমদ বেরলভীর এহেন জঘণ্যতম ফতওয়া পীরের ধ্যান করা যাকে ‘রাবেতায়ে শায়খ’ বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ পীর সাহেব যখন মুরিদ থেকে দূরে থাকেন, তখন মুরিদ তা’জিম ও মহব্বতে তাঁর গুণাবলীকে সামনে রেখে পীর সাহেবের ধ্যান করলে তাঁর সহবতে থাকার ন্যায় ফয়েজ ও বরকত লাভ করতে সক্ষম হবে। (আলকাউলুল জামীল ৫০ পৃষ্ঠা শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত) শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী আলায়হি রহমত) বলেন- আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করার জন্য এই পন্থাই সর্বোত্তম। অযোগ্য মুরিদ যখন পীরের সঙ্গে সীমাতিরিক্ত মহব্বতে বিভোর হয়ে (পীরের ধ্যানে মগ্ন হয়ে) পড়ে, তখন কামেল মুর্শিদ খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে মুরিদের মধ্যে যোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়ে থাকেন। (হাশিয়ায়ে কাউলুল জামীল ৫০ পৃষ্ঠা।
সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার এমন পীরের বিরুদ্ধে মূর্তিপূজার তহমত দিল, যিনি হিন্দুস্তানের খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ও ফকীহ ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ যাঁর শরিয়ত ও তরিকতের তা’লিম বা শিক্ষা হিন্দুস্তানের সীমানা অতিক্রম করে গিয়েছিল, এমন কামেল পীরের শরিয়তসম্মত নির্দেশ ‘তাছাব্বুরে শায়খ’ বা পীরের ধ্যানকে মূর্তিপূজা ও প্রকাশ্যে পৌত্তলিকতা বা শিরিক বলে আখ্যায়িত করে ফতওয়া প্রদান করলো- যা সহস্র বছর ধরে এ জমিনের বুকে আল্লাহ তা’য়ালার ওলীগণের আমল ছিল।
এখন যদি আপনি ইচ্ছা করে অজ্ঞ সৈয়দ আহমদের কথা গ্রহণ করেন, তাহলে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) ও বিশ্ববিখ্যাত মোহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) থেকে শুরু করে ইমামুত তরিকত শায়খ সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী আজমিরী ছিনজেরী, মোজাদ্দিদে আলফেসানী সিরহিন্দী ও বাহাউদ্দিন নকশেবন্দী রেদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈনসহ সকল আউলিয়ায়ে কেরামগণের উপর মূর্তিপূজা ও প্রকাশ্য শিরিক এর অপবাদ বা ফতওয়া থেকে বাদ পড়েনি।
সৈয়দ আহমদ যখন আউলিয়ায়ে কেরামের কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক একটা তরিকতের আমল পীরের ধ্যান করাকে পৌত্তলিকতা ও মুশরিক ফতওয়া দিতে দুঃসাহস করল, তখনই তার পীর ও মুর্শিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) সৈয়দ আহমদকে তার মতের উপর ছেড়ে দিলেন অর্থাৎ তাকে দরবার থেকে বের করে দিলেন এবং সেও তার বদ আক্বিদার উপর অটল থেকে নিজেও বের হয়ে গেল। শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর দরবার থেকে বের হয়ে সৈয়দ আহমদ নবীর সমকক্ষ হওয়ার দাবিদার হয়ে ‘তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া’ নামে একটা নিজস্ব তরিকা আবিষ্কার করলো। এ প্রসঙ্গে চেতনায় বালাকোট ২০১০ইং ৭৭ পৃষ্ঠায় মাওলানা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন-
‘সৈয়দ আহমদের সময় মানুষের জাহেরী আমল আগের চেয়ে অনেক পিছনে পড়ে গিয়েছিল, ধর্ম-কর্মের প্রতি মানুষের মোটেই লক্ষ্য ছিল না, তাই তিনি তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া বাতিনী তরবিয়াতের সাথে সাথে জাহিরী আমলের ও তরবিয়াত আরম্ভ করেন এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) এর নামানুসারে এ তরিকার নাম রাখলেন ‘তরীকায়ে মোহাম্মদীয়া’ কেননা রাসূল (স.) একই সাথে জাহির ও বাতিনের তরবিয়ত দিতেন।’
দেখলেন তো সৈয়দ আহমদকে আল্লাহর হাবীবের সঙ্গে কিরূপ তুলনা করলো।
(নাউজুবিল্লাহ) তরীকতের প্রত্যেক ইমামগণই জাহির ও বাতেন উভয়েরই তা’লিম ও তরবিয়ত দিয়েছিলেন, এতদসত্ত্বেও তাঁরা কেহই আল্লাহর হাবীবের নামানুসারে তরীকার নাম দেননি, কারণ আল্লাহর হাবীব তরীকার উর্দ্ধে তিনি হচ্ছেন শরিয়ত ও তরিকত উভয়েরই মূল।
কাদেরিয়া তরিকার ইমাম গাউছুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রাদিয়াল্লাহু আনহুও সর্বপ্রথম ‘গুণিয়াতুত্বালেবীন’ কিতাব লিখে আক্বাইদ ও আমলের সবিস্তার আলোচনা করেন এবং এ শিক্ষাও দিয়েছেন, শরিয়ত মজবুত না হলে তরিকত লাভ করা সম্ভব হবে না।
মোজাদ্দিদে আলফেসানী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর মকতুবাতশরীফ ১ম জিলদের ৫৫ নং মকতুবাতে ১১৩১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
جوشریعت کی پابندی کرتا ہے- وہ صاحب معرفت ہے جتنی پابندی زیادہ کرے گا اتنی ھی معرفت زیادہ ہوگی اور جوستی کرنے والاہے وہ معرفت سے بے نصیب ہے-
‘যে ব্যক্তি শরিয়ত মোতাবেক আমল করতে থাকবে সে ব্যক্তিই মা’রিফাতের অধিকারী হবে। শরিয়তের পাবন্দী যত বেশি হবে, ততই মা’রিফাত বেশি লাভ হবে। যে ব্যক্তি আলস্যবশতঃ শরিয়ত থেকে বঞ্চিত থাকবে সে কস্মিনকালেও মা’রিফাত লাভ করতে সক্ষম হবে না।’
উপরন্তু দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, তরিকার সকল ইমামগণই জাহেরী ইলিমের পাশাপাশি বাতেনী ইলিম শিক্ষা দিয়েছেন এতদসত্ত্বেও তারা কেহই আল্লাহর হাবীবের নামানুসারে তরিকার নামকরণ করেননি। শুধুমাত্র সৈয়দ আহমদ বেরলভী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামানুসারে ‘তরীকায়ে মোহাম্মদীয়া’ নামকরণ করার দাবি করেছে, তার মূল উদ্দেশ্য হলো সে নবীর সমকক্ষ হওয়ার দাবিদার।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর ‘মলফুজাত’ মাওলানা ইসমাইল দেহলভীর লিখনী এবং জৌনপুরী কেরামত আলীর সমর্থিত ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামীয় কিতাবের বর্তমান দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত ৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- ‘আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা তাঁর হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে জাত ও সিফাত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, সৈয়দ আহমদকেও নবীর জাত ও সিফাতের (গুণাবলীর) কামালে মুশাবিহত বা পুর্ণাঙ্গ সামঞ্জস্য রেখে সৃষ্টি করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ)
আরো লিখা রয়েছে- সৈয়দ আহমদের অক্ষর জ্ঞান ছিল না অর্থাৎ সে উম্মী ছিল।’
জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, উম্মী হওয়া আল্লাহর হাবীবের একটি অনুপম মু’জিযা। যিনি সৃষ্টিকুলের কারো নিকট জ্ঞানার্জন না করেই স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় জ্ঞানার্জন করেছেন তিনি হলেন উম্মী।
উম্মী হওয়া আল্লাহর হাবীবের অনুপম মু’জিযা হওয়া সত্ত্বেও সৈয়দ আহমদকে নবীর সঙ্গে তুলনা করেই দাবি করা হয়েছে যে, সৈয়দ আহমদ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সরাসরি ইলিম লাভ করেছেন।
এ সম্পর্কে সিলেটের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী সাহেবের পুত্র জনাব মাওলানা ইমাদউদ্দিন চৌধুরী সাহেব কর্তৃক লিখিত ‘সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভীর জীবনী’ গ্রন্থের (১ম সংস্করণ) ১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- ‘(সৈয়দ আহমদ বেরলভী) স্বগোত্রীয় অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের মত লেখাপড়ার দিকে তার তেমন ঝোঁক দেখা গেল না। দীর্ঘ তিন বৎসরে তিনি কোরআন শরীফের কয়েকটি মাত্র সূরা মুখস্থ করলেন এবং কিছু লিখতে শিখলেন।’
অনুরূপ সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী কর্তৃক লিখিত ও আবু সাঈদ মোহাম্মদ ওমর আলী কর্তৃক অনুদিত এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত, সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের জীবনী গ্রন্থ ‘ঈমান যখন জাগল’ (প্রথম সংস্করণ) ১৪/৭৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে-
‘চার বছর বয়সে তাকে মক্তবে পাঠানো হয়। কিন্তু বহু চেষ্টা তদবীর সত্ত্বেও লেখাপড়ার প্রতি তার প্রকৃতি ও স্বভাবকে ধাবিত করা গেল না। পুথিগত বিদ্যায় তার তেমন কোন উন্নতিও হল না।
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ, বিশেষ করে বিরোচিত ও সৈনিকসূলভ খেলাধুলার প্রতি। কাবাডি অত্যন্ত আগ্রহ ও উৎসাহের সাথেই খেলতেন।’
উপরোক্ত প্রমাণভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, সৈয়দ আহমদ বেরলভী লেখাপড়া করতে পারেননি তিনি জ্ঞানান্ধ, নিরক্ষর ও মূর্খ ছিলেন।
মূর্খ হয়ে কিভাবে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’র ইমাম ও মোজাদ্দিদ হবেন, এ চিন্তায় তার সমর্থকগণ লিখিতভাবে প্রকাশ করতে বাধ্য হলো তিনি (সৈয়দ আহমদ) মূর্খ হলেইবা কি দোষ (কোন দোষ-ত্রুটি নেই) কারণ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তো উম্মী বা নিরক্ষর ছিলেন। (নাউজুবিল্লাহ)
আল্লাহ তায়ালা যেভাবে তাঁর হাবীবকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তির চেয়েও বেশি জ্ঞান দান করেছিলেন। ঠিক তেমনিভাবে সৈয়দ আহমদকেও আল্লাহ তায়ালা সরাসরি ইলিম দান করেছেন। নাউজুবিল্লাহ।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জীবনী গ্রন্থের (১ম সংস্করণ) ১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
‘আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উম্মী বা নিরক্ষর বলে ঘোষণা করেও বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে যতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি জ্ঞান দান করেছিলেন।
এভাবে আল্লাহ তায়ালা শুধু আম্বিয়াগণকেই নয় তার অনেক মকবুল বান্দাকেও সরাসরি ইলিম দান করে থাকেন। সৈয়দ আহমদ (রা.)ও সে দান থেকে বঞ্চিত হননি।’ নাউজুবিল্লাহ।
দেখলেন তো সৈয়দ আহমদকে আলেম সাজাবার জন্য আল্লাহর হাবীবের সঙ্গে কিভাবে তুলনা করা হলো!
সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার পীর ও মুর্শিদ যিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত)সহ বিশ্বের সকল আউলিয়ায়ে কেরামগণকে মুশরিক ফতওয়া দিয়ে (তাছাব্বুরে শায়খ বা পীরের ধ্যান করাকে পৌত্তলিকতা বা মুশরিক বলে আখ্যায়িত করে (ফতওয়া দিয়ে) তাঁর দরবার (শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভীর দরবার) থেক বের হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সমকক্ষ হওয়ার দাবি করে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ নামকরণে তার বাতিল আক্বিদা প্রচারের একটা মাধ্যম সৃষ্টি করেছে।
সৈয়দ আহমদের সমর্থকগণের ভাষ্যমতে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ মূলত আরবের মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর প্রবর্তিত ওহাবী আন্দোলনের একটি শাখাই প্রমাণিত হয়।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের সিলসিলাভুক্ত ‘মকছুদুল মো’মিনীন’ গ্রন্থের লিখক কাজী মোহাম্মদ গোলাম রহমান (কে. এম. জি. রহমান, পো: তালতলা বাজার নোয়াখালী) লিখিত ‘হযরত শাহজালাল ও শাহপরান (রহ.) নামক পুস্তকের (১০ম মুদ্রণ, মার্চ ২০০৮ইং) ১৫৭ পৃষ্ঠায় ‘সিলেটে ধর্মীয় আন্দোলন’ শিরোনামে উল্লেখ করেন-
‘১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আহমদ বেরলভী ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ নামে একটি ধর্মীয় আন্দোলন শুরু করেন। তাহার এই আন্দোলনের মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় প্রেরণা জাগরিত করিয়া তাহাদিগকে আত্মসচেতন করিয়া তোলা। তাঁহার এই আন্দোলনের ঢেউ সিলেট জেলায়ও প্রবেশ করিয়াছিল। বহু লোক সিলেট হইতে কলিকাতায় গিয়া সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করিয়াছিল। সিলেটে যিনি তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া প্রচার করেন তাহার নাম জয়নাল আবেদীন। তিনি হায়দারাবাদের অধিবাসী ছিলেন। তাহার প্রচারের ফলে সিলেটের বহুলোক এই আন্দোলনে যোগদান করিয়াছিল। সিলেটের উর্দু কবি আশরাফ আলী মজুমদারও ইহাতে যোগদান করেন। আরবের আব্দুল ওহাব নামক জনৈক প্রখ্যাত আলেম এই আন্দোলনের প্রধান হোতা ছিলেন বলিয়া ইহাকে ওহাবী আন্দোলনও বলা হয়ে থাকে।’
উল্লেখ্য যে, অত্র শাহজালাল ও শাহপরান (রহ.) পুস্তকে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলন ১৭৮৬ ইংরেজি থেকে শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা মূলত এ আন্দোলনের প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জন্ম সন। ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে, আর সৈয়দ আহমদ বেরলভীর কলিকাতায় আগমন হয়েছিল ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে। মুদ্রণগত ভুলের দরুণ ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়ার কথা ছাপা হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।’
উক্ত পুস্তক লিখক কাজী মোহাম্মদ গোলাম রহমান সৈয়দ আহমদ বেরলভীর সিলসিলাভূক্ত একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব এবং আপন ঘরের লোক, তার লিখিত বক্তব্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলনের প্রধান হোতা ছিলেন আরবের মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী।
মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর ভ্রান্ত-মতবাদকে উপমহাদেশে প্রচার ও প্রসার করার মাধ্যম হিসেবে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করেন। এবং এই আন্দোলনের নাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাবের দিকে সম্পর্ক করে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ বলে নামকরণ করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে, সৌদিআরব থেকে প্রকাশিত ‘আশ শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদিল ওহহাব’ নামক পুস্তকের ৭৭/৭৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত তথ্যানুযায়ী সৈয়দ আহমদ বেরলভী আরবের নজদী মুবাল্লিগগণের ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
নিম্নে উক্ত কিতাবের এবারত দেওয়া হল-
كما غزت الدعوة الوهابية السودان كذالك غزت الدعوة بعض المقاطعات الهندية بواسطة احد الحجاج الهنود وهو السيد احمد وقد كان الرجل من امراء الهند
অর্থাৎ ‘যেমনিভাবে ওহাবী মতবাদ প্রচারের জন্য সুদানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়েছিল তেমনিভাবে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ওহাবী মতবাদ প্রচারের জন্য ভারতীয় হাজীগণ থেকেও একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি হচ্ছেন সৈয়দ আহমদ। তিনি ছিলেন ভারতের একজন আমীর।
সুতরাং সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব যে ওহাবী ছিলেন এবং তার আক্বিদা যে শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ আব্দুর রহিম মোহাদ্দিসে দেহলভী, শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমতসহ সমস্ত মোহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন ও আউলিয়ায়ে কেরাম তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার পরিপন্থী ছিল তা প্রমাণিত হয়ে গেল।
১৮১৮ ইংরেজি সনে সৈয়দ আহমদ বেরলভী যখন নবাব আমীর খানের সেনাদল থেকে বের হয়ে পুনরায় দিল্লিতে আগমন করলো, তখন মাও: আব্দুল হাই ও মাও: ইসমাইল দেহলভী উভয়ে তাদের বাতিল আক্বিদা প্রচারের মানসে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে পীর সাজিয়ে তার মুরিদ বা শিষ্যত্ব গ্রহণ করলো।
তারা (মাও: আব্দুল হাই ও মাও: ইসমাইল দেহলভী) উভয়ে সুদুর প্রসারী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে স্থির করে নিল যে, সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে বাতিল আকিদার প্রচার ও প্রসার সহজ সাধ্য হবে। কারণ সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার পীর ও মুর্শিদের শিক্ষা ‘তাছাব্বুরে শায়খ’ বা পীরের ধ্যানকে পৌত্তলিকতা বা শিরিক ফতওয়া দিয়ে তার মুর্শিদের দরবার থেকে বের হয়ে আসছে। এটাই তারা দুজন মাও: আব্দুল হাই ও মাও: ইসমাইল দেহলভী উভয়ের সাথে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর বাতিল আক্বিদার পূর্ণ সামঞ্জস্য বা মিল রয়েছে। এজন্য তারা দুইজন সৈয়দ আহমদ বেরলভীর অনুগত হয়ে গেল।
১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার ভ্রান্ত মতবাদ বা আক্বিদাগুলো লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন এবং সেই গ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন ‘সিরাতে মুস্তাকিম’। সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবটি মূলত সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত বা বাণী। যেগুলোকে সংকলন করেছিলেন তার দুই শিষ্য : ১. মৌলভী ইসমাইল দেহলভী, ২. মৌলভী আব্দুল হাই।
উক্ত কিতাবের সর্বমোট চারটি পরিচ্ছেদ। প্রথম ও চতুর্থ পরিচ্ছেদ মৌলভী ইসমাইল দেহলভী এবং দ্বিতীয় তৃতীয় পরিচ্ছেদ মৌলভী আব্দুল হাই কর্তৃক লিখিত।
অতঃপর মৌলভী ইসমাইল দেহলভী সৈয়দ আহমদ বেরলভীর সকল মলফুজাত বা বাণীগুলোকে একত্রিত করে অক্ষরে অক্ষরে দেখিয়ে শুনিয়ে তার (সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের) পুন: ইজাজত বা স্বীকৃতি লাভ করেন। (সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবে ভূমিকা দ্র:) এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের (বাংলা ও আসামের) প্রসিদ্ধ খলিফা মাও: কেরামত আলী জৈনপুরী তদীয় ‘জখিরায়ে কেরামত’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ২০ পৃষ্ঠায় লিখেন-
صراط المستقیم کہ اسکے مصنف حضرت سید صاحب اور اسکے کاتب مولانا محمد اسمعیل محدث دہلوی ہیں-
অর্থাৎ ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবের মুসাননিফ বা রচয়িতা সৈয়দ সাহেব (বেরলভী) এবং কাতিব বা লিখক মাওলানা মোহাম্মদ ইসমাইল মোহাদ্দিসে দেহলভী।’ এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হলো- ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের মলফুজাত বা বক্তব্য। উল্লেখ্য যে, মৌলভী আব্দুল হাই ছিলেন শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর জামাতা এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের দক্ষিণহস্ত ও মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ভুটানবী, ভুপালী তারই পুত্র। (তারিখে ইলমূল হাদীস) জেনে রাখা আবশ্যক উনি মাওলানা আব্দুল হাই লাখনবী নন। যিনি মাওলানা আব্দুল হালিম লাখনবী সাহেবের পুত্র। কেননা আব্দুল হাই লাখনবী সাহেবের জন্ম হয়েছে ১২৬৪ হিজরিতে। সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের জন্ম হলো ১২০১ হিজরিতে এবং মৃত্যু হয়েছে ১২৪৬ হিজরিতে। অতএব প্রমাণিত হলো সৈয়দ আহমদ সাহেবের মৃত্যুর ১৮ বছর পর আব্দুল হাই লাখনবী সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন।
______
একনজরে ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামক কিতাবের বাতিল আক্বিদা ও তারই পার্শ্বে ইসলামী আক্বিদা
____________________
একনজরে ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামক কিতাবের বাতিল আক্বিদা ও তারই পার্শ্বে সুন্নি আক্বিদা নিম্নে প্রদত্ত হলো-
বাতিল আক্বিদা-১
নামাযের মধ্যে নবীয়েপাকের খেয়াল করা গরু-গাধার খেয়ালে ডুবে থাকার চেয়েও খারাপ এবং তাঁকে নামাযের মধ্যে তা’জিমের সঙ্গে খেয়াল করা শিরক।
(সৈয়দ আহমদ বেরলভীর বাণী, ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘সিরাতে মুস্তাকিম- পৃষ্ঠা ১৬৭)
(জৈনপুরী কেরামত আলীর লিখিত ‘জখিরায়ে কেরামত’ পৃষ্ঠা- ১/২৩১, বাংলা জখিরায়ে কেরামত ১ম খণ্ড ২৯ পৃষ্ঠা দ্র:)
(মাও: ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জীবনী গ্রন্থের (২য় সংস্করণ ৬৭/৭১/৭২ পৃষ্ঠায় সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবকে হেদায়তের কিতাব বলে সার্টিফাই করেছেন)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-১
নামাযের বৈঠকে তোমার কলব বা অন্তরে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পবিত্র দেহাকৃতিকে হাজির করে বলবে আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবীউ ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু অর্থাৎ আল্লাহর হাবীবকে তা’জিমের সাথে খেয়াল করে সালাম পেশ করবে। কেননা আল্লাহর হাবীবের তা’জিমই আল্লাহর বন্দেগী। (এহইয়ায়ে উলুমিদ্দিন-১/৯৯ পৃষ্ঠা)
সুতরাং নামাযে আল্লাহর হাবীবের তা’জিম ও খেয়াল করাকে শিরকের ফতওয়া দেওয়া সাহাবায়ে কেরামসহ সমস্ত মুসলমানগণকে মুশরিক বানানোর পায়তারা বৈ কিছুই নয়।
বাতিল আক্বিদা-২
হাদীসশরীফের বর্ণনা চোর ও জিনাকারের ঈমান চুরি ও জিনার সময় পৃথক হয়ে যায়। ঠিক তেমনিভাবে মাজারশরীফে অবস্থান করে দোয়া করার সময় অধিক পরিমাণে ঈমান ধ্বংস হয়ে যায়। অজ্ঞতার ওজর না থাকলে তারা পরিষ্কার কাফের হয়ে যেত। জিয়ারতকারী ব্যক্তি যদি আলেম হয়, দোয়া করার সময় নিঃসন্দেহে কাফির। (সিরাতে মুস্তাকিম-১০৫ পৃষ্ঠা)
সিরাতে মুস্তাকিম কিতাব সৈয়দ আহমদের বাণী ইসমাইল দেহলভী লিখেছেন বলে জৈনপুরী কেরামত আলী সাহেব তা জখিরায়ে কেরামত ১/২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।
ফুলতলীর ইমাদ উদ্দিন সাহেব ও সোনাকান্দার পীর সাহেব আনিছুত তালেবীন ৪/৫১ পৃষ্ঠায় তা সমর্থন করেছেন।
অনুরূপ মাও: মওদুদী সাহেবের ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন ৭৬ পৃষ্ঠায় রয়েছে-
যারা মনষ্কামনা পূরণ করার জন্য আজমির অথবা সালারে মাসউদের কবরে বা এই ধরনের অন্যান্য স্থানে যায়, তারা এত বড় গোনাহ করে যে, হত্যা ও জিনার গোনাহ তার তুলনায় কিছুই নয়।’ (নাউজুবিল্লাহ)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-২
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর পীর ও মুর্শিদ ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) তদীয় তাফসিরে আজিজি ৩০ পারা ১১৩ পৃষ্ঠা ফার্সী উল্লেখ করেন-
‘অভাবগ্রস্ত ও কঠিন সমস্যায় নিমজ্জিত ব্যক্তি যদি ঐ সব ওফাতপ্রাপ্ত ওলীগণের নিকট হুজুরী দিয়ে নিজের হাজত পূরনের জন্য আরজী পেশ করে তা অবশ্যই পেয়ে থাকবেন। কেননা আউলিয়ায়ে কেরামগণ খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাদের মুশকিলাতকে দূর করে দিয়ে থাকেন।’
একাদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (আলাইহির রহমত) তদীয় মিরকাত শরহে মিশকাত’ নামক কিতাবের ২/৪০৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
‘সকল উলামায়ে কেরাম ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, পুরুষদের জন্য কবর জিয়ারত করা সুন্নত।’
সকল নবীপ্রেমিক ঈমানদারদের জন্য গভীরভাবে অনুধাবন করার প্রয়োজন যে, সৈয়দ আহমদ বেরলভীর ‘মলফুজাত’ বক্তব্যের দরুণ তার পীর ও মুর্শিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভীসহ সকল আউলিয়ায়ে কেরাম ও উলামায়ে কেরামগণ কাফের সাব্যস্থ হয়ে গেলেন। (নাউজুবিল্লাহ)
বাতিল আক্বিদা-৩
দূর-দূরান্ত থেকে আউলিয়ায়ে কেরামের মাজারশরীফ জিয়ারতের উদ্দ্যেশ্যে সফর করে তথায় পৌঁছামাত্রই শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে এবং আল্লাহ তায়ালার গজবের ময়দানে পতিত হবে। (সিরাতে মুস্তাকিম- ১০২ পৃষ্ঠা)
ক. জৈনপুরী কেরামত আলীর ভাষ্য ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাব সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত বা বক্তব্য এবং ইসমাইল দেহলভী এ কিতাবের লিখক। (জখিরায়ে কেরামত- ১/২০ পৃষ্ঠা)
খ. মাওলানা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলীর ভাষ্যমতে ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ হেদায়তের কিতাব (সৈয়দ আহমদের জীবনী গ্রন্থ ২য় সংস্করণ ৬৭/৭১/৭২ পৃষ্ঠা)
গ. মোহাম্মদ আব্দুর রহমান হানাফী পীর সাহেব সোনাকান্দা এর ভাষ্য ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত বা বক্তব্য। (আনিছুত তালেবীন- ৪/৫১ পৃষ্ঠা)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-৩
ইমাম শাফেয়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু সুদূর ফিলিস্তিন থেকে সফর করে কুফা এসে ইমামে আ’জম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাজারশরীফ জিয়ারত করে বরকত লাভ করতেন।
হানাফী মাযহাবের ইমামগণ তা সমর্থন করেছেন এজন্য আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (আলাইহির রহমত) রদ্দুল মুহতার কিতাবের ১/৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
‘আমি (ইমাম শাফেয়ী) ইমামে আ’জম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বরকত লাভ করার উদ্দেশ্যে তাঁর মাজারশরীফে আগমন করতাম। ইমাম শাফেয়ী বলেন যখনই আমার কোন হাজত বা প্রয়োজন হতো, তখনই আমি ইমামে আ’জম আবু হানিফার মাজারশরীফের নিকট গিয়ে দু’রাকাত নফল নামায পড়ে তাঁর জিয়ারতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রয়োজন পূরণের জন্য দোয়া করতাম। সাথে সাথে আমার সেই হাজত পূরণ হয়ে যেত। (শামী)
বিশ্বের মুসলিমসমাজ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে সক্ষম হবেন যে, সৈয়দ আহমদের ফতওয়া বা বক্তব্য, কেরামত আলী জৈনপুরী, ইসমাঈল দেহলভী, ইমাদউদ্দিন ফুলতলী, সোনাকান্দার পীর সাহেব, সকলের সমর্থিত সিরাতে মুস্তাকিমের ভাষ্য ‘ওলীর দরবারে জিয়ারতের জন্য পৌঁছার সাথে সাথে শিরকে নিমজ্জিত হবে এর দ্বারা চার মাযহাবের ইমামগণ মুশরিক, সকলই শিরকের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। নাউজুবিল্লাহ।
বাতিল আক্বিদা-৪
আউলিয়ায়ে কেরাম কবরে অবস্থান করে জীবিতের ন্যায় উপকার করতে সক্ষম নয়। যদি কবর জিয়ারতে মকছুদ পূরণ হতো, তাহলে দুনিয়ার সকল মানুষ মদিনাশরীফে চলে যেত। (সিরাতে মুস্তাকিম- ১০৩ পৃষ্ঠা)
জ্ঞানান্ধ সৈয়দ আহমদ বেরলভী আউলিয়ায়ে কেরামগণের জিয়ারতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েও শান্ত্বনা লাভ করতে পারেননি বরং আল্লাহর হাবীবের রওজা মোবারক মদিনাশরীফের জিয়ারতেও বাঁধা সৃষ্টি করতে দুঃসাহস করলো। তার উপরোক্ত বক্তব্য স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- মদিনাশরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাওয়াতেও কোন লাভ নেই। নাউজুবিল্লাহ।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-৪
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘মিরকাত শরহে মিশকাত’ (বাবে জিয়ারতে কুবুর ২য় খণ্ড ৪০৫ পৃষ্ঠায়) হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন- আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘আমি তোমাদেরকে ইতোপূর্বে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, মনযোগের সাথে শ্রবণ কর। এখন থেকে কবর জিয়ারত করতে থাক।’
‘ইমামে নববী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘আল ঈজাহ ফি মানাসিকিল হাজ্জ’ নামক কিতাবের ব্যাখ্যায় মোজাদ্দিদে আলফেসানী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর দাদা উসতাদ আল্লামা ইবনে হাজর হায়তামী মক্বী (আলাইহির রহমত) সহীহ হাদীস উল্লেখ করেছেন- যাকে ইমামে দার কুতনী, অনুরূপ ইমাম তিবরানী এবং ইবনে সুবুকী সহীহ সনদে হাদীস শরীফ রেওয়ায়েত করেছেন আল্লাহর হাবীব ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি আমার জিয়ারতের উদ্দ্যেশ্যে আমার নিকট আসবে, আমার জিয়ারত ব্যতিরেকে আর কোন হাজত বা উদ্দ্যেশ্য থাকবে না, তাহলে কিয়ামতের দিনে তার জন্য শাফায়াতকারী হওয়া আমার উপর হক্ব বা নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়বে।
অন্য এক রেওয়ায়েতে রয়েছে- আল্লাহর উপর হক্ব হয়ে পড়বে অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর উপর দয়া পরবেশ হয়ে আমাকে তার জন্য কিয়ামতের দিনে শাফায়াতকারী হিসেবে মঞ্জুর করে নিবেন।
বাতিল আক্বিদা-৫
‘একদিন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা স্বীয় শক্তিশালী হাতে সৈয়দ আহমদের ডান হাত ধরে বললেন আজ তোমাকে এই দিলাম, পরে আরও দিব। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি তার কাছে বায়আত গ্রহণ করার জন্য বারবার আরজি পেশ করতে থাকলে তিনি বললেন- আয় আল্লাহ আপনার এক বান্দা বায়আত গ্রহণ করার জন্য আমার কাছে আসছে, আর আপনি আমার হাত ধরে আছেন। আল্লাহতায়ালা উত্তরে বললেন- তোমার হাতে যারা বায়আত গ্রহণ করবে লক্ষ লক্ষ গোনাহ থাকলেও আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।’ (সিরাতে মুস্তাকিম ৩০৮ পৃষ্ঠা)
উপরোক্ত এবারতের তিনটি বিষয় লক্ষ্যণীয়-
১. সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব সরাসরি আল্লাহপাকের সাথে আলাপ কালামে হাকিকী হওয়ার দাবি করেছেন।
২. তিনি আল্লাহপাকের সাথে মজলিস হওয়ার দাবি করেছেন।
৩. এবং তিনি আল্লাহপাকের সাথে মুসাফা (করমর্দন) করার দাবি করেছেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-৫
ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘তাফসিরে আজিজি’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ৫৩৪ পৃষ্ঠায় (সূরা বাকারা) উল্লেখ করেন-
‘আল্লাহ তায়ালার সাথে সরাসরি কথা বলা একমাত্র ফেরেশতাগণ ও নবীগণ আলাইহিমুস সালাম এর জন্যই নির্ধারিত। অন্য কেহ এই মর্যাদায় পৌঁছতে পারে না।
অতঃপর যারা আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলার দাবি করে, তারা যেন নবী ও ফেরেশতা হওয়ার দাবি করল।’
‘আল্লামা কাজী আবুল ফজল আয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৫৪৪ হিজরি) তদীয় শিফাশরীফ ২/২৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার উলুহিয়ত ও তাওহীদের স্বীকৃতি দেয় অর্থাৎ আল্লাহকে এক মাবুদ বলে স্বীকার করে কিন্তু আল্লাহ তায়ালার সাথে সরাসরি কথাবার্তা বলার দাবি করে তবে ইজমায়ে উম্মত বা সকল মুসলমানের ঐকমত্য কুফুরি হবে।’
বাতিল আক্বিদা-৬
সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জাত ও সিফাতের সাথে কামালে মুশাবিহত বা পরিপূর্ণ মিল রেখে সৃষ্টি করা হয়েছে। এজন্য তার স্বভাবে জ্ঞানীদের রীতি অক্ষরজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। নাউজুবিল্লাহ (সিরাতে মুস্তাকিম- ৬ পৃষ্ঠা)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-৬
কোন সৃষ্টির সঙ্গে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তুলনা দেওয়া চলে না। যারা নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোন সৃষ্টির তুলনা দিয়ে থাকে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুমহান মর্যাদা ও শানে চরম বেআদবি করার দরুণ কুফুরিতে পতিত হবে। (শিফাশরীফ) (শরহে আক্বাইদে নাসাফী- ১৬৪ পৃষ্ঠা)
বাতিল আক্বিদা-৭
পূর্ণাঙ্গ শরিয়ত ও দ্বীনের যাবতীয় হুকুম আহকামের ব্যাপারে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে নবীগণের ছাত্রও বলা চলে, এবং নবীগণের উস্তাদের সমকক্ষও বলা চলে। নাউজুবিল্লাহ। (সিরাতে মুস্তাকিম- ৭১ পৃষ্ঠা)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-৭
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উস্তাদ একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। সুতরাং যারা সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে আল্লাহর হাবীবের উস্তাদের সমকক্ষ বলে দাবি করে, তারা প্রথমে আল্লাহর সঙ্গে চরম বেআদবি করলো এবং আল্লাহর হাবীবের সুমহান মর্যাদাহানী হওয়ার কারণে সে কুফুরিতে পতিত হবে। (নাউজুবিল্লাহ)
বাতিল আক্বিদা- ৮
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নিকট এক প্রকারের ওহী এসে থাকে, যাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘নাফাসা ফির রাও’ বলা হয়।
কোন কোন আহলে কামাল ইহাকে বাতেনী ওহী বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন এবং তাদের (সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তার ন্যায় অন্যদের) ইলিম যা হুবহু নবীদের ইলিম কিন্তু প্রকাশ্য ওহী দ্বারা অর্জিত নয় (অর্থাৎ বাতেনী ওহী দ্বারা অর্জিত) নাউজুবিল্লাহ। (সিরাতে মুস্তাকিম- ৭১ পৃষ্ঠা)
উপরোল্লেখিত বক্তব্য দ্বারা বুঝা গেল ‘নাফাসা ফির রাও’ যা জাহিরী ওহীর দ্বিতীয় প্রকার কেবলমাত্র নবীর জন্যই খাস, তা মনগড়া মতে বাতেনী ওহী ডিকলারেশন দিয়ে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নিকটও এসেছে এবং নবীগণের সমান সমান ইলিম তার ছিল বলে দাবি করা হয়েছে। (নাউজুবিল্লাহ)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-৮
ইসলামী আক্বিদা হলো ওহীয়ে জাহিরীর দ্বিতীয় প্রকার نفث فى الروع ‘নাফাসা ফির রাও’ এ প্রকারের ওহী কেবলমাত্র হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্যই খাস। অন্যের জন্য হতে পারে না। (নুরুল আনওয়ার দ্র:)
কোন উম্মত নবীদের সমান ইলিম লাভ করতে পারে না। এবং নবীদের সমকক্ষও হতে পারে না।
কোন উম্মতকে নবীদের সমকক্ষ বা নবী থেকে উত্তম আক্বিদা রাখা কুফুরি। (শরহে আক্বাইদে নাসাফী- ১৬৪)
নবুয়তের দাবিদার না হওয়া সত্ত্বেও যদি কেহ তার কাছে ওহী আসে বলে দাবি করে তাহলে তার এ দাবি কারাটাই আল্লাহর হাবীবকে অস্বীকার করার নামান্তরমাত্র এবং তাকে নবী বানানোর অপচেষ্টা করা বৈ কিছুই নয়। তাই তারা কুফুরিতে নিমজ্জিত হবে। (শিফাশরীফ- ২/২৮৫)
বাতিল আক্বিদা-৯
এই সকল বুজুর্গদের নিকট (যে সকল বুজুর্গদের নিকট ‘নাফাসা ফির রাও’ বা বাতেনী ওহী আসে) এবং নবীগণ আলাইহিমুস সালামের মধ্যে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, নবীগণ উম্মতগণের প্রতি প্রেরিত হয়ে থাকেন এবং সেই সকল বুজুর্গ তাদের মনে উদিত বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নবীগণের সাথে তাদের সম্পর্ক শুধু এতটুকু যতটুকু সম্পর্ক ছোট ভাই ও বড়ভাইয়ের মধ্যে অথবা বড়ছেলে ও বাপের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। নাউজুবিল্লাহ। (সিরাতে মুস্তাকিম- ৭১ পৃষ্ঠা)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-৯
ওহী একমাত্র নবীগণ আলাইহিমুস সালাম এর জন্য খাস। নবীগণ ছাড়া অন্য কারো কাছে ওহী আসার প্রশ্নই আসতে পারে না। ওহীয়ে খফী যাকে ‘এলহাম’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। নবীগণের ‘এলহাম’ সঠিক এবং সত্য যার মধ্যে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু ওলীগণের ‘এলহাম’ সত্য ও মিথ্যা উভয়ই হতে পারে। ওলীগণের এলহাম শরিয়তের দলিল হয় না। ওলীগণের এলহাম অন্যের জন্য যেমনি দলিলরূপে পরিগণিত হয় না তেমনি নিজের জন্যও হয় না। হ্যাঁ যদি এলহাম কোরআন সুন্নাহর মোতাবেক হয়, তা দ্বারা মনে সান্ত্বনা আসে মাত্র। (নুরুল আনোয়ার)
যদি বলা হয় কোন কোন আল্লাহর ওলী ‘ইলমে লাদুনী’ লাভ করে পূর্ণাঙ্গ শরিয়তের হুকুম আহকাম সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন। (যেমন সৈয়দ আহমদ বেরলভী) তা একেবারেই ভিত্তিহীন।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা আব্দুল গণি নাবিলুছি (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘আল হাদিকাতুন নাদিয়া’ নামক কিতাবের ১/১৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
فالعلم اللدنى نوعان لدنى روحانى لدنى شيطانى فالروحانى هو الوحى ولاوحى بعد الرسول صل الله عليه وسلم
ভাবার্থ ‘ইলমে লাদুনি দুই প্রকার- ১. লাদুনিয়ে রূহানী। ২. লাদুনিয়ে শয়তানী। লাদুনিয়ে রূহানী হলো ওহী এবং আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে আর কোন ওহী নেই।’
এ দ্বারা প্রতীয়মান হলো আল্লাহর হাবীব যেহেতু সর্বশেষ নবী কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী আসবেন না। সুতরাং ওহীর দরজা যেমনি বন্ধ তদ্রুপ লাদুনিয়ে রূহানীর দরজাও বন্ধ।
মোদ্দাকথা হলো- সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত ও ইসমাইল দেহলভীর লিখিত এবং মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সমর্থিত ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবের বক্তব্যের মাধ্যমে যে বাতিল আক্বিদাগুলি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো তা নিম্নরূপ-
১. রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর পূর্ণ সাদৃশ্য বর্তমান। আল্লাহর হাবীব উম্মী ছিলেন তিনিও উম্মী। (নাউজুবিল্লাহ)
২. সেচ্ছায় নামাযের মধ্যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেয়াল করলে নামাযতো হবেই না বরং শিরিক হবে। আর অনিচ্ছাকৃতভাবে নামাযের মধ্যে নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেয়াল যদি এসে যায়, তাহলে এক রাকাতের পরিবর্তে চার রাকাআত নফল নামায পড়ে নিতে হবে। (নাউজুবিল্লাহ)
৩. নামাযে যিনার ধারণার চেয়ে স্ত্রী-সহবাসের খেয়াল ভাল। (নাউজুবিল্লাহ)
৪. নবীগণ আলাইহিমুস সালাম উম্মতগণের প্রতি প্রেরিত হয়ে থাকে। (ইসলামের ভাষ্য মতে নবীগণ পূর্ণাঙ্গ শরিয়ত ও দ্বীনের যাবতীয় হুকুম আহকাম আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে উম্মতগণকে তা’লিম ও তরবিয়ত দিয়ে থাকেন সাথে বাতেনী তরবিয়তও দিয়ে থাকেন)
অপরদিকে সৈয়দ আহমদ বেরলভী মনে উদিত বিধানাবলীকে প্রতিষ্ঠিত করেন যা তিনি বাতিনী ওহী দ্বারা সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে লাভ করে থাকেন। (নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি ইলিম নবীগণ ব্যতীত অন্য কেহ পেতে পারে না।
৫. নবীগণ ও সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মধ্যে পার্থক্য শুধুমাত্র এতটুকু যতটুকু সম্পর্ক বড়ভাই ও ছোট ভাইয়ের মধ্যে অথবা বড় ছেলেও বাপের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। (নাউজুবিল্লাহ)
৬. একদিকে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে নবীগণের ছাত্রও বলা চলে অন্যদিকে নবীগণের উস্তাদের সমকক্ষও বলা চলে। (নাউজুবিল্লাহ)
৭. সৈয়দ আহমদ বেরলভী বাতেনী ওহীর মাধ্যমে নবীগণের সমতুল্য বা হুবহু নবীগণের ইলিমের সমপরিমাণ ইলিম সরাসরি অর্জন করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ)
৮. সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে মা’ছুম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (নাউজুবিল্লাহ) মা’সুম গুণ একমাত্র নবীগণের জন্য নির্ধারিত। নবীগণ ছাড়া অন্য কেহ এগুণে গুণান্বিত হতে পারে না। একমাত্র বাতিল ফির্কা শিয়া সম্প্রদায়ই তাদের ইমামগণকে মাসুম বলে আক্বিদা রাখে।
৯. একদিন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা স্বীয় শক্তিশালী হাতে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর ডান হাত ধরে বললেন আজ তোমাকে এতটুকু দিলাম, পরে আরো দিব। (নাউজুবিল্লাহ)
১০. আল্লাহ তায়ালা ও সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের মধ্যে পরস্পর সরাসরি কথাবার্তা হয়েছে। (নাউজুবিল্লাহ)
১১. আল্লাহ তায়ালার সাথে সৈয়দ আহমদের করমর্দন বা মুসাফা হয়েছে। (নাউজুবিল্লাহ) ১২. আউলিয়ায়ে কেরামের জিয়ারতের উদ্দ্যেশ্যে সফর করা শিরক এবং সে সকল ওলীদের দরবারে অবস্থান করলে আল্লাহর গজবে পতিত হবে। (নাউজুবিল্লাহ)।
১৩. চুরি ও জিনা করার মুহূর্তে যেভাবে ঈমান চলে যায়, ঠিক তেমনিভাবে ওলি আল্লাহগণের দরবারে অবস্থান করে দোয়া করার মূহূর্তে জিয়ারতকারীর ব্যক্তি ঈমানহারা হয়ে কাফের হয়ে যায়। (নাউজুবিল্লাহ)
১৪. যদি কোন কবর জিয়ারতে মকসুদ পূর্ণ হতো তাহলে দুনিয়ার সকল মানুষ মদিনা মুনাওয়ারা চলে যেত।
______
পাক ভারত উপমহাদেশের ওহাবী ফিতনার অনুপ্রবেশ
____________________
পাক-ভারত উপমহাদেশের ওহাবী ফিতনার অনুপ্রবেশ
পাক-ভারত উপমহাদেশে ওহাবী ফিতনার অনুপ্রবেশ ও এর সূত্রপাত যাদের মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছিল তাদের মধ্যে মৌলভী ইসমাইল দেহলভী অন্যতম। (নিহত ১৮৩১ ইং)
সে আরবের কুখ্যাত মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর প্রণীত কিতাবুত তাওহীদ এর তত্ত্বানুসারে উর্দু ভাষায় ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক একটি কিতাব রচনা করে এবং ইহা বহুসংখ্যক মুদ্রিত করে সারা উপমহাদেশে বহুল পরিমাণে তা প্রচার করে। ফলে তার প্রণীত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবটি সমগ্র ভারতবর্ষে ওহাবী ফিতনার সুতিকাগার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং ওহাবী ফিতনার সূত্রপাত ঘটে।
প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ্য যে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) ও মোজাহিদে মিল্লাত আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী রহমতুল্লাহ আলাইহি উভয়ে পর্যায়ক্রমে যে মুহূর্তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদের ফতওয়া প্রদান করে ভারতীয় মুসলমানদেরকে সোচ্চার ও জেহাদী চেতনায় উজ্জীবিত করেছিলেন এবং তাদের আপসহীন নেতৃত্বে মুসলমানদের আজাদী আন্দোলনের কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন ঠিক সে সময়ে মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর লিখিত ঈমান বিধ্বংসী ফেতনা ও অনৈক্য সৃষ্টিকারী কিতাব ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ প্রচারের ফলে মুসলমানদের বৃহত্তর ঐক্য ও আজাদী আন্দোলনে ইহা বিরাট আঘাত হানে। ফলশ্রুতিতে এই উপমহাদেশে ইংরেজ স্বার্থ ও ঔপনিবেশ আরো দীর্ঘায়িত হয়।
উপরোক্ত ঈমান বিধ্বংসী কিতাব ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ এর অপতত্ত্ব ও ভ্রান্ত মতবাদসমূহ হারামাইন শরীফাইন তথা মক্বাশরীফ ও মদিনাশরীফের উলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে এজাম অবগত হয়ে তার বিভ্রান্তির কবল থেকে মুসলিমসমাজকে মুক্তির লক্ষ্যে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ ও তার লেখক মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর বিরোদ্ধে ফতওয়া প্রদান করেন। যা আল্লামা কাযী ফজল আহমদ লুদিয়ানভী তদীয় ‘আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত’ নামক কিতাবের ১ম খণ্ড ৫৩৩ পৃষ্ঠায় সংকলন করেন। তা নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো-
لا شك فى بطلان منقول من تقوية الايمان بكونه موافقا للنجدية مأخوذ من كتاب التوحيد لقرن الشيطان وايضاله نسبت تقوية الايمان ومولف ان هذا الدجال والكذاب استحق اللعنة من الله تعالى وملئكة واولى العلم وسائر العالمين الخ ...
অর্থাৎ নিঃসন্দেহে (মৌ: ইসমাইল দেহলভীকৃত) তাকভীয়াতুল ঈমান নামক গ্রন্থটি বাতিল। উহা শয়তানের শিং (মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব) নজদীর কিতাবুত তাওহীদ এর অনুকরণে লেখা হয়েছে। এই কিতাবটির রচয়িতা দাজ্জাল কাজ্জাব যা আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ, বিচক্ষণ উলামায়ে কেরাম এবং সমস্ত সৃষ্টিকুলের পক্ষ থেকে লানত বা অভিশাপ পাওয়ার যোগ্য।’
উক্ত ফতওয়ার মধ্যে মক্বাশরীফ ও মদিনাশরীফ এর যে সকল উলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে এজাম স্বাক্ষর করেছিলেন তাদের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. আব্দুহু জামান শায়খ ওমর, মক্বা মুয়াজ্জমা।
২. আহমদ দাহলান, মক্বা মুয়াজ্জমা।
৩. আব্দুহু আব্দুর রহমান, মক্বা মুয়াজ্জমা।
৪. মুফতি মোহাম্মদ আল কবী, মক্বা।
৫. সৈয়দ আল ওয়াছউদ আল হানাফী মুফতি, মদিনা মুনাওয়ারা।
৬. মোহাম্মদ বালী, খতিব মদিনা মুনাওয়ারা।
৭. সৈয়দ ইউসুফ আল আরাবী, মদিনা মুনাওয়ারা।
৮. সৈয়দ আবু মোহাম্মদ তাহির ছিদ্দেকী, মদিনা মুনাওয়ারা।
৯. মোহাম্মদ আব্দুছ ছায়াদত, খতিব মদিনা মুনাওয়ারা।
১০. আব্দুল কাদির দিতাবী, মদিনা মুনাওয়ারা।
১১. মৌলভী মোহাম্মদ আশরাফ খুরাসানী, বেলাওতী, মদিনা মুনাওয়ারা।
১২. শামছুদ্দিন বিন আব্দুর রহমান, মদিনা মুনাওয়ারা।
রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ। (আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত- ১ম খণ্ড ৫৩৪ পৃষ্ঠা)
হারামাইন শরীফাইনের উপরোক্ত ফতওয়াখানা মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর যুগে ১৮৩১ ইংরেজি সনের পূর্বে প্রদত্ত হয়েছিল।
অনুরূপ মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাবের বাতিল আক্বিদা খণ্ডনে মোজাহিদে মিল্লাত আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী (আলাইহির রহমত) (ওফাত ১৮৬১ ইং ১২৭৮ হিজরি) তিনি ১২৪০ হিজরি রমজানশরীফের ১৮ তারিখে ‘তাহক্বীকুল ফতওয়া’ নামক একখানা কিতাব প্রণয়ন করে মুসলিমসমাজকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন।
উক্ত ফতওয়ার মধ্যে তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ ১৭ (সতের) জন উলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে এজামের স্বাক্ষর রয়েছে। তন্মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত মোহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর নাতী মাওলানা মাখছুছ উল্লাহ (আলাইহির রহমত) ও মাওলানা মুছা (আলাইহির রহমত) ছিলেন অন্যতম।
উল্লেখ্য যে, ‘হুসামূল হারামাইন’ নামক আরো একখানা ফতওয়া ১৩২৪ হিজরি সনে প্রকাশিত হয়। এ ফতওয়াখানা চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ আলা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা শাহ আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক প্রণীত এবং তৎকালীন মক্বাশরীফ ও মদিনাশরীফের প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে এজাম কর্তৃক প্রশংসিত ও স্বাক্ষরিত।
_______
এক নজরে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের কতিপয় বাতিল আক্বিদা ও তার পাশাপাশি সংক্ষেপে সুন্নি আক্বিদা
____________________
এক নজরে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের কতিপয় বাতিল আক্বিদা ও তার পাশাপাশি সংক্ষেপে সুন্নী আক্বিদা নিম্নে প্রদত্ত হলো-
বাতিল আক্বিদা-১ (তাকভীয়াতুল ঈমান- ৬০ পৃষ্ঠা)
‘হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বড়ভাই সুতরাং তাঁকে বড়ভাইয়ের ন্যায় সম্মান করতে হবে।’ (নাউজুবিল্লাহ)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা-১
সৃষ্টির সেরা আশরাফুল মাখলুকাত মানবজাতির মধ্যে আম্বিয়ায়ে কেরামের মর্যাদা সর্বোচ্চ। আর আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আল্লাহতায়ালা সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী।
উম্মতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হলো- তিনি স্বীয় উম্মতের দ্বীনি পিতা। এ প্রসঙ্গে শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘তুহফায়ে ইসনা আশারিয়া’ উর্দু ৪২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- ‘আল্লাহর হাবীবকে বড়ভাইয়ের মত সম্মান করতে হবে, এ ধরনের হীন উক্তি করা কুফুরি।’ (তাফসিরে সাভী, তাফসিরে মাদারিক)
বাতিল আক্বিদা-২ (তাকভীয়াতুল ঈমান- ১৪ পৃষ্ঠা)
‘ইহা ও দৃঢ়ভাবে জেনে লওয়া দরকার যে, প্রত্যেক মাখলুক বা সৃষ্টি বড় হউক বা ছোট হউক আল্লাহর শানের সম্মুখে চামার হতেও নিকৃষ্ট।’ (নাউজুবিল্লাহ)
উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- প্রত্যেক মাখলুক বা সৃষ্টি বড় হোক বা ছোট হোক এর মধ্যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও শামিল রয়েছেন। কারণ তিনি তো আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবচাইতে বড় বা আশরাফুল মাখলুকাত।
অপরদিকে চামার হচ্ছে মাখলুক বা সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট। ইসমাইল দেহলভী আল্লাহর হাবীবকে আল্লাহর শানের সম্মুখে চামার অপেক্ষা (জলিল) বা অপমানিত বলে উল্লেখ করেছে। (নাউজুবিল্লাহ)
ইসলামী আক্বিদা-২
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদা আল্লাহর কাছে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয়, তাঁকে কোন প্রকার নীচক অর্থবোধক শব্দ দিয়ে উপমা দেওয়া কুফুরি। (আকাইদ গ্রন্থ)
আল্লাহর কালাম- ইজ্জত বা সম্মান আল্লাহর জন্যেও তাঁর রাসূলের জন্যে এবং মুমিনের জন্য রয়েছে। যারা মুনাফিক তারা আল্লাহ, রাসূল ও মুমিনগণের ইজ্জত সম্মন্ধে একেবারেই অজ্ঞ। (আল কোরআন)
বাতিল আক্বিদা-৩ ( তাকভীয়াতুল ঈমান- ৬১ পৃষ্ঠা)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিথ্যা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-
‘আমিও একদিন মরে মাটির সাথে মিশে যাবো।’ (নাউজুবিল্লাহ)
মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর এ বক্তব্য দ্বারা আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে, হায়াতুন নবী বা জিন্দা নবী তা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।
ইসলামী আক্বিদা-৩
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বশরীরে ও স্বপ্রাণে জীবিত আছেন। এমনকি সমস্ত নবীগণ ও স্বশরীরে জীবিত আছেন। নবীগণের ওফাতশরীফের পর (দেহ মোবারক হতে রূহ মোবারক পৃথক হওয়ার পর) তাঁদের রূহ মোবারককে দেহ মোবারকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।) পূর্বের ন্যায় নবীগণ স্বশরীরে জিন্দা রয়েছেন। সকল নবীগণকে তাঁদের রওজাশরীফ হতে স্বশরীরে বের হওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। সকল নবীগণ আসমান ও জমিনের সর্বত্র পরিভ্রমণ করে ‘তছররফ’ বা বিপদগ্রস্থ উম্মতের বিপদে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
যেহেতু আমাদের চোখে পর্দা দেওয়া হয়েছে, এ কারণে আমরা আল্লাহর হাবীবকে দেখতে পারি না। যার চোখ থেকে আল্লাহতায়ালা পর্দা উঠিয়ে নিবেন, সে আল্লাহর হাবীবকে দেখতে সক্ষম হবেন। এতে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। (আল হাবী লিল ফাতাওয়া, তাফসিরে রূহুল মায়ানী)
বাতিল আক্বিদা-৪ (তাকভীয়াতুল ঈমান- ৮ পৃষ্ঠা)
‘হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বীয় উকিল ও সুপারিশকারী বলে আক্বিদা পোষণ করা (অর্থাৎ আল্লাহর হাবীব উম্মতকে শাফায়াত করবেন বলে আক্বিদা রাখা) কুফুরি এবং আল্লাহর রাসূলকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর সৃষ্টি বলে আক্বিদা রেখেও যদি কেহ আল্লাহর হাবীবের কাছে সুপারিশ বা শাফায়াত তলব করে সে আবু জেহেলের মত মুশরিক হবে।’ (নাউজুবিল্লাহ)
ইসলামী আক্বিদা-৪
কিয়ামত দিবসে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোনাহগার উম্মতের জন্য আল্লাহর দরবারে শাফায়াত বা সুপারিশ করবেন।
শরহে আক্বাইদে নাসাফী নামক কিতাবের ৮২ পৃষ্ঠা (পুরাতন ছাপা ১১৪-১১৫ পৃষ্ঠা নতুন ছাপা) উল্লেখ রয়েছে-
‘রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম) এবং নেককার বান্দাদের জন্য শাফায়াতের ক্ষমতা (কোরআন সুন্নাহ দ্বারা) প্রমাণিত। তাঁদের শাফায়াত কার্যকর হবে সে সব ঈমানদারের পক্ষেও যারা, কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয়েছিল। (এটাই হচ্ছে সর্বজন স্বীকৃত অভিমত) এর বিরোধিতা করে ছিল ভ্রান্ত মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের লোকেরা।’
আল্লাহর হাবীবের ফরমান- আমার শাফায়াত হবে, আমার উম্মতের মধ্যে যারা বড় বড় গোনাহগার তাদের জন্য। (মিশকাতশরীফ- ৪৯৪ পৃষ্ঠা, তিরমিজি, আবুদাউদ, ইবনে মাজাহ)
উল্লেখ্য যে, শাফায়াত সংক্রান্ত হাদীসসমূহ অর্থের দিক দিয়ে মুতাওয়াতির পর্যায়ে গণ্য। (শরহে আকাইদে নাসাফী- ৮২ পৃষ্ঠা)।
বাতিল আক্বিদা-৫ (তাকভীয়াতুল ঈমান- ২০ পৃষ্ঠা)
‘আল্লাহ তায়ালা যখন ইচ্ছা করেন, তখনই গায়েব সম্বন্ধে অবগত হয়ে যান, এটা আল্লাহর ছাহেবরই শান বা পজিশন।’ (নাউজুবিল্লাহ)
ইসলামী আক্বিদা-৫
একমাত্র আল্লাহতায়ালাই আলেমূল গায়েব। অর্থাৎ স্বত্ত্বাগতভাবে আল্লাহতায়ালা অসীম ইলমে গায়েবের অধিকারী। তাঁর ইলমে লাজিমও জরুরি, ইখতিয়ারি নয় অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা যখন ইচ্ছা করেন তখনই গায়েব সম্পর্কে অবগত হয়ে যান, আর যখন ইচ্ছা তখন জাহেল থাকেন। (নাউজুবিল্লাহ) এটা আল্লাহতায়ালার শান-বিরোধী। আল্লাহতায়ালার ইলিম এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর থেকে পৃথক হয় না।
সুতরাং যারা এ আক্বিদা রাখে আল্লাহতায়ালা যখন ইচ্ছা করেন তখনই গায়েব সম্পর্কে অবহিত হয়ে যান, আর যখন ইচ্ছা জাহেল থাকেন (নাউজুবিল্লাহ) এটা ঈমান বিধ্বংসী কুফুরি আক্বিদা।
মোদ্দাকথা হলো- যদি কেহ আল্লাহতায়ালা সম্পর্কে তাঁর প্রকৃত শানবিরোধী কথা বলে অথবা আল্লাহতায়ালাকে জাহিল অথবা অপারগ অথবা আল্লাহতায়ালার শানে ত্রুটিপূর্ণ কোন শব্দ প্রয়োগ করে সে কাফের হবে। (আলমগীরি, ২/২৫৮ পৃষ্ঠা, বাহরুর রায়েক- ৫/১২৯ পৃষ্ঠা)।
বাতিল আক্বিদা-৬ (তাকভীয়াতুল ঈমান-১০ পৃষ্ঠা)
‘রোজী রোজগারে ফরাগত বা সংকীর্ণ করা, শরীর সুস্থ বা অসুস্থ করা, অগ্রগামী বা পশ্চাৎগামী করা, অভাবমুক্ত করা, বিপদ দূরীভূত করা, কষ্ট লাঘব করা, ইত্যাদি সব আল্লাহর ক্ষমতাধীন। কোন নবী, ওলীর এ ক্ষমতা নেই। যদি কেউ আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকে এ ধরণের ক্ষমতার অধিকারী মনে করে এবং ওর থেকে উদ্দ্যেশাদি পূরণের প্রার্থনা করে এবং কোন বিপদ মুহূর্তে ওকে ডাকে, তাহলে সে মুশরিক হয়ে যাবে।
সে ওকে ঐ সব কাজের স্বয়ং ক্ষমতাবান মনে করুক অথবা খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতার অধিকারী মনে করুক, উভয় অবস্থায় এটা শিরিক।’ (নাউজুবিল্লাহ)
ইসলামী আক্বিদা-৬
মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর দোসর জালিম ইসমাইল দেহলভী যদি এভাবে বলতো আল্লাহ ছাড়া কাউকে নিজস্ব ক্ষমতায় ক্ষমতাবান বলে আক্বিদা রাখা এবং নিজস্ব ক্ষমতায় বিপদগ্রস্ত, অসুস্থদের বিপদ দূরীকরণের ক্ষমতা আছে বলে আক্বিদা পোষণ করা কুফুরি ও শিরিক তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে তার বক্তব্য সঠিক হতো।
এরূপ বদ আক্বিদা কোন মুসলমানদের নেই। মুসলমানদের আক্বিদা হলো আল্লাহ তায়ালা নিজস্ব ক্ষমতায় ক্ষমতাবান এবং নবীগণ ও আউলিয়ায়ে কেরামগণ খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতায় ক্ষমতাবান, তাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই।
এর মধ্যে আপত্তিকর কথা হলো খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে নবীগণ, আউলিয়ায়ে কেরামগণ মানুষের বিপদমুক্ত করতে পারেন, বিপদমুক্ত করে থাকেন এবং এ আক্বিদাকে শিরিক বলে ফতওয়া প্রদান করা তার চরম গোমরাহী ও কুফুরি।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা কালামে পাকে নিজেই এরশাদ করেন- اغنهم الله ورسوله من فضله আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে ধনাঢ্য করেছেন। এখানে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নিজস্ব ক্ষমতাবলে তাদেরকে ধনাঢ্য করলেন এবং তাঁর রাসূল খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাদেরকে ধনবান করলেন। আল্লাহ ছাড়া নবী ও ওলীগণ খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে মানুষের বিপদমুক্ত করতে পারেন।
বাতিল আক্বিদা-৭ (তাকভীয়াতুল ঈমান- ৫৮ পৃষ্ঠা)
‘কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, অমুক বৃক্ষের কত পাতা বা আসমানে কত তারা? এর উত্তরে যে এ রকম বলা না হয় যে আল্লাহ ও রাসূল তা জানেন। কেননা গাইবের কথা একমাত্র আল্লাহই জানেন, রাসূল কি-ই-বা জানেন?।’ (নাউজুবিল্লাহ)
ইসলামী আক্বিদা-৭
আল্লাহ আলিমূল গায়েব বা সমূহ অসীম অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী তিনি তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতিত অন্য কারো কাছে তাঁর নিজস্ব গায়েব প্রকাশ করেন না। (আল কোরআন)
সুতরাং ‘আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা তাঁর হাবীবকে যতটুকু ইলমে গায়েব দান করেছেন, নিশ্চয়ই হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ততটুকু গায়েবের জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত আছেন।’ (মিরকাত- ৩/৪২০ পৃষ্ঠা)
‘আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কতেক গায়েবের জ্ঞান রাখেন। গায়েবের জ্ঞান সম্বন্ধে অবহিত থাকা নবীর মু’জিযা।’ (তাফসিরাতে আহমদীয়া- ৩৩৭ পৃষ্ঠা)
‘আল্লাহর হাবীব নিজেই এরশাদ করেন- আমি মা কানা ওমা ইয়াকুনু অর্থাৎ যা কিছু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যা কিছু হতে থাকবে সমুদয় বস্তুর জ্ঞান আমি রাখি। কারণ নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র সৃষ্টিজগতের স্বাক্ষী।’ (তাফসিরে রুহুল বয়ান- ৯/১৮ পৃষ্ঠা)
আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লা তাঁর হাবীব নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সব কিছুর বয়ান শিক্ষা দিয়েছেন। অর্থাৎ অতীতে যা কিছু হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হতে থাকবে আউয়ালীন ও আখেরীন সব কিছুর সম্পর্কে অবহিত করেছেন। (তাফসিরে মুয়ালিমুত তানজিল- ৪/১১৬ পৃষ্ঠা)
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা তাঁর হাবীবকে উলুমে খামসা বা পঞ্চ বিষয়ের কিয়দাংশ জ্ঞান দান করেছেন। (অর্থাৎ ১. কিয়ামত কখন হবে। ২. বৃষ্টি কখন বর্ষণ হবে। ৩. মায়ের গর্ভের বাচ্চা নেককার না বদকার। ৪. আগামী কল্য কে কি অর্জন করবে। ৫. কে কোথায় মৃত্যুবরণ করবে)। কিন্তু তাঁকে (আল্লাহর হাবীবকে সেগুলো গোপন রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ (তাফসিরে সাভী- ৩/২৬০ পৃষ্ঠা)
‘মূল্লা আলী ক্বারী রাদিয়াল্লাহু আনহু فعلمت ما فى السموت والارض এ হাদীসের ব্যাপক ব্যাখ্যা দিতে দিয়ে লিখেছেন- অর্থাৎ যেভাবে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে সপ্ত আকাশ সপ্ত জমিনের সব কিছু দেখিয়েছেন এবং সব কিছু কাশফ বা খুলে দিয়েছেন ঠিক তেমনি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য গায়েবের দরজাসমূহ খুলে দিয়েছেন।’ (মিরকাত- ১/৪৬৩ পৃষ্ঠা)
আল্লামা শেখ আব্দুল হক্ব মোহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন এ হাদীসশরীফের এবারত দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো সপ্ত আকাশ সপ্ত জমিনের মধ্যে যা কিছু রয়েছে এর জুজী ও কুল্লী জ্ঞান আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাভ করেছেন। অর্থাৎ ছোট থেকে ছোট এবং বড় থেকে বড় সব কিছুর জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন এবং ঐ সব কিছু তার এহাতা বা আয়ত্বাধীন রয়েছে। (আশিয়াতুল লোমআত শরহে মিশকাত- ১/৩৩৩ পৃষ্ঠা)
তিনি আরো বলেন- হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল বিষয় সম্পর্কে অবহিত। হাবীবে খোদা আল্লাহর জাত, আল্লাহর বিধি-বিধান তাঁর গুণাবলী, তাঁর নাম, কর্ম ও ক্রিয়াদি এবং আদি অন্ত জাহের বাতেন সমস্ত জ্ঞানের পরিবেষ্টন করে রেখেছেন।’ (মাদারিজুন নবুয়ত-১/৩ পৃষ্ঠা)
বাতিল আক্বিদা-৮ (তাকভীয়াতুল ঈমান- ১৫ পৃষ্ঠা)
ف یعنی جتنے پیغمبر آۓ ہیں سو اللہ کی طرف سے یہی حکم لاۓ ہیں کہ اللہ کو مانے اور اسکے سواے کسی کونہ مانے-
অর্থ: দুনিয়াতে যত পয়গাম্বর এসেছেন, তারা আল্লাহর পক্ষ হতে এ হুকুমই নিয়ে এসেছিলেন যে, আল্লাহকে মানো (মান্য কর) আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মানবে না। (মান্য করবে না)
বাতিল আক্বিদা-৯ (তাকভীয়াতুল ঈমান- ১৮ পৃষ্ঠা)
اللہ کے سوا کسی کونہ مان
অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে মানিও না। (মান্য করিও না)।
বাতিল আক্বিদা-১০ (তাকভীয়াতুল ঈমান- ৭ পৃষ্ঠা)
اور ونکو ماننا محض خبط ہے-
অর্থ: আল্লাহ ছাড়া অন্যকে মান্য করা অকেজো।
উল্লেখ্য যে, ইসমাঈল দেহলভীর উপরোক্ত ৮, ৯, ১০ নং বক্তব্য দ্বারা সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এবং সকল ফেরেশতাগণ আলাইহিমুস সালাম এমন কি কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামসহ সকল ঈমানী বস্তুসমূহ মানিয়ে নিতে স্পষ্টভাবে অস্বীকৃত বা এনকার করা হয়েছে এবং ইহার ইফতেরা বা তহমত আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলগণের উপরই অর্পণ করা হয়েছে।
এ কুফুরসংক্রান্ত বক্তব্য শতশত কুফুরিকে সমষ্টিগতভাবে বুঝানো হয়েছে।
মুসলমানগণের মাযহাব বা আক্বিদার মধ্যে যেমন আল্লাহতায়ালাকে মানা বা তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করা জরুরি বা ফরয তেমনি উপরে বর্ণিত সকল বস্তুকে, মানা বা সকল বস্তুর উপর ঈমান আনয়ন করা ঈমানেরই অঙ্গ। এ সমস্ত ঈমানী বস্তুসমূহের মধ্যে যে কোন একটি বস্তুকে অমান্য বা একটির উপরও ঈমান আনয়ন না করলে কাফের হবে।
উল্লেখ্য যে, উর্দু ভাষাবিদগণ অবগত আছেন যে, (ماننا) মান্না (তাছলিম) বা সমর্থন করা। ‘কবুল’ বা গ্রহণ করা এবং ‘এতেকাদ’ বা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করার ব্যাপারে প্রয়োগ হয়ে থাকে। অর্থাৎ ‘মান্না’ শব্দের অর্থ ‘তাছলিম’ ‘কবুল’ ও বিশ্বাস করার নামান্তর।
সুতরাং উর্দু ভাষাবিদগণ ‘ঈমান’ শব্দের অর্থ ‘মান্না’ এবং ‘কুফর’ শব্দের অর্থ ‘না মান্না’ ব্যবহার করে থাকেন। মোদ্দাকথা হলো ইসমাইল দেহলভীর বক্তব্য (اللہ کے سوا کسی کو نہ مان) আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মানিও না অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উপর ঈমান আনিও না। (নাউজুবিল্লাহ) এতে নবীগণ, ফেরেশতাগণসহ যাদেরকে মানা বা বিশ্বাস করা ঈমানের অঙ্গ। তাদের উপর ঈমান না আনার জন্য নির্দেশ দিয়ে মুসলিমসমাজকে ঈমান হারা করার পায়তারা চালাচ্ছে। আল্লাহপাক যেন এ প্রকার কুফুরি থেকে ঈমানদারগণের ঈমানকে হেফাজত করেন। আমীন।
জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী, শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর পৌত্র এবং শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী ও শাহ আব্দুল কাদির মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) উভয়ের আপন ভ্রাতুষ্পুত্র। শাহ আব্দুলগণি (আলাইহির রহমত) এর পুত্র।
উল্লেখ্য যে, শাহ আব্দুল কাদির (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘মাউজুহুল কোরআনে’ ঈমানের তরজমা করেছেন ‘মান্না’ এবং কুফুরের তরজমা করেছেন ‘না মান্না’।
নিম্নে কয়েকখানা আয়াতে কারীমা ও এর সাথে সাথে ‘মাউজুহুল কোরআন’ এর তরজমা পেশ করা হলো-
আয়াতে কারীমা-১ (বাকারা ৬ নং আয়াত)
ءانذرتهم ام لم تنذرهم لا يِؤمنون
শাহ আব্দুল কাদির মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘মাউজুহুল কোরআনে’ উপরোক্ত আয়াতে কারীমার তরজমা করেছেন
وتو ڈراوے یانہ ڈراوے وے نہ ماکیں گے
অনুবাদ: আপনি তাদেরকে ভীত প্রদর্শন করুন কিংবা ভীতি প্রদর্শন না-ই করুন তারা মানবে না। (ঈমানা আনবে না)
আয়াতে কারীমা-২ (ইয়াসিন- আয়াত নং ৭)
لقد حق القول على اكثرهم فهم لا يؤمنون
‘মাউজুহুল কোরআনে’ উপরোক্ত আয়াতে কারীমার তরজমা করা হয়েছে
ثابت ہوچکی ہے بات ان بہتوں پر سووہ نہ مانیں
অনুবাদ: অবধারিত হয়েছে, তাদের অধিকাংশের উপর বাণী, সুতরাং তারা মানবে না। (ঈমান আনবে না) আয়াতে কারীমা-৩ (বাকারা আয়াত নং ৪)
والذين يؤمنون بما انزل اليك
‘মাউজুহুল কোরআনে’ উপরোক্ত আয়াতে কারীমার তরজমা করা হয়েছে
مانتے ہیں جو اترا تجھ کو
অনুবাদ: তারা মানে, যা অবতীর্ণ হয়েছে আপনার প্রতি। (অর্থাৎ ঈমান রাখে)
আয়াতে কারীমা-৪ (আরাফ আয়াত নং ৭২)
وقطعنا دابر الذين كذبوا بايتنا وما كانوا مؤمنين
‘মাউজুহুল কোরআনে’ এ আয়াতে কারীমার তরজমা করা হয়েছে
اور پچھاڑی کاٹی ان کی جو جھٹلاے تھے ہماری آیتین اور نہ تھے ماننے والے
অনুবাদ: ‘যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতো তাদেরকে নির্মূল করেছি, তারা মাননে ওয়ালা ছিল না।’ (অর্থাৎ তারা কাফের ছিল)
আয়াতে কারীমা-৫ (আনআম আয়াত নং ৫৩)
واذا جاءك الذين يؤمنون بايتنا فقل سلام عليكم
‘মাউজুহুল কোরআনে এ আয়াতে কারীমার তরজমা করেছেন-
اور جب آوین تیرے پاس ہماری آیتیں ماننے والے توکھ سلام ہے تم پر
অনুবাদ: আমার আয়াতসমূহকে মান্যকারী যখন আসবে আপনার নিকট, তখন আপনি তাদেরকে বলুন, ছালাম তোমাদের উপর’ মান্নে ওয়ালে (অর্থাৎ ঈমানদার)
আয়াতে কারীমা-৬ (বাকারাহ আয়াত নং ২৮৫)
امن الرسول بما انزل اليه من ربه والمؤمنون كل امن بالله وملئكته وكتبه ورسوله
‘মাউজুহুল কোরআনে’ এ আয়াতে কারীমার তরজমা করেছেন-
مانا رسول نے جو کچھ اترا اسکے رب کی طرف سے اور مسلمانوں نے سب نے مانا اللہ کو اور اسکے فرشتوں کو اور کتابوں کو اور رسولوں کو-
অনুবাদ: রাসূল মেনেছেন, যা তাঁর প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুসলমানগণও সবাই মেনে নিয়েছেন আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাগণকে তাঁর কিতাবসমূহকে এবং তাঁর রাসূলগণকে।
আয়াতে কারীমা-৭ (আরাফ, আয়াত নং ৭৬)
قال الذين استكبروا انا بالذى امنتم به كفرون
মাউজুহুল কোরআনে এ আয়াতে কারীমার তরজমা করা হয়েছে-
کھنے لگے بڑائ والے جوتم نے یقین کیا سوہم نہیں مانتے-
অনুবাদ: দাম্ভিকেরা বলল, তোমরা যা একিন করেছ আমরা তা মানি না। (এখানে কুফুরিকে ‘মানি না’ বলা হয়েছে)
মোদ্দাকথা হলো আল্লাহতায়ালা কালামেপাকে নিজেই এরশাদ করেছেন- ঈমানদারগণ, আল্লাহতায়ালা ও তাঁর ফিরেশতাগণ, তাঁর পাঠানো সকল কিতাব, সব রাসূলগণকে মেনেছেন (অর্থাৎ ঈমান এনেছেন)।
অপরদিকে ইসমাইল দেহলভী তার ব্যক্তিমতে বলতেছেন-
اللہ کے سوا کسی کو نہ مان
(তাকভীয়াতুল ঈমান ১৮ পৃষ্ঠা)
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে মানিও না অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর ঈমান আনিও না। (নাউজুবিল্লাহ) কত বড় গাজাখুরী কথা। তার এ কথা কোরআন-সুন্নাহর সম্পূর্ণ বিরোধী। কারণ ইসমাঈল দেহলভী নজদী চশমা চোখে দিয়ে দিশেহারা হয়ে দুনিয়ার সকল মুসলমানদের উপর কুফর ও শিরিকের ফতওয়া দিয়ে নিজেই ঈমান হারা হয়ে গেছে।
তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাবের ভ্রান্ত আক্বিদার খণ্ডনে যাঁরা কলম ধরেছেন
চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী (আলাইহির রহমত) জন্ম ১২৭২ হিজরি, ওফাত ১৩৪০ হিজরি) ‘আল কাওকাবাতুশ শিহাবীয়া, নামক কিতাবে ইসমাইল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ সৈয়দ আহমদ বেরলভীর বাণী ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ রেছালায়ে একরোজী, তানভীরুল আইনাইন, ইজুহুল হক, প্রভৃতি কিতাব হতে ৭০টি (সত্তরটি) কুফুরি আক্বিদা দলিল আদিল্লাহ দ্বারা প্রমাণ করেছেন।
__________
তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাবের ভ্রান্ত আক্বিদার খণ্ডনে দেশ বরেণ্য সুন্নি উলামায়ে কেরামের লিখিত কতিপয় কিতাবের তালিকা
____________________
‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাবের ভ্রান্ত আক্বিদার খণ্ডনে দেশ বরেণ্য সুন্নী উলামায়ে কেরামের লিখিত কতিপয় কিতাবের তালিকা
১. বিশ্ববিখ্যাত মোহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর নাতী, ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর ভাতিজা শাহ রফী উদ্দিন মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর দুই ছাহেবজাদা যথাক্রমে আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী (আলাইহির রহমত), ওফাত ১২৭১ হিজরি ১৮৫৬ ইংরেজী), ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের ভ্রান্ত আক্বিদার খণ্ডনে ‘মঈদুল ঈমান রদ্দে তাকভীয়াতুল ঈমান’ এবং আল্লামা শাহ মোহাম্মদ মুছা দেহলভী (আলাইহির রহমত), ওফাত ১২৫৯ হিজরি ১৮৪৩ ইংরেরি) ‘হুজ্জাতুল আ’মাল’ ও ‘ছাওয়াল ও জওয়াব’ দু’টি কিতাব প্রণয়ন করেছেন।
২. ব্রিটিশবিরোধী-আন্দোলনের অগ্রপথিক আযাদী-আন্দোলনের (১৮৫৭) বীর মোজাহিদ, মুসলিম মিল্লাতের গৌরব, মোজাহিদে আহলে সুন্নাত এবং শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর প্রসিদ্ধ ছাত্র আল্লামা ফযলে হক খায়রাবাদী (আলাইহির রহমত) জন্ম ১২১২ হিজরি ১৭৯৭ ইংরেজী, ওফাত ১২৭৮ হিজরি ১৮৬১ ইংরেজি) তিনি ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের ভ্রান্ত আক্বিদার খণ্ডনে লিখেছেন দু’টি কিতাব- ১. তাহক্বীকুল ফতওয়া, ২. ইমতিনাউন নাযীর।
৩. শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর সুযোগ্য শাগরিদ ও তরীকতের খলিফা আওলাদে রাসূল শায়খুল হাদীস সৈয়দ শাহ আলে রাসূল মারহারাবী (আলাইহির রহমত) এর খলিফা আল্লামা ফজলে রাসূল বাদায়ূনী (আলাইহির রহমত), ওফাত ১২৮৯ হিজরি (ইসমাঈল দেহলভীর সমসাময়িক) তিনি ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের ভ্রান্ত আকিদার খণ্ডনে লিখেছেন ‘ছাইফুল জব্বার’।
৪. আল্লামা আব্দুল্লাহ মোহাদ্দিসে খোরাসানী (আলাইহির রহমত)-এর লিখিত কিতাব ‘আছছাইফুর রাওয়ারিক’।
৫. আল্লামা মুখলিছুরর রহমান ইসলামাবাদী (আলাইহির রহমত) মির্জারখিল, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম- এর লিখিত ‘শারহুছ ছুদুর ফি দফয়িশ শুরুর’।
৬. আল্লামা মুফতি এরশাদ হুছাইন রামপুরী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘ইশআরুল হক’।
৭. আল্লামা আব্দুর রহমান সিলহেটী (আলাইহির রহমত)-এর লিখিত ‘ছাইফুর আবরার’।
৮. আল্লামা নকী আলী খাঁন বেরলভী (আলাইহির রহমত)-এর লিখিত ‘তাজকিয়াতুল ঈকান’।
৯. চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ ইমামে আহলে সুন্নাত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী (আলাইহির রহমত) ওফাত ১৯২১ইংরেজি) লিখিত ‘আল কাওকাবাতুশ শিহাবীয়া’।
১০. ছদরুল আফাজিল আল্লামা সৈয়দ নঈমুদ্দিন মুরাদাবাদী (আলাইহির রহমত) ওফাত ১৯৪৮ ইংরেজি)-এর লিখিত ‘আতইয়াবুল বয়ান’।
এ কিতাবটিতে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থের প্রতিটি গোমরাহীপূর্ণ বক্তব্যের দলিল-আদিল্লাভিত্তিক স্পষ্ট জবাব রয়েছে। একবার পাঠ করলেই পাঠকের কাছে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের স্বরূপ উন্মোচিত হবে। এ কিতাবটি বর্তমানেও প্রকাশিত ও প্রচারিত আছে। সুন্নী কুতুবখানায় সহজে পাওয়া যায়।
১১. মাওলানা কাজী ফজল আহমদ লুদিয়ানবী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত’। এ কিতাবটি ১৩৩০ হিজরি সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এতে তাঁর সমকালীন ৪১ (একচল্লিশ) জন খ্যাতনামা উলামায়ে কেরাম কর্তৃক সমর্থিত ও প্রশংসিত হয়।
১২. আল্লামা মুফতি ছদর উদ্দিন আযারদাহ দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘মুনতাহাল মাকাল’।
১৩. আল্লামা আহমদ ছায়ীদ নকশেবন্দী দেহলভী (আলাইহির রহমত) ওফাত ১২৭৭ হিজরি। এর লিখিত ‘তাহকিকুল মুবিন’ নামক গ্রন্থ।
১৪. মাওলানা পীর মেহের আলী শাহ গোলরভী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘এ’লাউ কালিমাতুল হক’।
১৫. মাওলানা নাছীর আহমদ পেশোয়ারী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘এহ কাকুল হক্ব’।
একই নামে মাওলানা সৈয়দ বদরুদ্দিন হায়দরাবাদী (আলাইহির রহমত) ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের খণ্ডনে আরো একটি কিতাব রচনা করেন।
১৬. মুফতি আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘যা আল হক্ব’।
১৭. মুর্শিদে বরহক শায়খুল ইসলাম আল্লামা আবিদশাহ মোজাদ্দিদে আল মাদানী (আলাইহির রহমত) ইসলাহে মাশায়েখ।’
১৮. হযরতুল আল্লামা গাজী আজিজুল হক শেরে বাংলা (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘দেওয়ানে আজিজ’।
________
আল্লামা ফজলে রাসূল বদায়ূনীর প্রশ্ন- আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভীর উত্তরসংক্রান্ত একটি ঐতিহাসিক পত্রালাপ
____________________
আল্লামা ফজলে রাসূল বদায়ূনীর প্রশ্ন- আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভীর উত্তরসংক্রান্ত একটি ঐতিহাসিক পত্রালাপ
মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থ প্রসঙ্গে আল্লামা শাহ মখছুছ উল্লাহ দেহলভী (আলাইহির রহমত)কে ৭ (সাতটি) গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্বলিত এক ঐতিহাসিক চিঠি প্রেরণ করলেন আল্লামা ফজলে রাসূল বদায়ূনী (আলাইহির রহমত)।
উত্তরে আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী (আলাইহির রহমত) ওফাত ১২৭৯ হিজরি ১৮৫৬ ইংরেজি) এর ঐতিহাসিক বক্তব্য।
উল্লেখ্য যে, আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী (আলাইহির রহমত) হচ্ছেন শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর আপন নাতি, এবং শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর আপন ভাতিজা ও শাহ রফী উদ্দিন (আলাইহির রহমত)-এর পুত্র। অপরদিকে মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর আপন চাচাত ভাই। এজন্য এই ঐতিহাসিক চিঠির গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়।
আল্লামা ফজলে রাসূল বদায়ূনী (আলাইহির রহমত) তার লিখিত ‘তাহকীকুল হাকীকত’ নামক কিতাবে তা (প্রশ্নোত্তর) লিপিবদ্ধ করেছেন যা ১২৬৭ হিজরি সনে বোম্বাই থেকে তা প্রকাশ করা হয়।
আল্লামা কাজী ফজল আহমদ লুদিয়ানবী (আলাইহির রহমত) কর্তৃক সম্পাদিত ‘আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত’ নামক গ্রন্থের ৫৩০ পৃষ্ঠা থেকে ৫৩৮ পৃষ্ঠা ব্যাপীয়া এ প্রশ্নোত্তর সম্বলিত চিঠি হুবহু সংকলিত করা হয়।
নিম্নে তারই বঙ্গানুবাদ পেশ করা হলো-
(ফজলে রাসূল বদায়ুনীর লিখিত পত্র)
ছালামবাদ আরজ এই যে, শাহ ইসমাঈল দেহলভী কৃর্তৃক প্রণীত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার পর থেকে জন সাধারণের মধ্যে এ কিতাবের পক্ষে বিপক্ষে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
গ্রন্থের বিপক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন, তারা বলছেন, এ গ্রন্থের বক্তব্য ছলফে ছালেহীন ও ছাওয়াদে আ’জম তথা বড় জামায়াত এমনকি লিখকের খানদানের নীতি বা আক্বিদা ও আমলের সম্পূর্ণ বিরোধী।
এ কিতাবে লিখিত ফতওয়ার দরুন তার উস্তাদগণ হতে সাহাবায়ে কেরাম পর্যন্ত কেহই তার সাজানো কুফুর ও শিরিক হতে অব্যাহতি পাননি।
আর এ গ্রন্থের সপক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন, তারা বলছেন, এ গ্রন্থের বক্তব্য ছলফে সালেহীন ও তার খান্দানের অনুকূলে। এ ব্যাপারে আপনি যা জানেন, সম্ভবত অন্য লোকেরা তা জানেন না। একটা প্রবাদ আছে-اهل البيت ادرى ما فى البيت অর্থাৎ ঘরের লোক ঘরে কি আছে, তা অন্যের তুলনায় অধিক জ্ঞাত।
এরূপ ধারণা করে আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি। আশা করি সঠিক উত্তর প্রদান করবেন।
প্রশ্ন-১. ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবটি আপনার খানদানের আক্বিদা ও আমলের পক্ষে না বিপক্ষে?
প্রশ্ন-২. অনেকে বলেন ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের মধ্যে আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে কেরামের সাথে বে-আদবী করা হয়েছে। এর প্রকৃত অবস্থা কি?
প্রশ্ন-৩. শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের লেখকের কি হুকুম?
প্রশ্ন-৪. অনেকে বলেন- আরবের মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী জন্ম নিয়ে, সে নূতন মতবাদ প্রচার করেছিল। আরবের হক্বানী উলামায়ে কেরামগণ তার উপর তাকফীর বা কুফুরি ফতওয়া প্রদান করেছেন। ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবটি ওহাবী মতবাদ অনুযায়ী লিখিত?
প্রশ্ন-৫. মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর লিখিত ‘কিতাবুত তাওহীদ’ যখন হিন্দুস্তানে পৌঁছে তখন আপনার চাচাগণ (শাহ আব্দুল আজিজ, শাহ আব্দুল কাদির, শাহ আব্দুল গণি) ও আপনার পিতা (শাহ রফী উদ্দিন) এ কিতাব দেখে কী মন্তব্য করেছিলেন?
প্রশ্ন-৬. এ কথা বিপুল প্রচারিত ও প্রসিদ্ধ যে, যখন ওহাবী মাযহাবের নূতন মতবাদ প্রচার হলো তখন আপনি দিল্লির জামে মসজিদে তাশরীফ নিয়ে গেলেন, তখন আল্লামা রশীদুদ্দিন খাঁন দেহলভী (ওফাত ১২৫৯ হিজরি ১৮৪৩ ইংরেজি) প্রমুখ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ আপনার সাথে ছিলেন। আপনারা খাস ও আম সমাবেশে মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ও মাওলানা আব্দুল হাই সাহেবদ্বয়কে তর্কযুদ্ধে নিরুত্তর ও পরাজিত করেছিলেন। এ কথা কতটুকু সত্য?
প্রশ্ন-৭. ঐ সময় (১২৪০ হিজরি) আপনার খান্দানের শাগরিদ ও মুরিদগণ (মাও: ইসমাঈল দেহলভী ও আব্দুল হাই উভয়ের মতবাদের) তাদের পক্ষে ছিলেন, না আপনাদের পক্ষে ছিলেন?
(নিবেদক- ফজলে রাসূল বদায়ূনী)।
উপরোক্ত (সাতটি প্রশ্ন সংবলিত) পত্রের জবাবে আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী বিন শাহ রফী উদ্দিন দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত বক্তব্যের হুবহু বঙ্গানুবাদ নিম্নে পেশ করা হলো-
উত্তর ১. ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের নাম আমি (শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী) তাফবিয়াতুল ঈমান রেখেছি। অর্থাৎ এ কিতাব একীন ও বিশ্বাসের সাথে পাঠ করলে ঈমানদারের ঈমান আর থাকে না, বরং ধ্বংস হয়ে যায়।
‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের খণ্ডনে ‘মঈদুল ঈমান’ নামক কিতাব রচনা করেছি। ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘ তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাব শুধু আমাদের খান্দান কেন? সকল আম্বিয়া ও রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম) এর তাওহীদ ও ঈমান শিক্ষার পরিপন্থী। কেননা পয়গাম্বরগণকে তাওহীদ শিখাবার জন্য এবং খোদাপ্রদত্ত ঈমান ও আক্বিদার উপর চালাবার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবে খোদাপ্রদত্ত তাওহীদ ও পয়গাম্বরগণের সুন্নাতের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। ইসমাঈল দেহলভী শিরিক ও বিদআতের সংজ্ঞা নিজের ব্যক্তিমতে সাজিয়ে লোকদেরকে শিখাবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে তার লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের মাধ্যমে।
উত্তর ২. ইসমাইল দেহলভী নিজের ব্যক্তিমতে সাজিয়ে শিরকের যে সংজ্ঞা প্রণয়ন করে তাকভীয়াতুল ঈমান কিতাব রচনা করেছেন, তাতে ফিরিশতাগণ এমনকি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আল্লাহর শরীক হয়ে যান। (নাউজুবিল্লাহ)
ইসমাঈল দেহলভীর ব্যক্তিমতে সাজিয়ে ও যে শিরকের সংজ্ঞা প্রণয়ন করেছেন, ঐ শিরকের ফতওয়ায় যারা রাজি থাকেন তারাও আল্লাহতায়ালার নিকট অপছন্দনীয়।
ইসমাঈল দেহলভী মনগড়ামতে বিদআতের যে সংজ্ঞা সাজিয়েছে, তাতে আউলিয়ায়ে কেরাম ও সুফিয়ায়ে এজামগণ বিদআতী সাব্যস্ত হন। এটাই শক্ত বে-আদবীর লক্ষণ।
উত্তর ৩: প্রথম দু’টি উত্তর দ্বারা দ্বীনদার, গুণী-জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ অতি সহজে বুঝতে সক্ষম হবেন, যে পুস্তকের দ্বারা লোকগণ সংশোধন হওয়ার পরিবর্তে উশৃঙ্খল ও বিশৃঙ্খল সৃষ্টিকারী লোক জন্ম নেয় এবং সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে এজামগণের বিপরীত বা ব্যতিক্রম মত ও পথ প্রকাশ হতে থাকে, কষ্মিকালেও তা হেদায়তের রাস্তা হতে পারে না।
তার লিখিত পুস্তক বা আমলনামা আমার নিকট মওজুদ আছে। এ কিতাব পাঠ করলে হেদায়তের পরিবর্তে ফিৎনা ফাসাদ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী লোকের প্রভাব বৃদ্ধি হতে থাকবে। অধিকন্তু এ পুস্তিকা অশান্তি, মূর্খতা ও বোকামীর উৎসাহ প্রদান করে।
বাস্তব সত্য যে, আমাদের খান্দানে ইসমাঈল নামে এমন এক ব্যক্তির জন্ম নিয়েছে, আমাদের খানদানের অন্য সব আলেমদের সঙ্গে তার কোন প্রকারের মিল নেই।
আক্বিদা বা বিশ্বাস, নিছবত বা সম্বন্ধ কোন কিছুতেই মিল অবশিষ্ট রহিল না। সে আল্লাহর প্রতি উদাসীন হওয়ার দরুণ সবকিছু তা থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এটা সে প্রবাদ বাক্যের মতো: যখন যথাযত সম্মান প্রদর্শন করবে না, সেটাই বেদ্বীনি। আর তাই হলো।
উত্তর ৪. মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর পুস্তিকা ‘কিতাবুত তাওহীদ’ যেন মতন বা পাঠ ছিল। মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর লিখিত কিতাব ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ যেন সেই কিতাবুত তাওহীদেরই শরাহ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত।
উত্তর ৫. বড় চাচা (শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত) দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁকে বলতে শুনেছি যদি অসুস্থতার কারণে অপারগ না হতাম, তা হলে শিয়াদের বদ আক্বিদার বিরোদ্ধে যেভাবে ‘তোহফায়ে ইছনা আশারা’ কিতাব লিখেছি ঠিক তেমনিভাবে আব্দুল ওহাব নজদীর লিখিত ‘কিতাবুত তাওহীদ’ এর বাতিল আক্বিদার খণ্ডনে কিতাব লিখতাম।
তাকে (ইসমাইল দেহলভীকে) ওহাবী মতবাদে প্রভাবান্বিত করে বিপথগামী করেছে। আমার পিতা (রফী উদ্দিন মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত) তাকে (ইসমাঈল দেহলভীকে) দেখেননি।
বড় হযরত (শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত) এ কথা বলার পর ইসমাইল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ দ্বারা তার বদ আক্বিদা প্রকাশ হয়ে গেল। যখন তিনি তাকে গোমরাহ বলে জানতে পারলেন, তখন ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের খণ্ডনে লিখতে নির্দেশ দিলেন।
উত্তর ৬. প্রশ্নেবর্ণিত সব কিছুই বাস্তব সত্য। এজন্য আমি (মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী) পরামর্শের দৃষ্টিতে তাকে (ইসমাইল দেহলভী) বলেছিলাম তুমি সকল থেকে (আমাদের খান্দানের উলামায়ে কেরামের আক্বিদা ও আমল থেকে) বিচ্যুত হয়ে যে- দ্বীনের গবেষণা করছ, তা তুমি লিখে কেন প্রকাশ কর না।
এভাবে আমাদের পক্ষ থেকে যত প্রকারেরই প্রশ্ন হয়ে ছিল, কোন প্রশ্নেরই উত্তর না দিয়ে, শুধুমাত্র জ্বি হ্যাঁ, জ্বি হ্যাঁ বলতে বলতে মসজিদ থেকে সে চলে গেল।
উত্তর ৭. ১২৪০ হিজরিতে দিল্লীর জামে মসজিদে প্রথম বিতর্ক সভা পর্যন্ত আমাদের খানদানের ভক্ত মুরিদগণ সবাই আমাদের মতবাদ ও নীতির উপরই বহাল ছিলেন।
অতঃপর তার অবাস্তব কথা শুনে আনাড়ী লোকেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমাদের পিতার শাগরিদ ও মুরিদগণের মধ্যে অনেকেই এর থেকে বেঁচে থাকছেন। যদিও কেউ কেউ গিয়ে থাকেন তা আমাদের জানা নেই।
মোদ্দাকথা হলো
শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী ইবনে শাহ রফী উদ্দিন দেহলভী ইবনে শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহিমুর রহমত)
আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী ও আল্লামা ফজলে রাসূল বাদায়ূনী (আলাইহিমুর রহমত) এর উপরোক্ত ‘পত্রালাপ’ দ্বারা স্পষ্টভাবে এ কথা প্রমাণিত হলো, মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য তার খানদানের বিশিষ্ট বুজুর্গানে দ্বীন যথাক্রমে শাহ আব্দুর রহিম মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ আব্দুল কাদির মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ রফী উদ্দিন মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ আব্দুল গণি মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ মুছা দেহলভী ও শাহ মাখছুছ উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী প্রমুখ ইসলামজগতের বিজ্ঞ মোহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন, উলামায়ে কেরামগণের আক্বিদা ও আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
কেননা তাঁরা সকলই ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পূর্ণ আক্বিদায় বিশ্বাসী। অপর দিকে ইসমাঈল দেহলভী ছিল ওহাবী মতাদর্শের বিশ্বাসী।
এমনকি তার (ইসমাঈল দেহলভী’র) সমকালীন অন্যান্য আলেমগণের মধ্যেও অধিকাংশ উলামায়ে কেরামগণ ছিলেন সুন্নী আক্বিদায় বিশ্বাসী। যার দরুণ তাঁরা তাকভীয়াতুল ঈমান কিতাবের গোমরাহী পূর্ণ বক্তব্যকে সমর্থন করেন নি।
সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও ইসমাঈল দেহলভীর গুনকীর্তন করিয়াও এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। যেমন ‘চেতনায় বালাকোট সম্মেলন স্মারক ২০১০ এর ৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
‘ইতিহাসের আয়নায় যদি আমরা বাস্তব অবস্থা অবলোকন করি তাহলে দেখতে পাই, ইসমাঈল দেহলভীর লেখা ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থের বক্তব্যকে তার সমসাময়িক গুটি কতক লোক ছাড়া কেউ সমর্থন করেননি।’
অনুরূপ মাওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী সাহেবও একথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ইবনে তাইমিয়া প্রভাবিত ওহাবী মতালম্বী ছিলেন, তাই তিনি ইবনে তাইমিয়ার নীতি অনুসরণ করে কার্যক্রম চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু তারই জদ্দে আমজাদ শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর সুন্নি মতাদর্শভিত্তিক অনেক কিতাবাদি বিদ্যমান থাকার দরুন, ইসমাইল দেহলভী, তার ইবনে তাইমিয়াপন্থী ওহাবী মতবাদ সংবলিত রচনাবলী তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি।
এ সম্পর্কে ওহাবী মতাবলম্বী সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী তার লিখিত পুস্তক ‘তাজদীদে এহইয়ায়ে দ্বীন’ যার বঙ্গানুবাদ ‘ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন’ এর ৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
‘যদিও মাওলানা শাহ ইসমাইল শহীদ এ সত্য যথার্থরূপ উপলব্ধি করে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নীতি অনুসরণ করেন, কিন্তু শাহ ওলী উল্লাহ (রা.) রচনাবলীতেই এর যথেষ্ট জওয়াব সরঞ্জাম ছিল এবং শাহ ইসমাঈলের রচনাবলীও তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’
মাওলানা মওদুদী সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্যের দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- ১. মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ইবনে তাইমিয়ার বাতিল আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলেন।
অপরদিকে তারই জদ্দে আমজদ শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) ইবনে তাইমিয়ার বাতিল আক্বিদার পরিপন্থী সুন্নী আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলেন।
২. শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) ও তাঁরই সাহেবজাদাগণ বিশেষ করে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) ওহাবীদের বদ আক্বিদার মূলৎপাঠন কল্পে অনেক কিতাবাদী লিখে সুন্নি আক্বিদার প্রচার ও প্রসার করেছেন। সে কারণে ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ তাকভীয়াতুল ঈমান প্রভৃতি রচনাবালী বাতিল আক্বিদা প্রচারে তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
এমনকি মুহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী সম্পাদিত পরওয়ানা জুন ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত ও মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরখলী লিখিত ‘ওহাবীদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্রের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে ২৩ পৃষ্ঠা উল্লেখ রয়েছে-
‘ইসলামের চিরশত্রু ওহাবীদের দ্বিতীয় গুরু হচ্ছে মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী (১৭৭৯-১৯৩৯ খ্রি:) সে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর লিখিত গ্রন্থ ‘কিতাবুত তাওহীদ’ এর ভারতীয় সংস্করণ করে এর নাম দিয়েছে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’। সে ওহাবী মতবাদের নাম দিয়েছে তাওহীদপন্থী। সেই মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী তার ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা সম্পর্কে যে কটুক্তি করেছে তা হচ্ছে এই- ১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হায়াতুন্নবী নন, তিনি মৃত্যুবরণ করে মাটি হয়ে গেছেন। ২. নবীগণ মেথর, চামার ও অকেজো লোকদের মতো। ৩. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান বড়ভাইয়ের মত। ৪. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে গায়েব আছে মনে করা শিরিক। ৫. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা শিরিক। ৬. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমতুল্য অন্য কেউ জন্মলাভ করা সম্ভব।
মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ গ্রন্থে লিখেছে- নামাযের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেয়াল আসা গরু ও গাধার খেয়াল আসার চেয়ে নিকৃষ্টতম।’
মাওলানা হুছামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক পরওয়ানায় এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত, এ ধরণের আরো নিবন্ধ প্রকাশিত হউক এটাই আমরা কামনা করি। যাতে উপমহাদেশের ওহাবী মতবাদের প্রচারক ও তাদের লিখিত বই-পুস্তকে গোমরাহীপূর্ণ উক্তি জনসাধারণ জানতে পারে।
বড়ই পরিতাপের বিষয় মাওলানা হুছামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী এর বড়ভাই মাওলানা ইমাদউদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী লিখিত সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভীর জীবনীগ্রন্থ দ্বিতীয় সংস্করণে উপমহাদেশের ওহাবী মতবাদের প্রচারক মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত বা মুখনিঃসৃতবাণী ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামক বিতর্কিত কিতাবটিকে হেদায়েতের কিতাব বলে উল্লেখ করেছেন।
আমাদের কাছে তাদের উভয়ের বক্তব্যকে স্ববিরোধী বক্তব্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আল্লাহ তা’য়ালাই হেদায়তের মালিক।
________
সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবখানা মূলত: সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের মলফুজাত বা বাণী
____________________
‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা মূলত: সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের মলফুজাত বা বাণী
১. এ প্রসঙ্গে মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী তদীয় ‘জখিরায়ে কেরামত’ ১ম খণ্ড (মুকাশিফাতে রহমত) ২০ পৃষ্ঠায় লিখেন-
صراط المستقیم کہ اسکے مصنف حضرت سید صاحب اور اسکا کاتب مولانا محمد اسمعیل محدث دہلوی ہیں-
‘সিরাতে মুসতাকিম’ এর মুছান্নিফ বা মূল গ্রন্থকার হযরত সৈয়দ সাহেব (সৈয়দ আহমদ বেরলভী) এবং এর লেখক বা সংকলক মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল মোহাদ্দিসে দেহলভী।
২. জৈনপুরী সাহেব উক্ত জখিরায়ে কেরামত কিতাবের ২য় খণ্ড ২৩৪ পৃষ্ঠায় লিখেন-
اگر چہ حضرت پرومرشد برحق حضرت سید احمد ۔ ۔ ۔ ۔ انکے ملفوظات کو بھی جسکا نام صراط المستقیم ہے-
‘তার (সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের) মলফুজাত বা মুখনিঃসৃত বাণী ‘সিরাতে মুসতাকিম’ কিতাব।’ ৩. মাও: কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেব জখিরায়ে কেরামত ২য় খণ্ড ১৮৭ পৃষ্ঠায় লিখেন-
تقویۃ الایمان ہو ہر قسم کے شرک کے رد میں ہے اور صراط المستقیم جو تصوف میں ہے اور حضرت سید صاحب ممدوح نے اسکو لکھوایا-
অর্থাৎ ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ হচ্ছে প্রত্যেক প্রকার শিরকের খণ্ডন এবং ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাব, যা ইলমে তাছাউফ সম্পর্কীয় এবং হযরত সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব উক্ত কিতাবখানা লিখায়েছেন।
৪. জৈনপুরী সাহেব জখিরায়ে কেরামত ৩য় খণ্ড ১৬২ পৃষ্ঠায় লিখেন-
سید احمد قدس سرہ کی کتاب صراط مستقیم کو جسکو مولانا محمد اسماعیل رحمہ اللہ نے لکھاہے-
অর্থাৎ ‘সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের কিতাব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ যা মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল ছাহেব লিখেছেন।’
উপরোক্ত চারটি এবারতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম সৈয়দ আহমদ বেরলভী ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবের মুসান্নিফ বা মূলগ্রন্থকার।
সিরাতে মুস্তাকিম সৈয়দ আহমদের ‘মলফুজাত’ বা বাণী।
সিরাতে মুস্তাকিম সৈয়দ আহমদের কিতাব লেখক ইসমাইল দেহলভী।
সৈয়দ আহমদ ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবকে লিখায়েছেন।
______
‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ ও সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবদ্বয়ের কতিপয় সমর্থকগণ
____________________
‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ ও সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবদ্বয়ের কতিপয় সমর্থকগণ
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বিতর্কিত সিরাতে মুস্তাকিম ও ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবদ্বয়ের গোমরাহীপূর্ণ বক্তব্যকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারী উলামায়ে কেরাম ও নবীপ্রেমিক সুন্নি মুসলমানগণ কোন ক্রমেই গ্রহণ করতে পারেন নি, এমনকি তারা আজ পর্যন্ত এর জোড় প্রতিবাদ ও খণ্ডন করে আসছেন। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, জৈনপুরী ও দেওবন্দী সিলসিলাভুক্ত একশ্রেণীর আলেম ঐ কিতাবদ্বয়ের গোমরাহীপূর্ণ বক্তব্যকে সাদরে গ্রহণ করে এর পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
নিম্নে কতিপয় সমর্থকদের পরিচয় পেশ করা হলো
১) মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী তার লিখিত জখিরায়ে কেরামত নামক কিতাবের ১ম খণ্ড ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
سواس فقیر نے تقویۃ الایمان کو جو خوب بغور دیکھا تو اسکا اصل مطلب سب اھل سنت کے مذھب کے موافق پایا اور عبارت اور الفاظ بھی اسکے بہت اچھے پائے گئے مگر پھر بھی اگر اس کتاب کی کوئ عبارت بے ڈھب پاویں اور جانیں کہ لفظ کے لکھنے میں مصنف (رح) سے خطا ہوئ تو ایک دو الفاظ میں خطا ہونیکے سبب سے اس سچی کتاب کو جو شرک کے رد میں ہے جھوٹی سمجھ کے مشرک نہ بنیں-
অর্থাৎ ‘সুতরাং আমি (মাও: কেরামত আলী জৈনপুরী) তাকভীয়াতুল ঈমান কিতাবকে গভীরভাবে দেখেছি (খুব মনোযোগের সহিত আদি অন্ত পাঠ করেছি) এটার মূল বিষয় সকল আহলে সুন্নাতের মাযহাব সম্মত পেলাম এবং এই কিতাবের এবারত ও শব্দাবলীতে অত্যন্ত উন্নতমানের পেয়েছি। তবুও যদি এই কিতাবের কোন এবারাত কোন প্রকার অসামাঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয় এবং একথা মনে করে যে শব্দটি লিখতে লিখকের ভুল হয়ে গিয়েছে তবুও দুই এক শব্দ ভুল হওয়ার দরুন শিরকের খণ্ডনে লিখা এ সত্য কিতাবকে মিথ্যা মনে করে কেহ যেন মুশরিক না হয়।’
জৈনপুরী কেরামত আলী সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত হলো তার নিকট ‘তাকভীয়াতু ঈমান’ কিতাবের সম্পূর্ণ বক্তব্য হক বা সঠিক।
আর ‘সিরাতে মুসতাকিম’ কিতাবকে সমর্থন করতে গিয়ে মাও: কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেব তার ‘জখিরায়ে কেরামত’ নামক কিতাবের ৩য় খণ্ড ১৩৭-১৩৮ পৃষ্ঠায় লিখেন-
بعد اسکے فقیر کھتا ہے کہ حضرت مرشد برحق سید احمد قدس سرہ العزیز سے اس فقیر نے بیعت ارادت کی کیا اور ان کی ھدایت سے اللہ تعالی کی معرفت سے اپنی جھل اور نادانی ثابت ہوگئ اور مشاھدہ سے نجات پاکے معرفت سے حیرت کی طرف پہنچا اور شرک اور بدعت سے پاک ہوا اور بموجب مضمون خلاقت نامه کے اور انکی کتاب صراط المستقیم کے مضمون کے موافق یہاں سے بنگالے تک شرک و بدعت کو مٹایا-
অনুবাদ: অতঃপর ফকীর (আমি কেরামত আলী জৈনপুরী) বলতেছি যে, হযরত মুর্শিদে বরহক সৈয়দ আহমদ কুদ্দিছা ছিরহুর নিকট পীর মুরিদীর বাইয়াত গ্রহণ করি, এবং তার হেদায়েত দ্বারা আল্লাহ তায়ালার মা’রিফাত হাসিলের মাধ্যমে স্বীয় অজ্ঞতা নাদানী প্রকাশ হলো এবং মোশাহাদার মাধ্যমে ঐ অজ্ঞতা থেকে নি®কৃতি করে শিরিক ও বিদআত হতে মুক্তি পেলাম। হুজুরের (সৈয়দ আহমদ বেরলভীর) দেওয়া খেলাফত নামা ও তার কিতাব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ এর বিষয় বস্তুর মর্মানুযায়ী এখান থেকে (জৈনপুর থেকে) বাংলা পর্যন্ত শিরিক ও বিদআতকে উৎখাত করি।’
জৈনপুরী সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্যের দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো-
ক) জৈনপুরী সাহেবের পীর ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ বেরলভী।
খ) সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের নিকট বায়আত হওয়ার পূর্বে জৈনপুরী কেরামত আলী সাহেব মুশরিক ও বিদআতী ছিলেন।
গ) জৈনপুরী সাহেব সৈয়দ আহমদ সাহেবের নিকট বায়আত করার পর শিরিক ও বিদআত থেকে তিনি পাক হয়ে ঈমানদার হয়েছেন। (পূর্বে ঈমানদার ছিলেন না)।
ঘ) তিনি ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবের বিষয় বস্তুর মর্মানুযায়ী জৈনপুর থেকে বাংলা পর্যন্ত শিরিক ও বিদআতকে উৎখাত করেছেন।
জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবের কতিপয় বাতিল ও কুফুরি আক্বিদা ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। জৈনপুরী সাহেব সেই বাতিল আক্বিদা ইসলামের সঠিক আকিদা সাব্যস্ত করে জৈনপুর থেকে বাংলা পর্যন্ত বাতিল আক্বিদা প্রচার করে তার ভ্রান্ত ও বাতিল আক্বিদাকে ঈমানী আক্বিদা বলে প্রকাশ করে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ)
২) মাওলানা আব্দুল বাতেন জৈনপুরী (ইবনে মাওলানা আব্দুল আউয়াল ইবনে মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেব) প্রণীত ‘মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেবের জীবনী’ নামক গ্রন্থের ১৩১ পৃষ্ঠায় লিখা আছে-
‘কাজেই এই নগণ্য খাদেম ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবখানা খুব ভাল করিয়া দেখিলাম। ইহাতে দেখিতে পাইলাম যে, উক্ত কিতাবের মূল উদ্দেশ্য সুন্নাতুল জামাতের মাযহাব অনুযায়ী। উক্ত কিতাবের শব্দ ও বাক্যবলী বেশ সুন্দর দেখিতে পাইলাম।’
৩) সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের ছিলসিলাভূক্ত, কুমিল্লা জেলার সোনাকান্দা নিবাসী মাওলানা মোহাম্মাদ আব্দুর রহমান হানাফী (সোনাকান্দার পীর সাহেব) কর্তৃক লিখিত ১৯৫৯ ইং সনে প্রকাশিত ‘আনিছুত্তালেবীন’ নামক পুস্তকের ৪র্থ খণ্ডের ৫১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
‘হযরত মোজাদ্দিদ সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত সিরাতে মুস্তাকিম।’
৪) ইংরেজ ঐতিহাসিক হান্টার তার লিখিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ নামক পুস্তক ৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ বা সরলপথ এটি সৈয়দ আহমদের বাণীর সংকলন। মওলভী ইসমাইল দেহলভী কর্তৃক লিখিত।’
৫) ফুলতলী সাহেবের জ্যৈষ্ঠপুত্র মাওলানা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী সাহেব কর্তৃক লিখিত ‘সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) জীবনী। (দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশকাল ১৯৯২ইং) নামক পুস্তকের ৬৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- ‘বুলগেরিয়ার একজন সুপ্রসিদ্ধ আলিম যিনি ফারসি ভাষা জানতেন, সৈয়দ সাহেবের নিকট বয়াত করেন। সৈয়দ সাহেব তাকে খিলাফত প্রদান করত: ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবের একটি অনুলিপি প্রদান করে বুলগেরিয়া বাসীর হেদায়াতের উদ্দেশ্যে প্রেরন করেন।’
উক্ত পুস্তকের ৭২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
‘সৈয়দ হামযা নামক এক ব্যক্তি স্বর্ণ ও অন্যান্য জওহরাত নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি সৈয়দ ছাহে্েবর হাতে বয়াত করেন। সৈয়দ ছাহেব তাকে তালিম ও তলকিন করেন এবং খিলাফতনামা প্রদান করে একখানা ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ প্রদান করে বার্মাবাসীর হেদায়তের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।’
উল্লেখ্য যে মাওলানা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী সাহেব তার পুস্তকের দুই জায়গায় স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের মলফুজাত ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাব হেদায়াতের কিতাব। অথচ কোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবের অনেক উক্তি বাতিল এমনকি কুফুরি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ইতোপূর্বে দলিলসহ মুখতছরভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
৬) দেওবন্দীগণের নেতা মৌলভী রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেব তার লিখিত ‘ ফতোয়ায়ে রশিদীয়া’ নামক কিতাবের ৪২ পৃষ্ঠায় মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী ও তার লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাবের প্রশংসায় বলেন-
مولوی محمد اسمعیل صاحب عالم متقی بدعت کے اکھاڑنے والے اور سنت کے جاری کرنے والے اور قران و حدیث پر پورا پورا عمل کرنے والے اور خلق کو ھدایت کرنے والے تھے اور تمام عمر اسی حال میں رھے آخرکار فی سبیل اللہ جھاد میں کفارکے هاتھ سے شھید ہوۓ- پس جسکا ظاھر حال ایساھووے وہ ولی اللہ اور شھید ہے - - - اور کتاب تقویۃ الایمان نھایت عمدہ کتاب ہے اور وہ رد شرک و بدعت میں لاجواب ھے استدلال اسکے بالکل کتاب اور احادیث سے ھیں اسکا رکھنا اور پڑھنا اور عمل کرنا عین اسلام ھے-
অর্থাৎ ‘ মৌলভী মোহাম্মদ ইসমাঈল দেহলভী সাহেব ছিলেন একজন পরহেজগার আলেম- বিদআতের উচ্ছেদ ও সুন্নতের প্রচলনকারী। কোরআন হাদিসের পরিপূর্ণ আমিল ও সৃষ্টির হেদায়তকারী এবং তামাম জিন্দেগী এই রাস্তায় কাটিয়েছেন। সর্বশেষে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের মধ্যে কাফেরদের হাতে শহীদ হয়ে গিয়েছেন। অতএব বাহ্যিক অবস্থা এইরূপ হয়েছে। তিনি আল্লাহর ওলী এবং শহীদ। উহা শিরিক ও বিদআতের খণ্ডনে লা জওয়াব এবং উহার দালাইল সম্পূর্ণ কোরআন হাদিস হতে গৃহীত। উহাকে প্রত্যেকের নিকট রাখা, পড়া এবং আমল করাই প্রকৃত ইসলাম।’
গাঙ্গুহী সাহেব উক্ত কিতাবের ৪৪ পৃষ্ঠায় বলেন-
بندہ کے نزدیک سب مسائل اسکے صحیح ھیں اگر چہ بعض مسائل میں بظاھر تشدد ھے اور توبہ کرنا ان کا بعض مسائل سے محض افترا اھل بدعت کا ہے-
অর্থাৎ ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের সমস্ত মাসায়েল আমার নিকট সহী শুদ্ধ। যদিও বাহ্যিকভাবে কোন মাসায়েল সীমা লঙ্ঘন হয়েছে মনে হয়। আর ইসমাইল সাহেব তার কোন কোন মাসায়েল থেকে তওবা করেছেন এই খবর বিদআতীদের অপবাদ মাত্র।’
৭) দেওবন্দীগণের মুরুব্বি মৌলভী আশরাফ আলী থানবী সাহেব তার লিখিত ‘এমদাদুল ফতোয়া’ নামক কিতাবের ৪র্থ খণ্ডের ১১৫ পৃষ্ঠায় ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ প্রসঙ্গে বলেন-
تقویۃ الایمان میں بعض الفاظ جو سخط واقع ہوگئے ہیں تو اس زمانہ کی جھالت کا علاج تھا-
অর্থাৎ ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের মধ্যে কোন কোন শব্দ যা শক্ত হয়েছে তা ঐ যুগের জেহালত বা মূর্খতার ঔষধ ছিল।’
উপরোক্ত বক্তব্যের দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, মৌলভী রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী ও মৌলভী আশরাফ আলী থানবী সাহেব তারা উভয়ই ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের বাতিল আক্বিদায় পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন।’ (নাউজুবিল্লাহ)
______
মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবে যে সমস্ত বক্তব্য বাতিল এবং ওহাবী আক্বিদা হিসেবে প্রমাণিত তন্মধ্যে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বিদা
____________________
মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবে যে সমস্ত বক্তব্য বাতিল এবং ওহাবী আক্বিদা হিসেবে প্রমাণিত তন্মধ্যে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বিদা নিম্নে প্রদত্ত হলো
১. হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বড়ভাই সুতরাং তাঁকে বড়ভাইয়ের ন্যায় সম্মান করতে হবে। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান ৬০ পৃষ্ঠা)
২. বড় মাখলুক অর্থাৎ হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর শানের সম্মুখে চামার হতেও নিকৃষ্ট। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান- ১৪ পৃষ্ঠা)
৩. আঁ হযরত বলেছেন, আমিও একদিন মরে মাটিতে মিশে যাব।’ (নাউজুবিল্লাহ) তাকভীয়াতুল ঈমান- ৬১)
৪. আল্লাহর রাসূলকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর সৃষ্টি বলে আক্বিদা রেখে যদি কেহ আল্লাহর হাবীবের কাছে সুপারিশ বা শায়ায়াত তলব করে সে আবু জেহেলের মতো মুশরিক হবে। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান- ৮)
৫. আল্লাহ তায়ালা যখন ইচ্ছা করেন, তখনই গায়েব সম্মন্ধে অবগত হয়ে যান, এটা আল্লাহ ছাহেবের শান বা পজিশন। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান-২০ পৃষ্ঠা)
৬. খোদা প্রদত্ত ক্ষমতা বলে নবীগণ, আউলিয়ায়ে কেরামগণ মানুষের বিপদ মুক্তি করতে পারেন, বিপদ মুক্তি করে থাকেন ইহা কুফুরি। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান- ১০ পৃষ্ঠা)
৭. হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন গায়েবই জানেন না। (নাউজুবিল্লাহ) তাকভীয়াতুল ঈমান- ৫৮ পৃষ্ঠা)
৮. গ্রামের জমিদার ও প্রত্যেক সম্প্রদায়ের চৌধুরীর যেই রূপ মর্যাদা রয়েছে ঠিক সেই অর্থেই প্রত্যেক পয়গাম্বর নিজ নিজ জাতির নিকট মর্যাদাবান (এর বেশি নয়) নাউজুবিল্লাহ (তাকভীয়াতুল ঈমান ৬৪ পৃষ্ঠা)
৯. দুনিয়াতে যত পয়গাম্বর এসেছেন, তারা আল্লাহর পক্ষ হতে এ হুকুমই নিয়ে এসেছিলেন যে, আল্লাহকে মানো (মান্য কর) আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মানবে না। (মান্য করবে না) (তাকভীয়াতুল ঈমান ১৫ পৃষ্ঠা)
নবীগণ, ফিরিশতাগণ, কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নাম সব কিছুই মানতে হবে অর্থাৎ আল্লাহকে ও যেমনিভাবে মানতে হবে (ঈমান আনতে হবে) ঠিক সেভাবে উপরে বর্ণিত সকল বস্তুর উপর ঈমান আনয়ন করা ঈমানের অঙ্গ।
সুপারিশ তলব করার ব্যাপারে
১০. আউলিয়া, আম্বিয়া, জ্বিন, শয়তান, ভূত, পরীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। (তাকভীয়াতুল ঈমান -৮ পৃষ্ঠা)
কোন নবী, ওলী, জ্বিন, ফেরেশতা, পীর, শহীদ, ইমাম, ইমাম জাদা, ভূত ও পরীকে আল্লাহ সাহেব কোন ক্ষমতা দান করেন নাই।
এখানে ভূত ও পরীকে আম্বিয়ায়ে কেরামদের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
এই ব্যাপারে ছোট বড় সমস্ত বান্দাই (নবী, ওলী) অক্ষম, অক্ষমতায় সবাই এক সমান।
______
মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেবের লিখিত ‘জখিরায়ে কেরামত’ নামক কিতাবে যে সমস্ত ভ্রান্ত ওহাবী আক্বিদা হিসেবে প্রমাণিত এর মধ্যে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বিদা
____________________
মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেবের লিখিত ‘জখিরায়ে কেরামত’ নামক কিতাবে যে সমস্ত ভ্রান্ত ওহাবী আক্বিদা হিসেবে প্রমাণিত এর মধ্যে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বিদা নিম্নে প্রদত্ত হলো
বাতিল আক্বিদা-১. (জখিরায়ে কেরামত ১ম খণ্ড ২৩১ পৃষ্ঠা)
‘নামাযে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল হতে নিজের গরু-গাধার খেয়ালে ডুবে থাকা ভাল। ইচ্ছা করে রাসূলেপাকের খেয়াল করলে মুশরিক হবে। আর অনিচ্ছায় নবীয়ে পাকের খেয়াল এসে গেলে শয়তান ওয়াছ ওয়াছা দিয়েছে মনে করে ওয়াছ ওয়াছা ওয়ালী এক রাকাআতের পরিবর্তে চার রাকাআত নফল নামায আদায় করতে হবে। (সিরাতে মুস্তাকিমেও অনুরূপ রয়েছে)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা হলো-
নামাযের মধ্যে তাশাহহুদ অথবা তেলাওয়াতে কালামেপাকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মোবারক আসলে রাসূল হিসেবে খেয়াল ও তা’জিম করতে হবে।
এহইয়ায়ে উলুমিদ্দিন ১/৯৯ পৃষ্ঠায় নামাযের বাতেনী শর্তের বয়ানে উল্লেখ আছে-
واحضر فى قلبك النبى صلى الله عليه وسلم وشخصه الكريم وقل السلام عليك ايها النبى ورحمة الله وبركاته
অর্থাৎ ‘তোমার ক্বলব বা অন্তরে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাজির করো এবং তাঁর পবিত্র দেহাকৃতিকে উপস্থিত জানবে এবং বলবে আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবীউ ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতাহু।’
শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ ২/৩০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
ثم اختار بعده السلام على النبى صلى الله عليه وسلم تنويها بذكره واثباتا للاقرار برسالته واداء لبعض حقوقه
অর্থাৎ ‘অতঃপর (তাশাহহুদের মধ্যে) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার উপর সালাম প্রদানকে নির্ধারণ করেছেন, এজন্য যে, নবীর জিকির (স্মরণ) যেন তা’জিমের সাথে হয় এবং নবীর রিসালতের স্বীকৃতি যেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং তাঁর কিছু হক্বও যেন আদায় হয়ে যায়।’
দেখলেন তো! জৈনপুরী কেরামত আলী ফতওয়া প্রদান করলেন ইচ্ছা করে নামাযে তা’জিমের সাথে নবীর খেয়াল করলে মুশরিক হবে। অপরদিকে শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) নবীর শান যে মহান তা প্রমাণ করতে গিয়ে বলেন, তা’জিমের সাথে নবীর জিকির হওয়ার জন্যই তাশাহহুদে আল্লাহর হাবীবকে সালাম প্রদান করার বিধান আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। সাথে সাথে রিসালতের স্বীকারোক্তি ও নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কিছু হক আদায় হওয়ার কথাও ব্যক্ত করেছেন।
কি আশ্চর্যের বিষয় জৈনপুরী কেরামত আলীর ফতওয়ায় শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী, ইমাম গাজ্জালী (আলাইহির রহমত) সহ সকল মুহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন এমনকি সাহাবায়ে কেরামও মুশরিক সাব্যস্থ হয়ে যান। (নাউজুবিল্লাহ)
বাতিল আক্বিদা-২. (জখিরায়ে কেরামত ৩/১১২ পৃষ্ঠা)
‘মাহফিলে মিলাদে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার রূহ মোবারক হাজির হন এ আক্বিদা রাখা শিরিক।’
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা হলো-
আল্লাহর হাবীব ছরকারে কায়েনাত নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক ঈমানদার মুসলমানদের প্রতিটি ঘরে হাজির আছেন।
শরহে শিফা মূল্লা আলী ক্বারী (আলাইহির রহমত) নাছীমুর রিয়াজ) ৩/৪৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
ان لم يكن فى البيت احد فقل السلام على النبى ورحمة الله وبركاته اى لان روحه عليه السلام حاضرة فى بيوت اهل الاسلام
বাতিল আক্বিদা- ৩. জৈনপুরী সাহেবের আক্বিদা ও বিশ্বাস হলো-
‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবে ইসমাইল দেহলভী যা লিখেছেন তা সঠিক। এ কিতাব (তাকভীয়াতুল ঈমান) তিনি নিজেই গভীর মনোযোগের সাথে দেখেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন যে, ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবে লিখিত সকল আক্বিদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পূর্ণ অনুকুলে, তার মধ্যে কোন ব্যতিক্রম নেই। (তাকভীয়াতুল ঈমান) কিতাবে অনেক গুলি কুফুরি আক্বিদা থাকা সত্ত্বেও জৈনপুরী সাহেব তা সমর্থন করে নিলেন) (নাউজুবিল্লাহ)
বাতিল আক্বিদা-৪. জখিরায়ে কেরামত ১/২০ পৃষ্ঠায় মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেব তাহকীকের সাথে ফতওয়া দিচ্ছেন, যারা ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবে লিখিত আক্বিদাগুলিকে সমর্থন করবে না, তারা মুশরিক বা ঈমানহারা। (জৈনপুরী সাহেবের ফতওয়া তাকভীয়াতুল ঈমানের কুফুরি আক্বিদা সমর্থন না করলে মুশরিক) (নাউজুবিল্লাহ)
বাতিল আক্বিদা-৫. জৈনপুরী সাহেবের বক্তব্য ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবটি সঠিক কিতাব। অতঃপর তিনি নসিহত করে বলেন, এই কিতাবকে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করে যেন কেহ মুশরিক না হয়। (কত বড় আজগুবি কথা নাউজুবিল্লাহ)
জৈনপুরী সাহেবের এসব বক্তব্য দ্বারা বুঝা গেল যখন ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবখানা ইসমাইল দেহলভী লিখে প্রকাশ করেছিল, তখনই এ কিতাবের বাতিল আক্বিদার রদে বা প্রতিবাদে হক্বানী ওলামায়ে কেরাম বই-পুস্তক লিখেছিলেন এবং সরলপ্রাণ মুসলমানগণকে এ কিতাবের বাতিল আক্বিদা থেকে ঈমান রক্ষা করতে পারে এ প্রসঙ্গে হেন্ডবিলও প্রকাশ করেছিলেন।
বাতিল আক্বিদা-৬. জৈনপুরী কেরামত আলী সাহেব ভ্রান্ত ফতওয়া: জখিরায়ে কেরামত ১/২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
اور اگر اپنی مرشد میں جس سے بیعت کرچکا ہے عقیدے کا فساد نہ پاوے اگر چہ وہ مرشد گناہ کبیرہ میں گرفتار ہو تو اسکے بیعت کے علاقے کو نہ چہوڑے۔
ভাবার্থ: আপনি যে মুর্শিদ বা পীরের নিকট বায়আত গ্রহণ করেছেন (মুরিদ হয়েছেন) তার মধ্যে যদি আক্বিদাসংক্রান্ত মাসআলার মধ্যে কোন ফাসিদ আক্বিদা না থাকে, এ ধরনের পীর ও মুর্শিদ যদিও কবীরা গোনাহে লিপ্ত থাকেন, এমতাবস্থায়ও তার বায়আত এর এলাকা ছাড়বে না অর্থাৎ তাকে মুর্শিদ হিসেবে মানবে। এ কবীরা গোনাহে লিপ্ত থাকার দরণ এ মুর্শিদকে ত্যাগ করে অন্য কোন মুর্শিদের আশ্রয় নিবে না।’
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতে কবীরা গোনাহে লিপ্ত থাকা যার সঠিক ভাবার্থ হলো- নামায ছেড়ে দেওয়া, জিনা ও শরাব পানে লিপ্ত থাকা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, যে এ সকল কুকর্মে লিপ্ত থাকবে, সে মুর্শিদ হতে পারবে না।
মুর্শিদ হওয়ার জন্য শর্ত হলো- ১. আক্বিদা শুদ্ধ থাকতে হবে। ২. মুত্তাকী ও পরহেজগারিতে অটল থাকবে। অর্থাৎ কবীরা ও ছগীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকবে অর্থাৎ কবীরা ও ছগীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকবে এমনকি সুন্নাত মোতাবেক প্রত্যেকটি কাজকর্ম অবশ্যই আঞ্জাম দিবেন।
মুর্শিদ যদি গোনাহে কবীরাতে লিপ্ত থাকেন এবং সুন্নতবিরোধী কার্যক্রমে অভ্যস্থ থাকেন, তাহলে এ মুর্শিদ তার মুরিদকে কি শিক্ষা দিবেন?
এ প্রসঙ্গে শরহে আক্বাঈদে নাসাফী ১১০ পৃষ্ঠায় (পুরাতন ছাপা) উল্লেখ রয়েছে-
اصل المسالة ان الفاسق ليس من اهل الولاية عند الشافعى رح لانه لاينظر لنفسه فكيف ينظر لغيره
জৈনপুরী কেরামত আলী সাহেব এ ধরণের ফতওয়া প্রদানের কারণ হলো- বালাকোটের যুদ্ধে তার পীর ও মুর্শিদ পাঠান মেয়েদেরকে জোরপূর্বক বিবাহ করেছেন। জোরপূর্বক কোন বিবাহ শুদ্ধ হয় না, মহিলা রাজি হয়ে এজিন দিতে হবে। এজিন ব্যতিরেকে কোন বিবাহ শুদ্ধ হয় না।
জৈনপুরীর পীর ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ বেরলভী জোরপূর্বক পাঠান মেয়েদেরকে বিবাহ করেছেন, হয়তো কোন মহিলা এজিন দেয় নাই, এমতাবস্থায় তার বিবাহ হল। যার কারণে এ মিলন কবীরা গোনাহে পরিণত হলো। সে প্রেক্ষাপটে জৈনপুরী সাহেবের মুর্শিদের পীরাকী অক্ষুন্ন রাখার জন্য তিনি এ ধরণের জঘণ্য ফতওয়া প্রদান করলেন।
উল্লেখ্য যে, ব্যভিচার ও চুরি করলে হবে ফাজির এবং নামায কাযা বা এ ধরণের অন্যান্য গোনাহে কবীরাতে লিপ্ত থাকলে হবে ফাছিকে মু’লিন বা প্রকাশ্য ফাসিক।
আল্লাহপাক সঠিক ঈমান ও আমলের হেফাজতের মালিক।
_____
সৈয়দ আহমদ বেরলভী কি মুজাদ্দিদ?
____________________
সৈয়দ আহমদ বেরলভী কি মুজাদ্দিদ?
চেতনায় বালাকোট সম্মেলন স্মারক ২০১০ইং-এর ৫২ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত, কাযী মুহাম্মদ আবুল বয়ান এম, আর, রহমান হাশেমীর লিখিত-
‘মুসলিম চেতনায় বালাকোট ও সৈয়দ আহমদ শহীদ’ নামক প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখ রয়েছে-
‘হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ যিনি তেরোশ হিজরির মুজাদ্দিদ’।
ইসলামী শরিয়তমতে শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হওয়ার জন্য যেসব শর্তাবলী ও গুণাবলী বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন, সৈয়দ আহমদ বেরলভীর কাছে আদৌ তা বিদ্যমান নেই। সুতরাং তাকে তেরোশ হিজরির মুজাদ্দিদ বলে আখ্যায়িত করা, তা প্রচার করা, অবাস্তব, অবান্তর ও বাতুলতামাত্র।
মুজাদ্দিদ শব্দ আরবি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় একটি বিশেষ ধর্মীয় মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিকে মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক বলা হয়। তাছাড়া এ বিষয়ে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যত বাণী করেছেন-
ان الله يبعث لهذه الامة على رأس كل مأئة سنة من يجدد لها امر دينها
অর্থাৎ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা এই উম্মতের ধর্মীয় কার্যা বলী সংস্কার সাধনের জন্য প্রতি শতাব্দীর প্রারম্ভে মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক পাঠাবেন’। (আবু দাউদ শরীফ- ২৪৯ পৃ.)
উপরোক্ত হাদীসশরীফে বর্ণিত من يجدد (মান ইউজাদ্দিদু) শব্দ থেকে মুজাদ্দিদ শব্দের উৎপত্তি।
মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও ফুকাহায়ে এজাম, এ হাদীসশরীফে নির্দিষ্ট শব্দ, ‘মান ইউজাদ্দিদু’ এর পরিপ্রেক্ষিতে মুজাদ্দিদ শব্দটিকে ইসলাম ধর্মের একটি প্রচলিত পরিভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
মুহাদ্দিছীনে কেরাম ও ফুকাহায়ে এজাম ‘মুজাদ্দিদ’ এর অন্যতম বিশেষ পরিচয় বর্ণনা করে বলেছেন, ‘মুজাদ্দিদ এক শতাব্দীর হিজরি সনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং জন্ম শতাব্দীতেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে জাহেরি, বাতেনী ইলিম ও মুজাদ্দিদের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে নির্দ্ধিধায় তাজদীদে দ্বীন বা দ্বীনের সংস্কারের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। এমনকি মৃত্যুকালীন হিজরি সনেও দায়িত্ব পালন করে যাবেন। অর্থাৎ শরিয়ত মতে প্রকৃত মুজাদ্দিদকে এক শতাব্দীর হিজরির শেষান্তে, পর শতাব্দীর শুরুতে উভয় শতাব্দীতে যথা নিয়মে মুজাদ্দিদের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
মুহাদ্দিসীন ও ফকীহগণের মতে ‘মুজাদ্দিদের পরিচয় হচ্ছে দ্বীন ইসলামের মৃত বিলুপ্ত, বিকৃত হুকুম-আহকাম ও আকিদাকে কোরআন সুন্নাহর মর্মানুসারে সাহাবায়ে কেরামগণের পূর্ণ অনুকরণে পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সংশোধন করা অর্থাৎ আকিদা ও আমলের মুর্দা সুন্নাতকে জিন্দা করা।
বিশেষত যথাসময়ে সৃষ্ট ভ্রান্ত মতবাদ ও বদ-আকিদার বিরুদ্ধে লেখা, ফত্ওয়া, ওয়াজ-নসিহত দ্বারা যথা সাধ্য ও নিয়মানুসারে সংগ্রাম করে সত্য ও বিশুদ্ধ আকিদা ও আমলে প্রচার ও প্রবর্তন করা মুজাদ্দিদের প্রধানতম দায়িত্ব।
উপরে বর্ণিত শর্ত-শরায়েত ছাড়া কতেক লোক বর্তমানে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে মুজাদ্দিদ বলে আখ্যায়িত করে বই-পুস্তক রচনা ও পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশ করে আসছে।
চেতনায় বালাকোট সম্মেলন স্মারক ২০১০ইং ও এরই ধারাবাহিক একটি প্রকাশনা মাত্র।
এতে সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রপথিক সিপাহসালার, শহীদে বালাকোট, আমিরুল মু’মিনীন, ইমামুত তরিকত ইত্যাদি ভূয়া উপাধিতে ভূষিত করে প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রায় দেড়শত বছর পরে এরূপ ভূয়া দাবি ও প্রচার করে জনসাধারণকে ধোকা দেয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। এসব ভূয়া, মিথ্যা দাবিদার ও প্রচারকদের জন্য সত্যই দঃখ, আফসোস হয়।
বর্তমানে লেখকদের জানা উচিত ছিল যে, সৈয়দ আহমদ বেরলভী কখনো ‘মুজাদ্দিদ’ ছিলেন না। ‘মুজাদ্দিদ’ হওয়ার জন্য যে সব যোগ্যতা, গুণাবলী ও শর্তাবলী থাকা আবশ্যক সেসব যোগ্যতা ও শর্তাবলী তার মধ্যে পাওয়া যায়নি বা তার মধ্যে আদৌ বিদ্যমান নেই।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের সিলসিলাভুক্ত বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আবুল হাসানাত আব্দুল হাই লাখনভী (ওফাত ১৩০৪ হিজরি) সাহেবের লিখিত ‘মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া’ নামক কিতাবের (যা এইচ, এম, ছাঈদ কোম্পানী আদব মঞ্জিল চক, করাচী পাকিস্তান, থেকে ১৪০৩ হিজরি সনে প্রকাশিত) এর ১১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
ان عبارتوں سے معلوم ہواکہ سید احمد برلوی جو سنہ۱۲۰۱ ھ میں پیدا ہوے ہیں اور انکے مرید مولانا اسمعیل دہلوی بھی اس حدیث کے مصداق میں داخل نہیں کیونکہ مجدد کیلۓ ضروری ہے کہ ایک صدی کے آخر میں اور دوسری صدی کے شروع میں ان اوصاف کا پایا جاۓ
অর্থাৎ ‘শতাব্দীর মুজাদ্দিদসংক্রান্ত হাদীস ও মুহাদ্দিসীনে কেরামের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, সৈয়দ আহমদ বেরলভী যার জন্ম ১২০১ হিজরিতে এবং তারই মুরিদ মাও. ইসমাইল দেহলভী ও এই হাদীসশরীফের মিছদাক বা মর্মানুযায়ী মুজাদ্দিদের মধ্যে শামিল নহেন। কেননা ‘মুজাদ্দিদ’ হওয়ার জন্য জরুরি হচ্ছে যে, এক শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এবং অন্য শতাব্দীর প্রারম্ভে তার মুজাদ্দিদসুলভ গুণাবলী প্রকাশ পাবে।’
মাওলানা আব্দুল হাই লাখনভী সাহেবের উপরোক্ত ফতওয়া দ্বারা প্রমাণিত হলো, সৈয়দ আহমদ বেরলভী তেরোশ হিজরির মুজাদ্দিদ নন।
বরং ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হচ্ছেন শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তার জন্ম ১১৫৯ হিজরি ওফাত ১২৩৯ হিজরি। উভয় শতাব্দীতে তিনি দ্বীনের সংস্কারমূলক কার্যা বলী আঞ্জাম দিয়েছেন।
মুদ্দাকথা হলো, আল্লাহ তায়ালা যাকে মুজাদ্দিদ হিসেবে প্রেরণ করতে চান, তিনি আবির্ভাবের পূর্বে শতাব্দীতে জন্ম নিয়ে ‘মুকাম্মাল’ আলেম হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এজন্য بعث (বায়াছা) يبعث (ইউবআছু) এর আভিধানিক অর্থ হলো- কোন কাজ বা দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত হওয়া এবং সেই দায়িত্বে নিয়োজিত হওয়া।
এ প্রসঙ্গে লোগাতে কেশওয়ারী ৭০ পৃষ্ঠায় এবং আল মনজিদ (আরবি) ২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
بعثه على الشئ اى حمله على فعله واقامة الخ
ভাবার্থ ‘তাঁকে কোন কিছুর দায়িত্ব দিয়ে যিনি প্রেরণ করেছেন অর্থাৎ তাকে যে কাজের দায়িত্বভার বহন উপযোগী করেছেন এবং তিনিও এ দায়িত্বভারকে পরিপূর্ণরূপে কায়েম করেছেন।
بعث (বায়াছা) শব্দের শরয়ী বা পারিভাষিক অর্থ হলো, (নবীর বেলায়) নিজ নিজ কউমের কাছে খোদাপ্রদত্ত পয়গাম এর তাবলীগ শুরু করে দেওয়া।
(উম্মতের বেলায়) بعث (বায়াছা) শব্দের অর্থ হলো যিনি দ্বীনি খেদমতের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনি এ কাজে নবীর অনুকরণ ও অনুসরণের মাধ্যমে নিয়োগ হয়ে যাওয়া।
এজন্যই আম্বিয়ায়ে কেরামের বেলাদত বা জন্ম থেকে অন্তত চল্লিশ বছর পর নবুয়তের প্রকাশ হয়ে থাকে। এ কারণে আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহি মুস্সালাম এর বেলায় يبعث (ইউবআছু) শব্দ প্রয়োগ হয়ে থাকে, এবং মুজাদ্দিদের ক্ষেত্রেও এ হাদীস শরীফে يبعث (ইউবআছু) শব্দ প্রয়োগ হয়েছে।
যিনি এক শতাব্দীর জন্ম নিয়ে শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এবং অন্য শতাব্দীর শুরুতে তাঁর তাজদীদের কাজ আরম্ভ হয়ে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, হযরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ রাদিয়াল্লাহু আনহু, যিনি সর্ব প্রথম হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম মুজাদ্দিদ।
তাঁর জন্ম ১৯ (ঊনিশ) হিজরি এবং ওফাতশরীফ ১১২ হিজরি। তিনি তাঁর জন্ম শতাব্দীর শেষ প্রান্ত থেকে আরম্ভ করে পর শতাব্দীর ১২ (বারো) বৎসর পর্যন্ত তাজদীদী কাজের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ইজমায়ে মুছলিমীন তথা সকল মুসলমানদের ঐকমত্যে মুজাদ্দিদ হিসেবে গণ্য।
পক্ষান্তরে সৈয়দ আহমদ বেরলভী জন্ম ১২০১ হিজরি (বারোশত এক হিজরি) তাই তার মধ্যে মুজাদ্দিদ হওয়ার শর্ত পাওয়া গেল না। এছাড়াও তিনি কোরআন সুন্নাহর শিক্ষা থেকে একেবারেই বঞ্চিত ছিলেন।
সে প্রসঙ্গে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর ভক্তগণের উক্তি মতে ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা হেদায়েতের কিতাব। উক্ত কিতাবের ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী উল্লেখ করেন-
এক
اس کتاب کے اکثر مضامین کے تحریر کرنے میں صرف جناب سید احمد صاحب کے فرماۓ ہوۓ کلمات کے ترجمہ ہی پراکتفا کیا اسی طرح تمام کتاب کے مضامین میں یہی طریق اختیار کیا جاتا لکین چونکہ آپ کی ذات والاصفات ابتداء فطرت سے رسالت مآب علیہ افضل الصلوۃ والتسلیمات کے کمال مشابھت پرپیدا کی گئ اسیلۓ آپ کی لوح فطرت علوم رسمیہ کے نقش اور تحریر وتقریر کے داشمندون کی راہ روش سے خالی تھیں
ভাবার্থ: ‘এই কিতাব (সিরাতে মুস্তাকিম) এর অধিকাংশ বিষয়বস্তু লিখতে কেবল জনাব সৈয়দ আহমদ সাহেবের মুখনিঃসৃতবাণীর অনুবাদের উপরই করা হয়েছে। এভাবে এ কিতাবের পূর্ণ বিষয়বস্তু লিখার এই ধারাই অবলম্বন করার কথা ছিল। কিন্তু জীবনের শুরু থেকেই সৈয়দ আহমদ সাহেবের জাত ও সিফাত হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কামালে মুশাবিহাত বা পরিপূর্ণ মিল রেখেই সৃষ্টি করা হয়েছে।
এজন্য তার সত্ত্বায় বা স্বভাবে লিখা পড়ার জন্য জ্ঞানী-গুণীদের যে ধারা রয়েছে, তা থেকে তিনি খালি বা মুক্ত ছিলেন।’
অর্থাৎ প্রচলিত লিখাপড়া শিক্ষায় যে নিয়মনীতি রয়েছে, সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মধ্যে এর কিছুই ছিল না। এক কথায় সৈয়দ আহমদ লেখাপড়া করতে পারেন নাই তিনি ছিলেন মুর্খ।
দুই
সুতরাং মুজাদ্দিদ হওয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য শর্ত হচ্ছে যে, তিনি কোরআন সুন্নাহর পূর্ণ জ্ঞানে জ্ঞানবান হতে হবে। কিন্তু সৈয়দ আহমদ বেরলভী একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন, কোরআন সুন্নাহর কোন জ্ঞানই তার মধ্যে ছিল না, মূর্খ ছিলেন। মূর্খ লোক মুজাদ্দিদ হতে পারে না।
অপরদিকে তারই শিষ্য মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর ভাষ্য মোতাবেক ইসমাইল দেহলভীর লিখা ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা তারই (সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবেরই) মলফুজাত বা বাণী। সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবে অনেকগুলি কুফুরি আকিদা বিদ্যমান।
সুতরাং সৈয়দ আহমদ বেরলভী দ্বীনের মুজাদ্দিদ নন।
তিন
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, সৈয়দ আহমদ বেরলভীর শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে। সত্যকথা বলতে কি, তার তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতাই ছিল না।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ইমাদউদ্দিন (মানিক) ফুলতলী সাহেবের লিখিত ‘সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভীর জীবনী ’ নামক পুস্তকের (১ম ছাপা) ১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।
‘তখনকার সম্ভ্রান্ত বংশে প্রচলিত প্রথানুযায়ী সৈয়দ আহমদকে চার বৎসর বয়সে মক্তবে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু স্বগোত্রীয় অন্যান্য ছেলে মেয়েদের মত লেখাপড়ার দিকে তার তেমন ঝোঁক দেখা গেল না। মা-বাবার একান্ত আদর যত্ন ও শিক্ষকের অকৃতিম ভালবাসা সত্ত্বেও দীর্ঘ তিন বৎসরে তিনি কোরানশরীফের কয়েকটি মাত্র সূরা মুখস্ত করলেন এবং কিছু লিখতে শিখলেন। অবস্থা দৃষ্টে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃদ্বয় চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তদীয় পিতা ভ্রাতৃদ্বয়কে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন ‘আহমদের লেখাপড়ার ব্যাপারে চিন্তা না করে আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও, দয়াময় তারপক্ষে যা ভাল মনে করেন তাই করবেন। ওকে তাগিদ করে লাভ হবে না।’
উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো সৈয়দ আহমদ বেরলভীর প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সনদ ছিল না। সুতরাং মুজাদ্দিদ হওয়ার জন্য ইলমী যোগ্যতার অতীব প্রয়োজন।
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর কাছে কোরআন সুন্নাহর ইলমি যোগ্যতা ছিল অনুপস্থিত। তাই তিনি মুজাদ্দিদ হওয়ার যোগ্যতা রাখেননি।
সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে ভূয়া মুজাদ্দিদ সাজানোর পায়তারা
সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে মুজাদ্দিদ সাজানোর জন্য তার এক শ্রেণীর ভক্তবৃন্দরা সে মুর্খ হওয়া সত্ত্বেও কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে ইলিম অর্জন করেছেন বলে দাবি করেছেন।
১. মাওলনা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী সাহেবের লিখিত ‘সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভীর জীবনী’ ১ম সংস্করণ ১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
‘আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উম্মি বা নিরক্ষর বলে ঘোষণা করেও বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে যতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি জ্ঞান দান করেছিলেন।
এভাবে আল্লাহ তায়ালা শুধু আম্বিয়াগণকেই নয় তার অনেক মকবুল বান্দাকেও সরাসরি ইলম দান করে থাকেন। সৈয়দ আহমদ ও সে দান থেকে বঞ্চিত হননি।’
২. অনুরূপ মুহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী লিখিত ‘ছোটদের সাইয়িদ আহমদ বেরলভী’ নামক পুস্তকের ১১ পৃষ্ঠায় লিখা রয়েছে-
ছোট্ট বন্ধুরা, আল্লাহ চাইলে তার অনেক মকবুল বান্দাকে সরাসরি ইলিম দান করে থাকেন। সাইয়িদ আহমদও সে দান থেকে বঞ্চিত হননি। আল্লাহ তাঁর নিজ আলোকে তাঁকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন।’
৩. শাজারায়ে তায়্যিবা’ হযরত ফুলতলী সাহেবের সিলসিলা পরিচিতি’ নামক পুস্তকের ৪র্থ পৃষ্ঠায় রয়েছে-
‘কোন মাধ্যম ব্যতীতই তরীকায়ে মুজাদ্দিদিয়াহ ও মুহাম্মদিয়াহর সরাসরি ফয়েজ ও বরকত লাভ করেছেন মহান আল্লাহ জাল্লাশানুহু থেকে।’
বড়ই পরিতাপের বিষয় উপরোল্লেখিত তিনটি পুস্তকে নিরক্ষর সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে মুজাদ্দিদ বানানোর অভিপ্রায়ে আলেম বা জ্ঞানী সাজানোর জন্য আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালা যেভাবে তাঁর হাবীবকে সরাসরি ইলিম দান করেছেন ঠিক সেভাবে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকেও সরাসরি ইলিম দান করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ)
দেখুন কত বড় গাজাখুরি কথা! কোথায় আল্লাহর হাবীব রাহমাতুল্লিল আলামীন আর কোথায় সৈয়দ আহমদ বেরলভী।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের তথা ইসলামের সঠিক আক্বিদা হলো, কোন ব্যক্তিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়াছাতত বা মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহ জাল্লাশানু থেকে ফয়েজ ও বরকত হাসিল করতে পারে না। এরূপ দাবি করা অমূলক, অবান্তর, অবাস্তব ও বিভ্রান্তি বই কিছুই নয়।
নিম্নে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদী থেকে কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলিলসমূহ পেশ করা হল:
দলিল-১. মুফতিয়ে বাগদাদ আবুল ফজল শিহাব উদ্দিন সৈয়দ মাহমুদ আলুছি বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (ওফাত ১২৭০ হিজরি) তদীয় ‘তাফসির রূহুল মায়ানী’ নামক কিতাবে ১৭ পারা ১০৫ পৃষ্ঠা- আল্লাহরতায়ালার কালাম وما ارسلناك الارحمة العالمين (ওমা আর সালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামীন)
আমি আপনাকে সমস্ত জগতের রহমত করে প্রেরণ করেছি। এ আয়াতে কারীমার তাফসিরে উল্লেখ করেন-
وكونه صلى الله عليه وسلم رحمة للجميع باعتبار انه عليه الصلوة والسلام واسطة الفيض الالهى على الممكنات على حسب القوابل ولذا كان نوره صلى الله عليه وسلم اول المخلوقات ففى الخبر اول ما خلق الله تعالى نور نبيك يا جابر وجاء الله تعالى المعطى وانا القاسم
অর্থাৎ ‘ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত জগতের জন্য রহমত, এই দৃষ্টিকোণ থেকে নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত মমকিনাত তথা: সকল সৃষ্টির জন্য তাদের যোগ্য অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালার ‘ফয়েজ’ লাভের মাধ্যম। এজন্য নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূর মোবারকই সৃষ্টির মধ্যে সর্বপ্রথম। যেহেতু হাদীসশরীফে বর্ণিত আছে, হে জাবির! আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন। অপর হাদীসশরীফে বর্ণিত আছে- আল্লাহর হাবীব নিজেই এরশাদ করেছেন- আল্লাহ দিচ্ছেন এবং দিতে থাকবেন এবং আমি বণ্টনকারী।’
উপরোক্ত তাফসীরে কোরআনের আলোকে দিবালোকের মত প্রমাণিত হলো- আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ফয়েজ ও বরকত লাভ করার মাধ্যম হচ্ছেন ছরকারে কায়েনাত ফখরে মওজুদাত নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর মাধ্যম ছাড়া কেহ কোন প্রকার ফয়েজ ও বরকত লাভ করতে পারবে না।
আল্লাহ তায়ালা যা অতীতে দিয়েছেন এবং বর্তমানে দিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে দিতে থাকবেন, সব কিছুরই বণ্টনকারী হচ্ছেন দু’জাহানের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহর হাবীবের মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কেউ কিছু পেতে পারে না।
সুতরাং সৈয়দ আহমদ বেরলভী সরাসরি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইলিম অর্জন করেছেন এ দাবি করে তাকে মুজাদ্দিদ বানানোর পায়তারা চালানো হচ্ছে জঘণ্যতম অপরাধ।
দলিল- ২. প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হযরত আল্লামা মূল্লা আলী ক্বারী মক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১০১৪ হিজরি) তদীয় ‘মিরকাত শরহে মিশকাত’ নামক কিতাবের ১ম খণ্ড ৫৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
وقال القرطبى من ادعى علم شئ منها غير مسند اليه عليه الصلوة والسلام كان كاذبا فى دعواه
অর্থাৎ ‘আল্লামা কুরতুবী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যে ব্যক্তি রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যম বিহীন কোন প্রকারের ইলিম (ইলমে শরিয়ত, ইলমে মা’রিফত) লাভ করার দাবি করে, তবে সে তার দাবিতে মিথ্যাবাদী।’
উপরোক্ত দলিলের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, সৈয়দ আহমদ বেরলভী আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সরাসরি ইলিম লাভ করার দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও বানোয়াট।
দলিল-৩.
قال الامام مالك علم الباطن لايعرفه الا من عرف علم الظاهر فمتى علم علم الظاهر وعمل به فتح الله عليه علم الباطن ولايكون ذالك الامع فتح قلبه وتنويره (الحديقة الندية ۱/۱۶۵)
আল্লামা আব্দুল গণি নাবুলিছি হানাফী (আলাইহির রহত) তদীয় ‘আল হাদীকাতুন নাদিয়া’ নামক কিতাবের ১/১৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
অর্থাৎ ‘ইমাম মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ইলমে জাহির (ইলমে শরিয়ত) যারা অর্জন করতে পারবে না তারা কস্মিনকালেও মারেফাতের ইলিম লাভ করতে পারবে না। সুতরাং শরিয়তের প্রয়োজনীয় ইলিম যারা অর্জন করে, সে মোতাবেক আমল ও করতে থাকে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য বাতেনী ইলিম ( মারেফাতের দরজা) খুলে দেন।’
মারেফাতের ইলিম অর্জন করতে হলে, তার জন্য অতিব প্রয়োজন যে, সে একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর হাবীবকে রাজী বা সন্তুষ্ট করার মানসে খালিস নিয়তে আমল করতে হবে এবং জিকির আযকার, মোরাকাবা, মোশাহাদার মাধ্যমে কলবকে সচ্ছ করে কলবে ঈমানী নূর পয়দা করতে হবে।’
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, সৈয়দ আহমদ বেরলভী যেহেতু ইলমে জাহের বা ইলমে শরিয়ত অর্জন করতে সক্ষম হননি, তার জন্য মারেফাত লাভ করা অসম্ভব।
এখন যদি কোন ব্যক্তি এ দাবি উত্থাপন করে বলে সৈয়দ আহমদ বেরলভী এলহাম বা বাতেনী ওহীর মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ইলিম বা জ্ঞান অর্জন করেছেন, যাকে ইলমে লাদুনি বলা হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে অত্র কিতাবের ১/১৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
فاعلم ان الالهام ليس حجة عند علماء الظاهر والباطن بحيث تثبت به الاحكام الشرعية فيستغون بذلك عن النقل من الكتاب والسنة بل هو طريق صحيح لفهم معانى الكتاب والسنة عند المحققين من علماء الباطن بعد تصحيح العمل على مقتضى ما فهم بالاجتهاد من معانى الكتاب والسنة والا كان وسوسة شيطانية لايجوز العمل به كما قال الامام القسطلانى فى مواهب لايظهر على احد شئ من نور الايمان الاباتباع السنة ومجانبة البدعة واما من اعرض عن الكتاب والسنة ولم يتعلق بالعلم من مشكاة الرسول صلى الله عليه وسلم بدعواه علما لدنيا اوتيه فهو من لدن النفس والشيطان وانما يعرف كون العلم لدنيا روحانيا موافقته لما جاء به الرسول عن ربه تعالى فالعلم اللدنى نوعان لدنى روحانى ولدنى شيطانى فالروحانى هو الوحى ولا وحى بعد الرسول صلى الله عليه وسلم واما قصة موسى مع الخضر فالتعلق بها فى تجويز الاستغناء عن الوحى بالعلم اللدنى الحاد وكفر مخرج عن الاسلام (الحديقة الندية ۱۶۶/۱۶۵)
অর্থাৎ ‘জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, জাহির ও বাতেন (শরিয়ত ও তরিকতের) ওলামায়ে কেরামগণের অভিমত হলো, কোরআন-সুন্নাহর দলিল আদিল্লাহর মাধ্যমেই শরিয়তের হুকুম আহকাম প্রমাণ করতে হবে। ওলী আল্লাহগণের ‘এলহাম’ কস্মিনকালেও দলিলরূপে গণ্য হতে পারে না।
বরং মারেফাত তত্ত্ববিধ মুহাক্কিকীন উলামায়ে কেরামগণের অভিমত হলো, সহীহ শুদ্ধভাবে আমল করার জন্য কোরআন-সুন্নাহ থেকে মুজতাহিদগণের ইজতেহাদী মাসআলা মোতাবেক আমল করাই সঠিক পন্থা। কোরআন-সুন্নাহ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র এলহামের উপর নির্ভর করে আমল করা শয়তানী ওয়াছ ওয়াছা বৈ কিছুই নয় বরং ইহা না জায়েয।
ইমাম কাছতালানী (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘মাওয়াহিবে লাদুনিয়া’ নামক কিতাবে এ মাসআলার ব্যাপারে কী সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন, (আক্বাইদী ও আমল) সুন্নাতের অনুকরণ ও অনুসরণ করা এবং (আকাইদী ও আমলী) বিদআত থেকে পরিহার করা ব্যতিরেকে কারো জন্য ঈমানী নূর প্রকাশ হতে পারে না।
যারা ইলমে লাদুনিয়ার দাবিদার হয়ে কোরআন-সুন্নাহ থেকে দূরে সরে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মাধ্যম ব্যতিরেকে ইলিম অর্জন করার দাবিদার হয়েছে, তারা লাদুনে নফস বা শয়তান।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ থেকে যে ইলিম নিয়ে আসছেন তার পূর্ণ অনুকূল হলেই ইলমে লাদুনিয়ায়ে রূহানী বলে অভিহিত করা যাবে। সুতরাং ইলমে লাদুনী দুভাগে বিভক্ত। ১. ইলমে লাদুনিয়ে রূহানী। ২. লাদুনিয়ে শয়তানী। ফলে লাদুনিয়ে রূহানী হল ওহী এবং আল্লাহর রাসূলের পরে ওহীর দরজা বন্ধ।
واما قصة موسى مع الخضر فالتعلق بها فى تجويز الاستغناء عن الوحى بالعلم اللدنى الحاد وكفر مخرج عن الاسلام الخ
উপরন্তু যারা হযরত মুছা ও খিজির আলাইহিস সালাম এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বলে থাকে ইলমে লাদুনি অর্জন করতে গেলে ওহীর প্রয়োজন নেই তারা হবে মূলহিদ, কাফের, ইসলাম থেকে বহির্ভূত।’
প্রশ্ন হতে পারে খিজির আলাইহিস সালাম ওলী হওয়া সত্ত্বেও ইলমে লাদুনি কিভাবে অর্জন করলেন?
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (আলাইহির রহমত) এ প্রশ্নের জওয়াবে তদীয় ‘ শরহে ফেকহে আকবর’ নামক কিতাবে নূতন ছাপা ১১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
ونبى واحد افضل من جميع الاولياء. وقد ضل اقوام بتفضيل الولى على النبى حيث امر موسى بالتعلم من الخضر وهو ولى قلنا الخضر كان نبيا وان لم يكن كما زعم البعض
অর্থাৎ ‘যে কোন একজন নবী সমস্ত আউলিয়ায়ে কেরাম থেকে অধিক মর্যাদাবান। তবে কোন কোন সম্প্রদায় ওলী আল্লাহকে নবীর উপর মর্যাদা দিয়ে বিপথগামী হয়েছে।
তারা তাদের দাবির স্বপক্ষে দলিল দিতে গিয়ে বলে থাকে, হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে হযরত খিজির আলাইহিস সালাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার হুকুম করা হয়েছিল, যার নিকট থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়, তিনি শিক্ষার্থী অপেক্ষা উত্তম হয়ে থাকেন। অথচ খিজির আলাইহিস সালাম ওলী ছিলেন। এর উত্তরে আমরা বলব, হযরত খিজির আলাইহিস সালাম নবী ছিলেন, ওলী ছিলেন না।
হযরত খিজির আলাইহিস সালাম নবী নন বলে যদিও একদল লোকের ধারণা রয়েছে।’
(الحديقة الندية) আল হাদীকাতুন নাদিয়া’ নামক কিতাবের ১/৩৭৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
‘কোন কোন ওলী আল্লাহগণ এমনও রয়েছেন, যারা এলহামের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে (মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর বাতেনী সাহায্যের দরুণ) নেক আমল ও সঠিক আক্বিাদার উপর ইস্তেকামত বা অটল থাকার সৌভাগ্য লাভ করেছেন এবং সেই আক্বিদা ও নেক আমল কোরআন সুন্নার পূর্ণ মুয়াফিক হয়েছে।’
মোদ্দাকথা হলো, আল্লাহর হাবীবের এলহাম সঠিক এবং সত্য যার মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশমাত্র নেই। পক্ষান্তরে আউলিয়ায়ে কেরামগণের এলহাম মশকুক বা সন্দেহজনক। এ এলহাম সত্যও হতে পারে আর মিথ্যাও হতে পারে।
যদি ওলী আল্লাহগণের এলহাম কোরআন সুন্নাহ মুয়াফিক হয়ে থাকে, তা হবে সঠিক ও সত্য।
অপরদিকে কেরআন-সুন্নাহর বিপরীত হলে তা হবে মিথ্যা। (নুরুল আনওয়ার)
তালিম তায়াল্লুম বা শিক্ষাদীক্ষা ব্যতিরেকে শুধুমাত্র এলহামের মাধ্যম শরিয়তের হুকুম আহকাম সম্বন্ধে অবগত হওয়া যা কোরআন সুন্নাহর মুয়াফিক হয়, সে প্রসঙ্গে ‘আল হাদীকাতুন নাদিয়া’ কিতাবের ১/৭৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
كما وقع لاويس القرنى رضى الله عنه مع وجوده فى زمان النبى صلى الله عليه وسلم ولم يجتمع بالنبى عليه السلام استغناء بالامداد الباطنى المحمدى له عن الاخذ من حيث الظاهر ومن كان موفقا كذالك
অর্থাৎ ‘যেমন ওয়ায়েছ কুরুনী রাদিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার যামানায় থাকা সত্ত্বেও অনিবার্য কারণবশত আল্লাহর নবীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারেন নাই, এমতাবস্থায় তিনি জাহিরী ইলিম (শরিয়তের হুকুম আহকাম) লাভ করার জন্য শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাতেনী সাহায্যের দরুণ তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং সঠিক আক্বিদা ও নেক আমল যথাযথভাবে আদায় করেছেন। এ পর্যায়ে তার আক্বিদা ও আমল সঠিক ছিল বলে আল্লাহর হাবীবের সম্মতিও পেয়েছেন।’
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এলহাম দ্বারা শরিয়তের হুকুম আহকাম এর ইলিম অর্জন করতে গেলে আল্লাহর হাবীবের বাতেনী সাহায্যের অতীব প্রয়োজন এবং সাথে সাথে কোরআন সুন্নাহর সঙ্গে তার পূর্ণ মুয়াফিক আছে কি না এদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
আল্লাহর হাবীবের বাতেনী সাহায্য বা ওছীলা ব্যতিরেকে সরাসরি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কেহ কোন সঠিক ইলিম লাভ করতে সক্ষম হবে না।
সুতরাং সৈয়দ আহমদ বেরলভী আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সরাসরি ইলিম অর্জন করার দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন এবং শরিয়তবিরোধী।
এ ব্যক্তি মুজাদ্দিদ হওয়া তো দূরের কথা বরং ঈমানের গণ্ডির ভেতরে আছে কি না, তাও সন্দেহজনক।
মূল কথা হলো, তার ভক্তবৃন্দরা তাকে নবী বানানোর পায়তারা চালাচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবের ৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
‘পূর্ণাঙ্গ শরিয়ত ও দ্বীনের যাবতীয় হুকুম আহকামের ব্যাপারে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে নবীগণের ছাত্রও বলা চলে এবং নবীগণের উস্তাদের সমকক্ষও বলা চলে। সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নিকট এক প্রকারের ওহী এসে থাকে, যাকে শরিয়তের পরিভাষায় নাফাসা ফির রাও বলা হয়।
কোন কোন আহলে কামাল ইহাকে বাতেনী ওহী বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তার ন্যায় অন্যদের ইলিম যা হুবহু নবীদের ইলিম কিন্তু প্রকাশ্য ওহী দ্বারা নয় বরং বাতেনী ওহী দ্বারা অর্জিত।’ (নাউজুবিল্লাহ)
উক্ত সিরাতে মুস্তাকিমের ৭৫ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ রয়েছে- ‘মা’ছুম বা নিষ্পাপ হওয়া নবীদের জন্য খাস নয় বরং নবী ছাড়া অন্যরাও মা’ছুম হতে পারে সেজন্য সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও মা’ছুম।’ (নাউজুবিল্লাহ)
উল্লেখ্য যে নবী ব্যতিত অন্য কেহ তার কাছে ওহীয়ে বাতেনী আসে ও মা’ছুম হওয়ার দাবিদারই নবুয়তী দাবির নামান্তর মাত্র।
এরই স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ আলাইহির রহমত তদীয় در الثمين (দুররুছ ছামিন) কিতাবে স্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে বলেন-
الحديث التاسع : سألته صلى الله عليه وسلم سوالا روحانيا عن الشيعة فا وحى الى ان مذهبهم باطل وبطلان مذهبهم يعرف من اللفظ الامام ولما افقت عرفتم الامام عندهم وهو المعصوم للفرض الوحى اليه وحيا باطنا وهذا هو المعنى النبى فمذهبهم يستلزم انكارختم النبوة قبحهم الله تعالىا
ভাবার্থ: শাহ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন- আমি শিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে রূহানী হালতে প্রশ্ন উপস্থাপন করলে হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশারা দিয়ে বললেন শিয়া সম্প্রদায়ের মাযহাব হল বাতিল।
শিয়া সম্প্রদায় বাতিল হওয়ার একমাত্র কারণ হলো ‘আল ইমাম’ শব্দ দ্বারা শিয়াদের বাতুলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
তিনি (শাহ ওলী উল্লাহ) বলেন- আমি জাগ্রত হয়ে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম শিয়া সম্প্রদায় তাদের ইমামকে মা’ছুম বলে আখ্যায়িত করে এবং তাদের কাছে বাতেনী ওহী আসে বলে দাবি করে। মা’ছুম ও বাতেনী ওহী আসার দাবিদার হওয়াই নবী দাবীর নামান্তর বটে। শিয়া সম্প্রদায়ের মতবাদই আল্লাহর হাবীব যে সর্বশেষ নবী তা অস্বীকার করা হয়ে থাকে। শাহ সাহেব বদদোয়া করে বলেন আল্লাহতায়ালা তাদেরকে ধবংস করুন। (আদদুররুছ ছামিন)
______
মুসলিম জাহানে দ্বীনের যে সকল মুজাদ্দিদগণ চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের নামের তালিকা
____________________
মুসলিম জাহানে দ্বীনের যে সকল মুজাদ্দিদগণ চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের নামের তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হলো
মুজাদ্দিদ-১
হিজরি প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম মুজাদ্দিদ:
খলিফাতুল মুসলিমীন ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি দ্বিতীয় ওমর বলে পরিচিত। তিনি খারেজী ও শিয়া ফিতনা উৎখাত, উমাইয়া শাসকগণের জুলুম নির্যাতন দমন, এজিদী কুসংস্কারের পতন এবং হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কর্তৃক আওলাদে রাসূলের প্রতি জুলুম ও নির্যাতনের উৎখাত প্রভৃতি স্বীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলে দমন করে ইসলামের তাজদীদী কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।
তাঁর জন্ম ১৯ (ঊনিশ) হিজরি, এবং ওফাতশরীফ ১১২ হিজরি (একশত বারো হিজরি)। তিনি তাঁর জন্ম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে পর শতাব্দীর ১২ (বারো) বৎসর তাজদীদী দ্বীনের কাজের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ইজমায়ে মুসলিমীন তথা সকল মুসলমানের ঐকমত্যে মুজাদ্দিদ হিসেবে গণ্য।
মুজাদ্দিদ-২
হিজরি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর দ্বিতীয় মুজাদ্দিদ:
ক) ইমাম শাফেয়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) হিজরি, ওফাত ২০৪ (দুইশত চার) হিজরি। তিনি জন্ম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে পর শতাব্দীর ৪ (চার) বৎসর পর্যন্ত তাজদীদী দ্বীনের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।
খ) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ১৬৪ (একশত চৌষট্্ির) হিজরি, ওফাত ২৪১ হিজরি (দুইশত একচল্লিশ) হিজরি। তিনি জন্ম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে পর শতাব্দীর ৪১ (একচল্লিশ) বৎসর পর্যন্ত তাজদীদী দ্বীনের দায়িত্বপালন করেন।
ইমাম শাফেয়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু এর উস্তাদ ছিলেন। তিনি দ্বীনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাজদীদের কাজের সূচনা করেন।
তাঁর এ মহান তাজদীদের কার্যাজবলী সমাপন করেন, তাঁরই সুযোগ্য সাগরিদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি সাড়ে সাতলক্ষ হাদীসের হাফিজ ছিলেন। তাঁর লিখিত হাদীসের কিতাব ‘মসনদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল’ জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, এ কিতাবে চল্লিশ হাজারেরও অধিক হাদীসশরীফ রয়েছে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু মু’তাযেলা ফেরকার ভ্রান্ত আক্বিদার খণ্ডন করে ইসলামের সঠিক আক্বিদাকে মুসলিমসমাজে পুনর্জীবিত করেন।
তাঁর যানাযা নামাজে আটলক্ষ পুরুষ এবং ষাট হাজার মহিলা শিরকত করেছিল। এছাড়াও নৌকা, ঘোড়ায় অসংখ্য লোকজন ছিল। (বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন)
তবকাতে শা’রানীতে উল্লেখ রয়েছে, এই দিনে বিশ হাজার ইহুদী ও নাসারা এবং অগ্নিপূজক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
মুজাদ্দিদ-৩
হিজরি তৃতীয় ও চতুর্থ শতকের তৃতীয় মুজাদ্দিদ:
ক) ইমাম নাছাই রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তাঁর জন্ম ২১৫ (দুইশত পনের) হিজরি এবং ওফাত ৩০৩ (তিনশত তিন হিজরি। তিনি জন্ম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে পর শতাব্দীর তিন বৎসর পর্যন্ত তাজদীদে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করেন।
খ) ইমাম আবুল হাছান আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ২৬০ (দুইশত ষাট) হিজরি এবং ওফাত ৩২০ (তিনশত বিশ) হিজরি। তিনি জন্ম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে পর শতাব্দীর বিশ বৎসর পর্যন্ত তাজদীদে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করেন।
ইমাম নাছায়ী প্রথমে ‘ছুনানে কবীর’ নামে হাদীসশরীফের একখানা কিতাব সংকলন করেন। অতঃপর উহাকে সংক্ষেপ করে ‘আল মুজতাবা’ নামকরণ করেন। এই ‘মুজতাবা’ ছেহহা ছিত্তার অন্যতম কিতাব। ইহাই নাছায়ীশরীফ নামে মুসলিমবিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
ইমাম নাছায়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিদআতী ফেরকা মুরজিয়ার উপদল জাহমিয়া ফেরকার ভ্রান্ত আকাইদের খণ্ডন করে তাজদীদে দ্বীনের কাজ সম্পন্ন করেন।
ইমাম আবুল হাসান আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু তিনি ইলমে আকাইদের একজন প্রসিদ্ধ ইমাম। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের দুইজন ইমামের মধ্যে একজন, অপরজন হচ্ছেন ইমাম আবু মনছুর মা’তুরদী বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু মুছা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর।
মুজাদ্দিদ-৪
হিজরি চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের চতুর্থ মুজাদ্দিদ:
ক) ইমাম বায়হাকী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ৩৮৪ (তিনশত চৌরাশি) হিজরি এবং ওফাত ৪৫৮ (চারশত আটান্ন) হিজরি। তিনি তাঁর জন্ম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে পর শতাব্দীর ৫৮ বৎসর পর্যন্ত তাজদীদে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দেন।
খ) ইমাম আবু বকর বাকেল্লানী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁরা উভয়ই রাফেজী ফেরকার স্বরূপ উন্মোচন করেন এবং মুসলমানদেরকে রাফেজী ফেরকার ভ্রান্ত আক্বিদার কবল থেকে তাঁদের ঈমান ও আক্বিদাকে হেফাজত করেন। ফলে মুসলিমসমাজ ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বাইদের উপর অটল থাকতে সক্ষম হন।
রাফেজী ফেরকা মূলত শিয়া ফেরকার একটি শাখা। রাফেজী শব্দের অর্থ পরিত্যাগকারী। যেহেতু তারা অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামগণকে পরিত্যাগ করেছে এবং শায়খাইন তথা খলিফাতুর রাসূল হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আমিরুল মো’মিনীন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বরহক খিলাফতকে অস্বীকার করে মুসলমানদের বৃহৎ জামায়াত ত্যাগ করে নূতন বিদআতী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এজন্য এদেরকে রাফেজী নামকরণ করা হয়েছে।
রাফেজীদের ভ্রান্ত আক্বিদা হলো- ১. তাদের ধর্মীয় ইমামগণ নিষ্পাপ, যাবতীয় ভুল ত্রুটি হতে পবিত্র। ২. সকল সাহাবায়ে কেরাম রেদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাইন থেকে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু আফজল বা সর্বোত্তম। ৩. হযরত উসমান গণি রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকে অস্বীকার করে।
পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা হলো- আল্লাহর হাবীবের ওফাতশরীফের পর সর্বপ্রথম বরহক খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পর্যায়ক্রমে হযরত ওমর ফারুক, হযরত উসমান গণি ও হযরত আলী রেদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন সকলের খেলাফতের উপর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মুজাদ্দিদ- ৫
হিজরি পঞ্চম ও ৬ষ্ঠ শতকের মুজাদ্দিদ হচেছন- হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ৪৫০ (চারশত পঞ্চাশ) হিজরি, ওফাত ৫০৫ (পাঁচশত পাঁচ) হিজরি।
তিনি তাঁর জন্ম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে পর শতাব্দীর পাঁচ বৎসর পর্যন্ত তাজদীদে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন।
ইমাম গাজ্জালী (আলাইহির রহমত) সমকালীন ভ্রান্ত দলের আক্বাইদসমূহ বিশেষ করে কাদরীয়া সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত আক্বিদার নাগপাশ থেকে মুসলিমজাতীর ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদাকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ইমাম গাজ্জালী (আলাইহির রহমত) এর পর যুগে যে বিদআতী দল সৃষ্টি হবে তার জওয়াবও দিয়েছেন।
যেমন সৈয়দ আহমদ বেরলভীর বাণী ইসমাঈল দেহলভীর কলম এবং জৈনপুরী কেরামত আলীর সমর্থিত কিতাব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ এ রয়েছে-
‘নামাযের মধ্যে নবীয়ে পাকের খেয়াল করা গরু-গাধার খেয়ালে ডুবে থাকার চেয়েও খারাপ এবং তাঁকে নামাজের মধ্যে তা’জিমের সঙ্গে খেয়াল করা শিরিক। (নাউজুবিল্লাহ)
ইমাম গাজ্জালী এহইয়ায়ে উলুমুদ্দিন ১/৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন- নামাযের বৈঠকে তোমার কলব বা অন্তরে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর দেহাকৃতিকে হাজির করে বলবে আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবীউ ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু অর্থাৎ আল্লাহর হাবীবকে তা’জিমের সাথে খেয়াল করে সালাম পেশ করবে। কেননা আল্লাহর হাবীবের তা’জিমই আল্লাহর বন্দেগী।
পাঠকবৃন্দ চিন্তা করে দেখুন ইমাম গাজ্জালী (আলাইহির রহমত) এর দূরদর্শী চিন্তাধারা কত ষ্পষ্ট।
মুজাদ্দিদ- ৬
হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের ষষ্ঠ মুজাদ্দিদ হচ্ছেন- শায়খুল ইসলাম ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ৫৪৪ (পাঁচশত চোয়াল্লিশ) হিজরি ওফাত ৬০৬ (ছয়শত ছয়) হিজরি।
তিনি তাঁর জন্ম শতকের শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে পর শতাব্দীর ছয় বৎসর পর্যন্ত তাজদীদে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর রচনাবলীর মধ্যে ‘তাফসিরে কবীর’ নামক কিতাবখানাই সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তাফসিরে কবীরের বৈশিষ্ট্য অপরিসীম।
তিনি তদীয় তাফসিরে কবীরে ‘ জাহমিয়া’ মু’তাজিলা’ মুজাসসিম’ কায়রা মিয়া এবং তাঁর যুগের সকল ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের বাতিল আক্বাঈদের খণ্ডন করে তাঁর তাজদীদী কাজ সমাপন করেছেন।
তন্মধ্যে একটি মাসআলা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মাসআলাটি হলো, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার আব ও আজদাদ তথা পিতৃকুল ও মাতৃকুলের মধ্যে কেহই কুফুরির উপর ছিলেন না বরং সবাই মো’মিন ছিলেন। এককথায় হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার পিতা-মাতা হযরত আব্দুল্লাহ ও হযরত আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা পর্যন্ত সবাই মোমিন ছিলেন। কেহই কাফের ছিলেন না।
আমাদের আকাবিরদের মধ্যে যদিও কেউ কেউ এ মাসআলা নিয়ে মতানৈক্য করেছেন, তা হলো তাঁদের ইজতেহাদী গলদ।
ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (আলাইহির রহমত) কোরআন পাকের আয়াতে কারীমা ও এ প্রসঙ্গে হাদীসশরীফের সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেই মাসআলার সুষ্ঠু সমাধান দিয়েছেন।
মুজাদ্দিদ- ৭
হিজরি সপ্তম ও অষ্টম শতকের সপ্তম মুজাদ্দিদ হচ্ছেন-
ক) ইমাম তকী উদ্দিন ছুবুকী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ৬৮৩ (ছয়শত তিরাশি) হিজরি এবং ওফাত ৭৫৬ (সাতশত ছাপ্পান্ন) হিজরি।
খ) ইমাম তকী উদ্দিন ইবনে দাকিকুল ঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ৬২৫ (ছয়শত পঁচিশ) হিজরি এবং ওফাত ৭০২ (সাতশত দুই) হিজরি।
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (আলাইহির রহমত) ইমাম তকী উদ্দিন ছুবকী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে খাতিমূল মুজতাহিদীন তথা মুজতাহিদগণের সর্বশেষ ব্যক্তিত্ব বলে অভিহিত করেছেন। সুতরাং তিনি যে মুজতাহিদ ছিলেন এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। যা মুজাদ্দিদ লকবের চেয়েও আরো বহু গুণ উপরে।
ইমাম ছুবুকি রাদিয়াল্লাহু আনহু অনেক মূল্যবান কিতাবাদি রচনা করেছেন। তিনি লিখনীর মাধ্যমে তাজদীদে দ্বীন তথা ধর্মীয় সংস্কারমূলক কাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তাঁর লিখিত কিতাবাদীর মধ্যে ‘শিফাউস সিকাম’ ‘আস সাইফুল মাছলুল’ ‘হুরবাতুল মুজিয়া’ এবং আত তা’জিম ওয়াল মিন্নাহ’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এগুলোর মধ্যে ‘শিফাউস সিকাম’ কিতাবখানাই সারাবিশ্বে অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এ কিতাবখানা নব্য খারেজি ফিতনায়ে ইবনে তাইমিয়ার খণ্ডনে একটি দলিলভিত্তিক কিতাব।
ইবনে তাইমিয়ার বাতিল আক্বিদার মধ্যে একটা জঘণ্যতম আক্বিদা হলো- আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে এজামের জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা শিরিক। (নাউজুবিল্লাহ)
তারই অনুকরণে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত যা ইসমাঈল দেহলভী লিখেছেন এবং কেরামত আলী জৈনপুরীর সমর্থিত কিতাব ‘ছিরাতে মুস্তাকিম’ এ রয়েছে-
‘দূর দুরান্ত থেকে আউলিয়ায়ে কেরামের মাজারশরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করলে শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে এবং আল্লাহর গজবের ময়দানে পতিত হবে।’ (নাউজুবিল্লাহ)
এ শতাব্দীর অপর আরেকজন অন্যতম মুজাদ্দিদ হচ্ছেন ইমাম তকী উদ্দিন ইবনে দাকীকুল ঈদ।
তিনি একজন সুদক্ষ লেখক ছিলেন। তাঁর লিখিত আল ইলমান ফি আহাদিসীল আহকাম, শরহে উমাদতুল আহকাম, আল ইকতেরা, মুকাদ্দামা তাতারিমী ও আরবায়িন ফি রিওয়ায়েতে আন রাব্বিল আলামীন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তিনি মালেকী ও শাফেয়ী উভয় মাযহাবের ফকীহ ছিলেন।
এছাড়াও তিনি কোরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তাঁর সমকালীন বাতিল বিদআতী আক্বিদার খণ্ডন করেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকাইদকে প্রতিষ্ঠা করে তাজদীদে দ্বীনের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। এজন্যই ইমাম জালালউদ্দিন সুয়ূতি রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘তুহফাতুল মুহতাদিন বি আখবারিল মুজাদ্দিদীন’ নামক কিতাবে ইবনে দাকিকুল ঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সপ্তম মুজাদ্দিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এছাড়া উলামায়ে কেরামের বিশ্বাস প্রতি সাতশত বৎসরের প্রারম্ভে যে বিজ্ঞ আলেমের আবির্ভাবের অঙ্গীকার রয়েছে, সেই বিজ্ঞ আলেম হচ্ছেন ইমাম তকী উদ্দিন ইবনে দাকিকুল ঈদ।
মুজাদ্দিদ- ৮
হিজরি অষ্টম ও নবম শতাব্দীর অষ্টম মুজাদ্দিদ হচ্ছেন, হাফিজুল হাদীস ইবনে হজর আসকালানী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ৭৭৩ (সাতশত তেয়াত্তর) হিজরি, ওফাত ৮৫২ (আটশত বায়ান্ন) হিজরি।
তিনি বহু গ্রন্থপ্রণেতা, দেড়শতেরও অধিক কিতাবাদি রচনা করেছেন। তাঁর লিখিত ‘ফতহুল বারি ফি শারহিল বোখারী’ এ বিশাল কিতাবখানাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর লিখনীর মাধ্যমে তাজদীদে দ্বীনের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।
মুজাদ্দিদ- ৯
হিজরি নবম ও দশম শতাব্দীর নবম মুজাদ্দিদ হচ্ছেন, ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতি রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ৮৪৯ (আটশত ঊনপঞ্চাশ) হিজরি, ওফাত ৯১১ (নয়শত এগারো) হিজরি।
মুজাদ্দিদ- ১০
হিজরি দশম ও একাদশ শতাব্দীর দশম মুজাদ্দিদ হচ্ছেন-
ক) আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (আলাইহির রহমত)। তাঁর ওফাত ১০১৪ (একহাজার চৌদ্দ) হিজরি।
খ) আল্লামা মুজাদ্দিদে আলফেসানী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর জন্ম ৯৭১ (নয়শত একাত্তর) হিজরি, ওফাত ১০৩৪ (একহাজার চৌত্রিশ) হিজরি।
গ) আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী। তাঁর জন্ম ৯৫৮ (নয়শত আটান্ন) হিজরি, ওফাত ১০৫২ (একহাজার বায়ান্ন) হিজরি।
মুজাদ্দিদ- ১১
হিজরি একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীর একাদশ মুজাদ্দিদ হচ্ছেন, ইমাম মহিউদ্দিন আওরঙ্গজেব শাহেনশাহে হিন্দ। তাঁর জন্ম ১০২৮ (একহাজার আটাইশ) হিজরি, ওফাত ১১১৭ (এগারোশ সতের) হিজরি।
তিনি তাঁর জন্ম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে, পর শতাব্দীর সতের বৎসর পর্যন্ত তাজদীদে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সম্পূর্ণ জীবন ধর্মত্যাগী মুরতাদ খোদাদ্রোহী বাতিল শক্তির মোকাবেলায় অতিবাহিত করেন।
তাঁর ব্যবস্থাপনায় প্রণয়ন করা হয়েছে, হানাফী মাযহাবের অমূল্য ফতওয়াগ্রন্থ ‘ফতওয়ায়ে আলমগীরি’ যে গ্রন্থখানা আরবদেশে ‘ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইহা বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের অমরকীর্তি হিসেবে পরিগণিত।
মুজাদ্দিদ- ১২
হিজরি দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর দ্বাদশ মোজাদ্দিদ হচ্ছেন, শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত)। তাঁর জন্ম ১১৫৯ (এগারোশ ঊনষাট) হিজরি, ওফাত ১২৩৯ (বারোশ ঊনচল্লিশ) হিজরি।
তিনি স্বীয় পিতা বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত)-এর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে কোরআন-সুন্নাহর তালিমের মিশন অব্যাহত রেখে বাতিল ফেরকার বদ আক্বিদা ও বিদআতী আমলকে বাঁধাগ্রস্থ করে সুন্নী আক্বিদা ও আমলকে অক্ষুন্ন রেখেছেন।
এতদভিন্ন তাঁর সমকালীন বিভিন্ন বাতিল ফেরকার মোকাবেলা ও তাদের ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডনে ‘তোহফায়ে ইসনা আশারিয়া’ নামক বিখ্যাত কিতাব প্রণয়ন করে এ শতাব্দীর তাজদীদে দ্বীনের কাজের আঞ্জাম দিয়েছেন।
এছাড়া ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন’ তাফসিরে আজিজি ও ফতওয়ায়ে আজিজিয়া’ সহ অনেক কিতাব প্রণয়ন করে সুন্নিয়তের পতাকা উড্ডিয়ন করেছেন।
মুজাদ্দিদ- ১৩
হিজরি ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হচ্ছেন, আলা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত, আজিমূল বারাকাত, তাজুশ শরিয়ত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরেলী (আলাইহির রহমত)।
তাঁর জন্ম ১০ই শাওয়াল ১২৭২ (বারোশ বায়াত্তর) হিজরি, ওফাত ২৫ শে সফর ১৩৪০ (তেরোশ চল্লিশ) হিজরি।
এ হিসেবে তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর ২৮ বৎসর ২ মাস ২০ দিন পেয়েছেন এবং চতুর্দশ শতাব্দীর ৩৯ বৎসর ১ মাস ২৫ দিন পেয়েছেন।
তাঁর ব্যক্তিত্বে বাস্তবিকই তাজদীদে দ্বীনের মহান গুণাবলী, শর্তাবলীসমূহ তাঁর মধ্যে পরিপূর্ণ রয়েছে। তিনি সমকালীন বিভিন্ন ভ্রান্ত ফেরকা যথা ওহাবী, রাফেজী, খারেজী, দেওবন্দী, শিয়া, কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডনে প্রায় দেড় সহস্রাধিক কিতাবাদী প্রণয়ন করেন। বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা বিশ্বাসকে উপস্থাপন করেন, এজন্য তাঁকে এ শতাব্দীর সফল মুজাদ্দিদ হিসেবে আরব আজমের প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম ও মণিষীবৃন্দ আখ্যায়িত করেছেন।
এজন্য যে, তাজদীদে দ্বীনের অর্থ হচ্ছে কোরআন-সুন্নাহর বিধানের যথার্থ বাস্তবায়ন করা, মুর্দা বা বিলুপ্ত সুন্নাতকে জিন্দা বা চালু করার মহৎ গুণাবলী ও শর্তাবলী আ’লা হযরতের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আলা হযরতের নিকট এ সমস্ত গুণাবলী থাকার কারণে আরব আজমের হক্বানী উলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে এজাম, মুহাদ্দিসীনে কেরাম তাঁকে সফল মুজাদ্দিদ হওয়ার ব্যাপারে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
______
মনীষীদের দৃষ্টিতে আ’লা হযরত রহমতুল্লাহ আলাইহি
____________________
মনীষীদের দৃষ্টিতে আ’লা হযরত রহমতুল্লাহ আলাইহি
আ’লা হযরত শাহ আহমদ রেযা খাঁন ফাযেলে বেরলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন খাঁটি নবীপ্রেমিক ইসলামী জ্ঞান বিশারদ ও মুজাদ্দিদ। তাঁর জন্ম এমনই এক সময় যখন বিজাতি ব্রিটিশরা উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল এবং দীর্ঘ মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান সাম্রাজ্যকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তুকে পরিণত করেছিল। ব্রিটিশরা ধর্মীয় অঙ্গনে বিভ্রান্তি ছড়াবার জন্য কিছু ভারতীয় দেওবন্দী উলামাকে ভাড়া করে তাদের দিয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করিয়ে কুরআন সুন্নাহর অপব্যাখ্যা দিচ্ছিল এবং মুসলমানদের ঈমান আক্বীদা কলুষিত করছিল। বিশেষ করে ইসলামের মহান পয়গাম্বর হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মান-মর্যাদা খাটো করে এই সব ভাড়াটে মৌলভীরা যখন ফতোয়াবাজি করছিল, ঠিক তখনই বজ্রনিনাদে আ’লা হযরত শাহ আহমদ রেজা খাঁন সাহেব ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে কলমী যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন এবং মুসলমানরূপী শত্রুকে সমূলে উৎখাত করেন।
তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের হৃদয়ে রাসূল প্রেমের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেন এবং ঈমানকে সঞ্জীবিত করেন।
বস্তুত তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ১৮৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৭ সালে। দেওবন্দের কাশেম নানুতবী, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, খলিল আহমদ আম্বেটী ও আশ্রাফ আলী থানবী রচিত কুফুরী আক্বিদা সম্বলিত সমস্ত কিতাবের খণ্ডণ লিখে তিনি ইমামে আহলে সুন্নাত ও মুজাদ্দেদ খেতাব লাভ করেন।
আ’লা হযরত সম্পর্কে বিশ্বের মনীষীগণ উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন। আমরা সেই সমস্ত মনীষীর বক্তব্য উপস্থাপন করবো। উল্লেখ্য যে- এগুলো পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাসউদ আহমদের “ইমাম আহমদ রেযা” শীর্ষক গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে। এ দেশীয় আ’লা হযরতের দুশমনরা এসব মন্তব্য দেখুন।
আ’লা হযরত সম্পর্কে পীর-মাশায়েখগণের ভাষ্য
১. আল্লামা হেদায়াতুল্লাহ সিন্দী মোহাজির মাদানী বলেন : তিনি (আ’লা হযরত) একজন প্রতিভাধর, নেতৃত্ব দানকারী আলেম, তাঁর সময়কার প্রখ্যাত আইনবিদ এবং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহর দৃঢ় হেফাজতকারী, বর্তমান শতাব্দীর পুণরুজ্জীবন দানকারী, যিনি “দ্বীনে মতিন” এর জন্য সর্বশক্তি দ্বারা আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যাতে শরীয়তের হেফাজত করা যায়। “আল্লাহর পথের” ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণকারীদের ব্যঙ্গ বিদ্রƒপের প্রতি তিনি তোয়াক্কা করেননি। তিনি দুনিয়াবী জীবনের মোহসমূহের পিছু ধাওয়া করেননি বরং রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসাসূচক বাক্য রচনা করতেই বেশি পছন্দ করেছিলেন। হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রেমের ভাবোন্মত্ততায় তিনি সর্বদা মশগুল ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়। সাহিত্যিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ও প্রেমভক্তিতে ভরপুর তাঁর “নাতিয়া পদ্যের” মূল্য যাচাই করা একেবারেই অসম্ভব। দুনিয়া এবং আখেরাতে তাঁর প্রাপ্ত-পুরস্কারও ধারণার অতীত। মওলানা আব্দুল মোস্তফা শায়েখ আহমদ রেযা খাঁন-হানাফী কাদেরী সত্যিই পাণ্ডিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়ার যোগ্য। আল্লাহ তাঁর হায়াত দারাজ করুন। (১৯২১ সালের প্রদত্ত বক্তব্য, তথ্যসূত্র : মা’আরিফে রেযা করাচী, ১৯৮৬ খ্রি. পৃষ্ঠা নং-১০২)
২. জিয়াউল মাশায়েখ আল্লামা মোহাম্মদ ইব্রাহীম ফারুকী মোজাদ্দেদী, কাবুল, আফগানিস্তান : তিনি বলেন-“নিঃসন্দেহে মুফতী আহমদ রেযা খাঁন বেরলভী ছিলেন একজন মহাপণ্ডিত। মুসলমানদের আচার- আচরণের নীতিমালার ক্ষেত্রে তরীকতের স্তরগুলো সম্পর্কে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। ইসলামী চিন্তা-চেতনার ব্যাখ্যা করেন জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উচ্চসিত প্রশংসার দাবীদার। ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মৌলনীতিমালার সাথে সঙ্গতি রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পরিশেষে, একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, এ আক্বিদা বিশ্বাসের মানুষের জন্য তাঁর গবেষণাকর্ম আলোকবর্তিকা হয়ে খেদমত আঞ্জাম দেবে”। (মকবুল আহমদ চিশতি কৃত পায়গামাতে ইয়াওমে রেযা, লাহোর, পৃ. -১৮)
বিদেশী অধ্যাপকবৃন্দের অভিমত
১. অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আলাউয়ী, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর : তিনি বলেন-“একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে যে, বিদ্যায় প্রতিভা ও কাব্যগুণ কোন ব্যক্তির মাঝে একসাথে সমন্বিত হয় না। কিন্তু আহমদ রেযা খাঁন ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তাঁর কীর্তি এ রীতিকে ভুল প্রমাণিত করে। তিনি কেবল একজন স্বীকৃত জ্ঞান বিশারদই ছিলেন না বরং একজন খ্যাতমানা কবিও ছিলেন”। (সাওতুশ শারক, কায়রো, ফেব্রুয়ারি ১৯৭০, পৃ. ১৬/১৭)
২. শায়খ আবদুল ফাততাহ আবু গাদ্দা, ইবনে সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় রিয়াদ, সৌদি আরব : তাঁর বক্তব্য- “একটি ভ্রমণে আমার সাথে এক বন্ধু ছিলেন। যিনি ফতোয়ায়ে রেযভীয়া (ইমাম সাহেবের ফতোয়া) গ্রন্থখানা বহন করছিলেন। ঘটনাচক্রে আমি ফতোয়াটি পাঠ করতে সক্ষম হই। এর ভাষার প্রাচুর্য, যুক্তির কীক্ষতা এবং সুন্নাহ ও প্রাচীন উৎস থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিসমূহ দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। আমি নিশ্চিত- এমনকি, একটি ফতোয়ার দিকে এক নজর চোখ বুলিয়েই নিশ্চিত যে- এই ব্যক্তিটি বিচারবিভাগীয় অন্তর্দৃষ্টি সমৃদ্ধ একজন মহাজ্ঞানী আলেম”। (ইমাম আহমদ রেযা আরবার ইত্যাদি, পৃ.-১৯৪)।
অন্যান্য ধর্মাবলম্বী পণ্ডিতবর্গের অভিমত
১. ড. বারবারা, ডি, ম্যাটকাফ, ইতিহাস বিভাগ বারকলী বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : তিনি অভিমত পেশ করেন- “ইমাম আহমদ রেযা খাঁন তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই অসাধারণ ছিলেন। গণিতশাস্ত্রে তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টির একটি ঐশীদান প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি ড. জিয়াউদ্দিনের একটি গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন- অথচ এর সমাধানের জন্য ড. জিয়াউদ্দিন জার্মান সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন”। (মা’আরিফে রেযা ১১তম খণ্ড আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ, ১৯৯১ পৃ.-১৮)।
২. অধ্যাপক ড. জে. এম. এস. বাজন-ইসলাম তত্ত্ব বিভাগ, লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়, হল্যান্ড : ড. মাসউদ আহমদের নিকট লিখিত তাঁর বক্তব্য হলো- “ইমাম সাহেব একজন বড় মাপের আলেম। তাঁর ফতোয়াগুলো পাঠের সময় এই বিষয়টি আমাকে পুলকিত করেছে যে- তাঁর যুক্তিগুলো তাঁরই ব্যাপক গবেষণার সাক্ষ্য বহন করছে। সর্বোপরি- তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ভারসাম্যপূর্ণ। আপনি (ড. মাসউদ আহমদ) সম্পূর্ণ সঠিক। পাশ্চাত্যে তাঁকে আরো অধিক জানা ও মূল্যায়িত করা উচিত- যা বর্তমানে হচ্ছে”। (ড. মাসউদ আহমদকে প্রেরিত পত্র, তাং-২১-১১-৮৬ হতে সংগৃহীত)
প্রতিপক্ষের দৃষ্টিতে ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রহ.)
১. মওলভী আশরাফ আলী থানবী, থানাবন, ভারত : তিনি বলেন-“(ইমাম) আহমদ রেযা খাঁনের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে- যদিও তিনি আমাকে কাফের (অবিশ্বাসী) ডেকেছেন। কেননা, আমি পূর্ণ অবগত যে, এটা আর অন্য কোন কারণে নয়- বরং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যক্তিত্বের প্রতি তাঁর সুগভীর ও ব্যাপক ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত”। (সাপ্তাহিক চাতান, লাহোর, ২৩শে এপ্রিল ১৯৬২)
২. আবুল আ’লা মওদুদী, প্রতিষ্ঠাতা, জামায়াতে ইসলামী : তিনি মন্তব্য করেন- “মাওলানা আহমদ রেযা খাঁনের পাণ্ডিত্যের উচুঁমান সম্পর্কে আমার গভীর শ্রদ্ধা বিদ্যমান। বস্তুত দ্বীনি চিন্তা-চেতনার তাঁর মেধাকে স্বীকার করতে হয়”। (মাকালাতে ইয়াওমে রেযা, ১ম ও ২য় খণ্ড, পৃ.- ৬০)
ইমাম আহমদ রেজা খাঁন রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন মুসলিম মনীষার প্রাণপুরুষ। তাঁর অধিকাংশ গবেষণাকর্ম উর্দু ভাষায় রচিত হওয়ায় বাংলা ভাষাভাষী জনগণ সেগুলো থেকে বঞ্চিত। তাঁর গবেষণা কর্মকে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আল্লাহপাক তাওফিক দিন।
____
নজদী ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভী
____________________
সৈয়দ আহমদ বেরলভী হচ্ছেন নজদী ওহাবীদের নেতা
বিশিষ্ট লেখক এম. আর. আখতার মুকুল কর্তৃক লিখিত ‘কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি’ নামক পুস্তকের ভাষ্যমতে :
‘ভারত উপমহাদেশে যারা মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর ভ্রান্ত (ওহাবী) মতবাদকে আমদানি করেছিলেন তারা হচ্ছেন : ১. হাজী শরিয়ত উল্লাহ ও ২. তদীয় পুত্র মুহাম্মদ মহসিন ওরফে পীর দুদু মিয়া ৩. নিসার আলী ওরফে তীতুমির এবং ৪. সৈয়দ আহমদ বেরলভী।’ (এম. আর. আখতার মুকুল কর্তৃক লিখিত ‘কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ নামক পুস্তক ৮২ পৃষ্ঠা ১ম সংস্করণ)
‘প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, তিতুমীর হজ্ব করার উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করলে সেখানেই ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিনি পবিত্র মক্বা নগরীতে অবস্থানকালে সৈয়দ আহমদ এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন’ (কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ৮৪ পৃষ্ঠা)
‘ঐতিহাসিক তথ্য থেকে দেখা যায় যে ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভী ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
...এদিকে টুংকু সরদার আমীর খান ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করলে সৈয়দ আহমদ বেরলভী ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে বেরেলী থেকে ... দিল্লীতে গমন করে তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজ আলাইহির রহমত এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন...
ফলে তিনি আটনা কেন্দ্রের দুইজন বিশ্বস্ত অনুসারী শাহ ইসমাইল ও আব্দুল হাই তার প্রতিনিধি বা খলিফা নিযুক্ত করে নিজেদের মতাদর্শ প্রচার অব্যাহত রাখা ছাড়াও অত্যন্ত সংগোপনে জেহাদের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দান করেন।...
...গবেষক মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহর মতে, পবিত্র হজ্ব পালনের পর সৈয়দ সাহেব মধ্যপ্রাচ্যে বহু দেশ সফর করেন এবং একমাত্র কনসতান্তিনোপলেই (ইস্তাম্বুলেই) শিষ্য ও দর্শনার্থীদের নিকট থেকে নয় লক্ষাধিক টাকা নজরানা পেয়েছিলেন। এসময় তিনি (সৈয়দ আহমদ বেরলভী) মুহাম্মদ আল্লামা (ইবনে) আব্দুল ওহাব-এর বেশ ক’জন অনুসারীর সংস্পর্শে আসেন এবং তার চিন্তাধারা পরিধির ব্যাপ্তি ঘটে। অতঃপর সৈয়দ আহমদ ১৮২৩ সালের অক্টোবরে দেশে প্রত্যাবর্তন করে দিল্লীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।...
‘সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী সীমান্ত প্রদেশের আফগান এলাকায় পৌঁছানোর পর তার প্রতিনিধিরা যেভাবে বাংলা ও বিহার এলাকা থেকে অর্থ ও নতুন রিক্রুট করা মুজাহিদ ট্রেনিং প্রদানের পর নিয়মিতভাবে প্রেরণ করেছে তা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এজন্য শহরেই প্রতিষ্ঠিত হলো ওহাবীদের প্রধান কেন্দ্র আর দ্বিতীয় কেন্দ্রটি গড়ে উঠলো মালদহে।
এ সময় মওলবী বেলায়েত আলী চট্রগ্রাম, নোয়াখালী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, ও বরিশাল এলাকায় এবং পাটনার এনায়েত আলী পাবা, রাজশাহী, মালদহ, বগুড়া, রংপুর, এলাকায় কট্টর রক্ষণশীল ওহাবী মতাদর্শ প্রচার ছাড়াও অন্যান্য বাঙালি মুসলমান যুবককে মুজাহিদ হিসেবে সংগ্রহ করেন।’ (কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ৮৬/৮৭ পৃষ্ঠা)
সংক্ষেপে ওহাবী আন্দোলনের গোড়ার ইতিহাস
‘ওহাবী আন্দোলনের প্রবর্তক মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব এর সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায়নি। (কোন গবেষকের মতে ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম) তবে তিনি ছিলেন সৌদিআরবের নজ্দ প্রদেশের জনৈক সম্ভ্রান্ত সরদারের পুত্র।...
আরবের অধিকাংশ এলাকাই তুরস্কেও সুলতানের (খলিফার) অধীনে ছিলো।...
অবশেষে দেরইয়ার সরদার মোহাম্মদ ইবনে সৌদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইহারই সাহায্যে তিনি বেদুঈনদের সমবায়ে একটি ক্ষুদ্র সশস্ত্র বাহিনী গঠনপূর্বক প্রথম সুযোগে তুরস্ক সরকারের বিরোদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া দেন। ... এরূপে অতি অল্পকালের মধ্যে মরু অঞ্চলে বিশেষ করিয়া নজ্দ প্রদেশে ইবনে আব্দুল ওহাবের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়া যায়। মোহাম্মদ ইবনে সৌদের সহিত তাহার এক কন্যার বিবাহ দিয়া ইবনে আব্দুল ওহাব সমগ্র নজদের শাসনক্ষমতা তাহার হস্তে অর্পণ করিয়া শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে স্বয়ং সর্বময় কর্তা হইয়া রহিলেন।...
... বাগদাদের তুর্কী শাসনকর্তা নজ্দ এ ইবনে আব্দুল ওহাবকে দমন করার লক্ষে ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিরাট সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু যুদ্ধে তুর্কীবাহিনী পরাজিত হলে ইবনে আব্দুল ওহাব একটি নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই আল্লামা ইবনে আব্দুল ওহাব ইন্তেকাল করেন। কিন্তু এর অনুসারীরা অচিরেই আরও শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। ১৭৯১ সালে ওহাবীরা পবিত্র মক্কানগরী আক্রমণ করে। কিন্তু সম্পুর্ণ সফলকাম হতে পারেনি। ১৭৯৭ সালে এরা বাগদাদ আক্রমণ করে ইরাকের একটি এলাকা নজ্দ এর অন্তর্ভূক্ত করে নেয়।...
... এখানে আরও একটি ব্যাপার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইবনে আব্দুল ওহাবের অনুসারীরা সব সময়েই নিজেদের মুজাহিদ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ইংরেজরাই এদের ওহাবী নামকরণ করেছে। ১৮০১ সালে এ ধরণের প্রায় লক্ষাধিক মুজাহিদ পবিত্র মক্বানগরী আক্রমণ করে। কয়েক মাসব্যাপী এই যুদ্ধে মক্বানগরী মুজাহিদদের দখলে আসে এবং মক্কায় তুর্কী শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। ১৮০৩ সাল নাগাদ মুজাহিদরা (ওহাবীরা) পবিত্র মদিনানগরীর উপর কর্তৃত্ব বিস্তারে সক্ষম হয়। কিন্তু মুজাহিদরা কবরপূজা ও এ ধরণের অন্যান্য অনৈসলামিক কার্যকলাপ বন্দের লক্ষ্যে এসব যুদ্ধের সময় মক্বা ও মদিনায় অবস্থিত দরবেশ ও পীর ফকিরদের কবরের উপর নির্মিত কতিপয় সৌধ ভেঙ্গে দেয়। এমনকি হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর রওজার একটা অংশ তাদের হাত হইতে সে সময় রক্ষা পায় না।’
এদিকে পবিত্র মক্বা ও মদিনা নগরী দু’টি হস্তচ্যুত হওয়ায় তুর্কী খলিফা খুবই রাগান্বিত ছিলেন। তাই ওহাবীরা হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) রওজার অংশবিশেষ ভেঙ্গে দিয়েছে এই কথাটা এবং অন্যান্য কয়েকটি অভিযোগ তুর্কীরা সমগ্র বিশ্বে বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে রটিয়ে দিলো। এরই দরুণ ১৮০৩ থেকে ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত আরবের বাইরে থেকে হজ্ব যাত্রীদের সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পেলো।...
...অন্যদিকে ইসলামী মূল্যবোধ এবং প্রকৃত ইসলামী রীতিনীতি সম্পর্কে আল্লামা ইবনে আব্দুল ওহাব যে ব্যাখ্যা দান (ওহাবীয়ত প্রচার) করেছিলেন, সেই দর্শন অচিরেই ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর কৃতিত্বের দাবিদার (ওহাবীয়ত প্রচারের দাবিদার) যথাক্রমে হাজী শরিয়ত উল্লাহ ও তদীয় পুত্র মুহাম্মদ মহসিন ওরফে পীর দুদু মিয়া, নিসার আলী ওরফে তীতুমির এবং সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী।’
(এম. আর আখতার মুকুল কর্তৃক লিখিত ‘কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ ৮১ হইতে ৮২ পৃষ্ঠা)
____
নজদী ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তার খলিফা শাহ ইসমাইল দেহলভী দ্বারা (ঈমান বিধ্বংসী) ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ লেখানোর কারণ
____________________
নজদী ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার খলিফা শাহ ইসমাইল দেহলভী দ্বারা (ঈমান বিধংসী) ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ লেখানোর কারণ
এ প্রসঙ্গে শারিহে বোখারী আল্লামা মুফতি শরিফুল হক আমজাদী সাহেব স্বীয় প্রণীত ‘সুন্নি দেওবন্দী এখতেলাফাত’ নামক কিতাবে ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ প্রসঙ্গে বলেন-
‘ভারতীয় মুসলমানগণ যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আজাদী আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন এবং সমস্ত মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে মৌলভী ইসমাইল দেহলভী মুসলমানদের একতা বিনষ্ট করার জন্য তার পীরের নির্দেশে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ একটি ঈমানবিধ্বংসী কিতাব রচনা করলেন।
কিতাবটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে চারদিকে হুলস্থূল পড়ে গেল। অবশ্যই তখনকার ইংরেজবিরোধী সুন্নী উলামায়ে কেরামগণ-এর দাঁতভাঙা জবাবও দিয়েছিলেন। এমনকী তার চাচাত ভাই মাওলানা মুছা ও মাওলানা মোহাম্মদ মাখছুছ উল্লাহ (আলাইহির রহমত) উভয়েই পৃথকভাবে এ ঈমান বিধ্বংসী কিতাবের বাতিল আক্বিদার খণ্ডন করেছিলেন। মাওলানা মোহাম্মদ মুছা দেহলভী (আলাইহির রহমত) এ বিষয়ে দু’টি ‘ছওয়াল ও জওয়াব’ এবং দ্বিতীয়টি হলো ‘হুজ্জাতুল আমল ফি ইবতালিল হায়ম’ ঠিক তেমনিভাবে মাওলানা মোহাম্মদ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী (আলাইহির রহমত) যে কিতাব লিখেছিলেন তার নাম ‘মঈদুল ঈমান ফি রদ্দে তাকভীয়াতুল ঈমান’।
তাছাড়া ইংরেজবিরোধী আজাদী আন্দোলনের অগ্রনায়ক আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী (আলাইহির রহমত) ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের বাতিল আক্বিদার রদে দু’টি কিতাব লিখেছিলেন। একটি হলো تحقيق الفتوى فى ابطال الطغوى (তাহকীকুল ফতওয়া ফি ইবতালিত তাগা) এবং অপরটি হলো امتناع نظير (ইমতেনাউন নাজীর)
হযরতুল আল্লামা ফজলে রাসূল বাদায়ুনী (আলাইহির রহমত) ও ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের বাতিল আক্বিদার খণ্ডনে লিখেছেন سيف الجبار (ছাইফুল জব্বার)।
উক্ত ঈমান বিধংসী ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবটি প্রকাশ হওয়ার পর নবীপ্রেমিক মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে লেখক নিজেই তা ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। যা তারই অনুসারী মাওলানা আশরাফ আলী থানবী সাহেব তদীয় ‘আরওয়াহে ছালাছা’ নামক কিতাবে ৭৪ পৃষ্ঠায় হুবহু তুলে ধরেছেন। ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের লেখক ইসমাইল দেহলভী বলেন-
میں نے یہ کتاب لکھی ھے اور میں جنتاہوں کہ اس میں بعض جگہ ذرا تیز الفاظ أگۓ ہیں اور بعض جگہ تشدد بھی ہوگیا ہے ہے مثلا ان امور کو جو شرک خفی تھے شرک جلی لکھ دیا گیا ھے ان وجوہ سے مجھے اندیشہ ھے کہ اشاعت سے شورش ضرور ہوگی ۔۔۔ گو اس سے شورش ہوگئ مگر توقع ھے کہ لر بھڑ کر خود ٹیک ہو جائیں گے ،
অর্থাৎ ‘আমি এ কিতাবটি লেখেছি এবং এর কোন কোন স্থানে সামান্য শক্ত কথা এসে গেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘনও হয়ে গেছে। যেমন যে সব বিষয় শিরকে খফী সেগুলোকে আমি শিরকে জলী লিখে দিয়েছি। এ কারণে আমি মনে করি এই কিতাবটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে অবশ্যই গোলমাল বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তবে আমার বিশ্বাস লড়ালড়ি করে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’
____
ইসমাইল দেহলভী ও সৈয়দ আহমদ বেরলভী ছিলেন ইংরেজদের দালাল
____________________
ইসমাইল দেহলভী ও সৈয়দ আহমদ বেরলভী ছিলেন ইংরেজদের দালাল
সত্যান্বেষী নবীপ্রেমিক বন্ধুগণ! ইসমাইল দেহলভী সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্যের দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয়ে যে, তিনি জেনেশুনে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে যা শিরকে জলী (স্পষ্ট শিরক) নয় অথচ তিনি তাকে শিরকে জলী (স্পষ্ট শিরিক) লিখে দিয়েছেন এবং তিনি এ তথ্য নিজেই স্বীকার করে নিয়ে বললেন, এটা প্রকাশ হওয়ার পর মুসলমানদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে।
এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে এই কিতাবটি লেখার কারণ কি? যা স্পষ্ট শিরিক নয় তা স্পষ্ট শিরিক বললেন কেন? এর জবাবে প্রত্যেক গুণী-জ্ঞানী নবীপ্রেমিক মুসলমানগণ বলতে বাধ্য হবেন, তার একমাত্র উদ্দ্যেশ্য ছিল মুসলমানদের ঐক্যকে বিনষ্ট করা এবং তাদের মন আজাদী আন্দোলনের প্রস্তুতি থেকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দেওয়া, কারণ তিনি ছিলেন ইংরেজদের মদদপুষ্ট দালাল।
কোন কোন লেখক মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ও তার পীর সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে ইংরেজবিরোধী মোজাহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ তারা উভয়ের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছিলেন না। বরং ইংরেজদের পক্ষে এবং আজাদী-আন্দোলনের প্রস্তুতির বিরুদ্ধে ছিলেন। নিুে ইসমাইল দেহলভী সাহেবের বক্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করুন-
১۔ মির্জা হায়রত দেহলভী প্রণীত ‘হায়াতে তাইয়িবা’ নামক মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর জীবনীগ্রন্থে (২৭১ পৃষ্ঠা মাতবায়ে ফারূকী) উল্লেখ রয়েছে-
کلکتہ میں جب مولانا اسمعیل نے جھاد کا وعظ فرمانا شروع کیا اور سکھوں کے مظالم کی کیفیت پیش کی تو ایک شخص نے دریافت کیا آپ انگریزوں پر جھاد کا فتوی کیوں نہیں دیتے؟ آپ نے جواب دیا ان پر جھاد کرنا کسی طرح واجب نہیںـ ایک تو ان کی ھم رعیت ہیں دوسرے ہمارے مذھبی ارکان کے ادا کرنے میں وہ ذرا بھی دست اندازی نہیں کرتے ـ ھمیں ان کی حکومت میں ہر طرح آزاد ی ھے بلکہ اگر ان پر کوئ حملہ وار ہو تو مسلمانوں پر فرض ھے کہ وہ اس سے لڑیں اور اپنی گور نمنٹ برطانیہ پر آنچ نہ آنے دیں
অর্থাৎ ‘মাওলানা ইসমাইল দেহলভী যখন কলিকাতায় জিহাদসংক্রান্ত ওয়াজ শুরু করলেন এবং শিখদের অত্যাচার সম্পর্কে বিবরণ দিচ্ছিলেন, তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন আপনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার ফতওয়া দিচ্ছেন না কেন? তিনি (মৌলভী ইসমাইল দেহলভী) উত্তরে বললেন- তাদের বিরুদ্ধে (ইংরেজদের বিরুদ্ধে) কোন অবস্থাতেই জিহাদ করা ওয়াজিব নয়। একদিকে আমরা হচ্ছি তাদের প্রজা। অপরদিকে আমাদের ধর্মীয় কোন কাজ সম্পন্ন করতে তারা কোন বাধা দিচ্ছে না। তাদের শাসনে (ইংরেজ শাসনে) আমাদের সর্বপ্রকার স্বাধীনতা রয়েছে। যদি ইংরেজদের উপর কোন বহিশত্রু আক্রমণ করে, তখন এ দেশীয় মুসলমানদের উপর ফরজ তারা যেন আক্রমণকারীদেরকে প্রতিহত করে এবং ইংরেজ সরকারের যেন কোন ক্ষতি করতে না পারে।’
উল্লেখ্য যে, মীর্জা হায়রত দেহলভী প্রণীত ‘হায়াতে তাইয়িবা’ কিতাবের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে মাওলানা মঞ্জুর নোমানী সাহেব ‘মাসিক আল ফোরকান ১৩৫৫ হিজরি শহীদ সংখ্যা ৫১ পৃষ্ঠায় বলেন-
کتاب مرزا حیرت مرحوم کی حیات طیبہ ھے شاہ اسمعیل شھید کی نہایت مضبوط سوانح عمری ھے ـ
অর্থাৎ ‘মীর্জা হায়রত দেহলভী লিখিত ‘হায়াতে তাইয়িবা’ শাহ ইসমাইল দেহলভীর জীবনী হিসেবে অত্যন্ত মজবুত গ্রন্থ।’
১. মুনসি মোহাম্মদ জাফর থানছিরী প্রণীত ‘ছাওয়ানেহে আহমদী’ নামক গ্রন্থেও ৪৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
یہ بھی صحیح روایت ھے کہ اثناۓ قیام کلکتہ میں جب ایک روز مولانا محمد اسمعیل دھلوی وعظ فرمارھے تھے ایک شخص نے مولانا سے یہ فتوی پوچھا کہ سرکار انگریزی ير جھاد کرنا درست ھے یا نہیں ؟ اس کے جواب میں مولانا نے فرما یاکہ اسی بے روریا اور غیر متعصب سرکار پر کسى طرح بھی جھاد دورست نہیں ـ
অর্থাৎ ‘ইহাও একটি সহী শুদ্ধ বর্ণনা যে, কলিকাতা অবস্থানকালে একদা মাওলানা ইসমাইল দেহলভী ওয়াজ করছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি মাওলানা ইসমাইল দেহলভীকে ফতওয়া জিজ্ঞাসা করল, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করা সঠিক কি না? প্রতি উত্তরে মাওলানা (ইসমাইল দেহলভী) বললেন, এ ধরণের সচেতন এবং সংস্কারক সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করা কোন অবস্থাতেই সঠিক হবে না।’
উল্লেখ্য যে, মুনসি জাফর থানছিরী লিখিত ‘ছাওয়ানেহে আহমদী কিতাবের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী সিরতে সৈয়দ আহমদ গ্রন্থেও ৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
سوانح احمدی وتواریخ عجیبہ اردو پھلی کتاب سید صاحب کے حالات میں مقبول و مشھور ھے جس سے سید صاحب کے حالات کی بہت اشاعت ھوئ ـ
অর্থাৎ ‘ছাওয়ানেহে আহমদী’ এবং তাওয়ারিখে আজিবা গ্রন্থদ্বয়ই উর্দুভাষায় প্রথম কিতাব, যা সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের জীবনী সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য ও প্রসিদ্ধ কিতাব। যা দ্বারা সৈয়দ আহমদ সাহেবের জীবনী খুব বেশি প্রচারিত হয়েছে।
ফুলতলী সাহেবের বড় ছাহেবজাদা মাওলানা মো: ইমাদউদ্দিন চৌধুরী ফুুলতলী সিলেট, সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী জীবনী ২য় সংস্করণ ৪৮ ও ৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেন, এক ইংরেজ আতিথ্য, এশার নামাযের পর নৌকার দিক দর্শকরা খবর দিল মশালধারী কয়েকজন লোক নৌকার দিকে এগিয়ে আসছে। সৈয়দ সাহেব খবর নিয়ে জানতে পারলেন জৈনক ইংরেজ ব্যবসায়ী সৈয়দ সাহেবের কাফেলার জন্য খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আসতেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ইংরেজ ভদ্রলোক কয়েকজন লোকসহ সৈয়দ সাহেবের সামনে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলেন, জনাব তিনদিন থেকে আপনার শুভাগমনের অপেক্ষায় ছিলাম। আজ সৌভাগ্যক্রমে আপনি তাশরীফ এনেছেন। আমার এই নগন্য দ্রব্যগুলি গ্রহণ করুন। সৈয়দ সাহেব কাফেলাসহ ইংরেজের আতিথ্য গ্রহণ করলেন।’
উপরোক্ত তথ্যাবলী থেকে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ও তার পীর সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব ইংরেজবিরোধী ছিলেন না বরং ইংরেজদের পক্ষেই কাজ করেছেন। ইংরেজের সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ করে সুকৌশলে মুসলমানদের চোখে ধূলি দিয়ে ইংরেজদের দালালী করেছেন। তিনি এবং তার পীর সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব শিখদের বিরুদ্ধে যে লড়াই বা যুদ্ধ করেছিলেন তাই ইংরেজদের স্বার্থেই করেছিলেন। কারণ ইংরেজরা চেয়েছিল স্বাধীন শিখ জাতির শক্তিকে ও দুর্বল করে দেওয়া।
এ প্রসঙ্গে ‘কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ পুস্তকের ৯০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
‘ওহাবী ও শিখদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে উভয়পক্ষেরই শক্তি ক্ষয় হোক এটাই ইংরেজদের কাম্য ছিল। এই প্রেক্ষিতে ১৮৩১ সালে ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদের ইন্তেকাল হয় এবং ১৮৩৯ সালে রণজিত সিং এর মৃত্যুর পর লর্ড ডালহৌসী একে একে পাঞ্জাব ও সিন্ধু এলাকা ইংরেজ রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত করে নেয়।’
এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ও তার পীর সৈয়দ আহমদ বেরলভীর আন্দোলনের দ্বারা ইংরেজরাই লাভবান হয়েছে এবং তাদের রাজত্বের পরিধি ও শক্তি আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। অপরদিকে এই আন্দোলনের দ্বারা মুসলমানদের জান-মালের বহু ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল।
_____
ইসমাঈল দেহলভীর মর্মান্তিক মৃত্যু
____________________
ইসমাঈল দেহলভীর মর্মান্তিক মৃত্যু
আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী (আলাইহির রহমত) তদীয় সুপ্রসিদ্ধ ‘জাআল হক্ব’ নামক কিতাবের ভূমিকায় লিখেন-
‘দিল্লী শহরে মৌলভী ইসমাইল দেহলভী নামে একজন লোক জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী প্রণীত ‘কিতাবুত তাওহীদ’ এর উর্দু ভাষায় খোলাসা করে অনুবাদ করেন ও ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামে প্রকাশ করে হিন্দুস্থানে এক ব্যাপক প্রচারের আয়োজন করেন। ‘এই তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবখানা প্রকাশ করার কারণে তিনি সীমান্তের পাঠান মুসলমানদের হাতে নিহত হন। শিখদের হাতে তিনি নিহত হয়েছেন বলে প্রচারণা চালিয়ে ওহাবীরা তাকে শহীদ বলে গণ্য করে থাকে। (আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত) চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরেলী কত সুন্দর উপমা দিয়ে বলেছেন-
وہ وھابیہ نے جیسے دیاھے لقب شھید و ذبیح کا
وہ شھید لیلے نجد تھا وذبیح تیغ خیار ھے
অর্থাৎ ‘ওহাবীরা যাকে শহীদ ও জবীহ বলে আখ্যায়িত করেছে আসলে তিনি নজদের লায়লার প্রেমে বিভোর হয়ে নবীপ্রেমিক মুসলমান ধার্মিকের হাতেই প্রাণ হারিয়েছেন। (আল কাওকাবাতু শিহাবীয়া)
যদি তাদের কথা মতো শিখরাই নিহত করতো তাহলে অমৃতসর বা পূর্ব পাঞ্জাবের কোন শহরে তিনি মারা যেতেন। কেননা পূর্ব পাঞ্জাবই হল শিখদের কেন্দ্র। সীমান্ত হলো পাঠানদের এলাকা এবং সেখানেই তিনি নিহত হয়েছেন।
অতএব স্পষ্টভাবে বুঝা গেল তিনি মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। তার মৃতদেহও উধাও করে ফেলা হয়েছিল। এজন্য কোথাও তার কোন কবর নেই।
_____
বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত
____________________
বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত (অনুবাদ ও টীকা সুন্নী ফাউন্ডেশন) ৯৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- বালাকোট যুদ্ধ (৬ মে ১৮৩১ খ্রি.) পটভূমিকা
‘পেশোয়ার থেকে কাশ্মীরের পথে বালাকোট একটি সুরক্ষিত এলাকা। চতুর্দিকে উঁচু পাহাড় দ্বারা বালাকোটবেষ্টিত। সুতরাং এটি একটি সুদৃঢ় দুর্গের ন্যায় ছিল। সীমান্ত এলাকায় ৫ বছর অবস্থান ও রাজত্বকালে সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব, ইসমাইল দেহলভী, মুজাহিদবাহিনীর কাজী ও কর্মচারীরা পাঠানদের কিছু কুমারী ও বিধবা মহিলাকে জোর করে বিবাহ করেছিল। এ নিয়ে ভারতীয় ও পাঠানদের মধ্যে বিরাট দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সৈয়দ আহমদ সাহেব একটি পাঠান বালিকাকে জোর করে বিবাহ করেন। তার গর্ভে এক কন্যা সন্তান হয়। এই বিয়ে নিয়ে সৈয়দ সাহেবের সাথে আফগান উপজাতীয়দের মন কষাকষি চরম আকার ধারণ করে। এই দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত সৈয়দবাহিনীর পরাজয় তরান্বিত করে। ফুলুড়ার যুদ্ধে সৈয়দবাহিনী চরমভাবে পর্যূদস্ত হয় এবং তার অসংখ্য ওহাবী সৈন্য নিহত হয়।
বিভিন্ন যুদ্ধে আফগান সীমান্তবাসীদের হাতে মার খেতে খেতে মুজাহিদবাহিনী কিছু নিহত হয় আর কিছু দল ত্যাগ করে মৌলভী মাহবুব আলীর নেতৃত্বে হিন্দুস্থানের দিকে পলায়ন করে। শেষ পর্যন্ত একলাখের মধ্যে হাজার বারোশ মুজাহিদ সৈয়দ সাহেবের সাথে থেকে যায়। এ অবস্থা দেখে সৈয়দ সাহেব ঐ এলাকা ত্যাগ করে কাশ্মীরে আশ্রয় নেওয়ার উদ্দেশ্যে পলায়ন করেন। সামনে শিখ সর্দার শের সিং এর বিশহাজার সৈন্যবাহিনী এবং পিছনে পাঠান আফগান সীমান্তবাসীর ধাওয়ার মধ্যখানে বালাকোট চুড়ান্ত ঘটনা সংঘটিত হয়েও পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়।’ (দেখুন- ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী লিখিত ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তক ‘শাহ ওলী উল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা পৃ. ৭৮-৮৬ অনুবাদক)
উপরোক্ত তথ্যাবলির দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ও তার পীর সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবদ্বয় বিধর্মী শিখদের হাতে নয় বরং সুন্নী আক্বিদায় বিশ্বাসী মুসলমান ধার্মিকদের হাতেই নিহত হয়েছিল।
তার কারণ ১. ইসমাইল দেহলভী ও তার পীর সৈয়দ আহমদ বেরলভী ‘সিরাতে মুস্তাকিম ও ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গং কিতাবসমূহের বাতিল আক্বিদাকে ইসলামী আক্বিদার নামে প্রচার ও প্রসারের নিমিত্তে ‘তরীকায়ে মোহাম্মদীয়া’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করে, যে আন্দোলন গড়ে তুলে ছিলেন এবং সাথে সাথে সরলপ্রাণ মুমলমানগণকে ধোকা দেওয়ার মানসে শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন।
এতে বাহ্যিক অবস্থা দেখে যদিও অনেক সরলপ্রাণ মুসলমান প্রতারিত হয়েছেন এবং মুসলমানদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এমতাবস্থায়ও তাদের (ওহাবীদের) এ বাতিল মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে তারা স্থানে স্থানে নবীপ্রেমিক সুন্নি মুসলমানদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
(এমনকি পেশওয়ারের একদল হক্বানী রব্বানী সাহসী বিজ্ঞ আলেম সমাজ) থেকে একটি কাগজের উপর স্বাক্ষর যুক্ত ফতওয়া গ্রহণ করে যে, সৈয়দ সাহেব এবং সঙ্গী সাথী মুজাহিদ (ওহাবী) বাহিনীর আক্বিদা বা ধর্মবিশ্বাস ভ্রান্ত।’ (আবুল হাসান আলী নদভীর, ঈমান যখন জাগল’ ৩৯)
ইসলামী আক্বিদাভিত্তিক এ সঠিক ফতওয়া প্রচার হওয়ার পর দুশমনে রাসূল সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তার খলিফা ইসমাইল দেহলভীর অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে গেল। মুসলমানগণ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সঠিক আক্বিদার সন্ধান লাভ করতে সক্ষম হলেন।
প্রকাশ থাকে যে, ‘ঈমান যখন জাগল’ এ পুস্তকের লিখক সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী যেহেতু নজদী ওহাবী আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলেন, এজন্য তিনি তার পুস্তকে হক্বানী উলামায়ে কেরামগণকে উলামায়ে সু’ বলে আখ্যায়িত করে সরলপ্রাণ সুন্নী মুসলমানগণকে প্রতারণা করেছিলেন।
তার কারণ ২. সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও ইসমাঈল দেহলভী যেহেতু পাঠান মহিলাদেরকে জোরপুর্বক বিবাহ করতে শুরু করলেন, তখনই পাঠান সুন্নী মুসলমান তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য হলেন। তদুপরি শিখজাতী তাদের স্বাধীনদেশ রক্ষণাবেক্ষণ করতে লিপ্ত ছিলেন। এমতাবস্থায় সৈয়দ আহমদ বেরলভী গং তাদের (শিখদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাই ইংরেজদের পক্ষে কাজ করার নামান্তর মাত্র।
অনুরূপ ‘তারিখে হাজারা’ নামক ইতিহাস গ্রন্থেও ৫১৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে যে, পাঠান মুসলমানদের মধ্যে নিয়ম ছিল যে, তার নিজেদের মেয়েদেরকে দেরিতে বিয়ে দিত। ইসমাইল দেহলভী এ প্রথা রহিতকরণের উদ্দেশ্যে কোন মুরিদের মেয়ে অবিবাহিত থাকলে সে তার বাহিনীর সঙ্গে থাকতে পারবে না। এই নির্দেশ জারি হওয়ার পর পাঠান খান্দানের ২০টি অবিবাহিত মেয়েকে পাঞ্জাবীবাহিনীর ২০ জনের সঙ্গে বিবাহ পড়িয়ে দেন এবং দুটি মেয়েকে স্বয়ং ইসমাইল দেহলভী সাহেব বিবাহ করেন।
তখন ইউসুফ জর্গাজয়ী এই বিবাহ রীতিনীতি দেখে বললেন, আমরা আপনার এই বিধান মানি না। আমারা আমাদের মেয়েগুলোকে ফেরত পেতে চাই। কিন্তু ইসমাঈল দেহলভী তাদের মেয়েগুলোকে ফেরত দিতে অস্বীকার করলে পাঠান ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। প্রথমদিন উভয়ের মধ্যে যুদ্ধের কোন ফলাফল হয় নাই। পরদিন ইউসুফ জর্গাজয়ী ইসমাঈল দেহলভীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে ইসমাঈল দেহলভী নিহত হয়, তার মৃত্যু দেখে পাঞ্জাবীগণ তার বাহিনী ত্যাগ করে চলে যায়। এ যুদ্ধেই সৈয়দ আহমদ বেরলভী মৃত্যুবরণ করেন। (আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত ও নজদী পরিচয় দ্র:)
এ সম্পর্কে বিস্তরিত জানতে হলে কলম সম্রাট আল্লামা আরশাদুল কাদেরী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত জের ও জবর, যালযালা প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠ করতে অনুরোধ রইল।
___
কর্মধার বাহাস
____________________
কর্মধার বাহাছ
কর্মধার বাহাছে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মুখোশ উন্মোচন
সংকলনে : মাওলানা হাফিজ তালিব উদ্দিন
আউশকান্দি, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
কর্মধার বাহাছের সূচনা
সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানাধীন ভৈরবগঞ্জ বাজার ৫নং কালাপুর ইউনিয়ন অফিসে ৭ পৌষ ১৩৮২ বাংলা এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সহযোগে সুন্নী-ওহাবী আক্বিদা নিয়ে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সিরাজনগরী সাহেব ওহাবীদের ১৪টি বাতিল আক্বিদা লিখিতভাবে পেশ করেন। এ সময়ে সুন্নি জামায়াতের পক্ষে যিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন, তিনি হলেন নয়ানশ্রী গ্রামের মরহুম আলহাজ্ব মোহাম্মদ আব্দুল গণি সাহেব। তাঁর সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করেন মরহুম হাজী মনোহর আলী চেয়ারম্যান ৫নং কালাপুর ইউপি। মরহুম মনছুর আলী (ভাইস চেয়ারম্যান ৫নং কালাপুর ইউপি) ও মরহুম মছদ্দর আলী (মেম্বার) লামা লামুয়া।
এ সভার সূত্রপাত নিয়েই ঐ ১৪টি বাতিল আক্বিদার উপর পরবর্তীতে ১৯৭৬ইং সনের ১২ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ২৯ মাঘ বৃহস্পতিবার কুলাউড়া থানার ১৩নং কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মরহুম মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী সাহেবের ব্যবস্থাপনায় ইলিয়াছী তাবলীগি জামায়াতের সমর্থকদের সাথে কর্মধার বাহাছ অনুষ্ঠিত হয়।
বাহাছের পটভূমি সম্পর্কে সিরাজনগরী হুজুরের বক্তব্য
বেশ কিছুদিন পূর্বে আমি (সিরাজনগরী) জুড়ি বাজারের নিকট এক ওয়াজের মাহফিলে যোগদান করেছিলাম। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে কুলাউড়া জামে মসজিদের ইমাম জনাব মাওলানা সৈয়দ রাশিদ আলী সাহেব (মরহুম) এর হুজরায় রাত্রিযাপন করি।
১নং কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মৌলভী ইয়াকুব আলী সাহেব ঘটনাক্রমে সেই হুজরায় উপস্থিত হন। তিনি ১৩নং কর্মধা ইউনিয়ন সংলগ্ন এক ওয়াজ মাহফিলের তারিখ চাইলে ৬/১/১৯৭৬ইং তারিখে ওয়াজের দিন নির্ধারণ করে দিলাম। আমার একজন সাগরিদকে রশিদ কুলাউড়া নিবাসী মাওলানা ফজলুল করিম একখানা পত্র দিলেন, সেই পত্র ওয়াজের নির্দিষ্ট তারিখে সকাল ৯টা ৩০ মিনিট এর সময় আমার নিকট হস্তগত হয়। পত্রে উল্লেখ ছিল ‘দেওবন্দী ওহাবীগণ’ কর্মধার ওয়াজের মাহফিলে বাহাছ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে, সুতরাং বাহাছের প্রয়োজনীয় কিতাবাদীসহ শ্রীমঙ্গল হইতে ১০-৩০ মি. এর ট্রেনে লংলা স্টেশনে পৌঁছা একান্ত প্রয়োজন। উস্তাযুল উলামা আল্লামা ফরমুজ উল্লাহ শায়দা সাহেব কেবলা (আলাইহির রহমত)ও এ ট্রেনে কর্মধা পৌঁছবেন।
পত্রের মর্মানুসারে আমি ট্রেনযোগে লংলা পরে রিকশা দ্বারা গন্তব্য স্থানে পৌঁছে শুনতে পারলাম জনৈক ওহাবী মৌলভী মাইকে লাফালাফি করে বাহাদুরী করতেছে। আল্লাহ জাল্লাশানুহুর অসীম রহমতে আমি রিকশা থেকে নামতেই তার বাহাদুরি শেষ হয়ে গেল।
আছরের নামাযের পর ওয়াজ শুরু করতেই কর্মধা মাদ্রাসার একজন শিক্ষক বাহাছ বাহাছ বলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি ওয়াজের মাধ্যমে বর্তমান প্রচলিত নব আবি®কৃত স্বপ্নে প্রদত্ত ইলিয়াছী তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বিদা ও শরিয়তবিরোধী মতবাদগুলি এবং তাদের মুরুব্বিগণের ভ্রান্ত আক্বিদাসমূহের স্বরূপ উপস্থিত জনসভায় তুলে ধরলাম। ফলে জনগণের সামনে তাদের গোমর ফাঁক হয়ে গেল। এতে তারা আরো অস্থির হয়ে পড়ল।
পরিশেষে ১৩নং কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মৌলভী ইয়াকুব আলী মরহুমের নেতৃত্বাধীন বাহাছের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এ সময় আমার সঙ্গে ছিলেন মাওলানা ফজলুল করিম ও মাওলানা আব্দুল মালিক তারা উভয়ই তখন ছাত্র ছিলেন।
সুতরাং ৬/১/১৯৭৬ইং তারিখে ১৩নং কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী সাহেবের নের্তৃত্বাধীন, নিম্নলিখিত শর্তাবলী ও বিষয়াদির উপর ১২/২/১৯৭৬ইং তারিখে বাহাছ অনুষ্ঠিত হবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
বাহাছের শর্তাবলী
১. সালিশকারীগণ উল্লেখিত, উভয়ের লিখিত বাহাছ অনুযায়ী রায় লিখে উভয় পক্ষকে এক এক কপি করে শীল মোহর করে প্রদান করবেন, অথবা সই ও তারিখ দিয়ে প্রদান করবেন।
২. বাহাছের সময় শান্তি রক্ষার জন্য দায়িত্ব চেয়ারম্যান সাহেবের থাকবে এবং তিনি শান্তি রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
৩. যতক্ষণ পর্যন্ত বাহাছ শেষ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বাহাছকারী বাহাছের স্থান হতে যাইতে পারিবে না। যদি কেহ যায় পরাজিত বলে সাব্যস্থ করা হবে।
৪. উভয় পক্ষের সালিশের উপর একজন সভাপতি অর্থাৎ প্রধান নিরপেক্ষ কোন সরকারি অফিসার হতে হবে। যদি রায়ের মধ্যে দুই পক্ষের সালিশগণ একমত না হন তখন বাহাছের রেকর্ড-এর মোতাবেক সেই অফিসারের রায় উভয় পক্ষগণ মানতে বাধ্য থাকবে।
৫. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকাইদের কিতাব দ্বারা আকাইদসংক্রান্ত মাসআলাসমূহের ফয়সলা হবে এবং ফরুয়ী (আমলী) মাছাঈলের ফয়সলা হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাব দ্বারা হবে। (অর্থাৎ আকাইদী মাসআলা কেরআন সুন্নাহ ও ইজমা এবং আমলী মাসআলা কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস এ চার দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।)
৬. যে পক্ষ বাহাছের রেকর্ড এর খেলাপ বা ব্যতিক্রম ছাপাবে, আইনত দণ্ডনীয় হবে।
(স্বাক্ষর) শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
(স্বাক্ষর) মোহাম্মদ ইব্রাহিম আলী ৬/১/১৯৭৬ ইং
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে বাহাছ করবেন
আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
তাবলীগি জামায়াতের পক্ষে বাহাছ করবেন
মাওলানা মোহাম্মদ ইব্রাহিম আলী
সুন্নীদের পক্ষে সালিশ
১. উস্তাযুল উলামা আল্লামা হরমুজ উল্লাহ শায়দা সাহেব তুরখলি
২. মাওলানা মোহাম্মদ ওমর আলী সাহেব, মৌলভীবাজার।
তাবলীগিদের পক্ষে সালিশ
১. মাওলানা মুফতি আব্দুল হান্নান দিনারপুরী
২. মাওলানা আব্দুন নূর সাহেব ইন্দেশশরী
মধ্যস্ত সালিশ
জনাব আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব, চেয়ারম্যান ১২নং ইউনিয়ন
বাহাছের তারিখ
২৯ শে মাঘ ১২ ফেব্রয়ারি ১৯৭৬ ইংরেজি
সময় : সকাল ১০ ঘটিকা।
বাহাছের স্থান:
১৩ নং কর্মধা ইউনিয়ন সংলগ্ন বাজার।
উপজেলা, কুলাউড়া, জেলা: সিলেট, (বর্তমান- মৌলভীবাজার।)
জনাব আল্লামা সিরাজনগরী সাহেবের ১৪ পয়েন্ট (১৪ দফা) এবং জনাব মাওলানা ইব্রাহিম আলী সাহেবের জওয়াব
১৪ দফা
১. নামাযের মধ্যে নবীয়েপাকের খেয়াল করা গরু-গাধার খেয়ালে ডুবে থাকার চেয়েও খারাপ এবং তাঁকে নামাযের মধ্যে ইচ্ছা করে তা’জিমের সঙ্গে খেয়াল করা শিরিক। এবং অনিচ্ছায় নামাযের মধ্যে নবীয়েপাকের খেয়াল এসে পড়লে এক রাকায়াতের পরিবর্তে চার রাকায়াত নফল নামায পড়তে হবে। (ওহাবীদের নেতা) মৌলভী ইসমাইল সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবে লিখেছেন।
সুন্নী জামায়াতের উলামাদের মতে উপরোক্ত আক্বিদা কুফুরি। যে ব্যক্তি এরূপ আক্বিদা রাখবে ও এ আক্বিদাকে হক বলে সমর্থন করবে সেও কাফের হবে।
শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী, ৬/১/৭৬ ইং জওয়াব
১. হযরত ইসমাইল (র.) দেহলভীর কিতাব ছিরাতে মুস্তাকিমের মধ্যে হুজুর (দ.) সম্বন্ধে ইহা অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
গরু-গাধার খেয়াল করার কথা তিনি কখনও বলেন নাই। তওহীদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া যে বর্ণনা উল্লেখ করিয়াছেন ইহা বিকৃত করা হইয়াছে।
স্বাক্ষর: মো: ইব্রাহিম আলী
৬/১/৭৬ইং
২. ইসমাইল দেহলভী উক্ত কিতাবের ৭০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তাকে (সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে) নবীগণের সাগরিদও বলা চলে এবং নবীগণের উস্তাদের সমকক্ষও বলা চলে।’
সুন্নী জামায়াতের মতে নবীগণ উম্মতের ছাত্র হতে পারে না। যে ব্যক্তি নবীগণকে কোন উম্মতের ছাত্র বলবে সে কাফের হবে।
স্বাক্ষর: শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী জওয়াব
২. হযরত ইসমাঈল শহীদ (রা.) কেন কোন ওলি আলেম অথবা যে কোন মানুষ নবীর উস্তাদ হতে পারে না। কিন্তু আলেম বা উম্মত নবীর সাগরিদ বা ছাত্র হতে পারে। ঐ কথাকে বিকৃত করা হয়েছে। নবীগণকে কোন উম্মতের ছাত্র মনে করা কুফুরি।
স্বাক্ষর: মো: ইব্রাহিম আলী
৩. সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবের ৭০ পৃষ্ঠায় লেখা আছে ‘নবীদের সঙ্গে (আলেমদের) সম্পর্ক শুধু এতটুকু- যতটুকু সম্পর্ক ছোটভাই ও বড়ভাইয়ের মধ্যে আছে।’ এবং ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাবের ৬০ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তা’জিম বড় ভাইয়ের মতে করিতে হইবে।’
সুন্নীদের মতে হুজুরকে বড় ভাইয়ের মত আক্বিদা রাখা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী জওয়াব
৩. হুজুরকে (আ.) বড়ভাই এর মত বলিয়া তাজিম করা কুফরি। উক্ত কথা উনার কিতাব হইতে অতি রঞ্জিত করিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে। তিনি একটি হাদীসের অনুবাদ করিয়া ছিলেন যাহাতে ভাই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৪. মিলাদশরীফ পাঠ করা কানাইয়ার জন্মের মতো অর্থাৎ কানাইয়া নামক হিন্দুর উৎসবের ন্যায়। (ফাতাওয়ায়ে মিলাদশরীফ, রশিদ আহমদ গাঙুহী (দ্র:)
সুন্নীদের মতে উক্ত আক্বিদা গোমরাহী।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী।
জওয়াব
৪. মৌং রশিদ আহমদ ছাহেব (র.) কিয়ামের হুকুম বয়ান করিতে গিয়া একটি দৃষ্টান্ত পেশ করিয়াছেন। ইহারই অপব্যাখ্যা করা হইয়াছে। মক্বা-মদিনার উলামায়ে কেরাম ইহা সমর্থন করিয়াছেন যে মিলাদের কিয়াম সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহা ঠিক। নফছে মিলাদের সম্বন্ধে কোন কথা বলেন নাই।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৫. নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইলমে গায়েবের কি বিশেষত্ব থাকতে পারে? এ ধরণের ইলমে গায়েব জায়েদ, আমর, ছেলে ও পাগলের বরং সমস্ত জীবজন্তুরও আছে। ‘হিফজুল ঈমান’ আশরাফ আলী থানবী।
সুন্নীদের মতে হুজুরের ইলমে গায়েবকে গরু-গাধার ইলিমের মতো আক্বিদা রাখা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
৫. রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর ইলমে গায়েব ইত্তেলায়ে কুল্লী নহে। রাসূলুল্লাহকে কুল্লী আলিমূল গায়েব মনে করা শিরকী। উনার কথা না বুঝিয়া পূর্বাপর মিল না রাখিয়া ভুল বুঝাবুঝির মাধ্যমে রাসূল (দ.)-এর সাথে বেআদবি করা হইয়াছে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৬. আরবের মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী কাফের, কারণ তার ভ্রান্ত আক্বিদার উপর বিশ্বজগতের মুফতিগণ তাকে কাফের বলে ফতোয়া প্রমাণ করেছেন। যারা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজীর ভ্রান্ত আক্বিদাকে সমর্থন করবে তারা বাতেল ও কাফের হবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী।
জওয়াব
৬. আব্দুল ওহাব নজদীর সঙ্গে আমাদের পীরি মুরিদীর কোন সম্পর্ক নাই। তাহার আকায়েদ আমরা আহলে সুন্নাত অল জামাত হানাফী গণের বিরোধী। তাহার ভ্রান্ত আক্বিদা বাতিল ও কুফুরি।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৭. শুধুমাত্র নবীগণের স্বপ্নই শরিয়তের দলিলরূপে গণ্য হইবে। নবীগণ ছাড়া অলীর স্বপ্ন ও দলিল রূপে পরিগণিত হবে না। মৌলভী ইলিয়াছ সাহেব যেহেতু স্বপ্ন দ্বারা তাবলীগ বাহির করেছেন সেই জন্য উহা বাতিল ও ভ্রান্ত।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
৭. এ কথার মধ্যে আমরা একমত যে ওলীগণের স্বপ্ন শরিয়তের কোন দলিল হইতে পারে না। মৌলভী ইলিয়াছ (রা.) স্বপ্ন দ্বারা তাবলীগ বাহির করেন নাই। বরং নবী করিম (দ.) যে তাবলীগ করিয়াছেন ঐ তাবলীগ কয়েকটি নীতি ও নিয়মের মাধ্যমে চালু করিয়াছেন যাহা ইসলামের পঞ্চভিত্তির অন্তর্ভূক্ত।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৮. তাবলীগীদের অভিমত কেয়ামত দিবসে সমস্ত মানব যখন কঠিন আযাব দর্শন করিয়া মহাভয়ে কম্পিত হইতে থাকিবে, এমনকি নবীগণ পর্যন্ত নফসী নফসী বলিয়া চিৎকার করিতে থাকিবে তখন এই মোজাহিদ বান্দাগণকে আল্লাহ সম্পূর্ণ ভয়শূন্য করত শান্তির ছায়া দান করিবেন। (দাওয়াতে তাবলীগ ৫৪ পৃষ্ঠা- ১ম খণ্ড)
সুন্নীদের মতে মাও: আম্বর আলীর উপরোক্ত আক্বিদা সম্পূর্ণ শরিয়ত বিরোধী আক্বিদা নবীগণ থেকে উম্মতকে বড় মনে করা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
৮. লিখক আম্বর আলী তিনি অপরিচিত। তাবলীগের মূল কিতাবে ইহা নাই। উম্মতগণকে নবীগণের উপর ফজিলত দেওয়া কুফুরি।
তবে যদি উক্ত কিতাবের দ্বারা এই মত প্রমাণিত হয়, নতুবা একটি কথার অনেক মকছুদ থাকতে পারে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৯. হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন উম্মতের মত (মিছাল) বলা জায়েজ কি না?
সুন্নীদের মতে কোন উম্মতকে নবীর মত বলা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
৯. হুজুর (আ.)কে মানুষের মত বলা যাইতে পারে না, উম্মতের মতো নয়। আলেমকে হাদীস অনুযায়ী নবীগণের নায়েব এবং শুধু তাবলীগ বা ধর্ম প্রচার করার বেলায় নবীর মতো (মিছাল) বলা যাইতে পারে। ঐ আলেম নবী হইতে পারে না। যদি ঐ আলমকে নবী বলা হয় তবে তাহা কুফরি।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
১০. মলফুজাত (ইলিয়াছ সাহেবের) ৪৬ পৃষ্ঠায় লেখা আছে-
ইলিয়াছ সাহেব বলিয়াছেন ‘যাকাতের দরজা হাদিয়া হইতে নিম্নে।’
সুন্নীদের মতে উপরোক্ত মতবাদ সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী, এই মতবাদের উপর যে বিশ্বাস করিবে সে পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ হইবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
১০. যাকাতের স্থান বা মান হাদিয়ার নিম্নে যাইতে পারে না। যদি নিয়ত সহী করিয়া যাকাত আদায় করিয়া থাকে এবং কিতাব অনুযায়ী তাহা খরচ করিয়া থাকে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
১১. যাকাতের মাছারিফ সম্বন্ধে ইলিয়াছ ছাহেবের ‘মলফুজাত’ কিতারেব ৪৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, ‘যাকাতের সহীহ গ্রহীতা ঐ সমস্ত লোক যাহারা যাকাতের টাকা পাইলে নিজের মধ্যে মালের লোভ পয়দা হয় না।’
আবার ৫৭ পৃষ্ঠায় লেখা আছে ‘আমি (ইলিয়াছ সাহেব) এই রূপ ৪০ জন লোকের নাম লিখিয়া দিয়াছি যাহাদের লোভ-লালসা নাই। তাহাদিগকে যাকাত দিলে তাহাদের মধ্যে লোভ-লালসা পয়দা হইবে না। তাহারা আল্লাহর উপর ভরসা করিয়া তাবলীগের কাজে লাগিয়া আছে।’
সুন্নীদের মতে উপরোক্ত আক্বিদা সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী ও গোমরাহী।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী।
জওয়াব
১১. যাকাতের মাছারিফ ঐ সমস্ত লোক যাহা কোরআন ও হাদীদ দ্বারা বর্ণিত আছে। তাবলীগের কিতাব ফাজায়েলে যাকাত (কৃত মৌং জাকারিয়া, মুহাদ্দিস মাদ্রাসায়ে মাজহারুল উলুম ছাহারানপুর)।
মৌ ইলিয়াছ (র.) ছাহেব মাছরাফে যাকাতের উল্লেখ করিয়াছেন। যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত যে কোন লোকই হউক বা গায়ের তাবলীগি হউক যাকাত দেওয়া যাইতে পারে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী।
১২. মিলাদশরীফের কিয়াম করা সুন্নীদের মতে জায়েজ বরং মোস্তাহাব। এবং যাহারা মিলাদ শরীফের কেয়ামকে কুফুরি শেরেকী, বেদআত ও নাজায়েয বলে, তাহারা বাতেল ও পথভ্রষ্ট।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী।
জওয়াব
১২. মিলাদশরীফের কিয়াম (প্রচলিত) নাজায়েজ। ইহা হাদীস কোরআনের বহির্ভূত এবং বিশেষ করিয়া হানাফী মাজহাবের মান্যবর ইমাম আবু হানিফা (রা.) এবং তার শাগরিদান ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম জাফর , ইমাম হাছান বিন জিয়াদ প্রমুখ ইহা করেন নাই। এবং তাহাদের কিতাবেও ইহা পাওয়া যায় নাই।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
১৩. ৬ উছুলী তাবলীগ শরিয়তবিরোধী কারণ রাসূলেপাক ও ছাহাবায়ে কেরামের তাবলীগ এরূপ ছিল না। যাহারা ছয় উছুলী তাবলীগ করিবে তাহারা বাতিল হইবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
১৩. ছয় উছুলী নিয়ম অনুসরণ করিয়া যে দ্বীনের কাজ চলিতেছে তাহা রাসূলুল্লাহ (দ.) ও ছাহাবায়ে কেরামগণের আদর্শের বাহিরে নয়।
ছয় উছুল মানা ফরয বা ওয়াজিব নয়।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী।
১৪. আল্লাহ মিথ্যা কথা বলিতে পারেন। ‘ফাতাওয়ায়ে রাশিদিয়া’ রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী।
সুন্নীদের মতে উক্ত আক্বিদা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
১৪. আল্লাহ হইতে অধিক সত্যবাদী আর কেহ নাই। ইহা মৌলভী রশিদ আহমদ সাহেবের ফতওয়ার একটি অপব্যাখ্যা মাত্র।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জনাব ইব্রাহিম আলী সাহেবের ৫ পয়েন্ট (৫ দফা) এবং আল্লামা সিরাজনগরী সাহেবের জওয়াব
১. গায়রুল্লাহর খিয়াল নামাযের মধ্যে ইচ্ছাপূর্বক আনিলে শিরিক হইয়া যাইবে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৬/১/৭৬ইং
জওয়াব
১. রাসূলে পাকের নাম মোবারক যখন ‘তাশাহুদ’ পড়ার সময় আসবে, রাসূল হিসেবে ইচ্ছা করে তা’জিমের সহিত আসবে, ঠিক তদ্রƒপ নামাযের ভিতর তেলাওয়াতে আসলেও তা’জিমের সাথে খিয়াল করবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
২. রাসূলুল্লাহ (দ.)কে ভাই এর বরাবর সম্মান করার দাবি আমরা স্বীকার করি না। ইহা আমাদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ। হুজুর (দ.)কে ভাইয়ের বরাবর জানা কুফুরি। তিনি সৃষ্টির সেরা।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জওয়াব
২. এই উক্তির ভিতরে আমি ও একমত অর্থাৎ হুজুর (দ.)কে বড় ভাইয়ের মতে মনে করা কুফুরি। যে ব্যক্তি এরূপ আক্বিদা রাখবে সে কাফের হবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
৩. প্রচলিত মিলাদের কেয়াম বিদআত। ইহা কুরুনে ছালাছার পরের আবি®কৃত।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জওয়াব
৩. মীলাদশরীফের কেয়াম বা দাঁড়াইয়া ছালাত ও সালাম পড়া মুসতাহাব ও মুসতাহসান।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
৪. রাসূলুল্লাহ (দ.)কে আলিমুল গায়েব ও হাজির নাজির বিশ্বাস করা বিলকুল শিরিক।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জওয়াব
৪. আল্লাহ তায়ালা একমাত্র আলেমুল গায়েব। আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসূলকে অসীম গায়েব থেকে কিছু কিছু গায়েবী ইলিম দান করেছেন। সুতরাং নিশ্চয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছু কিছু গায়েব জানেন যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীবকে জানিয়ে দিয়েছেন। রাসূলেপাকের সামনে সারা বিশ্বজগত রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহপাকের সাহায্যে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সবকিছু দেখেন ও শুনেন।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
৫. প্রচলিত তাবলীগ ইসলামের বহির্ভূত নহে। ইলিয়াছ এর উপর নবুয়তীর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ভুল। তিনি কোথাও নবুয়তীর দাবি করে নাই। তাহার কথাকে বিকৃত করা হইয়াছে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জওয়াব
৫. বর্তমান প্রচলিত স্বপ্নে প্রদত্ত ইলিয়াছি তাবলীগ শরিয়তসম্মত নহে। ইলিয়াছ নবীর সমকক্ষতার দাবিদার। স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
বহাছের বিষয় ও শর্তাবলীর কপি প্রদান
অদ্য ৬/১/১৯৭৬ইং তারিখে মোহাম্মদ আজিদ আলী সাহেবের সভাপতিত্বে ১৩নং কর্মধা ইউনিয়ন অফিসে বাহাছের পয়েন্টগুলি উভয় পক্ষ প্রদান করেছিলেন।
প্রত্যেক পক্ষকে সভাপতি সাহেব এক এক কপি প্রদান করেন।
(স্বাক্ষর) মো: ইয়াকুব আলী
(স্বাক্ষর) মো: ইব্রাহিম আলী
(স্বাক্ষর) শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
বাহাছের পূর্ব মুহূর্ত
২৯ মাঘ, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ইং রোজ বৃহস্পতিবার
সময়- সকাল ১০-৩০ মি. হতে বাহাছ আরম্ভ হয়।
উল্লেখ্য যে, পূর্বে সাব্যস্ত করা হয়েছিল বাহাছে উভয়পক্ষের মানীত সালিশ জনাব আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব (চেয়ারম্যান ১২নং ইউনিয়ন)
পক্ষান্তরে উপস্থিত বাহাছ সভায় রবিরবাজার জামে মসজিদের ইমাম জনাব মাওলানা আব্দুল মান্নান ছাহেবকে বাহাছ পরিচালনার সভাপতি হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।
বাহাছের সালিশ-
জনাব আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব
বাহাছের পরিচালক-
মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান সাহেব
জ্ঞাতব্য বিষয়- ইলিয়াছি তাবলীগি জামায়াতের পক্ষ অনুরোধপত্র দেওয়া হল যে, আমরা পূর্বে মাওলানা মো: ইব্রাহিম আলী সাহেবকে বাহাছের জন্য মনোনীত করেছিলাম। কিন্তু আমাদের অসুবিধা পড়ে যাওয়ায় মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেবকে (যাকে পূর্বে সালিশ হিসেবে মনোনীত করেছিলাম) অদ্যকার বাহাছে মুনাজির হিসেবে মনোনীত করতে চাইতেছি। অবশেষে তাদের এই দাবি মেনে নেওয়া হলো।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে
মুনাজির- সুলতানুল মোনাজিরীন আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী। সাহায্যকারী-
১. মাওলানা মুফতি আবু তাহের হুসাইনী, কুমিল্লা
২. মাওলানা উমর আলী, মৌলভীবাজার
৩. মাওলানা আব্দুল মজিদ খাঁন মির্জানগরী
তত্বাবধানে ছিলেন- শায়খুল ইসলাম আল্লামা সৈয়দ আবিদশাহ মোজাদ্দেদী আলমাদানী আলাইহির রহমত।
ইলিয়াছি তাবলীগি জামাতের পক্ষে
মুনাজির- মাওলানা মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব দিনারপুরী
সাহায্যকারী-
১. মাওলানা আব্দুল বারি সাহেব, প্রিন্সিপাল তালশহর আলিয়া মাদ্রাসা
২. মুফতি রহমত উল্লাহ
৩. মাওলানা ইব্রাহিম আলী
তত্বাবধানে- কর্মধা কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক মণ্ডলী।
সুন্নীদের পক্ষে সালিশ
১. আলেমকুল শিরোমণি আল্লামা হরমুজ উল্লাহ শায়দা আলাইহির রহমত তুরখলি
২. মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ, বড়হাট
তাবলীগীদের পক্ষে সালিশ
১. আল্লামা মাওলানা আব্দুন নূর সাহেব ইন্দেশ্বরী
২. মাওলানা মোহাম্মদ ইব্রাহিম আলী সাহেব।
শর্ত নিয়ে মতানৈক্য
বাহাছের শর্তাবলীর মধ্যে ১ম শর্ত ছিল, বাহাছ লিখিতভাবে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব ও তার দলের লোক ইহা কোন মতেই মানিয়া নিতে রাজি হলেন না। কারণ তারা দেখলেন, লিখিতভাবে যা পেশ করা হবে, তা আর অস্বীকার করার কোন উপায় থাকবে না, ফলে সমাজের সামনে তাদের গোমর ফাঁক হয়ে যাবে, এবং জনগণ তাদের চালাকী বুঝে নিতে সক্ষম হবেন।
আমাদের দাবি ছিল প্রত্যেক মুনাজির নিজ নিজ দাবি ও দলিল লিখিতভাবে পেশ করবেন এবং সাথে সাথে লোকজনকে বুঝিয়ে দিবেন। অপরদিকে মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব এতে রাজি হলেন না বরং তিনি না লিখে শুধু মুখে বাহাছ করার জন্য বারংবার কথা কাটাকাটি করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এ অজুহাতের উপরই তারা বাহাছের ময়দান হতে পালিয়ে যেতে চাচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে মৌখিক বাহাছ মেনে নেওয়া হল।
বাহাছের সারসংক্ষেপ
পূর্বের লেখা অনুযায়ী জনাব সিরাজনগরী সাহেবের ১৪ দফার মধ্যে ১ম দফা নিয়ে বাহাছ শুরু হয়।
দফা- ১
১. নামাযের মধ্যে নবীয়ে পাকের খেয়াল করা গরু-গাধার খেয়ালে ডুবে থাকার চেয়েও খারাপ এবং তাঁকে নামাযের মধ্যে ইচ্ছা করে তা’জিমের সঙ্গে খেয়াল করা শিরিক। এবং অনিচ্ছায় নামাযের মধ্যে নবীয়েপাকের খেয়াল এসে পড়লে এক রাকায়াতের পরিবর্তে চার রাকায়াত নফল নামায পড়তে হবে। (ওহাবীদের নেতা) মৌলভী ইসমাইল সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবে লিখেছেন।
সুন্নী জামায়াতের উলামাদের মতে উপরোক্ত আক্বিদা কুফুরি। যে ব্যক্তি এরূপ আক্বিদা রাখবে ও এ আক্বিদাকে হক বলে সমর্থন করবে সেও কাফের হবে।
শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
৬/১/৭৬ ইং
জওয়াব
১. হযরত ইসমাইল (র.) দেহলভীর কিতাব ছিরাতে মুস্তাকিমের মধ্যে হুজুর (দ.) সম্বন্ধে ইহা অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। গরু-গাধার খেয়াল করার কথা তিনি কখনও বলেন নাই। তওহীদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া যে বর্ণনা উল্লেখ করিয়াছেন ইহা বিকৃত করা হইয়াছে।
স্বাক্ষর: মো: ইব্রাহিম আলী
৬/১/৭৬ইং
বাহাছ আরম্ভ
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে- সুলতানুল মোনাজিরীন আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা হাতে নিয়ে উভয়পক্ষের সালিশ মধ্যস্ত সালিশ, সভার সভাপতি ও জনগণের সামনে পাঠ করে শুনালেন যে, এ কিতাবের ১৫০ পৃষ্ঠা (উর্দু) ১৯৫৬ হিজরি নভেম্বর মাসে প্রকাশিত লাহোর পাকিস্তান থেকে) লেখা রয়েছে-
بمقضاۓ ظلمات بعضها فوق بعض زنا کے وسو ے سے اپنی بی بی کی مجامعت کا خیال بہتر ہے اور شیخ يا اسى جیسے اور بزرگوں کی طرف خواہ جناب رسالت مآب ہی ہوں اپنی ہمت کو لگادینا اپنے بیل اور گدھے کی صورت میں مستغرق ہوںنے سے زیادہ برا ہے کیونکہ شیخ کا خیال تو تعظیم اور بزرگی کے ساتھ انسان کے دل میں چیٹ جاتا ہے اور بیل اور گدھے کے خیال کو نہ تو اسقدر چسپید گی ہوتی ہے اور نہ تعظیم بلکہ حقیر اور ذلیل ہوتا ہے اور غیر کی یہ تعظیم اور بزرگی جو نماز میں ملحوظ ہو وہ شرک کی طرف کھیچ کرلی جاتی ہے ـ
সিরাতে মুস্তাকিম ফারসি ৮৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
ظلمات بعضها فوق بعض از وسوسہ از زنا خیال مجامعت زوجہ خود بہتراست وصرف ہمت بسوی شیخ وامثال آں از معظمین گو جناب رسالتمآب باشند بچند ین مرتبہ بدتراز استغراق در صورت گاؤخر خوداست کہ خیال آن با تعظیم واجلال بسوید ای دل انسان می چسپد بخلاف خیال گاؤ وخرکہ نہ آسقدر چسپید گی می بود ونہ تعظیم بلکہ مہان ومحقر میبود واین تعظیم واجلال غیر کہ در نماز ملحوظ ومقصود میشود بشرک میکشد ـ
ভাবার্থ ‘কোন অন্ধকার কোন অন্ধকারের উপরে। (অর্থাৎ অন্ধকারের মধ্যেও যেমন কম বেশি পার্থক্য থাকে, ওয়াছ ওয়াছাও অল্প খারাপ ও বেশি খারাপের পার্থক্য আছে) যেমন নামাযে যিনার ওয়াসওয়াসা বা ধারণা হতে নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাসের খেয়াল কিছুটা ভাল। পীর বা কোন বুজুর্গানের প্রতি, এমনকি রাসূল (দ.)র স্মরণে নিজের হিম্মত বা নিজের অন্তরকে ঐদিকে ধাবিত করা নিজের গরু-গাধার সুরতে (আকৃতির খেয়ালে) ডুবে থাকার চেয়েও অধিক খারাপ। কেননা পীরের খেয়াল (এমনকি রাসূলেপাকের খেয়াল) তো শ্রদ্ধা ও সসম্মানে মানুষের অন্তরে এসে থাকে।
পক্ষান্তরে গরু-গাধার খেয়ালে এ ধরণের আকর্ষণ ও তাজিম আসে না। বরং এগুলো তুচ্ছ ও ঘৃণার সাথে খেয়াল এসে থাকে। তাই নামাজের মধ্যে এ ধরনের অন্যের (বুজুর্গান) এমনকি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র তা’জিম বা সম্মান শিরকের দিকে ধাবিত করে নিয়ে যায়।’ العياذ بالله উক্ত কিতাবের (সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবের) ১৫১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
بلکہ بعض تو حضور کے ساتھ خیالات سے خالی پڑھی تھیں اور بعض خیالات سے آلودہ ہوگئ تھی تو وسوسے والی رکعتوں میں سے ہر ایک رکعت کے بدلے چار رکعتیں ادا کرے ـ
অর্থাৎ ‘কোন কোন মুসল্লী হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র খেয়াল ছাড়াই নামায আদায় করে থাকেন। আবার কারো অনিচ্ছা সত্ত্বেও হুজুরের খেয়াল নামাযে এসে পড়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নামাযে হুজুরের খেয়াল এসে গেলে শয়তান তাকে ওয়াসওয়াসা দিয়েছে বলে মনে করতে হবে। ওয়াসওয়াসার দরুণ যে রাকাতে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র খেয়াল এসে পড়ে, এমন এক রাকাআত নামাযের পরিবর্তে চার রাকাআত আদায় করতে হবে।’ (নাউজুবিল্লাহ)
‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামক কিতাবের উপরোল্লেখিত এবারতের সারসংক্ষেপ হল এই-
ক) নামাযে যিনার ধারণার চেয়ে স্ত্রী-সহবাসের খেয়াল ভাল। (নাউজুবিল্লাহ)
খ) নামাযের মধ্যে রাসূলেপাকের খেয়াল করলে নামাযি মুশরিক হবে বরং নামাযে রাসূলেপাকের খেয়াল
করার চাইতে গরু-গাধার খেয়াল করা ভাল।
গ) স্বেচ্ছায় নামাযের মধ্যে রাসূলেপাকের খেয়াল করলে নামাযতো হবেই না বরং শিরিক হবে। অনিচ্ছাকৃতভাবে নামাযে হুজুরেপাকের খেয়াল এসে গেলে, এক রাকাআতের পরিবর্তে চার রাকাআত নামায পড়তে হবে। (নাউজুবিল্লাহ)
সাথে সাথে আল্লামা সিরাজনগরী সাহেব হিজরি পঞ্চ ও ষষ্ঠ শতকের পঞ্চম মুজাদ্দিদ হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘এহইয়ায়ে উলুমিদ্দিন’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ৯৯ পৃষ্ঠা খুলে দেখালেন, ইমামে গাজ্জালী বলেন-
واحضر فى قلبك النيى صلى الله عليه وسلم وشخصه الكريم وقل السلام عليك ايها النبى ورحمة الله وبركاته-
অর্থাৎ ‘তোমার কলবে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে হাজির কর এবং তাঁর পবিত্র সুরত মোবারককে উপস্থিত জানিবে এবং বলবে হে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমার উপর সালাম, আল্লাহর রহমত ও বরকত।
আবার তৎক্ষণাৎই আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ১৬৫ পৃষ্ঠা খুলে দেখালেন ইহাতে লেখা রয়েছে-
ازجملہ خصائص این رانیز ذکر کردہ اندکہ مصلی خطاب میکند انحضرت راصلی اللہ علیہ وسلم بقول خود السلام علیک ایھا النبی وخطاب نمیکند غیر اورا ـ
অর্থাৎ ‘রাসূলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ফাযায়েলের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুসল্লীগণ নামাযের মধ্যে আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবীউ’ পাঠকালে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে সম্বোধন করবে অন্য কারো প্রতি নয়। (অর্থাৎ হুজুরে পাকের খেয়াল করেই ছালাম পেশ করবে।’)
উপরন্তু ‘আশিয়াতুল লোমআত শরহে মিশকাত’ এর ১ম জিলদের ৪০১ পৃষ্ঠায় শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) আরো উল্লেখ করেছেন বলে কিতাব পাঠ করে শোনান আল্লামা সিরাজনগরী-
بعضے از عارفاء گفتہ اند کہ ايں خطاب بجھت سریان حقیقت محمدیہ است در ذرائر موجودات وافراد ممکنات پس انحضرت در ذات مصلیان موجود وحاضراست ـ
অর্থাৎ ‘কোন কোন আরিফ ব্যক্তিগণ বলেছেন, নামাযে আসসালামু আলাইকা আইয়ু হান্নাবীউ, বলে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা)কে সম্বোধন রীতির প্রচলন এজন্যই করা হয়েছে যে, হাকীকতে মোহাম্মদীয়া বা হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মূল সত্ত্বা সৃষ্টিকুলের অনুপরমাণুতে এমনকি সম্ভবপর প্রত্যেক কিছুতেই ব্যাপৃত। সুতরাং হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাযীগণের সত্ত্বার মধ্যে বিদ্যমান ও হাজের আছেন।’
অতঃপর আল্লামা সিরাজনগরী সাহেব ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ ২য় জিলদের ৩০ পৃষ্ঠা খুলে দেখান, বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) বলেন-
ثم اختار بعده السلام على النبى صلى الله عليه وسلم تنويها بذكره واثباتا للاقرار برسالته واداء لبعض حقوقه-
অর্থাৎ ‘অতঃপর আত্তাহিয়াতের মধ্যে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র প্রতি সালাম পাঠ করাকে নির্ধারণ করেছেন যে, যেন নবীর জিকির তা’জিমের সাথে হয়, তাঁর রিসালতের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার কিছু হক আদায় হয়।’ অর্থাৎ ছালাম হলো নবীর জিকির বা স্মরণ এবং নবীর স্মরণ তা’জিমের সঙ্গে করতে হবে।
তারপর সিরাজনগরী সাহেব বিশ্ববিখ্যাত শামী কিতাবের হাশিয়া দুররে মুখতার’ ১/৪৭৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করে বলেন- নামাযে তাশাহহুদ পাঠকালে আল্লাহর হাবীবকে সালাম দেওয়ার ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে-
ويقصد بالفاظ التشهد الانشاء كانه يحي على الله ويسلم على نبيه نفسه لا الاخبار-
ভাবার্থ ‘ নামাযে ‘‘তাশাহহুদ’ পাঠকালে মুসল্লীগণ উদ্দেশ্যে নিবে ‘ইনশা’ এখবার নয়। অর্থাৎ কথাগুলি যেন মুসল্লী নিজেই বলতেছেন এবং নিজেই যেন আপন প্রতিপালকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, এবং স্বয়ং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে উদ্দেশ্য করে সালাম আরজ করছেন।’
উক্ত এবারতের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে ‘ফাতাওয়ায়ে শামীতে বলা হয়েছে-
اى لا يقصد الاخبار والحكاية عما وقع فى المعراج منه صلى الله عليه وسلم ومن ربه سبحانه ومن الملائكة عليهم السلام
অর্থাৎ ‘তাশাহহুদ’ পাঠের সময় নামাযীর যেন এ নিয়ত না হয় যে, তিনি শুধুমাত্র মে’রাজের অলৌকিক ঘটনাটি স্মরণে করে সে সময়কার মহা প্রভু আল্লাহ হুজুরেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও ফেরেশতাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত কথোপকথনের বাক্যগুলো প্রকাশ করে যাচ্ছেন। বরং তাঁর নিয়ত হবে কথাগুলো যেন তিনি নিজেই বলছেন।’
স্বনামধন্য ফকীহগণের উপরোল্লেখিত ভাষ্য থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল যে, নামাযে ‘তাশাহহুদে সালাম পেশ করাকালীন তা’জিমের সাথে একমাত্র হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতি খেয়াল করতে হবে। অন্য কারো প্রতি নয়।
তাবলীগ জামাতের পক্ষে মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব
মুফতি সাহেব বলেন, সিরাতে মুসতাকিম’ কিতাবে লেখা রয়েছে, নামাযে রাসূলেপাকের খেয়াল করলে নামাজিকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়। নামাযী মুশরিক হবে এ কথা লেখা নেই।
(এ বলে একটি বর্ণনা দেন কিন্তু ‘সিরাতে মুসতাকিম’ ছাড়া অন্য কোন কিতাবের হাওয়ালা বা রেফারেন্স দিয়ে কোন কথা বলেন নাই। তাই তার পূর্ণ বিবরণ উদ্ধৃত করা হয় নাই।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব
উত্তরে সিরাজনগরী সাহেব বলেন, মুফতি সাহেব কি বুঝাইতে চাচ্ছেন। যে কাজ শিরকের দিকে নিয়ে যায়, সে কাজেইতো মানুষ মুশরিক হয়। যে কাজ মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায় সেই কাজে কি মানুষ ঈমানদার হবে? আশ্চর্যের বিষয়।
অতঃপর সিরাজনগরী সাহেব মিশকাতশরীফের ১০২ পৃষ্ঠা হতে একখানা হাদীসের শেষাংশ পাঠ করে শুনালেন-
অর্থাৎ ‘ হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন- হুজুরেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর রোগের সময় সিদ্দিকে আকবর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর নিকট লোক পাঠালেন তিনি যেন লোকদের নামায পড়িয়ে দেন। বার্তাবাহক আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর নিকট পৌঁছে বললেন, হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনাকে নামায পড়িয়ে দিতে আদেশ করেছেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যেহেতু একজন কোমল হৃদয় লোক ছিলেন, এজন্য তিনি নামায পড়াতে অক্ষমতা প্রকাশ করলেও অবশেষে নামায পড়াতে বাধ্য হলেন। সুতরাং আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সতের দিনের নামায পড়ালেন। তারপর একদিন হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছুটা সুস্থতাবোধ করলেন এবং দুই ব্যক্তির কাঁধে ভরদিয়ে মাটিতে পা মোবারক ছেছড়াতে ছেছড়াতে মসজিদে প্রবেশ করলেন-
فاردا ابو بكر ان يتاخر فاوما اليه النبى صلى الله عليه وسلم ان مكانك ثم اتى به حتى جلس الى جنبه فقيل للاعمش فكان النبى صلى الله عليه وسلم يصلى وابوبكر يصلى بصلاته والناس يصلون بصلوة ابى بكر فقال برأسه نعم ... الى ان ... وزاد ابو معاوية جلس عن يسار الى ابى بكر فكان ابو بكر يصلى قائما (بخارى ص۱/ ۹۱)
মিশকাত শরীফের ১০২ পৃষ্ঠায় আরো বর্ণিত আছে-
حتى جلس عن يسار ابى بكر فكان ابو بكر يصلى قائما وكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلى قاعدا يقتدى ابو بكر بصلوة رسول الله صلى الله عليه وسلم والناس يقتدون بصلوة ابى بكر متفق عليه وفى رواية لهما يسمع ابو بكر الناس التكبير
অর্থাৎ ‘যখন হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আগমনের পদধ্বনি শুনতে পেয়ে নিজে পিছনে সরতে উদ্যোত হলেন তখন হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) না সরতেই ইঙ্গিত করলেন। অতঃপর তিনি অগ্রসর হয়ে আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর বামদিকে বসে পড়লেন।
এমন সময় হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দাঁড়িয়েই নামায পড়ছিলেন। আর হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বসে (ইমাম হিসেবে) নামায পড়তে থাকলেন। অর্থাৎ হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নামাযের এক্তেদা করলেন এবং সাহাবায়ে কেরাম রেদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর অনুসরণ করলেন।’
‘বোখারী ও মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে- হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) মুকাব্বির হয়ে লোকদিগকে হুজুরের তাকবীর শুনাতে লাগলেন।’
উপরোক্ত হাদীস শরীফের স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল যে, নামায পড়া অবস্থায় হুজুরেপাকের খেয়াল করতে হবে। তা’জিম ও করতে হবে। যেমন সিদ্দিকে আকবর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নামাযের ভিতরে ছরকারে কায়েনাতের সম্মান করতে গিয়ে পিছনে সরতে উদে্যুাত হয়েছিলেন।
নামায পড়া অবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ হুজুরেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল তা’জিমের সঙ্গে করলেন। এমনকি হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ সমস্ত সাহাবাগণ নামায পড়া অবস্থায় নিয়ত পরিবর্তন করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইমামরূপে গণ্য করে নামায আদায় করলেন। অথচ নামাযের পর ছরকারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্দিকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর উপর শিরকের ফতোয়া দেননি।
দেখুন ইসমাইল দেহলভীর ফতোয়া ‘নামাযে রাসূলেপাকের খেয়াল তা’জিমের সঙ্গে করা শিরিক’ তার এ ফতোয়া অনুযায়ী সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম মুশরিক হয়ে গেলেন। (নাউজুবিল্লাহ)
তাবলীগ জামাতের পক্ষে মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব
মুফতি সাহেব বলেন, সিরাতে মুসতাকিম’ কিতাব হক্ব, যা স্বয়ং সৈয়দ আহমদ বেরলভী (র.) এর মলফুজাত বা ভাষ্য এবং মাওলানা ইসমাঈল দেহলভী লিখেছেন অর্থাৎ সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব তার শাগরিদ ও খলিফা মাওলানা ইসমাঈল দেহলভী দ্বারা সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবখানা লিখাইয়াছেন।
অতঃপর মুফতি সাহেব তার দাবির সপক্ষে তারই বিশিষ্ট খলিফা ও সাগরিদ মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেবের লিখিত ‘জখিরায়ে কেরামত’ কিতাবখানা হাতে নিয়ে উহার ১ম জিলদের ২০ পৃষ্ঠা (মুকাশাফাতে রহমত) খুলে দেখালেন যে, উহাতে লেখা রয়েছে, জৈনপুরী সাহেব বলেন-
اور صراط المستقیم کہ اسکے مصنف حضرت سید صاحب اور اسکے کاتب مولانا محمد اسمعیل محدث دہلوی ہیں
অর্থাৎ ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ এর মুছান্নিফ বা মূল গ্রন্থকার হযরত সৈয়দ আহমদ সাহেব (সৈয়দ আহমদ বেরলভী) এবং এর লিখক মাওলানা মোহাম্মদ ইসমাঈল মুহাদ্দিসে দেহলভী।’
অতঃপর মুফতি সাহেব বলেন- জখিরায়ে কেরামত ৩/১৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
سید احمد قدس سرہ کی کتاب صراط مستقیم کو جسکو مولانا محمد اسمعیل رحمہ اللہ نے لکھاہے
অর্থাৎ ‘সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের কিতাব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ যা মাওলানা মোহাম্মদ ইসমাঈল দেহলভী সাহেব লিখেছেন।’
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব
মুফতি সাহেবের জওয়াবে সিরাজনগরী সাহেব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা হাতে নিয়ে দেখালেন যে, উক্ত কিতাবের কভার পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে (مصنفه ) মুছান্নিফহু ইসমাঈল শহীদ অর্থাৎ সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবখানা ইসমাঈল দেহলভী লিখেছেন।’
তাবলীগ জামাতের পক্ষে মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব
মুফতি সাহেব আর একখানা সিরাতে মুস্তাকিম কিতাব হাতে নিয়ে দেখালেন, সে কিতাব ইসলামী একাডেমী ৪০ উর্দু বাজার লাহোর থেকে প্রকাশিত তার কভার পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে-
(شاہ اسمعیل شہید ـ سید احمد شہید)
সৈয়দ আহমদ শহীদ ও শাহ ইসমাঈল শহীদ উভয়ের নাম কভার পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব
সিরাজনগরী সাহেব বলেন আমার হাতে সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবের যে নুছকা আছে সে কিতাব থেকে বলছি।
এভাবে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় অবশেষে মাওলানা আব্দুন নুর ইন্দেশ্বরী, আল্লামা হরমুজ উল্লাহ শায়দা সাহেব ও উভয়ের পক্ষের সালিশ জনাব আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব ও সভাপতি মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেবসহ কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম সাহেবান এক নিরালা ঘরে প্রবেশ করে নিম্নে প্রদত্ত রায়টি লিখে প্রকাশ করেন, এবং রবিরবাজার হাফিজিয়া মাদ্রাসা প্রধান শিক্ষক জনাব হাফেজ আনছার উদ্দিন সাহেব উক্ত রায়টি জনগণের সামনে পাঠ করে শুনান।
রায়নামা
৭৮৬
ছিরাতে মুস্তাকিম নামক কিতাব নামাযের মধ্যে হুজুর (দ.)এর খেয়াল গরু-গাধার খেয়াল অপেক্ষা আরও খারাপ। এই কথাটি নেহাত খারাপ এবং দোষনীয়। কিতাবের লেখক যেই হউক না কেন সে দোষী এবং কিতাবও দোষী।
এই কথাটি যাহার দ্বারাই লিখা হইয়াছে তিনি দোষী বটে। দায়ী বটে।
স্বাক্ষর- মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান
ইমাম, রবিরবাজার জামে মসজিদ
১২/২/৭৬ইং
আ: ওয়াহিদ
১২/২/৭৬ইং
অতঃপর শায়দা সাহেবের নিকট প্রশ্ন করা হল ১ম মাসআলার ফয়সলা দ্বারা বুঝা গেল মাওলানা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম
সিরাজনগরী সাহেবের দাবি সত্য কিন্তু অন্যান্য আর ১৩টি মাসআলার ফয়সলা কি জানতে বাসনা।
উত্তরে উস্তাযুল উলামা আল্লামা শায়দা সাহেব বলেন বাকি ১৩টি মাসআলার ফয়সলা অনুরূপ বুঝে নিবেন।
রায়নামা প্রকাশ হওয়ার পর মাওলানা ইব্রাহিম আলী সাহেব, মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব ও তাদের দল তখনই সভা হতে চলে যেতে দেখা যায়।
তারপর পুলিশ ইনচার্জ সাহেবের অনুরোধে শায়খুল ইসলাম আল্লামা সৈয়দ আবিদশাহ মোজাদ্দেদী আল মাদানী সাহেব আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকাইদের মাসআলার উপর এক মখতছর ভাষন দান করেন। অবশেষে মিলাদশরীফ ও দোয়া পাঠান্তে মাহফিল সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
সংকলক
হাফিজ মাওলানা তালিব উদ্দিন।
উপসংহার:
নামাযে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল তা’জিমের সাথে করাই আল্লাহপাকের বন্দেগী এ সম্পর্কে হাদিসে কারীমা লক্ষ্য করুন-
حدثنا ابو اليمان قال اخبرنا شعيب عن الزهرى قال اخبرنى انس بن مالك الانصارى وكان تبع النبى صلى الله عليه وسلم وخدمه وصحبه ان ابا بكر كان يصلى لهم فى وجع النبى صلى الله عليه وسلم الذى توفى فيه حتى اذا كان يوم الاثنين وهم صفوف فى الصلوة فكشف النبى صلى الله عليه وسلم ستر الحجرة ينظر الينا وهو قائم كان وجهه ورقة مصحف ثم تبسم يضحك فهممنا ان تفتتن من الفرح برؤية النبى صلى الله عليه وسلم فنكص ابو بكر على عقبيه ليصل الصف وظن ان النبى صلى الله عليه وسلم خارج الى الصلوة فاشار الينا النبى صلى الله عليه وسلم ان اتموا صلاتكم وارخى الستر فتوفى من يومه صلى الله عليه وسلم. (بخارى شريف ص ۱/۹۳-۹۴)
ভাবার্থ: ‘হযরত আনাস ইবনে মালিক আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু যিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর (আক্বিদা ও আমলের) পূর্ণ অনুসারী ছিলেন এবং একাধারে দশ বৎসর আল্লাহর হাবীবের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন আর তিনি তাঁর একজন জলিল কদর সাহাবিও ছিলেন।
তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্তিম রোগ থাকাকালীন অবস্থায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহাবায়ে কেরামগণকে নিয়ে (ইমাম হয়ে) নামায আদায় করতেন।
অবশেষে সোমবার দিনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ইমামতিতে সাহাবায়ে কেরামগণ নামাযরত অবস্থায় কাতারবন্দী ছিলেন। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুজরা শরীফের পর্দা উঠিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় আমাদের দিকে তাকালেন। এ সময়ে তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) চেহারা মোবারক মাসহাফ তথা কোরআন কারীমের স্বচ্ছ পৃষ্ঠার ন্যায় ঝলমল করছিল। অতঃপর তিনি মুচকি হাসছিলেন।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূরানী চেহারা মোবারক দর্শনে আমরা (সাহাবায়ে কেরামগণ) স্বেচ্ছায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হুজরা মোবারক থেকে) নামাযের জামায়াতে আসবেন এ ভেবে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু (ইমামতির স্থান থেকে) পিছন দিকে সরে নামাযের প্রথম কাতারে প্রত্যাবর্তন করলেন। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ইশারায় বললেন اتموا صلاتكم তোমরা তোমাদের অসম্পূর্ণ নামাযকে পূর্ণ করে নাও। অতঃপর আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা মোবারক ফেলে দিলেন।
সে দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাত শরীফ হয়েছিল। (বোখারী শরীফ ১/৯৩ পৃ.)
উপরোক্ত হাদিসশরীফের মাধ্যমে শরিয়তের যে কয়েকটি মাসআলা প্রমাণিত হলো তা নিম্নরূপ-
১. হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অন্তিম বিমার শরীফে শয্যা শায়িত ছিলেন তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু সতের মতান্তরে একুশ ওয়াক্তের নামাযের জমায়াতে আল্লাহর হাবীবের নির্দেশ মোতাবেক ইমামতি করেছেন এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাত শরীফের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু ই হলেন তাঁর সর্বপ্রথম খলিফা। যাকে খলিফাতুর রাসূল বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। (اصح السير ‘আছাহহুছ ছিয়র’)
২. সাহাবায়ে কেরামগণ যখন আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ইমামতিতে সোমবার দিনে ফজরের ফরয নামাযের জামায়াতে কাতারবন্দী অবস্থায় ছিলেন। ঝুলন্ত পর্দা আবৃত হুজুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়ানো অবস্থায় পর্দা উঠিয়ে উক্ত জামায়াতের দিকে নূরানী হাস্যেজ্জ্বল চেহারা মোবারক নিয়ে তাকালেন। এমতাবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ স্বপ্রণোদিত হয়ে নামাযের কাজকর্ম স্থগিত রেখে আল্লাহর হাবীবের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং আনন্দে আত্মহারা হলেন। আর আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর হাবীবের দর্শনে ইমামতির স্থান থেকে পিছনের দিকে প্রথম কাতারে প্রত্যাবর্তন করলেন।
এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-
হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল ও তা’জিম সাহাবায়ে কেরামগণ নামাযের ভিতরেই করেছেন কেননা নামাযের ভিতরে তা’জিমের সঙ্গে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল করাই আল্লাহর বন্দেগী।
৩. যখন নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুজরা মোবারকে পর্দার ভিতরে ছিলেন, এমতাবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ মসজিদে নববীতে ফজরের ফরয নামাযের জমায়াত হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ইমামতির মাধ্যমে পড়তে ছিলেন।
যে মুহূর্তে হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা উঠিয়ে নামাযের জামায়াতের দিকে তাকালেন এবং সাহাবায়ে কেরামগণ আল্লাহর হাবীবকে দেখতে পেলেন, তখন সাহাবায়ে কেরামগণ নামাযের কাজকর্ম স্থগিত করে নবীর তা’জিমে তাঁর দিকে মুখ ফিরে নবীর মহব্বতে স্বেচ্ছায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন।
আবার যখন আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা মোবারক ফেলে দিলেন এবং অসম্পূর্ণ নামায আদায়ের নির্দেশ দিলেন, তখনই সাহাবায়ে কেরামগণ বাকী নামায সম্পূর্ণ করলেন।
এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-
নবীকে দেখতে না পেলে নামায রাসূলের ইমামতি ব্যতিরেকই আদায় করবে। এতে কোন ত্রুটি বিচ্যুতি নেই। আর যখনই রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখা যাবে নামায স্থগিত রেখে রাসূলের ইমামতি গ্রহণ করতে হবে এটাই আদব।
মোদ্দাকথা: আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেককার সালেহীন উম্মতের যানাযায় হাজির হয়ে উক্ত নামাযে যানাযাকে মহান আল্লাহর দরবারে কবুল ও মঞ্জুর করিয়ে নেন। (আল হাবী লিল ফাতাওয়া) এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা।
এ প্রসঙ্গে কোন কোন বাতিলপন্থীরা প্রশ্ন তোলে যে, যদি আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেককারের যানাযায় হাজির হয়ে থাকেন, তাহলে হাবীবে খোদার ইমামতি ছাড়া নামায পড়া হয় কেন?
এর উত্তরে আমরা বলব- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজির হওয়া স্বত্ত্বেও আমরা চাক্ষুস তাঁকে দেখি না, তাই নিজেদের ইমামতির মাধ্যমে নামায সম্পন্ন করি। যদি আমরা আল্লাহর হাবীবকে চাক্ষুস দেখতাম, তাহলে নামাযে যানাযা স্থগিত করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইমামতিতে নামায আদায় করতাম।
যেমনিভাবে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামায়াতের অতি নিকটবর্তী হুজরা মোবারকে পর্দা আবৃত অবস্থায় হাজির থাকা সত্ত্বেও হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ইমামতিতে সাহাবায়ে কেরামগণ মসজিদে নববীতে নামায পড়তেছিলেন। আর আল্লাহর নবী যখন পর্দা মোবারক সরিয়ে জামায়াতের দিকে তাকালেন এবং সাহাবায়ে কেরামগণ আল্লাহর হাবীবের দর্শনে ধন্য হলেন তখনই সকল সাহাবায়ে কেরাম নামাযের কাজকর্ম স্থগিত করে আল্লাহর হাবীবের নূরানী চেহারা মোবারক দেখে দেখে আত্মহারা হয়ে পড়লেন, অপরদিকে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর হাবীবের ইমামতির মাধ্যমে নামায আদায় করবেন ধারণায় ইমামতির স্থান ছেড়ে পেছনের কাতারে প্রত্যাবর্তন করলেন।
আবার যখন হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসম্পূর্ণ নামায সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ দিয়ে হুজরা মোবারকের পর্দা ফেলে দিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামগণ চাক্ষুসভাবে নবীকে দেখতে পেলেন না, এমতাবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু ইমামতিতে নামায সম্পন্ন করলেন। সুতরাং নেককারের যানাযাতে নবীর আগমন সত্য যেহেতু আমরা নবীকে চর্ম চক্ষুতে দেখি না, এজন্য আমরা নিজেদের ইমামতিতেই নামায আদায় করে থাকি। যদি নবীকে চাক্ষুসভাবে দেখার নসীব আমাদের হয়ে যেত তাহলে সাহাবায়ে কেরামগণের অনুকরণে নবীর ইমামতিতেই আমারা নামায আদায় করে নিতাম।
অপর একটি হাদিস
عن ابى حازم بن دينار عن سهل بن سعد الساعدى ان رسول الله صلى الله عليه وسلم ذهب الى بنى عمرو بن عوف ليصلح بينهم فحانت الصلوة فجاء المؤذن الى ابى بكر فقال اتصلى للناس فاقيم قال نعم فصلى ابو بكر فجاء رسول الله صلى الله عليه وسلم والناس فى الصلوة فتخلص حتى وقف فى الصف فصفق الناس وكان ابوبكر لايلتفت فى صفوته فلما اكثر الناس التصفيق التفت فراى رسول الله صلى الله عليه فاشار اليه رسول الله صلى الله عليه وسلم ان امكث مكانك فرفع ابوبكر يديه فحمد الله على ما امره به رسول الله صلى الله عليه وسلم من ذلك ثم استاخر ابو بكر حتى استوى فى الصف وتقدم رسول الله صلى الله عليه وسلم فصلى فلما انصرف قال يا ابا بكر ما منعك ان تثبت اذا امرتك فقال ابو بكر ما كان لابن ابى قحافة ان يصلى بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم مالى رأيتكم اكثر ثم التصفيق من نابه شئ فى صلاته فليسبح فانه اذا سبح التفت اليه وانما التصفيق للنساء. (بخارى شريف ۱/۹۴)
ভাবার্থ: ‘হযরত সাহাল ইবনে সা’দ সাঈদী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- নিশ্চয় একদা রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবনে আউফ গোত্রের একটি বিবাদ মিমাংসার জন্য তাদের বস্তিতে তাশরীফ নিয়েছিলেন, এদিকে নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেল। তখন মোয়াজ্জিন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট গিয়ে অবস্থা ব্যক্ত করে বললেন, আপনি জামায়াত পড়াইয়া নিন। এতে আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্মতি জ্ঞাপন করে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তখন আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু ইমাম হয়ে নামায আরম্ভ করলেন।
এমতাবস্থায় রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তথায় তাশরীফ আনলেন, যখন সাহাবায়ে কেরাম নামাযরত অবস্থায় ছিলেন।
আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিছনের কাতারগুলো অতিক্রম করে প্রথম কাতরে এসে দাঁড়ালেন, সে সময় (হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূলেপাকের আগমন অবগত করানো জন্য) কিছু সংখ্যক মুসল্লী (সাহাবায়ে কেরাম) হাতের উপর হাত মেরে শব্দ করলেন (হাততালি দিলেন)।
(উল্লেখ্য যে) হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু নামাযরত অবস্থায় কোন দিকে ফিরে তাকাতেন না। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম নামাযরত অবস্থায় যখন হাততালি দিতে লাগলেন তখন তিনি (আবু বকর) ফিরে তাকিয়ে আল্লাহর হাবীবকে দেখতে পেলেন। (এবং তৎক্ষণাৎই তিনি পিছনের দিকে সরে যেতে লাগলেন)
(এমতাবস্থায়) রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে (আবু বকরকে) নিজের অবস্থানে স্থির থাকতে ইশারায় নির্দেশ দিলেন। রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইশরার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দুইহাত উত্তোলন করে আল্লাহপাকের প্রশংসা করে পিছনে ফিরে প্রথম কাতারে এসে দাঁড়ালেন।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামনে এগিয়ে গিয়ে ইমামতি করে নামায আদায় করলেন। নামায শেষ করে তিনি বললেন হে আবু বকর! আমার নির্দেশ পালনে কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছিল? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বললেন, আবু কুহাফার পুত্রের জন্য আল্লাহর হাবীবের সামনে দাঁড়িয়ে (নিজে ইমাম হয়ে) নামায আদায় করা শোভা পায় না।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামগণের উদ্দেশ্যে বললেন- আমি তোমাদেরকে (নামাযের ভিতরে) হাতে তালি দিতে দেখলাম, ব্যাপার কি? শোন! নামাযের মধ্যে যদি কাউকে কোন কিছু থেকে ফিরাতে হয় তাহলে (পুরুষগণ) ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। সুবহানাল্লাহ বললেই তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হবে। আর হাতে তালি দেওয়া তো মহিলাদের জন্য। (কেননা মহিলাদের কণ্ঠস্বর বেগানা পুরুষদের শুনানো অনুচিত। (বোখারশরীফ ১/৯৪ পৃ.)
উপরোক্ত হাদিসশরীফ দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-
১. নামাযরত অবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল তা’জিমের সাথে ইচ্ছা করেই করেছেন। কারণ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কাতার ভেদ করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম নামাযরত অবস্থায় কাতার ফাঁক করে দিয়েছিলেন যাতে সামনে অগ্রসর হওয়া সহজ হয়।
২. নামাযের ভিতরে ইচ্ছা করে তা’জিমের সাথে রাসূলেপাকের খেয়াল করাই সাহাবায়ে কেরামগণের আক্বিদা ও আমল। এজন্যই তো হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ ইমামতির স্থান ছেড়ে পিছনের কাতারে স্বেচ্ছায় তা’জিম রক্ষার জন্য এসে দাঁড়ালেন এবং নামাযের ভিতরেই নিজের ইমামতি স্থগিত করে আল্লাহর হাবীবকে ইমামতি দিয়ে দিলেন, আর আল্লাহর হাবীবও স্বেচ্ছায় ইমামতি করে নামায সমাপন করলেন।
দেখুন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রথমে ছিলেন ইমাম, আল্লাহর হাবীব নামাযের জামায়াতে আসার দরুণ নিজে ইমামতি ছেড়ে আল্লাহর হাবীবকে ইমামতি দিয়ে দিলেন সুবহানাল্লাহ! দেখলেন তো নামাযের ভিতরে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর হাবীবকে কিভাবে স্বেচ্ছায় তা’জিম করলেন।
এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- নামাযের ভিতরে আল্লাহর হাবীবের তা’জিমই আল্লাহর বন্দেগী।
৩. সুতরাং যারা বলে নামাযে ইচ্ছা করে তা’জিমের সাথে আল্লাহর রাসূলের খেয়াল করলে মুশরিক হবে এবং অনিচ্ছায় খেয়াল এসে পড়লে যে রাকাআতে খেয়াল আসল এ এক রাকাতের স্থলে চার রাকাআত নফল নামায আদায় করতে হবে।
এ রকম বিভ্রান্তিকর ফতওয়া দ্বারা সাহাবায়ে কেরামগণ মুশরিক সাব্যস্থ হয়ে যান। (নাউজুবিল্লাহ) যা ইসলামবিরোধী আক্বিদা।
এরূপ ঘৃণ্য ফতওয়া দিয়েছেন মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী জখিরায়ে কেরামত ১/২৩১ পৃষ্ঠা, বাংলা জখিরায়ে কেরামত ১ম খণ্ড ২৯-৩০ পৃষ্ঠা। সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত এবং মাওলানা ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত কিতাব সিরাতে মুস্তাকিম ১৬৭-১৬৮ পৃষ্ঠা।
______
আল খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়ার বাতিল আক্বিদা
____________________
আল খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়ার বাতিল আক্বিদা
ফুলতলী সাহেবের লিখিত ‘আল খুতবাতুল ইয়াকুবিয়া’ কিতাব ১৯৯৮ইং ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। (প্রকাশক মোহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী, পরওয়ানা পাবলিকেন্স, ১৭৩ ফকিরাপুল, চতুর্থ তলা- ঢাকা-১০০০) উক্ত খুতবাতুল ইয়াকুবিয়ার ১৭ পৃষ্ঠা মহররমের ২য় খুতবায় আশুরার ফজিলত বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখা রয়েছে-
وفيه غفر لداؤد
এইদিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করেছেন।
وفيه غفر لنبينا محمد صلى الله عليه وسلم وعليهم اجمعين
এইদিনে আমাদের শিরতাজ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সকলকে পরিপূর্ণরূপে ক্ষমা করেছেন।
এ খুতবায় উল্লেখিত বক্তব্যে সুন্নি আক্বিদাবিরোধী ২টি আপত্তিকর উক্তি রয়েছে- যা সাধারণ মুসল্লিয়ানদের ঈমান আক্বিদা বিনষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে।
১. এতে বলা হয়েছে- ‘এইদিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করেছেন।’
প্রশ্ন জাগে কী ক্ষমা করেছেন। গোনাহে কবীরা নাকি গোনাহে সগীরা। হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম কি সত্যিকার কোন গোনাহ করেছিলেন? এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের কী অভিমত?
২. খুতবায় তাও উল্লেখ রয়েছে- ‘এইদিনে (আশুরার দিনে) আমাদের শিরতাজ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সকলকে পরিপূর্ণরূপে ক্ষমা করেছেন।
এতে প্রশ্ন জাগে আমরাতো গোনাহগার, আমাদের গোনাহ মাফ করানোর জন্য আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াতের প্রয়োজন রয়েছে, যেহেতু তিনি শাফিউল মুজনেবীন।
উপরোক্ত বক্তব্যে প্রমাণিত হচ্ছে, আমাদেরকে যেমনি মাফ করা হয়েছে, তেমনি আল্লাহর হাবীবকেও মাফ করা হয়েছে। ক্ষমার দিক দিয়ে নবী ও উম্মতের মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা আমাদের নবী মা’সুম বা নিষ্পাপ, অর্থাৎ আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর হাবীবকে গোনাহ সংঘটিত হওয়া থেকে পূর্ণ হেফাজত রেখেছেন। ফলে আল্লাহর হাবীবের কোন গোনাহ সংঘটিত হয় নাই।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে পাকে নিজেই এরশাদ করেছেন-
ليغفرلك الله ماتقدم من ذنبك
এ আয়াতে কারীমার তাফসিরে আল্লামা ফখরুদ্দিন রাজী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় ‘তাফসিরে কবীর’ নামক কিতাবের ১৩তম খণ্ড ২৬ পাড়া ১৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
انا معناه ان الله تعالى يغفرلك ولاجلك ماتقدم من ذنب امتك
‘উপরোক্ত আয়াতে কারীমার ভাবার্থ হল- নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা আপনার কারণে আপনার পূর্ববর্তী উম্মতের গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন।
এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন গোনাহ নেই বরং আল্লাহর হাবীবের উসিলায় আল্লাহপাক তাঁর উম্মতের গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন। কিন্তু খুৎবার ভাষ্যে প্রতীয়মান হয়- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাফ করা হয়েছে এবং উম্মতগণকেও মাফ করা হয়েছে।
এখানে নবী ও তাঁর উম্মতগণ সকলকে একাকার করে ব্যক্ত করা হয়েছে। এতে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান মর্যাদাকে ক্ষুণœ করা হয়েছে। যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা হচ্ছে-الانبياء معصومون (আল আমবিয়াউ মা’সুমুন) নবীগণ নিষ্পাপ। নবীগণকে আল্লাহ গোনাহ সংঘটিত হওয়া থেকে মুক্ত বা পূর্ণ হেফাজত রেখেছেন।
জনাব ফুলতলীর পীর সাহেব তদীয় ‘আল খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়ায় উপরোক্ত মওজু বা জাল ও বানোয়াট হাদিস পেশ করে আল্লাহর নবীর গোনাহ আশুরার দিনে আল্লাহপাক ক্ষমা করেছেন উক্তি দ্বারা আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান মর্যাদাকে ক্ষুণœ করা হয়েছে। যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
ক) আল্লামা ইবনে জাওযী রাদিয়াল্লাহু আনহু কিতাবুল মাওজুয়াত গ্রন্থের ২য় জিলদের ১৯৯ পৃষ্ঠা থেকে ২০১ পৃষ্ঠাব্যাপী অপর একখানা দীর্ঘ মাওজু হাদিস বর্ণনা করেন। এতে রয়েছে-
وهو اليوم الذى غفر الله لمحمد ذنبه ماتقدم وماتاخر
অর্থাৎ আশুরার দিনে আল্লাহপাক হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গোনাহ ক্ষমা করেছেন। উক্ত মাওজু হাদিসটি বর্ণনা করে আল্লামা ইবনে জাওযী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
هذا حديث لايشك عاقل فى وضعه
অর্থাৎ এই হাদিসটি মাওজু বা মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে কোন বিবেকবান ব্যক্তি সন্দেহপোষণ করতে পারে না। খ) উপমহাদেশের বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও উপরে বর্ণিত মিথ্যা হাদিসটি তদীয় ‘মাসাবাতা মিনাস সুন্নাহ’ নামক কিতাবে আশুরার দিনের আলোচনায় উল্লেখ করেছেন- যার মধ্যে রয়েছে-
وهو اليوم الذى غفر الله فيه لمحمد ذنبه ماتقدم وماتاخر
অর্থাৎ আশুরার দিনে আল্লাহপাক হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গোনাহ ক্ষমা করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন-
كلهم ذكره ابن الجوزى فى الموضوعات وقال رجاله ثقات فاالظاهر ان بعض المتاخرين وضعه وركبه على هذا الاسناد انتهى
অর্থাৎ আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন এ সকল হাদিসকে আল্লামা ইবনে জাওযী রাদিয়াল্লাহু আনহু মাওজুয়াত বা জাল হাদিসের মধ্যে গণ্য করেছেন এবং বলেছেন পরবর্তীকালে কিছুসংখ্যক লোক সেকাহ রাবীগণের নাম এর সনদের মধ্যে সংযুক্ত করে তাদের হীন উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। (নাউজুবিল্লাহ)
উপরোল্লেখিত আলোচনার দ্বারা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আলোচ্য হাদিসটি মিথ্যা বা জাল হাদিস। সুতরাং এই মিথ্যা হাদিসকে কেন্দ্র করে আল্লাহর হাবীব হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোনাহ ছিল এবং আশুরার দিনে ক্ষমা করা হয়েছে এই বক্তব্য দেওয়া সম্পূর্ণ অযুক্তিক ও গোমরাহী।
উল্লেখ্য যে, প্রখ্যাত উসূলবিদ আল্লামা মোল্লা জিউন রাদিয়াল্লাহু আনহু তাফসিরাতে আহমদীয়া নামক কিতাবের ২৭ পৃষ্ঠায় لا ينال عهد الظالمين আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন-
واذا تقرر هذا فما نقل عن الانبياء مما يشعر بكذب او معصية فما كان منقولا بطريق الاحد فمردود. وما كان منقولا بطريق التواتر فمصروف عن ظاهره ان امكن والا محمول على ترك الاولى او كونه قبل البعثة.
অর্থাৎ যখন কোন রেওয়ায়েত দ্বারা নবীগণের গোনাহ সাব্যস্ত হয়। তখন দেখতে হবে সেই রেওয়ায়েতটি আহাদসূত্রে বর্ণিত না তাওয়াতুর সূত্রে বর্ণিত। যদি আহাদসূত্রে বর্ণিত হয়ে থাকে তাহলে উহা পরিত্যজ্য হবে।
আর যদি তাওয়াতুরসূত্রে বর্ণিত হয়ে থাকে তাহলে যথা সম্ভব নবীগণের মর্যাদানুযায়ী জাহেরী অর্থ পরিবর্তন করতে হবে। অন্যথায় তরকে আউলা বা উত্তমতার ব্যতিক্রম ধরে নিতে হবে, যা পাপ বা গোনাহ নয় অথবা তা নবুয়ত প্রকাশ হওয়ার পূর্বের বিষয় হিসেবে প্রযোজ্য হবে।
প্রকাশ থাকে যে, قبل البعثة বা নবুয়ত প্রকাশ হওয়ার পূর্বের বিষয় কথা দ্বারা ঐ দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন ওহী বা শরিয়তের আদেশ নিষেধ কোন কিছু জারি হয়নি। সুতরাং ঐ সময়ের কোন কিছুই পাপ নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইসলামের প্রাথমিক যুগে সাহাবায়েকেরাম মদ পান করেছেন কিন্তু তাঁদের কোন গোনাহ হয়নি। কারণ তখনও মদ পান করা নিষেধ সম্বলিত আয়াত নাজিল হয়নি।
অতঃপর আল্লামা মোল্লা জিউন রাদিয়াল্লাহু আনহু উক্ত তাফসিরাতে আহমদীয়ার ২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
فالحق انه لاخلاف لاحد فى ان نبينا عليه السلام لم يرتكب صغيرة ولا كبيرة طرقة عين قبل الوحى وبعده كما ذكره ابو حنيفة فى الفقه الاكبر.
অর্থাৎ এ কথাই সত্য যে, নিশ্চয়ই আমাদের প্রিয়নবী ওহী প্রাপ্তির পূর্বে ও পরে এক মুহূর্তের জন্যেও কবিরা সগিরা কোন প্রকার গোনাহ করেননি। এতে কারো দ্বিমত নেই। যেমন ইমাম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু ফেকহে আকবর কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় মাদারিজুন নবুয়ত নামক কিতাবের ১ম খণ্ড ১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
خصوصا سید انبیاء وافضل رسل صلوۃ وسلامہ علیہ وعلیہم کہ عصمت اواتم واکمل ورتبہ اواعلی وارفع است وہرکہ بجناب وی چیزی بہ بندد وپسندد وبخلاف ادب دم زند ساقط است ذرہموۃ درک اسفل ضلالت ازانجاکہ خبر نداردووی از اول پاک واراستہ وپراستہ آمدہ است کہ دست ہیچ عیب ونقص رابدامان عزت وجلال او مجال وصول نیست بیت بہ تعلیم وادب او راچہ حاجت
کہ او خود زآغاز آمد مؤدب
অর্থাৎ ‘বিশেষত আমাদের প্রিয়নবী সায়্যিদুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বেলায় ইসমত বা গোনাহ থেকে পাক থাকা সর্বাধিক পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ এবং তার মর্যাদার অধিকতর উন্নত।
যে ব্যক্তি আল্লাহর হাবিবের শানে আদবের পরিপন্থি নিজের মনগড়া মতে কোন মন্তব্য করবে নিঃসন্দেহে সে পরিত্যজ্য হবে, নিশ্চয়ই সে মূর্খতার নিম্নতম অন্ধকারের গভীরতম গহব্বরে নিমজ্জিত রয়েছে।
হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সত্ত্বা প্রথম থেকেই এমন পবিত্র এবং সুসজ্জিত ছিল যে, কোন রকম দোষক্রটির হস্ত তাঁর ইজ্জত ও বুজুর্গির আঁচল স্পর্শ করতে পারেনি। যেমন কবি বলেছেন ‘তা’লিম ও আদব গ্রহণ করার তো তাঁর কোন প্রয়োজন নেই। কেননা তিনি সক্রিয় আদবশীল হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন।’
_____
হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম গোনাহ থেকে মুক্ত
____________________
হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম গোনাহ থেকে মুক্ত
জনাব ফুলতলী সাহেবের লিখিত ‘আল খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়া’ দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৪ ইংরেজি সনের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়। উক্ত কিতাবের ১৭ পৃষ্ঠা মহররম মাসের দ্বিতীয় খুৎবায় আশুরার ফজিলত সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে- وفيه غفر لداؤد এই দিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করেছেন।
উক্ত খুৎবার বয়ানের দ্বারা হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম গোনাহগার সাব্যস্ত হয়ে যান। কারণ এতে প্রশ্ন জাগে-
ক) কী ক্ষমা করেছেন। গোনাহে কবিরা না গোনাহে সগিরা, প্রথম দুই অবস্থাই মানছাবে নবুয়ত বা নবুয়তের মর্যাদার পরিপন্থি।
খ) খুতবায় কোন কিছু আলোচনা করতে হলে কোরআন সুন্নাহর আলোকে বলতে হবে।
আশুরার দিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করেছেন। এ বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন আয়াতে কারীমা বা কোন সহীহ হাদীস শরীফ কি রয়েছে? কষ্মিনকালেও নেই। হ্যাঁ এ ব্যাপারে একখানা মাওজু বা জাল ও বানোয়াট হাদিস পাওয়া যায়। যা মুহাদ্দিসিনে কেরামগণ প্রত্যাখান করেছেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা হচ্ছে- الانبياء معصومون (আল আম্বিয়াউ মা’সুমুন) নবীগণ নিষ্পাপ। নবীগণকে আল্লাহ গোনাহ সংঘটিত হওয়া থেকে মুক্ত বা পূর্ণ হেফাজতে রেখেছেন।
একটি মাওজু বা বানোয়াট জাল হাদিসের উপর ভিত্তি করে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে আশুরার দিনে আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করেছেন, এরূপ অমূলক বক্তব্য খুতবায় লিখে প্রকাশ করলে মুসল্লিয়ানগণের কাছে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হবে, এতে তারা বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আরিফ বিল্লাহ আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় ‘মাসাবাতা মিনাস সুন্নাহ’ ما ثبت من السنه নামক কিতাবে شهر المحرم (শাহরুল মুহাররাম) মহররম মাসের খুৎবার আলোচনায় উল্লেখ করেন- وغفر ذنب داؤد يوم عاشوراء (ওয়াগাফারা জামবা দাউদা ইয়াওমা আশুরাআ) অর্থ আশুরার দিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের গোনাহ ক্ষমা করেছেন’ তিনি (শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু) নিজ খুৎবায় এ উক্তি উল্লেখ করে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন-
موضوع ذكره ابن الجوزى عن ابن عباس رضى الله عنه وفيه حبيب بن ابى حبيب وهو افة
অর্থাৎ ‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে উপরের যে হাদিসখানা বর্ণিত আছে, ইবনে জাওযী এ হাদিসখানাকে মাওজু বা জাল বানোয়াট হাদিস বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা এই হাদিসের সনদের মধ্যে রয়েছে হাবিব বিন আবি হাবিব নামে একজন রাবী, যে মিথ্যা হাদিস রচনা করতো।’
উল্লেখ্য যে, হাদিস বিশারদ আল্লামা ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে আলী ইবনে আল জাওযী আলকুরশী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৫৯৭ হিজরি) তদীয় ‘কিতাবুল মওজুয়াত’ كتاب الموضوعات নামক গ্রন্থের ২য় জিলদ ২০২ পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ‘বাবু ফি জিকরে আশুরা’ باب فى ذكر عاشوراء অধ্যায়ে একখানা দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসের মধ্যে রয়েছে- وغفر ذنب داؤد فى يوم عاشوراء (আশুরার দিনে দাউদ আলাইহিস সালামের গোনাহ ক্ষমা করেছেন)
অতঃপর তিনি (ইবনে জাওযী) বলেন-
هذا حديث موضوع بلا شك قال احمد بن حنبل كان حبيب بن ابى حبيب يكذب وقال ابن عدى كان يضع الحديث.
অর্থাৎ ‘এ হাদিসটি নিঃসন্দেহে মাওজু বা জাল হাদিস। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন- এ হাদিসের রাবী বা বর্ণনাকারী হাবিব বিন আবি হাবিব মিথ্যুক এবং ইবনে আদি বলেছেন- হাবিব বিন আবি হাবিব মিথ্যা হাদিস রচনা করতো।’
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল যে, প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা ইবনে জাওজী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু বিশেষ করে আহমদ ইবনে হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ইবনে আদী রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ মুহাদ্দিসীনগণ এ হাদিসকে মাওজু বা জাল হাদিস প্রমাণ করেছেন। সুতরাং এই জাল বা মিথ্যা হাদিসকে কেন্দ্র করে আল্লাহর জলিল কদর নবী হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে গোনাহগার বা তাঁকে আশুরার দিনে ক্ষমা করেছেন বলে লিখিত বা অলিখিত বক্তব্য প্রদান করা কোন আলেমের পক্ষে আদৌ সমীচীন হবে না। বরং সাধারণ মুসলমানগণ এ এ বক্তব্যে বিপথগামী হওয়ার রাস্তা খুলে যাবে।
সমস্ত নবীগণ গোনাহ থেকে পাক ও পবিত্র الانبياء معصومون (আল আম্বিয়াউ মা’সুমুন) এ প্রসঙ্গে ইলমে কালাম বা আক্বাঈদ শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ‘শরহে আক্বাঈদে নাসাফী’ নামক গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
واذا تقرر هذا فما نقل عن الانبياء عليه السلام مما يشعر بكذب او معصية فما كان منقولا بطريق الاحد فمردود. وما كان بطريق التواتر فمصروف عن ظاهره ان امكن والا فمحمول على ترك الاولى او كونه قبل البعثة.
অর্থাৎ যখন এই কথা (আম্বিয়ায়ে কেরাম মা’সুম বা নিষ্পাপ) সাব্যস্ত হয়, যখন নবীগণ আলাইহিমুস সালামের ব্যাপারে এমন সব কথার বর্ণনা পাওয়া যায়, যা মিথ্যা অথবা গোনাহের আভাস দেয়। উহা যদি خبر واحد খবরে ওয়াহিদ সূত্রে বর্ণিত হয়ে থাকে, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আর যদি তা متواتر সূত্রে বর্ণিত হয়ে থাকে, এমতাবস্থায় তার জাহেরী বা প্রকাশ্য অর্থ হতে অন্য অর্থে (নবীর শান মোতাবেক) রূপান্তর করতে হবে যদি সম্ভব হয়। আর যদি সম্ভব না হয়, তাহলে তাকে এমন অর্থে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে বুঝা যায় যে, তাঁরা اولى (আউলা) বা উত্তমতা বর্জন করেছেন। অথবা উহা নবুয়ত প্রকাশ হওয়ার পূর্বের বিষয় হিসেবে প্রযোজ্য হবে।
প্রকাশ থাকে যে, قبل البعثة (কাবলাল বা’ছাত) বা নবুয়ত প্রকাশ হওয়ার পূর্বের বিষয়, কথা দ্বারা ঐ দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোন ওহী বা শরিয়তের আদেশ নিষেধ কোন কিছু জারি হয়নি। সুতরাং ঐ সময়ের কোন কিছুই পাপ নয়।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে সাহাবায়ে কেরাম মদ্যপান করা নিষেধ সম্বলিত আয়াত নাজিল হয়নি।
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-
১. কোন খবরে ওয়াহিদ خبر واحد হাদিসের মর্ম যদি আম্বিয়ায়ে কেরামের শানবিরোধী হয়, তবে তা মরদুদ বা পরিত্যজ্য হবে। উপরুন্তু মাওজু বা জাল হাদিস তো প্রকৃতপক্ষে হাদিস হিসেবে অগ্রহণযোগ্য। মাওজু হাদিসকে কোন অবস্থাতেই দলিলরূপে গ্রহণ করা যাবে না।
২. যদি মুতাওয়াতির متواتر সূত্রেও এরূপ আয়াতে কারীমা অথবা হাদিসশরীফের ভাবার্থ (মানছাবে নবুয়ত) منصب نبوت বা নবীর শানবিরোধী অর্থ প্রকাশ করে, তাহলে এ আয়াতে কারীমা বা হাদিসশরীফের প্রকাশ্য অর্থকে পরিবর্তন করে নবীর শান মোতাবেক অর্থে রূপান্তর করতে হবে যদি সম্ভব হয়।
আর যদি সম্ভব না হয় তাহলে খেলাফে আওলা উত্তমতা বর্জন বা নবুয়তের পূর্বের বিষয় হিসেবে গণ্য করতে হবে।
এজন্যই মুফতিয়ে বাগদাদ আল্লামা আবুল ফজল শাহাবুদ্দিন সৈয়দ মাহমুদ আল আলুছী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১২৭০ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল মা’য়ানী’ ৮ম খণ্ড ২৩ পারায় উল্লেখ করেন-
(فظن داؤد انما فتناه) ونعلم قطعا ان الانبياء عليه السلام معصومون من الخطايا لا يمكن وقوعهم فى شئ منها ضروة انا لو جوزنا عليهم شيئا من ذلك بطلت الشرائع ولم يوثق بشى مما يذكرون انه وحى من الله تعالى فما حكى الله تعالى فى كتابه يمر على ما اراده الله تعالى وماحكى القصاص مما فيه نقص لمنصب الرسالة طرحناه ونحن كما قال الشاعر-
ونؤثر حكم العقل فى كل شبهة
اذا اثر الاخبار جلاس قصاص ...
অর্থাৎ ‘وظن داؤد انما فتناه (এখন বুঝতে পেরেছেন দাউদ আলাইহিস সালাম কে আমি পরীক্ষা করেছি) (এ আয়াতে কারীমার তাফসিরে আল্লামা আলুছী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন)-
তরজমা : আমরা অকাট্য দলিলের মাধ্যমে অবগত হয়েছি, নিশ্চয়ই নবীগণ আলাইহিমুস সালাম সকল খাতা বা ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত বা মা’সুম। কোন প্রয়োজনে তাঁদের থেকে কোন গোনাহ সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়।
পক্ষান্তরে (বিল ফরযজ ও তকদির) আমরা যদি তাঁদের থেকে (নবীদের থেকে) কোন গোনাহ সংঘটিত হওয়া সম্ভব বলে ধরে নেই, তাহলে শরিয়তের যাবতীয় বিধি-বিধান বাতিল সাব্যস্ত হয়ে পড়বে এবং আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে যে সমস্ত ওহী নাজিল হয়েছে তা অনির্ভর হয়ে পড়বে। অতএব যে সমস্ত ঘটনাবলী আল্লাহ তা’য়ালা কালামে পাকে বর্ণনা করেছেন এগুলোর মুরাদ বা সঠিক ভাবার্থ আল্লাহ তা’য়ালার উপর ন্যস্ত করতে হবে এবং এ প্রসঙ্গে যে সব কাসাস বা ঘটনাবলী মানসাবে রিসালাত (منصب رسالت) বা নবুয়ত মর্যাদা ক্ষুণ হয়, এ সমস্ত ঘটনাবলীকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। (কেননা নবীর মর্যাদা হানিকর এসব বর্ণনা আদ্যোপান্তই ইসরাঈলী মনগড়া কাহিনী থেকে সংগৃহীত)
কবি যেভাবে বলেছেন এরূপ আমরাও বলব-
ونؤثر حكم العقل فى كل شبهة
اذا اثر الاخبار جلاس قصاص
তরজমা ‘এবং আমরা আক্বলে সলিমের হুকুমকে (রায়কে) অগ্রাধিকার দেব, এমনসব সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে- যা বেছে নেওয়া হয়েছে এমন সব খবর থেকে যেগুলো শুধু অলিক কেচ্ছা-কাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট।’ (অর্থাৎ কবি বলেন নবীগণ আলাইহিমুস সালামের শানবিরোধী যেসব ঘটনাবলী রয়েছে এগুলো ইসরাইলী মনগড়া কাহিনী থেকে গৃহীত) এসব ঘটনা আদৌ আল্লাহর হাবিব থেকে রেওয়ায়েত নেই। তাই এ সকল সন্দেহপূর্ণ কথা হতে আক্বলে সলিমের রায়ই প্রাধান্য পাবে। কারণ নবীগণকে আল্লাহ তায়ালা পূর্ণ হেফাজতে রেখেছেন। তাই তাঁদের থেকে গোনাহ সংঘটিত হয় নাই, এজন্যইতো নবীগণকে মা’সুম বলা হয়ে থাকে।
নবীগণ আলাইহিমুস সালাম যে মা’সুম বা বেগোনাহ এ কারণেই এই বর্ণনাটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্ণনা হল এই- নিশ্চয় কোন এক সম্প্রদায় হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে শহীদ করার সংকল্প করল, অতঃপর মেহরাব বা দেওয়াল টপকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল, অতঃপর তারা দাউদ আলাইহিস সালামের নিকট আরও কয়েকটি সম্প্রদায়কে পেল। সুতরাং তারা যা কিছু সংঘটিত করতে চেয়েছিল, তা আল্লাহ তায়ালা বিশদভাবে বর্ণনা করেছিলেন। ফলে দাউদ আলাইহিস সালাম তাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হলেন। অতঃপর দাউদ আলাইহিস সালাম তাদের প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছাপোষন করলেন। এমতাবস্থায় তিনি ধারণা করলেন যে, নিশ্চয় ইহা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষাটি হলো এই যে, তিনি রাগান্বিত হলেন নিজের জন্য, না অন্যের জন্য। তিনি আল্লাহর দরবারে ইস্তেগফার তথা রুজু করলেন, এই কাজ থেকে যা তিনি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েছিলেন যে, তাদের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এবং তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য স্বীয় ন্যায়পরায়ণ অভিমতের ভিত্তিতে কেননা ক্ষমা করা তার মহান মর্যাদার অনুকূলে।
আর বর্ণিত আছে, ক্ষমা প্রার্থনা হল ঐ ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি ভিড় বা শোরগোল জমাল হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের নিকট। এখানে আল্লাহ তায়ালার বাণী فغفرنا له (ফাগাফারনা লাহু) এ আয়াতে কারীমার অর্থ হলো فاغفرنا لاجله (ফাগাফারনা লি আজলিহী) অর্থাৎ দাউদ আলাইহিস সালামের কারণে তাকে ক্ষমা করেছি এবং হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম সংক্রান্ত সকল কাহিনী বা ঘটনাসমূহের বর্ণনাকে যদি বর্জন করা হয়, তাও ইনসাফের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয় বলে আমি (আলুছী) মনে করি। হ্যাঁ আবার নবুয়তের মর্যাদার কোন প্রকার বিঘœ সৃষ্টি হয় তাও অগ্রহণযোগ্য।
আর এমন তাভীল বা ব্যাখ্যাও গ্রহণযোগ্য নয় যা নবীগণ আলাইহিমুস সালামের ইসমত (গোনাহ থেকে মুক্ত হওয়া) বিদূরিত হয়ে পড়ে।
এ ব্যাপারে অতীব জরুরি কথা হচ্ছে এই, আল্লাহর নবীগণ আলাইহিমুস সালাম থেকে কোন প্রকারের দোষত্রুটি ও গোনাহ প্রকাশ হওয়া কোন অবস্থাতেই সম্ভবপর নয়। তবে নবীর শান মোতাবেক যা (اولى) আউলা (উত্তম) তা খেলাফ হতে পারে। আর এ থেকে নবী আলাইহিমুস সালামের ইস্তেগফারও হতে পারে এবং ইহা নবী আলাইহিস সালামের ইসমত বা গোনাহ থেকে পবিত্র হওয়ার মধ্যে কোন ব্যঘাতও ঘটায় না।’ অনুরূপ আবু হাইয়ান উন্দুলুসী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৭৫৪ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে বাহরুল মুহীত’ নামক কিতাবের ৯ম জিলদের ১৫১ পৃষ্ঠায় وظن داؤد انما فتناه(ওয়া যান্না দাউদা আন্নামা ফাতান্নাহু) আয়াতে কারীমার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন-
ويعلم قطعا ان الانبياء عليهم السلام معصومون من الخطايا الخ -
অর্থাৎ অকাট্য দলিলের মাধ্যমে অবগত, নিশ্চয়ই নবীগণ আলাইহিমুস সালাম সকল খাতা বা ভুলত্রুটি হতে মুক্ত।
এভাবে ইমাম আল্লামা ফখরুদ্দিন রাজী (রা.) ওফাত ৬০৪ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে কবীর’ নামক কিতাবের ১৩ নং জিল্দ ২৬ পারা ১৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
فداؤد عليه السلام استغفرلهم واناب- اى رجع الى الله تعالى فى طلب مغفرة ذلك الداخل القاصد للقتل- قوله (فغفرنا له ذلك) اى غفرنا له ذلك الذنب لاجل احترام داؤد ولتعظيمه -
অর্থাৎ ‘অতএব হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম তাদের জন্য (কওমের জন্য) ইস্তেগফার করলেন এবং ফিরে আসলেন অর্থাৎ যারা হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে শহীদ করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের মাগফিরাত তলবের জন্য আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে রুজু করলেন। আল্লাহ তায়ালার বাণী (فغفرنا له ذلك) অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর মহত্ত্ব ও সম্মানে তাদের ঐ অপরাধকে ক্ষমা করেছেন।’
ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘তদীয় ‘তাফসিরে কবীর’ নামক কিতাবের ১৩ নং জিল্দ ২৬ পারা ১৯২ পৃষ্ঠায় এবং আল্লামা শায়খ ইসমাঈল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতারেব ৮ম খণ্ড ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
ولذلك قال على رضى الله عنه من حدث بحديث داؤد عليه السلام على ما يرويه القصاص جلدته مائة وستين وذلك حد الفرية على الانبياء صلوات الله عليهم اجمعين – وفى الفتوحات المكيه فى الباب السابع والخمسين بعد المائة ينبغى للواعظ ان يراغب الله فى وعظه ويجتنب عن كل ما كان فيه تجر على انتهاك الحرمات فما ذكره المؤرخون عن اليهود من ذكر زلات الانبياء كداؤد ويوسف عليهما السلام مع كون الحق اثنى عليهم واصطفاهم-
অর্থাৎ ‘ হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়িব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নিশ্চয় হযরত আলী ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘোষণা করেছেন যে কেউ হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের কাহিনী গল্পগুজবের ন্যায় বর্ণনা করবে, আমি তাকে ১৬০ দোররা মারবো। অর্থাৎ অপবাদের শাস্তি হয়েছে ৮০ দোররা কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্বিগুণ শাস্তি দেওয়া হবে।
এজন্য হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন- যে ব্যক্তি হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের কাসাস সংক্রান্ত হাদীস বা অপবাদ সংক্রান্ত ঘটনা বর্ণনা করবে, আমি তাকে ১৬০ (একশত ষাট) টি বেত্রাঘাত করব। আর এটা হচ্ছে নবীগণ আলাইহিমুস সালামের উপর অপবাদকারীদের শাস্তি।
ফতুহাতে মক্কীয়া নামক কিতাবের সপ্তম বাবে একশত বেত্রাঘাত এর পরে আর পঞ্চাশটি বেত্রাঘাতের কথা উল্লেখ রয়েছে।
ওয়াইজ বা নসিহতকারী বক্তাগণের জন্য লক্ষ্য রাখা উচিত, আল্লাহতায়ালা যেন তাঁদের ওয়াজ ও নসিহতে ফলপ্রসূ দান করেন।
ওয়াইজ বা বক্তাগণ যেন সম্পূর্ণরূপে অমূলক কথা থেকে বিরত থাকেন, যে সমস্ত ঘটনা যা হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ও হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে ইহুদি-নাসারাদের ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করে নবীগণ আলাইহিমুস সালাম এর যাল্লত বা পদস্খলন সংক্রান্ত মিথ্যা ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন এ থেকে বিরত থাকেন।
বক্তাগণের জন্য উচিত হক কথা প্রকাশ করে নবীগণের শান মান বর্ণনা করে তাদের গুণগান বর্ণনা করবেন।
প্রকাশ থাকে যে, হাফেজ আবুল ফেদা ইমামুদ্দিন ইবনে কাসির দামেস্কী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৭৭৪ হিজরি) স্বরচিত সুপ্রসিদ্ধ ‘তাফসিরে ইবনে কাসির’ নামক কিতাবের ৪র্থ খণ্ড ৩১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
قد ذكر المفسرون ههنا قصة اكثرها ماخوذ من الاسرائيليات ولم يثبت من المعصوم حديث يجب اتباعه
অর্থাৎ ‘ এস্থলে তাফসিরকারকগণ এমন একটি কেচ্ছা বর্ণনা করেছেন, যার অধিকাংশই ইসরাঈলী মনগড়া কাহিনী হতে গৃহীত। প্রকৃতপক্ষে এ সম্মন্ধে মা’সুম তথা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে একটি হাদিস ও রেওয়ায়েত করা হয়নি। যার অনুসরণ করা জরুরি হতে পারে।’
অনুরূপ হাফেজ ইবনে কাসির রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বরচিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল বেদায়া ওয়ান নেহায়াহ’ প্রথম ভলিয়ম ২য় জুজ ১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
وهذا ذكر كثير من المفسرين السلف والخلف ههنا قصصا واخبارا اكثرها اسرائيليات ومنها ما هو مكذوب لا محالة تركنا ايرادها فى كتابنا قصدا اكتفاء واقتصارا على مجرد تلاوة القصة من القران العظيم والله يهدى من يشاء الى صراط مستقيم -
অর্থাৎ ‘সলফ ও খলফ বা প্রাচীন ও আধুনিক বহু তাফসিরকারকগণ এস্থলে (দাউদ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে) কয়েকটি গল্প ও কাহিনী নকল করেছেন। তাদের অধিকাংশই ইসরাইলী মনগড়া কাহিনী। এর মধ্যে কতক গল্প তো নিশ্চিতরূপে মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। এ কারণে আমি ইচ্ছা করেই এ সমস্ত অলিক কেচ্ছাগুলি আমার কিতাবে বর্ণনা করিনি। আল্লাহর কালামে ঘটনাটির যতটুকু বর্ণনা রয়েছে, আমিও ততটুকু বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হলাম, আর আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা করেন সরলপথে তাকে পরিচালিত করেন।’
উল্লেখ্য যে, হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের এ ঘটনা জিলহজ্ব মাসে সংঘটিত হয়েছে। মহররম মাসে বা আশুরার দিনে হয়নি। আল্লামা ইসমাইল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতাবের ৮ম জিলদের ১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
(فغفرنا له ذلك) اى ما استغفر منه كان فى شهر ذى الحجة كما فى بحر العلوم -
অর্থাৎ ‘এ ঘটনা সংক্রান্ত ইস্তেগফার সংঘটিত হয়েছিল জিলহজ্জ্ব মাসে যেমন বাহরুল উলুম নামক কিতাবে বর্ণিত আছে।’
অতএব যারা বলেন- আশুরার দিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করেছেন তা একেবারেই অবাস্তব অবান্তর ও ভিত্তিহীন।
মোট কথা হলো
১. হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ইস্তেগফার করেছেন কওমের পক্ষ থেকে নিজের জন্য নয়।
২. আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের মহত্ত্ব ও সম্মান রক্ষার জন্য তার কওমকে ক্ষমা করেছেন।
فداؤد عليه السلام استغفرلهم – اى غفرنا له ذلك الذنب لاجل احترام داؤد ولتعظيمه - تفسير كبيرص۱۹۳ ياره ۲۶ جلد ۱۳
______
জিব্রাইল আলাইহিস সালাম মাহবুবে খোদার শিক্ষক নন
____________________
জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম মাহবুবে খোদার শিক্ষক নন
ফুলতলীর পীর সাহেব ‘খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়া’ ২য় সংস্করণ ৫৭ পৃষ্ঠায় রবিউল আউয়াল চাঁদের চতুর্থ খুৎবায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মু’জিযা প্রসঙ্গে علمه شديد القوى (আল্লামাহু শাদিদুল কুওয়া) আয়াতে কারীমার ভাবার্থকে বিকৃত করে যা লিখেছেন তা নিম্নরূপ-
‘তাকে (নবীকে) সুঠামদেহী শক্তিশালী (জিব্্রাঈল) তা (কোরআন) শিক্ষা দিয়েছেন।’
তার এ বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উস্তাদ বা শিক্ষক এবং আল্লাহর হাবীব হচ্ছেন জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের ছাত্র। (নাউজুবিল্লাহ) এ আক্বিদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
এ প্রসঙ্গে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মু’তাবর বা নির্ভরযোগ্য আক্বাঈদের কিতাব شرح العقائد النسفية (শরহে আক্বাঈদে নাসাফী) নামক কিতাবে মানুষের রাসূল উত্তম না ফেরেশতাদের রাসূল উত্তম শীর্ষক আলোচনায় ইলমে কালাম বা আকাঈদ শাস্ত্রের সুমহান পণ্ডিত আল্লামা সায়াদ উদ্দিস মাসউদ বিন উমর তাফতাজানী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৭৯১ হিজরি) উল্লেখ করেন-
وذهب المعتزلة والفلاسفة وبعض الاشاعرة الى تفضيل الملائكة وتمسكوا بوجوه ... الثانى ان الانبياء مع كونهم افضل البشر يتعلمون ويستفيدون منهم بدليل قوله تعالى علمه شديد القوى ... ولا شك ان المعلم افضل من المتعلم. الجواب : ان التعليم من الله تعالى والملائكة انما هى المبلغون.
ভাবার্থ- বাতিল দলসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মু’তাজিলী এবং দার্শনিক ও আশায়েরা নামধারী কোন কোন ব্যক্তি এই অভিমত পোষণ করেন যে, মানুষের চেয়ে ফেরেশতাগণ উত্তম। তারা এ দাবির স্বপক্ষে কয়েকটি দলিলও পেশ করেছেন। এর মধ্যে তাদের দ্বিতীয় দলিল হচ্ছে- নবীগণ মানুষের মধ্যে আফজল বা উত্তম হওয়া সত্ত্বেও তারা ফেরেশতাদের নিকট হতে শিক্ষালাভ করেন এবং এতে উপকৃতও হয়ে থাকেন। মু’তাজিলী ও দার্শনিক তাদের এ দাবি প্রমাণ করতে গিয়ে علمه شديد القوى (আল্লামাহু শাদিদুল কুওয়া) এ আয়াতে কারীমার বিকৃত অর্থ করে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উস্তাদ বা শিক্ষক বানাতে চায় এবং তারা যুক্তি পেশ করে বলে- لا شك ان المعلم افضل من المتعلم নিঃসন্দেহে শিক্ষক ছাত্র থেকে উত্তম। জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে শিক্ষক ও আল্লাহর হাবীবকে ছাত্র বানানোর পায়তারা করে নবী থেকে জিব্রাঈলকে উত্তম ঘোষণা দিয়ে নবীর সুমহান মর্যাদাকে ক্ষুণœ করেছে। মু’তাজিলী ও দার্শনিকদের উপরোক্ত দলিলগুলি যে ভ্রান্ত এবং আয়াতে কারীমার যে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে এর খণ্ডন করতে গিয়ে আল্লামা তাফতাজানী এই কিতাবে উল্লেখ করেন-
الجواب : ان التعليم من الله تعالى والملائكة انما هى المبلغون. (شرح العقائد النسفية)
অর্থাৎ ‘মু’তাজিলী ও দার্শনিকদের উক্তি ভ্রান্ত। আয়াতে কারীমার সঠিক ভাবার্থ ও ইসলামী সঠিক আক্বিদা হলো নিশ্চয় এখানে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর ফেরেশতাগণ শুধু পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।’ ইহাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বিশুদ্ধ অভিমত।
আল্লাহর হাবীবকে ছাত্র এবং জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে শিক্ষক খুতবায় লিপিবদ্ধ করা এবং মুসল্লিয়ানদেরকে ইমাম সাহেবানগণ পড়িয়ে শুনানো যে কত বড় মারাত্মক অপরাধ তা ঈমানদার মুসলমানগণ নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলেই সঠিক মাসআলা বুঝতে সক্ষম হবেন।
প্রকাশ থাকে যে, জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর হাবীবকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন বলে দাবি করা বিদআতী, মু’তাজিলী ও ভ্রান্ত দার্শনিক সম্প্রদায়ের আক্বিদা, সুন্নি আক্বিদা নয়।
উল্লেখ্য যে, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম নিজেই উক্তি করেছেন كيف علمت مالم اعلم (ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি যা জানি না আপনি তা কেমন করে জানলেন?) এ প্রসঙ্গে আল্লামা শায়খ ইসমাঈল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতাবের পঞ্চম জিলদের ৩১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
ما روى فى الاخبار ان جبريل عليه السلام نزل بقوله تعالى (كهيعص) فلما قال كاف قال النبى عليه السلام (علمت) فقال ها فقال (علمت) فقال يا فقال (علمت) فقال عين فقال (علمت) فقال صاد فقال (علمت) فقال جبريل كيف علمت مالم اعلم.
অর্থাৎ ‘বিশিষ্ট তাফসিরকারক আল্লামা ইসমাইল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু كهيعص (কাফ, হা, ইয়া, আইন, ছোয়াদ) এর শানে নুযুল প্রসঙ্গে একখানা সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ওহী নিয়ে আল্লাহর হাবীবের দরবারে এসে যখন বললেন- كاف (কাফ) তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- علمت (আলিমতু) আমি বুঝে গেছি। যখন তিনি বললেন ها (হা) আল্লাহর হাবীব বললেন- علمت আমি বুঝে গেছি। যখন তিনি বললেন- يا (ইয়া) আল্লাহর হাবীব বললেন علمت আমি বুঝে ফেলেছি। যখন তিনি বললেন عين (আইন) হাবীবে খোদা বললেন علمت আমি বুঝেছি। যখন তিনি বললেন- صاد (ছোয়াদ) তখন মাহবুবে খোদা বললেন علمت আমি বুঝেছি।
অতঃপর জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আরজি পেশ করলেন كيف علمت مالم اعلم ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনি কেমন করে এ হরূফে মুকাত্তায়াত এর অর্থ বুঝে ফেললেন যা আমি জিব্রাঈল আমিন এর অর্থ সম্মন্ধে অবগত নই। অর্থাৎ আমি ওহী নিয়ে আসলাম অথচ আমি এ হরূফে মুকাত্তায়াতের অর্থ জানি না আপনি পূর্ব থেকেই জানেন? (সুবহানাল্লাহ)
উপরোল্লেখিত হাদিসভিত্তিক তাফসিরের আলোকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহপাক কোন মাধ্যম ছাড়াই কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আল্লাহর হাবীবের দরবারে ওহী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। দেখুন পূর্বেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বাঈদের গ্রহণযোগ্য কিতাব শরহে আক্বাইদে নাসাফীর এবারত উল্লেখ করা হয়েছে-
ان التعليم من الله تعالى والملائكة انما هى المبلغون.
কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়েছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এবং ফেরেশতাগণের শুধুমাত্র পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা
মানুষের রাসূলগণ ফেরেশতার রাসূলগণ হতে আফজল বা উত্তম
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মু’তাবর বা গ্রহণযোগ্য ‘শরহে আকাইদে নসফী’ নামক কিতাবে এ বিষয়ে দলিলভিত্তিক সবিস্তার আলোচনা করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ-
ورسل البشر افضل من رسل الملائكة ورسل الملائكة افضل من عامة البشر وعامة البشر من عامة الملائكة ... واما تفضيل رسل البشر على رسل الملائكة وعامة البشر على عامة الملائكة فبوجوه ... الثانى ان كل واحد من اهل اللسان يفهم من قوله تعالى وعلم ادم الاسماء كلها الاية ان القصد منه الى تفضيل ادم على الملائكة وبيان زيادة علمه واستحقاقه التعظيم والتكريم -
অর্থাৎ ‘মানুষের রাসূলগণ ফেরেশতার রাসূলগণ হতে উত্তম অপরদিকে সাধারণ মানুষ হতে ফেরেশতার রাসূলগণ উত্তম এবং সাধারণ মানুষ সাধারণ ফেরেশতা হতে উত্তম।
উল্লেখ্য যে, মানুষের রাসূল ফেরেশতার রাসূল হতে যে উত্তম এবং সাধারণ মানুষ সাধারণ ফেরেশতা হতে উত্তম হওয়া বিভিন্ন দলিল আদিল্লাহ দ্বারা প্রমাণিত।
ফেরেশতার রাসূল হতে মানুষের রাসূল যে উত্তম তার দ্বিতীয় দলিল হচ্ছে- প্রত্যেক ভাষাবিদ আল্লাহ তায়ালার কালাম علم ادم الاسماء كلها الاية (আল্লাহ তায়ালা আদম আলাইহিস সালামকে সকল বস্তুর নাম শিখিয়ে দিয়েছেন) এই কালাম দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, তার উদ্দেশ্য ছিল হযরত আদম আলাইহিস সালামকে ফেরেশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা এবং হযরত আদম আলাইহিস সালামের ইলিম বা জ্ঞান যে ফেরেশতাদের চাইতে অধিক এ প্রমাণ করা এবং এ কারণেই তিনি সিজদা ও সম্মানের উপযুক্ত হয়েছেন সাব্যস্ত করা।’
উপরোল্লেখিত দলিলের ভিত্তিতে আল্লাহতায়ালা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সকল বস্তুর নাম শিখিয়ে দিয়েছেন, এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল, হযরত আদম আলাইহিস সালামের উস্তাদ বা শিক্ষক হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত জিব্্রাঈল আলাইহিস সালাম নন এবং এর দ্বারা তাও প্রমাণিত হল হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামসহ সমস্ত ফেরেশতাগণের চেয়ে হযরত আদম আলাইহিস সালামের ইলিম অধিক।
সূরা আন নজমের ৫নং আয়াত علمه شديد القوى (আল্লামাহু শাদিদুল কুওয়া) এর সঠিক অনুবাদ ও তাফসির নিম্নরূপ-
আলা হযরত আল্লামা শাহ আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় ‘কানযুল ঈমান ফি তরজমাতিল কোরআন’ তরজমা করেছেন এরুপ-
انھیں سکھا یاسخت قوتوں والے طاقتورنے
তরজমা: ‘তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন প্রবল শক্তিসমূহের অধিকারী।’
অর্থাৎ প্রবল শক্তিসমূহের অধিকারী যাকে কোরআনের ভাষায় বলা হয়েছে شديد القوى (শাদিদুল কুওয়া) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিক্ষা দিয়েছেন।
‘শাদিদুল কুওয়া’ দ্বারা মুরাদ আল্লাহ তায়ালা না জিব্রাঈল আমীন, এ নিয়ে মুফাসসিরীনে কেরাম বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। একদল মুফাসসিরীনে কেরাম شديد القوى (শাদিদুল কুওয়া) দ্বারা আল্লাহ তায়ালা মুরাদ নিয়েছেন। অপরদিকে অন্য একদল মুফাসসিরীনে কেরাম ‘শাদিদুল কুওয়া’ দ্বারা জিব্রাঈল আমীনকে মুরাদ নিয়েছেন।
যারা ‘শাদিদুল কুওয়া’ দ্বারা আল্লাহ মুরাদ নিয়েছেন:
তাফসিরে জালালাইন শরীফ ৪৩৭ পৃষ্ঠা ১৬ নং হাশিয়া বা পার্শ্বটীকায় উল্লেখ রয়েছে-
قوله علمه شديد القوى الخ قال الحسن البصرى رحمه الله وجماعة علمه شديد القوى اى علمه الله وهو وصف من الله نفسه بكمال القدرة والقوة –
অর্থাৎ হযরত হাসান বসরী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও একদল মুফাসসিরীনে কেরাম شديد القوى ذومرة (শাদিদুল কুয়া জুমিররাতিন) আয়াতে কারীমার তাফসিরে বলেছেন, এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালার কথা বুঝানো হয়েছে। তিনি স্বীয় জাতকে এ গুণ দ্বারা উল্লেখ করেছেন কেননা তিনি অসীম কুদরত ও অসীম শক্তির অধিকারী। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন মাধ্যম ছাড়াই শিক্ষা দিয়েছেন।
অনুরূপ تفسير الحسن البصرى (তাফসিরে হাসান বসরী) (ওফাত ১১০ হিজরি) ৫ম জিলদের ৮২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
(علمه شديد القوى) الاية ۱۵۵۹ قال الحسن : اى : الله تعالى قوله تعالى : (ذومرة) الاية ۱۵۶ – قال الحسن : (ذومرة) ذوقوة من صفات الله تعالى -
অর্থ ‘ علمه شديد القوى(আল্লামাহু শাদিদুল কুয়া) এ আয়াতের মর্মে ইমাম হাসান বসরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- এ দ্বারা মুরাদ আল্লাহ তায়ালা এবং তিনি আরও বলেন ذومرة (প্রবল শক্তিশালী) দ্বারা আল্লাহর সিফাত বা গুণ বুঝানো হয়েছে।
হাসান বসরী এবং তাফসিরের আলোকে আয়াতে কারীমার ভাবার্থ হল এই- আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন মাধ্যম ছাড়াই শিক্ষা দিয়েছেন।
পক্ষান্তরে যারা شديد القوى (শাদিদুল কুয়া) দ্বারা জিব্রাঈল আমীন মুরাদ নিয়েছেন:
মুফতিয়ে বাগদাদ আল্লামা আবুল ফজল শাহাবুদ্দিন সৈয়দ মাহমুদ আলুছী বাগদাদী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১২৭০ হিজরি) তদীয় তাফসিরে রুহুল মায়ানী নামক কিতাবের ৯ম জিলদের ২৭ পারা ৪৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
(شديد القوى) هو جبريل عليه السلام كما قال ابن عباس وقتادة والربيع – فانه الواسطة فى ابداء الخوارق –
অর্থাৎ ‘ইবনে আব্বাস, কাতাদা ও রাবী রেদওয়ানুল্লাহী আলাইহিমুস সালাম আজমাঈন মুফাসসিরগণ شديد القوى (শাদিদুল কুয়া) আয়াতে কারীমার তাফসিরে বলেছেন, এর দ্বারা হযরত জিব্রাঈল আমীনের কথা বুঝানো হয়েছে। কেননা অলৌকিকতা প্রকাশের ক্ষেত্রে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মধ্যস্থতা রয়েছে।’
মুদ্দাকথা হল হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কোরআন নাজিল করেছেন অথবা আল্লাহ তায়ালা হযরত জিব্রাঈল আমীনের মাধ্যমে তাঁর হাবিবের ক্বলব মোবারকে ইলহাম পৌছিয়ে দিয়েছেন। এখানে تعليم (তা’লিম) تبليغ (তাবলীগ) তথা পৌঁছানো অর্থে প্রযোজ্য। অথবা এ অর্থও হতে পারে জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর হাবিবকে কোরআন জানিয়ে দিয়েছেন। আয়াতে কারীমায় বর্ণিত ( আল্লামা) শব্দের অর্থ জিব্রাঈল আমীন শিক্ষা দিয়েছেন এরূপ অর্থ করা সঠিক নয়।
‘তানভীরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবনে আব্বাস’ নামক কিতাবের ৪৪৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে (علمه) اى اعلمه جبريل অর্থাৎ ‘হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর হাবিবকে কোরআন জানিয়ে দিয়েছেন।
এখানে শিক্ষা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়নি বরং জানিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রখ্যাত মুফাসসিরে কোরআন আল্লামা শায়খ ইসমাইল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতাবের নবম জিলদের ২১৪ পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতে কারীমা علمه شديد القوى (আল্লামাহু শাদিদুল কুয়া) এর তাফসিরে উল্লেখ করেছেন-
(علمه) اى القران الرسول اى نزل به عليه وقراه عليه وبينه له هذا على ان يكون الوحى بمعنى الكتاب وان كان بمعنى الالهام فتعليمه بتبليغه الى قلبه فيكون كقوله نزل به الروح الامين على قلبك (شديد القوى) من اضافة الصفة الى فاعلها مثل حسن الوجه والموصوف محذوف اى ملك شديد قواه وهو جبريل فانه الواسطة فى ابداء الخواق –
ভাবার্থ: ‘হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কোরআন নাজিল করেছেন, এবং ইহা তেলাওয়াত করেছেন তদুপরি তাঁর জন্য ইহা বর্ণনাও করেছেন। যদি ওহী দ্বারা মুরাদ কিতাব হয়ে থাকে। আর যদি ওহী দ্বারা ইলহাম মুরাদ হয়, তাহলে تعليم (তালীম) শব্দটি تبليغ (তাবলীগ) বা পৌঁছিয়ে দেওয়ার অর্থে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্বলব মোবারকে ইলহাম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালার বাণী- نزل به الروح الامين على قلبك ইহাকে (কোরআনে কারীমকে) রুহুল আমীন (হযরত জিব্রাঈল আমীন) আপনার (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) ক্বলব মোবারকের উপর অবতরণ করেছেন।
شديد القوى(শাদিদুল কুয়া) দ্বারা মুরাদ হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম কেননা অলৌকিকতা প্রকাশের ক্ষেত্রে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মধ্যস্ততা রয়েছে।’
আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবিবকে নিজেই শিক্ষা দিয়েছেন, আল্লাহর বাণী- خلق الانسان علمه البيان এ আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় تفسير معالم التنزيل নামক কিতাবের ৪র্থ জিলদের ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
قال ابن كيسان : خلق الانسان يعنى محمدا صلى الله عليه وسلم علمه البيان يعنى بيان ما كان وما يكون لانه كان يبين عن الاولين والاخرين وعن يوم الدين –
অর্থাৎ ‘প্রখ্যাত মুফাসসির ইবনে কায়সান বলেন- আল্লাহ তা’য়ালা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ما كان وما يكون যা হয়েছে এবং যা হবে এ সব ইলিম আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর হাবীবকে শিক্ষা দিয়েছেন কেননা তিনি (আল্লাহর হাবীব) পূর্ববর্তী ও পরবর্তী এমনকি কিয়ামতের ঘটনাবলী সবিস্তার বর্ণনা করেছেন।’
মুদ্দাকথা হলো হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন বলে, বাংলা ভাষায় লিখে যারা প্রচার করছেন, তারা মারাত্মক ভুলের মধ্যে রয়েছেন। কারণ ইহা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিদআতী মু’তাজিলী ও বাতিল দার্শনিকদের ভ্রান্ত আক্বিদা।
কিতাবুল ফেকহে আ’লা মাজাহিবিল আরবায়া’ নামক কিতাবের ৫ম জিলদের ৪২২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
ويكفر ان عرض فى كلامه بسب نبى او ملك ... او الحق بنبى او ملك نقصا – ولو ببدنه – كعرج وشلل- اور طعن فى وفور علمه- اذ كل نبى اعلم اهل زمانه- وسيدهم صلى الله عليه وسلم اعلم الخلق اجمعين- او طعن فى اخلاق نبى او فى دينه – ويكفر اذا ذكر الملائكة بالاوصاف القبيحه- او طعن فى وفور زهد نبى من الانبياء عليهم الصلوة والسلام – كتاب الفقه على مذاهب الاربعة ص ۵/۴۲۲
অর্থাৎ ‘যদি কারও বক্তব্যে কোন নবী অথবা কোন ফেরেশতার প্রতি গালী প্রকাশ পায় তবে সে ব্যক্তি কাফের হবে।...
নবী অথবা ফেরেশতার সাথে যদি কেহ কোন ত্রুটি সংযুক্ত করে, যদিও তা নবীর পবিত্র শরীর মোবারকের প্রতি কোন ঘৃণিত রোগের প্রতি আরোপ করে যেমন খোঁড়া ও প্রতিবন্ধী ইত্যাদি অথবা কোন সম্মানিত নবীর পূর্ণাঙ্গ ইলিমের অবজ্ঞা করে এমতাবস্থায়ও সে কাফের হবে। কেননা প্রত্যেক নবী তাঁর যুগের অধিক ইলিমের অধিকারী হয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে নবীদের সর্দার হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। (অমান্যকারীগণ কাফের সাব্যস্ত হয়)
অথবা কোন নবীর চরিত্রের বা দ্বীনের উপর কালিমা লেপন করে। এমতাবস্থায়ও সে কাফের হবে। এমনকি যদি কোন ফেরেশতাকে মন্দ কাজের দ্বারা অভিহিত করে অথবা নবীগণের মধ্যে কোন নবীর অধিক বন্দেগীর উপর সমালোচনা করে, সেও কাফের হবে।
‘আশ শিফা বি তা’রীফে হুকুকিল মোস্তফা’ নামক কিতাবের দ্বিতীয় জিলদের ২১৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
من سب النبى صلى الله عليه وسلم او عابه او الحق به نقصا فى نفسه او نسبة او دينه او خصلة من خصاله او عرض به او شبهه بشى على طريق السب له او الا زراء عليه او التصغير لشانه او الغض منه والعيب له فهو ساب له والحكم فيه حكم الساب يقتل كما نبينه -
তরজমা : ‘যে ব্যক্তি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দ করবে অথবা দোষারূপ করবে অথবা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সত্তায় বা বংশে বা ধর্মে, বা তাঁর মহান চরিত্রাবলীর মধ্যে কোন চরিত্রে কোন প্রকার ত্রুটিযুক্ত করবে অথবা তাঁর মহান শান ক্ষুন্ন করবে অথবা এমন কথা বলবে যা তাঁর শানে গালির সাথে সামাঞ্জস্য রাখে অথবা তাঁর প্রতি কোন ত্রুটির বুঝা চাপাইয়া দিবে অথবা তাঁর মহান শানকে খাটো করবে অথবা তাঁর থেকে অনীহা প্রকাশ করবে ও তাঁর প্রতি দোষারোপ করবে এমতাবস্থায় সে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালিদাতা হিসেবে গণ্য হবে এবং তার হুকুম গালিদাতার হুকুমের অন্তর্ভূক্ত হবে, এরূপ গালিদাতাকে হত্যা করতে হবে যেমন আমরা এ বিষয়ে ইতোপূর্বে বর্ণনা করেছি।’ (শিফা শরীফ ২/২১৪ পৃ:)
______
Comments
Post a Comment