আযানের আগে সালাতু-সালাম
যুগান্তকারী দাঁতভাঙা ফত্ওয়া
আযানের আগে সালাত-সালাম
মূল: ছাহেবজাদা আল্লামা মুফতি ইকতেদার আহমদ খাঁন নঈমী,কাদেরী বদায়ুনী শায়খুল হাদিস ও মুফতি, দারুল উলুম গাউছিয়া নঈমিয়া গুজরাট, পাকিস্তান।
বঙ্গানুবাদ: মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন
অধ্যক্ষ, বুড়িশ্চর জিয়াউল উলুম ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
টেক্সট রেডীঃ মুহাম্মদ আব্দুল খালেক
প্রাকালাপ
'দরূদ শরীফ', আল্লাহ(ﷻ)এর দরবারে নিশ্চিত গ্রহণোপযোগী একটি এবাদতের নাম। কারণ এ কাজটি আল্লাহ(ﷻ) নিজেই করেন, ফেরেস্তাদের সাথে নিয়ে। সাথে সাথে আদেশ জারী করে তিনি আরো বলেন,ওহে মুমিনগণ! তোমরাও ঐ নবী (মুহাম্মদﷺ)এর প্রতি দরূদ আর সালাম যথার্থভাবে প্রেরণ কর। উল্লেখ্য যে, আদেশটি জারীর ক্ষেত্রে কোন প্রকার স্থান, কাল বা সময়ের শর্তারোপ করা হয়নি। ফলে আদেশটি সাধারণভাবে সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য বলে স্বীকৃত। তাই সকালে হবে বিকালে নয়, আগে হবে, পরে নয় বা পরে হবে আগে নয় ইত্যাকার শর্তারোপ করা কুরআনী আদেশের উপর বাড়াবাড়ি করার শামিল। ফিকাহ-ফতওয়ার আলোকে নিষেধ হিসাবে স্থান ও কাল বা সময় ছাড়া সব সময়ে দরূদ শরীফ পাঠ করা বৈধ ও উত্তম। তথাপি কেউ কেউ আযানের আগে সালাত সালামের বিরুদ্ধে এমনভাবে মেতে উঠে, মনে হয় যেন দরূদ শরীফের বিরোধীতা করার জন্যই তাদের জম্ম হয়েছে। তারা বেমালুম ভুলে যায় শরীয়তের আলোকে না জায়েয প্রমাণের জন্য দলীল চতুষ্ঠয়ের কথা। শুধু এ বলেই আর্তনাৎ করে যে,আযানের আগে সালাত-সালাম এটা একটি নব আবিষ্কার, যা নবীর যুগসহ কোন যুগেই ছিল না, তাই জঘন্য বেদয়াত। আসলে এহেন দূর্বল উক্তি কেবল মূর্খ লোকদের মুখেই মানায়। কারণ কোন বিষয়ের বিরুদ্ধে শরীয়তের অকাট্য দলীল পাওয়া না যাওয়া পর্যন্ত বিষয়টি প্রথমত: জায়েয হিসেবে স্বীকৃত। এটা সর্ব মজহাব মতে একটি অনুমোদিত নীতিমালা।
পাকিস্তানের সর্বজন মান্যবর আলেমে দ্বীন, হাকীমুল উম্মত, মুফতি আহমদ এয়ার খাঁন নঈমী রহমাতুল্লাহে আলাইহি'র ছাহেবজাদা মুহাক্কিক-ই-জামান, শায়খুল হাদিস ওয়াল ফিকহ্ মুফতি ইকতিদার আহমদ খান নঈমীর উক্ত বিষয়ে প্রণীত যুগান্তকারী অকাট্য ফতওয়া বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীকে পথের দিশা যোগাতে সাহায্য করবে এ আশায় তা বাংলায় অনুবাদ করি। সকলের জন্য বুঝতে সহজ করে তোলার জন্য অনুবাদের ভাষাকে সহজ ও সরল করার চেষ্টা করা হয়েছে। তথাপি মানুষ হিসাবে ভুল-ভ্রান্তি অস্বাভাবিক নয়। তার সাথে থাকতে পারে মুদ্রণগত বিভ্রাট। এসব কারণে কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি যদি কারো দৃষ্টি গোচরিত হয় তা জানিয়ে কৃতার্থ করবেন - এ আশা করি। পুস্তিকাটি সকলের কাছে সমাদৃত হলে অধমের কষ্ট সার্থক হয়েছে বলে মনে করব। আল্লাহ্ (ﷻ)ই প্রতিদানের মালিক।
---অনুবাদক
সওয়াল
ইদানিংকালে রেডিও পাকিস্তান লাহোর থেকে প্রায় দুপুর বেলায় একটি প্রোগ্রাম প্রচার করা হয়। যার শিরোনাম হল 'হাইয়্যা আলাল্ ফালাহ্'। নাম হল তার হাইয়্যা আলাল্ ফালাহ্, কিন্তু শুনলে মনে হয় যে, খাঁটি ওহাবিয়াতের প্রচারণার পাঠশালা। ওহাবিয়াতের যত মূর্খতার আক্বিদা আছে, সময়ে সময়ে তার প্রচার করা হয়। কখনো নাতে রসুল(ﷺ)এর বিরোধিতা প্রচারিত হয়, কখনো দরূদ শরীফের বিরোধীতায় প্রবন্ধ পাঠ করা হয়। 🔊 বক্তা অত্যন্ত বেয়াদবীমূলক ভঙ্গিতে তার বক্তব্য রেখে যায়। কিছু দিন থেকে আযানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করা নিয়ে নাজায়েজের ফতওয়া বার বার শুনানো হচ্ছে। আবার কখনো কখনো উদ্যতপূর্ণ ভাষায় গুনাহ বলেও ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। অথচ সবাই জানে যে, পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত তথা দরূদ শরীফ পাঠকারীদের অন্তর্ভূক্ত। দৃষ্টান্ত হিসাবে অধিকাংশ মসজিদে আজানের আগে দরূদ শরীফ পাঠের আওয়াজ শুনে সেই সংখ্যাধিক্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু আঠার মধ্যে লবণ সম কিছু ওহাবী উক্ত রেডিও ষ্টেশন থেকে মনে আঘাতজনক আলোচনা প্রচার করে নিজেদের দুঃশ্চরিত্রের প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। তাই হুযুর সমীপে আযানের আগে আযানের নির্দিষ্ট শব্দাবলী ছাড়া অন্য কোন যিকির বা দোয়া, কিংবা দরূদ শরীফ পাঠ করা যায় কিনা মর্মে প্রামাণ্য দলীল দ্বারা ফতওয়া প্রদান করার জন্য বিনীত ভাবে আরজ রাখছি। তাছাড়া প্রথম যুগে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় কি-না, তাও জানিয়ে বাধিত করবেন। বিরোধীতাকারীদের নিকট নিম্নের কয়েকটি দলিল রয়েছে-
১। আযানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করা আযান বৃদ্ধি করার শামিল। তাই আযানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করা গুনাহ্।
২। আযানের আগে কোন প্রকারের যিকির করার প্রমাণ কোরান হাদিসে কোথাও নেই।
৩। আল্লাহ আকবর দ্বারা আযানের সূচনা হওয়া উচিত। অন্য কোন কিছু দ্বারা নয়।
এসব কথা-বার্তা ছাড়া ওহাবীদের নিকট আযানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করা নাজায়েজ বলার আর কোন দলীল নেই। কিন্তু তারা মনে করে যে, শরীয়ত তাদের ঘরনা বিষয়। আমি পীর করম শাহ আযহারী থেকে মৌখিকভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বলেছেন, আযানের আগে দরূদ শরীফ না পড়া চায়। কারণ এর কোন প্রমাণ নেই। আপনি আমাদের জন্য দলীল ভিত্তিক ফতওয়া প্রদান করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বাধিত করুন।
জবাব
نَحٛمَدُهُ وَ نُصَلَّی عَلَی رَسُوٛلِهِ النَّبِیِّ الٛکَرِيٛمُ
হামদ ও সালাত নিবেদনের পর অধম ফকীর ইকতিদার বদায়ূনী কাদেরী নঈমী রেজভী আরজ করছি যে, ছওয়াবের আলোকে মুসলিম সমাজ তথা ইসলামে তামাম এবাদতের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট এবাদত হল দরূদ শরীফ পাঠ করা। আশেকীন শীর্ষ ব্যক্তিরা বলেন, পাঞ্জেগানা নামাযসহ সুন্নাত-নফলও আবশ্যক হয়েছে কেবল সালাত-সালামের জন্যেই। এমন কি নামাযের নামটাও রাখা হয়েছে সালাতুন্নবী(ﷺ)'র তত্ত্ব ও উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করার লক্ষ্যে। ইসলামী দুনিয়ায় এমন কোন নেকী কাজ নেই; যার সূচনা নবী করীম(ﷺ)'র পবিত্র নাম তথা দরূদ শরীফ ব্যতীত হয়। তবে জবেহ্ করার ক্ষেত্রটাই শুধু তার ব্যতিক্রম। কারণ এক্ষেত্রটা হল প্রচন্ডতা ও ক্রোধের। এ যুগের ওহাবীদের প্রতি বলা যায়, তারা কেবল রাহমাতুল্লীল আলামীন, রাহাতুল আশেকীন, নবী আকরম(ﷺ)'র প্রতি দুশমনী ও বেয়াদবীই লালন করছে। কারণ তারা ঘৃণ্য থেকে ঘৃণ্যতর স্মরণ-আলোচনা পছন্দ করতে পারে। কিন্তু যিকরে মোস্তফার প্রসঙ্গ আসলে তাদের উপর মৃত্যু নাযিল হয়। শিরক ও কুফরী ছাড়া আর কিছুই তাদের নজরে পড়ে না। একইভাবে রেডিও লাহোরও মূর্খ ওহাবীদের মূর্খতার প্রচার ও প্রসার করে যাচ্ছে কেবল ফেরকাবন্দীকে উস্কে দেয়ার কুমতলবে। এসব অনর্থক প্রচারণায় আহলে সুন্নাত মতাদর্শীদের মনে দুঃখ ও বেদনা সৃষ্টি হচ্ছে ঠিক, কিন্তু আকা(ﷺ)'র পবিত্র নামের চর্চাকে কখনো দমিয়ে রাখা যাবে না। দেওবন্দী মূর্খরা দরূদ শরীফের স্বপক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী সূত্রে প্রমাণ দাবী করে। নচেৎ আল্লাহ (ﷻ)এর হাবীবের শানে পঠিত নাত বা প্রশংসা সূচক সঙ্গীতের জন্য তাদের ব্যথা অনুভূত হয়। তাই সদা সর্বদা তারা প্রমাণ প্রমাণ বলে আহাজারী করতে থাকে। অথচ আজকাল হাজার রকমের এমন সব কর্মকাণ্ড তারা করে যাচ্ছে, পূর্বেকার কোন যুগেই যার কোন অস্তিত্ব ছিল না। তথাপি এসব কিছুকে তারা দ্বীনি কাজ হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছে। প্রতিটি কাজের স্বপক্ষে প্রমাণের জন্য তারা যদি এত ব্যাকুল হয়ে থাকে; তাহলে তাদের উচিত যে, বর্তমান মসজিদগুলোর শক্ত ও মজবুত পিলার, মারবেলের টাইলস, ইলেকট্রিক্যাল ফ্যানের স্বপক্ষে তাদেরকে প্রমাণ পেশ করা কিন্তু কোন দিনই তার কোন প্রমাণ তারা পেশ করতে পারবে না। তাহলে কথিত ঐসব প্রমাণ পাগল ওহাবীদের জন্য উচিত যে, তাদের ঐসব প্রমাণহীন বেদয়াতি মসজিদগুলো ভেঙে ফেলা। কিন্তু গোটা পৃথিবীবাসী জানে যে, ঐসব ওহাবী বেদয়াতিদের সকল কর্মকান্ড প্রমাণহীন হওয়া সত্ত্বেও চলে যাচ্ছে। তজ্জন্য শিরক, কুফর আর বেদয়াত কিছুই হয় না, শান-এ রেসালাতের প্রসঙ্গ আসলেই তাদের মাথা ব্যথা শুরু হয়। সুতরাং প্রমাণ হয়ে গেল যে, মূলতঃ প্রমাণের প্রতি ঐসব জালেমদের কোন আকর্ষণ নেই। তারা মূলত: যিকরে মোস্তফা(ﷺ)'র দুশমন। যিকরে মোস্তফাকে বন্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু গোটা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করছে যে, যিকরে মোস্তফা (ﷺ) দিনের পর দিন প্রসারিত হচ্ছে। মহান আল্লাহ(ﷻ)'র প্রশংসা করে বলছি যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নিকট প্রত্যেক মাসআলার ও সকল আমলের উপর দলীল-দালায়েল মওজুদ আছে। আমাদের কাছে প্রমাণের অভাব নেই। প্রমাণহীন অভদ্র প্রজন্ম হল তারাই। আমরা সুন্নীরা সর্বদৃষ্টিকোণে আমাদের মযহাব তথা আক্বীদা আমলের উপর দলীল পেশ করতে সক্ষম। মুছিবত হল সেই সব মূর্খদের নিয়ে, যারা বেপরোয়াভাবে যেমন তেমন কথা বলে, অথচ কোন কিছুরই প্রমাণ পেশ করতে পারে না; যেভাবে আহলে সুন্নাতের সর্বপ্রকার কর্মকান্ড প্রমাণ ভিত্তিক বিদ্যমান। তদ্রুপ আযানের আগে বড় আওয়াজে মাইকে কিংবা মাইক ছাড়া দরূদ শরীফ পাঠ করাও সর্বোতভাবে জায়েজ আছে। যারা বিরোধীতা করে তারা ইবলিসের বান্দা এবং মূর্খ। দুশমনির বিদ্বেষ চর্চা করতে গিয়েই তারা কেবল বিরোধীতা করে থাকে।
*আযানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করার বৈধতার স্বপক্ষে আটটি দলিল রয়েছে।
1️⃣প্রথম দলিল:
আল্লাহ(ﷻ) এরশাদ ফরমান:
اِنَّ اللهَ وَ مَلَاءِكَتَهُ يُصَلُّوٛنَ عَلَى النَّبِیّ يَاَ أَيُّهَا الَّذِيٛنَ اٰمَنُوٛا صَلُّوا عَلَيٛهِ وَسَلِّمُوٛا تَسٛلِيٛمًا
তরজুমা: নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা (ﷻ) ও তার ফেরেশতাকুল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ)এর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন, ওহে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর (ﷺ)'র প্রতি দরূদ পড় এবং যথার্থরূপ সালাম নিবেদন কর। (সুরা আহজাব, আয়াত ৫৬)
এটা একটি জেনারেল নির্দেশ। জেনারেল কোন বিষয় সর্বদা জেনারেল অর্থেই প্রযোজ্য হয়। কারো কোন ক্ষমতা নেই যে, এটার সাথে শব্দের হউক কিংবা সময়ের হউক কোন ধরনের কন্ডিশন আরোপ করা। বর্ণিত আয়াত দ্বারা জেনারেল আদেশ দানের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়ে গেল যে, কামিল ত্বরীকায় দরূদ শরীফ সর্বপ্রকার শব্দাবলী দ্বারা সব সময় পাঠ করা জায়েজ। আযানের আগে হউক বা আযানের পরে হউক কোন প্রভেদ নেই। যে সব দরূদ শরীফে সালাতের সাথে সাথে সালামও আছে, উহাই কামেল দরূদ শরীফ। যে দরূদ শরীফে সালাম নেই, তা কামেল নয়। এসব দরূদ শরীফ পাঠ করা নিষেধ। এ কারণে নামাযে পঠিত দরূদে ইব্রাহিমী কামেল দরূদ নয়। তাই এটা নামাযের বাহিরে পাঠ করা জায়েজ নেই। তবে হ্যাঁ, নামাযের মধ্যে এ জন্যেই জায়েজ যেহেতু তদপূর্বে সালাম পঠিত হয়ে গেছে। তাফসীরে রুহুল বয়ানে একাদশ খন্ডে বাইশ পারা ৮৩৭ পৃষ্ঠায় লিখা আছে যে-
وَاسٛتَدَلَّ النُّوَوىٛ رَحَمَهُ اللهُ تَعَالٰى بِالٛاَيَةِ عَلٰى كَرَاهَةِ اِفٛرَادِ الصَّلٰوةِ عَنِ السّلَامِ وَعَكٛسِهِ لِوُرُوٛدِ الٛاِمٛرِبِهِمَا مَعًا فِيٛهَا
অর্থাৎ : ইমাম নববী (রহমাতুল্লাহে আলাইহি) দরূদ শরীফের আদেশ বিষয়ক উক্ত আয়াত থেকে দলিল গ্রহণ করেছেন যে, সালামবিহীন দরূদ শরীফ পাঠ করা মাকরূহ তাহরিমী। তেমনি তার বিপরীত করাও মাকরূহ। অর্থাৎ সালাত ছাড়া কেবল সালামের দরূদ পড়াও নিষেধ। মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকারী ইমাম নববী রহমাতুল্লাহে আলাইহি তাঁর রচিত কিতাবের ১৭৫ পৃষ্ঠায় একটি বিশুদ্ধ হাদিস নকল করেছেন, তাতে সাহাবায়ে কেরাম দরূদ শরীফের ব্যাপারে একটি সওয়াল আরজ করেছিলেন যে, আমরা নামাযে দরূদ শরীফ কোনটি পাঠ করবো? নবী করীম(ﷺ)সাহাবীদের দরূদে ইব্রাহিমীর তালিম দিয়েছিলেন। এছাড়া অন্য যে কোন সময়, এমনকি আযানের আগেও সর্ব-প্রকারের দরূদ শরীফ পাঠ করা জায়েয। উপরন্তু কুরআন মজিদের উক্ত আয়াত দ্বারা সাধারণ আদেশ দানের দাবীও তাই।
2️⃣দ্বিতীয় দলিল
মেশকাত শরীফের আযান অধ্যায়ে ৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে-
عَنٛ عَبٛدِ اللهِ بٛنِ عَمَرِو ابٛنِ الٛعَاصِ قَالَ قَالَ رَسُوٛلُ اللّٰهِ(ﷺ)
اِذَ سَمِعٛتُمُ الٛمُؤَذِّنَ فَقُوٛلُوٛ مِثٛلَ مَا يَقُوٛلُ ثُمَّ صَلُّوٛ عَلَىَّ
তরজুমা : হে মুসলমানেরা! যখন তোমরা আযান শুনতে পাও, তখন তার অনুরূপ শব্দ তোমরাও বলে যাও। অতঃপর যখন আযান শেষ হয়ে যাবে, তখন মুসলমান সকলে আমার প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ কর। (মুসলিম শরীফ)
উক্ত হাদিস শরীফ দ্বারা স্পষ্টাকারে প্রমাণিত হয় যে, আযানের সাথে দরূদের সম্পর্ক ইসলামের সূচনা থেকেই। নচেৎ আযান সমাপ্তির সাথে সাথেই দরূদ পাঠের হুকুম দেয়া হতো না। সুতরাং আযান আর দরূদ শরীফের চিরস্থায়ী সম্পর্কের বিষয় যখন প্রমাণিত হয়ে গেল; তখন একটি বিষয় অনিবার্য হয়ে যায় যে, আযানের সাথে দরূদ শরীফ পাঠকারীগণ আল্লাহ ও রসুলের প্রিয়। উল্লেখ্য যে, এর পরে 'আমিন' বলার জাহেরী আদেশ রয়েছে মুক্তাদীদের প্রতি, কিন্তু একই ভাবে ইমামও 'আমিন' বলে থাকেন। কারণ মুক্তাদীদের সাথে ইমামও উক্ত আদেশের অন্তর্ভূক্ত। তেমনিভাবে আযান দানকারী মোয়াযযিন আযানের পরে দরূদ শরীফ তো অবশ্যই পড়বেন তার সাথে সাথে সকল মুসলমানও। কারণ َّصَلُّوٛ عَلَی এর আদেশ দরূদ শরীফকে সকল মুসলমানের উপর ওয়াজিব করে দিয়েছে। তাতে প্রমাণ হয়ে গেল যে, আযানের পরে দরূদ শরীফ পাঠ করা ওয়াজিব, পাঠকারী আর শ্রবণকারী উভয়ের উপর। ইসলামে ওয়াজিব এবাদত প্রকাশ্যে করা জরুরী। তাই বড় আওয়াজে দরূদ শরীফ পাঠ করা আবশ্যক। কিন্তু ওয়াহাবী-দেওবন্দীদের প্রতি লক্ষ্য করুন, তাদের মসজিদগুলো থেকে আযানের পরেও দরূদ শরীফের আওয়াজ ভেসে আসে না। অথচ রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে আদেশ জারী করেছেন। এতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ওহাবীদের নিকট প্রমাণ কোন উদ্দেশ্য নয় বরং তারা যিকরে মোস্তফা (ﷺ)কে প্রতিরোধ করতে চায়। রেডিও লাহোর থেকে আযানের আগে দরূদ শরীফ বন্ধ করার আলোচনা প্রচার করা হয় কিন্তু তাদের পক্ষে সুযোগ হয় না যে, আযানের পরে দরূদ শরীফ পাঠ করার হুকুম প্রচারের এবং ওহাবীদের দ্বারা পাঠ করানো। এ ধরনের জাহেলী প্রচারণা শুনে সর্ব সাধারণ এটাই বুঝেছেন যে, রেডিও লাহোরের উপর ওহাবীদের আধিপত্য রয়েছে। উপরন্তু তারা দরূদ শরীফের দুশমনও বটে। ছুফিবাদীরা বলেন, আযানের পরে দরূদ শরীফ পাঠ করার হুকুম হাদিস শরীফ অনুসৃত। যদ্বারা আযান ও দরূদ শরীফের সম্পর্ক প্রতীয়মান হয়। ঠিক একই সম্পর্কের কারণে আযানের আগেও দরূদ শরীফ পাঠ করা মোস্তাহাব। তাই যেভাবে আযানের পরে দরূদ শরীফ পাঠ করার হুকুম মান্যকারীগণ আল্লাহ(ﷻ) ও রসূল(ﷺ)'র প্রিয় উম্মত; ঠিক একই ভাবে আযানের আগে দরূদ সালামের হাদিয়া পেশের অভ্যস্থরাও আল্লাহ(ﷻ) ও তদীয় রসূল (ﷺ)'র অত্যন্ত প্রিয়। কারণ ভাল কাজ মুহাব্বত দ্বারা বেশী আমলকারীগণ আল্লাহ(ﷻ) ও তদীয় রসূল (ﷺ) 'র পছন্দনীয় বলে প্রমাণিত। যদি এতে কোন প্রকার নিষেধাজ্ঞা না থাকে।
3️⃣তৃতীয় দলীল:
ইবনে মাজাহ ও তিরমিজী শরীফ সূত্রে মিশকাত শরীফে ১ম খন্ড ৬৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত-
وَ عَنٛ بِلَالِ قَالَ قَالَ رَسُوٛلُ اللهِ(ﷺ)لَا تُثَوَّبَنَّ فِىٛ شَىِء مِنَ الصَلواتِ اِلَّا فِى صَلَوةِ الٛفَجٛرِ
তরজুমা : হযরত বেলাল রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমাকে আ'কা মওলা হুযুর (ﷺ)এরশাদ ফরমান, কেবল ফজরের নামাযের সময়ে তাছবীব (সতর্কবাণী) ঘোষণা কর। বর্ণিত বর্ণনায় فى (ফি) অব্যয়টি স্থান-কাল অর্থে প্রযোজ্য। নামাযের পুরা সময়টা তার প্রয়োগক্ষেত্রে, ফরজ নামায আদায়ের পূর্ব পর্যন্ত আর সম্পূর্ণ সময়ের মধ্যে আযান ও ইকামত উভয়টা অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং প্রমাণিত হল যে, ফজরের সময়ে আযানের আগে তাছবীব তথা সতর্কতামূলক বাণী উচ্চারণ করা জায়েজ আছে। তাছবীবের শাব্দিক তরজুমা হল কাপড় নাড়ানাড়ি করে কাউকে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে: কোন সংবাদ অবহিত করা। এ শব্দটি ثَوٛب (ছাউব) থেকে নির্গত, বাবে তাফয়ীল এর ক্রীয়ামূল। ثَوٛب এর অর্থ কাপড়। আর تَثٛوِيٛب (তাছবীব) এর মানে হল কাপড় নাড়া। পরিভাষায় তাছবীবের মানে হল, আযানের আগে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা এ মর্মে যে, এখন আযান হতে যাচ্ছে। প্রস্তুত হও এবং আযান শুনো। আযান শুনাও ইবাদত। ইবাদতের প্রতি এহেন মনোযোগ আকর্ষণের নাম হল তাছবীব। মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরকাত কিতাবে তাছবীব শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞা লিখা হয়েছে নিম্নরূপে যেমন উক্ত কিতাবের প্রথম খন্ড ৪১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
اَلٛاَصٛلُ فِى التَّثٛوِيٛبِ اَنَّ الرَّجُلَ اِذَا جَاءَ مُسٛتَصٛرِ خًالَوَّحَ بِثَوٛبِهِ فَيَكُوٛنُ ذَالِكَ دُعَاءٌ
তরজুমা : তাছবীবের মূল অর্থ হল এই যে, মানুষ যখন ভীত হয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে এবং মানুষকে একত্রিত করার জন্য কাপড় নাড়ায়, এতে যখন মানুষ একত্রিত হয়, তখন তাদেরকে আহ্বান করার উদ্দেশ্য অবহিত করা।
حَتّٰى سُمِّىَ الدُّعَاءُ تَثٛوِيٛبًا وَ قِيٛلَ هُوَ تَرٛدِيٛدُ الدُّعَاءِ
অর্থাৎ: এ কারণেই আহ্বান করার নাম তাছবীব রাখা হয়েছে। অনেকের মতে তাছবীবের অর্থ হল, পূণ: আহ্বান করা। তিরমিজী গ্রন্থকার উক্ত বর্ণনাকে দুর্বল বলেছেন। কেননা উক্ত বর্ণনার একজন বর্ণনাকারী আবু ইসরাঈল শিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত। তার দুর্বলতার কারণে উক্ত অর্থে এককভাবে নির্ভর করার সুযোগ নাই। তাই মিরকাতে বলা হয়েছে-
وَاسٛتَحٛسَنَ الٛمُتَاخِّرُوٛنَ التَثٛوِيٛبَ فى الصَّلوٰاتِ كُلِّهَا
তরজুমা : প্রত্যেক নামাজের সময় তাছবীব করা খুবই ভাল। তাছাড়া অন্য কারণ হল এই যে, অমনোযোগীতা ও অসাবধানতা দূর করার জন্য তাছবীব হয়ে থাকে। সাহাবাদের যুগে কেবল সামর্থগত অমনোযোগীতাকে দূর করার জন্য তাছবীবের হুকুম দান করা হয়েছিল। এ সময় কেবল ভোর সকালে ঘুমের প্রভাবে অমনযোগীতা হয়ে থাকতো, অন্য সময়গুলোতে অমনযোগীতার আশংকা ছিল না।
এ কারণে কেবল ফজরের সময়ে তাছবীবের হুকুম প্রদান করা হয়েছিল। বর্তমান আমাদের এযুগে মানুষ সব সময় অমনযোগী ও অসাবধানতায় বিভোর থাকে। তাই মিরকাতের ভাষ্য মতে প্রত্যেক নামাজের সময়ে তাছবীব করা অতীব জরুরী। মানুষ যেন তাছবীব শুনে আযান শুনার জন্য প্রস্তুত হয়। আর আযান শুনে যেন নামাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। মানুষের নজরে আসার মত হলে কাপড় নাড়া কিংবা পতাকা উড়ানো হল তাছবীব। কিন্তু দৃষ্টির অন্তরালে মানুষ গুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করা যদি উদ্দেশ্য হয়;। তাহলে শব্দাবলী উচ্চারণ করে তাছবীব করতে হয়। আর শব্দাবলী উচ্চারণের বেলায় আল্লাহ(ﷻ) ও রসূল (ﷺ)'র নিকট দরূদ শরীফই হল সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট শব্দাবলী। তাই তাছবীবেব নিয়তে প্রত্যেক আযানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করা সুন্নাত হিসাবে প্রমাণিত। তথাপিও না মানাটা তাছবীব হাদিসের অস্বীকার করা বুঝায়।
4️⃣চতুর্থ দলীল:
তামাম ছুফি-সাধক, অলি-আউলিয়াসহ ইসলামের তাফসীর বিশারদ ও ফকীহদের ঐক্যমত্য মাসআলা হল, প্রত্যেক দোয়ার আগে-পরে দরূদ শরীফ পাঠ করা ওয়াজিব নতুবা মোস্তাহাব। কারণ তাফসীরে রূহুল মায়ানী একাদশ খন্ড ৮১ পৃষ্ঠায় এবং তাফসীরে রুহুল বয়ান সপ্তম খন্ড ২২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে-
وكَذَالِكَ تَجِبُ الصَّلوٰةُ فِى كُلِّ دُعَاءِِ فِى اَوَّلِهِ وَ اٰخِرِهِ
তরজুমা : একইভাবে প্রত্যেক দোয়ার আগে-পরে দরূদ শরীফ পাঠ করা হল ওয়াজিব তথা জরুরী। আভিধানিক ও পারিভাষিক উভয় অর্থে আযানও দোয়া হিসাবে পরিগণ্য। কারণ দোয়া মানে হল ডাকা ও আহ্বান করা। শব্দ মূল বিবেচনা করলে তার অর্থ দাঁড়ায় দাওয়াত করা। মহান আল্লাহ(ﷻ) আলামীনের এরশাদ হচ্ছে-
يَوٛمَ نَدٛعُوٛا كُلَّ اُنَاسِِ بِاِمَامِهِمٛ
বর্ণিত আয়াতে نَدٛعُوٛا শব্দের অর্থ হল আমি ডাক দেবো। এ অর্থে 'আযান' ও 'দোয়া' অর্থে পরিগণিত। আর মহামান্য ফকীহদের মতে সর্বপ্রকার দোয়ার আগে পরে দরূদ শরীফ পাঠ করা প্রয়োজন বিধায় আযানের আগে পরে দরূদ পাঠ করা প্রয়োজন। যারা আযানের আগে পরে দরূদ শরীফ পাঠে বিরোধীতা করে তারা ইসলামের তাফসীর বিশারদ ও ফকীহদের অভিমতের চরম বিরুদ্ধাচরণ করে।
5️⃣পঞ্চম দলীল:
বিরুদ্ধবাদীরা বলে যে, আযানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করা (আযানের মধ্যে) বৃদ্ধি করার শামিল। আমরা বলতে চাই যে, আযানের শব্দাবলী অতিশয় প্রসিদ্ধ। প্রত্যেকেই জানে যে, দরূদ শরীফের শব্দাবলী কেমন হয়, আযানের শব্দাবলী কী রূপ। ফলে একত্রিত হয়ে যাওয়ার অবকাশ পর্যন্তও থাকে না উপরন্তু বৃদ্ধি তখনই হয়, যখন মধ্যখানে শামিল করা হয়। যেভাবে রাফেজী-শিয়ারা আযানের মধ্যে শামিল করেছে। আগে কিংবা পরে কতেক শব্দাবলী তাছবীব কিংবা আদবের নিয়তে বলাতে গুনাহ কিংবা বৃদ্ধি বুঝায় না। আজকাল প্রত্যেক দেওবন্দী ওহাবী আহলে হাদিস পন্থীদের কোরআন শরিফ তেলাওয়াতের পরে একেবারে মিলিয়ে বলে থাকে।
صَدَقَ اللهُ الٛعَظِيٛمُ
অথচ এর কোন প্রমাণ নেই। না কোন সাহাবা-ই-কেরাম এরুপ শব্দাবলী পাঠ করেছেন। তাবেয়ীনদের মধ্যেও এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই; তেমনিভাবে কোরআন হাদিসের মধ্যেও তার কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তথাপি এ সব লোক তা পাঠ করেই যাচ্ছে। এটা কী কোরআন মজিদে বৃদ্ধি করা নয়? প্রমাণ হয়ে গেল যে, এদের দুঃখ কেবল দরূদ শরীফ নিয়ে। আর না হয় এসব দেওবন্দীরা স্বয়ং হাজারো রকমের কাজ-কর্ম প্রমাণ ছাড়াই করে যাচ্ছে, যা কত জঘন্য বৃদ্ধি করার মত (তাতে কিন্তু কিছু আসে যায় না)। সুন্নীরা দরূদ শরীফ পড়লেই ঐ সব জালেমদের গায়ে জ্বালা লেগে যায়। অথচ আমরা আহলে সুন্নাত আযানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করে কিছুটা সময় দেরী করে আযান দিয়ে থাকি, আর এসব মূর্খরা কোরআন তেলাওয়াতের সাথে সাথেই মিলাইয়ে ُصَدَقَ الله এর আরবী শব্দাবলী তেলাওয়াতের কন্ঠ ধাঁচেই আদায় করে থাকে। যা সরাসরি কুরআন মজিদের মধ্যে মিলিত করার ফলে তাদের কথিত ফতোয়ার প্রেক্ষিতে, তারাই অপরাধী সাব্যস্ত হয়। কারণ কুরআন মজিদের শব্দাবলী তার আধিক্যতার কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে পরিচয় নির্ণয় করার সুযোগ থাকে না। ফলে সাধারণ মানুষ এসব শব্দাবলীকেও কোরআনের আয়াত মনে করতে পারে। আমাদের নিকট তো َصَدَق বলার বৈধতার স্বপক্ষেও দলীল আছে কিন্তু ওহাবীরা কি দলীল দেবে? মুখ লুকানো ছাড়া তাদের বাঁচার কোন পথ বাকী নাই।
6️⃣ষষ্ঠ দলীল:
উপরোল্লেখিত প্রশ্নে দরূদ শরীফ বিরোধীদের বিবৃত দ্বিতীয় দলীল হল এই যে, আযানের আগে কোন ধরনের যিকির করার ব্যাপারে কোরআন-হাদিসের মধ্যে কোন প্রমাণ নেই। তৃতীয় দলীল হল এই যে, আল্লাহ(ﷻ) শব্দ দিয়ে আযান শুরু করা উচিত। তা ভিন্ন অন্য কোন শব্দ উচ্চারণ না করা চায়, এ ধরনের বক্তব্য দেওবন্দী ওহাবীদের ইলমের দূর্বলতা এবং হাদিস ও রেওয়ায়েত সম্পর্কে মূর্খতারই প্রমাণ বহন করে। হযরত বেলাল রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু যখন যেখানে আযান দিতেন, তখন তিনি ওহাবীদের মত একেবারে আল্লাহু আকবর দিয়ে শুরু করতেন না বরং উচ্চ আওয়াজে আযানের আগে দোয়া পাঠ করতেন। যেমন আবু দাউদ শরীফের ১ম খন্ডে এবং তার ব্যাখ্যা গ্রন্থ বজলুল মাজহুদের ১ম খন্ডে ২৯৮ পৃষ্ঠায় 'আল আযান ফিল মিনার' শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখ আছে যে-
فَكَانَ بِلَالٌ يُؤَذًِنُ عَلَيٛهِ الٛفَجَرَ فَيَاتِىٛ بِسَحٛرِِ فَيَجٛلِسُ عَلَى الٛبَيٛتِ يَنٛظُرُ اِلٰى الٛفَجٛرِ فَاِذَا رَاٰهُ تَمٛطِىٛ ثُمَّ قَالَ اَللَّهُمَّ اِنِّى اَحٛمِدُكَ وَ اَسٛتَعِيٛنُكَ عَلٰى قُرَيٛشِِ اَنٛ يُّقِيٛمُوٛا دِيٛنَكَ قَالَتٛ ثُمَّ يُؤَذِّنُ قَالَتٛ وَاللهِ مَا عَلِمٛتُهُ كَانَ تَرَكَهَا لَيٛلَةً وَاحِدَةً يَعِنِى هٰذِه الٛكَلِمَاتِ
তরজুমা: পূর্ণ হাদিস শরীফটি এভাবে আছে যে, ইব্রাহীম ইবনে মায়াজ রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক থেকে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে জাফর ইবনে জুবাইর থেকে, তিনি আরওয়া ইবনে জুবাইর থেকে, তিনি বনি নাজ্জার গোত্রের জনৈকা মহিলা ছাহাবী থেকে। উক্ত (মহিলা সাহাবীর) ঘর মসজিদে নব্বী শরীফের অত্যন্ত নিকটেই ছিল। হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু) তাঁর ঘরের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে ফজরের আযান দিতেন। উক্ত মহিলা বলেন যে, প্রত্যহ হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু) আযানের আগে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করতেন-
اَللَّهُمَّ اِنِّى اَحٛمِدُكَ وَ اَسٛتَعِيٛنُكَ عَلٰى قُرَيٛشِِ اَنٛ يُّقِيٛمُوٛا دِيٛنَك
মহিলা ছাহাবীটি আরো বলেছেন, মহান আল্লাহ (ﷻ)'র শপথ, হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু) সর্বদাই আযানের আগে এই দোয়াটি পাঠ করতেন। আমি কোন সময় দেখি নাই যে, হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু) এই দোয়াটি পাঠ থেকে বিরত ছিলেন এবং তা পাঠ ব্যতীত আযান শুরু করেছেন। সোবহানাল্লাহ!
কতই না মজবুত দলীল। আযানের আগে দরূদ শরীফ তথা সালাত-সালাম পাঠ করার। বর্ণিত হাদিস শরীফ থেকে তিনটি বিষয় বুঝা যায়। প্রথমত: হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু) নবী করীম (ﷺ)'র জাহেরী বর্তমানে আযানের আগে দোয়ার এসব শব্দাবলীগুলো পাঠ করতেন। তারপর আযান দিতেন। কিন্তু নবী করিম (ﷺ) কখনো তাকে নিষেধ করেননি। আযানের আগে যদি কিছু পাঠ করা নাজায়েজ হতো; তাহলে প্রিয় আঁকা মাওলা (ﷺ) সাথে সাথে নিষেধ করে দিতেন। দ্বিতীয় বিষয়টি হল এই, হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু) দোয়ার উক্ত শব্দাবলীগুলো অত্যন্ত বড় আওয়াজে আযানের স্থানে দাঁড়িয়ে আযানের আগে পাঠ করতেন। মহিলা সাহাবীটি ঘরের নিচে বসে থেকে কিংবা চারপায়া বিশিষ্ট চৌকিতে শুয়ে শুয়ে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে শুনতেন বলেই হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু) পঠিত উক্ত শব্দাবলীগুলো উক্ত (মহিলার) মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয় বিষয়টি হল এই যে, হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু) দোয়ার এই শব্দাবলীগুলো কেবল এক কিংবা দুইবার বলেননি সব সময়ই তাই বলতেন। হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু)'র কোন আযান উক্ত দোয়া পাঠ ব্যতীত সূচনা হয়নি। কারণ উক্ত মহিলা সাহাবী কছম করে বলছেন যে, আমি আমার গোটা জীবনে কখনো দেখি নাই যে, হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু) উল্লেখিত দোয়া পাঠ ব্যতীত আযান শুরু করেছেন। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু) যেভাবে একদম আযান শুরু করতেন না বরং প্রথমে দোয়া জাতীয় শব্দাবলী উচ্চারণ করত: তারপর আযান শুরু করতেন। তেমনিভাবে আজকাল এবং তারও আগে থেকে আহলে সুন্নাতের মুয়াজ্জিনগণ কখনো শুরু করেন না বা করেন নি। বরং দোয়ামূলক শব্দাবলী পাঠ করে আযান শুরু করেন বা করতেন। সুতরাং যেসব লোক সরাসরি আযান শুরু করে দেয়, সেই আযান বেলালী আদর্শের অনুরূপ নয়। সর্বোপরি হাদিসে পাকের পরিপন্থীও বটে। তাই ওহাবীদের সব আযানই ত্রুটিপূর্ণ। কেননা তাদের আযানগুলো হাদিসে পাকের খেলাপ। আহলে সুন্নাতের আযানগুলো যেহেতু দরূদ শরীফ ব্যতীত শুরু করা হয় না সেহেতু এসব আযান নবী পাক (ﷺ)'র ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির অনুকূলে বলে পরিগণিত। কারণ হুযুর আকরম (ﷺ) হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু)'র ঐ সব আযানের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন, যেসব আযানের শুরুতে তিনি দোয়ার শব্দাবলী উচ্চারণ করে থাকতেন। তেমনি নবী করীম (ﷺ) আমাদের আযানগুলোতও খুশি আছেন। আলহামদুলিল্লাহ! সুতরাং প্রমাণিত হয়ে গেল যে, আযানের আগে দোয়া পাঠ করা জায়েয। কারণ হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু) পাঠ করতেন। পার্থক্য কেবল কতটুকুই, হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু) মক্কার কোরাইশ বংশের হেদায়েতের জন্য দোয়া পাঠ করতেন আর আমাদের মুয়াজ্জিগণ দরূদ শরীফের দোয়া পাঠ করে থাকেন।
হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু)মক্কার কাফিরদের শুদ্ধ করার জন্য আগ্রহ নিয়ে উল্লেখিত দোয়া পাঠ করতেন, আমরা আহলে সুন্নাত বর্তমান ওহাবীদের ঠিক করার কামনা নিয়ে আমাদের আঁকা(ﷺ)' র শানে দরূদ শরীফ নামীয় দোয়া পাঠ করে থাকি। নিয়ম একই। পার্থক্য কেবল শব্দের ভিন্নতা মাত্র।
আযানের আগে হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু)'র দোয়া পড়ার উক্ত ত্বরীকা যদি ছহী থাকে, তাহলে আমাদের প্রচলিত ত্বরীকাও ছহী। যদি আমাদের প্রচলিত ত্বরীকাকে ভুল বলে আখ্যা দেয়া হয়, তাহলে হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু)'র মুবারক ত্বরীকাকে কী বলবেন? আমরা আবু দাউদ শরীফের ছহী বর্ণনা দ্বারা প্রমাণ করেছি যে, আযানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করা সম্পূর্ণরূপে জায়েজ। তারপরও যদি কোন ওহাবী না মানে, তাহলে তার কোন ঔষধ নেই। আবু দাউদ শরীফ ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। প্রত্যেক মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস বা কামিল হাদিস ক্লাসে কিতাবটি পড়ানো হয়। উল্লেখিত হাদিসটির ব্যাপারে সবাই অবগত। তারপরও দরূদ শরীফের প্রতি জামানার ওহাবীদের দুঃখ আছে। মোস্তফা (ﷺ)'র জিকরে পাকের প্রতি শত্রুতা আছে। প্রমাণের প্রতি তাদের কোন আন্তরিক নেই। তাই তারা আযানের আগে দরূদ শরীফের বিরোধীতা করে যাচ্ছে। আমরা বহুবার শুনেছি যে, ওহাবীরা আযানের আগে তাদের হারিয়ে যাওয়া জিনিস এবং মেলা-মজলিসের ঘোষণা দিয়ে থাকে। তেমনি একাধিকবার আযানের পরেও ঘোষণা দিতে দেখেছি কিন্তু এগুলো সব জায়েয। যদি না-জায়েযের ফতওয়া লেগে থাকে, তাহলে কেবল দরূদ শরীফের প্রতি। যদি এটা দরূদ শরীফের প্রতি শত্রুতার কারণে না হয়, তাহলে তো আযানের পরে দরূদ শরীফের বৈধতার পক্ষে সম্পূর্ণ পরিষ্কার ভাবে বহু হাদিস শরীফের প্রমাণ রয়েছে। তার উপর আমল করে এ সব বিরোধীতাকারীরা আযানের পরে দরূদ শরীফ পাঠ করে না কেন? তাদের বিভিন্ন এলানের আওয়াজ দূর থেকে শুনা যায়, দরূদ শরীফের আওয়াজ তাদের মেলা-মজলিস তথা মসজিদ সমূহ থেকে শুনা যায় না কেন?
7️⃣সপ্তম দলীল:
বায়হাকী শরীফ ১ম খন্ড ৪২৫ পৃষ্ঠায় আবু দাউদ শরীফের উক্ত হাদিস তারই শব্দে এভাবে বর্ণিত আছে যে-
ثُمَّ يَنٛظُرُ اِلٰى الٛفَجٛرِ فَاِذَا رَاٰهُ تَمٛطِىٛ ثُمَّ قَالَ اَللَّهُمَّ اِنِّى اَحٛمِدُكَ
তরজুমা: বনী নাজ্জারের উক্ত মহিলা সাহাবী বলেন যে, আমার ঘরের ছাদের উপর হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু) ফজর উদয় হওয়ার অপেক্ষায় থাকতেন। যখন ফজর উদয় হতে দেখা যেতো; তখন তিনি উক্ত দোয়াটি পাঠ করতেন। অতঃপর আযান দিতেন। এতে প্রমাণিত হয়ে গেল যে, আযানের আগে দোয়া-প্রার্থনা করা জায়েয। যেহেতু দরূদ শরীফও একটি দোয়া, সেহেতু তাও জায়েজ। হাদিস শরীফের সূচনাবাক্য হল ُكَانَ بِلَالٌ يُؤَذِّن (বেলাল রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু আযান দিতেন) এখানে ক্রিয়াটিماضى استمراري (মাজি ইস্তিমরারী) হিসাবে ব্যবহৃত। আর মাজি ইস্তিমরারী স্থায়ী ও সর্বদায় সংগঠিত বিষয়কে প্রমাণ করে। যেহেতু একদিকে মাজি ইস্তিমরারীর ক্রিয়া অপরদিকে হাদিস শরীফের শেষান্তে উল্লেখিত উক্ত মহিলা সাহাবীর শপথ মূলক শব্দাবলী, যা দিয়ে তিনি কসম করে বলেছেন যে, হযরত বেলাল (রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু) আযানের আগে দোয়া করার প্রথাটি কখনো পরিত্যাগ করেননি। অর্থাৎ প্রতীয়মান হল যে, আযানের আগে সর্বদায় উক্ত দোয়াটি অবশ্যই পাঠ করতেন। আর এটা তো একজন বিবি সাহেবার উক্তি কেবল ফজরের আযান সম্পর্কে। অপরাপর আযানগুলোতেও নিঃসন্দেহে এভাবেই দোয়া পাঠ করা হতো। হয়তো উক্ত মহিলা সাহাবী কোন ব্যস্ততার কারণে শুনেন নাই। তথাপি আমরা বলবো যে, জায়েজ প্রমাণের জন্য অতটুকু যথেষ্ট। তাই এসব বিরোধীদের উচিত যে, অন্তত ফজরের সময়ে হলেও দরূদ শরীফ পাঠ করে হাদীস শরীফের উপর আমল করা। আর যদি আযানের আগে দিতে মুছিবত মনে হয় তাহলে আযানের পরে দিতে তারা কেন বাধা দেয়? প্রমাণ হয়ে গেল যে, তারা কেবল দরূদ শরীফের প্রতি শত্রুতা বশতঃ মুসলমানদেরকে দরূদ শরীফ থেকে বারণ করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যথায় অত শক্তিশালী দলীল প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আর কী বাঁধা থাকতে পারে। আমরা তো পরিষ্কারভাবে আযানের আগে সালাত-সালামকে সুন্নাতে বেলালী হিসাবে প্রমাণ করে দেখিয়েছি। তারা কোন তাবেয়ী বা তাবে-তাবেয়ীর হলেও এমন কোন উক্তি দেখাক,। যেখানে আযানের আগে দরূদ শরীফ কিংবা অন্য কিছু পাঠ করার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
8️⃣অষ্টম দলীল:
ওহাবী দেওবন্দীরা হাজার হাজার বিদয়াতের সাথে জড়িত রয়েছে। কিন্তু তার প্রতি তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সুন্নী সম্প্রদায় যখন আযানের আগে দরূদ শরীফ তথা সালাত-সালাম পাঠ করে; তখন তারা তা প্রতিরোধে মেতে উঠে। অথচ শরীয়তের কানুন মতে নিষেধ বা মানা করার আটটি পর্যায় রয়েছে। যার প্রত্যেক পর্যায়ের স্বপক্ষে দলীলাদি বর্তমান থাকতে হয়। যেমন ইসলামী আইনের মূলনীতি বিদ্যার স্বীকৃত গ্রন্থ 'আত্ তাওজীহ্' নামক কিতাবের ৪১৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে-
اَلنَّهٛىُ لِاِسٛتِعٛمَالِهِ فِى مَعَانِِ هِىَ التِّحٛرِيٛمُ وَ الٛكَرَاهَةُ وَ التَّنٛزِيٛهُ وَ التَّحٛقِيٛرُ و بَيَانُ عَاقِبَتِِ وَ الٛاَرٛشَادُ وَ السَّفٛقَةُ وَ الٛيَاسُ
তরজুমা: নিষেধের আটটি পর্যায় আছে। (১) হুরমত অর্থাৎ যা আমল করা হারাম।(২) মাকরুহ তাহরিমী (৩) মাকরুহ তানজিহী (৪) তিরষ্কার করার জন্য নিষেধ। (৫) খারাপ পরিণতি জানানোর জন্য নিষেধ। (৬) কেবল বাধা দানের জন্য নিষেধ। (৭) দুনিয়াবী ক্ষতির ভয়ে নিষেধ। (৮) যার প্রতি নিরাশ তা থেকে বিরত রাখার জন্য নিষেধ। প্রত্যেক প্রকারের নিষেধের জন্য শরীয়তের দলিল থাকা অপরিহার্য। যেমন ফতওয়া দুররে মোখতার এবং ফতওয়া রাদ্দল মোখতার ১ম খন্ড ৬১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে-
لَايَلٛزِمُ مِنٛهُ اَنٛ يَكُوٛنَ مَكٛرُوهاً اِلِّا بِنَهٛىِِ خَاصٍّ لِاَنَّ الٛكَرَاهَةَ حُكٛمٌ شَرٛعِىٌّ فَلَابُدِّلَهُ مِنٛ دَلِيٛلٍ
তরজুমা: তা বর্জনে মাকরুহ তানজিহী হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে না। তবে বিশেষ করে কুরআন হাদিসের নিষেধ না থাকলে হয়। কারণ মাকরুহ তানজিহী হওয়াও শরীয়তের হুকুমের মধ্যে গণ্য। তবে তার জন্য শরীয়তের দলীল থাকা অপরিহার্য। আযানের আগে সালাত-সালাম পাঠে অপছন্দকারী ঐসব ওহাবীদের নিকট জিজ্ঞেস করতে চাই, আমরাতো ভাষা, প্রয়োগ, ভাব ও ইঙ্গিতগত সব দিক থেকে আযানের আগে দরূদ শরীফ তথা সালাত-সালাম পাঠের বৈধতার প্রমাণ দিতে সমর্থ হয়েছি উপরন্তু সাহাবাদের যুগ থেকে প্রমাণ উদ্ধৃত করে বর্ণনা করেছি। কিন্তু তোমরা যদি এরপরও নিষেধ কর, তাহলে তার কোন প্রমাণ থাকলে বল, এটা পাঠ করা হারাম, মাকরুহ তাহরিমী, মাকরুহ তানজিহী, কেরাহতে তাহ্কিরী,কেরাহতে আকেবত, কেরাহতে ইরশাদ বা শাপকত মানে অসম্মানী-বেইজ্জতী অথবা কেরাহতে মা'য়ূসী ইত্যাদি যা ইচ্ছা বল, তৎমধ্যে 'সালাত-সালাম' কোন পর্যায়ের নিষেধের মধ্যে পড়ে। যে পর্যায়েরই নিষেধ বলে দাবী কর না কেন, তার দলীল এভাবে কোরআন-হাদিস কিংবা ফকীহ এবং মুফাচ্ছিরদের বরাত দিয়ে পেশ কর। তারপরই বুঝা যাবে তোমাদের বুকের পাঠা কত বড়। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি যে, তোমরা কিয়ামত পর্যন্ত কোন দলিল হাজির করতে পারবে না। কারণ সহস্রবারের মত আমাদের নিকট বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে যে, উক্ত রেডিও তার প্রচারণায় হাবীবে করীম (ﷺ)'র শানে বেয়াদবী এবং দরূদে পাকের প্রতি শত্রুতার প্রকাশ ঘটিয়ে কীভাবে জাহান্নামী রাস্তাকে অবলম্বন বানাচ্ছে।
আল্লাহ তায়ালা(ﷻ) সকলকে পূর্ণ হেদায়েত নসীব করুন। বাকী থাকলো মুহতরম পীর মুহাম্মদ করম শাহ সাহেবের মন্তব্য। যদিও তিনি আমাদের আক্বীদার একজন বুজুর্গ সর্বোপরি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। কিন্তু তিনি মাঝে মধ্যে অনেক দায়িত্বহীন কথা-বার্তা বলে থাকেন। সম্ভবতঃ তার এহেন স্ববিরোধী প্রীতি 'সবার সাথে সন্ধি' দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। কেননা তিনি তার বিরচিত তাফসীরে জিয়াউল কোরআন গ্রন্থেও বড় দায়িত্বহীন ভাবে তাড়াহুড়া করে দৃষ্টি আড়ালের চেষ্টা করেছেন। মাসিক রেযায়ে মোস্তফা নামক সাময়িকীতে মোজাহেদে মিল্লাত আবু দাউদ মওলানা ছাদেক সাহেব যা চিহ্নিত করে তার নিবন্ধে প্রকাশ করে দেন। উপরন্তু এ ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি কেবল তার থেকেই সংগঠিত হয়েছে তা নয় বরং আমাদের অনেক শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামও বোকার মত প্রলাপ করে থাকেন। কী বলতে কী বলেন তার শুরু-শেষ নেই। যেমন আরেফে কাড়ি শরীফ, মিয়া মুহাম্মদ সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার কাব্যগ্রন্থ সাইফুল মুলু-এ অনেক কবিতা পংক্তি (শে'র) শরিয়তের খেলাফ লিখে ফেলেন। গাউছুল আযমের প্রশংসা করতে গিয়ে এমন অনেক অসংলগ্ন শের লিখেছেন, যা নিশ্চিতভাবে ভুল সর্বোপরি ইসলাম ও হাকীকতের দৃষ্টিতে পরিপন্থীও বটে।
اَللَّهُمَّ اِنِّى اَحٛمِدُكَ وَ اَسٛتَعِيٛنُكَ عَلٰى وَهَابِيٛيِنَ اَنٛ يُّقِيٛمُوٛا دِيٛنَكَ وَحُبَّ حَبَيٛبِكَ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَ اللهُ تَعَالٰى وَ رَسُوٛلُهُ اَعٛلَمٛ
পরিশিষ্ট
প্রসঙ্গঃ মসজিদের ভিতরে আযান
ইসলামের পঞ্চ বেনার অনন্য বেনা-পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। এসব নামাজের জমাতের প্রতি ধর্মপ্রাণ জনসাধারণকে আহ্বানের যথানিয়ম হিসাবে প্রবর্তিত হয় - আযান। তাই প্রতি ওয়াক্ত নামাজের জামাতের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের দূরত্ব বজায় রেখে মসজিদের বাহিরে সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিনের আযান দানের প্রথা ইসলামের সূচনাকাল থেকেই চলে আসছে। সাহাবা-তাবেয়ীন-তাবে তাবেয়ীন ও আয়িম্মামে মুজতাহেদীনের যুগেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য যে, আধুনিক কালে মাইকের আবিষ্কারের সুবাদে আর আযানে তার ব্যবহারের ফলে আযান ও মুয়াজ্জিন মানবীয় খেয়ালীপনার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে পূর্ব প্রচলিত প্রথা ও স্থান ছেড়ে দেশের প্রায় সব মসজিদের আন্দরে ডুকে যায়। বিষয়টির ব্যাপারে সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর নিরবতাকে জ্ঞানের প্রশ্নে মেনে নেয়া গেলেও যুগে যুগে ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে পরিগণ্য ওলামায়ে কেরামের নিরবতাকে কখনো মেনে নেয়া যায় না। যেহেতু যে কোন কাজ-কর্মের প্রতি ওলামায়ে কেরাম এর নির্দেশনা তথা মতামতের উপর সাধারণ মানুষের আক্বিদা ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়, এ বিচারে দ্বীনের একজন নগন্য খাদেম হিসাবে যেখানেই তা চোখে পড়েছে; সাধ্যমতে প্রতিবাদসহ শরয়ী মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তবে লিখনীর মাধ্যমে শরয়ী দায়িত্ব পালন যা বাকী ছিল, তা আদায় করে দিয়ে জিম্মা মুক্ত হওয়ার অংশ হিসাবে প্রসঙ্গটি নিয়ে দু-কলম লিখার দুঃসাহস দেখাতে ✋ হাতে কলম নিয়েছি। এতে দ্বীন ও মাজহাবের সামান্যতম কল্যাণ সাধিত হলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে হবে। কারণ পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্বটা বান্দার, হেদায়তের দায়িত্ব আল্লাহ(ﷻ)'র কুদরতের হাতেই ন্যস্ত।
আযান একটি ইসলামী বিষয়, যা ইসলাম কর্তৃক সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। এখানে মানবীয় খেয়ালীপনা প্রদর্শনের কোন সুযোগ নেই। তাই আযান কখন দিতে হবে, কোথায় দিতে হবে, কিভাবে দিতে হবে, কে বা কারা দিতে পারবে ইত্যাকার যাবতীয় বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য সুষ্পষ্ট। এখন যেই বিষয় নিয়ে আসল সমস্যা, তা হল- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান কোথায় দিতে হবে। বাহিরে না ভিতরে, ভিতরে দিলে শরীয়তের হুকুম কি? যেহেতু বর্তমানে দেশের প্রায় সব মসজিদে মাইক যোগে আযান দানের প্রথা চালু হয়েছে, সেহেতু এ সমস্যাটি শরীয়তের মানদন্ডে বিচারের আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অন্যথায় ইতিপূর্বে-কার সময়ে মাইক যোগে আযান দিতে হতো না বলে এহেন সমস্যারও উদ্ভব হয় নি।
আজকাল যেহেতু মাইক যোগে আযান দিলে যেখান থেকে দেয়া হউক না কেন, জন-মানুষ শুনতে পায়, শুনা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয় না, সেহেতু কালের পরিক্রমায় সুবিধা তালাশে খেয়ালের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করে মাইক ওয়ালা মসজিদে আযান দানের প্রথা মসজিদের ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলা হয়। এমতাবস্থায় মাইক ওয়ালা মসজিদের ভিতরে আযান দেয়ার প্রচলিত প্রথা কতটুকু শরীয়তের আলোকে আইন সিদ্ধ, - তা ভেবে দেখার সকলেরই ঈমানী দায়িত্ব।
ফিকাহ ফতওয়ার সুপ্রসিদ্ধ প্রায় সব কিতাবাদি পর্যালোচনান্ত দেখা যায় যে, কোন অবস্থায় মসজিদের ভিতরে আযান দানের এই প্রথা শরীয়ত অনুমোদন করে না। যেহেতু ফতওয়া কাজী খান (মিশরী) ১ম খন্ড ৭৮ পৃষ্ঠা, ফতুওয়া আলমগীরী (মিশরী) ১ম খন্ড ৫৫ পৃষ্ঠা ও বাহরুর রায়েক ১ম খন্ড ২৬৮ পৃষ্ঠায় লিখা আছে যে,
لَا يُؤَذِّنُ فِیٛ الٛمَسٛجِدِ
অর্থাৎঃ মসজিদের ভিতরে আযান দেয়া যাবে না।
ফতহুল কাদীর ১ম খন্ড ২১৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে যে,
قَالُوٛا لَا يُؤَذِّنُ فِىٛ الٛمَسٛجِدِ
অর্থাৎঃ ফকীহদের বক্তব্য, মসজিদের ভিতরে আযান দেয়া যাবে না।
"তাহতাবী আলা মারাকিউল ফালাহ" নামক প্রসিদ্ধ ফিকাহ শাস্ত্রের ২১৭ পৃষ্ঠায় লিখা হয়েছে যে,
يَكٛرَهُ اَنٛ يُؤَذِّنُ فِىٛ الٛمَسٛجِدِ كَمَا فِى الٛقَهَسٛتَانِى عَنِ النَّظَمِ
অর্থাৎঃ মসজিদের ভিতরে আযান দেয়া মাকরূহ।
শরহে বেকায়া ৮৪ পৃষ্ঠা ও ফতওয়া খোলাছায়ে কলমীর ৬২ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে,
لَايُٶَذِّنُ فِیٛ الٛمَسٛجِدِ
অর্থাৎঃ মসজিদের ভিতরে আযান দেয়া যাবে না।
অতএব, ইসলামী শরীয়তের নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য কিতাবাদির নিরিখে প্রতিয়মান হয় যে, মাইক ওয়ালা মসজিদে বর্তমানে প্রচলিত ভিতরে আযান দানের প্রথা শরীয়তের আলোকে বিদয়াতে সাইয়্যা ও মাকরূহে তাহরিমী তথা সম্পূর্ণ বর্জনীয়। তাছাড়া ইতিহাসের নিরিখেও স্বীকার্য যে, ইসলামের সূচনাকাল থেকে গ্রহণযোগ্য কাল পর্যন্ত এমনকি মাইক আবিষ্কারের পূর্বকাল পর্যন্ত কোন কালেই মসজিদের ভিতরে আযান দানের প্রথা ছিল না। এতদসত্ত্বেও সাম্প্রতিক কাল থেকে মাইকযোগে মসজিদের ভিতরে প্রচলিত হয়ে আসা আযানের প্রথার ব্যাপারে ওলামাদের নিরব থাকার বিষয়টি সত্যিই বিস্ময়কর, সর্বোপরি শরয়ী দায়িত্ব পালনে অবহেলারই নামান্তর বৈ কি। তাই সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামের কর্ণধার ওলামায়ে কেরামের প্রতি বিনীত নিবেদন, এহেন গর্হিত কাজ থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষার তাগিদে প্রয়োজনীয় বক্তব্য মিল্লাতের উদ্দেশ্য পেশ করতে মর্জি করুন। কারণ মিল্লাতের দূর্যোগ মুহূর্তে একটি সুন্নাতকে জিন্দা করা শহীদের মার্তবা লাভের সমতুল্য। আল্লাহ (ﷻ) আমাদের সকলকে সুন্নাত জিন্দা করার আন্দোলনে শরীক হওয়ার তৌফিক দিন। আমিন।
নিবেদন-
অধ্যক্ষ মাওলানা এস.এম. ফরিদ উদ্দিন
🕌🕌🕌🌃🕌🕌🕌
Comments
Post a Comment