মৌং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ভ্রান্ত তাফসীর এর স্বরূপ উন্মোচন

মৌং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ভ্রান্ত তাফসীর এর স্বরূপ উন্মোচন
মৌং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ভ্রান্ত তাফসীর এর স্বরূপ উন্মোচন

✍️রচনাঃ আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান

টেক্সট রেডীঃ মুহাম্মদ আব্দুল খালেক


نَحٛمَدُه وَ نُصَلِّى وَ نُسَلِّمُ عَلٰى حَبِيٛبِهٖ الٛكَرِيٛم
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লী ওয়া নুসাল্লিমু আলা হাবীবিহিল করীম!

ভূমিকা
আল্লাহ তা'আলা এরশাদ ফরমানঃ "ইন্নাদ্দী-না ইনদাল্লা-হিল ইসলাম।" অর্থাৎ আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন হচ্ছে ইসলাম।" একথা সর্বজন বিদিত যে, পৃথিবী সৃষ্টির প্রারম্ভিক কাল থেকে এ পর্যন্ত বহু রকমের ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। তাই, গোটা বিশ্বে মুসলমান ছাড়াও ইহুদী, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ইত্যাদি ধর্মাবলম্বী মানুষও দেখা যায়। কিন্তু এসব ধর্মের ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন- "আমার নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম আর এটাই পূর্ণাঙ্গ, নির্ভুল। আল্লাহ তা'আলা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেনঃ "আল্ ইয়াউমা আকমালতু লাকুম দীনাকুম ওয়া আতমামতু আলায়কুম নি'মাতী।" অর্থাৎ "আজ (বিদায় হজ্বের দিন) আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ইসলাম)-কে পূর্ণতা দান করলাম এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।"

সুতরাং মানুষের ইহ ও পারলৌকিক জীবনের কোন একটা বিষয়ও ইসলাম থেকে বাদ পড়েনি। সমস্ত বিষয়ে নির্ভুলভাবে দিশাদান করা হয়েছে এ পূর্ণাঙ্গ দ্বীন-ইসলামে।

ইসলামের এ পূর্ণতার প্রোজ্জ্বল স্বাক্ষর হচ্ছে। 'পবিত্র ক্বোরআন'। ক্বোরআন হচ্ছে আল্লাহ পাকের কালাম। তাঁরই ভাষায়, ক্বোরআন হচ্ছে- 'তিব্ইয়ানুল লিকুল্লি শায়ইন'। অর্থাৎ অনু-পরমাণু থেকে আরম্ভ করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টির প্রত্যেকটির বিবরণ রয়েছে মহান গ্রন্থ পাক ক্বোরআনে।

বলা বাহুল্য, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধান সুবিন্যস্ত হয় এর 'চতুর্দলীল' বা ক্বোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসে। কিন্তু, ইসলামের বিধানাবলীর প্রধানতম উৎস হচ্ছে এ পবিত্র ক্বোরআন মজীদ। অবশিষ্ট তিনটা হচ্ছে এরই কার্যতঃ তাফসীর বা ব্যাখ্যা।

কাজেই, ইসলামের চতুর্দলীলের ভিত্তিতে মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র যদি নিয়ন্ত্রিত হয় তবে কার্যক্ষেত্রেও ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও সর্বাধিক কল্যাণকর হওয়া প্রমাণিত হতে বাধ্য। বিশ্বনবী, নবীকুল সরদার, সাইয়্যেদুল কাওনাঈন হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র জীবনাদর্শ এবং বিশেষ করে, খোলাফা-ই-রাশেদীন রাদিআল্লাহু তা'য়ালা আনহু-এর জীবনাদর্শ থেকে একথাটা মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় বিশ্ববাসীর নিকট সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণেই, যে পাশ্চাত্য দেশগুলো আজ বিশ্বে সভ্যতার দাবীদার সেজে বসেছে তারাও সর্বপ্রথম সভ্যতার তা'লীম নিয়েছে মুসলমানদের নিকট থেকে। সুতরাং মুসলমানরাই হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি।

কিন্তু পরবর্তী যুগগুলোর মুসলিম সমাজে সে ঐতিহ্য কি যথাযথভাবে অক্ষুন্ন রয়েছে? যে মুসলিম জাতি একদিন জোর গলায় বলতে পেরেছে-

دی آذانیں کبھی یورپ کے کلیساؤں میں
 اور کبھی افریقہ کے تپتے ہوئے صحراؤں میں
               دشت تو دشت ہیں دریا بھی نہ چھوڑے ہم نے
               بحر ظلمات میں دوڑادے گھوڑے ہم نے

"আমরা কখনো ইউরোপের গীর্জাগুলোতে আযানের রব ধ্বনিত
করেছি, কখনো আফ্রিকার উত্তপ্ত মরুভূমিগুলোতেও।
শুধু মাঠ আর ধূধূ ময়দান নয়; সমুদ্রগুলোকেও আমরা ছাড়িনি; সুদূর
প্রশান্ত মহাসাগরেও আমরা বিজয়ের ঘোড়া নামিয়ে দিয়েছি।"

সে মুসলিম জাতির ঐ গৌরবময় যোগ্যতা কি এখনো অক্ষুন্ন আছে? মুসলিম জাতি ইসলামী আদর্শের মাধ্যমে পৃথিবীর যেখানেই পদার্পণ করেছে সেখানেই হয়েছে বরিত, এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাঁরা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মানুষকে বিভিন্ন ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি, শোষণ-পীড়ন, লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত করে শান্তি, সমৃদ্ধি ও গৌরবের সঠিক দিশা দিতে পেরেছেন বলেই এ জাতি এক মহান জাতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু, তাদের পরবর্তী বংশধরেরা কি সেই বিশ্ব স্বীকৃত আস্থাকে এ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে?  এর জবাবে 'না' বললেও অত্যুক্তি হবে না।

এর কারণ কি?

এ বহুবিধ কারণ রয়েছে। যেমন-

একঃ আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের(ﷺ) প্রতি যেই অকৃত্রিম বিশ্বাসের কারণে আমাদের 'সলফ-ই-সালেহীন'(অগ্রণীগণ) তাঁদের যে কোন পদক্ষেপে আল্লাহর অশেষ রহমত ও সাহায্য লাভে সমর্থ হয়েছিলেন পরবর্তীতে মুসলমানদের মনেপ্রাণে সে ধরনের দৃঢ় বিশ্বাসে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে এখন আর সেই ঈমানী বল পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অনেকের মধ্যে ইসলামী অনুশাসন পালনের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে ঔদাসীন্য, অনেকের আবার ইসলামী আক্বীদায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে বিভিন্ন বিভ্রান্তির।

দুইঃ যেই ঐক্যের অদম্য শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মুসলিম জাতি তার স্বকীয়তা ও শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছিল এখন তো আর সেই শক্তি নেই। মুসলমানদের এক বিরাট অংশ ইসলামের সঠিক রূপরেখা  'আহলে সুন্নাত ওয়া জামা'আত'-এর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে নানা ভ্রান্ত আক্বীদার ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে ঐক্যের ইস্পাত কঠিন ভিতের উপর চরমভাবে আঘাত হেনেছে। আত্মাশুদ্ধির উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসে সেই ঐক্যের ভিতকে মজবুত রাখার পরিবর্তে নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদকে ইসলামের রূপ দেয়ার পাঁয়তারা চলতে থাকে। সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে সরল পথ দেখানোর স্থলে প্রতারণার মাধ্যমে বাতিল আক্বীদায় বিশ্বাসীদের দলে ভেড়ানোর ষড়যন্ত্র চলছে নিয়মিতভাবে।

তিনঃ যেই অব্যাহত কর্ম-তৎপরতা ও সচেতনতার মাধ্যমে মুসলিম জাতি তাদের বিজয় যাত্রাকে অব্যাহত রেখেছে, ক্রমশঃ সেই কর্মতৎপরতায় দুঃখজনকভাবে ভাটা পড়েছে। একদিকে ইসলামের সঠিক রূপরেখা তথা সুন্নী মতাদর্শের অনুসারীরা তাঁদের যতটুকু কর্মতৎপর ও সচেতন হওয়া উচিত ছিল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁরা এখনো পর্যন্ত অনড় ও অচেতন ভূমিকা পালন করছেন। অথবা, পার্থিব ক্ষুদ্র স্বার্থের মধ্যে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখার ফলে সুন্নী মতাদর্শের ভিত্তিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার গুরু-দায়িত্ব পালনের সুযোগ বা সময়ই পাচ্ছেন না। আত্ম-কোন্দল ও পারস্পরিক অনৈক্যের কারণে তাঁরা নিতে পারছেন না সম্মিলিত কোন উদ্যোগই। অন্যদিকে, এরই সুবাদে গজিয়ে উঠেছে বিভিন্ন বাতিল ঐক্য' হয়ে পড়েছে এক দুষ্কর ব্যাপার। অপরদিকে, ইসলামের শত্রুরা হয়ে উঠেছে শক্তিশালী। আর লাঞ্ছিত হচ্ছে তাদেরই হাতে ঐ এককালের অজেয় মুসলিম জাতি।

চারঃ ক্বোরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াস- ইসলামের এ চার মৌলিক দলীল ক্বিয়ামত পর্যন্ত সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে, যা বাস্তবায়িত করে ইসলাম অপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। তা বাদ দিয়ে পরবর্তী মুসলিম বিশ্বের শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন মানবগড়া বিধি-বিধান ধার করতে আরম্ভ করেছে। ফলে তাদের নিশ্চিত অকৃতকার্যতা ইসলামকেও কলংকিত করেছে। এককালে যে পবিত্র ক্বোরআন-সুন্নাহর আদর্শ দিয়ে মুসলিম জাতি নিজেদেরকে এবং বিশ্বের অন্যান্য জাতিকেও ধন্য করেছিল এবং যার আলোকে তাদের পার্থিব ও পারলৌকিক ক্ষেত্রে মুক্তি দিয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধি দান করেছিল সে মুসলিম জাতি নিজেদেরই দুর্বলতার কারণে আপন আপন ভূমিতেও সে নি'মাত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আমাদের বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের এ দেশ বিশ্বের ২য় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এদেশ ইসলামের প্রকৃত মতাদর্শ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার সুফল ভোগ করতে পারেনি। এর কারণ খুঁজতে গেলেও উপরোক্ত কারণগুলোই সামনে আসে। একদিকে সত্যপন্থী সুন্নী মতাদর্শীরা এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেননি, অন্যদিকে ইসলামের মুখোশ পরে ইসলামেরই দোহাই দিয়ে রাজনীতি করতে এসে কিছু কিছু ভ্রান্ত মতবাদী সম্প্রদায় তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসঞ্জাত বিভিন্ন ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসলামের স্বচ্ছ সুন্দর চেহারায় কালিমা লেপন করেছে। বিগত স্বাধীনতা যুদ্ধেই এদের অনেকের স্বরূপ বিশেষভাবে উন্মোচিত হয়েছে। এসব দলের মধ্যে পাকিস্তানের কুখ্যাত মওদুদীর অনুসারী জামায়াতপন্থীদের কথাই সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

বিগত স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াত পন্থীদের হীন কর্মকাণ্ডকে শুধু ধর্ম নয়, দেশের কোন শ্রেণীর মানুষই ধিক্কার না দিয়ে পারেনি। তদানিন্তন সরকার উক্ত দলটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জনগণেরই সেই ঘৃণা ও ধিক্কারের যথাযথ বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল। অতঃপর সেই সরকার প্রধানের আবার উদারতার ফলে সাধারণ ক্ষমার সুবাদে আবারও তারা ক্রমশঃ এদেশে রাজনৈতিকভাবে নিজেদের স্থান গড়ে নিয়েছে। এর পরবর্তী সরকারের নেপথ্যে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে তারা তাদের বিভিন্ন চক্রান্তমূলক কর্মতৎপরতা চালানোর সুযোগ লাভ করলো; যা বর্তমানে এদেশবাসীর নিকট গোপন নয়। 

সে জামায়াতীদের উদ্দেশ্যেমূলক পদক্ষেপসমূহের মধ্যে তাফসীরুল ক্বোরআনের নামে বিভিন্ন জায়গায় সভা-মাহফিলের আয়োজন অন্যতম। এদেশের লোক সাধারণতঃ ধর্মপ্রাণ। আউলিয়া কেরাম ও ওলামা কেরামের প্রচেষ্টার ফলে এদেশের সরলপ্রাণ মুসলমানগণ পবিত্র ক্বোরআনের প্রতি বিশেষভাবে ধাবিত। এ সত্যটা জামায়াতীরা বুঝতে পেরে সেটাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে কসূর করেনি। তারা সুপরিকল্পিতভাবে এমন কিছু লোককে মুফাসসিরে ক্বোরআন সাজালো, যাদের কন্ঠ ও বাক-চাতূর্যই একমাত্র সম্বল; যাদের না আছে মাদ্রাসা শিক্ষার কোন সনদ। কারো কারো সনদ থাকলেও তাদের মধ্যে তাফসীর করার মত শরীয়তসম্মত যোগ্যতা নেই। অথচ সুললিত কন্ঠে ও বাক-চাতূর্য্যের মাধ্যমে ক্বোরআনের তাফসীরের সূরে মওদুদী মতবাদ প্রচারেই তারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত। জামায়াত-পন্থীদের আয়োজিত মাহফিলে স্বপক্ষীয়দের দ্বারা সংরক্ষিত মঞ্চে সেই পরিকল্পিত বক্তব্য অনেকটা জোর কন্ঠে আওড়াতেও ওরা পটু।

উক্তসব সাজানো মুফাসসিরের মধ্যে মৌলভী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বেশ কয়েক বৎসর ধরে তার ভ্রান্ত তাফসীর আমরা লক্ষ্য করে আসছি। বেশ কয়েক বার পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এবং সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে তার বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কিন্তু তার পক্ষ থেকে কোনরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। বিধায় তার ও তার সহকারীদের ভ্রান্ত তাফসীর-এর স্বরূপ উন্মোচনের উদ্দেশ্যে আমি এ প্রামাণ্য পুস্তকখানা লেখার প্রয়াস পেলাম।

এ পুস্তককে মৌং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও তার সহকারীদের তথাকথিত তাফসীরের ক্যাসেট ও জামায়াতপন্থীদের প্রচারিত বই-ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে তার আপত্তিমূলক বক্তব্যের খণ্ডন করা হয়েছে।

পুস্তকখানা  'মাসিক তরজুমানে'  বিগত '৮৭ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হলে তা পাঠক সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। দেশের কোন কোন সাপ্তাহিক পত্রিকায় এর বরাত দিয়ে সাঈদী সাহেবকে জবাব দেয়ার প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে। কিন্তু তবুও তার পক্ষ থেকে কোন জবাব আসেনি। পরিশেষে, পাঠক সমাজে বিশেষ চাহিদার প্রেক্ষিতে পুস্তকটা প্রকাশিত হওয়া যুগের দাবী হিসেবে বিবেচিত হয়।

এতে তাদের প্রত্যেকটা আপত্তিকর বক্তব্যের প্রথমে হুবহু উদ্ধৃতি দেয়া হয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে উক্ত বক্তব্য পর্যালোচনা করে তা থেকে pointout করা হয়েছে। আর তৃতীয় অধ্যায়ে সেটার সপ্রমাণ খণ্ডন করা হয়েছে।

পুস্তকখানা একদিকে জামায়াতপন্থীদের ভ্রান্ত তাফসীরের স্বরূপ উন্মোচন করবে, অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শরীয়তের সঠিক ফয়সালা সম্পর্কে পাঠক সমাজকে সম্যক অবগত করবে বলে দৃঢ় আশা। আল্লাহ্ পাক কবূল করুন! আমীন!

***********************

ভ্রান্ত তাফসীরঃ নমুনা–১

১৯৮৭ ইংরেজীর জানুয়ারী মাসে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ময়দানে 'ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ' কর্তৃক আয়োজিত 'তাফসীরুল কোরআন মাহফিল'-এর ২য় দিনে নিম্নলিখিত আয়াতের তাফসীর (?) করেন–তথাকথিত আন্তর্জাতিক মুফাস্সিরে ক্বোরআন
মৌং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীঃ

حٰم۞تَنۡزِيۡلُ الۡكِتٰبِ مِنَ اللّٰهِ الۡعَزِيۡزِ الۡلِيۡمِ۞ۙغَافِرِ الذَّنۢبِ وَ قَابِلِ التَّوۡبِ شَدِيۡدِ الۡعِقَابِ ذِیۡ الطَّوۡلِ۔لَا اِلٰهَ اِلَّا هُوَ۔اِلَيۡهِ الۡمَصِيۡرُ۞    
(سورة المؤمن)

এক
এ আয়াতের তাফসীরের নামে মৌং সাঈদী সাহেব সেদিন যে দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করলেন তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি তার বক্তব্যে কোন নির্ভরযোগ্য 'তাফসীর'-এর তোয়াক্কা করেননি; বরং মনগড়াভাবে ইসলামের নামে আত্মপ্রকাশ করা একটা ভ্রান্ত মতবাদী সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক বক্তব্যই পেশ করেছেন মাত্র। এ দিনের বক্তব্যে তিনি উল্লেখিত আয়াতের ذِیۡ الطَّوۡل ও اِلٰه ('যিত্ তাওলি' ও 'ইলাহ') এ দু'টি শব্দের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। আর, এ দু'টি শব্দের এমন ব্যাখ্যা (তাফসীর) পেশ করলেন, যা একদিকে পবিত্র ক্বোরআন মজীদের নির্ভরযোগ্য কোন তাফসীরের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই বিভ্রান্তিপূর্ণ; অন্যদিকে, তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা যারা পোষণ করেনা, তাদের সবাইকে মনগড়াভাবে 'মুশরিক'(!) ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করার উদ্দেশ্যেই প্রকাশ করে মাত্র।

যেমন, তিনি اِلٰه (ইলাহ) শব্দের অর্থ বলেন– "সাহায্যকারী, সহযোগী, সর্বশক্তিমান, সব কিছুর মালিক, আইনদাতা, বিধানদাতা, শাসনকর্তা"। তিনি আরো বলেন, "ইলাহ্' কি? ইলাহ হলো– মুশরিকরা কল্পিতভাবে কাউকে না কাউকে, দেব-দেবীকে, বিভিন্নভাবে কাউকে সাহায্যকারী, সহযোগী, সাহায্যপ্রদানকারী, অভাব দূরকারী, প্রয়োজন মেটাতে পারে, এমনভাবে কাউকে না কাউকে মনে করতো-দোয়া শ্রবণকারী, অনিষ্ট সাধনকারী-মুশরিকরা মনে করতো। এখানে বলা হচ্ছে– ক্বোরআন নাযিল হয়েছে এমন এক সত্তার কাছ থেকে যিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, অর্থাৎ যিনি বিশ্ব জাহানকে পরিচালনা করছেন। একক শক্তির বলে, একক ক্ষমতার বলে তিনি সবকিছু পরিচালনা করছেন। ক্বোরআন শরীফে এ ধরণের 'গায়রুল্লাহ্' (আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ)-কে অস্বীকার করে এক আল্লাহর উলুহিয়্যাৎকে মেনে নেয়ার জন্য বলা হয়েছে, ক্ষমতা আর কারো নেই। সমস্ত ক্ষমতা হলো একমাত্র আল্লাহর জন্য কেন্দ্রীভূত। তিনি ছেলে দেয়ার মালিক, ছেলে না দেয়ার মালিক, খেতে ও পরতে দেয়ার মালিক, ব্যবসায় উন্নতি দেয়ার মালিক, বিপদ থেকে বাঁচাবার মালিক, রোগমুক্ত করার মালিক, হায়াতের মালিক, মওতের মালিক। তিনি হচ্ছেন 'ইলাহ্'। 'ইলাহ' মানে 'আইনদাতা, বিধান দাতা।' সুতরাং এক কথায়, আল্লাহ্ যে একমাত্র ইলাহ্, এ কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে, আর অন্যদেরকে যত ক্ষমতা আছে বলে মনে করা হয়, সমস্ত বিশ্বাসকে একই জায়গায় কেন্দ্রীভূত করতে হবে। কোন খাজার ক্ষমতা নাই কাউকে একটা ছেলে দেয়ার, কোন খাজাবাবার ক্ষমতা নাই কারো বিপদ থেকে মুক্ত করার। কোন দয়াল বাবার ক্ষমতা নাই কাউকে কোনক্রমে বিপদ-মুসীবৎ থেকে রক্ষা করার, ব্যবসায় বিরাট উন্নতি করে দেয়ার। এযে মানুষের উপর এ জাতীয় বিশ্বাস করা হয়- এ সমস্ত মুশরিকানা বিশ্বাস।"

'ইলাহ' শব্দের তিনি (মৌং সাঈদী) যে অর্থ পেশ করলেন, সে অর্থের ভিত্তিতে তিনি আরো বলেন–

"মানুষ অনেককে 'ইলাহ' বলে মেনে নিয়েছে। তা নাহলে কবরের কাছে গিয়ে এত কান্নাকাটি কেন? কবরের উপর চাদর কেন? কবরের উপর আগর বাতি কেন? গোলাপ পানি কেন? গম্বুজ কেন? তার কারণ কি? এর কারণ হলো– 'মানুষেরা, যারা কবরে শুয়ে আছেন তাদেরকে 'ইলাহ' মেনে করেছে। কবরে যারা শুয়ে আছে তাদের কোন ক্ষমতা নাই। খোদার কছম, কবরে যিনি শুয়ে আছেন তাঁর কোন ক্ষমতা নাই। অন্য কাউকে ক্ষমতাবান যদি মনে করেন, তবে মুসলমানদের খাতায় নাম থাকবে না, নাম উঠবে মুশরিকদের খাতায়।"

তিনি আরো বলেন, "মানুষের ভিতরে কেউ খাজা বাবারে ইলাহ বানাইছে, কেউ দয়াল বাবারে 'ইলাহ' বানিয়ে নিয়েছে, কেউ প্রেসিডেন্টকে 'ইলাহ' বানিয়ে নিয়েছে, কেউ দেশের আইনকে 'ইলাহ' বানিয়েছে, কেউ মন্ত্রীকে 'ইলাহ' বানিয়েছে, কেউ নিজের কোন হুযূরকে নিজের 'ইলাহ' বানিয়েছে, কেউ নিজের নাফসকে 'ইলাহ' বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা বলেন– "লাইলাহা ইল্লাহুয়া" অর্থাৎ এগুলো 'ইলাহ' না; 'ইলাহ' হলেন– আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন।"


দুই

পর্যালোচনা
মৌং সাঈদী সাহেব পবিত্র ক্বোরআনের দোহাই দিয়ে যা বলতে চান তার টার্গেট এদেশের মুশরিক-বিধর্মীরা নয়, বরং এদেশের সত্যপন্থী, সরলপ্রাণ মুসলমানরাই। এদেশের মুসলমানদেরকে ইসলামের সঠিক রূপরেখা 'সুন্নী মতাদর্শ' থেকে ফিরিয়ে বিপথে (সাঈদী সাহেবের সমর্থিত মওদুদী মতবাদের দিকে) ধাবিত করা-ই তার উদ্দেশ্য। তিনি বলতে চানঃ

এক) উক্ত আয়াতটা সেসব মুসলমানদের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে, যারা আউলিয়া কেরামের খোদা-প্রদত্ত ও ক্ষমতায় বিশ্বাসী।

দুই) এ দেশের মুসলমানরা আউলিয়া কেরাম প্রমুখকে 'ইলাহ' (উপাস্য) বলে বিশ্বাস করেন।

তিন) নবী ও ওলীগণের মাযার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাওয়া শির্ক।

চার) নবী ও ওলীগণের ওফাতের পর তাঁদের কোন ক্ষমতা থাকেনা।

পাঁচ) মাযার নির্মাণ, গিলাফ দেয়া, আগর বাতি জ্বালানো ইত্যাদি শির্ক।

আর মৌং সাঈদী তার এসব দাবীর স্বপক্ষে নিম্নলিখিত তথাকথিত প্রমাণাদিও পেশ করেনঃ

এক) ক্বোরআন তার সামনে আছে।

দুই) 'খোদার শপথ করে বলছি।'

তিন)

يَا اَيُّهَا النَّاسُ اذۡكُرُوۡا نِعۡمَةَ اللهِ عَلَيۡكُمۡ هَلۡ مِنۡ خَالِقٍ غَيۡرِ اللهِ يَرۡزُقُكُمۡ مِنَ السَّمَاءِ وَ الۡاَرۡضِ

(আল্লাহ্ ছাড়া কোন রিয্কদাতা নাই।)

চার)

لَا اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَاَنّٰی تُؤۡفَكُوۡنَ

(আল্লাহ্কে ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া নিষিদ্ধ।)

পাঁচ)

قُلۡ اَرَأَيۡتُمۡ اِنۡ اَخَذَ اللهُ سَمۡعَكُمۡ وَ اَبۡصَارَكُمۡ وَ خَتَمَ عَلٰی قُلُوۡبِكُمۡ مَنۡ اِلٰهٌ غَيۡرُ اللهِ يَأۡتِيۡكُمۡ

(আল্লাহর বাতিলকৃত শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেয়ার মত কোন 'ইলাহ্'নেই।)

ছয়)

قُلۡ اَرَأَيۡتُمۡ اِنۡ جَعَلَ اللهُ عَلَيۡكُمُ اللَّيۡلَ سَرۡمَدًا اِلٰی يَوۡمِ الۡقِيٰمَةِ مَنۡ اِلٰهٌ غَيۡرُ اللهِ يَأۡتِيۡكُمۡ بِضِيَاءٍ۔ اَفَلَا تَسۡمَعُوۡنَ۞

(আল্লাহ্ রাতকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘ করতে চাইতে রাতকে সরিয়ে দিন আনার মত কোন্ 'ইলাহ' নেই।)

সাত)

قُلۡ اَرَأَيۡتُمۡ اِنۡ جَعَلَ اللهُ عَلَيۡكُمُ النَّهَارَ سَرۡمَدًا اِلٰی يَوۡمِ الۡقِيٰمَةِ مَنۡ اِلٰهٌ غَيۡرُ اللهِ يَأۡتِيۡكُمۡ بِلَيۡلٍ تَسۡكُنُوۡافِيۡهِ۔ اَفَلَا تُبۡصِرُوۡنَ۞

(আল্লাহ্ যদি চান দিনকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত লম্বা করে দিতে, তবে দিনকে সরিয়ে রাত আনার মত কোন 'ইলাহ' নেই।)

[এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মৌং সাঈদী বলেন, "কোন খাজা বাবার শক্তি আছে– রাতকে সরিয়ে দিনের আলো এনে দেয়ার? তা যদি না থাকে তাহলে মাযারে কেন যাও? সব মসজিদে দৌঁড়াবে"।]

আট)

وَاتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِهٖ اٰلِهَةً لَايَخۡلُقُوۡنَ شَيۡئًا وَّهُمۡ يُخۡلَقُوۡنَ۞

(আল্লাহকে বাদ দিয়ে এ লোকগুলোকে, যাদেরকে 'ইলাহ' বলে মেনে নিয়েছে ওরা কেউ কিছু সৃষ্টি করতে পারেনা, বরং ওরা সৃষ্ট হয়েছে। –সাঈদী)]

[এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাঈদী বলেন, –"ওরা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। আল্লাহ্ বলেন– যাদেরকে 'ইলাহ' বানিয়েছে, সেটা দেব-দেবী হোক আর সেটা খাজা হোক, আর যাই হোক না কেন, ওরা নিজেরাই তৈরী হয়েছে। তারা কিছুই তৈরী করতে পারেনা।" এমনকি একটা ঘাস বা একটা পিঁপড়াও না"।]

নয়)

وَلَايَمۡلِكُوۡنَ لِاَنۡفُسِهِمۡ ضَرًّا وَّ لَا نَفۡعًا وَّ لَايَمۡلِكُوۡنَ مَوۡتًا وَّ ۞لَاحَيٰوةً وَّ لَانُشُوۡرًا

(ওরা নিজেরা নিজের উপকার করতে পারেনা, কোন ক্ষতি থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারেনা। ওরা হায়াত ও মওতের মালিক না। পুনরুত্থানের ব্যাপারেও তাদের কোন ক্ষমতা নেই। –সাঈদী)

দশ)

قُلۡ اَرَأَيۡتُمۡ مَّا تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللهِ اَرُوۡنِیۡ مَاذَا خَلَقُوۡا مِنۡ الۡارۡضِ اَمۡ لَهُمۡ شِرۡكٌ فِی السَّمٰوٰتِ۔

(আসমান ও যমীন বানানোর ব্যাপারে 'মিন-দূনিল্লাহ্' -এর কোন ক্ষমতা নেই। –সাঈদী)

এগার)

لَوۡ كَانَ فِيۡهِمَا اٰلِهَةٌ اِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَا  ج..........عَمَّا يَصِفُوۡنَ

(একাধিক 'ইলাহ' থাকলে আসমান-যমীন ধ্বংস হয়ে যেত। যেমন মাঝি বেশী হলে নৌকার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।)


তিন

মৌং সাঈদীর প্রতি জবাব

প্রথমতঃ মৌং সাঈদী সাহেব 'ইলাহ' শব্দের যে অর্থ বলেছেন তা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
কারণ, 'ইলাহ্' শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে– 'মা'বুদ' বা 'উপাস্য'। যেমন– "আল্লামা রাগেব ইস্পাহানীকৃত প্রসিদ্ধ 'আলমুফরাদাত'-এ উল্লেখ করা হয়েছে– اِلٰه (ইলাহ) শব্দটা  الله (আল্লাহ) শব্দের সমার্থক। 'আলিফ-লাম' (ال) সেটার সাথে সংযোজন করা হয়েছে। অতঃপর 'ইলাহ' (اِلٰه)-এর 'হামযাহ'-(همزه) টা বিলুপ্ত করা হয়েছে। 'ইলাহ' (اِلٰه) শব্দটা আল্লাহর জন্য খাস। এদিকে ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেন– هَلۡ تَعۡلَمُ لَهٗ سَمِيًّا ; তাছাড়া, কাফির ও মুশরিকগণ তাদের সমস্ত উপাস্য বস্তুকে 'ইলাহ' বলে আখ্যায়িত করতো। যেমন– তারা সূর্যের উপাসনা করতো, তাই তারা সেটাকে 'ইলাহ' বলে আখ্যায়িত করতো। لَآِ اِلٰهَ اِلَّا الله (আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই), لَآ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ (তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই।) ইত্যাদি কলেমা দ্বারা সেসব মুশরিকদের দাবীর খণ্ডন করা হয়েছে। তাদেরই উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা বা ইবাদত করলে সে মুশরিক হয়ে যাবে। যেমন– মুশরিকগণ মূর্তিকে তাদের উপাস্য মনে করে সেগুলোর পূজা করে। (আল-মুফরাদাতঃ ২১ পৃষ্ঠা)

এ কারণেই নির্ভরযোগ্য সমস্ত তাফসীরে সাঈদী সাহেবের তাফসীরকৃত (!) আয়াতের অংশ "লা-ইলাহা ইল্লা হুয়া' - এর মধ্যেকার 'ইলাহ্' শব্দের অর্থ বলা হয় 'মা'বূদ' বা উপাস্য। (তাফসীরে বায়যাবী, কাশশাফ, খাযাইন ইত্যাদি দ্রষ্টব্য।) বস্তুতঃ সাঈদী সাহেব 'ইলাহ' শব্দের অর্থ করতে গিয়ে আল্লাহর যেসব গুণবাচক শব্দের অবতারণা করলেন সেগুলো 'ইলাহ' শব্দের শাব্দিক অর্থ-নয়; বরং সেগুলো বুঝানোর জন্য نَصِيۡرٌ (সাহায্যকারী), وَلِیٌّ (সাহায্যদাতা), مُعِين(সাহায্য প্রদানকারী), مُغۡنِیٌّ (অভাব দূরকারী), قدير (সর্বশক্তিমান), مَالك (সব কিছুর মালিক), شارع (আইনদাতা, বিধানদাতা), احكم الحاكمين (সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনকর্তা) ইত্যাদি আলাদা আলাদা গুণবাচক নাম বা শব্দ রয়েছে। কিন্তু সাঈদী সাহেব 'ইলাহ' শব্দের প্রকৃত অর্থকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে অন্য এমনসব অর্থ বললেন, যাতে তার পরিকল্পিত মতলব পূরণ করতে পারেন, যা ক্বোরআনের মনগড়া তাফসীরেরই নামান্তর মাত্র।

দ্বিতীয়তঃ আয়াতাংশ ذی الطول - এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- আল্লাহ্ অধিক সাওয়াবদাতা, অবধারিত শাস্তি ক্ষমা করে অনুগ্রহ প্রদর্শনকারী। (বায়যাবী, জালালাঈন, খাযাইন ইত্যাদি) কিন্তু সাঈদী সাহেব এ শব্দটার অর্থ বা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বললেন- এটা নাকি নবী ও ওলীগণের নিকট সাহায্যের জন্য না যাওয়ার নির্দেশবহ। (নাঊযুবিল্লাহ্!)

তৃতীয়তঃ সাঈদী সাহেবের বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্ট মনে হয় যেন সূরা 'আল-মু'মিনের' প্্রর প্রথম আয়াতটা সেসব মু'মিন-মুসলমানের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে, যারা আউলিয়া কেরামের খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতা ও মর্যাদায় বিশ্বাসী। বস্তুতঃ আয়াতের শানে নুযূল ও মর্মার্থ তা নয়। আয়াতের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে- যেহেতু সূরাটা মক্কী, ইসলামের প্রাথমিক যুগে সূরা নাযিল হয়েছে, যখন মক্কার লোকেরা আল্লাহর সঠিক পরিচয় পায়নি, যেহেতু এ সূরা নাযিল করে আল্লাহ্ তা'আলা এতে, বিশেষ করে সূরার প্রথম আয়াতে উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মক্কাবাসী তথা গোটা বিশ্ববাসীকে একমাত্র আল্লাহ্কেই উপাস্য বলে মেনে নেয়ার অপরিহার্যতা সম্পর্কে অনুধাবন করিয়েছেন। যেমন-

এক) তাফসীরে বায়যাবী শরীফে উল্লেখিত আয়াতের তাফসীর উল্লেখ করা হয় এভাবেঃ
۞ِحٰم ۞ تَنۡزِيۡلُ الۡكِتٰبِ مِنَ اللهِ الۡعَزِيۡزِ الۡعَلِيۡم
(অর্থাৎ "এ কিতাব (ক্বোরআন মজীদ) অবতীর্ণ হয়েছে এমন এক সত্তার নিকট থেকে, যিনি পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ।) এখানে আল্লাহর দু'টি গুণ বিশেষভাবে এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, যেহেতু পবিত্র ক্বোরআনে এমন অকাট্য দলীলাদি এবং হিকমত বিদ্যমান, যা আল্লাহর পরিপূর্ণ কুদরত এবং যথাযথ হিকমত (প্রজ্ঞা)-এর প্রমাণ বহন করে।
غَافِرِ الذَّنۡبِ وَقَابِلِ التَّوۡبِ شَادِيۡدِ الۡعِقَابِ ذِیۡ الطَّوۡلِ
(অর্থাৎঃ এবং গুনাহ্ ক্ষমাকারী, তওবা কবুলকারী, তার শাস্তি অতীব কঠিন, মহা পুরস্কারদাতা।) এগুলো হচ্ছে আল্লাহর আরো কতেক গুণ। এগুলো এ কথা প্রমাণ করার জন্য যে, পবিত্র ক্বোরআন মজীদে উৎসাহ প্রদান, ভীতি প্রদর্শন এবং ক্বোরআন মজিদের উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ ইত্যাদি বিষয়বস্তু বিদ্যমান। ক্বোরআন পাকের উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরোপুরিভাবে সেই মহান আল্লাহর দিকে মানুষকে ঝুঁকিয়ে দেয়া, যিনি গুনাহ্ ক্ষমাকারী, তওবা কবুলকারী। পক্ষান্তরে, তাঁকে অস্বীকারকারী মুশরিক-কাফিরদের জন্য তাঁর শাস্তি অতীব কঠিন। তিনি ذی الطوۡل ; এখানে طول মানে মুসলমদের মধ্যে যারা শাস্তির উপযুক্ত তাদের শাস্তি মওকুফ করে দিয়ে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা। সুতরাং ذی الطول মানে– 'শাস্তি মওকুফ করে দিয়ে অনুগ্রহ প্রদর্শনকারী।' অতঃপর এরশাদ হয় لَٓااِلٰهَ اِلّاهُوَ (তিনি ব্যতীত অন্য কোন 'মা'বূদ' নেই।) সুতরাং একমাত্র তাঁরই ইবাদতের প্রতি পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করা বাঞ্ছনীয়।
اِلَيۡهِ الۡمَصِيرُ (তাঁরই প্রতি ফিরে যেতে হবে।) অতঃপর তিনি অনুগত ও অবাধ্যদেরকে নিজ নিজ কর্মফল প্রদান করবেন। (তাফসীরে বায়যাবীঃ ২য় খণ্ডঃ ২৫২ পৃষ্ঠা)

দুই) তাফসীরে জালালাঈন শরীফে উল্লেখ করা হয়– "হা-মীম (এ বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ্ই সর্বাধিক জ্ঞাত।) কিতাব বা ক্বোরআন মজীদ নাযিল হয়েছে সেই মহান আল্লাহর নিকট থেকে যিনি আপন রাজত্বে পরাক্রমশালী, (স্বীয় সৃষ্টি সম্পর্কে) সর্বজ্ঞ, (মু'মিনদের জন্য) গুনাহ্ ক্ষমাকারী, এবং (তাদের) তওবা কবুলকারী, তাঁর শাস্তি অতীব কঠিন, প্রশস্ত পুরস্কারের মালিক, (অধিক সাওয়াবদাতা); শাস্তির উপযোগী গুনাহ্গারদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে তাদের প্রতি অনুগ্রহকারী। তিনি ব্যতীত কোন মা'বূদ নেই এবং তাঁরই প্রতি প্রত্যাবর্তন করতে হবে।" (তাফসীরে জালালাঈন শরীফ)

তিন) তফসীরে 'খাযাইনুল ইরফান'- এ উল্লেখ করা হয়– "হা-মীম। এ কিতাব নাযিল করা আল্লাহর নিকট থেকে, যিনি ইজ্জতওয়ালা, গুনাহ্ ক্ষমাকারী এবং তাওবা কবুলকারী (ঈমানদারদের), কঠিন শাস্তিদাতা (কাফিরদেরকে), মহা পুরস্কারের মালিক ('আরিফ' বান্দাদের জন্য), তিনি ব্যতীত অন্য কোন'মা'বূদ'(উপাস্য) নেই। তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে (অর্থাৎ বান্দাদেরকে আখিরাতে)। (কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান)

তাছাড়া, এ পবিত্র আয়াত নাযিল করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাফসীরে খাযাইনুল ইরফানে আরো উল্লেখ করা হয়– "যেহেতু পবিত্র ক্বোরআন মজীদ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত, সেহেতু সেটাকে মান্য করার ক্ষেত্রে বিতর্ক করা কোন মু'মিনের কাজ হতে পারে না। যেমন, এ সূরায়ই এর পরবর্তী আয়াতে এরশাদ হয়েছে– "আল্লাহর আয়াতগুলোর মধ্যে বিতর্ক করে না, কিন্তু কাফির।" আর ক্বোরআনে ঝগড়া-বিতর্ক করা মানে- 'আল্লাহর আয়াতের প্রতি তিরস্কার করা, মিথ্যাবাদ দেয়া ও অস্বীকার করা'। কিন্তু জটিল বিষয়ের সমাধানের জন্য জ্ঞানগত ও মূলনীতিগত পর্যালোচনা করা (পবিত্র ক্বোরআনের ভুলব্যাখ্যা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও খণ্ডন করা ইত্যাদি) ঐ ধরণের ঝগড়া বা বিতর্কের পর্যায়ে পড়েনা; বরং সেটা হবে মহান আনুগত্য ও ইবাদত। কাফিরদের ঝগড়া-বিতর্ক আল্লাহর আয়াতসমূহে এ ছিল যে, তারা ক্বোরআন পাককে 'যাদু' বলতো, কখনো 'কবিতা' বলতো, কখনো আবার 'গণনা-শাস্ত্র' বলতো, কখনো 'পুরানা কিচ্ছা-কাহিনী' বলে আখ্যায়িত করতো।"
কিন্তু মৌং সাঈদী সাহেব কোন প্রকার উদ্ধৃতি ছাড়াই আয়াতের মনগড়া তাফসীর পেশ করলেন। বিশেষ করে, 'ইলাহ' ও 'যিত্ তাওল' শব্দ দু'টির সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নবী ও ওলীগণকে মুশরিকদের মূর্তিগুলোর স্থানে এবং তাঁদের খোদা-প্রদত্ত ও নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি সম্মত সম্মান, মর্যাদা ও ক্ষমতায় বিশ্বাসী মু'মিনদেরকে মূর্তিপূজারীদের স্থানে বসিয়ে দেয়ার প্রয়াস চালিয়েছেন। বস্তুতঃ নবী ও ওলীগণের মর্যাদা সম্পর্কে সাঈদীর উক্ত মন্তব্য জমায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মৌং মওদুদীরই ভ্রান্ত মতবাদের অনুসরণ বৈ-কিছুই নয়।

চতুর্থতঃ শরীয়তের যে কোন মাসআলা প্রমাণ করতে হবে ক্বোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের ভিত্তিতে। এটাই হচ্ছে ওলামা কেরামের নিয়ম। কিন্তু তা না করে সাঈদী সাহেব প্রয়াশঃ তাঁর বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে বলে থাকেন- 'আমি খোদার কছম করে বলছি, ক্বোরআন আমার সামনে আছে।' এটা কিসের আলামত? পবিত্র ক্বোরআনের ভাষায়, কথায় কথায় শপথ করা মুনাফিক ও ইহুদীদের স্বভাব। সাধারণতঃ মূর্খরাই এ ধরণের পন্থা অবলম্বন করে থাকে। অবশ্য, কলেজিয়েট ময়দানে অনুষ্ঠিত তাফসীরুল ক্বোরআন (!) মাহফিলের ৩য় দিনের ('৮৭) এডিশনাল মুফাসসির (!) মৌলভী লুৎফর রহমান সাহেবের 'শপথ করা' সম্পর্কিত বক্তব্যটা এখানে তুলে ধরলাম। উক্ত মৌং লুৎফর রহমান সাহেব বলেন– "কছম করা কোন নামী-দামী লোকের কাজ নয়। প্রাচীন ইরানের একটা প্রবাদ আছে– 'এক কথা তুমি একবার বলেছ, আমি বিশ্বাস করেছি। একই কথা যখন দু'বার বলেছ আমি সন্দেহ করেছি। একই কথা যখন তিনবার বলেছ, তখন তোমার কথা মিথ্যা বলে আমার সন্দেহ জেগেছে। আর যখন তুমি কসম করেছ, তখন তোমার কথা বিশ্বাস করার মত কোন কারণ আমার নিকট থাকছে না।" তিনি আরো বলেন– "গ্রাম বাংলার আদম আলী, কদম আলী, কোব্বাত আলী, যত অজ পাড়া-গাঁয়ের মূর্খ, নিরেট গোঁড়া মানুষ, তারাই কসম করে থাকে। কিন্তু যাদের ব্যক্তিত্ব আছে এবং নিজের উপর নিজের একটা আত্মপরিচয়, আত্মবিশ্বাস আছে, তারাতো কসম করে না। যার ব্যক্তিত্ব আছে তিনি বলেন, 'আমি যা বলবো সেটা কথা।"

সুতরাং বুঝা গেল, মৌং সাঈদীর বক্তব্যগুলোর পেছনে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। বাস্তবেও তাই।

পঞ্চমতঃ মৌং সাঈদী সাহেব বলেছেন যে, "এদেশের মুসলমানরা নাকি আউলিয়া কেরামকে 'ইলাহ্' বলে বিশ্বাস করেন। মানুষেরা খাজা বাবাকে, পীর সাহেবকে, নিজের কোন হুযূরকে, দেশের প্রেসিডেন্টকে, নিজের সাফ্সকেও নাকি 'ইলাহ' বানিয়ে নিয়েছে। এটা কি এদেশের মুসলমানদের প্রতি মৌং সাঈদীর জঘন্য অপবাদ নয়? অবশ্যই। কারণ, কোন মুসলমান-ঈমানদার যে কোন ওলীকে, নিজের পরীকে, তার হুযূরকে, কোন প্রেসিডেন্ট বা মন্ত্রীকে তার 'ইলাহ্' বানায় না এবং এমন ধারণাও করে না। একথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। এদেশের কোন মুসলমান কখনো এমন করেছে বলে নজীর নেই। তাঁরা কামিল পীর-দরবেশের নিকট বায়'আত গ্রহণ করে থাকেন। এটাতো সুন্নাত। তাঁরা আউলিয়া কেরামের মাজারে গিয়ে যিয়ারত করেন। যিয়ারত করাও তো পবিত্র হাদীস শরীফের ভাষায় সুন্নাত। মৌং সাঈদী সাহেব কি এমন সুন্নাতকেও 'শির্ক' বলে আখ্যায়িত করতে চান?

যিয়ারত করা ও যিয়ারত করার জন্য সফর করা যদি শির্ক হয় তবে হুযূর (দঃ)- এর হাদীস সহ নিম্নলিখিত দলীলগুলোর কী জবাব দেবেন?

(এক)

كُنۡتُ نَهَيۡتُكُمۡ عَنۡ زِيَارَةِ الۡقُبُوۡرِ فَزُوۡرُوۡهَا

অর্থাৎঃ "আমি তোমাদেরকে কবরসমূহ যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু (তা রহিত করা হলো; সুতরাং) এখন তোমরা সেগুলোর যিয়ারত কর।" (সিহাহ্)

দুই)

 رُوِیَ عَنۡ اَبِیۡ شَيۡبَةَ اَنَّ النَّبِیَّ صَلَّی اللّٰهُ عَلَيۡهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَأتِیۡ قُبُوۡرَ الشُّهَدَآءِ بِاُحُدٍ عَلٰی رَأۡسِ كُلِّ حَوۡلٍ

অর্থাৎঃ "হযরত ইবনে আবী শআয়বআহ্ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) প্রতি বছর উহুদের শহীদানের মাযারে তাশরীফ নিয়ে যেতেন।" (ফতোয়া শামীঃ ১ম খণ্ড বা-বু যিয়ারাতিল ক্বুবূর)

তিন)

عَنۡ رَسُوۡلِ اللّٰهِ صَلَّی اللّٰهُ عَلَيۡهِ وَسَلَّمَ يَأَتِیۡ قُبُوۡرَ الشُّهَدَآءِ عَلٰی رَأسِ كُلِّ حَوۡلٍ فَيَقُوۡلُ سَلَامٌ عَلَيۡكُمۡ بِمَا صَبَرۡتُمۡ فَنِعۡمَ عُقۡبٰی الدَّارِ وَ الۡخُلَفَآءُ الۡاَرۡبَعَةُ هٰكَذَا كَانُوۡا يَفۡعَلُوۡنَ.

অর্থাৎঃ হুযূর (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত, তিনি প্রতি বছর শহীদানের মাযারে তাশরীফ নিয়ে যেতেন, আর তাঁদেরকে সম্বোধন করে বলতেন, 'সালামুন্ আলায়কুম বিমা সাবারতুম ফা নি'মা ওক্ববাদ্দার।" (তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক, যেহেতু তোমরা তরবারির আঘাতে ধৈর্যধারণ করেছ। তোমাদের পরকাল কতই উত্তম!) খোলাফায়ে রাশেদীন (চার খলীফা লিঃ)-ও অনুরূপ তাঁদের মাযারে যেতেন। (এবং যিয়ারত করতেন)। (তাফসীরে কবীর ও তাফসীরে দুররে মানসূর)

চার) ইমাম শাফে'ঈ (রাহমাতুল্লাহি-আলায়হি) বরকত লাভের উদ্দেশ্যে সফর করে ইমাম আবূ হানিফা (রাহমাতুল্লাহি-আলায়হি)-এর মাযারে যেতেন।
উল্লেখ্য, বিশ্বের মুসলমানদের ন্যায় আমাদের দেশের মুসলমানরাও হুযূর (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম), খোলাফায়ে রাশেদীন, মাযাহাবের ইমামগণ প্রমূখের অনুসরণে গাউসে বাগদাদ, খাজা গরীব নওয়ায, সালারে মাস'ঊদ, দাতা গঞ্জে বখ্শ (রাহমাতুল্লাহি-আলায়হিম) প্রমূখ আউলিয়া কেরামের মাযার শরীফ যিয়ারত করে বরকত লাভ করে থাকেন। মৌং সাঈদী সাহেবকে কি তার অজ্ঞতা এতই দুঃসাহসী করে তুলেছে যে, তিনি পাইকারিভাবে সবাইকে 'মুশরিক' নামে আখ্যায়িত করে ছাড়ছেন?
বাকী, তাঁদের (আউলিয়া কেরাম) নিকট সাহায্য চাওয়া। তাওতো ক্বোরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং ক্বিয়াস মোতাবেক জায়েয আছে। এটাও তো এ জন্য যে, সমস্ত মু'মিন-মুসলমান মনেপ্রাণে একথা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। তিনি তাঁর নবীগণ এবং আউলিয়া কেরামকে তাঁদের জীবদ্দশায় এবং ওফাতের পর এমন ক্ষমতা দান করেন, যা দ্বারা তাঁরা আল্লাহর সৃষ্টির উপকার করতে পারেন। শরীয়তের পরিভাষায় এটাকে বলা হয় 'ইস্তেমদাদে রূহানী'। এটা যদি সাঈদী সাহেবের মতে শির্ক হয়, তবে তিনি নিম্নলিখিত দলীলাদির কী জবাব দেবেন?
এক) তাফসীরে কবীরঃ ৩য় খণ্ডঃ পারা- ৭ সূরা 'আন'আম-এর আয়াত 

وَلَوۡاَشۡرَكُوۡا لَحَبِطَ عَنۡهُمۡ مَّا كَانُوۡا يَعۡمَلُوۡنَ

-এর আলোকে উল্লেখ করা হয়–

 وَثَالِثُهَا الۡاَنۡبِيَاءُ هُمُ الَّذِيۡنَ اَعۡطَاهُمُ اللّٰهُ تَعَالٰی مِنَ الۡعُلُوۡنِ وَ المعَارِفِ مَا لِاَجَلِهٖ يَقۡدِرُوۡنَ عَلٰی التَّصَرُّفِة فِی بَوَاطِنِ الۡخَلۡقِ وَ اَرۡوَاحِهِمۡ وَاَيۡضًا اَعۡطَاهُمۡ مِنَ الۡقُدۡرَةِ وَ المَكۡنَةِ مَالِاَجَلِهٖ يَقۡدِرُوۡنَ عَلٰی التَّصَرُّفِ فِی ظَوَاهِرِ الۡخَلۡقِ

অর্থাৎঃ "তৃতীয়তঃ নবীগণ (আলাইহিমুস্ সালাম) তাঁরা হলেন ঐসব হযরত যাঁদেরকে প্রতিপালক আল্লাহ্ তা'আলা এমন সব জ্ঞান ও মা'রেফাত দান করেছেন, যা দ্বারা তাঁরা মাখ্লূকের অভ্যন্তরীন অবস্থা ও তাদের আত্মসমূহের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন এবং তাঁদেরকে এ পরিমাণ কুদরত বা শক্তি দান করেছেন, যা দ্বারা মাখলুকের প্রকাশ্য অবস্থার উপরও ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।"

দুই) 'মিশকাত শরীফঃ বা-বু যিয়ারাতিল ক্বুবূর' -এর হাশিয়ায় আছে–

وَاَمَّا الۡاِسۡتِمۡدَادُ بِاَهۡلِ الۡقُبُوۡرِ فِی غَيۡرِ النَّبِیِّ عَلَيۡهِ السَّلَامُ اَوِ الۡاَنۡبِيَآء فَقَدۡ اَثۡبَتَهُ المَشَآئِخُ الصُّوۡفِيَّةُ وَ بَعۡضُ الۡفُقۡهَآءِ قَالَ الۡاِمَامُ الشَّافِعِیؒ قَبۡرُمُوۡسٰی الۡكَاظِمِ تِرۡيَاقٌ مُّجَرَّبٌ لِاَجَابَةِ الدُّعَاءِ وَقَالَ الۡاِمَامُ الغَزَّّالِیُّ مَنۡ يُّسۡتَمَدُّ فِی حَيَاتِهٖ يُسۡتَمَدُّ بَعۡدَ وَفَاتِهٖ

অর্থাৎঃ রসূলে করীম﴾ﷺ﴿ এবং অন্যান্য নবীগণ (আলাইহিস্ সালাম) ছাড়াও অন্যান্য কবরবাসী থেকে কিছু চাওয়ার বৈধতাকে সুফী ও মাশাইখে কেরাম এবং ফক্বীহগণের একটা বিরাট সংখ্যা স্বীকার করেছেন। ইমাম শাফেয়ী (রাহঃ) বলেছেন– "হযরত মুসা কাযেম (রাদিয়াল্লাহু আনহু)- এঁর মাযার শরীফ প্রার্থনা কবুল হবার জন্য বিষ-পাথরের ন্যায় পরীক্ষিত।" ইমাম গাযযালী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) বলেছেন– "যে সব বুযর্গের নিকট থেকে তাঁদের জীবদ্দশায় সাহায্য চাওয়া যায়, তাঁদের নিকট তাঁদের ওফাতের পরও সাহায্য চাওয়া যায়।"

তিন) তাফসীরে কবীর, রূহুল বয়ান ও তাফসীরে খাযিনঃ সূরা য়ূসুফঃ আয়াত–

فَلَبِثَ فِی السِّجۡنِ بِضۡعَ سِنِيۡنَ

-এর তাফসীর উল্লেখ করা হয়–

اَلۡاِسۡتِعَانَةُ بِالنَّاسِ فِی دَفۡعِ الضَّرَرِ جَائِزٌ

অর্থাৎঃ "মুসীবতের সময় মানুষের সাহায্য গ্রহণ করা জায়েয।"

আর সাঈদী সাহেব বললেন– এদেশের লোকেরা দেশের আইন, প্রেসিডেন্ট বা মন্ত্রীকে 'ইলাহ্' বলে মেনে নিয়েছে। সেটার কোন বাস্তবতা আছে বলে কল্পনাও করা যায় না। এমন উদ্ভট কথাও কি তিনি রচনা করতে পারেন? আর যদি তিনি বলেন যে, দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে, দেশের কোন সম্মানিত মন্ত্রীকে কিংবা দেশের আইন-কানুনকে মান্য করাই শির্ক, তাহলে কি তিনি তাদেরকে মানেন না? যদি তা-ই হয় তাহলে জমায়াতে ইসলামীর আমীরেরা যে বলেছেন– "১৯৭২ ইংরেজীর সংবিধান জাতির পবিত্র আমানত"– এ কথার মতলব কি? আর সেটার অধীনে তাঁরা আবার নির্বাচনেই বা যান কেন? এ সংবিধানের অধীনে সংসদে আইন পাশ করার জন্য তিনিও তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিচ্ছেন কেন? তাঁর ঐ বক্তব্য কি একথা প্রমাণ করেন না যে, জমায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ যদি প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রী হন, আর তাঁদেরকেও যদি এ দেশের লোকেরা কখনো মেনে নেন (খোদা না করুক।) তাহলে তাও 'শির্ক' হবে? আর কোন প্রেসিডেন্ট বা মন্ত্রীকে নিয়ম মোতাবেক সম্মান করলেও কি শির্ক হয়ে যাবে?

ষষ্ঠতঃ মৌং সাঈদী সাহেবের দাবী হচ্ছে– 'যিনি কবরে শুয়ে আছেন– যেমন নবী, ওলী, তাঁর কোন ক্ষমতা নেই। (অর্থাৎ নবী ও ওলীগণের ওফাতের পর তাঁদের কোন ক্ষমতা থাকে না।) তাই মাযারে যেতে নেই, বরং দৌড়াতে হবে মসজিদের দিকে।'

এটাও মৌং সাঈদীর নিছক ভ্রান্তির পরিচায়ক। 




Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা