বায়াত ও খিলাফতের বিধান


ভূমিকা ও লেখক পরিচিতি
 

আত্মারূপ তরীকত (সূফীতত্ত্ব) ও দেহরূপ শরীয়ত এ দুইয়ের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা মুসলিম মানসে অপরিসীম। এ জন্য একজন প্রকৃত তাসাউফপন্থি (সূফী) এর জীবনে শরীয়ত-তরীকত ও মা'রিফাত সমভাবে ক্রিয়াশীল। প্রকৃত মুমিন ও প্রকৃত তরীকতপন্থি (সূফী)-তে তাই কোন পার্থক্য নেই। প্রকৃত সূফী মুসলমানই মুসলিম সমাজে মুমিন বা প্রকৃত মুসলমান বা কামিল ওলী-আল্লাহ রূপে পরিচিত । এ সম্পর্কে হযরত ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন,

مَن تَفَقَّهَ وَلَم یَتَصَوَّفَ فَقَد تَفَسَّقَ وَمَن تَصَوَّفَ وَلَم یَتَفَقَّه فَقَد تَزَندَقَ وَمَن جَمَعَ بَینَهُمَا فَقَد تَحَقَّقَ-

যে ব্যক্তি শুধু শরীয়ত (ফিকহ) মানে ও পালন করে, অথচ তাসাউফ অস্বীকার করে, সে ব্যক্তি ফাসিক। পক্ষান্তরে যে শুধু তাসাওউফ মানে ও পালন করে এবং শরীয়ত (ফিকাহ) অস্বীকার করে সে জিন্দিক । কিন্তু যে উভয়টিকে মেনে চলে সেই প্রকৃত মুমিন।
তাই তরীকত (তাসাউফ)-এর প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে জড়িত আছে কুরআন হাদীসের অমর বাণীসমূহ। বস্তুত তরীকত (তাসাউফ) হচ্ছে কুরআন-হাদীসের মগজ, ইসলামের আত্মা। ফলে মুসলিম সমাজে তাসাউফ এক সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়। এমনকি তাসাউফের প্রভাব এককালে এতই চরমে পৌঁছেছিলো যেকালে তার নামে ভণ্ডামির আর অন্ত রইলো না। ফলে একশ্রেণীর ওলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদ যথার্থ তাসাউফকে সংশয়ের চোখে দেখতে শুরু করলেন।
তাসাউফ (তরীকত) থেকে ইসলামি চিন্তাবিদদের সংশয় নিরসনে এবং তাসাউফ বা তরীকতের প্রকৃত স্বরূপ ও ব্যাখ্যা জনসম্মুখে তুলে ধরার মহৎ মানসে। হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীতে সেসব মহান মনীষী নিরন্তন গবেষণা করে যান তাঁদের মধ্যে আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম। তিনি যেমন শরীয়তের ইমাম (পথপ্রদর্শক), তেমনি তরীকত (তাসাউফ)-এর ইমামও। সকল প্রসিদ্ধ তরীকার খিলাফত ও ইজাযত তার অর্জন ছিলো। তিনি শুধু পীর-মুরিদীর মাধ্যমে ইলমে তাসাউফ চর্চায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেননি বরং কতেক রিপুতাড়িত মূখ সূফী কর্তৃক তাসাউফ চর্চার নামে সৃষ্ট যাবতীয় কুপ্রথা ও ভুল ধারণার সংশোধন এবং তাসাউফকে সুশৃঙ্খল নিয়মে ফিরিয়ে আনতে নিয়মিত কলম যুদ্ধও চালিয়ে যান। শরীয়তের বিধি বিধানকে উপেক্ষা করে যারা নিজেকে সূফী বা তরীকতপন্থি বলে বেড়ায় তিনি তাদের প্রবঞ্চনা থেকে দূরে থাকা উচিৎ বলে মনে করতেন। তার মতে, শরীয়ত হচ্ছে। তাসাউফের পথ-পরিক্রমায় প্রারম্ভিক স্তর। শরীয়ত সূফীর আধ্যাত্মিক পথ-পর্যটনের প্রথম ও অপরিহার্য অংশ। শরীয়তের যথার্থ চর্চা ও অনুশীলন ছাড়া মারিফাত (খাদা পরিচিতি-যা একজন সূফীর পরম লক্ষ্য) অর্জন অসম্ভব; তিনি শরীয়তকে তাসাউফের পথে উন্নতি ও সফলতা লাভের একমাত্র মাপকাঠি বলে মনে করতেন। শরীয়ত ও তরীকতের এ গৃঢ়রহস্য উন্মোচনে তিনি রচনা করলেন, মকালুল উরাফা বি-ইযাযি শরয়ী ওয়া উলামা।
তাসাউফের পথ-পরিক্রমায় একজন প্রকৃত পীরের হাতে মুরীদ হয়ে আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হওয়া সূফী তরীকার প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু বর্তমানে পীর-মুরিদীকে অনেকে লাভজনক ব্যবসা মনে করে থাকে। ফলে, শরীয়ত ও তরীকতের যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ না হয়ে অনেকেই পূর্বপুরুষের বুযর্গীর ও পীর হওয়ার সুবাদে শুধু বংশের ধারায় নিজেকে পীর বা সাজ্জাদানশীন বলে প্রকাশ করে তাসাউফ ও তরীকতের পথকে কলুষিত করে তুলেছে।
তাই আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা পীর-মুরিদ-বায়আত ইত্যাদি সব প্রয়োজনীয় বিষয়ের একটি নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেছেন নাকাউস সুলাফা ফী আহকামিল বায়আতি ওয়াল খিলাফা পুস্তকে। বর্তমানে আমাদের তরীকতের আকাশে যে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে, আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির এ পুস্তকটি সত্যসন্ধানীদেরকে সঠিক পথের দিশা দিতে পারে এ দৃঢ় আশায় এটার বঙ্গানুবাদের প্রয়াস পাই । চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লাস্থ মুহাম্মদী কুতুবখানা ১৯৯৯ সালে পুস্তকটি পীর-মুরিদ ও বায়আত : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ শিরোনামে অংশ বিশেষ প্রকাশ করে। বইটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বইটির এ পর্যন্ত তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এটা বর্ধিত ও পরিমার্জিত চতুর্থ সংস্করণ । আশা করি পূর্বের মতো এ সংস্করণও পাঠকের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে।
সনজরী পাবলিকেশনের স্বত্বাধিকারী শ্রদ্ধেয় মুহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরী পুস্তকটি প্রকাশে এগিয়ে এসেছেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে যারা আন্তরিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও মুবারকবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ তা'আলা আমাদের প্রচেষ্টা কবুল করুন।
আমিন।

মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন       ৯ যিলহজ ১৪৩০ হি.
সারাং বাড়ি, কুলগাঁও
২৭ নভেম্বর ২০০৯ ইং
বায়েজিদ বোস্তামী, চট্টগ্রাম
➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖
অধ্যায় ১

শরীয়ত ও তরিকতের প্রয়োজনীয়তাঃ

পবিত্র ইসলামী শরীয়তে সব কিছুই বিদ্যমান

نَحمَدُهُ وَنُصَلِّی وَنُسَلِّمُ عَلَي رَسُولِهِ الکَرِیمِ

পবিত্র ইসলামী শরীয়তে সব কিছুই বিদ্যমান
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের মধ্যে শরীয়ত, তরীকত ও হাকীকত ইত্যাদি সব কিছুরই বর্ণনা রয়েছে। ওই সবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট ও সহজ হচ্ছে শরীয়তের বিধানাবলী। আর শরীয়তের অবস্থা তো হচ্ছে এই যে, যদি মুজতাহিদ-ইমামগণ। শরীয়তের ব্যাখ্যা না করতেন, তবে আলিমগণ কিছুই বুঝতেন না । আর সম্মানিত আলিমগণ যদি মুজতাহিদ-ইমামগণের ইজতিহাদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ না করতেন তবে আমরা সাধারণ আলিমগণ ইমামগণের ইরশাদসমূহ বুঝতেও অক্ষম হতাম । আর যদি সাধারণ আলিমগণ সাধারণ লোকের (عوام) সামনে ইসলামী কিতাবসমূহের ব্যাখ্যা এবং ইমামগণের বিভিন্ন মতানৈক্যের মধ্যে সামাঞ্জস্য বিধান না করতেন তবে সাধারণ লোক কখনো কিতাবসমূহ থেকে শরীয়তের বিধি-বিধানসমূহ বের করে আমল করতে সক্ষম হতো না বরং হাজারো ভুল করে বসতো এবং একটির স্থলে অন্যটি বুঝে বসতো।

শরীয়তের অনুসরণে সাধারণ লোকের করণীয়

শরীয়তের অনুসরণে সাধারণ লোকের করণীয়।
সুতরাং এ পরম্পরা নির্ধারিত হলো যে, এ যুগের সাধারণ লোক আলিমে দ্বীনের শরণাপন্ন হবেন, আর আলিমগণ দ্বারস্থ হবেন বিজ্ঞ-আলিমগণের গ্রন্থাবলীর উপর আর বিত্ত-গ্রন্থপ্রণেতাগণ মাশায়িখে কিরামগণের ফতওয়ার উপর নির্ভর করবেন, মাশায়িখে কিরাম দ্বারস্থ হবেন হিদায়তের উপর প্রতিষ্ঠিত মুজতাহিদ ইমামগণের ওপর আর মুজতাহিদগণ নির্ভর করবেন কুরআন ও হাদীসের উপর । সুতরাং যে ব্যক্তি এ পরম্পরার যে কোন পর্যায় ভঙ্গ করলো সে অন্ধ । যে ব্যক্তি তার উর্ধ্বতন কোন হাদী (পথপ্রদর্শক) এর অনুসরণ ছেড়ে দিলো অতিসত্ত্বর সে কোন গভীর কুপে পতিত হবে ।
আরিফ বিল্লাহ সায়্যিদ ইমাম আবদুল ওহাব শা’রানী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি মিযানু শরীআতিল কুরবা গ্রন্থে বলেন,

لَو قَدَرَ أَنَّ أَهلَ دَورِ تَعدُوا مِن فَوقِهِم إِلَي الدَّورِ الَّذِي قَبلَهُ لاَ انقَطَعَت وَصلَتُهُم بِالشَّرعِ وَلِم یَهتَدُوا لِإِیضَاحِ مُشکِلٍ وَّلاَ تَفصِیلِ مُجَمَلٍ وَّتأَمُّلٍ. یَا أَخِيفرض! لَو لاَ أَنَّ رَسُولَ اللّٰهِ ﷺ فَصَّلَ بِشَرِیعَتِهِ مَا اجمَلَ فِي القُرآنِ لَبَقِيَ عَلَي اجمَالِهِ کَمَا أَنَّ الأٸِمَّةَ المُجتَهِدِینَ لَو لَم یُفَصَّلُوا مَا اجمَلَ فِي السُّنَّةِ ابقَیَةِ السُّنَّةُ عَلَي اجمَالَهَا وَهَکَذَا إلَي عَصرِنَا هَذَا.

‘মনে করুন, যদি কোন যুগের মানুষ তার পূর্ববর্তী যুগের মানুষ (আলিম ও মুজতাহিদগণ)-কে অতিক্রম করে যায়, তবে শরীয়ত প্রবর্তক হুযুর আলায়হিস সালাতু ওয়াস সালামের সাথে তাদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন তারা সংক্ষিপ্তকে ব্যাখ্যা এবং অস্পষ্টকে স্পষ্ট করার পথ পাবে না। হে ভাই! একটু চিন্তা করুন! যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআনের অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা না করতেন তবে কুরআন আপন অস্পষ্টতায় থেকে যেতো। তেমনিভাবে মুজতাহিদ-ইমামগণ হুযূর (ﷺ)র অস্পষ্ট সুন্নাতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না করতেন, তবে সুন্নাত স্বীয় অস্পষ্টতার উপর থেকে যেতো। আর এ ধারাক্রম আমাদের এ যুগ পর্যন্ত চলে আসছে।
ওই গ্রন্থে আরও উল্লেখ আছে যে,

کَمَا أَنَّ الشَّارعَ بَیَّنَ لَنَا بِسُنَّتِهِ مَا اجمَلَ فِي القُرٱنِ وَکَذَالِكَ الأَٸِمَّةُ المُجتَهِدِینَ بَیَّنُوا لَنَا مَا اجمَلَ فِي احَادِيثِ الشَّرِیعَةِ وَلَولاَ بَیَانُهُم لَنَا ذَالِكَ لَبَقِیَةِ الشَّرِیعَةُ عَلَي اجمَالِهَا وَهَکَذَ القَولُ فِي أَهلِ کُلِّ دَورٍ بِالنِّسبَةِ لِلدَّورِ الذَّینَ قَبلَهُم إِلَي یَومَ القِیَامَةِ فَإَنَّ الإِجمَالَ لَم یَزَل سَارِیَّا فِي کَلاَمِ عُلَمَاءِ الأُمَّةِ إِلَي یَومِ القِیَمَةِ وَلَولاَ ذَالِكَ مَا شَرِحَتِ الکُتُبُ وُلاَ عَمَلَ عَلَي الشُّرُوحِ حَوَاشُ کَمَا مَرَّ.

“যেমনি শরীয়ত প্রবর্তক হুযূর আলায়হিস সালাতু ওয়াসসালাম স্বীয় সুন্নাত দ্বারা কুরআন মজীদের সংক্ষিপ্ত ভাষ্যের ব্যাখ্যা করেছেন, তেমনি মুজতাহিদ ইমামগণ আমাদের জন্য শরীয়তের বিধান সংবলিত হাদীসমূহের সংক্ষিপ্ত ভাষ্যের ব্যাখ্যা করেছেন। যদি তাঁদের ব্যাখ্যা না হতো তবে শরীয়ত স্বীয় অস্পষ্টতার উপর থেকে যেতো। আর এ নিয়ম প্রত্যেক যুগে তার পূর্বকার যুগের লোকের জন্য প্রযোজ্য। এ ধারা কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। এ কারণে প্রত্যেক যুগের এই উম্মতের আলিমগণের বাণীতে কোন না কোন অস্পষ্টতা
১. শারানী, আল-মিযান আল-কুবরা, অনুচ্ছেদ : ومما بذالك علي صحة ارتباط جمیع اقوال علماء الشریعة আল-বাৰী, মিসর থেকেই যায়। যদি এমন পরিস্থিতি না হতো তবে কিতাবসমূহের ব্যাখ্যা আর ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোর টীকা-টিপ্পনী রচনা করা হতো না। এ আলোচনা ইতোপূর্বেও করা হয়েছে।”
গায়র-ই মুকাল্লিদগণ (ইমাম চতুষ্টয়ের যে কোন একজনের অনুসরণ ত্যাগকারী) এ পরম্পরাকে ত্যাগ করেই পথভ্রষ্ট হয়েছে । তাদের এটা জানা নেই যে,

ہمہ شیر ان جہاں بستہ ایں سلسلہ اند     روہہ از حیلہ چساں بگسلد ایں سلسلہ را

‘দুনিয়ার সমস্ত নেকড়ে এ শিকলে বন্দী, শৃগাল স্বীয় শঠতা দ্বারা এ শিকলকে নড়বড়ে করবে কেমনে।

তরীকত অনুশীলনের জন্য পীরের প্রয়োজনীয়তা

যখন শরীয়তের আহকাম (বিধি-বিধান)-এর বেলায় এ অবস্থা, তখন একথা সুস্পষ্ট হলো যে, তরীকতের নিগূঢ় রহস্য ও মারিফাতের প্রকৃত অবস্থা (হাকীকত)-এর ক্ষেত্রে কামিল পীর-মুরশিদের সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে কুরআন ও হাদীস থেকে হুকুম বের করা কিরূপ অসাধ্য ব্যাপার। তরীকত ও মারিফতের এ পথ অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং পীর মুরশিদের আলো ব্যতীত এ পথ অত্যন্ত ঘোর অন্ধকার। এ পথের অনেক বড় বড় অভিযাত্রীকে অভিশপ্ত শয়তান এমনভাবে পথভ্রষ্ট করেছে যে, জমিনের নিম্নস্তরে পৌছিয়ে দিয়েছে। সুতরাং কামিল রাহবার (পথপ্রদর্শন) ছাড়া এ পথে চলা এবং নিরাপদে পথ গমণ করার দাবি কী দুঃসাহস!
সম্মানিত ইমামগণ বলেছেন, কোন ব্যক্তি যতো বড় আলিম, যাহিদ ও কামিল হোক না কেন, তার উপর ওয়াজিব হলো কোন ওলী-ই আরিফকে নিজ মুরশিদ হিসেবে গ্রহণ করা। এ ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
মিযানুশ শরীয়ত গ্রন্থে ইরশাদ হয়েছে,

فَعُلِمَ مِن جَمِیعِ مَا قَرَّرنَاهُ وُجُوبَ إِتِّخَاذِ الشَّیخِ لِکُلِّ عَلِمَ طَلَبَ الوُصُولَ إِلَي شُهُودِ عَینِ الشَّرِیعَةِ الکُبرَاي وَلَوِ اجمَعَ جَمِیعُ أَقرَانِهِ عَلَي عِلمِهِ وَعَمَلِهِ وَزُهدِهِ وَوَرعِهِ وَلَقَّبُوهُ بِالقُطُبِیَّةِ الکُبرَي فَإِنَّ لِطَرِیقِ القَومِ شُرُوطً لاَ یَعرِفُوهَا إِلاَّ المُحُقِّقُونَ مِنهُم دُونَ الدَّخِیلِ فِیهِم بِالدَّعَوَی وَالأَوهَامِ وَرُبَمَا کَانَ مَن لَقَّبُوهُ بِالقُطُبِیَّةِ لاَ یَصلِحُ أَن یَکُونَ مُرِیدًا لِقُطُبٍ.

১. আবদুল ওহাব শা'রানী, আল-মিযান আল-কুবরা, অনুচ্ছেদ :
في بیان استحاله خروج شیٸ,
১/৪৬,
মোস্তাফা আল-বাবী, মিসর।

‘অতএব জানা গেলো যে, প্রত্যেক আলিম, যে মহান শরীয়তের নিগূঢ় তথ্য অবলোকনের মর্যাদায় পৌঁছতে চান, তার জন্য কোন কামিল শায়খ (পীর-মুরশিদ)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করা ওয়াজিব। যদিও তার যুগের সকল লোক তার ইলম, আমল, যুহদ-পরহেযগারীর উপর ঐক্যমত পোষণ করে এবং এমনকি যদি তাকে কুতুবিয়্যাত-ই কুবরার উপাধিও দেওয়া হয়। কারণ, এ সম্প্রদায় (তাসাউফপন্থি)-এর পথের কিছু শর্তাবলী রয়েছে, যেগুলো ওই পথের তাত্ত্বিক অনুসন্ধানীগণ ছাড়া জানে না। না ওই সব লোক জানে, যারা শুধু স্বপ্রবৃত্তিতে ওই পথে অনুপ্রবেশ করেছে। অনেক সময় যাকে লোকেরা কুতুব' হওয়ার উপাধি দান করেছে, সে কোন প্রকৃত কুতুব’-এর মুরিদ হওয়ার উপযুক্ত নয়।

সুতরাং তরীকতের অনুশীলনের মাধ্যমে মহান রবের প্রকৃত মারিফাত অর্জন করতে ইচ্ছুক লোকের জন্য পীর-মুরশিদের দীক্ষা গ্রহণ করা ওয়াজিব। অকর্মণ্য লোক যদি তরীকতের পথে চলতে নাও চাই তবুও ওসীলা গ্রহণের জন্য হলেও তার পীর মুরশিদের প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা তো স্বীয় বান্দাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

أَلَیسَ اُللّٰهُ بِکَافٍ عَبدَه

‘আল্লাহ কি তার বান্দাদের জন্য যথেষ্ট নয়?
তারপরও মহান আল্লাহ বলেন,

وَاَبتَغُوا إِلَیهِ الوَسِیلَةَ

‘আল্লাহর পথে ওসীলা তালাশ কর।

' ওসীলা' গ্রহণ ব্যতীত আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছা অসম্ভব

আল্লাহর দিকে `ওসীলা' হচ্ছেন রসূলুল্লাহ (ﷺ) আর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের দিকে ওসীলা। হচ্ছেন মাশাইখে কিরাম। এ পরম্পরায় আল্লাহ তা'আলা পর্যন্ত ওসীলা ব্যতীত পৌঁছা যেমন অসম্ভব, তেমনি রসূলুল্লাহ (ﷺ) পর্যন্তও ওসীলা
১. আবদুল ওহাব শা'রানী, আল-মিযান আল-কুবরা, অনুচ্ছেদ :ان القاٸل کیف الوصول, ১/২২, মোস্তফা আল-বাবী, মিসর
২. আল-কুরআন, সুরা আল-যুমার, ৩৯:৩৬
৩. আল-কুরআন, সুরা আল-মায়িদা, ৫:৩৫

ছাড়া পৌঁছা অসম্ভব। অসংখ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) শাফা'আতের অধিকারী। আল্লাহ তা'আলার সমীপে তিনি সুপারিশকারী হবেন আর হুযুরের সমীপে আলিম ও ওলীগণ স্ব-স্ব মুরিদ-ভক্তদের জন্য শাফাআত (সুপারিশ) করবেন। শায়খগণ ইহ-পরকালে, মৃত্যুশয্যা, কবর-হাশর ইত্যাদি অবস্থায় স্বীয় মুরিদগণের সাহায্য করে থাকেন।
মিযানুশ শরীয়ত গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে,

قَد ذَکَرنَا فِي کِتَابِ الأَجوَبَةِ عَن أَٸِمَّةِ الفُقهَاءِ وَالصُّوفِیَّةِ أَنَّ أَٸِمَّةَ الفُقهَاءِ وَالصُّوفِیَّةِ کُلُّهُم یَشفَعُونَ فِي مُقَلِّدِهِم وَیُلاَ حِظُونَ أَحَدَهُم عِندِ ظُلُوعِ رُوحِهِ وَعِندَ سُوَالِ مُنکَرٍ وَنَکِیرٍ لَّهُ وَعِندَ النَّشرِ وَالحَشرِ وَالحِسَابِ وَالمِیزَانِ وَالصِّرَاطِ وَلاَ یَغفِلُونَ عَنهُم فِي مَوقِفٍ مِنَ المَوَاقِفِ.

‘অবশ্যই আমি الاوبة عن اٸمة والفقهاء والصوفیة কিতাবে উল্লেখ করেছি যে, ফকীহ ও সূফীগণ সকলেই স্বীয় অনুসারীদের জন্য শাফাআত করবেন। তাঁরা স্বীয় অনুসারী ও মুরিদগণের মৃত্যুযন্ত্রণাকালে, রূহ বের হওয়া, মুনকার-নকীরের প্রশ্নকাল, হাশর, নশর এবং হিসাব-নিকাশ, মিযানে আমল ওজন করা ও পুলসিরাত অতিক্রম ইত্যাদি অবস্থা অবলোকন করে থাকেন এবং মুরীদের অবস্থানসমূহ থেকে কোন অবস্থান সম্পর্কে গাফিল হন না।”
সুতরাং ওই মুখাপেক্ষীতা ও অসহায়ত্বের চেয়েও বড় নির্বোধ এবং পরকালীন স্বীয় নিরাপত্তা ও শুভ পরিণামের শত্রু কে হতে পারে, যে ওইসব কঠিন সময়ের জন্য সাহায্যকারী প্রস্তুত রাখবে না?
হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

إِستَکثَرُوا مِنَ الإِخوَانِ فَإِنَّ لِکُلِّ مُٶمِنٍ شَفَاعَةُ یَومَ القِیَامَةِ.

‘আল্লাহর অগণিত নেক-বান্দাদের সাথে আত্মীয়তা ও ভালোবাসার যোগসূত্র স্থাপন করো, কারণ কিয়ামত দিবসে প্রত্যেক কামিল মুসলমানকে শাফা'আতের মর্যাদা দান করা হবে।' যেন তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারীদেরকে সুপারিশ করা হয়।

১. আবদুল ওহাব শা'রানী, আল-মিযান আল-কুবরা, অনুচ্ছেদ: فی بیان جملة من الامثلة المحسوسة, ১/৫৩, মোস্তফা আল-বাবী, মিসর।
২. কানযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়া আফ’আল,کتاب الصحبة من قسم الأقوال حرف الصاد, অধ্যায় : ১ম:في الترغیب فیها , হাদীস : ২৪৬২৪২

ধরুন, (আল্লাহর পানাহ্!) যদি তরীকতের দীক্ষা গ্রহণ দ্বারা যদি কোন উপকারই না হয় তবুও কোন তরীকায় দাখিল হওয়ার মাধ্যমে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত যোগসূত্র স্থাপনের বরকত কি সামান্য ব্যাপার? যে বরকত অর্জন করার জন্য এখনো সম্মানিত আলিমগণ হাদীসের সনদ নিয়ে থাকেন। এমন কি ‘রুতনে হিন্দী' ইত্যাদির মতো (অপ্রসিদ্ধ) সনদসমূহ দ্বারা বরকত অর্জন করে থাকেন।

ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী আল-ইসাবাহ ফী তাবীযিস সাহাবায় বলেন,

أُنبِٸتُ عَنِ المُحَدِّثِ الرَّحال جَمَالُ الدِّینِ مُحَمَّدُ بنِ أَحمَدَ بنِ أَمِینِ الأَقشَهرِيِّ نَزِیلُ المَدِینَةِ النَّبَوِّیَّةِ فِي فَوَاٸِدِ رِحلَتِهِ أَخبَرَنَا أَبُو الفَضَلِ وَأَبُو القَاسِمِ بنُ أَبِي عَبدِ اللّٰهِ عَلِيِّبنِ إِبرَاهِیمَ بنِ عَتِیقِ اللِّوَاتِي المَعرُوفِ بِإِبنِ الخَبَّازِ المَهدَوَّيَّ (فَذَکَرَ بِسَنَدِهِ حَدِیثًا مِن خَوَاجَةَ رُتَن) قَالَ: وَذَکَرَ خَوَاجَةَ رَتَنُ بنِ عَبدِ اللّٰهِ أَنَّهُ شَهِدَ مَعَ رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ الخَندَقَ وَسَمِعَ مِنهُ هَذَا الحَدِیثَ وَرَجَعَ إِلَي بِلاَدِ الهِندِ وَمَاتَ بهَا وَعَاشَ سَبعَماٸَةِ سَنَةٍ وَمَاتَ سَنَةَ سِتَّ وَتِسعِینَ وَخَمسَمِاٸَةٍ وَقَالَ الأَقشَهرِيُّ وَهَذَا السَّنَدُ یَتَبَرَّكُ بِهِ وَإِن لَّم یُوثِق بِصِحَّتِّهِ.

পরিভ্রমণকারী মুহাদ্দিস জামাল উদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে আমীন আশাহরী, তিনি যখন মদীনা শরীফে অবস্থান করছিলেন তখন তাঁকে খবর দেওয়া হলো (যা আমি ফাওয়াইদ-ই রিহলাতে বর্ণনা করেছি। আমাদেরকে আবুল ফযল এবং আবুল কাসিম ইবনে আবু আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীম ইবনে আতীক আল-লিওয়াতি যিনি ইবনে খাব্বাস মাহদাভী নামে প্রসিদ্ধ। (তিনি হযরত খাজা রতন থেকে স্বীয় সনদে হাদীস বর্ণনা করেছেন,) তিনি বলেন, খাজা রতন ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয় তিনি রসূলুল্লাহ্ (ﷺ)র সাথে খন্দক যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি তার থেকে এ হাদীস শ্রবণ করেছেন এবং হিন্দুস্তানে ফিরে যান আর সেখানে ওফাত বরণ করেন। তিনি ৭০০ বছর জীবিত ছিলেন। ৫৯৬ হিজরীত ওফাতবরণ করেন। আকশাহরী বলেন, ওই সনদ দ্বারা বরকত অর্জন করা যায়,ইবনুন নিজার স্বীয় তারিখে হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

যদিও তা সহীহ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
অতএব, তরীকতের সিলসিলাহ ও আওলিয়া কিরামগণের সনদসমূহের (বরকত ও মর্যাদা)-এর ব্যাপারে কি বলবো? বিশেষত হুযুর পুর নূর সায়্যিদুনা গাউসূল আযম কুতুব আলম ইরশাদ করেছেন,

وَإِنَّ یَدِي عَلَي مُرِیدِي کَالسَّمَاءِ عَلَي الأَرض

‘আমার মুরিদের উপর আমার হাত তেমনি, যেমন যমীনের উপর আসমান রয়েছে।
তিনি আরও ইরশাদ করেছেন,

أَنَا لِکُلِّ مَن عَشَرَ بِهِ مَرکَبُهُ مِن أَصحَابَي وَمُرِیدِي وَمُحِبِّي إِلَي یَومِ القِیَامَةِ آخِذُ بِیَدِهِ

‘যদি আমার মুরিদের পা পিছলে যায়, আমি তার হাত ধরে রক্ষা করবো।”
এজন্য হুযূর গাউসূল আ'যমকে ‘পীর-ই দস্তগীর' (হাত পাকড়াওকারী) বলা হয়।
তিনি আরও বলেন,

لَو انکَشَفَت عَورَةُ لِمُرِیدِي بِالمَغرِبِ وَأَنَا بِالمَشرِقِ لَسَتَرتُهَا.

‘যদি আমার মুরিদ পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে থাকে আর আমি পশ্চিম প্রান্তে থাকি, ঘুমের ঘােরে তার সতর অনাবৃত হলে আমি তা ডেকে দেবো।”
তিনি আরও বলেন,
‘আমাকে একটি দফতর দেওয়া হয়েছে, যাতে কিয়ামত পর্যন্ত আমার মুরিদের নাম লিপিবদ্ধ ছিলো। আমাকে বলা হয়েছে, এ সব আমি তোমাকে প্রদান করলাম।
উপরিউক্ত ইরশাদসমূহ নির্ভরযোগ্য ইমামগণ তাঁর (হযরত গাউসুল আযম) থেকে বর্ণনা করেছেন। আমীন! আল্লাহ্ তা'আলা সর্বজ্ঞ ।
১. আসকলানী, আল-ইসাবাহ ফী তাবীযিস সাহাবা, খণ্ড : ২য়; الراء بعدها الناء, পৃ. ৫৩৬
২. শানুফী, বাহজাতুল আসরার,ذکر فضل آصحابه وبشراهم, পৃ. ১০০
৩. শানুফী, বাহজাতুল আসরার,ذکر فضل آصحابه وبشراهم, পৃ. ১০২
৪. শানুফী, বাহজাতুল আসরার,ذکر فضل آصحابه وبشراهم, পৃ. ৯৯
৫. শাতনুফী, বাহজাতুল আসরার,ذکر فضل آصحابه وبشراهم, পৃ. ৯৯

  ➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖
অধ্যায় ২

খিলাফতের প্রকারভেদঃ

খিলাফতের প্রকারভেদ ও তার বর্ণনা

اَلحَمدُ لِلّٰهِ وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلٰی حَبِیبِهِ المُصطَفٰی وَاَلِهِ الکِرَامِ السَّادَاتِ الشُّرفَاءِ وَصَحَبَةِ العِظَامِ وَالأَولِیَاءِ العُرَفَاءِ وَعَلَینَا مَعَهُم دَاٸِمًا أَبَدًا

আল্লাহ তাআলা আউলিয়া কিরামের বরকতে দুনিয়া ও আখিরাতে আমাদেরকে উপকার দান করুন।

খিলাফতের প্রকারভেদ ও তার বর্ণনা।

(নিশ্চয় জেনে রাখুন যে,) হযরাতে আওলিয়া কিরামের প্রচলিত খিলাফত দু’প্রকার :
১. খিলাফতে আম্মাহ্ (خلافت عامة)
২. খিলাফতে খাসসাহ্ (خلافت خاصة)
এক. 'খিলাফতে আম্মাহু’ হচ্ছে, পীর-মুরশিদ স্বীয় নিকটবর্তী ও দূরবর্তী মুরিদগণ থেকে যাকে যাকে এরশাদ ও প্রশিক্ষণদানের উপযুক্ত মনে করবেন স্বীয় খলিফা ও নায়েব (প্রতিনিধি) মনোনীত করবেন এবং তাদেরকে বায়আত গ্রহণের, যিকর, দৈনন্দিন ওযিফা ও আমলসমূহের তালকীন, তরীকতের দীক্ষাগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণ ও তরীকত অম্বেষণকারীদের পথপ্রদর্শনের জন্য খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের মর্যাদায় ভূষিত করবেন। এ অর্থে এটা দ্বীনি পদবি। এতে খলিফার সংখ্যা অগণিত ও অসংখ্য হওয়া বৈধ। বস্তুত হুযুর সাইয়্যিদুল আলামীন মুরশিদুল কুল মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ)র সকল সম্মানিত সাহাবা এ অর্থে হুযুরের খলিফা ছিলেন। আর ওই খিলাফতকেই নবীগণের উত্তরাধিকার (ورثة الأنبیاء) বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এবং এ অর্থে ওলামায়ে দ্বীন, শরীয়ত ও তরীকতের কামিল পীর-মুরশিদগণ কিয়ামত পর্যন্ত সকলেই হুযুর আলায়হিস সালাতু ওয়াস্সালাম-এর খলিফাগণের নায়িব (প্রতিনিধি) ও খলীফা। আর এ প্রকার খিলাফত খিলাফতদাতার জাহেরী জীবনের সাথে একত্রিত হয়ে থাকে। যা কারো অজনা নয়।

দুই. 'খিলাফতে খাসসাহ্’ হচ্ছে, স্বীয় মুরশিদে মুরব্বীর ওফাতের পর তাঁর নির্দিষ্ট মসনদের ওপর উপবেশন করা, যে মসনদের ওপর তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ব্যতীত কেউ বসতে পারে নি এবং খানকাহ ও দরবারের সকল নিয়ম-শৃঙ্খলা, আয়-ব্যয়, খাদিম নিয়োগ ও বরখাস্ত, দরগাহের ওয়াক্ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও খানকাহর ব্যয়ভার নির্বাহ ইত্যাদি ওই খিলাফতের সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং এ অর্থেও এটা দ্বীনি কাজ, যদিও বাহ্যিকভাবে এসব কাজ পার্থিব কাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন, হযরত সায়্যিদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, হযরত সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর খিলাফত প্রসঙ্গে বলেছেন,

رَضِیَةُ رَسُولُ اللّٰهِ ﷺ لِدِینِنَا أَفَلاَ نَرضَاهُ لِدُنیَانَا

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে (হযরত আবু বক্কর সিদ্দিককে) আমাদের দ্বীনের জন্য পছন্দ করেছেন, সুতরাং আমরা তাঁকে আমাদের দুনিয়ার জন্য কেন পছন্দ করবো না!

এ প্রকার খিলাফত, ‘ইমামতে কুরবা’র সাথে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ । খিলাফতদাতার জাহেরী জীবনের সাথে এ প্রকার খিলাফত একত্রিত হয় না। এ প্রকার খিলাফতকে ‘সাজ্জাদানশীনী'ও বলা হয়।

সাজ্জাদানশীন মনোনীত করার পদ্ধতি

প্রথম প্রকারের খিলাফতের ক্ষেত্রে পীর-মুরশিদ যাকে খিলাফতের ভার অর্পণ করবেন অথবা তার ওফাত পূর্বক্ষণে যার ব্যাপারে ওসীয়ত করে যাবেন আর এই ওসীয়তও যদি শরীয়ত সম্মত হয় এবং ওই ব্যক্তিও খিলাফতের যোগ্য হয় আর দরগাহের কিছু ওয়াকফ-সম্পত্তি থাকে এবং ওই সম্পত্তির তত্ত্বাবধানেও সক্ষম হয় তবে এই ব্যক্তি ‘সাজ্জাদানশীন হিসেবে সাব্যস্ত হবে। উক্ত গ্রহণযোগ্য দলীল দ্বারা সাব্যস্ত ও শরীয়তসম্মত খিলাফতকে অসম্পূর্ণ মনে করে শূরা সদস্য ও আহলে হিল ওয়া আকদের সামনে এ ব্যাপারে মতামত চাওয়ার ভিত্তিতে (সাজ্জাদানশীন মনোনীত করার) প্রয়োজন নেই।
সাজ্জাদানশীন হওয়ার ব্যাপারে আপন পীর-মুরশিদের নির্দেশ ও ওসীয়ত ইত্যাদির মতো স্পষ্ট দলিলের তোয়াক্কা না করে কেউ যদি নিজে নিজে সাজ্জাদানশীন হয়ে বসে, তবে তা কখনো গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। যেমন, কোন ব্যক্তি পীর-মুরশিদের সামনে বললো যে, হুযুরের পর জায়েদ সাজ্জাদানশীন অথবা এ বিষয়ে কারো নামে পীরের সামনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হলো, আর তিনি ওই প্রস্তাব ও বক্তব্য শুনে নিশ্চুপ থাকলেন। পরবর্তীতে আমরের নামে বা জায়েদ ও আমর উভয়ের যৌথ নামে সাজ্জাদানশীন হওয়ার ওসীয়ত করে যান তবে এই শেষোক্ত ওসীয়তই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে। আর ওই নিশ্চুপ থাকাটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। উপরিউক্ত এই বক্তব্য ফিকহের এ দু'টি নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত যে,
১, ইবনে সা'দ, আত-তবকাতুল কুবরা, ذکر بیعة أبي بکر, ৩/১৮৩, দারু সাদির, বৈরুত, দেখুন মূল হাদীস:

عن الحسن قال قال علي لما قبض ﷺ نظرنا فی أمرنا فوجدنا النبی ﷺ قد قدم أبا بکر في الصلاة فرضينا لدنیانا من رضی رسول اللّٰه ﷺ لدیننا.

لاَ یُنسَبُ إلَی سَاکِتٍ قَولَ

নিশ্ৰুপ বা মৌনতা অবলম্বকারীর প্রতি কোন বিধান প্রযোজ্য হবে না।

أَنَّ الصَّرِیحَ یَفُوقُ الدَّلاَلَةَ

সুস্পষ্টতা (الصریح) অস্পষ্টতার উপর প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
আর যদি দু'টি সুস্পষ্ট দলিল (النص الصریح) পাওয়া যায়, (যেমন-) একটিতে জায়েদের প্রতি ওসীয়তের বর্ণনা রয়েছে আর অপরটিতে রয়েছে আমরের প্রতি অথবা উভয়ের প্রতি আর ওই সব ওসীয়তে একটির তারিখ অপরটির পরবর্তীতে হয়, তবে উভয় দলিলের উপর আমল করা যাবে । জায়েদ ও আমর উভয় ওসী (অনুমতিপ্রাপ্ত) সাব্যস্ত হবে। হাঁ! যদি শেষ দলিলে প্রথম ওসীয়ত থেকে প্রত্যাবর্তন ও প্রথম ওসীকে বরখাস্ত করা হয়েছে মর্মে বিবরণ থাকে তবে পরবর্তী দলীল পূর্ববর্তী দলীলের রহিতকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যেমন- ফতওয়া তাতারখানিয়ার সূত্রে রাদ্দুল মুহতার আদাবুল আওসিয়া থেকে বর্ণিত আছে যে,

أَوصَی إلَی رَجَلٍ وَمَکَثَ زَمَانًا فَأَوصَی إلَی آخَرَ فَهُمَا وَصِیَّانِ فِي کُلِّ وَصَایَاهُ، سَوَاءُ تَذَکَّرَ إیصَاءَهُ إلَی الاَوَّلِ أَو نَسِيَ لِأَنَّ الوَصِيَّ عِندَنَا لاَ یَنعَزِلُ مَا لَم یَعزِلُهُ المُوصِي، حَتَّی لَو کَانَ بَینَ وَصِیَّتَیهِ مُدَّةُ سَنَةٍ أَو اَکثَرَ لاَ یَنعَزِلُ الأَوَّلُ عَن الوِصَایَةِ.

কেউ যদি কোন পুরুষকে নিজ ওসী (প্রতিনিধি) বানালো আর কিছুকাল পর অন্য একজনকে প্রতিনিধি বানালো, তবে তারা উভয়েই ওই ব্যক্তির সমস্ত ওসিয়তে প্রতিনিধি সাব্যস্ত হবে। প্রথম ব্যক্তিকে প্রতিনিধি বানানো তার স্মরণে থাকুক বা ভুলে যাক-উভয়ই সমান। কারণ আমাদের মযহাবে ওসিয়তকারী ওসী (প্রতিনিধি)-কে যতক্ষণ পর্যন্ত পদচ্যুত করবে না, পদচ্যুত হবে না। এমনকি উভয় ওসিয়তের মধ্যে এক বছর বা ততোধিক ব্যবধান হোক না কেন। তবুও প্রথম ব্যক্তি ওসী (প্রতিনিধি) সাব্যস্ত হওয়াকে বাতিল করবে না।

১. ইবনে নুজাইম, আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ির,القاعدة الثانیة عشر ،الفن الأول, ১/১৮৪, এদারাতুল কুরআন, করাচি
২. ইবনে আবেদীন আশ-শামী, রদ্দুল মুহতার, کتاب النکاح, অধ্যায়: المهر, ২/৩৫৭, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাসিল আরবী, বৈরুত
৩. ইবনে আবেদীন আশ-শামী, রদ্দুল মুহতার, کتاب الوقف, অধ্যায়:فَصٸلُ یُرَاعَی شَرطُ الوَاقِفِ إجَارَتِهِ , ৩/৪১০, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাসিল আরবী, বৈরুত।

আর যদি কারো জন্য ওসী হওয়ার কোন দলীল না থাকে, তবে ওই দরগাহ ও খানেকায় ওসী নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে যে নিয়ম চলে আসছে তার উপরই বিধান। কার্যকর হবে অথবা পঞ্চায়েত যার উপর ঐক্যমত পোষণ করবে সেই ওসী হিসেবে গণ্য হবে। তবে এ উভয় পদ্ধতিতে এটা জরুরি যে, উক্ত ব্যক্তি ওই মুরশিদ-মুরব্বী থেকে সবর্জন গ্রহণযোগ্য খিলাফতে আম্মাহ্’র অধিকারী হতে হবে। অন্যথায় আমাদের দেশে শরঈ বিচার ব্যবস্থা না থাকার কারণে সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ও প্রথাগত কারণে ওয়াকফের উপর কর্তৃত্ব যদিও প্রতিষ্ঠিত হবে কিন্তু সাজ্জাদানশীন' হওয়া কখনো শুদ্ধ হবে না। কারণ এটা হচ্ছে খিলাফতে খাসসাহ্’। আর কোন ‘খিলাফতে খাসসাহ্', ‘খিলাফতে আম্মাহ্' অর্জন করা ছাড়া সম্ভব নয়। এবং খিলাফত-ই আম্মাহ্ সহীহ অনুমতি ছাড়া কখনো লাভ করা যায় না।

সাত ধরনের খিলাফতের বিবরণ

হযরত আসাদুল আরিফীন সায়্যিদুনা ওয়া মাওলানা হযরত সায়্যিদ শাহ্ হামযা আয়নী মারহারাভী কাদ্দাসাল্লাহ সিররাহু তাঁর বয়ায শরীফ (بیاض)-এ এরশাদ করেছেন- ‘প্রকাশ থাকে যে, মাশায়িখ কিরামের যে খিলাফত এ উপমহাদেশে প্রচলিত আছে তা সাত প্রকার । তম্মধ্যে কিছু আছে গ্রহণযোগ্য ও পরিচিত আর কিছু অজ্ঞাত । যেমন- প্রথমতঃ হচ্ছে ‘সরাসরি' (إصاالة), দ্বিতীয়তঃ অনুমতিক্রমে (إجازة), তৃতীয়তঃ ঐক্যমতের ভিত্তিতে (إجماعا), চতুর্থতঃ উত্তরাধিকারসূত্রে (وراثة), পঞ্চমতঃ নির্দেশগত (حکما), ষষ্ঠতঃ বাধ্যগত (تکلیفا) ও সপ্তমতঃ ওয়াইসীগত (أویسیا)।

এক. সরাসরি (إصالة) হচ্ছে, কোন বুযর্গ আল্লাহ তা'আলার হুকুমে কোন ব্যক্তিকে নিজ খলিফা বা জা-নশীন (প্রতিনিধি) মনোনীত করা। এটা এভাবে যে, হুযুর (ﷺ) হাদীস শরীফে ইরশাদ করেছেন,

مَا قَدَّمتُ اَبَا بَکَرٍ وَعُمَرَ وَلَکِنَّ اللّٰهَ قَدَّمَهُمَا

‘আমি আবু বক্কর সিদ্দিক ও উমর ফারুককে অগ্রবর্তী করিনি বরং আল্লাহ তা'আলা তাদের উভয়কে অগ্রবর্তী করেছেন।
হুযূর (ﷺ) থেকে আরো বর্ণিত আছে যে,

১. আলী মুত্তাকী হিন্দী, কনযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়া আফ’আল, ইবনে নাজ্জার হযরত আনাসের সূত্রে, হাদীস : ৩২৭০৬, ১১/৫৭২

یَا عَلِيُّ! سَأَلتُ اللّٰهَ ثَلاَثُا أَن یُّقَدَّمَكَ فَأَبَي إلاَّ أَن یَّقَدَّمَ أَبَا بَکَر

‘হে আলী! আমি তোমার ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলার কাছে তিনবার এমর্মে প্রার্থনা করেছি যে, তিনি যেন তোমাকে অগ্রবর্তী করেন। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা আবু বকর ব্যতীত অন্য কাউকে অগ্রবর্তী করতে চাননি।
হুযুর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন,

یَأَبِي اللّٰهُ والمُٶمِنُونَ إلاَّ أَبَا بَکَرٍ.‘আবু বকর সিদ্দিক ব্যতীত অন্য কাউকে ইমাম (খলিফা) মনোনীত করার ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা এবং মুমিনগণ অস্বীকার করবেন ।উপরিউক্ত বর্ণনা ছাড়াও অন্যান্য হাদীস শরীফে এ মর্মে আরো অনেক বর্ণনা রয়েছে।

দুই. অনুমতিক্রমে (إجازة) হচ্ছে, কোন শায়খ (পীর) কোন মুরিদকে চাই ওই মুরিদ তার ওয়ারিস হোক বা অন্য কেউ (শরীয়ত ও তরীকতের) কাজে উপযুক্ত দেখে নিজ সন্তুষ্টিতে ও প্রীত হয়ে স্বীয় খলিফা মনোনীত করা । [যেমনিভাবে আমিরুল মু'মিনীন হযরত আলী মুরতাজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হযরত আমিরুল মু'মিনীন হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে খলিফা মনোনীত করছিলেন।

তিন. ঐক্যমতের ভিত্তিতে (إجماعا) হচ্ছে, শায়খ (পীর) স্বীয় জীবদ্দশায় কাউকে খলিফা মনোনীত না করেই ওফাতবরণ করলো ফলে আহলে খানকাহ বা শায়খের মুরীদগণ শায়খের কোন ওয়ারিস বা কোন মুরিদকে শায়খের খলিফা। বা জা-নশীন (প্রতিনিধি) মনোনীত করা।
[যেমনিভাবে আসহাবুর রায় হযরত উসমান গনি রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর শাহাদতের পর আমীরুল মু'মিনীন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে খলিফা মনোনীত করেছেন।
কিন্তু এ প্রকার খিলাফত তরীকতের শায়খগণের নিকট বৈধ নয়। এ প্রকার খিলাফতকে খিলাফতে ইখতিরায়ী (خلافت إختواعي) বা মনোনয়নগত খিলাফত বলা হয়।

১. আলী মুত্তাকী হিন্দী, কনযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়া আফ’আল, ইবনে নাজ্জার হযরত আনাসের সূত্রে, হাদীস : ৩২৭০৬, ১১/৫৭২ ২. ইবনে সা'দ, আত-তবকাতুল কুবরা

ذکر الصلاة التی امر بمارسول اللّٰه علیه وسلم أبا بکر عند وفاته

৩/১৮০,দারু সাদির, বৈরুত।

(কারণ, এ ক্ষেত্রে খিলাফতে আম্মাহ্ পাওয়া যায়নি। অথচ খিলাফতে খাসের জন্য এটা শর্ত। কিন্তু হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ক্ষেত্রে এ প্রকার খিলাফত বৈধ হওয়ার কারণ হলো, তার ‘খিলাফতে আম্মা' অর্জিত ছিলো। কারণ, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মহান সম্মানিত খলিফাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

চার. উত্তরাধিকারসূত্রে (وراثة) হচ্ছে, কোন শায়খ (পীর) আপন জীবদ্দশায় নিজের কোন প্রতিনিধি মনোনীত করা ছাড়াই ইন্তেকাল করলে, খিলাফতের উপযুক্ত ওই শায়খের কোন ওয়ারিশ তার স্থানে বসে যাওয়া এবং নিজেকে ওই শায়খের খলিফা বানিয়ে নেওয়া। ‘যেমন, হযরত আমীর-ই মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর খিলাফতের দাবি করা, তার চাচাতো ভাই আমিরুল মু'মিনীন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর শাহাদতের পর এবং ইমাম হাসান মুজতাবা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করার পূর্বমুহূর্ত সময়গুলোতে। আর এ দাবি তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন খিলাফতের দাবি তার পূর্বে করবে। আর সঠিক অভিমত হচ্ছে, হযরত আমীর মুআবিয়া খিলাফতের দাবি অস্বীকার করতেন। তিনি বলতেন,

إِنِّي لأَعلَمُ أَنَّهُ أَفضَلُ مِنِّي وَأَحَقُّ، وَلَکِن أَلَستُم تَعلَمُونَ أَنَّ عُثمَانَ قُتِلَ مَظلُومًا، وَأَنَا ابنُ عُمِّهِ وَوَلِیِّهِ، وَاطَّالِبُ بِدَمِهِ.

‘অবশ্য আমি মানি যে, তিনি (আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু) আমার চেয়ে উত্তম এবং খিলাফতের জন্য বেশি উপযুক্ত। কিন্তু তোমরা জানো না, হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে আর আমি তার চাচার ছেলে ও তার ভাই এবং ওসী (অভিভাবক) হই। আমি তার হত্যার বদলা চাচ্ছি।”
কিন্তু ইমাম হাসান মুজতাবা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যখন তাঁকে খিলাফতের দায়িত্ব সমর্পন করেছেন, তখন নিঃসন্দেহে তিনি (হযরত আমীরে মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু) সত্য ইমাম ও সত্যবাদী আমীর ছিলেন। ইমাম ইবনে হাজর মক্কী আস- সাওয়াইকে এ কথা বলেছেন।
১. যাহাবী,معاویة بن أبي سفیان ، سیر أعلام النبلاء, ২/১৪০
এ হাদীস ইমাম বোখারীর উস্তাদ ইহইয়া ইবনে সুলায়মান জু'ফী কিতাবুস সিফফীনে উত্তম সনদ সহকারে আবু মুসলিম খাওলানীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
২. ইবনে হাজর মক্কী, আস-সাওয়ায়িকুল মুহরাকা, الخاتمة في بیان إعنقاد أهل السنة, পৃ- ২১৮, মকতবায়ে মজিদিয়া মুলতান।
কিন্তু এ প্রকারের খলিফা নির্বাচন বা মনােনয়ন করা তরীকতের শায়খগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

সাত, আর (ওয়াইসীগত হচ্ছে,) কখনো ওফাতপ্রাপ্ত শায়খ তার (মুরিদের) বাতিনে খিলাফতের নির্দেশ দেওয়া তরীকতে বা তাসাওউফে এ প্রকার খিলাফত বৈধ। কেননা, রুহের প্রতি নির্দেশ প্রদান করার বৈধতা তাসাউফপন্থীগণ স্বীকার করে থাকেন। [এই সময় ওয়াইসীয়া তরীকার প্রতি এ বিধান প্রত্যাবর্তন করা হবে। যেমন, হযরত আবুল হাসান খিরকানী হযরত আবু ইয়াযীদ বোস্তামী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর খলিফা ছিলেন। কিন্তু এ বিধান প্রত্যেক দাবিদারের ক্ষেত্রে মানা যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তার ন্যায়পরায়ণতা ও নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত না জানি অথবা আহলে-বাতিন-ব্যক্তিগণ তার ব্যাপারে সাক্ষ্য না দেবেন।

হ্যাঁ, খিলাফতে আম্মাহ্’ শুদ্ধ হওয়ার পর খলিফার মতো আচরণ করা এবং সবার ঐক্যমতে খলিফা নির্বাচিত হওয়া গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে এবং তা যথেষ্ট হবে । কারণ, (لِأَنَّ المَعهُودَ عُرفًا کَالمَشرُوطِ لَفظً) উরফের (লৌকিক প্রথার) ভিত্তিতে প্রমাণিত বিষয় নাম দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার অনুরূপ। (مَا رَأَی المُسلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِندَ اللّٰهِ حَسَنُ) মুসলমানগণ যা ভাল মনে করবে, তা আল্লাহ তা'আলার কাছেও ভালো।
এ ক্ষেত্রে সর্বজন স্বীকৃত লৌকিক প্রথা (عرف) হচ্ছে, বড় সন্তানই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খিলাফতের হকদার হবে। তার বর্তমানে অন্য কেউ দাবি করতে পারবে না। কিন্তু যদি বড় সন্তান খিলাফতের যােগ্যতা না রাখে অথবা শায়খ শুধু অন্যের নামে অথবা অন্যকে তার সাথে সমান অংশীদার করে ওসীয়ত করে যান, তবে অবশ্যই ওই ওসীয়তের উপর আমল করা থেকে বিরত থাকার কোন সুযোগ নেই। শরঈ যুক্তিসঙ্গত কারণে শায়খে তরিকত তার কোন নিকট-আত্মীয়কে খিলাফত থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করা যেমন তার জন্য বৈধ, তেমনিভাবে অন্যজনকে বিশেষ প্রযোজনে তার অংশীদার ও সহযোগী করাও বৈধ। যুক্তিগত কারণসমূহ থেকে একটি কারণ এ-ও হতে পারে যে, যখন ওই সম্মানিত পদের একটি দিক দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয় আর অপরদিক হয় দ্বীনের সাথে,

১. ইবনে আবেদীন আশ-শামী, রদ্দুল মুহতার, کتاب البیوع, ৪/৩৯, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাসিল আরবী, বৈরুত
২. হাকিম, আল-মুস্তাদরক, کتاب معرفة الصحابة, ৩/৭৮

তখন যে শুধু একটি বিষয় পরিচালনায় যথেষ্ট পারদর্শী, তার থেকে সমস্ত কিছুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আশা করা অনিশ্চিত। তাই যদি পরিনামদর্শী শায়খ (পীর) নিজ আত্মীয়ের মধ্যে একজনের পার্থিব বিষয়ে পরিচালনায় অভিজ্ঞ আর অন্যজনকে দ্বীনি বিষয় পরিচালনায় অভিজ্ঞ দেখেন, তবে তিনি আরিফ, অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন, পরিনামদর্শী, দ্বীনি বিষয়ে সবচেয়ে হিদায়প্রাপ্ত সরল-সঠিক পথের পথিক, পার্থিব লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ব্যক্তিকে ‘খলিফা মনোনীত করলে এবং পার্থিব ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞ ব্যক্তিকে তার অংশীদার ও সহযোগি নির্বাচন করলে তাতে কারো আপত্তি বা অভিযোগের সুযোগ নেই।
কারণ, এ উভয়ের ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটি সামাজিক ভিত্তি অর্জিত হয় এবং এ মহান পদের সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য উত্তম এবং সুচারুরূপে বিকাশ লাভ করে। কিন্তু ইমামতে কুবরা বা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে দ্বৈত্ব নেতৃত্ব অবৈধ। কারণ, দ্বৈত্ব নেতৃত্ব অনেক বড় বড় ফিতনার জন্ম দেয় এবং ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে অবতারণার কারণ হয় যা কারো অজানা নয়। প্রবাদ আছে যে, এক রাষ্ট্রে দু'বাদশা রাজত্ব করতে পারে না। আর তরীকতের খিলাফত অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় খিলাফতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তরীকতের খিলাফতের ক্ষেত্রে এ দ্বৈত খিলাফত জায়েয কিন্তু রাষ্ট্রীয় খিলাফতের ক্ষেত্রে তার চিন্তা। করাও যাবে না। তাই তরীকতের খিলাফতে রাষ্ট্রীয় খিলাফতের সকল বিধান কার্যকর হয় না। ফলে তরীকতের খিলাফতের জন্য খলিফাকে কুরাইশ বংশীয় হওয়া শর্ত নয় । যে যুক্তিগত কারণে আমি দ্বৈত খিলাফতের যে উদাহরণ পূর্বে বর্ণনা করেছি, তা যদি সত্যে পরিণত হয়, তবে বর্ণিত বিধান কার্যকর হবে। কারণ এ প্রকার দ্বৈত খিলাফত বাতিল হওয়ার ব্যাপারে কোন দলিল নেই। কেউ অবৈধ বললে তার দলিল পেশ করা আবশ্যক। হ্যাঁ, সাজ্জাদানশীন হওয়ার ক্ষেত্রে যে সাধারণ প্রথা চলে আসছে তা একজনের জন্যই প্রযোজ্য হবে। কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তার বিরোধিতা করা উচিত নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, যখন পীর ও মুরশিদ দু’জনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান, তা রদ করার কোন পথ নেই। হ্যাঁ উপরিউক্ত পদ্ধতিতে এটা বুঝে নিতে হবে যে, দ্বীনের ব্যাপারে যিনি বেশি হিদায়তের উপর প্রতিষ্ঠিত তিনি হলেন মূল স্থলাভিষিক্ত (জা-নশীন) আর অপরজন হচ্ছেন দরবার, দরগাহ বা খানেকার দেখাশোনাকারী ও ব্যবস্থাপক।
যেমন (ইতোপূর্বে) এ দিকে ইঙ্গিত করেছি। আর আল্লাহ ত্রুটিমুক্ত ও মহান, সঠিক অভিমত সম্পর্কে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিজ্ঞাত। তার নিকটই মূল কিতাব সংরক্ষিত। আল্লাহ তা'আলা দরূদ প্রেরণ করুন আমাদের আকা ও সরদার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি এবং তাঁর সকল আত্মীয়-স্বজন, সাহাবী, খলিফা, প্রতিনিধি তাবিঈ ও বন্ধুর প্রতি। আমীন।

➖➖➖➖➖➖➖
অধ্যায় ৩

হক্বানী পীরের বায়আত থাকা সত্ত্বেও অন্য পীরের কাছে বায়আত হওয়ার বিধানঃ

বায়আত থাকা সত্ত্বেও অন্য পীরের কাছে বায়আত হওয়ার বিধান

بِسمِ اللّٰهِ الرَّحمَنِ الرَّحِیمِ، اَلحَمدُ لِلّٰهِ الوَاحِدِ الأَحَدِ المَنَزِّهِ مِن کُلِّ شِركٍ وَعَدَدٍ، وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلَی النَّبِيِّ الأَوحَدِ وَاَلِهِ وَصَحبِهِ وَتَاِعِیهِم فِي الرُّشدِ مِنَ الأَزلِ إِلَي أَبَدِ الأَبَدِ.

আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম করুনাময় ও দয়ালু। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি এক ও একক, প্রত্যেক অংশীদার এবং সংখ্যা থেকে পবিত্র । পুরিপূর্ণ রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক নবী করিম (ﷺ)’র প্রতি, যিনি সৃষ্টির মধ্যে একক, তার পবিত্র বংশধর, অসহাব এবং হিদায়তের পথে তার অনুসরণকারীদের প্রতিও (রহমত ও শান্তি অবতীর্ণ হোক) আদি থেকে অনাদিকাল পর্যন্ত।

হক্কানী পীরের বায়আত থাকা সত্ত্বেও অন্য পীরের কাছে বায়আত হওয়ার বিধান।

(নিশ্চয় জেনে রাখুন যে,) বস্তুত বাধ্যকারী সঠিক প্রয়োজন ছাড়া স্বীয় পীর- মুরশিদ থাকা সত্ত্বেও অন্য পীরের হাতে ‘বায়'আতে ইরাদত´ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা জরুরী। এটাই নির্ভরযোগ্য অভিমত। এটাতেই কল্যাণ নিহিত। অন্যথায় পরিপূর্ণ ক্ষতির সম্ভাবনা বিদ্যমান। কারণ,
১. এলোমেলো চিন্তা ও ভবঘুরতা বঞ্চিত হওয়ার কারণ। আল্লাহ রাব্বল আলামীনের পানাহ পবিত্র কুরআনে পরিষ্কার ভাষায় ইরশাদ করছে,

ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلاً رَّجُلاً فِیهِ شُرَکَاءُ مُتَشَکِسُونَ وَرَجُلاً سَلَمًا لِّرَجُلٍ هَل یَستَوِیَانِ مَثَلاً ، اَلحَمدُ لِلّٰهِ ، بَل أَکثَرُهُم لاَ یَعلَمُونَ.

আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, এক ব্যক্তির মালিক অনেক, যারা পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন এবং আর এক ব্যক্তির মালিক কেবল একজন; সুতরাং একজন গোলাম শুধু একজন মনিবের হওয়াই নিরাপদ। এই দু’জনের অবস্থা কি সমান? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।

২. তাছাড়া, হক্কানী, সত্যবাদী পীর নিজ মুরিদের জন্য কিবলা স্বরূপ। আর নামাযে কিবলার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিলে নামায শুদ্ধ হয় না। যদিও আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেছেন,

فَأَینَمَا تُوَلُّوا فَثَمِّ وَجهُ آللّٰهِ.

তোমরা যেদিকে মুখ করো না কেন, ওই দিকে আল্লাহর রহমত তোমাদের দিকে রয়েছে।
তারপরও আল্লাহর রহমত অন্বেষণকারীদেরকে কুরআন এ হুকুমও শুনাচ্ছে যে,

وَحَیثُ مَا کُنتُم فَوَلُّوا وُجُوهَکُم شَطرَهُ.

‘তোমরা যেখানে থাক না কেন নিজেদের চেহারা মসজিদে হারামের দিকে করে নাও।

৩. তাছাড়া যে কোন ওয়াফাদার গােলাম তার দুনিয়াবী মালিকের দরজা ছেড়ে অন্যের দরজায় যাওয়াকে অকৃতজ্ঞতা বলে জানে।

ع سر ایخبا سجدہ ایخبا قرار ایخبا

বরং, কৃতজ্ঞ বান্দা মাথা রাখে মনিবের দরজায়, সাজদা করে মনিবের দরজায়, বন্দেগীও তার দরজায় এবং প্রশান্তিও তার দরজায়ই অন্বেষণ করে।

অতএব, পীর-মুরশিদের ইহসানের সাথে পার্থিব ইহসান (দয়া)-এর কোন তুলনাও হয় না। তাই ওই ব্যক্তির জন্য আশ্চর্য হতে হয়, যে নিজ পীর-মুরশিদের প্রতি ভালবাসা ও নিষ্ঠার দাবি করে, অথচ, তিনি জীবিত থাকা সত্ত্বেও এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়।

چو دل بادلبری آرام گیرد   زو صل دیگرے کے کام گیرد نہی

صد دستہ ریحاں پیش بلبل   نخو اہد خاطر ش جزء نگہت گل

১. আল-কুরআন, সুরা আয-যুমার, ৩৯:২৯
২. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১১৫
৩. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৪৪

“যখন অন্তর একজন প্রেমাস্পদের সাথে সম্পৃক্ত তখন অন্যজনের সাথে মেলামেশা করার প্রয়োজন কোথায়? বুলবুলের সামনে ফুলের শত গুচ্ছ রাখ না কেন, কিন্তু ফুলের সুবাস ছাড়া তার অন্য কিছু কাম্য নয়।

৪. তাছাড়া, পীরের ফয়েয (আধ্যাত্মিক করুণা) ‘মান ওয়া সালওয়া' (আসমানী খাদ্য বিশেষ) সদৃশ। আর আমরা অবশ্যই এক খাদ্যের উপর ধৈর্যধারণ করতে পারব না —এ কথা বলার পরিণতি অত্যন্ত মন্দ। সুতরাং তুমি ইসরাইলী হয়ো না, মুহম্মদী হও, তোমার নিকট সকাল-সন্ধ্যা রিযক (জীবিকা) আসবে।

৫. তাছাড়া, জন্মদাতা পিতা হচ্ছেন মাটির কায়ার (শরীর)-এর পিতা আর পীর হচ্ছেন অন্তরের পিতা। মনিব হচ্ছেন গোলামের মাটির কায়ার (শরীরের) মুক্তিদাতা আর পীর হচ্ছেন পবিত্র প্রাণ (আত্মার) মুক্তিদাতা। প্রবৃত্তি-পূজারীর অন্তরে ভয় সঞ্চার হওয়ার জন্য এই হাদীস যথেষ্ট যে, “যে ব্যক্তি আপন পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা বলে ডাকে অথবা নিজ মনিব থাকা সত্ত্বেও অন্যকে নিজের মনিব বলে পরিচয় দেয়, তার উপর আল্লাহ তাআলা, ফিরিশতাগণ ও সমস্ত মানুষের অভিশম্পাত। আল্লাহ তাআলা না তার ফরয কবুল করবেন, না নফল।
হাদীসশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ পাঁচজন ইমাম, আমীরুল মু'মিনীন আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু থেকে, তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন,

وَمَنِ ادَّعَی إِلَی غَیرِ أَبِیهِ أَوِ انتَمَی إِلَی غَیرِ مَوَالِیهِ فَعَلَیهِ لَعنَةُ اللّٰهِ وَالمَلاَٸِکَةِ وَالنَّاسِ أَجمَعِینَ لاَ یَقبَلُ اللّٰهُ مِنهُ یَومَ القِیَامَةِ صَرفًا وَلاَ عَدلاً.

‘যে ব্যক্তি নিজ পিতা ছাড়া অন্য ব্যক্তিকে পিতা বলে দাবি করলো অথবা নিজ মুনীব ছাড়া অন্যকে নিজের মুনীব বানালো, তার উপর আল্লাহ, ফিরিশতাগণ ও সমস্ত মানুষের লানত। আল্লাহ না তার ফরয কার্যাদি কবুল করবেন, না নফল ।
সুতরাং যে ব্যক্তি ক্রীড়াচ্ছলে এসব কাজ করে বসে, সে কি এ ভয় করে না, আল্লাহ না করুক! প্রকাশ্য কিয়াসের বিধান মতো এ সহীহ হাদীসে বর্ণিত কঠিন শাস্তির হিসসা পাবে।

১. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:৬১
১. মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল হজ, ১/৪৪২, কদীমী কুতুবখানা, করাচি
২, তিরমিযী, আল-জামি আস-সহীহ, আবওয়াবুল ওসায়া, ২/৩৪, আমিন কোম্পানী, দিল্লি
৩. আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মসনদ, ১/৮১, আল-মাকতাবু ইসলামী, বৈরুত।

চির সৌভাগ্যবান-ব্যক্তিগণ আপন পীর-মুরশিদের নির্দেশ সত্ত্বেও নিজ পীরকে ত্যাগ করে অন্য হককানী পীরের খিদমতে আত্মনিয়োগ করাকেও বৈধ মনে করেননি। আর এ ত্যাগ করাও এমন মহান ছিলো যে, ঝর্ণার নিকট থেকে গভীর সমুদ্রে ছুড়ে যাওয়া। এতদসত্ত্বেও পীরের আস্তানা ছেড়ে যাওয়াকে সঙ্গত মনে করেননি। আর এ আদব আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ পছন্দ করেছেন। (যেমন-) এক দিন হুযূর পুরনূর সায়্যিদুল আউলিয়া ইমামুল উরাফা হযরত সায়্যিদুনা গাউসূল আ'যম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হযরত আলী ইবনে হায়তী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হির কাছে মেহমান হন। হযরত আলী ইবনে হায়তী তাঁর বিশেষ মুরিদ হযরত আবুল হাসান আলী জাওসকী রাহমতুল্লাহি তা'আলা আলায়হিকে হযরত গাউসূল আ'যম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর খিদমতে নিয়োজিত থাকার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং ইতোপূর্বে এও বলেছিলেন যে, আমি হুযূর গাউসুল আযম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর গোলামদের একজন। হযরত আবুল হাসান আপন পীর-মুরশিদের এ নির্দেশ পেয়ে কাদা আরম্ভ করলেন, কোনভাবেই নিজ পীরের দরবার ত্যাগ করতে চাইলেন না। হুযুর গাউসূল আযম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তাঁকে কাঁদতে দেখে বললেন,

مَا یُحِبُّ إِلاَّ الثُّدي رَضَعَ مِنهُ.

‘সে যে স্তন থেকে দুধ পান করেছে, তা ছাড়া অন্য স্তন কামনা করছে না। আর তাকে নিজ পীরের খিদমতে অবস্থান করতেই নির্দেশ দিলেন।
আরিফ বিল্লাহ ইমাম আবদুল ওয়াহহাব শা’রানী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি মিযানুশ শরীয়্যাতুল কুবরা গ্রন্থে বলেন,

سَمِعتُ سَیِّدِيعَلِيَّ الخَوَّصَ رَحِمَهُ اللّٰهُ یَقُولُ: إِنَّمَا أَمَرَ عُلمَاءُ الشَّرِیعَةِ الطَّالِبَ بِالإِلتِزَامِ مَذهَبُ مُعَیِّنُ وَعُلَمَاءُ الحَقِیقَةِ لِلمُرِیدِ بِالإِلتِزَامِ شَیخُ وَاحِدُ.

‘আমি হযরত আলী খাওয়ায রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হিকে বলতে শুনেছি যে, শরীয়তের আলিমগণ শরীয়তের অনুসারীকে নিদের্শ দিয়েছেন, যেন মযহাব চতুষ্টয় থেকে নির্দিষ্ট একটি মযহাবের তাকলীদকে নিজের জন্য অপরিহার্য করে নেয়। আর তরীকতের আলিমগণ মুরিদকে বলেছেন, যেন একজন পীরকে অপরিহার্য করে নেয়।

১.শাতনুফী, বাহজাতুল আসরা, ذکر أي الحسن علي الحوسقي٫ পৃ. ২০৫
ইমাম নূরউদ্দিন আবুল হাসান আলী ইবনে ইউসূফ লাখমী (কাদ্দাসা সিররাহু) স্বীয় গ্রন্থ বাহজাতুল আসরার ওয়া মা´দানুল আওয়ারে এ সহীহ সনদে আবু হাফস উমর বাযযারের সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
২. আবদুল ওহাব শা'রানী, আল-মিযান আল-কুবরা, অনুচ্ছেদ : فان قلت فاذا انفك قلب السولي عسن التقلید, ১/২৩,
উক্ত বর্ণনার পর ওই লেখক এক স্পষ্ট উদাহরণের মাধ্যমে এ বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করেছেন। ইমাম আল্লামা মুহাম্মদ আবদরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (যিনি ইবনুলহাজ নামে প্রসিদ্ধ) মাদখাল নামক কিতাবে বলেন,

اَلمُرِیدُ یُعَظَّمُ شَیخَهُ وَیَٶثِرُهُ عَلَي غَیرِهِ مِمَّن هُوَ فِي وَقتِهِ لِأَنَّ النَّبِيَّ ﷺ یَقُولُ: مَن رُزِقَ فِي شَٸٍ فَلیَلزِمهُ.

‘মুরীদ স্বীয় পীরকে তা’যীম করবে এবং তাঁকে তাঁর যুগের সমস্ত ওলীর উপর প্রাধান্য দেবে। কারণ, হুযূর নবী করিম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, যাকে যে কারণে রিযক দেওয়া হয়, তার উচিৎ তাকে আকড়ে ধরা।

ওই গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে,

إِنَّ المُرِیدُ لَهُ اتُسَاعُ فِي حُسنِ الظَّنَّ بِهِم وَفِي التِبَاطِهِ عَلَي شَخصٍ وَاحِدٍ یَعُولُ عَلَیهِ فِي أُمُورِهِ وَیَحذِرُ مَن تَقضَي أَوقَاتَهُ لِغَیرِ فَاٸِدَةٍ.

‘মুরিদের জন্য এ-ও অবকাশ রয়েছে যে, সে স্বীয় যুগের সমস্ত শায়খ বা পীরদের প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করবে এবং একজন পীরের দামনের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে আর স্বীয় সকল কাজে তার উপরই নির্ভর করবে। অনর্থক সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকবে।

* ফায়েদা : এ হাদীস উক্ত ইমাম (লেখক) মু´দাল (معضلا) হিসেবে বর্ণনা করেছেন । হাদীসটি `হাসান´ পর্যায়ের । ইমাম বায়হাকী শুআবুল ঈমানে ‘হাসান’ সনদে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। আর এ একই হাদীস ইবনে মাজাহতে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়শা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহার সূত্রে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ বচনে বর্ণিত আছে যে,

مَن بُورِكَ لَهُ فِي شَيءٍ فَلیَلزِمهُ.

১. ইবনুল হাজ, আল-মাদখাল, حقیقة أحد العهد, ৩/২২৩ ও ২২৪, দারুল কিতাব আল-আরবী, বৈরুত

২. ইবনুল হাজ, আল-মাদখাল, في رسول المرید الحلوة, ৩/১৬০, দারুল কিতাব আল-আরবী, বৈরুত।

যাকে কোন জিনিসে বরকত দেওয়া হয়েছে, তার উচিৎ যেন তা উপরিহার্য। করে নেয়।
এ হাদীস কতই না বিশুদ্ধ ও উত্তম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি দান করেছেন ও ইহসান করেছেন। আর সালাত ও সালাম তার ওই মহান রসূলের উপর (বর্ষিত হোক) যিনি সবচেয়ে বেশি ইহসানকারী। তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবী এবং যাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছেন, সকলের উপরও। আল্লাহ তা'আলা অধিক পরিজ্ঞাত। তাঁর জ্ঞান পরিপূর্ণ, তাঁর হুকুম খুব শক্তিশালী।
১. মোল্লা আলী কারী,

الأسرار المرفوعة في الأحبار الموضرعة المعروف بالموضوعات الکسیر٫

২২৫, দারুল কুতুব আল-আলমিয়া, বৈরুত।

➖➖➖➖➖➖➖➖➖
অধ্যায় ৪

'যার পীর নেই, তার পীর শয়তান'- এ উক্তির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

শায়খ (পীর-মুরশিদ) বা আল্লাহর পথে পথ-প্রদর্শনকারী (হাদী) দু'ধরনের হয়ে থাকে।
১. সাধারণ হাদী (عام هادي) বা মুরশিদে আম
২. বিশেষ হাদী (خاص هادي) বা মুরশিদে খাস
এক. ‘সাধারণ হাদী’ হচ্ছে আল্লাহর কালাম, শরীয়ত ও তরীকতের ইমামগণের কালাম এবং আহলে যাহির ও বাতিন আলিমগণের কালাম। এ বিশুদ্ধ ধারা পরম্পরায় সাধারণ লোকের (عوام) হাদী হচ্ছেন আলিমগণের কালাম, আলিমগণের রাহনুমা হচ্ছেন ইমামগণের কালাম, ইমামগণের মুরশিদ হচ্ছেন রসূলের কালাম আর রসূলের পেশওয়া হচ্ছেন আল্লাহর কালাম।

দুই, ‘বিশেষ হাদী’ হচ্ছে, আল্লাহর এমন বিশেষ বান্দা যিনি নিজে হিদায়তের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত, অন্যকে হিদায়তের পথে পরিচালিত করতে সক্ষম এবং বায়আতের সকল শর্তের ধারক। একজন সাধারণ লোক তার হাতে বায়আত গ্রহণের মাধ্যমে নিজের সকল কাজ-কর্ম, কথাবার্তা, নড়াচড়া, উঠা-বসা ইত্যাদিতে শরীয়ত ও তরীকতের শিক্ষা ও আদর্শ অনুসারে ওই শায়খের নির্দেশনার উপর অটল-অবিচল থাকে।
উপরিউক্ত প্রথম প্রকারের শায়খ বা পীর-মুরশিদ প্রত্যেক লোকের জন্য আবশ্যক। এ প্রকার পীর-মুরিশদ বিহীন লোকের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তার ইবাদত বন্দেগী সবই ধ্বংসে নিপতিত। তাকে প্রথমে সালাম দেয়া নিষেধ। কিয়ামত দিবসে তার পুনরুত্থান হবে শয়তানের দলের সাথে । আল্লাহ তা'আলা বলেন,

یَومَ نَدعُوا کُلَّ أُنَاسِ بِإِمَمِهِ

‘ওই দিন প্রত্যেক দলকে তাদের ইমামের সাথে আহ্বান করা হবে।”
হিদায়তের উপর প্রতিষ্ঠিত ইমামগণকে যখন কেউ নিজের পীর-মুরশিদ (ইমাম) বলে মেনে না নেয়, তখন সে পথভ্রষ্ট ইমাম অর্থাৎ অভিশপ্ত শয়তানের মুরিদ হলো । অবশ্যই সে কিয়ামত দিবসে তারই দলে উত্থিত হবে। আল্লাহ তা'আলার পানাহ্! আর কালেমা-পড়ুয়া বা মুসলমানদের মধ্যে এ প্রকারের পীর-মুরশিদবিহীন লোক চারটি দলে বিভক্ত। যেমন--
১. আল-কুরআন, সুরা আল-ইসরা, ১৭:৭১

প্রথমত: ওইসব কাফির ও নাস্তিক যারা প্রথম থেকে কুরআন হাদিসকে মানে না। যেমন, ন্যাচারী (প্রকৃতিবাদী), যারা হাদীসের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে আর কুরআনের নিশ্চিত অকাট্য সঠিক অর্থকে রদ করে একটি সুবিধা মতো মনগড়া অর্থ করে থাকে। এসব লােকের উপর আল্লাহর লা'নত হোক।

দ্বিতীয়ত: গায়রে মুকাল্লিদ, যারা বাহ্যিকভাবে কুরআন-হাদীস মানে, কিন্তু দ্বীনের প্রকৃত ধারক-বাহক ও ইসলামী শরীয়তের মহান ইমামগণকে বাতিল ও অনুসরণযোগ্য নয় বলে বিশ্বাস রাখে । ইসলামী শরিয়তের মহান ইমামগণের অনুসরণ (বায়আত)-এর রজ্জু ছিন্ন করে সরাসরি আল্লাহ ও রসুলের সাথে হাত মেলাতে চায় ।

وَسَیَعلَمُ الَّذِینَ ظَلَمُوا أَیَّ مُنقَلَبٍ یَنقَلِبُون

‘জালিমরা শীঘ্রই জানবে কোন স্থলে ওরা প্রত্যাবর্তন করবে।

তৃতীয়ত: মুকাল্লিদ ওহাবীগণ, যদিও তারা বাহ্যিকভাবে ফিকহের প্রত্যেক শাখাগত (فروع) মাসআলায় ইমামগণের তাকলীদ (অনুসরণ) করার কথা বলে কিন্তু শরীয়তের মৌলিক (أصول) ও আকীদাগত (عقاٸد) বিষয়ে প্রকাশ্যে মুসলমানদের বৃহত্তম দল (سواد أعظم)-এর বিপরীতে চলে । আল্লাহর মহান ওলীগণের মকাম, মানসাব, তাসাররুফ ও মরতবা ইত্যাদি বিষয় তাদের গায়ের জ্বালার কারণ হয়।

চতুর্থত: অনুরূপভাবে সকল পথভ্রষ্ট, বদ-মযহাব ভ্রান্ত-দল-উপদল। যেমন, রাফেযী (শিয়া), খারেজী, মু'তাযিলা, কাদরীয়া ও জাবরীয়া ইত্যাদি। আল্লাহ তাদের সকলকে অপদস্থ করুক! ওই সব ভ্রান্ত দল-উপদল হিদায়তের পথ ছেড়ে নিজেদের কামনা-বাসনা ও কু-প্রবৃত্তিকে ইমাম বা (পীর-মুরশিদ) বানিয়েছে আর নিজেদের বায়আতের সিলসিলা অভিশপ্ত শয়তানের সাথে জুড়ে দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

أَفَرَءَیتَ مَنِ اُتَّخَذَ إِلَهَهُ٫ هَوَٸهُ. ‘তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে, যে তার খেয়াল-খুশীকে নিজ ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে?”

সুতরাং সার কথা হচ্ছে যে, যারা প্রবৃত্তির পুজারী অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়া জামা'আতের বিরোধী, তারা প্রথম অর্থের ভিত্তিতের পীরবিহীন বলে সাব্যস্ত হবে। তাদের পীর শয়তান, শয়তানের সাথে তাদের হাশর হবে, তারা পথভ্রষ্ট, তারা ইসলামের
১. আল-কুরআন, সুরা আশ-শুয়ারা, ২৬:২২৭
২. আল-কুরআন, সুরা আল-জাসিয়া, ৪৫:২৩
গণ্ডির বাইরে, তাদের ইবাদত-বন্দেগী কবুল হবে না-ইত্যাদি বিধান তাদের ক্ষেত্রে প্রযাজ্য হবে।
قَتَلَهُمُ اللّٰهُ ؑ أَنَّیٰ یُٶفَکُونَ. ‘আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! ওরা ওল্টো দিকে কোথায় ফিরে যাচ্ছে?
বিশুদ্ধ আকীদাধারী সুন্নী, যারা হিদায়তের উপর প্রতিষ্ঠিত ইমামগণকে মানেন, ইমামগণের তাকলীদকে জরুরি জানেন, সম্মানিত ওলীগণের প্রতি সাচ্ছা ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, এবং ইসলামের সকল মৌলিক বিশ্বাস (আকাইদ)-এ সঠিক পথের উপর অবিচল রয়েছেন, তারা কখনো পীরহীন হয় না।

আল্লাহ, রসূল, মাযহাবের ইমাম ও আলিমগণ এ চার পরম্পরা তাদের পীর মুরশিদ। এমতাবস্থায় সকল সুন্নী মুসলমানদের হাত পবিত্র শরীয়তের হাতের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। (কারো কারো ক্ষেত্রে) যদিও প্রকাশ্যে আল্লাহর কোন খাস-বান্দার পবিত্র হাতে হাত রেখে বায়আতের গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ হয় নি।

عہد ما بالب شیریں دہنا بست خداۓ   ما ہمہ بندہ وایں قوم خدا وندا نند

আল্লাহ তা'আলা মিষ্টভাষী লোকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক জুড়ে দিয়েছেন। আমরা সবাই হলাম গোলাম আর ওরা হচ্ছেন আকা বা মনিব ।
দ্বিতীয় অর্থের ভিত্তিতেও শায়খ বা পীর মুরশিদ ওই ব্যক্তির জন্য আবশ্যক যে সুলুক বা তরীকতের পথে চলতে চাই। এ পথ এতো সহজ নয় যে, নিজ ইচ্ছা মতো কিংবা এত সংক্রান্ত কিতাবাদি পড়ে চলা যায়। এ পথের পথিক তার যোগ্যতা ও অবস্থা অনুপাতে এমন সব কঠিন বিপদাপদের সম্মুখীন হয়, যার থেকে উত্তোরণ কামিল পীরের দিকনির্দেশনা ছাড়া সম্ভব নয়। আর এ বিশেষ প্রকার পীরের বায়আত ছেড়ে দেওয়ার কারণে কারো প্রতি ওই সব বিধান প্রয়োগ করা যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে, নিছক মিথ্যা, বাতিল ও প্রকাশ্য যুলম এবং দ্বীনের প্রতি সরাসরি অপবাদই। প্রথমত: তরীকতের এ বন্ধুর পথের অভিযাত্রী অতি নগণ্য। দ্বিতীয়ত: এ পথে কেউ চলতে চাইলেও উপযুক্ত পীর-মুরশিদ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। (কারণ)।

اےبسا ابلیس آدم ہوۓ ہست    پس بہر دستے نبا ید داددست

‘মানব আকৃতিতে অনেক শয়তান রয়েছে। অতএব যার-তার হাতে
১. আল-কুরআন, সুরা আত-তাওবা, ৯:৩০
২. তা হচ্ছে, পীরবিহীন লােক পথভ্রষ্ট, ইসলাম থেকে খারিজ, তার ইবাদত-বন্দেগী কবুল হয় না, তার নামায-রোযা তেলবিহীন প্রদীপের ন্যায়, পীরবিহীন লোকের তাসবীহ-দরূদ-ওযীফা ইত্যাদিতে সময় ব্যয় করা জীবন বরবাদ করার নামান্তর। সর্বোপরি পীরহীন লোকের পীর হচ্ছে শয়তান ইত্যাদি।

(বায়আতের জন্য) হাত দিও না।
এমন অনেক আলিম ও নেককার বান্দা দেখা যায়, যারা তরীকতের এ বিশেষ বায়আত (بیعت خاص)-এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। আল্লাহর পানাহ! তাই বলে কি তাঁদের ব্যাপারে ওইসব কঠিন বিধান প্রযোজ্য হবে? আর যারা এ বিশেষ বায়আত গ্রহণ করেছেন তারা কি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথেই হয়েছেন? কখনো না। বরং তাদের অনেকে যখন ইলমে জাহেরের ইমামতের উচ্চ মর্যাদায় গিয়ে পৌঁছেছেন, তারপর গিয়ে। এ বিশেষ বায়আত অর্জন করেন। তাহলে ওই দীর্ঘসময়কাল পর্যন্ত তারা কি ওই বিধানের উপযোগী ছিলেন? আল্লাহর পানাহ! এ প্রকার ধারণা নিরেট মুর্খতা ও সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার নামান্তর।
‘দুনিয়াতে যার শায়খ বা পীর নেই, পরকালে তার পীর শয়তান। অর্থাৎ শয়তানের সাথে তার হাশর হবে।'—এটা রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী (হাদীস) নয়। হ্যা আউলিয়া-ই কিরামের উক্তি হবে। আর-

اَلشَّیخُ فِي قَومِهِ کَالنَّبِيِّ فِي أُمَّتِهِ.

শায়খ (পীর) স্বীয় গোত্রে তেমনি, যেমন নবী নিজ উম্মতের মধ্যে।

এটা হাদীস হওয়া নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। যেমন, ইবনে হিব্বান কিতাবুদ দো'আফা আর দায়লামী মাসনাদুল ফেরদৌসে হযরত আবু রাফি রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন বলেছেন। যদিও এ হাদীসকে ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী এবং তার পূর্বে ইবনে তায়মিয়া মওযু আর ইমাম সাখাভী বাতিল বলেছেন। কিন্তু সঠিক অভিমত হচ্ছে তাই যা ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী থেকে বর্ণিত আছে। তার মতে, এ হাদীস শুধুমাত্র যয়ীফ; বাতিল ও মওযু নয়। তিনি জামে সগীর-এ দু’সূত্রে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন-

اَلشَّیخُ فِي أَهلِهِ کَالنَّبِيِّ فِي أُمَّتِهِ.

শায়খ (পীর) স্বীয় গোত্রে তেমনি, যেমন নবী নিজ উম্মতের মধ্যে।

اَلشَّیخُ فِي بَیتِهِ کَالنَّبِيِّ فِي قَومِهِ.

শায়খ (পীর) স্বীয় পরিবারে তেমনি, যেমন নবী নিজ উম্মতের মধ্যে।

১. সাখাবী,المقاصد الحسنة في بیان کثیر من الأحادیث المشتهرة علی الألسنة, হাদীস : ৬০৯, পৃ-২৫৭, দারুল কুতুব আল আলমিয়া, বৈরুত।
সুয়ুতী,خطبة المٶلف ٫ الجامع الصغیر من حدیث البشیر النذیر, হাদীস: ৪৯৬৯, দারুল কুতুব আল-আলমিয়া, বৈরুত।

আর তিনি উক্তগ্রন্থের ভূমিকায় তার এ গ্রন্থে কোন মওযু হাদিস বর্ণনা করবে না মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যেমন তিনি লিখেছেন-

تَرَکتُ القَشرَ وَأَخَذتُ اللُبَابَ وَصَنَعتُهُ عَمَّا تَفَرَّدَ بِهِ وَضَّاعُ أَو کَذَّبُ.

‘আমি কোশাকে ছিন্ন করে মগজ বের করেছি। মনগড়া হাদীস রচনাকারী ও মিথুকদের বর্ণনা থেকে এ গ্রন্থকে রক্ষা করেছি।'
কিন্তু উক্ত হাদীস দ্বারা এটুকু প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর পথের দিকে আহ্বানকারী হাদীদের আনুগত্য করা আবশ্যক। এ হাদীসের অর্থ নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোন কারণ নেই। কারণ স্বয়ং পবিত্র কুরআনের এ আয়াত

أَطِیعُوا اُللّٰهَ وَأَطِیعُوا اُلرَّسُولَ وَأَولِی ُالأَمرِ مِنکُم.

‘আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রসুলের এবং যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট।
উক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী (উলুল আমর) দ্বারা ওলামায়ে দ্বীন তথা শরীয়ত ও তরীকতের আলিমগণকে বুঝানো হয়েছে। এটাই সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য অভিমত। এ হাদীস দ্বারা এ অর্থে নেয়া “যে ব্যক্তি প্রকাশ্যভাবে কারো হাতে বায়আত গ্রহণ করলো না, সে গোমরাহ (পথভ্রষ্ট)'—চরম বাড়াবাড়ি, অপবাদ ও মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। আল্লাহর পানাহ।
হ্যাঁ! বায়আত ও ইমামতে কুবরা সম্পর্কে সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে,

~مَن خَلَعَ یَدًا مِن طَاعَةٍ لَقِيَ اللّٰهَ یَومَ القِیَامَةِ لاَ حُجَّةَ لَهُ وَمَن مَاتَ وَلَیسَ فِی عُنُقِهِ بَیعَةُ مَاتَ مِیتَةً جَاهِلِیَّةً~

“যে ব্যক্তি ইমামের আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিলো, যে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর সাথে এমতাবস্থায় সাক্ষাৎ করবে, তার হাতে কোন দলীল থাকবে না। যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করলো যে, তার গর্দানে বায়আত (আনুগত্যের) বেড়ি থাকলো না, সে জাহেলীয়াতের মৃত্যুতে মৃত্যুবরণ করলো।
এ পরিণতিও তখনই হবে যখন ইমাম বিদ্যমান থাকবে। অন্যথায় ওয়াজিব নয়। আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কষ্ট দেন না।

১. সুয়ুতী,خطبة المٶلف ٫الجامع الصغیر من حدیث البشیر النذیر, হাদীস : ৪৯৭০, দারুল কুতুব আল-আলমিয়া, বৈরুত
২. সুয়ুতী,خطبة المٶلف ٫الجامع الصغیر من حدیث البشیر النذیر, ১/৫, দারুল কুতুব আল-আলমিয়া, বৈরুত
৩. আল-কুরআন, সুরা আন-নিসা, ৪:৫৯
৪. মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল ইমরা, অধ্যায় : وجوب ملازمة جماعة المسلمین , ২/১২৮কদীমী কুতুবখানা।

➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖
অধ্যায় ৫

খিলাফত ও সাজ্জাদানশীনী সাব্যস্ত হওয়ার পদ্ধতি

খিলাফত ও সাজ্জাদানশীনী প্রমাণিত হওয়ার জন্য শরীয়তগত ও যুক্তিগত দু'টি পদ্ধতি রয়েছে।
১. সনদে ইত্তেসাল (سند اتصال) (খলীফা বা সাজ্জাদানশীনের সাথে তাঁর উর্ধ্বতন শায়খ বা পীরের যোগসূত্র ঠিক থাকা, মাঝখানে কোন কারণে সনদ বিচ্ছিন্ন না হওয়া)
২. প্রসিদ্ধি (شهرة) সুতরাং উক্ত দু’পদ্ধতির যে কোন একটি দ্বারা কারো খিলাফত ও সাজ্জাদানশীনী হওয়া প্রমাণিত হলে, এ ক্ষেত্রে কারো অস্বীকার ধর্তব্য নয়।
ফতহুল কাদীর, বাহরুর রাই’ক, নাহরুল ফাই’ক, মানহুল গাফফার ও রদ্দুল মুহতার ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে,

وَطَرِیقُ نَقلِهِ لِذَالِكَ عَن المُجتَهِدِ أَحَدُ أَمرَینَ: إِمَّا أَن یَکُونَ لَهُ سَنَدُ فِیهِ، أَو یَأخُذَ مِن کِتَابٍ مَعرُوفٍ تَدَاوَلَتهُ الأَیدِي نَحوُ کُتُبِ مُحَمَّدِینِ الحَسَنِ، وَنَحوِهَا مِن التَّصَانِیفِ المَشهُورَةِ لِلمُجتَهِدِینَ، لِأَنَّهُ بِمَنزِلَةِ الخَیرِ المُتَوَاتِرِ المَشهُورِ هَکَذَا ذَکَرَ الرَّازِيّ

‘মুজতাহিদ থেকে কোন উক্তি বর্ণনা করার জন্য দু'টি পদ্ধতির যে কোন একটি পদ্ধতির অনুকরণ করতে হবে। তা'হচ্ছে, ১.ঐ উক্তির সনদ এবং ২. ঐ উক্তি কোন প্রসিদ্ধ কিতাব থেকে উদ্ধৃতি করা, যা সর্বজন প্রসিদ্ধ। যেমন, মুহাম্মদ ইবনে হাসান-এর কিতাবসমূহ এবং তাঁর মতো অন্যান্য মুজতাহিদের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহ। কারণ, ঐ গুলো মুতাওয়াতির ও মশহুর হাদীসের সমমর্যাদাসম্পন্ন। ইমাম রাযীও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইমামগণের উপরিউক্ত বর্ণনা মতে, আল্লাহর দ্বীন ও শরীয়তের বিধি-বিধান, হালাল-হারামের মাসআলাসমূহ এবং ফতওয়া ও বিচার সম্পর্কীত বিষয়াদিতে এ দু’পদ্ধতি- ‘সনদ’ ও ‘প্রসিদ্ধি’ থেকে যে কোন একটি পাওয়া যাওয়াই যেখানে যথেষ্ট, যার ভিত্তিতে হদ ও কিসাসের বিধান জারী করা হয়, সেখানে খিলাফত ও
১. ইবনে আবেদীন আশ-শামী, রদুল মুহতার,کتاب القضاء, ৪/৩০৬, দারু ইয়াহয়ায়িত তুরাসিল আরবী, বৈরুত।
সাজ্জাদানশীনীর ক্ষেত্রে এ উভয় পদ্ধতিকে যথেষ্ট মনে না করা সরাসরি অবিচার বৈ কিছু নয় ।

১. সনদ'-এর অবস্থা তো এই যে, কোন শ্রোতা যখন কোন হাদীস বা ফিকহর মাসআলা আপন শায়খ (শিক্ষক) থেকে বর্ণনা করে এবং তার বর্ণনায় ‘আমি শুনেছি'-এ প্রকার বচন না থাকলেও ইমাম বোখারীসহ কতেক ইমামগণের মতে, ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে কখনো শুধু সাক্ষাত হয়েছে মর্মে প্রমাণ পাওয়া যাওয়াটাই তার হাদীস বা মাসআলা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আর ইমাম মুসলিমসহ জমহুর ইমামগণের মতে, শায়খ ও ছাত্রের মধ্যে সাক্ষাতেরও প্রয়োজন নেই বরং উভয়ে একই যুগের হওয়াই এবং সাক্ষাত লাভের সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকাই যথেষ্ট। আমাদের হানাফী আলিমগণের কাছে এটাই বিশুদ্ধ অভিমত। তাই, ‘আমি শুনেছি, আমাকে খবর দিয়েছেন, আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন'—এ প্রকার বচনের প্রয়ােজন নেই। এ সনদধারী তার শায়খ থেকে শুনেছেন কিনা মর্মে সাক্ষ্য তলব করাকে আবশ্যক মনে করা ইমামগণের ঐক্যমতে বাতিল।

  ইমাম মুসলিম তার সহীহ মুসলিমের মুকাদ্দামায় বলেন-

زَعَمَ القَاٸِلُ الَّذِی افتَتَحنَا الکَلاَمَ عَلَی الحِکَایَةِ عَن قَولِهِ وَالإِخبَارِ عَن سُوءِ رَوِیَّتِهِ أَنَّ کُلَّ إِسنَادٍ لِحَدِیثٍ فِیهِ فُلاَنُ عَن فُلاَنٍ وَقَد أَحَاطَالعِلمُ بِأَنَّهُمَا قَد کَانَ فِی عَصرٍ وَاحِدٍ وَجَاٸِزُ أَن یَکُونَ الحَدِیثُ الَّذِي رَوَی الرَّوِی عَمَّن رَوَی عَنهُ قَد سَمِعَهُ مِنهُ وَشَافَهَهُ بِهِ غَیرَ أَنَّهُ لاَنَعلَمُ لَهُ مِنهُ سَمَاعًا وَلَم نَجِد فِی شَیءٍ مِنَ الرَّوَایَاتِ أَنَّهُمَا التَقَیَا قَطُّ. وَهَذَا القَولُ- یَرحَمُكَ اللّٰهُ- فِی الطَّعنِ فِی الأَسَانِیدِ قَولُ مُختَرَعُ مُستَحدَثُ غَیرُ مَسبُوقٍ صَاحِبُهُ إِلَیهِ وَلاَ مُسَاعِدَ لَهُ مِن أَهلِ العِلمِ عَلَیهِ وَذَلِكَ أَنَّ القَولَ الشَّاٸِعَ المُتَّفَقُ عَلَیهِ بَینَ أَهلِ العِلمِ بِالأَخبَارِ والرَّوَایَاتِ قَدِیمًا وَحَدِیثًا أَنَّ کُلَّ رَجُلٍ ثِقَةٍ رَوَی عَن مِثلِهِ حَدِیثًا وَجَاٸِزُ مُمَکِّنُ لَهُ لِقَاٶُهُ وَالسَّمَاعُ مِنهُ لِکَونِهِمَا جَمِیعًا کَانَا فِی عَصرٍ وَاحِدٍ وَإِن لَم یَأتِ فِی خَیرٍ قَطُّ أَنَّهُمَا اجتَمَعا وَلاَ تَشَافَهَا بِکَلاَمٍ فَالرَّوَایَةُ وَالحُجَّةُ بِهَا لاَزِمَةُ إِلاَّ أَن یَکُونَ هُنَاكَ دَلاَلَةُ بَینَةُ أَنَّ هَذَا الرَّاوِیَ لَم یَلقَ مَن رَوَی عَنهُ إلخ

“যে ব্যক্তির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আমরা আলোচনা শুরু করেছি এবং যার ধ্যান-ধারণাকে আমরা বাতিল বলে গণ্য করেছি তার অভিমত হচ্ছে-‘যদি সনদের মধ্যে فُلاَنُ عَن فَلاَنٍ (অমুক অমুকের কাছ থেকে), এভাবে উল্লেখ থাকে এবং এ কথা জানা যায় যে, তারা উভয়ই একই যুগের রাবী, একই সময়ের লোক, তাছাড়া হাদিসটি সরাসরি শুনার এবং পরস্পর সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু সে তার উর্ধ্বতন রাবীব কাছ থেকে শুনেছে বলে আমরা জানতে পারিনি এবং কোন রেওয়ায়তের মধ্যেও আমরা পাইনি যে, তাদের উভয়ের মধ্যে কখনো সাক্ষাৎ ঘটেছে অথবা সামনি-সামনি কোন কথা-বার্তা হয়েছে-তাহলে এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির মতে এভাবে যতো হাদীস বর্ণিত হবে তা দলিল হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না, যে পর্যন্ত প্রমাণ না হবে যে, তারা উভয়ে গোটা জীবনে একবার অথবা একাধিকবার কোন এক জায়গায় একত্রিত হয়েছিল অথবা এর স্বপক্ষে কোন বর্ণনা মওজুদ আছে।' অতঃপর ইমাম মুসলিম বলেন, হাদীসের সনদসমূহকে ক্ষত বিক্ষত করার জন্য এটা এমন একটা মনগড়া অভিমত, যা ইতোপূর্বে কেউ বলেনি। আর হাদীস বিশারদ উলামা কেরামের কেউ এ কথার সমর্থনও করেননি। কেননা, অতীত ও বর্তমান তথা সর্বকালের হাদীস বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসদের ঐক্যমত হচ্ছে- প্রত্যেক নির্ভরযোগ্য (সিকা) রাবী যখন কোন নির্ভরযোগ্য রাবী থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করে এবং তারা দু'জন একই যুগের লোক হওয়ার দরুন তাদের মধ্যে পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ এবং একজন অন্যজন থেকে কোনা কথা শুনার সম্ভাবনা থাকে, যদিও কোন হাদীস বা খবর দ্বারা কখনো তাদের একত্রিত হওয়ার সঠিক কথা বা পরস্পর সামনা-সামনি বসে আলোচনা করার কথা জানা যায় নি, এমতাবস্থায় আলিমদের মতে এ জাতীয় হাদীস প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত হবে এবং তা দলীল হিসেবে গৃহীত হবে। তবে হাঁ, যদি কোন জায়গায় সুস্পষ্টভাবে এ নিদর্শন পাওয়া যায় যে, উক্ত রাবী, যার থেকে যে বর্ণনা করে তার সাথে আদৌ তার সাক্ষাত হয়নি অথবা তার থেকে এ ব্যক্তি কোন কিছু শুনে নি, তখন এ হাদীস দলীল হিসেবে গৃহীত হবে না। কিন্তু যেখানে ব্যাপারটি অস্পষ্ট এবং তাদের উভয়ের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান সেখানে অধস্তন রাবী তার উর্ধ্বতন রাবীর কাছে হাদিসটি শুনেছে বলে ধরে নেওয়া হবে।”
ইমাম নবভী তার ব্যাখ্যায় বলেন,

وَهَذَا الَّذِی صَارَ إِلَیهِ مُسلِمُ قَد أَنکَرَهُ المُحَقَّقُونَ وَقَالُوا: هَذَا الَّذِي صَارَ إِلَیهِ ضَعِیفُ وَالَّذِي رَدَّهُ هُوَ المُختَارُ الصَّحِیحُ الَّذِي عَلَیهِ أَٸِمَّةِ هَذَا الفَنِّ عَلِيُّ بنُ المَدِینِي وَالبُخَارِي وَغَیرِهِمَا إلخ

উপরিউক্ত অভিমত ইমাম মুসলিমের। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, মুহাক্কিক ইমামগণ উক্ত অভিমত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এটা যয়ীফ (দুবর্ল)। তাই সঠিক অভিমত হচ্ছে, যা আলী ইবনুল মাদানী ও ইমাম বুখারী প্রমুখ ইমামগণ গ্রহণ করেছেন। তা হচ্ছে, অন্তত একবার সাক্ষাৎ ঘটেছে বলে প্রমাণ হতে হবে, কেবল সাক্ষাৎ হবার সম্ভাব্যতাই যথেষ্ট নয়।

ফাতহুল কাদীর বিতর অধ্যায়ে উল্লেখ আছে,

وَمَا نُقِلُ عَن البُخَارِيِّ مِن أَنَّهُ أَعَلَّهُ بِقَولِهِ لاَیُعرَفُ سَمَاعُ بَعضِ هَٶُلاَءِ مِن بَعضٍ فَبِنَاءً عَلَی اشتِرَاطِهِ العِلمَ بِاللُّقِيِّ، وَالصَّحِیحُ الاِکتِفَاءُ بِإِمکَانِ اللُّقِِّ

“ইমাম বোখারী থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি (সাক্ষাতের সম্ভাব্যতাই যথেষ্ট) এ অভিমতকে ‘যয়ীফ (দুর্বল) বলেছেন। তাঁর মতে সাক্ষাৎ হয়েছে মর্মে জ্ঞাত হওয়াই যথেষ্ট। আর সঠিক অভিমত হচ্ছে-সাক্ষাতের সম্ভাব্যতাই যথেষ্ট।
উক্ত গ্রন্থে যাকাত অধ্যায়ে রয়েছে,

قَولِ الجُمهُورِ فِي الاِکتِفَاءِ بِالمُعَاصَرَةِ مَا لَم یُعلَم عَدَمُ اللُّقِيِّ. وَأَمَّا عَلَي مَا شَرَطَهُ البُخَارِيُّ وَابنُ المَدِینِيِّ مِن العِلمِ بِاجتِمَاعِهِمَا وَلَو مَرَّةً وَالحَقُّ خِلاَفُهُ.

১. মুসলিম, আস-সহীহ, مقدمة الکتاب, ১/২১-২২, কদীমী কুতুবখানা, করাচি
২. নববী, শরহুন ননবী আলা মুসলিম, مقدمة الکتاب, ১/২১, কদীমী কুতুবখানা, করাচি
৩. ইবনে হুমাম, ফতহুল কদীর,باب الوتر٫ کتاب الصلاة, ১/৩৭০, মকতবায়ে নুরিয়া রেজভিয়া।

অধিকাংশের অভিমত হচ্ছে, (মুনআনআন হাদীসের ক্ষেত্রে বারীগণ) একই যুগের হওয়াই যথেষ্ট, যদিও সাক্ষাত লাভ হয়েছে কিনা মর্মে জানা না যায়। কিন্তু ইমাম বোখারী ও আলী ইবনুল মাদানী ‘সমসাময়িক ও সাক্ষাৎ ঘটা' যদিও অত্যন্ত একবার হওয়াকে শর্তারোপ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে তার বিপরীত (অর্থাৎ সমসাময়িক হওয়াই সাক্ষাৎ ঘটার। সম্ভাব্যতার জন্য যথেষ্ট। তাই সাক্ষাৎ হয়েছে মর্মে নিশ্চিত জ্ঞাত হওয়ার প্রয়োজন নেই)।
খিলাফত ও সাজ্জাদানশীনী তো আছেই। স্বয়ং হুযূর পুর নুর সায়্যিদুল আলম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হওয়ার ব্যাপারে মুহাক্কিক আলিমগণ বলেন, নির্ভরযোগ্য (ثقة) ও ন্যায়পরায়ণ (عادل) ব্যক্তি যদি নিজের সম্পর্কে বললো, আমি মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যের সৌভাগ্য অর্জন করেছি'—এটা বলাটা তাঁর সাহাবী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যদিও অন্য কোন পদ্ধতিতে তাঁর সাহাবী হওয়ার প্রমাণ কোনভাবেই প্রমাণিত না হয়।
ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী আল-ইসাবাহ ফী তামীযীস্ সাহাব গ্রন্থে বলেন,

َافَصلُرالثَّانِيُّ فِي الطَّرِیقِ إِلَي مَعرَفَةٍ کَونِ الشَّخصِ صَحَابِیَّا وَذَلِكَ بِأَشیَاءٍ أَوَّلُهَا أَن یَّشبُتَ بِطَرِیقِ التَّوَاتُرِ أَنَّهُ صَحَابِیُّ، ثُمَّ بِالإِستِفَاضَةِ وَالشُّهرَةِ ثُمَّ بِأَن یَّروِي عَن أَحَدٍ مَّن الصَّحَابَةِ أَنَّ فُلاَنًا لَهُ صُحبَةُ مَثَلاً وَکَذَا عَن أَحَدِ التَّابِعِینَ بِنَاءً عَلَي قُبُولِ التَّزکِیَةِ مِن وَاحِدٍ وَهُوَ الرَّاجِحُ، ثُمَّ بِأَن یَّقُولَ هُوَ إِذَا کَانَ ثَابِتُ العَدَالَةِ وَالمُعَاصَرَةِ أَنَا صَحَابِيُّ.

দ্বিতীয় অধ্যায় হচ্ছে, কোন ব্যক্তি হুযূর (ﷺ)র সাহাবী হওয়ার পরিচিতির পদ্ধতির বর্ণনায়। আর তার কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। তা'হচ্ছে- তাওয়াতুর পদ্ধতিতে প্রমাণিত যে, তিনি একজন সাহাবী । অতঃপর ইসতিফাযাহ্ (الاستفاضة) ও প্রসিদ্ধির ভিত্তিতে, কোন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, অমুক হুযূরের সাহচর্য লাভ করেছেন। অনুরূপভাবে কোন একজন তাবিঈ থেকেও বর্ণিত থাকলে তা কবুল করা হবে। অতঃপর কারো আদিল ও সমসাময়িক হওয়া প্রমাণিত

১. ইবনে হুমাম, ফতহুল কদীর,فصل في البقر ، کتاب الزکات, ২/১৩৩, মকতবায়ে নুরিয়া রেজভিয়া  হওয়ার শর্তে যদি সে বলে, আমি সাহাবী (তবে তার কথা গ্রহণ করা হবে)।
মুসালিমুস সুবূতে রয়েছে যে,

إِخبَارُ العَدلِ عَن نَفسِهِ بِأَنَّهُ صَحَابِيُّ إِذَا کَانَ مُعَاصِرًا لاَ کَالرُّتنِ لَیسَ کَتَعدِیلِهِ نَفسَهُ.

‘কোন আদিল ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে একথা বলা যে, তিনি একজন সাহাবী, যখন তিনি একই যুগের হন তখন ওই আদিল ব্যক্তির সাহাবী হওয়ার দাবীকে স্বীকার করতে হবে। খাজা রুতনের মতো হলে হবে না, কারণ, তাঁর ব্যাপারে আদিল হওয়া প্রমাণিত নয়।
হাদীস শাস্ত্রের প্রবীণ ও নবীন ইমামগণ তাঁদের স্ব স্ব সহীহ, মসনদ, সুনান ও মু’জাম গ্রন্থসমূহে অনেক সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, অথচ তাঁদের ব্যাপারে নবী করীম (ﷺ)র এ বাণী উল্লেখ নেই যে, অমুক আমার সাহাবী, আমার সাহচর্য লাভ করেছে। না তারা সাহাবী হওয়া সম্পর্কে ওই সব ইমাম থেকে প্রমাণ চাওয়া হয়েছে বরং ওই সব নির্ভরযোগ্য সাহাবীর উক্তি--আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে ছিলাম, (ইত্যাদি বচন) তাদের সাহাবী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।' ইমাম আবু উমর ইবনে আবদুল বর ‘ইসতিয়াব’ গ্রন্থে আর হাফিয ইবনে হাজর প্রমুখ উপরিউক্ত অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

২. প্রসিদ্ধি (شهرة) এমন জিনিস, যা শুধু খিলাফতের ক্ষেত্রে নয় বরং বংশ পরিচিতিসহ হালাল-হারাম, শরীয়ত প্রবর্তিত অধিকার ইত্যাদি শরীয়তের বিধানাবলীও যার উপর | নির্ভরশীল, যা শরীয়তগত, বুদ্ধি-বিবেচনাগত, ইজমা ও প্রথাগত প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রমাণিত বিষয় হয়। যেমন, আমরা সাক্ষ্য দিই যে, হযরত আবু বকর ছিদ্দিক রাদিয়াল্লাহ তা'আলা আলহু হযরত আবু কুহাফা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর পবিত্র সন্তান আর ইমাম যয়নুল আবেদীন হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহ তা'আলা আলহুমা- এর পবিত্র সন্তান ও খলিফা। এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধি (شهرة) ছাড়া আমাদের কাছে আর কি দলীল আছে?

১. ইবনে হাজর,الفصل الثانی ٫ خطبة الکتاب الإصابة تمییز الصحابة, ১/৮, দারু সাদির, বৈরুত।
মুহিব্দুল্লাহ বিহারী, মুসাল্লিমুস সাৰ্বত, الأصل الثاني, পৃ. ১৯৫, মতবায়ে আনসারি, দিল্লি।
ফতওয়া-ই খুলাসাতে বর্ণিত আছে,

أَمَّا النَّسبُ فَصُورَتُهُ إِذَا سَمِعَ مِن إِنسَانٍ أَنَّ فُلاَنًا ابنُ فُلاَنِ الفُلاَنِي، وَمَعَهُ أَن یَّشهَدَ بِذَلِكَ وَإِن لَّم یُعَایِنِ الوِلاَدَةَ عَلَي فِرَاشِهِ أَلاَ یَرَی أَنَّا نَشهَدُ أَنَّ أَبَابَکَرِ الصِّدِّیقَ رَضِي اللّٰهُ تَعَالَي عَنهُ ابنَ أَبِي قُحَافَةَ وَمَا رَأَینَا أَبَا قُحَافَةَ رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالَي عَنهُ.

‘নসব’ (বংশ) প্রমাণিত হওয়ার একটি পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, যখন কোন মানুষ শুনলো যে, অমুক ব্যক্তি অমুক ব্যক্তির সন্তান। (এটা শুনার পর) ওই শ্রবণকারী ব্যক্তির জন্য ওই ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদানের সুযোগ রয়েছে, যদিও ওই ব্যক্তির বিছানায় (ঘরে) তার জন্মগ্রহণ শ্রবণকারী স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে নি। সে কি দেখে না, আমরা এ কথার সাক্ষ্য দিই যে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু আবু কুহাফার ছেলে, অথচ আমরা আবূ কুহাফাকে দেখিনি।

(কোনো বিষয়কে) প্রমাণিত করার এ দু'পদ্ধতি (সনদ ও প্রসিদ্ধি)-কে যদি যথেষ্ট মনে করা না হয়, তবে আউলিয়া কিরামের সমস্ত সিলসিলা থেকে (আল্লাহর পানাহ!) হাত ধুয়ে বসতে হবে। সিলসিলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক শায়খ তার উর্ধ্বতন শায়খ থেকে খিলাফত ও (বায়আতের) ইজাযত (অনুমতি) পাওয়া প্রমাণ করতে এ দু’পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি দ্বারা প্রমাণ করা কি সম্ভব? কখনো না। এটা অসম্ভব। সুতরাং এ দু'পদ্ধতির অস্বীকার (আল্লাহর পানাহ্!) সমস্ত সিলসিলার অস্বীকার করাকে অপরিহার্য করে। অতএব, শরীয়তের এ দু'দলিল দ্বারা কারো সাজ্জাদানশীনী ও খিলাফত প্রমাণিত হলে, খানেকা কেন্দ্রীক তরীকতের সকল রসম-রেওয়াজ পালন করা থেকে তাকে বাধা দেওয়ার কারো অধিকার নেই। কারো অস্বীকার এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে না। আকল (যুক্তিসঙ্গত) ও নকল (কুরআন-হাদীস)-এর সর্বগ্রাহ্য সূত্র হচ্ছে যে, না বাচকের উপর হাঁ বাচক প্রাধান্য পায়। যেমন দু’জন লোক সাক্ষ্য দিলো যে, যায়েদ ও হিন্দা উভয়ের মাঝে বিবাহ হয়েছে, পক্ষান্তরে হাজার ব্যক্তি সাক্ষ্য দিলো যে, ‘বিবাহ হয়নি’-এ ক্ষেত্রে ওই অস্বীকারকারীদের কথা গ্রহণযােগ্য হবে না। বিবাহ হয়নি’-তাদের এ সাক্ষ্য তাদের অজ্ঞতারই সামিল। অর্থাৎ হয়ত তাদের উপস্থিতিতে বিয়ে হয়নি। তাদের ‘না’ বলা, বিয়ে সংগঠিত না হওয়াকে অপরিহার্য করবে না। সর্বসম্মত শরীয়তের নীতিমালা

১. শায়খ তাহির, খুলাসাতুল ফতাওয়া,کتاب الشهادات, ৪/৫২, মকতবায়ে হাবীবিয়া, কোয়েটা  (উসূল) হচ্ছে- ‘হাঁ-বাচক না-বাচকের উপর অগ্রাধিকার পায়। (المُثبِتُ مُقَدَّمُ عَلَي النَّافِي) কারণ, যা জ্ঞাত, তা দলীল ওটার উপর যা জ্ঞাত নয়।
আশবাহ গ্রন্থে রয়েছে,

بَیَّنَةُ النَّفيِ غَیرُ مَقبُولَةٍ إِلاَّ فِي عَشرٍ... وَفِي أَیمَانِ الهِدَایَةِ : لاَ فَرَقَ بَینَ أَن یُحيِطَ بِهِ عِلمُ الشَّاهِدِ أَو لاَ.

না বাচকের দলিল গ্রহণযোগ্য নয়। তবে দশটি বিষয়ে গ্রহণ যোগ্য'।... ‘হিদায়া' গ্রন্থে কিতাবুল আয়মান’-এ রয়েছে, সাক্ষির জ্ঞান (ওই বিষয়কে) পরিবেষ্টন করুক বা না-ই করুক উভয় সমান।
এ ছাড়া তরীকতের সিলসিলাসমূহ দেখুন, প্রায় প্রতিটি তরীকতের সিলসিলায় ইমাম হাসান বসরীর মধ্যস্থায় হযরত আমীরুল মু'মিনীন মাওলা আলী কাররামাল্লাহু তাআলা ওয়াজহাহুর সাথে নিসবত বিদ্যমান। অথচ রিজালশাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য হাদীসের প্রায় সব বড় বড় ইমাম, হযরত মাওলা আলী কাররামাল্লাহু তাআলা ওয়াজহাহু থেকে হযরত হাসান বসরীর সেমা (হাদীস শ্রবণ) কে কখনো স্বীকার করেন না। তা সত্ত্বেও উপরিউক্ত আকলী ও নকলী নীতিমালার ভিত্তিতে তরীকতের সিলসিলার শায়খগণের ধারাক্রম (إتصال السلاسل)-এর মধ্যে কোন ক্রটি হতে দেয়নি। সুতরাং হাঁ-বাচক (إثبات)-এর সামনে যেখানে এমন বড় বড় ইমামগণের ‘না-বাচক উক্তি’ (نفي) গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেখানে কারো খিলাফতের সনদ বা প্রসিদ্ধি থাকা সত্ত্বেও ওই ব্যাপারে কারো অস্বীকার কি প্রভাব ফেলতে পারে?

বনী ইসরঈল থেকে আমালিকা সম্প্রদায় তাবুতে সকীনা' ছিনিয়ে নেয়। অনেক বছর পর তা ফেরৎ পায়। এ কারণে তা থেকে তাঁদের বরকত লাভের অধিকার কি চলে গিয়েছিলো?
আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَقَالَ لَهُم نَبِیُّهُم إِنَّ ءَایَةَ مُلکِهِ ٫ أَن یَأتِیَکُمُ اُلتَّابُوتُ فِیهِ سَکِینَةُُ مِن رَبِّکُم.

আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিলেন,তাঁর রাজত্বের নিদর্শন এই যে,
১. ইবনে নুজাইম, আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ির, کتاب القضاء والشهادات, ১/৩৫১-৫২, এদারাতুল কুরআন, করাচি।
তোমাদের নিকট ওই তাবৃত আসবে যাতে হবে তোমাদের রবের নিকট হতে চিত্ত-প্রশান্তি।

অথবা লাঞ্ছিত কারামাতিয়া সম্প্রদায় যখন কা'বা শরীফ থেকে হাজরে আসওয়াদ তুলে নিয়ে যায় এবং দীর্ঘ ২২ বছর পর মুসলমাগণ তা ফেরৎ পান, তবে কি মুসলমানগণ বা হেরমবাসীদের তা থেকে বরকত লাভ ও ইসতিলাম করার অধিকার বাকী থাকবে না? সুতরাং এ বিষয়গুলো অত্যন্ত স্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল। ইনসাফ (ন্যায়বিচার) হলো সর্বোত্তম গুণ । আল্লাহ তাআলা পুত-পবিত্র মহান ও সর্বজ্ঞ।
১. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা ২:২৪৮

➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖
অধ্যায় ৬

পীর-মুরশিদের মধ্যে যেসব শর্ত থাকা আবশ্যক

বায়আত নেওয়া এবং শায়খ বা পীরের মসনদে বসার জন্য একজন পীরের মধ্যে (নিম্নোক্ত) চারটি শর্ত পাওয়া অপরিহার্য।
১. সুন্নী, বিশুদ্ধ আকীদাসম্পন্ন হওয়া। কারণ, বদ-মযহাব (ভ্রান্ত মতবাদ সম্পন্ন) দোযখের কুকুর এবং নিকৃষ্টতর সৃষ্টি- যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে।

২. প্রয়োজনীয় ইলম (জ্ঞান) এর আলিম (জ্ঞানী) হওয়া। অর্থাৎ কমপক্ষে এতটুকু ইলম থাকা জরুরী যে, কারো সাহায্য ছাড়াই নিজের জরুরী মাসাইল কিতাব থেকে নিজেই বের করতে পারেন। কারণ, ইলমহীন ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয় ।

ع بے علم نتواں خدا راشناختঅর্থাৎ ইলমবিহীন ব্যক্তি খোদা পরিচিতি লাভ করতে পারে না।

৩. কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা । ['ফাসিক-ই মুলান' (প্রকাশ্য পাপাচারী) না হওয়া] কারণ, ফাসিক ব্যক্তিকে অবজ্ঞা করা ওয়াজিব আর পীর-মুরশিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব। সুতরাং এ উভয় বিষয় কি করে একত্রিত হতে পারে?

৪. (পীর-মুরশিদের) তরীকতের ‘ইজাযত’ সহীহ ও মুত্তাসিল হওয়া। [অর্থাৎ সিলসিলার(তরীকতের শায়খদের) ধারাক্রম হুযূর আকরাম (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছা, মাঝখানে কর্তিত না হওয়া। অর্থাৎ বাতিলপন্থী ও গোমরাহ্ ব্যক্তি ওই ধারায় না থাকা। আহলে বাতিনগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
যে ব্যক্তির মধ্যে ওই সব শর্ত থেকে কোন একটি শর্তও পাওয়া না যায়, তবে তাকে পীর হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয় ।

➖➖➖➖➖➖➖➖➖
অধ্যায় ৭

নিজ পীরের খলীফা বা সাজ্জাদানশীনের হাতে বায়আত হওয়ার বিধান

  কেউ যদি নিজ পীরের ইন্তেকালের পর ওই পীরের কোন খলীফা বা সাজ্জাদানশীন বা অন্য কোন পীরের হাতে তাজদীদ-ই বায়আত-এর নিয়তে পুনরায় বায়আত গ্রহণ করেন, তবে ওই ব্যক্তি তার প্রথম বায়আতের উপরই থাকবে। প্রথম ব্যক্তিই তার পীর হিসেবে গণ্য হবেন। তবে বায়আতের তাজদীদের কারণে ওই ব্যক্তি ওই খলীফা বা সাজ্জাদানশীন এর মুরীদ হিসেবে গণ্য হবে না। কারণ, সমস্ত কর্ম নিয়তের উপরই নির্ভরশীল। যেমন ইরশাদ হচ্ছে,

إِنَّمَا الأَعمَالُ بِالنِّیَّاتِ، وَإِنَّمَا لِکُلِّ امرِٸٍ مَا نَوَی.

সমস্ত কর্ম নিয়তের উপরই নির্ভরশীল, প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে তা-ই পায়।

এ প্রসঙ্গে হযরত তালহা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর কাজ (فعل) এবং হযরত আমীরুল মু'মিনীন ইমামুল আরিফীন মাওলাল মুসলিমীন আলী মুরতাদা কাররামাল্লাহু তাআলা ওয়াজহাহুল করীমের উক্তি সুস্পষ্ট দলীল। আমাদের জন্য দ্বীনের এ দু'মহান পেশওয়ার উক্তি ও কর্ম দলীলের জন্য যথেষ্ট। ঘটনাটি হচ্ছে যে, হযরত তালহা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু স্বীয় ইজতিহাদী ভুল স্বীকার করে আমীরুল মু'মিনীন হযরত আলীর হাতে যখন পুনরায় বায়আত গ্রহণ করতে চাইলেন কিন্তু জালিমের হাতে ভীষন আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার কারণে আমীরুল মু'মিনীন পর্যন্ত গিয়ে পৌছা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর ছিলোনা; তখন তার পাশ দিয়ে আমীরুল মু'মিনীনের একজন সেনাসদস্য অতিক্রমকালে তাকে ডেকে হযরত তালহা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তার হাতে বায়আত তাজবীদ করলেন। এর পরক্ষণই তিনি ইন্তিকাল করলেন। হযরত আমীরুল মু'মিনীন এ ঘটনা শুনে বললেন

أَبَي اللّٰهُ أَن یَّدخُلَ طَلحَةَ الجَنَّةَ إِلاَّ وَبَیعَتِي فِي عُنُقِهِ.আল্লাহ তা'আলা তালহার জান্নাতে যাওয়া চাননি যতক্ষণ আমার বায়আত তার স্কন্ধে ছিলো না।

১. বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় :

کَیفَ کَانَ بَدءُ الوَحيِ إِلَی رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ  ٫

১/২, হাদীস: কদীমী কুতুবখানা, করাচি।

২. হাকিম, আল-মুস্তাদরক, ذکر مناقب طلحة بن عبد اللّٰه التیمي رضي اللّٰه عنه کتاب معرفة الصحابة رضي اللّٰه عنهم , ৩/৪২১, হাদীস: ৫৬০১।

দেখুন হযরত আমীরুল মু'মিনীন ওই বায়আতকে নিজেরই বায়আত বলেছেন, সেনা সদস্যের বায়আত নয়। আর হযরত তালহা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলীকেই আমীরুল মু'মিনীন ও বায়আতের উপযুক্ত মনে করেছেন; আল্লাহর পানাহ! সেনাসদস্যকে নয়।
উপরিউক্ত দুটি মজবুত দলীল তােমার রবের পক্ষ থেকে উৎসারিত। আমার এ অভিমত শরীয়ত ও তরীকতের মুহাক্কিক মাওলানা মুহিব্বে রসূল আবদুল কাদির কাদেরী বাদায়ূনীর কাছে পেশ করেছি, (আল্লাহ তা'আলা তাঁকে প্রত্যেক বেহায়া ও ষড়যন্ত্রকারীর অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন) তিনি উক্ত অভিমতকে সঠিক ও উত্তম বলেছেন। আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক দোষ-ক্রটি থেকে পবিত্র ও উর্ধে। তার মর্যাদা মহান। তিনি সর্বজ্ঞাতা, তাঁর জ্ঞান পরিপূর্ণ ও মজবুত।

➖➖➖➖➖➖➖➖➖
অধ্যায় ৮

মহিলা পীর হতে পারে না

আউলিয়া কিরাম এ কথার উপর একমত যে, আল্লাহর পথে আহবানকারী পুরুষ হওয়া জরুরি। তাই সলফে সালিহীন থেকে আজ পর্যন্ত কোন মহিলা না পীর-মুরশিদ হয়েছে না লোকদের থেকে বায়আত নিয়েছে। যদিও ওই মহিলা পুন্যবতী, শরীয়তের পাবন্দ ও তরীকতের গুঢ় রহস্য সম্পর্কে জ্ঞাত হোক না কেন।

হুযুর পুর নূর সৈয়্যদে আলম (ﷺ) এরশাদ করেছেন,

لَن یُفلِحَ قَومُُ وَلّّوا أَمرَهُم امرَأَةً.

‘ওই সম্প্রদায় কখনো সফলকাম হবেনা, যারা কোন মহিলাকে নিজেদের নেতা বানিয়েছে।
আরিফ বিল্লাহ ইমাম আবদুল ওয়াহহাব শা’রানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মিনু শরীয়াতিল কুরবার কিতাবুল আকযিয়াতে বলেছেন

قَد اجمَعَ أَهلُ الکَشفِ عَلَي اشتِرَاطِ الذَکُورَةِ فِي کُلَّ دَاعٍ إِلَي اللّٰهِ تَعَالَي وَلَم یَبلُغنَا أَنَّ أَحَدًا مِّن نِسَاءِ السَّلفِ الصَّالِحِ تَصدَرَت لِتَربِیَّةِ المُرِیدِینَ أَبَدًا لِنُقصِ النِّسَاءِ فِي الدَّرجَةِ وَإِن وَرَدَ الکَمَالُ فِي بَعضِهِنَّ کَمَریَمَ بِنتِ عِمرَانَ وَاَسِیَةَ امرَأَةَ فِرعَونَ فَذَلِكَ کَمَالُُ بِالنِّسبَةِ لِلتَّقوَي وَالدِّینِ لاَ بِالنِّسبَةِ لِلحُکمِ بَینَ النَّاسِ وَتَسلِیکُهُم فِي مَقَامَاتِ الوِلاَیَةِ ، وَغَایَةُ أَمرِ المَرأَةِ أَن تَکُونَ عَابِدَةً وَزَاهِدَةً کَرَابِعَةِ العَدوِیَّةِ وَاللّٰهُ سُبحَانَهُ وَتَعَالَي أَعلَمُ وَعِلمُهُ جَلَّ مَجدَهُ أَتَمُّ وَأَحکَمُ. فَقَط

১. বুখারী, আস-সহীহ, کتاب الفتن, ২/১০৫২, হাদীস : ৭০৯৯, কদীমী কুতুবখানা, করাচি।
২. তিরমিযি, আল-জামি, أبواب الفتن, ২/৫১, আমিন কোম্পানী, দিল্লি।
৩. নাসায়ী, আস-সুনান, کتاب أداب القضاة, ২/৩০৪, নুর মুহাম্মদ কারখানায়ে তিজারতে কুতুব, করাচি।
৪. আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মসনদ, عن أبي بکرة, ৫/৫১, আল-মাকতাবুল ইসলামিয়া, বৈরুত।

আহলে কাশফ আল্লাহর পুন্যবান্দা, সম্মানিত ওলীগণ এ কথার উপর ঐক্যমত। পোষণ করেছেন যে, আল্লাহর দিকে আহবানকারীর জন্য পুরুষ হওয়া শর্ত। সলফে সালেহীনের কোন মহিলাকে মুরীদ করিয়েছেন মর্মে কোন খবর। আমাদের কাছে পৌছেনি। কারণ, কতেক মর্যাদায় মহিলা অসম্পূর্ণ, যদিও কিছু মহিলার মধ্যে সম্পূর্ণ কামালিয়াত বিদ্যমান ছিলো। যেমন- হযরত মরয়াম ইবনে ‘ইমরান ও ফিরউনের স্ত্রী আসিয়া। তাদের এ কামালিয়াত তাকওয়া ও দ্বীনের বেলায় প্রযোজ্য, লোকদের মাঝে নেতৃত্ব (হুকুমত) করার ক্ষেত্রে নয়। তাদেরকে বেলায়তের মর্যাদায় পরিগণিত করার চুড়ান্ত বিষয় হচ্ছে, তারা যেন। ইবাদতপরায়ণা ও যাহিদাহ হন। যেমন, হযরত রাবিয়া আদবীয়া বসরী ।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা সর্বাধিক পরিজ্ঞাত।
১. শা’রানী, আল-মিযান, کتاب الأقضیا, ২/১৮৯, মুস্তফা আলাবাবী।

➖➖➖➖➖➖➖
অধ্যায় ৯

জিজ্ঞাসা, জবাব ও সফলতাঃ

জিজ্ঞাসা ও জবাব

জিজ্ঞাসা : যদি কোন ব্যক্তির পীর বা মুরশিদ না থাকে, তবে সে ইহ-পরকলীন সফলতা অর্জন করতে পারবে কি পারবে না এবং এতে কি তার পীর বা মুরশিদ শয়তান হবে, না নয়, কেননা আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেন—

وَابتَغُوا إِلَیهِ اُلوَسِیلَةَ

‘তোমরা তাঁর পথে অসিলা অন্বেষণ কর।

জবাব : হাঁ! আওলিয়া কিরাম (কাদ্দাসালাল্লাহু বি আসরারিহিম)-এর বাণীতে এ প্রকার উক্তি পাওয়া যায়। আর আমি এ উক্তি দু’টিকে পবিত্র কুরআনের আলোকে প্রমাণ করতে প্রয়াস পাবো। প্রথমত এ যে, ‘পীর ছাড়া সফলতা (ফালাহ্) অর্জন হয় না, এতদ বিষয়ে হযরত সায়্যিদুনা শায়খুশ শূয়ূখ শিহাবুল হক ওয়াদ দ্বীন সোহরাওয়ার্দি কুদ্দিসা সিররুহু আ'ওয়ারিফুল মা'রিফ গ্রন্থে বলেন,

سَمِعتُ کَثِیرًا مَّن المَشَاٸِخِ یَقُولُونَ مَن لَم یَرَ مُفلِحًا لاَ یَفلِحُ.

‘আমি অনেক আওলিয়া কিরামকে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি সফলকাম লোকের সান্নিধ্য অর্জন করেনি, সে সফলকাম হবে না।
আ’ওয়ারিফ শরীফে আরো বর্ণিত আছে যে,

رَوِیَ عَن أَبِي یَزِیدِ (رَضِیَ اللّٰهُ تَعَالَي عَنهُ) أَنَّهُ قَالَ: مَن لَّم یَکُن لَّهُ اُستَاذُُ فَإِمَامُهُ الشَّیطَانُ.

‘সায়্যিদুনা আবু ইয়াযিদ (বায়েজিদ বোস্তামী) রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যার পীর নেই, তার ইমাম বা পীর হচ্ছে শয়তান।
ইমাম আবুল কাসিম কুশাইরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কৃত রিসালায় আছে যে,

یَجِبُ عَلَي المُرِیدِ أَن یَّتَأَدَّبَ بِشَیخٍ فَإِن لَم یَکُن لَّهُ أُستَاذُُ لاَ یَفلِحُ اَبَدًا هَذَا أَبُو یَزِیدِ یَقُولُ : مَن لَّم یَکُن لَّهُ أُستَاذُُ فَإِمَامُهُ الشَّیطَانُ.

১. আল-কুরআন, সুরা আল-মায়িদা ৫:৩৫
২. সোহরাওয়ারদী, আওয়ারিফুল মা’আরিফ, الباب الثاني,পৃ. ৭৮, মতবা'আতুল মাশহাদ আল-হুসাইনী
৩. সোহরাওয়ারদী, আওয়ারিফুল মা'আরিফ, الباب الثاني, পৃ. ৭৮, মতবা'আতুল মাশহাদ আল-হুসাইনী।

‘মুরিদের জন্য করণীয় যে, কোন পীরের দীক্ষা গ্রহণ করা। কারণ, পীরহীন লোক কখনো (উভয় জগতে) সফলতা লাভ করতে পারে না। আবু ইয়াযিদ (হযরত বায়জিদ বোস্তামী) এটাই বলেছেন যে, 'যার কোন পীর নেই, তার পীর শয়তান।

অতঃপর তিনি আরো বলেন,سَمِعتُ الأُستَاذَ أَبَا عَلِي الدِّقَاقَ یَقُولُ : الشَّجرَةُ إِذَا أَنبَتَت بِنِفسِهَا مِن غَیرِ غَارِسٍ فَإِنَّهَا تُورِقُ وَلَکِن لاَ تُتمِرُ کَذَلِكَ المُرِیدُ إِذَا لَم یَکُن لَهُ أُستَاذُُ یَأخُذُ مِنهُ طَرِیقَةً نَفسًا فَنَفسًا فَهُوَ عَابِدُ هَوَاهُ لاَ یَجِدُ نَفَاذًا.

আমি হযরত আলী দিকাক রাদিয়াল্লাহ তা'আলা আনহুকে বলতে শুনেছি যে, বৃক্ষ যখন কারো রোপন করা ছাড়া নিজে নিজেই জন্মে, এতে পাতা হয়, কিন্তু ফল হয় না। তেমনি মুরিদের যদি কোন পীর না থাকে, যার কাছে তরীকতের এক একটি শ্বাস-নিঃশ্বাসের নিয়মাবলী শিক্ষা লাভ করবে, তবে সে স্বীয় প্রবৃত্তির পুজারী, সে সুপথ পাবে না।

হযরত সায়্যিদুনা মীর আবদুল ওয়াহিদ বলগিরামী (কুদ্দিসা সিররুহু) সবঈ সানাবিল শরীফে বলেন-

چو پیر نیست پر تست ابلیس     کہ راہ دین نہ زدست از مکرو تلبیس

‘যখন তোমার পীর নেই, তবে তোমার পীর শয়তান, দ্বীনি পথে সে প্রতারণা ও ধোঁকার মাধ্যমে মানুষকে প্রতারিত ও বিতাড়িত করে। তবে আওলিয়া কিরামের এ প্রকারের উক্তি বিস্তারিত বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

সফলতা (ফালাহ)'র প্রকারভেদ

আল্লাহর তাওফিকক্ৰমে বলছি যে, সফলতা (ফালাহ) দু'প্রকার :

প্রথমত : ফালাহ-ই নাকিস (فلاح ناقص)-অসম্পূর্ণ সফলতা) বা অসম্পূর্ণ পরিত্রাণ ও মুক্তি, যা শাস্তি ভোগ করার পর অর্জন হয়। এ প্রকার সফলতা অর্জন করা সম্পর্কে বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য, যা আহলে সুন্নাতের আকীদার অন্তর্ভূক্ত। আর এ প্রকার সফলতা লাভের জন্য প্রচলিত নিয়মে কোন পীরের কছে বায়আত
১. কুশায়রী, আর-রিসালা, অধ্যায় : الوصیة للمریدین, পৃ. ১৮১, মোস্তাফা আলবাবী
২. কুশায়রী, আর-রিসালা, অধ্যায় : الوصیة للمریدین, পৃ. ১৮১, মোস্তাফা আলবাবী
৩. বলগিরামি, সবয়ি সানাবিল । ও মুরিদ হওয়ার উপর নির্ভর নয়। এ জন্য শুধু নবীকে মুরশিদ হিসেবে জানাটাই যথেষ্ট। এমনকি ইসলামের প্রাথমিক যুগে কোন দূরবর্তী পাহাড় বা নাম ঠিকানাহীন জনশূন্য দ্বীপে। বসবাসকারী যার কাছে নবুয়্যতের কোন খবরই পৌঁছেনি আর দুনিয়া হতে শুধু তাওহীদের উপর মৃত্যুবরণ করেছে শেষ পর্যন্ত এ প্রকার লোকের জন্যও এ প্রকার সফলতা (ফালাহ) প্রমাণিত। যেমন সহীহ বোখারী ও সহীহ মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহ তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, হাশরবাসী অন্যান্য নবী থেকে নিরাশ হয়ে আমার সমীপে উপস্থিত হবে। তখন আমি বলবো আজ আমিই এ শাফাআতের জন্য আদিষ্ট। অতঃপর আমি আমার রবের নিকট (শাফাআতের জন্য) অনুমতি চাইবো। তিনি আমাকে অনুমতি দেবেন। তখনই আমি সাজদায় পড়বো। (এ সাজদা হলো শাফাআতে কুবরার চাবিকাঠি, যা দ্বারা শাফাআতের দরজা খোলা হবে। তখন আল্লাহর পক্ষ হতে এরশাদ হবে-

یَا مُحَمَّدُ ارفَع رَأسَكَ، وَقُل یُسمَع لَكَ، وَسَل تُعطُ، وَاشفَع تُشَفَّعقلية.

হে হাবীব! মাথা মোবারক উত্তোলন করুন! বলুন, আপনার কথা শ্রবণ করা হবে আর প্রার্থনা করুন, আপনাকে প্রদান করা হবে, এবং শাফাআত করুন, আপনার শাফাআত কবুল করা হবে। অতঃপর আমি আরয করবো, হে আমার রব! আমার উম্মত, আমার উম্মত। (অর্থাৎ আমার উম্মতের ব্যাপারে আমার শাফাআত কবুল করুন!) তখন আল্লাহ বলবেন, যান! যার অন্তরে যব পরিমাণ ঈমান আছে তাকে দোযখ থেকে বের করে নিন। তাদেরকে বের করে আমি পুনরায় (আল্লাহর সমীপে) উপস্থিত হবো, সাজদা করবো। আবার বলা হবে যে, হে হাবীব! শির উঠান, আর বলুন, আপনার কথা শ্রবণ করা হবে। প্রার্থনা করুন, প্রদান করা হবে; শাফাআত করুন, কবুল করা হবে। তখন আমি আরয করবো, হে আমার রব! আমার উম্মত, আমার উম্মত। (অর্থাৎ তাদের হকে আমার শাফাআত কবুল করুন!) তখন এরশাদ করা হবে, যান, যার হৃদয়ে রাই বরাবর ঈমান রয়েছে, তাকে দোযখ হতে বের করে নিন। আমি তাদেরকে বের করে তৃতীয়বার (মহান রবের সমীপে) উপস্থিত হয়ে সাজদা করবো। তখন বলা হবে-হে হাবীব! শির উঠান! আর আপনি যা বলবেন তা গৃহীত হবে, যা প্রার্থনা করবেন প্রদান করা হবে, শাফাআত করুন ,কবুল করা হবে। তখন আমি আরয করবো, হে আমার রব! আমার উম্মত, আমার উম্মত (অর্থাৎ তাদের ব্যাপারে আমার শাফাআত কবুল করুন!) তখন এরশাদ হবে, যার অন্তরে রাইয়ের দানার চেয়ে স্বল্প পরিমাণ ঈমান আছে, তাকে বের করে নিন। আমি তাদেরকে (দোযখ হতে) বের করে চতুর্থ বার (মহান রবের দরবারে হাজির হবো। এবং সাজদায় পতিত হবো। তখন মহান রবের পক্ষ হতে এরশাদ হবে, হে হাবীব! মাথা। উত্তোলন করুন! এবং বলুন, আপনার অভিযোগ শ্রবণ করা হবে; যা চান, তা দেয়া হবে, শাফাআত করুন, তা গৃহীত হবে । তখন আমি আরয করবো, হে মহান রব! আমাকে দোযখ হতে ঐ সব লোককে বের করার অনুমতি প্রদান করুন যারা আপনাকে এক বলে জেনেছে। তখন মহান রবের পক্ষ হতে এরশাদ হবে, এটা আপনার কারণে নয় বরং আমার ইযযত, জালাল ও বড়ত্ব এবং মহত্বের শপথ, আমি প্রত্যেক একত্ববাদীকে সেখান হতে বের করে নেবো।”

আমার মতে, এখানে শেষোক্ত দলের ব্যাপারে হুযূর (ﷺ)র শাফাআত অগ্রাহ্য করা হয়নি বরং এটা কবুল করার নামান্তর। কারণ, হুযূর (ﷺ)-এর আরয করাতেই তো জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। এখানে শুধু একটা বলা হয়েছে যে, তাদের রিসালত দ্বারা উসিলা গ্রহণের সু্যোগ হয় নি, বরং নিজ জ্ঞান-বিবেক দ্বারা ঈমানের জন্য যেটুকু যথেষ্ট ছিলো (অর্থাৎ একত্ববাদে বিশ্বাস) সেটুকু বিশ্বাস করতো। হাদীসের অর্থে আমি যে ব্যাখ্যা করেছি, এতে সুস্পষ্ট হলো যে, এটা ওই সহীহ হাদিসের বিপরীত নয়, যাতে বলা হয়েছে,

فَمَا زِلتُ أَتَرَدَّدُ عَلَی رَبِّی ﷻ فَلاَ أَقُومُ مَقَامًا إِلاَّ شُفَّعتُ حَتَّی أَعطَانِی اللّٰهُ ﷻ مِن ذَلِكَ أَن قَالَ یَا مُحَمَّدُ ﷺ أَدخِل مِن أُمَّتِكَ مِن خَلقِ اللّٰهِ ﷻ مَن شَهِدَ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ یَومًا وَاحِدًا مُخلِصًا وَمَاتَ عَلَی ذَلِكَ.

‘আমি আমার রবের দরবারে আসা যাওয়ায় থাকবো, যে শাফাআতের জন্য আমি দণ্ডায়মান হবো, তা কবুল করা হবে। এমন কি আমার রব বলবেন যে, সৃষ্টিকুলের মধ্যে তোমার যতো উম্মত আছে, তাদের যে কেউ তাওহীদ বা একত্ববাদের উপর মৃত্যু বরণ করেছে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান।
উক্ত হাদীসে উম্মতের কথাই বলা হয়েছে, তাই হাদীসে বর্ণিত ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ দ্বারা পুরো কলেমাকে বুঝানো হয়েছে। যেমন- ইমাম আহমদ ও ইবনে হিব্বান হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, হুযূর আকদাস (ﷺ) এরশাদ করেছেন যে,

وَشَفَاعَتِی لَمِن شَهِدَ أَن لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ مُخلِصًا یُصَدَّقُ قَلبُهُ لِسَانَهُ وَلِسَانُهُ قَلبَهُ.

‘আমার শাফাআত প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট, যে আল্লাহর তাওহীদ

১. বুখারী, আস-সহীহ, کتاب التوحید, অধ্যায় : کَلاَمِ الرَّبِّ عَزَّ وَجَلَّ یَومَ القِیَامَةِ مَعَ الأَنبِیَاءِ وَغَیرِهِم, ২/১১১৮-১৯, কদীমী কুতুবখানা, করাচি
২. মুসলিম, আস-সহীহ, کتاب الإیمان, অধ্যায় : إثبات الشفاعة, ১/১১০, কদমী কুতুবখানা, করাচি
৩٠আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মসনদ, হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে, ৩/১৭৮

(একত্ববাদ) এবং আমার রিসালতের উপর এমন নির্ভেজালভাবে সাক্ষ্য দেয় যে, যার মুখ অন্তরের অনুরূপ আর অন্তর মুখের অনুরূপ হবে।”

হে রব! আপনি সাক্ষী হোন! আর আপনার সাক্ষীই যথেষ্ট যে, আমি আপন অন্তর ও মুখে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ (উপাস্য) নেই আর মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর রাসুল। সকল বাতিল ধর্ম হকে বিমুখ হয়েছি একনিষ্ট ইসলামপন্থী হয়ে আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (আর সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সমস্ত জাহানের রব।)

দ্বিতীয়ত : ফালাহ-ই কামিল (فلاح کامل) বা পরিপূর্ণ সফলতা হচ্ছে আযাব ভোগ করা ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করা। এটার দু'টি দিক রয়েছে। প্রথমত বাস্তবসম্মত সফলতা (وقوع) এবং দ্বিতীয়ত আশাসূচক সফলতা (امید)।

এক. বাস্তবসম্মত সফলতা (وقوع) আহলে সুন্নাতের মতে এ প্রকার সফলতা শুধু মহান রবের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল, তিনি যাকে চান এমন সফলতা (ফালাহ) দান করেন, যদিও সে লক্ষ কবীরা গুনাহে দোষী হোক। আর তিনি চাইলে একটি সগীরাহ গুনাহেও পাকড়াও করতে পারেন, যদিও তার লক্ষ পূন্যকর্ম থাকুক না কেন। এটা হচ্ছে তার ন্যায়পরায়ণতা এবং ওটা হলো তাঁর করুণা ও দয়া ।

১. আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মসনদ, হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে, ২/৩০৭
২. ইবনে হায়সমী, মাওয়ারিদুয যামান, باب جامع في البعث والشفاعة, পৃ. ৬৪৫, হাদীস : ২৫৯৪
২. যদিও তিনি এমনটি করবেন না। আল্লাহ তা'আলার ইরশাদ হচ্ছে,

وَیَجزِيَ الَّذِینَ أَحسَنُوا بِالحُسنَی. أَلَّذِینَ یَجتَنِبُونَ کَبَٰٸِرَ الإِثمِ وَالفَوَاحِشَ إِلاَّ اُللَّمَمَ ٓ إِنَّ رَبَّكَ وَسِعُ المَغفِرَةِ.

এবং যারা সৎকর্ম করে তাদেরকে দেন উত্তম পুরস্কার। তারা হচ্ছে ওইসব লোক যারা বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কাজ হতে, তবে এতটুকু যে গুনাহের নিকটবর্তী হয়ে বিরত থেকেছে । নিশ্চয় তোমাদের রবের ক্ষমা অপরিসীম । -আল-কুরআন, সুরা আন-নাজম ৫৩:৩১-৩২।

আল্লাহ তা'আলা আরও ইরশাদ করেন,

إِن تَجتَنِبُوا کَبَاٸِرَ مَا تُنهَونَ عَنهُ نُکَفِّر عَنکُم سَیِّٸَاتِکُم وَنُدخِلکُم مُّدخَلاً کَرِیمًا.

যদি তোমরা কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকো যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, তবে আমি তোমাদের অন্যান্য গুনাহ ক্ষমা করে দেব এবং তােমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে দাখিল করব।
—আল-কুরআন, সুরা আন-নিসা ৪:৩১

তিনি আরও ইরশাদ করেন,

فَیَغفِرُ لِمَن یَشَآءُ وَیُعَذِّبُ مَن یَشَآءُ.

তিনি (আল্লাহ) যাকে চান ক্ষমা করেন, যাকে চান আযাব দেন।
হুযুর আকদাস (ﷺ)-এর শাফাআত দ্বারা কবীরা গুনাহকারী এরূপ সফলতা (ফালাহ) লাভ করবে। নবী করিম (ﷺ) এরশাদ করেছেন যে,

=شَفَاعَتِی لأَهلِ الکَبَاٸِرِ مِن أُمَّتِي.

‘আমার উম্মতের কবীরা গুনাহকারীর জন্য আমার শাফাআত রয়েছে।
প্রিয় রাসুল (ﷺ) আরো এরশাদ করেছেন যে-

خُیِّرتُ بَینَ الشَّفَاعَةِ وَبَینَ أَن یَدخُلَ نِصفُ أُمَّتِی الجَنَّةَ فَاختَرتُ الشَّفَاعَةَ لأَنَّهَا أَعَمُّ وَأَکَفَی أَتُرَونَهَا لِلمُتَّقِینَ لاَ وَلَکِنَّهَا لِلمُذنِبِینَ الخَطَّاٸِینَ المُتَلَوِّثِینَ.
إِنَّ الحَسَنَٰتِ یُذهِبنَ السَّیِّٸَاتِ ؑ ذَٰلِكَ ذِکرَیٰ لِلذَّکِرِینَ.

সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্মকে মিটিয়ে দেয়, এটা উপদেশ; উপদেশগ্রহণকারীর জন্য।
–আল-কুরআন, সুরা আল-হুদ ১১:১১৪ ১. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:২৮৪
২. এ হাদীস ইমাম আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে হাব্বান, হাকিম ও বায়হাকী হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহ তা'আলা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন। আর বায়হাকী বলেন, এ হাদীস সহীহ। আর ইমাম তিরমিযী, ইবনে হাব্বান ও হাকিম হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ হতে বর্ণনা করেছেন এবং তাবরানী মুআজামুল কবীরে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে আর খাতীব কাআব ইবনে উজরা হতে এবং আবদুল্লাহ ইবনে ওমর হতে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।
১. আবু দাউদ, আস-সুনান, کتاب السنة, অধ্যায় : في الشفاعة, ২/২৯৬
২. তিরমিযী, আল-জামি, أبواب صغة القیامة , ২/৬৬
৩. ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, أبواب الزهد, অধ্যায় : ذکر الشفاعة, পৃ. ৩২৯
৪. আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মসনদ, হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে, ৩/২১৩
৫. বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, ১/২৮৭, হাদীস : ৩১০ ও ৩১৩
৬. বায়হাকী, আস-সুনান আল-কুবরা, کتاب الجنایات, ৮/১৭০
৭. ইবনে হায়সমী, মাওয়ারিদুয যামান, পৃ. ৬৪৫, হাদীস : ২৫৯৬
৮. তাবারানী, আল-মু'জাম আল-কবীর, ১১/১৮৯, হাদীস : ১৩৪৫৪

‘মহান রব আমাকে বললেন, আপনাকে এ অধিকার দেয়া হলো যে, চাইলে শাফাআত নিতে পারেন, না হয় আপনার অর্ধেক উম্মতকে আযাব ছাড়াই বেহেশতে প্রবেশ করাতে পারেন। আমি শাফাআতকে গ্রহণ করলাম, কেননা এটা অত্যন্ত ব্যাপক এবং অত্যন্ত যথেষ্ট। তোমরা কি মনে করছ আমার এ শাফাআত শুধুমাত্র মুমিন-মুত্তাকিদের জন্য? না এটা নয় বরং তা (শাফাআত) গুনাহগার-পাপী উম্মতদের জন্য।
আর এ প্রকার সফলতা (ফালাহ) ওই লোকও অর্জন করবে, যার গুনাহকে পূন্যকর্ম দ্বারা পরিবর্তন করা হবে। যেমন, আল্লাহ তা'আলা বলেন-

فَأُولَٰٓٸِكَ یُبَدِّلُ اللّٰهُ سَیِّٸَاتِهِم حَسَنَٰتٍ ؑ وَکَانَ اللّٰهُ غَفُورًا رَّحِیمًا.

আল্লাহ তাদের গুনাহসমূহকে পূন্যকর্ম দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন আর আল্লাহ ক্ষমাকারী, দয়াবান।
হাদীসে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তিকে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর সমীপে উপস্থিত করা হবে, এবং বলা হবে যে, তার ছোট ছোট গুনাহসমূহ তার সম্মুখে যেন পেশ করা হয় আর বড়গুলো যেন প্রকাশ করা না হয়। তখন তাকে বলা হবে, তুমি অমুক অমুক দিন এই এই কাজ করেছ? সে তা স্বীকার করবে এবং আর সে বড় গুনাহগুলো সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়বে। তখন এরশাদ হবে, তাকে প্রত্যেক গুনাহের স্থলে একটি করে নেকী দান কর। তখন সে বলে উঠবে, হে আল্লাহ! আমার আরো অনেক গুনাহ রয়েছে, যেগুলোর কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়নি। এটুকু বলে হুযুর আন্ওয়ার (ﷺ) এমনভাবে হাসলেন যে, তাঁর সম্মুখস্থ দাঁত মুবারক প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে।
১. এ হাদীস ইমাম আহমদ সহীহ সনদে এবং তাবরানী মু'জামুল কবীর-এ উত্তম সনদে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে আর ইবনে মাজাহ্ আবু মুসা আশআরী হতে বর্ণনা করেছেন। (আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন!)
১. ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, أبواب الزهد, অধ্যায়-: ذکر الشفاعة, পৃ. ৩২৯
২. আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মসনদ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সূত্রে, ২/৭৫
* আল-কুরআন, সুরা আল-ফুরকান, ২৫:৭০
৩. এ হাদীস ইমাম তিরমিযি হযরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন। তিরমিযী, আল-জামি, أبواب صفة جهنم, ২/৮৩
মূলকথা হচ্ছে যে, বাস্তবসম্মত সফলতা (وقوع) অর্জনের জন্য ইসলাম গ্রহণ এবং আল্লাহ ও রসূলের রহমত ও দয়া ছাড়া অন্য কিছুর শর্ত নেই।
দুই. আশাসূচক সফলতা (امید) এ প্রকার সফলতা হচ্ছে, মানুষের আমল, কর্ম, কথা ও অবস্থা এমন হওয়া যে, যদি তার উপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়, তবে আল্লাহ তাআলার দয়া ও রহমতে আযাব ছাড়াই জান্নাতে যাওয়ার দৃঢ় আশা করা। এটা এমন সফলতা (ফালাহ), যা তালাশ করার জন্য নির্দেশ রয়েছে। কারণ, মানুষের, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড এটার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন- আল্লাহ তা'আলা বলেন,

سَابِقُوا إِلَیٰ مَغفِرَةٍ مِّن رَّبِّکُم وَجَنَّةٍ عَرضُهَا کَعَرضِ السَّمَاءِ وَاَلأَرضِ.

‘তোমরা অগ্রণী হও তোমাদের রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাত লাভের প্রয়াসে যা প্রশস্ততায় আকাশ ও পৃথিবীর সমান।”
আর এ প্রকার সফলতা (ফালাহ) আবার দু'প্রকার :
১. বাহ্যিক সফলতা (فلاح ظاهر) যাকে ‘ফালাহ-ই তাকওয়া'ও বলা হয়।
২. অভ্যন্তরীণ সফলতা (فلاح باطن) যাকে ‘ফালাহ-ই ইহসান’ও বলা হয় ।

এক. বাহ্যিক সফলতা (فلاح ظاهر) দ্বারা উদ্দেশ্য কখনো এ নয় যে শুধুমাত্র বাহ্যিক বেশভূষাধারী মুত্তাকি লোক যার দৃষ্টি শুধু শরীয়তের বাহ্যিক আমল বা রীতিনীতির উপর নিবিষ্ট, বাহ্যিকভাবে শরীয়তের বিধি-বিধান দ্বারা সুসজ্জিত এবং গুনাহ হতে পবিত্র হয়ে নিজেকে একজন সফলকাম মুত্তাকির কাতারে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু নিজের অভ্যন্তর (বাতিন) নিন্মোক্ত বিধ্বংসী বিপদসমূহ দ্বারা অপবিত্র হয়ে আছে। যেমন-

১. রিয়া (লোক দেখানো মনোভাব)
২. ওযব (খোদপছন্দী)
৩. হাসদ (হিংসা)
৪. কিনা (দ্বেষ)
৫. তাকাব্বর (অহংকার) ৬. হুব্বে মাদাহ (স্বীয় প্রশংসার মোহ),
৭. হুব্বে জাহ (বিলাস মোহ)
৮. মহব্বতে দুনিয়া (পার্থিব মোহ),
৯. তলবে শহরাত (যশ-খ্যাতির মোহ)
১০. তা'আযীম-ই উমরা (ধনাঢ্য ও নেতৃস্থানীয় লোককে সম্মান দেখানো)
১১. তাহকীর-ই মাসাকীন (গরীবদের প্রতি ঘ ও তাচ্ছিল্যভাব)
১২. ইত্তেবা-ই শাহ্ওয়াত (কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ)
১৩. মদাহিনাত (খোশামোদ)
১৪. কুফরান-ই নিআমত (নিয়ামতের কুফরী)
১৫. হিরস
১. আল-কুরআন, সুরা আল-হাদীদ, ৫৭:২১
(লোভ-লালসা)
১৬. বুখল (কৃপণতা)
১৭. তোল-ই আমল (বেশি কামনা)
১৮. সূউ-ই যন (মন্দ ধারণা)
১৯. এনাদ-ই হক (সত্য হতে বিমুখ)
২০. এসরারে বাতিল (বার বার যার পাপে নিমজ্জিত হওয়া)
২১. মকর (প্রতারণা) ২২. উযর (আপত্তি)
২৩. খিয়ানত (আত্মসাৎ করা)
২৪. গাফলাত (অমনোযোগীতা)
২৫. কাসওয়াত (পাষণ্ডতা)
২৬. তাম’আ (লোভ)
২৭. তামাললুক (তোষামোদ)
২৮. ইতিমাদ-ই খালক্ (সৃষ্টির উপর ভরসা)
২৯. নিসয়ান-ই খালিক (স্রষ্টা হতে বিমুখ)
৩০. নিসয়ান-ই মাওত (মৃত্যু বিস্মৃতি)
৩১. জুরআত আলাল্লাহ (আল্লাহ ওপর দুঃসাহসিকতা)
৩২. নিফাক (কপটতা)
৩৩. ইত্তিবা-ই শয়তান (শয়তানের অনুসরণ)
৩৪. বন্দিগীয়ে নফস (কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব)
৩৫) রুগবত-ই বতালত (বেহুদাপনা)
৩৬. কারাহাত-ই আমল (অপছন্দনীয় কাজের প্রতি ঝোঁক)
৩৭. কিল্লাত-ই খাশয়াত (খোদা ভীতির অপ্রতুলতা)
৩৮. জয’আ (অধৈর্য)
৩৯. ‘আদমে খুশু (বিনয়-নম্রতার অভাব)
৪০. গযব-ই লিন নাফস্ ওয়া তাসাহুল ফিল্লাহ (নফসের ক্রোধ ও আল্লাহ প্রতি অমনোযোগিতা) ইত্যাদি। এ প্রকার লোকের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, পায়খানার উপর রেশমী কাপড়ের তাবু যার উপরিভাগ সুসজ্জিত আর ভেতরে পায়খানায় পরিপূর্ণ। এ অভ্যন্তরীণ পঙ্কিলতা বাহ্যিক সাধুতাকে ঠিক থাকতে দেবে কি? সাধারণ লোকের কথা কি বলবো, অনেক বাহ্যিক জ্ঞানের অধিকারী আলিম যদিও প্রকাশ্যে মুত্তাকি কিন্তু তারাও এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। তবে ভেতরে বাইরে পবিত্র হক্কানী আলেমও রয়েছেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা অতি নগন্য। এ বিষয়ে আরও খোলসমুক্ত করে দিতাম, কিন্তু তাতে উপকার কী? বরং এতে সত্য অনুধাবন করত: উপকার সাধন এবং সংশোধনের পথচলা দূরের কথা বরং উল্টো দুশমন মনে করে। তবুও এতটুকু বলব, ওই সব জ্ঞানপাপীর প্রতি হাজারো ধিক। ইদানিং অনেক ধর্মহারা মুরতাদ আল্লাহ ও রসূলের মান-মর্যাদায় কতোই বিশ্রী-কুশ্রী গালি-গালাজের ধুম উঠায়। তারা অত্যন্ত বেপরোয়া, বিলাসী ও প্রকৃতবাদী। বগলে ইট মুখে শেখ ফরিদ। তাহযীব-তামাদুনের কথা বললেও লোকভয়ে প্রতিবাদ করে না। তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে মুসলিম জনসাধারণের কাছে তাদের কুফরি বার্তার গোমর ফাঁস করে দেওয়া। এ কারণে যদিও পত্র পত্রিকায় আমাদের নিন্দা করা হবে এবং আমাদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হবে তারপরও আমাদের ক্ষান্ত হওয়া চলবে না। আমাদের ব্যক্তিত্ব হানি হলেও তাদের আমল ও বিশ্বাসের ত্রুটি ও ভুল ধরিয়ে দিতে আমরা ক্ষান্ত হবো কেন? যেভাবে হোক তাদের শত্রুতা ও বিরোধিতার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাদের ইবারতে ভুল-ত্রুটি ধরে দিয়ে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করা প্রয়োজন। সাধারণ লোকের সামনে তাদের পীরগিরি ও ওয়াজ-কালামে দুর্গন্ধ আকীদা ছড়ায়। সুতরাং এসব অসভ্য বর্বরদের মোকাবেলা না করে থাকাই কি তাকওয়া? এরা রসূলের শানে ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারীদের মোকাবেলায় খরগোশের ঘুমের মতো চোখবন্ধ করে থাকে। আত্মসম্ভ্রম রক্ষা করার বেলায় হুংকার দিয়ে বলে আল্লাহ ও রসূলের মহত্ব থেকে আত্মমর্যাদা রক্ষা করা শ্রেয়। এ সময় ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন এবং লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলীয়িল আযীম পড়া বৈ আর কি বলার আছে। মূলত: এ প্রকারের বক ধার্মিকতার সাথে সফলতার কোনোই সম্পর্কই নেই। বরং এ প্রকারের চরিত্র নিরেট ধ্বংসই ধ্বংস।

সুতরাং বাহ্যিক সফলতা (فلاح ظاهر) হচ্ছে, অন্তর ও শরীর উভয়ের উপর যতো খোদায়ী বিধান কার্যকর সবই মেনে চলা, কোন কবীরা গুনাহে লিপ্ত না হওয়া, কোন সগীরাহ গুনাহ বারংবার না করা, নফসের খারাপ অভ্যাসগুলো যদি দূরীভূত হয়, তবে তা হতে যথাসম্ভব সরে থাকা, এবং তার অনুসরণ না করা। যেমন যদি কারো অন্তরে কৃপণতা থাকে তবে নফসের ওপর জবরদস্তি করে হাতকে (সকলের তরে) প্রসারিত ও উন্মুক্ত রাখা। কারো প্রতি হাসদ বা হিংসা থাকলে ঐ ব্যক্তির অমঙ্গল না চাওয়া-এভাবে সকল খারাপ রিপুর দমন করা। এটা হচ্ছে ‘জিহাদে আকবর’-সর্বাপেক্ষা বড় জিহাদ। আর এটার পর পরকালে কোন পাকড়াও নেই, বরং আছে মহা প্রতিদান। ষড়রিপুর দমন করা প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে আছে যে, হুযুর আকদাস (ﷺ) এরশাদ করেছেন,

ثَلاَثُؑ لَم تُسلِم مِنهَا هَذِهِ الأمَّةِ: اَلحَسَدُ وَالظَّنُّ وَالطَّیرَةُ ، أَلاَ أُنَبِّٸُکُم بِالمَخرِجِ مِنهَا! إِذَا ظَنَنتَ فَلاَ تُحَقِّق ، وَإِذَا حَسَدتَ فَلاَ تَتَّبِع ، وَإِذَا تَطَیَرتَ فَامضِ.

‘এ উম্মত হতে তিনটি চরিত্র যাবে না, তা হচ্ছে, হিংসা, কুধারণা ও কুলক্ষণ। আমি কি তোমাদেরকে এটার চিকিৎসা বলবো না? কারো প্রতি খারাপ ধারণা আসলে তুমি তা সত্য মনে করো না, আর যদি হিংসার উদ্রেগ হয়, তাহলে তুমি তেমনটা চাইবে না। আর অমঙ্গলের আশঙ্কায় নিজ কর্ম থেকে বিরত থাকবে না।
এ হাদীস রাসতাহ, কিতাবুল ঈমানে ইমাম হাসান বসরী থেকে মুরসাল হিসেবে (সাহাবীর নাম উল্লেখ করা ব্যতীত) বর্ণনা করেন। আর ইবনে আদী মুত্তাসিল সনদে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন,

১. আলী মুত্তাকী হিন্দী, কনযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়া আফ'আল, ১৬/২৭ ও ২৮, হাদীস : ৪৩৭৮৯
إِذَا حَسَدتُّم فَلاَ تَبغُوا، وَإِذَا ظَنَنتُم فَلاَ تَحَقَّقُوا، وَإِذَ تَطَیَرتُم فَامضُوا، وَعَلَی اللّٰهِ فَتَوَکَّلُوا.

যখন তোমাদের অন্তরে হিংসা আসবে, তখন বাড়াবাড়ি করো না, আর যখন কারো প্রতি মন্দ ধারণা আসে, তবে তা জমিয়ে রাখবে না। আর (কোন কাজে) অমঙ্গলের ধারণা করলে সে কাজ করা থেকে বিরত থেকো না, বরং আল্লাহর উপর ভরসা কর। এটার অপর নাম ‘ফালাহ-ই তাওয়া’ (فلاح تقوي)। এটার দ্বারা মানুষ নির্ভেজাল মুত্তাকিতে পরিণত হয়। আমি এটাকে ‘ফালাহ-ই যাহির’ এ অর্থে বলেছি যে, এতে যা করার বা না করার আছে তার সব বিধান সুস্পষ্ট ও দেদীপ্যমান।

قَد تَبَیَّنَ الرُّشدَ مِنَ الغَیِّ.

‘নিশ্চয় হিদায়ত পথভ্রষ্টতা থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে।

দুই. অভ্যন্তরীণ সফলতা (فلاح باطن) হচ্ছে এমন সফলতা, যা অন্তর ও দেহের সকল দুষ্ট প্রবৃত্তি এবং যাবতীয় আমিত্ব ও অহংকার হতে পবিত্র হয়ে শিরক-ই খফী বা গোপন শিরকও অন্তর হতে দূরিভূত করার মাধ্যমে লাভ করা যায়। এমন কি তখন সালিকের হৃদয় ‘লা-মাকসুদা ইল্লাল্লাহ’-আল্লাহ ছাড়া কোন উদ্দেশ্য নেই, ‘লা মাশহুদা ইল্লাল্লাহ’-আল্লাহ ছাড়া কোন কিছুর প্রতি দৃষ্টি নেই, লা-মাওজুদা ইল্লাল্লাহ’-আল্লাহ ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই-এ রহস্যে দীপ্তমান হয়ে ওঠো । অর্থাৎ সালিকের হৃদয় তখন অন্যের ভাসনা হতে শূন্য হয়। অতঃপর অন্যের প্রতিবিম্ব দৃষ্টিপাত করাও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে, তারপর তার হৃদয়ে শুধু একমাত্র আল্লাহর সত্তাই বিরাজ করে। যেন মনে হয়, ওয়াজুদ (অস্তিত্ব) একমাত্র তারই জন্য বাকী আছে। অন্য সব তারই ছায়া ও প্রতি মাত্র। এটাই প্রান্তিক বা চূড়ান্ত সফলতা, যাকে ফালাহ-ই ইহসান বলা হয়। আর ফালাহ-ই তাওয়াকতে তো আযাব হতে মুক্তি আর জান্নাতের প্রশান্তি রয়েছে। কারণ,

فَمَن زُحزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدخِلَ الجَنَّةَ فَقَد فَازَ.

১. আলী মুত্তাকী হিন্দী, কনযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়া আফ’আল, ৩/৪৬১, হাদীস : ৭৪৪১
২. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:২৫৬

যাকে দোযখ হতে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করা হবে সে নিশ্চয় কল্যাণ (ফালাহ) লাভ করেছে। আর ‘ফালাহ-ই ইহসান' তার চেয়েও উত্তম। কারণ এমন কল্যাণ (ফালাহ) অর্জনকারীর জন্য শাস্তি তো দুরের কথা, বরং কোন প্রকারের ভয় ও বিষন্নতাও তাদের নিকট আসবে না। এসব সফলকাম ব্যক্তিদের ব্যাপারে বলা হয়েছে-

أَلَآ إِنَّ أَولِیَآءَ اُللّٰهِ لاَ خَوفُُ عَلَیهِم وَلاَ هُم یَحزَنُونَ.

‘শুনে নাও! নিশ্চয় আল্লাহর ওলীগণের না কোন ভয় আছে, না আছে কোন দুঃখ।
অধিকন্তু এ উভয় প্রকার সফলতা (ফালাহ) অর্জনের জন্য অবশ্যই পীর মুরশিদের প্রয়োজন আছে। হয় প্রথম প্রকার সফলতা- ফালাহ-ই তাকওয়া হোক, বা দ্বিতীয় প্রকার সফলতা- ফালাহ-ই ইহসান।

পীর বা মুরশিদের প্রকারভেদঃ

শায়খে ইত্তিসাল ও তার চারটি শর্ত

প্রথমত: মুরশিদ পীর দু'প্রকার।
১. মুরশিদ-ই আ’ম (مرشد عام), ও
২. মুরশিদ-ই খাস (مرشد خاص)

এক. মুরশিদ-ই আ’ম হচ্ছে আল্লাহর বাণী, রাসুলের বাণী, শরীয়ত ও তরীকতের ইমামদের বাণী, সত্য ও সঠিক পথের দিশারী দ্বীনদার আলিমগণের বাণী। এ পরম্পরায় সাধারণ লোকের পীর হচ্ছে আলিমগণের বাণী, ইমামগণের মুরশিদ হচ্ছে। রসূলের বাণী আর রসূলের পেশওয়া হলেন স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা। অতএব ‘ফালাহ-ই যাহির' এবং ‘ফালাহ-ই বাতিনা’ এ উভয় প্রকার সফলতা অর্জনের জন্য এ মুরশিদ-ই আমের অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়। যে কেউ এটা হতে পৃথক হবে, নিঃসন্দেহে সে কাফির বা পথভ্রষ্ট আর তার সব ইবাদত ক্ষতি ও ধ্বংসে পর্যবসিত হবে।

দুই. মুরশিদে খাস, এমন পীরকে বলে যার আকীদা ও আমল বিশুদ্ধ এবং যিনি বায়আতের সকল শর্তের ধারক ও বাহক, যার হাতে যে কোন লোক হাতে হাত রেখে বায়আত গ্রহণ করেন। এ মুরশিদে খাস, যাকে আমাদের পরিভাষায় ‘পীর’ বা ‘শায়খ’ বলা হয় ।
১. আল-কুরআন, সুরা আলে ইমরান, ৩:১৮৫
২. আল-কুরআন, সুরা ইউনুস, ১০:৬২
অতঃপর এ ‘মুরশিদে খাস’ আবার দু'প্রকার। যথা—
এক. শায়খ-ই ইত্তিসাল’ (شیخ إتصال) হচ্ছেন এমন পীর যার হাতে বায়আত গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের সম্পর্ক পরম্পরা হুযুর পুরনুর সায়্যিদুল মুরসালীন (ﷺ) পর্যন্ত গিয়ে সংযুক্ত হয় ।

শায়খে ইত্তিসাল ও তার চারটি শর্ত এ প্রকার পীরের জন্য চারটি শর্ত অপরিহার্য। যথা-
১. তরীকতের শায়খের সিলসিলা পরম্পরা সঠিক পন্থায় হুযুর আকদাস (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছা, মধ্যখানে কেউ বাদ না পড়া। কারণ বাদ পড়ার কারণে রসুল (ﷺ) পর্যন্ত যোগসূত্র স্থাপন অসম্ভব।
কতেক লোক বায়আত ছাড়া বাপ-দাদার পীর হওয়ার সুবাদে উত্তরাধিকারসূত্রে পীরের আসনে বসে যায় অথবা বায়আত থাকলেও খিলাফত মিলেনি আর বায়আত করানোর অনুমতি ছাড়াই মুরিদ করা আরম্ভ করে দেয়, অথবা এমন সিলসিলা যার ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে- যাতে কোন ফয়য রাখা হয়নি, লোকেরাও এতে অনুমতি ও খিলাফত দিয়ে দেন ; অথবা মূলত: সিলসিলাটা সঠিক কিন্তু মাঝখানে কোন এমন লোক আছে যার মধ্যে পীর হওয়ার অন্যান্য শর্তাদি না থাকার কারণে বায়আতের যোগ্যতা হারিয়েছে, ফলে তার মাধ্যমে সিলসিলার যে শাখা আরম্ভ হয়, তা হতে এটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে- এ সব পদ্ধতিতে এ বায়আত দ্বারা কখনো ইত্তেসাল বা রসূল (ﷺ) পর্যন্ত যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব নয়। মূলত এটা ষাড় হতে দুধ বা বাঝা গাভী হতে বাচ্চা কামনা করার মতো।

২. তরীকতের শায়খ সুন্নী ও বিশুদ্ধ আকীদাধারী হওয়া। বদমযহাব, গোমরাহদের সিলসিলা শয়তান পর্যন্ত পৌঁছবে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) পর্যন্ত নয়। বর্তমানে প্রকাশ্য অনেক বেদ্বীন, এমনকি ওহাবীরা-যারা শুরু হতেই আউলিয়া কিরামকে অস্বীকারকারী ও তাদের শত্রু তারাও সরলমনা মুসলমানদেরকে প্রতারিত করার জন্য পীর-মুরিদির জাল বিস্তার করে রেখেছে- তাদের ধোকা হতে হুশিয়ার! খবরদার! সাবধান! সাবধান!

بسا ابلیس آدم روٸے ہست    پس بہبر دستے نباید داد دست

‘পৃথিবীতে মানবাকৃতিতে বহু নররুপী শয়তান রয়েছে। সুতরাং বাচবিচার না করে যার তার হাতে হাত দেওয়া উচিৎ নয়।'

৩. আলিম হওয়া : তরীকতের শায়খকে আলেম হতে হবে। অর্থাৎ নিজের প্রয়োজন মতো ইলমে ফিকায় যথেষ্ট পারদর্শী হতে হবে, আহলে সুন্নাত-এর আকীদাগুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। কুফর ও ইসলাম, গোমরাহী ও হিদায়তের মধ্যে পার্থক্য নিরূপনে খুব দক্ষ হতে হবে। অন্যথায় আজকে যদিও বদমযহাবী নয়, কিন্তু পরে পথচ্যুত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রবাদ আছে যে,

ع فَمَن لَم یَعرِفِ الشَّرَّ فَیَومَا یَقَعُ فِیهِ.

‘যে মন্দ সম্পর্কে অবহিত নয়, একদিন সে তথায় পতিত হয়।'
এমন শত শত কথা ও কর্ম আছে, যা দ্বারা কুফর সাব্যস্থ হয় আর মূখ মূর্খতার কারণে তাতে আটকা পড়ে। কোন কথা ও কর্ম দ্বারা কুফর প্রকাশ পায় প্রথমতো তা সে জানেও না, আর না জানার দরুণ তওবা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে নিজের অজান্তে কুফরের উপর ডুবে থাকে। আর (ভাগ্যক্রমে) কেউ যদি তার কুফর সম্পর্কে বলে দেয়, তবে নম্র ও ভদ্র স্বভাবের অধিকারী মুখতো তাতে ভয়ও পায় আর তওবাও করে নেয়। কিন্তু ওই সাজ্জাদানশীন-যার পূর্বপুরুষ পীর হওয়ার সুবাদে নিজে হাদি ও মুরশিদ বনে বসে আছে তার হৃদয়ে তো বড়ত্ব ও অহংবোধ বিরাজ করছে, সে কী করে তার ভুল স্বীকার করবে!
কুরআন করিমের ভাষায়

وَإِذَا قِیلَ لَهُ اُتَّقِ اللّٰهَ أَخَذَتهُ العِزَّةُ بِالإِثمِ.

‘যখন তাকে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার আত্মাভিমান তাকে পাপানুষ্ঠানে লিপ্ত করে।”
আর পক্ষান্তরে যদি সে ভালো লোক হয় এবং নিজের ভুলও মেনে নেয় তবে তখন তওবা করে নেবে ঠিকই কিন্তু তার কুফরী কথা ও কর্ম দ্বারা যে বায়আত বাতিল হয়ে গেছে এতে সে কি এখন নতুনভাবে অন্যের হাতে বায়আত গ্রহণ করবে, আর শাজরাও ঐ নতুন পীরের নামে দেবে কী? যদিও প্রথম পীরের খলীফা হয়। এটা তার নফস কিভাবে মেনে নেবে? আর না আজ হতে সিলসিলা বন্ধ করে মুরিদ করা ছেড়ে দেয়াতে রাজি হবে? বরং যে অগত্যা ওই বিচ্ছিন্ন সিলসিলাই জারি রাখবে। তাই, এ সব কারণে পীরকে আহলে সুন্নাতের যাবতীয় আকীদার জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়া অপরিহার্য।

* আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:২০৬
৪. পীর ফাসিক-ই মুলান (প্রকাশ্য ফাসিক) না হওয়া। এ শেষোক্ত শর্ত ইত্তিসাল অর্জনের জন্য নির্ভরশীল নয়; কারণ, পীরের শাজরা শুধু ফিসক ও ফজুর (পাপাচার)-এর কারণে (সিলসিলার যোগসূত্র) রহিত হয় না। তবে পীরের সম্মান করা অপরিহার্য আর ফাসিককে অবজ্ঞা করা ওয়াজিব। আর উভয়ের সংমিশ্রণটা বাতিল। কারণ, এতে দুই বিপরীতধর্মী বস্তুর একত্রিত করণ (إجتماع) আবশ্যক হয়ে যায় । ইমাম যীইলীর তাবয়ীনুল হাকায়িক ও অন্যান্য কিতাবে ফাসিক সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে,

وَلِأَنَّ فِي تَقدِیمِهِ لِلإِمَمَةِ تَعظِیمَهُ وَقَد وَجَبَ عَلَیهِم إهَانَتُهُ شَرعًا.

‘ইমামতের জন্য তাকে অগ্রগামী করা হচ্ছে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন আর শরীয়ত তাকে অবজ্ঞা করা ওয়াজিব করে দিয়েছে।”

শায়খ-ই ইসালের শর্তসমূহ

শায়খ-ই ইসালের শর্তসমূহ দুই. ‘শায়খে ইসাল’ (شیخ إیصال) হচ্ছেন এমন শায়খ বা পীর যিনি উপরোক্ত শর্তাদির অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে নফসের ক্ষতিকারক বস্তু, শয়তানের প্রতারণা, কামনা বাসনার ফাদ সম্পর্কে জ্ঞাত হবেন, অন্যকে (মুরিদকে) তরীকতের প্রশিক্ষণ দিতে জানেন এবং নিজ মুরিদের প্রতি এমন স্নেহপরায়ণ যে তাকে তার দোষত্রুটি ধরিয়ে দেন এবং সংশোধনের পন্থা বলে দেন। আর তরিকতের পথ পরিক্রমায় যতো অসুবিধার সৃষ্টি হয় তা মীমাংসা করে দেন। যিনি শুধু সালিকও নন, আবার শুধু মজযূবও নন। আওয়ারিফ শরীফে উল্লেখ আছে যে, শুধু ‘সালিক আর শুধুমাত্র ‘মাজযুব’ এরা উভয়ে পীরের উপযুক্ত নন। কারণ প্রথমজন তাে স্বয়ং এখনও (তরীকতের) পথে রয়েছেন আর অন্যজন (মুরিদকে) প্রশিক্ষণ প্রদানে অমনোযোগী। বরং এ প্রকার পীরকে হয় ‘মাজযূব-ই সালিক হতে হবে, না হয়। ‘সালিক-ই মাজযুব'। তাদের মধ্যে প্রথমজনই সর্বোত্তম। কারণ উনি হচ্ছেন মুরাদ আর ইনি হচ্ছেন মুরিদ।

১. যায়ল’য়ী, তাবয়ীনুল হাকায়িক, অধ্যায় : আল-ইমামত, ১/১৩৪, আল-মতবা'আতুল কুবরা, বুলাক, মিসর
এক. সালিক : যারা কোন কামিল পীরের সাহচর্য (ফয়েযপ্রাপ্ত) নয় অথবা কোন পীরের সাহচর্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকলেও ফয়েয-বরকত অর্জন করে আল্লাহর প্রেমে আসক্তি ও প্রেরণা লাভ করতে পারেনি, তারা সাধারণ মুমিনের মধ্যে গণ্য। তাদের মধ্যে জজব থাকে না বলে তারা সাহিব-ই হাল' এবং 'সাহিব-ই তাসাররুফ' বা প্রভাব বিস্তারকারী নয়। তারা শুধু তালীমে ইলাহী ও ইরশাদের যোগ্যতা রাখে।

দুই. মাজযুব : ফয়েযে এলকায়ী বা এত্তেহাদী প্রাপ্ত হয়ে সদা-সর্বদা আল্লাহর প্রেমে বিভোর থাকেন এবং আল্লাহর একত্বে বিলীন হয়ে আল্লাহর গোপন রহস্যাদিতে ডুবে থাকেন তারা আল্লাহর সাথে সম্বন্ধ ও আলমে বাতেনের সাথে ঘনিষ্ঠতা রাখেন। তাই সাধারণত এই জগৎসমূহের পরিচালনার ভার তাদের ওপর ন্যস্ত হয়। তারা সাহিব-


বায়আতের প্রকারভেদ
বায়আতও দু'প্রকার। যথা-
১. বায়আতে বরকত (بیعت برکت) ও
২. বায়আতে এরাদত (بیعت إرادت)

এক. বায়আতে বরকত হচ্ছে শুধু তাবাররুক (বরকত লাভ) এর নিমিত্তে তরীকতের সিলসিলায় প্রবেশ করা। বর্তমানে সাধারণ বায়আতসমূহ এ প্রকারই । তাও ভাল নিয়্যতে হতে হবে। অনেক বায়আত তো পার্থিব কোন ফাসিদ উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে, তা আলোচনার বাইরে। আর এ প্রকার বায়আতের জন্য পীরের মধ্যে শায়খে ইত্তিসালের শর্ত চতুষ্টয় একত্রে পাওয়া গেলেই যথেষ্ট হবে।


বায়আতে বরকতের ফযীলত

এ ‘বায়আত বরকত’ গ্রহণ করাও অনর্থক নয় বরং ইহলোক ও পরলোকে এটাও অনেক উপকারে আসবে। প্রথমত: এ দ্বারা খোদা প্রেমিকদের দফতরে নাম লেখান, তাদের সাথে সিলসিলায় সম্পৃক্ত হওয়া আসলেই সৌভাগ্যের ব্যাপার।

১.    আল্লাহর প্রকৃত গোলামদের পথে এ বিষয়ে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আর রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন,

مَن تَشَبَّهَ بِقَومٍ فَهُوَ مِنهُم.

‘যে যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত।
সায়্যিদুনা শায়খুশ শায়ূখ শিহাবুল হক ওয়াদ্দীন সােহরাওয়ার্দি রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ‘আওয়ারিফুল মা’আরিফ গ্রন্থে বলেন,

ই হাল ও প্রভাবশালী হন। কুতুবিয়্যাত ও সাহিবে মকামের মর্যাদার অধিকারী হয়েও সুলুকে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন না। ফলে তারা কোন তরীকতের পথের যাত্রীকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও সুলুকের পথ দেখাতে অক্ষম।
তিন. সালেকে মজযুব : যারা কামিল পীরের সাহচর্যে ফয়েয-বরকত অর্জনে সক্ষম হয়েছেন এবং জজব ও সুলুকের সংমিশ্রণে আল্লাহ অন্বেষণ পথে সচেষ্ট থাকেন, তারা পর্যায়ক্রমে বিলায়তের সর্বোচ্চ মকাম অর্জনে সক্ষম হন। এবং তাদের মকাম অনুযায়ী প্রভাব বিস্তারেও সক্ষম। অধিক সময় তারা শান্ত অবস্থায় থাকে। ফলে হিদায়তমূলক কাজে পার্থিব জগতের সাথে সম্পর্কও রাখেন।

চার. মজযুবে সালেক : যারা কামিল পীরের কাছে সর্বপ্রকার বরকত অর্জন করে আল্লাহ প্রেমে অধিক বিভোর থাকেন, তারা পর্যায়ক্রমে বিলায়তের সকল মর্যাদা অর্জন করে আল্লাহর একত্বে মিশে যেতে সক্ষম হন এবং আল্লাহর গুপ্ত ব্যক্ত সকল রহস্য অবগত হয়ে তার জাহির-বাতিন রাজ্যসমূহের পরিচালক নিযুক্ত হন। তারা সমস্ত আলমে প্রভাব বিস্তারে পূর্ণ সামর্থবান। তাদের মধ্যে জজবের প্রাধান্য বেশি দেখা যায় । কিন্তু জজব ও সুলুক তাদের স্বভাব ও ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে। তারা যখন ইচ্ছা করেন সুলুকে আসতে সক্ষম হন।
- খাদিমুল ফুকরা সৈয়্যদ দেলোয়ার হোসাইন মাইজভান্ডারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকৃত বিলায়তে মুতলাকা দ্রষ্টব্য

১. আবু দাউদ, আস-সুনান, کتاب اللباس, ২/২০৩, আফতাবে আলম প্রেস, লাহোর
২. আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মসনদ, ২/৫০ ও ৯২, আল-মাকতাবুল ইসলামী, বৈরুত

وَاعلَم أَنَّ الخِرقَةَ خِرقَتَانِ خِرقَةُ الإِرَادَةِ وَخِرقَةُ التَّبَرُّكِ وَالأَصلُ الَّذِي قَصَدَهُ المَشَایِخُ لِلمُرِیدِینَ خِرقَةُ الإِرَادَةِ وَخِرقَةُ التَّبَرُّكِ مَن تَشَبَّهَ بِخِرقَةِ الإِرَادَةِ فَخِرقَةُ الإِرَادَةِ لِلمُرِیدِ الحَقِیقِيِّ وَخِرقَةُ التَّبَرُّكِ لِلمُتَشَبِّهِ وَمَن تَشَبَّهَ بِقَومٍ فَهُوَ مِنهُم.

‘প্রকাশ থাকে যে, খিরকা দু'টি, খিরকা-ই ইরাদত ও খিরকা-ই তাবাররুক। পীরগণ মুরিদদের থেকে খিরকা-ই ইরাদতই কামনা করেন আর খিরকা-ই তাবাররুক তাদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করার নাম। তাই প্রকৃত মুরিদের জন্য খিরকা-ই ইরাদত এবং সাদৃশ্য অবলম্বনকারীদের জন্য রয়েছে খিরকা-ই তাবাররুক। যে কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।

২. আসলে এটা (বায়আতে তাবাররুক) হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্যধন্য বান্দাদের সাথে একটি মুক্তা মালায় গ্রথিত হওয়ার নাম।

ع بلبل ہمیں کہ قافیہ گل شودبس است

‘বুলবুলির জন্য ফুলের সান্নিধ্যই যথেষ্ট।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাদীসে কুদসীতে এরশাদ করেন,

هُمُ القَومُ لاَ یَشقَی بِهِم جَلِیسُهُم.

তারা এই সব লোক, তাঁদের সাথে উপবেশনকারীও দুর্ভাগা হয় না।

৩. খোদা-প্রেমিকগণ আল্লাহর রহমতের নিদর্শন। তাঁরা তাঁদের নাম স্মরণকারীকেও আপন করে নেন। এবং তার উপর করুণার দৃষ্টি রাখেন। প্রখ্যাত ইমাম সায়্যিদি আবুল হাসান নুরুল মিল্লাত ওয়াদ্ দ্বীন কুদ্দিসা সিররুহু ‘বাহ্জাতুল আসরার' গ্রন্থে বলেন, হুযুর পুর নূর সায়্যিদুনা গাউসুল আযম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, যদি কোন ব্যক্তি হুযুরের নাম স্মরণকারী হয় আর না সে হুযুরের তরীকায় বায়আত হয়েছে, না হুযুরের।

১. সোহরাওয়ারদী, আওয়ারিফুল মা'আরিফ,الباب الثاني عشرة, পৃ. ৭৯, মতবা'আতুল মাশহাদ আল-হুসাইনী ২. আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মসনদ, ২/২৫২, অ৫৯ ও ৩৮৩
২. তিরমিযী, আল-জামি, أبواب الدعوات, ২/১৯৯

খিরকা পরিধান করেছে, সে কি হুযুরের মুরিদের মধ্যে গণ্য হবেন? তখন হুযূর গাউস-ই পাক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন,

مَنِ انتَمَي إِلَيَّ وَتُسَمِّي لِي قَبَلَهُ اللّٰهُ تَعَالَی وَتَابَ عَلَیهِ إِن کَانَ سَبِیلٍ مَکرُوهٍ وَهُوَ مِن جُملَةِ أَصحَابِي وَإِنَّ رَبِّي ﷻ وَعَدَنِي أَن یَّدخُلَ أَصحَابِي وَأَهلَ مَذهَبِي وَکُلَّ مُحِبِّ لِّيَ الجَنَّةَ.

‘যে স্বয়ং নিজেকে আমার প্রতি সম্পৃক্ত করবে আর নিজেকে আমার গোলামদের দফতরে শামিল করবে, আল্লাহ তাকে কবুল করবেন আর যদি সে কোন অপছন্দনীয় পথে থাকে, তবে তাকে তওবা করার। অবকাশ দেবেন, আর সে আমার মুরিদদের দলের অন্তর্ভুক্ত। এবং আমার মহান রব আমার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন যে, তিনি আমার মুরিদ, আমার মযহাবাবলম্বী আর আমাকে যারা চায় প্রত্যেককেই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা যিনি সমগ্র বিশ্বের রব)।

শায়খ-ই ইসালের শর্তসমূহঃ

বায়আত-ই-এরাদতের বর্ণনা

বায়আত-ই এরাদতের বর্ণনা দুই. বায়আত-ই এরাদত' হচ্ছে, নিজ ইচ্ছা ও স্বাধীনতা হতে একেবারেই বের হয়ে সত্যিকার আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত পীর ও মুরশিদের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দেয়া। একমাত্র তাঁকে নিজের হাকেম (বিচারক), মালিক (সত্ত্বাধিকারী) ও পরিচালক হিসেবে জানা। তাঁর প্রদর্শিত পথ দিয়েই তরীকতের পথে চলা, তার অনুমতি ছাড়া এ পথে কোন কদম না রাখা। তাঁর কোন নির্দেশ বা কাজ নিজের কাছে সঠিক মনে না হলে তা খিযির আলায়হিস সালামের কর্মের মতো মনে করা এবং (সঠিক মনে না হওয়াকে) নিজের বিবেকের ক্রটি বলে জানা। তার কোন কথাতে অন্তরেও প্রশ্ন উত্থাপন না করা। নিজের সকল বিপদ-আপদ তার কাছে পেশ করা। বস্তুত তার কাছে জীবিত হয়েও মৃতের মতাে থাকা। এটাই হলো সালিক বা প্রকৃত তরীকতপন্থীদের বায়আত। আর এটাই মুরশিদের প্রকৃত উদ্দেশ্য। এটাই আল্লাহ তা'আলা পর্যন্ত পৌঁছায়। আর এটাই হুযুর আকদাস (ﷺ) সাহাবা কিরামদের থেকে গ্রহণ করেছেন। যেমন, হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত আনসারী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এরশাদ করেছেন যে,

১. শানুফী, বাহজাতুল আসরার, ذکر فضل اصحابه وبشراهم, পৃ. ১০১, মোস্তফা আল-বাবী, মিসর।

بَایَعنَا رَسُولَ اللّٰهِ ﷺ عَلَی السَّمعِ وَالطَّاعَةِ فِی العُسرِ وَالیُسرِ وَالمَنشَطِ وَالمَکرَهِ وَعَلَی أَثَرَةٍ عَلَینَا وَعَلَی أَن لاَ نُنَزِعَ الأَمرَ أَهلَهُ.

‘আমরা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) হতে এ মর্মে বায়আত করেছি যে, সকল সহজ ও কঠিন, সকল খুশি ও দুঃখে তার নির্দেশ মান্য করব এবং আনুগত্য করবো আর নির্দেশদাতার কোন আদেশের বিরোধিতা করবো না।'

শায়খ বা পীরের নির্দেশ মূলতঃ রসূলের নির্দেশ আর রসূলের নির্দেশ আল্লাহর নির্দেশ আর আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার কারো সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا کَانَ لِمُٶمِنِ وَلاَ مُٶمِنَةٍ إِذَا قَضَی اللّٰهُ وَرَسُولُهُ٫ أَمرًا أَن یَکُونَ لَهُم الخِیرَةُ مِن أَمرِهِم ؑ وَمَن یَعصِی اللّٰهَ وَرَسُولَهُ٫ فَقَد ضَلَّ ضَلَٰلاً مُّبِینًا.

‘এবং না কোন মুসলমান পুরুষ, না কোন মুসলমান নারীর জন্য শোভা পায় যে, যখন আল্লাহ ও রাসূল কোন কাজের নির্দেশ দেন, তখন তাদের স্বীয় ব্যাপারে কোন ইখতিয়ার থাকবে এবং যে কেউ নির্দেশ অমান্য করে আল্লাহ ও রসূলের, সে নিশ্চয় স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পথভ্রষ্ট হয়েছে।

আওয়ারিফুল মা’আরিফ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে-

دُخُولُهُ فِي حُکمِ الشَّیخِ دُخُولُهُ فِي حُکمِ اللّٰهِ وَرَسُولِهِ وَأَحیَاءُ سُنَّةِ المُبَایَعَةِ.

‘মুরশিদের নির্দেশাধীন হওয়া মানে আল্লাহ ও রসূলের নির্দেশাধীন হওয়া আর তা বায়'আতের সুন্নাতকে জীবিত করা।

১.১. বুখারী, আস-সহীহ, کتاب الفتن, ২/১০৪৫, কদীমী কুতুবখানা করাচি
২. মুসলিম, আস-সহীহ, کتاب الإمارة, ২/১২৪, কদীমী কুতুবখানা করাচি
২. আল-কুরআন, সুরা আল-আহযাব, ৩৩:৩৬
৩. সোহরাওয়ারদী, আওয়ারিফুল মা'আরিফ, الباب الثاني عشرة, পৃ. ৭৮

উক্ত গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে,

وَلاَ یَکُونُ هَذَا إِلاَّ لِمُرِیدٍ حَصُرَ نَفسَهُ مَعَ الشَّیخِ وَانسَلَخَ مِن إِرَادَةِ نَفسِهِ وَفنَي فِي الشَّیخِ بِتَركِ اختِیَارِ نَفسِهِ.

‘বায়’আত-ই এরাদত অর্জন করা একমাত্র ওই লোকের জন্য সম্ভব, যে স্বীয় আত্মাকে মুরশিদের নিকট বন্দী করেছে এবং স্বীয় ইচ্ছা হতে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এসেছে আর নিজ স্বাধীনতা ছেড়ে শায়খের মধ্যে ফানা (বিলীন) হয়ে গেছে।

তিনি আরো বলেন যে,

وَیَحذَرُ الإِعتِرَاضُ عَلَی الشُّیُوخِ فَإِنَّهُ السَّمُّ القَاتِلُ لِلمُرِیدِینَ، وَقَلَّ أَن یَّکُونَ مُرِیدُ یَعتَرِضُ عَلَي الشَّیخِ بِبَاطِنِهِ فَیَفلِحُ، وَیَذکُرُ المُرِیدُ فِي کُلِّ مَا اشکَلَ عَلَیهِ مِن تَصَارِیفِ الشَّیخِ قِصَّةَ الخِضَرِ عَلَیهِ السَّلاَمَ کَیفَ کَانَ یَصدُرُ مِنَ الخِضَرِ تَصَارِیفُُ یُنکِرُهَا مَوسَي، ثُمَّ لَمَّا کَشَفَ لَهُ عَن مَعنَاهَا بِأَنَّ لِمُوسَي وَجَّهَ الصَّوَابَ فِي ذَلِكَ، فَهَکَذَا یَنبَغِي لِلمُرِیدِ أَن یَّعلَمَ أَنَّ کُلَّ تَصَرُّفٍ أَشکَلَ عَلَیهِ صِحَّتُهُ مِنَ الشَّیخِ، عِندَ الشَّیخِ فِیهِ بَیَانُُ وَبُرهَانُُ لِلصِّحَّةِ.

‘পীরের কোন বিষয়ে আপত্তি তোলা হতে বিরত থাকবে। কারণ, এটা মুরিদদের জন্য মৃত্যু দানকারী বিষতুল্য। এমন কম মুরিদই আছে, যে অন্তরে শায়খের উপর কোন আপত্তি তুলেছে অতঃপর কল্যাণ অর্জন করেছে! শায়খের ক্রিয়া-কাণ্ডে যা কিছু মুরিদের সঠিক বলে মনে হবে না, তাতে হযরত খিযির আলায়হিস সালাম-এর ঘটনাবলী স্মরণ করবে। কেননা, হযরত খিযির হতে ঐসব ক্রিয়া-কাণ্ড প্রকাশ হতাে যা বাহ্যিকভাবে অত্যন্ত আপত্তিকর ছিলো। (যেমন গরীব লোকের নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া, নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করা ইত্যাদি।) অতঃপর যখন তিনি তার কারণ বলতেন, তখন এটাই সুস্পষ্ট হতো যে, তাই সঠিক ছিলো, যা তিনি করেছেন। মুরিদের বিশ্বাস করা উচিত যে, শায়খের যে কাজ আমার কাছে
১. সোহরাওয়ারদী, আওয়ারিফুল মা’আরিফ, الباب الثاني عشرة, পৃ. ৭৮
শুদ্ধ বলে মনে হচ্ছে না, শায়খের কাছে তার শুদ্ধতার উপর সুদৃঢ় প্রমাণ বিদ্যমান।

ইমাম আবুল কাসিম কোশায়রী তাঁর রচিত “রিসালা’য় বলেন যে, আমি হযরত আবু আবদুর রহমান সালমাকে বলতে শুনেছি যে, তাকে শায়খ হযরত আবু সাহল সা’আলূকী বলেছেন যে,

مَن قَالَ الأُستَاذَهُ لِمَ، لاَ یَفلِحُ أَبَدًا

“যে ব্যক্তি স্বীয় পীরের কোন কথায় ‘কেন’ বলবে, সে কখনো কল্যাণ লাভ করবে না (কামিয়াব হতে পারবে না)।
আমরা যখন দ্বীনি কল্যাণ (ফালাহ), পীর-মুরশিদ ও বায়আত ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হলাম, এখন আসল মাস'আলার সমাধানের দিকে ফিরে যাই। সুতরাং জেনে রাখুন যে, সাধারণ দ্বীনি কল্যাণ (ফালাহ) অর্থাৎ পরকালীন মুক্তিলাভের জন্য মুরশিদে আ’ম (مرشد عام)-এর অবশ্যই প্রয়োজন । ফালাহ-ই তাকওয়া (فلاح تقوي) হােক, বা ফালাহ-ই ইহসান (فلاح احسان) -এ উভয় কল্যাণ মুরশিদে আ'ম হতে পৃথক হয়ে কখনো অর্জন করা যায় না। যদিও মুরশিদে খাস আছে, বা স্বয়ং নিজেই মুরশিদে খাস হোক না কেন।

যে কারণে মুরশিদে আম’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়
অতঃপর এ ‘মুরশিদে আ’ম' হতে বিচ্ছিন্ন দু'ভাবে হয়ে থাকে। যথা-
১. শুধু আমলগত ত্রুটির কারণে ও
২. আকীদাগত ত্রুটির কারণে।

এক. শুধু আমলগত কারণে মুরশিদে আম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। যেমন কোন কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়া বা সগীরা গুনাহ বারংবার করা। আর এর থেকেও নিকৃষ্ট ঐ মূর্খ যে উলামা-ই দ্বীনের প্রতি রুজু হয় না। আর এর চেয়েও নিকৃষ্ট ঐ লোক যে মূর্খতার সাথে রায়দাতা বনে আছে এবং আলিমগণের বিধানে নিজের অভিমত খাটায়, বা বিধিবদ্ধ বিধানের বিপরীতে ভ্রান্ত প্রথার উপর গেড়ে বসেছে। আর যদি হাদীস ও ফিকাহর আলোকে বলা হয় যে, এ ভ্রান্ত প্রথার কোন ভিত্তি নেই তারপরও ওটাকেই হক বলে জানে। অতএব এ সব লােক (দ্বীনি) কল্যাণের উপর নেই, আর তারা একজন অন্যজনের চেয়ে বেশি ক্ষতিতে নিমজ্জিত। তবে শুধু আমল ছেড়ে দেয়ার কারণে তারা পীর ছাড়াও নয় আবার তাদের পীর শয়তানও নয়। যেহেতু তারা

১. সোহরাওয়ারদী, আওয়ারিফুল মা'আরিফ, الباب الثاني عشرة, পৃ. ৭৯

২. কুশায়রী, আর-রিসালা, অধ্যায় : حفظ قلوب المشاٸخ وترك الخلاف علیهم, পৃ. ১৫০

ওলীগণ ও উলামা-ই দ্বীনের প্রতি নিষ্ঠার সাথে বিশ্বাসী। যদিও কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় নাফরমানী করে তবুও ‘মুরশিদে খাসের ভিত্তিতে বায়'আত যেমন দু'প্রকার ছিলো, তেমনি মুরশিদে আমের ভিত্তিতেও তারা যদি তার নির্দেশমতে চলে তবে তা বায়'আতে ইরাদত ধরতে হবে, নতুবা ওলামায়ে দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস রাখার দরুণ তা বায়আতে বরকত থেকে খালি নয়। কারণ, তাদের ঈমান ও আকীদা তো ঠিক আছে। অতএব গুনাহগার সুন্নী যদি চতুষ্টয় শর্তের ধারক কোন পীরের মুরিদ হয়। তবে তো ভালো কথা, অন্যথায় হুসনে ইতিকাদ (ভালো ধারণা)-এর কারণে মুরশিদে আ’মের অনুসারীদের মধ্যে গণ্য হবে যদিও নাফরমানির কারণে দ্বীনি কল্যাণ (ফালাহ)-এর উপর নেই।

যাদের পীর শয়তান তাদের বর্ণনা

দুই. অস্বীকার বা আকীদাগত কারণে মুরশিদ-ই আ’ম হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া। আর তা হচ্ছে :
১. উপহাসকারী ওই শয়তান, যে উলামা-ই দ্বীনকে নিয়ে হাসি-তামাসা করে এবং আলেমদের বর্ণিত শরয়ী বিধানগুলোকে অনর্থক মনে করে। তাদের মধ্যে আরো আছে-ওই সব মিথ্যুক ফকীর দাবিদার-যারা বলে যে, আলিমগণ ফকীরদের ডাক চিৎকারে সৃষ্টি হয়। এমনকি কতেক শয়তান সাজ্জাদাশীন বরং নিজেকে যুগের কুতুব হিসেবে দাবিকারী ব্যক্তিকে এ কথা বলতে শুনা যায় যে, আলেম আবার কে? সব তো পণ্ডিত। আলেম তো তারা, যারা বনী ইসরাঈলের নবীদের মতো মু'জিয়া দেখাতে পারে। ২. ঐ নাস্তিক, মুলহিদ (ধর্মত্যাগী) ফকীর ও স্বঘোষিত ওলী, যে বলে শরীয়ত হলো রাস্তা আর আমরা তো রাস্তা অতিক্রম করে উদ্দেশ্য পৌঁছে গেছি। এখন আমরা রাস্তা (শরীয়ত) দিয়ে কী করবো? আমার প্রণীত মক্কালু উরাফা বি-ইযাযিশ শরয়ী ওয়াল ওলামা (১৩২৭ হি.) পুস্তকে এসব দুষ্টদের মতবাদ খণ্ডন করেছি। উলামাদের মধ্যে ইমাম আবুল কাসিম কোশায়রী কুদ্দিসা সিররুহু তাঁর কৃত রিসালায় লিখেছেন যে, আবু আলী রুযুবারী রাদিয়াল্লাহু আনহু, যিনি বাগদাদে জন্মগ্রহণ করে, মিসরে বসবাস করতেন আর তথায় হিজরী ৩২২ সালে ইন্তিকাল করেন। তিনি সায়্যিদুত তায়িফা হযরত জোনাঈদ বাগদাদী ও হযরত আবুল হাসান আহমদ নূরী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর মুরিদ ছিলেন। তরীকতের পীরদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি তাসাউফের জ্ঞান রাখতেন এমন কেউ ছিল না । তার নিকট একদা প্রশ্ন করা হলো যে, এক ব্যক্তি মাযামীর (বাদ্যযন্ত্র) শুনে আর বলে যে,

هِیَ لِي حِلاَلُُ لأَنِّي وَصَلتُ إِلَي دَرجَةٍ لاَ تُٶثِرُ فِي اختِلاَفِ الأَحوَالِ فَقَالَ : نَعَم! قَد وَصَلَ وَلَکِن إِلَي سَقَرٍ.

এটা আমার জন্য হালাল, কারণ আমি এমন স্তরে পৌঁছেছি যে, বাদ্যযন্ত্রের রাগ আমার অবস্থার উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারে না । তখন তিনি প্রতিউত্তরে বললেন, হাঁ অবশ্যই সে পৌঁছেছে, কী পর্যন্ত জানো! জাহান্নাম পর্যন্ত।

আরিফ বিল্লাহ আব্দুল ওহাব শা'রানী কুদ্দিসা সিররুহু কিতাবুল ইওয়াকীত ওয়াজ জাওয়াহির ফী আকাঈদীল আকাবির গ্রন্থে লিখেছেন যে, হুযুর সায়িদুত তায়ীফা জুনাইদ বাগদাদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে আরয করা হয়েছে যে, কতেক লোক বলে যে,

إِنَّ التَّکَالِیفَ کَانَت وَسِیلَةُ إِلَي الوُصُولِ وَقَد وَصَلنَا.

শরীয়তের বিধিবিধান তো খোদা পর্যন্ত পৌঁছার একটা মাধ্যম মাত্র আর আমরা তো পৌঁছে গেছি। (অতএব তখন শরীয়তের বিধান মেনে চলার কী প্রয়োজন?)।

তখন তিনি বললেন,

صَدَقُوا فِي الوُصُولِ وَلَکِن إِلَي سَقَرِ وَالَّذِي یَسرُقُ وَیَزنِي خَیرُُ مِمَّن یَعتَقِدُ ذَلِكَ.

তারা সত্য বলেছে, অবশ্যই তারা পৌঁছে গেছে তবে জাহান্নাম পর্যন্ত।
চোর এবং ব্যভিচারী এমন আকীদা পোষণকারী হতে উত্তম।
৩. এই মুখ ও পথভ্রষ্ট যে লেখাপড়া না করে বা কিছু বই-পুস্তক পড়ে নিজে নিজে আলিম হয়ে শরীয়তের মহান ইমামদের হতে বিমুখ হয়ে আছে এবং কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যাদানে নিজেকে যুগের আবু হানিফা ও শাফেয়ী ধারণা করছে বরং তাদের চেয়েও উত্তম মনে করছে। আর বলে যে, তারা কুরআন ও হাদিসের বিপরীত নির্দেশ দিয়েছেন বা তাদের ভুলভ্রান্তি তালাশে ব্যস্ত-ফলে এ সব লোক গোমরাহ্, বেদ্বীন ও গায়র-ই মুকাল্লিদ বা তাকলীদ অস্বীকারকারীদের দলভুক্ত।

১. কুশায়রী, আর-রিসালা, অধ্যায় : منهم أبو علي أحمد بن محمد الروذباري, পৃ. ২৬, মোস্তাফা আলবাবী
২. শা’রানী, الیواقیت والجواهر في عقاٸد الاکابر, অধ্যায় : المبحث السادس والعشرون, ১/২৭২-৭৩, দারু ইয়াহইয়ায়ি তুরাসিল আরবী, বৈরুত

৪. তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট হলো ওই সব লোক যারা ওহাবী মতবাদের মৌলিক গ্রন্থ তাকবীয়াতুল ঈমানের দর্শনে বিশ্বাস করে বসে আছে। আর তার বিপরীত কুরআন ও হাদিসকে পেছনে নিক্ষেপ করেছে। আর এরা আল্লাহ ও রসূলকে পিঠ দিয়ে ওই কিতাবের মাসাঈলের উপর ঈমান এনেছে।

৫. তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট ঐসব দেওবন্দী যারা গাঙ্গুহী, নানুতবী ও থানবী প্রমুখ যাজক ও সন্ন্যাসীদের কুফরকে ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়ে আল্লাহ ও রসূলের প্রতি তাদের বড় বড় গাল-মন্দকে কবুল করে নিয়েছে।

৬. কাদিয়ানী
৭. নাস্তিক
৮. চকডালভী
৯. রাফেযী
১০. খারেজী
১১. নাওয়াসিব
১২. মুতাযিলা ইত্যাদি সকল মুরতাদ, পথভ্রষ্ট ও ধর্মের শত্রু সবাই মুরশিদে আ'মের বিরোধী ও অস্বীকারকারী। এরা অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং নিঃসন্দেহে তাদের সবার পীর শয়তান। যদিও বাহ্যিক কোন পীরের নাম নিয়ে থাকে অথবা নিজেকে পীর, ওলী ও কুতুব হিসেবে দাবি করে বসে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

اُستَحوَذَ عَلَیهِمُ الشَّیطَنُ فَأَنسَهُم ذِکرَ اللَّهِ أُولَٓٸِكَ حِزبُ الشَّیطَنِ ؑ أَلَآ إِنَّ حِزبَ الشَّیطَنِ هُمُالخَٰسِرُونَ.



‘শয়তান তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে, ফলে তাদেরকে সে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানের দল। সাবধান! শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্থ।”

ওইসব থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আশ্রয় কামনা করছি।

ফালাহ-ই তাকওয়া (فلاح تقوي)-এর জন্য মুরশিদে খাসের প্রয়োজন নেই

ফালাহ-ই তাকওয়ার জন্য মুরশিদে খাসের প্রয়ােজন নেই। এমন নয় যে
১. আল-কুরআন, সুরা আল-মুজাদিলা, ৫৮:১৯
মুরশিদে খাস ছাড়া এ প্রকার ফালাহ (দ্বীনি কল্যাণ) অর্জন করাই যায় না। পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, ফালাহে যাহিরের বিধান সুস্পষ্ট; ফলে যে কোন লোক স্বীয় জ্ঞান বা উলামা হতে জেনে জেনে মুত্তাকি হতে পারে। যদিও কলবের কার্যে কিছুটা সূক্ষ্মতা রয়েছে, তবুও তা সীমাবদ্ধ। আর ইমাম আবু তালিব মক্কী ও ইমাম হুজ্জাতুল ইসলাম গাযযালী প্রমুখ ইমামদের গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে। অতএব ‘বায়-আতে খাস' ছাড়াও এ পথ প্রশস্ত আর এটার দ্বার উন্মুক্ত। তাই আমি পূর্বে বর্ণনা করেছি যে, মুত্তাকী নয় এমন সুন্নী লোকও পীর ছাড়া নয়। সুতরাং মুত্তাকী কি করে পীর ছাড়া হবে আর কীভাবে তার পীর শয়তান হতে পারে! যদিও সে কোন মুরশিদে খাসের হাতে বায়আত গ্রহণ করেনি। আর সে যে পথে আছে তাও তাকওয়ার পথ। এতে মুরশিদে আ'ম ছাড়া মুরশিদে খাসের প্রয়ােজন নেই। যতো পীর তার দরকার সবই আছে। আর আওলিয়া কিরামের দ্বিতীয় উক্তি যার পীর নেই, তার পীর শয়তান’-এটা ফালাহ-ই তাকওয়া অর্জনকারীর ব্যাপারে হতে পারে না। আর তাঁদের প্রথম উক্তি, ‘পীরহীন' লোক দ্বীনি কল্যাণ (ফালাহ) হতে বঞ্চিত’–এটাতো কোন মতে এদের উপর প্রযোজ্য হয় না। কারণ ‘ফালাহ-ই তাকওয়া নিঃসন্দেহে ফালাহ (কল্যাণ), যদিও ‘ফালাহ-ই ইহসান’ তার চেয়ে উত্তম ও মহৎ। আল্লাহ তা'আলা বলেন-

إِن تَجتَنِبُوا کَبَآٸِرَ مَا تُنهَونَ عَنهُ نُکَفِّر عَنکُم سَیِّٸَاتِکُم وَنُدخِلکُم مُّدخَلاً کَرِیمًا.‘যদি তোমরা কবীরা গুনাহ্ হতে বিরত থাক, তবে তােমাদের পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়া হবে এবং তোমাদেরকে সম্মানিত স্থানে প্রবেশ করা হবে।

নিঃসন্দেহের মুত্তাকিদের জন্য এটা বড়ো বিজয়। আর আল্লাহ তা'আলা আহলে তাকওয়া ও আহলে ইহসান উভয়কে তাঁর নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বলেন,

إِنَّ اللّٰهَ مَعَ الَّذِینَ اُلتَّقُوا وَالَّذِینَ هُم مُّحسِنِینَ.‘নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন আর তাদের সাথে যারা আহলে ইহসান (তরীকতপন্থী)।

আল্লাহ তা'আলার সঙ্গত্ব এটা কতো বড়ো নিয়ামত, এছাড়া আর কী কল্যাণ চাইবো!

১. আল-কুরআন, সুরা আন-নিসা, ৪:৩১
২. আল-কুরআন, সুরা আন-নাহল, ১৬:১২৮

এখানে উল্লেখ্য যে, তাকওয়া অবলম্বন সাধারণত প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরযে আইন (অবশ্যই করণীয়)। আর এ দ্বীনি কল্যাণ অর্জন অর্থাৎ পরকালীন আযাব হতে মুক্তি লাভের জন্য আল্লাহর করুণা ও দয়ার সত্য প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট। আর ‘ফালাহ ই ইহসান’ অর্থাৎ তরীকতের অনুশীলন আল্লাহ তা'আলার সর্বোচ্চ সান্নিধ্য ও মর্যাদা অর্জনের জন্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু এটা ফালাহ-ই তাকওয়া অর্জনের মতো ফরয নয়। যদি তাই হতো তবে প্রতিযুগে এক লাখ চব্বিশ হাজার আওলিয়া কিরাম ছাড়া বাকী কোটি কোটি মুসলমান, হাজার হাজার উলামা ও নেককার বান্দা, সবাই (আল্লাহ না করুক!) ফরয ছেড়ে দেয়ার দায়ে অভিযুক্ত হতেন। আওলিয়া কিরামও লোকদেরকে এ পথে সার্বজনীন দাওয়াত দেন নি। বরং কোটির মধ্যে কিছু সংখ্যককে এ পথে চালিত করেছেন। আর এ পথের অনেক অনুসন্ধানীকে এব্যাপারে অযোগ্য পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর ফরয হতে বিরত রাখা কি করে সম্ভব? (অতএব তরীকতের অনুশীলন শরীয়তের মতো সার্বজনীনভাবে সকলের উপর ফরয নয়। কারণ,

لاَ یُکَلِّفُ اللّٰهُ نَفسًا إلاَّ وُسعَهَا.

‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কষ্ট দেন না।

لاَ یُکَلِّفُ اللّٰهُ نَفسًا إلاَّ مَآ ءَاتَهَا.

‘আল্লাহ যাকে যে সামর্থ্য দিয়েছে তার চেয়ে গুরুতর বােঝা তিনি তার ওপর চাপান না।
আওয়ারিফুল মা’আরিফ গ্রন্থে আছে যে,

أَمَّا خِرقَةُ التَّبَرُّكِ فَیَطلُبُهَا مِن مَقصُودِهِ التَّبَرُّكُ بِذِی القَومِ وَمِثلُ هَذَا لاَیُطَالِبُ بِشَرَاٸِطِ الصَّحَّةِ بَل یُوصِي بِلُزُومِ حُدُودِ الشَّرعِ وَمُخَالَطَةِ هَذَا الطَّاٸِفَةِ لَتَعُودُ عَلَیهِ بَرکَتِهِم وَیَتَأَدَّبُ بِأَدَابِهِم فَسَوفَ یُرقِیهِ ذَلِكَ إِلَي الأَهلِیَّةِ الخِرقَةِ الإِرَادَةِ فَعَلَي هَذِهِ خِرقَةُ التَّبَرُّكِ مَبذُولَةُُ لِکُلِّ طَالِبٍ وَخِرقَةُ الإِرَادَةِ مَمنُوعَةُ إِلاَّ مِن الصَّادِقِ الرَّاغِبِ.

১. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:২৮৬

২. আল-কুরআন, সুরা আত-তালাক, ৬৫:৭

‘খিরকায়ে তাবাররুক দ্বারা শুধু বরকত লাভের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এ প্রকার খিরকা লাভের ইচ্ছুক ব্যক্তি থেকে সান্নিধ্য লাভের শর্তাদি চাওয়া হবে না (অথাৎ খিরকায়ে ইরাদতের জন্য যে সব শর্ত প্রয়োজন তা চাওয়া হবে না বরং এটুকু বলা হবে, শরীয়তের বিধান মেনে চল এবং আল্লাহর ওলীদের সাহচর্য গ্রহণ কর। হয়ত এটার বরকতে তাকে খিরকায়ে ইরাদতের উপযুক্ত করে দেবেন। এ কারণেই খিরকায়ে তাবাররুক প্রত্যেক অনুসন্ধানকারীর জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু খিরকায়ে ইরাদত শুধু সত্যপন্থি নিষ্ঠাবান ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট।

সুতরাং খিরকা-ই তাবাররুক প্রত্যেককে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু ‘খিরাক-ই ইরাদত' তাকেই দেয়া হবে, যে এটার উপযুক্ত। অনুপযুক্ত হতে এ পথের শর্তাদি চাওয়া হবে না। বরং তাকে এটুকু বলবে যে, শরীয়ত মেনে চল আর আওলিয়াদের সান্নিধ্য গ্রহণ কর। হয়ত এটার বরকতে ঐ খিরকা-ই ইরাদতের উপযুক্ত করে দেবে।  অতএব এ কথা সুস্পষ্ট হলো যে, এটা (বায়'আত) পরিহার করার দরুণ দ্বীনি কল্যাণ (ফালাহ) অর্জনে না বাধা সৃষ্টি করে, না এতে তার পীর শয়তান হয়। পূর্ববর্তী অনেক বড় বড় আলেম ও ইমাম এমনও দেখা যায় যাদের হাতে এ প্রকার (তরীকতের) বায়’আত ছিল বলে কোন প্রমাণ নেই আর ইমামতের মর্যাদা অর্জনের পর শেষ বয়সে এমন বায়আতের প্রমাণ থাকলেও তাও ছিল বায়আত-ই বরকত (বায়আত-ই ইরাদত নয়)। যেমন ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী সায়্যিদ শায়খ মাদয়ান কুদ্দিসা সিররুহুর হতে বায়'আত-ই বরকত লাভ করেন।

হাঁ! তবে যে এটাকে অস্বীকার করত: বা বাতিল ও অনর্থ মনে করে ছেড়ে দেবে, সে অবশ্যই গোমরাহ ও দ্বীন কল্যাণ (ফালাহ) হতে বঞ্চিত এবং শয়তানের মুরিদ।

আর কেউ যদি স্বীয় যুগে ও নিজ শহরে কাউকে বায়আতের জন্য যথেষ্ট ও উপযুক্ত মনে না করে তা হতে বিমুখ হয়, তবে উদ্দেশ্য ভেদে হুকুম ভিন্ন হবে। যদি এটা নিজ অহংকারবশতঃ হয়, তবে।

أَلَیسَ فِي جَهَنَّمَ مَثوًی لِّلمُتَکَبِّرِینَ.

‘জাহান্নাম কি গর্বকারীদের ঠিকানা নয়।
আর যদি শরয়ী কোন কারণ ছাড়া নিজ কুধারণার বশীভূত হয়ে সকলকে অযোগ্য মনে করে তবে এটাও কবিরাহ গুনাহ্। আর কাবীরা গুনাহকারী সফলকাম নয়।

১. সোহরাওয়ারদী, আওয়ারিফুল মা'আরিফ, الباب الثاني عشرة, পৃ. ৮০, মতবা'আতুল মাশহাদ আল-হুসাইনী
২. আল-কুরআন, সুরা আয-যুমার, ৩৯:৬০

আর যদি তার (পীরের) মধ্যে এমন কিছু দেখা যায় যা সন্দেহে পতিত করে আর সে সাবধানতার খাতিরে (বায়'আত হতে) বিরত থাকে, তবে কোন আপত্তি নেই। কারণ,

إِنَّ مِنَ الحَزمِ سُوءِ الظَّنِّ دَع مَا یَرِیبُك إِلَي مَا لاَ یَرِیبُك.

“নিশ্চয় সাবধানতা হলো, মন্দ দিক হতে বাচার জন্য এ চিন্তা করা যে, যে কথায় সন্দেহ হয়, তা ছেড়ে দিয়ে ওটাই গ্রহণ করা যা সন্দেহাতীত।

বায়আতে বরকতের ফযীলতঃ

ফালাহ-ই ইহসান(فلاح احسان)-এর জন্য মুরশিদে খাসের প্রয়োজন

ফালাহ-ই ইহসান লাভের জন্য অবশ্যই মুরশিদ-ই খাসের প্রয়োজন। আর তাও শায়খ-ই ইসাল; শায়খ-ই ইত্তিসাল এ জন্য যথেষ্ট নয়। আর তার হাতে বায়’আত-ই ইরাদতই হতে হবে, বায়'আত-ই বরকত’ এখানে যথেষ্ট নয়। তরীকতের এ পথ পরিক্রমায় এমন কতেক সূক্ষ্ম ও দুর্গম পথ রয়েছে, যতক্ষণ এ পথের উঁচু-নীচু সব কিছু সম্পর্কে অবগত কামিল ও অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শক পথ দেখিয়ে না দেবে ততক্ষণ এ পথ দিয়ে পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। তরীকত বিষয়ক গ্রন্থাদি অধ্যয়ন এবং ওই মতে অনুশীলন এখানে কোন কাজ দেবে না। কারণ, এটা ফালাহ-ই তাকওয়ার রহস্য ও সূক্ষ্মতার মতো সীমাবদ্ধ ও সল্পসংখ্য নয়, যা তাসাউফগ্রন্থ ধারণ করতে পারে। তাই বলা হয়

اَلطُرقُ إِلَي اللّٰهِ بِعَدَدِ أَنفَاسِ الخَلاَٸِقِ.‘সৃষ্টি জগতের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমপরিমাণ আল্লাহর পথ রয়েছে।'
হুযুর সায়্যিদুনা গাউসূল আযম রাদ্বিয়াল্লাহ তা'আলা আনহু বলেন

إِنَّ اللّٰهَ لاَ یَتَجَلِّي لِعَبدٍ فِي صِفَتَینِ وَلاَ فِي صِفَةٍ لِعَبدَینِ.

‘আল্লাহ তা'আলা একজন বান্দার প্রতি না দু’গুণের প্রকাশ করেন, না এক গুণ দু’বান্দার (প্রতি প্রকাশ করেন)।
তাই আল্লাহর একান্ত নৈকট্যলাভের যে অগণিত পথ রয়েছে এই প্রত্যেক পথের দুর্গমতা, সূক্ষ্মতা ও অবতরণ স্থল ভিন্ন ভিন্ন, যা না নিজে বুঝতে পারবে, না তাসাউফ গ্রন্থ বলে দেবে। সে সাথে ঐ পুরাতন শত্রু, প্রতারক, অভিশপ্ত ইবলীস তো সর্বদা লেগে আছে। যদি বলে দেয়া চক্ষু, উন্মুক্ত হাত, পাকড়াওকারী ও সাহায্যকারী সাথে না থাকে, তবে আল্লাহ ভাল জানেন কোন গর্তে পতিত করে, কোন ঘাটে ধ্বংস করে বসে। তখন সূলুক (সাধনা) তো দুরে (আল্লাহ না করুক!) ঈমান পর্যন্ত হাত ছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা
১. শাহনুফী, বাহজাতুল আসরার,

فصول من کلامه مرضعا بشيء من عجانب أحواله, পৃ. ৮২, মোস্তাফা আল-বাবী, মিশর।
রয়েছে। যেমন অনেক তরীকতপন্থীদের বেলায় এ রকম ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। হুযুর সায়্যিদুনা গাউসূল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ইবলীসের প্রতারণাকে প্রতিহত করা এবং তাকে এ বলা যে, হে আবদুল কাদের! তোমাকে তোমার ইলম রক্ষা করেছে, অন্যথায় এ প্রতারণা দ্বারা আমি সত্তরজন তরীকতপন্থীকে ধ্বংস করেছি।' (তরীকতের পথে শয়তানের এ ধরনের প্রতারণার কথা সবার জানা বিষয়)।

এখানে জেনে রাখা উচিত যে, (তরীকতপন্থী এরূপ পদচ্যুত হওয়া) কখনো এটা মুরশিদে আমের দুর্বলতার কারণে নয়, বরং এটা সালিক এর দুর্বলতা। মুরশিদে আমের মাঝে সবকিছু বিদ্যমান । যেমন, ইরশাদ হচ্ছে,

مَا فَرَّطنَا فِي الکِتَابِ مِن شَیءٍআমি এ কিতাবের মধ্যে কোন কিছু লিপিবদ্ধ করতে ত্রুটি করিনি।
কিন্তু বাহ্যিক বিধানাবলী (আহকাম-ই যাহির) সাধারণ লোক বুঝতে পারে না। ফলে সাধারণের-লোক আলিমগণের প্রতি, আলিমগণ ইমামদের প্রতি আর ইমামগণ রসূলের প্রতি ধাবিত (রুজু) হওয়া ফরয । ইরশাদ হচ্ছে,

فَسٸَلُوا أَهلَ الذِّکرِ إِن کُنتُم لاَ تَعلَمُونَ.

‘সুতরাং হে লোকরা! জ্ঞানবানদেরকে জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমাদের জ্ঞান না থাকে।

এ বিধান মুরশিদে আমের ব্যাপারে যেমন প্রযোজ্য তেমনি এখানে ‘আহলে যিকর দ্বারা ঐ মুরশিদে খাসকেও বুঝানো হয়েছে, যার মধ্যে সবগুলো গুণাবলী বিদ্যমান।

অতএব যে ব্যক্তি এ (ফালাহ-ই ইহসান অর্জনের) পথে কদম রাখলো আর ১. কাউকে পীর ধররো না,
২. কোন বিদআতী,
৩. কোন এমন মূর্খপীরের মুরিদ হলো যে পীর ইত্তিসাল নয়,
৪. আবার এমন পীরের মুরিদ যিনি শুধু পীর-ই ইত্তেসাল কিন্তু ইসাল (খোদা পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়া) এর উপযুক্ত নয় আর তার উপর নির্ভর করে এ পথে পাড়ি দিতে চাইলো বা
৫. শায়খ-ই ইসালের মুরিদ কিন্তু নিজের ইচ্ছা মতো চলে, পীরের বিধানের উপর চলে না-তবে এ সব লোক এ ‘ফালাহ-ই ইহসান' লাভ করতে পারে না। ফলে এ পথে অবশ্যই তার পীর শয়তান হবে—এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, হয়ত
১, এ ঘটনা বাহজাতুল আসরারসহ প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত ইমামদের গ্রন্থে উল্লেখ আছে।
২. আল-কুরআন, সুরা আল-আন'আম, ৬:৩৮
৩. আল-কুরআন, সুরা আন-নাহল, ১৬:৪৩
তাকে মূল ফালাহ অর্থাৎ ঈমান হতেও দূরে নিক্ষেপ করতে পারে । (আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি।)
বরং এ প্রকার লোকদের সাথে শয়তান না থাকাটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। এটা মনে কারো না যে, এ ভুলের দরুণ হয়ত এ পথে প্রতারণার শিকার হবে, এটা (তরীকতের অনুশীলন) তো ফরয নয়, যা না পাওয়াতে মূল ফালাহ (ঈমান)ও থাকবে না। অবশ্যই এ ধারণা ঠিক নয়, কারণ অভিশপ্ত শয়তান তো ঈমানের শত্রু, সে সর্বদা ঈমান হরণ করার সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সে এমন কারিশমা দেখায় যা দ্বারা ঈমান ও আকীদায় বিচ্যুতি সৃষ্টি হয়। যদি কোন লোক একটি কথা শুনলো, আর এখন স্বচক্ষে দেখলো তার বিপরীত, তবে কতো কঠিন যে নিজের চাক্ষুস দেখাকে ভুল মনে করা আর এ বিশ্বাসে অটল থাকা। অথচ শুনা কথা দেখার মত নয়। তাই পীর-ই কামিলের উচিৎ, তরীকতের পথ পরিক্রমায় এরূপ সন্দেহ জনিত বিষয়গুলোর কশফ (স্বরূপ উদঘাটন) করানো। যেমন, ইমাম কোশাইরী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তাঁর রিসালাতে বলেন,

إِعلَم أَنَّ فِي هَذِهِ الحَالَةِ فَلَمَّا یَخلُو المُرِیدُ فِي أَوَانِ خُلُوَّتِهِ فِي ابتِدَاءِ إِرَادَتِهِ مِنَ الوَسوَسِ فِي الإِعتِقَادِ.

‘বায়আত-ই ইরাদতের প্রারম্ভে, খিলুয়াত (নির্জন সাধনা কালে) এমন কম মুরিদই রয়েছে যে, তখন তার আকীদায় কুমন্ত্রণা আসে না।”
তাই বেশির ভাগ লোক পীর ছাড়া এ পথে চলতে গিয়ে এ সব বিপদের জালে আটকা পড়ে আর নেকড়ে শয়তান তাকে রাখালহীন ভেড়া পেয়ে গ্রাস করে নেয়। যদিও লাখের মধ্যে একজন এমন পাওয়া সম্ভব যে, যাকে খোদায়ী আকর্ষণে টেনে পীরের মধ্যস্থতা ছাড়া নফস ও শয়তানের প্রতারণা থেকে রক্ষা করেন। তার জন্য মুরশিদে আ’ম, মুরশিদে খাসের কাজ দেয়। আর তখন স্বয়ং হুযুর (ﷺ) তার মুরশিদে খাস হবে। কারণ নবীর মধ্যস্থতা ব্যতিরেখে কোন উপায়ে খোদা পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয়। তবে এটা এমন দুর্লভ বিষয়, যা দ্বারা কোন বিধান বর্তায় না।

আর বিশেষভাবে মুরশিদ ছাড়া এ পথের পথিকদের মধ্যে সে লােকই বড়ো ভাগ্যবান, যে সর্বদা রিয়াযত ও মুজাহিদায় রত আছে আর এতে যদিও সফলকাম না হয়। আর এ পথে পথ উন্মুক্ত না হওয়াতে তেমন বিপদও আসে না, তবুও সে স্বীয় ‘ফালাহ-ই তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে দু’টি শর্তের ভিত্তিতে।

১. কুশায়রী, আর-রিসালা, অধ্যায় : الوصیة للمریدین পৃ. ১৮২, মোস্তাফা আলবাবী, মিসর

এক. যদি তার মুজাহিদা তাকে অহংকারী করে না তুলে এবং নিজেকে অন্যের থেকে উত্তম মনে না করে। অন্যথায় ‘ফালাহ-ই তাকওয়া' হতে হাত ধুয়ে বসবে।

দুই. তার এ কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার পরও বঞ্চিত হওয়া তাকে যেন কোন বড় অবাঞ্চিত বিষয়ে পতিত না করে। যদি বঞ্চিত হওয়ার দুঃখে এতে এমন কোন কটুবাক্য বলে বসে, বা মনে মনে অস্বীকার করে বসে তখন তো দ্বীনি কল্যাণ (ফালাহ) লাভ করা তো দূরে, বরং তখন তার পীর শয়তান হবে। আর যদি এটা নিজের ক্রটি মনে করে আর বিনয় ও নম্রতায় অটুট থাকে তবে এ হুকুম হতে নিষ্কৃতি পাবে। সে যখন পথ পায়নি তবে পথ দিয়ে চলেই নি। আর এটা এরূপ হলো যে, শুধু ফালাহ-ই তাকওয়ার উপরই চললো।

আয়াতে ওসীলার গূঢ়রহস্য

পবিত্র কুরআন-ই করিম অশেষ রহস্যেঘেরা । আল্লাহ তাআলা বলেন,

یَٓأَیُّهَا الَّذِینَ ءَامَنُوا التَّقُوا اللّٰهَ وَاُبتَغُوا إِلَیهِ الوَسِیلَةَ وَجَٓهِدُوا فِي سَبِیلِهِ ؑ لَعَلَّکُم تُفلِحُون

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর (তাকওয়ার পথ অবলম্বন কর) আল্লাহর পথে পাড়ি দিতে ওসিলা (মাধ্যম) অন্বেষণ কর। আর তার পথে সংগ্রাম (মুজাহিদা) কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।”
এ দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা এ আয়াতে করীমার পবিত্র বাক্যগুলো খুব সুন্দর নিয়মে বিন্যস্ত ও স্পষ্ট হলো যে, এ আয়াত ‘ফালাহ-ই ইহসান অর্জনের প্রতি সকলকে আহ্বান করা হয়েছে। আর এ জন্য তাকওয়া শর্ত। তাই প্রথমে নির্দেশ করা হয়েছে যে, আল্লাহকে ভয় করো অর্থাৎ প্রথমে তাকওয়ার পথ অবলম্বন কর। তাকওয়া অর্জন করে এখন যদি ইহসান এর পথে কদম রাখতে চাও, তবে জেনে নাও যে, (ইহসানের পথ অবলম্বন) শায়খ বা পীরের মাধ্যম ছাড়া অসম্ভব। তাই দ্বিতীয়বার তরীকতের পথে পা রাখার পূর্বে ওলিসা (পীর) তালাশ করাকে অগ্রগামী করা হয়। এরশাদ হচ্ছে, 'তোমরা ওসিলা তালাশ কর । তাই প্রবাদ আছে, প্রথমে সাথী তালাশ কর তারপর রাস্তা ধর’ (الرفیق ثم الطریق)। আর যখন পাথেয় যোগাড় হয়ে গেলো, আসল উদ্দেশ্যের প্রতি নির্দেশ হলো যে, তাঁর পথে বাজি রেখে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও অর্থাৎ মুজাহিদা করো যাতে ‘ফালাহ-ই ইহসান’ অর্জন হয় ।

১. আল-কুরআন, সুরা আল-মায়েদা, ৫:৩৫
আল্লাহ আমাদেরকে সফলকামদের মধ্যে যেন গণ্য করেন, ঐ রহমতের করুণা দ্বারা যা সফলকামদের প্রতি করা হয়েছে। নিশ্চয় তিনি বড়ো দয়াবান ও করুণাময়। আর আল্লাহ, দরূদ সালাম অবতীর্ণ করুক তার প্রতি যার সদকায় প্রত্যেক কল্যাণ ও উপকার হয়। তাঁর পরিজন ও সাহাবী, তাঁর সন্তান হুযূর গাউসূল আযম এবং তার সমস্ত দলভুক্তদের প্রতি রহমত অবতীর্ণ হোক। আমীন।

রব তা'আলা বলেন,

أَلآَ إِنَّ حِزبَ الشَّیطَنِ هُمُ الخَسِرُونَ.

শুনে নাও! শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত।

أَلآَ إِنَّ حِزبَ اللّٰهِ هُمُ المُفلِحُونَ.

‘আর শুনে নাও! আল্লাহরই দল সফলকাম।'
আর দ্বিতীয় উক্তিও সাব্যস্থ হলো যে, যার পীর নেই তার পীর শয়তান যার বর্ণনা পূর্বে করা হয়েছে।


__________________

Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা