দাফনের পূর্বাপর ও বালাকোটে কাল্পনিক কবর
দাফনের পূর্বাপর ও বালাকোটে কাল্পনিক কবর
মুফতী মুহাম্মদ গোলাম ছামদানী রেজবী
খাঁপুর (বেরেলী মহল্লা), প্রোঃ কালিকাপোতা দক্ষিণ ২৪ পরগনা ৭৪৩৩৫৫ শিক্ষক, ছয়ঘরী আলিয়া মাদ্রাসা প্রোঃ ছয়ঘরী, মুর্শিদাবাদ—৭৪২১০১
টেক্সট রেডীঃ মুহাম্মদ আব্দুল খালেক
একটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা
সমস্ত আজান মসজিদের বাহিরে দেওয়া সুন্নাত। কোন আজান মসজিদের ভিতরে দেওয়া জায়েজ নয়। মুখে হউক অথবা মাইকে হউক, খুতবার আজান হউক অথবা নামাজের আজান হউক মসজিদের ভিতর দেওয়া মাকরুহ তাহরিমী। অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ও একাংশ আলেম শয়তানের প্ররোচনায় আবু জাহেলের ন্যায় দৃঢ় হইয়া সুন্নাতের বিপরীত করতঃ খুতবার আজান তথা নামাজের আজান পর্যন্ত মসজিদের ভিতর দেওয়া আরম্ভ করিয়াছে। এই প্রকার আলেমদের অনুস্বরন করিয়া চলা হারাম।
একটি গুরুত্বপূর্ণ ফতওয়া
উলামায়ে আহলে সুন্নাত কোরআন ও হাদীসের আলোকে ফতওয়া প্রদান করিয়াছেন যে, ওহাবী, দেওবন্দী তাবলিগী ও জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি গোমরাহ ফিরকার পশ্চাতে নামাজ পড়া হারাম। ভুল বশতঃ পড়িয়া ফেলিলে পুনঃরায় আদায় করা জরুরী। অন্যথায় ফরজ ত্যাগের গোনাহ হইবে। অনুরূপ ওহাবী দেওবন্দীদের মাদ্রাসায় অথবা জামায়াতে ইসলামের কোন তহবিলে সাহায্য করা হারাম। রাকাত,উশুর, ফিৎরা ও কুরবাণীর পয়সা উহাদের দান করিলে যাকাত ও ফিৎরা ইত্যাদি আদায় হইবে না।
একটি ঘোষণা
'তাম্বীহুল আওয়াম'
নামক বিজ্ঞাপনের সহিত আমার কোন প্রকার সম্পর্ক নাই।
—:পূর্বাভাষ:—
গত ২৮-৩-৯৩ সালে জেলা মেদিনীপুর, মহিষাদল থানার অন্তর্গত কাজীচকের জালসায় উপস্থিত হইয়াছিলাম। সেখানে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়া আলোচনা কালে জনৈক ব্যক্তি দাফনের পর কবরের নিকট আজান দেওয়া জায়েজ কিনা, জানিতে চাহিয়া ছিলেন। উক্ত জালসায় আমার পরম শ্রদ্ধেয় পীরে তরীক্বত হজরত মাওলানা কুতবুদ্দীন আখতার আল ক্বাদেরী সাহেব কিবলা দাফনের পর আজান সম্পর্কে ইমাম আহমদ রেজা আলাইহির রাহমাতের লিখিত 'ইজানুল আজার ফি আজানিল কবর' নামক পুস্তিকাটি অনুবাদ করিবার জন্য আমাকে জোরালোভাবে পরামর্শ দিয়াছিলেন। এবং তিনি উহার উহার প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করিবার আশ্বাসও দিয়াছিলেন। আমি ইহাতে সম্মত হইয়া শীঘ্র পাণ্ডুলিপি পাঠাইবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলাম। পরে বিভিন্ন প্রকার চিন্তা করিয়া সিদ্ধান্ত নিলাম যে, কেবল কবরের আজান সম্পর্কে পুস্তিকাটি অনুবাদ না করিয়া দাফনের পূর্বাপর বিভিন্ন জরুরী মসলা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে একটি পুস্তক প্রণয়ন করিব। যাহাতে সাধারণ মানুষ বেশি উপকৃত হইবেন। তাই আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় অবসর বুঝিয়া হুজুর﴾ﷺ﴿এর প্রতি দরুদ-সালাম পাঠ করিবার পর কলম ধরিলাম। ইনশা আল্লাহ আগামী কাল হইতে পুস্তক লেখা আরম্ভ করিব।
ইতি—মুহাম্মদ গোলাম ছামদানী রেজবী ২৩/৪/৯৩
মুমূর্ষু ব্যক্তি
মানুষ যখন মৃত্যু মুখি হইবে। তখন তাহাকে ডাহিন কাত করিয়া কিবলার দিকে মুখ করিয়া শোয়ানো সুন্নাত। কিবলার দিকে পা করিয়া চিৎ করিয়া শোয়ানোও জায়েজ। কিন্তু এই অবস্থায় মাথার দিকটা সামান্য উঁচু করিয়া রাখিবে। যদি ইহাতে কষ্ট হয়, তাহা হইলে যে কোন অবস্থায় রাখা যাইবে। (শামীর সহিত দুর্রে মুখতার খঃ২ পৃঃ১৮৯, আলামগিরী খঃ ১ পৃঃ ১৪৭, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৩০)—হুজুর﴾ﷺ﴿বলিয়াছেন তোমাদের মূর্দাগণকে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' শিক্ষা দাও। (মিশকাত পৃঃ ১৪০) এখানে 'মুর্দা' বলিতে মরণাপন্ন ব্যক্তিকে বলা হইয়াছে। অধিকাংশ উলামাগণ মুমূর্ষু ব্যক্তিকে কালেমা ধীক্ষা দেওয়া মুস্তাহাব বলিয়াছেন। (মিরাতুল মানাজীহ খঃ ২ পৃঃ ৪৪৪) মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট উচ্চস্বরে 'আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অ আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ' পাঠ করিবে। কিন্তু উহাকে পাঠ করিতে আদেশ করিবেনা। (বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ১৩০) ইমাম আহমদ রেজা আলাইহির রাহমাত অসীয়ত করিয়াছিলেন যে, আমার ইন্তেকালের সময় ঘর হইতে অপবিত্র মানুষ, কুকুর, প্রাণীর ফটো অর্থাৎ টাকা পয়সা ইত্যাদি বাহির করিয়া ফেলিবে। (অসায়া শরীফ পৃঃ ২১) যখন প্রাণ বাহির হইয়া যাইবে। তখন চক্ষু বন্ধ করিয়া দিবে এবং হাত, পা ও আঙ্গুলগুলি সোজা করিয়া দিবে। চক্ষু বন্ধ করিবার সময় বিসমিল্লাহি অ আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহি আল্লাহুম্মা ইয়াসসির আলাইহি আমরাহু অ সাহহিল আলাইহি মাবা'দাহু অ আসইদ লিকাইকা অজয়াল মা খারাজা ইলাইহি খইরম্ মিন্না খরাজা আনহু' পাঠ করিবে। (শামীর সহিত দুর্রে মুখতার খঃ ১ পৃঃ ১৯৩. বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৩১) মূর্দা ঋণী হইলে অতি শীঘ্র ঋণ পরিশোধ করিয়া দিবে। হুজুর﴾ﷺ﴿ঋণী ব্যক্তির জানাজা পড়েন নাই। (মিশকাত পৃঃ ১৫৩) মৃত ব্যক্তির সম্পূর্ণ দেহ কাপড়ে ঢাকা থাকিলে উহার নিকট কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করা জায়েজ। (শামী খঃ ২ পৃঃ ১৯৩, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৩২)
মুর্দার গোসলের বিবরণ
মুর্দার গোসল দেওয়া ফরজে কিফায়া। কিছু মানুষ গোসল দিলে সবার দায়িত্ব পালন হইয়া যাইবে। (আলামগিরী খঃ ১ পৃঃ ১৪৭, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৩১) গোসল দেওয়ার নিয়ম ইহাই যে, যে তখতার উপর গোসল দিবে, প্রথম উহাতে তিনবার পাঁচবার অথবা সাতবার ধুনা দিবে। তারপর উহার উপর মূর্দাকে শোয়াইয়া নাভী হইতে হাঁটু পর্যন্ত কোন পবিত্র কাপড় দ্বারা ঢাকিয়া দিবে। ইহার পর গোসল দাতা নিজের হাতে কাপড় জড়াইয়া প্রথমে ইস্তেঞ্জা করাইবে। তারপর নামাজের ন্যায় অজু করাইবে। কিন্তু মুর্দার অজুতে প্রথমে কবজী পর্যন্ত হাত ধোয়া, কুল্লি করা ও নাকে পানি দিতে হইবে না। তবে কোন কাপড় ভিজাইয়া দাঁত,মাড়ী ও নাসিকার উপর বুলাইবে। তারপর মাথা ও দাঁড়ির চুল থাকিলে পাক সাবান দ্বারা ধুইবে। অন্যথায় সাদা পানি যথেষ্ট হইবে। ইহার পর বাম কাত করিয়া মাথা হইতে পা পর্যন্ত কুল পাতার গরম পানি বহাইয়া দিবে। যাহাতে তখতা পর্যন্ত পানি পৌঁছাইয়া যায়, তারপর ডান কাত করিয়া এই প্রকারে পানি বহাইয়া দিবে। যদি কুল পাতার গরম পানি না পাওয়া যায় তাহা হইলে সাদা সামান্য গরম পানি যথেষ্ট হইবে। তারপর হেলান দিয়া বসাইবে এবং খুব আস্তে পেটে হাত বুলাইবে। যদি কিছু বাহির হয়, তাহা ধুইয়া ফেলিবে। পুনরায় গোসল দেওয়ার প্রয়োজন নাই। তারপর শেষে মাথা হইতে পা পর্যন্ত কর্পুরের পানি বহাইয়া দিবে। ইহার পর উহার শরীর কোন পবিত্র কাপড় দ্বারা আস্তে আস্তে মুছিয়া দিবে। (আলাম গিরী খঃ ১ পৃঃ ১৪৯,জান্নাতী জেওর পৃঃ ৩৩৯/৩৪০)
মুর্দার দাড়ি অথবা মাথার চুলে চিরুনী করা অথবা নখ কাটিয়া দেওয়া অথবা কোন স্থানের চুল কাটিয়া দেওয়া মাকরুহ তাহরিমী। (রদ্দুল মুহতার খঃ ২ পৃঃ ১৯৮, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৩৮) মূর্দার দুই হাত দুই পাশে রাখিয়া দিবে। সিনার উপর রাখিবেনা / ইহা কাফিরদিগের তরীকা।(রদ্দুল মুহতারের সহিত দুর্রে মুখতার খঃ ২পৃঃ ১৯৮, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৩৮)
কাফনের বিবরণ
মূর্দাকে কাফন দেওয়া ফরজে কিফায়া। পুরুষের জন্য তিনটি কাপড় সুন্নাত। যথা চাদর, তহবন্দ ও কুরতা। কিন্তু তহবন্দ মাথা হইতে পা পর্যন্ত লম্বা হইতে হইবে। স্ত্রী লোকের জন্য পাঁচটি কাপড় সুন্নাত। চাদর, তহবন্দ,কুর্তা উড়নী ও সিনাবন্দ (আলমগিরী খঃ ১ পৃঃ ১৫০) একদিনের শিশুকেও পূর্ণ কাফন দেওয়া উত্তম। (রদ্দুল মুহতার খঃ ২ পৃঃ ২০৪) যদি মুর্দার কাফন চুরি হইয়া যায় এবং মূর্দা তাজা থাকে, তাহা হইলে পুনরায় কাফন দিবে। বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৪২)
কাফন পরাইবার নিয়মঃ— কাফনে তিনবার, পাঁচবার অথবা সাতবার ধুনা দিয়া প্রথমে চাদর বিছাইবে। তারপর উহার উপর তহবন্দ, তারপর কুর্তা বিছাইবে। ইহার পর মুর্দাকে শোয়াবে এবং কুর্তা পরাইবে। এইবার দাড়ি এবং সমস্ত শরীরে খোশবু লাগাইবে এবং সাজদার স্থানগুলিতে অর্থাৎ মাথা, নাক, দুইহাত, হাঁটু ও পায়ে কর্পুর দিবে। ইহার পর তহবন্দ জড়াইবে। তহবন্দ জড়াইবে। প্রথমে বাম দিকে তারপর ডান দিক। ইহার পর চাদর জড়াইবে। প্রথমে বাম দিক তারপর ডান দিক। তারপর মাথা ও পায়ের দিকে বাঁধিয়া দিবে। যাহাতে উড়িয়া ও খুলিয়া না যায়। স্ত্রীলোকের কাফন অর্থাৎ কুর্তা পরাইয়া উহার চুল দুইভাগ করিয়া কাফনের উপর সিনাতে রাখিয়া দিবে। উড়ানী অর্ধ পিঠের নিচে হইতে বিছাইয়া মাথার উপর আনিয়া মুখের উপর পর্দার ন্যায় ফেলিয়া দিবে যাহাতে উহার লম্বাই অর্ধ পিঠ হইতে সিনা পর্যন্ত এবং চওড়াই এক কানের লতি হইতে দ্বিতীয় কানের লতি পর্যন্ত থাকে। (আলামগিরী খঃ ১ পৃঃ ১৫১)।
জানাজা লইয়া যাইবার বিবরণ
চারজন মানুষ জানাজা উঠাইয়া পরস্পর চারটি পায়াতে কাঁধ দেওয়া সুন্নাত। প্রত্যেকবার দশ কদম করিয়া হাঁটিবে। পূর্ণ সুন্নাত ইহাই যে, প্রথমে সামনের ডান দিকে। তারপর পিছনের ডান দিকে। ইহার পর সামনের বাম দিকে। তারপর পিছনের বাম দিকে। প্রত্যেক বারে দশ কদম হাঁটিবে। মোট চল্লিশ কদম হইবে। হাদীস পাকে আছে— যে ব্যক্তি জানাজা চল্লিশ কদম লইয়া যাইবে। তাহার চল্লিশটি কবীরাহ গোনাহ ক্ষমা হইয়া যাইবে। (শামী খঃ ২ পৃঃ ২৩১) জানাজা লইয়া যাইবার সময় মাথার দিকটি সামনে থাকিবে। জানাজার সহিত স্ত্রীলোকের যাওয়া নাজায়েজ। জানাজার সামনে, ডান দিকে ও বাম দিকে যাওয়া মাকরুহ। (আলামগিরী খঃ ১ পৃঃ ১৫২)
জানাজার সঙ্গে আগুন লইয়া যাওয়া নিষেধ (১) (বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৪৪)
------------------------------------------------------------(১) এখানে আগুন বলিতে অগরবাতি, ধুপ ধুনা ইত্যাদি
--------------------------------------------------
জানাজার নামাজের বিবরণ
জানাজার নামাজ ফরজে কিফাইয়া। কোন এক ব্যক্তি পড়িলে সকলের দায়িত্ব পালন হইয়া যাইবে। অন্যথায় যে ব্যক্তি সংবাদ পাইয়া পড়ে নাই, সে গোনাহগার হইয়া যাইবে। যে ব্যক্তি উহার ফরজ হওয়া অস্বীকার করিবে সে কাফের হইয়া যাইবে।(শামীর সহিত দুর্রে মুখতার খঃ ২ পৃঃ ২০৭, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৪৫) জানাজার নামাজের জন্য জামায়াত শর্ত নয়। এক ব্যক্তি পড়িলে ফরজ আদায় হইয়া যাইবে। (আলাম গিরী খঃ ১ পৃঃ ১৫২) কয়েক শ্রেণীর মানুষের জানাজার নামাজ পড়া নাজায়েজ। যথা (১) পিতা মাতার মধ্যে কোন এক জনের হত্যাকারী (২) ডাকাত, যদি ঘটনাস্থলে মরিয়া যায়। (৩) যে ব্যক্তি কয়েকজন মানুষকে গলা টিপিয়া হত্যা করিয়াছে ইত্যাদি। (শামীর সহিত দুর্রে মুখতার খঃ ২ পৃঃ ২১১/২১২) আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়িতে হইবে।(বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৪৭, জান্নাতী জেওর পৃঃ ৩৪৩) মরা বাচ্চা প্রসব হইলে জানাজা পড়িতে হইবে না।(আলামগিরী খঃ ১ পৃঃ ১৫২)
জানাজার নামাজে চার তাকবীর
হুজুর﴾ﷺ﴿হাবশার বাদশার ইন্তেকালের সংবাদ দিয়া সাহাবাগণকে সঙ্গে লইয়া ঈদগাহে উপস্থিত হইয়া চার তাকবীরে জানাজার নামাজ সমাপ্ত করিয়াছিলেন (বোখারী খঃ ১ পৃঃ ১৭৭. মোয়াত্তায়ে ইমাম মালিক পৃঃ ৮৫, মোয়াত্তায়ে ইমাম মোহাম্মদ পৃঃ ১৭০, মিশকাত ১৪৪) জানাজার নামাজ চার তাকবীরে সমাপ্ত। ইহাতে চার ইমাম একমত এবং সাহাবায়ে কিরামগণ ইহার উপর ইজমা করিয়াছেন। সুতরাং হজরত উমার আবু বাকার সিদ্দিকের প্রতি হজরত ইবনো উমার হজরত উমারের প্রতি হজরত হাসান ইবনো আলী হজরত আলীর প্রতি ও হজরত ইমাম হোসাইন হজরত ইমাম হাসানের প্রতি চার তাকবীরে জানাজা পড়িয়াছেন। এমন কি ফিরিশতাগণ হজরত আদম আলাইহিস্ সালামের প্রতি চার তাকবীরে জানাজা পড়িয়াছেন। (মিরাতুল মানাজীহ খঃ ২ পৃঃ ৪৬৯) হুজুর﴾ﷺ﴿জীবনের শেষ জানাজা চার তাকবীরে সমাপ্ত করিয়া ছিলেন। (মোসনাদে ইমাম আজম মুতার্জাম পৃঃ ২১০)
জানাজার নামাজ পড়িবার নিয়ম
প্রথমে নিয়াত এই প্রকারে করিবে— আমি জানাজার নামাজের নিয়ত করিয়াছি। চার তাকবীরের সহিত। আল্লাহ তাআলার জন্য, দোয়া এই মাইয়েতের জন্য। আমার মুখ কা'বা শরীফের দিকে (মুক্তাদী আরো এতটুকু বলিবে) এই ইমামের পশ্চাতে। তারপর দুই হাত কান পর্যন্ত উঠাইয়া 'আল্লাহু আকবর' বলিয়া দুই হাত নাভীর নিচে বাঁধিবে। তারপর এই সানা— 'সুবহানাকা আল্লাহুম্মা কবি হামদিকা অ তবারা কাসমুকা অ তাআলা জাদ্দুকা অ জাল্লা সানাউকা অ লাইলাহা গায়রুকা' পাঠ করিবে। ইহার পর হাত না উঠাইয়া 'আল্লাহু আকবর' বলিবে এবং যে কোন দরুদ শরীফ অথবা দরুদে ইব্রাহিমী "আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়েদিনা মোহাম্মদিউ অ আলা আলে সাইয়েদিনা মোহাম্মাদিন কামা সল্লাইতা আলা ইব্রাহিমা আলা আলে সাইয়েদিনা ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা সাইয়েদিনা মোহাম্মাদিউ অ আলা আলে সাইয়েদিনা মোহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা সাইয়েদিনা ইব্রাহীমা অ আলা আলে সাইয়েদিনা ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ" পাঠ করিবে। তারপর হাত না উঠাইয়া "আল্লাহু আকবর' বলিবে এবং মুর্দা বালেগ হইলে এই দোয়া "আল্লাহুম্মা গলি হাইয়েনা আ মাইয়েতিনা অ শাহিদিনা অ গাইবিনা অ সগীরিনা অ কাবীরিনা অ জাকারানা অ উনসানা আল্লাহুম্মা মান আহ ইয়াইতাহু মিন্না ফাআহ ইহি আলাল ইসলাম অ মান তা অফফাইতাহু মিন্না ফাতা আফফাহু আলাল ঈমান" পাঠ করিবে। ইহার পর চতুর্থ তাকবীর বলিবে এবং কোন দোয়া পাঠ না করিয়া হাত খুলিয়া সালাম ফিরাইবে। (১) যদি নাবালেগ সন্তানের জানাজা হয়, তাহা হইলে তৃতীয় তাকবীরের পর এই দোয়া "আল্লাহুম্মাজ আলহু লানা ফারাতাঁ আজয়ালহু লানা আজরাঁও অ জুখরাঁও অজয়ালহু লানা শাফি আউঁ অ মুশাফ ফাআ" পাঠ করিবে। যদি নাবালেগ কন্যার জানাজা হয়, তাহা হইলে এই দোয়া— "আল্লাহুম্মাজ্ আলহা লানা ফারাতাঁও অজ্য়ালহা লানা আজরাঁও অ জুখরাঁও অজয়ালহা লানা শাফি আতাঁও অ মুশাফ ফাআহ" পাঠ করিবে। জানাজার নামাজে তিনটি লাইন করা উত্তম। হাদিস শরিফে আছে,—যাহার জানাজা তিনটি লাইনে পড়া হইয়াছে, তাহার ক্ষমা হইয়া যাইবে।যদি মোট সাত জন ব্যক্তি উপস্থিত থাকে। তাহা হইলে একজন ইমাম হইবে প্রথম লাইনে তিন জন, দ্বিতীয় লাইনে দুইজন, তৃতীয় লাইনে একজন দাঁড়াইবে। (বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৫৪) জানাজার নামাজে শেষ লাইনে সওয়াব বেশি। (শামীর সহিত দুর্রে মুখতার খঃ ২ পৃঃ ২১৪ মাগরিবের নামাজের সময় জানাজা উপস্থিত হইলে, ফরজ ও সুন্নাতের পর জানাজা পড়িবে। অন্য ফরজ নামাজের সময় আসিলে, যদি জামায়াত প্রস্তুত হইয়া যায়, তাহা হইলে ফরজ ও সুন্নাত পড়িয়া জানাজা পড়িবে। ঈদের নামাজের সময়
-----------------------------------------------------
(১) অধিকাংশ মানুষ হাত বাঁধিয়া সালাম ফিরাইয়া থাকে, ইহা ঠিক নয়। সহি মতে হাত খুলিয়া সালাম ফিরাইতে হইবে। (খোলাসাতুল ফাতাওয়া, ফাতাওয়ায় দারুল উলুম দেওবন্দ খঃ ১ পৃঃ ৩৩৭, ফাতাওয়ায় পাসবার্ণ পৃঃ ৭৮, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৫৪, কানুনে শরীয়ত খঃ ১ পৃঃ ১২৭, জান্নাতী জেওর পৃঃ ৩৪৪, নিজামে শরীয়ত পৃঃ ৩৪০, আনওয়ারে শরীয়ত পৃঃ ১১৮)
-------------------------------------------
আসিলে প্রথমে ঈদের নামাজ পড়িবে। তারপর জানাজার নামাজ পড়িবে। তারপর খোতবা পাঠ করিবে। (বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৫৯) বাচ্চা জীবিত অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করিয় মরিয়া গেলে উহার জানাজা পড়িতে হইবে। মৃত অবস্থায় প্রসব হইলে জানাজা পড়িতে হইবে না। কিন্তু উহার নাম রাখিতে হইবে। (শামী খঃ ২ পৃঃ ২২৮) মসজিদে জানাজার নামাজ পড়া মাকরুহ তাহারিমী।
(দুর্রে মুখতার, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৫৮) মাকরুহ সময়ের মধ্যে যদি জানাজা আসিয়া যায়। তাহা হইলে ঐ সময়ে জানাজার নামাজ পড়া নাজায়েজ ও মাকরুহ হইবে না। যদি জানাজা পূর্ব হইতে প্রস্তুত হইয়া থাকে এবং বিনা কারণে বিলম্ব করিয়া মাকরুহ সময়ে নিয়ে আসা হয়, তাহা হইলে ঐ সময়গুলিতে জানাজার নামাজ পড়া মাকরুহ হইবে। (রদ্দুল মুহতার খঃ ১ পৃঃ, বাহারে শরীয়ত খঃ ৩ পৃঃ ২১)
কবরের বিবরণ
কবর দুই প্রকার। লাহাদ ও সিন্দুক। হজরত উরওয়াহ্ বিন জুবাইর রাদী আল্লাহু আনহু হইতে বর্ণিত হইয়াছে,— হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য 'লাহাদ' তৈরী করা হইয়াছিল। এবং হজরত আমির বিন সায়াদ হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, হজরত সায়াদ বিন আবু ওকাস রাদী আল্লাহু আনহু তাঁহার দাফনের জন্য লাহাদ তৈরী করিতে নির্দেশ করিয়াছিলেন। (মিশকাত পৃঃ ১৪৮) অনুরূপ হজরত বুরাইদা রাদী আল্লাহু আনহু হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লামের জন্য লাহাদ তৈরী করা হইয়াছিল। (মোসনাদে ইমাম আজম মুতার্জাম পৃঃ ২১১) হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম বলিয়াছেন, 'লাহাদ' আমাদের জন্য এবং 'সিন্দুক' আহলে কিতাবদের জন্য। (কাঞ্জুদ দাক্বায়েক্ব পৃঃ ৫৩ টীকা নং ৪)—ইমাম আবু হানিফা আলাইহির রহমাতের নিকট 'লাহাদ' সুন্নাত। (আলমগীর খঃ ১ পৃঃ ১৫৫, শামী ২ খঃ ২৩৪ পৃঃ, খাজীখান ১ খঃ পৃঃ, বাহারে শরীয়ত ৪ খঃ ১৬০ পৃঃ) যদি মাটি নরম হয় এবং লাহাদ তৈরী করা সম্ভব না হয়, তাহা হইলে 'সিন্দুক' করায় দোষ নাই। বরং উলামায়ে কিরামগণ মুস্তাহসান বলিয়াছেন। (বাহরুর্রায়েক খঃ ২ পৃঃ ১৯৩) কবরের গভীরতা সম্পর্কে মতভেদ রহিয়াছে। সর্বাধিক সহীহ মতে কমপক্ষে মুর্দার অর্ধ পরিমাণ ও মধ্যম অবস্থায় সীনা পর্যন্ত এবং উত্তম ইহাই যে, মূর্দার সমান গভীর হইবে। (বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৬০) ফাতাওয়ায় আলগিরী ১ খঃ ১৫৫ পৃষ্ঠায় আছে,— মূর্দার অর্ধপরিমাণ গভীর করিতে হইবে। ইহার বেশি গভীর করা উত্তম। (শামীর সহিত দুর্রে মুখতার খঃ ২ পৃঃ)
লাহাদ— কবর সম্পূর্ণ খনন করিবার পর উহার কিবলার দিকে মূর্দা শোয়াইবার মত গর্ত খনন করিতে হইবে। সিন্দুক— কবরের মাঝখানে নহরের ন্যায় একটি গর্ত খনন করিতে হইবে। (আলমগিরী খঃ ১ পৃঃ ১৫৫, শামী খঃ ২ পৃঃ)
দাফনের বিবরণ
অধিকাংশ স্থানে মূর্দাকে চিৎ করিয়া শোয়াইয়া কেবল মুখটি কিবলার দিকে ঘুরাইয়া দিয়া থাকে। ইহা সম্পূর্ণ ভুল ও সুন্নাতের বিপরীত। মুর্দার সম্পূর্ণ দেহ কিবলার দিকে কাইত করিয়া দেওয়া সর্বসম্মতিক্রমে সুন্নাত। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লামের পবিত্র দেহ কবর শরীফে কাইত করিয়া রাখা হইয়াছে। ফতহুল ক্বদীর খঃ ৩ পঋ- ৯৫, ফাতাওয়ায় রেজবীয়া শরীফ খঃ ৪ পৃ, খুতবাতে মহাররম পৃঃ ৫৪, আনওয়ারুল হাদীস পৃঃ ২৩৭, ফাতাওয়ায় রশীদিয়া পৃঃ ২৩০) জনৈক ব্যক্তির দাফনের সময় স্বয়ং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম হজরত আলী রাদী আল্লাহু আনহুকে কাইত্ করিয়া শোয়াইতে আদেশ করিয়াছিলেন। আল্ মো'তাসারুজ জরুরী পৃঃ ৫৪, আনওয়ারুল হাদীস পৃঃ ২৩৭, ফাতাওয়ায় রশীদিয়া পৃঃ ২৩০)
হানাফী মাজহাবের সমস্ত নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলিতে কাইত করিবার কথা বলা হইয়াছে। যথা, কাজীখান খঃ ১ পৃঃ ৯৩, আলমগীর খঃ ১৫৫ রদ্দুল মুহতারের সহিত দুরে মুখতার খঃ ২ পৃঃ ২৩৬, বাহরুর্রায়েক খঃ ২ পৃঃ ১৯৪, কাঞ্জুদ্দাকায়েক পৃঃ ৫৩ টীকা নং ৭ বাদায়ে উস্ সানায়ে খঃ ১ পৃঃ ৩১৯, নুরুল ইজাহ মুতর্জাম ২২৩, হিদায়া ১খঃ পৃঃ ১৫৮ শরহে বেক্বায়া খঃ ১ পৃঃ২১০ টীকা নং ৩, শামী ২ খঃ ১৩৬ পৃঃ। চার মাজহাবের ইমামগণ এই মসলাতে একমত। যথা, শাফেয়ী মাজহাবের অন্যতম কিতাব মিনহাজুত তালেবীন ২৮ পৃষ্ঠায় কাইত করিয়া রাখিতে হইবে বলা হইয়াছে।
উলামায়ে আহলে সুন্নাত বেরেলবীদিগের সহিত দেওবন্দীদের বহু মসলাতে দ্বিমত রহিয়াছে। কিন্তু মুর্দাকে কাইত করিয়া শোয়ানোর ব্যাপারে সবাই একমত। যথা, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেব 'ফাতাওয়ায় রশীদিয়াতে' ২২৯ পৃষ্ঠা হইতে ২৩২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত প্রায় চল্লিশখানা কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়া কাইত করাকে সুন্নাত প্রমাণ করিয়াছেন। অনুরূপ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী সাহেব 'বেহেশতী গাওহার' কিতাবের ৮৯ পৃষ্ঠায় ও 'আগলাতুল আওয়াম' কিতাবের ৭৬ পৃষ্ঠায় কাইত করিবার কথা বলিয়াছেন। মাওলানা মুখতার আলী সাহেব 'আশরাফুল ইজাহ' কিতাবের ২১২ পৃষ্ঠাতে কাইত করিবার কথা বলিয়াছেন। অনুরূপ 'ফাতাওয়ায় দারুল উলুম দেওবন্দ' ২য় খণ্ড ৩৪৩ পৃষ্ঠায় কাইত করিতে বলা হইয়াছে,— উলামায়ে আহলে সুন্নাতের কয়েকখানা প্রামান্য কিতাবের উদ্ধৃতি প্রদান করিতেছি। যথা, ফাতাওয়ায় রেজবীয়া খঃ ৪ পৃঃ—' আল মালজ খঃ ৪ অ ৭৫, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৩০, কানুনে শরীয়ত খঃ ১ পৃঃ ১২৯, নিজামে অশরীয়ত খঃ পৃঃ ৩৪৭, ইমাম আহমাদ রেজা রাদী আল্লাহু আনহু তাহাকে কাইত করিয়া শোয়াইবার জন্য অসীয়ত করিয়াছিলেন। (অসায়া শরীফ পৃঃ ৯)— কয়েকখানা বাংলা পুস্তকের উদ্ধৃতি প্রদান করিতেছি। যথা, মকছোদোল মোমেনিন পৃঃ ১৬৯, ফাতাওয়ায় ছিদ্দিকিয়া খঃ ১ পৃঃ ২০০, মসলা ভাণ্ডার খঃ ৫, পুস্তকখানা হাতে না থাকিবার কারণে পৃষ্ঠা উল্লেখ করা সম্ভব হইলনা। সাপ্তাহিক মোজাদ্দেদ পৃঃ ২, ৭ই জুন সংখ্যা, ১৯৯০ সাল। মাওলানা রুহুল আমীন সাহেব 'খোলাসা' কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়া কাইত করিবার কথা লিখিয়াছেন। 'কাফন দাফনের বিস্তারিত মাসায়েল সম্ভবতঃ পৃষ্ঠা ২০। এক কথায় মুর্দাকে কাইত করিয়া শোয়ানোর ব্যাপারে কাহারো মতভেদ নাই। তবুও কিছু নির্বোধ দেওবন্দী ও ফুরফুরাপন্থী আলেম ইহার বিরোধীতা করিয়া থাকেন। মুর্দাকে কবরে রাখিবার সময় "বিসমিল্লাহি অ আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ" বলিবে। (শরহে বেক্বায়া ১ খঃ ২১০ পৃঃ) অন্য বর্ণনায় আছে "বিসমিল্লাহি অ আলা সুন্নাতি রাসুলিল্লাহ"। (আল আজকার পৃঃ ১৩৬) আরো একটি বর্ণনায় আছে "বিসমিল্লাহি অবিল্লাহি অ আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ"। (মিশকাত পৃঃ ১৪৮) আরো একটি বর্ণনায় 'বিসমিল্লাহ' এর পর 'অফি সআবঈলইল্লআহ' শব্দ আসিয়াছে। (রদ্দুল মুহতার খঃ ২ পৃঃ ২৩৫)
।। মাটি দেওয়ার নিয়ম।
তখতা লাগাইবার পর মাটি দিতে হইবে। মুস্তাহাব ইহাই যে, মাথার দিক দিয়া দুই হাতে তিনবার মাটি দিয়ে। প্রথম বারে 'মিনহা খলাক্বনাকুম' দ্বিতীয় বারে অফিহা নুঈদুকুম' তৃতীয় বারে 'অমিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা' বলিবে। (আল আজকার পৃঃ ১৩৭, মিরাতুল মানাজীহ খঃ ২ পৃঃ ৪৯৪, রদ্দুল মুহতার খঃ ২ পৃঃ ২৩৭) অন্য বর্ণনায় আছে,— প্রথম বারে 'আল্লাহুম্মা জাফিল আর্দা আন জাম্বাইহি' দ্বিতীয় বারে আল্লাহুম্মা তাহ আব্বাস সামায়ী লিরুহিহী' তৃতীয় বারে 'আল্লাহুম্মা জাবিবজহু মিন হুরিল ঈন' বলিবে। মুর্দা স্ত্রী লোক হইলে তৃতীয় বারে 'আল্লাহুম্মা আদখিল হাল জান্নাতা বিরাহ মাতিকা' বলিবে। (রদ্দুল মুহতার খঃ ২ পৃঃ ১৩৭, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৬২)
দাফনের পর মুস্তাহাব
দাফনের পর কবরের মাথার দিকে সূরা বাকারার প্রথমাংশ 'আলিফ লাম মিম' হইতে 'মুফলিহুন' পর্যন্ত এবং কবরের পায়ের দিকে সূরার বাকারার শেষাংশ 'আমিনার রাসুল' হইতে শেষ পর্যন্ত পাঠ করিবে। ইহা মুস্তাহাব। (আল আজকার পৃঃ ১৩৭ মিশকাত পৃঃ ১৪৯) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল বলিয়াছেন,— যখন কবর স্থানে যাইবে। তখন সূরা ফাতিহা, ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস পাঠ করিয়া মুর্দাদিগের জন্য সওয়াবরেসানী করিবে। (মিরাতুল মানাজীহ খঃ ২ পৃঃ ৪৯৮) হজরত উমর বিন আস রাদী আল্লাহু আনহু তাহার পুত্রকে অসীয়ত করিয়াছিলেন যে, একটি উটের বাচ্চা জবাই করিয়া মাংস বিতরণ করিতে যতক্ষণ সময় লাগে, ততক্ষণ সময় তোমরা আমার কবরের নিকট দাঁড়াইয়া থাকিবে। (মিশকাত ১৪৯) — দাফনের পর কবরের নিকট কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা, মুর্দার জন্য দোয়া করা, ওয়াজ করাও আউলিয়ায়ে কিরামগণের জীবনী আলোচনা করা মুস্তাহাব (আল আজকার পৃঃ ১৩৭)
দাফনের পর 'তালকীন' জায়েজ
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন। যখন তোমাদের কোন ভাই ইন্তেকাল করিবে এবং তোমরা উহার দাফন করিয়া দিবে। তখন তোমাদের মধ্যে কেহ উহার কবরের মাথার নিকট দাঁড়াইয়া বলিবে — হে অমুকের পুত্র অমুক। সে ইহা শুনিতে পাইবে কিন্তু উত্তর দিবে না। আবার বলিবে হে অমুকের পুত্র অমুক। এইবারে সে সোজা হইয়া বসিবে। আবার বলিবে— আল্লাহ তোমাকে হিদায়েত করেন, আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করেন। কিন্তু তোমরা ইহা অনুভব করিতে পারিবে না। এইবার বলিবে — উজকুর মা খরাজতা আলাইহি মিনাদ দুনইয়া শাহাদাতা আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অ আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসুলুহু ওয়া আন্নাকারদীতু বিল্লাহি রব্বাঁউ ওয়া বিল ইসলামে দিনাউঁ ওয়আবই মুহাম্মাদিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাবীয়াঁউ ওয়া বিল কুরআনে ইমামাউঁ ওয়া বিল কাবাতি কিবলাতান অতঃপর মুনকার ও নাকীর একে অপরের হাত ধরিয়া বলিবেন চলুন, আমরা ইহার নিকট বসিব না, যাহার দলীল শিখাইয়া দেওয়া হইয়াছে। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! যদি মুর্দার মাতার নাম জানা না থাকে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, হজরত হাওয়া আলাইহিস্ সালামের দিকে সম্বোধন করিবে। (রুহুল বয়ান খঃ ৫ পৃঃ ১৮৭) তালকীনের উল্লেখিত হাদীসটি কিছু ভাষা পরিবর্তন হইয়া আরো বিভিন্ন কিতাবে আসিয়াছে। যথা, আল্ আজকার পৃঃ ১৩৮, শারহুস্ সুদুর পৃঃ ৪৯, গুনিয়া তুত্তালিবীন মুতার্জাম পৃঃ ৫৮৫, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৬৬)।
অন্য বর্ণনায় রহিয়াছে— হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাফনের পর নিম্নরূপ ভাষায় তালকীন করিবে আদেশ করিয়াছেন। "হে অমুকের পুত্র অমুক, "উজুকর দ্বীনাকাল্লাজী কুনতা আলাইহি মিন শাহাদাতি আল্লা ইলাহা ইল্লাহু আ আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ ওয়া আন্নাল জান্নাতা হাক্কুন আন্নারা হাক্কুন ওয়া আন্নাল বা'সা হাক্কুন ওয়া আন্নাস সাআতা আতিয়াতুন লা রাইবা ফিহা ওয়া আন্নাল্লাহা ইয়াব আসু মান ফিল কুবুর ওয়া আন্নাকা রাদীতা বিল্লাহি রাব্বাঁউ ওয়া বিল ইসলামী দ্বীনাঁউ ওয়া বি মুহাম্মাদিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা নাবীয়াঁউ ওয়াবিল কুরআনে ইমামা ওয়াবিল কা'বাতি কিবলাতাঁউ ওয়াবিল মুমিনীনা ইখওয়ানা" (শামী খঃ ২ পৃঃ ১৯১) উলামায়ে আহলে সুন্নাত দাফনের পর তালকীন করা জায়েজ বলিয়াছেন। একমাত্র মোতাজিলা সম্প্রদায় ইহার বিপরীত মত পোষণ করিয়া থাকে।
।। দাফনের পর আজান জায়েজ।।
উলামায়ে আহলে সুন্নাত দাফনের পর আজান দেওয়া জায়েজ— মোস্তাহাব বলিয়াছেন। যথা, ফাতাওয়ায় রেজবীয়া শরীফ খঃ ২ পৃঃ ৪৬৪, নুজহাতুল কারী শরহে বোখারী খঃ ৩ পৃঃ ১০৩, মিরাতুল মানাজীহ খঃ ১ পৃঃ ৪০০/খঃ ২ পৃঃ ৪৯৭, বাহারে শরীয়ত খঃ ৩ পৃঃ ৩১, কানুনে শরীয়ত খঃ ১ পৃঃ , নিজামে শরীয়ত পৃঃ ৭৪, জান্নাতী জেওর পৃঃ ২৭৫, আনওয়ারুল হাদীস পৃঃ ২৩৮, ইসলামী জিন্দেগী পৃঃ ১১৪, আনওয়ারে শরীয়ত পৃঃ ৩৯, জা'ল হক্ব খঃ ১ পৃঃ ৩৭১ ইত্যাদি। ইমাম আহমাদ রেজা আলাইহির রহমাত দাফনের পর আজান সম্পর্কে স্ববিস্তারে একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা প্রনয়ণ করিয়াছেন। যথাক্রমে পুস্তিকাটির নাম হইল "ইজানুল আজর ফি আজানিল কবর"। তিনি তাঁহার দাফনের পর আজান দেওয়ার জন্য অসীয়তও করিয়াছিলেন। (অসায়া শরীফ পৃঃ ১০)
আজান সম্পর্কে হাফিজ ইবনো হাজার
হাফিজ ইবনো হাজার আসকালানীর কোন উক্তি হানাফীদিগের জন্য দলীল হইতে পারে না। কারণ, তিনি যেমন শাফয়ী মাজহাব অবলম্বী ছিলেন, তেমনই হানিফী মাজহাবের ঘোর বিরোধী ছিলেন। বিশেষ করিয়া তিনি তাহার কিতাবসমূহে ন্যায়ের সীমা অতিক্রম করতঃ হানিফী মাজহাবের বিরোধীতা করিয়াছেন। (জাফরুল মুহাসসিলীন বে আহওয়ালিল মুসান্নিফীন পৃঃ ১৬৫)
প্রকাশ থাকে যে, হাফিজ ইবনো হাজার দাফনের পর আজান দেওয়া কোনো সময় নাজায়েজ বলেন নাই। কেবল তিনি উক্ত আজানটির সুন্নাত হওয়াকে অস্বীকার করতঃ বেদআত বলিয়াছেন। এবং তিনি আরো বলিয়াছেন যে, যে উহাকে সুন্নাত ধারণা করিয়াছে সে ভুল করিয়াছে। (রদ্দুল মুহতার খঃ ২ পৃঃ ২৩৫) কারণ, শাফয়ী মাজহাবের একাংশ উলামায়ে কিরাম দাফনের পর আজান দেওয়া সুন্নাত বলিয়া থাকেন। (রদ্দুল মুহতার খঃ ১ পৃঃ ৩৮৫) - যেহেতু শাফয়ী মাজহাবের একাংশ আলেম উক্ত আজানকে সুন্নাত বলিয়া থাকেন। সেইহেতু ইবনো হাজার সুন্নাতের বিরোধীতা করিয়া বেদআত বলিয়াছেন। অতএব, এই স্থলে 'বেদআত' এর অর্থ নাজায়েজ —হারাম নয়। কারণ, প্রত্যেক বেদআত নাজায়েজ ও হারাম নয়। বহু বেদআত এমনই রহিয়াছে, যেগুলি মুস্তাহাব ও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। যদি তর্কের খাতিরে মুহূর্ত কালের জন্য ইবনো হাজারের উক্তিকে নাজায়েজ অর্থে গ্রহণ করা হয়। তথাপিও দাফনের পর আজান নাজায়েজ হইবে না। কারণ, তাঁহার উক্তি আদৌ দলীল ভিত্তিক নয়। বরং ইহা তাহার ব্যক্তিগত অভিমত, ইসলামের সংবিধান হইল "প্রত্যেক জিনিষ মূলতঃ হালাল" (তাফশিরাতে আহমাদীয়া পৃঃ ৭১০ শামী খঃ ১ পৃঃ ১০৫) উহা হারাম প্রমাণ করাতো দূরের কথা মাকরুহ তানজিহী প্রমাণ করিতে হইলে দলীলের প্রয়োজন হইবে।
আজান সম্পর্কে আল্লামা শামী
হানিফী মাজহাবের জগৎ বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইবনো আবিদীন শামী রহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট দাফনের পর আজান দেওয়া জায়েজ। অবশ্য তিনি উহার সুন্নাত হওয়া স্বীকার করেন নাই। যথা, তিনি তাঁহার জগৎ বিখ্যাত কিতাব ফাতাওয়ায় শামী—রদ্দুল মুহতারের দ্বিতীয় খণ্ডে ২৩৫ পৃষ্ঠায় সুন্নাত হওয়া বিরোধীতা করতঃ বলিয়াছেন, "মুর্দাকে কবরে নামাইবার সময় আজান দেওয়া সুন্নাত নয়। আল্লামা শামীর উক্তি হইতে পরিস্কার প্রমান হয় যে, তিনি জায়েজ হইবার স্বপক্ষে ও সুন্নাত হইবার বিপক্ষে ছিলেন। অন্যথায় তিনি "সুন্নাত নয়" না বলিয়া "জায়েজ নয়" বলিতেন। আল্লামা শামীর "সুন্নাত নয়" উক্তি হইতে নাজায়েজ প্রমাণ করিতে যাওয়া এক প্রকারের গোমরাহী ও মূর্খতামী ছাড়া কিছুই নয়।
আজান কেবল নামাজের জন্য নয়
আজান কেবল নামাজের জন্য নয়। বরং নামাজ ছাড়া আরো বহু স্থানে আজান দেওয়া জায়েজ রহিয়াছে। যথা,
(১) সন্তান জন্মগ্রহণ করিলে
(২) দুঃখিত ব্যক্তির নিকট
(৩) মৃগী রোগীর কানে
(৪) রাগান্বিত ব্যক্তির কানে
(৫) যে মানুষ অথবা পশুর অভ্যাস খারাপ হইয়া গিয়াছে, তাহার সম্মুখে
(৬) সৈনিকদের যুদ্ধের সময়
(৭) আগুন লাগিয়া যাইবার সময়
(৮) মৃত ব্যক্তিকে কবরে নামাইবার সময়
(৯) জ্বীনের উপদ্রবের সময়
(১০) মুসাফির রাস্তা ভুলিয়া গেলে।
(দুর্রে মুখতার ও শামী খঃ ১ পৃঃ ৩৮৫)
আজানে দুঃখ দূর হইয়া যায়
হজরত আলী রাদী আল্লাহু আনহু হইতে বর্ণিত হইয়াছে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দুঃখিত অবস্থায় দেখিয়া বলিলেন— হে আবু তালেবের পুত্র, তোমাকে দুঃখিত অবস্থায় দেখিতেছি। তুমি তোমার কানেতে আজান দেওয়ার জন্য কাহার আদেশ কর। কারণ, আজান দুঃখ দূর করিয়া থাকে। (মসনাদুল ফিরদাউস, সংগৃহীত জায়াল হক্ব খঃ ১ পৃঃ ৩৭৫) ইনশা আল্লাহ, দাফনের পর আজানের বরকতে মুর্দার অন্তরে দুঃখ দূর হইবে এবং শান্তি উপভোগ করিবে।
আজানে ভয় দূর হইয়া যায়
হজরত আবু হুরাইরা রাদী আল্লাহু আনহু হইতে বর্ণিত হইয়াছে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন, হজরত আদম আলাইহিস্ সালাম হিন্দুস্থানের সরন্দ্বীপ নামক স্থানে অবতীর্ণ হইয়া ভয় পাইয়াছিলেন। (তাঁহার ভয় দূর করিবার জন্য হজরত জিবরাঈল আলাইহিস্ সালাম অবতীর্ণ হইয়া আজান দিয়াছিলেন। (খাসায়েসে কোবরা খঃ ১ পৃঃ ৮) ইহজগতে অবতীর্ণের পর আজানে যেমন হজরত আদমের ভয় দূর হইয়াছে। ইনশাল্লাহ পরজগতে পদার্পণের পর আজানে মূর্দার ভয় দূর হইবে।
আজানে শয়তান পলায়ন করে
হজরত আবু হুরাইরা রাদী আল্লাহু আনহু হইতে বর্ণিত হইয়াছে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম বলিয়াছেন। যখন মুয়াজ্জিন আজান দেয়। তখন শয়তান বাত কর্ম করিতে করিতে পালাইয়া যায়। (বোখারী খঃ ১ পৃঃ ৮৫) হজরত জাবির রাদী আল্লাহু আনহু হইতে বর্ণিত হাদীসে রহিয়াছে যে, শয়তান আজান শুনিয়া 'রুহা' নামক স্থান পর্যন্ত পালাইয়া যায়। হজরত জাবির বলিয়াছেন যে, মদীনা হইতে 'রুহা' ছত্রিশ মাইলের ব্যবধান। (মুসলিম খঃ ১ পৃঃ ১৬৭)
কবরে শয়তানের আক্রমণ
ইমাম তিরমিজী 'নাওয়াদিরুল উসুল' এর মধ্যে হজরত সুফিয়ান সাউরী হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। যখন মুর্দাকে প্রশ্ন করা হয় যে, তোমার প্রতিপালক কে? তখন শয়তান উহার নিকট প্রকাশ হইয়া নিজের দিকে ইঙ্গিত করিয়া বলিয়া থাকে "আমি তোমার প্রতিপালক"। (ইজানুল আজার ফি আজানিল কবর পৃঃ ৩, জা'ল হক্ব খঃ ১ পৃঃ ৩৭৫) নুজহাতুল কারী শরহে বোখারী তৃতীয় খণ্ডে ১০৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত হাদীসটি হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদী আল্লাহু আনহু হইতে বর্ণিত হইয়াছে।
মোমেনের মহা শত্রু শয়তান, ঈমান মোমেনের অমূল্য সম্পদ। শয়তান শেষ আক্রমণ স্বরূপ কবরে উপস্থিত হইয়া মো'মেনের অমূল্য ঈমানকে ছিনাইবার চেষ্টা করিয়া থাকে। ইনশাআল্লাহ, দাফনের পর আজান দিলে শয়তান ছত্রিশ মাইল দূরে পালাইয়া যাইবে এবং মুর্দা মুনকার ও নাকীরের প্রশ্নের উত্তর সহজে দিতে পারিবে।
আল্লামা নিজামীর জবাব
হজরত আল্লামা মুশতাক আহমাদ নিজামী আলাইহির রহমাত ভারত অন্যতম মুনাজির — তর্কবাগিস ছিলেন। কয়েকটি মুনাজারাতে উলামায়ে দেওবন্দকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করিয়াছিলেন। ১৯৭৫ সালে নাগপুরের একটি সভায় হজরত আল্লামা উপস্থিত হইয়া জানিতে পারিলেন যে, কয়েকদিন পূর্বে দারুল উলুম দেওবন্দের সফীর মাওলানা ইরশাদ আহমাদ সাহেব এক সভায় কবরের আজান সম্পর্কে ব্যাঙ্গ করিয়া বলিয়া গিয়াছেন যে, সুন্নীদিগের কবরে শয়তান প্রবেশ করিয়া থাকে। তাই উহারা আজান দিয়া শয়তানকে বিতাড়িত করিয়া থাকে। দেওবন্দীদের কবরে শয়তান প্রবেশ করে না। তাই আমরা আজান দেওয়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করি না। ইহার জবাবে আল্লামা নিজামী বলিয়াছিলেন যে, যেহেতু শয়তান মো'মেনকে গোমরাহ করিয়া থাকে। সেহেতু সে সুন্নীদিগের কবরে প্রবেশ করে। কারণ, সে জানে যে কবরে একজন মো'মেন শুইয়া রহিয়াছেন। তাই তাঁহাকে গোমরাহ করিবার উদ্দেশ্যে তথায় উপস্থিত হইয়া থাকে। মো'মেনদিগের এই পরম শত্রু শয়তানকে বিতাড়িত করিবার জন্য সুন্নীগণ আজান দিয়া থাকেন। ইহা অতিসত্য যে, শয়তান দেওবন্দীদের কবরে প্রবেশ করে না। কারণ, সে জানে যে, কবরে আমার মত একজন বেঈমান-কাফের শুইয়া রহিয়াছে। আমি যাহা করিয়া থাকি, এ বেচারাও তাহা করিত। অতএব, উহার নিকট যাইবার কোন প্রয়োজন নাই। যেহেতু দেওবন্দীদের কবরে শয়তান প্রবেশ করে না। সেহেতু উহারা আজান দেওয়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করে না। (সারাংশ, দেওবন্দ কা নয়া দ্বীন পৃঃ ১২৭/১২৮)
কবরে বুজর্গদিগের ব্যবহৃত বস্তু
সাহাবাগণ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লামের ব্যবহৃত বস্তু অসীলা স্বরূপ কবরে লইয়া গিয়াছেন। যথা, হজরত মুয়াবিয়া রাদী আল্লাহু আনহু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লামের নখ ও চুল মোবারক তাঁহার চোখে ও মুখে রাখিতে অসীয়ত করিয়াছিলেন। (ফায়দানে সুন্নাত পৃঃ ৫৩১, জা'ল হক্ব খঃ ১ পৃঃ ৪০৬) স্বয়ং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম নিজের তহবন্দ শরীফ হজরত জয়নাবের কাফনের মধ্যে রাখিয়া ছিলেন। (মিশকাত পৃঃ এই সমস্ত হাদীসের ভিত্তিতে উলামাগণ বুজর্গদিগের ব্যবহৃত বস্তু ও 'দোয়ায় আহাদ নামা' প্রভৃতি কবরে রাখা জায়েজ বলিয়াছেন। শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দিস আলাইহির রহমাত বলিয়াছেন যে, তাঁহার পিতা হজরত সাইফুদ্দীন কাদেরী ইন্তেকালের সময় অসীয়ত করিয়াছিলেন যে, প্রার্থনামূলক কিছু কবিতা লিখিয়া আমার কাফনে রাখিয়া দিবে। (আখবারুল আখইয়ার, জা'ল হক্ব খঃ ১ পৃঃ ৪০৫) ইমাম তিরমিজী 'নাওয়াদেরুল উসুল' এর মধ্যে বর্ণনা করিয়াছেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম (আহাদ নামা সম্পর্কে) বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি এই দোয়া কোন পরচাতে লিখিয়া মুর্দার কাফনের নিচে সিনার উপর রাখিয়া দিবে। তাহার কবরে আজাব হইবে না এবং মুনকার ও নাকীর সামনে আসিবে না। দোয়াটির উচ্চারণ— "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু অহদাহু লা শারীকা লাহু লাইলাহা ইল্লাল্লাহু লাহুল মুলকু অলাহুল হামদু লাইলাহা ইল্লাল্লাহু অলা হাউলা অলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আজীম" (আল হারফুল হাসান ফিল কিতাবাতে আলাল কাফন পৃঃ ৪) —কবরে আহাদনামা ইত্যাদি রাখিবার নিয়ম— পশ্চিম দেওয়ালে মাথার দিকে একটি তাক তৈরী করিয়া সেখানে রাখিয়া দিবে। (মাজমুয়ায় ফাতাওয়া খঃ পৃঃ —, বাহারে শরীয়ত খঃ ৪ পৃঃ ১৩২)
দেওবন্দীদের কবরে জুতা
আমরা কবরে দোয়ায়ে আহাদনামা' ও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের 'জুতার নকশা শরীফ দিয়া থাকি। এলাকার বেদ্বীন দেওবন্দী আলেমদের ইঙ্গিতে সাধারণ মানুষ বিদ্রুপ করিয়া বলিয়া থাকে যে, বেরেলবীরা কবরে সার্টিফিকেট দিয়া থাকে। এই সমস্ত বেদ্বীন ও নাদানদের নিম্নের উদ্ধৃতি হইতে উপদেশ গ্রহণ করা উচিত।- হজরত মাওলানা আশরাফ আলী সাহেব মাদ্দাজিল্লাহ একবার (রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীকে) জিজ্ঞাসা করিলেন— হজরত কবরে শাজরাহ রাখা জায়েজ? হজরত (গাঙ্গুহী) বলিলেন-হ্যাঁ, কিন্তু মাইয়াতের কাফনে নয়, তাক খনন করিয়া রাখিয়া দিবে। তারপর হজরত মাওলানা বলিলেন, ইহাতে কি কিছু উপকার হয়? হজরত বলিলেন-হ্যাঁ ইহার পর বলিলেন, শাহ গোলাম আলী সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহির কোন একজন মুরীদ ছিলেন যাহার নিকট শাহ সাহেবের জুতা ছিল। লোকটি ইন্তেকালের সময় শাহ আব্দুল গনী সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে অসীয়ত করিয়াছিলেন যে, এই জুতা আমার কবরে রাখিয়া দিবেন। সুতরাং অসীয়ত অনুযায়ী রাখাও হইয়াছিল। ইহাতে মৌলভী নাজীর হোসাইন প্রমুখগণ শাহ সাহেবকে বিদ্রুপ করিয়া বলেন- বলুন, জুতাতে কতটা অপবিত্র লাগিয়াছিল? আবার কেহ জিজ্ঞাসা করিত, কতটা কাদা ছিল? ইহাতে শাহ সাহেব বলিয়াছিলেন, যদি এই কাজ নাজায়েজ হইত। তাহা হইলে আমাকে দলীল দিয়া বুঝাইয়া দিতেন।
ঠাট্রা বিদ্রুপ করিবার কি প্রয়োজন ছিল? যাক, তোমাদের নিকটে আর কখন বসিবনা। নিয়ম ইহাই ছিল যে, জুমার নামাজের পর মানুষ মসজিদে বসিত। ইহার পর শাহ সাহেবের কোন শিষ্য 'জারবুন নিয়াল আলা রউসিল জুহহাল' (অর্থাৎ জাহেলদের মস্তকে জুতার মার) নামক পুস্তিকা লিখিয়াছিলেন। ইহাতে সাহাবায়ে কিরাম ও অন্যান্যদের কর্ম হইতে প্রমাণ করিয়াছেন যে, বুজুর্গাণদিগের তাবাররুকাত (ব্যবহৃত বস্তু) কবরে লইয়া যাওয়া জায়েজ। এই পুস্তিকাটি দেখিয়া অস্বীকারকারীরা লজ্জিত হইয়াছিল। (তাজকিরাতুর রশীদ খঃ ২ পৃঃ ২৯০)
আউলিয়াগণের কবরে চাদর ও ফুল
হানাফী মাজহাবের জগৎ বিখ্যাত আলেম আল্লামা শামী আউলিয়ায়ে কিরামগণের মাজারে চাদর দেওয়া জায়েজ বলিয়াছেন। (রদ্দুল মুহতার খঃ পৃঃ - ) অনুরূপ ইসমাইল হাককী আলাইহির রাহমাত উলামা ও আউলিয়াদিগের মাজারে চাদর ইত্যাদি দেওয়া জায়েজ বলিয়াছেন। (রুহুল বয়ান খঃ পৃঃ)
আউলিয়া হইতে আরম্ভ করিয়া সাধারণ মানুষের কবরে ফুল দেওয়া জায়েজ। ইবনো আবিদ দুনইয়া ও জামেউল খুল্লান হজরত ইবনো মাসউদ রাদী আল্লাহু আনহু হইতে সনদসহ বর্ণনা করিয়াছেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের কবরে ফুল দিবে, আল্লাহ তাআলা ফুলের তাসমীয়াহের বরকতে মূর্দাকে ক্ষমা করিয়া দিবেন এবং ফুল দাতার আমলনামাতে সওয়াব লিখিবেন। (শরহে বরয়াক, সংগৃহীত 'কারী' মাসিক পত্রিকা দিল্লী হইতে ছাপা, পৃঃ ৩৩, জুন সংখ্যা, ১৯৮৮ সাল) হানাফী মাজহাবের জগৎ বিখ্যাত কিতাব আলমগিরী ৪র্থ খঃ কবর জিয়ারতের বিবরণে কবরে ফুল দেওয়া উত্তম বলা হইয়াছে। অনুরূপ আল্লামা শামী রদ্দুল মুহতার ২য় খণ্ড ২৪৫ পৃষ্ঠায় কবরে আস বৃক্ষের শাখা ইত্যাদি দেওয়া মুস্তাহাব বলিয়াছেন।
রোজা ও নামাজের ফিদইয়া প্রদান
মুর্দার জীবনে যে সমস্ত নামাজ ও রোজা ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত ত্যাগ হইয়াগিয়াছে, নিশ্চয় মুর্দা সেগুলি কোন দিন আদায় করিবার সুযোগ পাইবে না। যাহার কারণে তাহার আজাব ভোগ করিতে হইবে এই অসহায় অবস্থা হইতে মুর্দাকে বাঁচাইবার জন্য উলামায়ে ইসলাম একটি পন্থা অবলম্বন করিয়াছেন যে, প্রত্যেক নামাজ ও রোজার পরিবর্তে একটি করিয়া ফিতরার মূল্য (১) আল্লাহর প্রতি আশা রাখিয়া দান করিয়া দিবে। যদি কোন মুর্দার জীবনে বহু নামাজ, রোজা ত্যাগ
-----------------------------------------
(১) একটি ফিৎরার সমান ২ কিলো প্রায় ৪৭ গ্রাম গমের মূল্য। আনয়ারুল হাদীস ২৬২ পৃঃ)
----------------------------------------
হইয়া যায় এবং উহার ফিদইয়া প্রদান করা ওয়ারিশগণের পক্ষে সম্ভব না হয়, তাহা হইলে তাহাদের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা পয়সা লইয়া কোন গরীবকে অথবা নিজস্ব কোন আত্মীয়কে দান করিয়া দিবে এবং সে পুনরায় উহাকে দান করিয়া দিবে। যতক্ষণ পর্যন্ত মুর্দার ফিদইয়া সম্পূর্ণ আদায় না হইবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রকার দেওয়া নেওয়া করিতে থাকিবে। যথা, মুর্দার একশত ওয়াক্তের নামাজ ত্যাগ হইয়া গিয়াছে প্রত্যেক ওয়াক্তের জন্য একটি ফিতরার মূল্য পাঁচ টাকা হিসাবে ধরিলে একশত ওয়াক্তের সমান পাঁচ শত টাকা হইবে। এইবার নিজ সামর্থানুযায়ী কিছু টাকা মুর্দার পক্ষ হইতে কাহার দান করিয়া দিবে। এই টাকাটি গ্রহণ করিবার পর সে পুনরায় টাকাটি উহাকে দান করিয়া দিবে। যতক্ষণ পর্যন্ত পাঁচ শত টাকা আদায় না হইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রকার টাকা আদান প্রদান করিতে হইবে। মোট কথা মুর্দার পক্ষ হইতে ফিদইয়া প্রদান করা শরীয়তসম্মত। (তাফসীরাতে আহমাদীয়া পৃঃ ৫৩/৫৪, নুরুল আনওয়ার পৃঃ ৩৯) ফিদইয়ার মসলাতে উলামায়ে দেওবন্দের দ্বিমত নেই। (ফাতাওয়ায় দারুল উলুম দেওবন্দ ১ম ও ২য় খণ্ড ৩৪১ পৃঃ)
আরো কিছু বিক্ষিপ্ত মসলা
জানাজার পর হাত উঠাই দোয়া করা জায়েজ। উলামায়ে দেওবন্দ উহা নাজায়েজ বলিয়া থাকেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিতে হইলে 'ফাতাওয়ায় রেজবীয়া' ৪র্থ খঃ ও জায়াল হক্ব ১ম খঃ পাঠ করুন।—কবরে খেজুরের শাখা পুতিয়া দেওয়া জায়েজ। স্বয়ং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম দুইটি কবরে দিয়াছিলেন। (বোখারী খঃ ১ পৃঃ ১৮২, মিশকাত পৃঃ ৪২) হজরত বুরাইদা ইবনুল খসীব রাদী আল্লাহু আনহু তাহার কবরে খেজুরের শাখা দিতে অসীয়ত করিয়া ছিলেন (শামী ২য় খঃ পৃঃ ২৪৫) কোন কোন সাহাবার কবরের মধ্যেও খেজুর শাখা দেওয়া হইয়াছে। (শারহুস্ সুদুর পৃঃ ৩২) — কবরে সিজদা করা হারাম। কবর চুম্বনের ব্যাপারে উলামাদিগের মতভেদ রহিয়াছে। অতএব, সাবধানতা হেতু নিষেধ। কমপক্ষে চার হাত দূরে থাকা আদব। (আহকামে শরীয়ত খঃ ৩ পৃঃ ২৩৪, লেখক ইমাম আহমাদ রেজা)
ইমাম আহমদ রেজা 'জবদাতুজ জাকিয়া' কিতাবে চল্লিশটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে, কবরে সাজদা করা হারাম ও শির্ক। এতদসত্ত্বেও দেওবন্দী বেদ্বীনেরা বেরেলবীদিগকে বদনাম করিয়া থাকেন যে, উহারা কবরে সাজদা করিতে দর্দেশ দিয়া থাকেন।
মসলা মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট মহিলা মাসিকের অবস্থায় উপস্থিত হইতে পারেন। কিন্তু যাহাদের মাসিক ভাল হইয়া গিয়াছে এবং গোসল হয় নাই, তাহাদের উপস্থিত হওয়া উচিৎ নয়, অনুরূপ নাপাক অবস্থায় কোন পুরুষের উপস্থিত হওয়া উচিৎ নয়। * মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকটে সুগন্ধ রাখা মুস্তাহাব। * ইন্তেকালের পর বাচ্চা জীবিত থাকিলে পেটের বাম দিক কাটিয়া বাচ্চা বাহির করিতে হইবে। পেটে বাচ্চা মরিয়া গেলে, প্রয়োজনবোধে বাচ্চা কাটিয়া বাহির করিতে হইবে। কিন্তু বাচ্চা জীবিত থাকিলে, মাতার মতই কষ্ট হউক না কেন বাচ্চাকে কাটিয়া বাহির করা জায়েজ হইবে না। * মুর্দাকে গোসল দেওয়ার সময় যদি উহার আকৃতি আলোকিত হইয়া যায় অথবা উহার দেহ হইতে সুগন্ধ বাহির হয় অথবা এই প্রকার আরো কোন ভাল জিনিস প্রকাশ হইয়া যায়, তাহা হইলে উহা প্রচার করিতে হইবে। আর যদি কোন খারাপ জিনিস প্রকাশ হয়। যথা, আকৃতি কালো হইয়া গিয়াছে অথবা দুর্গন্ধ বাহির হইয়াছে অথবা দেহের কোন অঙ্গ বাঁকিয়া গিয়াছে ইত্যাদি বিষয়গুলি প্রচার করা জায়েজ নয়। অবশ্য কোন বদ্ মাজহাব যথা ওহাবী দেওবন্দী মরিয়া গেলে এবং উহাদের আকৃতিতে কোন প্রকার পরিবর্তন ঘটিলে, তাহা ভাল করিয়া প্রচার করিতে হইবে। কারণ, উহাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করিবে। * মুর্দা ছোট বালক হইলে মহিলা গোসল দিতে পারিবে। অনুরূপ মুর্দা ছোট বালিকা হইলে পুরুষ গোসল দিতে পারিবে। * পুরুষ নাপাক অবস্থায় অথবা মহিলা মাসিকের অবস্থায় গোসল দিলে মাকরুহ হইবে। কিন্তু গোসল হইয়া যাইবে। * বিনা অজুতে গোসল দিলে মাকরুহ হইবে না। * স্ত্রী স্বামীকে গোসল দিতে পারে। * তালাকে রাজয়ী প্রাপ্তা মহিলা ইদ্দাতের মধ্যে স্বামীকে গোসল দিতে পারে। কিন্তু তালাকে বায়েন প্রাপ্ত মহিলা ইদ্দাতের মধ্যেও স্বামীকে গোসল দিতে পারিবে না। * স্বামী স্ত্রীকে গোসল দিতে পারিবে না অবশ্য খাটিয়া কাঁধে লইতে পারিবে ও কবরে নামাইতে এবং মুখও দেখিতে পারিবে। * গোসল দেওয়ার মত কোন মহিলা উপস্থিত না থাকিলে, পুরুষ তায়াম্মুম করাইয়া দিবে অবশ্য যে ব্যক্তি তায়াম্মুম করাইয়া দিবে সে এমন একজন ব্যক্তি যে, উহার সহিত মৃতার বিবাহ জায়েজ ছিল না, তাহা হইলে তায়াম্মুম করাইবার সময় হাতে কাপড় জড়াইতে হইবে না। যথা, পিতা পুত্র ভাই প্রভৃতি। আর যদি স্বামী তায়াম্মুম করাইয়া দেয় অথবা এমন ব্যক্তি, যাহার সহিত বিবাহ জায়েজ ছিল, তাহা হইলে হাতে কাপড় জড়াইতে হইবে * কোন পুরুষ উপস্থিত না থাকিলে, মহিলা মূর্দা পুরুষকে তায়াম্মুম করাইয়া দিবে। অবশ্য মুর্দার সহিত উহার বিবাহ জায়েজ থাকিলে হাতে কাপড় * জড়াইতে হইবে। অন্যথায় কাপড় জড়াইতে হইবে না। * পানি পাওয়া না গেলে তায়াম্মুম করাইয়া জানাজার নামাজ পড়িবে। যদি নামাজের পর দাফনের পূর্বে যদি পানি পাওয়া যায়, তাহা হইলে পুনরায় গোসল দিতে হইবে এবং নামাজও পড়িতে হইবে। উভয় লিঙ্গ বিশিষ্ট হিজড়াকে পুরুষ ও মহিলা কেহ গোসল দিতে পারিবে না। বরং তায়াম্মুম করাইতে হইবে। অবশ্য অপরিচিত ব্যক্তি হইলে হাতে কাপড় জড়াইয়া লইবে। * উভয় লিঙ্গ বিশিষ্ট হিজড়া কোন পুরুষ অথবা মহিলাকে গোসল দিতে পারিবে না। * উভয় লিঙ্গ বিশিষ্ট হিজড়া শিশু হইলে পুরুষ অথবা মহিলা গোসল দিতে পারিবে। * যদি মুর্দা পানিতে পড়িয়া যায় অথবা মুর্দার উপর পানি বর্ষণ হইয়া সমস্ত দেহের উপর পানি বহিয়া যায়, তাহা হইলে গোসল হইয়া যাইবে। কিন্তু জীবিতরা যতক্ষণ পর্যন্ত উহাকে গোসল না দিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উহাদের জিম্মায় ওয়াজিব থাকিয়া যাইবে। অতএব, যদি পানিতে ডুবিয়া যাওয়া মুর্দাকে গোসলের নিয়তে একবার নড়াচড়া করা হয়, তাহা হইলে ওয়াজিব আদায় হইয়া যাইবে। আর যদি তিনবার নাড়াচাড়া করা হয়, তাহা হইলে সুন্নাত আদায় হইয়া যাইবে। আর যদি বিনা নিয়তে গোসল দেওয়া হয়, তাহা হইলে ওয়াজিব আদায় হইয়া যাইবে কিন্তু সওয়াব পাওয়া যাইবে না। যেমন, কোন ব্যক্তিকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মুর্দাকে গোসল দেওয়া হইল, ইহাতে ওয়াজিব আদায় হইয়া যাইবে কিন্তু সওয়াব পাওয়া যাইবে না। * নাবালেগ অথবা কাফের গোসল দিলে গোসল আদায় হইয়া যাইবে। অনুরূপ কোন অপরিচিতা মহিলা পুরুষকে অথবা পুরুষ কোন মহিলাকে গোসল দিলে গোসল আদায় হইয়া যাইবে। অবশ্য ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের গোসল দেওয়া নাজায়েজ। * যদি মুসলমান মুর্দার দেহের অর্ধাংশ পাওয়া যায়, তাহা হইলে গোসল ও কাফন দিতে হইবে এবং জানাজাও পড়িতে হইবে। ইহার পর বাকী অংশটুকু পাওয়া গেলে, উহার প্রতি জানাজা পড়িতে হইবে না। * দেহের অর্ধাংশের সহিত যদি মাথা থাকে, তাহা হইলে গোসল, কাফন ও জানাজা পড়িতে হইবে। আর যদি মাথা না থাকে অথবা লম্বায় মাথা হইতে পা পর্যন্ত ডান দিক অথবা বাম দিকের কেবল একটা অংশ পাওয়া গেলে গোসল, কাফন ও নামাজ কিছুই নাই। কেবল একটি কাপড়ে জড়াইয়া দাফন করিয়া দিতে হইবে। * যদি মুর্দার মধ্যে মুসলমান হইবার নিদর্শন পাওয়া যায় অথবা মুসলমানদের বস্তিতে মুর্দাকে পাওয়া যায়, তাহা হইলে গোসল ও নামাজ পড়িতে হইবে। অন্যথায় যে কিছুই করিতে হইবে না। * যদি মুসলমান মুর্দা কাফের মুর্দার সহিত মিশিয়া যায় এবং খৎনা ইত্যাদি নিদর্শন দেখিয়া যদি মুসলমানকে চেনা সম্ভব হয়, তাহা হইলে মুসলমান মুর্দাকে পৃথক করিয়া গোসল, কাফন ও নামাজ সব কিছু পালন করিতে হইবে। আর যদি মুসলমানকে চেনা সম্ভব না হয়, তাহা হইলে সবাইকে গোসল দিতে হইবে এবং জানাজার নামাজে কেবল মুসলমানদের উদ্দেশ্যে দোয়া পাঠ করিবে। আর যদি মুসলমান মুর্দার সংখ্যা বেশি হয় তাহা হইলে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করিবে, অন্যথায় নয়। * আসল কাফের মুর্দার জন্য গোসল, কাফন ও দাফন কিছুই নাই। মুসলমান উহাকে ছুঁইতে পারিবে না এবং উহার সমাধিস্থ করিতে যাইতে পারিবে না। যদি উহার স্বধর্মীয় কোন মানুষ না থাকে অথবা উহাকে লইয়া না যায়, তাহা হইলে কেবল একটি কাপড়ে জড়াইয়া পুঁতিয়া দিবে। যদি কোন মুসলমান প্রতিবেশী হিসাবে কোন কাফেরের শেষ ক্রিয়াতে অংশ গ্রহণ করে, তাহা হইলে দূরে দূরে থাকিবে। * যদি কোন মুসলমান কোন কাফেরের আত্মীয় হয় এবং উহার স্বধর্মীয় কোন মানুষ সেখানে না থাকে অথবা উহাকে গ্রহণ না করে, তাহা হইলে আত্মীয় তার দিক দিয়া গোসল, কাফন দাফন করা জায়েজ। কিন্তু কোন জিনিস সুন্নাত মোতাবিক করিবে না। কেবল অপবিত্র ধুইবার ন্যায় পানি ঢালিয়া দিবে এবং কাপড়ে জড়াইয়া সংকীর্ণ গর্তে পুঁতিয়া দিবে।
মসলা—মুর্তাদ যথা, কাদিয়ানী, ওহাবী ও দেওবন্দী মরিয়া গেলে মূলতঃ উহার গোসল, কাফন ও দাফন কিছুই নাই। বরং কুকুরের ন্যায় কোন সংকীর্ণ গর্তে ফেলিয়া দিয়া চাপা মাটি দিয়া পুঁতিয়া দিতে হইবে। * মুর্দার গোসল দেওয়ার জন্য নতুন বালতি, বদনা ইত্যাদি ক্রয় করিবার প্রয়োজন নাই। পুরাতন ব্যবহৃত বদনা বালতি ইত্যাদি দ্বারা গোসল দেওয়া জায়েজ। * মুর্দার গোসলের পর বালতি, বদনা প্রভৃতি জিনিসগুলি ভাঙ্গিয়া ফেলা নাজায়েজ — হারাম। অবশ্য সওয়াবের উদ্দেশ্যে এ জিনিসগুলি মসজিদ, মাদ্রাসায় অথবা কোন গরীবকে দান করিয়া দিলে সওয়াব হইবে। ইচ্ছা করিলে দিনেরাও ব্যবহার করিতে পারিবে। * প্রয়োজন মোতাবিক কাফন দেওয়ার সামর্থ্য থাকিলে, সুন্নাত মোতাবিক কাফন দেওয়ার জন্য ভিক্ষা করা জায়েজ নয়। পুরুষের জন্য তিনটি এবং মহিলার জন্য পাঁচটি কাপড় দেওয়া সুন্নাত। * উড়নি তিন হাত অর্থাৎ দেড় গজ হইতে হইবে। সিনাবন্দ স্তন্য হইতে নাভী পর্যন্ত হইবে। বান পর্যন্ত থাকা উত্তম। * বিনা চাওয়ায় যদি কোন মুসলমান সুন্নাত মোতাবিক কাফন পূর্ণ করিয়া দেয়, তাহা ইনশাআল্লাহ, পূর্ণ সওয়াব পাইবে। * যেহেতু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মুর্দাকে সাদা কাফন দিতে নির্দেশ করিয়াছেন। সেহেতু সাদা কাফন দেওয়া উত্তম। কাফন খুব ভাল দেওয়া উচিত। কারণ, হাদীস পাকে আছে, মুর্দারা একে অপরের সহিত সাক্ষাত করিয়া থাকে এবং ভাল কাফনে সন্তুষ্ট হইয়া থাকে। * কুসুমী রং অথবা জাফরানে রঙানো অথবা রেশমের কাফন পুরুষের জন্য জায়েজ নয়। স্ত্রীলোকের জীবিত অবস্থায় যে কাপড় পরিধান করা জায়েজ, ঐ কাপড় দিয়া উহাকে কাফন দেওয়া জায়েজ। * ১২ বৎসর বয়সের বালক এবং ৯ বৎসর বয়সের বালিকাকে সামর্থ থাকিলে পূর্ণ কাফন দিবে। ইহার কম বয়সের বালকের একটি কাপড় এবং বালিকার দুইটি কাপড় দিতে পারে। একদিনের হইলেও উভয়কে পূর্ণ কাফন দেওয়া উত্তম। * কাফনের কাপড় যদি ভিক্ষা করা হয় এবং যদি কিছু বাঁচিয়া যায়, তাহা হইলে যে দান করিয়াছে তাহাকে ফেরত দিতে হইবে। আর যদি উহাকে জানা না যায়, তাহা হইলে কোন গরীবের কাফনে খরচ করিয়া দিবে। অন্যথায় সদকা করিয়া দিবে। * যদি বহু মানুষের চাঁদা পয়সায় কাফন ক্রয় করা হয় এবং কিছু বাঁচিয়া যায়, তাহা হইলে চাঁদা প্রদানকরারীদের অনুমতি মোতাবিক খরচ করিতে হইবে। আর যদি ইহা সম্ভব না হয় তাহা হইলে সাদকা করিয়া দিবে। * যদি মুর্দাকে কোন জন্তু খাইয়া ফেলে এবং কাফন পাওয়া যায়, তাহা হইলে যদি মুর্দার পয়সার কাফন হয়, তাহা হইলে উহা মুর্দার সম্পত্তিতে গণ্য হইবে এবং প্রত্যেক ওয়ারিস উহার মালিক হইবে। আর যদি কোন আত্মীয় অথবা অপরিচিত কোন ব্যক্তি দিয়া থাকে, তাহা হইলে উহারা ইহার মালিক হইবে। * স্ত্রীলোকের কাফন পরাইয়া উহার মাথার চুল দুই ভাগ করিয়া কাফনের উপরে সিনার উপর ফেলিয়া দিবে। উড়নি অর্ধ পিঠের নিচে হইতে বিছাইয়া মাথার উপর আনিয়া মুখের উপর বোরকার মত ফেলিয়া দিবে, যাহাতে সিনার উপর থাকে। কারণ, উড়না অর্ধ পিঠ হইতে সিনা পর্যন্ত লম্বা এবং এক কান হইতে অপর কানের পাতা চওড়া হয়। জীবিত অবস্থায় যে উড়না ব্যবহার করিয়া থাকে, প্রকার ছোট উড়না মুর্দাকে দেওয়া সুন্নাতের খেলাফ। * জাফরান মিশ্রিত কোন সুগন্ধ পুরুষের দেহে দেওয়া জায়েজ নয়। অবশ্য উহা স্ত্রীলোকের জন্য জায়েজ রহিয়াছে। * কাফন মুন্ডিবার সময় প্রথম বাম দিক তার পর ডান দিক মুড়িবে। মোট কথা ডান দিকের কাফন উঁচুতে থাকিবে। অবশ্য ডাহিন ও বাম বলিতে মুর্দার ডাহিন ও বাম ধরিতে হইবে। * আমাদের দেশে সাধারণতঃ একটি কাপড়ের উপর দাঁড়াইয়া ইমাম সাহেব জানাজার নামাজ আদায় করিয়া থাকেন। পরে কাপড়টি ইমাম সাহেবকে অথবা অন্য কোন গরীবকে দান করিয়া দেওয়া হয়। যদি কাপড়টি মুর্দার পয়সায় ক্রয় করা হইয়া থাকে, তাহা হইলে সমস্ত ওয়ারিসগণ অনুমতি দিলে জায়েজ হইবে। অন্যথায় জায়েজ হইবে না। আর যদি ওয়ারিসগণের মধ্যে কেহ নাবালেগ থাকে এবং সে অনুমতি দেয় তবুও জায়েজ হইবে না। এই অবস্থায় যে মুর্দার পয়সায় কাপড়টি ক্রয় করিয়াছে এবং দান তাহাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে। খুব সাধারণ, নাবালেগ ওয়ারিসের মাল খরচ করা হারাম। অবশ্য অন্য কোন মানুষ কাপড়টি ক্রয় করিলে এবং দান করিয়া দিলে জায়েজ হইবে। * মুর্দার জন্য মীলাদ শরীফ, কালেমা শরীফ ও কোরআন শরীফ খতম করিয়া সওয়াব রেসানী করা জায়েজ। বেদ্বীন ওহাবী, দেওবন্দী জামায়াতে ইসলামী ও তাবলিগীরা এইগুলি নাজায়েজ বলিয়া থাকে। ঐ গোমরাহ ফিরকাহগুলি জিন্দা ও মুর্দা উভয়ের দুশমন। মসলা - চল্লিশ সংখ্যাটির একটি বিশেষত্ব রহিয়াছে। ইন্তেকালের ঠিক চল্লিশ দিনে ইসালে সওয়াব করা জায়েজ। মসলা - মুর্দার উপলক্ষে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবকে দাওয়াত করিয়া যে খানা দেওয়া হয়। উহা কঠিন হারাম। অবশ্য ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে গরীব মিসকীনকে খানা দেওয়া জায়েজ। মসলা — নাবালেগ ওয়ারিসের পয়সায় খানা দেওয়া, খতমে দেওয়া ও ইসালে সওয়াব করা জায়েজ নয়, বালেগ ওয়ারিসগণ নিজেদের মাল থেকে খরচ করিতে পারে। মসলা — মুর্দার অসীয়ত থাকিলে, উহার ঋণ পরিশোধ করিবার পর অবশিষ্ট মালের তৃতীয়াংশ হইতে অসীয়ত পূর্ণ করিতে হইবে। মসলা— মুর্দাকে চল্লিশ কদম লইয়া গেলে চল্লিশটি কবিরা গুনাহ মাফ হইবার কথা বর্ণিত হইয়াছে। সেহেতু প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত। মসলা—মুর্দা খুব বাচ্চা হইলে পরস্পর হাতে করিয়া লইয়া যাইতে পারে। এক ব্যক্তি হাতে করিয়া লইয়া যাইতেও পারে। বাচ্চা বেশ বড় হইলে খাটিয়াতে লইয়া যাইবে। মসলা— জানাজার পিছনে পিছনে যাওয়া উত্তম। পাশে যাওয়া ঠিক নয়। যদি কেহ সামনে যায়, তাহা হইলে এত দূরে দূরে যাইবে যে, জানাজার সঙ্গী বলিয়া মনে না হয়। মসলা—জানাজার সঙ্গে মহিলাদের যাওয়া জায়েজ নয়। মসলা—জানাজার সহিত যাহারা যাইবে, তাহাদের জন্য হাসি ঠাট্টা করা, দুনইয়ার কথা বলা জায়েজ নয়, মসলা— জানাজার সহিত আস্তে অথবা জোরে জিকির ও কালেমা প্রভৃতি পাঠ করিতে যাইবে। * - যতক্ষণ পর্যন্ত জানাজা রাখা না হইবে। ততক্ষণ পর্যন্ত সঙ্গীদের বসা মাকরুহ। রাখিবার পর বিনা প্রয়োজনে দাঁড়াইয়া থাকিবে না। যদি মানুষ বসিয়া থাকে এবং নামাজের জন্য জানাজা সেখানে লইয়া যাওয়া হয়, তাহা হইলে যতক্ষণ পর্যন্ত জানাজা রাখা না হইবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেহ দাঁড়াইবে না। অনুরূপ বসিয়া থাকা মানুষদের নিকট হইতে জানাজা অতিক্রম করিলে উঠীয়া দাঁড়ানো জরুরি নয়। অবশ্য যাহারা সঙ্গে যাইতে চাইবে, তাহারা উঠীয়া যাইবে। * জানাজা রাখিবার সময় পা অথবা মাথা কিবলার দিকে রাখিবেন। বরং এমনভাবে রাখিবে, যাহাতে ডান দিকে কিবলা থাকে। * —জানাজার সঙ্গে যাহারা থাকিবে, তাহাদের নামাজ না পড়িয়া চলিয়া আসা উচিৎ নয়। নামাজের পর অলীদিগের অনুমতি লইয়া ফিরিতে পারে অবশ্য দাফনের পর অলীর অনুমতি লইবার প্রয়োজন নয়। *— মুর্দা যদি প্রতিবেশী হয় অথবা আত্মীয় হয় অথবা কোন নেক ব্যক্তি হয়, তাহা হইলে উহার জানাজার সহিত যাওয়া নফল নামাজ অপেক্ষা উত্তম। *— যদি কেহ জুতা পরিধান করিয়া জানাজার নামাজ পড়ে। তাহা হইলে জুতা এবং উহার নিচের মাটি পাক হইতে হইবে। অন্যথায় নামাজ হইবে না। আর যদি কেহ জুতার উপর দাঁড়াইয়া নামাজ পড়ে। তাহা হইলে জুতা পাক হইতে হইবে। অন্যথায় নামাজ হইবে না। * অজু অথবা গোসল করিতে গেলে যদি জানাজার আশঙ্কা থাকে, তাহা হইলে তায়াম্মুম করিয়া নামাজ পড়িয়া লইবে। *— জানাজার নামাজে ইমামের বালেগ হওয়া শর্ত নাবালেগ পড়াইলে নামাজ হইবে না। *— মূর্দা উহাকে বলা হয়, যে জীবিত পয়দা হইয়া মরিয়া গিয়াছে। যদি জীবিত অবস্থায় অর্ধাংশের কম বাহির হইয়া মরিয়া যায়, তাহা হইলে জানাজা পড়িতে হইবে না। * যদি ছোট বাচ্চার পিতা মাতা উভয়েই মুসলমান হয় অথবা কোন একজন মুসলমান হয়, তাহা হইলে বাচ্চাকে মুসলমান ধরিতে হইবে এবং উহার জানাজা পড়িতে হইবে। পিতা মাতা উভয়েই কাফের হইলে জানাজা পড়িতে হইবে না। * কাফন পরাইবার পূর্বে নাপাক বাহির হইলে ধুইয়া ফেলিবে। পরাইবার পর বাহির হইলে ধুইবার প্রয়োজন নাই। * মূর্দার সম্পূর্ণ দেহ অথবা অধিকাংশ দেহ অথবা অর্ধাংশ দেহ মাথা সহ উপস্থিত থাকিলে জানাজার নামাজ হইবে। অন্যথায় নয়। *— অনুপস্থিত মূর্দার জানাজার নামাজ হইবে না। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম অনেক অনুপস্থিত মূর্দার জানাজার নামাজ পড়াইয়াছিলেন। উহা তাঁহার বিশেষজ্ঞ ছিল। আমাদের জন্য জায়েজ নয়। *— মূর্দা মাটিতে থাক অথবা হাতের উপর থাক, নিকটে থাকিতে হইবে। যদি মূর্দা কোন জানোয়ার ইত্যাদির পিঠে থাকে, তাহা হইলে নামাজ হইবে না। * লাশ মুসাল্লার সামনে কিবলার দিকে থাকিবে। যদি মুসাল্লার পশ্চাতে থাকে, তাহা হইলে সহীহ হইবে না। আর যদি লাশ উল্টা করিয়া রাখা হয় অর্থাৎ ইমামের ডান দিকে মূর্দার পা রাখা হয়, তাহা হইলে নামাজ হইয়া যাইবে কিন্তু ইচ্ছাকৃত এই প্রকার করিলে গোনাহগার হইবে। *— মূর্দা একটি হইলে উহার দেহের কোন একটি অংশ ইমামের সোজা থাকিলে হইবে। আর যদি একাধিক মূর্দা হয়, তাহা হইলে কোন একটির দেহের একাংশ ইমামের সোজা থাকিলে যথেষ্ট হইবে। *— একই মূর্দার একাধিকবার নামাজ পড়া নাজায়েজ। অবশ্য অলীর বিনা অনুমতিতে যতবার নামাজ হউক না কেন, অলী ইচ্ছা করিলে পুনরায় নামাজ পড়িতে পারেন। ইমাম আবু হানিফার ছয়বার জানাজা হইয়াছিল। সর্বশেষ জানাজা পড়িয়া ছিলেন তাঁহার পুত্র হজরত হাম্মাদ। *— জানাজার নামাজে সালাম ফিরাইবার সময় ফিরিশতা, মুসাল্লী ও মূর্দার নিয়ত করিতে হইবে।
*—ইমামাতের অধিকার প্রথম ইসলামী বাদশার, তারপর শরীয়তের কাজীর, তারপর জুমার ইমামের, তারপর মহল্লার ইমামের। অবশ্য মহল্লার ইমাম অপেক্ষা অলী আফজাল হইলে অলীর ইমামাত উত্তম হইবে। * মূর্দার পিতা ও পুত্র থাকিলে পিতার অগ্রাধিকার হইবে। অবশ্য যদি পিতা আলেম না হয় এবং পুত্র যদি আলেম হয়, তাহা হইলে নামাজের জন্য পুত্রের অগ্রাধিকার হইবে। *—মহিলা ও বাচ্চা জানাজার *— নামাজের অলী হইতে পারিবে না। *—ওহাবী দেওবন্দীর জানাজা পড়া অথবা উহাদের দ্বারায় জানাজা পড়ানো হারাম। *— যদি মূর্দা অসীয়ত করিয়া যায় যে, অমুক আমাকে গোসল দিবে অথবা জানাজা পড়াইবে। এই অসীয়ত পালন করা অলীর জন্য ওয়াজিব নয়। অলী ইচ্ছা করিলে নিজেই গোসল ও জানাজা পড়াইতে পারে অথবা যাহাকে অসীয়ত করিয়া গিয়াছে, তাহাকে অনুমতি দিতে পারে। * যদি ইমাম পাঁচ তাকবীর বলিয়া দেয়, তাহা হইলে মুক্তাদী শেষ তাকবীরে ইমামের অনুসরণ করিবে না। চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিবে। যখন ইমাম সালাম ফিরাইবে তখন উহার সহিত সালাম ফিরাইবে। * যে ব্যক্তি ইমামের সহিত সমস্ত তাকবীর পায় নাই, সে ইমামের সালাম ফিরাইবার পর বাকী তাকবীরগুলি পাঠ করিবে। দোয়াগুলি পাঠ করিতে গেলে যদি মুর্দাকে কাঁধে উঠাইবার আশঙ্কা হয়, তাহা হইলে দোয়া পাঠ করিতে হইবে না। কেবল তাকবীরগুলি পাঠ করিবে। *—যে চতুর্থ তাকবীরের পর আসিবে, সে ইমামের সালাম ফিরাইবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সামিল হইতে পারিবে এবং ইমামের সালামের পর তিনবার 'আল্লাহু আকবর' বলিবে। *—ইমামের প্রথম তাকবীরের সহিত আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু কোন কারণে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তাকবীর ত্যাগ হইয়া গিয়াছে, এমতাবস্থায় ইমামের চতুর্থ তাকবীর বলিবার পূর্বে ঐ তাকবীরগুলি বলিয়া নিবে। *—জানাজার নামাজে দোয়ার উদ্দেশ্যে সূরা ফাতিহা পাঠ করা জায়েজ। *—একাধিক মূর্দার জানাজা এক সঙ্গে পড়া জায়েজ। পৃথক পৃথক পড়া উত্তম। যিনি সব চাইতে উত্তম হইবেন, তাহার জানাজা প্রথম হইবে। *—কোন জিনিসের মধ্যে মূর্দা চাপা পড়িয়া গিয়াছে অথবা কুঁয়াতে পড়িয়া গিয়াছে। যদি বাহির করা সম্ভব না হয়, তাহা হইলে সেখানেই জানাজা পড়িতে হইবে। কিন্তু মূর্দা নদীতে ডুবিয়া গেলে বাহির করা সম্ভব না হইলেও জানাজা পড়িতে হইবে না। *—এক সঙ্গে একাধিক মূর্দার জানাজা হইলে সবার উত্তম ব্যক্তিকে ইমামের সামনে রাখিতে হইবে। এই প্রকারে পরস্পর রাখিতে হইবে। সবাই একই প্রকারের হইলে, যাহার বয়স বেশি হইবে, তাহাকে ইমামের সামনে রাখিতে হইবে। *— মুর্দা বিভিন্ন প্রকার হইলে, প্রথমে পুরুষ, তারপর শিশু, তারপর হিজড়া, তারপর মহিলা, তারপর মুবাহিক অর্থাৎ যে পূর্ণ বালেগ হয় নাই। *—যদি কোন কারণে একই প্রকার একাধিক মূর্দাকে একই কবরে দাফন করা হয়, তাহা হইলে সবার উত্তম ব্যক্তিকে কিবলার দিকে রাখিতে হইবে। আর যদি মূর্দা বিভিন্ন প্রকার হয়, তাহা হইলে কিবলার দিক হইতে প্রথমে পুরুষকে রাখিবে, তারপর শিশু, তারপর হিজড়া, তারপর মহিলা, তারপর মুবাহিক। *—জানাজা নামাজে ইমামের অজু নষ্ট হইয়া গেলে, অন্যকে খলিফা করা জায়েজ। *—অমুসলিম মহিলার পেট হইতে মুসলমানের অবৈধ সন্তান পয়দা হইয়া ইন্তেকাল করিলে জানাজা পড়িতে হইবে। *—অমুসলিম মহিলার পেটে মুসলমানের সন্তান থাকা অবস্থায় যদি মেয়েটি মরিয়া যায়, এবং উহাকে দাফন করা হয়, তাহা হইলে কিবলার দিকে পিছন করতঃ বাম কাতে পূর্ব মূখি করিয়া শোয়াইতে হইবে। তাহা হইলে সন্তানের মুখ কিবলার দিকে হইয়া যাইবে।
*—জুমার দিন ইন্তেকাল হইলে এবং জুমার পূর্বে দাফন করা সম্ভব হইলে জুমার পূর্বে দাফন করাই ভাল। বেশি মানুষ হইবার ধারণায় বিলম্ব করা মাকরুহ। *—বিনা জানাজায় দাফন হইয়া গেলে, যতদিন পর্যন্ত ফুলিয়া ফাটিয়া যাইবার আশঙ্কা না হয়, ততদিন পর্যন্ত কবরের নিকট জানাজা পড়িতে হইবে। উহার নির্ধারিত কোন সময় সীমা নাই। কারণ, অনেক স্থানে শীঘ্র ফাটিয়া যায়। আবার, অনেক স্থানে বিলম্ব হয়। শীতকালে ফাটিতে বিলম্ব হয়। গরম কালে শীঘ্র ফাটিয়া যায়। মূর্দা মোটা হইলে শীঘ্র ফাটিয়া যায়। মূর্দা স্বাস্থ্য ক্ষীণ হইলে ফাটিতে বিলম্ব হয়।
*—মসজিদে জানাজার নামাজ মাকরুহ তাহরিমী। ঈদগাহে জায়েজ। *—মাগরিবের নামাজের সময় জানাজা আসিলে ফরজ ও সুন্নাত পড়িয়া জানাজা পড়িবে। অন্য ফরজ নামাজের সময় আসিলে, যদি জামাত আরম্ভ হইবার সময় হয়, তাহা হইলে ফরজ ও সুন্নাত পড়িয়া জানাজা পড়িবে। অবশ্য মুর্দার দেহ খারাপ হইবার আশঙ্কা থাকিলে প্রথমে জানাজা পড়িয়া লইবে। *—ঈদের নামাজের সময় জানাজা আসিলে প্রথমে ঈদের নামাজ, তারপর জানাজা, তারপর খুৎবাহ। গ্রহণের নামাজের সময় আসিলে প্রথমে গ্রহণের নামাজ, তারপর জানাজা। *—কবরে কিছু বিছাইয়া দেওয়া জায়েজ নয়। মুর্দাকে সিন্দুকের মধ্যে রাখিয়া দাফন করা মাকরুহ। অবশ্য প্রয়োজনে জায়েজ রহিয়াছে যথা, মাটি খুবই নরম। সিন্দুকে ভরিয়া দাফন করিলে প্রথমে মাটি বিছাইয়া দেওয়া সুন্নাত। কবরের মাটি নরম হইলে ধূলা বিছাইয়া দেওয়া সুন্নাত। কাফনের বাঁধন না খুলিলে কোন দোষ নাই। *—দাফনের পর কবরের উপর পানি দেওয়া জায়েজ। অনেক স্থানে মাথার দিকে সামান্য পানি দিয়া পায়ের দিকে সমস্ত পানি ঢালিয়া দিয়া থাকে, ইহা ঠিক নয়। সব জায়গায় সমান দিবে। *—কবর অর্ধ হাতের বেশি উঁচু হইবে না। মরণের পূর্বে কবর তৈরি করিয়া রাখা অর্থহীন। অবশ্য কাফন ক্রয় করিয়া রাখিতে পারে। *—আউলিয়ায়ে কিরামগণের মাজারের উপর চাদর দেওয়া জায়েজ। ( তাফসীরে রুহুল বয়ান ৩য় খঃ ৪০০ পৃঃ রদ্দুল মুহতার ৬ খঃ ৩৬০ পৃঃ) *—কবর স্থানে মিষ্টান্ন বিতরণ করা আদৌ উচিৎ নয়। চাউল, ডাল ও পয়সা দান করা ভাল। *—যে গ্রামে অথবা যে শহরে ইন্তেকাল হইয়াছে, সেখানকার কবর স্থানে দাফন করা মুস্তাহাব। দাফনের পর স্থানান্তরিত করা নাজায়েজ। বিনা অনুমতিতে অপরের মাটিতে দাফন করিলে, মালিক মুর্দাকে বাহির করিয়া দিতে পারে অথবা কবরকে সমান করিয়া দিয়া চাষ করিতে পারে। অনুরূপ চুরি করা কাপড়ে কাফন দিলে, মালিক মুর্দাকে কবর হইতে বাহির করিতে পারে। কোন ওয়ারিস কোন ওয়ারিসের অনুপস্থিতে মুর্দাকে অলংকার সহ দাফন করিয়া দিলে অনুপস্থিত ওয়ারিস কবর খুঁড়িতে পারে। কবরে কাহার কিছু মাল পড়িয়া গেলে দাফনের পর স্বরণ হইলে কবর হইতে বাহির করিতে পারে। যদিও উহার মূল্য এক দিরহাম হয়। *—কবরের উপর হইতে হাঁটিয়া আত্মীয়ের কবরের নিকট যাওয়া নিষেধ। অনেক উলামা মহিলাদের জিয়ারতে যাওয়া জায়েজ বলিয়াছেন। বুড়ি বরকত হাসেলের জন্য অলীদের কবরে যাইতে পারে। কিন্তু যুবতীদের জন্য নিষেধ। ইমাম আহমদ রেজা আলাইহির রহমাত মহিলাদের জিয়ারতে যাওয়া মূলতঃ নাজায়েজ বলিয়াছেন। *—মূর্দার নামাজ, রোজার পরিবর্তে কুরআন শরীফ দান করিয়া দিলে সম্পূর্ণ ফিদ্ইয়া আদায় হইবে না। অবশ্য কুরআন শরীফের মূল্যের পরিমাণ ফিদ্ইয়া আদায় হইয়া যাইবে। মরণ বাড়িতে তিন দিন পর্যন্ত শান্ত্বনা দিতে যাওয়া সুন্নাত। ইহার পর মাকরুহ। শোক পালনের জন্য কালো কাপড় পরিধান করা নাজায়েজ। তিন দিনের বেশি লোক জায়েজ নয়। কিন্তু স্বামীর ইন্তেকালের স্ত্রী চার মাস দশদিন শোক করিবে।
(সমাপ্ত)
বালাকোটে কাল্পনিক কবর
প্রথমে পাঠ করুন
যেমন সূর্যের সম্মুখে মেঘ দীর্ঘ স্থায়ী হইতে পারে না। মেঘ সাময়িক সূর্যকে ঢাঁকিয়া ফেলিলেও যথা সময় সূর্য প্রকাশ হইয়া যায়। অনুরূপ সত্যের সম্মুখে মিথ্যা দীর্ঘস্থায়ী হইতে পারে না। সাময়িক মিথ্যা সত্যকে ঢাঁকিয়া ফেলিলেও যথা সময় সত্য প্রকাশ হইয়া যায়। — ইতিহাস কাহারো বন্ধুত্ব বরণ করে না। কেহ ইতিহাসকে বন্ধুরূপে ব্যবহার করিতেও পারে না। ইতিহাস সব সময় সত্য ও সঠিক হইয়া প্রকাশ হইতে চায় এবং দোস্ত ও দুশমন নির্বিশেষে যাহাকে যে অবস্থায় দেখিয়া থাকে, তাহার সেই অবস্থা অবিকল বর্ণনা করিয়া দেয়, — ভারত বিভক্ত হইবার পূর্ব পর্যন্ত ভারতবাসী মুসলমানেরা জানিত যে, ইসলামের ঘোর শত্রু বৃটিশের চক্রান্তে 'ওহাবী ফিরকা'র জম্ম হইয়াছে। ইহা কোন হিংসা ও ঈর্ষার কথা নয়, স্বয়ং ওহাবীরা স্বীকার করিয়াছে যে, তাহারা বৃটিশ সরকারের কাছে আবেদন করিয়া নিজেদের 'ওহাবী' নামের পরিবর্তে 'আহলে হাদীস' নাম অনুমোদন করিয়াছিল। (মুকাদ্দামায়ে হায়াতে সাইয়েদ আহমাদ পৃঃ ২৬, প্রফেসর মুহাম্মদ আইয়ুব ক্বাদেরী নফীস একাডেমী করাচী হইতে ছাপা) বৃটিশের তত্ত্বাবধানে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী ও ইসমাইল দেহেলভীর মাধ্যমে ভারতে ওহাবীয়াতের বীজ বপন করা হইয়াছিল। ধুরন্ধর বৃটিশ সুকৌশলে সর্বদিক দিয়া এই ওহাবী ফিরকাকে পুষ্টি ও বলিষ্ঠ করিয়া সীমান্ত এলাকায় পাঠানদের দেশে প্রেরণ করিয়াছিল। একদিকে যেমন এই ওহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে জিহাদের নামে সীমান্তে প্রদেশে তাহাদের দুই বড় শত্রু মুসলমান পাঠান ও শিখদের ঘায়েল করিয়াছে। তেমনই অপর দিকে মুসলমানদিগের মধ্যে দিনের জন্য চিড় ধরাইয়াছে। ১৯৪৭ সাঃ পর্যন্ত উলামায়ে দেওবন্দ ব্রিটিশের দোস্ত হিসাবে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলবী ও ইসমাঈল দেহেলভীর প্রতি গৌরব করিয়াছেন। ইহার পর হইতে ব্রিটিশের দুশমন প্রমাণ করিবার জন্য ধারাবাহিক মিথ্যা বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন। বিশেষ করিয়া পাকিস্তান স্বাধীন হইবার সাথে সাথে শত বৎসরের সমস্ত রেকর্ড ও ইতিহাসকে পরিবর্তন করিবার অপবিত্র মানসিকতা লইয়া সর্বপ্রথম গোলাম রসুল মেহের কল: ধরিয়া ছিলেন। তিনি তাহার পুস্তকাদীতে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলবী ও ইসমাঈল দেহেলভীর ওহাবী আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন ও উহাদের ইংরেজ দুস্তীকে ইংরেজ দুশমনী নামে পরিবর্তন করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। মেহর সাহেবের অনুকরণে উর্দু ও বাংলা ভাষায় যে সমস্ত পুস্তকাদি লেখা হইয়াছে। তন্মধ্যে একটি হইল 'রক্ত রাঙা বালাকোট' লেখক আজিজুল হক কাসেমী প্রসঙ্গত উল্লেখ করিতেছি, আমি আমার 'ইমাম আহমাদ রেজা' পত্রিকায় রক্তে রাঙা বালাকোটকে ধারাবাহিক তুলা ধুনা করিতে আরম্ভ করিয়াছি। লেখকের আরো একটি পুস্তক 'হাজের-নাজের প্রসঙ্গ' কে এমনই ডিম ভাঙ্গার ন্যায় চূর্ণ করিয়া দিয়াছি যে, লেখক তাহার উত্তর প্রস্তুত করিতে না পারিয়া কেবল এই বলিয়া প্রাণ বাঁচাইয়াছেন যে, 'পশ্চিম বাংলার রেজাখানী নেতা গোলাম ছামদানী সাহেব তাঁহার পত্রিকায় আমার 'হাজের নাজের প্রসঙ্গ' বইয়ের জওয়াব দাও: প্রহসন করিয়াছেন। ('আপবাদ ও প্রতিবাদ খণ্ডন' ১১৪ পৃঃ) দেওবন্দী লেখকেরা তাহাদের ধর্মগুরু সাইয়েদ ও ইসমাঈল দেহেলভীকে ইতিহাসের অপব্যাখ্যা করিয়া পীর মুজাহিদ, মুজাদ্দিদ ও শহীদ ইত্যাদি প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু কার্যত: উহাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ ও বিফল হইয়াছে। কারণ, প্রকৃত ইতিহাস প্রমাণ করিয়া থাকে যে, উহারা পীর সাজিয়া পাদ্রীর ভূমিকা অবলম্বন করিয়াছিলেন। জিহাদের নামে ইংরেজদের জয়ের ডংকা বাজাইয়া ছিলেন। সংস্কারের নামে মুসলমানদের সর্বনাশ করিয়া ছিলেন। এই দুর্নীতিবাজ অত্যাচারীরা শাহাদাতের পরিবর্তে মুসলমানদের হাতে নিহত হইয়া ছিলেন। — আসুন, ইতিহাসের আলোকে প্রমাণ করিতে যাই।
মুহাম্মদ গোলাম ছামদানী রেজবী
১৫-৫-৯৩
সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলবী
১২০১ হিজরী সফর মাসের ৬ তারিখ অনুযায়ী ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দের ২৯শে নভেম্বর সোমবার রায়ব্রেলবীতে সাইয়েদ আহমাদের জম্ম হইয়াছিল। (হজরত সৈয়দ আহমদ শহীদ ৪২ পৃঃ) সাইয়েদ আহমাদ অত্যন্ত বোকা ও বুদ্ধিহীন বালক ছিলেন। লেখা পড়ায় তাহার আদৌ উৎসাহ ছিল না। গোলাম রসুল মেহের লিখিয়াছেন, যখন সাইয়েদ সাহেবের বয়স চারি বৎসর চারি মাস চারিদিন হইয়াছিল। তখন তৎকালীন ভদ্র ঘরের নিয়ম অনুযায়ী তাহাকে মক্তবে পাঠানো হইয়াছিল। তাহাকে উপযুক্তভাবে শিক্ষিত করিয়া তুলিতে কোন প্রকার চেষ্টার ত্রুটি হয় নাই। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও লেখা পড়ার প্রতি তাহার কোন উৎসাহ ছিল না। (ডঃ সাঃ আঃ শহীদ পৃঃ ৪২) সাইয়েদ সাহেবের স্মৃতিশক্তি হীনতা সম্পর্কে মির্যা হায়রাত দেহলবী লিখিয়াছেন, "কারীমা বাহ বখশায়ে বর হালে মা" এই ছন্দটি মুখস্থ করিতে সাইয়েদ সাহেবের তিন দিন সময় লাগিয়াছিল। ইহার মধ্যে কখন 'কারীমা' ভূলিয়া গিয়াছেন, আবার কখন 'বর হালে মা' ভুলিয়া গিয়াছেন। (হায়াতে তাইয়্যেবা ৩৯০ পৃঃ) সাইয়েদ মুহাম্মদ আলী সাহেব লিখিয়াছেন, দীর্ঘ তিন বৎসরের মধ্যে সাইয়েদ সাহেব কেবল কুরআন শরীফের কয়েকটি সূরা পড়িতে এবং আরবী অক্ষরগুলি লিখিতে শিখিয়া ছিলেন।
* মৌলভী আব্দুল কাইউম বলিয়াছেন, কিতাব পাঠ করিবার সময় সাইয়েদ সাহেবের দৃষ্টি হইতে কিতাবের অক্ষরগুলি অদৃশ্য হইয়া যাইত। এই কথা শুনিয়া শাহ আব্দুল আজিজ উপদেশ দিয়াছিলেন, কোন সূক্ষ বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখ, উহা অদৃশ্য হইয়া যায় কিনা? পরীক্ষায় দেখা গেল, অতি সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতম বস্তুও তিনি দেখিতে পান। শাহ সাহেব বলিলেন, লেখা পড়া ছাড়িয়া দাও। ইহা কোন রোগ নয়। ইল্টে জাহিরী লাভ করা তাহার ভাগ্যে নাই। (হাঃ সাঃ আঃ শঃ ৪৩ পৃঃ) আরওয়াহে সালাসা ১২৬ পৃঃ)
(মাখযানে আহমদী ১২ পৃঃ) সাইয়েদ সাহেবের অন্যতম জীবনীকার মির্জা হায়রাত লিখিয়াছেন, তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা পড়া যপিবার পর সামান্য কিছু মুখস্থ হইত, আবার পর দিন তাহা ভুলিয়া যাইতেন। যখন সাইয়েদ সাহেবের এই অবস্থা হইল। তখন পিতা মাতা তাহাকে তিরস্কার ও মারপিট পর্যন্ত করিয়া ছিলেন। ইহাতেও পিতা মাতার আশা পূর্ণ হইল না। তাহারা লক্ষ করিয়া ছিলেন, আল্লাহর তরফ হইতে তাহার বুদ্ধিতে তালা লাগিয়া গিয়াছে। কোন প্রকার চেষ্টাতে পড়া হইবে না। তখন তাহারা বাধ্য হইয়া পড়া হইতে উঠাইয়া নিয়াছিলেন। (হায়াতে তাইয়েবা ৩৯১ পৃঃ) * মির্যা হায়রাতের ভাষায় বলা যায় যে, সাইয়েদ সাহেব একজন নাম করা নির্বোধ বালক ছিলেন। মানুষের ধারণা ছিল, তাহার লেখা পড়া শিক্ষা দেওয়া অর্থহীন হইবে। কখন কিছু শিখিতে পারিবে না। সায়েদ সাহেব কেবল বাল্যকালে লেখা পড়ার প্রতি অনাগ্রহী ছিলেন এমন কথা নয়। বরং তিনি যৌবন প্রাপ্তী পর্যন্ত কোন সময় লেখা পড়ার প্রতি আগ্রহী হন নাই। (হায়াতে তাইয়েবা ৩৮৯ পৃঃ) মির্যা হায়রাত লিখিয়াছেন, সাইয়েদ সাহেব ১৯ বৎসর বয়সে প্রথম বার লক্ষ্মৌ গিয়াছিলেন। যেখানে শিয়া ও সুন্নীর চরম মতবিরোধ। তখনও পর্যন্ত তিনি ঐ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মৌলিক মতভেদ কি তাহা জানিতেন না। যখন সাইয়েদ সাহেব জনৈক আমীরের নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন। তখন তিনি প্রশ্ন করিয়াছিলেন, আপনি 'খারিজী' না 'শিয়ানে আলী' ? ইহাতে সাইয়েদ সাহেব চঞ্চল হইয়া পড়িয়া ছিলেন। কারণ, এই শব্দ দুইটি সর্বপ্রথম তাহার কানে পড়িয়াছিল। তাই উহার অর্থ কি বুঝিতে পারেন নাই। ( হায়াতে তাইয়্যেবা ৩৯৫-৩৯৬ পৃঃ)
সাইয়েদ সাহেব প্রথম হইতে লেখা পড়ার প্রতি অমনোযোগী থাকিলে ও খেলাধুলা, হইহুল্লোড় অত্যন্ত পটু ছিলেন। মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী বলিয়াছেন,— বাল্যকাল হইতেই সায়েদ সাহেবের খেলার প্রতি ঝোঁক ছিল। খুব আগ্রহের সাথে হা-ডু-ডু খেলিতেন। কখনও বা বালকদিগকে দুই ভাগে ভাগ করিয়া দিতেন। একদল অন্য দলের দুর্গের উপর আক্রমণ করিত। (হাঃ সাঃ আঃ শঃ ৪৩ পৃঃ)
উল্লেখিত উদ্ধৃতিগুলির আলোকে দেখা যাইতেছে যে, সাইয়েদ সাহেব একজন অঞ্জনাদান মানুষ ছিলেন। তিনি জীবনে কোন সময় বিদ্যা অর্জন করিতে সক্ষম হন নাই। পরবর্তী জীবনে সাইয়েদ সাহেব মুসলমানদের একাংশের নিকট পীর ও খৃষ্টানদের নিকট পাদ্রী নামে খ্যাতি লাভ করিলেও নিজের মূর্খামির দাগ মুছিতে সক্ষম হন নাই।
শাহ আব্দুল আজীজের নিকট দীক্ষা গ্রহণ
অবিভক্ত ভারতের স্বনামধন্য মুহাদ্দিস ও আধ্যাত্মিক মুর্শিদ ছিলেন শাহ আব্দুল আজীজ। সাইয়েদ আহমাদ সাহেব শাহ আব্দুল আজীজের মাধ্যমে খ্যাতি লাভ করিবার উদ্দেশ্যে তাহার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মনোপ্রাণ দিয়া শাহ সাহেবকে মুর্শিদ বলিয়া মানিতেন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলিতেছি, যখন শাহ সাহেব সাইয়েদ সাহেবকে 'তাসাব্বুরে শায়েখ' করিবার আদেশ দিয়া ছিলেন। (অর্থাৎ পীরের অবর্তমানে তাঁহার আকৃতির দিকে ধ্যান মগ্ন হওয়া। যাহা 'ইল্মে মা'রেফাত' বা আধ্যাত্মিক বিদ্যার একটি অন্যতম স্তর।) তখন সাইয়েদ সাহেব সরাসরি শাহ সাহেবের বিরোধীতা করিয়া বলিয়া ছিলেন, আমি ইহা করিতে পারিব না। কারণ, তাসাব্বুরে শায়েখ এবং প্রতিমা পূজাতে কোন পার্থক্য নাই, যাহা জঘন্যতম কুফর ও শির্ক। শাহ সাহেব হাফিজ শীরাজির একটি কবিতা পাঠ করিয়া সাইয়েদ সাহেবকে উপদেশ দিয়াছিলেন যে, মুরীদ সর্বাবস্থায় মুর্শিদের আদেশ মানিতে বাধ্য। ইহাতে সাইয়েদ সাহেব বলিয়াছিলেন, আপনি যাহা আদেশ করিবেন তাহাই করিব। কিন্তু পীরের অবর্তমানে তাঁহার স্মরণাপন্ন হওয়া ও তাঁহার নিকট সাহায্য চাওয়া প্রকৃত প্রতিমা পূজা এবং প্রকাশ্য শির্ক। আমি উহা কখনই করিব না। (মাখযানে আহমদী ১৯ পৃঃ)—সুধী পাঠকবৃন্দ, নিশ্চয় আপনারা ভুলিয়া যান নাই, সাইয়েদ সাহেবের বিদ্যা ও বুদ্ধির ইতিহাস। যিনি কুরআন শরীফের কয়েকটি সূরা ব্যতীত কুরআন দেখিয়া পড়িতে পারিতেন না। 'কারীমা বাহ বখশায়ে বর হালে মা' এই ছন্দটি মুখস্থ করিতে যাহার তিন দিন সময় লাগিয়া ছিল। আবার ইতিমধ্যে কখন 'কারীমা আবার কখন 'বর হালেমা, ভুলিয়া যাইতেন। 'শায়ানে আলী' ও 'খারেজী' এর অর্থ যিনি জানিতেন না। যাহার চক্ষু হইতে অক্ষর অদৃশ্য হইয়া যাইত। সেই সুদক্ষ হা-ডু-ডু খেলোয়াড় সাইয়েদ সাহেব আজ শাহ আব্দুল আজীজ দেহেলভীর ন্যায় একজন জগৎ বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও মুর্শিদের প্রতি পরোক্ষ প্রতিমা পূজার অভিযোগ করিতেছেন এবং ইল্মে তাসাউফের অন্যতম স্তর 'তাসাব্বুরে শায়েখ' কে প্রকাশ্য কুফর ও শির্ক বলিতেছেন। আশাকরি আর কাহারো বুঝিতে বিলম্ব হইবে না যে, সাইয়েদ সাহেব যেমন জাহিরী বিদ্যাতে সুপণ্ডিত ছিলেন, তেমনই বাতিনী বিদ্যাতে পারদর্শিতা লাভ করিয়া ছিলেন।
উলামায়ে দেওবন্দ গাংগুহীকে বাঁচান
উলামায়ে দেওবন্দের নিকট 'আরওয়াহে সালাসা' একটি নির্ভরযোগ্য কিতাব। (যদিও আমাদের নিকট উহা সোনাভানের পূতি অপেক্ষা বেশি মূল্যের নয়) উক্ত কিতাবের ২৯০ পৃষ্ঠাতে আছে, একদা গাংগুহী সাহেব জোশের অবস্থায় ছিলেন এবং 'তাসাব্বুরে শায়েখ' সম্পর্কে আলোচনা করিতেছিলেন। তিনি বলিলেন, পূর্ণ তিন বৎসর হজরত ইমদাদুল্লার আকৃতি আমার অন্তরে ছিল। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা না করিয়া কোন কাজ করি নাই। অনুরূপ পূর্ণ তিন বৎসর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম আমার অন্তরে ছিলেন। তাঁহার বিনা জিজ্ঞাসায় আমি কোন কাজ করি নাই। যেমন সাইয়েদ সাহেবের উক্তি অনুযায়ী 'তাসাব্বুরে শায়েখ' প্রতিমা পূজার নামান্তর এবং প্রকাশ্য শির্ক ও কুফর। তেমন ফুরফুরার পীর আবু বক্কর সাহেবের ধারনায়ও উহা হারাম ও কুফর। পীর সাহেবের অসীয়ত নামায় রহিয়াছে 'জীবিত কি মৃত পীরের সুরাত হাজের-নাজের জানিয়া'- ধ্যান করা হারাম, যাহারা করে তাহারা বেইমান" দেওবন্দী লেখক আজীজুল হক কাসেমী সাহেব 'হাজের-নাজের প্রসঙ্গ' পুস্তকে ঊনচল্লিশ পৃষ্ঠায় পীর আবু বক্কর সাহেবের উক্ত অসীয়তের উদ্ধৃতি দিয়া লিখিয়াছেন, বেরেলবীদের নেতা আহমদ রেজা খান বলিতেছেন, তাহা হইলে পীর কোনো লময় মুরীদ হইতে পৃথক নহেন, সর্বক্ষণ সঙ্গে রহিয়াছেন।"........ অতএব ফুরফুরার পীর সাহেব কেবলার ফর্মূলা অনুযায়ী আহমদ রেজা খান সাহেব বেইমান কিনা চিন্তা করুন। — আজাজিলের গোলাম আজিজুল হক সাহেবকে বলিতেছি, আবু বাকার সাহেবের প্রাণহীন ভুয়া অসীয়ত অনুযায়ী ইমাম আহমদ রেজার ঈমানের বিচার করিবার অধিকার আপনার মত বেইমানের নাই। যদি আপনি সত্যিই সাইয়েদ আহমাদ ও আবু বকর সাহেবকে পীর বলিয়া মানেন, তাহা হইলে আপনাদের ইমামে রব্বানী রশীদ আহমদ গাংগুহী, যাহাকে 'তাসাব্বুরে শায়েখ' এর অপরাধে আসামীরূপে দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছি, তাহাকে পীর সাহেব দ্বয়ের ফর্মূলা অনুযায়ী প্রতিমা পূজক কাফের মোশরেক বেঈমান বলিবেন কিনা চিন্তা করুন।
দেওবন্দী সিলসিলার সর্বনাশ হইয়াছে
আজীজুল হক সাহেব লিখিয়াছেন,—"পাক ভারত উপমহাদেশে যাহারা 'ফেরকা নাজিয়া' বা 'জান্নাতী ফেরকা' তাহারা সকলেই হজরত শাহ ওলীউল্লাহর 'সিলসিলা' অর্থাৎ 'আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলে' জড়িত ও সংযুক্ত। আর যাহারা তাহার সিলসিলাভূক্ত নহে তাহারা 'ফেরকা নারিয়া' বা জাহান্নামী ফেরকা'র অন্তর্ভূক্ত।" (রক্তে রাঙ্গা বালাকোট খঃ ১ পৃঃ ৫৬)
যেহেতু আজীজুল হক সাহেবদের সিলসিলার উর্ধ্বতন পীর সাইয়েদ আহমাদ সাহেব এবং সাইয়েদ সাহেবের পীর শাহ আব্দুল আজীজ। যিনি শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসের পুত্র ও খলীফা। অতএব বগল বাজাইয়া গৌরব করিতে আর বাধা কোথায়? এই মুহূর্তে এ বিষয় বিশেষ কিছু বলিবার অবকাশ নাই। কেবল সিলসিলার সর্বনাশের সামান্য কারণ দেখাইয়া ইতি করিব। আগুন ও পানির সঙ্গে যেমন কোন সমঝোতা নেই, তেমন ঈমান ও কুফরের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। কোন মৌলিক বিষয়ে পীর ও মুরীদের মত ও পথ পৃথক হইলে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিন্ন হইয়া যায়। শাহ সাহেবের 'তাসাব্বুরে শায়েখ' এর মসলাকে শির্ক ও কুফর বলিবার সাথে সাথে সাইয়েদ সাহেবের সিলসিলা সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব পাক ভারত উপমহাদেশে সাইয়েদ সাহেবের মাধ্যমে যাহাদের সিলসিলা শাহ ওয়ালিউল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে, তাহারা 'জান্নাতী ফিরকা' না 'জাহান্নামী ফিরকা' তাহা বিবেচনা করিয়া দেখিবেন।
ইসমাঈল দেহলবী
১২ই রবিউস্ সানী ১১৯৩ হিজরী অনুযায়ী ১৭৭৯ সালে মাওলানা ইসমাঈল দেহেলভীর জন্ম হইয়াছিল। (হায়াতে তাইয়েবা ৩২) ইসমাঈল সাহেব শাহ আব্দুলগনীর পুত্র ও শাহ আব্দুল আজীজের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং শাহ ওলীউল্লাহর পৌত্র ছিলেন। তিনি সাইয়েদ আহমাদের ন্যায় নিরক্ষর ও মূর্খ ছিলেন না। শাহ আবদুল গনী ও শাহ আব্দুল আজীজের নিকট হইতে বিদ্যা শিক্ষা করিয়া উপযুক্ত আলেম হইয়াছিলেন। অবশ্য প্রথম জীবনে সাইয়েদ আহমাদের ন্যায় রং তামাশা ও খেলাধুলার প্রতি তাহার খুবই আগ্রহ ছিল। আরওয়াহে সালাসা'র ৮৯ পৃষ্ঠাতে আছে, 'তিনি সমস্ত প্রকার খেলা করিতে এবং হিন্দু, মুসলমানের সমস্ত মেলা-উৎসবে উপস্থিত হইতেন"। পরবর্তী জীবনে ওহাবী মতবাদ গ্রহণ গোমরাহ হইয়াছিলেন। যাহার কারণে ওলীল্লাহ খান্দান আজও কলঙ্ক হইয়া রহিয়াছে। তাহার লিখিত 'তাকবীয়াতুল ঈমান' কিতাবকে কেন্দ্র করিয়া আজও পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলমানেরা গৃহ যুদ্ধে রত রহিয়াছেন। এই অপবিত্র কিতাবে আউলিয়ায়ে কিরাম ও আম্বিয়া আলাইহিস্ সালামগণকে চরমভাবে অবমাননা করা হইয়াছে। যাহার কারণে শাহ ওলীউল্লাহর পৌত্র ও আব্দুল আজীজের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ মাখসু সুল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী ও শাহ মুহাম্মদ মুসা দেহলবী ইসমাঈল সাহেবের সহিত সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছিলেন। এবং তাহার ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডনে বহু পুস্তকাদিও লিখিয়াছিলেন। বিশেষ করিয়া শাহ মাখসুসুল্লাহ মুহাদ্দিস 'তাকবীয়াতুল ঈমান' এর খণ্ডনে 'মুঈদুল ঈমান' লিখিয়াছিলেন। যাহাতে প্রমাণ হয় যে, শাহ সাহেবের খান্দান 'তাকবীয়াতুল ঈমান' এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। শাহ আব্দুল আজীজের অন্যতম শিষ্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক আল্লামা ফজলে হক খয়রাবাদী দিল্লীর জামে মসজিদে মোনাজারা করিয়া ইসমাঈল সাহেব কে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করিয়াছিলেন এবং 'তাকবীয়াতুল ঈমান' এর খণ্ডনে 'তাহকীকুল ফাতাওয়া ফি ইবতালিত তাগা' নামক বৃহৎ কিতাব লিখিয়া ইসমাঈল সাহেবকে গোমরাহ কাফের মুরতাদ প্রমাণ করিয়া দিয়াছেন। পাক ভারত উপমহাদেশের উলামাগণ 'তাকবীয়াতুল ঈমান' এর খণ্ডনে শতাধিক কিতাব লিখিয়া ইসমাঈল দেহলভীর গোমরাহী দিবালোকের ন্যায় প্রকাশ করিয়া দিয়াছেন।
শাহ আব্দুল আজীজের যুগে
শাহ সাহেব বেঁচে থাকা অবস্থায় ইসমাঈল সাহেব ওহাবী মতবাদ লইয়া বিশেষ বাড়াবাড়ি না করিলেও একেবারে নীরব ছিলেন না। তিনি ইমামগণের তাকলীদ অস্বীকার করতঃ 'রাফয়ে ইয়াদাইন' (রুকু ও সিজদার পূর্বে হাত উঠানো) আরম্ভ করিয়াছিলেন। এবং ইহার স্বপক্ষে কিতাবও লিখিয়াছিলেন। মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও আহমাদ আলী সাহেব এ বিষয়ে শাহ সাহেবকে অবগত করিলে তিনি বলিয়াছিলেন, আমি দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি। আমার পক্ষে মোনাজারা করা সম্ভব নয়। তোমরা তাহার সহিত মোনাজারা করিয়া নাও। পরে শাহ সাহেবের ভাই শাহ আব্দুল কাদের সাহেব মৌলভী ইয়াকুব সাহেবের মাধ্যমে ইসমাঈল সাহেবকে 'রাফয়ে ইয়াদাইন' ত্যাগ করিতে বলিয়াছিলেন যে, উহাতে অযথা ফেৎনা হইবে। তিনি উত্তর দিয়াছিলেন, যদি সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তির দিকে লক্ষ করা হয়, তাহা হইলে সেই হাদীসের অর্থ কি হইবে? যাহাতে বলা হইয়াছেন,— আমার উম্মতের ফাসাদের সময় যে আমার সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করিবে সে একশত শহীদের সওয়াব পাইবে। কারণ, মৃত সুন্নাতকে জীবিত করিলে সাধারণ মানুষের মধ্যে অবশ্যই হাঙ্গামা হইবে। ইহা শুনিয়া শাহ আব্দুল কাদের সাহেব বলিয়াছিলেন, বাবা আমি ধারণা করিয়া ছিলাম ইসমাঈল আলেম হইয়া গিয়াছে। কিন্তু সে একটি হাদীসের অর্থও বুঝিতে পারে নাই। এই হাদীস তো সেই সময় প্রযোজ্য হইবে, যখন সুন্নাতের বিপরীত জিনিস সুন্নাতের মোকাবেলা করিবে। আমরা যাহা করিতেছি তাহা তো সুন্নাতের বিপরীত নয়, বরং সুন্নাত। উহার পর ইসমাঈল সাহেব নিরুত্তর হইয়াছিলেন। (আরওয়াহে সালাসা ৯৪/৯৫ পৃঃ)
কারামত আলী জৌনপুরী
আজিজুল হক কাসেমী কারামত আলী জৌনপুরী সাহেবের 'জখিরায়ে কারামত' কিতাবের ২য় খণ্ডের ২২৪ উদ্ধৃতি দিয়া লিখিয়াছেন, "হজরত ইসমাঈল শহীদের জামানার হানাফী আলেমগণ অত্যন্ত গোড়ামী করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, যাহারা 'রাফয়ে ইয়াদায়েন' করিত তাহাদিগকে তাহারা গুমরাহ এমন কি অমুসলমান মনে করিত। হজরত ইসমাঈল শহীদ (র:) এই ভ্রান্ত মনোভাবের প্রতিবাদে আরবী ভাষায় এই (তানবিরুল মোয়নায়েন নামক) পুস্তিকা প্রণয়ন করিয়াছিলেন। আর তিনি নিজেও 'রফে ইয়াদায়েন' করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার পীর হজরত সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (র:) তাঁহাকে বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে, গোড়ামীর প্রতিবাদের জন্য আপনার বই লেখাই যথেষ্ট। কিন্তু আমরা যখন হানাফী এবং হানাফীদের 'রফে ইয়াদায়েন' না করিবার পক্ষেও যখন হাদীস শরীফ এবং জোরদার যুক্তিসমূহ রহিয়াছে, তখন আপনার 'রফে ইয়াদায়েন' করিবার প্রয়োজন নাই। ইহাতে তিনি তাহা ত্যাগ করিয়া দিয়া ছিলেন। (রক্তে রাঙা বালাকোট ৭৭ পৃঃ)—উল্লেখিত উদ্ধৃতিটি করুণভাবে কারামত আলী জৌনপুরীর বিবরণকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রমাণ করিতেছে। কারণ, (১) ইসমাঈল সাহেবের যুগের হানাফী আলেমগণ কেবল 'রফে ইয়াদায়েন' করিবার কারণে গোমরাহ ও অমুসলমান বলিতেন, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এবং হানাফী উলামাদের প্রতি জঘন্যতম অপবাদ বৈ কিছুই নয়। ইহার কোন উপযুক্ত দৃষ্টান্ত দিতে পারিবেন কি? (২) যদি হানাফী উলামাগণ কোন মসলাতে গোড়ামী করেন বা দৃঢ়তা দেখান, তাহা হইলে হানাফী মাজহাব ত্যাগ করিয়া অন্য মাজহাব অবলম্বন করা কি? জায়েজ হইবে। জবেহ করিবার পর পেটের মরা বাচ্চাটি খাওয়া হানাফী মাজহাবে হারাম বলা হইয়াছে হানাফী আলেমগণ এই মসলাতে দৃঢ়তা দেখাইলে কি কাহারো জন্য উহা খাওয়া জায়েজ হইবে? (৩) সাইয়েদ সাহেবের কথা মত ইসমাঈল সাহেব 'রফেইয়াদাইন' ত্যাগ করিয়াছিলেন, ইহা সত্য বলিয়া মনে হয় না। কারণ, 'আরওয়াহে সালাসাতে' ইহার কোন উল্লেখ নাই। কেবল বলা হইয়াছে, তিনি শাহ সাহেবের যুক্তির কাছে পরাস্ত হইয়া নিরুত্তর হইয়া ছিলেন।
(৪) উপমহাদেশে ইল্মে জাদিরী ও বাতিনীর সমুদ্র ছিলেন শাহ আব্দুল আজীজ। শাহ সাহেবের ন্যায় মহান চাচার নিকট মুরীদ না হইয়া সাইয়েদ সাহেবের ন্যায় একজন নিরক্ষর জাহেলের নিকট ইসমাঈল সাহেবের মুরীদ হইবার উদ্দেশ্য তো ইহাই ছিল যে, সাইয়েদ সাহেবকে পুতুল হিসাবে ব্যবহার করিতে পারিবেন। যাহা শাহ সাহেবের নিকট সম্ভব নয়। যিনি শাহ আব্দুল আজীজের জীবদ্দশায় 'রফে ইয়াদাইন' করিতে ও শাহ আব্দুল কাদেরের সহিত তাহার অলক্ষে থাকিয়া মোনাজারা করিবার স্পর্ধা পাইয়াছেন, তিনি সাইয়েদ আহমাদের কথায় 'রফে ইয়াদাইন' ত্যাগ করিয়া ছিলেন, ইহা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। — অবিভক্ত ভারত সবসময় হানাফী প্রধান দেশ। এখানে অন্য কোন মাজহাবের অস্তিত্ব নাই। শাফয়ী মাজহাব অবলম্বীদের সংখ্যা অতি নগণ্য। যাহারা 'রফে ইয়াদাইন' করিয়া থাকে, তাহারা অধিকাংশই ওহাবী লামাজহাবী। ইহাদের সহিত কেবল হানাফীদের নয়, সমস্ত মাজহাবের মৌলিক মতভেদ রহিয়াছে। ইসমাঈল দেহলভী ছিলেন এই ওহাবীদের পৃষ্টপোষক। বর্তমানে উলামায়ে দেওবন্দ ও তাবলিগী জামাআত হানাফী বলিয়া দাবি করিলেও প্রকৃতপক্ষে ইহারা ওহাবী ও প্রকাশ্য ওহাবীদের পৃষ্টপোষকতা করিতেছে।
পীর ও মুরীদের রাজনৈতিক জীবন
সাইয়েদ আহমাদ ও ইসমাঈল দেহেলভী ইংরেজদের নিমকখোর দালাল ছিলেন। ইহারা শিখ ও মুসলমানদের সহিত একাধিক যুদ্ধ করিয়া ইসলামের ঘোর শত্রু ইংরেজদের রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হইতে সাহায্য করিয়াছিলেন। বৃটিশের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদী মনোভাবকে নষ্ট করিয়া ছিলেন। বৃটিশের রাজত্বকে নিজেদের রাজত্ব মনে করিতেন। সাইয়েদ আহমাদের জীবনীকার জাফর থানেশ্বরী লিখিয়াছেন, "ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করিবার ইচ্ছা সাইয়েদ সাহেবের আদৌ ছিল না। তিনি বৃটিশের রাজত্বকে নিজের রাজত্ব মনে করিতেন। ইহাতে সন্দেহ নাই যে, সে যদি ইংরেজ সরকার এই সময় সাইয়েদ সাহেবের বিরুদ্ধে হইতেন, তাহা হইলে হিন্দুস্থান হইতে সাইয়েদ সাহেবের নিকট কোন সাহায্য যাইত না। কিন্তু ইংরেজ সরকার এই সময় চাহিয়াছিল যে, শিখদের শক্তি কম হইয়া যাক।" (সাওয়ানেহে আহমদী ১৩৯ পৃঃ)— দেওবন্দী জগতে খ্যাতিসম্পন্ন আলেম ও তর্কবাগীশ মঞ্জুর নোমানী পর্যন্ত উল্লেখিত উদ্ধৃতির সহিত একমত। তিনি লিখিয়াছেন,— "তিনি সাইয়েদ সাহেব ইংরেজদের বিরোধীতা করিতে ঘোষণা করেন তাই বরং কলিকাতায় অথবা পাটনায় উহাদের সাহায্য করিবার কথা প্রকাশ করিয়াছেন। আরো ইহাও প্রচার রহিয়াছে, ইংরেজরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাহার সাহায্য করিয়াছেন। (আলফুরকান শহীদ নং ৭৮ পৃঃ) জাফর থানেশ্বরী আরো লিখিয়াছেন, তাহার (সাইয়েদ সাহেবের) জীবনীগুলিতে এবং চিঠিপত্র বিশেষ বেশি স্থানে পাওয়া গিয়াছে, সাইয়েদ সাহেব প্রকাশ্যে ও খোলামেলাভাবে শরীয়তের দলীল দিয়া তাহার অনুসরণকারীদের ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা করিতে নিষেধ করিয়াছেন (সাওয়ানেহে আহমদী ২৪৬ পৃঃ) সাইয়েদ সাহেবের উক্তি নকল করিয়া জাফর সাহেব লিখিয়াছেন' "আমরা কোন্ কারনে ইংরেজ সরকারের সহিত যুদ্ধ করিব? এবং মাজহাবী কানুন বিরোধীভাবে বিনা কারণে উভয় পক্ষের রক্ত ঝরাইব? (সাওয়ানেহে আহমদী ৭১ পৃঃ)— মির্জা হায়রাত দেহলভী লিখিয়াছেন, "কলিকাতায় যখন মাওলানা ইসমাঈল জিহাদ সম্পর্কে বক্তৃতা আরম্ভ করিয়াছিলেন। এবং শিখদের অত্যাচার সম্পর্কে বলিতেছিলেন, তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আপনারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া দেন না কেন? তিনি উত্তর দিয়া ছিলেন, উহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কোন প্রকারে ওয়াজিব নয়। প্রথমতঃ আমরা উহাদের প্রজা। দ্বিতীয়তঃ আমাদের মাজহাবী ক্রিয়াতে সামান্য বাধা প্রদান করে না। উহাদের রাজত্বে আমাদের সর্বদিক দিয়া স্বাধীনতা রহিয়াছে। বরং উহাদের প্রতি যদি কেহ আক্রমণ করে, তাহা হইলে মুসলমানদের উপর ফরজ যে, উহার সহিত যুদ্ধ করিবে এবং নিজেদের বৃটিশ সরকারের প্রতি আঘাত আসিতে দিবে না। (হায়াতে তাইয়্যেবা ২৯১ পৃঃ) অনুরূপ জাফর থানেশ্বরী সাওয়ানেহে আহমদী ৭৭ পৃষ্ঠায় ইসমাঈল দেহলভীর ফতওয়া নকল করিয়াছেন, "ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করা কোন প্রকারে জায়েজ নয়।" —মির্জা হায়রাত লিখিয়াছেন, "লর্ড হিস্টিংগ সাইয়েদ আহমাদের অসাধারণ কর্ম দক্ষতায় সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। দুই সৈন্য দলের মাঝখানে ফকটি তাঁবু করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে তিন ব্যক্তি, আমীরখান ও লর্ড হিস্টিংগ এবং সাইয়েদের আপষে চুক্তি হইয়াছি। সাইয়েদ আহমাদ সাহেব অতি কষ্টে আমীরখানকে বোতলে ভরিয়া ছিলেন। (হায়াতে তাইয়েবা ২৯৪ পৃঃ) মির্জা সাহেবের উক্তি হইতে ভালই বুঝা যায় যে, ইংরেজদের প্রতি যাহা অসম্ভব হইত তাহাদের এজেন্ট সাইয়েদ সাহেব তাহা সম্ভব করিয়া দিতেন। আমীরখান ইংরেজ বিরোধী ছিলেন। লর্ড সাহেব উহাকে স্বপক্ষে করিতে পারেন নাই। তাই সাইয়েদ সাহেবের মাধ্যমে আমীরখানকে স্বপক্ষে করা হইয়াছিল। এই প্রকার এজেন্টের জন্য সরকারী রেশনের সুব্যবস্থা হইবে কিনা? বর্তমানে দেওবন্দী জগতের মহান চিন্তাবিদ আবুল হাসান আলী নদভী সাইয়েদ সাহেবের একটি কাফেলা সম্পর্কে লিখিয়াছেন, "একজন ইংরেজ ঘোড়ায় চড়িয়া কয়েক পাল্কী খাদ্য লইয়া নৌকার নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, পাদরী সাহেব কোথায়? হজরত (সাইয়েদ সাহেব) নৌকা হইতে উত্তর দিলেন, আমি এখানে উপস্থিত রহিয়াছি। ইংরেজ ঘোড়া হইতে নামিয়া টুপী হাতে লইয়া নৌকায় আসিয়া কেমন আছেন? জিজ্ঞাসা করিবার পর বলিলেন, তিন দিন হইতে আমি আমার কর্মচারীকে এখানে রাখিয়াছি সে আমাকে আপনার সম্পর্কে অবগত করিয়া দিবে। আজ সে আমাকে জানাইয়াছে যে খুবই সম্ভব আজ হজরত কাফেলার সঙ্গে আপনার বাড়ীর সামনে উপস্থিত হইবেন। এই সংবাদ পাইয়া সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি খাদ্য তৈরি করিতে ব্যস্ত ছিলাম। তৈরি করিয়া আনিয়াছি সাইয়েদ সাহেব নিজেদের পাত্রে খাদ্য ঢালিয়া নিতে আদেশ করিলেন। কাফেলার সবাইকে খাদ্য বন্টন করিয়া দেওয়া হইল। ইংরেজ দুই তিন ঘণ্টা থাকিয়া চলিয়া গেলেন। (সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ১৯০ পৃঃ)—সুধী পাঠকবৃন্দ ইনসাফ করিয়া বলুন। উল্লেখিত উদ্ধৃতিগুলি হইতে কি প্রমাণ হয় না সে সাইয়েদ সাহেব ও ইসমাঈল দেহেলভী পীর সাজিয়া পাদ্রীর দায়িত্ব পূর্ণভাবে পালন করিয়া ছিলেন। ইহার পরেও উলামায়ে দেওবন্দ ইহাদিগকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বলিয়া চিহ্নিত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। দেওবন্দী লেখক আজীজুল হক কাসেমী সাহেব লিখিয়াছেন' "হজরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রেঃ, ভারত বর্ষে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জেহাদ করিয়াছিলেন। সীমান্ত প্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হইতে কাজ আরম্ভ করিয়াছিলেন। প্রথমে রঞ্জিত সিংহের নিকট হইতে সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাবকে মুক্ত করিতে সাইয়া তিনি বালাকোটের যুদ্ধ ক্ষেত্রে শহীদ হন "। (রক্তে রাঙা বালাকোট ৩২ পৃঃ) দেওবন্দীদের শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমাদ (নকলী) মাদানী সাহেব ইসমাঈল দেহলভীর জেহাদের উদ্দেশ্য বর্ণনা করিতে গিয়া লিখিয়াছেন, "সেহেতু সাইয়েদ সাহেবের আসল উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষ হইতে ইংরেজদের রাজত্ব এবং শক্তিকে সমূলে নির্মূল করা, যাহার কারণে হিন্দু, মুসলমান উভয়েই চঞ্চল ছিল। এই কারণে তিনি তাহার সহিত অংশগ্রহণ করিতে হিন্দুদেরও আহ্বান করিয়াছিলেন এবং পরিস্কার বলিয়া দিয়া ছিলেন, তাহার একমাত্র উদ্দেশ্য দেশ হইতে বিদেশীদের শক্তিকে ধ্বংস করিয়া দেওয়া। ইহার পর রাজত্ব কাহার হইবে? ইহাতে তাহার কোন উদ্দেশ্য নাই। সেই মানুষ রাজত্বের উপযুক্ত হইবে, হিন্দু অথবা মুসলমান অথবা উভয়েই, সেই রাজত্ব করিবে। (নকলে হায়াত ২ খঃ ১৩ পৃঃ)—
দেওবন্দী লেখকদের কলমে লেখা ইতিহাস হইতে প্রমাণ হয় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে সাইয়েদ আহমাদ ও ইসমাঈল দেহলভীর কোন অবদান থাকা তো দূরের কথা, এই সংগ্রামের সহিত উহাদের দূরের সম্পর্কও ছিল না। যদি মূহুর্ত কালের জন্য মানিয়া নেওয়া হয় যে, উহারা সংগ্রাম করিয়াছিলেন। তাহা হইলে প্রশ্ন জাগিবে এই সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল কি? আজীজুল হক সাহেব বলিয়াছেন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আজীজুল হক সাহেবদের শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ সাহেব বলিয়াছে, সেকুলার ষ্টেট বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কায়েম করা। ইসলামী রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মধ্যে আকাশ ও পাতালের ব্যবধান রহিয়াছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কায়েম করিবার জন্য প্রাণ দিলে শহীদ হইবে না। শায়খুল ইসলামের তুলনায় আজীজুল সাহেব শিশু তুল্যও নয়, অতএব প্রমাণ হইল যে, সাইয়েদ সাহেব ও ইসমাঈল দেহেলভী প্রকৃত শাহাদাত বরণ করেন নাই। বরং উহারা বিদেশী বিতাড়নের বিষে প্রাণ হারাইয়া ছিলেন। পরিশেষে আজীজুল হক সাহেবকে বলিতেছি, আপনার শায়খুল ইসলামের উক্তিকে মিথ্যা প্রমাণ করুণ। অন্যথায় এক হাত নিয়া নিজের কান ধরিয়া অপর হাত দিয়া নিজের গালে থাপ্পড় দিয়া আপনাদের (Aditor) সম্পাদক আল্লামা আমির উসমানীয় উক্তি হইতে উপদেশ গ্রহণ করুন। আল্লামা আমির উসমানী সাহেব লিখিয়াছেন,— "কোন সন্দেহ নাই, যদি মাননীয় উস্তাদ হজরত মাদানীর বর্ণনা সঠিক বলিয়া স্বীকার করা হয়, তাহা হইলে হজরত ইসমাঈলের শাহাদত নিছক মিথ্যা হইয়া যায়। পার্থিব কিছু চাঞ্চল্যতা দূরীভূত করিবার জন্য বিদেশী শক্তিকে ধ্বংস করিবার চেষ্টা করা আদৌ পবিত্র উদ্দেশ্য হইতে পারে না। এই উদ্দেশ্যে কাফের ও মোমেন সবাই সমান। এই প্রকার প্রচেষ্টায় মৃত্যুবরণ করা, ইসলামের পবিত্র শাহাদাতের সঙ্গে কি সম্পর্ক থাকিবে? এবং এই প্রকার চেষ্টার কারণে বিপদ সহ্য করিলে পরকালে সওয়াবের অধিকারী কেমন করিয়া হইবে? (সংগৃহীত জারদারি ২০ পৃঃ)
ইংরেজদের ইঙ্গিতে শিখদের সহিত যুদ্ধ
পূর্বে প্রমাণ হইয়াছে যে, ইংরেজদের সহিত সাইয়েদ সাহেব ও ইসমাঈল দেহলভীর অত্যন্ত সম্পর্ক ছিল। উহাদের বিরুদ্ধে ইহারা কোন সময় যুদ্ধ করিবার কল্পনাও করেন নাই। করেন, ইহারা ইংরেজদের রাজত্বকে নিজেদের রাজত্ব মনে করিতেন। ইংরেজরাও ইহাদের প্রতি সর্ব প্রকার সহানুভূতি ও সাহায্য করিত। সাইয়েদ সাহেব ও ইসমাঈল দেহেলভী শিখদের সহিত যে জিহাদ ঘোষণা করিয়াছিলেন, তাহা নিছক ইসলামের খাতিরে নয়, বরং ইংরেজদের ইঙ্গিতে। যেহেতু পাঞ্জাব, কাশ্মীর, সীমান্ত প্রদেশ ও সুলতান ইংরেজদের রাজত্বের বাহিরে ছিল। ইংরেজরা সমস্ত হিন্দুস্থানের উপর রাজত্ব করিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু ইহাতে প্রধান বাধা ছিল শিখ সম্প্রদায়। ইংরেজরা তাহাদের প্রধান শত্রু শিখ সম্প্রদায়কে পরাস্ত করিয়া সমস্ত হিন্দুস্তানে রাজত্ব কায়েম করিবার জন্য সাইয়েদ সাহেব ও ইসমাঈল দেহেলভীকে হাতিয়ার স্বরূপ ব্যবহার করিয়া ছিল। মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া লিখিয়াছেন, "ইংরেজদের অতি আশ্চর্য কৌশল ছিল যে, শিখদের প্রতি আক্রমণের জন্য হজরত শহীদ (ইসমাঈল) এর সুযোগ করিয়া দিয়াছিল। (কিতাব শাহ ইসমাঈল শহীদ ১৯৪ পৃঃ সংগৃহীত ইমতিয়াজে হক ১০৩ পৃঃ) শিখদের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য যাহাতে মুসলমানেরা বিনা দ্বিধায় ব্যাপক অংশগ্রহণ করিতে পারে, তাহার জন্য সাইয়েদ সাহেব কাল্পনিক ইলহাম (খোদাই নির্দেশ) প্রচার করিয়াছিলেন যে, "শিখ সম্প্রদায়ের ন্যায় দুশমনদের সহিত জিহাদের জন্য আমাকে নির্দেশ করা হইয়াছে এবং আমাকে জয় ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে।" (মাকতুব সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ২৭৩ পৃঃ) সাইয়েদ সাহেব আরো বলিয়াছেন, "মুসলমান কোন আমীর ও সরদারের সহিত আমার ঝগড়া ও বিরোধ নাই। কোন অভিশপ্ত কাফেরের সঙ্গে আমার ঝগড়া নাই, কোন ঈমানদারের সঙ্গেও নাই। কারণ, আমরা উহাদের প্রজা। বরং উহাদের স্বপক্ষে প্রজাদের অত্যাচার সমূলে নির্মূল করাই আমাদের দায়িত্ব" (মাকতুবাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, অনুবাদক সাখাওয়াত মির্জা ৩২ পৃঃ)- সূচতুর শয়তান জাতি বৃটিশ সরকার হিন্দুস্তানে তাহাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করিয়া উপলব্ধি করিয়াছিল যে, মুসলমানদের মাধ্যমে তাহাদের বিরুদ্ধে কোন দিন জিহাদ ঘোষণা হইতে পারে। তাই মুসলমানদের রণশক্তি দূর্বল করিবার উদ্দেশ্যে সাইয়েদ সাহেবের ন্যায় একজন পীর নামী পাদ্রীর মাধ্যমে জিহাদের নামে মুসলমানদের বিরাট একটা অংশকে একত্রিত করিয়া যুদ্ধবাজ শিখ সম্প্রদায়ের মোকাবেলা করিতে প্রেরণ করিয়াছিল। এই যুদ্ধে সাইয়েদ সাহেবের জয় ও পরাজয়ের মধ্যে ইংরেজদের উদ্দেশ্য অনিবার্যই সফল হইবে। কারণ, সাইয়েদ সাহেব জয়লাভ করিলে পাঞ্জাব সহজে ইংরেজদের আয়ত্তাধীন হইয়া যাইবে। আর পরাজয় হইলে মুসলমানদের রণশক্তি ধ্বংস হইয়া যাইবে। বাস্তবে ইংরেজদের উদ্দেশ্য সফল হইয়াছিল। সাইয়েদ সাহেবের জীবনীকার জাফর থানেশ্বরী লিখিয়াছেন, "পরিশেষে ১৮৪৫ সালে অর্থাৎ বালাকোটের যুদ্ধের ১৫ দিন পর সমস্ত পাঞ্জাব শিখদের হাত থেকে বাহির হইয়া আমাদের ন্যায়পরায়ণ সরকারের দখলে আসিয়া গিয়াছে।" (সাওয়ানে আহমদী ১৩৮ পৃঃ)— উলামায়ে দেওবন্দের দাবী যদি সত্য হয় যে, সাইয়েদ সাহেব খোদায়ী নির্দেশ প্রাপ্ত হইয়া ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শিখদের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন। তাহা হইলে একটি মৌলিক প্রশ্ন রহিয়া যায় যে, বালাকোটের যুদ্ধের শেষ ফলাফল কি হইয়াছিল? যদি সাইয়েদ সাহেবের জয়লাভ হইয়া থাকে, তাহা হইলে পাঞ্জাবে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হইয়া মুসলমানদের হাতে আসিল না কেন? আর যদি শিখদের জয়লাভ হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহাদের রাজত্ব সুদৃঢ় হইয়া দীর্ঘস্থায়ী হইল না কেন? বালাকোট যুদ্ধের মাত্র ১৫ দিন পর সমস্ত পাঞ্জাব ইংরেজদের অধীনে কেমন করিয়া আসিল? আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, ইতিহাসের আলোকে এই মৌলিক প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রদানকারী সাইয়েদ সাহেবের সিলসিলার কোন সুসন্তানের জম্ম হয় নাই।
মুসলমানের রক্ত পিপাসু পীর
খোদায়ী ইলহামে (নির্দেশে) নয়, ইংরেজদের ইমদাদে (সাহায্যে ও ইঙ্গিতে, প্রকৃত পীর নয়, খৃষ্টানদের পাদ্রী, সাইয়েদ আহমাদ সাহেব মুসলমানদের রক্তে রাঙা করিয়াছিলেন বহু ময়দান। এই সমস্ত মুসলমান রাজা ও প্রজাদের অপরাধ ছিল সুন্নী— হানিফা হওয়া, সাইয়েদ সাহেব ও ইসমাঈল দেহেলভীর আকায়েদ ওহাবী মতবাদ গ্রহণ করত। সাইয়েদ সাহেবকে আমিরুল মো'মেনীন বলিয়া সমর্থন না করা ইত্যাদি। সাইয়েদ সাহেব ঐ সমস্ত মুসলমানকে মুসলমান বলিয়া বিবেচনা করিতেন না। যাহারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লামের পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করিবার পর সাইয়েদ সাহেবকে আমিরুল মো'মেনীন বলিয়া স্বীকার করিত না। সাইয়েদ সাহেবকে না মানিবার কারনে সুন্নী মুসলমানদের প্রতি কাফের, মুর্তাদ ও মোনাফেক বলিয়া ফতোয়া প্রদান করিতেন। এবং উহাদের হত্যা করা ওয়াজিব ও উহাদের ধন সম্পদ খাওয়া হালাল বলিতেন। সাইয়েদ সাহেব নিজেকে সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি মনে করিতেন। সুতরাং তাঁহার একটি চিঠিতে লিখিয়াছেন, "সেই ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে গৃহীত, যে আমাকে আমিরুল মো'মেনীন' বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকে। আর যে আমাকে আমিরুল মো'মেনীন' বলিয়া স্বীকার করে না সে আল্লাহর দরবারে বিতাড়িত"। (মাকতুবাতে আহামাদী ২৪১ পৃঃ) মুনশী মুহাম্মদ হোসাইন বিজনুরী লিখিয়াছেন, "যখন পাঞ্জাবের কোন মুসলমান আমির ও আলেম সাইয়েদ সাহেবের প্রতি আকৃষ্ট হয় নাই, তখন তিনি উহাদের প্রতি কাফের বলিয়া ফতোয়া প্রদান করিয়াছিলেন। এই কুফরী ফতোয়া দেওয়ার জন্য পাঞ্জাবের সমস্ত আমির ও উলামাগণ অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন এবং উত্তর লিখিয়াছিলেন, আপনি ওহাবী মাজহাব অবলম্বী, আপনার নিকট বায়েত গ্রহণ করা উচিৎ নয়"। (ফরইয়াদে মুসলিমীন ৯৮ পৃঃ) সাইয়েদ সাহেব সর্বপ্রথম ইয়াগিস্তানের বাদশা ইয়ার মুহাম্মদ খানের সহিত যুদ্ধ করিয়া ছিলেন। (আরওয়াহে সালাসা ১৩৯ পৃঃ এই যুদ্ধে ইয়ার মুহাম্মদ খানের তিন শত মানুষ নিহত হইয়াছিল। সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ৫২৭ পৃঃ) ১৮৩০ সালে সাইয়েদ সাহেব ও ইসমাঈল দেহেলভী তাহাদের নিকট বায়েত গ্রহণের জন্য সরদার পায়েন্দা খানকে আহ্বান করিয়াছিলেন। ইহাতে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করিলে সাইয়েদ সাহেব তাহাকে কাফের বলিয়া ফতোয়া দিয়াছিলেন এবং যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছিলেন। (তারিখে তানাবুলিয়া ৪৯/৫০ পৃঃ। সাইয়েদ সাহেবের নিকট বায়েত গ্রহণ না করিবার কারনে সরদার খাদী খানকে মোনাফিক বলিয়া ফতোয়া দিয়াছিলেন (সাওয়ানেহে আহমাদী ২৪৩ পৃঃ) সাইয়েদ সাহেব বাল্যকাল হইতে মুসলমানকে কাফের বলিতে ও দাঙ্গা হাঙ্গামা করিতে অভ্যস্ত ছিলেন যথা সাইয়েদ সাহেবের জীবনীকার লিখিয়াছেন, "বস্তীর সমবয়স্ক বালকদিগকে ইসলামী লস্কররূপে সমবেত করিতেন জিহাদের নামে উচ্চস্বরে তকবীর ধ্বনি করিয়া মনগড়া কাফির সৈন্যদের উপর হামলা করিতেন"। (হঃ সাঃ আঃ শহীদ ৪৩ পৃঃ)
শিখদের সহিত সন্ধি
সীমান্তের মুসলমানেরা সাইয়েদ সাহেবের আক্বিদা ওহাবী মতবাদ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। সাইয়েদ সাহেবকে নিজেদের ন্যায় সুন্নী হানাফী মুসলমান ধারণা করতঃ প্রথমতঃ জানমাল দিয়া সর্বপ্রকার সাহায্য করিয়াছিলেন। উহাদের উদার সাহায্য ও সহানুভূতি দেখিয়া সাইয়েদ সাহেব ধারণা করিয়া ছিলেন যে, সীমান্তের মুসলমানেরা তাহাদের আক্বীদাহ মানিয়া লইয়াছেন। এই ভুল ধারনায় মুখর হইয়া সাইয়েদ সাহেব এবং তাহার সঙ্গীরা প্রকাশ্যে ওহাবী মতবাদ প্রচার করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। যখন সাইয়েদ সাহেব ও ইসমাঈল দেহেলভীর ওহাবী হওয়া দিবালোকের ন্যায় প্রকাশ হইয়া গেল। তখন সীমান্তের মুসলমানেরা ওহাবী মুজাহিদীনদের বিরুদ্ধে গোমরাহ ইত্যাদি ফতোয়া দিয়া সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছিলেন। এই সময় সাইয়েদ সাহেব শিখদের সহিত যুদ্ধ এড়াইয়া খাঁটি সুন্নী হানাফী মুসলমানদের প্রতি কাফের, মুনাফেক ও মুর্তাদ বলিয়া ফতোয়া দিতে এবং উহাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিয়া ছিলেন। সুতরাং সাইয়েদ সাহেব সরদার পায়েন্দাখানকে কাফের বলিয়া জিহাদ ঘোষণা করিয়া ছিলেন। পায়েন্দাখান পরাস্ত হইয়া তাহাদের চিরশত্রু শিখদের সহিত সন্ধি করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। সাইয়েদ মুরাদ আলী লিখিয়াছেন 'সরদার পায়েন্দাখান হরি সিংহকে নিম্নোরূপ ভাষায় চিঠি দিয়াছিলেন, খলীফা সাইয়েদ আহমাদ আমার দেশ দখল করিয়া লইয়াছেন। আপনি আমার সাহায্যে সৈনিক পাঠাইয়াছিল। আমি সব সময় আপনার অনুগত থাকিব। হরিসিংহ উত্তর দিয়াছিলেন, আমি সাহায্যের জন্য প্রস্তুত আছি কিন্তু একটি শর্তে যে, আপনার পুত্র জাহান্দাদ খানকে আমার নিকট বন্দক রাখিতে হইবে। তাহা হইলে আমাদের মধ্যে পরস্পর বিশ্বাস থাকিবে। সুতরাং সরদার পায়েন্দাখান নিজ পুত্রকে হরি সিংহের নিকট বন্দক রাখিয়াছিলেন। পায়েন্দাখানের সাহায্যে হরিসিংহের সৈন্য আসিয়া 'ফালড়াহ' নামক স্থানে ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছিল' (তারিখে তানাবুলিয়া ৫১/৫২ ৫৩ পৃঃ) ফালড়ার যুদ্ধে সাইয়েদ সাহেবের ভাগিনা সাইয়েদ আহমাদ আলী বেরেলবী সেনাপতি ছিলেন। সাইয়েদ সাহেবের সৈন্যদের শোচনীয় পরাজয় হইয়াছিল। (হাকায়েকে তাহরিকে বালাকোট ১৪৫ পৃঃ)
অত্যাচারীদের রক্তে রাঙ্গা বালাকোট
দুর্নীতিবাজ অত্যাচারী ওহাবী সাইয়েদ আহমাদ ও ইসমাঈল দেহেলভী জিহাদের নামে শত শত সুন্নী মজলুম মুসলমানদের রক্তে রাঙ্গা করিয়াছিলেন বহু ময়দান। ইহাদের পাপ পূর্ণ হইবার পর যথা সময়ে আল্লাহ তাআলা পাঠানদের হাতে উপযুক্তভাবে এই অত্যাচারীদের রক্তে রাঙ্গা করিয়াছিলেন বালাকোটের ময়দান, মুসলমানেরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিয়া ছিলেন যে, তাহাদের সম্মুখে দুই মহা শত্রুশক্তি দাঁড়াইয়া গিয়াছে। একটি হইল শিখ অপরটি হইল ওহাবী। শিখ সম্প্রদায় জান ও প্রাণের শত্রু। ওহাবী সম্প্রদায় ঈমান ও ইসলামের শত্রু। যেহেতু প্রাণের শত্রু অপেক্ষা ঈমানের অত্যন্ত মারাত্মক সেই হেতু প্রাণের শত্রু শিখদের সহিত সন্ধি করিয়া ঈমানের শত্রু ওহাবী সাইয়েদ আহমাদ ও ইসমাঈল দেহেলভী এবং উহাদের সৈন্য বাহিনীকে ১৮৩১ সালে ৬ই মে বালাকোটের ময়দানে নিপাত করিয়াছিলেন। আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সাইয়েদ আহমাদ বলিয়াছেন— "হিন্দুস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে যে পাহাড়ী সম্প্রদায় থাকে, উহারা সুন্নী মাজহাব হানাফী সম্প্রদায় যেহেতু এই পাহাড়ী সম্প্রদায় উহাদের (সাইয়েদ সাহেবের) আক্বায়েদের বিপরীত ছিল। এই কারনে ঐ ওহাবী (সাইয়েদ আহমাদ) পাহাড়ীদের এই কথার উপর আদৌ রাজী করাইতে পারেন নাই যে, উহাদের মসলা ভাল বলিয়া মানিয়া লইবে। কিন্তু পাহাড়ীরা শিখদের অত্যাচারে জর্জরিত হইয়াছিল। এই কারণে শিখদের উপর আক্রমণ করিবার জন্য ওহাবীদের পরিকল্পনায় অংশ গ্রহণ করিয়াছিল। কিন্তু সেহেতু এই সম্প্রদায় মাজহাবী বিরোধীতায় অত্যন্ত কঠোর ছিল। সেইহেতু এই সম্প্রদায় শেষে ওহাবীদের সহিত প্রতারণা করিয়া শিখদের সহিত সন্ধি করতঃ মৌলভী মুহাম্মদ ইসমাঈল সাহেব ও সাইয়েদ আহমাদ সাহেবকে শহীদ করিয়া ছিল "। (মাকালাতে স্যার সাইয়েদ নবম খঃ ১৩৯/১৪০ পৃঃ)
স্যার সাইয়েদ আহমদের উক্তি হইতে আসল রহস্য প্রকাশ হইয়া গেল যে, অর্থ ও পার্থিব কারনে সাইয়েদ সাহেবের সহিত পাহাড়ীদের মতবিরোধ হইয়াছিল না। বরং সাইয়েদ সাহেবের ওহাবী মতবাদকে পাহাড়ীরা প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল। যাহার কারনে সাইয়েদ সাহেব পাহাড়ী হানাফীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করিয়া ছিলেন। পাহাড়ীরা রণকৌশল অবলম্বনে শিখদের সহিত সন্ধি করতে ইসলামের মহা শত্রু ওহাবী সাইয়েদ সাহেব ও তাহার বাহিনীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করিয়াছিল। হয়ত অনেকেই ধারণা করিতে পারেন যে, স্যার সাইয়েদ ইংরেজদের প্রভাবে, প্রভাবিত হইয়া সাইয়েদ আহমাদ সাহেবকে ওহাবী বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন। এই ধারণা কিন্তু আদৌ ঠিক নয়। সাইয়েদ সাহেব নিঃসন্দেহে ওহাবী ও ইংরেজদের এজেন্ট ছিলেন। যাহা দেওবন্দীদের পরম বুজুর্গ শায়েখ আব্দুল হক হাক্বানীর উক্তি হইতে প্রকাশ হয়। আব্দুল হক সাহেব তাফসীর হক্বানীর প্রথম খণ্ডে ১১২ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন- "সাইয়েদ আহমাদ প্রথম জীবনে শাহ ওলীউল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলভীর পৌত্র মৌলভী মাখসুসুল্লার খিদমতে আসিয়া সামান্য আরবী ব্যাকরণ শিক্ষা করিয়াছিলেন এবং তাবীজ ও ঝাড় ফুঁক করাও শিখিয়াছিলেন। কিন্তু যখন এই ব্যবসা চলিল না, তখন বৃটিশ সরকারের দিকে আগাইয়াছিলেন এবং খোদাপ্রদত্ত নিজ প্রতিভায় ভাল আসন ও পাইয়াছিলেন। তারপর পাক্কা ওহাবী ও মৌলভী ইসমাঈল সাহেবের অনুসারী হইয়া যান"।
বালাকোটে কাল্পনিক কবর
সাইয়েদ আহমাদ ও ইসমাঈল দেহেলবীর সত্যিকারে সমাধি হইয়াছিল কিনা তাহা নিশ্চয়তার সহিত বলা দুস্কর। ইতিহাসের ইঙ্গিত অনুযায়ী উপলব্ধি করা যায় যে, উহাদের স্বসম্মানে সমাধি হয় নাই'। পবিত্র জানাজাও ভাগ্যে জোটে নাই। শিখ ও পাঠানেরা পাষণ্ডদের পাপি দেহকে টুকরা টুকরা করিয়া উধাও করিয়া দিয়াছিলেন। আজ পর্যন্ত উলামায়ে দেওবন্দ উহাদের সমাধি সম্পর্কে সঠিক প্রমাণ পেশ করিতে সক্ষম হন নাই। বালাকোটে কাল্পনিক কবর দেখাইয়া সামান্য শান্তি লাভ করিয়া থাকেন।— সাইয়েদ সাহেবের সমাধি সম্পর্কে মতভেদী সূত্রে তিনটি স্থানের নাম উল্লেখিত হইয়াছে। 'বালাকোট' 'তালহাটা' ও 'হাবীবুল্লাহ দুর্গা' বালাকোটি সমাধি সম্পর্কে বলা হইয়াছে যে, ১৮৩১ সালে ৬ই মে শিখ ও পাঠানদের হাতে নিহত সাইয়েদ সাহেবের লাশকে সনাক্ত করিয়া শিখ সেনাপতি শের সিংহ বালাকোটে কানাহার নদীর তীরে দাফন করাইয়াছিলেন। যেমন গোলাম রসুল মেহের লিখিয়াছেন "কোন সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধের ময়দানে অনুসন্ধান করিয়া একটি লাশ সম্পর্কে বলা হইয়াছিল যে, ইহা সাইয়েদ সাহেবের মনে হইতেছে। উহার মস্তক ছিল না মাথা খুঁজিয়া মিলাইবার পর অবগত ব্যক্তিরা স্বীকার করিয়াছেন যে, ইহা প্রকৃত সাইয়েদ সাহেবের। উহা সম্মানের সহিত দাফন করা হইয়াছিল। শের সিংহ সৈন্য লইয়া চলিয়া গেলেন। শিখদের একটি দল পিছনে রহিয়াছিল। যখন রাত হইয়া গেল তখন ঐ আকালীরা উক্ত লাশকে কবর হইতে বাহির করিয়া নদীতে নিক্ষেপ করিয়া দিয়া ছিল। (সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ৮০৫ পৃঃ) জনাব মেহের সাহেব আরো লিখিয়াছেন' বর্তমানে বালাকোটের যে কবরকে সাইয়েদ সাহেবের কবর বলা হইয়া থাকে, উহার সম্পর্কে খুব বেশী এই বলা যাইতে পারে যে, উহাতে অথবা উহার আশেপাশে সাইয়েদ সাহেব কবরস্থ হইয়াছেন। একদিন একরাত অথবা দুইদিন দুইরাত এখানে কবরস্থ ছিলেন। তারপর তাহার লাশ কবর হইতে বাহির করিয়া নদীতে নিক্ষেপ করা হইয়াছে এবং কবর নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে"। (সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ৮০৬ পৃঃ) জনাব মেহর আরো লিখিয়াছেন যে, ১৮৯৩ সালে খান আজব, খান বেরাদার জাদা খান আরসালা ও খান জিদাহ সাইয়েদ সাহেব ও শাহ ইসমাঈল সাহেবের কবর অনুসন্ধান করতে চাহিয়াছিল। বয়স্ক ও জ্ঞানী মানুষদের একত্রিত করিয়া ভালভাবে সন্ধান করিয়াছিলেন। তারপর কম বেশি ৬২ বৎসর পর ঐ কবরগুলির নিদর্শন কায়েম করা হইয়াছে"। (সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ৮০৭ পৃঃ) এই ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতে মেহর মন্তব্য করতঃ লিখিয়াছেন—মোটকথা, বর্তমান কবর ৬২ বৎসর পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন থাকিবার পর তৈরী হইয়াছে। দৃঢ়তার সহিত কেহ বলতে পারবে না যে, প্রথমে কবর যেখানে ছিল ঠিক সেই স্থানে তৈরী হইয়াছে। যদি ঐ স্থানেই তৈরী হইয়া থাকে তাহা হইলে এই কবর ঐ কবরের স্থান মনে করিতে হইবে যেখানে সাইয়েদ সাহেবের লাশ এক রাত অথবা দুই রাত দাফন ছিল"। (সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ৮০৭ পৃঃ) —বালাকোটি কবর সম্পর্কে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীর বিবরণ নিম্নরূপঃ- সাইয়েদ সাঃ সমাধি সম্পর্কে সমস্ত বিবরণগুলি একত্রিত করিবার পর অনুমান করা যায় যে, তাহার দেহ ও সমস্ত একত্রিত করিয়া ঐ কবরে দাফন করা হইয়াছে, যে কবরটি কানাহার নদীর কাছাকাছি এবং সাইয়েদ সাহেবের বলা হইয়া থাকে। তারপর লাশ বাহির করিয়া নদীতে নিক্ষেপ করা হইয়াছে। (সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ৪৪৯ পৃঃ)-তালহাটা ও হাবীবুল্লাহ দুর্গের সমাধি সম্পর্কে গোলাম রাসুল মেহর লিখিয়াছেন যে, লাশ নদীতে পড়িয়া ভাসিতে ভাসিতে তালহাটা পৌঁছিয়াছিল, যাহা বালাকোট হইতে প্রায় ৯ মাইল দক্ষিণে কানাহারের পূর্বতীরে একটি গ্রাম, দেহ ও মাথা প্রথম হইতে পৃথক পৃথক ছিল। নদীতে পড়িয়াও, পৃথক পৃথক ভাসিতে ছিল। গ্রামবাসীরা দেহ দেখিয়া পানি হইতে উঠাইয়া কোন অজ্ঞাত স্থানে সমাধিস্থ করিয়া রাখে। আমি অনুসন্ধান করিয়াও উহার কোন খোঁজ পাই নাই। মাথা ভাসিতে ভাসিতে হাবিবুল্লাহ খান দুর্গের নিকট গিয়া পৌঁছে। আজকাল যেখানে সেতু তৈয়ার করা হইয়াছে। এখানে একটি ঘটনা আছে যে, মাথাটি দুর্গের সামনে পূর্বদিকে আটকাইয়া ছিল। জনৈকা বৃদ্ধা নদীর ঘাটে পানি লইতে আসিয়া ছিন্ন মাথা দেখিয়া খানকে সংবাদ দিয়াছিল খান আসিয়া পানি হইতে মাথাটি উঠাইয়া নদীর তীরে দাফন করিয়া রাখেন। প্রথমে এই কবর ছোট ছিল এবং স্পষ্ট বুঝা যাইতেন যে, কেবল মাথার কবর। কবরে লাল রংয়ের কাপড় বিছানো থাকিত। দুর্গের অধিকাংশ মানুষ সকালে ফাতেহা ও দোয়ার জন্য উপস্থিত হইতেন। বর্তমানে সিমেন্ট দ্বারা পরিপূর্ণ কবর তৈরী করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহাকে কুতুব বাবা গাজীর' কবর বলা হয়"। (সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ৮০৫/৮০৬ পৃঃ)—মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী লিখিয়াছেন, "মাথা এবং দেহ পৃথক পৃথক ভাসিতে তালহাটা কোথা হইতে কোথা পৌঁছিয়া গিয়াছে। পৃথক পৃথক স্থানে দাফন করা হইয়াছে সম্ভবতঃ মাথা ঐ স্থানে দাফন হইয়াছে হাবীবুল্লাহ দুর্গের যে স্থানটি মাথার কবর বলিয়া বিখ্যাত হইয়া রহিয়াছে এবং দেহ তালহাটায় দাফন হইয়াছে যেখানে সাইয়েদ সাহেবের কবর বলা হয়।" (সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ ৪৪৯ পৃঃ)—উল্লেখিত উদ্ধৃতিগুলি সামনে রাখিয়া নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করিলে সাইয়েদ সাহেবের সিলসিলার সাধারণ সমর্থক ও স্বীকার করিতে বাধ্য হইবেন যে, বালাকোটের সমাধি নিঃসন্দেহে কাল্পনিক এবং তালহাটা ও হাবীবুল্লাহ খান দুর্গের সমাধিও সঠিক নয়। কারণ, বর্ণনাকারীগণ সব সময় সন্দেহাতীতভাবে বিবরণ দিয়েছেন। সাইয়েদ সাহেবের বিচ্ছিন্ন লাশ যে সনাক্ত করা হইয়াছিল তাহা একেবারে নিখুঁত নয়, আবার একদিন অথবা দুই দিন পর রাতের অন্ধকারে নদীতে নিক্ষেপ করা হইয়াছিল। তালহাটা ও হাবীবুল্লাহ খান দুর্গে পৌঁছিতে যে কতদিন লাগিয়াছিল তাহা কে জানে? সাধারণতঃ বিচ্ছিন্ন দেহ সনাক্ত করা সম্ভব হয় না। আবার কয়েকদিনের পঁচা ও ফোলা দেহহীন বিকৃত মাথা ও মুণ্ডহীন বিকৃত দেহকে সনাক্ত করা কেমন করিয়া সম্ভব হইল? হাবিবুল্লাহ দুর্গের ও তালহাটার সাধারণ গ্রামবাসীরা কেমন করিয়া জানিল যে, ইহা সাইয়েদ সাহেবের মাথা ও দেহ। মোটকথা, পাপাত্মারা পরকালে নরকাগ্নির ইন্ধন হইবে কিনা তাহা তো আল্লাহ তাআলা ভালই জানেন। কিন্তু পৃথিবীতে পার্থিব শাস্তি হিসাবে কিছু কম হইল না।
---------------সমাপ্ত---------------
রেডিও সংবাদে ঈদ হারাম
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম বলিয়াছেন, তোমরা চাঁদ দেখিয়া রোজা রাখিবে এবং চাঁদ দেখিয়া ইফতার (ঈদ) করিবে। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহা হইলে শাবান মাস ৩০ দিন পূর্ণ করিয়া লইবে। (বোখারী ও মুসলিম)— যেহেতু ঈদ ইসলামের একটি অন্যতম ইবাদত। সেহেতু ইসলাম ঈদ পালনের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম বলিয়াদিয়াছে। যথা, আকাশ পরিষ্কার থাকিলে বহু সংখ্যক মানুষের চাঁদ দেখার প্রয়োজন। যাহাতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ না থাকে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকিলে কমপক্ষে দুইজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুইজন মহিলার শাহাদাত (সাক্ষ্য) প্রদানের প্রয়োজন। অবশ্য উহাদের প্রত্যেকের পরহেজগার মুত্তাকী হওয়া শর্ত। —প্রকাশ থাকে যে, সংবাদ ও শাহাদাত এক নয়। দুনিয়াবী সংবাদ প্রচারের জন্য যে কোন যান্ত্রিক সাহায্য গ্রহণ করা যাইতে পারে। কিন্তু ইসলামী শাহাদাত প্রদানের জন্য কোন প্রকার যান্ত্রিক সাহায্য গ্রহণ করা জায়েজ নয়। এই কারণে রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতির মাধ্যমে সংবাদ পাইয়া ঈদ করা হারাম। এক শ্রেণীর বেনামাজী ও বেরোজাদার মানুষ রেডিওর সংবাদে ঈদ করিবার জন্য হাঙ্গামা সৃষ্টি করিয়া থাকে। ইহারা প্রকৃত অর্থে মুসলমান নয়। রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতির সংবাদে ঈদ করা হারাম হওয়া সম্পর্কে 'ইমাম আহমাদ রেজা' ৪র্থ ও ৫ম সংখ্যায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইয়াছে। যাহা ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হইবে।
হাদীসের আলোকে তাবলীগী জামায়াত
আলী রাদী আল্লাহু বলিয়াছেন। আমি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লামকে বলিতে শুনিয়াছি যে, শেষ যুগে নওজোয়ান ও কম বুঝের মানুষের একটি দল বাহির হইবে। তাহারা বাহ্যিক ভাল কথা বলিবে। কিন্তু ঈমান তাহাদের হুলকুমের নিচে নামিবে না। তাহারা ইসলাম হইতে এমনই বাহির হইয়া যাইবে, যেমন তীর শিকারকে ভেদ করিয়া বাহির হইয়া যায়। (বোখারী)— আবু উমামা বাহিলী রাদী আল্লাহু আনহু হইতে বর্ণিত হইয়াছে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম বলিয়াছেন। শেষ যুগে মোল্লারা পোকামাকড়ের ন্যায় বাহির হইয়া পড়িবে। যে ঐ যুগ পাইবে সে যেন উহাদের থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায়। (হুলিয়া)—যদি আপনি নিরপেক্ষ হইয়া হাদীস দুইটির প্রতি গভীরভাবে চিন্তা করেন তাহা হইলে হাদীসদ্বয়ের মর্মে অবশ্যই তাবলিগী জামাতের নকশা আপনার সম্মুখে ভাসিয়া উঠবে। কারণ, এই জামায়াতটি পোকামাকড়ের ন্যায় চারিদিক থেকে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। উহাদের মধ্যে অধিকাংশই নওজোয়ান ও অশিক্ষিত মানুষ। উহাদের বাহ্যিক কথাগুলি সত্যিই সুন্দর। কিন্তু আউলিয়া, আম্বিয়া ও আক্বায়েদ সম্পর্কে উহাদের ভাল করিয়া যাচাই করুন, তাহা হইলে দেখিবেন- নিশ্চয় উহারা দ্বীন হইতে খারিজ হইয়া গিয়াছে। যেহেতু তাবলিগী জামায়াতের সহিত যোগ দিতেই হইবে অথবা যোগ না দিলেই ক্ষতি হইবে এমন কথা নহে। কিন্তু উহাদের সহিত যোগ দিলেই ক্ষতির সম্ভাবনা রহিয়াছে। সেইহেতু উহাদের থেকে দূরে থাকাই উচিত বলিয়া মনে করিতেছি।
_____________________
Comments
Post a Comment