সত্যের সন্ধান ও কবরে আজান

সত্যের সন্ধান ও কবরে আজান

মূল লেখকঃ আলা হজরত ইমাম আহমদ রেজা রাজিআল্লাহতায়ালা আনহু

অনুবাদকঃ মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান রেজবী বি. এ.(অনার্স)

টেক্সট রেডীঃ মুহাম্মদ আব্দুল খালেক


প্রশ্নঃ দাফনের পর কবরে আজান দেওয়া সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের অভিমত কি? ইসলামী বিধি অনুসারে ইহা জায়েজ কিনা?

ফতোয়া   

                    

الحمد لله الذى جعل الاذان-علم الايمان-و سبب الامان و سكينة الجنان-و منفاة الاحذان-و مرضاة الرحمن-والصلاة و السلام الانسان و اكملان-على من رفع الله ذكره و اعظم قدره-فبذكره زان-كل خطبة و اذان-على اله وصحبه الذاكرين ايه مع ذكر مولاه-فى الحيات و الموت-والوجدان و الفوت-و كل حين وان-واشهد ان لا اله الا الله الجنان و المنان-وان محمدا عبده و رسوله سيد الجن و الجان-﴿ﷺ﴾ و على اله وصحبه و المرضين لديه ما اذن اذن لصوت الاذان-قال الفقير عبد المصطفى احمد رضا المحمدى السنى الحنفى القادرى البركاتى البريلوى سقاه المجيب-من كأس الحبيب-عذبا فرانا-وجعل من الذين هم اهل الايمان-و الصلاة و الاذان احياء و امواتا امين اله الحق امين-


উত্তরঃ কিছু সংখ্যক উলামায়ে কিরাম কবরে আজান দেওয়াকে সুন্নাত বলিয়াছেন। ইমাম ইবনে হাজর মক্কী এবং در مختار কিতাবের লেখক আল্লামা খাইরুল মিল্লাত অদ্দীন রামালী রঃ এই উদ্ধৃতি পেশ করিয়াছে—
اَمَّا الٛمَكِّیُّ فَقِیٛ فَتَاوٰاةُ وَ فِیٛ شَرٛحِ العُبَابِ وَ عَارَضَ۔وَاَمَّا الرَّمَلِیٛ فَفیٛ حَاشِيَةِ الٛبَحٛر الرَّائِقِ و مَرَّضَ۞
মোট কথা কবরে আজান দেওয়ার বৈধতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ নাই। শরীয়তে ইহার উপর কোন নিষেধাজ্ঞাও নাই। শরীয়তে যাহা নিষিদ্ধ করা হয় নাই প্রকৃতপক্ষে উহা অবৈধ হইতে পারে না। সুতরাং কবরে আজান দেওয়ার জন্য ইহাই যথেষ্ট যে, ইসলামী বিধি অনুসারে উহাকে নিষিদ্ধ করা হয় নাই।বিরুদ্ধবাদীগণ ইহার অবৈধতার বিধি কোথা হইতে আমদানী করিলেন? আজান তো আল্লাহ ও রসূল পাক ﴾ﷺ﴿ জিকির। এইরূপ জিকির সম্পর্কে মুসলমানের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা কেমন মুসলমানের কর্ম! শরীয়তে কোথাও এমন কথা নাই যে, কেবল নামাজের জন্যই আজান দেওয়া জায়েজ এবং অন্যত্র জায়েজ নহে। বরং নামাজ ব্যতীত অপরাপর বহু স্থানেই আজান দেওয়া জায়েজ এবং মুস্তাহাব। এই সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হইবে।যাহারা কবরে আজান দেওয়াকে নিষিদ্ধ মনে করিয়া থাকেন উহারা শরীয়তের বিধান অনুসারে নিজ মতের স্বপক্ষে যুক্তি প্রদান করুন। তথাপি জ্ঞানের রাজ্যে আলোচনার ক্ষেত্রে অধম লেখক (আলা হজরত রাঃ) বহু দলিল এবং উহার মূলসূত্রাবলী শরীয়ত হইতে প্রমাণিত করিতে সক্ষম। আলোচনার ধারা অনুযায়ী এইগুলি হৃদয়ঙ্গম করিতে থাকুন। ইনশাআল্লাহ, সত্যান্বেষী ব্যক্তি ইহাতেই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে সক্ষম হইবেন।


প্রথম দলিল  

মাইয়্যাতকে কবরে রাখিবার পর মুনকীর নকীর যখন উহাকে প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করে, তখন দূর্বৃত্ত শয়তান [আল্লাহ্ ﴾ﷻ﴿ তাহার প্রিয় হাবীব﴾ﷺ﴿-এর সদকায় প্রত্যেক মুসলমান নরনারী এবং সমস্ত জীবিত ও মৃতকে শয়তানের ধোকাবাজী হইতে রক্ষা করুন] তাহাকে ধোকা প্রদান করে এবং উহার সঠিক উত্তর প্রদানে বিঘ্ন সৃষ্টি করিয়া থাকে। আল্লাহপাক আমাদিগকে উক্ত সংকটাবস্থা হইতে পরিত্রাণ দিন। সর্বশক্তিমান আল্লাহপাক ব্যতীত আমাদের কোন শক্তি নাই। ইমাম তিরমিজী মুহাম্মদ বিন আলী তাহার نوادر الوصول নামক কিতাবে হজরত ইমামে আজল সওরী রঃ হইতে বর্ণনা করিয়াছেন—
اِنَّ الٛمَيِّتَ اِذَا سُئِلَ مَنٛ رَّبُّكَ تَرَئَ لَهٗ الشَّيٛطَانُ فَيَشِيٛرُ اِلٰی نَفٛسِهٖ اِنِّیٛ اَنَا رَبُّكَ فَلِهٰذَا وَرَدَ سُؤَالُ التَّثٛبَيٛتِ لَهٗ۔حِيٛنَ يَسٛئَلُ۔
অর্থঃ মাইয়্যাতকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে, তোমার প্রতিপালক কে? শয়তান তখন উহার সম্মুখে আবির্ভূত হইয়া নিজের দিকে ইশারা করিয়া বলিতে থাকে—আমিই তোমার প্রতিপালক। এই কারণে মাইয়্যাতের সঠিক উত্তর প্রদানের জন্য দুআ করিতে হয় যাহাতে ঐ ব্যক্তি শয়তানের শিকারে পরিণত না হয়।
       ইমাম তিরমিজী বলিয়াছে—
وَ يُؤَيَّدُهٗ مِنَ الٛاَخٛبَارِ قَوٛلَ النَّبِیَّ﴿ﷺ﴾عِنٛدَ دَفٛنِ الٛمِيَّتِ اللّٰهُمَّ اَجِرٛهُ مِنَ الشَّيٛطَانِ فَلَوٛلَمٛ يَكُنٛ لِلشَّيٛطَانِ هُنَاكَ سَبِيٛلٌ مَادَعَا﴿ﷺ﴾بِذٰلِكَ۔
অর্থঃ উক্ত হাদীসে এই হাদীসটির নিশ্চয়তা প্রতিপাদন করা হইয়াছে যে, হুজুর আকরম ﴾ﷺ﴿ দাফনের পর দুআ করিতেন—হে আল্লাহ, ইহাকে শয়তানের প্ররোচনা হইতে রক্ষা করিও। কবরে শয়তানের ধোকাবাজীর কোন আশঙ্কা যদি না থাকিত তাহা হইলে হুজুর আকরম ﴾ﷺ﴿ এইভাবে দুআ করিতেন না।
সহীহ হাদীস সমূহে বর্ণিত হইয়াছে যে, আজান শয়তানকে দূর করিয়া দেয়।
হাদীস (১): সহীহ বুখারী, সহীহ্ মুসলিম প্রভৃতি হাদীসের গ্রন্থে বিখ্যাত হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হজরত আবু হুরাইরাহ্ রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু হইতে বর্ণিত, হুজুর আকদাস ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছে—
اِذَا اَذَّنَ الٛمُؤَذِّنُ اَدٛبَرَ الشَّيٛطَانُ وَلَهٗ حُصَاصٌ۔
অর্থঃ আজান দাতা যখন আজান দিতে থাকেন শয়তান তখন পশ্চাৎ ফিরিয়া বায়ু নিঃসরণ করিতে করিতে পলায়ন করে।
হাদীস (২): সহীহ মুসলিম শরীফে হজরত জাবির রাঃ উল্লিখিত হাদীসের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া বলিয়াছেন—আজানের শব্দে শয়তান ছত্রিশ মাইল দূর পর্যন্ত পলায়ন করিয়া থাকে।
হাদীস (৩): হাদীস শরীফে ইহাও বলা হইয়াছে যে, কখনও কোন শয়তানী বেড়াজালে পতিত হইবার আশঙ্কা হইলে আজান দিবে। ইহাতে উক্ত সংকটাবস্থা হইতে পরিত্রাণ পাইবে।
এই হাদীসটি ইমাম আবুল কাসিম সুলাইমান ইবনু আহমদ তিবরানী হজরত আবু হুরাইরাহ্ রাঃ হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন। আমার লিখিত— نسيم الصبا فی ان الاذان يحول الوباء
নামক কিতাবে এই সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদীস পাকের উদ্ধৃতি দিয়াছি। সুতরাং কবরে যে দুরাচার শয়তানের আবির্ভাব ঘটিয়া থাকে ইহা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হইল। তৎসহ ইহাও সাব্যস্ত হইল যে আজানের শব্দ শুনিলে শয়তান সেই স্থান ত্যাগ করিয়া যায়। এই কারণে আমাদেরকে কবরে আজান দেওয়ার কথা বলা হইয়াছে। আমাদের প্রতি এই নির্দেশ বিশিষ্ট হাদীস সমূহ হইতে গৃহীত তত্ত্ব এবং সুন্নাতের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ। কবরে আজান দেওয়ার মাধ্যমে মুসলমান ভাইয়ের অন্তিম উপকার ও সাহায্য প্রদান সম্ভব। পবিত্র কুরআন এবং হাদীস পাকের বহু স্থানে এইরূপ উপকারী ব্যক্তির ভুয়সী প্রশংসা করা হইয়াছে।

দ্বিতীয় দলিল  

হাদীস(৪): ইমাম আহমদ,তিবরানী এবং বাইহাকী হজরত জাবির রাঃ হইতে নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন—

قَالَ لَمَّا دُفِنَ سَعٛدَ بٛنُ مَعَاذٍ(زادنی رواية)وَ سُوِّیَ عَلَيٛهِ سَبَّحَ النَّبِیُّ﴿ﷺ﴾وَ سَبَّحَ النَّاسُ مَعَهٗ طَوِيٛلًا ثُمَّ كَبَّرَ النَّاسُ ثُمَّ قَالُوا يَا رَسُوٛلَ اللهِ لِمَ سَبَّحٛتَ(زادنی رواية)قَالَ لَقَدٛ تَضَايَقَ عَلَی هٰذَا الرَّجُلِ الصَّالِحِ قَبٛرُهٗ حَتّٰی فَرَّجَ اللهُ تَعَالٰی عَنٛهٗ۔
অর্থঃ হজরত সা’দ ইবনু মা’আজের দাফনকার্য সমাধা হইলে নবী করিম ﴾ﷺ﴿ বহুক্ষণ পর্যন্ত ঐ স্থানে থাকিয়া’সুবহানাল্লাহ’ পাঠ করিতে থাকিলেন এবং উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম ও হুজুরের সহিত অনুরূপ করিতে লাগিলেন। অতঃপর হুজুর ﴾ﷺ﴿ ‘আল্লাহু আকবর’ পাঠ করিতে লাগিলেন এবং সাহাবায়গণও উহা বলিতে থাকিলেন। অবশেষে সাহাবায়ে কিরাম আরজ করিলেন,হে আল্লাহর রসূল—কবরে নিকট দাঁড়াইয়া প্রথমে ‘সুবহানাল্লাহ’ এবং পরে আল্লাহু আকবর পাঠ করিলেন কেন? হুজুর ﴾ﷺ﴿ বলিলেন—এই নেককার ব্যক্তির কবর ছোট হইয়া গিয়াছিল; অতঃপর আল্লাহপাক উহার কষ্ট দূর করিয়া দিলেন এবং কবর প্রশস্ত করিয়া দিলেন।
আল্লামা তইয়েবী রঃ মিশকাত শরীফের টীকায় উল্লেখ করিয়াছেন—
اَیٛ مَا زِلٛتُ اُكَبِّرُ وَ تُكَبِّرُوٛنَ وَاُسَبِّحُ وَ نُسَبِّحُوٛنَ حَتّٰی فَرَّجَهٗ اللهُ۔
অর্থাৎ, হাদীসের অর্থ হইল ইহাই যে—আমি (রসূল পাক ﴾ﷺ﴿) এবং তোমরা একই সঙ্গে “আল্লাহু আকবর” এবং “সুবহানাল্লাহ” বলিতে থাকিলাম। অবশেষে আল্লাহপাক উহার কবরের সংকীর্ণতা দূরীভূত করিয়া উহাকে মুক্তি প্রদান করিলেন।
উপরোক্ত হাদীসে পাকের বর্ণনা অনুসারে এই কথাই সাব্যস্ত হয় যে, রসূলে করিম ﴾ﷺ﴿ স্বয়ং মাইয়্যাতকে দাফনের পর উহার সাহায্যার্থে কবরের নিকট দাঁড়াইয়া বার বার “আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর” পাঠ করিয়াছেন। আজানের মধ্যে এই শব্দ যুগল মোট ছয়বার বলিতে হয়। সুতরাং ইহা হাদীস পাকের বর্ণনার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইহা ব্যতীত আজানের মধ্যে আরও বিভিন্ন কালেমা রহিয়াছে। এই কালেমাগুলি মাইয়্যাতের জন্য ক্ষতিকরও (নাউজুবিল্লাহ) নহে এবং পূর্বোক্ত হাদীস পাকের পরিপন্থীও নহে। বরং আজানের মধ্যে অতিরিক্ত এই কালেমাগুলি থাকা আরো বেশী ফলদায়ক। আল্লাহপাকের রহমত অবতীর্ণ করিবার জন্য তাহার জিকির করাটা প্রয়োজন।
পাঠকবর্গ লক্ষ্য করুন, কবরে আজান দেওয়ার মসলাটি হুবহু ঐ মসলার অনুরূপ যাহা হজ্জের তালবিয়ার সময় প্রখ্যাত সাহাবায়ে কিরামগণ যেমন, আমিরুল মুমিনীন হজরত উমার ফারুক রাঃ, হজরত আব্দুল্লাহ্ ইবনু উমার রাঃ, হজরত আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাসউদ রাঃ, হজরত ইমাম হাসান মুজতবা রাঃ প্রমূখ পাঠ করিতেন। ইহা ব্যতীত আয়িম্মায়ে কিরামও ইহার সমর্থন করিয়াছেন। هداية কিতাবে রহিয়াছে—
لَا يَنۢبَغِیٛ اَنٛ يُّخِلَّ بِسَئٍ مِنٛ هٰذِهٖ الٛكَلِمَاتِ لِاَنَّهٗ هُوَ الٛمَنٛقُوٛلُ فَلَايُنٛقُصُ عَنٛهٗ وَلَوٛ زَادَ فِيٛهَا جَازَ لِاَنَّ الٛمَقٛصُوٛدَ الثَّنَاءِ وَ اظٛهَارُِ الٛعُبُوٛدِيَّةِ فَلَايَمٛنَعُ مِنَ الزَّيَادَةِ عَلَيٛهِ مُلَخَّصًا۔
অর্থঃ উক্ত কালেমা সমূহের (তালবিয়ার) মধ্যে কিছু কম করা অনুচিৎ; কারণ রসুলে পাক ﴾ﷺ﴿ হইতে এইরূপেই বর্ণিত হইয়াছে। সুতরাং ইহা হইতে কিছু বাদ দেওয়া যাইবে না। কিন্তু অতিরিক্ত কিছু ইহাতে সংযোজিত করা যাইতে পারে, ইহাতে নিষেধ নাই। অবশ্য এক্ষেত্রে আল্লাহপাকের প্রশংসা এবং ইবাদতের নিয়াত থাকা জরুরী।
অধম লেখক (আল্লাহপাক তাহাকে ক্ষমা করুন) صفائح اللجين فى كون التصافح بكفى اليدين
প্রভৃতি কিতাবে এই সম্পর্কে কিছু কিছু আলোকপাত করিয়াছি।

তৃতীয় দলিল  

হাদীস (৫,৬,৭): ইহা সুন্নাত হইতে প্রমাণিত, হাদীস পাক সমর্থিত এবং ফিকাহ্ শাস্ত্র সম্মত অভিমত যে—মাইয়্যাতের সংকটময় মুহুর্তে উহার নিকট কালেমা তাইয়েবা 'লাইলাহা ইল্লাল্লাহ্' পাঠ করিতে থাকিবে, যাহাতে মুমূর্ষু ব্যক্তি উহা শুনিয়া উক্ত কালেমা স্মরণ করিতে পারে। সহীহ্ হাদীস শরীফে রহিয়াছে—হুজুর আকরম(ﷺ) لقنوا موتاكم لا اله الا الله অর্থাৎ, মৃত ব্যক্তির নিকট 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্' পাঠ করিয়া শুনাইতে থাক। হাদীসটির বর্ণনাকারী হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) এবং হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়াছেন ইমাম আহমদ, মুসলিম, আবু দাউদ,তিরমিজী, নিসায়ী প্রমূখ।  এখানে মাইয়্যাত অথবা মৃত বলিতে এক অর্থে মুমূর্ষু ব্যক্তিকেও বুঝান হয় এবং উহাকে কালেমা তালকীন করিবার কথা বলা হইয়াছে।যাহাতে ঐ ব্যক্তির অন্তিম সময়টুকু পবিত্র কলেমা পাঠের মধ্য দিয়াই অতিক্রান্ত হয়। ইহাতে শয়তান উহাকে ভ্রষ্ট করিতে পারিবে না। কিন্তু কোন ব্যক্তির প্রাণবায়ু তাহার নশ্বর দেহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলে তবেই তাহাকে মৃত বলা যায়। ইহার পর উহাকে যথারীতি কাফন-দাফন করা হইয়া থাকে। পূর্বোক্ত হাদীস পাকে প্রকৃতপক্ষে এই প্রকার কবরস্থ ব্যক্তিকে কালেমা পাঠ করিয়া শুনাইবার কথা বলা হইয়াছে। মাইয়্যাতকে কালেমা তালকীন করিবার উদ্দেশ্য হইল, আল্লাহ পাকের মেহেরবাণীতে মৃত ব্যক্তির উক্ত কালেমাটি স্মরণে আসিবে এবং ইহাতে সে দূর্বৃত্ত শয়তানের হাত হইতে রক্ষা পাইতে পারিবে। এই পবিত্র কালেমাটি আজানের মধ্যে তিন স্থানে মওজুদ রহিয়াছে। শুধু তাহাই নহে, আজানের মধ্যে উচ্চারিত প্রতিটি কালেমাই মুনকীর-নকীরের প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রদানের সহায়ক। যেমন,প্রথম প্রশ্ন হইবে—তোমার প্রতিপালক কে?(من ربك) দ্বিতীয় প্রশ্ন-তোমার ধর্ম কি?(ما دينك), এবং তৃতীয় প্রশ্ন করা হইবে—এই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কিরূপ ধারণা পোষণ করিতে?(ما كنت تقول فى هذا الرجل)।  আজানের প্রারম্ভে 'আল্লাহু আকবর' হইতে 'আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' পর্যন্ত প্রথম প্রশ্ন من ربك এর জওয়াব নিহিত রহিয়াছে। উক্ত কালেমাসমূহ শুনিবার পর মাইয়্যাতের স্মরণ আসিবে যে, আল্লাহপাকই আমার একমাত্র প্রতিপালক।  'আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ' কালেমাদ্বয়ের মধ্যে তৃতীয় প্রশ্ন ما كنت تقول فى هذا الرجل এর জওয়াব রহিয়াছে। অর্থাৎ মাইয়্যাত বলিবে—এই ব্যক্তিকে আমি আল্লাহর রসূলরূপেই জানিতাম।  দ্বিতীয় প্রশ্নের জওয়াব নিহিত রহিয়াছে 'হাইয়্যাআলাস্ সালাত্' হইতে 'হাইয়্যা আলাল ফালাহ্, কালেমা চতুষ্ঠয়ের মধ্যে। অর্থাৎ মাইয়্যাতের স্মরণ হইবে যে, আমার ধর্ম ছিল উহাই যাহাতে নামাজ ফরজ ছিল। নামাজ হইল ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদ (الصلاة عماد الدين)।  সুতরাং মাইয়্যাতের দাফনকার্য সমাধা হইবার পর উহার কবরে আজান দেওয়া ফলপ্রদ। ইহা প্রকৃতপক্ষে হাদীস পাকেরই সমর্থন, সহীহ হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী ইহা পছন্দনীয় এবং উত্তম আমল।  এস্থলে প্রশ্ন উঠিতে পারে যে—মৃত ব্যক্তি পূর্বোক্ত কালেমাসমূহ তথা আজানের শব্দ কবর হইতে শুনিতে সক্ষম কিনা। অধম লেখক (আল্লাহ তাহাকে ক্ষমা করুন) উল্লিখিত মসলার বিশদ আলোচনা সম্বলিত কিতাব حيات الموات فى بيان سماع الاموات এর মধ্যে ইহার আলোচনা করিয়াছি। উক্ত কিতাবে পঁচাত্তরটি হাদীস পাক, তিনশত পঁচাত্তরটি আয়িম্মায়ে কিরামের উদ্ধৃতি এবং বিরুদ্ধবাদী উলামাগণের বক্তব্য ও উদ্ধৃতাংশ হইতে প্রমাণিত করা হইয়াছে যে,মাইয়্যাত তাহার কবর হইতেও কাহারো কথা শুনিতে পায়, দেখিয়াও থাকে এবং বিভিন্ন প্রকারের কথাবার্তা বুঝিতে সক্ষম।এই মসলার উপর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মধ্যে ঐক্যমত রহিয়াছে। একমাত্র কিছু সংখ্যক অজ্ঞ, উদাসীন এবং স্থুলবুদ্ধি শিয়াল পণ্ডিতের ছাত্রগণ ব্যতীত এই ব্যাপারে কেহ বিরোধীতা করে না। উল্লিখিত কিতাবের কয়েকটি পরিচ্ছেদে তালকীনেরও বিশদ ব্যাখ্যা প্রদত্ত হইয়াছে।এই কারণে এস্থলে উহার পূনরালোচনা করিলাম না।             

চতুর্থ দলিল  

হাদীস (৮): আবু ইয়া'লা বর্ণনা করিয়াছেন হজরত আবু হুরাইরাহ্ (রাঃ) হইতে, হুজুর আকরম ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেনঃ اطفؤا الحريق بالتكبير অর্থাৎ, তকবীর দ্বারা অগ্নি নির্বাপিত কর।  হাদীস (৯,১০): ইবনু আদী হজরত আব্দুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস (রাঃ) এবং তিনি স্বয়ং, ইবনু সুন্নী এবং ইবনু আসাকীর বর্ণনা করিয়াছেন হজরত আব্দুল্লাহ্ ইবনু উমার ইবনু আস রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুম হইতে, রসুলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿বলিয়াছেন—

اِذَا رَأَيٛتُمُ الٛحَرِيٛقَ فَكَبِّرُوٛا فَاِنَّهٗ يَطٛفَئِ النَّارَ۔
অর্থাৎ, কোথাও অগ্নিকাণ্ড ঘটিলে বার বার ঐ স্থানে তকবীর পাঠ করিবে, ইহাতে অগ্নি নির্বাপিত হইয়া যাইবে।
আল্লামা মুনাবী রহঃ جامع صغير এর ব্যাখ্যা تيسير এর মধ্যে লিখিয়াছেন—
فَكَبِّرُوٛا اَیٛ قُوٛلُوٛا اللهُ اَكٛبَرُ وَ كَرِّرُوٛا كَثِيٛرًا۔
অর্থাৎ, তকবীর দেওয়ার অর্থ হইল বার বার অধিক পরিমাণে ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর” পাঠ করা।
মাওলানা আলী কারী রহঃ “হুজুর আকরম ﴾ﷺ﴿-এর রওজা মুবারকের নিকট দাঁড়াইয়া বহুক্ষণ ধরিয়া “আল্লাহু আকবর” পাঠ করিতে থাক”—এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ—
اَلتَّكٛبِيٛرُ عَلٰی هٰذَا الاِطٛفَاءِ الٛغَضَبِ الالٰهی وَلِذَا وَرَدَ اسٛتَحَابُ التَّكٛبِيٛرُ عِنٛدَ رويةِ الٛحَرِيٛقَ۔
অর্থঃ এইভাবে’আল্লাহু আকবর’পাঠ করিতে থাকিলে আল্লাহপাকের গজব প্রশমিত হয়। এই কারণে অগ্নিকাণ্ড দেখিয়া বার বার ‘আল্লাহু আকবর’ পাঠ করা মুস্তাহাব বলা হইয়াছে। حيرة الفقه কিতাবের উদ্ধৃতি পেশ করিয়া وسيلة النجاة কিতাবে উল্লিখিত হইয়াছে যে—
حكمت در تكبير انست براهل گورستان کہ رسول﴿ﷺ﴾فرمودہ است،اذا رأیتم الحریق فکبروا” چوں اتش در جائے افتد و ازدست شما بر نیاید کہ بنشانید کہ تکبیر بگوئید کہ اتش بہ برکت اں تکبیر فرد نشیند چوں عذاب قبر باتش است ودست چون نمی رسد تکبیر می باید گفت تا مردگان اتش دوزخ خلاص یابند”
অর্থঃ কবর স্থানে তকবীর পাঠ করিবার রহস্য হইল ইহাই যে—রসূলে আকদাস ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন, তোমরা জলন্ত অগ্নি দেখিলে তকবীর পাঠ করিবে। সুতরাং কোথাও অগ্নিকাণ্ড দেখিলে এবং উহা নিভাইবার মত সামর্থ্য না থাকিলে বারংবার’আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর’ পাঠ করিতে থাকিবে। ইহাতেই আগুন নিভিয়া যাইবে। অনুরূপভাবে কবরের আজাব যেহেতু মূলতঃ অগ্নি হইতেই এবং সাধারণভাবে উক্ত আগুনকে নিভানো তোমাদের সাধ্যাতীত সেই হেতু তোমরা ‘আল্লাহু আকবর’ পাঠ করিবে। মাইয়্যাত দোযখাগ্নি হইতে মুক্তি পাইতে পারে।
উপরের আলোচনা হইতে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানের কবরের উপর আজান দেওয়া সুন্নতেরই পরোক্ষ নির্দেশ। সুতরাং এই আজানও সুন্নাত হিসাবে পরিগণিত হইতে পারে। আজানের তকবীর,কালেমা প্রভৃতি ব্যতীত অন্যান্য অংশগুলি মৃতের জন্য ক্ষতিকর অথবা অমঙ্গলজনক কিছু নহে। সুতরাং ঐগুলির কারণে কবরে আজান দেওয়ার কোন প্রতিবন্ধকতা থাকিতে পারে না। ইতিপূর্বে দ্বিতীয় দলিল আলোচনার সময় ইহা বলা হইয়াছে।

পঞ্চম দলিল  

হাদীস (১১): ইবনু মাজাহ্,বাইহাকী প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে হজরত সাঈদ ইবনু মুসাইইব্ হইতে বর্ণিত হইয়াছে—
قَالَ حَضٛرَتُ اِبٛنُ عُمَرَ فِیٛ جَنَازَةٍ فَلَمَّا وَضٛعَهَا فِیٛ اللَّحٛدِ قَالَ بِسٛمِ اللهِ وَ فِیٛ سَبِيٛلِ اللهِ فَلَمَّا اَخَذَ فِیٛ تَسٛوِيَةِ اللَّحٛدِ قَالَ اَللّٰهُمَّ اَجِرٛهَا مِنَ الشَّيٛطَانِ وَ مِنَ عَذَابِ الٛقَبٛرِ ثُمَّ قَالَ سَمِعٛتُهٗ مِنٛ رَّسُوٛلُ اللهِ﴿ﷺ﴾۔هٰذَا مُخٛتَصَارٌ۔
অর্থঃ আমি হজরত আব্দুল্লা ইবনু উমার রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুমার সহিত একটি জানাজায় শরীক হইলাম। হজরত আব্দুল্লা রাঃ উক্ত মাইয়্যাতকে কবরে স্থাপন করিবার সময় ‘বিসমিল্লাহি উয়া ফি সাবিলিল্লাহ’ পাঠ করিলেন। অতঃপর কবর ঠিকঠাক করিয়া দেওয়া হইলে বলিতে লাগিলেন —ইলাহী, এই ব্যক্তিকে শয়তানের কুচক্র হইতে রক্ষা করুন এবং কবরের আজাব হইতে মুক্তিপ্রদান করুন। অতঃপর বলিলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿ কে এইরূপ বলিতে শুনিয়াছি।
ইমাম তিরমিজী হাকীম কুদ্দুস সির্রাহুল আজীজ সহীহ্ সনদসহ হজরত উমার ইবনু মুর্রাহ্ তাবেঈ হইতে বর্ণনা করিয়াছেন—
كَانُوٛا يَسٛتَحِبُّوٛنَ اِذَا وَضِعَ الٛمَيِّتُ فِیٛ اللَّحٛدِ اَنٛ يَقُوٛلُوٛا اَللّٰهُمَّ اَعِذٛهُ مِنَ الشَّيٛطَانِ الرَّجيٛمِ۔
অর্থঃ আসহাবে কিরাম এবং তাবেঈগণ কবরে লাশ রাখিয়া এইরূপে দুআ করা মুস্তাহাব জানিতেন—”হে আল্লাহ্, এই ব্যক্তিকে শয়তানের ধোকাবাজী হইতে রক্ষা করুন।”
ইমাম বুখারী ও মুসলিম রাঃ এর ওস্তাদ ইবনু আবী শাইবাহ্ তাহার مصنف নামক কিতাবে হজরত খাইশামা রাঃ হইতে বর্ণনা করিয়াছেন—
كَانُوٛا يَسٛتَحِبُّوٛنَ اِذَا دَفَنُوٛا الٛمَيَّتَ اَنٛ يَّقُوٛلُوٛا بِسٛمِ اللهِ وَ فِیٛ سَبِيٛلِ الله وَ عَلٰی مِلَّةِ رَسُوٛلِ اللهِ اَللّٰهُمَّ اَجِرٛهُ مِنٛ عَذَابِ الٛقَبٛرِ وَ عَذَابِ النَّارِ وَ مِنٛ شَرَّ الشَّيٛطَانِ الرَّجِيٛمِ۔
অর্থঃ সাহাবায়ে কিরাম ইহা মুস্তাহাব জানিতেন যে—যখন মৃত ব্যক্তির দাফনকার্য সমাধা হইয়া যায় তখন এইরূপ বলা হয়, ‘আল্লাহ পাকের নামে,আল্লাহর নির্দেশিত পথে এবং রসূলে খোদা ﴾ﷺ﴿ এর মতাদর্শানুসারে (ইহাকে কবরে স্থাপন করিলাম)। হে আল্লাহ, ইহাকে কবর ও দোজখের আজাব হইতে এবং অভিশপ্ত শয়তানের কবল হইতে রক্ষা করুন।
উপরোক্ত হাদীস সমূহ হইতে একদিকে যেমন ইহা প্রমাণিত হয় যে, দাফনের পর মাইয়্যাতের নিকট (আল্লাহ্ আমাদিগকে রক্ষা করুন) শয়তান আসিয়া কুমন্ত্রণা দিতে থাকে; অন্যদিকে ইহা সাব্যস্ত হয় যে, উক্ত শয়তানী প্ররোচনা হইতে মাইয়্যাতকে মুক্ত রাখিবার জন্য দুআ করা সুন্নাত। এইজন্য কেবল দুআই যথেষ্ট নহে, বরং উক্ত সংকটাবস্থা হইতে উত্তরনের সঠিক ব্যবস্থাপত্রও কিছু করা প্রয়োজন। ইতিপূর্বে প্রথম দলিলের হাদীস সমূহ হইতে একথা পরিস্কার হইয়া গিয়াছে যে, শয়তানকে বিতাড়িত করিবার জন্য আজান হইল সর্বোত্তম এবং সহজ ব্যবস্থা। সুতরাং কবরে আজান দেওয়া হাদীস পাকের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইল এবং শরীয়তী দৃষ্টিভঙ্গীতেও উহা নির্দ্বিধায় গ্রহনীয়।

ষষ্ঠ দলিল  

হাদীস (১২): আবু দাউদ,হাকীম,বাইহাকী প্রভৃতি হাদীস শরীফে আমিরুল মুমিনীন হজরত উসমানগনি (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে—
كَانَ النَّبِیُّ﴿ﷺ﴾اِذَا فَرَغَ مِنٛ دَفٛنِ الٛمَيِّتِ وَقَفَ عَلَيٛهِ قَالَ اسٛتَغٛفِرُوٛا لِاَخِيٛكُمٛ وَسَلُوٛا لَهُ التَّثٛبِيٛتَ فَاِنَّهٗ الٛاٰنَ يُسٛأَلُ۞
অর্থঃ হুজুর পুর নুর ﴾ﷺ﴿মাইয়্যাত দাফনের পর কবরের নিকট দাঁড়াইতেন এবং বলিতেন, নিজ মুসলমান ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং উহার জন্য মুনকীর নকীরের প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রদানের সময় ঠিক ঠিক জওয়াব প্রদানের জন্য দুআ করিতে থাক। কারণ এক্ষনে উহাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হইবে।
হাদীস (১৩): সাঈদ ইবনে মনসুর (রাঃ) তাহার سنن কিতাবে হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন—
كَانَ رَسُوٛلُ اللهِ﴿ﷺ﴾يَقِفُ عَلٰی الٛقَبٛرِبَعٛدِ مَا سَوِّیَ عَلَيٛهِ فَيَقُوٛلُ،اللّٰهُمَّ نَزِّلٛ بِكَ صَاحِبُنَا وَخَلَفَ الدُّنٛيَا خَلَفَ ظَهٛرِهٖ اللّٰهُمَّ ثَبِّتٛ عِنٛدَ الٛمَسٛئَلَةِ نُطٛقَةُ وَلَا تُبَتِّلٛهٗ فِیٛ قَبٛرِهٖ بِمَا لاَطَانَةَ لَهُ بِهٖ۞
অর্থঃ মাইয়্যাতের দাফন কার্যাদি সমাধা হইবার পর হুজুর পাক ﴾ﷺ﴿ কবরের নিকট দাঁড়াইয়া দুআ করিতেন—হে আল্লাহ, আমাদের সঙ্গী ব্যক্তি আজ তোমার অতিথি এবং আজ দুনিয়াকে সে পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছে।‌‌‍হে খোদা, প্রশ্নোত্তরের সময় উহার জবানকে তুমি ঠিক রাখিও এবং কবরের মধ্যে এমন কোন মসীবতে ফেলিও না যাহা এই ব্যক্তি বরদাস্ত করিতে না পারে।
উল্লিখিত হাদীসে পাক এবং পঞ্চম দলিলের বর্ণনা অনুযায়ী ইহা সাব্যস্ত হইল যে,মাইয়্যাতকে দাফন করিবার পর উহার জন্য দুআ করা সুন্নাত। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী হাকীম তিরমিজী কুদ্দুস সির্রাহুল করিম দাফনের পর দুআ করা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন—মুসলমানের জামাআতের সহিত জানাজার নামাজ রক্ষী বাহিনীর অনুরূপ। উহারা আল্লাহর নিকট মাইয়্যাতের জন্য সুপারিশ এবং ক্ষমা প্রার্থনার জন্য হাজির হইয়া থাকেন। অতঃপর উহারা কবরের নিকট দাঁড়াইয়া দুআ করিবার অর্থ হইল উক্ত রক্ষী বাহিনী কর্তৃক মাইয়্যাতকে সাহায্য করা। কারণ মাইয়্যাতের পক্ষে এই সময়টি বড়ই কঠিন। মৃত ব্যক্তি একে তো অপরিচিত অভূতপূর্ব নতুন বাসস্থানে আসিয়া হতবুদ্ধি হইয়া পড়ে, তদুপরি অল্পক্ষণের মধ্যেই উহাকে মুনকীর নকীরের প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে হইবে।
আমার মনে হয় না যে, মাইয়্যাতের জন্য দুআ করিবার প্রয়োজনীয়তাকে কেহ অস্বীকার করিবেন। হজরত ইমাম আজুরী রঃ বলিয়াছেন—
يُسٛتَحَبُّ الٛوُقُوٛفُ بَعٛدَ الدَّفٛنِ قَلِيٛلًا وَ الدُّعَاءُ لِلٛمَيِّت۞
অর্থাৎ, মাইয়্যাত দাফনের পর কবরের নিকট কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকা এবং উহার জন্য দুআ করা মুস্তাহাব। অনুরূপভাবে ازكار , মুসলিম শরীফের ভাষ্যকার ইমাম নুআবী (রাঃ) এবং فتاوى عالمگیریة ,در مختار,جوهره نيره
প্রভৃতি নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য কিতাবে এই সম্পর্কে বিশদ আলোচনা রহিয়াছে।
বিরুদ্ধবাদী চটকদারী মজহাবের দ্বিতীয় ইমাম তথা মৌলবী ইসহাক দেহলবী দেওবন্দী مایة عامل নামক পুস্তকে ‘দাফনের পর কবরে আজান দেওয়া’ সম্পর্কিত মসলার আলোচনা প্রসঙ্গে ,فتاواى عالمگیریة, نهر الفائق فتح القدیر, بحر الرائق
প্রভৃতি কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়া লিখিয়াছেন—কবরের নিকট দাঁড়াইয়া দুআ করা সুন্নাত হইতে প্রমাণিত। কিন্তু মৌলবী ইসহাক সাহেবের বুদ্ধিতে এইটুকু কুলাইলনা যে, আজানও একটি দুআ, বরং অন্যান্য দুআ অপেক্ষা ইহা অনেক উত্তম। কারণ আজান আল্লাহপাকের জিকির এবং আল্লাহর সমস্ত জিকিরই দুআ। সুতরাং কবরে আজান দেওয়া সম্পর্কে হাদীস শরীফের সমর্থন পাওয়া গেল। ইহার পরও সাধারণ (কমন) সুন্নাত সমর্থিত কার্যকলাপের প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া উহাকে দোষণীয় প্রমাণিত করিবার জন্য দলিল পেশ করিতে যাওয়া অলীক তামাশাই বটে।
মাওলানা আলী কারী রঃ মিশকাত শরীফের টীকাগ্রন্থ مرقات এর মধ্যে লিখিয়াছেন,
كُل دُعَاءِ ذِكٛرٌ وَ كُلُّ ذِكٛرٍ دُعَاءٌ۞
অর্থাৎ, প্রত্যেক দুআই জিকির, এবং জিকির মাত্রেই দুআ।
হাদীস (১৪): রসূলে পাক ﴾ﷺ﴿বলিয়াছেন— সবচাইতে উত্তম দুআ হইল ‘আলহামদুলিল্লাহ্’।
হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন ইমাম তিরমিজী এবং তিনি ইহাকে হাসান তথা উত্তম বলিয়াছেন।নিসায়ী, ইবনু হাব্বান,হাকীম প্রমূখ হাদীসটিকে সহীহ্ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। উপরোক্ত সমস্ত হাদীসেই ইহা হজরত জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ্ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুমা হইতে বর্ণনা করা হইয়াছে।
হাদীস (১৫): সহীহ্ বুখারী এবং মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে যে, কোন এক সফরে লোকজন উচ্চস্বরে ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর’ পাঠ করিতে আরম্ভ করিল। রসুলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿ উহাদিগকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন, ওহে লোক সকল—তোমরা নিজ নিজ প্রাণের প্রতি সদয় হও।
اِنَّكُمٛ لَا تَدٛعُوٛنَ اَصَمَّ وَلَا غَائبًا اِنَّكُمٛ تَدٛعُوٛنَ سَمِيٛعًا بَصِيٛرًا۞
অর্থাৎ, তোমরা কোন বধির অথবা কাল্পনিক স্বত্ত্বার নিকট দুআ চাহিতেছ না। যাহার নিকট দুআ চাহিতেছ তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা।
পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য করুন, এই স্থলে হুজুর আকরম ﴾ﷺ﴿ স্বয়ং কেবলমাত্র ‘আল্লাহু আকবর’ পাঠ করাকে দুআ বলিয়াছেন। সুতরাং আজান ও একটি দুআ একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। অতএব প্রমাণিত হইল যে, কবরে আজান দেওয়ার অর্থ মাইয়্যাতের জন্য দুআ করা এবং দুআ হইল সুন্নাত। সুতরাং কবরে আজান দেওয়া যে হাদীস সম্মত ইহাতে কোন সন্দেহ রহিল না।

সপ্তম দলিল  

পূর্ববর্তী আলোচনা হইতে প্রতীয়মান হইল যে, মাইয়্যাতের দাফনকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর উহার জন্য দুআ করা সুন্নাত। ইসলামী তত্ত্ববিদগণের শুদ্ধ মত হইল যে, কোন দুআ প্রার্থনার পূর্বে কোন নেককার্য করিবার প্রয়োজন। ইমাম শামশুদ্দীন মুহাম্মদ বিন জাজরী রাঃ তাহার حصن حصین কিতাবে উল্লেখ করিয়াছেন—
اَدَابُ الدُّعَاء مِنٛهَا تَقٛدِيٛمُ عَمَلٍ صَالِحٍ وَ ذِكٛرُهٗ عِنٛدَ لشِّدَّةِ م د ت۞
হাদীস (১৬): আল্লামা আলী কারী রঃ صرز ثمین কিতাবে লিখিয়াছেন, পূর্বোক্ত حصن حصین কিতাবে দুআর পূর্বে কিছু নেক কার্যের কথা বলা হইয়াছে এবং উল্লেখ করা হইয়াছে যে ইহা দুআর আদব—এই উদ্ধৃতিটি হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) হইতে আবু দাউদ, তিরমিজী, নিসায়ী, ইবনু মাজাহ্, ইবনু হাব্বান প্রভৃতি হাদীস শরীফে বর্ণিত হইয়াছে। আজান একটি নেক কর্ম ইহাতে সন্দেহ নাই। সুতরাং মাইয়্যাতের জন্য দুআ করার পূর্বে আজান দেওয়া উক্ত উদ্দেশ্যের পরিপূরক এবং ইহা সুন্নাত হইতে প্রমাণিত ও সমর্থিত।

অষ্টম দলিল  

হাদীস (১৭): রসূলে আকদাস ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন—
ثَنَتَانِ لَاتُرَوَّانِ الدُّعَاءُ عِنٛدَ النَّدَاءِ وَعِنٛدَ الٛبَأَسِ۞
অর্থঃ দুই প্রকারের দুআ কখনও ব্যর্থ হয় না। প্রথমটি হইল আজানের সময়কার দুআ এবং অপরটি হইল যুদ্ধ ক্ষেত্রে কাফিরদিগের সহিত যুদ্ধের সময়কার দুআ।
হাদীসটি সহীহ্ সনদ হিসাবে হজরত সাহল ইবনু সা’দিস্ সায়েদী (রাঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন আবু দাউদ, ইবনু হিব্বান, হাকীম প্রমূখ।
হাদীস (১৮,১৯): রাসূলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন—
اِذَا نَادَیٛ الٛمُنَادِیٛ فُتِحَتٛ اَبٛوَابُ السَّمَاءِ وَاسٛتُجِيٛبَ الدُّعَاءِ۞
অর্থঃ আজান দাতা যখন আজান দিতে থাকেন তখন আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করিয়া দেওয়া হয় এবং ঐ সময় কোন দুআ করিলে তাহা কবুল করা হয়।
হাদীসটি হজরত আবু ইয়া’লা এবং হাকীম আবু উমামাহ্ বাহেলী (রাঃ) হইতে এবং আবু দাউদ ত্বয়ালসী ও জিয়া’এবং আবু ইয়া’লা المختارة কিতাবে হাসান (উত্তম) সনদ দলিল যা ধারাবাহিকতাভাবে বর্ণিত। বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। হাদীসের বর্ণনাকারী হইলেন হজরত আনাস ইবনু মালিক রাদিআল্লাহু আনহুমা।
উপরিলিখিত হাদীসপাক হইতে সাব্যস্ত হয় যে—কোন দুআর পূর্বে আজান দেওয়া উক্ত দুআ কবুল হইবার কারণ। সুতরাং এস্থলে মাইয়্যাতের জন্য দুআ আল্লাহপাকের নিকট কবুল হইবার কারণ হিসাবে আজান দেওয়া উত্তম এবং উলামায়ে ইসলামের নিকটও ইহা প্রশংসনীয়।

নবম দলিল  

হাদীস (২০-২৪): নবী করীম ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন—
يُغٛفَرُ لِلٛمُؤَذِّنِ مَنٛتَهٰی اَذَانِهٖ وَ يَسٛتَغٛفِرُ لَهٗ كُلُِّ رَطٛبٍ وَّيَابِسٍ سَمِعَهٗ۞
অর্থাৎ, আজানের শব্দ যতদূর পর্যন্ত পৌঁছাইয়া থাকে মুয়াজ্জিনের জন্য সেই অনুপাতে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। আজান দাতার জন্য পানি ও স্থলের জীব ও জড় যাবতীয় বস্তুসমূহ ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া থাকে।
উপরোক্ত হাদীস পাকের মোদ্দা কথা হইল ইহাই, আজান ক্ষমাপ্রাপ্ত হইবার অন্যতম কারণ এবং ইহা সুনিশ্চিত যে, ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দুআই আল্লাহ পাকের নিকট অধিক গ্রহণীয় এবং কবুল হইবার উপযোগী। এই কারণে অন্যত্র হাদীস শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে যে, নেককার এবং মার্জিত ব্যক্তির মাধ্যমেই দুআ চাওয়া উচিৎ।
হাদীস (২৫): হজরত ইমাম আহমদ (রাঃ) তাহার مسند নামক কিতাবে হজরত আব্দুল্লা ইবনু উমার রাদিআল্লাহু আনহুমা হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন যে, রসূলে পাক ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন—
اِذَا لَقِيٛتَ الٛحَاجَّ فَسَلّمٛ عَلَيٛهِ وَصَافِحٛهٗ وَمُرٛهُ اَنٛ يَسٛتَغٛفِرَلَكَ قَبٛلَ اَنٛ يَدٛخُلَ بَيٛتَهٗ فَاِنَّهٗ مَغٛفُوٛرٌلَهٗ۔
অর্থঃ যখন তুমি কোন হাজীর সহিত মিলিত হইবে উহাকে সালাম দিবে এবং মুসাফাহ্ করিবে। হাজী সাহেব তাহার নিজ গৃহে প্রবেশ করিবার পূর্বেই তাহার দ্বারা তোমার ক্ষমা প্রার্থনা করাইয়া লও। কারণ হাজীগণ ক্ষমাপ্রাপ্ত।
সুতরাং কোন মাইয়্যাতকে দাফন করার পর কোন নেককার ব্যক্তির দ্বারাই আজান দেওয়ানো উত্তম। ফলে সহীহ্ হাদীস সমূহের বর্ণনা অনুসারে উহাতে মাইয়্যাতের গুনাহ মার্জনা হইতে পারে। ইহা ব্যতীত উক্ত পূণ্যবান ব্যক্তির মাধ্যমেই দুআ চাওয়া উচিৎ। কারণ উহার দুআই আল্লাহ পাকের নিকট কবুল হইবার অধিক আশা রহিয়াছে। সুতরাং কবরে আজান দেওয়ার বিপক্ষে কোন প্রকারের অভিযোগ থাকাটা অবাঞ্ছিত, কারণ ইহা শরীয়তী বিধিসম্মত এবং প্রাসঙ্গিক একটি নেক আমল।

দশম দলিল  

হাদীস (২৬,২৭): আজান আল্লাহপাকের জিকির এবং আল্লাহর জিকির তাহার প্রদত্ত আজাব হইতে নিষ্কৃতি পাওয়ার অন্যতম কারণ। রসুলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন—
مَا مِنٛ شَيٛئٍ اَنٛجٰی مِنٛ عَذَابِ اللهِ مِنٛ ذِكٛرِاللهِ۔
অর্থাৎ, আল্লাহপাকের জিকির অপেক্ষা অন্য কোন কিছুই তাহার আজাব হইতে অনুরূপ নিষ্কৃতি প্রদানকারী নহে। অর্থাৎ আল্লাহর জিকিরই সর্বাধিক পরিমাণে তাহার প্রদত্ত আজাবের লাঘব ঘটাইতে পারে।
উপরোক্ত হাদীসটি হজরত মুআজ ইবনে জাবাল এবং ইবনু আবীদ দুনইয়া রাদিআল্লাহু আনহুমা হইতে বর্ণনা করিয়াছেন ইমাম আহমদ, এবং বাইহাকীও ইহা বর্ণনা করিয়াছেন হজরত ইবনু উমার রাদিআল্লাহু আনহুমা হইতে। যে স্থানে আজান দেওয়া হয় ঐ দিন উক্ত স্থান সর্বপ্রকার আজাব হইতে নিরাপদ থাকে।  হাদীস (২৮,২৯): ইমাম তিবরানী তাহার معاجیم তিনটি নামক কিতাবে
(معاجیم صغیر، معاجیم کبیر، معاجیم اوسط)
হজরত আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হইতে রওয়ায়েত করিয়াছেন—
হুজুর আকরম ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেনঃ
اِذَا اُذِّنَ فِیٛ قَرٛيَةٍ اَمَّنَهَا اللهُ مِنٛ عَذَابِهٖ فِیٛ ذٰلِكَ الٛيَوٛمِ۔وَشَاهِدُهٗ عِنٛدَهٗ فِیٛ الٛكَبِيٛرِ مِنَ حَدِيٛثِ مَعٛقِلِ بِنٛ يَسَارَ۔رَضِیٛاللهُ تَعَالٰی عَنٛهٗ۔
অর্থঃ কোন বসতি এলাকায় যখন আজান দেওয়া হয়, আল্লাহ্পাক ঐদিন সম্পূর্ণ এলাকাকেই আজাব মুক্ত করিয়া দেন।
প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমান ভাইয়ের স্বার্থে এমন কিছু করা কর্তব্য যাহা উহাকে আল্লাহপাকের আজাব হইতে নিষ্কৃতি প্রদান করিতে পারে। ইহাই ছিল বিশ্বনবী ﴾ﷺ﴿ এর জীবনাদর্শ। এই কারণে কবরে আজান দেওয়াটা রসূলে পাক ﴾ﷺ﴿ এর আদর্শের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মাওলানা আলী কারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি مین العلم নামক কিতাবের ব্যাখ্যায় এক স্থানে তাহার কবরের নিকটে কুরআন মজীদ তেলাওয়াত, তসবিহ পাঠ, এবং আল্লাহপাকের অনুগ্রহ লাভ ও ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য দুআ করিবার অসিয়ত করিতে গিয়া বলিয়াছেন—
فَاِنَّ الٛاَذٛكَارَ كُلَّهَا نَافِعَةٌ لَهٗ فِیٛ تِلٛكَ الدَّارِ۔
অর্থাৎ, জিকির যেমনই হউক উহা সমস্তই মাইয়্যাতের জন্য ফলদায়ক।
ইমাম বদরুদ্দীন আহমদ আইনী রহঃ সহীহ্ বুখারী শরীফের موعظة المحدث নামক অধ্যায়ে একটি হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ-
مَصٛلِحَةُ الٛمَيِّتِ اَنٛ يَّجٛتَمِعُوٛا عِنٛدَهٗ لِقُرٛاءةِ الٛقُرٛاٰنِ وَ الذِّكٛرِ فَاِنَّ الٛمَيِّتَ يَنٛفَعُ بِهٖ۔
অর্থাৎ, মাইয়্যাতের কবরের নিকট কোন মুসলমান কুরআন শরীফ পাঠ এবং জিকির প্রভৃতি করিতে থাকিলে উহাতে মাইয়্যাতের হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে এবং উহা হইতে মাইয়্যাত উপকৃত হয়। আয় খোদা! আজান কি জিকির নহে? এবং উহার দ্বারা কি কোন মুসলমান ভাইয়ের কিছু উপকার পাওয়া সম্ভব নয়।

একাদশ দলিল  

আজান রসূলে পাক ﴾ﷺ﴿ এর জিকির এবং রসূলপাক ﴾ﷺ﴿ এর জিকির আল্লাহপাকের রহমত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ।  প্রথমেই উল্লেখ্য যে, বিশ্বনবী ﴾ﷺ﴿ এর জিকির প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পাকেরই জিকির। ইমাম ইবনে আতা, কাজী আয়াজ প্রমূখ খ্যাতনামা আয়িম্মায়ে কিরাম পবিত্র কুরআনের ورفعنالك ذكرك আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন—
جَعَلٛنَكَ ذِكٛرًا مِنٛ ذِكٛرِیٛ فَمَنٛ ذَكَرَكَ ذَكَرَنِیٛ۔
অর্থঃ (আল্লাহপাক তাহার প্রিয়তম হাবীব ﴾ﷺ﴿ কে বলিতেছেন) আমি তোমাকে আমার স্মরণীয় বস্তু সমূহের মধ্যে অন্যতম করিয়াছি। সুতরাং যে কেহ তোমার জিকির করে, বস্তুতঃপক্ষে ঐ ব্যক্তি আমারই জিকির করিল। আল্লাহপাকের জিকির নিঃসন্দেহে তাহার রহমত বর্ষিত হওয়ার কারণ।
হাদীস (৩০): সহীহ্ হাদীস শরীফের মধ্যে রহিয়াছে, হুজুর ﴾ﷺ﴿ জিকিরকারীদিগের সম্পর্কে বলিয়াছেন—
خَفَّتٛهُمُ الٛمَلَائِكَةُ وَغَشِيَتٛهُمُ الرَّحٛمَةُ وَ نَزَلَتٛ عَلَيٛهِمُ السَّكِيٛنَةُ۔
অর্থঃ ফেরেস্তামণ্ডলী উহাদিগকে ঘিরিয়া লয় এবং আল্লাহপাকের রহমত উহাদিগকে ঢাকিয়া দেয়। উহাদের উপর উত্তম ও নির্মল প্রশান্তি বর্ষিত হইতে থাকে।
এই হাদীসটি হজরত আবু হুরাইরাহ্ এবং আবু সাঈদ রাদিআল্লাহু আনহুমা হইতে বর্ণনা করিয়াছেন ইমাম মুসলিম এবং তিরমিজী রহঃ।
ইহা ব্যতীত কোন খোদাভক্ত ব্যক্তির জিকির (স্মরণ, উল্লেখ, আলোচনা, গুণগান) এর দরুণ ও আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হয়, যেমন, ইমাম সুফ্ইয়ান ইবনে উয়াইনাহ্ রঃ বলিয়াছেন—
عِنٛدَ ذِكٛرِ الصَّالِحِيٛنَ تَنٛزِلُ الرَّحٛمَةُ۞
অর্থাৎ, কোন নেককার ব্যক্তির জিকির করিলে ঐ স্থানে আল্লাহর অশেষ করুণা বর্ষিত হইয়া থাকে। হজরত আবু জাফর ইবনু হামদান রঃ হজরত আবু উমার ইবনু বাখীদ রঃ বলিয়াছেন,
فَرَسَوٛلُ اللهِ﴿ﷺ﴾ رَأٛسُ الصَّالِحِيٛنَ۞
অর্থাৎ, “অতএব রাসূলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿ সালেহীনদের (নেককার খোদাভক্ত ব্যক্তি) সর্বোচ্চ সরদার।” সুতরাং যে স্থানে আজান প্রদত্ত হইবে তথায় আল্লাহপাকের রহমত বর্ষিত হইতে থাকে—এই সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। যে নেককর্মের মাধ্যমে কোন মুসলমান ভাই এবং নিজেদের উপর আল্লাহপাকের রহমত বর্ষিত হয়, উহা কখনও নিষিদ্ধ হইতে পারে না, বরং ইহা প্রশংসনীয় এবং প্রয়োজনীয়ও বটে।

দ্বাদশ দলিল  

মাইয়্যাত প্রথমতঃ কবরে গিয়া তথাকার সংকীর্ণ ও অন্ধকার বাসগৃহের মধ্যে ভয়ানকভাবে ঘাবড়াইয়া যায়। ইহা হাদীস পাক হইতে প্রমাণিত এবং সর্বজন স্বীকৃত অভিমত। অবশ্য আল্লাহপাক যাহাদিগকে অনুগ্রহ করিয়াছেন উহাদের কথা স্বতন্ত্র। আল্লাহই সর্বাপেক্ষা অধিক ক্ষমাশীল এবং অপার করুণাময়।  আজান মানুষের সমস্ত প্রকারের বিষণ্ণতা ও সংকটাপন্ন অবস্থায় প্রশান্তি প্রদান করিতে সক্ষম। কারণ, আজানের মধ্যে রহিয়াছে আল্লাহপাকের জিকির। খোদাবন্দ কুদ্দুস﴾ﷻ﴿বলিয়াছেন—
اَلَا بِذِكٛرِ اللهِ تَطٛمَئِنُّ الٛقُلُوٛب۞
অর্থাৎ,(হে বান্দাগণ) শুনিয়া লও, আল্লাহর জিকির অন্তরে শান্তি প্রদান করিয়া থাকে। সুতরাং মাইয়্যাতকে দাফন করিবার পর উহার চিন্তিত ও বিমর্ষ অবস্থায় আজান যে উহাকে শান্তি প্রদান করিতে সক্ষম একথা বলাই বাহুল্য।
হাদীস (৩১): হজরত আবু নুআঈম (রাঃ) এবং ইবনে আসাকির (রাঃ) হজরত আবু হুরাইরাহ্ (রাঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, হুজুর পুর নুর ﴾ﷺ﴿বলিয়াছেন—
نَزَلَ اٰدَمُ بِالٛهِنٛدِ وَاسٛتَوٛحَشَ فَنَزَلَ جِبٛرَئِيٛلُ عَلَيٛهِ صَلَاةُ وَ السَّلَامُ فَنَادٰی بِالٛاَذَانِ-الحديث
অর্থঃ হজরত আদম আঃ জান্নাত হইতে ভারতবর্ষের মাটিতে অবতরণ করিয়া প্রথমতঃ প্রচণ্ড ঘাবড়াইয়া গেলেন (কারণ জান্নাতের সুখভোগের ইহা ছিল বিপরীত এবং তিনি এমতাবস্থায় উক্ত প্রকারের পার্থিব জীবন যাপনে একেবারেই অনভ্যস্ত।) এমনি সময়ে হজরত জিব্রাঈল আঃ অবতরণ করিলেন এবং আজান দিলেন (ইহাতে হজরত আদম আঃ এর উক্ত প্রকারের আশঙ্কা এবং নিঃসঙ্গতার ভয় দূরীভূত হইল।—অনুবাদক।)
সুতরাং আমরা আমাদেরই এক মুসলমান ভাইয়ের আত্মার কল্যান সাধনের মানসে এবং তাহার কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা ভাব হইতে উত্তরণের জন্য যদি আজান দিই, তবে ইহাতে কি অন্যায় করিলাম? বরং কোন মুসলমানকে অনুরূপভাবে সাহায্য করা অথবা সাহায্য করিবার উদ্দেশ্যে হস্ত প্রসারিত করা আল্লাহপাক রব্বুল ইজ্জতের নিকট অতীব পছন্দনীয়।
হাদীস (৩২): হুজুর আকরম ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন—
اللهُ فِیٛ عَوٛن الٛعَبٛد مَا كَانَ الٛعَبٛدُ فِیٛ عَوٛنِ اَخِيٛهِ۞
অর্থঃ কোন মুসলমান বান্দা যতক্ষণ অপর মুসলমান ভাইকে সাহায্য ও সহযোগিতা করিতে থাকে, আল্লাহপাক ততক্ষন পর্যন্ত উহাদিগকে সহায়তা করিতে থাকেন।
হাদীসটি প্রখ্যাত হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীয়ে রসূল ﴾ﷺ﴿ হজরত আবু হুরাইরাহ্ (রাঃ) হইতে ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনু মাজাহ্, হাকীম প্রমূখ বর্ণনা করিয়াছেন।
হাদীস (৩৩): রসূলে খোদা ﴾ﷺ﴿বলিয়াছেন—
مَنٛ كَانَ فِیٛ حَاجَةِ اَخِيٛهِ كَانَ اللهُ فِیٛ حَاجَتِهٖ وَ مَنٛ فَرَجَ مَنٛ مُّسٛلِمٍ كُرٛبَةً فَرَجَ اللهُ عَنٛهُ بِهَا كُرٛبَةً مَِنٛ كُرَبِ يَوٛمِ الٛقِيَامَةِ۞
অর্থঃ কোন মুসলমান যখন তাহার অপর কোন মুসলমান ভাইয়ের কর্মে সহায়তা করে তখন আল্লাহপাক উহার প্রয়োজন পূর্ণ করিয়া দেন, এবং যে ব্যক্তি কোন মুসলমান ভাইয়ের কষ্টকে দূরীভূত করে আল্লাহপাক উহার পরিবর্তে তাহাকে কিয়ামতের মুসীবত সমূহের মধ্যে একটি মুসীবত দূর করিয়া দিবেন।
উল্লিখিত হাদীসটি হজরত ইবনু উমার রাদিআল্লাহু আনহুমা হইতে বর্ণনা করিয়াছেন ইমাম বুখারী, মুসলিম আবু দাউদ (রাঃ)।

ত্রয়োদশ দলিল  

হাদীস (৩৪): مسند الفردوس নামক কিতাবে হজরত আমীরুল মুমিনীন মাউলাল মুসলিমীন সাইয়িদিনা আলী মূর্তজা কার্রামাল্লাহু উয়াজহাহুল কারীম হইতে বর্ণিত হইয়াছে—
قَالَ رَأََنِیٛ النَّبِیُّ﴿ﷺ﴾حَزِيٛنًا فَقَالَ يَا اِبٛنَ اَبِیٛ طَالِبٍ اِنِّیٛ اَرَاكَ حَزِيٛنًا فَمُرٛ بَعٛضَ اَهٛلِكَ يُؤَذِّنُ فِیٛ اُذُنِكَ فَاِنَّهٗ دَرَّاءٌ لِلٛهَمِّ۞
অর্থঃ হুজুর আকরম সরকারে দো আলম ﴾ﷺ﴿ আমাকে (হজরত আলী কঃ) বিষণ্ণ অবস্থায় দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—ওহে আলী, আমি তোমাকে চিন্তিত অবস্থায় দেখিতে পাইতেছি। সুতরাং তোমার বাড়ীর কাউকে গিয়া বল তোমার কানে যেন কেহ আজান দেয়। কারণ আজান মনের চিন্তিত ও বিষণ্ণ অবস্থাকে দূরীভূত করিয়া দেয়।
মাওলা আলী কঃ এবং মাওলা আলী কঃ পর্যন্ত এই হাদীসের যতগুলি বর্ণনাকারী রহিয়াছে প্রত্যেকেই বলিয়াছেন যে,
فَجَرَّبٛتُهٗ فَوَجَدٛتُّهٗ كَذٰلِكَ۞
অর্থঃ আমরা অনুরূপভাবে কাহারো বিষণ্ণ অবস্থায় তাহার নিকট আজান দিয়া পরীক্ষা করিয়াছি এবং উহাতে সুফলপ্রাপ্ত হইয়াছি। ইবনু হাজরও একই কথাই বলিয়াছেন, যেমনটি রহিয়াছে মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা مرقات এর মধ্যে।
হাদীসপাক এবং অপরাপর প্রমান্য কিতাবসমূহে ইহা সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হইয়াছে যে, মাইয়্যাতকে দাফন করিবার পর সে অত্যন্ত চিন্তিত ও বিমর্ষ হইয়া পড়ে। কিন্তু আল্লাহপাকের প্রিয়পাত্র ব্যক্তিত্বসমূহ (অলী,গওস, কুতুব, আবদাল প্রভৃতি) আল্লাহপাক উহাদিগকে দেখিয়া বলিয়া থাকেন—
مَرٛحَبًا بِحَبِيٛبٍ جَاءَ عَلٰی فَاقَةٍ۞
অর্থঃ স্বাগতম! আমার এই বন্ধু অনাহারী অবস্থায় আমার নিকট আসিয়াছে এই সমস্ত পূণ্যাত্মাদিগের কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু সাধারণ পর্যায়ের মুসলমান যাহারা এই প্রকার উচ্চ পর্যায়ে উন্নিত হইতে সক্ষম হয় নাই, উহাদিগের কবরে আজান দিয়া উহাদিগের বিপদাপন্ন ও বিমর্ষ অবস্থায় প্রশান্তি প্রদান করণে শরীয়তের কোন প্রতিবন্ধকতা থাকিতে পারে না। বরং কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির সাহায্যের জন্য হস্ত প্রসারিত করা আল্লাহপাকের নিকট পছন্দনীয়।
হাদীস (৩৫): তিবরানী তাহার معجم کبیر এবং معجم اوسط নামক গ্রন্থদ্বয়ে হজরত আবদুল্লা ইবনু আব্বাস রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুমা হইতে নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন—রসূলুল্লাহ্ ﴾ﷺ﴿বলিয়াছেন—
اِنَّ اَحَبَّ الٛاَعٛمَالِ اِلٰی اللهِ تَعَالٰی بَعٛدَ الٛفَرَئِضِ اِدٛخَالُ الشُّرُوٛرِ عَلٰی الٛمُسٛلِمِ۞
অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ্পাকের নিকট ফরজ কর্মসমূহের পরেই সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় কর্ম হইল কোন মুসলমানকে খুশী করা।
হাদীস (৩৬): তিবরানীকৃত উপরোক্ত কিতাবদ্বয়ে হজরত ইমাম ইবনুল ইমাম সাইয়িদিনা হাসান মুজতবা রাদিআল্লাহু আনহুমা হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, হুজুর সরকারে দো আলম ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন—
اِنَّ مِنٛ موٛجِبَاتِ الٛمَغٛفِرَةِ اِدٛخَالَ السُّرُوٛرِ عَلٰی اَخِيٛكَ الٛمُسٛلِمِ۞
অর্থঃ ইহা সুনিশ্চিত যে কোন মুসলমান ভাইকে খুশী করিলে উহার পরিবর্তে ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয়।

চতুর্দশ দলিল  

আল্লাহপাক বলিয়াছেন—
يَااَيُّهَا الَّذِيٛنَ اٰمَنُوٛا اِذٛكُرُوٛا اللهَ ذِكٛرًا كَثِيٛرًا۞
অর্থঃ ওহে ঈমান আনয়নকারীগণ, তোমরা অত্যাধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করিতে থাক।
হাদীস (৩৭): হুজুর পুর নুর ﴾ﷺ﴿বলিয়াছেন—
اَكٛثِرُوٛا ذِكٛرَ اللهِ حَتّٰی يَقُوٛلُوٛا مَجٛنُوٛنٌ۞
অর্থঃ এত অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করিতে থাক যাহাতে লোকজন তোমাদিগকে পাগল বলিতে থাকে।
হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হইতে হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন যথাক্রমে ইমাম আহমদ, আবু ইয়ালা, ইবনু হাব্বান,হাকিম,বাইহাকী প্রমূখ। হাদীসটি সহীহ্ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন হাফিজ এবং হাফিজ ইবনু হাজর উহাকে হাসান (উত্তম) বলিয়াছেন।
হাদীস (৩৮): রসুল পাক ﴾ﷺ﴿বলেন—
اُذٛكُرُوٛا اللهَ عِنٛدَ كُلِّ حَجَرٍ وَ شَجَرٍ۞
অর্থঃ প্রস্তরাদি ও বৃক্ষসমূহের নিকটে আল্লাহর জিকির কর।
হাদীসটির উদ্ধৃতকারী ইমাম আহমদ (রাঃ) তাহার کتاب الزهد কিতাবে ইহা উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইমাম তাবারানী তাহার الکبیر এর মধ্যে হজরত মুআজ ইবনু জাবাল (রাঃ) হইতে বিশুদ্ধ সনদ হিসাবে হাদীসটি বর্ণনা করেন।
হজরত আব্দুল্লা ইবনু আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুমা বলেন—
لَمٛ يَفٛرِضِ اللهُ عَلٰی عِبَادِهٖ فَرِيٛضَةً اِلَّا جَعَلَ لَهَا حَدَّا مَعٛلُوٛمًا ثُمَّ عَذَّرَ اَهٛلَهَا فِیٛ حَالِ الٛعُذٛرِ غَيٛرَ الذِّكٛرِ فَاِنَّهُ لَمٛ يَجٛعَلٛ لَهٗ حَدَّانٍ اِنٛتَهٰی اِلَيٛهِ وَ لَمٛ يُعَذِّرٛ اَحَدً فِیٛ تَرٛكِهٖ اِلَّا مَغٛلُوٛبًا عَلٰی عَقٛلِهٖ وَاَمَرَهُمٛ بِهٖ فِیٛ الٛاَحٛوَالِ كُلِّهَا۞
অর্থঃ আল্লাহপাক বান্দাদিগের জন্য যে সমস্ত ফরজ কার্যাবলী নির্দিষ্ট করিয়াছেন উহার একটি সীমাও নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন। শরীয়ত সম্মত আপত্তির দরুণ কাহারো ফরজ পালনে অক্ষমতা থাকিতে পারে। কিন্তু আল্লাহপাকের জিকিরের ক্ষেত্রে কোন প্রকার সীমা নির্ধারিত হয় নাই এবং উহার জন্য কেহ কোন কারণ প্রদর্শন করিতে পারে না। একমাত্র অচেতন অবস্থা ব্যতীত সমস্ত অবস্থাতেই আল্লাহপাক জিকিরের নির্দেশ দিয়াছেন।
পূর্বোক্ত হজরত আব্দুল্লা ইবনু আব্বাস (রাঃ) এর শিষ্য ইমাম মুজাহিদ (রাঃ) বলিয়াছেন—
الذِّكٛرُ الٛكَثِيٛرُ اَنٛ لَّايَتَنَاهٰی اَبدًا۞
অর্থঃ অধিক পরিমাণে জিকির করিবার অর্থ হইল এমন জিকির যাহা কখনো শেষ হইবে না।
সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে, সমস্ত ক্ষেত্রেই আল্লাহপাকের জিকির অতীব পছন্দনীয়, প্রাসঙ্গিক এবং উহাই শিষ্টাচার বলা হইয়াছে। ইহাতে কোন প্রকারের বিরোধীতা অথবা নিষেধাজ্ঞা থাকিতে পারে না। যে কোন দৃষ্টিতেই দেখা হউক না কেন, আজান যে আল্লাহপাকের জিকির ইহাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। এমতাবস্থায় মাইয়্যাতের কবরের পার্শ্বে আল্লাহপাকের উক্ত প্রকার জিকিরের ক্ষেত্রে যে কিরূপ প্রতিবন্ধকতা থাকিতে পারে তাহা আল্লাহপাকই অধিক জ্ঞাত আছেন। আমাদের প্রতি নির্দেশ হইল যে, তোমরা প্রস্তর ও বৃক্ষাদির নিকট জিকির করিতে থাক। পাঠকবৃন্দ, নিরপেক্ষভাবে একবার বিচার করিয়া দেখুন তো—পাথরের নিকট জিকির করিবার নির্দেশ মুসলমানের কবরের পার্শ্বে জিকিরের অনুরূপ হইতে পারে কিনা। অথবা উহার অর্থ কি হইতে পারে।বিশেষতঃ কোন মাইয়্যাত দাফনের পর উহার নিকটে আল্লাহর জিকির করা হাদীস সমূহ হইতে প্রমাণিত। মহাত্মা আয়িম্মায়ে কিরাম ইহাকে মুস্তাহাব বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। এই কারণেই ইমামে আজল হজরত আবু সুলাইমান খতাবী রঃ তালকীন সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন—
لَانَجِدُ لَهٗ حَدِيٛثًا مَّشٛهُوٛرًا۔وَلَا بَأٛسَ بِهٖ اِذَا لَيٛسَ فِيٛهِ اِلَّا ذِكٛرُ اللهَ تَعَالٰیِ اِلٰی قَوٛلِهٖ وَ كُلُّ ذٰالِكَ حَسَنٌ۞
অর্থঃ এই সম্পর্কে (কবরে আজান সম্পর্কে) আমরা কোন মশহুর হাদীস পাই নাই বটে, তবে ইহাতে ক্ষতিকর কিছু নাই। কারণ আজানের মধ্যে আল্লাহপাকেরই জিকির রহিয়াছে এবং এই জিকির আল্লাহপাকের নিকট পছন্দনীয় ও প্রশংসনীয়।

পঞ্চদশ দলিল  

সহীহ্ মুসলিম শরীফের ভাষ্যকার ইমাম হজরত আবু জাকারিয়া নুআবী (রাঃ) کتاب الاذکار এর মধ্যে লিখিয়াছেনঃ
يُسٛتَحَبُّ اَنٛ يَّقٛعَدَ عِنٛدَ الٛقَبٛرِ بَعٛدَ الٛفَرَاغِ سَاعَةً قَدٛرَ مَا يَنٛحَرُ جَرُوٛرٌ وَ يُقٛسَمُ لَحٛمُهٗ وَ يَسٛتَغِلُ الٛقَاعِدُوٛنَ بِتِلَاوَةِ الٛقرٛاٰنِ وَ الدَّعَاءُ لِلٛمَيِّتِ وَ الٛمَوَاعِظِ وَ الٛحِكَايَاتِ لِاَهٛلِ الٛخَيٛرِ وَ الصَّالِحِيٛنَ۞
অর্থঃ দাফন কার্য সমাধা হইয়া গেলে কবরের নিকট কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকা উত্তম। একটি উট জবেহ করিয়া উহার গোশত সম্পূর্ণরূপে বন্টন করিয়া দিতে পারা যায় অনুরূপ সময়কাল পর্যন্ত ঐ স্থানে অবস্থান করিবে। কবরের নিকট বসিয়া কুরআন মজীদ তেলাওয়াত,মাইয়্যাতের জন্য দুআ,ওয়াজ নসীহত, নেককার ব্যক্তিদিগের সম্পর্কে আলোচনা প্রভৃতিতে মগ্ন থাকিবে।
শায়খ মুহাক্কিক মাওলানা আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী কুদ্দুস সির্রাহুল আজীজ ‘মিশকাত’ শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ لمعات এর মধ্যে লিখিয়াছেন—
قَدٛ سَمِعٛتُ عَنٛ بَعٛضِ الٛعُلَمَاءِ اِنَّهٗ يُسٛتَحَبُّ ذِكٛرُ مَسٛئَلَةٍ مِّنَ الٛمَسَائِلِ الٛفقٛهِيَّةِ۞
অর্থঃ কোন কোন উলামায়ে কিরামের নিকট আমি শুনিয়াছি যে, মাইয়্যাতকে দাফন করিবার পর উহার কবরের নিকট ফিকাহর মসলা আলোচনা করা মুস্তাহাব।
উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি আমীরুল মুমিনীন হজরত উসমানগনি (রাঃ) হইতে বর্ণিত একটি হাদীসের টীকা। অধম লেখক ইতিপূর্বে ষষ্ঠ দলিলের আলোচনা প্রসঙ্গে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করিয়াছি।
ফার্সী ভাষায় লিখিত মিশকাত শরীফের টীকাগ্রন্থ اشعة اللمعات এর মধ্যে এই সম্পর্কে বলা হইয়াছে—
باعث نزول رحمت است○
অর্থঃ ইহা রহমত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ। আরো লিখিয়াছেন—
مناسب حال ذکر مسئله فرائض○
অর্থাৎ, বর্তমান সময়ের পক্ষে উপযোগী ফারায়েজের মসলা। পুনরায় এই সম্পর্কে লিখিয়াছেন—
اگر ختم قرآن کنند اوای و افضل باشد○
অর্থাৎ, যদি কুরআন মজীদ খতম করা হয় তবে উহাই সর্বোত্তম।
উলামায়ে কিরাম নেককার ব্যক্তিদিগের সম্পর্কে আলাপ আলোচনা, বুজুর্গানে দ্বীনের কথা স্মরণ, কুরআন মজীদ খতম, মসলা মাসায়েলের আলোচনা প্রভৃতিকে মুস্তাহাব বলিয়াছেন।
যদিও এইগুলি সহীহ হাদীস সমূহে সুস্পষ্টরূপে উল্লিখিত হয় নাই, কিন্তু এই সমস্ত কিছুরই মূল উদ্দেশ্য মৃত ব্যক্তির জন্য আল্লাহপাকের অনুগ্রহ বর্ষন। আজানের মাধ্যমে আল্লাহপাকের অশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হইয়া থাকে, ইহা সহীহ্ হাদীস সমূহ হইতে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত। হাদীসপাকে ইহাও বলা হইয়াছে যে, আজান আজাবকে প্রশমিত করে। সুতরাং এহেন কল্যানকর একটি আমল কেবল জায়েজই নহে,মুস্তাহাবও বটে।
মোট কথা, পূর্ববর্ণিত দলিলসমূহ হইতে রৌদ্রকিরণোজ্জ্বল সূর্যের ন্যায় ইহা প্রতিভাত হয় যে, কবরে আজান দেওয়া জায়েজ তো বটেই, সেই সঙ্গে ইহা মুস্তাহাব। কোন কোন আলেম সম্প্রদায় ইহাকে সুন্নাতও বলিয়াছেন। তবে যাহারা কবরে আজান দেওয়াকে সুন্নাত বলিয়াছেন,যেমন ইমাম ইবনু হাজর মক্কী এবং আল্লামা খায়ের রামালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমা প্রমূখ, এবং যে সমস্ত উলামায়ে কিরাম উহাদের উদ্ধৃতি দিয়াছেন—সম্ভবতঃ তাহারা সুন্নাত অর্থে ‘সুন্নাত সমর্থিত’ একথা বুঝাইতে চাহিয়াছেন। সুন্নাত বলিতে এস্থলে হুবহু হাদীস পাক দ্বারা সরাসরিভাবে উল্লিখিত—একথা বুঝান হয় নাই। এই কারণে অনভিজ্ঞ সাধারণ মুসলমান সম্প্রদায় কবরে আজান দেওয়াকে যদি সরাসরি সুন্নাতরূপেই ধারণা করিতে থাকে, সেক্ষেত্রে কখনো কখনো উহা পরিত্যাগ করিবে। তবে কোন মুস্তাহাব কর্ম যদি সাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হইয়া পড়ে এবং তদ্বারা যদি প্রত্যেকের সওয়াব হাসিল করিবার উদ্দেশ্য হইয়া থাকে তবে উহা বাতিল করা কোন মতেই সমীচিন নহে। আল্লাহপাকই এই সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত।
মহান আল্লাহর সমীপে লাখো শুকরিয়া। কবরে আজান দেওয়া সম্পর্কিত মসলার আলোচনা প্রসঙ্গে পূর্বোক্ত পনেরটি দলিল পেশ করিলাম। অল্প সময় কালের মধ্যেই এইগুলি নিজ স্মৃতিপটে উদিত হইয়াছিল। তৎপর পাঠকবর্গের জন্য উহা লিপিবদ্ধ করিয়া দিলাম। নিরপেক্ষ এবং ন্যায় বিচারক পাঠকবৃন্দ এইগুলি পাঠ করিয়া ইহা হইতেই সঠিক রায় পেশ করিতে সক্ষম হইবেন ইনশাআল্লাহ তাআলা।পূর্বোল্লিখিত দলিল সমূহের মধ্যেকার অধিকাংশই হাদীস শরীফ প্রভৃতির উদ্ধৃতি যাহা এই অধম লেখক তালাস করিয়া সন্নিবেশিত করিয়াছে। কিছু কিছু উদ্ধৃতি যাহা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অপরাপর মহাত্মা উলামায়ে কিরামের কিতাবাদি হইতে সংগৃহীত হইয়াছে, অধম লেখক (আল্লাহ পাক তাহাকে ক্ষমা করুন)ঐগুলিকে ধারাবাহিকভাবে সুসংবদ্ধ করিয়া পেশ করিয়াছে। অত্র পুস্তিকার প্রতিটি দলিল স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং ইহার সামান্য (Common) আকারের উদ্ধৃতি সমূহকে বিশেষ (Particular) আকারে বিশ্লেষণ করিয়া সরলীকরণ করা হইয়াছে। সমস্ত প্রশংসা ও গুণগান বিশ্ব প্রতিপালক মহান আল্লাহপাকের। لاشك ان الفضل للمتقدم অর্থাৎ, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই যে, যাবতীয় দান সবই পূর্বসূরীগণেরই।
যে সমস্ত স্বনাম ধন্য উলামায়ে কিরাম নিজ নিজ ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত বিষয়সমূহ একত্রিত করিয়া একটি সামগ্রিক সুসংবদ্ধরূপ প্রদান করিয়াছেন এবং এহেন এক দূরূহ কর্মকে আমার জন্য অপেক্ষাকৃত সরল করিয়া দিয়াছেন—সেই সমস্ত মহাত্মাদিগের নিকট আমি একান্তরূপেই কৃতজ্ঞ। আল্লাহপাক আমাদিগের এবং ইসলাম ও সুন্নাতের তরফ হইতে উহাদিগকে উত্তম প্রতিফল প্রদান করুন। আমীন বজাহে সাইয়িদুল মুরসালীন।
       পাঠকবর্গের জন্য সতর্কতা  (১) অত্র পুস্তিকায় পূর্ববর্ণিত দলিল—প্রমাণাদি হইতে নির্নীত সঠিক রায় প্রদানকারী ও উপলব্ধিকারীদিগের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য—  এস্থলে আপনারা রহমতের মহত্ত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। অসীম করুনার ভাণ্ডারী আল্লাহপাক﴾ﷻ﴿তাহার মুসলমান বান্দাদিগের জন্য মৃত এবং আজানদাতার জন্য কিরূপ মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত রাখিয়াছেন তাহা লক্ষ্য করুন। এসমস্তই বিশ্বনিয়ন্তা মহান আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা। মুসলমান মাইয়্যাতের জন্য উহাতে সাত প্রকারের ফায়দা হাসিল হয়। ফায়দাগুলি নিম্নরূপঃ  (ক) আল্লাহপাকের অসীম ক্ষমতাবলে শয়তানের ধোকাবাজী হইতে পরিত্রাণ,  (খ) আজানের মধ্যস্থ তকবীরের বদৌলতে জাহান্নামের আগুন হইতে নিরাপদ,  (গ) মুনকীর নকীরের প্রশ্নের সঠিক উত্তর স্মৃতিপটে উদিত হওয়া,  (গ) আজানের ফজিলতের কারণে মৃতের কবরের আজাব হইতে পরিত্রাণ,  (ঙ) আজানের মধ্যে হুজুর আকরম ﴾ﷺ﴿ এর জিকির রহিয়াছে, উহার দরুন আল্লাহপাকের রহমত বর্ষিত হয়,  (চ) আজানের বদৌলতে মাইয়্যাতের ভীত দূরীভূত হয়।  (ছ) বিষণ্ণ ও চিন্তিত অবস্থা হইতে উত্তীর্ণ হইয়া হৃদয়ে প্রশান্তি এবং সান্তনা লাভ করা।  অপর দিকে আজান দাতার জন্য রহিয়াছে পনের প্রকারের সওয়াব। তম্মধ্যে সাতটি হইল পূর্বোক্ত সাত প্রকারের ফায়দা মাইয়্যাতের নিকট পৌঁছানো। কারণ কাহারো উপকার করিলে উহার পরিবর্তে উপকারী ব্যক্তিকেও উপযুক্ত সওয়াব প্রদান করা হয়। এই সওয়াব কমপক্ষে দশটি নেকী। সুতরাং কোন মুসলমান মাইয়্যাতের নিকট উপরোক্ত ফায়দাসমূহ পৌঁছাইলে আজান দাতার সওয়াব ইহাতে কতটা হইতে পারে তাহা আল্লাহপাকই অধিক জ্ঞাত।  (জ) মাইয়্যাতকে শয়তানের প্ররোচনা হইতে রক্ষার জন্য তদবির করা রসূলে পাক ﴾ﷺ﴿এর সুন্নাত,  (ঝ) মৃতের পক্ষে মুনকীর-নকীরের প্রশ্নের সঠিক প্রদানে সহায়তা করা, (ঞ) কবরের নিকট দুআ করা সুন্নাত,  (ট) মাইয়্যাতের সাহায্যের মানসে কবরের নিকট তকবীর পাঠ করা সুন্নাত,  (ঠ) জিকিরের যাবতীয় ফজিলত যাহা পবিত্র কুরআন ও হাদীসপাকে উল্লিখিত হইয়াছে উহা লাভ করা,  (ড) নবী করিম ﴾ﷺ﴿এর জিকিরের দরুন আল্লাহপাকের রহমত বর্ষিত হওয়া,  (ঢ) দুআ করার ফজিলত যাহার সম্পর্কে হাদীস শরীফে বিশেষভাবে বর্ণিত হইয়াছে এবং উহাকে ইবাদতের মগজ মগজ বলা হইয়াছে—উহা লাভ করা,  (ণ) সাধারণভাবে আজানের বরকতে বিশেষ বিশেষ কয়েকটি উপকার প্রাপ্ত হওয়া যায়। যেমন, আজান দাতার আজানের শব্দ যতদূর পর্যন্ত পৌঁছায় সেই পরিমাণে উহাকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। পানি ও স্থলবাসী যাবতীয় জীব ও জড় প্রত্যেকেই আজান দাতার জন্য সাক্ষ্য এবং ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া থাকে। হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ করা যায়। এস্থলে আজানের অপর একটি রহস্য হইল যে—আজানের মধ্যে প্রকৃত পক্ষে মূল বাক্য সাতটি। যেমন—     ১)    الله اكبر     ২)   اشهد ان لا اله الا الله     ৩)   اشهد ان محمدا رسول الله     ৪)   حی علی صلوه     ৫)   حی علی الفلاح     ৬)   الله اكبر     ৭)   لا اله الا الله  কিন্তু সম্পূর্ণরূপে আজান বলিতে গেলে মোট পনেরটি বাক্য উচ্চারণ করিতে হয়। যেমন الله اكبر প্রভৃতি কালেমাসমূহ একাধিকবার বলিতে হয়। এক্ষণে আজানের মধ্যে মাইয়্যাতের জন্য উপরোক্ত সাত প্রকারের ফায়দা এবং আজান দাতার জন্য পনের প্রকারের সওয়াব নিহিত রহিয়াছে। হে আল্লাহ, বিশ্বভূবনের তুমিই প্রতিপালক এবং সমস্ত প্রশংসা তোমারই।  ভাবিলে আশ্চর্য হইতে হয়, যাহারা কবরে আজান দেওয়াকে নিষিদ্ধ মনে করেন তাহারা আজান দাতা এবং মাইয়্যাতকে পূর্বোক্ত সাত এবং পনের প্রকারের ফায়দা হইতে বঞ্চিত করার মধ্যে কি প্রকারের যৌক্তিকতা খুঁজিয়া পাইলেন! রাসূলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন,  হাদীস (৩৯): ইমাম আহমদ এবং মুসলিম, হজরত জাবির ইবনু আব্দুল্লা রাদিআল্লাহু আনহুমা হইতে হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন—
من استطاع منكم ان ينفع اخاه فلينفعه۞
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে যাহাদের পক্ষে সম্ভব তাহারা যেন অপরাপর মুসলমান ভাইয়ের উপকার করিয়া থাকে। ইহা মুসলমানের জন্য জরুরী।
সুতরাং এহেন সুস্পষ্ট নির্দেশের পরও যে সম্পর্কে শরীয়তে কোন প্রকারের বাধা নিষেধ নাই এইরূপ উত্তম আমলের প্রতি নিষেধ করা হয় কোন দলিল দেখাইয়া? ইহার সঠিক উত্তর আল্লাহপাকই ভাল জানেন। হে আল্লাহ! তুমি প্রত্যেককে বুঝিবার মত শক্তি প্রদান কর। আমিন বজাহে ইমামুন নবীঈন﴾ﷺ﴿।
(২) হাদীস পাকে উল্লিখিত হইয়াছে, রসূলে আকরম ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন—হাদীস (৪০,৪১):
نية المؤمن خير من عمله۞
অর্থঃ মুসলমানের নিয়াত (কোন সৎকর্ম করিবার সংকল্প) তাহার কর্ম হইতে উত্তম।
বাইহাকী হাদীসটি বর্ণনা করেন হজরত আনাস (রাঃ) হইতে এবং তাবারানী তাহার كبير কিতাবের মধ্যে হজরত সাহল্ ইবনু সা’দ (রাঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন।
নিয়াত সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত কোন ব্যক্তি একই কর্মের নিয়াতের মাধ্যমে বিবিধ নেকী অর্জন করিতে সক্ষম। যেমন, নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাইবারকালে উহার গমণ করাটা যেমন নেকীর কর্ম তদ্রুপ ঐ ব্যক্তির প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য একটি করিয়া নেকী লিখিত হয়। ইহা অতিরিক্ত অর্জিত সওয়াব যাহা একই কর্মের নিয়াতের মাধ্যমে প্রাপ্ত হওয়া যায়। অনুরূপভাবে নিয়াত সম্পর্কে যিনি উত্তমরূপে অবগত আছেন এমন কোন ব্যক্তি মসজিদে নামাজ পড়িতে গিয়া নিম্নোক্ত প্রকারের নিয়াতগুলিও করিয়া উহার সওয়াব হাসিল করিতে পারেন। যেমন—
(১) প্রধান উদ্দেশ্য অর্থাৎ নামাজ পড়িবার জন্য যাইতেছি,
(২) আল্লাহর ঘর (মসজিদ) দর্শন করিব,
(৩) ইসলামের নির্দেশ সমূহের মধ্যে একটি প্রকাশ করিতেছি,
(৪) আল্লাহ পাকের নির্দেশ তথা মুআজ্জিনের ‘হাইয়্যা আলাস সলাহ’ (নামাজ পড়িতে এস)এর আহ্বানে সাড়া দিতেছি,
(৫) তাইয়্যাতুল মসজিদ নামাজ পড়িতে যাইতেছি,
    (৬) মসজিদ হইতে ধূলা-বালি, জঞ্জাল প্রভৃতি দূর করিব,     (৭) মসজিদে গিয়া ই'তিকাফ করিব। উলামায়ে কিরামের সর্বসম্মত অভিমত হইল যে, উক্ত প্রকারের ই'তিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত নহে। ইহা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য হইতে পারে, আবার কয়েক ঘণ্টার জন্যও হইতে পারে। সুতরাং কোন ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করিয়া মসজিদ হইতে বাহির হইবার সময় পর্যন্ত ই'তিকাফের নিয়াত করিয়া লইলে ঐ ব্যক্তি একাধিক্রমে নামাজের জন্য অপেক্ষা করিবার সওয়াব এবং নামাজ আদায় করিবার সওয়াব প্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ই'তিকাফের ও সওয়াব পাইবে।      (৮) আল্লাহ্পাকের নির্দেশ—
خُذُوٛا زِيٛنَتَكُمٛ عِنٛدَ كُلِّ مَسٛجِدٍ
(৮ম পারা, সূরা আ’রাফ ১০ রুক)
অর্থঃ “তোমরা পরিপাটি ও সুসজ্জিত হইয়া মসজিদে গমণ করিবে।” আল্লাহর এই নির্দেশ পালনার্থে মসজিদে যাইতেছি।
(৯) মসজিদে কোন্ আলেমের সাক্ষাৎ পাইলে তাহার নিকট মসলামাসায়েল জিজ্ঞাসা করিব এবং ধর্মকথা কিছু শ্রবণ করিব।
(১০) অজ্ঞ ব্যক্তিদিগকে মসলা-মাসায়েল শিক্ষা দিব এবং দ্বীনের কথা শুনাইব।
(১১) জ্ঞানে গুনে আমার সহযোগী ব্যক্তিদিগের সহিত ধর্মীয় ভাবের আদান প্রদান করিব,
(১২) উলামায়ে কিরামের জিয়ারত করিব,
(১৩) পূণ্যবান মুসলমানের দর্শন লাভ করিব,
(১৪) বন্ধু-বান্ধবের সহিত মিলিত হইব,
(১৫) অপরাপর মুসলমান ভাইয়ের সহিত মিলিত হইব,
(১৬) কোন আত্মীয় স্বজনের সহিত মোলাকাত হইলে উহার সহিত সদ্ব্যবহার করিব,
(১৭) মুসলমানের প্রতি সালাম জানাইব,
(১৮) মুসলমানের সহিত মুসাফাহ্ করিব,
(১৯) উহাদের সালামের জওয়াব দিব,
(২০) মুসলমানের জামাআতের সহিত নামাজ পড়িবার সওয়াব হাসিল করিব,
(২১) মসজিদে যাইবার পথে বিশ্বনবী হুজুর আকরম ﴾ﷺ﴿ এর প্রতি দুরূদ ও সালাম পেশ করিব,
(২২) بسم الله، الحمد لله، والسلام على رسول الله পাঠ করিব,
(২৩,২৪) মসজিদে প্রবেশ এবং বাহির হইবার সময় হুজুর আকদাস ﴾ﷺ﴿ এবং তাহার পবিত্র বংশধর ও পাক পবিত্রা সহধর্মিণীদিগের প্রতি দুরূদ শরীফ পাঠ করিব।দুরূদ শরীফ নিম্নরূপঃ—
اَللّٰهُمَّ صَلِّی عَلٰی سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَ عَلٰی اٰلِ سَيّدِنَا مُحَمَّدٍ وَ عَلٰی اَزٛوَاجِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ۞
(২৫) কোন অসুস্থকে দেখিলে উহার কুশল জিজ্ঞাসা করিব,
(২৬) কোন বিমর্ষ ও চিন্তান্বিত ব্যক্তি দেখিলে উহার সমবেদনা জানাইব এবং সান্তনা প্রদান করিব।
(২৭) কোন মুসলমান হাঁচির পর الحمد لله (আলহামদুলিল্লাহ)পাঠ করিলে উহার প্রত্যুত্তরে يرحمك الله(ইয়ারহামুকাল্লাহ্)বলিব,
(২৮,২৯) সৎ কর্মের প্রতি নির্দেশ এবং অসৎ কর্মের জন্য নিষেধ করিব,
(৩০) নামাজীর জন্য পানি আনিয়া দিব,
(৩১,৩২) নিজে মুয়াজ্জিন হইলে অথবা মসজিদে তেমন কেহ নির্দিষ্ট না থাকিলে নিয়াত করা যে—’আমি আজান ও একামত পাঠ করিব।’ কিন্তু এইরূপ নিয়াত করিবার পর আজান অথবা একামত দিতে না পারিলে(অন্য কেহ আজান বা একামত পাঠ করিলে) তথাপি উক্ত নিয়াতের দরুন সওয়াব প্রাপ্ত হইবে। উহার সৎ নিয়াতের সওয়াব আল্লাহ্পাক উহাকে প্রদান করিবেন।
(৩৩) কেহ পথ ভুলিয়া গেলে উহাকে সঠিক পথ দেখাইয়া দিব,
(৩৪) অন্ধ ব্যক্তির সাক্ষাৎ পাইলে উহাকে সহায়তা করিব,
(৩৫) জানাজা উপস্থিত হইলে উহাতে শরীক হইব,
(৩৬) তেমন কোন অসুবিধা না থাকিলে মৃতের দাফনকার্য সমাধা হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করিব এবং অসুবিধা না থাকিলে উহার কবরে আজান দিব (অনুবাদক)।
(৩৭) দুইজন মুসলমানের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হইলে যতদূর সম্ভব সুষ্ঠুভাবে উহার মীমাংসার চেষ্টা করিব,
(৩৮,৩৯) সুন্নাত অনুযায়ী মসজিদে যাইবার সময় প্রথমে ডাহিন এবং পরে বামপদ রাখিব,
(৪০) পথিমধ্যে কোন কিছু লিখিত কাগজপত্র পাইলে আদরের সহিত উহা অন্যত্র সরাইয়া দিব।
ইহা ব্যতীত আরো বহু প্রকারের সৎ নিয়াত হইতে পারে। পূর্বোক্ত নিয়াতসমূহের মধ্যে প্রথম ছাব্বিশটির কথা বিভিন্ন সূক্ষ্মদর্শী উলামায়ে কিরাম উল্লেখ করিয়াছেন। শেষোক্ত ২৭ হইতে ৪০ পর্যন্ত মোট ষোলটির কথা অধম লেখক লিপিবদ্ধ করিয়াছে। বেে
সুতরাং পাঠকবর্গ লক্ষ্য করুন, কোন ব্যক্তি যদি পূর্বোক্ত চল্লিশ প্রকারের নিয়াত লইয়া গৃহ হইতে মসজিদে গমন করেন তবে তিনি যে কেবল নামাজ পড়িবার সওয়াবই প্রাপ্ত হইবেন তাহা নহে, বরং একই সঙ্গে তিনি উল্লিখিত চল্লিশ প্রকারের পূণ্যকর্মের নিয়াতের নেকীও অর্জন করিতে পারিবেন । সুতরাং ঐ ব্যক্তির প্রতিটি পদক্ষেপ চল্লিশটি নেকীর সমতুল্য হইবে। এস্থলে লক্ষণীয় যে, পূর্বে ঐ ব্যক্তির প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য একটি করিয়া নেকী বরাদ্দ ছিল; এক্ষণে তাহা চল্লিশটি হইয়া গেল।
অনুরূপভাবে কবরে আজানদাতার প্রতি কর্তব্য যে, তিনি আজান দেওয়ার পূর্বেই পূর্বোক্ত পনের প্রকার সওয়াব হাসিল করিবার জন্য নিয়াত করিয়া লইবেন। ইহাতে প্রত্যেক প্রকারের নিয়াতের দরুন পৃথক পৃথকভাবে ফায়দা হাসিল করা যাইবে।আজানদাতা ইহাও নিয়াত করিবেন যে—মাইয়্যাতের জন্য দুআ করিবার যে নির্দেশ মুসলমানের প্রতি রহিয়াছে, আমি ঐ নির্দেশ পালন করিতেছি। কিন্তু ইহার পূর্বে কোন নেক কার্য করা প্রয়োজন। কারণ দুআ করিবার জন্য ইহাই সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি। ইতিপূর্বে সপ্তম দলিলের বিবরণে ইহার সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে।
বহু ব্যক্তি এমন আছেন যাহারা কবরে আজান দেন বটে, কিন্তু আজানের উপকারিতা এবং নিয়াতসমূহ সম্পর্কে তাহারা সঠিকভাবে অবগত নহেন। এই সমস্ত ব্যক্তি নিজ নিজ নিয়ত অনুসারেই সওয়াব প্রাপ্ত হইবেন। কারণ, হুজুর আকদাস ﴾ﷺ﴿ বলিয়াছেন—
فَاِنَّمَا الٛاعٛمَالُ بِالنّيَاتِ وَ اِنَّمَا لِكُلِّ امٛرٍء مَا نَوٰی
অর্থঃ প্রতিটি কর্ম উহার নিয়াতের সহিত সম্পর্কিত । কোন ব্যক্তি যেইরূপ নিয়াতে কোন কার্য করিবে সেইরূপেই উহার প্রতিদান দেওয়া হইবে।
(৩) কবরে আজান দেওয়া সম্পর্কিত মসলার বিরুদ্ধাচরণকারী কতিপয় অজ্ঞ নিরেট ব্যক্তি এইরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া থাকে যে—আজান তো কেবল নামাজের জন্য দেওয়া হয়, সুতরাং কবরে কিসের নামাজ হইবে যে উহার জন্য আজান দিতে হইবে?
আসলে ইহা প্রশ্নকারীর অজ্ঞতা ব্যতীত অন্য কিছু নহে। এই সমস্ত বিকট ও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করিয়া প্রকৃতপক্ষে উহারা কবরে আজান দেওয়াকে অস্বীকার করিতে চায়। উহারা এতটুকু অবগত নহে যে আজান কোন কোন উদ্দেশ্যে দেওয়া হইয়া থাকে এবং উহাতে কি কি উপকার রহিয়াছে! শরীয়তে নামাজ ব্যতীত আরো বহু স্থানে আজান দেওয়ার কথা বলা হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে কতক স্থানে আজান দেওয়া মুস্তাহাব। যেমন, বিষন্ন, চিন্তিত, বিমর্ষ, বিপদগ্রস্ত এবং নবজাত শিশুর কর্ণে আজান দেওয়া মুস্তাহাব। এইরূপ আরো বহু স্থানে আজান দেওয়ার কথা উল্লিখিত হইয়াছে। এই সম্পর্কে আমি نسيم الصبا فی ان الاذان يحول الوباء নামক কিতাবে বিশদভাবে আলোচনা করিয়াছি।
কোন কোন অজ্ঞ ব্যক্তি এইরূপ ধারণা পোষণ করিয়া থাকেন যে, নবজাত শিশুর কর্ণে যে আজান দেওয়া হয় উহার নামাজ মৃত্যুর পর তাহার জানাজার নামাজের মাধ্যমে আদায় করা হয়। কিন্তু কবরে যে আজান দেওয়া হইবে উহার নামাজ কোথায়?
এই প্রশ্নের জবাব বহু প্রকারে দেওয়া যাইতে পারে।যেমন, প্রথমতঃ (ক) কবরে যে আজান দেওয়া হয় উহা কোন নামাজের জন্য নহে। ইতিপূর্বে ইহার আলোচনা করা হইয়াছে। প্রশ্নকারীর বক্তব্য অনুসারে শিশুর কানে যে আজান দেওয়া হয় জানাজা পড়িয়া উহা আদায় করা হয়। কিন্তু জানাজার নামাজ প্রকৃতপক্ষে দুআ স্বরূপ। ইহাতে রূকু, সিজদা, বৈঠক,তাশাহুদ প্রভৃতি কিছুই নাই।
(খ) শিশুর কানে যে আজান দেওয়া হয় জানাজা উহার নামাজ হইতে পারে না। কারণ প্রত্যেক নামাজের জন্য পৃথকভাবে আজান দিতে হয়। ফজরের নামাজের জন্য আজান দিয়া ঐ আজানে জোহর আসর প্রভৃতি পড়া যাইবে না। সদ্যজাত শিশুর কানে যে আজান দেওয়া হয় যদি উহা কোন নির্দিষ্ট নামাজের ওয়াক্তেই হইয়া থাকে, কিন্তু উহার মৃত্যুর পর জানাজা ঠিক সেই ওয়াক্তেই পড়িতে হইবে এমন কোন নিয়ম শরীয়তে নাই।
(গ) নবজাত শিশুর কানে আজান প্রদানকারী ব্যক্তি নামাজ পড়িবার জন্য ঐ আজান দেন না। যদি নামাজের জন্য ঐ আজান হইত তবে ঐ নবজাত শিশুকে তখনই নামাজ পড়ানো প্রয়োজন হইত কিন্তু সে বর্তমানে উহাতে অক্ষম। সুতরাং উহার নামাজ তো তাহা হইলে কাজা হইয়া গেল! কিন্তু তাহার পর যখন জানাজা পড়া হয় তখন তো কাজা নামাজের নিয়াত করা হয় না। সুতরাং জানাজার নামাজ উক্ত আজানের জন্য নহে, বরং উহা অপরাপর মুসলমানের জন্য ফরজে কিফায়াহ্।
দ্বিতীয়তঃ কোন ব্যক্তির উপর নামাজ ফরজ হইলে আজান শুনিলে তবেই উহার নামাজ ফরজ হইবে এমত নহে। শরীয়তী দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক হইলেই উহার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হইয়া যায়। সুতরাং প্রাপ্ত বয়স্ক (সাবালক) হওয়ার পূর্বে লক্ষাধিকবার আজান শুনিলেও উহার জন্য নামাজ ফরজ হয় না। সুতরাং কাহারো মৃত্যুর পর তাহার জানাজা পড়িয়া নামাজ শোধ দিতে হইবে একথা ঠিক নহে।
তৃতীয়তঃ ঝড়, তুফান, ভূমিকম্প প্রভৃতি দূর্যোগের সময় আজান দেওয়ার কথা শরীয়তে বলা হইয়াছে।বুজুর্গানে দ্বীনও এইরূপ মন্তব্য করিয়াছেন যে, তাহারা উল্লিখিত দূর্যোপূর্ণ অবস্থায় আজান দিয়া পরীক্ষা করিয়াছেন এবং সুফল প্রাপ্ত হইয়াছেন। সুতরাং তুফান, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রলয়ংকর অবস্থায় যে আজান দেওয়া হয় উহার জন্য তো কোন নামাজ পড়া হয় না এবং শরীয়তেও এইরূপ আজানের জন্য কোন নামাজ পড়িবার কথা বলা হয় নাই।
সুতরাং আজান যে কেবলমাত্র নামাজের জন্য নহে, একথা পরিস্কার হইয়া গেল।
চতুর্থতঃ বিরুদ্ধবাদীদিগের বক্তব্য অনুযায়ী, কবরে যে আজান দেওয়া হইবে এক হিসাবে উহারও নামাজ রহিয়াছে। জানাজার নামাজে যেমন কেবল দাঁড়াইয়া থাকিয়াই নামাজ সমাপ্ত করা হয়।(এবং এই দাঁড়ানো অবস্থাটি নামাজের অন্যান্য শর্তের মধ্যে একটি মাত্র। কেবল দাঁড়াইয়া থাকাটাই নামাজ নহে। প্রকৃত পক্ষে জানাজা একটি দুআ। ইহার নিয়ম কানুন কতটা নামাজের মত বলিয়াই ইহাকে নামাজ বলা হয়।—অনুবাদক।) তদ্রুপ হাশরের ময়দানে কেবল সিজদার মাধ্যমেই একটি নামাজ পাঠ করা হইবে। সিজদা নামাজের প্রয়োজনীয় একটি শর্ত। হাশরের ময়দানে সমস্ত মুসলমান সিজদায় পতিত হইবে, কিন্তু মুনাফিকের দল সিজদা করিতে পারিবে না। ইহার বিবরণ কুরআন মজীদে সূরা কা’ফ-এর মধ্যে উল্লেখ করা হইয়াছে। কবরে আজানের জন্য নামাজ পড়িতে হইবে ইহা সেই নামাজ।
(৪) শরীয়তের মসলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হইল যে, যে সমস্ত নিয়মাবলী অথবা কার্যকলাপ শরীয়ত বর্ণিত উদ্দেশ্য সমূহের সহিত সুসামঞ্জস্য উহা গ্রহণীয় এবং প্রশংসনীয়।
কিন্তু যাহা শরীয়ত বর্ণিত নিয়মাবলীর উদ্দেশ্য সমূহের সহিত সামঞ্জস্যবিহীন উহা পরিত্যাজ্য। কোন বিষয়ে শরীয়তের কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকিলে সাধারণ (General) নির্দেশ কোন মসলার প্রতি পূর্ণরূপেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ উহার পৃথক পৃথক অংশ সমূহের প্রতিও এই নির্দেশ কার্যকরী। সুতরাং যে স্থলে সাধারণ নিয়ম দ্বারা কোন মসলা উত্তম বলিয়া সাব্যস্ত হয় উহার জন্য কোন বিশেষ পদ্ধতি (Particular Method) অবলম্বনের প্রয়োজন হয় না। সাধারণভাবে প্রশংসনীয় এবং উত্তম আমল বলিয়া গৃহীত হওয়াটাই কোন মসলার প্রমাণের জন্য যথেষ্ট,উহাই কোন মসলা জায়েজ (সিদ্ধ) হইবার দলিল।
কোন মুবাহ্কে নাজায়েজ বলা যায় না বরং উহা জায়েজ হইবার দলিল। মুবাহ কাজকর্ম সিদ্ধ করিতে কোন প্রমাণাদির প্রয়োজন হয় না। কোন সামান্য (Common, সার্বজনীন) নিয়মের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করিবার যৌক্তিকতা অস্বীকার করা এবং কোন সার্বজনীন নিষেধাজ্ঞা নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের প্রতি প্রযোজ্য হওয়াকে স্বীকার না করা কেবল বিরুদ্ধবাদীদিগের একগুঁয়েমিই নহে, বরং এক প্রকারের পণ্ডিতিপনা উহাদের অজ্ঞতা এবং নির্বুদ্ধিতাকেই বেশী করিয়া প্রকাশ করিয়া দেয়।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামায়ে কিরাম (আল্লাহপাক উহাদিগের উত্তম প্রচেষ্টার উত্তম প্রতিফল প্রদান করুন) উল্লিখিত মসলা সম্পর্কে সুন্দরভাবে আলোচনা করিয়াছেন।ইহাদিগের অনুসৃত যাবতীয় নিয়মাবলী এবং অপরাপর আদেশ-নির্দেশসমূহ মেঘমুক্ত আকাশের অত্যুজ্জল সূর্যের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করিয়া আমাদেরকে উপহার দিয়াছেন। এই গুরুকর্মের ধ্বজাধারী ও পথিকৃৎ স্বনামধন্য জগদ্বরেন্য সার্থকজম্মা “হজরত খিতামুল মুহাক্কিকীন ইমামুল মুদাক্কিকীন হুজ্জাতুল্লাহি ফীল আরদীন মু’জিজাতুম মিম মু’জিজাতি সাইয়িদিল মুরসালীন সালাতুল্লাহি উয়া সালামুহু আলাইহি উয়া আলা আলিহী উয়া আসহাবিহী আজমাঈন,সাইয়িদুল উলামা সানাদুল কুমালা তাজুল আফাজিল সিরাজুল আমাসিল হজরত শ্রদ্ধেয় মদীয়, আব্বাজান কাদ্দাসাল্লাহু তাআলা সির্রাহু উয়া রাজাকানা বির্রাহু” তাহার অনুপম কিতাব—
اذانة الاءثام لمانی عمل المولد و القيام ،اصول الرشاد فی قمع مبانی الفساد প্রভৃতিতে লাজওয়াব এবং হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করিয়াছেন। অধম লেখকও বর্তমান সময়ের প্রয়োজনীয়তাবোধে انامة القيامة على طاعن القيام لنبى تهامة نسيم الصبا فى ان الاذان يحول الوباء، منير العين فى حكم تقبيل الابهامين
প্রভৃতি কিতাব প্রনয়ন করিয়া উল্লিখিত বিভিন্ন প্রকারের আজান প্রসঙ্গে বিশদভাবে আলোচনা করিয়াছি। এই কারণে উক্ত মসলা-মাসায়েল বিস্তৃত আলোচনা পুনরায় করা হইল না।
وبالله التوفيق و هو المعين و الحمد لله رب العلمينخ و الصلاة والسلام على سيد المرسلين محمد واله و صحبه اجمعين امين برحمتك يا ارحم الرحم
সমস্ত প্রশংসা ও গুণগান একমাত্র আল্লাহই। এই পুস্তকটি মুহর’ম মাসের শেষার্ধে ১৩০৭ হিজরীতে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই লিখিত হইল।
ولله سبحانه و تعالى اعلم و علمه جل محمد اتم و احكم
পুস্তক প্রণেতা—অধম আহমদ রেজা বেরেলবী রাঃ
আব্দুল মুস্তফা আহমদ রেজা খান
মুহাম্মদী সুন্নী হানাফী কাদেরী
সংযোজনঃ বিশ্ববিশ্রুত হাদীস বিশেষজ্ঞ এবং সুপণ্ডিত হজরত শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিস দেহলবী রহঃ রচিত عزيزى ملفوظات নামক কিতাবে রহিয়াছে ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
*عمل مشائخ ست که اذان بر قبر بعد دفن می گویند
অর্থঃ দাফনের পর কবরে আজান দেওয়া মাশায়েখে কিরামের রীতি। (টীকাকার ও সংকলক মুঃ আব্দুল মুবীন নু’মানী)
ইহা হইতে স্পষ্টরূপে বুঝা গেল যে, দাফনের পর কবরে আজান দেওয়ার রীতি বুজুর্গগণের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরিয়া পালিত হইয়া আসিতেছে। সুতরাং ইহা হালফিল উদ্ভাবিত নতুন কোন মসলা নহে। হজরত শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিস দেহলবী রহঃ এর সময়কাল ছিল খ্রীষ্টিয় ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় দুইশত বৎসরের কাছাকাছি সময়। তৎকালীন সময়ে তাহার রচিত কিতাবের বর্ণনা মতে তৎপূর্বের বহু মাশায়েখে কিরামও কবরে আজান দিতেন। সুতরাং আজকের দিনের ইচড়ে পাকা শিয়াল পণ্ডিতের দল কবরে আজান দিলে মুখ ভেংচান কেন?

ইতি—

খাকসার—মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান

সুন্নী, হানাফী।

Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা