বাংলা ও আসামে ওহাবী মতবাদের আমদানী হলো কী ভাবে?
প্রশ্ন: বাংলা ও আসামে ওহাবী মতবাদের আমদানী হলো কী ভাবে?
উত্তর: পাকভারত উপমহাদেশে ওহাবী ফিতনার অনুপ্রবেশ ও এর সূত্রপাত যাদের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল তাদের মধ্যে মৌলভী ইসমাইল দেহলভী অন্যতম (নিহত ১৮৩১ইং)। সে আরবের বিতর্কিত ব্যক্তি শয়তানের শিং খ্যাত মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর লিখিত কিতাবুত তাওহীদ গং এর মর্মানুযায়ী উর্দূ ভাষায় ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক একটি কিতাব রচনা করে উপমহাদেশে বহুল পরিমাণে তা প্রচার করে। ফলে তাকভীয়াতুল ঈমান গ্রন্থটি পাকভারত উপমহাদেশে ওহাবী মতবাদের প্রচারপত্র হিসেবে কাজ করে।
উল্লেখ্য যে, উক্ত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক বিতর্কিত কিতাবটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে হারামাঈন শরীফাইন তথা মক্কা-মদীনার তদানিন্তন শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে এজামগণ এ কিতাবটিকে নজদী-ওহাবী মতবাদ অবলম্বনে লিখিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং উক্ত কিতাবের ভ্রান্ত আক্বিদা থেকে মুসলমানদের সতর্ক থাকার উপদেশ দিয়ে উক্ত কিতাবের বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রদান করেন। যা আল্লামা কাযী ফজল আহমদ লুদিয়ানভী তদীয় আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত’ নামক কিতাবের ১ম খণ্ড ৫৩৩ পৃষ্ঠায় সংকলন করেন। যা নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো-
لا شك فى بطلان منقول من تقوية الايمان بكونه موافقا للنجدية مأخوذ من كتاب التوحيد لقرن الشيطان وايضاله نسبت تقوية الايمان ومولف ان هذا الدجال والكذاب استحق اللعنة من الله تعالى وملئكة واولى العلم وسائر العالمين الخ ...
অর্থাৎ ‘নি:সন্দেহে (মৌং ইসমাইল দেহলভী কৃত) ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক গ্রন্থটি বাতিল। উহা শয়তানের শিং (মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব) নজদীর কিতাবুত তাওহীদ অনুকরণে লেখা হয়েছে। এ কিতাবটির রচয়িতা দাজ্জাল কাজ্জাব যা আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ, বিচক্ষণ উলামায়ে কেরাম এবং সমস্ত সৃষ্টিকুলের পক্ষ থেকে লা’নত বা অভিশাপ পাওয়ার যোগ্য।’
উক্ত ফতওয়ার মধ্যে মক্বাশরীফ ও মদিনাশরীফ এর যে সকল উলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে এজাম স্বাক্ষর করেছিলেন তাদের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. আব্দুহু জামান শায়খ ওমর, মক্বা মুয়াজ্জমা।
২. আহমদ দাহলান, মক্বা মুয়াজ্জমা।
৩. আব্দুহু আব্দুর রহমান, মক্বা মুয়াজ্জমা।
৪. মুফতি মোহাম্মদ আল কবী, মক্বা।
৫. সৈয়দ আল ওয়াছউদ আল হানাফী মুফতি, মদিনা মুনাওয়ারা।
৬. মোহাম্মদ বালী, খতিব মদিনা মুনাওয়ারা।
৭. সৈয়দ ইউসুফ আল আরাবী, মদিনা মুনাওয়ারা।
৮. সৈয়দ আবু মোহাম্মদ তাহির ছিদ্দেকী, মদিনা মুনাওয়ারা।
৯. মোহাম্মদ আব্দুছ ছায়াদত, খতিব মদিনা মুনাওয়ারা।
১০. আব্দুল কাদির দিতাবী, মদিনা মুনাওয়ারা।
১১. মৌলভী মোহাম্মদ আশরাফ খুরাসানী, বেলাওতী, মদিনা মুনাওয়ারা।
১২. শামছুদ্দিন বিন আব্দুর রহমান, মদিনা মুনাওয়ারা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমুখ। (আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত- ১ম খণ্ড ৫৩৪ পৃষ্ঠা)
হারামাইন শরীফাইনের উপরোক্ত ফতওয়াখানা মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর যুগে ১৮৩১ ইংরেজী সনের পূর্বে প্রদত্ত হয়েছিল।
অনুরূপ মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাবে বাতিল আক্বিদার খণ্ডনে মোজাহিদে মিল্লাত আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী (আলাইহির রহমত) (ওফাত ১৮৬১ ইং ১২৭৮ হিজরি) তিনি ১২৪০ হিজরি রমজানশরীফের ১৮ তারিখে ‘তাহক্বীকুল ফতওয়া’ নামক একখানা কিতাব প্রণয়ন করে মুসলিমসমাজকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন।
উক্ত ফতওয়ার মধ্যে তৎকালীন যুগশ্রেষ্ট ১৭ (সতের) জন উলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে এজামের স্বাক্ষর রয়েছে। তন্মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত মোহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর নাতী মাওলানা মাখছুছ উল্লাহ (আলাইহির রহমত) ও মাওলানা মুছা (আলাইহির রহমত) ছিলেন অন্যতম।
উল্লেখ্য যে, ‘হুসামূল হারামাইন’ নামক আরো একখানা ফতওয়া ১৩২৪ হিজরি সনে প্রকাশিত হয়। এ ফতওয়াখানা চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ আলা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা শাহ আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক প্রণীত এবং তৎকালীন মক্বাশরীফ ও মদিনাশরীফের প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে এজাম কর্তৃক প্রশংসিত ও স্বাক্ষরিত।
হারামাইন শরীফাইনের তদানিন্তন মুফতিয়ানে কেরামের প্রদত্ত ফতোয়া দ্বারা প্রমাণিত হলো মৌলভী ইসমাইল দেহলভী কৃত তাকভীয়াতুল ঈমানই হচ্ছে উপমহাদেশের ওহাবী মতবাদের উপর লিখিত প্রথম গ্রন্থ এবং ইসমাঈল দেহলভী হল এই মতবাদের অন্যতম নেতা।
তাকভীয়াতুল ঈমান কিতাবের বাতিল আক্বিদাসমূহ
১. হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বড় ভাই সুতরাং তাঁকে বড় ভাইয়ের ন্যায় সম্মান করতে হবে। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান ৬০ পৃষ্ঠা)
২. বড় মাখলুক অর্থাৎ হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর শানের সম্মুখে চামার হতেও নিকৃষ্ট। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান- ১৪ পৃষ্ঠা)
৩. আঁ হযরত বলেছেন, আমিও একদিন মরে মাটিতে মিশে যাব।’ (নাউজুবিল্লাহ) তাকভীয়াতুল ঈমান- ৬১)
৪. আল্লাহর রাসূলকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর সৃষ্টি বলে আক্বিদা রেখে যদি কেহ আল্লাহর হাবীবের কাছে সুপারিশ বা শায়ায়াত তলব করে সে আবু জেহেলের মতো মুশরিক হবে। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান- ৮)
৫. আল্লাহ তায়ালা যখন ইচ্ছা করেন, তখনই গায়েব সম্মন্ধে অবগত হয়ে যান, এটা আল্লাহ ছাহেবের শান বা পজিশন। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান-২০ পৃষ্ঠা)
৬. খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতা বলে নবীগণ, আউলিয়ায়ে কেরামগণ মানুষের বিপদ মুক্তি করতে পারেন, বিপদ মুক্তি করে থাকেন ইহা কুফুরি। (নাউজুবিল্লাহ) (তাকভীয়াতুল ঈমান- ১০ পৃষ্ঠা)
৭. হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন গায়েবই জানেন না। (নাউজুবিল্লাহ) তাকভীয়াতুল ঈমান- ৫৮ পৃষ্ঠা)
৮. গ্রামের জমিদার ও প্রত্যেক সম্প্রদায়ের চৌধুরীর যেই রূপ মর্যাদা রয়েছে, ঠিক সেই অর্থেই প্রত্যেক পয়গাম্বর নিজ নিজ জাতির নিকট মর্যাদাবান (এর বেশি নয়) নাউজুবিল্লাহ ( তাকভীয়াতুল ঈমান ৬৪ পৃষ্ঠা)
৯. দুনিয়াতে যত পয়গাম্বর এসেছেন, তারা আল্লাহর পক্ষ হতে এ হুকুমই নিয়ে এসেছিলেন যে, আল্লাহকে মানো (মান্য কর) আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মানবে না। (মান্য করবে না) (তাকভীয়াতুল ঈমান ১৫ পৃষ্ঠা)
সুতরাং মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী এবং তার লিখিত তাকভীয়াতুল ঈমানকে যারা সঠিক বলে সমর্থন করে তারাই এ উপমহাদেশে ওহাবী নামে পরিচিত।
Comments
Post a Comment