তাজিমী সিজ্দা
তাজিমী সিজ্দা
আলা হযরত শাহ ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)
حُرْمَتِ سجده تعظِيْم
তাজিমী সিজ্দা
মূলঃ আ'লা হযরত শাহ আহমদ রেযা খান বেরলভী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)
অনুবাদঃ এস, এম আশরাফ আলী আল-কাদেরী
টেক্সট রেডীঃ মুহাম্মদ আব্দুল খালেক
সূচী
-------
বিষয়
✿ প্রথম পত্র
✿ দ্বিতীয় পত্র
✿ পত্রের উত্তর
✿ কুরআন করীম দ্বারা তাজিমী সিজদা হারাম প্রমাণিত
✿ চল্লিশ হাদীছ দ্বারা তাজিমী সিজদা হারাম প্রমাণিত
✿ কবরের দিকে সিজদা করার নিষেধাজ্ঞা
✿ দেড়শ ফিকহি দলীল দ্বারা তাজিমী সিজদা হারাম প্রমাণিত
✿ কারো সামনে মাটি চুমু দেয়া প্রসঙ্গ
✿ মাযারে সিজদা দেয়া সম্পর্কিত আলোচনা
✿ সাহাবায়ে কিরাম, আয়িম্যায়ে এজাম, আওলীয়া কিরাম ও বিভিন্ন কিতাবের প্রতি অপবাদ
✿ হুজুর ﴾ﷺ﴿ এর প্রতি অপবাদ
✿ আল্লাহ তাআলার প্রতি অপবাদ
✿ হযরত আদম ও হযরত ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) কে সিজদা প্রসঙ্গে আলোচনা
অনুবাদকের কথা
আলা হযরত শাহ আহমদ রেযা খান বেরলভী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বিরচিত 'হুরমতে সিজ..দায়ে তাজিম' পুস্তিকাখানি 'তাজিমী সিজদা' নামকরণ করে বাংলায় অনুবাদ করতে পেরে নিজকে ধন্য মনে করছি। আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় এ ধরণের পুস্তিকা প্রকাশিত হয়নি। যার ফলে এ তাজিমী সিজদাকে নিয়ে আমাদের দেশে এখনও কিছুটা ভুল বুঝাবুঝি রয়েছে। কেউ একে শিরক মনে করে। আবার কেউ একে জায়েয মনে করে। অথচ এটা শিরকও নয় আবার জায়েযও নয়, বরং হারাম। কুরআন, হাদীছ ও ফিকহ গ্রন্থের অকাট্য প্রমাণ দ্বারা আলা হযরত এটাই প্রমাণ করেছেন। আশা করি এ পুস্তিকা পাঠে সকল ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটবে। পুস্তিকাটি যতটুকু সম্ভব হুবহু অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। তবে শেষের দিকে মূল বক্তব্য অটুট রেখে কিছুটা সংক্ষিপ্ত করেছি যাতে পাঠকমহলের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে এবং যেন এক নাগাড়ে পুস্তিকাটি আদিঅন্ত পাঠ করে মূল বক্তব্যটুকু হৃদয়াঙ্গম করতে সক্ষম হন। অনুবাদ যতটুকু সম্ভব সহজ সরল ও মার্জিত করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে সাধারণ পাঠকগণ উপকৃত হতে পারেন।
ওমান প্রবাসী জনাব মুহাম্মদ আব্দুল করিম সাহেবের অনুপ্রেরণায় এবং তারই আর্থিক আনুকূল্যে পুস্তিকাটি প্রথমবার প্রকাশিত হয়েছিল। এজন্য আমি তাঁর কাছে একান্ত কৃতজ্ঞ। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আমি নিজ খরচায় প্রকাশ করেছি। পাঠক মহল পুস্তিকা পড়ে উপকৃত হলে, আশা করি আমার জন্য আন্তরিকভাবে দুআ করবেন।
আমীন
অনুবাদক
بِسٛمِ اللّٰهِ الرَّحٛمٰنِ الرَّحِيٛم
نَحٛمُدُهٗ وَ نُصَلِّیٛ عَلٰی رَسُوٛلِهٖ
প্রথম পত্র
৯ই রমযান ১৩৩৭ হিজরীতে মাদ্রাসায়ে ইব্রাহিমিয়া বানারস থেকে মাওলানা হাফেজ আব্দুস সামী সাহেব নিম্নবর্ণিত মাসআলা সম্পর্কে আলা হযরত শাহ আহমদ রেযা খান সাহেবের অভিমত জানতে চেয়ে একখানা পত্র লিখেন।
মাসআলাটি হচ্ছে যায়েদ বলে যে, তরিকতের পীর মুর্শেদের জন্য তাজিমী সিজদা এখনও জায়েয আছে। এতদ্ব্যাপারে সে ফিরিশতাগণ কর্তৃক আদম (আলাইহিস্ সালাম)কে সিজদা ও হযরত ইউসুফ (আলাইহিস্ সালাম) এর ঘটনাকে দলীল হিসেবে পেশ করে। সে আরও বলে যে, যাদুকরেরা হযরত মুসা (আলাইহিস্ সালাম)কে সিজদা করেছে। কিন্তু আমর বলে যে, তাজিমী সিজদা আগের দ্বীন সমূহে জায়েয ছিল; আমাদের শরীয়তে সে হুকুম মনসুখ (রহিত) হয়ে গেছে। তাফসীরে জালালাইন, মাদারেক, খাযেন, রুহুল বয়ান, জামেউল বয়ান, তফসীরে কবীর, ফতহুল আজিজ ইত্যাদিতে তা উল্লেখিত আছে। আর যাদুকরেরা সত্যের সন্ধান লাভ করে আসল খোদাকে সিজদা করেছিল, হযরত মুসা (আলাইহিস্ সালাম)কে নয়। যেমন কালামে পাকে আছে-
قَالُوٛا اٰمَنَّا بِرَبِّ الٛعَالَمِيٛنَ رَبِّ مُوٛسٰی وَ هَارُوٛنَ
এ আয়াত দ্বারা তা-ই বুঝা যায়। যায়েদ বলে যে, কুরআন শরীফের বর্ণনা ও কাহিনীমূলক আয়াত নাসিখ মনসুখ হয় না, নুরুল আনোয়ারে তাই বর্ণিত আছে। তাই সিজদার বৈধতা এখনও বলবৎ আছে। কিন্তু আমর বলে যে, তাফসীরকারকগণ এর হুকুমটা মনসুখ বলে বর্ণনা করেছেন।
যায়েদ বলে যে, তাফসীরকারকদের নিজস্ব মতামত দলীল হতে পারে না, যতক্ষণ এর নাসিখ বা রহিতকারী কোন আয়াত পাওয়া না যায়। আমর বলে যে, এর নিষেধাজ্ঞায় কুরআনের সুষ্পষ্ট আয়াত আছে। যথা-
يَااَيُّهَا الَّذِيٛنَ اٰمَنُوٛا الرٛكَعُوٛا وَ اسٛجُدُوٛا وَ اعٛبُدُوٛا رَبَّكُمٛ
(হে মুমিনগণ! তোমরা রুকু কর, সিজদা কর এবং ইবাদত কর তোমাদের প্রতিপালকের)।
সুতরাং বুঝা গেল যে, সিজদা হচ্ছে ইবাদত যা খোদা ভিন্ন অন্য কারো জন্য হবে শিরক। কুরআন শরীফে আরও বর্ণিত আছে-
فَاسٛجُدُوٛا لِلّٰهِ وَاعٛبُدُوٛا وَاسٛجُدُوٛا لِلّٰهِ الَّذِیٛ خَلَقَهُنَّ اِنٛ كُنٛتُمٛ اِيَّهُ تَعٛبُدُوٛنَ
(অতএব আল্লাহকে সিজদা কর এবং তাঁরই ইবাদত কর। সিজদা কর আল্লাহকে যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর।) এখানে প্রথম আয়াতে لام এবং দ্বিতীয় আয়াতে اِيَّاهُ বিশেষত্বের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং সিজদা একমাত্র জাতেপাকের জন্য নির্দিষ্ট; অন্য কারো জন্য শিরক, হারাম ও কুফরী।
যায়েদের মতে উপরোক্ত আয়াত সমূহে আল্লাহর জন্য খাস করা হয়েছে ইবাদতের সিজদা, তাজিমী সিজদা নয়। সুতরাং সেটা জায়েজ। কিন্তু আমরের বক্তব্য হলো لَاتَسٛجُدُوٛا لِلشَّمٛسِ وَ لَالِلٛقَمَرِ এ আয়াত দ্বারা খোদা ভিন্ন অন্য কারো জন্য সিজদা নিষিদ্ধ প্রমাণিত যদিওবা তা তাজিমী সিজদা হোক না কেন। ফকীহ ও ইসলামী দার্শনিকগণ একে হারাম ও কুফর বলেছেন। মোল্লা আলী কারী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর শরহে ফিকহে আকবর, আনজাহুল হাজা, হলবি শরহে মুনিয়া, মালাবুদ্দা ও আলমগীরীতেই তা-ই বর্ণিত আছে। অধিকন্তু এর বিপক্ষে অনেক সহীহ হাদীছ রয়েছে।
যায়েদের উত্তর হলো কুরআনের আয়াতে لَاتَسٛجُدُوٛا لِلٛاِنٛسَانِ (মানুষকে সিজদা কর না।) উল্লেখ নেই। এবং এর পক্ষে অনেক হাদীছ রয়েছে। যেমন ইকরামা ইবনে আবু জেহেল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর হুযুর ﴾ﷺ﴿কে সিজদা করেছিল। হুযুর ﴾ﷺ﴿ তাকে নিষেধ করেন নি। (মাদারেজুন নবুয়াত ও রাউজাতুল আহবাব দৃষ্টব্য) জনৈক সাহাবী হুযূর আলাইহিস সালামের কপাল মুবারকে সিজদা করেছিলেন। তখন হুযূর ﴾ﷺ﴿ বলেছিলেন তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছে। অতএব প্রমাণিত হলো যে সিজদা জায়েয।
এর প্রতি উত্তরে আমর বলে যে, ইকরামার রেওয়ায়েত থেকে সিজদা মুরাদ লওয়া কি ধরনের ধোঁকাবাজি তা আলেম সমাজের অজানা নয়। কেননা উক্ত হাদীছে উল্লেখিত আছে-
فَطَأطًأ رَأسَهُ مِنَ الٛحَيَاءِ كَمَا فِیٛ سِيٛرَةِ الٛحَلٛبِیٛ وَسِيٛرَةِ النَّبَوَّةِ
(লজ্জায় মাথানত করে) মাদারেজুন নাবুয়াতের উক্তিটা হচ্ছে-
نگاه از شرمندگی سردر پيش آن کند
(তখন তিনি লজ্জায় মাথানত করেন)।
মিশকাত শরীফের হাদীছ দ্বারা বুঝা গেল যে, কপাল মুবারক সিজদাস্থল ছিল কিন্তু সিজদার লক্ষ্যস্থল ছিল না। তাই ওদের দাবী ভিত্তিহীন। যে জিনিসটার উপর সিজদা করা হয়, সেটাকে সিজদার লক্ষ্যস্থল বলা হয় না। অধিকন্তু হযরত কায়স (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ) ও হযরত মুয়ায ইবনে জবল (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) এর রেওয়ায়েতকৃত হাদীছ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে তাজিমী সিজদার নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয়েছে (মিশকাত, ইবনে মাজা ও ১৩৩৩ হিজরী রজব মাসে প্রকাশিত মাসিক সূফীর ১২৪ সংখ্যা দ্রষ্টব্য)।
যায়েদের মতে এসব হাদীছ খবরে আহাদের পর্যায়ভুক্ত অর্থাৎ একক রেওয়ায়েত কৃত। তাই এগুলো নিষেধাজ্ঞার দলীল হতে পারে না। অধিকন্তু কুরআনের আয়াত দ্বারা এর অনুমতি রয়েছে। যদিওবা বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে, কিন্তু এর হুকুম সার্বজনীন। আমরের কথা হলো কুরআনের আয়াত, হাদীছে নববী, ফকীহ ও দার্শনিকগণের বিশ্লেষণ দ্বারা তাজিমী সিজদা হারাম ও কুফরী প্রমাণিত এবং অনুমতির স্বপক্ষে কোন দূর্বলতর রেওয়ায়েতও বর্ণিত নেই। সুতরাং এটা দলীলবিহীন দবী মাত্র। অতএব সম্মানিত মুফতীগণ থেকে জানতে চাই- কার বক্তব্যটা সঠিক?
দ্বিতীয় পত্র
২৯শে শাওয়াল ১৩৩৭ হিজরীতে খায়ব নগর মীরাট থেকে নওয়াব মমতাজ আলী খানের পৌত্র জনাব মুজাহেরুল ইসলাম প্রেরিত।
বর্তমান শতাব্দীর মুজাদ্দেদ জনাব মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব, তসলীম বাদ আরয এই যে, গত ২৮শে জুন ২৯শে রমযান তাজিমী সিজদার সমর্থনে প্রকাশিত নিজামুল মাশায়েখ নামক একটি রিসালা আপনার সমীপে প্রেরণ করা হয়েছে। আশা করি আপনি মেহেরবানী করে তাজিমী সিজদা জায়েয-নাজায়েয সম্পর্কে শরীয়ত সম্মত আপনার মূল্যবান অভিমত প্রকাশ করে এ জটিল মাসআলার ব্যাপারে সঠিক ধারণা দানে বাধিত করবেন। কিছুদিন হলো, তকবিয়াতুল ঈমানের রদে আপনার রচিত معركة الاراء দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। উক্ত রেসালার ৪৩ পৃষ্ঠায় তাজিমী সিজদা জায়েযের পক্ষে নিম্নবর্ণিত ইবারতটি দেখলামঃ
وَاِذٛ قُلٛنَا لِلٛمَلٰئِكَةِ اسٛجُدُوٛا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوٛا اِلَّا اِبٛلِيٛسَ
(যখন আমি ফিরিশতাগণকে বললাম আদমকে সিজদা করার জন্য তখন ইবলিস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো।)
وَرَفَعَ اَبٛوَيٛهِ عَلٰی الٛعَرٛشِ وَ خَرُّوٛا لَهُ سُجَّدًا
(ইউসুফ (আলাইহিস্ সালাম) তাঁর মাতাপিতাকে উচ্চাসনে বসালেন এবং তাঁরা সবাই তার সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন)
এ সিজদার দ্বারা তাহলে আল্লাহ তা'আলা, ফিরিশতা, আদম, ইয়াকুব ও ইউসুফ (আলাইহিস্ সালাম) সবার শিরক হলো কারণ আল্লাহ হুকুম দিয়েছেন, ফিরিশতাগণ সিজদা করেছেন, আদম রাজি ছিলেন; ইয়াকুব সিজদাকারী ছিলেন এবং ইউসুফ সম্মতি দান করেন। অতপর আপনি লিখেছেন "এখানে নাসেখ (রহিত করণ) এর প্রশ্ন উত্থাপন করা নিছক মূর্খতা বৈ কিছু নয়, কোন শরীয়তে শিরক হালাল হতে পারে না। কখনও সম্ভব নয় যে, আল্লাহ শিরকের হুকুম দেন। যদিওবা এটা পরে মনসুখ বা রহিত করেন"।
জনাব, আপনার উপরোক্ত ইবারত থেকে তাজিমী সিজদা জায়েয বুঝা যাচ্ছে। অতএব মেহেরবানী করে যদি এ অধমকে আপনার মূল্যবান অভিমতটি জানান, বিশেষ উপকৃত হবো এবং ইসলামের একটা বিরাট খেদমত হবে।
উত্তর
﷽
اَلّٰهُمَّ لَكَ الٛحَمٛدُ يَامَنٛ خَشَعَتٛ لَهُ الٛقُلُوٛبُ وَ خَضَعَتٛ لَهُ الٛاعٛنَاقُ وَ سَجَدَتٛ لَهُ الٛجِبَاهُ وَ حُزِم السُّجُوٛدُ فِیٛ هٰذا الذیٛ الٛمحٛمَوٛد وَ الشَّرٛع المَسٛعُوٛدِ لِمَنٛ سِوَاهُ صَلِّ وَسَلِّم وَبَاركٛ علٰی اَكٛرَمِ مَنٛ سَجَدلَكَ لَيٛلًا وَ نَهَارًا وَ حَرَم السُجُود لِغيٛرِكَ تَحٛريٛمًا جِهَرًا وَّعَلٰی اٰلِهٖ وَ صَحٛبَهٖ الٛفائِزِيٛن بِخَيٛرِهٖ الذين لَمٛ يَشَّ اللّٰهُ وَجُوٛهَهُمٛ بِألخُرُوٛدِ لِغَيٛرِهٖ نَوَّرٛنَا اَللّٰهُ بِاَنٛوَارِهِمٛ وَفَّقٛنَا لِاِتِّبَاع اٰثَارِهِمٛ اٰمِيٛنَ
মুসলমান! ওহে মুসলমান!! শরীয়তে মুস্তাফা ﴾ﷺ﴿ এঁর অনুসারী হউন এবং জেনে রাখুন, নিশ্চয় জেনে রাখুন যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা নিষেধ। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের নিয়তে সিজদা করা নিঃসন্দেহে শিরক এবং সুস্পষ্ট কুফরী আর তাজিমী সিজদা করা হারাম ও গুনাহে কবীরা। এটাকে কুফরী বলার ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ফক্বীহগণের এক দলের মতে কুফরী তবে এর বিশ্লেষণ করে দেখলে বোঝা যায় যে তাঁরা একে কুফরে সূরী অর্থাৎ আচরণগত কুফরী বলেছেন। এ প্রসঙ্গে ইনশাআল্লাহ পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। অবশ্য মূর্তি, ক্রুশ ও চাঁদ-সূর্যকে সিজদা করা কুফরী যেমন শরহে মওয়াকেফ ও অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত আছে। কিন্তু পীর ও মাযারকে সিজদা করা অমার্জনীয় শিরক নয়, যেমন ওহাবীদের এ ধরণের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। আবার যায়েদের বাতিল দলীল মোতাবেক জায়েয বা মোবাহও নয় বরং হারাম, কবীরাহ গুনাহ-
فَيَغٛفِرُ لِمَنٛ يَّشَاءُ وَ يُعَذِّبُ مَنٛ يَّشَاءُ
(সুতরাং যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছে শাস্তি দেবেন) শিরকের দাবীকে রদ করার জন্য হযরত আদম (আলাইহিস্ সালাম) হযরত ইউসুফ (আলাইহিস্ সালাম) এর ঘটনাই দলীল হিসেবে যথেষ্ট। এটা অসম্ভব যে, আল্লাহ কোন মখলুককে তাঁর সাথে শিরক করার নির্দেশ দেন, যদিওবা পরে রহিত করা হয়। এটাও অসম্ভব যে, ফিরিশতাদের মধ্যে কেউ কাউকে এক মুহুর্তের জন্য খোদার অংশীদার সাব্যস্ত করে বা একে জায়েয মনে করে। কাউকাবুশ শাহাবিয়া' কিতাবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং ওহাবীদের ভ্রান্ত ধারণাকে সুস্পষ্ট দলীল দ্বারা খন্ডন করা হয়েছে। ওহাবীদের শিরক ধারনাকে বাতিল ও খন্ডন করার জন্যই এতকিছু বলার উদ্দেশ্য। ওহাবীরা এ অমার্জনীয় শিরকের হুকুমজারী করে মাযাল্লা হযরত আদম, ইয়াকুব, ইউসুফ (আলাইহিস্ সালাম)কে মুশরিক বানিয়েছে এবং আল্লাহ তাআলাকে শিরকের হুকুমদাতা ও জায়েযের সমর্থক বলে চিহ্নিত করেছে কিন্তু এটা ওদের মনগড়া ধারণা বৈ কিছু নয়। তবে শিরক নয় বলে জায়েয বা বৈধ মনে করা যাবে না। এমন হলে তো যেনা, হত্যা, মদ শুকরের মাংস সবকিছু হালাল সাব্যস্ত হয়ে যায়, যেহেতু এগুলো শিরক নয়। এ ধরনের ধারণা সুস্পষ্ট গুমরাহী। হাদীছে মুতাওয়াতের, ইমামগণের বিভিন্ন দলীল ও ফক্বীহগণের বিভিন্ন উক্তি থেকে তাজিমী সিজদা হারাম প্রমাণিত এবং এটা নাজায়েয ও গুনাহ কবীরা হওয়ার ব্যাপারে সর্বসম্মত অভিমত রয়েছে।
'নিজামুল মাশায়েখ' নামক পুস্তিকায় তাজিমী সিজদা প্রসঙ্গে বিভ্রান্তিমূলক কিছু ভ্রান্ত বক্তব্য ছাড়া আর কিছু নেই। পুস্তিকায় আগাগোড়া বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যে ভরপুর। তাতে উদ্ধৃত ইবারতসমূহের মনগড়া ব্যাখ্যা করা হয়েছে, পবিত্র শরীয়ত নিয়ে জঘন্যভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে। এমনকি স্বয়ং নবী করীম ﴾ﷺ﴿ এর উপর আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়েছে এবং আল্লাহ ও নবীর শানে অপবাদ দেয়া হয়েছে। সাহাবী, ইমাম, ফকীহ ও ওলীগণের উচ্চমর্যাদার প্রতি আদৌ ভ্রুক্ষেপ না করে তাঁদের সম্পর্কে যা-তা বলা হয়েছে। এমনকি তাঁদেরকে শুধু মুর্খ, একরোখা, পাষাণ বলে ক্ষান্ত হয়নি বরং অভিশপ্ত শয়তান বলে আখ্যায়িত করেছে-
سَيَجٛزِی اللّٰهُ الٛفَاسِقِيٛنَ كَذَالِكَ يَجٛزِی الظَّالِمِيٛنَ
এ গুমরাহ যখন কোন মাজহাবের ধার ধারে না তখন এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু মহা সমস্যা হলো সেই সব মনগড়া উদ্ধৃতিসমূহকে নিয়ে যেগুলো বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য কিতাবের বলে চালিয়ে দিয়েছে। তা-ও আবার খন্ড, পৃষ্ঠা ও অধ্যায় উল্লেখপূর্বক। লজ্জা-শরমের বালাই থাকলে কেউ এ ধরণের জাজ্জ্বল্যমান মিথ্যা কথা কিছুতেই বলতে পারে না। জানি না সেকি এ ধরণের কিছু লিখে কুখ্যাত হতে চাচ্ছে, নাকি সে এ রিসালার বদৌলতে সূফী বা শেখ হওয়ার জন্য ললায়িত। যা হোক, মুসলমানদেরকে এর ধোঁকা থেকে রক্ষা করা একান্ত কর্তব্য। তাই আমি এ পুস্তিকার প্রণেতাকে বকর নামে আখ্যায়িত করে আমার বক্তব্য রাখছি। ইতিপূর্বে উল্লেখিত প্রথম পত্রে যায়েদের মূখ দিয়ে যে সব প্রতারণামূলক কথা প্রকাশ করা হয়েছে, তা আসলে বকরেরই কুমন্ত্রণা। এদের উদ্দেশ্য হলো ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা। এ ধরণের বক্তব্য যদিওবা আদৌ প্রণিধানযোগ্য নয়। কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার পর এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া অপরিহার্য। তাই আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে আমার বক্তব্যকে ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত করে এর উত্তর দিতে সচেষ্ট হয়েছি।
প্রথম অধ্যায়ে কুরআনে করীম দ্বারা সিজদায়ে তাজিমকে হারাম প্রমাণিত করা হয়েছে। নিজামুল মাশায়েখ' এর ৯ পৃষ্ঠায় বকর যে বলেছে কুরআনে করীমে মানুষকে সিজদা করার বিপক্ষে কোন আয়াত নেই, এটা সেটারই রদ।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে চল্লিশ হাদীছ দ্বারা তাজিমী সিজদাকে হারাম প্রমাণিত করা হয়েছে। উক্ত পুস্তিকার ৯ পৃষ্ঠায় একটি দুর্বল হাদীছ উল্লেখ করে বকর তাজিমী সিজদা প্রমাণিত করতে চেয়েছে। এটা তারই রদ। এ দুর্বল হাদীছটি ব্যতীত ওদের অন্য কোন দলীল নেই। অথচ হাদীছে মুতওয়াতেরের মুকাবেলায় এ ধরনের দুর্বল হাদীছের কোন গুরুত্ব নেই।
তৃতীয় অধ্যায়ে একশত পঞ্চাশটি ফিকহী প্রমাণ দ্বারা তাজিমী সিজদাকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটা বকরের পুস্তিকার ২৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত সেই বক্তব্যের রদ, যেথায় সে বলেছে মুষ্টিমেয় কতেক একগুঁয়ে লোক ছাড়া আর কেউ তাজিমী সিজদার বিরোধী ছিল না"। উক্ত পুস্তিকার ২৪ পৃষ্ঠায় তাজিমী সিজদার অস্বীকারকারীদেরকে সে শয়তানের মত অভিশপ্ত এবং ১০ পৃষ্ঠায় লানতে ভাগী বলেছে-
وَ سَيَعٛلَمُوٛنَ الَّذِيٛنَ ایُّ مُنٛقَلِبُوٛنَ
(তারা শীঘ্রই জানবে তাদের গন্তব্যস্থল কোথায়)
চতুর্থ অধ্যায়ে স্বয়ং বকরের স্বীকারোক্তি, তার প্রদত্ত দলীলাদি এবং তারই উদ্ধৃতি, কুরআন মজিদ, হাদীছে মুতওয়াতের, উলামায়ে কিরাম ও আওলিয়ায়ে এজামের সর্বসম্মত অভিমত দ্বারা তাজিমী সিজদা হারাম বলে প্রণিত করা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে বকরের সেই ক্ষুদ্র পুস্তিকার দ্বারা তার মিথ্যাভাষণ, অসাধুতা, অজ্ঞতা ও বোকামী প্রমাণ করা হয়েছে।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে হযরত আদম ও ইউসুফ (আলাইহিস্ সালাম)কে প্রদত্ত সিজদার আলোচনা করা হয়েছে এবং এর থেকে দলীল দেয়ার অসারতা প্রমাণ করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়
কুরআন করীম দ্বারা তাজিমী সিজদা হারাম প্রমাণ
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান-
وَلَايَأٛمُرُكُمٛ اَنٛ تَتَّخِذُوٛا الٛمَلٰئِكَةُ وَ النَّبِيِّيٛنَ اَرٛبَابًا اَيَاٛمُرُكُمٛ بِالٛكُفٛرِ بَعٛدَ اِذٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ
(তিনি ফিরিশতা ও নবীগণকে প্রতিপালকরূপে গ্রহণ করতে তোমাদেরকে নির্দেশ দিবেন না। তোমাদের মুসলমান হওয়ার পর তিনি কি তোমাদেরকে কুফরীর নির্দেশ দিবেন?) হযরত আবদ ইবনে হামিদ স্বীয় মসনদে ইমাম হাসান বসরী (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন-
بَلَغَنِیٛ اَنَّ رَجُلًا قَالَ يَارَسُوٛلَ اللّٰه نُسَلِّمُ عَلَيٛكَ كَمَا يُسَلِّمُ بَعٛضُنَا عَلٰی بَعٛضٍ اَفَلَا نَسٛجُدُلَكَ قَالَ لَا وَلكِنٛ اكٛرَمُوٛا نَبِيَّكُمٛ وَاعٛرِفُوٛا الٛحَقَّ لِاَهٛلِهٖ فَاِنَّهُ لَايَنٛبَغِیٛ اَنٛ يَّسٛجُدٛ لِاَحَدٍ مِنٛ دُوٛنِ اللّٰهِ. فَأَنٛزَلَ اللّٰهُ تَعَالٰی مَاكَأنَ لِبَشَرٍ اِلٰی قَوٛلِهٖ بَعٛدَ اِذٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ.
অর্থাৎ- আমার কাছে এ হাদীছটি পৌঁছেছে যে, জনৈক সাহাবী হুযূরের কাছে আরয করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমরা পরস্পর যেভাবে সালাম আদান প্রদান করি, আপনাকেও সেভাবে করে থাকি। আমরা কি আপনাকে সিজদা করতে পারি না? তিনি ﴾ﷺ﴿ ইরশাদ ফরমালেন- না, বরং তোমাদের নবীর সম্মান কর। সিজদা একমাত্র আল্লাহর জন্য খাস এবং তাঁরই জন্য সংরক্ষিত রেখ। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ সিজদার উপযোগী নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়।
এ হাদীছটি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ পূর্বক বর্ণিত আছে-
فَفِيٛهِ تَحٛرِيٛمُ السُّجُوٛدِ لِغَيٛرِ اللّٰهِ تَعَالٰی
এতে খোদা ভিন্ন অন্য কাউকে সিজদা করা হারাম বলা হয়েছে। উক্ত আয়াতের আর একটি শানেনুযুল হচ্ছে জনৈক খৃষ্টান বলেছিল যে, ঈসা (আলাইহিস্ সালাম) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে আমরা যেন তাঁকে খোদা বলে মানি। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াতটি নাযিল হয়। ইমাম খাতেমুল হোফ্ফাজ জালালাইন শরীফে উভয় শানে নুযুল এক সঙ্গে বর্ণনা করেছেন-
نَزَلَ لَمَّا قَالَ نُصَارٰی نَحٛرَانَ اِنَّ عِيٛسٰی اَمَرَهُمٛ اَنٛ يَّتَّخِذُوٛهُ رَبّا اَوٛ لَمَّا طَلَبَ بَعٛضُ الٛمُسٛلِمِيٛنَ لَهُ صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيٛهِ وَسَلَّمٛ
তাই উভয় বক্তব্যটাই জোরালো বোঝা যায়। জনাব ইমাম সাহেব স্বীয় তফসীরের ভূমিকায় অঙ্গীকার করেছেন যে, তাঁর তফসীরে ও ধরণের উক্তিই গ্রহণ করবেন, যেগুলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। তফসীরে বয়জাবী মাদারেক, আবুস সাউদ, কাশশাফ, কবীর, শাহাব, জুমুল ও অন্যান্য তফসীরে তফসীরকারকগণ প্রথম বক্তব্যটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন অর্থাৎ মুসলমানগণ হুযূরকে সিজদা করার আবেদন করার পর এ আয়াতটি নাযিল হয়। স্বয়ং সেই আয়াতেই উল্লেখিত আছে- তোমরা মুসলমান হওয়ার পর কি তোমাদেরকে কুফরীর নির্দেশ দিবে? এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ইহুদী নয় বরং সেসব মুসলমানদেরকেই সম্বোধন করে বলা হয়েছে, যারা সিজদা করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। তফসীরে মাদারেক ও কাশশাফে বর্ণিত আছে-
بَعٛدَ اِذٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ- يُدُلُّ عَلَی الٛمُخَاطِبِيٛنَ كَانُوٛا مُسٛلِمِيٛنَ وَهُمُ الَّذِيٛنَ اِسٛتَانُوٛهُ اَنٛ يَّسٛجُدَلَهُ.
(بَعٛدَ اِنٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ এ আয়াতাংশ দ্বারা বোঝা যায় যে সম্বোধিত ব্যক্তিগণ হলেন সে সব মুসলমান, যারা সিজদা করার অনুমতি চেয়েছিলেন।) তাফসীরে কবীরে কাশশাফের উক্তিটা হুবহু নকল করা হয়েছে। ফতুহাতে উল্লেখিত আছে-
يُقَرَّبُ هٰذَا الٛاِحٛتِمَالُ قَوٛلُهٗ فِی اٰخِرِ الٛاٰيَاةِ بَعٛدَ اِذٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ.
আয়াতের শেষের অংশ দ্বারা এ বক্তব্যটির সম্ভাবনা বেশি প্রকাশ পায়। ইনায়েতুল কাজীতে বর্ণিত আছে-
هٰذِهِ الٛفَاصِلَةُ تَرَجُّحُ الٛقَوٛلِ بِاَنَّهَا نَزَلَتٛ فِی الٛمُسٛلِمِيٛنَ الٛقَائِلِيٛنَ اَفَلَا نَسٛجُدُلَكَ.
তফসীরে নিশাপুরিতেও একই কথার উপর জোর দেয়া হয়েছে। যদি উক্ত আয়াতের সম্বোধিত ব্যক্তি খৃষ্টান বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কেননা খৃষ্টানেরা মুসলমান কিভাবে হতে পারে? তখন আয়াতটির ব্যাখ্যা এভাবে করতে হবে-
اَيَأٛمُرُ اٰبَأءُكُمُ الٛاَوَّلِيٛنَ بِالٛكُفٛرِ بَعٛدَ اَنٛ كَانُوٛا مُسٛلِمِيٛنَ.
অর্থাৎ হযরত ঈসা তোমাদের বাপ দাদাদেরকে, যারা দ্বীনে হকের উপর অটল ছিল, তাদের ঈমান আনার পর কি কুফরীর হুকুম দিতে পারে?
উক্ত আয়াতে মুসলমানদের সম্বোধন করে বলার সময় ব্যবহৃত كفر শব্দটিরও তাবিলের প্রয়োজন আছে। মুসলমানেরা কখনো সিজদায়ে ইবাদত করতে চাননি; তাজিমী সিজদাই করতে চেয়েছিলেন। কারণ প্রথমতঃ এ ধরণের প্রত্যাশা সাহাবায়ে কিরাম কিছুতেই করতে পারেন না। তাঁরা ঈমান আনার প্রথম দিন থেকেই তাওহীদ সম্পর্কে ভাল মতে অবহিত ছিলেন, শত্রু মিত্র আপন পর সব কিছু সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন। তখন প্রতি ঘরে আল্লাহর ইবাদতের অনুশীলন ছিল। এক আল্লাহর প্রতি সবাইকে আহবান জানাতেন, এবং অন্য কোন কিছুকে শিরক থেকে মারাত্মক মনে করতেন না। তাই এ ধরণের সাহাবা কিভাবে নবীকে সিজদায়ে ইবাদত করার আবেদন করতে পারেন। তাও আবার হযরত মুয়ায ইবনে জবল, কাইস ইবনে সাদ, সালমান ফার্সী এমনকি সিদ্দিকে আকবরের (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) মত সাহাবা। দ্বিতীয়তঃ হুযূর আলাইহিস সালাম উত্তরে বলেছিলেন, এ রকম কর না কিন্তু এ রকম বলেননি যে তোমরা গায়রুল্লাহর ইবাদতের অনুমতি চেয়ে কাফির হয়ে গেছ, তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের আকদ থেকে বের হয়ে গেছে, তওবা কর, পুনরায় ইসলাম গ্রহণ কর এবং আকদ থেকে বহির্ভূত স্ত্রীগণ যদি রাজি হয়, পুনরায় বিবাহ কর। তৃতীয়তঃ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো আল্লাহ তাআলা স্বয়ং সেই আয়াতে তাঁদেরকে মুসলমান বলতেছেন-তোমরাতো মুসলমান। তোমাদেরকে কি কুফরীর হুকুম দেয়া যায়? এ কারণেই ইমাম মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ হাফেজুদ্দীন (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) প্রখ্যাত وجيز কিতাবে বলেছেন-
قَوٛلُهٗ تَعَالٰی مُخَاطِبًا لِلصَّحَابَةِ رَضِیَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنٛهُمٛ اَتَاٛمُرٛكُمٛ بِالٛكُفٛرِ اِذٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ. نَزَلَتٛ حِيٛنَ اِسٛتَاٛذَنُوٛا فِی السُّجُوٛدِ لَهُ صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيٛهِ وَسَلَّمَ وَ لَايَخٛفٰی اَنَّ الٛاِسٛتِهٛدَانَ لِسَجُوٛدِ التَّحِيَّةِ بِدَلَالَةٍ بَعٛدَ اِذٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ وَمعَ اِعٛتِقَادِ جَوَازِ سَجٛدَةِ الٛعِبَادَةِ لَايَكُوٛنَ مُسٛلِمًا فَكَيٛفَ يُطٛلَقُ عَلَيٛهِمٛ بَعٛدَ اِذٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ.
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কিরামকে সম্বোধন করে বলেছেন তোমরা মুসলমান হওয়ার পর নবী কি তোমাদেরকে কুফরীর নির্দেশ দিবেন? এ আয়াতটি তখনই নাযিল হয়, যখন সাহাবায়ে কিরাম হুযূর ﴾ﷺ﴿কে সিজদা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। আয়াতের بَعٛدَ اِذٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ (তোমরা মুসলমান হওয়ার পর) এ অংশ দ্বারা প্রকাশ পায় যে, তাঁরা তাজিমী সিজদার অনুমতি চেয়েছিলেন। কেননা সিজদায়ে ইবাদতকে জায়েয মনে করলে মুসলমান থাকে না এবং এটাও কিভাবে বলা যায় 'তোমরা মুসলমান হওয়ার পর'।
এটা পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল যে, উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখিত কুফর দ্বারা কুফরে হাকীকিকে বুঝানো হয়নি, কেননা কুফরে হাকীকির আবেদন করলেও মুসলমান থাকে না। অথচ এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে بَعٛدَ اِنٛ اَنٛتُمٛ مُسٛلِمُوٛنَ (তোমরা মুসলমান হওয়ার পর)-
وَقَدٛ كَانَ اِسٛتَدَلَّ بِهِ الٛبَعٛضَ الٛقَائِلُوٛنَ بِاَنَّ سَجٛدَةَ التَّحِيَّةِ كُفٛرٌ وَذِكٛرِهُ فِی الٛوَجِيٛز دَلِيٛلًا لَهُمٛ فَانٛقَلَّتِ الدَّلِيٛلُ عَلَی الٛمُدَّعٰی وَثَبَتَ اَنَّهَا لَيٛسَتٛ بِكُفٛرٍ كَمَا عَلَيٛهِ الٛجَمٛهُوٛرُ وَالٛمُحَقِّقُوٛنَ فَاحٛفِظٛ وَتَثٛبِتٛ وَلِلّٰهِ الٛحَمٛدُ-
নিঃসন্দেহে আয়াতে উল্লেখিত কুফর দ্বারা কুফরে সুরী (কুফরী নয়- তবে কুফরীর মত) কে বুঝানো হয়েছে। ব্যাখ্যাকারকদের পরিভাষায় এ রকম উক্তি প্রচলিত আছে। বিশেষ করে সিজদার মধ্যে অপরকে পূজা করার সাদৃশ্য রয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে জমীনে চুমু দেয়া প্রসঙ্গে কানী শরহে দানী, কেফায়া, তবয়ীন শরহে কনয, দুর্রুল মুখতার, মুজমাউল আনহার ফতহুল্লাহিল মুবীন ইত্যাদির উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করা হবে। কেননা এটার সাথে মূর্তি পূজার সাদৃশ্য রয়েছে। সিজদার মধ্যে এর থেকে অধিক সাদৃশ্য রয়েছে। এর আকৃতির সাথে কুফরীর আকৃতির অবিকল মিল রয়েছে। এ জন্য একে কুফরে সুরী বলা হয়। যেমন দ্বিতীয় অধ্যায়ে খোলাসা, মুহিত, মনহুর রউজ, নিসাবুল ইহতিসাব ইত্যাদি কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত আছে- اِنَّ هٰذَا كُفٛرٌ (ইহা নিশ্চয় কুফরী) অর্থাৎ সিজদার আকৃতিটা কুফরীর আকৃতির মত। তাঁদের এ উক্তি দ্বারা অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে সামনে আলোচনা করা হবে। যা হোক উপরোক্ত আয়াতের উল্লেখিত শানে নুযুলের যে কোন একটা হবেই। এ জন্য ইমাম খাতেমুল হুফফাজ উভয় শানে নুযুল উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, এক এক আয়াতের কয়েক রকম শানে নুযুল হতে পারে এবং কুরআনের সব শানে নুযুলই দলীল হিসেবে বিবেচ্য। সুতরাং কুরআনের দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, তাজিমী সিজদা এমন জঘন্য হারাম, যার সাথে কুফরীর তুলনা চলে। আল্লাহ থেকে পানা চাই। সাহাবায়ে কিরাম হুযূরকে তাজিমী সিজদা করার চেয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরশাদ করা হয় তোমাদেরকে কি কুফরীর হুকুম দেব'। বুঝা গেল যে তাজিমী সিজদা এমন ঘৃণিত বিষয় যাকে কুফরীর মত বলা হয়েছে। যখন হুযূর (আলাইহিস সালামকে) তাজিমী সিজদা করার এ হুকুম, তখন অন্যদের প্রশ্নই উঠতে পারে না। আল্লাহ হেদায়েত করুন।
দ্বিতীয় অধ্যায়
চল্লিশ হাদীছ দ্বারা সিজদা হারাম প্রমাণিত
চেহেল হাদীছ বা চল্লিশ হাদীছের অনেক ফজিলত বর্ণিত আছে। ইমাম ও ওলামাগণ নানা ধরনের চল্লিশ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আমি এখানে গায়রুল্লাহকে সিজদা করা হারাম সম্পর্কিত চল্লিশটি হাদীছ বর্ণনা করলাম। এ হাদীছগুলো দু'প্রকারের- প্রথম প্রকার গায়রুল্লাহকে সিজদা করা সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় প্রকার বিশেষ করে কবরকে সিজদা বিষয়ক।
প্রথম প্রকারের হাদীছ
১নং হাদীছঃ জামে তিরমিযী, সহীহ ইবনে হাব্বান, সহীহ মুসতাদরক, মসনদে বাযার ও সুনানে বায়হাকীতে হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত আছে-
قَالَ جَاءَتٛ اِمٛرَاةٌ اِلٰی رَسُوٛلِ اللّٰهِ صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلِيٛهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتٛ يَارَسُوٛلَ اللّٰهِ اَخٛبِرٛنِیٛ مَاحَقُّ الزَّوٛجِ عَلَی الزَّوٛجَةِ؟ قَالَ لَوٛ كَانَ يَنٛبَغِیٛ لِبَشَرٍ اَنٛ يَّسٛجُدَ لِبَشَرٍ لَاَمَرٛتُ الٛمَرٛأَةَ اَنٛ تَسٛجُدٛ لِزَوٛجِهَا اِذَا دَخَلَ عَلَيٛهَا لِمَافَضَّلَهُ اللّٰهُ عَلَيٛهَا هٰذَا لَفٛظُ الٛبَزَارِ وَالٛحَاكِم وَالٛبَيٛهَقِیٛ. وَعِنٛدَ التِّرٛمِذِیُّ الٛمَرٛفُوٛعُ مِنٛهُ بِلَفٛظِ لَوٛكُنٛتُ اٰمِرًا اَحَدًا اَنٛ يَّسٛجُدَ لِاَحَدٍ لَاَمَرٛتُ الٛمَرٛأَتُ اَنٛ تَّسٛجُدُ لِزَوٛجِهَا.
জনৈক মহিলা হুযূর আলাইহিস সালামের বারগাহে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন- ইয়া রাসূলুল্লাহ, স্ত্রীর উপর স্বামীর হক্ব কি? ইরশাদ ফরমান, যদি কোন মানুষকে অন্য কোন মানুষ কর্তৃক সিজদা করা যেত, তাহলে আমি মহিলাকে বলতাম যেন সে তাঁর স্বামীকে সিজদা করে যখন সে ঘুরে প্রবেশ করে, সেই ফজিলতের কারণে, যা আল্লাহ তাআলা তার উপর ওকে দিয়েছে। ইমাম তিরমিযী বলেছেন যে, এ হাদীছটি হাসান ও সহীহ।
২ং হাদীছঃ বযার কর্তৃক হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত আছে-
تَالَ دَخَلَ النَّبِیُّ صَلَّی اللّٰهُ عَلَيٛهِ وَسَلَّمَ حَائِطًا فَجَاءَ بَعِيٛرٌ فَسَجَدَلَهُ فَقَالُوٛا هٰذَهٖ بَهِيٛمَةٌ لَاتَعٛقِلُ سَجَدٛتَ لَكَ وَنَحٛنُ نَعٛقِلُ فَنَحٛنُ اَحَقُّ اَنٛ نَسٛجُدُ لَكَ فَقَالَ صَلَّی اللّٰهُ عَلَيٛهِ وَسَلَّمَ لَايَصٛلِحٛ لِبَشَرٍ لَوٛصَلَحَ لَاَمَرٛتُ الٛمَرٛأَةَ اَنٛ تَسٛجُدُ لِزَوٛجِهَا لِمَالَهُ مِنَ الٛحَقِّ عَلَيٛهَا.
হুযূর আলাইহিস সালাম একটি বাগানে তশরীফ নিলে একটি উট সামনে এসে হুযূরকে সিজদা করলো। উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন- এ অবোধ চতুষ্পদ জন্তু হুযূরকে সিজদা করলো, আমরা বোধশক্তি সম্পন্ন হওয়ায় হুযূরকে সিজদা করার ব্যাপারে অধিক উপযোগী। হুযূর আলাইহিস সালাম ইরশাদ ফরমান- কোন মানুষকে কোন মানুষ কর্তৃক সিজদা করা অবৈধ। যদি তা বৈধ হতো, আমি মহিলাকে বলতাম যেন ওর স্বামীকে সিজদা করে। সেই অধিকারের কারণে, যা তার উপর ওর রয়েছে। ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) مناهل الصفاء নামক কিতাবে বলেছেন যে এ হাদীছটির সনদ হাসান।
৩নং হাদীছঃ ইমাম আহমদ, নাসায়ী, বযার ও আবু নঈম হযরত আনাস (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন-
قَالَ اَهٛلُ بَيٛتٍ مِنَ الٛاَنٛصَارِ
Comments
Post a Comment