দুশমনে রাসুলদের স্বরূপ
হ্যাম্ফার এর ডায়রি থেকে বাংলায় অনুবাদ
মাওলানা আব্দুল হাই রেজভী চিশতী আল কাদরী ও সৈয়দ আলী নওয়াজ
প্রকাশকের কথা
যুগের চলমান প্রবাহের সাথে সাথে আমরা একটা প্রান্তিক সময়ে এসে পৌঁছেছি, যার প্রতিটা নিদর্শন আমাদের সামনে আজ ষ্পষ্ট। প্রত্যেক মুসলমান আজ নিজ নিজ নাফসের তাড়নায় দিশেহারা, যার থেকে উত্তোরণের পথ সুনির্দিষ্ট এবং কঠিন। এই পথের মাঝেই শয়তান দজ্জাল আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়ে নিঃশ্ব করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। একাজে সহযোগী হিসাবে সে ব্যবহার করছে আমাদেরই সমাজের তথাকথিত কিছু আলেম এবং নেতৃবর্গকে। এর কিছু প্রামাণ্য দলিল সকলের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা একান্ত কর্তব্য বিবেচনা করে আমাদের এই প্রয়াস। আমরা আশা করছি এটা পড়ে আমাদের মুসলমান সমাজ সচেতন হবেন এবং এ ধরনের চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত করে তাদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেদের তথা সমাজকে রক্ষা করে আখেরাতের কামিয়াবি হাসিল করবেন।
সৈয়দ আলী হাসান
প্রকাশক
সূচিপত্র
প্রথম পর্ব
প্রথম অধ্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায়
তৃতীয় অধ্যায়
চতুর্থ অধ্যায়
দ্বিতীয় পর্ব
পঞ্চম অধ্যায়
ষষ্ঠ অধ্যায়
সপ্তম অধ্যায়
ভূমিকা
এক বিট্রিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের শত্রুতা
"পূর্বমধ্য এশিয়ার এক বিট্রিশ গুপ্তচর" মিস্টার হেম্ফারের স্মৃতি কথা এই শিরোনামে এক প্রামাণ্য দলিল প্রথমে এক জার্মান পত্রিকা স্পিজেল এবং পরবর্তীকালে এক বিখ্যাত ফরাসি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। লেবাননের এক ডাক্তার এই প্রামাণ্য দলিলকে আরবী ভাষায় অনুবাদ করে এবং তারপর সেখান থেকে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়। ওয়াকফ ইখলাস পাবলিকেশনস্ এই প্রামাণ্য দলিলকে ইংরেজি ভাষায় "কনফেকশান অফ আ ব্রিটিশ স্পাই এণ্ড ব্রিটিশ এনিমিটি আগেষ্ট ইসলাম" শিরোনামে পুস্তিকা আকারে এবং বৈদ্যুতিক মাধ্যমে সম্প্রচার করে। বর্তমানে মাওলানা মহতারাম আব্দুল হাই রেজভী চিশতী উল কাদেরি এ. এফ (মুর্শিদাবাদ) এম.এম (ইউ.পি) এবং সৈয়দ আলী নওয়াজ চিশতী এটাকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কতিপয় দরবার শরীফের একান্ত সহযোগিতা এবং প্রচেষ্টায় "দুশমনে রাসুল'দের স্বরূপ" নামক পুস্তকে রূপদান করা হয়েছে। এই প্রামাণ্য দলিলটি ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত পশ্চাদপদটিকে তুলে ধরে, যে আন্দোলনের স্থপতি হল মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব। এই প্রামাণ্য দলিলের মাধ্যমেই জানা যায়, এই ওয়াহাবিরা কীভাবে ইসলামের নামে কত অজস্র ত্রুটিপূর্ণ মিথ্যা বিষয়কে ছড়িয়ে দিয়েছে মানুষের মনে আর আরো জানা যায়, ইসলাম ধর্মের প্রতি, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং সর্বোপরি মুসলিমদের প্রতি তাদের শত্রুতার কদর্যরূপ। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই ওহাবি দলটি আজ সন্ত্রাসবাদের মেরুদন্ড, সন্ত্রাসবাদের মূল চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের সমস্ত অর্থ, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় মুসলিম ও অপরাপর নিরীহ মানুষদের রক্তঝরানোর জন্যে। তাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের কদর্য কলঙ্কের ইতিহাস জানা যায় "মক্কার মুফতি" এর লেখা "ফিতনাতুল ওয়াহাবিয়া" এ উল্লেখিত সম্প্রতিককালের হত্যালীলা এবং কুরআনের লঙ্ঘনের নোংরা রূপ যার লেখক মক্কার ঐ মুফতির নাম শেখ আহমেদ যাইনি দাহলান। আর এসবই ঘটেছে তাদের এক অসুস্থ ত্রুটিপূর্ণ বিশ্বাসের কারণে যে- তারা নিজেরা বাদে আর সকলেই হচ্ছে আল্লাহর নিন্দুক, পাপি। করুণাময় আল্লাহ যেন এই শয়তানদের হাত থেকে আমাদের এই জাতিকে রক্ষা করেন।
প্রথম পর্ব
প্রথম অধ্যায়
পূর্ব মধ্য এশিয়ায় এক বিট্রিশ গুপ্তচর, মিস্টার হেম্ফার এর স্মৃতিকথা
আমাদের গ্রেট ব্রিটেন আজ এতটাই বিস্তৃত যে, সূর্যের উদয় এবং অস্তগমন স্থলের মধ্যবর্তী সম্পূর্ণ ভূভাগটাই আমাদের সম্রাজ্য। তথাপি আমাদের এই সুবিশাল ঔপনিবেশিক দেশ, ভারতবর্ষ, চীন এবং পূর্ব মধ্য এশিয়ার উপনিবেশগুলিকে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এখনও জড়তা করে। এই দেশগুলি পুরোপুরিভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সে কারণে আমরা এই সকল স্থানে সফলভাবে এবং সক্রিয়ভাবে কিছু গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় আছি। খুব শীঘ্রই আমরা ঐ সকল দেশগুলিকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হব। তবে দুটি বিষয় এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১) আমরা ইতিমধ্যেই যে সকল স্থান করায়ত্ব করেছি, সেগুলিকে ধরে রাখার চেষ্টা করা।
২) আর এখনও আমরা যে সকল স্থান দখল করতে পারিনি, সেই সকল স্থান অধিকার করা।
ঔপনিবেশিক মন্ত্রনাগার প্রত্যেকটি উপনিবেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেছে এই দুটি বিষয়কে বাস্তবায়নের জন্য। যেইমাত্র ঔপনিবেশিক মন্ত্রনাগারে আমি প্রবেশ করলাম, মন্ত্রী আমার ওপর আস্থা স্থাপন করে আমাকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক পদে নিযুক্ত করলেন। বাইরের দিক থেকে এটা একটা ব্যবসায়িক কোম্পানি। কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চল করায়ত্ত করার জন্য পন্থার সন্ধান করা।
আমাদের সরকার ভারতবর্ষ সম্পর্কে মোটেই হতোদ্যম ছিল না। ভারত ছিল এমন একটা দেশ, যেখানে বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন ভাষাভাষির মানুষ, বিভিন্ন বিরুদ্ধ স্বার্থযুক্ত মানুষ মিলেমিশে বসবাস করে। চীন সম্পর্কেও আমরা শঙ্কিত ছিলাম না। কারণ চীনের দুটি ধর্ম- বৌদ্ধ ধর্ম ও কনফুসিয়াস ধর্ম, এগুলির কোনটিই ভীতিপ্রদ ছিল না। আর দুটি ধর্মই সেই সময় মৃত ধর্মের সমতুল্য, যেগুলি জীবন সম্পর্কে জ্ঞান- শিক্ষাদানে একেবারেই অসমর্থ হয়ে পড়েছিল এবং পরিচিতি ছাড়া বর্তমানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এ কারনে, এই দুটি দেশে বসবাসকারী লোকদের মধ্যে দেশপ্রেমের বিন্দুমাত্র অনুভূতি খুঁজে পাওয়া যেত না। এই দুই দেশের জন্য আমরা মোটেই উদ্বিগ্ন ছিলাম না, অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন ঘটনাগুলি আমরা চিন্তাভাবনার মধ্যেই রেখেছিলাম। এই দুটি দেশে বিচ্ছিন্নতা, অশিক্ষা, দারিদ্র্যতা এবং রোগব্যাধি প্রভৃতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। আমরা এই দুই দেশের মানুষের ঐতিহ্য এবং প্রথাগুলিকে অনুকরণ করতাম। ফলে আমাদের গোপন উদ্দেশ্য গোপনই থাকত।
কিন্তু ইসলামিক দেশগুলিই আমাদের স্নায়ুগুলিকে সবচেয়ে বেশি দুর্বল করে দিয়েছিল। ইতিমধ্যে আমরা কিছু চুক্তি বা বোঝাপড়া করে নিয়েছি "অসুস্থ মানুষ" বা অটোম্যন সম্রাটের সাথে। আর সেগুলির প্রতিটিই আমাদের লাভের দিক মাথায় রেখেই করা। ঔপনিবেশিক মন্ত্রনাগারের অভিজ্ঞ সদস্যরা এই মনোভাব পোষণ করে যে, এই অসুস্থ মানুষটি ১০০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মৃত্যুবরণ করবে। সেই সাথে -সাথে ইরান সরকারের সাথে আমরা কিছু গোপন চুক্তি সেরে নিলাম। আর এই দুটি দেশের রাষ্ট্রনেতাদের আমাদের রাজমিস্ত্রী বানিয়ে রেখেদিলাম। ঘুষ দিয়ে প্রশাসনকে অকেজো করে পর্যাপ্ত ধর্মশিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখে আমরা তাদের ব্যস্ত করে দিলাম সুন্দরী রমণীদের দিকে। আর তারা ব্যাপকভাবে তাদের কর্তব্যে অবহেলা করতে লাগলো, এইভাবে এই দুটি দেশের মেরুদন্ডগুলিকে ভেঙ্গে দিলাম। এত সব কিছু সত্ত্বেও আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম এই নিয়ে যে, আমাদের কর্মকাণ্ডগুলি হয়তো আমাদের প্রত্যাশা মতো সুফল দিতে পারবে না। এই উদ্বেগের কারণগুলি আমি বর্ণনা করলামঃ
১) মুসলিমরা ইসলামের প্রতি ভীষণভাবে অনুরক্ত। প্রত্যেকটি মুসলিম ব্যক্তি ইসলামের সাথে শক্ত পোক্তভাবে জড়িত, ঠিক যেমনটা খ্রীষ্টান সাধকরা ধর্মের সাথে জড়িত। এর বেশি না হলেও কম যায় না, যেমন এটা সকলের জানা যে খ্রীষ্টান পুরোহিত ও সন্ন্যাসীরা মরে গেলেও খ্রীষ্টান ধর্ম ত্যাগ করবে না। এদের মধ্যে ইরানের শিয়ারা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক। কারণ যে সব মানুষ শিয়া নয়, তারা তাদের অবিশ্বাসী ও জঘন্য হিসাবে মনে করে। অন্যরা শিয়াদের দৃষ্টিতে হচ্ছে জঘন্যতম নোংরার মতো। স্বভাবতইঃ নোংরা বা ময়লার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য, যে কোন ব্যক্তি সর্বদাই সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা করে। আমি একবার এক শিয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিলামঃ তোমরা কেন খ্রীষ্টানদের এইরূপ দৃষ্টিতে দেখ? সে উত্তর দিয়েছিলঃ "ইসলামের নবী খুব জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি খ্রীষ্টানদেরকে আধ্যাত্মিকভাবে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য আল্লাহ এর ধর্ম ইসলামে যোগ দিতে বলেন। এর ফলে যতক্ষণ না কোন মানুষ আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য শপথ গ্রহণ না করছে, তাকে বিপদজ্জনক হিসাবেই দেখা হবে। এটা হচ্ছে একটা রাজনৈতিক পরিকল্পনা। আমি যে নোংরা বা ময়লার কথা বলছি এটা পার্থিব নয়, এটা হচ্ছে একটা ধর্মীয় বলপ্রয়োগ, যা শুধুমাত্র খ্রীষ্টানের জন্য আরোপিত নয়। এর আওতায় সুন্নী এবং অন্য সব অবিশ্বাসীরাও পড়ে। এমনকি ইরানের সুপ্রাচীন ম্যাজাই ধর্মের ধারক বাহকরাও শিয়াদের মতে দোষী বা জঘন্য। আমি তাকে বললাম, : "সুন্নী এবং খ্রীষ্টানরাও তো আল্লাহয়ে বিশ্বাস করে, নবীগণকে বিশ্বাস করে, এমনকি শেষ বিচারের দিনেও বিশ্বাস করে; তাহলে কেন ওদেরকে দোষী বা জঘন্য বলা হবে? সে উত্তর দিল, "দুটি কারণে ওরা দোষী বা জঘন্য। ওরা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদের উপর মিথ্যাদোষ লাগাতে চায়। আল্লাহ যেন আমাদের যেন আমাদের এইরূপ জঘন্য কার্য্য থেকে রক্ষা করেন। আর আমরা এই জঘন্য অপবাদের প্রত্যুত্তরে, এই নিয়মটাকে অনুসরণ করি। যেটা প্রকাশিত হয়েছে নিম্নলিখিত বক্তব্যে, "যদি কোন ব্যক্তি তোমায় বিরক্ত করে, পরিবর্তে তুমিও তাকে বিরক্ত করতে পারো", এবং "তাদের বলো তোমরা দোষী বা কাফের।"
দ্বিতীয়তঃ খ্রীষ্টানরা আল্লাহর নবীদের সম্পর্কে আপত্তিকর অভিযোগ হেনেছে। উদাহরণস্বরূপঃ তারা বলে ঈসা (যীশু) (আঃ সাঃ) মদ্যপান করতেন, ফলে তিনি অভিশপ্ত এবং তিনি ক্রুশবিদ্ধ হন।
হতবুদ্ধি হয়ে আমি ঐ ব্যক্তিকে বললাম খ্রীষ্টানরা ঐরূপ কথা বলেনি। উত্তর এল - হ্যাঁ তারা বলেছে " আর তুমি সে সম্পর্কে মোটেই অবগত নও। পবিত্র বাইবেলে এইরূপ উল্লেখ আছে। আমি নিশ্চিত হলাম লোকটা প্রথম ক্ষেত্রে ঠিক হলেও, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সঠিক বলেন নি। আমি ঐ বিতর্ক বেশিক্ষণ চালিয়ে যেতে চাইছিলাম না, কারণ তারা আমাকে মুখোশধারী মুসলিম হিসাবে সন্দেহ করতে পারে। তাই আমি বিতর্কটি এড়িয়ে গেলাম।
২) ইসলাম একসময় এমন এক ধর্ম হিসাবে পরিগণিত হত যে, ইহাই ছিল প্রশাসন ও সর্বদিক থেকে উচ্চতম স্থানের অধিকারী ও নিয়ন্তা। আর মুসলমানরা সর্বত্র সম্মানিত হতেন। এটা বলাটা বিপজ্জনক হতে পারে যে সেই সম্মানীয় ব্যক্তিরা বর্তমানে দাসের পর্যায়ে নেমে এসেছে। ইসলামিক ইতিহাসকে বিকৃত করা বা মুসলমানদের এটা বলা সম্ভব নয় যে একসময় তোমরা সম্মান ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলে পরিস্থিতি অনুকূলে থাকার ফলেই। সেই দিন আর নেই এবং আর কখনও ফিরে আসবে না।
৩) আমরা খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম এই নিয়ে যে অটোম্যনরা এবং ইরানিরা আমাদের পরিকল্পনা বুঝে ফেলতে পারে এবং আমাদের শয়তানি ফাঁদগুলিকে নষ্ট করে দিতে পারে। এই দুই রাষ্ট্রকে যথেষ্ট পরিমাণে হীনবল করা হয়ে গেছে -এটা সত্ত্বেও আমরা যথেষ্ট পরিমাণে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। কারণ দুটি কেন্দ্রীয় সরকারই তখনও যথেষ্ট বিত্তবান, অস্ত্রশস্ত্রে বলবান এবং প্রবল কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত।
৪) ইসলামিক ধর্মগুরুরা ছিল আমাদের নিকট ভয়ানক অস্বস্তিকর। কারণ, ইস্তাম্বুলের ধর্মগুরুরা এবং আল-আজ-হার ইরাকি ও দামাস্কাসের ধর্মগুরুরা ছিল আমাদের শয়তানী ফন্দিগুলি বাস্তবায়িত করার পথে দুর্লঙ্ঘ প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ। কারণ তাঁরা তাঁদের নীতি আদর্শগুলির ন্যুনতম বিচ্যুতিও করবেন না। তাঁরা এমনই প্রকৃতির লোক। তার উপর তাঁরা পার্থিব আড়ম্বরও ভোগবিলাস থেকে সম্পূর্নরূপে বেরিয়ে এসেছেন এবং কূর-আন-উল কারীম এ প্রস্তাবিত জান্নাতের দিকে তাঁদের দৃষ্টি নিবদ্ধ। মানুষ তাঁদের পদাঙ্ক ভীষণভাবে অনুসরণ করত। এমনকি সুলতানও তাঁদের ভয় করে চলত। তবে সুন্নিরা শিয়াদের মতো ধর্মগুরুদের প্রতি ভীষণভাবে অনুরক্ত ছিল না। কারণ-শিয়ারা পাঠ করত না; অন্ধভাবে ধর্মগুরুদের মান্য করত, এছাড়া সুলতানকেও তারা আমল দিত না বা তাঁরা প্রাপ্য সম্মান দিত না। অপরপক্ষে সুন্নিরা পুস্তকও পড়ত, ধর্মগুরুদেরও মান্য করত, আবার সুলতানকেও মর্যাদা দিত।
তাই আমরা কিছু ধারাবাহিক আলোচনা সভার ব্যবস্থা করলাম। আর যতবারই আমরা ফাঁদ পাতার চেষ্টা করলাম, ততবারই আমরা হতাশভাবে দেখলাম যে- আমাদের শয়তানীর পথ বন্ধ। আমাদের গুপ্তচরদের কাছ থেকে যে সব বার্তাগুলি আসছিল সেগুলি সবই হতাশা ব্যাঞ্জক আর আলোচনা সভাগুলি নিরর্থক হয়ে উঠতে লাগল। তথাপি আমরা আশা ত্যাগ করলাম না। কারণ, আমরা হলাম এমন এক জাতের মানুষ, যারা একটা গভীর শ্বাস গ্রহণ করে শান্ত হয়ে ধৈর্য ধরে চুপটি করে বসে থাকাটা বেশ ভালো ভাবেই রপ্ত করে নিয়েছি।
মন্ত্রী নিজে, পুরোহিতদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদাধিকারী এবং কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এইরূপ একটি আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আমরা ২০ জন উপস্থিত ছিলাম। আমাদের সভা তিন ঘন্টা ধরে চলেছিল এবং কোন প্রকার নিশ্চিত সীমান্তে না এসেই সভা সমাপ্ত করতে হল। তথাপি একজন পুরোহিত বললেন, উদ্বিগ্ন হয়ো না! কারণ মসীহ এবং তাঁর সাথীরা তিনশত বৎসরের নিপীড়ন সহ্য করার পর কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এটা আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে, অজানা এক জগত থেকে তিনি আমাদের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন এবং আমাদের উপর সৌভাগ্যের আশীর্বাদ প্রদান করবেন। যাতে আমরা
(৪) অবিশ্বাসী (মুসলিম) দেরকে তাদের কেন্দ্রগুলি থেকে উৎখাত করতে পারি। যদি সেক্ষেত্রে তিনশত বৎসর লাগে লাগুক। দৃঢ় বিশ্বাস এবং অপরিসীম ধৈর্য্য নিয়ে আমরা নিজেদেরকে রণসাজে সজ্জিত করব! কর্তৃত্ব অর্জন করার জন্য সবধরনের গন মাধ্যমগুলিকে আমরা প্রথমে গ্রাস করে নেব, আর সম্ভাব্য সকল প্রকার প্রচেষ্টার যথোপযুক্ত প্রয়োগ চালিয়ে যাব। আমাদেরকে অবশ্যই মুসলিমদের মধ্যে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারের প্রচেষ্টা করতে হবে। শতাব্দীর পরে হলেও এটা আমাদেরকে উদ্দীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে বড়সড় সুফল এনে দেবে। কারণ পিতারা কর্ম করে যান তাঁদের সন্তানদিগের কল্যানের জন্য।
একটা আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হল, সেখানে রাশিয়া, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের কূটনীতিকরা এবং ধর্মগুরুরা অংশগ্রহণ করেছিল। আমি ছিলাম খুব সৌভাগ্যবান। আমিও যোগদান করতে পেরেছিলাম, কারণ মন্ত্রীর সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আলোচনা সভায় মুসলিমদেরকে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে দেওয়ার এবং তাদেরকে তাদের বিশ্বাস থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার এবং তাদেরকে স্পেনীয়দের মতো বিশ্বাস ঘুরিয়ে দিয়ে খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার সিদ্ধান্ত আলোচিত ও গৃহীত হল। কিন্তু প্রত্যাশামতো সিদ্ধান্তগুলি সেইরূপ হল না। এই আলোচনা সভায় যা কিছু আলোচিত হয়েছিল তা আমি "ইলা-মালাকুত- ইল -মসিহ" পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেছি।
যে বৃক্ষের মূল মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করে গেছে হঠাৎ করে তাকে উপড়ে ফেলে দেওয়া খুব কঠিন। কিন্তু কঠিনকে আমাদের সহজ করে নিতে হবে এবং সেগুলিকে অতিক্রম করে যেতে হবে। খ্রীষ্টানধর্ম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। "মসীহ" আমাদের প্রভু এই বিষয়ে আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিমের খারাপ পরিস্থিতি মুহাম্মদকে সহযোগিতা করেছিল। সেইসব খারাপ পরিস্থিতি কেটে গেছে এবং তাদের সাথে ইসলাম নামে এক অপ্রীতিকর সমস্যাকেও দূর করে নিয়ে গেছে। আমরা মহানন্দে অবলোকন করছি যে, ঐ সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমাদের অপরিসীম পরিশ্রম এবং আমাদের মন্ত্রনাগার ও অন্যান্য খ্রীষ্টানরা ক্রমোন্নয়নের পথে আগুয়ান। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমরা যে সকলস্থান হারিয়ে ফেলেছিলাম সেই সকল স্থান পূনর্দখলের সময় হয়েছে। প্রবল শক্তিশালী রাষ্ট্র আমাদের গ্রেটব্রিটেনে, ইসলামকে মুছে ফেলার এই মহা আশীর্বাদ প্রাপ্ত কাজটি সম্পাদনে নেতৃত্ব দিয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়
হিজরী সন ১১২২-এ (১৭১০খ্রীঃ) মন্ত্রনাগারের মন্ত্রী আমাকে ইসলামকে ধ্বংস করার প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য গুপ্তচর হিসাবে ইজিপ্ট, ইরাক, হিজায ও ইস্তাম্বুলে প্রেরণ করে। একই সময়ে মন্ত্রনাগার, একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রবল ধূর্ত ও সাহসী আরও নয়জনকে প্রেরণ করে। আমাদেরকে প্রয়োজনীয় অর্থ তথ্যাদি এবং মানচিত্রের সাথে সাথে আমাদেরকে সেই সকল স্থানের রাষ্ট্রনেতা, ধর্মগুরু এবং উপজাতীয় প্রধানদের একটা তালিকা দেওয়া হল। আমি কখনোই ভুলতে পারব না! আমি যখন সেক্রেটারীকে বিদায় জানাচ্ছি, তিনি বললেন, "আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ তোমার উপরই নির্ভর করছে। সুতরাং তোমাকে তোমার সর্বশক্তি নিংড়ে নিতে হবে"।
ইসলামের খলিফা শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে আমার সমুদ্র যাত্রা শুরু হল। আমার প্রাথমিক কর্তব্য পালনের পাশাপাশি আমাকে তুর্কী ভাষা ও সেখানে প্রচলিত স্থানীয় ভাষাগুলিও ভালোভাবে শিখতে হবে। আমি ইতিমধ্যে লন্ডনে থেকে তুর্কী ও আরবী (কোরানের ভাষা) বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেছি। এছাড়া পার্সি ও ইরানের ভাষাও ভালোভাবে শিখে ফেলেছি। কিন্তু একটা ভাষা শিক্ষা লাভ করা আর সেই ভাষাটি যেই স্থানের, সেই স্থানের মানুষদের সাথে সেই ভাষায় স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা চালনা সম্পূর্ণ আলাদা। যখন একটাকে রপ্ত করতে বেশ কয়েকটি বছর লেগে যায়, তখন অপরটাকে পুনরায় ভালোভাবে ব্যবহারের উপযুক্ত করে তুলতে (প্রয়োজনের তাগিদে) ধরতে গেলে ঠিক তত সময়ই লেগে যায়। আমি তুর্কী ভাষাটা খুব সূক্ষ্মভাবে রপ্ত করেছিলাম যাতে স্থানীয় লোকেরা আমাকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করে।
ওরা আমাকে সন্দেহ করতে পারে এ বিষয়ে আমার কোন উদ্বেগ ছিল না।
কারণ- মুসলমানরা সহনশীল, মুক্তমনা, দয়াবান, যেটা তারা ওদের নবী মুহম্মদ (সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছে। তারা আমাদের মতো সন্দেহ বাতিক গ্রস্থ ছিল না। বিশেষতঃ সেই সময় তুর্কী সরকারের এমন কোন সংগঠন ছিল না, যারা গুপ্তচরদের গ্রেপ্তার করতে সমর্থ।
একটা ক্লান্তিকর সমুদ্র যাত্রা শেষে আমি ইস্তাম্বুলে এসে পৌঁছালাম। আমার নাম মুহাম্মদ বলে আমি আমার পরিচয় দিলাম এবং মুসলিমদের মসজিদে যাতায়াত শুরু করলাম। মুসলমানদের নিয়মাচার পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা এবং আনুগত্য- তা আমার ভালো লাগল। এক মুহুর্ত আমি আমার মনে ভাবলাম, কেন আমরা এই সকল নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করছি? আমাদের প্রভু "মসীহ" কি আমাদের এই উপদেশ দিয়েছিলেন? কিন্তু সাথে সাথে আমি আমার ঐ, পৈশাচিক চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম এবং সর্বোত্তম উপায়ে নিজের কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হলাম।
ইস্তাম্বুলে এক বৃদ্ধ জ্ঞানী মানুষ "আহমেদ ইফেন্দির" সাথে আমার সাক্ষাত হল। আমাদের ধর্মের ধার্মিক পুরুষদের মধ্যে কারোর ভেতরে আমি এত সুন্দর ভদ্র আচরণ, সহৃদয়তা, আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতা এবং দয়া কখনো দেখিনি। এই মানুষটি নিজেকে নবী মুহম্মদের মতো গুণাবলী যুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য দিনরাত প্রচেষ্টা করত। তাঁর মতে, মুহাম্মদ হলেন সর্বাপেক্ষা পবিত্র, সর্বোত্তম মানব। যখনই তিনি তাঁর নাম স্মরণ করতেন, তাঁর দুনয়ন অশ্রুসিক্ত হত। আমি ছিলাম ভীষণই সৌভাগ্যবান, যে তিনি আমাকে নাম- পরিচয় বা কোথা থেকে আসছি তার কিছুই জিজ্ঞাসা করেননি। তিনি আমাকে "মুহম্মদ ইফান্দি বলে সম্বোধন করতেন। তিনি খুব স্নেহ ও যত্নের সাথে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং আমার সাথে সুব্যবহার করতেন। কারণ তাঁর ধারণা ছিল, আমি একজন অতিথি এবং তুর্কীতে কর্মের উদ্দেশ্যে ইস্তাম্বুল এসেছি খলিফার ছত্রছায়ায় বাস করব বলে। আর খলিফা হলেন নবী মুহম্মদের প্রতিনিধি। আমার ইস্তাম্বুলে সাময়িক বসবাসের এই হল প্রাথমিক ছুঁতো।
একদিন আমি আহমেদ ইফেন্দিকে বললামঃ- আমার বাবা মা মারা গেছে। আমার কোন ভাই বোনও নেই। আর আমার কোন বিষয় সম্পত্তিও নেই। আমি জীবিকা অর্জনের জন্য এবং কুর-আন-উল-কারীম ও সুন্নত শিক্ষার জন্য ইসলামের এই কেন্দ্রস্থলে এসে পৌঁছেছি; অর্থাৎ আমি এখানে এসেছি আমার ইহলোক এবং পরলোক উভয় উপার্জনের জন্যই। "তিনি আমার এই কথাগুলি শুনে খুশি হয়েছিলেন এবং বললেন, "তুমি তিনটি বিশেষ কারণের জন্য সম্মানিত হওয়ার যোগ্যতা রাখ। "তিনি যা বলেছিলেন ঠিক তেমন ভাবেই আমি নীচে উল্লেখ করলাম।
১) তুমি একজন মুসলমান। আর সকল মুসলমান ভাই-ভাই।
২) তুমি একজন অতিথি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছিলেন, "তোমাদের অতিথিদের সহৃদয় আতিথেয়তা প্রদান করো।"
৩) তুমি কাজ করতে চাও। একটি হাদীছ শরীফে এইরূপ উক্ত হয়েছে যে কোন ব্যক্তি কর্ম তৎপর হলে আল্লাহ্ তাকে ভালোবাসেন। কথাগুলি শুনে আমি খুবই সন্তুষ্ট হলাম। আমি মনে মনে বললাম "এইরূপ জ্বলন্ত সত্য কি খ্রীষ্টান ধর্মেও আছে? এটা খুব লজ্জার বিষয় যে সেখানে এইরূপ একটাও নেই। "যেটা আমাকে অবাক করল, সেটা হল এই যে, ইসলাম যে এত মহান একটি ধর্ম, সেটি একদল উদ্ধত, অহংকারী এমন সব মানুষের হাতে অধঃপতিত হতে চলেছে, যারা জীবনের বিন্দু বিসর্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ।
আমি আহমেদ ইফেন্দিকে বললাম যে, আমি কুর-আন-উল-কারীম শিখতে চাই। তিনি উত্তরে জানালেন যে, তিনি খুব সুন্দরভাবে আমাকে এটি শেখাবেন এবং আমাকে সূরা ফাতিহা শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। যখন আমরা সেটি পাঠ করছিলাম তিনি এর অর্থগুলি ব্যাখ্যা করে দিচ্ছিলেন। কিছু শব্দ উচ্চারণে আমার অসুবিধা হত। দুই বছরের মধ্যে আমার কুর-আন-উল-কারীম সম্পূর্ণটাই তৈরী হয়ে গেল। প্রত্যেকটি পাঠ নেওয়ার পূর্বে তিনি ওজু করতেন এবং আমাকেও ওজু করতে নির্দেশ দিতেন। তিনি কিবলা (কা'বা) এর দিকে মুখ করে বসতেন এবং শিক্ষা দিতে শুরু করতেন।
মুসলিমরা যেটাকে ওজু করা বলে, সেটা একগুচ্ছ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার সমষ্টি। সেগুলি নিম্নরূপ।
১) মুখ ধুতে হবে পরিস্কার করে।
২) তারপর আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত ডান বাহু পরিস্কার করে ধুতে হবে।
৩) তারপর আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত বাম বাহু পরিস্কার করে ধুতে হবে।
৪) তারপর হাত দুটোকে সিক্ত করে সেই হাত দিয়ে ঘষে ঘষে মস্তক কানের পশ্চাত, ঘাড় প্রভৃতি পরিস্কার করতে হবে।
৫) দুই পা পরিস্কার করে ধুতে হবে।
মিসওয়াক ব্যবহার করতে আমার খুবই বিরক্ত লাগত। "মিসওয়াক" হল একজাতীয় গাছের ডাল যেটা দিয়ে মুসলিমরা তাদের মুখের ভেতরটা এবং দাঁত পরিষ্কার করে। আমি ভেবেছিলাম এই কাঠের জিনিষটা মুখের জন্য ক্ষতিকর। মাঝে মাঝে এটা আমার দাঁতে আঘাত করত এবং রক্ত বেরোত। তথাপি আমাকে এটা ব্যবহার করতে হত। কারণ, তাঁদের মতে, মিসওয়াক ব্যবহার নবীর মুয়াক্কাদ সুন্নত পালনের মধ্যে পড়ে। তারা বলে যে, এই কাঠের ডালটি খুব উপকারী। আমার মুখ দিয়ে রক্তপাতও বন্ধ হয়ে গেছে এবং অধিকাংশ ব্রিটিশদের মতো আমার মুখ থেকে তখনও দুর্গন্ধ বেরোত, সেটা দূর হয়ে গেল।
ইস্তাম্বুলে থাকার সময় আমি একটি ঘরে রাত কাটাতাম, যেটা আমি ভাড়া নিয়েছিলাম একটা লোকের কাছ থেকে। যে একটা মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল। এই সেবকের নাম ছিল "মারওয়ান ইফেন্দি"। নবী মুহম্মদের সাহাবাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল মারওয়ান। এই সেবক ছিল ভীষণ স্নায়ুবিকভাবে দূর্বল। সে তার নাম নিয়ে খুব অহংকার করত এবং আমাকে বলত যে আমার যখন ছেলে হবে, আমি যেন আমার ছেলের নাম রাখি মারওয়ান, কারণ মারওয়ান হচ্ছে ইসলামের সবচেয়ে খ্যাতনামা যোদ্ধাদের মধ্যে একজন।
"মারওয়ান ইফেন্দি" সান্ধ্যভোজ প্রস্তুত করত। আমি মুসলিমদের ছুটির দিন, শুক্রবার কাজে যেতাম না। বাকি দিনগুলিতে আমি খালিদ নামে এক কাঠ মিস্ত্রীর কাছে কাজ করতাম, আর সাপ্তাহিক বেতন পেতাম। যেহেতু আমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আংশিক সময়ের জন্য কাজ করতাম, তাই তিনি আমাকে অর্ধেক মজুরি দিতেন এবং বাকি অর্ধেক মজুরি তিনি অন্য কর্মীদের দিতেন। ঐ কাঠুরে তার অবসর সময়ের অধিকাংশটা "খালিদ বিন ওয়ালিদ" এর গুণকীর্তন করে কাটাতেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ হলেন নবী মুহম্মদের সাহাবাদের মধ্যে একজন। এবং তিনি ছিলেন একজন মহান মুজাহিদ (ইসলামের যোদ্ধা)। তিনি বহু ইসলামিক যুদ্ধ জয় করেছিলেন। তথাপি উমর বিন খাত্তাবের খিলাফৎ প্রাপ্তির সময় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করাটা ঐ কাঠমিস্ত্রীর মনকে রাগান্বিত করত। "খালিদ" নামে যে কাঠমিস্ত্রীর কাছে আমি কাজ করতাম, সে ছিল একজন নীতি বর্জিত এবং ভীষণভাবে বায়ুগ্রস্থ লোক। তিনি আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করতেন। আমি এর কারণ জানতাম না, কিন্তু সম্ভবতঃ তাঁর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম বলে। তিনি গোপনে শরিয়ত অমান্য করতেন। কিন্তু যখন তিনি তাঁর বন্ধুদের সাথে থাকতেন তিনি শরিয়তের নির্দেশ পালন করার মতো মনোভাব দেখাতেন।
তিনি শুক্রবার নামাজে যোগদান করতেন কিন্তু অন্যান্য দিনের প্রার্থনাগুলি ঠিকমতো করতেন কিনা সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। আমি দোকানেই আমার প্রাতঃরাশ করতাম। কাজের শেষে আমি মসজিদে যেতাম দুপুরের নামাজের জন্য এবং সেখানে বিকালের নামাজের সময় পর্যন্ত থাকতাম। বিকালের নামাজের পর আমি আহমেদ ইফেন্দির বাড়িতে যেতাম, যেখানে তিনি আমাকে কুর-আন-উল-কারীম, আরবি, তুর্কী প্রভৃতি ভাষা সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন রোজ দুই ঘন্টার জন্য। প্রতি শুক্রবার আমি তাঁকে আমার সাপ্তাহিক উপার্জনটা দিয়ে দিতাম কারন তিনি আমাকে খুব আন্তরিকতার সাথে শিক্ষা দিতেন। বাস্তবিকই, তিনি আমাকে দারুনভাবে শিখিয়ে ছিলেন, কেমন করে কুর-আন-উল-কারীম পড়তে হয়, ইসলাম ধর্মের প্রয়োজনীয়তা এবং আরবি ও তুর্কী ভাষার সূক্ষ্মতা সম্পর্কে।
যখন "আহমেদ ইফেন্দি" বুঝল যে আমি অবিবাহিত সে তার এক মেয়ের সাথে আমার বিবাহ দিতে চাইলো। আমি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। কিন্তু সে আমাকে উদ্বুদ্ধ করল- এই বলে যে, বিবাহ হল স্রষ্টার প্রেরিত মহানবীর একটা সুন্নত এবং স্রষ্টার প্রেরিত মহামানব বলেছেন যে "যে ব্যক্তি আমার সুন্নত থেকে দূরে থাকে সে কখনো আমার সাথে থাকতে পারবে না।" এই ব্যাপারটা আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে নষ্ট করে দিতে পারে, এটা আশঙ্কা করে, আমার তার সাথে মিথ্যা বলতে হল, "আমার যৌন ক্ষমতার ঘাটতি আছে। এইভাবে আমি আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় এবং বন্ধুত্বের ধারাকে নিশ্চিত করলাম"।
যখন ইস্তাম্বুলে আমার দুই বছরের বসবাস শেষ হল আমি বললাম "আহমেদ ইফেন্দি" আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। সে বলল, "না যেও না" তুমি চলে যাচ্ছ কেন? তুমি ইস্তাম্বুলে যা সন্ধান করছো তার সবই পেতে পারো। আল্লাহ তাআলা এই শহরে ধর্ম এবং জাগতিক বিষয়, দুটোই দিয়েছেন। তুমি বলেছ যে, তোমার পিতামাতা গত হয়েছেন আর তোমার কোন ভাই বোনও নেই। তুমি ইস্তাম্বুলে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে না কেন? ....." "আহমেদ ইফেন্দি" আমার সহচর্যের উপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এ কারনে সে আমার সঙ্গ ছাড়তে চাইল না এবং আমাকে ইস্তাম্বুলে স্থায়ীভাবে বাড়ি তৈরী করে থেকে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করল। কিন্তু কর্তব্যের মধ্যেকার দেশপ্রেমিক অনুভূতি আমাকে লন্ডনে ফিরে যেতে বাধ্য করল, খলিফা শাসনাধীন অঞ্চলের কেন্দ্র সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন জানানোর জন্য এবং নতুন নির্দেশ পাওয়ার জন্য।
ইস্তাম্বুলে থাকার সময় আমার নজরদারির মাসিক প্রতিবেদন আমি ঔপনিবেশিক শাসকদের মন্ত্রকে নিয়মিত পাঠাতাম। আমার মনে পড়ে আমার এক প্রতিবেদন পাঠানোর পরবর্তী নির্দেশ হিসাবে আমাকে বলা হয় যে, ঐ ব্যক্তির সাথে সমকামী যৌন সঙ্গী হিসাবে লিপ্ত হওয়ার জন্য।
আমাকে বলা হল এটা তুমি করতে পারো, যদি এটা তোমাকে লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করে। এই কথায় আমি ভীষণভাবে ক্রুব্ধ হলাম। আমার মনে হল যেন পুরো পৃথিবীটা আমার মাথার উপর ভেঙে পড়েছে। আমি পূর্ব থেকেই জানতাম যে এই নোংরা কার্যটি ইংল্যান্ডে নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার। তথাপি আমি এই কাজটি করলাম না। যদিও আমার উর্দ্ধতন কর্তারা আমাকে এটা করার নির্দেশ দিয়েছিল। আমার কি করা উচিত? জঙ্গলকে জঞ্জালের স্ত্তূপে ফেলা ব্যতীত আমার নিকট আর অন্য কোন পথ রইল না। তাই আমি নীরব রইলাম এবং আমার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম।
যখন আমি "আহমেদ ইফেন্দি" কে বিদায় জানালাম তার নয়ন অশ্রুসিক্ত হল এবং সে আমাকে বলল, "আমার বাঁচা! আল্লাহ্ তায়ালা তোমার সাথে থাকুক! যদি তুমি ইস্তাম্বুলে আবার ফিরে আসো আর দেখ যে আমি মারা গেছি, আমার কথা স্মরণ করো। আমার আত্মার মাগফেরাতের জন্য সুরা ফাতিহা উচ্চারণ করো! মহা বিচারের দিনে "রাসূলুল্লাহ" এর সম্মুখে আমাদের সাক্ষাত হবে।" বাস্তবিকই আমিও ব্যথা অনুভব করলাম; এতটাই ব্যথিত হলাম যে, আমার দুচোখ বেয়ে উষ্ণ অশ্রু ঝরতে লাগল। যাই হোক, আমার কর্তব্যের অনুভূতি ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী।
তৃতীয় অধ্যায়
আমার লন্ডনে পৌঁছানোর পূর্বেই আমার বন্ধুরা পৌঁছে গেল আর তারা মন্ত্রণাগার থেকে যথারীতি নতুন নির্দেশ পেয়ে গেল। ফিরে এসে আমিও নতুন নির্দেশ পেয়ে গেলাম। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের মধ্যে মাত্র ছয়জন ফিরে এসেছে। সেক্রেটারী বললেন অপর চার জনের মধ্যে একজন মুসলিম হয়ে গেছে এবং ইজিপ্টেই বসবাস করছে। কিন্তু সেক্রেটারী তবু খুশি কারণ, তিনি বললেন ও(যে ব্যক্তিটি মিশরে বসবাস করছে) প্রতারণা করে কোন গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়নি। দ্বিতীয় জন রাশিয়ায় গেছে এবং সেখানেই বসবাস করছে। বংশগত দিক থেকে সে সত্যিই ছিল রাশিয়ান। সেক্রেটারী তার ব্যাপারে খুবই মর্মাহত একারণে নয় যে সে তার জন্মভূমিতে ফিরে গেছে বরং সে রাশিয়ার ঔপনিবেশিক মন্ত্রকের উপর নজরদারি চালাচ্ছিল এবং স্বভূমিতে ফিরে গেছে কারণ তার মিশন সফল হয়ে গেছে। সেক্রেটারী বললেন, তৃতীয় ব্যক্তি বাগদাদের নিকটবর্তী "ইমারা" নামক শহরে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। চতুর্থ ব্যক্তিকে মিনিষ্ট্রি খুব সতর্কভাবে নির্বাচন করে পাঠিয়েছিল ইয়েমেনের সানা নামক শহরে এবং এক বছর ধরে তার পাঠানো প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে পাঠানো বন্ধ হয়ে গেল এবং অপরিসীম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। মিনিষ্ট্রি এই চার জনের অদৃশ্য হওয়াকে মহা দুর্ঘটনা হিসাবে দেখছে। কারণ ক্ষুদ্র জনসংখ্যাযুক্ত আমাদের জাতি, বিশাল এবং প্রবল কর্মমুখর এবং মহান দায়িত্বে অবিচল। তাই আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের উপর গণনা নির্ণয় যথেষ্ট নিখুঁতভাবে করা হয়।
আমার কয়েকটি প্রতিবেদন পাঠানোর পরে, সেক্রেটারী একটা সভা ডাকলেন আমরা চারজন যে সব প্রতিবেদন পাঠিয়েছি সেগুলি পুনঃ পর্যালোচনার জন্য। যখন আমার অন্য বন্ধুরা তাদের কাজের প্রতিবেদনগুলি দাখিল করল। তারা আমার প্রতিবেদন থেকে কিছু নোট নিল।
মন্ত্রী, সেক্রেটারী এবং যারা এই সভায় উপস্থিত ছিল তাদের কয়েকজন আমার কাজের প্রশংসা করল। যদিও সকলের মধ্যে আমার অবস্থান তৃতীয় স্থানে।
নিঃসন্দেহে আমি তুর্কী এবং আরবী ভাষা শিক্ষায় ছিলাম ব্যাপকভাবে সফল। এমনকি কোরআন এবং শরিয়ত শিক্ষায়ও ছিলাম ওস্তাদ। তথাপি আমি আমার প্রতিবেদনে অটোম্যন রাজত্বের দূর্বল দিকগুলি প্রস্তুত করতে অসমর্থ হলাম আমাদের মন্ত্রকের জন্য। দুই ঘন্টার সভা শেষে সেক্রেটারী আমার ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলেন। আমি বললাম "আমার গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য ছিল কোরআন, শরিয়ত ও তার ভাষাগুলি শিক্ষা লাভ করা। অন্য কোন কাজ করার মতো অতিরিক্ত সময় আমার হাতে ছিল না। কিন্তু যদি আপনি আমার উপর আস্থা রাখেন তাহলে এবার অবশ্যই আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবো" সেক্রেটারী কাজে নিশ্চিতভাবে সফল কিন্তু তিনি চান আমি যেন প্রথম স্থানটি অধিকার করতে পারি (এবং তিনি বলতে লাগলেন)ঃ "ওহে হেস্ফার তোমার দ্বিতীয় মিশনে মূলতঃ দুটি কাজ থাকবে"ঃ
১) মুসলিমদের দূর্বল জায়গাগুলি চিহ্নিত করা এবং সেই বিষয়গুলি চিহ্নিত করা, যেগুলির মধ্যে দিয়ে আমরা অনায়াসে ওদের শরীরে ঢুকতে পারব এবং তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলিকে আলাদা করে দিতে পারব। প্রকৃতপক্ষে এটাই হচ্ছে শত্রু নিপাত করার পর।
২) যে মুহুর্তে তুমি এই জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করে তোমার কার্য সমাধা করতে পারবে যেটা আমি তোমাকে বলেছি[অন্য কথায় বলতে গেলে যখন তুমি মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপণ করতে পারবে এবং একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই বাধিয়ে দিতে পারবে], তুমিই হবে সবচেয়ে সফল গোয়েন্দা এবং সরকারের পক্ষ থেকে একটা পদক পাবে।
আমি ছয়মাস লন্ডনে থাকলাম। আমি পৈতৃক দিক থেকে এক তুতো বোনকে বিয়ে করলাম যার নাম "মারিয়া স্যাভি" সেই সময় আমার বয়স ২২ বছর, এবং তার বয়স ২৩ বছর। "মারিয়া স্যাভি" ছিল খুব সুন্দরী মেয়ে, মোটামুটি বুদ্ধি সুদ্ধি যুক্ত এবং সাধারণ মনের সাংস্কৃতিক ব্যকগ্রাউন্ড যুক্ত। তার সাথে আমি যে দিনগুলি কাটিয়েছিলাম সেই দিনগুলি ছিল আমার কাছে সবচেয়ে সুখের ও আনন্দের। আমার স্ত্রী গর্ভবতী হল। আমরা আমাদের নতুন অতিথির অপেক্ষায় ছিলাম, ঠিক তখনই আমার নিকট ইরাকের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার নির্দেশ সম্বলিত এক বার্তা এল।
নির্দেশটি এমন সময় এল যখন আমি আমার পুত্রের জন্মলাভের অপেক্ষায় ছিলাম, ফলে আমি খুব ব্যথিত হলাম। যাইহোক, আমি আমার দেশের কাজে সদা নিয়োজিত এটাকে গুরুত্ব দিয়ে এবং আমার সহকর্মীদের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হয়ে খ্যাতি অর্জন করার দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে স্বামী এবং পিতৃত্বের আবেগকে দমন করলাম। তাই আমি কোন প্রকার দ্বিধা ছাড়াই দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। আমার স্ত্রী আমার সন্তানের জন্ম হওয়া পর্যন্ত আমার যাত্রা স্থগিত রাখতে চাইল কিন্তু আমি ওর কথায় গুরুত্ব দিলাম না। বিদায়ের সময় আমরা দুজনেই কাঁদছিলাম। আমার স্ত্রী বলল, "আমাকে চিঠি লিখতে ভুলে যেওনা। আমাদের নতুন বাড়ি সম্পর্কে আমি সবসময় তোমায় চিঠি লিখব, যেটা আমাদের কাছে সোনার মত দামি।" ওর ওই উচ্চারিত কথাগুলি আমার হৃদয়ে তুফান তুলেছিল। আমি সফরটা বাতিল করে দেব বলে প্রায় স্থির করে ফেলেছিলাম। তথাপি আমি আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হলাম। তার কাছ থেকে আমার বিদায়ের দিন পিছিয়ে নিয়ে, আমি মন্ত্রনাগারে গেলাম অন্তিম নির্দেশাবলী গ্রহণের জন্য।
ছয়মাস পরে আমি ইরাকের বসরায় পৌঁছালাম। এই শহরে ছিল কিছু শিয়া এবং কিছু সুন্নী। বাসরা ছিল এমন একটি শহর যেখানে নানান উপজাতির মানুষ, আরবি, ফার্সিয়ান এমনকি সামান্য সংখ্যক খ্রীষ্টানের মিশ্র বসবাস দেখা যায়। আমার জীবনে এই প্রথমবার ফার্সিদের সাথে সাক্ষাত হল। যাইহোক, এখন আমি শিয়া এবং সুন্নী সম্পর্কে একটু আলোকপাত করব।
শিয়ারা বলে যে, তারা আলী ইবনে আবু তালিবের অনুগামী যিনি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কন্যা ফাতেমার স্বামী এবং সেই সাথে সাথে মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতার দিক থেকে খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে। তারা বলে যে, মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে নিযুক্ত করেন আর ১২ জন ইমাম হলেন আলীর বংশধর, যারা আলীর পরে, একের পর এক আসেন এবং এরাই খলিফা পদের উত্তরাধিকারী।
আমার মতে, আলি হাসান এবং হুসায়েনের খিলাফৎ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে শিয়ারা সঠিক। কারণ ইসলামের ইতিহাস থেকে আমি যতদূর জ্ঞান লাভ করেছি আলী ছিলেন একজন খ্যাতিমান এবং উচ্চ গুণ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব যা খেলাফত পাওয়ার জন্য প্রয়োজন। মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হাসান এবং হুসেনকে খলিফা হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন, এতে আমি বেমানান কিছুই খুঁজে পাই না। কিন্তু যেখানে আমার সন্দেহ জাগে তা হল এই যে মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুসেনের ছেলেকে এবং তাঁর আটজন নাতিকে খলিফা হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। কারণ হুসেনের একজন মাত্র ছেলে ছিল মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর সময়। কীভাবে মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি জানলেন যে তাঁর আটজন নাতি আছে। যদি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি সত্যিকারেরই একজন প্রেরিত মহাপুরুষ হন আল্লাহ তায়ালা কৃত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব, যেমন মশীহ অলৌকিক উপায়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন, এ কারনে মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রেরিত মহাপুরুষ হিসাবে আমরা খ্রীষ্টানরা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখি।
মুসলিমরা বলে যে "মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে প্রেরিত মহাপুরুষ ছিলেন সে সম্পর্কে অনেক প্রমাণ আছে। যেগুলির মধ্যে একটি হল কুর-আন" আমি কোরআন পড়েছি। বাস্তবিকই এটা হল একটা খুব উচ্চ গুণসম্পন্ন গ্রন্থ এমনকি "তোরা" (তাওরাত) এবং বাইবেল থেকেও উন্নত গ্রন্থ কারণ ইহা যথাযথভাবে আইন, কানুন এবং নৈতিক গুণাগুণ ইত্যাদি দ্বারা সমৃদ্ধ।
কী ভাবে মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মত একজন অশিক্ষিত ব্যক্তি এরকম উচ্চ গুণাগুণের সমৃদ্ধ গ্রন্থ অবতীর্ণ করলেন এবং কী ভাবেই যা তিনি পেলেন ঐ সমস্ত নৈতিক আদর্শ অতিমানবিক এবং ব্যক্তিগত গুণাগুণ যা কোন মানুষ অজস্র পড়ে বা অজস্র ভ্রমণের মাধ্যমেও অর্জন করতে পারে না; তা আমার কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। আমার সন্দেহ জাগে যে এই সমস্ত বিষয়গুলিই কি শুধুমাত্র মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রেরিত মহাপুরুষ হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে?
আমি সর্বদাই সত্য উদঘাটনের জন্য গবেষণা এবং অনুসন্ধান চালিয়েছি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রেরিত মহামানব হওয়ার ব্যাপারে। একবার আমার লন্ডনের একজন খ্রীষ্টান পুরোহিত সম্পর্কে
আগ্রহ জন্মাল। তার উত্তরগুলি ছিল গোঁড়া এবং যুক্তিহীন এবং একেবারেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়। যখন আমি তুর্কীতে ছিলাম আমি আহমেদ ইফেন্দিকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু আমি কোন সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। সত্যি কথা বলতে আহমেদ ইফেন্দিকে এই প্রশ্ন সরাসরি জিজ্ঞাসা করার পন্থা এড়িয়ে চলতাম, যাতে সে আমার গুপ্তচর বৃত্তি সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ না করে ফেলে।
আমি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অনেক ভাবনা চিন্তা করেছি। নিঃসন্দেহে তিনি আল্লাহ এর নবীদের মধ্যে একজন, যাদের সম্পর্কে আমরা পুস্তকে পড়ি। তথাপি, খ্রীষ্টান হিসাবে তার নবী হওয়ার বিষয়ে আমি আস্থা আনতে পারি না। এটা নিঃসন্দেহে যে অনেক জ্ঞানীদের থেকে তিনি অনেক বেশি উচ্চে।
অপরপক্ষে সুন্নি হল - "নবীর মৃত্যুর পরে মুসলমানরা আবু বকর, উমর, উসমান এবং আলীকে তাদের খলিফা হিসাবে মেনে নেয়।
সব ধর্মেই বিশেষভাবে খ্রীষ্টানধর্মে এই বিষয়ে প্রচুর মতপার্থক্য আছে। যেহেতু উমর এবং আলী উভয়ের বর্তমান মৃত। এই সমস্ত বিতর্কিত বিষয় মনে পোষণ করা বর্তমানে অর্থহীন। আমার তরফ থেকে আমি বলতে চাই যে যদি মুসলমানরা যুক্তিপূর্ণ হন তাঁরা বর্তমানের নিরিখে বিচার করুন, সেই বহু পুরাতনের নিরিখে নয়।"
একদিন আমি ঔপনিবেশিক মন্ত্রনাগারে শিয়া ও সুন্নির পার্থক্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে পাঠালাম এই বলে যে "যদি মুসলমানরা জীবন সম্পর্কে কিছু অবগত থাকে, তাদের মধ্যে শিয়া ও সুন্নির পার্থক্যের ব্যাপারটা ওরাই সমাধান করবে এবং পরস্পর সমবেত হবে।" কেউ একজন আমাকে বাধা দিল এবং প্রতিবাদের সুরে বলল "তোমার কর্তব্য হচ্ছে এই বিভাজন ভেদ আরও দৃঢ়তর হয় সেটাকে আরো উদ্দীপিত করা, মুসলমানদের সংগঠিত করা নয়"।
আমার ইরাকের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার পূর্বে সেক্রেটারী বলল 'ওহে হেম্ফার তোমার জানা উচিত যে জন্নগতভাবেই মানুষের মধ্যে পার্থক্য বিরাজমান। যেহেতু স্রষ্টাই আবেল এবং কেইনকে সৃষ্টি করেছেন। এইরূপ ঝঞ্ঝাট চলতেই থাকবে "মশীহের" ফেরা পর্যন্ত। একারণেই জাতিগত, উপজাতিগত, আঞ্চলিকতা, জাতীয়তা এবং ধর্মীয় ঝঞ্ঝাট বিরাজমান। "বর্তমানে তোমার দায়িত্ব হচ্ছে এই সকল ঝামেলা ঝাটিগুলিকে নিখুঁতভাবে নিরূপণ করা এবং সেই সব বিষয়ে মন্ত্রনাগারে প্রতিবেদন পাঠানো। যত বেশি সফলভাবে তুমি মুসলিমদের মধ্যে এই বিভাজন বাড়িয়ে দিতে পারবে ততবেশি মহৎভাবে ইংল্যান্ডের জন্য সেবা করা হবে"।
"আমাদের ঔপনিবেশিক এলাকাগুলিতে মানুষের মধ্যে অশান্তি এবং ভাঙ্গন ধরাতে হবে, তাহলে আমরা ততবেশি আত্মকল্যান এবং বিলাসীতা ভোগ করতে পারব।" একমাত্র এই ধরণের উস্কানির সাহায্যেই আমরা অটোম্যন রাজবংশকে ধ্বংস করতে সমর্থ হবে। তা না হলে স্বল্প জনসংখ্যাযুক্ত একটা দেশ কেমন করে অনেক বেশি জনসংখ্যাযুক্ত একটা জাতিকে নিজের পদানত করবে? তোমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে ফাটলের মুখ খোঁজার চেষ্টা কর এবং পাওয়া মাত্র ফাটলে ঢুকে পড়ো। তোমার জানা উচিত যে অটোম্যন এবং ইরানি রাজবংশ তাদের পতনের শেষ সীমায় পৌঁছেছে। সুতরাং তোমার প্রাথমিক কর্তব্য হল, প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানুষকে উস্কে দেওয়া। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে "সাধারণ মানুষের বিদ্রোহই হচ্ছে সমস্ত সুবিশাল বিপ্লবের মূল উৎস"। যখন মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ভঙ্গ হবে এবং তাদের মধ্যেকার সাধারণ সহানুভূতিও নষ্ট হয়ে যাবে, তারা শক্তিহীন হয়ে পড়বে এবং এইভাবে আমরা খুব সহজেই ওদেরকে ধ্বংস করতে পারব।
চতুর্থ অধ্যায়
যখন আমি বসরায় পৌঁছালাম, আমি একটা মসজিদে এসে উঠলাম। মসজিদের ইমাম একজন আরব বংশোদ্ভুত সুন্নী সম্প্রদায়ের ব্যক্তি, যার নাম শেখ উমর তায়ী। তার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর আমি তার সাথে কথা বলতে লাগলাম। কিন্তু সে আমাকে প্রথম থেকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগল এবং অজস্র প্রশ্ন করতে লাগল। আমি নিম্নলিখিতভাবে ঐ ভয়ানক কথোপকথন থেকে নিজেকে বাঁচালাম। আমি তুর্কীর ইগদির অঞ্চল থেকে এসেছি। আমি ইস্তাম্বুলের আহমেদ ইফান্দির শিষ্য। আমি খায়ালি (হালিদ) নামক একজন কাঠমিস্ত্রীর কাছে কাজ করতাম। আমি তাঁকে তুর্কী সম্পর্কে কিছু তথ্য দিলাম, যেটা আমি তুর্কী থাকাকালে সংগ্রহ করেছিলাম। তার উপর আমি আমার কিছু কথা তুর্কী ভাষায় চালালাম। আমি সঠিকভাবে তুর্কী ভাষায় কথা বলছি কিনা, তা পরীক্ষা করতে ইমাম তখন একজনকে চোখের ইশারায় আমার পেছনে নিয়োগ করল। উত্তরটা আমার স্বপক্ষে ছিল। ইমামকে বশে আনতে পেরে আমি খুব খুশি হলাম। কিন্তু আমি ভুল করলাম। কয়েকদিন পর আমি হতাশ হয়ে দেখলাম যে, ইমাম আমাকে তুর্কী গুপ্তচর হিসাবে সন্দেহ করছে। পরের দিকে আমি লক্ষ্য করলাম যে অটোম্যন সুলতানের নির্বাচিত ঐ অঞ্চলের শাসক এবং ঐ ইমামের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য ও বিদ্বেষ আছে।
শেখ উমর ইফান্দির মসজিদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে আমি একটি সরাইখানার একটি ঘর ভাড়া নিলাম যেটা ভ্রমণকারী ও বিদেশীদের ব্যবহার্য এবং সেখানে চলে গেলাম। সরাইখানার মালিক ছিল একটা নির্বোধ যার নাম মুর্শিদ ইফেন্দি। প্রত্যহ ভোরে সে আমাকে বিরক্ত করত। ভোরের নামাজের আজান দেওয়ার সাথে সাথে জোরে আমার দরজায় কড়া নাড়তো।
তার কথা আমাকে মান্য করতে হত। তাই আমি উঠে ভোরের নামাজ পড়তাম। তারপর সে বলত" তুমি ভোরের নামাজের পরে কুরআনুল কারীম পড়বে। "যখন আমি তাকে বললাম যে এটা ফরজ (ইসলাম নির্দেশিত একটি কর্তব্য) নয় যে কুরআন আল কারীম পড়তেই হবে এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন সে আমাকে এত উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে, সে উত্তর জানাল, "দিনের এই সময়ে ঘুমিয়ে থাকাটা এই সরাইখানা এবং এখানে বসবাসকারীদের জন্য দারিদ্র্যতা এবং দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে পারে।" আমাকে তার এই নির্দেশ পালন করতে হল। কারণ সে আমাকে বলেছিল, তা না হলে সে আমাকে সরাইখানা থেকে বের করে দেবে। সুতরাং আযান দেওয়া মাত্র আমি উঠে, ভোরের নামাজ পড়তাম এবং তারপর এক ঘন্টা কুর-আন-উল-কারীম পড়তাম।
একদিন মুর্শিদ ইফেন্দি আমার কাছে এসে বলল "যখন থেকে তুমি সরাইখানার এই ঘরটা ভাড়া নিয়েছ, নানা ধরনের দুর্ভাগ্য আমার লেগেই রয়েছে। তোমার অপয়া লক্ষনই এর জন্য দায়ী। আর এর কারণ হচ্ছে তুমি অবিবাহিত। অবিবাহিত থাকাটা অমঙ্গলের চিহ্ন সূচক। হয় তুমি বিয়ে কর, না হয় আমার সরাইখানা ছাড়"। আমি তাকে জানলাম যে বিয়ে করার মতো পর্যাপ্ত ধন বা অর্থ আমার নিকট নেই। যেটা আমি আহমেদ ইফেন্দিকে বলতে পেরেছিলাম, সেটা আমি ওকে বলতে পারলাম না। কারণ মুর্শিদ যৌনাঙ্গ দেখবে, আমি সত্যি বলছি, না মিথ্যা বলছি, তা পরীক্ষা করার জন্য।
যখন আমি অমনটা বললাম মুর্শিদ ইফেন্দি আমাকে তিরস্কার করে বলল, তুমি কি দুর্বল ঈমান নিয়ে চল! তুমি কি আল্লাহ এর ঐ আয়াতটি পড়নি? যেখানে বলা হচ্ছে, "যদি কেউ দরিদ্র হয়, আল্লাহ তায়ালা তাঁর করুনা দ্বারা তাদের ধনী করবে"। আমাকে বন্ধু বানানো হল। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম "ঠিক আছে আমি কম খরচেই কোন মেয়েকে বিয়ে করতে পারি এমন মেয়ের সন্ধান দিতে পারি?"
কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা করে মুর্শিদ ইফেন্দি বলল, "আমি পরোয়া করি না! হয় রজব মাসের শুরুতে বিয়ে কর, নয় আমার সরাইখানা ছাড়।" রজব মাস শুরু হতে আর মাত্র ২৫ দিন বাকি।
ঘটনাক্রমে, আমি এখানে আরবি মাসগুলির কথা উল্লেখ করছি; মহরম, সফর, রবিউল-আউয়াল, রবি-উল-আখির, জামাদি-উল-আউয়াল, জামাদি-উল-আখির, রজব, সাবান, রামাদান, সাওয়াল, জিল্কদ, জিলহজ। তাদের মাসগুলির দিন সংখ্যা ৩০ দিনের বেশী নয়, আবার ২৯ দিনের কম নয়। চান্দ্র হিসাবের উপর নির্ভর করে হিসাব হয়।
একটা কাঠ মিস্ত্রীর সহকারীর কাজ নিয়ে আমি মুর্শিদ ইফেন্দির সরাইখানা ছাড়লাম। খুব কম মজুরির বিনিময়েই আমি চুক্তিবদ্ধ হলাম, কিন্তু আমার থাকা খাওয়ার খরচ মালিককেই দিতে হবে। আমি আমার জিনিসপত্র ঐ কাঠমিস্ত্রীর দোকানে নিয়ে চলে এলাম রজব মাস শুরু হবার অনেক আগেই, কাঠমিস্ত্রী ছিলেন খুব মানবিক গুনসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি আমাকে তাঁর পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন ইরানের খোরাসান থেকে আগত একজন শিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষ এবং তার নাম ছিল আব্দুর রেযা। তার সাহচর্যের সুযোগ নিয়ে আমি ফার্সি শিখতে শুরু করলাম। প্রত্যেক বিকালে ইরানি শিয়ারা তার বাড়িতে মিলিত হত এবং রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করত। অধিকাংশ সময়ই তারা শুধু নিজ দেশের দুর্বল সরকার সম্পর্কেই আলোচনা করত না, তারা ইস্তামুলে খলিফার শাসন সম্পর্কেও আলোচনা করত। যখনই কোন আগন্তুক ভেতরে আসত তারা তাদের আলোচনার বিষয় পাল্টে ফেলত এবং তাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করত।
ওরা আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করত। যেটা পরের দিকে আমি বুঝলাম, ওরা আমাকে আজারভাইজানের লোক ভেবেছে-যেহেতু আমি তুর্কী ভাষায় কথা বলি।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে আমাদের কাঠমিস্ত্রীর দোকানে এক যুবক এল। ওর সাজ পোশাক দেখলে মনে হয় যে, সে একটা ছাত্র যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাচ্ছে, আর সে আরবী ফার্সি এবং তুর্কী ভাষা বুঝত, তার নাম ছিল মুহম্মদ বিন আব্দ- উল- ওয়াহাব নাজদি। এই যুবকটি ছিল ভীষণভাবে বদরাগী ও খুব ভীতু প্রকৃতির লোক। যখন অটোম্যন সরকার সম্পর্কে প্রবলভাবে গালাগালি দিত তখন কখনো ইরানী সরকার ত্রুটি সম্পর্কে একটাও কথা বলত না। এই যুবকের সাথে দোকান মালিক আব্দুর-রেজা এর একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তা হল- উভয়ই ইস্তাম্বুলের খলিফা সম্পর্কে শত্রুভাবাপন্ন। কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব যে এই যুবকটি যে ছিল সুন্নি ফার্সি ভাষী লোক আর আব্দুর রিযার বন্ধু যে কিনা একজন শিয়া এই শহরে সুন্নিরা শিয়াদের সাথে ব্যবহার করে বন্ধুত্বপূর্ণ এমনকি ভ্রাতৃসুলভ শহরের অধিকাংশ অধিবাসী আরবী এবং ফার্সি দুটোই বুঝত। আর অধিকাংশ লোকেই তুর্কী ভাষাগুলি ভালোভাবে বুঝতো। মুহম্মদ -উল-নাজদি বাহ্যদিক থেকে ছিল সুন্নি যদিও অধিকাংশ সুন্নি শিয়াদের সমালোচনা করত, অন্ততপক্ষে তারা বলে যে শিয়ারা হচ্ছে অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত, কিন্তু এই লোকটি কখনো তীব্রভাবে শিয়াদের সমালোচনা করতো না। মুহম্মদ-উল-নাজদির মতে; এর কোন যুক্তিই হয় না যে সুন্নিরা চারিটি মাঝ-হাব এবং একটার সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। সে বশতঃ "আল্লাহ এর গ্রন্থের সাথে এই চারটি মাঝ-হাবের সম্পর্ক আছে এমন কোন প্রমাণ নেই", সে উদ্দেশ্যে প্রণোদিতভাবেই আয়েত-ই- কারীমা কে আচ্ছিল্য করত এই ব্যাপারে এবং হাদিছ-ই-শরীফকে লঘু চোখে দেখত।
চারটি মাঝ হাবের বিষয় বলতে গেলে বলতে হয় তাদের নবি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর
১০০ বছর পরে সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে চার জ্ঞানী পুরুষের আবির্ভাব হয়, আবু হানিফ, আহম্মাদ বিন হানবাল, মালিক বিন আনাস এবং মুহম্মদ
বিন ইদ্রিস শাফি। কয়েকজন খালিফা এই চারজন জ্ঞানীদের একজনকে অনুকরণ করার জন্য সুন্নিদের জবরদস্তি করতে থাকে। তারা বলতে থাকে এই চার জন মহাজ্ঞানীকে বাদ দিয়ে কেউই কুরআন আল -কারীম বা সুন্নতের মধ্যে ইজতিহাজ করতে পারবে না। এই পরিবর্তন মুসলমানদের ইসলামিক জ্ঞান এবং বোধের দরজাকে বন্ধ করে দিল।
ইজতিহাজের এই নিষিদ্ধ করনকেই মনে করা হয় ইসলামের গতি স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
শিয়ারা এই ত্রুটিপূর্ণ বক্তব্যগুলিকে স্বীয় স্বার্থসাধনের কাজে লাগাল। এই সময় শিয়াদের সংখ্যা ছিল সুন্নিদের দশভাগের একের চেয়ে কম। কিন্তু বর্তমানে তার সংখ্যা বর্ধিত হয়েছে এবং সংখ্যার নিরিখে সুন্নিদের সমান সমান হয়ে গেছে। এরূপ ফলই স্বাভাবিক। কারণ ইজতিহাজ হল একটি অস্ত্রের মত। এটা ইসলামে ফিকাহ্ শাস্ত্রের উন্নতি সাধন করে এবং কুর-আন-উল-কারীম ও সুন্নত সম্পর্কে জ্ঞানের নবনব মাত্রা প্রদান করে। অপরপক্ষে ইজতিহাজের নিষিদ্ধ করন একটা অর্থহীন অস্ত্রের মতো। এটা মাঝ-হাব কে ক্ষুদ্র কুঠুরির মধ্যে আবদ্ধ করে দেওয়া। এর ফলে এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে সীমান্তের দরজা হবে বন্ধ এবং সময়ানুগ পরিবর্তনের চাহিদা হবে অস্বীকৃত। যদি তোমাদের অস্ত্র হয়ে যায় ভোঁতা এবং শত্রুতা হয় দৃঢ়তর তোমরা তোমাদের শত্রুদের হাতে মার খেতে খেতে নিপাত যাবে শীঘ্রই অথবা কিছু কালের মধ্যে এটা আমার বিশ্বাস। চিন্তাশীল সুন্নিরা ইজতিহাজের দরজা অদূর ভবিষ্যতে খুলে দেবে। যদি তারা এটা না করে, কয়েক শতাব্দীর মধ্যে শিয়ারা হয়ে পড়বে সংখ্যাগুরু।
[যাই হোক, ঐ চারটে মাঝ হাবের ইমামরা (নেতারা) ঐ একই ধর্মমত, একই বিশ্বাস ধরে থাকল। তাদের চারজনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তাদের পার্থক্য শুধু ধর্মপালন পদ্ধতিতে। আর এটার কারণে মুসলমানরা সুবিধা ভোগ করল। অপরপক্ষে শিয়ারা, বারোটা (১২) ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল, এইভাবে তারাও পরিণত হচ্ছে-পচা ভোঁতা অস্ত্রে -মিলাল ওয়া নিহাল গ্রন্থে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।]
দূবিনীত যুবক মুহম্মদ-উল-নাজদি, কুরআন এবং সুন্নত এ বর্ণনা অনুযায়ী সে যা বুঝেছিল সেইভাবে নফস্ বা রিপুর ধারণা অনুসরণ করত। সে জ্ঞানীগনের বক্তব্যে কোন রকম আমল দিতনা; শুধুমাত্র সেই সময়কার চার মাঝ-হাব-এর নেতাগণ এবং তৎকালীন মনীষীদের বক্তব্যকেই নয় বরং আবুবক্কর এবং উমর এর মতো মহাখ্যাতিমান সাহাবীদের বক্তব্যকেও যখনই কুরআনের কোন আয়াত তার সামনে আসত, সে ঐ সকল ব্যক্তিগণের বক্তব্যের সাথে সেগুলিকে সঙ্গতিহীন হিসাবে খুঁজে পেত, সে বলত, "নবী বলেছেনঃ আমি তোমাদের জন্য কুরআন এবং সুন্নত রেখে গেলাম। "তিনি কখনো বলেননি যে, আমি তোমাদের জন্য এই কুর-আন, এই সুন্নত, এই সাহাবীগণ, এবং মাঝ-হাব-এর ইমামদের রেখে গেলাম।" সুতরাং যেটা ফরজ সেটা হল কুরআন এবং সুন্নতকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে, তৎকালীন মনীষী বা সাহাবীদের বক্তব্যের সাথে বা মাঝ- হাব-এর বক্তব্যের সাথে তা যতটাই পার্থক্য হোক না কেন তাতে কিছু এসে যায় না।
আবু -উর-রিদার বাড়িতে একদিন সান্ধ্যভোজনের কথাবার্তা চলাকালীন মুহম্মদ-উল-নাজদি এবং কুম থেকে আসা একজন শিয়া মনীষী শেখ জাভেদ এর সাথে নিম্নলিখিত কথা কাটাকাটি উঠে এলঃ
শেখ জাভেদঃ যেহেতু তুমি পোষণ কর যে, আলী একজন মুজতাহিজ ছিলেন, তাহলে তুমি শিয়াদের মতো তাকে অনুসরণ করো না কেন?
মুহম্মদ-উল-নাজদিঃ উমর অথবা অন্য সাহাবীদের সাথে আলীর কোন পার্থক্য নেই। তাঁর বক্তব্যগুলির কোন প্রমাণ স্বরূপ মূল্য নেই, (কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বলতে গেলে বলতে হয়)।
আস-হাব-ই-কিরাম -এর অন্তর্গত যে কোন কারুর দেওয়া বক্তব্যের একটা প্রামাণ্য স্বরূপ মূল্য বিদ্যমান। আমাদের নবী আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলির যে কোন একটিকে অনুসরণ করার জন্য।
শেখ জাভেদঃ যেহেতু আমাদের নবী বলেছেন, আমি হচ্ছি জ্ঞানের শহর, আলী হচ্ছে সেই শহরের দরজা,* তবে এতে কি বোঝা যায় না যে, আলী এবং অন্যান্য সাহাবীদের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে?
মুহম্মদ উল নাজদিঃ যদি আলীর বক্তব্যের একটা প্রামাণ্য স্বরূপ মূল্য থেকে থাকে, তবে কি বলতেন না, আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম কুরআন, সুন্নত এবং আলীকে?
শেখ জাভেদঃ হ্যাঁ, আমরা ধরে নিতে পারি যে, তিনি (নবী) তাই বলেছেন, কারণ একটা হাদীছ -ই-শরীফ এ বর্ণিত হয়েছে যে, আমি রেখে যাচ্ছি (আমি পিছনে) আল্লাহের গ্রন্থ এবং আমরা আহল-ই-বায়েত। আর
তাঁর পরবর্তীতে আলী হলেন, আহল-ই-বায়েত এর সর্বাপেক্ষা মহিমান্বিত সদস্য। নবী এমনটা বলেছেন মুহম্মদ উল নাজদি এটা মেনে নিতে অস্বীকার করল। শেখ জাভেদ বিশ্বাস উৎপাদন করানোর প্রমাণ দিয়ে মুহম্মদ-উল-নাজদির যুক্তিকে খ'ন করতে চাইলেন।
তা সত্ত্বেও মুহম্মদ-উল-নাজদি সেই কথার বিরোধিতা করলেন এবং বললেন, আপনি বললেন যে নবী বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহের গ্রন্থ এবং আমার আহল-ই-বায়েত। তাহলে নবীর সুন্নতের কি হল?
শেখ জাভেদঃ আল্লাহের বার্তাবাহকের কথায় সুন্নত হল,- কোরআনের ব্যাখ্যা। আল্লাহের দূত বলেছেন, আমি তোমাকে দিলাম আল্লাহের গ্রন্থ এবং আমার আহল-ই-বায়েত। 'আল্লাহের গ্রন্থ এই শব্দগুচ্ছ-এর মধ্যেই সুন্নত বিদ্যমান, যেটা হচ্ছে কোরআনের ব্যাখ্যা।
মুহম্মদ- উল - নাজদিঃ আহলে-ই-বায়েত -এর বক্তব্য যদি কোরআনের ব্যাখ্যা হয়ে থাকে, তবে হাদিছ অনুযায়ী এর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
শেখ জাভেদঃ যখন হজরত নবী মারা যান, তখন তাঁর উম্মতরা সিদ্ধান্ত নেন যে কোরআনের উপযুক্ত ব্যাখ্যার
প্রয়োজন আছে, যেটা সময়ের প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে।
হজরত নবী তাঁর উম্মতগণকে কোরআন অনুসরণ করতে বলে গেছেন, এটা এই কারণে যে, কোরআন হচ্ছে মূল গ্রন্থ, আর তাঁর আহল-ই-বায়েতরা, যারা কোরআনকে ব্যাখ্যা করবে এমনভাবে যে তা সময়ের প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে।
আমার এই তর্ক যুদ্ধ খুব ভালো লাগল। মুহম্মদ উল-নাজদি শেখ জাভেদের সম্মুখে নিশ্চল হয়ে গেল, যেন একটা গৃহ চড়াই শিকারির হাতে পড়েছে।
মুহম্মদ উল-নাজদি ছিল এমন একটা যুবক যেমনটা আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। কারণ, বর্তমানকালের মনীষীগণের প্রতি তাঁর অশ্রদ্ধা, এমনকি প্রথম চার খলিফাকেও তার হালকা চোখে দেখা, কুরআন এবং সুন্নতকে বোঝার ব্যাপারে তার স্বাধীন চিন্তাভাবনা ছিল তার সব থেকে দুর্বলতম জায়গা, যার মাধ্যমে তাকে শিকার করা যাবে এবং করায়ত্ত করা যাবে। আহমেদ ইফেন্দি যিনি ইস্তাম্বুলে আমাকে শিক্ষা দিতেন তার থেকে এই অহংকারী যুবকটি কতইনা পৃথক চরিত্রের। তাঁর পূর্বপুরুষদের মত ঐ মনীষীও একটি সুবিশাল পর্বতের কথা মনে করিয়ে দেয়। কোন শক্তিই যেন তাকে নাড়াতে সক্ষম নয়। যেইমাত্র তিনি আবু হানিফার নাম মুখে আনতেন। তিনি উঠে দাঁড়াতেন, চলে যেতেন এবং অজু করে আসতেন। যখনই তিনি বুখারী নামক হাদীস বইটি ধরতেন বা স্মরণ করতেন, তিনি আবার গিয়ে ওজু করতেন। সুন্নিরা এই বইটিকে খুবই বিশ্বাস করে। মুহম্মদ উল নাজদি অপরপক্ষে আবু হানিফাকে খুবই অবজ্ঞার চোখে দেখত, সে বলত, আবু হানিফা যা জানে, আমি তার থেকে অনেক বেশি জানি। সেই সাথে সাথে সে এই মতও পোষণ করত যে বুখারী গ্রন্থের অর্ধেকটাই ভুল।
যখন আমি হেম্ফারের এই সব স্বীকারোক্তি তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করছিলাম আমার মনে পড়ে গেল নিম্নলিখিত ঘটনাঃ-
আমি ছিলাম একটা হাই স্কুলের শিক্ষক। একটা পাঠ চলাকালে আমার ছাত্রদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করল, জনাব, যদি একজন মুসলিম যুদ্ধে নিহত হন, তবে কি তাঁকে শহীদ বলা যাবে? হ্যাঁ, সে হবে শহীদ। আমি বললাম, নবী কি এইরূপ কথা বলেছেন? হ্যাঁ, তিনিই বলেছেন। যদি সে সাগরের জলেও ডুবে মারা যায়, তাহলেও কি সে শহীদ হবে? আমি উত্তর বললাম, হ্যাঁ,। আর এ ক্ষেত্রে সে অনেক বেশি সোয়াব অর্জন করবে। তারপর সে জিজ্ঞাসা করেছিল, যদি সে উড়োজাহাজ থেকে পড়ে যায়, তাহলেও কি সে শহীদ হবে? আমি বললাম, হ্যাঁ তাই হবে, আমাদের নবী কি এই কথাও বলে গেছেন? হ্যাঁ বলে গেছেন, এই কথা শুনে সে সশব্দে বিজয়ীর হাঁসি হাসল এবং বলল, জনাব সেই জমানায় কি উড়ো জাহাজ ছিল? আমি তাকে নিম্নলিখিতভাবে উত্তর দিলামঃ আমার বেটা, আমাদের নবীর ৯৯ টা নাম। প্রতিটি নামই ছিল এক একটি সুন্দর গুণ সমৃদ্ধ। তাঁর একটা নাম ছিল জামি -উল-কালিম। তিনি একটি শব্দ দ্বারা অনেক ঘটনাকে এক সাথে প্রকাশ করতেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেছিলেন, উপর থেকে পড়ে যার মৃত্যু হয়, সে শহীদ হিসাবে পরিগণিত হবে। শিশুটি আমার এই উত্তরকে প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতার সহিত গ্রহণ করল, একইভাবে বলা যায়। কুরআন্ আল-কারীম এবং হাদীস-ই-শরীফ এ আছে অসংখ্য শব্দ, আইন, আদেশ, নিষেধ প্রভৃতি। সেগুলি প্রত্যেকটির বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের মানে হয়। সেই সকল অর্থগুলিকে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে সঠিকভাবে বুঝতে পারা এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে উপযুক্তটিকে প্রয়োগ করাকে বলে ইজতিহাজ। বিস্তৃত ও বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী না হলে ইজতিহাজ পালন করা যায় না। এ কারনেই, সুন্নিরা অজ্ঞ মানুষদের ইজতিহাজ পালন নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। ইজতিহাজ নিষিদ্ধ করার সাথে এটা সম্পর্ক যুক্ত নয়। হিজরী সন চারশত এর শেষের দিকে কোন জ্ঞানী মনীষী এত উচ্চ শিক্ষিত ছিলনা যে তাঁরা একজন প্রকৃত মুজতাহিদের পর্যায়ে উন্নীত হবে।(মুজতাহিদ বলতে সেইরূপ বিস্তৃত জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যে ইজতিহাজ ঠিক ঠিক পালনে সক্ষম) সেই কারণে কেউই ইজতিহাজ পালন করত না, ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ইজতিহাজের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। পৃথিবী ধ্বংসের প্রাক্কালে ঈসা (যীশু) আলাইহি স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন এবং মেহেদি (প্রত্যাশিত ইসলামিক নায়ক) প্রকাশিত হবেন, এরাই ইজতিহাজ পালন করবেন।
আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পরে মুসলিমরা তিয়াত্তরটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়বে। শুধুমাত্র একটা গোষ্ঠীই জান্নাতবাসী হবে। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল কারা হবে সেই গোষ্ঠীভুক্ত, তিনি উত্তরে জানালেন, যারা তাদের অন্তর আমার উপর এবং আমার সাহাবীদের উপর রুজু রাখবে। অপর একটি হাদিস- ই -শরীফে তিনি বলেছেন, আমার সাহাবীরা হচ্ছে হচ্ছে জান্নাতি নক্ষত্রের মত, তোমরা তাদের যে কোন কাউকে অনুসরণ করলেই হিদায়েত প্রাপ্ত হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, তিনি বলেছেন, তোমরা জান্নাতের পথ প্রাপ্ত হবে*। ইয়েমেনের এক ইহুদী, আবদুল্লাহ বিন সাবা যার নাম, সে মুসলিমদের মধ্যে যারা 'আস-হাব' তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক কাজে উস্কানি দিত। ঐ সমস্ত অজ্ঞ লোকেরা যারা ঐ ইহুদীকে বিশ্বাস করত এবং আস-হাবদের বিরুদ্ধে শত্রুতার মনোভাব পোষণ করত, তাদের বলা হত শিয়া। আর যে সকল ব্যক্তি হাদীস -শরীফ মেনে চলত এবং আস-হাব-ই-কিরামকে ভালোবাসত এবং অনুসরণ করত তাদের বলা হত সুন্নি।
আমি নজদের মুহম্মদ-বিন-আবু-উল-ওয়াহাব এর সাথে অন্তরঙ্গ সখ্যতা স্থাপন করলাম, আমি সব জায়গাতেই, যেখানে সে উপস্থিত থাকত, তার প্রশংসা করতে শুরু করলাম। একদিন আমি তাকে বললামঃ তুমি আলী আর উমরের থেকেও অনেক বেশি মহিমান্বিত। যদি নবী আজও থাকতেন, তবে তিনি ওদেরকে বাদ দিয়ে তোমাকেই খলিফা করতেন। আমার প্রত্যাশা যে, তোমার হাত দিয়ে ইসলাম নব নব গুণে গুণান্বিত হত। তুমি হচ্ছ একমাত্র মনীষী যে ইসলামকে প্রচারিত করবে সারা দুনিয়া ব্যাপী।
আব্দুল-ওয়াহাবের পুত্র মুহম্মদ এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা কোরআনকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করব, এই ব্যাখ্যাগুলিতে শুধুমাত্র আমাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনাই প্রতিফলিত হবে এবং এগুলি হবে সাহাবা, মাজহাবের ইমামগণ এবং মুফাসসির (উচ্চ শিক্ষিত মনীষী যারা কুরআনের বিশেষজ্ঞকারী) গণের দেওয়া ব্যাখ্যার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। আমরা কুরআন পাঠ করছিলাম এবং কয়েকটি আয়াত নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই সকল কর্মে তাকে জড়িয়ে দিয়ে তাকে ভুল পথে পরিচালিত করা। অন্ততপক্ষে সে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে একজন বৈপ্লবিক মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে, আর তাই খুব সহজেই আমার মতামত এবং চিন্তাভাবনাকে মহানন্দে গ্রহণ করবে। তা সে এমনভাবে করবে যে, আমি যেন তার উপর আরও অনেক বেশি করে আস্থা স্থাপন করতে পারি। একদিন সুযোগ বুঝে আমি তাকে বললাম, জিহাদ (ইসলামের জন্য সংগ্রাম) ফরজ হতে পারে না।
সে প্রতিবাদ করল, আল্লাহর নির্দেশ সত্ত্বেও কেন এটা ফরজ হবেনা, যে ক্ষেত্রে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই কর?
আমি বললাম, তাহলে কেন নবী মুনাফেকদের বিরুদ্ধে ইসলামের জন্য লড়াই কর।(অপরপক্ষে, সাওয়াহির লাডুনিয়া গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সাতাশ (২৭) টি জিহাদ সংঘটিত হয়েছে। তাঁদের সেইসব তলোয়ার আজও ইস্তাম্বুলের মিউজিয়ামে রাখা আছে। মুনাফেকরা সেই সময় মুসলমান হওয়ার ভান করত। সেই সময় এই মুনাফেকরা মসজিদ-ই-নববীতে আল্লাহর দূতের সাথে নামাজ আদায় করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সকলকেই চিনতেন। তথাপি তিনি তাদের কাউকে কিছু বলতেন না, তুমি একটা মুনাফিক, যদি তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন এবং তাদের হত্যা করতেন, লোকে বলত, মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবার বিশ্বাসী মানুষদের হত্যা করতে শুরু করেছেন, সুতরাং, তিনি তাদের বিরুদ্ধে মৌখিক জিহাদ করলেন, অতঃপর; শরীরের সাথে ধন-সম্পদের সাথে এমনকি মৌখিক কথাবার্তা বলাতেও জেহাদ ফরজ হল। আয়াত-ই-কারীমাতে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদ সংঘটিত করার নির্দেশ লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু কি ধরনের জিহাদ সংঘটিত করতে হবে তা বর্ণিত হয়নি। কারণ, অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদ অবশ্যই সংগঠিত করতে হবে লড়াইয়ের মাধ্যমে এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ সংঘটিত করতে হবে ধর্মালোচনা এবং উপদেশ দানের মাধ্যমে। আয়াত-ই-কারীমাতে এই ধরনের জিহাদেরই নিদর্শন মেলে।
সে বলল, নবী তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন তাঁর বক্তব্য দানের মাধ্যমে।
আমি বললাম, জিহাদ যেটাকে বলা হচ্ছে ফরজ (নির্দেশিত), সেটা কি এমন একটা জিনিস যেটা সংঘটিত হতে পারে শুধুমাত্র কারুর বক্তব্যদানের মাধ্যমে? সে বলল, রাসূলুল্লাহ্ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আমি বললাম, নবী অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কারণ, অবিশ্বাসীরা বারংবার তাকে হত্যা করতে চেয়েছে।
সে এবার সদর্থক মাথা নাড়ল।
অন্য এক সময় আমি আমি তাকে বলেছিলাম, মুতা নিকাহ্ অনুমোদনযোগ্য বা স্বীকৃতিযোগ্য। সে প্রতিবাদ করল, না, এটা মোটেই হতে পারে না।
আমি বললাম, আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, তুমি তাদের যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছ তার পরিবর্তে তাদের পূর্ব হতে ধার্য্য মেহের দাও।
সে বলল, উমর দুই ধরনের মুতা প্রথাকে নিষিদ্ধ করে ছিলেন যেগুলি তাঁর সময়ে প্রচলিত ছিল এবং বলেছিলেন যারা এই প্রথা চালাবে তাদের শাস্তি পেতে হবে।
আমি বললাম, দুই ধরনের কথা বলছ, একবার বলছ তুমি উমরেরও উর্দ্ধে আবার তাকেই অনুসরণ করছ। তার উপর 'উমর বলেছেন তিনি এটাকে নিষিদ্ধ করেছেন যদিও তিনি জানতেন যে নবী এটাকে অনুমোদন দিয়েছেন। কেন তুমি নবীর বক্তব্যকে দূরে সরিয়ে উমরের বক্তব্যকে পালন করছ।
সে কোন উত্তর দিল না। আমি বুঝলাম যে তার যথেষ্ট বিশ্বাস এসেছে।
আমি অনুভব করলাম যে মুহম্মদ উল-নাজদি এই মুহূর্তে নারী কামনায় মগ্ন; সে ছিল অবিবাহিত। আমি তাকে বললাম, তাদের নিয়ে আমাদের সময়গুলো বেশ ভালোই কাটবে। সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। এটা ছিল আমার নিকট একটি মারাত্মক সুযোগ। তাই তাকে আমি কথা দিলাম যে আমি তার জন্য একটা নারীর সন্ধান করব, যাকে নিয়ে সে আনন্দে দিন কাটাবে। আমার লক্ষ্য ছিল মানুষজন সম্পর্কে তার যে ভীরুতা ছিল সেটাকে কাটিয়ে ফেলা। কিন্তু সে একটা শর্ত রাখল যে, ব্যাপারটা আমাদের দুজনের মধ্যেই গোপন থাকবে এবং এমনকি মেয়েটিকে তার প্রকৃত নাম কি সেটাও জানানো হবে না। আমি দ্রুত চলে গেলাম সেই খ্রীষ্টান নারীদের বাড়িতে যাদের ঔপনিবেশিক মন্ত্রক প্রেরণ করেছে এখানকার যুবকদের ব্যভিচারে প্রলুব্ধ করার কাজে। আমি তাদের একজনের সাথে পুরো ব্যাপারটা আলোচনা করলাম। সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল, তাই আমি তার একটা ছদ্মনাম দিলাম, 'সাফিয়া'। আমি মুহম্মদ-উল-নাজদিকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলাম। সাফিয়া বাড়িতে একা ছিল। আমরা এক সপ্তাহের জন্য বিবাহ সম্পর্কিত চুক্তি সারলাম মুহম্মদ-উল-নাজদির জন্য, যে মোহর এর বদলে সোনা দিল ঐ রমনীকে। এইভাবে আমরা মুহম্মদ-উল-নাজদিকে ভুল পথে পরিচালিত করতে শুরু করলাম। সাফিয়া ভেতর থেকে, আমি বাইরে থেকে।
মুহম্মদ উল-নাজদি এখন সম্পূর্নরূপে সাফিয়ার করায়ত্ত। তাছাড়া, ইজতিহাজ থেকে মুক্ত এবং সমস্ত চিন্তাভাবনা হতে মুক্ত হওয়ার অজুহাতে সে এখন শরিয়তের নির্দেশ লঙ্ঘন করার আনন্দের স্বাধ পেয়ে গেছে।
মুতা নিকাহ্ (সাময়িক বিবাহ) -এর তৃতীয় দিনে তার সাথে দীর্ঘক্ষণ আমার কথা কাটাকাটি হল এই বিষয় নিয়ে যে 'মদ' হারাম (ইসলামে নিষিদ্ধ) নয়। যদিও সে উল্লেখ করল অনেক আয়াত ও হাদীস; এটা দেখানোর জন্য যে মদ্য পান হারাম, আমি সেগুলির সবই প্রত্যাখান করে দিলাম এবং শেষ পর্যন্ত বললাম, এটা সত্য যে এজিদ, উমাইয়া এবং আব্বাসি প্রভৃতি খলিফারা মদ্যপান করতেন। তারা সকলেই কি দুষ্কৃতকারী আর তোমরাই হচ্ছ একমাত্র সৎ পথে অবিচল ব্যক্তি? তারা নিঃসন্দেহে কুরআন এবং সুন্নতকে অনেক ভালোভাবে অনেক বেশি জানতেন যা তুমি জানো তার অপেক্ষা। তারা কুরআন এবং সুন্নত থেকেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, মদ্যপান মাকরুহ অর্থাৎ মদ্যপানে কোন অসুবিধা নেই, ইহা হারাম নয়। এছাড়া ইহুদী এবং খ্রীষ্টান গ্রন্থগুলিতে লিপিবদ্ধ আছে যে, মদ্যপান মুবাহ্ (মকরু)। সমস্ত ধর্মই আল্লাহ্ এর নির্দেশ বহনকারী। বাস্তবিকই একটি বর্ণনা অনুযায়ী, 'একটি আয়াত 'তোমাদের সকলের মদ্যপান ত্যাগ করতে হবে, তোমরা কি তাই করবে না' আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উমর মদ্যপান করতেন।* যদি এটা হারাম হত, নবী তাকে গুরুতর শাস্তি প্রদান করতেন। যেহেতু নবী তাকে করেননি, মদ্যপান হালাল বা বৈধ। (বাস্তবিক পক্ষে উমর রাজি আল্লাহ্ তায়ালা আনহু মদ্যপান করতেন ইহা হারাম বা অবৈধ ঘোষণা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। ইহা নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর তিনি কখনো মদ্যপান করেননি। যদি উমাইয়া বা আব্বাস ঘরানা থেকে বেরিয়ে আসা খলিফারা মদ্যপান করে থাকেন, এতে এটা প্রকাশিত হয় না যে মদ্যপানে কোন প্রকার পাপ নেই বা মদ্যপান মাকরুহ। এতে এটাই প্রকাশিত হবে যে তারা পাপী আর তারা হারাম কার্য করেছে। কারণ ঐ গুপ্তচর কর্তৃক উল্লিখিত আয়াত-ই-কারীমা, অন্যান্য আয়াত-ই-কারীমা এবং হাদীস শরীফ বর্ণনা অনুযায়ী মদ জাতীয় তরল পান হারাম। এটা রিয়াদ-ই-নাসিহিন এ উল্লেখিত হয়েছে, প্রথম দিকে মদ্যপান অনুমোদিত ছিল। হজরত উমর, সাদ ইবনে ওয়াক্কাস এবং আরও কয়েকজন সাহাবী মদ্যপান করতেন। পরে সুরা বাকারার ২১৯ (দুইশত উনিশ) নম্বর আয়াতে ঘোষণা করা হয় যে এটা একটা ভয়ানক পাপ কার্য। এর পর সুরা নিসা এর ৪২ (বিয়াল্লিশ) নম্বর আয়াতে এর উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সেখানে ঘোষণা করা হয় যে, মদ্যপান করলে বা মাতাল অবস্থায় নামাজ আদায়ে দাঁড়াবে না। অবশেষে সুরা সাইদা এর ৯৩ (তিরানব্বই) সংখ্যক আয়াতে অবতীর্ণ হল যে, মদ্যপান হারাম। হাদীস শরীফে এইভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, যদি কোন কিছু অধিক পরিমাণ গ্রহন আমাদেরকে নেশাগ্রস্ত করে, সেটা সামান্য পরিমাণ গ্রহনও হারাম হিসাবে গণ্য করা হয়। আর মদপান হল ভয়ানকতম পাপ। এবং মদ্যপান করে এমন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করো না। তার শবযাত্রায় ও অংশগ্রহণ করো না (যখন সে মারা যাবে)। তার সাথে কোন বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করো না। এবং মদ্যপান করা মূর্তিপূজার সমগোত্রীয় অথবা আল্লাহ্ তায়ালা তাহাদিগকে অভিশপ্ত করবেন যারা মদ্যপান করে এটা বিক্রয় করে, এটা তৈরী করে অথবা এটা দেয়।
মুহম্মদ উল-নাজদি বলল, কিছু বর্ণনা অনুযায়ী, উমর মদ্যজাতীয় জিনিস পান করতেন জলের সাথে মিশিয়ে এবং বলতেন যদি কোন কিছু নেশাগ্রস্ত না করে, তবে সেটি হারাম নয়। উমর এর মতামত সঠিক, কারণ এটা কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে যে, শয়তান তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ উৎপাদন করতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহ এর জিকর ও নামাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় মদ্যপান এবং জুয়ার মাধ্যমে। তোমরা এই মুহূর্তে সেগুলি পরিত্যাগ কর। মদ্যপান ঐ আয়াতে বর্ণিত পাপ ঘটাবে না যদি এটা নেশাগ্রস্ত না করে তোলে। সুতরাং মদ্যপান হারাম নয় যখন সেগুলির কোন নেশাগ্রস্ত প্রভাব না পড়ে।
আমি সাফিয়াকে ঐ বিতর্কের বিষয়ে বললাম যা ছিল মদ্যপান সম্পর্কিত এবং তাকে পরামর্শ দিলাম যেন তাকে খুব কড়া প্রকৃতির মদ খাওয়ায়। পরে সে বলেছিল তুমি যেমনটা বলেছ আমি তাই করেছি, আর তাকে মদ খাইয়েছি। সে নাচতে লাগল এবং আমার সাথে সঙ্গম করল বারবার ঐ রাত্রে। সেই থেকে সাফিয়া আর আমি মুহম্মদ-উল-নাজদিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে বা কবজার মধ্যে নিয়ে চলে এলাম।
আমাদের বিদায়ের সময় ঔপনিবেশিক মন্ত্রনাগারের মন্ত্রী আমায় বললেন, আমরা স্পেনকে করায়ত্ত করেছি অবিশ্বাসীদের হাত থেকে (তিনি অবিশ্বাসী বলতে মুসলমানগণকে বোঝাতে চেয়েছেন) মদ্য এবং যৌন ব্যভিচারের মাধ্যমে। এস আমরা আমাদের পুরাতন উপনিবেশগুলি একে একে পুনরায় করায়ত্ত করে নেব এই দুটো ভয়ানক অস্ত্রকে ব্যবহার করে। এখন আমি বুঝতে পারছি এই বক্তব্য কতখানি সত্য ছিল।
একদিন আমি রোজাকে মুহম্মদ-উল-নাজদির কাছে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসাবে তুলে ধরলামঃ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, তোমার জন্য তোমার রোজা ভীষণই উপকারী। এটা বলা হয়নি যে রোজা ফরজ (অবশ্য পালনীয় উপকারী কর্তব্য)। তাহলে রোজা হল সুন্নত, ফরজ নয়, এই ইসলাম ধর্মে। সে প্রতিবাদ করল এবং বলল, তুমি কি আমাকে আমার ঈমান থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছ। আমি প্রত্যুত্তরে বললাম,
কারুর ঈমান তার অন্তরের পবিত্রতার উপর নির্ভর করে। তার আত্মার উদ্ধার করনের অন্যের জন্য অধিকারের উপর মাত্রা লঙ্ঘন করার মাধ্যমে নয়। নবী কি এটা উপস্থাপন করেননি, 'বিশ্বাসই হল ভালোবাসা'? কুরআন আল কারীমে আল্লাহ কি ঘোষণা করেননি, যতক্ষণ না তোমার মধ্যে ইয়াক্বিন আসছে ততক্ষণ তোমার রব (আল্লাহ) এর প্রতি তোমার পূজা সংঘটিত হবে না? তারপর যখন কেউ আল্লাহ্ এর প্রতি এবং শেষ বিচারের দিনের প্রতি ইয়াক্বিন সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে এবং তার অন্তর এবং কর্মকে পবিত্র করে ফেলে, সে তখন হয়ে ওঠে মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী। সে আমার এই সকল কথার উত্তরে তার মাথা নাড়ল।
একদিন আমি তাকে বললাম, নামাজ ফরজ নয় কীভাবে এটা ফরজ না হতে পারে? আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেছেন, 'আমাকে স্মরণ করার জন্য নামাজ পড়,' তাহলে লক্ষ হল আল্লাহকে স্মরণ করা, সুতরাং তুমি নামাজ আদায় না করেও আল্লাহকে যথেষ্ট ভালোভাবে স্মরণ করতে পারো।
সে বলল, হ্যাঁ, আমি শুনেছি যে কিছু মানুষ নামাজ আদায় করার বদলে শুধু আল্লাহ এর জিকর করে। তার এই বক্তব্যে আমি খুব সন্তুষ্ট হলাম। আমি আপ্রান চেষ্টা করতে লাগলাম তার এই সব ধারণা বা বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করার এবং তার অন্তরকে গ্রাস করার। তারপর আমি লক্ষ্য করতে লাগলাম যে সে নামাজের প্রতি আর বেশি একটা গুরুত্ব দেয় না আর নামাজ পড়ে হঠাৎ করে বা মাঝে মধ্যে। বিশেষ করে সে বেশি অবহেলা করত ভোরের নামাজকে। কারণ, তাকে আমি শুতে যাওয়ার পূর্বে আটকে রেখে দিতাম মধ্যরাত্রি পর্যন্ত তার সাথে আলাপ আলোচনা করে কাটিয়ে। ফলে সে সকালের নামাজের জন্য ওঠার ব্যাপারে খুবই ক্লান্ত অনুভব করত।
আমি মুহম্মদ-উল-নাজদির কাঁধ থেকে ধীরে ধীরে তার বিশ্বাসের চাদর টেনে নামাতে শুরু করলাম। একদিন আমি তার সাথে নবীর সম্পর্কেও তর্কে নিয়োজিত হতে চাইলাম। এখন থেকে, যদি তুমি এই বিশেষ বিষয়টি নিয়ে আমার সাথে আর কোন কথা বল, আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হবে এবং আমি তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব চিরকালের মতো ছিন্ন করবো। এই ঘটনার পরে, আমি নবীকে নিয়ে কোন কথা তোলা পরিত্যাগ করলাম আমার এতদিনের সমস্ত প্রচেষ্টা এক মুহুর্তে সমূলে নষ্ট হওয়ার ভয়ে।
আমি তাকে উপদেশ দিলাম এমন একটি জীবনধারা গঠনের জন্য যা হবে শিয়া এবং সুন্নিদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সে আমার এই প্রস্তাবটা সমর্থন করল, কারন সে ছিল একটা বড়ই অহংকারী ব্যক্তি। আমি যে শেষ পর্যন্ত তাকে ফাঁসির দড়ি পরাতে পারলাম, এর জন্য সাফিয়াকে ধন্যবাদ।
আরেকদিন সুযোগ বুঝে আমি বললাম, আমি শুনেছি যে নবী তার আসহাবদের সাথে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে আবদ্ধ হতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা কি সত্য? তার সদর্থক উত্তর পেয়ে আমি জানতে চাইলাম এই ইসলামিক আইনটি অস্থায়ী না চিরস্থায়ী। সে বর্ণনা করল, এটা চিরস্থায়ী, কারণ নবী মুহম্মদের জবান থেকে নির্গত হালাল, পৃথিবী ধ্বংসের দিন পর্যন্ত হালাল এবং তার মুখ থেকে নির্গত হারাম পৃথিবী ধ্বংসের দিন পর্যন্তই হারামই থাকবে। তখন আমি তাকে আমার ভ্রাতা হওয়ার জন্য আহ্বান জানালাম। সেই দিন থেকে আমরা হলাম ভাই।
সেই দিন থেকে আমি কখনো তাকে একা থাকতে দিইনি। সে যখন বেড়াতে যেত তখনও আমি তার সাথে থাকতাম। সে ছিল আমার নিকট ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমার যৌবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়গুলিকে ব্যয় করে, আমি যে গাছটি রোপণ করেছি ও বড় করে তুলেছি, সেটিই এখন ফল উৎপাদন করতে শুরু করেছে।
আমি লন্ডনের ঔপনিবেশিক মন্ত্রনাগারে মাসিক প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে পাঠাচ্ছিলাম, আর আমি যে সব উত্তর পাচ্ছিলাম সেগুলি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক এবং অভয়প্রদানকারী এবং ভরসাপ্রদ। মুহম্মদ উল-নাজদির জন্য যে পথ আমি তৈরী করেছি, সে পথই সে মহানন্দে অনুসরণ করে চলেছে।
আমার কর্তব্য ছিল তাকে পর নির্ভরতামুক্ত, স্বাধীন এবং সন্দেহপ্রবনতা বা অবিশ্বাসের রঙে রঞ্জিত করা। আমি সর্বদায় তার প্রশংসা করতাম, এই বলে যে এক সুবিশাল ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তার জন্য অপেক্ষা করছে। একদিন আমি এক কৃত্রিম স্বপ্ন রচনা করলাম গত রাত্রে আমি আমাদের নবীকে স্বপ্নে দর্শন করেছি। আমি হোজাদের কাছ থেকে তার যে সকল গুণ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলাম তিনি ছিলেন সম্পূর্নরূপে সেই সকল গুণাবলীযুক্ত। এবং ঐ সকল গুণকীর্তন করে আমি তাকে সম্বোধন করলাম। তিনি একটি মঞ্চের উপর বসেছিলেন। তাঁকে ঘিরে আছেন অনেক জ্ঞানী মনীষী যাঁদের আমি চিনিনা। এরপরে সেখানে তুমি প্রবেশ করলে। তোমার মুখমন্ডল জ্যোতির্বলয়ের মত উজ্জ্বল। তুমি নবীর সম্মুখ এগিয়ে গেলে, আর যখন তুমি একেবারে নিকটে গেলে নবী উঠে দাঁড়ালেন এবং তোমার দুই চক্ষুর মাঝে চুম্বন করলেন। তিনি বললেন, 'তুমি আমারই নাম যুক্ত, আমার জ্ঞানের উত্তরাধিকারী, ধর্মীয় এবং পার্থিব সমস্ত ব্যাপারে আমারই প্রতিনিধি, আমার সহকারী।' তুমি বললে, 'হে আল্লাহ এর বার্তাবাহক! আমি মানুষের নিকট আমার জ্ঞানের ব্যাখ্যা করতে শঙ্কিত হচ্ছি। 'তুমি মহত্তম, ভয় পেওনা,') উত্তরে নবী জানালেন।
মুহম্মদ বিন আবু-উল-ওয়াহাব আনন্দে পাগলপারা হয়ে গেল যখন সে শুনল এই স্বপ্নের কথা। সে আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল যে, আমি তাকে যা বলেছি সেটা সত্যি কিনা। আর প্রতিবারই আমি তাকে উত্তরে জানিয়েছি যে, হ্যাঁ তা সত্য। শেষ পর্যন্ত সে নিশ্চিত হল যে আমি যা বলেছি সেটা সত্যি। আমার মনে হয়, সেই দিন থেকেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে ধারণাগুলি দ্বারা আমি তাকে সিক্ত ও রাঙিয়ে তুলেছিলাম, সেগুলিকে প্রচার করতে এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করতে।
দ্বিতীয় পর্ব
পঞ্চম অধ্যায়
হেম্ফার বলতে লাগলঃ-
সেই সকল দিনগুলিতে একদিন যখন মুহম্মদ উল নাজদি আর আমি খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠলাম। আমি লন্ডন থেকে একটি বার্তা পেলাম যাতে বলা হল আমাকে কারবালা ও নাজাফ শহরে গিয়ে ঘাঁটি গাঁড়ার জন্যে, সেগুলি জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে শিয়াদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান। তাই আমাকে মুহম্মদ-উল-নাজদির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হল এবং বাসরা ছাড়তে হল। কিন্তু সন্তুষ্ট অনুভব করলাম কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এই অজ্ঞ এবং নৈতিক দিক থেকে অধঃপাতে যাওয়া লোকটি একটি নতুন গোষ্ঠী তৈরীর ব্যাপারে এগিয়ে চলেছে, পরিবর্তে যা ইসলামকে ভিতর থেকে বিনষ্ট করে দেবে, আর আমিই হলাম এই নতুন গোষ্ঠীর মহাগুপ্ত মতবাদগুলির গুপ্ত রচয়িতা। সুন্নিদের চতুর্থ খলিফা আলী এবং শিয়ামতে যিনি প্রথম খলিফা তাঁর মাজার আছে নাজফে। কুফা নগর, যেটা নাজাফ থেকে এক ফেরসা বা এক ঘন্টার হাঁটা পথের দূরত্বে অবস্থিত, ছিল আলীর শাসনাধীন অঞ্চলের রাজধানী। যখন আলীকে হত্যা করা হয়, তাঁর পুত্ররা হাসান এবং হুসেন তাঁকে কবরস্থ করেন কুফার বাইরে এক স্থানে, যার বর্তমান নাম নাজাফ। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে নাজাফ ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল, আর কুফা ক্রমশ ধ্বংস হতে লাগল। ধার্মিক শিয়ারা নাজাফে ক্রমে সমবেত হতে লাগল। অট্টালিকা, বাজার, মাদ্রাসা (ইসলামিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়) নির্মিত হতে লাগল।
ইস্তাম্বুলের খলিফা তাদের প্রতি খুবই করুনা পরবশ ছিলেন নিম্নলিখিত কারণগুলির জন্যঃ-
১। ইরানের শিক্ষা, প্রশাসন শিয়াদের সমর্থন করতে লাগল। তাই তাদের কাজে খলিফার হস্তক্ষেপ উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে দেশে দেশে এবং যার ফলে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।
২। নাজাফের অধিবাসীদের মধ্যে অনেক সশস্ত্র উপজাতি আছে যারা শিয়াদের সমর্থন করে। যদিও তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও সংগঠনের ব্যাপারে তেমন কোন গুরুত্ব নেই, তথাপি তাদের সঙ্গে সমস্যা সৃষ্টির ব্যাপারে ঝুঁকি নেওয়াটা খলিফার পক্ষে জ্ঞানহীনের মত কাজ হবে।
৩। সারা পৃথিবীর শিয়াদের উপর নাজাফের শিয়াদের কর্তৃত্ব আছে। বিশেষ করে আফ্রিকা ও ভারতে। যদি খলিফা তাদের বিরক্ত করে, সমস্ত শিয়ারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। হুসেন বিন আলী, নবীর নাতি অর্থাৎ তাঁর কন্যা ফাতেমার পুত্র কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। ইরাকবাসী মদিনাতে অবস্থিত হুসেনের সাথে দেখা করে এবং তাঁকে নিমন্ত্রণ করে তাঁকে তাদের খলিফা হিসাবে নির্বাচিত করার জন্য। হুসেন ও তাঁর পরিবার যখন কারবালার প্রান্তরে উপনীত হলেন তখন ইরাকিরা তাদের আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ করল এবং তারা ইয়াজিদ বিন মাবিয়ার পাঠানো নির্দেশে কর্মে সচেষ্ট হল, যে হচ্ছে দামাস্কাতে বসবাসকারী উমাইয়া বংশজাত খলিফা, তারা তাঁকে বন্দী করার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে এল। হুসেন ও তাঁর পরিবার ঐ ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করল। তাঁদের মৃত্যুর সাথে সাথে এই সংগ্রাম সমাপ্ত হল, এইভাবে ইরাকি বাহিনী হল বিজয়ীপক্ষ। সেই দিন থেকে শিয়ারা কারবালাকে করল তাদের তীর্থস্থান। সারা পৃথিবী থেকে এত শিয়ারা এখানে এসে সমবেত হয় যে, আমাদের খ্রীষ্টানধর্ম এটাকে পছন্দের দৃষ্টিতে দেখে না।
কারবালা, একটা শিয়া শহর। যেখানে আছে অসংখ্য শিয়া মাদ্রাসা। এই শহরটি আর নাজাফ পরস্পরের পরিপূরক। এই দুই শহরে ঢোকার নির্দেশ গ্রহণ করে, আমি বসরা ছেড়ে বাগদান এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম এবং সেখান থেকে গেলাম ইউফ্রেটিস নদী তীরে গড়ে ওঠা হুল্লা শহরে।
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী এসেছে তুর্কী থেকে, ইরাকের মধ্য দিয়ে হয়েছে বিস্তৃত এবং পারস্য উপসাগরে এসে পড়েছে। ইরাকের কৃষি এবং সমৃদ্ধি এই দুটি নদীকে কেন্দ্র করেই।
যখন আমি লন্ডনে ফিরলাম। আমি ঔপনিবেশিক মন্ত্রনাগারকে প্রস্তাব দিলাম যে এই দুই নদী বিরোধ অঞ্চলের পরিবর্তনের জন্য এমন একটা প্রোজেক্ট করতে, যাতে ইরাক আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে। যখন ইরাকের জলের পরিমাণ কমে যাবে, ইরাককে আমাদের দাবি মেনে নিতে হবে।
আমি আজারবাইজানি ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে হুল্লা থেকে নাজাফে প্রবেশ করলাম। শিয়া ধর্মের লোকদের সাথে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করলাম এবং তাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে লাগলাম। আমি তাদের ধর্মীয় নির্দেশাবলী যেখানে থেকে পরিচালিত হয় সেই কেন্দ্রে যোগ দিলাম। আমি দেখলাম তারা সুন্নিদের মতো বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করে না, অথবা সুন্নিদের মতো সুন্দর নৈতিক গুণাবলীর অধিকারীও নয়। উদাহরণস্বরূপঃ-
১) তারা ভীষণভাবে অটোমান সরকার বিদ্বেষী, কারণ তারা শিয়া আর তুর্কীরা হল সুন্নী। তাঁদের মতে সুন্নীরা অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত।
২) শিয়া মনীষীরা ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় শিক্ষায় লিপ্ত এবং পার্থিব জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে তাদের কোন উৎসাহই দেখা যেতনা ঠিক যেমন এক সময় আমাদের ইতিহাসে দেখা যায় পুরোহিতরা একটা সময় গতিহীন করে দিয়েছিল।
৩) তারা ছিল যথেষ্ট অসচেতন। ইসলামের গুরুত্ব সম্পর্কে বা পরম মহিমান্বিত চরিত্রগুলি সম্পর্কে এবং বর্তমান সময়ের বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না।
আমি মনে মনে বললামঃ এই শিয়ারা কি ভয়ানক লোকরে বাবা। যখন সারা পৃথিবী জাগ্রত থাকে তাদের সকলকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, বারবার আমি তাদের খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য প্রলুব্ধ করতে লাগলাম। দুর্ভাগ্যবশতঃ কেউ আমার কথা শুনলই না কেউ কেউ আমাকে এমন বিদ্রুপ করতে লাগল, যেন আমি তাদের পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলেছি। কারণ তারা খলিফাকে মনে করত এমন এক সামরিক ঘাঁটি, যা দখল করা অসম্ভব। তাদের মতে পূর্ব বর্ণিত "মেহদি" আবির্ভূত হয়ে তাদের একদিন খলিফার কথা থেকে মুক্ত করবে।
তাদের মতে মেহেদি হচ্ছে তাদের ১২ তম ইমাম, যিনি ছিলেন ইসলামে নবীর বংশধর। যিনি হিজরি সন ২৫৫ (দুই শত পঞ্চান্ন) তে অদৃশ্য হন। তাদের বিশ্বাস তিনি আজও জীবিত এবং একদিন প্রকাশিত হবেন এবং এই পৃথিবীর নির্মম ব্যভিচার এবং অধর্মের হাত থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করবেন এবং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা করবেন।
ইহা হতাশ জনক! শিয়ারা কীভাবে এইসব অন্ধ বিশ্বাস মেনে নিল। এটা ঠিক ঐ অন্ধ মতবাদটির মতো, "যীশুখ্রীষ্ঠ আবার ফিরে আসবেন এবং পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন," আমাদের খ্রীষ্টানরা যেটাকে বুকে বেঁধে রেখেছে।
একদিন আমি তাদের একজনকে বললাম " এটা কি তোমাদের জন্য ফরজ নয় যে ইসলামের নবী যেটা করেছেন ঠিক সেইভাবে অবিচারকে প্রতিরোধ করা? "সে উত্তরে বললঃ" তিনি অবিচারের প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন কারণ আল্লাহ তাঁর সহযোগিতা করেছিল। "কুর-আনে লিপিবদ্ধ আছে যে, যদি তুমি আল্লাহ এর মনোনীত ধর্মকে সহযোগিতা কর, তুমি একটা ব্যবসায়ী, এগুলি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার। তুমি এগুলি বুঝবে না।"
আলীর সমাধিসৌধ আমির-উল-মোমেনিন অসাধারণ সুন্দরভাবে সুসজ্জিত। এখানে আছে এক অসাধারণ সুন্দর প্রাঙ্গন, একটি সোনায় আচ্ছাদিত কবর এবং দুটি দীর্ঘ মিনার। প্রত্যেকদিন প্রচুর সংখ্যক শিয়া এই সমাধিসৌধ দর্শনে আসত। তারা এখানে জমাতে নামাজ আদায় করত। দর্শক এর চৌহদ্দির গায়ে অবনত হয়ে চুম্বন করত তারপর মাজার জিয়ারত করত। তারা অনুমতি প্রার্থনা করে তারপর ভিতরে প্রবেশ করত। সমাধিসৌধ ছিল এক বিস্তৃত প্রাঙ্গন যেখানে ছিল অসংখ্য কক্ষ ধার্মিক মানুষদের জন্য এবং দর্শকদের জন্য।
আলীর সমাধিসৌধের ন্যায় আরও দুটি সমাধিসৌধ কারবালায় ছিল। সেগুলির একটা হুসেনের এবং অপরটি তার ভ্রাতা আব্বাসের, যিনি তাঁর সাথেই কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। নাজাফে শিয়ারা যে সব কাজ করত, কারবালায় সমাধিসৌধেও তারা একই কাজ করত। নাজাফের তুলনায় কারবালার আবহাওয়া ছিল অনেক বেশি ভালো। এর চারিদিকে ছিল সুন্দর সুন্দর ফলের বাগান আর অসাধারণ সুন্দর নির্ঝরিনী।
আমার ইরাক মিশনের সময় একদিন আমি এক দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম যেটা আমার অন্তরে স্বস্তি এনে দিল। কিছু ঘটনা যেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের ধ্বংসের কথা ঘোষণা করল। সেখানে ইস্তাম্বুলের প্রশাসন কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসক ছিল একজন অশিক্ষিত ও ক্রুব্ধ লোক। সে যা মন চাইত তাই করত। লোকেরা তাকে পছন্দ করত না। সুন্নিরা অস্বস্তিবোধ করত কারণ প্রশাসক তাদের স্বাধীনতা খর্ব করেছে এবং তাদের কোনরকম মূল্য দিত না। আর শিয়ারা রেখেছিল, কারণ প্রশাসক ছিল একজন তুর্কী অথচ সেখানে ছিল অনেক সৈয়দ ও শরীফ নবীর বংশধর যারা হতে পারত অনেক বেশি উপযুক্ত ও পছন্দের প্রশাসক হিসাবে।
শিয়ারা তখন একবারেই শোকে দুঃখে ব্যাকুল অবস্থায়। তারা একটি জীর্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত পরিবেশে জীবনযাপন করছে। রাস্তাগুলি নিরাপদ ছিল না। সৈন্য সামন্ত না থাকলে, রাজপথে দস্যুরা যখন তখন মরুযাত্রীদলদের থামাত ও আক্রমণ করত।
এই কারণে মরুযাত্রীর দলদের অপেক্ষায় থাকতে হত, যতক্ষন না সরকার তাদের সাথে সৈন্য সামন্ত পাঠাচ্ছে। শিয়া উপজাতি একে অপরের সাথে ভয়ানক যুদ্ধপরায়ন। তারা রোজই একে অপরের সাথে লুটপাট ও খুনখারাবি চালাত। অজ্ঞতা এবং অশিক্ষিত ভয়ানকভাবে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। শিয়াদের এই অবস্থা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ইউরোপের সেই সময়ের কথা, যখন ইউরোপ ছিল যাজক শাসনাধীন। নাজাফ ও কারবালায় বসবাসকারী ধর্মীয় নেতা এবং মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক মানুষকে বাদ দিলে শিয়াদের প্রতি হাজারের মধ্যে একজনও লিখতে বা পড়তে পারে না। অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে সম্পূর্ণরূপে, আর জনগণ চরম দারিদ্র্যতায় জর্জরিত। দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পরিচালিত হয় নির্দেশ বহির্ভূতভাবে, শিয়ারা সরকারের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতামূলক কাজে লিপ্ত হতে লাগল।
রাষ্ট্র এবং জনগণ একে অপরকে সন্দেহের নজরে দেখে। ফলস্বরূপ তাদের মধ্যে কোন পারস্পরিক সহযোগিতা নেই। শিয়া ধর্মীয় নেতারা, সুন্নিদের সর্বদাই নিন্দামন্দ করে, জ্ঞান অর্জনের পথভ্রষ্ট, এমনকি ব্যবসায়িক, ধর্মীয় বা পার্থিব কোন কিছুতেই তারা ঠিকঠাক নেই।
আমি কারবালা ও নাজাফ এ চারমাস কাটিয়ে ছিলাম। নাজাফে আমি ভয়ানক শারীরিক অসুস্থতায় ভুগলাম। আমার এত অসুস্থবোধ হচ্ছিল যে আমি সুস্থ হওয়ার আশা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করলাম। তিন সপ্তাহ আমার এ অবস্থা ছিল। আমি এক ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে একটা প্রেসক্রিপশন করে দিলেন। ঔষধ ব্যবহার করতে করতে আমি সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলাম। অসুস্থ থাকার কারণে আমার গৃহকর্তা আমাকে ঔষধ ও পথ্য তৈরী করে দিত একটা নিতান্ত সামান্য বিনিময়ে শুধুমাত্র ছওয়াব প্রাপ্তির আশায়। কারণ আমি ছিলাম আলী -আমির -উল-মুমেনিনের দর্শনার্থী। ডাক্তার আমাকে প্রথম কিছুদিনের জন্য শুধু মুরগির সুপ খাওয়ার অনুমতি দিলেন। তৃতীয় সপ্তাহে আমি খেলাম চাল সেদ্ধ করে সুপ। ভালোভাবে সুস্থ হওয়ার পর আবার আমি বাগদাদ গেলাম। আমি আমার নাজাফ, হুল্লা, বাগদাদ এ চলার পথে অন্যান্য স্থান তদারকির একটা একশত পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রস্তুত করলাম। আমি প্রতিবেদনটি ঔপনিবেশিক মন্ত্রনাগারের বাগদাদ প্রতিনিধির কাছে প্রেরণ করলাম। আমি মন্ত্রনাগারের নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম যে আমি ইরাকেই থাকব না লন্ডনে ফিরে যাব।
আমি লন্ডনে ফিরে যাওয়ার জন্য উৎসুক হলাম। কারণ, বহুদিন হল আমি বিদেশে কাটাচ্ছি। আমি আমার মাতৃভূমি ও আমার পরিবারের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম।
বিশেষতঃ আমার পুত্র রাসপুটিনকে দেখার জন্য আমার মন ব্যাকুল হতে লাগল, যার জন্ম হয়েছে আমার দেশ ছাড়ার পরে। তাই আমার প্রতিবেদনের সাথে আমি একটি আবেদনপত্র জুড়ে দিলাম, অনুমতি দানের জন্য, যাতে খুব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও আমি লন্ডন ফিরতে পারি। আমার তিন বছরের ইরাক মিশনে কি প্রভাব পড়েছে তার একটা মৌখিক বিবৃতি আমি দিতে চাইলাম এবং সেই সাথে সাথে কিছু দিনের জন্য বিশ্রামও প্রার্থনা করলাম। মন্ত্রণাগারের ইরাক প্রতিনিধি আমাকে তার কাছে ঘনঘন যাওয়া আসা না করতে উপদেশ দিল, কারণ এতে আমি সন্দেহের কবলে পড়তে পারি। সে আমাকে আরও উপদেশ দিল যে টাইগ্রিস নদীর তীরবর্তী কোন সরাইখানায় আমি যেন একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি, এবং বলল, "যখন আমরা লন্ডন থেকে বার্তা পাব, মন্ত্রনাগারের উত্তর আমি তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব।" বাগদাদ থাকার সময় আমি অবলোকন করলাম, খলিফার রাজধানী ইস্তাম্বুলের সাথে বাগদাদের আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের কত সুবিশাল ফারাক।
যখন আমি কারবালা ও নাজাফ যাওয়ার জন্য বাসরা ছাড়লাম, আমি খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম যে মুহম্মদ-উল-নাজদিকে আমি যে পথে পরিচালিত করে এসেছিলাম সে সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে কিনা। কারণ সে ছিল ভয়ানক চঞ্চল ও ভীরু প্রকৃতির লোক। আমার ভয় হচ্ছিল যে তার উপর ভিত্তি করে আমি যে লক্ষ্য নির্মাণ করেছিলাম সেটা নষ্ট হয়ে গেছে কিনা। সে ইস্তাম্বুল যাওয়ার জন্য মনস্থির করেছিল যখন আমি তার থেকে বিদায় নিয়ে আসি। ইতিমধ্যে তাকে এই ঝামেলা থেকে নিস্তার করতে, আমি আপ্রান চেষ্টা করলাম। আমি বললাম, "আমি ভেবে খুব উদ্বিগ্ন হচ্ছি যে, যখন তুমি সেখানে যাবে, তুমি না বুঝে যেখানে সেখানে তোমার এই বক্তব্য বলবে, আর তারা তোমাকে ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করে তোমাকে হত্যা করবে।"
আসলে, আমার আশংকা ছিল এই কারণে যে সেখানে গিয়ে তার কোন সুবিশাল জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত হয়ে যেতে পারে, যে তার ভ্রান্ত ধারণাগুলিকে দূর করে তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করে তাকে পুনরায় সুন্নি ধর্ম মতে পরিবর্তিত করে দিতে পারে এবং এইভাবে আমার সব স্বপ্ন মাটি হয়ে যেতে পারে। কারণ ইস্তাম্বুলে ইসলামের মধ্যেকার জ্ঞান ও নৈতিক আদর্শ ছিল যথেষ্ট পরিমাণে বিকশিত। যখন আমি দেখলাম যে মুহম্মদ উল-নাজদি বাসরায় থাকতে চাইছে না, আমি তাকে ইস্পাহান এবং সীরাজ নামক শহরে যাওয়ার জন্য সুপারিশ করলাম। কারণ এই দুটি শহরই ছিল অনুকূল। আর সেখানকার অধিবাসীরা ছিল শিয়া, আর শিয়ারা সম্ভবতঃ মুহম্মদ-উল-নাজদিকে প্রভাবিত করতে পারবে না। কারণ শিয়ারা জ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্রে বহুগুণ পিছিয়ে। এইভাবে আমি নিশ্চিন্ত হলাম যে আমি তাকে যে গতিপ্রকৃতি দিয়েছি সে সেখান থেকে আর বেরোবে না।
যখন আমরা বিদায় নেব আমি তাকে বললাম, "তুমি কি তাকিয়া" বিশ্বাস কর?" "হ্যাঁ আমি বিশ্বাস করি, "সে বলল।" অবিশ্বাসীরা এক সাহাবাকে বন্দী করেছিল এবং তাঁর উপর অত্যাচার চালায় এবং তাঁর বাবা মাকে হত্যা করে। এই অবস্থায় সে"তাকিয়া তৈরী করে, সেটা হল, সে সরাসরি বলে যে, সে এখন বহু ঈশ্বর তত্ত্বে বিশ্বাসী (যখন সে ফিরে আসল এবং বলল যে কি ঘটেছিল) নবী তাকে কোন প্রকার নিন্দামন্দ করলেন না।" আমি তাকে উপদেশ দিলাম, যখন তুমি শিয়াদের মধ্যে বসবাস করতে শুরু করবে, "তাকিয়া কর; ওদের বোলো না তুমি একটা সুন্নি। তাহলে কিন্তু ওরা খুব সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাদের প্রথা এবং ঐতিহ্যগুলি শিখে নাও, কারণ তারা একেবারেই অজ্ঞ ও একগুঁয়ে প্রকৃতির।
যখন আমি বিদায় নিলাম আমি তাকে জাকাত হিসাবে কিছু অর্থ দিলাম। জাকাত হল একটা ইসলামিক কর, যা দরিদ্রদের জীবন ধারণের জন্য সংগৃহীত হয়। সেই সাথে আমি তাকে জিন সহকারে একটা পশু দিলাম উপহার হিসাবে। এভাবে আমরা বিদায় নিলাম। বিদায়ের পর আমার তার সাথে কোন সংযোগই থাকল না। এটা আমাকে ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল। যখন আমরা বিদায় নিয়েছিলাম আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমাদের দুজনকেই বাসরায় ফিরতে হবে। আর যে পক্ষই আগে আসুক না কেন যদি দ্বিতীয় পক্ষ না থাকে তবে চিঠি লিখে যেন আব্দ-উর-রেজার কাছে রেখে যায়।
ষষ্ঠ অধ্যায়
আমি কিছুদিন বাগদাদে কাটালাম। তারপর লন্ডনের ফেরার নির্দেশ সম্বলিত বার্তা পেয়ে আমি বাগদাদ ত্যাগ করলাম। লন্ডনে মন্ত্রণাগারের সেক্রেটারী ও কয়েকজন অফিসারের সাথে আমার কথাবার্তা হল। আমি আমার এই দীর্ঘ মিশনের সময় আমার কার্যকলাপ এবং নজরদারি সম্পর্কে জানালাম। আমি ইরাক সম্পর্কে তাদের যা তথ্য দিলাম তাতেও তারা খুবই খুশি তারা সন্তুষ্ট এবং অপরপক্ষে মুহম্মদ উল- নাজদির নারী সঙ্গিনী যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সেটা আমার বক্তব্যের পরিপূরক। আমি আরও বুঝলাম যে আমার মিশনের সময় মন্ত্রনাগারের লোকেরা আমাকে সর্বদাই অনুসরণ করেছে। এই সব লোকেরাও প্রতিবেদন পাঠিয়েছে যা আমার প্রতিবেদনের পরিপূরক ছিল এবং সেক্রেটারিকে আমার বলা বক্তব্যের সহযোগী ছিল।
সেক্রেটারী আমার সাথে মন্ত্রীর একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। যখন মন্ত্রীর সাথে আমার সাক্ষাত হল। তিনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে লাগলেন যা ইস্তাম্বুল থেকে ফেরার পরও আমার সাথে মোটেও করেন নি। আমি বুঝলাম যে তাঁর অন্তরে আমি একটা বিশেষ স্থান দখল করে ফেলেছি।
মন্ত্রী জেনে খুব খুশি হল যে আমি মুহম্মদ উল-নাজদিকে পুরোপুরি করায়ত্ত করেছি। "আমাদের মন্ত্রণাগার যেমন অস্ত্রের সন্ধান করছিল এ হচ্ছে সেই রূপ একটা অস্ত্র। তাকে সব ধরনের প্রতিশ্রুতি দাও। তুমি তোমার সারাটা সময় ওকে পরিচালনার কাজে লাগাও, এটাই আমাদের কাম্য," তিনি বললেন। যখন আমি বললাম, "আমি মুহম্মদ উল-নাজদির বিষয়ে বড় উদ্বিগ্ন। সে তার মনের পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। তিনি উত্তরে জানালেন," উদ্বিগ্ন হয়ো না। তুমি তাকে ছেড়ে আসার পর সে তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয় নি। মন্ত্রনাগারের গুপ্তচররা ইস্পাহানে তার সাথে সাক্ষাত করেছে এবং মন্ত্রনাগারকে প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে সে নিজেকে পরিবর্তন করে নি। "আমি মনে মনে বললাম" কী ভাবে মুহম্মদ উল-নাজদি তার গোপন কথা একজন আগন্তুককে জানাল?" আমি মন্ত্রীকে সাহস করে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলাম। তা সত্ত্বেও পরে যখন মুহম্মদ উল-নাজদির সাথে সাক্ষাত করেছিলাম, আমি দেখলাম যে ইস্পাহানে আব্দুল- করি নামে একটা লোকের সাথে তার সাক্ষাত হয়। সে জানায় যে সে শেখ মুহম্মদ (অর্থাৎ আমি) এর ভাই এবং তার গোপন কথাগুলি গর্ত খুঁড়ে বের করে।
মুহম্মদ উল-নাজদি আমায় বলল," সফিয়া আমার সাথে ইস্পাহান গিয়েছিল এবং আমার মুতা নিকাহ্ নিয়ে আরও দুইমাস একসাথে বসবাস করেছি। আব্দুল- করিম আমার সাথে সীরাজ যায় এবং আমার জন্য আসিয়া নামের একটা মেয়ে নিয়ে আসে, যে ছিল সফিয়ার চেয়েও অনেক সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া। ঐ মহিলার সাথে মুতা নিকাহ্ সম্পাদন করে আমি ঐ মহিলার সাথে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি"। পরে আমি অনুসন্ধানে জানলাম আবু-উল-করীম হচ্ছে এক খ্রীষ্টান গোয়েন্দা যে ইস্পাহানের জেলফা জেলায় বসবাস করছিল এবং মন্ত্রনাগারের জন্য কাজ করছে। আর আসিয়া একজন ইহুদি যে সীরাজে বসবাস করছিল, মিনিষ্ট্রির আরেক গোয়েন্দা। আমরা চারজন মিলিতভাবে মুহম্মদ উল-নাজদিকে এমন এক পথে প্রশিক্ষণ দিতে লাগলাম যে ভবিষ্যতে তার কাছ থেকে আশা অনুরূপ ফল পাওয়া যাবে।
যখন আমি মন্ত্রীর সেক্রেটারি এবং মন্ত্রনাগারের আরো দুইজন ব্যক্তিকে তার ঘটনাগুলি জানালাম, মন্ত্রী আমাকে বললেন "মন্ত্রনাগারের প্রদত্ত সবচেয়ে মহান পুরুস্কারটি তোমার প্রাপ্য। কারণ তুমি হচ্ছো মন্ত্রণাগারের সবচেয়ে দামী গোয়েন্দা সফলতম একজন। সেক্রেটারী তোমাকে বলবে কিছু রাজনৈতিক গোপন কথা, যেগুলি তোমাকে তোমার মিশন পূরণে সহযোগিতা করবে"।
তারপর তারা আমাকে দশদিনের ছুটি দিল পরিবারের সাথে কাটানোর জন্য। তাই আমি তাড়াতাড়ি ফিরলাম এবং আমার পুত্র দেখতে হয়েছে ঠিক আমারই মত, তার সাথে আমার সবচেয়ে মিষ্টিমধুর সময়গুলি কাটালাম। আমার ছেলে কয়েকটা কথা বলতে শিখেছে এবং হাঁটত এত সুন্দরভাবে যে আমার মনে হত যেন সে আমার শরীরেই একটা অঙ্গ। আমি এই দশটা দিন খুব আনন্দের সাথে খুব সুখে কাটালাম। আমার মনে হত যেন আমি আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছি। আমার বাড়ি ফেরাটা এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানোটা ছিল বড় আনন্দের। এই দশদিনের ছুটিতে আমার পৈতৃক সূত্রে আবদ্ধ কাকিমার সাথে সাক্ষাত করাটা খুব ভালো হয়ে ছিল কারণ, আমার তৃতীয় মিশনে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে আমি খুব দুঃখিত হলাম।
এই দশদিনের ছুটি এক ঘন্টার মতো শেষ হয়ে গেল। এমন আনন্দের দিনগুলি যখন একটা ঘন্টার মতো কেটে যায় তখন দুঃখের দিনগুলি যেন এক শতাব্দীর মতো মনে হয়। যেন কাটতে চায় না। আমার মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা, যখন আমি নাজাফে অসুস্থ অবস্থায় পড়েছিলাম। সেই যন্ত্রণাদায়ক দিনগুলিকে আমার বছরের পর বছরের মত মনে হত। নতুন নির্দেশ পাওয়ার জন্য আমি যখন মন্ত্রনাগারে গেলাম, সেক্রেটারির লম্বা দেহ ও হাস্য মুখরিত মুখ দেখলাম। তিনি এত উষ্ণভাবে আমার সাথে করমর্দন করলেন যে সেখানে তার স্নেহ আমি টের পাচ্ছিলাম।
তিনি আমায় বললেন, "আমাদের উপনিবেশের তত্ত্বাবধায়ক কমিটি এবং মন্ত্রীর নির্দেশে আমি তোমাকে দুটি রাষ্ট্রনৈতিক গোপন কথা বলব। দুইজন বিশেষ ব্যক্তি ছাড়া যা কেউই জানে না।
আমার হাত ধরে তিনি আমাকে মন্ত্রনাগারের একটা কক্ষে নিয়ে গেলেন। এই কক্ষে আমি কিছু আকর্ষণীয় বিষয় দেখলাম। একটা গোলটেবিলের চারিদিকে দশজন লোক বসে আছে। প্রথমজন অটোম্যান সম্রাটের ছদ্মবেশে বসে আছে। সে তুর্কী ভাষায় ও ইংরেজিতে কথা বলছিল। দ্বিতীয় জন ইস্তাম্বুলের শেখ-উল-ইসলাম (যিনি ইসলামিক সমস্ত বিষয়ের প্রধান) -এর সাজে বসে আছেন। তৃতীয় জন ইরানের শাহ-এর সাজে সজ্জিত। চতুর্থ জন ইরানের প্রাসাদের প্রধানমন্ত্রীর সাজে সজ্জিত। পঞ্চম জন নাজাফের শিয়া প্রধানের সাজে সজ্জিত। এই লোকদের শেষ তিন জন ইংরেজি ও ফার্সিতে কথা বলছে। এই পাঁচজনের প্রত্যেকের পাশে একজন করে কেরানী বসে আছে, যা তারা বলছে তা লেখার জন্য। গোয়েন্দারা যে সব তথ্য পাঠিয়েছে, ইস্তাম্বুল, ইরান এবং নাজাফ সম্পর্কে, এই পাঁচ জন কেরানী সেগুলি জানাচ্ছে। সেক্রেটারি বললেন, "এই পাঁচটি লোক সেখানকার পাঁচজনের প্রতিরূপ। সেখানকার এই সকল ব্যক্তিরা কি চিন্তা করছে সেটা জানার জন্যে আমার এই সব লোক জনকে শিখিয়েছি ও প্রশিক্ষণ দিয়েছি তাদের আদি রূপ হিসাবে। ইস্তাম্বুল, ইরান এবং নাজাফের ঐ সব লোকেরা মূল রূপগুলি থেকে আমরা যে সব গোপন তথ্য পেয়েছি তা আমাদের পরিবেশন করবে, আর এই সব লোকগুলি ঐ সকল স্থানে তাদের মূলরূপগুলিকে নিজেদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করছে। তাহলে আমরা এদের প্রশ্ন করি আর এরা উত্তর দিক। আমরা নিশ্চিত এই লোকেরা যে উত্তর দেবে তা সেখানকার আসল ব্যক্তিরা যে উত্তর দেবে তার সাথে ৭০% সঙ্গতিপূর্ণ।
"যদি তোমার মন চায় নির্ধারণের জন্য তুমি তাদের প্রশ্ন করতে পার। তুমি ইতিমধ্যে নাজাফের ঐ জ্ঞানী মনীষীর সাথে সাক্ষাত করেছি কয়েকটা কারণে।" এখন আমি তার নকল ব্যক্তির সামনে গেলাম এবং বললাম, "প্রিয় শিক্ষক, আমাদের কি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা ঠিক হবে? কারণ এটা একটা যুক্তিহীন সুন্নি সরকার?" তিনি কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, "না, সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা অনুমোদন যোগ্য নয়, সরকার সুন্নি হয়েছে তাতে কি? কারণ সব মুসলমান ভাই ভাই। আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করব তাদের (সুন্নি মুসলমান) বিরুদ্ধে শুধুমাত্র যদি তারা উম্মত (মুসলিম) দের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ায় ও নির্যাতন চালায়, আর এমনকি এ ক্ষেত্রেও আমরা "আমর -ই-বিল- মারুফ" ও "নআহই-ই-আনইল-মউনকআর"-এর আদর্শ মেনে চলব। যেইমাত্র তারা তাদের নির্যাতন বন্ধ করবে আমরাও নাক গলানো বন্ধ করব।
আমি বললাম, "প্রিয় শিক্ষক, খ্রীষ্টান আর ইহুদীরা হচ্ছে নোংরা শয়তান, এ বিষয়ে কি আমি আপনার মতামত জানতে পারি? তিনি বললেন। "হ্যাঁ, তারা নোংরা শয়তান।" 'তাদের থেকে সর্বদাই দূরে থাকা প্রয়োজন"। যখন আমি কারণ জানতে চাইলাম, তিনি উত্তরে বললেন, অপমানের সমুচিত জবাব হিসাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওরা আমাদেরকে অবিশ্বাসী হিসাবে দেখে এবং আমাদের নবী মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অস্বীকার করে। সুতরাং এই বিষয়ে আমরা প্রতিহিংসা পরায়ণ। "আমি তাঁকে বললাম, "শ্রদ্ধেয় শিক্ষক পবিত্রতা ঈমানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নয় কি?" তা সত্ত্বেও শান-ই-শরীফ (হজরত আলীর সমাধিসৌধের চারিপার্শ্বস্থ স্থান) এর চারিধারের রাস্তা ঘাটগুলি পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন নয়। এমনকি মাদ্রাসাগুলি, যেগুলি জ্ঞান অর্জনের স্থান, সেগুলিকেও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বলা যায় না। "তিনি উত্তরে জানালেন, "হ্যাঁ এটা সত্য, পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। তথাপি এখানে কিছু করার নেই, কারণ - শিয়ারা পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাকে খুবই অবহেলা করে।
মন্ত্রনাগারের এই ব্যক্তির দেওয়া তথ্যগুলি ভীষণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ যা আমি নাজাফের মহান শিয়া মনীষীর কাছ থেকে পেয়ে ছিলাম। নাজাফের শিয়া মনীষীর সাথে এই ব্যক্তির বক্তব্যের এত ব্যাপক মিল আমাকে দারুনভাবে অবাক ও উৎফুল্ল করল। তারপর লোকটি পার্সিভাষায় কথা বলছিল।
সেক্রেটারী বললেন, "অপর চার ব্যক্তিত্বের নকল প্রতিমাদের সাথে যদি তুমি কথা বলতে চাও, তুমি কথা বল এবং মিলিয়ে দেখ তারা তাদের আসলদের সাথে কত নিখুঁতভাবে সঙ্গতিপূর্ণ।" যখন আমি বললাম, "শেখ-
উল-ইসলাম এর চিন্তাভাবনা সম্পর্কে আমি জানি, কারণ ইস্তাম্বুলে আমার হোজা - আহমেদ ইফেন্দি, শেখ- উল-ইসলাম সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।" সেক্রেটারি আমায় বললেন, "তাহলে তুমি তার নকল প্রতিমার সাথে কথা বলতে এগিয়ে যাও।"
আমি শেখ-উল-ইসলামের নকল প্রতিরূপের সামনে গেলাম এবং তাকে বললাম, "খলিফাকে মান্য করা কি ফরজ?" হ্যাঁ এটা হল ওয়াজিব। তিনি উত্তরে বললেন।" এটা হল ওয়াজিব কারণ ফরজ হল আল্লাহ এবং নবীকে মান্য করা।" যখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম এটা প্রমাণ করার জন্য তার কাছে কোন তথ্য আছে কিনা, সে উত্তরে বলল" তুমি কি জনাব -ই-আল্লাহ এর আয়াতটি শোননি? 'আল্লাহ, নবী এবং তোমাদের মধ্যেকার উলুল আমরকে মেনে চল?' আমি বললাম, "এর মাধ্যমে কি এটাই প্রকাশিত হয় যে আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন খলিফা ইয়াজিদকে মেনে চলতে, যে নির্দেশ দিয়েছিল মদিনা লুন্ঠন করতে ও নবীর প্রিয় পৌত্র হুসায়েনকে হত্যা করতে, আর ওয়ালিদ যে মদপান করত?" তাঁর উত্তর ছিল এই রকমঃ "আমার পুত্র! ইয়াজিদ আল্লাহ -এর অনুমোদনেই আমির- উল মোমেনিন হয়েছেন। তিনি হুসেনকে হত্যা করতে নির্দেশ দেননি? শিয়াদের এইসব মিথ্যা কথা বিশ্বাস করো না! পুস্তকগুলি ভালো করে পাঠ কর। তিনি একটা ভুল করেছেন তারপর তিনি এর জন্য তওবা করেছেন (তিনি অনুতাপ করলেন এবং আল্লাহ এর ক্ষমা এবং করুনা প্রার্থনা করলেন) মদিনা-ই-মূনাওয়ারা লুন্ঠনের নির্দেশ দিয়ে তিনি সঠিক কাজ করেছেন। কারণ মদিনাবাসী হয়ে উঠেছিল যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণহীন ও দুর্বিনীত। আর ওয়ালিদের ক্ষেত্রে সে ছিল একটা পাপী। ওয়াজিব শুধুমাত্র খলিফাকে অনুসরণ করা নয়, বরং শরিয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নির্দেশগুলিকে পালন করাকেই বোঝায়। "আমি একই প্রশ্নগুলি আমার হোজা আহমেদ ইফেন্দিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এবং সামান্য পার্থক্য ভিন্ন একই উত্তরই লাভ করেছিলাম। তারপর আমি সেক্রেটারিকে জিজ্ঞাসা করলাম "এইসব নকল প্রতিরূপ তৈরী করার মূল উদ্দেশ্য কি?" তিনি বললেন, "এই পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা অটম্যন সুলতান ও মুসলিম মনীষীদের মানসিক অবস্থা নির্ধারণকারি, তারা সুন্নি সম্প্রদায়ের হোক বা শিয়া। আমরা
এখান থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলি আবার অনুসন্ধান করি, ফলে তাদের মোকাবেলা করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ যদি তুমি জান শত্রু সৈন্য কোন দিক থেকে আসছে, তুমি সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারবে, উপযুক্ত স্থানে তোমার সৈন্যবাহিনী স্থাপন করে, তারপর শত্রুকে সমূলে বিনাশ কর। অপরপক্ষে, তুমি যদি নিশ্চিত না হতে পার শত্রুপক্ষ কোন দিক থেকে তোমাকে আঘাত হানতে চলেছে,
তাহলে তুমি তোমার সেনাদের এলোপাথাড়ি যেখানে সেখানে ছড়িয়ে দেবে এবং পরাজয় ভোগ করবে।.......... ঠিক সেইভাবে মুসলিমদের ধর্মবিশ্বাস তাদের মাজহাবের সত্যতা প্রমাণের জন্য তারা যে যে স্বাক্ষ্য প্রমাণ বহন করে, সেগুলি তুমি যদি জান তাহলে সেগুলির বিপরীতযুক্তও তোমার পক্ষে তৈরি করা সম্ভব হবে, যেগুলিকে ব্যবহার করে তাদের বিশ্বাসে আঘাত হানতে হবে।
তারপর তিনি আমাকে একটা বই দিলেন। ১০০০ পৃষ্ঠার ঐ বইটিতে পূর্বোল্লিখিত ঐ পাঁচজন ব্যক্তির প্রতিনিধিদের দেওয়া প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, শিক্ষা, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে পালিত সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষন এবং প্রকল্পের ফলাফল লিপিবদ্ধ আছে। তিনি বললেন, "দয়া করে বইটা পড়বে এবং আমাদের ফেরত দেবে"। আমি বইটা গভীর মনোযোগের সহিত পড়লাম আমার তিন সপ্তাহ ছুটি কাটানোর সময়।
বইটি সত্যিই বিস্ময়কর। কারণ এতে লিপিবদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ উত্তরগুলি এবং সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষনগুলিকে মনে হল সম্পূর্ণ সঠিক। আমার মনে হল ঐ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ছদ্ম প্রতিরূপদের দেওয়া উত্তরগুলি ৭০% এর বেশি সঠিক এবং সঙ্গতিপূর্ণ।
বই পড়ে আমার নিজের দেশের প্রতি আমার আরও আস্থা জন্মাল এবং আমি নিশ্চিতভাবে বুঝলাম যে এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে অটোম্যান সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে শক্তভাবে প্রস্তুত হয়ে গেছে। সেক্রেটারী আরো বললেন, "অন্য একই রকম কক্ষগুলিতে এমনই একটি করে অবিকল টেবিল আছে, আমরা যে সব দেশে উপনিবেশ স্থাপন করার পরিকল্পনা চলছে সেগুলির নীতিনির্ধারণের জন্য"। যখন আমি সেক্রেটারিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় পেয়েছেন এইসব উদ্যোমি এবং প্রতিভাবান লোকগুলিকে? তিনি উত্তরে জানালেন, "সারা পৃথিবীব্যাপী আমাদের গুপ্তচরেরা আমাদেরকে অনবরত প্রতিভার সরবরাহ করছে। যেমন তুমি দেখলে, এই সকল প্রতিনিধিরা তাদের কাজে কতখানি দক্ষ। স্বভাবতই যদি তুমি কোন বিশেষ ব্যক্তির জ্ঞাত তথ্যগুলির সব জানো এবং তোমাকে তার সাজে সজ্জিত করা হয়, তুমি তখন তার মতই চিন্তা করতে পারবে এবং তার নেওয়া সিদ্ধান্তের সাথে তোমার সিদ্ধান্ত একই হবে। কারণ তুমি হচ্ছ তারই বিকল্প।"
সেক্রেটারি বলে চললেন, "এটা হল প্রথম গোপন কথা যা মন্ত্রনাগার তোমাকে জানানোর জন্য আমায় বলেছেন"।
"আর একমাস পরে আমি তোমাকে দ্বিতীয় গোপন কথাটা জানাবো, যখন তুমি ১০০০ পৃষ্ঠার এই বইটি ফেরত দেবে"।
আমার সমস্ত মনোপ্রান ঢেলে আমি খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত এই বইটি আদি থেকে অন্ত পড়লাম। এটা মুসলমানদের সম্পর্কে আমার জ্ঞানকে বর্ধিত করল। এখন আমি আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি তারা কি চিন্তা করে, আর কোথায় তাদের দূর্বলতা, কোনটা তাদের শক্তিশালী করেছে এবং কীভাবে তাদের গুণাবলী নগন্য বিন্দুতে পরিণত করা যাবে।
মুসলিমদের দুর্বল দিকগুলি যা এই বইতে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেগুলি হলঃ
১) সুন্নি-শিয়া বিরোধিতা; সারাদেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতা; তুর্কি-ইরানিদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতা; উপজাতীয় লড়াই এবং জ্ঞানী মানুষদের সাথে সরকারের বিরোধিতা।
২) বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ব্যতীত মুসলিমরা সকলেই অজ্ঞ ও অশিক্ষিত।
৩) আধ্যাত্মিকতা, জ্ঞান ও নীতিবোধের ঘাটতি।
৪) পার্থিব বিষয় থেকে তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলেছে এবং পরলোকে কি ঘটবে এই নিয়ে তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত।
৫) সম্রাটরা সকলেই ক্রব্ধ ও স্বৈরাচারী।
৬) পথঘাট সব নিরাপত্তাবিহীন ও পরিবহন এবং ভ্রমণ অনিয়মিত।
৭) যে সকল রোগগুলি মড়কাকারে আসে যেমন -প্লেগ, কলেরা, সেগুলির বিরুদ্ধে কোন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। স্বাস্থ্য বিধি সম্পর্কে কোন দৃষ্টিই দেওয়া হয় না।
৮) শহরগুলি ধ্বংস প্রায়, সেখানে জল সরবরাহের কোন সুব্যবস্থা নেই।
৯) প্রশাসন বিদ্রোহী এবং সশস্ত্র প্রত্যাঘাতকারীদের বিরুদ্ধে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছে না, সর্বদাই অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে। কুর-আন এর আইন নিয়ে তারা এত গর্বিত, কিন্তু সেটার চর্চার বড়ই অভাব।
১০) চরম অর্থনৈতিক ব্যর্থতা, দারিদ্র্য এবং ক্রমাবনতি।
১১) সংঘবদ্ধ কোন সেনাবাহিনী নেই, পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রও নেই এবং সঞ্চিত অস্ত্রশস্ত্রগুলি ব্যবহারের সময় অতিক্রম করে এসেছে এবং সহজেই নষ্ট হয়ে যাবে এমন। (তারা কি ওরহান গাজীর সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর কথা ভুলে গেছে, যে অটোম্যান সিংহাসনে আরোহণ করেছিল। ৭২৬ সালে (সি.ই. ১৩২৬) বা ইলদিরিম (বজ্র) বায়েজিদ খানের প্রতাপশালী ক্রটিহীন সেনাবাহিনীর কথা, যারা ৭৯৯ সালে (সি.ই. ১৩৯৯) নইবোলুতে ক্রুসেডারদের সুবিশাল সেনাবাহিনীকে সমূলে উৎপাটিত করেছিল?)
১২) নারী অধিকারে যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ।
১৩) পরিবেশগত স্বাস্থ্য ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার মারাত্মক অভাব।
ওপরের অনুচ্ছেদগুলিতে মুসলিমদের যে জায়গাগুলিকে দূর্বল জায়গা বলে বিচার করা হয়, সেগুলি সরলাকারে বর্ণিত হওয়ার পর বইটিতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে মুসলিমদের কিভাবে- ইসলাম, পার্থিব জগৎ এবং তাদের বিশ্বাসের আধ্যাত্মিক প্রাধান্য বা উৎকর্ষতা থেকে অচেতনা রেখে দেওয়া যাবে সেই সম্পর্কে। তারপর এটি ইসলাম সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্যগুলি পরিবেশন করেছেঃ
১) ইসলাম একতা এবং পারস্পারিক সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছে এবং অনৈক্য নিষিদ্ধ করেছে। কুর-আনে উল্লেখিত হয়েছে, "সম্মিলিতভাবে সর্বপ্রকারে আল্লাহ -এর সাথে রজ্জু দ্বারা আবদ্ধ হও।"
২) ইসলাম নির্দেশ দেয় শিক্ষিত এবং সচেতন বা নীতিজ্ঞানপূর্ণ হওয়ার জন্য। কুর-আনে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, "পৃথিবী ভ্রমণ কর"।
৩) ইসলাম নির্দেশ দেয় জ্ঞান অর্জনের জন্য। হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, "প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান শিক্ষা করা ফরজ, এমন কি পুরুষ-নারী সকলের জন্য"।
৪) ইসলাম শিক্ষা দেয় জগতের জন্য কাজ করতে। কুর-আনে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, "হে আমাদের আল্লাহ! এই জগতে ও পরজগতে যা কিছু সুন্দর তার কিছু অংশ আমাদেরকে দাও"।
৫) ইসলাম আলাপ আলোচনা করার নির্দেশ দিয়েছে। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, "তাদের পারস্পরিক আলোচনা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে।"
৬) ইসলাম পথ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছে। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, "পৃথিবীতে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ কর।"
৭) ইসলাম মুসলমানদের তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার নির্দেশ দিয়েছে।
একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে "জ্ঞান অর্জন করতে হবে চারটি ধাপেঃ-১) বিশ্বাসের সুরক্ষার জন্য ফিকাহ এর জ্ঞান অর্জন; ২) স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য ঔষধপত্রের জ্ঞান অর্জন, ৩) ভাষা সম্পর্কিত সুরক্ষার জন্য, আরবী ব্যাকরণ; সর্ফ ও নাহু সম্পর্কে জ্ঞানার্জন। ৪) সময় সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।"
৮) ইসলাম ক্রমোন্নতির নির্দেশ দেয়। কুর-আনে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ -সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছে শুধু তোমাদের জন্য।
৯) ইসলাম সুশৃঙ্খলতার নির্দেশ দেয়। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে "সবকিছুই হিসাব ও শৃঙ্খলা বিন্যাসের উপর নির্ভরশীল।"
১০) ইসলাম অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হওয়ার নির্দেশ দেয়। একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, "তোমার দুনিয়ার জন্য এমন কাজ কর যাতে তুমি অমর হও। আর তোমার পরলোকের জন্য কাজ কর এইভাবে যে তুমি কালই মৃত্যুবরণ করতে চলেছ।"
১১) ইসলাম শক্তিশালী অস্ত্রেসুসজ্জিত সেনাবাহিনী গঠনের নির্দেশ দেয়। কুর-আনে বর্ণিত হয়েছে, "তাদের বিরুদ্ধে যত বেশি সংখ্যক পারো সেনা গঠন কর।"
১২) ইসলাম নারী অধিকার রক্ষা ও তাদের সম্মান করার নির্দেশ দেয়। কুর-আনে বর্ণিত হয়েছে যে, "পুরুষের যেমন নারীর প্রতি আইনত অধিকার আছে, নারীর ও তেমনি পুরুষের প্রতি আইনত অধিকার আছে।"
১৩) ইসলাম পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ দেয়। একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে "পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।"
তারপর বইটিতে সুপারিশ করা হয়েছে নিম্নলিখিত শক্তির উৎসগুলিকে ক্ষতিসাধন ও বিনষ্ট করার জন্য।
১) ইসলাম জাতিগত, ভাষাগত, ঐতিহ্যগত, প্রথাগত এবং এই জাতীয় সমস্ত প্রকার গোঁড়ামিকে ঘৃণা করে।
২) সুদের আদান প্রদান মুনাফাবাজী, যৌন ব্যভিচার, মদ্যপান, শুকুরের মাংস সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
৩) মুসলমানরা তাদের উলেমা (ধর্মীয় মনীষীদের) অনুগত।
৪) অধিকাংশ সুন্নি মুসলমানরাই তাদের খলিফাকে নবীর প্রতিনিধি হিসাবে মানে। তারা বিশ্বাস করে এটা হল ফরজ, আল্লাহ এবং নবীকে যতখানি সম্মান করা উচিত, খলিফাকেও ঠিক ততখানি সম্মান করা উচিত।
৫) জিহাদ হল ফরজ।
৬) শিয়া মুসলমানদের কাছে সমস্ত অমুসলিমরা এবং সুন্নি মুসলিমরা খারাপ, জঘন্য।
৭) সব মুসলিমরাই বিশ্বাস করে যে, ইসলাম হল একমাত্র প্রকৃত ধর্ম।
৮) অধিকাংশ মুসলিম বিশ্বাস করে যে আরব উপদ্বীপ থেকে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের বিতাড়িত করা ফরজ।
৯) তারা তাদের আরাধনা (যেমন -নামাজ, রোজা, হজ্ব........) সম্পন্ন করে সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতা দিয়ে।
১০) শিয়া মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলিতে গীর্জা নির্মাণ হারাম (নিষিদ্ধ)।
১১) মুসলমানরা ইসলামিক বিশ্বাসের আইনগুলিকে শক্তভাবে ধরে চলে।
১২) শিয়া মুসলমানরা মনে করে পবিত্র যুদ্ধে প্রাপ্ত লুঠের মালপত্র এর ১/৫ অংশ উলেমাদের দান করা ফরজ।
১৩) মুসলিমরা তাদের সন্তানদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলে যে, তারা তাঁদের পূর্বপুরুষদের প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয় না।
১৪) মুসলিম নারীরা নিজেদেরকে এমন ভালোভাবে পোশাক দ্বারা আচ্ছাদিত করে যে তাদের সাথে বা তাদের দ্বারা যেন কোন কটুকাজ না হয়।
১৫) মুসলিমরা জামাতে নামাজ পড়ে, এর ফলে তারা দিনে পাঁচবার করে সমবেত হওয়ার সুযোগ পায়।
১৬) যেহেতু তাদের মতে নবীর, আলীর এবং অন্যান্য ধর্মপ্রাধান মুসলিমদের মাজার পবিত্র স্থান, তাই তারা সেখানে সমবেত হয়।
৩ ও ৪) তাদের উপস্থিতিতে জান্নাতের প্রশংসা করা এবং তাদেরকে প্ররোচিত করা এই বিষয়ে যে, পার্থিব জীবনধারণের জন্য কোন কাজ করার দরকার নেই। তাসাওফ এর পরিধিকে সীমা ছাড়িয়ে দেওয়া। মুসলিমদের একটা অসচেতন অবস্থার মধ্যে রেখে দেওয়া; নিম্নোক্ত জুহুদ বিষয়ে গাজ্জালির লেখা এহিয়া-উল-উলুম-ইদ- দীন, মাওলানার লেখা পুস্তক মাসনাবি এবং মুহিউদ্দিন আরবির লেখা বিভিন্ন পুস্তক পাঠে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে।
৫) সম্রাটদের মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে অত্যাচার এবং স্বৈরাচারে লিপ্ত করতে হবে। নিম্নলিখিত মিথ্যায় ভরা বাকপটু-কথায় মনভিজিয়ে, আপনারা হচ্ছেন পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। বাস্তবিকই আবু বকর, উমর, উসমান, আলী, উমাইয়াগণ, আব্বাসীয় খলিফারা ক্ষমতা দখল করেন পুরদস্তুর সৈন্যবল এবং তলোয়ারের জোরে এবং তারা সকলেই হয়ে ওঠেন এক এক জন সম্রাট। উদাহরণস্বরূপ- আবু বকর ক্ষমতা দখল করেন উমরের তলোয়ারের সহযোগিতায় এবং যারা তার আদেশ অমান্য করেছিল তাদের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে, যেমন ফাতিমার বাড়ি। আর উমর খলিফা হন আবুবকর এর সুপারিশে। অপরপক্ষে উসমান রাষ্ট্রপতি হন উমর এর নির্দেশে। আর আলীর ক্ষেত্রে তিনি দেশের সর্বাধিপতি হন কতকগুলি ডাকাতের নির্বাচনে জয়ী হয়ে। মাবিয়া তলোয়ারের বলে ক্ষমতায় আসেন। তারপর উমাইয়া বংশীয়দের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। ফলস্বরূপ এটা বলা যায় যে, ইসলামিক সম্রাটদের ইতিহাসে স্বৈরাচারের অজস্র উদাহরণ আছে। ৬) সংবিধান থেকে নরহত্যাজনিত কারণে মৃত্যুর সাজা রদ করতে হবে। (মৃত্যুদণ্ড হল নরহত্যা ও দস্যুবৃত্তির একমাত্র প্রতিবন্ধ। নৈরাজ্য এবং লুটতরাজ মৃত্যুদণ্ড ব্যতীত প্রতিরোধ করা কঠিন) রাজপথে রাহাজানি ও ডাকাতির শাস্তিদানের ব্যাপারে প্রশাসনকে বাধাদান করা। তাদের সমর্থন করে এবং অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে পথে চলাচলকে নিরাপত্তাহীন করে দেওয়া।
৭) নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে তাদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে প্ররোচিত করা সব কিছুই নসিবে আল্লাহ এর লিখনের উপর নির্ভর করে। স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে ডাক্তারি চিকিৎসার কোন ভূমিকা নেই। আল্লাহ কি কুরআনে বলেনি, "আমার আল্লাহ -ই-আমার জন্য খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করেন। আমি যখন অসুস্থ হই তিনিই আমাকে সুস্থ করেন। তিনিই শুধুমাত্র আমাকে হত্যা করবেন এবং পুনরায় জাগরিত করবেন।" তাহলে আল্লাহ এর ইচ্ছা ব্যতীত কেউই অসুস্থতা থেকে সুস্থ হতে পারবে না বা মৃত্যু থেকে অব্যাহতি পাবে না।
৮) হিংসা বিদ্বেষ বৃদ্ধির জন্য নিম্নলিখিত বক্তব্য বারবার প্রকাশ করতে হবেঃ
ইসলাম হচ্ছে সম্পূর্ণ আরাধনা ও ত্যাগের ধর্ম। রাজনৈতিক বিষয়ে এদের কোন স্বার্থ বা উৎসাহ কিছুই নেই।
সে কারণেই মুহম্মদ এবং তাঁর খলিফাদের কোন মন্ত্রী বা লিখিত আইনের প্রয়োজন হত না।
৯) এত দূর আলোচিত ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডগুলির মাধ্যমে খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক অবনমন নেমে আসবে। আমরা এই অবক্ষয়ের সাথে যোগ করবো আরও ক্ষতি। উৎপাদিত ফসল পচিয়ে ফেলে, বানিজ্য তরীগুলি ডুবিয়ে দিয়ে, বাজার এলাকাগুলিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে, বাঁধ এবং কৃত্রিম জলাধারগুলিকে ধ্বংস করে দিয়ে এবং এই কৃষি এবং শিল্প অঞ্চলগুলিকে ডুবিয়ে দিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের পানীয় জলের কেন্দ্রগুলিকে দূষনে ভরিয়ে দিয়ে।
১০) রাষ্ট্রনেতাদের যুক্ত করে দিতে হবে বিভিন্ন বদ অভ্যাসের মধ্যে যেমন- যৌন ব্যভিচার, খেলাধুলা, মদ্যপান, জুয়া, দূর্নীতি ইত্যাদি যেগুলি তাদের প্ররোচিত করবে তাদের নিজেদের মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহ, গোপন চক্রান্ত এবং রাষ্ট্রের সম্পত্তি ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করার ব্যাপারে। প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকদের এই সকল কাজ করার জন্য উৎসাহ দিতে হবে এবং যারা আমাদের স্বপক্ষে এইভাবে কাজ করবে তাদের পুরুস্কৃত করা হবে। তারপর বইটিতে নিম্নলিখিত উপদেশ দেওয়া হয়েছেঃ যে সকল ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, তাদেরকে গোপনে এবং প্রকাশ্যে অবশ্যই সংরক্ষণ করা হবে কিন্তু মুসলিমদের হাতে গ্রেপ্তার হলে তাদের উদ্ধারের জন্য কোন অর্থ ব্যয় করা হবে না।
১১) "সব ধরনের সুদ গ্রহণকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। কারণ সুদের কারবার কেবলমাত্র জাতীয় অর্থনীতিকেই ধ্বংস করবে, সেই সাথে কুরআনের আইনগুলিকে অমান্য করার ব্যাপারেও যুক্ত করে দেবে। একবার কেউ কুরআনের কোন আইনের কোন অংশকে অমান্য করে অপরাপর আইনগুলিকে অমান্য করাও তার পক্ষে খুবই সহজ হয়ে উঠবে। তাদের এটা জোর দিয়ে বোঝাতে হবে যে, ঋনের গুণিতক সুদ গ্রহণই হচ্ছে হারাম কারণ, কুরআনে বলা হয়েছে যে "ঋণের গুণিতক সুদ গ্রহণ করো না", সুতরাং সব ধরনের সুদ গ্রহণই হারাম
নয়, ঋণ পরিশোধের সময় অবশ্যই পূর্ব হতে নির্ধারণ করা উচিত নয়। ঋণ দানের সময় যে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার বোঝাপড়া হয় তাকে বলে সুদ, অতিরিক্ত অর্থ হিসাবে যদি এক দিরহাম দেওয়ারও চুক্তি হয় তবে সেটা ভয়ানক পাপ হিসাবে পরিগণিত হয়। হানাফী মাজহাব মতে, যদি ঋণ করা অর্থের সমান পরিমাণ অর্থ একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর, শোধ করার চুক্তি হয়, তবে তাও সুদ হিসাবেই পরিগণিত হয়। ধার বাকিতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পরিশোধের সময় অবশ্যই ধার্য্য করে দিতে হবে; তথাপি যদি ঋণকারি ধার্য্য সময়ের পূর্বে তার ঋণ পরিশোধ না করতে পারে এবং সময় বাড়াতে হয় এবং সেই সাথে একটা অতিরিক্ত অর্থ দানের চুক্তি হয়, তবে সেই ধরনের সুদকে বলে মুদাফ ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই ধরনের সুদের কথা আয়াত-ই-করিমাতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
১২) মান্য গণ্য জ্ঞানীদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতার মিথ্যা অভিযোগ ছড়াতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা প্রচার করতে হবে, আর এইভাবে মুসলিমদেরকে তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। আমাদের কিছু গুপ্তচরকে সেইসব স্থানের ছদ্মবেশী জ্ঞানীগুণী সাজবো। তারপর তাদেরকে দিয়ে আমরা জঘন্যতম কার্যকলাপ করাবো। এইভাবে তারা জ্ঞানীগুণীদের প্রতি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে আর সব জ্ঞানীগুণীদেরই তারা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করবে। আমরা মুসলিমদের সাথে জ্ঞানীগুণীদের বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য স্কুল-কলেজ খুলবো এই সকল স্কুলগুলিতে আমরা শিক্ষা দেব বাইজানটাইন, গ্রীক ও আমেরিকান শিশুদের এবং তাদেরকে মুসলিমদের ভয়ানক শত্রু হিসাবে গড়ে তুলব। আর মুসলিম বাচ্চাদের ক্ষেত্রে; আমরা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে দোষী সাব্যস্ত করতে উদ্বুদ্ধ করব, যে তাদের পূর্ব পুরুষরা ছিল অজ্ঞ। এইসব বাচ্চাদের খলিফা, জ্ঞানীগুণী, রাষ্ট্রনেতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে গড়ে তোলার জন্য আমরা তাদের কাছে ঐ সকল ব্যক্তিদের ভুলত্রুটিগুলি সম্পর্কে বারবার করে বলব এবং তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করব এই সব বলে যে, খলিফারা তাদের রক্ষিতাদের নিয়ে মজায় মত্ত, আর তাদের মান্য গণ্য সকল ব্যক্তিরাই নানা ধরনের যৌন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। তারা জনগণের সম্পত্তির অপব্যবহার করছে এবং তারা কোন কাজেই নবীকে মান্য করে না।
১৩) ইসলাম নারী জাতিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে, এই কুৎসা ছড়ানোর জন্য আমরা এই আয়াতটি উল্লেখ করব। "পুরুষেরা নারীদের প্রভু" এবং এই হাদীছটি উল্লেখ করব। "নারীরা হচ্ছে অসংখ্য ত্রুটির সমন্বয়।"
১৪) পর্যাপ্ত জলের ঘাটতির ফলে অপরিচ্ছন্নতা আসে। সুতরাং নানা প্রকার পন্থা অবলম্বন করে আমরা জল সরবরাহের ক্রমোন্নতিকে ব্যাপকভাবে বাধা প্রদান করব। মুসলিমদের শক্ত ঘাঁটিগুলিকে ধ্বংস করার জন্য বইটিতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
১) ইসলামের প্রথম দিককার বীরোচিত কর্মকাণ্ড থেকে তাদের মনকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে জাত-পাত, জাতীয়তা এই ধরনের উগ্রজাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডে প্ররোচিত করতে হবে। উজ্জীবিত করতে হবে ইজিপ্টের ফ্যারাও এর সময় কালকে, ইরানে ম্যাজাই এর শাসন কালকে, ইরাকে ব্যবিলনীয়দের শাসনকালকে, অ্যটিলা এবং চেঙ্গিজযুগকে (দমনপীড়ন মূলক আদর্শ) এইসব প্রচারে উজ্জীবিত করতে হবে অটোম্যানদের মধ্যে (তারা এই বইতে এই বিষয়ে এক দীর্ঘ তালিকা প্রদান করেছে)।
২) নিম্নলিখিত পাপকার্যগুলি অবশ্যই গোপনে অথবা জনসমক্ষে চালু করতে হবে মদ্যপান, জুয়া, যৌন ব্যভিচার, শুকুরের মাংস (খেলাধুলার সাথে যুক্ত ক্লাবগুলির মধ্যে লড়াই) এটা করার জন্য ইসলাম রাষ্ট্রগুলিতে বসবাসকারী খ্রীষ্টান, ইহুদি, সহ ম্যাজিয়ান এবং অপরাপর অ-মুসলিম মানুষদেরকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে হবে। এই সকল উদ্দেশ্য সাধনে যারা কাজ করবে তাদের কমনওয়েলথ মন্ত্রণাগারের অর্থ দপ্তর থেকে উচ্চ বেতনে পুরুস্কৃত করা হবে।
৩) ওদের মধ্যে জেহাদের ব্যাপারে সন্দেহের বীজ বপন কর। তাদের এই বলে প্রভাবিত কর যে জিহাদ হল একটা অস্থায়ী নির্দেশ এবং এটা বর্তমানে সেকেলে হয়ে গেছে এখন আর চলে না।
৪) শিয়াদের মন থেকে এই ধারণা, বিশ্বাসকে দূর করে দাও যে, "অবিশ্বাসীরা ঘৃণ্য"। কুরআনের এই আয়াতটি উল্লেখ কর, কোন পবিত্র গ্রন্থে প্রদত্ত "অন্ন" যেমন তোমাদের জন্য হালাল, তেমনই তোমাদের অন্নও ওদের জন্য হালাল। আর ওদের বলো যে, সফিয়া নামে এক ইহুদী স্ত্রী এবং মারিয়া নামে এক খ্রীষ্টান স্ত্রী ছিল এবং এটাও বলো যে নবীর স্ত্রীরা মোটেই অবৈধ বা ঘৃণ্য হতে পারে না।
৫) মুসলমানদের এই বিশ্বাসের রঙে রঞ্জিত করো যে, "নবী ইসলাম বলতে যে প্রকৃত ধর্মকে বুঝিয়েছেন, ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মও তারই সমগোত্রীয়।" নিম্নলিখিত যুক্তির মাধ্যমে এটাকে ন্যায্য বলে প্রতিপন্ন কর। কুরআন ইসলাম বলতে সকল ধর্মের মানুষকেই বুঝিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ নবী যোশেফ (ইউসুফ আলাইহিস সালাম) দৈবশক্তির কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, "আমাকে হত্যা কর একজন মুসলিম হিসাবে"। নবী ইব্রাহিম ও নবী ইসমাইল প্রার্থনা জানিয়েছেন, "হে আমাদের রব (আল্লাহ), তোমার প্রিয় মুসলিম হিসাবে আমাদের গড়ে তোল এবং আমাদের বংশধরদের মধ্যে থেকে একজন মুসলিম তৈরি কর, "নবী ইয়াকুব তাঁর পুত্রদের বলেছিলেন" মৃত্যুর পূর্বে মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ কর"।
৬) বারংবার পুনরাবৃত্তিকর যে, চর্চা নির্মাণ হারাম নয়, নবী এবং তাঁর খলিফারা গীর্জা বা চার্চ ধ্বংস করেননি বরং পরিবর্তে তাঁরা সেগুলিকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন যেমন কুরআনে লিপিবদ্ধ হয়েছে। "যদি আল্লাহ অন্য উপায়ে কিছু মানুষকে দূর করে না দিতেন, তবে মনাষ্টারী, চর্চা সিনাগগ এবং মসজিদ যেখানে ভীষণভাবে আল্লাহ এরই নাম কীর্তন করা হয়, সেগুলি এতদিন ধ্বংস হয়ে যেত।" এটাও বলো যে, ইসলাম মন্দিরকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে, ইসলাম মন্দির ধ্বংসের পক্ষপাতী নয় আর যারা এগুলি ধ্বংস করতে উদ্ধত হয়, তাদের হাত থেকে ইসলাম এগুলিকে রক্ষা করে।
৭) হাদীছগুলি সম্পর্কে মুসলিমদের দ্বিধাগ্রস্থ কর যেখানে উল্লিখিত হয়েছে, "আরব অঞ্চল থেকে ইহুদীদের উচ্ছেদ কর এবং আরব উপদ্বীপ অঞ্চলে দুটি পৃথক ধর্মের সহাবস্থান সম্ভব নয়" এটা বোঝাওঃ "যদি এ হাদিস দুটি সত্য হয়, তবে নবী কখনো একটা ইহুদি এবং একটা খ্রীষ্টানদের সাথেও কোন সমঝোতা করতেন না।"
৮) মুসলিমদের নানা আরাধনায় বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা কর এবং তাদের আরাধনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত কর এই বলে যে, মানুষের আরাধনায় আল্লাহ এর কোন প্রয়োজন নেই। তাদের "হজ্ব" এ বাধা প্রদান কর এবং অন্য যে কোন আরাধনা যেগুলির মাধ্যমে তারা এক জায়গায় সমবেত হতে পারে, সে সকল কাজে বাধা প্রদান কর। সেই সাথে সাথে মসজিদ, মাজার, এবং মাদ্রাসা নির্মাণ এবং "কাবা" ঘর সংরক্ষণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কর।
৯) যুদ্ধে শত্রুপক্ষের কাছ থেকে আদায় করা "গানিমা" সম্পত্তির ১/৫ অংশ আলেমদের দিতে হবে, শিয়াদের এই আইন সম্পর্কে হতবুদ্ধি করে দাও এবং তাদের এই ব্যাখ্যা দাও যে দার-উল-হার্ব এর কাছ থেকে নেওয়া "গানিমা" সম্পত্তির ১/৫ অংশ মোটেই ব্যবসায়িক উপার্জন হতে পারে না। তারপর এটা
বল যে, হামাস (উপরে উল্লেখিত ১/৫ অংশ) দিতে হবে নবীর নামে অথবা খলিফাগণকে, আলেমগণকে নয়। কারণ আলেমদের বাড়ি, প্রাসাদ, গবাদিপশু, ফলের বাগান প্রভৃতি বহুকিছু দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে হামাস দিতে হবে এটা অনুমোদনযোগ্য নয়।
১০) ইসলাম ধর্মতত্ত্বে বিরুদ্ধ মতের অনুপ্রবেশ ঘটাও আর তারপর ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম হিসাবে সমালোচনা কর। প্রচার কর যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলি অধঃপতনের পথে এগিয়ে চলেছে এবং সেগুলি এক বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে। (বিপরীত পক্ষে মুসলিমরাই এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সুমহান এবং সুসভ্য সাম্রাজ্য গঠনে সক্ষম হয়েছে, তারা অনুজ্জ্বল হয়েছে, যেহেতু তাদের ইসলামের প্রতি অনুগত্য অবনতি ঘটেছে।)
১) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম বাচ্চাদের তাদের পিতার কাছ থেকে পৃথক করে দাও, এইভাবে তাদের গুরুজনদের কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দাও, আমরা তাদের শিক্ষাদেব। পরিণামে পিতা প্রদত্ত শিক্ষা থেকে পৃথক হওয়ার সাথে সাথে, শিশুদের বিশ্বাস-আস্থা এবং ধর্মগুরুদের সাথে সম্পর্ক রাখার সম্ভাবনা অচীরেই বিনষ্ট হবে।
১২) নারীদের তাদের প্রথাগত পর্দাপ্রথা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত কর। এইরূপ মিথ্যার জাল বোন যে, "পর্দা প্রথা প্রকৃতপক্ষে কোন ইসলাম সমর্থিত নির্দেশ নয়। আব্বাস বংশীয়দের শাসনকালে এই প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বের লোকেরা নবীর স্ত্রীগণকে এবং অন্যান্য রমণীগণকে সমস্ত ধরনের সামাজিক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত হতে দেখেছেন। নারীদেরকে তাদের প্রথাগত পর্দার আড়াল থেকে বের করে নিয়ে এসে যুবকদের তাদের প্রতি আকৃষ্ট করো এবং তাদের মধ্যে অভদ্রতামূলক আচার আচরণকে প্ররোচিত কর। ইসলামকে নির্মূল করার এ এক মহাফলপ্রদ উপায়। অ-মুসলমান নারীদের প্রথমে এ কাজে ব্যবহার কর। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে মুসলিম রমণীরা স্বাভাবিকভাবেই পথভ্রষ্ট হবে এবং ঐ সকল অমুসলিম রমণীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে।
১৩) মসজিদের ইমামদের নামে কুৎসা রটিয়ে তাদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি তুলে ধরে জামাতের মুসলিম (যারা প্রতিদিন নামাজের জন্য ইমামদের পশ্চাতে দণ্ডয়মান হয়) এবং ইমামদের মধ্যে বিরোধিতা ও বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করে মিলিতভাবে জামাতে নামাজ পড়ার সমস্ত সুযোগ বানচাল কর এবং একেবারে শেষ করে দাও।
১৪) সমস্ত মাজারগুলি যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়, এই বলো আর এটা বোঝাও যে নবীর সময়ে এসবের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সেই সাথে সাথে মুসলিমদের মধ্যে কবর পরিদর্শনে যাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের সৃষ্টি করে তাদেরকে নবীদের কবর, খলিফা এবং পবিত্র মুসলিমদের কবর পরিদর্শনে যাওয়া থেকে নিরস্ত কর। উদাহরণ হিসাবে বল "নবীর কবর দেওয়া হয়েছিল তাঁর মায়ের পাশে এবং আবুবকর ও উমরের কবর দেওয়া হয়, 'বাকী' নামক কবর স্থানে। উসমানের কবর কোথায় দেওয়া হয়েছিল তা অজ্ঞাত। হানানা নামক কবরস্থানে, হুসেনের মস্তক কবরস্থ করা হয়। আর তাঁর দেহ কোথায় কবরস্থ করা হয় তা অজ্ঞাত কাজিমিয়ার কবরগুলি হল হজরত মুহম্মদের দুই উত্তরাধিকারীর কিন্তু সেগুলি আসলে নবীর দুই উত্তরাধিকারী কাজিম ও জাভেদের
নয়। আর "তুস" শহরের কবরটি আহল-ই-বায়েত (নবীর পরিবার) এর সদস্য 'রেযা' র নয়, সেটি 'হারুন' এর। সামেয়ার কবরগুলি হল আব্বাস বংশীয়দের, আহল-ই-বায়েত এর সদস্য 'হাদি', 'আসকারি' এবং 'মেহেদির' নয়। যেহেতু ইসলামিক রাষ্ট্রগুলিতে সমস্ত সমাধিসৌধ এবং কবরগুলিকে ধ্বংস করে ফেলা একটি ফরজ তাই অবশ্যই "বাকী" -র কবরস্থানটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে।
১৫) মানুষের মনে এই বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি কর যে, সৈয়দ বংশীয়রা আদৌ নবীর বংশধর কিনা। যারা সৈয়দ বংশীয় নয় তাদের কালো ও সবুজ পাগড়ি পরিয়ে সৈয়দ বংশীয়দের মধ্যে মিশিয়ে দাও। লোকেরা এইভাবে বিষয়টা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে এবং পরিণাম ফলস্বরূপ তারা সৈয়দ বংশীয়দের অবিশ্বাস করতে শুরু করবে। ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ আব্বাস বংশীয়দের মাথা থেকে পাগড়ির অধিকার ছিনিয়ে নাও যাতে নবীর বংশ গৌরব হারিয়ে যায় এবং ধর্মীয় কর্তৃপক্ষকে কেউ আর শ্রদ্ধার চোখে না দেখে।
১৬) এটা বলো যে, এটা হল ফরজ। যে সকল স্থানে শিয়ারা শোক প্রকাশ করে, সেই সকল স্থানগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়া। আর এই প্রথাটি ধর্মবিরুদ্ধ ও বিপথগামী। মানুষজনকে ঐ সকল স্থান পরিদর্শনে যেতে বাধা প্রদান করতে হবে, ধর্মগ্রন্থ ব্যাখ্যা তাদের সংখ্যা সেখানে ক্রমশঃ কমাতে হবে এবং ধর্মগ্রন্থ ব্যাখ্যা তা ও শোক প্রকাশ স্থানের মালিকদের উপর কর ধার্য করতে হবে।
১৭) প্রেম ভালোবাসা প্রকাশের স্বাধীনতার অজুহাতে সমগ্র মুসলিমদের এই বলে প্ররোচিত করো যে "প্রত্যেক মানুষেরই নিজের সম্পূর্ণ পছন্দমত কাজ করার স্বাধীনতা আছে। 'আমর-ই-বিল-মারুপ' এবং 'নাহি -ই-আনিল মুনকার' পালন করা বা ইসলামিক নীতি আদর্শ শিক্ষা দান ফরজের মধ্যে পড়ে না।" {বিপরীত পক্ষে আসলে ইসলামের শিক্ষা লাভ এবং ইসলামের শিক্ষা দান হল ফরজ। এটা মুসলিমদের সর্ব প্রথম কর্তব্য।} সেই সাথে সাথে তাদের অন্তরকে এই রঙে রঞ্জিত করো যে, "খ্রীষ্টানরা চলবে তাদের নিজস্ব বিশ্বাস খ্রীষ্টানধর্ম নিয়ে আর ইহুদীরা মেনে চলবে তাদের নিজস্ব ধর্ম মতকে। একজন কখনো অপরজনের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। আমর-ই-বিল-মআরউফ এবং নাহি-ই-আনিল মুনকার হল খলিফাগণের কর্তব্য।"
১৮) মুসলিমদের সংখ্যার ক্রমবৃদ্ধিকে প্রতিরোধ করতে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং বহুবিবাহ প্রথা রদ করতে হবে। বিবাহ বিষয়টিকে আনতে হবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। দৃষ্টান্ত হিসাবে এটা অবশ্যই বোঝাতে হবে যে, একজন আরবি বিবাহ করতে পারে না একজন ইরানিকে, একজন ইরানি বিবাহ করতে পারে না একজন আরবিকে, একজন তুর্কী বিবাহ করতে পারে না একজন আরবিকে।
১৯) ইসলামিক ধর্মপ্রচার বন্ধ করা এবং ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ বন্ধ করা সুনিশ্চিত করতে হবে। এই ধারণাটা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে যে, ইসলাম হল এমন একটা ধর্ম যা আরবদের জন্য উপযুক্ত। এর প্রমাণ হিসাবে কুরআনের এই লাইনগুলিকে উপস্থাপন কর-যেখানে বলা হচ্ছে, 'এই জিকর হল শুধুমাত্র তোমার এবং জনগণের জন্য।'
২০) ধর্ম প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আবদ্ধ করতে হবে। বিস্তৃতভাবে বলা যায় যে, কোন বিশেষ ব্যক্তি নিজের ইচ্ছমত রাষ্ট্রের অনুমোদন ব্যতীত মাদ্রাসা বা অপর-কোন ধর্মপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।
২১) মুসলিমদের মনে কুরআনের পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি কর; মূল লেখাকে বিকৃত করে কোথাও যোগ করে কোথাও প্রক্ষিপ্ত করে পরিবর্ধিত করে কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ কর এবং তারপর বল, কুরআনকে অপবিত্র করা হয়েছে। এই পুস্তকের প্রতিলিপিগুলি একে অপরের সাথে সঙ্গতিহীন। কোন প্রতিলিপির একটা আয়াত অপর প্রতিলিপিতে নেই, "যে সকল বক্তব্যে ইহুদিও খ্রিষ্টানদের অথবা অমুসলিমদের সমালোচনা হয়েছে সেই সকল অংশ বাদ দিয়ে
নতুন পুস্তক প্রকাশ করতে হবে। যে সকল অংশ জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমর-ই-বিল মারুফ এবং নাহি-ই-আনিল মুনকারও বাদ দিতে হবে। কুরআনকে তুর্কী, পার্সি, ভারতীয় প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত করতে হবে। এইভাবে আরবের বাইরে কুরআন যাতে আরবি ভাষায় পড়া বা শিক্ষা না হয় সে বিষয়ে প্রতিরোধ গড়তে হবে। আর তারপর আজান, নামাজ ও দোয়া যাতে আরবের বাইরে আরবি ভাষায় না পড়া হয় সেই বিষয়েও প্রতিরোধ গড়তে হবে।
একইভাবে মুসলিমদেরকে হাদীছ সম্পর্কে সন্দেহযুক্ত করে তুলতে হবে। কুরআনের অনুবাদ সমালোচনা ও প্রক্ষেপ সম্পর্কে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, হাদীছের ক্ষেত্রেও তার প্রয়োগ করতে হবে।
যখন আমি এই পুস্তকখানি গভীর মনোযোগের সহিত পাঠ করলাম, যার নামকরণ করা হয়েছে "হাও কেন বি ডিমলিশ ইসলাম" (কীভাবে আমরা ইসলামকে ধ্বংস করব) আমার মনে হল সত্য সত্যই পুস্তকটি অসাধারণ। এটা ছিল আমি যা করতে চলেছি তার একটি অতুলনীয় পথপ্রদর্শক গ্রন্থ। যখন আমি সেক্রেটারীকে পুস্তকটি ফিরিয়ে দিলাম এবং বললাম যে, পুস্তকটি আমার মনে খুবই আনন্দ দিয়েছে। তিনি বললেন, "তোমার নিশ্চিত জেনে রাখা দরকার যে
এই গুপ্ত কাজে শুধুমাত্র তুমিই নিয়োজিত নও, আমাদের অজস্র লোক একই কাজে নিয়োজিত। আমাদের মন্ত্রণাগার এই মিশনে অন্তত ৫০০০ লোক প্রেরণ করেছে। মন্ত্রনাগার এই কর্মীদের সংখ্যা অন্ততঃপক্ষে ১০০০০০ (একলক্ষ) করতে চায়। যখন আমরা কর্মী সংখ্যা এক লক্ষ করতে সমর্থ হব, আমরা সমস্ত মুসলিমদের আমাদের পদানত করতে পারব এবং সব মুসলিম রাষ্ট্রগুলি দখল করে ফেলতে পারব।"
কিছুক্ষণ পর সেক্রেটারি বলল। "তোমার জন্য সুসংবাদ আছে! এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের মন্ত্রণাগারের একশ বছর লাগবে। ঐ সুখের দিনগুলি দেখার জন্য আমরা হয়তো জীবিত থাকব না কিন্তু আমাদের বংশধর দেখবে। এই বক্তব্যটি কি সুন্দর যে- অন্যরা যা রোপণ করেছে আমি তা গ্রহণ করেছি; তাই আমিও অপরদের জন্য বপন করছি। যখন ব্রিটিশরা এটা করতে সক্ষম হবে, সমগ্র খ্রীষ্টান জাতিকে তারা খুশি করতে পারবে এবং ১২০০ (বারোশত) বছর পুরনো এক ভয়ানক উপদ্রবের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।" সেক্রেটারী আরও বলে চললেনঃ "শত শত বৎসর ধরে চলা ধর্মযুদ্ধের অভিযান কোন কাজেই আসেনি, অথবা মোগল (চেঙ্গিস খাঁর সেনা বাহিনী) দেরও
ইসলামকে উৎপাটনের দায়িত্ব দেওয়া যায় না। কারণ -তাদের কাজ ছিল ক্ষনিক, অনিয়মিত এবং ভিত্তিহীন। তারা সামরিক অভিযান করত তাদের পরাক্রম ও বৈরিতা প্রকাশের জন্য। পরিণামে কিছুকালের মধ্যেই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সম্মানীয় প্রশাসনিক কর্তারা ইসলাম ধ্বংস করতে চাইছে এক অতি সূক্ষ্ম নির্ভুল পথে এবং অসীম ধৈর্য্য সহকারে। আমাদের সামরিক শক্তিও ব্যবহার করতে হবে। যদিও এটা হবে একেবারে অন্তিমে। যখন আমরা ইসলামকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলব। তারও পরে যখন আমরা এটাকে সর্বদিক থেকে আঘাত হেনে এমন এক দুর্বিষহ অবস্থায় ফেলব। যেখান থেকে এটা আর কখনো সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে না এবং আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে না। অবশেষে সেক্রেটারি বললেন, "ইস্তাম্বুলে আমাদের সেরারা খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করছে। তারা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমাদের পরিকল্পনাগুলিকে বাস্তবায়িত করছে। তারা মুসলিমদের মধ্যে মিশে গিয়ে বাচ্চাদের জন্য অসংখ্য মাদ্রাসা খুলেছে। তারা গীর্জা নির্মাণ করেছে। তারা সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছে মদ্যপান, জুয়া, অসভ্যতা প্রভৃতি ছড়াতে এবং উস্কানি দিয়ে তাদের দলে দলে ভাগ করে নিতে এবং ফুটবল ক্লাব গড়তে। যুবক মুসলিমদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে তারা ভীষণভাবে সফল হয়েছে। তাদের সরকারের মধ্যে বিবাদ এবং বিরোধী পক্ষ গঠনেও তারা ভীষণভাবে সফল হয়েছে। তারা সমস্ত জায়গায় বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা কলুষিত করছে সমস্ত প্রশাসক, পরিচালক, রাষ্ট্রনায়কদের, তাদের বাড়িগুলি খ্রীষ্টান রমনীতে পূর্ণ করে। এই সকল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে তারা শক্তিহীন হয়ে পড়ছে। তাদের একতা এবং সংযোগ ক্রমশঃ হীনবল হয়ে পড়েছে। এখন সময় এসেছে আকস্মিক যুদ্ধ সংঘটিত করার এবং ইসলামকে নির্মূল করার।
সপ্তম অধ্যায়
প্রথম গোপন সত্যটি উপভোগ করার পর আমি দ্বিতীয় গোপন সত্যটি জানার জন্য উন্মুখ হলাম। এমতাবস্থায় একদিন সেক্রেটারি তার প্রতিশ্রুতি
মতো দ্বিতীয় গোপন সত্যটি আমার কাছে তুলে ধরলেন। দ্বিতীয় গোপন সত্যটি হল মন্ত্রনাগারে কর্মরত উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের করা পঞ্চাশ পৃষ্ঠার একটি পরিকল্পনা যার মাধ্যমে এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে ইসলামকে সম্মিলিতভাবে উৎপাটন করা হবে। এই ষড়যন্ত্র ১৪টি খন্ড নিয়ে তৈরি। এই ষড়যন্ত্রের দলিলটিকে খুব গোপনে সংরক্ষণ করা হয় মুসলিমদের হাতে পড়ে যাওয়া ও সব ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে। এই ষড়যন্ত্রের ধারাগুলি নীচে আলোচনা করা হলঃ
১) আমাদেরকে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক ভিত্তিতে রাশিয়ার জারের সাথে একটি সুসংহত মৈত্রী ও চুক্তি সম্পাদন করতে হবে; বুখারা, তাজিকিস্তান, আর্মেনিয়া, খোরাসান এবং এই সকল দেশের নিকটস্থ অঞ্চলগুলি দখল করার জন্য। আবার রাশিয়ানদের সাথে একটি নিদারুণ শক্তিশালী চুক্তি সম্পাদন করতে হবে তাদের প্রতিবেশী দেশ তুর্কী দখল করার জন্য।
২) আমাদের ফ্রান্সের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে-ইসলামিক দুনিয়াকে আভ্যন্তরীণ ও বাহির থেকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য।
৩) আমরা তুর্কী ও ইরানি সরকারের মধ্যে ভয়ানক বিরোধ বাঁধিয়ে দেব এবং জাতীয়তাগত এবং জাতিগত চিন্তাভাবনা উভয় পক্ষের মনে ঢুকিয়ে দেব এবং এইভাবে তাদের মনকে পরস্পরের প্রতি বিষিয়ে দেব। প্রতিবেশী মুসলিম জাতি, উপজাতি এবং দেশগুলিকে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইতে লিপ্ত করে দেব। সমস্ত ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলিকে, এমনকি মৃত ধর্মগুলিকে চিহ্নিত করে পুনরুজ্জীবিত করে একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বন্দে লিপ্ত করে দেব।
৪) মুসলিম দেশগুলির অনেকগুলি অংশকে অমুসলিম জাতিগোষ্ঠীর হাতে হস্তান্তর করতে হবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, মদীনা দিয়ে দেওয়া হবে ইহুদিদের হাতে, আলেকজান্দ্রিয়া দেওয়া হবে খ্রীষ্টানদের হাতে। ইমারা দেওয়া হবে সাইবাদের হাতে, কেরমানশাহ দেওয়া হবে নুসাইরিয়া গোষ্ঠীকে যারা আলীকেই শ্রেষ্ঠ বলে মান্য করে। মওসুল দেওয়া হবে ইয়াজিদ বংশীয়দের হাতে, ইরানি উপসাগরীয় অঞ্চল দেওয়া হবে হিন্দুদের হাতে, ত্রিপোলি দেওয়া হবে দ্রুজিদের হাতে এবং কাস দেওয়া হবে আলাভীদের হাতে, মাস্কাট দেওয়া হইবে খারেজী গোষ্ঠীর হাতে। পরবর্তী পদক্ষেপ হল এই সকল গোষ্ঠীকে এমন অস্ত্রে সজ্জিত করতে হবে যাতে এরা ইসলামের দেহের উপর কাঁটার মতো বিরাজ করে এবং তারা তাদের সীমানা বাড়াবে যতদিন না ইসলাম ধ্বংস হয়ে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে।
৫) একটা পরিকল্পনা অবশ্যই উদ্ভাবন করতে হবে মুসলিম এবং অটোম্যন রাষ্ট্রগুলিকে যতটা সম্ভব ছোট ছোট রাষ্ট্রে ভেঙে দেওয়ার জন্য এবং ছোট আঞ্চলিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য, যেগুলি নিজেদের মধ্যে সর্বদাই যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকবে। উদাহরণ হিসাবে বর্তমান ভারতের অবস্থার কথা বলা যায়। নিম্নলিখিত তথ্যটি খুবই প্রচলিত, "ভাঙো আর শাসন কর" অথবা "নিজেদের মধ্যে ভাঙন এলে তোমরা ধ্বংস হবে"।
৬) ইসলামের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত ধর্ম ও সম্প্রদায় তৈরি করে ইসলামের সার বস্তুতে ভেজাল মিশিয়ে গুণমান নষ্ট করা বিশেষ প্রয়োজন। এই কাজ খুব সুক্ষ্মতিসূক্ষ্মভাবে করতে হবে যে, যে নতুন ধর্মগুলি আমরা আবিস্কার করতে চলেছি, সেগুলি অবশ্যই হবে পার্থিব ভোগ লিপ্সায় ভরা উদ্ধত স্বভাবের লোকদের দ্বারা পরিচালিত শিয়া অধ্যুষিত দেশগুলিতে আমরা চারটি নতুন ধর্মের সৃষ্টি করবঃ-
১) একটা যেটা হজরত হুসেনকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে মানে।
২) একটা ধর্ম যেটা জাফর সাদিককে শ্রেষ্ঠ হিসাবে মানে।
৩) একটা ধর্ম যেটা মেহেদিকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে মানে।
৪) একটা ধর্ম যেটা আলী রেযাকে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করে।
প্রথমটি কারবালার জন্য উপযুক্ত দ্বিতীয়টি ইস্পাহানের জন্য তৃতীয়টি সামারার জন্য এবং চতুর্থটি খোরাসানের জন্য। সেই সাথে সাথে আমাদের অবশ্যই বর্তমানের চারটি সুন্নি মাযহাবকে ভেঙে চারটি স্বতন্ত্র ধর্ম গড়ে তুলতে হবে। এইরূপ কর্মকাণ্ডের পর আমরা 'নাজদ্' এ এক নতুন ইসলামিক গোষ্ঠী গঠন করব এবং এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রক্তাক্ত সংগ্রাম বাঁধিয়ে দেব। আর এই চারটি মাজহাবের সমস্ত বই পত্রগুলিকে ধ্বংস করে দেব, যাতে এদের প্রত্যেকেই নিজেদের মনে করে একমাত্র ইসলামের বার্তাবাহক হিসাবে এবং অপরদের মনে করে ধর্মদ্রোহী হিসাবে যাদের হত্যা করতে হবে।
৭) অধর্ম এবং অনিষ্ঠের বীজ, যেমন যৌন ব্যভিচার, সমকামিতা, নেশা, মদ এবং জুয়া খেলা আমরা মুসলমানদের ভেতরে সর্বত্র ছড়িয়ে দেব। দেশের অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে কার্যকরভাবে এ কাজে ব্যবহার করা হবে। আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য সেই উশৃঙ্খল বাহিনী গড়তে বিপুল সংখ্যক সেনা ইতিমধ্যে নিয়োগ হয়ে গেছে।
৮) শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ মূলক ফতোয়া এবং অধিকারিকদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেব। এই সকল নেতৃবর্গকে আমরা (কমনওয়েলথের/ব্রিটিশ কলোনির মন্ত্রণাগার) আমাদের প্রয়োজন মত যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারব এবং তাদের প্রয়োজনগুলোও আমরা পূরণ করব। এদের মাধ্যমে আমরা আমাদের ইচ্ছাগুলিকে নতুন নতুন আইন জারির মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে বাস্তবায়িত করব। আমরা এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করব যেখানে শরীয়ত পালনকারীকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে এবং ইবাদতকারীকে সেকেলে (মানধাতা) হিসাবে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করা হবে। অমুসলিমদেরকে তাদের ধর্মীয় কর্তা সাজিয়ে সমাজের ঐ সকল উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করব, যাতে তারা আমাদের উপরোক্ত কাজগুলি সহজে করতে পারে।
৯) আরবী ভাষা শিক্ষা নিবারণের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। আরবী ভাষার পরিবর্তে ফার্সি, কুর্দিশ এবং পস্তু ভাষাকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। আরব দেশগুলিতে বিদেশী ভাষার প্রচলন ঘটাতে হবে এবং স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। যাতে কুরআন এবং সুন্নাহর অর্থগত পরিবর্তন সহজে ঘটানো হয়ে যায়।
১০) নেতৃবর্গের আশেপাশে আমরা আমাদের (ব্রিটিশ কলোনির মন্ত্রণাগার) লোক নিয়োগ করব, যারা ক্রমে ঐ নেতৃবর্গের সচিব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করে যাবে। এ কাজের জন্য সহজতম পন্থা হল কৃতদাস নিয়োগঃ যে সমস্ত চরদেরকে আমরা কৃতদাস এবং দাসী হিসাবে পাঠাবো, তাদেরকে এ কাজের জন্য যথেষ্ঠ পরিমাণে শিক্ষা দিয়ে দেওয়া হবে। এর পরে ঐ সকল নেতৃস্থানীয়দের নিকট-আত্মীয়দের কাছে সেই দাস দাসীদেরকে বিক্রি করে দেব। সেই দাসদাসীরা, ঐ সকল নেতাদের নিকট আত্মীয়দের প্রদর্শিত পথে চলতে এবং আমাদের লক্ষ্য অর্জন বাধ্য করবে। এভাবে আমরা ঐ নেতৃবর্গের পরিচালক-পরিচালিকা কখনো বা তাদের মা সেজে তাদেরকে এভাবে ঘিরে রাখব যেভাবে চুড়ি একজনের কবজিকে প্রতিনিয়ত আকড়ে থাকতে থাকতে হাতেরই একটা অংশে পরিণত হয়।
১১) আমরা প্রচার পরিধিকে সমাজের পেশাগত প্রান্ত যেমনঃ চিকিৎসা, কারিগরি, হিসাব-নিকাশ ইত্যাদি সমূহ পর্যন্ত বিস্তার করব। আমাদের ধর্ম কেন্দ্রগুলোর আওতায় স্কুল, হাসপাতাল, ধর্মপ্রচার, লাইব্রেরী এবং বিভিন্ন সাহায্যমুখী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের খ্রীষ্টান ধর্মের সকল বই পুস্তক প্রচুর পরিমাণে অবশ্যই আমরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরবরাহ করব। আমরা খ্রীষ্টান ধর্মের ইতিহাস এবং অন্তর্বর্তীকালিন আইন এর পাশাপাশি তুলনামূলক ইসলাম এর ইতিহাস এর বই মুদ্রণ করব। উপরোক্ত ধর্ম প্রতিষ্ঠান এবং চার্চগুলিতে আমরা আমাদের গুপ্তচরদের ধর্মযাজক, সন্যাসী এবং সন্যাসীনির ছদ্মবেশে নিয়োগ করব। এই সব চরদের মাধ্যমে আমরা সমাজে খৃষ্টান ধর্মের প্রতি অনুরাগ এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব দেব। এই গুপ্তচরেরা তাদের (মুসলমানদের) সমাজে সৃষ্ট প্রতিটি ভাবগতি এবং আন্দোলনক চিহ্নিত করবে এবং তৎক্ষণাৎ -তা আমাদের (মন্ত্রণাগারের) কাছে জানিয়ে দেবে। আমরা অধ্যাপক, বৈজ্ঞানিক, অনুসন্ধানী ইত্যাদির ছদ্মবেশে খৃষ্টীয় সেনাদল গঠন করে ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস এবং ধর্ম রীতি ও পদ্ধতি এবং প্রয়োজনীয় দলিল- গুলোকে গায়েব করে দেব এবং তদস্থলে বিকৃত ইতিহাস এবং ধর্ম রীতি পদ্ধতির দলিলগুলো তৈরি করে ঢুকিয়ে দেব। আমরা তাদের (মুসলিমদের) অতি প্রয়োজনীয় সব বইগুলো ধ্বংস করে তাদের শিক্ষা পদ্ধতিকেও সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেব।
১২) আমরা যুবক যুবতী এবং ছেলে মেয়েদের মনে সুকৌশলে ইসলামের বিরুদ্ধে সন্দেহ ও অনিহার বীজ বুনে দেব। আমরা স্কুল, কলেজ, বই, ম্যাগাজিন, ক্লাব, প্রচারণা, চলচ্চিত্র, নাটক, টেলিভিশন ইত্যাদির মাধ্যমে তাদেরকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে দেব এবং এ বিষয়ে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধিরা সাহায্য করবে। আমাদের (ইহুদী এবং খৃষ্টান) অবক্ষয় প্রাপ্ত যুব সমাজ খুব সহজেই ওদের (মুসলমানদের) যুব সমাজকে ফাঁদে ফেলে পথভ্রষ্ট করে দিতে পারবো; কিন্তু ওদের সাথে মেলামেশার পরিবেশ এবং সুযোগ আগে আমাদের তৈরি করে দিতে হবে।
১৩) গৃহযুদ্ধ এবং বিপ্লব সৃষ্টি করে দিতে হবে যাতে মুসলমানরা প্রতি নিয়ত নিজেদের ভিতরে এবং বাহিরে দন্দ্ব এবং যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। ফলে তাদের শক্তি এবং সময় ফুরাবে কিন্তু অগ্রগতি এবং একতাবদ্ধ হওয়ার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের (মুসলমানদের) প্রাণবন্ত মানসিক চেতনা এবং অর্থনৈতিক উৎসগুলোকে নির্মূল করতে হবে। যুবক এবং কর্মঠ ব্যক্তিদেরকে এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যে, তাদের হুমকি এবং অরাজক-গুণ্ডা শক্তির সামনে আদর্শ আত্মসমর্পণ করে।
১৪) তাদের (মুসলিমদের) অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে হবে। তাদের আয়ের উৎসগুলো এবং কৃষি ক্ষেত্রগুলি ধুলিসাৎ করে দিতে হবে। তাদের সেচের নালা এবং খালগুলিকে নষ্ট করে দিতে হবে এবং নদীগুলোকে শুকিয়ে দিতে হবে। এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যে তারা যেন নামাজ, সেই সাথে অন্য কাজ কর্মকেও ঘৃণা করতে শুরু করে। তাদের ভেতর আলস্য এবং শৈথিল্য বিস্তার করে দিতে হবে, সেই সাথে বিভিন্ন ধরণের নেশা ও মদের সর্বব্যাপি প্রচলন ঘটাতে হবে। (উপরোক্ত প্রবন্ধটি সহজে বোধগম্য করার জন্য, পুস্তকটির প্রয়োজনীয় স্থানগুলিতে ম্যাপ, ছবি এবং চার্ট সহকারে ব্যাখ্যা দেওয়া ছিল) এই অদ্ভুত সুন্দর প্রবন্ধটির এক কপি আমাকে দেওয়ায়, আমি সেক্রেটারি মহাশয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম।
একমাস লণ্ডনে কাটানোর পর, আমার কাছে বার্তার মাধ্যমে মন্ত্রনাগার থেকে নির্দেশ দেওয়া হল, "আমি যেন ইরাকে ফিরে গিয়ে মোহাম্মদ -উল-নাজদির সাথে পূণরায় মিলিত হই। আমার কার্য ক্ষেত্রে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে, সেক্রেটারী মহোদয় আমাকে উপদেশ দিলেন, "মোহাম্মদ-উল-নাজদিকে কখনই খাটো চোখে দেখো না। এ পর্যন্ত আমাদের গুপ্তচরদের পাঠানো বার্তায় যা বোঝা যাচ্ছে, মোহাম্মদ-উল-নাজদি ই হচ্ছে সেই বোকা- গাধা, যাকে ভিত্তি করে আমরা, আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারব"।
মোহাম্মদ-উল-নাজদির সাথে খোলাখুলি কথা বলবে। আমাদের প্রতিনিধি ইস্পাহানে তার সাথে খোলাখুলি কথা বলেছে। সে কিছু শর্তসাপেক্ষে আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। তার চুক্তির শর্তগুলো হলঃ
তার মতাদর্শ প্রচার করার সাথে সাথে, সরকার এবং উলামা সম্প্রদায় তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে, যা প্রতিহত করার জন্য তাকে প্রচুর পরিমাণে সহায়- সম্পদ এবং অস্ত্র শস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে হবে। একটা নতুন শরীয়ত তার দেশে চালু হবে, যদিও দেশটা ক্ষুদ্রাকার তবুও আমাদের মন্ত্রণালয় নিম্নলিখিত কাজগুলি তার মাধ্যমে করানোর শর্তসাপেক্ষে তার শর্ত মেনে নিয়েছে। এই সংবাদ শুনে আমি এতো খুশি হলাম যে, আমার মনে হল আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছি। আমি সেক্রেটারি মহোদয়ের কাছে জানতে চাইলাম, "এ ব্যাপারে আমাকে কি করতে হবে?" তিনি জবাবে জানালেন মন্ত্রণাগার সূক্ষ্মভাবে মোহাম্মদ-উল-নাজদির করণীয় দায়িত্বগুলির ব্যাপারে কৌশলগত পন্থা নির্ধারণ করেছে। যেগুলো হল-
১) তাকে ফতোয়া জারি করতে হবে যে "সকল মুসলমান অবিশ্বাসী এবং প্রচার করতে হবে, তাদেরকে মেরে ফেলা, তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া, তাদের সতীত্ব হরন করা, তাদেরকে দাস-দাসী হিসাবে রক্ষিত নেওয়া, যৌনাচার করা এবং কৃতদাস দাসী হিসেবে বাজারে বিক্রয় করা সম্পূর্ণ জায়েয বা হালাল"।
২) তাকে ফতোয়া দিতে হবে, কাবা একটি প্রতিমূর্তি সুতরাং ওটাকে অবশ্যই ভেঙে গুড়িয়ে দিতে হবে। হজ্ব ব্রত পালনকে নিবারণের জন্যে বিভিন্ন উপজাতিদেরকে সে উত্তেজিত করবে যাতে তারা হজ্ব যাত্রীদের মেরে, তাদের সহায় সম্পদ লুটে নেয়।
৩) মুসলমানরা যাতে খলিফার অবাধ্য হয় সে জন্য তাকে সর্বশক্তি ও প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মুসলিমরা যাতে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সে ব্যাপারে সে তাদেরকে উত্তেজিত করবে।
৪) তাকে ঘোষণা দিতে হবে, মাজার, সৌধ এবং ইসলামিক জগতের পবিত্র স্থানসমূহ সবই প্রতিমূর্তি বা বহুদেববাদের নামান্তর সুতরাং সেগুলোকে ধ্বংস করে দিতে হবে।
নবী মুহাম্মদ, তার খলিফাগণ, মাযহাবের আলেম/ইমামগণকে ব্যঙ্গ করার উদ্দেশ্য নতুন আচার -অনুষ্ঠানাদি প্রচলনের জন্য তার সর্ব ক্ষমতা নিয়োগ করতে হবে।
৫) মুসলিম বিশ্বে বিদ্রোহ -অবিচার, অরাজকতাকে উস্কে দেওয়ার জন্য তাকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে।
৬) কুরআনে নতুন নতুন বিষয় সংযোজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে হবে, একইভাবে হাদিস এরও একটা নতুন সংকলন তৈরি করতে হবে।
উপরোক্ত ছয় ধারা কর্মসূচির ব্যাখ্যা প্রদান শেষ করে, সেক্রেটারী মহোদয় যোগ করলেন, "এই বিশাল কর্মসূচী দেখে ঘাবড়ে যেওনা। কারণ, আমাদের দায়িত্ব হল ইসলামকে ধ্বংস করার বীজ বপন করে দেওয়া। এটা বাস্তবায়িত করার কাজ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের। ধৈর্য্যধারণ করা এবং একটার পর একটা পদক্ষেপ নেওয়া বৃটিশ সরকারের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। নবী মুহাম্মদ কি আমাদেরি মত মানুষ ছিলেন না? যিনি ইসলাম ধর্ম প্রবর্তন করেন এবং এই আশ্চর্যজনক সুবিশাল ইসলামিক সভ্যতা গড়ে তোলেন। এই মোহাম্মদ-উল-নাজদি আমাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, তার নবীর মত আমাদের ধর্মটাকে সে প্রতিষ্ঠিত করবে। দুদিন পর, আমি আমার মন্ত্রী এবং সেক্রেটারি মহোদয় থেকে অনুমতি নিয়ে আমার পরিবার এবং বন্ধু বান্ধবকে বিদায় জানিয়ে বসরা রওনা হলাম। আমি বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে আমার বাচ্চা ছেলেটা বলল, "বাবা শীঘ্র বাড়ি ফিরে এসো।" আমার চোখে জল এসে গেল। এই দুঃখ, আমি আমার স্ত্রী থেকে লুকোতে পারলাম না। বড় ক্লান্তিকর সফরের মধ্যে দিয়ে রাত্রে বসরায় পৌঁছলাম। আমি আব্দুর রেযার বাড়িতে গেলাম। সে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম থেকে জাগার পর আমাকে দেখে সে ভীষণ খুশি হল। সে আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। আমি রাতটা ওর ওখানে কাটালাম। পরদিন সকালে সে আমাকে বলল, "মোহাম্মদ-উল-নাজদি এসেছিল এই চিঠিটা সে তোমার জন্য দিয়ে চলে গেছে।" আমি চিঠিটা খুললাম। সে লিখেছে, 'সে নাজদ রওনা হয়ে যাচ্ছে এবং তার ঠিকানা দিয়ে গেছে।' আমিও তৎক্ষণাৎ ওর ওখানে যাওয়ার জন্য রওনা হলাম। অত্যন্ত ক্লেশকর একটা সফরের পর আমি তার ওখানে পৌঁছলাম। আমি মোহাম্মদ-উল-নাজদিকে বাড়িতেই পেলাম। সে ভীষণ রোগা হয়ে গেছে, এ ব্যাপারে আমি তাকে কিছু বললাম না। পরবর্তীতে আমি জানতে পারলাম সে বিয়ে করেছে। আমরা পরামর্শ করলাম যে, জনসমক্ষে সে আমার পরিচয় দেবে তার দাস হিসাবে এবং বলবে, আমাকে কোন কাজে পাঠিয়েছিল 'যেখান থেকে এখন আমি ফিরে এসেছি।' কথামত সে এভাবেই আমার পরিচয় করিয়ে দিল।
আমি মুহাম্মদ-উল-নাজদির সাথে দুই বছর ছিলাম। তার আহ্বান ঘোষণার জন্য আমি একটা অনুষ্ঠান করলাম। অবশেষে হিজরী সন ১১৪৩ অব্দে (১৭৩০ খ্রীষ্টাব্দে) আমি তার প্রস্তাবের খসড়া প্রস্তুত করলাম। এইভাবে তার চারিদিকে সমর্থক সংগ্রহ করে তাদের মধ্যে যারা তার খুব আপন হয়ে উঠল, তাদের অন্তরে তার আহ্বানের গুপ্ত বক্তব্যগুলির নিপুনভাবে অনুপ্রবেশ ঘটাতে লাগলাম। আমি তার চারধারে রক্ষী নিয়োগ করলাম, তার শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। আমি তারা যতখানি চাইল, তাদের তত সম্পত্তি ও অর্থ দিলাম। যখনই মুহাম্মদ -উল-নাজদির শত্রুরা তাকে আক্রমণ করতে চাইল, আমি তাদের অর্থাৎ তার রক্ষীদের সতর্ক করলাম। যখন তার আহ্বান আরও বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, তার শত্রুর সংখ্যাও ক্রমশ বাড়তে লাগল। অনেক সময় সে তার আহ্বান পরিত্যাগ করার কথা বলত। বিশেষতঃ তার উপর আক্রমণের মাত্রা যখন ব্যাপকতর হয়ে উঠত ভীত বিহ্বল হয়ে। আমি কখনই তাকে একা ছেড়ে দিতাম না এবং তাকে সর্বদাই উৎসাহ দিতাম। আমি তাকে বলতাম, ওহে মুহাম্মদ-উল-নাজদি তুমি এতদিন ধরে যা উৎপীড়ন সহ্য করেছ, তোমার ধর্ম বিশ্বাসের কারণে নবী তার চেয়ে বহুগুন বেশি অত্যাচার সহ্য করেছেন। তুমি জানো, এতে আরও সম্মান বৃদ্ধি পায়। অন্য যে কোন বিপ্লববাদীদের মতো, তোমাকেও কিছু বিপদ আপদের মধ্যে দিয়েই অগ্রসর হতে হবে।
প্রতি পদে পদে শত্রুদের আক্রমণ হতে লাগল তার শত্রুদের হাত থেকে তাকে রক্ষার জন্য আমি গুপ্তচর নিয়োগ করলাম। যখনই তার শত্রুরা তার উপর হামলার ছক কষত, গুপ্তচরেরা আমায় খবর পাঠাত এবং আমি তাদের পরিকল্পনা বানচাল করে দিতাম। একদিন আমাকে সংবাদ পাঠানো হল যে, শত্রুরা তাকে হত্যার ছক কষেছে। তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার জন্য আমি পূর্ব হতে সমস্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলাম। যখন মুহাম্মদ-উল-নাজদির চারপাশের ব্যক্তিরা শত্রুদের এই পরিকল্পনার কথা শুনল; তারা তাদেরকে আরও ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। শত্রুরা যে ফাঁদ পাতল, সে ফাঁদে তারা নিজেরাই পড়ল।
মুহাম্মদ-উল-নাজদি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিল যে, এই পরিকল্পনার ছয়টি (৬) ধারাকেই সে ফলপ্রসূ করবে এবং বলল, "বর্তমান সময়ের পরিস্থিতিতে আমি শুধুমাত্র সেগুলিকে আংশিকভাবেই সম্পাদন করতে পারি।" সে যা বলেছে, সেটা প্রকৃতই সত্য ছিল। সেই সময়, সেগুলির সবকটিকে বাস্তবায়িত করা তার পক্ষে প্রকৃতই অসম্ভব ছিল।
সে দেখল যে "কাবা ধ্বংস করা একেবারেই অসম্ভব, আর "কাবা" হচ্ছে একটা পুতুল মাত্র এই কথা ঘোষণা করার চিন্তা সে মাথা থেকে দূর করল। সেই সাথে সাথে কুরআনের কথার পরিবর্তিত রূপযুক্ত নতুন কুরআন প্রকাশের কথা প্রত্যাখ্যান করল। এ বিষয়ে সে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতে লাগল মক্কার শরীফদের এবং ইস্তাম্বুলের সরকারক"। সে আমাকে বলল যে, "যদি এখনই আমরা এই দুটি ঘোষণা করি, তবে আমরা একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী দ্বারা
আক্রান্ত হবো।" আমি তার আপত্তিটি গ্রহণ করলাম। কারণ সে সঠিক কথাই বলেছিল। সেই সময় পরিস্থিতি মোটেই অনুকূল ছিল না।
আরও দুই বছর পর কমনওয়েলথ এর মন্ত্রণাগার দরিয়া নামক স্থানের আমির মুহাম্মদ বিন সাউদকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে আমাদের তৈরি করা আদর্শে যুক্ত করতে সমর্থ হল। তারা আমাকে এই বিষয়ে অবগত করানোর জন্য একজন বার্তা বাহককে প্রেরণ করল এবং এই দুই মুহম্মদের মধ্যে একটা পারস্পরিক মধুর ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিল। ফলে মুসলিমদের হৃদয় এবং বিশ্বাস অর্জনের জন্য আমরা ধর্মীয়ভাবে ব্যবহার করলাম।
মুহম্মদ-উল-নাজদিকে এবং রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করলাম মুহম্মদ-বিন-সাউদকে। এটা একটা ঐতিহাসিক সত্য যে, ধর্মকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী হয়, অধিক শক্তিশালী হয় এবং হয় অধিক প্রশংসনীয়।
এইভাবে আমরা ক্রমশ হয়ে উঠলাম অধিক থেকে অধিকতর শক্তিশালী। দারিয়া শহরকে আমরা আমাদের রাজধানী বানালাম। আমরা আমাদের এই নবপ্রতিষ্ঠিত ধর্মের নাম দিলাম ওয়াহাবী ধর্ম। আমাদের মন্ত্রণাগারের সমর্থনে এক গুপ্ত পথে ওয়াহাবী সরকার গঠিত হল সেই দেশে। এই নতুন সরকার দাস ক্রয়ের নাম করে যুদ্ধ ফেরত এবং আরবী ভাষা সম্পর্কে উপযুক্ত শিক্ষিত এগারো জন ব্রিটিশ অফিসার ক্রয় করল। এই অফিসারদের সহযোগিতা নিয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা স্থির করলাম। উভয় মোহাম্মদ'ই আমাদের প্রদর্শিত পথ সুন্দরভাবে অনুসরণ করতে লাগল। যখন আমরা মন্ত্রণাগারের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ পেতাম না, আমরা নিজেরাই আমাদের পরিকল্পনা স্থীর করতাম।
আমরা সবাই বিভিন্ন উপজাতিদের মেয়ে বিবাহ করলাম। একজন মুসলমান স্ত্রীর স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসার আনন্দ আমরা উপভোগ করলাম। এইভাবে উপজাতিগুলির সাথে আমাদের শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে উঠল। সবকিছুই এখন বেশ সুষ্ঠভাবে চলছে প্রতিনিয়ত, আরো বেশি আঁট ষাট বেঁধে সকল ক্ষমতা দখল করে আমরা গেড়ে বসছি।
আমাদের ক্ষমতা ও অর্থের কেন্দ্রীকরণ প্রতিদিন আরোও বেশি বেশি করে শক্তিশালী হচ্ছে। যদি কোন আকস্মিক মহাদুর্ঘটনা না ঘটে, আমরা যে খাদ্য প্রস্তুত করেছি সেটা আমরা খেতে পারবই পারব। কারণ যা যা প্রয়োজন ছিল তার সবই আমরা করেছি এবং বীজ বপন করে ফেলেছি।
______ সমাপ্ত ______
Comments
Post a Comment