আযানের আগে দরূদ পড়া জায়েয
কিতাবঃ আযানের আগে দরূদ পড়া জায়েয
রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (মা.জি.আ.)
প্রকাশনায়ঃ আন্জুমানে কাদেরীয়া চিশ্তীয়া আজিজিয়া, বাংলাদেশ।
اَلصَّلَواةُ عَلٰى حَبِيْبِ الرَّحْمٰنِ قَبْلَ الْاِقَامَةِ وَالْاَذَانِ
আচ্ছালাতু আ’লা হাবিবির রহমান ক্বাবলাল ইক্বামাতে ওয়াল আজান (আযানের আগে দরূদ পড়া জায়েয)
সার্বিক তত্ত্বাবধানঃ শাহজাদা আল্লামা আবুল ফরাহ্ মুহাম্মদ ফরিদউদ্দিন
অধ্যক্ষ- ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মুঈনীয়া কামিল মাদ্রাসা
অনুবাদঃ গোলাম মোহাম্মদ খান সিরাজী
সংস্করণঃ এম.এম. মহিউদ্দীন
নির্বাহী সম্পাদক- মাসিক আল-মুবীন
টেক্সট রেডীঃ মাসুম বিল্লাহ সানি
(লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত)
প্রকাশকাল
১ম প্রকাশ- ১২ রবিউল আউয়াল ১৪০১, জানুয়ারি ১৯৮১ ইংরেজি
২য় প্রকাশ- ১লা জুলাই ২০০৮ ইংরেজি
৩য় প্রকাশ- ১লা জুন ২০১৭ ইংরেজি
অর্থায়ন
আলহাজ্ব জহুর আহমদ
এর পক্ষে ছেলে
মোহাম্মদ আলমগীর সওদাগর (বি.এ)
মোজাফ্ফর পুর, মেখল, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
হাদিয়া : ৬০ (ষাট) টাকা মাত্র
গ্রন্থকারের কথা
اللهم يا من خلقت العالم لاجل حبيبك المصطفٰے صاحب الشرعية والبرهان وجعلت الصلوٰة والسلام عليه قرار لنا فى كل اوقات الامكان لك الحمد والثناء والكبرياء والامتنان والصلوٰة والسلام عليك يا سيد بنى عدنان وعلٰى اٰلك واصحابك يا خير الرسلان – امّا بعد
আল্লাহপাক জাল্লা শানুহুর হাম্দ ও রাসূলে পাক (ﷺ)-এর দরূদ শরীফের পর- অবগত হওয়া আবশ্যক যে, আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পাঠ করা হয়। কোন কোন আলেম উক্ত কাজটাকে বেদা’ত কিংবা হারাম বা নাজায়েয বলে থাকেন। আরো জানা যায় যে, কোন একটা মসজিদে আজান দেয়ার পূর্বে ঘন্টা বাজানো হত। তাতে লোকেরা বলেছিলেন, ঘন্টা বাজানো অবৈধ (হারাম) বরং এক্ষেত্রে আল্লাহর হাবীব (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ করা অনেক উত্তম ও উৎকৃষ্ট কাজ। আমার কিছু বন্ধু এ ব্যাপারে আমার কাছে জানতে চাইলেন যে, শরীয়তে এর বৈধতা কতটুকু, আর এর হুকুম কি হবে? তাই আমি এ বিষয়ে সকলের অবগতির জন্য অত্র কিতাবখানা রচনায় যত্নবান হলাম।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা প্রদানের আগে সম্মানিত পাঠকমহলের নিকট আবেদন, তাঁরা যেন আমার এই সংক্ষিপ্ত পুস্তকখানা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়ে দেখেন; যাতে উক্ত মাছআলা সহজে বোধগম্য হয়। মাঝে মাঝে কিছু কিছু পড়লে আসল মাছআলাটা ভালভাবে বুঝে আসবে না। বাস্তবিক পক্ষে আজানের পূর্বে শিংগা বা ঘন্টা (নাকারা) বাজানো মাকরূহে তাহরীমী বা অবৈধকারক বিশ্রী। খ্রিষ্টানদের আজান হলো ঘন্টা বাজানো।
আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ তেলাওয়াত করা আমার তাহ্কীক বা গবেষণা অনুযায়ী জায়েয, বৈধ ও মুস্তাহাব।
ইতি:
মুহাম্মদ আজিজুল হক আল্-কাদেরী
পবিত্র আয়াতে কোরআন দ্বারা দরূদ পড়ার ব্যাপকতা
❏ আল্লাহ্ পাক কালামে পাকে ইরশাদ করেন:
إِنَّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيْمًا .
অর্থাৎ- নিশ্চয়ই আল্লাহ্পাক এবং তাঁর সকল ফেরেশতা অদৃশ্য জ্ঞানের সংবাদদাতা নবী করীম (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ করেন। (অতএব) ওহে ঈমানদারগণ! তোমরা সেই নবী মুস্তফা (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ কর এবং সালামের মত সালাম দাও।
উক্ত আয়াতে করীমাটি সর্বসাকুল্যতার ব্যাপারে একক (মুতলাক্ক) অর্থাৎ- আল্লাহর এই নির্দেশগুলি কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর নিবদ্ধ বা সীমিত নয়। উচ্চস্বরে, নীচ স্বরে, দাঁড়ানো, বসায়, স্থান, কাল ইত্যাদি কোন অবস্থা বা কোন প্রকারের কথার উলেখ নাই। সুতরাং শরীয়তের নিষেধাজ্ঞা বা প্রতিবন্ধকতার কারণ না থাকলে নির্দ্বিধায় যে কোন অবস্থায় খুশি মত নবী মুস্তফা (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা জায়েজ ও মুস্তাহাব প্রমাণিত হল। সমগ্র উম্মতে ইজাবত বা যারা প্রিয়নবী (ﷺ)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন অর্থাৎ সমস্ত ঈমানদার নবী মুস্তফা (ﷺ)-এর করুণাকামী। তাঁরই দুয়ারের ভিখারী। তাই সর্বপ্রকার মঙ্গল ও উন্নতির সোপান হল রাসূলে পাক (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা।
صلوا عليه وسلموا : قوله تعالى
❏ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাহুল বারী الاقتداء بالمخالف নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন:
ومن المعلوم ان الاصل فى كل مسئلة هو الصحة واما القول بالفساد والكراهة فيحتاج إلى حجة من الكتاب والسنة اواجماع الامة .
জ্ঞাতব্য যে- প্রত্যেক মাসআলা মূলত বিশুদ্ধভাবে হওয়াই ছহীহ্ আর প্রত্যেক নিষিদ্ধ ও মাকরূহ বলার ক্ষেত্রে কোরআন, সুন্নাহ কিংবা ইজমায়ে উম্মাত (সকলের ঐক্যমত) এর দলিলের প্রয়োজন।
আর এখানে صلوا عليه وسلموا সাধারণভাবে উলেখ রয়েছে। যেখানে স্থান-কালের কোন নির্ধারণ নাই। কাজেই আজানের আগে-পরে দরূদ শরীফ পাঠ করা অতীব ছওয়াবের কাজ এবং তা জায়েয হওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নাই। তবে আজানের বাক্যের সাথে সম্পৃক্ত না হওয়ার দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা আবশ্যক।
বর্তমান ফিৎনা-ফ্যাসাদের যুগ। অনেক মসজিদে ইমাম বদ্আক্বীদার লোক হবে। এমনকি কাদিয়ানী, শিয়া, খারেজী ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোকগণও আজান দিয়ে থাকে। লোকগণ ধোঁকায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কাজেই যখন আজানের আগে-পরে দরূদ শরীফ পাঠ করবে তখন ছহীহ্ আক্বীদা পোষণকারীদের জ্ঞাত হওয়া যাবে কোনটি বিশুদ্ধ আক্বীদার মসজিদ, আর কোনটি নয়। যাতে করে বিশুদ্ধ আক্বীদাপন্থীদের সাথে নামাজ আদায় করতে পারে। বদ আক্বীদাপন্থীদের থেকে পরহেজ থাকতে পারে।
❏ ‘কাশফুল ইরতিয়াব’ গ্রন্থে ১৪৪ পৃষ্ঠায় উলেখ আছে:
الادلة الشرعية بعمومها او اطلاقها على استحباب الصلواة على النبى صلّى الله عليه وسلّم فى اى وقت كان .
সাধারণভাবে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী নবী করীম (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ করা যে কোন সময়ে যে কোন স্থানে যখনই হউক না কেন তা মোস্তাহাব নিষিদ্ধ সময় ব্যতীত।
সমস্ত সৃষ্টি হুজুর (ﷺ)-এর মুখাপেক্ষী
❏ মাওলানা আরেফ রুমী স্বীয় মছনবী শরীফে উলেখ করেছেন:
زيں سبب فرمود حق صلوا عليه
كه محمد بود محتاج اليه
অর্থাৎ-আল্লাহ্ পাক নবী মুস্তফা (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করার আদেশ দিয়ে ‘ছল্লু আলাইহি’ বলেছেন; কেননা সমস্ত মুসলমান নর-নারী নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর দিকে মুখাপেক্ষী। এমন কি সমগ্র নবী (عليه السلام)ও তাঁরই মুখাপেক্ষী। যেমন:
❏ ইমাম বুছিরী (رحمة الله) স্বীয় কছিদা বুরদাহ শরীফে উলেখ করেছেন:
وكلهم من رسول الله ملتمس
غرفا من البحر او رشفا من الديم
অর্থাৎ- সকল আম্বিয়া কেরাম (عليه السلام) মুস্তফা (ﷺ)-এর (মা’রেফত) সমুদ্র হতে অথবা করুণা বারি হতে একটি মাত্র বিন্দু লাভের আশায় তাঁর নিকট প্রার্থনা করে থাকেন। এমন কি সমগ্র সৃষ্টিজগত তাঁর মুখাপেক্ষী।
যেমনঃ
❏ আ’লা হযরত মুজাদ্দেদে মিল্লাত শাহ্ আহমদ রেজা খান (رحمة الله) আপন কাব্যগ্রন্থে উলেখ করেছেনঃ
سياه لباسان دارد نياء وسبذ پوشان عرش اعلے
هراك هے انكے كرم كا پياسا يہ فيض انکى جناب ميں هے
কথা ও কাজে বিপরীতমুখী ধর্মে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। আমাদের এক সম্মানিত মাওলানা সাহেবের নিকট কেউ জিজ্ঞাসা করলেন যে, হুজুর! আজানের আগে দরূদ শরীফ পড়া কি? উক্ত মাওলানা সাহেব নিশ্চিন্তে জবাব দিয়ে ফেললেন যে, বেদা’ত। তবে উক্ত মাওলানা সাহেবের একটা নৈমিত্তিক অভ্যাস ছিল যে, যখন কোন নামাজের মুনাজাতের জন্য তিনি হাত উঠাতেন তখন কোন দোয়ায়ে মাছুরা ছাড়াই শুধু:
اَلصَّلَوٰةُ وَالسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ الله اَلصَّلَوٰةُ وَالسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا حَبِيْبَ الله
(আচ্ছালাতু ওয়াচ্ছালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্)
এতটুকু বলেই মুনাজাত শেষ করতেন। এ ব্যাপারে তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হল যে, এ ধরনের মুনাজাত তো পূর্ববর্তী বা পরবর্তী কোন ধর্মবিশারদ (ছলফ বা খলফ) হতে বর্ণিত নাই। তথাপিও আপনি দরূদ শরীফকে মুনাজাত সাব্যস্ত করেন এবং জায়েয বলে স্বীকার করেন ও আমল করেন আর আজানের পূর্বে দরূদ পাঠ করাকে বেদা’ত বলেন এটা কোন্ ধরণের কথা? একথা শোনে উক্ত মাওলানা সাহেবের গালে মাছি যাওয়া অবস্থা হয়েছিল একেবারে লাজওয়াব।
রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্র নামের চর্চা এবং ঐ নামের প্রতি দরূদ পড়া কোরআন ভিত্তিক বিধান
আসুন এবার আমি পাঠকবৃন্দের অন্যজগতে ভ্রমণ করাব।
❏ আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেনঃ وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ অর্থাৎ- আমি আপনারই সন্তুষ্টিকল্পে আপনার প্রশংসাগীতিকে বহু ঊর্ধ্বে উত্তোলন করে দিয়েছি। এই আয়াতে পাকে হুজুর পাক (ﷺ)-এর প্রশংসা করা, উনার উপর দরূদ শরীফ পাঠ করা, তাঁর নামসমূহ উচ্চরবে ডাকা সবই অন্তর্ভূক্ত। তফসীরে ‘খাজায়েনুল এরফান’ কিতাবে একটা হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। এতে উলেখ হয়েছে যে, রাসূলে পাক (ﷺ) উক্ত আয়াতের ভাবার্থ সম্পর্কে হযরত জিব্রাঈল আমিনের নিকট জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন- আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, “আপনার গুণগান উন্নত করার অর্থ হল যখন যেখানেই আমার জিকির করা হবে সাথে সাথে আপনারও জিকির করা হবে।” আল্লাহ্ পাকের স্মরণের সাথে সাথে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর নামও লওয়া হবে।
❏ ভারতের হযরত জিয়াউদ্দিন (رحمة الله) তার কবিতায় কতই না সুন্দর বলেছেনঃ
قلم هر گاه رقم نام خدا كرد
رقم نام محمد مصطفٰے كرد
যেথায় কলম খোদার নাম লিখিল
পাশেতে নূরনবীর নাম লিখিল।
❏ অপর এক কবি বলেছেন:
كلمه ونماز ميں تكبير واذان ميں
هے نام الهى سے ملا نام محمد
❏ হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ফরমান উক্ত আয়াতের ভাবার্থ হল আজান, তাকবীর, তাশাহুদ, মিম্বরের উপর খুতবা পাঠ ইত্যাদিতে কেউ যদি আল্লাহ্ পাকের ইবাদত করে, প্রত্যেক ব্যাপারে আল্লাহকে স্বীকার করে আর আকায়ে দো’আলম (ﷺ)-এর স্বীকারোক্তি না করে তা হলে সব ইবাদত বন্দেগী অকেজো, নিস্ফল, সব মাঠে মারা যাবে। ইবাদতকারী কাফেরই থেকে যাবে।
❏ হযরত কাতাদাহ (رضي الله عنه) ফরমানঃ আল্লাহ্ তায়ালা নূরনবী (ﷺ)-এর জিকিরকে ইহকাল ও পরকালে সুশোভিত করেছেন, বুলন্দ করেছেন। প্রত্যেক খুতবা পাঠকারী প্রত্যেক তাশাহুদ পাঠকারী
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ
(আমি মা’বুদ হিসাবে এক আল্লাহকেই স্বীকার করতেছি) পড়ার সাথে সাথে
أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ
(আমি মুহাম্মদ (ﷺ)-কে আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকার করতেছি) এই বাক্যটাও পাঠ করে থাকেন।
মোদ্দাকথাঃ হযরত রাসূলে পাক (ﷺ)-এর পবিত্র নাম উচ্চস্বরে বলা, ঐ নামের গুঞ্জন ও চর্চা করা এবং ঐ নামে ডাকার অভ্যাস করা ঐ নামের প্রতি দরূদ পাঠ করা পবিত্র কুরআন ভিত্তিক বিধান বলে প্রমাণিত হল। যার অন্তরে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর প্রতি বিদ্রূপ ও অভক্তি আছে সে-ই একমাত্র উক্ত বিধিকে অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু খোদার প্রতিশ্রুতি আছে যে, নিজের নামের সাথে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর নাম পাকও কিয়ামত পর্যন্ত সর্বকালে সর্বস্থানে সমুন্নত, সমুজ্জ্বল ও প্রচলিত রাখবেন। যদিও বা মুনাফিক (বিশ্বাসঘাতক)রা ঠাট্টা ও অস্বীকার করে থাকে।
❏ আ’লা হযরত বর্তমান শতাব্দীর মুজাদ্দিদ মাওলানা শাহ আহমদ রেজা খান (رحمة الله) কতই না সুন্দর বলেছেনঃ
مٹ گئے مٹتے هيں مٹ جائنگے اعداتيرا
نه مٹا هے نه مٹيگا كبهى چرچاتيرا
নূরনবী (ﷺ)-এর নাম মোবারক এবং দরূদ শরীফ শুনে ঐ ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয় আর মুখ মলিন করে, যে ব্যক্তি আড়ালে মুনাফিক এবং আত্মিক জগৎ হতে হতভাগ্য ও মন্দ কপাল। যিনি মুসলমান মুমিন তিনি কখনও নাখোশ বা অসন্তুষ্ট হতে পারেন না। হবেই বা কেমনে যে মধুমাখা নাম অন্তরকে দান করে অনাবিল আনন্দ, সে নামে পাওয়া যায় ঈমানের স্বাদ। যে নামের উপর বাকবিতন্ডা করা কখনও সম্ভব নয়। এটা তো পথভ্রষ্ট ‘খারেজী’দের লক্ষণ।
আল্লাহর নামের সাথে হুজুর (ﷺ)-এর নাম মোবারক বিদ্যমান
আল্লাহ্ পাক প্রত্যেক জায়গায় নিজের নামের সাথে আপন মাহবুব (ﷺ)-এর নাম পাককে মহীয়ান করেছেন এবং মাহবুব (ﷺ)-কে স্মরণ করাকে নিজকে স্মরণ করা আর তাঁর প্রশংসাকে নিজের প্রশংসা বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং নিজের বহু প্রশংসাসূচক নাম যেমন: রউফ, রহীম, করীম, মুহী, আলেম, আ’লীম প্রভৃতি নাম আপন বন্ধু মুস্তফা (ﷺ)-কে দান করে দিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও এমন দরূদ শরীফ ও নাম মোবারককে ঘৃণা করা যাদের অন্তর মৃত, কলুষিত ও অপবিত্র তাদের কাজ।
❏ জনৈক কবি সুন্দর করে সাজিয়েছেন:
در مصطفٰے سے پهر جانا يه كوئـى هو شمندى هے
مسلمان پهر نهيں سكتا پهرے توخارجى هے
একথা স্মরণ রাখা চাই যে, আল্লাহ্ তায়ালা মা’বুদ হওয়া, ইবাদত তাঁর জন্যই হওয়া, তিনি সৃষ্টিকর্তা হওয়া, নিজের প্রত্যেক গুণাবলীতে অনাদিকাল হতে ভূষিত হওয়া প্রভৃতি আল্লাহ্ পাকের বিশেষত্ব এবং ওগুলিতে তিনি একক সত্তা।
উপরোলেখিত বিশেষণ হতে একথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহ্ পাকের মর্যাদা ও মহানুভবতার পর পরই রাসূলে পাক (ﷺ)-এর মর্যাদা, মহানুভবতা ও মহত্বের স্থান।
❏ আল্লামা শেখ সাদী (رحمة الله) বলেনঃ
بعد از خدا بزرگ توئى قصه مختصر
অতএব, যে কেউ সেই মহাসম্মানিত সত্তা (জাত) নূরনবী (ﷺ)-এর উপর তিল পরিমাণ অপমানজনক কোন ব্যবহার করে এবং ঐ মহাসত্তার মান মর্যাদাকে ক্ষুদ্র ও হীন মনে করে তাহলে সে কাফের, মালাউন ও মরদুদ। বিতাড়িত ও অভিশপ্ত। যেমনঃ
❏ তফসীরে ছাবী ৩য় খন্ড ১২৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছেঃ
ان من استخف بجنابه صلّى الله عليه وسلّم فهو كافر ملعون فى الدنيا والاخرة .
অর্থাৎ- একথা নিশ্চিত যে, যে ব্যক্তি হুজুর পাক (ﷺ)-এর জাতে পাক (অস্তিত্ব) ও মান মর্যাদা এবং সম্মানসূচক সম্বোধনকে ক্ষুদ্র ও সাধারণ মনে করবে সে ব্যক্তি কাফের এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সে বিতাড়িত ও অভিশপ্ত।
با خدا ديوانه باش وبا محمد هو شيار
খোদার সাথে পাগলামী, মাতলামী সব খাটে কিন্তু খোদার বন্ধু মুস্তফা (ﷺ)-এর সাথে কোন প্রকারের পাগলামী চলে না। উনার দরবারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
❏ অসভ্য-বর্বরদের উপর দুঃখ প্রকাশ করে মাওলানা শাহ্ আহমদ রেজা খান (رحمة الله) স্বীয় কাব্যগ্রন্থে উলেখ করেছেনঃ
اور تم پرميرے آقا كى عنايت نه سهى
نجديو كلمه پڑهانے كا بهى احسان گيا
আজান ইবাদত সমতুল্য, ইবাদতের পূর্বে সতর্ক
স্বরূপ দরূদ পাঠ করা জায়েয ও বৈধ
এখন আমি মূল বক্তব্যের দিকে ফিরে যাচ্ছি। জেনে রাখা ভাল যে, আজানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করা কোন প্রকার দোষনীয় নয় এবং তাতে আজানের বাক্যগুলোতে কোন প্রকার পরিবর্তন ঘটে না। হ্যাঁ, যদি আজানের বাক্যগুলো বর্জন করে শুধু দরূদ শরীফকে আজান বলে অভিহিত করা হয় তাহলে তা জায়েয হবে না। কারণ আজানের বাক্যগুলো শরীয়তে নির্ধারিত হয়েছে। আজানের সময় দরূদ শরীফ পাঠ করলে বেশ কয়েকটি উপকার হয়ে থাকে। লোকেরা যখন ঐ সময় দরূদ শরীফ শুনে তখন তাড়াতাড়ি আজান শোনার জন্য ওদিকে মনোনিবেশ করে এবং ভালভাবে আজান শুনার জন্য তৈরী হয়ে যায়, আর নামাজের দিকে ধাবিত হয়। অথবা এটাও বলা চলে যে, আজানটা নামাজের ঘোষণা বা আহ্বান অথবা ইবাদত সমতুল্য। সুতরাং ইবাদতের পূর্বে সতর্ক করে দেয়া জায়েয ও বৈধ।
❏ যেমন প্রসিদ্ধ একটি উক্তি আছেঃ
التنبيه للعبادة مشروع
অর্থাৎ- ইবাদতের জন্য হুঁশিয়ার করে দেয়া শরীয়ত সম্মত।
সুতরাং ঐ সময়ে দরূদ শরীফের মাধ্যমে আজান শুনার জন্য সতর্কতা জ্ঞাপন করা হল। এটাও বলা যায় যে, ঐ সময় দরূদ শরীফ মুয়াজ্জিনদের তছবীহতে পরিগণিত, কারণ এভাবে তছবীহ পাঠ করা মুয়াজ্জিনদের জন্য ইসলামী আইনশাস্ত্রবীদদের (ফোকাহা) নিকট বৈধ।
অতএব, আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পাঠ করা শরীয়তের কোন খেলাফ বা উল্টো হয়নি।
বর্তমান যুগে মানুষের মধ্যে অলসতা খুবই বেড়ে গেছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে; যখন আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পড়া হয় তখন লোকেরা বলে উঠেন যে, এখন নামাজের আজান হবে। যেন ঐ সময়ে দরূদের শব্দ শুনে নামাজের প্রতি ভক্তি ও ভালবাসা বেড়ে গেল, মনের অলসতা দূর হয়ে গেল, অন্তরের কালিমা মুছে গেল, এমনভাবে পরিলক্ষিত হয়। একথা কখনো বলা চলে না যে, মনের অলসতা দূর করণার্থে দরূদ শরীফ ব্যবহার করা হয়। আর তা জায়েযও নয়। বরং অন্তরের ময়লা, কলুষ, অলসতাও বিদূরিত করা যায়। যাতে লোকেরা অপর কোন কাজে ব্যস্ত থাকলে তা ত্যাগ করতঃ তাদের ধ্যান-ধারণা আজানের প্রতি দিতে পারেন এবং মনোযোগ সহকারে আজান শুনে নামাজের দিকে মনোনিবেশ করতে পারেন।
এ কথাটি অবশ্যই জেনে রাখা প্রয়োজন যে, আমরা আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পড়াকে অপরিহার্য বলি না। অথচ আমাদের দাবী হল ঐ সময়ে কোন মুয়াজ্জিন যদি দরূদ শরীফ পড়েন তা হলে কোন অপরাধ হবে না। বরং শরীয়তের কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকার কারণে সেটা হবে মুস্তাহাব, আর যদি কেউ তা না পড়েন তাতেও দোষ হবে না; পড়ার জন্য বাধ্য করা যাবে না; আবার পাঠকারীকে বাধাও দেয়া যাবে না। যার মনে চায় পড়বে, যার ইচ্ছা হয় পড়বে না। তবে হ্যাঁ, যিনি পড়বেন তাঁকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, দরূদ শরীফ পাঠ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। যাতে আজানের বাক্যের সাথে সংযুক্ত হয়ে না যায়।
এখন সাব্যস্ত হলো যে, আজানের আগে দরূদ শরীফ পড়া দোষণীয় বেদা’ত হতে পারে না। কারণ বেদা’তে মজমুমা বা দোষণীয় বেদা’ত হতে পারে না। কেননা, বেদা’তে মজমুমা বা দোষণীয় বেদা’ত বলে ঐ সব নব আবিষ্কৃত কর্মকে যা সুন্নতে মুতাওয়ারেছা বা রাসূলে পাক (ﷺ) হতে প্রাপ্ত সুন্নাতকে বিকৃত করে ফেলে অথবা সুন্নাতের পরিপন্থী হয়। তবে আজানের বাক্যসমূহ বর্জন করে যদি দরূদ শরীফ কিংবা অপর কোন বাক্য ব্যবহার করে তাহলে তা অবশ্যই দোষণীয় বেদা’ত হবে। কেননা আজানের কলেমাগুলো হুজুর পাক (ﷺ) হতে প্রাপ্ত সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত আছে।
❏ হযরত ছৈয়দ আহমদ বিন জাইনী দাহলান (رحمة الله) আপন কিতাব ‘রিছালাতুন নছর’ এর ১৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন:
لايجوز ان يجعل بدل الاذان الصلواة والسلام على النبى صلّى الله عليه وسلّم المنائر لان الشارع جعل للاذان الفاظا مخصوصة لايجوز ابدالها بغيرها .
অর্থাৎ- মিনারায় চড়ে আজানের পরিবর্তে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর উপর ছালাত-ছালাম (দরূদ শরীফ) পাঠ করা জায়েয নাই। কেননা শরীয়ত প্রণেতা ও শরীয়তের নির্দেশদাতা নবী মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) আজানের বিশেষ কতগুলো শব্দ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং ঐ নির্বাচিত শব্দগুলোর পরিবর্তন সাধন করা জায়েয নাই।
এখন বুঝা গেল আজানের বাক্যসমূহ পরিত্যাগ করা অথবা কোন বাক্যকে অন্য বাক্য দ্বারা বদলে দেয়া ঐগুলো সব নিকৃষ্ট বেদা’ত। কারণ এখানে সুন্নাতকে বিকৃত করা হল, যে কাজটা সুন্নাতকে উল্টিয়ে দেবে সেটা হবে বেদা’তে ছাইয়েআ বা মন্দ বেদা’ত। আর যে কাজটা সুন্নাতের সহায়ক হবে সেটাও সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত।
عمل فى السنة বা সুন্নাতের মধ্যে অনাধিকার চর্চা করা জায়েয নাই। আর عمل للسنة বা সুন্নাতকে উজ্জ্বল ও দৃঢ় করার নিমিত্ত কোন কর্ম করা জায়েয আছে।
আল্লামা ইবনে জাইনী দাহলানের উপরোক্ত উক্তিটি হতে এটাও প্রতীয়মান হল যে, আজানের কলেমাগুলো ঠিক রেখে তার আগে ও পরে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ করা জায়েজ ও উত্তম।
কেউ যদি একথা বলে থাকে যে, শুধুমাত্র কুরআন ও হাদীস শরীফ দ্বারা যা কিছু প্রমাণিত হবে শুধুমাত্র তাই পালন করব, অন্য কিছু মানব না। আসলে এ সমস্ত কথা নিছক বোকামী, পথভ্রষ্টতা আর ইজমায়ে উম্মতের পরিপন্থী বৈ আর কিছু নয়। কেননা সাহাবায়ে কেরাম হতে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদীয়ার সম্মিলিত ঐক্যমত এই যে, যা কিছু আদিল্লায়ে আরবা (ইসলামের প্রামাণ্য চতুঃশাস্ত্র কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াছ) দ্বারা প্রমাণিত আছে ঐসবগুলোই শরীয়তের হুকুম। অনেক মাছআলা আছে কুরআন শরীফে তার হুবহু কোন প্রমাণ নাই। অথচ তা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত আছে। এভাবে যা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় না তা আবার ইজমা দ্বারা প্রমাণিত আছে। অনুরূপ ইজমাতে প্রমাণ পাওয়া না গেলে কেয়াছেই তার সমাধান পাওয়া যায়।
দুঃখের বিষয় এ যুগে এমন এক দল সৃষ্টি হয়েছে যারা নিজের খাহেশাত বা কুমনোবৃত্তি আর বিজ্ঞানের পিছনে পড়ে ইজমা ও কেয়াছের বিরুদ্ধে চিৎকার শুরু করে দেয়। অপ্রত্যাশিতভাবে আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়ে গেল। এখন আগের কথায় আসা যাক। আমাদের দাবী হল আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পাঠ করা বৈধ।
صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
কুরআনে পাকের আদেশসূচক উক্ত আয়াতটি গভীরভাবে বিশেষণ করলে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশটি হল অনির্দিষ্ট (মুতলাক)। তবে একথা সত্যি যে, শরীয়তের কোন নিষেধাজ্ঞা বা বাধা থাকলে সেক্ষেত্রে দরূদ শরীফ পাঠ করা জায়েয নাই। সব কথার সারাংশ এই দাঁড়াল যে, যাদের অন্তরসমূহে ঐ মধুমাখা পবিত্র নামের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, ঐ নামের প্রতি অগাধ ভক্তি অতীব আন্তরিকভাবে হয়ে গেছে; তাঁরা অবশ্যই সম্ভাব্য সবসময়ে দরূদ শরীফের জপনা করে থাকেন। আর যারা আজল বা আত্মক জগত হতেই ঐ অমূল্যরত্ন লাভ করা থেকে বঞ্চিত রয়েছে; তারা বেদা’ত বা শির্কের ফত্ওয়া না দিয়ে আর করবে কি?
সর্বদা দরূদ পাঠ করা উন্নত ধরণের মুস্তাহাব
❏ বেলায়তের রাজাধিরাজ শেরে খোদা হযরত আলী (رضي الله عنه) ফরমানঃ
لولا اجد ما فى ذكرالله لجعلت الصلواة النبوية عبادتى كلها .
অর্থাৎ- যদি আমি খোদার জিকির সংক্রান্ত নির্দেশগুলো না পেতাম তাহলে আমি অবশ্যই নবী মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ করাকেই আমার যাবতীয় ইবাদত হিসাবে গ্রহণ করতাম। (সুবহানাল্লাহ্)
❏ বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ তিরমিযী শরীফে হযরত উবাই বিন কা‘আব (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে: তিনি বলেন, “আমি প্রিয়নবী (ﷺ)-এর পাক দরবারে আরজ করলাম; ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমি আপনার প্রতি বিস্তর দরূদ শরীফ পাঠ করে থাকি; হুজুর! এখন আমাকে আদেশ করুন যে কি পরিমাণ দরূদ শরীফ আপনার জন্য নির্ধারিত করব। তখন প্রিয়নবী (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, যে পরিমাণে তোমার ইচ্ছা হয় পড়। আমি (বর্ণনাকারী) নিবেদন করলাম হুজুর এক চতুর্থাংশ পড়ব। নূরনবী মোস্তফা (ﷺ) ফরমান: তুমি যতটুকু চাও পড়। তবে দরূদ শরীফ বেশী করে পড় তাতে তোমার কল্যাণ হবে। অতঃপর আমি পুনরায় আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (ﷺ) অর্ধেক পড়ব। তিঁনি ইরশাদ ফরমানঃ যতটুকু ইচ্ছা হয় পড়। যদি এর চেয়েও অধিক পড়তে পার তাতে তোমার কল্যাণ হবে। অতঃপর আমি পুনরায় আরজ করলাম; ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! দুই তৃতীয়াংশ পড়ব। ফরমানঃ যে পরিমাণে ইচ্ছা হয় পড়। যদি এর চেয়েও বেশী পড়তে পার তাতে তোমার কল্যাণ হবে। আমি পুনরায় নিবেদন করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)!
أَجْعَلُ لَكَ صَلَاتِي كُلَّهَا قَالَ إِذًا تُكْفَى هَمَّكَ وَيُغْفَرُ لَكَ ذَنْبُكَ .
অর্থাৎ- আমি সব সময়ের জন্য আপনার প্রতি দরূদ শরীফ পড়াকেই আমার অজিফা বা জপনায় পরিণত করব। তখন রসূলে পাক (ﷺ) ফরমানঃ তবেই তো সেটা তোমার দুশ্চিন্তা মুক্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট আর তোমার গুনাহসমূহ মুছে দেবার উপকরণ। (অর্থাৎ- এটি পরকালের সকল চিন্তা-ভাবনা বিদূরিত হবে আর তোমার সব পাপ মাফ করে দেওয়া হবে) [মেশকাত শরীফ]
উক্ত হাদীস শরীফ থেকে জানা গেল শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন বাধা না থাকলে সবসময় দরূদ শরীফ পাঠ করা উন্নত ধরণের মুস্তাহাব। তা থেকে একথাও জানা গেল যে, কুফুরী আর শির্ক ছাড়া ফিছক্ ও ফুজুরী গুনাহসমূহের কাফ্ফারা বা মোছনকারী হল দরূদ শরীফ (সুবহানাল্লাহ)।
❏ মোল্লা জামী (رحمة الله) তা কত সুন্দর করে ব্যক্ত করেছেন:
اگرچه غرق در فسق وفجورم
بحمد الله كه من عبد رسولم
অর্থাৎ- যদিও আমি পাপের মধ্যে ডুবে থাকি তথাপিও আল্লাহর শোকর আদায় করি এ জন্য যে, আমি রসূলে পাক (ﷺ)-এর বান্দা (উম্মত)।
বস্তুত ঐ পাক দরবার হতে একগুঁয়েমী করে ফিরে থাকা হতভাগার লক্ষণ মাত্র।
❏ কবি সুন্দর বলেছেন:
فجاء محمد سراجا منيرا
فصلوا عليه كثيرا كثيرا
অর্থাৎ- মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) অত্যুজ্বল প্রদীপরূপে শুভাগমন করেছেন সুতরাং হে বিশ্ববাসী তোমরা এমন পবিত্র অস্তিত্বের (জাত) উপর অসংখ্যভাবে দরূদ শরীফ পড়তে থাক। অর্থাৎ মুস্তফা (ﷺ) আল্লাহ্ তায়ালার ফয়ূজাত বা অনুকম্পার সূর্যসাদৃশ। হে খোদার জ্যোতি অন্বেষণকারীরা! সেই খোদায়ী অনুকম্পা লাভের জন্য নূরনবী সরকারে দো’আলম (ﷺ)-এর নূরানী কদমে সদা-সর্বদা বিনম্রচিত্তে, বিনয়াবনত মস্তকে দরূদ-ছালামের তোহফা পাঠাতে থাক। তাহলে তোমরা খোদার আলোকে আলোকিত ও নূরানী হতে পারবে। হুজুর ছৈয়দে কায়েনাত (ﷺ) নবুওয়াত ও হেদায়তের সূর্য; যেটা উদিত হওয়ার পর অন্য কোন আলোকের প্রয়োজন পড়ে নাই। অপর সব আলো ঐ অত্যুজ্বল আলোকে হারিয়ে গেছে। সমগ্র সৃষ্টিজগত ঐ প্রধান ও অনির্বাণ আলোকবর্তিকার অন্বেষণকারী এবং মুখাপেক্ষী। এমন কি পূর্ববর্তী সব নবী (عليه السلام) ও ঐ নূরের প্রত্যাশী।
❏ হযরত ইমাম বুছিরী (رحمة الله) উলেখ করেছেন:
فانه شمس فضلهم كواكبها
يظهرن انوارها للناس فى الظلم
রসূলে পাক (ﷺ) ফয়েজ, বরকত, রহমত ও বুজর্গীর সূর্যস্বরূপ এবং সমস্ত আম্বিয়া কেরাম (عليه السلام) ঐ সূর্য হতে কিরণ লাভকারী নক্ষত্রস্বরূপ। যারা অন্ধকারের মধ্যে আপন নূর দিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে পথ প্রদর্শন করে থাকেন। এমন কি চন্দ্রও কিরণ লাভের উদ্দেশ্যে সূর্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়। কেননা আল্লাহ্ তায়ালা সূর্যকে আলোর কেন্দ্ররূপে তৈরী করেছেন। অনুরূপভাবে খোদার নূর (জ্যোতি) আর ফয়েজ (অনুকম্পা) এর কেন্দ্ররূপে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র নবী মুস্তফা (ﷺ)-কে। এ জন্যই পূর্ববর্তী নবীগণ (عليه السلام) ও নবী মুস্তফা (ﷺ) হতে নূর ও ফয়েজ তালাশ করে থাকেন। ইমাম বুছিরী (র.) সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
❏ আল্লাহ্ পাকও আদেশ করেছেনঃ
صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থাৎ- হে অন্বেষণকারীরা! নবী মুস্তফা (ﷺ)-এর প্রতি অগণিত, বিস্তর পরিমাণে দরূদ ও সালাম নিবেদন কর।
❏ আবার মাওলানা আরেফ রুমীও সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন:
زيں سبب فرمود حق صلوا عليه
كه محمد بود محتاج اليه .
অর্থাৎ- আল্লাহ্পাক সমগ্র সৃষ্টিকে রসূলে পাক (ﷺ)-এর দরূদ শরীফ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন এ কারণেই যে, নূরনবী (ﷺ) সৃষ্টি জগতের ‘‘মুহতাজ ইলাইহী” (ভিখারীর লক্ষ্যস্থল)। তিনি দাতা এবং সমগ্র মখলুক তারই দুয়ারের ভিখারী। বস্তুত ভিক্ষুক এবং দাতার মধ্যে নিগুঁঢ়, নিবিড় সম্পর্ক অপরিহার্য। এজন্যই আল্লাহর আদেশ হল:
صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
এই খোলা নির্দেশ অনুযায়ী শরীয়ত অসম্মত স্থান, কাল, পাত্র ব্যতীত প্রত্যেক সময়ে দরূদ শরীফ পড়া মুস্তাহাব ও উত্তম।
❏ মখ্দুম হযরত মাওলানা ছৈয়দ জমীর উদ্দিন সাহেব স্বরচিত এ পুস্তকে ‘‘ইয়ানাতুত্তালেবীন” ২৩৬ পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর লিখেছেন:
فبهذا ثبت الصلواة والسلام عليه قبل الاذان فبعض الفقهاء المحققين استحسن هذا .
অতএব, এ উক্তি থেকে আজানের পূর্বে মুস্তফা (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ করা প্রমাণিত হল। কোন কোন ফোকাহা (ধর্ম বিশেষজ্ঞ) উক্ত আমলটাকে মুস্তাহাছান (সুন্দর ও সুশ্রী কাজ) বলে ব্যক্ত করেছেন।
আজানের আগে-পরে দরূদ পড়ার ফজিলত
হযরত বেলাল (رضي الله عنه) হতে আজানের পূর্বে দরূদ পড়ার প্রমাণ
আজানের পর দরূদ শরীফ বা দোয়া পড়ার ব্যাপারে হয়ত কারো দ্বিমত নাই।
❏ কেননা হাদীসে পাকে স্পষ্ট ‘নছ’ (প্রামাণ্য বাক্য) আছে যে,
ثُمَّ صَلُّوا عَلَيَّ فَإِنَّهُ مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ بِهَا عَشْرًا ثُمَّ سَلُوا اللهَ لِي الْوَسِيلَةَ -الخ .
অর্থাৎ- যে ব্যক্তি আজানের পর আমার উপর দরূদ শরীফ পড়বে, তার প্রতি আল্লাহ্ পাক দশবার করুণা বর্ষণ করবেন। অতঃপর আল্লাহর নিকট আমার জন্য উছিলা প্রার্থনা কর।
এখন কথা হল আজানের আগে দোয়া ও দরূদ শরীফ পড়ার ব্যাপার। আমি এখন পাঠকমহলের সান্ত্বনাদায়ক একটি বর্ণনা প্রামাণ্য ও বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ আবু দাউদ শরীফ হতে উপস্থাপন করছি, যাতে উক্ত মাছআলাটা পরিস্কার হয়ে যায়।
❏ হযরত উরওয়া বিন জোবায়ের (رضي الله عنه) বনু নুজারের এক মহিলা হতে বর্ণনা করেছেন:
قَالَتْ كَانَ بَيْتِي مِنْ أَطْوَلِ بَيْتٍ حَوْلَ الْمَسْجِدِ فَكَانَ بِلَالٌ يُؤَذِّنُ عَلَيْهِ الْفَجْرَ فَيَأْتِي بِسَحَرٍ فَيَجْلِسُ عَلَى الْبَيْتِ يَنْظُرُ إِلَى الْفَجْرِ فَإِذَا رَآهُ تَمَطَّى ثُمَّ قَالَ اللَّهُمَّ إِنِّي أَحْمَدُكَ وَأَسْتَعِينُكَ عَلَى قُرَيْشٍ أَنْ يُقِيمُوا دِينَكَ قَالَتْ ثُمَّ يُؤَذِّنُ قَالَتْ وَاللهِ مَا عَلِمْتُهُ كَانَ تَرَكَهَا لَيْلَةً وَاحِدَةً هَذِهِ الْكَلِمَاتِ. (أبى دواد شريف)
অর্থাৎ- মহিলাটি এরূপ বর্ণনা করেছেন যে, মসিজদের চতুঃপাশের্ব অবস্থিত সকল ঘর হতে আমার ঘরটি ছিল খুব উঁচু। হযরত বেলাল (رضي الله عنه) ঐ ঘরের উপরে এসে ফজরের আজান দিতেন। তবে তিনি প্রথম থেকে এসেই ওখানে বসে ছুবহে ছাদেকের দিকে দেখতেন। যখন ছুবহে ছাদেক হয়ে যেত তখন অনেক্ষণ বসে থাকার দরুন অবশ হয়ে যাওয়াতে এপাশ ওপাশ গা ভাঙতেন আর হাই তুলতেন। তারপর (এই দোয়া) বলতেন ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আহমদুকা--- অর্থ: হে আল্লাহ্! আমি তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং তোমার নিকট কুরাইশদের তরে সাহায্য প্রার্থনা করছি যাতে তারা তোমার ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করে (অর্থাৎ মুসলমান হয়ে যাক) তারপর তিনি আজান দিতেনঃ আমি (বর্ণনাকারী) খোদার শপথ করে বলছি; কখনো তাকে উক্ত দোয়াটি (ভুলেও) বর্জন করতে দেখিনি। এ থেকে পরিস্কার প্রতীয়মান হল; আজানের পূর্বে দোয়া বা প্রার্থনা করা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে। আর সেই সময়ে ঐ প্রকারের দোয়া অধিকতর প্রযোজ্য ছিল। এ জন্যই হযরত বেলাল (رضي الله عنه) ঐ দোয়াটাই পড়তেন; যেন কুরাইশরা মুসলমান হয়ে আল্লাহর দ্বীনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন। যখন আজানের পূর্বে দোয়া করা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হল তাহলে সমগ্র দোয়ার ভান্ডার দরূদ শরীফ কি করে নাজায়েয ও বেদা’ত হতে পারে। অথচ আলেমগণ বর্ণনা করেছেন যে, দরূদ ও সালাম দোয়া হতে অনেক শ্রেষ্ঠ।
মুসলমান! চিন্তা করে দেখুন হযরত বেলাল (رضي الله عنه) ঐ দোয়াটা পড়ার পর আজান দিতেন। কেউ কি একথা বলার দুঃসাহস করতে পারত যে, হযরত বেলাল (رضي الله عنه) আজানের কলমা বা বাক্যগুলো বদলে দিয়েছেন বা তাতে নিজের তৈরী কোন বাক্য ঢুকিয়ে দিয়েছেন অথবা বর্ধিত করেছেন কিংবা ঐ দোয়াটা আজানের অংশ হয়ে গেছে? না কেউ এ ব্যাপারে মুখ খোলার সাহস রাখে না। উলেখিত হাদীস শরীফ হতে একথাও প্রমাণিত হল যে, ঐ দোয়াটা উচ্চ স্বরে পাঠ করা হত তা না হলে ঐ মহিলাটি কি করে প্রত্যহ ঐটা শুনতে পেতেন। মনে রাখা চাই যে, আজান হল ইবাদত।
❏ যেমনঃ ফোকহায়ে কেরামরা উলেখ করেছেন:
الاذان عبادة يقصد منها الخشوع لله (كتاب الفقه)
অর্থাৎ- আজান হল ইবাদত। এর মাধ্যমে অন্তরে খোদাভীতি জাগরণের ইচ্ছা পোষণ করা হয়। কেননা ইবাদতের পূর্বে এবং পরে দরূদ শরীফ পড়া মুস্তাহাব সাব্যস্ত হল। কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা উত্তম ইবাদত।
❏ যেমন হাদীস শরীফে আছে:
أَفْضَلَ الْعِبَادَةِ تِلَاوَتِ الْقُرآن .
অর্থাৎ- নফল ইবাদতগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম ইবাদত হল কোরআন মজীদ পাঠ করা। কিন্তু সেই তেলাওয়াতের পূর্বে ও পরে দরূদ শরীফ পাঠ করা হয়। এখন বলুন এর কারণ ও প্রমাণ কি আছে। একথা অবশ্যই মানতে হবে যে, ওলামাগণের মতে ইবাদতের আগে ও পরে দরূদ শরীফ পড়া মুস্তাহাব। কেউ যদি কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের পূর্বে দরূদ শরীফ পাঠ করে, তাতে কি কেউ একথা বলবে যে, দরূদ শরীফ কুরআনের অংশ হয়ে যাওয়ার ভয় আছে; তাই না পড়াই ভাল হবে।
❏ আজানের পর তো মতভেদ ছাড়াই দরূদ শরীফ পড়া শরীয়তসম্মত। যেমনঃ
الصلواة على النبى عقبه مشروعة بلاخلاف سوأ كانت من المؤذن او من عيره (كتاب الفقه)
অর্থাৎ-আজানের পর রাসূলে পাক (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ করা ইমামদের মতভেদ ছাড়াই প্রমাণিত ও শরীয়ত সম্মত। তাতে আজানদাতা ও শ্রোতা উভয়ের জন্য একই হুকুম।
আর এই নির্দেশ হাদীস শরীফ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং এটা অবশ্যই করণীয় মুস্তাহাব। এর বিরুদ্ধাচারণকারী ফাছেক ও পাপী। আজানের পূর্বে দরূদ পড়া তো মুস্তাহাব। তবে তা হাদীস শরীফে স্পষ্ট না থাকার কারণে বর্জনকারী ফাছেক হবে না। কিন্তু এটা মূল ভিত্তি (উছুলী) আর ফেকাহ্শাস্ত্রবিদদের রীতি (কাওয়ায়েদ ফক্হীয়া) অনুসারে কেয়াছ (ইসলামের চতুঃশাস্ত্রের একটি) এবং শরীয়তের প্রমাণাদির অন্তর্ভূক্ত। অতএব আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ না পড়ার জন্য শাস্তি অথবা পড়ার জন্য বাধ্য বাধকতা নাই।
বেদা’তের বর্ণনা এবং প্রকৃত বেদা’ত সম্পর্কে আলোচনা
প্রশ্নঃ ইবাদতের কর্মের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে হুজুর (ﷺ) থেকে প্রমাণিত হওয়া আবশ্যক। যদি হুজুর (ﷺ) থেকে প্রমাণিত না হয় তাহলে সে কর্ম ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত করা بدعت سيئه হবে।
উত্তরঃ البدعة ادخال ما ليس من الدين فى الدين যা দ্বীন তথা শরীয়ত দ্বারা প্রমাণিত নয় তা দ্বীনের অন্তর্ভূক্তি করা বেদা’ত। অর্থাৎ-
من احدث فى امرنا فليس منه এর মাপকাঠি অনুযায়ী বিদা’ত আর যা فى امرنا এর অন্তর্ভূক্তি না হয়ে বরং للدين অর্থাৎ (لامرنا) দ্বীনের সত্যায়ন ও হক এবং সুদৃঢ়তার জন্য হয় তখন فى امرنا এর অন্তর্ভূক্ত নয়।
❏ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদী মিম্বর কিংবা আজানখানায় হুজুর (ﷺ)-এর উপর উচ্চস্বরে দরূদ শরীফ পড়তে নিষেধ করেছে।
انه قتل رجلا اعمى كان مؤذنا صالحا ذاصوت حسن نهاة عن الصلواة على النبى صلّى الله عليه وسلّم .
অর্থাৎ- একজন নেক ও সৎ এবং সুকন্ঠশীল অন্ধ মোয়াজ্জিনকে রাসূল পাক (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা থেকে নিষেধ করার পরও দরূদ পাঠ করার কারণে কতল করা হয়েছে।
অথচ বেদা’ত উহাই যা কোরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী হবে। অর্থাৎ যা শরীয়তের মধ্যে নাই এমন কিছুকে শরীয়তে অন্তর্ভূক্তি করা।
ادخال ما ليس من الدين فى الدين كاباحة محرم او تحريم مباح او ايجاب ما ليس بواجب ندبه او نحو ذالك سواء كانت فى القرون الثلاثة او بعدها .
মুবাহ্কে হারাম কিংবা হারামকে মুবাহ অথবা ওয়াজিব হিসেবে গ্রহণ করা যা ওয়াজিব কিংবা মুস্তাহাছন নয় এধরনের কর্মকে অর্থাৎ মুবাহকে হারাম আর হারামকে মুবাহ মনে করা অথবা ওয়াজিব ইত্যাদি মেনে নেয়া যা ওয়াজিব নয় এটিই হচ্ছেঃ احداث فى امـرنا
❏ প্রখ্যাত ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) ফরমানঃ
ان احداث مالا ينازع الكتاب والسنة ليس بمذموم
অর্থাৎ- যে কাজগুলো কোরআন ও হাদীসের পরিপন্থী না হয় তা মজমুমা বা ঘৃণিত বেদা’ত হতে পারে না।
❏ শীর্ষস্থানীয় ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) ফরমানঃ
وما احدث من الخير ولم يخالف من ذالك فهو البدعة المحمودة
অর্থাৎ- উত্তম কাজগুলোর মধ্যে যেগুলো নতুন প্রচলন করা হয়েছে এবং (কুরআন-হাদীসের) উল্টো হয়নি। সুতরাং তা বেদা’তে মাহমুদা (প্রশংসনীয় বেদা’ত)।
❏ আল্লামা তাপতাজানী প্রণীত শরহে মোকাছেদ ও আবদুন্নবী বিন আবদুর রসূল রচিত দস্তুরুল ওলামা কিতাবে আছেঃ
ومن الجهلة من يجعل كل امر لم يكن فى زمن من الصحابة بدعة مذمومة وان لم يقم دليل على قبح بقوله صلى الله عليه وسلم اياكم محدثات الامور ولا يعلمون المراد بذالك ان يجعل فى الدين ما هو ليس منه .
অর্থাৎ- কতগুলো জাহেল বা মূর্খ ব্যক্তি ছাহাবাদের যুগে ছিল না এমন কাজগুলোকে বেদাতে মজমুমা বা নিন্দনীয় নব আবিষ্কার বলে থাকে। যদিও বা এটা মন্দ হওয়ার কোন প্রমাণ নাই। আর এর মর্ম সম্পর্কে না জেনে এ হাদীসটিকে প্রমাণ হিসেবে খাড়া করে যে, “(ধর্ম) নতুন আবিষ্কৃত কাজ হতে বেঁচে থাক।” অথচ ধর্মের মধ্যে ধর্মবিরোধী সব কাজ হতে নিষেধ করা হয়েছে।
❏ ‘দুর্রুল মুখতারে’ আছে:
وهى اعتقاد خلاف المعروف عن الرسول صلّى الله عليه وسلّم .
অর্থাৎ- রাসূলে পাক (ﷺ)-এর মনোনীত আক্বীদাসমূহের পরিপন্থি সকল আক্বীদার (ধর্মবিশ্বাস) নাম বেদা’ত।
এখন আমি এমন কিছু বেদা’ত ও মাকরূহ কাজের কথা উলেখ করছি যার মধ্যে প্রত্যেক দল নিমজ্জিত আছেন। জিজ্ঞাসা করি তাদের প্রতিফল কি হবে? যথা: মসজিদের দেয়ালে কোরআনে পাকের আয়াত লিখা।
❏ যা ফোকহায়ে কেরামরা নিষেধ করেছেন:
لا ينبغى الكتابة على جدر انه اى خوفا من ان تسقط وتوطا . شامى، ج/১، رقم: ৬৬৩
অর্থাৎ- পড়ে যাওয়া বা পদদলিত হওয়ার আশঙ্কায় মসজিদের দেয়ালে কোরআন শরীফের আয়াত এবং সম্মানিত বস্তু লেখা সঙ্গত নয়। অথচ নিষেধ সত্ত্বেও মসজিদের দেয়ালে দেয়ালে লিখিত কোরআনের আয়াত বা হাদীস শরীফ দৃষ্টিগোচর হয়।
লোকেরা কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে। দেখুন এর ভিতর কত বেদা’ত জড়িয়ে রয়েছে। পারা পারা করে সাজানো, জের, জবর, পেশ ইত্যাদি লাগানো, রুকু বাঁধা আমাদের সম্মুখস্থ কুরআনের বর্তমান অবস্থা ইত্যাদি এসব কাজের অস্তিত্ব নূরনবী (ﷺ)-এর জমানার পরেই হয়েছে।
❏ মসজিদে মুয়াজ্জিনের জন্য মিনারা করাটাও বেদা’ত। যেমনঃ
فالمنارة فى نوع البدعة
(মসজিদের মিনারা বেদা’ত)
এতদসত্ত্বেও অধিকাংশ মসজিদে মিনারা করা হয়েছে, যার উপর আজান দেয়া হয়। অথচ উক্ত কাজটা বেদা’ত।
❏ এ কারণে ইমাম আবদুল গণি নাবেলছি (رحمة الله) ফরমানঃ البدعة المستحبة
(মসজিদের মিনারা মুস্তাহাব জাতীয় বেদা’ত)
এইভাবে অপরাপর কাজগুলোও পরিমাপ করা যেতে পারে। মাদ্রাসা যেখানে নাহু, ছরফ, মানতেক, বালাগাত, উছুল ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত করা হয় তাও বেদা’ত।
অথচ লোকেরা বিভিন্ন প্রকারের সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে উক্ত বেদাতটিকে আরো মজবুত ও দৃঢ় করে তোলে। কিতাব রচনা করা, শরীয়তের আইন-কানুন, সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো ইত্যাদি কাজও বেদা’ত।
❏ হাদীকাতুন্নদীয়াহ নামক কিতাবে উলেখ আছে:
والمدرسة المبنية للعلم وقراة القرآن وتصنيف الكتب الشرعية ونظم الدلائل
অর্থাৎ: এলম হাছিল ও কোরআন পাঠের জন্য মাদ্রাসা স্থাপন, শরীয়তসংক্রান্ত পুস্তকাদি রচনা এবং শরীয়তের প্রমাণাদি শ্রেণীবদ্ধ করা এসব কাজ একেবারে বেদা’ত।
কিন্তু এসব বেদাতের মধ্যে প্রত্যেক ফেরকার আলেমগন প্রত্যক্ষভাবে সবসময় ডুবে আছে। হেরেম শরীফের মধ্যে চার ইমামের চারটি মুসল্লা, নবী মুস্তফা (ﷺ)-এর যুগেও ছিল না। ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেঈন কারো যুগে ছিল না, এমনকি চার মাজহাবের ইমামরাও এ কাজটা করতে বলেননি অথচ আলেম সম্প্রদায় এ কাজটা সম্পর্কে লিখেছেন: لكنها بدعة حسنة لا سيئة (কিন্তু কাজটি উৎকৃষ্ট বেদা’ত, নিকৃষ্ট বেদা’ত নয়) এখন বলুন অতসব বেদা’তের পরিণাম কি হবে। সুতরাং আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পড়ার ব্যাপারেও তাই। এতে আজানের বাক্যগুলোতে কোন ক্ষতি হয় না বরং উপকারই হয়। অতএব এটা নাজায়েয বা নিকৃষ্ট বেদা’ত হতে পারে না। তাহলে একথা দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করতে হবে যে, ওগুলো সব বেদা’তে হাছানা বা উৎকৃষ্ট বেদা’ত। আর বেদাতে হাছানার আদায়কারীকে আহলে বেদা’ত বা বেদা’তী বলা হয় না, বরং আহলে সুন্নাত বা সুন্নী বলা হয়।
আহলে বেদা’ত ও আহলে সুন্নাতের সংজ্ঞা
❏ ইমাম আবদুল গণি নাবলুছি (رحمة الله) হাদীকাতুন্নদীয়া শরহে তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া কিতাবে লিপিবদ্ধ করেছেন:
ويبصرون بنعلهم السنة الحسنة وان كان بدعة باهل السنة لا اهل البدعة لان النبى صلّى الله عليه وسلّم قال من سن سنة حسنة تسمى المبتدع للحسن مستا فادخله النبى صلّى الله عليه وسلّم فى السنة وقرن بذالك الابتداع وان لم يرد فى الفعل فقد ورد فى القول فالسان سنى مدخوله بتسمية النبى صلّى الله عليه وسلّم فيما فر من السنة .
অর্থাৎ: তোমরা কি দেখ না যে, ঐ ধরণের সুন্নতের অনুসরণ করার কারণে তাদেরকে আহলে সুন্নাত বলা হয়। আহলে বেদা’ত বলা হয় না, অথচ প্রচলন করেছেন নতুন কাজের, কেননা হাদীস শরীফের মধ্যে উত্তম কোন কাজ নতুন প্রচলনকারীকে সুন্নতের উপর আমলকারী নামে ভূষিত করা হয়েছে। আর রসূলে পাক (ﷺ) ইজাদ (নব আবিষ্কৃত) ও সুন্নত দুই শব্দকে একই সঙ্গে উলেখ করেছেন। ঐ সমস্ত কাজ সুন্নত হওয়ার ব্যাপারে হুজুর পাক (ﷺ)-এর কৃতকর্ম হতে প্রমাণ না থাকলেও পবিত্র বাণী হতে প্রমাণিত আছে। সুতরাং ধর্মে নতুন কাজের সৃষ্টিকারীরা ‘সুন্নী’। কেননা ঐ কাজগুলোকে হুজুর পুরনুর (ﷺ) সুন্নত নামে অভিহিত করেছেন। বুঝা গেল কোন ভাল কাজ যে কোন সময়েই প্রচলিত হয়, সেটা বেদাতে ছাইয়্যেয়া বা নিকৃষ্ট বেদা’ত হতে পারেনা। বরং সেটা উৎকৃষ্ট বা হাছানা।
❏ হাদীসঃ من سن فى الإسلام سنة حسنة এর মধ্যে من যে শব্দটি রয়েছে তা অনির্দিষ্ট হওয়ার প্রেক্ষিতে চাইতো কুরুনে ছালাছাতে (নূরনবী (ﷺ) হতে পরবর্তী তিনটি যুগে) হোক বা এর পরে হোক সেটা উৎকৃষ্ট। এক্ষেত্রে যে কাজটা শরীয়তভিত্তিক হবে সেটাই বেদাতে হাসানা ও গ্রহণযোগ্য। যদি শরীয়ত সম্মত না হয় তাহলে তা হবে নিকৃষ্ট ও পরিত্যাজ্য।
❏ হাদীসঃ خير القرون قرنى ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم الخ
অর্থাৎ: উত্তম যুগ হল আমার যুগ অতঃপর ছাহাবাদের অতঃপর তাবেঈনদের যুগ---।
উক্ত হাদীসটিতে যুগ বা জমানার উন্নতমানের কথাই উলেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ- অপরাপর যুগ হতে তুলনামূলকভাবে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর যুগই সর্বোত্তম। খাইর ও বরকত এবং বিভিন্ন প্রকারের বিশৃঙ্খলা, ঝগড়া-বিবাদ মুক্ত ইত্যাদির দিক দিয়ে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর যুগই সর্বোৎকৃষ্ট, তারপর ছাহাবাদের যুগ, এরপর তাবেঈনদের যুগ। পরবর্তী যুগসমূহে মারামারি ঝগড়া-বিবাদ বাড়তে থাকবে। শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন মানুষের জন্য দুষ্কর হয়ে উঠবে। অশান্তির কালো মেঘে ছেয়ে ফেলবে এ বিশ্বভ্রহ্মান্ড। পার্থিব লোভী, হিংসুক, বিদ্বেষকারী ও মোহ-লালসা বেড়ে যাবে। উন্নতি ও স্বচ্ছলতা কমতে থাকবে।
উদ্ধৃত হাদীসটিতে উলেখিত বিষয়াবলীর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। শরীয়তের নির্দেশ ও কর্ম পদ্ধতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়নি। ভাল কাজ যেই যুগেই হোক না কেন সেটা ভাল আর মন্দ কাজ যে যুগেই হোক না কেন সেটা হবে মন্দ।
❏ ওদিকেই নির্দেশ করা হয়েছে এই হাদীসটিতে যে,
من سن فى الإسلام سنة حسنة الخ
অর্থাৎ: যখনি যে কেউ দ্বীনে ইসলামের মধ্যে কোন ভাল পদ্ধতি আবিষ্কার বা প্রচলন করবে তার জন্য পুণ্য বা ছওয়াব নিহিত রয়েছে আর যারা তদানুযায়ী আমল করবে তাদের জন্যও পুণ্য বা ছওয়াব নির্ধারিত রয়েছে।
বুঝা গেলঃ (خير القرون قرني) ‘খায়রুল কুরুনে করনি’ হাদীসটি যুগের খায়র-বরকত ও শান্তির সাথে সংশিষ্ট আর ‘মন ছান্না সুন্নাতান হাছানাতান’ হাদীসটি আমল তথা আহকামের সাথে সংশিষ্ট। অতএব, যে আমল বা কাজটা ভাল ও সৎ; সেটা কুরুনে ছালাছার মধ্যে প্রচলিত না থাকলেও তা মুস্তাহাব এবং মুস্তাহাছান (সুন্দরময়)। ঐ আমলের উপর সওয়াব দেয়া হবে। বস্তুত ঐ ধরণের আমলকে বেদা’ত বা পালনকারীকে বেদাতী বলা নিঃসন্দেহে হাদীস এবং শরীয়তের উছুল (ভিত্তিসমূহের) এর বিরোধীতামূলক কথা।
اهل قرون ثلاثة নিষ্পাপ নয়।
فان اهل القرون الثلاثة غير معصوم بالاتفاق
অর্থাৎ- সকলের ঐক্যমত দ্বারা প্রতীয়মান যে,
اهل قرون ثلاثة নিষ্পাপ নয়।
শরীয়তের দলীল দ্বারা যা প্রমাণিত তা সর্বাবস্থায় জায়েয আর শরীয়ত নাজায়েয বলেছে তা সর্বাবস্থায় নাজায়েয। দ্বীনের اصولات তথা দ্বীনের ধারাসমূহ পরিবর্তন পরিবর্ধনশীল নয়।
উপরোক্ত বেদা’ত তাদের ধারণাপ্রসূত বেদা’ত। কেননা শরীয়তের ভিত্তিতে মিম্বরে দরূদ শরীফ পাঠ করার কারণে কতলের হুকুম দেওয়াটা কোন দলীলের ভিত্তিতে জায়েয ছিল?
❏ ‘কাশ্ফ’ এর ১৪৫ পৃষ্ঠায় উলেখ আছে:
ان الصلواة عليه مستحبة مطلق مع رفع الصوت وبدونه على المنارة وغيرها فيجوز مطلقًا .
সাধারণত হুজুর (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ করা মুস্তাহাব, উচ্চস্বরে হউক কিংবা নিম্নস্বরে (গোপনে) হউক। আজানখানায় হউক কিংবা অন্য যে কোন জায়গায় হউক। কেবলমাত্র যেখানে পাঠ করা নিষেধ আছে তা ব্যতীত সর্বস্থানে উচ্চস্বরে কিংবা নিম্নস্বরে উভয়ই এক সমান।
رفع الصوت بالصلوات على النبى صلّى الله عليه وسلّم عند الاذان فان الصلواة عليه اذا كانت سنة لم يكن رفع الصوت بها بدعة وكان فاعلها مخيرا بين رفع الصوت وخففه .
দরূদ শরীফ পাঠ করা যখন সুন্নাত কাজেই উচ্চস্বরে পাঠ করা বেদা’ত নয়। দরূদ শরীফ পাঠকের ইখতিয়ার রয়েছে যে, সে উচ্চস্বরে পাঠ করুক কিংবা গোপনে পাঠ করুক। অতএব আজানের সময় উচ্চস্বরে দরূদ শরীফ পাঠে অসুবিধার কিছু নাই। বরং তা মুস্তাহাব ও মুস্তাহাছন।
نعم لو فعلت بقصد الخصوصية والورود كانت بدعة .
হ্যাঁ, যদি কেউ উক্ত কাজটি এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বলে মতপোষণ করে তা হবে বেদা’ত।
ولم يقصدان هذا ماموربه بخصوصه لم يكن مبدعا فى الدين مبد دلالة الادلة الشرعية بعمومها او اطلاقها على استحباب الصلوة على النبى صلّى الله عليه وسلّم فى اى وقت كان .
নির্দিষ্টকরণের ক্ষেত্রে যদি ماموربه হওয়ার ইচ্ছা না করে তবে فى الدين হবেনা। শরীয়তে যেখানে সাধারণভাবে মুস্তাহাব হওয়ার কথা বলেছে। হুজুর (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করার জন্য কোন সময়সীমা সুনির্দিষ্ট নাই বরং যেখানে যখন ইচ্ছা হয় কেবলমাত্র নিষেধকৃত সময় ব্যতীত তা মুস্তাহাব।
আমাদের এই বর্ণনার উপর ভিত্তি করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বহু আমল, মাছআলা ও আকীদা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হবে। উপরে বর্ণিত হয়েছে যে,
❏ ইমাম আবদুল গণি নাবেলছি হানাফী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেনঃ
فالسان سنى
অর্থাৎ- নতুন ভাল কোন পদ্ধতির প্রচলনকারী হল সুন্নী।
❏ রাসূলে পাক (ﷺ) এগুলোকে সুন্নাত বলে আখ্যায়িত করে ইরশাদ ফরমানঃ
من سن سنة حسنة الخ
(যে ব্যক্তি সুন্দর সুন্নাতের প্রচলন করল)।
সুন্নাতের পারিভাষিক বিশেষণ
ভাইয়েরা! বাস্তবিক পক্ষে নব প্রচলিত, প্রশংসনীয় ধর্মীয় সকল পদ্ধতিই সুন্নত। এটি কিন্তু নূরনবী (ﷺ) হতে প্রাপ্ত নয় এমন সুন্নাত। অর্থাৎ
❏ বিভিন্ন হাদীস যেমন:
عليكم بسنتى এবং من تمسك بسنتى
প্রভৃতি পরম্পরায় সুন্নত (রাসূল পাক (ﷺ) হতে প্রাপ্ত) এর উপর প্রমাণবহ। আর من سن سنة حسنة প্রভৃতি হাদীস সুন্নতে গায়রে মুতাওয়ারেছার দিকে ইঙ্গিতবহ। যাকে বেদাতে হাছানা (উৎকৃষ্ট)ও বলা চলে। উপরোক্ত হাদীস শরীফের উপর ভিত্তি করেই উম্মতে মুহাম্মদীয়ার (ﷺ) মধ্যে অনেক কর্মের নবপ্রচলন ঘটেছে। যেমন: নামাজে শব্দসহকারে মুখে নিয়ত করা ইত্যাদি।
হ্যাঁ, তবে ঐ দুই প্রকারের সুন্নাতের মধ্যে তারতম্য এই যে, যে সুন্নাতটি হুজুর পাক (ﷺ) হতে পর্যায়ক্রমে আমাদের নিকট পৌঁছেছে তা সুন্নাতে মুতাওয়ারেছা, এটি অনেক উন্নতমানের ও বিশেষ গুণসম্পন্ন। আর যেটি নূরনবী মোস্তফা (ﷺ)-এর উম্মতের সম্মানিত ও সর্বজনমান্য ইসলামী মনীষী ও গবেষক এবং ছুফি সম্প্রদায়ের গবেষণালব্ধ জ্ঞান হতে প্রকাশ পেয়েছে এবং সেটার প্রকাশকাল কুরুনে ছালাছা (নূরনবী মোস্তফা (ﷺ)-এর যুগ হতে পর পর তিনটি যুগে) এর মধ্যে হোক বা পরে হোক সেটা হবে ‘সুন্নাতে গায়রে মুতাওয়ারেছা’ বা নূরনবী মোস্তফা (ﷺ) হতে পর্যায়ক্রমে প্রাপ্ত নয় এমন সুন্নাত। বস্তুত উভয় প্রকারের অর্থগত সংজ্ঞা হলো এক ও অভিন্ন। যা উত্তমপন্থা ও প্রশংসিত পদ্ধতি। এ কারণেই ইমাম আবদুল গণি নাবেলছি (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন নতুন প্রচলিত পদ্ধতির অনুসরণকারী সুন্নী।
হুজুর (ﷺ)-কে সম্বোধন করে ছালাত ও ছালাম পাঠ করার বিধান
এখন কথা হলো, হুজুর পাক (ﷺ)-কে সম্বোধন করে ছালাত-ছালাম পড়া।
❏ এটা অবশ্য আল্লাহপাকের বাণী হতে প্রমাণিত হয় যে,
صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
(তাঁর প্রতি দরূদ পড় ও ছালামের মত ছালাম পরিবেশন কর)। যারই প্রেক্ষিতে নামাজে তাশাহুদ পাঠকালে সম্বোধন করে ছালাম দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ফেকাহ্শাস্ত্রবিদ ও হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতে সম্বোধন সহকারে ছালাত ও ছালাম পড়া জায়েয।
নূরনবী (ﷺ)-এর রওজা মোবারকে ‘আচ্ছালাতু ওয়াচ্ছালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (ﷺ)’ এরূপ ‘ইয়া’ সম্বোধনসূচক শব্দ দ্বারা ছালাত ও ছালাম নিবেদন করার জন্য ফেকার কিতাবসমূহে উলেখ করা হয়েছে।
সুফি সম্প্রদায় হতে তো সর্বদা সম্বোধনসূচক শব্দ দ্বারা দরূদ শরীফ পড়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।
❏ হযরত ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজেরে মক্কী (رحمة الله) যিনি সর্বদল স্বীকৃত ইসলামী মনীষী তিনি সম্বোধন করেই বলেছেনঃ
الصَّلواةُ وَالسَّلامُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ الله
(হে নবী আপনার উপর ছালাত ও ছালাম)।
কেউ কেউ বলে থাকে এটা اتصال معنوى বা অর্থগত সামঞ্জস্য له الخلق والامر (সৃষ্টি ও নির্দেশ) আলমে আমর বা নির্দেশ জগতে নির্দিষ্ট কোন দিক কিংবা দূরে ও নিকটে এগুলো কিছুই নাই। সুতরাং উক্ত সালামের উত্তর প্রদানে সন্দেহের অবকাশ নাই।
شماع امدادية (পৃষ্ঠা-৫২)
এ বিষয়ের উপর অতিরিক্ত বিশেষণের জন্য আমার লিখিত কিতাব ‘ফজায়েলে দরূদ শরীফ’ ও আত্তাহ্কীকুল আ’জীব আ’লা সালাতিন নবীয়্যীল হাবীব (ﷺ) দেখুন। বাজে লোকের ধারণা যে, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (رحمة الله) জাহেরী এলমে অভিজ্ঞ ছিলেন না। তাই তাঁর কথায় শরীয়তের নির্দেশ সাব্যস্ত হবে না। তাহলে আমি ঐ সমস্ত লোকের নিকট আরজ করব তারা যেন-
❏ মুহাজিরে মক্কী শাহ সাহেবকে ঐ সব খোদার প্রিয় বান্দাদের মধ্যে ধরে নেয় যাদের সম্পর্কে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর হাদীস বিদ্যমান আছে:
اذا احب الله عبدا علمه من غير تعلم .
অর্থাৎ- ‘যখন আল্লাহ্পাক কোন বান্দার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন তখন তাঁকে প্রকাশ্যভাবে বিদ্যা অর্জন ব্যতীত এলম দান করে থাকেন।’
যদিওবা তিনি জাহেরীভাবে আলেম ছিলেন না তথাপিও দেওবন্দী আলেম ছাড়া ভারতের প্রখ্যাত ও প্রসিদ্ধ আলেমগণ তাঁর হাত মোবারকে হাত দিয়ে বায়েত গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে বাহরুল উলুম হযরত মাওলানা আবদুছ ছমী শাহ সাহেব যিনি আনোয়ারে ছাতেয়া কিতাবের রচয়িতা এবং উস্তাদে জমানা হযরত মাওলানা শাহ আহমদ হোসাইন কানপুরী বিশেষভাবে উলেখযোগ্য।
তিনটি স্থানে দরূদ শরীফ পাঠ করা হারাম বা নিষিদ্ধ
(১) ব্যবসায়ী যখন কোন দ্রব্য ক্রেতাকে দেখানোর পর তার খাঁটিত্ব প্রমাণের জন্য দরূদ শরীফ পাঠ করা।
(২) কোন অনুষ্ঠানে বা সভায় কোন খ্যাতনামা ব্যক্তি আগমন করলে দরূদ শরীফ দ্বারা তার আগমন সংবাদ দেয়া।
(৩) ফরজ নামাজে আত্তাহিয়্যাতুর মধ্যে যখন হুজুর পাক (ﷺ)-এর নাম মোবারক আসে তখন দরূদ পাঠ করা।
______ সমাপ্ত ______
Comments
Post a Comment