সুন্নী দৃষ্টিকোণ হতে গাদীরে খুম-সংক্রান্ত হাদীসের বিশ্লেষণ

সুন্নী দৃষ্টিকোণ হতে গাদীরে খুম-সংক্রান্ত হাদীসের বিশ্লেষণ

মূল: Chiite.fr (ফ্রান্স)

বঙ্গানুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন 


ভূমিকা

প্রিয়নবী (ﷺ) গাদীরে খুম স্থানটিতে যা এরশাদ করেছিলেন, প্রথমে তার সুনির্দিষ্ট পটভূমি ও প্রসঙ্গ না বুঝে এতদসংক্রান্ত হাদীসটি সম্পর্কে আলোচনা করা অসম্ভব। বস্তুতঃ সামগ্রিক ইসলামী বিধিবিধানের ক্ষেত্রে এটা একটা সার্বিক বা সাধারণ নিয়ম: ক্বুরআনী আয়াতের শানে নুযূল বা কোনো নির্দিষ্ট হাদীসের পটভূমি জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণস্বরূপ, وَٱقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُم - “তাদেরকে যেখানে পাও হত্যা করো” মর্মে আল-ক্বুরআনের আয়াতটিকে (২:১৯১) প্রাচ্যবিদবর্গ অহরহ প্রয়োগ করেন, যাতে অন্যায়ভাবে প্রদর্শন করা যায় যে ইসলাম ‘সর্বদা’ মানুষ হত্যার পক্ষে ওকালতি করে থাকে। আমরা যদি আয়াতটি নাযেলের সময়কালের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, তাহলে দেখতে পাবো যে এটা সুনির্দিষ্টভাবে মুসলমান ও ক্বুরাইশ মুশরিকদের মধ্যে একটি যুদ্ধ চলাকালে অবতীর্ণ হয়েছিলো। এর দরুন আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, মানুষ হত্যা করার বিধানটি সার্বিক নয়; বরং এই আয়াতটির একটি বিশেষ পরিস্থিতিগত পটভূমি রয়েছে।

অনুরূপভাবে, গাদীরে খুমের হাদীসটিও স্রেফ সেটার পটভূমি বা প্রসঙ্গ অনুসারেই অনুধাবন করা যায়: মুসলমান সৈন্যদের একটি দল কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র তীব্র সমালোচনায় লিপ্ত ছিলো; আর এই সংবাদ মহানবী (ﷺ)’র কানে পৌঁছুলে তিনি গাদীরে খুমের হাদীসটিতে তাঁর এতদসংক্রান্ত বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রাচ্যবিদদের মতো শীয়া প্রপাগান্ডাকারীরাও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিভ্রান্তিকর চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্যে এই হাদীসের পটভূমিকে অপসারণের বা মুছে ফেলার অপচেষ্টায় রত আছে।

প্রিয়নবী (ﷺ) কর্তৃক গাদীরে খুমে প্রদত্ত ভাষণটি কোনোক্রমেই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে (রাষ্ট্রীয়) খলীফা মনোনীত করার উদ্দেশ্যে ছিলো না, বরঞ্চ এটা ছিলো তাঁকে কুৎসা হতে রক্ষা করার লক্ষ্যে। কেবল এর পটভূমি মুছে ফেলার মাধ্যমেই এ শাস্ত্রীয় লিপিসংক্রান্ত শীয়া দৃষ্টিকোণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব; এ কারণেই সদাসর্বদা শীয়া মুসলমান ভাইদেরকে হাদীসে গাদীরে খুমের পটভূমি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিৎ আমাদের।

শীয়াদের কাছে গাদীরে খুমের গুরুত্ব

শীয়াবর্গ দাবি করেন যে, গাদীরে খুম স্থানটিতে রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)‘কে ঐশীভাবে তাঁরই (রাষ্ট্রীয়) খলীফা/উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। শীয়া ভাইদের সাথে এই ঘটনাটি আলোচনা করার আগে আমাদেরকে ওই বাহাস-আলোচনার স্থিতি-মাপ নির্ধারণ করা দরকার। আরেক কথায়, আমাদেরকে এর সাথে সম্পৃক্ত দায় স্পষ্ট করা প্রয়োজন:

১/ শীয়া সম্প্রদায় যদি গাদীরে খুমের ব্যাপারে তাঁদের ভাষ্য প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) কর্তৃক ঐশীভাবে (রাষ্ট্রীয়) খলীফা নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং শীয়া সম্প্রদায় সঠিক পথের ওপর রয়েছে।

(২) কিন্তু যদি সুন্নী জামাআত, মহানবী  (ﷺ) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে (রাষ্ট্রীয়) খলীফা/উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেছিলেন মর্মে শীয়াদের এই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমাদের শীয়া ভাইদের এ কথা মেনে নিতে ইচ্ছুক হতে হবে যে কখনোই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) প্রিয়নবী  (ﷺ) কর্তৃক (রাষ্ট্রীয়) উত্তরাধিকারী/খলীফা মনোনীত হননি, আর তাই গোটা শীয়া দলটি-ই অবৈধ তথা ভ্রান্ত।

এ বিষয়টি প্রথমেই খোলাসা করার কারণ হলো, শীয়া প্রপাগান্ডাকারীদের এক রহস্যময় দক্ষতা আছে বিতর্ক হারতে বসলে গোলপোষ্ট নির্দিষ্ট স্থান হতে সরাবার। তাঁরা এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে লাফাতে থাকেন; গাদীরে খুমের বিতর্ক হারলে তাঁরা দরজার ঘটনা (হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ও হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে নিয়ে বানোয়াট গল্প), কিংবা বনূ সাক্বিফা’র বাগানবাড়ি (হযরত আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খলীফা হওয়ার বিষয়), অথবা ফাদাক বাগান (হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র ওয়ারিশী দাবি), বা কে জানে আরো কতো ঘটনার অবতারণা করবেন!

শীয়া মতবাদের গোটা ভিত্তিস্তম্ভ-ই গাদীরে খুম ঘটনার ওপর নির্ভরশীল। কেননা ধরে নেয়া হয় যে এখানেই প্রিয়নবী  (ﷺ) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে তাঁর খলীফা/উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। শীয়াদের দাবিকৃত এই ঘটনা যদি (ইতিহাসে) না ঘটে থাকে, তাহলে মহানবী  (ﷺ) কখনোই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে নিয়োগ করেননি এবং শীয়াদেরকে তাঁদের সমস্ত দাবি-ই পরিত্যাগ করতে হবে; যেমন - তাঁদের এরকম একটি ধারণা হলো হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) খোদাতা’লা কর্তৃক নিয়োগকৃত হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র খেলাফত গ্রাস করেছিলেন - নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক!

সত্য বটে, গাদীরে খুমের ঘটনাটি শীয়া নমুনার জন্যে এতোখানি মুখ্য, শীয়া ধর্মীয় দর্শনের জন্যে এতোখানি গুরুত্বপূর্ণ

যে, শীয়া জনগোষ্ঠী একটি বাৎসরিক উৎসব পালন করেন যার নাম ‘ঈদে গাদীর।’

শীয়াপন্থী আমানা-ডট-ওর্গ ওয়েবসাইট-টি বলে, “শীয়া মুসলমানদের দ্বারা ঈদে গাদীর মহা আনন্দের সাথে পালিত হয়, যা’তে ঈমানদারবৃন্দের প্রতি মহানবী  (ﷺ)’র রেখে যাওয়া শেষ নির্দেশনাগুলোকে তাঁরা স্মরণ করেন। ঈদে গাদীর হচ্ছে বিশ্বব্যাপী শীয়া মুসলমানদের পালিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব দিবসগুলোর একটি। কেননা এটাই সেই দিন, যখন আমাদের প্রিয়নবী  (ﷺ) তাঁর শেষ হজ্জ্ব পালনশেষে ফেরার পথে গাদীরে খুমে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র খেলাফত সম্পর্কে ঘোষণা দেন।” [http://www.amaana.org/gadhir/gadhir1.htm]

শীয়াদের ধারণাকৃত গাদীরে খুমের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তাঁরা হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)’এর খেলাফতকে অস্বীকার করেন; মুসলমানবৃন্দের মূলস্রোত হতে বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খোদা-নিযুক্ত প্রথম খলীফা হিসেবে ঘোষণা করেন। শীয়াপন্থী ‘আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ’ ওয়েবসাইট-টি গাদীরে খুমকে একটি ‘যুগান্তকারী ঘটনা’ এবং হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ইমামতের ভিত্তি হিসেবে উদ্ধৃত করে।

গাদীরে খুমের প্রকৃত গুরুত্ব ও তাৎপর্য শীয়া গোষ্ঠীর কাছে দৃঢ়ভাবে এখানে তুলে ধরার কারণ হচ্ছে এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে যে, শীয়া প্রপাগান্ডার অস্ত্র ভাণ্ডারে যাকে সবচেয়ে মোক্ষম ‘অস্ত্র’ হিসেবে ধারণা করা হয়, সেটা আসলে অত্যন্ত দুর্বল। বস্তুতঃ এটাই যদি হয় শীয়াবাদের মূলভিত্তি, তাহলে শীয়া একটি নড়বড়ে মতবাদ। শীয়াপন্থীরা বলেন রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে গাদীরে খুমে (খলীফা) নিয়োগ করেছিলেন, কিন্তু সাধারণ যুক্তি ও বিচার-বিবেচনা অন্য কথা বলে।

শীয়াদের দাবি অনুযায়ী যা ঘটেছিলো

শীয়া ওয়েবসাইট ‘আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ বলে:

“হাজ্জ্বাতুল ওয়াদা’আ’ (বিদায়ী হজ্জ্ব) সমাপন করে প্রিয়নবী  (ﷺ) মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা (শরীফাইন) ত্যাগ করছিলেন, যখন তিনি এবং অনেক মানুষ গাদীরে খুম নামের একটি স্থানে পৌঁছেন (যেটা আল-জুহফাহ শহরের কাছে)। এটা এমনই এক জায়গা ছিলো, যেখানে বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ (হজ্জ্বশেষে) নিজ নিজ বাড়ির পথে যাত্রার আগে একে অপরের সাথে (বিদায়ী) কুশলাদি বিনিময় করতেন।

ওই স্থানেই নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ হয়:

يَـٰأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَٱللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ ٱلنَّاسِ

অর্থ: হে রাসূল! পৌঁছিয়ে দিন যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনার প্রতি আপনারই রব্বের কাছ থেকে; এবং যদি এমন না হয় তবে আপনি তাঁর কোনো সংবাদ-ই পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষ থেকে। [আল-ক্বুরআন ৫:৬৭; নূরুল এরফান]

ওপরোক্ত আয়াতের শেষ বাক্যটি ইঙ্গিত করে যে, মহানবী  (ﷺ) ঐশীবাণী পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন; কিন্তু এ আয়াতে আল্লাহতা’লা তাঁকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হবার জন্যে বলেন। কেননা তিনি-ই তাঁর রাসূল  (ﷺ)’কে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন।

অতঃপর মূল বাক্যটি ব্যক্ত হয়, যা স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয় মুসলিম উম্মাহ’র ইমাম/অধিকর্তা হিসেবে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র স্পষ্ট পদমর্যাদা। রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র হাত (মোবারক) ধরেন এবং ঘোষণা করেন:

فَقَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ

অর্থাৎ, আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা।

প্রিয়নবী  (ﷺ)’র ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই নিচের ক্বুরআনী আয়াতটি অবতীর্ণ হয়:

ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلإِسْلٰمَ دِيناً

অর্থ: আজ আমি (আল্লাহ) তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্যে ইসলামকে মনোনীত করলাম। [আল-ক্বুরআন, ৫:৩; নূরুল এরফান]

উপরিল্লিখিত আয়াতটি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে, নবী করীম  (ﷺ)’এর বেসাল পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বের বিষয়টি খোলাসা না করা পর্যন্ত দ্বীন-ইসলাম পূর্ণতাপ্রাপ্ত ছিলো না; আর তা পূর্ণতা পেয়েছে তাঁরই পরবর্তী উত্তরাধিকারীর ঘোষণার মাধ্যমে।” [http://www.al-islam.org/ghadir/incident.htm]

অর্থবোধক নয় যে কারণে -

শীয়াপন্থী গোষ্ঠীর দাবি হলো, প্রিয়নবী  (ﷺ) মক্কায় বিদায়ী হজ্জ্ব সমাপন করে আরাফাত পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে বিদায়ী ধর্মোপদেশ/খুতবা দান করেন এবং পরে গাদীরে খুমে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা নিযুক্ত করেন। আমরা এক্ষণে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করবো: গাদীরে খুম স্থানটি মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারার মাঝামাঝি অবস্থিত, যা আল-জুহফাহ শহরের কাছে, যেমনটি আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ ওয়েবসাইটটিতে উল্লেখিত হয়েছে। এটা মরুভূমির মাঝখানে একটা পানীয় জলাশয় । শীয়া এই অপযুক্তির চূড়ান্ত খণ্ডন হলো এ বাস্তবতা যে, গাদীরে খুম মক্কা মোয়াযযমা হতে আনুমানিক ২৫০ কিরোমিটার দূরে অবস্থিত। এই অতি সহজ বাস্তবতা শীয়াবাদের পুরো যুক্তিকে ভেঙ্গে খানখান করে দেয়।

আমরা জানি, রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) মক্কায় বিদায়ী হজ্জ্বের সময় তাঁর শেষ খুতবাটি দিয়েছিলেন।এটা ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানবৃন্দের সামনে, যাঁরা বিভিন্ন শহর হতে হজ্জ্ব করতে এসেছিলেন। প্রিয়নবী  (ﷺ) যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কেই নিজের (পরবর্তী) উত্তরাধিকারী নিয়োগ করতে চাইতেন, তাহলে (হজ্জ্বে উপস্থিত) সকল মুসলমানের সামনে বিদায়ী ভাষণের সময় তা ঘোষণা না করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ বা ব্যাখ্যাই নেই। গোটা উম্মাহ তাঁর শেষ ভাষণ শোনার জন্যে সেখানে ছিলেন উপস্থিত; তাই উত্তরাধিকারী নিয়োগ করার সেটাই ছিলো সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ও সুযোগ।

হুজূরে পূর নূর  (ﷺ) ও মুসলমান সাধারণ তাঁদের হজ্জ্ব সুসম্পন্ন করার পরে নিজ নিজ শহরের দিকে ফিরে যান। মদীনাবাসীবৃন্দ মদীনায় ফেরেন; তায়েফবাসী ফিরে যান তায়েফ নগরীতে; ইয়েমেনবাসী প্রত্যাবর্তন করেন ইয়েমেনদেশে; কুফাবাসী ফেরত যান কুফায়; সিরিয়াবাসী ফেরেন সিরিয়ায়; আর মক্কাবাসী থেকে যান মক্কায়।

আরব উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলীয় শহরগুলোতে বসবাসকারী মানুষের দলটি-ই কেবল (ফেরার পথে) গাদীরে খুম অতিক্রম করেন। এঁদের মধ্যে (বেশির ভাগ) ছিলেন মদীনাবাসী এবং বাকিরা সংখ্যালঘু মুসলমান, যাঁরা ছিলেন সিরিয়ার মতো স্থানে বসবাসকারী। অতএব, প্রিয়নবী  (ﷺ) যখন গাদীরে খুমে থামেন এবং (শীয়াদের) ধারণাকৃত ঘটনাটি ঘটে, তখন মুসলমানবৃন্দের বিশাল একটি অংশ যাঁরা মক্কা মোয়াযযমা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করছিলেন, তাঁরা সেখানে ‘উপস্থিত’ ছিলেন না। হজ্জ্বের শেষে মক্কাবাসী মক্কায় থেকে যান; তায়েফবাসী তায়েফ নগরীতে ফেরত যান; কুফাবাসী কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন, আর ইয়েমেনবাসী ইয়েমেনে ফেরেন। স্রেফ মদীনাগামী দলটি কিংবা ওই শহর অতিক্রমকারী হাজ্বীবৃন্দ প্রিয়নবী  (ﷺ)’র সাথে গাদীরে খুমে গমন করেন।

অতএব, শীয়াপন্থীদের দাবির ঠিক উল্টো, মহানবী  (ﷺ) সমগ্র মুসলিম উম্মাহ’র সামনে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা নিয়োগ করেননি; বরঞ্চ গাদীরে খুমে যা ঘটেছিলো তা মুষ্টিমেয় কিছু মুসলমানের সামনেই ঘটেছিলো, যাঁরা মদীনায় কিংবা তারও উত্তরে (সিরিয়া ও আশপাশে) ফিরে যাচ্ছিলেন।

আমরা এবার দেখবো একটি শীয়া ওয়েবসাইট কী দাবি করেছে। দ্য সাক্বালাইন মুসলিম এসোসিয়েশান বলে:

“যিলহজ্জ্ব মাসের ১৮ তারিখ প্রিয়নবী  (ﷺ) বিদায়ী হজ্জ্ব সম্পন্ন করার পর মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাঁর সাথী হয়েছিলেন গোটা মুসলিম কাফেলা, যার সংখ্যা এক লক্ষাধিক। তাঁরা যাত্রা-বিরতি করেন গাদীরে খুম নামের স্থানে, যা মরু-প্রান্তরে হলেও মক্কা ও মদীনার মাঝে এক কৌশলগত অবস্থানে ছিলো (আল-জুহফাহ শহরের কাছে)। ওই দিনগুলোতে গাদীরে খুম (হাজ্বীদের জন্যে) যাত্রা আরম্ভ করার জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিলো, যেখান থেকে পার্শ্ববর্তী রাজ্য/প্রদেশগুলোর হাজ্বী সাহেবান নিজ নিজ বাড়ির পথে ফিরতি যাত্রা করতেন।" [http://www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf]

শীয়া ওয়েবসাইট-টি দাবি করছে যে গাদীরে খুম “(হাজ্বীদের জন্যে) যাত্রা আরম্ভ করার জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিলো, যেখান থেকে পার্শ্ববর্তী রাজ্য/প্রদেশগুলোর হাজ্বী সাহেবান নিজ নিজ বাড়ির পথে ফিরতি যাত্রা করতেন।" যে কোনো ম্যাপ/গোলকের দিকে স্রেফ একবার তাকালেই বোঝা যাবে কী ধরনের উদ্ভট ধারণা এটা! নিচের ম্যাপটি আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ নামের শীয়া ওয়েবসাইট থেকে সরবরাহ করা হয়েছে (চিত্র-১):

মক্কা মোয়াযযমা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি রাজ্যের মুসলমানবৃন্দ নিজ নিজ শহরের বাড়িতে ফেরার পথে কেন ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত গাদীরে খুমে যাত্রা করবেন, তার কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে কি? আমরা আশা করি পাঠকমণ্ডলী এই উদ্ভট দাবির অসারতা সম্পর্কে বুঝতে পারবেন।

বোঝার জন্যে একটি মিসাল তথা তুলনা দেয়া যাক। ধরুন, উত্তর আমেরিকার ইসলামী সোসাইটির (বিদায়ী) সভাপতি স্যান ফ্রানসিসকো’তে বসবাস করেন এবং তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীকে ওই সোসাইটির সকল সদস্যের সামনে মনোনীত করতে চান। প্রতি বছর উক্ত সোসাইটি তার সবচেয়ে বড় সভা শিকাগো’তে আয়োজন করে থাকে, যা’তে সারা আমেরিকার সকল শহর/নগর হতে হাজার হাজার সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। তাঁরা আগমন করেন স্যান ফ্রানসিসকো, অস্টিন, এটলান্টা, মিলওয়াকী, ওয়াশিংটন ডিসি প্রভৃতি নগর হতে। তাঁদের ফ্লাইট দেখতে অনেকটা এরকম হবে (চিত্র-২): 

শিকাগো’তে উক্ত সোসাইটির বাৎসরিক সভায় সমস্ত সদস্য উপস্থিত হলে সভাপতির জন্যে ওইখানে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করা কি সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হবে না? সভাশেষে সবাই বিভিন্ন শহরে অবস্থিত নিজ নিজ বাড়ির দিকে যাত্রা করেন; আর (সাবেক) সভাপতিও স্যান ফ্রানসিসকো’তে অবস্থিত তাঁর বাড়ির দিকে রওয়ানা হন। পথে তিনি শেয়েন শহরে যাত্রা-বিরতি করেন। এমতাবস্থায় সোসাইটির অন্য সব সদস্য তাঁদের শহরগুলোর ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত শেয়েন শহর ঘুরে যাওয়াটা কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? এর তো কোনো মানেই হয় না, যা নিচের চিত্রের মতো দেখাবে (চিত্র-৩):

যুক্তিসঙ্গত চিন্তাধারার কেউ এটা গ্রহণ করতে পারেন না। শিকাগো’তে অনুষ্ঠিত বাৎসরিক সভায় সভাপতি কর্তৃক উত্তরাধিকারী মনোনীত করার বিপরীতে শেয়েনে তা করাটা নিরর্থক হবে। ওয়াশিংটন ডিসি’তে বসবাসকারী কেউ শেয়েনের উদ্দেশ্যে পশ্চিম দিকে যাত্রা করবেন না, বরং তিনি বিপরীত দিকে অবস্থিত তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। যে সদস্য শিকাগো’তে বসবাস করেন, তিনি নিশ্চয় সভাশেষে সভাপতির সাথে শেয়েনে যাবেন না, বরং বসবাসস্থল শিকাগো’তেই থেকে যাবেন। প্রকৃতপক্ষে ওই সোসাইটির সদস্যদের ফিরতি যাত্রা অনেকটা এরকম দেখাবে (চিত্র-৪):

ওপরের এ দৃষ্টান্তে স্যান ফ্রানসিসকো’কে ধরা যাক মদীনার স্থলে, শিকাগো’কে মক্কার স্থলে, আর শেয়েন’কে গাদীরে খুমের স্থলে। এটা স্পষ্ট যে, শেয়েন অতিক্রমকারী মানুষ স্রেফ তাঁরাই হবেন, যাঁরা স্যান ফ্রানসিসকো বা পশ্চিম (মানে ক্যালিফোর্নিয়ার) তীরে বসবাস করেন। অতএব, উক্ত সোসাইটির সভাপতির পক্ষে শেয়েনে তাঁর মনোনয়ন দানের ভাষণ প্রদান করাটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে না। কেননা সেখানে অন্যান্য নগরীর মুসলমান সমদ্যবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন না। বরঞ্চ শিকাগো, যেখানে সভাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেখানেই ওই ভাষণ দেয়াটা তাঁর জন্যে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হবে। অনুরূপভাবে, মহানবী  (ﷺ)’কেও উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে হলে মক্কায় তাঁর বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণে তা করতে হতো, মদীনায় ফেরার পথে অপরিচিত (তথা যাত্রায় সবার অব্যবহৃত) কোনো স্থানে নয়।

মুসলমানবৃন্দ যখন হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন, আমরা ধরে নিতে পারি, তাঁরা নিম্নের পথগুলো গ্রহণ করতেন (চিত্র-৫):

এখন যখন হাজ্বী সাহেবান সকল শহর/নগর হতে মক্কা মোয়াযযমায় সমবেত হয়েছেন, তখন এটা কি সবচেয়ে উপযুক্ত সময় নয় প্রিয়নবী  (ﷺ)’র পক্ষ হতে আপন উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার? শীয়া প্রপাগান্ডাকারীরা আমাদের বিশ্বাস করাতে চান যে তায়েফ ও ইয়েমেন প্রত্যাবর্তনকারী হাজ্বী সাহেবান যাওয়া-আসায় (আপ-ডাউন) অতিরিক্ত ৫০০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে গাদীরে খুমের জলাশয়ে যেতেন এবং এরপর বাড়ি ফিরতেন। শীয়াপন্থীদের বক্তব্য অনুসারেই গাদীরে খুম ছিলো একটি জলাধার এবং ভ্রমণকারীদের জন্যে একটি বিশ্রামের স্থান। তবে তাঁরা যা বলতে ব্যর্থ হয়েছেন তা হলো, এটা ছিলো ওই রাস্তা অতিক্রমকারীদেরই বিশ্রামস্থল; একদম বিপরীত দিকে গমনকারীদের বিশ্রামস্থল মোটেও এটা নয়! শীয়াপন্থীরা আমাদেরকে বিশ্বাস করাতে চান যে হাজ্বী সাহেবানের ফিরতি যাত্রা হতো অনেকটা এ রকম (চিত্র-৬):

এ দাবি স্রেফ অর্বাচীনতা ছাড়া কিছু নয়। হজ্জ্বশেষে প্রত্যেকেই নিজ নিজ শহরে ফেরত গিয়েছেন, আর মক্কাবাসী মুসলমান মক্কায় স্থিত হয়েছেন। কেননা তাঁরা মক্কা নগরীতে বসবাস করতেন। এমতাবস্থায় তাঁরা কেন অব্যবহৃত একটি স্থানের জলাশয়ে গমন করতে যাবেন? মুসলমানবৃন্দ তদানীন্তনকালে পায়দলে চলতেন বিবেচনা করলে গাদীরে খুম অভিমুখি ২৫০ কিলোমিটার ও ফিরতি যাত্রায় সমপরিমাণ দূরত্ব অতিক্রমের দরুন বেশ কিছু অতিরিক্ত সপ্তাহ লেগে যাওয়ার কথা। এটা কি যুক্তি ও বিচার-বিবেচনার পরিপন্থী নয়? নিশ্চয় অর্থবহ চিত্রটি নিচে পাওয়া যাবে (চিত্র-৭):

অতএব, আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, প্রিয়নবী  (ﷺ) সকল মুসলমানের সামনে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা নিযুক্ত করেছিলেন মর্মে শীয়াদের দাবি একেবারেই অবান্তর, কেননা তিনি তাঁর বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণে এই বিষয়টি মোটেও উত্থাপন করেননি। আর গাদীরে খুমের ঘটনার ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, মহানবী  (ﷺ) কর্তৃক হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা মনোনীত করার সম্ভাবনা এই স্থানটিতে একদম নেই। বরঞ্চ গাদীরে খুম সম্পর্কে মুসলিম মূলস্রোতের ভাষ্যই অধিকতর অর্থবোধক (তথা গ্রহণযোগ্য)।

গাদীরে খুমে যা ঘটেছিলো -

কেউই গাদীরে খুমের ঘটনা অস্বীকার করেন না। তবে আমরা যা অস্বীকার করি, তা উক্ত ঘটনার ব্যাপারে শীয়াপন্থীদের অতিরঞ্জন। প্রথমতঃ ওই স্থানে উপস্থিত মুসলমানদের সংখ্যা সম্পর্কে শীয়া গোষ্ঠী অতিরঞ্জন করেন; তাঁরা অহরহ দাবি করেন ওই সংখ্যা শত-সহস্র। আমরা ইতোমধ্যে দেখিয়েছি যে, স্রেফ মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী মুসলমানবৃন্দ-ই গাদীরে খুমে উপস্থিত ছিলেন; যার মানে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না মক্কাবাসীবৃন্দ, বা তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি রাজ্যের মুসলমানবৃন্দ। বস্তুতঃ শীয়াপন্থীরা ঘনঘন দাবি করে থাকেন যে ১ লক্ষ মানুষ গাদীরে খুমে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এটা অতিরঞ্জন ছাড়া কিছু নয়। বরঞ্চ এই সংখ্যক হাজ্বী সাহেবান মক্কায় বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণের সময় উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা এসেছিলেন বিভিন্ন শহর হতে। ওতে মদীনায় প্রত্যাবর্তনকারী মুসলমানই কেবল উপস্থিত ছিলেন না (যাঁরা ওই ১ লাখের একটি অংশমাত্র)। বাস্তবতা হলো, শীয়াপন্থী গোষ্ঠী যে সংখ্যাই বলুন না কেন, তা মুসলমানদের একাংশই হবে; কেননা এতে অন্তর্ভুক্ত হবেন না মক্কা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমান জনগোষ্ঠী।

গাদীরে খুমের পটভূমিকে বিবেচনায় নেয়া জরুরি। এর পরিপ্রেক্ষিত ছিলো এই যে, মহানবী  (ﷺ) নির্দিষ্ট এমন কিছু ব্যক্তির প্রতি জবাব দিচ্ছিলেন, যাঁরা ছিলেন হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমালোচনামুখর। এর পটভূমি হলো, কিছু মাস আগে রাসূল  (ﷺ) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে ৩০০ জনের এক বাহিনীসহ ইয়েমেন দেশে সেনা অভিযানে প্রেরণ করেন। এটা নাজাফ-ডট-ওর্গ শীর্ষক শীয়া ওয়েবসাইটে উল্লেখিত হয়েছে এভাবে: “আলী  (رضي الله عنه)’কে ইয়েমেনের সামরিক অভিযানে অধিনায়ক নিয়োগ করা হয়।” [http://www.najaf.org/english/book/20/4.htm]

হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র পরিচালনাধীন সৈন্যবাহিনী ইয়েমেনে অত্যন্ত সফল হয়েছিলো এবং মুসলমানবৃন্দ প্রচুর গনীমতের মালামাল লাভ করেছিলেন। এই গনীমত (বণ্টন) নিয়ে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সাথে তাঁর সৈন্যদের মতবিরোধ দেখা দেয়। ইবনে ক্বাসীর নিজ “আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া’ পুস্তকে লেখেন:

“গনীমতের পাঁচ ভাগের এক ভাগ রাষ্ট্রীয় অংশের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ শণজাত বস্ত্র ছিলো, যা গোটা সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটাতে সক্ষম ছিলো। কিন্তু হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) সিদ্ধান্ত নেন তা স্পর্শ না করে প্রিয়নবী  (ﷺ)’র কাছে হস্তান্তর করতে হবে।”

ইয়েমেন বিজয়ের পরে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁর বাহিনীর সহ-অধিনায়ককে সেখানকার দায়িত্ব দিয়ে মহানবী  (ﷺ)’র সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে মক্কায় হজ্জ্বে গমন করেন। ‘আল-বেদায়া’ গ্রন্থে  আমরা পড়ি:

“তবে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র অনুপস্থিতিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহ-সেনা অধিনায়ককে প্রভাবিত করে ওই শণজাত বস্ত্র হতে প্রত্যেক সৈন্যের জন্যে একটি নতুন জামা ধার দেয়া হয়। এই জামাকাপড় পরিবর্তন খুবই প্রয়োজনীয় ছিলো, কেননা সৈন্যরা প্রায় তিন মাস বাড়ির বাইরে ছিলেন।” (মানে বস্ত্রের অভাব দেখা দিয়েছিলো)

অতঃপর ইয়েমেনে অবস্থিত সৈন্যবাহিনী প্রিয়নবী  (ﷺ)’র সাথে হজ্জ্ব সমাপনের উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করে। আল-বেদায়া পু্স্তকে লেখা হয়:

“সৈন্যরা (মক্কা) নগরীতে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছুলে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁদের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সওয়ারে চড়ে এগিয়ে যান, কিন্তু (তাঁদের জামাকাপড়ে) পরিবর্তন দেখে তিনি আশ্চর্য হন। সহ-অধিনায়ক তাঁকে বলেন, ‘আমি তাদেরকে বস্ত্রগুলো দিয়েছি যাতে তারা মানুষের মাঝে (মানে ভদ্রলোকের সমাজে) প্রবেশ করলে গ্রহণযোগ্য হয়।’ সৈন্যরা জানতেন যে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সম্মানে মক্কায় অবস্থানকারী সবাই সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরবেন; আর তাই তাঁরাও নিজেদের সেরা বস্ত্রাবরণে তাতে (মানে ধর্মীয় সমাবেশে) উপস্থিত হতে উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) অনুভব করেন তিনি এ রকম স্বাধীনতা তাঁদেরকে দিতে পারেন না এবং এ কারণে তিনি তাঁদেরকে তাঁদের পুরোনো জামাকাপড় পরার আদেশ দেন, আর নতুন জামাগুলো গনীমতে ফেরত দিতে বলেন। এই বিষয়ে গোটা বাহিনীর মাঝে বড় ধরনের ক্ষোভের সঞ্চার হয়। মহানবী  (ﷺ) এই ব্যাপারে জানার পর বলেন, ‘হে মানব সকল, আলীকে দোষারোপ কোরো না; কেননা সে আল্লাহর পথে (ন্যায়ের পক্ষে) এতোই বিবেকবান যে তাকে দোষারোপ করা চলে না।’ কিন্তু হুজুর পাক  (ﷺ)’এর এই কথা যথেষ্ট হয়নি; কিছু মানুষ হয়তো এ কথা মেনে নেন। কিন্তু (বাকিদের) ক্ষোভ এতে মিটে যায়নি।

“(হজ্জ্বশেষে) মদীনায় ফেরার পথে সৈন্যরা রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)’এর কাছে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ব্যাপারে তিক্ততাভরে অভিযোগ করেন, যার দরুন তাঁর চেহারা মোবারকের রং পরিবর্তিত হয়। তিনি বলেন:

أَلَسْتُمْ تَعْلَمُونَ أَنِّي أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ قَالُوا بَلَى قَالَ أَلَسْتُمْ تَعْلَمُونَ أَنِّي أَوْلَى بِكُلِّ مُؤْمِنٍ مِنْ نَفْسِهِ قَالُوا بَلَى قَالَ فَأَخَذَ بِيَدِ عَلِيٍّ فَقَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ       

অর্থাৎ, ‘আমি কি তোমাদের জীবনের চেয়ে আওলা’ (শ্রেয়তর, অধিকতর মূল্যবান) নই?’ আসহাবে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম যখন উত্তরে বলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, জি, (আপনি শ্রেয়তর)’, তখন তিনি বলেন, ‘তাহলে আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা।’ যাত্রার পরবর্তী পর্যায়ে গাদীরে খুমে বিশ্রামের জন্যে থামলে তিনি সবাইকে সমবেত করেন এবং হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র হাত ধরে ওই একই কথা (আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা) পুনর্ব্যক্ত করেন। অতঃপর এ দুআ যোগ করেন:

اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ

অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।’ এরই ফলশ্রুতিতে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র বিরুদ্ধে গজগজ স্তব্ধ হয়ে যায়।” [ইবনে ক্বাসীর কৃত ‘আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া; লিঙ্ক - https://www.rokomari.com/book/67805/al-bidaya-one-nihaya--islamer-itihas---adi-onto---1-10-part-]

হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র অধীনস্থ সৈন্যরা বস্ত্রের পরিবর্তন নিয়েই কেবল ক্ষুব্ধ ছিলেন না, বরং তাঁরা সামগ্রিকভাবে গনীমতের মালামাল বণ্টন নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের বদৌলতে মুসলমানবৃন্দ অনেক উট লাভ করেন (গনীমত হিসেবে), কিন্তু তিনি সবাইকে সেগুলোর মালিকানা/দখল নিতে বারণ করেন। আল-বায়হাক্বী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন হযরত আবূ সাঈদ (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে যে, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁদেরকে ওই উটগুলোতে চড়তেও নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি যখন মক্কার উদ্দেশ্যে ইয়েমেন ত্যাগ করেন, তখন তাঁর সহ-অধিনায়ক মানুষের দাবির মুখে আত্মসমর্পণ করেন এবং সৈন্যদেরকে উটগুলোতে চড়ার অনুমতি দেন। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) এটা দেখার পর রাগান্বিত হন এবং সহ-অধিনায়ককে দোষারোপ করেন। হযরত আবূ সাঈদ (রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু) বলেন: “আমরা মদীনা প্রত্যাবর্তনকালে প্রিয়নবী  (ﷺ)’র কাছে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হতে আমাদের প্রত্যক্ষকৃত কঠোরতা সম্পর্কে উল্লেখ করি। তিনি (উত্তরে) বলেন: ‘থামো...আল্লাহর কসম, আমি জেনেছি সে আল্লাহরই ওয়াস্তে (বা খাতিরে) ভালো কাজ করেছে’।” [বঙ্গানুবাদকের নোট: জ্বেহাদে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদবৃন্দের জন্যে তাঁদের অধিনায়ককে মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। নিজেদের নফস/কুপ্রবৃত্তিকে বিলীন করা বাধ্যতামূলক। কোনো রকম আরাম-আয়েশ এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। তরীক্বতের পথ চলার বেলায়ও মুরীদকে তাঁর মুর্শীদের ইচ্ছার মাঝে বিলীন হতে হয়। আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করতে হয়। এই আত্মদমনকে হাদীসের ভাষায় সর্ববৃহৎ জ্বেহাদ বলা হয়েছে]

ইবনে ইসহাক্বের রচিত ‘সীরাহ রাসূল-আল্লাহ’ শীর্ষক বইয়েও অনুরূপ একটি ঘটনার বিবরণ পাই, যেখানে লিপিবদ্ধ আছে:

“মহানবী (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ইয়েমেন হতে মক্কা শরীফে আগমন করলে তিনি ত্বরা করে হজুরের  (ﷺ) কাছে যান; আর এ সময় তিনি তাঁরই এক সাথীর কাছে অধীনস্থ সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করে আসেন, যিনি হযরত ইমাম (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’এর আয়ত্তাধীন গনীমতের মধ্যে সমস্ত শণবস্ত্র প্রত্যেক সৈন্যের কাছে বণ্টন করেন। সেনাবাহিনী (মক্কার কাছে) পৌঁছুলে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁদের সাথে সাক্ষাতের জন্যে সওয়ারে চড়ে এগিয়ে যান এবং গিয়ে দেখেন তাঁরা সবাই ওই শণবস্ত্র পরিহিত। তিনি তাঁদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তাঁর সহ-অধিনায়ক বলেন তিনি বস্ত্র দিয়েছেন যাতে সৈন্যরা মানুষের সাথে মেশার সময় গ্রহণযোগ্য হন। হযরত ইমাম (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) প্রিয়নবী  (ﷺ)’র সামনে উপস্থিত হবার আগে ওই বস্ত্র খুলে ফেলার জন্যে সহ-অধিনায়ককে আদেশ করেন। তাঁরা তাঁর আদেশ পালন করেন এবং গনীমতের মালে বস্ত্র ফেরত দেন। (কিন্তু) সৈন্যবাহিনী এ আচরণে ক্ষুব্ধ হন....তাঁরা যখন ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)’এর কাছে অভিযোগ করেন, তখন তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে বলার জন্যে উঠে দাঁড়ান এবং বর্ণনাকারী শুনতে পান তাঁর এ বক্তব্য: ‘আলীকে দোষারোপ কোরো না; কেননা সে আল্লাহর পথে (ন্যায়ের পক্ষে) এতোই বিবেকবান যে তাকে দোষারোপ করা চলে না’।” [ইবনে ইসহাক্ব কৃত ‘সীরাহ রাসূল-আল্লাহ’, ৬৫০ পৃষ্ঠা, পিডিএফ ডাউনলোড লিঙ্ক: https://www.thereligionofpeace.com/pages/muhammad/Guillaume--Life%20of%20Muhammad.pdf]

ইবনে ক্বাসীর বর্ণনা করেন যে (ইয়েমেনে প্রেরিত) সৈন্যরা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমালোচনা আরম্ভ করেন; কেননা তিনি তাঁদেরকে তাঁদের লাভকৃত উটে চড়তে বাধা দিয়েছিলেন এবং নতুন বস্ত্র ফেরত নিয়েছিলেন। এই ব্যক্তিবৃন্দ-ই মদীনা হতে গাদীরে খুমে মহানবী  (ﷺ)’র সাথে যাত্রা করেছিলেন, আর এঁদেরই প্রতি বিখ্যাত হাদীসে গাদীরে খুমের ভাষণটি দেয়া হয়েছিলো।

বস্তুতঃ ‘তারীখুল ইসলাম’ বইটিতে গাদীরে খুমের ঘটনাটির শিরোনাম ‘হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সান্ত্বনা।’ তাতে লেখা হয়:

‘হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সান্ত্বনা’

হজ্জ্বের সময় হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কিছু অনুসারী যাঁরা ইয়েমেন অভিযানে তাঁর সাথী হয়েছিলেন, তাঁরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে (তাঁর বিরুদ্ধে) অভিযোগ করেন। ইয়েমেনে গমনকারী এই সৈনিকদের কিছু ভুল বুঝাবুঝি অনাস্থার জন্ম দিয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) গাদীরে খুমে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রশংসা করে সাহাবা-এ-কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’কে বলেন:

مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ

অর্থ: “আমি যার মওলা/বন্ধু, আলী-ও তার মওলা/বন্ধু।” এই ভাষণের পরে হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) হযরত ইমাম (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “আজ হতে আপনি আমার অতি বিশিষ্ট এক বন্ধু।” অতঃপর প্রিয়নবী  (ﷺ) মদীনা মোনাওয়ারায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং তাঁর পুত্র ইবরাহীম (رضي الله عنه) বেসালপ্রাপ্ত হন। [তারীখ আল-ইসলাম, ১ম খণ্ড, ২৪১ পৃষ্ঠা; লিঙ্ক: https://www.alkitab.com/10226.html]  

হযরতে আলী (ক:)’র প্রতি কারা ক্ষুব্ধ ছিলেন?

শীয়া প্রপাগান্ডাকারীরা এরপর দাবি করেন সর্ব-হযরত খালিদ ও বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)-ই কেবল হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন।

ShiaOfAhlAlBayt ওয়েবসাইটের এডমিন তা’য়ের-আল-ক্বুদস্ বলেন:

“হাদীসগুলোর কোনোটাই হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ব্যাপারে অভিযোগকারী বা ‘বোগয’ তথা শত্রুতার ইন্ধনদাতা হিসেবে খালিদ বিন ওয়ালীদ ও বোরায়দা (তিরমিযীতে বারা’আ বলা হয়েছে) ছাড়া তৃতীয় কারো নাম উল্লেখ করে না, যেমনটি এই ঘটনায় বর্ণিত হয়।”

তা’য়ের-আল-ক্বুদস এডমিনের এটা আরেকটা নির্লজ্জ মিথ্যাচার। বস্তুতঃ হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমস্ত (অথবা অন্তত বেশির ভাগ) সৈন্য-ই তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন; স্রেফ একজন বা দুইজন নন। শায়খ মুফীদ লেখেন:

আমিরুল মো’মেনীন (ক:) তাঁদের কাছ থেকে সব বর্ম খুলে নেন এবং বস্তায় ভরেন। এতে তাঁরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। তাঁরা যখন মক্কায় আগমন করেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগের সংখ্যা অগণিত হয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়নবী  (ﷺ) আদেশ করেন মানুষের কাছে এ আহ্বান জানাতে: “আলী ইবনে আবী তালিবের বিরুদ্ধে তোমাদের জিহ্বাকে সংযত করো! সে মহান আল্লাহর খাতিরে অত্যন্ত কঠোর; সে এমন নয়, যে ধর্মের ক্ষেত্রে ধোকা দেয়...।” [শায়খ মুফীদ প্রণীত ’কিতা’ব আল-ইরশা’দ’,  ১১৬-১২০ পৃষ্ঠা; লিঙ্ক: https://www.shia-maktab.info/index.php/en/library/books/english?format=raw&task=download&fid=93]

হযরতে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ছিলো ‘অগণিত’ এবং ‘মানুষেরা’ তাঁর প্রতি ছিলেন অসন্তুষ্ট (একজন বা দু জন নন); আর প্রিয়নবী  (ﷺ) মানুষের প্রতি যে আহ্বান জানান, তা ছিলো সার্বিক। এটা স্পষ্ট যে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সৈন্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন এ কারণে যে, খুমস্-এর বর্মগুলো পরার অনুমতি তিনি তাঁদেরকে দেননি। অতএব, একজন বা দু জনের ওপর এই দোষ চাপানো যথোচিৎ হবে না। বরঞ্চ সত্য হলো এই যে, ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)‘র ওই আচরণের কারণে তাঁর সৈন্যরা অসন্তুষ্ট হন, আর তাই এর দোষ নির্দিষ্ট কারো ঘাড়ে চাপানো হতে আমরা আল্লাহর দরবারে মুক্তি চাই (আমীন) - বিশেষ করে প্রিয়নবী  (ﷺ) স্বয়ং যেখানে হযরত বোরায়দা ও অন্যান্যদের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তবে মোদ্দা কথা হলো, অনেক মানুষ হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি রাগান্বিত হওয়ার কারণে মহানবী  (ﷺ)’কে গাদীরে খুমের ঘোষণা দিতে হয়, যাতে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি দোষারোপ বন্ধ হয়ে যায়। এটা কোনোক্রমেই তাঁকে উত্তরাধিকারী খলীফা নিয়োগের ঘোষণা ছিলো না।

বানোয়াট সংস্করণ  

একটি সার্বিক শীয়া কৌশল হচ্ছে সাধারণ সুন্নীদের কাছে প্রথমে বিবৃত করা যে গাদীরে খুম-বিষয়ক হাদীসটি বুখারী শরীফ ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান (বেশির ভাগ সময় লম্বা রেফারেন্স দ্বারা সুন্নীদের মনে অনুকূল ধারণা সৃষ্টি করে); অতঃপর তাঁরা অপরিচিত ও অনির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সংস্করণ উদ্ধৃত করেন, যা গাদীরে খুমকে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী মূলতঃ যেভাবে প্রতিফলিত করে তার থেকে একদম ভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলে। মানুষকে বোকা বানাবার এই কৌশলকে বলা হয় “acceptance by association"  মানে সংশ্লিষ্টকরণের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি।

বস্তুতঃ গাদীরে খুম-সংক্রান্ত হাদীসের স্রেফ দুটো সংস্করণ রয়েছে যেগুলোকে সহীহ/বিশুদ্ধ বিবেচনা করা হয় এবং তাও শুধু কিছু আলেম-উলেমার দৃষ্টিতেই। বিতর্কের খাতিরে আমরা সেগুলোকে সহীহ হিসেবে গ্রহণ করছি। তবে ওই দুটো বর্ণনা সহিহাইন (বুখারী ও মুসলিম) গ্রন্থ দুটোয় নেই; বরং সেগুলোকে পাওয়া যায় অন্যান্য কিতাবের পৃথক পৃথক বিবরণে। হাদীসশাস্ত্রের শিক্ষার্থীমাত্রই জানেন, আহাদীসের বিভিন্ন শ্রেণিকরণ রয়েছে; গাদীরে খুম-বিষয়ক হাদীসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিশুদ্ধ বিবরণটি রয়েছে সহীহ বুখারী হাদীসের গ্রন্থে, যা ওপরে আমরা উদ্ধৃত করেছি। অন্য দুটো সংস্করণ নিম্নরূপ:

১/ প্রথম সংস্করণটি - مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ - অর্থ: ‘আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা।’

২/ দ্বিতীয় সংস্করণটি - اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ - অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।’

প্রথম সংস্করণটি সাধারণভাবে গৃহীত; দ্বিতীয়টি দুর্বলতর, তবে কিছু আলেম-উলেমা এটাকে সহীহ বিবেচনা করেন। অন্যান্য সংস্করণগুলো সহীহ হাদীসের কিতাবে নেই এবং মওদূ তথা জাল/বানোয়াট। সাধারণতঃ শীয়া গোষ্ঠী তাঁদের যুক্তি এই দুটো হাদীসের ওপর ভিত্তি করেই অবতারণা করে থাকেন। কিন্তু তাঁদের রদ করা হলে নিঃসন্দেহে তাঁরা বেশির ভাগ সময়ই কিছু অপরিচিত সূত্র হতে অতিরিক্ত সংস্করণ উপস্থাপন করেন, যেখানে প্রিয়নবী  (ﷺ) হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে তাঁরই ‘ওয়াসী’, খলীফা, ইমাম ইত্যাদি বলে সম্বোধন করেছিলেন। এগুলোর সবই বানোয়াট, আর ঐতিহাসিকভাবে শীয়া সম্প্রদায় হলো জাল হাদীস রচনাকারী। তাঁরা গাদীরে খুম সম্পর্কে অপরিচিত রেফারেন্স-এর এক লম্বা তালিকা তৈরিতে উস্তাদ, কেননা গাদীরে খুমের ব্যাপারে অসংখ্য জালিয়াতির জন্যে তাঁরাই দায়ী।

আমরা সহীহ বুখারীতে নিহিত গাদীরে খুমের সংস্করণটি ইতোমধ্যেই দেখেছি; আরো লক্ষ্য করেছি কীভাবে ‘মওলা’ শব্দটি তাতে নিহিত নেই। তবে এই ‘মওলা’ শব্দটি নিচের হাদীসের সংস্করণে পাওয়া যায়:

عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ غَزَوْتُ مَعَ عَلِيٍّ الْيَمَنَ فَرَأَيْتُ مِنْهُ جَفْوَةً فَلَمَّا قَدِمْتُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَكَرْتُ عَلِيًّا فَتَنَقَّصْتُهُ فَرَأَيْتُ وَجْهَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَغَيَّرُ فَقَالَ يَا بُرَيْدَةُ أَلَسْتُ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ قُلْتُ بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ.

হযরত বোরায়দা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সাথে ইয়েমেন অভিযানে যাই এবং তাঁর তরফ থেকে শীতলতা প্রত্যক্ষ করি; তাই আমি (ফেরার পরে) রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)’এর কাছে এসে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কথা উল্লেখ করে তাঁর সমালোচনা করি; এমতাবস্থায় প্রিয়নবী  (ﷺ)’র চেহারা মোবারক বদলে যেতে দেখি। আর তিনি বলেন: “ওহে বোরায়দা, আমি কি ঈমানদারদের তাদের নিজেদের চেয়েও কাছে নই?” আমি (উত্তরে) বলি: জি, এয়া রাসূলাল্লাহ  (ﷺ)। অতঃপর তিনি বলেন: “আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা।” [মুসনদে ইমামে আহমদ ৫ম খণ্ড, ৩৪৭ পৃষ্ঠা #২২৯৯৫, যার সনদ সহীহ ও রাবী/বর্ণনাকারীবৃন্দ সিক্বা/আস্থভাজন (সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিমের বিশ্বস্ত); সুনানে নাসাঈ ৫ম খণ্ড, ৪৫ পৃষ্ঠা #৮১৪৫; মুস্তাদরাকে হাকিম ৩য় খণ্ড, ১১৯ পৃষ্ঠা #৪৫৭৮; আবূ নুয়াইম, ইবনে জারীর ও অন্যান্যরা]

সামান্য ভিন্নতর আরেকটি সংস্করণ নিম্নরূপ:

قَالَ حَدَّثَنِي بُرَيْدَةُ قَالَ بَعَثَنِي اَلْنَّبِيُّ صَلَّىَ اَللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَعَ عَلِيٍّ إِلَى الْيَمَنَ فَرَأيْتُ مِنْهُ جَفْوَةً فَلَمَّا رَجَعْتُ شَكَوْتُهُ إِلَىْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلْيْهِ وَسَلَّمَ فَرَفَعَ رَأسَهُ إِلَيَّ قَالَ يَا بُرَيْدَةُ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ

হযরত বোরায়দা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী  (ﷺ) আমাকে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সাথে ইয়েমেন অভিযানে প্রেরণ করেন এবং আমি তাঁর (হযরত আলীর) তরফ থেকে শীতলতা লক্ষ্য করি; আমি যখন প্রত্যাবর্তন করি, তখন রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)’এর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করি। মহানবী  (ﷺ) আপন শির মোবারক (তাঁর দিকে) উঠিয়ে বলেন: “আমি যার মওলা, এই আলী-ও তারই মওলা।” [সুনান আল-কুবরা’, ৫ম খণ্ড, ১৩০ পৃষ্ঠা, #৮৪৬৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ’তেও অনুরূপ বর্ণনা বিদ্যমান (৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩৭৪ পৃষ্ঠা)]

অন্যান্য বর্ণনায় হুজূর পাক বলেন - اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ - অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।’ কিছু আলেম এই হাদীসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সন্দিহান হলেও আমরা (তর্কের খাতিরে) এই দ্বিতীয় সংস্করণটিকে সহীহ হিসেবে গ্রহণ করবো।

হাদীসে গাদীরে খুমের স্রেফ দুটো সংস্করণকেই সহীহ বিবেচনা করা যায়, আর তাই আমরা ওই দুটোকে নিয়েই আলোকপাত করবো। শীয়া প্রপাগান্ডাকারীবর্গ অহরহই অচেনা ও অনির্ভরযোগ্য উৎস হতে বিভিন্ন হাদীসের সংস্করণ পেশ করে থাকেন; কিন্তু সেগুলো বিতর্কের বৈধ পদ্ধতি নয়। কেননা বেশির ভাগ সময়েই এগুলোকে যাচাই করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়; উপরন্তু, বেশির ভাগ সময়ে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব-ও খুঁজে পাওয়া যায় না; কিংবা এগুলোকে নাটকীয় অপ্রাসঙ্গিকতায় তুলে ধরা হয়। যা অদ্ভুত ও কিছুটা হাস্যকর তা হলো, সুন্নী মুসলমানবৃন্দ প্রায়ই শীয়াদের নির্ভরযোগ্য ‘আল-কাফী’ হাদীসগ্রন্থ হতে উদ্ধৃতি দেন, অথচ শীয়া গোষ্ঠী তা তর্কের ভিত্তিস্বরূপ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। যদি  শীয়াদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থের প্রতি এটাই তাঁদের মনোভাব হয়, তাহলে শীয়াবর্গ কেন অচেনা ও অনির্ভরযোগ্য উৎস হতে গৃহীত বিবরণসমূহ আমাদের দ্বারা গ্রহণের আশা করেন? যাহোক, ন্যায়নিষ্ঠার খাতিরে আমরা এখানে যে দুটো সংস্করণ সম্পর্কে আলোচনা করবো, তা হলো: ১/ এই আলী-ও তার মওলা... এবং ২/ (হে আল্লাহ) তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।

শীয়াপন্থী আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ ওয়েবসাইট-টি দাবি করে:

এই স্থানেই (মানে গাদীরে খুমে) নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ হয় - يَـٰأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَٱللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ ٱلنَّاسِ

অর্থ: হে রাসূল! পৌঁছিয়ে দিন যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনার প্রতি আপনারই রব্বের কাছ থেকে; এবং যদি এমন না হয় তবে আপনি তাঁর কোনো সংবাদ-ই পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষ থেকে। [আল-ক্বুরআন ৫:৬৭; নূরুল এরফান]

কিছু সুন্নী রেফারেন্স বইয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, প্রিয়নবী  (ﷺ)’র গাদীরে খুমে প্রদত্ত ভাষণের ঠিক আগ মুহূর্তে ক্বুরআনের এ আয়াতটি নাযেল হয়। রেফারেন্স:

১/ তাফসীরে কবীর, প্রণেতা - ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী; ৫:৬৭-এর তাফসীর, ১২তম খণ্ড, ৪৯-৫০ পৃষ্ঠা; সর্ব-হযরত ইবনে আব্বাস, বারাআ ইবনে আযীব ও মুহাম্মদ ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’র সূত্রে বর্ণিত।

২/ আসবাব আল-নুযূল, রচয়িতা - আল-ওয়াহিদী, ৫০ পৃষ্ঠা; সর্ব-হযরত আতিয়াহ ও আবূ সায়ীদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’র সূত্রে বর্ণিত।

৩/ নুযূল ক্বুরআন, লেখক - হাফেয আবূ নুয়াইম; সর্ব-হযরত আবূ সাঈদ খুদরী ও আবূ রাফী’ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’র সূত্রে।

৪/ আল-ফুসূল আল-মুহিম্মাহ, কৃত - ইবনে সাব্বাগ আল-মালিকী আল-মক্কী, ২৪ পৃষ্ঠা।

৫/ দুর্রুল্ মানসূর, প্রণেতা - হাফেয আল-সৈয়ূতী, ৫:৬৭-এর তাফসীর।

৬/ ফাতহুল ক্বাদির, রচয়িতা - শওকানী, ৫:৬৭-এর তাফসীর।

৭/ ফাতহুল বয়ান, লেখক - হাসান খাঁন, ৫:৬৭-এর তাফসীর।

৮/ শায়খ মুহিউদ্দীন নববী, ৫:৬৭-এর তাফসীর।

৯/ সীরাতে হালাবিয়্যাহ, কৃত - নূরুদ্দীন হালাবী, ৩য় খণ্ড, ৩০১ পৃষ্ঠা।

১০/ উমদাতুল ক্বারী ফী শরহে সহীহ আল-বুখারী, প্রণেতা - ইমাম বদরুদ্দীন আইনী।

১১/ তাফসীর আল-নিসাপুরী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৯৪ পৃষ্ঠা।

১২/ ইবনে মারদাওয়াইহ ও অনুরূপ আরো অনেকে....। [http://www.al-islam.org/ghadir/incident.htm]

শীয়া প্রপাগান্ডাকারীবর্গ ধোকাবাজ; তাঁদের সম্পর্কে এ ছাড়া আর কী বলার আছে? তাঁদের অর্ধ-উদ্ধৃতির জন্যে তাঁরা অনেক দুর্নাম কুড়িয়েছেন। এখানে শীয়া গোষ্ঠী ১২টি সূত্র পেশ করেছে; আমরা তা একে একে পর্যবেক্ষণ করবো। প্রথমটি ইমাম রাযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র ‘তাফসীরে কবীর।’ শীয়াচক্র সুন্নীদেরকে ধোকা দিতে চাচ্ছেন এমনভাবে যেনো ইমাম রাযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) আল-ক্বুরআনের ৫:৬৭ আয়াতটি গাদীরে খুমে অবতীর্ণ বলে বিশ্বাস করতেন। আসলে তিনি তাঁর বইয়ে এর ঠিক উল্টোটা লিখেছিলেন!

ইমাম রাযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) উল্লেখ করেন যে বিভিন্ন মানুষ আয়াতটিকে ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষে অবতীর্ণ বলে দাবি করেছিলেন। তিনি এর দশটি সম্ভাব্যতা তালিকাবদ্ধ করেন। এটা সর্বজনজ্ঞাত যে, উলামাবৃন্দের লেখনীর ধারায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত বিষয়টি তালিকায় প্রথমে স্থান পেতো এবং সবচেয়ে কম গুরুত্বের বিষয়টি সবশেষে লেখা হতো। ধোকাবাজ শীয়াদের মনোযোগ আকর্ষণের মতো বিষয় যেটা, সেটা হলো ইমাম রাযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) গাদীরে খুমকে একদম শেষে মানে ১০ নম্বরে রেখেছেন। বোঝাই যাচ্ছে এটা তাঁর দৃষ্টিতে সবচেয়ে দুর্বলতম অভিমত।

এক্ষণে আমরা ইমাম রাযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র তাফসীরের হুবহু অনুবাদ পেশ করবো [https://archive.org/details/altafsiralkabir03rzfauoft/page/n502]:

মুফাসসির আলেম-উলামা এ আয়াতের অনেক শানে নুযূল (পরিপ্রেক্ষিত) উল্লেখ করেছেন:

১/ প্রথমটি হলো, এই আয়াতটি পাথর নিক্ষেপ ও প্রত্যাঘাতের ব্যাপারে অবতীর্ণ, যেমনটি ইতিপূর্বে ইহুদীদের ঘটনায় উল্লেখিত হয়েছে।

২/ দ্বিতীয়টি ইহুদীদের দ্বারা ধর্মের সমালোচনা ও উপহাস করার কারণে; আর প্রিয়নবী  (ﷺ) তাদের ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিলেন। এমতাবস্থায় এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।

৩/ তৃতীয়টি হলো, যখন বেছে নেয়ার স্বাধীনতাসূচক আয়াতটি নাযেল হয়, যা’তে ঘোষিত হয়েছিলো - يٰأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لأَزْوَاجِكَ - ‘হে রাসূল! আপনার স্ত্রীদের বলুন...’ (৩৩:২৮), নবী করীম  (ﷺ) তখন ওই আয়াতটি প্রকাশ করেননি এ আশঙ্কায় যে তাঁর স্ত্রীবৃন্দ দুনিয়াকে বেছে নিতে পারেন; আর তাই এটা (৫:৬৭) নাযেল হয়।

৪/ চতুর্থটি যায়দ ও যায়নাব বিনতে জাহশ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) প্রসঙ্গে হতে পারে। হযরত মা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: যে ব্যক্তি বলে রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) তাঁর প্রতি অবতীর্ণ বাণীর কিয়দংশ গোপন করেছেন, সে নিশ্চয় আল্লাহরই প্রতি জঘন্য মিথ্যে আরোপ করে; কেননা আল্লাহ ঘোষণা করেন -  ’হে রাসূল! ঐশীবাণী প্রকাশ করুন,’ আর প্রিয়নবী  (ﷺ) যদি তাঁর প্রতি অবতীর্ণ ওহী/খোদার বাণীর অংশবিশেষ গোপন করতেন, তাহলে তিনি আল্লাহর এ বাণীটিও গোপন করতেন -  وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا ٱللَّهُ مُبْدِيهِ - ‘আর আপনি স্বীয় অন্তরের মধ্যে ওই কথা (গোপন) রাখতেন, যেটাকে প্রকাশ করা আল্লাহর ইচ্ছা ছিলো’ (৩৩:৩৭)।

৫/ পঞ্চমটি জ্বেহাদ প্রসঙ্গে হতে পারে, কেননা মোনাফেক্ববর্গ এটাকে ঘৃণা করতো। তাই তাদেরকে এর প্রতি তাকিদ দেয়া হতে তিনি বিরত ছিলেন।

৬/ ষষ্ঠটি আল্লাহর কালাম -  وَلاَ تَسُبُّواْ ٱلَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ فَيَسُبُّواْ ٱللَّهَ عَدْواً بِغَيْرِ عِلْمٍ - ‘এবং তোমরা ওই সবকে গালি দিও না, আল্লাহকে ছেড়ে যেগুলোর তারা পূজো করছে; কেননা তারা আল্লাহর শানে বেয়াদবি করবে সীমালঙ্ঘন ও মূর্খতাবশতঃ’ [আল-ক্বুরআন, ৬:১০৮]। এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মহানবী  (ﷺ) মুশরিকদের উপাস্যগুলোর সমালোচনা করা হতে বিরত থাকেন। অতঃপর এই আয়াতটি নাযেল হয় এবং আল্লাহ ঘোষণা করেন -  بَلِّغْ - ‘পৌঁছিয়ে দিন;’ মানে ঘোষণা করুন তাদের উপাস্যগুলোর ত্রুটিবিচ্যুতি এবং গোপন করবেন না, আল্লাহ আপনাকে তাদের কাছ থেকে রক্ষা করবেন।

৭/ সপ্তমটি হলো, এ আয়াতটি মুসলমানদের অধিকারগুলো প্রকাশের খাতিরে অবতীর্ণ হয়। কেননা বিদায়ী হজ্জ্বে তিনি হজ্জ্বের বিধিবিধান ও রীতিনীতি ঘোষণা করেন এই বলে: ‘আমি কি (তোমাদের কাছে ঐশীবাণী) পৌঁছে দেই নি?’ সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) বলেন: ‘জি।’ তিনি উত্তরে বলেন: ‘হে আল্লাহ, আপনি আমার সাক্ষী থাকুন।’

৮/ অষ্টমটিতে বর্ণিত হয়েছে যে, প্রিয়নবী  (ﷺ) কোনো এক যাত্রার মাঝে একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং তাঁর তরবারিখানা ওই গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকাকালীন জনৈক বেদুঈন এসে তরবারি ছিনিয়ে নেয় এবং তাঁকে বলে: ‘হে মুহাম্মদ  (ﷺ)! আমার কাছ থেকে আপনাকে এখন রক্ষা করবেন কে?’ তিনি উত্তর দেন: ‘আল্লাহ।’ এ কথা শোনার সাথে সাথে বেদুঈনের হাত কাঁপা আরম্ভ করে এবং হাত থেকে তরবারি পড়ে যায়, আর সে গাছের সাথে মাথায় বাড়ি খেতে থাকে, যতোক্ষণ না তা ফেটে যায়। তাই আল্লাহ এই আয়াত অবতীর্ণ করেন এবং তাঁকে জানান তিনি তাঁকে রক্ষা করবেন।

৯/ নবমটি হলো, তিনি ক্বুরাইশ, ইহুদী ও খৃষ্টানদের ব্যাপারে শঙ্কিত ছিলেন; তাই আল্লাহ এ আয়াত দ্বারা তাঁর অন্তর থেকে ওই শঙ্কা দূর করে দেন।

১০/ দশমটি হলো, এ আয়াতে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র গুণগত মহত্ত্বের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; আর আয়াতটি নাযেল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) তাঁর হাত মোবারক ধরে বলেন -

مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ، اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ  - অর্থাৎ, ‘আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা;  হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।’ এ ঘটনার পরপরই হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বলেন: “হে ইবনে আবী তালিব! আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই; এখন থেকে আপনি আমার মওলা (প্রিয়ভাজন বন্ধু) এবং সকল মুসলিম নরনারীর মওলা।” এই বিবরণ এসেছে সর্ব-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, বারাআ ইবনে আযিব ও মুহাম্মদ বিন আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’র সূত্রে।

আপনাদের জানা উচিত যে, যদিও এসব বর্ণনা অসংখ্য, তবুও এ আয়াতটিকে আল্লাহ কর্তৃক রাসূল  (ﷺ)’এর হেফাযতের নিশ্চয়তা হিসেবে ব্যাখ্যা করাই যথোচিৎ হবে, যে সুরক্ষা তিনি ইহুদী ও খৃষ্টানদের ধূর্ত চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাঁকে দিয়েছিলেন এবং তাদেরকে ভয় না পেয়ে এ ঘোষণা দেয়ার জন্যে আদেশ করেছিলেন। কেননা এ আয়াতের পটভূমিস্বরূপ আগের ও পরের আয়াতগুলো ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে সম্বোধন করে; কোনো একটি আয়াতকে (আয়াতসমূহের) মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে আগের ও পেছনের আয়াতগুলোর সাথে সেটাকে প্রাসঙ্গিক করাটা সম্ভব নয়।[ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী কৃত ‘তাফসীর আল-কবীর,’ ৫:৬৭, ১২তম খণ্ড, ৪৯-৫০ পৃষ্ঠা]

আরেক কথায়, ইমাম রাযী (رحمة الله) ১০টি সম্ভাব্যতার কথা উল্লেখ করলেও তিনি ইহুদী ও খৃষ্টানদের ব্যাপারেই আয়াতটির অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাকে জোরালো বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। আর এ কারণেই তিনি এই সম্ভাবনাকে সর্বপ্রথমে উল্লেখ করেছিলেন।

ইমাম রাযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) যে দশটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন এবং প্রথমটিকেই একমাত্র যুক্তিসঙ্গত কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, তা ধোকাবাজ শীয়া বিশ্বকোষটি প্রকাশ না করার মধ্যে বিস্ময়ের কী আছে? বরঞ্চ শীয়াচক্র তো নির্ভর করেন অর্ধ-উদ্ধৃতিগুলোর ওপর; আর নিশ্চয় তাঁরা হলেন তাক্বিয়াহ ও ধোকাপরায়ণ লোক। আমরা সুন্নী সর্বসাধারণকে সতর্ক করছি যেনো তাঁরা শীয়াদের দীর্ঘ রেফারেন্স-এর তালিকা দেখে অভিভূত না হন; যখনই তাঁরা সুনির্দিষ্ট উদ্ধৃতি না দিয়ে ওই লম্বা তালিকা দেন, তৎক্ষণাৎ বুঝবেন মূল লিপিকে বিকৃত করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে তাঁদের। ঠিক যেমনটি তাঁরা ক্বুরআন মজীদকে অপব্যাখ্যা করেন এবং পবিত্র গ্রন্থ নিয়ে পুতুল খেলে থাকেন।

আর ইবনে আবী হাতিম প্রদত্ত বর্ণনাটির প্রসঙ্গে সেটার সনদ নিচে উপস্থাপন করা হলো:

‘আমার পিতা আমাদের বলেন: উসমান ইবনে খুরজাদ আমাদের জানান: ইসমাঈল ইবনে যাকারিয়্যা আমাদের জানান: আলী ইবনে আবিস আমাদের জানান আল-আমাশ হতে, তিনি আতিয়্যা আল-আওফী হতে, তিনি আবূ সাঈদ খুদরী হতে।’

এই এসনাদটি দুর্বল। এর বর্ণনাকারীদেরকে যাচাই করলে আমরা পাই:

১/ ইসমাঈল ইবনে যাকারিয়্যা আল-কুফী

আবূ ইয়াহইয়া ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হতে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: “সে দুর্বল।”

আল-নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ‘জারহ ওয়া তা’দীল’ পুস্তকে বলেন: “সে নির্ভরযোগ্য নয়।”

২/ আলী ইবনে আবিস

ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন বলেন: “সে কিছুই নয়।” একই কথা বলেন ইবরাহীম ইবনে এয়াক্বূব আল-জুযক্বানী, আল-নাসাঈ ও আবূল ফাতহ আল-আযদী।

ইবনে হিব্বান (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: “তার ভুলত্রুটি এতো মাত্রাতিরিক্ত যে, সে পরিত্যক্ত হবার যোগ্য।”

৩/ আল-আমাশ

সে মুদালিস (তাদলীস চর্চাকারী)

৪/ আতিয়্যা আল-আওফী

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: “সে দুর্বল।”

ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: “সে দুর্বল।”

ইমাম ইবনে হিব্বান (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: “সে আবূ সাঈদ (رضي الله عنه) হতে হাদীসসমূহ শুনেছিলো এবং তিনি যখন ইন্তেক্বাল করেন, তখন সে আল-কালবী’র সাথে বসতো; তাই কালবী যদি বলতো: ‘রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) এ-কথা, ও-কথা বলেছেন,’ অমনি সে তা মুখস্থ করে নিতো; আর সে তাকে আবূ সাঈদ (رضي الله عنه)’র কুনিয়া প্রদান করেছিলো এবং তার (কালবী) কাছ থেকে (হাদীস) বর্ণনা করেছিলো। অতঃপর তার কাছে যখন জিজ্ঞেস করা হতো: ‘কে এটা তোমার কাছে বর্ণনা করেছেন,’ তখন সে উত্তর দিতো: ‘আবূ সাঈদ এটা আমার কাছে বর্ণনা করেন।’ যাঁরা তাকে এ প্রশ্নটি করতেন, তাঁরা মনে করতেন সে বুঝি হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (رضي الله عنه)’কে বুঝিয়েছে; অথচ বাস্তবে সে কালবী’কেই বুঝিয়েছিলো।”

ইমাম ইবনে হিব্বান (রহমতুল্লাহে আলাইহে) আরো বলেন: “তার প্রদত্ত বর্ণনাগুলো লিপিবদ্ধ করার অনুমতি নেই; শুধু সেগুলোর প্রতি অবাক হওয়া ছাড়া।”

অতঃপর ইমাম ইবনে হিব্বান (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হযরত খালিদ আল-আহমার হতে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: “আল-কালবী আমাকে জানান যে আতিয়্যা তাকে বলেছিলো: ‘আমি আপনাকে আবূ সাঈদের কুনিয়া প্রদান করেছি, তাই আমি বলি: আবূ সাঈদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেন’।”

ওপরের বিবরণ মোতাবেক আবূ সাঈদ হতে পারেন আল-কালবী, (মোটেও) সাহাবী-এ-রাসূল  (ﷺ) হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) নন।

৫/ আবূ সাঈদ: (ওরফে) মুহাম্মদ ইবনে আল-সায়েব আল-কালবী

ইমাম আল-সৈয়ূতী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) আপন ‘আল-ইতক্বান’ পুস্তকে তাফসীরে ইবনে আব্বাস  (رضي الله عنه) প্রসঙ্গে বলেন: “আর সবচেয়ে দুর্বলতম এসনাদ (সনদ) হচ্ছে আল-কালবী’র সূত্রে, তিনি আবূ সালেহ’র সূত্রে, তিনি ইবনে আব্বাস  (رضي الله عنه)’এর সূত্রে। আর যদি তরুণ মুহাম্মদ ইবনে মারওয়ান আল-সা’আদী’র বিবরণ এতে যুক্ত হয়, তবে তা মিথ্যের এক সনদে পরিণত হবে; আর অহরহই আল-সালাবী ও আল-ওয়াহেদী এগুলোর মধ্যে বর্ণনা করে থাকে।”

এয়াক্বূত আল-হামাভী ‘মু’জাম আল-উদাবা’ পুস্তকে ‘তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারী’ সম্পর্কে বলেন: “আর তিনি (তাবারী) কোনো অনির্ভরযোগ্য তাফসীরের উদ্ধৃতি দেননি; কারণ তিনি তাঁর গ্রন্থে মুহাম্মদ ইবনে আল-সায়েব আল-কালবী অথবা মুক্বাতিল ইবনে সুলাইমান কিংবা মুহাম্মদ ইবনে উমর আল-ওয়াক্বিদী’র বইপত্র হতে কোনো কিছুই গ্রহণ করেননি; কেননা তারা তাঁর দৃষ্টিতে সন্দেহের (আসিনা’) উদ্রেক করেছিলো, আর আল্লাহ-ই ভালো জানেন।”

আল-বুখারী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) নিজ ‘তারীখ আল-কবীর’ গ্রন্থে বলেন: “মুহাম্মদ ইবনে আল-সায়েব আবূ আল-নাযির আল-কালবী’কে ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ পরিত্যাগ করেন।” ইবনে মাহদী ও আলী আমাদের জানান: “ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আমাদের জানান সুফিয়ান হতে; তিনি বলেন, আল-কালবী আমাকে বলেন, তোমাকে যা জানিয়েছি, তার সবই মিথ্যে।”

ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: “সে বিশ্বস্ত নয় এবং তার কাছ থেকে হাদীস লিপিবদ্ধ করা উচিৎ নয়।”

আহমদ ইবনে হারূন বলেন: “আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رضي الله عنه)’কে ‘তাফসীরে কালবী’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন: ‘মিথ্যে।’ আমি প্রশ্ন করি: ‘তা দেখার অনুমতি আমার আছে কি?’ তিনি উত্তর দেন: ‘না’।”

সিদ্ধান্ত: এই বর্ণনার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।

শীয়াদের উদ্ধৃত অন্যান্য বইপত্রেও এই একই সনদটি বিদ্যমান, যেমন - ইমাম ওয়াহিদী আল-নিশাপুরী’র রচিত ‘আসবাব আল-নুযূল’ কিতাব:

أخبرنا أبو سعيد محمد بن علي الصفار قال: أخبرنا الحسن بن أحمد المخلدي قال: أخبرنا محمد بن حمدون بن خالد قال: حدثنا محمد بن إبراهيم الخلوتي قال: حدثنا الحسن بن حماد سجادة قال: حدثنا علي بن عابس عن الأعمش وأبي حجاب عن عطية عن أبي سعيد الخدري قال: نزلت هذه الآية (يا أَيُّها الرَسولُ بَلِّغ ما أُنزِلَ إِلَيكَ مِن رَّبِّكَ) يوم غدير خم في علي بن أبي طالب رضي الله عنه

ইমাম সৈয়ূতী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র প্রণীত ‘তাফসীর দুর্র আল-মানসূর’ গ্রন্থেও আমরা ওই একই সনদ উদ্ধৃত হয়েছে দেখতে পাই:

حدثنا ابى ثنا عثمان بن حرزاد، ثنا اسماعيل بن زكريا، ثنا علي بن عابس عن الاعمش ابني الحجاب، عن عطية العوفي عن ابى سعيد الخدري قال: نزلت هذه الاية يا ايها الرسول بلغ ما انزل اليك من ربك في علي بن ابى طالب

আল-শওকানীর কৃত ‘ফাতহুল ক্বাদির’ পুস্তকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

ব্যাপার হলো, এসব সূত্রের কোনোটাই শীয়াদের যুক্তি প্রমাণ করে না। এগুলো যদি তা প্রমাণ করতো, তাহলে আপনারা দেখতে পেতেন শীয়া গোষ্ঠী পূর্ণ উদ্ধৃতি উপস্থাপন করছেন; কিন্তু তাঁরা তো তা করতে পারছেন না! কেননা এতে তাঁদের যুক্তির অসারতাই প্রমাণিত হবে। অতএব, সিদ্ধান্ত হলো, কোনো বিশ্বস্ত বা নির্ভরযোগ্য সুন্নী সূত্রই এই আয়াতটিকে গাদীরে খুমে অবতীর্ণ বলে বিবৃত করে না।

এ কথা সর্বজনবিদিত যে, গাদীরে খুমের ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)’এর যাহেরী জিন্দেগীর শেষপ্রান্তে ঘটেছিলো, যখন তাঁরই হেদায়াত দ্বারা মুসলমান জাতি সমগ্র আরব অঞ্চল নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে এসেছিলেন; এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন নাজরানের খৃষ্টান ও ইয়েমেনের ইহুদী জাতিগোষ্ঠীও। এমতাবস্থায় প্রিয়নবী  (ﷺ)’র অনুসারীবৃন্দ যেখানে এক শ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিলেন, সেখানে (ঐশীবাণী) ঘোষণা করার বেলায় তাঁর আর ভয়ের কী থাকতে পারে? তাঁর (রাষ্ট্রীয়) ক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকাকালীন এ আয়াতটির নাযেল হওয়ার কোনো অর্থ-ই হয় না। বরঞ্চ এ আয়াতখানা নুবুওয়্যতের আরো অনেক প্রাথমিক সময়ে অবতীর্ণ হয়েছিলো, যখন ইসলাম ধর্ম টিকে থাকার জন্যে ছিলো সংগ্রামরত আর শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত।

শীয়াদের আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ ওয়েবসাইট-টি দাবি করে:

ক্বুরআনী আয়াত ৫:৩ নাযেল

রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) ভাষণ শেষ করার অব্যবহিত পরেই আল-ক্বুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়:

ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلإِسْلٰمَ دِيناً

অর্থ: আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ

করলাম, আর তোমাদের জন্যে ইসলামকে মনোনীত করলাম। [আল-ক্বুরআন, ৫:৩]

ওপরের আয়াতটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, রাসূল  (ﷺ)’এর পরে নেতৃত্বের বিষয়টি সুস্পষ্ট করা ছাড়া দ্বীন সম্পূর্ণ হতো না; আর দ্বীনের এই সম্পূর্ণতা এসেছে তাঁরই পরবর্তী উত্তরসূরীর ঘোষণা দ্বারা। [http://www.al-islam.org/ghadir/incident.htm]

আসলে এটা আরেকটা শীয়া বানোয়াট কাহিনি; কেননা আল-ক্বুরআনের উক্ত ৫:৩ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিলো আরাফাতের পাহাড়ে বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণের সময়। এই কথা ব্যক্ত হয়েছে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আল-সুনান ও অন্যান্য হাদীসের বইপত্রে। যেমন বিবৃত হয়েছে:

“এটা (আয়াত ৫:৩) এক শুক্রবার, আরাফাত দিবসে প্রকাশিত হয়...।”

বাস্তবতা হলো, এটা ছিলো প্রিয়নবী  (ﷺ)’র বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণ এবং তাই এটা দ্বীন-ইসলাম সম্পূর্ণ হওয়ার যথার্থ স্থান, এমনটি ধারণা করাই স্বাভাবিক হবে। বস্তুতঃ এই কারণেই আমরা গাদীরে খুমকে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ইমামতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাব্যতা অস্বীকার করি। “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম” - এ আয়াতটি ইতোমধ্যেই নাযেল হয়েছিলো এবং এর পরে ঈমানের সাথে আর অন্য কোনো কিছু যুক্ত করার ছিলো না। শীয়াপন্থীরা যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ইমামতের মতো বড় কোনো বিষয়কে এর সাথে যুক্ত করার বেলায় পীড়াপীড়ি করেন, তাহলে (প্রশ্ন হচ্ছে) আল-ক্বুরআনে এতদসংক্রান্ত আয়াতগুলো কোথায়?

হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র মনোনয়নের ব্যাপারে ক্বুরআন মজীদ নীরব কেন? নিশ্চয় আল্লাহতা’লা তা পাক কালামে উল্লেখ করতেন, যদি তা ঐশী আজ্ঞা হতো। (শীয়াদের) ধারণা অনুযায়ী, আল্লাহ ৫:৬৭ ও ৫:৩ আয়াতগুলো হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ও তাঁর ইমামত সম্পর্কে নাযেল করেন; অথচ তিনি কেন ওই সব আয়াতে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র নাম মোবারক অন্তর্ভুক্ত করেননি, যাতে মুসলমানদের কাছে স্পষ্ট হয় যে তিনি-ই খোদাতা’লা কর্তৃক নিযুক্ত মুসলমানদের পরবর্তী ইমাম/খলীফা? এই বিষয়ে আরো অস্পষ্টতা হলো, আয়াতগুলোর কোনোটাই ইমামত বা খেলাফত সম্পর্কে কোনো রকম আলোচনা করেনি। এটা সত্যি অবাক হওয়ার মতো বিষয় যে, শীয়াচক্র সর্বদাই এ কথা বলে থাকেন, আর দাবি করেন যে উক্ত আয়াতে করীমা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ইমামতকে উদ্দেশ্য করেছে। অথচ আল্লাহতা’লা কখনোই নিজে তা বলেননি তাঁর পাক কালামে।

আরবী ’মওলা’ শব্দটির সংজ্ঞা

 শীয়াপন্থী গোষ্ঠী দাবি করেন যে ‘মওলা’ শব্দটি এখানে ‘মনিব’ (বা মালিক) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটির এই ভ্রান্ত অর্থ করে তাঁরা দাবি করেন প্রিয়নবী  (ﷺ) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে তাঁরই উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। বস্তুতঃ ‘মওলা’ শব্দটি অন্যান্য বহু আরবী শব্দের মতোই একাধিক অর্থ বহন করে। কোনো অ-বিশেষজ্ঞ শীয়া ব্যক্তি এটা জেনে মর্মাহত হতে পারেন যে ‘মওলা’ শব্দটির সবচেয়ে সার্বিক মানে হলো ‘গোলাম/সেবক,’ ‘মনিব’ নয়। সাবেক কোনো (ক্রীত) দাস যখন গোলাম/সেবক পর্যায়ে উন্নীত হন, আর যিনি কোনো গোত্রীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট নন, তাঁকে ‘মওলা’ বলে ডাকা হতো। এর দৃষ্টান্ত হলেন সালিম, যাঁকে সালিম ‘মওলা’ আবী হুযায়ফা নামে অভিহিত করা হতো; কেননা তিনি ছিলেন হযরত আবূ হুযায়ফা (رضي الله عنه)’র সেবক।

 ’মওলা’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ দেখতে হলে একটি আরবী অভিধান খুল্লেই চলে। ইবনে আল-আসীর বলেন ‘মওলা’ শব্দটিকে যেসব অর্থে ব্যবহার করা যায়, তার মধ্যে রয়েছে: মনিব, মালিক, দাতা, মুক্তিদাতা, সাহায্যকারী, হাবীব/মহব্বতকারী, মিত্র, ক্রীতদাস, সেবক, ভায়রা/শ্যালক, কাজিন তথা চাচাতোভাই, বন্ধু ইত্যাদি।

 এক্ষণে আমরা আবারো হাদীসটিকে পরীক্ষা করবো:

 مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ، اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ

 অর্থ: ‘আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা। হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।’

 এখানে ব্যবহৃত ‘মওলা’ শব্দটির অর্থ ‘মনিব’ হতে পারে না, বরঞ্চ বড় জোর ‘প্রিয়ভাজন বন্ধু’ হতে পারে। এটা স্পষ্ট যে ‘মওলা’ শব্দটি এখানে এশক্ব-মহব্বত ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করে; কোনোক্রমেই ইমামত ও খেলাফতের দিকে ইঙ্গিত করে না। ’মুওয়ালাত’ (ভালোবাসা) হচ্ছে ‘মু’আদত’ তথা শত্রুতার বিপরীত। ‘মওলা’ শব্দের এই সংজ্ঞাটি প্রাসঙ্গিকতায় সবচেয়ে অর্থবোধক, কেননা প্রিয়নবী  (ﷺ) হাদীসটিতে পরপরই বলেন, “হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।”

 শীয়াপন্থীরা হয়তো এখানে ব্যবহৃত ‘মওলা’ শব্দটির মানে ‘প্রিয়ভাজন বন্ধু’ বলে বিশ্বাস করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো এটাকে আর অন্য কোনো উপায়ে অর্থ করা যায় না, যখনই আমরা বিবেচনায় নেই যে  উদ্ধৃত দ্বিতীয় অংশটি ‘তাঁর সাথে শত্রুতা’ সংক্রান্ত, আর সেটা তাঁরই দ্বারা শাসিত বা অনুরূপ কোনো অর্থে ব্যক্ত হয়নি। এ বাস্তবতা সত্যি অবিশ্বাস্য যে শীয়া গোষ্ঠী এটাকে খলীফা ও ইমাম হিসেবে অর্থ করেন, যখন এর প্রসঙ্গের সাথে ওই অর্থের কোনো সম্পর্ক-ই নেই।

 আল-জাযারী (رحمة الله) ‘নেহা’য়াহ’ পুস্তকে বলেন:

 “হাদীসটিতে ‘মওলা’ শব্দটি ঘনঘন উল্লেখিত হয়েছে; আর এটা এমনই একটা নাম যার বহুবিধ ব্যবহার। তা হতে পারে মনিব, মালিক, দাতা, ক্রীতদাস মুক্তিদাতা, সহায়তাকারী, হাবীব, অনুসারী, প্রতিবেশি, কাজিন (চাচাতো ভাই), মিত্র, শ্বশুরপক্ষীয়, ক্রীতদাস, মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম, কারো উপকারপ্রাপ্ত কেউ। এসব অর্থের অধিকাংশই বিভিন্ন হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। অতএব, কোনো নির্দিষ্ট হাদীসের প্রসঙ্গ বা পরিপ্রেক্ষিতভিত্তিক উল্লেখ অনুযায়ী সেটার অর্থ বুঝতে হবে।”

 ইমাম শাফেঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) গাদীরে খুমের এই নির্দিষ্ট হাদীস প্রসঙ্গে বলেন:

 “এর দ্বারা ইসলামের (বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার) বন্ধনকে বোঝায়।”

আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন:

فَٱلْيَوْمَ لاَ يُؤْخَذُ مِنكُمْ فِدْيَةٌ وَلاَ مِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مَأْوَاكُمُ ٱلنَّارُ هِيَ مَوْلاَكُمْ وَبِئْسَ ٱلْمَصِيرُ

অর্থ: সুতরাং আজ না তোমাদের কাছে কোনো মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে এবং না প্রকাশ্য কাফিরদের কাছ থেকে। তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে (জাহান্নামের) আগুন। তা তোমাদের সাথী (মওলা) এবং কতোই মন্দ পরিণতি! [আল-ক্বুরআন, ৫৭:১৫; নূরুল এরফান]

জগতের কোনো অনুবাদক, এমন কী সবচেয়ে একগুঁয়ে শীয়াপন্থীও এটাকে ‘ইমাম’ বা ‘খলীফা’ হিসেবে অর্থ করতে পারবেন না! কেননা তা করা হলে আয়াতটি অর্থবোধক হবে না। জাহান্নামের আগুনকে কুফফারবর্গের মওলা হিসেবে উক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে সেটার প্রতি তাদের ঘনিষ্ঠতার কারণেই। আর হাদীসে গাদীরে খুমে উল্লেখিত ‘মওলা’ শব্দটি এই সংজ্ঞার অনুসরণে বলা হয়েছে (মানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, হযরতে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও ঈমানদারবৃন্দের মধ্যকার ঘনিষ্ঠতা)। নিশ্চয় ‘মওলা’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘উইলায়্যাহ শব্দটি হতে, ‘ওয়ালায়্যাহ’ শব্দ হতে নয়। উইলায়্যাহ মানে এশক্ব-মহব্বত ও নুসরাহ (সাহায্য-সহযোগিতা); আর এটাকে ‘ওয়ালায়্যাহ,’ যার মানে নেতৃত্ব, তার সাথে তালগোল পাকানো উচিৎ নয়।

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

 ذَلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ مَوْلَى ٱلَّذِينَ آمَنُواْ وَأَنَّ ٱلْكَافِرِينَ لاَ مَوْلَىٰ لَهُمْ      

অর্থ: এটা এ জন্যে যে, মুসলমানদের অভিভাবক (মওলা) আল্লাহ এবং কাফিরদের কোনো অভিভাবক (মওলা) নেই। [আল-ক্বুরআন, ৪৭:১১; নূরুল এরফান]

এই আয়াতটি কোনো খেলাফত বা ইমামতের দিকে ইঙ্গিত করে না, বরং এটা একজন ঘনিষ্ঠ রক্ষাকারী বন্ধুর কথা উল্লেখ করে। নতুবা আয়াতটি অনর্থক সাব্যস্ত হয়। শীয়া তাফসীরকারকবর্গ দৃশ্যতঃ এ আয়াতটির দ্বিতীয়াংশকে এড়িয়ে যান, যেখানে আল্লাহ বলেন, “কাফিরদের কোনো অভিভাবক (মওলা) নেই।” এর মানে কি এই অর্থ দাঁড়ায় যে কাফিরবর্গের কোনো নেতা থাকবে না? নিশ্চয় তাদেরও নেতা আছে, যেমনি আমেরিকার বর্তমান নেতা হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই বাস্তবতাটি আল-ক্বুরআনে উল্লেখিত হয়েছে এভাবে:

 فَقَاتِلُوۤاْ أَئِمَّةَ ٱلْكُفْرِ  

অর্থ: কুফরের নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। [আল-ক্বুরআন, ৯:১২; নূরুল এরফান]

 وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَدْعُونَ إِلَى ٱلنَّارِ

অর্থ: এবং তাদেরকে আমি দোযখবাসীদের নেতা করেছি; তারা আগুনের দিকে আহ্বান করছে। [আল-ক্বুরআন, ২৮:৪১; নূরুল এরফান]

অতএব, আল্লাহ যখন বলেন, “কাফিরদের কোনো অভিভাবক (মওলা) নেই,” তখন এর মানে হলো অতি ঘনিষ্ঠ অভিভাবক; এর মানে এই নয় যে তাদের কোনো ইমাম/নেতা নেই। ইমাম বা খলীফা বোঝাতে এই আয়াতটি মোটেও ‘মওলা’ শব্দটিকে ব্যবহার করেনি, বরং এটা একজন ঘনিষ্ঠ অভিভাবক বন্ধুর কথাই উল্লেখ করেছে।

গাদীরে খুম-সংক্রান্ত হাদীসটিকে ওপরের একই পন্থায় ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রিয়নবী  (ﷺ) তাতে মানুষের প্রতি হযরতে মওলা আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে ভালোবাসবার ও তাঁর ঘনিষ্ঠ হবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর এটাই সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর ও উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) করেছিলেন (মানে তাঁরা ছিলেন হযরতে ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু‘র ঘনিষ্ঠ বন্ধু)। বস্তুতঃ ফারূক্বে আযম হযরতে উমর (رضي الله عنه) হযরতে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র এতোই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে তিনি (আলী) তাঁকে (উমরকে) নিজ কন্যা সম্প্রদান করেন। হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁর পূর্ববর্তী তিনজন খলীফারই ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এমনই ছিলো ওই তিনজন খলীফা ও হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র মধ্যকার পারস্পরিক মহব্বত ও শ্রদ্ধাবোধ। আরেক কথায়, প্রিয়নবী  (ﷺ) কর্তৃক হযরতে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে উত্তরাধিকারী খলীফা মনোনীত করার সাথে গাদীরে খুমের হাদীসটির কোনো সম্পর্ক-ই নেই; বরঞ্চ এটা ছিলো মানুষের দ্বারা তাঁর সমালোচনা বন্ধ করার ও তাঁকে ভালোবাসার উদ্দেশ্যেই ব্যক্ত।

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

 إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُ وَٱلَّذِينَ آمَنُواْ ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ ٱلزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ وَمَن يَتَوَلَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ وَٱلَّذِينَ آمَنُواْ فَإِنَّ حِزْبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلْغَالِبُونَ

অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের বন্ধু তো (হলেন) আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ও ঈমানদারবৃন্দ - যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহরই সামনে বিনত হয়। এবং যেসব লোক আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুসলমানদেরকে স্বীয় বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহরই দল বিজয়ী হয়। [আল-ক্বুরআন, ৫:৫৫-৫৬; নূরুল এরফান]

এই আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা সকল ঈমানদারকে মওলা হিসেবে উদ্ধৃত করেন। তাহলে শীয়াপন্থীরা কীভাবে দাবি করতে পারেন যে মওলা শব্দটি খেলাফত বা ইমামতকে উদ্দেশ্য করে, যদি না ঈমানদারবৃন্দ সবাই অকস্মাৎ খলীফা ও ইমাম হয়ে যান? (এর জবাবে শীয়া মতাবলম্বীরা জঘন্য দাবি উত্থাপন করেন এ মর্মে যে, আয়াতটি একমাত্র হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু’কেই উদ্দেশ্য করে; যদিও বাস্তবতা হলো এটা ঈমানদারদেরকে জমআ’ তথা বহুবচনে সম্বোধন করে। নিঃসন্দেহে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু অন্যান্য পুণ্যাত্মা ঈমানদারের মতোই এ আয়াতের উদ্দিষ্ট ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু এটা স্রেফ তাঁকেই উদ্দেশ্য করতে পারে না; কেননা আয়াতটি স্পষ্টতঃ বহুবচনে ব্যক্ত হয়েছে) নিশ্চয় এখানে উদ্ধৃত ‘মওলা’ শব্দটি এশক্ব-মহব্বত, ঘনিষ্ঠতা ও সাহায্যকে বুঝিয়েছে। বস্তুতঃ আল-ক্বুরআনে একটি নজিরও নেই যেখানে খেলাফত বা ইমামতকে বোঝাতে ‘মওলা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

আল্লাহতা’লা ক্বুরআন মজীদের অন্যত্র ঘোষণা করেন:

 يَوْمَ لاَ يُغْنِي مَوْلًى عَن مَّوْلًى شَيْئاً وَلاَ هُمْ يُنصَرُونَ

অর্থ: যেদিন (শেষ বিচার দিবস) কোনো বন্ধু (মওলা) কোনো বন্ধুর (মওলার) কোনো কাজে আসবে না এবং না তাদের সাহায্য করা হবে। [আল-ক্বুরআন, ৪৪:৪১; নূরুল এরফান]

এর মানে কি “শেষ বিচার দিবসে কোনো নেতা তাঁর নেতার উপকারে আসবে না?” অবশ্যঅবশ্য এর কোনো মানেই হয় না। বরঞ্চ এই আয়াতে আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহতা’লা দুটো শ্রেণির লোককে উদ্দেশ্য করেছেন এবং দুটোকেই ‘মওলা’ সম্বোধন করেছেন। যদি মওলা শব্দটি নেতা বোঝাতো, তাহলে স্রেফ একটি-ই হতো অন্যটির নেতা। কিন্তু যদি ‘মওলা’ বলতে বোঝায় প্রিয়ভাজন বন্ধু, তাহলে উভয়েই একে অপরের বন্ধু হতে পারে। আর তাদের দুটোকেই মওলা হিসেবে সম্বোধন করা ভাষাগতভাবে সঠিক হয়, ঠিক যেমনটি আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামে সম্বোধন করেছেন।

হাদীস শরীফেও ‘মওলা’ শব্দটিকে প্রিয়ভাজন বন্ধু হিসেবে বোঝানো হয়েছে। চলুন, আমরা সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, বই নং ৫৬, হাদীস নং ৭১৫ পর্যবেক্ষণ করি। প্রিয়নবী  (ﷺ) বলেন:

حَدَّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ سَعْدٍ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ هُرْمُزَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ قُرَيْشٌ وَالأَنْصَارُ وَجُهَيْنَةُ وَمُزَيْنَةُ وَأَسْلَمُ وَغِفَارُ وَأَشْجَعُ مَوَالِيَّ، لَيْسَ لَهُمْ مَوْلًى دُونَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ‏"‏‏.‏

অর্থ: “ক্বুরাইশ, আনসার, জুহাইনা, মুযাইনা, আসলাম, গিফার ও আশজাআ’ গোত্রগুলো হচ্ছে আমার প্রিয় ‘মাওয়ালী’ (প্রিয়ভাজন সহায়তাকারী); আর তাদের নেই কোনো রক্ষাকারী আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যতিরেকে।”

এখানে উদ্ধৃত ‘মওলা’ শব্দটি কি খেলাফত বা ইমামতকে বুঝিয়েছে? এসব গোত্র কি মহানবী  (ﷺ)’র ওপরে খলীফা বা ইমাম? অবশ্যই না! অতএব, যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত হলো, তারা প্রিয়নবী  (ﷺ)’র অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ও ঘনিষ্ঠ এবং তাই তাদেরকে ‘মাওয়ালী’ (মওলা’র বহুবচন) হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

এ বিষয়টিও উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) গাদীরে খুমের হাদীসটিতে “আমার পরে” বাক্যটি ব্যবহার করেননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, “আমি যার মওলা, এই আলীও তার মওলা।” তিনি এতে কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করে দেননি। এর মানে এই বাস্তবতা কোনো সময়সীমা দ্বারা আবদ্ধ নয়; মানে এটা কালের অতীত। তিনি যদি বোঝাতেন “আমি যার ইমাম/নেতা, এই আলীও তার নেতা,” যেটা আমাদের শীয়া ভাইয়েরা বোঝাতে চান, তাহলে এতে মুসলিম উম্মাহ’র জন্যে একটা বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতো। কেননা একটি রাষ্ট্রে একই সময়ে দুইজন খলীফা থাকতে পারেন না; আর এমন বহু হাদীস আছে যেখানে প্রিয়নবী  (ﷺ) দুইজন খলীফা থাকার বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। এমতাবস্থায় ‘আমার পরে’ কথাটি ছাড়া ওই বাক্যটি চরম বিভ্রান্তিকর হয়ে যেতো, যা মারাত্মক ফিতনা-ফাসাদের সৃষ্টি করতো। অবশ্যঅবশ্যই হুজূরে পূর নূর  (ﷺ) সে অর্থে বোঝাননি এবং সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’বৃন্দের কেউই সেভাবে বোঝেননি। পক্ষান্তরে, একই সময়ে একাধিক মওলা (প্রিয়ভাজন বন্ধু) থাকাটা সম্পূর্ণভাবে সঠিক। কেউ প্রিয়নবী  (ﷺ)’কে ভালোবাসতে পারেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠও হতে পারেন; পাশাপাশি হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কেও তিনি ভালোবাসতে পারেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠও হতে পারেন।

প্রিয়নবী  (ﷺ) যদি হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা মনোনীত করতে চাইতেন, তাহলে তিনি কেন এ ধরনের দ্ব্যর্থবোধক বাক্য ব্যবহার করেছিলেন? ‘আমি যার মওলা, এই আলীও তার মওলা’ জাতীয় অস্পষ্ট কথা না বলে তিনি কেন আরো স্পষ্টভাবে বলেননি - “আমি আলীকে আমার বেসাল শরীফের পরে আমারই খলীফা মনোনীত করছি;” অথবা “আলী আমার উত্তরাধিকারী (হিসেবে) আমার বেসাল শরীফের পরে প্রথম মুসলিম খলীফা।” নিশ্চয় এটা বিষয়টাকে স্পষ্টভাবে খোলাসা করতো। মহানবী  (ﷺ)’কে ঐশীবাণী পৌঁছুনোর সময় স্পষ্টভাষী হতে আদেশ করা হয়েছিলো; আর গাদীরে খুমে প্রদত্ত রাসূল  (ﷺ)’এর ভাষণকে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রথম খলীফাস্বরূপ মনোনীত হবার পক্ষে দলিল হিসেবে কোনো সাহাবী  (رضي الله عنه)-ই ব্যাখ্যা করেননি।

এই কথার জবাবে শীয়া প্রপাগান্ডাকারীরা পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত দেন। উদাহরণস্বরূপ, জনৈক ShiaChat সদস্য বলেন:

“প্রিয়নবী  (ﷺ) বাস্তবিকই বলেছিলেন ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁর উত্তরাধিকারী ও পরবর্তী খলীফা এবং এছাড়া অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন; কিন্তু সাহাবা  (رضي الله عنه) ও সুন্নীবৃন্দ ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র খেলাফত অস্বীকার করার অভিপ্রায়ে এসব হাদীস বর্ণনা করেননি। সাহাবা  (رضي الله عنه) ও সুন্নীমণ্ডলী ‘মওলা’-বিষয়ক হাদীসটি অপসারণ করেননি, যাতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র খেলাফতকে অস্বীকার করার জন্যে সেটাকে অপব্যাখ্যা করা যায়।

“কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট কথা বলেছেন, নতুবা লোকেরা তাঁর কথাকে বিকৃত করতো। তিনি যদি আরো সোজা ও স্পষ্ট বাক্য ব্যবহার করতেন, তাহলে সাহাবা  (رضي الله عنه) জেনে যেতেন মানুষেরা এটাকে ইমামে আলী (কার্রমাল্লাহ ওয়াজহাহু)’র খেলাফত-বিষয়ক ভাববে, আর তারা এরপর এসব কথাকে মুছে ফেলবে। বস্তুতঃ অনেক শীয়া হাদীসে মহানবী  (ﷺ) স্পষ্টভাবে বলেন ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-ই তাঁর উত্তরাধিকারী ও পরবর্তী খলীফা; কিন্তু সুন্নীবৃন্দ সেসব হাদীস প্রত্যাখ্যান করেন।” [জনৈক ShiaChat সদস্যের বক্তব্য এখানে সমাপ্ত]

শীয়াদের এই যুক্তি প্রকৃতপ্রস্তাবে পুরো বিতর্কটি হেরে গিয়ে সমর্পণ করার সামিল। এখানে শীয়া সদস্যটি বলেন:

১/ প্রিয়নবী  (ﷺ)’র সমস্ত স্পষ্ট বাণী সুন্নীদের দ্বারা অপসারিত হয়েছে।

২/ ইমাম আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র মওলা হওয়া সম্পর্কিত গাদীরে খুমের হাদীসটি সরানো হয়নি, কেননা ইমামত ও খেলাফত বিষয়ে এটা অতোটা সোজা ও স্পষ্ট ছিলো না।

এমতাবস্থায় বিতর্কের আর কী বাকি থাকলো? এই পুরো সময়টুকু জুড়ে শীয়াবর্গ-ই কি দাবি করছিলেন না যে গাদীরে খুমের হাদীসটি হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ইমামত ও খেলাফতের পক্ষে একটি স্পষ্ট ও নিশ্চিত প্রমাণ? নিশ্চয় (ShiaChat সদস্যের) ওপরের এ যুক্তিটি এই বাস্তবতার একটি স্বীকারোক্তি যে, হাদীসে গাদীরে খুম স্পষ্টভাবে ইমামত ও খেলাফত সম্পর্কে বক্তব্য রাখে না। রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) কর্তৃক হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে ‘মওলা’ অভিহিত করাটা কোনোক্রমেই প্রমাণ করে না যে তিনি পরবর্তী

 খলীফা হবেন। বস্তুতঃ তা যদি স্পষ্ট হতো, তাহলে (শীয়া যুক্তি অনুসারে) সাহাবা কেরাম  (رضي الله عنه) ওই হাদীস বর্ণনা করতেন না, ঠিক? সুতরাং (শীয়া) এই চিন্তাভাবনার আলোকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ইমামত সম্পর্কে হাদীসে গাদীরে খুম স্পষ্ট কোনো দলিল নয়, নইলে এটা ওই একই সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম), যাঁরা তাঁর খেলাফতকে জবরদখল করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের দ্বারা বর্ণিত হতো না। প্রকৃতপক্ষে গাদীরে খুমের এই হাদীসটিকে কখনোই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র খলীফা মনোনীত হবার পক্ষীয় দলিল হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়নি, বরং এটা ছিলো স্রেফ তাঁরই গুণাবলীর একখানি বিবরণ। প্রিয়নবী  (ﷺ) যদি কারো প্রশংসা করতেন, তা আপনাআপনি ওই ব্যক্তিকে উম্মতের খলীফা বানিয়ে দিতো না। আর এতদসংক্রান্ত শীয়া হাদীস সম্পর্কে বলবো, সেগুলো আমাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক; কেননা হাদীস বিষয়ে শীয়াবর্গ মিথ্যুক ও ব্যাপক জালিয়াতির হোতা হিসেবে সর্বজনবিদিত।

শীয়াদের অপযুক্তির খণ্ডন

জনৈক ShiaChat সদস্য বলেন

“গাদীরে খুমের অবস্থান একটি (ভৌগোলিক) কেন্দ্রবিন্দুতে; তা একটি জলাশয়, যা শেষ স্থান হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে হাজ্বীদের জন্যে, যেখান থেকে তাঁরা (হজ্জ্বকার্য সমাধার পর) নিজ নিজ বাড়ির পথে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে বিদায় নেন। প্রত্যেক হাজ্বী’র উপস্থিতির এটাই শেষ ক্ষণ।” 

আসলে গাদীরে খুম স্রেফ সেসব হাজ্বীদের জন্যেই কেন্দ্রবিন্দু ছিলো, যাঁরা উত্তরাঞ্চল অভিমুখী ছিলেন, হয় মদীনা মোনাওয়ারায়, না হয় তা পেরিয়ে আরো উত্তরে সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন প্রভৃতি অঞ্চলে। আমরা আগেই আলোকপাত করেছি, মক্কা ও মদীনা নগরী দুটোর মাঝামাঝি অবস্থান করছে গাদীরে খুম, যা মক্কা শরীফ হতে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে। এটা উত্তরাঞ্চলে প্রত্যাবর্তনকারী হাজ্বীদের জন্যে সাধারণ ক্ষণিক-বিশ্রাম স্থান হতে পারে, কিন্তু মক্কার দক্ষিণে অবস্থিত তায়েফ বা ইয়েমেনের মতো বিপরীত দিকে প্রত্যাবর্তনকারী হাজ্বীদের জন্যে এটা কোনোক্রমেই কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে না।

হজ্জ্বকার্য সুসমাধার পরে মক্কাবাসীদের জন্যে গাদীরে খুম হয়ে ‘রিটার্ন ট্রিপ’ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? তাঁরা কি নিজেদের বসবাসের নগরীতে নন? মক্কাবাসী হাজ্বীবৃন্দ হজ্জ্বশেষে সেখানেই থেকে যাবেন; মদীনাবাসী হাজ্বীবৃন্দ তাঁদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হবেন এবং মক্কায় রেখে আসা মক্কাবাসীদের সঙ্গ ছাড়াই গাদীরে খুমে যাত্রাবিরতি করবেন। একই কথা প্রযোজ্য হবে তায়েফ ও ইয়েমেনবাসীদের ক্ষেত্রেও। বস্তুতঃ এই প্রধান প্রধান মুসলিম নগরীগুলোকে গাদীরে খুমের ভাষণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, আর এটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক (শীয়াদের দাবির সূত্র ধরে)। কারণ প্রিয়নবী  (ﷺ) যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা মনোনীত করতে চাইতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবে মক্কা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি এলাকার সকল মুসলমানের উপস্থিতিতেই তিনি তা করতেন।

প্রকৃতপক্ষে শীয়া বাদানুবাদকারীরা এই বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক অবগত। আর এ কারণেই তাঁরা সর্বসাধারণকে বোঝাতে পীড়াপীড়ি করেন যে, গাদীরে খুম ছিলো পবিত্র হজ্জ্বব্রত সুসম্পন্নকারী হাজ্বীদের বিদায়ের স্থান, যেখান থেকে তাঁরা বাড়ির পথে প্রত্যাবর্তন করতেন; আর তাই গাদীরে খুমের ভাষণটি সমস্ত মুসলমানের উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছিলো। এই ‘কাহিনি’ কেবল অজ্ঞ মানুষের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে, যারা (ভূগোল) ম্যাপ/গোলক বের করে গাদীরে খুম আসলে কোথায়, তা খোঁজার গরজ অনুভব করেন না। কেউ যখন-ই ম্যাপ বের করে দেখেন, তৎক্ষণাৎ তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় শীয়াচক্রের দাবিগুলো কী রকম বোগাস! বস্তুতঃ মুসলমানদের একটি অংশই ওই দিন গাদীরে খুমে উপস্থিত ছিলেন (যথা - মদীনা প্রত্যাবর্তনকারী হাজ্বীদের কাফেলা)।

মক্কা মোয়াযযমা হতে গাদীরে খুমের দূরত্বের ওপর ভিত্তি করেই আমরা এ ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিরূপণ করি যে, মহানবী  (ﷺ) মুসলিম সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে ভাষণটি দেননি, বরং তিনি মুসলমানদের একটি নির্দিষ্ট দলকে সংশোধন করছিলেন (মানে ইয়েমেন অভিযানে প্রেরিত সেনাসদস্যবৃন্দ)। গাদীরে খুমের ভাষণটি মূলতঃ ওই দলটিরই প্রতি উদ্দেশ্যকৃত, যাঁরা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমালোচনামুখর ছিলেন। আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) শেষ হজ্জ্বের বিদায়ী ভাষণে মুসলিম সর্বসাধারণের সামনে এই বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করেননি।

‘দি সাক্বালাইন মুসলিম এসোসিয়েশন’ শীর্ষক শীয়া ওয়েবসাইট-টি বলে:

“সাধারণ বুদ্ধি-বিবেচনার কাছে আহ্বান:

আল্লাহ যিনি সর্বজ্ঞ, তিনি রাসূল (صلّى الله عليه وآله وسلّم)’এর সর্বোৎকৃষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা করেন -

لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ             

অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের কাছে তাশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই রাসূল, যাঁর কাছে তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক, তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের প্রতি পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু। [আল-ক্বুরআন, ৯:১২৮]

নবী করীম (صلّى الله عليه وآله وسلّم) অত্যন্ত দয়ালু ও করুণাপূর্ণ অন্তরের অধিকারী ছিলেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের ভালাই ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে কষ্ট স্বীকার করতেন। আর তিনি কখনোই তাঁদের ওপরে অতিরিক্ত বোঝা ও দুঃখকষ্ট চাপিয়ে দিয়েছেন বলে জানা যায় না। কোনো শিশুর কান্না শুনলে তিনি এমন কী নামায-ও সংক্ষিপ্ত করতেন বলে জানা যায়। অতএব, এই সিদ্ধান্ত নেয়া অসম্ভব যে, তিনি তাঁর সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’কে (গাছের) ছায়াবিহীন তপ্ত আরবীয় মরুভূমিতে কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিলেন শুধু এ কথা ঘোষণা করার জন্যে যে হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁরই ‘বন্ধু’ ছিলেন।” [লিঙ্ক: http://www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf]

জনৈক ShiaChat সদস্য বলেন:

“মহানবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) আপন বেসাল শরীফ হতে যাচ্ছে, এ কথা জানার কয়েক মাস আগে মরুভূমির মাঝখানে ৬০,০০০ মুসলমানকে কেন থামিয়েছিলেন বলে মনে করেন? স্রেফ এ কথা বলার জন্যে যে ‘আলী আমার বন্ধু’?”

প্রকৃতপক্ষে শীয়াদের উত্থাপিত এ যুক্তিটি তাঁদের পক্ষে যায় না, বরং বিপক্ষেই যায়। আমরা তাঁদেরকে ওই একই প্রশ্ন করতে চাই: প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) কেন অনর্থক মক্কা হতে ২৫০ কিলোমিটার বাইরে মরুভূমির মাঝখানে অবস্থিত গাদীরে খুম নামের জলাশয়ে যেতে মক্কাবাসীদেরকে বাধ্য করেছিলেন? আর কেনই বা তিনি তায়েফবাসীকে তাঁদের বাড়ির ঠিক বিপরীত দিকে অনুরূপ যাত্রা করতে বলপ্রয়োগ করেছিলেন? বর্তমানে তায়েফ নগরীতে বসবাসকারী শীয়া মতাবলম্বীরা হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ গমন করেন এবং তা পালনশেষে তায়েফে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁরা ২৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত গাদীরে খুমে যাত্রা করে এসে আবার ২৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করে মক্কায় ফিরে গিয়ে এরপর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত তায়েফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না! এই যাত্রার জন্যে পূর্ব জমানায় অতিরিক্ত কয়েক সপ্তাহের প্রয়োজন পড়তো!

বরঞ্চ মদীনাগামী প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) ও মুসলমানবৃন্দের জন্যে গাদীরে খুমে যাত্রাবিরতি করে নিজেদেরকে চাঙ্গা করার ব্যাপারটাই অধিকতর সম্ভাব্য বলে বিবেচিত। সেখানেই রাসূল (صلّى الله عليه وآله وسلّم) কিছু মানুষ কর্তৃক হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমালোচনার কথা শুনতে পান, যদিও তিনি ইতিপূর্বে তাঁদেরকে সে ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি তাঁদের প্রতি গাদীরে খুমের ভাষণ দান করেন এবং হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে তাঁদের প্রিয়ভাজন বন্ধু হিসেবে গ্রহণের জন্যে তাকিদ দেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মদীনাগামী মানুষ সে যুগে গাদীরে খুমে যাত্রাবিরতি করতেন, কেননা তা একটি জলাশয় ও ক্ষণিক-বিশ্রামের জায়গা ছিলো, যেখানে মুসলমানবৃন্দ বিশ্রাম নিতেন। আর এখানেই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমালোচক মুসলমানদের একটি দলের প্রতি প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) ভাষণ দেন।

‘দি সাক্বালাইন মুসলিম সোসাইটি’ বিবৃত করে:

মুসলমানদের পক্ষ থেকে প্রশংসা

গাদীরে খুমে প্রদত্ত ভাষণের পর মহানবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) সবাইকে হযরতে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে এবং তাঁকে অভিনন্দন জানাতে বলেন। এ কাজে প্রথম মুসলমানবৃন্দ হলেন সর্ব-হযরত উমর ও আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা), যাঁরা বলেন: “হে আবূ তালিবের পুত্র, অতি উত্তম কাজ করেছেন! আজ আপনি সকল ঈমানদার নর-নারীর মওলা (নেতা) হয়েছেন।” (মুসনাদে ইমাম হাম্বল, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী কৃত তাফসীরে কবীর, তাবারী প্রণীত কিতাবুল উইলায়াহ ও অন্যান্য পুস্তকে উদ্ধৃত) [লিঙ্ক: http://www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf]

এটা আসলে শীয়া বৈশিষ্ট্যসূচক ও তাঁদেরই চিরায়ত প্রপাগান্ডা। তাঁরা বলে থাকেন, ‘এ তো আপনাদের নিজেদের বইপত্রেই বিদ্যমান;’ অতঃপর তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের বই হতে উদ্ধৃতি দেন বটে, তবে নিজেদের (মনগড়া) অর্থ তাতে সন্নিবেশিত করেন। শাস্ত্রলিপিগুলোতে যা পাওয়া যায়, তাতে কেবল হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه)-ই তাঁকে সকল মুসলমানের মওলা (প্রিয়ভাজন বন্ধু) হওয়ার সুবাদে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি নিজ আনুগত্য প্রকাশ করেননি। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে তাঁরই অধীনস্থ সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ ওই সময় কড়া সমালোচনা করছিলেন; সেই পরিস্থিতিতে প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) তাঁর পক্ষ সমর্থন করেন এবং মুসলমানদেরকে জানান যে তাঁদের উচিৎ তাঁকে ঘৃণা না করা, বরং মহব্বত করা।

বস্তুতঃ ওপরের এই শীয়া যুক্তিটির কোনো অর্থ-ই হয় না। হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) ও অন্য সব মুসলমান যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কাছে বাইয়াত তথা আনুগত্য প্রকাশ করতেন এবং বলতেন, “আজ আপনি নেতা হয়েছেন...,” তাহলে প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم)’র ব্যাপারটি কী হতো? এখানে মূল শব্দগুলো হচ্ছে ‘আজকে’ ও ‘আপনি হয়েছেন,’ যার মানে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হচ্ছেন বর্তমানে মওলা। আমরা যদি এর সংজ্ঞা ইমাম বা খলীফা হিসেবে গ্রহণ করি, তবে এতে বোঝা যাবে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-ই এখন মুসলমানদের নেতৃত্বদানকারী এবং রাসূল (صلّى الله عليه وآله وسلّم) আর নেতৃত্বে নেই। নিশ্চয় নিশ্চয় মুসলমানদের একই সময়ে দু জন ইমাম থাকতে পারেন না। এ কথা সুন্নী ও শীয়া হাদীসগ্রন্থগুলোতে উল্লেখিত হয়েছে। হযরত উমর (رضي الله عنه) যদি সত্যিসত্যি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে পরবর্তী খলীফা মনোনীত হওয়ার জন্যে অভিনন্দন জানাতেন, তাহলে তিনি এ রকম কিছু একটা বলতেন: “অতি উত্তম কাজ করেছেন, হে আবূ তালিবের পুত্র! আপনি শিগগিরই সকল মুসলমানের খলীফা হতে চলেছেন।” অথবা হয়তো এভাবে বলতেন: “অতি উত্তম কাজ করেছেন, হে আবূ তালিবের পুত্র! আপনি একদিন মুসলমানদের খলীফা হবার (ভবিষ্যতকাল/মোস্তাক্ববিল) জন্যে মনোনীত হয়েছেন।” কিন্তু তিনি নিশ্চিতভাবে “অভিনন্দন...আজ আপনি নেতা হয়েছেন” বলতেন না।

হযরত উমর (رضي الله عنه)’র এই অভিনন্দনের যথাযথ উপলব্ধি হলো, সকল মুসলমানের প্রিয়ভাজন বন্ধু হওয়ার জন্যেই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে তিনি অভিনন্দিত করেছিলেন। পরিস্থিতি ছিলো এ রকম যে, মানুষেরা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমালোচনা করছিলেন এবং তাঁকে ব্যথিত করে তুলেছিলেন। এমতাবস্থায় মহৎ সাহাবী হযরতে উমরে ফারূক্ব ইবনে আল-খাত্তাব (رضي الله عنه) তাঁকে সান্ত্বনা দেয়ার ও স্নেহময় কথা বলার জন্যে গিয়েছিলেন। তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন পাঠক লক্ষ্য করবেন যে, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রশংসায় হযরত উমর (رضي الله عنه) অত্যন্ত সদয় ও সহানুভূতিশীল ছিলেন; তাই শীয়াদের দ্বারা তাঁদের দু জনের মধ্যে (কল্পিত) শত্রুতার নমুনা, যা হযরত উমর (رضي الله عنه)’কে হযরত আলী (কার্ররামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র নিপীড়নকারী হিসেবে প্রতিফলিত করে, এই ঘটনা ঠিক তার উল্টো। এই স্নেহভরা কথা কি এমন ব্যক্তির কাছ থেকে হতে পারে মনে হয়, যিনি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি ঘৃণা বা হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করেন, ঠিক যেমনটি শীয়াচক্র দাবি করে থাকেন?

আমরা যদি ‘মওলা’ শব্দটিকে ‘নেতা’ অর্থ করি, তাহলে হযরত উমর (رضي الله عنه) কেন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর প্রতি এরকম মহব্বত সহকারে বাইয়াত তথা আনুগত্য প্রকাশ করবেন? শীয়া গোষ্ঠী ইতিপূর্বে দাবি করেছিলেন যে, আল্লাহতা’লা ক্বুরআন মজীদের ৫:৬৭ আয়াতটি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে মনোনীত করার এবং মানুষের বিরোধিতাকে ভয় না পাবার ক্ষেত্রে প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم)’কে উৎসাহিত করার জন্যেই নাযেল করেছিলেন:

يَـٰأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَٱللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ ٱلنَّاسِ إِنَّ ٱللَّهَ لاَ يَهْدِي ٱلْقَوْمَ ٱلْكَافِرِينَ         

অর্থ: হে রাসূল! পৌঁছিয়ে দিন যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনার প্রতি আপনারই রব্বের কাছ থেকে; এবং যদি এমন না হয় তবে আপনি তাঁর কোনো সংবাদ-ই পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষ থেকে (যারা ফিতনা সৃষ্টিকারী) । নিশ্চয় আল্লাহ সঠিক পথ দেখান না অবিশ্বাসীদেরকে। [আল-ক্বুরআন ৫:৬৭]

শীয়াপন্থীরা দাবি করেন যে, আয়াতোক্ত ‘মানুষ (যারা ফিতনা সৃষ্টিকারী)’ বাক্যটি সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’কে উদ্দেশ্য করে, বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে সর্ব-হযরত আবূ বকর ও উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’কে। এই আয়াতটি যদি সত্যিসত্যি হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর উদ্দেশ্যে নাযেল হতো এবং তিনি যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র খেলাফত জবরদখল করতে চাইতেন, তাহলে তিনি কেন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে নেতা মনোনীত হওয়ার জন্যে অভিনন্দিত করেছিলেন? আমরা এ রকম ব্যক্তির কাছ থেকে বড় জোর অনিচ্ছা সহকারে বাইয়াত গ্রহণ করার আশা করতে পারি, যদি তা মোটেও হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে হযরত উমর (رضي الله عنه)’কে আমরা দেখতে পাই মওলা হওয়ার জন্যে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহু)’র প্রতি সর্বপ্রথমে তিনি-ই অভিনন্দন জানাচ্ছেন। মোদ্দা কথা হলো, ‘মওলা’ শব্দটি যদি নেতা বোঝাতো, তাহলে হযরত উমর (رضي الله عنه) তাঁকে সেটার খাতিরে অভিনন্দিত করতেন না। হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর এই প্রশংসা মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়; এমতাবস্থায় তিনি কেন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে ওই সুযোগ বা সুবিধা দিতে যাবেন, যদি তিনি সত্যিসত্যি তাঁর বিরুদ্ধে থাকতেন, কিংবা যদি ‘মওলা’ শব্দটি বলতে প্রকৃতই ‘নেতা’ বোঝাতো? আসলে হযরত উমর (رضي الله عنه) ‘মওলা’ শব্দটিকে ‘প্রিয়ভাজন বন্ধু’ বুঝেছিলেন, ‘নেতা’ বোঝেন নি; আর তদানীন্তনকালের মানুষেরাও এই একই অর্থই বুঝেছিলেন।

‘দি সাক্বালাইন মুসলিম এসোসিয়েশন' বলে:

‘মওলা’ শব্দটির অর্থ

মাযহাবগুলো ‘মওলা’ শব্দটির অর্থগত ব্যাখ্যা নিয়ে পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেছে। আরবী ভাষায় ‘মওলা’ শব্দটির অনেক মানে বিদ্যমান। এর অর্থ মনিব, বন্ধু, গোলাম, অথবা এমন কী মক্কেল-ও। কোনো শব্দের একাধিক মানে থাকলে সেটার আসল অর্থ নির্ণয়ের খাতিরে ‘ক্বারিনাহ’ তথা সংশ্লিষ্টতা ও পটভূমি/পরিপ্রেক্ষিতের দিকে লক্ষ্য করাই সেরা উপায়। আলোচ্য এ হাদীসে ‘সংশ্লিষ্টতা’ একগাদা, যা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান করে যে এর একমাত্র যথার্থ মানে হতে পারে ‘মনিব।’ নিচে এর অর্থগুলোর কিছু বর্ণনা করা হলো.... ।[লিঙ্ক: http://www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf]

আমরা অবশ্যই শীয়া লেখকের সাথে একমত যে, ‘মওলা’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে, আর আমরা আনন্দিত যে তাঁরা অন্ততঃ এতোটুকু স্বীকার করেছেন। আমরা আশা করি যে শীয়া সাধারণ পাবলিক তর্কবিতর্কের সময় এই সত্যটি স্বীকার করবেন এবং ’মওলা’ কেবল ‘মনিব’কেই বোঝায় এমন ধারণা পোষণের ক্ষেত্রে একগুঁয়েমি পরিহার করবেন। যদিও আমরা ওপরের ভাষ্যটি একটি শীয়া ওয়েবসাইট থেকে উদ্ধৃত করেছি, তবুও নিঃসন্দেহে আমরা নিচের বিষয়গুলোর ব্যাপারে একমত:

১/ ‘মওলা’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ বিদ্যমান;

২/ শব্দটির প্রয়োগ অনুযায়ী পরিপ্রেক্ষিতের দিকে লক্ষ্য করতে হবে অর্থ বের করার ক্ষেত্রে।

তবে আমরা ওই লেখার সাথে দ্বিমত পোষণ করি, কেননা সেটা ‘মওলা’ শব্দটিকে স্রেফ ‘মনিব’ হিসেবে ভাষান্তর করেছে। আমরা প্রতিটি যুক্তি ধরে ধরে খণ্ডন করবো, ইনশা’আল্লাহ।

সালাম-ইরান-ডট-ওর্গ শীর্ষক ওয়েবসাইটি-টি বিবৃত করে:

আরো রয়েছে গাদীরে খুমে প্রদত্ত প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم)’র ভাষণ। উম্মাহ সেখানে তাঁর ভাষণ শোনার জন্যে সমবেত হয়েছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন:

“আমি কি তোমাদের জীবনের চেয়ে আওলা’ (শ্রেয়তর, অধিকতর মূল্যবান) নই?”

আসহাবে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম যখন উত্তরে বলেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, জি, (আপনি শ্রেয়তর)।”

অতঃপর নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) কোনো বিরতি ছাড়াই গোছালো বক্তব্য প্রদান করেন:

“আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা।” [http://salamiran.org/Religion/Imaml/index.html]

‘দি সাক্বালাইন মুসলিম এসোসিয়েশন' বলে:

প্রথমতঃ এই ঘোষণাটির প্রাক-মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ (صلّى الله عليه وآله وسلّم) প্রশ্ন করেন, “আমি কি তোমাদের জীবনের চেয়ে আওলা’ (শ্রেয়তর, অধিকতর মূল্যবান) নই?” (মানে তোমাদের জীবনের ওপর বেশি কর্তৃত্বশীল নই?) সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) বলেন, “জি, অবশ্যই।” অতঃপর তিনি ঘোষণা করেন, “আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা।” নিঃসন্দেহে এই ঘোষণায় ব্যবহৃত ‘মওলা’ শব্দটি ‘আওলা’ (তোমাদের ওপর অধিকতর কর্তৃত্বশীল) শব্দটির মতো একই অর্থবোধক। [http.//www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf]

সন্দেহাতীতভাবে তা মোটেও (সঠিক) নয়! ‘আওলা’ ও ‘মওলা’ সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা শব্দ! নিজের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) বলেন:

أَلَسْتُمْ تَعْلَمُونَ أَنِّي أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ

অর্থাৎ, “আমি কি তোমাদের জীবনের চেয়ে আওলা’ (শ্রেয়তর, অধিকতর মূল্যবান) নই?” (মানে তোমাদের জীবনের ওপর বেশি কর্তৃত্বশীল নই?)

পক্ষান্তরে, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে অকস্মাৎ তিনি শব্দচয়ন পাল্টে বলেন:

مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ

অর্থ: “আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা।”

শব্দচয়নে এই অকস্মাৎ পরিবর্তন শীয়াদের দাবিকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দেয়! তাঁর যেখানে স্রেফ বলা দরকার ছিলো ‘আলী-ও মুসলমানদের ‘আওলা,’ সেখানে তিনি ‘মওলা’ শব্দটি ব্যবহার করতেই আগ্রহী হন। তিনি ভাষণের শুরুতে বলেছিলেন, মানুষের ওপর আল্লাহরই (সকল) কর্তৃত্ব; অতঃপর তিনি নিজের সম্পর্কেও একই ‘আওলা’ শব্দটি ব্যবহার করে মানুষের ওপর নিজের কর্তৃত্বের ঘোষণা দেন। কিন্তু হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ক্ষেত্রে হঠাৎ ওই শব্দটি পরিবর্তন করে ‘মওলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন; যদিও তিনি আল্লাহতা’লা ও তাঁর নিজের ক্ষেত্রে ‘আওলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।

প্রিয়নবী  (ﷺ) উল্লেখ করেন যে ঈমানদারবৃন্দের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব বিদ্যমান, আর তাই তাঁরা তাঁর কথা মান্য করবেন এবং হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে তাঁদের প্রিয়ভাজন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবেন, ঠিক যেমনটি তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কামনা করেন। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র অধীনস্থ মুসলিম সেনাদল তাঁকে (সে সময়) অপছন্দ করছিলেন; এমতাবস্থায় হুজূর পাক  (ﷺ) নিজের প্রভাব খাটিয়ে তাঁদেরকে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি মহব্বতশীল হবার ও তাঁকে প্রিয়ভাজন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবার জন্যে ভাষণ দেন। ধরা যাক, কোনো রাজ্যের কোতোয়াল জনৈক বেইকার (রুটি প্রস্তুতকারক)’কে (কোনো কারণে) আটক করতে উদ্যত। কিন্তু ওই বেইকার এক রাজন্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এমতাবস্থায়, রাজন্য ওই কোতোয়ালকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি আমার প্রতি বিশ্বস্ত এবং আমার আদেশ মান্যকারী?” কোতোয়াল হাঁ-সূচক উত্তর দিলে রাজন্য তাকে বলেন, “তুমি যদি আমার আদেশ মান্যকারী হও, তাহলে এই বেইকারের প্রতি ভদ্র আচরণ কোরো। কেননা সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু; আর তুমি যদি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে থাকো, তাহলে এই বেইকারের সাথেও তোমার বন্ধুত্ব রাখা উচিৎ।”

এটা দৃশ্যমান হচ্ছে যে, শীয়া গোষ্ঠী ‘মওলা’ শব্দটির সাথে ইমামত বা খেলাফতকে সম্পৃক্ত করার মানসে (পানিতে) খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরার চেষ্টারত। তাঁদের দাবিকে জোরালো করার উদ্দেশ্যে তাঁরা পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়াদি সংক্রান্ত ক্বুরআনী আয়াতসমূহ উপস্থাপন করে থাকেন। শীয়াদের মনগড়া মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে যা-ই সুবিধাজনক, তার সবই তাঁরা ব্যবহার করেন। এখানে শীয়াচক্র চান আমাদের বিশ্বাস করাতে যে, ‘আওলা’ ও ‘মওলা’ একই অর্থবোধক। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা আর মাত্র এক কদম দূরে আছেন এই দাবি হতে যে, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) অবশ্যই ‘ওলী,’ কেননা ‘আলী’ ও ‘ওলী’ শব্দগুলো অনেকটা অনুরূপ।

‘দি সাক্বালাইন মুসলিম সোসাইটি’ ব্যক্ত করে:

দ্বিতীয়তঃ এ ঘোষণার পরে প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) নিচের দুআ পাঠ করেন, “হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আলীকে ভালোবাসে, তাকে ভালোবাসুন; আর তার শত্রুর প্রতি শত্রুতাভাব পোষণ করুন; যে ব্যক্তি আলীকে সাহায্য করে, তাকে আপনি সাহায্য করুন, আর যে ব্যক্তি তাকে ত্যাগ করে, তাকেও আপনি ত্যাগ করুন।”

এই দুআ’টি প্রতীয়মান করে যে, ওই দিন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি একটি গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছিলো, যা প্রকৃতিগতভাবে কিছু লোককে শত্রুতে পরিণত করবে; আর ওই দায়িত্ব পালন করতে তাঁর প্রয়োজন হবে সাহায্যকারী ও সমর্থকদের। কোনো বন্ধুত্ব জারি রাখতে কি কখনোই সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয়? [লিঙ্ক: http://www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf]

আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ বিবৃত করে:

গাদীরের ঘটনার সাথে সম্পর্কিত ঝলমলে আহাদীস

“আমি যার মওলা, এই আলীও তারই মওলা। হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আলীর বন্ধু হয়, আপনিও তার বন্ধু হোন। আর যে ব্যক্তি তার সাথে শত্রুতা রাখে, আপনিও তার সাথে শত্রুতা রাখুন।” [http://al-islaml.org/murajaat/54.htm]

এই প্রবন্ধের শীয়া লেখক স্পষ্টভাবে বলেন ‘মওলা’ শব্দটির অর্থ খুঁজে বের করতে আমাদেরকে ওর পটভূমিগত সূত্রগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। আর তিনি আমাদেরকে ঠিক পরের বাক্যটি প্রদর্শন করেন, যেখানে রাসূলুল্লাহ (صلّى الله عليه وآله وسلّم) বলেন - اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ - ‘হে আল্লাহ! আপনি সে ব্যক্তির বন্ধু হোন, যে আলীর বন্ধু হয়; আর যে ব্যক্তি তার সাথে শত্রুতা রাখে, আপনিও তার সাথে শত্রুতা রাখুন।’

শীয়া দাবিকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্যে এটা একটা শক্তিশালী হুজ্জাহ/প্রামাণ্য দলিল! এখানে ব্যবহৃত ‘বন্ধু’ বা ‘মহব্বত’ শব্দগুলো হতে বোঝা যায় যে, ‘মওলা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ’প্রিয়ভাজন বন্ধু’ বোঝাতে। এ থেকে স্পষ্ট যে, ‘মওলা’ শব্দটি এখানে মহব্বত ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে উদ্দেশ্য করেছে, কোনোক্রমেই খেলাফত বা ইমামতকে নয়। মুওয়ালাত (এশক্ব-মহব্বত) হচ্ছে মু’আদত (শত্রুতা)’এর বিপরীত। পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে ‘মওলা’ শব্দটির এই অর্থটি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও যথাযথ; কেননা প্রিয়নবী (صلّى الله عليه وآله وسلّم) তৎক্ষণাৎ বলেন, “হে আল্লাহ! আপনি সেই ব্যক্তির বন্ধু হোন, যে আলীর বন্ধু হয়, আর যে ব্যক্তি তার সাথে শত্রুতা রাখে, আপনিও তার সাথে বৈরিতা পোষণ করুন।”

এমতাবস্থায় আমরা কীভাবে এটাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি, যখন-ই আমরা বিবেচনায় নেই যে এর দ্বিতীয় অংশে তাঁর সাথে বন্ধুত্বের কথা বলা হয়েছে; তাঁর দ্বারা শাসিত হওয়া বা অনুরূপ কিছু বলা হয়নি। এটা সত্যি অবিশ্বাস্য যে, শীয়াচক্র এটাকে ইমামত বা খেলাফতের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করতে পেরেছে, যেখানে এর পটভূমি তার সাথে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। আরো বেশি অবিশ্বাস্য হলো তাঁরা এটাকে প্রামাণিক দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন; অথচ এটা তাঁদের নিজেদেরই যুক্তির বিরুদ্ধে একটি (কার্যকর) দালিলিক প্রমাণ!

আর 'দি সাক্বালাইন মুসলিম এসোসিয়েশন’ সংস্থার কথার এই অংশটির ক্ষেত্রে:

এই দুআ’টি প্রতীয়মান করে যে, ওই দিন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি একটি গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছিলো, যা প্রকৃতিগতভাবে কিছু লোককে শত্রুতে পরিণত করবে; আর ওই দায়িত্ব পালন করতে তাঁর প্রয়োজন হবে সাহায্যকারী ও সমর্থকদের। [http://www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf]

এই বক্তব্য স্রেফ শীয়াদের (অমূলক) ধারণাপ্রসূত। আসলে তাঁদের কল্পনার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই এবং তাই এই শীয়া লেখক এ লিপি পাঠে অদ্ভূত বিষয়াদি খুঁজে পেয়েছেন। এ যেনো তাঁর কোনো বিশেষ দৈব ক্ষমতা রয়েছে কিংবা তিনি সুপার গগলস্ পরে আছেন এবং তা দ্বারা স্বাভাবিক মানুষ যা পড়তে অক্ষম, তা তিনি প্রতিটি লাইনে পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন! আর এই গগলস্ জোড়া-ই তিনি ক্বুরআন-হাদীস অধ্যয়নের সময় ব্যবহার করছেন! কে জানে, হয়তো মঙ্গল গ্রহ থেকে এলিয়েনরা আক্রমণ করতে এসেছিলো, তাই প্রিয়নবী  (ﷺ) এ কথা বলেছিলেন আর কী! আর দেখুন, ইংরেজি 'alien' শব্দটির মধ্যেও 'Ali’ (আলী) শব্দটি বিদ্যমান! (কৌতুক)

শীয়াদের কল্পনা ও ধারণার কোনো প্রয়োজনই আসলে নেই, যেহেতু আমরা জানি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওযাজহাহু)’র অনেক শত্রু ছিলো। তিনি তাঁর অধীনস্থ সৈন্যদের কাছ থেকে গনীমতের মালামাল ফেরত নেয়ায় তাঁরা যে তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং তাঁর ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন, সে সম্পর্কে একাধিক বর্ণনা বিরাজমান। এই অস্থির পরিস্থিতিতেই প্রিয়নবী  (ﷺ) তাঁকে সমর্থন দিতে এগিয়ে আসেন এবং ওই সকল মানুষের প্রতি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব পোষণ করার আহ্বান জানান; কেননা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে সমগ্র উম্মতেরই ভালোবাসা উচিৎ। বাস্তবিকই গোটা আহলুস্ সুন্নাহ (সুন্নী মুসলমান সমাজ) অদ্যাবধি তাঁকে মহব্বত করেন।

অধিকন্তু, বন্ধুরা সাহায্যকারী নন মর্মে উদ্ভট শীয়া ধারণার ব্যাপারে বলবো, এই শীয়া লেখকের বন্ধুরা কী ধরনের হতে পারেন তা-ই এক্ষণে চিন্তার বিষয়! বন্ধুত্বের একটি মুখ্য দিক হচ্ছে সাহায্য-সহযোগিতা করা, সহায়তার হাত বাড়ানো ইত্যাদি। রাসূলে আকরাম  (ﷺ) অসংখ্য হাদীস শরীফে বলেন যে মুসলমানদের তাঁদের ভাই, বন্ধু, প্রতিবেশিকে সাহায্য-সহযোগিতা করা উচিৎ।

‘দি সাক্বালাইন মুসলিম সোসাইটি’ বিবৃত করে:

তৃতীয়তঃ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম)’র ঘোষণায় তিনি বলেন: “মনে হয় (আল্লাহ কর্তৃক) আমার চলে যাবার ডাক পাওয়াটা অতি সন্নিকটে এবং আমি তা মান্য করবো।” এই বাণীটি স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট করে যে, তিনি তাঁর বেসাল শরীফের পরে মুসলমানদের নেতৃত্ব নির্ধারণে ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন। [http://www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf] 

এটা কীভাবে স্পষ্ট হলো? মোটেও স্পষ্ট হয়নি। প্রিয়নবী  (ﷺ) যদি তা-ই বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি কেন তা সরাসরি বলেননি? কেন শীয়াটিকে হুযূর পাক  (ﷺ)’এর মুখপাত্র হয়ে সর্বদা আমাদেরকে জানাতে হবে যে তিনি এ কথা বলেছেন, যদিও প্রকৃতপক্ষে তিনি এ কথা বলেননি বরং অন্য কথা বলেছিলেন? অবশ্যই তিনি বলতে পারতেন, “আমি (সহসা) বেসালপ্রাপ্ত হতে যাচ্ছি এবং আমার উত্তরসূরীর ব্যাপারে চিন্তিত; তাই আমি আলীকে আমার পরে খলীফা মনোনীত করছি।” অথচ আমাদেরকে নির্ভর করতে হচ্ছে শীয়াটির কথার ওপরে যে, প্রিয়নবী  (ﷺ) আসলে কী বুঝিয়েছেন; আর আমরা জানি শীয়াটি কল্পনা করতে কতোখানি পটু!

এই শীয়া দাবি পূর্ণ নাকচের প্রমাণ হলো এ বাস্তবতা যে, রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) আরাফাত পাহাড়ের ওপরে বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণে অনুরূপ একটা কথা বলেছিলেন; ভাষণের শুরুতেই তিনি বলেন:

“ওহে মানব জাতি, আমার কথা ভালোভাবে শোনো। কেননা আমি জানি না এ বছরের পরে আর তোমাদের মাঝে থাকবো কি না।” [বায়হাক্বী]

আবারো দেখা যাচ্ছে প্রিয়নবী  (ﷺ) এই ভাষণে মুসলমানদের নেতেৃত্বের কথা উল্লেখ করেননি। আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনি আপন বেসাল শরীফের কথা দিয়ে আরম্ভ করেছিলেন, আর এটা নেতৃত্বের প্রসঙ্গে আলোচনা বোঝায় না। বস্তুতঃ তিনি তাঁর পরে নিজের পরিবারের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। এটা একটা স্বাভাবিক আবেগ ও দুশ্চিন্তা। ইন্তেক্বালের আগে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ স্ত্রী-সন্তান, বা নিকটাত্মীয়ের কী হবে, এ নিয়ে আমরা চিন্তা করি। মৃত্যুশয্যায় এটাই প্রত্যেক মানুষের দুশ্চিন্তা। আর প্রিয়নবী  (ﷺ)’র ক্ষেত্রে এই দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পেয়েছিলো এ কারণে যে, তাঁরই মেয়ের জামাইয়ের প্রতি কতিপয় ব্যক্তির সমালোচনা তাঁকে (হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু’কে) ব্যথিত করে তুলেছিলো।

‘দি সাক্বালাইন মুসলিম সোসাইটি’ শীর্ষক শীয়া সাইটটি বিবৃত করে:

চতুর্থতঃ সাহাবাবৃন্দের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) অভিনন্দন জ্ঞাপন ও আনন্দ প্রকাশ এই ঘোষণার অর্থ সম্পর্কে কোনো রকম সন্দেহেরই অবকাশ রাখে না। [http://www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf]

আমরা ইতিপূর্বে এ বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করেছি। শীয়া গোষ্ঠী এর আগে দাবি করেছিলেন যে আল্লাহতা’লা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম)’র প্রতি আল-ক্বুরআনের ৫:৬৭ আয়াতটি নাযেল করেছিলেন লোকের বিরোধিতার ভয় না করে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে মনোনীত করার তাকিদ দেয়ার জন্যে। এরশাদ হয়েছে -

يَـٰأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَٱللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ ٱلنَّاسِ إِنَّ ٱللَّهَ لاَ يَهْدِي ٱلْقَوْمَ ٱلْكَافِرِينَ 

অর্থ: হে রাসূল! পৌঁছিয়ে দিন যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনার প্রতি আপনারই রব্বের কাছ থেকে; এবং যদি এমন না হয় তবে আপনি তাঁর কোনো সংবাদ-ই পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষ থেকে (যারা ফিতনা সৃষ্টিকারী) । নিশ্চয় আল্লাহ সঠিক পথ দেখান না অবিশ্বাসীদেরকে। [আল-ক্বুরআন ৫:৬৭]

অধিকন্তু, শীয়া গোষ্ঠী দাবি করে থাকেন যে সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-ই হযরত ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র মনোনয়নের বিরোধিতা করেছিলেন; আর এখানে তাঁরা বলছেন যে সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) হতে ‘খুশির অভিব্যক্তি’ প্রকাশ পেয়েছিলো। এটা পরস্পরবিরোধী (দাবি) নয় কি? সাহাবামণ্ডলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ও জনসাধারণ যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র মনোনয়নের বিরোধিতা করে থাকেন এমনই এক পর্যায়ে যে আল্লাহতা’লাকে সে কারণে আয়াতে করীমা নাযেল করতে হয়েছিলো, তাহলে তাঁরা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে অভিনন্দন জানাতে যাবেন কেন? আর ‘খুশির অভিব্যক্তি’-ই বা দেখাতে যাবেন কেন? এটা নিশ্চয় বড় একটা অসঙ্গতি। তবে এটা নিজের (মনগড়া) মতকে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টায় কোনো অপযুক্তি, তা যতো ত্রুটিপূর্ণ-ই হোক না কেন, তা পেশের অনিবার্য পরিণতি বটে। শীয়া প্রপাগান্ডাকারী এটা এতো ঘনঘন করেন যে, তিনি নিজের ইতিপূর্বেকার যুক্তিগুলোর কথা ভুলে যান এবং ভুলক্রমে আরো দুটো পরস্পরবিরোধী দাবি উত্থাপন করে বসেন।

আসলে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে মানুষজন অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন এই কারণে যে, তাঁকে মুসলমান সর্বসাধারণের প্রিয়ভাজন বন্ধু বলে ঘোষণা করা হয়েছিলো। কোনো সন্তানের পিতামাতা যদি তাকে অমুকের বন্ধু হতে বলেন, তাহলে সে সর্বপ্রথমে কী করবে? নিঃসন্দেহে সে ওই ব্যক্তির কাছে যেয়ে নিজের পরিচয় দেবে এবং তাঁকে সহানুভূতিপূর্ণ কথা বলবে। গাদীরে খুমের বিষয়টি এ রকমই; হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমালোচনামুখর ছিলেন কিছু মানুষ। কিন্তু প্রিয়নবী  (ﷺ) তাঁকে মুসলমানদের প্রিয়ভাজন বন্ধু বলে ঘোষণা করেন; এমতাবস্থায় মানুষেরা তাঁর কাছে গিয়ে সহানুভূতিপূর্ণ কথা বলেন এবং তাঁকে এই মহাসম্মানের ব্যাপারে অভিনন্দিত করেন। অতএব, আবারো প্রতিভাত হচ্ছে যে এর সাথে নেতৃত্ব, ইমামত বা খেলাফতের প্রশ্ন কোনোভাবেই জড়িত নয়। যদি তা জড়িত হতো, তাহলে অন্ততঃ শীয়া নমুনা অনুযায়ী হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) কি আনন্দের পরিবর্তে গোমড়া-মুখো ও বিষন্ন হতেন না?

‘প্রিয়ভাজন বন্ধু’ ঘোষিত হওয়ার মাহাত্ম্যকে ধামাচাপা দেয়ার শীয়া অপচেষ্টা কতোখানি আজব! আমরা অহরহ দেখি শীয়াচক্র বলেন, “নিশ্চয় এটা ‘স্রেফ একজন বন্ধু’ হওয়াকে বোঝায় না।” আমরা বুঝি না ‘স্রেফ একজন বন্ধু’ বলতে তাঁরা কী বুঝিয়ে থাকেন। প্রথমতঃ এ কোনো পুরোনো বন্ধু নন, বরঞ্চ এ হলেন ‘প্রিয়ভাজন বন্ধু,’ যা গভীর এশক্ব-মহব্বত প্রকাশক। পয়গম্বর ইবরাহীম (আলাইহিস্ সালাম)’কে বলা হয়েছে “খলীলউল্লাহ,” যার মানে আল্লাহর বন্ধু; আর এটা আল্লাহতা’লা কর্তৃক তাঁকে দান করা হয়েছিলো। এটা এক মহা লক্বব/খেতাব। কেউই এটাকে ‘স্রেফ এক বন্ধু’ বলতে পারবেন না কখনোই। আল্লাহর বন্ধু ঘোষিত হওয়াটা কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নয়; আর ‘উম্মাতের প্রিয়ভাজন বন্ধু’ ঘোষিত হওয়াটাও কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নয়!

‘দি সাক্বালাইন মুসলিম এসোসিয়েশান’ ব্যক্ত করে:

....তাঁদের (মানে সাহাবা কেরামের) কাছে শুধু ঘোষণা করতে যে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁরই ‘বন্ধু।’ এ ধরনের দাবি আরো উদ্ভট প্রতীয়মান হয়, যখনই এ কথা বিবেচনা করা হয় যে অন্যান্য মুসলমানদের তুলনায় হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ইতোমধ্যে অনেক উচ্চমর্যাদাপূর্ণ মক্বামে অধিষ্ঠিত ছিলেন। [http://www.utm.thaqalayn.irg/files/ghadeer.pdf]

হ্যাঁ, হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ইতোমধ্যেই উচ্চমর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, কিন্তু মহানবী  (ﷺ) কারো প্রশংসা স্রেফ একবার কী দু বারই করতে পারেন, এমন ধারণা পোষণ করাটা নেহায়েত আহাম্মকি। তিনি হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)’র মর্যাদা অসংখ্যবার উন্নীত করেন। কিন্তু আমরা এমন কোনো সুন্নী মুসলমান খুঁজে পাবো না, যিনি এমন কারোর প্রশংসার নির্ভরযোগ্যতাকে সন্দেহ করবেন যাঁর সম্পর্কে ইতিপূর্বে প্রশংসা করা হয়েছে। প্রশংসার যোগ্য পুণ্যাত্মাদের প্রতি রাসূলূল্লাহ  (ﷺ) নিয়মিত প্রশংসার স্তূপ ব্যক্ত করতেন, আর হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহা্হু) ছিলেন তাঁদেরই একজন। যদিও তিনি অতীতে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওযাজহাহু)’র মর্যাদা অসংখ্য উপায়ে উন্নীত করেছিলেন, তবুও এখানেই তিনি তাঁকে উম্মতের প্রিয়ভাজন বন্ধু হওয়ার মহাসম্মান দান করেন।

উপরন্তু, এই ঘটনা এর যথাযথ পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে দেখা দরকার। মহানবী  (ﷺ) মানুষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি জবাব দিচ্ছিলেন, যাঁরা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে ঘৃণা করছিলেন এবং তাঁর শত্রুতে পরিণত হচ্ছিলেন। এই সময়কাল-নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রিয়নবী  (ﷺ) মুসলমান সাধারণের প্রতি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে মহব্বত করার তাকিদ দেন। অতএব, গাদীরে খুমে যা বলা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিতে হবে। যদি এর পরিবর্তে অন্য কোনো সাহাবী  (رضي الله عنه) ওভাবে অপমানিত ও ঘৃণিত হতেন, তাহলে সম্ভবতঃ রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) ওই সাহাবী  (رضي الله عنه)’র পক্ষেও ভাষণ দিতেন। এ ধরনের বিষয়কে ইমামত বা খেলাফতের সাথে সম্পৃক্ত করা একেবারেই দুষ্কর

আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ’ শীর্ষক শীয়া সাইটটি ব্যক্ত করে:

গাদীরে খুমে উপস্থিত সাহাবা  (رضي الله عنه)’র সংখ্যা

আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল  (ﷺ)’র প্রতি এই লক্বব/উপাধি দানের কথা মানুষকে জানানোর আদেশ দেন এমন এক সময়ে যখন স্থানটি জনাকীর্ণ ছিলো, যাতে সবাই এই রওয়ায়াতের বর্ণনাকারী হতে পারেন; আর তাঁদের সংখ্যা ছিলো এক লক্ষাধিক। [http://al-islaml.org/murajaat/54.htm]

শীয়া গোষ্ঠী এই বর্ণনাটিকে অহরহ ব্যবহার করে থাকেন, যাতে প্রমাণ করা যায় যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ গাদীরে খুম স্থানটিতে উপস্থিত ছিলেন। তবে নিরপেক্ষ পাঠকমণ্ডলীর প্রতি আমরা মূললিপির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে অনুরোধ করবো, যা’তে বিবৃত হয়েছে: “(সেখানে) এমন কেউই ছিলেন না, যিনি রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)’কে নিজ চোখে দেখেননি এবং নিজ কানে শ্রবণ করেননি।” সহজ কথা হলো, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) সম্পর্কে তিনি যা যা বলেছিলেন, গাদীরে খুমে উপস্থিত সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ঠিক তা-ই শুনেছিলেন। আমরা ইতোমধ্যেই একমত হয়েছি যে, গাদীরে খুমে উপস্থিতজনেরই প্রতি তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। আর বাস্তবতা হলো, ওই দিন মুসলমানদের একটি অংশই কেবল গাদীরে খুম অতিক্রম করছিলেন।

হযরত আলী (ক:)’র পৌত্র হযরত হাসান ইবনে হাসান  (رضي الله عنه)’এর ভাষ্য    

ইবনে সা’আদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর ‘তাবাক্বাত-এ-কুবরা’ পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে:

ইমাম হাসান ইবনে হাসান ইবনে আলী (رضي الله عنه)’কে একবার জনৈক রাফেযী শীয়া (সর্ব-হযরত আবূ বকর ও উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা’র খেলাফত অস্বীকারকারী) প্রশ্ন করেছিলো, “রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) কি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে বলেননি: ‘আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা’?”

ইমাম হাসান (رضي الله عنه) উত্তর দেন, “আল্লাহর শপথ, যদি তিনি এর দ্বারা আমিরাত ও প্রশাসন বোঝাতেন, তাহলে তিনি তোমাদের কাছে সালাত, যাকাত, বায়তুল্লাহর হজ্জ্ব ইত্যাদি ঐশী বিধানের মতোই স্পষ্ট ভাষায় তা ব্যক্ত করতেন। তিনি তোমাদের বলতেন, ‘ওহে মানবকুল! আমার পরে এই ব্যক্তি-ই হবে তোমাদের ইমাম/নেতা।’ রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) সর্বোত্তম উপদেশ দিতেন (স্পষ্ট অর্থসহ)।” [আল-তাবাক্বাত আল-কুবরা, ৫ম খণ্ড]

অন্যান্য সাহাবী  (رضي الله عنه)’বৃন্দের প্রতি অনুরূপ প্রশংসা

প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) কর্তৃক হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে ‘মওলা’ সম্বোধনের উদাহরণটি তাঁকে খলীফা মনোনীত করার দলিল হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। অন্যান্য অনেক সাহাবী  (رضي الله عنه)’কেও অনুরূপভাবে প্রশংসা করা হয়েছে বিভিন্ন হাদীস শরীফে। অথচ সেসব হাদীসের ব্যাখ্যা দ্বারা কেউই ওই সাহাবা  (رضي الله عنه)’বৃন্দের ঐশী নিয়োগপ্রাপ্ত নিখুঁত ইমামতকে বোঝেননি। চলুন, হযরত উমর (رضي الله عنه) সম্পর্কে হাদীসগুলো বিশ্লেষণ করা যাক।

প্রিয়নবী  (ﷺ) ঘোষণা করেন:

الحق بعدي مع عمر حيث كان

অর্থ: আমার পরে সত্য উমরের সাথে (অবস্থানকারী), সে (উমর) যেখানেই থাকুক না কেন। [হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে আল-তাবারানী কৃত ‘আল-আওসা’ত’, ৩য় খণ্ড, ১০৪ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ২৬২৯]

অথচ কেউই এর মানে নবী পাক  (ﷺ) কর্তৃক তাঁকে আপন উত্তরাধিকারী নিয়োগ বলে বোঝেননি। এমন কী হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه)’ও সেভাবে ব্যাখ্যা করেননি; আর তিনি নিজেই হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)’কে খলীফা হিসেবে নির্বাচন করেন। আরেকটি হাদীসে আমরা দেখতে পাই:
لو كان بعدى نبى لكان عمر بن الخطاب

অর্থ: আমার পরে যদি কেউ নবী হতো, তাহলে সে উমর। [সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৬৮৬]

এই হাদীসটি যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ক্ষেত্রে হতো, তাহলে শীয়াচক্র এটা ডানে, বামে ও সামনে উদ্ধৃত করতেন। কিন্তু আহলুস সুন্নাহ’র সুচিন্তিত উপলব্ধি অনেক সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’র প্রতি রাসূল  (ﷺ)’এর নানা পন্থায় প্রশংসাসম্বলিত বিভিন্ন আহাদীসকে বিবেচনায় নেয়। এগুলো অবশ্যই সাহাবা  (رضي الله عنه)’বৃন্দের উচ্চমর্যাদার দলিল, কিন্তু খেলাফতের মনোনয়ন প্রমাণকারী নয়; আর আল্লাহতা’লা কর্তৃক কোনো নিয়োগও এগুলোতে ব্যক্ত হয় না। আরেকটি হাদীসে আমরা পাঠ করি:

প্রিয়নবী  (ﷺ) বলেন, “সত্য যার সাথে সর্বপ্রথমে করমর্দন করবে, সে উমর।” [উবাই ইবনে কাআব বর্ণিত]

অন্যত্র তিনি ঘোষণা করেন:

لقد كان فيمن كان قبلكم من بنى إسرائيل رجال يكلمون من غير أن يكونوا أنبياء ، فإن يكن من أمتى منهم أحد فعمر

অর্থ: বনূ ইসরাঈল বংশে ইতিপূর্বে এমন কিছ ব্যক্তি ছিলো যারা নবী না হয়েও ঐশী বার্তাপ্রাপ্ত হয়েছিলো; আমার উম্মতের মাঝে এরকম একজন হলো উমর। [সহীহ বুখারী, সাহাবায়ে কেরামের গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী বিষয়ক বই, হাদীস নং ৩৪৮৬]

অতএব, এসব হাদীস ও অন্যান্য সাহাবাবৃন্দের  (رضي الله عنه) উদ্দেশ্যে বলা অপরাপর হাদীসের ওপর ভিত্তি করে আমরা দেখতে পাই যে, প্রিয়নবী  (ﷺ) কর্তৃক হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াহাহু)’কে ‘মওলা’ অভিহিত করার মানে খেলাফতের মনোনয়ন নয়; কেননা অনুরূপ পদ্ধতিতে অন্যদেরও প্রশংসা করা হয়েছে। শীয়াদের সমস্যা হলো, তাঁদের অপছন্দনীয় সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’র বেলায় বর্ণিত হাদীসগুলোর সবই তাঁরা প্রত্যাখ্যান করে থাকেন; আর এরপর স্রেফ হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র বেলায় ব্যক্ত হাদীসগুলো গ্রহণ করেন। যা মজার ব্যাপার তা হলো, শীয়া গোষ্ঠী হাদীসের এসনাদ/সনদের দিকে তাকাতে গরজ করেন না। যেসব হাদীস হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রশংসায় বর্ণিত, তা-ই তাঁদের কাছে সহীহ; আর অন্যান্য সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’র শানে বর্ণিত সমস্ত কিছুই তাঁদের দৃষ্টিতে জাল, বানোয়াট। এটাই শীয়া গোষ্ঠীর হাদীসশাস্ত্রীয় জ্ঞান। তাঁরা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র শানে মিকি মাউস কর্তৃক বর্ণিত ‘হাদীস’কেও সহীহ বলতে কুণ্ঠিত হবেন না, এমন কথা বলা অত্যুক্তি হবে না মোটেও (কৌতুক)! আর খোদ হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) কর্তৃক সর্ব-হযরত আবূ বকর ও উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’র শানে বর্ণিত আহাদীসকে প্রত্যাখ্যান করতেও তাঁরা পিছপা হবেন না।

এবার আমরা আলোচ্য গাদীরে খুম-সংক্রান্ত হাদীসটির দ্বিতীয়াংশকে বিশ্লেষণ করবো, যা নিম্নরূপ:

اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ

অর্থ: হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।

 শীয়া মতাবলম্বীরা এই হাদীসটিকে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সাথে তর্কবিতর্ককারী সাহাবাবৃন্দের  (رضي الله عنه) বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন, অথচ তাঁরা জানেন না প্রিয়নবী  (ﷺ) অন্যান্য সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের ব্যাপারেও অনুরূপ কথা বলেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, নিচের হাদীসটি দেখা যাক:

 من أبغض عمر فقد أبغضني، ومن أحب عمر فقد أحبني

অর্থ: যে ব্যক্তি উমরের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন, সে আমারও প্রতি বৈরীভাব পোষণকারী; আর যে ব্যক্তি উমরকে ভালোবাসে, সে প্রকৃতপক্ষে আমাকেও ভালোবাসে। [তাবারানী কৃত ‘আল-আওসাত’ পুস্তক, ১৪তম খণ্ড, ৪৯৩ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৬৯১৫]

বস্তুতঃ এ কথা নবী করীম  (ﷺ) স্রেফ সর্ব-হযরত আলী ও উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’র ক্ষেত্রেই ব্যক্ত করেননি, বরঞ্চ সকল সাহাবাবৃন্দের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) ক্ষেত্রেও ব্যক্ত করেছিলেন:

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يَحْيَى، حَدَّثَنَا يَعْقُوبُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ بْنِ سَعْدٍ، حَدَّثَنَا عَبِيدَةُ بْنُ أَبِي رَائِطَةَ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ زِيَادٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مُغَفَّلٍ، قَالَ:‏‏‏‏ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:‏‏‏‏ اللَّهَ اللَّهَ فِي أَصْحَابِي،‏‏‏‏ اللَّهَ اللَّهَ فِي أَصْحَابِي، ‏‏‏‏‏‏لَا تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضًا بَعْدِي فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّي أَحَبَّهُمْ، ‏‏‏‏‏‏وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ، ‏‏‏‏‏‏وَمَنْ آذَاهُمْ فَقَدْ آذَانِي، ‏‏‏‏‏‏وَمَنْ آذَانِي فَقَدْ آذَى اللَّهَ، ‏‏‏‏‏‏وَمَنْ آذَى اللَّهَ فَيُوشِكُ أَنْ يَأْخُذَهُ

অর্থ: আল্লাহ, আল্লাহ! আমার সাহাবাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো! যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালোবাসে, সে আমার প্রতি ভালোবাসার কারণেই ভালোবাসে; আর যে ব্যক্তি তাদেরকে ঘৃণা করে, সে আমার প্রতি ঘৃণার কারণেই তা করে; আর যে ব্যক্তি তাদের প্রতি বৈরিতা রাখে, সে প্রকৃতপক্ষে আমারই প্রতি বৈরিতা রাখে; আর আমার প্রতি যে ব্যক্তি বৈরীভাব পোষণ করে, সে আল্লাহরই প্রতি বৈরীভাব পোষণ করে; যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি শত্রুতা রাখে, সে আল্লাহর শাস্তির মুখোমুখি হবে। [হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল হতে ইমাম তিরমিযী বর্ণিত (জামিউল তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, ২৮৫তম অধ্যায়, হাদীস নং ৩৮৬২); ইমাম আহমদ কর্তৃক তিনটি শক্তিশালী সনদে ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত; আল-বুখারী কর্তৃক নিজ ‘তারীখ;’ আল-বায়হাক্বী আপন ‘শুয়াবুল ঈমান’ এবং অন্যান্যরা। আল-সৈয়ূতী নিজ ‘জামেউস্ সগীর’ কিতাবে এটাকে ‘হাসান’ (নির্ভরযোগ্য) ঘোষণা করেন]

শেষ কথা

আসলে শীয়া গোষ্ঠী গাদীরে খুমের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। এতদসংক্রান্ত হাদীসটি ইমামত বা খেলাফত-বিষযক নয়; আর তা যদি তা-ই হতো, তাহলে প্রিয়নবী  (ﷺ)’কে তা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হতে কিছুই বাদ সাধে নি; ’মওলা’ শব্দটি, যার অর্থ সবাই ‘প্রিয়ভাজন বন্ধু’ বলে জানতেন, তা ব্যবহার করার কোনো দরকারই ছিলো না তাঁর। অধিকন্তু, গাদীরে খুম যে মক্কা শরীফ হতে ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, সে বিষয়টিও গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। মহানবী  (ﷺ) যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা মনোনীত করতে চাইতেন, তাহলে বিদায়ী হজ্বের ভাষণে তিনি আরাফাত পাহাড়ের ওপরে সকল নগরী হতে আগত মুসলমানদের আরো বড় সমাবেশে তা ঘোষণা করতেন।

শীয়া মতাবলম্বীদের ধারণাটি একদম ঠুনকো ও সহজে খণ্ডনযোগ্য, যা ব্যক্ত করে সকল মুসলমান হাজ্বী সাহেবান হজ্বশেষে গাদীরে খুমে সমবেত হতেন এবং সেখান থেকে বিদায় নিয়ে নিজ নিজ বাড়ির পথে যাত্রা করতেন। নিশ্চয় মদীনার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী হাজ্বী সাহেবান-ই কেবল গাদীরে খুম অতিক্রম করতেন; কিন্তু মক্কা, তায়েফ, ইয়েমেন ইত্যাদি অঞ্চলের হাজ্বী সাহেবান তা করতেন না। দুই শ বছর আগেও শীয়াচক্র মুসলমানদেরকে এ নিয়ে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হতেন, কেননা তখন অনেকের কাছেই ভৌগোলিক ম্যাপ ছিলো না; ফলশ্রুতিতে তাঁরা ওই ধারণাটি গ্রহণ করতে বাধ্য হতেন যে গাদীরে খুম সত্যিসত্যি বুঝি হাজ্বী সাহেবানের বিদায় নেয়ার সর্বশেষ কেন্দ্র। কিন্তু আজকে তথ্য-প্রযুক্তির যুগে নিখুঁত ম্যাপ আমাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে এবং কেউই আর ওই শীয়াদের সৃষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়বেন না।

আমরা প্রদর্শন করেছি যে, প্রিয়নবী  (ﷺ) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে গাদীরে খুমে খলীফা মনোনীত করেননি, যেমনটি শীয়া মতাবলম্বীরা দাবি করে থাকেন। এটাই হচ্ছে শীয়া মতবাদের ভিত্তিস্তম্ভ, যা ছাড়া তাঁদের মতবাদের কোনো রকম খুঁটি-ই নেই। প্রিয়নবী  (ﷺ) যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা মনোনীত না করে থাকেন, তাহলে শীয়া গোষ্ঠী আর কখনোই দাবি করতে পারেন না যে হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) বা সুন্নী মুসলমান সমাজ হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ঐশীভাবে মঞ্জুরিকৃত খেলাফত কেড়ে নিয়েছিলেন। আর এরই ফলশ্রুতিতে শীয়া মতবাদ নিজের ওপর ভেঙ্গে পড়বে! এটা স্রেফ মক্কা হতে গাদীরে খুমকে পৃথককারী ব্যাখ্যাতীত ২৫০ কিলোমিটার ও সত্য হতে শীয়া মতবাদকে পৃথককারী দূরত্বের কারণেই।


*সমাপ্ত*



Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা