এটা ইমাম গাযালি, ইবনুস সালাহ, ইবন তায়মিয়া, ইবন হাজার হায়তামিসহ জমহুরে আলেমের অভিমত। তবে ইয়াযিদকে লানত দিতে নিষেধ করার পেছনে তাঁদের কারণগুলাে ভিন্ন ভিন্ন :
১. হুসাইন (رضي الله عنه)কে ইয়াযিদ হত্যার হুকুম দেয়নি। এটা ইমাম গাযালি, ইবনুস সালাহ, ইবন হাজার হায়তামি (رحمة الله) প্রমুখের মত।
২. যতক্ষণ একথা প্রমাণিত না হবে যে, ইয়াযিদ সেইসব জালিম ও ফাসিকদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের লানত দেয়া বৈধ এবং এই অবস্থায়ই সে মারা গিয়েছে, ততক্ষণ তাকে লানত দেয়া যাবে না। তাই সে যদি তেমন হয়, তবেই তাকে লানত দেয়া বৈধ হবে। এটা ইবন তায়মিয়ার
অভিমত। দেখা যাচ্ছে ইয়াযিদকে লানত দেয়া সম্পর্কে মতপার্থক্য সুনির্দিষ্টভাবে কোনাে ফাসিককে লানত করা বৈধ কি না, তার উপর নির্ভরশীল। জমহুরের মত হলাে কোনাে ফাসিককে নাম ধরে লানত দেয়া যাবে না। মােটকথা যারা মনে করেন, ফাসিককে নাম ধরে লানত দেয়া জায়েয, তারাই ইয়াযিদকে লানত দেয়া বৈধ বলেছেন। আবার যাদের কাছে সেটা বৈধ নয়, তারাই ইয়াযিদকে নাম ধরে লানত দিতে নিষেধ করেছেন। লানত না দেয়ার পক্ষে ইমাম গাযালি, ইবন হাজার হায়তামি প্রমুখের যুক্তিটি ধােপে টেকে না। আমরা যদি এটা মেনেও নেই যে, ইয়াযিদের প্রত্যক্ষ আদেশে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)কে হত্যা করা হয়নি, তবুও তাে এটা অগ্রাহ্য করার কোনাে উপায় নেই যে, এতে সে আনন্দিত হয়েছিল, তার পবিত্র শির মােবারক তার সামনে আনা হলে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল, ইবনুয যাবারির কুফরি কবিতা আবৃত্তি করেছিল (ইবনুল জাওযি এ বিষয়টি সামনে উল্লেখ করবেন)। এছাড়া হুসাইন (رضي الله عنه)র খুনিদের সে বিন্দুমাত্র শাস্তি দিয়েছে
অথবা তাদের তত্ত্বাবধায়ক ইবন যিয়াদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে বলে কোথাও দুর্বল সনদেও কোনাে বর্ণনা নেই। হুসাইন (رضي الله عنه)র হত্যাকাণ্ড তার সবচেয়ে বড় অপকর্ম হলেও অন্যান্য অপরাধগুলােও ছােট করে দেখার সুযােগ নেই। সে মদিনাকে লুটপাট-ধর্ষণ-হত্যার জন্য বৈধ করে দিয়েছিল, যা রসুলুল্লাহ (ﷺ)এর মদিনা তাে দূরের কথা, মুশরিকদের কোনাে শহরের জন্যও বৈধ হতে পারে না। সর্বশেষ বছর মক্কা মুকাররামাতেও সে একই কাণ্ড ঘটিয়েছে। তখন কাবাঘরে গােলা বর্ষণ করা হয়েছে। অতএব সে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)কে হত্যার আদেশ দেয়নি' নিছক এ কারণে তাকে লানত দেয়া না জায়েয হওয়ার মতামত আঁকড়ে থাকা নিতান্তই অবান্তর। কারবালার ঘটনা যদি কোনদিন নাও ঘটত, তবুও হাররার ঘটনাই হাদিসের আলােকে তার লানতযােগ্য হবার জন্য যথেষ্ট ছিল। একইভাবে ইবন তায়মিয়ার যুক্তিটিও টেকে না। কারণ ইয়াযিদ নিঃসন্দেহে একজন ফাসেক ছিল। এ ব্যাপারে আলিমদের ইজমাও রয়েছে।
❏ ইয়াযিদের ফাসিক হবার বিষয়টি ইবন তায়মিয়া নিজেও মিনহাজুস সুন্নাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এখন একটা বিষয় বাকি থাকে যে- ইয়াযিদ ঐ অবস্থার উপরেই মারা গিয়েছে কি না? ইতিহাস গ্রন্থাদিতে আমরা যেমন দেখতে পাই, ইয়াযিদ যখন মারা যাচ্ছিল, তখনও তার বাহিনী মক্কায় কাবা ঘরে গােলাবর্ষণ করছে। ইয়াযিদ তাওবা করলে সেকথা বিশেষভাবে অবশ্যই ইতিহাস গ্রন্থাদিতে থাকত। অবশ্য হুসাইন (رضي الله عنه)র হত্যাকাণ্ডের পর তার অনুতপ্ত হবার বর্ণনা আছে। আবার এর বিপরীতমুখী বর্ণনাও আছে।
❏ একটি বর্ণনায় আছে, সে বলেছিল, আমি হলে হুসাইনের সাথে এমন করতাম না।' আরেক বর্ণনামতে, সে প্রথমে খুশি হলেও পরে অনুতপ্ত হয়েছিল। আরেকটি বর্ণনামতে সে হুসাইন (رضي الله عنه)কে হত্যার জন্য এবং এর মাধ্যমে মুসলিমদের সামনে নিজেকে ঘৃণিত করার জন্য ইবন যিয়াদকে লানত দিয়েছিল।
(ইবনু কাছির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ৮, পৃ. ২৩২)।
কিন্তু তার অনুতপ্ত হবার হাকিকত বােঝা দুষ্কর। একজন অনুতপ্ত মানুষ কীভাবে আবার হাররার মতাে ঘটনা ঘটায়।
❏ ইবন তায়মিয়া বলেছেন, 'কিছু মানুষ ভাবে ইয়াযিদ একজন ভালাে লােক ছিল, ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিল, মহানবি (ﷺ)এর যুগে জন্ম নেয়া সাহাবি ছিল। এগুলাে পথভ্রষ্টতা।'
(ইবন তায়মিয়া আল হাররানি, মাজমু আল ফাতাওয়া, খ.৪, পৃ. ৪৮২)
❏ আস সাওয়াইকুল মুহরিকা গ্রন্থে ইবন হাজার হাইতামি (মৃ. হি.) ইয়াযিদের ফাসিক হবার ব্যাপারে আলিমদের একমত হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন,
ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়া কাফির কি না, তা নিয়ে আহলুস সুন্নাহর আলিমগণের মাঝে মতপার্থক্য আছে।
একদল তাকে কাফের মনে করে। অপরদিকে অন্যদল বলেন, সে মুসলিম হলেও ফাসিক, ফাজির ও মদ্যপ ছিল। তার ফাসিক হওয়া নিয়ে সবার ইজমা রয়েছে। একদল আলিমের মতে তাকে নাম ধরে লানত দেয়া। যাবে। ইমাম আহমদ, ইবনুল জাওযি প্রমুখ এ মত পােষণ করেন...। উক্ত গ্রন্থে তিনি আরও লিখেছেন, উমর ইবন আব্দুল আযিয (رحمة الله) এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, ইয়াযিদকে যে আমিরুল মুমিনিন বলত, তিনি তাকে বিশটি দোররা মারার হুকুম জারি করতেন।
(আস সাওয়াইকুল মুহরিকা, পৃ. ২২১)
❏ ইমাম যাহাবি মুহাম্মদ ইবন আবুস সারি আল আসকালানির সূত্রে বর্ণনা করেছেন,→ ইয়াহইয়া ইবন আব্দুল মালিক ইবন আবু গানিয়্যাহ বলেন,→নওফল ইবন আবুল ফুরাত বলেন,→আমি একদিন উমর ইবন আব্দুল আযিযের কাছে ছিলাম। হঠাৎ এক লােক বলল, আমিরুল মুমিনিন ইয়াযিদ বলেন...'। তখন উমর তাকে শাস্তি দেয়ার হুকুম দিলেন। তাকে বিশ ঘা চাবুক মারা হলাে।' এছাড়াও আরও বলা উচিত, ইয়াযিদ তাে ফাসিক হলেও অন্যান্য ফাসিকের মতাে নয়। সে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)কে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর শির মােবারককে কুফা থেকে দামেস্কে নিয়ে যাওয়ার পর সামনের দাঁতে ছড়ি দিয়ে খোঁচা দিয়েছে, আহলুল বায়তের সদস্যদের হত্যা করার পর জীবিতদের বন্দী করেছে। মদিনায় বাইয়াত অস্বীকারকারীদের হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি, মদিনাকে তার সৈন্যদের জন্য বৈধ করে দিয়েছিল; তারা সেখানে যা ইচ্ছা করেছে। মক্কায় ইবন যুবায়র (رضي الله عنه)মা ও তার সঙ্গীদের অবরুদ্ধ করেও ক্ষান্ত হয়নি, কাবা শরিফের উপর গােলাবর্ষণ করেছে। তাছাড়া শাসনক্ষমতা পাওয়ার আগে থেকেই সে খেলতামাশা, মদ্যপান ইত্যাদিতে কুখ্যাত ছিল। তাই সে কীভাবে অন্যান্য ফাসিকদের মতাে হতে পারে? কেউ কেউ নিম্নোক্ত হাদিসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন,
لعن المؤمن كقتله .
‘কোনাে মুমিনকে লানত দেয়া তাকে হত্যা করার ন্যায়।' (সহিহ বুখারি, কিতাব : আল আদব, বাব : মা ইউনহা মিনাস সিবাবি ওয়াল লান)
❏ এ হাদিস তাে ঐ মুমিনের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য, যে লানতের যােগ্য নয়। নির্দিষ্ট কোনাে মুমিনকে লানত দেয়া প্রসঙ্গে ইমাম নববি বলেছেন, ‘নির্দিষ্ট কোনাে ব্যক্তিকে লানত দেয়া, যে ইহুদি, খ্রিষ্টান, জালিম, ব্যভিচারী, চিত্রাঙ্কণকারী, চোর অথবা সুদখােরের মতাে কোনাে পাপে লিপ্ত, স্পষ্ট হাদিস অনুসারে তাকে লানত দেয়া হারাম নয়।'
(ইমাম নববি, আল আযকার মিন কালামি সাইয়্যিদিল আবরার, রিয়াদ : মাকতাবাতু নাযার মুসতফা আল বায, ১৯৯৭ খ্রি. খ, ২, পৃ. ৪২৮)
যারা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে ইয়াযিদকে লানত দিয়েছেন, তাদের কয়েকজনের মতামত নিম্নরূপ :
❏ আল্লামা মানাভি (رحمة الله) বলেন,
হুসাইন (رضي الله عنه)র হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা আমাদের কলজে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, শরীরকে গলিয়ে দেয়। যে তাঁকে হত্যা করেছে, অথবা এতে সম্ভষ্ট হয়েছে, অথবা আদেশ দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের উপর আল্লাহর লানত; আদ জাতি যেভাবে ধ্বংস হয়েছে, তারাও সেভাবে ধ্বংস হােক।' হাফিজুদ্দিন আল কুরদি আল হানাফি তার ফতােয়ায় বলেন, ইয়াযিদকে লানত দেয়া জায়েয, তবে না দেয়াই উচিত। হাজ্জাজের ক্ষেত্রেও একই কথা।'
❏ ইমাম কাওয়ামুদ্দিন আস সাফফারি (رحمة الله) বলেন, ইয়াযিদকে লানত দিতে কোনাে দোষ নেই। তবে মুয়াবিয়া রা. কে লানত দেয়া যাবে না।'
❏ ইবনুল জাওযি (رحمة الله) কে ইয়াযিদ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন,
‘রসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে আবু সুফিয়ানের ঘরে ঢুকবে, সে নিরাপদ। আর আমরা জানি তার বাবা সেই ঘরে ঢুকেছিলেন, ফলে নিরাপদ হয়ে গেছেন। কিন্তু পুত্র তাে সেখানে ঢােকেনি।
❏ আল মাওলা ইবনুল কামাল (رحمة الله) বলেন, প্রকৃত কথা হলাে, ইয়াযিদকে তার কুফরির কুখ্যাতি, বীভৎসতা ও অপকর্মের জন্য, যেসবের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে তাকে লানত দেয়া জায়েয। তা না হলে কোনাে ফাসিককেও নির্দিষ্ট করে লানত দেয়া যাবে না।
❏ আল্লামা তাফতাযানি (رحمة الله) বলেছেন,
لاَ أَشُكُّ فِي إِسلَامِه بَل فِي إِيمَانِهِ فَلَعنَةُ اللّٰه عليه وعلى أَنصَارِهِ وأغوَانِه
আমি তার ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ করি না, তবে ইমানের ব্যাপারে করি। তার উপর, তার সহযােগী ও সহায়তাকারীদের উপর আল্লাহর লানত।
❏ একদিন ইবনুল জাওযি (رحمة الله) ওয়াজের মজলিসে চেয়ারে বসে ছিলেন। একজন জিজ্ঞেস করল, এটা বলা কীভাবে সহিহ হতে পারে যে, ইয়াযিদ হুসাইন (رضي الله عنه)কে হত্যা করেছে? সে তাে তখন দামেস্কে এবং হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ইরাকে ছিলেন। তখন ইবনুল জাওযি নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করলেন,
سهم أصاب وراميه بذي سلم من + بالعراق لقد أبعدت مزماي
‘ইরাকে যে আছে, তার কাছে তীর লক্ষ্যভেদ করেছে, যে তীর ছোঁড়া হয়েছে যি সালাম নামক জায়গা থেকে।
তােমার নিশানা তাে বহু দূরের।
❏ এটি শরিফ রাজির ‘ইয়া যাবিয়্যাতাল বান’ নামের একটি বিখ্যাত কবিতার লাইন। কবি এখানে প্রেমিকার সাথে তার ভালােবাসার সম্পর্ককে লক্ষ্যভেদী তীর হিসেবে। আখ্যা দিয়েছেন। এই তীর স্থানগত দূরত্ব থাকার পরও হিজাযের যি সালাম থেকে বহু দূরে ইরাকে গিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। (আব্দুর রউফ আল মানাভি, ফাইযুল কাদির শারহুল জামিইস সাগির মিন আহাদিসিল বাশিরি ওয়ান নাযির, বৈরুত, দারুল মারেফাহ, ১৯৭২ খ্রি., খ. ১, পৃ. ২০৫)।
❏ ইয়াযিদ সম্পর্কে ইমাম যাহাবি (رحمة الله)'র ব্যক্তিগত মূল্যায়ন এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন,
وَكَانَ نَاصِبِيَّا فَظَّا غَلِيظًا جِلفًا يَتَنَاوَلُ المُسكِرَ وَيَفعَلُ المُنكِرَ افتَتَحَ دَؤلَتَهُ بِمَقتَلِ الشَّهِيدِ الحُسَينِ وَاختَتَمَهَا بِوَاقِعَةٍ الحَرَّةَ فَمَقَتَهُ النَّاسُ وَلَم يُبَارَك فِي عُمرِهِ وَخَرَجَ عَلَيهِ غَيرُ وَاحِدٍ بَعدَ الحُسَينِ كَأَهلِ المَدِينَةِ قَامُوا لِلّٰهِ
“সে ছিল আহলে বায়ত বিদ্বেষী (নাসেবি), নির্দয়, কর্কশ, অত্যাচারী; সে নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করত, খারাপ কাজ করত। শহিদ হুসাইন (رضي الله عنه)র হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সে খেলাফত শুরু করেছে আর শেষ করেছে হাররার ঘটনা দিয়ে। লােকেরা তাকে ঘৃণা করত। তার বয়সেও সে বরকত পায়নি। হুসাইন (رضي الله عنه)র পর অনেকেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। যেমন মদিনাবাসী তারা শুধু আল্লাহর জন্য তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। ইমাম যাহাবি আরও উল্লেখ করেছেন, যিয়াদ আল হারেসি উল্লেখ করেছেন, ইয়াযিদ একবার আমাকে এমন শরাব পান করাল, তেমন স্বাদের শরাব আর কখনাে খাইনি। বললাম, আমিরুল মু'মিনিন! এমন মদ আমি কখনাে পান করিনি। তখন ইয়াযিদ বলল,
هَذَا رُمَّانُ حُلوَانَ ، بِعَسَلِ أَصبَهَانَ بِسُکَّرِ الأَهوَازِ ، بِزَبِيبِ الطَّاٸِفِ ، بِمَاءِ بَرَدَی
‘এটা মিষ্টি ডালিম, ইস্পাহানের মধু, আহওয়াযের চিনি, তায়েফের আঙ্গুর এবং বারাদার পানি দিয়ে তৈরি।
❏ ইমাম যাহাবি মুহাম্মদ ইবন আহমদ ইবন মিসমা
(رحمة الله)’র সূত্রে বর্ণনা করেছেন,
سَكِرَ يَزِيدُ فَقَامَ يَرقُصُ فَسَقَطَ عَلَى رَأسِهِ فَانشَقُُ
‘একবার ইয়াযিদ মাতাল হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করল। এরপর চিৎ হয়ে পড়ে তার মাথা ফেটে গেল।' (ইমাম যাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা, বৈরুত : মুয়াসসাতুর রিসালা, খ. ৪, পৃ. ৩৭)।
❏ ইবন খাল্লিকান (রহঃ) বলেন,
وَسُئِلَ إِلكِيَاهَرًا اسِي أَيضًا عَن يَزِيدِ بن مُعَاوِيَةَ فَقَالَ : إِنَّهُ لَم يَکُن مِنَ الصَّحَابَةِ لِأَنَّهُ وَلِدَ فِي أَيَّامِ عُمَرَ بِن الخَطَّابِ رَضِيَ اللّٰهُ عَنهُ. وأما قَولُ السَّلَف فَفِيهِ لِأَحمَد قَولاَنِ تَلوِيحِّ وَتَصرِيحُ وَلِمَالِكَ فِيهِ قَولَانِ تَلوِيحُ وَتَصرِيحُ ولأبِي حَنِيفَةَ قَولَانِ تَلوِيحُ وَتَصرِيحُ وَلَنَا قَؤلُ وَاحِدُ تَصرِيحُ دُونَ التَّلوِيح! وَکَیفَ لَا يَكُون كَذَلِكَ وَهُوَ الَّلاعِبُ بِالنُّردِ وَالمُتَصَيِّدُ بِالفُهُودِ وَمُد مِنُ الخَمرِ.
‘বিশিষ্ট শাফেঈ ফকিহ ইলকিয়া হাররাসিকে ইয়াযিদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ইয়াযিদ কোনাে সাহাবি ছিল না। সে জন্ম নিয়েছিল উমর (رضي الله عنه)'র খিলাফতকালে। তার ব্যাপারে সালাফ বা পূর্বসূরি, যেমন ইমাম আহমদ, ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফা প্রমুখের পক্ষ থেকে দুটি মত রয়েছে। একটি মত তালউইহ (ইশারায় লানত দেয়া) ও আরেকটি মত তাসরিহ (স্পষ্টভাষায় লানত দেয়া)। আর আমাদের মত কেবল একটিই। তা হলাে, তাসরিহ বা সুস্পষ্টভাবে লানত দেয়া, তালউইহ নয়। আর এটা হবে নাই বা কেন? ইয়াযিদ পাশা খেলত, চিতাবাঘ দিয়ে শিকার করত, সর্বোপরি সে ছিল মদ্যপ।'
(ইবন খালিকান, ওয়াফিয়াতুল আইয়ান ফি আনবায়ি আবনায়িয যামান, বৈরুত: দারু সাদির, ১৯৭২ খ্রি., খ. ৩, পৃ. ২৮৭)
❏ আল্লামা শাওকানি বলেছেন,
وَلَقَد أَفرَطَ بَعضُ أَهلِ العِلمِ كَالكَرَّامِیَّةِ وَمَن وَافَقَهُم فِي الجُمُودِ عَلَى أَحَادِيثِ البَابِ حَتَّی حَكُومُ بِأَنَّ الحُسَينَ السِّبطَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنهُ وَأَرضَاهُ بَاغ عَلَى الخِمِّيرِ السِّکِّيرِ الهَتِاكِ لِحُرُمِ الشَّرِيعَةِ المُطَهَّرَةِ یَزِیدَ بنِ مُعَاوِيَةَ لَعَنَهُم اللّٰهُ ، فَيَاللّٰهِ العَجَبُ مِن مَقَالاَتِ تَقشَعِرُّ مِنهَا الجُلُودُ وَيَتَصَدَّعُ مِن سَمَاعِهَا كُلُّ جُلمُودٍ
‘কিছু আলেম যেমন কাররামিয়া ও তাদের সমমনা কিছু লােক এ অধ্যায়ের হাদিসগুলাের উপর ভিত্তি করে বাড়াবাড়ি করেছে। এমনকি এমন রায় দিয়েছে যে, মদ্যপ, মাতাল, পবিত্র শরিয়াতের পবিত্র বিধিবিধান ছিন্নকারী ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে রসুলুল্লাহ (ﷺ)এর নাতি হুসাইন (আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হােন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করুন) বিদ্রোহী হয়েছেন। আল্লাহ ঐসব লােককে লানত দিন। হায় আল্লাহ! কী বিস্ময়কর তাদের কথা! এগুলাে শুনলে শরীর শিউরে ওঠে, কঠিন প্রস্তরও কেঁপে ওঠে।'
(ইমাম মুহাম্মদ ইবন আলি আশ শাওকানি, নাইলুল আওতার, খ. ৭, পৃ. ১৮৬)।
❏ আল্লামা সাদুদ্দিন আত তাফতানি (رحمة الله) বলেন,
وبعضهم أطلق اللغن عليه لما أنه حين أمر بقتل الحسين كفر رضي الله عنه واتفقوا على جواز اللعن على من قتله أو أمر به أو أجازه أو رضي به. والحق إن رضا يزيد بقتل الحسين واستبشارة بذلك وإهاننه أهل بيت رسول الله مما تواتر مغناه وإن كان تفصيله
أحادا فنحن لا تتوقف في شأنه بل في كفره وإيمانه لعنة الله عليه وعلى أنصاره وأعوانه.
উলামায়ে আহলে সুন্নাতের কেউ কেউ তাকে অর্থাৎ ইয়াযিদকে লানত দিয়েছেন। কারণ সে যখন হুসাইন (رضي الله عنه)কে হত্যার আদেশ দিয়েছিল, তখনই সে কুফরি করেছিল। এছাড়া হুসাইন (رضي الله عنه)র হত্যাকারী, হত্যায় আদেশদাতা, অনুমােদনদাতার অথবা তাতে সম্ভষ্ট ব্যক্তিকে লানত দেয়ার ক্ষেত্রে আলিমগণ একমত পােষণ করেছেন। প্রকৃত কথা হলাে, হুসাইন (رضي الله عنه)র হত্যাকাণ্ডে ইয়াযিদের সন্তুষ্টি ও আনন্দ, রসুলুল্লাহ (ﷺ) এর আহলে বায়তকে লাঞ্ছিত করা যার বর্ণনা আলাদা আলাদাভাবে খবরে আহাদ পর্যায়ের হলেও অর্থগতভাবে মুতাওয়াতির পর্যায়ের; এসবের জন্য আমরা তার ব্যাপারে চুপ থাকব না। এমনকি সে মুমিন নাকি কাফির সে ব্যাপারেও চুপ থাকব না। আল্লাহ তায়ালার লানত তার উপর, তার সহযােগী ও সহায়তাকারীদের উপর।' (সাদুদ্দিন আত তাফতানি, শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, আস্তানা, কাজাখস্তান, ১২৭৭ হি., পৃ. ১৮০-১৮১)
❏ তিনি আরও বলেন,
فمن علماء المذهب من لم يجوز اللعن على يزيد مع علمهم بأن يستحق ما يربو على ذلك ويزيد! قلنا تحاميا عن أن يرتقي إلى الأعلى فالأعلى كما هو شعار الروافض
যদি এটা বলা হয় যে, এই মাযহাবের অনেক আলিমই জানেন, ইয়াযিদ শুধু লানত নয়, তার চেয়েও বেশি কিছুর উপযুক্ত। এসব জেনেও তারা ইয়াযিদকে লানত দেয়া জায়েয বলেন, না!' আমরা এর জবাবে বলব, লানত দেয়ার এই প্রবণতা] যাতে আরও উপরের স্তর কিংবা তারও উপরের স্তরে না যায়, সেজন্যই তারা নিষেধ করেন, সেটা রাফেযিদের নিদর্শন।'
(সাদুদ্দিন আত তাফতানি, শারহুল মাকাসিদ, বৈরুত: দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যা, ২০১১ খ্রি., খ.৩, পৃ. ৫৩৬-৫৩৭)।
❏ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি (رحمة الله) বলেন,
فقتل وجيء برأسه في طست حتی وضع بين يدي ابن زیاد، لعن الله قاتله وابن زياد معه ويزيد أيضا. وكان قتله بكربلاء
এরপর ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)কে হত্যা করা হলাে এবং একটি থালায় তার মাথা এনে ইবন যিয়াদের সামনে রাখা হলাে। তার হত্যাকারী, ইবন যিয়াদ এবং ইয়াযিদকে আল্লাহ লানত দিন। তাঁকে কারবালায় হত্যা করা হয়েছিল।'
(ইমাম জালালুদ্দিন আস সুয়ুতি, তারিখুল খুলাফা, বৈরুত : দার ইবন হাযম, পৃ. ১৬৫)
❏ শায়খুল ইসলাম ইবন হাজার আল আসকালানি (رحمة الله) বলেন,
وأما المحبة فيه والرفع من شأنه فلا تقع إلا من مبتدع فاسد الاعتقاد فإنه كان فيه من الصفات ما يقتضي سلب الإيمان عمن يحبه لأن الحب في الله والبغض في الله من الإيمان .
‘ইয়াযিদের প্রতি মহব্বত রাখা ও তার গুণকীর্তন করা কেবল বেদয়াতি ও বাতিল আকিদাধারীর পক্ষেই সম্ভব। কারণ ইয়াযিদের ভেতর এমন কিছু বৈশিষ্ট ছিল, যেজন্য কেউ তাকে ভালােবাসলে তার বেইমান হয়ে যাওয়া আবশ্যক হয়ে যায়। কারণ শুধু আল্লাহর জন্য ভালােবাসা এবং শুধু তার জন্য ঘৃণা করা উভয়ই ইমানের অন্তর্ভুক্ত।'
(ইবন হাজার আল আসকালানি, আল ইমতা বিল আরবাঈন আল মুতাবাইনাতুস সামা, বৈরুত : দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৭ খ্রি., পৃ. ৯৬)
❏ আবু বকর মুহাম্মদ ইবনুল হুসাইন আল আজুররি (মৃ. ৩৬০ হি.) বলেন, হুসাইন ইবন আলি (رضي الله عنه)র হত্যাকারীর উপর আল্লাহর লানত এবং সমস্ত লানতদাতার লানত। একইসাথে তাকে হত্যায় যে সহযােগিতা করেছে। আলি ইবন আবু তালিব, হাসান, হুসাইন (رضي الله عنه)মকে গালি দিয়েছে অথবা ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে তাঁর পুত্রদের ব্যাপারে কষ্ট দিয়েছে অথবা রসুলুল্লাহ (ﷺ) এর আহলে বায়াতকে কষ্ট দিয়েছে, তার উপর আল্লাহর লানত ও গযব বর্ষিত হােক। মহান আল্লাহ তার জন্য কোনাে মিযান স্থাপন করবেন না, সে মহানবি (ﷺ) এর শাফায়াতও অর্জন করতে পারবে না।'
(মানাকিবু ও ফাদাইলু আলে বাইতিন নাবি (ﷺ), পৃ. ৩০৫)
❏ আল্লামা আলুসি র, তাঁর তাফসিরে ইয়াযিদ সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল জাওযি (رحمة الله) এর একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন। তার সেই উক্তিটিও এখানে প্রাসঙ্গিক
من الاعتقادات العامة التي غلبت على جماعة منتسبين إلى السنة أن يقولوا : إن يزيد كان على الصواب وإن الحسين رضي الله تعالی عنه أخطأ في الخروج عليه ولو نظروا في السير لعلموا كيف
عقدت له البيعة وألزم الناس بها ولقد فعل في ذلك كل قبيح ثم لو قدرنا صحة عقد البيعة فقد بدت منه بواد كلها وجب فسخ العقد ولا
يميل إلى ذلك إلا كل جاهل عامي المذهب يظن أنه يغيظ بذلك الرافضة.
‘নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাতের দিকে সম্পর্কিত করে, এমন একটি গােষ্ঠীর সাধারণ আকিদা হলাে, ইয়াযিদ সঠিক ছিল আর হুসাইন (رضي الله عنه) তার। বিরুদ্ধে বের হয়ে ভুল করেছিলেন। এরা চরিতগ্রন্থগুলাে দেখলে জানতে পারত ইয়াযিদের বাইয়াত কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল আর সাধারণ মানুষকে সে কীভাবে তাতে বাধ্য করেছিল। এজন্য সে সবরকমের খারাপ কাজ করেছিল। এরপরও যদি ধরে নেই যে, তার বাইয়াত যথাযথভাবে হয়েছিল, তবুও তারপর তার কাছ থেকে এমন বিষয় প্রকাশ পেয়েছিল, যাতে বাইয়াত ভঙ্গ করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। উপরােক্ত মতের প্রতি কেবল সেই আকৃষ্ট হতে পারে, যে গণ্ডমূর্খ ও ধর্মীয় জ্ঞানহীন, যে ভাবে এমন অবস্থান নিয়ে সে রাফেযিদেরকে রাগিয়ে দিতে পারবে।'
(আল্লামা মাহমুদ আলুসি, প্রাগুক্ত, খ. ২৬, পৃ. ৭৩)।
❏ ইমাম আবু শামা বলেছেন, “ইবনুল জাওযিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ইয়াযিদকে লানত দেয়া যাবে কি না? তিনি বলেছেন, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল তাকে লানত দেয়া জায়েয বলেছেন। আর আমরা বলি, সে আমাদের নবিজী (ﷺ) এর কন্যার সন্তানের সাথে যা করেছে, রসুলুল্লাহ (ﷺ) এর পরিবারকে উটের কুঁজে উঠিয়ে বন্দী হিসেবে যেভাবে সিরিয়ায় নিয়ে গিয়েছে এবং যেভাবে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অবাধ্য হয়েছে, সেসবের জন্য আমরা তাকে পছন্দ করি না। আমাদের এ সমন্বয়মূলক কথায় যদি তােমরা সস্তুষ্ট না হও, তবে আমরা মূল দাবিতে ফিরে যাব। তা হলাে তাকে লানত দেয়া জায়েয। ইবনুল জাওযি আরও বলেছেন, সামনের দাঁতের যে স্থানে রসুলুল্লাহ (ﷺ) চুমু খেয়েছেন, সেখানে যে লােক ছড়ি দিয়ে আঘাত করেছে, তার কথা বলে আমাদের সময়কে কলুষিত করাে।
(আবু শামা আল মাকদিসি, আয যাইলু আলার রাওদাতাইন, বৈরুত, ১৯৭৪ খ্রি., পৃ. ২৩)।
❏ মুহাম্মদ রশিদ রিদা বলেন, সেই শাসক শক্তি প্রয়ােগ করে, ছলচাতুরি করে মুসলমানদের শাসনভার নিয়েছিল। সে হলাে ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়া। আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করুন। কাররামিয়া ও নাসেবি(رضي الله عنه) যারা তার মদদদাতা, তাদেরকেও আল্লাহ লাঞ্ছিত করুন।
(তাফসিরুল মানার, খ. ৬, পৃ. ৩৬৭)।
❏ ফুরফুরার মুজাদ্দেদে যামান আবু বকর সিদ্দিকি ফুরফুরাভী (رحمة الله) এর ছেলে আবু জাফর সিদ্দিকি (رحمة الله) বলেন, খায়রুল কুরুনের সময় রাফজী, কারিয়া, মােতাজেলা প্রভৃতি বেদাত দলগুলির আবির্ভাব হওয়ায় তাহারা ও তাহাদের মতামতগুলি কী ভালাে হইবে? হজরত মােয়াবীয়ার পুত্র এজিদ তাবেয়ীনের কালে ছিল। কিন্তু সে হজরত হুসাইন (رضي الله عنه) কে কতল করিয়াছিল...।'
(আল্লামা আবু জাফর সিদ্দিকি, তাহকীকুল মাসায়েল, ফুরফুরা শরীফ মােজাদ্দেদ মিশন, তাবি, পৃ. ১২)
Comments
Post a Comment