সুন্নী চার মাযহাবের বৈচিত্র্যের মাঝে খোদার রহমত
সুন্নী চার মাযহাবের বৈচিত্র্যের মাঝে খোদার রহমত
মূল: ইমাম কাজী সাফাদী (رحمة الله)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
[Bengali translation of Imam Qadi Safadi’s book “The Mercy in the Difference of the Four Sunni Schools of Islamic Law” as found in Aisha Bewley’s English translation]
উৎসর্গ: পীর ও মোর্শেদ সৈয়দ মওলানা এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব (رحمة الله)-এর পুণ্যস্মৃতিতে….
অনুবাদকের কথা
ইমাম কাজী সাফাদী দামেশকী (رحمة الله) প্রায় ৬০০ বছর আগে এই বইটি রচনা করেন। শিরোনামেই এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। এই বইটিতে লেখক বিভিন্ন বিষয়ে চার মযহাবের ইমামবৃন্দ যে এজতেহাদী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। বর্তমান এই ফিতনার জমানায় ইসলামী স্বর্ণযুগের ‘উলুল আমর’ তথা উলামাবৃন্দের বিধি-বিধান তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার মহৎ উদ্দেশ্যেই আমরা বইটি অনুবাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস পেয়েছি। আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব (ﷺ) ও আউলিয়া কেরাম (رحمة الله)-এর অসীলায় আমাদের এই উদ্যোগকে কবূল করুন, আমীন!
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহূ ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম
আম্মা বা’দ।
আয়েশা বিউলী’র ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতা’লার প্রাপ্য। আমরা তাঁরই মহিমা বর্ণনা করি এবং তাঁরই সাহায্য, হেদায়াত (পথপ্রদর্শন) ও ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমাদের নিজেদের মধ্যকার যাবতীয় মন্দ এবং আমাদেরই বদকর্ম হতে আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাঁকে হেদায়াত দেন, তিনি সঠিক পথপ্রাপ্ত; আর আল্লাহ যাকে হেদায়াত দেন না, সে সঠিক পথপ্রাপ্তির জন্যে কোনো হেদায়াতকারী-ই পায় না। প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। তিনি যা দান করেন কেউ-ই তা আটকে রাখতে পারে না, আর তিনি যা আটকে রাখেন, কেউ-ই তা দিতে পারে না।
ফেক্বাহ’র চার মযহাবের বিভিন্ন এজতেহাদ-সম্পর্কিত এই বইটির স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা পক্ষপাত হতে মুক্ত এবং এর প্রতিপাদ্যে সহজবোধ্য। চার মযহাবের অনুসারীদেরকে তাঁদের একে অপরের মযহাবের ফিক্বহী সিদ্ধান্তগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই বইটি রেফারেন্স পুস্তক হিসেবে প্রণীত হয়েছে, যাতে অজ্ঞতা ও পক্ষপাত হতে অনর্থক বৈরিতা ও ভুল বোঝাবুঝির উদ্ভব না হয়। শরয়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং বিশেষ করে অপরিকল্পিত ও অপ্রশিক্ষিত পন্থায় তা কাজে বাস্তবায়নের জন্যে এটাকে খোদ কোনো উৎস হিসেবে উদ্দেশ্য করা হয়নি। বইটির লেখক হচ্ছেন বিখ্যাত বিচারক ইমাম কাজী সাফাদী (رحمة الله) যাঁর পুরো নাম মুহাম্মদ ইবনে আবদির রাহমান ইবনে আল-হুসাইন আস্ সাফাদী আশ্ শাফেঈ। তিনি দামেশকীয় আলেম ছিলেন এবং বিভিন্ন বই লিখেছিলেন। হিজরী ৭৮৪ মোতাবেক ১৩৭৮ খৃষ্টাব্দে তিনি বেসালপ্রাপ্ত হন।
ফেক্বাহ-শাস্ত্র দ্বীন-ইসলামের বাণীকে অনুশীলন বা চর্চায় পরিণত করে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে: (১) এবাদত ও আমল যা আল্লাহ পাক সরাসরি তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর কাছে কুরআন মজীদ ও সুন্নাহ মারফত প্রকাশ করেছেন, আর মহানবী (ﷺ)-এর দায়িত্ব যেখানে শুধু তা পৌঁছে দেয়ার এবং খোলাসাভাবে ব্যাখ্যা করার, যেমনটি আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান, “ওয়া মা এয়ানতিকু আনিল হাওয়া ইন হুয়া ইল্লা ওয়াহইউঁ ইউহা”, মানে “এবং তিনি কোনো কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না; তা তো ওহী-ই যা তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়” [আল-কুরআন, ৫৩:৩-৪; মুফতী আহমদ এয়ার খান (رحمة الله)-এর কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]; এবং (২) দুনিয়াবী/পার্থিব বিষয়াদি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসমূহ, যেগুলোর ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মানুষের সাথে পরামর্শ করার অনুমতি পেয়েছিলেন, যেটার উদাহরণ হলো তিনি উহুদের জ্বেহাদে আসহাব-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর ঐকমত্যের বিপরীতে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলেন; কিংবা যেসব ক্ষেত্রে তিনি পরামর্শ না করে সিদ্ধান্ত নিতেন না।
মুসলমানদের দ্বারা সঠিক শরয়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের অন্বেষণকে পথপ্রদর্শনের লক্ষ্যে ইসলাম ধর্ম কয়েকটি সাধারণ নিয়ম আরোপ করে থাকে:
এমন বিষয় খোঁজা নিষেধ যা প্রকৃতপক্ষে ঘটেনি। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “হে ঈমানদার সকল! তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যেগুলো তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হলে তোমাদের খারাপ লাগবে; এবং যদি ওই সব বিষয়ে ওই সময় প্রশ্ন করো, যখন ক্বুরআন অবতীর্ণ হচ্ছে, তবে তোমাদের কাছে (তা) প্রকাশ করে দেয়া হবে।” [আল-ক্বুরআন, ৫:১০১]
অসংখ্য প্রশ্ন ও কষ্টসাধ্য (জটিল) সমস্যাদি এড়িয়ে চলা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ তোমাদের দ্বারা অলস কথাবার্তা, এক গাদা প্রশ্ন ও সম্পদ-সম্পত্তি অপব্যয়কে অপছন্দ করেন।” তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান, “আল্লাহতা’লা বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেন, অতএব, সেগুলোর প্রতি অবহেলা করো না; তিনি সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সুতরাং সেগুলো লঙ্ঘন করো না; আর তিনি কিছু জিনিসকে অবৈধ করেছেন, তাই সেগুলো সংঘটন করো না; অধিকন্তু, বিস্মৃত হয়ে নয় বরং করুণাস্বরূপ তিনি অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে নিশ্চুপ/নীরব থেকেছেন; অতএব, সেগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না।”
মতানৈক্য ও বিভক্তি হতে দূরে সরে থাকা। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “এবং নিশ্চয় এই যে, তোমাদের দ্বীন (ঈমান-আকীদাহ) একই দ্বীন” [আল-ক্বুরআন, ২৩:৫২]। তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান, “এবং আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো সবাই মিলে, আর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না”[আল-ক্বুরআন, ৩:১০৩]। তিনি এছাড়াও এরশাদ করেন, “আর পরস্পরের মধ্যে বিবাদ করো না; তা করলে পুনরায় সাহস হারাবে এবং তোমাদের সঞ্চিত বায়ু বিলুপ্ত হতে থাকবে” [আল-ক্বুরআন, ৮:৪৬]। তিনি আরো এরশাদ করেন, “ওইসব লোক যারা আপন দ্বীনের মধ্যে পৃথক পৃথক রাস্তা বের করেছে এবং কয়েক দলে বিভক্ত হয়েছে, হে মাহবূব, তাদের সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই” [আল-ক্বুরঅান, ৬:১৫৯]।
মতবিরোধপূর্ণ বিষাদির ক্ষেত্রে (ফায়সালার জন্যে) সেগুলোকে কুরআন ও সুন্নাহ’র শরণাপন্ন করা। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতভেদ দেখা দেয়, তবে সেটাকে আল্লাহ ও রাসূলের সম্মুখে রুজু করো” [আল-ক্বুরআন, ৪:৫৯]। তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান, “তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করো, সেটার ফায়সালা আল্লাহরই কাছে অর্পিত” [আল-ক্বুরআন, ৪২:১০; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله) প্রণীত তাফসীরে নূরুল এরফান]।
অতএব, এ বিষয়টি চূড়ান্ত এবং এর পথপ্রদর্শক স্তম্ভগুলোও স্পষ্ট। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্যে ইসলামকে দ্বীন (হিসেবে) মনোনীত করলাম” [আল-ক্বুরআন, ৫:৩; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله) প্রণীত ’তাফসীরে নূরুল এরফান]। দ্বীন-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো স্পষ্ট করা হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সিদ্ধান্তের সূত্রে এবং তাই মুসলমান ভাইদের মধ্যে মতপার্থক্য ও বিভেদের কোনো কারণ আর অবশিষ্ট নেই। সাহাবা-এ-কেরা্ম (رضي الله عنه) ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম এই নিয়ম-ই মেনে চলেছিলেন। নির্দিষ্ট কতগুলো প্রশ্নে অবশ্য মতপার্থক্য ছিল এবং সেগুলো (শরয়ী) উৎস-নিঃসৃত বিভিন্ন উপলব্ধি হতে উদ্ভূত হয়েছিল; এটা বোধগম্য হয় মহানবী (ﷺ)-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদীসের আলোকে, যেখানে তিনি এরশাদ ফরমান যে তাঁর উম্মতের মধ্যকার মতপার্থক্য আল্লাহতা’লারই রহমত বা করুণাবিশেষ [‘এখতেলাফু উম্মাতী রাহমাতুন্’]।
চার মযহাবের ইমামবৃন্দ যখন আবির্ভূত হন, তাঁরা তখন তাঁদের পূর্ববর্তীদের নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করেন এবং নিজেদের মযহাবের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেননি; কেউ তাঁদের (এজতেহাদী) সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হলে তাঁরা তাকে তাঁদের অনুসরণে বাধ্য করেননি। (চার মযহাবের) ইমামবৃন্দের কাছ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তাঁদের মধ্যে কেউ (এজতেহাদী) সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে বলতেন, “এটাই আমার জ্ঞান মোতাবেক। আমার এই ফায়সালার পরিপন্থী কোনো কিছু যদি তোমরা আল্লাহর ক্বুরআন বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ’তে খুঁজে পাও, তবে আমার কথা পরিত্যাগ করো।”
বর্ণিত আছে যে ইমাম মালেক (رحمة الله) তাঁর ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থটি সংকলন করলে খলীফা আল-মনসূর সেটার নকল (কপি) করিয়ে সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চান এবং সবার প্রতি অন্যান্য বই বাদ দিয়ে শুধু এ বইটাই পড়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার কথা খেয়াল করেন। কিন্তু ইমাম মালেক (رحمة الله) এতে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে তাঁর গ্রন্থটিতে মহানবী (ﷺ)-এর সমস্ত বর্ণনা সন্নিবেশিত হয়নি, আর পৃথিবীর বুকে অনেক উলামা ছড়িয়ে পড়ায় তাঁদের এমন অনেক বিষয় জানা আছে যা তাঁর জানা নেই এবং এমন অনেক হাদীস-ও তাঁদের জানা আছে যা তাঁর জানা নেই।
ইমামবৃন্দ মানুষকে দ্বীনের সাথে পরিচিত করাতে এবং হেদায়াত দিতে সর্বাত্মক প্রয়াস পেয়েছিলেন। মহানবী (ﷺ)-কে যেভাবে অনুকরণ-অনুসরণ করা হয়, সেভাবে তাঁরা হতে চাননি। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষ যাতে আল্লাহতা’লার আদেশ-নিষেধগুলো সম্পর্কে বোঝে। তাঁদের সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো:
Comments
Post a Comment