ইমাম ইবনে জাওজী (রহ.) এর বর্ণনায় ইয়াজিদ
ইমাম ইবনে জাওজী (রহ.) এর বর্ণনায় ইয়াজিদ।
মূলঃ ইমাম ইবনে জাওজী (রহ.)
অনুবাদ ও টীকাঃ আব্দুল্লাহ যােবায়ের।
(বঙ্গানুবাদঃ ইয়াজিদকে নিন্দা করার বৈধ্যতা বই থেকে কিছু অংশ তোলে ধরা করা হল)
ইয়াযিদ বন্দনার পরিণাম
ইমাম ইবনে জাওজী (রহ.) তাঁর রচিত গ্রন্থে বলেন,
আমি এখন ইয়াযিদের কিছু অবস্থা বর্ণনা করব। এছাড়া সে কীভাবে শাসনভার পেল, তার শাসনামলে যা যা ঘটেছে, তা আবু বকর ইবন আবিদ দুনয়া, ‘তাবাকাত' গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ ইবন সাদ, আবু জাফর ইবন জারির ও অন্যান্য ইমামগণ যা উল্লেখ করেছেন, তা থেকে সংক্ষেপে কিছুটা উল্লেখ করব, যাতে তার কাজকর্মের জন্য তাকে নিন্দা করা যে বৈধ, সেটা বুঝা যায়। এরপর ইয়াযিদের বন্দনা ও ওকালতিতে ঐ শায়খ আব্দুল মুগিস যেসব যুক্তি পেশ দেখিয়েছেন, সেগুলাে খণ্ডন করব। আসলে একজন মানুষ আরেকজনের কল্যাণকামী তখনই হয়, যখন তার প্রতি তার ভালােবাসা থাকে।
❏ সহিহ সূত্রে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
المرء مع من أحب
ব্যক্তি আখিরাতে তার সাথেই থাকবে, যাকে সে ভালােবাসে।
{ইমাম বুখারি, প্রাগুক্ত, কিতাব : আল আদব, বাব : আলামাতু হুব্বিল্লাহি তায়ালা। আব্দুল মুগিসের মতাে শায়খরা ইয়াযিদকে ভালােবাসে বলেই তার গুণকীর্তন করে দোষগুলাে ঢাকতে চায়। এজন্য নির্জলা মিথ্যা কথার আশ্রয় নিতেও তারা কুণ্ঠাবােধ করে না। এ হাদিসটি উল্লেখ করে ইমাম ইবনুল জাওযি বুঝাতে চেয়েছেন, যারা ইয়াযিদকে ভালােবাসে, তাদের হাশরও ইয়াযিদের সাথেই হবে।}
[ইমাম ইবনে জাওজী (রহ.) : ইয়াজিদকে নিন্দা করার বৈধতা]
ইয়াযিদ সম্পর্কে ইমাম আহমদ যা বলেছেন, তা লানতকেও ছাড়িয়ে গেছে।
❏ আমাদের জানিয়েছেন আবু বকর মুহাম্মদ ইবন আব্দুল বাকি আল বাযযায়, তিনি আবু ইসহাক আল বারমাকি থেকে, তিনি আবু বকর আব্দুল আযিয ইবন জাফর থেকে, তিনি বলেন, মিহনা ইবন ইয়াহইয়া আমাদেরকে বলেছেন,
"আমি একদিন ইমাম আহমদকে ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, 'এ তাে সেই লােক, যে মদিনায় এমন এমন করেছে। আমি বললাম, সে কী করেছে?' তিনি বললেন, “সে মদিনায় গুন্ডামী করেছে। আমি বললাম, আমরা কি তার থেকে হাদিস বর্ণনা করতে পারি?' তিনি বললেন, ইয়াযিদ থেকে হাদিস বর্ণনা করা যাবে না। এমনকি তার হাদিস লেখাও অনুচিত।' আমি বললাম, “সে যা করেছে, তখন তার সাথে কারা ছিল?' তিনি বললেন, ‘সিরিয়ার লােকজন। {ইবন তায়মিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া, ৩/৪১২ }
❏ কাযি আবু ইয়ালা মুহাম্মদ ইবনুল হুসাইন ইবনুল ফাররা তার ‘আল মুতামাদ ফিল উসুল' গ্রন্থে আবু জাফর আল আবকারী থেকে, তিনি আবু আলি আল হুসাইন ইবনুল জুনায়েদ থেকে তিনি আবু তালিব ইবন শিহাব আল আবকারি থেকে, তিনি আবু বকর মুহাম্মদ ইবনুল আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি সালিহ ইবন আহমদ ইবন হাম্বলকে বলতে শুনেছি,
"আমি একবার আমার আব্বা অর্থাৎ ইমাম আহমদকে বললাম, একদল লােক আমাদেরকে ইয়াযিদের মিত্র বলে মনে করে। তিনি বললেন, বাছা। ইয়াযিদের সাথে ইমানদার কেউ সম্পর্ক রাখতে পারে? আমি বললাম, তাহলে আপনি তাকে লানত দেন না কেন? তিনি বললেন, তুমি কবেই বা আমাকে কোনাে কিছুকে লানত দিতে দেখেছ? আল্লাহ স্বয়ং যাকে পবিত্র কুরআনে লানত দিয়েছেন, তাকে কেন লানত দেয়া হবে না? আমি বললাম, 'আল্লাহ তাঁর কিতাবের কোথায় ইয়াযিদকে লানত দিলেন?' তিনি তখন তিলাওয়াত করলেন,
فهل عسيتم إن توليتم أن تفسدوا في الأرض وتقطعوا أرحامكم أولئك الذين لعنهم الله فأصمهم وأعمى أبصارهم
তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত তােমরা যমিনে ফাসাদ করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরকেই লানত করেন আর বধির ও অন্ধ করেন। {সুরা মুহাম্মদ : ২২-২৩ ১৪.}
এরপর তিনি মন্তব্য করলেন, 'হত্যার চেয়েও জঘন্য কোনাে ফাসাদ আছে?
[ইমাম ইবনে জাওজী (রহ.) : ইয়াজিদকে নিন্দা করার বৈধতা]
মক্কায় ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)
হুসাইন (رضي الله عنه) পরিবার-পরিজন নিয়ে মক্কায় চলে গিয়েছিলেন। এদিকে কুফাবাসীরা তাকে তাদের কাছে যাবার জন্য তাগাদা দিতে লাগল। তারা বলল, আমরা এক লাখ লােক আপনার সাথে আছি।' ইউনুস ইবন আবু ইসহাক বলেন, কুফাবাসীরা যখন জানতে পারল যে, হুসাইন (رضي الله عنه) মক্কায় এসেছেন এবং ইয়াযিদের বাইয়াত গ্রহণ করেননি, তখন তাঁর কাছে তাদের একটি প্রতিনিধি দল গেল। সুলাইমান ইবন সারদ ও মুসাইয়্যাব ইবন নাজাবা চিঠি লিখলেন। এছাড়া মদিনার একদল গণ্যমান্য ব্যক্তিও তাকে নিজের নামে বাইয়াত করাতে এবং ইয়াযিদকে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তারা বলছিলেন, ‘আমরা লােকদের এমনভাবে রেখে এসেছি, যে তারা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা আশা করি আপনার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের হকের উপর জমায়েত করবেন; তারা যে অত্যাচার করছে, সেগুলাে থেকেও আপনার মাধ্যমে তাদেরকে নিবৃত্ত করাবেন। খিলাফতের জন্য আপনিই ইয়াযিদের চেয়ে বেশি হকদার। সে উম্মতের খিলাফত
জবরদখল করেছে, হত্যা করেছে উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে। তিনি মুসলিম ইবন আকিলকে ডেকে বললেন, কুফায় যাও। তাদের ভেতর ঐক্যবদ্ধতা দেখলে আমাকে চিঠি লিখে জানাবে। জীবনীকারগণ লিখেছেন, হুসাইন (رضي الله عنه) মুসলিমকে কুফায় পাঠালে এ খবর ইয়াযিদের কাছেও পৌঁছল। এরপর সে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদকে কুফার গভর্নর হিসেবে নিয়ােগ করল। ইয়াযিদ তার কাছে চিঠি লিখল, ‘আমি খবর পেলাম হুসাইন ইরাকের দিকে রওয়ানা হয়েছেন। তার উপর নজর রাখাে, সশস্ত্র সৈন্য প্রস্তুত রাখাে। সতর্ক থাকো। সন্দেহ হলে তাকে আটক করাে, অপবাদ দেয়া হলেও গ্রেফতার করাে।
এদিকে মুসলিম ইবন আকিল হুসাইন (رضي الله عنه)কে চিঠি লিখলেন, “তেরাে হাজার লােক আমার কাছে বাইয়াত করেছে। আপনি দ্রুত আসুন। হুসাইন (رضي الله عنه) কুফায় রওয়ানা হলেন। এদিকে উবায়দুল্লাহ ইবন ঠান হযরত মুসলিম ইবন আকিলকে পাকড়াও করে হত্যা করে ফেলল। ইতােমধ্যে কায়স ইবন মুসহিরকে হুসাইন (رضي الله عنه) মুসলিম ইবন আকিলের কাছে পাঠিয়েছিলেন। মুসলিমের মৃত্যুর খবর তখনও তার অজানা। উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ তাকে ধরে ফেলল। তাকে বলল, “লােকদের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যুকের ছেলে মিথ্যুক গালিগালাজ করাে। একথা বলে সে ইমাম হুসাইনকে বুঝিয়েছিল। কিন্তু কায়স বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে বললেন, “হে মানুষ! আমি হুসাইনকে উষর প্রান্তরে ছেড়ে এসেছি। তিনি তােমাদের কাছে সাহায্য কামনা করেছেন।' তখন উবায়দুল্লাহ তাকে হত্যা করার আদেশ দিল। তাকে দুর্গের চূড়া থেকে ফেলে দেয়া হলাে। এতেই তিনি ইন্তিকাল করেন। এদিকে মুসলিম ইবন আকিলের হত্যার সংবাদ হুসাইন (رضي الله عنه)'র কাছে পৌঁছল। তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন।
{হুসাইন রাদিয়াল্লাহু সে সময় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন এই মর্মে অন্য কোনাে বর্ণনা আমি ইতিহাসের বইগুলােতে পাইনি- অনুবাদক।}
তাঁর সাথে বানু আকিলের পাঁচজন সদস্য ছিল। তারা বলল, 'আপনি ফিরে যাবেন, অথচ আমাদের ভাই নিহত হয়েছে!' ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ঘােড়ার কাছে চলে আসলেন। এরপর বললেন, ‘তােমাদের চিঠিগুলাে না আসা পর্যন্ত আমি তােমাদের কাছে আসিনি।' তারা বলল, আমরা নিজেরাও বুঝিনি আমরা কী বলছি!' ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এরপর কারবালার দিকে ফিরে চললেন। তার সাথে তখন ৪৫ জন অশ্বারােহী আর প্রায় একশাে জন পদাতিক সঙ্গী ছিল। এরপর উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ উমর ইবন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাসকে সেনাপতি নিযুক্ত করল। সে এসে ডাকল, 'হুসাইন!' হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, 'হয় তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে, তাহলে আমি সীমান্ত এলাকায় অথবা যেখান থেকে এসেছি, সেখানে চলে যাব। নয়তাে ইয়াযিদের কাছে আমাকে নিয়ে যাবে।
{ইয়াযিদের কাছে নিয়ে যাবার কথা ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বলেছিলেন কি না, তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। উকবা ইবন সামআন মদিনা থেকে কারবালা পর্যন্ত হুসাইন (رضي الله عنه)'র সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি হুসাইন (رضي الله عنه)'র সবগুলাে ভাষণ শুনেছি। তিনি কখনাে ইয়াযিদের হাতে হাত রাখার কথা বলেন নি। মােটকথা, ইবন সামআনের মতে, হুসাইন (رضي الله عنه) বলেছিলেন, তাঁকে যেন মদিনায় ফিরে যেতে অথবা সীমান্ত এলাকাগুলাের কোনাে একটায় চলে যেতে দেয়া হয়। (ইবনুল আসির, প্রাগুক্ত, খ, ৩, পৃ. ৪১৩)।}
–––––––––––––––
উমর ইবন সাদ একথা উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদকে লিখে পাঠাল।
কিন্তু ইবন যিয়াদ তখন জবাব দিল যে, না। যতক্ষণ না তিনি আমার হাতে হাত না রাখেন, আমার তাতে কোনাে সম্মান নেই। তিনি যদি অস্বীকার করেন, তবে তার সাথে যুদ্ধ করবে। তিনি নিহত হলে ঘােড়দৌড় করিয়ে তার বুককে পদপিষ্ট করবে। তখন আবৃত্তি করবে,
ألان حين تعلقته حبالنا + يرجو الخلاص ولات حين مناص
সাবধান! যখন আমাদের ফাদ তাকে জড়িয়ে ধরেছে, তিনি তখন মুক্তির আশা করেছেন, অথচ বাঁচার আর সময় নেই।'
{কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)র অসহায় অবস্থা নিয়ে বিদ্রুপ করে দুরাত্মা ইবন যিয়াদ এ উক্তি করেছে। তার কবিতার মর্মার্থ হলাে, একবার যেহেতু মরুভূমিতে এসে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাদের ফাঁদে আটকা পড়েছেন, তিনি ফিরে যেতে চাইলেও আর যেতে দেয়া হবে না।}
–––––––––––––––––
কিন্তু হুসাইন (رضي الله عنه) সাফ জানিয়ে দিলেন, আমি কখনাে উবায়দুল্লাহর হাতে হাত রাখব না।'
তিনি সঙ্গীদেরকে বললেন, আজ রাতেই তােমরা অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়াে, আমাকে রেখে যাও।'
তারা বললেন, আপনার যা হবে, আমাদেরও তাই হবে। আল্লাহর কসম! সে পর্যন্ত আমরা আপনাকে ছেড়ে যাব না।'
এদিকে সৈন্যরা তাঁদের পানির মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াল। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তখন বললেন,
“হে আমার জাতি! আমাকে মেরে ফেলা কি তােমাদের শােভা পায়? আমার রক্ত কি তােমাদের জন্য বৈধ? আমি কি তােমাদের রসুলুল্লাহ (ﷺ)'র কন্যার পুত্র নই? আমি কি তার চাচাতাে ভাইয়ের পুত্র নই? এই দুজন জান্নাতবাসী যুবকদের নেতা’—আমি আর আমার ভাইয়ের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (ﷺ) এর এ বাণী কী তােমরা শােন নি? আমার কথা বিশ্বাস করলে ভালাে। নয়তাে তােমরা জাবির ইবন আব্দুল্লাহ, আবু সাঈদ, যায়দ ইবন আরকাম—এঁদেরকে জিজ্ঞেস করাে।'
তখন শিমার বলল, আমি দ্বিধা-সংশয় নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করি। আপনি কী বলছেন, তা যদি আমি বুঝতে পারতাম!' উমর ইবন সাদ সর্বপ্রথম হুসাইন (رضي الله عنه)'র বাহিনীর উপর তীর ছুড়ল। তখন আলি ইবন হুসাইন (رضي الله عنه) যুদ্ধ করতে বের হলেন। তিনি আবৃত্তি করছিলেন,
أنا علي بن الحسين بن علي نحن وبيت الله أولى بالنبي من شمر وعمر وابن الدعي
‘আমি আলি ইবন হুসাইন ইবন আলি। বায়তুল্লাহর কসম! আমরাই নবিজীর সবচেয়ে আপন
শিমার, উমর আর পিতৃপরিচয়হীন লােকটি কে এখানে?”
{অর্থাৎ শিমর ইবন যিল যওশন, উমর ইবন সাদ ও উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ এর মতাে
লােকদের স্থান কোথায়?}
এক লােক তাকে আঘাত করল। তিনি শহিদ হয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন আলি আল আকবর। হুসাইন (رضي الله عنه)র পরিবারের একটি ছেলে এসে তার কোলে বসল। এক লােকের ছােড়া তীরে সেই শিশুটিও শহিদ হলাে। হুসাইন (رضي الله عنه) পানি খাবার জন্য পানি আনতে বললেন। পানি নিয়ে আসা হলাে। তিনি পানের ইচ্ছা করা মাত্রই হাসিন ইবন নুমায়র তীর ছুড়ল। সেই তীর তাঁর চোয়ালে বিদ্ধ হলাে। তিনি সেই রক্ত অঞ্জলি ভরে হাতে নিলেন। এভাবে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহুর পরিবারের সবাইকেই শহিদ করা হলাে। পুরুষদের মধ্যে কেবল তিনি একাই অবশিষ্ট ছিলেন।
{হুসাইন (رضي الله عنه) একা একাই লড়াই করে যাচ্ছিলেন। শিমারসহ অশ্বারােহীর দল
চারদিক থেকে তাকে আক্রমণ করছিল। তিনি একাকী তরবারি চালাচ্ছিলেন। তাবারিসহ অন্যান্য ইতিহাসগ্রন্থে বলা হয়েছে, হিংস্র নেকড়ে আক্রমণে যেভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ছিল। সবশেষে শিমার সবাইকে একযােগে আক্রমণে
প্ররােচিত করে।}
অবশেষে ঘুরআহ ইবন শুরায়ক তার কাঁধে আঘাত হানল। আরেকজন আঘাত করল তার কাঁধের হাড়ের জোড়ায়। অবশেষে সিনান ইবন আনাস এসে তাঁর কণ্ঠার হাড়ে, এরপর তার বুকে বর্শাঘাত করল। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। তখন সে নেমে এসে হুসাইন (رضي الله عنه)কে জবাই করল, তার মাথা কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। কেউ কেউ বলেছেন, তার মাথা বিচ্ছিন্ন করেছিলেন খাওলা বিন ইয়াযিদ। তার শরীরে ৩৩ টি বর্শাঘাতের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল। তার কাপড়ে তীরের জন্যই ছিদ্র হয়েছিল ১১৯ টি। এরপর তারা ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)'র অস্ত্রশস্ত্র ও পরিধেয় বস্ত্রও নিয়ে নিয়েছিল। তার তরবারি কালাফিস আন নাহশি নিয়ে নেয়। বাহর ইবন কাব তার পাজামা খুলে নিয়ে তাকে বস্ত্রহীন করে ফেলে রাখে।
{এসব দুরাত্মা পাপিষ্টের উপর কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর লানত বর্ষিত হােক- অনুবাদক}
––––––––––––––––
কায়স ইবন আশআস তার জামা খুলে নেয়। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)'র পাগড়ি এবং ফাতিমা বিনত
হুসাইনের (মূল পােশাকের উপর পরিধেয় বাড়তি কাপড় জাবির ইবন ইয়ায়িদ ছিনিয়ে নেয়। আরেকজন ফাতিমা বিনত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহার অলঙ্কারগুলাে নিয়ে নেয়। এরপর উমর ইবন ইয়াযিদ ঘােষণা দিল, যে হুসাইনের মাথা নিয়ে আসবে, তাকে এক হাজার দিরহাম দেয়া হবে। সে আরও বলল, “কে ঘােড়া দিয়ে হুসাইনের লাশকে পদপিষ্ট করে আসবে? একদল লােক নিজেদের ঘােড়া নিয়ে এসে তার শরীরকে পদদলিত করে [মাটির সাথে মিশিয়ে দিল। উমর ইবন সাদ এবার হুসাইন (رضي الله عنه)'র মাথাকে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দিল। তার সাথে শিশু আর নারীদেরকেও বাহনে উঠানাে হলাে।
{তাঁদেরকে কুফায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।}
তাদের কাফেলা যখন শহিদদের লাশের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল, তখন যয়নব বিনত আলি চিৎকার করে বলে ওঠেন :
‘ও মুহাম্মদ! ও মুহাম্মদ! হুসাইন এই উন্মুক্ত প্রান্তরে ছিন্নভিন্ন রক্তস্নাত দেহে পড়ে আছে। ও মুহাম্মদ! আপনার কন্যারা আজ যুদ্ধবন্দি আর বংশধরেরা সবাই মৃত। তাঁদের উপর দিয়ে পূবালি বাতাস বয়ে চলেছে।
একথা শুনে শত্রু-মিত্র সবাই কেঁদে ফেলেছিল। কুফার অলিতে গলিতে হুসাইন (رضي الله عنه)'র মাথা প্রদক্ষিণ করানাে হলাে। এরপর ইবন যিয়াদ তাঁর মাথাকে (বর্শার ডগায়] বিদ্ধ করতে বলল। যর ইবন হুবায়শ বলেন, হুসাইনের মাথাই সর্বপ্রথম বর্শার ডগায় বিদ্ধ করা হয়।
❏ মুহাম্মদ ইবন সিরিন বর্ণনা করেন, আনাস ইবন মালিক (رضي الله عنه) বলেন, উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের কাছে হুসাইন (رضي الله عنه)'র মাথা এনে একটি পাত্রের উপর রাখা হলাে। এরপর সে তার সৌন্দর্যের ব্যাপারে মন্তব্য করল। তখন আনাস বললেন,
كان أشبههم برسول الله صلى الله عليه وسلم
‘আকৃতির দিক থেকে রসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে তার সাদৃশ্য ছিল সবচেয়ে বেশি।' হুসাইন (رضي الله عنه)'র (চুল-দাড়িতে) তখন ওয়াসমা দ্বারা কলপ লাগানাে ছিল।
{ইমাম বুখারি, প্রাগুক্ত, কিতাব : ফাদাউলু আসহাবিন নাবি (ﷺ), বাব : মানাকিবুল হাসান ওয়াল হুসাইন (رضي الله عنه)। }
––––––––––––––––
আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু রা: থেকে আরও বর্ণিত আছে, হুসাইনের মাথা এনে যখন একটি পাত্রের উপর রাখা হয়, তখন আমি ইবন যিয়াদকে দেখতেছিলাম। সে হাতের একটি ছড়ি দিয়ে তাঁর দাঁতের উপর খোঁচা দিতে লাগল বলতে লাগল, ইনি আসলেই অত্যন্ত সুপুরুষ।' আমি বললাম,
والله لأسوءنك لقد رأيت رسول الله صلى الله عليه وس موضع قضيبك من فيها
আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তােমাকে নিবৃত্ত করব। তাঁর মুখে যেখানে তুমি ছড়ি রেখেছ, আল্লাহর রসুলকে সেখানে চুমু দিতে দেখেছি আমি।৩৭
{ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, ফাদাইলুস সাহাবা, ফাদাইলুল হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহ}
মিরদাস তার বাবা থেকে এবং তিনি সাঈদ ইবন মুয়ায এবং আমর ইবন সাহল—এ দুজন থেকে বর্ণনা করেন, তারা দুজন উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের কাছে ছিল। তখন সে হাতের ছড়ি দিয়ে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাক ও দুচোখে খোচা দিল, তার মুখেও আঘাত করল। তখন যায়দ ইবন আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “তােমার ছড়ি সরিয়ে নাও। তুমি যেখানে ছড়ি রেখেছ, আমি সেখানে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর ঠোট রাখতে দেখেছি। ইবন যিয়াদ বলল, বুড়াে হয়ে তােমার ভীমরতি হয়েছে, মতিভ্রম হয়েছে।' যায়দ তখন বললেন, “তােমাকে অবশ্যই এমন একটি হাদিস শুনাব, যা তােমার জন্য এর চেয়েও দুঃসহ। আমি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, তিনি তাঁর ডান উরুর উপর হাসানকে এবং বাম উরুর উপর হুসাইনকে বসিয়েছেন। এরপর তাঁর হাত তাদের দুজনের মাথার উপর রেখে বলেছেন,
اللهم إني أستودعك إياهما وصالح المؤمنين
‘হে আল্লাহ। আমি তাদেরকে আপনার কাছে ও নেককার মুমিনদের কাছে সােপর্দ করছি।'
তােমার কাছে আল্লাহর রসুলের রেখে যাওয়া আমানতের কী অবস্থা করেছ? হিশাম ইবন মুহাম্মদ আযদের জনৈক শায়খের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, ইবন যিয়াদের কাছে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর কর্তিত শির এবং তার সাথে তার পরিবারবর্গ, সন্তান-সন্ততি আর বােনদেরকে নিয়ে আসা হলাে। যয়নব বিনত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহা তখন তাঁর সবচেয়ে মলিন পােশাক পরে ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। অন্য নারীরা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল। ইবন যিয়াদ বলল, ইনি কে? কিন্তু তিনি কোনাে প্রত্যুত্তর করলেন না। ইবন যিয়াদ একই প্রশ্ন তিনবার করল। তিনি একবারও জবাব দিলেন না। শেষপর্যন্ত জনৈক নারী বললেন, ইনি হলেন আলি ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা।
তখন ইবন যিয়াদ বলল, “আলহামদুলিল্লাহ। তিনি তােমাদের লাঞ্চিত হত্যা করেছেন এবং তােমাদের অতিশয়ােক্তি মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন। যয়নব রাদিয়াল্লাহু আনহা বলে উঠলেন, “আলহামদুলিল্লাহ। তিনি আমাদেরকে মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন, উত্তমভাবে আমাদের পবিত্র করেছেন। তুমি যা বলছ, তা ঠিক নয়। আল্লাহ তাকেই লাঞ্চিত করেন, যে পাপিষ্ঠ। আল্লাহ তাকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন, যে অপরাধী। ইবন যিয়াদ বলল, তােমাদের পরিবারের সাথে আল্লাহ কেমন ব্যবহার করেছেন তা তাে দেখলে। যয়নব বললেন, আল্লাহ তাদের জন্য নিহত হওয়া নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। এজন্য তারা তাদের বধ্যভূমিতে লড়াইয়ের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। আল্লাহ খুব দ্রুতই তাদের সাথে তােমাকে একত্রিত করবেন। এরপর তারা আল্লাহর কাছে তােমাকে নিয়ে বিচার দেবেন। হুমায়দ ইবন মুসলিম বলেন, উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ আমাদের উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছিল। তাতে সে বলেছিল,
‘আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি হককে এবং হকপন্থীদেরকে বিজয়ী করেছেন; যিনি আমিরুল মুমিনিন ও তার দলকে সাহায্য করেছেন এবং মিথ্যুকের ছেলে মিথ্যুককে সদলবলে হত্যা করেছেন।
একথা শুনে আব্দুল্লাহ ইবন আফিফ আল আযদি দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, “ওহে মারজানার পুত্র! মিথুকের বাচ্চা মিথুক হলাে তুমি নিজে, তােমার বাবা এবং যে তােমাকে গভর্নর বানিয়েছে।'
হাসান বসরির কাছে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পৌঁছলে তিনি কেঁদেছিলেন। কান্নার তােড়ে তাঁর দুকাধ কাঁপছিল। তিনি বলছিলেন, সেই উম্মতের জন্য লাঞ্ছনা! যে উম্মতের নবির সন্তানকে পিতৃপরিচয়হীন ব্যক্তি হত্যা করে।
{উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের পিতা যিয়াদের পিতৃপরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এজন্য তা যিয়াদ ইবন আবিহ নামে ডাকা হতাে। এদিক থেকে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের কে বংশ পরিচয় নেই।}
রাবি ইবন খাইসাম বললেন, 'তারা সেই শিশুটিকে হত্যা করেছেন, সফর থেকে ফিরলে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকে [বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতেন।
হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথা মােবারকের সাথে ইয়াযিদের ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণঃ
এরপর ইবন যিয়াদ যাহর ইবন কায়সকে ডেকে পাঠাল। হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সঙ্গীদের মাথাসহ তাকে ইয়াযিদের কাছে পাঠাল। এদিকে ইয়াযিদের কাছ থেকেও দূত আসল। ইয়াযিদ বলে পাঠিয়েছে, তার কাছে যেন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর অস্ত্রশস্ত্র এবং পরিবারের বেঁচে যাওয়া সদস্যদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। জামিল ইবন মুররা বর্ণনা করেছেন, আবুল ওয়াসানি বলেন, যে উটের পিঠে হুসাইন ও তাঁর সঙ্গীদের মাথা নিয়ে আসা হয়েছিল, সে উটটিকে আমরা জবাই করেছিলাম। কিন্তু সে গােশত কেউ খেতে পারেনি, সেটা ঘৃতকুমারীর চেয়েও তেতাে হয়ে গিয়েছিল।'
ইয়াযিদের কাছে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথা পৌঁছানাের পর সে আসন নিয়ে বসল। সিরিয়ার গণ্যমান্য লােকদের ডেকে এনে তার চারপাশে বসাল। এরপর তার সামনে তার মাথা রাখা হলাে। সে একটি ছড়ি দিয়ে তার মুখে খোচা মারছিল। সে আবৃত্তি করছিল,
نفلقن هاما من رجال أعزة + علينا وهم كانوا أعق وأظلما
‘[তরবারি] এমন লােকদের দ্বিখণ্ডিত করে, যারা আমাদের কাছে সম্মানের পাত্র যদিও তারা আরও বেশি অবাধ্য, আরও বেশি জালিম।'
আমাকে বলেছেন মুহাম্মদ ইবন নাসির, জাফর ইবন আহমদ ইবন সাররাজ, তিনি আবু তাহির মুহাম্মদ ইবন আলি ইবনুল আল্লাফ, তিনি আবুল হুসাইন ইবন আখি মিমি, তিনি হুসাইন ইবন সাফওয়ান, তিনি আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ ইবন আবিদ দুনয়া আল কুরাশি, তিনি মুহাম্মদ ইবন সালিহ, তিনি আলি ইবন মুহাম্মদ, তিনি খালিদ ইবন ইয়াযিদ ইবন বিশর আস সাকসাকি, তিনি তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, কাবিসা ইবন যুয়ায়ব আল খুযাঈ বলেন, হুসাইনের মাথা এসে পৌঁছানাের পর ইয়াযিদের সামনে এনে রাখা হলাে। তখন সে হাতের একটি ছড়ি দিয়ে তাতে আঘাত করল। বলল,
نفلقن هاما من رجال أعزة علينا وهم كانوا أعق وأظلما
[তরবারি] এমন লােকদের দ্বিখণ্ডিত করে, যারা আমাদের কাছে সম্মানের কাজ যদিও তারা আরও বেশি অবাধ্য, আরও বেশি জালিম।
ইবন আবিদ দুনয়া বর্ণনা করেছেন, যায়দ ইবন আরকাম নিজেই বলেছেন, “আমি ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়ার কাছে ছিলাম। তখন হুসাইন ইবন আলির মাথা নিয়ে আসা হলাে। সে তখন ছড়ি দিয়ে তার দুঠোটের উপর খোচা দিতে লাগল। সে তখন আবৃত্তি করছিল, ‘[তরবারি] এমন লােকদের দ্বিখণ্ডিত করে, যারা আমাদের কাছে সম্মানের পাত্র, যদিও তারা আরও বেশি অবাধ্য, আরও বেশি জালিম। আমি বললাম, তােমার লাঠি উঠাও। সে বলল, তুমি আমাকে নিষেধ করছ? আমি বললাম, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, তিনি ডান উরুর উপর হাসানকে এবং বাম উরুর উপর হুসাইনকে রেখেছেন। এরপর হাসানের মাথায় ডান হাত এবং হুসাইনের মাথায় বাম হাত রেখেছেন। তিনি বলছিলেন, হে আল্লাহ! আমি তাদেরকে আপনার কাছে ও নেককার মুমিনদের কাছে সােপর্দ করছি। ওহে ইয়াযিদ! আল্লাহর রসুলের আমানত তুমি কীভাবে সংরক্ষণ করলে? ইবন আবিদ দুনয়া বলেন, আমাকে বলেছেন আবুল ওয়ালিদ, তিনি খালিদ ইবন ইয়াযিদ ইবন আসাদ, তিনি আম্মার আদ দুহনি থেকে বর্ণনা করেন, আবু জাফর বলেছেন, হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথা ইয়াযিদের সামনে রাখা হয়েছিল। সেখানে আবু বারযা রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন। ইয়াযিদ তার ছড়ি দিয়ে তাঁর মুখে আঘাত করতে লাগল। সে আবৃত্তি করছিল, ‘[তরবারি] এমন লােকদের দ্বিখণ্ডিত করে, যারা আমাদের কাছে সম্মানের পাত্র, যদিও তারা আরও বেশি অবাধ্য, আরও বেশি জালিম।
{ইয়াযিদের এ ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ উল্লেখ করে ইমাম ইয়াফেঈ বলেছেন, “ইয়াযিদের এ কাজে
তার চরম ধর্মদ্রোহিতা ও পাপিষ্ঠতা স্পষ্ট বােঝা যায়।' (আবু মােহাম্মদ আল ইয়াফেঈ, প্রাগুক্ত, খ.১, পৃ.১০৮)}
তখন আবু বার বললেন, তােমার ছড়ি উঠাও। আল্লাহর কসম! আমি বারবার রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের মুখকে দেখেছি ঐ মুখকে চুমু খেতে। ইবন আবিদ দুনয়া বলেন, সালামা ইবন শুবায়ব, তিনি হুমায়দি, তিনি সুফয়ান, তিনি সালিম ইবন আবু হাফসা থেকে বর্ণনা করেন, হাসান বলেছেন, “রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে মুখ রাখতেন, সেই জায়গাটিকে ইয়াযিদ ছড়ি দিয়ে খোঁচা দিয়েছে এবং অপমানিত করেছে। সুফইয়ান বলেন, আমি শুনেছি, এ ঘটনার পর থেকে হাসিন আবৃত্তি করতেন,
سمية أضحى نسلها عدد الحصى + وليس لآل المصطفى اليوم من نسل
'সুমাইয়ার বংশধর বেড়েছে কঙ্করের সংখ্যায়
অথচ নবি পরিবারের আজ কোনাে বংশধর নেই।'
মজাহিদ বলেন, হুসাইন ইবন আলির মাথা এনে ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়ার সামনে রাখা হয়েছিল। এ অবস্থার সাথে তুলনা দিয়ে সে নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করল,
ليت أشياخي ببدر شهدوا + جزع الخزرج في وقع الأسل
فأهلوا واستهلوا فرحا + ثم قالوا لي هنيا لا تشل
বদরে নিহত হওয়া আমাদের পূর্বপুরুষেরা যদি দেখত
বর্শা পড়ার সময় খাযরাজদের আতঙ্ক। তাহলে তারা হর্ষধ্বনি করত, খুশিতে উজ্জ্বল হতাে মুখ এরপর আমাকে বলত, ‘খােশ আমদেদ! তুমি কর্মময় থাকো।
মুজাহিদ বলেন, ইয়াযিদ এখানে মুনাফেকি করেছে। আল্লাহর কসম! আবারও আল্লাহর কসম করে বলছি, তার বাহিনীর প্রত্যেকেই তাকে পরিত্যাগ করেছিল। অর্থাৎ তাকে ভৎসনা করেছিল, সমালােচনা করেছিল। আমি বলছি, এ লাইনগুলাে ইবনুয যাবারির লেখা :
ليت أشياخي ببدر شهدوا + جزع الخزرج في وقع الأسل
حين حگت بقباء بركها + واستحر القتل في عبد الأشل وقتلنا الضعف من أشرافكم + وعدلنا ميل بذر فاعتدل
'বদরে নিহত হওয়া আমাদের পূর্বপুরুষেরা যদি দেখত
বর্শাবৃষ্টির সময় খাযরাজদের আতঙ্ক। যখন কোবাতে তাদের উট যমিনে বুক লাগিয়ে বসেছিল আর
আবদুল আশহালে চলছিল হত্যাযজ্ঞ।
আমরা তােমাদের দ্বিগুণ সম্রান্তকে হত্যা করেছি। আর বদরের ঝোকানাে পাল্লাকে সমান সমান করে দিয়েছি.'
এ কবিতার প্রেক্ষাপট হলাে, মুসলিমরা বদরের দিন কাফিরদের অনেককে হত্যা করেছিলেন। আবার কাফিররা উহুদের যুদ্ধে অনেক মুসলমানকে হত্যা করেছিল। তাই ইয়াযিদ এই কবিতাকে প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃতি দিয়েছিল। সে কবিতার কিছু শব্দ পরিবর্তন করেছিল। এই উদ্ধৃতি দেয়া তার লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবার জন্য যথেষ্ট।
(এ কবিতাটি ইবন আসাকিরসহ অনেকেই উল্লেখ করেছেন। ইবন কাসির বলেছেন, ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়া যদি এ কথা বলেই থাকে, তবে তার উপর আল্লাহর লানত এবং সমস্ত লানতদাতার লানত। আর যদি সে এটা না বলে থাকে, তবে যে একথা বানিয়েছে তার উপরই আল্লাহর লানত। }
ইয়াযিদের চরিত্র-বিচারঃ
ইয়াযিদের কাছে এরপর আলি ইবন হুসাইনসহ নারী ও শিশুদের ডেকে আনা হলাে। তাদেরকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তাদেরকে যখন ইয়াযিদের সামনে আনা হলাে, আলি ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “ওহে ইয়াযিদ! রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তােমার কী ধারণা? তিনি যদি আমাদের এভাবে বাঁধা দেখতেন, তাহলে কি আমাদের প্রতি দয়াপরবশ হতেন না?' তখন ইয়াযিদ বলল, ‘আলি! তােমার বাবাই তাে আমার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আমার সাথে শাসনক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। এরপর আল্লাহ তাকে নিয়ে যা করেছেন, তা তাে দেখেছ। তখন সিরিয়াবাসীর এক লােক দাঁড়িয়ে বলল, “হে আমিরুল মুমিনিন! এই মেয়েটিকে আমাকে দিন। সে ফাতিমা বিনত আলিকে বুঝিয়েছিল। ফাতিমা উজ্জ্বল বর্ণের তরুণী ছিলেন। তিনি ভয়ে কেঁপে উঠে বােন যয়নবের কাপড় আঁকড়ে ধরলেন। তিনি ভেবেছিলেন, তারা বােধ হয় সত্যিই এটা করে ফেলবে। তখন যয়নব বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি মিথ্যা বলেছ। তােমার বা ইয়াযিদের কারােরই এটা করার অধিকার নেই। একথা শুনে ইয়াযিদ রেগে গেল। সে বলল, তুমি মিথ্যা বলছ। আমার এমন অধিকার আছে। আমি সেটা করতে চাইলে করতে পারি।' যয়নব বললেন, ‘কখনো না। আল্লাহর কসম! এটা তােমার জন্য কখনই বৈধ নয়। তবে তুমি যদি আমাদের ধর্ম থেকে বেরিয়ে যাও অথবা নতুন কোনাে ধর্মে দীক্ষিত হও, তবে ভিন্ন কথা!' এরপর তাঁদের সবাইকে মদিনায় পাঠিয়ে দেয়া হলাে। হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথা আমর ইবন সাঈদ ইবনুল আসের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। সে ছিল মদিনায় ইয়াযিদের গভর্নর। সে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথা গ্রহণ করেছিল। তার মাথা আমর ইবন সাঈদের সামনে রাখা হলে সে তাঁর নাকের বাঁশি স্পর্শ করেছিল।
এরপর তার আদেশে তার মাথা কাফন দিয়ে তার মা ফাতিমা বাদিয়াল্লাহু আনহার কবরের পাশে দাফন করা হয়। মুহাম্মদ ইবন সাদ এমনটাই বলেছেন।
উসমান ইবন আব্দুর রহমান ও মুহাম্মদ ইবন উমর ইবন সালিহের সূত্রে ইবন আবিদ দুনয়া বর্ণনা করেছেন, ইয়াযিদের কোষাগারে তারা হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথা খুঁজে পেয়েছিলেন। এরপর তারা সেটিকে কাফন দিয়ে দামেস্কের বাবুল ফারাদিস নামক স্থানে দাফন করেছিলেন। মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে এই উসমান ও মুহাম্মদ নির্ভরযােগ্য কেউ নন। তাই প্রথম মতটিই বেশি বিশুদ্ধ। আবু জাফর বলেন, বন্দীরা যখন মদিনায় পৌঁছলেন, তখন আব্দুল মুত্তালিবের বংশীয় এক নারী কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসলেন। তাঁর চুল ছিল খােলা, জামার আস্তিন ছিল মাথার উপর রাখা। তিনি বন্দিদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি আবৃত্তি করছিলেন,
ماذا تقولون إن قال النبي لكم + ماذا فعلتم وأنتم آخر الأمم بعثرتي وبأهلي بعد مفقدتي + منهم أساری وقتلى ضرجوا بدم ما كان هذا جزائي إذ تصحت لكم + أن تخلفوني بسوء في ذوي رحمی
‘কী জবাব দেবে? নবিজী যদি তােমাদেরকে বলেন,
সর্বশেষ উম্মত হয়েও তােমরা করেছ কী— আমার বংশধর আর পরিবারের সাথে আমি চলে যাবার পর।
তারা কেউ বন্দী আর কেউ নিহত রক্তে রঞ্জিত। তােমাদের যখন উপদেশ দিয়েছিলাম, তার প্রতিদান তাে এটা নয় যে, আমার পরে আমার আত্মীয়দের সাথে খারাপ আচরণ করবে।'
ইবরাহিম আন নাখঈ বলেছেন, যারা হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যায় সমর্থন দিয়েছে, আমি যদি তাদের মধ্যে থাকতাম আর এরপর আমাকে বলা হতাে, ‘জান্নাতে ঢােকো’; তবুও আমি কৃতকর্মের জন্য রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুখ দেখাতে লজ্জাবােধ করতাম। ইবন আবিদ দুনয়া উল্লেখ করেছেন, “উম্মু সালামার কাছে যখন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পৌঁছল, তখন তিনি কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘ওরা তাঁকে হত্যা করেছে! আল্লাহ ওদের কবর আর ঘরগুলােকে আগুনে পিরপূর্ণ করে দিন। একথা বলেই তিনি মূৰ্ছিত হয়ে পড়েন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি একদিন দুপুরবেলা মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখলাম। তাঁর চুলদাড়ি এলােমেলাে, ধুলােমলিন; হাতে একটি বােতল। বললাম, এই বােতল কিসের?' তিনি বললেন, হুসাইন ও তাঁর সঙ্গীদের রক্ত আছে এই বােতলে। আজই আমি এগুলাে সংগ্রহ করলাম। দেখা গেল ঐদিনই হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু শহিদ হয়েছিলেন। আমি বলি,” উমর ইবন সাদ ও উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ যা করেছে, তা আর্শ্চযপর বিষয় নয়।
{অর্থাৎ ইমাম ইবনুল জাওযি}
আশ্চর্যজনক হলাে ইয়াযিদের কর্মকাণ্ড। সে অসদুদ্দেশ্য সাধনের (হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথাকে অপমানিত করেছিল, ছড়ি দিয়ে তার সামনের দাঁতে খোচা দিয়েছিল এবং এরপর দাফন-কাফন না করেই) মদিনায় ফিরিয়ে দিয়েছিল। খারেজিদের সঙ্গেও কি এমন আচরণ করা জায়েয? শরিয়াত
অনুসারে কি তাদের জানাযা পড়ে দাফন করার কথা ছিল না? এছাড়া সে বলেছিল, আমার অধিকার আছে তাদেরকে বন্দী করার।' এটা এমন একটি কাজ, যার কর্তা আর যাতে বিশ্বাসীর উপর লানত ছাড়া আর কিছুই সাজে না। সে যদি হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথা তার কাছে আসার পর যথাযথ সম্মান করত, যদি থালার উপর ফেলে না রাখত, যদি ছড়ি দিয়ে খোচা না দিত, তবুও তার কোনাে ক্ষতি হতাে না। হত্যা করার যে উদ্দেশ্য তার ছিল, তা তাে পূর্ণ হয়েই গিয়েছিল। আসলে তার জাহেলি বিদ্বেষই ছিল এসবের কারণ। তার আবৃত্তি করা পূর্বোক্ত কবিতাটিই এর প্রমাণ :
'বদরে নিহত হওয়া আমাদের পূর্বপুরুষেরা যদি দেখত
বর্শা পড়ার সময় খাযরাজদের আতঙ্ক। তাহলে তারা হর্ষধ্বনি করত, খুশিতে উজ্জ্বল হতাে মুখ এরপর আমাকে বলত, “খােশ আমদেদ! তুমি কর্মময় থাকো।'
ইয়াযিদের হাতে বাইয়াতে মদিনাবাসীর অস্বীকৃতিঃ
৬২ হিজরি শুরু হবার পর ইয়াযিদ মদিনার গভর্নর হিসেবে উসমান ইবন মুহাম্মদ ইবন আবু সুফিয়ানকে নিযুক্ত করে। উসমান ইয়াযিদের কাছে মদিনা থেকে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল। সেই প্রতিনিধি দল ফিরে এসে মদিনার ব্যাপারে ইয়াযিদের বিদ্বেষ ফাস করে দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, ‘আমরা এমন এক লােকের কাছ থেকে এসেছি, যার কোনাে ধার্মিকতা নেই; সে মদ খায়, তাম্বুরা বাজায় আর কুকুর নিয়ে খেলা করে। তােমাদের সাক্ষ্য রেখে বলছি, আমরা অর্থাৎ মদিনাবাসী তার বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করছি।'
মুনযির বললেন,
{আবু উসমান মুনযির ইবন যুবায়র ইবন আওয়াম ইবন খুয়াইলিদ। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র রাদিয়াল্লাহু আনহুমার ভাই। তিনি কন্সট্যান্টিনােপলের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ৬৪ হিজরিতে যখন আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়রকে অবরুদ্ধ করা হয়, তখন তাঁকে সাহায্য করার জন্য মক্কায় ছুটে এসেছিলেন। সে সময়েই তার কন্যা ফাতিমাসহ তিনি শহিদ হন}
‘আল্লাহর কসম! সে আমাকে এক লাখ দিরহাম উপহার দিয়েছে। কিন্তু আমাকে যা দেয়া হয়েছে, সেটা তােমাদের কাছে সত্য বলতে আমাকে বাধা দেবে না। আল্লাহর কসম! সে মদ খায় এবং এমন মাতাল হয় যে সালাতও ছেড়ে দেয়।' এরপর মদিনাবাসী ফেরেশতাদের হাতে গােসলকৃত হানযালা রাদিয়াল্লাহু আনহুর পুত্র আব্দুল্লাহর হাতে বাইয়াত হন এবং ইয়াযিদের গভর্নর উসমান ইবন মুহাম্মদকে বহিষ্কার করেন। হানযালা রাদিয়াল্লাহু আনহুর পুত্র তখন বলছিলেন,
“হে আমার গােত্র! আল্লাহর শপথ করে বলছি, আকাশ থেকে আমাদের উপর পাথর ছােড়া হবে—এই আশঙ্কা না হওয়া পর্যন্ত আমরা ইয়াযিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিনি। এই লােকটি মা-মেয়ে-বােনের সাথে বিয়ে করে, মদ খায়, সালাত পরিত্যাগ করে। আল্লাহর কসম! একটা মানুষও যদি আমার সাথে না থাকত, তবুও আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে একাকী বীরত্ব দেখাতাম। আব্দুল্লাহ ইবন আমর একজন নির্ভরযােগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। তিনি বলেছেন মদিনাবাসী মিম্বরের কাছে একত্রিত হয়ে ইয়াযিদের বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবন আবু আমর ইবন হাফস আল মাখযুমি বলেছিলেন, ‘আমি যেভাবে আমার পাগড়ি খুলে ফেললাম, ঠিক সেভাবে ইয়াযিদের বাইয়াতও প্রত্যাখ্যান করলাম। তিনি এরপর পাগড়িটি মাথা থেকে ছুঁড়ে ফেলেন। বলেন, ‘সে আমার সাথে ভালাে সম্পর্ক রেখেছে, আমাকে ভালাে ভালাে উপহার দিয়েছে। কিন্তু সে আল্লাহর শত্রু; হদ্দ মাতাল।
এই খবর ইয়াযিদের কাছে পৌছানাের পর সে মুসলিম ইবন উকবাকে ডেকে পাঠাল। বলল, মদিনাবাসীকে তিনবার [আনুগত্যের জন্য] আহ্বান জানিয়ে দেখবে তারা সাড়া দেয় কিনা। নতুবা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। যখন তােমরা বিজয় লাভ করবে, তখন তিনদিনের জন্য মদিনায় যত অর্থসম্পদ, অস্ত্রশস্ত্র অথবা খাদ্য যাকিছু আছে, সেনাবাহিনীর জন্য [লুটপাট] বৈধ করে দেবে। তিনদিন পার হবার পর বিরত হবে।
মুসলিম ইবন উকবা তিনদিনের জন্য মদিনাকে বৈধ করে দিয়েছিল। সৈন্যরা পুরুষদের হত্যা করেছিল, মালামাল লুটপাট করেছিল, চড়াও হয়েছিল নারীদের উপর। জনৈক নারী মুসলিম ইবন উকবার কাছে তার পুত্রকে নিয়ে সুপারিশ করেছিলেন। সে সৈন্যদের হাতে বন্দী হয়েছিল। মুসলিম একথা শুনে বলল, “ও তাহলে বন্দী হয়েছে! তােমরা দ্রুত করাে।' তখন ছেলেটির শিরােচ্ছেদ করে ফেলা হলাে। এরপর মুসলিম ইবন উকবা সবাইকে ইয়াযিদের প্রতি বাইয়াতে ডাকল। সে বলল, তােমরা এই মর্মে বাইয়াত করাে যে, তােমরা ইয়াযিদের দাস এবং তােমাদের ধনসম্পদও ইয়াযিদের। তখন ইয়াযিদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন যামআহ বললেন, আমরা আল্লাহর কিতাবে বাইয়াত করেছি। তখন মুসলিম ইবন উকবা তাকে হত্যার আদেশ দিল। তার শিরােচ্ছেদ করা হলাে। সাঈদ ইবন মুসাইয়্যিবকেও মুসলিম ইবন উকবার কাছে ধরে নিয়ে আসা হলাে। তারা বলল, বাইয়াত করাে।' তিনি বললেন, আমি আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মতাদর্শে বাইয়াত করছি। মুসলিম তাঁকেও শিরােচ্ছেদের আদেশ দিয়ে দিল। এক লােক বলল, “এর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। তখন তাকে ছেড়ে দেয়া হলাে।
মুহাম্মদ ইবন সাদ তার ‘আত তাবাকাত' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, মারওয়ান ইবন সকাম মদিনাবাসীর বিরুদ্ধে [যুদ্ধ করতে] মুসলিম ইবন উকবাকে উৎসাহ দিয়েছিল। এমনকি সে মুসলিমকে সাহায্য করার জন্য তার সাথে মদিনাবাসীর কাছে এসেছিল। শেষপর্যন্ত তারা বিজয়ী হয়ে মদিনায় গুণ্ডামি করে এবং তিনদিনের জন্য মদিনাকে [লুটপাট, খুন ও ধর্ষণের জন্য] বৈধ করে দেয়। পরবর্তীতে ইয়াযিদের কাছে গেলে সে মারওয়ানের এই কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল এবং তাকে নিজের কাছের লােকদের মধ্যে স্থান দিয়েছিল। মাদাইনি ‘আল হাররা' নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যুহরি বলেছেন, হাররার দিনে সাতশাে গণ্যমান্য কুরায়শ, আনসার ও মুহাজির এবং মুক্তিপ্রাপ্ত দাস নিহত হয়েছিলেন। এছাড়া স্বাধীন নারী-পুরুষ ও দাসদের মধ্য থেকে আরও অজ্ঞাত পরিচয় দশ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন। আমাদেরকে জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইবন নাসির, তিনি মুবারক ইবন আব্দুল জাব্বার, তিনি আবুল হাসান মুহাম্মদ ইবন আব্দুল ওয়াহিদ, তিনি আবু বকর আহমদ ইবন ইবরাহিম ইবন শাযান, তিনি আহমদ ইবন শায়বাহ আল বাযযায, তিনি আহমদ ইবন হারিস আল খাযযায, তিনি আবুল হাসান আল মাদাইনি, তিনি আবু আব্দুর রহমান আল কুরাশি, তিনি খালিদ থেকে বর্ণনা করেন, আমতাম উম্মুল হাইসাম বিনত ইয়াযিদ বলেছেন, 'আমি একজন কুরায়শ গােত্রের নারীকে দেখলাম তাওয়াফ করছেন। হঠাৎ একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি তার কাছে আসতেই তিনি তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমাে খেলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর বান্দী! এই কৃষ্ণাঙ্গ লােকটির সাথে এমন করলেন? তিনি বললেন, এ আমার ছেলে। হাররার দিন এর পিতা আমার উপর চড়াও হয়েছিল। এরপর আমি তাকে জন্ম দিয়েছিলাম।
{অথাৎ সেই নারীরা বলাৎকারের শিকার হয়েছিলেন এবং অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।}
মাদাইনি আবু কুররা থেকে বর্ণনা করেন, হিশাম ইবন হাসসান বলেছেন, হাররার দিনের পর মদিনার এক হাজার কুমারী নারী সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন।৪৪
{৪৪. হাররার ঘটনা মানবেতিহাসের পৈশাচিক গণহত্যাগুলাের একটি। তিনদিনের মধ্যে ইয়াযিদের
গহনা ১০,০০০ মুসলিমকে হত্যা করেছিল। মুসলিমদের রক্তে মদিনার রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। মসজিদে নববিকে সৈন্যবাহিনীর আস্তাবলে পরিণত করা হয়েছিল। পরবতীতে ধর্ষণের শিকার ১০০০ নারী অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।}
আমি বলি, যে ব্যক্তি কোনাে বিস্ময়কর ঘটনা দেখতে চায়, সে যেন হাররার দিনে মদিনাবাসীর অবস্থা দেখে, ইয়াযিদ তখন সৈন্যদেরকে লুটপাটে ছেড়ে দিয়েছিল।
এ বিষয়ে একটি গ্রন্থ আমাদের শায়খ আবুল ফযল ইবন নাসিরের কাছ থেকে শুনেছি, সেটা একাধিক খণ্ডের।
{মুহাম্মদ ইবন নাসির ইবন মুহাম্মদ ইবন আলি আস সাল্লামি আল বাগদাদি। বিভিন্ন শাস্ত্রে সমুদ্রতুল্য জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। ইবনুল জাওযি র. নিজেই বলেছেন, 'আমি তার কাছে ত্রিশ বছর ছিলাম। তাঁর কাছ থেকে যেভাবে জ্ঞানার্জন করতে পেরেছি, অন্য কারও কাছ থেকে তেমন পারিনি। এই মহান শায়খ ৫৫০ হিজরিতে ইন্তিকাল করেন।}
আমরা দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছি না। তিনি বলেছেন, আমাকে ইবনুল হুসাইন বলেছেন, তিনি ইবনুল মাযহাব ভিe আহমদ ইবন জাফর, তিনি আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, তিনি উবাই, তিনি আনাস ইবন ইয়ায, তিনি ইয়াযিদ ইবন খুসাইফা, তিনি আতা ইবন ইয়াসার থেকে এবং তিনি সাইব ইবন খাল্লাদ থেকে বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
أهلَ الْمَدِينَةِ فَلَمّا أحَاقَهُ اللَّهُ وَعَلَيْه لَعَنَ الله والملايكة مَن أحَاف وَالنَّاس أَجْمَعِينَ لا يَقبَلَ اللَّهُ مِنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صرفا وَلا عَدّلا
‘যে মদিনাবাসীকে অন্যায়ভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত করবে, আল্লাহ স্বয়ং তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করবেন। তার উপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা এবং সমগ্র মানবমণ্ডলীর লানত। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কাছ থেকে কোনাে ফরজ বা নফল ইবাদত কবুল করবেন না।'
{ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, আল মুসনাদ, মুসনাদুল আশারাতিল মুবাশশিরিনা বিল জান্নাহ,
মুসনাদুল মাদানিয়্যিন রাদিয়াল্লাহু আনহুম, হাদিসুস সায়িব ইবন খাল্লাদ।}
আমাদেরকে বলেছেন আব্দুল আউয়াল, তিনি দাওয়ারদি, তিনি ইবন আয়ান, তিনি আযবাযি, তিনি বুখারি, তিনি হুসাইন ইবন হুরাইস, তিনি ফযল ইবন জুয়াইদ, তিনি আঈশা এবং তিনি সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, আমি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
لأيكيد أهل المدينة أحد إلآ انماع كما ينماع الملح في الماء
‘যে মদিনাবাসীর সাথে ষড়যন্ত্র বা প্রতারণা করবে, সে লবণ যেভাবে পানিতে গলে যায়, সেভাবে গলে যাবে।
{ইমাম বুখারি, প্রাগুক্ত, কিতাব : ফাদাইলুল মাদিনা, বাব : ইসমু মান কাদা আহলাল মাদিনা।}
একই অর্থে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন,
ولا يريد أحد أهل المدينة بسوء إلا أذابه الله في النار دؤب الرصاص أو ذوب الملح في الماء
‘যে মদিনাবাসীর ক্ষতি করার ইচ্ছা করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে আগুনে গলিয়ে ফেলবেন, যেভাবে তাতে সিসা গলে যায় অথবা পানিতে লবণ গলে যায়।
{ইমাম মুসলিম, প্রাগুক্ত, কিতাব : আল হাজ্জ, বাব : ফাদলুল মাদিনাতি ওয়া দুআউন নাবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিহা বিল বারাকা}
ইমাম মুসলিম আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে আল্লাহ! আপনি মদিনাবাসীর ‘মুদ’
এ বরকত দিন। তিনি আরও বলেছেন,
من أراد أهلها بسوء أذابه الله ما يذوب الملح في الماء
মদিনাবাসীর ক্ষতি করতে চাইবে, লবণ যেভাবে পানিতে গলে যায়, আল্লাহ ঠিক সেভাবেই তাকে গলিয়ে দেবেন।
{ মুসলিম, প্রাগুক্ত, কিতাব : আল হাজ্জ, বাব : মান আরাদা আহলাল মাদিনাতি বিসুইন আযাবাহুল্লাহ।}
এই নির্বোধ প্রতিপক্ষের ধারণা মদিনাবাসীকে যারা আক্ষরিক অর্থে ভয় দেখাবে, হাদিসে কেবল তারাই উদ্দেশ্য। হাদিসের যে অর্থ এই লোেক শিখেছে, নিঃসন্দেহে এই অর্থ ইমাম আহমদের কাছেও অজানা ছিল। এজন্যই তিনি বলেছিলেন, সে কি মদিনাবাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করেনি?” [আব্দুল মুগিস ছাড়া] অন্য কারও জানা ছিল যে, মদিনাবাসীকে এভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত করা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। যদিও ধরে নেয়া হয় যে, ইয়াযিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য মদিনাবাসীকে ভয় দেখানাে বৈধ (অবশ্য এক্ষেত্রে আমাদের দ্বিমত আছে), তবুও কি মদিনাকে তিনদিন লুটপাট ও নৈরাজ্যের জন্য] হালাল করে দেয়া জায়েয? আমরা আগেই বলেছি যে, সে নিজেই এ কাজের আদেশ দিয়েছিল। এরপর যা ঘটেছে সেজন্য কি সে আনন্দিত হয়নি? উপরন্তু সে এজন্য মারওয়ান ইবন হাকামকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। এ বিষয়ে আগেই আমরা আলােচনা করেছি। এই অপরাধ থেকে তাকে মাফ করা তাে আরও বড় অপরাধ।
হাররার ঘটনা ও ইবন উকবার মৃত্যুঃ
হাররার ঘটনা ঘটেছিল ৬৩ হিজরির ২৮ যিলহজ্জ বুধবারে। ৬৪ হিজরি যখন শুরু হলাে, মুসলিম ইবন উকবা ততক্ষণে মদিনাবাসীকে হত্যার কাজ সেরে ফেলেছিল। তার সৈন্যরাও মদিনাবাসীর মালামাল লুটপাট সমাধা করে ফেলেছিল। এরপর মুসরিফ আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সাথে যুদ্ধ করার জন্য মক্কায় রওয়ানা হলাে।
{মদীনায় লুটপাট করার জন্য মুসলিম ইবন উকবাকে অনেকেই মুসরিফ’ নাম দিয়েছিলেন। মুসরিফ' অর্থ সীমালঙ্ঘনকারী।}
কিন্তু পথিমধ্যে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মদিনায় সংঘটিত লুটপাট আর তার মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র কয়েক দিনের। লবণ যেভাবে পানির মধ্যে গলে যায়, সেও ঠিক সেভাবে গলে গিয়েছিল। নির্বুদ্ধিতার চূড়ান্ত দেখিয়ে সে মৃত্যুর সময় বলেছিল, হে আল্লাহ! লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে সাক্ষ্য দেয়ার পর থেকে মদিনাবাসীকে হত্যার চেয়ে প্রিয় কোনাে কাজ আমি করিনি। এরপরও জাহান্নামে গেলে আমি নিশ্চই হতভাগা।। এরপর সে হুসাইন ইবন নুমাইর আস সুকুনিকে ডাকল। তাকে বলল, আমিরুল মুমিনিন আমার পর তােমাকে দায়িত্বভার দিয়েছেন। দ্রুত রওয়ানা হও। ইবন যুবায়রকে তিনদিনের বেশি সময় দেবে না; এর মধ্যেই তাঁর কাজ সেরে ফেলবে। হুসাইন ইবন নুমাইর এরপর মক্কায় গিয়ে ইবন যুবায়র রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে অবরােধ করে। এ অবরােধ চৌষট্টি দিন স্থায়ী হয়েছিল। ভয়াবহ যুদ্ধ চলেছিল এ কদিন। ৩ রবিউল আউয়াল, শনিবার কাবা’র উপর কামান দাগা হলাে। এক সৈন্য বর্শার ডগায় এক টুকরাে জ্বলন্ত অঙ্গার রেখেছিল। সেটা বাতাসে উড়ে গিয়ে কাবায় আগুন ধরিয়ে দিল। এদিকে মক্কাবাসীর কাছেও রবিউল আউয়াল মাস বাকি থাকতে থাকতে ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়ার মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছল। হাররার ঘটনা ও তার মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র তিন মাসের। মদিনাবাসীর যারা অকল্যাণ চায় তাদের ক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে বাণী উল্লেখ করেছি, ঠিক সেভাবেই সে আগুনে সিসার গলে যাবার মতাে গলে গিয়েছিল।
{লেখক পূর্বোক্ত হাদিসের দিকে ইঙ্গিত করেছেন
لأيكيد أهل المدينة أحد إلآ انماع كما ينماع الملح في الماء
যে মদিনাবাসীর সাথে ষড়যন্ত্র বা প্রতারণা করবে, সে লবণ যেভাবে পানিতে গলে যায়, সেভাবে গলে যাবে।' (ইমাম বুখারি, প্রাগুক্ত, কিতাব : ফাদাইলুল মাদনা, বাব : ইসমু মান কাদা আহলাল মাদিনা)}
{আল্লামা ইবনুল জাওযি রচিত ‘আল মুনতাযাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম'। গ্রন্থটি তার দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ থেকে ১৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ।}
__________ সমাপ্ত __________
Comments
Post a Comment