শানে মুস্তফা (ﷺ) ও সুন্নী আকিদা

কিতাবঃ

শানে মুস্তফা (ﷺ) ও সুন্নী আকিদা

গ্রন্থনা ও সংকলনে

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খুরশীদ আলম (অবঃ)

সম্পাদনায়

মুফ্তি মাওলানা আলাউদ্দিন জিহাদী

প্রকাশনায়

আবতাহী ফাউন্ডেশন প্রকাশনা বিভাগ

টেক্সট রেডীঃ

মাসুম বিল্লাহ সানি

লেখক কর্তৃক সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত

প্রকাশকালঃ

২০ নভেম্বর ২০১৬

কম্পিউটার কম্পোজঃ

সৈয়দ আমিরুল হক

জনি ঘোষ

ডিজাইনঃ

মুহাম্মদ মাহাদী হাসান তুহিন

মোবাইল: ০১৮ ২৫৩৩ ৯৪৯৪

মূদ্রণঃ

জয়নাব প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজেস্

২০৩/২, ফকিরাপুল, মতিঝিল, ঢাকা।

মোবাইল: ০১৭১১১৭৬৭২৩

শুভেচ্ছা মূল্যঃ ১৬০/- (একশত ষাট টাকা) মাত্র।

উৎসর্গ

অলীয়ে কামেল, হাদীয়ে আগা, কুতুবুজ্জামান, আশেকে রাসূল (ﷺ), ঢাকার নিকুঞ্জস্থ (টানপাড়া) মকিমীয়া মোজাদ্দেদীয়া দরবার শরীফের পীর সাহেব কেবলা ও আমার মহান মুরশিদ শাহ সূফী হযরত মাওলানা শেখ আবদুস সালাম ফরিদপুরী নকশ্বন্দী মোজাদ্দেদী (মাঃ জিঃ আঃ) এর পবিত্র করকমলে

পীরে তরিকত, রাহনুমায়ে শরিয়ত, আশেকে রাসূল (ﷺ) এবং ঢাকার নিকুঞ্জস্থ মকিমীয়া মোজাদ্দেদীয়া দরবার শরীফের পীর সাহেব কেবলা হযরত শেখ আবদুস সালাম নকশ্বন্দী মোজাদ্দেদী (মাঃ জিঃ আঃ) সাহেবের

অভিমত

আউযু বিল্লাহি মিনাশ্ শাইত্বানির রাজীম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

সকল প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিনি কূল কায়েনাতের সৃজক ও একচ্ছত্র অধিপতি। লাখো দরূদ হাজার সালাম জাত পাকের নূরের প্রথম তাজাল্লি তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমাদ মুজতবা (ﷺ) এর প্রতি।

আমি এক নালায়েক অধম গুনাহগার। আমাকে জনাব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) খুরশীদ আলম নকশ্বন্দী মোজাদ্দেদী রচিত “শানে মুস্তফা (ﷺ) ও সুন্নী আকিদা” নামক পুস্তক খানার বিষয়ে মতামত লিপিবদ্ধ করতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো হয়েছে। যে নবীর নাম শুনলে প্রতিনিয়ত আমার শিরায় শিরায় কম্পন অনুভব করি, সারাটি জীবন যার প্রেমের পথে দীন ভিখারীর মত পদ বিক্ষেপে চলমান রয়েছি এবং তৃষিত চাতকের মত যাঁর রহমত ফোঁটা পাওয়ার জন্য অদ্যাবধি অপেক্ষমান রয়েছি, তাঁর শান বর্নিত বই খানার উপরে মতামত প্রদান করতে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। বিরহী হৃদয় নিগড় হতে যে বাক্যগুলো উৎসারিত হলো সশ্রদ্ধ চিত্তে তাই লিখে ফেললাম।

নবী আমার রাহ্মাতাল্লিল আ’লামীন, জীবন্ত র্কোআন, সিরাজুম্ মুনীরা ও দয়াময় প্রভুর সৃজনের মহা-শাসক। তাঁর শান-মর্যাদা সীমিত পরিসরে তুলে ধরা শুধু অসম্ভবই নয় অবাস্তব। আমার রূহানী র্ফজন্দ্ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) খুরশীদ আলম সে অসাধ্য সাধনে ব্রতী হয়েছেন। আশেকের অনুরাগ এই প্রয়াসের মাধ্যমে বিচ্ছুরিত হয়েছে। নবীজির শান-মর্যাদার মহা সমুদ্র তটে দাঁড়িয়ে যতটুকু তিনি এই পুস্তকের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন, তা অতুলনীয়। নবী ছাহেবে র্কোআন। তাঁর গুনগানেরই এক মহাকাব্য আল্লাহর কালাম পাক কোরআন। হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, “ আমাকে যদি সূরা ফাতিহার তাফ্সীর লিখতে বলা হয়, তাহলে সত্তরটি উটের বোঝা হয়ে যাবে”। পবিত্র র্কোআনের অক্ষরে অক্ষরে, ছত্রে ছত্রে আমার আঁকা হুযুর পুর নূর (ﷺ) এর শান, প্রশংসা সুদীপ্ত নূরের প্রদীপের মত আলো ছড়াচ্ছে। আল্লাহ পাকের কোরআন নাযিল ও হুজুর (ﷺ) এর তা’ গ্রহন - শানে মুস্তফার এক অনন্য নিদর্শন। মুসলিম উম্মাহ আজ দিকভ্রান্ত বিপর্যস্ত, দিকে দিকে নবীজির শান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা চলছে। নবীজির উম্মতের মধ্যে বিভাজন আর বিভক্তির লক্ষন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এমন দূর্বিপাকে অত্র ক্ষুদ্র পুস্তক খানায় নবীজির শান-মর্যাদার কিয়দংশ তুলে ধরার প্রচেষ্টা অনুধাবনীয়। বই খানা লেখার উদ্যোগ লেখকের নবী প্রেমের বহিঃপ্রকাশ।

বই খানা পড়ে বিমুগ্ধচিত্তে আমি বলতে চাই যে, বই খানায় উত্থাপিত বিষয়াদি পাঠান্তে নবীজির প্রতি পাঠকের ইশ্ক্ আরও গভীর ও প্রানবন্ত হবে এবং পথহারাদের উজ্জিবিত করে খাঁটি ইসলামী আকিদা গ্রহনের নিয়ামক হিসেবে সহায়ক হবে।

লেখকের নবী প্রেমের পরিধি আরও প্রসারিত হোক এবং তাঁর হৃদয় নিগড়ে সঞ্চিত নবীপ্রেম আরও উদ্ভাসিত হোক মহান আল্লাহর পবিত্র দরবারে এই আরজী জানাই।

শেখ আবদুস সালাম নকশ্বন্দী মোজাদ্দেদী

দরবারে মকিমীয়া মোজাদ্দেদীয়া

টানপাড়া, নিকুঞ্জ-২, খিলক্ষেত, ঢাকা-১২২৯।


সংকলকের কথা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।

নাহমাদুহু ওয়ানুসাল্লি আ’লা রাসূলিহিল কারিম। আম্মাবাদ।

আল্লাহ্ এক। ছিলেনও একা। হঠাৎ ইচ্ছা হলো নিজেকে প্রকাশ করার। তাই كُنْ فَيَكُونُ “কুন ফাইয়াকুন”ঃ “হও, (বললে) হয়ে যায়” এর কালাম দ্বারা স্বীয় নূর হতে সৃষ্টি করলেন “নূরে মুহাম্মদী”। এ নূর হতে সৃষ্টি করলেন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের অপরাপর সব কিছু। এ নূর হলো আল্লাহর সকল সৃষ্টির মূল। তাঁর নাম রাখলেন আসমানে আহমদ, আর জমিনে মুহাম্মদ। তাঁর মর্যাদা ও গুনাবলীর প্রমাণ স্বরুপ আল্লাহ্ স্বীয় সিফাতী নামের ৭০টি নামে তাঁকে ভূষিত করলেন। আপন গুনে গুনান্বিত করে আল্লাহ্ তাঁকে বানালেন নিজ হাবীব এবং করলেন আপন প্রকাশ ও বিকাশস্থল। আর আল্লাহ্ তাঁর হাবীবের কথাকে নিজের কথা, হাবীবের যিকিরকে নিজের যিকির এবং হাবীবের অনুসরনকে আপন মহব্বত পাওয়ার মাধ্যম হিসাবে ঘোষনা দিলেন। আল্লাহ্ তাঁর হাবীবের অনুসরন, তাঁর প্রতি আদব প্রদর্শন, তাঁকে মহব্বত করন ইত্যাদি বিষয়ে বান্দার প্রতি নির্দেশ জারী করলেন। তাঁকে সকল নিয়ামত ও ধন-ভান্ডারের চাবি দান করে বন্টনকারী বানালেন। রাব্বুল আ’লামিন তাঁর রবুবিয়াতের সকল সীমানা পর্যন্ত তাঁর হাবীবকে রাহমাতুল্লীল আ’লামিন বানিয়ে এমন মর্যাদা ও বৈশিষ্ট দান করলেন যার পূর্ণ বর্ণনা একমাএ আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। তাঁর উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার ঘোষণা দিলেন, তাঁর উম্মতকে হাশরে অন্যান্য উম্মতের সাক্ষী হিসাবে মনোনীত করলেন, তাঁর উম্মতের জন্য জমিনকে জায়নামাজ বানিয়ে দিলেন এবং তাঁর উম্মত জান্নাতে প্রবেশের পূর্বে অন্য উম্মতের জন্য জান্নাত হারাম ঘোষণা দিলেন।

আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। আর নবী রাসূলগণ হলেন আশরাফুল মাখলুকাতের অর্থাৎ মানুষ্যকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) হলেন সেরাদের সেরা। অর্থাৎ নবী-রাসূলগণের মধ্যে তিনি হলেন শ্রেষ্ঠ ও তাঁদের সর্দার। তারপর ও আল্লাহ্ বলেন, وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ “ওয়ারাফা’না লাকা যিক্রাক্”: “এবং আমি তোমার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি” (সূরা: ইনশিরাত; আয়াত: ৪)। আল্লাহ্ আরো ফরমান, وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى “ওয়ালাল আখিরাতু খাইরুল লাকা মিনাল উলা”: “তোমার জন্য পরবর্তী সময় তো পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা শ্রেয়” (সূরা: দুহা; আয়াত: ৪)। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) কে শুধু উচ্চ মর্যাদাই দান করেননি, বরং আল্লাহ্্ তাঁর মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছেন এবং করেই চলছেন। তদুপরি আল্লাহ্ স্বয়ং নিজে ফেরেশতাদের নিয়ে নবীর প্রতি অনুগ্রহ প্রেরণ করছেন এবং মু‘মিনদিগকেও তাজিমের সাথে সালাত-সালাম প্রেরনের নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা: আহযাব; আয়াত: ৫৬)। একই কাজ সার্বক্ষনিক ভাবে রওজা শরীফ তাওয়াফরত ৭০,০০০ ফেরেস্তাগণও করছেন। হুজুর (ﷺ) এর মর্যাদা বৃদ্ধির প্রথম প্রকাশ ঘটে মি’রাজের মাধ্যমে। আর সর্বশেষ (চুড়ান্ত) প্রকাশ ঘটবে হাশরের মাঠে যখন তিনি মাকামে মাহমুদে বসে উম্মত তরাবেন।

যে নবীর এত মর্যাদা এবং যাঁর শা’ন এত বুলন্দ, সে নবীর এ সুমহান মর্যাদাকে খর্ব করার অপচেষ্টায় ইদানিং কিছু লোক তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা তাঁকে আমাদের বড় ভাইয়ের মত কিংবা আমাদের মত মানুষ বলে দাবী করছে (নাউযুবিল্লাহ্)। তিনি মরে গেছেন, মরে মাটি হয়ে গেছেন, কবরে অন্যান্যদের মতই নিষ্ক্রিয় আছেন, তাঁর উসিলা নেওয়া যাবে না, তাঁর কাছে কিছু চাওয়া যাবে না (নাউযুবিল্লাহ্) ইত্যাদি ইত্যাদি। মোট কথা সৃষ্টির মূল, সৃষ্টির সেরা, ইনসানে কামেল এবং আল্লাহ্ হাবীব ও তাঁর প্রকাশ-বিকাশস্থল, আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ)কে তারা সাধারন মানুষের কাতারে এনে দাঁড় করাতে উঠে পড়ে লেগেছে। তারা হয়ত কুরআনে পড়ে নাই কিংবা ভূলে গেছে যে আল্লাহ্ অনেক কওমকে তাদের নবীকে নিজেদের মত মানুষ মনে করার জন্য ধ্বংস করে দিয়েছেন। যাঁর দরবারে ২৩ বছরে জিব্রাইল (عليه السلام) ২৪,০০০ বার আগমন করেছেন (গড়ে আনুমানিক দৈনিক ০৩ বার) এবং যাঁর হুজরায় বিনা অনুমতিতে আজরাইল (عليه السلام) এর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, তাঁর শা’নে এমন বেয়াদবী? কিন্ত তাঁর শা’নে তাদের এহেন চরম বেয়াদবী সত্ত্বেও ওয়াদা অনুযায়ী আল্লাহ্ তাঁর হাবীবের সম্মানেই আমাদের সমূলে ধ্বংস করছেন না, করবেন না।

ইসলামের বিরুদ্ধে বাতিল পন্থীদের আগ্রাসন নতুন কিছু নয়। হুজুর (ﷺ) এর যামানায়ই খারেজী ফেৎনার সূচনা হয়। হযরত আলী (رضي الله عنه) এর যামানায় তা চরম আকার ধারন করে। উমাইয়াদের আট দশকের বেশী শাসনকালে হুজুর (ﷺ) এর শান-মানকে খর্ব করা এবং আহলে বাইতগণকে প্রকাশ্যে ও জুম্মার খোৎবায় গালমন্দ করা তো রাষ্ট্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঐ আমলে হুজুর (ﷺ) ও তাঁর আহলে বাইতগণের সম্পর্কিত আদব, মহব্বত, তাজিম ও শিষ্টাচারের বহু হাদিস ধ্বংস করা হয় এবং অনেক জাল হাদিসের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। দূর্ভাগ্যবশত চেঙ্গিস খান-হালাকু খানরা বাগদাদে রক্ষিত ইসলামের অমূল্য গ্রন্থ সমূহ এবং বহু হাদিসের কিতাব পুড়িয়ে বা পানিতে ফেলে ধ্বংস করে দেয়। এই ধ্বংসলীলায় অন্যান্য দলিল ও গ্রন্থের সাথে আদব-মহব্বতের হাদীস ও গ্রন্থ সমূহও ধ্বংস হয়ে যায়।

বিগত শতাব্দীর শুরুর দিকে নতুন এক ফেৎনার আবির্ভাব হয়। তা হলো সালাফী বা লা-মাযহাবী বা আহলে হাদিসের ফেৎনা। এ আক্বীদার জনক হলেন ৭ম শতক হিজরীর ইবনে তাইমিয়া। তার ফিরকাহ দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক হতে সক্রিয় হয়ে উঠে যা বর্তমানে প্রকট রূপ ধারন করে মারাত্মক ফেৎনা হিসাবে মুসলিম বিশ্বে আত্ম-প্রকাশ করেছে। এদের পাল্লা ভারী করেছে ওহাবী ফেৎনা ও মওদুদী ফেৎনা। সৌদি আরবে নাসির উদ্দিন আলবানী নামক সালাফী (মৃত্যু-১৯৯৯) নিরীক্ষার (তাহকিক) নামে মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য ধর্মীয় কিতাব ও হাদিস গ্রন্থে এক নির্মম পরিবর্তন-পরিবর্ধন যজ্ঞ চালিয়ে ইসলামের এমন ক্ষতি সাধন করেছে যা সম্ভবত আর কোন দিন সংশোধন করা যাবে কিনা সন্দেহ। অধিকাংশ আদব, মহব্বত, তাজিম, শিষ্টাচার, বরকতময় আমল সংক্রান্ত হাদিস তাহকিকের নামে বাদ দিয়েছে কিংবা জাল হাদিসকে সহিহ এবং সহিহ হাদিসকে জাল বানিয়েছে। এমন কি বাতিলপন্থীরা বর্তমানে বাংলাদেশেও ইসলামের বিখ্যাত মূল গ্রন্থ সমূহ অনুবাদের সময় আদব-মহব্বত, বরকতময় আমল সংক্রান্ত বিষয় সমূহ বাদ দিয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে অর্থ পরিবর্তন করে তা প্রকাশ করছে। এ কারনেই ঈমান-আক্বীদার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে আজ এত বিভক্তি। আমাদের বইয়ের বাজার বদ-আক্বীদার কিতাবাদিতে সয়লাব। হক্কানী লেখকদের গ্রন্থ সমূহের ভূল ও অপব্যাখ্যা করে আমাদের ঈমান-আক্বীদা ও আমল-আখলাকের মধ্যে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে। যার কারনে আজ আমরা দিশাহারা ও বিভক্ত এবং আমাদের পক্ষে হক্ব-বাতিলের পরিচয় বুঝা কঠিন হয়ে গেছে। এ ধারায় যারা অনুপ্রাণিত তারাই আজ উগ্রবাদে লিপ্ত। এ ধারা প্রতিহত না করলে অচিরেই এ সমস্যা আরো প্রকট অকার ধারন করবে।

এহেন পরিস্থিতিতে আল্লাহর হাবীব (ﷺ) এর শান, মান ও মর্যাদার যথাযথ উপলব্ধির জন্য আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। এ পুস্তকে প্রিয় নবী (ﷺ) এর কিছু শানের বর্ণনা ছাড়াও রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আক্বীদাগত বিষয় যা হুজুর (ﷺ) এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট সংক্রান্ত। এ কিতাবের বহুলাংশ বিষয় ভিত্তিক চুম্বক আকারে লিখা। এ সমস্ত বিষয় বিশদভাবে লিখতে গেলে কিতাবের আকার বিশাল হতো। তবে জ্ঞান পিপাসুরা, যারা বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক, আমার বিশ্বাস এ সকল পয়েন্টের সূত্র ধরে গবেষনার সুযোগ পাবে।

আমি লেখকও নই, আলেমও নই। শুধু ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য এ প্রচেষ্টা। এতে অনেক ভূল-ভ্রান্তি থাকা খুবই স্বাভাবিক। তেমন ভূল-ভ্রান্তি দৃষ্টিগোচর হলে তা’ জানানোর আর্জি রইল। পরবর্তীতে সংশোধন করে দেয়ার আশা রাখি।

পরিশেষে আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমার মহান মুরশিদ হযরত শেখ আব্দুস সালাম নকশ্বন্দী মুজাদ্দেদী (মা: জি: আ:) এর প্রতি, যাঁর ইলমি ছোহবত ও দোয়ার বরকতে আমি গোনাহ্গার এ ক্ষুদ্র কিতাব রচনায় উৎসাহিত হয়েছি। আরো শুকরিয়া জানাই তাদেরকে, যারা আমাকে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছেন, বিশেষ করে মুফতি মাওলানা আলাউদ্দিন জিহাদী সাহেবকে যিনি এই কিতাব সম্পাদনা ও আরবী এবারত সংযোজন করে আমাকে কৃতার্থ করেছেন। মুফতি মুহাম্মদ আবদুল আলী কাদেরী ও মাওলানা মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ সিদ্দিকিকেও সহযোগীতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মহান রাব্বুল আ’লামিন সকলকে উত্তম বিনিময় দান করুন এবং এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কবুল করেন। আমিন।

বিনীত

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খুরশীদ আলম (অবঃ)

খাদেম, দরবারে মকিমীয়া মোজাদ্দেদীয়া

টানপাড়া, নিকুঞ্জ-২, খিলক্ষেত, ঢাকা-১২২৯।


শা‘নে মুস্তফা (ﷺ)

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

(“এবং আমি তোমার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি”।-আল কোরআন)

১। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিজের জানের চাইতে বেশী ভালবাসলেই তবে মু‘মিন হওয়া যায়। তাই মু‘মিন হওয়ার চাবি-কাঠি হলো ইশ্কে রাসূল (ﷺ)।

২। নবী (ﷺ) যে আল্লাহর পয়গম্বর ছিলেন এই ইলম আবু জেহেলেরও ছিল। কিন্তু সে পন করেছিল হুজুর (ﷺ) কে মানবে না- তাই কাফের।

৩। কুরআন হতে জানা যায় যে হুজুর (ﷺ) সম্বন্ধে আহলে কিতাবীদের মা‘রেফত ছিল। কিন্তু অস্বীকার করার কারনে কাফের। (সূরা: আনআম; আয়াত: ২০)

৪। আর মুসলমানরা হুজুর (ﷺ) এর আজমত ও শান জানা সত্বেও তাঁকে অসম্মান করে, তাঁর মর্যাদাকে খর্ব করে, তাঁকে নিজেদের মত মানুষ মনে করে, আল্লাহ্ প্রদত্ত তাঁর বৈশিষ্ট ও গুণাবলীকে অস্বীকার করে এবং তাঁর দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আজ তারা মুনাফিক।

৫। তাই দেখা গেল, কাফের, মুশরিক, মুনাফিক- এরা সবাই আল্লাহ্কে মানে, কিন্তু আল্লাহর রাসূলকে অস্বীকার, অমান্য ও অসম্মান করে। যার ফলে তারা বিপদগামী ও ক্ষতিগ্রস্থ।

৬। মু‘মিনের জন্য সব চাইতে মূল্যবান সম্পদ হলো ঈমান। আর ঈমানের মূল হলেন হুজুর (ﷺ) ও তাঁর মহব্বত। এবং এই ঈমান দূরস্ত রাখার জন্য প্রয়োজন সঠিক আক্বীদা। আমাদের মাঝে এক শ্রেণীর লোক আছে যারা আজ হুজুর (ﷺ) এর শান-মানকে খর্ব করার জন্য খুব সচেষ্ট। তাই আমাদের ঈমান বাঁচাতে হলে সঠিক আক্বীদা পোষন এবং হুজুর (ﷺ) শানকে সমুন্নত রেখে তাঁকে অশেষ মহব্বত করতে হবে।

৭। যেমনিভাবে আল্লাহ্কে এক ও অদ্বিতীয় মানলেই চলবে না, তাঁকে তাঁর সমস্ত গুণাবলি (সিফাত) ও বৈশিষ্ট সহকারে মানতে হবে। তেমনিভাবে হুজুর (ﷺ) কে শুধু আল্লাহর রাসূল মানলেই চলবে না, তাঁকে আল্লাহ্ প্রদত্ত সকল সিফাত ও বৈশিষ্ট সহকারে মানতে হবে। হুজুর (ﷺ) এর মর্যাদা অনুধাবনের জন্য এখানে দু‘টি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজনঃ

১) আল্লাহ্ হুজুর (ﷺ) কে সৃষ্টি না করলে কিছুই সৃষ্টি করতেন না এবং তিনি নিজেও প্রকাশিত হতেন না।

২) আল্লাহ্ হলেন রাব্বুল আ‘লামীন। আর হুজুর (ﷺ) হলেন রাহমাতুল্লিল আ‘লামীন। যেখানেই আল্লাহর রবুবিয়াত, সেখানেই নবী (ﷺ) এর রহমত। অর্থাৎ আল্লাহর রবুবিয়াতের সকল প্রান্ত পর্যন্তই হুজুর (ﷺ) এর রহমত বিস্তৃত। হুজুর (ﷺ) এর এই শান আল্লাহ্ প্রদত্ত (আতায়ী)।

৮। শয়তানের দল, মুনাফিকের দল, ইয়াজিদের দল- এরা সবাই আল্লাহ্কে মানে; কিন্তু নবী-রাসূল ও আওলিয়া কেরামের মান-মর্যাদা মানতে তাদের যত আপত্তি। তাইতো আল্লাহ্ ফরমান, ‘আল্লাহ্কে মেনে ও যারা রাসূলের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে- তারা মুনাফিক’ (নিসা-৬১)। আজ তারা নবীকে বড় ভাই জ্ঞান করে, কবর জীবনে তাঁকে নিষ্ক্রিয় ও হায়াতে আমাদের মত মানুষ মনে করে। অথচ কুরআন হতে জানা যায়, যেই সম্প্রদায়ের লোক নিজ নবীকে নিজেদের মত মানুষ মনে করেছে, আল্লাহ্ ঐ সমস্ত কওমকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। ৩৩ : ৫৭ (আহযাব)- “নিশ্চয়ই যারা কষ্ট দেয় আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে, তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত- দুনিয়া ও আখিরাতে এবং আল্লাহ্ তাদের জন্য লাঞ্চনার শাস্তি প্রস্তুুত করে রেখেছেন”। আল্লাহ্কে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে; তাঁর জন্য এমন কোন বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা, যা থেকে তিনি পবিত্র অথবা তাঁর প্রিয় বান্দাদের নির্যাতন করা। আর রাসূল (ﷺ) কে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে; তাঁর বরকতময় কাজকে তুচ্ছ মনে করা, কিম্বা তিরস্কার করা, তাঁর গুণাবলী চর্চায় বাধা দেওয়া, দোষ-ত্রুটি আরোপের অপচেষ্টা করা, তাঁর (আল্লাহ্ প্রদত্ত) শান-মান ও বৈশিষ্ট্য সমূহ অস্বীকার করা কিংবা খর্ব করার চেষ্টা করা ইত্যাদি। এমনকি হুজুর (ﷺ)এর আহলে বাইত, সাহাবায়ে কেরাম এবং আল্লাহর অলীগণেরও এমন মর্যাদা যে তাদেরে কষ্ট দিলে অর্থাৎ তাদের শা’নে বেয়াদবী করলে কিম্বা তাদের মর্যাদা খর্ব করলে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)এর অসন্তষ্টি নসীব হবে। এমনকি কেহ অলীগণের বিরুদ্ধে শত্রুতা করলে আল্লাহ্ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন।

৯। যেমনটা বলেছি, ঈমান বাঁচাতে হলে আক্বীদা ঠিক রাখতে হবে। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূখ্য আক্বীদা হলোঃ

১) ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালন করা উত্তম। ইহা তাকওয়া অর্জন ও সওয়াবের কাজ।

২) মিলাদ-কিয়াম জায়েয। কিয়াম মুস্তাহাব।

৩) নবী (ﷺ) নূরের সৃষ্টি।

৪) নবী করীম (ﷺ) হায়াতুন্নবী।

৫) হুজুর (ﷺ) হাজির-নাযির।

৬) নবী (ﷺ) ইলমে গাইবের অধিকারী।

৭) হুজুর (ﷺ) ও আউলিয়া কেরামের উসিলা গ্রহন জায়েয।

৮) নবী (ﷺ) এর মা-বাবা জান্নাতী (নাজী)।

৯) নবী-রাসূলগণ নিষ্পাপ।

১০) নবী (ﷺ) শাফায়াতের অধিকারী।

১১) শবে বরাত উদ্যাপন হক্ক ও জায়েয।

১২) নবী (ﷺ) আমাদের মত মানুষ নন।

১৩) নবী (ﷺ) নাম উচ্চারিত হলে আদব দেখাতে হবে (দরূদ পড়া, নখ চুম্বন ইত্যাদি)।

১৪) মি‘রাজ স্বশরীরে হয়েছে।

১৫) নামাজ শেষে (০৫ ওয়াক্ত নামাজের পর) হাত তুলে মোনাজাত করা জায়েয ও হাদীস সমর্থীত।

১৬) কবর যিয়ারত মুস্তাহাব। কবর/মাজার যিয়ারতের নিয়তে বের হওয়া জায়েয।

১৭) সাহাবায়ে কেরাম ও আহলে বাইয়েতের ব্যাপারে কোন বেয়াদবীপূর্ণ আচরণ করা যাবে না। তাঁরা হলেন সত্যের মাপ-কাঠি। মর্যাদায় আহলে বাইয়েত সাহাবায়ে কেরামগনের উপরে।

১৮) তাসাউফ চর্চা করা অপরিহার্য।

১৯) কারামতে আউলিয়া হক্ক।

২০) মাযহাবের অনুসরন অপরিহার্য।

২১) কদমবুচী জায়েয এবং হাদিস সমর্থিত।

২২) হুজুর (ﷺ) আখেরী নবী এবং তাঁর পরে আর কোন নবীর আগমন হবে না।

১০। অন্যান্য নবীগণ জন্ম হতে নবী, কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) সৃষ্টির শুরু হতেই নবী। অর্থাৎ সকল সৃষ্টির পূর্ব হতেই তিনি নবী ছিলেন এবং তাঁর নূর মোবারক হতেই আল্লাহ্ অন্যান্য সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন।

১১। রাসূলের ইতাদ বা অনুসরনই হলো আল্লাহর ইতাদ।

১২। কুরআনে ৩৮ আয়াতে আল্লাহ্ ও রাসূলের ইতাদের কথা বলা হয়েছে। তন্মধ্যে ২০ আয়াতে উভয়ের ইতাদ এবং ১৮ আয়াতে শুধু রাসূলের ইতাদের হুকুম রয়েছে; কিন্তু একবারও আলাদাভাবে বা এককভাবে আল্লাহর ইতাদের কথা বলা হয়নি (ইহার ভেদ হলো, যেন মুনাফিকরা কোন বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে)।

১৩। শুধু আল্লাহ্কে মানলে হবে না, আল্লাহ্কে রাসূলের মাধ্যমে মানতে হবে। (যেমন আল্লাহ্কে মেনে ও আদম (عليه السلام) কে সেজদা না করায় আজাযিল মরদুদ শয়তান হয়ে গেল)।

১৪। কুরআনে ১০০টির অধিক আয়াত আছে যেখানে আল্লাহ্ ও রাসূলের নাম এক সঙ্গে বা পাশাপাশি বিদ্যমান। তাই রাসূলকে আল্লাহর সাথে মিলানো শিরক্ নয়, যেমনটা আজ কাল কেউ কেউ মনে করে

১৫। আল্লাহ্ নিজেই তাঁর ও তাঁর হাবীব (ﷺ) এর মধ্যকার ব্যবধান দূর করে দিয়েছেন। যেমন ঈমানী কালেমায় ‘ওয়াও’ অক্ষরটা ও উঠিয়ে দিয়েছেন।

১৬। ইবাদতে আল্লাহর সাথে নবীকে যেমন যুক্ত করা শিরক্, তেমনি অন্য সকল বিষয়ে নবী (ﷺ) কে আল্লাহ্ হতে বিযুক্ত বা পৃথক করা কুফর।

১৭। ইবাদত হবে শুধু আল্লাহর জন্য, রাসূলের জন্য নয়। তথাপি ইবাদত রাসূলের তরিকামত না হলে তা গ্রহনযোগ্য নয়।

১৮। কুরআনে ০৭টি আয়াত আছে যেখানে উল্লেখ ০২জনের (অর্থাৎ আল্লাহ্ ও রাসূলের), কিন্তু কর্মে বা ইতাদে শুধু একজনের (রাসূলের)।

১৯। সাহাবীগণ আল্লাহ্ ও রাসূলের বারগাহে তওবা করতেন। এমন কি মা আয়েশা (رضي الله عنه) ও তা করেছেন। (বোখারী শরীফ)

২০। নেককারদের জন্য খোদা, আর গুনাহগারদের জন্য মুস্তাফা (ﷺ)।

২১। বান্দার আমল সমূহ মদিনা হয়ে আরশে যায়। ভাল আমল হলে হুজুর (ﷺ) আল্লাহর প্রসংশা করেন এবং মন্দ হলে আল্লাহর দরবারে মাফ করার জন্য সুপারিশ করেন। (ছামহুদী: অফাউল অফা)। দরূদ ও সালামও মদিনায় হুজুরের রওজায় পেশ হয়। হুজুর (ﷺ) নিজ কানে তা শুনতে পান। দরূদ পাঠকারীর নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা হুজুর (ﷺ) এর নিকট পেশ হয়। তাই দরূদ ও সালামের মাধ্যমে পাঠকারীদের সাথে নবীজীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যার ফলশ্রুতিতে হুজুর (ﷺ) তাদের হাশরে চিনবেন ও শাফায়াত করবেন। (হুজুর (ﷺ) মক্কার সেই সালাম দেওয়া পাথরকে, দীর্ঘদিন পর মদিনায় বসে, চিনতেন বলে জানিয়েছেন।)

২২। আশেকের লক্ষন হলো, তারা হুজুর (ﷺ) এর প্রতি আদব, সম্মান ও মহব্বতকে বেশী বেশী গুরুত্ব দিবে এবং আলোচনা করবে। আর ওহাবী, সালাফী ও লা-মাযহাবীদের লক্ষন হলো, তারা শুধু ইলম ও আমলের প্রতি বেশী বেশী গুরুত্ব দিবে।

২৩। আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। আর নবী রাসূলগণ হলেন আশরাফুল মাখলুকাতের অর্থাৎ মানুষ্যকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) হলেন সেরাদের সেরা। অর্থাৎ নবী-রাসূলগণের মধ্যে তিনি হলেন শ্রেষ্ঠ ও তাঁদের সর্দার।

তারপর ও আল্লাহ্ বলেন,

 وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

“এবং আমি তোমার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি” (সূরা: ইনশিরাত; আয়াত: ৪)।

আল্লাহ্ আরো ফরমান,

 وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى

“তোমার জন্য পরবর্তী সময় তো পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা শ্রেয়”(সূরা: দুহা; আয়াত: ৪)।

অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) কে শুধু উচ্চ মর্যাদাই দান করেননি, বরং আল্লাহ্ তাঁর মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছেন এবং করেই চলছেন।

তদুপরি আল্লাহ্ স্বয়ং নিজে ফেরেশতাদের নিয়ে নবীর প্রতি অনুগ্রহ প্রেরণ করছেন এবং মু‘মিনদিগকেও সালাত-সালাম প্রেরনের নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা: আহযাব; আয়াত: ৫৬)।

একই কাজ সার্বক্ষনিক ভাবে রওজা শরীফ তাওয়াফরত ৭০,০০০ ফেরেস্তাগণও করছেন। হুজুর (ﷺ) এর মর্যাদা বৃদ্ধির প্রথম প্রকাশ ঘটে মি’রাজের মাধ্যমে। আর সর্বশেষ (চুড়ান্ত) প্রকাশ ঘটবে হাশরের মাঠে যখন তিনি মাকামে মাহমুদে বসে উম্মত তরাবেন।

২৪। যখন আল্লাহর যিকির করা হয়, তখন হুজুর (ﷺ) এর যিকিরও করা হয়। কারন আল্লাহ্ নবীর যিকিরকে নিজের যিকিরের সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেন, “ওগো আমার হাবীব! আপনাকে আমার যিকির করেছি, অতপর যারা আপনার যিকির করবে, তা আমারই যিকির হবে” (হাদীসে কুদসী)। উদাহরন- নামায, আযান, একামত ইত্যাদি। (ইমাম জাফর সাদেক (র:) বলেছেন: নবী করিম (ﷺ) এর যিকিরই হলো আল্লাহর যিকির।)

২৫। مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ

কেহ রাসূলের আনুগত্য করলে, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল (সূরা: নিসা; আয়াত: ৮০)।

২৬। ২৪ঃ ৫৪ (নূর) وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ

রাসূলের আনুগত্য করলে সৎ পথ পাবে....।

অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) এর আনুগত্যে সৎপথ ও জান্নাত পাওয়া যাবে, অন্যথায় গোমরাহী ও জাহান্নাম।

২৭। ৪৭ঃ ৩৩ (মুহাম্মদ)- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ

“হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলে আনুগত্য কর, তোমাদের কর্মফল বিনষ্ট করোনা।”

অর্থাৎ রাসূলে অবাধ্য হলে বা আনুগত্য না করলে কর্মফল বৃথা যাবে।

২৮। ৮ঃ ২০ (আনফাল)- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَوَلَّوْا عَنْهُ وَأَنْتُمْ تَسْمَعُونَ হে মু’মিনগণ! আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমরা যখন তাহার কথা শ্রবণ করিতেছে তখন উহা হতে মুখ ফিরাইও না;

২৯। ৮ঃ ২৪ (আনফাল) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ -হে মু’মিনগণ! রাসূল যখন তোমাদিগকে এমন কিছুর দিকে আহবান করে যাহা তোমাদিগকে প্রাণবন্ত করে তখন আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিবে...।

৩০। ৪ঃ ১৫০ ও ১৫১ (নিসা)- আল্লাহ ও রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারীরা কাফের।

(যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের মধ্যে ঈমানের ব্যাপারে তারতম্য করে এবং বলে ‘আমরা কতেক বিশ্বাস করি ও কতেক অবিশ্বাস করি’)।

৩১। রাসূল (ﷺ) এর কথা আল্লাহরই কথা।

 وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى

“এবং সে মনগড়া কথা বলে না। ইহা তো ওহী, যাহা তাহার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়” (সূরা: নাজম; আয়াত: ৩ ও ৪)

৩২। সূরা এখলাসে তৌহিদের ঘোষণা রিসালতের দরবার থেকেই শুরু হয়। যেমন- قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ (“বল, তিনিই আল্লাহ্, এক-অদ্বিতীয়”)।

অর্থাৎ শুরতে ‘বল’ শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ্ রিসালাতের দরবারকে আগে প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরে তাঁর একত্মবাদের ঘোষণা দেন।

৩৩। হুজুর (ﷺ) নব্যুয়ত প্রাপ্তির পর তাঁর নিকট আত্মীয়গণকে নিয়ে এক পাহাড়ের উপর গিয়ে তাদের প্রশ্ন করেন যে, ‘যদি বলি পাহাড়ের উল্টা দিক থেকে শত্রু বাহিনী আসছে, তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে?’ সবাই বলেন, ‘তুমি আল আ’মিন, অবশ্যই তোমাকে বিশ্বাস করব।’ কিন্তু যখন তৌহিদের দাওয়াত দিলেন, তখন প্রায় সবাই তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখান করে, এমন কি আবু লাহাব গালমন্দ করে চলে যায়। ঐ দিন যারা তাঁর কথা মানল তারা মুসলমান, যারা মানলনা তারা কাফের।

৩৪। সর্ব প্রথম হাদীস মানতে হবে, তার পরে কুরআন। কিন্তু যারা আজকাল হাদীস মানে না এবং বলে কুরআনই যথেষ্ট, তারা কুরআন পেল কোথায়? কুরআনের নাজিলকৃত প্রথম ৫টি আয়াত (ইকরা...) যখন হুজুর (ﷺ) লোকদের শুনালেন, তারা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ইহা পেলেন কোথায়?’ হুজুর (ﷺ) এর জবাবে বলেন, ‘ইহা আল্লাহর কালাম।’ তাঁর এই জবাবটা হলো হাদীস। আর যারা এই হাদীস মানল তারা মুসলমান, যারা মানল না তারা কাফের।

৩৫। যেই কুরআন আসমান, জমিন ও পর্বতমালা বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করে, তা হুজুর (ﷺ) এর উপর নাযিল হয়।

৩৬। মি’রাজের রজনীতে যেখানে নূরের তৈরী, ফেরেশতাকুলের সর্দার, জিব্রাইল (عليه السلام) যেতে পারেননি, সেখানে আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) অবলিলায় চলে গেছেন।

৩৭। যাঁর পবিত্র আঙ্গুলের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়।

৩৮। যাঁর ইশারায় অস্তমিত সূর্য আলী (رضي الله عنه) এর আছরের নামাজ আদায়ের জন্য ফিরে আসে। (খায়বর বিজয় করে ফিরার পথে।)

৩৯। যিনি মদিনায় বসে চন্দ্র গ্রহনের সময় জান্নাত অবলোকন করেন এবং জান্নাতী ফলের গুচ্ছ স্পর্শ করেন।

৪০। যিনি মদিনায় বসে জান্নাত-জাহান্নাম দেখতে পান।

৪১। যিনি মাতৃগর্ভ থেকে লৌহে মাহফুজের কলমের লেখার খস্খস্ আওয়াজ শুনতে পান।

৪২। যিনি মদিনা থেকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত পাথরের শব্দ শুনতে পান।

৪৩। যাঁর সাহাবীগণ ছিলেন আকাশের নক্ষত্রতুল্য এবং তাদের যে কোন একজনকে অনুসরন করলেই পথ পাওয়া যাবে। অন্য কোন নবীর সহচরগণ এমন মর্যাদা লাভ করেননি।

৪৪। যিনি দুনিয়াতেই তাঁর দশজন সাহাবীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন, যারা আশরায়ে মোবাশে^রা নামে খ্যাত।

৪৫। যাঁর হাতে পাথর কলেমা পড়ে এবং যাঁকে পাথর সালাম দেয়।

৪৬। যাঁকে মেঘমালা ছায়া দেয়।

৪৭। যাঁর সোহবতে শুকনা গাছ পত্র-পল্লবে ভরে উঠে।

৪৮। যাঁকে বৃক্ষ ছায়া দেয় এবং যাঁর হাজত পূরনের জন্য নির্দেশিত হয়ে মরুর বুক চিড়ে হাজির হয়।

৪৯। যাঁর পবিত্র হস্তের স্পর্শে উম্মে মা'য়াদের রুগ্ন ছাগীর বান দুধে ভরে যায় (হিজরতে)।

৫০। যিনি হযরত আনাস (رضي الله عنه) এর বাগানে তাশরিফ আনলে- বৎসরে একবারের পরিবর্তে দুইবার ফল দেওয়া শুরু হয়।

৫১। যাঁকে উট সিজদা করে ও তার মালিকের বিরুদ্ধে নালিশ জানায়।

৫২। যিনি সকলের (বিভিন্ন দেশ ও জাতির মানুষ, জ্বিন, পশু, গাছ ইত্যাদি) ভাষা জানতেন।

৫৩। এক বেদুঈন হাতুড়ে ডাক্তার মোজেযা তলব করলে- হুজুর (ﷺ) এর নির্দেশে একটি খেজুরের ছড়া নিজ ডালা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁকে সালাম দিতে দিতে উপস্থিত হয় এবং পরবর্তী নির্দেশে যথাস্থানে গিয়ে জুড়ে যায়। ইহা দেখে বেদুঈন ঈমান আনে।

৫৪। যিনি বৃষ্টির জন্য দোয়া করলে শুক্রবার হতে শুক্রবার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে থাকে।

৫৫। যাঁর ফু দেওয়া কম্বল আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) বুকে জড়িয়ে ধরার কারনে ০২ লক্ষ হাদিস অবলিলায় মুখস্ত করে ফেলেন।

৫৬। যিনি বরকতের দোয়া করে দিলে আবু হোরায়রা (رضي الله عنه), তাঁর থলে থেকে ২৬ বৎসর যাবৎ খেজুর খেতে থাকেন। (হযরত ওসমান (رضي الله عنه) এর শেষ দিনের ফেৎনার সময় ঐ থলেটি হারিয়ে যায়)। উল্লেখ্য, তাবুকের যুদ্ধে খাদ্যাভাব দেখা দিলে হুজুর (ﷺ) ২১টি খেজুর দ্বারা ৩০,০০০ সৈন্যকে তৃপ্তিসহকারে আপ্যায়ন করেন। তারপরও দেখা যায় ২১টি খেজুরই অবশিষ্ট রয়ে গেছে, যা আবু হোরায়রা (رضي الله عنه)কে দেওয়া হয়। (মেশকাত শরীফ)

৫৭। যাঁর সোহবত ও মহব্বতে শুকনা খেজুরের খুঁটি (উস্তুুনে হান্নানা) জীবন লাভ করে ক্রন্দন করেছে এবং জান্নাতে হজুর (ﷺ) এর প্রতিবেশী হওয়ার আর্জি করেছে।

৫৮। যাঁর ছায়া ছিল না এবং যাঁর গায়ে মশা-মাছি বসতো না।

৫৯। যাঁর মল-মূত্র জমিন গ্রাস করে নিত।

৬০। যাঁর মেজবান (হযরত জাবের (رضي الله عنه)) ছোট একটি বকরী ও সমান্য আটা দিয়ে খন্দকের যুদ্ধের সময় ১৫০০ লোককে আপ্যায়ন করেন।

৬১। যিনি একটি সামান্য পানি ভর্তি বাটিতে পবিত্র হাত রাখলে তা ঝর্ণায় রূপান্তরিত হয় এবং ১৫০০ লোকের পানির চাহিদা পূরণে যথেষ্ট হয়।

৬২। যিনি কুপে তীর নিক্ষেপ করলে, থুথু মোবারক ফেললে, কুলির পানি বা অজুর পানি ফেললে, কুপ কানায় কানায় মিষ্টি পানিতে ভরে যায়।

৬৩। যিনি জনৈক মহিলার মোশকের দুধ সাথীদের আকুন্ঠ পান করানোর পরও মোশক দুধে ভরপুর থাকে; উপরন্তু দুধ স্বরযুক্ত হয়ে যায়।

৬৪। যিনি অপর এক মহিলার মোশকের পানি পরিপূর্ণভাবে সাথীদের পান করানোর পর খালি মোশক পানিতে ভরে যায়।

৬৫। যিনি আকাশের দিকে তাকালে কিবলা পরিবর্তন হয়ে যায়।

৬৬। যাঁর জন্মের বৎসর আরবের সকল মহিলা পুত্র সন্তান প্রসব করে। (কন্যা সন্তানকে জীবন্ত অবস্থায় মাটিতে পুতে ফেলার মত অনাচার থেকে ঐ বৎসর আরব বিশ্বকে পবিত্র রাখার উদ্দেশ্যে)

৬৭। যাঁর পবিত্র মুখের কথা ও আদেশ-নিষেধই হলো শরিয়ত।

৬৮। আল্লাহ্ স্রষ্ঠা ও প্রদানকারী। আর তিনি (ﷺ) হলেন আল্লাহর পক্ষে বন্টনকারী।

৬৯। যিনি খাদেমের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে (রবীয়া ইবনে কা’ব আসলামী (رضي الله عنه)) জান্নাত দান করেন।

৭০। যিনি এক বাঁদীকে (হুজুর (ﷺ) জিহাদ হতে সহি সালামতে ফিরলে) দফ বাজিয়ে গান করার আর্জি করলে, তা’ মঞ্জুর করেন।

৭১। যিনি এক ব্যক্তিকে শরিয়তের ০৫ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে শুধু ০২ ওয়াক্ত নামাজের শর্তে ঈমান আনতে চাইলে, তা’ অনুমোদন করেন।

৭২। ইসলামী শরিয়তে ০৪টি বিবাহ জায়েয হলেও, আলী (رضي الله عنه) এর (মা ফাতেমা (رضي الله عنه) জীবিত থাকা অবস্থায়) দ্বিতীয় বিবাহের আবেদন প্রত্যাখান করেন।

৭৩। মৃত্যুর পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন এবং শরিয়তে নিষিদ্ধ হলেও তিনি হযরত আলী (رضي الله عنه) কে মা ফাতেমা (رضي الله عنه) এর ওফাতের পর তাঁকে গোসল করানোর নির্দেশ দেন।

৭৪। কুরআন অনুযায়ী মৃত প্রানী হারাম হলেও তিনি মৃত মাছকে হালাল ঘোষনা করেন।

৭৫। যাঁর আগমন টের পেয়ে হযরত সিদ্দিকে আকবর (رضي الله عنه) ইমামতি ছেড়ে দিয়ে তাঁকে ইমামতি করতে দেন।

৭৬। শরিয়তে বিলাপ করা নিষিদ্ধ হলেও যিনি উম্মে আতিয়া (رضي الله عنه)কে বিলাপ করার অনুমতি দেন।

৭৭। শরিয়তে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও যিনি সিদ্দিকে আকবর (رضي الله عنه)কে একবার নাপাক অবস্থায় মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেন। মওলা আলীর জন্য এই আদেশ দায়েমী ছিল।

৭৮। এক ব্যক্তির কাফ্ফারার সদকা তাকেই খাওয়ার অনুমতি দেন। (জনৈক রোজা ভঙ্গকারী সাহাবী “ধ্বংস হয়ে গেছি” বলে চিৎকার করতে করতে রিসালাতের দরবারে হাজির হলে, হুজুর (ﷺ) তাকে রোজার কাফ্ফারা স্বরূপ ০১জন গোলাম আজাদ করতে কিংবা ৬০ দিন রোজা রাখতে কিংবা ৬০ জন মিসকিনকে খাওয়ানোর নির্দেশ দেন। ঐ সাহাবী কোনটাই করতে সামর্থ নন বলে জানান। এমন সময় অন্য এক আগন্তুক কিছু খেজুর হাদিয়া সরুপ পেশ করলে, হুজুর (ﷺ) রোজা ভঙ্গকারী সাহাবীকে ঐ খেজুর প্রদান করে তা রোজার কাফ্ফারা স্বরূপ সদকা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু সে নিজেই গরীব বলে দাবী করলে হুজুর (ﷺ) তাকেই ঐ সদকার খেজুর খাওয়ার অনুমতি দেন।)

৭৯। সুরাকাকে হিজরতের সময় (ভবিষ্যৎবানীর মাধ্যমে) পারস্য সম্রাটের সোনার কংকন পরার অনুমতি দেন, যদিও পুরুষের জন্য স্বর্ণালংকার পরিধান হারাম। ইহা বাস্তবায়িত হয়েছিল হযরত উমর (رضي الله عنه) এর খেলাফত কালে পারস্য বিজয়ের পর।

৮০। এক সাহাবাকে তার স্ত্রী তার জন্য অবৈধ ঘোষনা করেন।

৮১। যাঁর উপর দরূদ পড়লে গুনাহ্ ঝরে যায়।

৮২। যাঁর উপর দরূদ পড়লে আল্লাহ্ পাঠকারীর উপর দরূদ পড়েন।

৮৩। যাঁর রওজা শরীফ নিয়ত করে যিয়ারত করলে জান্নাত পাওয়া যায়।

৮৪। শয়তান যাঁর রূপ ধারন করতে পারে না। (বুখারী ও মিশকাত)

৮৫। যাঁকে কবরে না চিনলে জান্নাত পাওয়া যাবে না।

৮৬। যাঁকে ওহুদের পাহাড় ভালবাসে এবং বুক চিরে আশ্রয় দেয়। (মিশকাত)

৮৭। যিনি ছাড়া অন্য কেউ হাশরের মাঠে বিচার শুরুর সুপারিশের সাহস পাবে না।

৮৮। হুজুর (ﷺ) যুবায়ের ও আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (رضي الله عنه) কে রেশমি কাপড় পড়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। কারণ তাদের উভয়ের শরীরে ছিল খোস পাঁচরা। (বোখারী ও মুসলীম)

৮৯। যাঁর হাতে হাশরের মাঠে হামদের পতাকা থাকবে।

৯০। যাঁর উম্মত হাশরের মাঠে অন্য সব উম্মতের সাক্ষী হবেন। (বোখারী)

৯১। যাঁকে মহান রাব্বুল আ’লামীন হাশরে শাফায়াতে কোবরার অধিকারী করবেন এবং যাঁকে সবাইর জন্য শাফায়াতের অধিকার দেওয়া হয়েছে। (বুখারী)

৯২। যাঁর আশেক উম্মতদের পার করার জন্য স্বয়ং জিব্রাইল (عليه السلام) পুলসেরাতের উপর নিজ পাখা বিছিয়ে দিবেন।

৯৩। যাঁর উম্মত বেহেশতে প্রবেশের পূর্বে অন্য উম্মতের জন্য বেহেশতে প্রবেশ হারাম করা হয়েছে।

৯৪। যিনি হলেন ঈমামুল মুরসালিন (মি’রাজে প্রমাণ)।

৯৫। যাঁকে সাহায্য ও যাঁর তবলীগ করার ওয়াদা করে অন্যান্য নবীগণ নবী হলেন। (সূরা আলে-ইমরান; আয়াত ৮১ ও ৮২)

৯৬। যাঁর নূর আল্লাহ্ তা’য়ালা সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেন। আরশ-কুরছি, লওহ-কলম, আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য সব মাখলুক তাঁর নূরে পয়দা এবং তিনি স্বয়ং আল্লাহর যাতী নূর হতে পয়দা। (মুসান্নাফ-হযরত জাবের (رضي الله عنه)

৯৭। যাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ্ কিছুই সৃষ্টি করতেন না এবং নিজেও প্রকাশ হতেন না। (বোখারী)

৯৮। যাঁর মাধ্যমে আমরা আল্লাহ্কে আল্লাহ্ বলে জানলাম এবং আল্লাহর কালাম পবিত্র কোরআন লাভ করলাম।

৯৯। যিনি হলেন মহান রাব্বুল আ’লামিনের প্রকাশও বিকাশস্থল।

১০০। যাঁর উসিলায় আদম (عليه السلام) মুক্তি পেলেন। (হাকেম)

১০১। যাঁর উম্মত হওয়ার জন্য নবীগণ পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছেন। তাই ঈসা (عليه السلام) তাঁর উম্মত হিসাবে পুনরায় দুনিয়ায় তাশরিফ আনবেন।

১০২। যিনি ভূমিষ্ঠ হয়েই উম্মতের নাজাতের জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ শুরু করেন। আজও মদিনায় “রাব্বি হাবলী উম্মতি” বলে কাঁদছেন।

১০৩। যাঁর জন্মের বৎসর পৃথিবীতে বেশী বেশী ফুল, ফল ও ফসল হয়। পুরা পৃথিবী বরকতময় হয়ে যায়।

১০৪। যিনি ভূমিষ্ঠ হলে কা’বা শরীফ মাকামে ইব্রাহিমসহ সেজদাবনত হয় এবং কা’বার সকল মূর্তি (৩৬০টি) মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

১০৫। যাঁর জন্মের দিন পশু-পাখীর জবান খূলে যায় এবং একে অপরের নিকট আনন্দ প্রকাশ করে।

১০৬। যাঁর জন্মের সময় আকাশের তারকারাজী অধিক উজ্জলতা লাভ করে এবং জমিনের নিকটবর্তী হয়ে যায়।

১০৭। যাঁর জন্মের আগমনী বার্তা স্বরূপ পারস্য সম্রাটের প্রাসাদের চূড়া ভেঙ্গেঁ পড়ে, তাদের হাজার বছরের শিখা অনির্বান নিভে যায়, জলাশয়ের জল শুকিয়ে যায় এবং স¤্রাটের মুকুট মাথা থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

১০৮। যাঁর নাম মোবারক হুরদের চোখের পাতায়, আরশের গায়ে, বেহেশতের দরজায়, তুবা ও অন্যান্য জান্নাতি বৃক্ষের পাতায় পাতায় লিখা রয়েছে।

১০৯। যাঁর কারনে আল্লাহ্পাক জমিনকে জায়নামাজ বানিয়েছেন (পবিত্র/সেজদার উপযোগী করেছেন) এবং পানির অভাবে অযু-গোসলের পরিবর্তে মাটি দ্বারা তৈয়ম্মুম করার অনুমতি দিয়েছেন।

১১০। যাঁর ঘাম মোবারক মেশক আম্বরের চাইতেও বেশী খুশবুদার ছিল। (বোখারী, মুসলিম, মিশকাত)

১১১। যিনি কোন রাস্তায় গমন করলে সুবাশ ছড়িয়ে পড়ত এবং পরবর্তিতে অন্যরা বলতে পারত এই পথে তিনি গমন করেছেন।

১১২। যিনি হাসলে অন্ধকারেও সুই খুঁজে পাওয়া যেত।

১১৩। যাঁর চেহারা ও দন্ত মোবারক হতে নূর বিচ্ছুরিত হতো।

১১৪। যিনি কারো মাথায় হাত রাখলে সেই মাথায় কোন দিন চুল পাকতো না।

১১৫। যিনি কারো বুকের উপর হাত রাখলে সে মস্তবড় আলেম হয়ে যেত।

১১৬। যাঁর সুপারিশ গ্রহনের জন্য আল্লাহ্ স্বয়ং বান্দাদেরকে শিখিয়েছেন।

১১৭। যাঁর অনুসরণ না করলে আল্লাহর মহব্বতও পাওয়া যায় না।

১১৮। যাঁর অনুসরণ না করলে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় না।

১১৯। যাঁকে ভালবাসলে আল্লাহর ভালবাসা পাওয়া যায়।

১২০। যাঁর নিকট হতে আজও আল্লাহর অলীগণ দ্বীনি ফায়সালা ও দিক নির্দেশনা পেয়ে থাকেন।

১২১। যাঁর উপর স্বয়ং আল্লাহ্পাক ও তাঁর ফেরেশতাগণ দরূদ পাঠ করেন এবং আল্লাহ্ মু’মিনদের ও দরূদ পাঠের নির্দেশ দেন।

১২২। ঈমানী কালেমায় যাঁর নাম আল্লাহর নামের সাথে লিখা। আর কুরআনে যাঁর পবিত্র নাম আল্লাহর পবিত্র নামের সাথে ১০০টির বেশী আয়াতে লিখা আছে।

১২৩। আযানে যাঁর নাম শুনলে আদম (عليه السلام) এর স্বস্থি ফিরে আসে। (পৃথিবীতে আগমনের পর আদম (عليه السلام) অস্থির হয়ে পড়েন। তখন আল্লাহ্ তা’য়ালা জিব্রাইল (عليه السلام) কে আদম (عليه السلام) এর নিকট গিয়ে আযান দিতে বলেন)।

১২৪। সৃষ্টির পর আরশের গায়ে কম্পন শুরু হলে, যাঁর নাম মোবারক লিখে দিলে আরশের কম্পন বন্ধ হয়ে যায়।

১২৫। যাঁর উপর ঈমান না আনলে মুসলমান হওয়া যায় না।

১২৬। যাঁকে ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, এমনকি নিজের জানের চাইতে বেশী ভাল না বাসলে মু’মিন হওয়া যায় না, ঈমান কামেল হয় না।

১২৭। যিনি মু’মিনের নিকট তাদের নিজেদের চাইতে ঘনিষ্ঠতর এবং যাঁর পত্নীগণ মু’মিনদের মাতা।النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ (সূরা: আহযাব; আয়াত: ৬)

১২৮। যিনি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে কোন মু’মিন পুরুষ বা নারীর সেই বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকে না। (সূরা: আহযাব; আয়াত: ৩৬)

১২৯। وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ যাঁর আনুগত্য করলে সৎপথ পাওয়া যায়। (সূরা: নূর; আয়াত: ৫৪)

১৩০। যিনি আমাদের মধ্যে থাকার কারনে আল্লাহ্ (আমাদের অসংখ্য গুনাহ্ স্বত্বেও) আমাদিগকে শাস্তি দিচ্ছেন না (সমূলে ধ্বংস করছেন না)। (সূরা: আনফাল; আয়াত: ৩৩)

১৩১। যাঁর সহিত/যাঁর শানে কুফরী করলে আল্লাহ্ কখনো ক্ষমা করবেন না, এমনকি তিনি (ﷺ) প্রার্থনা করলেও না। (সূরা: তওবা; আয়াত: ৮০ ও ৮৪)

১৩২। عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ উম্মতের কষ্টে যিনি নিজেই কষ্ট পান এবং মু’মিনদের জন্য তিনি রাউফ ও রাহীম। (সূরা: তওবা; আয়াত: ১২৮)

১৩৩। যাঁকে আল্লাহর ৯৯টি সিফাতি নামের মধ্যে ৭০টি নাম দান করা হয়েছে। যেমন-রাউফ, রাহীম, করিম, আউয়াল, আখের, যাহের, বাতেন, নূর ইত্যাদি। (মাদারেজুন্নবুয়াত)

১৩৪। যাঁকে সম্মান করার জন্য বান্দাদিগকে আল্লাহ্ নিজেই শিখিয়েছেন। لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ (সূরা: ফাত্হ; আয়াত: ৯)

১৩৫। যাঁর সম্মুখে কোন বিষয়ে অগ্রনী হতে আল্লাহ্ বারন করেছেন।لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ (সূরা: হুজুরাত; আয়াত: ১)

১৩৬। যাঁর কন্ঠস্বরের চাইতে নিজের কন্ঠস্বর নিচু রাখতে আল্লাহ্ কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। এমন কি তাঁর কন্ঠস্বর হতে নিজের কন্ঠস্বর উচুঁ করলে নিজের অজ্ঞাতসারে সারাজীবনের কর্মফল বিনষ্ট হয়ে যাবে। أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ (সূরা: হুজুরাত; আয়াত: ২)

১৩৭। যাঁকে ঘরের বাহির হতে ডাকতে আল্লাহ্ নিষেধ করেছেন বরং তাঁর জন্য ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করাই হতো উত্তম (পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ নিজে রিসালাতের দরবারের আদব শিখাচ্ছেন)। (সূরা: হুজুরাত; আয়াত: ৪ ও ৫)

১৩৮। যাঁকে আল্লাহ্ “জামে কালাম” অর্থাৎ ‘ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত কালামের’ ক্ষমতা দিয়েছেন।

১৩৯। প্রত্যেক নবী তাঁদের স্বজাতির প্রতি প্রেরিত, কিন্তুু হুজুর (ﷺ) নিখিল বিশ্বের নবী।

১৪০। যাঁর উম্মতের জন্য গনিমতের মাল হালাল করা হয়েছে, যা পূর্বে হালাল ছিল না।

১৪১। যাঁর পবিত্র নামের তাসিরে এক মাসের দূরত্বে শত্রুর মনে ভয়-ভীতি সৃষ্টি হতো। (মিশকাত)

১৪২। যিনি সামনে, পিছনে, দিনে ও রাত্রে সমানভাবে দেখতেন। (বোখারী, বায়হাকী)

১৪৩। যিনি নিদ্রা অবস্থায় ও সব কিছু দেখতেন ও শুনতেন। (বোখারী)

১৪৪। নবীগণের মধ্যে একমাত্র তিনিই উম্মী (সৃষ্টির মূল) উপাধি লাভ করেন। (মাওয়াহিব)

১৪৫। যিনি ৬৫,০০০ মোজেযার অধিকারী, যখন অন্যান্য নবীগণ অনধিক নয়টির অধিকারী। (পয়গামে মোহাম্মদী)

১৪৬। যাঁর অধিকারে সমস্ত ধনভান্ডার ও ইলমে-গাইবের চাবি ন্যাস্ত হয়। (মাওয়াহিব)

১৪৭। সমস্ত নবীগণের সম্মিলিত উম্মতের চাইতে যাঁর উম্মতের সংখ্যা অধিক হবে। (সূরা কাউছার)

১৪৮। কুরআনে আল্লাহ্ সকল নবীগণকে নাম ধরে, কিন্তুু হজুর (ﷺ)কে তাঁর উপাধি ধরে সম্বোধন করেছেন।

১৪৯। সকল নবীগণ আল্লাহর প্রেমিক, কিন্তুু আল্লাহ্ হলেন তাঁর প্রেমিক। তিনি একাধারে খলিলুল্লাহ্ ও হাবীবুল্লাহ্ (প্রেমিক ও প্রেমাষ্পদ)। (মাওয়াহিব)

১৫০। যাঁর জানাযা হয় বিনা ইমামে এবং চার তাকবির ব্যতিত, শুধু দরূদ ও সালামের মাধ্যমে। (মাওয়াহিব ও বেদায়া)

১৫১। যাঁর নাম আল্লাহর পবিত্র নাম মাহমুদ ও আহাদ নাম হতে যথাক্রমে মুহাম্মদ ও আহমদ রাখা হয়। (তাফসীরে রুহুল বয়ান)

১৫২। যাঁর রওজা মোবারক আরশ হতেও উত্তম। (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া, ফাতোয়া শামী)

১৫৩। যাঁর রওজা মোবারক প্রতি দিনে ও রাতে (৭০,০০০ + ৭০,০০০) ১,৪০,০০০ ফেরেশতা কিয়াম অবস্থায় দরূদ পাঠে রত, যা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। (মিশকাত)

১৫৪। যিনি সর্বপ্রথম হাশরের মাঠে ৭০,০০০ হাজার ফেরেশতা (তাওয়াফ/কিয়ামসহ দরূদ পাঠকারী সর্বশেষ দল) সহকারে উপস্থিত হবেন।

১৫৫। শিশুকালে যিনি চাঁদের সাথে খেলা করতেন ও কথা বলতেন। (আব্বাস (رضي الله عنه))

১৫৬। যাঁর দরবারে জিব্রাইল (عليه السلام) ২৪,০০০ বার (২৩ বছরে আনুমানিক গড়ে প্রতিদিন ০৩ বার করে) আগমন করেছেন। (অন্যান্য নবীগণের নিকট সর্বমোট মাত্র ৫২১বার এসেছেন; যেমন হযরত মূসা (عليه السلام) ৪০০ বার, হযরত নূহ (عليه السلام) ৫০ বার, হযরত ইব্রাহিম (عليه السلام) ৪২ বার, হযরত আদম (عليه السلام) ১২ বার, হযরত ঈসা (عليه السلام) ১০ বার, হযরত ইয়াকুব (عليه السلام) ৪ বার এবং হযরত আইউব (عليه السلام) ৩ বার।)

১৫৭। যাঁর পবিত্র হুজরা শরীফে প্রবেশের জন্য জিব্রাইল (عليه السلام) ও আযরাঈল (عليه السلام) এর মত ফেরেশতাগণ অনুমতি নিতেন।

১৫৮। যাঁকে দেখলে হককেই দেখা হয়।

১৫৯। যিনি নিজেই ঈমান আর আমরা মু’মিন।

১৬০। যাঁর কলেমা- “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আন্নি রাসূলাল্লাহ।”

১৬১। আর আমাদের কলেমা- “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলাল্লাহ।”


---ঃ---

 ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)

১। ঈদ অর্থ খুশী। আর ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর অর্থ হুজুর (ﷺ) এর জন্ম উপলক্ষে ঐ দিনকে খুশীর দিন মনে করে উদযাপন করা।

২। নবীজি (ﷺ) ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার (২০ এপ্রিল, ৫৭০ খৃ:) এই পৃথিবীতে তাশরিফ আনেন।

৩। দীর্ঘকাল যাবৎ এই ঈদে মিলাদুন্নবী বিভিন্নভাবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। কিন্তু বিগত কয়েক দশক হতে, কুরআন-হাদীসে ইহার উল্ল্যেখ নেই, এই দোহাই দিয়ে কিছু সংখ্যক লোক ইহার উদযাপন সম্বন্ধে আপত্তি করে আসছে। আবার কেউ কেউ মিলাদুন্নবীর পরিবর্তে সিরাতুন্নবী বা দাওয়াতুন্নবী পালন করছে। কিন্তু মিলাদুন্নবী পালনকারীগণ সিরাতুন্নবী ও দাওয়াতুন্নবীকে অস্বীকার করে না।

নোটঃ ১) মিলাদুন্নবীর যদি কোন দলিল না থাকে, তবে সিরাতুন্নবী/দাওয়াতুন্নবী পালনের দলিল কোথায়?

২) মিলাদুন্নবীতে সিরাতুন্নবীও আছে এবং দাওয়াতুন্নবীও আছে। কিন্তু সিরাতুন্নবী/দাওয়াতুন্নবীতে মিলাদুন্নবী নাই। আর মিলাদুন্নবী অস্বীকার করে ঐ দিনে সিরাতুন্নবী পালন করা অবৈধ। যেমন কোরবানীর জন্য সকল হালাল প্রানীকে অস্বীকার করে শুধু ছাগল দ্বারা কোরবানী করা অবৈধ।

{সিরাতুন্নবী শব্দটি আখলাকুন্নবী হওয়া অধিক যুক্তিসঙ্গত, কারণ সিরাতুন্নবী শব্দটির পাল্টা উত্তম শব্দ হচ্ছে আখলাকুন্নবী। সিরাত মানে ভাল-মন্দ মিশ্রিত জীবন চরিত্র, আর আখলাক হচ্ছে মন্দবিহীন সুন্দর জীবন চরিত্র।}

৪। আহলে সুন্নাত ওয়াল জমায়াতের প্রকৃত অনুসারীগন ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর দিনকে অত্যন্ত বরকতময় মনে করে। এই দিনটি উদযাপনে তারা সচেষ্ট থাকে। এই দিনের ইবাদত হলো- জন্ম বৃত্তান্তসহ হুজুর (ﷺ) এর উপর বিষধ আলোচনা, দরূদ-সালাম, মিলাদ-কিয়াম, যিকির-আজকার, রোজা ও অন্যান্য নফল ইবাদত।


ঈদে মিলাদুন্নবীর দলিল-কুরআন হতে

১। মহান রাব্বুল আ’লামিন আরশে সর্ব প্রথম মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করেন। ইহা ছিল আজ হতে ২২ লক্ষ বৎসর আগে যা “মিছাকে রিসালতে মুহাম্মদী (ﷺ)” নামে খ্যাত। দলিল- সূরা: ৩ (আলে-ইমরান); আয়াত ৮১-

وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ

“স্মরণ কর, যখন আল্লাহ্ নবীদের অঙ্গিকার নিয়েছিলেন, তোমাদিগকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি অতঃপর তোমাদের কাছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসূল আসবে তখন তোমরা তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম।”

فَمَنْ تَوَلَّى بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

“ইহার পর যারা মুখ ফিরাবে তারাই ফাছেক/কাফের।” (সূরা আলে ইমরান: ৮২)

নোটঃ ১) ১,২৪,০০০ পয়গম্বরের মধ্যে আল্লাহ্ কারো জন্যই মিছাক (সাক্ষ্য)/মিলাদ অনুষ্ঠান করেননি, একমাত্র আমাদের নবীজি ব্যতিত।

        ২) এই অঙ্গিকার প্রদান পূর্বক নবীগণ নবী হলেন।

        ৩) আল্লাহ্ নিজেই এই অঙ্গিকারের সাক্ষী হলেন এবং অন্য সকল নবীকে সাক্ষী বানালেন।

        ৪) এই অঙ্গিকার গ্রহনের জন্য সকল নবীগণের রূহের জন্য মাহফিল সাজানো হয়েছিল।

        ৫) তাই বলা যায় সর্ব প্রথম ঈদে মিলাদুন্নবীর মাহফিল/ আলোচনা হয়েছিল রূহের জগতে। তাই ইহা পালন আল্লাহর সুন্নাত।

২। জন্মের ৪০০০ বৎসর পূর্বে হযরত ইব্রাহিম (عليه السلام) এর দোয়া (সূরা:২ (বাকারা); আয়াত: ১২৯)-

رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

“হে আমার প্রতিপালক! তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ করিও যে তোমার আয়াত সমূহ তাদের নিকট তিলওয়াত করবে, তাদিগকে হেকমত শিক্ষা দিবে এবং তাদিগকে পবিত্র করবে। তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”

নোটঃ ইহা হুজুর (ﷺ) এর আগমন/জন্ম সংক্রান্ত দোয়া।

৩। জন্মের ৫৭০ বৎসর পূর্বে হযরত ঈসা (عليه السلام) এর তাবলীগ (সূরা: ৬১ (সাফ্ফ); আয়াত: ৬)-

وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ

“স্মরণ কর, মরিয়ম তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল এবং আমার পূর্ব হতে তোদাদের নিকট যেই তওরাত রয়েছে আমি তার সমর্থক এবং আমার পরে আহমদ নামে যে রাসূল আসবে আমি তার সুসংবাদদাতা।” হুজুর (ﷺ) এর শুভাগমনের আলোচনা তো স্বয়ং ঈসা (عليه السلام) করেছেন, যা পবিত্র কোরআনেই বর্ণিত রয়েছে।

৪। সূরা: ৯০ (বালাদ); আয়াত: ১-৩- لَا أُقْسِمُ بِهَذَا الْبَلَدِ وَأَنْتَ حِلٌّ بِهَذَا الْبَلَدِ وَوَالِدٍ وَمَا وَلَدَ “আমি শপথ করছি ঐ শহরের, আর তুমি এই শহরে তাশরিফ এনেছো, শপথ জন্মদাতার [ইব্রাহিম (عليه السلام)] ও যা সে জন্ম দিয়েছে [নবী (ﷺ)]।”

নোটঃ জন্মের বিষয় গুরুত্ব বহন না করলে আল্লাহ্ কখনো হুজুর (ﷺ) এর জন্মভূমি মক্কা শহরের শপথ করতেন না বা কসম খেতেন না।

৫। সূরা: ৯ (তওবা); আয়াত: ১২৮- لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ “অবশ্যই তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছে। তোমাদিগকে যা বিপন্ন করে উহা তার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদের মঙ্গলকামী। মু’মিনদের প্রতি সে দয়াদ্র ও পরম দয়ালু (রাউফুর রাহীম)।”

৬। সূরা: ৬২ (জুমু’আ); আয়াত: ২- هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ “তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য হতে, যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁর আয়াত সমূহ; তাদের পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত; .................”।

৭। সূরা: ২১ (আম্বিয়া); আয়াত: ১০৭- وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ “আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।”

নোটঃ রাসূলের শুভাগমনের কথা তো তাঁর জন্মেরই আলোচনা। যা স্বয়ং মহান রাব্বুল আ’লামিন নিজেই করেছেন পবিত্র কোরআনে।

৮। সূরা: ৪ (নিসা); আয়াত: ৮৩-

 وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَاتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلَّا قَلِيلًا “.....

তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ (ফজল) ও দয়া (রহমত) না থাকত তবে তোমাদের অল্প সংখ্যক ব্যতিত সকলে শয়তানের অনুসরন করত।”

নোটঃ মূলত ফজল ও রহমত তো হলেন হুজুর (ﷺ)।

৯। সূরা: ২৮ (কাসাস); আয়াত: ৭৭- وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ “.... তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ্ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন ...।”

নোটঃ আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেন। আর তাঁর সর্বোত্তম অনুগ্রহ হলো আমাদের মাঝে হুজুর (ﷺ) এর শুভাগমন।

১০। সূরা: ২ (বাকারা); আয়াত: ৪৭- يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ “হে বনী ইসরাঈল! তোমরা আমার সেই নিয়ামত/অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর যদ্বারা আমি তোমাদেরকে অনুগৃহিত করেছিলাম ......।”

নোটঃ অনুগ্রহ বা নিয়ামতের স্মরণ ও আলোচনা করা আল্লাহর হুকুম। হুজুর (ﷺ) এর বিলাদতের বা শুভাগমনের চাইতে বড় কোন নিয়ামতই নেই।

১১। সূরা: ১০ (ইউনূস); আয়াত: ৫৮- قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ “বল, উহা আল্লাহর ফজল (অনুগ্রহ) ও তাঁর রহমত (দয়া); সূতরাং ইহাতে উহারা আনন্দিত হউক। উহারা যা পূঞ্জীভূত করে তা অপেক্ষা ইহা উত্তম।”

নোটঃ এই ফজল ও রহমতকে কেউ বলেছেন ইসলাম ও কুরআন, কেউ কুরআন ও হাদীস। কিন্তু অনেকের মতে উহা হুজুর (ﷺ) এবং জশনে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপন সংক্রান্ত আয়াত। ইহার মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ ও যথাযথভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালনের ইঙ্গিত রয়েছে।

১২। সূরা: ৩ (আলে-ইমরান); আয়াত: ১৬৪- لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ “আল্লাহ্ তা’য়ালা মু’মিনদের প্রতি বড়ই এহসান/অনুগ্রহ করেছেন যে তাদের কাছে তাদের মধ্য হতেই একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলওয়াত করে, তাদিগকে পরিশোধন করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, ........”

নোটঃ আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতরাজীর মধ্যে একমাত্র হুজুর (ﷺ) এর আগমনকে মু’মিনদের প্রতি এহসান করার কথা বলে খোটা দিয়েছেন। তিনি অন্য কোন নিয়ামতের খোটা দেননি। তাই এহসানের শোকর করার জন্যই হলো ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন।

১৩। সূরা: ২২ (হাজ্জ); আয়াত: ৩২- ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ “ইহাই আল্লাহর বিধান এবং কেহ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে ইহা তো তার হৃদয়ের তাকওয়া সৃষ্টির মাধ্যম।”

১৪। সূরা: ২ (বাকারা); আয়াত: ৩৯- وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ “যারা কুফরী করে এবং আমার নিদর্শন সমূহকে অস্বীকার করে তারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।”

নোটঃ ১) উপরোক্ত দুই আয়াতের দ্বারা ইহা প্রমানিত যে, যারা আল্লাহর নিদর্শনকে সম্মান করে তাদের তাকওয়া সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হয়। আর যারা আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করে তারা হবে জাহান্নামী।

        ২) আল্লাহর সকল নিদর্শনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলেন হুজুর (ﷺ)। তাই তাঁর সম্মান করা আমাদের জন্য ফরজ এবং অস্বীকারের পরিনতি অগ্নিবাস।

১৫। সূরা: দুহা (৯৩); আয়াত: ১১- وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ “তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের (নিয়ামতের) কথা জানাইয়া দাও।”

১৬। সূরা: ইব্রাহিম (১৪); আয়াত: ৭- وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ “স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষনা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হইলে তোমাদিগকে অবশ্যই অধিক দিব আর অকৃতজ্ঞ হইলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর।”

নোটঃ ১) উপরোক্ত দুই আয়াতের দ্বারা জানা গেল অনুগ্রহ/নিয়ামতের চর্চা করা এবং নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা শোকর করার জন্য আল্লাহ্ নির্দেশ করেছেন। আর অকৃতজ্ঞ হলে কঠোর শাস্তির ঘোষনা দিয়েছেন।

        ২) আল্লাহর সকল নিয়ামতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো হুজুর (ﷺ) এর শুভাগমন। তাই তাঁর আগমনের চর্চা ও শোকর গুজারী আমাদের জন্য অপরিহার্য, অন্যথা কঠিন শাস্তি।

১৭। সূরা: ৫ (মায়িদা); আয়াত: ১১৪- قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ “মরিয়ম তনয় ঈসা (عليه السلام) বলেন, হে আল্লাহ্! আমাদের জন্য উর্ধ্বজগত হতে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা অবতরন করুন, ইহা হবে আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য ঈদ সরূপ আর আপনার নিকট হতে নিদর্শন।”

নোটঃ জান্নাতি খাবার অবতরন যদি ঈদ সরূপ হয়, তা’হলে হুজুর (ﷺ) এর শুভাগমন তো আমাদের জন্য সেরা ঈদ।

১৮। সূরা: ৫ (মায়িদা); আয়াত: ১৫- قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ “............ আল্লাহর নিকট হতে তোমাদের নিকট একটি নূর [হুজুর (ﷺ)] ও স্পষ্ট কিতাব (কুরআন) এসেছে।” ইহাও হুজুর (ﷺ) এর আগমন বার্তাই বটে।

১৯। উপরোক্ত ১৮টি কুরআনের আয়াতের আলোকে বলা যায়, আল্লাহ্ জাল্লাশা’নূহু তাঁর হাবীব (ﷺ) কে পৃথিবীতে পাঠিয়ে আমাদের উপর এহসান করেছেন, তাঁর আগমন উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশের ইশারা দিয়েছেন, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে তাঁকে সম্মানের আদেশ করেছেন, নিয়ামত হিসাবে শোকর গুজারের নির্দেশ দিয়েছেন, নিজে মিলাদ পালন করেছেন, অন্যান্য নবীগণকে তাঁর আগমনের তাবলীগ করার অঙ্গিকার নিয়েছেন, সকল আসমানী কিতাবে নবীজির জিকির, প্রশংসা, শান-মান বর্ণনা, আগমনী বার্তা সন্বিবেশিত করেছেন। কাজেই আমরা কি ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) অস্বীকার করি?

২০। যেমনিভাবে কুরআনের অনেক আয়াতে হুজুর (ﷺ) এর বেলাদতের বর্ণনা রয়েছে, একইভাবে কুরআনে অন্যান্য অনেক নবী-রাসূলগণের, বিশেষ করে মূসা (عليه السلام) ও ঈসা (عليه السلام) এর, জন্ম বৃত্তান্ত স্ববিস্তারে আলোচনা রয়েছে। তাই ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর আলোচনার অনুষ্ঠান ও উদযাপন আল্লাহর সুন্নাত হিসাবে প্রমানিত।


বিলাদতের কুদরতী আয়োজন

১। নবীজি (ﷺ) এর আগমনের ৪০০০ বৎসর পূর্বে আল্লাহ্ তাঁর খলিল ইব্রাহিম (عليه السلام) এর মাধ্যমে মক্কা/বাক্কা আবাদ করেন।

২। বেলাদতের ৭০০/১০০০ বৎসর পূর্বে ইয়েমেনের তুব্বা বাদশা কর্তৃক মদিনা/ইয়াসরিব আবাদ করেন।

নোটঃ তুব্বা বাদশা মক্কা আক্রমনের ইচ্ছা পোষন করলে রোগক্রান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর প্রধান ওলামার পরামর্শে মক্কা আক্রমনের ইচ্ছা ত্যাগ করলে সুস্থ্য হয়ে যান এবং মদিনায় গমন করেন। মদিনা নবীজির আগমনের বা হিজরতের স্থান হবে জানতে পেরে ০১ বৎসর তথায় অবস্থান করেন। এর মধ্যে হুজুর (ﷺ) আগমন না করায় তাঁর ৪০০০ আলেমের জন্য ৪০০০টি ঘর নির্মান করে তাদেরে তথায় রেখে এবং হুজুর (ﷺ) এর জন্য ০১টি আলাদা বাসস্থান নির্মান করে প্রধান ওলামার নিকট নবীজির উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে (আগাম ঈমান এনে) তিনি মদিনা ত্যাগ করেন। জনৈক আবু লায়লা ঐ চিঠি পরবর্তীতে নবীজিকে হস্তান্তর করেন এবং নবীজি মদিনায় তাশরিফ আনলে তাঁর উঠনী তুব্বা বাদশা কর্তৃক নবীজির জন্য নির্মিত ঘরের সামনে বসে পড়ে। হুজুর (ﷺ) ঐ ঘরেই শুরুতে অবস্থান করেন (ঐ ঘরে তখন প্রধান ওলামার বংশধর হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (رضي الله عنه) বসবাস করতেন)।

৩। যমযম কূপ সর্বমোট তিনবার জাহের হয়। প্রথমবার আদম (عليه السلام) এর জন্য, দ্বিতীয় বার হযরত ইসমাঈল (عليه السلام) এর জন্য এবং তৃতীয়বার নবী করিম (ﷺ) এর জন্য খাজা আবদুল মোত্তালিবের মাধ্যমে।

৪। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূলগণ নবীজির আগমনের তবলীগ করে গেছেন। তাই দুনিয়ার মানুষ তাঁর আগমনের প্রতিক্ষায় ছিলেন এবং তাদের মনে তাঁর আগমনের তৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছিল।


হাদিসের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)

১। একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কিছু লোকের সামনে নবীজি (ﷺ) এর জন্মের ঘটনাবলী বর্ণনা ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেন। হঠাৎ হুজুর (ﷺ) তসরিফ আনলেন এবং আলোচনা শুনে বললেন, “আমার শাফায়েত তোমাদের জন্য হালাল হয়ে গেল।” (আন নে’মাতুল কুবরা)

২। একবার হুজুর (ﷺ) হযরত আবু দারদা (رضي الله عنه) কে নিয়ে হযরত আমের আল আনসারী (رضي الله عنه) এর ঘরে তাশরিফ আনলেন। তখন আমের (رضي الله عنه) নিজ সন্তান ও প্রতিবেশীদের নিয়ে হুজুর (ﷺ) এর জন্মের ঘটনাবলী বর্ণনা করছিলেন। হুজুর (ﷺ) ইহা শুনে বললেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’য়ালা তোমাদের জন্য রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং সকল ফেরেস্তা তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। যারা তোমাদের মত কাজ (ভবিষ্যতেও) করবে তাদের ও তোমাদের মত সওয়াব ও প্রতিদান মিলবে।” (আন নে’মাতুল কুবরা)

৩। হুজুর (ﷺ) প্রতি সোমবার রোজা রাখতেন। যখন জিজ্ঞাসা করা হলো ইহার কারন কি? তখন জবাবে তিনি ফরমান যে, ‘সোমবার হলো আমার জন্ম দিন।’ (সহীহ্ মুসলীম, মেশকাত)

৪। হুজুর (ﷺ) নিজেই নিজের ২য় আক্বিকা করেছেন। জন্মের পর মক্কায় প্রথম আক্বিকা করেছিলেন তাঁর দাদা খাজা আবদুল মোত্তালিব। (খাছাইছুল কুবরা)

৫। হুজুর (ﷺ) নিজেই তাঁর নছবনামা ও জন্ম বৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এ’বিষয়ে অসংখ্য সহীহ হাদীস বিদ্যমান। যেমন (হাদীস)- আদম (عليه السلام) হইতে হুজুর (ﷺ) এর পিতা-মাতা পর্যন্ত কাউকেই ব্যভিচারের কলংক স্পর্শ করে নাই।

৬। হাদীস- শুক্রবার আমাদের জন্য ঈদের দিন। এই দিন আফজাল/উত্তম দিন। ইহার কারণ জানতে চাইলে হুজুর (ﷺ) তিনটি বিষয় উল্লেখ করেনঃ-

ক) হযরত আদম (عليه السلام) এর জন্ম/সৃষ্টি।

খ) হযরত আদম (عليه السلام) এর ওফাত।

গ) কিয়ামত শুক্রবারে সংগঠিত হবে।

নোটঃ আদম (عليه السلام) এর জন্ম দুনিয়াবাসীর জন্য আনন্দের। কারন তাঁর মাধ্যমেই তো আল্লাহ্ আমাদের বিস্তার ঘটিয়েছেন। তাঁর ওফাত তাঁর নিজের জন্য আনন্দের। কারন তিনি আল্লাহর নিকট পৌছে গেছেন। কিয়ামত আনন্দের এই জন্য যে ইহার পরবর্তী পর্যায়েই তো মু’মিনগন আল্লাহর দিদার লাভ করবেন। আদম (عليه السلام) এর জন্ম/আগমন যদি আনন্দের ও ঈদের দিন হতে পারে, তবে হুজুর (ﷺ) এর আগমন কেন ঈদের দিন হবে না?

৭। আবু লাহাবের মৃত্যুর ০১ বৎসর পর হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) তাকে স্বপ্নে দেখে তার পরকালীন অবস্থা জানতে চান। উত্তরে আবু লাহাব জানায় যে, হুজুর (ﷺ) এর জন্মের সুসংবাদ দেওয়ার জন্য সে তার দাসী সুয়াইবাকে ডান হাতের শাহাদাৎ আঙ্গুলীর ইশারায় আযাদ করে দেয়। ফলশ্রুতিতে প্রতি সোমবার তার আযাব হালকা করে দেওয়া হয় এবং ডান হাতের শাহাদাৎ আঙ্গুলি দ্বারা মিষ্টি পানি পান করার সুযোগ হয়। (সহীহ্ বুখারী)

নোটঃ কাফেরদের সর্দারের জন্য যদি হুজুর (ﷺ) এর জন্মে আনন্দিত হওয়ার কারনে আল্লাহর অনুগ্রহ তথায় প্রতি সোমবার জাহান্নামের আযাব হালকা করা হয়, তা’হলে মু’মিনগন আনন্দিত হলে ও ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপন করলে অবশ্যই অশেষ অনুগ্রহ পাবেন।

৮। হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) সোমবার মরার জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতেন, কারন ইহা ছিল হুজুর (ﷺ) এর ওফাত দিবস। বরকতের জন্য যদি ওফাত দিবস বিবেচিত হতে পারে, তবে হুজুর (ﷺ) এর জন্ম দিবসে আনন্দ প্রকাশ কল্যানকর হবে না কেন?

৯। মিরাজের রজনীতে হুজুর (ﷺ) ঈসা (عليه السلام) এর জন্মস্থান বেতলেহামে ০২ রাকাত নফল নামাজ পড়েন। জন্ম/জন্মস্থান মর্যাদাশীল না হলে তিনি হয়ত তা করতেন না।

১০। হাদীস গ্রন্থ বোখারী, মুসলিম ও তিরমীজি অনুযায়ী নবীজি (ﷺ) ইয়ামুল মূসা, ইয়ামুল নূহ এবং ইয়ামুল গিলাফে কা’বা পালন করতেন এবং রোজা রাখতেন। যখন হুজুর (ﷺ) অন্যান্য নবীর বিশিষ্ট দিনের উৎসব করতেন, তখন এই উম্মত কি তাদের নিজের নবীর আগমন উদ্যাপন করবে না?

১১। উপরোক্ত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ইমাম ইবনে হাজর আসকেলানীকে (যিনি ইমামুল মোহাদ্দেসীন) ঈদে মিলাদুন্নবী সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ইহার পক্ষে রায় দেন এবং তিনি ইয়ামুল মূসা পালনকে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালনের দলিল হিসাবে পেশ করেন। ইবনে হাজর আসকেলানী (رحمة الله) এর এই রায় ইমামুল মোফাস্সেরিন হযরত জালাল উদ্দিন সূয়তী (رحمة الله) তাঁর নিজস্ব কিতাবে বর্ণনা করেন। ইহার ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:-

ক) ইহুদীরা আশুরার দিন রোজা রাখে। ইহা শ্রবনে নবীজি (ﷺ) ঐ দিবস (আশুরা) উপলক্ষে ০২টি রোজা রাখার নির্দেশ দেন।

খ) মূসা (عليه السلام) নীল নদ পার হওয়ার কারনে যদি ইহুদিরা এই দিবসটি পালন করতে পারে এবং জায়েজ হয়, তবে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালন অবশ্যই জায়েজ এবং উত্তম কাজ।

১২। বৎসরে মুসলমানদের ঈদ সর্বমোট ৫৬টি। যথা- ৫২শুক্রবার, ১আরাফা, ১ফিতর এবং ১আযহা= ৫৫ ঈদ। এই ৫৫টি ঈদ মানতে বাতিল পন্থীদের আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু ৫৬ ঈদের অন্যতম ঈদ-ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) মানতে ও পালনে।

১৩। কথিত আছে প্রতি সোমবার দুপুরের আগে নবীজি (ﷺ) এর জন্মস্থানের দোয়া আল্লাহ্পাক কবুল করে থাকেন।

১৪। হযরত আদম (عليه السلام) থেকে হযরত ঈসা (عليه السلام) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণ হুজুর (ﷺ) এর জন্মের আলোচনা করেছেন অর্থাৎ মিলাদ মাহফিল করেছেন। এমন কি ঈসা (عليه السلام) নবীজির আগমন সংক্রান্ত বর্ণনা করার সময় কিয়াম করতেন। তাই ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালন নবীগণের সুন্নাত।


বিশিষ্ট ওলামাগণ হতে প্রাপ্ত দলিল

১। ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) দিনে কা’বার দরজা খুলে দেওয়া হতো এবং সৈয়দগণ খাবার বিতরন করতেন (ইহা অষ্টম শতাব্দির লেখক ও পর্যটক ইবনে বতুতার কিতাবে পাওয়া যায়)।

২। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলভী (رحمة الله) বলেন- একবার মক্কা মোয়াজ্জেমায় দেখলাম হুজুর (ﷺ) এর জন্মের ঘটনাবলী বর্ণনা করা হচ্ছে এবং নবীজির উপর দরূদ-সালাম পেশ করা হচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম মাহফিলের উপর নূরের তাজাল্লি বর্ষিত হচ্ছে। এ ও দেখলাম ফেরেস্তাদের নূরের সাথে রহমতের নূর মিশ্রিত হচ্ছে। (ফায়জুল হারামাইন)

নোটঃ উপরোক্ত দুইটি বর্ণনা দ্বারা বুঝা গেল ওহাবী ফেৎনা শুরুর আগে মক্কা-মদিনায় ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপিত হতো এবং এই উপলক্ষে মিছিল, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা, উত্তম খাবার বিতরন উৎসব আকারে পালিত হতো।

৩। একবার হযরত আবদুর রহিম মোহাদ্দেস দেহলভী (رحمة الله) এর ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) উৎযাপনের জন্য অর্থ ছিল না। তিনি শুধু ভূনা চানা বিতরন করে এই দিনটি উৎযাপন করেন। রাত্রে নবীজি (ﷺ) কে স্বপ্নে দেখেন এবং তিনি ফরমান, আবদুর রহিম তোমার চানা আমার দরবারে পৌছে গেছে। (আদ র্দুরুছ ছামীন ফি মুবাশ্শারাতি নাবিয়ীল আমিন)

৪। কাসেম নানূতবী, আশরাফ আলী থানভী, রশীদ আহমদ গঙ্গোঁহী- ওনাদের পীর হযরত এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (رحمة الله) ঈদে মিলাদুন্নবীকে অত্যন্ত বরকতময় জানতেন এবং উৎযাপন করতেন। তাঁর লিখা কিতাব হাফতে মাসয়ালা (পৃ:১৫) এর বর্ণনা নি¤েœ দেয়া হলোঃ

        ‘এ ফকিরের নিয়ম হলো আমি মিলাদ মাহফিলে অংশ গ্রহণ করে থাকি বরং মিলাদ অনুষ্ঠানকে বরকত লাভের উসিলা মনে করে প্রত্যেক বৎসরই মিলাদের মজলিস করে থাকি এবং কিয়ামের সময় অশেষ আনন্দ ও আরাম উপভোগ করি।’

৫। ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর রাত্রি হযরত আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী (رحمة الله) এর মতে, শবে ক্বদরের রাত্রির চাইতে উত্তম। কারণঃ-

ক) মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর রাত্রি স্বয়ং মাহবুবে খোদা (ﷺ) এর আগমনে রাত্রি। আর শবে ক্বদর তো তাঁকেই দান করা হয়েছে।

খ) ক্বদরের রাত্র ফেরেশতাগনের অবতীর্নের কারনে ফজিলত মন্ডীত। আর মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর রাত্র স্বয়ং রাসূলে খোদা (ﷺ) এর আগমন দ্বারা মহিমান্বিত।

গ) ক্বদরের রাত্রে শুধু এই উম্মতের জন্য অনুগ্রহ, ইহসান ও রহমত রয়েছে। আর মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর রাত্রে সমগ্র সৃষ্টির জন্য অনুগ্রহ, ইহসান ও রহমত রয়েছে।

ঘ) ক্বদরে কুরআন নাজিল হয়। আর মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর রাত্র স্বয়ং সাহেবে কুরআন তাশরিফ আনেন। (মাহারেজুন্নবুয়াত)

৬। ইমাম শাফেয়ী (র:) মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন সম্পর্কে বলেন: ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্য কিছু ঈমানদার ভাইদের একত্রিত করে এবং মিলাদের জন্য কিছু তাবারকের ব্যবস্থা করে, আল্লাহ তাঁকে সিদ্দিকীন, শোহাদা-সালেহীনদের সাথে জান্নাতুন নাঈমে থাকার ব্যবস্থা করবেন।’

৭। আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ূতী (র:) বলেন: ‘আমাদের জন্য হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করে শোকরিয়া আদায় করা মুস্তাহাব। (তাফসীরে রুহুল বয়ান- ৯/৫৬-৫৭ পৃষ্ঠা)

৮। আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (র:) ইমাম শামছুদ্দীন সাখাবী (র:) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: ‘যারা কয়েক বৎসর ব্যাপী মক্কা শরীফে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তম্মধ্যস্থ বরকতের পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন আমি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। (আল মাওরুদুর রাবী ফি মাওলিদীন নববী, ৮৫ পৃষ্ঠা)

৯। বিখ্যাত সূফী ও ফকিহ সাইয়্যেদ আহমদ আবেদীন (رحمة الله) ইমাম ইবনে হাজর (رحمة الله) এর ‘আলা মাওলুদুল কবির’ কিতাবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর বিরচিত ‘নে‘মাতুল কুবরা’ গ্রন্থে লেখেন, যারা আল্লাহর হাবিবের প্রতি প্রকৃত মহব্বত রাখেন তাদের উচিত এই রবিউল আওয়াল মাসের আগমনে আনন্দিত হওয়া এবং মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহফিলের অনুষ্ঠান করা এবং সেই মাহফিলে রাসূলাল্লাহ (ﷺ)এর জন্ম সম্বন্ধীয় সহীহ হাদিসসমূহ পাঠ করা। আশা করা যায় এমন লোকেরা আল্লাহ পাকের নেক বান্দাগণের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

১০। আল্লামা ইবনুল জাওজী (رحمة الله) বলেন, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুষ্ঠান দ্বারা যে সব উপকার লাভ হয়ে থাকে তন্মধ্যে ইহা অন্যতম ও পরীক্ষিত যে, সে বৎসর বিপদাপদ হতে নিরাপদ থাকা যায় এবং নিজের ন্যায় সঙ্গত আকাঙ্খা পূর্ন হয়ে থাকে।’

১১। আল্লামা ইবনুল জাযরী (رحمة الله) বলেন, ‘এ মিলাদুন্নবী (ﷺ)এর অনুষ্ঠান দ্বারা শয়তানের পিঠে কষাঘাত পড়ে। আর ঈমানদারগণের হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়।’ (সিরতুশ সামিয়া)

১২। ইমাম নববীর ওস্তাদ ইমাম আবু শামা (رحمة الله) বলেন, ‘আমাদের জামানায় আরবাল শহরে হুজুর (ﷺ) পবিত্র বেলাদতের দিন যে সব দান-খয়রাত, সৌন্দর্য এবং আনন্দ প্রকাশের জন্য করা হয়, তা বিদআতে হাসানারই অন্তর্ভুক্ত। কেননা এর মাধ্যমে ফকীরদের প্রতি এহসান করা ছাড়াও আরো রয়েছে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুহাব্বত, মর্যাদা এবং তা‘জিম করার বহিঃপ্রকাশ। আর আল্লাহ তা‘য়ালা রহমাতুল্লিল আলামিন রূপে যে নেয়ামত দান করেছেন, তজ্জন্য শোকরিয়া প্রকাশ করার বিষয় নিহিত রয়েছে।’

১৩। ইমাম কুস্তুলানী (رحمة الله) বলেন, ‘রবিউল আওয়াল যেহেতু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদতের মাস। সেহেতু অত্র মাসে তামাম মুসলমান সবসময় মিলাদ শরীফের খুশিতে মাহফিলের আয়োজন করে আসছে। তারা রাতে দান-সদকা করে থাকে, আর সৎ আমল সম্পাদন করে থাকে। বিশেষত, এসব মাহফিলে বরকত যে পাওয়া যায়, তা পরীক্ষিত; এ মাহফিলের জন্য ঐ বছর নিরাপদে অতিবাহিত হবে। আর স্বীয় উদ্দেশ্য ও হাজত পূর্ণ হওয়ার দ্রুত সুসংবাদ লাভ করবে।

১৪। ইমাম শামছুদ্দীন সাখাবী (র:) বলেন, বিশ্বের চতুর্দিকে ও শহরগুলোতে নবী করীম (র:) এর আগমনের মাসে মুসলমানরা বড় বড় আনন্দ অনুষ্ঠান করে থাকে। এ মাসের রাত্রসমূহে প্রাণ খুলে সদকা করা হয়, আনন্দ প্রকাশ করা হয়, বেশি বেশি নেক আমল করা হয় এবং হুজুর (رحمة الله) এর আগমনের ঘটনাবলি পড়ে পড়ে আনুগত্য প্রকাশ করা হয়। ফলে তাদের উপর রাশি রাশি বরকত থেকে বিপুল পরিমাণ করুণা বর্ষিত হয়।’

১৫। হাফেজ আবু জুরআ ইরাকী (رحمة الله) বলেন, ‘মাহফিলে মিলাদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হল, এটি কি মুস্তাহাব না কি মাকরুহ? এ সম্বন্ধে কোন কিছু ওয়ারেদ হয়েছে কি না কিংবা যাকে এক্তেদা করা যায়, এমন কেউ এটা করেছেন কিনা? তিনি বলেন, সবসময় আহার করানো মুস্তাহাব। তাহলে খাওয়ানোর আনন্দটা যদি এ সম্মানিত মাসে নূরে নবূয়তের হুজুর (ﷺ) এর সাথে যুক্ত হয়, তাহলে এর মর্যাদা কিরূপ হবে? আমরা জানি না এটি সলফে সালেহীন করেছেন কি না, কিন্তু পূর্বযুগে না হওয়াতে তা মাকরুহ হওয়া আবশ্যক নয়। কেননা এমন অনেক বিদআত আছে, যা সলফে সালেহীন কৃত না হওয়া সত্ত্বেও মুস্তাহাব এমনকি ওয়াজিব বটে।’

১৬। ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله) বলেন, আমাদের এখানে মিলাদ মাহফিল জিকির-আজকার যা কিছু অনুষ্ঠিত হয়, তার অধিকাংশই ভাল কাজের অন্তর্ভুক্ত। যেমন :সদকা করা, জিকির করা, দরূদ পড়া ও রাসুলে পাক (ﷺ) এর উপর সালাম পেশ করা।

১৭। হযরত ইসমাইল হাক্কী (رحمة الله) বলেন, রাসুলে করীম (ﷺ)এর মিলাদ শরীফ অনুষ্ঠান করাও তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি দিক, যদি তাতে গর্হিত কোন কাজ না হয়। (রুহুল বয়ান ৭/৬৬১)

১৮। শাহ্ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) এক কিতাবে বলেন, আমি মিলাদ শরীফের অনুষ্ঠানে দুরূদ শরীফ এবং দাঁড়িয়ে সালাম পাঠ করে থাকি। (আখরারুল আখয়ার, পৃষ্ঠা-৬২৪)

১৯। ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী (رحمة الله) ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মধুর কন্ঠে কুরআন পাকের তেলাওয়াত ও নবী পাক (ﷺ) এর শানে ক্বাসিদা, নাত, জীবন বৃত্তান্ত পাঠে ক্ষতি কি? অর্থাৎ- কোন ক্ষতি নেই। (মুজাদ্দিদে আলফে সানি: মাকতুবাত শরীফ)

২০। মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন, ‘সব দেশের ওলামা-মাশায়েখ মাহফিলে মিলাদে মুস্তফা (ﷺ) ও উহার সমাবেশকে এতই তাজিম করেন যে, কেহই অংশ গ্রহন করতে অস্বীকার করেন না। এতে শরীক হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই মোবারক মাহফিলের বরকত হাসীল করা।’ (আনোয়ারে ছাতেয়া, পৃষ্ঠা-১৪৪)

২১। ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) উৎযাপন শুরু থেকেই বিভিন্নভাবে হয়ে আসছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্ব প্রথম ইহা উৎযাপন করেন উত্তর ইরাকের ইরবিলের বাদশা আবুল মোজাফ্ফর (رحمة الله) (মৃত্যু-৬০৪ হিঃ) ৬ষ্ঠ শতক হিজরীর শেষের দিকে। (তাফছিরে রুহুল বয়ান)

২২। এই উপমহাদেশেও ইংরেজ, পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এই দিনটি পালিত হচ্ছে এবং এই দিনে সরকারী ছুটি থাকে।

নোট: উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপন বুজুর্গানে দ্বীনগণের সুন্নাত হিসাবে প্রমাণিত হলো।


মিলাদ/বিলাদত

১। আদম (عليه السلام) কে সৃষ্টির পর নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) আদম (عليه السلام) এর পৃষ্ঠ দেশে স্থাপন করা হয়।

২। পরবর্তীতে আরাফার ময়দানে জাবালে রহমতে উহা পূনঃ স্থাপন করা হয়।

৩। বংশপরাম্পরায় এই পবিত্র নূর পবিত্র ঔরস থেকে পবিত্র রেহেমে স্থানান্তরিত হতে হতে খাজা আবদুল্লাহর ঔরসেও মা আমেনা (عليه السلام) এর গর্ভে স্থানান্তরিত হয়।

৪। এই শানদার নবী যেই দিন মাতৃগর্ভে তাশরিফ আনেন (যাকে লাইলাতুল রাঘায়েবের রজনী বলা হয়)- ঐ দিন জলে স্থলে সকল প্রাণীকে এই পয়গাম পৌছে দেওয়া হয়। প্রাণীকূল ইহাতে আনন্দ প্রকাশ করে, তাদের জবান খুলে যায় এবং একে অপরকে মোবারকবাদ জানায়। আর কুরাইশদের জন্তুরা বলে উঠল- “কা’বা শরীফের মালিকের শপথ! মুহাম্মদ (ﷺ) আজ স্বীয় মাতৃগর্ভে শুভাগমন করেছেন।”

৫। ঐ দিন বেহেস্তের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং গায়েবী আহবানকারী আসমান ও জমিনে তাঁর (ﷺ) আগমনের সুসংবাদ ঘোষণা করে দেয়।

৬। প্রতি মাসে একজন নবী এসে স্বপ্নের মাধ্যমে মা আমেনা (عليه السلام) কে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানব আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন এবং বলেছেন জন্মের পর নাম রেখো মুহাম্মদ।’ তা’ছাড়া নবীজি (ﷺ)কেও সালাম পেশ করেছেন। তাঁদের আগমনঃ-

১) প্রথম মাসে- হযরত আদম (عليه السلام)

২) ২য় মাসে- হযরত শীশ (عليه السلام)

৩) ৩য় মাসে- হযরত নূহ (عليه السلام)

৪) ৪র্থ মাসে- হযরত ইদ্রিস (عليه السلام)

৫) ৫ম মাসে- হযরত হুদ (عليه السلام)

৬) ৬ষ্ঠ মাসে- হযরত ইব্রাহিম (عليه السلام)

৭) ৭ম মাসে- হযরত ঈসমাইল (عليه السلام)

৮) ৮ম মাসে- হযরত মূসা (عليه السلام)

৯) ৯ম মাসে- হযরত ঈসা (عليه السلام)

৭। সপ্তম মাসে পারস্য সম্রাট কিসরার রাজ প্রাসাদ কেঁপে উঠে এবং ১৪টি চূড়া ভেঙ্গেঁ কংকর খসে পড়ে যা অদ্যাবধি মেরামত সম্ভব হয়নি।

৮। অষ্টম মাসে পারস্যের হাজার বছরের পুরানা অগ্নিকুন্ড-শিখা অনির্বান নিভে যায় এবং তাদের জলাশয় শুকিয়ে যায়।

৯। নবম মাসে কিসরার রাজ মুকুট মাটিতে পড়ে যায়।

১০। মা আমেনা গর্ভধারন অবস্থায় অন্যান্য গর্ভধারীনিদের মত হন নাই। অর্থাৎ কোন ওজন অনুভব করেননি এবং কোন ব্যাথাও হয়নি। কারন গর্ভে তো নূরের নবী (ﷺ)।

১১। গর্ভাবস্থায় মা আমেনা (عليه السلام) হাঁটলে পায়ের নিচের পাথর মোমের মত হয়ে যেত।

১২। তিনি কুয়ায় পানি আনতে গেলে পানি কুয়ার কানায় কানায় ভরে উঠত।

১৩। জন্মের বছর বেশী বেশী ফুল, ফল ও ফসল হয় (যেন মানুষের অভাব-অনটন না থাকে এবং সবাই সুখী থাকে)।

১৪। ঐ বছর আরবের প্রত্যেক মাতা পুত্র সন্তান জন্ম দেন (কন্যা সন্তান হলে মেরে ফেলার মত অনাচার থেকে ঐ বছরকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে)।

১৫। গর্ভাবস্থায় মা আমেনা একটি নূর দেখেছিলেন-ইহাতে তিনি শ্যাম দেশ পর্যন্ত দেখতে পান। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আরেকবার নূর প্রকাশিত হয়- যা সমগ্র পূর্ব-পশ্চিম আলোকিত করে। তাইতো হুজুর (ﷺ) ফরমান, “আমি আমার মায়ের দেখা সেই নূর।” (খাসায়েসুল কুবরা)


বিলাদতের রজনী ও শৈশব কাল

১। আম্মাজান হযরত আমেনা (عليه السلام) অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় ছিলেন। তিনি ভয়ে আক্রান্ত ছিলেন, এমন কি ঘরে প্রদীপের তৈল ও ছিল না।

২। আম্মাজানের অসহায়ত্বের কথা জিব্রাইল (عليه السلام) মহান রাব্বুল আ’লামিনের দরবারে পেশ করলে, দয়াময় প্রভূ মা হাওয়া, মা আসিয়া, মা হাজেরা ও মা মরিয়ম (عليه السلام) কে নিজের পরিচয় গোপন করে ধাত্রী হিসাবে প্রেরন করেন (আবদে মুনাফের কন্যাদের মত দেখতে)।

৩। জিব্রাইল (عليه السلام) মা আমেনা (عليه السلام) কে দুধের চাইতে সাদা এবং মধুর চাইতে মিষ্টি শরবত পান করান।

৪। ধূসর বরন কুদরতী পাখীর পালকের পরশে আম্মাজানের ভয়-ভীতি ও ব্যথা-বেদনা দূরিভূত হয়ে যায়।

৫। জিব্রাইল (عليه السلام) আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে তাশরিফ ও শুভাগমনের জন্য আহবান করেন।

৬। তিনি (ﷺ) খাতনাকৃত ও নাভীকাটা অবস্থায়, চোখে সুরমা, গায়ে জান্নাতি পোষাক পরিহিত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়ে-সেজদায় লুটিয়ে পড়েন এবং আঙ্গুল উঁচিয়ে উম্মতের মাগফেরাত কামনা করেন।

৭। জন্মে একটি নূর প্রকাশ পায় যদ্বারা প্রাচ্য ও প্রাচ্যাত্য আলোকিত হয় এবং শ্যাম দেশের বালাখানা ও ইয়েমেনের উটের গর্দান দেখা যায়।

৮। জন্মে ০৩টি ঝান্ডা উত্তোলন করা হয়-প্রাচ্যে, প্রাচ্যাত্যে ও কা’বার উপর।

৯। ফেরেশতাগণ দলে দলে এসে সালাম পেশ করেন।

১০। ৭০,০০০ হুর তাওয়াফ করেন।

১১। তাঁকে জল-স্থল, আসমান-জমিন সবকিছু দেখানো ও পরিচিত করানো হয়।

১২। “কা’বা শরীফ” নবী এ- দু’জাহানের আগমন সংবাদ দেয় এবং মা আমেনা (عليه السلام) এর ঘরের দিকে সেজদাবনত হয়ে ঘোষনা দেয়- “মা আমেনা (عليه السلام) হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর জন্ম দিলেন”।

১৩। কা’বার মুর্তি সব মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে।

১৪। কা’বার উপর নূরের তাজাল্লী বর্ষিত হয়। তারকারাজী জমিনের কাছাকাছি চলে আসে এবং মনে হচ্ছিল যেন জমিনের উপর পতিত হবে। ইহা ছিল কুদরতি আলোক সজ্জা- যার জন্য মু’মিনরাও এই দিনে আলোক সজ্জা করে।

১৫। হযরত ওসমান বিন আবিল আস-সাকাফী (رضي الله عنه) এর আম্মা হযরত ফাতেমা বিনতে আবদুল্লাহ সাকাফি (رضي الله عنه) বলেন- যখন হুজুর (ﷺ) এর শুভাগমন হয়, তখন আমি কা’বার পাশে ছিলাম এবং দেখলাম যে কা’বা শরীফ নূরে আলোকিত হয়ে গেছে এবং নক্ষত্রসমূহ ভূ-পৃষ্ঠের এত কাছাকাছি এসে গেছে যেন আমার মাথার উপর পড়বে।

১৬। ইহুদী পন্ডিত বলতে লাগলো- ‘আজ রাত্রে আহমদ-ই-মুস্তফা (ﷺ) নক্ষত্র উদিত হয়েছে এবং এই রাত্রে তিনি জন্মগ্রহন করেছেন।’ (হযরত হাসান বিন সাব্বিত (رضي الله عنه) ইহার সাক্ষ্য দেন, তখন যার বয়স ছিল ৮ বৎসর)

১৭। ঐ ইহুদী সকালে হুজুর (ﷺ) কে দেখে চিৎকার দিয়ে বলে উঠে- 'হে বনি ইসরাঈল! নবুয়ত তোমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে’। এই বলে সে বেহুশ হয়ে পড়ে যায়।

১৮। জন্মের সময় হুজুর (ﷺ) এর দাদা খাজা আবদুল মোতালেব কা’বার প্রাচীর থেকে একটি ধ্বনি শুনতে পান- “মুস্তফা জন্মগ্রহন করেছেন।”

১৯। হুজুর (ﷺ) এর শুভাগমনের কারনে একদিকে যেমন আনন্দের বন্যা, অন্যদিকে শয়তান “আবু কুবাইস পাহাড়ে” গিয়ে দুঃখে কাঁদতে লাগলো। যেমনি আজ নবীদ্রোহী ও শয়তানের দোসররা ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালনের কথা শুনলে কাঁদে।

২০। জন্মের ০৬ মাস পূর্বে পিতা খাজা আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেন এবং ০৬ বৎসর বয়সে মা আমেনা (عليه السلام)।

২১। তিনি কোন স্কুলে যাননি। স্বয়ং আল্লাহ্ ওনার শিক্ষক। তাইতো তিনি উম্মী নবী (ﷺ)।

২২। হুজুর (ﷺ) এর দুধ মা হালিমা (رضي الله عنه)।

২৩। তিনি তাঁর দুধ মার ডান স্তন হতে দুধ পান করতেন এবং বাম স্তন হতে তাঁর দুধ ভাই আবদুল্লাহ। ইনসাফ!

২৪। “রৌদ্র আমার কোরাইশ ভাইকে স্পর্শ করে না। মেঘখন্ড ছায়া দেয়।”-দুধ বোন সায়মা।

২৫। মক্কায় তিনি মা আমেনা (عليه السلام) ও সুয়াইবার দুধ ১৭দিন এবং মা হালিমার দুধ ২৩ মাস ১৩ দিন = ২ বৎসর তিনি বুকের দুধ পান করেন। পরবর্তীতে কুরআনে শিশু অবস্থায় মায়ের দুধ ০২ বৎসরের জন্য জায়েযের নির্দেশ আসে।

২৬। আল্লাহর ফরমানঃ-

ক) তোমরা আমার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর।

খ) যদি তোমরা আমার নিয়ামতের না শোকর কর, তা হলে অবশ্যই আমার আযাব কঠিন।

গ) আমি আমার হাবীবকে রহমাতুল্লিল আ’লামিন অর্থাৎ দুনিয়ার জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরন করেছি।

নোটঃ ১) রাহমাতুল্লিল আল-আমিন অর্থাৎ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের জন্য রহমত। আমাদের নবীজি (ﷺ) এর চাইতে বড় কোন নিয়ামত ও রহমত আমাদের জন্য নাই।

        ২) আর নিয়ামতের শোকর করার জন্য আল্লাহ্ নির্দেশ করেছেন এবং না করলে আযাবের ঘোষনা দিয়েছেন।

        ৩) তাই আমাদের উচিত ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালন করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, বরকত হাসিল করা এবং আযাব-গজব হতে নিজেদের বাঁচানো।

ঘ) তোমরা আমার নিদর্শনের সম্মান কর, তাতে তাকওয়া সৃষ্টি হবে।

ঙ) তোমরা যদি আমার নিদর্শনের সম্মান না কর, তবে পরিনতি হবে অগ্নিবাস।

নোটঃ ১) আল্লাহর সকল নিদর্শনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলেন হুজুর (ﷺ)।

        ২) তাই হুজুর (ﷺ) কে সম্মান না করলে এবং শুভাগমন উদযাপন না করলে পরিনতি হবে ভয়াবহ।


মিলাদুন্নবী না সিরাতুন্নবী-তার প্রমাণ

১। আল্লাহ্ ছিলেন গুপ্ত খাজিনা। আল্লাহ্ চাহিলেন আত্ম-প্রকাশ ও আপন কুদরতের বিকাশ। তাই তিনি নিজের নূর হতে সৃষ্টি করলেন নূরে মোহাম্মদী (ﷺ) এবং সেই নূর হতেই সকল সৃষ্টি। (তাফছিরে কবীর)

২। আদম (عليه السلام) এর সৃষ্টির ১৪০০০ বৎসর পূর্ব হতেই তিনি প্রভূর সমীপে নূর হিসাবে বিদ্যমান ছিলেন (দুনিয়ার হিসাবে যা ৫১১ কোটি বৎসর-আসমানের ০১দিন দুনিয়ার ১০০০ বৎসরের সমান)। (তাফছিরে রুহুল বয়ান)

৩। জিব্রাইল (عليه السلام) কে সৃষ্টির পর তিনি (জিব্রাইল) আল্লাহর নূরের চতুর্থ পর্দায় ৭০,০০০ বৎসর পরপর ৭২,০০০ বার নবী নূর উদিত হতে দেখেছেন (৫০৪ কেটি বৎসর)। (তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৪৩)

৪। আদম (عليه السلام) যখন মাটি ও পানির মধ্যে তখনও তিনি নবী ছিলেন। (কাশফুল খাফা)

৫। আদম (عليه السلام) যখন রূহ ও দেহের মধ্যবর্তী তখনও তিনি নবী ছিলেন। (তিরমিজি শরীফ)

৬। আদম (عليه السلام) সর্ব প্রথম মাথা উত্তোলন করে বেহেশতের দ্বারে যেই কালেমা দেখতে পান উহাতে তখনও তাঁর নাম মোবারক রাসূল হিসাবেই ছিল। (হাকেম: মুস্তাদরাক)

৭। প্রত্যেক নবীই জন্মে নবী। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) সৃষ্টিতেই নবী। অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদীর সৃষ্টি হতেই তিনি নবী।

৮। নবীগণ যে ৪০ বৎসর বয়সে নবুয়ত লাভ করে নবী হন- এ’কথা ঠিক নয়। উদাহরন- قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا ‘(শিশু অবস্থায়) সে (ঈসা (عليه السلام) বলিল, আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন,’- সূরা: ১৯ (মারইয়াম); আয়াত: ৩০)।

৯। রূহের জগতে “মিসাকে নবুয়ত” উপলক্ষে একটি খাস মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শুধু নবীগণের রূহ উপস্থিত ছিল। আর ইহা হয় ২২ লক্ষ বৎসর পূর্বে।

১০। শ্যাম দেশের বহিরা/পাদ্রী বাল্যকালে হুজুর (ﷺ)কে দেখে তাঁর নিম্নোক্ত বৈশিষ্টের কথা বর্ননা করেন:-

        ক) তিনি (ﷺ) নবীউ আখেরীজ্জামান।

        খ) রাসূলে রাব্বিল আ’লামিন।

        গ) রহমাতুল্লিল আ’লামিন।

        মক্কার বণিকরা এর প্রমাণ জানতে চাইলে পাদ্রী বলেন যে, গাছ তাঁকে সেজদা করে, মেঘ তাঁকে ছায়া দেয় ও তাঁর আগমনে গীর্জার সামনের শুকনা বৃক্ষ পত্রে আচ্ছাদিত হয়ে যায়। (তখন হুজুর (ﷺ) এর বয়স ছিল মাত্র ১২ বৎসর।)

১১। মা আমেনা (عليه السلام) গর্ভাবস্থায় ০৯ মাসে নয় জন নবীকে স্বপ্নে দেখেন-যাঁরা “সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের” আগমন বার্তা পৌঁছে দেন। হুজুর (ﷺ) ৪০ বৎসর বয়সে নবী হলে জন্মে “সর্বশ্রেষ্ঠ মানব” হন কেমন করে? নবী না হলে তো নবুয়তের পূর্বে অন্যান্য নবীগণের উপর মর্যাদা দেওয়া যায় না।

১২। তাই আমরা ২৩ বৎসরের জীবন ও সিরাতের মধ্যে সীমিত না করে নবীজি (ﷺ) এর জন্মের পূর্ব হতে জন্মের পর অর্থাৎ সমগ্র জীবনের উপরই আলোচনা করি এবং গুরুত্ব দেই। তাই আমরা সিরাতুন্নবী বা দাওয়াতুন্নবী নয় মিলাদুন্নবীতেই বিশ্বাস করি এবং যথাযথভাবে উদযাপন করি।

১৩। সিরাতুন্নবী {মূলত শব্দটি হওয়া উচিত আখলাকুন্নবী} পালনকারীরাও সওয়াব পাবে, কিন্তু মিলাদুন্নবী পালনকারীদের বাড়তি পাওনা হলো হুজুর (ﷺ)এর মহব্বত। কিন্তু মিলাদুন্নবী অস্বীকার করা বদনসিবী।

১৪। আমরা হুজুর (ﷺ)এর ওফাত দিবস পালন করি না। কারণ আল্লাহ্ যখন তাঁর কোন নবীর উম্মতের উপর খাস রহমত করতে চান, তখন তাদের নবীকে বেছাল দান করে তাদেরকে শাফায়াতের ছামান দান করেন। আর যদি কোন জাতির ধ্বংস কামনা করেন, তখন ঐ নবীর জীবদ্দশায়ই তাদেরে আযাবে নিপতিত করে হালাক করে দেন এবং ঐ নবীকে চোখের শীতলতা দান করেন। তাই হুজুর (ﷺ) এর ওফাত সম্বন্ধীয় মাহফিল উচিত নয়।

১৫। হাশরের মাঠে তিনি (ﷺ) শাফায়াতে কোবরার অধিকারী হবেন, তাঁর হাতে থাকবে হামদের পতাকা এবং তিনি মাকামে মাহমুদে বসে উম্মত তরাবেন (সুপারিশ করবেন এবং যাকে ইচ্ছা বেহেশত দান করবেন, আল্লাহর ইচ্ছায়)। (মেশকাত শরীফ)

১৬। এই নবীকে পাওয়ার আশায় শতশত আম্বিয়া মক্কা নগরীতে এসে জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করেছেন যাদের মাজার হাজরে আসওয়াদ ও যমযমের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) এর মতে এই সংখ্যা-৩০০।

১৭। হাশরের মাঠে সকল নবীগণের অনুসারীদের কাতার হবে ২০টি এবং আমাদের নবীজি (ﷺ) এর অনুসারীদের হবে ৮০টি।

১৮। ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালন হলোঃ

        ক) আল্লাহর সুন্নাত।

        খ) নবীগণের সুন্নাত।

        গ) আমাদের নবী (ﷺ) এর সুন্নাত (আক্বীকা ও রোজা)।

        ঘ) সাহাবাগণের সুন্নাত।

        ঙ) বুজুর্গানে দ্বীনগণের সুন্নাত।

        চ) কেয়াস দ্বারাও প্রমানিত (শুক্রবার উত্তমদিন, কেননা এই দিনে আদম (عليه السلام) জন্ম গ্রহন করেছেন।)

১৯। যেই নবীর উসিলায় আদম (عليه السلام) মুক্তি পান, যেই নবীর নামের বরকতে আরশের কম্পন বন্ধ হয়ে যায়, যেই নবীকে কবরে না চিনলে জান্নাত পাওয়া যাবে না, যেই নবীর উম্মত হওয়ার জন্য ঈসা (عليه السلام) কাঁদতেন-সেই নবীর শানে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপনকে যেন আমরা গনিমত মনে করি।


কিছু আপত্তি ও তার খন্ডন

আপত্তি নং ১ঃ- একজন বাদশা কর্তৃক প্রবর্তিত ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন নাজায়েয নয় কি? 

আপত্তি নং ১ঃ- একজন বাদশা কর্তৃক প্রবর্তিত ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন নাজায়েয নয় কি? (এই বাদশা ছিলেন উত্তর ইরাকের ইরবিলের বাদশা মুজাফ্ফর বিন কাওকাবারী, যিনি ছিলেন সালাউদ্দিন আইয়ূবী (رحمة الله) এর ভগ্নিপতি এবং অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ও পরহেজগার ব্যক্তি।)

আপত্তির খন্ডনঃ- বাদশা হাজ্জাজ বিন ইউছুফ পবিত্র কোরআনের নুকতার প্রবর্তণ করে। অথচ নুকতা তো নাজায়েয নয়। নুকতা না হলে আজ আমাদের কি অবস্থাই না হতো। তাছাড়া ইয়েমেনের তুব্বা বাদশা কাবার গিলাফ চড়ানোর প্রথার সূচনা করেন। হুজুর (ﷺ) বাদশা তুব্বা কর্তৃক প্রবর্তিত প্রথা তো রদ করেননি এবং অদ্যাবদি ইহার প্রচলন জারি রয়েছে।

সুতরাং একজন বাদশা কর্তৃক প্রবর্তিত ঈদে মিলাদুন্নবী বৈধ হওয়ার বিষয়ে সম্ভবত এই দুই উদাহরণই যথেষ্ঠ বলে মনে করি। তাছাড়া ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন বাদশা মুজাফ্ফরের পূর্বেও প্রচলিত ছিল, কিন্তু তিনি রাষ্ট্রিয়ভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইহার প্রচলন শুরু করেন।


আপত্তি নং ২ঃ- আমরা হুজুর (ﷺ) এর বিলাদতের জন্য ঈদ উদযাপন করি, কিন্তু একই তারিখে ওফাত হয়েছে- তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করিনা কেন?

আপত্তির খন্ডনঃ- হুজুর (ﷺ) হায়াতুন্নবী তাই আমরা দুঃখ প্রকাশ করিনা। হায়ান্নবী বলেই তিনি (ﷺ) আমাদের দুরূদ শুনেন ও যিয়ারতকারীদেরে চিনেন। তাছাড়া আমরা আত্মার উপর জুলুম করলে আল্লাহ আমাদেরে নবীর দরবারে হাজির হওয়ার নির্দেশ করেছেন, যা হায়াতুন্নবী হওয়ারই প্রমাণ। পবিত্র কোরআন অনুযায়ী শহিদগণ জিন্দা। সে হিসেবে হুজুর (ﷺ) তো আরো উত্তমরূপে জিন্দা। আর আমাদের শরয়ী বিধান অনুযায়ী মৃত্যুর পর ৩ দিনের বেশী দুঃখ প্রকাশ জায়েয নয়। তাই সাড়ে চৌদ্দশত বছর পর কেন আমরা দুঃখ প্রকাশ করব ?


আপত্তি নং ৩ঃ- শরিয়ত মোতাবেক ঈদের দিনে রোজা রাখা নাজায়েয। ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর দিন ঈদ হলে ঐ দিন কেন আমরা রোজা রাখি?

আপত্তির খন্ডনঃ- আমাদের শরিয়াতে শুক্রবারও ঈদ। অথচ হাদিস অনুযায়ী শুক্রবারের সাথে একদিন মিলিয়ে ২ দিন রোজা রাখার বৈধতা রয়েছে। ছহীহ্ হাদিস অনুযায়ী আরাফার দিনও আমাদের ঈদ, অথচ ঐ দিনও আমাদের জন্য রোজা রাখা বৈধ। কাজেই ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে রোজা রাখা নাজায়েয হবে কেন ?


---ঃ---

মিলাদ, কিয়াম ও তাজিম

১। বর্তমান জামানায় দরূদ, মিলাদ, কিয়াম ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মতভেদ ও ফিৎনা বিরাজমান। দীর্ঘ দিনের এই প্রচলিত আমলকে আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীগন আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। কিন্তু বর্তমানে কিছু সংখ্যক লোক ইহাকে অস্বীকার করে, এমন কি বেদআত/হারাম আখ্যায়িত করে। কেউ আবার দরূদ/মিলাদ মানলেও কিয়ামের ঘোর বিরোধী। তাই আমরা চেষ্টা করব কোরআন-হাদীস ও ইজমা-কিয়াসের আলোকে এই বিষয়টির ফয়সালা তথায় বৈধতা নিরূপন করতে।

২। নবী করিম (ﷺ) এর সুন্নাত হলো ০৩ প্রকারেরঃ-

ক) কাওলী- যা হুজুর (ﷺ) বলেছেন।

খ) আমলী- যা হুজুর (ﷺ) আমল করেছেন।

গ) তাকরীরি- যে সমস্ত বিষয়ে হুজুর (ﷺ) নিজে দেখে বা অবগত হয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন কিম্বা নিষেধ বা আপত্তি করেন নাই।

এখন আমাদের বুঝতে সহজ হবে হাদীসের আলোকে দরূদ, মিলাদ, কিয়াম, তাজিম ইত্যাদি আদৌ বৈধ কিনা।

৩। দরূদ- ইহা ফার্সি শব্দ। কুরআনে দরূদ হলো “ছল্লু”। ইহার অর্থ হলো হুজুর (ﷺ) এর প্রতি অনুগ্রহ প্রেরণ বা দোয়া করা। অতএব, দরূদ কোরআন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ্ নিজে ফেরেশতাগনকে নিয়ে ছল্লু করেন এবং মু’মিনদিগকে ছল্লু (দরূদ) ও সালাম, তাসলিমার সাথে প্রেরনের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তাসলিমা অর্থাৎ যথাযথভাবে বা তাজিমের সাথে প্রেরনের নির্দেশ দ্বারা তাজিমকেও আল্লাহ্ প্রতিষ্ঠা করেছেন (৩৩ : ৫৬- আহ্যাব)। মিলাদে কিয়ামই হলো তাজিম।

৪। মিলাদ ও মওলুদ- ইহা একই জিনিষ। ইহা হলো কারো জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করা। আর যখন “মিলাদ শরীফ” বলা হয়, তা হলো একমাত্র আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করা। ইহা রহমন-বরকত প্রাপ্তির জন্য করা হয়। ইহা কোরআন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ নিজেই অনেক নবী রাসূলের জন্ম বৃত্তান্ত পবিত্র কুরআনে আলোচনা করেছেন।

৫। কিয়াম- কিয়াম হলো দাঁড়ানো। ইহা হুজুর (ﷺ) এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত শুনার সময় করা হয়। ইহা একটি সুন্নাত/মুস্তাহাব আমল। সাধারনত যারা মিলাদ মানে ও কিয়াম করে তারা হলেন সুন্নী ও আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী। হাদীস অনুসারে বহু প্রকারের কিয়াম আছে। তন্মধ্যে মূখ্য হলো নিম্নোক্ত ০৭ প্রকারঃ-

ক) কিয়ামুল ইস্তেকবাল- অভ্যর্থনা/

খ) কিয়ামুল মুহাব্বা- মহব্বত/

গ) কিয়ামুল ফারহা- খুশী/

ঘ) কিয়ামুল তাজিম- সম্মান/

ঙ) কিয়ামুল ইকরামুল ইনসানী- মানবতা/ (হুজুর (ﷺ) মৃত ইহুদীর লাশ অতিক্রম করার সময় দাঁড়িয়েছিলেন)

চ) কিয়ামুল যিকির- নাত/

ছ) কিয়ামুল সালাম- আনন্দ/তাজিম/মহব্বত/যিকির ইত্যাদি কিম্বা এদের এক বা একাধিকের সমন্বয়।

৬। অনেকে বলেন, দরূদ, মিলাদ, কিয়াম- এ’সব উপমহাদেশীয় সংস্করন। আসলে বিষয়টা তেমন নয়। উদাহরনঃ-

ক) তিরমিযী শরীফে মিলাদের একটা আলাদা অধ্যায় রয়েছে।

খ) বোখারী ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থেও মিলাদ শব্দ বিদ্যমান।

গ) ইমামুল মোহাদ্দেসীন ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله) মিলাদের উপর আলাদা কিতাব লিখেছেন।

ঘ) সর্বমোট ৩৮জন নাথ পরিবেশনকারী হুজুর (ﷺ) এর জীবদ্দশায় নাথ/মিলাদ সংক্রান্ত গজল লিখেছেন এবং পেশ করেছেন।

ঙ) এমনকি ০৪জন খলিফা ও মা ফাতেমা (رضي الله عنه) নাথ লিখেছেন এবং হুজুর (ﷺ) কে শুনিয়েছেন। ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও নাথ রচনা করে হুজুর (ﷺ) এর অনুমতিক্রমে তা শুনিয়েছেন। তাবুকের যুদ্ধ শেষে ৩০,০০০ যোদ্ধার (সাহাবীগণ) সামনে আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক পেশকৃত নাতে রাসূল তো সু-প্রসিদ্ধ।


তাজিমের দলিল

১। বোখারী ও তিরমিযী শরীফে হস্ত ও পদ চুম্বন সংক্রান্ত আলাদা অধ্যায় রয়েছে- আদবের আওতায়। তাছাড়া ইমাম বোখারী কর্তৃক প্রণিত আল কিতাবুল মুফরাদ গ্রন্থেও হস্ত এবং পদ চুম্বনের আলাদা অধ্যায় রয়েছে। (অধ্যায়- ৪৪৫- হস্ত চুম্বন এবং অধ্যায়- ৪৪৬- পদচুম্বন)

২। আবু দাউদ শরীফ

ক) হাদীস নং-৫১৩৫, হস্ত চুম্বন।

খ) হাদীস নং-৫১৩৬, শরীর চুম্বন।

গ) হাদীস নং-৫১৩৭, হস্ত ও পদ চুম্বন।

ঘ) হাদীস নং-৫১২৭ ও ৫১২৮, সা’আদ ইবনে মুআয (رضي الله عنه) অর্থাৎ অন্যের জন্য সম্মানসূচক কিয়াম।


মিলাদ-কিয়ামের উদাহরণ, দলিল ও ফজিলত

১। একবার হযরত সা’আদ ইবনে মু’আয (رضي الله عنه) হুজুর (ﷺ) এর দরবারে এলে হুজুর (ﷺ) নিজে দাঁড়ান এবং মুআযের গোত্রের আনসারগনকে তাদের সর্দারের আগমনে অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন।

২। একবার হযরত আকরামা (رضي الله عنه) হুজুর (ﷺ) এর দরবারে উপস্থিত হলে তিনি (ﷺ) খুশীতে/আনন্দে দাঁড়িয়ে যান।

৩। একবার যায়েদ বিন হারেসা (رضي الله عنه) হুজুর (ﷺ) এর ঘরে আগমন করলে, তখন হুজুর (ﷺ) তাকে অভ্যর্থনা জানানো এবং আনন্দ ও মহব্বত প্রকাশের জন্য দাঁড়িয়ে যান এবং চুম্বন করেন।

৪। হুজুর (ﷺ) মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর হুজরার মধ্যে দাখিল হওয়া পর্যন্ত সাহাবায়ে কেরামগন হুজুর (ﷺ) এর তাজিম ও সম্মানে দাঁড়িয়ে থাকতেন।

৫। হুজুর (ﷺ) যখন তাঁর হুজরা থেকে বের হতেন তখন দেখা মাত্র সাহাবীগন তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতেন।

৬। ঈসা (عليه السلام) ইঞ্জিল কিতাবে হুজুর (ﷺ) এর আগমন সংক্রান্ত বর্ণনা করার সময় কিয়াম করতেন।

৭। মি’রাজের রজনীতে মূসা (عليه السلام) নিজ কবরে দাঁড়িয়ে হুজুর (ﷺ) এর সম্মানে সালাত ও সালাম করেছিলেন।

৮। মা ফাতেমা (رضي الله عنه) হুজুর (ﷺ) এর হুজরায় তাশরিফ আনলে হুজুর (ﷺ) নিজে দাঁড়িয়ে যেতেন, হস্ত চুম্বন করতেন এবং নিজের আসন ছেড়ে দিতেন। মা ফাতেমা (رضي الله عنه) ও হুজুর (ﷺ) তাশরিফ আনলে রাসূল (ﷺ) এর সম্মানে একই আমল করতেন।

৯। হাসান বিন সাব্বিত (رضي الله عنه) কিয়ামরত অবস্থায় হুজুর (ﷺ) এর উপস্থিতিতে হুজুর (ﷺ) এর গৌরব গাঁথা পেশ করতেন। এমন কি হুজুর (ﷺ) সাব্বিত (رضي الله عنه) এর জন্য মিম্বার তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন।

১০। মিলাদ-কিয়ামের উদ্দেশ্য হলো হুজুর (ﷺ) এর জন্য তাজিম, মহব্বত ও খুশী প্রকাশ করা। ইহুদীরা পর্যন্ত হুজুর (ﷺ) কে তাজিম করত, এমন কি হস্ত ও পদ চুম্বন করত।

১১। মিলাদ-কিয়ামের সময় হুজুর (ﷺ) হাযির আছেন/কিম্বা হবেন- এই ধারনা নিয়ে কিয়াম/দাঁড়ানো অবৈধ (যদিও হুজুর (ﷺ) হাযির হওয়ার ক্ষমতা রাখেন- কারন তিনি হাযির-নাযির)। কিন্তু মহব্বতে, তাজিমে বা আনন্দ প্রকাশের জন্য কিয়াম করা বৈধ-যা আমরা করি।

১২। আবার কেউ যদি আশা করে লোক তার উদ্দেশ্যে দাঁড়াবে কিম্বা কিয়াম করবে কিম্বা হস্ত-পদ চুম্বন করবে - তবে তা নিষিদ্ধ এবং ইসলাম সম্মত নয়। যদি কেউ স্বেচ্ছায় সম্মানে/তাজিমে/মহব্বতে/আনন্দে তা’ করল- তবে তা বৈধ।

১৩। নূর স্বশরীরে উপস্থিত হতে পারে। যেমনঃ-

ক) মূসা (عليه السلام) এর নিকট আজরাইল (عليه السلام) পৌঁছলে মূসা (عليه السلام) তাকে থাপ্পড় দেন- ফলে চক্ষু বেরিয়ে আসে। (বোখারী- ৩১৫৯)

খ) জিব্রাইল (عليه السلام) বশর/মানুষের আকৃতিতে মরিয়ম (عليه السلام) নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন (কুরআন)।

গ) জিব্রাইল (عليه السلام) দেহিয়া কালবী (رضي الله عنه) এর সূরতে হুজুর (ﷺ) এর দরবারে কখনো কখনো উপস্থিত হতেন।

১৪। ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله), জালাল উদ্দিন সূয়ুতী (رحمة الله), মোল্লা আলী কারী (رحمة الله), আবদুল হক মোহাদ্দেস (رحمة الله), হাজী এমদাদ উল্লাহ মোহজেরে মক্কী (رحمة الله) সহ সকল মোহাদ্দেস, মোফাস্সের ও বিখ্যাত বুজুর্গানে দ্বীন ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ), দরূদ, মিলাদ, কিয়াম ইত্যাদিতে বিশ্বাস করতেন ও আমল করতেন।

১৫। হাদীস- কোন ব্যাক্তি যখন আমার প্রতি সালাম পেশ করে আল্লাহ্পাক আমার রুহ ফেরত দিয়ে দেন যাতে করে আমি সালামের জবাব প্রদান করতে পারি। (সুনানে আবু দাউদ)

১৬। একটি হাদীস অনুযায়ী জানা যায় হুজুর (ﷺ) কে সালাম দিলে, আল্লাহ্ তাঁর রূহ মোবারক ফিরৎ দেন এবং তিনি সালামের জবাব দেন। কিন্তু বাস্তবে হুজুর (ﷺ) এর রূহ মোবারক উত্তমস্থানে অর্থাৎ তাঁর (ﷺ) দেহ মুবারকেই রক্ষিত। তাঁর রূহ মোবারক বারংবার দেহ থেকে বের করে নেওয়া এবং দরূদ-সালাম পেশ করলে জবাবের জন্য ফেরৎ দেওয়া- এমনটা হয় না। কারনঃ-

ক) ইহা তাঁর শানের খেলাফ ও কষ্টদায়ক।

খ) হুজুর (ﷺ) এর উপর পৃথিবীর কোথাও না কোথাও হতে উম্মত প্রতিনিয়তই সালাম পেশ করতে থাকেন। নামাজেও সালাম আছে।

গ) ৭০ হাজার ফেরেশ্তা সার্বক্ষনিক তওয়াফ ও দরূদ-সালাম পেশ করছেন।

ঘ) মহান রাব্বুল আ’লামিন সার্বক্ষনিক ফেরেশতাদের নিয়ে হুজুর (ﷺ) উপর দরূদ পাঠাচ্ছেন।

কাজেই হুজুর (ﷺ) এর রূহ মোবারক দেহ হতে বের হওয়ার আর সুযোগই বা কোথায়?

১৭। যে কসরতের সাথে দরূদ পড়ে ও দায়েমীভাবে জারি রাখে, সে সাহেবে হুজুরী হাসিল করবে, এবং হুজুর (ﷺ) এর দরবার পর্যন্ত পৌছে যাবে এমন কি তার স্বপ্নেই নয় রবং জাগ্রত অবস্থায়ও দীদার নসীব হবে। (হাদীস- যে স্বপ্নে হুজুর (ﷺ) দীদার লাভ করল, অচীরেই সে জাগ্রত অবস্থায়ও দীদার লাভ করবে।)

১৮। দরূদ পুলসিরাত পার করিয়ে দিবে।

১৯। দরূদ বান্দাকে আখিরাতে আল্লাহর বারগাহে প্রবেশ করিয়ে দিবে।

২০। দরূদ ব্যতিত কোন মজলিস সমাপ্ত হলে- তাদের বদনসীবি।

২১। সঠিকভাবে দরূদ পাঠকারীর গুনাহ ০৩ দিন পর্যন্ত না লিখার জন্য আল্লাহ্ ফেরেশতাকে নির্দেশ দেন।

২২। হাদীস- বদনসীব ঐ লোকের যে আমাকে দেখবে না। কারা দেখবে না (প্রশ্ন করলে)- যারা বখীল। কারা বখীল- যারা হুজুর (ﷺ) এর নাম মোবারক শুনে দরূদ পাঠ করবে না।

২৩। দরূদের বিশেষ রাজ/গুপ্ত রহস্য হলো এই যে, নবী (ﷺ) এর নাম শুনামাত্র যদি কেউ দরূদ পাঠ করে, তাৎক্ষনিক বিশেষভাবে নিয়োজিত ০২ জন ফেরেশতা বলে উঠেন, “আল্লাহ্ তোমাকে মাফ করে দিন।” আর এই দোয়ার সাথে সাথে স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জতও বলে উঠেন, “আমীন।” -রাবী- ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর সাহেবজাদী।

২৪। পরিপূর্ণ পবিত্রতা এবং খুব মনোযোগ ও যতেœর সহিত সুন্দরভাবে খুশুখুযুর সাথে দরূদ ও সালাম পেশ করতে হবে। কারন ইহা মদীনা মনোয়ারায় রওজা আকদাসে পৌছানো হয়।

২৫। গোসল, অজু ও পরিপূর্ণ পবিত্রতার সহিত কলেমা শাহাদাৎ পড়ে দরূদ শুরু করবে।

২৬। বৃহস্পতিবার রাত ও জুম্মার দিন বেশী বেশী দরূদ পড়। কারন ঐ দিন সোনার কলম ও চান্দির কাগজ নিয়ে বিশেষ ফেরেশতা প্রেরিত হয়- বেশী দরূদ পাঠকারীদের নাম তালিকাভূক্তির জন্য।

২৭। তুমি ০১ বার দরূদ পড়লে আল্লাহ্ তোমার উপরে ১০ বার দরূদ পাঠাবেন। মেশকাত শরীফে (হাদীস নং-৮৭৪) ৭০ বার আল্লাহ্ কর্তৃক দরূদ পাঠানোর কথা বলা আছে।

২৮। কিয়ামতের দিন দরূদ পাঠকারীর নাম হুজুর (ﷺ) এর নিকট পেশ করা হবে (শাফায়াতের জন্য)।

২৯। যে যত বেশী দরূদ পড়বে তার তত বেশী হুজুর (ﷺ) এর নৈকট্য ও হুজুরী নসীব হবে।

৩০। হাদীস- কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তিই আমার সব চাইতে বেশী নিকটতম হতে সক্ষম হবে যে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশী দরূদ ও সালাম পেশ করবে (তিরমিযী)। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অধিক দরূদ পাঠকারীকে হুজুর (ﷺ) সাথে সাথে রাখবেন এবং আশা করা যায় সে বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে। (দারোগার কি সাধ্য প্রধান মন্ত্রীর কাছ থেকে আসামীকে ছিনিয়ে নেয়)

৩১। হাশরের মাঠে হুজুর (ﷺ) দরূদ পাঠকারীকে দরূদের বরকতে চিনতে পারবেন- যেমন তিনি মদিনায় বসে মক্কার সালাম দাতা পাথকে চিনার কথা বলেছেন।

৩২। হুজুর (ﷺ) নিজের জন্ম বৃত্তান্ত নিজেই অসংখ্যবার বর্ণনা করেছেন।

৩৩। পবিত্র কুরআনে হুজুর (ﷺ) সহ বেশ কিছু নবী-রাসূলের জন্ম বৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। মিলাদ-কিয়ামের অনুষ্ঠানে আমরাও হুজুর (ﷺ)এর জন্ম ও জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করে থাকি।

৩৪। আদম (عليه السلام) থেকে ঈসা (عليه السلام) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণ হুজুর (ﷺ) এর জন্মের আলোচনা/মিলাদ ও কিয়াম করেছেন। ঈসা (عليه السلام) ইঞ্জিল কিতাবে হুজুর (ﷺ) এর আগমন সংক্রান্ত বর্ণনা পড়ার সময় কিয়াম করতেন।

৩৫। যেই দিন হুজুর (ﷺ) মাতৃগর্ভে এলেন- ঐ রজনীতে কোরাইশদের গৃহপালিত পশুগুলো বলাবলি করছিল- আজ সমস্ত পৃথিবীর চেরাগ মাতৃগর্ভে এসেছেন এবং আনন্দ করছিল। কিন্তু শয়তান আজকের মত ঐ দিনও খুব নারাজ ছিল এবং কান্নাকাটি করেছে।

৩৬। হাদীস- ‘তোমরা আমার উপর বেশী করে দরূদ শরীফ পাঠ কর। কেননা তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়।’ (এই পর্যায়ে এক সাহাবী ইন্তেকালের পর কি হবে তা জানতে চান)। তখনও আমি তোমাদের দরূদ শুনব কেননা আল্লাহ্ তা’য়ালা এ জমিনের জন্য সম্মানিত নবীগণের দেহ ভক্ষন করা হারাম করে দিয়েছেন।

৩৭। হাদীস- আম্বিয়ায়ে কেরাম নিজ নিজ কবরে জীবিত আছেন এবং নামাযও পড়েন। (দায়লামী/ফতহুল বারী/বায়হাকী)

৩৮। হাদীস- ঈসা (عليه السلام) দুনিয়ায় অবতীর্ণ হওয়ার পর এক পর্যায়ে হজ্জ/ওমরার জন্য বের হবেন এবং ‘নিশ্চয় তিনি আমার কবরে আসবেন। আর আমাকে সালাম দিবেন। আর আমি নিশ্চয় তাকে উত্তর দিব।’ (হাকিম- আল- মুসতাদরাক)

৩৯। আদম (عليه السلام) এর বিবাহের মাহর ছিল- ৩ বা ২০বার দরূদ শরীফ পাঠ করা।

৪০। ১১:১২০ (হুদ)- আর রাসূলগনের কাহিনী থেকে সবকিছু আমরা আপনার কাছে বর্ণনা করেছি এই জন্য যে, সে সবের দ্বারা আমরা আপনার চিত্তকে বলিষ্ঠ করব।

নোটঃ অন্য নবীদের জীবন বৃত্তান্ত যদি চিত্তকে বলিষ্ঠ করে, তবে আমাদের নবী (ﷺ) এর আলোচনা আমাদিগকে অবশ্যই উজ্জীবিত করবে বৈকি? মিলাদ-কিয়ামেতো হুজুর (ﷺ)এর গুনগান এবং আলোচনাই করা হয়।

৪১। ১০ : ৫৮ (ইউনূস)- قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا এই আয়াতে ফজল ও রহমত বলতে হুজুর (ﷺ) কেই বুঝানো হয়েছে। তাই তাঁর আগমন উপলক্ষে আনন্দ করা জরুরী। (তাফছিরে দূররে মনসুর- সূয়ুতী (رحمة الله)

মৃত্যুর পর হুজুর (ﷺ) এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁর তাজিম করা এইরূপ ওয়াজিব যেমন তাঁর জীবদ্দশায় ওয়াজিব ছিল। (আশ শিফা- কাজী আয়ায (رحمة الله))

৪৩। ২২ : ৩২ (হাজ্জ)- وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعائِرَ اللَّهِ فَإِنَّها مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ যে আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করবে, সেটা তার কলবের তাকওয়ার পরিচারক হবে।

৪৪। আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে সব চাইতে বড় নিদর্শন ০৪টি- (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা- ওয়ালিউল্লাহ (رحمة الله)

        ১) কুরআন মজিদ, ২) কা’বা শরীফ, ৩) নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ৪) নামায।

৪৫। সম্মানী ব্যক্তির আগমনে যে কিয়াম করা হয় তা মুস্তাহাব- ইমাম নববী (رحمة الله)।

৪৬। শুভ সংবাদ শুনে দাঁড়িয়ে যাওয়া মুস্তাহাব- মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله)।

৪৭। হুজুর (ﷺ) তাঁর দুধ বাবা-মা আগমন করলে তাঁদের সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং নিজের চাদর/পাগড়ী বসার জন্য বিছিয়ে দিতেন। (আবু দাউদ- ৫২১৭, তিরমীজি- ৩৮৮৪)

৪৮। হুজুর (ﷺ) জানাযা/লাশ পাশ দিয়ে অতিবাহিত হওয়ার সময় দাঁড়িয়ে যান- যদিও তা ছিল এক ইহুদীর লাশ। (বুখারী- ১২৫০, মুসলিম- ৯৬১)

৪৯। কবরের লাশ তো আমরা দেখি না। তারপরও আমরা দাঁড়িয়ে কবর যিয়ারত করি (বসে কবর যিয়ারত মাক্রূহ)। এতে বুঝা গেল অনুপস্থিত ব্যক্তির সম্মানে দাঁড়ানো জায়েয।

৫০। নবীজি বলেননি যে কিয়াম করো না, বরং বলেছেন পারস্যবাসীদের মত কিয়াম করো না।

৫১। ইমাম বুখারী (رحمة الله) “আল আদাবুল মুফরাদ” কিতাবে সুন্নাহর আলোকে কিয়াম বৈধ হওয়ার উপর একটা অনুচ্ছেদ লিখেছেন।

৫২। হাদীস- জুম্মার দিন একবার দরূদ পড়লে আল্লাহ্পাক বান্দার ১০০টি প্রয়োজন মিটাবেন- ৩০টি দুনিয়ায় এবং ৭০টি আখেরাতে। (হযরত আনাস (رضي الله عنه)

৫৩। হাদীস- জুম্মার দিন ১০০ বার দরূদ পাঠ করলে আল্লাহ্ তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন।

৫৪। ইমাম জয়নাল আবেদীন (رحمة الله) এর মতে যারা অধিক সংখ্যক দরূদ ও সালাম পাঠ করে তারাই হলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভূক্ত/অনুসারী।


কিয়ামের আনুষ্ঠানিক যাত্রা

১। কিয়াম তো পূর্বেও হয়েছে, যেমনটা আমরা আলোচনা করেছি। কিন্তু ইহা আনুষ্ঠানিকরূপ ধারণ করে ৭ম শতক হিজরী হতে। বর্ণনা-ইমাম তকিউদ্দিন সুবকী (رحمة الله) (৬৭৩-৭৫৬ হিঃ) এর দরবারে অসংখ্য লোকের ও অনেক আলেম ওলামার উপস্থিতিতে হযরত আবু যাকারিয়া সারসারী (رحمة الله) কর্তৃক প্রনীত “দেওয়ান” নামক পুস্তক হতে হুজুর (ﷺ) এর কাসিদা পাঠ শুরু হয়। “রৌপ্যের পত্রে স্বর্নের কালি দ্বারা নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের প্রশংসা ও স্তুতি লিখা হলেও তা হবে খুবই সামান্য। তাঁর আলোচনা শুনার সময় সম্মানিত লোকেরা যদি দন্ডায়মান হয় এবং কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়ায়, আর আরোহী লোকেরা (তাদের) যান বাহনের উপর দাঁড়ায়, তাও হবে সামান্য শ্রদ্ধা। তোমরা জেনে রাখ যে, আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য অথবা তাঁর উচ্চ মর্যাদা রক্ষার্থে তাঁর নামটি আরশে লিখে রেখেছেন, যাতে সৃষ্টিকুল তাঁর সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে অবহিত হতে পারে।”

        এই কাসিদা শুনার পর ইহার মর্ম অনুযায়ী বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য ইমাম সুবকী (رحمة الله) দাঁড়িয়ে যান এবং তাঁর সঙ্গে সকল উপস্থিতি। ফলে এক অভূতপূর্ব হাল সৃষ্টি হয়। ইহার পর হতে সকল বুজুর্গানে দ্বীন এই আমল (কিয়াম) করে আসছেন। যেমনঃ-

ক) ইমামুল মোহাদ্দেসীন এবং ফতহুল বারীর প্রনেতা- ইবনে হাজর আসকালানী (র)।

খ) প্রখ্যাত মোফাস্সের এবং তফসিরে জালালাইনের প্রনেতা- জালালউদ্দিন সূয়ুতী (رحمة الله)।

গ) ইমাম কস্তলানী (رحمة الله)।

ঘ) আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী (رحمة الله)।

ঙ) হাজী ইমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী (رحمة الله), যিনি হলেন নিম্নোক্ত ওলামাগনের পীর-

১) হযরত কাসেম নানূতবী (رحمة الله)।

২) হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুঁহী (رحمة الله)।

৩) হযরত আশরাফ আলী থানভী (رحمة الله)।

        (আবার হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুঁহী (رحمة الله) হলেন উজানীর ক্বারী ইব্রাহিম (رحمة الله) এবং দিল্লীর তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস মেওয়াতী (رحمة الله) এর পীর।)


উপসংহার

১। কিয়াম ফরজ, ওয়াজিব বা সুন্নত নয়। ইহা একটি মুস্তাহাব আমল। যারা কিয়াম করে না তারা কিয়ামকারীদের বেদআতী বলে। অথচ কিয়ামকারীরা কিয়াম অস্বীকারকারীদের গালি দেয় না বা বেদআতী বলে না। আসলে কিন্তু কিয়াম একটি প্রতিষ্ঠিত আমল। হাদীসে আছে মুসলমানদের মতে যাহা উত্তম, তাহা আল্লাহর নিকট ও উত্তম বলে গণ্য। অর্থাৎ মুসলমানগণ যে কাজকে পছন্দনীয় বলে বিবেচনা করেন- তা’ আল্লাহর নিকট ও পছন্দনীয় (মুসলিম/ হাকেম/ তাবরানী)। মিলাদ-কিয়াম শত শত বৎসর পর্যন্ত পালিত হচ্ছে। উপরোক্ত হাদীসের আলোকে মিলাদ-কিয়াম অবশ্যই আল্লাহর নিকট একটি পছন্দনীয় আমল। আর যেই আমল আল্লাহ্ একবার পছন্দ করেছেন, পরবর্তীতে তিনি তা আবার অপছন্দ করবেন- এমনটা হতে পারে না।

২। হাদীস- আল্লাহ্ আমার সমস্ত উম্মতকে গোমরাহীর বিষয়ে কখনো ঐক্যমত করবেন না। কাজেই পূর্ব যুগের ইমামগণের স্বীকৃতির কারনে মিলাদ ও কিয়ামের বিষয়টি ইজমায়ে উম্মত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তাই শরিয়তের বিধান অনুযায়ী মিলাদ-কিয়াম এর মত একটি প্রতিষ্ঠিত আমলকে অস্বীকার করাই বরং গর্হিত অপরাধ।

৩। হাদীস- ‘সর্বোত্তম যুগ আমার যুগ। তারপর আমার সাহাবাদের যুগ। তারপর তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগ’। (এই যুগ ২২০ হিঃ পর্যন্ত ছিল)। উত্তম যুগের স্বীকৃত আমল বর্তমান যুগে এসে বাতিল হতে পারে না।

৪। এতদসত্বেও হক্কানী আলেম ওলামাগণ একটি মুস্তাহাব আমলের জন্য ফেৎনা সৃষ্টি করা উচিত নয় বলে মনে করেন এবং সংখ্যাধিক্যের উপর ভিত্তি করে আমল করার পরামর্শ দেন। মজার বিষয় হলো এই যে, যারা মিলাদ-কিয়ামের বিরুদ্ধে আজ সোচ্চার তাদের মুরুব্বিগণই পূর্বে নিজেরা মিলাদ-কিয়াম করেছেন কিম্বা ইহার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এমনকি ইদানিং তারা এই বিষয়ে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন এবং কিয়ামের সমর্থন করেছেন। আরো উল্লেখ্য, যারা কিয়াম করে তাদের মধ্যেও জান্নাতি হবে এবং যারা কিয়াম করেনা তাদের মধ্যেও। কিন্তু যারা ফেৎনা করে তারা হবে জাহান্নামী।

৫। যদি দাঁড়ানো অবস্থায় দরূদ ও সালাম পেশ করা হারাম বা নাজায়েয হয়, তবে জানাযার নামাজের দ্বিতীয় তাকবিরের পর রাসূল (ﷺ) এর প্রতি দাঁড়ানো অবস্থায় দরূদ ও সালাম পাঠ করা কি হবে ?

৬। ৩ : ১৯১ (আলে ইমরাম)-

 الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ

দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহ্কে স্মরনের কথা বলা হয়েছে। একই কথা সূরা নিসা (৪): আয়াত-১০৩ এ বর্ণিত আছে।

৭। মহান রাব্বুল আ’লামিন প্রিয় নবী (ﷺ) এর যিকিরকে নিজের যিকিরের অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছেন। যেমন-

ক) আমি আপনার যিকিরকে আমার যিকিরের অন্তর্ভূক্ত করে দিলাম। সুতরাং যে আপনার যিকির আদায় করল, সে যেন আমার যিকিরই পাঠ করল। (শেফা শরীফ)

খ) যখন আমার যিকির করা হবে, তখন আমার সাথে আপনার যিকিরও করতে হবে। (শেফা শরীফ)

যেহেতু রাসূল (ﷺ) এর যিকির ও আল্লাহর যিকির, সেহেতু রাসূল (ﷺ) এর যিকিরও দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে করা যাবে।

৮। রওজা শরীফ যিয়ারতের সময় আজও সকলে দাঁড়িয়েই হুজুর (ﷺ) কে সালাম পেশ করে।

৯। হুজুর (ﷺ) কে দাঁড়িয়ে সম্মান বা সালাম দেওয়া যাবে না, এমনটা কুরআন-হাদীসে কোথাও নাই। বরং ৪৮:৯ (ফাতহ্)-এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর হাবীব (ﷺ)কে সম্মান করার নির্দেশ করেছেন, ৭:১৫৭ (আ’রাফ) আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ বান্দাকে তার নিজস্ব সফলতার জন্য হুজুর (ﷺ)কে সম্মান করার পরামর্শ দিয়েছেন এবং ৩৩:৫৬ (আহযাব) আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরে “তাসলিমা” অর্থ তাজিমের সাথে হুজুর (ﷺ) এর প্রতি ‘ছল্লু’ অর্থ দরূদ পড়ার জন্য আদেশ করেছেন। তাই আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে প্রকৃত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীগণ হুজুর (ﷺ) এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য কিয়াম করে থাকেন। এতে আল্লাহর পবিত্র হুকুমের প্রতিপালন ব্যতিত অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। অতএব কিয়াম সম্পূর্ন বৈধ ও জায়েয একটি আমল।


---ঃ---

নূর নবী (ﷺ)

১। প্রথম বশর হলেন- আদম (عليه السلام)। কিন্তু নবী (ﷺ) আদম (عليه السلام) এর বহু পূর্বে সৃষ্ট। তাই তিনি (ﷺ) মাটির সৃষ্টি নন। তাঁর বাশারিয়তের সূরত প্রকাশ পায় দুনিয়ায় তাশরিফ আনার পর।

২। বিশ্বের সমস্ত কিছু নবী নূর হইতে সৃষ্ট। মানুষের শরীরে উপাদান হলো- মাটি, পানি, বাতাস ও আগুন এবং এ’গুলি অনেক পরের সৃষ্টি। তাই মাটি যদি ওনার পরে এবং ওনার নূর হতে সৃষ্ট হয়- তা’ হলে উনি মাটির হন কেমন করে?

৩। হুজুর (ﷺ) এর কোন ছায়া ছিল না। চন্দ্র, সূর্য, কিম্বা রাত্রের বাতির মধ্যে তাঁহার ছায়া হতো না। এটা তাঁর নূর হওয়ার প্রমাণ।

৪। তাঁহার সীনা ছাক (মোট ০৪ বার) করার সময় রক্তপাত হয়নি। ইহাও তাঁর নূর হওয়ার প্রমাণ।

৫। হাদিস- “আমি আদম (عليه السلام) সৃষ্টির ১৪০০০ বৎসর পূর্বে আমার প্রতিপালকের নিকট নূর হিসাবেই বিদ্যমান ছিলাম।” (তথাকার ০১দিন = পৃথিবীর ১০০০ বৎসর = ৫১১ কোটি বছর) (তাফছিরে রুহুল বয়ান)

৬। কাযী আয়ায কর্তৃক (শিফা শরীফে) বর্ণিত হাদীস- “আমি আদম (عليه السلام) এর সাথেই পৃথিবীতে নেমে এসেছি।”

৭। নূর হিসাবেই তিনি আদম (عليه السلام) ললাটে চমকাতেন এবং নূর হিসাবেই বিভিন্ন পবিত্র ঔরসে স্থানান্তারিত হতে থাকেন। (প্রথমে আদম (عليه السلام) এর ললাটে, তারপর ডান হাতে শাহাদাৎ আঙ্গুলীতে এরপরে পৃষ্ঠদেশে স্থাপন করা হয়। নূর পৃষ্ঠে স্থাপিত হলেও ইহার জ্যোতির ঝলক চমকাতো ললাটে।)

৮। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন মা আমেনা (رضي الله عنه) ব্যথা অনুভব করেননি। ওজন ও বোধ হয়নি। (খাসায়েসুলকুবরা)

৯। জন্মের পূর্বে আম্মাজানের গর্ভ হইতে একটি নূর বের হয়ে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত করে। হাদিস- “আমি আমার মায়ের দেখা সেই নূর।”

১০। মি’রাজে জিব্রাইল (عليه السلام) যেখানে যেতে পারেননি, তিনি (ﷺ) অবলিলায় সেই পথ পাড়ি দিয়েছেন। তিনি নূরী বলেই তা সম্ভব হয়েছিল।

১১। আমাদের তরিকার ও মাযহাবের ইমামগণ এবং বহু বুজুর্গ নূর হিসাবেই স্বীকার করেছেন।

১২। মা আয়েশা (رضي الله عنه) অন্ধকারে হুজুর (ﷺ) চেহারা মুবারকের নূরের ঝলকে ওনার সূই খুঁজে পান।

১৩। কুরআনে আল্লাহ্ নূর এসেছে বলেই জানিয়েছেন। (৫ঃ১৫-মায়িদা)

قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ  

“অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর (রাসূল) এবং সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।”(এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে মারেফুল কুরআন, আবি সউদ, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, ইবনে জারীর, কবীর, কুরতুবী, বায়জাভী ও মাযহারী সহ অধিকাংশ তফসীর গ্রন্থে একটি নূরকে কুরআন এবং অপর নূরকে হুজুর (ﷺ)কেই বুঝানো হয়েছে বলা হয়।)

১৪। পাথরের সৃষ্ট তুর পাহাড় আল্লাহর নূরের ছটায়/তাজাল্লীতে পুড়ে সুরমা হয়ে যায়, অথচ মূসা (عليه السلام) শুধু মাত্র বেহুশ হন (পুড়ে যাননি)। এ বিষয়ে আল্লাহ্ই ভাল জানেন মূসা (عليه السلام) নূরের ছিলেন না কী মাটির।

১৫। হযরত ওসমান (رضي الله عنه)কে জিননুরাইন (দুই নূরের অধিকারী) বলা হয়। কারন তিনি পরপর ০২জন নবী দুলারীকে শাদী করেছেন। এ ক্ষেত্রে নবী দুলারীগণও কী তা হলে নূর ছিলেন? (তা’ আল্লাহ্ই ভাল জানেন)।

১৬। হাদিস- “নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম আল্লাহ্ আমার নূর সৃষ্টি করেছেন”। (মাদারেজুন্নবুয়াত)

১৭। হাদিস- হে যাবের! সমস্ত কিছুর পূর্বে নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁর স্বীয় নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। (মাওয়াহিব)

১৮। হুজুর (ﷺ) কর্তৃক একরাত্রে অন্ধকারে পথ চলার জন্য ০২জন সাহাবীকে প্রদত্ত ০২টি লাঠি হতে নূর/আলোক রশ্মি বিচ্ছুরিত হয় এবং তাদের পথ আলোকিত করে।

১৯। তিনি (ﷺ) আল্লাহর পক্ষ হইতে নূর হিসাবে এসেছেন এবং দুনিয়াকে ঐ নূর দ্বারা আলোকিত করেছেন। তাই তো তিনি “সিরাজুম্মুন্নীরা”।

২০। ৪র্থ আসমানে একটি তারকা ৭০ হাজার বৎসর পর পর উদিত হইত। জিব্রাইল (عليه السلام) এই তারকা ৭২ হাজার বার উদিত হইতে দেখেছেন। হুজুর (ﷺ) ফরমান- আল্লাহর শপথ, আমিই সেই তারকা। (ঐ তারকা ছিল নূরের)।

২১। আদম (عليه السلام) মাথা উঠাইলে আরশের চৌকাঠে নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) দেখেন। আল্লাহ্কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে

-هذا نور نبي من ذريتك اسمه في السماء أحمد، وفي الأرض محمد، لولاه ما خلقتك ولا خلقت سماء ولا أرضًا

‘এটা তোমার বংশধর হতে একজন নবীর নূর। (যিনি) আসমানে আহমদ এবং জমিনে মুহাম্মদ। তাকে সৃষ্টি না করলে- আসমান জমীন কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’ (মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া)

২২। সাহাবায়ে কেরামগণের মধ্যে, কেউ তাঁকে পূর্ণিমার চাঁদের সাথে, কেউ উদিত সূর্যের সাথে, কেউ ঝলমলে সূর্যের মত, কেউ দাঁত মোবারক হতে আলোর ছটা, কেউ পছিনা/ঘাম মোবারক হতে নূরের বিকিরণ, কেউ চেহারা মোবারক হতে নূরের বিচ্ছুরন ইত্যাদি দেখেছেন বা তুলনা করেছেন। ইহা হুজুর (ﷺ) নূরানীয়াতেরই সাক্ষ্য বহন করে।

২৩। নবী করিম (ﷺ) এর ৩টি সূরত রয়েছে- বাশারী, মালাকী ও হাক্কী। এই ৩ সূরতের ব্যাখ্যা আমরা ৩টি হাদিসের মাধ্যমে জানতে পারি। যথা:

ক) সূরতে বাশারীর হাদিস: “আমি শুধু সুরতে বা আকৃতিতে তোমাদের মত মানুষ।”

খ) সুরতে মালাকির হাদিস: “আল্লাহর সাথে আমার এমন একটি ঘনিষ্ঠ সময় আসে-যেখানে কোন প্রেরিত নবী অথবা নিকটবর্তী কোন ফেরেশতাও আমার সমকক্ষ হতে পারে না।”

গ) সুরতে হাক্কীর হাদিস: “যে ব্যক্তি আমাকে দেখেছে, সে হক্ক-কেই দেখেছে।”


মালাকী ও হাক্কীর হাদিসদ্বয় 

হুজুর (ﷺ) নূরের হওয়াই প্রমাণ করে। কারণ মালাকী ও হাক্বী হালতো নূরী ব্যতীত অন্য কিছু নয়।

২৪। নবী করিম (ﷺ) সৃষ্টি ও অন্যান্য মানুষের সৃষ্টি-

ক) আদম (عليه السلام) পৃথিবীর মাটি দ্বারা সৃষ্ট।

খ) মা হাওয়া (عليه السلام) আদম (عليه السلام) এর বাম পাজরের নরম হাড় দ্বারা সৃষ্ট। (সূরা-নিসা; আয়াত:১, বুখারী-৩৩৩১,খন্ড-৪, পৃ:১৩৩ এবং মুসলিম-১৪৬৮, খন্ড-২, পৃ:১০৯১)

গ) ঈসা (عليه السلام) রুহ দ্বারা সৃষ্ট। তাইতো তিনি রুহুল্লাহ। (সূরা-আম্বিয়া; আয়াত:৯১ এবং সূরা-তাহরিম; আয়াত:১২)

ঘ) অন্যান্য মানব সন্তান- পিতা মাতার মিলিত বীর্যের নির্যাস দ্বারা সৃষ্ট। (ফুরকান/৫৪, তারিক/৫, মুরসালাত/২০ ও ২১ এবং মু’মিনুন/১২, ১৩ ও ১৪)

ঙ) কিন্তু হুজুর (ﷺ) আল্লাহর নূর হতে সৃষ্ট। (মায়েদা/১৫, তওবা/৩২, নূর/৩৫, আহযাব/৪৫ ও ৪৬ এবং সাফ/৮)

২৫। হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র দেহ মোবারক নূর হওয়ার পক্ষে বিশিষ্ট কিছু বুযুর্গ কর্তৃক বর্ণিত যুক্তি প্রমাণ নিম্নে প্রদত্ত্ব হল:-

ক) চন্দ্র সূর্যের আলোতে নবী করিম (ﷺ) এর দেহ মোবারকের ছায়া পড়ত না। কেননা তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর। (যুরকানী শরীফ, ৪র্থ খন্ড, ২১০ পৃ:)

খ) দিনের সূর্য্যরে আলো কিংবা রাতের চাঁদের আলো - কোনটাতেই হুজুর (ﷺ) এর দেহ মোবারকের ছায়া পড়ত না। কারন তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর। (ইমাম কাজী আয়্যাজ: শিফা শরীফ, ১ম খন্ড, ২৪২ পৃ:)

গ) এ কথা সর্বজন স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ যে, আমাদের হুজুর (ﷺ) এর দেহের ছায়া ছিলনা। কেননা আঁ হুজুর (ﷺ) মাথা মোবারক হতে পা মোবারক পর্যন্ত শুধু নূর আর নূর ছিলেন। (থানভী: শুকরে নেয়ামত, ৩৯ পৃ:)

ঘ) প্রদিপটি নিভে গেল এবং আমি সুঁচটি হারিয়ে ফেললাম। এ পরপরই নবী করিম (ﷺ) অন্ধকারে আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁর চেহারা মোবারকের নূরের জ্যোতিতে আমার অন্ধকার ঘর আলোকিত হল। আমি আমার হারানো সূইটি খুজে পেলাম। (ইবনে হাজার হায়তামী: আন নেয়ামাতুল কোবরা, ৪১ পৃ:)

ঙ) নবী করিম (ﷺ) মায়ের গর্ভেই যে নূর ছিলেন এর দলিল হচ্ছে, এ সময়ে বিবি আমেনা (عليه السلام) কোন ব্যাথ্যা বেদনা অনুভব করেননি এবং গর্ভবতী অন্যান্য মহিলাদের মত কোন আলামতও তাঁর ছিলনা। হুজুর (ﷺ) এর দেহ মোবারক যে মাতৃগর্ভে নূর ছিল ইহাই তার প্রমাণ। (মাওলানা আব্দুল আওয়াল জৈনপুরী)

চ) “হে প্রিয় রাসূল! আপনি আল্লাহর নূরের প্রতিচ্ছবি বা ছায়া। আপনার প্রতিটি অঙ্গই এক একটি নূরের টুকরা। নূরের যেমন ছায়া হয়না, তদ্রূপ ছায়ারও প্রতিচ্ছায়া হয়না”। (আ’লা হযরত: হাদায়েকে বকশিশ, ২য় খন্ড, ৭ পৃ:)

ছ) হযরত রাসূল করিম (ﷺ) এর সৃষ্টি কোন মানুষের সৃষ্টির মত নয়, কারণ আল্লাহ তাকে স্বীয় নূর দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। (ইমামে রব্বানী: মাকতুবাত, ৩য় জি: মাকতুব নং ১০০)

জ) হে জাবের! আল্লাহ তা’লা আপন নূরের ফয়েজ বা জ্যোতি হতে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। (থানভী: নশরুত্তিব, ৫ পৃ:)

ঝ) আল্লাহ তা’লা তাকে নূর বলে আখ্যায়িত করার কারণ হচ্ছে তিনি সকল দৃশ্য ও অদৃশ্য নূর সমূহের মূল উৎস। (তাফছিরে সাভী, সূরা মায়েদার ১৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়)

নোট: তিনি আদিতে নূর, মায়ের গর্ভেও নূর এবং দুনিয়াতেও দেহধারী নূর। সে নূরকে বাশারী সূরতে/খোলশে আবৃত করা হয়েছে। যেমন তারের কভারে বিদ্যুতকে আবৃত করা হয়।

২৬। আদম (عليه السلام) এর মধ্যে আল্লাহ্ রূহ ফুঁকে দেন। ঈসা (عليه السلام)ও আল্লাহর রূহ (এই জন্যই ঈসা আঃ কে রূহুল্লাহ বলা হয়)। এটার অর্থ এই নয় যে তারা দুইজনই আল্লাহর রূহের টুকরা বা অংশ বা আল্লাহ্ তাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। তেমনিভাবে হুজুর (ﷺ) নূর হওয়ার অর্থ এই যে, তিনি কোন মাধ্যম ব্যতিত প্রভুর ফয়েজ লাভ করেছেন। তবে ব্যক্তি মোহাম্মদী (ﷺ) এক কথা এবং হাকিকতে মোহাম্মদী (ﷺ) আর এক কথা। ব্যক্তি মোহাম্মদ হলেন মা আমেনা (عليه السلام) এর নয়ন মনি, মা আয়েশার (رضي الله عنه) এর শিরোমনি, মা ফাতেমা (رضي الله عنه) এর পিতা ইত্যাদি। আর হাকিকতে মোহাম্মদী (ﷺ) হলেন-আল্লাহ্ তা’য়ালার যাতী নূরের প্রথম তাজাল্লী। আর আল্লাহ্ হলেন সমস্ত তাজাল্লীর কেন্দ্রবিন্দু। ব্যক্তি মোহাম্মদ (ﷺ)- “হে নবী (ﷺ)! আপনি বলে দিন আমি তোমাদের মত বশর”। হাকীকতে মুহাম্মদী (ﷺ)- “আমি ঐ সময় নবী যখন আদম (عليه السلام) মাটি এবং পানির মধ্যে নিহিত।” এই ক্ষেত্রে তিনি আদম (عليه السلام) এর বংশোদ্ভূতও নন এবং আমাদের মত বশরও নন, তিনি কারো পিতাও নন এবং কারো সন্তানও নন। তিনি সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টির উৎস। তিনি তখনও নবী যখন বশরের উপাদান (মাটি, পানি, আগুন ও বাতাস) পর্যন্ত সৃষ্টি হয় নাই। তিনি বশরীয়তের খোলশে নূর; তিনি নূরে মুজাস্সাম। তাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আক্বীদা হলো তিনি “নূরানী বশর”।


---ঃ---

হায়াতুন্নবী (ﷺ)

১। ইহা একটি আক্বীদাগত বিষয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীগণের আক্বীদা হলো হুজুর (ﷺ) ওফাতে শুধু পর্দার আড়াল হয়েছেন এবং কবর জীবনে তিনি পরিপূর্ণভাবে স্বক্রিয়। কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীরা তা অস্বীকার করে। এমন কি তিনি মাটির মানুষ, মাটির সাথে মিশে গেছেন- এমন আক্বীদা পোষন করে। (নাউযুবিল্লাহ)

২। কবর জীবনে আযাব ও নিয়ামত আত্মা ও রূহের উপর ন্যাস্ত হয়। মৃত্যুর পর শরীর বিনষ্ট হলেও আত্মার সাথে শরীরের সম্পর্ক থাকে বলে আযাব/নিয়ামত কষ্ট/আনন্দ শরীরেও অনুভব হয়। যেমন দাঁতের ব্যথায় কষ্ট হয়, অথচ দাঁতে রূহ নাই। ইমাম সূয়ূতী, মোল্লা কারী (رحمة الله) বলেন- “প্রত্যেক শরীরের সাথে আত্মার গোপন সম্পর্ক থাকে।” যেমন সূর্য্য রশ্মির সাথে পৃথিবীর।

৩। হুজুর (ﷺ) এর কথা তো আলাদা- কেন না জমিনকে তাঁর দেহ মোবারক ভক্ষন করা হারাম করা হয়েছে। যাদের সাথে জিব্রাঈল (عليه السلام) কথা বলেছেন- তাদের দেহ ও মাটি ভক্ষন করতে পারে না।

৪। কুরআনে- ০২টি মৃত্যু ও ২টি জীবনের কথা বলা হয়েছে। সেই হিসাবেও তিনি হায়াতে। (প্রাণহীন থেকে প্রাণ দান আবার মৃত্যুর পর জীবিতকরণ, সূরা বাকারা: ২৮)

৫। কুরআন- মৃত পাখীরা ইব্রাহিম (عليه السلام) এর ডাকে সাড়া দিয়েছে।

৬। কুরআন- সালেহ (عليه السلام) নিজ জাতির ধ্বংসের পর তাদের সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ মৃতরা শুনে।

৭। কুরআন- ইব্রাহিম (عليه السلام) আবু কুবাইস পাহাড়ে উঠে হজ্জের ঘোষনা দেন। সবাই শুনেছেন এবং যারা লাব্বাইক বলেছেন তারা হজ্জ করবেন। অর্থাৎ রুহের জগত থেকেও মানুষ শুনতে পায়।

৮। কুরআন- বিভিন্ন আয়াত হতে জানা যায় আল্লাহ্ হুজুর (ﷺ) কে শাহীদ/সাক্ষী করেছেন। ইহা দ্বারা হায়াত ও হাযির-নাযির প্রমানিত।

৯। কুরআন-مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ যাহা আমাদিগকে বিপন্ন করে তা নবীর জন্য কষ্টদায়ক (৯ : ১২৮- তওবা)। হায়াতে না থাকলে তো কষ্ট অনুভব করার কথা নয়।

১০। কুরআন- নিজের আত্মার উপর যুলুম করলে নবীর কাছে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে-তিনি হায়াতে না থাকলে সুপারিশ করবেন কিভাবে?

১১। কুরআন- শহীদগণে তোমরা মৃত মনে করোনা। তারা রিজিকপ্রাপ্ত। নবী (ﷺ) ও শহীদ, তাই হায়াতে।

১২। হাদীস- যদি কেউ ভাল কাজের সূচনা করে তবে কিয়ামত পর্যন্ত ঐ ভাল কাজের সকল আমলকারীদের সওয়াব উদ্ভাবকের খাতায় লিখা হবে। শহীদগণতো হুজুর (ﷺ) এর ডাকে সাড়া দিয়েই শহীদ হন। তাই হুজুর (ﷺ) সকল শহীদের মর্যাদা পাবেন বরং তার চাইতেও বেশী। তাই তিনি জীবিত ও রিযিক প্রাপ্ত।

১৩। হাদীস- বদরের মাঠে দাফনকৃত কাফেরদের হুজুর (ﷺ) সম্বোধন করেছেন।

১৪। হাদীস- কবরের শাস্তির আওয়াজ চতুষ্পদ জন্তুরা শুনে। যে জীবিত তাকেই শাস্তি দেওয়া হয়।

১৫। হাদীস- কবরের প্রশ্ন-উত্তর। প্রশ্নতো শুধু যে শুনে তাকেই করা যায়।

১৬। হাদীস- হুজুর (ﷺ) এর সংস্পর্শের কারনে জড় বস্তুর (উস্তুনে হান্নানা) জীবন লাভ হয়। তা’হলে হুজুর (ﷺ) কি পরিমান জীবনের অধিকারী।

১৭। হাদীস- মি’রাজে মূসা (عليه السلام) এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। মূসা (عليه السلام) হায়াতে আছেন বলেই তা’ সম্ভব হয়েছে। অতএব, হুজুর (ﷺ) ও হায়াতে আছেন।

১৮। হাদীস- মৃতকে দাফনের পর দাফনকারীরা বাড়ীর দিকে ফিরলে ৪০ কদম পর্যন্ত মৃত ব্যক্তি তাদের জুতার মৃদু আওয়াজ শুনতে পায়।

১৯। হাদীস- নিশ্চয়ই মৃতকে ঐ সব বিষয় কষ্ট দেয় যা তাকে দুনিয়ায় কষ্ট দিত।

২০। হাদীস - মৃতের হাড্ডি ভাঙ্গাঁ জীবিতদের হাড্ডি ভাঙ্গাঁর নামান্তর।

২১। হাদীস- আমাদের আমল সমূহ আমাদের কবরবাসী আত্মীয়দের কাছে পেশ করা হয়। ভাল হলে খুশী হয়, মন্দ হলে কষ্ট পায়। হায়াতে না থাকলে দুঃখ-কষ্ট কি ভাবে পাবে ?

২২। হাদীস- নবীগণ নিজ নিজ কবরে জীবিত এবং তাঁরা নামায আদায় করেন।

২৩। হাদীস- প্রত্যেক জুমার দিন আমাদের সালাম নবীর দরবারে পেশ করা হয়। তাই ঐ দিন বেশী বেশী দরূদ সালাম পাঠানোর নির্দেশ রয়েছে।

২৪। হাদীস- হুজুর (ﷺ) আমাদের সালামের উত্তর দেন।

২৫। কবরবাসীদের আমরা সালাম দেই (ইয়া আহলাল কুবুর বলে)। সালাম দেওয়া-নেওয়ার জন্য শুনা আবশ্যক। ইয়া আহলাল কুবুর বলাও হায়াতের পরিচায়ক।

২৬। হাদীস- যে ব্যক্তি আমার ওফাতে যিয়ারত করল- সে যেন আমার জীবিত অবস্থায় যিয়ারত করল।

২৭। হাদীস- আমি আমার মহব্বতকারীদের দরূদ নিজে শুনি ও তাদেরকে জানি। (দালাইলুল খায়রাত-পৃ: ৮১)

২৮। হাদীস- বিভিন্ন হাদীসের আলোকে ইমাম যুরকানী (رحمة الله) বলেন- নবী ও শহীদগণ নিজ নিজ কবরে জীবিত, তাঁরা পানাহার করেন, নামায আদায় করেন, রোজা রাখেন ও হজ্জ আদায় করেন।

২৯। হাদীস- অসিয়ত অনুযায়ী আবু বকর (رضي الله عنه) এর মৃত দেহ রওজা মুবারকের নিকট নিয়ে হুজুর (ﷺ) এর পাশে দাফনের অনুমতি চাওয়া হলে জবাব আসে- ادخُلُوا الحبيب إِلَى حَبِيبه فَإِن الحبيب إِلَى الحبيب مشتاق “বন্ধুকে বন্ধুর সাথে মিলিত কর। কেন না বন্ধু বন্ধুর সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী।”

৩০। হাদীস- শেষ জামানায় ঈসা (عليه السلام) রওজা মুবারকের পাশে এসে “হে মুহাম্মদ” বলে ডাকবেন এবং উত্তর পাবেন।

৩১। হাদীস- দাফনের ০৩দিন পর এক বেদুঈন কুরআনের আয়াতের উল্লেখ করে নিজের জন্য ক্ষমার আবেদন করলে রওজা থেকে ঘোষনা আসে- “নিশ্চয় তোমাকে ক্ষমা করা হলো।”

৩২। হাদীস- মা আয়শা (رضي الله عنه) রওজা সংলগ্ন ঘর হতে পেরাক ও কিলের আওয়াজ শুনে খবর পাঠান যে, “তোমরা রাসূলকে কষ্ট দিওনা।”

৩৩। খলিফা আবুবকর ও ওমর (رضي الله عنه) লোকজনকে মসজিদে নববীতে উচ্চঃস্বরে কথা বলতে কঠোরভাবে বারন করতেন যেন হুজুর (ﷺ) কবরে কষ্ট না পান।

৩৪। হাদীস- ওমর (رضي الله عنه) এর দাফনের পর মা আয়েশা (رضي الله عنه) পর্দা করে হজুর (ﷺ) এর রওজায় যেতেন। (মিশকাত)

৩৫। “হাররার” ঘটনার ঐ তিন দিন হযরত সাঈদ ইবনে মুস্যায়িব (رضي الله عنه) রওজা মুবারক হতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় আযান ও ইকামতের আওয়াজ শুনতেন এবং তদনুসারে নিজেও নামাজ পড়তেন। (মিশকাত)

৩৬। আহমদ কবীর রেফাই (رحمة الله) (বাসরাবাসী) কর্তৃক ৫৫০ হিঃ তে হুজুর (ﷺ) এর নূরানী হস্ত মোবারক চুম্বনের সৌভাগ্য হাসিল করেন।

৩৭। হুজুর (ﷺ) ইমাম আবু হানীফা (رضي الله عنه) কে ইমামে আজম খেতাব প্রদান করেন।

৩৮। আজমেরী (رحمة الله) কে আতায়ে রাসূল (ﷺ) বলা হয়। কারণ তিনি হুজুর (ﷺ) হতে রওজা যিয়ারতের সময় খাস নেয়ামত প্রাপ্ত হন এবং ভারতে হিজরতের নির্দেশ পান।

৩৯। হাদীস- হুজুর (ﷺ) তিনবার বলেছেন, حَيَاتِي خَيْرٌ لَكُمْ “আমার জীবনও তোমাদের জন্য উত্তম।” তিনবার ইহাও বলেছেন,وَمَوْتِي خَيْرٌ لَكُمْ “আমার ওফাতও তোমাদের জন্য কল্যান।” কিভাবে তা’ জানতে চাইলে ফরমান- জীবন কল্যানময় এইজন্য যে তাঁর নিকট ওহী আসে এবং মানুষ হালাল-হারাম জেনে নেয়। আর মৃত্যু কল্যানময় এই জন্য যে, প্রতি বৃহস্পতিবার তাঁর নিকট আমল পেশ করা হয় ও ভাল হলে তিনি (ﷺ) আল্লাহর প্রশংসা করেন, আর মন্দ হলে পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

৪০। নামাজে কিয়ামত পর্যন্ত তাশাহুদ পাঠ করা হবে (যাতে সালাম রয়েছে), যা নবী (ﷺ) এর জীবনের প্রমাণ।

৪১। ইমাম আবু হানীফা (رضي الله عنه)- যিয়ারতকারীর উচিত কবরের দিকে মুখ করা এবং কিবলাকে পিছনে রাখা যাতে মৃত তাহাকে সহজে চিনতে পারে।

৪২। রাসূল নোমা (رحمة الله) কে হুজুর (ﷺ) আত্মহত্যা থেকে বাঁচান।

৪৩। সূয়ূতী (رحمة الله) কে ৭৫ বার স্ব-শরীরে দীদার দান করেন।

৪৪। বুসীরি (رحمة الله) কে চাদর দান করেন।

৪৫। শেখ সাদী (رحمة الله) ৪র্থ পংথি- “ছল্লু আলাইহি ওয়ালিহি” দান করেন।

৪৬। হযরত সাদ উদ্দিন তাফতাজানী (رحمة الله) সব ওস্তাদ ও সহপাঠীর নিকট মেধাহীন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এক রাত্রে হুজুর (ﷺ) স্ব-শরীরে এসে তাকে মুখের থুথু মোবারক দান করেন। ফলে তাফতাজানী যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম ও উম্মতের ইমাম বনে যান।

৪৭। হে নবী! আমি তো তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী রূপে, (সূরা আহযাব: ৪৫)।

৪৮। সেই দিন উপস্থিত করব প্রত্যেক সম্প্রদায়ের তাদেরই মধ্য হতে তাদের বিষয়ে একজন সাক্ষী এবং তোমাকে আমি আনব ইহাদের বিষয়ে সাক্ষী রূপে। (সূরা নাহল: ৮৯)

নোট: উপরোক্ত আয়াতদ্বয় হুজুর (ﷺ) হায়াতুন্নবী হওয়াই প্রমাণ করে। তিনি হায়াতুন্নবী এবং বরযখে সক্রিয় না থাকলে সাক্ষী দিবেন কিভাবে?

৪৯। আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ)সহ সকল নবী-রাসূলগণই যে জীবিত/হায়াতুন্নবী তার পক্ষে ০৩টি দলিল নিম্নে প্রদত্ত হলো:-

ক)

عَن أَنَس أَن رَسولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيه وَسَلَّم قَالَ: مَرَرْتُ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِي بِمُوسَى بْنِ عِمْرَانَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيه وَسَلَّم، وهُو يُصَلِّي في قبره.

-“হজরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: মেরাজের রাত্রে আমি মূসা ইবনে ইমরান (عليه السلام) এর উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম, আর তিনি তাঁর মাজারে সালাত পাঠ করছিলেন।” (মুসলীম শরীফ, হাদিস নং ২৩৭৫; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস নং ৬৯৯০; সুনানে নাসাঈ, হাদিস নং ১৬৩৪; মু’জামে ইবনে আরাবী, হাদিস নং ২২৬০; ছহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৪৯)।

খ)

عَن أَنَسٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الأَنْبِيَاءُ أَحْيَاءٌ يُصَلُّونَ فِي قُبُورِهِمْ.

-“হজরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: সমস্ত নবীগণ জীবিত এবং তাঁদের কবরে সালাত পাঠ করেন।” (মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদিস নং ৩৪২৫; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস নং ৬৩৯১ ও ৬৮৮৮; জামেউল আহাদিছ, হাদিস নং ১০২১৩; হায়াতুল আম্বিয়া লিল-বায়হাক্বী, হাদিস নং ১ ও ২; ফাওয়াইদে তামাম, হাদিস নং ৫৮; আল-কামিল, রাবী নং ৪৬০; তারিখে দামেস্ক, রাবী নং ১৪০৪; বদরুল মুনীর, ৫ম খন্ড, ২৮৪ পৃ:; মজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ১৩৮১২; ফাতহুল কবীর, হাদিস নং ৫০৭৫; আল-হাভী লিল ফাতওয়া, ২য় খন্ড, ১৭৮ পৃ:)।

গ)

وَعَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَكْثِرُوا الصَّلَاةَ عَلَيَّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، فَإِنَّهُ مَشْهُودٌ تَشْهَدُهُ الْمَلَائِكَةُ،... قَالَ: قُلْتُ: وَبَعْدَ الْمَوْتِ؟ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى الْأَرْضِ أَنْ تَأْكُلَ أَجْسَادَ الْأَنْبِيَاءِ، فَنَبِيُّ اللَّهِ حَيٌّ يُرْزَقُ

-“হজরত আবু দারদা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: তোমরা শুক্রবারে আমার উপর অধিক হারে সালাত পাঠ কর, কেননা ফেরেশতারা আমার কাছে ইহা পেশ করেন।....রাবী বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম: ইহা কি আপনার ইন্তেকালের পরেও? প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা নবীদের ভক্ষণ করা জমীনের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। ফলে আল্লাহর নবীগণ জীবিত ও রিজিকপ্রাপ্ত।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৬৩৭; মুসনাদে জামে, হাদিস নং ১১০৬৫; মেসকাত শরীফ, হাদিস নং ১৩৬৬; তাফছিরে ছা’লাভী, ১০ম খন্ড, ১৬৫ পৃ:; তাফছিরে ইবনে কাছির, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৪১৯ পৃ:; মেরকাত শরহে মেসকাত, ৩য় খন্ড, ১০১৭ পৃ:; তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ২০৯০; শরফুল মুস্তফা, ৩য় খন্ড, ১৮৯ পৃ:; সিরাতে নববীয়া লি’ইবনে কাছির, ৪র্থ খন্ড, ৫৪৮ পৃ:; ইমতাউল আসমা, ১১তম খন্ড, ৬৫ পৃ:; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১২তম খন্ড, ৩৫৭ পৃ:; আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খন্ড, ১৬৪ পৃ:)।


---ঃ---

হাযির-নাযির

১। ‘হাযির’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- সামনে উপস্থিত থাকা, অনুপস্থিত না থাকা। ‘নাযির’ শব্দের আভিধনিক অর্থ হলো- দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি, দ্রষ্টা, চোখের মণি, নাকের রগ, চোখের পানি ইত্যাদি। আর হাযির ও নাযির- এর পারিভাষিক অর্থ হলো- পবিত্র ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি একই স্থানে অবস্থানপূর্বক সমগ্র জগতকে নিজ হাতের তালুর মত দেখা, দুরের-কাছের আওয়াজ শুনতে পারা, অথবা এক মূহুর্তে সমগ্র জগত ভ্রমন করার ক্ষমতা রাখা। অনেক দূরে অবস্থানকারী বিপদগ্রস্থকে সাহায্য করতে পারা। এক্ষেত্রে আসা-যাওয়া রুহানীভাবে অথবা রুপক শরীর নিয়ে বা আসল দেহ নিয়ে হতে পারা। অতএব, আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারীগণ হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ক্ষেত্রে ‘হাযির’ ও ‘নাযির’ হওয়ার যে আক্বীদা পোষণ করি এর অর্থ এ নয় যে, নবী করিম (ﷺ) স্বশরীরে প্রত্যেকের সামনে উপস্থিত আছেন; বরং মর্মার্থ হলো- রুহ বা আত্মা যেভাবে দেহের প্রত্যেক অংশে উপস্থিত, অনুরুপভাবে উভয় জগতের প্রাণ, প্রিয় নবী (ﷺ) এর নুরানী মৌলিক অস্তিত্ব জগতের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে অস্তিত্ববান। ফলে তিনি নূরে নবুওয়াতের মাধ্যমে একই সময়ে পৃথিবীর একাধিক স্থানে অবস্থান করতে পারেন। আল্লাহর ওলীগণ অধিকাংশ সময় জাগ্রত অবস্থায় কপালের চোখে- হুজুর (ﷺ) কে দেখেছেন। আর এমতাবস্থায় হুজুর (ﷺ) নিজ গোলামদের সামনে উপস্থিত থাকাই হলো তাঁর ‘হাযির’ হওয়া। আর আপন গোলামদের আপন বরকতময় দৃষ্টিতে দেখার মর্মার্থ হলো ‘নাযির’ হওয়া। উল্লেখ্য যে, এখানে শিরক-এর কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ, হুজুর (ﷺ) এর ‘হাযির-নাযির’ হওয়ার ক্ষমতা মহান আল্লাহ্ প্রদত্ত। আর আল্লাহ্ তা’য়ালার যাবতীয় গুণাবলী স্বত্তাগত ও নিজস্ব। উপরোক্ত আলোচনার সার সংক্ষেপ হলো- হুজুর (ﷺ) সৃষ্টিজগতের সবকিছু নূরে নবুওয়াতের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করতে পারেন এবং একই সময় একাধিক স্থানে রুহানীভাবে, রুপক দেহ সহকারে এমনকি আসল দেহ মুবারক সহকারে উপস্থিত থাকতে পারেন। এটাই হলো- ‘হাযির-নাযির’ আক্বীদার মূলকথা।

২। আধ্যাত্বিক শক্তি সম্পন্ন পূন্যাত্মাগন নিজ হাতের তালুর মত সমস্ত পৃথিবী দেখেন, নিকট ও দূরের আওয়াজ শুনেন, মূহুর্তের মধ্যে সমগ্র পৃথিবী পরিভ্রমন করেন, প্রার্থীকে হাজার মাইল দূর থেকে সাহায্য করতে পারেন। মোট কথা হাযির-নাযির হলোঃ-

ক) এক জায়গা থেকে সমস্ত জগৎ দেখা।

খ) এক মূহুর্তের মধ্যে সমস্ত পৃথিবী ভ্রমন করা।

গ) একই সময় কয়েকস্থানে দৃশ্যমান হওয়া।

ঘ) প্রয়োজনে প্রার্থীকে সাহায্য করা।

৩। এখন বিভিন্ন দলিল পর্যালোচনা করে দেখা যাক হায়াতে ও বরযখে হুজুর (ﷺ) কে আল্লাহ্ এ’সকল গুণাবলী/ক্ষমতা দান করেছেন কি না।


কুরআন হতে দলিল

১। ৩৩ : ৪৫ ও ৪৬ (আহযাব)

- يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا  

নিশ্চয়ই আমি আপনাকে প্রেরন করেছি শাহেদ/সাক্ষী/হাযির-নাযির, সুসংবাদদাতা, ভয় প্রদর্শনকারী আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁর দিকে আহবানকারী এবং উজ্জল প্রদীপ (সিরাজুম্মুনীরা/সূর্য) হিসাবে।

২। ৪ : ৪১ (নিসা)

- فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا

যখন আমি প্রত্যেক উম্মত হইতে একজন সাক্ষী উপস্থিত করিব এবং তোমাকে উহাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীস্বরূপ উপস্থিত করিব তখন কী অবস্থা হবে।

৩। ২ : ১৪৩ (বাকারা)

 لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا

তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হবে।

৪। ১৬ : ৮৯ (নাহল)

- وَيَوْمَ نَبْعَثُ فِي كُلِّ أُمَّةٍ شَهِيدًا عَلَيْهِمْ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَجِئْنَا بِكَ شَهِيدًا عَلَى هَؤُلَاءِ

সেই দিন আমি উপস্থিত করিব প্রত্যেক স¤প্রদায়ের তাহাদের মধ্য হইতে তাহাদের বিষয়ে এক একজন সাক্ষী এবং তোমাকে আনিব সাক্ষীরূপে উহাদের বিষয়ে। ........

৫। আমি তোমাদেরকে সমস্ত উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দান করেছি, যাতে তোমরা অন্যান্য লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করতে পার এবং রাসূল (ﷺ) তোমাদের জন্য পর্যবেক্ষণকারী ও সাক্ষীরূপে প্রতিভাত হন।

৬। ৪৮ : ৮ (ফাত্হ)-

 إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا

আমি তোমাকে প্রেরন করিয়াছে সাক্ষীরূপে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে।

নোটঃ হাশরের মাঠে যখন পূর্ববর্তী উম্মতগণ তাদের নবীগণ কর্তৃক দ্বীন প্রচারের বিষয় অস্বীকার করবে, তখন আল্লাহ্ অন্যান্য উম্মতের বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য হুজুর (ﷺ) এর উম্মতগণকে তলব করবেন। অন্যান্য উম্মতের সময়ে এই উম্মত যেহেতু উপস্থিত ছিল না, তাই এই বিষয়ে পূর্বকার উম্মতগণ প্রতিবাদ করবে। তখন হুজুর (ﷺ) কে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য বলা হবে। তখন হুজুর (ﷺ) বলবেন যে, পূর্ববর্তী নবী (আ.) গণ শরিয়তের বিধান প্রচার করেছেন এবং এই উম্মত সাক্ষ্য প্রদানে উপযুক্ত।

৭। ৯ : ১২৮ (তওবা)- لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ

অবশ্যই তোমাদের মধ্য হইতেই তোমাদের নিকট এক রাসূল আসিয়াছে। তোমাদিগকে যাহা বিপন্ন করে উহা তাহার জন্য কষ্টদায়ক। ..........

▪ আমাদের সুখে-দুঃখে যদি হুজুর (ﷺ) সর্বদা অবগত না হবেন, তবে কেমন করে তিনি আমাদের জন্য কষ্ট পাবেন।

৮। ৮ : ৩৩ (আনফাল)- وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ আল্লাহ্ এমন নহেন যে, তুমি তাদের মধ্যে থাকবে অথচ তিনি তোমাদিগকে শাস্তি দিবেন। .............


▪ ইহা দ্বারা প্রমানিত তিনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান।

৯। ৪ : ৬৪ (নিসা) وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا

যখন তাহারা নিজের আত্মার উপর যুলুম করে, তখন তারা তোমার নিকট আসলে- তওবা করলে- আল্লাহ্কে দয়ালু ও ক্ষমাকারী হিসাবে পাবে।

▪ এই আদেশ সর্বকালীন এবং কাছের ও দূরের সকলের জন্য প্রযোজ্য। হাযির-নাযির বলেই এ’টা সম্ভব।

১০। ৩৩ : ৬ (আহযাব)- النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ নবী মু’মিনদের নিকট তাদের প্রানের চাইতেও অতি নিকটে .......


▪ হাযির-নাযির না হলে প্রানের চাইতে নিকট কি সম্ভব ?

১১। ২১ : ১০৭ (আম্বিয়া)- وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ আমিতো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরন করিয়াছি।

নোটঃ আল্লাহ্ হলেন রাব্বুল আ’লামিন, আর হুজুর (ﷺ) হলেন রাহমাতুল্লিল আ’লামিন। কাজেই যেখানে রবুবীয়াত সেখানেই রহমত।

১২। ২৪:২৭ (নূর) এবং ২৪:৬১ (নূর)- এই দুই আয়াতে গৃহে প্রবেশের সময় সালাম দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।

নোটঃ আল্লামা ইবনে তাইমিয়া বলেন, তোমরা যখন মসজিদে ও গৃহে প্রবেশ কর তখন বলবে, “আস্সালামুয়ালাইকা আয়ুহাননাবীউ ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।” মসজিদে ও ঘরে যদি হুজুর (ﷺ) এর উপস্থিতি না থাকবে তবে সালাম কেন ?


হাদিস হতে দলিল

১। যখনই তোমাদের কেউ আমার প্রতি দরূদ প্রেরন করে, তখন আল্লাহ্তা’য়ালা আমার রূহ ফেরৎ পাঠান, এমন কি আমি তার সালামের জবাব দেই।

(বারী- আবু হোরায়রা (رضي الله عنه)- আবু দাউদ, বায়হাকী, তাবরানী, আহম্মদ বিন হাম্বল)

২। মূসা (عليه السلام) মিরাজের রজনীতে কবরে নামাজ পড়েছেন, হুজুর (ﷺ) এর ইমামতিতে বাইতুল আকসায় নামাজ পড়েছেন এবং ৬ষ্ঠ আসমানে ইস্তেকবাল জানিয়েছেন ও ৫০ থেকে ০৫ ওয়াক্ত নামাজের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন।

নোটঃ মি’রাজের রজনীতে মূসা (عليه السلام) এর এই তিন জায়গায় যথাসময়ে উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, তিনি বোরাখের চেয়েও দ্রুত গতিতে চলেছেন। মূসা (عليه السلام) এর গতি ও উপস্থিতির অবস্থা যদি এমন হয় তা’হলে হুজুর (ﷺ) এর গতি ও উপস্থিতির অবস্থা কি হতে পারে ?

৩। মৃত্যুর পর কবরে প্রত্যেকে ৩য় প্রশ্নের জবাবের সময় হুজুর (ﷺ) এর দর্শন লাভ করবে। হুজুর (ﷺ) হাযির-নাযির না হতে পারলে এত কবরে তাঁকে কেমন করে দেখা যাবে? উল্লেখ্য, তাবু সরালে সূর্য দেখা যায় আর চোখের পর্দা সরালে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দেখা সম্ভব।

৪। মুতার যুদ্ধে এক এক করে ০৩ সেনাপতির শাহাদাৎ বরণ এবং ৪র্থ সেনাপতি কর্তৃক বিজয় লাভের ধারাবাহিক বর্ণনা তিনি (ﷺ) ১৫০০ কিলোমিটার দূরে মদিনার মিম্বর থেকে দিয়েছেন।

৫। মুতার যুদ্ধে শহীদ সেনাপতি জাফর ইবনে আবু তালেব (رضي الله عنه) এর জানাযা মদিনায় পড়ান এবং সালামের জবাব দেন। (বোখারী, মিশকাত)

৬। ৯ম হিজরীতে আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশী (رضي الله عنه) এর মৃত্যু সংবাদ দেন এবং মদিনাতে জানাযা পড়ান।

৭। হাদিস- তোমাদের সঙ্গে আমার পুনরায় সাক্ষাতের স্থান হলো “হাউসে কাউসার”, যা আমি এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি। (মেশকাত শরীফে “বাবু ওফাতিন্নাবী” অধ্যায়-রাবী হযরত ওকবা ইবনে আমের (رضي الله عنه) এবং বোখারী ও মুসলিম)

৮। খলিফা ওমর (رضي الله عنه) মদিনার মসজিদের মিম্বারে দাড়িয়ে ১২০০ মাইল দূরে যুদ্ধরত সেনাপতি সারিয়া (رضي الله عنه) কে যুদ্ধের কৌশল বলে দেন- يَا سَارِيَ الْجَبَلَ “ওহে সারিয়া, পাহাড়ের দিকে পিঠ দাও।” (দালায়েলুন্নবুয়াত, মিশকাত)

৯। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার সময় তিনি (ﷺ) তথায় উপস্থিত ছিলেন। প্রমাণ-

(১) ইবনে আব্বাসকে স্বপ্নে রক্তের শিশি দেখিয়ে বলেছিলেন-তিনি (ﷺ) তথায় তা প্রত্যক্ষ করেছেন।

(২) ইমাম জয়নাল আবেদীন (رحمة الله)কে বলেছিলেন- ‘তুমি কি মনে করো আমি তা’ (কারবালার ঘটনা) দেখিনি? (মিশকাত, তিরমীযি শরীফ-২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২১৭)

১০। তোমরা নিজেদের কাতার সোজা কর এবং একজনের সাথে অপরজন লেগে দাঁড়াও। কারণ নিশ্চয় আমি তোমারেকে পিছনেও দেখি। (বোখারী)


বিশিষ্ট ওলামাগণ হতে প্রাপ্ত দলিল ও কিছু যুক্তি প্রমাণ

১। কথিত আছে হযরত আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) কে একই সময় ৩০০ স্থানে দেখা গেছে।

২। একই সময় হযরত আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) এর পায়ের ছাপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ/এলাকায় অবস্থিত সকল অলীগন তাদের কাঁধের উপর অনুভব করেন।

৩। কথিত আছে যে, একই দিন এবং একই সময়ে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (رحمة الله) ৭০জন মুরিদের বাড়ীতে ইফতারের দাওয়াত রক্ষা করেছেন।

৪। যার কিতাব না পড়লে আলেম হওয়া যায় না (তাফসীর “আদ্ দুররুল মানসুর” এবং “তাফসীরে জালালাইন” এর প্রনেতা) সেই মহাত্মা হযরত জালাল উদ্দিন সূয়ূতী (رحمة الله) ৭৫ বার স্বচক্ষে এবং স্বশরীরে হুজুর (ﷺ) এর দীদার লাভ করেছেন বলে নিজেই জানিয়ে গেছেন।

৫। হুজুর (ﷺ) স্বশরীরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসে, রাসূল নোমা হযরত ফাতেহ আলী (رضي الله عنه) কে পানিতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করেন।

৬। ইমাম আবু হানিফা (رضي الله عنه) কে রওজা মুবারক থেকে স্বশব্দে “ইমামুল মুসলেমিন” উপাধিতে ভূষিত করেন।

৭। ইমাম বোখারী (رحمة الله) হুজুর (ﷺ) কর্তৃক সত্যায়নের পর হাদিস গ্রহন/সংকলন করেন।

৮। কাসিদায়ে বুরদার রচয়িতা ইমাম বুসিরি (رحمة الله) কে স্ব-শরীরে এসে হুজুর (ﷺ) চাদর প্রদান করেন।

৯। শেখ সাদী (رحمة الله) এর ৪র্থ পংথি- “ছল্লু আলাইহি ওয়ালিহি”- পূরন করে দেন।

১০। আজরাইল (عليه السلام) জান কবজের জন্য একই সময় একাধিক জায়গায় উপস্থিত হন।

১১। খিযির (عليه السلام) সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমন করেন।

১২। সূরা: আরাফ(৭); আয়াত:২৭-“শয়তান ও তার বংশধররা তোমাদের সকলকে এমন স্থান থেকে দেখে- যেখান থেকে তোমরা তাদেরে দেখতে পাও না।” তাই বুঝা গেল, শয়তানও ধোকা দেওয়ার জন্য একই সময় অসংখ্য স্থানে উপস্থিত হতে পারে।

নোটঃ ১) [২:১৩৮ (বাকারা)] আল্লাহ বলেন- صِبْغَةَ اللَّهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً وَنَحْنُ لَهُ عابِدُونَ বান্দারা যেন আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হয়। “আমরা গ্রহন করলাম আল্লাহর রং, রঙে আল্লাহ্ অপেক্ষা কে অধিকতর সুন্দর এবং আমরা তাঁহারই ইবাদতকারী।”

        ২) হাদীস- تخلَّقوا بأخلاق الله তোমরা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও। অর্থাৎ আল্লাহর গুণাবলীর প্রকাশস্থল হয়ে যাও।

        ৩) হুজুর (ﷺ) হলেন আল্লাহর প্রকাশ/বিকাশ স্থল। কাজেই অবশ্যই তিনি আল্লাহর গুনে গুনান্বিত এবং আল্লাহর রঙে রঞ্জিত। তবে আল্লাহর গুন হলো সত্তাগত, আর হুজুর (ﷺ) এর গুন হলো আতায়ী।

১৩। মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া গ্রন্থে ইমাম কুস্তোলানী (رحمة الله) বলেন- “আমাদের সুবিখ্যাত উলামায়ে কেরাম বলেন, রাসূল (ﷺ) এর হায়াত ও ওফাতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তিনি নিজ উম্মতকে দেখেন, তাদের অবস্থা, নিয়ত, ইচ্ছা ও মনের কথা ইত্যাদি জানেন। এগুলো তাঁর কাছে সম্পূর্ণরূপে সুস্পষ্ট, কোনরূপ অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতার অবকাশ নেই।” এই কারনে হুজুর (ﷺ) হাশরের মাঠে উম্মতের ব্যাপারে সাক্ষী দিতে পারবেন।

১৪। জুরকানী শরহে মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া- “আল্লাহ্ তা’য়ালা আমার জন্য দুনিয়াকে এমনভাবে উম্মুক্ত করে দিয়েছেন যে, উহাতে যা কিছু আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে সব আমি দেখতে পাচ্ছি এবং দেখব, যেমনভাবে আমি আমার নিজ হাতের তালুকে দেখতে পাচ্ছি।”

১৫। মোহাদ্দেস মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله)- (মিরকাত, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৪১)- নবীগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে প্রকাশিত হতে পারেন। এটা আকল দ্বারাও বৈধ। যেমনিভাবে হাদীস দ্বারাও প্রমানিত।

১৬। মোহাদ্দেস মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله)- অলীগণ একই মূহুর্তে কয়েক জায়গায় একাধিক শরীরের অধিকারী হয়ে বিচরন করতে পারেন। তাদের জন্য জমিন সঙ্কুচিত করা হয়েছে এবং এটা অসম্ভব ব্যাপার নয়।

১৭। শিফা শরীফ, কাজী আয়ায (رحمة الله)- “যে ঘরে কেউ থাকে না সে ঘরে প্রবেশ করার সময় বলবে, হে নবী (ﷺ) আপনার প্রতি সালাম, আপনার উপর আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হউক।” শরহে শিফায় মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন- لأن روحه عليه السلام حاضر في بيوت أهل الإسلام “কেননা নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র রূহ মোবারক মুসলমানদের ঘরে ঘরে উপস্থিত আছেন।” (শরহে শিফা, ২য় খন্ড, ১১৮ পৃ:)

১৮। আসিফ বিন বরখিয়া (হযরত সুলাইমান (عليه السلام) এর উজির ও একজন অলী) চোখের পলকে ইয়েমেন হতে রানী বিলকিসের সিংহাসন তুলে এনে বায়তুল মোকাদ্দেসে হযরত সুলাইমান (عليه السلام) এর দরবারে পেশ করেছিলেন। (অর্থাৎ তিনি একই সময়ে ইয়েমেন ও সিরিয়ায় উপস্থিত) (সূরা: নমল; আয়াত: ৪০)

১৯। সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله) বলেন-“তুমি যখন মসজিদে প্রবেশ করবে তখন রাসূল (ﷺ)কে শ্রদ্ধার সাথে সালাম দিবে। নিশ্চয়ই রাসূল (ﷺ) মসজিদে উপস্থিত থাকেন।” তাঁর শিখানো মসজিদে প্রবেশের দোয়া- “বিসমিল্লাহী আচ্ছালাতু ওয়া আসছালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহী রাব্বিগ ফিরলী আবওয়াবা রাহমাতিকা।”

২০। ইহ্ ইয়া উলুম- ১ম খন্ড, ৪র্থ অধ্যায়, ৩য় পরিচ্ছদে তিনি আরো বলেনঃ- তোমরা নামাযে তাশাহুদ পড়ার সময় রাসূল (ﷺ) কে সালাম দিয়ে যখন বলবে- আচ্ছালামু আলাইকা আইয়্যূহান্নাবীউ ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু- তখন তুমি রাসূল (ﷺ) এর পবিত্র সত্তাকে তোমার অন্তরে উপস্থিত জানবে।

২১। মুহাদ্দিস আবদুল হক দেলেভী (رحمة الله) (মাদারেজুন্নবুয়াত)- “রাসূল (ﷺ) কে স্মরন কর ও তাঁর উপর দরূদ পড় এবং তাঁকে স্মরন করার সময় এ অবস্থায় থাক যে, হুজুর (ﷺ) জীবিত অবস্থায় তোমার সামনে আছেন এবং তুমি তাঁকে দেখছ। তুমি আদব, সম্মান, ভয় ও লজ্জা অবস্থায় থাক। তুমি আরো জানো যে, হুজুর (ﷺ) তোমাকে দেখছেন এবং তোমার কথা শুনছেন। কেননা রাসূল (ﷺ) আল্লাহর গুনে গুনান্বিত। আল্লাহর এক গুন এই যে- আল্লাহ তাঁর স্মরণকারীর সাথে থাকেন।” এতে বুঝা গেল- আল্লাহ্ যেমন তাঁর স্মরণকারীর সাথে থাকেন তদ্রুপ নবীজী ও তাঁর স্মরণকারীর সাথে থাকেন।

২২। শরহে ছুদুর গ্রন্থ- প্রসিদ্ধ মুফাচ্ছের হযরত জালালুদ্দিন সূয়ূতী (رحمة الله)- “যদি কোন লোক এই বিশ্বাস পোষন করে যে, নিশ্চয়ই রাসূল (ﷺ) এর রূহ মোবারক জিছমে মেছালী মিলাদ পাঠের সময় ও রমজানে খতমে কুরআনের সময় এবং নাথ পাঠ করার সময় উপস্থিত হন- তবে এমন বিশ্বাস পোষন করা জায়েয।”

২৩। আল্লামা কাজী মুহাম্মদ ছানাউল্লাহ পানিপথী (رحمة الله)- তফসীরে মাযহারী-১ম খন্ডঃ

-ان الله تعالى يعطى لارواحهم قوة الأجساد فيذهبون من الأرض والسماء والجنة حيث يشاؤن “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁদের রূহগুলোতে (নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও ওলীগণ) দেহের শক্তি-সামর্থ্য দান করেন। ফলে তাঁরা পৃথিবী, আকাশ ও জান্নাতের যত্রতত্র ইচ্ছা যেতে পারেন। এবং তাঁদের বন্ধুদের সাহায্য করতে ও শত্রুদের পর্যুদস্ত করতে পারেন। ইনশাআল্লাহ্ তা’য়ালা।”

২৪। দেওবন্দী আলেমগণের শ্রদ্ধেয় পীর হাজী এমদাদুল্লাহ্ মোহাজেরে মক্কী (رحمة الله) ‘ফয়সালা হাফত মাসআলায়’ বলেন- “রাসূল (ﷺ) মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন, এ আক্বীদা বা বিশ্বাসকে কুফরী ও শিরক্ বলা বাড়াবাড়ি। কেননা মিলাদ মাহফিলে রাসূল (ﷺ) উপস্থিত হওয়া সম্ভব- এটা যুক্তিগত ও কিতাবজাত দলিল দ্বারা প্রমানিত। বরং অনেক জায়গায় রাসূল (ﷺ) আগমন করেছেন- তার প্রমাণ ও আছে।”

২৫। মজার ব্যাপার হলো- যারা হাযির-নাযির মানে না, মৃত্যুর পর তাদের মুরুব্বী কাসেম নানুতবী সাহেব ও আশরাফ আলী খানবী সাহেব প্রমূখ স্বশরীরে হাযির হয়েছেন, এমন কথা তাদের কিতাবাদিতে পাওয়া যায়। (যালযালা)

২৬। আল্লাহর হাযির-নাযির, রউফ ও রাহীম ইত্যাদি গুন হলো সত্তাগত বা নিজ ক্ষমতাবলে। কিন্তু একই গুন রাসূল (ﷺ) এর ক্ষেত্রে হলো আতায়ী বা আল্লাহ্ প্রদত্ত। তাই হাযির-নাযির আক্বীদা উপরোক্ত দলীল ও যুক্তির ভিত্তিতে শিরক্ বা কুফর হতে পারে না বরং এই আক্বীদা সম্পূর্ণ বৈধ ও হক্ব।

২৭। ইমাম জালাল উদ্দিন সূয়ূতী (رحمة الله) বলেন, নবী করিম (ﷺ) শরীর ও রূহ মোবারক সমন্বয়ে দেহধারী হিসাবে জীবিত আছেন। তিনি দুনিয়ার জীবদ্দশার মতই এখনও আসমান জমিনের যথায় ইচ্ছা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম। কিন্তু ফেরেশতাদের মতই তিনি লোক চক্ষুর অন্তরালে বিরাজমান।

২৮। হযরত সাওবান (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেন, “আল্লাহ্ তা’আলা আমার সম্মুখে গোটা পৃথিবীকে এমনভাবে সঙ্কুচিত করে দিয়েছেন যে, আমি পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত ও পশ্চিম প্রান্ত সমূহ স্বচক্ষে অবলোকন করেছি।” (ইমাম বোখারী, ইমাম নববী, মোল্লা আলী ক্বারী, মেশকাত শরীফ)

২৯। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূল (ﷺ) একবার নামাযে হাত সামনের দিকে নিয়ে গিয়ে আবার পিছনে ফিরিয়ে আনেন। অতপর সাহাবায়ে কেরাম তার কারন জিজ্ঞাসা করলে হুজুর (ﷺ) বলেন, নামাযে দাঁড়ালে জান্নাতকে আমার সম্মুখে দেখতে পেলাম এবং আমি তা থেকে ফল নিতে চাইলাম। আমার প্রতি ফিরে আসার প্রত্যাদেশ আসল। এমনকি তখন জাহান্নামও উপস্থিত ছিল। (মুসলিম শরীফ, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)

৩০। “যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখেছে, সে অচিরেই আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পাবে। শয়তান আমার সূরত ধারন করতে পারে না।” (বোখারী ও মুসলিম)

৩১। সূরা নমল; আয়াত:১৮

-يَا أَيُّهَا النَّمْلُ ادْخُلُوا مَسَاكِنَكُمْ لَا يَحْطِمَنَّكُمْ سُلَيْمَانُ وَجُنُودُهُ وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ

“হে পিপঁড়ার দল! তোমরা তাড়াতাড়ি গর্তে ঢুকে পড়ো-যাতে সুলায়মান ও তাঁর সৈন্যদল তাঁদের অজান্তে তোমাদেরকে পিষে মেরে না ফেলে।” -হযরত সুলাইমান (عليه السلام) ০৩ মাইল দুর থেকে পিপঁড়ার সর্দারের আওয়াজ/কথা শুনে হেসে ফেলেন।

৩২। হযরত ইয়াকুব (عليه السلام) কেনান/ফিলিস্তিন থেকে সুদূর মিশরে তাঁর ছেলে হযরত ইউসূফ (عليه السلام)কে বিবি যোলায়খার যৌন আক্রমন থেকে বাঁচানোর জন্য (রূহানীভাবে) উপস্থিত হন।

৩৩। রাহমাতুল্লিল আলামিন হওয়ার জন্য হাজির নাযির হওয়া আবশ্যক।

৩৪। আল্লামা জালালুদ্দিন সূয়তি (رحمة الله) তার এক কিতাবে বলেন, উম্মতের বিবিধ কর্মকান্ডের প্রতি দৃষ্টি রাখা, তাদের পাপরাশির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদের বালা মুছিবত থেকে রক্ষার জন্য দোয়া করা, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণ করা ও বরকত দান করা এবং নিজ উম্মতের কোন নেক বান্দার ওফাত হলে তার জানাযাতে অংশগ্রহণ করা, এগুলো হচ্ছে হুজুর (ﷺ) এর শখের কাজ। কাজেই হাজির নাযির আকিদায় বিশ্বাস করা “শিরক” বা “কুফর” নয়। বরং এমনটা বলা মারাত্মক সীমালঙ্গন। হক্কানী সকল আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখগণ হুজুর (ﷺ) হাযির-নাযির -- এই আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং আছেন। এমন কি আজ যারা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হাযির-নাযির জানা বা এই আক্বীদায় বিশ্বাসীগণকে কাফের-মুশরিক মনে করেন, তাদের মুরুব্বিরাও হুজুর (ﷺ) এর হাযির নাযির সংক্রান্ত আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই আল্লাহ্ তাদেরকে হেদায়েত নসীব করুন।


---ঃ---

ইলমে গাইব

১। ‘গাইব’ হচ্ছে এমন এক অদৃশ্য বিষয় যা মানুষ পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে না এবং ইহা জ্ঞানের পরিধিতেও আসে না। গাইব আবার ০২ প্রকারের। এক প্রকারের গাইব আছে যা দলিল বা যুক্তি প্রমানের মাধ্যমে অনুভব করা যায়। যেমনঃ বেহেশত, দোযখ, আল্লাহর স্বত্ত্বা ও গুনাবলী। আরেক প্রকার গাইব আছে যা দলিল বা যুক্তি প্রমাণ দ্বারাও অনুভব করা যায় না। যেমনঃ মানুষ কখন মারা যাবে, কিয়ামত কখন হবে, সে কি জান্নাতী না জাহান্নামী ইত্যাদি।

২। ইলমে গাইব হলো একটি আক্বীদাগত বিষয়। এই গাইব নিয়েও আজকাল অনেক ফেৎনা ও বিভ্রান্তি। বিশেষ করে হুজুর (ﷺ) এর গাইবের ইলম (জ্ঞান) সম্পর্কে। কারো মতে হুজুর (ﷺ) অসীম ইলমে গাইবের অধিকারী ছিলেন, কারো মতে তিনি যৎ সামান্য ইলমে গাইব জানতেন, আবার কারো মতে তাঁর কোন গাইবের জ্ঞানই ছিল না। শেষোক্ত মতবাদে যারা বিশ্বাসী, তারা মনে করেন যে, ইলমে গাইবের মালিক শুধু আল্লাহ্ এবং অন্য কেউ ইলমে গাইব জানতে পারেন বা জানতেন এমন ধারনা পোষন করা র্শিক। অথচ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীগণের আক্বীদা হলো, আল্লাহ্ ইলমে গাইবের মালিক - এটা অকাট্য সত্য কথা। কিন্তু ঐ ব্যক্তিও ইলমে গাইবের জ্ঞানে জ্ঞানী যাকে আল্লাহ্ তা দান করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহর ইলমে গাইব জানা হলো স্বত্তাগত আর অন্য কেউ ইহার অধিকারী হলে, তা হলো আতায়ী। এখন আমরা দেখার চেষ্টা করব আল্লাহ্ ইলমে গাইব কাউকে বিশেষ করে হুজুর (ﷺ)কে দান করেছেন কিনা এবং করে থাকলে কতটুকু।


কুরআন হতে দলীল

১। ৭২ঃ২৬ ও ২৭ (জ্বীন)- عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ ‘তিনি (আল্লাহ্) অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনি তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কাউকে অবহিত করেন না, তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতিত।’ (এই এক আয়াত দ্বারাই ইহা স্পষ্টভাবে প্রামণিত হয় যে হজুর (ﷺ) ইলমে গাইবের অধিকারী ছিলেন।)

২। ৪ঃ১১৩ (নিসা)- وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا ‘তুমি [অর্থাৎ হুজুর (ﷺ)] যা জানতে না, তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, তোমার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে।’

৩। ২ঃ৩১ (বাকারা)- وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ‘তিনি (আল্লাহ্) আদম (عليه السلام)কে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন’, ........ (ইহা ইলমে গাইব, যা ফিরিশতাদেরও ছিল না।)

৪। ৬ঃ৭৫ (আন-আম)- وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُونَ مِنَ الْمُوقِنِينَ

‘এ’ভাবে আমি ইব্রাহিমকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পরিচালনা ব্যবস্থা দেখাই, যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত হয়।’

৫। ৮১:২৪ (তাকভীর)- وَمَا هُوَ عَلَى الْغَيْبِ بِضَنِينٍ “সে (হুজুর (ﷺ)) অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে বলতে কৃপণ নহে।” (অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত বিষয় প্রকাশ ও প্রচারে হুজুর (ﷺ) কৃপণতা করেননি।) এই আয়াত প্রমাণ করে যে আল্লাহ্ তাঁকে (ﷺ) গাইবের/অদৃশ্য বিষয়ের খবর দিতেন।

৬। ১২ঃ৯৬ (ইউনুস)- إِنِّي أَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ‘আমি আল্লাহর নিকট হতে জানি, যা তোমরা জান না।’ (ইয়াকুব (عليه السلام) এর এ উক্তি ষ্পস্টভাবে প্রমাণ করে যে তিনি ইলমে গাইবের অধিকারী ছিলেন। সে মতে হুজুর (ﷺ)তো আরো অধিক ইলমে গাইব জানতেন।)

৭। ১৮ঃ৯৮ (কাহ্ফ)- فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاءَ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا ‘যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে তখন তিনি উহাকে (ইয়াজুজ-মাজুজ পরিবেষ্টনকারী প্রাচীর) চূর্ন-বিচূর্ন করে দিবেন।’ এই উক্তি যুল-কারনায়নের, যা আল্লাহ্ পাক পবিত্র কোরআন মজিদে নিজেই বর্ননা করেছেন। তার মানে আল্লাহ্ যে শেষ জামানায় ঐ প্রাচীর ভেঙ্গেঁ দিবেন, যুল-কারনায়নের সেই জ্ঞান ছিল যা ইলমে গাইবের আওতাভূক্ত।

৮। ১৯ঃ৩০ (মারইয়াম)- قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا ‘আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন।’ শিশুকালে ঈসা (عليه السلام) এমন সাক্ষ্য দেন। অর্থাৎ তিনি যে কিতাব প্রাপ্ত নবী হবেন এই গাইবের জ্ঞান আল্লাহ্পাক তাকে নবুয়তের পূর্বেই শিশু অবস্থায় আতা করেছেন।

৯। ১৮ঃ৬৫ (কাহ্ফ)- وَعَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا ‘আমার (আল্লাহর) নিকট হতে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।’ (খিযির (عليه السلام)কে আল্লাহ্ মা’রেফাত/ইলমে গাইব দান করেছেন। খিযির হলেন একজন অলী। এ'তে বুঝা গেল অলীগণ ও আল্লাহর ইচ্ছায় ইলমে গাইব লাভ করতে পারেন।)

১০। ৩ঃ১৭৯ (আলে - ইমরান)- وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَجْتَبِي مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَشَاءُ ‘অদৃশ্য সম্পর্কে তোমাদিগকে আল্লাহ্ অবহিত করার নহেন; তবে আল্লাহ্ তাঁর রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন।’ তাই কুরআন দ্বারা প্রমানিত হলো যে, আল্লাহ্ তাঁর মনোনীত নবী রাসূলগণকে ইলমে গাইব দান করেছেন। তা’ছাড়া নবী শব্দের অর্থই হলো গাইবের সংবাদ দাতা।


হাদীস ও অন্যান্য ঘটনা দ্বারা প্রমাণ

১। হুজুর (ﷺ) এর জন্মের সাথে সাথেই ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে দিক-দিগন্তে নিয়ে যান এবং (সবকিছুর সাথে) পরিচয় করিয়ে দেন (মাদারেজুন নবুয়াত)। অর্থাৎ জন্ম লগ্নেই তাঁকে (ﷺ) গাইবের জ্ঞান আতা করা হয়।

২। নবী করিম (ﷺ) জিব্রাইল (عليه السلام)কে ফরমান, তিনি (জিব্রাইল) চতুর্থ আসমানে যেই তারকা ৫০৪ কোটি বৎসর (৭০,০০০ ৭২,০০০-সত্তর হাজার বছর পরপর মোট ৭২ হাজার বার) পূর্ব হতে দেখে আসছেন। প্রিয় নবীজি (ﷺ) বলেন:- انا ذلك الكوكب (আনা জালিকাল কাওকাব) -“আমিই ছিলাম সেই তারকা।” (তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৫৪৩ পৃ:)। জন্মের শত শত কোটি বৎসর আগের ঘটনার কথা জানা কি ইলমে গাইব নয়?

৩। হুজুর (ﷺ) ফরমান,

 كنت نورا بين يدى ربى قبل خلق آدم باربعة عشر ألف عام

‘আদম (عليه السلام) এর সৃষ্টির ১৪,০০০ বৎসর পূর্বেও আমি নূর নবী ছিলাম।’ (তাফছিরে রুহুল বয়ান, ২য় খন্ড, ৩৭০ পৃ:)। উর্দ্ধ জগতের ০১ দিনের সমান যদি পৃথিবীর ১,০০০ বৎসরের সমান হয়, সেই হিসাবে ৫১১ কোটি বৎসর পূর্বেও হুজুর (ﷺ) নবী ছিলেন- এই খবর তিনি জানতেন যা গাইবেরই সংবাদ।

৪। মি’রাজের পূর্বে একদিন হুজুর (ﷺ) হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)কে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি আমার জীবনের সাথী, হিজরতের সাথী, কবরের সাথী, হাশরের সাথী এবং বেহেস্তেরও সাথী। আবু বকর (رضي الله عنه) যে বেহেস্তের সাথী হবেন-এতো গাইবেরই সংবাদ।

৫। মি’রাজের রাত্রের ঘটনা বর্ননা করতে গিয়ে হুজুর (ﷺ) ফরমান, ‘অত:পর আমার জন্য এক ফোঁটা আরশ থেকে ফেলা হয়েছে যা আমার মুখে পতিত হলো। কোন স্বাদ গ্রহনকারী কখনো এরূপ স্বাদ গ্রহন করেনি। এর ফলে আল্লাহ্ আমাকে আগে-পরের সব সংবাদ প্রদান করেন এবং আমার অন্তরকে আলোকিত করেছেন।’ সূত্র: নুযহাতুল মাজালিস; পৃষ্ঠা-১২২-আবদুর রহমান সফূরী (رحمة الله), আনোয়ারে মুহাম্মদিয়া; পৃষ্ঠা-৩৪৮ এবং মাদারেজুন্ নবুয়ত; পৃষ্ঠা-২০৩, খন্ড-১।

৬। হিজরতের সময় পিছু অনুসরনকারী সুরাকাকে হুজুর (ﷺ) ফরমান, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার হাতে পারস্য সম্রাটের সোনার কঙ্কন শোভা পাবে।’ (ইহা ২৫/৩০ বৎসর পর হযরত ওমর (رضي الله عنه) এর খেলাফতকালে বাস্তবতা লাভ করে।)

৭। হুজুর (ﷺ) ওহুদের প্রান্তরে (ওফাতের বছর) শহীদানদের কবর যিয়ারত শেষে মিম্বারে উঠে খোৎবা দেন। তিনি ফরমান- وَأَنَا عَلَيْكُمْ شَهِيدٌ وَإِنَّ مَوْعِدَكُمُ الْحَوْضُ وَإِنِّي لَأَنْظُرُ إِلَيْهِ من مَقَامِي هَذَا وَإِنِّي قَدْ أُعْطِيتُ مَفَاتِيحَ خَزَائِنِ الْأَرْضِ وَإِنِّي لَسْتُ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوا بعدِي وَلَكِنِّي أخْشَى عَلَيْكُم الدُّنْيَا أَن تنافسوها فِيهَا -‘আমি তোমাদের জন্য শাহীদ (সাক্ষী) এবং তোমাদের সাথে প্রতিশ্রুতি থাকল কাউসার নামক ঝর্ণার পাশে তোমাদের সাথে আবার আমার সাক্ষাৎ হবে। কসম আল্লাহর, আমি এখান থেকে তা’ (হাউজে কাউসার) দেখতে পাচ্ছি। আমি তোমাদের ব্যাপারে এই আশংকা করি না যে, তোমরা পুনরায় র্শিকে লিপ্ত হবে। বরং আমার ভয় হচ্ছে তোমরা দুনিয়ার লোভ-লালসায় লিপ্ত হয়ে পড়বে। (বুখারী ও মুসলিম, মেসকাত, হাদিস নং ৫৯৫৮)। এই হাদীস দ্বারা আমরা নিম্নোক্ত বিষয় জানতে পারি:-


ক) মাজার/কবর যিয়ারত বৈধ/জায়েয।

খ) মাজার যিয়ারতের সময় এ’কথা বলার তাৎপর্য- মনে হয় যেন হজুর (ﷺ) নবুয়তের নূরের দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলেন যে শেষ জামানায় মু’মিনগণ মাজার যিয়ারতের কারনে শিরক এর অপবাদের সম্মুখীন হবেন। তাই কেউ যেন মু’মিনদের মাজার যিয়ারতের কারনে শিরক্/কুফরের অপবাদ না দেয়, তার জন্য তিনি (ﷺ) হয়ত এমন উক্তি করেন।

গ) ওহুদের মাঠ থেকে হাউজে কাউসার দেখা, হাশরের মাঠে কোথায় হুজুর (ﷺ) এর সহিত উম্মতের পরবর্তী সাক্ষাৎ হবে তার বর্ননা প্রদান এবং এই উম্মত ভবিষ্যতে শিরকে লিপ্ত হবে না - এমন ঘোষনা প্রদান, এ’সবইতো গাইবের সংবাদ।

৮। একদিন সাহাবাগণ হুজুর (ﷺ) এর ইমামতিতে নামাজ পড়ছিলেন। كُنَّا نُصَلِّي وَرَاءَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرَّكْعَةِ قَالَ: سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ . فَقَالَ رَجُلٌ وَرَاءَهُ: رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ فَلَمَّا انْصَرَفَ قَالَ: مَنِ الْمُتَكَلِّمُ آنِفًا؟ قَالَ: أَنَا. قَالَ: رَأَيْتُ بِضْعَةً وَثَلَاثِينَ مَلَكًا يَبْتَدِرُونَهَا أَيُّهُمْ يَكْتُبهَا أول তিনি রুকু থেকে মাথা উঠাবার সময় এক মোক্তাদী বলল, “রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ, হামদান কাসীরান তাইয়্যেবান মুবরাকান ফীহ।” নামাজ শেষে হুজুর (ﷺ) ফরমান যে, ত্রিশ জনের ও বেশী ফেরেশতা উহার (বরকত) লিখার জন্য প্রতিযোগীতা করছিল (বুখারী ও মুসলিম)। ফেরেশতাদের সওয়াব লিখা তো গাইবেরই বিষয়।

৯। একদা এক সাহাবী নামাজের কাতারে সামিল হয়ে বলেন, اللَّهِ أَكْبَرُ كَبِيرًا، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيرًا، وَسُبْحَانَ اللَّهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا “আল্লাহু আকবার কাবীরান, ওয়াল হামদু লিল্লাহে কাসীরান, ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকরাতান ওয়া আসীলা”। নামাজ শেষে হুজুর (ﷺ) ফরমান, فُتِحَتْ لَهَا أَبْوَابُ السَّمَاءِ ইহার কারনে আসমানের দরজা সমূহ খুলে গেছে (নাসাঈ শরীফ, হাদিস নং ৮৮৬)। ইহা তো গাইবেরই সংবাদ।

১০। একদিন এশার নামাজের সময় হুজুর (ﷺ) বেলাল (رضي الله عنه)কে প্রশ্ন করেন, ‘হে বেলাল! তুমি কিসের বলে আমার আগে জান্নাতে গেলে?’ উত্তরে বেলাল (رضي الله عنه) বলেন, ‘আমি যখনই আযান দিয়েছি এখনই দুই রাকাত সালাত পড়েছি। আর যখনই আমার পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে পবিত্রতা অর্জন করেছি এবং মনে করেছি আল্লাহর জন্য আবার দুই রাকাত সালাত পড়া দরকার।’ তখন নবীজি (ﷺ) ফরমান, ‘হ্যাঁ ওটা দ্বারাই তুমি এ সম্মান লাভ করেছ’ (বুখারী, মুসলিম ও ইমাম আহমদ, মেসকাত ৫৮৩ পৃ:)। উল্লেখ্য, হুজুর (ﷺ) জান্নাতে মি’রাজ রজনীতে বেলাল (رضي الله عنه) এর জুতার আওয়াজ শুনেছিলেন। বেলাল (رضي الله عنه) যে জান্নাতে যাবেন-এ’টা তো গাইবেরই সংবাদ।

১১। হুজুর (ﷺ) মার্তৃগর্ভে থাকা অবস্থায় লওহে মাহফুজে ফিরিশতাদের কলম দ্বারা লিখার খস্ খস্ আওয়াজ শুনতে পেতেন। (খাসায়েসুল কুবরা)

১২। তিনি (ﷺ) মদিনায় বসে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত পাথরের পতনের শব্দ শুনতে পান।

১৩। একদিন হুজুর (ﷺ) দুই হাতে দুইখানা কিতাব নিয়ে হাজির হন এবং উহাতে কি লিখা আছে জানতে চান। সাহাবাগণ উত্তর দানে অপারগ হলে তিনি নিজেই ফরমান, فِيهِ أَسْمَاءُ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَأَسْمَاء آبَائِهِم وقبائلهم ثمَّ أجمل على آخِرهم فَلَا يُزَادُ فِيهِمْ وَلَا يُنْقَصُ مِنْهُمْ أَبَدًا ডান হাতের কিতাবে সকল জান্নাতী উম্মতগণের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা রয়েছে এবং فِيهِ أَسْمَاءُ أَهْلِ النَّارِ وَأَسْمَاء آبَائِهِم وقبائلهم ثمَّ أجمل على آخِرهم فَلَا يُزَادُ فِيهِمْ وَلَا يُنْقَصُ مِنْهُمْ أَبَدًا বাম হাতের কিতাবে সকল জাহান্নামীদের। তাই জানা গেল- হুজুর (ﷺ) শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সকল উম্মতের জান্নাতী বা জাহান্নামী হওয়ার খবর জানতেন, যা গাইবের বিষয়।

১৪। আবু জাহেল (মূর্খের বাবা), পূর্বে যার নাম ছিল আবুল হাকাম (জ্ঞানীর বাবা), একদিন হুজুর (ﷺ) কে পরীক্ষা করার জন্য এক মুষ্টি কংকর নিয়ে [নবী (ﷺ) এর সমীপে] উপস্থিত হয়। কাফের সর্দার আবু জাহেলও জানতো যে নবীরা গাইব জানে- তাই সে মুষ্টিবন্ধ কংকর নিয়ে পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। আবু জাহেল মুষ্টিতে কি আছে জানতে চাইলে হুজুর (ﷺ) ফরমান, ‘তোমার মুষ্টিতে কি আছে তা’ আমি বলব না হাতে যা আছে তা বলবে আমি কে?’ উল্লেখ্য, হুজুর (ﷺ) আবু জাহেলের মুষ্টিতে কিছু আছে তা জেনে ফেলেছেন বলেই এমন প্রশ্ন করেছিলেন। সে বলল, তা’ হলে তো আরো উত্তম। তখন কংকর কলেমা পড়ে বলল, তুমি যাকে প্রশ্ন করছ- তিনি হলেন গাইবের সংবাদ দাতা আল্লাহর নবী। উনি যে নবী এই গাইবের জ্ঞান তো কংকরের ও ছিল। তা’ হলে হুজুর (ﷺ) এর কি পরিমান গাইবের জ্ঞান ছিল তা সহজেই অনুমেয়। আরো একটি প্রানিধানযোগ্য বিষয় এই যে হুজুর (ﷺ) এর তাওয়াজ্জোতে কংকর জীবন লাভ করে, বাকশক্তি প্রাপ্ত হয়, জ্ঞানবুদ্ধি লাভ করে এবং ইলমে গাইবের অধিকারী হয়ে যায়, যা মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করার চাইতে অধিক আশ্চর্য্যরে বিষয়।

১৫। হিজরতের প্রাক্কালে, ৭০০ বৎসর পূর্বে ইয়েমেনের তুব্বা বাদশা কর্তৃক হুজুর (ﷺ) এর উদ্দেশ্যে লিখে যাওয়া চিঠি নিয়ে বাহক উপস্থিত হলে, (বাহক কিছু বলার আগেই) হুজুর (ﷺ) বাহকের নাম ধরে (আবু লায়লা) চিঠি হস্থান্তর করতে বলেন। (খাসায়েসুল কুবরা)

১৬। হিজরতের পর হুজুর (ﷺ) যেই দিন প্রথম মদিনায় পৌছেন, ঐ দিন মদিনার সর্দারগণ হুজুর (ﷺ)কে নিজ নিজ গৃহে আমন্ত্রন করার জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু হুজুর (ﷺ) ফরমান, ‘আমার উট (কাসওয়া) আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট। উট যেখানে থামবে আমি সেখানেই অবস্থান করব।’ দেখা গেল তুব্বা বাদশা কর্তৃক ৭০০ বৎসর পূর্বে হুজুর (ﷺ) এর জন্য নির্মিত দোতলা বাসস্থানের সামনে গিয়ে উট বসে গেল (সেই ঘরে তখন বাস করতেন তুব্বা বাদশার প্রতিনিধির বংশধর-আবু আইউব আনসারী (رضي الله عنه))। এই ঘটনা হতে বুঝা যায়, হুজুর (ﷺ) এর উট কাসওয়ারও গাইবের এলেম ছিল। (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া)

১৭। সামাজিক বয়কোটের কারনে ০৩ বৎসর যাবৎ শিয়াবে আবু তালেব নামক উপত্যকায় অবস্থানের পর ইলমে গাইবের মাধ্যমে নিরাপদে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। কারন কাফেরদের সাথে সম্পাদিত চূক্তিনামা যা কা’বার গায়ে টানানো ছিল, আল্লাহর নাম ছাড়া ঐ চূক্তির বাকী সবকিছু উঁই পোকা খেয়ে ফেলেছিল-হুজুর (ﷺ) তা বলে দিয়েছিলেন। (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া)

১৮। নবুয়তের ৫ম সালে হুজুর (ﷺ) মক্কার কাফেরদের উৎপীড়ন এড়াতে ১৫জন সাহাবার একটি কাফেলা আবিসিনিয়ায় হিজরত করান। তাদের বিদায়ের প্রাক্কালে হুজুর (ﷺ) বলেছিলেন, আবিসিনিয়ার খৃষ্টান বাদশা একজন ‘ন্যায়পরায়ন শাসক’। এমন মন্তব্য হুজুর (ﷺ) এর ইলমে গাইবেরই পরিচায়ক। (মেসকাত)

১৯। আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশী ৭ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহন করেন এবং ৯ম হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। হুজুর (ﷺ) মদিনা হতে ইলমে গাইবের মাধ্যমে নাজ্জাশীর মৃত্যু সংবাদ লাভ করেন এবং মদিনায় গায়েবী জানাযা পড়ান। (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া-৩০৪ পৃঃ)

২০। হুজুর (ﷺ) হযরত আলী (رضي الله عنه)কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আলী! তুমি সাধারনভাবে মৃত্যুবরন করবে না - যে পর্যন্ত না তোমার সাদা দাঁড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে যাবে।’ বাস্তবে অক্ষরে অক্ষরে এমনটাই হয়েছিল।

২১। বদরের যুদ্ধে কাফের বাহিনীর সর্দাররা কে কোথায় নিহত হবে তা হুজুর (ﷺ) যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই বলে দিয়েছিলেন এবং বাস্তবে তাই হয়েছিল। (ছহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ১৭৭৯; সুনানে আবুদাউদ, হাদিস নং ২৬৮১ জিহাদ অধ্যায়; বায়হাক্বী শরীফ, হাদিস নং ১৮৪৩৮; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৮২; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস নং ২২২; ছহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৪৭২২)।

২২। বদরের যুদ্ধে বন্দী হওয়ার পর ইবনে আব্বাসের মুক্তিপণ হিসাবে ১৬০ উখিয়া ধার্য্য করা হয়। তিনি ইহার সামর্থ নেই বললে হুজুর (ﷺ) ফরমান যে, আপনি রাত্রে চাচী উম্মুল ফজলের নিকট গোপনে ১৬০ উখিয়া লুকিয়ে এসেছিলেন যার ভিত্তিতে এই পরিমান অর্থ মুক্তিপণ ধার্য্য করা হয়। অথচ এই ঘটনা ইবনে আব্বাস ও তার পত্নী ব্যতিত অন্য কারো জানার কথা নয়।

২৩। বদরের যুদ্ধে হুজুর (ﷺ) আহত হলে, মালেক ইবনে সিনান (رضي الله عنه) হুজুর (ﷺ) এর জখমীস্থানে মুখ লাগিয়ে রক্ত চুষে খেয়ে ফেলেন। ইহা দেখে হুজুর (ﷺ) বলেন, আমার রক্ত যার সাথে মিশে আছে তাকে জাহান্নাম স্পর্শ করবে না। (সুনানে সাঈদ ইবনে মানছুর; উমদাতুল ক্বারী, ফাতহুল বারী শরহে বুখারী)। অথচ জান্নাত-জাহান্নামে যাওয়ার বিষয়তো অনেক পরের ঘটনা।

২৪। ওহুদের যুদ্ধের পর হযরত হানযালা (رضي الله عنه) এর লাশ খুজে পাওয়া যাচ্ছিলনা। তখন হুজুর (ﷺ) ফরমান, ‘হানযালাকে ফেরেশতারা আকাশে নিয়ে বেহেস্তের পানি দ্বারা গোসল দিয়ে পূনঃ ফিরত নিয়ে আসছে।’ তিনি (ﷺ) জমিনে বসেই আকাশের খবর দিয়ে দিলেন।

২৫। ৫ম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধের পর হুজুর (ﷺ) ঘোষনা দেন, “এ’ বৎসর হতে কোরাইশরা আর তোমাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহস করবে না।” বাস্তবেও তাই হয়েছিল।

২৬। খন্দকের যুদ্ধের সময় পরিখা খনন করতে গিয়ে বড় একটি পাথর পড়ে, যা কেউ ভাঙ্গতে পারছিল না। অতপর সাহাবগণ হুজুর (ﷺ) এর শরণাপন্ন হলে তিনি তিনটি আঘাতে পাথরটি ভেঙ্গেঁ ফেলেন এবং প্রথম আঘাতে পারস্যের রাজপ্রাসাদ, দ্বিতীয় আঘাতে সিরিয়াস্থ তৎকালীন রোমান রাজপ্রাসাদ এবং তৃতীয় আঘাতে সানার (বর্তমানে ইয়েমেনের রাজধানী) প্রাসাদমালা দেখা যায় এবং ঐসব স্থান বিজয়ের ভবিষ্যৎবানী করেন। (মিশকাত)

২৭। হুদাইবিয়ায় বায়আতে রিদওয়ানকালে হুজুর (ﷺ) নিজের বাম হাত ডান হাতের নিচে রেখে ফরমান, ‘আমি ওসমানের পক্ষে এই বায়আত গ্রহন করছি।’ (তাফছিরে ইবনে কাছির)। মৃত ব্যক্তির পক্ষে বায়আত হয় না। বায়আতের পূর্বে গুজব উঠেছিল যে মক্কায় ওসমান (رضي الله عنه)কে কাফেররা শহীদ করে ফেলেছে। অর্থাৎ এই বায়আতে ওসমান (رضي الله عنه) যে জীবিত ছিলেন তার ইঙ্গিঁত ছিল।

২৮। ৭ম হিজরীতে, হুদাইবিয়ার চুক্তির পরপরই হুজুর (ﷺ) ১৪০০ পদাতিক ও ২০০ অশ্বারোহী নিয়ে খায়বর দূর্গ অবরোধ করেন। ১৯ দিন যুদ্ধ অমিমাংসিত থাকার পর তিনি ঘোষনা দেন, ‘আগামীকাল আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে ইসলামী পতাকা ও নেতৃত্ব দেবো যাকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল বিশেষভাবে ভালবাসেন। আল্লাহ্ তাঁর মাধ্যমেই বিজয় দিবেন।’ পরদিন আলী (رضي الله عنه) এই দায়িত্ব পান এবং ভবিষৎবানী অনুযায়ী বিজয় লাভ করেন। (ছহীহ্ মুসলীম, মেসকাত)

২৯। খায়বরে ইহুদী মহিলা কর্তৃক বিষ প্রয়োগের ঘটনা-ছাগলের ভূনা করা বাহু হুজুর (ﷺ)কে বিষের সংবাদ বলে দিয়েছে। ভূনা গোস্তও হুজুর (ﷺ) এর তাবেদার এবং সংবাদ দাতা। (মিশকাত)

৩০। মুতার যুদ্ধের জন্য ০৩জন সেনাপতি নিয়োগ এবং যুদ্ধে তাঁদের শাহাদাৎ লাভ হুজুর (ﷺ) এ ইলমে গাইব জানারই প্রমাণ (শাহাদাৎ প্রাপ্তরা ছিলেন, প্রথম-পালকপুত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (رضي الله عنه), দ্বিতীয়-হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (رضي الله عنه) এবং তৃতীয়-হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা (رضي الله عنه))। উল্লেখ্য, শাহাদাতের পরপরই আল্লাহ্ প্রদত্ত নূরের দুই বাহু সহকারে আকাশ পথে ফেরেশতাদের সাথে উড়ে যাওয়ার সময় জাফর (رضي الله عنه) হুজুর (ﷺ)কে সালাম দেন এবং হুজুর (ﷺ) তার জবাব দেন (বোখারী)। আকাশ পথে শহীদের রূহ ফেরেশতাদের সাথে চলমান অবস্থায় সালাম দিলে মদিনায় বসে হুজুর (ﷺ) তা দেখতে ও জানতে পারেন। তা’ছাড়া নবী (ﷺ) তাঁদের জন্য মদিনায় জানাযা পড়িয়েছিলেন এবং জানাযা শেষে দোয়া করেছিলেন। (মেরকাত শরহে মেসকাত, ২য় খন্ড, ৩৫৫ পৃ:)। অথচ তারা তৎকালিন একমাসের চলার পথের দূরত্বে শহীদ হয়েছিলেন।

৩১। উপরন্ত আলোচ্য তিন সেনাপতির শাহাদাৎ বরনের ধারাবাহিক বর্ননা হুজুর (ﷺ) মাদিনার মসজিদে খোতবা দানের সময় প্রদান করেন। এমনকি অবশেষে হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ (رضي الله عنه) এর সেনাপতিত্বে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে তার গাইবী সংবাদও বলে দেন। অথচ যুদ্ধ চলছিল ১২০০কিলোমিটার দূরে। (মেরকাত শরহে মেসকাত, উমদাতুল ক্বারী)

৩২। হাদীস- কিয়ামত পর্যন্ত আর মক্কায় মুর্তি পূজা হবে না।

৩৩। হাদীস-عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ: إِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ، وَأَسْمَعُ مَا لَا تَسْمَعُونَ -“হজরত আবু জার গিফারী (রা) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: আমি যা দেখি তোমরা তা দেখনা! এবং আমি যা শুনি তোমরা তা শুননা।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২১৫১৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৪১৯০; তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ২৩১২; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ৩৮৮৩; হুলিয়াতুল আউলিয়া, ২/২৩৬; শুয়াইবুল ঈমান, হাদিস নং ৭৬৪; শরহে সুন্নাহ, হাদিস নং ৪১৭২; মুসনাদে বাজ্জার, হদিস নং ৩৯২৫; বায়হাক্বী সুনানে কুবরা, হাদিস নং ১৩৩৩৭)।

৩৪। হাদীস- فعلمت علم الأولين والآخرين আমাকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের সম্পর্কে সমস্ত জ্ঞান অবগত (করা হয়েছে)। (তছিরে রুহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৩৩০ পৃ:)। (এই হাদীস দেওবন্দী আলেমগণও তাদের “আকায়েদে ওলামায়ে দেওবন্দ” পুস্তকে স্বীকার করেছেন-পৃষ্ঠা-৫২)।

৩৫। হাদীস- عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: صَعِدَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُحُدًا، وَاتَّبَعَهُ أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ وَعُثْمَانُ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اثْبُتْ أُحُدُ، فَإِنَّمَا عَلَيْكَ نَبِيٌّ، وَصِدِّيقٌ، وَشَهِيدَانِ -“হজরত আনাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আবু বকর (رضي الله عنه), উমর (رضي الله عنه) ও উছমান (رضي الله عنه) উহুদ পাহাড়ে দাঁড়ালেন। ফলে উহুদ পাহাড় নড়ে উঠল। রাসূল (ﷺ) তাঁর পা মোবারক দ্বারা উহুদ পাহাড়ে আঘাত করলেন ও বললেন, থাম হে উহুদ! কেননা তোমার মাঝে একজন নবী, একজন সিদ্দিক ও ২জন শহিদ রয়েছে।” (ছহীহ্ বূখারী, হাদিস নং ৩৬৭৫; তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ৩৬৯৭; শরহে সুন্নাহ, হাদিস নং ৩৯০১; মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদিস নং ৩১৯৬; আস সুন্নাহ লি ইবনে আছেম, হাদিস নং ১৪৩৮; মেসকাত শরীফ, ৫৬৩ পৃ:; মেরকাত শরহে মেসকাত, ১১তম খন্ড, ২৩৪ পৃ:)। আর বাস্তবে হযরত ওমর (رضي الله عنه) ও হযরত ওসমান (رضي الله عنه) শাহাদাৎ লাভ করেন। ইহাও গাইবের জ্ঞান।

৩৬। মক্কা বিজয়ের পর হুজুর (ﷺ) খানায়ে কা’বার চাবি ওসমান ইবনে তালহা নামক কোরাইশের নিকট হতে গ্রহন করে পরে তা তাকেই ফেরৎ দেন। উল্লেখ্য, মক্কী জীবনে হুজুর (ﷺ) কা’বায় প্রবেশের জন্য ওসমান ইবনে তালহার নিকট চাবি চেয়ে প্রত্যাখাত হলে এই ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন - ‘হে ওসমান! আজ তুমি আমাকে বাধা দিচ্ছ, হয়ত এমন একদিন আসবে-যখন তোমার হাতের চাবিখানা আমার হাতে আসবে এবং আমি যাকে ইচ্ছা (এই চাবি) তাকে দিয়ে দিব?’ বাস্তবেও তাই ঘটেছিল।

৩৭। মি’রাজের রজনীতে আল্লাহর সাথে গোপন আলাপের কিয়দাংশ ছিল ইলমে গাইব সংক্রান্ত। ৩০+৩০+৩০ = ৯০ হাজার এলেম দান করা হয়। ত্রিশ হাজার আম/শরিয়ত সংক্রান্ত, ত্রিশ হাজার খাস/মারেফত সংক্রান্ত এবং ত্রিশ হাজার খাস্সুল খাস/গোপনীয়-যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই জানেন। (পুরাতন কাছাছুল আম্বিয়া, রুহুল বয়ান)

▪ সূরা নাজম- فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى অর্থ: “যা গোপনে বলার, আল্লাহ্ তা’ আপন প্রিয় বান্দার কাছে গোপনেই বলেছেন।”

▪ হাদীস- আমাকে অনেক প্রকারের গুপ্ত এলেম দান করা হয়েছে এবং সাথে সাথে ঐ এলেমের কোন কোন বিষয় গোপন রাখতেও বলা হয়েছে।

▪ প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “নূরুল আনোয়ার”এর গ্রন্থাকার আল্লামা মোল্লা জিওন (رحمة الله) তফসীরে আহমদিয়া, পৃঃ ৩৩১, সূরা নাজমের ব্যাখ্যায় ৯০ হাজার এলেমের কথা বলেছেন। তাঁর বই কওমী/আলিয়া সবাই পড়ে।

৩৮। শেষ জামানায় ইমাম মাহদী (عليه السلام) এবং কাফেরদের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন সময় দাজ্জালের আত্ম প্রকাশের সংবাদ আসবে। তখন ইহার সত্যতা যাচাই করার জন্য ১০জন অশ্বারোহীকে প্রেরন করা হবে যারা হবেন তৎকালীন মানুষদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। হুজুর (ﷺ) আরো জানান, ‘আমি তাদের ও তাদের পিতার নাম জানি। এমনকি তাদের ঘোড়ার গায়ের রং কি হবে তাও জানি’ (মুসলিম শরীফ)। ইহা ইলমে গাইব নয় কি?

৩৯। হাদীস- ‘এ’সব লোকদের (মোনাফিকদের) কি যে হলো আমার জ্ঞান নিয়ে তারা বিরূপ সমালোচনা করছে। তোমরা এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যেকোন বিষয় সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করো আমি অবশ্যই উহা তোমাদেরকে বলে দেব।’ অতপর: প্রশ্ন করা হলে তিনি (সাঃ) কাউকে জান্নাতী, কাউকে জাহান্নামী, কাউকে যারজ ইত্যাদি বলে জানিয়ে দেন। এ পর্যায়ে হযরত উমর (رضي الله عنه) এসে কদমবুচী করে ক্ষমা ভিক্ষা চান।

তাফছিরে তাবারী, ৭ম খন্ড, ৮৯ পৃ:; সূরা মায়িদার ১০১ নং আয়াতের ব্যখ্যায় হাফেজ ইবনে কাসির তাঁর তাফসিরে এই ঘটনা বর্ননা করেছেন- বুখারী ও মুসলিম শরীফের বরাতে।

৪০। হযরত ওমর (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূল (ﷺ) এক জায়গায় আমাদের সাথে অবস্থান করছিলেন। সেখানে তিনি আমাদিগকে ফজর হতে মাগরিব পর্যন্ত সৃষ্টির সূচনা থেকে সংবাদ দিচ্ছিলেন, এমনকি বেহেস্তবাসী ও দোযখবাসীরা নিজ নিজ ঠিকানায় পৌছে যাওয়া অবধি পরিব্যপ্ত যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনাবলীর বর্ননা প্রদান করেন। যিনি ঐসব স্মরন রাখতে পেরেছেন তিনি তো স্মরন রেখেছেন, আর যিনি স্মরন রাখতে পারেননি-তিনি ভুলে গেছেন” (ছহীহ্ বুখারী, মিশকাত শরীফ ৫০৬ পৃ:)। এমনকি ‘নেহাদ’ নামক ব্যক্তি সর্বশেষ জান্নাতে প্রবেশ করবে, তিনি তাও বলে দেন। হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ঐ দিনের বর্ননা যে যত বেশী স্মরন রাখতে পেরেছিল সে আমাদের মধ্যে তত বড় আলেম বলে পরিচিত ছিল।’ তাই তো আল্লামা বুছরী (رحمة الله) তাঁর কাসিদায়ে বুরদায় লিখেন, “হে রাসূল (ﷺ)! আপনার বদান্যতায়ই দুনিয়া ও আখেরাতের অস্তিত্ব। লওহে মাহফুজ ও কলমের জ্ঞান আপনার জ্ঞান ভান্ডারের সামান্য অংশমাত্র।”

৪১। মক্কা-মদিনার মধ্যবর্তি “আবওয়া” নামক স্থানে নবী করিম (ﷺ) স্বীয় আম্মাজানের কবর যিয়ারত করেন। (সুনানে আবু দাউদ, ৪৬১ পৃ:)। মৃত্যুর ৫০ বৎসর পর কোন প্রদর্শক ছাড়া আম্মাজানের কবরের অবস্থান জানা তাঁর গাইব জানারই প্রমাণ।

৪২। হুজুর (ﷺ) ২৩মাস ১৩দিন মা হালিমার দুধ পান করেন এবং তার পূর্বে মক্কায় ১৭দিন অর্থাৎ সর্বমোট ২৪মাস। পরবর্তীতে কুরআনেও দুধ পানের ২৪মাসের বিধান জারী হয়।

৪৩। হুজুর (ﷺ) শিশুকালে চাঁদের সাথে খেলা করেছেন। হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) ইহার সাক্ষ্য দিলে হুজুর (ﷺ) ফরমান, “চাচাজান শুধু তাই নয়, আমি চাঁদের সাথে কথা বলতাম, চাঁদও আমার সাথে কথা বলত।” (খাসায়েসুল কুবরা)

৪৪। ইসলামের প্রথম মহিলা শহীদ সুমাইয়া (رضي الله عنه) এর ছেলে আম্মার (رضي الله عنه)কে কোরাইশরা হত্যার চেষ্টা করে। তখন নবী (ﷺ) ভবিষৎবানী করেন, “তোমাকে কোরাইশরা শহীদ করতে পারবে না। تَقْتُلُكَ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ তুমি শহীদ হবে মুসলিম বিদ্রোহীদলের হাতে।” তিনি সিফ্ফিনের যুদ্ধে মাওলা আলী (رضي الله عنه) এর পক্ষে যুদ্ধ করে মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর বাহিনীর হাতে শহীদ হন।

৪৫। আবু জাহেল নবী করিম (ﷺ)কে খাট করার জন্য ইয়েমেনের শাসক “হাবীব ইবনে মালেকের” সাহায্য চায়। সে দলে বলে মিনায় উপস্থিত হয়। আবু জাহেল নবী (ﷺ)কে সংবাদ দিলে তিনি (ﷺ) সিদ্দিকে আকবর (رضي الله عنه) কে সঙ্গেঁ নিয়ে উপস্থিত হন। আবু জাহেলের ইঙ্গিঁতে হাবীব ইবনে মালেক জমিনের মোজেযার পরিবর্তে আকাশের চাঁদ দ্বিখন্ডিত করার আবদার পেশ করে। নবী (ﷺ) ০২ রাকাত নামায পড়ে আঙ্গুঁল দ্বারা ইশারা করতেই চাঁদ দুই টুকরা হয়ে যায় এবং আবু কোবায়েছ পর্বতের দুইদিকে দুইটুকরা অবস্থান নেয়। হাবীব ইবনে মালেক নিজ দেশ থেকে যাত্রার প্রাক্কালে মনে মনে নিয়ত করে এসেছিল যদি তিনি সত্য নবী হন তবে তার আজন্ম পঙ্গুঁ মেয়ের জন্য রোগমুক্তির দোয়া চাইবে। তাই পরীক্ষা করার জন্য প্রশ্ন করল- বলুন আমি কি নিয়ত করে এসেছি? ” হুজুর (ﷺ) বলেন, তুমি পঙ্গুঁ মেয়ের জন্য দোয়া চাইবে। যাও তোমার মেয়ে আরোগ্য লাভ করেছে এবং মুসলমান হয়ে গেছে। ইহা শুনে হাবীব ইবনে মালেকও ঈমান আনেন।

৪৬। হুজুর (ﷺ) আসমা বিনতে ওসায়মকে ফরমান- তোমাকে আমার উম্মতের ০৩ ব্যক্তি বিবাহ করবে। পরবর্তীতে জাফর ইবনে আবু তালেব (رضي الله عنه), হযরত আবু বকর ইবনে আবু কোহাফা (رضي الله عنه) এবং হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (رضي الله عنه) - পরপর এই ০৩জনের সাথে শাদীর মাধ্যমে হুজুর (ﷺ) এর ভবিষ্যৎবানী বাস্তবায়িত হয়। (শাওয়াহেদুন নবুয়ত; পৃষ্ঠা-১৯৪)

৪৭। হুজুর (ﷺ) হযরত আলী (رضي الله عنه)কে ফরমান- তুমি এমন লোকদের সাথে যুদ্ধ করবে যারা ইসলাম থেকে খারেজ। তার মধ্যে একজন হবে যার কাঁধে মহিলাদের স্তনের মত গোস্ত খন্ড থাকবে। সত্যি তাই ঘটেছিল। যুদ্ধ শেষে ৪০টি মৃত দেহের নীচে তার দেহ পাওয়া যায়। (শাওয়াহেদুন নবুয়ত; পৃষ্ঠা-১৯৪)

৪৮। হযরত আবু যর (رضي الله عنه) এর ওফাত- তিনি ওসমান (رضي الله عنه)এর খিলাফতকালে মদিনার বাইরে “রবযা” নামক স্থানে স্ত্রীসহ বসবাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর সময় স্ত্রী কাঁদতে লাগলেন। জিজ্ঞাসিত হলে বললেন-‘ঘরে একখন্ড কাপড়ও নাই, আপনার কাফন দিব কিভাবে।’ তখন তিনি ফরমান - হুজুর (ﷺ) ফরমাইয়াছেন যে, “তোমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি উজাড় জনশূন্য প্রান্তরে ইন্তেকাল করবে, তখন মুসলমানদের একটি দল সেখানে সমবেত হবে। ঐ সময় যারা ঐখানে উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে আমি ছাড়া সবাই মারা গেছেন। তাই তুমি পাহাড়ের উপর গিয়ে দেখ নিশ্চয়ই কেউ এই পথে আসবেন।” স্ত্রী গিয়ে দেখলেন যে ঠিকই একটি কাফেলা আসছে, যারা সযতেœ আবু যর (رضي الله عنه) এর দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন। (শাওয়াহেদুন নবুয়ত; পৃষ্ঠা-১৯৫)

৪৯। হাদীস- হুজুর (ﷺ) ভবিষ্যৎবানী করেছেন যে, পূর্ব দিক হতে দুইটি শয়তানের শিংয়ের আবির্ভাব হবে। বুজুর্গদের মতে একটি ছিল মোসায়লামা কাজ্জাব যে আবু বকর (رضي الله عنه) এর খেলাফতকালে নবী দাবী করেছিল। আরেক শিং হলো আবদুল ওহাব নজদী, যার বদ আক্বীদার কারনে আজ মুসলিম উম্মাহ মারাত্বক ফেৎনায় জর্জরিত।

৫০। হাদীস- হুজুর (ﷺ) আরো ভবিষ্যৎবানী করেছেন, এই উম্মতের মধ্যে এমন একজনের আবির্ভাব হবে, যদি আল্লাহ্ জ্ঞানকে সুরাইয়া তারকাতেও লুকাইয়া রাখেন, তবে সে ঐ জ্ঞান ছিনিয়ে নিয়ে আসবে। তাঁর বিষয়ে এজমা হলো-তিনি ছিলেন ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله)। (শামী, মুকাদ্দমা)

৫১। যিনি গাইব এর মালিক মহান রাব্বুল আ’লামিনকে দেখেছেন, তাঁর কাছে আর গাইবের বাকী রইল কি?

৫২। হাদীস- হুজুর (ﷺ) ইমাম মাহদী (عليه السلام) এর আগমন সম্মন্ধে বলে গেছেন। তা’ছাড়া তিনি কেয়ামতের বিষয়ে আমাদের জন্য অসংখ্য হাদীস রেখে গেছেন। শেষ জামানায় উম্মতের আমল-আক্বীদা সম্মন্ধেও বলে গেছেন।

৫৩। ঈসা (عليه السلام) তাঁর কওমে উদ্দেশ্য করে বলেন, وَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ "তোমরা তোমাদের ঘরে কি কি খাচ্ছ এবং কি কি জিনিস জমা করে রাখছো - তা আমি না দেখেই তোমাদের বলে দিচ্ছি।” (সূরা: আলে ইমরান: আয়াত: ৪৯।) ইহা ছিল গাইবের জ্ঞান যা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। ঈসা (عليه السلام)এর যদি গাইবের জ্ঞান থাকতে পারে তবে হুজুর (ﷺ) এর কি তা ছিল না?

৫৪। হযরত খিজির (عليه السلام) হযরত মূসা (عليه السلام)কে ০৩টি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন; (১) মাঝির নৌকার তলা ছিদ্র করার বিষয়, (২) সুন্দর বালকটি লাঠির আঘাতে হত্যার বিষয় ও (৩) ভাঙ্গাঁ দেওয়াল বিনা পারিশ্রমিকে মেরামতে সাহায্য করা। ইহাও ছিল গাইবের জ্ঞান, যা পবিত্র কোরআনে বর্নিত (সূরা: কাহফ)। হযরত খিজির (عليه السلام) একজন অলী। তাঁর যদি এমন গাইবের জ্ঞান থাকে তবে হুজুর (ﷺ) এর গাইবের জ্ঞান তো নিঃসন্দেহে আরও ব্যাপক।

৫৫। একদিন হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ (رضي الله عنه) রিসালতের দরবারে বিষন্ন অবস্থায় বসা ছিলেন। ইহা দেখে হুজুর (ﷺ) কারন জানতে চান। হযরত যাবের (رضي الله عنه) ফরমান, তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ (رضي الله عنه) ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হন এবং তিনি ছয় সন্তান ও ঋন রেখে গেছেন তাই বিষন্ন। হুজুর (ﷺ) তখন ফরমান, হে যাবের! তোমাকে কি এমন সংবাদ দিব যা শুনে তুমি খুশী হয়ে যাবে? যাবের (رضي الله عنه) উত্তরে হ্যাঁ বললে, হুজুর (ﷺ) ফরমান, ‘অদ্যবধি কোন মৃত ব্যক্তির সাথে আল্লাহ্ সরাসরি কথা বলেননি। তোমার শহীদ পিতাই হলেন প্রথম ব্যক্তি যার সাথে আল্লাহ্ সরাসরি কথা বলেছেন এবং জিজ্ঞাস করেছেন। হে আবদুল্লাহ্ তুমি কি চাও? তোমার পিতা পুনরায় দুনিয়ায় এসে পূন: শাহাদাতের স্বাদ পেতে চায়। কিন্তু তাকে বলা হয়, কেউ পরীক্ষায় পাশ করার পর আবার পরীক্ষা দেওয়ার বিধান নাই।’ -(বুখারী)

৫৬। এক মহিলা সাহাবী প্রিয় নবী (ﷺ) এর দরবারে এসে, বদরের যুদ্ধে শাহাদাত লাভকারী তার যুবক ছেলে (হযরত হারেজ (رضي الله عنه)) কি অবস্থায় আছে তা জানতে চাইলে, হুজুর (ﷺ) ঐ মাকে সান্তনা দিয়ে বলেন, “আমি দেখছি, তোমার শহীদ ছেলে সর্বোচ্চ জান্নাত, জান্নাতুল ফিরদাউসে রয়েছে।”

৫৭। জনৈক সাহাবী (মায়েয আসলামী)কে শাস্তিমূলক অপরাধের জন্য পাথর নিক্ষেপ করে ছঙ্গেঁছার করা হয়েছিল। ঐ সাহাবীর অপরাধের জন্য অন্য সাহাবী কটুক্তি করেন। তা’ শুনে হুজুর (ﷺ) ফরমান, “ওকে তুমি মন্দ বলছো, অথচ সে এখন বেহেস্তের ঝর্ণাধারায় তৃপ্তিতে অবগাহন করছে।”

৫৮। আম্মাজানগণ জানতে চাইলেন- “হে আল্লাহর প্রিয় রাসূল! আমাদের মধ্যে সবার আগে (ওফাতের পর) কে আপনার সাথে মিলিত হবে?” জবাব- "তোমাদের মধ্যে যাঁর হাত লম্বা-তিনি।” (হাত লম্বা ছিল মা সওদার (رضي الله عنه), কিন্তু প্রথম ইন্তেকাল করেন মা জয়নব (رضي الله عنه)- দানশীলা হিসাবে তাঁর হাতই অধিক লম্বা ছিল।)

৫৯। দুই কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আযাব দেখলেন। এটাও জানলেন-একজন চোগলখুরীর জন্য এবং অপরজন উটের প্রস্রাব থেকে সতর্ক ছিল না বলে শাস্তি ভোগ করছেন। তিনি (ﷺ) দুই কবরের উপর দুইটি তাজা খেজুর ডালা (আযাব হালকা করার জন্য) পুতে দিলেন। - ইহা গাইব জানা নয় তো কি?

৬০। নবী করিম (ﷺ)কে যখন জিব্রাইল (عليه السلام) হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) এর কারবালায় শহীদ হওয়ার সংবাদ দেন, তখন তাঁকে কারবালার মাটির নমুনা পেশ করা হয়। এই মাটি হুজুর (ﷺ) আম্মাজান উম্মে সালমা (رضي الله عنه) এর নিকট গচ্ছিত রেখে ফরমান, যখন এই মাটি লাল হয়ে যাবে তখন বুঝবে আমার হুসাইন শহীদ হয়ে গেছেন। ৬১হিঃ তে কারবালার ঘটনা পর্যন্ত উম্মুলমোমেনীনদের মধ্যে একমাত্র মা সালমা (رضي الله عنه)ই জীবিত ছিলেন। এই ঘটনা হুজুর (ﷺ) এর গায়েবের জ্ঞানেরই পরিচায়ক।

৬১। তিনি ওসমান (رضي الله عنه) এর শাহাদাতের কথা ও বলে গেছেন। এমনকি ঐ সময় ওসমান (رضي الله عنه) কোরআন পাঠ করতে থাকবেন এবং তাঁর রক্তের ফোটা কোন আয়াতের উপর ছিটকে পড়বে তাও বলে গেছেন এবং বাস্তবেও তাই ঘটেছিল।

৬২। তিনি জানিয়ে গেছেন যে উমর (رضي الله عنه) বেঁচে থাকতে কোন ফেৎনা বা সন্ত্রাস প্রকাশ পাবে না। বাস্তবেও তাই হয়েছিল।

৬৩। তিনি বলেছিলেন- তোমাদের মধ্যে সকলের শেষে মৃত্যুবরনকারী অগ্নিদগ্ধ হবে। ঐ দলে ছিলেন- আবু হুরায়রা (رضي الله عنه), হুযাইফা (رضي الله عنه) ও সামুরা বিন জুনদব (رضي الله عنه)। দেখা গেল সামুরা (رضي الله عنه) তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ ইন্তেকাল করেন এবং তা ছিল অগ্নিদগ্ধ হয়ে।

৬৪। তিনি জানিয়েছিলেন মুসাইলামা আল্-কায্যাবকে আল্লাহ্ কেটে ফেলবেন। শেষে আবু বকর (رضي الله عنه) এর খিলাফতের সময় তাকে নবুয়তের দাবী করায় হত্যা করা হয়।

৬৫। তিনি জানিয়েছিলেন- ‘আমার পর খেলাফত থাকবে ৩০ বৎসর। তারপর রাজার শাসন শুরু হবে।’ (আবু দাউদ) বাস্তবে তাই হয়েছিল।

৬৬। তিনি ওয়াইস করনীর খবর দিয়েছিলেন।

৬৭। إِنَّ ابْنِي هَذَا سَيِّدٌ وَلَعَلَّ اللَّهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِين          

আমার এ’ পূত্র ‘সাইয়্যেদ’ (নেতা), এর হাতে আল্লাহ্ তা’য়ালা দু’টি বড় দলের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করবেন (বুখারী ও মুসলিম)। ইহা ছিল ইমাম হাসান (رضي الله عنه) সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী।

৬৮। হুজুর (ﷺ) মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, যা তাঁর জীবদ্দশায়ই সম্পন্ন হয়। এমন কি তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের ও ভবিষ্যতদ্বানী করেছিলেন, যা ওমর (رضي الله عنه) এর খেলাফতকালে বাস্তবে রূপ নেয়।

৬৯। তিনি ইয়ামান, শ্যামদেশ ও ইরাক বিজয়ের ও ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন। (মেসকাত)

৭০। তিনি উম্মতের মধ্যে বিভেদ ও বিপর্যয় নেমে আসার ভবিষ্যদ্বানী করেন। লোকেরা স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের পথ ও মত গ্রহন করতে থাকবে। তারা ৭৩ ফিরকায় বিভক্ত হবে যা এখন বাস্তবরূপ নিয়েছে।

৭১। তিনি বলে গেছেন- উত্তম লোকের উপর দুষ্ট লোকেরা কর্তৃত্ব করবে।

৭২। তিনি জানিয়ে গেছেন- তাঁর উম্মতের রাজত্ব পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এই ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে মুসলিম উম্মাহর রাজত্ব পূর্ব ও পশ্চিমে যতটুকু বিস্তার লাভ করেছে উত্তর-দক্ষিনে ততটা বিস্তার লাভ করেনি।

৭৩। তিনি বলে গেছেন- কোন এক উম্মুল মু’মিনের সামনে হাওআব এর কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠবে। আলী (رضي الله عنه) এবং মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর মধ্যে যুদ্ধের সময় মা আয়েশা (رضي الله عنه) এর সামনে এমনটাই হয়েছিল। তিনি ইহাও বলে গেছেন যে তাঁর এক স্ত্রীর চারপাশে বহু লোক নিহত হবে, কিন্তু তিনি বেঁচে যাবেন। (মেসকাত) ঐদিন আয়েশা (رضي الله عنه) এর চারপার্শে ২৩,০০০ লোক নিহত হয়েছিল অথচ তিনি অক্ষত বেঁচে যান।

৭৪। তিনি বনু উমাইয়্যাগণের রাজত্ব লাভের কথাও জানিয়ে গেছেন।

৭৫। তিনি আরো জানিয়েছেন যে, বনু আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব কালো পতাকা নিয়ে বের হবেন এবং তারা ইতিপূর্বে যারা (রাজত্বের) অধিকারী হয়েছেন তার চেয়ে বহুগুন বড় রাজত্বের অধিকারী হবেন।

৭৬। ঈসা (عليه السلام) হাওয়ারীগণের অনুরোধে নূহ (عليه السلام) এর আমলের বন্যার ঘটনার বর্ননা শুনানোর জন্য এক জায়গায় উপস্থিত হয়ে কয়েকটা পয়েন্ট হতে বালি একত্রিত করে আল্লাহর নামে নূহ (عليه السلام) এর এক পুত্র ছামকে জীবিত করেন। ছামের নিকট হতে বন্যার বর্ননা শুনার পর তার মাথায় হাত রাখেন (যেন ছামের পুনরায় মৃত্যু যন্ত্রনা না হয়) এবং ছাম আবার বালিতে পরিণত হয়ে যান। দেখা গেল যে ছামের দেহের মাটি কোথায় ছিল তা ঈসা (عليه السلام) জানতেন।

৭৭। হযরত আলী (رضي الله عنه) এর শাহাদাৎকারী (আবদুর রহমান মুলজিম), যে পূর্বে তাঁরই গোলাম ছিল, একদিন সফরের সময় পিপাসায় কাতর হয়ে পানির আর্জি করে। মওলা আলী একটি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবরবাসীর নাম হইতে শুরু করে হযরত আদম (عليه السلام) পর্যন্ত তার সকল পূর্ব পুরুষের নাম উল্লেখ পূর্বক পানির সন্ধান জানতে চান। কবরবাসী কিছু দূরেই পানি আছে বলে সংবাদ দেন। তখন মুলজিম বলে ফেলল, ‘একটু দূরে পানি আছে তা জানেন না, অথচ কবরবাসীর সকল পূর্ব পুরুষের নাম জানেন-এ কেমন কথা! তখন আলী (رضي الله عنه) ফরমান, ‘আমি তা’ও জানতাম। তবে আমার মধ্যে অহংকার যেন না আসে তাই আমি বলি নাই।’ ইহা হলো আল্লাহ্ ওয়ালাগণের হেকমত।

৭৮। সিফ্ফিনের যুদ্ধে-পানির তীব্র সংকট। দূরে বিজন ভূমিতে একটি গীর্জা দেখা গেল। গীর্জাবাসীদের পানির কথা জিজ্ঞাসা করলে তারা ০২ ফার্লং দূরে পানি আছে বলে জানালেন। তখন হযরত আলী (رضي الله عنه) ফরমান-ঐখানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, এখানেই মাটি খনন কর। একটু খননের পরই একটা পাথর বের হলো। তিনি বললেন, এই পাথরের নিচেই পানি, তাই পাথর উল্টে ফেল। কিন্তু কেউ পারলনা। হযরত আলী (رضي الله عنه) নেমে সামান্য ধাক্কা দিলেই পাথর সরে গেল, আর বেরিয়ে এলো সচ্ছ ও ঠান্ডা পানি। সকলে পানি পান করে ঝর্না বন্ধ করে দিল। (শাওয়াহেদুন নবুয়ত; পৃষ্ঠা-২১৯ ও ২২০) (ইহা আলী (رضي الله عنه) এর গাইবের জ্ঞান। আর এই ঘটনা দেখে পাদরী ইসলাম কবুল করে নিল। নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম কবুলের কারন জিজ্ঞাসা করলে সে বলে- তার কিতাবে লিখা ছিল যে আখেরী নবী বা তাঁর প্রতিনিধি একদিন এসে এই ঝর্নার মুখের পাথর অপসারন করে সাথীদের তৃষ্ণা নিবারণ করবেন। এই ঘটনা ইহাও প্রমাণ করে যে, অলীগণও আল্লাহর ইচ্ছায় ইলমে গায়েব লাভ করতে পারেন।)

৭৯। হযরত ওমর (رضي الله عنه), তাঁর খেলাফত আমলে, মদিনার মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে ১২০০ মাইল দূরে যুদ্ধরত সেনাপতি সারিয়া (رضي الله عنه) কে যুদ্ধের কৌশল বলে দেন- يَا سَارِيَ الْجَبَلَ “ওহে সারিয়া! পাহাড়ের দিকে পিঠ দাও।” (দালায়েলুন্নবুয়াত, মেসকাত শরীফ)

৮০। গাউস পাক হযরত আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর সকল শহর দেখে নিয়েছি।’ একজন ওলীর জ্ঞানের অবস্থা যদি এমন হয়, তা’ হলে সাহাবীগণের, নবী রাসূলগণের এবং সকল নবীদের সর্দার হুজুর পুর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর গাইবের জ্ঞানের অবস্থা কেমন হবে?


উপসংহার

যারা হুজুর (ﷺ)কে উম্মি নবী অর্থে মনে করে যে তাঁর কোন প্রাতিষ্ঠানিক এলেম বা ইলমে গাইব নেই,তাদের উচিত কোন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পিএইচডিধারী কিম্বা কোন আল্লামার উম্মত হওয়া। আমাদের আলেমরা হাদীস শিখে আলেম হয়। আর যাঁর কথাই হাদীস তিনি উম্মি হন কিভাবে? ইমাম আবু হানীফা হলেন ইমামে আযম, আর ইমাম আবু হানীফার যিনি ইমাম সেই মহান স্বত্তা (হুজুর (ﷺ)) এলেমহীন হন কেমন করে? হুজুর (ﷺ)তো হলেন জ্ঞানের আধার। তাই তো তিনি উম্মি (অর্থাৎ সকল জ্ঞানের আধার এবং সকল সৃষ্টির মূল)।

হুজুর (ﷺ) হলেন মহান রাব্বুল আ’লামিনের প্রকাশ/বিকাশস্থল। অতএব, তিনি অবশ্যই আল্লাহর গুনে গুনান্বিত এবং আল্লাহর রঙে রঞ্জিত। তাই আমরা বলতেই পারি যে, হুজুর (ﷺ)ও ইলমে গাইবের অধিকারী ছিলেন এবং আল্লাহ্ তাঁকে অফুরন্ত গাইবের এলেম দান করেছেন। এমনকি অলীগণও এ’ জ্ঞান লাভ করতে পারেন। তবে আল্লাহ্ হলেন ইলমে গাইবের মালিক ও স্রষ্টা। আল্লাহর ইলমে গাইবের গুন হলো সত্তাগত, আর নবী-রাসূল ও অলীগণের এই গুন হলো আতায়ী। ইহাই হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আক্বিদা।


---ঃ---

উসিলা (তাওয়াচ্ছুল)

১। উসিলার অর্থ কারো মধ্যস্থতায় আল্লাহর নিকট কিছু প্রার্থনা করা বা চাওয়া। এই উসিলা নিয়ে বর্তমান যুগে অনেক ফেৎনা, বিভ্রান্তি ও বিভক্তি রয়েছে। যদিও উসিলা কুরআন-হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত ও প্রমানিত, তবু এই বিষয়ে আপত্তির কোন শেষ নেই। এর মূল কারন হলো ভিন্ন মতাবলম্বিদের গুরু আবদুল ওহাব নজদী উসিলা এবং শাফায়াতকে র্শিক/হারাম বলেছেন। আর তার অনুসারী সৌদী হুকুমত প্রতি বছর আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ হজ্জ ও ওমরা পালনকারী মুসল্লিদের মধ্যে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের দ্বারা উসিলাসহ আরো অনেক বদ আক্বীদার আগ্রাসন চালাচ্ছেন এবং একই আক্বীদায় বিশ্বাসী আমাদের দেশের (ভিন্ন মতাবলম্বি) আলেমগণ ইহার স¤প্রচার জোরে শোরে চালিয়ে যাচ্ছেন। তদুপরী সৌদিতে কর্মরত আমাদের লক্ষ লক্ষ প্রবাসী কর্মজীবি মানুষ বুঝে-না-বুঝে সৌদী আরব থেকে বদ আক্বীদার বিষবাষ্প আমদানী করে বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে উসিলা সংক্রান্ত মূখ্য ফেৎনাসমূহ নিম্নরূপঃ-

ক) চাইতে/প্রার্থনা করতে হবে আল্লাহর নিকট। কারো মধ্যস্থতা বা উসিলা গ্রহন শিরক/বিদআত।

খ) নবী করিম (ﷺ) এর উসিলা হায়াতে বৈধ হলেও আগে পরে নেওয়ার দলিল কোথায়?

গ) (তাদের মতে) কুরআনে যেই উসিলার কথা বলা হয়েছে, তা’ শুধু নেক আমলকে (আমলে সালেহা) বুঝায়, কোন ব্যক্তির উসিলা নয়।

২। আমলে সালেহার উসিলা হক্ব। কিন্তু আমলে সালেহা যদি আল্লাহর নিকট পছন্দীয় হয়, তা’ হলে আল্লাহর মাহবুব বান্দাদের উসিলা তো আরো বেশী হক্ব। কারন আমল কবুল হওয়ার জন্যও তো উসিলার প্রয়োজন রয়েছে। হয়ত আমরা ভূলে গেছি যে, আমলে সালেহা ও জান্নাতের মাঝে নবী (ﷺ)কে কবরে চিনা একটি শর্ত বা বরযখ। যাহা হউক, আমরা উসিলা বৈধ না অবৈধ এবং ইহা হুজুর (ﷺ) এর ওফাতের আগে ও পরে নেওয়া যাবে কিনা তা খতিয়ে দেখব।


উসিলার দলিল

১। ৫ঃ৩৫ (মায়িদা)- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ “হে মুমিনগণ! আল্লাহ্কে ভয় কর, তাঁহার নৈকট্য লাভের উসিলা (মাধ্যম বা উপায়) অন্বেষন কর; যাহাতে তোমরা সফলকাম হইতে পার!” ইহা উসিলার সর্বকালীন হুকুম।

২। ২ঃ৮৯ (বা’কারা)- وَلَمَّا جَاءَهُمْ كِتَابٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ وَكَانُوا مِنْ قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ فَلَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْكَافِرِينَ “তাঁহাদের নিকট যাহা আছে (তৌরাত) আল্লাহর নিকট হইতে তাহার সমর্থক কিতাব আসিলে; যদিও পূর্বে সত্য প্রত্যাখানকারীদের (কাফির) বিরুদ্ধে তাহারা ইহার সাহায্যে বিজয় প্রাথনা করিত, তবুও তাহারা যাহা জ্ঞাত ছিল উহা যখন তাহাদের নিকট আসিল তখন তাহা উহারা প্রত্যাখান করিল। সুতরাং কাফিরদের প্রতি আল্লাহর লা’নত।” অর্থাৎ- হুজুর (ﷺ) এর জন্মের পূর্বে বনি ইসরাঈল তাঁহার (ﷺ) উসিলা নিয়ে যুদ্ধে জয় লাভ করত। ইহা হুজুর (ﷺ) এর জন্মের পূর্বের উসিলার দলিল।

৩। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর বর্ননা থেকে ইমাম আজমী (رحمة الله) উদ্ধৃত করেন- ইহুদীরা যুদ্ধে পরাস্থ হওয়ার উপক্রম হলে যুদ্ধের ময়দানে তৌরাতের ঐ নির্দিষ্ট আয়াতের উপর, যেখানে হুজুর (ﷺ) এর আগমনের কথা বর্র্ণিত, আঙ্গুল রেখে তাঁর (ﷺ) উসিলা নিয়ে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করে যুদ্ধে বিজয় লাভ করত। এ ঘটনা এবং কুরআনে সূরা বা’কারার উপরোক্ত ৮৯নং আয়াতের আলোকে- একদা হযরত মোয়াজ ইবনে জাবাল (رضي الله عنه) এক ইহুদীকে পাকড়াও করে বলেন- পূর্বে তোমরা যুদ্ধে জয়লাভের জন্য তাঁর (ﷺ) উসিলা নিতে, আর এখন যখন তিনি আগমন করেছেন, তখন আমরা মু’মিন আর তোমরা বিরোধীতা করছ।

৪। ৪ঃ৬৪ (নিসা)- وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا যদি নিজের আত্মার উপর যুলুম কর, নবী (ﷺ) এর নিকট যাও, যদি নবী (ﷺ) সুপারিশ করেন, তবে তোমরা আমাকে ক্ষমাকারী হিসাবে পাবে। ইহা হতে বুঝা গেল আল্লাহ্ নিজেই উসিলা গ্রহনের শিক্ষা দিচ্ছেন। এই নির্দেশও স্বর্বকালীন।

৫। ১৭ঃ৫৭ (বনি ইসরাঈল)- يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ তাহারাইতো (নবী-রাসূলগণ) তাহাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উসিলা সন্ধান করে যে, তাহাদের মধ্যে কে কত নিকটতর হইতে পারে। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ হইতে উসিলার বৈধতার প্রমাণ মিলে।

৬। আদম (عليه السلام)কে হিন্দুস্থানের জমিনে অবতরনের পর তিনি ভীষন অস্থির ও পেরেশান হন। অবস্থা দৃষ্টে আল্লাহ্ জিব্রাইল (عليه السلام) কে তলব করে আদম (عليه السلام) এর নিকট গিয়ে আযান দিতে বলেন। আযানে আশহাদুআন্না মুহাম্মাদুর রাসূল আল্লাহ্- ইহার উসিলায় আদম (عليه السلام) স্বস্থি ফিরে আসে, তিনি প্রশান্ত হন।

(হিন্দুস্থানের জমিনে তিনটি বিশেষ ঘটনা: সর্বপ্রথম আদম (عليه السلام) এর আগমন, সর্বপ্রথম জিব্রাইল (عليه السلام) এর আগমন এবং সর্বপ্রথম আযান)।

৭। হাদীস- আল্লাহ্ আদম (عليه السلام) কে তাঁর খেলাফে আওলার জন্য বেহেশত হতে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। ঐ সময় আল্লাহ্ আদমকে কিছু কালাম শিক্ষা দেন। ঐ কালাম দ্বারা আদম (عليه السلام) ৩৪০ বৎসর কান্নাকাটি করার পরও যখন ক্ষমা পেলেন না, তখন প্রিয় নবী (ﷺ) এর উসিলা দিয়ে দোয়া করে মার্জনা লাভ করেন। যদিও ঐ কালাম উসিলা গ্রহনের যোগ্যতা অর্জনে সহায়ক ছিল। (আদম (عليه السلام) যে আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) এর উসিলায় মুক্তি পান, এই বর্ণনা ইবনে কাসীর (رحمة الله) এর “মুসনাদ আল ফারুক, কিতাবুল মুজিযাতি ওয়াল মানাক্কিবি ওয়াল ফাদ্বায়িল-২/৬৭১ পৃষ্ঠায় রয়েছে”)

৮। আদম (عليه السلام) শীশ (عليه السلام) কে অছিয়ত করেন- যখনই আল্লাহর নাম নিবে তখন সাথে নবী (ﷺ) এর নামও নিবে। কারন জান্নাতে সর্বত্র আদম (عليه السلام) হুজুর (ﷺ) এর নাম লিখা দেখেছেন। উল্লেখ্য, ইহা ছিল পৃথিবীর সর্বপ্রথম অছিয়ত, এবং তা’ ছিল উসিলার শিক্ষা সংক্রান্ত।

৯। হুজুর (ﷺ) এর জন্মের ৫০ দিন পূর্বে বাদশা আবরাহা মক্কা আক্রমনের জন্য আসলে- নবী (ﷺ) এর নূরের উসিলায় আবরাহার হস্তী বাহিনী আবাবিল পাখী দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছায় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। (জন্মের পূর্বে)

১০। আল্লাহ্ আরশ সৃষ্টি করলে আরশের গায়ে কম্পন শুরু হয়। অতপর আরশের গায়ে “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্” লিখলে আরশের কম্পন বন্ধ হয়। (জন্মের পূর্বে) (মুস্তাদরাকে হাকেম)

১১। একবার মদিনায় অনাবৃষ্টির কারনে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। দোয়ার জন্য বিষয়টি মা আয়েশা (رضي الله عنه) এর নিকট পেশ করলে তিনি রওজা শরীফের ছাদ থেকে একটা আচ্ছাদন সরানোর নির্দেশ দেন, যাতে করে সরাসরি সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতে পারে। এই আদেশ পালনের সাথে সাথেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আজও সবুজ গম্বুজের মধ্যে একটি ছিদ্র বিদ্যমান এবং ইহা কোন সৈয়দযাদা খুলে দিলে বৃষ্টি হয়। (ওফাতের পরে) (সুনানে দারেমী শরীফ, মেশকাত শরীফ)

১২। মক্কাবাসী অনাবৃষ্টির জন্য খাজা আবদুল মোতালেবের নিকট দোয়া চাইলে তিনি শিশু নবী (ﷺ)কে নিয়ে (৫/৬ বৎসর বয়সের সময়) কা’বার গায়ে পিঠ লাগিয়ে দোয়া করতে বলেন। শিশু নবী (ﷺ) আকাশের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উপরে উঠালে পরিষ্কার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে বৃষ্টি শুরু হয়। (শৈশবে) (তারিখে দামেস্ক, তাফছিরে মাজহারী)

১৩। একবার খলিফা ওমর (رضي الله عنه), দোয়ার হকদার হওয়া সত্বেও, তিনি নিজে দোয়া না করে হুজুর (ﷺ)এর চাচা হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)কে আসনে বসাইয়া বৃষ্টির জন্য দোয়া করান। (ওফাতের পর) (ছহীহ্ বুখারী, ১ম খন্ড, ১৩৭ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ১৩২ পৃ:)।

১২ এবং ১৩নং হাদীসদ্বয় আল্লামা ইবনে তাইমিয়াও রদ করেন নাই এবং নিজ কিতাবে উল্লেখ করেছেন।

১৪। হাদীস (বোখারী)-হাশরের মাঠে বিচারকার্য শুরুর জন্য উলুলে আযম পয়গম্বর (عليه السلام)গণের নিকট, হাশরবাসীগণ অন্যান্য নবী-রাসূলগণসহ, উসিলার জন্য দৌড়াবেন। শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) এর উসিলায় (তাঁর শাফায়াতের কারনে) আল্লাহ্ হাশরের মাঠে বিচারকার্য শুরু করবেন। ইহা উসিলা ও শাফায়াতের দলিল। মজার ব্যাপার, হাশরের মাঠে, আল্লাহর উপস্থিতিতে নবী আলাইহিমুস সালামগণ উসিলার জন্য দৌড়াতে থাকবেন। সরাসরি আল্লাহর নিকট চাইবেন না।

১৫। وَعَن ربيعَة بن كَعْب قَالَ: فَأَتَيْتُهُ بِوَضُوئِهِ وَحَاجَتِهِ فَقَالَ لِي: سَلْ فَقُلْتُ: أَسْأَلُكَ مُرَافَقَتَكَ فِي الْجَنَّةِ. قَالَ: أَو غير ذَلِكَ؟ . قُلْتُ هُوَ ذَاكَ. একবার হুজুর (ﷺ) হযরত রা’বিয়া (رضي الله عنه) এর খেদমতে খুশী হয়ে বলেন, আমার কাছে কি চাইবা চাও। রা’বিয়া (رضي الله عنه) জান্নাত চাইলেন। উত্তরে হুজুর (ﷺ) ফরমান, আর কি চাও। রা’বিয়া (رضي الله عنه) বললেন, ইহাই যথেষ্ট। এখানে তিনটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল, প্রথমত: রা’বিয়া (رضي الله عنه) জান্নাত পেয়ে গেলেন।

(ছহীহ্ মুসলীম, মেসকাত শরীফ, হাদিস নং ৮৯৬)।

দ্বিতীয়ত: জান্নাত চাওয়ার কারনে রা’বিয়াকে ভৎসনা করেন নাই যে আমার কাছে চাইলে কেন আল্লাহর কাছে চাও। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ)এর নিকট কিছু চাওয়া বা তাঁর মাধ্যমে/উসিলায় কিছু চাওয়ার বৈধতা প্রমানিত হয়ে গেল। তৃতীয়ত: হুজুর (ﷺ) জান্নাতের মালিক, তাই তিনি প্রার্থীকে জান্নাত দিতেই পারেন।

১৬। হাদীস -তিরমিযী শরীফ- [রাবী-হযরত ওসমান বিন হুনাইফ (رضي الله عنه)] একবার নবী (ﷺ) এর নিকট এক অন্ধ সাহাবী, মসিজিদে নববীতে এসে, তার অন্ধত্ব দূরীকরনের আর্জি পেশ করেন। হুজুর (ﷺ) তাকে ধৈর্য ধারনের পরামর্শ দিলে তার অসহায়ত্বের কারনে তাৎক্ষনিক সুস্থতার অনুরোধ জানান। হুজুর (ﷺ) তাকে নিজ ঘরে গিয়ে অজু করে ০২ রাকাত নফল পড়ে হুজুর (ﷺ) এর উসিলা নিয়ে এবং তাঁর (ﷺ) নাম মোবারক তলব করে প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেন। হুজুর (ﷺ) মসজিদ হতে ঐ মজলিস শেষ করে উঠার আগেই বর্ণিত আমল করে ঐ সাহাবী সম্পূূর্ন অরোগ্য লাভ করে ফিরে আসেন। (তিরমিজি শরীফ, ইবনে মাজাহ, তাবারানী, আহমদ, নাসাঈ, ইবনে খুযামা, হাকীম, মুজামুল কবীরে)। এই হাদীস দ্বারা উসিলা গ্রহন শরীয়তের বৈধ হুকুম হয়ে গেল এবং সুন্নাতে সাহাবা হয়ে গেল। (হায়াতে উসিলার দলিল)

১৭। হযরত ওসমান বিন হুনাইফ (رضي الله عنه), যিনি অন্ধত্ব থেকে দৃষ্টি প্রাপ্ত সাহাবীর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যখন জানতে পারলেন যে, এক লোক খলিফা হযরত ওসমান (رضي الله عنه) সহিত বারবার সাক্ষাতের চেষ্টা করেও দারোয়ানের আসহযোগীতার কারনে ব্যর্থ, তখন তিনি ঐ একই আমল করে হুজুর (ﷺ) নাম মোবারক বলে ডাক দিয়ে প্রার্থনা করার পরামর্শ দেন। ঐ আমল করে পরদিন ঐ ব্যক্তি খলিফার সাক্ষাতে এলে, এবার দারোয়ান আগ্রহ সহকারে তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। খলিফা তাঁর প্রয়োজন মিটিয়ে দেন এবং ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে যখন খুশী সাক্ষাতের অনুমতি দেন। (ওফাতের পর) (তাবারানী মুজামুল কবীরে ছহীহ্ সনদে, বুখারী-২/২৭, হাদীস নং ১০১০ এবং বাগাবী-৪/৪০৯, হাদীস নং ১১৬৫)।

নোটঃ হুজুর (ﷺ) এর উসিলা নিয়ে এবং পবিত্র নাম মোবারক তলব করে দোয়ার নিয়ম হলো, اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ لِتُقْضَى لِيَ، اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ. ‘হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি এবং তোমার নবী-যিনি রহমতের নবী-সেই নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে উসিলা করে তোমার দিকে আমি মুতাওয়াজ্জাহ (মনোযোগী) হলাম। হে প্রিয় মুহাম্মদ (ﷺ), আমি আমার এই মাকসুদ পুরনের জন্য আপনার মাধ্যমে (উসিলায়) আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জাহ হলাম। হে আল্লাহ্! তুমি আমার মাকসুদ পুরনের ব্যপারে হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ কবুল কর।’

১৮। আল্লাহ্ সৃষ্টিকারী, আর নবী (ﷺ) বন্টনকারী। কাজেই কিছু পেতে হলে বন্টনকারীর নিকট চাইতে হবে কিংবা তাঁর উসিলা নিতেই হবে-এটাই রীতি এবং এটাই বিবেকের দাবী।

১৯। হযরত ওমর (رضي الله عنه) এর খেলাফতকালে, হযরত বেলাল বিন হারেস আল-মাযনী (رضي الله عنه) নামক এক সাহাবী রওজা শরীফের পাশে দাঁড়িয়ে সরাসরি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এর উসিলায় বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন। তার দোয়া কবুল হয় এবং স্বপ্নে হুজুর (ﷺ) তাকে বৃষ্টির সংবাদটি খলিফা হযরত ওমর (رضي الله عنه) কে পৌঁছে দিতে বলেন এবং খলীফাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করার এবং কোমলতা প্রদর্শনের জন্য পরামর্শ দেন। (অফাউল অফা)

২০। হযরত ওমর (رضي الله عنه) হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) এর উসিলা নিয়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতেন।اللهم إنا كنا نتوسل إليك بنبينا فتسقينا، وإنا نتوسل إليك بعم نبينا فاسقنا ‘হে আল্লাহ্ এত দিন আমরা নবী করিম (ﷺ) এর উসিলা দিয়ে বৃষ্টি কামনা করতাম। বর্তমানে নবীজির চাচা হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)কে উসিলা করে তোমার কাছে বৃষ্টি কামনা করছি। তুমি আমাদেরকে বৃষ্টি দাও।’ এ’ভাবে প্রার্থনা করে বৃষ্টি পেতেন। (বোখারী শরীফ, ১ম খন্ড, ১৩৭ পৃ:)

২১। হযরত বোখারী (رحمة الله) এর উসিলা নিয়ে সমরকন্দের শাসক বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে ফলপ্রসূ হন।

২২। বোখারী শরীফ (হাদীস নং-৩২১০)- তিন ব্যক্তি গর্তে আটকে পড়ে নেক কাজের উসিলায় উদ্ধার পান;

ক) পাওনা টাকা ব্যবসায় খাটিয়ে মুনাফাসহ পাওনাদারকে প্রদান করেন। ইহার উসিলা দিলে এক-তৃতীয়াংশ গুহার মুখ খুলে।

খ) বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবার উসিলা দিয়ে প্রার্থনা করলে আরেক তৃতীয়াংশ গুহার মুখ খুলে যায়।

গ) যিনা থেকে খোদার ভয়ে বিরত থাকার উসিলা নিয়ে প্রার্থনা করলে গুহার অবশিষ্ট তৃতীয়াংশ খুলে যায়।

২৩। কুরআন- হযরত মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام) এর জুতা, কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রীর উসিলায় (যাহা সিন্দুকের মধ্যে ছিল) বনি ইসরাঈল হাজার বছর যাবৎ যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। (সূরা-বাকারা; আয়াত-২৪৮)

২৪। আউলিয়াদের উসিলায় ৯৯+১=১০০ জনের খুনী শুধু নিয়তের কারনে জান্নাতী হয়ে যান- যদিও আউলিয়াদের বস্তির দিকে রওয়ানা করে পথিমধ্যে তাঁর মৃত্যুর কারনে তথায় পৌঁছতে পারেননি। (খবিচ বস্তি ও শরীফ বস্তির হাদীস)

২৫। মূসা (عليه السلام) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন যেন তাঁর ভাই হারূনকে তাঁর সাহায্যকারী / উসিলা হিসাবে মনোনিত করেন। (সূরা: শুআরা; আয়াত: ১৩ এবং সূরা: তা’হা; আয়াত: ২৯-৩২)

২৬। আল্লাহ্ নিজে ফেরাউনকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য মূসা (عليه السلام)কে মনোনিত করেন। (সূরা-তা’হা; আয়াত: ৪১-৪৩)

২৭। গজনীর সুলতান মাহমুদ (رحمة الله) হযরত আবুল হাসান খেরকানী (رحمة الله) এর জুব্বা মোবারক সামনে রেখে তার উসিলা দিয়া দোয়া করলে ১৭ বারের আক্রমনের সময় সোমনাথ মন্দির জয় করেন। রাত্রে খেরকানী (رحمة الله) স্বপ্নে বলেন, মন্দির ছাড়াও যদি সকল কাফেরদের ইসলামের দাওয়াত দেয়া হত,জুব্বার উসিলায় তা’ও হয়ে যেত।

২৮। হযরত ইউসূফ (عليه السلام) নিজ জামা তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (عليه السلام) এর দৃষ্টি শক্তি ফিরানোর জন্য প্রেরণ করেন। ঐ জামা চোখের উপর রাখলে ইয়াকুব (عليه السلام) দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান। এখানে নেক লোকের বসন বা ব্যবহৃত বস্তুুর উসিলা প্রমানিত হলো। তাঁরা দুই জনই আল্লাহর নবী, অথচ তাঁরা আল্লাহর নিকট দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়া না করে ইউসূফ (عليه السلام) এর জামাকে উসিলা বানিয়েছেন। তাই ইহা নিঃসন্দেহে জায়েয যাহা পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমানিত। (সূরা-ইউসূফ; আয়াত: ৯৩ ও ৯৬)

২৯। হযরত মরিয়ম (عليه السلام) এর হুজরায়, যিনি ছিলেন একজন ওলী, জান্নাতী ও বেমৌসুমী ফলমূল দেখে হযরত যাকারিয়া (عليه السلام) সেইখানেই (মরিয়মের চৌকাঠে) দাঁড়িয়ে সন্তানের জন্য দোয়া করেন এবং তৎক্ষনাৎ পুত্র সন্তান ইয়াহইয়ার (عليه السلام) সুসংবাদ লাভ করেন। নিজে স্বয়ং একজন নবী হয়ে ওলীর হুজরাকে পবিত্র মনে করে ঐ স্থানের উসিলা দিয়ে দোয়া করলে আল্লাহ্ তা কবুল করেন। ইহা দ্বারা পবিত্রস্থানের উসিলা দিয়া দোয়া করা নবীর সুন্নাত প্রামানিত হলো। (সূরা-আলে-ইমরান; আয়াত: ৩৭-৩৯)

৩০। ইমাম জাফর সাদেক (رحمة الله), হযরত আলী (رضي الله عنه) এর বরাত দিয়ে বর্ননা করেন যে, হুজুর (ﷺ) এর ওফাতের ০৩ দিন পর এক বেদুঈন সূরা নিসা এর ৬৪নং আয়াত উল্লেখ করে রওজা শরীফের উপর কান্নাকাটি করলে হুজুর (ﷺ) তাকে মাফ করে দেন, রওজা শরীফ হতে আওয়াজ ভেসে আসে- “নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করা হলো”। (তাফছিরে কুরতুবী)

৩১। হাফেজ ইবনে কাসির (رحمة الله) বর্ননা করেন যে, একই আয়াত পাঠ করে অন্য এক আরবী নিজের ফিরিস্তি নবী (ﷺ)কে পেশ করে কাঁদতে কাঁদতে যখন ফিরছিলেন তখন হযরত উতবী মোঃ বিন ওবায়েদুল্লাহ (رحمة الله) স্বপ্নের মাধ্যমে নবী (ﷺ) কর্র্র্তৃক নির্দেশিত হয়ে ঐ আরবীকে ডেকে আল্লাহ্ কর্তৃক তাকে মাফ করার সুসংবাদ জানিয়ে দেন। উল্লেখ্য, হাফেজ ইবনে কাসির (رحمة الله) এর মতে আল্লাহ্ গুনাহগার উম্মতকে ঐ আয়াতের وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا (৪ঃ৬৪) আমলের জন্য (স্থায়ী) হুকুমী নির্দেশ জারী করেছেন। (ইবনে কাসীর ছিলেন ওহাবীদের মুরুব্বী। আর উতবী (رحمة الله) ছিলেন ইমাম শাফী (رحمة الله) এর ওস্তাদ)

৩২। হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ (رضي الله عنه) তাঁর পাগড়ীতে রাখা হুজুর (ﷺ) এর চুল মোবারকের উসিলায় জীবনের সকল জিহাদে বিজয়ী হন। (জিকরে হাছিন)

৩৩। উম্মে সালমা (رضي الله عنه) রৌপ্যের পাত্রে রক্ষিত হুজুর (ﷺ) এর চুল মুবারক ধৌত পানি লোকজনকে শেফার জন্য পান করাতেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ)

৩৪। হযরত আসমা (رضي الله عنه) এর নিকট হুজুর (ﷺ) এর একটি জুব্বা ছিল। তিনি উক্ত জুব্বা মুবারক ধৌত পানি রোগীদের পান করাতেন। (মুসলিম, তাবারানী, আহমদ বিন হাম্বল)

৩৫। জাবির (رضي الله عنه) অজ্ঞান হয়ে গেলে হুজুর (ﷺ) অজু করে অজুর পানি তার চেহারায় ঢেলে দিলে সে জ্ঞান ফিরে পায়। (বোখারী, হাদীস-৫২১৯)

৩৬। অছিয়ত অনুযায়ী হুজুর (ﷺ) এর চুল মোবারক এবং ০১খানা নালায়েন মোবারক আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) এর সাথে দাফন করা হয়। (সুনানে বায়হাকী)

৩৭। অছিয়ত অনুযায়ী আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)কে হুজুর (ﷺ) জামার উপর এবং চোখ ও কপালের উপর নখ ও চুল মোবারক রেখে দাফন করা হয়।

৩৮। আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه) নিজ কাফনের কাপড়ে নবী (ﷺ) এর পবিত্র ঘাম মুবারক মাখার অছিয়ত করেছিলেন।

৩৯। একবার হুদাইবিয়ায় নবী (ﷺ) চুল কাটাচ্ছিলেন এবং ঐ অবস্থায় তাঁর চুল মুবারক হযরত আবু তালহা (رضي الله عنه)কে তবারক হিসাবে দান করেন এবং উহা সাহাবীদের মধ্যে বিতরনের নির্দেশ দেন। (মুসলিম, তিরমিযী,)

৪০। হুজুর (ﷺ) পানিতে কুলি করে আবু মূসা আশারী (رضي الله عنه) ও আবু আশরায়ী (رضي الله عنه) (তাঁরা দুই ভাই) কে কুলির পানি মুখে, সিনায় মালিশ করার আদেশ করেন।

৪১। নবী (ﷺ) পানি আনয়ন করে তাঁর মাথা ও মুখ মোবারক ধৌত করে খাদেমা সালমা (رضي الله عنه)কে ঐ পানি এমন স্থানে ফেলার নির্দেশ করেন যেন উহা কোন লোকের পায়ের নিচে না পড়ে। খাদেমা ঐ পানি জমিনে ফেলার পরিবর্তে পান করে ফেলেন। নবী (ﷺ) উহা জানতে পেরে বলেন- আল্লাহ্ তোমার জন্য দোযখ হারাম করে দিয়েছেন। (বুখারী, মুসলিম)

৪২। উম্মে আয়মন (رضي الله عنه), পেয়ালার পানি (প্রস্রাব) ফেলে দেয়ার নির্দেশ পেয়ে উনি উহা পান করে ফেলেন। হুজুর (ﷺ) জানতে পেরে বলেন- তোমার আর জীবনে পেটের পীড়া হবে না। (মাদারেজুন নবুয়াত)

৪৩। উম্মে হাবীবা (رضي الله عنه) এর এক খাদেমা একই কাজ করেন- হুজুর (ﷺ) ফরমান, তোমার জন্য জাহান্নাম হারাম।

৪৪। অপর এক সাহাবী রক্ত পান করে ফেলেন- জাহান্নাম হারাম। (সুনানে সাঈদ ইবনে মানছুর, ফাতহুল বারী শরহে বুখারী)।

৪৫। হযরত মালেক ইবনে সিনান (رضي الله عنه) ওহুদের যুদ্ধে নবী (ﷺ) এর রক্ত মোবারক লুকিয়ে রাখার পরিবর্তে পান করে ফেলেন, হুজুর (ﷺ) উহা জানতে পেরে বলেন- তাঁর পেটে অসুখ হবে না এবং তাঁর বংশধরগণ জাহান্নামী হবে না।

৪৬। এক সাহাবীয়া নবী (ﷺ) এর ঘাম মোবারক আতর হিসাবে ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করেন। (ছহীহ্ মুসলীম)

৪৭। কথিত আছে, এক গরীব সাহাবী তাঁর মেয়ের বিয়ের জন্য হুজুর (ﷺ) এর নিকট মেশ্ক ও আম্বরের জন্য আর্জি করেন। হুজুর (ﷺ) তাকে একটি শিশি নিয়ে আসতে বলেন এবং এক ফোঁটা ঘাম মুবারক দান করেন যা মেয়ের বিয়ের সময় ব্যবহার করলে সকল ধনী ঘরের তরুনীদেরকে মাতোয়ারা করে ফেলে।

৪৮। হুদাইবিয়ার প্রান্তরে সাহাবাগণ হুজুর (ﷺ) এর অযুর পানি, থুথু মোবারক বরকতের জন্য চেহারায় ও শরীরে মালিশ করেন। (ছহীহ্ বুখারী)

৪৯। যদি হুজুর (ﷺ) এর চুল, কুলির পানি, নখ ইত্যাদি বরকতময় ও জায়েয না হতো তবে তিনি নিজে উহা কখনো সংগ্রহ এবং বন্টনের নির্দেশ দিতেন না।

৫০। যেখানে হুজুর (ﷺ) এর কুলির পানি পান, মুখ ও মাথ ধৌত পানি পান, ঘাম, চুল, নখ, থুথু, অজুর পানি, রক্ত, প্রস্রাব ইত্যাদি তাওয়াচ্ছুল/উসিলা/তবারক/ফয়েজ/শেফা/বরকতময় হয়ে যায়, সেখানে তিনি (ﷺ) নিজে/স্বয়ং উসিলা হবেন না-এ কেমন কথা!

৫১। ঈসা (عليه السلام) ৬ষ্ঠ আসমান হতে মসজিদের ছাদের উপর অবতরনের পর নীচে নামার জন্য সিড়ি চাইবেন। ইহা উসিলার দলিল।

৫২। হুজুর (ﷺ) তাঁর চাচী (হযরত আলী (رضي الله عنه) এর আম্মা) ফাতেমা বিনতে আসাদ (رضي الله عنه)এর কবরে দাঁড়িয়ে (দাফনের সময়) দোয়া করেন- ‘হে প্রভূ, আমি তোমার নবী ও পূর্বযুগের নবীগণের উসিলা করে প্রার্থনা করছি.......(উসিলা সহকারে শাফায়েত করেন)।’ তাই উসিলা গ্রহন ও শাফায়াত করা সম্পূর্ণ জায়েয-মৃত ও জীবিত উভয় ক্ষেত্রে।

নোট: قال امام الغزالى: من يستمد فى حياتى يستمد بعد مماتى জীবদ্দশায় যার কাছে সাহায্য চাওয়া জায়েয, মৃত্যুর পরও তার কাছে সাহায্য চাওয়া জায়েয। [আশিয়াতুল লুমআত, যিয়ারত অধ্যায়; মেসকাত শরীফ, ১৫৪ পৃ: হাশিয়া ; এহইয়াউল উলুমুদ্দিন-ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله)]।

৫৩। নবী (ﷺ) হযরত ওমর ও হযরত আলী (رضي الله عنه)কে হযরত ওয়েস করনী (رحمة الله) নিকট গমন পূর্বক তাঁদের নিজেদের জন্য এবং হুজুর (ﷺ) এর উম্মতের জন্য দোয়া করানোর অছিয়ত করে যান। সর্বশ্রেষ্ঠ দুই সাহাবী, আশরারে মোবাশ্বেরার দুইজন এবং খোলাফায়ে রাশেদার অন্যতম দুই খলিফা, হুজুর (ﷺ) এর অছিয়ত মোতাবেক একজন তাবেঈনের নিকট দোয়া চাইতে ইয়েমেন গেছেন। এই ঘটনার মাধ্যমে কোন বুজুর্গের নিকট দোয়া চাওয়ার জন্য গমন, সাহাবী কর্র্তৃক ওলীর নিকট দোয়া চাওয়া, উসিলা গ্রহন, শাফায়েত করা ইত্যাদি বিষয়ের বৈধতা ও জায়েয হওয়া ষ্পষ্টভাবে প্রমানিত হলো।

৫৪। তাওয়াক্কুল ও তাওয়াচ্ছুলকে আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারি নাই বলেই হয়ত উসিলা গ্রহন নিয়ে ফেৎনা। মূলত এই দুটি বিষয় সাংঘর্ষিক নয় বা র্শিকও নয়, বরং একে অপরের পরিপুরক।

৫৫। ৪২ঃ৫১ (শুরা)- আল্লাহ্ যখন কোন বান্দার সাথে মাধ্যম/উসিলা ব্যতিত সরাসরি কথা বলার জন্য বান্দাকে যোগ্য মনে করেন না, তখন বান্দা মাধ্যম ব্যতিত খোদার সাথে কেমন করে যোগাযোগ করবে, কথা বলবে, সংযোগ স্থাপন করবে?

৫৬। ৫০ ওয়াক্ত নামাজ (মি’রাজে) আতাকারী স্বয়ং আল্লাহ্ এবং ঐ নির্দেশ গ্রহণকারী স্বয়ং হুজুর (ﷺ)। অথচ হযরত মূসা (عليه السلام) এর মাধ্যমে (উসিলায়) ০৫ ওয়াক্তে নির্ধারিত হয়। মূসা (عليه السلام) এর পরামর্শে হুজুর (ﷺ) কয়েকবার আল্লাহর নিকট যাওয়া আসার পর ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে ৫০ ওয়াক্ত হতে ০৫ ওয়াক্তে আনা হয়। আমাদের পক্ষে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় যে কষ্টকর হবে এবং পরিশেষে যে ০৫ ওয়াক্ত নামাজ আমাদের জন্য সাব্যস্থ হবে তা’ আল্লাহ্ কিম্বা হুজুর (ﷺ) কি জানতেন না? তা’ হলে এ ঘটনা কেন? এ ঘটনার কারন সম্বন্ধে কেউ কেউ বলেন যে, মূসা (عليه السلام) এর আল্লাহ্কে দেখার তামান্না পরোক্ষভাবে ইহার মাধ্যমে পূরন করা হয়। তবে এ ঘটনার আসল রহস্য আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীব (ﷺ)ই উত্তম জানেন। যাহা হউক, এই ঘটনায় মূসা (عليه السلام) হলেন ৫০ ওয়াক্ত নামাজকে ০৫ ওয়াক্ত করার উসিলা।

৫৭। কবরে হুজুর (ﷺ)কে চিনার উসিলায় জান্নাত পাওয়া যাবে।

৫৮। হুজুর (ﷺ) নিজেই যখন মসজিদে প্রবেশ করতেন, তখন বলতেন-“হে আল্লাহ্! আমি আমার সমস্ত প্রার্থনাকারী উম্মতকে উসিলা বানিয়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি।” (আদিল্লাত আহলিছ সুন্নাত-সৈয়দ ইউসূফ রেফায়ী)

৫৯। সামেরী জিব্রাইল (عليه السلام) এর ঘোড়ার খুরের নিচের বালি স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত বাছুরের মুখে দিলে- তার উসীলায় বাছুর হাম্বা হাম্বা বলা শুরু করে। (সূরা-তা’হা; আয়াত:৯৬)। স্বর্ণের বাছুর বরকতময় বালির উসিলায় জীবন লাভ করে।

৬০। একবার বুরহানুদ্দীন মালেকী নামে এক গরীব লোক রওজা শরীফে উপস্থিত হয়ে বলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি ভূখা আছি।” এই বলে রওজার কোনে গিয়ে বসে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যে এক লোক এসে তাকে খাবার পরিবেশন করেন এবং জিজ্ঞাস করেন আপনি কি হুজুর (ﷺ) এর নিকট খাবার চেয়েছিলেন?

৬১। একবার ইমাম আবু বকর মুকরী (رحمة الله), ইমাম তাবরানী (رحمة الله) এবং আবু শায়েখ ক্ষুধার্ত অবস্থায় কিছুদিন অতিবাহিত করার পর রওজা শরীফ উপস্থিত হন। ক্ষিধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে লজ্জিত ভাবে ইমাম আবু বকর মুকরী (رحمة الله) হুজুর (ﷺ) এর নিকট, আমি ক্ষুধার্ত ইয়া হাবীব আল্লাহ্ (ﷺ) বলে রওজা শরীফের কোনে গিয়ে বসে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক সাইয়্যেদ তাঁর গোলামকে নিয়ে খাবার সহ উপস্থিত হন এবং বলেন যে, আপনারা আমার দাদা হুজুর (ﷺ) এর নিকট খাবারের অনুরোধ করেছেন। তাই তিনি (ﷺ) আমাকে স্বপ্নে আপনাদেরে খাবার প্রদানের আদেশ করেন।

৬২। একবার আবুল আব্বাস ইবনে নাফিস (رحمة الله) যিনি অন্ধ ছিলেন, তিন দিন অভূক্ত থাকার পর হুজুর (ﷺ) এর দরবারে আর্জি পেশ করেন, “হে রাসূলে খোদা (ﷺ), আমি ক্ষুধার্ত।” কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ব্যক্তি এসে তাকে নিজ ঘরে নিয়ে খাবার পরিবেশন করেন এবং জানান যে হুজুর (ﷺ) তাকে খাবার পরিবেশনের জন্য স্বপ্নে নির্দেশ দিয়েছেন।

৬৩। একবার ইবনে জালাহ (رحمة الله) হুজুর (ﷺ) এর রওজা আকদাসে গিয়ে বলেন, “ইয়া রাসূল আল্লাহ (ﷺ), আজ আপনার কাছে এসেছি অতিথি হয়ে। আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত।” এই বলে ঘুমিয়ে পড়েন। হুজুর (ﷺ) তাকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং একটা বড় রুটি প্রদান করেন। ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি রুটি খাওয়া শুরু করেন এবং জেগে দেখেন অর্ধেক রুটি তখনও তার হাতে অবশিষ্ট রয়েছে।

৬৪। আবুল খায়ের আক্বতা নামক এক ব্যক্তি ক্ষুধার কারনে আর্জি করলে একই রকম ঘটনা ঘটে।

৬৫। একবার হযরত আবু আবদুল্লাহ্ ইবনে বার’আ শিশুকালে তার পিতার সাথে মদিনা রওজা শরীফ পৌছেন। তারা খুব ক্ষুধার্ত ছিলেন। শিশু হওয়ার কারনে তিনি ক্ষুধার জ্বালায় কান্নাকাটি করতে থাকেন। কান্না থামাতে না পেরে পিতা অস্থির হয়ে যান এবং হুজুর (ﷺ) এর নিকট “এ রাতে আমরা আপনার অতিথি” বলে আর্জি করেন। এই বলে চোখ বুজার কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে হাসলেন এবং পরে খুব করে কাঁদলেন। কারন হুজুর (ﷺ) এসে তার হাতে টাকা দিয়ে গেছেন।

৬৬। আহমেদ ইবনে মুহাম্মদ সূফী হিজাযের মরুভূমিতে তিন মাস ঘুরাঘুুরি করে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় রওজা শরীফ এসে হুজুর (ﷺ) কে সালাম জানিয়ে এক কোনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। স্বপ্নে হুজুর (ﷺ) এসে ফরমান-“তুমি এসেছ আহমদ? তোমার হাত দাও দেখি।” এই বলে হুজুর (ﷺ) স্বর্ণ দিয়ে তার হাত ভরে দিলেন যা জেগে উঠেও বাস্তবে দেখতে পান।

আমার বিশ্বাস, উপরোক্ত দলিলের ভিত্তিতে উসিলা গ্রহন বৈধ বলে নিশ্চিতভাবে প্রমানিত হয়েছে। এতগুলো দলিল প্রমানের পরও যদি কেউ উসিলা অস্বীকার করে বা না মানে তবে এ’টা বদনসীবই বলতে হবে। আল্লাহ্ আমাদিগকে সঠিক বুঝ দিন এবং হেদায়েত নসিব করুন। আমীন।


-ঃ সমাপ্তঃ-

“মুস্তফা জানে রহমত পে লাখো ছালাম,

শাময়ে ভজমে হেদায়াত পে লাখো ছালাম।।”

Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা