তাযকিয়ায়ে আহলে বায়ত (রাঃ)
তাযকিয়ায়ে আহলে বায়ত (রাঃ)
মূল: মওলানা উসমান আফেন্দী (رحمة الله)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: মুহাম্মদ রুবাইয়াৎ বিন মূসা
অনুবাদকের আ’রয
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম,
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আ’লা রাসূলিহিল কারীম, আম্মা বা’দ।
আল্ হামদু লিল্লাহ্ ! বর্তমান বিশ্বে বহু ফিতনার মধ্যে শিয়া ফিতনা ব্যাপক তহবিলপুষ্ট হয়ে বিভ্রান্তি ছড়ালেও তুরস্কভিত্তিক ’ওয়াকফ এখলাস’ সংস্থাটি এই মতবাদের খণ্ডনে তুরস্কের বিশিষ্ট জ্ঞান বিশারদ মওলানা উসমান আফেন্দী (رحمة الله)’র মহামূল্যবান ‘তাযকিয়ায়ে আহলে বায়ত’ বইটি প্রকাশ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিজয় কেতন উড়িয়েছে। আমরা এ বইখানা অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছি যাতে বাংলাদেশে গজিয়ে ওঠা শিয়াপন্থীদের ধোকা থেকে মুসলমান সমাজ রক্ষা পান। এর জন্যে আমি নিজ পীর ও মুরশিদ হযরত সৈয়দ মওলানা এ,জেড,এম সেহাবউদ্দীন খালেদ আল্ কাদেরী আল্ চিস্তী সাহেব কেবলা (رحمة الله)’র দরবারে শোকরিয়া আদায় করছি। আল্লাহ্ পাক মুসলমান সমাজকে হেদায়াত দিন, আমীন!
মুখবন্ধ
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহতা’লারই প্রাপ্য, যিনি সবার প্রভু ও স্রষ্টা। আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ)-এর প্রতি জানাই অসংখ্য দুরুদ-দালাম যিনি আমাদেরকে সত্য ও সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। তাঁর আহলে বায়ত (রাঃ) ও আসহাবে কেরাম (রাঃ) যাঁরা তাঁকে বিশ্বাস করার ও তাঁর সুন্দর, জ্যোতির্ময় চেহারা দেখার সম্মান অর্জন করেছেন, তাঁদের প্রতিও দুরুদ-সালাম জানাই।
এই পৃথিবী যা মানব জাতির জন্যে একটা পরীক্ষার স্থান এবং মন্দ হতে ভালকে পৃথক করার একটা প্রকাশ্য ক্ষেত্র, সেখানে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত বাহাত্তরটি ভ্রান্ত ও বদমাইশ দলের মধ্যে শয়তানের সবচেয়ে গোঁড়া সমর্থক হলো সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীরা। তারা নিজেদের নফসের ধোকায় এমনভাবে বিপর্যস্ত যে তারা শয়তানের চেয়েও এক কদম এগিয়ে গিয়েছে তাদের দুশমনির ক্ষেত্রে। এ সকল লোকেরা মহানবী (ﷺ)-এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ও সন্তান-সন্তুতিদের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার প্রদর্শনী দিয়ে থাকে এবং বলে যে তাঁদেরকে মুহব্বত করা সর্বশ্রেষ্ঠ এবাদত। তারা নিম্নোক্ত আয়াতে করীমার অনুসারী হওয়ার দাবি করে যা এরশাদ ফরমায় –
قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى
“দ্বীন ইসলাম নিয়ে আসার জন্যে আমি কোনো প্রতিদান চাই না। আমি শুধু চাই তোমরা আমার আহলে বায়তকে ভালোবাসো যারা আমার ঘনিষ্ঠ”। [১]
[১] আল কুরআন : আশ শুআরা, ৪২:২৩।
তবু তারা ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ বুযূর্গ ও শিক্ষক হযরত রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর সাহাবীদেরকে (রাঃ) গালমন্দ করাতেই নিজেদের ব্যস্ত রাখে। তাদের কেউ কেউ আরও অগ্রসর হয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ও আল্লাহ্ পাকের সবচেয়ে আস্থাভাজন ওহী বহনকারী ফেরেশতা জিবরাইল আমীন আলাইহিস সালাম-এর সমালোচনা করতেও কুণ্ঠিত হয় না। তাদের এ বদমাইশিকে তারা এবাদত মনে করে।
এ সকল গোমরাহ্ নেতারা অন্যান্যদেরকে পথভ্রষ্ট করার মানসে রাত-দিন চেষ্টা করে এবং তাদের প্রয়াসকে ‘মানবতার প্রতি সাহায্য’ বলে গর্ব করে থাকে। তাদের মধ্যে সর্বাধিক ধূর্ত ব্যক্তিরা হোজ্জা কিংবা শায়খ সেজে অজ্ঞাতসারে গ্রামে গ্রামে সফর করে বেড়ায় এবং নিজেদের একগুঁয়ে ও বিষাক্ত ধ্যান-ধারণা প্রচার করে। ধনীরা এ লক্ষ্য হাসিলে তাদের সমস্ত সম্পদ ও অর্থ-কড়ি ব্যয় করে। বস্তুতঃ সুলতান আবদুল হামীদ খান ২য়-এর এইড-ডি-ক্যাম্প ফিল্ড মার্শাল নামিক পাশা আমাকে বলেছেন, “বাগদাদে আমি যখন গভর্নর ছিলাম, তখন আমি এ সব সীমা লংঘনকারী দুর্বৃত্তকে ইরাকের পল্লীগুলোতে গোপনে লাখ খানেক বই বিতরণ করতে দেখেছি। আমি ওই সব বই সংগ্রহ করে নদীতে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা করি। এতে করে তাদেরকে ওই ধরনের ফিতনা সৃষ্টিকারক বই প্রচার করা হতে আমি বাধা দেই।” এতো চেষ্টা সত্ত্বেও এ সব হীন প্রকৃতির লোককে ফিতনা সৃষ্টি এবং মানুষকে গোমরাহ্ করা হতে বাধা দেয়া যায় নি। এ পর্যন্ত তারা এ কাজে নিজেদের জান-মাল উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত হয় নি।
আহলে সুন্নাতের মতাদর্শ অনুসারে আহলে বায়তে নববী (রাঃ) তথা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও তাঁর সন্তানদেরকে (রাঃ) ভালোবাসা অবশ্য কর্তব্য। তাঁদেরকে ভালোবাসলে ঈমান সহকারে ইন্তেকাল হবে প্রত্যেক মুসলামানের। আহলে সুন্নাতের আলেমদের বইপত্র আহলে বায়তের (রাঃ) প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। ইরানী ইহুদী মুরতজা যিনি ’হুসনিয়া’ বইটির লেখক, তিনিও এ সত্যটি জানতেন। তিনি তাঁর বইয়ের প্রারম্ভে আহলে বায়তের (রাঃ) প্রতি নিজ মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসার কথা লিখেছেন, যাতে অজ্ঞ মানুষেরা এই সকল ধোকাপূর্ণ কথায় বিভ্রান্ত হয়ে মনে করে যে ইসলাম বুঝি কেবল আহলে বায়তকে (রাঃ) ভালোবাসাই এবং এতে তারা ’হুসনিয়া’ বইটিকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করে গালমন্দকারী এ বইটিকে সঠিক মনে করবে এবং ফলশ্রুতিতে পথভ্রষ্ট হবে।
পারসিক ভাষায় লিখিত ও ভারতে প্রকাশিত ‘তোহফায়ে এসনা আশারিয়া’ গ্রন্থটি তথাকথিত ওই সকল বইয়ের খণ্ডনে ছাপানো হয়েছে এবং গ্রন্থটি তুর্কী ভাষায়ও ছাপানো হয়েছে সুলতান আবদুল হামিদ খাঁন ২য়-এর আদেশক্রমে, যাতে করে মানুষদেরকে গোমরাহীর হাত থেকে রক্ষা করা যায়। তবুও ‘হুসনিয়া’ বইটির আরেকটি খণ্ডন পুস্তক লেখা আমরা বিহিত মনে করলাম। আমরা এ খণ্ডন পুস্তকের নাম রেখেছি ’তাযকিয়ায়ে আহলে বায়ত’ (নবী বংশের পবিত্রতা)।
’হুসনিয়া’ বইটির পর্যবেক্ষণ দ্বারা বোঝা যায় যে এর অনুবাদক কোনো পারসিক (ইরানী) নন, বরং উসমানীয় তুর্কী প্রশাসনের কোনো কেরানী হবেন, যিনি বংশীয়ভাবে সুন্নী হলেও পথহারা হয়ে গিয়েছেন। এ ব্যক্তিকে এবং ওই বইটি পাঠ করার দুর্ভাগ্য লাভকারী তরুণদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ্ তা’লার ওপর নির্ভর করে আমরা এ খণ্ডন পুস্তক লেখা শুরু করছি।
— শায়খ উসমান বিন নাসির আফেন্দী
ইয়ানিকাপী মৌলভীখানা,
ইস্তাম্বুল, তুরস্ক
আপত্তি ও জবাব- ০১
আপত্তি ও জবাবঃ
১। — ’হুসনিয়া’ পুস্তকের প্রারম্ভে বিবৃত হয়েছে: “ইমাম জাফর সাদিকের (رحمة الله) জনৈক সওদাগর বন্ধুর একজন সুন্দরী জারিয়া (দাসী) ছিল, নাম হুসনিয়া। এই জারিয়া ২০ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত ইমাম জাফর সাদিকের (رحمة الله) সাথে থেকে সকল জ্ঞানের শাখা শিক্ষা করেছিলেন। হযরত ইমামের বেসালের পরে সওদাগর বন্ধুটি দেউলিয়া হয়ে যান এবং তিনি খলিফা হারুনুর রশীদের কাছে ওই জারিয়াকে বিক্রি করে দিতে মনস্থ করেন। তরুণীটির সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে খলিফা হারুনুর রশীদ তার মূল্য জানতে চান। প্রত্যুত্তরে জানানো হয় যে পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা। ওই তরুণী এ মূল্য পাওয়ার জন্যে কী কী গুণের অধিকারী খলিফা তা জানতে চাইলে সওদাগর তাঁকে ওই জারিয়ার জ্ঞান ও গুণাবলী সম্পর্কে অবহিত করেন। জ্ঞান বিশারদদের উপস্থিতিতে ওই তরুণীর একটি পরীক্ষা নেয়া হয়। এতে ওই জারিয়া তাঁদের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেন। তিনি উলামাদেরকে খণ্ডন করেন। মুজতাহিদ ইমাম ও উলামায়ে কেরাম যাঁদের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইব্রাহীম ও ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস শাফেয়ী উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা কেউই তরুণীর কথার জবাব দিতে সক্ষম হন নি। তাঁরা এমন একজন আলেমকে জানতেন যাঁকে তাঁরা তাঁদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করতেন। এই বিজ্ঞ পণ্ডিত যাঁর নাম ইব্রাহীম খালেদ তিনি বসরা নগরীতে বসবাস করতেন এবং তিনি বহু গ্রন্থও প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁরা তাঁকে এনে উপস্থিত করলেন, তবুও তরুণীর কাছে তিনি পরাজিত হলেন এবং লা-জওয়াব হয়ে গেলেন।” (হুসনিয়া)
জবাব: কতিপয় মযহাব অনুযায়ী সওদাগর বন্ধুটির মালিকানাধীন অবস্থায় জারিয়াটির অন্য কোনো পুরুষের কাছে অবস্থান করাটা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। কিছু কিছু উলামার মতানুযায়ী হানাফী মযহাবেও এর কোনো অনুমতি নেই। ইবনে আবেদীনের ফতোয়ার ৫ম খণ্ডের দুই শ পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠায় তাই লেখা আছে। ইমাম জাফর সাদিকের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু‘র মতো ওয়ারা ও তাক্ওয়া (পরহেযগারী)-সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের পক্ষে আরেক ব্যক্তির সুন্দরী যুবতী জারিয়াকে কাছে রেখে তাকে বছরের পর বছর জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার কথা বলাটা ওই মহান ইমামের কুৎসা রটনা করা ছাড়া আর কিছু নয়। এ কথা হয়তো চিন্তা করা হতে পারে যে ইমাম জাফর সাদিক (رحمة الله) একজন মুজতাহিদ হওয়ার দরুন এ কাজকে নিজ এজতেহাদ দ্বারা অনুমতিপ্রাপ্ত সাব্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু আমরা এ যুক্তি কীভাবে মেনে নিতে পারি যে ওই মহান ইমাম তাঁর শিক্ষাপ্রাপ্ত একজন জারিয়াকে এতো বছর স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রেখেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত বিক্রি করার দুরবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন? অন্যান্য মুজতাহিদ ও উলামাকে জ্ঞানের সকল শাখায় পরাস্ত করার ’ঘটনা’ প্রতিভাত করে যে জারিয়াটি বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ অর্জন করেছিল। এমতাবস্থায় ইমাম জাফর সাদিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ ধরনের গুণবতী জারিয়ার মূল্যায়ন না করে এবং তাকে মুক্ত না করে দিয়ে তাকে অন্যদের কাছে বিক্রি করার দুরবস্থায় ফেলে রেখে গিয়েছেন বলাটা ওই মহান ইমামের বিরুদ্ধে বর্বরতার অভিযোগ উত্থাপনের সামিল। আর এটাই হলো আহলে বায়তের (রাঃ) প্রতি ভালোবাসার স্থলে শত্রুতা। ’হুসনিয়া’ পুস্তকটির এ অভিযোগ মওলানা জালালউদ্দীন রূমী (رحمة الله) প্রণীত ’মসনবী শরীফ’ গ্রন্থে বর্ণিত সেই ঘটনাটির মতোই, যেখানে জনৈক ব্যক্তি তার বন্ধুকে মাছির উপদ্রব থেকে বাঁচানোর জন্যে একটি পাথর দ্বারা আঘাত করে মেরে ফেলেছিল। উপরন্তু, পুরুষ মানুষকে শোনাবার জন্যে কণ্ঠস্বর উঁচু করা নারীদের জন্যে হারাম। কতিপয় উলামার মতানুযায়ী, জরুরি প্রয়োজনে নারীরা কথা বলতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে নিচু স্বরে কথা বলতে হবে এবং প্রয়োজন শেষ হওয়ামাত্রই কথা বলা শেষ করতে হবে। ’দুররুল মোখতার’ ও তার ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থের ২৭০ পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এ বাস্তবতার আলোকে সহস্র মানুষের সামনে জারিয়াটির প্রকাশ্য মঞ্চে বিতর্ক সভায় অংশগ্রহণ ও লিখিত আকারে বিতর্ক করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উচ্চস্বরে বিতর্ক করা নিঃসন্দেহে অশোভনীয়। তাছাড়া জারিয়াটির সাথে প্রকাশ্য বিতর্ক করার দরুন ওই সকল মুজতাহিদ ও উলামার বিরুদ্ধেও পর্দা প্রথা লংঘনজনিত গুণাহের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। কোনো মুসলমান-ই এ মিথ্যা অভিযোগ বিশ্বাস করবেন না।
২। — “হুসনিয়া কুরআন মজীদের আয়াত ও হাদীস্ শরীফ উদ্ধৃত করে এমন যথাযথ ব্যাখ্যাবলী প্রদান করেন যে উপস্থিত পণ্ডিতবর্গ সবাই নিরুত্তর হয়ে যান। এ পরিস্থিতি খলীফা হারুন-উর-রশীদকে হতভম্ব করে দেয়। বাগদাদের উলামাদেরকে হুসনিয়ার পরাভূত করার ঘটনাটা বহু দিন যাবত সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।” (হুসনিয়া শীর্ষক পুস্তক)
জবাব: এ অভিযোগ উত্থাপনকালে ’হুসনিয়া’ পুস্তকটি জবাব দানে অক্ষমতা সৃষ্টিকর কথিত প্রশ্নগুলো সম্পর্কে কোনো বর্ণনা-ই দেয় নি। প্রশ্নগুলো লিপিবদ্ধ হলে আমরা সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতাম সেগুলো কতোটুকু সারগর্ভ! পক্ষান্তরে বর্তমানে বিরাজমান অসংখ্য বইপত্র এ সত্যটিকে বিদালোকের মতো প্রতীয়মান করে যে কেবল আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদগণ-ই নন, বরং তাঁদের প্রশিক্ষিত শিষ্যবর্গ-ও ওই সকল গোমরাহকে খণ্ডন করে বহু উত্তর প্রদান করেছেন যা তারা জবাব দিতে না পেরে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে। সবাই এ সত্যটি উপলব্ধি করেন। নিশ্চয় দ্বীনের নিশান-বরদার ওই সকল আলেম একজন জারিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম হওয়ার মানহানিকর অবস্থায় পতিত হতে পারেন না; একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষও এই মানহানিকর অভিযোগে বিশ্বাস করবেন না। আরেকটি বিষয় সর্বজনবিদিত যে, কোনো আলেম-ই একজন মুজতাহিদের সমকক্ষ নন। আর কোনো ইসলামী গ্রন্থ-ই বসরার ইব্রাহীম খালেদ নামে কোনো বড় আলেমের নাম উল্লেখ করে নি। ’হুসনিয়া’ পুস্তকের ইহুদী লেখক সম্ভবতঃ আবু সাওর ইব্রাহীম বিন খালেদের নামটি শুনে এ ঘটনাটি বানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আবু সাওর বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন এবং সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি পাঁচ শ শিষ্যকে শিক্ষাদান তো দূরে থাক, ইতিপূর্বে নিজেই ইমামে আযমের (رحمة الله) শিষ্যদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ইমাম শাফেয়ীর (رحمة الله) কাছেও শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।
৩। — ’হুসনিয়া’ পুস্তকটি ওই জারিয়াকে উদ্ধৃত করে: “রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর বেসালের পরে আবু বকর সিদ্দিককে খলিফা নিয়োগ করার দরুন সাহাবায়ে কেরাম সকলেই কাফের (অবিশ্বাসী) হয়ে যান। অতএব, তাঁদেরকে অভিসম্পাত দেয়া বিহিত। রাসূলে পাক (ﷺ) এরশাদ ফরমান – ‘আমার পরে আমার সাহাবীরা বহু হাদীস উদ্ধৃত করবে। এর অধিকাংশই হবে ভুয়া। আমার সাহাবীদের কথায় বিশ্বাস কোরো না; যদি তারা আমার আহলে বায়তের (রাঃ) অন্তর্ভুক্ত হয়, তবেই কেবল বিশ্বাস কোরো।” [এ কথা দ্বারা লেখক মুরতজা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর বাণী –
وَإِنَّ أُمَّتِي سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلاَثَةٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً كُلُّهَا فِي النَّارِ إِلاَّ فِرْقَةً وَاحِدَةً قِيلَ : يَا رَسُولَ اللهِ مَنْ هُمْ ؟ قَالَ : مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي.
“আমার উম্মত তিয়াত্তর দলবিভক্ত হবে; বাহাত্তরটি জাহান্নামী হবে, শুধু একটি নাজাত পাবে; যারা আমাকে ও আমার সাহাবীদেরকে অনুসরণ করবে তারাই নাজাতপ্রাপ্ত। [২]
[২] তাবারানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ১৪:৫৩।
যা হাদীসে উদ্ধৃত তা পরিবর্তন করে বলেছে – “যারা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ও তাঁর আহলে বায়তকে অনুসরণ করবে তারাই নাজাতপ্রাপ্ত।” – লেখক উসমান আফেন্দী]
অতঃপর ওই জারিয়া মো’তাযেলা মতবাদের অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছে:
“কুরআন মজীদকে একটি সৃষ্টি ও অনন্ত নয় প্রমাণার্থে জারিয়াটি বিভিন্ন প্রশ্ন করেন যার কোনো সদুত্তর মুজতাহিদবৃন্দ দিতে পারেন নি। এতে সুন্নী হওয়া সত্ত্বেও উপস্থিত সহস্র সহস্র মানুষ মুজতাহিদদের মুখে থুথু ছুঁড়ে মারেন এবং মানুষেরা জারিয়াকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। খলীফা হারুনুর রশীদের সম্মুখেই জারিয়া বলেন যে আহলে বায়তের ১২ ইমাম ছাড়া অন্য কেউই খেলাফতের হকদার নয় এবং সুন্নীরা পাপিষ্ঠ ও বদমাইশ হওয়া সত্ত্বেও যে কোনো ব্যক্তিকে খলীফা বানাতে কুণ্ঠিত নয়; জারিয়া উপস্থিত সুন্নী জনতাকে অভিসম্পাত দেন। উপস্থিত সকল মানুষের সামনে যখন ওই তরুণী বলেন যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও অপর ছয়জন সাহাবী আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতের বিরোধী ছিলেন এবং এই মতবিরোধ যুদ্ধসমূহে পরিণত হয়েছিল এবং আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর সমর্থকবৃন্দ ২২ জনে উপনীত হয়েছিলেন এবং এই ২২ জন ব্যতিরেকে সকল সাহাবী ও তাঁদের মুহব্বতকারী ও অনুসারী মুজতাহিদ ইমাম এবং উলামায়ে কেরাম ও সুন্নী মুসলামনবৃন্দ সবাই কাফের এমন কী কাফেরের চেয়েও নিকৃষ্ট এবং তাঁদের সবাইকে অভিসম্পাত দেয়া সর্বাধিক মূল্যবান এবাদত হবে, তখন খলীফা হারুনুর রশীদ এতো খুশি হন এবং জারিয়াকে এতো পছন্দ করেন যে তিনি সময়ে সময়ে তার দিকে স্বর্ণ ছিটাতে থাকেন” (হুসনিয়া)। এই মিথ্যাকে রং দিয়ে বইটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
জবাব: সুরা তওবার ১০০ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে –
رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ
আল্লাহ্ তা’লা সাহাবীদেরকে ভালোবাসেন এবং তাঁরাও তাঁকে ভালোবাসেন। [৩]
[৩] আল কুরআন : আত তাওবা, ৯:১০০।
এখানে আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেছেন যে তিনি আনসার ও মোহাজির নির্বিশেষে সকল সাহাবীকেই (রাঃ) ভালোবাসেন।
সুরা আহযাবের ৬ষ্ঠ আয়াতে এরশাদ হয়েছে – وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ
রাসূল (ﷺ)-এর স্ত্রীবৃন্দ মোমেনদের মাতা”।[৪]
[৪] আল কুরআন : আল আহযাব, ৩৩:৬।
এ ক্ষেত্রে খোদাতা’লা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নেয়ামতপ্রাপ্ত স্ত্রীবৃন্দের প্রশংসা করেছেন। অতঃপর এ সকল আয়াতে করীমার বিরোধিতা করা, আয়াতোল্লিখিত বুযূর্গদের কাফের তথা অবিশ্বাসী আখ্যা দেয়া এবং তাঁদের দ্বারা বর্ণিত হাদীসগুলোকে নির্ভরযোগ্য নয় বলা কোনো পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। এগুলো একমাত্র ইসলামকে হেয় ও ধ্বংস করার চেষ্টারত অন্তর্ঘাতী শত্রুদের দ্বারাই সম্ভব।
কুরআন মজীদকে একটি সৃষ্টি এবং মানুষের কর্মসমূহ সৃষ্টি নয় মর্মে মো’তাযেলা মতবাদের অনুসরণে যে সকল প্রশ্ন করা হয়েছিল বলে বইটিতে বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো মুজতাহিদবৃন্দের শিক্ষিত শিষ্যদের দ্বারা দ্ব্যর্থহীন ও দালিলিকভাবে খণ্ডিত হয়েছে; এ লক্ষ্যে বহু গ্রন্থও প্রণীত হয়েছে এবং সেগুলো ভাষান্তরিত হয়ে বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী জনের দ্বারা সমাদৃতও হয়েছে। অতএব, মুজতাহিদ-মণ্ডলী জারিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি মর্মে মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তায় কেবলমাত্র অজ্ঞ আহাম্মকেরা-ই ধোকাপ্রাপ্ত হতে পারে। সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন যে কোনো মানুষই স্পষ্ট দেখতে পাবেন যে এগুলো দ্বীনের অন্তর্ঘাতী শত্রুদের বানানো কুৎসা যা তাদের হাতিয়ার হিসেবে দ্বীনকে ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কুরআন মজীদ একটি সৃষ্টি এবং মানুষের বদ-কর্ম মানুষ নিজেই সৃষ্টি করে, আল্লাহ্ সৃষ্টি করেন না – এ বিষয়গুলো প্রমাণার্থে মো’তাযেলা সম্প্রদায় আহলে সুন্নাতকে যে সব প্রশ্ন করেছিল সেগুলো লিখতে গিয়ে ’হুসনিয়া’ পুস্তকের লেখক আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামাবৃন্দের প্রদত্ত প্রকাশ্য ও খণ্ডনকারী জবাবগুলো ধামাচাপা দিতে অপপ্রয়াস পেয়েছেন। তবে আহলে সুন্নাতের এ সকল জবাব আমাদের কালাম শাস্ত্রের গ্রন্থাবলীতে বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ আছে।
আব্বাসীয় খলীফাবৃন্দের মধ্যে হারুনুর রশীদ ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞানী, সাহসী এবং ন্যায়পরায়ণ। এমন একজন খলীফার উপস্থিতিতে এবং উলামায়ে কেরাম ও রাষ্ট্রবিদদের সামনে ওই জারিয়া খলীফাকে হেয় করেছে এ কথা বলে যে, তাঁর খেলাফত ন্যায্য নয়; আর উপস্থিত সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের দিকে ফিরে সে তাঁদেরকে এ মর্মে অভিযুক্ত করেছে যে, তাঁরা একজন জঘন্য পাপীকে তাঁদের খলীফা বানিয়েছেন। এই যুক্তি মানব মস্তিষ্কে কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। জারিয়ার এ ধরনের কথাবার্তায় খলীফা হারুনুর রশীদ খুশী হয়ে তাকে স্বর্ণমুদ্রা দান করেছেন মর্মে লেখকের অভিযোগ উত্থাপন এতোই উদ্ভট ও বানোয়াট যে এতে মানুষদের হাস্যরসের খোরাক রয়েছে। ”জারিয়া এ সকল কথা বলে উলামায়ে কেরামকে স্তব্ধ করে দিলেন,যার দরুন কেউই আর তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না; এতে উপস্থিত জনতা ও বাগদাদের সুন্নী মুসলমান সমাজ খুশি হলেন এবং মুজতাহিদদেরকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন”- এ কথাটি লিখে ‘হুসনিয়া’ পুস্তকের লেখক বোঝাতে চেয়েছেন যে মুজতাহিদ, খলীফা ও উপস্থিত সুন্নী জনতা সবাই মো’তাযেলা মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অথচ সকল বইপত্র ও ঐতিহাসিক দলিলপত্র সর্বসম্মতভাবে ব্যক্ত করে যে খলীফা হারুনুর রশীদ সারা জীবন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী ছিলেন, তিনি সুন্নী উলামায়ে কেরামের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং কোনো কাজ করার আগে তিনি তাঁদের সাথে পরামর্শ করতেন। তাঁর শাসনামলে বাগদাদের সুন্নী জনতা মো’তাযেলা মতবাদ গ্রহণ করার কোনো লিখিত দলিল কিংবা আলামত পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, হারুনুর রশীদের পরবর্তীকালের ২-১ জন খলীফা জনগণকে মো’তাযেলা মতবাদ গ্রহণ করার তাগিদ দিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিলো এবং সকল ইরাকী ও ইরানী জনগণ সুন্নী মতাদর্শ আঁকড়ে ধরেছিলেন যতো দিন না শাহ্ ইসমাইলের আবির্ভাব ঘটেছিল। শাহ্ ইসমাইল সাফাভী (জন্ম-৮৯২ হিজরী/মৃত্যু-৯৩০ হিজরী মোতাবেক ১৫২৪ খৃষ্টাব্দ) কর্তৃক ইন্ধনপুষ্ট হয়ে শিয়া মতবাদের পুনরাগমন ঘটেছিল উসমানীয় তুর্কী প্রশাসনকে বিভক্ত করার জন্যে, যাতে করে শাহ্ ইসমাইল নিজের দখলে একটি ভূখণ্ড রাখতে পারেন। এই ঘটনা খলীফা হারুনুর রশীদের বহু শতাব্দী পরের। অতএব, প্রতিভাত হচ্ছে যে খলীফা হারুন ও তাঁর জনগণ জারিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মর্মে অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যা এবং হেয় প্রতিপন্ন করার অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
৪। — জারিয়াকে দিয়ে বলানো হয়েছে – “ইতিপূর্বে মোতা নেকাহ্ (বিয়ে) সর্বত্র প্রচলিত ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ওমর ফারুক এ প্রথা রহিত করেন।”
জবাব: বস্তুতঃ نَهَى يَوْمَ الْفَتْحِ عَنْ مُتْعَةِ النِّسَاءِ
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-ই মক্কা বিজয়ের দিন মোতা’ বিবাহ নিষিদ্ধ করে দেন।[৫]
[৫] (ক) ইবনে আবী শায়বা : ৩:৫৫১ হাদীস নং ১৭০৬৬।
(খ) মুসলিম : আস সহীহ, ২:১০২৬ হাদীস নং ১৪০৬।
(গ) তাবারানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ৭:১১২ হাদীস নং ৬৫২৯।
(ঘ) বায়হাকী : শু‘আবুল ইমান, ৭:৩৩১ হাদীস নং ১৪১৫৭।
মোতা বিয়ের অর্থ হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে একজন নর ও একজন নারীর মধ্যে সহবাসের চুক্তিনামা। একজন সতী নারী তো দূরে থাক, কোনো পতিতা নারীও এ ব্যাপারে হাজার হাজার মানুষের সামনে এতো নির্লজ্জভাবে আলাপ-আলোচনা করতে পারবে না; তাহলে ইমাম জাফর সাদিক (رحمة الله)-এর কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন সতী, পূর্ণতাপ্রাপ্ত, সুন্দরী যুবতী নারীর পক্ষে এ ব্যাপারে আলোচনা করার অভিযোগটি জঘন্য কুৎসা রটনা ছাড়া আর কিছু নয়।
৫। — জারিয়া বলে, “মক্কা হতে মদীনা শরীফে হিজরতের রাতে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁর সাহাবীদেরকে নিজ নিজ ঘর ত্যাগ করতে মানা করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আবু বকর সিদ্দিক তাঁর ঘর হতে বের হয়ে আসেন এবং রাসূলে খোদা (ﷺ)-কে অনুসরণ করেন। রাসূলে করীম (ﷺ) তাঁকে অনুসরণ করতে দেখতে চান নি এবং তাঁকে ফেরত পাঠাবার কথা চিন্তা করছিলেন, এমনি সময় জিবরাইল আমীন আলাইহিস সালাম এসে নবী পাক (ﷺ)-কে সতর্ক করে দিলেন এবং বল্লেন যে আবু বকর ফিতনা সৃষ্টি করতে চান এবং তাঁকে ফেরত পাঠালে তিনি কুরাইশদের পক্ষ নিয়ে রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন। সুরা তওবার ৪০ নং আয়াতে ঘোষিত لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا
ভয় পেয়ো না, আল্লাহ্ আমাদের সাথে আছেন। [৬]
[৬] আল কুরআন : আত তাওবা, ৯:৪০।
ঐশী বাণীটি পরিস্ফুট করে যে আবু বকর সিদ্দিক একজন কাফের তথা অবিশ্বাসী ছিলেন।” (নাউযু-বিল্লাহে মিন যালেকা) (হুসনিয়া পুস্তক)
জবাব: ইতিহাসের গ্রন্থাবলীর সর্বসম্মত বর্ণনা অনুযায়ী রাসূলে আকরাম (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীদের প্রতি কোরাইশ বংশীয় কাফেররা দিনকে দিন তাদের নির্যাতন-নিপীড়ন বৃদ্ধি করে চলেছিল। অবশেষে তারা তাঁদের প্রতি অবরোধ দিয়েছিল। এই তিন বছরের অবরোধের সময় কিছু সাহাবী মদীনা মেনাওয়ারায়, আর কিছু সাহাবী আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। উদাহরণস্বরূপ, হযরত উসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যিনি কুরআন মজীদকে সংকলন করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন, তিনি ও তাঁর স্ত্রী নবী নন্দিনী রুকাইয়া যখন আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে মক্কা ত্যাগ করছিলেন, তখন নূর-নবী (ﷺ) তাঁদেরকে দেখে বল্লেন,إِنَّ عُثْمَانَ أَوَّلُ مَنْ هَاجَرَ إِلَى اللهِ بِأَهْلِهِ بَعْدَ لُوطٍ
“নবীদের মধ্যে লুত আলাইহিস সালাম-ই তাঁর স্ত্রীসহ সর্বপ্রথম হিজরত করেন।[৭]
[৭] তাবারানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ১:৯০ হাদীস নং ১৪৩।
আর আমার সাহাবীদের মধ্যে তুমি-ই সর্বপ্রথম স্ত্রীসহ হিজরত করতে যাচ্ছো। আল্লাহতা’লা জান্নাতে তোমাকে লুত আলাইহিস সালাম-এর সাথী করে দেবেন” (আল হাদীস)। রোকাইয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন হুজূর পূর নূর (ﷺ)-এর দ্বিতীয় কন্যা। সকল সাহাবীর হিজরতের দরুন হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ছাড়া আর কেউই মক্কা মোকাররমায় বাকি রইলেন না। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বেশ কয়েকবার হিজরত করার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) অনুমতি দেন নি এ কথা বলে – لَا تَعْجَلْ؛ لَعَلَّ اللهَ يَجْعَلُ لَكَ صَاحِبًا – তুমি আমার সাথে হিজরত করবে” ।[৮]
[৮] তাবারানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ২২:১৭৭।
অতঃপর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহতা’লার নির্দেশের প্রতীক্ষায় রইলেন। ইত্যবসরে কোরাইশ গোত্র-প্রধান ইসলামের জানী দুশমন আবু জাহেলের পরামর্শক্রমে কাফেররা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে [আবু জাহেলের আসল নাম আমর বিন হিশাম বিন মুগীরা। সে কুরাইশ বংশীয় বনী মাহযুম গোত্রভুক্ত মাহযুম বিন ইয়াকনাতা বিন মুররার বংশধর। কুরাইশ হলো ফিহর-এর নাম যিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর ১১তম পিতৃপুরষ। মুররা হলেন তাঁর ৭ম পিতৃপুরুষ। আবু জাহেল ২য় হিজরীতে বদর যুদ্ধে নিহত হয় – ওয়াকফ এখলাস]। খুনীকে যাতে শনাক্ত করা না যায়, সে জন্যে তারা ১২ জন ভবঘুরেকে বেছে নেয়। এ সব ভবঘুরে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রভুক্ত ছিল। তারা বুধবার দিবাগত রাতে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর ঘরে অবরোধ দেয়। তারা যখন হত্যা করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করতে উদ্যত, ঠিক তখনি আল্লাহতা’লা তাঁকে হিজরত করার ঐশী প্রত্যাদেশ দেন। তিনি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকতে দিয়ে সূর্যোদয়ের আগেই ইয়াসিন সুরার ৮ম আয়াতে করীমা তেলাওয়াত করতে করতে কাফেরদের সামনে দিয়ে হেঁটে ঘর ত্যাগ করেন, অথচ কাফেররা তাঁকে দেখতেই পায় নি। দুপুর পর্যন্ত একটা অজ্ঞাত গোপন স্থানে অবস্থান করার পরে তিনি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র ঘরে গমন করেন। তিনি হযরত আবু বকরের পুত্র আবদুল্লাহ্ (বহু জিহাদে অংশ গ্রহণকারী এই সাহাবী ১১ হিজরীতে বেসালপ্রাপ্ত হন)-কে কাফেরদের মাঝে প্রত্যহ হেঁটে তাদের কাছ থেকে তথ্যাদি সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট গুহায় রাতে তা পৌঁছে দেয়ার জন্যে আদেশ করেন। হযরত আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খাবারও উক্ত গুহায় পৌঁছানোর আদেশ পান। انْتَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وسلَّم وَأَبُو بَكْرٍ إِلَى الْغَارِ لَيْلًا، – অতঃপর সেই রাতে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ও হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু গৃহ ত্যাগ করে উক্ত সাওর নামক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন। সেখানে রাসূলে খোদা (ﷺ) হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র হাঁটুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন।فَلَمَسَ الْغَارَ لِيَنْظُرَ أَفِيهِ سَبُعٌ أو حية، গুহার মধ্যে অবস্থিত কোনো সাপ বেরিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)’কে কামড়াতে পারে, এই ভয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর জামা ছিঁড়ে প্রায় সমস্ত গর্ত জামার ছেঁড়া টুকরো দ্বারা বন্ধ করে দেন। وَبَقِيَ مِنْهَا جُحْرٌ وَاحِدٌ، فَأَلْقَمَهُ كَعْبَهُ শুধু একটি গর্ত অবশিষ্ট থেকে যায় । এই গর্ত হতেই একটি সাপ মাথা বের করে। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সাপটিকে বের হতে বাধা দেয়ার উদ্দেশ্যে নিজের একটি পা দ্বারা গর্তের মুখ বন্ধ করে দেন। فَجَعَلَتِ الْأَفَاعِي تَنْهَشُهُ وَدُمُوعُهُ تَسِيلُ. এতে সাপটি তাঁর পায়ে ছোবল দেয়, কিন্তু তিনি তাঁর কদম মোবারক সরিয়ে আনেন নি। তবে সাপে কাটার ব্যথায় হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র চোখে পানি এসে যায় [৯]
[৯] ইবনে কাছির : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩:২২৫।
এবং তা গড়িয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর পবিত্র মুখমণ্ডলে গিয়ে পড়ে। ফলে নবী পাক (ﷺ) ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। অবস্থা দেখে বুঝতে পেরে তিনি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র পায়ের সাপে কাটা স্থানে নিজের একটু থুথু লাগিয়ে দেন। সাথে সাথেই ব্যথা দূর হয়ে যায়। উক্ত গুহায় তিন রাত অতিবাহিত করার পর তাঁরা রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম সোমবার মদীনার উদ্দেশ্যে উটের পিঠে চড়ে রওয়ানা হন। এ সময় তাঁরা সমুদ্র তীরবর্তী পথটি গ্রহণ করেন, কেননা তা সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত রাস্তা ছিল। যখন তারা কুদাইদ নামক স্থানে পৌঁছুলেন তখন একটি তাঁবু দেখতে পেলেন। এ তাঁবুতে একজন নারী বসবাস করতেন। তাঁরা তাঁকে কেনার মতো কোনো আহার্য আছে কিনা তা জিজ্ঞেস করলেন। মহিলা জানালেন যে কোনো খাবারই নেই কেবল একটি রুগ্ন ও দুধবিহীন ভেড়ী ছাড়া।
فَدَعَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بالشَّاة فَمَسَحَهَا وَذَكَرَ اسْمَ اللَّهِ وَمَسَحَ ضَرْعَهَا وَذَكَرَ اسْمَ اللَّهِ وَدَعَا بِإِنَاءٍ لَهَا يُرْبِضُ الرَّهْطَ فَتَفَاجَّتْ وَاجْتَرَّتْ فَحَلَبَ فِيهَا ثجا حتى ملأه
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ভেড়ীর দুধ দোহন করার অনুমতি চাইলেন। অনুমতি মেলার পরে তিনি ভেড়ীটির পিঠে হাত বুলালেন এবং বাসমালা শরীফ পাঠ করেই দুধ দোহন শুরু করলেন। প্রচুর দুধ বেরিয়ে এলো এবং উপস্থিত সকলে তা পেট ভরে পান করলেন ও মহিলার কাছে মওজুদ সমস্ত পাত্র-ও তা দ্বারা পূর্ণ করা হলো।[১০]
[১০] ইবনে কাছির : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩:২৩৫।
যখন মহিলার স্বামী আগমন করে এ মো’জেযা (অলৌকিক ক্রিয়া)-র কথা জানলেন, তৎক্ষণাৎ তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মুসলমান হয়ে গেলেন।
হিজরত সম্পর্কে সকল ইতিহাস পুস্তক এই একই বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছে। যেহেতু মক্কা নগরীতে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আলী কাররামা আল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ছাড়া আর কেউই ছিলেন না, সেহেতু ”রাসূলুল্লাহ্ তাঁর সাহাবীদেরকে নিজেদের ঘর ত্যাগ করতে বারণ করেছিলেন”, এ কথাটা ভুয়া ও বানোয়াট বলেই প্রতিভাত হয়। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হতে দুই বছরের ছোট ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই তাঁরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এই ঘনিষ্ঠতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে যতোদিন তাঁরা যাহেরী (প্রকাশ্য) জিন্দেগীতে ছিলেন। তাঁরা সর্বদা পরস্পরের সাহচর্যে ছিলেন। যখন রাসূলে খোদা (ﷺ) দু বার দামেস্কে তাশরীফ নিয়েছিলেন, তখন হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-ও তাঁর সাথী হয়েছিলেন। এই মুহব্বত ও ঘনিষ্ঠতাকে এবং আত্মত্যাগকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁকে বিশ্বাস করেন নি মর্মে ধারণা করা শুধু প্রকাশ্য মিথ্যাচারই নয়, বরং একটি জঘন্য কুৎসা রটনাও। ’হুসনিয়া’ পুস্তকের লেখক বলছেন যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে হিজরতের কথা জানান নি। অথচ কাফেররা যারা ঘর অবরোধ করেছিল, তারা হুজুর পূর নূর (ﷺ)-কে ঘর থেকে বের হতে দেখেই নি। যদি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এটা অনুভব করতে পেরে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)’কে অনুসরণ করেন, তাহলে এতে বোঝা যায় যে তিনি কাশফ (দিব্যদৃষ্টি) ও কারামত (অলৌকিক ক্ষমতা)-সম্পন্ন সিদ্ধপুরুষ। এমতাবস্থায় এ কথা বলা কি যু্ক্তিসঙ্গত হবে যে একজন কাশফ ও কারামতসম্পন্ন ব্যক্তি হুজুর পূর নূর (ﷺ)-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন? যদি বিশ্বাসঘাতকতা করাই তাঁর নিয়্যতে থাকতো, তাহলে তিনি ওই সময় তা করলেন না কেন যখন কাফেররা শুক্রবারে গুহার মুখে এসে মাকড়সার জাল দ্বারা গুহার মুখ আবৃত দেখে তাতে প্রবেশ করার পরিকল্পনা ত্যাগ করে বলেছিল – “পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন হতে মনে হয় এখানে কোনো মানুষ প্রবেশ করে নি?” হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কি এ করম একটা সুযোগ হাতছাড়া করতে পারতেন? لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا – “ভয় পেয়ো না, আল্লাহ্ আমাদের সাথে আছেন”- আয়াতটিকে বিকৃত ব্যাখ্যা করে তা হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র বিরুদ্ধে ব্যবহার করার অপচেষ্টা দ্বীনের প্রতি বৈরিতা ও মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। এর জবাব না দেয়াই উচিৎ।
৬। — “হুসনিয়া দীর্ঘক্ষণের জন্যে ইব্রাহীম খালেদের সাথে আলাপ করেন। সূক্ষ্ম বিষয়াদি সম্পর্কে তিনি তাঁকে প্রশ্ন করেন। অন্যান্য মুজতাহিদদের মতো তিনিও কোনো জবাব দিতে সক্ষম হন নি। ফাঁপরে পড়ে তিনি হুসনিয়াকে জিজ্ঞেস করেন যে খেলাফতের প্রকৃত অধিকারী কে? যখন হুসনিয়া জবাব দেন যে খেলাফতের প্রকৃত অধিকারী হচ্ছেন প্রাথমিক সময়কার মুসলমান, তখন ইব্রাহীম খালেদ জিজ্ঞেস করেন যে কে এই প্রাথমিক সময়কার মুসলমান। এতে হুসনিয়া জবাব দেন ‘হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম’। ইব্রাহীম খালেদ এই জবাবের প্রতি আপত্তি উত্থাপন করে বলেন, ‘হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম মুসলমান হওয়ার সময় বাচ্চা ছিলেন; যেহেতু এ অর্থে একজন বাচ্চার মুসলমান হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেহেতু প্রথম মুসলমান ছিলেন হযরত আবু বকর’। হুসনিয়া হযরত ঈসা সমীহ আলাইহিস সালাম, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কুরআন মজীদের আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে বলেন যে ওই সকল পয়গম্বর ছোট বেলাতেই মুসলমান হয়েছিলেন; হুসনিয়া ইব্রাহীম খালিদ ও উলামায়ে আহলে সুন্নাতকে গালমন্দ করেন। সভায় উপস্থিত হযরত ইমাম শাফেয়ী ওই জারিয়াকে শাস্তি দেয়ার জন্যে খলীফাকে অনুরোধ জানান। খলীফা এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আদেশ দেন যে জারিয়াকে শুধু জ্ঞান দ্বারাই পরাস্ত করতে হবে।” (হুসনিয়া শীর্ষক পুস্তক)
জবাব: পক্ষান্তরে, সুন্নী মুসলমান সমাজে প্রসিদ্ধ রয়েছে এই হাদীস শরীফ-
كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ
– “প্রত্যেক শিশুই দুনিয়াতে আগমন করে মুসলমান হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তাদের বাবা মা-ই ইহুদী কিংবা খৃষ্টান অথবা নাস্তিক বানিয়ে দেয়।[১১]
[১১] (ক) মালেক : আল মুয়াত্তা, ২:৩৩৮ হাদীস নং ৮২৩।
(খ) আহমদ : আল মুসনাদ, ২:২৩৩ হাদীস নং ৭১৮১।
(গ) বুখারী : আস সহীহ, ২:৯৪ হাদীস নং ১৩৫৮।
(ঘ) আবু দাউদ : আস সুনান, ৪:২২৯ হাদীস নং ৪৭১৪।
(ঙ) বাযযার : আল মুসনাদ, ১০:৩৮৪।
(চ) আবু ইয়ালা : আল মুসনাদ, ১১:১৯৭ হাদীস নং ৬৩০৬।
(ছ) ইবনে হিব্বান : আস সহীহ, ১:৩৩৬ হাদীস নং ১২৮।
(জ) তাবারানী : আল মু‘জামুল আওসাত, ৫:১৬০ হাদীস নং ৪৯৪১।
(ঝ) বায়হাকী : আস সুনানুস সগীর, ২:৩৪৮ হাদীস নং ২২৬৯।
এই হাদীস শরীফের উপস্থিতিতে ইব্রাহীম খালেদ কিংবা অন্য কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব “হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম মুসলমান হওয়ার সময় বাচ্চা ছিলেন; তাই তাঁর মুসলমান হওয়াটা বিবেচ্য নয়”- এ কথাটি বলেছিলেন বলে ধারণা করা এবং এই সীমা লংঘনকারী কথার শ্রোতা শত শত জ্ঞান বিশারদ তা শুনে নিশ্চুপ হয়ে বসেছিলেন বলাটা অনেকটা সাদাকে কালো বলা এবং তাতে বিশ্বাস করার মতোই ব্যাপার, যা একেবারেই অবান্তর ও হাস্যকর। কিন্তু কী সাংঘাতিক ব্যাপার! এই অভিযোগটি উত্থাপন করেছে একজন ইরানী ইহুদী।
৭। — “ওই জারিয়া উলামাদের খণ্ডনার্থে বলেন, যদিও খলীফা হওয়ার একমাত্র হকদার ছিলেন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম, তথাপি তিন খলীফা তাঁকে জোরপূর্বক বঞ্চিত করেন। সালমান ফারিসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য পাঁচ থেকে ছয়জন সাহাবী হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর সাথে থেকে যান এবং তিনজন খলীফার পক্ষে রায় দেন নি। তাঁরা ওই নিষ্ঠুর শাসকদের বিরুদ্ধে পঁচিশ বছর সংগ্রাম করেন। এই কারণেই তিন খলিফা ও আশআরায়ে মোবাশশারা (১০ জন সাহাবী যাঁরা নাজাতের আগাম শুভসংবাদপ্রাপ্ত) এবং খলীফাদেরকে সমর্থন দানকারী হাজার হাজার সাহাবী সকলেই কাফের তথা অবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিলেন।” (নাউযুবিল্লাহে মিন যালিকা) অতঃপর হুসনিয়া বুযূর্গানে দ্বীনকে বিশ্রী ভাষায় গালি-গালাজ করে। (হুসনিয়া শীর্ষক গ্রন্থ)
জবাব: হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্যে হুরুফী শিয়া সম্প্রদায় খেলাফতকেও এর সাথে সম্পৃক্ত করে। এতে করে তারা ইসলাম-নির্দেশিত সীমা লংঘন করে এবং গোমরাহ ধ্যান-ধারণায় নিমজ্জিত হয়। যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করা হয়, তাহলে পরিদৃষ্ট হবে যে শরীয়তের বিধান খেলাফতকে তারা দুনিয়াবী জাঁকজমকের একটা মাধ্যম মনে করে। তাদের নিজেদের নেতৃবৃন্দের মধ্যকার ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্যাদি জানতে পেরে তারা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর চার খলীফাকেও (রাঃ) তাদের নেতৃবৃন্দের মতোই মনে করে। অথচ চার খলীফা (রাঃ) কীভাবে মানবতার সেবা করেছেন তা ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে। আর এটাই হলো খেলাফতের প্রকৃত অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।
আমাদের মনিব হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র খেলাফত আমলে একবার হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে এক বস্তা গম বহন করতে দেখেন। তিনি খলীফাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। খলীফা উত্তর দেন, “ওহে ওমর! আমার সংসারের জন্যে কি আমাকে আয়-রোজগার করতে হবে না?” হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই জবাবে কেবল বিমুগ্ধ-ই হলেন না, বরং বিস্মিতও হলেন। তিসি প্রস্তাব করলেন এ মর্মে যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর খলীফাকে বায়তুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে একটা সম্মানী ভাতা যেন দেয়া হয়, যাতে করে মানুষের খেদমত করার দায়িত্ব ও কর্তব্য খলীফা সুচারুভাবে পালন করতে পারেন। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর এ প্রস্তাব সাহাবায়ে কেরাম গ্রহণ করে নেন এবং বায়তুল মাল থেকে খলীফাকে একটা মাসিক সম্মানী ভাতা বরাদ্দ করা হয়। একজন সাধারণ মানুষের জন্যে যতোটুকু টাকা প্রয়োজন, ঠিক ততোটুকু অর্থই খলীফা গ্রহণ করতেন এবং বাকি টাকা থাকলে তা বায়তুল মালে ফেরত দিতেন। দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর আমলেও তাই হতো। যখন ইসলামী বাহিনী পবিত্র জেরুসালেম নগরী ও তার আশপাশ জয় করেন, তখন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো একজন অত্যন্ত জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ রাষ্ট্রদূতকে জেরুসালেমে প্রেরণ করে। এই ব্যক্তি খলীফার সাথে একটা সৌজন্য সাক্ষাৎশেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করে যে রিপোর্ট পেশ করেন তা প্রত্যাখ্যাত হলেও তিনি তাতে খলীফার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন, “খলীফা (ওমর ফারুক-রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এমনই এক শাসক যিনি উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানী ও শ্রদ্ধা কাড়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কোনো রাজ প্রাসাদ কিংবা অলংকারসমৃদ্ধ জামা-কাপড় নেই। আমি তাঁর পরণের কাপড়ের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম। তাতে আঠারোটি তালি ছিল। এ ধরনের একজন অনলংকৃত মহানায়ক যিনি সদা-সর্বদা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত, তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একেবারেই অসম্ভব।” এ ঘটনাটি নিরপেক্ষ ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে। মওলানা জালালউদ্দীন রূমী (৬০৪ হিজরীতে বলখ নগরীতে জন্ম এবং ৬৭২ হিজরী/১২৭৩ খৃষ্টাব্দ সালে কোন্ইয়া নগরীতে বেসালপ্রাপ্ত) প্রণীত ’মসনবী’ গ্রন্থটি যার মধ্যে ৪৭ হাজার দ্বিচরণ শ্লোক রয়েছে তা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই বইতে নিম্নোক্ত তথ্য বিবৃত হয়েছে: বিজিন্টিনীয় সম্রাটের প্রেরিত দূত মদীনা আগমন করে খলীফার রাজপ্রাসাদ কোথায় জিজ্ঞেস করলেন। তাঁকে একটা কুটির দেখানোর পরে তিনি সেটার আঙ্গিনায় প্রবেশ করে খলীফাকে দেখতে পেলেন। খলীফা ওমর ফরুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তখন মাথার নিচে একটা পাথর রেখে মাটিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। অতঃপর ঘুম থেকে জেগে উঠে তিনি রাষ্ট্রদূতের দিকে তাকাতেই দূত এই প্রথম চাহনির দরুন ভয়ে কম্পমান হন। এরপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দূত খলীফার সাথে কথা বলে বিদায় নেন। বিদায় নেয়ার সময় খলীফার পুণ্যবতী স্ত্রী রাষ্ট্রদূতকে একটি উপহার প্রদান করেন যা তিনি একজন পরিচিতজনের কাছ থেকে ১৮ দিরহাম রৌপ্য মুদ্রা ধার করে প্রস্তুত করেছিলেন এবং যা তিনি সম্রাটের স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান। প্রতিদানে সম্রাটের স্ত্রী তাঁকে একটা হীরক-খচিত উপহার প্রেরণ করেন। খলীফা যিনি তাঁর কর্তব্য-কর্মে কখনোই অন্যায় ও বে-ইনসাফী করেন নি, তিনি তাঁর পুণ্যবতী স্ত্রীকে ১৮ দিরহাম মূল্যের রৌপ্য মুদ্রা দান করে বাকিটুকু বায়তুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন।
হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর খাবার মাটির থালায় গ্রহণ করতেন। একদিন সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শে খলীফার কন্যা হাফসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তাঁর পিতাকে অনুরোধ করলেন,
হে আমার পিতা আমীরুল মোমেনীন! প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মেনাফেকদের সাথে সংগ্রাম করতে এমনই ব্যস্ত ছিলেন যে তিনি বিশ্রাম করার ফুরসৎ পান নি। বর্তমানে আপনি পূর্ব ও পশ্চিমে বহু দেশ জয় করেছেন। সারা বিশ্বের রাষ্ট্রদূতবৃন্দ আপনার কাছে আসেন এবং আপনার রন্ধনশালায় প্রস্তুতকৃত খাদ্য গ্রহণ করে ধন্য হন। আপনার কি উচিৎ নয় মাটির থালা-বাসন পরিবর্তন করে ওই সকল মেহমানদের উপস্থিতিতে তাম্র কিংবা অন্যান্য ধাতুর তৈজসপত্র ব্যবহার করা”? আসলে এটা ছিল সাহাবীদের পরামর্শ। হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উত্তর দেন, “হে আমার কন্যা হাফসা! অন্য কেউ হলে আমি এ কথার জন্যে তাকে ভর্ৎসনা করতাম। তোমার থেকে আমি জানতে পেরেছি যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর একটা ঘাস দ্বারা পূর্ণ তোষক ছিল। ওই বিছানায় তাঁকে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে না দেখে তুমি একটা নরম বিছানাতে তাঁকে ঘুমোতে দিয়েছিলে। ফলে তিনি সেই রাতে আর ঘুম থেকে জেগে উঠে তাহাজ্জুদের নামায পড়তে পারেন নি। এতে তিনি সন্তাপ প্রকাশ করে বলেছিলেন , ’এ কাজ আর কখনোই কোরো না!
হিলইয়াতুল আউলিয়া গ্রন্থে হাদিসটির ইবারত রয়েছে নিমোক্তভাবে,
قَالَتْ حَفْصَةُ بِنْتُ عُمَرَ لِعُمَرَ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ: يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ لَوْ لَبِسْتَ ثَوْبًا هُوَ أَلْيَنَ مِنْ ثَوْبِكَ، وَأَكَلْتَ طَعَامًا هُوَ أَطْيَبَ مِنْ طَعَامِكَ، فَقَدْ وَسَّعَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنَ الرِّزْقِ، وَأَكْثَرَ مِنَ الْخَيْرِ؟ فَقَالَ: ” إِنِّي سَأَخْصُمُكِ إِلَى نَفْسِكِ، أَمَا تَذْكُرِينَ مَا كَانَ يَلْقَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ شِدَّةِ الْعَيْشِ؟ فَمَا زَالَ يُذَكِّرُهَا حَتَّى أَبْكَاهَا، فَقَالَ لَهَا: «وَاللهِ إِنْ قُلْتِ ذَلِكَ، أَمَا وَاللهِ [ص:49] لَئِنِ اسْتَطَعْتُ لَأُشَارِكَنَّهُمَا بِمِثْلِ عَيْشِهِمَا الشَّدِيدِ، لَعَلَى أُدْرِكُ مَعَهُمَا عَيْشَهُمَا الرَّخِيَّ»[১২]
[১২] আবু নুয়াইম ইস্পাহানী : হিলইয়াতুল আউলিয়া, ১:৪৮।
সুরা ফাত্হ-এর ২য় আয়াতে ঘোষিত হয়েছে,
لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا
‘যাতে আল্লাহ্ আপনার (রাসূল-(ﷺ)) কারণে পাপ ক্ষমা করে দেন – আপনার পূর্ববর্তীদের ও আপনার পরবর্তীদের, অর্থাৎ, আপনারই কারণে উম্মতের গুণাহ্ ক্ষমা করেন।[১৩]
[১৩] আল কুরআন : আল ফাতহ, ৪৮:২।
যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে খোশ-খবরী দেয়া হয়েছে যে তাঁকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, তিনি যদি ওইভাবে জীবন যাপন করতে পারেন, তাহলে আমি উমর, যার ভবিষ্যত সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর জীবনধারা ত্যাগ করে কীভাবে আমি তাম্র প্লেটে খাওয়ার মতো বিলাসী জীবন যাপন করতে পারি?”
হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রত্যহ মদীনা মোনাওয়ারায় অবস্থান করে এশিয়ায় তাঁর সৈন্যবাহিনীর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন এবং তাদের ভাল-মন্দ দেখাশুনা করতেন। রাতে তিনি ছদ্মবেশে শহরময় ঘুরে বেড়াতেন প্রজা-সাধারণের জান-মাল-ইজ্জত হেফাযতের উদ্দেশ্যে।
এক রাতে যখন তিনি টহল দিচ্ছিলেন, তখন তিনি কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। এক বৃদ্ধা মহিলা বল্লেন, “আমার এমন কেউ নেই উপার্জন করার। আমি এখানে এসেছি দুই দিন হলো। আমার সন্তানেরা খাদ্যের জন্যে কান্নাকাটি করছে দুই দিন যাবত। আমি চুলা জ্বালিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করছি বলে তাদেরকে এ পর্যন্ত ভুলিয়ে রেখেছি।” খলীফা ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এতো ব্যথিত হলেন যে তিনিও কেঁদে ফেল্লেন। তিনি আফসোস করতে লাগলেন এই বলে, “হায়, উমর ধ্বংস হয়ে গেল; উমর বিনাশ হয়ে গেল!” তিনি সহসা কিছু গোস্ত নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন।
ঘটনাটি আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে নিম্নোক্ত ইবারত সহযোগে বিধৃত হয়েছে,
فَأَتَيْنَاهُمْ فَإِذَا امْرَأَةٌ مَعَهَا صِبْيَانُ لَهَا وَقِدْرٌ مَنْصُوبَةٌ عَلَى النَّارِ وَصِبْيَانُهَا يَتَضَاغَوْنَ، فَقَالَ عُمَرُ: السَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا أَصْحَابَ الضَّوْءِ، قَالَتْ: وَعَلَيْكَ السَّلَامُ. قَالَ: أَدْنُو.
قَالَتْ: أدن أودع. فَدَنَا فَقَالَ: مَا بَالُكُمْ؟ قَالَتْ: قَصَّرَ بِنَا اللَّيْلُ وَالْبَرْدُ. قَالَ: فَمَا بَالُ هَؤُلَاءِ الصِّبْيَةِ يَتَضَاغَوْنَ؟ قَالَتْ: مِنَ الْجُوعِ. فَقَالَ: وَأَيُّ شَيْءٍ على التار؟ قَالَتْ: مَاءٌ أُعَلِّلُهُمْ بِهِ حَتَّى يَنَامُوا، اللَّهُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ عُمَرَ. فَبَكَى عُمَرُ وَرَجَعَ يُهَرْوِلُ إِلَى دَارِ الدَّقِيقِ فَأَخْرَجَ عِدْلًا مِنْ دَقِيقٍ وَجِرَابَ شَحْمٍ،
[১৪]
[১৪] ইবনে কাছির : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭:১৩৬।
পরোপকার করতে কতোই না কষ্ট সহ্য করেছেন তিনি! এগুলো কোনো কল্পকাহিনী নয়। এগুলো ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে। আজকে কতিপয় চিত্র নির্মাতার বানোয়াট ছায়াছবি দেখে কিছু লোক মনে করছে যে দ্বীন ইসলাম বুঝি কিংবদন্তি ও কল্পকাহিনী।
ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ছিল। বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার সময় তাঁর বৈষয়িক সম্পদ ছিল রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর কাছ থেকে আমানত হিসেবে প্রাপ্ত ঘোড়া ’দুলদুল’, তাঁর তরবারি ’যুলফিকার’ ও তাঁর জামা। তাও আবার এগুলো জনৈক ইহুদীর কাছে ধার শোধের উদ্দেশ্যে বন্ধকী বস্তু হিসেবে প্রদত্ত হয়েছিল। একইভাবে সর্বশেষ নবী ও সুবচনের অধিকারী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামও একটা সেগুন কাঠের খাট, একটা জামা এবং এক সেট কাপড় রেখে গিয়েছিলেন। বিশটি উট, এক’শটি ভেড়া ও সাতটি ছাগল হতে প্রাপ্ত দুধ তিনি গরিব সাহাবীদের মাঝে সর্বদা দান করে দিতেন। তাঁর নিজস্ব কোনো ঘরও ছিল না। চারজন খলীফার (রাঃ) সকলেই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর মতো জীবনযাপন করতেন। তাঁরা কখনোই তাঁর নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত হন নি। চারজন-ই খেলাফতকে দ্বীন ইসলামের আদেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, নিজ নিজ কাঁধে একটা দায়িত্ব বহনের অঙ্গীকার করেছিলেন মাত্র; কেননা উম্মতে মোহাম্মদী তাঁদেরকে সর্বসম্মতভাবে খলীফা নির্বাচিত করেছিলেন। আমাদের রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হাদীস শরীফে এরশাদ করেছেন,لَا يَجْمَعُ اللَّهُ أُمَّتِي عَلَى ضَلَالَةٍ – “আমার উম্মতগণ গোমরাহীর ওপর একমত হবে না;। [১৫]
[১৫] হাকিম : আল মুস্তাদরাক, ১:২০১ হাদীস নং ৩৯৭।
“মুসলমানদের কাছে যা সুন্দর বলে বিবেচিত, তা আল্লাহর কাছেও সুন্দর বলে গৃহীত” (আল হাদীস)। খলীফাদেরকে উম্মতবৃন্দ নির্বাচিত করার বাস্তবতা সত্ত্বেও যদি ধারণা করা হয় যে তাঁরা জোর-জবরদস্তি খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, তবে এই ধারণা শুধু উদ্ভটই নয়, বরং হেয় প্রতিপন্ন করার একটা জঘন্য অপপ্রয়াসও। নিম্নবর্ণিত ঘটনাটি পরিস্ফুট করে যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মোটেই খেলাফতের প্রতি লালায়িত ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইতিপূর্বে কতিপয় অবিশ্বাসীকে বায়তুল মাল থেকে কিছু দুনিয়াবী বস্তু-সামগ্রী প্রদান করতেন যাতে তাদের সাথে মুসলমান সমাজের একটা সদ্ভাব ও সৌহার্দ্য বজায় থাকে। এ ধরনের মালামাল যে সকল অবিশ্বাসীকে দেয়া হতো, তাদেরকে বলা হতো “মুয়াল্লাফায়ে কুলুব।” যখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলীফা হন, তখন তিনি বায়তুল মাল থেকে জনৈক মুয়াল্লাফায়ে কুলুবকে এক খণ্ড জমি দান করেন। এই ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরামের মাঝে হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর জনপ্রিয়তা আঁচ করতে পেরে এবং তাঁকে খলীফা হিসেবে প্রত্যাশ্যা করতে পেরে জমির দলিলটি হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে নিয়ে যান এবং তাঁকে ওতে সমর্থনসূচক স্বাক্ষর করতে অনুরোধ জানান। এই দলিল দেখতে পেয়ে হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলীফার কাছে দলিলটিসহ উপস্থিত হন এবং তাঁকে প্রশ্ন করেন কেন এই ব্যক্তিকে বায়তুল মাল থেকে জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। খলীফা যখন ব্যাখ্যা করলেন যে মোয়াল্লাফায়ে কুলুবদেরকে রাসূল খোদা (ﷺ)-এর সময়েও বায়তুল মাল থেকে জমি বরাদ্দ করা হয়েছে, তখন হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বল্লেন, “সেটা এ কারণে করা হয়েছিল যে মুসলমান সম্প্রদায় সেই সময় শক্তিশালী ছিলেন না। আমরা তো আর এখন দুর্বল নই, তাই সেই প্রয়োজন এ মুহূর্তে আর বিরাজমান নেই। যদি এখনো তার প্রয়োজন থেকে থাকে, তবে ছয় কিংবা সাতজন সাহাবীর সাথে পরামর্শ করে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।” খলীফা এ কথায় অত্যন্ত প্রীত হয়ে বল্লেন, “হে উমর, যখন আমাকে খলীফা নির্বাচিত করা হয়, তখন আমি বলেছিলাম যে আমি এই পদের যোগ্য নই এবং আপনাকে শ্রেয়তর পছন্দ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলাম। কিন্তু সাহাবীবৃন্দ (রাঃ) আমার কথায় কর্ণপাত করেন নি। এ ঘটনায় আরেকবার প্রতিভাত হয়েছে যে আপনি আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমি খেলাফত থেকে পদত্যাগ করতে চাই। আপনার প্রতি আমার অনুরোধ এই যে, দয়া করে এ পদবী গ্রহণ করুন।” হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যথাযথ সম্মান সহকারে প্রত্যুত্তর দিলেন যে তিনি মোটেই শ্রেষ্ঠ নন এবং তিনি খলীফা হওয়ার চিন্তাও করেন না; তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাঁর মতানুযায়ী যা সঠিক বলে বিবেচিত তা সম্পর্কে খলীফাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া। অতঃপর বায়তুল মাল সংক্রান্ত বিষয়াবলীতে কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে পরামর্শ করার বিধান খলীফা আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জারি করেন।
হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফত আমলে বেশ কিছু সাহাবী তাঁর কাছে এসে অনুরোধ জানান এ মর্মে যে, খলীফার পুত্র আব্দুল্লাহ্ (ইবনে ওমর-রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আসহাবে কেরামের (রাঃ) মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী পণ্ডিত এবং রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হওয়ার দরুন তাঁকে যেন খলীফা হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওসিয়তের (উইলের) দ্বারা পরবর্তী খলীফা পদপ্রার্থী হিসেবে সুপারিশ করেন। খলীফা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উত্তর দেন, “খলীফা হওয়া একটা বিরাট বোঝা, আমার ছেলের ঘাড়ে এ বোঝা আমি চাপিয়ে দিতে পারি না।” ২৩ হিজরী সালে জনৈক সাহাবী মোগিরার অবিশ্বাসী দাস আবু লুলু একটা তরবারির আঘাতে হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে শহীদ করে। যখন খলীফা প্রাণঘাতী তরবারির আঘাত পেলেন, তখন তিনি তাঁর উত্তরসূরী পদপ্রার্থী হিসেবে ছয়জন সাহাবীকে মনোনীত করলেন। তাঁর ভাষ্যে এই সাহাবীরা “অন্যান্যদের চেয়ে বেশি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর প্রিয়ভাজন ছিলেন।” এই ছয়জন সাহাবী হলেন হযরত উসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আলী ইবনে আবি তালেব কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম, হযরত তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ নিজেদের মধ্যে হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে খলীফা নির্বাচিত করেন। ফলে হযরত উসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তৃতীয় খলীফা হন। তাঁর খেলাফত আমলে যত্রতত্র মোনাফেকদের দ্বারা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। যখন কিছু অজ্ঞ ও হীন প্রকৃতির লোক মদীনা অবরোধ করে, তখন কতিপয় সাহাবী খলীফাকে (রাঃ) পদত্যাগ করার জন্যে পরামর্শ দেন। তিনি এর জবাবে বলেন, “রাসূলে খোদা (ﷺ) আমাকে জানিয়েছেন যে আমি কুরআন তেলাওয়াত করার সময় শাহাদাতপ্রাপ্ত হবো।” এ কথা দ্বারা তিনি প্রমাণ করেন যে তাকদীরকে মেনে নেয়ার ও দুঃসময়ে সবর (ধৈর্য) এখতেয়ার করার সদগুণ তাঁর ছিল। ৩৫ হিজরী সালে কতিপয় দুর্বৃত্ত খলীফার ঘর আক্রমণ করে। যখন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম এ দুঃসংবাদ শুনেন, তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর দুই পুত্র ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে দুইটি সিংহের মতো খলীফার জান-মাল ও ইযযত রক্ষার্থে খলীফার গৃহে পাঠিয়ে দেন। এই দুই তরুণ উম্মুক্ত তরবারি হাতে প্রধান ফটকের সামনে প্রহরা দিতে থাকেন যার দরুন কোনো কাক-পক্ষীও খলীফার গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় নি। তবু পাঁচ কিংবা ছয়জন দুর্বৃত্ত মইয়ের সাহায্যে পেছনের একটা জানালা দিয়ে প্রবেশ করে এবং রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী খলীফাকে কুরআন তেলাওয়াতরত অবস্থায় শহীদ করে। যখন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম এই নিন্দনীয় ও মর্মান্তিক সংবাদ শুনতে পেলেন, তখন তিনি তাঁর দুই পুত্রকে খলীফার প্রাণ রক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগে ভীষণ ভর্ৎসনা করলেন এবং এমন কী তাঁর পবিত্র হাত দ্বারা মারতে পর্যন্ত উদ্যত হলেন। তবে যখন তিনি জানতে পারলেন যে তাঁরা যথাযথভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং খুনী দু্ষ্কৃতকারীরা পেছনের জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে খলীফাকে শহীদ করেছিল, তখন তিনি তাঁদের ক্ষমা করে দিলেন।
এই বিয়োগান্ত ঘটনার পরে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) সকলে সমবেত হয়ে সর্বসম্মতিক্রমে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে খলীফা নির্বাচিত করেন। অধিকাংশ সাহাবী (রাঃ), যাঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন হযরত তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, তাঁরা খুনীদেরকে আটক করে ইসলামের অনুশাসন অনুসারে তাদের শাস্তি বিধানের জন্যে নতুন খলীফাকে অনুরোধ জানান। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তাঁদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে জবাব দেন যে পরিস্থিতি গোলমেলে হওয়ার দরুন খুনীদেরকে গ্রেফতার করা একেবারেই অসম্ভব এবং তদন্ত করতে গেলে আরেকটি বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে; তাই শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরে খুনীদেরকে শাস্তি দেয়ার ইসলামী এ বিধান তিনি প্রয়োগ করবেন। তাঁরা এ জবাবের তীব্র প্রতিবাদ জানান এ কথা বলে যে, ইসলামের বিধান যে খলীফা কার্যকর করেন না, তাঁকে মান্য করা যায় না। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর ইজতেহাদ (ধর্মীয় সিদ্ধান্ত) সঠিক ছিল। অপর দিকে তাঁর প্রতিপক্ষও নিজেদের ইজতেহাদ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য ছিলেন। আর খলীফাও তাঁর অমান্যকারীদের আয়ত্তে আনতে শক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য ছিলেন। ফলশ্রুতিতে ‘জঙ্গে জামাল’ তথা উটের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং বহু মুসলমানের রক্তপাত হয়। ইত্যবসরে হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু দামেশকে গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে চলে গিয়েছিলেন, তাই তিনি উটের যুদ্ধে অংশ নেন নি। এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কোনো সিরীয় রক্তও তিনি ঝরতে দেন নি। যখন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম দামেশকীয়দেরকেও তাঁকে মান্য করতে বল্লেন, তখন হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজ ইজতেহাদ অনুসরণ করে ওই সমস্ত খুনীকে গ্রেফতার করার জন্যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রতি আহবান জানালেন। এতে আরেকটি যুদ্ধ তথা সিফফিনের যুদ্ধের উদ্ভব হলো।
অতএব পরিস্ফুট হয়েছে যে, চার খলীফা (রাঃ) এবং সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) কেউই দুনিয়াবী লাভের জন্যে কখনোই খেলাফতের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেন নি। তাঁরা আল্লাহ্ তা’লার বিধান কার্যকর করার উদ্দেশ্যেই সংগ্রাম করেছেন। চার খলীফা (রাঃ) কখনোই নিজেদের আরাম-আয়েশের দিকে ফিরেও তাকান নি; ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতে তাঁরা দিন-রাত চেষ্টারত ছিলেন এবং এ দায়িত্বকে আল্লাহর ওয়াস্তে গ্রহণ করেছিলেন।
হুরুফি (শিয়া)-রা খেলাফতকে রাজতন্ত্র মনে করে। যেহেতু তারা এ রকম চিন্তা করে, সেহেতু তারা বলে যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম অপর তিন খলীফার খেলাফতের বিরোধী ছিলেন এবং তাই তাঁদের বিরুদ্ধে অবিরত ২৫ বছর যাবত যুদ্ধ করেছিলেন। তারা ধারণা করে যে, হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম খেলাফতের জন্যে বহু বছর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং তাঁর খেলাফতের বিরুদ্ধাচরণের কারণে তিনি সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) প্রতি হিংসাপরায়ণ ছিলেন। হুরুফীরা অভিযোগ উত্থাপন করে, “তিন খলীফা ও তাঁদেরকে নির্বাচনকারী সহস্র সহস্র সাহাবীকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত লা’নত তথা অভিসম্পাত দিতে হবে।” নিজেদেরকে সঠিক প্রমাণ করার জন্যে তারা এমন কতোগুলো অস্বাভাবিক কাহিনী বানিয়ে নেয় যেগুলো ইসলাম কিংবা যুক্তিনির্ভর নয় এবং যেগুলো হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর শান-মানের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
৮। — জারিয়াকে দিয়ে বিবৃত হয়েছে, “যখন আবু বকর খলীফা হন, তখন তিনি হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর মালিকানাধীন খেজুর বাগানটি জোর-জবরদস্তি বাজেয়াপ্ত করেন। যার দরুন হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা আবু বকরের বিরুদ্ধে মৃত্যু অবধি বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন। বস্তুতঃ তাঁর বেসালের আগে তিনি ’উইল’ করে যান যেন তাঁকে রাতের বেলায় দাফন করা হয়, পাছে আবু বকর ও ওমর তাঁর জানাযায় শরীক হন।” (হুসনিয়া শীর্ষক গ্রন্থ)
জবাব: কথিত বাগানটিতে মাত্র কয়েকটি গাছ ছিল। যদি ধরেও নেয়া হয় যে বাগানটি বিশাল বন সম্পদে পূর্ণ ছিল, তবে কতো জঘন্য কুৎসা রটনা ও কতো বড় মূর্খতা হবে এই কথা ধারণা করা যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর কন্যা, নারীকুলশ্রেষ্ঠ হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যাঁকে দুনিয়ার নিরাসক্তির কারণে ‘বাতুল’ বলা হতো, তিনি দুনিয়ার কোনো বস্তুর জন্যে তাঁর পিতারই ভবিষ্যদ্বাণীকৃত ও জান্নাতের খোশ-খবরীপ্রাপ্ত তিন খলীফার (রাঃ) প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালেক)! এই জঘন্য কুৎসা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর সুউচ্চ শান-মানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং তাঁদের প্রতি ভালোবাসার পরিবর্তে দুশমনির বহিঃপ্রকাশ।
আহমদ জওদাত পাশা যিনি ১২৩৮ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন ও ১৩১২ হিজরী মোতাবেক ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে ইন্তাম্বুলে ইন্তেকাল করেন এবং পবিত্র ফাতিহ্ মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ কবরস্থানে সমাধিস্থ হন, তাঁর প্রণীত বিশালাকৃতির ‘কাসাসে আম্বিয়া’ (পয়গম্বরগণের ইতিহাস) গ্রন্থটি ১৩৩১ হিজরী সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের ৩৬৯ পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত তথ্যটি বিধৃত হয়েছে: রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁর ’ফাদাক’ নামের খেজুর বাগানটি একটি ওয়াকফ পরিচালনা ট্রাস্টে উৎসর্গ করেছিলেন এবং এর পরিচালনার পদ্ধতি নির্দেশ করেছিলেন। তিনি তাঁর ওসিয়তনামায় (উইলে) পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন বাগানটির আয় বিদেশী কূটনীতিক, ভ্রমণকারী, মেহমান ও দর্শনার্থীদের প্রদান করা হয়। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ উইলটি তাঁর খেলাফত আমলে বাস্তবায়ন করেন। যখন হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তার পিতা হতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মনে করে খেজুর বাগানটি খলীফার কাছে দাবি করলেন, তখন খলীফা আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বল্লেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি –
نَحن مَعَاشِرَ الْأَنْبِيَاءِ لَا نُورَثُ
“আমাদের (আম্বিয়াদের) কাছ থেকে ওয়ারিসীসূত্রে কেউই কিছু পাবে না।
لَا نُورَثُ مَا تَرَكْنَا فَهُوَ صَدَقَةٌ আমরা যা রেখে যাবো তার সবই দান-সদকা।[১৭]
[১৭] (ক) আব্দুর রাযযাক : আল মুসান্নাফ, ৫:৪৭৯ হাদীস নং ৯৭৭২।
(খ) আহমদ : আল মুসনাদ, ১:৪ হাদীস নং ৯।
(গ) বুখারী : আস সহীহ, ৪:৭৯ হাদীস নং ৩০৯২।
(ঘ) মুসলিম : আস সহীহ, ৩:১৩৭৭ হাদীস নং ১৭৫৭।
(ঙ) আবু দাউদ : আস সুনান, ৩:১৩৯ হাদীস নং ২৯৬৩।
(চ) বাযযার : আল মুসনাদ, ১:৫৪।
(ছ) নাসায়ী : সুনানুল কুবরা, ৪:৩২৯ হাদীস নং ৪৪২৭।3
لَسْتُ تَارِكًا شَيْئًا كَانَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْمَلُ بِهِ إِلاَّ عَمِلْتُ بِهِ ، إِنِّي أَخْشَى إِنْ تَرَكْتُ شَيْئًا مِنْ أَمْرِهِ أَنْ أَزِيغَ – এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর প্রতিষ্ঠিত কোনো বিষয়কে আমি পরিবর্তন করতে অক্ষম। নচেৎ আমি আশঙ্কা করি যে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারি।’ যখন হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা জানতে চাইলেন যে তাঁর, অর্থাৎ, খলীফার উত্তরাধিকারীরা কারা, তখন তিনি জবাব দিলেন, ’আমার স্ত্রী ও সন্তানরা।’ অতঃপর হযরত ফাতেমা জিজ্ঞেস করলেন: ’তাহলে আমি কেন আমার পিতার উত্তরাধিকারিনী হতে পারবো না?’ এ প্রশ্নের জবাবে খলীফা বল্লেন, ’আমি আপনার পিতা রাসূলে খোদা (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি: ”কেউই আমাদের (আম্বিয়াদের) উত্তরাধিকারী হতে পারবে না” (আল হাদীস)। অতএব আপনি তাঁর উত্তরাধিকারিনী হতে পারবেন না। তবে আমি নবী করীম (ﷺ)-এর খলীফা। তাঁর যাহেরী জিন্দেগীতে তিনি যাঁদেরকে দান করতেন, তাঁদেরকে আমিও দেবো। আপনাকে আপনার বিষয়াদিতে সাহায্য করা, আপনার প্রয়োজন পূরণ করা, এবং আপনার খেদমত করা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য।’ এ বক্তব্যের পরে হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা নিশ্চুপ হয়ে গেলেন এবং উত্তরাধিকার সম্পর্কে আর কখনোই আলাপ করেন নি।” (‘কাসাসে আম্বিয়া’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি এখানেই শেষ হলো)
বিদআতী গোমরাহ্ ও মযহাব-বিহীন লোকদের চেয়ে পৃথিবীতে সুন্নী মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রতি হুরুফী শিয়া সম্প্রদায় অভিসম্পাত দিয়ে থাকে, যদিও তারা সুন্নীদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক কম। যদি সুন্নী মুসলমানবৃন্দ-ও শিয়াদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অন্যায় আচরণের প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে তাদেরকে গোমরাহ্ (পথভ্রষ্ট) আখ্যায়িত করেন, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল-ই সঠিক হিসেবে প্রতীয়মান হবে। উপরন্তু, তিন খলীফার (রাঃ) প্রতি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন কিংবা হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা খেজুর বাগানের জন্যে আসহাবে কেরামকে (রাঃ) অভিসম্পাত দিয়েছিলেন, এ কথা বলাটা কুরআন মজীদের সম্পূর্ণ খেলাফ। কেননা, সুরা মায়েদার ২য় আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান: وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ – “এবং সৎ ও খোদাভীরুতার কাজে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করো, আর পাপ ও সীমা লংঘনে একে অন্যের সাহায্য করো না।[১৮]
[১৮] আল কুরআন : আল মায়িদাহ, ৫:২।
যদি সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) পরস্পরকে ভালো না বাসতেন এবং যদি মুসলমানবৃন্দ একে অপরকে কাফের আখ্যায়িত করতেন, তাহলে এটা গুণাহ্ সৃষ্টিকারক অবস্থা হতো যা একেবারেই তাক্ওয়া (খোদাভীরুতা) ও বির্র (সৎ কাজ)-এর পরিপন্থী। আর এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা উপরোক্ত আয়াতে করীমা অমান্য করেছেন বলে অপবাদ দেয়া। “ওই সকল সাহাবী হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতের বিরোধিতা ও সাহাবাবৃন্দের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হওয়ার দরুন তাঁদের পরবর্তী প্রজম্মের মুসলমানদের মাঝেও পরস্পরকে কাফের আখ্যা দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবার বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারেন নি যা তাঁদেরকে আয়াতে করীমার পরিপন্থী একটি সর্বসম্মতিতে উপনীত করেছিল। যদি তাঁরা অনুধাবন করতে সক্ষম হতেন, তাহলে তাঁরা এ আচরণ পরিত্যাগ করতেন”- এ কথাগুলো বলে তাঁদের কাশফ ও কারামতকে অপর দিকে অস্বীকার করার হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে।
সাইয়েদ আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) যিনি ৪৭১ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫৬১ হিজরী মোতাবেক ১১৬৬ খৃষ্টাব্দে বাগদাদে বেসালপ্রাপ্ত হন এবং যিনি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর একজন বংশধর ও অন্যতম-শ্রেষ্ঠ ওলী ছিলেন, তিনি তাঁর প্রণীত ’গুন্ইয়াতুত্ তালেবীন’ গ্রন্থে নিম্নবর্ণিত তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন: “শিয়া সম্প্রদায়ের মতানুযায়ী খেলাফত একমাত্র বারো ইমামেরই একচ্ছত্র অধিকারে। এ ইমামবৃন্দ নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ। তাঁরা কখনোই গুণাহ (পাপ) সংঘটন করেন না। একমাত্র তাঁদের কাছেই কাশফ ও কারামত পরিদৃষ্ট হয়। যা অতীতে ঘটে গেছে এবং যা ভবিষ্যতে ঘটবে সবই তাঁরা জানেন”।[১৯]
[১৯] মুহিউদ্দীন আব্দুল কাদেরী জিলানী : গুনইয়াতুত্ তালেবীন।
পক্ষান্তরে, এই বিশ্বাসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হবে এ কথা বলা যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম, যিনি শস্য-বীজের খবর থেকে আরম্ভ করে সমস্ত বিষয় অবগত ছিলেন, তিনি তাঁর দ্বারা হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে নির্বাচিত না করার দরুন লক্ষ লক্ষ মুসলমানের পথভ্রষ্ট হওয়ার বিষয়টি জানতেন না।
হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফত সংক্রান্ত আমাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণে আমরা ইতোমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছি যে খেলাফত একটা ভারী বোঝা ছিল। এমতাবস্থায় একজন মুসলমানের জন্যে কোনটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন হবে – অন্যান্য সুমলমান তাঁকে নির্বাচিত না করার দরুন নাখোশ হওয়া ও তাঁদের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হওয়া, নাকি তাঁর কাঁধে ভারী বোঝা না চাপানোর জন্যে খুশি হওয়া? উপরন্তু, তিনি যদি জানতে পারেন যে তাঁর বৈরী ভাব কেয়ামত দিবস পর্যন্ত পৃথিবীতে ফিতনার বিস্তার ঘটাবে, তাহলে তিনি অবশ্যঅবশ্যই স্বেচ্ছায় খলীফাকে নির্বাচিত করবেন।
সুরা আলে ইমরানের ১৮৫ তম আয়াত এবং সুরা হাদিদের ২০ তম আয়াত ঘোষণা করে: وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ – “পার্থিব জীবন এমন কতোগুলো বিষয়ের সমষ্টি যা মানুষদেরকে ধোকা দেয়া ।[২০]
[২০] আল কুরআন : আলে ইমরান, ৩:১৮৫, আল হাদীদ : ৫৭:২০।
সুরা আনআমের ৩২ তম আয়াত ঘোষণা করে: وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَلَلدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ “পার্থিব জীবন তো খেলাধূলা ছাড়া আর কিছু নয়; এবং নিঃসন্দেহে পরকালের নিবাস শ্রেয় তাদেরই জন্যে যারা (আল্লাহকে) ভয় করে। সুতরাং তোমাদের কি বুঝ নেই?” ।[২১]
[২১] আল কুরআন : আল আন‘আম, ৬:৩২।
সুরা আনফালের ২৮ তম আয়াত এবং সুরা তাগাবুনের ১৫ তম আয়াত ঘোষণা করে: وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ “এবং জেনে রেখো যে তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি সবই ফিতনা এবং আল্লাহর কাছে মহা পুরস্কার রয়েছে”।[২২]
[২২] আল কুরআন : আল আনফাল, ৮:২৮। তাগাবুন : ৬৪:১৫।
সুরা তওবার ৩৮ তম আয়াত ঘোষণা করে: اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ “তোমরা কি পার্থিব জীবনকে আখিরাতের বিনিময়ে পছন্দ করে নিয়েছো? (অথচ) পার্থিব জীবনের মুনাফা আখেরাতের তুলনায় অতিশয় কম”।[২৩]
[২৩] আল কুরআন : আত তাওবা, ৯:৩৮।
সুরা কাহাফের ৪৬ তম আয়াতে এরশাদ হয়েছে: الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا – ধনৈশ্বর্য ও পুত্র সন্তানাদি পার্থিব জীবনেরই শোভা; এবং স্থায়ী উত্তম কথাবার্তা (অর্থাৎ কর্ম) আপনার প্রভুর কাছে শ্রেয় হিসেবেই গৃহীত” ।[২৪]
[২৪] আল কুরআন : আল কাহাফ, ১৮:৪৬।
পৃথিবীর ধন-সম্পদ ও যশ-প্রতিপত্তির প্রতি আসক্ত না হওয়ার আজ্ঞা-সম্বলিত আরো ৬৬টি অনুরূপ আয়াতে করীমা কুরআন মজীদে বিদ্যমান। এ ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে অসংখ্য হাদীস শরীফ ব্যক্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি হাদীসে কুদসীতে এরশাদ হয়েছে: “ওহে আদম সন্তান! দুনিয়ার দ্রব্য-সামগ্রী তুমি মওজুদ করতে সারা জীবন অতিবাহিত করেছ। তুমি কখনোই বেহেস্ত কামনা করো নি” (হাদীসে কুদসী)। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যিনি জ্ঞান-শহরের দরজাসদৃশ ছিলেন এবং হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যিনি নারীকুলশ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাঁরা অবশ্যঅবশ্যই এ আয়াতে করীমাগুলো সম্পর্কে অন্যান্যদের চেয়ে অধিক অবহিত ছিলেন। একটি খেজুর বাগানের মতো দুনিয়ার বস্তু কিংবা পদ মর্যাদার জন্যে তাঁরা পরস্পর কলহে লিপ্ত হয়েছিলেন মর্মে বদ ধারণা কীভাবে পোষণ করা যায়?
আপত্তি ও জবাব- ০২
আপত্তি: হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর দুঃখ-বেদনা কিংবা বিরোধিতা দুনিয়ার মোহ থেকে নিঃসৃত হয় নি। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে জোরপূর্বক খেলাফত দখল করার পাপ সংঘটন করতে দেখে তাঁরা উভয় সাহাবীকে গুণাহের অবস্থা থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
জবাব: সুরা আনআমের ১৬৪ তম আয়াত ও সুরা ইসরার ১৫ তম আয়াত এরশাদ ফরমায়:وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى “এবং কোনো পাপী অন্য কারো পাপের বোঝা বহন করবে না”।[২৫]
[২৫] আল কুরআন : আল আনআম, ৬:১৬৪, আল ইসরা : ১৭:১৫।
তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যাক যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পাপ সংঘটন করেছিলেন (যদিও তা একেবারেই অসম্ভব), তবুও উপরোক্ত আয়াত অনুসারে এর কোনো প্রভাব হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর ওপরে পড়বে না এবং এ কারণে তাঁর যুদ্ধ করাও আবশ্যক হবে না। তাহলে এমন কোনো যুদ্ধ কি তাঁর দ্বারা আরম্ভ করা সম্ভব, যার ফলশ্রুতিতে লক্ষ কোটি মানুষ চিরস্থায়ীভাবে দোযখের আগুনে পুড়বে?
এই ফকির (অর্থাৎ, মওলানা উসমান আফেন্দী) জনৈক শিয়া পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা খেজুর বাগানটি ফেরত না পাওয়ার দরুন সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হলে প্রতিভাত হবে যে তিনি দুনিয়ার প্রতি আসক্ত। এটা তো শরীয়তে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়।” প্রত্যুত্তরে শিয়া পণ্ডিত বলেন, “তাঁর অসন্তুষ্ট হওয়াটা দুনিয়ার মোহ থেকে হয় নি। বরং তিনি একটা বদমাইশিকে পছন্দ করেন নি বলেই তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।” এই দায় এড়ানো উত্তর দ্বারা ওই শিয়া পণ্ডিত হুজুর পূর নূর (ﷺ)-এর নির্মল কন্যাকে হেয় প্রতিপন্ন করলেন। কেননা, দ্বীন ইসলামের সাথে সঙ্গতি রেখে কৃত কোনো কাজ একমাত্র নফসে আম্মারা (কুপ্রবৃত্তি)-এর কাছেই বদ হিসেবে গৃহীত হবে। আমি এই কথা স্মরণ করতে পেরে নিম্নোক্ত ব্যাখ্যাটি প্রদান করলাম। তিনি এমন হতভম্ব হয়ে গেলেন যে কোনো জবাবই দিতে পারলেন না। আমার ব্যাখ্যা ছিল এ রকম: ইতিহাস অধ্যয়নকারী সকলেরই জানা যে একবার এক জেহাদে হযরত ইমাম আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম জনৈক কাফেরকে ধরাশায়ী করে তার বুকের ওপর উঠে চূড়ান্ত আঘাত হানার সন্ধিক্ষণে কাফেরটি তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে থুথু নিক্ষেপ করেছিল। এতে তিনি কাফেরটিকে হত্যা করা হতে নিবৃত্ত হন। কাফেরটি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কেন হত্যা করলেন না; ভয় পেয়েছেন কি?” হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তাকে ছেড়ে দিয়ে বল্লেন, “তুমি মুসলমান না হওয়ার কারণে তোমার সাথে যুদ্ধ করে তোমাকে হত্যা করার জন্যে আমি আল্লাহর বিধান মোতাবেক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি যে বদ কাজ করেছো সেই জন্যে আমার নফস (প্রবৃত্তি) এখন তোমার শত্রু হয়ে গিয়েছে। এখন যদি তোমাকে আমি হত্যা করি তাহলে তা হবে আমার প্রবৃত্তি (নফস)-এর সন্তুষ্টির জন্যে। ফলশ্রুতিতে তা সওয়াবের স্থলে গুণাহ্ সৃষ্টিকারক হবে।” এ কথা শোনার পর কাফেরটি দ্বীন ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বে অভিভূত হলো – যে শ্রেষ্ঠত্বের ওপর হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর বিবেক ভিত্তি গেড়েছিল। অতঃপর কাফেরটি সর্বান্তকরণে কলেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করে স্বেচ্ছায় দ্বীন ইসলাম কবুল করে নিলো। কিছুক্ষণ আগেও যাঁরা ছিলেন জানী দুশমন, তাঁরা হয়ে গেলেন পরস্পর আলিঙ্গনকারী ভ্রাতা।
হযরত ইব্রাহীম বিন আদহাম (رحمة الله) যিনি শ্রেষ্ঠ আউলিয়াবৃন্দের মধ্যে অন্যতম, তিনি ৯৬ হিজরী সালে বলখ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৬২ হিজরী মোতবেক ৭৭৯ খৃষ্টাব্দে দামেশকে বেসালপ্রাপ্ত হন। তিনি ইতিপূর্বে বলখ-এর বাদশাহ্ ছিলেন। কিন্তু তিনি রাজ সিংহাসন ত্যাগ করে মক্কা মোকাররমা চলে আসেন। তিনি আগুন জ্বালাবার কাঠ পিঠে বহন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নফসের সাথে তিনি আজীবন জেহাদ করেছিলেন।
সপ্তম উসমানীয় তুর্কী বাদশাহ্ ফতেহ্ সুলতান মুহাম্মদ খাঁন (দিগ্বিজয়ী মুহাম্মদ) ৮৩৩ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিজেনটিনীয়দের কাছ থেকে ৮৫৭ হিজরী মোতাবেক ১৪৫৩ খৃষ্টাব্দে ইস্তাম্বুল কবজা করে নেন। ফলে নতুন যুগের সূচনা হয়। তিনি ৮৮৬ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর পিতা সুলতান মুরাদ খাঁন ২য় যিনি ষষ্ঠ উসমানীয় তুর্কী বাদশাহ্ ছিলেন, তিনি ৮০৬ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৫৫ হিজরী মোতাবেক ১৪৫১ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে বুরসায় দাফন করা হয়। তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেন ৮২৪ হিজরী সালে। ৮৪৭ হিজরী সালে তিনি স্বেচ্ছায় পুত্রের উদ্দেশ্যে শাসনভার ত্যাগ করেন এবং মাগ্নিসা নামের স্থানে অবসর জীবন যাপন করেন। এখানে তিনি তাঁর বাকি জীবন খোদাতা’লার এবাদত-বন্দেগীতে একাকী অতিবাহিত করেন।
দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ও অন্তঃসারশূন্য চাকচিক্য এবং নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ করার আবশ্যকতা সম্পর্কে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা নিশ্চয় উপরোক্ত সম্রাট দু’জনের চেয়ে অধিক অবহিত ছিলেন। তাহলে একজন মুসলমানের দ্বারা এ কথা বলা কীভাবে সম্ভব যে দুনিয়ার সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্যে এই সকল মহান ব্যক্তিত্ব লালায়িত ছিলেন এবং তাঁরা লক্ষ্য হাসিলের জন্যে বিদ্বেষভাব পোষণ করতেন? বস্তুতঃ এ সকল কুৎসা রটনা করেছিল আবদুল্লাহ ইবনে সাবা নামের এক মোনাফেক ইহুদী। হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফত আমলে এই ইহুদী লোকটি মিসরের উদ্দেশ্যে ইয়েমেন ত্যাগ করে এবং সেখান থেকে মদীনা মোনাওয়ারায় চলে আসে। মদীনায় সে একজন নব্য মুসলমান সেজে দ্বীন ইসলামের এমন ক্ষতি সাধন করে যা অন্যান্যরা এ যাবৎ করতে সক্ষম হয় নি।
সূরা আলে এমরানের ১৩৩ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে: وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ –
“এবং (তোমরা) দ্রুত অগ্রসর হও নিজ প্রতিপালকের ক্ষমা এবং এমন বেহেস্তের প্রতি যার প্রশস্ততার গণ্ডিভুক্ত সমস্ত আসমান ও জমীন যা পরহেযগারদের জন্যে তৈরি রাখা হয়েছে; (ওই সব লোকেরই জন্যে) যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে সুখে ও দুঃখে এবং ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষদেরকে ক্ষমা করে; এবং আল্লাহ্ তো ভালোবাসেন সৎ ব্যক্তিবর্গকে”।[২৬]
[২৬] আল কুরআন : আলে ইমরান, ৩:১৩৩।
সুরা হুজুরাতের ১০ম আয়াতে এরশাদ হয়েছে: إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ
মোমেন মুসলমানবৃন্দ পরস্পর ভাই ভাই। অতএব, আপন দু’ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দাও”।[২৭]
[২৭] আল কুরআন : আল হুজুরাত, ৪৯:১০।
অনুরূপ আরো প্রায় ত্রিশটি আয়াতে করীমায় মোমেন মুসলমানদেরকে পরস্পরের প্রতি রাগান্বিত হতে নিষেধ করা হয়েছে এবং ক্ষমাশীল ও দয়াশীল হতে আদেশ করা হয়েছে। একটি হাদীস্ শরীফে এরশাদ হয়েছে:
الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمَ الرَّحْمَان ، ارْحَمُوا من في الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ.
‘পরস্পরের প্রতি করুণাশীল ব্যক্তিদের প্রতি আল্লাহ্ পাকও করুণা করেন। তিনি রহমতের আধার। ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের প্রতি তোমরা করুণাশীল হও যাতে বেহেস্তে অবস্থিত ফেরেশতারা তোমাদের প্রতি করুণাশীল হন”।[২৮]
[২৮] (ক) ইবনে আবী শায়বা : আল মুসান্নাফ, ৮:৩৩৮।
(খ) তিরমিযী : আস সুনান, ৪:৩২৩ হাদীস নং ১৯২৪।
(গ) বায়হাকী : শু‘য়াবুল ইমান, ১৩:৪০১ হাদীস নং ১০৫৩৭।
অনুরূপ আরো প্রায় পঞ্চাশটি হাদীস শরীফ আপন জেদ দমন করার ও দয়াশীল হওয়ার জন্যে আদেশ করে এবং মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষা দেয়।
এমতাবস্থায় হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যদি দুনিয়াবী পদ ও কিছু খেজুর গাছের জন্যে নাখোশ হয়ে সারা জীবন সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁরা এ সকল আয়াতে করীমা এবং হাদীস্ শরীফকে অমান্য করেছেন। এটা কি আদৌ সম্ভব? এ ধরনের অভিযোগ তাঁদের সুউচ্চ শান-মান তথা মর্যাদর খেলাফ বা পরিপন্থী।
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর প্রিয়ভাজন এই দুইজনকে সম্ভাব্য হেয়করণ থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে আহলে সুন্নাতের উলামাবৃন্দ তাঁদের সম্পর্কে এ ধরনের উদ্ভট মন্তব্য করা হতে বিরত থেকেছেন এবং তাঁদেরকে ভালোবাসতে পরামর্শ দিয়েছেন এ কথা বলে – “এ সকল বুযূর্গদেরকে ভালোবাসলে ঈমান সহকারে ইন্তেকাল হবে।” তাঁদের প্রতি কার ভালোবাসা খাঁটি: শিয়াদের, নাকি আহলে সুন্নাতের? বিবেক ও যুক্তিসম্পন্ন যে কেউই এ পার্থক্যটি উপলব্ধি করতে পারবেন।
এ সত্য সর্বজনবিদিত যে, মহানবী (ﷺ)-এর উম্মতবৃন্দ পরস্পর ভ্রাতা এবং একে অপরকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। উদাহরণস্বরূপ, একদিন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর খেদমতে উপস্থিত হন। হুজূর পূর নূর (ﷺ) তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন নিম্নোক্ত হাদীস শরীফে: “শেষ বিচার দিবসে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার বারাত তথা পরিত্রাণের ছাড়পত্র দেয়া হবে – যখনই তার সকল কর্ম পরিমাপ করা সম্পন্ন হবে। আবদুল্লাহ্ (ইবনে ওমর-রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এ পৃথিবীতেই তার বারাত পেয়ে গিয়েছে।” যখন এর কারণ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তিনি এরশাদ ফরমান: “আবদুল্লাহ্ কেবল ’ওয়ারা’ ও ’তাক্ওয়া’-সমৃদ্ধই নয়, সে যখন দোয়া করে তখন বলে: ‘হে প্রভু! আমার শরীরকে এতো বড় করে দিন যেন আমি একাই জাহান্নামকে ভরে ফেলতে সক্ষম হই। ফলে জাহান্নামকে মনুষ্য দ্বারা পূর্ণ করার ব্যাপারে আপনার ওয়াদা পূরণ হয়ে যাবে এবং রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর উম্মতের কেউই আর জাহান্নামের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরবে না।’ তার এ দোয়া দ্বারা আবদুল্লাহ্ প্রমাণ করেছে যে সে তার মুসলমান ভাইদেরকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে” (আল হাদীস)। ‘মানাকিবে চিহার ইয়ারে গুযিন’ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-ও অনুরূপ প্রার্থনা জানাতেন। এটা সন্দেহাতীত যে মুসলমানদের প্রতি হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর ভালোবাসার চেয়ে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর মহব্বত অনেক বেশি ছিল। তাঁকে খলীফা নির্বাচন না করার কারণে তিনি মুসলমানদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের সহস্র সহস্র জনকে জাহান্নামের আগুনে পুড়ে মরতে পাঠিয়েছেন বলে ধারণা-ই করা যায় না।
নিম্নোক্ত ঘটনাটি ইমাম গাযযালী (رحمة الله)-এর ’কিম্ইয়ায়ে সায়াদাত’সহ অন্যান্য গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে: তাবুকের জেহাদে এক দল সাহাবী গুরুতর আহত অবস্থায় পানির জন্যে কাতর ছিলেন। জনৈক মুসলমান ব্যক্তি পানির পাত্র সহকারে এসে তাঁদের একজনকে তা বাড়িয়ে দিলেন। তৃষ্ণার্ত সাহাবী তা গ্রহণ না করেই আরেকজন তৃষ্ণার্ত সাহাবীর কাছে দেবার জন্যে ওই মুসলমানকে অনুরোধ জানালেন। ফলে এভাবে এক সাহাবী থেকে অপর সাহাবীর কাছে পানিটুকু স্থানান্তরিত হতে থাকলো এবং শেষ পর্যন্ত কেউই পানি পান না করে শাহাদাত বরণ করলেন। এটাই ছিল হুজূর পূর নূর (ﷺ)-এর সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপ্তি। তাহলে এ কথা কীভাবে ধারণা করা যায় যে ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যিনি সমস্ত জেহাদে নিজ জীবন বিপন্ন করেছিলেন এবং হযরত মা ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর প্রিয় কন্যা ছিলেন, তাঁরা তিন খলীফা (রাঃ) ও অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন ছিলেন? এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও প্রশংসার অভিব্যক্তি নয়, বরং একটি জঘন্য ধরনের বদমাইশি ও বর্বরতা যা আয়াতে করীমা এবং হাদীস্ শরীফ দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেহেতু ওই মহান ব্যক্তিত্ববৃন্দ এ সকল বর্বর ও বদ কাজ থেকে একদম নির্মল ছিলেন, সেহেতু এ কথা স্পষ্ট যে ওই ধরনের অভিযোগগুলো দ্বীন ইসলামের শত্রুদের বানানো মিথ্যা কুৎসা ছাড়া আর কিছু নয়।
৯। — জারিয়াকে উদ্ধৃত করা হয়েছে: “আমাদের মনিব হযরত রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর বেসালের পরে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যখন দাফন-কাফন ইত্যাদি পর্ব সম্পন্ন করতে ব্যস্ত, তখন আবু বকর ও ওমর ফারুক এবং ৫/৬ জন আনসার সাহাবা সাকিফার পুত্রদের নিকুঞ্জে সমবেত হয়ে নিজেদের মধ্যে খেলাফত ভাগ-বাটোয়ারা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরিশেষে ওমর ফারুক আবু বকরের হাত ধরে বলেন, ‘আপনি-ই খলীফা হবেন।’ অন্যান্যরাও তাতে সায় দেন। অতঃপর ওমর ফারুক খোলা তরবারি হাতে মদীনার পথ-ঘাট তিন দিন যাবৎ ঘুরে বেড়িয়ে যাঁকে সামনে পেলেন তাঁকেই আবু বকরের খেলাফত বল প্রয়োগ করে মেনে নিতে বাধ্য করলেন। দ্বিতীয় দিন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে বল্লেন, “তোমাদের মধ্যে আমি-ই সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী, শ্রেষ্ঠ ও সাহসী। আমাকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করার কোনো অধিকার কি তোমাদের আছে?” অনুরূপ আরো বহু বক্তব্য পেশ করে তিনি খেলাফতের ওপর তাঁর হক-এর কথা জানালেন এবং ২০ জন ব্যক্তির সমর্থন আদায় করলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবু বকরের খেলাফতকে মেনে নেন”। (’হুসনিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থ)
জবাব: যখন হযরত রাসূলে করীম (ﷺ) বেসালপ্রাপ্ত হন, তখন সকল সাহাবায়ে কেরাম-ই শোকাহত হয়ে কর্তব্য-কর্ম সম্পর্কে দিশে হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা কী করণীয় তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। এই শোক এমনই বজ্রাঘাতের মতো আঘাত হেনেছিল যে তাঁদের কেউ কেউ বাক্ শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন; আর কেউ কেউ হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁদের চলৎশক্তি। শোক হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কেও হতবিহ্বল করেছিল, তাই তিনিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এতোই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি উম্মুক্ত তরবারি হাতে বলছিলেন, ‘যে ব্যক্তি বলবে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইন্তেকাল করেছেন, তার গর্দান থেকে মাথা আমি আলাদা করে ফেলবো।’ অপর দিকে অন্তর্ঘাতী মোনাফেকরা এই অশান্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিতে অপতৎপর হয়েছিল। এই টাল-মাটাল অবস্থা দেখে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে প্রবেশ করে মিম্বরে আরোহণ করে নিম্নোক্ত ভাষণ দেন: “ওহে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর সাহাবায়ে কেরাম! আমরা আল্লাহ্ তা’লার এবাদত-বন্দেগী করি। তিনি চিরঞ্জীব, অমর। তাঁর কখনোই পরিসমাপ্তি ঘটবে না। সুরা যুমারের ৩০ তম আয়াতে করীমায় তিনি এরশাদ করেছেন: إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ ‘হে প্রিয় রাসূল! নিশ্চয় আপনাকেও (যাহেরী জিন্দেগী থেকে) ইন্তেকাল করতে হবে’ ।[২৯]
[২৯] আল কুরআন : আয যুমার, ৩৯:৩০।
আল্লাহ্ তা’লার এই ঘোষণা অনুযায়ী আমাদের মনিব রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বেসালপ্রাপ্ত হয়েছেন।” এ ধরনের কার্যকর বক্তব্য-বিবৃতি দ্বারা হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সাহাবায়ে কেরামকে (রাঃ) উপদেশ দেন যা তাঁদের বিচলিত ভাবকে তিরোহিত করে এবং তাঁদের সম্বিৎ ফিরিয়ে আনে। বস্তুতঃ হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যিনি শ্রোতামণ্ডলীর মধ্যে ছিলেন, তিনি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে আয়াতে করীমাটি শ্রবণের পর বলেন, “আমি এই আয়াতটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলাম যার দরুন আমি মনে করেছিলাম এটা বুঝি নতুন কোনো ওহী।” হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মোনাফেকদের ফিতনা সৃষ্টি ও তা দ্বারা নিজেদের মধ্য থেকে খলীফা নির্বাচনের পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং তাই তিনি দাফন-কাফন আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি পরিত্যাগ করে সেই স্থানে গমন করেন যেখানে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) খেলাফতের সমস্যাটি নিয়ে আলোচনায় মগ্ন ছিলেন। আলোচনাশেষে উপস্থিত সকল মানুষ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতের পক্ষে রায় দেন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর বেসালের পরের দ্বিতীয় মঙ্গলবারে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম মসজিদে যান এবং হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতকে স্বীকার করে নেন। ফলে সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে খলীফা নির্বাচিত করা হয়।
আল্লাহ্ তা’লা তাঁর সকল প্রিয় বান্দাদের কাছে প্রেরিত আসমানী কেতাবেই অহঙ্কার ও ঔদ্বত্যভাবকে নিষেধ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, কুরআন মজীদের সুরা নহলের ২৩ তম আয়াতে এরশাদ হয়েছে: إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْتَكْبِرِينَ “নিশ্চয় আল্লাহতা’লা অহঙ্কারীদেরকে পছন্দ করেন না”। [৩০]
[৩০] আল কুরআন : আন নাহল, ১৬:২৩।
একটি বাইবেলীয় শ্লোক অনুযায়ী একবার হযরত ঈসা মসীহ আলাইহিস সালাম-এর হাওয়ারী তথা প্রেরিত প্রতিনিধিবৃন্দ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হে আল্লাহর পয়গম্বর! আমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ এবং কে নিকৃষ্ট?’ এ প্রশ্নের জবাবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ফরমান: ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সবচেয়ে ছোট; আর নিকৃষ্ট ব্যক্তি সবচেয়ে বড়।’ তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো, যে ব্যক্তি নিজেকে বড় ভাবে সে একজন নিকৃষ্ট ব্যক্তি; আর যে ব্যক্তি বিনয়ী, সে-ই মহান। উপরন্তু, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বহু হাদীস শরীফে এরশাদ ফরমান: “যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর খাতিরে নিজেকে অন্যান্য মুসলমানদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা না করে, তাহলে আল্লাহতা’লা তার সম্মান উন্নীত করবেন” (আল্ হাদীস)। আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদমণ্ডলী ব্যক্ত করেন যে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর জন্মগত বান্দাদেরকে জ্ঞান ও কুদরতের (ক্ষমতার) মতো তাঁর নিজস্ব প্রতিটি সিফাত (গুণ) হতে একটি অনুকণা দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। তবু তিনটি গুণ কেবল তাঁরই জন্যে খাস্ (নির্দিষ্ট)। এই তিনটি গুণের মধ্যে তিনি তাঁর কোনো সৃষ্টিকে শরীক করেন নি। এগুলো হলো কিবরিয়া, গণী এবং খালেক (স্রষ্টা)। কিবরিয়া অর্থ মহান ও শ্রেষ্ঠ। গনী অর্থ কারো মুখাপেক্ষী না হওয়া, কিন্তু সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী হওয়া। পক্ষান্তরে, তিনি তাঁর জন্মগত বান্দাদেরকে তিনটি হীন সিফাত দান করেছেন। এগুলো হলো যুল্ ও ইনকিসার, অর্থাৎ, নিচু বা হীন এবং মুখাপেক্ষী ; তৃতীয়তঃ ফানী তথা লয়প্রাপ্তি অভিমুখী। অতএব, দাম্ভিক হওয়ার অর্থ খোদা তা’লার গুণাবলীর ক্ষেত্রে সীমা লংঘন যা তাঁরই একচ্ছত্র অধিকারে।
দম্ভ জন্মগত বান্দাদের শোভা পায় না। এটা গুরুতর পাপ। একটি হাদীসে কুদসীতে খোদা তা’লা এরশাদ ফরমান: “আযামত (অহঙ্কার) ও কিবরিয়া (মহত্ত্ব) শুধু আমারই অধিকারে। مَنْ نَازَعَنِي وَاحِدًا مِنْهُمَا ، قَذَفْتُهُ فِي النَّارِ – এই দুটো গুণ যারা আমার সাথে ভাগ করে নিতে চায়, তাদেরকে আমি মর্মন্তুদ শাস্তি দেবো”।[৩১]
[৩১] আহমদ : আল মুসনাদ, ১৫:২১১ হাদীস নং ৯৩৫৯।
এ কারণেই তাসাউফের গুরুজন ও ইসলামের পণ্ডিতবৃন্দ মুসলমানদেরকে বিনয়ী হওয়ার জন্যে পরামর্শ দিয়েছেন। মুসলমানবৃন্দ স্বার্থপর হতে পারেন না। আল্লাহ্ তা’লা স্বার্থপর লোকদেরকে পছন্দ করেন না। আউলিয়াকুল-শ্রেষ্ঠ ও মুতাসাউয়ীফবৃন্দের ইমাম হযরত আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) ইরানের জিলান নগরীতে ৪৭১ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাগদাদে ৫৬১ হিজরী মোতাবেক ১১৬৬ খৃষ্টাব্দে বেসালপ্রাপ্ত হন। একদিন সৈয়দ আহমদ কবীর রেফাঈ (رحمة الله) ও তাঁর কিছু মুরীদ টাইগ্রিস (দজলা) নদীর তীরে বসেছিলেন। তাঁরা কথাবার্তা বলার মাঝখানে শায়খ রেফাঈ (رحمة الله) এমন কিছু কারামত প্রদর্শন করেন যার দরুন উপস্থিত সকলেই বিস্ময়াভিভূত হয়ে যান। কেউ একজন যখন বিস্ময়ে আত্মহারা হয়ে বে-খেয়াল অবস্থায় একটি স্তুতি বাক্য উচ্চারণ করেন, তখন হযরত আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) সবাইকে অচেতন অবস্থা থেকে জাগ্রত করেন নিম্নোক্ত বিনয়ী কথা বলে: “আমি মনে করি না যে পৃথিবীতে আমার চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো মুসলমান আছে।” হযরত শায়খ আহমদ কবীর রেফাঈ (رحمة الله) বসরা ও ওয়াসিত এলাকার মধ্যবর্তী উম্মে উবায়দা নামের একটি গ্রামে ৫১২ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫৭৮ হিজরী মোতাবেক ১১৮৩ খৃষ্টাব্দে তথায় বেসালপ্রাপ্ত হন। অতএব, এটা পরিস্ফুট যে অহঙ্কার একটি দোষ; অপর পক্ষে, বিনয় একটি মহৎ ও সুন্দর গুণ। সকল পয়গম্বরই (আ:) তাঁদের কাজ-কর্মে বিনয়ী ছিলেন। আসহাবে কেরামও (রাঃ) তাই ছিলেন। খেলাফত নির্বাচনের সময় তাঁদের একে অপরের প্রতি প্রশংসাস্তুতি এবং একে অপরকে খেলাফত গ্রহণের প্রস্তাব পেশ প্রতিভাত করে যে তাঁরা ভীষণ বিনয়ী ও সৎ ছিলেন। এই যখন অবস্থা, তখন সাহাবায়ে কেরামকে (রাঃ) উদ্দেশ্য করে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর “আমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী, মহৎ ও সাহসী আর কেউ কি আছে?”- এ কথা বলাটা তাঁর পক্ষে দাম্ভিকতা ছাড়া কিছু নয়। এটা ইবলিস (শয়তান)-এর আচরণের স্মৃতিবহ। যেহেতু হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর মতো মহান ব্যক্তিত্বের সাথে ওই ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথার কোনো সঙ্গতি নেই, সেহেতু এটা নিশ্চিত যে এগুলো খোদা তা’লার সিংহ তথা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রতি আরোপিত মিথ্যা কুৎসা ছাড়া আর কিছুই নয়। আরেকটি উদ্ভট অপবাদ হলো এই যে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে খলীফা বানানো নিশ্চিত করার জন্যে হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু না-কি সাহাবায়ে কেরামকে তরবারি দ্বারা ভীতি প্রদর্শন এবং জোর-জবরদস্তি করেছিলেন। কেননা, হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যে দুটো গোত্র বণু হাশেম ও বণু উমাইয়ার সাথে সম্পর্কিত ছিলেন, তাঁরা সাহাবায়ে কেরামের মাঝে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর আত্মীয়স্বজন তেমন একটা ছিল না।” হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর পক্ষে তলোয়ার উঁচিয়ে ওই দুটো গোত্রকে নিজ মতের অধীনে আনা একেবারেই অসম্ভব ছিল। উপরন্তু, হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ছিলেন আসাদুল্লাহ্ (খোদার সিংহ)। এমতাবস্থায় আসহাবে কেরাম (রাঃ) কেবল হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর হুমকি-ধমকির ভয়ে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর পরিবর্তে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে খলীফা নির্বাচন করেছিলেন ধারণা করাটা যুক্তির সাথেও অসঙ্গতিপূর্ণ।
কিরকুক অঞ্চলের জনৈক আলেমের কাছ থেকে আমি (শায়খ উসমান আফেন্দী) নিম্নবর্ণিত ঘটনাটি জানতে পারি; ওই আলেম বর্ণনা করেন:
একবার আমি কোনোমতে ইরানী এলাকায় গমন করি। তাদের একটি মসজিদে আমি প্রবেশ করি। একজন আলেম সেখানে ওয়ায করছিলেন। ওয়াযের এক পর্যায়ে তিনি বল্লেন, “একদিন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘরে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে কান্নারত দেখতে পেয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি সূর্যের কিরণ থেকে বাঁচার জন্যে আমার ঘরের সামনের দরজায় কিছু তক্তা জোড়া দিয়েছিলাম। খলীফা ওমর পথচারীদের ক্ষতি হবে মর্মে অজুহাত দেখিয়ে সেগুলো খুলে নামিয়ে ফেলেছেন। আমি এই অপমান সহ্য করতে পারছি না।’ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তাঁর যুলফিকার নামের তরবারিটি খাপ থেকে বের করে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে খলীফা ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খোঁজে দৌড়ে বেরিয়ে পড়েন। তবে খলীফাকে যথাসময়ে সতর্ক করার দরুন তিনি পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন।” এই পর্যায়ে ওই আলেমের জনৈক শিষ্য কথা বলার অনুমতি চেয়ে নিয়ে বল্লেন, “যদি একটি কাঠের পর্দার জন্যে হরযত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম খলীফাকে তরবারির ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন, তবে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন কেন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তরবারির ভয় দেখিয়ে সমর্থনকারী সাহাবায়ে কেরামকে (রাঃ) বিতাড়িত করতে পারলেন না? যদি তিনি তাঁর তরবারি উঁচিয়ে তাঁদেরকে পদানত করতেন, তাহলে উম্মতে মুহাম্মদী (মুসলমান সম্প্রদায়) এতোগুলো দলে এর দরুন বিভক্ত হতেন না এবং এতোজন মুসলমানও এভাবে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হতেন না।” শিষ্যের এ কথায় ওই প্রচারক এর জবাব কীভাবে দেয়া যায় তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। এরপর তিনি চেঁচিয়ে বল্লেন, “এই ব্যক্তি অবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছে। তাকে মারো, তাকে হত্যা করো!” অসহায় মানুষটির ভাগ্য ভালো ছিল যে তাকে কেবল মসজিদ থেকেই বের করে দেয়া হয়েছিল। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতের পক্ষে রায় দেয়ার জন্যে হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তরবারি বের করে সাহাবায়ে কেরামকে (রাঃ) ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেছিলেন কথাটা বলেই এ সকল লোক ক্ষান্ত হয় নি, বরং হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর বিরুদ্ধে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তরবারি বের করেছিলেন এ কথা বলার ধৃষ্টতাও তারা দেখিয়েছে।
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যেদিন তাঁর উপস্থিতি দ্বারা পরকালকে সম্মানিত ও ধন্য করেন, সেই দিন আসহাবে কেরামের (রাঃ) মাঝে সংঘটিত ঘটনাবলীকে কিছু লোক অত্যন্ত হীন ও জঘন্য কুৎসার সংমিশ্রণে বর্ণনা করে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ‘কাসাসে আম্বিয়া’ গ্রন্থের নিম্নবর্ণিত উদ্ধৃতিটিকে যথার্থ বিবেচনা করেছি, যা রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর বেসালের ঘটনা এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কর্তৃক মোকাবেলাকৃত তৎপরবর্তী ঘটনাবলী সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছে:
এগারো হিজরী সালের সফর মাসের ২৭ তম দিবসে আমাদের মনিব হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর মাথায় ব্যথা আরম্ভ হয়। তিনি মা আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর ঘরে তাশরীফ নেন। তিনি আবদুর রহমান বিন আবি বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে বলেন যে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে খলীফা নিয়োগ করার ক্ষেত্রে সুপারিশ করার জন্যে তিনি একটা লিখিত উইল (অসিয়তনামা) করতে চান এবং তিনি আবদুর রহমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে একটা দোয়াত-কলম আনতে আদেশ করেন। আবদুর রহমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই হুকুম তামিল করার জন্যে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেন, “তুমি এ কাজ পরে করো, এখন আমরা অপেক্ষা করবো।” অতঃপর তিনি মসজিদে নববীতে তাশরীফ নেন। আসহাবে কেরামও (রাঃ) খবর পেয়ে মসজিদে সমবেত হন। ফখরে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মিম্বরে আরোহণ করে তাঁর সাহাবায়ে কেরামকে উপদেশ দান করেন এবং তাঁদেরকে অনুরোধ করেন তাঁকে ক্ষমা করে দিতে, যাতে করে কখনো অসাবধানতাবশতঃ তাঁদের অন্তরে আঘাত করার কারণে তাঁদের অন্তরে দুঃখ-বেদনা না থাকে। এর পরে তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চমর্যাদার জন্যে উচ্চসিত প্রশংসা করেন এবং বলেন যে তিনি তাঁকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। এর কিছু দিন পরে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা আরো বৃদ্ধি পায়। মদীনার অধিবাসী আনসার সাহাবীবৃন্দ (রাঃ) অত্যন্ত শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা মসজিদে নববীর আশপাশে প্রপেলারের পাতের মতো ঘুরতে আরম্ভ করেন। হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর পুত্র ফযল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং আবু তালেবের পুত্র হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম এই পরিস্থিতি সম্পর্কে রাসূলে কারীম (ﷺ)-কে অবহিত করেন। দয়ালু রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এই দু’জনের কাঁধে ভর দিয়ে অতি কষ্টে হেঁটে হেঁটে মসজিদে নববীতে উপনীত হন। আসহাবে কেরামও (রাঃ) সেখানে সমবেত হন।
فحمد الله وأثنى عليه وقال: يا أيها الناس، بلغنى أنكم تخافون من موت نبيكم، هل خلد نبى قبلى فيمن بعث إليه فأخلد فيكم؟ ألا إنى لاحق بربى، وإنكم لاحقون به فأوصيكم بالمهاجرين الأولين خيرا، وأوصى المهاجرين فيما بينهم
নবী পাক (ﷺ) মিম্বরে আরোহণ করেন। আল্লাহ্ তা’লার হামদ ও সানা (প্রশংসা স্তুতি) শেষে তিনি আনসার সাহাবীদের দিকে ফিরে ঘোষণা করেন: “ওহে আমার আসহাব! আমি শুনেছি যে তোমরা আমার বেসালের ব্যাপারে চিন্তিত। কোনো নবী কি অনন্তকাল তাঁর উম্মতের সাথে অবস্থান করেছেন যে তোমরা আশা করছো আমি তোমাদের কাছে চিরকাল অবস্থান করবো? জেনে রাখো, আমি আমার রব্ব (আল্লাহ্)-কে পেতে যাচ্ছি। মোহাজির সাহাবীদের নেতৃবৃন্দকে শ্রদ্ধা করার জন্যে আমি তোমাদের প্রতি উপদেশ দিলাম।”
وأوصيكم بالأنصار خيرا، فإنهم الذين تبوؤا الدار والإيمان من قبلكم أن تحسنوا إليهم، ألم يشاطروكم فى الثمار؟ ألم يوسعوا لكم فى الديار؟ ألم يؤثروكم على أنفسهم وبهم الخصاصة؟ ألا فمن ولى أن يحكم بين رجلين فليقبل من محسنهم وليتجاوز عن مسيئهم،
অতঃপর তিনি বলেন,
“ওহে মোহাজিরবর্গ! তোমাদের প্রতি আমার উপদেশ হলো আনসার সাহাবাদের কল্যাণ সাধন কোরো। তারা তোমাদের প্রতি সদাচরণ করেছে। তারা নিজেদের ঘরে তোমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে কষ্ট হলেও তারা তোমাদেরকে নিজেদের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তারা নিজেদের সম্পত্তি তোমাদের সাথে ভাগাভাগি করেছে। যদি তোমাদের মধ্যে কেউ তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, তবে সে যেন তাদের যত্ন নেয় এবং তাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে।”
এরপর তিনি কিছু সুন্দর ও কার্যকর উপদেশ দিয়ে এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ্ তা’লা তাঁর একজন জন্মগত বান্দাকে পৃথিবীতে থাকার অথবা তাঁকে পাবার দুইটি পছন্দ দান করেছেন। জন্মগত বান্দা তাঁর প্রভুকে পাবার পথটা-ই পছন্দ করে নিয়েছেন।”
রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর এই বক্তব্য প্রতীয়মান করে যে তিনি কিছু কালের মধ্যেই বেসালপ্রাপ্ত হতে যাচ্ছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই কথার অর্থ বুঝতে পেরেই কাঁদতে শুরু করেন এ কথা বলে, “এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমাদের জীবন আপনার জন্যে কুরবান হোক!” রাসূলে আকরাম (ﷺ) তাঁকে ধৈর্য ধারণ করার আদেশ করেন। তাঁর পবিত্র নয়ন অশ্রু সজল হয়ে উঠেছিল। তিনি এরশাদ ফরমান- “ওহে আমার আসহাব! দ্বীন ইসলামের খাতিরে নিজ সম্পত্তি একনিষ্ঠভাবে উৎসর্গকারী আবু বকরের প্রতি আমি সন্তুষ্ট। পরবর্তী জগতে চলার পথে যদি কোনো বন্ধুর প্রয়োজন হয়, তবে আমি তাকেই পছন্দ করবো।” অতঃপর যে সকল সাহাবার ঘরের দরজা মসজিদে নববীর সাথে সংযুক্ত ছিল, সেগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্যে তিনি আদেশ দান করেন; শুধু হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পরে এরশাদ ফরমান:
“ওহে মোহাজির ও আনসারবর্গ! যখন কোনো বিষয়ের সময় জ্ঞাত হয়ে যায়, তখন তার জন্যে তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। আল্লাহ্ তা’লা তাঁর জন্মগত বান্দাদের কারো ব্যাপারেই তাড়াহুড়ো করেন না। যদি কেউ আল্লাহ্ তা’লার কাযা ও কদর (বিধি) পরিবর্তন ও তাঁর এরাদা (ইচ্ছা)-কে পরাভূত করতে চায়, তাহলে তিনি তাঁর গযব দ্বারা তাকে পরাস্ত ও বিধ্বস্ত করবেন। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’লাকে ধোকা দিতে চায়, তাহলে সে নিজের সাথেই প্রতারণা করবে এবং তার বিষয়াদির ওপর সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। এটা জ্ঞাত হোক যে আমি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল ও দয়াবান। আমার সাক্ষাৎ পাওয়ার নেয়ামত তোমরা আবার লাভ করবে। হাউজে কাউসার-এর জায়গায় তোমরা আবারো আমার সাক্ষাৎ পাবে। যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করার এবং আমার সাথে অবস্থান করার নেয়ামত লাভ করতে চায়, সে যেন অলস ও বে-হুদা কথাবার্তা না বলে। ওহে মুসলমান সম্প্রদায়! অবিশ্বাস (কুফর) ও অপকর্ম বা বদ-কর্ম আশীর্বাদে ঘাটতি সৃষ্টি করে এবং তা কোনো ব্যক্তির রিযিকও কমিয়ে দেয়। যদি মানুষেরা আল্লাহ্ তা’লার বিধি-বিধান মান্য করে, তবে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান, গভর্নরবৃন্দ তাদের প্রতি দয়াশীল হবেন। আর যদি তারা বদমায়েশ, অসভ্য, অবাধ্য ও পাপী হয়, তবে তাদের শাসকবর্গও দয়াবান হবে না। আমার (যাহেরী) জিন্দেগী যেমন তোমাদের জন্যে উপকারী হয়েছে, তেমনি আমার বেসালপ্রাপ্তিও উপকারী হবে। যদি অন্যায়ভাবে আমি তোমাদের কাউকে মেরে থাকি কিংবা অপমান করে থাকি, তবে তার দ্বারা বদলা নেয়ার জন্যে আমি প্রস্তুত রয়েছি। অথবা আমি যদি কারো সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করে থাকি, তাহলে সে যেন সামনে এসে তা ফেরত নেয়; আমি তা ফেরত দিতে প্রস্তুত রয়েছি। কেননা, পরকালীন শাস্তির তুলনায় এই পৃথিবীর শাস্তি অনেক কম মর্মন্তুদ। দুনিয়ার শাস্তি সহ্য করা সহজ।” অতঃপর রাসূলে খোদা (ﷺ) মিম্বর থেকে অবতরণ করেন। নামায আদায়শেষে তিনি আবার মিম্বরে আরোহণ করেন ও ওসিয়ত/উইল প্রদান করেন এবং আরো কিছু উপদেশ দেন। অবশেষে তিনি বলেন, “আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্ তা’লার কাছে সমর্পণ করলাম।” এই বক্তব্যশেষে তিনি নিজ ঘরে তাশরীফ নেন। তাঁর অসুস্থতার মাঝে যখন নামাযের আযান দেয়া হতো তখনই তিনি মসজিদে যেতেন এবং নিজে ইমাম হয়ে জামাতে নামায আদায় করতেন। বেসালের তিন দিন আগে তাঁর অসুখ চরম আকার ধারণ করে। তিনি আর মসজিদে গমন করতে পারছিলেন না। তাই তিনি আদেশ দেন, “আবু বকরকে বলো যেন সে (আমার স্থলে ইমাম হয়ে) আমার সাহাবাদের নামায পড়ায়।” রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর যাহেরী জিন্দেগীতে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইমামের দায়িত্ব নিয়ে সর্বমোট সতেরো বার নামায পড়িয়েছিলেন। হুজুর পূর নূর (ﷺ) হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে দাফন-কাফনের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। তাঁর শেষ অসুখের আগে তিনি কিছু স্বর্ণমুদ্রা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্য থেকে বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা তিনি গরিবদেরকে দান করেন, আর বাকিগুলো তিনি হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে দিয়ে দেন। রবিউল আউয়াল মাসের ১০ম দিবস, শনিবারে আল্লাহ্ তা’লা হযরত জিবরাইল আমীন আলাইহিস সালাম-কে প্রেরণ করেন তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিতে। পরবর্তী দিবস, অর্থাৎ, রোববারও জিবরাইল ফেরেশতা আলাইহিস সালাম হুজুর পূর নূর (ﷺ)-কে দেখতে আসেন এবং তিনি কেমন আছেন তা জিজ্ঞেস করেন; ফেরেশতা খোশ-খবরী (সুসংবাদ) দেন এই মর্মে যে ইয়েমেনের মিথ্যুক ও নবী দাবিদার ভণ্ড আস্ওয়াদ-ই-আনাসী নিহত হয়েছে। রাসূলে আকরাম (ﷺ) তাঁর আসহাবে কেরামকে এ শুভ সংবাদটি জানিয়ে দেন। রোববারে হুজুর পূর নূর (ﷺ)-এর অসুখ গুরুতর আকার করে। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপতি উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আগমন করেন এই সময়। নবী করীম (ﷺ) অচেতন অবস্থায় তাঁর বিছানায় শায়িত ছিলেন। তিনি উসামাকে কিছু বল্লেন না। তবে তিনি তাঁর এক হাত উঠিয়ে আদর সহকারে উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর শরীরে বুলিয়ে দিলেন। এতে বোঝা গেল যে তিনি উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে আশীর্বাদ করেছিলেন। সোমবারে ফজরের নামায যখন সাহাবায়ে কেরাম হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর ইমামতিতে মসজিদে নববীতে কাতারবদ্ধ হয়ে আদায় করছিলেন, ঠিক তখন-ই হযরত ফখরে আলম (ﷺ) মসজিদে সায়াদাতে গমন করেন। উম্মতকে কাতারবদ্ধ হয়ে নামায আদায় করতে দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি হন এবং এতে তিনি স্মিত হাস্যও করেন। তিনি নিজেও হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর ইমামতিতে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আদায় করেন। আসহাবে কেরাম (রাঃ) তাঁকে মসজিদে দেখতে পেয়ে ভাবলেন যে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গিয়েছেন এবং তাই তাঁরা আনন্দিত হলেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম হযরত মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র ঘরে প্রত্যাবর্তন করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তিনি মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর উদ্দেশ্যে ফরমালেন, “আমি আল্লাহ্ তা’লার সামনে হাজির হতে চাই কোনো দুনিয়াবী সম্পত্তি আমার পেছনে ফেলে না রেখেই। তোমার কাছে যে স্বর্ণমুদ্রাগুলো আছে, তার সবই গরিবদের দান করে দাও!” এর পরে তিনি চোখ খুলে আবারো মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে জিজ্ঞেস করেন স্বর্ণগুলো গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে কি-না। তিনি জবাবে সেগুলো বিতরণের আশ্বাস দেন। হুজুর পূর নূর (ﷺ) মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে সেগুলো তৎক্ষণাৎ বিতরণ করার জন্যে বার বার আদেশ করতে থাকেন। যখন সেগুলো তৎক্ষণাৎ বণ্টন হয়ে যায়, তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আমি এখন দায়মুক্ত।”
উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সহসা প্রত্যাবর্তন করেন। রাসূলে আকরাম (ﷺ) ঘোষণা করেন, “আল্লাহ্ তা’লা তোমাকে সাহায্য করুন। তুমি জেহাদ করতে বেরিয়ে পড়ো!” এই আদেশ পেয়ে উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর সৈন্যবাহিনীর কাছে গেলেন এবং যাত্রা করার আদেশ দিলেন।
ওই সময় রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর অসুস্থতা আরো তীব্র আকার ধারণ করলো। তিনি তাঁর পবিত্র ও প্রিয়তম কন্যা হযরত ফাতেমাতুয্ যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে ডেকে পাঠালেন। হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এলে পরে তিনি তাঁর কানে কী যেন বল্লেন। এতে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। পর মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁর কানে আবারো কী যেন বল্লেন। এবার হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হেসে উঠলেন। পরবর্তীকালে জানা গিয়েছে যে, প্রথমবার রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁকে বলেছিলেন, “আমি বেসালপ্রাপ্ত হবো।” এ কথা শুনে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা কেঁদে ফেলেছিলেন। দ্বিতীয় দফায় নবীয়ে মকবুল (ﷺ) তাঁকে বলেন, “হে আমার আহলে বায়ত! তুমি-ই সর্বপ্রথম আমার সাথে (পরবর্তী জগতে) মিলিত হবে।” এতে হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা অত্যন্ত খুশি হন এবং হেসে ওঠেন।
সেই সোমবার দিন বিকেলে জিবরাইল আমীন আলাইহিস সালাম ও আযরাইল আলাইহিস সালাম ঘরের দরজায় আগমন করেন। হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি রাসূলে কারীম (ﷺ) জানান যে আজরাইল আলাইহিস সালাম অনুমতির অপেক্ষায় ঘরের দরজায় অপেক্ষারত। হুজুর পূর নূর (ﷺ) তাঁকে ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন। হযরত আযরাইল আলাইহিস সালাম ঘরে প্রবেশ করে সালাম জানালেন এবং আল্লাহ্ তা’লার হুকুমের বিষয়টি রাসূলে করীম (ﷺ)-কে অবহিত করলেন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) জিবরাইল আমীন আলাইহিস সালাম-এর চেহারার দিকে তাকালেন। হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম বল্লেন, “এয়া রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)! মালা-ই-আ’লা আপনার অপেক্ষারত!” এতে হুজুর পূর নূর (ﷺ) ফরমালেন, “হে আযরাইল! তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো।” অতঃপর আযরাইল ফেরেশতা আলাইহিস সালাম হযরত রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর রূহ্ মোবারককে আ’লা-ই-ইল্লিয়ীনে নিয়ে গেলেন।
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর বেসালের আলামত দেখে হযরত উম্মে আয়মান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তাঁর পুত্র উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে জরুরি বার্তা প্রেরণ করেন। এই শোক সংবাদ পেয়ে উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আবু উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যবাহিনী ত্যাগ করে মসজিদে নববীতে প্রত্যাবর্তন করেন। যখন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ও অন্যান্য মহিলা কাঁদতে শুরু করেন, তখন মসজিদে নববীতে অবস্থানকারী সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) হতবিহ্বল ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত হন। হযরত উসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বাক্ শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এই সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ঘরে ছিলেন। যখন তিনি দৌড়ে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছুলেন, তখনই তিনি হুজরাহ্ আস্ সায়াদা (কল্যাণময় ঘর)-এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। ফখরে আ’লম (ﷺ)-এর পবিত্র চেহারা মোবারক উম্মুক্ত করে তিনি দেখতে পেলেন যে নবী পাক (ﷺ) বেসালপ্রাপ্ত হয়েছেন। হুজুর পূর নূর (ﷺ)-এর পবিত্র মুখমণ্ডল ও শরীর এতো পরিষ্কার এবং জ্যোতির্ময় ছিল যে তাঁকে উজ্জ্বল কোনো মণ্ডল দ্বারা পরিবেষ্টিত মনে হচ্ছিল। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বুসা দিয়ে বল্লেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ্ (ﷺ)! (যাহেরী) জিন্দেগী কিংবা বেসালপ্রাপ্ত অবস্থায় আপনি কতো সুন্দর!” তিনি প্রচুর ক্রন্দন করলেন। এরপর হুজুর পূর নূর (ﷺ)-এর চেহারা মোবারকের ওপর চাদরটি পুনরায় টেনে দিলেন। বাড়ির সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন। আসহাবে কেরামকে কিংকর্তব্যবির্মূঢ় অবস্থা থেকে তিনি উপদেশ দিয়ে ধাতস্থ করলেন এবং পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে এলো। ফলে সাহাবামণ্ডলী (রাঃ) সবাই বিশ্বাস করলেন যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বেসালপ্রাপ্ত হয়েছেন। ইত্যবসরে উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর অধীন সৈন্যবাহিনী মদীনা নগরীতে প্রবেশ করে। হযরত বুরাইদাত-ইবনে-হাসিব তাঁর হাতে ধরে রাখা পতাকাটি স্থাপন করেন। সকল সাহাবার হৃদয়কে বিরহ জ্বালা কুরে কুরে খাচ্ছিল। অশ্রু সজল নয়নে তাঁরা বিচ্ছেদের বেদনায় আপ্লুত ছিলেন।
হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, তাঁর পুত্র ফযল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও বাড়ির মানুষেরা দাফন-কাফনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন এবং শেষকৃত্য কার্যে সাহায্য করছিলেন। কিন্তু শোক ও আহাজারি তো উদ্দেশ্য সাধন করবে না। দ্বীন ইসলামের হুকুম জারি ও মুসলমানদের বিষয়াদির তদারকির জন্যে একজন খলীফার তখন বিশেষ প্রয়োজন। ওই সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-ই ছিলেন এই কাজের জন্যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।
হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়। তবু সরকারে কায়নাত (ﷺ) হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কেই সকল সাহাবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করেছেন, যাঁকে তিনি হিজরতের সময় সাথী করেছিলেন। তাঁর অসুস্থতার সময় যখন তিনি তাঁর সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, তখন তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কেই বেশি পছন্দ করেন। তিনি মসজিদে নববীতে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছাড়া বাকি সবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বেসালের তিন দিন আগে তিনি সকল সাহাবার নামায পড়াবার জন্যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে ইমাম নিয়োগ করেছিলেন, যা দ্বীন ইসলামের একটি মৌলভিত্তি। এ সব ঘটনা প্রতীয়মান করে যে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কেই খলীফা হিসেবে পছন্দ করা হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম একজোট হয়ে তাঁকে নির্বাচিত করাই বাকি ছিলমাত্র।
অপর দিকে কিছু আনসার সাহাবী তাঁদের নিজেদের মধ্য থেকে খলীফা নির্বাচনে প্রবৃত্ত হন। বনী সায়েদার ঝোপ-ঝাড় আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁরা সমবেত হন। সাদ ইবনে উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যিনি খাযরাজ গোত্রের প্রধান ছিলেন, তিনি অসুস্থ অবস্থায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি আনসার সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বল্লেন:
“ওহে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা যে গুণাবলীর অধিকারী তা অন্য কোনো গোত্র ধারণ করে না। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মক্কা নগরীতে তেরোটি বছর তাঁর গোত্রকে ইসলাম ধর্মের দিকে আহবান করেছিলেন। তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই তাঁকে বিশ্বাস করেছে। আর যারা তাঁকে বিশ্বাস করেছে, তারা জেহাদ করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক ছিলেন না। আল্লাহ্ তা’লা যখন তোমাদেরকে মুসলমান হওয়ার সম্মান দান করেন, তখন তিনি তোমাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ও তাঁর আসহাবকে (রাঃ) রক্ষা করার এবং জেহাদ দ্বারা দ্বীন ইসলামকে প্রচার-প্রতিষ্ঠা করার সৌভাগ্যও দান করেন। তোমরাই শত্রুদেরকে পরাভূত করেছো। তোমাদের তরবারির ভয়েই আরবের কৃষকেরা মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার আগে তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এখন নেতৃত্ব করার অধিকার তোমাদেরই রয়েছে। এই অধিকার তোমরা অন্য কাউকে দেবে না।”
অধিকাংশ আনসার সাহাবী (রাঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন; তাঁরা সবাই বল্লেন, “আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা আপনাকে খলীফা নির্বাচন করলাম, আল্লাহ্ আপনাকে সাহায্য করুন!” কিন্তু আনসারদের (রাঃ) মধ্যে আউস্ গোত্র একে পছন্দ করলেন না। তাঁরা তাঁদের নেতা উসাইয়াদ ইবনে হুদাইরের আশপাশে সমবেত হলেন।
অপর দিকে মুহাজির সাহাবী-মণ্ডলীও (রাঃ) আনসারের (রাঃ) দুইটি গোত্র থেকে খলীফা নির্বাচনকে পছন্দ করেন নি। কেননা, সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডে কোরাইশ গোত্র-ই ছিল সবচেয়ে অভিজাত ও মহাসম্মানিত। তাই মুসলমানদের মধ্যে বড় ধরনের একটা বিতর্ক অত্যাসন্ন হলো।
এমনি একটি সংকটময় মুহূর্তে জীবন রক্ষক হযরত খাজা খিজির আলাইহিস সালাম-এর মতো হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আবু উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বিতর্ক স্থানে উপস্থিত হন। সেই সময় জনৈক আনসার উঠে দাঁড়িয়ে ভাষণ দান করছিলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে সাহায্য করেছি। মোহাজিরদেরকে আশ্রয় দিয়েছি। খলীফা আমাদের মধ্য থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।”
পক্ষান্তরে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) সব সময়ই তাঁর ডানে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও বাম পাশে হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে রাখতেন। হযরত আবু উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে তিনি বলতেন, “এই উম্মতের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি।” যখন এই তিনজন একত্রে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন, তখন মনে হলো যেন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-ই পুনরুত্থিত হয়ে আগমন করেছেন। সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাঁদের বক্তব্য শ্রবণের অপেক্ষায় রইলেন। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বল্লেন:
“এই উম্মতের লোকেরা ইতিপূর্বে মূর্তি পূজা করতো। আল্লাহ্ তা’লা তাদের মাঝে একজন রাসূল (ﷺ) প্রেরণ করেন যাতে তারা আল্লাহর-ই এবাদত করেন। কাফেররা নিজেদের পিতৃপুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করাকে কষ্টকর মনে করেছিল। আল্লাহ্ তা’লা মোহাজিরদেরকে ঈমানদার তথা বিশ্বাসী হওয়ার সম্মান নসীব করেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাথী ও দুঃখের ভাগীদার হয়ে যান। দ্বীনের শত্রুদের অত্যাচার-নিপীড়ন তাঁরা তাঁর সাথে ভাগাভাগি করে সহ্য করেন। তাঁরাই হক্ক সোবহানাহু ওয়া তা’লার প্রাথমিক এবাদতকারী। এ কারণেই খলীফা তাঁদের মধ্য থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে তাঁদের অংশীদার কেউই হতে পারে না। তাদের এ অধিকার হরণ করা নিষ্ঠুর আচরণ হবে নিঃসন্দেহে। ওহে আনসার! দ্বীন ইসলামের প্রতি তোমাদের খেদমতকেও অস্বীকার করা যায় না। আল্লাহ্ তা’লা তাঁর নবী (ﷺ) এবং দ্বীনকে সাহায্য করার জন্যে তোমাদের পছন্দ করে নিয়েছেন। তিনি তাঁর রাসূল (ﷺ)’কে তোমাদের মাঝে প্রেরণ করেছেন। প্রাথমিক মোহাজির হওয়ার সম্মান লাভকারীদের পরে তোমাদের চেয়ে অধিক মূল্যবান আর কেউ নেই। তোমরা-ই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)’কে অনুসরণ করেছো। তাঁকে সাহায্য করার গর্ব ও সম্মান তোমাদের-ই প্রাপ্য। কেউই এতে দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না। তবুও সমস্ত আরববাসী কুরাইশ বংশীয় কাউকে খলীফা পদে অধিষ্ঠিত দেখতে চায়, আর কাউকেই তারা দেখতে চায় না। কেননা, সবাই জানে যে বংশ-মর্যাদা ও গুণাবলীতে কুরাইশ বংশই আরবীয়দের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আর তাদের ভূমিও আরবের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। আমাদেরকে আমীর তথা আদেশকর্তা হতে দাও, তোমরা হবে আমাদের উজির ও উপদেষ্টা। তোমাদের উপদেশ ও পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত বা কাজ করা হবে না।”
অতঃপর হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বল্লেন, ‘ওহে আনসার সম্প্রদায়! রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁর অসুখের সময় তোমাদের জিম্মাদারী আমাদের কাছে ন্যস্ত করেছেন। যদি তোমরা হুকুম দেয়ার পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার অবস্থায় থাকতে, তাহলে আমাদেরকে তিনি তোমাদের জিম্মাদারীতে রেখে যেতেন।”
এ সব কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কী বলবেন তা বুঝতে না পেরে গভীর চিন্তামগ্ন হলেন। তাঁদের মধ্যে হোবাব বিন মুনযির উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করলেন, “আমাদের থেকে একজন এবং তোমাদের থেকে একজন আমীর নির্বাচন করা যেতে পারে।” এতে হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জবাব দিলেন, “একই সময়ে দুইজন আমীর থাকতে পারেন না। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর একই গোত্রভুক্ত না হলে আরবীয় সর্বসাধারণ খলীফাকে গ্রহণ কিংবা মান্য করবেন না। হোবাব এর প্রতিবাদ জানিয়ে বল্লেন, “হে আনসার! আরবীয় সর্বসাধারণ তোমাদের তরবারির মাধ্যমে এই ধর্মকে গ্রহণ করেছে। তাই এ অধিকার থেকে কেউ যেন তোমাদেরকে বঞ্চিত না করতে পারে!”
উবায়দা ইবনে জাররাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হুঁশিয়ার করলেন এ কথা বলে, “হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা-ই এ দ্বীনের প্রারম্ভিক খেদমতগার। সতর্ক হও যাতে তোমরা এর প্রথম বিনষ্টকারী না হও!” এ ধরনের বাদানুবাদের মুহূর্তে বশীর ইবনে সা’দ বিন নু’মান বিন কা’ব বিন খাজরাজ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নামের খাজরাজ গোত্রভুক্ত জনৈক আনসার সাহাবী উঠে দাঁড়িয়ে বল্লেন, “ওহে মুসলমানবৃন্দ! হযরত রাসূলে খোদা (ﷺ) কুরাইশ গোত্রভুক্ত। তাই খলীফা তাদের মধ্য থেকে হওয়াই যথাযথ। এটাই সঠিক হবে। হ্যাঁ, আমরাই প্রাথামিক পর্যায়ে মুসলমান হয়েছিলাম। ইসলামের খেদমতে নিজেদের জান-মাল কোরবানি করার সম্মান আমরাই লাভ করেছি। অথচ আমরা তা করেছি এ কারণে যে, আমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)’কে ভালোবাসি। আমরা এ খেদমতের বিনিময়ে কোনো বৈষয়িক প্রতিদান প্রত্যাশা করি না।” হোবাব জিজ্ঞেস করলেন, “হে বশীর! তুমি কি তোমার জেঠাত ভাইয়ের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ?” জবাবে বশীর বল্লেন, “আল্লাহর নামে শপথ, আমি মোটেই ঈর্ষাপরায়ণ নই। আমি শুধু কুরাইশদের হক্কের (অধিকারের) ওপর কারো পদদলন দেখতে চাই না।”
ওই সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বল্লেন, “আমি এই দুইজন ব্যক্তিকে মনোনীত করছি তোমাদের জন্যে, তাদের যে কাউকে তোমরা পছন্দ করতে পারো।” তিনি হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখিয়ে এ কথা বল্লেন। কিন্তু তাঁরা উভয়ই পিছু হটে গিয়ে বল্লেন, “রাসূলে খোদা (ﷺ) যাঁকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন তাঁর মোকাবেলায় কে দাঁড়াতে পারে? এতে উচ্চস্বরে তর্ক-বিতর্ক আরম্ভ হলো এবং বিশৃংখলা দেখা দিলো।
এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আবু বকর (ﷺ)-কে উদ্দেশ্য করে বল্লেন, ”রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আপনাকে নামাযে তাঁর খলীফা নিয়োগ করেছিলেন যা ইসলামের ভিত্তিস্তম্ভ। তিনি আপনাকে আমাদের সামনে স্থান দিয়েছেন। আপনার হাত সামনে বাড়ান। আমি আপনাকে খলীফা হিসেবে পছন্দ করেছি। হযরত উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-ও অনুরূপ করতে যখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এমনি সময়ে বশীর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সামনে লাফিয়ে পড়ে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর হাত মোবারক ধরলেন এবং সবার আগে আনুগত্যের বায়াত হলেন। তিনি বল্লেন, “আপনি-ই আমাদের নতুন খলীফা।” হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-ও আনুগত্যের বায়াত হলেন। সমগ্র আউস গোত্র ও তার নেতা উসাইয়াদ ইবনে হুদাইর এসে নতুন খেলাফতকে মেনে নিলেন। তাঁদেরকে দেখে খাজরাজ গোত্র-ও আনুগত্যের বায়াত হলো।
যদি আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং আবু উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওই সময় ঘটনাস্থলে না পৌঁছুতেন, তবে সা’দ ইবনে উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে খলীফা হিসেবে মেনে নেয়া হতো, যা আউস্ ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জন্ম দিতো। অপর দিকে কুরাইশ গোত্র-ও এর বিরোধিতা করতো যার দরুন মুসলমান সম্প্রদায় বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়তো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই বিপদ দূর করে দেন। তাঁর খলীফা হওয়ার ফলে ইসলাম একটা বড় ধরনের সংকট থেকে রক্ষা পায় এবং মুসলমান সম্প্রদায়ও দ্বিধা-বিভক্তি থেকে বেঁচে যায়।
সোমবার দিন খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পরে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মঙ্গলবার দিন মসজিদে নববীতে গমন করেন এবং সেখানে সমস্ত সাহাবায়ে কেরামকে সমবেত করেন। মিম্বরে আরোহণ করে তিনি প্রথমে হামদ ও সানা পাঠ করেন এবং তার পরে এই ভাষণটি দেন: “ওহে মুসলমান সম্প্রদায়! আমি তোমাদের শাসনকর্তা ও রাষ্ট্রপতি হয়েছি। তবু আমি তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নই। যদি আমি ভাল কাজ করি, তাহলে আমাকে সাহায্য করো। আর যদি আমি ভুল করি, তবে আমাকে সঠিক পথপ্রদর্শন করো। সংশোধন করাটা বিশ্বস্ততা। মিথ্যা বলাটা বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের মধ্যে দুর্বল ব্যক্তি আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। আমি তার হক্ক বা অধিকার সংরক্ষণ করবো। আর যে ব্যক্তি নিজ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, সে আমার কাছে দুর্বল। কেননা, আমি তার দ্বারা হরণকৃত অন্যান্যদের অধিকার তারই কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসবো, ইনশা’আল্লাহ্ তা’লা। তোমাদের কেউই যেন জিহাদকে অবহেলা না করে। যারা জেহাদ পরিত্যাগ করবে, তারা ঘৃণিত হয়ে যাবে। আমি যতোক্ষণ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)’কে মান্য করবো, শুধু ততোক্ষণই তোমরা আমাকে মান্য করবে। যদি আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)’কে অমান্য করি এবং সত্য, সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হই, তবে আমাকে অনুসরণ করার আর কোনো দরকার-ই তোমাদের থাকবে না। উঠে দাঁড়াও, আমরা এক সাথে নামায আদায় করবো। আল্লাহ্ তা’লা তোমাদের সকলকে আশীর্বাদধন্য করুন।”
অতঃপর তাঁরা রাসূলে করীম (ﷺ)-এর শেষকৃত্য সংক্রান্ত সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত দলে দলে নারী, পুরুষ, শিশু ও গোলাম-বর্গ সকলে ওই ঘরে প্রবেশ করে জামাত ব্যতিরেকেই কেবল ব্যক্তিগতভাবে সালাত-সালাম পাঠ করে বেরিয়ে আসেন। বুধবার রাতের অন্ধকারে তাঁরা মহানবী (ﷺ)’কে ওই ঘরে সমাধিস্থ করেন।
’কাসাস-এ-আম্বিয়া’ গ্রন্থের ৪১০ পৃষ্ঠায় আরো লেখা আছে:
রাসূলে খোদা (ﷺ) যতোদিন তাঁর যাহেরী জিন্দেগীতে ছিলেন, ততোদিন ওহী (ঐশী প্রেরণা) তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং উম্মত তথা মুসলমান সম্প্রদায়ও আল্লাহ্ তা’লার বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছিলেন। তাঁর বেসালের পরে আর ওহী অবতীর্ণ হয় নি। তবু অধিকাংশ সাহাবা-ই (রাঃ) কুরআন মজীদকে তাঁদের স্মৃতিতে গেঁথে ফেলেছিলেন। আর যে সব বিষয় কুরআন মজীদে প্রকাশ্যভাবে ব্যাখ্যা করা হয় নি তা সুন্নাতে সানিয়্যা তথা রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর কথা, কাজ ও তাঁর সম্মতিতে অন্যদের কৃত কর্মের অনুসরণে সম্পাদিত হচ্ছিল। তবে সুন্নাতে সানিয়্যা ও হাদীস শরীফগুলো সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) স্মৃতিপটে পুরোপুরিভাবে আঁকা ছিল না। কেননা, তাঁদের কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন ব্যবসা-বাণিজ্যে; আর কেউ কেউ তদারকি করছিলেন তাঁদের খেজুর বাগান ও ক্ষেত-খামার। এমতাবস্থায় তাঁদের পক্ষে মহানবী (ﷺ)-এর সমস্ত সোহবত লাভ করা সম্ভব হয় নি। যাঁরা কোনো একটি সোহবত পেতেন, তাঁরা অন্যান্যদের সে সোহবতে শ্রুত বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত করতেন। ফলে হাদীস শ্রবণ করেন নি এমন ব্যক্তি ওগুলোর শ্রোতাদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে জানতে সক্ষম হতেন। বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে সমাধিস্থ করতে সাহাবায়ে কেরামকে (রাঃ) অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস্ শরীফকে অনুসরণ করেই তাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যে ঘরে বেসালপ্রাপ্ত হন সেখানে তাঁকে সমাধিস্থ করেন। অনুরূপভাবে, তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তাঁরই রেখে যাওয়া সম্পত্তি বণ্টন করার ক্ষেত্রেও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) প্রচুর কষ্ট স্বীকার করেন। আবারো হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-ই নিম্নোক্ত হাদীসটি উদ্ধৃত করেন: “আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিস সালাম কোনো উত্তরাধিকার রেখে যান না”। ফলে এই হাদীস অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মুসলমান সম্প্রদায়ের মাতা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বেসালপ্রাপ্ত হন, তখন মোনাফেকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আরবীয়রাও ইসলামদ্রোহী হয়ে যায়। আনসারবৃন্দ (রাঃ) এর থেকে দূরে সরে থাকেন। আমার পিতার ওপরে যে বোঝা বা মসিবত এসে পড়ে তা পাহাড়ের ওপরে পড়লে নিশ্চয় পাহাড় চুরমার হয়ে যেতো। এমনি ছিল অবস্থা, যেখানে বিভেদ-বিভক্তি দানা বাঁধতো সেখানেই আমার পিতাকে উপস্থিত হতে হতো এবং তা মিটমাট করে দিতে হতো।”
যখন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এমন কোনো বিষয়ের সম্মুখীন হতেন যা তাঁদের অজ্ঞাত, তখন তাঁরা সুন্নাতে সানিয়্যাতে এর সমাধান খুঁজতেন। যদি সমাধান তাতে না পাওয়া যেতো, তবে তাঁরা রায় (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) কিংবা কেয়াস্ (তুলনা দ্বারা অনুসন্ধান) পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ, তাঁদের জ্ঞাত কোনো বিষয়ের সাথে কেয়াস বা তুলনা করে অজ্ঞাত বিষয়াটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতেন। এটাই এজতেহাদের দ্বার উম্মুক্ত করে। যদি আসহাবে কেরাম (রাঃ) ও অন্যান্য মুজতাহিদদের এজতেহাদ কোনো বিষয়ে একমত হতো, তবে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকতো না। এজতেহাদের এই ঐকমত্যকে এজমায়ে উম্মত বলে। এজতেহাদ প্রয়োগের জন্যে প্রয়োজন ছিল গভীর জ্ঞানী হওয়া। এই গভীর জ্ঞানী আলেমদেরকেই মুজতাহিদ বলে। যদি মুজতাহিদদের কৃত এজতেহাদ একে অপরের সাথে না মিলতো, তবে প্রত্যেক মুজতাহিদের জন্যে নিজ এজতেহাদ অনুসরণ করা ওয়াজিব হতো।
খেলাফতের নির্বাচনটিও এজতেহাদের বিষয় ছিল। এমন কিছু হাদীস্ শরীফ ছিল যেগুলোতে ঘোষিত হয়েছিল যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উসমান যিন্নুরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং শেরে খোদা হযরত আলী মোরতজা কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম খলীফা হবেন। কিন্তু তাঁদের খেলাফতের সময়কাল স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয় নি। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এ কথা বলেন নি, “আমার বেসালের পরে অমুককে খলীফা নিয়োগ করো।” তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন। খেলাফতের নির্বাচনে আসহাবে কেরাম (রাঃ) কর্তৃক কৃত এজতেহাদ একে অপরের সাথে মিলে নি। এ ক্ষেত্রে তিনটি ভিন্ন প্রকৃতির এজতেহাদ ছিল:
প্রথমটি ছিল আনসারদের (রাঃ) রায়; তাঁরা বলেন যে, “ইসলামের সর্বাধিক খেদমতকারী ব্যক্তি-ই হবেন খলীফা। আরবীয় সম্প্রদায় আমাদের তরবারির ছায়ায় মুসলমান হয়েছিলেন। তাই খলীফা আমাদের মধ্য থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।”
দ্বিতীয় প্রকৃতির এজতেহাদ ছিল অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামের গৃহীত পদ্ধতি; তাঁরা বলেন যে, “খলীফাকে উম্মতের মাঝে বিধি-বিধান প্রয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। আরবীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও ক্ষমতাশালী গোত্র ছিলো কুরাইশ। তাই খলীফা কুরাইশ গোত্রভুক্ত হওয়াই উচিৎ।”
তৃতীয় প্রকার এজতেহাদ ছিল হাশেমীদের (রাঃ) রায়; তাঁরা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর আত্মীয়স্বজনদের মধ্য থেকেই খলীফা নির্বাচন করতে হবে।
তিনটি এজতেহাদের মধ্যে সঠিক এজতেহাদটি ছিল দ্বিতীয়টি। হ্যাঁ, আনসার সাহাবাবৃন্দ (রাঃ) দ্বীন ইসলামের ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিয়েছিলেন সত্য। অপর দিকে রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর আত্মীয়স্বজনের মর্যাদার ব্যাপারটিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবুও খেলাফত তো ছিল না কোনো আরাম কেদারা যা অতীতের খেদমতের জন্যে উপহারস্বরূপ দেয়া যেতো। এটা ওয়ারিশী সম্পত্তিও ছিল না যে ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া যেতো। দ্বিতীয় এজতেহাদটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুরাইশের হাতে খেলাফত ন্যস্ত করা হয় এ কারণে নয় যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ওই গোত্রভুক্ত, বরং এ কারণেই যে সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডে কুরাইশ গোত্র ছিল সম্মান, ক্ষমতা, প্রভাব ও মর্যাদার জন্যে সুপ্রসিদ্ধ। কেননা, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য, বিশ্বস্ততা ও সামাজিক শৃংখলা বিধান করার জন্যেই খেলাফতের কার্যকারিতা ছিল। আর এ কাজ করতে কর্তৃত্বের প্রয়োজন ছিল। খলীফার কর্তব্য হলো ফিতনা-ফ্যাসাদ ও বিদ্রোহ দমন/প্রতিরোধ করা, শান্তি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, জেহাদ পরিচালনা করা এবং শৃংখলা বজায় রাখা, যাতে মুসলমান সমাজ তাঁদের বিষয়াদি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সহজে সুসম্পন্ন করতে সক্ষম হন। এগুলো করতে ক্ষমতার প্রয়োজন।
খেলাফত নির্বাচনে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) যে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন, তা হলো মুসলমান গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন। কুরাইশ গোত্রের দশটি শাখার একটি হাশেমী গোত্রকে করা সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় যতো অধিক সংখ্যক মানুষ জড়িত হবে, ততোই শক্তিশালী হবে সরকার। এই কারণেই কুরাইশ গোত্রের নেতৃস্থানীয় কাউকে নির্বাচন করা জরুরি ছিল। আর নির্বাচিত ব্যক্তিকে কেবল গোত্রীয় পরিচয় ও বংশ মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ হলে চলবে না, বরং ইসলামের দৃষ্টিতেও উচ্চ মকামের অধিকারী হতে হবে। কুরাইশ গোত্রের মধ্যে তখন শ্রেষ্ঠ ছিল বনী উমাইয়া বংশ এবং তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবু সুফিয়ান ইবনে হরব। তবু ওহুদ জেহাদে মুসলমানদের প্রতি তাঁর দ্বারা কৃত ক্ষতি তখনো একদম বিস্মৃত হয় নি। ইতিমধ্যে তিনি একজন খাঁটি ও দৃঢ় বিশ্বাসী মুসলমানে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু অন্যান্য মুসলমান তাঁকে পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে পারেন নি। ফলে হিজরতের সময় গুহাতে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাথী, প্রাথমিক সময়কার মুসলমান ও অন্যান্যদেরকে মুসলমান হতে উদ্বুদ্ধকারী এবং রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ইমাম হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর সমকক্ষ আর কেউই ছিলেন না। সবাই তাঁর পক্ষে রায় দেবেন এটাই ছিল নিশ্চিত। উপরন্তু, যেহেতু খলীফা নির্বাচনে সকল সাহাবা (রাঃ) ঐক্যবদ্ধভাবে সমর্থন করাটা ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সেহেতু আনসার সাহাবাদের (রাঃ) নিজেদের মধ্যে খলীফা নির্বাচনের প্রচেষ্টা বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতো। অতএব, হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এই বিপদকে মোকাবেলা করে মুসলমান সমাজকে মহা একটা ফিতনা থেকে রক্ষা করেন।
এই সময় হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তাঁর স্ত্রী হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর ঘরে অবস্থান করছিলেন। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর মেয়ের জামাই যুবাইর, মিকদাদ, সালমান, আবু যর এবং আম্মার ইবনে ইয়াসের (রাঃ) প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের এজতেহাদ তৃতীয় দলটির সাথে মিলে যায়। তাই হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে এসে হাত বাড়িয়ে তাঁর খেলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছিলেন যে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলীফা হয়ে গিয়েছেন, তাই তিনি এই প্রস্তাব অস্বীকার করেন। আবু সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আপনার হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আনুগত্য স্বীকার করবো। যদি আপনি ইচ্ছা করেন, তবে আমি সর্বত্র অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেবো।” হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম এ প্রস্তাবকেও নাকচ করে দেন এ কথা বলে, “ওহে আবু সুফিয়ান! ইসলামী জাতির মধ্যে কি আপনি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চান?”
অতএব, এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে মুসলমানদের মধ্যে একটা সম্ভাব্য ফিতনা বা বিবাদের ব্যাপারে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম উভয়ই শঙ্কিত ছিলেন। প্রথমাবস্থায় সাকিফার ঝোপ-ঝাড়ের আশ্রয়কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে না ডাকার কারণে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম একটু ব্যথিত হয়েছিলেন। হযরত মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী (رحمة الله)-এর “মুসামারাত” গ্রন্থে এবং হামিদ বিন আলী ইমাদী (১৭৫৭ খৃষ্টাব্দ)-এর “দাও’উস্ সাবাহ্” গ্রন্থে কৃত ব্যাখ্যানুযায়ী, হযরত আবু উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যে ঘরে অবস্থান করছিলেন, সেখানে গমন করেন। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত বক্তব্য-বিবৃতি তিনি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কাছে বর্ণনা করেন [এ সকল দীর্ঘ ও কার্যকর ভাষণ ’কাসাসে আম্বিয়া’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে]। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম সেগুলো মনোযোগ সহকারে শোনেন। এ সব বক্তব্য এতো আকর্ষণীয় ছিল যে, তা তাঁর মজ্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার অনুভূতি তিনি লাভ করেন। তিনি বল্লেন, “ওহে আবু উবায়দা! খলীফা হওয়ার উদ্দেশ্যে কিংবা ’আমর-ই-মা’রূফ’ (সৎ কাজের আদেশ)-এর প্রতিবাদ করার জন্যে অথবা কোনো মুসলমানকে সমালোচনা করার খেয়ালে আমি এ ঘরের কোণায় বসি নি। রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর বিচ্ছেদ জ্বালায় আমার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে এবং আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছি।” পরবর্তী সকালে তিনি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে সবাইকে অতিক্রম করে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র কাছে গিয়ে আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তার পর বসে পড়েন। খলীফা তাঁকে বলেন, “আপনি আমাদের কাছে পবিত্র ও সম্মানিত। যখন আপনি রাগান্বিত হন, তখনো আল্লাহকে ভয় করেন। যখন আপনি খুশি হন, তখন খোদা তা’লাকে ধন্যবাদ জানান। আল্লাহ্ প্রদত্ত পদমর্যাদার অতিরিক্ত কিছু দাবি যে ব্যক্তি করেন না, তিনি কতো মহান ও সৌভাগ্যবান! আমি খলীফা হতে চাই নি। তবু আমাকে তা গ্রহণ করতে হয়েছে পাছে কোনো ফিতনা জাগ্রত হয়। এ দায়িত্ব পালনে আমার বিশ্রাম নেই। আমার ওপর একটা ভারী বোঝা ন্যস্ত করা হয়েছে। এটা বহন করার শক্তি আমার নেই। আল্লাহ্ আমায় শক্তি দান করুন! আল্লাহ্ তা’লা আপনার কাঁধ থেকে এই বোঝা নামিয়ে দিয়েছেন। তাই আপনাকে আমাদের প্রয়োজন। আমরা আপনার শ্রেষ্ঠত্ব ও উন্নত গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।”
হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, খেলাফতের জন্যে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অন্যান্যদের চেয়ে অধিক যোগ্য ছিলেন। তাঁরা আরো বলেন যে খলীফা নির্বাচন সম্পর্কে তাঁদেরকে না জানানোর জন্যে তাঁরা প্রথমাবস্থায় দুঃখিত হলেও পরে তাঁরা এর দরুন অনুতপ্ত হন। খলীফা তাঁদের ক্ষমা করেন। অতঃপর হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম মসজিদে নববী থেকে প্রস্থানের অনুমতি চেয়ে উঠে দাঁড়ান। হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বিনয় সহকারে বিদায় দেন। বিদায় নেয়ার মুহূর্তে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম বলেন, “আমার এখানে আসায় দেরি হওয়াটা খলীফার বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে নয়; আর এখন এখানে আসাটাও ভয় হতে নিঃসৃত নয়।” সকল হাশেমী হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে খলীফার আনুগত্য স্বীকার করে নেন। ফলে একটা মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
খেলাফত নির্বাচনের পুরো সময় হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম উভয়ই অত্যন্ত তৎপর এবং জ্ঞানসমৃদ্ধ ভূমিকা পালন করেন। সাকিফার ঝোপ-ঝাড়ের আশ্রয় কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সভায় সেই দিন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে না ডাকাটাই সৌভাগ্যময় ছিল। কেননা, তিনি যদি সেই দিন ওখানে থাকতেন, তবে হাশেমীদের অংশগ্রহণ দ্বারা আনসার ও মুহাজিরদের তর্ক-বিতর্ক দ্বিগুণ আকার ধারণ করতো, যার দরুন পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যেতো। খেলাফত নির্বাচন সংক্রান্ত এজতেহাদগত পার্থক্য সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য করা উচিৎ নয়। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) হলেন শ্রেষ্ঠ মুসলমান। তাঁদের প্রত্যেকেই নক্ষত্র সমতুল্য যা মানুষদেরকে হেদায়াত দানে সক্ষম । তাঁদের কাছ থেকেই কুরআন মজীদের অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকেই শত-সহস্র হাদীস শ্রুত হয়েছে। আর তাঁদের মাধ্যমেই আল্লাহ্ তা’লার আদেশ-নিষেধ শিক্ষা করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাকে তাঁদের আচরণ যাচাইয়ের মানদণ্ড বানানো আমাদের জন্যে অশোভনীয় হবে। হ্যাঁ, ভুল করা মানুষেরই স্বভাব। মুজতাহিদবৃন্দ-ও ভুল করতে পারেন। কিন্তু মুজতাহিদ-মণ্ডলী ভুল করলেও সওয়াব পেয়ে থাকেন; ভুল না করলে দশটি এবং ভুল করলে একটি সওয়াব পান।
প্রত্যেক সাহাবী-ই (রাঃ) দ্বীন ইসলামের স্তম্ভ। তাঁদের মধ্যকার মতভেদসমূহ তাঁদের এজতেহাদ হতে নিঃসৃত ছিল। একে অপরকে সমালোচনা করলেও তাঁরা একে অপরের মূল্যায়ন-ও করতেন। যদি হযরত যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে ব্যক্তিগত পছন্দকে অগ্রাধিকার দিতেন, তাহলে তিনি তাঁর শ্বশুর হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে দ্বিমত পোষণ করতেন না। খেলাফত নির্বাচনে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থক ছিলেন হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। আবার তিনি-ই হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। একদিন তিনি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে একটা প্রশ্ন করেন এবং হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তার উত্তর দেন। এতে হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর অনুপস্থিতিতে জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া থেকে আমি আল্লাহর হেফাযত চাই।” হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম সব সময় বলতেন, “রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর পরে এই উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে উপকারী হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।”
খেলাফত নির্বাচনের এক মাস পরে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মিম্বরে আরোহণ করেন এবং বলেন, “আমি এই খলীফার দায়িত্ব হতে পদত্যাগ করতে চাই। যদি রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে আমাকে তোমরা দেখতে চাও, তবে তা সম্ভব নয়। কারণ, শয়তান তাঁর কাছে আসতে পারতো না। উপরন্তু, তাঁর প্রতি ওহী (ঐশী প্রত্যাদেশ) নাযেল হতো।” প্রিয় পাঠক! এ ধরনের মহান ব্যক্তিত্বদের হৃদয়ে কি রাষ্ট্রীয় পদ ও ক্ষমতার মোহ বিরাজ করতে পারে? তাঁদের প্রতি বিষোদগার করা কি কোনো জিহ্বার পক্ষে শোভনীয়?
প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তাঁর পিতার বিচ্ছেদ বেদনায় এতোই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে তিনি ঘর থেকে বেরোতে পারেন নি। এমতাবস্থায় হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম’কেও বাসায় থাকতে হয়েছে তাঁকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে। তাই তিনি ঘন ঘন খলীফার সোহবতে যেতে পারেন নি। তবে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র বেসালপ্রাপ্তির পরে তিনি খলীফার দরবারে গমন করতেন এবং তাঁকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন।
’কাসাসে আম্বিয়া’ হতে উদ্ধৃত উপরোক্ত ঘটনাবলীর বর্ণনা প্রমাণ করে যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও অপর ছয় জন সাহাবী (রাঃ) হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন নি মর্মে শিয়া অভিযোগটি ভিত্তিহীন। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে না মেনে সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) ঐকমত্যের বিরোধিতা করা ও এ সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করা শুধু ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণই নয়, বরং তা সাহাবায়ে কেরামকে (রাঃ) প্রদত্ত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর এই আদেশটিরও খেলাফ যা ঘোষণা করে- “ঐক্যবদ্ধ হও এবং মতবিরোধ এড়িয়ে চলো” (আল হাদীস)। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও ছয়জন সাহাবী (রাঃ) এবং নারীকুলশ্রেষ্ঠা মা ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এই আদেশ মান্য করেন নি ও দ্বীন ইসলামকে অমান্য করেছেন বলাটা তাঁদেরকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ তো নয়ই, বরং তাঁদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপপ্রয়াসই। তাঁদের প্রতি আরোপিত এই বিতর্ক এতোই মারাত্মক যে এটা দ্বীন ইসলামের মধ্যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে এবং পৃথিবীর অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত আগত লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে বিচ্যুতির অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আহলে সুন্নাতের সাথে মতভেদ সৃষ্টি করে যারা লক্ষ লক্ষ মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছে এবং ইসলামের ক্ষতি সাধন করেছে কেবল হুরুফী শিয়াদের এই মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনী পড়ে, তারা-ই দ্বীন ইসলামের অগ্রগতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। আহমদী ও কাদিয়ানী সম্প্রদায় দ্বীনের যে ক্ষতি সাধন করেছে তা তো সবার সামনেই দৃশ্যমান। দ্বীন ইসলামের জ্ঞানের আলো দ্বারা উদ্ভাসিত ও ঈমান দ্বারা পূর্ণ হৃদয়সম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে কি এ কথা বলা সম্ভব যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-ই এই মহা ফিতনা-ফ্যাসাদের একমাত্র কারণ।
আউলিয়াকুলশ্রেষ্ঠ গাউসুল আ’যম বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী কুদ্দেসা সির-রূহ্ তাঁর প্রণীত ’গুন্ইয়াহ্’ গ্রন্থে নিম্নোক্ত বিবরণটি লিপিবদ্ধ করেন: “বাহাত্তরটি ভ্রান্ত দলের মধ্যে নয়টি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। শিয়া এদের মধ্যে অন্যতম। তারা বিশটি উপদলে বিভক্ত হয়েছে, কেউই কাউকে দেখতে পারে না। আবদুল্লাহ্ ইবনে সাবা’র উপদলটি ইহুদীদের মতো। উদাহরণস্বরূপ, ইহুদীরা বলে যে একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষেরই ইমাম হওয়ার অধিকার রয়েছে। অনুরূপভাবে, এই উপদলটিও দাবি করছে যে খেলাফত একমাত্র ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর বংশধরদেরই হক্ক এবং মুসলমানদের শাসন করা আর কারো জন্যেই অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। ইহুদীদের মতানুযায়ী দজ্জালের আবির্ভাবের আগে জেহাদ করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। আর সাবা’ উপদলের মতে আল্ মাহদীর আবির্ভাবের আগে জেহাদের কোনো অনুমতি নেই। ১২তম ইমাম তথা মুহাম্মদ মাহদী (رحمة الله) যিনি হযরত আলীর কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর দশম অধঃস্তন পুরুষ, তিনি হাসান আস্কারীর পুত্র ছিলেন। তাঁর জন্ম ২৫৯ হিজরী সালে। যখন তাঁর বয়স সতেরো বছরে উপনীত হয়, তখন তিনি একটি গুহায় প্রবেশ করেন এবং আর ফেরত আসেন নি। সাবা’ উপদলটি মনে করে যে তিনি-ই বুঝি সেই প্রতিশ্রুত মাহ্দী যিনি ইসলামের শিক্ষানুযায়ী আখেরী জামানায় আবির্ভূত হবেন। আকাশে তারকারাজি না উদিত হলে ইহুদীরা তাদের উপবাস ভঙ্গ করে না। সাবা’ উপদলের ক্ষেত্রেও একই কথা। অযু করার সময় ইহুদীরা নিজেদের মোজার ওপর মসেহ করে। সাবা’ উপদলটিও তাই করে। একজন ইহুদীর জন্যে কোনো মুসলমানকে হত্যা করা বৈধ। সাবা’ উপদলটির জন্যেও কোনো সুন্নী মুসলমানকে হত্যা করা বৈধ। একজন ইহুদীর দ্বারা তালাকপ্রাপ্তা নারী ইদ্দাতের সময়টুকু অপেক্ষা করা ছাড়াই পুনঃবিবাহ করতে পারবে। সাবা’ উপদলটিও ইদ্দাতের সময়টুকু অপেক্ষা করে না। ইহুদীদের মতানুযায়ী তিনবার বিচ্ছেদপ্রাপ্তা নারীকে আবার বিয়ে করাতে কোনো বাধা নেই। সাবা’ উপদলটিও তিনবার তালাক দিয়ে একই নারীকে আবার বিয়ে করতে পারে। ইহুদীরা তৌরাতকে পরিবর্তন করেছে। পৃথিবীতে আজকে আর কোনো মৌলিক তৌরাত (বাইবেলের পুরাতন নিয়ম) নেই। একইভাবে, সাবা’ উপদলটিও তাদের গোমরাহ্ বইপত্রে কুরআন মজীদের কতিপয় আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করেছে। তারা এগুলো করেছিল এ কারণে যে, তারা মনে করেছিল কুরআন মজীদে সংযোজন ও বিয়োজনসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছিল।” (গুন্ইয়াতুত্ তালেবীন)
এই ফকির (উসমান আফেন্দী), ‘তাযকিয়ায়ে আহলে বায়ত’ গ্রন্থপ্রণেতা, (উসমানীয় তুর্কী) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যখন ছিলাম, তখন দুইটি সিন্দুকে ভরে সাবা’ উপদলের একখানা তাফসীরের পাণ্ডুলিপি আমার কাছে প্রেরিত হয়। তা প্রকাশের অনুমতি দেয়া হলো না। তারা জিজ্ঞেস করলো: “কেন? এতে কি ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু বিদ্যমান?” আমি জবাব দিলাম: ‘হ্যাঁ, আপনারা লিখেছেন যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম একজন কাফের ছিলেন।” তাদের দলনেতা উত্তেজিত হয়ে গেল। আমি তাকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করে বল্লাম, “দেখুন, বইয়ের পরিচিতির মধ্যে উত্থাপিত অভিযোগ অনুযায়ী হযরত তালহা (রাঃ) হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ’গুজব ছড়িয়েছে এই মর্মে যে হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৭০টি এবং হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৮০টি আয়াত কুরআন মজীদ থেকে কাট-ছাঁট করে ফেলেছেন। এ গুজব কি সত্য?’ যখন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম সায় দেন, তখন হযরত তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আবারো জিজ্ঞেস করেন, ’কথিত আছে যে আপনার কাছে একখানা অবিকৃত কুরআন মজীদ আছে। এ কথা কি সত্য?’ হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম জবাব দেন, ’নিশ্চয়ই। আমার কাছে যে কপিটি আছে, তা বর্তমানকার কুরআনের দ্বিগুণ আকৃতিসম্পন্ন।’ যখন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে জিজ্ঞেস করা হয় কেন তিনি তা মুসলমানদের কাছে প্রকাশ করেন নি, তখন তিনি অভিযোগ করেন, ’যদি তারা আমাকে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র পরিবর্তে খলীফা নির্বাচন করতো, তাহলে আমি তা তাদেরকে দিতাম। যেহেতু তারা আমাকে সমর্থন দেয় নি, সেহেতু আমি আর তাদেরকে ওই কুরআন মজীদটি দেবো না। আমি উইল (ওসীয়ত) করে যাবো যাতে করে আমার বংশধররা কেয়ামত দিবস পর্যন্ত এটা আর প্রকাশ না করে।’ এ সব কথা আপনাদের তাফসীর বইতে লেখা রয়েছে। এক্ষণে আল্লাহর ওয়াস্তে আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, রাসূলে খোদা (ﷺ) সম্পর্কে ২০টি তৌরাতের পংক্তি ইহুদীরা গোপন করার দরুন আল্লাহ্ তাদের সম্পর্কে ঘোষণা দিয়েছেন: “আমার আয়াত গোপনকারীর চেয়ে নিষ্ঠুর ও গোমরাহ্ ব্যক্তি কি আর কেউ হতে পারে?” আপনাদের অভিযোগ অনুযায়ী হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম কুরআন মজীদের দ্বিগুণ আকৃতিসম্পন্ন একটি কপি গোপন করেছেন যার অর্থ তিন সহস্রাধিক আয়াত তিনি গোপন করেছেন। আপনাদের এই অভিযোগটি খোদা তা’লার সিংহের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও গোমরাহীর অপবাদ কি আরোপ করে না? আল্লাহর ওয়াস্তে এর সঠিক জবাব দান করুন!” হতবিহ্বল ও লা-জওয়াব হয়ে তাদের দলনেতা বল্লো, “আমি শিয়া কিংবা সুন্নী নই; আমি একজন ফ্রী-মাসন (যিন্দিক গোষ্ঠী)।”
ইহুদী সম্প্রদায় হযরত জিবরাইল আমীন আলাইহিস সালাম-এর প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন। একইভাবে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কাছে ওহী নিয়ে যাওয়ার সময় হযরত রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর কাছে ভুলক্রমে তা পৌঁছে দেয়ার অপবাদ দিয়ে সাবা’ উপদলটিও হযরত জিবরাইল আমীন আলাইহিস সালাম-এর প্রতি শত্রুতার মনোভাব গ্রহণ করেছে। এ সকল তথ্য পরিস্ফুট করে যে এ মিথ্যার জন্মদাতা কোনো সুন্নী কিংবা শিয়া নন, বরং আবদুল্লাহ ইবনে সাবা’ নামের এক ইহুদী।
মিরজা রেযা, জনৈক পারসিক আলেম, যিনি মুসলমান রাষ্ট্রগুলোতে ৩০/৪০ বছর যাবত ভ্রমণ করেছেন, তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম: “আপনি তো সকল শিয়া উপদলকে জানেন; সিরিয়া ও এনটিওক্ অঞ্চলে বসবাসকারী মুলহিদ নামে অভিহিত লোকদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?” তিনি জবাব দেন, “তারা ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে পূজা করে বিধায় কাফের।” যখন আমি তাঁকে ইরাকে বসবাসকারী কিযিলবাস্ উপদলটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম তখন তিনি জানালেন, ‘তারাও কাফের তথা অবিশ্বাসী, কেননা তারা আল্লাহ্ তা’লার অধিকাংশ আয়াতকে অস্বীকার করে। অতঃপর আমি বেকতাশী নাম গ্রহণকারী হুরুফী শিয়াদের সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জবাব দিলেন, “এ সকল লোকেরা নিজেদের দলীয় রীতি সবার কাছ থেকে গোপন করে থাকে; তাই তাদের গোষ্ঠীর প্রকৃত রূপ জানা যায় না। তবে তারা ফরযসমূহ অস্বীকার করে। তারা হারামকে হালাল বলে। এই কারণে হুরুফী শিয়ারাও কাফের।” [হযরত হাজী বেকতাশ-ই-ওলী ছিলেন একজন সুন্নী আলেম ও ওলী। তাঁর জন্ম ইরানের নিশাপুরে। ইমাম মূসা কাজেমের (رحمة الله) বংশধর এ বুযর্গ আনাতোলিয়ায় গমন করেন এবং আহলে সুন্নাতের আদর্শ প্রচার শুরু করেন। তদানীন্তন উসমানীয় তুর্কী সুলতান ওরহান গাযী (জন্ম ৬৮০ হিজরী/মৃত্যু ৭৬১ হিজরী মোতাবেক ১৩৫৯ খৃষ্টাব্দ) তাঁর দরবারে যাতায়াত করতেন এবং তাঁর ফয়েয দ্বারা ধন্য হয়েছিলেন। এই মহান বুযর্গ জ্যানিসারীদের প্রতিও আশীর্বাদ বর্ষণ করেন। তিনি ৭৭৩ হিজরী মোতাবেক ১৩৭১ খৃষ্টাব্দে উসমানীয় সুলতান মুরাদ খোদা ওয়ান্দেগার (জন্ম ৭২৬ হিজরী/শাহাদাৎ ৭৯১ হিজরী মোতাবেক ১৩৮৯ খৃষ্টাব্দ)-এর আমলে বেসালপ্রাপ্ত হন। কিরসাহির অঞ্চলের হাজী বেকতাশ নামের একটি জায়গায় তাঁর মাযার অবস্থিত। এই মহান ওলীর মুরিদানকে বেকতাশী বলা হতো। তুরস্কের বেকতাশীবৃন্দ তাঁর সত্য পথেরই অনুসারী। ক্যাল্ডিরান যুদ্ধে শাহ্ ইসমাইল যখন পরাভূত হয়ে পালালো, তখন কিযিল্বাস্ তথা হুরুফীরা যারা তার সৈন্যবাহিনীতে ছিল, তারা আনাতোলিয়ায় বিস্তৃত হলো। বাঁচার জন্যে তারা বেকতাশী খানকাহগুলোতে আশ্রয় নিল। সময়ের পরিক্রমণে তারা এ সব খানকাহগুলোতে নিজেদের বিষাক্ত ও ক্ষতিকর ধ্যান-ধারণা সংক্রমণ করতে সক্ষম হলো। আজকে তুরস্কে এদের সমকক্ষ আর কোনো অসভ্য মাতাল নেই। – ওয়াকফ এখলাস]
মিরযা রেযার কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বল্লাম, ‘এক্ষণে একটি মাত্র শিয়া উপদল বাকি রইলো; তারা ইমামীয়া গোষ্ঠী। তাদের জনসংখ্যা ৫০ লক্ষ হতে ১ কোটি হবে। অথচ বর্তমানে সুন্নী মুসলমানদের সংখ্যা ৩৫ কোটিরও বেশি। তাঁদের মধ্যে মুসলমান সমাজ বিভক্ত হওয়ার মতো এমন কোনো বিতর্ক বিরাজমান নেই। তাঁরা সবাই কুরআন মজীদ ও হাদীস্ শরীফ মান্য করেন। তাঁদের সবার ঈমান একই । তাহলে মুসলমান সমাজ বিভক্ত হওয়ার মতো এমন একটা ফিতনা সৃষ্টিকারী বিতর্ক হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রতি আরোপ করাকে কীভাবে কারো জিহ্বা ও বিবেক ক্ষমা করতে পারে?” মিরযা রেযা জবাব দিলেন, “সুন্নীবৃন্দ সকল ক্ষেত্রেই সঠিক। শিয়ারা ভ্রান্ত, তবে সুন্নীরা একটিমাত্র ভুল করছেন এবং তা হলো তাঁরা একগুঁয়েভাবে মোয়াবিয়ার পক্ষে ওকালতি করছেন।” এই ফকির (উসমান আফেন্দী) বল্লাম, “আমরা ইয়াযিদকে ঘৃণা করি এবং তাদেরকেও ঘৃণা করি যারা আহলে বায়তকে (রাঃ) নিপীড়ন করেছিল। আমরা বলি যে তারা বদমায়েশ ছিল। কিন্তু হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর ক্ষেত্রে আমরা স্বীকার করি যে তাঁর এজতেহাদ ভুল ছিল এবং হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর এজতেহাদ সঠিক ছিল। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর সাথে হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ করেছিলেন এজতেহাদের ওপর ভিত্তি করে। তবুও তিনি কখনো-ই হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর সমালোচনা কিংবা কুৎসা রটনা করেন নি। যুদ্ধের সময়েও তিনি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে শ্রদ্ধা করেছেন, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন এবং ওই মহান ইমামের প্রশংসাস্তুতি বর্ণনা করেছেন। আপনারা যাঁকে হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র শত্রু মনে করছেন, তিনি আসলে অত্যন্ত উদার। আর তাঁর রব্ব (আল্লাহ্ পাক)-ও অত্যন্ত দয়াবান। এ কারণেই আমরা তাঁদের মধ্যকার যুদ্ধগুলো সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করি না। সুরা ফাত্হ-এর শেষ দিকের আয়াতে করীমা উদ্ধৃত করে আমরা বলি যে, তাঁরা পরস্পরের প্রতি দয়াশীল ছিলেন।”
[’বারাকাত’ শীর্ষক গ্রন্থটি যার অপর নাম ’মাকামাত-ই-সেরহেন্দীয়া’ অথবা ’যোবদাতুল মাকামাত’, তা পারসিক ভাষায় মুহাম্মদ হাশেম কিশমী কর্তৃক ভারতে লিখিত হয়েছিল ১০৩৭ হিজরী মোতাবেক ১৬২৭ খৃষ্টাব্দে। এ গ্রন্থের একখানা সংস্করণ মুরাদ মোল্লা পাঠাগার যা ইস্তাম্বুলের ইয়াভুজ সুলতান সেলিম নামের জেলায় অবস্থিত, তার ১৩১৭ নম্বর সেকশনে শোভা পাচ্ছে। গ্রন্থটি ১৯৭৭ খৃষ্টাব্দে ওয়াকফ এখলাস কর্তৃক অফসেট প্রসেস্ দ্বারা ইস্তাম্বুল, তুরস্ক হতে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।]
’বারাকাত’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ৮ম অধ্যায়ে ইমামে রব্বানী আহমদ ফারুকী সেরহেন্দী (رحمة الله)-এর কারামতসমূহ লিপিবদ্ধ আছে। গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ হাশেম হযরত ইমাম সাহেবের (رحمة الله) সপ্তম কারামতটি এভাবে বর্ণনা করেন, ”মাদ্রাসায় আমার (লেখক হাশেমের) একজন তরুণ বয়সী সৈয়দ বংশীয় সহপাঠী ছিলেন। একদিন তিনি হাঁফাতে হাঁফাতে আমার কাছে এলেন। একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা তিনি বর্ণনা করলেন। তিনি ইমামে রব্বানী মোজাদ্দেদে আলফে সানী (رحمة الله)’র একটি কারামত দর্শন করেছেন। তিনি বিবরণে বল্লেন:
’আমি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর সাথে যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদেরকে ঘৃণা করতাম; এঁদের মধ্যে হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অন্যতম। এক রাতে আমি আপনার মনিব (ইমামে রব্বানী) রচিত ’মাকতুবাত’ (চিঠি) পড়ছিলাম। এতে লেখা ছিল, “ইমাম আনাস্ বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন যে হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে ঘৃণা বা সমালোচনা করা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে ঘৃণা বা সমালোচনা করারই সামিল। যদি কেউ তাঁকে অভিসম্পাত দেয়, তবে ওই দুইজন মহান সাহাবীর (রাঃ) প্রতি অভিসম্পাত দেয়ার মতো অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিসম্পত দানকারী ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে হবে।” এই উদ্ধৃতি পড়ার পরে আমি বিরক্ত হয়ে মনে মনে বল্লাম, তিনি (ইমামে রব্বানী) এই ছাইপাশ কীভাবে এখানে লিপিবদ্ধ করলেন? আমি মকতুবাত গ্রন্থটি ছুঁড়ে মেরে ঘরের মেঝেতে ফেলে দিলাম এবং বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আপনার মহান শায়খকে আমার দিকে রাগান্বিত হয়ে আসতে দেখলাম। তিনি তাঁর পবিত্র হাত দ্বারা আমার কান টেনে ধরে বল্লেন, “মূর্খ ছেলে কোথাকার! আমার গ্রন্থে যা লিখেছি তা পছন্দ না করে তুমি গ্রন্থটিকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলেছো। আমার লেখনী তোমাকে বিস্মিত করেছে এবং তাতে তুমি বিশ্বাস করছো না। এক্ষণে তোমাকে আমি এমন একজন মহান ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাবো যাতে তুমি নিজেই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারো! তাঁর বন্ধু ও রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর আসহাবে কেরামকে (রাঃ) ঘৃণা করার ক্ষেত্রে তুমি যে কতোটুকু ভ্রান্ত তা তিনি-ই তোমাকে জানাবেন!” এ কথা বলে তিনি আমাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চল্লেন একটি বাগান পর্যন্ত। আমাকে বাগানে একা রেখে তিনি আরো অগ্রসর হলেন। আমি দূরে একটা বড় ঘরে তাঁকে প্রবেশ করতে দেখলাম। একজন জ্যোতির্ময় চেহারার ব্যক্তি ওই ঘরে বসে ছিলেন। হাঁটু গেড়ে তাঁর সামনে বসে অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আদব সহকারে ইমাম সাহেব (رحمة الله) তাঁকে সম্ভাষণ জানালেন এবং তিনিও ইমাম সাহেবকে পাল্টা সম্ভাষণ জানালেন। ইমাম সাহেব (رحمة الله) আমাকে দেখিয়ে তাঁকে কী যেন বল্লেন। আমি তাঁকে আমার দিকে তাকাতে দেখলাম এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলাম যে ইমাম সাহেব (رحمة الله) তাঁকে আমার সম্পর্কেই কিছু বলছিলেন। কিছুক্ষণ পরে আপনার শায়খ (ইমামে রব্বানী) আমার উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে ডেকে বল্লেন, “এই মহান ব্যক্তিত্ব হলেন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম। ভালভাবে শুনো তিনি কী বলেন।” আমি ওই ঘরে প্রবেশ করে যথারীতি সম্ভাষণ জানালাম। জ্যোতির্ময় চেহারার বুযর্গ (ক:) বল্লেন, “রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর আসহাবে কেরাম (রাঃ) সম্পর্কে কখনোই বদ ধারণা পোষণ করো না! কখনোই ওই মহান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে কুৎসা রটনা করো না! বাহ্যিক দৃষ্টিতে যুদ্ধ বলে মনে হওয়া আমাদের কর্মকাণ্ডে আমাদের কী নিয়্যত ছিল তা শুধু আমরা এবং আমাদের সেই সকল ভ্রাতাই জানি।” অতঃপর আপনার সেই মহান শায়খের (رحمة الله) নাম উল্লেখ করে তিনি আরো যোগ করলেন, “তাঁর লেখনীর বিরোধিতা আর কখনোই করবে না!” তাঁর এই উপদেশ শ্রবণের পরে আমি আমার অন্তরে তালাশ করে দেখলাম যে কথিত যুদ্ধগুলোর সংঘটনকারীদের প্রতি আমার অনুভূত বিদ্বেষ ও বৈরিতা তখনো বিরাজমান। তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে রাগান্বিত হলেন এবং বল্লেন, “তোমার মহান শায়খের দিকে তাকাও!” ইমামে রব্বানীর (رحمة الله) দিকে তাকিয়ে তিনি বল্লেন, “এই ছেলের অন্তর আরো ভালভাবে পরিষ্কার করা দরকার। তার গালে একটা চড় মারুন।” হযরত শায়খ মোজাদ্দেদে আলফে সানী (رحمة الله) আমার মুখে একটা চড় মারলেন যার দরুন আমার মনে এই ভাবনার উদয় হলো যে “এই ব্যক্তিত্ব (হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম)-এর প্রতি ভালোবাসাই আমাকে ওই সকল সাহাবীকে (রাঃ) ঘৃণা করতে প্ররোচিত করেছে, অথচ এর দরুন স্বয়ং তিনি-ই ভারাক্রান্ত। তিনি চাচ্ছেন আমি যেন এই মনোভাব ত্যাগ করি। তাই আমাকে এই বর্বর মনোভাব ত্যাগ করতে হবে।” আমি যখন পুনরায় আমার অন্তর তালাশ করলাম, তখন এটাকে এই হিংসা-বিদ্বেষ হতে পরিশুদ্ধ পেলাম। ঠিক এমনি সময় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। জাগ্রত অবস্থায়ও তখন ওই হিংসা-বিদ্বেষ থেকে আমার অন্তর পবিত্র রয়েছে। স্বপ্নে প্রাপ্ত রূহানী ফয়েয (আধ্যাত্মিক পুরস্কার) ও উপদেশ বাণী আমার মধ্যে আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে। আমার অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো প্রকার ভালোবাসা বিরাজমান নেই এবং আপনার মহান শায়খ (ইমামে রব্বানী)-এর প্রতি ও তাঁর লেখনীর মা’রেফতের প্রতি আমার বিশ্বাস আরো সুদৃঢ় হয়েছে।” (বারাকাত গ্রন্থের উদ্ধৃতি এখানে শেষ হলো)
দুনিয়াতে অন্য কাউকে লা’নত বা অভিসম্পাত না দেয়ার জন্যে শেষ বিচার দিবসে কোনো ব্যক্তিকে দোষারোপ করা হবে না। কাউকে অভিসম্পাত দিতে আমাদের প্রতি আদেশ জারি করা হয় নি। এমন কী তা যদি আমাদের মনিব ফখরে কায়নাত (ﷺ)’কে এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম’কে তেরো বছর যাবত নিপীড়নকারী কাফেরবর্গ কিংবা তাদের নেতৃবৃন্দও হয়। এ সকল মাত্রাতিরিক্ত বর্বর লোক বহু আগেই বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছে। ব্যতিক্রম একমাত্র আবু জাহেল। পৃথিবীতে যে কোনো ধর্মের যে কোনো মানুষকে অভিসম্পাত দেয়া ইসলামী বিধান নয়। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’লার আদেশসমূহ মান্য করেন এবং নিষেধসমূহ তথা হারাম বর্জন করেন, তাহলে তাঁর জীবনে কেবল একবারও শয়তানকে লা’নত না দেয়ার জন্যে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে না। শয়তানের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছেন মর্মে কোনো অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত হবে না। অপর পক্ষে, যদি কোনো ব্যক্তি ওই সব আদেশ-নিষেধ অমান্য করে, কিন্তু দৈনিক ১০০ বার শয়তানকে লা’নত দেয়, তবুও তাকে জবাবদিহি করতে হবে এবং তার ওই শয়তানকে লা’নত দেয়া তাকে আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না। এ ব্যক্তিকে শয়তানের একজন শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হবে না, বরং বন্ধুদের একজন হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। ফলশ্রুতিতে এই ব্যক্তিকে কিংবা আহলে বায়তের (রাঃ) প্রতি ভালোবাসা প্রমাণার্থে লা’নত দেয়াকে মানসিক দিক থেকে উদ্ভট ও অর্থহীন প্রতিভাত হবে এবং তা ইসলামের দৃষ্টিতে তওবা করার বা ক্ষমা প্রার্থনার দাবিও রাখবে। ইরানী সম্রাট নাদির শাহ্ ১১৪৮ হিজরী সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ১১৫২ হিজরী মোতাবেক ১৭৩৯ খৃষ্টাব্দে দিল্লী অধিকার করেন। বাগদাদ দখলের চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। ১১৬০ হিজরীতে এক বিদ্রোহে তিনি নিহত হন। নাদির শাহ্ যখন বাগদাদের ওপর থেকে তাঁর অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন, তখন তিনি সুন্নী ও শিয়া পণ্ডিতদের একটা বিতর্ক সভা ডাকেন এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে হুসাইন সুওয়াইদী রহমতুল্লাহে আলাইহে (জন্ম-১১০৪ হিজরী/ইন্তেকাল-১১৭৪ হিজরী মোতাবেক ১৭৬০ খৃষ্টাব্দ)’কে সভাপতিত্ব করতে আমন্ত্রণ জানান। এই সভা সুন্নী ও শিয়া মুসলমানদের মধ্যে আক্বীদা-বিশ্বাসগত পার্থক্যসমূহ দূর করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এই সিদ্ধান্তটি উপস্থিত সকল জ্ঞান বিশারদ সমর্থনসূচক স্বাক্ষর দ্বারা মেনে নেন। নাদির শাহের ইন্তেকালের কারণে এ উপকারী প্রয়াস কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে গেল। নাদির শাহ্ শিয়া আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ইহুদী, খৃষ্টান ও কেতাবহীন অবিশ্বাসীরা কি দোযখে যাবে; নাকি বেহেস্তে?” সর্বসম্মত জবাব ছিল তারা জাহান্নামে যাবে। অতঃপর নাদির শাহ্ সুন্নী মুসলমানদের গন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। শিয়া আলেমবর্গ জবাব দেন, “তারাও জাহান্নামে যাবে।” এতে শাহ্ অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বল্লেন, “জনাবে হক্ক (আল্লাহ্ তা’লা) কি ৮টি বেহেস্ত শুধু ইরানী জনগণের একটি দলের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন?”
এই ফকির (মওলানা উসমান আফেন্দী) ১২৮২ হিজরী/১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে হজ্জে গিয়েছিলাম। পথে হাসান আফেন্দী নামের জনৈক ইরানী পণ্ডিতের সাথে আমার দেখা হয়। আমি তাঁকে বল্লাম, “বহু হাদীস্ শরীফে আসহাবে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম’কে প্রশংসা করা হয়েছে। এই যখন অবস্থা, তখন আপনারা কেন তাঁদের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন এবং কেন আপনারা তাঁদেরকে লা’নত দেন?” তিনি বল্লেন, “আমি তাঁদের প্রতি বিরূপ নই। তবে অধিকাংশ শিয়া পণ্ডিতের মতানুযায়ী আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কাছ থেকে জোর-জবরদস্তি খেলাফত কেড়ে নিয়েছিলেন; তাই তাঁরা মুরতাদ হয়ে গিয়েছেন।” এ কথার জবাবে আমি বল্লাম, “আমাদের মনিব রাসূলে খোদা (ﷺ) যখন এ সকল মানুষের ভূয়সী প্রশংসা করেন, তখন কি তিনি জানতেন না যে এঁরা মুরতাদ হয়ে যাবেন?” শিয়া পণ্ডিত বল্লেন, “তিনি জানতেন না যে এঁরা শেষ পর্যন্ত তাই করবেন। যদি তিনি জানতে পারতেন, তবে তিনি তাঁদের প্রশংসা করতেন না, বরং অভিসম্পাত দিতেন।” অতঃপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আল্লাহ্তা’লা বিভিন্ন আয়াতে জলীলা-তে সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) প্রশংসা করেছেন। তিনিও কি জানতেন না?” শিয়া পণ্ডিত এর জবাব দিতে পারলেন না। আমি আরো অগ্রসর হলাম: “এটা কি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর জন্যে মানহানিকর যে তিনি দুনিয়াবী পদমর্যাদা লাভের উদ্দেশ্যে কোন্দল করেছিলেন?” তিনি জবাব দিলেন এই বলে, “পার্থিব পদমর্যাদার জন্যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) সাথে দ্বন্দ্ব করেন নি। আমাদের মনিব ফখরে কায়নাত (ﷺ) পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে খলীফা নিয়োগ করা হয়। সাহাবাবৃন্দ (রাঃ) এই আজ্ঞা অমান্য করে ধর্মচ্যুত হয়েছেন। আর রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর এই আদেশকে কার্যকর করতেই হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যুদ্ধ করেছিলেন।” শিয়া পণ্ডিতের এই কথার প্রেক্ষিতে আমি তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করি: “শিয়াপন্থীরা রাসূলে পাক (ﷺ)-এর কতো আদেশই তো অমান্য করেছেন, তাঁরা অসংখ্য বিদআত আবিষ্কার করেছেন। আপনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁরাও কি ধর্মচ্যুত নন?” তিনি এর জবাব দিতেও ব্যর্থ হলেন। আমি অগ্রসর হয়ে বল্লাম, “ধরা যাক, হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম নির্বাচিত না হওয়ার দরুন এবং হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা খেজুর বাগান না পাওয়ার কারণে সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) প্রতি বিরাগভাজন হয়েছিলেন। একজন মোমেন মুসলমানের জন্যে তাঁর মুসলমান ভ্রাতাদের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে তিন দিনের অধিক সময় অতিবাহিত করা হারাম। এমতাবস্থায় তাঁরা পৃথিবীর শেষ অবধি বিরূপ থাকাটা কি যথার্থ?” শিয়া পণ্ডিত জবাব দিলেন, “অন্যান্যরা আজ্ঞাটি মানেন নি বলেই তাঁরা বিরূপ হয়েছিলেন।” অতঃপর আমি বল্লাম, “যদি মোমেন মুসলমানবৃন্দ ইসলাম অমান্য করেন, তবে তাঁদের প্রতি রাগান্বিত হওয়া এবং তাঁদেরকে দায়িত্ব পালনের উপদেশ দান করা ফরয। আর এটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগ ও উলামাদের প্রচার দ্বারাই করতে হবে। অন্যান্য মানুষ তাঁদের হৃদয়ে ঘৃণাই শুধু পোষণ করতে পারেন যা ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। কিন্তু হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম হলেন আসাদউল্লাহ্ তথা আল্লাহর সিংহ। তিনি কেন ক্ষমতা প্রয়োগ করে আদেশ জারি করলেন না? তিনি কি দুর্বল ছিলেন? যদিও কারো পিতা, মাতা কিংবা সন্তানের হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করার জন্যে দাবি উত্থাপন করার অধিকার সেই ব্যক্তি সংরক্ষণ করেন, তথাপি সুরা বাকারার ২৩৭ আয়াত ঘোষণা করে – وَأَنْ تَعْفُوا أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى “যদি তোমরা ক্ষমা করো, তবে তা তাক্ওয়া বা পরহেযগারীর নিকটতর”।[৩২]
[৩২] আল কুরআন : আল বাকারা, ২:২৩৭।
সুরা নিসায় ঘোষিত হয়েছে – إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ “নিশ্চিয় আল্লাহ্ শেরেক তথা কুফর ছাড়া অন্যান্য পাপ হতে যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন”।[৩৩]
[৩৩] আল কুরআন : আন নিসা, ৪:৪৮ ও ১১৬।
সুরা মায়েদায় এরশাদ হয়েছে
–فَمَنْ تَابَ مِنْ بَعْدِ ظُلْمِهِ وَأَصْلَحَ فَإِنَّ اللَّهَ يَتُوبُ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“সুতরাং যে ব্যক্তি যুলুম তথা পাপ করার পরে তওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করতে প্রবৃত্ত হয়, আল্লাহ্ তার প্রতি দয়াপরবশ হন এবং তার দিকে ফিরে তাকান”।[৩৪]
[৩৪] আল কুরআন : আল মায়িদা, ৫:৩৯।
তওবা কবুল হওয়ার ওয়াদা-সম্বলিত এ রকম আরো ত্রিশটি আয়াত বিদ্যমান। একজন সাধারণ বান্দা যদি পাপ করার পরে তওবা করে আল্লাহর দরবারে মাফ পেতে পারে, তাহলে আপনি কীভাবে জানতে পারলেন যে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর সাহাবা-মণ্ডলী (রাঃ) তওবা করে মাফ পান নি – তর্কের খাতিরে তাঁদের খেলাফত সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে আমরা ভুল হিসেবে ধরে নিলেও?” শিয়া পণ্ডিত আরেকবার জবাব দিতে ব্যর্থ হলেন।
বাগদাদের মুফতী আরুসযাদা আফেন্দী আমাকে নিম্নবর্ণিত ঘটনাটি জানান যা তিনি কারবালায় অবস্থিত হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মাযারের রক্ষণাবেক্ষণকারীর কাছ থেকে শুনেছিলেন:
এক রাতে মাযারের রক্ষণাবেক্ষণকারী হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে স্বপ্নে দেখেন যিনি তাঁকে বলেন, “আগামীকাল ইরান থেকে একটি লাশ এখানে আনা হবে। তাকে আমার ধারে-কাছে কোথাও কবর দিতে দেবে না।” পরের দিন ঠিক ঠিক ইরান থেকে একটা লাশ আনা হলো। লাশ বহনকারীরা তাকে মাযারের কাছে দাফন করতে চাইলো। প্রথম প্রথম রক্ষণাবেক্ষণকারী তাদেরকে বাধা দিলেন। কিন্তু তারা ধনী হওয়াতে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে অবশেষে তাঁকে রাজি করালো। ফলে মাযার হতে ২০০০ কদম দূরে তারা লাশটি দাফন করলো। ওই রাতে রক্ষণাবেক্ষণকারী আবারো ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে স্বপ্নে দেখলেন। এবার হযরত ইমাম (রাঃ) অত্যন্ত রাগান্বিত ছিলেন এবং তিনি তাঁকে ভর্ৎসনা করলেন। মাযারের রক্ষণাবেক্ষণকারী বল্লেন যে তিনি অত্যন্ত অনুতপ্ত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। পরবর্তী রাতেও হযরত ইমাম (রাঃ) স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাঁকে বকাঝকা করলেন। রক্ষণাবেক্ষণকারী তখন বল্লেন যে তিনি লাশটি কবর থেকে তুলে আরো দূরে কোথাও দাফন করবেন। এমতাবস্থায় রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর পৌত্র ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বল্লেন, “যদি কোনো মৃত ব্যক্তি আমাদের কাছে দুই রাত পড়ে থাকে, তাহলে তাকে ক্ষমা করা হয়। এ ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয়েছে ইতোমধ্যেই। তবুও এক বিষয়টি আমার জন্যে প্রচুর অসুবিধা সৃষ্টি করেছে।” তাঁর এ কথা দ্বারা তিনি বুঝিয়েছেন যে মাযারের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও মৃত ব্যক্তি উভয়কেই ক্ষমা করা হয়েছে। যখন মাযারের রক্ষণাবক্ষেণকারী এ ঘটনাটা আরুসযাদাকে জানালেন, তখন সম্মানিত মুফতী সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “যদি ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত একজন পাপী মাত্র দুই রাত তাঁর মাযারের ২০০০ কদম দূরে থাকার দরুন মাফ পেতে পারে, তাহলে রওযায়ে আকদসে হযরত রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর পাশে বারো’শ ষাট বছর যাবৎ সমাহিত থাকার জন্যে শায়খাইন (হযরত আবু বকর ও হযরত উমর) কি মাফ পান নি এখনো?” এ কথায় মাযারের রক্ষণাবেক্ষণকারী একদম হাবা বনে গেলেন এবং কোনো জবাব দিতে পারলেন না। তাঁর অজ্ঞতা ও অথর্বতা প্রকাশিত হয়ে গেলো। কী সুন্দর প্রত্যুত্তর এবং কতোই না শোচনীয় পরাজয়!
আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর যিকিরকে বুলন্দ (সমুন্নত) করার উদ্দেশ্যে শায়খাইনদের মধ্যে হযরত উমর ফারূক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বহু রাজ্য ও নগরী তাঁর খেলাফত আমলে জয় করেছিলেন। তাঁর সেনাবাহিনী আরব উপদ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে বীর দর্পে পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে এবং কুফর ও অনৈতিকতার অমানিশাকে ইসলামের আলো দ্বারা বিদূরিত করে। দ্বীন ইসলামের প্রতি তাঁর এ খেদমতের খাতিরে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তাঁর প্রতি বিরাগভাজন থাকতে পারেন কি-না তাই ভাবছি আমি। কুদুস-ই-শরীফ বিজয়ে বেরোবার আগে হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে খেলাফতের দেখাশোনার ভার দিয়ে গিয়েছিলেন। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ভারপ্রাপ্ত খলীফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথেই খেলাফত তাঁকে হস্তান্তর করেন। এতে কি তাঁদের মধ্যকার পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ প্রতিভাত হয় না? যদি তাঁদের মধ্যে সামান্যতম দ্বন্দ্বও বিরাজ করতো, তাহলে কি হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে সহকারী নিয়োগ করতেন? আর খেলাফতের পদ গ্রহণের পরেই বা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম কি তা ফেরত দিতেন? যদি বলা হয় যে “হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম পরবর্তী সময়ে খেলাফত সম্পর্কে বিস্মৃত হয়েছিলেন; যদি তিনি ভুলে না যেতেন তবে তিনি তা কখনোই উমরকে ফেরত দিতেন না”, তাহলে এতে বোঝা যাবে যে তাঁদের মধ্যে কোনো বিরোধই ছিল না এবং তাই হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র সমালোচনা করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়।
হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র খেলাফত আমলে ১৭ হিজরী সালে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তাঁর কন্যা উম্মে গুলসুমকে চল্লিশ হাজার রৌপ্য মুদ্রা দেনমোহরে খলীফার সাথে বিয়ে দেন। উম্মে গুলসুমের গর্ভে খলীফার একজন পুত্র যায়দ ও একজন কন্যা রুকাইয়া জন্মগ্রহণ করেন। ফলে হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র মেয়ের জামাতা হন এবং তাঁদের মধ্যকার ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম মুসলমানদের কল্যাণ-চিন্তায় অধিকাংশ সময় এক সাথে অতিবাহিত করতেন এবং নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতেন। এতো ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও কি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম মনের মধ্যে ক্ষোভ লুকিয়ে রেখেছিলেন? এ ধরনের কথা বলা ওই মহান সাহাবী ও ইমামের প্রতি কতো বড় কুৎসা রটনা!
আমি এমন একজন ব্যক্তিকে চেনতাম যিনি পাশা ও উজির হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও বেকতাশী তরীকার ছদ্মবেশ ধারণকারী হুরুফী শিয়াদের গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। কিছুকাল পরে এই ব্যক্তি সম্বিত ফিরে পেয়ে তওবা করেন। যখন এই ফকির (লেখক উসমান আফেন্দী) তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম কেন এবং কীভাবে তিনি তওবা করলেন, তখন তিনি নিম্নবর্ণিত ঘটনাটি পেশ করলেন: বেকতাশীদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে গৃহীত একটা গ্রন্থ হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে কাফের আখ্যা দেয়। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম কীভাবে একজন ‘কাফেরের’ কাছে নিজ কন্যাকে সম্প্রদান করলেন এই স্বাভাবিক প্রশ্নকে ধামাচাপা দেয়ার জন্যে বইটিতে লেখা হয়েছে যে একদিন খলীফা উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে ডেকে পাঠিয়ে তাঁকে জানান যে তিনি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কন্যাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বলেন যে ওই কন্যা তাঁর জন্যে খুবই অল্প বয়স্কা হবে। এতে খলীফা উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘আলীর জবাবও একই ছিল; তাকে গিয়ে বলুন, সে যদি মেয়ে বিয়ে না দেয়, তাহলে আমি দুইজন মিথ্যা সাক্ষী হাজির করে তাকে চোর সাব্যস্ত করবো এবং তার দুটো হাত-ই কেটে নেবো।’ উপায়ান্তর না পেয়ে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তাঁর কন্যা খলীফার কাছে সম্প্রদান করেন। এই বইটি পাঠ করে আমি মনে মনে বল্লাম, ‘যদি কোনো নিষ্ঠুর ব্যক্তি জোর করে আমার কন্যাকে কোনো কাফেরের সাথে বিয়ে দিতে চাইতো, তবে আমি জান দিতাম কিন্তু কোনোক্রমেই আমার কন্যাকে কোনো কাফেরের সাথে বিয়ে দিতাম না। আমি একজন পাপী হওয়া সত্ত্বেও এ রকম করতাম। অতএব, হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যিনি আসাদউল্লাহ্ (আল্লাহর সিংহ), প্রিয় নবী (ﷺ)-এর প্রিয়ভাজন ও নেককার মুসলমান ছিলেন, তাঁর পক্ষে সম্ভাব্য জীবন হারানোর ভয়ে দ্বীন ইসলামে নিষিদ্ধ এমনতর কন্যা সম্প্রদানে সায় দেয়া সম্ভব নয়। আমি উপলব্ধি করলাম যে আমি ভুল করেছি এই মতবাদ গ্রহণ করে এবং তাই তওবা করে হুরুফী শিয়া ধর্মমত ত্যাগ করেছি।
বাগদাদে গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জনৈক উসমানীয় তুর্কী উজির একজন পারসিককে হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র এই বিয়ের ব্যাপারে কতোটুকু তিনি অবগত আছেন সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। এই বেয়াদব লোকটি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর পবিত্র কন্যা সম্পর্কে বেশ কিছু অশোভন ও কুৎসামূলক উক্তি করে স্থান ত্যাগ করে। ওপরে প্রদত্ত তথ্যাদি থেকে এটা সুস্পষ্ট যে মহান ওলী হযরত আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) হুরুফী-শিয়াদেরকে ইহুদীদের সাথে পনেরোটি ক্ষেত্রে সাযুজ্যপূর্ণ বলে যে তুলনা দিয়েছেন, তাতে তিনি একদম সঠিক। এটা নিশ্চিত যে আব্দুল্লাহ্ ইবনে সাবা’ নামের এক ইহুদী দ্বীন ইসলামকে ধ্বংস করার অসৎ উদ্দেশ্যে হুরুফী-শিয়া সম্প্রদায়ের গোড়াপত্তন করে। মুসলমান সমাজের মধ্যে ফিতনার বীজ বপন করার জন্যে এই ইহুদী অভিযোগ উত্থাপন করেছে যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-কে জোরপূর্বক খেলাফত থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে গোমরাহীর এমন এক দীর্ঘ মেয়াদকালের সূত্রপাত হয়েছে যার মধ্যে এক লাখ চব্বিশ হাজার সাহাবীর (রাঃ) প্রতি ভ্রান্তিপূর্ণ কুফরীর ফতোয়া আরোপিত হয়েছে।
[ইয়াকুব আলাইহিস্ সালামের বারোজন পুত্রের বংশধরই হলো ইহুদী সম্প্রদায়। যেহেতু পয়গম্বর ইয়াকুব আলাইহিস্ সালামের নাম ছিল ইসরাইল, সেহেতু ইহুদীদেরকে বণী ইসরাইল তথা ইসরাইল সন্তান বলা হয়। ইসরাইলের মানে হলো আবদুল্লাহ্ বা আল্লাহর বান্দা। যখন মূসা আলাইহিস সালাম তুর পাহাড়ে (সিনাই পর্বতে) গমন করেন, তখন এ সকল লোক তাদের ঈমান পরিত্যাগ করে একটি গো-বৎসের পূজা-অর্চনা আরম্ভ করে। পরবর্তী সময়ে তারা তওবা করে স্ব-ধর্মে প্রত্যাবর্তন করে। অতঃপর তাদেরকে ইয়াহুদী (ইহুদী) বা ’জুডা’ আখ্যা দেয়া হয়। ’জুডা’ হলো সেই ব্যক্তি যে নাকি পরিত্রাণের রাস্তা খুঁজে পায়। ইহুদী সম্প্রদায় হযরত মূসা আলাইহিস সালাম’কে বহু কষ্ট দিয়েছিল। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এক সহস্র পয়গম্বরকে শহীদ করে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর কোনো পিতা না থাকার দরুন তারা তাঁর কুৎসা রটনা করে। তারা তাঁর মাতা মরিয়মকে অসতী নারী পর্যন্ত আখ্যা দেয়। তারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম’কে হত্যার ষড়যন্ত্রও করে। তারা সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম’কে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতেও চেয়েছিল। হযরত উসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র খেলাফত আমলে ইহুদীরা ফিতনা লাগিয়ে দিয়েছিল যার ফলশ্রুতিতে খলীফা শহীদ হন। তারাই হুরুফী শিয়াদের এই গোষ্ঠীটির গোড়া পত্তন করে এবং মুসলমান জাতিকে দ্বিধা বিভক্ত করে ফেলে। আল্লাহ্ তা’লার প্রেরিত পয়গম্বরদের এবং তাঁদের আনীত দ্বীনের বিনাশ সাধনের অপতৎপরতায় ইহুদীরাই যুগে যুগে ছিল সক্রিয়। ধর্মকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তারা প্রতিষ্ঠা করেছে ফ্রী ম্যাসন চক্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তারা কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের গোড়া পত্তন করে, যেগুলো ধর্ম, নৈতিকতা, সততা ইত্যাদির প্রতি ছিল বৈরী ভাবাপন্ন। ইত্যবসরে ইহুদী রাব্বীদের প্রধান কর্তা হাইয়িম নাউম সাম্রাজবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলোর সাথে আঁতাত করে উসমানীয় তুর্কী ইসলামী রাষ্ট্রটির ধ্বংস সাধনের গভীর চক্রান্তে মেতে ওঠেন। ফলে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী এ রাষ্ট্রটির পতন ঘটে। মুসলমানদের পশ্চাদগতিশীল আখ্যা দেয়া হয় এবং ইসলামকে বিলুপ্তির সর্বশেষ ধাপে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়। – ওয়াকফ এখলাস]
ধর্মীয় ও ইতিহাসের বইপত্র সর্বসম্মতভাবে বিবৃত করে যে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে সোমবার দিন খলীফা নির্বাচন করা হয়। পরের দিন মঙ্গলবার হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও আরো কিছু ব্যক্তি মসজিদে নববীতে গমন করে খলীফার আনুগত্য স্বীকার করেন। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম খলীফার বেসালপ্রাপ্তি পর্যন্ত তাঁর সমস্ত আদেশ মান্য করেছেন। দ্বীন ইসলামের প্রচার-প্রসারে তিনি সাধ্যমতো করেছিলেন। এ সকল বাস্তব ঘটনার পরিবর্তে শিয়ারা কুরআন মজীদে নিষিদ্ধ বদ-স্বভাবগুলো এই মহান ইমামের প্রতি আরোপ করে। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রতি এ ধরনের কুৎসা রটনা কি কোনো মুসলমানকে ভীত-সন্ত্রস্ত করতো না? হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে যখন খলীফা নির্বাচন করা হয়, তখন তাঁরা বলেন যে তাঁদের চেয়েও যোগ্য ব্যক্তি আছেন: তাঁরা প্রত্যেকই খেলাফতের দায়িত্ব বহনের ক্ষেত্রে নিজেকে অযোগ্য বিবেচনা করেছেন। আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশিত বিনয় গুণটির অধিকারী হওয়ার কারণেই তাঁরা এ রকম হতে পেরেছিলেন। “পরবর্তী দিবসে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম দম্ভভরে সামনে এসে সবাইকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন: আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কি আর কেউ এখানে আছে” – এই মর্মে অভিযোগটি উত্থাপন করা একজন প্রকৃত মুসলমানের পক্ষে কতোটুকু শোভনীয়? অধিকাংশ তাসাউফের তরীকাগুলো হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম হতে নিঃসৃত। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তাসাউফের ইমামবৃন্দ তাঁদের মুরীদানকে পরিচালনা করে থাকেন। আর প্রথম শিক্ষাটি যা তাঁরা দেন, তা হলো বিনয় ও আদব। আমাদের দ্বীনী ভাইদের দোষত্রুটি ক্ষমা করার উপদেশ দানকারী বহু আয়াতে করীমা যেখানে বিদ্যমান, সেখানে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তো দূরে থাক, একজন নিকৃষ্ট গুণাহ্গার মুসলমানের প্রতিও কীভাবে ত্রিশ বছর যাবত প্রতিহিংসা লালন করার এবং অন্যান্যদেরকে এই হিংসা-বিদ্বেষ কেয়ামত পর্যন্ত লালন করতে পরামর্শ দানের অপবাদ আরোপ করা যায়? এটা কি ন্যায়সঙ্গত? তাসাউফের মহান ইমামমণ্ডলী তাঁদের মুরীদদেরকে আয়াতে করীমা উদ্ধৃত করে শিক্ষা দেন যে সমস্ত বস্তুই আল্লাহ্ তা’লার সৃজিত এবং তাই তাঁরা কাযা (তাকদীর, নিয়তি)’তে সমর্পিত হতে উপদেশ দিয়ে থাকেন। তাহলে যে ব্যক্তি এই উপদেশ দিয়েছেন, তিনি কীভাবে স্বয়ং ’কাযা’র বিরোধিতা করতে পারেন? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? এটা কি জঘন্য কুৎসা রটনা নয়? বহু আয়াতে করীমা যেখানে বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে উপদেশ দেয়, সেখানে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম কেমন করে একটি সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিতে অধৈর্য হয়ে উঠতে পারেন? পার্থিব উচ্চাভিলাষ সংক্রান্ত আয়াতে করীমাগুলো কি ভুলে গিয়ে তিনি দুনিয়ার মোহে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মাঝে ফিতনার বীজ বপন করেছিলেন? এই মহান ইমাম যাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণীসমূহ মুসলমানদের কাছে জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে গৃহীত, তাঁর বিরুদ্ধে এ সব অভিযোগ উত্থাপন করা কি আদৌ অনুমতিপ্রাপ্ত?
তিন খলীফা (রাঃ) অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন এবং তা এই কারণে যে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) তাঁদেরকে নির্বাচন করার দরুন তাঁদের ওপর এ দায়িত্ব ফরয হয়েছিল। তাঁরা নিজেদের পুত্রদেরকে ‘অসিয়ত/উইল’ করে খেলাফতের উত্তরাধিকারী বানিয়ে যান নি। এ বাস্তবতা কি আমাদের কথাকে সত্য প্রমাণ করে না? যখন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে সর্বসম্মতিক্রমে খলীফা নির্বাচন করেন, তখন তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবু যখন হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ভুল এজতেহাদ দ্বারা নিজেকে প্রকৃত খলীফা দাবি করেন, তখন হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বহু কষ্ট স্বীকার করে তাঁকে হুকুম মান্য করায় বাধ্য করেন; কেননা তা ছিল ইসলামের হুকুম। এ বিষয়টি সবারই জানা। উপরন্তু, বহু আয়াতে করীমা ও হাদীস শরীফে মুসলমানদের প্রতি এবং সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়াপরবশ হতে আদেশ দেয়া হয়েছে; হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যিনি সুন্দর নৈতিক গুণাবলীর উৎসস্থল, তিনি অত্যন্ত দয়াবান হিসেবে সুবিখ্যাত, যা বহু প্রসিদ্ধ ঘটনা দ্বারা সর্বজনবিদিত হয়েছে। তাঁর করুণাশীল হওয়ার কারণে আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে এ মর্মে খোশ-খবরী দিয়েছেন যে শেষ বিচার দিবসে হাউজে কাউসার থেকে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর দ্বারা তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের পানি পান করাবেন। এমতাবস্থায় এ সকল তথ্য উপেক্ষা করে কীভাবে কেউ এ অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কারণেই কোটি কোটি ঈমানদার তথা বিশ্বাসী মুসলমান চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের আগুনে জ্বলে পুড়বেন? এ অভিযোগ হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তো দূরে থাক, একজন নিকৃষ্ট গুণাহ্গার মুসলমানের বিরুদ্ধে উত্থাপন করাও কি যুক্তিসঙ্গত? মানুষের প্রতি দয়া করার মানে হলো তাঁদের পরকালীন সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা; তাঁদেরকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করা। তাঁদের বৈষয়িক বিষয়াদিতে সাহায্য করাটা তাঁদেরকে পরকালীন মুক্তিতে সাহায্য করার তুলনায় কিছুই নয়। শিয়াদের বানোয়াট অভিযোগ অনুযায়ী কোটি কোটি মুসলমান একমাত্র হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কারণেই চিরকাল দোযখের আগুনে জ্বলে পুড়বেন।
গীবত, কুৎসা রটনা ও মুসলমানদেরকে বিদ্রূপ করার প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণকারী এতোগুলো আয়াতে করীমা ও হাদীস্ শরীফ বর্তমান থাকতে মহানবী (ﷺ)-এর আদেশ মান্যকারী আসহাবে কেরাম (রাঃ) ও সুন্নী মুসলমানদের প্রতি অহর্নিশ কুফরীর অপবাদ ও লানত দেয়া কি সত্য এবং সঠিক পথ হতে পারে? একজন মুসলমানের কি এ সিদ্ধান্ত নেয়া শোভনীয় যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কারণেই এটা হয়েছে, যিনি সাহাবায়ে কেরামের আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওই ঘৃণিত কাজটিকে আদেশ করেছেন? আসহাবে কেরাম (রাঃ) ও উম্মতের বুযূর্গবৃন্দ (رحمة الله) নিজেদের নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকেই প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য জ্ঞান করেছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁর পবিত্র নফসের ওপর আঘাত এলেও হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম নিঃসন্দেহে এমন একটা মহা-গুণাহ্ সংঘটন করতে পারতেন না। আর যেহেতু তাঁর নফস্ একেবারেই আঘাতপ্রাপ্ত হয় নি, সেহেতু এটা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার যে তাঁর ওই গুণাহ্ সংঘটন করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ-ই নেই।
আমরা শিয়াদেরকে বিবেচনাশীল হবার জন্যে আহবান জানাচ্ছি; কেননা তারা যাঁদেরকে চির শত্রু মনে করছে সেই সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর খালা ও প্রথম চাচাতো ভাই এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। বিভিন্ন আয়াতে করীমায় যেখানে আত্মীয়স্বজনের প্রতি দয়াশীল হওয়া এবং তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করাকে ওয়াজিব বলা হয়েছে, সেখানে ঈমানদার কোনো ব্যক্তি কি এই অভিযোগ উত্থাপন করতে পারবে যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তাঁর ‘অসিয়তে/উইলে’ এই সকল আত্মীয়স্বজনকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করার তাকিদ দিয়ে গিয়েছেন? আয়াতে করীমায় ঘোষিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর পবিত্র বিবি সাহেবান (রাঃ) মোমেন মুসলমানদের মাতা এবং আরো ঘোষিত হয়েছে যে পিতামাতাকে শ্রদ্ধা ও মান্য করা দ্বীন ইসলামেরই একটি আজ্ঞা; এমতাবস্থায় একজন ঈমানদার মুসলমান কীভাবে এ মর্মে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেন যে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র আনুগত্য স্বীকার করার জন্যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর ওই সকল পবিত্র বিবি সাহেবার (رحمة الله) প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হয়েছিলেন এবং তাঁদেরকে কাফের আখ্যা দিয়েছিলেন? যেহেতু হাদীস শরীফে ফিতনা সৃষ্টিকারীকে অভিসম্পাত দেয়া হয়েছে, সেহেতু এ কথা কি বলা যাবে যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম উম্মতে মুহাম্মদীর মাঝে ফিতনা (কোন্দল) সৃষ্টি করেছিলেন?
হযতর উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “যখন আমি কোনো দুর্যোগের সম্মুখীন হই, তখন আমি তিনটি কারণে খুশি হই। প্রথমতঃ দুর্যোগটি স্বয়ং খোদাতা’লা হতে প্রেরিত হয়েছে। তাই প্রেমাস্পদ হতে প্রেরিত যে কোনো জিনিসই মধুর। দ্বিতীয়তঃ আমি আল্লাহ্ তা’লাকে ধন্যবাদ জানাই এর চেয়ে মারাত্মক দুর্যোগ প্রেরণ না করার জন্যে। তৃতীয়তঃ আল্লাহ্ তা’লা তাঁর বান্দাদের কাছে এমন কোনো কিছু পাঠাবেন না যা অর্থহীন বা বৃথা। দুর্যোগের প্রতিদানস্বরূপ তিনি পরকালে নেয়ামত দেবেন। আমি বালা-মসীবত নিয়ে সন্তুষ্ট, কেননা তা পরকালীন নেয়ামত (আশীর্বাদ)-এর তুলনায় একেবারেই নগন্য।” এমন কী বর্তমানেও বহু সুন্নী মুসলমান আছেন যাঁরা বালা-মুসীবতের মাঝে রাজি থাকেন; কেননা তাঁরা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর তরীকা অনুসরণ করে নিজেদের কলব্ (অন্তর) পরিষ্কার করেছেন। তাহলে এই কূটতর্কে কে বিশ্বাস করবে যে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম বালা-মসীবতের সময় রাজি না থেকে বছরের পর বছর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কষ্ট ভোগ করেছেন এবং বেসালপ্রাপ্তির আগে আসহাবে কেরাম (রাঃ) ও কোটি কোটি মুসলমানের প্রতি বৈরী মনোভাব গ্রহণের জন্যে উপদেশ দিয়ে ‘অসিয়ত/উইল’ করে রেখে গিয়েছিলেন?
বিভিন্ন আয়াতে করীমা ও হাদীস শরীফে হুব্বু ফীল্লাহ্ ওয়াল বুগদু ফীল্লাহ্ তথা আল্লাহর ওয়াস্তে মুসলমানদেরকে মুসলমান হওয়ার কারণে ভালোবাসা এবং অবিশ্বাসী ও দ্বীনের শত্রুদেরকে ঘৃণা করার আদেশ দেয়া হয়েছে; একটি আয়াতে করীমায় সাহাবীদেরকে (রাঃ) শুভসংবাদ দেয়া হয়েছে এই মর্মে – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ‘আল্লাহ্ তা’লা তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট, তাঁরাও আল্লাহ্ তা’লার প্রতি সন্তুষ্ট”।[৩৫]
[৩৫] আল কুরআন : আল মায়িদা, ৫:১১৯।
বহু হাদীস শরীফে মোহাজির ও আনসার সাহাবীদের (রাঃ) প্রশংসা করা হয়েছে এবং দশজন সাহাবী (আশারায়ে মোবাশশারা)-কে বেহেস্তপ্রাপ্তির আগাম শুভসংবাদ দেয়া হয়েছে। হাদীস শরীফে সাহাবাদের (রাঃ) প্রতি বৈরী আচরণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় আহলে বায়তের (রাঃ) শিরোমণি ও জ্ঞান-শহরের প্রবেশদ্বার হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম কি বিদ্বেষভাব অন্তরে লালন করতে পারেন? এই ধরনের একটি ঘৃণিত অপবাদ ওই মহান ইমামের প্রতি আরোপ করা কি তাঁর প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শন? নাকি শত্রুতার?
আয়াতে করীমা ও হাদীস শরীফসমূহে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে জুমআর নামায ও দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাআতে না আদায় করলে গুণাহ্গার হতে হবে। সবাই জানতেন যে ফরয নামায মসজিদে নববীতে আদায় করা হয় এবং খলীফা তাতে ইমামতি করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যদি তিন খলীফা (হযরত আবু বকর, হযরত উমর ও হযরত উসমান)-কে কাফের আখ্যা দিয়ে থাকেন, তবে তাও তিনি তাঁদের ইমামতিতে মসজিদে নববীতে নামায পড়েছেন। যদি কোনো ব্যক্তি ইমামকে নিশ্চিত কাফের (কিংবা মুরতাদ) জেনেশুনেও তাঁর পেছনে নামায আদায় করেন, তাহলে তিনিও কাফের হয়ে যাবেন। যদি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম এই তিনজন খলীফার ইমামতিতে নামায না পড়েন, তাহলে তিনি নিশ্চয় জুমআ ও অন্যান্য ওয়াক্তের ফরয নামাযগুলো অবহেলা করেছেন, যার পরিণতি হচ্ছে শক্ত গুণাহ্ সংঘটন। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর পক্ষে উভয় ধরনের গুণাহ্ করা একেবারেই অসম্ভব। উপরন্তু, হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম তাঁর কন্যাকে হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে বিয়ে দেন। যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে কাফের জেনে তাঁর কাছে নিজ কন্যা সম্প্রদান করেন, তিনি নিজেও কাফেরে পরিণত হন। ওই মহান ইমামের পক্ষে কি এমন কাজ শোভনীয় হতো?
এ পর্যন্ত আমরা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছি কেমন করে হুরুফী বিশ্বাস ও মিথ্যাসমূহ শিয়া উপদলগুলোতে সংক্রমিত হয়ে আকিদাগত দূষণের সৃষ্টি করেছে। হুরুফী গোষ্ঠীর প্রবর্তক হলো আবদুল্লাহ্ ইবনে সাবা নামের এক ইয়ামেনী ইহুদী। উম্মতে মুহাম্মদীকে বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট ও বিভক্ত করতে এবং ইসলামের আলোকেবর্তিকা আহলে বায়তের (রাঃ) ওপরে প্রতিশোধ নেয়ার অসৎ উদ্দেশ্যেই সে এই মতবাদের গোড়াপত্তন করে। তার অসৎ উদ্দেশ্যকে গোপন রাখার জন্যে সে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রতি অত্যধিক ভালোবাসার প্রদর্শনী দিয়েছে এবং অভিযোগ উত্থাপন করেছে যে তাঁকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে; আর তাই তার সিদ্ধান্ত হলো এই যে, তিনজন খলীফা ও সাহাবায়ে কেরাম সবাই কাফের হয়ে গিয়েছেন! সে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রতি ভালোবাসার ছদ্মাবরণে তাঁরই প্রতি বিদ্বেষকে লুকিয়ে রেখেছিল। সে এমন কিছু ভুলত্রুটি বানিয়ে নিয়েছিল যা শুধু অধর্মই ছিল না, বরং ছিল অবান্তরও। এই ইহুদীটির পাতা ফাঁদে ঈমান-আকিদা ও জ্ঞানহীন কিছু অজ্ঞ-আহাম্মক লোক পতিত হয়ে তার আরোপিত কুৎসায় বিশ্বাস করে বসে এবং হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর উচ্চমর্যাদার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এই সব কুৎসা দ্বারা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর মান-মর্যাদা বিনষ্ট করার অপচেষ্টায় ইহুদীটিকে অন্ধভাবে সমর্থন জোগায়। [আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদদের ক্ষুরধার লেখনী ও জ্ঞানসমৃদ্ধ বইপত্র আবদুল্লাহ্ ইবনে সাবা’-র এই ফিতনাকে যুগে যুগে স্তব্ধ করে দিয়েছে এবং মুসলমানদেরকে জাগ্রত করেছে। পারসিক ইহুদী ফযলুল্লাহ্ হুরুফী (মৃত্যু-৭৯৬ হিজরী মোতাবেক ১৩৯৩ খৃষ্টাব্দ) এই ফিতনাকে পুনরায় জাগ্রত করে। – ওয়াকফ এখলাস]
হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রতি হুরুফী শিয়াদের আরোপিত শয়তানী অপবাদের রীতি-পদ্ধতি বাইবেল ও তৌরাতে লিপিবদ্ধ আছে। এই কারণে ইহুদী ও খৃষ্টানরা স্বীকার করে যে এ সব কুৎসা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রতি বন্ধুত্বের পরিবর্তে শত্রুতাই বহন করে।
শেষ কথা
আমরা ’হুসনিয়া’ গ্রন্থের ধর্মদ্রোহী কুৎসার খণ্ডন করে পর্দার অন্তরালে লুকিয়া রাখা লেখকের অসৎ উদ্দেশ্যের মুখোশ উন্মোচন করেছি। নিম্নে জনৈক ইসলামী জ্ঞান বিশারদের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো যা তিনি হুরুফীদের লিখিত ‘হাকাইকুল্ হাকাইক্’, ‘আলফাযে কুদসিয়া’ এবং ‘আইনুল্ হায়াত্’ শীষক আরবী গ্রন্থগুলোর জবাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।
এই আলেম ব্যক্তি ‘আইনুল্ হায়াত’ গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পান যে এতে তিন খলীফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম, হযরত আমীরে মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এবং আহলে সুন্নাতের উলামায়ে কেরামের প্রতি জঘন্য অপবাদ দেয়া হয়েছে। তিনি এ সব কুৎসা নিম্নতালিকাভুক্ত করেন:
আইনুল হায়াত গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে, “যখন আমাদের মনিব ফখরে আলম (ﷺ) বেসালপ্রাপ্ত হন, তখন সালমান ফারিসী, আবু যর ও মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম ছাড়া বাকি সমস্ত সাহাবা কাফের হয়ে যান। হযরত উসমানকে লা’নত দেয়া এবং কা’বকে কাফের আখ্যা দেয়া জরুরি ছিল।” এই মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তা গ্রন্থটির প্রথম দিকের পৃষ্ঠাগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে যা ৯ম পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
এতে আরো অভিযোগ করা হয়েছে, “ওই তিনজন খলীফা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ও অধিকাংশ সাহাবা-ই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর দ্বীনের শত্রু ছিলেন এবং তাঁরা মুশরিক ছিলেন। ইমামে আ’যম আবু হানিফা ও সুফিয়ান সাওরী এবং সকল সুন্নী মুসলমান কাফের।” ২৭তম পৃষ্ঠা পর্যন্ত গ্রন্থটি ওয়াহদাতুল অজুদ (আল্লাহর একক অস্তিত্ব) সংক্রান্ত বিষয়ে আহলে সুন্নাতের বুযূর্গ আলেম ও তাসাউফ শাস্ত্রের মহান ইমামদের প্রতি কুৎসা রটনা করে।
গ্রন্থটিতে বিবৃত হয়েছে, “হযরত উসমান ও তাঁর খেলাফত আমলের সাহাবীরা সবাই কাফের হয়ে গিয়েছিলেন।” এতে আরো কুৎসা রটনা করা হয়েছে, “অধিকাংশ ইরাকী জনগণই সঠিক পথ হতে বিচ্যুত হয়েছেন। আল্লাহ্ তা’লা তাঁর জন্মগত বান্দাদের রিযিক বারোজন ইমামের মাধ্যমে পাঠিয়ে থাকেন। ওই তিনজন খলীফাকে অভিসম্পাত দেয়া জরুরি। তাঁরা কাফের, গুণাহ্গার ও ইহুদী হয়ে গিয়েছিলেন। এই তিন খলীফার প্রতি ভালোবাসার কারণে সুন্নী মুসলমান সমাজ কাফের হয়ে গিয়েছেন। উটের (জামাল) যুদ্ধে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম হযরত রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর সহকারী হিসেবে হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর তালাক কার্যকর করেন (?)। বিদ্যমান তাফসীরগুলো বিকৃত হয়ে গিয়েছে। আবু বকর, উমর, তালহা ও যুবাইর কাফের হয়ে গিয়েছিলেন। উসমান, আয়েশা, তালহা, যুবাইর ও মোয়াবিয়া অপবিত্র, বদমাইশ ও নিষ্ঠুর মানুষ ছিলেন।” (নাউযুবিল্লাহ্)
এতে আরো অভিযোগ করা হয়েছে, “আমাদের রাসূলে খোদা (ﷺ) জিবরাইল আমীন আলাইহিস সালাম, মিকাইল আলাইহিস সালাম ও ইসরাফীল আলাইহিস সালাম হতে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং এ সকল ফেরেশতা লওহ-কলম থেকে শিখেছেন; ওলী হওয়াটা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও বারো ইমামের জন্যেই নির্দিষ্ট। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর ইচ্ছা আল্লাহ্ তা’লারই সিদ্ধান্ত। শেষ বিচার দিবসে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-ই সিদ্ধান্ত নেবেন কে জান্নাতী হবেন আর কে হবে জাহান্নামী। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ও শয়তানের মধ্যকার যুদ্ধ ও ঘটনাবলীর বিবরণ হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর কাছে প্রকাশিত হয় ৯০ পৃষ্ঠার কেতাবে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখা হয় যে তিন খলীফা ও আসহাবে কেরাম নিষ্ঠুর, দুরাচারী ও পাপী মানুষ ছিলেন। মূসা নবী আলাইহিস সালাম ও খিজির আলাইহিস সালাম হতে ইমাম জা’ফর সাদেক (رحمة الله) উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। সূরা ইসরার ৮৫তম আয়াতে উল্লিখিত রূহ্ হলো একজন ফেরেশতা যাকে বারো ইমামের খেদমতগার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। হযরত ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম মৃতকে জিন্দা করতেন।” ’আইনুল হায়াত’ গ্রন্থটি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র খেলাফতকে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যখন স্বীকার করে নেন, তখন তাঁর প্রতি নিক্ষিপ্ত বিষোদগারের দীর্ঘ উদ্ধৃতিসমূহ পেশ করেছে। এতে আরো অভিযোগ করা হয়েছে: “উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতামণ্ডলী সবাই বারোজন ইমামের আজ্ঞাবহ সেবক। পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা ও জীব বিজ্ঞানের নিয়ম এবং অণু-পরমাণু ও সৌর বস্তুসমূহ বারো ইমামের নিয়ন্ত্রণাধীন। শেষ বিচার দিবসে আম্বিয়াদেরকেও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। নূহ আলাইহিস সালাম হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর শরণাপন্ন হবেন এবং তিনি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর প্রেরিত দুইজন সাক্ষীর সাহায্য দ্বারা নাজাত পাবেন। সুন্নী মুসলমান সমাজ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর দ্বীনকে অপবিত্র করেছেন এবং হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল বলেছেন; তাই তাঁরা সবাই পথভ্রষ্ট হয়ে কাফের হয়ে গিয়েছেন। হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-ই সুন্নী পথের উদ্ভাবন করেন। তিনি এটাকে শয়তান ও গোমরাহদের সাহায্য দ্বারা প্রচার-প্রসার করেন। এরই ফলশ্রুতিতে ইমাম জাফর সাদেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও সুফিয়ান সাওরীর মধ্যে গোমরাহীপূর্ণ বাক্য বিনিময় হয় যার দরুন বোঝা যায় যে সুফিয়ান সাওরী কুফরী ও গোমরাহীর গহ্বরে পতিত হয়েছিলেন।
“আহলে সুন্নাতের উলামাবৃন্দ মোহকাম, মোতাশাবেহ, নাসিখ ও মনসুখ আয়াতগুলোকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন নি। তাঁরা শরীয়তের আদেশগুলো অমান্য করেছেন এবং হারাম বর্জন করেন নি। ফলে তাঁরা অজ্ঞতা ও গোমরাহীর অতল সাগরে নিমজ্জিত হয়েছেন। সুফিয়ান সাওরী ও আয়ায-ই-বসরী দ্বীন ইসলামকে ধ্বংস করতে অপপ্রয়াস পেয়েছিলেন। ইব্রাহীম বিন হিশাম ছিলেন একজন যিনদিক। সুন্নী মুসলমানবৃন্দ এবাদতের নামে নাচ-গানে মত্ত। মা’রূফ কারখী একজন মিথ্যুক ছিলেন। সুন্নী মুসলমান সমাজ জাহান্নামে যাবে। হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারী একজন সমকামীও তার গুণাহের জন্যে ক্ষমা পাবে। আহলে সুন্নাত কর্তৃক পালিত তারাবীহর নামায প্রদর্শনীমূলক এবং গোমরাহীপূর্ণ। এটা কাফেরদের পূজা-অর্চনার মতোই। যে ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান হতে চায়, সে লা’নতপ্রাপ্ত। শেষ বিচার দিবসে আল্লাহ্ তা’লা শিয়াদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন যেমনিভাবে এক ভাই অপর ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চায়। সুন্নী মুসলমান সমাজ কাফেরদের সাথে চিরকাল দোযখে অবস্থান করবেন। তাঁরা মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) ও কাফের (অবিশ্বাসী)। তাঁদের ওযর ও অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হবে এবং তাঁদের আর কখনোই দোযখ থেকে নিস্তার দেয়া হবে না। ফেরাউন, হামান ও কারূন জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে এবং আবু বকর, উমর, উসমান ও উমাইয়া সন্তানদেরকে উপস্থাপন করবে।” গ্রন্থটি দোযখের আগুনের ভয়ঙ্কর রূপ, দোযখে কীভাবে শাস্তি দেয়া হবে, হাবিলের হন্তা কাবিল, নমরুদ, ফেরাউন, ইহদীদেরকে বিপথগামী করার হোতা জনৈক ইহুদী এবং খৃষ্টানদেরকে পথভ্রষ্টকারী পৌল নামের ইহুদী ব্যক্তির ওপর পতিত দোযখের শাস্তি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেয়। এটা আরো বর্ণনা করে যে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র ওপরও একই শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে হযরত আমীরে মোয়াবিয়ার প্রতি ফেরাউনের মতো শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। [নাউযুবিল্লাহ]
অতঃপর গ্রন্থটিতে আরো মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে: “হযরত ফখরে আলম (ﷺ) প্রতিদিন তাঁর কন্যা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’কে বুসা দিতেন এবং ঘ্রাণ নিতেন। তাঁর স্ত্রী হযরত আয়েশা তা দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়তেন। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ আলী রাসূলুল্লাহ্’ বাক্যটি বেহেস্তের সর্বত্র উৎকীর্ণ রয়েছে। বিনা ওযুতে নামায পড়া জায়েয (অনুমতিপ্রাপ্ত), তবে এ ক্ষেত্রে কারো উচিৎ নয় (পরকালীন) সওয়াব আশা করা। কুরাইশ গোত্রের কাফেররা যেহেতু বলেছিল যে ফেরেশতামণ্ডলী খোদা তা’লার কন্যা, সেহেতু একটি আয়াত নাযেল হয়েছিল। একটি আয়াতে বিবৃত হয়েছে যে একমাত্র সত্যপস্থী দল শিয়ারা কালক্রমে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে এবং অন্যান্য দল-উপদল বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেহেতু কুরআন মজীদের সুরা আহযাবের অধিকাংশ আয়াতে করীমা কুরাইশ নরনারীদের বদমাইশি প্রকাশ করে দিয়েছিল, সেহেতু সেগুলোর মধ্যে কিছুকে কর্তন করা হয়, আর কিছুকে পরিবর্তন করা হয়। আবু বকর, উমর ও উসমান অবিরতভাবে অশোভনীয়, নিষিদ্ধ ও পাপ-কাজ সংঘটন করেন এবং গোমরাহীতে নিমজ্জিত হন।” ’আইনুল হায়াত’ গ্রন্থটি উটের যুদ্ধে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম কর্তৃক হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’কে বন্দী করার দীর্ঘ কাল্পনিক কাহিনী বর্ণনা করে এবং হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ও সত্তর জন বন্দীকে কীভাবে মদীনায় প্রেরণ করা হয় তার বিবরণ দেয়। গ্রন্থটি হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’কে লা’নত দেয়। হযরত মোয়বিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি কুৎসা রটনা করে গ্রন্থটি বর্ণনা করে: “আল্লাহ্ তা’লা চার’শ দিরহাম রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কাছে বেহেস্ত ও দোযখ এবং একজন জারিয়াকে (দাসী) বিক্রি করে দেন। মোয়াবিয়া ও হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর মধ্যে যুদ্ধের সময় হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম একটা দীর্ঘ ভাষণ দেন যার মধ্যে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে মোয়াবিয়া লা’নতপ্রাপ্ত। সুন্নী মুসলমান সম্প্রদায় পরহেযগারীর প্রদর্শনী দেয়ার উদ্দেশ্যে সূতার জামাকাপড় পরেন। এই কারণে তাঁদেরকে লা’নত দেয়া হয়েছে। ওহীর মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে সুন্নী মুসলমান সমাজ কাফের ও যিনদিক। মুহাম্মদ গাযযালী, আহমদ গাযযালী, জালালউদ্দীন রূমী এবং মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী গং হলেন লা’নতপ্রাপ্ত কাফের।” গ্রন্থটি তিন খলীফাকে (রাঃ) অভিসম্পাত দেয় এবং গালি-গালাজ করে; অতঃপর অভিমত প্রকাশ করে যে হাসান বসরী (رحمة الله), মনসুর দাওয়ানিকী, মামুন ও হারুনুর রশীদ লা’নতপ্রাপ্ত। গ্রন্থটি আরো যোগ করে, “মনসুর হাল্লাজ, আবু জাফর শালগামানী এবং উলামায়ে আহলে সুন্নাত সকলেই কাফের ও যিনদিক।”
যদি গ্রন্থটির উপরোক্ত তালিকা মনোযোগ সহকারে পড়া হয়, তবে পরিস্ফুট হবে যে গ্রন্থটি উদ্ভট বক্তব্য ও কাহিনীতে ভরপুর যার কোনো মজবুত ভিত্তি-ই নেই। এ সকল বিষয় কোনো ধর্মীয় ব্যক্তি কর্তৃক লিখিত হতে পারে না। বিশেষ করে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর কাছে আল্লাহ্ তা’লা বেহেস্ত বিক্রি করে দিয়েছেন এবং হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম যাকে পছন্দ করেন তাকে বেহেস্তে কিংবা যাকে ঘৃণা করেন তাকে দোযখে প্রেরণ করতে পারেন, আর বারো ইমাম দুনিয়াবী বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করেন – এ সকল দাবির মানে হলো আল্লাহ্ তা’লার চূড়ান্ত এরাদা (ইচ্ছা)’কে অস্বীকার করা, যার ফলশ্রুতি দাঁড়াবে মহা-শিরক। হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’কে ’ফাদাক’ নামের খেজুর বাগানটি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রদান করতে অস্বীকার করার ঘটনাকে এমন অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করা হয়েছে যে পারসিক রূপকথার কাহিনীও এর কাছে হার মানতে বাধ্য। এই ’ফাদাক’ খেজুর বাগানটি খায়বারের কাছে অবস্থিত ছিল। এর আয় থেকেই রাসূলে খোদা (ﷺ) তাঁর ঘর-সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন এবং উদ্বৃত্ত যা থাকতো তা দান-সদকা করা হতো। তাঁর বেসাল শরীফের আগে তিনি এই বাগানটি গরিবদেরকে এবং মুসাফিরদেরকে ওয়াকফ করে দেন। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর খেলাফত আমলে বাগানটির আয়ের হিসেব-নিকেশ নিজে করে রাখতেন। যখন হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলীফা হন, তখন তিনি হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম-এর দাবির প্রেক্ষিতে বাগানটির ব্যবস্থাপনা তাঁর হাতে অর্পণ করেন। এ ঘটনাকে এতো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এমন জঘন্যভাবে খলীফা আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও খলীফা উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি কুৎসা রটনা করা হয়েছে যে তওবা করলেও একে ক্ষমা করা যায় না।
উপরোক্ত তিনটি গ্রন্থ ছাড়াও আরো দশটি বই রয়েছে যেগুলো গোমরাহীতে পূর্ণ। এগুলো ইরান ও ইরাকে প্রচার করা হচ্ছে। তারা আনাতোলীয় (তুর্কী) মুসলমানদেরকেও বিভ্রান্ত করতে অপতৎপর। নিজেদের আলাভী (শিয়া) নাম দিয়ে তারা তুর্কিস্তানের আলাভী মুসলমানদেরকে ধোকা দিতে অপতৎপর। তাদের উদ্দেশ্য হলো এমন এক প্রজন্ম গড়ে তোলা যারা উলামায়ে আহলে সুন্নাতের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হবে। ফলে ভেতর থেকে ইসলামের ধ্বংস সাধন সম্পন্ন হবে।
পারস্যের নজফ ও কারবালায় বসবাসকারী ইমামীয়া উপদলের শিয়াদের উচিৎ আহলে সুন্নাতের সাথে সহযোগিতা করা, যাতে করে পথভ্রষ্টদের বানোয়াট কুৎসামূলক কল্পকাহিনীগুলোকে প্রতিরোধ করা যায়। এই ইসলামী জরুরাত পূরণে অবহেলা করা হলে গোমরাহদের সংখ্যাই শুধু বৃদ্ধি পাবে। ৯২০ হিজরী (১৫১৪ খৃষ্টাব্দ) সালে ক্যালডিরান ইয়াভুজ সুলতান সেলিম খাঁনের বিজয়ের পরে এই বদমায়েশ গোমরাহদের প্রতি আরোপিত নিষেধাজ্ঞাটি পনেরো বছর আগে ১২৮০ জিহরী (১৮৬৪ খৃষ্টাব্দ) সালে তুলে নেয়া হয় এবং হঠাৎ করে এ সকল গোমরাহীপূর্ণ কুৎসার পুনরাবির্ভাব ঘটে। এগুলো মুসলমানদের অবহেলা ও ঢিলেমির-ই ফল।
= সমাপ্ত =
Comments
Post a Comment