কারবালার অন্যান্য দুর্বৃত্তদের মুখোশ উন্মোচন
কারবালার অন্যান্য দুর্বৃত্তদের মুখোশ উন্মোচন
মূল: মাহাজ্জা-ডট-কম
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
সম্পাদনাঃ মাসুম বিল্লাহ সানি
[Bengali translation of Mahajjah’s article “Unmasking the other villains of Karbala;” translator: Kazi Saifuddin Hossain]
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার বিবরণ পুনর্ব্যক্ত করা (মাতম করা) ঐতিহ্যগতভাবে (প্রথম ইতিহাস হিসেবে) শিয়া ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর শাহাদাত বিষয়ে ইরান ও ভারত উপমহাদেশে রচিত আবেগময় নাটক, গদ্য ও পদ্য সাহিত্য এবং মুহর্রম মাসে শিয়া সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজমান শোক প্রকাশের সার্বিক পরিবেশ শিয়া ক্যালেন্ডারে এই ঘটনার গুরুত্বের স্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে। শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে আশুরা’ হচ্ছে বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।
তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কারবালা’র বিষয়টি বিস্তর মনোযোগ আকর্ষণ করলেও এই ঘটনা নিরবিচ্ছিন্নভাবে দুই পক্ষীয় (বিরোধ) হিসেবে চিত্রিত হয়ে চলেছে। এটাকে সদাসর্বদা দেখানো হচ্ছে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) বনাম এয়াযীদ হিসেবে; মিথ্যা ও জুলূমের বিরুদ্ধে সত্য-ন্যায়ের রুখে দাঁড়ানো হিসেবে। অনেক সুবিধাবাদী লোক আবার এমন কী এটাকে আহলে সুন্নাত (সুন্নী) ও শিয়া বিরোধের পর্যায়ে টেনে নিয়ে গিয়েছে।
কারবালার প্রকৃত ঘটনার প্রতি কেন্দ্রীভূত এই আংশিক প্রকাশ এবং এর দরুন সুবিধামতো আশূরা’র বিয়োগান্ত উপাখ্যান হতে মনোযোগ অন্যদিকে ফেরানোতে নিহিত রয়েছে আপনাআপনি আরেকটি বিয়োগান্ত উপাখ্যান। কেননা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর শাহাদাতকে ঘনঘন স্মরণ করা (ভাল কিন্তু) তাঁর বাহ্যিক বিরোধিতাকারী/শত্রু ও খুনিদের শনাক্ত করা, তাদের অভিসম্পাত দেয়া ও বিনাশ সাধন করা হলেও তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (প্রয়োজনের) মুহূর্তে যারা তাঁকে ছেড়ে পালিয়েছিলো, তাদের জন্যে কেউই ক্ষণিকের (জন্যও) উষ্মা প্রকাশের প্রয়োজনও বোধ করেন নি। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন ছায়াতে লুকোনো লোকগুলোকেই কারবালা’র প্রকৃত দুষ্কৃতকারী আখ্যা দেয়া বিহিত; আর এই লেখাটি তাদের চেহারা আলোতে আনার উদ্দেশ্যেই রচিত।
[আহলে বাইতের (সমর্থনকারী কুফাবাসী শিয়ারা) যারা (১২০০০-১৮০০০ লোক) ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পাশে দাঁড়ানোর শপথ করেছিল সর্বপ্রথম তারাই ইমামের কঠিন মুহূর্তে তাঁকে ধোঁকা দিয়ে ইয়াজিদ বাহিনীর সম্মুখে একা ছেড়ে দেন। তারা প্রকৃতপক্ষে নামে মাত্র প্রমিক ছিল আর পরে ইন্তেকালের পর তারাই সেই অনুশোচনা নিয়ে মাতম করার ঐতিহ্য চালু করেছিল আর নিজেদেরকে তওবাহকারী দল হিসেবে ঘোষণা করে। তারা নিজেদের আশেক দাবী করলেও বস্তুত তারাই সেই অভিশপ্ত জাতি যারা ইমামের দুর্দিনে মিরজাফরের মত বিশ্বাসঘতকতা করেছিল। কোন আশেক প্রাণ দিতে পারে কিন্তু কখনও বিশ্বাসঘাতক হতে পারে না।]
ঘটনার সূচনা হয়েছিলো ৬০ হিজরী সালের রমযান মাসে
ঘটনার সূচনা হয়েছিলো ৬০ হিজরী সালের রমযান মাসে, যখন ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (رضي اللّٰه عنه) মদীনা মোনাওয়ারা ত্যাগ করে মক্কা মোয়াযযমায় হযরত আব্বাস ইবনে আবদিল মুত্তালিব (رضي اللّٰه عنه)’এর গৃহে অবস্থানকালে কুফা নগরী থেকে পত্রসমূহ আসা আরম্ভ করেছিলো। এসব চিঠিতে এয়াযীদ ইবনে মু’আবিয়া’র বিরুদ্ধে বিদ্রোহে কুফাবাসী ‘ভক্ত-আশেক্বীন‘দেরকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে তাঁর প্রতি তাকিদ দেয়া হয়, আর তাঁকে কুফাবাসীদের বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের নিশ্চয়তাও দেয়া হয়। আমীরে মু’আবিয়া (رضي اللّٰه عنه) মাত্র দু মাস আগে বেসালপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর পুত্র এয়াযীদের প্রতি তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছিলো, যাকে দিয়ে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে বায়’আত গ্রহণ করানো হয়েছিলো। বিশেষ করে কুফাবাসী লোকেরা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর নেতৃত্বের দিকে তাকিয়েছিলো; আর তাই সহসা কুফা হতে স্রোতের মতো চিঠিপত্র আসা আরম্ভ করে। কোনো কোনো দিনে এ রকম ৬০০ চিঠি পর্যন্ত এসে পৌঁছুতো; পত্রবাহক-বর্গ কুফাবাসীদের কাছ থেকে তিনি কেমন সমর্থন পেতে যাচ্ছেন তারও উৎসাহব্যঞ্জক বিবরণ প্রদান করতো।
কুফা ছিলো একটি অনন্য স্থান, আর কুফাবাসীদের প্রকৃতিও ছিলো অদ্ভূত
কুফা ছিলো একটি অনন্য স্থান, আর কুফাবাসীদের প্রকৃতিও ছিলো অদ্ভূত। ইতিপূর্বে হিজরী ৩৭ সালে সায়্যিদুনা ইমামে আলী (كرم الله وجهه) তাঁর রাজধানী মদীনা মোনাওয়ারা হতে কুফা’য় স্থানান্তর করেছিলেন। সে সময় হতেই আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم)’এর পক্ষীয় হওয়ার দাবিদার লোকদের বসতিস্থল হয়ে ওঠে এই শহর। ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه)’এর সাথে হযরত মু’আবিয়া (رضي اللّٰه عنه)’এর ৪১ হিজরী সালে সম্পাদিত সন্ধির পরে ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه)’এর বাহিনীর অনেক সৈন্য কুফায় বসতি স্থাপন করে। হিজরী ৬০ সালে হযরত মু’আবিয়া (رضي اللّٰه عنه)’এর বেসালপ্রাপ্তির সময় শহরটিতে প্রচুর ইমামে আলী (كرم الله وجهه)-পক্ষীয় আবেগ-অনুভূতি বিরাজমান ছিলো। বস্তুতঃ শহরটি তখনো ইমামে আলী (كرم الله وجهه)-পক্ষীয় ছিলো। এমতাবস্থায় সুযোগ দেখা দেয়া মাত্রই কুফাবাসী, যারা নিজেদেরকে আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم)’এর শিয়া (সমর্থক) মনে করতো, তারা এয়াযীদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর শরণাপন্ন হয়।
ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে কুফার পরিস্থিতি যাচাই করার জন্যে সেখানে পাঠাতে মনস্থ করেন। তিনি পরিস্থিতি অনুকূল পেলে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে সে কথা লিখে জানাবেন, আর হযরত ইমাম (رضي اللّٰه عنه) সপরিবার মক্কা ত্যাগ করে তাঁর সাথে (কুফায়) যোগ দেবেন। মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه) যিলক্বদ মাসে কুফায় এসে পৌঁছেন। তাঁর আগমন সম্পর্কে জানতে পেরে কুফাবাসী লোকেরা মুসলিম ইবনে আওসাজাহ আল-আসাদী’র বাসভবনে উপস্থিত হয়, যেখানে মুসলিম বিন আক্বীল থাকছিলেন। সহসা ১২০০০ কুফাবাসী নিজেদের জান-মালের বিনিময়ে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর পক্ষ সমর্থন ও তাঁর সুরক্ষা দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তথা আনুগত্যের শপথ নেয়। তাদের এই সংখ্যা ১৮০০০ হলে মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه) যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হয়ে একজন সংবাদবাহককে প্রেরণ করেন কুফাবাসীর বায়’আতের বার্তা-সহ এবং তিনি ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে মক্কা হতে অগ্রসর হবার তাকিদ দেন।
কুফা নগরীতে সংঘটিত ঘটনাবলীর গুজব সহসা দামেশকে অবস্থিত এয়াযীদের কানে পৌঁছোয়। সে তৎক্ষণাৎ কুফার প্রাদেশিক শাসক নু’মান বিন বশীরকে বদলে নিষ্ঠুর উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়া’দকে নিয়োগ দেয় এই আদেশসহ যেনো হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়। ইবনে যিয়া’দ কুফায় প্রবেশ করে যিলহজ্জ্ব মাসের প্রথম দিকে; তার সাথে ঘোড়-সওয়ারী ছিলো (মাত্র) সতেরো জন সৈন্য। তার পাগড়ির প্রান্তভাগ মুখের ওপরে টানা থাকায় তাকে কেউই চিনতে সক্ষম হয় নি; আর কুফাবাসী লোকেরা যারা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতীক্ষায় ছিলো, তারা তাকে ভুল বশতঃ হযরত ইমাম (رضي الله عنه) মনে করে সাদর অভ্যর্থনা জানায় এই বলে: “সালাম/শান্তি আপনার প্রতি (বর্ষিত হোক), হে রাসূল (صلى اللّٰه عليه وسلم)‘এর পৌত্র!” এভাবেই ইবনে যিয়া’দ গুজব যে সত্য সে সম্পর্কে জানতে পারে। তার ঘোড়-সওয়ারী সৈনিকদের একজন যখন কুফাবাসীদের প্রতি চিৎকার করে বলে - “সরে দাঁড়াও! উনি প্রাদেশিক শাসনকর্তা উবায়দুল্লাহ বিন যিয়া’দ!” - কেবল তখনই কুফাবাসী লোকেরা নিজেদের মারাত্মক ভুল বুঝতে পারে।
প্রাদেশিক শাসনকর্তার বাসভবনে পৌঁছে ইবনে যিয়া’দ তার জনৈক সেবককে ব্যাগভর্তি ৩০০০ দিরহাম দিয়ে সিরীয় হিমস্ শহর থেকে আসন্ন বিপ্লবে অংশগ্রহণেচ্ছু নবাগত ব্যক্তি সেজে হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه) কোথায় অবস্থান করছেন সে খবরাখবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে। ওই সেবক তাঁকে হা’নী ইবনে উরওয়াহ’র গৃহে খুঁজে পায় এবং তাঁর হাতে আনুগ্রত্যের শপথ গ্রহণ করে। নগদ অর্থটুকু সে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’এর ভারপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ আবূ সুমা’মাহ আল-আমিরী’র কাছে হস্তান্তর করে। তাঁদের সাথে কিছুদিন অবস্থান করে তাঁদের গোপন কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে যা জানার তার অধিকাংশ জেনে সে ইবনে যিয়া’দের কাছে ফিরে যায় এবং তাকে সব কিছু জানায়। হা’নী ইবনে উরওয়াহ’কে আটক করা হয়। তিনি প্রথমে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’এর অবস্থান জানেন না বলে অভিযোগটি অস্বীকার করেন, কিন্তু যখন ‘হিমস্ নগরী হতে নবাগত’কে তাঁর সামনে হাজির করা হয়, তখন তিনি স্বীকার করে নেন। তথাপিও তিনি হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’এর অবস্থান প্রকাশে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) ইতোমধ্যে হা’নী ইবনে উরওয়াহ’র আটক হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে শোনেন। চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক মোকাবিলার ক্ষণ উপস্থিত বুঝে তিনি তাঁর রণ-হুঙ্কার দেন - ‘এয়া মানসূর!’ - যার ফলশ্রুতিতে তাঁর কাছে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী ৪০০০ কুফাবাসী আশপাশে জড়ো হয় এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তার দুর্গের দিকে অগ্রসর হয়। উবায়দুল্লাহ বিন যিয়া’দ যখন নিজের ফটকে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’কে কুফাবাসীদের সাথে দেখতে পায়, তখন সে কুফার কিছু গোত্রপতিকে তাদের নিজেদের লোকদের (মানে ৪০০০ জনের) সাথে আলোচনা করতে এবং তাদেরকে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) হতে দূরে সরাতে প্রেরণ করে; আর দামেশক হতে সেনাবাহিনী এসে পৌঁছুলে তাদের ওপর যে ক্রোধ পতিত হবে, সে সম্পর্কেও তাদেরকে সতর্ক করতে গোত্রপতিদের পাঠানো হয়। সহসা হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’এর সাথে অবস্থানরত সৈন্যদের মায়েরা তাদের পুত্রদের বলে, “বাড়ি ফিরে এসো, এখানে অন্য অনেক লোক আছে।” তাদের বাবারা আপন আপন পুত্রদের ভয়-জাগানো ভাষায় সতর্ক করে, “কাল কী হবে, যখন সিরীয় সেনাবাহিনী আগমন করা শুরু করবে? তখন তোমরা কী করবে?” এয়াযীদ ও তার সিরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) ও আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم)’এর (মহৎ) উদ্দেশ্যকে সমর্থন ও সুরক্ষার পবিত্র শপথ যে লোকেরা নিয়েছিলো, সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) তাঁর নিকটজন-সহ ঠিক ওই মুহূর্তে যাদের আনুগত্যের শপথের ওপর ভরসা রেখে কুফা অভিমুখে যাত্রারত ছিলেন, সেই কুফাবাসী লোকেরা ওই হুমকি ও নিরুৎসাহিতকরণের মুখে নিজেদের স্থির-সংকল্প ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। প্রাদেশিক শাসকের দুর্গে অবস্থিত ফটকের নিচেই তারা এক এক করে হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে ত্যাগ করে। সূর্যাস্ত নাগাদ তাঁর সাথে মাত্র ৩০ জন অবশিষ্ট থাকে। তিনি মাগরেবের নামাযে তাদের ইমামতি করেন এবং কুফার কিনদাহ বসতির দ্বারে সরে যান। সেই দ্বার দিয়ে তিনি প্রবেশ করেন মাত্র দশজনকে সাথে নিয়ে। তাঁর কোনো কিছু বোঝার আগেই কুফার রাস্তাগুলোতে তিনি নিজেকে একা দেখতে পান। ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে যারা এয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে এতো আগ্রহ সহকারে পত্র লিখেছিলো, আর কিছুদিন আগেও ১৮০০০ লোক যারা নিজেদের ডান হাত বাড়িয়ে প্রিয়নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর দৌহিত্রের যে আদর্শকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁরই পক্ষে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’এর হাতে আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলো, তাদের কেউই ওই রাতে নিজেদের সঙ্গ দ্বারা হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে উপস্থিত ছিলো না।
হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه) অবশেষে তেষ্টায় কাতর হয়ে একটি গৃহের দরজায় টোকা দেন। বাড়িতে বসতকারিনী বৃদ্ধা তাঁর পরিচয় জানার পর তাঁকে ঘরে প্রবেশ করতে দেন। তিনি তাঁকে লুকিয়ে রাখেন; কিন্তু তাঁর পুত্র যার থেকে ওই বৃদ্ধা নারী ওয়াদা নিয়েছিলেন কারো কাছে এ কথা প্রকাশ না করতে, সে কেবল সকাল অবধি অপেক্ষা করেছিলো, যতোক্ষণ না সে প্রাদেশিক শাসনকর্তার বাসভবনে এই খবর পৌঁছে দেয়। অতঃপর হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) বুঝতে পারেন ওই ঘরটি ঘেরাও দেয়া হয়েছে। তাঁর তরবারি বের করে তিনি আক্রমণকারীদেরকে তিনবার পিছু হটিয়ে দেন; কিন্তু তারা যখন ঘরে আগুন দিতে নেয়, তখনই তিনি ঘরের বাইরে এসে তাদেরকে মোকাবিলা করতে বাধ্য হন। তাঁকে আটক করার দায়িত্বপ্রাপ্ত আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আশ’আস্ তাঁর জীবনের নিরাপত্তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরই কেবল তিনি তরবারি অবনমন করেন। এটা একটা ভুল ছিলো, কেননা তারা তাঁর তরবারি কেড়ে নেয় এবং তাঁকে ইবনে যিয়াদের কাছে নেয়ার জন্যে একটা গাধার পিঠে চড়িয়ে দেয়। হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) বুঝতে পারেন তাঁর শাহাদাৎ অনিবার্য। তাঁর চোখ হতে অশ্রু বেয়ে পড়ে - নিজের তাক্বদীর/ভাগ্যের জন্যে নয়, বরং ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) ও তাঁর পরিবার-সদস্যদের দুশ্চিন্তায়, যাঁরা কঠোর, নির্দয় মরু অঞ্চল পাড়ি দিয়ে আরো কঠোর ও নির্দয় তাক্বদীরের তথা নিয়তির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন; অগ্রসর হচ্ছিলেন এমন এক শত্রুর দিকে, যে তাঁর (সাহসী) উদ্যোগের ইতি টানতে ছিলো বদ্ধপরিকর; আর অগ্রসর হচ্ছিলেন এমন এক বিশ্বাসঘাতক পক্ষের দিকে, সবচেয়ে প্রয়োজনের মুহূর্তে যাদের পক্ষত্যাগ তাঁর জীবনকে এই বিয়োগান্ত পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) ইবনে আল-আশ’আসের কাছে মিনতি করেন যাতে কেউ ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর কাছে নিম্নের বার্তাটি পৌঁছে দেন: “আপনার (হযরত ইমামের) কাছে ইবনে আক্বীল আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি আপনাকে বলেছেন, ‘আপনার পরিবারসহ আপনি ফেরত চলে যান। কুফার লোকদের দ্বারা ধোকাপ্রাপ্ত হবেন না। তারা আপনার পিতার সেই একই সমর্থক দল, যাদের কাছ থেকে আপনার পিতা একান্তভাবে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন - বেসালপ্রাপ্তি অথবা শাহাদাৎ দ্বারা। কুফাবাসী আমার কাছে মিথ্যে বলেছে, আপনার সাথেও মিথ্যাচার করেছে; আর একজন মিথ্যুকের কোনো জ্ঞান ও অনুভূতি নেই’।”
ওই দিন, ৯ই যিলহজ্জ্ব আরাফাত দিবসের পরের বেলায়
ওই দিন, ৯ই যিলহজ্জ্ব আরাফাত দিবসের পরের বেলায়, হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠানো হয়। তাঁকে সেখানে নেয়ার মুহূর্তে তিনি তসবীহ, তাহলীল, তাকবীর ও ইস্তিগফার পাঠ করেন। তাঁর শেষ কথাগুলো কুফাবাসীদের প্রতি নিজের চরম হতাশা প্রতিফলন করে: “হে আল্লাহ, আমাদের ও আমাদের লোকদের মাঝে আপনি-ই হোন বিচারক। তারা আমাদের প্রতারিত করেছে এবং আমাদের পক্ষত্যাগ করেছে।” কেল্লার সর্বোচ্চ চূড়া থেকে তাঁর শির মোবারক নিচে ধুলোয় পতিত হয় - তাদেরই জাজ্বল্যমান দৃষ্টির সম্মুখে, যাদের আমন্ত্রণ ও আনুগত্যের শপথ তাঁকে এতো আশান্বিত করেছিলো, অথচ যাদের কাপুরুষতা ও বিশ্বাসঘাতকতা তাঁকে হতাশা ছাড়া কিছু এনে দেয় নি। আর ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) তখন পথে….।
উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ স্রেফ সতেরো জন সৈন্যসহ কুফা শহরে প্রবেশ করেছিলো
উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ স্রেফ সতেরো জন সৈন্যসহ কুফা শহরে প্রবেশ করেছিলো। তাদের প্রতিজনের মাথায় হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’এর হাতে আনুগত্যের অঙ্গীকারকারী সহস্রাধিক কুফাবাসী ছিলো। অথচ তাঁকে রক্ষা করার জন্যে একটি তরবারিও ওঠানো হয়নি। তাঁর হত্যার প্রতিবাদে একটি কণ্ঠস্বরেরও সোচ্চার হওয়ার সৎসাহস হয়নি। আর এরা ওই একই লোক, যারা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে বলেছিলো, “আসুন, আমরা আপনার সাথে আছি।”
ইতিপূর্বে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’এর চিঠি পেয়ে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) কুফা অভিমুখে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কুফাবাসীদেরকে তাঁর আসন্ন আগমন সম্পর্কে জানাতে সহসা বার্তাবাহক ক্বায়স্ ইবনে মুস-হির’কে সেখানে প্রেরণ করেন। ওই বার্তাবাহককে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ আটক করে তাঁকে কেল্লার সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠিয়ে জনসমক্ষে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) ও তাঁর বাবাকে অভিসম্পাত দানের জন্যে আদেশ করে। কিন্তু তিনি এর পরিবর্তে সাইয়্যেদুনা আলী (كرم اللّٰه وجهه) ও সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং কুফাবাসীদেরকে হযরত ইমামের এ অভিমুখী যাত্রার কথা জানিয়ে তাদেরকে নিজেদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাঁকে সাহায্য করার জন্যে পরামর্শ দেন। বার্তাবাহক তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণ ইবনে যিয়াদের প্রতি অভিসম্পাতের দ্বারা সমাপ্ত করেন। এমতাবস্থায় ইবনে যিয়াদের আদেশে তাঁকে দুর্গের ওপর থেকে ফেলে দেয়া হয় এবং তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন। এই আবেগময় আবেদন সত্ত্বেও কুফাবাসী লোকেরা নির্বিকার ছিলো।
মক্কা নগরীর কিছু সংখ্যক গণ্যমান্য সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم) ও তাঁদের সন্তানেরা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে কুফায় গমন করা হতে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন; আর তাঁরা তাঁকে আপন পিতা (ইমামে আলী-ক:) ও ভ্রাতা (ইমাম হাসান-রা:)’এর প্রতি কুফাবাসীদের চপলতা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন। সর্ব-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, জাবের ইবনে আবদিল্লাহ, আবূ সাঈদ আল-খুদরী, তাঁর আপন ভাই মুহাম্মদ, এবং তাঁর ভায়রা ও কাজিন আবদুল্লাহ ইবনে জা’ফর (رضي اللّٰه عنهم) সবাই তাঁকে ইরাক্বে যেতে বারণ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর মনস্থির করে ফেলেছিলেন। অতঃপর যিলহ্জ্জ্ব মাসের ৮ তারিখ তিনি হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’এর করুণ পরিণতি সম্পর্কে না জেনেই মক্কা হতে (ইরাক্বের উদ্দেশ্যে) যাত্রা আরম্ভ করেন।
প্রায় এক মাসব্যাপী কষ্টকর এক সফরশেষে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর দল ইরাক্বে পৌঁছেন। সেখানেই তিনি কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’এর শাহাদাতের খবর প্রথম জানতে পারেন। পরবর্তী সময়ে তিনি (বার্তাবাহক) ক্বায়স ইবনে মুস-হিরের শাহাদতের খবরও শুনতে পান। বেশ কিছু সংখ্যক মরুভূমির আরবীয় লোক ইত্যবসরে তাঁর দলে যোগ দিয়েছিলো এই ভেবে যে, কুফা বুঝি বাস্তবিকই তাঁর অধীনে চলে এসেছে (এতোদিনে)। ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমাদের শী’আহ (সাহায্যকারী) আমাদেরকে ত্যাগ করেছে। অতএব, যার এখান থেকে চলে যাওয়ার ইচ্ছা হয়, সে এ ব্যাপারে স্বাধীন।” সহসা তাঁকে ছেড়ে সবাই চলে যায়, স্রেফ তাঁর সাথে যারা মক্কা হতে যাত্রা করেছিলেন তাঁরা ছাড়া।
কুফা নগরীর ওপর ইবনে যিয়াদ কড়া নজরদারি বসিয়েছিলো
কুফা নগরীর ওপর ইবনে যিয়াদ কড়া নজরদারি বসিয়েছিলো। যখন ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর আগমনের বার্তা তার কাছে পৌঁছোয়, সে পারস্যের - دیلمیان - দে’লামিয়্যা’ন যোদ্ধাদের সাথে লড়বার জন্যে অগ্রসরমান ৪০০০ সেনার একটি শক্তিশালী দলকে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর মোকাবিলায় প্রেরণ করে। এই সৈন্যদেরকে উমর ইবনে সা’আদের নেতৃত্বের অধীনে দেয়া হয়। এই বাহিনীর দ্বারা কুফা ত্যাগ কুফাবাসী লোকেরা যে নিজেদের চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলো, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি আনুগত্যের শপথ, যা তারা হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’এর হাতে নিয়েছিলো, তার সম্মান রক্ষা করার শেষ সুযোগ হতে পারতো এটাই। এটাই ছিলো প্রিয়নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর দৌহিত্রের পাশে দাঁড়ানোর চূড়ান্ত সুযোগ। কেননা তাদেরই আমন্ত্রণ ও সাহায়্যের আশ্বাসে তিনি নিরাপদ মক্কা মোয়াযযমা ত্যাগ করে ইরাক্বের নিরাপত্তাহীন যুদ্ধক্ষেত্রে আসার উৎসাহ পেয়েছিলেন। কিন্তু কুফাবাসীর মধ্যে আরেকবার বিশ্বস্ততা, সৎসাহস ও অঙ্গীকারবদ্ধতায় ঘাটতি দৃশ্যমান হয়। স্রেফ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ কারবালায় ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর সাথে যোগ দেন।
অতঃপর ১০ই মুহর্রমের সূর্য যখন অস্তমিত হয়, ততোক্ষণে কুফাবাসী বে-ঈমান শী’আহ’দের প্রায়শ্চিত্ত করার সময় শেষ হয়ে গিয়েছিলো; কেননা কারবালার বালুকাময় ভূমি ততোক্ষণে সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) ও তাঁর একাত্তর জন অনুসারীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো।
চার বছর পরে কুফাবাসী শী’আহ চক্র
চার বছর পরে কুফাবাসী শী’আহ চক্র হযরত রাসূলুল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর পরিবার-সদস্যদের পক্ষ ত্যাগে নিজেদের পাপ মোচনের এক চেষ্টা চালায়। কুফাবাসীদের মধ্য হতে এমন একটি দল আবির্ভূত হয়, যারা নিজেদের ’তাওওয়া’বূন’ (তওবাকারী) নামে অভিহিত করে; এই লোকেরা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর হত্যাকারীদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করাকে নিজেদের কর্তব্য হিসেবে নেয়। ইবনে যিয়াদের পিছু ধাওয়া করে সিরিয়া যাওয়ার পথে তারা কারবালা অতিক্রম করে, যেখানে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর পবিত্র মাযার শরীফ অবস্থিত। এখানেই তারা উচ্চস্বরে (মেকি) কান্না জুড়ে দেয় এবং সারা রাত ওই বিয়োগান্ত ঘটনার আহাজারিতে অতিবাহিত করে, যে ঘটনা তারাই চার বছর আগে ঘটতে দিয়েছিলো (নিষ্ক্রিয়তা দ্বারা)। তারা যদি ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর সবচেয়ে প্রয়োজনের মুহূর্তে তাঁর জন্যে ওই একই দরদ দেখাতে পারতো, তাহলে ইসলামের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো।
কতিপয় নির্দিষ্ট লেখক ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে পরিত্যাগের (মানে গাদ্দারির) অপরাধ হতে শী’আহ চক্রকে মুক্তিদানের অপচেষ্টা চালিয়েছেন। কেউ কেউ আবার প্রাদেশিক শাসক ইবনে যিয়াদের কুফা শহর অবরোধ বা ঘেরাওয়ের অজুহাত দেখিয়েছেন। এস, এইচ, এম, জা’ফরী নিজ ‘Origins and Early Developments of Shi’ah Islam’ পুস্তকে লেখেন:
….এটা আবারো লক্ষণীয় যে, কুফা ও তার আশপাশ এলাকায় আসার রাস্তাগুলোতে অবরোধ আরোপের ফলে কুফার শী’আহ যারা লুকিয়ে ছিলো, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের এবং বসরা’র মতো শহরগুলোতে বসবাসকারী শী’আহ লোকদের জন্যে (শহরে প্রবেশ) প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। [১৯৮ পৃষ্ঠা, আনসারিয়ান পাবলিকেশনস্, ক্বুম, এন.ডি.]
কুফাবাসী শী’আহ গোষ্ঠীর দল ত্যাগের এই ব্যাখ্যাটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না, যখনই কেউ বিবেচনায় নেন হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’এর হাতে বায়’আহ গ্রহণে তাদের বিশাল সংখ্যাটিকে (১৮০০০ লোক)। পক্ষান্তরে, আমরা দেখেছি ইবনে যিয়াদ মাত্র ১৭ জন সেনা নিয়ে কুফায় প্রবেশ করেছিলো। এমন কী সাইয়্যেদুনা হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর বিরুদ্ধে লড়তে সে যে বাহিনী পাঠিয়েছিলো, তাদের সংখ্যাও ছিলো মাত্র ৪০০০ সৈন্য [নোট: কিছু শিয়া সূত্রে প্রদত্ত এবং সম্প্রতি স্থানীয় রেডিওতে উদ্ধৃত ৮০,০০০ সেনার সংখ্যাটি স্পষ্টতঃ কাল্পনিক। নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্রগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া ছাড়াও এ দাবির উৎস যে আবেগময় শিয়া অতিশয়োক্তি তা স্বতঃপ্রমাণিত]। অধিকন্তু, ওই বাহিনী সুনির্দিষ্টভাবে কারবালার জন্যে প্রস্তুত করা হয়নি; সেটা কুফা অতিক্রম করছিলো স্রেফ পারসিক দে’লামিয়্যা’ন সেনাদের সাথে লড়বার উদ্দেশ্যে। ইবনে যিয়াদ কুফাবাসীদেরকে এ রকম বাহিনী দ্বারা বশ্যতা স্বীকার করাতে পারবে বলে ধারণা করা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা তারা সংখ্যায় ওই বাহিনীর চেয়ে ঢের বেশি ছিলো। না, তাদের নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতা ও চপলতা-ই (মানে গাদ্দারি-ই) ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর পক্ষ ত্যাগে তাদেরকে পরিচালিত করেছিলো। তারা হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে যেভাবে ফেলে পালিয়েছিলো, তা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট পরিদৃষ্ট হয়।
শিয়াপন্থী লেখকদের এমনও দাবি করার প্রবণতা রয়েছে যে, সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর পক্ষ যারা ত্যাগ করেছিলো, তারা শী’আহ নয়। জা’ফরী লেখেন:
….ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে যারা কুফায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো এবং তাঁর প্রতিনিধি হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’এর কাছে যে ১৮,০০০ লোক আনুগত্যের অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করেছিলো, তাদের সবাই শী’আহ শব্দটির ধর্মীয় পরিভাষাগত অর্থে শী’আহ ছিলো না, বরঞ্চ তারা ছিলো হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর ঘরের মানুষদের (মানে বংশধরদের) রাজনৈতিক আদর্শগত সমর্থক - এই পার্থক্যটুকু মাথায় অবশ্যই রাখতে হবে, যাতে শিয়াবাদী ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাস (সহজে) বোঝা যায়। [জা’ফরী, ‘Origins and Early Developments of Shi’ah Islam', ১৯৫ পৃষ্ঠা]
সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর দলত্যাগকারী
সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর দলত্যাগকারী লোকদেরকে (’রাজনৈতিক’ আদর্শের বিপরীতে) ইমামে আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর বংশের ‘ধার্মিক’ সমর্থকদের কাতার থেকে বাইরে রাখার বেলায় জা’ফরীর (গোপন) উদ্দেশ্য একদম পরিষ্কার। তিনি স্পষ্টতঃ এই বাস্তবতার ব্যাপারে বিব্রত যে, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে শী’আহ গোষ্ঠী নিজেরাই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁকে ও তাঁর পরিবার-সদস্যদেরকে পরিত্যাগ করেছিলো। এই ‘ধর্মীয়’ ও ‘রাজনৈতিক’ সমর্থকদের কথিত পার্থক্যের ধারণাটি আমরা প্রত্যাখ্যান করি এই বাস্তবতার আলোকে যে, খোদ ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) একাধিক স্থানে কুফাবাসীদেরকে তাঁর শী’আহ (সাহায্যকারী) বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এছাড়াও বহুবার কুফাবাসীদেরকে তাঁর পিতা (হযরত আলী-ক:) ও ভাই (ইমাম হাসান-রা:)’এর অনুসারী (যদিও অনির্ভরযোগ্য অনুসারী) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আমরা যদি ধরেও নেই যে ‘ধর্মীয়’ দিক থেকে তাদের অনেকে, এমন কী বেশির ভাগও শী’আহ ছিলো না, তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন দাঁড়ায়: প্রকৃত শী’আহবর্গ কোথায় ছিলো যখন তাদের ইমামের সবচেয়ে বেশি সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিলো? তাঁরা কি ওই হাতে গোনা মানুষগুলো যাঁরা কুফা থেকে (কারবালায়) আবির্ভূত হয়েছিলেন? এটা সত্যি আশ্চর্যজনক যে, শিয়াদের দ্বারা কুফার দলত্যাগকারীদেরকে নিজেদের বলে গ্রহণ করাতে শত অনিচ্ছা ব্যক্ত হলেও তারা তওওয়াবূন (তওবাকারীদের) আন্দোলনের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত বা চিহ্নিত করতে ভীষণ গর্বিত ও আগ্রহান্বিত হন। এই তওওয়াবূন আন্দোলনের গোড়াপত্তনের সময় যে সব ভাষণ দেয়া হয়েছিলো, তাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে ওরা ওই একই লোক যারা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে দাওয়াত করে এনেছিলো এবং পরে ছেড়ে পালিয়েছিলো [প্রাগুক্ত জা’ফরী, ‘Origins and Early Developments of Shi’ah Islam’, ২২৩ পৃষ্ঠা]। এক্ষেত্রে তাদের নামগুলোই নিজেদের অপরাধের ইঙ্গিতবহ। শী’আহদের দ্বারা এ অপরাধ থেকে নিজেদেরকে দায়মুক্ত করার অপপ্রয়াসটুকু হতাশাব্যঞ্জক ছাড়া আর কিছু নয়।
কারবালার ঘটনা রাসূলুল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর আহলে বায়ত (رضي الله عنه) তথা বংশধরবৃন্দের সাথে শী’আহদের বিশ্বাসঘাতকতার সবশেষ দৃষ্টান্ত ছিলো না
কারবালার ঘটনা রাসূলুল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর আহলে বায়ত (رضي الله عنه) তথা বংশধরবৃন্দের সাথে শী’আহদের বিশ্বাসঘাতকতার সবশেষ দৃষ্টান্ত ছিলো না। ষাট বছর পরে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর পৌত্র হযরত যায়দ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন (رحمة اللّٰه عليه) উমাইয়া শাসক হিশাম ইবনে আবদিল মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ৪০,০০০ লোকের কাছ থেকে আনুগত্যের অঙ্গীকার পেয়েছিলেন, যার মধ্যে ১৫০০০ লোকই ছিলো ওই একই কুফাবাসী যারা তাঁর পিতামহের পক্ষত্যাগ (গাদ্দারি) করেছিলো। এই দফায় যুদ্ধ আরম্ভ হবার প্রাক্কালে তারা খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে হযরত যায়দ (رحمة اللّٰه عليه)’এর কাছে সর্ব-হযরত খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও খলীফা উমর ফারূক্ব (رضي اللّٰه عنهما) সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চায়। তিনি উত্তর দেন: “আমি কখনো শুনি নি আমার পরিবার-সদস্যবৃন্দের কেউ (মানে উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কেউ) তাঁদের দু জনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন; আর তাঁদের সম্পর্কে ভালো ছাড়া কিছু আমি বলি না।” এই উত্তরে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে তারা দল বেঁধে পরিত্যাগ করে এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে যে, প্রকৃত ইমাম হতে পারেন একমাত্র তাঁরই ভাতিজা হযরত জা’ফর আল-সা’দিক্ব (رحمة اللّٰه عليه)। চল্লিশ হাজার সৈনিকের মধ্য হতে হযরত যায়দ (رحمة اللّٰه عليه)’এর কাছে অবশিষ্ট থাকে মাত্র কয়েক শত। দলত্যাগকারীদের প্রস্থানের সময় তিনি মন্তব্য করেন: “আমি শঙ্কিত যে তারা আমার সাথে তা-ই করেছে, যা তারা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর সাথে করেছিলো।” হযরত যায়দ (رحمة اللّٰه عليه) ও তাঁর ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন এবং শাহাদাৎ বরণ করেন। ফলে ১২২ হিজরী সালের ১লা সফর, বুধবার, আহলে বায়ত (رضي الله عنه)’এর আরেকজন সদস্য কুফাবাসী শী’আহ চক্রের বিশ্বাসঘাতকতার শিকারে পরিণত হন [মুহাম্মদ আবূ যাহরা’, ‘তারীখুল মাযা’হিবিল-ইসলা’মিয়্যাহ’, ৬১৩ পৃষ্ঠা; দারুল ফিকর্ আল-আরবী, কায়রো, এন.ডি.]। এক্ষণে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না তাঁকে পরিত্যাগকারীরা কুফাবাসী শী’আহ ছিলো কী ছিলো না।
সহস্র সহস্র শী’আহ যারা হযরত যায়দ (رحمة اللّٰه عليه)’কে পরিত্যাগ করেছিলো
সহস্র সহস্র শী’আহ যারা হযরত যায়দ (رحمة اللّٰه عليه)’কে পরিত্যাগ করেছিলো, তাদের দ্বারা হযরত জা’ফর সাদিক্ব (رحمة اللّٰه عليه)’কে নিজেদের প্রকৃত ইমাম বিবেচনা করার বাস্তবতা পরিস্ফুট করে যে, তারা মোটামুটি ইসনা’ আশারী গোষ্ঠী কিংবা বর্তমানকালের ইমামী বা জা’ফরী শিয়া সম্প্রদায়ের মতোই একটি দল ছিলো। ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (رحمة اللّٰه عليه)’এর এতো এতো ভক্ত-অনুসারী থাকা সত্ত্বেও কেন তাহলে তিনি উমাইয়া বা আব্বাসীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন নি? এই প্রশ্নের উত্তর একটি বর্ণনায় প্রদান করা হয়েছে, যা লিপিবদ্ধ আছে আবূ জা’ফর আল-কুলাইনী’র বিশাল ‘আল-কা’ফী’ পুস্তকে। এ বইটি শিয়াদের হাদীস সংকলনগুলোর মাঝে অদ্বিতীয় মর্যাদা ভোগ করে থাকে। বর্ণিত আছে:
সুদাইর আল-সায়রাফী বলেন: আমি আবূ আবদিল্লাহ (মানে ইমাম জা’ফর সাদিক্ব- رحمة اللّٰه عليه)’এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বলি, “আল্লাহর কসম, আপনি অস্ত্র সংবরণ করে থাকতে পারেন না।” তিনি প্রশ্ন করেন, “কেন?” আমি উত্তর দেই, “কারণ আপনার এতো এতো সমর্থক ও সাহায্যকারী (শী’আহ)। আল্লাহর শপথ, যদি আমীরুল মো’মেনীন হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه) আপনার মতো এতো বিশাল সংখ্যক শী’আহ ও সমর্থক পেতেন, তাহলে তাইম (হযরত আবূ বকরের গোত্র) ও আদী (হযরত উমরের গোত্র) ও রকম পরিকল্পনা দ্বারা কখনোই তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন না।” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “আর তাদের সংখ্যা কতো হতে পারে, ওহে সুদাইর?” আমি বলি, “এক শ হাজার (মানে এক লাখ)।” তিনি প্রশ্ন করেন, “এক শ হাজার?” আমি উত্তর দেই, “জি, এবং দুই শ হাজার (মানে দু লাখ)।” তিনি আবার প্রশ্ন করেন, “দুই শ হাজার?” আমি উত্তর করি, “জি, এবং দুনিয়ার অর্ধেক।” ইমাম জা’ফর সাদিক (رحمة اللّٰه عليه) নিশ্চুপ থাকেন। এরপর তিনি বলেন, “তুমি কি আমাদের সাথে এয়ানবু বন্দরে আসবে?” আমি হ্যাঁ-সূচক জবাব দেই। তিনি একটি খচ্চর ও একটি গাধাকে জিন পরাতে আদেশ করেন। আমি দ্রুত গাধার পিঠে চড়ে বসি, কিন্তু তিনি বলেন, “সুদাইর, তুমি বরং আমাকে গাধার পিঠে চড়তে দেবে কি?” আমি বলি, “খচ্চর অনেক শোভনীয় এবং অভিজাতও।” কিন্তু তিনি বলেন, “গাধা আমার কাছে বেশি আরামদায়ক।” এরপর আমি সওয়ার থেকে নেমে যাই। তিনি তাতে চড়েন, আর আমি খচ্চরে উঠে বসলে আমরা চলা শুরু করি। নামাযের সময় আগমন করলে তিনি বলেন, “সুদাইর, নামো। চলো আমরা নামায আদায় করি।” এরপর তিনি মন্তব্য করেন, “এই মাটি শেওলা আবৃত; এখানে নামায আদায় করা জায়েয নেই।” এমতাবস্থায় আমরা সওয়ারে চড়ে এগোতে থাকি যতোক্ষণ না আমরা এমন স্থানে পৌঁছুই যেখানকার মাটি লাল। তিনি (সেখানকার) মেষচারক বালকটির দিকে তাকিয়ে বলেন, “সুদাইর, আল্লাহর কসম, এখানে যে পরিমাণ ভেড়া আছে, আমার যদি সে সংখ্যক শী’আহ থাকতো, তাহলে অস্ত্র সংবরণ করা আমার জন্যে গ্রহণযোগ্য হতো না।” অতঃপর আমরা সওয়ার থেকে নেমে নামায আদায় করি। আমাদের নামায শেষ হলে আমি মেষ গণনার উদ্দেশ্যে ফিরে তাকাই। সেখানে (মাত্র) সতেরোটি ভেড়া ছিলো। [আল-কুলাইনী, ‘আল-কা’ফী’ (উসূল), ২য় খণ্ড, ২৫০-২৫১ পৃষ্ঠা (দারুল্ আদওয়া, বৈরুত, ১৯৯২]
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (رحمة اللّٰه عليه)’কে তাঁর অনুসারী
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (رحمة اللّٰه عليه)’কে তাঁর অনুসারী দাবিদারদের সম্পর্কে এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছিলো, যা বর্তমানকালের শিয়া গোষ্ঠী আজো অস্বীকার করে চলেছে: আর তা হলো, রাসূলুল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর আহলে বায়ত তথা পরিবার-সদস্যদের কষ্টভোগ ও দুর্ভাগ্যের পেছনে শী’আহ চক্রের ভূমিকা তাঁদের বহিঃশত্রুদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলো না, যদি বেশি না হয়ে থাকে। অতএব, এটা আশ্চর্যের কোনো বিষয় নয় যে, ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর পরে (শিয়াদের) ধারণাকৃত ইমামদের কেউই তাঁদের সময়কার শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের চেষ্টা করেন নি। কারবালা তাঁদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলো ওই সব লোকের চপলতা (গাদ্দারি) ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে, যারা তাঁদের শী’আহ (সাহায্যকারী) দাবি করেছিলো। তাদেরই সম্পর্কে ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (رحمة اللّٰه عليه) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “কেউই আমাদের প্রতি এতোখানি ঘৃণা পোষণ করে না, যেমনটি করে থাকে আমাদের প্রতি প্রেম-ভক্তির দাবিদার-বর্গ” [আবদুল্লাহ আল-মা’মাক্বা’নী, ‘মিক্ববা’স আল-হিদা’য়া’, ২য় খণ্ড, ৪১৪ পৃষ্ঠা (মু’আস-সাসাত আ’লে আল-বায়ত লি-ইহইয়া আত তুরা’স্, বৈরুত, ১৯৯১); ‘রিজা’ল আল-কাশশী’ হতে উদ্ধৃত]। বর্ণিত আছে যে ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (رحمة اللّٰه عليه) আরো বলেন: “মোনা’ফিকূন-বর্গের প্রতি আয়াত আল্লাহতা’লা অবতীর্ণ করেন নি, শুধু শী’আহ-তন্ত্র প্রচারকবর্গ ছাড়া” (মানে তাদেরই উদ্দেশ্যে আয়াতগুলো নাযেলকৃত) [প্রাগুক্ত ২য় খণ্ড, ৪০৭ পৃষ্ঠা]।
ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর বড় ভাই ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه)-ও ইতিপূর্বে কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন। বিখ্যাত শিয়াপন্থী লেখক আবূ মানসূর আত্ তাবারসী নিজ ‘আল-এহতেজা’জ’ পুস্তকে সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه)’এর নিম্নোক্ত মন্তব্যটি সংরক্ষণ করেন: “আল্লাহর কসম, আমি মনে করি আমার শী’আহ (সাহায্যকারী) দাবিদার এসব লোক থেকে আমীরে মু’আবিয়া (رضي اللّٰه عنه) আমার জন্যে অধিকতর শ্রেয়।” [আবূ মানসূর তাবারসী, ‘আল-এহতেজা’জ’, ২য় খণ্ড, ২৯০-২৯১ পৃষ্ঠা (মু’আস-সাসাত আল-আ’লামী, বৈরুত, ১৯৮৯]
সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه)
সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه) যখন তাঁর তথাকথিত শী’আহ গোষ্ঠীর চপলতায় অতিশয় ক্রুদ্ধ হন, তখন তিনি আমীরে মু’আবিয়া (رضي اللّٰه عنه)’এর সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ একজন আমীরে মু’অবিয়া (رضي اللّٰه عنه)’এর সাথে শান্তি স্থাপনের ফলে শী’আহ চক্রকে অপমানিত করা হয়েছে মর্মে প্রতিবাদ করলে ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه) জবাব দেন:
আল্লাহর কসম, আমি তাঁর (আমীরে মু’আবিয়া - رضي اللّٰه عنه)’এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছি অন্য কোনো কারণে নয়, বরং এ কারণে যে আমি কোনো সমর্থক খুঁজে পাইনি। আমি যদি সমর্থক খুঁজে পেতাম, তাহলে তাঁর সাথে রাত-দিন লড়তাম যতোক্ষণ না আল্লাহ আমাদের মাঝে (কারো পক্ষে) সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু আমি কুফাবাসীদের জানি এবং চিনি। তাদের ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা আছে। তাদের মধ্যে মন্দ লোকেরা আমার জন্যে উত্তম নয়। তাদের নেই কোনো বিশ্বস্ততা/আনুগত্য; নেই কথা ও কাজে কোনো সততা বা ন্যায়পরায়ণতা। তাদের মধ্যে রয়েছে মতপার্থক্য। তারা দাবি করে তাদের অন্তর আমাদের (মানে আহলে বায়তের) প্রতি নিবেদিত, অথচ তাদের তরবারি আমাদের বিরুদ্ধে রয়েছে উন্মুক্ত, কোষমুক্ত। [আল-কুলাইনী, ‘রওদা’তুল কা’ফী’, ৮ম খণ্ড, ২৮৮ পৃষ্ঠা]
ইমাম মূসা কা’যিম (رحمة اللّٰه عليه), যিনি ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (رحمة اللّٰه عليه)’এর পুত্র ও শিয়াদের ধারণাকৃত সপ্তম ইমাম, তিনি শী’আহ গোষ্ঠী সম্পর্কে নিচের বর্ণনাটি প্রদান করেন:
আমার শী’আহ (সাহায্যকারীদের) সম্পর্কে যদি সত্যি আমাকে মূল্যায়ন করতে হয়, তাহলে আমি তাদেরকে পেয়েছি ভণ্ড বা ভানকারী হিসেবে। আমি তাদেরকে পরীক্ষায় ফেল্লে কেবল ধর্মত্যাগী (মুরতাদ্দ) হিসেবেই পাবো। আমি তাদেরকে যাচাই-বাছাই করলে হাজারে কেবল একজনকে (খাঁটি হিসেবে) পাবো। আর আমি তাদেরকে তুষ বাছাই করলে স্রেফ মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে পাবো যারা সত্যি আমার (অনুসারী)। তারা বরাবরই গদির ওপর বসে এ কথা বলে আসছে - “আমরা ইমামে আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর শী’আহ/সাহায্যকারী।”
আজকে আশূরা’কে (১০ই মহর্রমকে) যদি (ন্যায়ের) সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার দিবস হিসেবে স্মরণ করতে হয়, তাহলে এ দিনটিকে আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা ও দলত্যাগের দিবস হিসেবেও স্মরণ করতে হবে। যখন এয়াযীদ, উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ, উমর বিন সা’আদ ও শিমর ইবনে যিল জওশানের নামগুলো উচ্চারিত হবে এবং তাদের স্মৃতির প্রতি অভিসম্পাত দেয়া হবে, তখন যেনো কুফাবাসী শী’আহদের বিশ্বাসঘাতকতার কথাও আমরা ভুলে না যাই। শিয়া গোষ্ঠী কর্তৃক তাদের আশূরা অনুষ্ঠানে একটি বিষয়ের পুনঃপ্রবর্তন দীর্ঘকাল বাকি পড়েছে, আর তা হলো তওওয়াবূনের প্রথম স্মারক অনুষ্ঠানের অংশটি। সেই হারানো অংশটি হচ্ছে সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (رضي اللّٰه عنه)’এর পবিত্র রক্ত ঝরানোতে ইবনে যিয়াদ, এয়াযীদ ও অন্যান্যদের পাশাপাশি শী’আহ’দের নিজেদেরও অপরাধ স্বীকার করা।
*সমাপ্ত*
[রেফারেন্স: এই ইতিহাসভিত্তিক গবেষণার অধিকাংশ তথ্য-উপাত্ত ইবনে কাসীরের ‘আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ’ পুস্তক হতে গ্রহণ করা হয়েছে। আবদুর রাযযাক্ব আল-মূসাভী আল-মুক্বার্রম রচিত ‘মাক্বতাল আল-হুসাইন’ (৫ম সংস্করণ, প্রকাশক- মাকতাবাহ বাসীরাতী, ক্বুম, ১৩৮২ হিজরী) শীর্ষক শিয়া ইতিহাসগ্রন্থেরও সহায়তা নেয়া হয়েছে]
__________∆__________
Comments
Post a Comment