জিকরুল্লাহ ও আল্লাহ সম্পর্কিত আকিদা

জিকরুল্লাহ ও আল্লাহ সম্পর্কিত আকিদা

সংকলকঃ মাসুম বিল্লাহ সানি

জিকরুল্লাহ
------------

মহান আল্লাহ তা'য়ালা ক্ষমাশীল
____________________
মহান আল্লাহ তা'য়ালা ক্ষমাশীলঃ

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালার হাজারোগুণের একটি গুণ হলো ক্ষমা। ক্ষমার গুণে তিনি গুণান্বিত।
মহান আল্লাহ সেই গুণের কথা কোরআনে বারবার উল্লেখ করেছেন। যে শব্দে তিনি তাঁর ক্ষমার গুণ উল্লেখ করেছেন তা হলো ‘গফুর’ (غَفُورٌ) আরবী গফুর শব্দের অর্থ হলো- অধিক পরিমাণে ক্ষমা প্রদর্শন করা, বান্দার দোষ গোপন করা,।

আরবি ব্যাকারণগত অর্থে গফুর হলো সদা ক্ষমা করা। যে সত্তা ক্ষমা করতে করতে নিজেই ক্ষমার গুণে গুণান্বিত হয়ে যায় সেই সত্তাকে গফুর বলে।

এই ‘গফুর’ শব্দটি স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে ৪৮টি আয়াতে। এছাড়াও আরো বহুস্থানে ভিন্ন শব্দে অন্য বয়ানে আল্লাহর ক্ষমাশীলতা বর্ণনা করা হয়েছে। শুধুমাত্র গফুর শব্দটি আছে। এই গফুর শব্দসম্ভলিত আয়াতগুলোর বিশেষ ফজিলত আছে। কেউ শুধু এগুলো পাঠ করে দোয়া বা তওবা করলে তওবা কবুল হয়। আজকে সেই আয়াতগুলোই অর্থসহ জানবো, ইনশাল্লাহ।

(১)
إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘তিনি তো তোমাদের জন্য কেবল মৃত জন্তু রক্ত ও শুকরের গোশত হারাম করেছেন এবং সেই জন্তুও, যার প্রতি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারণ করা হয়। হ্যাঁ, কোনো ব্যক্তি যদি চরম অনন্যোপায় অবস্থায় থাকে (ফলে এসব বস্তু হতে কিছু খেয়ে নেয়) আর তার উদ্দেশ্য মজা ভোগ করা না হয় এবং সে (প্রয়োজনের) সীমা অতিক্রমও না করে, তবে তার কোনো গুনাহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা: বাকারাহ, আয়াত: ১৭৩)
(২)
فَمَنْ خَافَ مِنْ مُوصٍ جَنَفًا أَوْ إِثْمًا فَأَصْلَحَ بَيْنَهُمْ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘হ্যাঁ, কারোর যদি আশঙ্কা হয়, ওসিয়তকারী অন্যায় পক্ষপাতিত্ব বা গুনাহের কাজ করবে আর সে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মীমাংসা করে দেয় তবে তার কোনো গুনাহ হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সূরা: বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫)
(৩)
فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘অতপর তারা যদি নিরস্ত হয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সূরা: বাকারাহ, আয়াত: ১৯২)
(৪)
ثُمَّ أَفِيضُوا مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : তাছাড়া (একথা স্মরণ রেখ যে,) তোমরা সেই স্থান থেকেই রওয়ানা হবে, যেখান থেকে অন্যান্য লোক রওয়ানা হয়। আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সুরা বাকারাহ : আয়াত নং ১৯৯)
(৫)
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَتَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘(অপর দিকে) যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ কেরেছে, তারা নিঃসন্দেহে আল্লাহর রহমতের আশাবাদী। আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা: বাকারাহ, আয়াত: ২১৮)
(৬)
لِلَّذِينَ يُؤْلُونَ مِنْ نِسَائِهِمْ تَرَبُّصُ أَرْبَعَةِ أَشْهُرٍ فَإِنْ فَاءُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘যারা নিজেদের স্ত্রীদের নিকট গমন করবে না বলে কসম খেয়ে বসে তাদের জন্য চার মাসের অবকাশ রয়েছে অতঃপর যদি পারস্পরিক মিল-মিশ করে নেয়, তবে আল্লাহ ক্ষামাকারী দয়ালু।’ (সূরা: বাকারাহ, আয়াত: ২২৬)
(৭)
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘(হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু ‘ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)
(৮)
إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘অবশ্য যারা এর পরও তাওবা করবে ও নিজেদেরকে সংশোধন করবে, (তাদের জন্য) আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৮৯)
(৯)
وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘আকাশমন্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা আল্লাহরই। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন, আর যাকে চান শাস্তি দেন। আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ১২৯)
(১০)
وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ مِنْكُمْ طَوْلًا أَنْ يَنْكِحَ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ فَمِنْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ فَتَيَاتِكُمُ الْمُؤْمِنَاتِ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِإِيمَانِكُمْ بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ فَانْكِحُوهُنَّ بِإِذْنِ أَهْلِهِنَّ وَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ مُحْصَنَاتٍ غَيْرَ مُسَافِحَاتٍ وَلَا مُتَّخِذَاتِ أَخْدَانٍ فَإِذَا أُحْصِنَّ فَإِنْ أَتَيْنَ بِفَاحِشَةٍ فَعَلَيْهِنَّ نِصْفُ مَا عَلَى الْمُحْصَنَاتِ مِنَ الْعَذَابِ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ الْعَنَتَ مِنْكُمْ وَأَنْ تَصْبِرُوا خَيْرٌ لَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘তোমাদের মধ্যে যারা স্বাধীন মুসলিম নারীদের বিবাহ করার সামর্থ্য রাখেনা, তারা তোমাদের অধিকারভুক্ত মুসলিম দাসীদেরকে বিবাহ করতে পারে। আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তোমরা সকলে পরস্পরে সমতুল্য। সুতারাং সেই দাসীদেরকে তাদের মালিকদের অনুমতিক্রমে বিবাহ করবে এবং তাদেরকে ন্যায়ানুগভাবে তাদের মাহর প্রদান করবে। এই শর্তে যে, (বিবাহের মাধ্যমে) তাদের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করা হতে, তারা কেবল কাম-চরিতার্থকারিণী হবে না এবং গুপ্ত প্রণয়ী গ্রহণকারিনীও নয়। তারা যখন বিবাহের হেফাজতে এসে গেল, তখন যদি কোনো গুরুতর অশ্লীলতায় (ব্যভিচারে) লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তাদের শাস্তি হবে স্বাধীনা (অবিবাহিতা) নারীর জন্য ধার্যকৃত শাস্তির অর্ধেক। এসব (অর্থাৎ দাসীদেরকে বিবাহ করার বিষয়টা) তোমাদের মধ্য হতে যারা (বিবাহ না করলে) গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা বোধ করে, তাদের জন্য। আর তোমরা যদি সংযমী হয়ে থাক, তবে সেটাই তোমাদের পক্ষে শ্রেয়। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ২৫)
(১১)
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِإِثْمٍ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে মৃত জানোয়ারের রক্ত শুকরের গোশত, সেই পশু যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম উচ্চারিত হয়েছে, শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত জন্তু, উপর হতে পতনের মৃত জন্তু অন্য কোনো পশুর শিংয়ের আঘাতে মৃত জন্তু এবং হিংস্র পশুতে খেয়েছে এমন জন্তু, তবে (মরার আগে তোমরা) যা যবাহ করেছে তা ছাড়া এবং সেই জন্তুও (হারাম) যাকে (প্রতিমার জন্য) নিবেদনস্থলে (বেদিতে) বলি দেয়া হয়। এবং জুয়ার তীর দ্বারা (গোশত ইত্যাদি) বণ্টন করাও (তোমাদের জন্য হারাম)। এসব বিষয় কঠিন গুনাহের কাজ। আজ কাফিরগণ তোমাদের দ্বীনের (পরাস্ত হওয়ার) ব্যাপারে হতাশ হয়ে গেছে। সুতরাং তারেকে ভয় করো না। আমাকেই ভয় করো। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে (চিরদিনের জন্য) পছন্দ করে নিলাম। (সুতরাং এ দ্বীনের বিধানাবলি পরিপূর্ণভাবে পালন করো) হ্যাঁ, কেউ যদি ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়ে যায় (এবং সে কারণে কোনো হারামবস্তু খেয়ে নেয়) আর গুনাহের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে, তবে আল্লাহ নিশ্চয়ই অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু ‘ (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত ০৩)
(১২)
إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘তবে সেই সব লোক ব্যতিক্রম, যারা তোমাদের আয়ত্বাধীন আসার আগেই তাওবা করে। এরূপ ক্ষেত্রে জেনে রাখো আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৩৪)
(১৩)
فَمَنْ تَابَ مِنْ بَعْدِ ظُلْمِهِ وَأَصْلَحَ فَإِنَّ اللَّهَ يَتُوبُ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘অতপর যে ব্যক্তি নিজ সীমালঙ্ঘনমূলক কার্যক্রম থেকে তাওবা করবে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেবে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত: ৩৯)
(১৪)
أَفَلَا يَتُوبُونَ إِلَى اللَّهِ وَيَسْتَغْفِرُونَهُ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘তারপরও কী তারা ক্ষমার জন্য আল্লাহর দিকে রুজু করবে না এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? অথচ আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত: ৭৪)
(১৫)
اعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ وَأَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘জেনে রাখ আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর এবং এটাও জেনে রাখ যে, তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত: ৯৮)
(১৬)
وَإِذَا جَاءَكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِنَا فَقُلْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلَى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ أَنَّهُ مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ سُوءًا بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَصْلَحَ فَأَنَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘আর যখন তারা আপনার কাছে আসবে যারা আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করে, তখন আপনি বলে দিনঃ তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের পালনকর্তা রহমত করা নিজ দায়িত্বে লিখে নিয়েছেন যে, তোমাদের মধ্যে যে কেউ অজ্ঞতাবশতঃ কোনো মন্দ কাজ করে, অনন্তর এরপরে তওবা করে নেয় এবং সৎ হয়ে যায়, তবে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, করুণাময়।’ (সূরা: আনআম, আয়াত: ৫৪)
(১৭)
قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ رَبَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘(হে নবী! তাদেরকে) বল, আমার প্রতি যে ওহি নাযিল করা হয়েছে, তাতে আমি এমন কোনো জিনিস পাই না, যা কোনো আহারকারীল জন্য হারাম, তাবে যদি তা মৃত জন্তু বা বহমান রক্ত কিংবা শূকরের গোশত হয় (তা হারাম)। কেননা তা নাপাক। অথবা যদি হয় এমন গুনাহের পশু, যাকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নামে যবাহ করা হয়েছে। হ্যাঁ যে ব্যক্তি (এসব বস্তুর মধ্যে কোনোটি খেতে) বাধ্য হয়ে যায়, আর তার উদ্দেশ্য মজা লোটা না হয় এবং প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম না করে, তবে নিশ্চয়ই তোমার রব (আল্লাহ) অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা: আনআম, আয়াত ১৪৫)
(১৮)
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘এবং তিনিই সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীতে তোমাদের কতককে কতকের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং কতককে কতকের উপর মর্যাদায় উন্নীত করেছেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন। নিশ্চয়, তোমার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তিদাতা এবং নিশ্চয়ই, তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা: আনআম, আয়াত: ১৬৫)
(১৯)
وَالَّذِينَ عَمِلُوا السَّيِّئَاتِ ثُمَّ تَابُوا مِنْ بَعْدِهَا وَآمَنُوا إِنَّ رَبَّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘আর যারা মন্দ কাজ করে ফেলে তারপর তাওবা করে নেয় ও ঈমান আনে, তোমার প্রতিপালক সেই তাওবার পর (তাদের পক্ষে) অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা: আরাফ, আয়াত: ১৫৩)
(২০)
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكَ لَيَبْعَثَنَّ عَلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ يَسُومُهُمْ سُوءَ الْعَذَابِ إِنَّ رَبَّكَ لَسَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
তরজমা : ‘এবং (সেই সময়ের কথা স্মরণ কর) যখন তোমর প্রতিপালক ঘোষণা করলেন, তিনি কিয়ামত দিবস পর্যন্ত তাদের উপর এমন লোকদেরকে কর্তৃত্ব দান করতে থাকবেন, যারা তাদেরকে নিকৃষ্ট রকমের শাস্তি দেবে। নিশ্চয়, তোমার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তিদানকারী এবং নিশ্চয়ই, তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালুও বটে। (সূরা: আরাফ, আয়াত: ১৬৭)

কুরআন-হাদীছের আলোকে ক্ষমা
____________________
কুরআন-হাদীছের আলোকে ক্ষমা

‘ক্ষমা’ অর্থ- দোষ-ত্রুটি, অপরাধ মার্জনা করে দেওয়া। আলোচ্য প্রবন্ধে আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমাই উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল। পবিত্র কুরআনের এই সুসংবাদ হ’তেই মানুষ তাঁর নিকট বিভিন্নভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তওবা করে, নিজের পিতা-মাতা, পরিবারবর্গ, আত্মীয়-স্বজন, সকল ঈমানদার মুমিন-মুসলমানদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। অবশ্য আল্লাহর নিকট প্রত্যেকেরই ক্ষমা প্রার্থনা করা অপরিহার্য কর্তব্য। 

কারণ স্বয়ং আল্লাহ ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছেন, 

وَاسْتَغْفِرُوْا اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ 

‘তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর আল্লাহর কাছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (মুযযাম্মিল ৭৩/২০)। 

অন্যত্র সবার উদ্দেশ্যে তাঁর প্রিয় হাবীব (ﷺ)-কে প্রত্যাদেশ করেন,

وَقُلْ رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِيْنَ 

‘আর তুমি বল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর ও দয়া কর। বস্ত্ততঃ তুমিই শ্রেষ্ঠ দয়ালু’ (মুমিনূন ২৩/১১৮)।

আল্লাহ তা‘আলা উপরের আয়াতদ্বয় দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে মানুষকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছেন। আবার পরোক্ষভাবেও ক্ষমা প্রার্থনার বহু সুসংবাদ বিদ্যমান। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيْرٌ 

‘যারা না দেখে তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার’ (মুলক ৬৭/১২)।

অন্য আয়াতে তিনি বলেন,

وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَكَانَ اللهُ غَفُورًا رَّحِيمًا-

‘আকাশ ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই, তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন, যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। তিনি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু’ (ফাতাহ ৪৮/১৪)।

প্রকৃত ক্ষমাপ্রার্থীকে আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা করবেন। এই মর্মে তিনি বলেন,

وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ-

‘অথচ আল্লাহ কখনো তাদের উপর শাস্তি নাযিল করবেন না যতক্ষণ তুমি (হে মুহাম্মাদ!) তাদের মধ্যে অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না যতক্ষণ তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে’ (আনফাল ৮/৩৩)।

আর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন,

قُلْ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوا إِنْ يَنْتَهُوْا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ 

‘তুমি কাফিরদের বলে দাও যদি তারা বিরত হয় (ও ইসলাম কবুল করে), তাহ’লে তাদের ক্ষমা করা হবে, যা তারা ইতিপূর্বে করেছে’ (আনফাল ৮/৩৮)।

আল্লাহর নিকট একনিষ্ঠ চিত্তে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি ক্ষমা করে দিবেন। কেননা আল্লাহ পাক কুরআনের প্রায় শতাধিক আয়াতে নিজেকে ক্ষমাশীল বলে ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

 نَبِّئْ عِبَادِيْ أَنِّي أَنَا الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ 

‘আমার বান্দাদের জানিয়ে দাও যে, নিশ্চয়ই আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও অপরিসীম দয়ালু’ (হিজর ১৫/৪৯)। 

অন্য আয়াতে তিনি বলেন, 

أَفَلَا يَتُوْبُوْنَ إِلَى اللهِ وَيَسْتَغْفِرُوْنَهُ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ

‘এরপরেও কি তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে না (অর্থাৎ তওবা করবে না) ও তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? অথচ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (মায়েদাহ ৫/৭৪)।

তিনি আরও বলেন,

 إِنَّهُ كَانَ حَلِيْمًا غَفُوْرًا ‘

নিশ্চয়ই তিনি অতি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৪৪)।

বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ অসীম। আল্লাহ বলেন,

 قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِيْنَ أَسْرَفُوْا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَحْمَةِ اللهِ إِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ 

‘বল, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহ হ’তে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (যুমার ৩৯/৫৩)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

وَإِنَّ رَبَّكَ لَذُوْ مَغْفِرَةٍ لِلنَّاسِ عَلَى ظُلْمِهِمْ وَإِنَّ رَبَّكَ لَشَدِيْدُ الْعِقَابِ 

‘মানুষের যুলুম সত্ত্বেও তোমার পালনকর্তা তাদের প্রতি ক্ষমাশীল। আর নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক শাস্তিদানে কঠোর’ (রা‘দ ১৩/৬)।

তিনি আরও বলেন,

الَّذِيْنَ يَجْتَنِبُوْنَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ 

‘যারা বড় বড় গোনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে, ছোট-খাট অপরাধ করলেও নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তার ক্ষমা সুদূর বিস্তৃত’ (নাজম ৫৩/৩২)।

ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ
____________________
ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ :

যারা নিজেদের সৎকর্মের কারণে আল্লাহর কাছে নিশ্চিত ক্ষমার অধিকারী হবে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الْمُسْلِمِيْنَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِيْنَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِيْنَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِيْنَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِيْنَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِيْنَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِيْنَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِيْنَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِيْنَ اللهَ كَثِيْرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيْمًا،

‘আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও নারী, বিশ্বাসী পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, নম্র পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, ছিয়াম পালনকারী পুরুষ ও নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আললাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী এদের জন্য আল্লাহ ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান রেখেছেন’ (আহযাব ৩৩/৩৫)।

অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন,

وَسَارِعُوْا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِيْنَ، الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِيْنَ الْغَيْظَ وَالْعَافِيْنَ عَنِ النَّاسِ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ، وَالَّذِيْنَ إِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوْا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوْا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوْا لِذُنُوْبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلَّا اللهُ وَلَمْ يُصِرُّوْا عَلَى مَا فَعَلُوْا وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ-

‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য। যারা সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন। যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করলে কিংবা নিজের উপর কোন যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে। অতঃপর স্বীয় পাপসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ব্যতীত পাপসমূহ ক্ষমা করার কে আছে? আর যারা জেনেশুনে স্বীয় কৃতকর্মের উপর হঠকারিতা প্রদর্শন করে না’ (আলে ইমরান ৩/১৩৩-১৩৫)।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের পালনকর্তার প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করে, তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আপনার রহমত ও জ্ঞান সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব যারা তওবা করে এবং আপনার পথে চলে তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন। হে আমাদের পালনকর্তা! আর তাদেরকে দাখিল করুন চিরকাল বসবাসের জান্নাতে, যার ওয়াদা আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের বাপ-দাদা, পতি-পত্নী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করে তাদেরকে। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আর আপনি তাদেরকে অমঙ্গল থেকে রক্ষা করুন। আপনি যাকে সেদিন অমঙ্গল থেকে রক্ষা করবেন, তার প্রতি অনুগ্রহই করবেন। এটাই মহাসাফল্য’ (মুমিন ৪০/৭-৯)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য একমাত্র অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। স্বয়ং আল্লাহ তাঁর প্রতি পরম সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে নিজের খলীল উপাধিতে ভূষিত করেন (মুসলিম হা/২৩৮৩; মিশকাত হা/৬০১১)।

পবিত্র কুরআনে আদেশ হ’ল এক আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণ কর। আর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর একনিষ্ঠ অনুসরণ কর। এ দু’টি বিষয়ই পবিত্র কুরআনে বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তাঁকেই একমাত্র উপাস্য হিসাবে তাঁর ইবাদত করার এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণের আদেশ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহরই আনুগত্য করে’ (নিসা ৪/৮০)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, তবে তোমাদের কর্ম বিন্দুমাত্রও নিষ্ফল করা হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১৪)।

বস্ত্ততঃ আল্লাহর কাছে ক্ষমা লাভের জন্য তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ অপরিহার্য। এর কোন বিকল্প নেই। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ- ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।

আল্লাহ তাঁর ভয়ে ভীত বান্দাকে ভালোবাসেন এজন্য তিনি বার বার তাদেরকে ভীতির আহবান জানিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)। 

‘আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা আমাকে ভয় কর’ (নাহল ১৬/২)। 

‘হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’ (আহযাব ৩৩/৭০)। 

একই মর্মার্থে পুনরায় আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের প্রতিপালক। অতএব তোমরা আমাকে ভয় কর’ (মুমিনূন ২৩/৫২)।

অতঃপর যারা প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর ভয়ে ভীত হবে, তারা তাঁর পক্ষ থেকে অনেক কল্যাণ লাভ করবে এবং মুক্তির পথও পাবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য মুক্তির পথ করে দেন’ (ত্বালাক ৬৫/২)। 

আল্লাহ আরও বলেন, যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন’ (ত্বালাক ৬৫/৪)।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা মন্দ কাজ করে ও এরপরে তওবা করে ও ঈমান আনে, নিশ্চয়ই তোমার প্রভু উক্ত তওবার পরে ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আ‘রাফ ৭/১৫৩)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘যে কেউ দুষ্কর্ম করে অথবা নিজের জীবনের প্রতি অবিচার করে, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হয়, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও দয়ালু পাবে’ (নিসা ৪/১১০)।

আল্লাহ বলেন, ‘নভোমন্ডল ও ভূখন্ডের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। তিনি ক্ষমাশীল পরম মেহেরবান’ (ফাতহ ৪৮/১৪)।

একই মর্মার্থে আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (ﷺ)-কে বলেন, ‘তুমি কি জানো না যে, আল্লাহরই জন্য সকল রাজত্ব আসমান ও যমীনে। তিনি যাকে খুশী শাস্তি দেন ও যাকে খুশী ক্ষমা করেন। আর আল্লাহ সকল কিছুর উপর ক্ষমতাশালী’ (মায়েদাহ ৫/৪০)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,

 فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَاللهُ يَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَمَثْوَاكُمْ 

‘জেনে রাখো, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। ক্ষমা প্রার্থনা কর, তোমার ত্রুটির জন্যে এবং মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্যে। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। 

মহাবিজ্ঞ আল্লাহ নবী করীম (ﷺ)-কে একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তুলনা করে অহি প্রেরণ করেন,

 قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوْحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَاسْتَقِيْمُوْا إِلَيْهِ وَاسْتَغْفِرُوْهُ وَوَيْلٌ لِلْمُشْرِكِيْنَ 

‘বল, আমিও তোমাদের মতই মানুষ, আমার প্রতি অহী আসে যে, তোমাদের মা‘বূদ একমাত্র মা‘বূদ। অতএব তাঁর দিকেই দৃঢ় থাক এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর মুশরিকদের জন্যে রয়েছে দুর্ভোগ’ (হা-মীম সাজদা ৪১/৬)।

এ ক্ষমা আল্লাহর সন্তুষ্টি, ভালোবাসা ও করুণার বহিঃপ্রকাশ। যা সরাসরি জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম হ’তে বাঁচার মাধ্যম। ক্ষমাপ্রাপ্ত ও ক্ষমাবঞ্চিত উভয় দলের পরিণতির বর্ণনা দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন, ‘যারা ভাগ্যবান (ক্ষমাপ্রাপ্ত) তারা থাকবে জান্নাতে, সেখানে তারা স্থায়ী হবে ততদিন পর্যন্ত যতদিন আকাশ ও পৃথিবী থাকবে, যদিনা তোমার প্রতিপালক অন্যরূপ ইচ্ছা করেন। এ এক নিরিবচ্ছিন্ন পুরষ্কার’ (হূদ ১১/৮)।

যারা ক্ষমা বহির্ভূত তাদের সম্পর্কেও মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যারা হতভাগা হবে তারা জাহান্নামে থাকবে। সেখানে তারা চিৎকার ও আর্তনাদ করবে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক যদি অন্য কিছু চান। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যা চান তা করে থাকেন’ (হূদ ১১/১০৬-১০৭)।

পৃথিবীর জীবনের শেষে মৃত্যু ও কবর, অতঃপর এক সময় কিয়ামত হবে। কিয়ামত দিবস মানুষের বিচার দিবস, এ দিবসে মানুষের ভাল ও মন্দ কর্মের হিসাব ও বিচার হবে। এই বিচারের রায়েই সৌভাগ্যবানরা জান্নাতের উত্তরাধিকার হবে, পক্ষান্তরে হতভাগ্যদের জন্য জাহান্নামের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হবে।

যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ও কৃতজ্ঞ তারাই ক্ষমাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী ও অকৃতজ্ঞ তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা হিসাবে জাহান্নাম প্রস্ত্তত করা হয়েছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন, ‘আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া কাউকে শাস্তি দিই না’ (সাবা ৩৪/১৭)।

ক্ষমা বা মাগফিরাত লাভের কতিপয় উপায়
____________________
ক্ষমা বা মাগফিরাত লাভের কতিপয় উপায় :

পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করার অনেক উপায় বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি উপায় এখানে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. ঈমান ও আমলে ছালেহের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা :

যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে, আল্লাহ তাদের ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,

وَعَدَ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيْمًا 

‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের’ (ফাতহ ৪৮/২৯; মায়েদা ৫/৯)।

তিনি আরো বলেন

,فَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ ورزق كريم 

‘অতএব যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা (অর্থাৎ জান্নাত)’ (হজ্জ ২২/৫০)।

অন্যত্র তিনি বলেন,وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَّأَجْرٌ كَبِيْرٌ ‘আর যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার’ (ফাতির ৩৫/৭)।

এছাড়া কুরআন তেলাওয়াত ও শ্রবণের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি, আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল ও আল্লাহর রাস্তায় দান প্রভৃতি নেক আমলের মাধ্যমে ক্ষমা লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন,

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ، الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلاَةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ، أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيْمٌ-

‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে। যারা ছালাত কায়েম করে এবং তাদেরকে আমরা যে জীবিকা দান করেছি, তা থেকে খরচ করে, এরাই হ’ল সত্যিকারের মুমিন। এদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে উচ্চ মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রূযী’ (আনফাল ৮/২-৪)।

তিনি আরো বলেন

,إِنْ تُقْرِضُوا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعِفْهُ لَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ شَكُوْرٌ حَلِيْمٌ 

‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর তিনি তোমাদের জন্য উহা বহু গুণ বৃদ্ধি করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী ধৈর্যশীল’ (তাগাবুন ৬৪/১৭)।

আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা
____________________
২. আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা :

আল্লাহর ক্ষমা লাভের জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ বলেন, 

وَاسْتَغْفِرُوا اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ ‘

আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (বাক্বারাহ ২/১৯৯; মুয্যাম্মিল ৭৩/২০)। 

তিনি আরো বলেন,

وَمَنْ يَّعْمَلْ سُوْءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللهَ يَجِدِ اللهَ غَفُوْرًا رَحِيْمًا- 

‘যে কেউ দুষ্কর্ম করে অথবা স্বীয় জীবনের প্রতি অবিচার করে, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হয়, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও দয়ালু পাবে’ (নিসা ৪/১১০)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَاللهُ يَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَمَثْوَاكُمْ. ‘ক্ষমা প্রার্থনা কর তোমার জন্য এবং মুমিন নর-নারীদের পাপের জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্বন্ধে অবগত আছেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)।

রাসূল (ﷺ) বলেন,وَاللهِ إِنِّيْ لَأَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ فِي الْيَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سبعيْنَ مرَّةً. ‘আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই আমি দিনে সত্তর বারেরও বেশী আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই এবং তাঁর নিকট তওবা করি’ (বুখারী, মিশকাত হা/২৩২৩)।

অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন

,يَا عِبَادِيْ إِنَّكُمْ تُخْطِئُوْنَ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَأَنَا أَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا فَاسْتَغْفِرُوْنِيْ أَغْفِرْ لَكُمْ- 

‘হে আমার বান্দারা! তোমরা অপরাধ করে থাক রাতে-দিনে। আমি সমস্ত অপরাধ মাফ করে দেই। সুতরাং তোমরা আমার নিকট ক্ষমা চাও, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিব’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৩২৬)।

অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন,

يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ، يَقُوْلُ مَنْ يَدْعُوْنِيْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِيْ فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِيْ فَأَغْفِرَ لَهُ-

‘আমাদের প্রতিপালক তাবারকা ওয়া তা‘আলা প্রত্যেক রাতের তিন ভাগের শেষ ভাগে (এক-তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে) প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কে আছ আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আমার কাছে কিছু চাইবে আমি তাকে তা দিব। কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দিব’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১২২৩)।

অন্য হাদীছে রাসূল (ﷺ) বলেন,

قَالَ الله تَعَالَى يَا ابْنَ آدَمَ، إنَّكَ مَا دَعَوْتَنِيْ وَرَجَوْتَنِيْ غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ مِنْكَ وَلاَ أُبَالِي. يَا ابْنَ آدَمَ، لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوْبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ، ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِيْ غَفَرْتُ لَكَ وَلاَ أُبَالِيْ. يَا ابْنَ آدَمَ، إِنَّكَ لَوْ أتَيْتَنِيْ بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا، ثُمَّ لَقِيْتَنِيْ لاَ تُشْرِكْ بِيْ شَيْئاً، لأَتَيْتُكَ بقُرَابِهَا مَغْفِرَةً-

‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান! যতদিন তুমি আমাকে ডাকবে এবং আমার নিকট ক্ষমার আশা রাখবে আমি তোমাকে ক্ষমা করব, তোমার অবস্থা যাই হোক না কেন। আমি কারো পরওয়া করি না। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশ পর্যন্তও পৌঁছে অতঃপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব। আমি ক্ষমা করার ব্যাপারে কারো পরওয়া করি না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার দরবারে উপস্থিত হও এবং আমার সাথে কোন শরীক না করে আমার সামনে আস, আমি পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার নিকটে উপস্থিত হব’ (তিরমিযী, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/২৩৩৬)।

তওবা করা
____________________
৩. তওবা করা :

আল্লাহর ক্ষমা লাভের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে পাপ করার পরই তাঁর নিকটে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করা। আল্লাহ বলেন,وَهُوَ الَّذِيْ يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ- ‘তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন ও পাপ মোচন করেন’ (শূরা ৪২/২৫)। তিনি আরো বলেন

,أَفَلاَ يَتُوْبُوْنَ إِلَى اللهِ وَيَسْتَغْفِرُوْنَهُ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ ‘

এরপরেও কি তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে না (অর্থাৎ তওবা করবে না) ও তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? অথচ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (মায়েদাহ ৫/৭৪)।

রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

 تُوْبُوْا إِلَى اللهِ فَإِنِّيْ أَتُوْبُ إِلَيْهِ فِى الْيَوْمِ مِائَةَ مَرَّةٍ- 

‘তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর। কেননা আমি দৈনিক একশতবার তাঁর নিকট তওবা করি’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৩২৫)।

তিনি আরো বলেন,

فَإِنَّ الْعَبْدَ إِذَا اعْتَرَفَ ثُمَّ تَابَ تَابَ اللهُ عَلَيْهِ- 

‘যখন বান্দা গোনাহ স্বীকার করে এবং অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ক্ষমা চায় আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৩৩০)।

অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন,

إنَّ الله تَعَالَى يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوْبَ مُسِيْئ النَّهَارِ، ويَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوْبَ مُسِيْئ اللَّيْلِ، حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا- 

‘আল্লাহ তা‘আলা রাতে স্বীয় হাত প্রসারিত করেন, যাতে দিনের গোনাহগার যারা তারা তওবা করে। আবার দিনের বেলায় হাত প্রসারিত করেন যাতে রাতের গোনাহগার ব্যক্তিরা তওবা করে। এভাবে তিনি ক্ষমার হাত প্রসারিত করতে থাকবেন পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৩২৯)।

আরেকটি হাদীছে এসেছে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘কোন বান্দা অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি অপরাধ করেছি, তুমি তা ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, (হে আমার ফিরিশতাগণ!) আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? (তোমরা সাক্ষী থাক) আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর আল্লাহ যতদিন চাইলেন ততদিন সে অপরাধ না করে থাকল। আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আবার অপরাধ করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর সে অপরাধ না করে থাকল যতদিন আল্লাহ চাইলেন। সে আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আবার আরেক অপরাধ করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। সে যা ইচ্ছা করুক’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৩৩৩)।

তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা
____________________
৪. তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা:

আল্লাহর নির্দেশিত বিষয় প্রতিপালন ও নিষিদ্ধ বিষয় পরিহার করার মাধ্যমে তাক্বওয়া অর্জন করা, যা ক্ষমা লাভের অন্যতম উপায়। আল্লাহ বলেন

,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنْ تَتَّقُوا اللهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا وَيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيْمِ  

‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহভীরু হও, তাহ’লে তিনি তোমাদের জন্য সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার পথ বের করে দিবেন এবং এর ফলে তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন ও তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ হ’লেন মহা অনুগ্রহশীল’ (আনফাল ৮/২৯)। 

অন্যত্র তিনি বলেন

,إِنَّ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيْرٌ- 

‘যারা দৃষ্টির অগোচরে তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার’ (মুলক ৬৭/১২)।

পরিশেষে বলব, আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত ক্ষমাশীল। মানুষ পাপ করার পর তাঁর নিকটে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেন। আর এ ক্ষমা জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম। অতএব জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ ও জান্নাত লাভের জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে গোনাহ মাফের মাধ্যমে তা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন-আমীন!

আল্লাহর জিকির মনের প্রশান্তি
____________________
আল্লাহর জিকির মনের প্রশান্তি

❏ যাহারা দাঁড়াইয়া, বসিয়া ও শুইয়া আলাহর স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, ‘হে আমাদের প্রভুপালক! তুমি ইহা নিরর্থক সৃষ্টি কর নাই, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদিগকে অগ্নিশাস্তি হইতে রক্ষা কর।
● সুরা আলে ইমরান আয়াত ১৯১

❏ যে ব্যক্তি জান্নাতের বাগানে পরিভ্রমণ করতে চায়, সে যেন আলাহর জিকির অত্যধিক পরিমাণে করে।
● হাদিসটি হজরত মুয়াজ থেকে বর্ণনা করেছেন ইবনে আবী শায়বা এবং তিবরানী

❏ হজরত আলী (رضي الله عنه) বলেছেন, রসুলে পাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, তাফাক্কুরের মতো কোনো ইবাদত নেই।

❏ হজরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, রসুল (ﷺ) বলেছেন, এক ব্যক্তি রাতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো বিস্ময়ঘেরা নক্ষত্রমন্ডলে। সে অভিভূত হলো এবং সাক্ষ্য দিলো, নিশ্চয়ই আমার প্রভূপালক সত্য। আমার স্রষ্টা সত্য। হে আমার আলাহ্! তুমি দয়া করে আমাকে মার্জনা করো। আলাহপাক তার প্রতি রহমত বর্ষণ করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
● আবু শায়েখ, ইবনে হাব্বান, সা’লাবী

❏ হাসান বসরী র. বলেছেন, উচ্চঃস্বরের দোয়া ও নিম্নরের দোয়ার মধ্যে সত্তর হাজার গুণ পার্থক্য রয়েছে। প্রথম যুগের মুসলমানগণ দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া করতেন। তাঁদের ওই দোয়ার সামান্য আওয়াজও শোনা যেতো না। শুধু শোনা যেতো ওষ্ঠ সঞ্চালনের শব্দ। কেননা আলাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন―
তোমরা বিনীতভাবে এবং গোপনে তোমাদের প্রভুপালককে ডাক।
● সুরা আ’রাফ, আয়াত ৫৫

❏ নবী জাকারিয়া সম্পর্কে অন্যত্র এরশাদ করেছেন―
যখন সে তাহার প্রভুপালককে আহবান করিয়াছিল নিভৃতে।
● সুরা মার্‌য়াম, আয়াত ৩

❏ হজরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস বর্ণনা করেছেন, রসুল (ﷺ) বলেছেন, উত্তম জিকির হচ্ছে জিকরে খফি (নীরব জিকির) এবং উত্তম জীবিকা হচ্ছে ঐ জীবিকা, যা ন্যূনতম সামর্থের অন্তর্ভূত।
● আহ্‌মদ, ইবনে হাব্বান, বায়হাকী

❏ হজরত আবু মুসা আশআরী বর্ণনা করেছেন, খয়বর যুদ্ধের সময় একটি প্রান্তর অতিক্রমকালে মুসলিম সৈন্যরা উচ্চঃস্বরে তক্‌বীর উচ্চারণ করেছিলেন। রসুলেপাক (ﷺ) তখন বলেছিলেন, শান্ত হও। তোমরা কোনো অনুপস্থিত স্বত্বা তো আহবান করছো না তোমরা ওই সত্তাকে ডাকছো, যিনি সর্বশ্রোতা এবং নিকটতম।

❏ যাহারা বিশ্বাস করে এবং আলাহর স্মরণে যাহাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জানিয়া রাখ, আলাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।
● সুরা রা’দ, আয়াত ২৮

❏ রসুলেপাক (ﷺ) বলেছেন, মানুষের অন্তঃকরণে (ক্বলবে) রয়েছে দুটি প্রকোষ্ঠ। একটিতে থাকে ফেরেশতা এবং অপরটিতে থাকে শয়তান। অন্তরে জিকির উত্থিত হলে শয়তান পালিয়ে যায়। আর জিকির না থাকলে শয়তান ক্বলবে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয় তার চিন্ত। এভাবেই সে মানুষকে প্ররোচিত করে।
‘মুনসিফ’ গ্রন্থে হজরত আবদুলাহ ইবনে শাকীক থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইবনে শায়বা এবং হজরত ইবনে আব্বাস থেকে মারফুরূপে প্রলম্বিত সূত্র সহযোগে বর্ণনা করেছেন বোখারী।

❏ হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বাগবীও এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনার সাথে এই উক্তিটিও রয়েছে যে,
হজরত আনাস বলেছেন, নিজের পাঁচটি আঙ্গুল গণনা করার মতো স্পষ্টরূপে এই হাদিসটি আমি রসুলুল্লাহর কাছ থেকে শুনেছি।

❏ হজরত আবদুলাহ ইবনে শাকীক (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলেপাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন,
মানুষের অন্তর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। এক কক্ষে থাকে ফেরেশতা, অপর কক্ষে থাকে শয়তান। যখন মানুষ আলাহপাকের জিকির করে তখন শয়তান তার কুঠুরী ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর যখন জিকির থেকে অমনোযোগী হয়, তখন শয়তান তার ঠোঁট অন্তরে প্রবেশ করিয়ে কুমন্ত্রণা দেয়।
● ইবনে আবী শায়বা

❏ আবু শাইখ এবং দায়লামী ‘মসনদে ফিরদাউস’ গ্রন্থে জোবায়েরের মাধ্যমে তিনি জুহাকের মাধ্যমে এবং তিনি হজরত আবদুলাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, রসুলে করীম সলালাহু আলাইহি ওয়া সালাম ‘ফাজকুরূনী আজকুরকুম’ আয়াতের শানে এরশাদ করেছেন― আলাহপাক বলেন,
হে বান্দাসকল! তোমরা আমাকে ইবাদতের মাধ্যমে স্মরণ করো। আমি মাগফিরাতসহ তোমাদেরকে স্মরণ করবো। অর্থাৎ তোমরা আমার ইবাদত করো; আমি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবো।

❏ হজরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলে আকরম (ﷺ) বলেছেন,
আলাহপাক বলেন― আমার বান্দা আমার প্রতি যে ধারণা পোষণ করে, আমি তার সেই ধারণার অনুকূল। সে যখন আমাকে স্মরণ করে, তখন আমিও তাকে স্মরণ করি। সে যদি কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে স্মরণ করি অধিকতর উত্তম অনুষ্ঠানে। সে যদি আমাকে অন্তরে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে অন্তরে স্মরণ করি। সে যদি আমার দিকে অর্ধ হাত এগিয়ে আসে, তবে আমি এগিয়ে যাই একহাত। সে একহাত এলে আমি যাই দুই হাত। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, তবে আমি যাই দৌড়ে।
● বোখারী, মুসলিম

❏ ‘আক্বিমিস্ সলাতা লি জিকরি’ (নামাজ প্রতিষ্ঠা করো আমার স্মরণের জন্য)- সুরা ত্বহা, আয়াত ১৪।

❏ তোমাদিগকে স্মরণ করিব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং কৃতঘ্ন হইও না।
● সুরা বাকারা আয়াত , ১৫২

❏ হজরত আনাস বর্ণনা করেছেন, অন্তিম যাত্রা কালে এক যুবকের শয্যাপাশে উপস্থিত হলেন রসুলেপাক (ﷺ)। বললেন, তোমার মনের অবস্থা এখন কেমন?
যুবক বললো, আমি আলাহর ক্ষমার আশা রাখি আবার তাঁর ভয়ে আমি ভীতও। তিনি (ﷺ) বললেন, পৃথিবী পরিত্যাগের প্রাক্কালে যার অন্তরের অবস্থা এরূপ হয়, আল্লাহ্‌ তাকে দান করেন তার কাম্যবস্তু এবং রক্ষা করেন ভয়ভীতি থেকে।● তিরমিজি, ইবনে মাজাহ

❏ হজরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় এসেছে, শয়তান দলিত মথিত করতে থাকে মানুষের অন্তর। সে যখন জিকিরে রত হয়, তখন শয়তান পশ্চাদপসরণ করে, আর অমনোযোগী হলে অন্তরে ঢেলে দেয় কুমন্ত্রণা ।

❏ উম্মত-জননী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنه) থেকে আবু ইয়ালী বর্ণনা করেছেন, রসুল (ﷺ) বলেছেন, সরব জিকির অপেক্ষা নীরব জিকির সত্তর হাজার গুণ অধিক মর্যাদাপূর্ণ। শেষ বিচারের দিন ফেরেশতারা যখন মানুষের আমলনামা উপস্থিত করবে, তখন আলাহ্‌পাক এক লোককে দেখিয়ে বলবেন, ভালো করে দ্যাখো আমার এই বান্দার কোনো পাপ পুণ্য লেখা বাদ পড়লো কিনা! ফেরেশতারা বলবে, আমরা যা কিছু জেনেছি, শুনেছি ও দেখেছি― সবকিছুই আমলনামায় লিখে নিয়েছি। কোনো কিছুই পরিত্যাগ করিনি। আলাহ্‌তায়ালা বলবেন, আমার এই বান্দার গোপন আমলও রয়েছে, যার কথা তোমরা জানো না। সেই আমল হচ্ছে জিক্‌রে খফি।

❏ সশংকচিত্তে অনুচ্চস্বরে প্রত্যূষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ করিবে এবং তুমি উদাসীন হইবে না
● সুরা আ’রাফ, আয়াত ২০৫।

ব্যাখ্যাঃ

❏ হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেছেন, এই আয়াতে নামাজের ক্বেরাতের উচ্চারণসীমা নির্দেশ করা হয়েছে। ‘ওয়াজকুর রব্বাকা ফি নাফসিকা’ কথাটির মধ্যে উলেখিত ‘জিকির’ অর্থ নামাজের ক্বেরাত অর্থাৎ এখানে বলা হয়েছে নামাজের মধ্যে গোপনে, মনে মনে (জিহবা সঞ্চালনসহ) ক্বেরাত পাঠ করবে। ‘ওয়া দুনাল জাহরি মিনাল ক্বওলি’- এখানে আল জাহরি অর্থ প্রকাশ্য নামাজ (যে নামাজে সশব্দে ক্বেরাত পাঠ করতে হয়)। দুনাল জাহ্‌রি অর্থ অনুচ্চস্বরে। অর্থাৎ সুউচ্চ স্বরের চেয়ে কম আওয়াজে এবং নিঃশব্দ আওয়াজের চেয়ে কিছুটা উচ্চস্বরে। এরকম বলার উদ্দেশ্য এই যে- যে নামাজগুলোতে উচ্চস্বরে ক্বেরাত পাঠের বিধান আছে (মাগরিব, এশা, ফজর) সে নামাজগুলোতে অত্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণে কোরআন পাঠ কোরো, অতিরিক্ত চিৎকার কোরো না। বরং এমন শান্তভাবে মধুর স্বরে পড়ো, যেনো পশ্চাতের ব্যক্তিদের শুনতে কোনো অসুবিধা না হয়।

❏ মুজাহিদ বলেছেন, জিকির করবে অন্তরে অন্তরে। এটাই এই আয়াতের বক্তব্য। প্রার্থনার মধ্যে থাকতে হবে বিনয় ও শংকা। উচ্চকন্ঠ হবে না। চিৎকার করে আলাহকে ডাকবে না। মনে মনে দোয়া করলে হৃদয়ের বিশুদ্ধতা বৃদ্ধি পায়। আমি বলি, এখানে অনুচ্চস্বরে এবং মনে মনে কথা দুটোর মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক সংযোগ। কথা দুটোর মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে জিকরে জেহরী (অনুচ্চস্বরে জিকির) এবং জিকরে খফিকে (মনে মনে জিকিরকে)। ‘বিলগুদুব্যি’ অর্থ প্রত্যুষে, সকালে। আর ‘ওয়াল্ আস্লি’ অর্থ দিবসের শেষভাগ, সন্ধ্যা। সকাল ও সন্ধ্যা এ দুটো সময় যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তাই এই দুই সময়ে বিশেষভাবে জিকিরে নিমগ্ন থাকতে বলা হয়েছে। নতুবা জিকির তো করতে হবে সর্বক্ষণ। তাই শেষে বলা হয়েছে ‘ওয়ালা তাকুম্ মিনাল্ গফিলীন’ (এবং তুমি উদাসীন হয়ো না)। একথার অর্থ কোনো সময়ই আলাহর জিকির থেকে অমনোযোগী থেকো না।

আমি বলি, আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে ‘ওয়াজকুর্‌ রব্বাকা ফি নাফসিকা’। পরে বলা হয়েছে, ‘বিল গুদুব্যি ওয়াল আস্লি ওয়ালা তাকুম্ মিনাল্ গফিলীন’। এই বিবরণভঙ্গির মাধ্যমে এখানে জিকির বলে সব রকম জিকিরকেই বুঝানো হয়েছে। কোরআন পাঠসহ সকল জিকিরই এই নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত।

❏ অতঃপর যখন তোমরা হজ্জের অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত করিবে তখন আল্লাহ্‌কে এমনভাবে স্মরণ করিবে যেমন তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষগণকে স্মরণ করিতে, অথবা তদপেক্ষা অভিনিবেশ সহকারে।
● সুরা বাকারা, আয়াত ২০০

আল্লাহ সুবহানুতা'য়ালা পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু
____________________
আল্লাহ সুবহানুতা'য়ালা পরম করুণাময়, অসীম দয়ালুঃ

“নিশ্চয়ই আমি আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করে দিব, আপনাকে অসন্তুষ্ট করব না।"
-------------------------------------------------
একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআনে ইবরাহীম (আঃ) এর দু'আ সম্বলিত আয়াতঃ "হে আমার প্রতিপালক। এ সকল প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত। আর যে আমার অবাধ্য হবে তুমি তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু"— (সূরা ইবরাহীম ১৪ঃ ৩৬) তিলাওয়াত করেন। আর "ঈসা (আঃ) বলেছেনঃ “তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও তবে তারা তো তোমারই বান্দা, আর যদি তাদেরকে ক্ষমা কর, তবে তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়"- (সূরা আল মায়িদাহ ৫ঃ ১১৮)। তারপর তিনি তার উভয় হাত উঠালেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত! আর কেঁদে ফেললেন।
তখন মহান আল্লাহ বললেন, হে জিবরীল! মুহাম্মাদ (ﷺ) এঁর নিকট যাও, তোমার রব তো সবই জানেন তাকে জিজ্ঞেস কর, তিনি কাঁদছেন কেন? জিবরীল (আঃ) এসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেছিলেন, তা তাকে অবহিত করলেন। আর আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ। তখন আল্লাহ তা'আলা বললেন, হে জিবরীল! তুমি মুহাম্মাদ (ﷺ) এর কাছে যাও এবং তাকে বল, “নিশ্চয়ই আমি (আল্লাহ) আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করে দিব, আপনাকে অসন্তুষ্ট করব না"।
▪[সহীহ মুসলিম ৩৮৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৯৩]

হাদীস শরীফে ইরশাদ-

كُلّ ابْنِ آدَمَ خَطّاءٌ وَخَيْرُ الخَطّائِينَ التّوّابُونَ.

প্রতিটি বনী আদম ‘খাত্তা’-বারংবার পাপকারী। তবে ‘খাইরুল খাত্তাঈন’ অর্থাৎ পাপকারীদের মধ্যে উত্তম হল তারা, যারা ‘তাওয়াবূন’ অর্থাৎ যারা বেশি বেশি তওবা করে; গোনাহ হলেই তওবা করে নেয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৯৯

হাঁ, গোনাহ হলে তওবা করে নেওয়াই তো মুমিনের গুণ। মুমিনের এ গুণের বর্ণনা এসেছে কুরআনে, এভাবে-

وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوْبِهِمْ وَ مَنْ یَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اللهُ، وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰی مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ.

এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনোভাবে) নিজেদের প্রতি যুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কেই বা আছে, যে গোনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৫

আর প্রত্যেকের পাপ-পূণ্যের হিসাব দিতে হবেঃ

مَنْ جَآءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهٗ عَشْرُ اَمْثَالِهَا، وَ مَنْ جَآءَ بِالسَّیِّئَةِ فَلَا یُجْزٰۤی اِلَّا مِثْلَهَا وَ هُمْ لَا یُظْلَمُوْن.

কেউ কোনো সৎ কাজ করলে সে তার দশ গুণ পাবে আর কেউ কোনো অসৎ কাজ করলে তাকে শুধু একটি পাপের শাস্তি দেওয়া হবে। আর তাদের প্রতি কোনো যুলুম করা হবে না। -সূরা আনআম (৬) : ১৬০

হাদীসে কুদসীতে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

إِذَا هَمّ عَبْدِي بِحَسَنَةٍ وَلَمْ يَعْمَلْهَا، كَتَبْتُهَا لَهُ حَسَنَةً، فَإِنْ عَمِلَهَا كَتَبْتُهَا عَشْرَ حَسَنَاتٍ إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ، وَإِذَا هَمّ بِسَيِّئَةٍ وَلَمْ يَعْمَلْهَا، لَمْ أَكْتُبْهَا عَلَيْهِ، فَإِنْ عَمِلَهَا كَتَبْتُهَا سَيِّئَةً وَاحِدَةً.

বান্দা যখন কোনো নেক কাজের ইচ্ছা করে, উক্ত নেক কাজ না করলেও (এ ইচ্ছার কারণে) একটি নেকী লেখা হয়। যদি সে নেক কাজটি করে তাহলে দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত নেকী লেখা হয়। আর যখন কোনো গোনাহের ইচ্ছা করে, কিন্তু ওই পাপ কাজটি করে না; তখন (এ ইচ্ছার কারণে) কোনো গোনাহ লেখা হয় না। হাঁ, যদি ওই পাপ কাজটি করে বসে তখন মাত্র একটি পাপ লেখা হয়। -
▪সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২৮

পৃথিবী-ভর্তি পাপও তিনি ক্ষমা করেন

(হাদীসে কুদসী) আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা বলেছেন-

يَا ابْنَ آدَمَ إِنّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلاَ أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السّمَاءِ ثُمّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ، وَلاَ أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ إِنّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمّ لَقِيتَنِي لاَ تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً.

বনী আদম! তুমি যতক্ষণ আমাকে ডাকতে থাকবে, আমার কাছে (ক্ষমার) আশা করতে থাকবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না।

বনী আদম! তোমার পাপরাশি যদি মেঘমালা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও আমি ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না।

বনী আদম! তুমি যদি পৃথিবী-ভর্তি পাপ নিয়ে আমার কাছে আস এবং শিরক থেকে মুক্ত হয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ কর আমি পৃথিবী-ভর্তি ক্ষমা নিয়ে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব।
▪জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৪০

নিরাশ হয়ো না, তিনি সব গোনাহ মাফ করে দেন

ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত- "কিছু মুশরিক নবীজীর কাছে এল, যারা মানুষ হত্যা করেছে; অগণিত মানুষকে হত্যা করেছে। যারা যিনা করেছে; প্রচুর পরিমাণে যিনা করেছে। তারা বলল, আপনি যা বলেন এবং যেদিকে আহ্বান করেন তা তো খুব সুন্দর ও উত্তম। যদি আপনি আমাদের বলতেন যে, আমাদের অতীত পাপের কাফফারা আছে! তখন নাযিল হল-

وَ الَّذِیْنَ لَا یَدْعُوْنَ مَعَ اللهِ اِلٰهًا اٰخَرَ ...

এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোনো মাবুদের ইবাদত করে না। এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং ব্যভিচার করে না।
(যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গোনাহের শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করা হবে। এবং সে লাঞ্ছিত অবস্থায় তাতে সর্বদা থাকবে।
তবে কেউ তওবা করলে, ঈমান আনলে এবং সৎকর্ম করলে, আল্লাহ এরূপ লোকদের পাপরাশিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।) [সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৮-৭০]

এবং নাযিল হল-

قُلْ یٰعِبَادِیَ الَّذِیْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ، ( اِنَّ اللهَ یَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِیْعًا، اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ).

বলে দাও, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর অবিচার করেছ- আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। (আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।) [সূরা যুমার (৩৯) : ৫৩] -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮১০

সূরা যুমারের ৫৩ নং আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর রাহ. কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেন। এরপর বলেন-

فَهَذِهِ الْأَحَادِيثُ كُلّهَا دَالّةٌ عَلَى أَنّ الْمُرَادَ: أَنّهُ يَغْفِرُ جَمِيعَ ذَلِكَ مَعَ التّوْبَةِ...

এসকল হাদীস থেকে বুঝা যায়, এ আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য, আল্লাহ সকল গোনাহ ক্ষমা করেন- তওবার শর্তে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা যুমার, ৫৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)

আল্লাহ ক্ষমা করার জন্য বাহানা তৈরি করেন

فَأَوْحَى اللهُ إِلَى هَذِهِ أَنْ تَقَرّبِي، وَأَوْحَى اللهُ إِلَى هَذِهِ أَنْ تَبَاعَدِي، وَقَالَ: قِيسُوا مَا بَيْنَهُمَا، فَوُجِدَ إِلَى هَذِهِ أَقْرَبَ بِشِبْرٍ، فَغُفِرَ لَهُ.

আল্লাহ নেককার লোকদের ভূমিকে বললেন, তুমি নিকটবর্তী হও। আর অপর ভূমিকে বললেন, তুমি দূরবর্তী হও। তারপর যখন ভূমির দূরত্ব মাপা হল, দেখা গেল সে নেককারদের এলাকার দিকে এক বিঘত এগিয়ে রয়েছে। তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হল (এবং রহমতের ফিরিশতা তার জান কবয করল)।
▪ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৭০)

এ যেন ঐ হাদীসেরই একটি বাস্তব উদাহরণ, যে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেছেন-

وَإِنْ تَقَرّبَ إِلَيّ بِشِبْرٍ تَقَرّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا...

বান্দা যদি আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে আমি বান্দার দিকে এক হাত এগিয়ে আসি...। -
▪সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৪০৫

আল্লাহ ক্ষমা করে খুশি হন

لَلّهُ أَشَدّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ، مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ، فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ، فَأَيِسَ مِنْهَا، فَأَتَى شَجَرَةً، فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا، قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ، فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا، قَائِمَةً عِنْدَهُ، فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا، ثُمّ قَالَ مِنْ شِدّةِ الْفَرَحِ: اللهُمّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبّكَ، أَخْطَأَ مِنْ شِدّةِ الْفَرَحِ.

এক ব্যক্তি বিরান মরুভূমিতে চলছিল। তার খাদ্য-পানীয় সব ছিল তার বাহন জন্তুটির পিঠে। (সে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য নামল এবং ঘুমিয়ে গেল। উঠে দেখল,) খাদ্য-পানীয়সহ বাহন জন্তুটি পালিয়ে গেছে। সে নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে গেল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখল, বাহন জন্তুটি (খাদ্য-পানীয়সহ) উপস্থিত! সাথে সাথে বাহনের লাগাম ধরে ফেলল এবং আনন্দের আতিশয্যে বলে উঠল-

اللهُمّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبّكَ.

আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা আমি তোমার রব! আনন্দের আতিশয্যে সে উল্টো বলল (সে বলতে চেয়েছিল, আল্লাহ! তুমি আমার রব আর আমি তোমার বান্দা!)। বান্দার তওবায় আল্লাহ ঐ ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন।
▪ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৪৭)

আল্লাহ পাক সুমহান এ সম্পর্কে আরও কিছু আয়াতঃ

আল্লাহ্‌ সুবহান আল্লাহু তায়ালা বলেন , "তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকেই স্মরণ করব..."
[সূরা আল-বাকারাহ ২ঃ১৫২]

 "..যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিস্কৃতির ব্যবস্থা করে দিবেন –"[সূরা আত-তালাক্ব৬৫ঃ২]

"আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রকৃতি তাকে যে কুমন্ত্রনা দেয় তা আমি জানি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমণী অপেক্ষাও নিকটতর।"[সূরা ক্বা-ফ ৫০ঃ১৬]

" যখন কেহ অশ্লীল কাজ করে কিংবা স্বীয় জীবনের প্রতি অত্যাচার করে অতঃপর আল্লাহকে স্মরণ করে এবং অপরাধসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, এবং আল্লাহ ব্যতীত কে অপরাধসমূহ ক্ষমা করতে পারে? " [সূরা আল-'ইমরান ৩ঃ ১৩৫]

, "হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ - আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়োনা; আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তিনিতো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।"[ সূরা আয-যুমার ৩৯ঃ৫৩]

"তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব।"
[সূরা আল-মু'মিন বা গাফির ৪০ঃ৬০]

আল্লাহর জিকির অসীম নেকীর ভান্ডার
____________________
আল্লাহর জিকির অসীম নেকীর ভান্ডারঃ

সহজ দশটি আমল যার সাওয়াব অনেক বেশি :

(১) প্রতিদিন ১০০ বার সুবহান আল্লাহ্‌ পাঠ করলে ১০০০ সাওয়াব লিখা হয় এবং ১০০০ গুনাহ মাফ করা হয়।[সহীহ মুসলিম-৪/২০৭৩]

(২) আলহামদুলিল্লাহ মীযানের পাল্লাকে ভারী করে দেয় এবং সর্বোত্তম দোআ’। [তিরমিযী-৫/৪৬২, ইবনে মাযাহ-২/১২৪৯, হাকিম-১/৫০৩, সহীহ আল জামে’-১/৩৬২]

(৩) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সর্বোত্তম যিকর। [তিরমিযী-৫/৪৬২, ইবনে মাযাহ-২/১২৪৯, হাকিম-১/৫০৩, সহীহ আল জামে’-১/৩৬২]

(৪) সুবহান আল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর এই কালিমাগুলি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় এবং নবী (ﷺ) বলেনঃ পৃথিবীর সমস্ত জিনিসের চইতে আমার নিকট অধিক প্রিয়। [ সহীহ মুসলিম -৩/১৬৮৫, ৪/২০৭২]

(৫) যে ব্যক্তি সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহী প্রতিদিন ১০০ বার পাঠ করবে সমুদ্রের ফেনা পরিমান (সগীরা) গুনাহ থাকলে ও তাকে মাফ করে দেওয়া হবে। [সহীহ আল-বুখারী-৭/১৬৮, সহীহ মুসলিম-৪/২০৭১]

(৬) নবী (ﷺ) বলেনঃ সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহী সুবহানাল্লিল আযীম এই কালীমাগুলি জিহ্বায় উচ্চারনে সহজ , মীযানের পাল্লায় ভারী , দয়াময় আল্লাহর নিকট প্রিয়। [সহিহ আল- বুখারী-৭/১৬৮, সহীহ মুসলিম-৪/২০৭২]।

(৭) যে ব্যক্তি সুবহানাল্লাহিল আযীমি ওয়াবি হামদিহী পাঠ করবে প্রতিবারে তার জন্য জান্নাতে একটি করে (জান্নাতী)খেজুর গাছ রোপন করা হবে।

[আত-তিরমিযী-৫/৫১১, আল-হাকীম-১/৫০১, সহীহ আল-জামে’-৫/৫৩১, সহীহ আত-তিরমিজী-৩/১৬০ ]

(৮) নবী (ﷺ) বলেনঃ লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ হচ্ছে জান্নাতের গুপ্তধন সমুহের মধ্যে একটি গুপ্তধন। [ সহীহ আল-বুখারী -১১/২১৩, সহীহ মুসলিম- ৪/২০৭৬]

(৯) নবী (ﷺ) বলেনঃ সুবহান আল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ এই কালীমাগুলি হচ্ছে “অবশিষ্ট নেকআ’মল সমুহ”। [ আহমাদ (সহীহ)-৫১৩, মাজমাউজ জাওয়াঈদ-১/২৯৭ ]

(১০) নবী (ﷺ) বলেনঃ যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দুরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তাআ’লা তার প্রতি দশ বার রহমত বরষন করবেন।

আল্লাহুম্মা সাল্লি ’আলা মুহাম্মাদিঁওয়া ’আলা আলি মুহাম্মাদিন্‌ কামা সাল্লায়তা ’আলা ইব্রাহীমা ওয়া ’আলা ’আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজিদ।
আল্লাহুম্মা বারিক ’আলা মুহাম্মাদিঁওয়া ’আলা আলি মুহাম্মাদিন্‌ কামা বারাকতা ’আলা ইব্রাহীমা ওয়া ’আলা ’আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজিদ।

এবং তিনি (ﷺ) আরো বলেনঃ যে ব্যক্তি আমার প্রতি সকালে দশবার এবং বিকেলে দশবার দুরুদ পাঠ করবে সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত পাবে। [তাবারানী, মাজময়াউজ জাওয়াঈদ-১০/১২০, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব-১/২৭৩]


আল্লাহ সম্পর্কিত আকিদা
---------------------------

আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে পবিত্র
____________________
আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে পবিত্র :

ইমাম ত্বহাবী (رحمة الله) বলেন,
تعالى عن الحدود والغايات ، والأركان والأعضاء والأدوات ، لا تحويه الجهات الست كسائر المبتدعات
মহান আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের সীমা-পরিসীমা, অঙ্গ-প্রতঙ্গ, সহায়ক বস্তু ও উপায়-উপকরণ থেকে পবিত্র। অন্যান্য সৃষ্ট বস্তুর ন্যায় ছয় দিক তাকে বেষ্টন করে না। (অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের দিক থেকেও পবিত্র) 

সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমাদের আক্বিদা হলো, তিনি মাখলুক থেকে পবিত্র এক মহান সত্ত্বা। তিনি সময়, স্থান ও দিক থেকে পবিত্র। মাখলুকের সঙ্গে সামান্যতম সাদৃশ্যও দেয়াও কুফুরী। কেননা তিনি ইরশাদ করেছেন, তার সদৃশ কিছু নেই। তিনি মহা বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে যেমন ছিলেন,আরশ-কুরশী সৃষ্টির পূবের্ যেমন ছিলেন, এখনও আছেন। মহাবিশ্ব ধ্বংসের পরও থাকবেন। সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে যেমন সময় ও স্থান থেকে পবিত্র অবস্থায় ছিলেন, এখনও তিনি সব ধরনের স্থান ও সময় থেকে পবিত্র। এই কথাটি সংক্ষেপে রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الْآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ
" আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে কিছু নেই। আপনিই শেষ, আপনার পরে কিছু নেই। আপনিই প্রকাশ্য, আপনার উপরে কিছু নেই। আপনিই গোপন, আপনার নিচে কিছু নেই।"
(মুসলিম শরীফ, হাদীস নং২৭১৩)

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের এই সহীহ আকিদা পবিত্র কুরআন ও রাসূল (ﷺ) এর বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা কোথায়? এর সহজ উত্তর হলো, আল্লাহ তায়ালা অনাদিকালে যেমন ছিলেন, এখনও আছেন। কোন সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে আল্লাহর অবস্থানের জন্য যেমন কোন স্থানের প্রয়োজন হয়নি, এখনও প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তায়ালা স্থান ও সময়ের উর্ধ্বে। স্থান ও সময় দু'টো্ই আল্লাহ পাকের সৃষ্টি। তিনি সৃষ্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন, বরং সকল সৃষ্টি তার নিয়ন্ত্রণে।

১. হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন,
"من زعم أن إلهنا محدود فقد جهل الخالق المعبود"
অর্থ: যে বিশ্বাস করলো যে আল্লাহ তায়ালা সসীম, সে আমাদের মা'বুদ আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ"
[ হিলয়াতুল আউলিয়া, খ.১, পৃ.৭৩]

২. বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম যাইনুল আবেদীন [মৃত: ৯৪ হি:] বলেন,
"أنت الله الذي لا يَحويك مكان"
অর্থ: হে আল্লাহ, আপনি সেই সত্ত্বা, কোন স্থান যাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না।
[ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, আল্লামা মোর্তজা জাবিদী, খ.৪, পৃ.৩৮০]

তিনি আরও বলেন,

"أنت الله الذي لا تُحَدُّ فتكونَ محدودًا"
অর্থ: আপনি সেই সত্ত্বা যার কোন হদ বা সীমা নেই। সীমা থাকলে তো আপনি সসীম হয়ে যাবেন।
[ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.৪, পৃ.৩৮০]

৩.ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) তার আল-ফিকহুল আবসাতে বলেছেন,
:"قلتُ: أرأيتَ لو قيل أين الله تعالى؟ فقال ـ أي أبو حنيفة ـ : يقال له كان الله تعالى ولا مكان قبل أن يخلق الخلق، وكان الله تعالى ولم يكن أين ولا خَلْق ولا شىء، وهو خالق كل شىء"
অর্থ: যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আল্লাহ তায়ালা কোথায়? ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) এর উত্তরে বলেন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে, যখন কোন স্থানই ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। আল্লাহ তায়লা তখনও ছিলেন যখন কোন সৃষ্টি ছিলো না, এমনকি 'কোথায়' বলার মতো স্থানও ছিলো না। সৃষ্টির একটি পরমাণুও যখন ছিলো না তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। তিনিই সব কিছুর সৃষ্টা" [ আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ.২০, আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারীর তাহকীক]

ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) আরও বলেন,
"ولقاء الله تعالى لأهل الجنة بلا كيف ولا تشبيه ولا جهةٍ حقٌّ"
অর্থ: জান্নাতবাসীর জন্য কোন সাদৃশ্য, অবস্থা ও দিক ব্যতীত আল্লাহ তায়ালার দর্শন সত্য।
[কিতাবুল ওসিয়্যা, পৃ.৪, শরহে ফিকহুল আকবার, মোল্লা আলী কারী, পৃ.১৩৮]

ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) স্পষ্ট লিখেছেন, আল্লাহ তায়ালা দিক থেকে পবিত্র। পরকালে আল্লাহ তায়ালাকে দেখা যাবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালাকে দেখার জন্য আল্লাহর কোন দিকে থাকার প্রয়োজন নেই। ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) এর মতো বিখ্যাত তাবেয়ীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তাবেয়ীগণের আকিদাও এটি ছিলো। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে পবিত্র।

৪. বিখ্যাত সূফী ইমাম জুন-নুন মিসরী (رحمة الله) [মৃত: ২৪৫ হি:] বলেন,
"ربي تعالى فلا شىء يحيط به * وهْو المحيط بنا في كل مرتصد

لا الأين والحيث والتكييف يدركه * ولا يحد بمقدار ولا أمد
وكيف يدركه حد ولم تره * عين وليس له في المثل من أحد
أم كيف يبلغه وهم بلا شبه * وقد تعالى عن الأشباه والولد"
অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালাকে কোন কিছু পরিবেষ্টন করে না। তিনি সর্বাবস্থায় আমাদেরকে পরিবেষ্টন ও নিয়ন্ত্রণ করছেন। কোথায়, কেমন, কীভাবে, কী অবস্থা.. এগুলো থেকে আল্লাহ পবিত্র। কোন পরিমাপ-পরিমিতি দ্বারা তিনি সীমাবদ্ধও নন। আল্লাহ তায়ালার সীমা কীভাবে নির্ধারণ করবে? অথচ তাকে চক্ষু দেখেনি এবং তার তুলনীয় কিছুই নেই? কোন সাদৃশ্য ছাড়া কেউ আল্লাহ তায়ালাকে কীভাবে কল্পনা করবে? অথচ আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের সাদৃশ্য ও সন্তান থেকে পবিত্র। [হিলয়াতুল আউলিয়া, খ.৯, পৃ.৩৮৮]

৫. ইমাম ইবনে জারীর তবারী (মৃত: ৩১০ হি) বলেন,
"فتبيَّن إذًا أن القديم بارىء الأشياء وصانعها هو الواحد الذي كان قبل كل شىء، وهو الكائن بعد كلّ شىء، والأول قبل كل شىء، والآخر بعد كل شىء، وأنه كان ولا وقت ولا زمان ولا ليل ولا نهار، ولا ظلمة ولا نور ولا سماء ولا أرض ولا شمس ولا قمر ولا نجوم، وأن كل شىء سواه محدَث مدبَّر مصنوع، انفرد بخلق جميعه بغير شريك ولا مُعين ولا ظهير، سبحانه مِنْ قادر قاهر"
অর্থ: স্পষ্টত: কাদীম বা অনাদী সত্ত্বা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সব কিছুর অস্তিত্বের পূর্বে ছিলেন। তিনিই সব কিছু ধ্বংসের পরেও থাকবেন। তিনিই সবকিছুর পূর্বে, তিনিই সবকিছুর পরে। তিনি তখনও ছিলেন যখন কোন সময় ছিলো না। রাত দিন, আলো-আধার, আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, তারকারাজি কিছুই ছিলো না। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি, তার নিয়ন্ত্রণাধীন। কোন অংশীদার, সাহায্যকারী বা সহযোগী ছাড়া তিনি একাই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। মহান ক্ষমতাধর ও কর্তৃত্বপরায়ণ সব সৃষ্টি থেকে পবিত্র”
[তারীখে তবারী, খ.১, পৃ.৩০]

৬. ইমাম ত্বহাবী (رحمة الله) [মৃত: ৩২১ হি:] বলেন,
تعالى عن الحدود والغايات ، والأركان والأعضاء والأدوات ، لا تحويه الجهات الست كسائر المبتدعات
মহান আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের সীমা-পরিসীমা, অঙ্গ-প্রতঙ্গ, সহায়ক বস্তু ও উপায়-উপকরণ থেকে পবিত্র। অন্যান্য সৃষ্ট বস্তুর ন্যায় ছয় দিক তাকে বেষ্টন করে না। (অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের দিক থেকেও পবিত্র)

ইমাম ত্বহাবী (رحمة الله) তার বিখ্যাত আকিদার কিতাব “আকিদাতু ত্বহাবী” এর ভূমিকাতে বলেছেন, এটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা। এটি ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (رحمة الله) এর আকিদা। তিনি এই কিতাবের শেষে লিখেছেন, এই কিতাবে যেসব আকিদা লেখা হয়েছে, সেগুলোই আমরা বিশ্বাস করি। এর বাইরে যতো আকিদা আছে, সেগুলো ভ্রষ্টতা ও গোমরহী।

ইমাম ত্বহাবী (رحمة الله) লিখেছেন,
فهذا ديننا واعتقادنا ظاهرا وباطنا ، ونحن براء إلى الله من كل من خالف الذي ذكرناه وبيناه ، ونسأل الله تعالى أن يثبتنا على الإيمان ، ويختم لنا به ، ويعصمنا من الأهواء المختلفة ، والآراء المتفرقة ، والمذاهب الردية ، مثل المشبهة والمعتزلة والجهمية والجبرية والقدرية وغيرهم ؛ من الذين خالفوا السنة والجماعة ، وحالفوا الضلالة ، ونحن منهم براء ، وهم عندنا ضلال وأردياء ، وبالله العصمة.
“ মৌখিক ও আন্তরিকভাবে এগুলোই আমাদের দীন ও আকিদা। আমরা যেসব আকিদা উল্লেখ করেছি, এর বিপরীত যারা আকিদা পোষণ করে আমরা আল্লাহর নিকট তাদের থেকে মুক্ত। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে ইমানের উপর অটল-অবিচল রাখেন। এরপরই আমাদের যেন মৃত্যু হয়। বিভিন্ন মতবাদ, প্রবৃত্তিপূজা, উদভ্রান্ত লোকদের অনুসরণ এবং নিকৃষ্ট মাজহাবসমূহ থেকে তিনি যেন আমাদেরকে রক্ষা করেন। যেমন, মুশাব্বিহা [যারা আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়], মু’তাজিলা, জাহমিয়া, জাবরিয়া, কাদারিয়া ও অন্যান্য ফেরকা। এরা সবাই আহলে সুন্নতের বিরোধিতা করেছে। ভ্রষ্টতা গ্রহণ করেছে। আমরা এদের থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। আমাদের দৃষ্টিতে তারা পথভ্রষ্ট ও নিকৃষ্ট। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই রক্ষাকর্তা।
[ আকিদাতুত ত্বহাবীর সর্বশেষ আলোচনা]

৭. ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন,
"كان الله ولا مكان فخلق العرش والكرسي ولم يحتجْ إلى مكان، وهو بعد خلق المكان كما كان قبل خلقه"

অর্থ: আল্লাহ তায়ালা কোন স্থান সৃষ্টির পূর্বে ছিলেন। এরপর তিনি আরশ-কুরসী সৃষ্টি করেছেন। কোন সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তায়ালা কোন স্থানে অবস্থানের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। সৃষ্টির অস্তিত্বের পরও তিনি তেমনই আছেন যেমন সৃষ্টির অস্তিত্বের আগে ছিলেন।
[তাবঈনু কিজবিল মুফতারা, পৃ.১৫০]

আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান
____________________
আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান :
১-
ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ

অতঃপর তিনি আরশে সমাসিন হন {সূরা হাদীদ-৩}
২-
قوله تعالى {وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ}

আর যখন আমার বান্দা আমাকে ডাকে, তখন নিশ্চয় আমি তার পাশেই। আমি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেই যখন সে ডাকে। {সূরা বাকারা-১৮৬}
৩-
قوله تعالى {وَنَحنُ أَقرَبُ إِلَيهِ مِن حَبلِ الوَرِيدِ} [ق 16]

আর আমি বান্দার গলদেশের শিরার চেয়েও বেশি নিকটবর্তী। {সূরা কাফ-১৬}
৪-
فَلَوْلا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ (83) وَأَنْتُمْ حِينَئِذٍ تَنْظُرُونَ (84) وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لا تُبْصِرُونَ (85)

অতঃপর এমন কেন হয়না যে, যখন প্রাণ উষ্ঠাগত হয়। এবং তোমরা তাকিয়ে থাক। এবং তোমাদের চেয়ে আমিই তার বেশি কাছে থাকি। কিন্তু তোমরা দেখতে পাওনা {সূরা ওয়াকিয়া-৮৩,৮৪,৮৫}
৫-
{ وَللَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّواْ فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ } [البقرة-115]

পূর্ব এবং পশ্চিম আল্লাহ তায়ালারই। সুতরাং যেদিকেই মুখ ফিরাও, সেদিকেই রয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞাত {সূরা বাকারা-১১৫}
৬-
قوله تعالى { وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَمَا كُنتُمْ } [ الحديد – 4 ]

তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন {সূরা হাদীদ-৪}
৭-
وقال تعالى عن نبيه : ( إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا (التوبة من الآية40

যখন তিনি তার সাথীকে বললেন-ভয় পেয়োনা, নিশ্চয় আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন {সূরা হাদীদ-৪০}
৮-
قوله تعالى مَا يَكُونُ مِن نَّجْوَى ثَلاثَةٍ إِلاَّ هُوَ رَابِعُهُمْ وَلا خَمْسَةٍ إِلاَّ هُوَ سَادِسُهُمْ وَلا أَدْنَى مِن ذَلِكَ وَلا أَكْثَرَ إِلاَّ هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا عَمِلُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ( المجادلة – 7 )

কখনো তিন জনের মাঝে এমন কোন কথা হয়না যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি উপস্থিত না থাকেন, এবং কখনও পাঁচ জনের মধ্যে এমন কোনও গোপন কথা হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি উপস্থিত না থাকেন। এমনিভাবে তারা এর চেয়ে কম হোক বা বেশি, তারা যেখানেই থাকুক, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন। অতঃপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে অবহিত করবেন তারা যা কিছু করত। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন {সূরা মুজাদালা-৭}
৯-
وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ

আল্লাহ তায়ালার কুরসী আসমান জমিন ব্যাপৃত {সূরা বাকারা-২৫৫}

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান হলে আকাশের দিকে কেন হাত উঠিয়ে দুআ করা হয়?
____________________
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান হলে আকাশের দিকে কেন হাত উঠিয়ে দুআ করা হয়?

আদবের জন্য। যদিও আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান। তিনি ডান দিকেও আছেন, বাম দিকেও আছেন, উপরেও আছেন, নিচেও আছেন। সামনেও আছেন। বাম দিকেও আছেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার শান হল উঁচু, তাই আদব হিসেবে উপরের দিকে হাত উঠিয়ে দুআ করা হয়।

যেমন কোন ক্লাশরুমে যদি লাউডস্পীকার ফিট করা হয়। চারিদিক থেকে সেই স্পীকার থেকে শিক্ষকের আওয়াজ আসে। তবুও যদি কোন ছাত্র শিক্ষকের দিকে মুখ না করে অন্যত্র মুখ করে কথা শুনে তাহলে শিক্ষক তাকে ধমক দিবেন। কারণ এটা আদবের খেলাফ। এই জন্য নয় যে, অন্য দিক থেকে আওয়াজ শুনা যায় না। তেমনি আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান থাকা সত্বেও উপরের দিকে মুখ করে দুআ করা হয় আল্লাহ তায়ালা উুঁচু, সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই আদব হিসেবে উপরের দিকে হাত তুলে দুআ করা হয়।

জিবরাঈল উপর থেকে নিচে নেমে আসেন মানে কি?
____________________
জিবরাঈল উপর থেকে নিচে নেমে আসেন মানে কি?

এর মানে হল-যেমন পুলিশ এসে কোন অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে কারণ বলে যে, উপরের নির্দেশ। এর মানে কি পুলিশ অফিসার উপরে থাকে? না সম্মান ও ক্ষমতার দিক থেকে যিনি উপরে তার নির্দেশ তাই বলা হয় উপরের নির্দেশ? তেমনি আল্লাহ তায়ালা ফরমান নিয়ে যখন জিবরাঈল আসেন একে যদি বলা হয় উপর থেকে এসেছেন, এর মানেও সম্মানসূচক ও পরাক্রমশালীর কাছ থেকে এসেছেন। তাই বলা হয় উপর থেকে এসেছেন। এই জন্য নয় যে, আল্লাহ তায়ালা কেবল আরশেই থাকেন।

আল্লাহ তায়ালা কি সকল নোংরা স্থানেও আছেন? নাউজুবিল্লাহ
____________________
আল্লাহ তায়ালা কি সকল নোংরা স্থানেও আছেন? নাউজুবিল্লাহ

এই উদ্ভট যুক্তি যারা দেয় সেই আহমকদের জিজ্ঞেস করুন। তার কলবে কি দু’একটি কুরাআনের আয়াত কি সংরক্ষিত আছে? যদি বলে আছে। তাহলে বলুন তার মানে সীনায় কুরআনে কারীম বিদ্যমান আছে। কারণ সংরক্ষিত সেই বস্তুই থাকে, যেটা বিদ্যমান থাকে, অবিদ্যমান বস্তু সংরক্ষণ সম্ভব নয়। তো সীনায় যদি কুরআন বিদ্যমান থাকে, সেটা নিয়ে টয়লেটে যাওয়া কিভাবে জায়েজ? কুরআন নিয়েতো টয়লেটে যাওয়া জায়েজ নয়। তখন ওদের আকল থাকলে বলবে-কুরআন বিদ্যমান, কিন্তু দেহ থেকে পবিত্র কুরআন। তেমনি আমরা বলি আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু তিনি দেহ থেকে পবিত্র। সেই হিসেবে সর্বত্র বিরাজমান।


সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা
---------------------------

স্রষ্টাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে ইহুদী ধর্ম
____________________
স্রষ্টাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে ইহুদী ধর্ম :-

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহ এর আকিদা হল আল্লাহর সাথে কারো কোন তুলনা নেই। আল্লাহর আকার-আকৃতি কেমন তা মানুষের কল্পনার বাইরে তিনি গায়েব (অদৃশ্য) মানুষের মত তার হাত, পা, দেহ এসব কল্পনা করা মারাত্মক পথভ্রষ্টতা। প্রভুর সাথে যেমন কারো শরিক নেই প্রভুর সাথে কারো তুলনা বা সাদৃশ্যও স্থাপন করা বাতিলের কাজ, মুর্খের কাজ।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

وجاوزنا ببني إسرائيل البحر فأتوا على قوم يعكفون على أصنام لهم قالوا يا موسى اجعل لنا إلها كما لهم آلهة

অর্থ: আর আমি বনী ইসরাইলকে সাগর পার করে দিয়েছি, তখন তারা এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছলো, যারা নিজেদের বানানো কতোগুলো প্রতিমার পূজায় রত ছিলো। বনী ইসরাইল বলল, হে মুসা, আমাদের জন্য এরূপ একটি উপাস্য নির্ধারণ করে দেন, যেরূপ এদের উপাস্য রয়েছে।

[সূরা আ’রাফ, আয়াত নং ১৩৮।]

পবিত্র কুরআনে আরও স্পষ্টভাবে বনী ইসরাইলের এই মানসিকতা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা মহান আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং রীতিমত মূর্তি বানিয়ে তার পূজা শুরু করেছে। তারা সর্বদা আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সদৃশ একটি সত্ত্বা বলেই বিশ্বাস করতো।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

واتخذ قوم موسى من بعده من حيلهم عجلاً جسداً له خوار

অর্থ: আর মুসার সম্প্রদায় তাঁর অনুপস্থিতিতে নিজেদের অলংকার সমূহ দিয়ে একটি গো-বৎসের আকৃতি বানালো, যার আওয়াজ ছিলো।

[সূরা আ’রাফ, আয়াত নং ১৩৮।]

তাদের এই বাছুর পূজা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা অন্য আয়াতে বলেন,

فَأَخْرَجَ لَهُمْ عِجْلًا جَسَدًا لَهُ خُوَارٌ فَقَالُوا هَٰذَا إِلَٰهُكُمْ وَإِلَٰهُ مُوسَىٰ فَنَسِيَ

অর্থ: “এরপর সে তাদের জন্য একটি বাছুর বানালো, যা একটি দেহ ছিলো, যাতে গরুর আওয়াজ ছিলো। তখন তারা বলতে লাগল, তোমাদের এবং মুসার মাবুদ তো এটাই, মূসা তো ভুলে গেছে।”

[সূরা ত্বহা, আয়াত নং ৮৮।]

বাইবেলের বুক অব এক্সোডাসে রয়েছে,

Now when the people saw that Moses delayed to come down from the mountain, the people assembled about Aaron and said to him, “Come, make us a god who will go before us”

অর্থ: যখন লোকেরা দেখল মুসা আ. পাহাড় থেকে অবতরণ করতে বিলম্ব করছে, তারা হারুন আ. এর নিকট একত্রিত হয়ে বলল, “আমাদের জন্য এমন একটা প্রভূ তৈরি করো, যে আমাদের সামনে চলা-ফেরা করবে”

[বুক অব এক্সোডাস, পরিচ্ছেদ, ৩২, শ্লোক, ১।]

একই বইয়ে রয়েছে,

After leaving Sukkoth they camped at Etham on the edge of the desert. By day the LORD went ahead of them in a pillar of cloud to guide them on their way and by night in a pillar of fire to give them light, so that they could travel by day or night.

অর্থ: তারা সুকুত থেকে যাত্রা করলো এবং মরুভূমির প্রান্তে ইছাম নামক স্থানে শিবির স্থাপন করলো। দিনের বেলায় প্রভূ তাদের সামনে মেঘের স্তম্ভ হয়ে চলছিলো এবং রাতে আগুনের স্তম্ভ হয়ে তাদেরকে আলো দিচ্ছিল , যেন তারা দিনে ও রাতে ভ্রমণ করতে পারে।

[বুক অফ এক্সোডাস, পরিচ্ছেদ, ১৩, শ্লোক, ২০-২১।]

বাইবেলে রয়েছে,

Moses and Aaron, Nadab and Abihu, and the seventy elders of Israel went up. and they saw the God of Israel. There was under his feet as it were a pavement of sapphire stone, like the very heaven for clearness. But God did not raise his hand against these leaders of the Israelites; they saw God, and they ate and drank.

অর্থ: মুসা, হারুন, নাদাব, আবিহু এবং বনী ইসরাইলের সত্তরজন বয়স্ক লোক পাহাড়ে আরোহণ করল। তারা ইসরাইলের প্রভূকে দেখল। প্রভূর পায়ের নিচে যেন নীলকান্ত মণি পাথর ছিলো, যা ছিলো আকাশের মতো স্বচ্ছ। প্রভূ ইসরাইলের নেতাদের দিকে তার হাত প্রসারিত করলেন না। তারা প্রভূকে দেখল, আহার করল এবং পান করলো।

[বুক অব এক্সোডাস, পরিচ্ছেদ, ২৩, শ্লোক, ৯-১১।]

বুক অব জেনেসিসে রয়েছে,

Whoever sheds the blood of man, by man shall his blood be shed, for God made man in his own image.

অর্থ: যে মানুষের রক্ত ঝরাবে, তার রক্তের বিনিময়ে হত্যাকারীর রক্ত ঝরানো হবে। কেননা প্রভূ মানুষকে নিজের আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন।

[বুক অব জেনেসিস, পরিচ্ছেদ, ৯, শ্লোক, ৬।]

The LORD said to Moses, “Behold, I will come to you in a thick cloud, so that the people may hear when I speak with you and may also believe in you forever.” Then Moses told the words of the people to the LORD. The LORD also said to Moses, “Go to the people and consecrate them today and tomorrow, and let them wash their garments; and let them be ready for the third day, for on the third day the LORD will come down on Mount Sinai in the sight of all the people.

অর্থ: প্রভূ মুসাকে বললেন, মনে রেখো, আমি তোমার নিকট পাতলা মেঘের আবরণে আগমণ করবো। আমি যখন তোমার সঙ্গে কথা বলব, মানুষ যেন শুনতে পায়। সম্ভবত: তারা তোমার উপর স্থায়ী বিশ্বাস স্থাপন করবে। অত:পর মুসা আ. প্রভূর বাণী লোকদেরকে শোনাল। প্রভূ মুসাকে আরও বলল, মানুষের কাছে যাও। আজ ও আগামীকাল তাদেরকে পবিত্র করো এবং তারা যেন তাদের কাপড় পবিত্র করে। তারা যেন তৃতীয় দিনের জন্য প্রস্তুত হয়। তৃতীয় দিন সব মানুষের চোখের সামনে প্রভূ সিনাই পর্বতে নেমে আসবে।

[বুক অব এক্সোডাস, পরিচ্ছেদ,১৯, শ্লোক, ৯-১১।]

অল্ড টেস্টামেন্টের দি বুক অব সামে রয়েছে,

you have sat on the throne, giving righteous judgment.

অর্থ: আপনি ন্যায়-পরায়ণ হিসেবে কুরসীতে উপবেশন করেছেন।

[বুক অব সাম, পরিচ্ছেদ,৯, শ্লোক, ৪।]

বাইবেলের পুরাতন নিয়মে রয়েছে,

In my distress I called upon the LORD, and cried unto my God: he heard my voice out of his temple, and my cry came before him, even into his ears. Then the earth shook and trembled; the foundations also of the hills moved and were shaken, because he was wroth. There went up a smoke out of his nostrils, and fire out of his mouth devoured: coals were kindled by it.

আমার বিপদের মুহূর্তে আমি প্রভূকে ডাকলাম এবং আমার প্রভূর নিকট ক্রন্দন করলাম। তিনি তার উপাসনালয়ের বাইরে থেকে আমার আওয়াজ শুনলেন। আমার ক্রন্দন তাঁর নিকট পৌছল। এমনকি তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল। অত:পর ভূমি প্রকম্পিত হলো এবং ঝাকুনি দিল। পাহাড়ের ভিত নড়ে উঠল। কেননা প্রভূ রাগান্বিত ছিলেন। তার নাক থেকে ধুয়া বের হলো এবং তার মুখ থেকে আগুন বের হলো, সেই আগুনে কয়লা জ্বলে উঠল।

[বুক অব সাম, পরিচ্ছেদ, ১৮, শ্লোক, ৬,৭,৮।]

আল্লাহ তায়ালা দৌড়ান সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা
____________________
আল্লাহ তায়ালা দৌড়ান সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা :

পূর্বের আলোচনায় আমরা উল্লেখ করেছি যে, সালাফীদের আকিদা হলো আল্লাহ তায়ালা আরশে বসে আছেন। এরা আল্লাহর জন্য উঠা, নামা, দৌড়ানো, স্থানান্তর হওয়া সব কিছুই সাব্যস্ত করে। এ পর্বে আল্লাহর দৌড়ানো সম্পর্কে আলোচনা করবো।

হাদীসে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমার নিকট যে হেটে হাসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যায়। ” এই হাদীস থেকে তারা প্রমাণ দিয়েছে যে আল্লাহ পাক দৌড়ান। অথচ সহীহ আকিদার একজন শিশুও বুঝবে যে, এখানে দৌড়ানো দ্বারা আল্লাহ তায়ালা তাকে সাহায্য ও কবুল করা উদ্দেশ্য। যাই হোক, কতো বড় আশ্চর্যের বিষয়, এজাতীয় ভ্রান্ত বিশ্বাস রাখার পরেও এরা সহীহ আকিদার দাবী করে?

সউদি মুফতী বোর্ডের ফতোয়া:
*********************

সউদি মুফতী বোর্ডে প্রশ্ন করা হয়, আল্লাহ তায়ালার কী দৌড়ানোর গুণ রয়েছে। তারা উত্তর দেয়, হ্যা আল্লাহর জন্য দৌড়ানোর গুণ রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা দৌড়ান। এ ফতোয়ায় সাক্ষর করেছে, ইবনে বাজ, আব্দুর রাজ্জাক আফিফী, আব্দুল্লাহ ইবনে গাদইয়ান, আব্দুল্লাহ বিন কুউদ।

ফতোয়া নং-৬৯৩২ [খ.৩, পৃ.১৪২]

ইবনে উসাইমিনের বক্তব্য:
*****************
ইবনে উসাইমিন বলেন,

“আল্লাহ তায়ালার জন্য দৌড়ানোর গুণ প্রমাণিত। …….সুতরাং এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক”

[মাজমুউ ফাতাওয়া ও রসাইল, খ.১, পৃ.১৮২]

বিরোধী বক্তব্য:
**********

ইবনে জিবরীনের বক্তব্য:

ইবনে জিবরীন বলেন, ” দৌড়ানো আল্লাহর গুণ নয়। বরং দৌড়ানো দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, বান্দার প্রয়োজন পূরণে বিলম্ব না করা।”
বিস্তারিত:
http://audio.islamweb.net/audio/Fulltxt.php?audioid=149331

সালেহ আল-ফাউজানের বক্তব্য:

শায়খ সালেহ আল -ফাউজানের মতে, দৌড়ানো আল্লাহর কোন গুণ নয়।
বিস্তারিত:
http://www.alathary.net/vb2/showthread.php?12736-%C7%E1%E5%D1%E6%E1%C9-%E1%ED%D3%CA-%C8%D5%DD%C9-%E1%E1%E5-%C7%E1%DA%E1%C7%E3%C9-%D5%C7%E1%CD-%C7%E1%DD%E6%D2%C7%E4&s=9354b41efc504cacfee627988b532970

আলবানী সাহেবের আশ্চর্যজনক উত্তর:
*************************
আলবানী সাহেব দৌড়ানোর বিষয়ে আশ্চর্যজনক স্ববিরোধীতার আশ্রয় নিয়েছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,
” আল্লাহর তায়ালার অবতরণ ও আসার মতো দৌড়ানো আল্লাহর একটি গুণ”
[মাউসুয়াতুল আলবানী, খ.১, পৃ.২৫৮]

আল্লাহর আকার সম্পর্কে সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা
____________________
আল্লাহর আকার সম্পর্কে সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা:

এটি প্রমাণের ধারনাটি মূলত: ইহুদী ধর্ম থেকে এসেছে। ইহুদীরা আল্লাহ তায়ালাকে মানুষের আকৃতিতে বিশ্বাস করে। মানুষের প্রায় সব গুণাগুণ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে থাকে। দেহবাদী আকিদার ক্ষেত্রে ইহুদীদের এসব জঘন্য আকিদা কাররামিয়া ও শিয়াদের মাধ্যমে ইসলামী আকিদায় প্রবেশ করে। পরবর্তীতে কাররামিয়াদের অনুসারী তথাকথিত সালাফীরাও এসব বাতিল আকিদা লালন করে এবং সমাজে দেহবাদী আকিদা প্রচার করতে থাকে।

আল্লাহর আকার সম্পর্কে ইহুদী আকিদা:

ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অব জেনেসিসে রয়েছে,
And God said, Let us make man in our image, after our likeness: and let them have dominion over the fish of the sea, and over the fowl of the air, and over the cattle, and over all the earth, and over every creeping thing that creepeth upon the earth.

“প্রভূ বললেন, আমি আমার আকৃতিতে, আমার সাদৃশ্যে মানুষ সৃষ্টি করবো, যারা মাছ, সমুদ্র…..জয় করবে”

[বুক অব জেনেসিস, পরিচ্ছেদ-১, শ্লোক-২৬]

একই বইয়ের ২৭ নং শ্লোকে রয়েছে,

So God created man in his own image, in the image of God created he him; male and female created he them.

অর্থাৎ সুতরাং প্রভূ মানুষকে নিজের আকৃতিতে সৃষ্টি করলেন; প্রভূর আকৃতিতে মানুষকে সৃষ্টি করলেন। আর তাদেরকে সৃষ্টি করলেন পুরুষ ও মহিলা হিসেবে।
[বুক অব জেনেসিস, পরিচ্ছেদ-১, শ্রোক, ২৭]

অনলাইন ভার্সন:
http://studybible.info/KJV/Genesis%201:27

ইহুদীদের কিতাব থেকে আল্লাহর আকার প্রমাণ:

তথাকথিত সালাফীরা যে ইহুদীদের কিতাব থেকে তাদের এই আকিদাটি নিয়েছে, এটি আমাদের মৌখিক কোন দাবী নয়। বরং তাদের কিতাবেই বিষয়গুলো স্পষ্ট রয়েছে।

সালাফীদের বক্তব্য:

সালাফীদের অন্যতম শায়খ হলেন আব্দুল আজিজ রাজেহী ও শায়খ সালেহ ইবনে আব্দুল আজিজ আলুশ শায়খ। তাদের মতে আল্লাহ তায়ালার সুরত বা আকৃতি রয়েছে। এই সুরত হলো আল্লাহর শিকল বা গঠন ও অবকাঠামো। আল্লাহ তায়ালার এই গঠন ও অবকাঠামোর মাধ্যমে তিনি অন্যদের থেকে পৃথক হয়ে থাকেন। আল্লাহ তায়ালার বিদ্যমান হওয়ার জন্য এমন একটি সুরত বা গঠন প্রয়োজন, যার মাধ্যমে তিনি অস্তিত্বশীল হয়ে থাকেন।

[বয়ানু তা’লবিসিল জাহমিয়া, পৃ.৪৫৫]

সৌদি মুফতী বোর্ডের ফতোয়া:

সালাফীরা শুধু আল্লাহ তায়ালার আকার আছে, একথা বলেই ক্ষ্যান্ত হয় না। বরং তাদের মতে আল্লাহর আকার হলো মানুষের মতো। এর স্বপক্ষে তারা দলিল দিয়ে থাকে, আল্লাহ তায়ালা আদম আ. কে নিজ আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন এই হাদীস দ্বারা। তাদের মতে আল্লাহ তায়ালা আদম আ. কে আল্লাহর নিজের আকৃতি অনুযায়ী সৃষ্টি করেছেন। বরং তাদের নিকট আল্লাহর আকার ও মানুষের আকারের মাঝে একটি মা’নায়ে কুল্লী বা সামষ্টিক অর্থ রয়েছে। অর্থাৎ উভয়ের আকৃতি একই রকম। তবে এই মা’নায়ে কুল্লী বা সামষ্টিক অর্থ থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর আকৃতি মানুষের সাথে সাদৃশ্য রাখে না। অর্থাৎ আল্লাহর একটি গঠন বা আকৃতি রয়েছে যেটা মানুষের মতো। কিন্তু এই গঠন হুবহু মানুষের আকৃতির সাইজ, রং বা পরিমাপ এক নয়। তাদের নিকট আল্লাহর আকার ও মানুষের আকারের মাঝে গুণগত পার্থক্য বিদ্যমান কিন্তু সমষ্টিগতভাবে উভয় আকৃতি একই রকম। এই কথাটি সৌদি মুফতী বোর্ডের পক্ষ থেকে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ) ফতোয়া নং-২৩৩১

ইবনে উসাইমিনের বক্তব্য:

“ইবনে উসাইমিনের মতে আল্লাহর গুণের সাথে মানুষের সাদৃশ্য রয়েছে। তার মতে আল্লাহর হাত ও মানুষের হাতের মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে। আল্লাহর চোখ ও মানুষের চোখের মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে। আল্লাহর চেহারার সাথে মানুষের চেহারার সাদৃশ্য রয়েছে। তবে আল্লাহর হাত হুবহু মানুষের হাতের মতো নয়।” অর্থাৎ ইবনে উসাইমিনের মতে আল্লাহর সাথে মানুষের সাদৃশ্য রয়েছে কিন্তু আল্লাহর হাত হুবহু মানুষের হাতের মতো নয়।
এই হুবহু জিনিসটা বোঝার জন্য ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি,
আমরা জানি ত্রিভুজ কয়েক প্রকার। এর মধ্যে এক প্রকার ত্রিভুজ হলো, সমবাহু ত্রিভুজ। অর্থাৎ একটা ত্রিভুজকে অপর আরেকটি ত্রিভুজের কোণ ও বাহুর দিক থেকে সমান। একটাকে আরেকটা দিয়ে রিপ্লেস করা যায়। কিন্তু সমবাহু ত্রিভুজ ছাড়া অন্যান্ সব ত্রিভুজই একটা আরেকটার সাথে সাদৃশ্য রাখে। কিন্তু এগুলো তো একটা আরেকটা হুবহু একই রকম নয়।
সারকথা হলো, ইবনে উসাইমিনের মতো আল্লাহ তায়ালা ও মানুষের মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে কিন্তু আল্লাহ ও মানুষ হুবহু এক নয়। আল্রাহর চেহারার সাথে মানুষের চেহারার সাদৃশ্য রয়েছে, কিন্তু আল্রাহ ও মানুষের চেহারা হুবহু এক নয়।

সালাফীদের শায়খ হামুদ বিন আব্দুল্লাহ তুয়াইজারী একটি কিতাব লিখেছে। কিতাবের নাম, আকিদাতু আহলিল ইমান ফি খালকি আদম আলা সুরতির রহমান ( মু’মিনের বিশ্বাস: আল্লাহ তায়ালা আদম আ. কে আল্লাহর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন)। সৌদি শায়খ ইবনে বাজ এই কিতাবের উপর একটি ভূমিকা লেখে দিয়েছে। কিতাবের ভূমিকায় ইবনে বাজ লিখেছে, আল্লাহ তায়ালার নিজ আকৃতিতে আদম আ. কে সৃষ্টি করেছেন এটি সালাফে সালেহীনের আকিদা। তিনি অন্যান্য আলেমদেরকে এটি বিশ্বাস করার আহ্বান জানিয়েছেন। হামুদ বিন আব্দুল্লাহ আত-তুয়াইজারী এ কিতাবটি একটি জঘন্য কিতাব। তার বক্তব্যগুলো স্পষ্ট মুজাসসিমাদের বক্তব্য। সে মূলত: দেহবাদী আকিদা প্রমাণের জন্য এই বই লিখেছে। এই তুয়াইজারী আল্লাহর আকৃতি প্রমাণের জন্য তাউরাত থেকে প্রমাণ দিয়েছে যে, আল্লাহর আকৃতি রয়েছে।

কথিত সালাফী আলেমদের বিরোধীতা:

সালাফী আলেমদের মাঝে শায়খ আলবানী আল্লাহর আকার বা আকৃতি অস্বীকার করেছেন। এছাড়াও ইবনে খোযাইমা তার কিতাবুত তাউহীদে আল্লাহর আকৃতি অস্বীকার করেছেন। আলবানী সাহেবের ছাত্র নাসীব রিফায়ীও আল্লাহর আকৃতি অস্বীকার করেছেন।

আলবানী সাহেবের বক্তব্য:

শায়খ আলবানী ইবনে বাজের ভূমিকা সমৃদ্ধ কিতাব “আকিদাতু আহলিল ইমান ফি খালকি আদম আলা সুরতির রহমান” ( মু’মিনের বিশ্বাস: আল্লাহ তায়ালা আদম আ. কে আল্লাহর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন) কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি তুয়াইজারীর লেখা এই কিতাব সম্পর্কে সহীহু আদাবিল মুফরাদে লিখেছেন,
” তুয়াইজারী “আকিদাতু আহলিল ইমান ফি খালকি আদম আলা সুরতির রহমান” ( মু’মিনের বিশ্বাস: আল্লাহ তায়ালা আদম আ. কে আল্লাহর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন) এই কিতাব লিখে সালাফী আকিদা ও রাসূল স. এর হাদীসের প্রতি নিকৃষ্ট কাজ করেছে।”

তুয়াইজারী সম্পর্কে শায়খ আলবানী বলেন, সে হাদীস নিয়ে কথা বলার যোগ্য নয় এবং আলেমদের বক্তব্য বিকৃত করে থাকে। অর্ধেক বক্তব্য উল্লেখ করে এবং অর্ধেক ছেড়ে দেয়।
[সহীহু আদাবিল মুফরাদ, ৩৭৫ পৃ.]

এছাড়াও দেখুন, ফাতাওয়াশ শায়খ আলবানী ফিল মদিনাতি ওয়াল ইমারত, পৃ,১৬-১৭। মুখতাসারু সহীহিলি বোখারী, খ.২, পৃ.১৭৮।

আলবানী সাহেব আল্লাহর আকৃতি অস্বীকার করায় অন্যান্য সালাফী শায়খরা তার উপর বেশ চটেছেন। সালাফীদের দু’জন শায়খ স্পষ্ট আলবানীর সমালোচনা করেছে। এরা হলেন, শায়খ আব্দুর রাজ্জাক আফিফী ও শায়খ আব্দুল্লাহ দাবিশ।

আব্দুর রাজ্জাক আফিফীর বক্তব্য:

“আল্লাহ তায়ালা আদম আ. কে নিজ আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। এটিই সঠিক। যদিও আলবানী ও নাসীব রিফায়ী এর বিরোধীতা করেছে”

[ফাতাওয়া ও রসাইল, পৃ.১৬০,, খ.১]

আব্দুল্লাহ দাবিশ এর বক্তব্য:
****************

শায়খ আব্দুল্লাহ দাবিশ আলবানী সম্পর্কে লিখেছে,
” আলবানীর মতটি আমি দেখেছি। এটি আহলে সুন্নতের বক্তব্যের বিরোধী এবং পথভ্রষ্ট জাহমিয়াদের বক্তব্যের অনুরুপ”
[দিফাউ আহলিস সুন্নাহ, পৃ.৫]

যারা আল্লাহর আকার সাব্যস্ত করে তাদের সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী রহ. এর বক্তব্য:

যারা আল্লাহর আকার সাব্যস্ত করেছে এবং আল্লাহর আকৃতিতে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে এধরনের বিশ্বাস রাখে, ইমাম কুরতুবী তাদেরকে মুশাববিহা বলেছেন। ইমাম কুরতুবী এধরনের আকিদা পোষণকারীদেরকে কাফের পর্যন্ত বলেছেন।

[আল-মুফহিম, খ.৬, পৃ.৫৯৮]

আল্লাহ আরশের উপর বসে আছেন বলে সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা
____________________
আল্লাহ আরশের উপর বসে আছেন বলে সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা

এই পর্বে ইহুদী খৃষ্টান ধর্মের আকিদার সাথে মিল রেখে সালাফী, আহলে হাদিস দের আকিদা সেটা প্রমান করব।
ইসলাম ধর্মে তাদের বিপরীত করার আদেশ রয়েছে কিন্তু সালাফীরা তাদের আকিদাহকে ধরেছেঃ

বলে দিনঃ অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের প্রাচুর্য তোমাকে বিস্মিত করে। অতএব, হে বুদ্ধিমানগণ, আল্লাহকে ভয় কর-যাতে তোমরা মুক্তি পাও। ৫:৯৯-১০০”

তোমরা অগ্নিপূজকদের বিপরীত কর"। [(মুসলিম ২,৫১০]

"তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের স্বভাবের অনুসরণ করবে, প্রতি পদে পদে, এমনকি তারা যদি কোন ধাব(গুইসাপের গর্ত) এও প্রবেশ করে তবে তোমরাও তাই করবে।" আমরা (সাহাবাগণ) জানতে চাইলাম, "হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি ইহুদী ও নাসারাদের অনুকরণের কথা বলছেন?" তিনি বললেন, "নয়তো কারা?" (বুখারী, মুসলিম)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
" যে ব্যক্তি যে জাতির সামঞ্জস্যতা অবলম্বন করবে সে কিয়ামতের দিন তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। " 
[আবূ দাউদ ৪/৪০৩১ মুসনাদে আহমদ ২/৫০]

        আরশে বসার ব্যাপারে ইহুদী আকিদা:

অল্ড টেস্টামেন্টের ফাস্ট কিং বইয়ে রয়েছে,
And Micaiah said, “Therefore hear the word of the LORD: I saw the LORD sitting on his throne, and all the host of heaven standing beside him on his right hand and on his left;
অর্থাৎ সুতরাং প্রভূর বাণী শোনো। আমি প্রভূকে তার কুরসীর উপর বসা দেখলাম এবং আসমানের সকল সৈন্য তার ডান ও বাম পাশে দাড়ানো ছিলো।
[ অল্ড টেস্টামেন্ট, দি বুক অফ ফাস্ট কিং, পরিচ্ছেদ ২২, শ্লোক, ১৯]

অনলাইন ভার্সন:
http://biblehub.com/1_kings/22-19.htm

অল্ড টেস্টামেন্টের দি বুক অব সামে রয়েছে,
you have sat on the throne, giving righteous judgment.

অর্থ: আপনি ন্যায়-পরায়ণ হিসেবে কুরসীতে উপবেশন করেছেন। [বুক অব সাম, পরিচ্ছেদ,৯, শ্লোক, ৪।]

অল্ড টেস্টামেন্টের বুক অব সামে রয়েছে,
God reigns over the nations; God sits on his holy throne.
অর্থ: প্রভূ জাতিসমূহের উপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন, প্রভূ তার পবিত্র কুরসীতে বসলেন।
[ বুক অব সাম, পরিচ্ছেদ, ৪৭, শ্লোক, ৮]

অনলাইন ভার্সন:
http://biblehub.com/psalms/47-8.htm

বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে রয়েছে,
and crying out with a loud voice, “Salvation belongs to our God who sits on the throne

অর্থাৎ উচু স্বরে চিৎকার করে কেদে উঠলো এবং বলল, আমাদের প্রভূর জন্য মুক্তি, যিনি তার কুরসীতে বসে আছেন।

[The Book of Revelation, পরিচ্ছেদ, ৭, শ্লোক, ১০]

অনলাইন ভার্সন:
http://biblehub.com/revelation/7-10.htm

একই পরিচ্ছেদের ১৫ নং শ্লোকে রয়েছে,

"That is why they stand in front of God's throne and serve him day and night in his Temple. And he who sits on the throne will give them shelter.

অর্থাৎ আরশে উপবেশনকারী তাদেরকে আশ্রয় দিবে।

[The Book of Revelation, পরিচ্ছেদ, ৭, শ্লোক, ১৫]

অনলাইন ভার্সন,
http://biblehub.com/revelation/7-15.htm

একই বইয়ের ৪ নং পরিচ্ছেদে রয়েছে,
And when those beasts give glory and honour and thanks to him that sat on the throne, who liveth for ever and ever
অর্থাৎ তারা সেই সত্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো যিনি আরশে বসে আছেন, যিনি চিরণ্জীব।
[The Book of Revelation, পরিচ্ছেদ, ৪, শ্লোক, ৯]
http://biblehub.com/revelation/4-9.htm

                     কাররামিয়াদের আকিদা:

১. মুহাম্মাদ ইবনে কাররামের একটি মৌলিক ভ্রান্ত আক্বিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। তার দেহের একটি সীমা ও সমাপ্তি রয়েছে। তার মতে আল্লাহর দেহের নিচের দিকের কেবল সীমা ও সমাপ্তি রয়েছে, যেই দিক আরশের সাথে সংশ্লিষ্ট।

২. ইবনে কাররামের আরেকটি আক্বিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপরের অংশ স্পর্শ করে আছেন।

৩. ইবনে কাররামের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর স্থির হয়ে আছেন। সত্ত্বাগতভাবে তিনি উপরের দিকে রয়েছেন। আরশ হলো আল্লাহর অবস্থানের স্থান।

বিস্তারিত দেখুন,
আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৩, আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৮, ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.১৭, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৪, আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৮।

                              সালাফী আকিদা:

১. সালাফীদের অন্যতম শায়খ হলেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী। তিনি বেশ কিছু কিতাব লিখেছেন। এসব কিতাবের অন্যতম একটি কিতাব হলো কিতাবুত তাউহীদ। কিতাবুত তাউহীদের একটি ব্যাখ্যা লিখেছে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর নাতী শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে হাসান। তিনি কিতাবুত তাউহীদের এ ব্যাখ্যার নাম দিয়েছেন ফাতহুল মাজীদ। ফাতহুলী মাজীদ কিতাবুত তাউহীদের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ। এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছেন, শায়খ আব্দুল কাদের আর-নাউত। ফাতহুল মাজীদের ৪৮৫ পৃষ্ঠায় আল্লাহর আরশে বসার কথা রয়েছে। এখানে রয়েছে,
إذا جلس الرب علي الكرسي
"যখন প্রভূ কুরসীর উপর বসলেন"।

২. সউদি সরকারের সাবেক প্রধান মুফতী সালাফীদের অন্যতম শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম আলুশ শায়খও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আল্লাহর আরশে বসার আকিদা বর্ণনা করেছেন। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা রাসূল স. কে মাকামে মাহমুদ বা প্রশংসনীয় মর্যাদা দ্বারা সম্মানিত করবেন। মাকামে মাহমুদ এর অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত দিবসে রাসূল স. কে শাফায়াতে উজমা বা সবচেয়ে বড় শাফায়াতের ক্ষমতা দান করবেন। শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম আলুশ শায়খ "মাকামে মাহমুদের" ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন,

" কেউ কেউ বলেছেন, মাকামে মাহমুদ হলো, ব্যাপক শাফায়াত বা সুপারিশ। কেউ কেউ বলেছেন, মাকামে মাহমুদ হলো, আল্লাহ তায়ালা রাসূল স. কে আরশের উপরে তার পাশে বসাবেন। এটি আহলে সুন্নতের প্রসিদ্ধ বক্তব্য" উভয় বক্তব্যের মাঝে কোন বৈপরীত্ব নেই। উভয়ের মাঝে এভাবে সমন্বয় করা সম্ভব যে উভয়টি রাসূল স. কে দেয়া হবে। তবে আল্লাহর পাশে রাসূল স. কে বসানো হবে, এই ব্যাখ্যাটি অধিক যুক্তিসঙ্গত।
[ফতোয়া ও রসাইল, পৃ.১৩৬। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম আলুশ শায়খ, তাহকীক মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম ইবনে কাসেম, প্রথম প্রকাশ, ১৩৯৯ হি:, মাতবায়াতুল হুকুমিয়া, মক্কা]

৩. সালাফীদের বিখ্যাত একজন শায়খ হলেন সালেহ আল-উসাইমিন। শায়খ সালেহ আল-উসাইমিনের উস্তাদ হলেন, আব্দুর রহমান সা'দী। তিনিও আরব সালাফীদের মাঝে বেশ পরিচিত। আব্দুর রহমান সা'দীও আরশে বসার আকিদা পোষণ করেন। তিনি লিখেছেন,
" ইস্তেওয়ার একটি ব্যাখ্যা হলো, স্থির হওয়া বা বসা। এই ব্যাখ্যাটি সালাফ বা পূর্ববর্তীদের থেকে বর্ণিত"
[আল-আজইবাতুস সা'দিয়া আনিল মাসাইলিল কুয়েতিয়্যা, পৃ.১৪৭। তাহকীক, ড. ওলীদ আব্দুল্লাহ। ]

৪. বর্তমান সালাফীদের বিখ্যাত শায়খ হলেন সালেহ আল-উসাইমিন। তিনিওএই ইহুদীবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিলেন। আল্লাহর আরশে বসার আকিদাটি তিনিও স্বীকৃতি দিয়েছেন। শায়খ সালেহ আল-উসাইমিন তার মাজমুউল ফতোয়ায় ইবনুল কাইয়্যিম এর বক্তব্য এনেছেন। ইবনে তাইমিয়ার বিখ্যাত ছাত্র ইবনুল কাইয়্যূমও আরশে বসার আকিদা রাখতো। শায়খ সালেহ আল-ফাউজান লিখেছেন,
" ইস্তাওয়া শব্দের আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, বসা। ইবনুল কাইয়্যিম আস-সাওয়াইকুল মুরসালা (খ.৪, পৃ.১৩০৩) কিতাবে এই ব্যাখ্যাটি খারিজা ইবনে মুসআব থেকে বর্ণনা করেছেন। সূরা ত্বহার ৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি লিখেছেন, বসা ছাড়া কখনও কি ইস্তাওয়া হয়?
[মাজমুউ ফাতাওয়া ও রসাইল, ইবনে উসাইমিন, খ.১, পৃ.১৩৫, দারুল ওযাতন]

৫. সালাফীদের অন্যতম বিখ্যাত শায়খ হলেন শায়খ সালেহ আল-ফাউজান। তিনি আব্দুল আজীজ বিন ফয়সাল আর-রাজেহীর একটি কিতাবের ভূমিকা লেখে দিয়েছে। কুদুমু কাতাইবিল জিহাদ নামক এই বইয়ে আব্দুল আজিজ রাজেহী আরশে বসার আকিদা সম্পর্কে লিখেছে,
"বসা ছাড়া কখনও কি ইস্তাওয়া হয়? এই কথাটি সঠিক। এর উপর কোন ধুলোবালি নেই। অর্থাৎ এটি নি:সন্দেহে সঠিক।"
[কুদুমু কাতাইবিল জিহাদ, পৃ.১০১]

৬. ইবনে তাইমিয়ার বিখ্যাত ছাত্র হলেন ইবনুল কাইয়্যিম। নাওনিয়াতু ইবনিল কাইয়্যিম নামে তার একটি কিতাব রয়েছে। শায়খ সালেহ আল-ফাউজান ইবনুল কাইয়্যিমের এ কিতাবের উপর সংক্ষিপ্ত টীকা লিখেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন, আত-তা'লিকুল মুখতাসার আলাল কাসিদাতিত নাউনিয়্যাহ। এ কিতাবে শায়খ ফাউজান আরশে বসার আকিদাটি স্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন,
" মাকামে মাহমুদ এর ব্যাখ্যা হলো, আল্লাহ তায়ালা রাসূল স. কে আরশে নিজের পাশে বসাবেন।"
[আত-তালীকুল মুখতাসার, সালেহ আল-ফাউজান, পৃ.৪৫৩]

                         আশ্চর্যজনক স্ববিরোধীতা :

আকিদার ক্ষেত্রে সালাফী শায়খদের দোদুল্যমান অবস্থা দেখলে সত্যিই আশ্চর্য লাগে। এদের নির্দিষ্ট কোন দিক নেই। এখন পূর্বে থাকলে কিছুক্ষণ পরে ঠিকই পশ্চিমে যায়। এধরনের স্ববিরোধী অবস্থান বড় বিস্ময়কর। শায়খ সালেহ আল-ফাউজান অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় আল্লাহর বসার আকিদা স্বীকার করেছেন। যারা এটা অস্বীকার করে তাদেরকে দুর্বল মস্তিষ্কের আখ্যাযিত করেছেন। এমনকি তাদের কথা ধর্তব্য নয় বলেও রায় দিয়েছেন। অথচ তিনি আবার লিখেছেন,

প্রশ্ন: যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ ইস্তাওয়া গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ তিনি আরশে বসেছেন, তার সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী? এটা কি তা’বীল বা ব্যাখ্যার অন্তুর্ভূক্ত হবে?

১. উত্তর: এটি বাতিল ও ভ্রান্ত। কেননা বসা দ্বারা ইস্তাওয়ার ব্যাখ্যা করা হয় না।আর আমরা নিজেদের পক্ষ থেকে কিছু বলি না।
[শরহু লুময়াতিল ই’তেকাদ, পৃ.৩০৫]

২. শায়খ ইবনে জিবরীন সালাফীদের অন্যতম শায়খ। তিনি আল-জওয়াবুল ফাইক ফির রদ্দি আলা মুবাদ্দিলিল হাকাইক নামে একটা পুস্তক লিখেছেন। এই পুস্তকে তিনি আল্লাহর বসার আকিদাটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। এমনকি যারা এ আকীদাকে আহলে সুন্নতের আকিদা বা নজদের ওহাবী বা সালাফী আলেমদের আকিদা বলে থাকে, তাদেরকে মিথ্যুক বলেছেন। তিনি লিখেছেন,
“সালাফে সালেহীনের কিতাবে ইস্তাওয়া শব্দের ব্যাখ্যায় বসার কোন অর্থ উল্লেখ নেই। সুতরাং আহলে সুন্নতের দিকে এই আকিদা সম্পৃক্ত করা কিংবা সালাফী আলেমদের দিকে এই আকিদা সম্পৃক্ত করা, তাদের সম্পর্কে মিথ্যাচার বৈ কিছুই নয়।“

৩. শায়খ আলবানীর বক্তব্য:

শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানীর মতে যেসব হাদীসে স্পষ্টভাবে আল্লাহর দিকে বসার কথা উল্লেখ রয়েছে এগুলো জাল হওয়া বান্ছনীয়। কেননা এসব হাদীসের বক্তব্য মুনকার। কেননা আল্লাহর আরশে বসার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই। আর বসার কথা যেসব হাদীসে রয়েছে, সেগুলো কখনও রাসূল স. এর হাদীস হতে পারে না। কারণ আল্লাহর দিকে বসার সম্পৃক্ততাই প্রমাণ করে যে এটি রাসূলস. এর হাদীস নয়। শায়খ আলবানীর সব লেখা সংকলন করে একটি মউসুয়া বের করা হয়েছে। এই মউসুয়ার প্রথম খন্ডে আকিদা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম খন্ডের ৩৪৩ পৃষ্ঠার শিরোনাম হলো,
“আল্লাহ তায়ালা জন্য বসার আকিদাটি ভিত্তিহীন”
এখানে শায়খ আলবানী বলেছেন,

“ আল্লাহর বসার ব্যাপারে কোন বিশুদ্ধ বর্ণনা নেই। সুতরাং আল্লাহর দিকে বসার আকিদা সম্বলিত হাদীস জাল হওয়াটাই বান্চনীয়”

এছাড়া শায়খ আলবানী লিখেছে :

এ বর্ণনায় আল্লাহ তায়ালার দিকে বসার কথা সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আরশে স্থির আছেন এটা সাব্যস্ত হয়। অথচ আল্লাহর বসার ব্যাপারে বিশুদ্ধ কোন বর্ণনা নেই। সুতরাং এটি বিশ্বাস করা এবং তা আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করা বৈধ হবে না।
[মুখতাসারুল উলু, পৃ.১৭, প্রথম সংস্করণ]

ইস্তাওয়া শব্দের ভুল ব্যাখ্যায় সালাফীদের বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত আকিদা
____________________
ইস্তাওয়া শব্দের ভুল ব্যাখ্যায় সালাফীদের বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত আকিদাঃ

ইবনে উসাইমিনের বক্তব্য:

সালাফীদের ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আল-আকিদাতুল ওযাসিতিয়্যা নামে একটি আকিদার কিতাব লিখেছেন। আকিদাতুল ওয়াসিতিয়্যা ব্যাখ্যা লিখেছেন ইবনে উসাইমিন। তিনি এর নাম দিয়েছেন, শরহুল আকিদাতিল ওয়াসিতিয়্যা। কিতাবটি দারু ইবনিল জাওযী প্রকাশ করেছে। ইবনে উসাইমিন এ কিতাবে লিখেছে,

” ইস্তাওয়ার অর্থ হলো, উচু হওয়া ও স্থির হওয়া”

[শরহুল আকিদাতিল ওয়াসিতিয়্যা, খ.১, পৃ.৩৫৭, দারু ইবনিল জাওযী]

ইবনে জিবরীনের বক্তব্য:

সালাফী শায়খ ইবনে জিবরীন আল-আকিদাতুল ওয়াসিতিয়্যার একটি ব্যাখ্যা লিখেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন, আত-তালিকাতুজ জাকিয়্যা। তিনি এ কিতাবে লিখেছেন,

” অধিকাংশ আহলে সুন্নতের মতে “ইস্তাওয়া” এর অর্থ হলো স্থির হওয়া (এটা জঘন্যতম মিথ্যা কথা)”

[আত-তা’লিকাতুজ জাকিয়্যা, পৃ.২১১-২১২, খ.১]

সালেহ আল-ফাউজানের বক্তব্য:

সালাফী শায়খ সালেহ আল-ফাউজান তার শরহু লুমআতিল ই’তেকাদ কিতাবে লিখেছে,
” সালাফে সালেহীন ইস্তাওয়ার একটি ব্যাখ্যা করেছেন ” স্থির হওয়া”

[শরহু লুময়াতিল ই’তেকাদ, পৃ.৯১]

সালাফী শায়খদের স্ববিরোধীতা:

পূর্বে যাকে আহলে সুন্নতের আকিদা, সালাফে সালেহীনের আকিদা হিসেবে উল্লেখ করা হলো, সে আকিদা সম্পর্কে সালাফী শায়খরা বলছেন, এসব আকিদা থেকে আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত। এধরনের দ্বিমুখী কথা সত্যিই বিস্ময়কর। সালাফীদের বিখ্যাত শায়খ, সউদি মুফতী বোর্ডের সদস্য ড. বকর আবু যায়েদ এই আকিদাকে সালাফীদের সম্পর্কে মিথ্যাচার বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ ইবনে তাইমিয়ার মতে আল্লাহ তায়ালা আরশে বসে আছেন। এমনকি তার মতে আল্লাহ তায়ালা মাছির পিঠেও বসতে পারেন। ইবনে তাইমিয়া যে আল্লাহর স্থির হওযার কথা বলেছেন, ড. বকর আবু যায়েদ এটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তার মতে যারা ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে এধরনের কথা বলে তারা ইবনে তাইমিয়ার উপর মিথ্যাচার করে। কারণ ইবনে তাইমিয়া আল্লাহর স্থির হওয়ার আকিদা রাখতো না। ড. বকর আবু যায়েদ লিখছেন,

"কিছু বিভ্রান্ত লোক ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে বলেছে, তিনি আল্লাহর আরশের উপর স্থির হওয়ার কথা বলেছেন। এটি ইবনে তাইমিয়ার উপর মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়” [মু’জামুল মানাহিল লফজিয়্যা, পৃ.৯১]

আলবানীর বক্তব্য:

সালাফীদের শায়খ নাসীরুদ্দিন আলবানী লিখেছে,
"আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে স্থির হওয়ার কথা বলা বৈধ নয়। কারণ এটি মানুষের বৈশিষ্ট্য বা গুণ”
[মাওসুয়াতুল আলবানী, পৃ.৩৪]

ইস্তেওয়া শব্দের সঠিক অর্থ এবং সালাফীদের অপপ্রচার
____________________
ইস্তেওয়া শব্দের সঠিক অর্থ এবং সালাফীদের অপপ্রচারঃ

সালাফে-সালেহীনের যুগেই আকিদার অঙ্গনে ভয়ংকর ফেতনা দু’টি জেকে বসেছিলো। ইমাম আবু হানিফা রহ. এসম্পর্কে বলেন,
“أتانا من المشرق رأيان خبيثان جهم معطل ومقاتل مشبه
অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে আমাদের নিকট দু’টি নিকৃষ্ট মতবাদ এসেছে। ১. জাহাম ইবনে সাফওয়ানের মতবাদ যে ছিলো মুয়াত্তিলা (আল্লাহর গুণ অস্বীকারকারী )। ২. মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের মতবাদ যে ছিলো মুশাববিহা (আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য প্রদানকারী)। [তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬৪]
মুজাসসিমা ও মুশাববিহাদের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে “দেহবাদী আকিদার স্বরূপ বিশ্লেষণ (১-৫) “পড়ুন।

ইস্তেওয়া সম্পর্কে সাদামাটা কিছু কথা:
=====================
১. আরবী ভাষায় ইস্তেওয়া শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। ইস্তেওয়ার সাথে অব্যয় পদ (ইলা, আলা) ইত্যাদির ব্যবহারের পার্থক্যের সাথে সাথে অর্থের পরিবর্তন হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো, ইস্তেওয়া আলা এর অর্থ বিশ্লেষণ করা। 
২. পবিত্র কুরআনের বিখ্যাত তাফসীরসমূহে “ইস্তেওয়া আলা” এর দু’টি অর্থ করা হয়েছে। ১. কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ২. মর্যাদাগতভাবে সমুন্নত হওয়া। ইস্তেওয়ার আরেকটি অর্থ হলো, পরিপূর্ণতায় পৌছানো।
৩. আমার ক্ষুদ্র তাহকীক অনুযায়ী, পৃথিবী বিখ্যাত কোন তাফসীরে পবিত্র কুরআনের সূরা ত্ব-হা বা অন্য আয়াতের ইস্তেওয়ার অর্থ বসা, সমাসীন হওয়া, অধিষ্ঠিত হওয়া, অধিষ্ঠান গ্রহণ করা ইত্যাদি অর্থ করা হয়নি। আরবী ভাষায় সমাসীন হওয়া বা বসার আরবী হলো, জালাসা (جلس), কায়াদা (قعد)। বিখ্যাত কোন তাফসীরে ইস্তেওয়ার এই বসার অর্থ করা হয়নি।
৪. আমরা এখানে ধারাবাহিকভাবে অনেক বিখ্যাত মুফাসসিরের বক্তব্য উল্লেখ করবো যারা তাদের তাফসীরসমূহে ইস্তেওয়ার অর্থ করেছেন, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
৫. ইস্তেওয়ার একটি ভ্রান্ত ও বাতিল অর্থ হলো, বসা বা সমাসীন হওয়া। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে এধরনে বাতিল বিশ্বাস ইমানের জন্য ভয়ংকর। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়া অবশ্যই কুফুরী। সুতরাং এধরনের ইমান বিধ্বংসী বিশ্বাস থেকে দূরে থাকতে হবে। কুরআনের কোন বাংলা অনুবাদক ভুল করে বা না জেনে এধরনের অর্থ করে থাকতে পারেন। তবে কেউ যদি ইচ্ছা করে এধরনের বাতিল বিশ্বাস রাখে তবে সে অবশ্যই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত থেকে বের হয়ে ভ্রান্ত ফেরকা মুজাসসিমাদের অন্তুর্ভূক্ত হবে।
৬. আরবী ভাষার প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ ব্যবহারে সমাসীন বা বসার অর্থে কখনও ইস্তেওয়া ব্যবহৃত হয় না। বরং এর জন্য জালাসা (جلس), কায়াদা (قعد) ব্যবহৃত হয়। আরবী অভিধান অনুযায়ী ইস্তেওয়ার অর্থ বসা করাটাও অপ্রচলিত ও অপ্রসিদ্ধ ব্যবহার গ্রহণ করা হয়। অধিকাংশ অভিধানবিদ তাদের অভিধানে ইস্তেওয়ার এই অপ্রচলিত অর্থটি লেখেননি।
৭. সালাফে-সালেহীনের কারও থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনায় ইস্তেওয়ার অর্থ বসা বা সমাসীন হওয়া পাওয়া যায় না। মূলত: ইস্তেওয়ার এই অর্থটি মুজাসসিমা ও কাররামিয়াদের সৃষ্টি।
৮. সালাফীদের বিখ্যাত ফতোয়ার সাইট ইসলাম ওয়েব এ বিষয়ে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হয়। তারা এর উত্তরে লিখেছেন,
وأما تفسيره بالجلوس فليس مشهورا ولا معروفا عنهم
” সালাফে-সালেহীন থেকে প্রসিদ্ধ বা পরিচিত কোন বর্ণনায় ইস্তেওয়ার শব্দটি বসা বা সমাসীন হওয়ার অর্থে পাওয়া যায় না।”
ফতোয়ার লিংক:
http://fatwa.islamweb.net/fatwa/index.php?page=showfatwa&Option=FatwaId&Id=172147

বিখ্যাত মুফাসসিরগণের মতে ইস্তেওয়ার অর্থ
____________________
বিখ্যাত মুফাসসিরগণের মতে ইস্তেওয়ার অর্থ:
========================
১. আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনুল মুবারক [মৃত: ২৩৭ হি:] এর তাফসীর:

বিখ্যাত ভাষাবিদ ও আরবী ব্যাকরণবিদ আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনুল মুবারক [মৃত: ২৩৭ হি:] তার ” গারিবুল কুরআন ও তাফসীরুহু” -তে লিখেছেন,
: الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه:5] استوى: استولى” اهـ}
” সূরা ত্ব-হা এর পাঁচ নং আয়াত: দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। “ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, ইস্তাওলা তথা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা”
[গারিবুল কুরআন ও তাফসীরুহু, পৃষ্ঠা.২৪৩, আলামুল কুতুব]

২. ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. [মৃত: ৩১০ হি:] এর তাফসীর:
=========================
ইমাম ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. তার বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ “জামিউল বয়ান” এ ইস্তেওয়া শব্দের বিশ্লেষণ করেছেন। আরবী ভাষায় ইস্তেওয়া শব্দের বিভিন্ন ব্যাবহার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আরবী ভাষায় ইস্তেওয়ার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো ইস্তাউলা বা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আরবী ভাষায় ইস্তেওয়ার এর অনুগামী অব্যয়ের কারণে এর অর্থের পবির্তন হয়। ইস্তেওয়ার অনুগামী অব্যয় পদ যখন “ইলা” (إلي) হয়, তখন তিনি এর অর্থ গ্রহণ করেছেন সমুন্নত হওয়া বা উঁচু হওয়া। তিনি স্পষ্টভাষায় লিখেছেন, সমুন্নত হওয়া দ্বারা স্থান বা অবস্থানগত সমুন্নত বা উচু হওয়া উদ্দেশ্য নয়। বরং সমুন্নত হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য মর্য়াদা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দিক থেকে সমুন্নত হওয়া। এ বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম ত্ববারী রহ, দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে পবিত্র। তিনি উচু বা সমুন্নত হওয়ার দ্বারা কখনও এটি উদ্দেশ্য নয় যে, তিনি স্থানগত দিক থেকে উচু বা সমুন্নত হয়েছেন। বরং আল্লাহর সমুন্নত হওযার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মর্যাদাগত সমুন্নত হওয়া। ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. সূরা বাকারার ২৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
علا عليها علو ملك وسلطان لا علو انتقال وزوال.اهـ “তিনি নিজের কর্তৃত্ব, মালিকানা ও ক্ষমতার দিক থেকে আসমান সমূহের উপর সমুন্নত হয়েছেন। সমুন্নত হওয়া হওয়া দ্বার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া কিংবা এক জায়গা থেকে সরে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়।”
[ তাফসীরে ত্ববারী, খ.১, পৃ.৪২৯-৪৩০, তাহকীক, আহমাদ শাকের]

মূল বইয়ের ডাউনলোড লিংক:
https://archive.org/details/TafsirTabariShakir

এছাড়াও ইমাম ত্ববারী রহ. স্পষ্টভাষায় তার তারীখে ত্ববারীর ভূমিকায় আল্লাহ তায়ালাকে দিক থেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন। ইমাম ত্ববারী রহ. তারীখে ত্ববারীর ভূমিকায় বলেন,
” لاتحيط به الأوهام ولا تحويه الأقطار و لا تدركه الأبصار “
অর্থাৎ কারও ধ্যান-ধারণা আল্লাহকে পরিব্যাপ্ত করতে পারে না, কোন দিক আল্লাহকে বেষ্টন করে না, কোন চোখ তাকে অবলোকন করতে পারে না।”
[তারীখে ত্ববারী, খ.১, পৃ.৩, তাহকীক, মুহাম্মাদ আবুল ফজল ইব্রাহিম]

#মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
http://www.waqfeya.com/book.php?bid=8541

সুতরাং ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. এর নিকট আল্লাহ তায়ালা বান্দার ধারণা থেকে উর্ধ্বে। মানুষ আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে যেসব কল্পনা করে তিনি তা থেকে পবিত্র। আল্লাহ তায়ালা সমস্ত দিক থেকে পবিত্র। কোন দিকেই আল্লাহ তায়ালা অবস্থান করেন না। কোন দিকই আল্লাহ তায়ালাকে পরিবেষ্টন করে না। তিনি স্থান ও দিক থেকে পবিত্র। দুনিয়াতে চর্মচোখে আল্লাহ তায়ালাকে দেখা অসম্ভব।

3. ইমাম আবু ইসহাক ঝুজাজ রহ.[মৃত: ৩১১] এর তাফসীর:
=========================
ইমাম ঝুজায রহ. আরবী ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণবিদ ও ভাষাবিদ। ইমাম যাহাবী [মৃত ৭৪৮ হি:] তার সম্পর্কে বলেন, “তিনি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণবিদ ছিলেন” [সিয়ারু আ'লামিন নুবালা, খ.১৪, পৃ.৩৬০]। ইমাম ঝুজায রহ. তাঁর “মায়ানিল কুরআন ও ই’রাবুহু” নামক কিতাবে লিখেছেন,
وقالوا: معنى استوى استولى اهـ
অর্থাৎ ” ইস্তেওয়ার অর্থ হলো ইস্তাউলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ”
[মায়ানিল কুরআন ও ই'রাবুহু, খ.৩, পৃ.৩৫০, তাহকীক, ড. আব্দুল জলীল আব্দুহ]
#মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
http://www.waqfeya.com/book.php?bid=1404

৪. ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি হানাফী রহ. [মৃত:৩৩৩ হি] এর বক্তব্য:
=========================

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিখ্যাত ইমাম ও যুগশ্রেষ্ঠ আকিদাবিশারদ ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদী তার যুগশ্রেষ্ঠ তাফসীর “তা’বীলাতু আহলিস সুন্নাহ” নামক কিতাবে লিখেছেন, ইস্তেওয়ার একটি অর্থ হলো কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি সূরা ত্বহার ৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইস্তেওয়ার আরো দু’টি অর্থ লিখেছেন। অর্থাৎ ক্ষমতা ও মর্যাগতভাবে সমুন্নত হওয়া। আরেকটি অর্থ হলো, আরশের মাধ্যমে সৃষ্টিকে পরিপূর্ণতায় পৌছানো।
[তা'বীলাতু আহলিস সুন্নাহ, খ.৭ পৃ.২৬৭, তাহকীক, ড.মাজদী বাছলুম।]

# মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
https://archive.org/details/Tafsirmaturidi

৫. আবুল কাসেম আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক আয-ঝুযাযী রহ. [মৃত:৩৪০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবুল কাসেম আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক রহ. বিখ্যাত একজন আরবী ভাষাবিদ ও ব্যাকরণবিদ ছিলেন। ইমাম যাহাবী তার সম্পর্কে বলেন,
“شيخ العربية وتلميذ العلامة أبي إسحاق إبراهيم بن السري الزجاج، وهو منسوب إليه”اهـ
” ইমাম আবুল কাসেম আরবী ভাষার শায়খ ছিলেন এবং তিনি ইমাম ঝুযাযের বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন।” [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১৫, পৃ.৪৭৫।
ইমাম আবুল কাসেম ঝুযাযী রহ. তার “ইশতেকাকু আসমাইল্লাহ”-তে লিখেছেন,
” আল্লাহর দু’টি গুণগত নাম হলো আলী (علي) ও আ’লী (عالي)। এর অর্থ হলো, কোন কিছুর উপর ক্ষমতাধর বা কর্তৃত্ববান। আরবরা বলে থাকে, علا فلان فلانا অর্থাৎ অমুক অন্যের উপর কর্তৃত্ববান বা ক্ষমতাশীল হয়েছে। যেমন কবি বলেছেন,

فلما عَلَونا واستوينا عليهم ** تركناهم صرعى لنسر وكاسرِ
” আমরা যখন তাদের উপর ক্ষমতাশালী হলাম এবং তাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলাম, আমরা তাদের মৃতদেহ গুলোকে শকুন ও বাজপাখীর জন্য রেখে দিলাম”

[ইশতেকাকু আসমাইল্লাহ, আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক ঝুযাজী রহ. , পৃ.১০৯, তাহকীক, আব্দু রব্বিল হুসাইন মোবারক]

# মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
http://www.waqfeya.com/book.php?bid=1862

পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহার ৫ নং আযাতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى
“দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন”।

এই আয়াত ব্যবহার করে বাতিল আকিদার কিছু লোক বলে থাকে, আল্লাহ তায়ালা আরশে বসে আছেন নাউযুবিল্লাহ। এধরনের বাতিল বক্তব্যের সাথে এই আয়াতের কোন দূরতমত সম্পর্ক নেই। যারা এধরনের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করে মানুষের আকিদা নষ্ট করার চেষ্টা করছেে তাদের ব্যপারে সচেতন হওয়া আবশ্যক। আমরা ইস্তেওয়া শব্দের অর্থের উপর সংক্ষিপ্ত কিছু পর্যালোচনা বিগত পর্বে উল্লেখ করেছি। আগ্রহী পাঠকগণ প্রথম পর্ব দেখতে পারেন। আমরা এই ধারাহাবিক আলোচনায় ইনশাআল্লাহ অনেক মুফাসসিরিন গনের বক্তব্য উল্লেখ করবো, যারা প্রত্যেকেই ইস্তেওয়া শব্দের সঠিক অর্থ উল্লেখ করেছেন।

৬. বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ত্ববরানী (মৃত:৩৬০ হি:) তার তাফসীরে কাবীরে বলেন,
والاستواء: الاستيلاء، ولم يـزل الله سبحانه مستوليا على الأشياء كلها، إلا أن تخصيص العرش لتعظيم شأنه
অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ, ইস্তিলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তায়ালা সদা-সর্বদা সমস্ত বস্তুর উপর নিজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। তবে এখানে বিশেষভাবে আরশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আরশের গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রকাশের উদ্দেশ্যে।
[আত-তাফসীরুল কাবীর, ইমাম ত্ববরানী, খ.৩, পৃ.৩৭২]

৭. ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. [মৃত:৩৭০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবু বকর জাসসাস তার বিখ্যাত কিতাব আহকামুল কুরআনে লিখেছেন,
“: قوله تعالى: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه:5] قال الحسن: استوى بلطفه وتدبيره، وقيل: استولى.اه
অর্থাৎ মহান আল্লাহর বাণী: দয়াময় আল্লাহ আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন।(সূরা ত্ব-হা, আয়াত নং৫)। ইমাম হাসান বলেন, তিনি নিজের দয়া, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার পূর্ণতা দান করেছেন। এবং কারও মতে ইস্তেওয়ার অর্থ হলো, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[আহকামুল কুরআন, খ.৩, পৃ.৩২৫]
৮. ইমাম আবুল লায়স সামরকন্দী রহ(মৃত:৩৭৫ হি:) এর তাফসীর:
ইমাম আবুল লায়স বলেন,
ويقال استوى استولى
অর্থাৎ ইস্তেওয়ার আরেকটি অর্থ বলা হয়, ইস্তাওলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[তাফসীরে সমরকন্দী বা বাহরুল উলুম, খ.২, পৃ.৩৭৬]

৯. ইমাম আবু বকর ইবনে ফাউরক [মৃত:৪০৬ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবু বকর ইবনে ফাউরক তার মুশকিলুল হাদীস কিতাবে বলেন,
: لأن استواءه على العرش سبحانه ليس على معنى التمكن والاستقرار، بل هو على معنى العلو بالقهر والتدبير وارتفاع الدرجة بالصفة، على الوجه الذي يقتضي مباينة الخلق. اهـ
অর্থাৎ আরশে র উপর আল্লাহর ইস্তেওয়া দ্বারা কখনও এটি উদ্দেশ্য নয় যে তিনি আরশের উপর অবস্থান করেন বা আরশের উপর স্থির হয়েছেন। বরং কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার দ্বারা সমুন্নত হওয়া এবং গুণগত মর্যাদা উদ্দেশ্য। কেননা আল্লাহ তায়ালা সমস্ত সৃষ্টি থেকে পৃথক ও ভিন্ন।
[মুশকিলুল হাদীস, পৃ.২২৯]

১০ইমাম আবু মনসুর নাইসাপুরী রহ. [মৃত: ৪২১] এর বক্তব্য:
ইমাম আবু মনসুর নাইসাপুরী রহ. বলেন ,
إن كثيرا من متأخري أصحابنا ذهبوا إلى أن الاستواء هو القهر والغلبة
আমাদের পরবর্তী অনেক আলেম এমত গ্রহণ করেছেন যে, ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও প্রতাপ।
[আল-আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ.৩৭২]

১১. ইমাম আবু মুহাম্মাদ জুয়াইনী (মৃত: ৪৩৮ হি:) এর বক্তব্য:
ইমাম জুয়াইনী রহ. বলেন,
“ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ পূর্ণক্ষমতা দ্বারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেষ্টণ করা। এর দ্বারা কখনও আল্লাহর স্থান, দিক, অবস্থানের জায়গা কিংবা সীমা উদ্দশ্যে নয়।”
[ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১১০]

১২.ইমাম আবুল হাসান মাওয়ারদী রহ. [মৃত: ৪৫০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবুল হাসান মাওয়ারদী রহ. বলেন,
: { ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ } [سورة الأعراف: 54]: فيه قولان: …والثاني: استولى على العرش كما قال الشاعر :
قد استوى بِشْرٌ على العِراقِ ** من غير سَيفٍ ودمٍ مُهراقِ”اهــ

অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের বাণী: অত:পর আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। [সূরা আ'রাফ, ৫৪]। ইমাম মাওযারদী বলেন, ইস্তেওয়া শব্দের দু’টি অর্থ রয়েছে। …। দ্বিতীয় অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন কবি বলেছেন,
বিশর ইরাকের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। কোন তরবারী চালনা কিংবা রক্তপাত ব্যতীতই।
[আন-নুকাতু ওয়াল উয়ূন, খ.২, পৃ.২২৯]

১৩. ইমাম আবু বকর বাইহাকী রহ. [মৃত: ৪৫৮ হি:] এর বক্তব্য:
ইমাম বাইহাকী রহ. বলেন
أن الاستواء هو القهر والغلبة، ومعناه أن الرحمن غلب العرش وقهره، وفائدته الإخبار عن قهره مملوكاته، وأنها لم تقهره، وإنما خص العرش بالذكر لأنه أعظم المملوكات، فنبه بالأعلى على الأدنى، قال: والاستواء بمعنى القهر والغلبة شائع في اللغة، كما يقال استوى فلان على الناحية إذا غلب أهلها، وقال الشاعر في بشر بن مروان: قد استوى بشر على العراق * * من غير سيف ودم مهراق. اهـ يريد أنه غلب أهله من غير محاربة

অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, কর্তৃত্ব ও ক্ণমতা বজায় রাখা। এর অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং একে নিজের ক্ণমতার অধীন করেছেন। আয়াতে বিষয়টি উল্লেখের বিশেষ ফায়দা হলো, আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে জানিয়েছেন, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর ক্ণমতার অধীন। এবং তিনি কারও অধীন নন। আর এক্ণেত্রে বিশেষভাবে আরশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এজন্য যে, আরশ আল্লাহর সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। সুতরাং তিনি সবচেয়ে বড় সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, সমস্ত ছোট সৃষ্টিও আল্লাহর ক্ণমতা ও কর্তৃত্বের অধীন। কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অর্থে ইস্তেওয়া শব্দটির ব্যবহার আরবী ভাষায় ব্যাপক পরিচিত। যেমন বলা হয়, , অমুক উক্ত অন্চলের উপর ইস্তেওয়া করেছে বা নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশর ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে কবি বলেন, বিশর ইরাকের উপর নিজের ক্ণমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। কোন রক্তপাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই। এখানে কবি
উদ্দেশ্য নিয়েছেন, কোন যুদ্ধ ছাড়া বিশর ইরাকের মানুষের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
[আল-আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ.৪১২]

১৪. ইমাম আবুল হাসান নাইসাপুরী রহ. [মৃত: ৪৬৮ হি:]এর তাফসীর:

ইমাম আবুল হাসান নাইসাপুরী রহ. তার আল-ওজীয নামক তাফসীরে লিখেছেন,
{ اسْتَوَى } أي استولى.اهـ
ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো ইস্তাউলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

১৫. ইমাম আবু ইসহাক শিরাজী রহ. [মৃত: ৪৭৬ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবু ইসহাক শিরাজী রহ. বলেন,
الاستواء بمعنى الاستيلاء، استوى على العرش أي استولى عليه، يقال استوى فلان على الملك أي استولى عليه

অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইস্তাওয়া আলাল আরশ এর অর্থ হলো, আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরবী ভাষায় বলা হয়, অমুক ব্যক্তি দেশে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
[আল-ওয়াজীয, খ.২, পৃ.১৫]

১৬. ইমাম হুসাইন ইবনে আহমাদ আদ-দামিগানী হানাফী রহ.[মৃত:৪৭৮ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম দামিগানী রহ. তার ইসলাহুল উজুহ কিতাবে লিখেছেন,

الاستواء بمعنى القهر والقدرة، قوله تعالى في سورة طه: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى }، أي قدر وقهر. اهـ
অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও কুদরত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহায় বলেন, "দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। অর্থাৎ এখানে ইস্তেওয়ার অর্থ হলো, ক্ষমতা ও কুদরত প্রকাশ করা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

[ইসলাহুল উজুহ, পৃ.২৫৫]

১৭. ইমাম আবুল মায়ালী জুয়াইনী রহ. [মৃত: ৪৭৮ হি:] এর বক্তব্য:

ইমাম জুয়াইনী রহ. তার আল-ইরশাদ কিতাবে লিখেছেন,
فإن استدلوا بظاهر قوله تعالى: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه:5]، فالوجه معارضتهم بآي يساعدوننا على تأويلها، منها قوله تعالى: {وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ} [سورة الحديد: 4] وقوله تعالى: {
أَفَمَنْ هُوَ قَآئِمٌ عَلَى كُلِّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ} [سورة الرعد: 33] فنسائلهم عن معنى ذلك، فإن حملوه على كونه معنا بالإحاطة والعلم، لم يمتنع منا حمل الاستواء على القهر والغلبة، وذلك شائع في اللغة، إذ العرب تقول استوى فلان على الممالك إذا احتوى على مقاليد الملك واستعلى على الرقاب. وفائدة تخصيص العرش بالذكر أنه اعظم المخلوقات في ظن البرية، فنص عليه تنبيها بذكره على ما دونه. ... ثم الاستواء بمعنى الاستقرار بالذات ينبئ عن اضطراب واعوجاج سابق، والتزام ذلك كفر."اهــ

অর্থ: যদি মুজাসসিমারা সূরা ত্বহার ৫ নং আয়াতের বাহ্যিক অর্থ দ্বারা প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের বিপরীতে সেসব আয়াত উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলো এই আয়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং তারা এগুলোর ব্যাখ্যা করতে বাধ্য। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যেখানেই থাকো আল্লাহ তোমাদের সাথে রয়েছেন। [সূরা হাদীদ, আযাত নং ৪]। আল্লাহ তায়ালা সূরা রাযাদ এর ৩৩ নং আয়াতে বলেন, তাদের কর্মসমূহ পর্যবেক্ষণের জন্য আল্লাহ তায়ালা কি প্রত্যেক নফস বা আত্মার উপর দন্ডায়মান নন? আমরা তাদেরকে এসব আয়াতের অর্থ জিজ্ঞাসা করবো। তারা যদি এসব আয়াত দ্বারা রুপক অর্থ নেয় যে, আল্লাহ তায়ালা ইলম ও পরিবেষ্টন দ্বারা আমাদের সাথে রয়েছেন, তাহলে আমরাও বলবো, ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, ক্ষমতা প্রয়োগ করা বা অধীন করা। আরবী ভাষায় এর ব্যবহার রয়েছে। কেননা আরবরা বলে থাকে, استوى فلان على الممالك অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি দেশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জনগণকে নিজের অধীন করেছে।

আল্লাহ তায়ালা আরশের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এজন্য যে, সৃষ্টির মধ্যে আরশ সবচেযে বড়। এটি উল্লেখ করে তিনি বুঝিয়েছেন, অন্যান্য ছোট সৃষ্টিও তার ক্ষমতার অধীন। ..... ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ যদি করা হয়, আল্লাহর সত্ত্বা স্থির হয়েছেন বা স্থান গ্রহণ করেছেন, তাহলে এটি নির্দেশ করে যে, আল্লাহ তায়ালা পূর্বে অস্থির বা গতিশীল ছিলেন। আর এধরনের অর্থ সুস্পষ্ট কুফুরী।

১৮. বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ আবুল হাসান আলী ইবনে ফাজ্জাল আল-মুজাশায়ী [মৃত: ৪৭৯ হি:] তার আন-নুকাতু ফিল কুরআনিল কারীমে ইস্তেওয়ার অর্থ করেছেন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[আন-নুকাতু ফিল কুরআনিল কারীম, পৃ.১৭৪-১৭৫]

১৯. জগৎ বিখ্যাত আরবী ভাষাবিদ ইমাম রাগেব ইসপাহানী [মৃত: ৫০২ হি:] তার " আল-মুফরাদাত" নামক কিতাবে লিখেছেন,
"ومتى عدّي- أي الاستواء – بـ "على" اقتضى معنى الاستيلاء كقوله: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه]"اهــ

অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দটি যখন 'আলা' অব্যয় সহ ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ হয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, " দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। [সূরা ত্ব-হা, আয়াত নং-৫] [আল-মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, পৃ.২৫১]

২০. ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ আল-মুতাওয়াল্লী [মৃত: ৪৭৮ হি:] তার আল-গুনইয়া নামক কিতাবে ইস্তেওয়ার অর্থ করেছেন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[আল-গুনিয়া ফি উসুলিদ্দীন, পৃ.৭৮]

২১. ইমাম গাজালী রহ. [মৃত: ৫০৫ হি:] তার বিখ্যাত কিতাব ইহইয়াউ উলুমিদ্দীনে লিখেছেন,
"وليس ذلك إلا بطريق القهر والاستيلاء" اه
"পবিত্র কুরআনের ইস্তেওয়া মূলত: ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অর্থেই গৃহীত হবে"
[ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ইয়াহইয়াউ উলুমিদ্দীন, খ.১পৃ.১৮৬]

২২. ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী হানাফী রহ. [মৃত: ৫০৮ হি:] তার বিখ্যাত কিতাব " তাবসিরাতুল আদিল্যা"-তে লিখেছেন,

"فعلى هذا يحتمل أن يكون المراد منه: استولى على العرش الذي هو أعظم المخلوقات وتخصيصه بالذكر كان تشريفا له"، ثم قال: وتزييف (بعض) الأشعرية هذا التأويل لمكان أن الاستيلاء يكون بعد الضعف. وهذا لا يتصور في الله تعالى، ونسبتهم هذا التأويل إلى المعتزلة ليس بشىء، لأن أصحابنا أولوا هذا التأويل ولم تختص به المعتزلة. وكون الاستيلاء إن كان في الشاهد عقيب الضعف ولكن لم يكن هذا عبارة عن استيلاء عن ضعف في اللغة، بل ذلك يثبت على وفاق العادة كما يقال علم فلان، وكان ذلك في المخلوقين بعد الجهل، ويقال قدر، وكان ذلك بعد العجز، وهذا الاطلاق جائز في الله تعالى على إرادة تحقق العلم والقدرة بدون سابقة الجهل والعجز، فكذا هذا. "اهــ.

" ইস্তেওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ারা আরশের উপর নিজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরশ আল্লাহর সবচেয়ে বড় মাখলুক। আরশকে বিশেষভাবে উল্লেখের ফায়দা হলো, আরশের বড়ত্ব প্রকাশ করা। কিছু কিছু আশআরী ইস্তেওয়ার এই ব্যাখ্যাকে এভাবে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করেছে যে, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা দ্বারা তো বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা পূর্বে দুর্বল বা কর্তৃত্বহীন ছিলেন। অথচ আল্লাহর ক্ষেত্রে এটি কল্পনাও করা যায় না। কেউ কেউ এ ব্যাখ্যাকে মু'তাজিলাদের দিকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে। কেননা বহু আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরাম এই ব্যাখ্যা করেছেন। এটি শুধু মু'তাজিলাদের ব্যাখ্যা নয়। বাহ্যদৃষ্টিতে আমরা কর্তৃত্বহীন ব্যক্তিকে কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে দেখি। কিন্তু আরবী ভাষা কখনও এটি বোঝায় না। বরং এটি সৃষ্টির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী ঘটে থাকে। যেমন বলা হয়, অমুক জ্ঞানী হয়েছে। মাখলুকের ক্ষেত্রে পূর্বে মূর্খ থাকলেই কেবল বলা হয় সে জ্ঞান অর্জন করেছে। আমরা বলে থাকি, সে শক্তিশালী হয়েছে। মাখলুক ক্ষমতাহীন অবস্থা থেকে ক্ষমতা অর্জন করলেই কেবল এটা বলা হয়। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে ইলম ও কুদরত শব্দ এই শর্তে ব্যবহার করা জায়ে যে, আল্লাহর ক্ষেত্রে পূর্বে অক্ষমতা বা মূর্খতার কল্পনাও করা যাবে ন। একইভাবে ইস্তেওয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। "
[তাবসিরাতুল আদিল্লাহ, খ.১, পৃ.২৪২]

আল্লাহ সম্পর্কিত দেহবাদী আকিদার স্বরুপ উন্মোচন
____________________
আল্লাহ সম্পর্কিত দেহবাদী আকিদার স্বরুপ উন্মোচনঃ 

স্রষ্টাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে বাতিল ফেরকাসমূহ আসমানী ধর্মসমূহের মধ্যে স্রষ্টাকে সৃষ্টির স্তরে নামিয়েছে ইহুদীরা। খ্রিষ্টানরা স্বয়ং সৃষ্টিকে স্রষ্টা বানিয়েছে। এভাবে মূল তাউহীদের আক্বিদায় মারাত্মকভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে কুফুর-শিরকে নিপতিত হয়েছে। পরবর্তীতে মুসলমানদের অনেক বাতিল ফেরকা ইহুদী-খ্রিষ্টানদের এসব কুফুরী-শিরকী আক্বিদা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কুফুরী আক্বিদাগুলো মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। ইহুদী বর্ণনার দ্বারা প্রভাবিত মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম শিয়ারা এসব কুফুরী আক্বিদা প্রচার করে। এদের পাশাপাশি একদল অজ্ঞ মুহাদ্দিস কুরআন-সুন্নাহের বাহ্যিক শব্দ অনুসরণের নামে ইহুদীদের এসব কুফুরী আক্বিদা প্রচার করতে থাকে।

এবাবে সাধারণ মুসলমানদের মাঝে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কুফুরী আক্বিদাগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানদেও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এবং কুরআন সুন্নাহের অনুসরণের ধুয়ো তুলে তারা অনেক সাধারণ মানুষকেও এসব কুফুরী আক্বিদার দিকে পরিচালিত করে। আল্লাহ তায়ালার নাম ও গুণাবলী বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে এসব বাতিল ফেরকাসমূহের পরিচিতি স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক।

শিয়াদের মুজাসসিমাঃ

যারা আল্লাহর শরীর, দেহ ও অঙ্গ-প্রতঙ্গ সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুজাসসিমা বলে।

মুশাববিহা ফেরকাঃ

যারা আল্লাহর জন্য সৃষ্টির গুণাবলী সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুশাববিহা বলে।

ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কুফুরী আক্বিদা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক শিয়া-রাফেযী আল্লাহ তায়ালার জন্য সৃষ্টির গুণাবলী সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির স্তরে নামিয়েছে। মানুষের মতো রক্ত-মাংসের প্রভূ হিেেসব গ্রহণ করেছে। বাস্তবে এরা মুসলমান দাবী করলেও এরা হিন্দুদেরই সমগোত্রীয়।

এদের নিজেদের মধ্যে অনেক দল রয়েছে। প্রত্যেক দলের এক একজন নেতা রয়েছে। এদের মতাদর্শের মধ্যে সামান্য কিছু বাহ্যিক পার্থক্য দেখা গেলেও আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দেয়ার ক্ষেত্রে সব মতবাদই অভিন্ন। শিয়াদের মধ্যে প্রসিদ্ধ মুজাসসিমাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। 

হিশামিয়া: বাতিল ফেরকা বিষয়ে অভিজ্ঞ ইমাম ও ঐতিহাসিকগণ হিশামিয়া দ্বারা দু’টি বাতিল ফেরকা উদ্দেশ্য নেন। একটি ফেরকার জনক হলো, হিশাম ইবনে হাকাম (মৃত: ১৯০ হি.)। অপর ফেরকার জনক হলো, হিশাম ইবনে সালিম আল-জুয়ালিকি।
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.৪৭।]

ইমাম বাগদাদী (رحمة الله) এর মতে ফেরকাটি শিয়াদের ইমামের ধ্যান-ধারণা, আল্লাহর শরীর সাব্যস্তরণের ভ্রষ্টতা এবং আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানের ক্ষেত্রে অভিন্ন। ইমাম ইসফারাইনী (رحمة الله) বলেন,وهم الأصل في التشبيهঅর্থ: আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে এই দলটি হলো মূল। [আত-তাবসীর ফিদ দিন, পৃ.২৫।]

ইমাম শাহরাস্তানীর মতে হিশামিয়া মূলত: একটি ফেরকা, দুই ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। এদের মতাদর্শও এক। এরা মূলত: একজন আরেকজনের অনুগামী ছিলো। তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে অগ্রগামী ছিলো হিশাব ইবনে হাকাম। হিশাব ইবনে সালেম আল-জুয়ালিকি ছিলো তার অনুগামী এবং তারা উভয়ে একই পথে হেঁটেছিলো।[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৪]

হিশাম ইবনে হাকাম এর উপনাম ছিলো আবু মুহাম্মাদ। সে বনী শাইবান এর আযাদকৃত গোলাম ছিলো। বাগদাদ থেকে কুফায় স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানেই বসবাস করে। সে শিয়াদের অন্যতম একজন বক্তা ছিলো। খলিফা মা’মুনের সময় সে ইন্তেকাল করে।
[আল-ফিহরিস্ত, ইবনে নাদীম, খ.১, পৃ.১৪১। সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৪, পৃ.৫৪৪।]

ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) হিশাম ইবনে হাকাম ও তাঁর অনুসারীদের আক্বিদা বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন,

الهشامية أصحاب هشام بن الحكم الرافضي، يزعمون أن معبودهم جسم له نهاية وحد طويل عريض طوله مثل عرضه، وعرضه مثل عمقه لا يوفي بعضه على بعضه. ولم يعينوا له طولاً غير الطويل. وإنما قالوا: طوله مثل عرضه على المجاز دون التحقيق، وزعموا أنه نور ساطع، له قدر من الأقدار. في مكان دون مكان. كالسبيكة الصافية كاللؤلؤة المستديرة من جميع جوانبها.ذو لون وطعم ورائحة. لونه هو طعمه، هو رائحته، ورائحته هي محسته. وهو نفسه لونه. ولم يعينوا لوناً ولا طمعاً هو غيره. وزعموا أنه هو اللون وهو الطعم، وأنه قد كان لا في مكان، ثم حدث المكان بأن تحرك الباري فحدث المكان بحركته فكان فيه. وزعم أن المكان هو العرش.وذكر أبو الهذيل في بعض كتبه أن هشام بن الحكم قال إن ربه جسم ذاهب جاء، فيتحرك تارة ويسكن أخرى، ويعقد مرة ويقوم أخرى، وإنه طويل عريض عميق، لأن ما لم يكن كذلك دخل في حد التلاشي. قال: فقلت له: فأيهما أعظم إلهك أو هذا الجبل وأومأت إلى جبل أبي قبيس قال: فقال هذا الجبل يوفي عليه، أي هو أعظم منه. وذكر ابن الراوندي أن هشام بن الحكم كان يقول: إن بين إلهه وبين الأجسام المشاهدة تشابهاً من جهة من الجهات، لولا ذلك ما دلت عليه.وحكي عنه خلاف هذا وأنه كان يقول إنه جسم ذو أبعاض لا يشبهها ولا تشبهه، وحكى عنه الجاحظ أنه قال في ربه في عام واحد خمسة أقاويل، مرة رغم أنه كالبلورة وزعم مرة أنه كالسبيكة. وزعم مرة أنه غير ذي صورة، وزعم مرة أنه بشبر نفسه سبعة أشبار، ثم رجع عن ذلك وقال هو جسم لا كالأجسام.وزعم الوراق أن بعض أصحاب هشام أجابه مرة إلى أن الله عز وجل على العرش مماس له وأنه لا يفضل عن العرش ولا يفضل العرش عنه

অর্থ: হিশাম ইবনে হাকাম শিয়ার অনুসারীদেরকে হিশামিয়া বলা হয়। তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালার শরীর রয়েছে। শরীরের সমাপ্তি ও সীমা-পরিসীমা রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ রয়েছে। আল্লাহর শরীরের দৈর্ঘ্য প্রস্থের সমান। শরীরের প্রস্থ এর গভীরতার সমান। আল্লাহর শরীরের কোন অংশ একে-অপরের পরিপূরক নয়। তারা আল্লাহর জন্য দৈর্ঘ্য সাব্যস্ত করেছে কিন্তু এই দৈর্ঘ্যরে সুনিদিষ্ট কোন পরিমাণ উল্লেখ করেনি। আল্লাহর দৈর্ঘ্য তার প্রস্থের সমান এজাতীয় কথা তারা অনেক সময় রূপক অর্থে ব্যবহার করে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা হলেন, একটি উজ্জ্বল আলো। এই উজ্জ্বল আলোর সুনির্দিষ্ট একটা পরিমাপ রয়েছে। এটি কোন স্থানে রয়েছে, তবে তা সুনির্দিষ্ট নয়। তিনি উজ্জ্বল ধাতু-মিশ্রণের মতো। চতুর্দিক থেকে গোলাকার মণি-মুক্তার উজ্জ্বল।আল্লাহর রঙ, স্বাদ ও ঘ্রাণ রয়েছে। আল্লাহর রঙ তার স্বাদের অনুরূপ। আল্লাহর রঙ তার ঘ্রাণেরও অনুরূপ। আল্লাহর ঘ্রাণ তার স্পর্শ অনুভূতির প্রকাশ। সেটিই আবার তার রঙ। তারা আল্লাহর সত্তার অতিরিক্ত কোন রঙ বা ঘ্রাণ সাব্যস্ত করেনি। বরং তাদের নিকট স্বয়ং এই রঙ ও ঘ্রাণই আল্লাহ। তাদের বিশ্বাস হলো, আদিতে আল্লাহ তায়ালা কোন স্থানে ছিলেন না। অত:পর আল্লাহ তায়ালা নড়া-চড়া করেন, ফলে স্থান সৃষ্টি হয়। তিনি নতুন সৃষ্ট এই স্থানে থাকেন। তাদের বিশ্বাস হলো, নতুন সৃষ্ট এই স্থান হলো আরশ।আবুল হুজাইল তার একটি কিতাবে লিখেছে, হিশাম ইবনে হাকামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই পাহাড় বড় না তোমার প্রভূ বড়। সে বলল, প্রভূ বড়। আমি তাকে আবু কুবাইস পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ইবনে রাওয়ান্দী বলেন, হিশাম ইবনে হাকাম বলত, বাহ্যিক শরীর ও তার প্রভূর মাঝে একটি বিশেষ দিক থেকে সাদৃশ্য রয়েছে। যদি এটি না থাকত, তাহলে আল্লাহর প্রমাণ পাওয়া যেত না।কেউ তার এই বক্তব্যের বিপরীত বক্তব্য তার থেকে বর্ণনা করেছে। সে বলত, আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিশিষ্ট সত্তা। তবে তার সঙ্গে তুলনীয় কিছু নেই এবং তিনিও কারও সাদৃশ্য রাখেন না। ইমাম জাহেয তার থেকে বর্ণনা করেন, সে একই বছরে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে পাঁচ ধরনের মতবাদ তৈরি করতো। কখনও সে বলত, আল্লাহ তায়ালা উজ্জ্বল মণি-মুক্তার মতো। কখনও ধারণা করতো আল্লাহ তায়ালা মিশ্রধাতুর মতো। কখনও বিশ্বাস করতো আল্লাহ তায়ালা আকার-আকৃতি বিশিষ্ট নন। কখনও বলত, আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতের পরিমাপ হিসেবে সাত বিঘাত। অত:পর, এসব থেকে ফিরে এসে নতুন মতবাদ চালু করলো যে, আল্লাহ তায়ালার দেহ রয়েছে, তবে অন্যান্য দেহ এর মতো নয়।ওয়াররাক বলেন, হিশামের কিছু অনুসারী তাকে উত্তর দিয়েছিলো, আল্লাহ তায়লা আরশের উপর আরশ স্পর্শ করে আছেন। তিনি আরশ থেকে বড় নন এবং আরশও তার থেকে বড় নয়। 
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.৩১-৩৪। তাদের মতবাদ সম্পর্কে অবগত হতে আরও দেখুন, আত-ম্বীহ ওয়ার রাদ, পৃ.২৪। আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০, ৪৭। আল-বুদউ ওয়াত তা’রীখ, খ.৫, পৃ.১৩২। আত-তাবসীর ফিদ দীন, পৃ.২৪, ৭০। আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৪। সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১০, পৃ.৫৪৪।]

ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله) হিশাম ইবনে হাকামের আক্বিদা সম্পর্কে বলেন,
وكان يزعم أن الله تعالى جسم. وغيَّر مذهبه في سنة واحدة عدة تغيرات. فزعم تارة أن الله تعالى كالسبيكة الصافية، وزعم مرة أخرى أنه كالشمع الذي من أي جانب نظرت إليه كان ذلك الجانب وجهه. واستقر رأيه عاقبة الأمر على أنه سبعة أشبار، لأن هذا المقدار أقرب إلى الاعتدال ليس بجسم، لكن صورته صورة الآدمي، وهو مركب من اليد والرجل والعين لأن أعضاءه ليست من لحم ولا دم

অর্থ: “সে বিশ্বাস করতো আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। একই বছরে সে তার মতাদর্শ কয়েকবার পরিবর্তন করতো। কখনও ধারণা করতো আল্লাহ তায়ালা উজ্জ্বল মিশ্র ধাতুর মতো। কখনও বিশ্বাস করতো আল্লাহ তায়ালা মোমবাতির আলোর মতো; যেদিক থেকে দেখা হয় সেদিকেই এর মুখ থাকে। সর্বশেষ সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, আল্লাহ তায়ালা সাত বিঘাত বিশিষ্ট। কেননা এই পরিমাপ ভারসাম্যের অধিক নিকটবর্তী। সর্বশেষ সে বলতো, আল্লাহ তায়ালা দেহ বিশিষ্ট নন। তবে তিনি মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। তিনি হাত, পা, চোখ ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। তবে তার অঙ্গ-প্রতঙ্গ রক্ত-মাংশের নয়।”[ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.৩৪ ও ২০৯।]

হিশাম ইবনে সালেম আল-জুয়ালেকী:ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) হিশাম ইবনে সালিম আল-জুয়ালেকী এর আক্বিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন,

الهشامية أصحاب هشام بن سالم الجواليقي يزعمون أن ربهم على صورة الإنسان، وينكرون أن يكون لحماً ودماً، ويقولون: هو نور ساطع يتلألأ بياضاً وأنه ذو حواس خمس بحواس الإنسان، له يد ورجل وأنف وأذن وعين وفم، وأنه يسمع بغير ما يبصر به، وكذلك سائر حواسه عندهم متغايرة

অর্থ: হিশাম ইবনে সালেম আল-জুয়ালেকীর অনুসারীদেরকেও হিশামিয়া বলা হয়। তাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। তবে তারা আল্লাহর জন্য মানুষের মতো রক্ত-মাংশ সাব্যস্ত করে না। তারা বলে, আল্লাহ তায়ালা হলেন উজ্জ্বল আলো। যেটি উজ্জ্বল সাদা আলোয় জ্বল জ্বল করে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের মতো পঞ্চ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট। আল্লাহ তায়ালার হাত, পা, নাক, কান, চোখ ও মুখ রয়েছে। তিনি যা দিয়ে শ্রবণ করেন সেটি তার দর্শনের অঙ্গ থেকে ভিন্ন। এভাবে আল্লাহ তায়ালার সকল ইন্দ্রিয় ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।”
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.৩৪ ও ২০৯।]

ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) বলেন,وحكى أبو عيسى الوراق أن هشام بن سالم كان يزعم أن لربه وفرة سوداء وأن ذلك نور أسودআবু ইসা আল-ওররাক বলেন, হিশাম ইবনে সালেম বিশ্বাস করতো যে, আল্লাহ তায়ালার কালো গোফ রয়েছে। আর এই কালো গোফ কালো আলো বিশিষ্ট।
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ. ২০৯]

ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) বলেন,قال إنه تعالى على صورة إنسان أعلاه مجوف وأسفله مصمت.. ليس بجسم لكن صورته صورة الآدمي وهو مركب من اليد والرجل والعين، لأن أعضاءه ليست من لحم ولا دم
অর্থ: হিশাম ইবনে সালেম এর আক্বিদা-বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। আল্লাহর শরীরের উপরের অংশ ফাঁকা গহ্বর বিশিষ্ট এবং নিচের অংশ নিঃছিদ্র। আল্লাহ তায়ালা দেহ বিশিষ্ট নয়। তবে আল্লাহর আকৃতি মানুষের আকৃতির মতো। তিনি হাত, পা, চোখ ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। আল্লাহর অঙ্গ-প্রতঙ্গ রক্ত-মাংসের নয়।”
[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.২১০]

মুগিরিয়া ফেরকা:

মুগিরা ইবনে সাইদ আল-ইজলি (মৃত:১১৯ হি:) ও তার অনুসারীদেরকে মুগিরিয়া বলা হয়। ইমাম যাহাবী মুগিরা ইবনে সাইদ সম্পর্কে বলেন,
وكان هذا الرجل ساحراً فاجراً شيعياً خبيثاًঅর্থ: সে যাদুকর, পাপী, শিয়া ও নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোক ছিলো।

মুগিরিয়া ফেরকার আক্বিদা সম্পর্কে ইমাম আব্দুল কাহের বাগদাদী (رحمة الله) বলেন,
ومنها إفراطه في التشبيه، وذلك أنه زعم أن معبوده رجل من نور على رأسه تاج من نور، وله أعضاء على صور حروف الهجاء، وأن الألف منها مثال قدميه والعين على صورة عينيه، …ومنها أنه تكلم في بدء الخلق فزعم أن الله تعالى لما أراد أن يخلق العالم تكلم باسمه الأعظم فطار ذلك الاسم ووقع تاجاً على رأسه. وتأول على ذلك قوله تعالى: (سبح اسم ربك الأعلى) وزعم أن الاسم الأعلى إنما هو ذلك التاج. ثم إنه بعد وقوع التاج على رأسه كتب بإصبعه على كفه أعمال عباده. ثم نظر فيها فغضب من معاصيهم فعرق، فاجتمع من عرقه بحران أحدهما مالح والآخر عذب. ثم اطلع في البحر فأبصر ظله فذهب ليأخذه فطار فانتزع عيني ظله فخلق منها الشمس والقمر، وأفنى باقي ظله وقال: لا ينبغي أن يكون معي ثم خلق الخلق من البحرين فخلق الشيعة من البحر العذب النير فهم المؤمنون وخلق الكفرة وهم أعداء الشيعة من البحر المظلم المالح

অর্থ: তার ভ্রান্ত বিষয়গুলোর একটি হলো সে আল্লাহ তায়ালাকে নিকৃষ্টভাবে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করতো। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা আলোকময় এক ব্যক্তি, যার মাথায় নূরের মুকুট রয়েছে। আরবী বর্ণমালার আকৃতি অনুযায়ী আল্লাহর আকৃতি রয়েছে। আরবী বর্ণমালার আলিফ আল্লাহর পায়ের উদাহরণ। আরবী আইন অক্ষরটি আল্লাহর চোখের অনুরূপ। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির শুরুতে কথা বলেন। সে ধারণা করতো আল্লাহ তায়ালা যখন মহাবিশ্ব সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তিনি তার ইসমে আ’জম উচ্চারণ করেন। এই ইসমে আজম উড়ে গিয়ে তার মাথায় বসে এবং এটি তার মুকুট হয়। সে তার বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে পবিত্র কুরআনের আয়াত উপস্থাপন করে এর বিকৃত ব্যাখ্যা করে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আপনি আপনার প্রভূর নামের পবিত্রতা বর্ণনা করুন, যিনি মহান। সে এই আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা করে বলেছে, এখানে সম্মানিত নাম দ্বারা আল্লাহর মুকুট উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালার মাথায় এই মুকুট আসার পর তিনি তার দুই আঙ্গুল দ্বারা হাতের তালুর উপরে বান্দার আমল লিপিবদ্ধ করেছেন। অত:পর তিনি এই আমলগুলোর দিকে দৃষ্টি বুলান। বান্দার গোনাহ দেখে তিনি রাগান্বিত হয়ে যান। এই রাগের কারণে তিনি ঘর্মাক্ত হয়ে যান। তার ঘাম থেকে দু’টি সমুদ্র প্রবাহিত হয়। একটি লবণাক্ত, অপরটি সুমিষ্ট। এরপর তিনি সমুদ্রের দিকে উঁকি দেন। সেখানে তিনি নিজের ছায়া দেখতে পান। তিনি সেটা ধরতে যান। কিন্তু ছায়া উড়ে যায়। এরপর তিনি তার নিজ ছায়া থেকে চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেন। অবশিষ্ট ছায়াকে তিনি নি:শেষ করে দেন। অত:পর তিনি বললেন, এগুলো আমার সাথে থাকা উচিৎ নয়। দুই সমুদ্র থেকে তিনি মাখলুককে সৃষ্টি করলেন। সুমিষ্ট পানির সমুদ্র থেকে শিয়াদেরকে সৃষ্টি করেন এবং লবণাক্ত ও অন্ধকার সমুদ্র থেকে শিয়াদের শত্রুদেরকে সৃষ্টি করেন।”
(আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, ২৩১-২৩৩। আরও দেখুন, আল-ফিসাল, ইবনে হাজাম, খ.৪, পৃ.১৪১। আত-তাবসীর, পৃ.৭০, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, শাহরাস্তানী, পৃ.১৭৬, আল-কামেল, ইবনুল আসীর, খ.৪, পৃ.৪২৯।)

বয়ানিয়া ফেরকা:

বয়ান ইবনে সাময়ান (মৃত:১১৯) ও তার অনুসারীদেরকে বয়ানিয়া ফেরকা বলা হয়। সে কুফার অধিবাসী ছিলো। বয়ান ইবনে সাময়ানের আক্বিদা-বিশ্বাস ছিলো,

وكان يزعم أنه يعرف الاسم الأعظم، وأنه يهزم به العساكر ৃثم أنه زعم أن الإله الأزلي رجل من نور، وأنه يفنى كله غير وجهه. وتأول على ذلك قوله: (كل شيء هالك إلا وجهه) وقوله: (كل من عليها فان) وقوله (ويبقى وجه ربك) ورفِع خبر بيان هذا إلى خالد بن عبد الله القسري في زمان ولايته في العراق فاحتال عليه حتى ظفر به

অর্থ: সে বিশ্বাস করতো যে সে ইসমে আ’জম জানে। এর মাধ্যমে সে সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে বলে প্রচার করতো। তার আক্বিদা ছিলো, আল্লাহ তায়ালা নূরের তৈরি একজন লোক। আল্লাহর চেহারা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। তার এই মতের স্বপক্ষে সূরা কাসাস এর ৮৮ নং আয়াত, সূরা আর-রহমানের ২৬ ও ২৭ নং আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করতো। সূরা কাসাস এর ৮৮ নং আয়াতের অর্থ: আল্লাহর চেহারা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। সূরা আর-রহমানের ২৬ ও ২৭ নং আয়াতের অর্থ: ভূ-পৃষ্ঠের উপর যা কিছু রয়েছে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। কেবল আপনার প্রভূর চেহারা অবশিষ্ট থাকবে।বয়ান ইবনে সাময়ানের এসব ভ্রান্ত আক্বিদা সম্পর্কে ইরাকের গভর্ণর খালেদ ইবনে আব্দুল্লাহ কাসারী অবগত হন। তিনি তাকে গ্রেপ্তার করে শূলিতে চড়ান। 
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২২৭-২২৮। বিস্তারিত জানতে দেখুন, আল-ফিসাল, খ.৪, পৃ.১৪১। আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, পৃ.১৫৩।]

ইউনুসিয়া ফেরকা:

বিখ্যাত শিয়া ইউনুস ইবনে আব্দুর রহমান ও তার অনুসারীরা বয়ানিকা ফেরকা নামে পরিচিত। তার আক্বিদা ছিলো, ফেরেশতারা আল্লাহ তায়ালাকে বহন করে। ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) বলেন,زعم أن الملائكة تحمل العرش والعرش يحمل الرب تعالىঅর্থ: সে বিশ্বাস করতো যে ফেরেশতাগণ আরশ বহন করছে এবং আরশ আল্লাহ তায়ালাকে বহন করছে।
[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৮।]

জাওয়ারিবি ফেরকা:

দাউদ জাওয়ারিবি ও তার অনুসারীরা জাওয়ারিবি ফেরকা নামে পরিচিত। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন,

رأس في الرافضة والتجسيم من مرامي جهنم

অর্থ: মুজাসসিমা ও শিয়াদের গুরু এক জাহান্নামী।
[লিসানুল মিজান, খ.২, পৃ.৪২৭।]

ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) তার আক্বিদা সম্পর্কে বলেন,
يحكى عن داود أنه قال: أعفوني عن الفرج واللحية، واسألوني عما وراء ذلك فإن في الأخبار ما يثبت ذلك. وقال: إن معبوده جسم ولحم ودم ومع ذلك جسم لا كالأجسام، ولحم كاللحوم ودم لا كالدماء، وكذلك سائر الصفات، وحكي أنه قال هو أجوف من أعلاه إلى صدره مصمت ما سوى ذلك وأن له وفرةً سوداء وله شعر قطط

অর্থ: দাউদ জাওয়ারিবি থেকে বর্ণিত, সে বলতো, আমাকে আল্লাহর গুপ্তাঙ্গ ও দাঁড়ি ছাড়া আর সব কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো। কেননা, হাদীসে এই দু’টো ছাড়া সব কিছু আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা শরীর, রক্ত, গোশত বিশিষ্ট। এগুলো থাকা সত্ত্বেও তার শরীর অন্য কোন শরীরের মতো নয। আল্লাহর গোশত অন্য কারও গোশতের মতো নয় এবং তার রক্ত অন্য কারও রক্তের মতো নয়। আল্লাহর অন্য সব গুণ সম্পর্কে একই কথা। তার থেকে বর্ণিত আছে, সে বলতো, আল্লাহ তায়ালা উপরের অংশ থেকে বুক পর্যন্ত ফাঁপা গহ্বর বিশিষ্ট এবং পরবর্তী অংশ ফাঁপা নয়। আল্লাহর কালো গোফ রয়েছে এবং কোকড়ানো চুল রয়েছে।
[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৫। আল-ফিসাল, খ.৪, পৃ.১৩৯।]

শয়তানিয়া ফেরকা:

শয়তান আত-তাক ও তার অনুসারীদেরকে শয়তানিয়া ফেরকা বলা হয়। শয়তান আত-তাক এর প্রকৃত নাম হলো, মুহাম্মাদ বিন আলী আল-কুফী। সে শিয়াদের বড় একজন ইমাম ছিলো। মুশাববিহা ও মুজাসসিমাদের আক্বিদা প্রচার করতো। সে হিশাম আল-জুয়ালেকীর অনেক মতাদর্শ গ্রহণ করেছিলো।
[আল-বুদউ ওয়াত তারিখ, খ.৫, পৃ.১৩২।]

তার আক্বিদা সম্পর্কে ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) বলেন,

وقال إن الله تعالى على صورة إنسان ربانيসে বলতো, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতির অনুরূপ আকৃতি বিশিষ্ট।
[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৭।]

ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله) শয়তান তাকের আক্বিদা সম্পর্কে বলেন,
الشيطانية أتباع شيطان الطاق وهم يزعمون أن الباري تعالى مستقر على العرش والملائكة يحملون العرش. وهم وإن كانوا ضعفاء بالنسبة إلى الله تعالى. لكن الضعيف قد يحمل القوي كرجل الديك التي تحمل مع دقتها جثة الديك

অর্থ: শয়তান তাকের অনুসারীদেরকে শয়তানিয়া বলা হয়। তাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশে অবস্থান করেন এবং ফেরেশতাগণ আরশ বহন করে। ফেরেশতারা যদিও আল্লাহর তুলনায় দুর্বল কিন্তু কখনও দুর্বল সবলকে বহন করতে পারে। যেমন, মোরগের পা দু’টি চিকন হওয়া সত্ত্বেও মোরগের শরীর বহন করে।
[ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.৬৩।]

আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে রাফেযী শিয়াদের কুফুরী আক্বিদা ও তাদের বিভিন্ন ফেরকা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো। এই আলোচনার মৌলিক একটি উদ্দেশ্য হলো, বর্তমানেও বিভিন্ন নামে এসব আক্বিদা আমাদের সমাজে প্রচার করা হচ্ছে সে বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেয়া। ইসলামের তেরশ’ বছর আগে এসব কুফুরী আক্বিদার সূচনা হলেও এগুলো নি:শেষ হয়ে যায়নি। বরং বর্তমানে নতুনরূপ দিয়ে নতুন আঙ্গিকে মানুষকে এসব কুফুরীর দিকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ পাক মুসলিম উম্মাহকে এধরণের ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন।

মুকাতেলিয়া ফেরকা:

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান আল-বালখী (মৃত:১৫০ হি:) ও তার অনুসারীদেরকে মুকাতিলিয়া ফেরকা বলা হয়। মুকাতিল ইবনে সুলাইমান তাফসীর শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলো, কিন্তু আক্বিদার ক্ষেত্রে সে ছিলো মুশাববিহা ও মুজাসসিমা। হাদীস শাস্ত্রে মুহাদ্দিসদের ঐকমত্য অনুসারে সে পরিত্যক্ত।

ইমাম যাহাবী (رحمة الله) সিয়ারু আ’লামিন নুবালাতে লিখেছেন,
أجمعوا على تركه
অর্থ: হাদীস শাস্ত্রে সে পরিত্যাক্ত হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের ইজমা হয়েছে।
(সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৭, পৃ.২০২। বিস্তারিত জানতে দেখুন, আত-তারীখুল কাবীর, খ.৮, পৃ.১৪। আল-জারহু ওয়াত তা’দীল, খ.৭, পৃ.৩৪৫, মিজানুল ই’তেদাল, খ.৪, পৃ.১৭২।)

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান মুজাসসিমা হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তার আক্বিদা বিশ্বাস বাতিল হওয়ার ব্যাপারেও কারও দ্বিমত নেই।
ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) তার সম্পর্কে বলেন,

حكي عن أصحاب مقاتل أن الله جسم وأن له جثةً وأنه على صورة الإنسان لحم ودم وشعر وعظم وجوارح وأعضاء من يد ورجل ورأس وعينين مصمت وهو مع ذلك لا يشبه غيره ولا يشبهه غيره

অর্থ: মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের অনুসারীদের থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। তিনি মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। আল্লাহর গোশত, রক্ত, চুল, হাড্ডি ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেমন হাত, পা, মাথা ও দু’ চোখ রয়েছে। এগুলো থাকা সত্ত্বেও তিনি কারও সঙ্গে সাদৃশ্য রাখেন না এবং কেউ তার সদৃশ নয়।
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.১৫২, ২০৯।]

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর আক্বিদাগত ভ্রান্তি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) তার ওকালতি করার অনর্থক চেষ্টা করেছেন। ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) মুজাসসিমা প্রীতি খুবই আশ্চর্যজনক। তিনি মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর অনর্থক ওকালতি করে লিখেছেন,

وأما مقاتل فالله أعلم بحقيقة حاله والأشعري ينقل هذه المقالات من كتب المعتزلة وفيهم انحراف عن مقاتل بن سليمان فلعلهم زادوا في النقل عنه أو نقلوا عن غير ثقة وإلا فما أظنه يصل إلى هذا الحد

অর্থ: মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ ভালো জানেন। ইমাম আবুল হাসান আশআরী মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের এসব বক্তব্য মু’তাজিলাদের থেকে বর্ণনা করেছে। সম্ভবত তারা মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে অতিরঞ্জন করেছে অথবা বিশ্বস্ত নয় এমন বর্ণনাকারীদের বর্ণনা গ্রহণ করেছে। নতুবা আমি মনে করি না, সে আক্বিদার ক্ষেত্রে এতোটা নি¤œ স্তরে পৌঁছেছিল।[৩]
[মিনহাজুস সুন্নাহ, খ.২, পৃ.৬১৮।]

অথচ মুকাতিল ইবনে সুলাইমান মুজাসসিমা হওয়ার বিষয়টি কারও কাছে অস্পষ্ট নয়। ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) এর এই মুজাসসিমা প্রীতি তাকে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত করেছে। মুজাসসিমাদের প্রতি এই অনর্থক প্রীতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিজেও মুজাসসিমাদের আক্বিদা প্রচার করেছেন এবং সেগুলো সমর্থন করেছেন।

খতীব বাগদাদী নিজ সনদে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) বলেন,أتانا من المشرق رأيان خبيثان جهم معطل ومقاتل مشبه অর্থ: পূর্ব দিক থেকে আমাদের নিকট দু’টি নিকৃষ্ট মতবাদ এসেছে। ১. জাহাম ইবনে সাফওয়ান আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী অস্বীকার করে। ২. মুকাতিল ইবনে সুলাইমান আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করে।
[তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬৪, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৭, পৃ.২০২।]

ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর আক্বিদা বর্ণনা করে লিখেছেন,

إن الله جسم وله جثه وإنه على صورة الإنسان لحم ودم وشعر وعظم..وهو مع ذلك لا يشبه غيره، ولا يشبهه غيره

অর্থ: আল্লাহ তায়ালা শরীর ও দেহ বিশিষ্ট। তিনি মানুষের আকৃতির মতো। তার গোশত, রক্ত, চুল ও হাড় রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এগুলো থাকলেও তিনি কারও সাথে সাদৃশ্য রাখেন না এবং কোন কিছু তার সদৃশ নয়।
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.২৫১।]

মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের মতাদর্শ একটু লক্ষ্য করুন। সে আল্লাহর জন্য শরীর সাব্যস্ত করেছে। রক্ত, মাংশ সাব্যস্ত করেছে। অথচ নিজেকে বাঁচানোর জন্য বলেছে, আল্লাহ তায়ালা কারও সাথে সাদৃশ্য রাখেন না। পরবর্তী আলোচনায় মুশাববিহাদের এই প্রতারণামূলক বক্তব্য প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখতে পাবেন। তারা আল্লাহ তায়ালার জন্য মানুষের আকৃতি সাব্যস্ত করলেও সেটা সাদৃশ্য দেয়া হয় না। আল্লাহর জন্য হাড্ডি ও চুল সাব্যস্ত করলেও সাদৃশ্য দেয়া হয় না। তারা মূলত: সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দেয়ার পর বলবে যে আল্লাহ তায়ালার সাথে কিছুই সাদৃশ্য রাখে না। মুশাববিহারা এধরনের স্ববিরোধীতার আশ্রয় নিয়েই তাদের কুফুরী আক্বিদা সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচার করে থাকে।

ইমাম জাহাবী (رحمة الله) মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে বলেন,

مقاتل بن سليمان.. متروك الحديث وقد لطخ بالتجسيم مع أنه كان من أوعية العلم بحراً في التفسيرমুকাতিল ইবনে সুলাইমান হাদীসের ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত। সে আল্লাহর শরীর সাব্যস্তের নোংরা আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলো। অথচ সে প্রচুল ইলমের অধিকারী ছিলো এবং তাফসীর শাস্ত্রে সমুদ্রের মতো গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলো।
[তাযকিরাতুল হুফফায, খ.১, পৃ.১৭৪। তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬২।]

ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিসগণের বর্ণনা অনুযায়ী মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এই নিকৃষ্ট আক্বিদায় বিশ্বাসী হওয়ার মূল কারণ ছিলো সে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের বর্ণনা গ্রহণ করতো এবং তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস চর্চা করতো। ইসরায়েলী বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে মুকাতিল ইবনে সুলাইমান আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করতো। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) এ প্রসঙ্গে বলেন,

كانت له كتب ينظر فيها إلا أني أرى أنه كان له علم بالقرآن

অর্থ: তার কাছে (ইহুদী-খ্রিষ্টানদের) কিছু কিতাব ছিলো, সে এগুলো দেখতো। তবে সে তাফসীর শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলো। [তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬১।]

ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে বলেন,

كان يأخذ عن اليهود والنصارى علم القرآن الذي يوافق كتبهم وكان مشبها يشبه الرب بالمخلوقين. وكان مع ذلك يكذب في الحديث অর্থ: সে ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের নিকট থেকে তাফসীর শিখতো। ইহুদী-খ্রিষ্টানরা তাদের কিতাব থেকে এই তাফসীর বর্ণনা করতো। সে একজন মুশাববিহা ছিলো। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করতো। এছাড়া সে হাদীস শাস্ত্রে মিথ্যুক ছিলো।
[আল-মাজরুহুন, খ.২, পৃ.১৫। আরও দেখুন, ওফায়াতুল আইয়ান, খ.৫, পৃ.২৫৫, আজ-জুয়াফা, ইবনুল জাওযী, খ.১, পৃ.১৩৬।]

ইমাম আহমাদ ইবনে সাইয়ার (رحمة الله) তাঁর সম্পর্কে বলেন,
مقاتل متروك الحديث كان يتكلم في الصفات بما لا تحل الرواية عنه

অর্থ: মুকাতিল ইবনে সুলাইমান হাদীসের ক্ষেত্রে পরিত্যাক্ত। আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে সে এমন সব মতবাদ প্রচার করতো যা বর্ণনা করাও বৈধ নয়।
[তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬২।]

ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তার সম্পর্কে বলেন,ظهر بخراسان الجهم بن صفوان ودعا إلى تعطيل صفات الله عز وجل.. وظهر في خراسان في قبالته مقاتل بن سليمان المفسر وبالغ في إثبات الصفات حتى جسم وقام على هؤلاء علماء التابعين وأئمة السلف وحذروا من بدعهم

অর্থ: খোরাসানে জাহাম ইবনে সাফওয়ানের আবির্ভাব হয়। সে মানুষকে আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী অস্বীকারের প্রতি আহ্বান করে। একই সময়ে খোরাসানে মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের আবির্ভাব হয়। সে আল্লাহর গুণাবলী সাব্যস্তের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করে, এমনকি সে আল্লাহর দেহ সাব্যস্ত করে। এই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাবেয়ী ও সালাফে-সালেহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাদের বিরুদ্ধে মানুষকে সতর্ক করেন এবং তাদের প্রচারিত বিদয়াত থেকে মানুষকে সচেতন করেন।
[ত্ববাকাতুল হুফফায, খ.১, পৃ.১৫৯।]

খতীব বাগদাদী (رحمة الله) তাফসীর বিষয়ে তার জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। খতীব বাগদাদী (رحمة الله) বলেন, সে মানুষের তাফসীর একত্র করে নিজের নামে চালিয়ে দিতো এবং মুফাসসিরদের কাছ থেকে শোনা ব্যতীত তাদের বর্ণনা উল্লেখ করতো।
[তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬২। তাহযীবুল কামাল, খ.২৮, পৃ.৪৩৬।]

মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের আক্বিদাগত ভ্রান্তির ব্যাপারে কোন সংশয় নেই। এ ব্যাপারে কোন ইমামের দ্বিমত নেই। মুজাসসিমাদের প্রতি অন্যায় প্রীতির কারণে ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে যা কিছু বলেছে তার বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। নিজস্ব কিছু ধারণার উপর ভিত্তি করে ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) এর পক্ষে এধরনের ভিত্তিহীন মন্তব্য খুবই আশ্চর্যজনক।

আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দেয়ার বিষয়টি শুধু মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অনেক মুহাদ্দিসই এসব ইসরাইলী বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত এই ভ্রান্ত আক্বিদায় নিপতিত হয়েছিলো। মুহাদ্দিসরা শুধু এগুলো বর্ণনা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং এগুলো তাদের আক্বিদা হিসেবে প্রচার করেছে এবং এর বিরোধীতাকারীদেরও মারাত্মক সমালোচনা করেছে। অনেকে এক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রসর হয়ে আহলে কিতাবদের বর্ণনাগুলো রাসূল স. এর হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছে এবং এভাবেই আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের জাল বর্ণনার উদ্ভব হয়েছে।

ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) বলেন,

وزادوا في الأخبار أكاذيب وضعوها ونسبوها إلى النبي عليه الصلاة والسلام وأكثرها مقتبس من اليهود فإن التشبيه فيهم طباع حتى قالوا اشتكت عيناه فعادته الملائكة وبكى على طوفان نوح حتى رمدت عيناه وإن العرش ليئط من تحته أطيط الرحل الجديد وإنه ليفضل من كل جانب أربعة أصابع

অর্থ: তারা আল্লাহর গুণাবলীর বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা বর্ণনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে এবং এগুলোকে রাসূল স. এর হাদীস হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। এসব বর্ণনার অধিকাংশ ইহুদীদের কাছ থেকে নেয়া। কেননা আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়ার বিষয়টি ইহুদীদের স্বভাবজাত ছিলো। এমনকি তারা বলত, আল্লাহর দুই চোখ অসুস্থ হয়ে পড়লে ফেরেশতা তার শুশ্রুষা করেন। নূহ আ. এর তুফানের সময় আল্লাহ তায়ালা এতো ক্রন্দন করেন যে তার দুই চোখ ফুলে ওঠে। নতুন বাহনে আরোহণের সময় যেমন আওয়াজ হয় তেমনি আল্লাহ তায়ালা যখন আরশে আরোহণ করেন তখন আওয়াজ হয়। তিনি আরশের চার দিক থেকে চার আঙ্গুল পরিমাণ পৃথক রয়েছেন। [আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৬]

অনেক মুহাদ্দিস ইহুদীদের এসব বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুশাববিহাদের আক্বিদা পোষণ করতো। তাদের লিখিত আক্বিদা বিষয়ক কিতাবগুলো তাদের এই ভ্রান্তির স্পষ্ট প্রমাণ। আস-সুন্নাহ, আল-ইবানা বা আর-রদ্দু আলাল জাহমিয়া নামে তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেসব কিতাব লিখেছে এগুলো পড়লে বোঝা যায়, তারা ইসরাইলী বর্ণনা দ্বারা কতটা প্রভাবিত ছিলো। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, অনেক মুহাদ্দিস শুধু ইসরাইলী বর্ণনা একত্র করার উদ্দেশ্যে কিতাব লিখেছেন। তারা এর থেকে কোন আক্বিদা প্রমাণ করেননি এবং এর বিপরীত আক্বিদা পোষণকারীদেরও সমালোচনা করেননি। আমরা সেসব মুহাদ্দিসগণ সম্পর্কে আলোচনা করছি না। বরং যেসব মুহাদ্দিস রীতিমত এগুলো দ্বারা তাদের আক্বিদা প্রমাণ করেছেন এবং এর বিপরীত আক্বিদা পোষণকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন, আমরা কেবল তাদের সম্পর্কে আলোচনা করছি।আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী (رحمة الله) বলেন,

على أنه حيث سمى كتابه (السنة) يفيد أن ما حواه ذلك الكتاب هو العقيدة المتوارثة من الصحابة والتابعين.. فلا حاجة إلى مناقشته فيما ساقه من الأسانيد… فيتبين بذلك الفرق بين ذكر شيء في كتاب يسميه مؤلفه باسم (السنة) وبين ذكره في كتاب لا يسمى بمثل هذا الاسم، لأن الثاني لا يدل على أن جميع ما فيه مما يعتقده مؤلفه، بل قد يكون جمع فيه ما لقي من الروايات تاركاً تمحيصها للمطالع بخلاف الأول فلا نناقش المؤلف في الأسانيد بل نوجه النقد إلى المؤلف مباشرة من جهة أن ما حواه هو معتقده

অর্থ: যেহেতু সে এই কিতাবের নাম রেখেছে কিতাবুস সুন্নাহ, তার এই নামকরণ দ্বারা বোঝা যায় সে এই কিতাবে যা কিছু লিখেছে এগুলো সাহাবা ও তায়েবীগণ থেকে পরম্পরাসূত্রে বর্ণিত আক্বিদা। সুতরাং তার লিখিত কিতাবের সনদ নিয়ে আলোচনার কোন প্রয়োজন পড়ে না। স্পষ্টত: লেখক তার কিতাব যদি আস-সুন্নাহ হিসেবে নামকরণ করে তাহলে তার মধ্যে ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য থাকে। কেননা যারা তাদের কিতাবকে এজাতীয় নামে নামকরণ করেনি তারা বর্ণনাগুলো সংকলনের সময় তাদের আক্বিদা প্রমাণকে মুখ্য গণ্য করে না। অনেক সময় একই বিষয়ক সকল বর্ণনা একত্র করার উদ্দেশ্যে বর্ণনা উল্লেখ করে থাকে। প্রথম ব্যক্তি এর বিপরীত। সে মূলত: এসব বর্ণনা দ্বারা তার আক্বিদার প্রমাণ দিয়েছে। সুতরাং আমরা এসব বর্ণনার সনদ বিশ্লেষণ ছাড়া সরাসরি তার লেখকের আক্বিদা বিশ্লেষণ করবো, কেননা সে তার আক্বিদার কিতাবে যা কিছু লিখেছে সেটি তার আক্বিদা হিসেবেই লিখেছে। [মাকালাতুল কাউসারী, পৃ৩২৬।]

যারা তাদের আক্বিদার কিতাবে ইসরাইলী বর্ণনাগুলো উল্লেখ করেছে তারা মূলত: এসব বর্ণনা দ্বারা তাদের আক্বিদা প্রমাণ করতে চেয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে বর্ণনা দুর্বল না সহীহ, সেটা এখানে মুখ্য নয়। বরং সে এই বর্ণনা থেকে যে আক্বিদা প্রমাণ করেছে সেটাই মুখ্য। সুতরাং যেসব মুহাদ্দিস তাদের আক্বিদার কিতাবে ইহুদীদের এসব ভ্রান্ত আক্বিদা বর্ণনা করে নিজেদের আক্বিদা প্রমাণের চেষ্টা করেছে, তাদের এসব বর্ণনার সনদ বিশ্লেষণ করার পূর্বে তাদের আক্বিদা নিযে প্রশ্ন করা হবে। জাল, যয়ীফ ও ইসরাইলী বর্ণনা দ্বারা কেউ যদি আক্বিদা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, তবে তাকে শুধু একারণে নির্দোষ বরা যাবে না যে, সে জাল বর্ণনা এনেছে। বরং এসব জাল বর্ণনা থেকে সে কী কী ভুল আক্বিদা প্রমাণ করতে চেয়েছে সেগুলোও বিশ্লেষণ করা হবে। বিষয়টি সালাফী শায়খরাও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।

ড. রেজা বিন না’সান লিখেছেন,إن علماء السلف قد ألفوا كتباً كثيرة وقد أطلق على كثير منها اسم الإبانة…. وأحيانا يطلقون على هذه المؤلفات اسم (السنة) أو (شرح السنة) – وعد كتباً منها كتاب السنة لعبد الله بن أحمد، والسنة لابن أبي عاصم، ثم قال- ويهدف مؤلفو هذه الكتب إلى إبراز عقيدة السلف كما كانت خالصة من شوائب الفرق الأخرى وشبهها، وذلك من خلال روايتهم للآثار الواردة في هذه العقيدة. ويكاد يكون موضوع هذه الكتب ونهجها واحداً وهو كما قلنا رواية الأحاديث الواردة في جميع أبواب العقيدة السلفية وذكر عقائد السلف الصالح

অর্থ: পূর্ববর্তী আলেমগণ (আক্বিদা বিষয়ক) অনেক কিতাব লিখেছেন। তদের অনেক কিতাবের নাম আল-ইবানা। কখনও কখনও তারা এসব আক্বিদার কিতাবের নাম দিয়েছে আস-সুন্নাহ অথবা শরহুস সুন্নাহ। এজাতীয় কিতাবের মধ্যে রয়েছে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) এর ছেলের কিতাব আস-সুন্নাহ এবং ইবনে আবি আসেম এর লেখা আস-সুন্নাহ। এসব কিতাবের লেখকদের মূল উদ্দেশ্য হলো, সালাফে-সালেহীনের আক্বিদা বিশ্বাস সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা। অন্যান্য বাতিল ফেরকার ভ্রান্তি স্পষ্ট করে সালাফে-সালেহীনের বিশুদ্ধ আকিদা বর্ণনাই ছিলো এসব কিতাব লেখার মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে তারা নিজেদের আক্বিদা প্রমাণের জন্য এ বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। সত্য কথা হলো, আক্বিদা বিষয়ক এজাতীয় সকল কিতাব রচনার পদ্ধতি একই। সেটি হলো, তারা সালাফে-সালেহীনের আক্বিদা বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রত্যেক অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট আক্বিদা ও এসম্পর্কিত হাদীস উল্লেখ করেছেন।
[ইবনে বাত্তা এর লেখা আল-ইবানা এর তাহকীক, খ.১, পৃ.৪৮।]

কাররামিয়া ফেরকা:

এই ফেরকার আক্বিদা-বিশ্বাস জানার পূর্বে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরি। প্রথমত: মুশাববিহা ও মুজাসসিমাদের অন্যান্য ফেরকা সময়ের পরিবর্তনে বিলুপ্ত হলেও এই ফেরকার আক্বিদা বিশ্বাস এখনও মুসলিম সমাজে প্রচলিত। এই ফেরকার প্রবর্তকের মৃত্যুর সঙ্গে এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এই ফেরকার অনেক আক্বিদা-বিশ্বাসই বর্তমানে সালাফী আক্বিদার মোড়কে আমাদের সমাজে বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমান সালাফী আক্বিদা মূলত: পূর্ববর্তী মুজাসসিমা ও মুশাববিহা আক্বিদার নতুন রূপ, যা নতুন মোড়কে সাধারণ মানুষের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ফেরকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন শ্লোগান, কৌশলের আশ্রয় নিয়ে এই ফেরকা সাধারণ মানুষের মাঝে আক্বিদাগত ভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়। এই ফেরকার অনেকেই বাহ্যিক ইবাদত বন্দেগি দ্বারা সাধারণ মানুষকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করতো এবং তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতো কুফুরী আক্বিদা সমূহ। এভাবে তারা ইসলামের কয়েক শতাব্দীব্যাপী মুসলমানদের একটি শ্রেণীকে আক্বিদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত করেছে। সময়ের পরিবর্তনে এদের মতাদর্শে নিত্য-নতুন মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে কাররামিয়া ফেরকাটি মূলত: মুসলমানদের মাঝে ইহুদী আক্বিদার প্রতিনিধিত্ব করেছে। কাররামিয়া ফেরকার উত্তরসূরী হলো বর্তমান সময়ের সালাফী ও আহলে হাদীস ফেরকা। কাররামিয়াদের ভ্রান্ত আক্বিদা-বিশ্বাস উল্লেখের পরে এদের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।কাররামিয়া ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা:কাররামিয়া ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা হলো আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম। সে সিজিস্তানে জন্মগ্রহণ করে এবং সেখানেই বড় হয়। সে সিজিস্তান থেকে খোরাসানে প্রবেশ করে, পরবর্তীতে নিশাপুরে ফিরে আসে। এবং সেখানে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার শুরু করে। সিজিস্তান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর নিশাপুরে গেলে সেখান থেকেও সে বিতাড়িত হয়। পরবর্তীতে সে বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থান শুরু করে। সেখানেই সে ২৫৫ হি: ইন্তেকাল করে।

ইবনে কাররাম মূলত: ইবাদত বন্দেগী ও বুযুর্গীর মাধ্যমে মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতো। সে খুবই সামান্য ইলম অর্জন করেছিলো। প্রত্যেক মাযহাব থেকে কিছু কিছু নিয়ে নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে। দুনিয়া বিমুখতা ও খোদাভীতি দেখিয়ে নিজের দিকে সাধারণ মানুষকে ভিড়াতো। তার এসব কৌশলের কারণে অনেক সাধারণ মানুষ তার ভক্ত হয়। এমনকি তার একদা তার অনুসারীদেরকে গ্রেপ্তার করা হলে প্রায় সত্তর হাজারী অনুসারী গ্রেপ্তার হয়।তার মৃত্যুও সময় বাইতুল মুকাদ্দাসে তার অনুসারী ছিলো প্রায় বিশ হাজার। সিজিস্তান ও খোরাসানে এরকম হাজার হাজার অনুসারী ছিলো।
[আত-তাবসীর ফিদ দীন, পৃ.৬৫। আল-মুনতাজিম, ইবনুল জাওযী, খ.১২, পৃ.৯৮।]

কাররামিয়াদের ভ্রান্ত কুফুরী আক্বিদা-বিশ্বাস: কাররামিয়াদের অনেক ফেরকা ও মতবাদ রয়েছে। ভ্রান্ত ফেরকার উপর লিখিত গ্রন্থগুলোতে এদের অনেক ফেরকার নাম পাওয়া যায়। ইমাম আবু মনসুর বাগদাদী (رحمة الله) আল-ফরকু বাইনাল ফিরাক এর মধ্যে এদের তিনটি দলে ভাগ করেছেন। ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله) এদেরকে ছয়টি দলে বিভক্ত করেছেন। ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) এদের বারটি দলের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা তাদের বিভিন্ন ফেরকা সম্পর্কে আলোচনার পরিবর্তে তাদের মৌলিক আক্বিদাগুলো এখানে তুলে ধরবো।মুহাম্মাদ ইবনে কাররামের একটি মৌলিক ভ্রান্ত আক্বিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। তার দেহের একটি সীমা ও সমাপ্তি রয়েছে। তার মতে আল্লাহর দেহের নিচের দিকের কেবল সীমা ও সমাপ্তি রয়েছে, যেই দিক আরশের সাথে সংশ্লিষ্ট।
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৩, আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৮, ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.১৭।]

ইবনে কাররামের আরেকটি আক্বিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপরের অংশ স্পর্শ করে আছেন।
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৪, আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৮।]

ইবনে কাররামের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর স্থির হয়ে আছেন। সত্ত্বাগতভাবে তিনি উপরের দিকে রয়েছেন। আরশ হলো আল্লাহর অবস্থানের স্থান।ইবনে কাররামের নিকট আল্লাহ তায়ালা চলা-ফেরা করেন, তিনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করেন, তিনি উপর থেকে নিচে অবতরণ করেন।সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইবনে কাররামের মতে আল্লাহ তায়ালার ভার বা ওজন রয়েছে। ইমাম বাগদাদী (رحمة الله) বলেন,

وأعجب من هذا كله أن ابن كرام وصف معبوده بالثقل وذلك أنه قال في كتاب عذاب القبر في تفسير قوله تعالى “إذا السماء انفطرت” إنها انفطرت من ثقل الرحمن عليها

অর্থ: পূর্বোক্ত কুফুরী আক্বিদাগুলোর চেয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক আক্বিদা হলো মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম আল্লাহ তায়ালার জন্য ওজন বা ভার সাব্যস্ত করেছে। সে তার আজাবুল কবর বইয়ে সূরা ইনফেতার এর প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লাহর ওজন সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন (অর্থ:) যখন আসমান বিদীর্ণ হবে।
[সূরা আল-ইনফিতার, আয়াত নং ১।]

সে এর ব্যাখ্যায় লিখেছে, আসমান আল্লাহর ভারে বিদীর্ণ হবে। [আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৭।]

ইবনে কাররামের আরেকটি কুফুরী আক্বিদা হলো, সে আল্লাহর জন্য কাইফিয়াত বা অবস্থা সাব্যস্ত করেছে। ইমাম বাগদাদী (رحمة الله) লিখেন,ثم إن ابن كرام ذكر في كتابه عذاب القبر باباً له ترجمة عجيبة فقال: باب في كيفوفية الله عز وجل، ولايدري العاقل من ماذا يتعجب أمن جسارته على إطلاق لفظ الكيفية في صفات الله عز وجل؟ أم من قبح عبارته عن الكيفية بالكيفوفية، وله من جنس هذه العبارة أشكال ৃ وقد عبر عن مكان معبوده في بعض كتبه بالحيثوثية وهذه العبارات لائقة بمذهبه السخيف

অর্থ: ইবনে কাররাম তার আজাবুল কবর নামক কিতাবে একটি আশ্চর্যজনক পরিচ্ছেদ লিখেছে। পরিচ্ছেদের নাম দিয়েছে, আল্লাহর কাইফিয়াত বা অবস্থার বর্ণনা। আমি জানি না, একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার এই পরিচ্ছেদের নাম দেখে আশ্চর্যন্বিত হবে না কি আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে কাইফিয়াত বা অবস্থা সাব্যস্তের মতো ধৃষ্টতা দেখে আশ্চর্য হবে, না কি তার নিকৃষ্ট শব্দ ব্যবহারে আশ্চর্য হবে? সে আরবী কাইফিয়াত শব্দ থেকে বিকৃত শব্দ কাইফুফিয়াত বানিয়েছে। সে এজাতীয় আরও অনেক বিকৃত শব্দ ব্যবহার করেছে। সে তার একটি কিতাবে আল্লাহর স্থান সাব্যস্তের জন্য হাইসুসিয়াত শব্দ ব্যবহার করেছে। এধরনের বিকৃত শব্দ শুধু তার নিকৃষ্ট মাযহাবেরই উপযুক্ত।
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৭]


মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম ও তার অনুসারীদের ভ্রান্ত আক্বিদাসমূহ:

ইমাম আব্দুল কাহের বাগদাদী, ইমাম ইসফারাইনী, ও ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম ও তার অনুসারীদের আক্বিদা বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। আমরা তাদের মৌলিক আক্বিদাগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করছি,

১. আল্লাহ তায়ালার পরিমাপ ও সীমা রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা রয়েছে। পরিভাষা অনুযায়ী দৈঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বিশিষ্ট বস্তুকে মূলত: দেহ বলা হয়। এজন্য প্রত্যেক মুজাসসিমা আল্লাহ তায়ালার দেহ সাব্যস্ত করে থাকে।

২. আল্লাহ তায়ালাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা সম্ভব। এমনকি আল্লাহ তায়ালাকে স্পর্শ করা সম্ভব। কারণ তাদের মতে আল্লা তায়ালা জিসম বা দেহবিশিষ্ট। আর প্রত্যেক দেহ বিশিষ্ট বস্তু র্শ করা সম্ভব।

৩. আল্লাহ তায়ালা আরশ স্পর্শ করে আছেন। কেননা তিনি আরশের উপর বসে আছেন। তাদের কারও কারও মতে তিনি আরশ থেকে পৃথক অবস্থায় আরশের উপরে রয়েছেন।

৪.আল্লাহ তায়ালার অঙ্গ-প্রতঙ্গ রয়েছে। যেমন, হাত, চোখ, পা ইত্যাদি।

৫. অধিকাংশ মুজাসসিমার মতে আল্লাহ তায়ালা সব দিক থেকে সীমাবদ্ধ। তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহ তায়ালা নিচের দিক তথা আরশের দিক থেকে সীমাবদ্ধ এবং আরশ ব্যতীত অন্যান্য দিকে অসীম।

৬. আল্লাহ তায়ালার শোনা, দেখা, ইলম, কুদরত মোট কথা সব গুণ নশ্বর। এগুলো আল্লাহর সত্ত্বার মাঝে সৃষ্টি হয়।

৭. আল্লাহ তায়ালার কোন কাজের জন্য নড়া-চড়া প্রয়োজন। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা কিছু করার জন্য নড়া-চড়া বা হরকত করেন। তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহ তায়ালার নড়া-চড়াই হলো আল্লাহর কাজ।
[আল-কাশিফুস সগীর, সাইদ আব্দুল-লতিফ ফুদা, পৃ.৩১-৩২।]


__________ সমাপ্ত __________

Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা