নন্দিত নারী
নন্দিত নারী
____________________
নন্দিত নারী
হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ ওসমান গণি
আরবি প্রভাষক, জামেয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।
মোবাইল: ০১৮১৭-২৩২৩৬৪
টেক্সট রেডীঃ মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ সানি, ফাতেমাতুয জোহরা শাকিলা
প্রকাশিকাঃ নূরজাহান বেগম শিউলী
হিলভিউ, হামজারবাগ, চট্টগ্রাম
সহযোগিতায়
বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও শিক্ষানুরাগী
আলহাজ্ব রশিদ আহমদ
হিলভিউ, হামজারবাগ, চট্টগ্রাম।
মোহাম্মদ নূর সোবহান চৌধুরী
পরিচালক: ফিন্যান্স মেসার্স নূর সোপ এণ্ড ক্যামিকেল ইণ্ডাস্ট্রিজ
পটিয়া, চট্টগ্রাম
গ্রন্থস্বত্ব
সংকলক কর্তৃক সংরক্ষিত
প্রকাশকাল
৩ জুলাই, ২০১৯ ঈসায়ী
প্রকাশনা
চিশতী প্রকাশনী, বালুচরা, বায়েজীদ, চট্টগ্রাম
মুদ্রক
মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক
এ. আরঃ কম্পিউটার, ষোলশহর, চট্টগ্রাম
প্রচ্ছদ
এট্যাচ এ্যাড, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম
মূল্য : ১৭০/-[একশত সত্তর টাকা মাত্র]
উৎসর্গ
আমার জান্নাতবাসী পিতা-মাতা
মরহুম আহমদ জরিফ
মরহুমা আলহাজ্বাহ্ আনোয়ারা বেগম
ও
প্রকাশিকার জান্নাতবাসী শ্বশুর
মরহুম তোফায়েল আহমদ
লেখকের কথা
____________________
লেখকের কথা
আল্লাহ তা‘আলার জন্য সকল প্রশংসা, যিনি একই সত্তা থেকে নারী-পুরুষ সৃষ্টি করে তাদের মাধ্যমে মানব বংশের বিস্তার করেছেন সমগ্র বিশ্বে। নারী জাতিকে করেছেন ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষদের শীর্ষে। যিনি পবিত্র কুরআনে সূরা নাযিল করেছেন ‘রমনীর নামে’, বর্ধিত সুযোগ দিয়েছেন শরীয়তের আহকামে।
দুরূদ সালামের হাদিয়া পেশ করছি সেই মানবতার অগ্রদূত, নারী জাতির মুক্তিদূত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নূরানী মহামানব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা, আহমদ মুজতবা (ﷺ)র পাক চরণে, যিনি আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বে সর্বপ্রথম নারী জাতির পূর্ণ মানবিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। যিনি মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত ঘোষণা দেন। অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীজাতিকে পুরুষের পদতল থেকে মাথার মুকুট বানিয়ে দেন। লাঞ্চিত, বঞ্চিত, নিন্দিত রমনীকূলকে সম্মানীত, পুরস্কৃত ও নন্দিত করে তুলেছেন। নারীকে অলঙ্কৃত করেছেন পুরুষের ভূষণে, ভুলেননি তাদেরকে বিদায় হজ্জের ভাষণে। স্মরণ করছি সর্বকালের সকল মহিয়সী নারীদেরকে যারা জগতের সকল নবী-রাসূল, অলী-আউলিয়া এবং মহামনীষীদের গর্ভধারিণী, যারা তাদেরকে দুগ্ধপানকারিনী। যাদের কোল ছিল তাদের প্রাথমিক শিক্ষালয়, যাদের প্রেরণায় করেছে তারা বিশ্বজয়। তাইতো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “কোনোকালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।”
মহাপরাক্রমশালী মহাশিল্পী বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায় অর্থাৎ নর ও নারী করে। উভয়ের সৃষ্টির উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। আর তা হলো আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্ব। উভয়ের ক্ষেত্রেই আল্লাহ তা‘আলা স্বতন্ত্র অবস্থান ও দায়িত্ব নিরূপণ করে দিয়েছেন যা তাদের সৃষ্টিগত ও স্বভাবগত স্বাতন্ত্রের উপযোগী ও শোভনীয়। পুরুষের কর্মক্ষেত্র হচ্ছে ঘরের বাইরে, প্রকৃতির রুদ্র কঠিন পরিবেশে। পুরুষ জাতির উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে দেশ, জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার। পক্ষান্তরে নারীদের দায়িত্ব কোমল স্বভাব উপযোগী, গৃহের যাবতীয় কার্যাদি সম্পাদন করা। নিতান্ত প্রয়োজন হলে পর্দা সহকারে তাদের উপযোগী বাইরের কাজ-কর্মও করতে পারে। জলভাগ ও স্থলভাগের প্রাণীকূলের যেমন একের স্থান অপরের জন্য অনুপযোগী তেমনি নর-নারীরাও নিজ নিজ স্থানে অবস্থান করাই উপযোগী।
নারী আজ তার স্থান থেকে সরে এসে তারা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুঠারাঘাত করছে। এ কারণে সমগ্রবিশ্বে বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড দগ্ধ, নারী পাচার, অশ্লীল যৌনাচার সর্বোপরি নারী জাতির নারীত্বের অবমাননা। বর্তমানে এটা যেন অপ্রতিরোধ্য এক সংক্রামক রোগ।
নারী হয়েছে বিজ্ঞাপন সামগ্রী। শাড়ী, লিপস্টিক থেকে শুরু করে পুরুষ ব্যবহৃত সামগ্রীর বিজ্ঞাপনের জন্য নারীর নগ্ন ছবি ব্যবহার করা হয়। অফিসে, দোকানে, আবাসিক হোটেলে গ্রাহকের মনোরঞ্জনের জন্য সুন্দরী নারী নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে নারীদের ব্যবহার করছে। ঠিক অন্ধকার যুগের ন্যায় নারীরা পুনরায় ভোগের সামগ্রীতে পরিণত হচ্ছে, ভোগ্য পণ্য হিসাবে বিক্রি হচ্ছে, পুরুষের প্রাইভেট সেক্রেটারী পদে নিয়োগ হচ্ছে। নন্দিত নারী নিন্দিত গন্তব্যে চলছে। পশ্চিমা নগ্ন সভ্যতার অনুকরণই এগুলোর জন্য দায়ী। তথাকথিত নারী প্রগতি কেবল নারীকেই ধ্বংস করছে না বরং গোটা সমাজ ও জাতিকে ধ্বংস করছে। কারণ যে ছেলেকে মানুষ করতে একজন মায়ের বিশ বছর সময় লাগে, সে ছেলেকে একটি মেয়ে বিশ মিনিটের মধ্যে নষ্ট করে দিতে পারে। শয়তান যেখানে পরাস্ত সেখানে জয়ী হয় নারী। এ কারণে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন- إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا নিশ্চয় শয়তানের ষড়যন্ত্র ছিল দুর্বল। আর নারী সম্পর্কে বলেছেন- إِنَّ كَيْدَ هن عظيما
নিশ্চয়ই নারীদের ষড়যন্ত্র বড়। সুতরাং পুরুষের মাথার মুকুট মা জাতি নারীদের বিজাতীয় কুসংস্কার অনুকরণ পরিত্যাগ করে ইসলামী অনুশাসন অনুসরণ করা উচিত। তবেই নন্দিত নারী নন্দিত গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে এবং তাদের গর্ভ থেকে নন্দিত মহাপুরুষও জন্মলাভ করবে।
ইসলাম নারীকে কত উন্নত মর্যাদার আসনে আসীন করেছে তা আমাদের দেশের নারী সমাজ জানেনা। কারণ এ দেশের মুসলিম পরিবারের নারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল কেবল মক্তবে গিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা পর্যন্ত। নয় থেকে বার বছরের মধ্যে তাদেরকে বিয়ের আসরে বসতে হতো। তাছাড়া পুরুষরা যেভাবে বাজারে গিয়ে বই কিনতে পারে নারীরা তা পারে না। ফলে এদেশে নারী পাঠকের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। এখন শিক্ষা-দীক্ষায় নারীরা পুরুষের চেয়ে একধাপ এগিয়ে। শহর-বন্দর ও গ্রাম-গঞ্জে মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে (যদিও প্রয়োজনের তুলনায় কম) নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। পরীক্ষার ফলাফলেও দেখা যায় ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা ভাল করছে। সুতরাং বর্তমানে যে হারে নারী পাঠক সৃষ্টি হচ্ছে সে তুলনায় নারী সম্পর্কীয় নির্ভরযোগ্য বই পুস্তক কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক শুভাকাক্সক্ষী পাঠক মহল থেকেও বারংবার অনুরোধ এসেছে এ বিষয়ে কলম ধরার জন্যে। জ্ঞান-বিদ্যায় অপরিপক্ক হলেও বিজ্ঞ পাঠক মহলের স্নেহ-ভালোবাসাকে পুঁজি করে মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে প্রিয় নবী (ﷺ)র উসিলা নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। ইতিপূর্বের সকল গ্রন্থ লেখা সমাপ্ত হওয়ার পর একাধিক নাম থেকে একটি নাম নির্বাচিত করা হতো। কিন্তু কেন জানিনা এই গ্রন্থখানা লেখা আরম্ভ করার পূর্বেই নাম নির্ধারিত হয়েছে। আর তা হলো ‘নন্দিত নারী’ যদিও তাতে নিন্দিত বিষয়ও স্থান পেয়েছে।
বইটি নারীদের জন্য হলেও তাতে পুরুষদের অনেক বিষয় স্থান পেয়েছে যা নর-নারী উভয়ের জন্য অতীব জরুরী। এতে নারী বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা-মাসাইল বর্ণিত হয়েছে। আশা করি বইটি পাঠক সমাজে সমাদৃত হবে। যে সকল গ্রন্থকারের গ্রন্থ থেকে বইটিতে উদ্ধৃতি নিয়েছি এবং প্রকাশিকাসহ যারা যেভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। জ্ঞানের দৈন্যতা, অভিজ্ঞতার শূন্যতা, যোগ্যতার অপূর্ণতা ও মুদ্রণ জনিত ভুল-ভ্রান্তির ব্যাপারে বিজ্ঞ পাঠক মহলের ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি কাম্য, তবে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ শিরোধার্য ও পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনযোগ্য। পরিশেষে সকলের উভয় জগতের মঙ্গল কামনা করে এবং মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কথার ইতি টানছি। আল্লাহ কবুল করুন, আমীন।
- মুহাম্মদ ওসমান গণি
প্রকাশিকার কথা
____________________
প্রকাশিকার কথা
সমস্ত প্রশংসা মহান সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা আল্লাহর জন্য, যিনি এক নর ও এক নারী থেকে মানবজাতি সৃজন করেছেন এবং বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন। অসংখ্য অগণিত দুরূদ-সালাম পেশ করছি সর্বকালের সেরা সফল ব্যক্তিত্ব নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহর (ﷺ)র উপর। যিনি মানব জাতিকে বিশেষত নারী জাতিকে যাবতীয় অকল্যাণ ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে সম্মান ও মর্যাদার চরম শিখরে উপনীত করেছেন, নারীদের জান্নাত লাভের পথ সহজতর করে দিয়েছেন। শান্তি বর্ষিত হোক সকল নারী-পুরুষের উপর যারা যুগে যুগে নারীর কল্যাণের জন্য অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে মু’মিনদের জননী সর্বজন শ্রদ্ধেয়া রমনী হযরত খাদীজাতুল কুবরা(رضي الله عنه) কে স্মরণ করছি যিনি সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করে এবং রাহমাতুল লিল আলামীনকে আর্থিকসহ সার্বিক সহযোগিতা করে ইসলামের ইতিহাসে নারী জাতির মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন।
পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ নারী হওয়া সত্ত্বেও তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবহেলিত, বঞ্চিত। লাইব্রেরিসমূহে যে পরিমাণ পুরষের জন্য লিখিত বই-পুস্তক বিদ্যমান নারী সম্পর্কীয় বই-পুস্তক তার তুলনায় অতি নগন্য। এদিক থেকেও নারী পাঠকরা অবহেলিত ও বঞ্চিত বলে মনে হয়। হাতে গোনা কয়েকটি বই পাওয়া গেলেও তা মান ও গুণগত বিশেষত আকীদাগত বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। তাই দীর্ঘ দিন যাবৎ ইসলামী অঙ্গনে নারী বিষয়ক বিশুদ্ধ আকিদা সম্বলিত ও কুরআন-হাদিস সম্মত একটি পূর্ণাঙ্গ বই’র প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়ে আসছে।
জনপ্রিয় নন্দিত লেখক হাফেয মাওলানা মুহাম্মদ ওসমান গণি কর্তৃক লিখিত ‘নন্দিত নারী’ নামক বইটি পড়ে মনে হলো নারী-পুরুষ সকলের জন্য এটি অতি জরুরি। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য-পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন সকলেই উপকৃত হওয়ার মতো বই এটি। তাই বইটি প্রকাশ করে বিরাজমান শুন্যতাকে পূর্ণতা দেবার চেষ্টা করছি মাত্র।
আশা করি বইটি পড়ে পাঠক-পাঠিকাগণ আনন্দিত ও উপকৃত হবেন এবং এটাই কাম্য। লেখক, পাঠক-পাঠিকা মহলসহ যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বইটি অস্তিত্বলাভ করেছে সকলের উভয় জগতের সফলতা কামনা করছি। আল্লাহ! কবুল করুন, আমীন।
নূরজাহান বেগম শিউলী, হিলভিউ, হামজারবাগ (চট্টগ্রাম)
নারী সৃষ্টি
____________________
নারী সৃষ্টি
হযরত আদম (عليه السلام) কে বর্তমান কা’বা শরীফের অবস্থান স্থলে জুমার দিন সৃষ্টি করা হয়। এরপর তিনি পৃথিবীতে একাকী চলাফেরা করতেন আর পৃথিবীর প্রত্যেক প্রাণীকে ভিন্ন জাতি দেখে ভয় পেয়ে যেতেন। এবং আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতেন- যদি স্বজাতি থাকতো তবে তাদের সাথে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব হতো। পরবর্তী জুমার দিন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। এ সময় ফেরেশতাগণ তাঁর বাম পাঁজর কেটে তা থেকে মুহুর্তের মধ্যে অত্যন্ত সুশ্রী নারী হযরত হওয়া (عليه السلام) কে সৃষ্টি করেন। তবে এতে হযরত আদম (عليه السلام) অনুভবও করতে পারেন নি। অতঃপর তাঁর কাটা স্থান জোড়া লাগিয়ে দেয়া হলো। তিনি জাগ্রত হয়ে হাওয়া (عليه السلام) কে জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি কে? উত্তর আসল, ইনি আমার বন্দিনী। তোমার ভীতি দূরীভূত করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ১
১.আব্দুল আযিয মুহাদ্দিস দেহলভী র. (১২২৫ হি.), তাফসীরে আযিযী, সূত্র. মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী র. (১৩৯১ হি.) তাফসীরে নঈমী, উর্দূ, পৃ. ২৭৭
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এবং আরো কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত আদম (عليه السلام) একাকী ছিলেন। কোন বন্ধু কিংবা সুখ-দুঃখের কোন সাথী ছিলনা। আল্লাহ তা‘আলাতাকে ঘুমিয়ে রাখলেন। অতঃপর তাঁর বাম পাঁজর থেকে মাংস নিয়ে হযরত হওয়া (عليه السلام) কে সৃষ্টি করলেন। তাঁর উক্ত স্থানে সাথে সাথে মাংস জন্মে গেল। হযরত আদম (عليه السلام) জাগ্রত হলে হওয়া (عليه السلام) কে তাঁর মাথার পাশে দণ্ডায়মান দেখেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি কে? তিনি বললেন-আমি আওরাত তথা নারী। হযরত আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন- তোমাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? উত্তরে তিনি বললেন, আপনি যেন আমা থেকে শান্তি লাভ করতে পারেন। ফেরেশতারা হযরত আদম (عليه السلام)’র জ্ঞানের পরিধি পরিমাপের উদ্দেশ্যে আদম (عليه السلام) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে? উত্তরে তিনি বললেন- ইনি ‘ইমরাতুন’ অর্থাৎ নারী। ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করলেন- এর নাম ‘ইমরাতুন’ কেন রাখা হলো? উত্তরে হযরত আদম (عليه السلام) বলেন, কেননা তার সৃষ্টি ‘ইমরুন’তথা পুরুষ থেকে হয়েছে। ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করলেন- এর নাম কী? উত্তরে তিনি বললেন- হাওয়া। ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করলেন- এর নাম হাওয়া হলো কেন? উত্তরে তিনি বললেন, যেহেতু ইনি জীবন্ত বস্তু থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তাই এর নাম হয়েছে হাওয়া।
অতঃপর আদম (عليه السلام) হাওয়া (عليه السلام)’র দিকে হাত বাড়াতে চাইলে আদেশ হলো- হে আদম! আগে তার মাহর আদায় কর তারপর হাত লাগাবে। আদম (عليه السلام) আরয করলেন, হে আমার প্রতিপালক! এর মাহর কী? বলা হলো আমার শেষ নবী মুহাম্মদ (ﷺ)র উপর দশবার দুরূদ শরীফ পাঠ কর। এভাবে ফেরেশতাদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে হযরত আদম (عليه السلام)’র সাথে হযরত হাওয়া (عليه السلام)’র বিবাহ সম্পন্ন হয়।
হযরত আদম (عليه السلام)’র সৃষ্টি সর্বসম্মতিক্রমে পৃথিবীতে মক্কা শরীফে হয়েছে। তবে হযরত হাওয়া (عليه السلام)’র সৃষ্টির স্থান নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)’র মতে হযরত হাওয়া (عليه السلام) জান্নাতে সৃষ্টি হয়েছেন। কিন্তু হযরত ওমর (رضي الله عنه) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামের মতে- ফেরেশতা হযরত আদম (عليه السلام) ও হাওয়া (عليه السلام) কে নূরানী তখতে বসায়ে হযরত আদম (عليه السلام) কে নূরানী পোশাক ও মাথায় তাজ পরায়ে এবং হযরত হাওয়া (عليه السلام) কে স্বর্ণের পোশাকে সুসজ্জিত করে ফেরেশতাদের অভ্যর্থনার মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরত হাওয়া (عليه السلام) জান্নাতে প্রবেশের পূর্বে পৃথিবীতেই সৃষ্টি হয়েছেন।পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
يَاآدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ
হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে অবস্থান কর। ২
২.সূরা বাকারা, আয়াত: ৩০
আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদম (عليه السلام) ও হাওয়া (عليه السلام) উভয়কে সসম্মানে সমমর্যাদায় জান্নাতে নি’য়ামতরাজী ভোগ করার অধিকার দিয়েছেন কেবল নিষিদ্ধ বৃক্ষের কাছে যেতে এবং তার ফল খেতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় এবং হযরত হাওয়া (عليه السلام)’র প্রেরণায় সর্বোপরি আল্লাহর ইচ্ছায় তারা নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়ে জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হলেন এবং পৃথিবীতে অবতরণ করলেন।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদম (عليه السلام) কে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা তথা প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টিকারী। ৩
৩.সূরা বাকারা, আয়াত: ৩৫
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে জান্নাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্যে দেননি বরং তাদের উদ্দিষ্ট বাসস্থানে প্রেরণের একটি উপলক্ষ সৃষ্টির জন্য অবস্থান করতে দিয়েছিলেন। তাদের নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়াটা গুনাহ নয় বরং আল্লাহর উদ্দেশ্য পূরণের সহায়ক। যদিও বা বাহ্যিক দৃষ্টিকোণে আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে ইজতিহাদী ভুল বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এজন্যে হযরত আদম (عليه السلام)কে যেমন দোষারোপ করা যাবেনা অনুরূপ হযরত হাওয়া (عليه السلام) কেও দোষারোপ করা ঠিক হবে না।
নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য
____________________
নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য
কুরআন-হাদিসে নারী-পুরুষ সৃষ্টির যেমন উদ্দেশ্য উল্লেখিত হয়েছে মূলতঃ তা হলো মূল উদ্দেশ্য। এর বাইরেও আরো বহু উদ্দেশ্য নিহিত আছে। যেমন-
আল্লাহ তা‘আলা মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
আর আমি জ্বিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য। ৪
৪.সূরা যারিয়াত, আয়াত: ৫৬
এখানে ইনসানের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয় অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং বলা যায় যে, নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্যও আল্লাহর ইবাদত করা। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)র প্রতিটি আদেশ-নিষেধ পুরুষের পাশাপাশি নারীও অন্তর্ভূক্ত আছে। কেবল কিছু কিছু বিষয়ে নারীর সুবিধার্থে ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়।
মানব বংশ বিস্তারও নারী সৃষ্টির অন্যতম উদ্দশ্য। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা থেকে স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি তাদের দু’জন থেকে বহু নর-নারী বিস্তার করেছেন। আর আল্লাহকে ভয় কর যাঁর নামে তোমরা একে অপরকে যাচনা কর এবং সতর্ক থাকো জাতিবন্ধন সম্পর্কে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। ৫
৫.সূরা নিসা, আয়াত: ১
এই আয়াতটিতে মানব বংশের সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আয়াতটিতে তিনটি বিষয়ের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
এক. সকল মানুষ হযরত আদম (عليه السلام) থেকে সৃষ্ট।
দুই. হযরত হাওয়া (عليه السلام) কেও হযরত আদম (عليه السلام) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
তিন. সকল নর-নারী হযরত আদম (عليه السلام) ও হযরত হাওয়া (عليه السلام) থেকে সৃষ্ট।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَل ِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
হে মানব! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ এবং এক নারী থেকে। তারপর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা পরষ্পরে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সমস্ত খবর রাখেন। ৬
৬.সূরা হুজরাত, আয়াত: ১৩
সুতরাং একথা নির্বিঘ্নে বলা যায় যে, আজকের বিশাল পৃথিবীতে সম্প্রসারিত অগণিত মানব প্রজন্ম এবং কিয়ামত পর্যন্ত মানব বংশ বিস্তার হযরত আদম (عليه السلام) ও হাওয়া (عليه السلام)’র যুগল জীবনের ফসল আর মহান আল্লাহর অপার করুণা।
নারী সৃষ্টির আরো একটি উদ্দেশ্য হলো - পুরুষের একাকীত্ব দূরীভূত করা, তার সুখ-দুঃখের সঙ্গী হওয়া যা নারী সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় উল্লেখ হয়েছে।
তাছাড়া স্বামীর বিছানার সঙ্গী হওয়া, সন্তান জন্ম দেওয়া, সন্তানের লালন-পালন করা, স্বামীর ধন-সম্পদ, আসবাবপত্র সংরক্ষণ করা, পারিবারিক কাজ-কর্ম সম্পাদন করা, ভালকাজে স্বামীকে সহযোগীতা ও উৎসাহিত করা ইত্যাদি নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
ইসলাম পূর্বে নারী সমাজ
____________________
ইসলাম পূর্বে নারী সমাজ
ইসলাম নারী সমাজকে কী মর্যাদা দিয়েছে, কত উঁচু আসনে আসীন করেছে, কত অধিকারে অধিষ্টিত করেছে তা বুঝা ও অনুভব করার জন্য ইসলাম পূর্ব নারী সমাজের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা প্রয়োজন। দুঃখের দৃশ্য না দেখলে যেমন সুখের মূল্য বুঝা যায়না অন্য ধর্মের নারীর করুণ অবমাননা না জানলে ইসলামের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বুঝে আসবেনা। তাই বিশুদ্ধ হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, মৃত মানুষকে যখন কবরে রাখা হবে, তখন দুইজন ফেরেশতা এসে প্রশ্ন করবেন। প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে সে জান্নাতী বলে সাব্যস্থ হবে। তখন তাকে প্রথমে জাহান্নামের ভয়াবহ দৃশ্য দেখানো হবে আর তাকে বলা হবে এই জাহান্নামেই ছিল তোমার অবস্থান স্থল কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে তোমাকে তা পরিবর্তন করে জান্নাতকে তোমার স্থায়ী আবাসস্থল করে দিয়েছেন। তখন জাহান্নামকে তার চোখের সামনে এনে তাকে দেখানো হবে। এর উদ্দেশ্য হলো
জাহান্নামের ভয়ানক দৃশ্য দেখে যেন সে জান্নাতের মূল্যায়ন করতে পারে। তাই আমরা বিভিন্ন ধর্মে নারী সমাজের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করবো।
পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতা নারী জাতিকে কেবল ভোগ-বিলাসের নিষ্প্রান পণ্যে পরিণত করে নারীর মর্যাদা ও অধিকারকে ভূলুণ্টিত করেছে। পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য বলুন আর সমাজতান্ত্রিক পাশ্চাত্য, উভয় দলে নারী সমাজ দারুণভাবে অবহেলিত, অপদস্ত ও বঞ্চিত। উভয় সমাজেই নারীকে পুরুষের মনোরঞ্জন এবং পুরষালী দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধ্য করা হচ্ছে। অন্য দিকে তথাকথিত ধর্মগুলো তো নারীকে মানুষ হিসাবে মানতেই চায়না। কোন কোন ধর্মে নারীকে ‘সকল পাপের উৎস’ বলে ঘোষণা করেছে। আবার কোন কোন ধর্মে নারীর আত্মা আছে কিনা সন্দেহ পোষণ করে।
খ্রিস্টানদের বাইবেল, ইহুদীদের তৌরাত, বৌদ্ধদের ত্রিপটক, পারসিকদের জিন্দাবেস্তা, শিখদের গ্রন্থ সাহেব আর হিন্দুদের বেদ-ঋগবেদ বা গীতার কোথাও নারীদের অধিকার ও মর্যাদা সংক্রান্ত কোন আইন-কানুনের অস্থিত্ব নেই। এমনকি নারীদের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোন আলোচনা পর্যন্ত নেই। বরং নারী নির্যাতন ও নারীর অবমাননা এবং নারী লাঞ্চনার অপমানজনক ও লোমহর্ষক কাহিনী অথবা যৌন ব্যভিচারের অশ্লীল কাহিনী পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন ইতহিাসে মানুষের মধ্যে সর্বদা রক্তক্ষয়ী, যুদ্ধবিগ্রহ, দস্যুবৃত্তি, চুরি-ডাকাতি, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, নারী ও শিশু নির্যাতন দৃশ্যমান হয়। এসব ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা হলো মূখ্য। তাই পুরুষ জন্মগ্রহণ করলে তারা আনন্দিত হতো। আর ওইসব ক্ষেত্রে নারীর কোন ভূমিকা থাকেনা বরং তারা অসহায় ও পুরুষ নির্ভরশীল হয়ে থাকে। কোন নারীকে শত্রু পক্ষ বন্দী করলে ক্রীতদাসী বানিয়ে রাখে। তাই নারী সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তারা নাখোশ হতো, অপমানবোধ করতো এবং দুঃশ্চিন্তায় ভোগতো। তারা নারীকে সমাজে পুরুষের উপর বোঝা মনে করতো।
চীন সমাজে নারী
____________________
চীন সমাজে নারী
চীনে নারীর সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নিকৃষ্ট। চীনারা তাদের নারীদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতো। এক চীনা মহিলা বলেন- “আমাদের স্থান হচ্ছে মানবতার সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান এবং এজন্যেই আমাদের অংশে এসেছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কর্ম”। তারই এক নীতিকথা এখানে উল্লেখযোগ্য- ‘নারী কতো হতভাগিনী’। পৃথিবীতে তার মতো মূল্যহীন দ্রব্য আর কিছু নেই। ছেলেরা তার সামনে এসে এমনভাবে দাঁড়ায় যেন তারা আকাশ থেকে আগত কোন দেবতা। অধিকন্তু মেয়েদের জন্মমুহুর্তেও আনন্দের সানাই বাজে না। যখন তারা বড় হয়ে উঠে তখন তাদেরকে বদ্ধ ঘরে লুকিয়ে রাখা হয় যেন কোনো মানুষ তাকে দেখতে না পায়। যখন সে নিজ গৃহ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় তখন তার জন্যে দু’ফোটা অশ্রুজল ফেলার মতো কেউ থাকেনা। ৭
৭.‘কিসসাতুল হামারার চীন সভ্যতা’ শীর্ষক অধ্যায় থেকে গৃহীত, পৃ. ২৮৩, সূত্র. , ইসলামে নারী, পৃ. ১৬-১৭
প্রাচীন হিন্দু ধর্মে নারী
____________________
প্রাচীন হিন্দু ধর্মে নারী
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে মনু স্মৃতির অধ্যয়নে জানা যায় যে, মনু যখন নারী সৃষ্টি করেছিল তখন সে নারীকে পুরুষের প্রতি প্রেম, রূপ চর্চা, যৌন ব্যবিচারে লিপ্ত থাকা এবং ক্রেধের প্রবণতা দানকারিণী রূপে সৃষ্টি করে এবং মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে নারীকে নিকৃষ্টতম ব্যবহারের উপযুক্ত বলে ঘোষণা করে। সুতরাং হিন্দু সমাজে এই ধারণা প্রসিদ্ধ লাভ করে যে, নারী হচ্ছে নোংরামীর মূল এবং তার অস্তিত্ব হচ্ছে পুরোপূরি নরক। ৮
৮.বিশ্ব ইতিহাস, পৃ. ৩৯৪, সূত্র. আলবাহী আল খাওলী, ইসলামে নারী, পৃ.১৭
প্রাচীন হিন্দু সমাজে রীতি ছিল যে, স্বামী মৃত্যুবরণ করলে স্ত্রীকে জীবন্ত আগুনে মৃত স্বামীর সাথে জ্বলে পুড়ে মরতে হতো। এটাকে সতীদাহ প্রথা বলা হতো। পরবর্তীতে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় তা রহিত হয়েছে।
গ্রিস সভ্যতায় নারী
____________________
গ্রিস সভ্যতায় নারী
প্রাচীন গ্রিস সমাজের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে নারীর কোন ভূমিকা ছিলনা এবং নারী ছিল সম্পর্ণরূপে সমাজ বিচ্ছিন্ন। নারীকে একান্ত অর্থহীন দ্রব্যের মতো ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্ধ করে রাখা হতো। এমনকি বড় বড় গ্রিক দার্শনিক ও চিন্তাবিদরাও মনে করতেন যে, নারীর অস্তিত্বের মতো নারী নামটাকেও যেন বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়। ৯
৯.গ্রিক ইতিহাস, পৃ. ১১৪-১১৭, সূত্র. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮
প্রখ্যাত গ্রিক চিন্তাবিদ ডেমোস্তিন বলেন- “আমরা যৌন তৃপ্তি অর্জনের জন্য বেশ্যালয়ে যাই এবং আমাদের দৈনন্দিন কর্মসূচী তৈরী করে থাকে বালিকা বন্ধুরাই আর আমরা কেবল আইনগতভাবে সন্তান উৎপাদনের জন্যেই স্ত্রী গ্রহণ করি।
রোমান সভ্যতায় নারী
____________________
রোমান সভ্যতায় নারী
রোমান সভ্যতাকে পাশ্চাত্য পদ্ধতির গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয়। সেখানে পরিবারের প্রবীন পুরুষই ছিল ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরু। নারীর কোন গুরুত্ব, অধিকার বা মর্যাদা স্বীকৃত ছিলনা। কোন রকমের আইনগত অধিকার থেকেও নারী ছিল বঞ্চিত। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু ও পাগলের ন্যায় নারীকেও মনে করা হতো অযোগ্য ও অক্ষম। নারী হয়ে জন্ম নেওয়াই ছিল তার অযোগ্যতার সর্বাপেক্ষা বড় প্রমাণ। এমনকি পিতার কাছ থেকে বিয়ের সময় যৌতুক হিসাবে কিংবা ওয়ারীশ হিসাবে পাওয়া সম্পত্তিতেও নারীর কোন অধিকার ছিল না। স্বামীর ঘর করার সাথে সাথে স্ত্রীর সব ব্যক্তিগত সম্পদও স্বামীর মালিকানায় চলে যেতো। রোমান নারী আদালতে বিচার প্রার্থনার অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল, এমনকি তার সাক্ষ্য দেওয়ার অধিকার ছিলনা।
রোমান সমাজে ‘সর্দারী বিয়ে’ নামে এক ধরণের বিয়ের প্রথা ছিল। কোন নারীর উপর সর্দারের নজর পড়লে সে তার স্ত্রী হয়ে যেতো এবং সাবেক পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যেতে হতো। সেই স্ত্রী কোন অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সর্দার তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অধিকারও রাখতো। কোন মহিলার স্বামী মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী ছেলেদের উত্তরাধিকারে পরিণত হতো। যদি পুত্র সন্তান না থাকতো তাহলে বিধবা মহিলাটি স্বামীর ছোট ভাই বা চাচার অধিকারে চলে যেতো।
ইহুদি ধর্মে নারী
____________________
ইহুদি ধর্মে নারী
ইহুদিদের মধ্যেও একদল বোনকে তার ভাইয়ের সমান অধিকার ও মর্যাদা দিতে সম্মত ছিল না। ইহুদি সমাজে নারীর মান ছিল নিছক সেবিকার সমান। নারীদেরকে তাদের ভাইদের ন্যায় সম্পত্তির উত্তরাধিকারের অংশ দেওয়া হতোনা এবং পিতা তার প্রাপ্ত বয়স্ক কিংবা অপ্রাপ্ত মেয়েকে বিক্রি করে দেওয়ার অধিকার রাখতো।
খ্রিস্ট ধর্মে নারী
____________________
খ্রিস্ট ধর্মে নারী
খ্রিস্টান পাণ্ডিতরা তাদের ধর্মগ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে প্রচার করে যে, “নারীকে লজ্জায় মরে যাওয়ার জন্যে এতটুকু কথাই যথেষ্ট যে, সে নারী। তাছাড়া মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানোর মতো অবমাননার কারণও এই নারী। তাদের মতে নারী হচ্ছে নরকের দরজা এবং পাপের প্রতিমা।” তারা মনে করে ‘নারী হচ্ছে শয়তানের সন্তান।” তারা আরো বলেছে- “নারীদের উপর অভিশাপ করা অপরিহার্য, কারণ বিপথগামিতার আসল কারণ তারাই।” খ্রিস্টান পাদ্রিদের শংকা ছিল যে, নারীরা কি পুরুষদের মতো খোদার উপসনা করতে পারবে? নারী কি স্বর্গে যেতে পারবে? নারীর মধ্যে কি মানবিক আত্মা আছে? নাকি তারা ভৌতিক জীবন-যাপন করে? এই ছিল খ্রিস্টান ধর্মে নারী সম্পর্কে ধারণা।
বৌদ্ধ ধর্মে নারী
____________________
বৌদ্ধ ধর্মে নারী
বৌদ্ধ ধর্মে নারীর অবস্থা ছিল অত্যন্ত হীন ও তুচ্ছ। বুদ্ধদেব স্বয়ং স্ত্রী পুত্র, সংসার পরিত্যাগ করে সন্যাসী জীবন-যাপন করেন। নারীদেরকে তিনি মোহের বাস্তব স্বরূপ ও মানবাত্মার নির্বাণ লাভে বিঘ্ন বলে মনে করতেন। বৌদ্ধরা নারীকে সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখতো। নারীরা পূজা-অর্চনায় যোগদান কিংবা স্বাধীনভাবে ধর্মালোচনা করতে পারতো না। মন্দিরে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
জাহেলী যুগে নারী
____________________
জাহেলী যুগে নারী
জাহেলী যুগে আরব দেশে নারী ছিল নির্যাতিত, নিপীড়িত ও ঘৃণিত। কারো ঘরে নারী জন্ম হওয়ার সংবাদ পেলে তারা দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তো। লজ্জায় সমাজে মুখ দেখাতো না এবং এই মেয়েকে কী করবে তা নিয়ে ভারী দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যেতো। অনেক ক্ষেত্রে রাতের বেলা কন্যা সন্তান জন্ম হলে সকালে জানাজানি হওয়ার আগে রাতের বেলাই জীবন্ত দাফন করে দিত। এদিকে ইঙ্গিত করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُو َكَظِيمٌ يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
আর যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখ কাল হয়ে যায় এবং সে যেন তিক্ত ঢোক গিলে নিতো। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকে। সেভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে (কন্যাকে) বেঁচে থাকতে দেবে, না তাকে মাটির নীচে পুঁতে ফেলবে। সাবধান!তাদের সিদ্ধান্ত খুবই নিকৃষ্ট। ১০
১০.সূরা নাহাল, আয়াত: ৫৮-৫৯
আরবে এই প্রথাও ছিল যে, যখন কোনো স্ত্রীর স্বামী মারা যেতো তখন তার বড় ছেলে দাঁড়িয়ে যেতো এবং তার পিতার স্ত্রীকে যদি নিজের জন্যে প্রয়োজন মনে করতো তাহলে তার ওপর নিজের জামা ছুঁড়ে মারতো আর এভাবে সেই বিধবা তার একান্ত মালিকানায় এসে যেতো।
ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান বলেন, “অরাজকতাপূর্ণ আরবদেশে নারীর কোন সামাজিক মর্যাদা ছিলনা; তাহারা অস্থাবর ও ভোগবিলাসের সামগ্রীরূপে গণ্য হইত। বৈবাহিক বন্ধনের পবিত্রতা ক্ষুন্ন করিয়ে পুরুষগণ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ ও বর্জন করিতে পারিত এবং অবৈধ প্রণয়ের মত বিবেকবর্জিত কার্যেও তাহারা লিপ্ত হইত। অপরদিকে নারীরাও একই সঙ্গে একাধিক স্বামী গ্রহণ করিত। বহুপতি গ্রহণের ঘৃণিত প্রথা পরবর্তীকালে পুরুষ প্রধান সমাজে বিলুপ্ত হইয়া পড়ে। ব্যভিচার সমাজ জীবনকে পাপ-পঙ্কিলতার শেষ স্তরে এরূপ নিমজ্জিত করে যে, স্বামীর অনুমতিক্রমে স্ত্রী পুত্র সন্তান লাভের আশায় পর পুরুষের সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হইত। সম্পত্তি ভোগ করিবার অধিকার নারীর ছিলনা। কারণ, মৃত পিতা অথবা স্বামীর সম্পত্তির অংশ হইতে তাহারা বঞ্চিত ছিল। নারীদের প্রতি গৃহপালিত পশুর মত ব্যবহার করা হইত। অভিজাতবর্গ দ্রুতগামী অশ্বের লেজের সঙ্গে জীবন্ত নারীকে বাঁধিয়া খেলাচ্ছলে টানিয়া লইয়া যাইত; ইহার ফলে হতভাগ্য নারীর জীবনাবসান হইত।
প্রাক-ইসলামী সমাজ জীবনের সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য প্রথা ছিল নবজাত শিশু সন্তানকে নিষ্ঠুরভাবে জীবন্ত কবর দেওয়া। কন্যা সন্তানের জন্মকে আরববাসীরা অভিশপ্ত ও লজ্জাকর মনে করিত এবং কুসংস্কার ও কখনও কখনও দারিদ্রের কাষাঘাতে জীবন্ত সমাধি দিতে কুণ্ঠিত হইত না। কুরআন শরীফে তাই বলা হইয়াছে “দারিদ্রের ভয়ে তুমি তোমার সন্তানদিগকে হত্যা করিও না। আমি তাহাদের এবং তোমার জীবিকা সরবরাহ করিয়া থাকি। নিশ্চয় তাহাদের হত্যা করা মহাপাপ।” কায়েস বিন আসিম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে ৫ কিংবা ৬ বৎসর বয়স্ক দশটি কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেন।
অনাচার, নৈতিক অবনতি, ব্যভিচার আরব সমাজকে কলুষিত করে। লম্পট ও দুশ্চরিত্র আরব পিতার মৃত্যুর পর বিমাতাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করিত। সম্ভবত এরূপ ব্যভিচারমূলক বিবাহ প্রথা তৎকালীন বিশ্বে ছিল কিনা সন্দেহ। স্বামীর মৃত্যুর পর তাহার নিকটবর্তী কোন আত্মীয়ের সঙ্গে স্ত্রীর পুণর্বিবাহ হইত। মদ্যপান, জুয়াখেলা, লুঠতরাজ, নারী হরণ, কুসিদ প্রথা প্রভৃতি চরম নৈতিক অধঃপতনের স্বাক্ষর তাহাদের মধ্যে বিরাজমান ছিল। ১১
১১.ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, ইসলামের ইতিহাস, পৃ. ৫০-৫১
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা নারী জাতির নির্মম দুরাবস্থার করুণ চিত্র অনুমান করতে পারি এবং নারী সম্পর্কে অতীত যুগের নিন্মোক্ত ভ্রান্তিগুলোবুঝতে পারি।
১.পুরুষের দৃষ্টিতে নারীর কোন মানবিক মান-মর্যাদা ছিলনা।
২.সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার কোনো অবকাশ ছিলনা।
৩.নারীর অধিকার আদায়ের কোন চেষ্টা-সাধনা ছিলনা।
৪.নারীর জন্য পৃথক কোনো কর্মক্ষেত্রেও ছিলনা।
৫.নারীর উপসনা করার অধিকার ছিলনা। এমনকি তারা মন্দিরে কিংবা উপসনালয়ে প্রবেশের অধিকার ছিলনা।
৬.নারীকে আত্মাহীন জন্তু মনে করা হতো।
৭.স্বামীর কাছে স্ত্রীর মর্যাদা পেতোনা বরং ক্রীতদাসীর চেয়ে নিকৃষ্টতর মনেকরতো।
৮.নারী কোন বস্তুর মালিক হতে পারতো না।
৯.উত্তরাধিকারের কোন অংশ তার কপালে ছিলনা।
১০.কোন প্রকারের ক্রয়-বিক্রয় করার ক্ষমতা ছিলনা।
১১.নারীকে মনে করতো সকল পাপের উৎস।
১২.নারী হয়ে জন্ম নেওয়াটাই ছিল তার বড় অপরাধ।
১৩.কেবল পুরুষের অধীনস্থ হয়ে লাঞ্চিত ও বঞ্চিত অবস্থায় জীবন-যাপনের জন্যেই তার সৃষ্টি।
১৪.পুরুষের নিকট তারা যেন পণ্য সামগ্রী।
১৫.নারী হচ্ছে নরকের দরজা এবং পাপের প্রতিমা।
১৬.নারী জাতি স্বর্গে যেতে পারবে না।
১৭.পৃথিবীতে নারীর মতো মূল্যহীন দ্রব্য আর কিছু নেই।
১৮.স্ত্রীর নিকট স্বামী যেন তার প্রভু।
১৯.স্বামীর সাথে খাবার গ্রহণ করার অধিকার তার নেই বরং স্বামীর উচ্ছিষ্ট সে খেতে পারবে।
২০.আদালতে বিচার প্রার্থনার অধিকার ছিলনা এমনকি সাক্ষী দেওয়ার অধিকারও ছিলনা।
২১.কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবরস্থ করা হতো।
২২.নারীদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও পুরুষের করুণার উপর নির্ভরশীল ছিল।
ইসলামে নারীর মর্যাদা
____________________
ইসলামে নারীর মর্যাদা
এতক্ষণ আমরা ইসলামপূর্ব ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দৃষ্টিকোণে নারীর অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এখন পবিত্র ইসলামের আলোকে নারীর মান-মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করবো।
আজ থেকে প্রায় দেড়হাজার বছর পূর্বে মানবতার অগ্রদূত, নারী জাতির মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) সর্ব প্রথম নারীর যথাযোগ্য মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে নারীজাতির পূর্ণ মানবিক অধিকার, মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। আর সর্বাগ্রে ইসলামের আদর্শ গ্রহণ করে ইসলাম গ্রহণ করেন একজন মহিয়সী নারী হযরত খদীজাতুল কুবরা (رضي الله عنه)। ইসলামে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) । পবিত্র কুরআনে একটি বৃহৎ সূরার নাম সূরা ‘নিসা’ রাখা হয়েছে অথচ পুরুষের নামে কোন সূরা নেই। ইসলাম নারী জাতিকে মানবিক উন্নতি-প্রগতির আসল বুনিয়াদ বলে ঘোষণা করে। ইসলাম ঘোষণা করে যে, “নারী পুরুষের মতোই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ”, বরং নারীকে তার নারীত্বের কারণে পুরুষের চেয়েও বেশী মর্যাদার অধিকারী করে ঘোষনা করেছে। ইসলাম নারীর স্বভাব প্রকৃতির আলোকে তার ন্যায্য মান, দায়িত্ব ও কর্মক্ষেত্রেও নির্ধারণ করে দেয়। ইসলাম নারীকে সব ধরণের অন্যায় বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে স্বাধীন, সক্ষম, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। নারী-পুরুষ একে অপরের বন্ধু ও সহায়ক বলে ঘোষণা দেয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু-সহায়ক। তারা ভালকাজের আদেশ দেয় আর মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য করে। এদের উপর আল্লাহ তা‘আলা রহমত নাযিল করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, সুকৌশলী। ১২
১২.সূরা তাওবাহ, আয়াত: ৭১
যেখানে পূর্ববর্তী যুগে বা ধর্মে নারীকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দেয়নি সেখানে ইসলামে নারীকে পুরুষের বন্ধু ও সহায়ক বলে সমান সম্মানের অধিকারী করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ
নারীরা তোমাদের পুরুষদের পোশাক আর তোমরা নারীদের পোশাক। ১৩
১৩.সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭
এখানে নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিচ্ছদ বলে উভয়কে সমান অধিকার ও সমমান দান করা হয়েছে। মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (رحمة الله) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন- এখানে নারী-পুরুষ একজন অপরজনের লিবাস বলার কারণ হলো-
১.স্বামী-স্ত্রী মিলনের সময় পরস্পর পরস্পরের সহিত এভাবে মিলে যায় যেভাবে পোশাক শরীরের সাথে মিলে যায়।
২.স্বামী স্ত্রীর এবং স্ত্রী স্বামীর গোপনীয়তা এমনভাবে লুকায় যেমন পোশাক শরীরকে লুকায়।
৩.স্ত্রী স্বামীর জন্য এমনভাবে নির্দিষ্ট হয় যেমনিভাবে শরীরের জন্য তার পোশাক।
৪.স্বামী স্ত্রীর এবং স্ত্রী স্বামীর দোষ-ত্রুটি এমনভাবে গোপন করে যে, যেমনিভাবে পোশাক শরীরের দোষ-ত্রুটিকে গোপন করে।
৫.স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি এমন মুখাপেক্ষী যে, যেমন সব মৌসুমে পোশাকের মুখাপেক্ষী।
৬.স্ত্রীর কারণে স্বামী এবং স্বামীর কারণে স্ত্রী সর্বপ্রকার বদনামী ও অপবাদ থেকে রক্ষা পায়। অথবা পরস্পর পরস্পরের জন্য প্রশান্তি। ১৪
১৪.তাফসীরে নঈমী, খণ্ড.২, পৃ. ২৫২
অর্থাৎ উপরোক্ত বিষয়সমূহে নর-নারী উভয়কে সমান গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর নবুয়তের যবানে ঘোষণা করেছেন-
حُبِّبَ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا النِّسَاءُ وَالطِّيبُ، وَجُعِلَ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلَاةِ
পৃথিবীর যাবতীয় সামগ্রী থেকে আমার নিকট প্রিয় বানানো হয়েছে নারী, সুগন্ধি এবং নামাযের মধ্যে আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে। ১৫
১৫.ইমাম নাসাঈ র. (৩০৩ হি.) নাসাঈ শরীফ, খণ্ড.২, পৃ. ৯৩
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দুনিয়ার মধ্যে তিনটি জিনিসকে ভালবাসতেন।
الطَّعَامُ وَالنِّسَاءُ وَالطِّيبُ فَأَصَابَ اثْنَيْنِ وَلَمْ يُصِبْ وَاحِدًا أَصَابَ النِّسَاءَ وَالطِّيبَ وَلَمْ يُصِبِ الطَّعَامَ.
খাদ্য, নারী ও সুগন্ধি। এর মধ্যে তিনি দু’টি লাভ করেছিলেন, আর একটি লাভ করেন নি। লাভ করেছিলেন নারী ও সুগন্ধি আর লাভ করেননি খাদ্য। ১৬
১৬.আহমদ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ৪৪৯
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
الدُّنْيَا كُلُّهَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَة الصَّالِحَة
বিশ্ব ভূমণ্ডল পুরোটাই হলো সম্পদ। আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো সতী-সাধ্বী নারী। ১৭
১৭.ইমাম মুসলিম ইবনে হুজ্জাজ কুশাইরী র.(২৬১হি.), সহীহ মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; ২৬৭
আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنْثَى
(কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোন কোন) পুরুষ নারীর সমকক্ষ নয়।১৮
১৮.সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩৬
অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রে যেমন- ইবাদত-বন্দেগী ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে অনেক নারী পুরুষের অগ্রগামী।
জন্মগত মর্যাদা
____________________
জন্মগত মর্যাদা
ইসলাম নর-নারী উভয়কে জন্মগত দিক দিয়েও সমান মর্যাদায় আসীন করেছে। পুরুষের যেভাবে পৃথিবীতে জন্ম নেয়ার অধিকার রয়েছে অনুরূপ নারীরও পৃথিবীতে আগমনের অধিকার রয়েছে। উভয়ের জন্মগ্রহণের ধরনও এক রকম। সৃষ্টিকর্তা এর মধ্যে কোন পার্থক্য রাখেন নি। পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে নিরাপত্তার সাথে বসবাস করার অধিকারও উভয়ের ক্ষেত্রে সমান এবং উভয়ের স্রষ্টাও এক। এখানে বান্দার কোন হাত নেই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
لِلّٰهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা‘আলারই। তিনি যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছ বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল। ১৯
১৯.সূরা আশ শুরা, আয়াত: ৪৯-৫০
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সন্তানের প্রকার বর্ণনায় প্রথমে কন্যা সন্তানের উল্লেখ করেছেন, আর পরে পুত্র সন্তানের উল্লেখ করেছেন। এ ইঙ্গিত দৃষ্টে হযরত ওয়াছেলা ইবনে আসকা (رضي الله عنه) বলেন, যে নারীর গর্ভ থেকে প্রথমে নারী সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, সে পূণ্যময়ী। ২০
২০.ইমাম কুরতুবী র. (৬৭১ হি.) তাফসীরে কুরতুবী
বিশ্বাস, ইচ্ছাবোধ, অনুভূতি, কর্মস্পৃহা, প্রজ্ঞা, মেধা, জ্ঞান, বিবেক ও সত্তার দিক দিয়ে নারী আর পুরুষের মধ্যে কোন বিভেদ করা হয়নি। এভাবে ইসলাম নারীর মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত করেছে।
দুনিয়ার সব মানুষই একজন পুরুষ ও একজন নারীর যৌন মিলনের মাধ্যমে সৃষ্ট, কেবল হযরত ঈসা (عليه السلام) ব্যতীত। তিনি শুধু আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে পিতা বিহীন মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মানব সমাজ বিকাশে নারীর অবদানই বেশী পরিলক্ষিত হয়। কারণ পিতা ছাড়া সন্তান জন্ম হয়েছে কিন্তু মাতা ছাড়া সন্তান জন্ম হওয়ার কোন নজীর নেই।
মানব বংশ বিস্তারে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান সমান। কারণ পুরুষের শুক্রানু ও নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে ভ্রুণের সৃষ্টি হয। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى
হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয় আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। ২১
২১.সূরা হুজরাত, আয়াত: ১৩
অতএব, তারা পৃথিবীতে পুরুষের ন্যায় খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ, মতামত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার রাখে তবে দৈহিক ও সৃষ্টিগত এবং তাকওয়ার ভিত্তিতে উভয়ের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা অস্বীকার করার কারো সুযোগ নেই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ
পুরুষ নারীদের উপর কর্তা- এ জন্য যে, আল্লাহ তাদের মধ্যে এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ জন্য যে, পুরুষগণ নারীদের জন্য নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করেছে। ২২
২২.সূরা নিসা, আয়াত: ৩৪
জাহেলী যুগে নারীদের সমাজে কোন স্থান ছিলনা। নারী জাতি ছিল তখন বাজারের পণ্য। তাদেরকে গৃহস্থলীর সাধারণ উপকরণ মনে করা হতো। তারাও যে মানুষ একথা ভাবাই অন্যায় ছিল। পুরুষরা নারীদের উপর যখন-তখন যথায়-তথায় নির্মম নির্যাতন করতো। তারা যেন গৃহপালিত পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট ছিল। নারীদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও পুরুষের করুণার উপর নির্ভর করতো। যে কোন সময় যে কোন নারীকে যখন ইচ্ছা অপরের হাতে হস্তান্তর করতো। কন্যা সন্তান ছিল তাদের বীরত্বের কলংক। যত্র-তত্রলুণ্ঠন হতো নারীর মান-সম্ভ্রম। অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর মতো নারীরাও মক্কার বাইরে রপ্তানী হতো। অবস্থাসম্পন্ন ধনী লোকেরা এদেরকে ক্রয় করে নিয়ে গিয়ে দাসী বানিয়ে রাখতো। প্রভুরা তাদের সাথে পশুর ন্যায় আচরণ করতো। অত্যাচার অবিচার পাওনা ছিল নারীদের নিয়মিত হোমওয়ার্ক। লাঞ্চনা ছিল তাদের কাজের পুরস্কার। মনের ইচ্ছায় বিনা কারণে তারা নারীদেরকে প্রহার করতো। প্রত্যেহ নিত্য নতুন শাস্তির সম্মুখীন হতো নারীরা। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে কঠোর পরিশ্রম করানো হতো তাদের দিয়ে। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে প্রচণ্ড মার-ধর সহ্য করতে হতো। প্রহারের প্রচণ্ডতায় শরীর থেকে কাপড় খুলে গেলেও ঐ পাষাণ্ডদের অন্তরে মমতাবোধ জাগ্রত হতো না। শরীর ক্ষত-বিক্ষত হলেও কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো না। তাদের বর্বরতা সহ্য করতে না পারলে দু’চোখে অশ্রু বর্ষণ করতে চাইলেও পারতো না। কারণ চোখে পানি দেখলে মনিবরা আরো হিংস্র হয়ে উঠতো। দিনের বেলা পরিশ্রমের ঘানি থাকতো তাদের কাঁধে আর রাতের বেলা হতো প্রভুর শয্যাসঙ্গিনী। এমনকি প্রভুর বন্ধুদেরও প্রমোদবালা হতে হতো। পিতার মৃত্যুর পর সৎ মাকে তারা বিয়ে করতে পারতো। স্বামীর সম্পত্তি থেকে স্ত্রী, পিতার সম্পত্তি থেকে মেয়ে বঞ্চিত হতো। তাদের খাদ্য তালিকা ছিল স্বতন্ত্র। কোন কোন খাদ্য পুরুষরা খেতে পারলেও নারীরা তা খেতে পারতো না। নারীদের জন্য মৃত জন্তু হালাল বলা হতো। নারীদের মর্যাদা শূন্যের কোঠায় ছিল বলে তাদের সাথে এরূপ আচরণ করা হতো।
উক্ত আয়াতে পুরুষকে নারীর উপর দু’স্তর বেশী মর্যাদার অধিকারী করা হয়েছে। একটা হচ্ছে সত্তাগত অর্থাৎ কর্মক্ষমতা ও শক্তিশালী হওয়ার দিক থেকে আর অপরটি হলো বাহ্যিক তথা পুরুষ নারীর ভরণ-পোষণ ও যাবতীয় প্রয়োজন নিজের উপার্জন কিংবা স্বীয় সম্পদ দ্বারা পূরণ করে থাকে। প্রথমটি হলো- আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত ও নির্ধারিত আর দ্বিতীয়টি হলো নিজস্ব।
মনে রাখতে হবে যে, সাধারণভাবে পুরুষজাতি নারীজাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তবে প্রতিটি পুরুষ প্রতিটি নারী অপেক্ষা উত্তম নয়। কারণ বহু নারী আছেন যারা বহু পুরুষ থেকে উত্তম।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ
আর নিশ্চয় স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর যেমনিভাবে পুরুষদের অধিকার রয়েছে স্ত্রীদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। তবে নারীদের উপর পুরুষের মর্যাদা এক স্তর বেশী। ২৩
২৩.সূরা বাকারা, আয়াত: ২২৮
উক্ত আয়াতে নারীদের অধিকারের কথা পুরুষের অধিকারের পূর্বে বলা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে যে, পুরুষরা নিজের ক্ষমতায় ও খোদা প্রদত্ত মর্যাদার বলে নারীর কাছ থেকে স্বীয় অধিকার আদায় করে নিতে সক্ষম কিন্তু নারীরা শারিরীকভাবে ও প্রকৃতিগতভাবে পুরুষ অপেক্ষা দুর্বল হওয়ার কারণে তারা পুরুষদের কাছ থেকে অনেক সময় নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ে অক্ষম হয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের অধিকারের কথা প্রথমে উল্লেখ করেছেন। আবার সাথে নারীর উপর পুরুষের প্রাধান্যের কথাও উল্লেখ করে দিয়েছেন।
কর্মগত সমমর্যাদা
____________________
কর্মগত সমমর্যাদা
আল্লাহ তা‘আলা নারী ও পুরুষের মধ্যে কর্ম ও কর্তব্যবোধে কোন তারতম্য রাখেন নি। প্রত্যেক নিজ নিজ যোগ্যতানুসারে কর্ম, কর্তব্য ও ইবাদত পালনে সমানভাবে বাধ্য। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ
প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী। ২৪
২৪.সূরা মুদ্দাসসির, আয়াত: ৩৮
অর্থাৎ নারী-পুরুষ প্রত্যেকের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কিয়ামত দিবসে জিজ্ঞাসিত হবে। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য পুরস্কৃত এবং অবহেলার জন্য তিরস্কৃত ও শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলাও নারী হোক কিংবা পুরুষ হোক কারো আমল বিফল করেন না বরং উভয়ের আমলের মূল্য ও প্রতিদান আল্লাহর কাছে সমান। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ
অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের আহবানে সাড়া দিলেন (আর বললেন) আমি তোমার মধ্যে কোন কর্মনিষ্ঠ নর বা নারীর কর্মকে বিফল করিনা, তোমরা পরস্পর পরস্পরের অংশ বিশেষ। ২৫
২৫.সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯৫
অর্থাৎ আমল কবুল হওয়ার দিক দিয়ে এবং এর প্রতিদান পাওয়ার ক্ষেত্রে নর-নারী আল্লাহর নিকট একসমান।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرً
আর পুরুষ কিংবা নারী যে কোন মু’মিন কোন ভাল কাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি বিন্দু পরিমান অন্যায় করা হবেনা। ২৬
২৬.সূরা নিসা, আয়াত: ১২৪
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
নর হোক কিংবা নারী হোক যে কেউ মু’মিন অবস্থায় ভাল কাজ করবে, তবে তাকে আমি অবশ্যই উন্নত ও পবিত্র জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করবো এবং অবশ্যই আমি তাদের উত্তম কৃতকর্মের প্রতিদান দান করবো।
সুতরাং কর্ম ও কর্তব্যবোধ এবং প্রতিদান পাওয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম নারী-পুরুষকে সমান মর্যাদায় আসীন করেছে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا
নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারী, মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ ও রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নারী তাদের সকলের জন্যে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা ও মহান প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন। ২৭
২৭.সূরা আহযাব, আয়াত: ৩৫
এখানে পুরুষের জন্য কোন পৃথক কিংবা উন্নতমানের আর নারীর জন্য নিম্নমানের প্রতিদানের কথা উল্লেখ নেই বরং উভয়ের ক্ষেত্রে সমান প্রতিদানের কথা বর্ণিত হয়েছে। এরূপ আরো আয়াতে এ ধরণের সমতা ও মর্যাদার কথা উল্লেখিত হয়েছে।
তাকওয়া ভিত্তিক সমমর্যাদা
____________________
তাকওয়া ভিত্তিক সমমর্যাদা
তাকওয়া মু’মিন নর-নারীর এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষেত্রেও ইসলাম নারীকে পুরুষের সমমর্যাদা দান করেছে। তাকওয়া দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য ও আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান হওয়া যায়। যেমন পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে-
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ
তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট তার মর্যাদা সবচেয়ে বেশী তোমাদের মধ্যে যে সর্বশ্রেষ্ঠ মুত্তাকী। ২৮
২৮.সূরা জাসিয়া, আয়াত: ১৯
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন-
اللَّهُوَلِيُّ الْمُتَّقِين
তাকওয়া অর্জনকারীগণ আল্লাহর বন্ধু। ২৯
২৯.সূরা হুজরাত, আয়াত: ১৩
অর্থাৎ তাকওয়ার ব্যাপারেও ইসলাম নর-নারীর মধ্যে কোন ধরণের প্রভেদ রাখেনি; বরং উভয় সমমর্যাদার অধিকারী। আল্লাহর নিকট মর্যাদাশীল হওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই বরং তাকওয়াই হলো শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি।
শাস্তির বিধানের ক্ষেত্রে সমমর্যাদা
____________________
শাস্তির বিধানের ক্ষেত্রে সমমর্যাদা
ইসলামে শাস্তির বিধানের ক্ষেত্রেও নারীকে পুরুষের সমমর্যাদা দেয়া হয়েছে। পুরুষের শাস্তির বিধান একরকম এবং নারীর শাস্তির বিধান অন্য রকম এরূপ নয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللهِ
ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী, তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে অভিভূত না করে। ৩০
৩০.সূরা নূর, আয়াত: ২
অনুরূপ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا
যে পুরুষ ও নারী চুরি করবে তাদের হাত কেটে দাও। ৩১
৩১.সূরা মায়িদাহ, আয়াত: ৩৮
গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকার জন্যে নর-নারী উভয়কে পাশাপাশি আদেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ। তিনি ইরশাদ করেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللّٰهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ
হে নবী! আপনি মু’মিন পুরুষদেরকে আদেশ দিন, যেন তারা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গ সংরক্ষণ করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্রতা। তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা অবহিত। আর আপনি আদেশ দিন, মু’মিন রমনীদেরকে তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে। তারা সাধারণত যা প্রকাশ করে থাকে, তা ব্যতিত তাদের আবরণ প্রদর্শন না করে তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত থাকে। ৩২
৩২.সূরা নূর, আয়াত: ৩০-৩১
ঈমান, আমল ও ইবাদতে সমমর্যাদা
____________________
ঈমান, আমল ও ইবাদতে সমমর্যাদা
ইসলামে ঈমান, আমল ও ইবাদতেও নর-নারীকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, সকল নবী-রাসূল, পরকাল, তাকদীর, মৃত্যুর পর পুণঃজীবনলাভ, জান্নাত, জাহান্নাম, কবর আযাব ইত্যাদি ঈমান-আকীদা এবং নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতসহ যাবতীয় আমল-ইবাদতের বেলায়ও নারী-পুরুষ সমানভাবে আদিষ্ট। ঈমান, আমল ও ইবাদত দ্বারা অনেক সময় একজন নারী একজন পুরুষকেও অতিক্রম করে যেতে পারে। আল্লাহর কাছে উত্তম কর্ম তথা ইবাদতই গ্রহণযোগ্য। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
তিনিই আল্লাহ, যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃজন করেছেন যেন তোমাদের কার কর্ম উত্তম তা জেনে নিতে পারেন। ৩৩
৩৩.সূরা মূলক, আয়াত: ২
কুরআন-হাদিসে যেসব স্থানে আদেশ-নিষেধ সূচক শব্দে কিংবা যেসব শব্দ দ্বারা বিধি-বিধান আবশ্যক হয় তা যদিও পুংলিঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে তবুও তাতে স্ত্রী লিঙ্গ নিহিত রয়েছে। অলংকার শাস্ত্রের নিয়ামানুযায়ী তাগলীবের ভিত্তিতে পুংলিঙ্গ ব্যবহার হয়েছে মাত্র। নতুবা বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে উভয় অন্তর্ভূক্ত। অতএব, ইসলাম ঈমান, আমল ও বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমমর্যাদায় আসীন করেছে। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর প্রকৃতিগত কারণে এবং নারীর স্বার্থে কিছুটা ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় যা পরে আলোচনা করা হবে।
বিবাহ-শাদীর ক্ষেত্রে সমমর্যাদা
____________________
বিবাহ-শাদীর ক্ষেত্রে সমমর্যাদা
আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে প্রত্যেক বস্তুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ
আর প্রত্যেক বস্তুকে আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি।৩৪
৩৪.সূরা যারিয়াত, আয়াত: ৪৯
মানুষের বেলায়ও নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন। যৌন ক্ষুধা উপশমের জন্য নারী পুরুষ একে অপরের প্রতি মুখাপেক্ষী এবং মানব বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রেও একে অপরের প্রতি মুখাপেক্ষী। বিয়ের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ একে অপরকে পছন্দ করার বেলায়ও ইসলাম উভয়কে সমান অধিকার দান করেছে। ইসলামী বিয়েতে বর-কনে উভয়ের অনুমতি প্রযোজ্য। এমনকি নিজের পিতা বা অভিভাবক কনের অনুমতি ছাড়া তার ইচ্ছার বিরোদ্ধে বিবাহ দিলে ইসলাম তাকে বিবাহ বহাল রাখা কিংবা ভেঙ্গে দেয়ার ইখতিয়ার দিয়েছে।
মানুষ হিসাবে সমমর্যাদা
____________________
মানুষ হিসাবে সমমর্যাদা
মানুষ বলতে নারী-পুরুষ উভয়ের সমষ্টিকে বুঝায়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ
হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। এরপর তোমাদেরকে জাতি ও গোত্র বানিয়েছি যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। ৩৫
৩৫.সূরা হুজরাত, আয়াত: ১৩
উক্ত আয়াতে ঘোষিত হয়েছে যে, সকল মানবমণ্ডলীকে এক পিতা হযরত আদম (عليه السلام) ও এক মাতা হযরত হুাওয়া (عليه السلام) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এদিক দিয়ে হযরত আদম (عليه السلام) হলেন সকল নর-নারীর পিতা এবং হযরত হাওয়া (عليه السلام) হলেন সকল নর-নারীর মাতা। আর এই দু’জন ব্যতিত বাকী সকল মানবজাতি একে অপরের ভাই-বোন সম্পর্কীয়। এ যেন একই সত্ত্বার দু’টি রূপ। সুতরাং মানুষ হিসাবেও ইসলামে নারী-পুরুষ সমান বিবেচ্য।
পারিবারিক বিষয়ে সমমর্যাদা
____________________
পারিবারিক বিষয়ে সমমর্যাদা
পারিবারিক যে কোন বিষয়ে পুরুষ বুদ্ধিমতি ও বিজ্ঞ নারীর সাথে পরামর্শ ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করলে সফলতা ও পারিবারিক সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি হয়। এবং পরিবারে স্বৈরচারী শাসনের বিলুপ্ত ঘটে। সন্তানকে দুধপান করানোর সীমা নির্ধারণ, সন্তানের সুস্বাস্থ্য, লেখা-পড়া এবং বিয়ে-শাদীর বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর সাথে পরামর্শ ও মতামত প্রকাশ করার নারীর পূর্ণ অধিকার রয়েছে ইসলামে।
মক্কার কুরাইশদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় মুসলমানরা উমরা করতে পারেনি বিধায় মনক্ষুন্ন ছিলেন তারা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সে সময় মুসলমানদেরকে কুরবানী দেয়ার আদেশ দিলে সাহাবীগণ কেউ তা করলেন না। তাদের অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ ভীষম চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এ ব্যাপারে তিনি এ বিষয়ে তাঁর সফর সঙ্গীনী স্ত্রী হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه)’র কাছে পরামর্শ চাইলেন। তিনি তাঁকে সান্তনা দিয়ে পরামর্শ দিলেন যে, আগে আপনি কুরবাণী দিন। তারপর আপনার দেখা দেখিতে তারাও কুরবানী দিবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার পরামর্শ মতে কাজ শুরু করলে সাহবীগণও তাঁকে অনুসরণ করলেন এবং সামস্যা সমাধান হয়ে গেল।
যিনি ওহীর ধারক-বাহক তাঁর কারো পরামর্শের প্রয়োজন নেই। তবুও তিনি পরামর্শ করে জাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন যেন তারাও তাঁর অনুসরণার্থে নারী-পুরুষ কোন ভেদাভেদ না করে পরিবারে সবাইকে সমান গুরুত্ব দেয়। এতে নারী নিজেকে অসহায় বোধ করবেনা বরং পারিবারিক কাজে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্ববান মনে করে নিজেকে পারিবারিক কাজে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করবে।
আমাদের সমাজে কিছু পুরুষকে দেখা যায় যে, তারা স্ত্রী কিংবা নারী জাতিকে পাত্তাই দিতে চায়না। নারীদেরকে কেবল রান্নাঘর ও বেডরুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়। পরিবারে অনেক বিষয়ে নারীর গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত পরামর্শ ও মত থাকলেও অগ্রাহ্য হবে ভেবে বলে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। পরিবার ক্ষতি ও বিপদগ্রস্থ হয়।
মানব সমাজের মূলভিত্তি হলো পরিবার। পরিবারের কেন্দ্রস্থল পরিবার কর্তার-স্ত্রী নিজে। পরিবারের ভিত্তি সুদৃঢ় হলে সমাজের বুনিয়াদ মযবুত হয়ে থাকে। এই পরিবারের দৃঢ়তার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে নারী বা গৃহকর্ত্রী। সুতরাং একটি শান্তিপূর্ণ ও সুশিক্ষিত এবং আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন একজন চরিত্রবান, আদর্শবান, সুশিক্ষিতা ও সুস্থ নারী।
বিশ্ব সমাজের প্রাথমিক ইউনিট পরিবার যত স্বচ্ছ, নিষ্ঠাবান ও আদর্শ হবে মানব সমাজের সামগ্রিক ইউনিট বিশ্ব সমাজও হবে ততই সুন্দর, আদর্শবান ও মানবতার মূর্ত প্রতীক। আর তেমন একটি পরিবার ও সমাজ গড়ে উঠতে পারে একজন সৎ, চরিত্রবান ও আদর্শ নারীর মাধ্যমে।
নারীর অর্থনৈতিক অধিকার
____________________
নারীর অর্থনৈতিক অধিকার
পুরুষ যেমন ধন-সম্পদের মালিক হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি করার অধিকার রাখে অনুরূপ ইসলামে নারীও ধন-সম্পদের মালিক হতে পারে এবং পর্দা সহকারে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারে। নারী স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক ও মৃত নিকটাত্মীয়দের উত্তরাধিকারী হতে পারে। অনুরূপভাবে বিবাহের দেন-মাহরের মালিকও স্ত্রী। ইসলাম নারীর ওপর থেকে অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটায় এবং তাকে তার ন্যায্য অধিকার প্রদান করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
للرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْكَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا
পুরুষদের জন্য ধন-সম্পদের অংশ রয়েছে যা পিতা-মাতা এবং নিকটাত্মীয়রা রেখে গেছেন এবং নারীদের জন্য ও সেই ধন-সম্পদে অংশ রয়েছে যা পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়রা রেখে গেছেন- কম হোক বা বেশী হোক। এটি (আল্লাহ কর্তৃক) নির্ধারিত। ৩৬
৩৬.সূরা নিসা, আয়াত: ৭
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً
আর তোমরা (স্বামীরা) স্ত্রীদের মাহর সন্তুষ্টচিত্তে আদায় কর। ৩৭
৩৭.সূরা নিসা, আয়াত: ৪
উক্ত আয়াতে মাহর নারীর হক ঘোষিত হয়েছে। সুতরাং কোন অভিভাবক মাহর গ্রহণ করলেও তা নারীকে প্রদান করতে হবে। স্ত্রী ব্যতিত এর অন্যকেউ মালিক হতে পারবে না।
উম্মুহাতুল মু’মিনীন হযরত খদীজাতুল কুবরা (رضي الله عنه) ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) উষ্টের যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন এবং নিজে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। তবে এসব ক্ষেত্রে নারীকে পর্দা ও শালীনতা বজায় রাখতে হবে।
নারী হলো মানব গোষ্ঠির একটি অংশ। সুতরাং তাদেরকে বাদ দিয়ে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন সম্ভয় নয়। ইসলাম নারীদের কর্মপদ্ধতি ও কর্মসীমা তাদের স্বাভাবিক ক্ষমতা প্রকৃতি, দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার আলোকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। অতীতের মুসলিম নারী সমাজ ইসলামী জীবনাদর্শের আলোকে জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে জীবনের বৃহত্তর অঙ্গনে গঠনমূলক ও বিপ্লবাত্মক ভূমিকা ও অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জীবনে সব ক্ষেত্রে তারা পর্দা অবলম্বন করেই পুরুষের পাশাপাশি যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। তারা নিজের স্বামী ও সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে যুদ্ধের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে এবং যুদ্ধের ময়দানে আহতযুদ্ধাদের সেবায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করতেন। আজকের মুসলিম নারী ইসলামী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত বলে, ইসলামের সঠিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অজ্ঞ বলে এবং তথাকথিত আধুনিক চাকচিক্যের প্রতারণায় বিভ্রান্ত বলে এতটা পিছিয়ে পড়েছে।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে সকলের জন্য নির্ধারিত বিধি-বিধান বিদ্যমান। কেউ অন্ধ বলে যেমন সূর্যকে অস্বীকার করতে পারেনা অনুরূপ কেউ ইসলামী বিধি-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ বলে ইসলামকে দোষারোপ করতে পারেনা। ইসলামী আদর্শ অনুসরণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)'র নীতি অনুসরণ করার মধ্যেই নারী-পুরুষ ও সমাজের বৃহত্তম কল্যাণ নিহিত রয়েছে। অতএব, ইসলামী পথ ধরে অগ্রসর হলেই নারী-পুরুষ নিজ নিজ প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ বিভিন্ন সামাজিক কাজে যেমন পরস্পরের পরিপূরক, তেমনি অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও একে অপরের সম্পূরক। কারণ প্রকৃতিগতভাবে নারী-পুরুষ কেবল দৈহিক ও মানসিক স্বাতন্ত্রের অধিকারীই নয় বরং উভয়ের কর্মস্পৃহা ও কর্মদক্ষতার মাঝেও রয়েছে বিরাট পার্থক্য। আবার এ দু’য়ের কেউ স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। নারী-পুরুষের কর্মের সামর্থ ও যোগ্যতার ভিন্নতার কারণে পরিবারের সম্পূরক হিসাবে কর্মবণ্টন না হয়ে পরিবর্তক বা বিকল্প হিসাবে হয়ে থাকলে, তা হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক এবং ফলাফলের দিক থেকে স্বল্প মেয়াদে সামাজিক সমতা মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা অর্থনৈতিক অকল্যাণ বয়ে আনবে সুনিশ্চিতভাবে।
একজন বিচরককে সার্জনের দায়িত্বে নিয়োগ করা, একজন শিক্ষককে চিকিৎসকের পদে নিয়ে যাওয়া যেমন অর্থনৈতিক কল্যানের পরিপন্থী, ঠিক তেমনি নারীদের উপযোগী কাজে পুরুষদের নিয়োগ ও পুরুষোচিত কাজে নারীদের নিয়োগ তার চাইতেও অধিক অকল্যাণ কর। প্রাকৃতিক বিধি-বিধান ও রীতি-নীতির বিপরীত করলে মানব জাতির একাংশ নারী সমাজের উপর হবে যুলুম এবং সাধ্যাতীত কর্মভার ন্যস্ত করে তাদের প্রতি করা হবে অমানবিক আচরণ।
নারী-পুরুষের মৌলিক পার্থক্য
____________________
নারী-পুরুষের মৌলিক পার্থক্য
মহান আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে নর ও নারীকে সৃষ্টি করেছেন। মৌলিকত্বের দিক দিয়ে নর ও নারী মানুষ। মানুষ হিসেবে সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল আল্লাহর প্রতি ঈমান আনাসহ সকল ইসলামী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন এক বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যার কারণে নর নারীকে ভালোবাসে, নারীর জন্য নরের প্রয়োজনীয়তা অত্যাধিক। শুধু মানুষ নয় সকল জীব-জন্তু বা প্রাণীর মধ্যে ঐ জাতির বিপরীত লিঙ্গের প্রাণী রয়েছে। পৃথিবীতে বংশ বিস্তার, পৃথিবীকে আবাসস্থল হিসেবে মেনে নেবার প্রবণতা সৃষ্টির জন্য একজনের প্রতি আরেকজনের আকর্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে দেখা দেয়। আল্লাহ তা‘আলা এ আকর্ষন মিটানোর জন্যে এক জাতির মধ্যে দুই বিপরীতধর্মী লিঙ্গের প্রাণী বা জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। মানুষরে ক্ষেত্রেও তদ্রূপ। নর অর্থাৎ হযরত আদম (عليه السلام) কে সৃষ্টি করার পর এ প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা একই সত্ত্বা দিয়ে বিপরীত লিঙ্গের নারী সৃষ্টি করলেন অর্থাৎ বিবি হাওয়াকে পৃথিবীতে পদার্পণ করলেন। এ বিপরীতধর্মী নর ও নারীর বৈশিষ্ট্যের কারণে বা অবস্থানের কারণে তাদের মধ্যে শারীরিক তারতম্য, রুচির তারতম্য, মেধার তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। আর আল্লাহ তা‘আলাও তাদের অর্থাৎ নারীদের স্বভাব ও চরিত্রের কারণে ঐ ধরনের নির্দেশ ও আদেশ জারি করেছেন তাদের জন্য। মৌলিক ইবাদতের ক্ষেত্রে কোন তারতম্য নেই। তবে পালনের পদ্ধতিগত দিক থেকে মেয়েলী স্বভাবের কারণে নারীদের জন্য এক রকম পদ্ধতি, নরের পুরুষ বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের ইবাদতের পদ্ধতি অন্য রকম। এ পার্থক্য সামান্য। তবে পালনের মৌলিক পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে আবার কোন তারতম্য নেই। মৌলিক কথা হল নরকে তাদের বৈশিষ্ট্যের কারণে এক রকম স্বভাব এবং নারীদের মেয়েলী চরিত্রের কারণে আরেক রকম স্বভাব বিদ্যমান। নর ও নারীর এ প্রভেদমূলক অবস্থানকে সকল স্তর থেকে একবাক্যে স্বীকার করা বাঞ্ছনীয়। অবস্থানের মৌলিকত্বকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। এ অবস্থানের প্রাপ্ত অধিকার হরণ করাকে মর্যাদা বিপন্নের পর্যায়ে পড়ে; কিন্তু অবস্থানকে অস্বীকার করে আরেকটি অবস্থানে গিয়ে অধিকার দাবী করা অগ্রাহ্য। কারণ অবস্থানের ক্ষেত্রে যে পার্থক্য রয়েছে তা নরের জন্য যেমন সুবিধাজনক, তেমনি নারীর ক্ষেত্রেও তা সহজতর। আল্লাহ তা‘আলা খুব ভাল করে জানেন নরের জন্য কি রকম আইন তৈরি করা হলে তার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক হবে। নারীর জন্যও তাদের সুবিধাজনক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে নরের পাশাপাশি তারা মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারে। তাই নারী ও নরের যেসব ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায় তা অতি সংক্ষেপে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
১. নারীর শারীরিক পার্থক্য
____________________
১. নারীর শারীরিক পার্থক্য
বিজ্ঞানীদের মতে নারী ও পুরুষের মধ্যে দৈহিক গঠনের ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। নারীর আকৃতি, অবয়ব, অংগ-প্রত্যংগ হতে আরম্ভ করে শারীরিক অণু পরমাণু পর্যন্ত পুরুষ হতে সম্পূর্ণ পৃথক। শরীরতত্ব বিষয়ে গবেষণার ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে, নারীর তুলনায় পুরুষের শারীরিক অবস্থা অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী। মাতৃগর্ভে সন্তানের নারী বা পুরুষ আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাদের শারীরিক গঠন লাভ করে। নারীর দৈহিক গঠন এমনভাবে গঠিত হয় যাতে করে নারী সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালন করতে পারে। এজন্য দেখা যায় নারীর জরায়ূ গঠন হতে আরম্ভ করে প্রাপ্তবয়স্কা পর্যন্ত তার দেহের পূর্ণ বিকাশ জেনেটিক প্রভাবে হয়ে থাকে। নারীর স্তনযুগল থাকে যা পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ সন্তান লালন-পালনের জন্য তাকে যুগল স্তন দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে। নারীদের দেহে ডিম্বকোষ থাকার ফলে মাসিক ঋতুস্রাব হয়ে থাকে। এ সময় তার দেহের তাপ সংরক্ষণ হ্রাস পায়, রক্তে চাপ কমে যায়, হজম শক্তি ব্যাহত হয়, স্বাধ অবসন্ন, স্মরণশক্তি কমে যায় এবং মনের একগ্রতা বিনষ্ট হয়। এ বিষয়গুলো পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এজন্য নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। নারীর ভিতরে হরমোনজনিত কারণে লিঙ্গের পরিবর্তন হয়েছে এবং তাদের শারীরিক গঠন কিছুটা নরম। শরীর বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ এমিল নুডিক, ডাক্তার ক্রেগার গীব হার্ডদের মতে ঋতুবর্তী নারীদের মধ্যে শারীরিক দুর্বলতা সম্পর্কে রোগ বেশি বিদ্যমান। অধ্যাপক লাপিনস্কি বলেন- “মাসিক ঋতুকালে নারীদের কর্মাধীনতা নষ্ট হয়ে পড়ে এবং একটা প্রভাবশালী ক্ষমতা তাকে বাধানুগত করে ফেলে। স্বেচ্ছায় কোন কাজ করা বা না করার শক্তি প্রায় নষ্ট হয়ে পড়ে। ডাক্তার ক্রাফটের মতে ভদ্র, বিনয়ী, প্রফুল্লাচিত্ত নারীদের মধ্যে ঋতুস্রাবের সময় পরিবর্তন দেখা দেয়। এ ডাক্তারের মতে এ সময় নারীরা হঠাৎ রুক্ষ, ঝগড়াটে ও অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওয়েনবার্গ মন্তব্য করেন- “আত্মহত্যাকারী নারীদের শতকরা ৫০ জন ঋতুকালেই আত্মহত্যা করে থাকে।” ডাক্তার রিপ্রেসেভের মতে নারীদের অতিরিক্ত দৈহিক উপাদানসমূহ ক্ষুধার্ত অবস্থায় যে পরিমাণে বের হয়, গর্ভাবস্থায় তদপেক্ষা অধিক পরিমাণে নির্গত হয়ে থাকে। ডাক্তার ফিশার, মোল, হিউলাক, এলবার্ট, ইলিয়াস প্রমুখের মতে গর্ভকালীন মাসে নারীদের দৈহিক ও মানসিক শ্রম করার যোগ্যতা থাকে না। ফ্রান্সের নোবেল প্রাইজ বিজয়ী ড. জলেকিস ক্যারেল-এর মতে নারী পুরুষে যে বৈষম্য বিরাজমান তা মৌলিক ও বুনিয়াদী ধরনের। এ বৈষম্য তাদের দেহে সৃষ্ট স্নায়ুমণ্ডলীতে বিদ্যমান। নারীদের সম্পূর্ণ দৈহিক অবয়বই ভিন্ন ধরনের। তাদের জীবনকোষ হতে এক প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয় যা গর্ভ ধারণের উপযোগী করে সৃজন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নারী দেহের প্রতিটি কোষ নারীত্বের নিদর্শন বহন করে। নারী আর পুরুষের মধ্যে এ পার্থক্যের কারণেই একজনকে সন্তান উৎপাদন ও লালনপালন উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে, আরেকজনের দৈহিক গঠন করা হয়েছে ব্যাপক পরিধিতে কাজকর্ম করার জন্যে। এ ক্ষেত্রে নারী আর পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ করা সম্ভবপর নহে। এটি আল্লাহর সৃষ্টিগত পার্থক্য। নারীরা নরের চেয়ে দুর্বল। শক্তির ক্ষেত্রেও তাদের মধ্যে তফাৎ রয়েছে। একটি নরের যে পরিমাণ শক্তি বা সামর্থ্য থাকে নারীদের ততটা নয়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রেও ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। নরের লিঙ্গের আকার ও আকৃতি এক রকম; নারীদের লিঙ্গ অন্য রকমের। এ লিঙ্গের পার্থক্যগত কারণেও স্বভাব-চরিত্রেও পার্থক্য বিদ্যমান থাকে। দৈর্ঘ্য বা উচ্চতার দিক থেকে নারীরা নরের চেয়ে সামান্যতম ছোট হয়। অনেকে প্রমাণ করে বলেছেন স্বাভাবিক নারীর দৈর্ঘ্য থাকে বার সেন্টিমিটারের অধিক। এ পার্থক্য পরিবেশগত কারণেও পার্থক্যের হার সব দেশে বা অঞ্চলে একই রকম থাকে না। ওজনের ক্ষেত্রেও নারীরা নরের চেয়ে অনেক কম থাকে। নারীদেহের ওজন যে কোন স্বাভাবিক পুরুষের চেয়ে পাঁচ কিলোগ্রাম কম। শিরা উপ-শিরার গতি ও শক্তির দিক থেকেও নারী জাতি পুরুষের চেয়ে অনেক দুর্বল। নারীদের শিরা-উপশিরা নরের চেয়ে স্বতন্ত্র। নারীর শিরার স্পন্দনের দ্রূততাও ধীরতার ক্ষেত্রে অনুরূপ পার্থক্য বিদ্যমান। নরের শিরাগুলো নারীদের শিরা থেকে দৃঢ়তর, তেমন দ্রুততর। শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্রুততা ও শক্তির দিক থেকেও নর-নারীর ভেতরে বড় রকমের বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। নিঃশ্বাসের ভেতর দিয়ে যে কার্বলিক এসিডের রেণুগুলো বেরিয়ে আসে, তা দেহের ভেতরকার তাপের প্রভাবে গরম হয়ে যায়। নিঃশ্বাসের সময় নর প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১১ ড্রাম কার্বন জ্বালিয়ে দেয়।পক্ষান্তরে নারী ঘণ্টায় ৬ ড্রাম জ্বালায় মাত্র। এতে প্রমাণিত হয় যে, নারীদেহের শক্তিজাত তাপ পুরুষের অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি। নরের মগজ সাধারণত গড়ে ৪৯.১০ আউন্স, আর নারীর মগজের ওজন মাত্র ৪৪ আউন্স। এ ওজনের তারতম্যের কারণেই বুদ্ধি প্রখরতা ও মন্থরতা নির্ভরশীল। তাই বলা যায় নর ও নারীর মগজের আকৃতি ও প্রকৃতি উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। পুরুষের মগজের ওজন নারীর মগজের চেয়ে সাধারণত ১ ড্রাম বেশি। নারীদের মগজে শিরা ও প্যাচ খুব কম। তার আবরণ ব্যবস্থাও অসম্পূর্ণ। এ সব কারণে নর-নারীর মধ্যে এ সৃষ্টিগত পার্থক্যকে কোনভাবে অস্বীকার করা যায় না।
এভাবে মহান আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের চেয়ে, নারীদের শারীরিক শক্তি দৈহিক কাঠামো ও গঠন এবং মেধার দিক থেকে দুর্বল করে সৃষ্টি করেছেন। তবে তাদেরকে সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত যোগ্যতম করে তৈরি করা হয়েছে। নারী ও পুরুষের শারীরিক কাঠামো, দৃঢ়তা, সুস্থতা, ঋতুস্রাব, গঠন এবং হরমোনের কারনে আল্লাহ তা‘আলা নর ও নারীর জন্য একই ধরনের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেনি। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, নর ও নারীর যৌন অনুভূতি, জীববিজ্ঞানের বাস্তবতা ও সামাজিক পরিবেশ হতে অস্তিত্ব লাভ করেছে। তাদের দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ ও অধিকার সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
২. নারীর মানসিক পার্থক্য
____________________
২. নারীর মানসিক পার্থক্য
মেধাগত এবং মানসিকগতভাবেও তারা নরের চেয়ে পেছনে আছে। নারীর জ্ঞানশক্তি নরের জ্ঞানশক্তি থেকে যতখানি দুর্বল ঠিক ততখানি পার্থক্য দেখা দেয় তাদের রুচিরোধের ভেতর। তাদের স্বভাব সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। তাই দেখা যায় তাদের ভাল-মন্দ বিচার পুরুষের ভাল-মন্দ বিচারের সাথে সাধারণ এক হয় না। তাই নারীর ইন্দ্রিয়শক্তি অত্যন্ত দুর্বল। নারীরা হাল্কা ব্যাসিক এসিডের ঘ্রাণ বিশ হাজারের এক ভাগ হলে অনুভব করতে পারে। পক্ষান্তরে নর এক হাজার ভাগের একভাগ হলেই অনুভব করতে পারে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নারীদের ঘ্রাণশক্তি নরের চেয়ে দুর্বল। স্বাদ ও ঘ্রাণে এবং স্মরণশক্তির দিক দিয়ে নরেরা নারীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
৩. নারীর অঙ্গের পার্থক্য
____________________
৩. নারীর অঙ্গের পার্থক্য
নারীরা গর্ভধারণ করতে পারে। নরেরা তা পারে না। নারীরা সন্তানকে দুধ খাওয়ানের কারণে তাদের স্তন দুধে পরিপূর্ণ থাকে। তাদের ভিতরের অঙ্গে জরায়ু আছে। এ অঙ্গগুলো তাদের বেশি। আর এ কারণে তারা নারী। এ বৈশিষ্ট্য নারীদের সম্পূর্ণভাবে রয়েছে। এ বৈশিষ্ট্যের ওপরই নির্ভর করে তাদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন আলাদা, স্বভাব আলাদা। তাদের অনুভূতি উচ্ছ্বাসপ্রবণ। যে কোন প্রভাব অতি সহজেই তাদের মনে দাগ কাটে। তারা নরের তুলনায় বেশি দুর্বলমনা। তাদের যৌন ক্ষুধা উপশমের পদ্ধতিও আলাদা। পুরুষ যেভাবে যৌন-সুখ ভোগ করে তারা অন্যভাবে ভোগ করে। উত্তেজনাও তাদের বহু দেরীতে আসে। নর নারীকে দেখামাত্র উত্তেজিত হয়ে পড়ে। নারীকে অনেক নিয়ম-কানুন পালন করে উত্তেজিত করতে হয়। এসব কারনে তাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য।
৪. নারীর সামাজিক দায়িত্ব পালনে পার্থক্য
____________________
৪. নারীর সামাজিক দায়িত্ব পালনে পার্থক্য
মানুষের রূহ অনন্তকালের জন্য স্থায়ী। তবে এ রূহকে স্বল্পতম সময়ের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে সৎ কল্যাণ করার জন্য। এ কর্মের ওপরই নির্ভর করে পরকালীন জীবনের অনন্ত সুখ। এ পৃথিবীতে মানুষের কর্মের স্থল দুটি। একটি পরিবারে, অন্যটি পরিবারের বাইরে। নর ও নারীর এ দায়িত্ব পালনের ভিন্নতা রয়েছে। নর ও নারী মিলেমিশে এ সংসার জীবনকে সুন্দরময় করার গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে ইসলামে। নর কাজ করবে বাহিরে, নারী থাকবে ঘরে। দুজনই যদি একই কাজ করে তাহলে আরেকটি কাজ সমাধান হওয়ার সুযোগ নেই। বলা যায় নারী যদি পরিবারের দায়িত্ব ছেড়ে বাইরে চলে যায় তাহলে পরিবারের যাবতীয় কাজ কে করবে? হয়তো কে ঘরে করবে, আর কে বাইরে করবে- তার দায়িত্ব অধীনস্থ করে দেয়নি। এটা নির্ধারণ করে, মুক্ত করে বা স্বাধীন করে নর বা নারীকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। তাই এ দায়িত্ব নিয়ে নারীরা আজ সংশয়ে আছে; কিন্তু গর্ভে সন্তান ধারণ তো আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ দায়িত্ব থেকে নারী তো ইচ্ছা করলে মুক্ত হতে পারে না। কই এ দায়িত্ব নিয়ে তো তাদের অমনোযোগিতা নেই। কারণ এটা তাদের স্বাধীন মনের বাইরে। এর ওপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাহলে ঘরের কাজ করতে এত আপত্তি কেন? এটা তো আল্লাহই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই নারীদের সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে প্রথমে তারা সন্তান গর্ভে ধারণ করে। এ দায়িত্ব নরের নেই। সন্তানকে লালন-পালন করা, স্নেহ-মায়া-মমতা দিয়ে তা আঁকড়িয়ে রাখা, দুধ খাওয়ানো হল নারীর প্রথম দায়িত্ব। এ দায়িত্বের পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব সংসারে রাণী হিসেবে সংসার পরিচালন করা। “সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে” প্রবাদ বাক্যটি যথার্থ সার্থকতায় রূপ দেয়াও তাদের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। মসজিদে ইমামতি তারা করতে পারে না। এ দায়িত্ব নরের। সাক্ষীর ক্ষেত্রে তাদের ২জন নারীকে একজন পুরুষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। রাসূলে করীম বলেছেন- “এবং নারী তার স্বামীর ঘরের পরিচালিকা, রক্ষণাবেক্ষণকারিনীর কর্ত্রী।” নর ও নারীর জ্ঞান বৃদ্ধি, কর্মদক্ষতা ও দৈহিক আঙ্গিকের স্বাভাবিক পার্থক্যের কারণে সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তারতম্য করা হয়েছে। পারিবারিক জীবনে নর ও নারীর মধ্যে কর্ম বণ্টনের নীতি পূর্ণ নির্ধারণ করা হয়েছে। পুরুষকে করা হয়েছে আয় রোজগার ও শ্রম মেহনতের জন্য দায়িত্বশীল আর নারীকে করা হয়েছে ঘরের পরিচালিকা। এজন্যে রাসূলে কারীম বলেছেন- “তাদের ঘরই তাদের জন্যে সুখ শান্তি ও সার্বিক কল্যাণের আকর।” নারীরা ঘরে বসেই আল্লাহর পথে জিহাদ করতে পারে। মহানবী এ সম্পর্কে বলেছেন- “যে মেয়েলোক তার ঘরে অবস্থান করলো, সে ঠিক আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মত কাজ সম্পন্ন করতে পারলো।” ইমামতি করা নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের নামাযের স্থান সম্পর্কে রাসূলে করিম বলেছেন- “আল্লাহর কাছে মেয়েলোকের সে নামায সবচেয়ে বেশি প্রিয় ও পছন্দনীয়, যা সে তার ঘরের অন্ধকারতম কোণে পড়েছে। এভাবে নর নারীর মধ্যে সামাজিক দায়িত্বে প্রভেদ করেছেন। জানাযায় যাওয়া নারীদের জন্য নিষিদ্ধ। হযরত উম্মে আতীয়া (رضي الله عنه) বলেছেন- “রাসূলে করীম আমাদেরকে জানাযায় যেতে নিষেধ করেছেন; কিন্ত নরের জন্য এটা স্পষ্টভাবে বৈধ। প্রয়োজনের তাগিদে, না গেলেই নয় এরূপ ক্ষেত্রে নারীদেরকে ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে কাপড় দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে যাওয়া শর্ত করা হয়েছে। নিরুপায় হলে তারা অবশ্য ঘরের বাইরে যেতে পারে। নবী করীম বলেছেন- তোমরা আল্লাহর বাদীদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করো।
অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে- “আল্লাহর বাদীদেরকে মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে নিষেধ করো না। নারীদের একা সফর করার বিধান রাখা হয়নি। যেতে হলে মুহাররম পুরুষকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। নবী করিম (ﷺ) বলেছেন- মেয়েলোকে আদৌ বিদেশ সফর করবে না, তবে কোন মুহাররম পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে করতে পারে।” নরের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। তবে নারীদের জন্য অলংকার পরা জায়েয আছে। সুগন্ধি ছাড়া প্রসাধন ব্যবহার নারীদের জন্য প্রযোজ্য। তবে নরের জন্য প্রযোজ্য নয়। জুমআর নামায পড়াও নারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। রাসূলে করিম (ﷺ) বলেছেন- “জুমআর নামায জামায়াতের সাথে পড়া সব মুসলমানদের ওপরই ফরয। তবে চার শ্রেণির লোকদের তা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে- ক্রীতদাস, মেয়েলোক, লেংড়া ও রোগী।”
নারী ও নরের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত কারণে তাদের অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা তারতম্য বিদ্যমান। নারীদের প্রকৃত স্থান এবং আসল কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তাদের ঘর। এখানে থেকেই তারা প্রতিটি মৌলিক অধিকার অর্জন, সম্মান লাভ এবং আল্লাহর ইবাদত করতে পারে। এতে কোন অসুবিধা হয় না। মানুষের মধ্যে নর ও নারী- এ শ্রেণিবিভাগের কারণে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে। যার যার দায়িত্ব থেকে সে সে ইবাদত করবে, সমাজে সুখ ও শান্তি আনয়ন করবে এবং নর ও নারী উভয়কে সহযোগিতা করবে। নরকে দেওয়া হয়েছে বাহিরেকাজ আর তা সম্পন্ন করার জন্য যে যোগ্যতা, কর্মক্ষমতা ও কাঠিন্য, অনমনীয়তা, কষ্ট, সহিষ্ণুতা, দুর্ধর্ষতার প্রয়োজন, তা কেবল পুরুষদেরই আছে। আর মেয়েদের আছে স্বাভাবিক কোমলতা, মসৃণতা, অসীম ধৈর্যশক্তি, সহনশীলতা, অনুপম তিতীক্ষা ঘরের অংগনকে সাজিয়ে-গুছিয়ে সমৃদ্ধ করে তোলা, মানব বংশের কুসুম কোমল লোকদের গর্ভে ধারণ, প্রসবান্তে স্তন দান ও লালন-পালন করার দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও আল্লাহর মৌলিক ইবাদত করা হল তাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। ৩৮
৩৮.আল বাহি আল খাওলী, ইসলামে নারী, পৃ; ৫৭-৬২
হাদিস শরীফের আলোকে ইসলামে নারীর মর্যাদা
____________________
হাদিস শরীফের আলোকে ইসলামে নারীর মর্যাদা
যাহেলী যুগে নারীদের অবস্থা যখন অবনতির চরমসীমায় পৌঁছেছে, তখন নারী মুক্তির অগ্রদূত হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) মানবতার ধর্ম ইসলাম সহকারে আত্মপ্রকাশ করলেন। তিনি অতল সাগরে ডুবে যাওয়া নারীকে উদ্ধার করে সসম্মানে তীরে তুলে আনলেন, নারীকে পুরুষের পদতল থেকে মাথার মুকুট বানিয়ে দিলেন। আমরা হাদিস শরীফের আলোকে এ বিষয়ে আলোকপাত করবো।
حُبِّبَ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا النِّسَاءُ وَالطِّيبُ، وَجُعِلَ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلَاةِ
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- পৃথিবীর নিয়ামত সমূহের মধ্যে আমার নিকট প্রিয় বানানো হয়েছে নারী, সুগন্ধি এবং নামাযের মধ্যে আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে। ৩৯
৩৯.আহমদ ইবনে শোয়াইব র. (৩০৩ হি.) নাসাঈ শরীফ, খণ্ড.২, পৃ. ৯৩
الدُّنْيَا كُلُّهَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَة الصَّالِحَة
হযরত আব্দুল্লাহ ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- বিশ্ব ভূমণ্ডল পুরোটাই উপকৃত বস্তু সামগ্রী, তম্মধ্যে সর্বোত্তম উপকৃত সামগ্রী হলো নেককার নারী। ৪০
৪০.মুসলিম শরীফ, সূত্র, মিশকাত শরীফ, পৃ;.২৬৭, হাদিস নং-৩০৮৩
উপরোক্ত হাদিস দু’খানাতে নারী জাতির মর্যাদা ফুটে উঠেছে। প্রথম হাদিসে বলা হয়েছে-রাহমাতুললিল আলামীনের নিকট নারীকে প্রিয় করে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত আগত মুসলমানদের নিকটও নারী জাতি প্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ উম্মতের ওপর নবী করিম (ﷺ)র অনুসরণ ফরয। সুতরাং নারী জাতির জন্য অহংকারের বিষয় হলো যে, তারা প্রিয় নবীর কাছে প্রিয়। আর দ্বিতীয় হাদিসে সৎ নারীদেরকে পৃথিবীর সর্বোত্তম নিয়ামত বলা হয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন, যার গৃহে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলো। অতঃপর সে তাকে কষ্ট দেয়নি, তার ওপর অসন্তুষ্টও হয়নি আর পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রাধান্যও দেয়নি তাহলে তার এ কন্যা সন্তানের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ৪১
৪১.ইমাম আহমদ ইবনে হম্বল র. ২৭১ হি. মুসনাদে আহমদ, খণ্ড.১, পৃ. ২২৩
হযরত উকাবাহ ইবনে আমের (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি- যার তত্ত্বাবধানে তিযনজন কন্যা সন্তান রয়েছে, অতঃপর সে তাদের লালন-পালনের কষ্ট সহ্য করেছে এবং সামর্থানুযায়ী তাদের পানাহার ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করেছে। কিয়ামত দিবসে ঐ কন্যা সন্তানেরা তার জন্য জাহান্নামের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। ৪২
৪২.মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযিদ র. (২৭৩ হি.), ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃ. ২৬১
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ ابْتُلِيَ بِشَيْءٍ مِنَ البَنَاتِ فَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّارِ.
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করিম ইরশাদ করেন, যাকে কন্যা সন্তান দ্বারা পরীক্ষায় লিপ্ত করা হয়েছে, আর সে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করেছে ঐ কন্যা সন্তানরা কিয়ামত দিবসে তার জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের উপলক্ষ হবে। ৪৩
৪৩.ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী (২৭৯ হি.) তিরমিযী শরীফ
যে নারী জাতিকে অন্যান্য ধর্মে ‘নরকের দরজা’ বলা হয়েছে ইসলামে তাকে জান্নাতে প্রবেশের উপলক্ষ ও উসীলা বলা হয়েছে।
عَائِشَةَ، أَنَّهَا قَالَتْ: جَاءَتْنِي مِسْكِينَةٌ تَحْمِلُ ابْنَتَيْنِ لَهَا، فَأَطْعَمْتُهَا ثَلَاثَتَ مَرَاتٍ، فَأَعْطَتْ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا تَمْرَةً، وَرَفَعَتْ إِلَى فِيهَا تَمْرَةً لِتَأْكُلَهَا، فَاسْتَطْعَمَتْهَا ابْنَتَاهَا، فَشَقَّتِ التَّمْرَةَ، الَّتِي كَانَتْ تُرِيدُ أَنْتَ أْكُلَهَا بَيْنَهُمَا، فَأَعْجَبَنِي شَأْنُهَا، فَذَكَرْتُ الَّذِي صَنَعَتْ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: إِنَّ اللهَ قَدْ أَوْجَبَ لَهَا بِهَا الْجَنَّةَ، أَوْ أَعْتَقَهَا بِهَا مِنَ النَّارِ
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমার নিকট একদা এক গরিব মিসকীন মহিলা আগমণ করলো-যার দু’টি কন্যা সন্তানও ছিল।আমি তাদেরকে খাওয়ার জন্য তিনটি খেজুর দিলাম। তখন ঐ মহিলা প্রত্যেক কন্যা সন্তানকে একটি করে খেজুর দিল এবং নিজে একটি খেজুর খাওয়ার জন্য মুখের নিকট নিয়ে গেল। তখন তার কন্যাদ্বয় নিজেদেরটা খেয়ে ঐ খেজুরটাও তার থেকে চাইতে লাগল। তখন তাদের মা ঐ খেজুরটিকে দু’টুকরো করে দু’জনকে ভাগ করে দিল। হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ এই মেয়েদের কারণে তার জন্য বেহেশত ওয়াজিব করে দিয়েছেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন। ৪৪
৪৪.ইমাম মুসলিম ইবনে হুজ্জাজ কুশাইরী র. (২৬১ হি.) সহীহ মুসলিম, পৃ. ৩৩০
যখন কন্যা সন্তান জন্ম নিলে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন অসন্তুষ্ট হতো এবং নারী জাতিকে কলংকের কারণ মনে করা হতো আর কলংক মুক্ত হওয়ার জন্য কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো সে সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করাকে সৌভগ্যের সোপান ঘোষণা করেছেন- "
من بركة المرأة تبكيرها بالأنثى، أما سمعت الله تعالى يقول: {يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثاً وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ}.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, নারী ভাগ্যবতী হওয়ার প্রমাণ হলো তার প্রথম সন্তান কন্যা হওয়া। ৪৫
৪৫.আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুসসামউদ্দিন র. (৯৭৫ হি.), কানযুল উম্মাল, খণ্ড.৬, পৃ. ৬১১
বর্তমান আমদের সমাজেও জাহেলী যুগের ন্যায় কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে পিতা-মাত, দাদা-দাদী, নানা-নানী ও অন্যান্য নিকটত্মীয় স্বজন নাখোশ হয়। একজন পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে সকলের মুখে আনন্দের যে উল্লাস পরিলক্ষিত হয় একজন কন্যা সন্তানের বেলায় হয় তার বিপরীত। অনেকেই পুনরায় কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করার ভয়ে সন্তান নিতে চায় না। পুত্র সন্তানের নাম রাখা ও আকীকা অনুষ্ঠান যেভাবে ধুমধামের সহিত করা হয় তা কন্যা সন্তানের বেলায় অনুপস্থিত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কন্যা সন্তান গর্ভধারণ করেছে বলে স্ত্রীর প্রতি স্বামী ও স্বামী পক্ষের লোকজন অসন্তুষ্ট থাকে এবং শশুর বাড়িতে স্ত্রীর গুরুত্ব কমে যায়। তাদের আচরণ দেখে মনে হয় গর্ভের সন্তান নারী পুরুষ হওয়া না হওয়ার মধ্যে স্ত্রীর হাত রয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-“তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন।” ৪৬
৪৬.সূরা শুরা, আয়াত: ৪৯
কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে অসন্তুষ্ট হওয়ার অর্থ হলো স্বয়ং আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হওয়ার শামিল। আর আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট বান্দার জন্য কুফুরী। কন্যা সন্তান জন্মের সংবাদ শুনলে চেহারা মলিন হয়ে যাওয়া জাহেলী যুগের কাফির-মুশরিকদের আলামত। সুতরাং এ আলামত মু’মিনদের মধ্যে পাওয়া যাওয়া অনুচিত ও অন্যায়।
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা যদি মানব সৃষ্টির ব্যাপারে মানুষের চাহিদা মত কাজ করতেন, তাহলে মানব জাতি আর বাকী থাকতো না, কারণ তারা কেবল ছেলে চায় মেয়ে চায় না। আর সবাই যদি ছেলে হয়ে যায় তাহলে মেয়ের অভাবে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।
وعن أنس أن رجلا كان عند النبي صلى الله عليه وسلم فجاء ابن له فقبله وأجلسه على فخذه وجاءته بنت له فأجلسها بين يديه فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : " ألا سويت بينهم "
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্নিত, এক ব্যক্তি নবী করিম (ﷺ)র দরবারে বসা ছিলেন। ইতিমধ্যে তার এক পুত্র সন্তান এলো। সে তাকে চুম্বন করে উরুর উপর (আদরের সহিত) বসালো। একটু পরে তার এক কন্যা সন্তান এলো। সে তাকে সামনে বসিয়ে দিলো। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেন, কেন তুমি দু’জনের সাথে সমান আচরণ করলেনা? ৪৭
৪৭.নুরুদ্দীন আলী ইবনে আবু বকর র. (৮০৮হি.), মাজমাউয যাওয়ায়েদ
নারীর বিশেষ মর্যাদা
____________________
নারীর বিশেষ মর্যাদা
ইসলামী নর-নারী উভয়ের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে বরং কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর মর্যাদা সমুন্নত করা হয়েছে। কারণ তারা হলেন মা-বোন। তারা সন্তানের গর্ভধারিনী, দুধপানকারী এবং শিশুকালে লালন-পালনকারিনী। মহানবী (ﷺ)বিভিন্ন সময় নারীদের ফযিলত বর্ণনা করে তাদের সম্মান বৃদ্ধি করেছেন। হাদিস শরীফে বর্নিত আছে-
يا معشر النسوان أما إن خياركن يدخلن الجنة قبل خيار الرجال فليغسلن ويطببن في دفعن إلى أزواجهن على براذين ( براذين : البرذون : الدابة . الحمر والصفر معهن الولد انك أنهن اللؤلؤ المنثور
হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, হে মহিলাদের দল! স্মরণ রেখো, তোমাদের মধ্যে যে পূণ্যবতী, সে সৎপুরুষদের পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতঃপর তাকে গোসল করিয়ে, সুগন্ধি লাগিয়ে স্বামীর নিকট সোপর্দ করা হবে। লাল ও হলুদ রঙের সৌন্দর্যপূর্ণ সাওয়ারীরর ওপর এবং তার সাথে তার বাচ্চা থাকবে- যেন ছড়ানো মুক্তা। ৪৮
৪৮.আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুসসামউদ্দিন র. (৯৭৫ হি.), কানযুল উম্মাল, খণ্ড.১৬, পৃ; ১৭১
عن ام سلمة قلت يارسول الله انساء الدنيا افضل ام الحور العين قال نساء الدنيا افضل من الحور العين كفضل الظهارة على البطانة قلت يارسول الله وبم ذا ؟ قال لصلا تهن وصيامهن وعبادتهن الله عزوجل-
হযরত উম্মে সালমাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ কে জিজ্ঞাসা করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়ার মহিলারা শ্রেষ্ঠ নাকি জান্নাতের ডাগর চক্ষু বিশিষ্ট হুরগণ উত্তম? উত্তরে তিনি বললেন, জান্নাতী ডাগর চক্ষু বিশিষ্ট হুরগণ থেকে দুনিয়ার নারীজাতি শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে তারা এমন যেমন আভ্যন্তরীণ থেকে প্রকাশমান উত্তম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এর কারণ কী? তিনি বললেন- তাদের নামায, রোযা ও ইবাদতের কারণে। ৪৯
৪৯.ইমাম তাবরানী র. (৩৬০ হি.) সূত্র. আশারাতুন নিসা, পৃ. ৫৪০
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন যার একটি কন্যা বা বোন আছে, সে তাকে জীবন্ত প্রোথিত করেনি এবং তাকে তুচ্ছও মনে করেনি আর তার উপর পুত্র সন্তানকে প্রাধান্যও দেয়নি, তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ৫০
৫০.আবু দাউদ, সূত্র. মিশকাত, পৃ; ৪২৩
মা হিসাবে মর্যাদা
____________________
মা হিসাবে মর্যাদা
ইসলামী নারী জাতিকে মা হিসাবে বিশেষ মর্যাদা দান করেছে। এমনকি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সন্তানের সদাচরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে পিতার উপর মাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ أَحَقُّ بِحُسْنِ صَحَابَتِي؟ قَالَ: أُمَّكَ . قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: أُمَّكَ . قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ أُمَّكَ . قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: أَبُوكَ . وَفِي رِوَايَةٍ قَالَ: أُمَّكَ ثُمَّ أُمَّكَ ثُمَّ أُمَّكَ ثُمَّ أَبَاكَ ثمَّ أدناك أدناك
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমার সদাচরণ পাওয়ার সর্বাপেক্ষা অধিকারী কে? উত্তরে তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললো, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা, লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলো এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। অন্য বর্ণনায় আছে- লোকটি পরপর প্রশ্নের উত্তরে তিনবার মায়ের কথা বলেছেন অতঃপর চতুর্থবার বলেছেন- তোমার পিতা। এরপর তোমার নিকটতম আত্মীয়-স্বজন। ৫১
৫১.ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ৪১৮
উপরোক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাকে পিতার উপর তিনগুণ বেশী মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়েছেন। পরপর তিনবার মায়ের কথা বলার পর চতুর্থবার পিতার কথা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং নারীর মর্যাদা রক্ষায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) র ভূমিকার কথা ভুলে গেলে নারীদের জন্য হবে মহাভুল।
وَعَن معاويةَ بن جاهِمةُ أَنَّ جَاهِمَةَ جَاءَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَدْتُ أَنْ أَغْزُوَ وَقَدْ جِئْتُ أَسْتَشِيرُكَ. فَقَالَ: هَلْ لَكَ مِنْ أُمٍّ؟ قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: فَالْزَمْهَا فَإِنَّ الْجَنَّةَ عِنْدَ رِجْلِهَا
হযরত মুয়াবিয়া ইবনে জাহিমাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, জহিমা নবী করিম (ﷺ)র খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললো- হে আল্লাহর রাসূল! আমি যুদ্ধ করার ইচ্ছা পোষণ করেছি এবং আপনার পরামর্শের জন্য আপনার নিকট এসেছি। তিনি বললেন, তোমার মা কি জীবিত আছেন? সে বললো, হ্যাঁ জীবিত আছেন। তখন তিনি বললেন, তাহলে তুমি তাঁর সেবা করো, কেননা মায়ের পায়ের নিকট হলো (সন্তানের) জান্নাত। ৫২
৫২.ইমাম আহমদ র. (২৪১ হি.) ইমাম নাসাঈ র. (৩০৩ হি.) ও ইমাম বায়হাকী র. (৪৫৮হি.) সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৪২১
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে-
اَلْجَنَّةُ تَحْتَ اَقْدَامُ اَلْاُمَّهَات
জান্নাত জননীর পদতলে। ৫৩
৫৩.হাশিয়ায়ে মিশকাত, পৃ. ৪২১, হাশিয়া নং-৪
উপরোক্ত হাদিস দু’টোতে সন্তানের বেহেশত জননীর পদতলে ঘোষণা করে নারী তথা মা জাতিকে এমন সম্মানিত করা হয়েছে যে, যে নারী ছিলো পুরুষের পদতলে তাকে তুলে আনা হয়েছে পুরুষের মাথার উপরে। তারপরও যদি কোন নারী ইসলামকে, মহানবী (ﷺ) কে দোষারোপ করে তাহলে সেটা হবে অত্যন্ত ঘৃণিত অকৃতজ্ঞতা ও চরম অন্যায়।
ইসলামে অমুসলিমের সাথে শর্তসাপেক্ষে ক্ষেত্রে বিশেষে সদাচার করার অনুমতি আছে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-انما المشركون نجس
মুশরিকরা নাপাক। এতদসত্ত্বেও মায়ের সাথে বিনাশর্তে সদাচরণ করার অনুমতি দিয়েছেন মহানবী
।عَنْ أَسْمَاءَ، قَالَتْ: قَدِمَتْ عَلَي أُمِّي وَهِيَ مُشْرِكَةٌ، فِي عَهْدِ قُرَيْشٍ فَاسْتَفْتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ: إِنَّ أُمِّي قَدِمَتْ عَلَي وَهِيَ رَاغِبَةٌ؟ أَفَأَصِلُهَا؟ قَالَ: نَعَمْ، صِلِي أُمَّكِ
হযরত আসমা বিনতে আবি বকর (رضي الله عنه) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, কুরাইশদের সাথে চুক্তিকালীন অর্থাৎ হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় আমার মা আমার কাছে মুশরিকা অবস্থায় (মদীনায়) আগমন করলেন। তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)র কাছে জিজ্ঞাসা করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা আমার কাছে এসেছেন অথচ তিনি ইসলামের প্রতি অনাগ্রহী, এমতাবস্থায় আমি কি তাঁর সাথে সদাচরণ করবো? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি তাঁর সাথে সদাচরণ করো। ৫৪
৫৪.ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. বুখারী ও মুসলিম শরীফ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৪১৮
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " دَخَلْتُ الْجَنَّةَ فَسَمِعْتُ فِيهَا قِرَاءَةً فَقُلْتُ: مَنْ هَذَا؟ قَالُوا: حَارِثَةُ بْنُ النُّعْمَانِ كَذَلِكُمُ الْبِرُّ كَذَلِكُمُ الْبِرُّ. وَكَانَ أَبَرَّ النَّاسِ بِأُمِّهِ.
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্নিত,তিনি বলেন, রাসূলূল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, আমি (স্বপ্নে) বেহেশতে প্রবেশ করলাম এবং তথায় কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পেলাম, তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ ব্যক্তি কে? ফেরেশতারা বললেন, ইনি হারিসা ইবনে নু’মান। পূণ্যের প্রতিফল এরূপই, পূণ্যের প্রতিফল এরূপই। সে ছিল সকল মানুষের তুলনায় নিজের মায়ের সাথে সর্বাদিক সদাচরণকারী। ৫৫
৫৫.শরহুস সুন্নাহ ও ইমাম বায়হাকী র. (৪৫৮ হি.), শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৪১৯
وَعَن ابْن عمر أَنَّ رَجُلًا أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي أَصَبْتُ ذَنْبًا عَظِيمًا فَهَلْ لِي مِنْ تَوْبَةٍ؟ قَالَ: هَلْ لَكَ مِنْ أُمٍّ؟ قَالَ: لَا. قَالَ: وَهَلْ لَكَ مِنْ خَالَةٍ؟ . قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: فبرها .
হযরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করিম (ﷺ)র দরবারে হাযির হয়ে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমি একটি জঘন্য পাপ করেছি, আমার জন্য তওবার কোন সুযোগ আছে কিনা? তিনি বললেন, তোমার মা জীবিত আছেন? লোকটি বললো না। তিনি বললেন, তোমার কি কোন খালা আছে? সে বললো হ্যাঁ, আছে। তিনি বললেন, তবে তুমি তার সাথেসদাচরণ করো। ৫৬
৫৬.ইমাম তিরমিয়ী র. (২৭৯ হি.), সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৪২০
উক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গুনাহ মাফের জন্য মায়ের সেবা আর মা জীবিত না থাকলে মা’র বোন খালার খেদমত করাকে তাওবা ঘোষণা করেছেন। এখানে পিতা কিংবা পিতার ভাই চাচা-জেঠার কথা বলা হয়নি বরং মা-খালার খেদমত করাকে গুনাহ মাফের উপলক্ষ্য ঘোষণা করে নারী জাতির মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
হযরত মুগীরা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ عُقُوقَ الْأُمَّهَاتِ
নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর মায়ের অবধ্যতাকে হারাম করেছেন। ৫৭
৫৭.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৪১৯
পিতা-মাতা উভয়ের অবাধ্য হওয়া সন্তানের জন্য নাজায়িয। কিন্তু এখানে কেবল মায়ের কথা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো মায়ের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করা।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা তাঁর দুধুমা হযরত হালিমা (رضي الله عنه)’র আগমনে তার সম্মানার্থে নিজের পরিধেয় চাদর বিছিয়ে দিয়েছিলেন এবং দুধুমা চাদরে বসেছিলেন। ৫৮
৫৮.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.) আবু দাউদ শরীফ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ৪২০
উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় মুল্লা আলী কারী (رحمة الله) মিরকাত গ্রন্থে বলেন, হযরত হালিমা (رضي الله عنه) হুনাইনের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)র নিকট এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন এবং নিজের পরিধেয় চাদর মোবারক বিছিয়ে দিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি তাতে বসেছিলেন।
অনুরূপ ঘটনা আবু লাহাবের দাসী সুআইবা যিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে দুধ পান করায়েছিলেন তার সম্পর্কেও সংঘটিত হয়েছিল। ৫৯
৫৯.মিশকাত শরীফ, পৃ. ৪২০, টীকা নং-৫
যার সম্মানে কুল কায়েনাত দাঁড়িয়ে যায়, যাঁকে বসানোর জন্য সর্বোচ্চ মূল্যবান আসবাবপত্র উৎসর্গ করা হয়, যার কদমে ধন্য হয়েছিল খোদার আরশ তিনি কোন জন্মদানকারীনী মা নয় বরং দুধ পানকারীনী মায়ের সম্মানার্থে সাহাবায়ে কিরামের সামনে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং যাঁর ব্যবহৃত কাপড়কে উম্মত তার্বারুক হিসাবে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতো, যার ব্যবহৃত বস্তুকে কবরে নাজাতের উসীলা মনে করতো, দুনিয়া-আখিরাতে বরকত ও সৌভাগ্যের সোপান মনে করতো তিনি তাঁর পরিধেয় চাদর মোবারক বিছিয়ে দিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত নারী জাতির সম্মান সমুন্নত করেছেন। তাঁর এরূপ তা’যীম দেখে উপস্থিত কম বয়স্ক সাহাবীগণ বয়স্ক সাহাবীগণের নিকট জানতে চাইলেন যে, ইনি কে? ইনাকে এত সম্মান করার কারণ কি? উত্তরে তারা বলেন, ইনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে দুধপানকারীনী।
পিতা-মাতা উভয়ের দোয়া-বদদোয়া আল্লাহর দরবারেখুব দ্রুত কোন প্রতিবন্ধক ছাড়াই কবুল হয়ে যায়। তবুও বিভিন্ন ইসলামী নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে মায়ের দোয়া-বদদোয়া সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে যে, বনী ইসরাইলের জুরাইজ নামক এক সাধক ব্যক্তি মায়ের বদ দোয়ার কারণে দুনিয়াতে অপদস্ত হতে হয়েছিল। ৬০
৬০.বুখারী শরীফ, পারা-৯, ৩৩৭, হাদিস নং-২৩২০
ফকীহ আবুল লাইস সমরকন্দি (رحمة الله) তান্বীহুল গাফিলীন কিতাবের ৭৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, মায়ের অসন্তোষের কারণে আলকামা নামক এক ব্যক্তির মৃত্যুকালীন ঈমান নসীব হচ্ছিল না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কৌশল করে মাকে সন্তুষ্টি করলে এবং মা ছেলেকে ক্ষমা করে দেয়ার পরে ছেলের মুখে কালিমা উচ্চারিত হলো আর ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
এতক্ষণ আমরা আলোচনা করেছি কেবল মায়ের মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে। তবে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বহুস্থানে পিতা-মাতার মর্যাদা ও সম্মানের কথা একত্রে বর্ণিত হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনের কোন আয়াতে আল্লাহর ইবাদতের সাথে পিতা-মাতার আনুগত্যের কথা তাদের সেবা-যত্নের কথা, কোন আয়াতে পিতা-মাতার শোকর আদায় করার কথা উল্লেখিত হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে পবিত্র কুরআনের সূরা আনআম, আয়াত; ১৫১, সূরা নিসা, আয়াত; ৩৬, সূরা লোকমান, আয়াত; ১৪ ও সূরা বনী ইস্রাঈল, আয়াত; ২৩ দেখুন।
হাদিস শরীফেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতা-মাতাকে জান্নাতের দরজা, পিতা-মাতার অবাধ্যতাকে কবীরা গুনাহ ও অমার্জনীয় অপরাধ, পিতা-মাতার চেহারা দেখা মকবুল হজ্বের সাওয়াব ইত্যাদি বর্ণনা করে পিতা-মাতার গুরুত্ব ও মর্যাদা তুলে ধরেছেন।
মূলত ইসলামের ন্যায় অন্য কোন ধর্মে পিতা-মাতার প্রতি এতো গুরুত্বারোপ করতে দেখা যায়না। কারণ এই পৃথিবীতে সন্তানের অস্তিত্ব মূলত মাতা-পিতারই অবদান। সন্তানের জন্য পিতা-মাতার ত্যাগ-তিতিক্ষা, শ্রম-সাধনা ও স্নেহ-মমতা বাদ দিলেও সন্তানের অস্তিত্বের জন্যই পিতা-মাতা এসব মর্যাদার অধিকারী সাব্যস্ত হয়। এ কারণেই ইসলাম ব্যতিত অন্য ধর্মীয় সমাজে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের এতো ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সেবা-যত্ন করতে দেখা যায় না। পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি, দাদা-দাদীসহ সব মিলে মিশে একই সংসারে একই ঘরে শান্তিতে বসবাস করার দৃশ্য পৃথিবীর বহু তথাকথিত সভ্য সমাজে বিরল। পশ্চিমা সমাজে দেখা যায় সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে গেলে পিতা-মাতার সাথে কোন সম্পর্ক থাকেনা। সন্তান তার পূর্ণ একক অধিকার নিয়ে পৃথকভাবে বসবাস করে, ইচ্ছে মতো পছন্দের মেয়ের সাথে ঘুরা- ফেরা করে। পিতা- মাতা বৃদ্ধাবস্থায় পুত্র ও পুত্রবধু থেকে সেবা-যত্ন পাওয়ার কল্পনাও করতে পারেনা তাদের সমাজে। বরং বৃদ্ধাকালীন অসহায় অবস্থায় আপনকে পর করে পরকে আপন করে বৃদ্ধাশ্রমে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হয়। আর এটাই তাদের সমাজের স্বাভাবিক ব্যাপার। এটাকে তারা অমানবিক কিংবা দোষনীয়ও মনে করেনা। অথচ ইসলামী সমাজে ছেলে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাবস্থায় সেবা-যত্ন না করলে কিংবা পুত্রবধু শ্বশুর-শ্বাশুরীর সেবা-যত্ন না করলে নিন্দিত, বদনামী ও গুনাহের ভাগী হয়। অথচ ওই সব সভ্য সমাজে তা অকল্পনীয়।
বিবাহ
____________________
বিবাহ
আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুকে জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষ করে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ
আমি প্রত্যেক বস্তু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যাতে শিক্ষা গ্রহণ কর। ৬১
৬১.সূরা যায়িয়াত, আয়াত: ৪৯
অন্যত্র ইরশাদ করেছেন-
سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنْفُسِهِمْ
পবিত্র তিনি, যিনি যমীন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদকে, তাদেরই থেকে মানুষকে জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন। ৬২
৬২.সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৩৬
মহান আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রত্যেক প্রাণীর বংশ বিস্তার করেন। যেভাবে নেগেটিভ ও প্রজেটিভের সমন্বয়ে বৈদ্যুতিক আলো সৃষ্টি হয় তেমনি নর-নারীর মিলনে মানব বংশ সৃষ্টি হয়।
আল্লাহ তা‘আলা নারীজাতি সৃষ্টি করার অন্যতম উদ্দেশ্য পুরুষের একাকীত্ব দূরীকরণ, শান্তিলাভ ও মানব বংশ বিস্তার ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَلَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم ْمَوَدَّةً وَرَحْمَةً
আর এ নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি অর্জন কর, এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। ৬৩
৬৩.সূরা রূম, আয়াত: ২১
উপরিউক্ত আয়াতে নর-নারীর দাম্পত্য জীবনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে স্ত্রী দ্বারা পুরুষের মনের শান্তি অর্জন। এটা তখন সম্ভবপর যখন উভয়পক্ষ একে অপরের অধিকার সম্পর্কে সজাগ থাকে এবং তা আদায় করে। যে পরিবারে এটা বর্তমান আছে, সেই পরিবারে সৃষ্টির ও বৈবাহিক জীবনের উদ্দেশ্য সফল। যে পরিবারে মানসিক শান্তির অনুপস্থিত সেই পরিবারে আর যাই থাকুক দাম্পত্য জীবনে সাফল্য নেই।
হযরত আদম (عليه السلام) জান্নাতের ন্যায় সুখ-শান্তির চরম স্থানে থাকা সত্ত্বেও মানসিক শান্তির অভাববোধ করেছিলেন এবং নিঃস্ব মনে করেছিলেন। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বাম পাঁজরের হাড্ডি থেকে হযরত হাওয়া (عليه السلام) কে সৃষ্টি করেছেন। এখানে শান্তি দ্বারা যৌনতৃপ্তির শান্তি উদ্দেশ্য নয়। কারণ এটি নর-নারী উভয় অর্জন করে থাকে। এখানে শান্তি দ্বারা নারী থেকে পুরুষ মানসিক শান্তি উদ্দেশ্য। নারী তার কোমল, নাজুক ও নম্র স্বভাব-আচরণের মাধ্যমে স্বামীকে মানসিক শান্তি দান করবে।
তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর যৌবন ঢলে পড়ার পরে বার্ধক্য অবস্থায় তাদের মধ্যে এক অনবদ্য আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে উঠে যা তাদের শেষ জীবনকে করে তোলে সুমধুর। তাই আয়াতে সেই দিকেই ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে
وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً
অর্থাৎ যাতে করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্প্রীতি, ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরস্পর পরস্পরের প্রেম-ভালোবাসা ও বিশ্বাস বড় প্রয়োজন। এটার অভাবে অনেক সময় পারিবারিক জীবন জান্নাতের পরিবর্তে জাহান্নামে পরিণত হয়ে উঠে। পরিশেষে দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। দুই পরিবারের মধ্যে খুন-খারাবী ও মামলা মোকাদ্দামা আরম্ভ হয়। ফলে বিয়ের বহুমুখী কল্যাণ ও উদ্দেশ্য পণ্ডু হয়ে যায়।
মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুখাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন জাতি। তাই পশু-পাখির ন্যায় লাগামহীন ভাবে যৌন মিলনে লিপ্ত হতে পারে না। সামাজিক স্বীকৃতির মাধ্যমে বৈধ পন্থায় বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে নারী-পুরুষের যুগল জীবন বিবাহের মাধ্যমে শুরু হয়। আদি পিতা আদম (عليه السلام) ও আদি মাতা হাওয়া (عليه السلام) থেকে বিবাহ প্রথা শুরু হয়। আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উপর দুরূদ শরীফ পাঠকে মাহর নির্ধারণ করে তাদের বিবাহ সম্পন্ন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো ইরশাদ করেন-
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا
তিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়। ৬৪
৬৪.সূরা আ’রাফ, আয়াত: ১৮৯
বিবাহের সংজ্ঞা
____________________
বিবাহের সংজ্ঞা
বিবাহ শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হলো নিকাহ। নিকাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো মিলানো, একত্র করা ও সঙ্গম করা। রূপকভাবে এ শব্দটি বৈবাহিক বন্ধন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কেউ কেউ বলেন, নিকাহ শব্দটি মিলন ও বৈবাহিক বন্ধন উভয় অর্থেই সমানভাবে ব্যবহৃত হয়। যার দ্বারা স্বামী তার স্ত্রীর সাথে মিলনের অধিকার লাভ করে।৬৫
৬৫.আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী র (৮৫২ হি.), খণ্ড,৩
মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও বংশবৃদ্ধির জন্য নারী-পুরুষের যৌনমিলন অপরিহার্য। এই যৌন জীবনকে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ ও বংশধারার সঠিকত্বের জন্য বৈবাহিক প্রথা অপরিহার্য। হযরত আদম (عليه السلام) ও হযরত হাওয়া (عليه السلام) হলেন আদি মানব দম্পতি। তখন থেকে অদ্যবধি এই বিবাহ প্রথা চলে আসছে। যুগ, জামানা, জাতি, বর্ণভেদে বিবাহের বিভিন্ন প্রথা ও পদ্ধতি চালু ছিল এবং বর্তমানেও চালু আছে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে জাহেলী যুগে আরব সমাজে বিবাহের নামে বহু কুপ্রথা ও অপসংস্কৃতি চালু ছিল। ইসলাম সকল কুসংস্কার ও অশ্লীলতার অবসান ঘটিয়ে পূত-পবিত্র ও সুশৃঙ্খল বিবাহ রীতি প্রবর্তন করে।
মানুষ যেহেতু পশু নয়, তাই উচ্ছৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র যৌনক্ষুধা নিবারণের অনুমতি দেয়া হয়নি তাকে, বরং নিয়ম-নীতির আলোকে সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে সম্মানজনক পন্থায় কাম-চাহিদা পূরণ ও তা ফলপ্রদ করার পূণ্যময় রীতি প্রণয়ন করেছে শরীয়ত।
বিবাহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
____________________
বিবাহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
বিবাহের লক্ষ্য হচ্ছে-অশ্লীলতা ও ব্যভিচার থেকে নিজেকে সংরক্ষণ করা, অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধ্বংস থেকে নারীর সত্ত্বা রক্ষা করা। ঈমানদার সন্তান লাভ করা মানব বংশধারা সংরক্ষণ করা এবং ঘর-সংসার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করা।
বিবাহের শরয়ী বিধান
____________________
বিবাহের শরয়ী বিধান
অবস্থাভেদে বিবাহের হুকুম বিভিন্ন হয়ে থাকে, কোনো কোনো অবস্থায় সুন্নাত কখনও ফরয আবার কখনও মাকরূহ ও হারাম হয়ে থাকে।
স্বাভাবিক অবস্থায় বিবাহ করা সুন্নাত। অর্থাৎ কোনো পুরুষ যখন মাহর আদায়ে ও স্ত্রীর ভরণ-পোষণের খরচ নির্বাহে সক্ষম এবং যৌনমিলনে সামর্থবান হয় তখন তার জন্য বিবাহ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।
যৌন আবেগ যদি প্রবল হয়ে ওঠে তখন বিবাহ করা ওয়াজিব আর দুর্দমনীয় যৌনাবেগের কারণে যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হলে তখন বিবাহ করা ফরয। তবে উভয় অবস্থায় তাকে মাহর আদায় ও স্ত্রীর খোরপোশ দানে সক্ষম হতে হবে।
স্ত্রীর প্রতি যুলুমের আশঙ্কা দেখা দিলে অর্থাৎ স্ত্রীর বৈবাহিক অধিকারসমূহ পূরণে অসমর্থ হলে বিবাহ করা মাকরূহে তাহরীম আর আশঙ্কা নিশ্চিত হলে সেক্ষেত্রে বিবাহ করা হারাম। ৬৬
৬৬.আল্লামা সৈয়দ আমীন ইবনে আবেদীন শামী র. (১২৫৩ হি.) ফাতোয়া শামী, খণ্ড ২
বিবাহ সংঘটিত হয় ইজাব ও কবুল দ্বারা। এ দু’টি বিবাহের রুকন এবং উভয়টি ক্রিয়াপদ হতে হবে। উভয়টি অতীতকাল প্রকাশক হতে হবে অথবা একটি অতীতকাল ও অপরটি ভবিষ্যতকাল হলেও চলবে। বিবাহের জন্য দু’জন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ ও দুইজন মহিলার সাক্ষী শর্ত। সাক্ষীদের আযাদ, বুদ্ধিমান, প্রাপ্তবয়স্ক ও মুসলমান হতে হবে। ৬৭
৬৭.আল্লামা বুরহান উদ্দিন আলী ইবনে আবি বকর র. (৫৯৩ হি.) আল হিদায়া, কিতাবুন নিকাহ, খণ্ড ২, পৃ. ২৮৫
বিয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
____________________
বিয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
মানুষ স্বাভাবিকভাবে আরামপ্রিয়। এ কারণেই সে দুঃখ কষ্টকে ভয় করে এবং এড়িয়ে চলতে চায়। প্রজ্ঞাময় আল্লাহ নর-নারীর মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে না দিলে মানুষ বিয়ের ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতো এবং মানব বংশ বিস্তারের ধারা ব্যহত হতো। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللهُ لَكُمْ
অতঃপর তোমরা নিজ স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো এবং যা কিছু আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন তা অর্জন করো। ৬৮
৬৮.সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যাদাতাগণ বলেছেন- তোমরা সন্তান-সন্ততি লাভের আশায় স্ত্রী সঙ্গম করো নিছক যৌন প্রবৃত্তির তাড়না মিটানোর জন্য করোনা।
প্রাচীন সমাজে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী ব্যক্তিকে অর্থাৎ বিবাহে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তিকে আধ্যাত্মিকতায় অপূর্ণ মনে করা হতো এবং তাকে খোদার নৈকট্য লাভের অযোগ্য মনো করা হতো। সুতরাং সেযুগের সাধু ব্যক্তিরা আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভের জন্য বিবাহ ও সংসারধর্ম বর্জনকে আবশ্যক মনে করতো। তারা সব রকমের পার্থিব তৎপরতা থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে খোদার ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়তো। কিন্তু ইসলাম প্রাচীনযুগের অযৌক্তিক ভ্রান্ত ধারণাকে সমূলে প্রত্যাখ্যান করে দেয় এবং বিয়ে ও সংসার করাকে পবিত্রতা ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের উত্তম মাধ্যম বলে ঘোষণা করে।
বিবাহ করা দু’একজন ছাড়া বাকী সব নবী-রাসূলে সুন্নাত। বিবাহ করা মহানবী (ﷺ)র আদর্শ। বিবাহের পবিত্র ছোঁয়ায় পরিচ্ছন্ন জীবন লাভ করে একজন বিবাহিত মর্দে মু’মিন। ইসলামী শরীয়তে বিবাহকে দ্বীনের অর্ধেক বলে ঘোষণা করেছে। কারণ এর মাধ্যমে মানুষ শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষ ও পবিত্রতার চরম শিখরে পৌঁছতে পারে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَأَنْكِحُوا الْأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
তোমাদের মধ্যে যেসব ছেলেদের স্ত্রী নেই এবং যেসব মেয়েদের স্বামী নেই তাদের এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দাও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। ৬৯
৬৯.সূরা নূর, আয়াত: ৩২
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
مَنْ أَرَادَ أَنْ يَلْقَى اللهَ طَاهِرًا مُطَهَّرًا، فَلْيَتَزَوَّجِ الْحَرَائِرَ
যে ব্যক্তি পূত পবিত্র অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে চায় সে যেন স্বাধীন নারী বিবাহ করে। ৭০
৭০.ইমাম ইবনে মাজাহ র. (২৭৩হি.), ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃ. ১৩৫
عَنْ أَبِي أَيُّوبَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرْبَعٌ مِنْ سُنَنِ الْمُرْسَلِينَ: الحَيَاءُ، وَالتَّعَطُّرُ، وَالسِّوَاكُ، وَالنِّكَاحُ
হযরত আবু আইয়ুব(رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- নবী-রাসূলগণের সুন্নত চারটি। লজ্জাবোধ, সুগন্ধি ব্যবহার, মিসওয়াক করা এবং বিবাহ করা। ৭১
৭১.ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী র. (২৭৯হি.) তিরমিযী শরীফ, পৃ. ১২৮
أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ،يَقُولُ: جَاءَ ثَلاَثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوتِ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمَّا أُخْبِرُوا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوهَا، فَقَالُوا: وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قَدْ غُفِرَلَهُمَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ، قَالَ أَحَدُهُمْ: أَمَّا أَنَا فَإِنِّي أُصَلِّي اللَّيْلَ أَبَدًا، وَقَالَ آخَرُ: أَنَا أَصُومُ الدَّهْرَ وَلاَ أُفْطِرُ، وَقَالَ آخَرُ: أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلاَ أَتَزَوَّجُ أَبَدًا، فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَيْهِمْ، فَقَالَ: ্রأَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا، أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ، وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা তিনজন সাহাবী নবী করিম (ﷺ)র স্ত্রীদের খেদমতে এস তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জানতে চাইল। যখন তাঁর ইবাদত সম্পর্কে তাদের বলা হলো, তারা যেন তা একটু কম মনে করলো, আর বললো- তিনি কোথায় আমরা কোথায়? তাঁর তো আগ-পর সকল ত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর তাদের একজন বললেন, আমি রাতে ঘুমাবোনা বরং সারা রাত নামায পড়বো। অপরজন বললেন, আমি সর্বদা রোযা রাখবো কখনো ইফতার করবো না। তৃতীয়জন বললেন, আমি নারীদের থেকে দূরে থাকবো-কখনো বিয়ে করবোনা। অতঃপর নবী করীম(ﷺ) তাদের নিকট তাশরীফ আনলেন আর বললেন, তোমরাই এমন লোক যারা এরূপ এরূপ বলেছ, সাবধান! খোদার শপথ। আমি তোমাদের সকলের চেয়ে আল্লাহকে বেশী ভয় করি, নামায পড়ি আবার নিদ্রাও যাই এবং নারীদেরকে বিবাহও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাত থেকে বিমুখ থাকে সে আমার দলভুক্ত নয়। ৭২
৭২.বুখারী ও মুসলিম. সূত্র মিশকাত, পৃ. ২৭, হাদিস নং ১৩৪
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِذَا تَزَوَّجَ الْعَبْدُ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ نِصْفَا لدِّينِ فَلْيَتَّقِ اللهَ فِي النِّصْفِ الْبَاقِي
হযরত আনাস(رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, কোনো বান্দা যখন বিয়ে করলো তখন সে দ্বীনের অর্ধেকটা পূর্ণ করলো। অতঃপর সে যেন বাকী অর্ধেকের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে। ৭৩
৭৩.ইমাম বায়হাকী র (৪৫৮ হি.) শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত. পৃ. ২৬৮
মানবিক প্রাকৃতিক চাহিদার কারণেই মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কারণ ইসলামী শরীয়ত এটাকে পুরো দ্বীনের অর্ধেক বলে আখ্যায়িত করেছে। কারণ দুনিয়াবী প্রতিটি কাজকে ইসলামী শরা মোতাবেক করলে এবং নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকলে তা দ্বীনি কাজের রূপান্তরিত হয়। তাছাড়া সমস্ত ইবাদতে মানসিক শান্তি ও চারিত্রিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। আর তা অধিকাংশ অর্জিত হয় বৈবাহিক জীবনের মাধ্যমে পারিবারিক সুখ-শান্তি দ্বারা।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রيَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা তা চক্ষুকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। আর যে সামর্থ্য রাখেনা সে যেন রোযা রাখে। রোযা তার যৌনক্ষুধাকে অবদমিত করে।৭৪
৭৪.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৬৭
وَعَنْ مَعْقِلِ بْنِ يَسَارٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রتَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمُ الْأُمَم
হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার(رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, তোমরা প্রেমময়ী অধিক সন্তানসম্ভবা নারীকে বিয়ে করো, কারণ আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে অন্যান্য উম্মতের উপর গর্ব করবো। ৭৫
৭৫.আবু দাউদ ও নাসাঈ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৬৭
বৈবাহিক জীবনে আল্লাহর বরকত
____________________
বৈবাহিক জীবনে আল্লাহর বরকত
সমাজে অনেক বিবাহের উপযুক্ত যুবককে বলতে শুনা যায় যে, ‘আমি এখনো আর্থিকভাবে সচ্ছল নই, তাই এখন বিবাহ করবো না। এটা সম্পূর্ণ একটা ভুল ধারণা। সমাজে কয়জন আছে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিবাহ করেছে? বরং দেখা যায় বিবাহ করে মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয় বেশি। মানুষ পৃথিবীতে আসার পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা তার রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন। স্ত্রী যখন স্বামীর ঘরে আসবে তখন তার রিযিক স্বামীর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা স্বামীর ঘরেই পৌঁছিয়ে দেন। পরে যখন সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ করে তখন তাদের রিযিক তাদের পিতার মাধ্যমে তাদের ঘরে পৌঁছে যায়। বিবাহ পূর্বে সাধারণত দেখা যায় ছেলে বেকার থাকে, পকেটে চা খাওয়ার মতো পয়সা থাকেনা। কিন্তু বিবাহ পরবর্তী দেখা যায় সে মনোযোগ সহকারে উপার্জন করতে থাকে। ওই দিকে ইঙ্গিত করে কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে,
-إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ
তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। ৭৬
৭৬.সূরা নূর, আয়াত: ৩২
হযরত ইবনে মাসউদ(رضي الله عنه) বলেন, তোমরা যদি ধনি হতে চাও, তাহলে বিবাহ করো। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ (ইবনে কাসীর)।
ব্যক্তি যখন ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার নিয়্যতে নিজের চরিত্র সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এবং সুন্নাতে রাসূল (ﷺ)র অনুসরণার্থে সদুদ্দেশ্যে বিবাহ করবে তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে আর্থিক সাচ্ছন্দ্য দান করবেন। এই উদ্দেশ্যে নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ করেন-
ثَلَاثَةٌ حَقٌّ عَلَى اللهِ عَوْنُهُمْ: الْمُكَاتَبُ الَّذِي يُرِيدُ الْأَدَاءَ وَالنَّاكِحُ الَّذِي يُرِيدُ الْعَفَافَ وَالْمُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللهِ
তিন প্রকারের ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর উপর আবশ্যক। যে মুকাতাবা দাস তার মুক্তিপণ আদায় করতে চায়, বিবাহকারী যে আপন চরিত্র পবিত্র রাখতে চায় এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কারী। ৭৭
৭৭.তিরিমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৬৭
বিয়ের দ্বারা মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বহুমুখী ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা প্রকাশ পায়। মানুষের মধ্যে কর্তব্যবোধ ও দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। অনেক নিঃস্কর্ম ও অলুক্ষণে মানুষও বিয়ের পরে কর্মটো ও সৌভাগ্যশালী হয়ে ওঠে। বিশেষত স্ত্রী যদি পূণ্যবতী ও বুদ্ধিমতি হয় তাহলে সৎ পরামর্শ দিয়ে স্বামীকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়।
বিয়ের মাধ্যমে দু’টি পরিবারের মধ্যে স্থায়ীভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন হয়। এতে সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র বহু বিবাহের অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি অন্যতম কারণ। হাদিস শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- لَمْ تَرَ لِلْمُتَحَابِّينَ مثل النِّكَاح বিবাহের ন্যায় পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা-সম্প্রীতি সৃষ্টিকারী আর কিছুই দেখবে না। ৭৮
৭৮.ইবনু মাজাহ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৬৮
বিবাহের প্রকারভেদ
____________________
বিবাহের প্রকারভেদঃ
শরীয়তের দৃষ্টিতে বিবাহ তিন প্রকার।
১. সহীহ বিবাহ,
২. ফাসিদ বিবাহ ও
৩. বাতিল বিবাহ।
সহীহ বিবাহ
বিবাহের রুকন ও শর্তাবলী পূর্ণরূপে পালন করে যে বিবাহ সম্পাদন হয় তাকে সহীহ বিবাহ বলে। সহীহ বিবাহের বিধান হলো নর-নারী একে অপরের স্বামী-স্ত্রী বলে স্বীকৃতি লাভ করবে এবং উভয়ের ওপর বিবাহের বিধানাবলীর অনুসরণ বাধ্যতামূলক হয়ে পড়বে। স্বামী-স্ত্রীর যে সব অধিকার পরস্পরের ওপর অর্পিত হয় তা পালন করা অপরিহার্য হয়ে যায়।
ফসিদ বিবাহ
বিবাহ সম্পাদনের বেলায় বিবাহের কোনো রুকন বা শর্ত অপূর্ণ থাকলে তাকে ফাসিদ বিবাহ বলা হয়। যেমন সাক্ষীবিহীন বিবাহ। ফাসিদ বিবাহের বিধান হলো- বিবাহের ত্রুটি সংশোধন করে নিলে তা সহীহ বিবাহ রূপান্তরিত হয়ে যায়।
বাতিল বিবাহ
বিবাহ সম্পাদনকালে সংশোধনযোগ্য নয় এমন শর্তবাদ পড়লে কিংবা কোন অবৈধ শর্তযুক্ত করলে তাকে বাতিল বিবাহ বলে। যেমন মাহরাম আত্মীয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিবাহ। কোনো নারীর স্বামী বিদ্যমান থাকা অবস্থায় তাকে বিবাহ করা ও তিন তালাক দেওয়া স্ত্রীকে তাহলিল ব্যতিত পুনরায় বিবাহ করা বাতিল বিবাহের অন্তর্ভুক্ত। বাতিল বিবাহের বিধান হলো- এর দ্বারা স্বামী-স্ত্রী সাব্যস্ত হবে না বরং বাতিল বিবাহ প্রমাণিত হলে তৎক্ষণাৎ পৃথক হয়ে যাওয়া আবশ্যক।
পাত্র-পাত্রী নির্বাচন
____________________
পাত্র-পাত্রী নির্বাচন
ইসলাম পাত্রকে তার পাত্রী এবং পাত্রীকে তার পাত্র নির্বাচনের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। কোন অভিভাবক তাদের অধীনস্থ নর-নারীকে তাদের অসম্মতিতে জোর-জবরদস্তী বিবাহ দিতে পারে না।
বিয়ের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব অস্তিত্বের ধারা অব্যাহত রাখা, বৈধভাবে যৌনতৃপ্তি অর্জন এবং স্নেহ-ভালোবাসা, সহানুভূতি ও নিঃস্বার্থ সেবাভিত্তিক সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা। এজন্যে একজন উত্তম স্ত্রী কেবল সেই নারীই হতে পারে, যে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে পূর্ণ সজাগ রয়েছে এবং উত্তম পন্থায় তার স্ত্রীসুলভ দায়িত্ব পালনে সক্ষম, নীতি, চরিত্র ও জ্ঞান বুদ্ধিতে হবে সেই নারী আদর্শস্থানীয়। সুতরাং এমন স্ত্রী নির্বাচন করতে হবে যার অন্তর হবে ঈমানের আলোকে উজ্জ্বল এবং কথায় ও কাজে হবে যথার্থ মুসলিম। যার চরিত্র হবে উন্নত, যে শিক্ষায় ও সততায় হবে সুন্দর, শ্লীলতা-শালীনতা, পবিত্রতা ও আত্মমর্যাদার ব্যাপারে হবে সচেতন ও সজাগ।
সমাজে এমন লোক আছে যারা জীবনের আসল সুখ-সমৃদ্ধি সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা বিয়েকে ধন-সম্পদ অর্জনের মাধ্যম মনে করে। তারা পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেবল সম্পদকেই প্রাধান্য দেয়। তারা ওসব পাত্রীই অন্বেষণ করে যাকে বিয়ে করলে ধন-সম্পদের মালিক হওয়া যায়। এতে বিয়ের আসল উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় না এবং সামান্য অর্থলোভে দীর্ঘমেয়াদি সুখ-সমৃদ্ধি থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে। নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন- “তোমরা ধন-সম্পদের ভিত্তিতে নারীদের বিয়ে করো না, কেননা এতে করে তাদের অবাধ্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”৭৯
৭৯.ইবনে মাজাহ, বায়হাকী, সূত্র. আলবাহী আলখাওলী, ইসলামে নারী, পৃ. ৭৮
পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মহানবী (ﷺ) চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করলেও দ্বীনদারীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন
-تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ: لِمَالِهَا وَلِحَسَبِهَا وَلِجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا فَاظْفَرْ بِذَات الدّين
সাধারণত চারটি বৈশিষ্ট্যের কারণে কোন মেয়েকে বিবাহ করা হয়। তার সম্পদ, তার সৌন্দর্য্য, তার বংশমর্যাদা ও তার দ্বীনদারী। তবে তোমরা ধর্মপরায়নতাকেই প্রাধান্য দিবে। ৮০
৮০.বুখারী ও মুসলিম, সূত্রঃ মিশকাত, পৃ. ২৬৭
একজন নারী স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, পাত্র ঈমানদার, মুত্তাকী, পরহেযগার, চরিত্রবান, শিক্ষিত, মিষ্টিভাষী, ভদ্র এবং পরোপকারী কিনা? টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত ক্ষণস্থায়ী বস্তু। আজ আছে কাল নেই। রূপ সৌন্দর্যও অস্থায়ী। কিন্তু উপরে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো স্থায়ী সৌন্দর্য্য ও সর্বাপেক্ষা বড় সম্পদ। এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে নবী করিম (ﷺ) নারীজাতিকে পরামর্শস্বরূপ বলেছেন- “যখন তোমাদের কাছে এমনব্যক্তির বিয়ের প্রস্তাব আসে যে সভ্য ও চরিত্রবান তাহলে তার সাথে বিয়ে করে নাও। যদি তা না কর তাহলে পৃথিবীতে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে।” ৮১
৮১.তিরমিযী, সূত্র. আলবাহী ওয়াল খাওলী, ইসলামে নারী. পৃ. ৮১
পাত্র-পাত্রী দেখা
____________________
পাত্র-পাত্রী দেখা
ইসলাম বৃহৎ স্বার্থে সীমিত পর্যায়ে পাত্র-পাত্রী একে অপরকে দেখা বৈধ ঘোষণা করেছে। বিবাহ দ্বারা দু’টি মন ও দু’টি পরিবারের মধ্যে চিরস্থায়ী সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সম্পর্ক ও ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার জন্য বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রী একে অপরকে দেখে এবং বুঝে নেওয়া জরুরী। হযরত মুগীরা ইবনে শো’বা (رضي الله عنه) বলেন-
خَطَبْتُ امْرَأَةً فَقَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: هَلْ نَظَرْتَ إِلَيْهَا؟: قُلْتُ: لَا قَالَ: فَانْظُرْ إِلَيْهَا فَإِنَّهُ أَحْرَى أَنْ يُؤْدَمَ بَيْنَكُمَا
আমি একজন নারীকে বিবাহের প্রস্তাব করলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে বললেন, তাকে দেখে নাও। কেননা এটা তোমাদের উভয়ের মধ্যে স্থায়ী ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবে। ৮২
৮২.আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৬৯
হযরত জাবির (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
إِذَا خَطَبَ أَحَدُكُمُ الْمَرْأَةَ فَإِنِ اسْتَطَاعَ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى مَا يَدْعُوهُ إِلَى نِكَاحهَا فَلْيفْعَل
যখন তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, তখন যদি তার পক্ষে তার এমন কোন (জায়েয অঙ্গ) দেখা সম্ভবপর হয় যা তাকে বিবাহের দিকে আহবান করে, তখন সে যেন তা দেখে নেয়। ৮৩
৮৩.আবু দাঊদ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৬৮
তবে ইসলামের প্রদত্ত এই সুযোগকে পুঁজি করে বিয়ের পূর্বে নারী-পুরুষ অবাধ মেলা-মেশা করা, একত্রে ঘুরা-ফিরা করা সম্পূর্ণ হারাম। ইসলাম বিয়ের পরে ভালোবাসাকে সমর্থন করে বিয়ের পূর্বে নয়।
স্বামী নির্বাচনে ইসলাম নারীকে পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। কোনো অভিভাবক এই অধিকার খর্ব করতে পারে না। হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন-
لَا تُنْكَحُ الْأَيِّمُ حَتَّى تُسْتَأْمَرَ وَلَا تُنْكَحُ الْبِكْرُ حَتَّى تُسْتَأْذَنَ. قَالُوا: يَا رَسُول الله وَكَيف إِذْنهَا؟ قَالَ: أَنتسكت
বালিগ বিবাহিতা নারীকে ষ্পষ্ট অনুমতি ব্যতীত বিবাহ দেওয়া যাবে না। অনুরূপ বালিগা কুমারী নারীকেও তার অনুমতি ছাড়া বিবাহ দেওয়া যাবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কুমারী নারীর অনুমতি কীভাবে বুঝা যাবে? তিনি বললেন, নিরবতাই তার অনুমতি। ৮৪
৮৪.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৭০
হযরত খানাসা বিনতে খিযাম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তার পিতা তাকে বিবাহ দিল অথচ সে পূর্ব বিবাহিতা; উক্ত বিবাহ অপছন্দ করলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ ’র নিকট গিয়ে অভিযোগ করলে তিনি উক্ত বিবাহ ভেঙ্গে দেন। ৮৫
৮৫.বুখারী, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৭০
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, এক বালিগা কুমারী মেয়ে রাসূলুল্লাহ ’র দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করলো যে, তার পিতা তার অমতে তাকে বিবাহ দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে এ স্বামীর সাথে থাকা না থাকার ইখতিয়ার দিলেন। ৮৬
৮৬.আবু দাউদ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৭১
এভাবে একটি মেয়ে নবী করিম (ﷺ) ’র নিকট এসে বললো যে, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা আমার বিয়ে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে করে দিয়েছেন। সুতরাং এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রিয়নবী (ﷺ) মেয়েটিকে অধিকার দিলেন যে, তুমি চাইলে এ বিয়ে বহাল রাখ, চাইলে ভঙ্গ কর। এরপর মেয়েটি বললো, আমি আমার পিতার সিদ্ধান্তকে বহাল রাখছি। কিন্তু আমি এই প্রশ্ন মহিলাদেরকে একথা জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য করেছি যে, তাদের ব্যাপারে পৃষ্ঠপোষকদের কোনো ক্ষমতা নেই। ৮৭
৮৭.বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, নাসাঈ, সূত্র, ইসলামে নারী, পৃ. ৮১
এভাবে মানবতার ইতিহাসে নারী এতোবড় অধিকার ও মর্যাদা লাভ করলো। অর্থাৎ ইসলামপূর্বে নারীর গ্রহণ ও বর্জনের কোনো অধিকার ছিলোনা। তখন তার জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো পুরুষরাই। তার ইচ্ছা-অধিকার ছিলোনা যেকোনো পুরুষ তাকে ক্রয়-বিক্রয় করতো।
মাহর
____________________
মাহর
বিবাহবন্ধন উপলক্ষে স্বামী বাধ্যতামূলক ভাবে স্ত্রীকে নগদ অর্থ, সোনা-রূপা বা স্থাবর সম্পত্তির আকারে যে মাল প্রদান করা হয় তাকে মাহর বলে। অথবা বলা হয় মাহর হলো ঐ সম্পদের নাম যা বিবাহের আকদের ফলে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ ব্যবহারের অধিকারের বিনিময়ে স্বামীর উপর ওয়াজিব হয়। তা নির্দ্দিষ্টভাবে উল্লেখ করার মাধ্যমেও হতে পারে কিংবা আকদের ভিত্তিতে সাব্যস্থ হতে পারে। দেন মাহর স্বামীর একটি বাধ্যতামূলক কর্তব্য এবং এটা সম্পূর্ণ স্ত্রীর হক। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِنْ طِبْنَلَكُمْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَرِيئًا
আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মাহর দিয়ে দাও সন্তুষ্ট চিত্তে। খুশী মনে তারা মাহরের কিছু অংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দে ভোগ কর। ৮৮
৮৮.সূরা নিসা আয়াত: ৪
প্রাক ইসলামী যুগে স্ত্রীদের মাহর আদায়ের ক্ষেত্রে বহু ধরনের তালবাহনা ও অবিচার প্রচলন ছিল।
এক. স্ত্রীর মাহর তার হতে পৌঁছত না বরং মেয়ের অভিভাবকগণ তা আদায় করে আত্মসাৎ করতো। এ প্রথা উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে-
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ
অর্থাৎ তোমরা স্ত্রীদের মাহর তাদেরকে অর্পণ করো কোন অভিভাবকের হাতে নয়।
দুই. স্ত্রীর মাহর পরিশোধ করার ক্ষেত্রে নানা প্রকার তিক্ততার সৃষ্টি করা হতো। মাহর পরিশোধ না করার উপায় খুঁজতো। একান্ত পরিশোধ করতে হলে এটাকে জরিমানা মনে করতো এবং সন্তুষ্টচিত্তে তা পরিশোধ করত না। এ অন্যায় রোধ করার উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে نحلة অর্থাৎ তোমরা মাহর খুশি মনে পরিশোধ কর। তিন. অনেক স্বামী স্ত্রীকে প্রহসনমূলক রাজি করিয়ে কিংবা চাপ সৃষ্টি ও নির্যাতন করে মাহর মাপ করিয়ে নিতো এবং স্বামী এভাবে নিজেকে দায়মুক্ত মনে করতো। তা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে বলা হয়েছে
فَإِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَرِيئًا
অর্থাৎ যদি স্ত্রী স্বতর্ফুত ভাবে নিজের পক্ষ থেকে মাহরের কোনো অংশ ক্ষমা করে দেয়, তবেই তোমরা তা ভোগ করতে পারবে। সুতরাং ইসলাম নারীকেই মাহরের অধিকারী সাব্যস্থ করেছে। এখানে স্বামী কিংবা অভিভাবক কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। মাহর মূলত দেনা স্বরূপ। অনাদায় আবস্থায় স্বামী মারা গেলে তার সম্পত্তি থেকে স্ত্রী তার মাহর উসূল করে নিতে পারবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বর্তমান মুসলিম সমাজে জাহেলী যুগের ন্যায় মাহর নিয়ে নানা তালবাহানা ও অন্যায় অবিচার পরিলক্ষিত হয়। এই সব বদ অভ্যাস থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। বতমানে আরো একটি পরিত্যাজ্য বিষয় আমাদের অহংকারে পরিনত হয়ে উঠেছে। তা হলো মোটা অংকের বিরাট পরিমাণের মাহর ঘোষনা করা। স্বমীর অবস্থা ভেদে মাহর নির্ধারিত হওয়া উচিত। তার পিতার অবস্থা বিবেচ্য নয়। কারণ এটি পিতার উপর কর্তব্য নয় বরং ছেলের উপর ওয়াজিব। আর আমাদের দেশে তা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করতে হয়না বলে লাগামহীন ভাবে বড় আকারের মাহর নির্ধারণ করা হয়। এটা একপ্রকারের প্রতিযোগিতা ও লৌকিকতায় পরিণত হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ ’র স্ত্রীদের মাহর সাড়ে বার উকিয়া তথা পাঁচশত দেরহামের বেশী ছিলনা। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (رضي الله عنه) বলেন-
أَلَا لَا تُغَالُوا صَدُقَةَ النِّسَاءِ فَإِنَّهَا لَوْ كَانَتْ مَكْرُمَةً فِي الدُّنْيَا وَتَقْوَى عِنْدَ اللهِ لَكَانَ أَوْلَاكُمْ بِهَا نَبِيُّ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا عَلِمْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَكَحَ شَيْئًا مِنْ نِسَائِهِ وَلَا أَنْكَحَ شَيْئًا مِنْ بَنَاتِهِ عَلَى أَكْثَرَ مِنَ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ أُوقِيَّةً.
সাবধান! তোমরা স্ত্রীদের মাহর বৃদ্ধি করোনা। কেননা তা যদি দুনিয়াতে সম্মানের এবং আখিরাতে আল্লাহর কাছে তাকওয়ার বিষয় হতো তবে তোমাদের অপেক্ষা সেই ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অধিক উপযোগি ছিলেন। কিন্তু তিনি বার উকিয়ার বেশী দিয়ে কোন স্ত্রীকে বিবাহ করেছেন কিংবা তার কোন কন্যাকে বিবাহ দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। ৮৯
৮৯.আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী, সূত্র মিশকাত, পৃ.২৭৭
জান্নাতে রমনীকুলের সর্দার, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অতি আদরের কন্যা হযরত ফাতিমা রা,’র মাহর ছিল ৪৮০ মতান্তরে ৫০০ দিরহাম।
ইসলামী নীতি অনুসরণ না করে বড় মাপের মাহর ঘোষণা করলে পরিবারে বহুবিদ সমস্যা দেখা দেয়। একদিকে স্ত্রীর সামান্য ব্যতিক্রম দেখলে স্বামী বলে তোমাকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা মাহর দিয়ে বিয়ে করেছি- এই বলে স্ত্রীকে খোটা দেয়। অপরদিকে স্ত্রী ও স্ত্রীপক্ষ মনে করে বিবাহ ভেঙ্গে গেলেও ভয় নেই, কারণ মাহর উসূল করে ঐ টাকা দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবো কিংবা বিয়ে দেবো। ফলে বিয়ে খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়না। বরং ধীরে ধীরে ফাটল ধরে এবং একসময় তা ভেঙ্গে যায়।
বিবাহের ইসলামী নিয়ম
____________________
বিবাহের ইসলামী নিয়ম
পবিত্র ধর্ম ইসলামে বিবাহ নিছক একটি আনুষ্ঠানিকতার নাম নয় বরং এটি একটি ইবাদতও বটে। দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ছেলে-মেয়ে সরাসরি কিংবা উভয়ের নিযুক্ত প্রতিনিধি ইজাব (প্রস্তাব) ও কবুল (গ্রহণ) এর মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হয়। এ অনুষ্ঠানকে আকদও বলা হয়। ইজাবও কবুল নর-নারী উভয়ের পক্ষ থেকে হতে পারে যদিও সাধারণত পুরুষের পক্ষ থেকে ইজাব পাঠানো হয় আর কনের পক্ষে তা কবুল করা হয়ে থাকে।
আকদে একটি খুৎবা পাঠ করা সুন্নাত যাতে বিবাহ সম্পর্কীয় কুরআনের আয়াত ও হাদিস শরীফ বিদ্যমান থাকবে। মুত্তাকী পরহেযগার ও বিজ্ঞ আলিম দ্বারা আকদ দেওয়া, বিশেষ করে এসময় স্বামী-স্ত্রীর অধিকার সর্ম্পকে তাদেরকে নসিহত করা শ্রেয়। সামর্থ অনুযায়ী খুরমা বিতরণ করা সুন্নাত।
ইসলামে গোপন বিয়ে নিন্দনীয়। কারণ এতে বহুধরণের অপকর্মের জন্ম দেয়। তাছাড়া হাঠাৎ করে তাদের সন্তান জন্ম হলে কিংবা স্ত্রী গর্ভবতী হলে আত্মীয়স্বজন খারাপ মন্তব্য করবে এবং নিজের মানহানী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
أَعْلِنُوا هَذَا النِّكَاحَ وَاجْعَلُوهُ فِي الْمَسَاجِدِ وَاضْرِبُوا عَلَيْهِ بِالدُّفُوفِ .
এবং বিবাহ কাজ মসজিদে সম্পাদন করবে আর বিবাহ উপলক্ষে দফবাজাবে।৯০
৯০.তিরমিযী, সূত্র, মিশকাত; পৃ.২৭২, হাদিস নং ৩০০৬
মসজিদে আকদ অনুষ্ঠান করার কারণ হলো মসজিদে সমাজের সকল মানুষ উপস্থিত হয়। মসজিদে আকদ অনুষ্ঠিত হলে সমাজের সকলেই সহজে জানতে পারে। তাছাড়া পৃথিরীতে সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদ। সুতরাং বিবাহের ন্যায় পবিত্র অনুষ্ঠান পবিত্র স্থানে হওয়াই বাঞ্চনীয়।
আর দফ বাজানোর কারণ হলো বিবাহের প্রচার করা এবং সীমিত পর্যায়ে আনন্দ প্রকাশ করা। নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন-
" فَصَلَ مَا بَيْنَ الْحَلَالِ وَالْحَرَامِ: الصَّوْتُ وَالدُّفُّ فِي النِّكَاحِ ".
হালাল ও হারাম বিয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো শব্দ করা ও দফ বাজানো। ৯১
৯১.আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ, সূত্র, মিশকাত; পৃ. ২৭২
অর্থাৎ হালাল পন্থায় বিবাহ করলে তাতে দফ বাজিয়ে প্রচার করা হয় এবং উঁচু আওয়াজে আনন্দ প্রকাশ করা হয়। পক্ষান্তরে যদি হারাম পন্থায় কিংবা অবৈধভাবে বিবাহ হয় তা গোপনে চুপে চুপে সম্পন্ন করা হয়।
বিয়ের আনন্দ
____________________
বিয়ের আনন্দ
উল্লেখ্য যে, বিবাহে শরীয়ত সম্মত পন্থায় সীমিত আকারে আনন্দ প্রকাশ বৈধ। উপদেশমূলক ও শিক্ষনীয় বিষয়বস্তু সম্বলিত কবিতা, আবৃতি, নাত, গযল পরিবেশন ও ইসলামী সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান করে খুশি উদযাপন করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) তাঁর এক আনসারী আত্মীয়া মেয়েকে বিবাহ দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাশরীফ আনলেন আর বললেন, মেয়েটাকে কী স্বামীর সাথে পাঠিয়ে দিয়েছো? উপস্থিত লোকেরা বলল, হ্যা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, গান পারে এমন কাউকে তার সাথে পাঠিয়েছো কী? হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বললেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করলেন,
إِنَّ الْأَنْصَارَ قَوْمٌ فِيهِمْ غَزَلٌ فَلَوْ بَعَثْتُمْ مَعَهَا مَنْ يَقُولُ: أَتَيْنَا كُمْ أَتَيْنَاكُمْ فحيانا وحياكم ".
-আনসারীরা এমন সম্প্রদায় যাদের মধ্যে গযলের প্রবণতা রয়েছে। যদি তার সাথে এরূপ বলার লোক পাঠাতে যে বলত- আমরা তোমাদের কাছে এসেছি। আমরা তোমাদের কাছে এসেছি, আল্লাহ আমাদেরকে দীর্ঘজীবি করুন এবং তোমাদেরকেও দীর্ঘজীবি করুন। ৯২
৯২.ইবনে মাজাহ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৭২, হাদিস নং ৩০০৯
মুসনাদে আহমদে উল্লেখ আছে- প্রিয়নবী (ﷺ) নীরব বিয়েকে পছন্দ করতেন না, যতক্ষণ না তাতে দফ না বাজানো হয় এই গান না গাওয়া হয়-
“এসেছি মোরা তোমাদের কাছে - এসেছি মোরা তোমাদের পাশে
তাহলে, মোদের বল মারহাবা - তোমাদের মোরা বলি মারহাবা।”
হযরত আমের ইবনে সা’দ (رضي الله عنه) বলেন, আমি একদা এক বিবাহে হযরত কারযা
ইবনে কা’ব আনসারী ও আবু মসঊদ আনসারী (رضي الله عنه) ’র কাছে পৌঁছলাম। তখন সেখানে দেখি কতেক মেয়ে গান গাইছে। এটা দেখে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (ﷺ) ’র সাহাবীদ্বয় এবং বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদ্বয়! আপনাদের সামনে এরূপ করা হচ্ছে? (অর্থাৎ আপনারা নিষেধ করছেন না কেন?) তখন তাঁরা বললেন, তোমার ইচ্ছে থাকলে বস এবং আমাদের সাথে শোন, আর ইচ্ছে না হলে চলে যাও। কেননা বিয়ের সময় সীমিত আকারে আনন্দ প্রকাশের ব্যাপারে আমাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ৯৩
৯৩.নাসাঈ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৭৩, হাদিস নং ৩০১৩‘
বিবাহ নিশ্চয় আনন্দের সময়। ইসলাম তার অনুসারীদের জীবনকে সত্যিকার আনন্দ উল্লাস থেকে বঞ্চিত করেনা বরং পরিচ্ছন্ন আনন্দ উল্লাসের সুযোগ দান করেছে, যেন তাদের জীবন শুষ্ক ও নিরানন্দ না হয়ে থাকে। ইসলামে স্থবিরতা ও বিরক্তির অবকাশ নেই। মানুষ তার স্বভাবের তাগিদে পরিচ্ছন্ন ও শালীনতার মধ্যে থেকে নির্দোষ আনন্দ উপভোগ করতে পারে।
উপরোক্ত হাদিসে বিবাহ উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশের নিমিত্তে গান-গযল ইত্যাদির অনুমতি প্রদান করার পাশাপাশি গান-গযলের ধরনও বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং উক্ত হাদিসের উপর ভিত্তি করে লাগামহীন ও অশ্লীল গান ও বাদ্য-বাজনা সহ নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা করা সম্পূর্ণ হারাম।
বর্তমান মেহেদী অনুষ্ঠান কিংবা গায়ে হলুদের নাম দিয়ে নাচ-গান, প্যাকেজ অনুষ্ঠান বিয়ের অপরিহার্য বিষয়ে পরিনত হয়ে পড়েছে। টাকা না থাকলে কর্জ করে হলেও দুই-তিন লক্ষ টাকা খরচ না করলে পারিবারিক স্টেটাস বজায় থাকে না। এক্ষেত্রে পরিবার প্রধান ধার্মিক হলেও অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে পরাস্ত হতে হয়।
একদা এরূপ এক পরিবার প্রধান অর্থাৎ বরের পিতা ইশার নামাযের পর মসজিদে আমাকে বলেছিলেন- হুজুর! আপনি আমাকে অনুমতি দিলে আজ রাতে আমি মসজিদে থাকতে চাই, আমি বললাম, আপনার বাসায় কী মেহমান বেশি এসেছে? উনি অত্যন্ত অসহায় সুরে বললেন, না হুজুর। তবে আমার বাসায় মেহেদী অনুষ্ঠানের গান-বাজনা হবে আজ রাত। আমি তাদেরকে অনেক নিষেধ করেছি কিন্তু আমার কথা কেউ শুনেনা। তাই আজ রাত মসজিদে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার কথা শুনে মনে মনে ভাবলাম- মানুষ নিজের আপনজনের কাছেও কত অসহায়। নিজের বাড়ি ত্যাগ করতে হচ্ছে তবুও গান-বাজনা ও প্যাকেজ অনুষ্ঠান প্রতিরোধ করতে পারছে না।
মু’মিনের ঘুমও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আর এসব অশ্লীল ও বেহায়াপনা গান-বাজনা দ্বারা পুরো এলাকাবাসীর আরামের ঘুম হারাম হয়ে যায় এবং এলাকার যুবক-যুবতীদের চরিত্র হরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে এসব অনুষ্ঠান।
এসব বাজে কালচার প্রতিরোধ করতে হলে সমাজের নেতৃস্থানীয় , মুরুব্বীগণ সহ মসজিদের ইমাম-খতীবগণ সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং এর বিপরীতে না’ত, গযল ও ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিকল্প ব্যবস্থার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে।
যৌতুক প্রথা
____________________
যৌতুক প্রথা
ইসলামে যৌতুক প্রথা নিষিদ্ধ। এটি একটি নির্যাতনমূলক এবং জঘন্য কুপ্রথা। কনে পক্ষ থেকে বিবাহের বিনিময়ে শর্ত ও দাবী করে বরপক্ষ আর্থিক ধন-সম্পদ, গাড়ি, বাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, ফার্নিসার ইত্যাদি আদায় করাকে যৌতুক বলে। তবে কন্যাপক্ষ বর বা বরপক্ষকে স্বেচ্ছায় খুশীমনে উপহার, হাদিয়া স্বরূপ প্রদান করাকে জেহেয বলা হয়। এটি বৈধ। কিন্তু শর্তারোপ ও বাধ্যতামূলকভাবে কন্যাপক্ষ থেকে কিছু গ্রহণ করা শরীয়ত গর্হিত হারাম। বর্তমানে আমাদের সমাজে যৌতুক একটি মারাত্মক আর্থ-সামাজিক ব্যধিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি একটি নির্লজ্জ ব্যাপার। যৌতুক প্রদানে অপরারগতার কারণে কতো কন্যা কুমারীত্ব বরণ করতে হচ্ছে, কতো মহিলার বিবাহ প্রদান অসম্ভব হয়ে উঠেছে, কতো বিবাহিতা মহিলা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, কতো রমনীর সংসার ভেঙেছে, কতো নারী আত্মহত্যা করেছে এবং কতো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তা হিসাব করা মুশকিল। অশিক্ষিত সমাজের পাশাপাশি শিক্ষিত সমাজেও এ ব্যাধি পরিলক্ষিত হয়। এটি একটি নিরব ছিনতাই, চাঁদাবাজী এবং ভদ্রতার অন্তরালে অভদ্র আচরণ, কুসংস্কার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। কোন সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ দাবীপূর্বক যৌতুক আদায় করতে পারেনা। এর বিরোদ্ধে সামাজিক ও সম্মিলিতভাবে আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। এটা যে অত্যন্ত নিন্দনীয়, গর্হিত, মন্দ, নির্লজ্জ কুপ্রথা সে বিষয়ে জনসচেতনতার প্রয়োজন। এ ব্যাপারে পত্রিকা ও মিডিয়া, আলিম-উলামা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। যৌতুক গ্রহণকারী ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে বয়কট করে শাস্তির আওতায় আনা জরুরী। এ বিষয়ে বিদ্যমান আইনকে যথাযথ বাস্তবায়ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে এই কুপ্রথা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
বিয়ের পূর্বাপর প্রচলিত কুপ্রথা
____________________
বিয়ের পূর্বাপর প্রচলিত কুপ্রথা
আমাদের দেশে কোনো কোনো এলাকায় বিবাহের পূর্ব রাতে গায়ে হলুদ নামক একটি অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়। এতে অনেক বিজাতীয় সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন কুলাতে বদনা রেখে বদনার উপর চেরাগ স্থাপন করে সোহাগ কেটে কেটে বরের ভারীরা ঐ আগুনে আংটি লাগিয়ে বরের কপালে দাগ লাগানো। বরপক্ষ থেকে কনের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে কনের বাড়িতে আসা এবং কনেপক্ষ থেকে যুবক-যুবতীরা বরের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে বরের বাড়িতে যাওয়া এবং বরপক্ষের লোকেরা কনেকে আর কনে পক্ষের লোকেরা বরকে গোসল করানো এবং মেহেদী লাগানো। এই গায়ে হলুদকে কেন্দ্র করে আরো কতো ধরনের বিজাতীয় কর্মকাণ্ড ও বেহায়াপনা আচার অনুষ্ঠান করা হয় যা ইসলামী শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
প্রীতিভোজ
____________________
প্রীতিভোজ
ইসলামে ওলীমা করা সুন্নাত। বিবাহ অনুষ্ঠানের পর কিংবা বাসর রাত যাপনের পর স্বামীর পক্ষ থেকে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দাওয়াত দিয়ে ভোজের ব্যবস্থা করাকে ওলীমা বলা হয়। এটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় সামর্থানুযায়ী করা হবে। এতে চাপ প্রয়োগ কিংবা কোনো প্রকারের ধরা-বাঁধা করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ বিবাহে ওলীমা অনুষ্ঠান করেছেন। হযরত যয়নাব (رضي الله عنه) কে বিয়ে করে বকরী যবেহ করে গোশ্ত ও রুটি দ্বারা মেহমানদের তৃপ্তি সহকারে আহার করান। ৯৪
৯৪.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র, মিশকাত, পৃ. ২৭৮, হাদিস নং ৩০৬২-৬৩
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (رضي الله عنه) কে বলেন أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ তুমি একটি বকরী দিয়ে হলেও ওলীমা অনুষ্ঠান করো। ৯৫
৯৫.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র মিশকাত; পৃ. ২৭৮, হাদিস নং ৩০৬১
তবে অহংকার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে প্রতিযোগীতামূলক খাবার আয়োজনকারীর দাওয়াত কবুল না করাই উত্তম। এ ধরনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত অন্ষ্ঠুানে অংশগ্রহণ করতে এবং পানাহার করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিষেধ করেছেন। ৯৬
৯৬.বায়হাকী, (৪৫৮ হি.) শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬৯, হাদিস নং ৩০৭৭
কিন্তু আমরা ইসলামী আদর্শচ্যুত হয়ে অনেক অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছি। কনে পক্ষ থেকে এক প্রকারের জোর জরবদস্তীভাবে বর পক্ষ দুই হাজার, পাঁচ হাজার লোকের খাবার আদায় করা চরম অন্যায়। শুধু তা নয় বরং খাবারের আইটেম কী হবে- তাও উল্লেখ করে দেয়। খাবারের আগে-পরে কী কী দিতে হবে, কোন ক্লাব ভাড়া করবে, বিয়ের দিন প্রথমে একশ থেকে পাঁচশ জনের খাবার বরের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। নির্ধারিত মেহমানের অতিরিক্ত আসলে তাদেরকেও যথাযথভাবে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি খাবারের আইটেম নিয়ে বাড়াবাড়ী করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বিয়ে ভঙ্গের বহু নজীরও আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখতে পাই। কনে পক্ষ হওয়াটাই যেন তাদের অপরাধ, সব গ্লানি তাদেরই সহ্য করতে হয়। বিয়ের পর দিন বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে কনে পক্ষ (মুরগীর পাক, ট্যাংয়ের) ভাত নিয়ে দেখতে গেলে বিয়ের দিন কনেপক্ষ থেকে পাঠানো ফ্রিজে রাখা বাসী খাবার খেয়ে ফিরে আসতে হয়।
বিয়ের দিন বরের বাড়ির জন্য সংসারে প্রয়োজনীয়- অপ্রয়োজনীয় যাবতীয় আসবাবপত্র- পাটি-বালিশ, খাট-ফালং, টিভি-ফ্রিজ থেকে আরম্ভ করে ময়লা ফেলার পাত্র থেকে শুরু করে চুলার ছাই তুলার কাঠিমালা পর্যন্ত পাঠাতে হয়। ছোট থেকে মাঝারী ও বড় আকারের হান্ডি, পাতিল, ডেক্সি, কড়াই, পিঠা বানানোর মেলুন, পীরা, গরম ডেক্সি ধরার জন্য লোশনী, সাবানদানীসহ এতো সব দেওয়ার পরও বরপক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। কোন একটি আইটেম একটিু নিরস হলে কিংবা ভুলে বাদ পড়লে তড়িৎগতিতে তা কনে পক্ষের কানে পৌঁছানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে খোটা মেরে বউকে ইঙ্গিতে কিংবা প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো পরিবারে এজন্যে কনেকে নির্যাতিতও হতে হয়।
বিয়ের পরে কমপক্ষে দীর্ঘ এক বছর যাবৎ বিভিন্ন মাস ও দিবসকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন প্রকারের নাস্তা ও খাবার প্রেরণ করতে হয়। যেমন- রমযানে ইফতারী সামগ্রী, ঈদে বরপক্ষের ছোট বড় সকলের জন্য কাপড়, সেমাই-চিনি, শবে কদর, শবে বরাত, মর্হরম, মিলাদুন্নবী (ﷺ) , কুরবানীতে গরু-ছাগল ও যাবতীয় মরিচ, মসল্লা, তেলসহ রন্ধন সামগ্রী, রুটি, পরটা, বাগরখানী, রাধা ও কাঁচা সব ধরনের বস্তু সামগ্রী কনে পক্ষ থেকে বরপক্ষকে দিতে বাধ্য। আবার মৌসুমী ফল-ফ্রুট যেমন- আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, তরমুজ, বাঙী, জাম, বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন প্রকারের নাস্তা-পিঠা যেমন মধুভাত, গুড়াপিঠা, শীতপিঠা, জালিপিঠা, তালপিঠা, ফুলপিঠা ইত্যাদি নাম জানা-অজানা বহু ধরনের নাস্তা সামগ্রী পাঠাতে হয়। এগুলোর পরিমাণ আবার কম হতে পারবে না। সামর্থানুযায়ী কেউ সি.এন.জি করে কেউ ঠেলাগাড়ি করে আবার কেউ ট্রাকভরে পাঠায়। বরপক্ষ এগুলো তার সমাজে, পাড়া-প্রতিবেশীকে এবং আত্মীয়-স্বজনকে বিতরণ করে। বরপক্ষের চাহিদার তুলনায় এসব সামগ্রী একটু কম হলে বরের মা পুত্র বধুকে বলে- “ও বউ! আমরা তোমার পিতা-মাতার কাছে এসব কিছু চাইনি। দিলেন যখন এতো কম দিলেন কেন? আমার আত্মীয় স্বজন যে বেশী তা তোমার পিতা-মাতা কি জানেনা? এখন এগুলো কাকে বাদ দিয়ে কাকে দেবো? তখন কনে পিতা-মাতার নিকট ফোন করে এ নিয়ে ঝগড়া করে। তখন কনের পিতা-মাতার মনের কষ্ট বহুগুণ বৃদ্ধি পায় আর মনে প্রশ্ন জাগে কনের পিতা-মাতা হলাম কেন?
বিয়ের পরে কনে পক্ষের আত্মীয় স্বজন নতুন জামাই বাবুকে দাওয়াত খাওয়াই। যেমন কনের খালার বাড়িতে, নানার বাড়িতে কিংবা ফুফুর বাড়িতে একের পর এক দাওয়াত গ্রহণ করতে হয় বরকে। প্রতি জনের পক্ষ থেকে বরসহ বরের ঘরের ছোট-বড় সকল সদস্যকে শাড়ি, থ্রিপিছ, পেন্ট-শার্ট ও জামা-কাপড় উপহার দিতে হয়। কোন সদস্য বরের সঙ্গে না আসলেও তার পোশাক পাঠিয়ে দিতে হয়। যেন এটা তাদের একান্ত প্রাপ্য। হ্যাঁ, কেউ যদি কাউকে কোন হাদিয়া বা উপঢৌকন দেয় তা নেয়া আবশ্যক। ফেরৎ দেওয়া অসৌজন্যমূলক আচরণ বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু আমরা যেসব আচার-অনুষ্ঠানের কথা বলছি তা হাদিয়ার পর্যায় অতিক্রম করে বাধ্যতামূলক অন্যায়-অবিচারে পর্যবেশীত হয়ে পড়েছে। কারণ এগুলোর কোন একটির সামান্য ব্যতিক্রম হলে সমালোচিত হয় এবং যার খেসারত দিতে হয় দীর্ঘদিনের প্রিয় বাড়ি-ঘর, ভাই-বোন. পিতা-মাতা ছেড়ে আসা কোমলমতি নতুন বধুকে।
এক বছর পর মেয়ের ঘরে যখন কোনো সন্তান আসবে তখন আকীকার জন্য নানা বাড়ি থেকে গরু কিংবা ছাগল এবং সমপরিমাণ যাবতীয় খাবার সামগ্রী সরবরাহ করতে দেখা যায়। এসব আচার-ব্যবহার কনেপক্ষ মেয়ের সুখ-শান্তির জন্য ঋন করে হলেও করে থাকে। তারা একটুখানিও ভেবে দেখেনা যে, তাদেরও তো কন্যা সন্তান আছে। আবার এরকম মানুষও আছে যারা বলে- আমরাও আমাদের মেয়েদেরকে এসব দিয়ে এসেছি এখন ছেলেদের বেলায় নেবোনা কেন? এসব অপসংস্কৃতি ও অনৈসলামী কালচার চট্টগ্রামেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। বরপক্ষ তাদের বধুকে স্বর্ণালংকার প্রদান করে যা পরিধান করে বধু স্বামীর বাড়িতেই আসবে তার মূল্য হিসাব করে নির্ধারিত মাহর থেকে বিয়োগ করা হয়। পক্ষান্তরে কনে পক্ষ থেকে যত মূল্যবান সামগ্রী দেয়া হোকনা কেন যা সর্বদা বরের ঘরে ব্যবহৃত হয় থাকে তা কোনো হিসাবেই আসে না। অবশ্য এসব চরিত্র সব পরিবারে সকল মানুষের মধ্যে নেই। এর ব্যতিক্রমধর্মী অনেক পরিবার দেখা যায় যারা এইসবকে মনে-প্রাণে পছন্দ করেন না বরং ঘৃণার চোখে দেখেন। এরূপ ভালো মানুষ আছে বলেই পৃথিবীতে সুখ-সমৃদ্ধি আদর্শ পরিবার আদৌ বিদ্যমান। যারা পুত্র বধুকে নিজেদের কন্যার ন্যায়, ভাসুর, দেবর, ননদরা নিজেদের বোনের মতো যথাক্রমে স্নেহ-মমতা ও সম্মান প্রদর্শন করে সহজেই আপন করে নেয়। নব বধুও নিজের পিতা-মাতা ও ভাই-বোন থেকে শশুরবাড়ির লোকজনকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের মনজয় করতে সচেষ্ট হয়। এভাবে একটি সুখী-সমৃদ্ধি পরিবার গঠিত হয়। আর এরূপ পরিবারকেই বলা হয় পৃথিবীর স্বর্গ।
বর্তমান আমাদের মুসলিম সমাজে উপরোক্ত অনৈতিক কার্যক্রম অলিখিত বিধি হিসাবে প্রচলিত হয়ে আসছে। দাতা কর্তব্য মনে করে দিচ্ছে আর গ্রহীতা হকদার মনে করে গ্রহণ করছে। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে এই সত্যটা বেরিয়ে আসবে যে, আজকে একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সম্ভবত এ কারণেই পিতা-মাতার চেহারা মলিন হয়ে যায়।
মহানবী (ﷺ) তাশরীফ এনে ইসলাম থেকে যাহেলী যুগের যেসব অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে মুসলমানদেরকে বিশেষত নারী জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন বর্তমান মুসলিম জাতি ধীরে ধীরে পুনরায় সেই তিমিরে ফিরে যাচ্ছে। সুশিক্ষা ও আত্মমর্যাদাবোধের অভাবে এবং স্বার্থপরতা, বিলাসিতা ও লোভের মোহে অন্ধ হয়ে চোখ বুঝে এইসব অমানবিক কর্মকান্ড আমরা দিব্বি করে যাচ্ছি। এইসব থেকে বেরিয়ে আসা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আর এজন্য প্রয়োজন কুরআন-হাদিসের সঠিক জ্ঞান ও অনুসরণ। এ বিষয়ে সমাজের সুশিক্ষিত আলোকিত মানুষ বিশেষত আলিম সমাজের ভূমিকা ফলপ্রসূ হবে বলে আশা করা যায়।
দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, আজকের তথাকথিত নারী মুক্তির আন্দোলনকারীরা এ বিষয়ে সোচ্চার হতে এবং এগুলো বন্ধের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায় না, বরং তাদের কর্মকান্ড ও বিষয়বস্তু দেখে মনে হয় তারা কেবল ইসলামের বিরুদ্ধে নারী জাতিকে উচকিয়ে দিয়ে ইসলাম বিমুখ করার টীকাধারী নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য
____________________
স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য
মানুষের পারষ্পরিক সম্পর্কের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বামী-স্ত্রী একজন অপরজনের পরিপূরক সত্তা। এ কারণে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার এবং উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ
আর নারীদের তেমনি অধিকার আছে যেমনি আছে তাদের উপর পুরুষদের অধিকার; কিন্তু নারীদের উপর পুরুষদের মর্যাদা রয়েছে। ৯৭
৯৭.সূরা বাকারা, আয়াত: ২২৮
স্বামীর অধিকার স্ত্রীর উপর তুলনামূলক একটু বেশী। তাই স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য অধিক। সুতরাং কুরআন, হাদিসের আলোকে প্রথমে স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার এবং স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করবো।
১. স্ত্রীর প্রধানতম দায়িত্ব হলো স্বামীকে সম্মান করা
____________________
১. স্ত্রীর প্রধানতম দায়িত্ব হলো স্বামীকে সম্মান করা।
নারীদের জন্য বিয়ের পুর্বে সর্বাপেক্ষা সম্মানী হলেন পিতা-মাতা। বিয়ের পর হলেন স্বামী। সম্মান প্রদর্শনের সর্বোচ্চ মাত্রা হলো সিজদা করা যা একমাত্র মহান আল্লাহকে করা হয়। স্ত্রীর জন্য স্বামী আল্লাহর পরে সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এ দিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
لَو كُنْتُ آمُرُ أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِأَحَدٍ لَأَمَرْتُ الْمَرْأَة أَن تسْجد لزَوجهَا
যদি আমি কোন ব্যক্তিকে সিজদা করার আদেশ দিতাম তবে স্ত্রীকে আদেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করতে। ৯৮
৯৮.তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮১
অন্য বর্ণনায় আছে-
لَو كنت آمُر أحد أَنْ يَسْجُدَ لِأَحَدٍ لَأَمَرْتُ النِّسَاءَ أَنْ يَسْجُدْنَ لِأَزْوَاجِهِنَّ لِمَا جَعَلَ اللَّهُ لَهُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ حق
আমি যদি কাউকে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তবে আমি স্ত্রীদেরকে তাদের স্বামীদেরকে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম। কারণে আল্লাহ স্ত্রীদের উপর স্বামীদের আধিপত্য দিয়েছেন। ৯৯
৯৯.আবু দাউদ, আহমদ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮২
অর্থাৎ স্ত্রীর কাছে স্বামী এতই সম্মানীয় যে, স্ত্রী কর্তৃক সিজদার উপযোগী স্বামী; কিন্তু মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা নিষিদ্ধ বলে তা করা যাবে না।
২. স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব হলো স্বামীর আনুগত্য করা।
____________________
২. স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব হলো স্বামীর আনুগত্য করা।
শরীয়ত সম্মত সব বিষয়ে স্ত্রী স্বামীর অনুগত হবে। তবে স্বামীর শরীয়ত বিরোধী কোনো আদেশ-নিষেধ মানতে স্ত্রী বাধ্য নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
الْمَرْأَةُ إِذَا صَلَّتْ خَمْسَهَا وَصَامَتْ شَهْرَهَا وَأَحْصَنَتْ فَرْجَهَا وَأَطَاعَتْ بَعْلَهَا فَلْتَدْخُلْ مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ شَاءَتْ
যে মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করবে, রমযান মাসের রোযা রাখবে, নিজের লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে এবং স্বামীর অনুগত থাকবে সে জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। ১০০
১০০.আবু নুয়াইম র. হিলয়া, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮১
وَلَوْ كُنْتُ آمُرُ أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِأَحَدٍ لَأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا وَلَوْ أَمَرَهَا أَنْ تَنْقُلَ مِنْ جَبَلٍ أَصْفَرَ إِلَى جَبَلٍ أَسْوَدَ وَمِنْ جَبَلٍ أَسْوَدَ إِلَى جَبَلٍ أَبْيَضَ كَانَ يَنْبَغِي لَهَا أَن تَفْعَلهُ
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, যদি স্বামী তার স্ত্রীকে লাল পাহাড়কে কাল পাহাড়ে কিংবা কাল পাহাড়কে লাল পাহাড়ে রূপান্তরিত করতে আদেশ করেন তবে স্ত্রী তা করার চেষ্টা করবে। ১০১
১০১.ইবনে মাহজাহ, পৃ. ১৩৪, মিশকাত; পৃ. ২৮৩
উপরিউক্ত হাদিস দ্বারা উদ্দেশ্য হলো স্বামী যদি স্ত্রীকে কোন অসম্ভব কাজের আদেশ করেন তবুও স্ত্রী তা করার আপ্রাণ চেষ্ট চালিয়ে যাবে। অসম্ভব বলে স্বামীর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া উচিত হবে না।
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: فَقَالَ رَسُولُ اللهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-: "أَبْلِغِي مَنْ لَقِيتِ مِنَ النِّسَاءِ أَنَّ طَاعَةَ الزَّوْجِ وَاعْتِرَافًا بِحَقِّهِ يَعْدِلُ ذَلِكَ وَقَلِيلٌ مِنْكُنَّ مَنْ يَفْعَلُهُ
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, যে মহিলার সাথে তোমার সাক্ষাত হবে তাকে বলে দিবে যে, স্বামীর আনুগত্য এবং তার অধিকার স্বীকৃতি দিলে জিহাদের সাওয়াব পাবে, কিন্তু তোমাদের মধ্যে এমন মহিলা অল্প। ১০২
১০২.নুরুদ্দিন আলী ইবনে আবি বকর র (৮০৮ হি.),মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খণ্ড, ৪, পৃ, ৩০৮
৩. স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্ত্রী ঘর থেকে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ।
____________________
৩. স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্ত্রী ঘর থেকে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র নিকট একজন মহিলা জিজ্ঞাসা করল যে, স্ত্রীর উপর স্বামীর কী কী হক রয়েছে? উত্তরে তিনি ইরশাদ করলেন, স্ত্রী কখনো নিজেকে স্বামী থেকে দূরে রাখবে না যদিও সে উঠের পিঠে আরোহন অবস্থায় থাকে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘরে থেকে কিছু কাউকে দিবেনা। যদি কেউ এরূপ করে তবে সে গুনাহগার হবে এবং এর কোন সাওয়াব পাবে না। স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘর থেকে বের হবে না। যদি বের হয় তবে তাওবা না করা এবং ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত রহমত ও গযবের ফেরেশতারা তার উপর অভিশাপ দিতে থাকে। জিজ্ঞাসা করা হলো- স্বামী যদি যালিম হয় তবুও? তিনি বললেন, স্বামী যালিম হলেও। ১০৩
১০৩.ইমাম বায়হাকী র (৪৫৮ হি.) সুনানে বায়হাকী
এক হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- وَهَلُمَّ اَيُّهَا اِمْرَاةٍ خَرَجْتُ مَنْ بَيْنَهَا بِغَيْرِ اَذِنَ زَوْجِهَا كَانَتْ فِىْ سَخَطِ اللهِ حَتَّى تَرْجِعَ إِلَى بَيْتِهَا وَيَرْضَ عَنْهَا زَوْجَهَا
কোন স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতি ব্যতিত ঘর থেকে বের হয় তবে সে ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত এবং স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে থাকে। ১০৪
১০৪.ইমাম গাজ্জালী র. ইয়াহিয়াউল উলুম উদ্দিন
৪. স্বামীর অনুমতি ব্যতিত নফল রোযা রাখার অনুমতি নেই।
____________________
৪. স্বামীর অনুমতি ব্যতিত নফল রোযা রাখার অনুমতি নেই।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
لَا يَحِلُّ لِلْمَرْأَةِ أَنْ تَصُومَ وَزَوْجُهَا شَاهِدٌ إِلَّا بِإِذْنِهِ وَلَا تَأْذَنَ فِي بَيْتِهِ إِلَّا بِإِذْنِهِ
স্বামী উপস্থিত থাকলে তার অনুমতি ব্যতিত স্ত্রীর জন্য নফল রোযাজায়েয নেই এবং স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। ১০৫
১০৫. ইমাম মুসলিম (২৬১ হি.) সহীহ মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ১৭৮
তবে গুনাহের কাজে স্বামীর আনুগত্য স্ত্রীর উপর আবশ্যক নয়। কারণ মিশকাত শরীফে হাদিস বর্ণিত আছে-
لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ
স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। সুতরাং স্বামী যদি স্ত্রীকে শরীয়ত বিরোধী কোনো কাজে আদেশ দেয় তা মানতে স্ত্রী বাধ্য নয়। ১০৬
১০৬.শরহুস সুন্নাহ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৩২১
বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে-
لَا طَاعَةَ فِي مَعْصِيَةٍ إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوف
অর্থাৎ কোন পাপ কাজে কারো আনুগত্য করা যাবে না, আনুগত্য কেবল সৎকাজে করা হবে। ১০৭
১০৭.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৩১৯
৫. স্ত্রীর উপর স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখা একান্ত কর্তব্য।
____________________
৫. স্ত্রীর উপর স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখা একান্ত কর্তব্য।
যে সব স্ত্রী স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখে তারা স্ত্রী হিসাবে উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কোন স্বভাবের স্ত্রী উত্তম? তিনি বললেন-
الَّتِي تَسُرُّهُ إِذَا نَظَرَ وَتُطِيعُهُ إِذَا أَمَرَ وَلَا تُخَالِفُهُ فِي نَفْسِهَا وَلَا مَالِهَا بِمَا يَكْرَهُ
সেই স্ত্রী উত্তম যার দিকে স্বামী তাকালে সে তাকে সন্তুষ্ট করে, যখন তাকে স্বামী কোন কাজের আদেশ দেয় তখন সে তা যথাযথ পালন করে। আর সে নিজের ব্যাপারে এবং তার সম্পদের ব্যাপারে এমন কোন কাজ করে না যা স্বামী অপছন্দ করে। ১০৮
১০৮.নাসাঈ, বায়হাকী শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮৩
হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
أَيُّمَا امْرَأَةٍ مَاتَتْ وَزَوْجُهَا عَنْهَا رَاضٍ دَخَلَتِ الْجَنَّةَ
যে নারী তার স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।১০৯
১০৯.তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮১
يامعشر النساء : اتقين الله ، والتمسن مرضاة أزواجكن ، فان المرأة لو
تعلم ما حق زوجها لم تزل قائمة ما حضر غداؤه وعشاؤه
হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে মারফু হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, হে মহিলাদের দল! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর নিজের স্বামীর সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রাখ। যদি স্ত্রী জানত যে, স্বামীর প্রতি তার হক কতটুকু? তাহলে স্ত্রী স্বামীর জন্য সকাল-সন্ধার খাবার নিয়ে সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকত। ১১০
১১০.আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুসামউদ্দিন র (৯৭৫ হি.), কানযুল উম্মাল, খণ্ড ১৬, পৃ. ১৪৫
অর্থাৎ আদর্শ স্ত্রী সর্বদা স্বামীর সন্তুষ্টি ও তার মনজয় করার চেষ্টা করে। যেসব কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, সেবা-যত্ন, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-নাওয়া স্বামীর পছন্দ সর্বদা তা করা, প্রস্তুত রাখা স্ত্রীর উচিত। এক কথায় প্রত্যেক বৈধ বিষয়ে যে স্বামীর চাহিদা পূরণ করে স্বামীর সন্তুষ্টি অর্জন করা স্ত্রীর উপর আবশ্যক।
হযরত জাবির (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
ثَلَاثَةٌ لَا تُقْبَلُ لَهُمْ صَلَاةٌ وَلَا تَصْعَدُ لَهُمْ حَسَنَةٌ الْعَبْدُ الْآبِقُ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَى مَوَالِيهِ فَيَضَعَ يَدَهُ فِي أَيْدِيهِمْ وَالْمَرْأَةُ السَّاخِطُ عَلَيْهَا زَوْجُهَا وَالسَّكْرَانُ حَتَّى يصحو
তিন ব্যক্তির নামায কবুল হয় না এবং তাদের নেকী উপরে উঠেনা। ১. পলাতক ক্রীতদাস, যতক্ষণ না সে আপন মাওলার কাছে ফিরে আসে ও তার হাতে ধরা দেয়। ২. সেই স্ত্রী যার উপর তার স্বামী অসন্তুষ্ট, যতক্ষণ না সে তাকে সন্তুষ্ট করে এবং ৩. মাতাল, যতক্ষণ না সে হুশে আসে। ১১১
১১১.বায়হাকী, শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮৩
অর্থাৎ স্ত্রীর অসাবধানতা বশত কোন আচরণে স্বামী কষ্ট পেলে স্ত্রী অভিমান করে মুখ ভার করে না থেকে নারীর মমতা দিয়ে স্বামীকে খুশী করা প্রয়োজন। কারণ অন্যথা স্ত্রীর অন্যতম নামাযের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদত পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে যে, বনি আসহাল গোত্রের হযরত আসমা বিনতে ইয়াযিদ আনসারী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, তিনি নবী করিম (ﷺ) ’র দরবারে আগমণ করেন। তখন নবী করিম (ﷺ) সাহাবীদের মাঝে অবস্থান করছিলেন। আসমা (رضي الله عنه) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর উৎসর্গ হোক আমি সমগ্র নারী জাতির প্রতিনিধি হয়ে এসেছি। আমার জীবন আপনার জন্য উৎসর্গীত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল মহিলারা শুনবে যে, আমি আপনার কাছ থেকে বের হয়ে এসেছি অথবা শুনবে না। নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে নারী-পুরুষের সকলের প্রতি সত্য নবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন। আমরা আপনার উপর এবং আপনি যা নিয়ে আগমণ করেছেন তার উপর ঈমান এনেছি। আমরা নারী সম্প্রদায় আবদ্ধ ও সীমাবদ্ধ আপনাদের ঘরে অবস্থানকারী। আপনাদের চাহিদা পূরণকারিনী ও আপনাদের সন্তানের গর্ভধারিনী। আর আপনারা পুরুষদেরকে জুমা, জামাত, রোগীর সেবা, জানাযায় উপস্থিত ও হজ্জের ক্ষেত্রে আমাদের উপর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আর সর্বোত্তম হজ্জ হচ্ছে জিহাদ করা। আপনাদের কেউ হজ্জ, ওমরা ও জিহাদে বের হলে আমরা আপনাদের সম্পদ সংরক্ষণ করি। আমরা কি এসব আমলের সাওয়াব ও উত্তম কাজে আপনাদের সাথে শরীক হবো? নবী করিম (ﷺ) সাহাবীদের দিকে চেহারা ফিরিয়ে বললেন, কোন নারী কি তার দ্বীন সম্পর্কে এ নারীর চেয়ে উত্তম প্রশ্ন করেছে? উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা ভাবিনি কোনো নারী এরূপ হেদায়ত গ্রহণ করেন। নবী করিম (ﷺ) আসমা রা’র দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, হে নারী! তুমি বুঝ এবং তোমার পশ্চাতে থাকা নারীদের জানিয়ে দাও, স্বামীর জন্য স্ত্রী অনুরোক্তি, তার সন্তুষ্টি কামনা করা এবং তার সিদ্ধান্তের অনুসরণ করা পুরুষদের ঐসব নেক আমলের সাওয়াবের সমান। তারপর মহিলাটি খুশীতে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও তাকবীর বলতে বলতে চলে গেল। ১১২
১১২.ইমাম বায়হাকী র (৪৫৮ হি.) শোয়াবুল ঈমান, খণ্ড ৬, পৃ. ৪৬১
৬. স্বামীর সেবা যত্ন করা
____________________
৬. স্বামীর সেবা যত্ন করা
তার জিনিসপত্রকে নিজের মনে করে সংরক্ষণ করা, তার চাহিদা মতে খাবার তৈরি করা, তার উযূ-গোসলের পানি তৈরি রাখা এবং স্বামীর পোশাকাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতি খেয়াল রাখা স্ত্রীর উচিত। হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বলেন-
كُنْتُ أَغْسِلُهُ مِنْ ثَوْبِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَيَخْرُجُ إِلَى الصَّلاَةِ،
আমি রাসূলুল্লাহ ’র কাপড় থেকে নাপাক ধৌত করতাম, অতঃপর তিনি (তা পরিধান করে) নামাযের জন্য (মসজিদে) গমন করতেন। ১১৩
১১৩.বুখারী, খণ্ড ১, পৃ. ৩৬
স্বামীর কাপড় ধৌত করলে স্ত্রীর মর্যাদা কমে না বরং স্বামীর অন্তরে মহান মর্যাদার অধিকারীনী হয় এবং উভয়ের মধ্যে অকৃত্রিম ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বলেন-
كُنْتُ أَصْنَعُ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلَاثَةَ آنِيَةٍ مِنَ اللَّيْلِ مُخَمَّرَةً، إِنَاءً لِطَهُورِهِ، وَإِنَاءً لِسِوَاكِهِ، وَإِنَاءً لِشَرَابِهِ
আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র জন্য রাতে তিনটি পাত্রের ব্যবস্থা করে রাখতাম। ১. পানির পাত্র (যা দ্বারা তিনি ইস্তিঞ্জা ও উযূ করতেন) ২. মিসওয়াক ও ৩. পানি পান করার পাত্র। ১১৪
১১৪.ইবনে মাজাহ, পৃ. ৩০
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) মারফু হাদিসে বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
خد متكت زوجتك صدقة
তোমার স্ত্রী তোমার সেবা করা সাদকা স্বরূপ। ১১৫
১১৫.আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুসমামউদ্দিন র (৯৭৫হি.),কানযুল উম্মাল, খণ্ড ১৬, পৃ. ১৬৯
৭. স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া
____________________
৭. স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া
স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া আদর্শ স্ত্রীর কর্তব্য। স্বামী তার সাধ্যানুযায়ী যখন যা স্ত্রীকে প্রদান করেন স্ত্রী তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনে না করে অল্পকেও অধিক মনে করে হাসিমুখে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করা উচিত। বস্তু কিংবা বস্তুর মূল্য হিসাব না করে স্বামী যে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা প্রকাশার্থে উপহার দিয়েছেন সেটা হিসাব করা উচিত যা একজন স্ত্রীর জন্য অমূল্য সম্পদ। একজন স্ত্রীর জন্য তার স্বামীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসাই হলো সবচেয়ে বড় মূল্যবান বস্তু যা টাকা দিয়ে কিনা যায় না। কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীকে আরো বেশি দিতে ইচ্ছে হয়। আল্লাহ তা‘আলাও বলেছেন- যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, তবে তোমাদেরকে আমি নিয়ামত আরো বাড়িয়ে দেবো।
স্বামীর কোন উপহার স্ত্রীর পছন্দ না হলেও মুখের সামনে অপছন্দের কথা বলা উচিত নয়। এতে সমস্ত আনন্দ মুহুর্তের মধ্যে ভেস্তে যাবে এবং উভয়ের মধ্যে মনমালিন্যতা দেখা দেবে।
অনেক মেয়েদের স্বভাব হলো স্বামী তার কোনো একটি চাহিদা পূরণ করতে না পারলে স্ত্রী রাগান্বিত হয়ে বলেন- “তুমি জীবনে আমার একটি চাহিদাও পূর্ণ করনি।” অর্থাৎ সামান্য বিষয়ে অতীতের স্বামীর সব অবদানকে অস্বীকার করে বসে। হযরত আসমা (رضي الله عنه) বলেন, আমাদের মহিলাদের একটি দলের নিকট দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গমন করছিলেন এবং তিনি আমাদেরকে সালাম দিয়ে বললেন, সাবধান! কল্যাণকারীর অকৃতজ্ঞ হওয়া থেকে বেঁচে থাক। আমি বললাম,হে আল্লাহর রাসূল! কল্যাণকারীর প্রতি অকৃতজ্ঞতা কী? তিনি বললেন, তোমরা একটা সময় পর্যন্ত পিতা-মাতার অধীনে জীবন যাপন কর। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা (বিবাহের মাধ্যমে) স্বামীর দ্বারা আনন্দিত করেন। তার মাধ্যমে তোমাদের এবং সন্তানাদির আর্থিক কল্যাণ অর্জিত হয়। অতঃপর তোমরা তার প্রতি যখন অসন্তুষ্ট হয়ে যাও তখন বলে ফেল যে, আমি কখনো তার থেকে কোনো কল্যাণ পাইনি। ১১৬
১১৬.ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. (২৪১ হি.) মুসনাদে আহমদ, আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুসসাম উদ্দিন র. (৯৭৫হি.) কানযুল উম্মাল খণ্ড ১৬, পৃ. ১৬৫; নুরুদ্দিন আলী ইবনে আবি বকর র. (৮০৮হি.) মাজমাউয যাওয়ায়েদ।
لا ينظر الله إلى امرأة لا تشكرلزوجها وهي لا تستغني عنه
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত মারফু হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- আল্লাহ তা‘আলা ঐ মহিলার প্রতি দয়ার দৃষ্টিতে থাকাবেন না, যেই মহিলা তার স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞ, অথচ স্ত্রী স্বামীর অমুখাপেক্ষী নয়। ১১৭
১১৭.আলী ইবনে হুসসাম উদ্দিন র (৯৭৫হি.) কানযুল উম্মাল, খণ্ড ১৬, পৃ. ১৬৫
সাধারণত দেখা যায় যে, মহিলারা তারা নিজেদের চেয়ে বৃত্তবান ধনীদের অবস্থা দেখে নিজেদের অবস্থা বিবেচনা করে থাকে। অন্যদের চেয়ে নিজের শাড়ি-গয়না একটু নিরস হলে স্বামীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় না রেখে ঝগড়া আরম্ভ করে দেয়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- “তোমরা নিজেদের চেয়ে উন্নতদের দিকে তাকিও না বরং নিজেদের চেয়ে যারা নিম্নমানের জীবন-যাপন করে তাদের দিকে তাকাও।” এতে কৃতজ্ঞতার উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে।
হযরত শেখ সাদী (رحمة الله) জ্ঞানার্জনের সময়কালে একদা অভাবেব কারণে খালি পায়ে জুতা বিহীন চলছিলেন। মনে মনে তিনি নিজের ভাগ্যের প্রতি আক্ষেপ করছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে, তার ন্যায় অন্য একজন মানুষের একটি পা নেই। তখন তিনি এই বলে আল্লাহর শোকর করলেন যে, আল্লাহ আমাকে জুতা কিনার তাওফিক না দিলেও তো অন্তত পা দিয়েছেন যা দিয়ে আমি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছি। তখন সাথে সাথে তার অন্তর থেকে বিষণœতা দূরীভূত হয়ে গেল এবং আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন।
স্বামীর সাধ্যের অতিরিক্ত ভরণ-পোষণ দাবী করা স্ত্রীর অনুচিত। একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র স্ত্রীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে অতিরিক্ত খোরপোশ দাবী করেছিলেন। তারা তাঁর চতুর্দিকে বসে রইলেন। এ অবস্থায় হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) ও হযরত ওমর (رضي الله عنه) তাঁর অনুমতিক্রমে ভিতরে প্রবেশ করলেন, হযরত ওমর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বিমর্ষ অবস্থায় চুপ করে বসে থাকতে দেখলেন। হযরত ওমর (رضي الله عنه) বলেন, আমি মনে মনে বললাম, আমি এমন কথা বলবো যাতে রাসূলুল্লাহ হাসেন। হযরত ওমর (رضي الله عنه) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আপনি দেখতেন যে, আমার স্ত্রী বিনতে খারেজা আমার কাছে এরূপ (অতিরিক্ত) খোরপোশ চাইতেছে, তাহলে আমি উঠে তার ঘাড়ে আঘাত করতাম। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হেসে দিলেন আর বললেন, এরা আমার চারপাশে ঘিরে বসে আছে- তারা তাদের বাড়তি খোরপোশ চাচ্ছে। তখন হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) উঠে তাঁর কন্যা হযরত আয়িশা রা’র ঘাড় মটকাতে লাগলেন এবং হযরত ওমর (رضي الله عنه) উঠে তাঁর কন্যা হযরত হাফসা রা’র ঘাড় মটকাতে লাগলেন আর উভয়ে বলতে লাগলেন- তোমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র নিকট এমন বস্তু দাবী করছ যা তাঁর কাছে নেই। তখন তারা বললেন, খোদার কসম! আমরা আর কখনো তাঁর কাছে এমন কিছু দাবী করবো না যা তাঁর কাছে নেই। অতঃপর তিনি এক মাস কিংবা ঊনত্রিশ দিন তাঁদের কাছ থেকে পৃথক রইলেন। অতঃপর এই আয়াত নাযিল হল- “হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের বলুন, যদি তোমরা পার্থিব জিন্দেগী ও দুনিয়ার ভোগ-বিলাস চাও, তবে এসো আমি তোমাদেরকে কিছু দিয়ে ভালভাবে বিদায় করে দিই। আর যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এবং পরকাল চাও, তবে তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল তাদের জন্য আল্লাহ মহান পুরস্কার ঠিক করে রেখেছেন। ১১৮
১১৮.সূরা আহযাব, আয়াত: ২৮-২৯
অতঃপর তিনি হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) কে প্রথমে বললেন, হে আয়েশা! আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই, এর উত্তর তোমার পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ ব্যতিত দ্রুত দিওনা। আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন কি বিষয়ে? তখন তিনি উক্ত আয়াতদ্বয় পাঠ করে শুনালেন। তখন আয়েশা (رضي الله عنه) বললেন, আপনার ব্যাপারেও কি আমাকে আমার পিতার সাথে পরামর্শ করতে হবে? বরং আমি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পরকালকে গ্রহণ করলাম।১১৯
১১৯.ইমাম মুসলিম র. (২৬১হি.) সহীহ মুসলিম, সূত্র মিশকাত, পৃ. ২৮১
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র কাছে তাঁর স্ত্রীগণ অতিরিক্ত খোরপোশ দাবী করছিলেন আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ কারণে মনক্ষুন্ন হয়ে বসে আছেন। ওদিকে মহান আল্লাহ আরশ আ‘যম থেকে তাঁর হাবীব (ﷺ) ’র অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আয়াত নাযিল করে স্ত্রীদের শাসিয়ে দিয়ে তাঁর হাবীব (ﷺ) কে সান্তনা দিলেন। কারণ রাসূলুল্লাহ ’র কষ্ট আল্লাহ কখনো বরদাস্ত করেন না।
স্বামী-স্ত্রী কখনো কোনো বিষয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হলে তা যদি কনের পিতা-মাতার বোধগম্য হয় তখন তাদের উচিত প্রথমে নিজেদের মেয়েকে শাসন করা যেভাবে ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফা হযরত আবু বকর ও ওমর (رضي الله عنه) করেছিলেন। এতে দু’টি উপকার নিহিত থাকে। প্রথমত স্ত্রী মনে করবে যখন আমার পিতা-মাতা স্বামীর পক্ষে রয়েছেন তখন নিশ্চয় আমি অন্যায় করছি। দ্বিতীয়ত স্বামীর রাগ কমে যাবে এবং শ্বশুর-শাশুরীকে ভুল বুঝবেনা। পক্ষান্তরে স্বামীর পিতা-মাতার উপস্থিতিতে ঝগড়া হলে তখন তার পিতা-মাতা প্রথমে নিজেদের ছেলেকেই থামিয়ে দেওয়া উচিত। এতে স্ত্রী অন্তত মনে করবে যে, স্বামী বিপক্ষ হলেও শ্বশুর-শাশুরী আমার পক্ষে রয়েছেন। এভাবে পানি দিয়ে জলন্ত আগুনকে যেভাবে নিভানো হয় তেমন স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় প্রজ্জলিত অনল নিভানো সম্ভব। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে আগুনে তেল ছিটানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
হযরত নু’মান ইবনে বশীর (رضي الله عنه) বলেন, একদা হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র গৃহে গিয়ে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। এ সময় তিনি হযরত আয়িশা রা’র উচ্চকণ্ঠ শুনতে পেলেন। ভিতরে প্রবেশ করে হযরত আশিয়া (رضي الله عنه) কে ধরে চড় মারার জন্য উদ্যত হলেন আর বললেন, সাবধান! আর কোনদিন যেন তোমাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র সামনে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে না দেখি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) কে আয়িশা (رضي الله عنه) কে প্রহার করা থেকে বাধা দিলেন। আবু বকর (رضي الله عنه) নিজ কন্যার উপর রাগান্বিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আবু বকর (رضي الله عنه) চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) কে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখলে তুমি? এ ব্যক্তির হাত থেকে তোমাকে আমি কিভাবে বাঁচালাম? বর্ণনাকারী বলেন, এ ঘটনার পর কয়েকদিন যাবৎ হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র ঘরে আসলেন না। অতঃপর একদিন হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ ’র ঘরে এসে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন এবং প্রবেশ করে দেখলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও হযরত আয়িশা রা’র মধ্যে আপোষ হয়ে গেল। অর্থাৎ তাঁরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন। এটা দেখে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) বললেন, আপনারা দু’জনে শান্ত পরিবেশে আমাকেও অন্তর্ভূক্ত করে নিন, যেভাবে আপনাদের অশান্ত পরিবেশে আমাকে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমরা তাই করলাম, আমরা তাই করলাম। ১২০
১২০.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫হি.), সুনানে আবু দাউদ, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৪১৭
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِذَا نَظَرَ أَحَدُكُمْ إِلَى مَنْ فُضِّلَ عَلَيْهِ فِي الْمَالِ وَالْخَلْقِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْهُ: مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ قَالَ: ্রانْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَا تَنْظُرُوا إِلَى من
هُوَ فوقكم فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لَا تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُم
হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, যখন তোমাদের কেউ এমন ব্যক্তিকে দেখবে যাকে ধন-সম্পদে ও সুন্দরে তার থেকে অধিক দেয়া হয়েছে, তখন সে যেন নিজের চাইতে নিম্নমানের ব্যক্তির দিকে তাকায়। বুখারী ও মুসলিম, মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, তোমরা নিজেদের অপেক্ষা নিম্ন অবস্থার লোকদের প্রতি তাকাও। এমন ব্যক্তির দিকে তাকিও না যারা তোমার চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের। যদি এই নীতি অবলম্বন করা তাহলে তোমার প্রতি আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামতকে ক্ষুদ্র ও হীন মনে করবে না। ১২১
১২১.শায়খ ওয়ালী উদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ র. (৭৪৯ হি.), মিশকাত, পৃ. ৪৪৭
৮. স্বামীর রাগ দমন করা
____________________
৮. স্বামীর রাগ দমন করা
পুরুষ মানুষ সাধারণত ঘরের বাইরে সারাদিন বিভিন্ন কারণে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে স্ত্রী সন্তানের কাছে ঘরে আসে একটু শান্তি লাভের উদ্দেশ্যে। এ সময় বুদ্ধিমতি স্ত্রী হাসিমুখে ও রূপ-গুণ দিয়ে স্বামীকে সান্তনা দিয়ে শান্ত করতে সক্ষম হয়। আবার অনেক বোকা স্ত্রীদের দেখা যায় যে, স্বামী ঘরে আসা মাত্র বিভিন্ন সমস্যা ও অপ্রাপ্তির কথা উল্লেখ করে স্বামীকে আরো উত্তেজিত করে তোলে। এটা মোটেও উচিত নয়। বরং এ সময় তার উচিত স্বামীর হাত থেকে বাজারের থলে নিয়ে নেওয়া, গরম থেকে আসলে তাড়াতাড়ি পাখা চালু করে বাতাসের ব্যবস্থা করা, স্বামী গোসল করলে তার কাপড় ও গামছা খুঁজে নিয়ে তার সামনে পেশ করা এবং সময় মতো স্বামীর সেবা-যত্ন করা তাহলে কোন বিবেক সম্পন্ন স্বামী তার স্ত্রীর উপর রাগ করে থাকতে পারেন না। এদিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী নারী সম্পর্কে বলব না? উপস্থিত সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয় বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, স্বামীর প্রতি আসক্ত অধিক সন্তান জন্মদানকারিনী স্ত্রী। যখন স্বামী রাগান্বিত হয় কিংবা স্ত্রীকে ভাল-মন্দ কিছু বলে বা স্বামী অসন্তুষ্ট হয়ে যায় তখন এই মহিলা (স্বামীকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে) বলে, আমার হাত আপনার হাতে আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট না হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি ঘুমাবো না। ১২২
১২২.আত তারগীব, খণ্ড. ৩, পৃ. ৩৭
এ ধরনের পূণ্যবতী স্ত্রীদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- মু’মিনের জন্য খোদাভীতির মতো নিয়ামতের পর এমন কোন কল্যাণ কামিতা নেই যা পূণ্যবতী ও পরহেযগার স্ত্রীর চেয়ে বড়।
إِنْ أَمْرَهَا أَطَاعَتْهُ وَإِنْ نَظَرَ إِلَيْهَا سرته وَإِن أقسم عَلَيْهِ أَبَرَّتْهُ وَإِنْ غَابَ عَنْهَا نَصَحَتْهُ فِي نَفْسِهَا وَمَاله
যদি স্বামী কোনো কথা বলে তা পূরণ করে, যদি স্বামী তার দিকে তাকায় স্বামীকে খুশী করে, স্বামী যদি কোনো বিষয়ে শপথ করে তাহলে, স্ত্রী তা পূরণ করে, স্বামী যদি কখনো বাইরে যায় তবে নিজের জান ও স্বামীর সম্পদের ব্যাপারে সজাগ থাকে। ১২৩
১২৩.ইবনে মাজাহ, পৃ. ১৩২, মিশকাত, পৃ. ২৬৮
৯. স্বামীর মানবিক চাহিদা পূরণ করা
____________________
৯. স্বামীর মানবিক চাহিদা পূরণ করা
স্বামী-স্ত্রীর মানবিক চাহিদা পূরণও বিবাহের একটি উদ্দেশ্য। আর এই মানবিক চাহিদা কার কখন সৃষ্টি হয় তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এটা সম্পূর্ণ মনস্তাত্বিক ব্যাপার। সুতরাং স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেককেই একে অপরের মানবিক চাহিদার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় নিজের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অপরজনের খাতিরে তা মেনে নিতে হয়। হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন-
إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ، فَأَبَتْ أَنْ تَجِيءَ، لَعَنَتْهَا المَلاَئِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ
যখন স্বামী তার স্ত্রীকে নিজ বিছানায় আসার জন্য ডাকে আর স্ত্রী যদি না যায় তবে ফেরেশতারা ঐ স্ত্রীর উপর সকাল পর্যন্ত অভিশাপ দিতে থাকে। ১২৪
১২৪.ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী র. (২৫৬হি.) সহীহ বুখারী, খণ্ড, ২ পৃ. ২৮২
হযরত তালাক ইবনে আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
إذا دعا الرجل زوجته لحاجتهفلتأته وإن كانت على التنور
স্বামী যখন নিজের স্ত্রীকে প্রয়োজনে ডাকে তখন স্ত্রীর উচিত তৎক্ষণাত ডাকে সাড়া দেওয়া। যদিও সে চুলার উপর রান্না বসিয়ে রাখুন না কেন। ১২৫
১২৫.তিরমিযী
হযরত যায়েদ বিন আকরাম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
الْمَرْأَةُ لَا تُؤَدِّي حَقَّ اللهِ عَلَيْهَا حَتَّى تُؤَدِّيَ حَقَّ زَوْجِهَا حَتَّى لَوْ سَأَلَهَا وَهِي عَلَى ظَهْرِ قَتَبٍ لَمْ تَمْنَعْهُ نَفْسَهَا
কোন নারী ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর হক আদায়কারিণী হতে পারবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত না স্বামীর হক আদায় করবে। স্বামী যদি তাকে ডাকে আর সে যদি উটের পিঠেও থাকে তবুও নিজেকে স্বামী থেকে বিরত রাখতে পারবেনা। ১২৬
১২৬.তাবরানী আল মু’জাম ও আত তারগীব, খণ্ড. ৩, পৃ.৩৮
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَلَمْ تَأْتِهِ فَبَاتَ غَضْبَانَ عَلَيْهَا لَعَنَتْهَا الْمَلاَئِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ :.
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, স্বামী যখন তার স্ত্রীকে বিছানায় ডাকে, অতঃপর স্ত্রী যদি না যায় আর স্বামী স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট অবস্থায় রাত যাপন করে তাহলে সকাল হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা ঐ স্ত্রীকে অভিশাপ করতে থাকে। ১২৭
১২৭.ইমাম মুসলিম র. মুসলিম শরীফ, পৃ. ৪৬৪
অপর হাদিসে আছে, আল্লাহ তা’আলা এমন নারীর উপর অসন্তুষ্ট হন যতক্ষণ পর্যন্ত স্বামীকে সন্তুষ্ট না করে। ১২৮
১২৮.ইমাম মুসলিম র. মুসলিম শরীফ, পৃ. ৪৬৪
ইমাম নবভী (رحمة الله) উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন- শরঈ কারণ ব্যতীত স্ত্রী স্বামীর বিছানায় না যাওয়া হারাম সাব্যস্ত হওয়া উক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এমনকি মাসিক হওয়াটা স্বামীর বিছানায় না যাওয়ার কারণ হতে পারে না। কারণ ঐ সময় স্ত্রীর কাপড়ের উপর দিয়ে স্ত্রী থেকে উপকৃত হওয়ার অধিকার আছে। ১২৯
১২৯.শরহে সহীহ মুসলিম, ইমাম নবভী র. (৬৭৭ হি.),হাশিয়ায়ে মুসলিম, পৃ. ৪৬৪
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا بَاتَتِ الْمَرْأَةُ هَاجِرَةً فِرَاشَ زَوْجِهَا لَعَنَتْهَا الْمَلاَئِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন- স্ত্রী যখন স্বামীর বিছানা থেকে পৃথক হয়ে রাত্রী যাপন করে তখন ফেরেশতারা স্ত্রীর উপর অভিশাপ দিতে থাকে, যতক্ষণ না স্ত্রী স্বামীর বিছানায় ফিরে আসে। ১৩০
১৩০.ইমাম মুসলিম র. (২৬১ হি.), সহীহ মুসলিম, পৃ. ৪৬৪
মোট কথা হলো স্বামী-স্ত্রী উভয় সামান্য ব্যাপারে কিংবা বিনা কারণে ঘরের মধ্যে বিছানা পৃথক করা উচিত নয়। কারণ এতে ধীরে ধীরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারিরীক দূরত্বের সাথে সাথে মন ও ভালোবাসার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে যদি এরূপ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে এবং স্বামি স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে হয় তবে দোষনীয় নয়।
১০. সন্তান লালন পালন করা স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।
____________________
১০. সন্তান লালন পালন করা স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।
মায়ের কোলই হলো সন্তানের প্রথম বিদ্যালয়। ফল দ্বারা যেমন বৃক্ষের পরিচয় হয় তেমনি সন্তান দ্বারা মায়ের পরিচয় পাওয়া যায়। একদা এক ব্যক্তির হাঁচি আসলে আলহামদুলিল্লাহ’র স্থলে আস্সালামু আলাইকুম বলছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জবাবে বলেছিলেন-وعلى (ﷺ) امك তোমার মায়ের উপর সালাম বর্ষিত হোক। অর্থাৎ কোথায় সালাম বলবে আর কোথায় আলহামদুলিল্লাহ বলবে, কোন হাতে খাবার খাবে, রাস্তার কোন পাশ দিয়ে চলবে , হাই আসলে কী বলবে ইত্যাদি মায়ের কাছ থেকেই সন্তানরা শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। এ কারণে এসব বিষয়ে কোন ব্যতিক্রম ঘটলে বিজ্ঞ লোকেরা বলেন, “মনে হয় তোমার মাতা-পিতা এগুলো শিখায়নি’’।
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم خَيْرُ نِسَاءٍ رَكِبْنَ الإِبِلَ صَالِحُ نِسَاءِ قُرَيْشٍ أَحْنَاهُ عَلَى وَلَدٍ فِى صِغَرِهِ وَأَرْعَاهُ عَلَى زَوْجٍ فِى ذَاتِ يَدِهِ.
উটের উপর আরোহনকারিনী মহিলাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম হলো কুরাইশ মহিলারা। কারণ তারা শিশু সন্তানের প্রতি অধিক যত্নবান-মেহেরবান হয়ে থাকে আর স্বামীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষনকারিনী হয়ে থাকে। ১৩১
১৩১.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র মিশকাত; পৃ. ২৬৭
নারী জাতির অন্যতম প্রধান কাজ হল সন্তানের লালন পালন করা। কাজের মেয়েদের উপর এর দায়িত্ব অর্পন করা হল চাকর-চাকরানীর আদর্শে আদর্শবান হবে। অনেক ভদ্র ঘরের ছেলেকে অভদ্র আচরণ করতে দেখা যায়। একারণে এতে সন্তান প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। একজন মায়ের অন্তরে সন্তানের প্রতি যে দয়া-ভালোবাসা স্নেহ মমতা থাকবে তা কখনো কোন চাকর-চাকরানীদের মধ্যে থাকবে না। নিজেদের সুযোগ সুবিধার জন্য সন্তানকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সন্তানের উপর নিশ্চিত যুলম ও অন্যায়।
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে এক দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- হে নারীরা! তোমরা কী এতে সন্তুষ্ট নও? যখন কোন নারী তার স্বামীর দ্বারা তার সম্মতিতে গর্ভবতী হবে তখন সে এত পরিমাণ সওয়াবের অধিকারিনি হবে যে পরিমাণ সওয়াব কোন রোযাদার ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত অবস্থায় রোযা রাখার দ্বারা পেয়ে থাকে। আর যখন তার প্রসব বেদনা আরম্ভ হয় তখন আসমান ও পৃথিবীবাসীরা জানতে পারে না যে, তার চোখের শীতলতার জন্য কি লুকিয়ে রাখা হয়েছে। আর সে সন্তান প্রসব করে তখন তার সন্তান যে দুধ চোষণ করে এবং দুধের প্রতিটি ফোটা ও ঢোকের বিনিময়ে একটি করে নেকী প্রাপ্ত হয়, এবং মা সন্তানের জন্য একটি রাত বিনিদ্রাযাপন করে তবে সে সত্তরজন সুস্থ সবল দাসী আল্লাহর রাস্তায় আযাদ করার সওয়াব পাবে। ১৩২
১৩২.সোলাইমান ইবনে আহমদ তাবরানী, আল মু’জামু, খণ্ড ৪, পৃ. ৩০৭ ও ৩০৮
عن أبي أمامة قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : حاملات والدات رحيمات بأولادهن لولا يعصين أزواجهن دخلن الجنة )شعب الإيمان
হযরত আবু উমামা বাহেলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের কষ্টকে সহ্যকারিণী, নিজ সন্তানের প্রতি মহানুভবতাসম্পন্না নারি যদি স্বামীর অবাধ্য না হয়, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ১৩৩
১৩৩.ইবনে বায়হাকী র. (৪৫৮ হি.) শোয়াবুল ঈমান , খণ্ড ৬, পৃ. ৪০৬
বর্তমান আধুনিক নারীরা এক দু’বারের বেশী গর্ভবতী হতে চায় না। অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন
- خير نسائكم الولود الودود
তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা অধিক সন্তান জন্মদানকারিনী, অধিক ভালোবাসা প্রধানকারিনী। ১৩৪
১৩৪.আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুসসাম উদ্দিন র.(৯৭৫হি.), কানযুল উম্মাল, খণ্ড ১৬, পৃ. ১২৬
দ্বিতীয়তঃ তথাকথিত পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণে অনেক মুসলিম নারীরাও শারীরিক পিটনেস নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে সন্তানকে দুধ পান করাতে চায় না। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে দুধ পান করানোর দ্বারা মা ও সন্তান উভয়ের স্বাস্থ্য সুস্থ ও ভালো থাকে।
দুনিয়ায় যত প্রকার খাদ্য আছে, তন্মধ্যে আল্লাহ তা’আলা মায়ের দুধকে সবচেয়ে উপকারী, শক্তিবর্ধক, স্বাস্থ্যসম্মত ও সহজপাচ্য হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। দুগ্ধদানকারি সকল প্রাণির দুধের মধ্যে তাদের বাচ্চার দৈহিক বৃদ্ধি ও গঠনের যাবতীয় উপাদান ও উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যমান থাকে। শিশু মায়ের রক্তের কুদরতি রাসায়নিক পরিবর্তনের ফল। দুধও মায়ের রক্ত থেকে সৃষ্টি হয়। সুতরাং মায়ের সন্তানের জন্য দুধই অধিক উপযোগি। অন্যমহিলার দুধ থেকেও মায়ের দুধ সন্তানের জন্য অতি উত্তম।
তাছাড়া যখন সন্তান জন্ম হয় কেবল তখনই মায়ের স্তনে দুধ আসে। মায়ের দুধ সন্তানের উপযোগি করে তৈরি করা হয়। প্রথমে দুধ থাকে তরল ও পাতলা যা নবজাতকের জন্য উপযোগি। বাচ্চার বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার হজমশক্তির ভিত্তিতে দুধও গাঢ় ও ঘন হয়ে উঠে। মায়ের বুকের দুধ বেসী ঠান্ডা নয় যাতে বাচ্চার নিমোনিয়া হয়ে যায় আবার বেশী গরমও নয়, তা লবণাক্তও নয় আবার পানসেও নয়। অধিক মিষ্টিও নয়। সুতরাং শিশুর জন্য খোদাপ্রদত্ত মায়ের দুধের কোন বিকল্প নেই।
বিজ্ঞানিদের গবেষনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মায়ের দুধপানকারী শিশুরা অন্যদের তুলনায় অধিক মেধাবী হয় এবং রোগ ব্যাধি থেকেও তারা মুক্ত থাকে বেশী। মায়ের দুধে এমন কিছু উপাদান থাকে যা শিশুর মেধাশক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি গাভীর দুধে থাকে না। অতএব “শিশু সুস্বাস্থ্যের এবং মেধাশক্তির জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নেই” কথাটি প্রত্যেক মাকে বুঝতে হবে। সন্তানকে দুধপান করানোর দ্বারা মায়ের স্বাস্থ্যও রক্ষা হয়। এর দ্বারা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সন্তানকে দুধপান না করালে স্তনে ব্যাথা হয় আর এই ব্যাথা উপশমের জন্য ওষুধ সেবন করতে হয় যাতে পার্শপ্রতিক্রিয়া থাকে। সুতরাং নারীর অন্তত নিজের স্বার্থে হলেও সন্তানকে দুধ পান করানো উচিত।
সন্তান মায়ের দুধের হকদার। বুকের দুধ থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করা অন্যায় ও যুলুম। এটা হিংস্র ইতর প্রাণির চেয়েও নিকৃষ্ট কাজ। কারণ বাঘ, ভালুক ও সিংহের ন্যায় হিংস্র প্রাণিরাও নিজের সন্তানকে দুধপান থেকে বঞ্চিত করে না। যারা সন্তানকে দুধপান করাবে না তারা সন্তান নেওয়াও অনুচিত।
১১. স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব হলো ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ করা
____________________
১১. স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব হলো ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ করাঃ
স্ত্রী গৃহের যাবতীয় ব্যাপারে আমানতদার। স্বামীর অর্জিত সম্পদ ও ঘরের আসবাবপত্র যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা স্ত্রীর কর্তব্য। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
كلكم راع ومسؤول عن رعيته فالإمام راع ومسؤول عن رعيته والرجل في أهله راع وهو مسؤول عن رعيته والمرأة في بيت زوجها راعية وهي مسؤولة عن رعيتها والخادم في مال سيده راع وهو مسؤول عن رعيته
তোমাদের প্রত্যেক হলে রক্ষক আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজেদের অধিনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। বাদশা রক্ষক, তার প্রজা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবারের রক্ষক আর স্ত্রী তার স্বামীর রক্ষক এবং খাদেম তার মালিকের সম্পদের রক্ষক। ১৩৫
১৩৫.মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, (২৫৬ হি.), সহীহ বুখারী, খণ্ড ২, পৃ. ৭৮৩
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত ফাতিমা ও হযরত আলী (رضي الله عنه) মধ্যে পরিবারের দায়িত্ব বন্টন করতে ফায়সালা করলেন যে, ফাতিমা গৃহের কাজ-কর্ম সম্পাদন করবে আর আলী গৃহের বাইরের কাজ-কর্ম আঞ্জাম দেবে। ১৩৬
১৩৬.আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম, যাদুল মা’য়াদ, খণ্ড ৪, পৃ.৪০
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে- কতিপয় মহিলা নবী করিম (ﷺ) ’র কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল- হে আল্লাহর রাসূল! জিহাদ করার মাধ্যমে পুরুষরা অনেক সওয়াবের অধিকারী হচ্ছে। আমাদের নারীদের জন্য এমন কোন আমল আছে কী যার দ্বারা আমরাও জিহাদের ফযিলত অর্জন করতে পারি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেন-
-نعم مهنة إحداكن فى بيتها تبلغ به فضل الجهاد
হ্যাঁ, ঘরের কাজকর্মের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য জিহাদের সমপরিমাণ সওয়াব। ১৩৭
১৩৭.ইমাম বায়হাকী র. (৪৫৮ হি.) সুনানে বায়হাকী, খণ্ড ৬, পৃ. ৪৩০
পুরুষরা জিহাদে গিয়ে নিজেদের জান-প্রাণ দিয়ে জিহাদ করে যে সওয়াব পাচ্ছে নারীরা কেবল ঘরের মধ্যে থেকে নিজের প্রয়োজনে ঘরের কাজ-কর্ম সম্পাদন করলেই জিহাদের সওয়াব পাচ্ছে।
১২. স্বামীকে কষ্ট না দেওয়া স্ত্রীর কর্তব্য
____________________
১২. স্বামীকে কষ্ট না দেওয়া স্ত্রীর কর্তব্য
আগেই বলা হয়েছে যে, স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখা স্ত্রীর উপর আবশ্যক। স্বামীকে কষ্ট না দেওয়া আদর্শ স্ত্রীর জন্য উচিত।
عن معاذ بن جبل : عن النبي صلى الله عليه و سلم قال لا تؤذي امرأة زوجها في الدنيا إلا قالت زوجته من الحور العين لا تؤذيه قاتلك الله فإنما هو عندك دخيل يوشك أن يفارقك إلينا
হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যখনই কোন স্ত্রী তার স্বামীকে কষ্ট দিতে থাকে তখনই (জান্নাতের) ঢাগর চক্ষুবিশিষ্ট হুরদের মধ্যে যে তার স্ত্রী হবে সে বলে, (হে অভাগিনী!) তুমি তাকে কষ্ট দিও না। আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন, স্বামী তোমার কাছে মেহমান স্বরূপ কিছুদিনের জন্য আছেন। অচিরেই তিনি তোমাকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবেন। ১৩৮
১৩৮.ইমাম তিরমিযী র. (২৭৯ হি.), সুনানে তিরমিযী, তিনি হাদীসখানাকে হাসান বলেছেন, সূত্র ইমাম ইয়াহিয়া ইবনে শরফ নবভী র. (৬৭৬ হি.) রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৪৯ ও মিশকাত; পৃ. ২৮১
أول ما تسأل المرأة يوم القيامة عن صلاتها ، ثم عن بعلها كيف عملت إليه-
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন মহিলাদের নিকট সর্বপ্রথম নামায সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। তারপর তার স্বামী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে যে, তার সাথে কেমন আচরণ করেছিলে?১৩৯
১৩৯.আলী ইবনে হুস্সামুদ্দিন র. (৯৭৫ হি.), কানযুল উম্মাল, খণ্ড ১৬, পৃ. ১৬৬
স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার
____________________
স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার
এতক্ষণ যাবত আমরা স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার নিয়ে আলোচনা করেছি। এখন স্বামীর উপর স্ত্রীর কী কী অধিকার রয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা করবো। ইসলামে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যেরূপ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তেমনি স্ত্রীর প্রতিও স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য কোন অংশে কম নয়। অর্থাৎ স্ত্রীর উপর যেমন স্বামীর অধিকার স্বীকৃত অনুরূপ স্বামীর উপরও স্ত্রীর অধিকার স্বীকৃত। নিম্নে আমরা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব।
১. মাহর আদায়
____________________
১. মাহর আদায়
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো স্বামী স্ত্রীর জন্য ধার্য্যকৃত মাহর আদায় করা। পূর্বেও বলা হয়েছে মাহর স্ত্রীর হক। স্ত্রীই কেবল মাহরের মালিক। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
وَآَتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً
আর তোমরা (স্বামীরা) স্ত্রীদের মাহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান কর। ১৪০
১৪০.সূরা নিসা; আয়াত ৪
মধ্যপ্রাচ্যে বিবাহের সাথে সাথে স্ত্রীকে মাহর আদায় করে দেওয়ার নিয়ম প্রচলন থাকলেও আমাদের দেশে তা সম্পূর্ণ বিপরীত। এদেশে অনেক স্বামীরা জানেও না যে তার উপর মাহর আদায় ওয়াজিব। আবার অনেকে জানলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। শুধু স্ত্রীকে তালাক দিলেই অনেক বিচার আচারের পর বহু কাট-চাট করে নামেমাত্র কিছু দিয়ে ঝামেলা মুক্ত হয়। এদেশে অনেক মহিলারাও হয়তো জানেও না যে , মাহর তার হক ও প্রাপ্য। ফলে তারা শত নির্যাতিত হলেও স্বামীকে মাহর আদায়ের কথা মুখে উচ্চারণ করে না। বরং সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে স্ত্রীর অভিভাবকরা অনেক দেন দরবার করে মাহর আদায় করে নেয়। ইসলামীব্যবস্থায় সভ্য সমাজে এটা মোটেও কাম্য ও উচিত নয়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
أيما رجل تزوج إمرأة على ما قل من المهر أو أكثر ليس فى نفسه أن يؤدى إليها حقها خدعها فمات و لم يؤد إليها حقها لقى الله يوم القيامة و هو زان
-যদি কোন ব্যক্তি কোন মেয়েকে কম বা বেশী মাহর নির্ণয় করে বিয়ে করে, যদি ঐ ব্যক্তির অন্তরে মাহর আদায় করার ইচ্ছা না থাকে তাহলে সে নিজ স্ত্রীর সাথে প্রতারণা করলো। যদি মাহর অনাদায় অবস্থায় সে মারা যায় তাহলে কিয়ামত দিবসে সে যিনাকারী হিসেবে উঠবে। ১৪১
১৪১.তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাঊদ ও ইবনে মাজাহ
২. ভরণ-পোষণ
____________________
২. ভরণ-পোষণ
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। ভরণ-পোষণ বলতে স্ত্রীর আবাস, পোশাক, খাবার ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু সামগ্রী প্রদান করা। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ-
পুরুষ নারীর কর্তা। কারণ আল্লাহ তাদের একজনকে অপরজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং পুরুষ তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে। ১৪২
১৪২.সূরা নিসা, আয়াত: ৩৪
وبما انفقوا من امولهم
আয়াতাংশ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে ভরন-পোষণের দায়িত্ব পুরুষের। মহিলার উপর নয়।
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,
- وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ-
জনকের কর্তব্য বিধিমতে তাদের ভরণ-পোষণ করা। ১৪৩
১৪৩.সূরা বাকারা, আয়াত: ২৩৩
স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ধরণ ও মান কী হবে এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آَتَاهُ اللَّهُ-
বিত্তবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে। আর যার জীবনোপকরণ সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করবে। ১৪৪
১৪৪.সূরা তালাক, আয়াত: ৭
এ থেকে বুঝা গেল যে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের মান ও ধরণ স্ত্রীর অবস্থার ভিত্তিতে হবে না বরং স্বামীর অবস্থার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে। স্বামী বিত্তবান হলে বিত্তবান সুলভ ভরণ পোষণ দেওয়া ওয়াজিব হবে যদিও স্ত্রী গরিব হয়। স্বামী দরিদ্র হলে দরিদ্রসুলভ ভরণ পোষণ দেওয়া ওয়াজিব হবে যদিও স্ত্রী বিত্তশালী হয়। এক্ষেত্রে স্ত্রীকে ধৈর্য্যধারণ করার নিমিত্তে পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে,
سَيَجْعَلُ اللَّهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْرًا
অচিরেই আল্লাহ দুঃখের পর সুখ দেবেন। অর্থাৎ সুখ-দুঃখ কারো জন্য স্থায়ী নয়। বিবাহের প্রথম দিকে সাধারণত স্বামীর আয় রোজগার কম হয়। ধীরে ধীরে আল্লাহ তা’আলা অবস্থা উন্নত করে দেন। একথা মাথায় রেখে স্ত্রীর উচিত অভাব-অনটনে অধৈর্য্য না হয়ে আল্লাহরব উপর ভরসা করে অপেক্ষা করা। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা একদিন সচ্ছলতা দান করবেন।
বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
ولهن عليكم رزقهن وكسوتهن بالمعروف-
তোমরা স্বামীদের উপর কর্তব্য হলো যথাবিধি স্ত্রীদের ভরণ-পোষনের ব্যবস্থা করা। ১৪৫
১৪৫.আলি ইবনে আবি বকর র. (৫৯৩ হি.) হিদায়া, খণ্ড ২, পৃ. ৪৩৭
وإنك لن تنفق نفقة تبتغي بها وجه الله إلا أجرت حتى ما تجعل في في امرأتك-
হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে তুমি যা কিছু ব্যয় কর তোমাকে এর প্রতিদান দেওয়া হবে। এমনকি যে লোকমা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিচ্ছ তার প্রতিদানও পাবে।১৪৬
১৪৬.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র ইয়াহিয়া ইবনে শরফুদ্দীন নবভি র., রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৫৫
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم دِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ وَدِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِى رَقَبَةٍ وَدِينَارٌ تَصَدَّقْتَ بِهِ عَلَى مِسْكِينٍ وَدِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ أَعْظَمُهَا أَجْرًا الَّذِى أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ -
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লহর রাস্তায় (জিহাদে) এক দিনার তুমি ব্যয় করেছ, গোলাম আযাদ করার জন্য একটি দিনার তুমি ব্যয় করেছ, গরীব-মিসকীনকে তুমি একটি দিনার দান করেছ এবং নিজ পরিবারের জন্য তুমি একটি দিনার খরচ করেছ। তবে সবগুলোর মধ্যে সওয়াবের দিক দিয়ে নিজ পরিবারের জন্য তুমি যেটি ব্যয় করেছ সেটিই উত্তম পূণ্য। ১৪৭
১৪৭.মুসলিম, সূত্র, ইমাম নবভী র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৫০ ও মিশকাত, পৃ. ১৭০
عَنْ أَبِى مَسْعُودٍ الْبَدْرِىِّ عَنِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا أَنْفَقَ عَلَى أَهْلِهِ نَفَقَةً وَهُوَ يَحْتَسِبُهَا كَانَتْ لَهُ صَدَقَةً.-
হযরত আবু মাসঊদ বদরী (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন, কোন ব্যক্তি যখন সওয়াবের নিয়তে তার পরিবারের জন্য ব্যয় করে তখন তার জন্য তা সাদকা হয়ে যায়। অর্থাৎ সে সাদকার সওয়াব পাবে। ১৪৮
১৪৮.মুসলিম, সূত্র, ইমাম নবভী র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৫১ ও মিশকাত, পৃ. ১৭০
হযরত সাওবান (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন,
-أَفْضَلُ دِينَارٍ
يُنْفِقُهُ الرَّجُلُ دِينَارٌ يُنْفِقُهُ عَلَى عِيَالِهِ
কোন ব্যক্তি যত দিনার খরচ করে তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিনার হলো যে দিনার নিজ পরিবারের জন্য খরচ করে। ১৪৯
১৪৯.ইমাম মুসলিম র. (২৬১ হি.), সহীহ মুসলিম, সূত্র মিশকাত, পৃ. ১৭০
অতএব উপরোক্ত হাদীস সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, স্বামী তার স্ত্রী ও সন্তান সন্তুতির জন্য যা কিছু সঠিক পন্থায় ব্যয় করবে তা সাদকা হবে এবং এর প্রতিদান সে পাবে।
৩. সদাচরণ
____________________
৩. সদাচরণ
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আরেকটি গুরুত্বপুর্ন দায়িত্ব হলো স্ত্রীর সাথে সর্বদা সদ্ব্যবহার ও সদাচরণ করা। মূলতঃ স্বামী থেকে সদাচার পাওয়াটা স্ত্রীর একান্ত অধিকার বটে। কারণ বৈবাহিক সম্পর্কটাই হচ্ছে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক। ভালোবাসার অভাব ঘটলে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সুখের জীবন বিষন্ন হয়ে পড়ে। স্বামী স্ত্রীর সাথে সদাচরণ করলে, প্রাণভরা ভালোবাসা দিলে তবেই স্ত্রীর অন্তরে স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ সৃষ্টি হবে। ফলে স্ত্রী স্বামীর আদেশ-নিষেধ শিরোধার্য্য করে নিবে। এভাবে একটা সুন্দর সংসার গড়ে উঠবে। আল্লাহ তা’আলা স্বামীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন-
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ-
নিজ স্ত্রীদের সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপন কর। ১৫০
১৫০.সূরা নিসা, আয়াত: ১৯
أكمل المؤمنين إيمانا أحسنهم خلقا وخياركم خياركم لنسائهم خلقا
-হযরত আবু হুরাইরা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, মু’মিনদের মধ্যে সে অধিকতর পূর্ণ মু’মিন যে (মানুষের সাথে) উত্তম ব্যবহারকারী এবং আর তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীদের নিকট উত্তম । ১৫১
১৫১.তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৮২
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন
- خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي وإذا مات صاحبكم فدعوه-
তোমাদের কাছে সে ব্যক্তিই উত্তম যে নিজের পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি হচ্ছি তোমাদের সবার চেয়ে আমার পরিবারের নিকট উত্তম। আর যখন তোমার কোন সঙ্গী মৃত্যুবরণ করে তবে তোমরা তাকে ছেড়ে দাও। অর্থাৎ তার দোষ ত্রুটি বর্ণনা করো না। ১৫২
১৫২.তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮১
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন
- فاستوصوا بالنساء خيرا فإنهن خلقن من ضلع وإن أعوج شيء في الضلع أعلاه فإن ذهبت تقيمه كسرتهوأن تركته لم يزل أعوجواستوصوا بالنساء خيرا-
তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণের ব্যাপারে উপদেশ গ্রহণ কর। কেননা তাদেরকে পাঁজড়ের হাঁড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আর হাঁড়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বাকা হলো উপরেরটা। সুতরাং যদি তুমি তাকে সোজা করতে যাও ভেঙ্গে ফেলবে, আর যদি ছেড়ে দাও তাহলে সর্বদা তা বাকাই থাকবে। অতএব তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ সম্পর্কিত উপদেশ গ্রহন কর। ১৫৩
১৫৩.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮৩
لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ -
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, কোন মু’মিন পুরুষ (স্বামী) কোন মু’মিন নারীকে (স্ত্রী) ঘৃণা না করে ও পরিত্যাগ না করে। কারণ যদি স্ত্রীর কোন স্বভাব স্বামীর অপছন্দ হয় তাহলে হতে পারে অন্য কোন ভালো স্বভাব স্বামীর নিকট পছন্দ হতে পারে। ১৫৪
১৫৪.ইমাম মুসলিম র. (২৬১ হি), সহীহ মুসলিম, সূত্র. ইমাম নবভী র. রিয়াদুস সালেহিন, পৃ. ১৪৫
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কী চমৎকার বলেছেন! কোন স্ত্রীর স্বভাব স্বামীর পছন্দ নাও হতে পারে কিন্তু সব স্বভাব যে অপছন্দ হবে এমন নয়। কারণ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ উভয় স্বভাব বিদ্যমান থাকে। সুতরাং স্ত্রীর কোন একটি স্বভাব স্বামীর অপছন্দ হলেও স্ত্রীর অন্য কোন স্বভাব চরিত্র নিশ্চয় তার পছন্দ হবে। যেমন কোন স্ত্রী যদি একটু রাগী হয় দেখা যায় সে আবার সরল, কাজ-কর্মে চালু, স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের প্রতি যত্নবান কিংবা সাংসারিক বিষয়ে আন্তরিক। সুতরাং একটা মন্দ স্বভাবের উপর ভিত্তি করে স্ত্রীকে তালাক দেয়া কিংবা ঘৃণা করা উচিত নয়। বরং তাকে বুঝিয়ে মন্দ স্বভাব পরিহার করার চেষ্টা করা উচিত। এটাই ইসলামের বিধান।
৪. স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখা ও আনন্দ দেওয়া
____________________
৪. স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখা ও আনন্দ দেওয়া
স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখা এবং মাঝে মধ্যে শরীয়ত সম্মত পন্থায় আনন্দ প্রকাশের সুযোগ দেওয়া স্বামীর উচিত। এতে মন প্রফুল্ল থাকে এবং ঘরের কাজে ও স্বামীর সেবায় স্ত্রী উৎসাহিত হয়।
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- كنت ألعب بالبنات عند النبي صلى الله عليه و سلم وكان لي صواحب يلعبن معي فكان رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا دخل يتقمعن منه فيسربهن إلي فيلعبن معي-
আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র সামনে পুতুল খেলা খেলতাম। আমার কয়েকজন সাথী ছিল যারা আমার সাথে খেলা করত। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রবেশ করতেন তখন তারা আত্মগোপন করতো। কিন্তু তিনি তাদেরকে আমার কাছে (খেলার জন্য) পাঠিয়ে দিতেন। তারপর তারা আমার সাথে খেলতো। ১৫৫
১৫৫.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৮০
قَالَتْ عَائِشَةُ وَاللَّهِ لَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُومُ عَلَى بَابِ حُجْرَتِى - وَالْحَبَشَةُ يَلْعَبُونَ بِحِرَابِهِمْ فِى مَسْجِدِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَسْتُرُنِى بِرِدَائِهِ لِكَىْ أَنْظُرَ إِلَى لَعِبِهِمْ ثُمَّ يَقُومُ مِنْ أَجْلِى حَتَّى أَكُونَ أَنَا الَّتِى أَنْصَرِفُ. فَاقْدُرُوا قَدْرَ الْجَارِيَةِ الْحَدِيثَةِ السِّنِّ حَرِيصَةً عَلَى اللَّهْوِ.-
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি নবী করিম কে আমার হুজরার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। এসময় হাবশীরা মসজিদের আঙ্গীনায় বর্শা নিয়ে খেলা করছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন তার চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে নিতেন, যাতে আমি তাঁর কান ও কাঁধের মধ্য দিয়ে তাদের খেলা দেখতে পারি। এসময় তিনি কেবল আমার কারণে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন যতক্ষণ না আমি তা হতে ফিরতাম। এখন অনুমান কর অল্প বয়স্ক খেলার প্রতি আকৃষ্ট বালিকার খেলা দেখার সময়ের পরিমাণ কতক্ষণ হতে পারে? ১৫৬
১৫৬.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮০
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) ’র যেহেতু অল্প বয়সে বিবাহ হয়েছিলো তাই তার অন্তরে খেলাধুলার প্রবণতা ছিলো। তাছাড়া অল্প বয়স্ক একজন কোমলমতি নারী যখন পিতা-মাতা, ভাই-বোন নিজ পরিবারের সকলের মায়া-মমতা ত্যাগ করে অপরিচিত এক নতুন পরিবেশে স্বামীর ঘরে চলে যায়, তখন নারীর মনটা খুবই নাজুক এবং অসহায় অবস্থায় থাকে। এসময় সে নিজেকে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ মনে করে। তখন স্বামী বা স্বামীপক্ষের কেউ তাকে একটু সঙ্গ দিলে কিংবা শরীয়তসম্মত কিছুটা আনন্দ দিলে নারী অনন্ত সাগরে কুল পাওয়ার ন্যায় স্বস্তি বোধ করে। একারণেই মানবতার উত্তম আদর্শ নবী মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর একমাত্র কুমারী স্ত্রী হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) কে তার খেলার সাথীদের ডেকে দিয়ে তার সাথে খেলার সুযোগ করে দিতেন।
দ্বিতীয় হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) কে খেলা দেখানোর উদ্দেশ্যে দরজায় দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতেন। কারন তাঁর কাছে খেলা দেখার আগ্রহ বা শখ ছিল না। সাধারণতঃ অল্প বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের মধ্যে খেলাধুলা করা ও দেখার শখ থাকে। দীর্ঘক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর কষ্ট হলেও কুমারী স্ত্রীর চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নিজ থেকে স্ত্রীকে নিয়ে আসতেন না। এটাই স্বামী-স্ত্রীর প্রকৃত ভালোবাসার রূপ ও দৃষ্টান্ত।
عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهَا أَنَّهَا كَانَتْ مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِى سَفَرٍ قَالَتْ فَسَابَقْتُهُ فَسَبَقْتُهُ عَلَى رِجْلَىَّ فَلَمَّا حَمَلْتُ اللَّحْمَ سَابَقْتُهُ فَسَبَقَنِى فَقَالَ ্র هَذِهِ بِتِلْكَ السَّبْقَةِ -
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, একবার তিনি রাসূলুল্লাহ ’র সাথে সফরে ছিলেন। তিনি বলেন আমি তাঁর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা দিলাম এবং আমি তাঁর উপর বিজয়ী হলাম। অতঃপর আমি যখন মোটা হয়ে গেলাম তখন একবার প্রতিযোগিতা করলাম। এবার তিনি আমার উপর জয়লাভ করলেন আর বললেন, এটা ঐ বিজয়ের বদলা। ১৫৭
১৫৭.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.), আবু দাউদ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮১
প্রিয় পাঠক! দেখুন আর চিন্তা করুন, উভয়ই জগতের সর্দার, সৃষ্টির সর্বোত্তম ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্ত্রীর মনে আনন্দ দেওয়ার উদ্দেশ্যেস্বেচ্ছায় পরাজয় বরণ করেছিলেন। কারণ অল্প বয়স্ক ছেলে-মেয়েরা প্রতিযোগিতায় কাউকে হারাতে পারলে খুবই খুশী ও আনন্দিত হয়। স্ত্রীর চেহারায় সেই অনাবিল আনন্দ ফুটে তোলার জন্য পৃথিবী বিজয়ী মানুষ নিজ স্ত্রীর কাছে হেরে গেলেন। কিয়ামত পর্যন্ত (ﷺ) উম্মতকে শিক্ষা দেওয়াও ছিল এর একটি উদ্দেশ্য।
৫. স্ত্রীর গোপন বিষয় প্রকাশ না করা
____________________
৫. স্ত্রীর গোপন বিষয় প্রকাশ না করা
স্বামী-স্ত্রীর বিষয়টি একান্ত নিজস্ব ও গোপনীয়। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের আমানত স্বরূপ। সুতরাং পরষ্পর পরষ্পরের আমানত রক্ষা করা আবশ্যক। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয় বিষয়, কথা-বার্তা, শরীরের গোপন অঙ্গের ধরণ ইত্যাদি কারো নিকট প্রকাশ অত্যন্ত নিন্দনীয় ও নির্লজ্জ ব্যাপার। অনেক বেহায়া পুরুষকে দেখা যায়, তারা স্ত্রীর বাসর রাতের বিস্তারিত বর্ণনা সকালে উঠে বন্ধু বান্ধবদের নিকট পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বর্ণনা করে আর বিভিন্ন মন্তব্য করে হাসি-তামাসা করে। আবার কিছু কিছু মহিলাও রয়েছে যারা স্বামীর গোপন বিষয় নিয়ে বান্ধবীর সাথে আড্ডায় ও গল্প গুজবের ফাঁকে প্রকাশ করে ফেলে। এর দ্বারা অন্যদের কাছে নিজেও হালকা হয়ে যায় এবং স্বামীকেও ছোট করে ফেলে।সামান্য আনন্দ উপভোগের জন্য সহপাঠিদের নিকট নিজেরাই তাচ্ছিল্য ও হেয় হচ্ছে। হাদিস শরীফে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরূপ করতে নিষেধ করেছেন।
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَعْدٍ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا سَعِيدٍ الْخُدْرِيَّ، يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِنَّ مِنْ أَعْظَمِ الْأَمَانَةِ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وفى رواية إِنَّ مِنْأَشَرِّ النَّاسِ عِنْدَ اللهِ مَنْزِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، الرَّجُلَ يُفْضِي إِلَى امْرَأَتِهِ، وَتُفْضِي إِلَيْهِ، ثُمَّ يَنْشُرُ سِرَّهَا
হযরত আবদুর রহমান ইবনে সা’আদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আবু সাঈদ (رضي الله عنه) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, কিয়ামত দিবসে আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট ব্যক্তি সে, যে নিজের স্ত্রীর নিকট যায় এবং স্ত্রী তার নিকট আসে অতঃপর সে নারীর গোপনীয়তা প্রকাশ করে বেড়ায়। ১৫৮
১৫৮.ইমাম মুসলিম র. (২৬১ হি.), সহীহ মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; ২৭৬
অর্থাৎ স্ত্রীর গোপনীয়তা স্বামীর নিকট বড় আমানত যা খিয়ানত করলে আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট পাপী হিসেবে বিবেচ্য হবে।
জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে কথিত আছে যে, তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা করলে লোকেরা তার কাছে এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইল। উত্তরে তিনি বললেন, আমি আমার স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি কেন পর লোকের নিকট বর্ণনা করব? তালাক দেওয়ার পর লোকেরা পুনরায় জিজ্ঞাসা করছিল যে, এখন তো উনি আপনার স্ত্রী নয়। সুতরাং তালাকের কারণ এখন বলুন। উত্তরে তিনি বললেন, আমি পর মহিলার দোষ কেন বর্ণনা করব? এরূপ চরিত্রই আমাদের সকলের জন্য একান্ত আবশ্যক।
উল্লেখ্য যে, এসব গোপন কথা আপনি যতই তাগিদ দিয়ে এমনকি শপথ করায়ে কাওকে না বলার জন্য বললেও সে তা মানবে না, বরং ঐসব কথা আরো কিছু জোড়া-তালি দিয়ে আকর্ষনীয় করে অন্যকে বলে বেড়াবে। এজন্যই হযরত শেখ সাদী (رحمة الله) বলেন- “যে কথা বলে আবার শ্রোতাকে বলতে হয় তুমি কথাটা কাওকে বলোনা, সে কথা কাউকে না বলাই শ্রেয়।” কাউকে বলোনা শব্দটি বলার প্রতি উৎসাহিত করে দেয়। কারণ হাদিসে আছে- الانسان حريص مما منعমানুষ নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয়। মোট কথা হলো ভদ্র, সভ্য, সুশীল ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ কোনদিন এসব গোপন কথা ফাঁস করে না। যারা এসব কাজ করে তারা অভদ্র, অসভ্য ও বিকৃত রুচিসম্পন্ন মানুষ।
৬. স্ত্রীকে প্রহার না করা
____________________
৬. স্ত্রীকে প্রহার না করা
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাই প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার উপর প্রতিষ্ঠিত। রূপ-সৌন্দর্য্য ক্ষণস্থায়ী। বয়সকালে রূপ সৌন্দর্য্য হ্রাস পেলেও ভালোবাসা আরও মজবুত হয়। স্বামী নিজেকে সদা স্ত্রীর প্রভু মনে করা এবং তুচ্ছ বিষয়ে স্ত্রীকে মারধর করা, কথায় কথায় স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা ভালোবসার অন্তরায়। হাদিস শরীফে আছে-
عَنْ مُعَاوِيَةَ بن حيدة قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا حَقُّ زَوْجَةِ أَحَدِنَا عَلَيْهِ؟، قَالَ: أَنْ تُطْعِمَهَا إِذَا طَعِمْتَ، وَتَكْسُوَهَا إِذَا اكْتَسَيْتَ، أَوِ اكْتَسَبْتَ، وَلَا تَضْرِبِ الْوَجْهَ، وَلَا تُقَبِّحْ، وَلَا تَهْجُرْ إِلَّا فِي الْبَيْتِ
হযরত মুয়াবিয়া ইবনে হায়দাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের কোন ব্যক্তির উপর তার স্ত্রীর কী অধিকার রয়েছে? তিনি বললেন, তুমি যখন আহার কর তাকেও আহার করাও, তুমি যখন পরিধান কর, তাকেও পরিধান করাও এবং ঘরের মধ্যে ছাড়া তার কাছ থেকে পৃথক হইওনা। হাদিসখানা হাসান। ১৫৯
১৫৯.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.), আবু দাউদ, সূত্র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৪৬
অনুরূপ হাদীস হাকীম ইবনে মুয়াবিয়া কুশাইরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে। ১৬০
১৬০.আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮১
عَنْ إِيَاسِ بْنِ عَبْدُ اللَّهِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: ্রلَا تَضْرِبُوا إِمَاءِ اللَّهِ فَجَاءَ عُمَرُ إِلَى رَسُولِ الله فَقَالَ: ذَئِرْنَ النِّسَاءُ عَلَى أَزْوَاجِهِنَّ فَرَخَّصَ فِي ضَرْبِهِنَّ فَأَطَافَ بَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نِسَاءٌ كَثِيرٌ يَشْكُونَ أَزْوَاجَهُنَّ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَقَدْ طَافَ بِآلِ مُحَمَّدٍ نِسَاءٌ كَثِيرٌ يَشْكُونَ أَزْوَاجَهُنَّ لَيْسَ أُولَئِكَ بِخِيَارِكُمْ
হযরত ইয়াস ইবনে আব্দুল্লাহ আবি যুবাব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহর বন্দীনীদের প্রহার করো না। অতঃপর হযরত ওমর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ কাছে এসে বললেন, (বর্তমান) স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের উপর চড়াও হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ স্বামীদের অনুমতি দিয়েছেন স্ত্রীদের প্রহার করতে। ফলে অনেক মহিলা রাসূলুল্লাহ ’র পরিবারের নিকট এসে তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে (প্রহার করার) অভিযোগ করল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমাদের অনেক মহিলা এসে মুহাম্মদের পরিবারের কাছে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এরা (যারা স্ত্রীকে প্রহার করে) তোমাদের মধ্যে মোটেও উত্তম লোক নয়। ১৬১
১৬১.ইমাম তিরমীযী র. (২৭৯ হি.) তিরমিযী, হাদীসখানা হাসান, সূত্র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৪৭, মিশকাত; পৃ. ২৮২
عَنْ لَقِيطِ بْنِ صَبْرَةَ" قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّ لِي امْرَأَةً وَإِنَّ فِي لِسَانِهَا شَيْئًا - يَعْنِي الْبَذَاءَ - قَالَ: فَطَلِّقْهَا إِذًا قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لَهَا صُحْبَةً، وَلِي مِنْهَا وَلَدٌ، قَالَ: " فَمُرْهَا يَقُولُ: عِظْهَا فَإِنْ يَكُ فِيهَا خَيْرٌ فَسَتَفْعَلْ، وَلَا تَضْرِبْ ظَعِينَتَكَ كَضَرْبِكَ أُمَيَّتَكَ
"ইবনে সাবুরা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল। আমার এক স্ত্রী আছে, যার মুখ চলে। অর্থাৎ ঝগড়াটে। তিনি বললেন, তুমি তাকে তালাক দিয়ে দাও। আমি বললাম তার ঘরে আমার সন্তান রয়েছে এবং সে আমার দীর্ঘদিনের সহবাসের সঙ্গিনী। তিনি বললেন, তাহলে তুমি তাকে উপদেশ দাও। যদি তার মধ্যে কোন কল্যাণ থাকে তবে সে তা সহজে গ্রহণ করবে। কিন্তু তুমি তোমার বিছানার সাথীকে বাঁদীর ন্যায় প্রহার করোনা।১৬২
১৬২.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.) সুনানে আবু দাউদ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮১
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ زَمْعَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لاَ يَجْلِدُ أَحَدُكُمُ امْرَأَتَهُ جَلْدَ العَبْدِ، ثُمَّ يُجَامِعُهَا فِي آخِرِ اليَوْمِ وفى رواية ্রيَعْمِدُ أَحَدُكُمْ، فَيَجْلِدُ امْرَأَتَهُ جَلْدَ العَبْدِ، فَلَعَلَّهُ يُضَاجِعُهَا مِنْ آخِرِ يَوْمِهِ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যামআ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যেন নিজের স্ত্রীকে দাসের ন্যায় প্রহার না করে, অতঃপর দিন শেষেই তার সাথে সহবাস করে। অপর বর্ণনায় আছে তোমাদের কেউ যখন তার স্ত্রীকে মারতে উদ্যত হয় তখন সে গোলামের ন্যায় মারে, অথচ ঐদিন শেষেই তার সাথে শোয়। ১৬৩
১৬৩.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৮০ ও রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৪৫
উপরিউক্ত হাদীসসমূহে নিজ স্ত্রীকে দাস দাসীর ন্যায় তুচ্ছ বিষয়ে প্রচণ্ডভাবে প্রহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। মুনিব দাস-দাসীর পুরো শরীরের মালিক। সুতরাং কোন মুনিব যদি অধীনস্থ কোন দাস-দাসীকে খুনও করে তবুও তার উপর কিসাস আবশ্যক হবে না। কিন্তু পুরুষ মাহর আদায় করে কোন মহিলাকে বিয়ে করলে সে কেবল স্ত্রীর নির্দিষ্ট একটি অঙ্গের মালিক হয়, স্ত্রীর পুরো শরীরের মালিক হয় না। ফলে তাকে নির্যাতন ও প্রহার করার অধিকার স্বামীর নেই।
তবে স্ত্রী যদি পাপাচারিণী হয় কিংবা স্বামীর চরম অবাধ্য হয় তবে তাকে মৃদু প্রহার করা বৈধ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًاআর যে স্ত্রী সম্পর্কে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং (মৃদুভাবে) প্রহার কর। যদি তাতে তারা তোমার অনুগত হয়ে যায়, তবে তাদের ব্যাপারে অন্য কোন পথ অনুসরণ করো না। ১৬৪
১৬৪.সূরা নিসা, আয়াত: ৩৪
অর্থাৎ, স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীর অবাধ্য ও নাফরমানী পাওয়া যায় কিংবা আশংকা করে তখন তাদের সংশোধনের প্রথম ধাপ হলো নম্রভাবে তাদের বোঝাবে, উপদেশ দিবে। যদি তাতেও বিরত কিংবা সংশোধন না হয়, তবে দ্বিতীয় ধাপ হলো নিজের বিছানা থেকে স্ত্রীকে পৃথক করে দিবে। যাতে স্বামীর অসন্তুষ্টি বুঝতে পারে এবং কৃতকর্মে জন্য অনুতপ্ত হয়ে স্বামীর অনুগত হতে পারে। কারণ আদর্শ স্ত্রীর জন্য স্বামীর বিছানা থেকে বঞ্চিত হওয়া বড় ধরনের একটা শাস্তি। কুরআনে করীমেفي المضاجع শব্দ উল্লেখ দ্বারা বুঝা যায়, কেবল ঘরের মধ্যে বিছানা পৃথক করবে, ঘর থেকে বের করে দেবে না। এতে যদি স্ত্রী সংশোধন হয়ে যায় তাহলে ভালো। নতুবা তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে বলা হয়েছে তোমরা স্ত্রীকে মৃদু প্রহার কর। এটা সর্বশেষ পন্থা যেটাকে আমরা প্রথম ধাপে উন্নীত করে দিয়েছি। এরপর যদি স্ত্রী স্বামীর অনুগত হয়ে যায় তবে তাদের ব্যাপারে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করো না।
এ প্রসঙ্গে হযরত আমর ইবনে আহওয়াস আল জুমাশি (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন
-أَلَا وَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا، فَإِنَّمَا هُنَّ عَوَانٌ عِنْدَكُمْ، لَيْسَ تَمْلِكُونَ مِنْهُنَّ شَيْئًا غَيْرَ ذَلِكَ، إِلَّا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ، فَإِنْ فَعَلْنَ فَاهْجُرُوهُنَّ فِي المَضَاجِعِ، وَاضْرِبُوهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ، فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا، أَلَا إِنَّ لَكُمْ عَلَى نِسَائِكُمْ حَقًّا، وَلِنِسَائِكُمْ عَلَيْكُمْ حَقًّا، فَأَمَّا حَقُّكُمْ عَلَى نِسَائِكُمْ فَلَا يُوطِئْنَ فُرُشَكُمْ مَنْ تَكْرَهُونَ، وَلَا يَأْذَنَّ فِي بُيُوتِكُمْ لِمَنْ تَكْرَهُونَ، أَلَا وَحَقُّهُنَّ عَلَيْكُمْ أَنْ تُحْسِنُوا إِلَيْهِنَّ فِي كِسْوَتِهِنَّ وَطَعَامِهِنَّ
সাবধান! তোমরা স্ত্রীদের প্রতি সদ্ব্যবহার কর। কেননা তারা তোমাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তোমরা তাদের নির্দিষ্ট স্থান থেকে উপকৃত হওয়া ব্যতীত অন্য কিছুর মালিক নও। কিন্তু যদি তারা প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়। যদি তারা এরূপ করে তবে তোমাদের বিছানা থেকে তাদেরকে পৃথক করে দাও এবং তাদেরকে প্রহার করো কিন্তু কঠোরভাবে নয়। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তবে তাদের জন্য বিকল্প পথ অনুসন্ধান করো না। সাবধান! তোমাদের স্ত্রীদের উপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে তেমনই তোমাদের উপর তাদের অধিকার রয়েছে। তাদের উপর তোমাদের অধিকার হলো- তারা তোমাদের অপছন্দনীয় ব্যক্তিদের দ্বারা তোমাদের বিছানা কলুষিত করবে না এবং তাদেরকে তোমাদের ঘরে প্রবেশ করতে অনুমতি দিবে না। তোমাদের উপর তাদের অধিকার হলো- তোমরা তাদের জন্য উত্তম ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে। ১৬৫
১৬৫.ইমাম তিরমীযী র. (২৭৯ হি.) সুনানে তিরমিযী, হাদীসখানা হাসান, সূত্র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৪৬
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا يُسْأَلُ الرَّجُلُ فِيمَا ضَرَبَ امْرَأَتَهُ عليه –
হযরত ওমর (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, স্ত্রীকে প্রহার করার ব্যাপারে কোনো স্বামীকে (কিয়ামত দিবসে) জিজ্ঞাসা করা হবে না। ১৬৬
১৬৬.আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮২
অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের বর্ণনা মতে যৌক্তিক কারণে স্বামী স্ত্রীকে মৃদু প্রহার করলে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর কাছে জবাবদীহি করতে হবে না। বরং ক্ষমাযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই বলে অযৌক্তিক কারণে প্রচন্ডভাবে স্ত্রীকে প্রহার ও আঘাত করলে স্বামীর বিরুদ্ধে আইনগত আদালতে গিয়ে বিচারিক ব্যবস্থা নিতে পারবে। এটা নারীর আইনগত অধিকার।
চার কারণে স্বামী স্ত্রীকে প্রহার করতে পারে
____________________
চার কারণে স্বামী স্ত্রীকে প্রহার করতে পারেঃ
১. স্বামী স্ত্রীকে সাজ-সজ্জা করার হুকুম করা সত্ত্বেও সে সাজ-সজ্জা না করলে।
২. সহবাসের জন্য স্ত্রীকে ডাকার পর সে স্বামীর ডাকে সাড়া না দিলে।
৩. নামায না পড়লে এবং হায়েয-নিফাস বন্ধ হওয়ার পর গোসল না করলে। এমনিভাবে জানাবতের গোসল না করলে এবং
৪. মাহর পরিশোধ করা সত্ত্বেও স্বামীর অনুমতি ব্যতীত বাড়ি থেকে অন্য কোথাও গমনাগমণ করলে। ১৬৭
১৬৭.ফাতাওয়ায়ে কাযী খান, পাদটীকা, আলমগীরী, খণ্ড.১
৭. একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সমতা রক্ষা করা
____________________
৭. একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সমতা রক্ষা করা
ইসলামে একাধিক স্ত্রী তথা একসাথে চারজন স্ত্রী একজন পুরুষ রাখতে পারে, যদি সকলের মধ্যে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা সম্ভব হয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
واِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً
আর যদি ইনসাফ করার ব্যাপারে তোমরা ভয় কর, তবে একটি স্ত্রী রাখাই উত্তম। স্ত্রীদের বাসস্থান, ভরণ-পোষণ, অলংকার, উপঢৌকন, ভালোবাসা, রাত্রিযাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা প্রয়োজন।
তবে সন্তানের মা হলে তাকে খোরপোশ একটু বেশী দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক সাথে নয়টি স্ত্রীর মধ্যে পূর্ণ ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করতেন যদিও তাঁর উপর তা আবশ্যক ছিলনা। তিনি কেবল আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও জাতিকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তা করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
مَنْ تَشَاءُ مِنْهُنَّ وَتُؤْوِي إِلَيْكَ مَنْ تَشَاءَ
আপনি তাদের (স্ত্রীদের) মধ্য থেকে যাকে চান দূরে রাখুন আর যাকে চান কাছে রাখুন। ১৬৮
১৬৮.সূরা আহযাব, আয়াত: ৫১
عن ابن عباس ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قبض عن تسع نسوة وكان يقسم منهن لثمان
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নয়জন স্ত্রী রেখে দুনিয়া থেকে ওফাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি তাদের মধ্যে আট দিন পালা বণ্টন করে দিয়েছেন। ১৬৯
১৬৯.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭৯
عَنْ عَائِشَةَ ان سودة الما كبرت قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ، قَدْ جَعَلْتُ يَوْمِي مِنْكَ لِعَائِشَةَ، ্রفَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقْسِمُ لِعَائِشَةَ يَوْمَيْنِ، يَوْمَهَا وَيَوْمَ سَوْدَةَ
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় হযরত সাওদা (رضي الله عنه) যখন বৃদ্ধা হয়ে গেলেন তখন তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার পালার দিনটা হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) কে দিয়ে দিলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আয়িশা রা’র জন্য দু’দিন নির্ধারণ করে দিলেন। একদিন তার নিজের আর একদিন হযরত সাওদাহ (رضي الله عنه) এর। ১৭০
১৭০.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭৯
উপরিউক্ত হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, স্ত্রী তার নির্ধারিত দিনকে অন্য কারো জন্যে উৎসর্গ করে দিতে পারে। কারণ এটি স্ত্রীর হক। সুতরাং স্ত্রী তা যাকে ইচ্ছে দিতে পারেন।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইন্তেকালের সময় নিম্নোক্ত নয়জন স্ত্রী বিদ্যমান ছিলেন।
১. হযরত আয়িশা (رضي الله عنه)
২. হযরত হাফসাহ (رضي الله عنه)
৩. হযরত সাওদাহ (رضي الله عنه)
৪. হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه)
৫. হযরত সাফিয়া (رضي الله عنه)
৬. হযরত মাইমূনা (رضي الله عنه)
৭. হযরত উম্মে হাবীবা (رضي الله عنه)
৮. হযরত যয়নাব (رضي الله عنه) ও
৯.হযরত জুআইরিয়া (رضي الله عنه) ।
মানুষ হিসাবে সর্বক্ষেত্রে সাধ্যানুযায়ী স্ত্রীদের প্রতি সমতা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। এতদসত্ত্বেও যদি যেসব বিষয়ে ব্যক্তির হাত নেই সেই সব বেষয়ে আল্লাহর নিকট অক্ষমতা প্রকাশ করা এবং আল্লাহর দরবারে তাওবা করা উচিত।
عن عائشة أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقْسِمُ بَيْنَ نِسَائِهِ فَيَعْدِلُ , ثُمَّ يَقُولُ: ্রاللَّهُمَّ هَذَا قَسْمِي فِيمَا أَمْلِكُ , فَلَا تَلُمْنِي فِيمَا تَمْلِكُ وَلَا أَمْلِكُ
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি নিজ পবিত্র স্ত্রীগণের মাঝে সমতা রক্ষা করতেন এত্যন্ত ইনসাফ করতন আর বলতেন, হে আল্লাহ! এটা আমার বণ্টন যার মালিক আমি। আপনি আমাকে ভৎর্সনা করবেন না ঐ বিষয়ে যার মালিক আপনি, আমি নই। ১৭১
১৭১.তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, দারেমী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭৯
অর্থাৎ কারো প্রতি মনের আকর্ষণ ও ভালোবাসা বেশী হওয়া ব্যক্তির আয়ত্তাধীন নয়, বরং তা আল্লাহ প্রদত্ত বিষয়। এক্ষেত্রে যদি মানুষ থেকে কারো প্রতি অন্তরের ভালোবাসা প্রবল হয়ে থাকে সে বিষয়ে আল্লাহ যেন বান্দাকে পাকড়াও না করেন সেজন্য তাঁর প্রতি নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে ক্ষমার প্রার্থনা করা উচিত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَلَنْ تَسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصْتُمْ فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ
আর তোমরা কখনো স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবেনা, যদিও এর আকাঙ্খী হও। অতএব তোমরা কোন একজনের দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়োনা এবং অপরজনকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখোনা। ১৭২
১৭২.সূরা নিসা, আয়াত: ১২৯
আগেই বলা হয়েছে এসব বিষয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তবুও উম্মতকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এরূপ করেছেন।
একাধিক স্ত্রী থাকলে স্বামীর সাথে সফরে যাওয়ার জন্য স্ত্রীরা সবাই আগ্রহ প্রকাশ করে। সেক্ষেত্রে একজনের উপর অপরজনকে প্রাধান্য দিলে অপর স্ত্রীরা নাখোশ হবে। আবার সবাইকে সফরে নিয়ে যাওয়াটাও স্বামীর পক্ষে যদি সম্ভব না হয় তাহলে সমস্যা থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে স্ত্রীদের মধ্যে লটারীর মাধ্যমে সফরের জন্য নির্বাচিত করা যেতে পারে।
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন কোথাও সফরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন স্ত্রীদের মধ্যে লটারীর ব্যবস্থা করতেন।
فَأَيَّتُهُنَّ خَرَجَ سَهْمُهَا خَرَجَ بِهَا مَعَهُ،
তাদের মধ্যে যার নাম লটারীতে উঠে আসতো তিনিই তাঁর সাথে সফরে বের হতেন। ১৭৩
১৭৩.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭৯
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্রإِذَا كَانَ عِنْدَ الرَّجُلِ امْرَأَتَانِ فَلَمْ يَعْدِلْ بَيْنَهُمَا جَاءَ يَوْمَ القِيَامَةِ وَشِقُّهُ سَاقِطٌ
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তির নিকট দু’জন স্ত্রী আছে আর সে তাদের মধ্যে ইনসাফ করে না তাহলে সে কিয়ামত দিবসে এক পার্শ্ব ঝোঁকা অবস্থায় উপস্থিত হবে।১৭৪
১৭৪.তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, দারেমী, সূত্র. মিশকাত; ২৭৯
মাসআলা : সমতা শুধু অবস্থান করার ক্ষেত্রে, সহবাস করার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা ওয়াজিব নয়। ১৭৫
১৭৫.ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড ১, ও হিদায়া, খণ্ড ২
মাসআলা : স্ত্রী নতুন হোক বা পুরাতন, কুমারী হোক বা অকুমারী, সুস্থ হোক বা অসুস্থ, গর্ভবতী হোক বা না হোক, ঋতুবতী হোক বা না হোক, পাগল হোক বা সুস্থ মস্তিষ্ক- সর্বাবস্থায় স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করা ওয়াজিব। এভাবে স্বামী সুস্থ হোক বা অসুস্থ, পৌরষত্ব সম্পন্ন হোক বা পৌরষত্বহীন, বালিগ হোক বা বালিক হওয়ার কাছাকাছি বয়সের হোক- সকল অবস্থায়ই স্বামীর উপর সমতা বজায় করা ওয়াজিব। ১৭৬
১৭৬.ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড ১
উল্লেখ্য যে, পূর্ণ সমতা বজায় রাখার মানে সংখ্যা ও পরিমাণের দিক দিয়ে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা বুঝানো হয়নি বরং প্রত্যেক স্ত্রীর অধিকার, সাম্য ও প্রয়োজননুপাতে দরকারী জিনিসপত্র পরিবেশন করার কথা বলা হয়েছে। কারণ একাদিক স্ত্রীর মধ্যে প্রত্যেকের রুচি, চাহিদা ও পছন্দ একই ধরনের হবে না। যুক্তি সঙ্গত চাহিদা, রুচি ও প্রয়োজন পরিমাণ স্বামীর সাধ্যানুযায়ী স্ত্রীদের মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে। বিলাসিতা, অযৌক্তিক, অপব্যয় এবং স্বামীর সামর্থের বাইরে অতিরিক্ত কিছু স্ত্রীরা দাবী করলে তা পূরণ করতে স্বামী বাধ্য নয়।
৮. স্ত্রীকে হাদিয়া দেওয়া
____________________
৮. স্ত্রীকে হাদিয়া দেওয়া
একে অপরকে হাদিয়া বা উপঢৌকন বিনিময় করলে মহব্বত সৃষ্টি হয়। মনের কলুষতা দূরীভূত করে। বিশেষত নারীরা সামান্য উপহার পেলেও অতি আনন্দিত হয়। পরিবারে সুখ-শান্তি অটুট রাখার উদ্দেশ্যে মাঝে মধ্যে স্ত্রীকে হাদিয়া বা উপহার দেওয়া স্বামীর উচিত। পুরুষরা প্রায় দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করে। এ সময় স্ত্রীর পছন্দনীয় কোন বস্তু স্বল্প মূল্য হলেও যদি স্ত্রীর জন্য কিনে আনে তাতে স্ত্রীর খুশীর সীমা থাকে না। এর দ্বারা স্ত্রী থেকে কোন বাড়তি কাজ আদায় করতে চাইলে স্ত্রীরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তা করতে প্রস্তুত থাকে। কারণ এর মাধ্যমে স্ত্রী বুঝতে পারে যে, স্বামী তাকে খুবই পছন্দ করে। সফরে গিয়েও আমার কথা ভুলেনি। নারীরা এটাকে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে এবং আত্মতৃপ্তি বোধ করে। আর স্ত্রীরও উচিত স্বামীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। ফলে আরেক সময় স্ত্রীর জন্য হাদিয়া নিতে উৎসাহী হবেন। হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন
-مَنْ لَمْ يَشْكُرِ النَّاسَ لَمْ يَشْكُرِ اللَّهَ
যে মানুষের কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ করে না সে আল্লাহরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।১৭৭
১৭৭.আহমদ, তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬১
হাদিয়া বিনিময় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- تَهَادَوْا فَإِنَّ الهَدِيَّةَ تُذْهِبُ الضغاءن
তোমরা পরষ্পর উপহার বিনিময় কর, কেননা, উপহার হিংসা-বিদ্ধেষ দূর করে।১৭৮
১৭৮.ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী’র (২৭৯হি.) তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬১
হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন-
تَهَادَوْا فَإِنَّ الهَدِيَّةَ تُذْهِبُ وَحَرَ الصَّدْرِ، وَلَا تَحْقِرَنَّ جَارَةٌ لِجَارَتِهَا وَلَوْ شِقَّ فِرْسِنِ شَاةٍ
তোমরা একে অপরকে হাদিয়া দিও। কেননা, হাদিয়া অন্তরের কলুষ দূর করে। এক প্রতিবেশীনী অপর প্রতিবেশীনীকে হাদিয়া দিতে যেন অবহেলা না করে এবং কেউ যেন হাদিয়া তুচ্ছ মনে না করে; যদিও এক টুকরা ভেড়ার ক্ষুরও হয়। ১৭৯
১৭৯.ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী র. (২৭৯হি.) তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬১
৯. স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ পোষণ না করা
____________________
৯. স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ পোষণ না করা
ইসলামের মূলই হল অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। মানুষের অধিকাংশ কার্যক্রম চলে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। ব্যবসা-বাণিজ্যতো সম্পূর্ণ বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস না করলে যেখানে একটা সমাজ পরিচালিত হওয়া অসম্ভব সেখানে স্বামী-ন্ত্রী একে অপরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ পোষণ করলে একটি পরিবার কীভাবে চলবে? কোন স্বামী কোন বিষয়ে স্ত্রীকে সন্দেহ করলে স্বামী ঘরে ও বাইরে, অফিস-আদালতে কোথাও শান্তিতে থাকতে পারবে না বরং সন্দেহের অনলে সে সর্বক্ষণ জ্বলতে থাকবে এবং সর্বদা অস্থিরতায় ভোগবে। অনুরূপভাবে স্ত্রীরও উচিত স্বামীকে সন্দেহের চোখে না দেখা। এর দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ইত্যাদি লোপ পায় এবং ধীরে ধীরে অশান্তির চরম শিখরে উন্নীত হয়। পরস্পর পরস্পর থেকে লোকচুরি করে কোন কাজ করা এবং সন্দেহ সৃষ্টি হয় এমন কাজ পরিহার করা উভয়ের উচিত। কারো প্রতি কোন বিষয়ে সন্দিহান হলে সাথে সাথে খোলা-মেলা আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الحَدِيثِ
তোমরা কারো প্রতি ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক, কেননা, আনুমানিক ধারণা বড় মিথ্যা। ১৮০
১৮০.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৪২৭
স্বামী-স্ত্রী কেউ কারো কোন ত্রুটি দেখলে যাচাই-বাছাই না করে কোন ধরনের মন্তব্য করা অনুচিত। বরং ধীর-স্থীরভাবে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করে মীমাংসার মানসিকতা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় আলোচনা করা উচিত। নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন-
الأَنَاةُ مِنَ اللَّهِ وَالعَجَلَةُ مِنَ الشَّيْطَانِ
কোন কাজে ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, পক্ষান্তরে তাড়াহুড়া শয়তানের পক্ষ থেকে হয়।১৮১
১৮১.ইমাম আবু ঈসা তিযমিযী র (২৭৯হি.), তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৪২৯
তালাক
____________________
তালাক
তালাক শব্দটি আরবি ‘তালাকুন’ থেকে বাংলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আভিধানিক অর্থ- ছেড়ে দেওয়া, অবমুক্ত হওয়া, বিচ্ছিন্ন করা ও বন্ধন খুলে দেওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় তালাক মানে বিয়ের বন্ধন খুলে দেওয়া। স্বামী কর্তৃক সরাসরি অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে নির্দিষ্ট বাক্য কিংবা ইঙ্গিতে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন করাকে তালাক বলে।
ইসলামে তালাক প্রথার রহস্য
____________________
ইসলামে তালাক প্রথার রহস্য
বিবাহ সারা জীবনের জন্যই সম্পাদন করা হয়ে থাকে। তাই তা ভঙ্গ করার মত কোন পরিস্থিতি যেন না হয়, সেদিকেও বিশেষ লক্ষ্য রাখার তাগিদ দিয়েছে ইসলাম। এই সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরিণাম শুধু স্বামী-স্ত্রী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না, বংশ ও সন্তানদের জীবনেও তার প্রভাব পড়ে। এমনকি উভয় পক্ষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাধও সৃষ্টি হয় এবং সংশ্লিষ্ট অনেকেই এর ফলে বহুমুখী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এগুলো থেকে বেঁচে থাকার জন্য নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবন সুখময়, শান্তিময় ও স্ন্দুর পারিবারিক ও সামাজিক জীবন গড়ে উঠার জন্য ইসলাম প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান প্রদান করেছে।
স্বামী-স্ত্রীর পারষ্পরিক সম্পর্ক যখন এতদূর খারাপ হয়ে যায় যে, তারা পরস্পর মিলে মিশে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সহকারে জীবন যাপন করতে কোন সম্ভাবনাই দেখতে পায়না, এমনকি এরূপ অবস্থার সংশোধন বা পরিবর্তনের শেষ আশাও বিলীন হয়ে যায়, যার ফলে বিয়ের মূল উদ্দেশ্যই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়, কেবল তখনই উভয়ের ভবিষ্যত দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও তিক্ততা-বিরক্তির বিষাক্ত পরিণতি থেকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে উভয়ের মধ্যে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেওয়াই উভয়ের জন্য কল্যাণকর।
এই তালাকের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই মস্ত বড় আযাব থেকে মুক্তি পায় এবং উভয়ে স্বস্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে।
ইসলামে তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ এবং উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বড় বড় মনীষীগণও ইসলামের তালাক ব্যবস্থার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
ইসলাম তালাক প্রদানকে নিষিদ্ধ করেনি, আবার বল্গাহীনভাবে তুচ্ছ বিষয়ে তালাক প্রদানের অনুমতিও প্রদান করেনি। তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে মানুষ ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চললে তালাকের হার বহুলাংশে হ্রাস পেতো। ইসলামে তালাক দেওয়াকে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- مَا أَحَلَّ اللَّهُ شَيْئًا أَبْغَضَ إِلَيْهِ مِنَ الطَّلَاقِআল্লাহ তালাকের চেয়ে নিকৃষ্ট কোন বস্তুকে হালাল করেন নি। ১৮২
১৮২.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫হি.) সুনানে আবু দাউদ, খণ্ড ১, পৃ. ৩১২
হযরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন, أَبْغَضُ الْحَلَالِ إِلَى اللَّهِ الطَّلَاقُ সব হালাল বস্তুর মধ্যে মহান আল্লাহর নিকট তালাক সর্বাপেক্ষা অপছন্দনীয়। ১৮৩
১৮৩.ইমাম আবু দাউদ র (২৭৫ হি.) সুনানে আবু দাউদ, পৃ. ৩১২, সূত্র মিশকাত. পৃ. ২৮৩
অপর হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত মুয়ায (رضي الله عنه) কে সম্বোধন করে বলেন, হে মুয়ায!
ولا خلق الله شيئا على وجه الارض ابغض اليه من الطلاق
আল্লাহ তা‘আলা ভূপৃষ্ঠে তালাকের চেয়ে অতি নিকৃষ্ট কোন বস্তু সৃষ্টি করেননি।১৮৪
১৮৪.দারে কুতুনী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮৪
হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, তোমরা বিয়ে কর কিন্তু তালাক দিওনা। কেননা, তালাক দিলে তার দরুণ আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। ১৮৫
১৮৫.তাফসীরে কুরতুবী, খণ্ড. ১৮, পৃ. ১৪৯, সূত্র. দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ই.ফ.বা.পৃ. ৪১৩
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমরা বিয়ে কর তবে তালাক দিয়োনা। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা সেসব স্বামী-স্ত্রীকে পছন্দ করেন না, যারা নিত্য-নতুন বিয়ে করে স্বাদ গ্রহণ করতে অভ্যস্ত। ১৮৬
১৮৬.আহকামুল কুরআন, খণ্ড, ৩৯, পৃ. ১৩৩, সূত্র. প্রাগুক্ত
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
তোমরা (স্বামীরা) যদি তাদের (স্ত্রীদের) অপছন্দ করো, তাহলে হয়ত এমনও হতে পারে যে, তোমরা যাকে অপছন্দ করছো আল্লাহ তা‘আলা তার মধ্যে প্রভূত কল্যাণ রেখে দিয়েছেন। ১৮৭
১৮৭.সূরা নিসা, আয়াত: ১৯
অর্থাৎ স্ত্রীদের কোন একটি বিষয় বা অভ্যাসকে অপছন্দ করে তাকে ঘৃণা করা কিংবা তালাক দেওয়া উচিত নয় কারণ এমনও তো হতে পারে তার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা আরো বহু পছন্দনীয় গুণাবলী ও চরিত্র দান করেছেন। কারণ কোন মানুষের সব অভ্যাস ও চরিত্র মন্দ হয় না; বরং ভাল-মন্দ মিলেই মানুষ। সর্বদিক দিয়ে প্রশংসীত ও ভাল হলে তো সে ফেরেশতা হয়ে যাবে। এরকম স্ত্রী খুঁজে পাওয়া পৃথিবীতে বিরল।
এই পর্যন্ত কুরআন-হাদিসের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামে তালাক প্রদান করাকে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। এরপরও যদি স্ত্রীর আচার-আচরণ ও কর্ম-কাণ্ড স্বামীর নিকট অসহনীয় হয় এবং ক্ষমা ও উপেক্ষা করার মতও না হয়, সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে রাগের মাথায় তালাক না দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে সে আচরণ সংশোধন করার চেষ্টা চালানোর জন্য উপদেশ প্রদান করা হয়েছে স্বামীকে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا
আর স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার তোমরা আশংকা কর তাকে সদুপদেশ দাও। এরপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহার কর। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরোদ্ধে অন্য কোন বিকল্প পথ অন্বেষণ করো না। ১৮৮
১৮৮.সূরা নিসা, আয়াত: ৩৪
উক্ত আয়াতে স্ত্রীকে সংশোধন করার জন্য পর্যায়ক্রমে তিনটি ধাপ বর্ণনা করা হয়েছে।
১. তাকে উত্তমভাবে সদুপদেশ দিয়ে সংশোধনের প্রচেষ্টা করা। অর্থাৎ স্ত্রীর রাগ চলে গেলে ইসলামের আলোকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে ঠান্ডা মাথায় উপযুক্ত সময় সুযোগ বুঝে স্ত্রীকে সত্য ও ন্যায়কে বুঝিয়ে দিতে হবে।
২. উপদেশ দ্বারা সংশোধন না হলে সাময়িকভাবে তার শয্যা বর্জন করা হবে। এতে স্বামীর সঙ্গ ও শয্যা যে কত মধুর তা উপলব্দি করতে পারবে। কারণ স্ত্রীর জন্য স্বামীর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হওয়া দুর্বিসহ ও অপমানের বিষয়। এভাবে তাকে ভুল উপলব্দি করে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে।
৩. এতো কিছুর পরও যদি স্ত্রী সংশোধন না হয় তাহলে তাকে আহত না হয় মতো মৃদু প্রহার করা যাবে যাতে চেহারায় বা অন্য কোন অঙ্গের ক্ষতি ও সৌন্দর্য্যহানি না হয়।
উল্লেখিত ব্যবস্থাগুলো অবলম্বন করার পরও যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি না হয় তাহলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পরিবারের একজন করে সালিস নিযুক্ত করে তাদের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَاআর যদি তাদের মধ্যে (স্বামী-স্ত্রী) বিরোধ আশংকা থাকে তাহলে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার হতে একজন আর স্ত্রীর পরিবার হতে একজন সালিস মনোনীত করে মীমাংসার জন্য পাঠাও। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবেন। ১৮৯
১৮৯.সূরা নিসা, আয়াত: ৩৫
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- والصلح خيرআর উভয়ের মধ্যে সমঝোতা করে নেওয়াই উত্তম। ১৯০
১৯০.সূরা নিসা, আয়াত: ১২৮
অর্থাৎ সরকার অথবা স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের অভিভাবকগণের পক্ষ থেকেএকজন করে সালিস নিযুক্ত করে স্বামী-স্ত্রীর নিকট পাঠাবেন মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য। সালিসদ্বয়ের মধ্যে সৎ উদ্দেশ্য ও মীমাংসা করার মত যোগ্যতা থাকতে হবে। তারা স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে মাঝখানে কয়েক দিনের বিরতি দিয়ে একে একে তিনবার বৈঠক করে সমঝোতা করার চেষ্টা করবেন।
যদি সমঝোতার এই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাও ফলপ্রসূ না হয় তাহলে এর অর্থ হবে- স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্য জীবনে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে তালাক কামনা করছে তাহলে সেই ক্ষেত্রে তালাকের মাধ্যমে তাদের পৃথক হয়ে যাওয়ার পথ খোলা রয়েছে ইসলামে।
তালাক প্রদানের বেলায়ও স্বামীকে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে বলা হয়েছে। প্রথমত- স্ত্রীকে মাসিক ঋতুস্রাব অবস্থায় তালাক দেওয়া পরিহার করবে এবং যে পবিত্র অবস্থায় সহবাস হয়েছে তাতেও তালাক দিবেনা বরং এমন পবিত্র অবস্থায় তালাক দিবে যাতে স্ত্রীর সাথে সহবাস করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত- তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রের এক পবিত্র অবস্থায় এক তালাক দিতে বলা হয়েছে। একসাথে তিন তালাক দেওয়াকে অনুত্তম বলা হয়েছে। এভাবে তিন মাসে তিন ‘তুহর’ তথা পবিত্র অবস্থায় তালাক দিলে এই দীর্ঘ সময়ে হয়তো একদিকে যেমন স্বামীর রাগ কমে যেতে পারে তেমনি অন্যদিকে স্ত্রী সংশোধনের সময় ও সুযোগ পাবে। ফলে তালাক প্রত্যাহার করে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পারবে।
তৃতীয়ত- তালাক প্রদানের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে পুরুষকে; নারীকে নয়। কারণ মহিলাদের মধ্যে সাধারণত বুদ্ধি-বিবেচনা ও দূরদৃষ্টির অভাব থাকে এবং তারা কোন কোন ক্ষেত্রে সাময়িক উত্তেজনার বশে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ গ্রহণে অতি দ্রুত এগিয়ে যায়। কাজেই যদি মহিলাদের হাতেও তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হতো তাহলে অতি তুচ্ছ ঘটনাতে বহু সংসার বিরান হয়ে যেতো।
আবার স্ত্রীর উপর যদি স্বামী কোন প্রকারের যুলুম-অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন করে আর স্বামীর আকদের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায় তাহলেও ইসলামে এর সুযোগও রাখা হয়েছে। স্ত্রী স্বামীকে কিছুর বিনিময়ে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারে যাকে শরীযতে ‘খুলা’ বলা হয়। তাছাড়া স্বামী থেকে প্রাপ্ত ক্ষমতা বলেও স্ত্রী নিজেকে নিজে তালাক দিতে পারে-শরীয়তে এটাকে ‘তালাকে মুফাওয়াযাহ’ বলা হয়।
ইসলামে তালাক পছন্দনীয় নয় বলে এবং তালাক সহজে প্রদান না করার জন্য এতগুলো পর্যায় ও ধাপ অতিক্রম করে একেবারে অপারগ হয়ে পড়লে তখনই তালাক প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ইসলামের এই পদ্ধতি গ্রহণ করলে সমাজে তালাকের পরিমাণ শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
তালাক সম্পর্কে ইসলামের এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শোনা ও জানার পরও যদি এ কারণে ইসলামকে দোষারোপ করা হয় তবে তা হবে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা মূলক আচরণ।
তাছাড়া ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রে তালাক সম্পর্কীয় মাসয়ালা-মাসায়েল অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। ফকীহগণ পারতপক্ষে কোন ঘর-সংসার ভাঙতে চাননি, বরং তালাকের মাসয়ালায় কোন ফাঁক-ফোকর থাকলেই যা দিয়ে বৈবাহিক বন্ধন বহাল রাখা যায় তা দিয়ে বিবাহ বহাল রাখার চেষ্টা করেন।
তালাকের প্রকারভেদ
____________________
তালাকের প্রকারভেদ
সময় ও সংখ্যার বিচারে তালাক তিন প্রকার। ক. আহসান; খ. হাসান ও গ.বিদ্ঈ।
ক. আহসান তালাক: ঋতুস্রাব পরবর্তী যে তুহরে স্ত্রীর সাথে সহবাস করা হয়নি, সেই তুহরে এক তালাকে রাজঈ প্রদান করে ইদ্দতকালীন সময় পর্যন্ত আর কোন তালাক না দেওয়া।
বিধান: এরূপ তালাক প্রদান করা হলে ইদ্দত চলাকালীন সময়ের মধ্যে স্বামী ইচ্ছা করলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পারবে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতির প্রয়োজন হয়না। আর ইদ্দত অতিবাহিত হয়ে গেলে এক তালাক বাইন পতিত হবে। আকদ নবায়ন করা ব্যতিত স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
খ. হাসান তালাক:সহবাস করা হয়নি এমন তুহরে স্ত্রীকে এক রাজঈ তালাক দেওয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তুহরে পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তালাক প্রদান করা। এ অবস্থায় স্ত্রী মুগাল্লাযা তথা চুড়ান্ত তালাক প্রাপ্তা হয়ে যাবে।
বিধান: শরয়ী হালাল ব্যতিত স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
গ. বিদঈ তালাক: স্ত্রীকে একই সাথে তিন তালাক দেওয়া বা একই তুহরে তিন তালাক দেওয়া।
বিধান:এরূপ তালাক দেওয়া হলে তিন তালাকই পতিত হয়ে স্ত্রী মুগাল্লাযা হয়ে যাবে। এভাবে তালাক দেওয়া গুনাহের কাজ।ঋতুস্রাবকালীন তালাক দেওয়া কিংবা যে তুহরে সহবাস করা হয়েছে সেই তুহরে তালাক দেওয়াও বিদঈ তালাকের অন্তর্ভুক্ত।
ইদ্দত
____________________
ইদ্দত
‘ইদ্দত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ গণনা করা। শরীয়তের পরিভাষায় ইদ্দত বলা হয় স্বামীর মৃত্যু অথবা তালাক দানের পর মহিলাদের বিশেষ নিয়মে একটি সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা। ১৯১
১৯১.শামী, খণ্ড. ৩, আলমগীরী, খণ্ড. ১
ইদ্দত ওয়াজিব হয় বিবাহিতা মহিলার স্বামীর মৃত্যু ঘটলে কিংবা নিকাহে সহীহ বা নিকাহে ফাসিদের মাধ্যমে সহবাস কিংবা বাধামুক্ত নির্জন বাস সাব্যস্থ হওয়ার পর স্বামী কর্তৃক তালাক দান বা অন্য কোন কারণে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেলে। ইদ্দত পালনকালে মহিলাদের উপর অনেক বৈধ কাজ অবৈধ হয়ে যায়। যেমন, সাজসজ্জা করা, অন্যের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। ১৯২
১৯২.ফাতহুল কাদীর, খণ্ড. ৪
ইদ্দত পালন করার রহস্য হল- সন্তানের নসব (বংশ) সাব্যস্ত করা। অর্থাৎ স্ত্রীর গর্ভে স্বামীর কোন সন্তান বিদ্যমান আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে ইদ্দত পালন করতে হয়। তালাকের সাথে সাথে যদি স্ত্রী অন্য স্বামী গ্রহণ করে এবং পরে সে গর্ভবতী হয় তখন ওই সন্তান কি প্রথম স্বামীর না বর্তমান স্বামীর? তা নির্ণয় করা মুশকিল হয়ে পড়বে। তাছাড়া ইদ্দত পালনের এই দীর্ঘ সময়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা ও বনিবনাও হয়ে যেতে পারে।
ইদ্দতের প্রকারভেদ
____________________
ইদ্দতের প্রকারভেদ
ইদ্দত মোট চার প্রকার। ১. হায়েযের মাধ্যমে ইদ্দত পালন করা। যে মহিলার মাসিক হয় সে তালাকপ্রাপ্তা হলে তার ইদ্দত হবে পূর্ণ তিন হায়েয। দলীল-
والمطلقات يتربصن بانفسهن ثلاثة قروء
আর তালাকপ্রাপ্ত নারীরা তিন হায়েয পর্যন্ত অবস্থান করব। ১৯৩
১৯৩.সূরা বাকারা, আয়াত: ২২৮
২. মাস গণনার মাধ্যমে ইদ্দত পালন করা। যে মহিলার হায়েয হওয়ার সময় হয়নি কিংবা হায়েযে বয়স ইদ্দত পালন করা। যে মহিলার হায়েয হওয়ার বয়স হয়নি কিংবা হায়েযের বয়স অতিক্রম করে বার্ধক্যে পৌঁছেছে। এরূপ মহিলা তালাকপ্রাপ্তা হলে তার ইদ্দত হল তিন মাস। দলীল-
وَاللَّائِي يَئِسْنَ مِنَ الْمَحِيضِ مِنْ نِسَائِكُمْ إِنِ ارْتَبْتُمْ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلَاثَةُ أَشْهُرٍ وَاللَّائِي لَمْ يَحِضْنَ
তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের হায়েয হওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং যাদের আদৌ হায়েয হয়নি তাদের ইদ্দত হল তিন মাস। ১৯৪
১৯৪.সূরা তালাক, আয়াত: ৪
৩. সন্তান প্রসবের মাধ্যমে ইদ্দত পালন। তালাক প্রাপ্তা মহিলা যদি গর্ভবতী হয়, তাহলে সে ইদ্দত পালন করবে সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত। দলীল
-وَأُولَاتُ الْأَحْمَالِ أَجَلُهُنَّ أَنْ يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ
আর গর্ভবতীদের ইদ্দত হল সন্তান প্রসব করা।১৯৫
১৯৫.সূরা তালাক, আয়াত: ৪
৪. চার মাস দশ দিন। গর্ভবতী নয় এমন মহিলার স্বামী মারা গেলে তার ইদ্দত হল চারমাস দশ দিন। দলীল-
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا
তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যুবরণ করেছে ঐসব স্ত্রীরা চার মাস দশদিন ইদ্দত পালন করবে। ১৯৬
১৯৬.সূরা বাকারা, আয়াত: ২৩৪
ইদ্দত পালনকালীন বিধান
____________________
ইদ্দত পালনকালীন বিধান
স্ত্রী স্বামীর ঘরেই ইদ্দত পালন করবে। স্বামী জোর জরবদস্তি করে নিজের ঘর থেকে বের করে দিতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
لَا تُخْرِجُوهُنَّ مِنْ بُيُوتِهِنَّ وَلَا يَخْرُجْنَ
ইদ্দত চলাকালীন সময়ে তোমরা (স্বামী) তাদেরকে তাদের ঘর থেকে বের কর না এবং তারা নিজেরাও বের হবে না। ১৯৭
১৯৭.সূরা তালাক, আয়াত: ১
ইদ্দত কালীন সময়ে স্ত্রীকে স্বামীর ঘরে রাখার পেছনেও হেকমত আছে। এতে উভয়ের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ থাকে। এ কারণেই ইমাম আবু হানিফা র বলেন, ইদ্দত পালনকালীন সময়ে স্ত্রী খুব সাজসজ্জা ও রূপচর্চার সাথে থাকা উচিত। উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্কারাদি পরিধান করা এবং উৎকৃষ্ট মানের সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করা উচিত। যেন স্বামী তার দিকে আকৃষ্ট হয়।
ইদ্দতের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর কোন একজন যদি মারা যায় তবে উভয়েই একে অন্যর উত্তরাধিকারী হবে।
ইদ্দত শেষ না হওয়া পর্যন্ত মহিলা অন্য কাউকে বিয়ে করতে পরবে না। ইদ্দতের সময়ে স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পারবে। এতে স্ত্রীর অনুমতি ও সম্মতির প্রয়োজন পড়বে না।
এ পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি, তাদের দাম্পত্য জীবনের বিভেদ ও সমস্যাবলীর ইসলামী সমাধান এবং তালাক, ইদ্দত ইত্যাদির শরয়ী নীতি ও বিধিবিধান সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে আলোকপাত করেছি। এসব আলোচনার ফলে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও উপকারিতা এবং মানব সমস্যাবলির সমাধানে ইসলামের গভীর আন্তরিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তব ভিত্তিরও ভারসাম্যপূর্ণতার ছবি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ইসলাম যে, সহজ ও উদারনৈতিক জীবনাদর্শ এবং এতে চরম পন্থার কোনো সুযোগ নেই আমাদের আলোচনা থেকে সেই সত্যতাও ফুটে উঠেছে।
পর্দা
____________________
পর্দা
পর্দা মুসলিম রমনীর সৌন্দর্য। পর্দা নারীর ভূষণ। নারীর মান-সম্মান, ইজ্জত-আবরুর রক্ষাকবচ পর্দা। ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’ ঘোষণার মাধ্যমে নারী জাতিকে মহামান্বিত করেছে যে ইসলাম, নারীর মহামহিম মর্যাদা রক্ষায় পর্দার অপরিহার্যতাকে অনিবার্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছে সেই ইসলাম।
ইসলাম পর্দার মাধ্যমে অন্ধকার যুগের অশ্লীলতা ও দেহ প্রদর্শনী প্রথার মূলোচ্ছেদ করেছে এবং পর্দাহীন সমাজে সৃষ্ট যাবতীয় বেলেল্লাপনা ও যৌন অপরাধ প্রবণতা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যাহেলী যুগের পর্দাহীন নারীর কী দূরাবস্থা ও কী করুণ বিপর্যয় ছিল তার ইতিহাস জানা থাকলে ইসলামে পর্দা প্রথার গুরুত্বও আবশ্যকতা বুঝতে সহজ হবে। আবার এ মুসলমানরাই পর্দা প্রথা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে পর্দা প্রথাকে বিতর্কিত করে তুলেছে। অনেক লোক বিভ্রান্তিবশত পর্দার অর্থ বলতে নারীকে অন্ধকার ঘরে বসিয়ে রাখাকে বুঝিয়েছেন, যেখান থেকে নারী যেন কোথাও আসতে বা যেতে না পারে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, বিয়ের পর মেয়েরা শুধু নিজের পিতৃগৃহ ছাড়া আর কোথাও যাতায়াত করতে পারত না এবং স্বামীর গৃহ থেকেই শেষ বারের মতো তার জানাযা বের হতো। এটাকে তারা তাদের পারিবারিক আভিজাত্যের প্রতীক মনো করতো এবং এটা ছিল তাদের কাছে বিশেষ প্রশংসনীয় বিষয়। এ ধরণের বিদঘুটে অবস্থায় নারী যদি কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতো তাহলে ডাক্তারকে পর্যন্ত রোগীনীকে দেখার অনুমতি দেওয়া হতো না।
আবার কোন কোন সমাজে কড়াকড়িটা একটু কম ছিল। তাদের মেয়েরা নিকটাত্মীয়দের বাড়ি যাতায়াত করতে পারতো, তবে এই আসা-যাওয়ার অনুমতি ছিল শুধু রাতের বেলায় যেন তার উপর কোন পুরুষের নজর না পড়ে। আর বিত্তশালী পরিবারে মেয়েরা পালকি বা পশুচালিত যানবাহনে যাতায়াত করতো; কিন্তু এসব যানবাহন ও পালকির দরজা-জানালা খুব ভালো করে বন্ধ রাখা হতো। দরজা-জানালা না থাকলে সেক্ষেত্রে পুরো পালকি ও বাহনটিকে কাপড় দিয়ে মুড়ে দেওয়া হতো। এরূপ কঠোর পর্দা ব্যবস্থা দেখে অনেক মুসলিম রমনী পর্দা প্রথাকে ভয়ংকর ও অনেক কঠিন বিধি মনে করে এর বাস্তবায়ন থেকে নিজেকে দূরে সরে রেখেছে। ইসলামের সহজ বিধানকে কঠিন করে তোলা উচিত নয়। আমাদেরকে এ কথাও ভুলে গেলে চলবেনা যে, দ্বীন সহজের জন্য কঠিন করে তোলার জন্য নয়। মহান আল্লাহও মানুষের সাধ্যের বাইরে কোন কাজ কারো উপর আরোপিত করেন না। সুতরাং পর্দা অবলম্বন করা নারীদের জন্য মোটেও কঠিন বিষয় নয়।
পর্দা কি প্রগতির অন্তরায়?
____________________
পর্দা কি প্রগতির অন্তরায়?
ইসলাম নারীকে শুধু পুরুষের সমান মর্যাদা দেয়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চাইতেও বেশি মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী দাবিদার ইসলামী পর্দাবিধানকে প্রগতির অন্তরায় বলে উপেক্ষা করে।
কথিত প্রগতিবাদিীদের দাবি হলো, নারীরা মাতৃত্বের গুরুদায়িত্ব পালন করবে, মাজিস্ট্রেট হয়ে জেলার শাসনকার্যও পরিচালনা করবে এবং নর্তকি ও গায়িকা হয়েও চিত্তবিনোদন করবে। কী অদ্ভুত খেয়াল! বস্তুত কথিত প্রগতি নারীর ওপর দায়িত্বের এরূপ দুরূহ বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে, যার ফলে সে কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সমাধা করতে পারছে না।
প্রগতির ঢেঁকিরা নারীকে এমন সব কাজে নিযুক্ত করছে, যা জন্মগতভাবেই নারীর প্রকৃতি বিরুদ্ধ। শুধু তাই নয়, তাকে তার সুখের নীড় থেকে টেনে এনে প্রতিযোগিতার ময়দানে দাঁড় করাচ্ছে, যেখানে পুরুষের মোকাবেলা করা তার পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
এর স্বাভাবিক পরিণতি এই দাঁড়াবে যে, প্রতিযোগিতামূলক কাজে সে পুরুষের পেছনে পড়ে থাকতে বাধ্য হবে। আর যদি কিছু করতে সক্ষম হয় তবে তা নারীত্বের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যকে বিসর্জন দিয়েই করতে হবে। তথাপি এটাকেই প্রগতি বলে মনে করা হয়। আর এই তথাকথিত প্রগতির মোহেই নারীর ঘর সংসার ও পারিবারিক জীবনের মহান কর্তব্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়। অথচ এই ঘর সংসার হচ্ছে মানব তৈরি একমাত্র কারখানা। এ কারখানার সাথে জুতা কিংবা পিস্তল তৈরির কারখানার কোনো তুলনাই চলে না। কারণ এ কারখানা পরিচালনার জন্য যে বিশেষ ধরনের গুণাবলি, ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা আবশ্যক, প্রকৃতি তার বেশির ভাগ শক্তিই দিয়েছেন নারীর ভেতরে। এ কারখানার পরিসর বিস্তৃত। কাজও অনেক।
যদি কেউ পরিপূর্ণ দায়িত্বনুভূতি সহকারে এ কারখানার কাজে আত্মনিয়োগ করে, তার পক্ষে বাইরের দুনিয়ায় নজর দেয়ার আদৌ অবকাশ থাকে না। বস্তুত এ কারখানাকে যতখানি দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সাথে পরিচালনা করা হবে, ততখানি উন্নত ধরনের মানুষই তা থেকে বেরিয়ে আসবে।
কাজেই এ কারখানা পরিচালনার উপযোগী শিক্ষা ও ট্রেনিংই নারীর সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। আর এ জন্যেই ইসলাম পর্দাপ্রথার ব্যবস্থা করেছে।
মোটকথা নারী যাতে তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে বিপথে চালিত না হয় এবং পুরুষও যাতে নারীর কর্মক্ষেত্রে নিয়মহীনভাবে প্রবেশ করতে না পারে, তাই হচ্ছে পর্দার লক্ষ্য। আজ তথাকথিত প্রগতির মোহে এক শ্রেণির নারীবাদী ব্যক্তি ও সংগঠন ইসলামী পর্দার বিধানকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, যদি এ উদ্দেশ্যে অটল থাকা যায়, তাহলে এর পরে দুটি পথের একটি অবলম্বন করতে হবে। হয় ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থার সমাধি রচনা করে হিন্দু কিংবা খ্রিস্টানদের মতো নারীকে দাসী ও পদসেবিকা বানিয়ে রাখতে হবে, নতুবা দুনিয়ার সমস্ত মানব তৈরির কারখানা ধ্বংস হয়ে যাতে জুতা কিংবা পিস্তল তৈরির কারখানা বৃদ্ধি পায়, তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এ কথা দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যে, ইসলামের প্রদত্ত জীবনবিধান ও সামাজিক শৃঙ্খলাব্যবস্থাকে চুরমার করে দিয়ে নারীর সামাজিক মর্যাদা এবং পারিবারিক ব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের কবল থেকে বাঁচিয়ে রাখা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
প্রগতি বলতে যাই বোঝানো হোক না কেন, কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন যে, আপনারা কী হারিয়ে কী পেতে চান? প্রগতি আকেটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। এর কোনো নির্দিষ্ট কিংবা সীমাবদ্ধ অর্থ নেই।
মুসলমানরা এককালে বঙ্গোপসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিশাল বিস্তৃত রাজ্যের শাসনকর্তা ছিল। সে যুগে ইতিহাস, দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানে তারাই ছিল দুনিয়ার শিক্ষাগুরু। সভ্যতা ও কৃষ্টিতে দুনিয়ার কোনো জাতিই তাদের সমকক্ষ ছিলনা। আপনাদের অভিধানে ইতিহাসের সেই গৌরবোজ্জ্বল যুগকে প্রগতির যুগ বলা হয় কিনা জানি না। তবে সেই যুগকে যদি প্রগতির যুগ বলা যায় তাহলে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, পর্দার পবিত্র বিধানকে পুরোপুরি বজায় রেখেই তখনকার মুসলকমানরা এতটা উন্নতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল।
ইসলামের ইতিহাসে বড় বড় বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, চিন্তানায়ক, আলেম ও দিগি¦জয়ী বীরের নাম উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। সেসব বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিগণ নিশ্চয় তাদের মুর্খ জননীর ক্রোড়ে লালিতপালিত হননি। শুধু তাই নয়, ইসলামী ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা বহু খ্যাতনামা মহিলার নামও দেখতে পাই। সে যুগে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে দুনিয়ায় অসাধারণ প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। তাঁদের এই উন্নতি ও প্রগতির পথে পর্দা কখনোই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি।
ভ্রান্তির বেড়াজালে পর্দাবিধান
____________________
ভ্রান্তির বেড়াজালে পর্দাবিধান
পর্দাবিধানটি আজ নানা ষড়যন্ত্র এবং নানাবিদ সমস্যায় জর্জরিত। নানান ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে পর্দাবিধান। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, খোদ মুসলিমদের দ্বারাই লঙ্ঘিত আজ পর্দার প্রকৃত বিধান। এসব মুসলমান উপলব্ধি করতে পারছে না যে, এটি নিজের পায়ে কুঠারাঘাতের শামিল। ইসলামের এই বিধানটি শুধু আমাদের আখেরাতে নাজাতেরই উপায় নয়, আমাদের দুনিয়ার জীবনের শান্তি, স্বস্তি ও পবিত্রতারও রক্ষাকবচ। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও বিভিন্ন অপপ্রচারকারীদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আমরা নিজেদের আদর্শ ত্যাগ করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি।
কথিত আধুনিক দাবিদাররা এ কথার ডাকঢোল পিটিয়ে বেড়াচ্ছে যে, ইসলামী পর্দাবিধান নারীদেরকে ঠকিয়েছে। বস্তুত ইসলামী শরীয়তের মাধ্যমে নারীরা অনেক বড় নেয়ামত, দয়া সহানুভূতি ও উপকার লাভ করেছে। যেমন ইসলাম নারীদের ইজ্জত সম্মান ও পুত-পবিত্রতা রক্ষা করেছে এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার গ্যারান্টি দিয়েছে। ইসলাম নারীদের উচ্চ মর্যাদার আসন দিয়েছে, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে হ্যাঁ! নারীদের জন্য ইসলাম লেবাস-পোশাক, সৌন্দর্য প্রদর্শন ও চলাফেরা ইত্যাদির ক্ষেত্রে যেসব বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, তা শুধু সামাজিক অনিষ্টতা ও ফেতনা ফাসাদে যাবতীয় উপায় উপকরণের পথকে বন্ধ করার নিমিত্ত এবং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যেই করেছে; নারীদের প্রতি অবিচার কিংবা কোনো প্রকার বৈষম্য সৃষ্টির জন্য নয়।
ইসলাম নারীর প্রতি বিধি-নিষেধ আরোপ করে তাদের স্বাধীনতা হরণ কিংবা তাদের গৃহবন্দি করেনি; বরং তারা যাতে তাদের জীবনে চলার পথে চরম অবনতি ও অপমানের খপ্পরে না পড়ে এবং যাতে মানুষের দৃষ্টির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত না হয়, তা থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলাম এই বিধি-নিষেধ ও পর্দাবিধান প্রদান করেছে।
তাই সর্বাগ্রে ভালোভাবে জানতে হবে যে, প্রকৃতরূপে পর্দা কাকে বলে? এছাড়া পর্দার উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা এবং তার উপকারিতা-অপকারিতা সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে হবে। মূলত আল কুরআনের নির্দেশ থেকেই ইসলামী সমাজে পর্দার সূচনা। অতঃপর এ প্রসঙ্গে আর যত আয়াতই নাজিল হয়েছে, তার সমষ্টিকে ‘আহকামে হিজাব’ বা পর্দাবিধান বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা নূর ও সূরা আহযাবে এ সম্পর্কিত নির্দেশাবলি বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
এসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, মহিলারা যেন তাদের মর্যাদাসহ আপন ঘরেই বসবাস করে এবং জাহেলী যুগের মেয়েদের মতো বাইরে নিজেদের রূপ সৌন্দর্যের ফেরি করে না বেড়ায়। একান্ত যদি তাদের ঘরের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তবে আগেই যেন চাদর (কাপড়) দ্বারা তারা নিজেদের দেহকে আবৃত করে নেয় এবং ঝংকারদায়ক অলংকারাদি পরিধান করে ঘরের বাইরে না যায়। ঘরের ভেতরেও যেন তারা মাহরাম পুরুষ ও গায়রে মাহরাম পুরুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে এবং ঘরের চাকর ও মেয়েদের ব্যতীত অন্য কারো সামনে যেন জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে না বেরোয়। মাহরাম পুরুষদের সামনে বের হওয়া সম্পর্কেও এ শর্তারোপ করা হয়েছে যে, তারা বের হওয়ার পূর্বে যেন ওড়না দ্বারা তাদের মাথাকে আবৃত করে নেয় এবং নিজেদের সতর লুকিয়ে রাখে।
অনুরূপভাবে পুরুষদেরকেও তাদের মা বোনদের নিকট যাওয়ার পূর্বে অনুমতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেন অসতর্ক মুহূর্তে মা-বোনদের দেহের গোপনীয় অংশের প্রতি তাদের দৃষ্টি পড়তে না পারে।
কুরআন মাজীদে উল্লিখিত এ সমস্ত নির্দেশকেই আমরা পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি। নবী করীম (ﷺ) এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মহিলাদের সতর হচ্ছে মুখমণ্ডল, হাতের কব্জি ও পায়ের পাতা ব্যতীত দেহের অবশিষ্টাংশ। এই সতরকে মুহাররাম (যাদের সাথে দেখা করা বৈধ) পুরুষ এমনকি পিতা, ভাই প্রমুখের সামনেও ঢেকে রাখতে হবে। মেয়েরা এমন কোনো মিহি কাপড় পরিধান করতে পারবে না, যাতে তাদেরগোপনীয় অংশ বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর হতে পারে। তাছাড়া তাদেরকে মাহরাম পুরুষ ছাড়া অন্য কারো সাথে ওঠাবসা কিংবা ভ্রমণ করতে নবী করীম (ﷺ) স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। শুধু তাই নয়, নবী করিম মহিলাদেরকে সুগন্ধি মেখেও ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। এমনকি তিনি মসজিদে জামায়াতের সাথে নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে মহিলাদের জন্য পৃথক স্থান পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। নারী ও পুরুষকে মিলিতভাবে একই কক্ষে বা একই স্থানে নামায আদায়ের তিনি কখনো অনুমতি প্রদান করেননি। এমনকি নামায শেষে খোদ নবী করীম (ﷺ) ও তার সাহাবীগণ মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে আগে বের হওয়ার সুযোগ দিতেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মসজিদ থেকে সম্পূর্ণরূপে বের না হতেন ততক্ষণ পুরুষরা তাঁদের কক্ষের ভেতরেই অপেক্ষা করতেন। পর্দার এই সকল বিধান সম্পর্কে যদি কারো মনে সংশয় থাকে, তাহলে তিনি কুরআনের সূরা নূর ও সূরা আহযাব এবং হাদীসের বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করে দেখতে পারেন। বর্তমানে আমরা যাকে পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি, তার বাহ্যিক রূপে কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বটে। কিন্তু মূলনীতি ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার দিক দিয়ে রাসূলে কারীম (ﷺ) কর্তৃক মদিনার ইসলামী সমাজে প্রবর্তিত পর্দাব্যবস্থারই অনুরূপ। বস্তুত পর্দা সম্পর্কে আমাদের মনে যদি কোনো প্রকার সন্দেহমূলক বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে থাকে, তাহলে নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়ারই বা কী অধিকার আছে? কারণ পর্দা কোনো মনগড়া জিনিস নয়, বরং এটি আল্লাহ এবং রাসূলেরই প্রদত্ত বিধান।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বেপর্দার কুফল
____________________
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বেপর্দার কুফল
সিসিলির একজন বিখ্যাত অমুসলিম যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ। তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, আমার দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, আত্মীয়স্বজনদের নির্বিঘেœ ঘরে যাতায়াত করা, সাধরণ আত্মীয়স্বজন বিনা অনুমতিতে ঘরে অবস্থান করা এবং চা পান করা সার্বিকভাবে ক্ষতিকর। আর এর প্রভাব কয়েক পুরুষ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এর দ্বারা নারীর প্রকৃত যৌন সৌন্দর্য, নারীত্ব এবং যৌনশক্তি অনেক কমে যায়।
তিনি আরো বলেন, আমি এরূপ মেলামেশায় নারীদেরকে অন্যান্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখেছি। এ মেলামেশার দরুন তালাকের আধিক্য দেখতে পেয়েছি। যেনা এবং অপকর্ম বৃদ্ধি পেতে দেখেছি। ঘর উজার হয়ে যেতে দেখেছি। আত্মহত্যা করতে দেখেছি। নারী-পুরুষের জেলে যেতে দেখেছি। এসব কিছুর মূলে রয়েছে ঘরে যে কোনো নারী-পুরুষের অবাধে যাতায়াত করা। এছাড়া আর কিছু নয়।
শরয়ী পর্দা ছেড়ে দেয়ার ফলে একজন অমুসলিম প্রায় পনেরোশ বছর পর এতগুলো ক্ষতির বর্ণনা দিয়েছেন। অথচ প্রিয়নবী (ﷺ) শরয়ী পর্দার আদেশ দিয়েছেন প্রায় পনেরোশ বছর পূর্বে। তিনি আমাদেরকে সকল ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন আজ হতে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে।
গাইরে মাহরাম পুরুষের সাথে মেলামেশা হারাম
____________________
গাইরে মাহরাম পুরুষের সাথে মেলামেশা হারাম
অনাত্মীয় গাইরে মাহরাম পুরুষের সাথে বসা নারীর জন্য হারাম। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত-
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ“
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে বর্ণনা করেন, সাবধান কোনো পুরুষ যেন কোনো গায়ওে মাহরাম মেয়ের সাথে কোনো অবস্থায় নির্জন জায়গায় না বসে, শুধুমাত্র মাহরাম হলে তার জন্য পাশে বসা বৈধ।” ১৯৮
১৯৮.বুখারী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৭৮৭
মেয়েদের জন্য গায়রে মাহরাম পুরুষের সাথে বসা নির্জন স্থানে হোক বা প্রকাশ্যে কোনো জায়গায় হোক, কোনো অবস্থায়ই জায়েয নেই। সাথে কোনো আত্মীয় থাকলেও গায়রে মাহরামের পাশে বসা মেয়েদের জন্য কোনো অবস্থায় বৈধ নয়। মনে রাখতে হবে যে, এই সহঅবস্থান দ্বারা শয়তান চোখ, কান, পা এবং অন্তরের যেনায় উভয়কে লিপ্ত করায়। যা এক সময় পরিপূর্ণ যেনায় মানুষকে লিপ্ত করায়। বর্তমান সময়ে শহরে মেয়েরা বিশেষ করে কম বয়স্ক মেয়েরা গাইরে মাহরামের সাথে উঠাবসা, চলাফেরা, কাজকর্ম করাকে মোটেই দোষনীয় মনে করে না। অথচ এগুলো কোনো অবস্থায়ই জায়েয নেই। লঞ্চ, ট্রেন, বিমান, বাস ভ্রমণেও এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।
মনে রাখতে হবে যে, শরীয়তে নিষিদ্ধ কোনো কাজকে ফ্রি মাইন্ড বলে এড়িয়ে যাওয়া, পাত্তা না দেয়া কারো জন্যেই শুভ নয়। শরীয়তের নির্দেশিত পথই হচ্ছে সর্বোচ্চ শান্তি ও নিরাপত্তার পথ। অতএব, পার্কে, সমুদ্র সৈকতে, হোটেলে ও উদ্যানে কোনো অবস্থাতেই গাইরে মাহরাম পুরুষের সাথে বসা, গল্প করা কারো জন্যেই জায়েয নেই। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া গাইরে মাহরাম পুরুষের সাথে কথা বলাও জায়েয নেই। অতএব, সবাইকে এ পথ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, জান্নাত বড় সুখের আর জাহান্নাম বড় নিকৃষ্ট ও কষ্টদায়ক স্থান।
পর্দাহীনতা ধর্ষণের প্রকোপ বৃদ্ধি করে
____________________
পর্দাহীনতা ধর্ষণের প্রকোপ বৃদ্ধি করে
পর্দাহীনতা ধর্ষণের প্রকোপ মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি ঘটায়। ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা জানা সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী এ বিষয়ে অভিযোগ করে না। ফলে যে সংখ্যা পাওয়া যায়, বাস্তবে তা অনেক বেশি ঘটে।
ব্রিটিশ পুলিশের মতে, ১৯৮৪ সালে এক বছরে বৃটেনে বিশ হাজারের অধিক নিগ্রহ এবং পনের শত ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়। এর মতে, বৃটেনে প্রতিবছর অন্তত পাঁচ থেকে ছয় হাজার ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়ে থাকে। আর প্রকৃত সংখ্যা তার চাইতেও বেশি। ১৯৯৪ সাল নাগাদ এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজারে।
উক্ত সংস্থার মতে,” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি সবচাইতে ভয়াবহ। এখানে বিশ্বের সর্বাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। সে সংখ্যা জার্মানীর সংখ্যার চাইতে চারগুণ, বৃটেনের চাইতে ১৮ গুণ আর জাপানের চাইতে প্রায় ২০ গুণ বেশি।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক এবং বাস্তবতা এই যে, ৭৫% ধর্ষণের ঘটনাই ঘটে থাকে পূর্ব পরিচিতের দ্বারা। আর ১৬% নিকট আত্মীয় বা বন্ধুর দ্বারা।
নামক সংস্থার মতে, ৩৮% ক্ষেত্রে পুরুষ তাঁর অফিসিয়াল ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে নারীকে ধর্ষণ করে থাকে। আর ৮৮% মহিলা কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির স্বীকার হয়ে থাকেন। এ হলো তথাকথিত উন্নত ও নারী-স্বাধীনতার দাবিদার দেশগুলোর অবস্থা।
পর্দাহীনতা বিবাহ-বিচ্ছেদ বাড়ায়
____________________
পর্দাহীনতা বিবাহ-বিচ্ছেদ বাড়ায়
পর্দাহীনতা বিবাহ-বিচ্ছেদ বাড়িয়ে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিবাহপূর্ব সহবাস এবং -এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণকারী বৃটেনের নারীদের প্রায় অর্ধেক প্রাক-বিবাহ সহবাসের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এর পক্ষে তাঁদের যুক্তি ছিল যে, এর ফলে নর-নারী একে অপরকে ভালোভাবে জানতে পারে এবং এর পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে তা স্থায়িত্ব লাভ করে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ইংল্যান্ডেই সর্বাধিক বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে থাকে। ১৯৮৩ সালে যুক্তরাজ্যে যেখানে এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। ১৯৯৪ সলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় এক লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০ সালে বিবাহ-বিচ্ছেদের সংখ্যা ছিল সাত লক্ষ আট হাজার আর ১৯৯০ সালে তা দাঁড়ায় এগারো লক্ষ পঁচাত্তর হাজারে। পক্ষান্তরে, বিবাহের হারে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিবর্তন হয়নি।
পর্দাহীনতা কুমারী মাতৃত্ব ও একক মাতৃত্ব ডেকে আনে
____________________
পর্দাহীনতা কুমারী মাতৃত্ব ও একক মাতৃত্ব ডেকে আনে
আজকের বিশ্বে কুমারী মাতৃত্বের অন্যতম কারণ হলো পর্দাহীনতা। পশ্চিমা-বিশ্বের তথাকথিত ‘নারী স্বাধীনতা’র আরেক অভিশাপ হলো কুমারী মাতৃত্ব।
বৃটেনে এক জরিপে দেখা যায় যে, ১৯৮২ সালে যেখানে কুমারী-মাতার সংখ্যা ছিল নব্বই হাজার, ১৯৯২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লক্ষ পনেরো হাজার। ১৯৯২ সালে জন্ম নেয়া শিশুদের ৩১% ছিল অবিবাহিতা মাতার সন্তান। এই অবিবাহিতা বা কুমারী-মাতাদের মধ্যে আড়াই হাজারের বয়স ১৫ বছরের নিচে। বৈধ বিবাহের মাধ্যমে জন্ম নেয়া শিশুর তুলনায় অবৈধ শিশুর জন্মের হারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে অবৈধভাবে জন্ম নেয়া শিশুর দায়ভার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্তাচ্ছে কুমারী-মাতা বা একক-মাতৃত্বের ওপর। নারীর ওপর কুমারী-মাতৃত্বের এই দায়ভার পশ্চিমা-বিশ্বে নারী-নিপীড়নের এক নিষ্ঠুর উদাহরণ।
পর্দাহীনতাকে উসকে দেয় বিজ্ঞাপন ও পর্নোগ্রাফী
____________________
পর্দাহীনতাকে উসকে দেয় বিজ্ঞাপন ও পর্নোগ্রাফী
তথাকথিত নারী-স্বাধীনতার নামে নারীকে আজ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিজ্ঞাপন-সামগ্রী এবং পর্নোগ্রাফীতে। আর এটি উসকে দিচ্ছে পর্দাহীনতা। পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারী যেন আজ একটি অপরিহার্য বিষয়। সম্প্রতি ‘দি ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার বরাত দিয়ে বাংলাদেশের ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়-
“আমেরিকার মেয়েরা যৌন-আবেদনময়ী হওয়ার পরিবেশেই বড় হচ্ছে। তাদের সামনে যেসব পণ্য ও ছবি তুলে ধরা হচ্ছে তাতে তারা যৌনতার দিকেই আকৃষ্ট হচ্ছে। মার্কিন সংস্কৃতি, বিশেষ করে প্রধান প্রধান প্রচার মাধ্যমে মহিলা ও তরুণীদের যৌন ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন (এপিএ) ‘টাস্কফোর্স অন দ্যা সেক্সুয়েলাইজেশন অব গার্লস’-এর সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে একথা বলা হয়।
রিপোর্টের প্রণেতাগণ বলেন, টিভি-শো থেকে ম্যাগাজিন এবং মিউজিক-ভিডিও থেকে ইন্টারনেট পর্যন্ত প্রতিটি প্রচার-মাধ্যমেই এই চিত্র দেখা যায়। তাদের মতে, যৌন, রূপ ও মনদান তরুণী ও মহিলাদের এ তিনটি অতি সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এগুলো হলো পেটের গোলযোগ, আত্মসম্মানহানিবোধ এবং মনমরা ভাব।
আমেরিকান লিজ গুয়া নামের একজন মহিলা বলেন, তিনি তাঁর ৮ বছরের মেয়ের উপযোগী পোশাক খুঁজে পেতে অসুবিধায় রয়েছেন। প্রায়ই সেগুলো খুবই আঁটসাঁট, নয়তো খুবই খাটো। যৌন-আবেদন ফুটিয়ে তোলার জন্যই এ ধরনের পোশাক তৈরি করা হয়।” ১৯৯
১৯৯.দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭
এতক্ষণ পর্যন্ত তথাকথিত নারী স্বাধীনতার নামে পশ্চিমা জগতের ঘুণেধরা সমাজের একটি ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরা হলো। বাস্তবচিত্র তার চাইতেও আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। অর্থনৈতিক চাকচিক্য আর প্রযুক্তিগত উন্নতির আড়ালে তথাকথিত ‘আধুনিক’ বিশ্বের সমাজ ও পারিবারিক ব্যবস্থায় আজ ধস নেমেছে। নারী-স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার নামে নারী আজ পদে পদে লাঞ্চিত ও নিগৃহীত হচ্ছে, ব্যবহৃত হচ্ছে ভোগের সামগ্রী হিসেবে। এ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও জীবন নির্ধারনের সঠিক ও পূর্ণ অনুসরণ এবং পর্দা বিধানকে গ্রহণ করা।
উল্লিখিত সবগুলো পরিণামই ইহলৌকিক পরিণাম। এছাড়া পর্দার বিধান লঙ্ঘন করার কারণে রয়েছে পারলৌকিক পরিণাম। আর এ ইহলৌকিক পরিণামের একটি শেষ বা সীমান্ত রয়েছে। কিন্তু পারলৌকিক পরিণাম বা শাস্তির কোনো শেষ বা সীমান্ত নেই। সুতরাং একটি সুস্থ বিবেক এবং একটি সুস্থ কেয়াস বা চিন্তাশক্তির বিবেচনায় পর্দা অপরিহার্য একটি বিধান বলে প্রমাণিত।
উল্লিখিত জরিপগুলোকে সুস্থ বিবেক ও মানসিকতা নিয়ে বিবেচনা করলে একটিমাত্র কারণই খুঁজে পাওয়া যায়। আর সেটি হলো, পর্দাহীনতার বিস্তৃতি। পরীক্ষামূলকভাবে এবং নিজস্বভাবে যেসব এলাকা বা ব্যক্তিত্ব ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে পর্দার বিধানকে গ্রহণ করেছেন, তারাই রক্ষা পেয়েছেন এই ভয়াবহতা থেকে।
পর্দাহীনতার বৈশ্বিক জরিপ
____________________
পর্দাহীনতার বৈশ্বিক জরিপ
ইসলামের পর্দাব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞতা অথবা এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য না বোঝার কারণে কতিপয় জ্ঞানপাপী একে পশ্চাৎপদতা, সেকেলে, নারীকে শৃঙ্খলিতকরণের পন্থা, উন্নয়নের অন্তরায় এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি বৈষম্য সৃষ্টির প্রয়াস বলে আখ্যায়িত করে থাকে। মূলত এই ভুল বুঝাবুঝির জন্য মুসলিম বিশ্বের কতিপয় এলাকায় ইসলামের সত্যিকার শিক্ষার অপপ্রয়োগ আর পাশ্চাত্য গণমাধ্যমের নেতিবাচক ভূমিকাই দায়ী। কিছু গণমাধ্যমের এটা একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ইসলামের কথা উঠলেই তার প্রতি একটা কুৎসিত আচরণ প্রদর্শন করা হয়। আর তাদের এই অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের এই অঞ্চলেও অনেকে পর্দাপ্রথা সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করে থাকে।
বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায়, একজন খ্রিস্টান ‘নান’ বা ধর্মাজাজিকা যখন লম্বা গাউন আর মাথা-ঢাকা পোশাক পরে থাকে তখন তা আর পশ্চাৎপদতা, উন্নয়নের অন্তরায় বা নারীকে শৃঙ্খলিতকরণের প্রয়াস বলে বিবেচিত হয় না; বরং তা শ্রদ্ধা, ভক্তি বা মাতৃত্বের প্রতীক রূপেই বিবেচিত হয়। পক্ষান্তরে একজন মুসলিম নারী যখন বোরকা বা হিজাব ব্যবহার করেন, তখন তা নিয়ে শুরু হয় তর্কবিতর্ক আর আলোচনা-সমালোচনা। মূলত ইসলামের পর্দাব্যবস্থা নারীকে লাঞ্চিত করার পরিবর্তে তাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। পর্দাব্যবস্থা সমাজে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে।
আসুন আমরা দেখি, তথাকথিত প্রগতি, নারী-স্বাধীনতা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সমাজকে বা নারীকে কী দান করেছে? প্রচলিত সাধারণ ধারণায় বিংশ শতাব্দী, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়কে নারী স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হলেও এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এই সময়ে বিশ্বে নারী-নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা পঁচিশ ভাগ। এ বিষয়ে এখানে একটি জরিপের বিবরণ তুলে ধরা হলো।
পর্দাহীনতা গর্ভপাত বাড়ায়
____________________
পর্দাহীনতা গর্ভপাত বাড়ায়
পর্দাহীনতার ফলে গর্ভপাতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৬৮ সালে ইংল্যান্ডে গর্ভপাতকে বৈধতা প্রদান করার পর সেখানে কেবল রেজিস্টার্ড গর্ভপাতের ঘটনাই বৃদ্ধি পেয়েছে দশগুণ। এর মধ্যে মাত্র শতকরা একভাগ (১%) স্বাস্থ্যগত কারণে আর বাকি ৯৯%-ই অবৈধ গর্ভধারণের কারণে ঘটেছে। ১৯৬৮ সালে যেখানে ২২ হাজার রেজিস্টার্ড গর্ভপাত ঘটানো হয়, সেখানে ১৯৯১ সালে এক লক্ষ আশি হাজার আর ১৯৯৩ সালে তা দাঁড়ায় আট লক্ষ উনিশ হাজারে। এর মধ্যে পনেরো বছরের কম বয়সী মেয়ের সংখ্যা তিন হাজার।
এটা তো গেল যুক্তরাজ্যের অবস্থা। এখন আসুন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকার দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। সেখানকার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। রেজিস্টার্ড পরিসংখ্যা অনুযায়ী কেবলমাত্র ১৯৯৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে দশ লক্ষ গর্ভপাত ঘটানো হয়। নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, প্রকৃত গর্ভপাতের সংখ্যা উক্ত সংখ্যার তুলনায় ১০%-২০% বেশি।
এক্ষেত্রে কানাডার পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক। তবে জাপানের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ। অর্থাৎ, জাপানে প্রতি বছর প্রায় বিশ লক্ষ রেজিস্টার্ড গর্ভপাত ঘটানো হয়ে থাকে। তথাকথিত সভ্য জগতে ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’র জন্য বিগত ২৫ বছরে এক বিলিয়ন অর্থাৎ দশ কোটিরও অধিক ভ্রুণকে হত্যা করা হয়। উক্ত সংখ্যা কেবলমাত্র রেজিস্টার্ড পরিসংখ্যান থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আরো ভয়াবহ।
বর্বর যুগে কন্যা-সন্তানদের হত্যা করা হতো অর্থনৈতিক কারণে। কিন্তু আজ তথাকথিত সভ্য-জগতে ব্যভিচার, অবৈধ মিলন আর অনৈতিকতার চিহ্ন মুছে ফেলতে এসব হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। এসবই হলো বেপর্দা আর নারী-পুরুষের অবাধ মেলামশার ভয়াবহতা। ২০০
২০০.কারী উম্মে রুমান, নারীর জান্নাত পাওয়ার পথ, পৃ. ১৬৬-১৭৫
পর্দার বিধান
____________________
পর্দার বিধান
পর্দাকে আরবিতে ‘হিজাব’ বলা হয়। ‘হিজাব’ ও ‘সতর’ এক জিনিস নয়। সতর নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ফরয। পক্ষান্তরে ‘হিজাব’ শুধু মহিলাদের জন্য খাস। মহিলাদেরকে আরবিতে ‘আওরাত’ বলা হয়। আরবিতে ‘আওরাত’ ঢেকে রাখার, গোপন করার বস্তুকে বুঝায়- যা প্রকাশে লজ্জা অনুভূত হয়। মহিলাদের আপাদমস্তকই ঢেকে রাখার বস্তু। সুতরাং নারী মুখমণ্ডল, হাতের কব্জি ও পায়ের পাতা সতরের অর্ন্তভুক্ত না হলেও ওইসব অঙ্গ পর্দার অন্তর্ভুক্ত।
কুরআন হাদিসের আলোকে পর্দাকে তিন স্তরে ভাগ করা যায়। যথা-
১. মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জি ব্যতিত মহিলাদের পুরো শরীরই পর্দার আওতাভূক্ত। এটা হচ্ছে পর্দার সর্বনিম্ন স্তর। এটা মূলত মহিলাদের জন্য সতরও।
২. মুখমণ্ডল ও হাত-পা সর্বাঙ্গ বোরকা দ্বারা আবৃত রাখা। এটা হচ্ছে পর্দার মাধ্যমিক স্তর।
৩. ঘরের অভ্যন্তরে অবস্থান করা এবং খুব প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে বের না হওয়া। এটা হচ্ছে পর্দার সর্বোচ্চ স্তর।
প্রথম স্তর সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে
____________________
প্রথম স্তর সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে নবী! মু’মিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করে। তারা যেন সাধারণত প্রকাশমান অঙ্গ ব্যতিত তাদের আবরণ প্রদর্শন না করে, তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে, তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনাহীন পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ব্যতিত কারো নিকট তাদের আবরণ প্রকাশনা করে, তারা যেন তাদের গোপন আবরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে।হে মু’মিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। ২০১
২০১.সূরা নূর, আয়াত: ৩১
বেগানা নারীকে দেখা, কথা বলা, উঠা-বসা করা সর্বশেষ ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া
____________________
বেগানা নারীকে দেখা, কথা বলা, উঠা-বসা করা সর্বশেষ ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া
এ সবকিছু হারাম, কিন্তু বক্ষমান আয়াতে দেখা ও ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার কথা উল্লেখিত হয়েছে। কারণ চোখে দেখা হলো পাপের সূচনা আর ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া হলো এর পরিণতি। এখানে প্রথম ও শেষটা উল্লেখ করে এ উভয়ের মাঝখানের সবকিছু হারামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নারী-পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার প্রথম ধাপ হলো দৃষ্টি। তাই এই অপকর্মের সূচনাকেই বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এখানে দৃষ্টি সংযত রাখার কথা বলা হয়েছে।
উপরিউক্ত আয়াতে নারীদের দৃষ্টি ও লজ্জাস্থান সংযত ও হেফাযত করতে বলা হয়েছে কিন্তু এর পূর্বের আয়াতে পুরুষদের দৃষ্টি ও যৌনাঙ্গের হেফাযত করার কথা বলা হয়েছে। কারণ ব্যভিচারের সূচনা নারী-পুরুষ উভয়ের পক্ষে হতে পারে। হযরত হাসান বসরীর মুরসালরূপে বর্ণনা করেন-
قَالَ: بَلَغَنِي أَنَّ رَسُولَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:لَعَنَ اللَّهُ النَّاظِرَ وَالْمَنْظُورَ إِلَيْهِ –
আমার কাছে বিশ্বস্ত সূত্রে পৌছেছে যে, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ইরশাদ করেন, যে অন্যের প্রতি দৃষ্টি দিবে এবং যার দিকে দৃষ্টি পতিত হবে উভযের প্রতি আল্লাহ লা’নাত করেন। ২০২
২০২.ইমাম বায়হাকীর (৪৫৮ হি.) শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭০
হযরত বুরাইদা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা হযরত আলী (رضي الله عنه) কে বললেন
يَا عَلِيُّ لَا تُتْبِعِ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ فَإِنَّ لَكَ الْأُولَى وَلَيْسَتْ لَكَ الْآخِرَةُ
হে আলী ! হঠাৎ একবার দৃষ্টির পর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দিও না, কেননা তোমার প্রথম বার ক্ষমাযোগ্য কিন্তু দ্বিতীয়বার ক্ষমাযোগ্য নয়। ২০৩
২০৩.আহমদ, তিরমিযী, দারেমী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬৯
হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) বলেন,
-سَأَلَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ نَظَرِ الْفُجَاءَةِ فَأمرنِي أَن أصرف بَصرِي –
আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলাম যদি কারো প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায় তখন কি করব? উত্তরে তিনি আমাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশ করলেন।২০৪
২০৪.ইমাম মুসলিম রা. (২৬১ হি.), সহীহ মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬৮
হযরত আবু উমাম (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন-
قَالَ: مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَنْظُرُ إِلَى مَحَاسِنِ امْرَأَةٍ أَوَّلَ مَرَّةٍ ثُمَّ يَغُضُّ بَصَرَهُ إِلَّا أَحْدَثَ اللَّهُ لَهُ عِبَادَةً يَجِدُ حلاوتها –
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, কোন স্ত্রী লোকের সৌন্দর্য্যরে প্রতি যদি কোন মুসলমান পুরুষের প্রথম দৃষ্টি পড়ে যায় অতঃপর সাথে সাথে সে তার দৃষ্টি অবনত করে ফেলে তাহলে আল্লাহ তার জন্য এমন এক ইবাদতের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেন যেই ইবাদতের স্বাদ সে পায়। ২০৫
২০৫.ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র, (২৪১ হি.), মুসনাদে আহমদ, সৃত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭০
হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, একদা তিনিও হযরত মাইমূনা (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র কাছে ছিলেন। হঠাৎ অন্ধ সাহাবী হযরত উম্মে মাকতূম (رضي الله عنه) তাঁর কাছে আগমন করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেন,
- احْتَجِبَا مِنْهُ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلَيْسَ هُوَ أَعْمَى لَا يُبْصِرُنَا؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَفَعَمْيَاوَانِ أَنْتُمَا؟ أَلَسْتُمَا تُبْصِرَانِهِ؟
তোমরা তার থেকে পর্দা কর। আমি বললাম হে ইয়া রাসূলাল্লাহ ! সে কি অন্ধ নয় ? সে তো আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা কি অন্ধ ? তোমরা কি তাকে দেখছ না ? ২০৬
২০৬.আহমদ, তিরমিযী ও আবু দাউদ, সূত্র. মিশকাত; পৃ.২৬৯
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
فالعينان زِنَاهُمَا النَّظَرُ وَالْأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الِاسْتِمَاعُ وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الْكَلَامُ وَالْيَدُ زِنَاهَا الْبَطْشُ وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الْخُطَا وَالْقَلْبُ يَهْوَى وَيَتَمَنَّى وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الْفَرْجُ وَيُكَذِّبُهُ
চোখের যিনা হলো (অবৈধ) দৃষ্টিদান, কানের যিনা হলো (হারাম) কথা বার্তা শ্রবণ করা, মুখের যিনা হলো (হারাম) কথা-বার্তা বলা, হাতের যিনা হলো ( হারাম বস্তৃ) ধরা এবং পায়ের যিনা হলো (হারাম কাজের প্রতি) চলা। তারপর মনে (অপকর্মের প্রতি) আকাক্সক্ষা জম্মায়(এটা মনের যিনা), এরপর লজ্জাস্থান সেটাকে কার্যে পরিণত করে (এটাই হচ্ছে যিনার সর্বশেষ পর্যায়) অথবা তা প্রত্যাখ্যান করে। ২০৭
২০৭.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ৬১১, হাদিস নং ১৬২২২
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আসমা (رضي الله عنه) কে সন্বোধন করে বলেন-
يَا أَسْمَاءُ، إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا بَلَغَتِ الْمَحِيضَ لَمْ تَصْلُحْ أَنْ يُرَى مِنْهَا إِلَّا هَذَا وَهَذَاগ্ধ وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ –
হে আসমা ! নিশ্চয় মহিলা বালেগ হলে তার এই এই অঙ্গ ব্যতিত অন্য কোন অঙ্গ প্রদর্শন জায়েয নেই। তিনি এ সময় তার চেহারা মোবারক ও হাতের কব্জি মোবারকের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ২০৮
২০৮.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.) সুনানে আবু দাউদ।
পর্দার দ্বিতীয়স্তর সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে
____________________
পর্দার দ্বিতীয়স্তর সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে -
হে নবী ! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যগণকে এবং মু’মিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে (সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেয়ে হিসাবে) চিনতে সহজ হবে। ফলে তাদেরকে (বকাটরা) উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালূ। ২০৯
২০৯.সূরা আহযাব, আয়াত: ৫৯
মাথার উপর ওড়না ব্যতিত লম্বা চাদরকে ‘জিলবাব’ বলা হয়, যা সম্ভ্রান্ত ও স্বাধীন মহিলা ওড়নার উপর মাথার উপরিভাগ দিয়ে পেছিয়ে চোখ দু’টি ব্যতিত মুখমন্ডলকে ঢেকে ফেলে। এর দ্বারা দাসী ও স্বাধীন মহিলার মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। তৎকালে রাস্তা-ঘাটে বখাটে ও দুষ্টু যুবকরা দাসীদের উত্যক্ত করত স্বাধীন মহিলাদেরকে নয়। তাই এ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের উদ্দেশ্য এরূপ জিলবাব পরিধান করার আদেশ দেয়া হয়েছে।
বর্তমানেও সত্যিকার অর্থে পর্দা সহকারে মহিলারা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে আসলে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা মনে করে তাকে উত্যক্ত করা হয় না। পক্ষান্তরে নারী যখন বেপর্দা, আঁটসাঁট ও টাইট জিন্স পোশাক পরে কিংবা শরীরের আকর্ষনীয় অঙ্গ প্রদর্শনপূর্বক দেহ প্রদর্শনী, সৌন্দর্য প্রকাশ করে বিভিন্ন অঙ্গী-ভঙ্গি করে পথ চলে তখন রাস্তার অসৎ যুবকরা বুঝে নেয় যে, এটা কোন সভ্য ঘরের মেয়ে নয়। তাই তারা নির্ভিঘ্নে উক্ত মেয়েকে ইভটিজিং ও উত্যক্ত করে আর আজে-বাজে মন্তব্য ছুড়ে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন,
-ترخى المراة الازار شبرا فقالت ام سلمة اذا تكشف اقدامهن قال فيرخين زراعا
মহিলাগণ তাদের গায়ের চাদর (পায়ের নলার) এক বিগত নিচে ঝুলিয়ে ব্যবহার করবে। উম্মে সালমা (رضي الله عنه) বললেন, তাহলে তো তাদের পা অনাবৃত হয়ে যাবে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তাহলে একহাত পরিমাণ ঝুলিয়ে দিবে।
তৃতীয়স্তরে পর্দার ব্যাপারে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى –
হে নবীপত্নীগণ ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পর পুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে-মূখর্তা যুগের অনুরূপ নিজেদের প্রদর্শন করবে না। ২১০
২১০.সূরা আহযাব; আয়াত: ৩১-৩২
উপরোক্ত আয়াতে বিনা প্রয়োজনে রূপ-সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নারীদেরকে বাইরে বেরুতে নিষেধ করা হয়েছে। নতুবা হজ্ব, ওমরা, পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাত, মাহরাম অসুস্থ, নিকটাত্মীয়-স্বজনকে সেবা এবং একান্ত প্রয়োজন হলে জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্মস্থানে পর্দা সহকারে বাইরে যাওয়া-আসা নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত।
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ
তোমরা তাঁর (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)) পত্নীগণের নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। ২১১
২১১.সূরা আহযাব; আয়াত: ৫৩
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন -
الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ
নারী হলো গোপন রাখার যোগ্য। যখন সে ঘর থেকে বেপর্দা বের হয়, শয়তান তখন তাকে উঁকি মেরে দেখতে থাকে। ২১২
২১২.ইমাম তিরমিযী র. (২৭৯ হি.) জামে তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬৯
মূলত পর্দা সর্ম্পকে প্রথমে সূরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াত মতান্তরে তৃতীয় ও পঞ্চম হিজরি সনে হযরত যয়নাব বিনতে জাহাশ (رضي الله عنه)’র সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র বাসররাত যাপনের সময় অবতীর্ণ হয়। ২১৩
২১৩.বুখারী, হাদিস নং ৪৭৯২
হযরত আনাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, একবার হযরত ওমর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র কাছে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আপনার নিকট ভালোমন্দ সব রকমের মানুষ যাতায়াত করে। আপনি আপনার পবিত্র স্ত্রীদেরকে পর্দা করার আদেশ দিলে খুবই ভালো হতো। এর প্রেক্ষিতে পর্দার আয়াত নাযিল হয়।
হাদিসে আরো একটি ঘটনা বর্ণিত আছে যে, উম্মুল মু’মিন হযরত সাওদা বিনতে জাময়া (رضي الله عنه) এক রাতে নিজের কোন প্রয়োজনে পর্দা সহকারে বাইরে গিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে হযরত ওমর (رضي الله عنه)’র দৃষ্টি তাঁর উপর পড়ে। যেহেতু তিনি দীকাকৃতির ছিলেন এ কারণে হযরত ওমর (رضي الله عنه) তাঁকে চিনে ফেলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম ! হে সওদা (رضي الله عنه)! আপনি আমাদের দৃষ্টি থেকে লুকোতে পারবেন না। দেখেই চেনা যায়। সুতরাং আপনি বাইরে বের হবেন না। এ কথা শুনে হযরত সওদা (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ)’র কাছে উপস্থিত হন এবং পুরো ঘটনা খুলে বলেন। প্রিয় নবী তখন হযরত আয়িশা রা’র গৃহে নৈশ ভোজ গ্রহণ করছিলেন এবং তাঁর হাতে গোশতপূর্ণ একখানা হাড় ছিল। এমতাবস্থায় তার কাছে ওহী নাযিল হলো। যখন ওহী নাযিল হওয়া শেষ হলো তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা প্রয়োজনে তোমাদের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ২১৪
২১৪.ইমাম বুখারী র. (২৫৬ হি.) সহীহ বুখারী, হাদি নং ৪৮৬১
এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, পর্দার এই আদেশ দেয়া হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র পূত পবিত্র স্ত্রীগণকে যাদের সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই বলেছেন
-إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে যাবতীয় অপবত্রিতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে। ২১৫
২১৫.সূরা আহযাব, আয়াত: ৩৩
অর্থাৎ যাঁদেরকে স্বয়ং মহান আল্লাহ ভিতরে বাইরের যাবতীয় পাপ পঙ্খিলতা থেকে সম্পূর্ণ পূত-পবিত্র রেখেছেন তাদেরকেই পর্দা করার আদেশ দিয়েছেন। অপর দিকে যে সব পুরুষদেরকে সম্বোধন করে এই বিধান জারি করেছেন তারা হলেন কষ্টি পাথরে পরীক্ষীত নিঁখুত খাটি মু’মিন এবং যাঁরা হিদায়েতর উজ্জ্বল নক্ষত্র ফেরেশতাতুল্য সাহাবায়ে কিরাম। তাদের জন্য যদি এই বিধান প্রজোয্য হয়, তাহলে আমাদের ন্যায় পাপী-তাপীদের বেলায় পর্দার বিধানের গুরুত্বও প্রয়োজনীয়তা সহস্রগুণ বেশী। সুতরাং যত বড় মুত্তাকী পরহেযগার হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই কোন বেগানা নারী-পুরুষ ইসলামী পর্দা প্রথার উর্ধ্বে নয়।
যাদের থেকে পর্দা করা ফরয
____________________
যাদের থেকে পর্দা করা ফরয
যে সব নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ-শাদী জায়েয, তাদের পরস্পরের মধ্যে পর্দা করা ফরয। একজন অপর জনের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হারাম।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا كَانَ ثالثهما الشَّيْطَان
কোন (প্রাপ্ত বয়স্ক) নারী-পুরুষ নির্জনে একত্রিত হবে না, কারণ তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় জন হবে শয়তান।২১৬
২১৬.ইমাম তিরমিযী র. (২৭৯ হি.) জামে তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ.২৬৯
বর্তমান মুসলিম সমাজের অভিভাবকরা নিজেদের যুবতী কন্যাদেরকে যুবকদের সাথে সিনেমা হলে, সমুদ্র সৈকতে, চাইনিজ রেঁস্তোরায় কিংবা কোনো আত্মীয়ের বাড়ীতে নি:সংকোচ চিত্তে যাওয়া-আসার অনুমতি দেন। অভিভাবকদের দৃষ্টিতে এরা কচি মনে হলেও বয়স ও মনের কুমন্ত্রণার দিক দিয়ে কিন্তু তারা কচি নয়। বর্তমানে আরো প্রত্যেক যুবক-যুবতীর হাতে রয়েছে মোবাইল যা সকল অনিষ্ট ও চরিত্র হননের বৃহৎ হাতিয়ার। তার সঙ্গে রয়েছে হাদিসের ভাষ্য মতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অদৃশ্য শক্তিশালী মানবের চিরশত্রু অভিশপ্ত শয়তান। সুতরাং তালতো ভাই, খালাতো ভাই, চাচাতো ভাই, ক্লাসভাই কিংবা বয়ফ্রেন্ড- এদের কারো সাথে অবাধ মেলা-মেশা করা সম্পূর্ণ হারাম।
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ননা করেন
-لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا ذُو مَحْرَمٍ
মাহরাম ব্যতিত কোনো পুরুষ কোন নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হবেনা। ২১৭
২১৭.ইমাম বুখারী র. (২৫৬ হি.) সহীহ বুখারী, খণ্ড-২, পৃ-২৮৭
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন,
-اذا استطعرت المراة فمرت على القوم – ليجدوا ريحها فهى زانية
–নারী সুগন্ধি ব্যবহার করে মানুষের পাশ দিয়ে চলা-ফেরা করে এই উদ্দেশ্যে যে, লোকেরা তার সুগন্ধি লাভ করবে তাহলে সেই নারী ব্যভিচারিণী বলে গণ্য হবে।২১৮
২১৮.কানযুল উম্মাল, খণ্ড. ১৬, পৃ. ১৫৯
দেবর, ভাসুরকেও নারীরা দেখা দিতে পারবেনা বরং তাদের থেকেও পর্দা করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ: رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ: يَا رَسُولَ اللهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ؟ قَالَ: الْحَمْوُ الْمَوْتُ
হে পুরুষগণ ! তোমরা বেগানা নারীদের ঘরে প্রবেশ থেকে বিরত থাক। একজন সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! স্ত্রীলোকের শ্বশুরালয়ের পুরষদের-দেবর-ভাসুর সম্পর্কে আপনার কি মতামত ? অর্থাৎ তাদেরকে কি দেখা দিতে পারবে ? উত্তরে তিনি বললেন দেবর তো মৃত্য স্বরূপ। অর্থাৎ দেবর তো ভাবীর জন্য আরো মারাত্মক। ২১৯
২১৯.বুখারী ও মুসলিম, সৃত্র. মিশকাত; পৃ.২৬৮
হাদিসের বাস্তবতা
____________________
হাদিসের বাস্তবতা
আমরা তখন ছাত্র, জামেয়ার হোস্টেলে অবস্থান করতাম। একদিন দেখলাম- একজন মহিলা ও একজন যুবক আমাদের কক্ষের সামনে কাকে যেন খুঁজছে। জিজ্ঞাস করে জানতে পারলাম তাওবা করার জন্য এসেছে। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করলে উত্তরে মহিলটি বলল, আমার স্বামী বিদেশে থাকেন। আমার পাশে ইনি আমার দেবর। আমার দেবরের সাথে দীর্ঘদিন যাবৎ আমার অবৈধ সম্পর্ক চলে আসছে। এখন আগামী কাল আমার স্বামী আসবেন। তাই একটু তাওবা করার জন্য এসেছি। আমরা তখন তাদেরকে আমাদের একজন মুফতি সাহেবের কাছে প্রেরণ করেছি। এই হলো সমাজে প্রচলিত হাজারো ঘটনার একটি। এ কারণেই ভবিষ্যত দ্রষ্টা নবী করিম (ﷺ) দেবরকে মৃত্যুর ন্যায় ভয়ানক বলে আখ্যা দিয়েছেন।
পর্দার উপকারিতা
____________________
পর্দার উপকারিতা
কুরআন-হাদিসের আলোকে উপরিউক্ত পর্দা সম্পর্কে শরীয়তের বিধান থেকে অনুমান করা যায় যে, ইসলামে পর্দার উপকারিতার গুরুত্ব কতখানি। মূলত কোন পুরুষ যখন কোন নারীর প্রতি তাকায়, তার সৌন্দর্য অবলোকন করে এবং তার শরীরের কামোত্তেজক অঙ্গগুলো প্রত্যক্ষ করে তখন সেই পুরুষের হৃদয়ে জ্বলে ওঠে কামনার প্রাকৃতিক শিখা। সে শিখার দহনে অবিরাম দগ্ধিভ‚ত হতে থাকে সে। নিশায় ভাবতে থাকে কল্পনার স্বচ্ছ দর্পণে অঙ্কিত সেই নারীর দেহ সৌন্দর্য নিয়ে। কত ঘুম তার নষ্ট হয় সেই ভাবনার আঘাতে। কত রজনী কাটে বিনিদ্র কল্পনার জাল বুনতে বুনতে। কল্পনার সেই ছোট ছোট ঢেউ এক সময় বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গের সৃষ্টি করে তার যৌবন দরিয়ায়। সে তরঙ্গে অনামের মত হারিয়ে যায় সমাজ সভ্যতা নামের সকল বেড়ি-বন্ধন। স্বপ্নের নীল আকাশে সে তখন উড়তে থাকে কল্পনার পাখায় গা এলিয়ে বিলাসী বিহঙ্গেঁর মত। তার স্বপ্নের নারীকে একান্তে পাবার ক্ষীপ্র বাসনায় ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মত হিংস্র হয়ে ওঠে সে। তারপর যা ঘটে তা আমরা নিয়মিত প্রত্যক্ষ করি চোখের সামনে কিংবা পত্র-পত্রিকায়। কিন্তু ভেবে দেখিনা এর উৎসটা কোথায়?
ইসলাম সে উৎসটাই সমূলে উপড়ে ফেলতে চায়। যেই কামময় দেহদর্শন শত অনিষ্টের জননী শরীয়ত সেই দেহ সৌন্দর্যকেই ঢেকে রাখতে আদেশ করেছে। কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। শরীয়ত সমর্থিত প্রয়োজন ছাড়া নারী ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। একান্ত প্রয়োজনে বের হলে দবিজ পর্দার আড়াল হয়ে বের হবে। যেন তার উপস্থিতি কোন পুরুষের কামচেতনায় অযথা ঝড় না তুলে। বলা বহুল্য, নারীর সতীত্ব, সম্ভ্রম ও নাজুক মযার্দার সুরক্ষায় পর্দা বিকল্প আশ্রায়। এর গুরুত্ব বাস্তবসিদ্ধ ও প্রশ্নাতীত। এর লংঘন শরীয়ত বিরোধী ও সামাজিক মযার্দার পরিপন্থী। ২২০
২২০.দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পৃ. ৩৯৪, ই.ফা.বা.
মহিলাদের পোশাক
____________________
মহিলাদের পোশাক
পোশাক-পরিচ্ছদ মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পোশাক দ্বারা মানুষের রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ পায়। পোশাক দ্বারা মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন ঢেকে রাখা ও সৌন্দর্যের উপকরণ তেমনি শরীয়তের দিক নিদের্শনা মেনে ব্যবহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। পোশাক-পরিচ্ছদের ভালোমন্দ মানুষের মধ্যে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে এবং অন্তর ও মন-মানসিকতায় গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে শরীয়তের বিধান অত্যন্ত যৌক্তিক ও উপকারী।শরীয়ত বিশেষ কোন পোশাক সুনির্দ্দিষ্ট করে দেয়নি এবং কোন নির্দিষ্ট ডিজাইন বা আকৃতিও বলে দেয়নি। কারণ বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল, আবহাওয়া ও মৌসুমভেদে পোষাক পরিধানের স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে কিছু মৌলিক নীতি ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, এ ধরনের পোশাক গ্রহণীয় ও এ ধরনের পোশাক বর্জনীয়। সুতরাং মুসলমান নারী-পুরুষের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে এসব নীতিমালা অনুসরণ করা আবশ্যক যা দ্বারা পোশাক-পরিচ্ছদের মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন সাধিত হবে।
মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ পরবে না শাড়ী ?
____________________
মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ পরবে না শাড়ী ?
ডরশরঢ়বফরধ এর বর্ণনায় শাড়ী শব্দটি সংস্কৃত যার মানে ৩ থেকে ৪ ফুট প্রস্থ আর ১৮ থেকে ২০ ফুট দৈর্ঘের বস্ত্র খণ্ড যা ভারতবর্ষের মেয়েরা অঙ্গজুড়ে পরিধান করে। এর অনুসঙ্গ হিসাবে আরো দু’টি অন্তর্বাসের কথা বলা হয়েছে। একটি নীচের অংশ ‘পেটিকোট’ যা উত্তরে মারটি ভাষায় লেহাংগা, তামিলে পাভিল, তেলেগুতে পাভিলা পশ্চিমে ঘাঘরা আর পূর্ব ভরতে ‘ছায়া’ নামে পরিচিত। উপরের অংশের নাম সাধারণ ভাবে ব্লাউজ বলে। এই পোশাকটা ভরতীয় ধর্ম দর্শন অনুযায়ী সমস্ত দেবীদের প্রিয় পোশাক এবং এখনও পূজামন্ডপে স্থাপিত দেবী মূর্তির গায়ে শাড়ী পরিহিতা অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০-১৮০০ শতকের মধ্যে ভারতের পশ্চিম অংশে এর প্রচলন ঘটে বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। ভারতীয় প্রাচীন ঐতিহ্য ‘নাট্যশাস্ত্রে’ মহিলাদের নাভিমূল হলো পবিত্রতা ও সৃষ্টিকুশলতার উৎস। সে কারণে শাড়ী পরিধানের সময় ঐস্থান উম্মুক্ত রাখতে হয়। শাড়ী পরিধানের এই ধরন ভারত , বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় এখনো প্রচলিত তবে কিতা হিন্দু ধর্মের দেবীদের অনুসরণ করে ? মুসলমান ঘরের মা-বোনদের শুধু এটুকু ভাবতে বলবো শাড়ী যে তাদের পোশাক নয় তা তাদের বোধগম্য হওয়া প্রয়োজন। এই তিনটা দেশ ব্যতিত দুনিয়ার কোনো দেশের মুসলিম মেয়েদের পোশাকের তালিকায় শাড়ী নেই। এটা যারা হজ্জ্ব করেছেন তারা সাক্ষ্য দেবেন। শাড়ী মুসলমানদের পোশাক কখনোই ছিলনা, তবে শাড়ী পরা দোষের হতো না যদি এর দ্বারা পুরো শরীর, মাথা, ঘাড়, বুক ও পেট ঢেকে পরিধান করা হতো। শাড়ী পরিধানের ঢংটাই এমন যে, বুক, পিট ও পেট উদোম রাখতে হবে মাথা ও ঘাড়ে তা উঠবে না। পূজোর দিনে কেউ যদি মন্ডপে যেয়ে থাকেন তাহলে স্বরস্বতী, লক্ষীকে এই কায়দায় শাড়ী পরিহিতা পাবেন। তাহলে আমি একজন মুসলিম নারী হিসাবে যে কাপড়টা পরিচ্ছদ হিসাবে পরিধান করছি যার কাটিং এবং পরিধানের ঢং সম্পূর্ণ হিন্দু একজন দেবীর মত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এরূপ পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করেছেন যা ভিন্ন ধমাবলম্বীরা পরিধান করে থাকে। আমি কি তবে ভিন্ন ধর্মানুসারীর পোশাকই পড়ছি?
মূল কথা হলো নারীর পোশাক হতে হবে সালোয়ার কামিজ, লম্বা গাউন, পাজামা কামিজ যা দ্বারা চেহারা, হাতের তালু ও পায়ের সন্ধি বাদে সারা শরীর আবৃত হবে। এ জন্য কটন মোটা কাপড় নির্বাচন করা যেতে পারে। বর্তমান অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে এই পোশাকে কারো কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বউ হলে শাড়ী পরতেই হবে। নতুবা মুরুব্বীদের রোষানলে পড়তে হয়। তারা বলেন, শাড়ী পরিধান না করলে নাকি বউয়ের মতো লাগেনা। অনেক নতুন বধু শাড়ী পরতেও জানেনা। তবু অভিজ্ঞ নারীর সাহায্যে কিংবা পার্লারে গিয়ে হলেও শাড়ী পরতেই হবে। শাড়ী লম্বায় বার হাত হলেও এর পরার ভঙ্গিমা কোনভাবেই পর্দার চাহিদাও শর্ত পূরণ করে না। অন্যদিকে বিকল্প পোশাকগুলো পরলে একদিকে কাপড়ের সাশ্রয় অন্যদিকে কাজের পক্ষে সহায়ক এবং পর্দার বিধানও পূর্ণ হয়।
নারীর পোশাক এমন আঁট সাঁট ও ছোট মাপের হতে পারেবে না। যা পরলে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকে এবং দৈহিক গঠন ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে উঠে।
এ প্রসঙ্গে হযরত আবু ইয়াযিদ মুযানী (رحمة الله) বলেন, হযরত ওমর (رضي الله عنه) মহিলাদেরকে কাবাতী (মিসরে প্রস্তুতকৃত এক ধরণের সাদা কাপড়) পরতে নিষেধ করতেন। লোকেরা বলল, এই কাপড়ে তো ত্বক দেখা যায় না। তিনি বললেন, ত্বক দেখানা গেলেও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে উঠে। ২২১
২২১.আবু বকর আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ র. মুসান্নিফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং ২৫২৮৮
নারীর পোশাক খুব পাতলা ও মিহি না হওয়া উচিত যা দ্বারা শরীর দেখা যায় এবং সতর প্রকাশ পায়। অবশ্য পাতলা কাপড়ের নীচে যদি সেমিজ জাতীয় কিছু ব্যবহার করে তবে আপত্তি নেই।
এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আবু আলকামা তার মা থেকে বর্ণনা করেন, একবার হাফসা বিনতে আব্দুর রহমান তার ফুফু উম্মুল মু’মিন হযরত আয়িশা (رضي الله عنه)’র নিকট বেড়াতে এলেন। তখন তার পরনে ছিল একটি পাতলা ওড়না। হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন। ২২২
২২২.ইমাম মালিক র. (১৭৯ হি.) মুয়াত্তা, খণ্ড.২, পৃ. ৯১৩
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، أَنَّ أَسْمَاءَ بِنْتَ أَبِي بَكْرٍ، دَخَلَتْ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَلَيْهَا ثِيَابٌ رِقَاقٌ، فَأَعْرَضَ عَنْهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَقَالَ: يَا أَسْمَاءُ، إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا بَلَغَتِ الْمَحِيضَ لَمْ تَصْلُحْ أَنْ يُرَى مِنْهَا إِلَّا هَذَا وَهَذَا وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) হতে বণিত একদা (আমার বোন) আসমা বিনতে আবু বকর (رضي الله عنه) পাতলা কাপড়ে পরিহিতা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র নিকট প্রবেশ করলেন। তিনি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন, হে আসমা ! মেয়েরা যখন বালিগা হয়, তখন শরীরের কোনো অঙ্গ প্রকাশ পাওয়া উচিত নয়, তবে কেবল মাত্র চেহারা ও হাতের কব্জি ব্যতিক্রম। ২২৩
২২৩.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.) সুনানে আবু দাউদ
নারী পুরুষের পোশাক পরিধান করতে পারবে না। অনুরূপ ভাবে পুরুষও নারীর পোশাক পরতে পারবে না। অর্থাৎ একে অপরের সাদৃশ্যতা গ্রহণ করতে পারবে না
।عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ : لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐসব পুরুষকে অভিশাপ দিয়েছেন যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে। ২২৪
২২৪.ইমাম বুখারী র. (২৫৬ হি.), সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৫৪৬৫
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ، وَلَا يَجِدْنَ رِيحَهَا، وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا
আমি জাহান্নামীদের দু’টি দলকে এখনো পর্যন্ত দেখিনি। একদল এমন যাদের গরুর লেজের ন্যায় লাঠি হবে। এর দ্বারা মানুষকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে। দ্বিতীয় দল ঐসব মহিলা যারা কাপড় পরিধান করবে কিন্তু মূলত তারা দ্বিগম্বর। তারা পুরুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য কাপড় পরিধান করবে। এ সব মহিলাদের মাথা হবে উটের কুঁজের ন্যায় যা ঝুঁকে থাকবে। এ সব মহিলারা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবেনা। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ অনেক দূর থেকে (পাঁচশ বছরের দূরত্ব থেকে) পাওয়া যাবে। ২২৫
২২৫.ইমাম মুসলিম র. (২৬১ হি.), সহীহ মুসলিম, খণ্ড.২, পৃ.২০৫
হযরত দিহিয়া ইবনে খলীফা (رضي الله عنه) থেকে বণির্ত, তিনি বলেন, একদা নবী করিম (ﷺ)’র একটি কিবতী কাপড় আসে। (যা ছিল অতি মিহি) তিনি কাপড়খানা আমাকে দিয়ে বললেন- এটাকে দু’টুকরা করো। এক অংশ দিয়ে তোমার নিজের জামা তৈরী করো এবং অপর অংশ তোমার স্ত্রীকে দিও, যেন উহা দ্বারা ওড়না তৈরী করতে পারে। অতঃপর সে যখন কাপড়টা নিয়ে যেতে লাগল তখন তিনি বললেন-
وأمر امرأتك ان تجعل تحته ثوبا لا يصفها
তোমার স্ত্রীকে আদেশ করবে যেন এই কাপড়ের নীচে আস্তর লাগিয়ে ব্যবহার করে , যাতে শরীর দেখা না যায়।
সতর ঢাকার জন্য পায়জামা হলো সর্বোত্তম পোশাক। লুঙ্গী, পেটিকোট অনেক সময় খুলে যায় কিংবা বাতাসে উল্টে যায়, ফলে সতর প্রকাশ হয়ে যায়। হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা প্রবল বর্ষনের সময় আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র পাশে বাকী নামক স্থানে বসা ছিলাম। এমন সময় একজন মহিলা অতিক্রম করল যার মাথায় বোঝা ছিল। তার গাধাটি মাটির গর্তে পড়ে গেল। ফলে মহিলাটিও মাটিতে পড়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)দ্রুত মহিলার দিক থেকে তাঁর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। তখন অমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ! মহিলাটি তো পায়জামা পরিহিতা। তিনি বললেন-
اللهم اغفر للمسر ولاف من امى ثلاثا ياايها الناس اتخذوا السرا ولات فانها من استر ثيابكم وحضوابها نسامكم اذا خرجن قال الشيخ احمد رحم الله المتسرولات
–হে আল্লাহ ! আমার উম্মতের যারা পায়জামা পরিধান করবে তাদের আপনি ক্ষমা করে দিন। তিনি এই দোয়া তিনবার করেছিলেন। তারপর বলেছেন, হে লোক সকল ! তোমরা পায়জামার প্রচলন কর। কেননা পায়জামা তোমাদের পোশাকের মধ্যে পর্দা করার ক্ষেত্রে অধিক উপযুক্ত। আর তোমরা তোমাদের নারীদের উৎসাহিত কর তারা যেন প্রয়োজনে বাইরে গেলে পায়জামা পরিধান করে।
শায়খ আহমদ (رحمة الله) বলেন, অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)পায়জামা পরিহিতা মহিলাদের জন্য রহমতের দোয়া করেছেন।২২৬
২২৬.মুজমায়া, খণ্ড. ৫,প.১২৩ ও আদাবে বায়হাকী, পৃ. ৩৫৮
নারী-পুরুষ প্রত্যেকের পোশাক পৃথক
____________________
নারী-পুরুষ প্রত্যেকের পোশাক পৃথক
ইসলামী শরীয়তের নারী-পুরুষ তাদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত পোশাক রয়েছে। একে অপরের পোশাক পরিধান সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে কঠোর হুশিয়ারী এসেছে। হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত-
لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلَ يَلْبَسُ لِبْسَةَ الْمَرْأَةِ، وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لِبْسَةَ الرَّجُلِ
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমন পুরুষের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন যারা নারীদের পোশাক পরিধান করে এবং এমন নারীর প্রতি অভিশাপ করেছেন যারা পুরুষদের পোশাক পরিধান করে। ২২৭
২২৭.ইমাম আবু দাউদ রা. (২৭৫ হি.), আবু দাউদ, খণ্ড.২, পৃ. ৫৬৬, কিতাবুল লিবাস
অপর হাদিসে আছে -
لَعَنَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المُخَنَّثِينَ مِنَ الرِّجَالِ، وَالمُتَرَجِّلاَتِ مِنَ النِّسَاءِ، وَقَالَ: أَخْرِجُوهُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ
নবী করিম (ﷺ) নারীর বেশ গ্রহণকারী পুরুষ এবং পুরুষের বেশ গ্রহণকারী মহিলাদেরকে অভিশম্পাত করেছেন এবং আরো বলেছেন- তোমরা তাদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দাও। ২২৮
২২৮.ইমাম বুখারী রা. (২৫৬ হি.), সহীহ বুখারী, খণ্ড.২, পৃ.৮৭৪, কিতাবুল লিবাস
হযরত আবি মালিকা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) কে বলা হল যে,
امْرَأَةً تَلْبَسُ النَّعْلَ، فَقَالَتْ: لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلَةَ مِنَ النِّسَاءِ
এক মহিলা পুরুষের জুতা পরে। তখন হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুরুষের আকৃতি ধারণকারিণী মহিলাদেরকে অভিশম্পাত করেছেন। ২২৯
২২৯.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.) সুনানে আবু দাউ, খণ্ড. ২, পৃ. ৫৬৬
নারীর সাজসজ্জা
____________________
নারীর সাজসজ্জা
নারীর রূপচর্চা ও সাজসজ্জার ব্যাপারে ইসলামে কোনো বয়সের বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। স্ত্রী তার স্বামীর পছন্দ মতো পোশাক পরিচ্ছদ, সুগন্ধি দ্রবাদি এবং অলংকারাদি ব্যবহার করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে, নারীর নারী সূলভ মানবিকতাই হচ্ছে তার আসল রূপ সৌন্দর্য এবং উৎকৃষ্ট অলংকার। নারীর নম্রতা, শিষ্টতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং সততাই হচ্ছে তার প্রকৃত গুণাবলী।
ইসলামে সোনা, রূপা, ইয়াকুত, জমরুদ, আশমাস প্রভৃতিহীরা-মুক্তা ব্যবহারে অনুমতি নারীর জন্য রয়েছে। তবে এসবকিছু কেবল স্বামীর উপস্থিতে তাকে আনন্দিত করার জন্য এবং তার মনে নিজের জন্যে ভালোবাসার আবেগ সৃষ্টি করার উদ্দশ্যে হতে হবে- কোনো পর পুরুষকে দেখানোর জন্য নয়।
হযরত আসমা বিনতে আবি বকর (رضي الله عنه) থেকে বণির্ত, তিনি একদা তাঁর বোন হযরত আয়িশা (رضي الله عنه)’র সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলেন। এসময় (তাঁর স্বামী) যুবায়ের (رضي الله عنه) অনুপস্থিত ছিলেন।
فدخل النبى صلى الله عليه وسلم فوجد ريح طيب فقال ماعلى المرأة ان لا تتطيب وزوجها غائب
অতঃপর নবী করিম (ﷺ) ঘরে প্রবেশ করলে সুগন্ধি অনুভব করলেন। তারপর (আসমা (رضي الله عنه) কে উদ্দেশ্য করে) বললেন, স্বামী অনুপস্থিত থাকলে কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করা মহিলাদের উচিত নয়। ২৩০
২৩০.নুর উদ্দিন আলী ইবনে আবি বকর ও (৮০৮ হি.) মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খণ্ড. ৪, পৃ. ৩১৭)
হযরত ওসমান ইবনে মাযউন (رضي الله عنه)’র স্ত্রী আগে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। কিন্তু পরে তা বন্ধ করেছেন। একদিন সুগন্ধি বিহীন অবস্থায় তিনি হযরত আয়িশা (رضي الله عنه)’র নিকট যান। হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) তাকে এ অবস্থায় দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হন এবং সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার বর্জনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি প্রশ্নের উত্তরে বললেন, হে উম্মুল মু’মিনীন, ওসমান তো সংসার ত্যাগের তালে আছে। সংসারের দিকে পরিবার পরিজনের দিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। একথা শুনে হযরত আয়িশা নবী করিম (ﷺ) কে গিয়ে সব কথা খুলে বললেন। এরপর তিনি একদা ওসমান (رضي الله عنه)’র দেখা পেলে জিজ্ঞাসা করলেন- হে ওসমান ! তুমি তো মু’মিন ও তৌহিদ বাদী নয় কি? উত্তরে ওসমান (رضي الله عنه) বললেন, নিশ্চয়ই, তখন নবী করিম ইরশাদ করলেন- তাহলে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য এবং আগ্রহ দেখাও। ২৩১
২৩১.ইমাম আহমদ র (২৪১ হি.) মুসনাদ
عن ميمونة بنت سعد (مرفوعا) مامن امرأة تخرج فى شهرة من الطيب فيظر الرجال اليها الالم نزل فى سخط الله حتى ترجع الى بيتها
হযরত মাইমুনা বিনতে সা’দরা থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন, যে মহিলা সুগন্ধি ব্যবহার করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয় তখন সে আল্লাহর গযবে প্রবেশ করে যতক্ষণ না সে তার ঘরে ফিরে যায়। ২৩২
২৩২.আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুস্সামুদ্দিন’র (৯৭৫ হি.) কানযুল উম্মাল, খণ্ড- ১৬, পৃ. ১৪১
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র খাদেমা হযরত মাইমূনা বিনতে সা’দ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
-مَثَلُ الرَّافِلَةِ فِي الزِّينَةِ فِي غَيْرِ أَهْلِهَا كَمَثَلِ ظُلْمَةِ يَوْمِ القِيَامَةِ لاَ نُورَ لَهَا.
যে মহিলা স্বামীকে দেখানো ব্যতিত সাজসজ্জা করে শহরে বন্দরে যেখানে সেখানে চলাফেরা করে সে কিয়ামতের দিন অন্ধকারে থাকবে। কোনো প্রকার আলো সে পাবে না। ২৩৩
২৩৩.ইমাম তিরমিযী র (২৭৯ হি.) সুনানে তিরমিযী, পৃ. ২৩০
নারী যখন বেপর্দা, টাইট জামা কাপড় পরিধান করে কিংবা কাটসাট অর্ধ উলঙ্গ পোশাক পরিধান করে বডি স্প্রে ও দুর্লভ সুগন্ধি সেন্ট ব্যবহার করে অলংকারের ঝনঝনানির শব্দ করে লোকালয়ে চলে তখন তাদের উদ্দেশ্য হয় লোকেরা তাকে দেখুক, তার সৌন্দর্য উপভোগ করুক এবং যুবক পুরুষরা তার প্রতি আকৃষ্ট হোক। এ সমস্ত মহিলা অন্যকে কুনজর ও ব্যভিচারে আহবান করে। বকাটে যুবকরা যখন তার দিকে চোখ তুলে তাকায় তখন তারা নিজেদের সুন্দরী মনে করে গর্বিত ও আনন্দিত হয়। কিন্তু যখন কোনো দুর্ঘটনার স্বীকার হয় তখন পুরুষের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির দাবী করে। এসব চরিত্রহীন নারীদের প্রতি অনেকের প্রশ্ন যে, তোমরা চলবে ইউরোপ আমেরিকার স্টাইলে আর বিচার চাইবে সৌদি বিধি মতে? এটাতো হতে পারে না।
আর এসব মহিলার স্বামীরাও আহমক। কারণ তাদের কষ্টের অর্জিত টাকা-পয়সা দিয়ে দামী পোশাক ও প্রসাধনী কিনে ব্যবহার করে তার কাছে সৌন্দর্য প্রকাশ না করে পরপুরুষকে রূপ-যৌবন প্রদর্শন করে আনন্দিত হচ্ছে। টাকা যাচ্ছে স্বামীর আর ভোগ করছে অন্যরা। অবিবাহিত নারীদের বেলায় পিতা-মাতা এবং বিবাহিত রমনীদের ক্ষেত্রে স্বামীদেরকে সজাগ থাকতে হবে এবং কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। কলা যেমন আবরণে থাকলে মূল্য থাকে অনুরূপ নারী পর্দার আবরণে থাকলে নারীর মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে।
সাজ সজ্জার পদ্ধতি
____________________
সাজ সজ্জার পদ্ধতি
সাধারণত সাজ সজ্জার দু’টি পদ্ধতি প্রচলিত আছে। ১. কৃত্রিম পদ্ধতি ২. স্বাভাবিক পদ্ধতি। প্রথমটি হচ্ছে শরীরের বিশেষ কোনো অংশকে ক্ষত করে বা কাটাকাটি করে চিত্র বা রেখা অঙ্কন করা। অথবা অন্য কোনোভাবে শরীরের স্বাভাবিক ত্বক নষ্ট করে কৃত্রিম কিছু লাগানো। এটা আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন সাধন করা হয় বলে সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম।
যেমন- দাঁতকে সরু করা এবং দাঁতকে ছোট করা। ইসলাম নারীর রূপচর্চা ও সাজ সজ্জাকে শুধু পছন্দই করেনা; বরং তাকে উৎসাহিতও করে এবং এই বিষয়টি ইসলামের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণও। কিন্তু রূপচর্চার নামে এমন সীমালঙ্ঘন করা যাতে শরীরকেও বিগড়ে দেওয়া হবে- তা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে শরীরের মালিক নয় বরং আমানতদার। এরূপ করার মানে হলো সে আমানতের খিয়ানত করা। এ ধরনের কুৎসিত প্রবণতা মহত্তম উদ্দেশ্য ও ব্যক্তিমর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
বর্তমান সমাজে নারীদের খোলা-মেলা নির্লজ্জ চাল-চলন, পোশাক পরিচ্ছদ পরন দ্বারা মনে হয় যে, পৃথিবীর সকল পুরুষ যেন তাদের স্বামী আর তারা সকলের স্ত্রী। তাদেরকে ভোগ করার অধিকার যেন সকল পুরুষের রয়েছে। আজকে নারী নির্যাতন, ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ জাতীয় অপরাধের সংঘটিত হওয়ার পেছনে নারীর ওদ্যত্বপূর্ণ আচরণই বহুলাংশে দায়ী। পবিত্র কুরআনে আছে- শয়তান বলেছিল- وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِআমি তাদেরকে আদেশ করবো আর তারা আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি বিকৃত করবে। ২৩৪
২৩৪.সূরা নিসা, আয়াত: ১১৯
عَنْ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: ্রلَعَنَ اللهُ الْوَاشِمَاتِ وَالْمُسْتَوْشِمَاتِ، وَالنَّامِصَاتِ وَالْمُتَنَمِّصَاتِ، وَالْمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ الْمُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللهِ قَالَ: فَبَلَغَ ذَلِكَ امْرَأَةً مِنْ بَنِي أَسَدٍ يُقَالُ لَهَا: أُمُّ يَعْقُوبَ وَكَانَتْ تَقْرَأُ الْقُرْآنَ، فَأَتَتْهُ فَقَالَتْ: مَا حَدِيثٌ بَلَغَنِي عَنْكَ أَنَّكَ لَعَنْتَ الْوَاشِمَاتِ وَالْمُسْتَوْشِمَاتِ، وَالْمُتَنَمِّصَاتِ وَالْمُتَفَلِّجَاتِ، لِلْحُسْنِ الْمُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللهِ، فَقَالَ عَبْدُ اللهِ: وَمَا لِي لَا أَلْعَنُ مَنْ لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ وَهُوَ فِي كِتَابِ اللهِ فَقَالَتِ الْمَرْأَةُ: لَقَدْ قَرَأْتُ مَا بَيْنَ لَوْحَيِ الْمُصْحَفِ فَمَا وَجَدْتُهُ فَقَالَ: " لَئِنْ كُنْتِ قَرَأْتِيهِ لَقَدْ وَجَدْتِيهِ، قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আল্লাহ তা’আলা অভিশাপ দিয়েছেন তাদেরকে যারা উল্কি অংকন করে বা করায়, ভ্রুর কেশ যারা সরু করে ও করায় এবং সৌন্দর্য্যের জন্য যারা দাঁতকে সরু করে ও করায় আর যারা আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন সাধন করে। বণি আসদের এক মহিলা তাঁর কাছে আসল যার নাম উম্মে ইয়াকুব। সে বলল, আমি সংবাদ পেলাম যে, আপনি উল্কী কারিণী বা যে করায়, ভ্রুর কেশ যারা উপড়ে ফেলে বা উপড়ায় এবং সৌন্দর্য্যরে জন্য যারা দাঁত সরু করে আর আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন সাধন করে এদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বলেছেন? তিনি উত্তরে বললেন, কেন বলবোনা? যখন আল্লাহর কিতাবে আছে। ঐ মেয়ে বলল, আমি তো কুরআন পড়েছি, কিন্তু কুরআন শরীফে তো আমি তা পাইনি। ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বললেন, তুমি যদি সত্যিকার অর্থে কুরআন পড়তে তাহলে অবশ্যই পেতে। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা তোমরা ধারণ কর আর যা থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বেঁচে থাক। ২৩৫
২৩৫.ইমাম মুসলিম র. (২৬১ হি.), সহীহ মুসলিম, খণ্ড ২, পৃ. ২০৫, মিশকাত; পৃ. ৩৮১
এইসব নাজায়েয হওয়ার কারণ হলো এগুলো এক প্রকারের ধোকাবাজী ও প্রতারণা। কারণ এর উদ্দেশ্য হলো বয়স্কা মহিলাকে অল্প বয়স্কা বুঝানো। তাছাড়া শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ হলো আল্লাহর আমানত। এ গুলোতে পরিবর্তন সাধন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য বৈধ নয়। সুতরাং বিউটি পার্লারে যারা এসব কাজে লিপ্ত থাকে তারাও সমানভাবে গুনাহগার হবে। বিউটি সার্জারী, বিউটি অপারেশন এবং প্লাস্টিক সার্জারী ইত্যাদি হারাম। তবে কোনো রোগের কারণে হলে তা বৈধ।
।وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَعَنَ اللَّهُ الْوَاصِلَةَ وَالْمُسْتَوْصِلَةَ والواشمة والمستوشمة
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সে নারীর উপর আল্লাহর লা’নত যে নারী অন্য নারীর মাথায় কৃত্রিম চুল মিশ্রিত করে কিংবা নিজ মাথায় কৃত্রিম চুল মিশ্রিত করায় এবং অন্যের শরীরে উল্কী অংকন করে বা নিজের শরীরে উল্কী অংকন করায়। ২৩৬
২৩৬.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৩৮১
হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (ﷺ)’র নিকট একজন মহিলা এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ছোট এক মেয়ে বউ হয়েছে, অসুস্থতার কারণে তার চুল পড়ে গিয়েছে। এখন আমি কি তার চুলের সাথে নতুন চুল গুজে দিব?فقال لَعَنَ اللَّهُ الْوَاصِلَةَ وَالْمُسْتَوْصِلَةَ
তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা অভিশাপ দিয়েছেন যারা চুল লাগায় এবং যারা চুল লাগিয়ে দেয়।২৩৭
২৩৭.ইমাম মুসলিম র. (২৬১ হি.) সহীহ মুসলিম, খণ্ড ২, পৃ. ২০৫
ভালো কাজে সাহায্য করা যেমনি পূণ্যের কাজ তেমনি পাপ কাজে সাহায্য করাও পাপ। তাই যারা এসব পাপ কাজে সহযোগিতা করে অর্থাৎ বিউটিশিয়ানরাও পাপের অংশীদার হবে।
স্বাভাবিক পদ্ধতি
____________________
স্বাভাবিক পদ্ধতি
রূপচর্চার স্বাভাবিক পদ্দতি বলতে বুঝায় সুরমা, খিযাব এবং অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্যাদির (যা হালাল বস্তু দ্বারা তৈরি) মাধ্যমে কৃত ব্যবস্থাবলী। এ ধরনের দ্রব্যাদি ব্যবহারে কোনো আপত্তি নেই। যদিও এগুলো দ্বারা আল্লাহর প্রকৃত সৃষ্টির রূপ পরিবর্তন করে তবুও তা অবৈধ নয়, কারণ এই পরিবর্তন স্থায়ী নয়; বরং সাময়িক এবং খুই দ্রুত তা মুছে গিয়ে চেহারার আসল রূপ ধারণ করে। তবে এসব মেকাপের কারণে উযূর সময় যদি ত্বকে পানি না পৌঁছে কিংবা মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে উযূ করে নামায আদায় করেনা তবে তা নিশ্চিত হারাম। বর্তমান নাকি বিয়ের সময় নারীরা চোখের পানি পড়ে মেকাপ মুছে যাবার ভয়ে পিত্রালয় ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত ক্রন্দন করে না। আবার এরূপও হয় যে, বিয়ের দিন কৃত মেকাপ তিন/চার দিন পর্যন্ত রেখে দেওয়া হয় এবং মুখে পানি পর্যন্ত লাগায়না নব বধূরা। যে কাজের কারণে ফরয তরক হয় সে কাজও নিষিদ্ধ। তাছাড়া এসব প্রসাধনী সামগ্রীতে রাসায়নিক মেডিসিন ব্যবহার করা হয় এবং ভেজাল বস্তু মিশ্রিত হয় যা দ্বারা ত্বকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং এইসব প্রসাধনী সামগ্রীর মাধ্যমে সাময়িক ও কৃত্রিমভাবে সুন্দর হওয়ার মানসিকতা ত্যাগ করে নারীর আসল সৌন্দয্য, নম্রতা, কোমলতা, লাজুকতা, চারিত্রিক উৎকর্ষতা, ধার্মিকতা ও অন্তরের পবিত্রতা দ্বারা সৌন্দর্য্যমণ্ডিত হওয়ার দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত যা স্থায়ী ও অক্ষয়।
ইসলামে স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রীর রূপচর্চা ও সাজসজ্জা করা শুধু বৈধ নয় বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। স্বামীর চাহিদা ও পছন্দ মতো স্ত্রী সাজসজ্জা করা এবং নিজেকে স্বামীর জন্য সর্বদা প্রস্তুত রাখা উচিত। নিজের উপর স্বামীর পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। অনেক পরিবারে এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধে মনোমালিন্য পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুরুষদেরকে সফর থেকে এসে হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন। কারণ এ সময় স্বামী সহবাসের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে আর স্ত্রী তখন অপ্রস্তুত থাকতে পারে কিংবা অগোছালো থাকতে পারে যা দেখে হয়তো স্বামী বিরক্তবোধ করবে।
عَنْ جابر أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِذَا دَخَلْتَ لَيْلًا فَلَا تَدَخُلْ عَلَى أهلك حَتَّى تستحد المغيبة وتمتشط الشعثة
হযরত জাবির (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন, যদি তোমরা (কোনো সফর থেকে) রাতের বেলায় তোমাদের এলাকায় প্রবেশ কর, তখনই নিজ স্ত্রীর কাছে যেয়োনা, যাতে তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে পারে এবং তাদের চুল চিরুনী দিয়ে সুবিন্যস্ত করে নিতে পারে। ২৩৮
২৩৮.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র, মিশকাত; পৃ. ৩৩৯
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, দূরের সফর থেকে ফিরে এসে হঠাৎ করে বাড়িতে গিয়ে হাযির হওয়া উচিত নয়। কেননা, এতে সে স্ত্রীকে এমন অবিন্যস্ত ও অপছন্দনীয় অবস্থায় দেখার আশঙ্কা থাকে, যাতে তার অপছন্দ ও ঘৃণার উদ্রেক হতে পারে। ২৩৯
২৩৯.বুখারী ও মুসলিম
মহিলাদের রাস্তাঘাটে চলাফেরার নিয়ম
____________________
মহিলাদের রাস্তাঘাটে চলাফেরার নিয়ম
ইসলাম নারীদেরকে ঘরের মধ্যে অবরোধবাসিনী করে রাখার পক্ষে নয়। বরং একান্ত প্রয়োজনে পর্দা সহকারে ও মার্জিত পোশাকে বাইরে যাবার অনুমতি প্রদান করেছে। হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
قَدْ أَذِنَ اللَّهُ لَكُنَّ أَنْ تَخْرُجْنَ لِحَوَائِجِكُنَّ
নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তোমরা নারীদেরকে বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে যেতে অনুমতি প্রদান করেছেন। ২৪০
২৪০.ইমাম বুখারী র. (২৫৬ হি.) সহীহ বুখারী, খণ্ড ২, পৃ. ৭৮৮
কারো মৃত্যুতে, সন্তান হলে, রোগীর সেবা-যত্ন করার উদ্দেশ্যে কিংবা পিতা-মাতার সাথে দেখা করার জন্য এবং অন্য কোন বিশেষ প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে শরয়ী নিয়ম-কানুন এবং স্বামীর অনুমতি অবশ্যই প্রয়োজন।
হযরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) মারফূরূপে বর্ণনা করেন-
ليس للنساء نصيب فى الخروج الامضطرة وليس لهن نصيب فى الطرق الا الحواشى
–নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন, অতি প্রয়োজন ব্যতিত মহিলারা ঘর থেকে বের হবার অনুমতি নেই আর রাস্তার এক পাশে ব্যতিত চলার অনুমতি নেই। ২৪১
২৪১.আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুসসাম উদ্দিন র. (৯৭৫ হি.) কানযুলউম্মাল, খণ্ড. ১৬, পৃ. ১৬৩
হযরত আবু উসাইদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখলেন যে, নারী-পুরুষ একত্রে মিলেমিশে রাস্তায় চলছে। তখন তিনি বললেন-
فَقَالَ النِّسَاء: اسْتَأْخِرْنَ فَإِنَّهُ لَيْسَ لَكُنَّ أَنْ تُحْقِقْنَ الطَّرِيقَ عَلَيْكُنَّ بِحَافَاتِ الطَّرِيقِ . فَكَانَتِ الْمَرْأَةُ تَلْصَقُ بِالْجِدَارِ حَتَّى إِنَّ ثَوْبَهَا لَيَتَعَلَّقُ بِالْجِدَارِ.
তখন তিনি বললেন, মহিলারা পিছনে চল, রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচলের তোমাদের জন্য অনুমতি নেই। বরং তোমরা অবশ্যই রাস্তার একপাশ দিয়ে চলবে। একথা শুনে তারা রাস্তায় এমনভাবে প্রাচীর ঘেষে চলতো যে, কখনো কখনো তাদের কাপড় প্রাচীরের সাথে আটকে যেতো। ২৪২
২৪২.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.) সুনানে আবু দাউদ ও ইমাম বায়হাকী র. (৪৫৮ হি.) শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ৪০৫
রাস্তায় পুরুষদের সাথে মিলে মিশে একত্রে চলাচল করা নারীদের জন্য নিষিদ্ধ। বরং পুরুষের পেছনে কিংবা রাস্তার এক পাশ দিয়ে চলবে। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একবার আদেশ দিয়েছিলেন রাস্তার পাশ দিয়ে চলার জন্য। মহিলারা এই আদেশ এমনভাবে পালন করেছিলেন যে, রাস্তার পাশ দিয়ে চলতে গিয়ে অনেক সময় তাদের কাপড়ের আঁচল প্রাচীরের সাথে আটকে যেতো। কিন্তু বর্তমান নারীদেরকে শত-সহস্র বার বললেও শরীয়তের বিষয় তারা আমলে নেয়না, বরং শরীয়তকে তারা পাত্তাই দেয়না।
নারীর কল্যাণকর বিষয়
____________________
নারীর কল্যাণকর বিষয়
নারীর কল্যাণ মূলত পর্দা প্রথার মধ্যে নিহিত রয়েছে। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে-
عن علي أنه كان عند النبي ص فقال : أي شئ خير للمرأة ؟
فسكتوا ، قال : فلما رجعت قلت : لفاطمة : أي شي خير للنساء ؟ قالت
: لا يرين الرجال
হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, একদা তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর নিকট ছিলেন। তখন নবী করিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)জিজ্ঞাসা করলেন, নারীদের কল্যাণ কিসে? উপস্থিত লোকেরা চুপ রইল। আমি ফিরে এসে হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه) ’র কাছে জিজ্ঞাসা করলাম- নারীদের কল্যাণ কিসে? তখন তিনি বললেন, পুরুষরা তাদেরকে না দেখার মধ্যেই রয়েছে তাদের কল্যাণ। ২৪৩
২৪৩.কানযুল উম্মাল, খণ্ড. ২৩, পৃ. ২৮৩
ঘর নারীর মসজিদ
____________________
ঘর নারীর মসজিদ
عن ام سلمة رضى الله تعالى عنها عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال خير مساجد النساء قعر بيوتهن হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ইরশাদ করেন, মহিলাদের জন্য উত্তম মসজিদ হলো ঘরের কোণা। ২৪৪
২৪৪.মুসনাদে আহমদ, আল মু’জামুল কবীর তাবরানী, আততারগীব, খণ্ড ১, পৃ. ১৪১
নারীর চুল মুণ্ডানো নিষিদ্ধ
____________________
নারীর চুল মুণ্ডানো নিষিদ্ধ
মহিলাদের মাথা মুণ্ডানো বা ফ্যাশনস্বরূপ চুল ছেটে ছোট করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। মহিলাদের মাথার চুল পুরুষদের দাড়ির মতোই সৌন্দর্যবর্ধক ও নারীত্বের পরিচায়ক। হাদিস শরীফে হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন
-نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ تَحْلِقَ الْمَرْأَةُ رَأْسَهَا
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মহিলাদের মাথা মুণ্ডানো নিষেধ করেছেন। ২৪৫
২৪৫.ইমাম নাসাঈ র. (৩০৩ হি.), সুনানে নাসাঈ, সূত্র রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ৬১৭, হাদিস নং ১৬৪১
বর্তমানে অনেকে সামনের চুল ছোট ও পিছনের চুল লম্বা রাখাকে কিংবা তার বিপরীত করাকে ফ্যাশন মনে করে থাকে। এরূপ করা নারী-পুরুষ কারো জন্যে জায়েয নেই।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قال نهى رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنِ القَزَعِ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাথার চুলের কিছু অংশ মুণ্ডন করে কিছু অংশ চুল রাখতে নিষেধ করেছেন। ২৪৬
২৪৬.বুখারী ও মুসলিম, সুত্র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ৬১৬, হাদিস নং ১৬৩৮
ইসলামে নারীদের চুল লম্বা ও পুরুষের চুল ছোট রাখতে উৎসাহিত করেছে। অথচ আজকের পরিবেশ তার বিপরীত। ইদানিং নারীরা চুল ছোট করে এবং ছেলেরা ফ্যাশনেবল লম্বা চুল রাখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে থাকে। বর্তমানে নারী-পুরুষরা এমনভাবে চুলের ফ্যাশন করে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে পড়ে। বিশেষত এমন কিছু নারী আছে, যাদের চুলের ফ্যাশন দেখলে মনে হয় তারা ভিন্ন গ্রহের আজব প্রাণী। চুলের এই ফ্যাশনে প্রতিদিনই নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। মনে হয় চুলের রাজ্যে ফ্যাশনের তাড়া খেয়ে উভ্রান্তের মতো ছুটছে ফ্যাশনেবল তরুণীর দল। তারা স্থির করে বলতে পারছেনা কেমন চুল, কেমন স্টাইল তাদের কাম্য কিংবা পছন্দ। তারা ভুলে গেছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি।
কানাডার ফিজিওথেরাপিস্ট স্যার জেমস সাগম এক গবেষণা প্রতিবেদনে লিখেছেন, মেয়েদের লম্বা চুল তার ত্বক, দেহ, মস্তিষ্ক, শিরা-উপশিরার খিঁচুনী, মাথা ব্যাথা, ঘাড়ের রগের ব্যাথা, দৃষ্টিশক্তি, শারীরিক দূর্বলতা ইত্যাদি থেকে অনেকাংশে রক্ষা করে। মেয়েদের চুল লম্বা হলে বারবার আঁচড়াতে হয়, বেনি কাটা হয়, ফিতা তোলা হয়। আর মাথা আঁচড়ানোর দ্বারা এক প্রকার উষ্ণতা এবং শরীরে এনার্জি সৃষ্টি হয়, যা পশম বা চুলের মাধ্যমে শরীরে শিরাতন্ত্রকে প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী করে। এমনকি নিয়মিত চুল আঁচড়ালে চুল বৃদ্ধি পায় এবং ঘন হয়। ২৪৭
২৪৭.ক্বারী উম্মে রুম্মান, নারীর জান্নাত পাওয়ার পথ, পৃ. ২১০
নখ পালিশের বিধান
____________________
নখ পালিশের বিধান
নখে পালিশ লাগানো ইদানিং ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ কাল হলেও প্রকৃতিগতভাবে নখ সাদা ও মসৃণ। সাদা মানুষ কাল মানুষ সকলের জন্য নখ মানানসই। কৃত্রিম কোনো রং লাগিয়ে বিভিন্ন রঙে রঙ্গিন করার কোনো প্রয়োজন নেই। এর দ্বারাও আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃত সাধন হয়ে থাকে। মেহেদীর রং হলে উযূতে কোনো অসুবিধা হয় না; কিন্তু যদি এমন রং লাগানো হয় যা নিবিড়ভাবে স্তর জমে আবরণ সৃষ্টি করে যার ভিতরে উযূ ও গোসলের পানি প্রবেশ করেনা তবে তা নিষিদ্ধ। উযূ ও গোসলের পরে লাগালে এবং এ অবস্থায় নামায পড়লে নামায় শুদ্ধ হবে। তবে উযূ ও গোসলের পূর্বে ঐ রং ও পালিশ সম্পূর্ণ তুলে ফেলতে হবে।
এই নেইল পালিশের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কোনো সৌন্দর্য বর্ধক জিনিস নেই। বরং এতে নারীদের হাত ও পায়ের আঙ্গুল বিশ্রী হয়ে কোন হিংস্র জীব-জন্তুর পাঞ্জার ন্যায় ভয়ংকর হয়ে যায়। এগুলো কেবল পশ্চিমা অশ্লীল নারীদের অন্ধ অনুকরণ বৈ কিছুই নয়। মূলত যেসব নারী ইসলামী বিধি-বিধান পালনে যত্নবান, রুচিশীল, ভদ্র ও শান্ত স্বভাবসম্পন্ন তারা কখনো এসব বাজে ও অনর্থক কাজে সময় ও অর্থ নষ্ট করেনা।
নারী ও ফেরীওয়ালা
____________________
নারী ও ফেরীওয়ালা
নারীদের জন্য মাহরাম (যাদের সাথে বিবাহ হারাম) ব্যতিত অন্য কাউকে দেখা দেওয়া নিষিদ্ধ ও কবীরা গুনাহ। যেখানে স্বামীর বড় ভাই, ছোট ভাইকে পর্যন্ত দেখা দেওয়া জায়েয নেই সেখানে নারীরা অহরহ ফেরীওয়ালা অচিন পুরুষকে শুধু দেখা দিচ্ছেনা বরং গায়ের কাছে গিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বা বসে হাসিমুখে দরদাম করে জিনিসপত্র ক্রয় করে। এ সময় ফেরীওয়ালা ও নারীর আচরণ দেখে মনে হয় তারা একে অপরের অত্যন্ত আপনজন। ফেরীওয়ালা দেখলে নারীরা মনেই করেনা যে, ওরা পরপুরুষ। পাঁচ-দশ টাকা কম দামে কিনার উদ্দেশ্যে অনেকেই তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে। অথচ সাধারণ পুরুষের চেয়ে এরা আরো মারাত্মক, এদের থেকে বেশী পর্দা করা উচিত। কারণ এরা পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন জনের ঘরে যাওয়া-আসা করে এবং এক পরিবারের গোপনীয়তা অন্য পরিবারের কাছে ফাঁস করে। এক জনের দোষ-ত্রুটি অপর জনের নিকট বর্ণনা করে বেড়ায়।এরূপ দৃশ্য স্বামী বা স্বামী পরিবারের কোন পুরুষ দেখলেও কিন্তু নারীদেরকে কিছুই বলেনা বরং মৌন সম্মতি প্রকাশ করে এটাকে পারিবারিক ভাবে বৈধ ঘোষণা করে। কোন ব্যক্তিত্ববান পুরুষ নিজের স্ত্রীকে এভাবে পর পুরুষের সাথে খোলামেলাভাবে আলাপ চারিতায় দেখে নিরব থাকতে পারেনা। সুতরাং স্বামী ও গৃহকর্তার উচিত বাঁধা প্রদান করা এবং কঠোর হুঁশিয়ার করে দেওয়া।
স্বামীর সম্পদ থেকে স্ত্রীর দান করা
____________________
স্বামীর সম্পদ থেকে স্ত্রীর দান করা
عن عمرو بن شعيب عن ابيه عن جده عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قال إِذَا تَصَدَّقَتِ المَرْأَةُ مِنْ بَيْتِ زَوْجِهَا، كَانَ لَهَا أَجْرُهَا وَلَهُ مِثْلُهُ، وَلِلْخَازِنِ مِثْلُ ذَلِكَ لا ينقص كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِنْ اجر صاجبه صاجبه شيئاله بما كسب ولها بما انفقت
হযরত আমর ইবনে (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তাঁর পিতা তাঁর দাদা থেকে, তিনি নবী করিম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি ইরশাদ করেন, স্ত্রী যখন স্বামীর ঘর থেকে সাদকা করে এতে তার সাওয়াব হয় এবং অনুরূপ তার স্বামীরও সাওয়াব হয়। উভয়ের সাওয়াব থেকে কমতি হয় না। স্বামীর সাওয়াব হয় রোজগারের কারণে আর স্ত্রীর সাওয়াব হয় ব্যয় করার কারণে।২৪৮
২৪৮.ইমাম বুখারী র (২৫৬ হি.), সহীহ বুখারী, পৃ. ১৯৩
عَنْ عَائِشَةَ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا أَنْفَقَتِ المَرْأَةُ مِنْ طَعَامِ بَيْتِهَا غَيْرَ مُفْسِدَةٍ، كَانَ لَهَا أَجْرُهَا بِمَا أَنْفَقَتْ، وَلِزَوْجِهَا أَجْرُهُ بِمَا كَسَبَ، وَلِلْخَازِنِ مِثْلُ ذَلِكَ، لاَ يَنْقُصُ بَعْضُهُمْ أَجْرَ بَعْضٍ شَيْئًا
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, স্ত্রী অপব্যয় ব্যতিত ঘর থেকে কোনো খাদ্যবস্তু খরচ করলে সে নিজেও সাওয়াব পাবে এবং তার স্বামীও সাওয়াব পাবে। কারণ সে তা সংগ্রহ করেছে এবং এতে যে শ্রমিক শ্রম দিয়েছে তারও সাওয়াব হবে। আর এতে কারো সাওয়াবে কোনো কমতি হবে না। ২৪৯
২৪৯.ইমাম বুখারী র (২৫৬ হি.), সহীহ বুখারী, পৃ. ১৯২
সাধারণত ঘরের যাবতীয় কাজ স্ত্রীই সম্পাদন করে থাকে। স্বামীরা ঘরের ছোট-খাট বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। সামান্য টাকা-পয়সা কিংবা খাদ্যবস্তু কাউকে দান করার অনুমতি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে দিয়ে রাখা উচিত। স্বামীর যদি মৌনসম্মতি থাকে এবং স্ত্রীও যদি জানে যে, স্বামী অপছন্দ করবে না তাহলে স্ত্রী স্বামীর সম্পদ থেকে স্বল্প পরিমাণ দান-খয়রাত কিংবা অবশিষ্ট খাবার গরীব মিসকীনকে দান করা জায়েয।
অনুরূপভাবে প্রতিবেশীকে সামান্য বস্তু দিয়ে হলেও সাহায্য করা, তাদের প্রয়োজন পূরণ করা উচিত। কারণ এগুলো প্রতিবেশীর অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ)ইরশাদ করেন,
من اعطى نارا فكأنما تصدقت بجميع ما انضجت النار
যে ব্যক্তি কাউকে একটু আগুন দিয়ে সাহায্য করল, সে যেন আগুনে পাকানো সম্পূর্ণ খাদ্যই সাদকা করল। ২৫০
২৫০.নুরুদ্দিন আলী ইবনে আবু বকর র (৮৮০ হি.), মাজমউয যাওয়াযেদ, পৃ. ১৩৬
عَنْ أَبُو هُرَيْرَةَ قَالَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَوَمَا أَنْفَقَتْ مِنْ كَسْبِهِ مِنْ غَيْرِ أَمْرِهِ، فَإِنَّ نِصْفَ أَجْرِهِ لَهُ
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, স্ত্রী স্বামীর আদেশ ব্যতিতও ব্যয় করলে স্বামী তাতে অর্ধেক সাওয়াব পাবে। ২৫১
২৫১.ইমাম মুসলিম র (২৬১ হি.) সহীহ মুসলিম, খণ্ড ২, পৃ. ৩৩০
মহিলারা প্রতিবেশীকে কিছু দিলে কিংবা কাউকে কিছু দিলে সামান্য মনোমালিন্য হলেই তারা তা খোটা দিয়ে গ্রহিতাকে লজ্জিত করে দেয়। কারো উপকার করে খোটা দিলে উপকারের সাওয়াব বিনষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
-يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى
হে ঈমানদারগণ ! খোটা দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে বিনষ্ট করোনা।২৫২
২৫২.সূরা বাকারাহ, আয়াত ২৬৪
আল্লামা শেখ সাদী (رحمة الله) বলেন, উপকার করে খোটা দেওয়ার মানে হলো বৃক্ষরোপন করে দীর্ঘদিন লালন-পালন করে ফল খাওয়ার সময় বৃক্ষের গোড়ায় কুড়াল মারা। অর্থাৎ কারো উপকার করে উপকারকারী যে সাওয়াব প্রাপ্ত হলো তা ভোগ করার সময় খোটা দিয়ে সাওয়াব নষ্ট করে ফেলা অত্যন্ত বোকামী কাজ।
স্বামী ভক্তি
____________________
স্বামী ভক্তি
আমাদের দেশের নারীদের মধ্যে একটা অভ্যাস প্রচলিত আছে যে, স্বামী বা পরিবারের পুরুষরা পানাহার না করা পর্যন্ত নারীরা পানাহার করে না। এমনকি ঘরে কোনো কিছু তৈরি করলে আগে সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের পুরুষদেরকে ভালো ও উন্নতগুলো খাওয়ায়, পরে অবশিষ্ট থাকলে নিজেরা খায়। এটা অত্যন্ত ভালো ও প্রশংসীত অভ্যাস। কারণ এতে নারী নিজের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দেয় যাকে আরবিতে ‘ঈসার’ বলা হয়।
অনেক স্ত্রী আবার স্বামীর পূর্বে পানাহার করাকে পাপ মনে করে- এটা কিন্তু ঠিক নয়; এটাকে শরয়ী বিধান মনে করা ভুল হবে। তবে এর দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা গভীয় হয় এবং সংসার সুখের হয়।
পরিবারের ঐক্য, শৃঙ্খলা অঁটুট রাখার জন্য পরিবারের সকল সদস্য এক দস্তরখানায় বসে একত্রে পানাহার করা উত্তম। এতে যেমনি আহার্য বস্তুতে বরকত হয়, তেমনি পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক ও মায়া-মমতা গড়ে উঠে, সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি সুন্নাতও প্রতিষ্ঠিত হয়।
হযরত ইবনে হারব (رضي الله عنه) তার পিতা হতে তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেন, একদা সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা খানা-পিনা করি কিন্তু আমরা পরিতৃপ্ত হইনা। তিনি বললেন, সম্ভবত তোমরা পৃথকভাবে খানা খাও। তারা বললেন, হ্যাঁ, অতপর তিনি বললেন-
فَاجْتَمِعُوا عَلَى طَعَامِكُمْ وَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ يُباركْ لكم فِيهِ
তোমরা সমবেতভাবে খানা খাবে এবং আল্লাহর নাম নিবে, এতে তোমাদের খানায় বরকত হবে। ২৫৩
২৫৩.আবু দাউদ, সূত্র, মিশকাত, পৃ. ৩৬৯
এ ব্যাপারে পিতা-মাতা উভয়ের ভূমিকা রাখা প্রায়োজন। কারণ কোনো একজনের দ্বারা আদর্শ পরিবার গঠন সম্ভবপর নয়। আল্লামা যামখশরী বলেছেন, ‘নারী এবং পুরুষ গাড়ীর দু’টি চাকার ন্যায়, চাকা যদি স্ব স্ব স্থানে বিদ্যমান না থাকে তবে বিপর্যয় অনিবার্য।’ পরিবার নামক গাড়ীটি সঠিকভাবে পরিচালিত করতে নারী ও পুরুষ তথা স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
আদর্শ স্ত্রীরা পরিবারের সুখ শান্তি বজায় রাখার জন্য একটু অতিরিক্ত কাজ করে থাকে। যেমন স্বামী পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের সদাচরণ করা, তাদেরকে মেহমানদারীতে কৃপণতা না করা, তাদের জন্য মাঝে-মধ্যে সামর্থানুযায়ী উপঢৌকন পাঠানো, তাদের প্রতি সহানুভুতিশীল হওয়ার জন্য স্বামীকে উৎসাহিত করা, স্বামীর কাছে তাদের প্রশংসা করা ইত্যাদি।
কিছু নারী আছে যারা স্বামী পক্ষের আত্মীয়-স্বজনকে খোলামনে মেনে নিতে পারেনা, স্বামী তাদেরকে কিছু প্রদান করা সহ্য করতে পারে না, স্বামী পক্ষের আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে আসলে মুখভর করে রাখে, স্বামীর কাছে সর্বদা তাদের দোষ-ত্রুটি তুলে ধরে। অপারগ হয়ে তাদের মেহমানদারী করে, তারা চলে গেলে স্বামীকে বলে অমুকের ছেলে গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেছে, অমুকের মেয়ে ওয়াশরুম বরবাদ করে দিয়েছে ইত্যাদি বলে স্বামীর কান ভার করে দেয়। অথচ স্ত্রীপক্ষের কেউ আসলে আন্তরিকতার সহিত স্বতঃস্ফুর্তভাবে পাঁচ রকমের নাস্তা ও সাত প্রকারের রান্না করে মেহমানদারী করে। স্বামী পক্ষ নাস্তা-পানি আনলে ওগুলো রান্নাঘরের এক কোণে ফেলে রাখে, স্বামী জিজ্ঞাসা করলে- “তোমাকে দেখাতে ভুলে গেছি” বলে অল্প নাস্তা প্রকাশ করে স্বামীর সামনে উপস্থিত করে। পক্ষান্তরে নিজের পক্ষের আত্মীয়-স্বজন কিছু আনলে ওগুলো স্বামীকে না দেখানো পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেনা। এসব স্ত্রীরা স্বার্থপর ও লোভী। এদের অধিকাংশই স্বামীর ঘরে সুখ-শান্তি পায়না। এসব বিষয় নিয়ে সর্বদা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকে। স্বামী পক্ষের কোন আত্মীয় স্বজন তাদের নিকট আসতে চায়না, কোনো সময় মুছিবতে পড়লে তাদের কেউ এগিয়ে আসতে চায়না।
ইসলাম ও নারী শিক্ষা
____________________
ইসলাম ও নারী শিক্ষা
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এতে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আদর্শ সমাজ বিনির্মানে পুরুষ শিক্ষার পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ সমাজের অর্ধেক হচ্ছে নারী। এদেরকে অন্ধকারে রেখে সমাজ উন্নতি লাভ করতে পারে না।
নারী আমাদের মাতৃজাতি। জগতের মহামানব, সাধক-তাপসকুলের জননী, নবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়াদের গর্ভধারিনী। পৃথিবীর বিখ্যাত সব বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক সকলেই মায়ের কোলে লালিত। মায়ের কোলই সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষাগার, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘোষণা করেছেন-
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
প্রত্যেক মুসলমানের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয। কোনো বর্ণনায় আছে- مسلمة অর্থাৎ নারী-পুরুষ উভয়ের উপর জ্ঞানার্জন আবশ্যক। ২৫৪
২৫৪.ইমাম বায়হাকী র (৪৫৮ হি.), শোয়াবুল ঈমান, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৩৪
ইসলামে নারীদের জন্য জ্ঞানার্জন কেবল অধিকার বলেনি বরং একান্ত ফরয করে দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীদেরকে জ্ঞানার্জনের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি ও সরবরাহ করাটা পরিবার, গোটা সমাজ তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
মহানবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অন্ধকারে নিমজ্জিত নারীদের মাঝে জ্ঞান-সূর্যের উদয় ঘটালেন। তিনি মানব সমাজকে নারী জাতির শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন- “যার নিকট তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনটি বোন রয়েছে, অতঃপর তাদের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের আদব শিক্ষা দিয়েছে আর তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করেছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
অন্য হাদিসে তিনি আরো ইরশাদ করেন- “যদি কারো অধীনে কোনো দাসী থাকে এবং সে তাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে, উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়, অতঃপর তাকে মুক্ত করে দিয়ে নিজ স্ত্রী রূপে গ্রহণ করে, তবে তার জন্য দু’টি প্রতিদান রয়েছে। ২৫৫
২৫৫.ইমাম বুখারী র (২৫৬ হি.), সহীহ বুখারী, পৃ. ২০, হাদিস নং ৯৭
নারীকে একটি নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ পরিবেশের সুযোগ করে দিয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে বিদ্যা-বুদ্ধি ও স্বাভাব চরিত্রে সুগঠিত করে সমাজকে একটা যোগ্যতর কন্যা ও আদর্শ মা উপহার দেওয়া সম্ভব।
একজন আদর্শ নারী (মা) দ্বারা একটি আদর্শ পরিবার এবং আদর্শ পরিবার দ্বারা একটি আদর্শ সমাজ গঠিত হয়। আর আদর্শ সমাজ দ্বারা আদর্শ জাতি গঠিত হয়। তাই নেপোলিয়ন বলেছিলেন “আমাকে একটি আদর্শ মা দাও, আমি তোমাকে একটি আদর্শ জাতি উপহার দেবো।” আর এরূপ আদর্শ নারী গঠিত হবে ইসলামী জ্ঞানার্জন দ্বারা।
মু’মিন জননী হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) ছিলেন একাধারে একজন মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুফাস্সির, সাহিত্যিক, কবি ও মুজতাহিদ। তিনি সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাত জনের অন্যতম ছিলেন। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রেও পারদর্শী ছিলেন। বড় বড় সাহাবায়ে কিরাম তাঁর কাছ থেকে জটিল বিষয়ের সমাধান নিতেন। অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর কাছ থেকে হাদিসসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। নবী করিম (ﷺ) তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন- “এ হুমায়রা (হযরত আয়িশা (رضي الله عنه)’র ডাক নাম) থেকে তোমার দ্বীনের অর্ধেক গ্রহণ করো।” এ হাদিস ও উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামে নারীর শিক্ষা গ্রহণের সাথে সাথে তাদের শিক্ষাদানেরও অধিকার স্বীকৃত।
নারী যেহেতু সমাজের অর্ধেক অংশ। তাদের বাদ দিয়ে সমাজ ও দেশের উন্নয়ন কোনোমতে সম্ভব নয়। তাই একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মানে দরকার নারীদের সুশিক্ষিত করে তোলা। শিক্ষা ও অগ্রগতির ধারাকে কেবল এক অংশের মাঝে সীমিত রাখলে বাকী অর্ধাংশ পঙ্গু, বিকল ও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তা সমাজের সার্বিক কল্যাণের পথ ব্যাহত করবে। এ কারণেই ইসলাম নারী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে।
নারীর জন্য নিরাপদ শিক্ষালয়
____________________
নারীর জন্য নিরাপদ শিক্ষালয়
নারীর শিক্ষা যেমন আবশ্যকীয় তেমনি নারীর জন্য নিরাপদজনক পৃথক শিক্ষালয় প্রয়োজন। তবে প্রাইমারী ও ইবতিদায়ী তথা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলে মেয়ে সহপাঠ সম্ভব। এর উপরে গেলে পৃথক ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। কারণ নারী-পুরুষের সম্পর্কটা হচ্ছে লৌহ ও চুম্বকের ন্যায়। লোহা চম্বুকের কাছে আসলেই আকর্ষণ করবে। এটাকে কোনো শক্তি প্রতিরোধ করতে পারবেনা। এই সত্যটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এভাবে নারীদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারীরাও নারী হওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ শিক্ষক-কর্মচারীরাও তো মানুষ-কোনো ফেরেশতা নয়। যেখানে হারূত-মারূত ফেরেশতাদ্বয় পর্যন্ত কুরআনের বর্ণনা মতে নারীর ফাঁদে পড়ে কিয়ামত পর্যন্ত শাস্তি ভোগ করছে, সেখানে মানুষের কী গ্যারান্টি। সুতরাং এক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তে কোনো অযুহাতই গ্রহণযোগ্য হবে না। মোট কথা হলো পুরুষের জন্য পুরুষ শিক্ষক এবং নারীর জন্য নারী শিক্ষক জরুরী। এর ব্যত্যয় ঘটলে সেখানে অঘটন ঘটবে নিশ্চিত।
নারীর পায়জামা টাখনুর নিচে হবে
____________________
নারীর পায়জামা টাখনুর নিচে হবে
বর্তমানে আর এক নতুন ফ্যাশন পরিলক্ষিত হয়, তা হলো যুবতী নারীরা তাদের পায়জামা টাখনুর প্রায় এক বিঘত উপরে করে সেলাই করে যেন পায়ের গোড়ালী দেখা যায়। অথচ ঐ অংশও তাদের সতরের অংশ যা ঢেকে রাখা ওয়াজিব। হযরত আনাস ইবনে মালিক (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)
شبر لفاطمة من عقبها شبرا وقال هذا ذيل المرءة
হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه) কে পায়ের পেছনের অংশ অর্থাৎ গোড়ালী থেকে এক বিঘত পরিমাণ পায়জামা লম্বা রাখতে অনুমতি দিয়েছেন এবং ইরশাদ করেছেন-নারীদের কাপড় এতটুকু ঝুলে থাকবে। ২৫৬
২৫৬.নুরুদ্দিন আলী ইবনে আবু বকর র. ( (৮০৮ হি.), মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খণ্ড ৫, পৃ. ১২৭
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি অহংকারের নিয়তে নিজের পরিধেয় কাপড়কে টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে রাখবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’য়ালা তার দিকে অনুগ্রহের দৃষ্টিতে তাকাবেন না।
فَقَالَتْ أُمُّ سَلَمَةَ: فَكَيْفَ يَصْنَعْنَ النِّسَاءُ بِذُيُولِهِنَّ؟ قَالَ: يُرْخِينَ شِبْرًا، فَقَالَتْ: إِذًا تَنْكَشِفُ أَقْدَامُهُنَّ، قَالَ: فَيُرْخِينَهُ ذِرَاعًا، لاَ يَزِدْنَ عَلَيْهِ قال الترمذى وفى الحديث رخصة للنساء فى جر الازار لانه يكون استر لهن
অতঃপর হযরত উম্মে সালামা (رضي الله عنه) আরয করলেন, নারীরা নিজের পরিধেয় কাপড় কীভাবে রাখবে? তিনি বললেন, নারীরা এক বিঘত অতিরিক্ত রাখবে। হযরত উম্মে সালামা (رضي الله عنه) আরয করলেন, যদি এতে করেও পা অনাবৃত থাকে? তখন তিনি বললেন, তাহলে এক হাত পরিমাণ নিচে ঝুলিয়ে রাখবে- এর থেকে অতিরিক্ত নয়। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বলেন, এই হাদিসে নারীদেরকে টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে রাখার আদেশ এসেছে। এতে তাদের জন্যে অধিক সতর সংরক্ষিত হবে। ২৫৭
২৫৭.ইমাম তিরমিযী র. (২৭৯ হি.), সুনানে তিরমিযী, পৃ.২০৬
নারী প্রধান হলে
____________________
নারী প্রধান হলে
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا كَانَ أُمَرَاؤُكُمْ خِيَارَكُمْ وَأَغْنِيَاؤُكُمْ سُمَحَاءَكُمْ وَأُمُورُكُمْ شُورَى بَيْنِكُمْ فَظَهْرُ الْأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ بَطْنِهَا. وَإِذَا كَانَ أمراؤكم شِرَاركُمْ وأغنياؤكم بخلاؤكم وَأُمُورُكُمْ إِلَى نِسَائِكُمْ فَبَطْنُ الْأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ من ظهرهَا
হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ধনীরা হবে দানশীল এবং তোমাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম সম্পাদিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে, তখন পৃথিবীর পেট অপেক্ষা তারপীঠ হবে তোমাদের জন্য উত্তম। পক্ষান্তরে যখন তোমাদের শাসক হবে তোমাদের মন্দ লোকেরা, বৃত্তবান লোকেরা হবে কৃপণ এবং তোমাদের কাজ-কর্ম ন্যস্ত হবে তোমাদের নারীদের উপর, তখন পৃথিবীর পিঠ অপেক্ষা পেট হবে তোমাদের জন্য উত্তম। ২৫৮
২৫৮.তিরমিযী, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৪৫৯
عَنْ أَبِي بَكْرَةَ قَالَ: لَمَّا بَلَغَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّ أَهْلَ فَارِسَ قَدْ مَلَّكُوا عَلَيْهِمْ بِنْتَ كِسْرَى قَالَ: لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ وَلَّوْا أَمْرَهُمُ امْرَأَةً
হযরত আবি বাকরা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন জানতে পারলেন যে, পারস্যবাসী কিসরার (পারস্য সম্রাট) কন্যাকে রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছে, তখন তিনি বললেন, সে জাতি কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারবেনা যারা তাদের শাসক নিযুক্ত করেছে নারীকে। ২৫৯
২৫৯.বুখারী, খণ্ড, পৃ. ৬৩৭ ও তিরমিযী, খণ্ড ২, পৃ. ৫২, মিশকাত; পৃ. ৩২১
মহানবীর দৃষ্টিতে নিকৃষ্ট নারী
____________________
মহানবীর দৃষ্টিতে নিকৃষ্ট নারী
বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত ও নারীমুক্তির অগ্রদূত নবী করিম (ﷺ) কতিপয় নারীকে নিকৃষ্ট বলেছেন। হাদীসে এসেছে-
عن ام سلمة رضى الله تعالى عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم انى لا بغض المرئة تخرج من بيتها تجر ذيلها تشكو زوجها -
“হযরত উম্মে সালামা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত- নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, আমার নিকট ঐ নারী বড়ই নিকৃষ্ট, যে নিজের ঘর থেকে স্বামীর অনুমতি ব্যতীত চাদর জড়াতে জড়াতে স্বামীর সমালোচনা করতে করতে বের হয়।” ২৬০
২৬০.মাজমায়ুয যাওয়াযিদ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩১৬
মনে রাখতে হবে যে, স্বামী-স্ত্রী সব সময় এক সাথে থাকার কারণে অনেক দোষ-ত্রুটি, ভুল-ভ্রান্তি হয়েই থাকে। পরস্পরের সমস্যা ভুল ত্রুটিগুলো দ্বারা অনেক সময় পরস্পরের মহব্বত নষ্ট হয়ে তিক্ততার জন্ম হয়। এক পর্যায়ে দেখা যায় সংসারই টিকে না। সোনালি সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। তাই সংসারের সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো মেনে নিয়ে ধৈর্য সহকারে স্বামীর সাথে বসবাস করাই হচ্ছে একজন মুমিন নারীর দায়িত্ব।
মনে রাখতে হবে যে, একজন নারীর মূল পরিচয় হচ্ছে তার স্বামী। যেমন কোনো মেয়ের স্বামী যদি আলেম হয়, মন্ত্রী, এমপি হয় তখন সমাজের দৃষ্টিতে তার মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। যদিও সে কৃষকের মেয়ে হোক। পক্ষান্তরে যদি কোনো মন্ত্রীর মেয়ে ডাকাত স্বামীর স্ত্রী হয়, তখন সমাজে তাকে ডাকাতের স্ত্রী হিসেবেই জানে এবং ঘৃণা করে। তাই প্রত্যেক মেয়েকে মনে রাখতে হবে, সে যদি স্বামীর বদনাম করে কার্যত সে নিজের বদনামই করল।
অনেক নারী নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছে নিজ স্বামীর বদনাম করে। সে তলিয়ে দেখে না যে, এতে আত্মীয়স্বজনের দৃষ্টিতে তার স্বামীই হালকা হয়ে যায়। পরবর্তীতে যখন মেয়ে চেষ্টা করে তার স্বামীর ভালো গুণ বর্ণনা করতে বা তাদের চোখে ভালো করাতে, তখন শত চেষ্টা করেও আর পারে না। অতএব প্রত্যেক মেয়ের জন্য উচিৎ যে, নিজের স্বামীর বদনাম না করে স্বামীকে সময় ও সুযোগ মতো তার দোষগুলো ধরিয়ে দেয়া। এতে তিনি ঠিকই শোধিত হয়ে যাবেন এবং আপনার সংসার হয়ে যাবে সুখের বাগান।
জাহান্নামি নারীর পরিচয়
____________________
জাহান্নামি নারীর পরিচয়
নারী যেমন স্বল্প আমলের মাধ্যমেই জান্নাতি হতে পারে, তেমনি কতিপয় আচরণের দ্বারা সে জাহান্নামি হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা হাফিজ শামসুদ্দীন যাহাবী (رحمة الله) তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আল কাবায়ির’ -এ একটি বিখ্যাত হাদীস সংকলন করেছেন। হাদীসটি হলো- একবার হযরত আলী (رضي الله عنه) এবং হযরত ফাতেমা (رضي الله عنه) হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য তাঁর ঘরে গেলেন। হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, আমরা গিয়ে মহানবী কে ক্রন্দনরত অবস্থায় পেলাম। এমনকি নবী করিম (ﷺ)-র কান্নায় অবিরাম অশ্রু ঝরছিল। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এত কাঁদছেন কেন? উত্তরে নবী করিম (ﷺ)ইরশাদ করলেন, মেরাজের রাতে আমি মহিলাদেরকে দোযখের বিভিন্ন রকম শাস্তিতে নিপতিত দেখেছি। সে শাস্তির ভয়ারহতায় আমি কাঁদছি। অতঃপর মহানবী (ﷺ) ইরশাদ করলেন,
প্রথম মহিলাকে দেখলাম, জাহান্নামে তাকে চুল দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তার মাথার মগজ পাতিলের ফুটন্ত পানির ন্যায় টগবগ করছে।
দ্বিতীয় মহিলাকে তার জিহবা দ্বারা জাহান্নামের ভিতর লটকানো দেখলাম।
তৃতীয় মহিলাকে দেখলাম, নিজ স্তন দ্বারা জাহান্নামে ঝুলানো রয়েছে।
চতুর্থ মহিলাকে দেখলাম, তার পদ-যুগল বক্ষের সাথে বাঁধা আর হস্তদ্বয় বাঁধা ললাটের সাথে।
পঞ্চম মহিলাকে দেখতে পেলাম, তার চেহারার অংশ শূকরের মতো, বাকি শরীর গাধার মতো। অথচ সে তো এক মহিলা। আরো দেখতে পেলাম তার সমস্ত শরীরে সাপ, বিচ্ছু জড়ানো।
ষষ্ঠ মহিলাকে দেখতে পেলাম, সে কুকুরের আকৃতিতে বিকৃত হয়ে আছে এবং তার মুখের গহ্বরে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা দাউদাউ করে প্রবেশ করছে। এমনকি গোটা শরীর ভস্ম হয়ে গুহ্যদ্বার দিয়ে বের হচ্ছে। তাকে আবার আযাবের ফেরেশতারা গুর্জা মেরে পিটাচ্ছে।
অতপর হযরত ফাতেমা (رضي الله عنه) আরজ করলেন, তাদের ওপর এমন শাস্তির কারণ কী? তাদের এমন কী বদআমল ছিল যে, আপনি তাদেরকে এত ভয়াবহ শাস্তিরত অবস্থায় দেখলেন?
জবাবে নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করলেন, যে মহিলাকে তার চুলের সাথে ঝুলানো দেখেছি তার শাস্তির কারণ হলো, সে ঘরের বাইরে তথা রাস্তাঘাটে খালি মাথায় চলাফেরা করত। এক কথায় বেগানা তথা গায়রে মাহরাম পুরুষের সামনে চুল না ঢাকা তথা চুলের বেপর্দেগী। মাথার চুলও সতরের অন্তর্ভুক্ত কেননা, মহিলাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সমস্ত শরীরই সতর। চেহারা, উভয় হাতের কব্জি এবং উভয় পায়ের টাখনু ব্যতীত সমস্ত শরীর সতরের আওতাভুক্ত, যা নামাযের মধ্যে ঢাকা ফরয। এজন্য যদি নামাযের মধ্যে চুলের চার ভাগের একভাগ খুলে যায় এবং তিন তাসবীহ পরিমাণ সময় খোলা থাকে তাহলে নামায হবে না। অথবা এমন পাতলা ওড়না যাতে চুল দেখা যায়, তাতেও নামায হবে না। কেননা পাতলা ওড়নায় পূর্ণাঙ্গ সতর ঢাকা হয়নি। অনেক মহিলা পাতলা ওড়না দু’ভাজ করে মাথায় পরে। তা সত্ত্বেও যদি চুল দেখা যায় বা ওড়না এতো ছোট যে, চুলের খোঁপা বের হয়ে থাকে বা কামিসের হাতা এত ছোট যে, ওড়না পরা সত্ত্বেও হাতের কব্জি পর্যন্ত আবৃত হয় না। তবে এসব ক্ষেত্রে মাসয়ালা হচ্ছে যেসব অঙ্গ নামাযের মধ্যে ঢেকে রাখা ফরয, যদি এসব অঙ্গের চার ভাগের এক ভাগ খুলে যায় এবং তিন তাসবীহ পরিমাণ খোলা থাকে তাহলে নামায হবে না।
কিছু কিছু পর্দা পালনকারিণী মহিলা ঘরের বাইরে তো মাথা ঢেকে রাখার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে থাকে, কিন্তু ঘরের ভেতরে বেগানা আত্মীয়স্বজনের সামনে এর কোনো গুরুত্বই দেয় না। অথচ উক্ত হাদীসের মধ্যে এ বিষয়ে ভয়াবহ শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় মহিলা যাকে মহানবী (ﷺ) জিহবার দ্বারা ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছেন, তার সম্পর্কে ইরশাদ করেন যে, সে ঐ মহিলা, যে জিহবা দ্বারা স্বামীকে কষ্ট দিত।
তৃতীয় মহিলা যাকে মহানবী (ﷺ) স্তনের মাধ্যমে ঝুলানো দেখেছেন, তার সম্পর্কে নবী করিম (ﷺ) বলেন, সে ঐ মহিলা, যে বিবাহিতা হওয়া সত্ত্বেও পরপুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্ক রাখত।
চতুর্থ মহিলা যাকে রাসূল তার পদযুগল বক্ষের সাথে আর হস্তদ্বয় ললাটের সাথে বাঁধা অবস্থায় দেখেছেন, তার সম্পর্কে মহানবী (ﷺ) ইরশাদ করেন, সে ঐ মহিলা, যে দুনিয়াতে অপবিত্রতা ও হায়েয নেফাস হতে পবিত্রতার গুরুত্ব দিত না। সাথে সাথে নামাযের গুরুত্ব দিত না; বরং তা নিয়ে উপহাস করত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপর যখন গোসল ফরয হয় তখনই গোসল করে নিতে হবে। যদি ঐ সময় গোসল করতে না পারে তবে কমপক্ষে ইস্তেঞ্জা করে, অযু করে, কুলি করে, হাত মুখ ধৌত করে ঘুমাবে। তাও যদি করা সম্ভব না হয় তাহলে সুবহে সাদেকের পর সূর্য উঠার এতটুকু সময় পূর্বে গোসল করে নিবে, যাতে পুরুষ হলে জামাতের সাথে নামায আদায় করতে পারে। আর মহিলা হলে যাতে সূর্য উঠার পূর্বেই নামায পড়ে নিতে পারে। এটি হলো সর্বনিম্ন স্তর।
যদি কোনো ব্যক্তি অপবিত্র অবস্থায় ঘুমিয়ে যায়, এরপর সূর্যোদয়ের পরে উঠে, তার জন্য উক্ত শাস্তি হবে। কেননা সে গোসল করতে এ পরিমাণ বিলম্ব করেছে যে, যার কারণে তার জামাত ছুটে যায় বা নামায কাযা হয়ে যায়। এটি সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয তথা হারাম।
এমনিভাবে হায়েয, নেফাসেরও একই হুকুম। হায়েয, নেফাস বন্ধ হওয়ার পর যদি নামাযের জন্য এতটুকু সময় থাকে, যাতে করে সে গোসল করে নামাযের সময় শেষ হওয়ার পূর্বেই ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে পারবে, তবে ঐ ওয়াক্তের নামায ফরয হয়ে যাবে। আর যদি এর থেকে বেশি সময় পাওয়া যায়, তবে তো নামায ফরয হবেই, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এ সময় দ্রুত গোসল করে নামায পড়তে হবে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কেউ নামাযের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা পূর্বে হায়েয বন্ধ হওয়ার আলামত পেল। তাহলে তখনই সে গোসল করে নামায আদায় করবে। কিন্তু বর্তমানে মহিলাদের মাঝে এ রোগ ব্যাপক হয়ে পড়েছে যে, তারা ওয়াক্তকে বেপরোয়ার সাথে কাটিয়ে দেয়। যদি এশার পর হায়েয বন্ধ হয় তাহলে সারারাত অববিত্র অবস্থায় কাটিয়ে দেয়। অথচ সুবহে সাদেকের পূর্বে গোসল করে এশার নামায পড়া তার উপর ফরয ছিল। তাই তার করণীয় হবে, তাকে সে সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা এবং নামায আদায় করা।
ঐ শাস্তির তৃতীয় কারণ, নামায নিয়ে বিদ্রোপ করা এবং নামাযকে সাধারণ জিনিস মনে করা। নামাযের ব্যাপারে বেপরোয়া হওয়া।
বর্তমানে অধিকাংশ পুরুষ মহিলাই এ অবস্থার শিকার। যুবক-যুবতিদের মাঝে আজ নামাযের গুরুত্ব নেই। এমনিভাবে বয়স্ক মহিলাদেরও নামাযের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদেরকে যদি নামায সম্পর্কে বলা হয় তাহলে এমনভাবে উত্তর দেয় যে, মনে হয় যেন নামায তাদের নিকট সাধারণ একটি তুচ্ছ বিষয়। অথচ নামায অন্যতম ফরয ইবাদত। আর এ নামাযের মতো এমন ফরয ইবাদত নিয়ে যদি কেউ উপহাস করে তবে তার ঈমান হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
পঞ্চম ঐ মহিলা যাকে মহানবী (ﷺ) এমন অবস্থায় দেখেছেন যে, তার চেহারা শূকরের মতো, বাকি শরীর গাধার মতো আর সাপ, বিচ্ছু তার শরীরে জড়ানো। এ মহিলা সম্পর্কে মহানবী (ﷺ)বলেন যে, সে মিথ্যা কথা বলত এবং চুগলখোরি করত। যার কারণে তার এ শাস্তি।
ষষ্ঠ মহিলা যাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কুকুরের আকৃতিতে দেখেছেন এবং তার মুখ দিয়ে আগুন প্রবেশ করছে আর গুহ্যদ্বর দিয়ে বেরুচ্ছে। ওদিকে জাহান্নামের ফেরেশতা গুর্জা দিয়ে পিটাচ্ছে। এই শাস্তির কারণ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন যে, এর কারণ হলো প্রথমত হিংসা, দ্বিতীয়ত উপকারের খোঁটা দেয়া।
হিংসার অর্থ হলো কারো নেয়ামত ও সুখ দেখে দুঃখিত হওয়া ও তার অবসান কামনা করা। আজকাল হিংসা এত বেশি পরিমাণ দেখা যায় যে, একজন অন্যজনের শান্তিতে থাকা, খাওয়া, পরিধান করা ইত্যাদি দেখতে পারে না। মোটকথা, অপরের শান্তি আদৌ সহ্য হয় না। কারো উন্নতি দেখলেই হিংসার আগুনে জ্বলে অঙ্গার হয়ে যায়। যা হারাম এবং মহাপাপ।
উপকারের খোঁটা দেয়া তথা উপকার করার সময় উদ্দেশ্য থাকে যে, আমি তার থেকে এ উপকারের বিনিময় পাব। যখন বিনিময় পায় না তখনই খোঁটা দেয়। যেমন কোনো মহিলার বিবাহ শাদি কিংবা বিপদ আপদে অন্য মহিলা সাহায্য করল। অতঃপর যখন তাকে উপযুক্ত বিনিময় হিসেবে সাহায্য না করে, তখন সে অন্যান্য মহিলার কাছে বলতে থাকে যে, দেখ! আমি তার কত কিছু করলাম। আর সে আমার এমন বিপদের সময় কিছুই করল না।
এজন্য নারী-পুরুষ উভয়েরই উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কারো উপকার করা। আর আল্লাহ তায়ালার নিকটই প্রতিদানের আশা করা। তাহলে অন্তরে কোনো কষ্ট আসবে না।
জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়
____________________
জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়
একজন মুমিন ব্যক্তির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ। জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকাই একজন প্রকৃত মুমিনের ধ্যান ও সাধনা হওয়া উচিত। হাদীসে জাহান্নাম হতে বাঁচার উপায় হিসেবে বলা হয়েছে,
-عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: شَهِدْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلَاةَ يَوْمَ الْعِيدِ، فَبَدَأَ بِالصَّلَاةِ قَبْلَ الْخُطْبَةِ، بِغَيْرِ أَذَانٍ وَلَا إِقَامَةٍ، ثُمَّ قَامَ مُتَوَكِّئًا عَلَى بِلَالٍ، فَأَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ، وَحَثَّ عَلَى طَاعَتِهِ، وَوَعَظَ النَّاسَ وَذَكَّرَهُمْ، ثُمَّ مَضَى حَتَّى أَتَى النِّسَاءَ، فَوَعَظَهُنَّ وَذَكَّرَهُنَّ، فَقَالَ: تَصَدَّقْنَ، فَإِنَّ أَكْثَرَكُنَّ حَطَبُ جَهَنَّمَ، فَقَامَتِ امْرَأَةٌ مِنْ سِطَةِ النِّسَاءِ سَفْعَاءُ الْخَدَّيْنِ، فَقَالَتْ: لِمَ؟ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: لِأَنَّكُنَّ تُكْثِرْنَ الشَّكَاةَ، وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ، قَالَ: فَجَعَلْنَ يَتَصَدَّقْنَ مِنْ حُلِيِّهِنَّ، يُلْقِينَ فِي ثَوْبِ بِلَالٍ مِنْ أَقْرِطَتِهِنَّ وَخَوَاتِمِهِنَّ“
হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, আমি ঈদের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র সাথে ছিলাম। মহনবী আযান, ইকামত ব্যতীত নামায পড়ালেন। অতঃপর হযরত বেলাল রা-এর উপর ভর করে দাঁড়ালেন। খোতবার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার প্রতি তাকওয়ার আদেশ করলেন এবং তার আনুগত্যের প্রতি উৎসাহ প্রদান করলেন। লোকদের উপদেশ দিলেন। অতঃপর নারীদের দিকে তাশরীফ নিলেন। তাদেরকে ওয়ায ও উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন, তোমরা বেশি পরিমাণে দান-সদকা কর। কারণ তোমরা অধিক সংখ্যক জাহান্নামে জ্বলবে। নারীদের মধ্য থেকে অত্যন্ত দূর্বল একজন নারী দাঁড়ালেন। যার মুখমণ্ডল সঙ্কুচিত ছিল। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এর কারণ কী? নবী করিম (ﷺ)ইরশাদ করলেন, এর কারণ হলো, তোমরা নারীরা অভিযোগ বেশি কর এবং স্বামীর অকৃতজ্ঞতাও বেশি কর। একথা শোনার পর নারীরা নিজ নিজ অলঙ্কারসমূহ দান করতে লাগল।” ২৬১
২৬১.মুসলিম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৯০
এ হাদীসের দ্বারা জানা গেল যে, নারীদের অকৃতজ্ঞতার প্রতিকার হলো দান-সদকা করা। অর্থাৎ নারীরা যার কারণে জাহান্নামের উপযুক্ত হবে, দান-সদকার দ্বারা তার প্রতিকার হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে দান-সদকা বড় বড় নেকী বা সাওয়াব এবং উত্তম আমলসমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যার কারণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি মিলতে পারে। প্রত্যেক আমলের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অর্থাৎ ঐ সমস্ত আমলের দ্বারা বিশেষ বিশেষ জিনিসের উপর প্রভাব পড়ে।
যেমন অধিক পরিমাণ
لاحول ولا قوة الا بالله
এর দ্বারা কষ্ট লাঘব হয়।
استغفار দ্বারা রিজিকের মধ্যে বরকত হয়। উত্তম আচরণের দ্বারা হায়াতের মধ্যে বরকত হয়। শোয়ার সময় সূরা মুলক তেলাওয়াতের দ্বারা কবরের আযাব থেকে মুক্তি মিলে।
জাহান্নামে মহিলারা যাবে বেশি
____________________
জাহান্নামে মহিলারা যাবে বেশি
عن عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَال َ إِنَّ أَقَلَّ سَاكِنِي الْجَنَّةِ النِّسَاءُ
হযরত ইমরান ইবনে হুছাইন থেকে বর্ণিত,নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, জান্নাতে বসবাসকারী মহিলা খুব কম হবে। অর্থাৎ পুরুষের তুলনায় মহিলারা জান্নাতে কম যাবে। ২৬২
২৬২.বুখারী, খণ্ড ২, পৃ. ৭৮৩, মুসলিম খণ্ড ২, পৃ. ৩৫২
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ يقول قالِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: اطَّلَعْتُ فِي الجَنَّةِ فَرَأَيْتُ أَكْثَرَ أَهْلِهَا الفُقَرَاءَ، وَاطَّلَعْتُ فِي النَّارِ فَرَأَيْتُ أَكْثَرَ أَهْلِهَا النِّسَاءَ
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, আমি জান্নাত দেখেছি, এতে আমি অধিকাংশ দরিদ্র লোক দেখেছি। আর আমি জাহান্নাম দেখেছি, এতে আমি অধিকাংশ মহিলা দেখেছি। ২৬৩
২৬৩.বুখারী, খণ্ড ২, পৃ. ৭৮৩, মুসলিম, খণ্ড ২, পৃ. ২৫২
অসংখ্য হাদীসে রয়েছে, নবী করিম (ﷺ) যতবারই জাহান্নাম পরিদর্শন করেছেন, ততবারই মহিলাদেরকে সেখানে বেশি পেয়েছেন। পুরুষের তুলনায় মহিলাদেরকে বেশি দেখা গেছে। প্রশ্ন হলো মহিলারা বেশি কেন? হাদীস শরীফে এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং ইরশাদ ফরমান, জাহান্নামে বেশি মহিলা হওয়ার কারণ হলো অসামঞ্জস্য কথাবার্তা বলা, অভিশম্পাত জাতীয় কথা বলা। কুৎস রটনা করা বিষাক্ত কথাবার্তা বলা। মনে যা চায় তাই যেখানে সেখানে বলে বেড়ানো, কুৎসারটনা বা গালি-গালাজ করার মধ্যে সকলকে সমান মনে করা, স্বামীর না-শোকরিয়া করা অতীতের কর্মকাণ্ড ঘেঁটে ঘেঁটে বের করে স্বামীর বদনাম করা। পান থেকে চুন খসে পড়লে ঝগড়া আরম্ভ করা, শান্তির জীবন কখনো পায়নি বলে বদনাম রটানো। মা ও বোনেরা! আর কখনো মুখ থেকে এ ধরনের কথাবার্তা বের করবেন না। এগুলো শয়তানের কাজ। এগুলো আল্লাহর ক্রোধকে ত্বরান্বিত করে জাহান্নামে নিয়ে যায়।
অধিকাংশ মহিলা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ
____________________
অধিকাংশ মহিলা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أُرِيتُ النَّارَ فَإِذَا أَكْثَرُ أَهْلِهَا النِّسَاءُ، يَكْفُرْنَ قِيلَ: أَيَكْفُرْنَ بِاللَّهِ؟ قَالَ: " يَكْفُرْنَ العَشِيرَ، وَيَكْفُرْنَ الإِحْسَانَ، لَوْ أَحْسَنْتَ إِلَى إِحْدَاهُنَّ الدَّهْرَ، ثُمَّ رَأَتْ مِنْكَ شَيْئًا، قَالَتْ: مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَطُّ
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর নবী (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, জাহান্নামে আমি মহিলাদেরকেই বেশি দেখতে পেয়েছি। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, এটা কেন হল হে আল্লাহর নবী ! হুজুর বলেন, অকৃতজ্ঞতার কারণে, জিজ্ঞেস করা হল তাহলে কি আল্লাহর না-শোকরিয়া করার কারণে। তারা সৌজন্যবোধের অকৃতজ্ঞতা এভাবে করে যে, তোমরা জীবনভর তাদের প্রতি এহসান কর অতঃপর কোন কারণে অখুশির কথা তথা অসন্তুষ্টিমূলক কোন কথা হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ বলে দেবে, আমি তার কাছে কখনো ভাল আচরণ পাইনি। ২৬৪
২৬৪.বুখারী খণ্ড. ২, পৃ. ৭৮৩
অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, হুজুর জাহান্নাম পরিদর্শনকালে এতে অধিকাংশ আরামপ্রিয় লোক ও মহিলাকে দেখতে পেয়েছেন। এর কারণ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বর্ণনা করেছেন, অধিকাংশ মহিলারা স্বামীর না শোকরিয়া করে থাকে। স্বামীর সারা জীবনের অনুকম্পা অল্পতেই ভুলে যায়।
মোটকথা, নিমক-হারামী ও অকৃতজ্ঞতা তাদের মধ্যে বেশি। মা ও বোনেরা মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। উপরিউক্ত দুটি বিষয় ছেড়ে দিন। আল্লাহ পাক আপনার ভাগ্যে যে ধরনের স্বামীই নির্ধারণ করেছেন তাতেই তুষ্ট থাকুন। স্বামী আপনাকে কষ্ট দিলেও ধৈর্য ধরুন এবং জীবন অতিবাহিত করুন। যাবতীয় আশা আকাক্সক্ষা দুনিয়াতে পূর্ণ হবার নয়। স্বামীর পক্ষ থেকে যা কিছুই পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকুন। ভুল করেও কখনো বলবেন না যে, কি পেলাম তোমার কাছ থেকে? ঘরে এসে আমার শান্তি হলো নাইত্যাদি। বরং বলুন, যা কিছুই পেলাম আল্লাহ পাক যা কিছুই দান করেছেন সবই ভালো। হে আল্লাহ! তোমার শোকরিয়া আদায় করছি। স্বামীকে বলুন, আপনি আমাকে যা দিলেন তাতো খুবই উত্তম। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এতে বেচারা স্বামী খুশি হবে এবং জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে না।
মহিলারা জাহান্নাম থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে?
____________________
মহিলারা জাহান্নাম থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে?
হযরত জাবের (رضي الله عنه) বলেন, এক ঈদে আমি নবী করিম (ﷺ) -এর সাথে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)আযান ইক্বামত ব্যতীত খুৎবা দেয়ার পূর্বে নামায আদায় করলেন। তারপর হযরত বেলাল (رضي الله عنه) -এর গায়ে হেলান দিয়ে ভাষণ দেয়া শুরু করলেন। ভাষণে হুজুর আল্লাহকে ভয় করতে এবং তাঁর আনুগত্য করার আদেশ করলেন। এভাবে তিনি পুরুষদের উপদেশ দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)মহিলাদের কাছে তশরীফ নিলেন এবং তাদেরকে নছীহত করতে গিয়ে বলেন, তোমরা দান-খয়রাত কর। কারণ তোমরাই জাহান্নামে বেশি যাবে। মহিলাদের পেছন থেকে একজন অতি দুর্বল (মহিলা) যার গালের চামড়া ঝুলে পড়েছিল সে বলল, হে আল্লাহর নবী (ﷺ)! তা কেন? রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বলেন, কারণ তোমরা মহিলারা বদনাম কর বেশি স্বামীর নাশোকরিয়া কর। তারপর মহিলারা নিজ নিজ অলংকার ছদকা করতে লাগল এবং হযরত বেলাল (رضي الله عنه) -এর কাপড়ের উপর কান বালা এবং আংটি ফেলতে লাগল। ২৬৫
২৬৫.মুসলিম খণ্ড. ১, পৃ. ২৯০
উল্লেখিত হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, মহিলাদের নাশোকরীর প্রতিকার যে সমস্ত কর্মের কারণে জাহান্নাম আবশ্যক হয়ে যায় ছদকা ফিতরার কারণে এগুলোর প্রতিকার হয়। ছদকা ফিতরা ঐ সমস্ত মহান কর্মের নেক আমল যেগুলো দ্বারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং নাজাত পাওয়া যায়। প্রতিটি কর্মেরই একটি প্রভাব রয়েছে। অতএব, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা পাঠ করলে অধিক চিন্তা বিদূরিত হয়।
ইস্তেগফারের দ্বারা আয় রুজিতে বরকত হয়। সদকার দ্বারা জীবনে নানা দিকে বরকত হয়। নিদ্রার সময় সূরা মূলক পাঠ করলে কবর আযাব লাঘব হয়। চাশ্ত নামায দ্বারা রুজিতে বরকত হয়। বেশি বেশি দরুদ পাঠে কিয়ামতের দিন নবী করিম (ﷺ) -এর অতি নিকটে থাকা যাবে। অনুরূপ দান খয়রাত দ্বারা আল্লাহর ক্রোধ শীতল হয়, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বিপদাপদ বিদূরিত হয়। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) কে গুরুত্বসহ বলেছেন, খেজুরের একটি আঁটি হলেও দান করে জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাক।
দুরা’কাত নামায পড়ে জাহান্নাম থেকে বাঁচুন -এ কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেননি। অবশ্য নামায গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মধ্যে গণ্য। এর সওয়াব অনেক। কিন্তু দান-খয়রাত বিপদাপদ মুসীবত এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষার এক বিশেষ প্রভাব। সুতরাং হাদীস শরীফে এসেছে, দান-খয়রাত ইত্যাদি সত্তরটি বিপদ দূর করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিপদ হল কুষ্ঠ রোগ থেকে রক্ষা করে।২৬৬
২৬৬.জামে ছগীর, পৃ.৩১৭
এক হাদীসে এসেছে যে, ছদকা গুনাহকে এমনভাবে নিঃশেষ করে দেয় যেমনিভঅবে পানি আগুনকে ধ্বংস করে দেয়। ২৬৭
২৬৭.তারগীব, খণ্ড ২, পৃ. ১১
আরেক হাদীসে এসেছে, ছদকা আল্লাহর ক্রোধকে প্রশমিত করে। ২৬৮
২৬৮.তারগীব, পৃ. ১২
অন্য হাদীসে এসেছে, ছদকা জাহান্নামকে শীতল করে দেয়।২৬৯
২৬৯.তারগীব, খণ্ড ২, পৃ. ২০
এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মহিলাদেরকে দান-খয়রাত করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর যুগের মহিলারা তা বুঝতে পেরে তারা তাদের অলংকারাদি দান করতে থাকেন।
বর্তমানে আমাদের সমাজের মহিলারা মোটেই দান-খয়রাত করতে চায় না। শয়তান চায় যে, মহিলারা জাহান্নাম থেকে না বাঁচুক। তাই সে তাদেরকে দান-খয়রাত করতে নানাভাবে বাধা দেয়। ছদকার কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। যাই হোক যতটুকুই হোক দান করা যায়। নিজের পড়নের কাপড় দান করা যায়। দান করার মত বস্তু নিজের কাছে না থাকলে স্বামীর কাছ থেকে হাওলাত নিয়ে হলেও দান করুন। এখন যাই হোক দান করুন কাল কিয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারবেন।
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়ার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে
____________________
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়ার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে
হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর খেদমতে এসে নালিশ করল যে, এক লোক যথেষ্ট পরিমাণ নামায রোযা আদায় করে। কিন্তু সে তার মুখ দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। হুজুর বলেন, সে লোক জাহান্নামে যাবে। ২৭০
২৭০.মিশকাত, পৃ. ৪২৪
প্রতিবেশীর অধকার রক্ষায় পবিত্র কুরআন ও হাদীসে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাবর্ণিত আছে। প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া তাদের অধিকার বিনষ্ট করার ব্যাপারে
সাবধানবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। এক হাদীসে রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম দু’জন প্রতিবেশীর মামলা উত্থাপন করা হবে। ২৭১
২৭১.তারগীব, পৃ. ৩৫৪
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরমান, যে ব্যক্তি প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া করল সে যেন আমারই সাথে ঝগড়া করল। ২৭২
২৭২.তারগীব, পৃ. ৩৫৬
অন্য হাদীসে হুজুর ইরশাদ করেন, জিব্রাইল আ আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে এতই তাগিদ দিচ্ছিলেন যে, আমার ভয় হচ্ছিল যে, না জানি প্রতিবেশীকে আমার ওয়ারিশ করে দেয়া হয়। প্রতিবেশীর সাথে খারাপ আচরণ কিয়ামতের লক্ষণ। ২৭৩
২৭৩.ইবনে আবু দানিয়া, পৃ. ২৩২
ইমাম গাযালী (رحمة الله) বলেন, প্রতিবেশীর হক এই নয় যে, কেবল তাদেরকে কষ্ট না দেয়া বরং তাদের হক তাও যে, তাদের কষ্ট সহ্য করা। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরমান, প্রতিবেশীর হক কি জেনে লও। আর তা হচ্ছে এই যে, তোমার কাছে তারা সাহায্য চাইলে সাহায্য কর, কর্জ চাইলে দাও।
প্রতি ৯৯ জন মহিলার মধ্যে একজন জান্নাতে যাবে
____________________
প্রতি ৯৯ জন মহিলার মধ্যে একজন জান্নাতে যাবে
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ من تسع وتسعين امرأة واحدة وبقيتهن فى النار
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে, ৯৯ জন মহিলার মধ্যে একজন মহিলা জান্নাতে যাবে, অবশিষ্ট মহিলা জাহান্নামে যাবে।২৭৪
২৭৪.কানযুল উম্মাল, পৃ. ১৬৫
হে আল্লাহ! আপনার নিকট আমরা পানাহ চাই। সম্মানিত পাঠক পাঠিকা দেখুন, হাদীসের মর্মানুযায়ী কি পরিমাণ মহিলা জাহান্নামে যাবে। অত্যন্ত শিক্ষনীয় বিষয় মহিলারা আলা ভোলা সহজ সরল হওয়ার কারণে জ্ঞান-বুদ্ধির স্বল্পতা এবং শরীয়তের বিষয়াদিতে দুর্বলতা হেতু মহিলারা শয়তানের জালে আটকে গিয়ে জাহান্নামের উপযোগী হয়ে যায়। গুনাহর অনুভূতিই তাদের হয় না। আবার তারা খাঁটি দিলে তওবাহও করে না। অধিক সময় নেক কাজের পরিবর্তে পাপের কাজে অধিক মনোযোগী হয়ে যায়। যে সমস্ত কাজের কারণে মহিলারা গুনাহগার হয় সেগুলো আমরা এখন আলোচনা করব। সুতরাং বর্ণিতব্য বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে এবং কার্যে পরিণত করলে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবে।
১। জ্যোতিষের গণনা এবং গণকের কাছে গিয়ে গণনা করানো। যারা এ সমস্ত বিশ্বাস করে তাদের ঘরে কোন প্রকার বরকত হবে না। যে সমস্ত মহিলার প্রতি স্বামী অসন্তুষ্ট থাকে, স্বামীকে বশে আনতে শরীয়ত বিরোধী নানা তাবিজ ও তন্ত্রমন্ত্র বিশ্বাস করে। এ ধরনের কাজ কারবার সরাসরি হারাম। তাবিজ ব্যবসায়ীরা নাকি গায়েব জানতে পারে। মানুষের কাছ থেকে তারা টাকা পয়সা গ্রহণের জন্য নানা ভেলকি বাজি করে বেড়ায়, ধোঁকা দেয় মানুষকে বিশেষ করে মহিলাদেরকে সর্বনাশ করে ছাড়ে।
২। প্রতিটি বিপদে মুছিবতে জিন-ভূত ইত্যাদির প্রভাব আছে বলে মনে করা। এগুলো ছাড়া ভণ্ড পীর ফকিরের আশ্রয় নেয়া এবং তাদের কাছ থেকে ইসলাম পরিপন্থী নানা উপকরণ গ্রহণ করা।
৩। যে কোন কাজ সমাধান করতে যাদু-টোনা টুটকা চিকিৎসা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজে বিশ্বাস করা। আল্লাহ না করুন, এ ধরনের অপ্রত্যাশিত কাজের সম্মুখীন হয়ে গেলে এ বিষয়ে যে সমস্ত নেককার লোক অভিজ্ঞ তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে যে সমস্ত দোয়া কালাম ও নিয়ম-নীতি আছে সেগুলো প্রয়োগ করায় দোষ নেই। ভণ্ড ধোঁকাবাজ ও শরীয়তের ধার ধারে না, এ ধরনের সর্বনাশা লোকদের খপ্পরে পড়ে এদের বিশ্বাস করে ঈমান ধ্বংস করা যাবে না। এ ব্যাপারে মহিলারাই বেশি উৎসাহী ও আগ্রহী। তারা ভণ্ড পীর-ফকিরদের প্রতি বেশি দুর্বল।
৪। মহিলারা প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে পান থেকে চুন খসে পড়লেই ঝগড়ার সূচনা ঘটায়। স্বাভাবিক কথা-বার্তা বন্ধ করে দেয়, একে অপরকে দেখলে সহ্য করতে পারে না। অথচ জাগতিক ও প্রবৃত্তির কারণে এক মুমিন অপর মুমিনের সাথে তিন দিনের বেশি সালাম কালাম কথাবার্তা ছেড়ে দেয়া জায়েজ নেই। বুখারী শরীফে হযরত আবু আইয়ূব আনসারী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে, কোন মানুষ তার অপর ভাইয়ের সাথে তিন দিন ধরে কথাবার্তা বন্ধ করা জায়েজ নেই। দেখা-সাক্ষাৎ হলে একে অপরকে এড়িয়ে যাওয়া মোটেও কাম্য নয়। তাদের মধ্যে সেই উত্তম যে অগ্রে সালাম করে। ২৭৫
২৭৫.বুখারী খণ্ড ২, পৃ. ৮৯
৫। অভিশাপ, কুৎসা রটনা ইত্যাদি স্বাভাবিক বিষয় অল্প কথায় লা’নত দিতে থাকে, কুৎসা রটনায় লেগে যায় এবং এক পর্যায়ে ঝগড়া আরম্ভ হয়ে যায়। তাদের এই নোংরা কাজের ফলাফল শেষ পর্যন্ত এ রকম হয় যে, তাদের সন্তানদের মধ্যে গিয়ে গড়ায়। মারা-মারি, হত্যা, জেল জরিমানা এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। নিষেধ করলেও বিরত হয় না। উল্টো আরো বলে, আমার মনে যা চায় তাই করব। এতে তোমার নাক গলানোর অধিকার নেই। মনের ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে জাহান্নামে চলে গেলে কারো কিছু বলার আছে কি? বা কেউ তাদেরকে এ রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনবে কি? তাই সাবধান! সামাজিকভাবে একে অপরের সাথে মনোমালিন্য ঝগড়া ইত্যাদি অধিকাংশ হয় মহিলাদের কারণে। আর মহিলারা এ সুযোগটা পেয়েছে বেপর্দা থাকার কারণে। মহিলারা শরীয়ত মত পর্দা করলে আর কোন সমস্যা থাকবে না বলে মনে করি।
৬। মহিলারা বেশির ভাগই নামাযের ধার ধারে না। কখনো সন্তানের বাহানা, কখনো বানোয়াট বাহানা ও রান্না-বান্নার বাহানা দিয়ে নামায থেকে বিরত থাকে। আবার পড়লেও সময়ের প্রতি মোটেও লক্ষ্য রাখে না। নামায যেন তাদের কাছে একটা বোঝা। ওয়াক্ত চলে যায় যায় এ সময় কাজও প্রায় সমাপ্তির পথে। একটু জিরিয়ে নেয়ার দরকার, তাই নামাযটাকে জিরিয়ে নেয়ার উপকরণ হিসেবে আদায় করে। আযান দিলেই নামায আদায় করে নেয়া কর্তব্য। দেরী করলে মাকরূহ বা কাযা হয়ে যেতে পারে।
৭। মহিলারা সাধারণত ফজরের নামায আদায় করে না। আবার আদায় করলেও কাযা আদায় করে থাকে। অধিক রাত জেগে থেকে শয়ন করে এবং সকালে জাগ্রত হয় দেরীতে। কোন কোন সময় সূর্যোদয় পর্যন্ত হয়ে যায়। আফসোস! হাদীস শরীফে রয়েছে, এ সময় যারা ঘুম থেকে জাগ্রত হয় শয়তার তাদের কানে পেশাব করে। কোন কোন মহিলা এমন সময় ফজরের নামায আদায় করতে যায় যখন সূর্যোদয় হতে থাকে। অধিকাংশ মহিলা ফজরের সময় হল কি হল না এদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করে না। ব্যাস, পড়লেই হল। নামায হল কি হল না এদিকে চিন্তা করার ফুরসতও নেই।
৮। মহিলারা সাধারণত অলংকাররাদির কারণেই যাকাতের উপযোগী তথা সাহেবে নিসাব হয়ে থাকে। বর্তমানে চার হাজার টাকার অলংকার হলেই নিসাব পূর্ণ হয়ে যায়। এতদ্ব্যতীত অলংকারের যাকাত হয় না। এর আরেকটি কারণ এ হতে পারে যে, অধিকাংশ সময় তাদের হাতে টাকা -পয়সা হয় না। শরীয়ত মত এ অসুবিধাটি গ্রহণযোগ্য নয়। এ গুরুত্বপূর্ণ ফরজটি আদায়ের জন্য কিংবা স্বামীর কাছ থেকে হাওলাত নিয়ে কিংবা স্বামীকে এ কথা বলে যে, এই পরিমাণ অলংকারের যাকাত দেয়া আবশ্যক। যেমনিভাবে অন্যান্য বস্তু স্বামীর নিকট চাওয়া হয়। যাকাতের ন্যায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আদায় করার জন্য স্বামীর কাছে চেয়ে হলেও আদায় করা কর্তব্য। এ ব্যাপারে স্বামী তার কথায় কর্ণপাত না করলে এ ফরজ কাজটি সম্পাদনের জন্য এবং গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য কিছু অলংকার বিক্রি করে হলেও যাকাত আদায় করতে হবে। কিংবা নির্ধারিত পরিমাণের চাইতে কমিয়ে ফেলা উচিত। অথবা কন্যা বা অন্য কাউকে এর মালিক বানিয়ে দেয়া কর্তব্য। অথবা বিক্রি করে নিজের প্রয়োজনে টাকাগুলো খরচ করে ফেলবে।
৯। ধন-সম্পদ বা অলংকারাদির কারণে মহিলারা সাহেবে নিসাব হওয়া সত্ত্বেও কুরবানী করে না। অথচ সাহেবে নিসাব হওয়াতে কুরবানীর এক অংশ ওয়াজিব হয়ে যায়। এ ধরনের সংকীর্ণতার আরেকটি কারণ তাও হতে পারে যে, মহিলাদের হাতে নগদ অর্থ-কড়ি থাকে না। এতে কুরবানীর দায় থেকে অব্যাহতি পাবে না, যাকাতের ফরজিয়াত থেকে মুক্তি পাবে না।
১০। হায়েয এবং ইস্তেহাযা (নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত জরায়ু থেকে রক্ত বের হওয়া) সম্পর্কে নিয়ম বিধি না জানার কারণে অনেক সময় প্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। ঋতুশ্রাব ব্যতীত ইস্তেহাযার রক্ত বের হতে থাকলে মহিলারা সাধারণত নামায আদায় করে না, এভাবে তারা কত ফরজ থেকে বিরত থাকে তার ইয়ত্তা নেই। অথচ হায়েজ ব্যতীত ইস্তেহাযার রক্ত বের হলেও নামায মাফ নেই। নিজে এই মাসয়অলা না জানলে বিভিন্ন ইসলামী ফিকহ গ্রন্থ থেকে জেনে নেয়া যেতে পারে কিংবা কোন আলেমের নিকট থেকে তা জেনে নেয়া যেতে পারে। এতে লজ্জার কিছু নেই। এ লজ্জা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।
১১। মহিলারা সাধারণত অপবিত্রতার গোসল বিলম্বে করে থাকে। এমন কি নামাযও কাযা হয়ে যায়। সুতরাং রাতের বেলা কোন কারণে অপবিত্র হয়ে গোসল করা জরুরী হয়ে গেলে প্রত্যুষে গোসল করে না এবং ফজরের নামায পড়ে না বরং দিনের বেলা গোসল করে। সময় মত নামায না পড়ে কাযা করে ফেলা কবিরা গুনাহ। গোসলের প্রয়োজন হলে সকাল সকাল গোসল করে ফজর পড়ে নেয়া উচিত। গোসলের প্রয়োজনীয় উপকরণাদি আগে থেকে প্রস্তুত রাখা ওয়াজিব। ঠাণ্ডা পানি দ্বারা গোসল করা ক্ষতিকর হলে গরম পানির ব্যবস্থা করা আবশ্যক। তাহলে সময় মত নামায পড়া যাবে।
১২। কয়েকজন মহিলা একত্রিত হলে তারা একে অপরের কুৎসা রটনা, অপরের বদনাম, নানা ধরনের দোষ ত্রুটি খুঁজে থাকে। এটা গুনাহের কাজ। কারো সামনে যা বলা যায় না সে কথাটি তার অগোচরে বলা অত্যন্ত দোষণীয়। অপরের গীবত করা পবিত্র কুরআনে মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খাওয়ার মত জঘন্য কথা বলা হয়েছে। গীবত মায়ের সাথে ব্যভিচার করার চাইতে জঘন্য অপরাধ। মহিলাদের উচিত তারা যেন একে অপরের কুৎসা রটনা না করে এবং অপর কেউ করলেও তাতে বাধা দিবে। কোন মহিলা করলেও সেখান থেকে উটে যাবে। এ ধরনের কাজ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা এটা পাপের কাজ।
১৩। ঝগড়-ঝাটির বিষয়টা মহিলাদের মধ্যে বেশি হয়। সামান্য কথাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। ঝগড়া-ফ্যাসাদ অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। এগুলো এড়িয়ে যাওয়া কর্তব্য।
১৪। যে স্বামীর অধীনে থেকে জীবন চলে যায় তার সম্মান করা ওয়াজিব। তার প্রতি মুখভার করা হয়, স্বামীর কোন প্রশ্নের জবাব তো দেয়ই না অধিকন্তু উল্টো ঝগড়ায় লেগে যায়। স্বামী কোন কষ্টের কথা বলে ফেললে ঝগড়া না করে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। হ্যাঁ, ভদ্রতা বজায় রেখে এক সময় বলবে যে, আপনার অমুক কথাটি ঠিক হয়নি। আমি কি ঠিক বলিনি? এমন কথা বলতে নেই যে, মনে আঘাত লাগবে। এতে করে স্বামীর মনেও বিষয়টি সম্পর্কে বুঝে আসবে। তাহলে স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসায় চির ধরবেনা।
১৫। অধিকাংশ যুবতী মহিলাই নামাযের ধার ধারে না। জীবনের একটি মহামূল্যবান অংশ চলে যাবার পর নামাযের কথা স্মরণ হয়। মূর্খতার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। বালেগা হওয়ার পূর্ব থেকেই নামায আরম্ভ করা উচিত। আর বালেগা হওয়ার পর তো নামায পড়া ফরজই হয়ে যায়। আগে থেকেই অভ্যাস না থাকলে বালেগা হওয়ার পরও নামায পড়তে চায় না।
১৬। যে সমস্ত মহিলা নামায পড়ে তারা ভ্রমণাবস্থায় নামায ছেড়ে দেয় কিংবা কাযা করে। মনে রাখবেন, ভ্রমণাবস্থায় নামায কাযা বা ছেড়ে দেয়া জায়েজ নেই। পর্দা করে ওযু করুন। রেলগাড়ীতে ভাল করে ওযু করা যায়। মারাত্মক কোন অসুবিধা না থাকলে নামায কাযা করা কবীরা গুনাহ।
১৭। মহিলারা সাধারণত কৃপণ হয়ে থাকে। টাকা পয়সা কাপড় চোপর ইত্যাদি যত্ন করে রেখে দেয়। কিন্তু কোন অভাবগ্রস্তকে বা ফকির মিসকিনকে প্রয়োজনের সময় দেয় না। দান-খয়রাত করা, অপরকে সহায়তা করা আবশ্যক। অতটুকুও না করা কৃপণতা এবং জাহান্নামে যাবার কারণ।
১৮। ভুল হয়ে গেলে বা কারো অধিকার বিনষ্ট হয়ে গেলে ক্ষমা চাওয়া লজ্জা মনে করে। আপনার পক্ষ থেকে কেউ কষ্ট পেলে বা তার অধিকারে হস্তক্ষেপ হয়েছে তাহলে সত্বর তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তাহলে কিয়ামতের দিন এভাবে জিজ্ঞাসিত হবেন না।
১৯। কোন প্রকার পাপ কিংবা আল্লাহর নাফরমানী হয়ে গেলে লজ্জিত হওয়ার কিংবা ইস্তেগফার করতে লজ্জাবোধ করা হয়। তা বোকামী। নামায পড়ে আল্লাহর নিকট অতি সত্বর ক্ষমা চাওয়া আবশ্যক। মনে রাখবেন, কোন গুনাহ হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি তওবাহ করুন। নামায পড়ে ক্ষমা চান। কিয়ামতের দিন কবীরা গুনাহ থেকে না বাঁচার কারণে জাহান্নামে যাওয়ার উপযোগী হয়ে যায়।
মায়ের অধিকার নষ্ট করে স্ত্রীর কথামত কাজ করা কিয়ামতের লক্ষণ
____________________
মায়ের অধিকার নষ্ট করে স্ত্রীর কথামত কাজ করা কিয়ামতের লক্ষণ
হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, আমার উম্মতের মধ্যে যখন ১৫টি কাজ হতে লাগল তখনই তাদের উপর নানা প্রকার বিপদাপদ আসতে লাগল। জিজ্ঞেস করা হলো, সেগুলো কি হে আল্লাহর রাসূল ! তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বলেন-
১.গনীমতের মালকে যখন নিজের ভাবতে শুরু করেছে।
২.আমানতের মালকে গনীমতের মাল ভাবতে শুরু করেছে।
৩.যাকাতকে যখন বোঝা ভাবতে শুরু করেছে।
৪.মাকে বাদ দিয়ে স্ত্রীর কথা মত চলা শুরু করেছে।
৫.পিতার সাথে অসৎ আচরণ করে বন্ধুর সাথে সুন্দর আচরণ শুরু করেছে।
৬.মসজিদসমূহে উচ্চ আওয়াজে কথাবার্তা শুরু হয়েছে।
৭.গোত্রের নেতৃত্বে আসবে চরিত্রহীন লোক। কারণ তার অশুভ থাবা থেকে বাঁচতে লোক তার আনুগত্য করবে।
৮.মদ হয়ে যাবে অতি সাধারণ বিষয়।
৯.রেশম ব্যবহার করা হবে।
১০.গায়িকা হবে অনেক।
১১.মানুষের অনুপস্থিতিতে একে অপরের কুৎসা রটনা করা হবে। ২৭৬
২৭৬.তিরমিযি, খণ্ড ২, পৃ. ৪৪
আর এ সময় জমিন ধসে যাবে। এবং তখন চেহারা বিকৃতির জন্য অপেক্ষা কর। আজকাল অনেকেই পিতা-মাতার মোকাবেলায় এমন কি আল্লাহ ও রাসূলের মোকাবেলায় স্ত্রীর গোলামী করে। পিতা-মাতার প্রতি অবিচার করা হলেও তাতে কিছু এসে যায় না। স্ত্রীর যাতে কোন কষ্ট না হয় সেদিকে নজর থাকে ভাল। স্ত্রীর হক আদায় করতে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। ইসলাম এটাকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু গোলামী করার কথা কেউ বলেনি। বরং পিতা-মাতার গোলামী করার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং তাই করতে হবে।
আধুনিক নারী বনাম নারীর আধুনিকতা
____________________
আধুনিক নারী বনাম নারীর আধুনিকতা
নারীরা স্বাভাবিকভাবে একরূপে অবস্থান করে। কিন্তু যখন নিজের সৌন্দর্যকে অতিরিক্ত সুন্দর করতে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনীর প্রলেপ মেখে অন্যের চোখে নিজেকে সুন্দরী হিসেবে পরিস্ফুট করে তুলতে চায় আর এই প্রবণতা বর্তমান থাকে তাহলে তা ধ্বংসমুখী ফলদান করে।
এভাবে নিজেকে ফুটিয়ে তোলা জাহির করে তোলা আর একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার মানসিকতাই হলো বর্তমান নারীকে সমাজের আধুনিকতার হিড়িকে বর্তমান ফ্যাশনে গা ভাসিয়ে দিতে নারীরা কুণ্ঠাবোধ করে না। এই অদূরদর্শিতার ফলে সে যে পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয় সেটা কেউ আঙ্গুল উচিয়ে দেখিয়ে দিলেও নারীরা সে পথ থেকে সরে আসতে লজ্জাবোধ করে। এরা হতে চায় অগ্রগামিনী বাধা-বন্ধনহীন দিগন্তের মুক্ত বিহঙ্গ। সম্মুখে চলার নেশায় ভেঙ্গে যায় সংসার। নিছক দুনিয়াদারীর দাবী আদায়ের জন্য মন-মানসিকতার আদি সংগঠনকে বিশৃংখল অবস্থায় ঠেলে দেয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করার সুযোগ দিয়ে নিজেরা বেছে নেয় কিছু হীন নিয়ম-নীতি। ভেসে চলে নষ্ট আবর্জনার স্রোতে।
নারীদের সৌন্দর্য রূপচর্চা কেবল সে পুরুষের জন্য যে তার প্রকৃত বন্ধু কর্তা এক কথায় যিনি স্বামী। যার উপর নারীর অর্ধেক অধিকার রয়েছে। আর সে নারীর ওপর যার অর্ধেক অধিকার। কিন্তু নারী যখন তার রমণী বেশ অধিকতর আকর্ষণীয় করে ক্লাব, পার্টি মেলা-খেলার নামে সকল পুরুষের সাথে হাসি তামাশায় মত্ত হয়ে যায় তখন সে বেহায়াপনাকে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হবে। একজনের হাতা কাটা ব্লাউজ দেখে অন্যজন নিজেকে আরো উজ্জ্বলতর করতে হাফ বুক পিঠ বের করে রাখবে। চুলে মৌতাত গন্ধের শ্যাম্পু। ফুরফুরে হাওয়ায় উড়বে মসৃণ সোনালী কেশ। গণ্ডদেশে পাউডারের প্রলেপে মণির সুবাস। অধরে লাল টকটকে পালিশ, আকর্ষণীয় কর্ণ কুসুম আর কণ্ঠের হার।
মস্তকে উটের পিঠের মত কুজোঁ করে বাঁধবে চুল। বসাবে হরেক রকমের ক্লিপ ব্যান্ড, প্রজাপতি। চরণে হাই হিল। হেলে দুলে হাঁটবে কাড়বে পুরুষের মন। তার পেছনে লাগবে বেশ কয়েকজন ছেলে। বন্ধুু-বান্ধবীর কাছে হেসে হেসে বলবে তারই গাল-গল্প। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, দোযখীদের দুটি প্রকার আমি দেখে যেতে পারিনি। সে সব নারী যারা পোশাক পড়েও উলঙ্গ হবে এবং গর্বিত ভঙ্গিমায় কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে অপূর্ব চালে চলবে। তাদের মস্তক উটের পিঠের নমনীয় কুঁজের মত হবে। (অর্থাৎ মাথায় কৃত্রিম কেশ সংযোজন করে উঁচু খোপা বাঁধবে) এ কারণে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। বরং জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি অনেক দূর থেকেও পাওয়া যাবে। ২৭৭
২৭৭.মুসলিম
ইসলাম চির আধুনিক, চির উন্নত জীবনবিধান। সব যুগের সাথে শতাব্দীর সাথে তাল মিলিয়ে চলার অধিকার একমাত্র ইসলামই রাখে। অথচ এ সম্বন্ধে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান নবী রাসূল, ওলি-আউলিয়া মহিয়ষী নারীগণ এবং তাদের আদর্শ সম্বন্ধে জানার, তাদের সম্বন্ধে আলোচিত বই-পুস্তক পড়ার চেয়ে সিনেমার নায়ক-নায়িকা ও রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাসের প্রতি আগ্রহ অনেক গুণে বেশি। বর্তমান যুগের আধুনিক শিক্ষিতা নারীরা আরবি ভাষা পড়তে জানে না, কুরআন পড়তে জানে না। মনে করে ওসব পড়ে সার্থকতা কি? এর চেয়ে বায়োলজি কেমিষ্ট্রি মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করা ভাল। কারণ তারা এটাও জানে না যে, সৃষ্টি জগতের সবকিছুই কুরআনে সন্নিবেশিত আছে। হাদীস পড়ে সময় নষ্ট করতে চাইবে না। রাত জেগে আল্লাহর ইবাদতের কথা শুনলে চোখ কপালে উঠতে পারে। তবে রাত জেগে চুপি চুপি ব্লু-ফিল্ম নায়ক-নায়িকার বস্ত্রহীন শরীরের সুকীর্তি দেখতে নয়নে সুপ্তির লেশও আসবে না। প্রতিবেশী আর বান্ধবীদের সাথে পাল্লা দেয়ার ফলে আলনায় আটবে না পোশাক, বক্সে আটবে না রকমারি গহনার সাজ-সরঞ্জামে ড্রেসিং টেবিলের সামনে জড়ো হবে বিশ্বের দামী প্রসাধনী। অথচ নবী করিম (ﷺ)এর উক্তি- কোন ব্যক্তির ইসলামী জীবনের সৌন্দর্য হচ্ছে এই যে, যা তার প্রয়োজনীয় নয় তা পরিত্যাগ করা। ২৭৮
২৭৮.তিরমিযি
চাকরির ক্ষেত্রে হোক আর সিনেমা বিজ্ঞাপনের হোক তাতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া আধুনিক নারীরা গর্বের ব্যাপার মনে করে। সে পেশার প্রকার যাই হোক না কেন। পোশাক খোলা-খুলি হবে যতটা পারা যায়। প্রথমে হয়ত মৃদু আপত্তি থাকে তারপর কিছুই থাকে না। যদিও মেয়েদের উপর বহিরাঙ্গনের কর্তব্য চাপানো হয়নি। তারা জ্ঞানার্জন দাওয়াতী সাহায্য-সহযোগিতা নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতি অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন হলে বাইরে যেতে পারে। তবে পুরুষের সাথে কাজ করাটাতো পরম আনন্দ উল্লাস আর চরম স্বাধীনতা নয়। নিজেকে খোলাখুলিভাবে সহস্র পুরুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার মনোভাবও ঠিক নয়। মেয়েদের সাজ-সজ্জায় নিষেধ করা হয়নি। তাই বলে কড়া সেন্টে ডুবে ডানা কাটা পরী সেজে গল্প কবিতা নাটক করে ছেলেদের সাথে মশকরা কোন ক্রমেই বৈধ হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “তোমরা গৃহে অবস্থান করবে। আর পূর্বের জাহেলি যুগের ন্যায় নিজেদের সাজিয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করবে না। তোমরা নামায কায়িম করবে যাকাত আদায় করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকবে।” ২৭৯
২৭৯.সূরা আহযাব, আয়াত-৩০
হায়রে নারী মায়ের জাত
____________________
হায়রে নারী মায়ের জাত
বর্তমান নারী সমাজ আরেকটি বিষয়ে জঘন্য অনুকরণ শুরু করেছে। আর তা হচ্ছে ছেলেদের পোশাক। নিজেকে বিলিয়ে এরা পরের ধাঁচে নিজেকে গড়ে নিজস্ব সত্তাকেও বিলিয়ে দিচ্ছে। অথচ কোন পুুরুষ মেয়েদের পোশাক পড়ে বাইরে দেখাতে যায় না।শাড়ী ব্লাউজ অথবা সালোয়ার কামিজ পড়ে ঘোরে না। অথচ এ যুগের বুদ্ধিমতী রমনীগণ পুরুষের পোশাক পরে পুরুষ সেজে যে লজ্জাহীনতা ও হীনমন্যতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে তা সত্যিই অতি দুঃখজনক। অথচ নারীদের জন্য পুরুষের মত জুতা পরিধান করা এবং পুরুষের বেশ ধারণ করা হারাম। এ ধরনের নারীর উপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অভিশম্পাত করেছেন।
বর্তমানে এরা আবার সস্তা অধিকার আদায়ের জন্য ময়দানে নেমেছে। আন্দোলন করছে, মিছিল করছে। তারা এমনও বক্তব্য দিচ্ছে যে, শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার। এদের যে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে হয়ত ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে যে, সে নাস্তিক। আল্লাহকে বিশ্বাস করে না। তার কাজে ভাগ্য কোন ফ্যাক্টর নয়। পরিশ্রমে ভাগ্য গড়া যায়। বিবাহ প্রথার অবমাননা করে বলে বিবাহ দ্বারা মানুষ শৃংখলিত হয়। পুরুষের দাসীতে পরিণত হয়। কি বিচিত্র কথাবার্তা! আন্দোলনকারীরা জানে না যে অধিকার আদায়ের নামে তারা মাঠে নেমেছে সেটা বেহায়াপনা ও যৌন স্বাধীনতা ছাড়া আর কি হতে পারে? ফলস্বরূপ আমাদের চোখে দেখতে হচ্ছে বিচিত্র ও বিভিন্ন ধরনের ব্যভিচার দৃশ্য। এভাবে চলতে থাকলে অবাধ মেলামেশার ফলে আমাদের সোনার বাংলাদেশ একদিন পিতৃপরিচয়হীনজারজ সন্তানে ভরে যাবে।
নারীর স্বেচ্ছাচারিতার সামগ্রিক ফলস্বরূপ ধ্বংস হয়ে যাবে একটি দেশ। ধ্বংস করার ব্রত খুঁজছে। নরের সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়েছে। করছে আঘাত। স্বাভাবিকভাবেই সে মর্মপীড়ায় পীড়িত। এ কারণেই তারা অফিস কক্ষের কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন করতে পারবে না। এক ফাইলের সই দিবে অন্য ফাইলে। চোখে ভুল ধরা পড়বে না। কেননা পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে কাছে পেতে চায় আর সে স্ত্রী যদি তখন পার্টিতে ক্লাবে চাইনিজ রেস্তোরাঁয় অবস্থান করে তখন একজন পুরুষের সুন্দরতম মানসিক অবস্থার বিঘ্ন ঘটবেই। কিন্তু একথা বর্তমান যুগের নারীদের বলতে গেলেই তারা নিজের পরাধীনতার কথা তুলবে। বলবে, এই পুরুষটির জন্যই জীবনে সুখ হল না। এহেন মনের পরিস্থিতিতে একজন নর নারীকে ছেড়ে পর নারীর কাছে যেতে চাইবেই। একজন নারীর জন্য তার স্বামী হতে পারে ঘরমুখী অথবা পরমুখী। আর নারী ‘শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার’ শ্লোগান তুলে যাবে অন্য একজন পুরুষের কাছে। বিচিত্র কিছুই না অথচ নিয়মিত যাতায়াত শুরু করতে জুলকিনা চালিয়ে গেলে মিছিলের সহকারিণীরই জানালার শিক ঘরে উঁকিঝুঁকি মারবে। ফিস ফিস করবে। নিশ্চয়ই এটি বেশ বড় সাফল্য! অথচ যে দেহ আমার আমার বলে বেড়াচ্ছো ভেবে দেখেছো কি এর শেষ পরিণতি কি? ইদানীং নারী সহকর্মিনী বাদ দিয়ে সবল সবল পুরুষদের সাথে মাঠে নামছে অধিকার আদায়ের প্রশ্নে। অথচ এক সময় এমন হবে যে, এ গর্বের তনুখানা কতগুলো ব্যাকটেরিয়া ঝাঝরা করে করে খাবে। কিন্তু এ চিন্তা করার সময়ও তো নেই। এক ঘরে মৃতের আত্মীয়-স্বজনরা রোদন করছে। অপর দিকে চলছে আধুনিক নৃত্য সংগীত। এরা ধর্মের বিধানকে সাম্প্রদায়িকতায় বিধৌত করে নতুন মানবধর্ম তৈরি করছে। ইসলাম সম্বন্ধে মুখে বিছমিল্লাহ উচ্চারিত হলেও এরা স্বীকার করে না। বিশ্বাস করে না অন্তরে। আর আমল? সে তো আধুনিক ফ্যাশনের নিকট লজ্জিত। এদের মুখে কানে সেই গান যাতে হৃদয়ে প্রেমের গদ্য রচিত হয়। প্রেমিকের তরে উঠে আহাজারী। দেশীয় গান দিয়েও এরা ক্ষান্ত হয় না। উর্দূ হিন্দি অথবা বিচিত্র সুরের ইংরেজি গান। সাথে চলে ডিসকো-নর্তন আর কুর্দন। বিভিন্ন ধরনের তাল সামলাতে না পেরে চলে যায় বিচিত্র আরেক জগতে। সেখানে কেবল রূপ আর বস্ত্রের প্রদর্শনী নয় সাথে চলে শরীর প্রদর্শনী। নারীর শরীরী ঢেউয়ের দোলায় পুরুষের জিভে জল ঝরুক, গন্ধ নিয়ে খাওয়ার স্বাদ মিটাক অথবা নিরুপায় হয়ে হাইজ্যাক, কিডন্যাপ কিংবা ব্যর্থ হয়ে এসিড ছুড়–ক। আধুনিক মডেলের নারীরা যদি তাই না চায় তাহলে রাস্তার পুরুষকে খুশি করতে প্রসাধনী ফার্স্ট ক্লাশ হতে বিউটি পার্লারে ঘন ঘন যাতায়াতই বা হবে কেন? স্বামী বা পিতার নিকট হতে মেয়েরা এই অর্থ আদায় করে থাকে। আর সেই অর্থ দিয়ে অন্য পুরুষকে দেখানোর জন্য নারী হয়ে অন্য নারীকে সৌন্দর্যে টেক্কা দেয়ার জন্য রূপচর্চার প্রতিযোগিতায় এরা অহর্নিশি অর্থ অপব্যয় করে থাকে। কিন্তু এগুলো বড়জোর কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। নতুন করে সাজতে হয় আবার। একজন অবিবাহিতা অথবা বিবাহিতা নারীর কয়েকজন পুরুষ বন্ধু অথবা প্রেমিকা বুকে হাত দিয়ে কেউ কি বলতে পারবে কোন পুরুষ সে নারীর শরীরের কোন অংশে তার হাত অথবা মুখ লাগায়নি। অবৈধভাবে কাউকে ভালোবাসতে গেলে সে নারী এঁটো হয়ে ফিরবেই। নবী করিম বলেছেন- হালাল নয় এমন কোন নারীর সাথে টক্কর খাওয়ার চেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত কর্দমায় জড়িত শূকরের সাথে টক্কর লাগাও অধিক সহনীয়।২৮০
২৮০.তিবরানী, আবু উমামা, সূত্র. জান্নাতি রমণীর গুণাবলী
নারী স্বাধীনতার কুফল
____________________
নারী স্বাধীনতার কুফল
পশুর মত অবাধ যৌনাচার ও ব্যভিচার যে বেহায়াপনা ও নারী স্বাধীনতারই ফল এ বাস্তর সত্য কেউ অস্বাীকার করতে পারবে নাকি? এটা যে মানবতা বিধ্বংসী পশুসুলভ কারবার একথ স্বতঃসিদ্ধ। ব্যভিচারের কুফল স্বরূপ ব্যক্তি সমাজ দেশ ও জাতি সবার সর্বনাশ ও অপমৃত্যু ঘটে এটা ইতিহাস পরীক্ষিত সত্য। তাই সৃষ্টির আদিকাল থেকে দুনিয়ার কোন নবী-রাসূল, মহামনীষী জ্ঞানী-বিজ্ঞানী বুদ্ধিজীবী কেউ ব্যভিচারের অনুমতি দেননি। অনুমতি দিয়েছে শুধু তথাকথিত মানবতা ও সভ্যতার ধ্বজা ধারী বর্তমান পাশ্চাত্য সমাজ। কিন্তু এর মারাত্মক পরিণতির শিকার হয়ে এখন তাদের হুঁশ হয়েছে এবং আত্মরক্ষার পথ খুঁজছে। ততক্ষণে তাদের সমাজ এমন বেসামাল হয়ে পড়েছে যে আত্মরক্ষার কোন পথ না পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দুর্গতির অতল সাগরে নিমজ্জিত করতে চাচ্ছে। আমাদের সংসারে তারা আগুন জ্বালাতে চাচ্ছে।
আজ যারা পুরুষের অধিকারে অর্ধেক ভাগ বসাতে হর-হামেশা চিল্লা চিল্লি করছে তারা যে মহালম্পট ও ইতর প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট তা তাদের কথার মধ্যেই পাওয়া যায়। কেননা তারা কি জানে না নারী ও পুরুষের মধ্যে দৈহিক দিক দিয়ে মানসিক দিক দিয়ে গুণ ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে কত পার্থক্য বিদ্যমান? এসব পার্থক্য ঘুচানোতো কোনক্রমেই সম্ভব নয়। যদি সম্ভব না হয় তবে নারী পুরুষের অধিকার ও কর্তব্য সমান হবে কেমন করে, কোন যুক্তিতে? শরীর বিজ্ঞানীগণ বিশ্লেষণ করে নারী ও পুরুষের মধ্যে যেসব পার্থক্য দেখতে পেয়েছেন তা নিম্নরূপ:
১. নারীর শরীর অন্তধর্মী এবং পুরুষের শরীর ক্ষারধর্মী।
২. নারী শরীর চুম্বকধর্মী আর পুরুষের শরীর বিদ্যুৎধর্মী।
৩. নারীর শরীর স্থিতিশীল ও রক্ষণশীল আর পুরুষের শরীর অস্থিতিশীল অরক্ষণশীল।
৪. সাধারণত পুরুষের দৈহিক গড় ওজন ১৪০ পাউণ্ড এবং নারীর দৈহিক গড় ওজন ১২৮ পাউণ্ড।
৫. পুরুষের দেহের মাংসপেশী ৪১.৫% ভাগ আর নারীর মাংস পেশী ৩৫%।
৬. পুরুষের দেহের হাড়ের ওজন সাধারণত সাত সের আর নারীর দেহের হাড়ের ওজন সোয়া পাঁচ সের।
৭. পুরুষের দেহের শতকরা ১৮ ভাগ চর্বি, আর নারী দেহে ২৮% চর্বি।
৮. রক্তের লাল কণিকা নারীর চাইতে পুরুষের অনেক বেশি। পুরুষের এক কিউবিক মিলিমিটার রক্তে পঞ্চাশ লক্ষ রক্ত কণিকা থাকে আর নারীর থাকে ৪৫ লক্ষ।
৯. পুরুষের মগজের ওজন গড়পাড়তা সারে ঊনচল্লিশ আউন্স, আর নারী মগজের ওজন ৪৪ আউন্স। পুরুষের মগজের সর্বনিম্ন ওজন ৩৪ আউন্স আর সর্বোচ্চ ৬৫ আউন্স আর নারী সর্বনিম্ন ৩১ আউন্স এবং সর্বোচ্চ ৫৪ আউন্স, (প্রতি আউন্স আড়াই তোলা সমান)। উল্লেখ্য যে, মগজের ওজনের উপর নির্ভর করে বুদ্ধিমত্তার তারতম্য।
১০. নারীর পঞ্চেন্দ্রীয় পুরুষের পঞ্চেন্দ্রীয়ের তুলনায় অনেক দুর্বল।
১১. নারীর মগজের বক্রতা ও প্যাঁচ পুরুষের তুলনায় অনেক কম। মগজের স্নায়ুমণিতেও বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান।
১২. নারীর হৃদপিণ্ড পুরুষের হৃদপিণ্ড থেকে ওজনে ৬০ গ্রাম কম।
১৩. নারীর স্পন্দন পুরুষের চেয়ে মিনিটে ৫ বার বেশি।
১৪. শ্বাস প্রশ্বাসে পুরুষ ঘণ্টায় ১১ ড্রাম কার্বন জ্বালাতে পারে আর নারী পারে মাত্র ৬ ড্রাম। এখান থেকে বুঝায় যায় নারীর দেহে অক্সিজেনের ভাগ কম।
১৫. দৈহিক শক্তিতে নারী পুরুষের চাইতে অনেক কম। পুরুষের চামড়ার দৈর্ঘ্য ১.৮ মিটার আর নারীর চামড়ার দৈঘ্য ১.৬ মিটার। এছাড়া পুরুষ হয় বলবীর্যবান, শক্তিশালী আর নারী হয় কোমল ও লাজুক। পুরুষরা সাহসী আর নারীরা ভীরু। পুরুষ চিন্তাশীল ভাবুক আর নারী স্বভাবধর্মী পরশ্রীকাতর। পুরুষের চিন্তাধারা জাগ্রত ও বিপ্লবী, নারীর চিন্তাধারা সুপ্ত ও সাম্য। পুরুষ আলোড়নকারী। নারী প্রেরণা দানকারী।
এ সমস্ত তথ্য দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নারী পুরুষের মত শক্তিশালী নয়। সূ²দর্শী নয়, চিন্তাশীল নয়, বিপ্লবী নয়। আবিষ্কারক নয়, ধৈর্য্যশীল নয়। জ্ঞান-বুদ্ধি ও সৃজনশীলতায় নারী পুরুষ হতে অনেক গুণ কম। তাদের মস্তিষ্কের গঠন প্রণালী সরল সহজ। পুরুষের মস্তিষ্কের ন্যায় সু² ও জটিল নয়। এজন্য কোন নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করার পরও নতুন কিছু আবিষ্কার করে জগৎকে মুগ্ধ করতে পারেনি। নতুন থিওরী দিয়ে সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। সুশাসক হয়ে প্রজাসাধারণের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারেনি। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত বৈজ্ঞানিক ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে নারীর কি কোন অবদান আছে? নারী কোন দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে সমুদ্রগর্ভে, পর্বত শিখরে অথবা মহাশূন্যে বিচরণ করতে পারেনি। করলেও কদাচিত। নারী কোন যুগে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারক, ধর্মযাজক ধর্মনেতা বা পয়গাম্বর হয়েও আসেনি। মোট কথা, প্রকৃতগতভাবে নারীর মধ্যে যেসব দুর্বলতা বিদ্যমান নারী ও পুরুষের মধ্যে যেসব পার্থক্য বিদ্যমান তা কোন বৈজ্ঞানিক কৌশল অবলম্বন করেও ঘুচানো সম্ভব নয়। প্রকৃতির নিয়মকে লংঘন করা যাবে না। নারীর মুখে যেমন গোঁফ গজানো যায় না, তেমনি পুরুষের বুকেও স্তন স্থাপন করা যায় না। নারীকে দুধ ডিম কলা ইত্যাদি বলকারক খাদ্য খাইয়েও বৈজ্ঞানিক-আবিষ্কারক বানানো যায় না। তেমনি কোন যন্ত্র প্রয়োগ করেও পুরুষের পেটে সন্তানের ব্যবস্থা করা যায় না।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নারীকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কই ক’জন নারী নব আবিষ্কারের দ্বারা জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে? কোন নারী সমুদ্রের তলদেশ থেকে মণিমুক্তা আহরণ করে এনেছে? কোন নারী নাবিক হয়ে দেশ-দেশান্তর পাড়ি জমিয়েছে? কে কবে হিমালয় শৃঙ্গে অভিযান করেছে? গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে কে কবে বাঘ সিংহ হাতী গন্ডার শিকার করেছে? যারা একটা বিড়াল মারার ক্ষমতা রাখে না তাদের আবার স্বাধীনতা? যতসব অসাধ্য দুঃসাধ্য কঠিন ঝুকিপূর্ণ কাজ তা সব পুরুষ করেছে, করছে।
আর অধিকারের বেলায় সমান, হায়রে অধিকার কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। নারী ও পুরুষের মধ্যে এতসব পার্থক্য থাকা সত্তে¡ও সমান অধিকারের দাবী তোলা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। নারীর জন্য যা কল্যাণজনক ও উপযোগী তা আল্লাহ পাক তাকে দিয়েছেন। নারীর প্রতি কোন অত্যাচার অবিচার করা হয়নি। নবী করিম -এর মাধ্যমে যা দেবার তা একটুও কম দেয়া হয়নি। আজ তো নারীকে দাসী বানানো হয় না কন্যা সন্তানকে আর গলা টিপে হত্যা করা হয় না। মৃত স্বামীর সাথে তো সহমরণে যেতে হয় না। বনবাস দিয়ে তো আর হিংস্র প্রাণীর মুখে তুলে দেয়া হয় না। শিক্ষার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয় না। তবু যদি নারী পুরুষের সমান অধিকার চায় বা দেয়া হয় তাহলে ধ্বংস তো অনিবার্য। নারী যদি বাজারের পণ্য হতে চায় তাহলে সেটা হবে তাদেরই দুর্ভাগ্য।
নারী ও পুরুষ এক শ্রেণির নয়
____________________
নারী ও পুরুষ এক শ্রেণির নয়
নারী এবং পুরুষ আল্লাহর প্রবীণতম সৃষ্টি। তিনি ইচ্ছা করলে সব মানুষকে নারী অথবা পুরুষ করে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু ভিন্ন অবয়ব দিয়ে নারীকে সৃষ্টি করার কি মহান উদ্দেশ্য ও চিন্তা বা গবেষণা বর্তমানে আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। বরং পাশ্চাত্য অসভ্যদের ন্যায় নারীগণকে পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। নারীরা জোর গলায় আওয়াজ তুলছে, আল্লাহ নাকি নারী ও পুরুষকে সমঅধিকারের ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এ সমঅধিকারের তাৎপর্য কি বা পদ্ধতি বা কি? এসব বিশ্লেষণ না করেই সমান অধিকারের ভুল অর্থ সৃষ্টি করে নারী প্রগতির নামে মেতে উঠেছে। কি সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করে আল্লাহ নারী জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তা অনুসন্ধান না করে তথাকথিত আধুনিকতার মোহে প্রলুব্ধ হয়ে আল্লাহ প্রদত্ত সম্মানের আসন পরিত্যাগ করে লাঞ্চিতা পদদলিত ও ধর্ষিতা হয়ে আজ তারা কেবল ভোগের সামগ্রী তথা বংশখণ্ডে পরিণত হয়ে গিয়েছে। নারী শাসিত সমাজের কর্তা ব্যক্তিরা চাকুরি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোটা নির্ধারণ করে দিলেই নারীদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। অপর দিকে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক বিএ, এমএ পাস করে চাকুরি না পেয়ে সন্ত্রাস চুরি ডাকাতি করছে রিক্শা টেম্পু চালাচ্ছে। এতেও বেকারত্বের অবসান না হওয়ায় দেশ আজ কোন দিকে চলে যাচ্ছে।
কথায় আছে- মানুষ কাজ না পেলে আকাম করে। ভালো কাজ না পেলে কুকাম করে। নারীদের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব পুরুষের। নারীর মান-সম্মান খোরপোষ কিভাবে যোগাবে তা পুরুষরাই বুঝবে। বর্তমানে এ সত্যের স্বীকৃতি না দিয়ে নারীদেরকে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দিয়ে সীমাহীন বিশৃংখলার আমদানী করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, কোটাপ্রাপ্ত হয়ে নারীরা চাকুরিতে প্রবেশ করেই যেসব অনর্থপাত ও লজ্জাকর ঘটনা ঘটাচ্ছে তা জাতীয় ইতিহাসকে কলঙ্কিত করছে। এসব দুর্ঘটনার ফিরিস্তি একত্রিত ও সংগৃহীত হওয়ার ব্যবস্থা হলে প্রতি মাসেই একটি করে বিরাট বই হয়ে যাবে। একেই বলে জাতীয় দুর্ভাগ্য।
আমাদের নারী সমাজকে আরো বেশি সর্বনাশ করেছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এনজিওগুলো। এরা জানে পুরুষকে কাবু করতে হলে নারী যন্ত্র আবশ্যক তাই তারা পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় নারী সমিতি গঠন করে তাদের সুন্দর ব্যবসা জমজমাট করেছে। এসব সমিতিতে পুরুষ সদস্য গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষিত মহল অবশ্যই অবগত যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কি কৌশলের জাল বিস্তার করে এদেশ জয় করে নিয়েছিল। যে কারণে আমাদের বাপ-দাদারা দু’শ বছর তাদের গোলামী করতে হয়েছিল। এনজিওদের পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদী। যার ফলে এখন দেখা যাচ্ছে, এদেশের নারী সমন্বয়ে সমিতি গঠন করা হচ্ছে এবং সুদের ব্যবসা করা হচ্ছে। কিন্তু তা ক্রমে ক্রমে সম্প্রসারিত হতে হতে আমাদের চরম কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়ার যে ষড়যন্ত্র তা যে দিন পূর্ণত্বপ্রাপ্ত হবে সেদিন দেখা যাবে আমাদের পায়ের নীচের মাটি অনেক দূরে সরে গেছে। আমাদের জানা আছে যে, বাবা আদমকে গন্দম (নিষিদ্ধ ফল) খাওয়াতে মহিলা মা হাওয়ারও কিন্তু একটা ভূমিকা ছিল। শয়তান মা হাওয়াকেই সর্বপ্রথম তার কূটজালে আবদ্ধ করেছিল। আল্লাহ পাক বলেন, নিশ্চয়ই শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল। কিন্তু অন্যত্র আল্লাহ পাক ফরমান- “নিশ্চয়ই মহিলার চক্রান্ত মারাত্মক।” শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে তার কূটজাল থেকে বাঁচার জন্য আউযুবিল্লাহ বা লাহাওলা অলা কুওয়াতা ইত্যাদি নানা দোয়া কালাম আছে। যেগুলো পাঠ করা মাত্রই শয়তানের গায়ে আগুন লেগে যায়। অতঃপর শয়তান পালাতে বাধ্য হয়। আযানের আওয়াজ শুনলে তো শয়তানের বেহাল অবস্থা হয়ে যায়। সে পেছন বায়ু ছাড়তে ছাড়তে পালাতে থাকে। কিন্তু কোন মহিলা কাউকে সর্বনাশ করতে চাইলে শয়তানকেও সে হার মানায়। এখানে না চলে কোন দোয়া কালাম আর না চলে আযান। এখানে কামান দাগালেও কাজ হবে না। কারণ এখানে নাকি মন দেয়া নেয়া হয়। এদের একটি মন আছে। এই মনটির নাম রাক্ষুসী। এই রাক্ষুসী মনটা হয়ত আপনার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারে, নয়তো এমন কলংক আপনার জীবনে উপহার দিবে যা আমৃত্যু আপনি অনুশোচনায় ভুগতে থাকবেন। এ ধরনের দুর্ঘটনা হাজার নয় লাখ নয় অসংখ্য অগণিত ঘটেছে ঘটছে ঘটবে- ধর্মীয় অনুশাসন না মানলে। আমার মায়ের জাতিরা এ থেকে বাঁচতে ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ুন বা মহামনীষীদের জীবনী পড়ুন। দেখবেন কোন পুরুষকে ধ্বংস করার মন-মানসিকতা থাকবে না, কোন ছেলে উত্তক্ত করলেও তার প্রতি ঘৃণা আসবে। হয়ত এক সময় নিক্ষিপ্ত হতে পারে। বাড়ি থেকে বের হতে হলে বোরকা বা চাদরাবৃতা হয়ে বের হোন। দেখবেন যত বড় অসভ্যই হোক না কেন আপনাকে মায়ের নজরে দেখতে বাধ্য। কিন্তু হায়! এ ধরনের নছীহত উপদেশ কত যে হচ্ছে। একদিকে একদল হর-হামেশা নছীহত করছেন অপরদিকে আরেকটা বড় দল নারীকে টেনে আনছে রাজপথে। তারা মিটিং করছে হাত পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মিছিল করছে, জোর গলায় শ্লোগান দিচ্ছে। আর পুলিশ যখন তাদেরকে লাঠিপেটা করে পরণের বস্ত্রহরণ করে নেয় তখন এই নারকীয় দৃশ্য কয়জন মানুষ সহ্য করে নিতে পারে? এ হল আধুনিক নারীর পাওনা। যেখানে গেলে নারীদের ধ্বংস অনিবার্য সেখানে আজ নারীরা দল বেঁধে যাচ্ছে। এখনও সময় আছে ফিরে আসুন আপনার ঘরে। গায়ে পড়ে এত কথা বলা হচ্ছে এজন্য যে, নারীরা পুরুষদের অর্ধাঙ্গিনী। শরীরের অর্ধেকটা যদি প্যারালাইসিস হয়ে যায় তাহলে মানুষটা যেমন চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায় তেমনি বাংলার নারী সমাজ তথা অর্ধেকেরও বেশি স্থানচ্যুত গৃহচ্যুত হওয়ার ফলে বাংলার পুরুষ সংখ্যার অর্ধেকও আজ বিপথগামী হয়ে যাওয়ার কারণে স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও দেশের কোন উন্নতি হচ্ছে না।
আমাদের অর্ধাঙ্গিনী বেহায়া নির্লজ্জ হওয়ার কারণে বাংলাদেশের অর্ধেক লোক আজ আমাদের প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। এ কারণেই দেশের এই করুণদশা। মেয়েটা স্কুল-কলেজ থেকে অক্ষত হয়ে ফিরে আসবে কি না এ চিন্তায় আমরা প্রতিটি মা-বাবা চিন্তা করে মরছি।
নারী প্রতিবাদীনীরা সভা করে হাত পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে জোর গলায় বলে যে, বোনেরা! আমরা পুরুষের দাসী হয়ে জীবন কাটাত সৃষ্টি হইনি। ওহে নারী! কে বলে তুমি দাসী? তাহলে কি ধর্ষকের হাতে পরে ধর্ষিতা হতে পুলিশের হাতে পরে বিবস্ত্র হতে কাঁচাবাজারে অন্যান্য মার্কেটে পুরুষের ধাক্কা টিটকারী ও ফিসফিসানী সহ্য করতে সৃষ্টি হয়েছেন? আধুনিকতা আপনাদেরকে পশুতে পরিণত করেছে। পশুর চেয়ে দাসীতো অনেক ভালো। নারীরা শুনুন, মন দিয়ে শুনুন! আপনারা দাসী নন পুরুষের সম্রাজ্ঞী। আপনারা ঘরের লক্ষী। আপনারা নির্ধারিত অঙ্গনে বসে সম্রাজ্ঞীর আসন অলংকৃত করুন। আপনাদের সেবায় পুরুষ জাতি। নিজেকে দাসী বলে নিজেই অপমানিত হবেন না। যেহেতু আপনারা আমাদের মা-বোন স্ত্রী। ২৮১
২৮১.মাওলানা মুজিবুর রহমান, জান্নাতী রমণীর গুণাবলী, পৃ. ২৪০-২৪১
পর্দা নারীর ইজ্জতের গ্যারান্টি
____________________
পর্দা নারীর ইজ্জতের গ্যারান্টি
অনিয়ম অরাজকতা নেই জঙ্গলের হিংস্র হায়েনাদের মাঝে। বাঘের গুহায় সিংহ প্রবেশ করে না। শৃগালের গর্তে বাঘ প্রবেশ করে না। হিংস্র অসভ্য হয়েও তারা নিজ নিজ অবস্থানে আছে। মহাবিশ্বেও নেই কোন অনিয়ম, নেই কোন ঝগড়া-ফ্যাসাদ। অগণিত তারকারাজি পৃথিবী থেকে ১৩ লক্ষগুণ বড় সূর্য, রাতের মায়াময়ী চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র সবাই নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে চলেছে অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে। নিজের কক্ষপথ পরিত্যাগ করে অন্যের কক্ষপথে কেউ কোন দিন ঘোরাফেরা করার জন্য মুহুর্তের জন্যও যায়নি। যাবেও না কোন দিন। এ জন্যই এরা সৃষ্টির পর থেকে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়নি। একটার সাথে আরেকটা ধাক্কা লেগে টুকরা টুকরা হয়ে মাটিতে পড়ে যায়নি। ধ্রুব তারা সৃষ্টির পর থেকে উত্তর আকাশে নির্দিষ্ট স্থানে উদিত হচ্ছে এবং আল্লাহর বিধান মেনে স্বীয় কর্তব্য পালন করে দিক নির্ণয়ের পস্থা নিরূপণ করে চলছে। সূর্য পূর্বাকাশ থেকে সকালবেলা লাল হয়ে উদিত হচ্ছে নিয়মিতভাবে। ধ্রুব তারা উত্তর আকাশ হতে সরে গিয়ে কোনদিন পূর্ব পশ্চিম অথবা দক্ষিণ আকাশের কোলে আবিভূত হয়নি। সূর্য সবুজ বা কালো কিংবা সাদা হয়ে পশ্চিম দক্ষিণ কিংবা উত্তর আকাশে সন্ধ্যে দুপুর বা বিকেলে উদিত হয়নি। পূর্ণ চব্বিশ ঘণ্টাতেই দিবা রাত্রি সংঘটিত হচ্ছে। কখনো ২৩ বা ২৫ ঘণ্টাতে হচ্ছে না। কোন অমাবশ্যায় পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যায় না, আবার কোন রাহু গ্রাসে পূর্ণিমার রাতে অমাবশ্যাও হয় না। এত সব সুশৃংখলাতে কারো কোন কারিগরি নেই। অদৃশ্য মহান শক্তির নির্ধারিত নিয়মেই বিশ্বের প্রতিটি পদার্থ তার কাজ করে চলেছে। অন্যথায় জীবন হয়ে উঠবে অচল ও দুর্বিষহ। পুরুষের পরিবর্তে নারীর স্বাভাবিকভাবে গোঁফ দাড়ি উঠে না। আর নারীর পরিবর্তে পুরুষের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের অনিয়ম ও অব্যবস্থার অপূর্ণতা চরম পর্যায়ে উপনীত হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বয়ে চলেছে নিয়মের রাজত্ব। তেমনি পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এবং সংঘাত বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ কল্পে মহান আল্লাহ নারী-পুরুষের অবস্থান ও কর্মক্ষেত্র পৃথক পৃথক গণ্ডী নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
নারীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণ
____________________
নারীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণ
নারীদের বিভিন্ন অপরাধ ও আর্থিক কর্মকাণ্ডের চুক্তিতে সাক্ষ্য হিসাবে আদৌ গ্রহণ করা হবে কিনা অথবা তাদের সাক্ষ্য কতটুকু গ্রহণ করা হবে এ নিয়ে বর্তমান সময়ে ইসলামিক স্কলারগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন বিষয়ের সাক্ষী নারী কর্তৃক অপরাধ প্রমাণে ব্যবহৃত হবে সে ব্যাপারেও কিছু বক্তব্য বিভ্রান্তিমূলক বিশেষ করে আর্থিক লেনদেনজনিত সুরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াতের দৃষ্টান্ত তুলে সকল ক্ষেত্রে মহিলার সাক্ষ্য পুরুষের অর্ধেক এমন যুক্তিও তুলে ধরা হচ্ছে আর এতে করে নারীবাদীরা বলার সুযোগ পায় যে ইসলাম নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা ও সম্মান দেয়নি। নারী শুধুমাত্র তার নারীত্বের কারনেই পুরুষের সমান জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, পারদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তা থাকার পরও সকল ক্ষেত্রে সাক্ষ্যদানের বিষয়ে এক পুরুষ দুই নারী এই নীতি গ্রহণ করতে হবে-এমন বক্তব্যের সাথেও আধুনিক অনেক স্কলার একমত নন। পবিত্র কুরআনের ‘এক পুরুষ সমান দুই নারীর’ সাক্ষ্য বিষয়ের আয়াতটার অনুবাদ হল-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অন্যের সাথে যখন নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের (আর্থিক লেনদেন) কারবার করো তখন তা লিখে রাখবে। তোমাদের মধ্যে কোন লেখক যেন ন্যায্যভাবে লিখে দেয়, লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না। খোদ আল্লাহ তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং সে যেন লিখে এবং ঋণগ্রহীতা যেন লেখার বিষয়বস্তু বলে দেয় এবং তার রবকে ভয় করে আর উহার কিছু যেন না কমায় কিন্তু ঋণ গ্রহীতা যদি নির্বোধ অথবা দুর্বল হয় অথবা লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে না পারে তবে যেন তার অভিভাবক লেখার বিষয়বস্তু বলে দেয়। সাক্ষীদের মধ্যে যাদের উপর তোমরা রাজী তাদের মধ্যে দুইজন পুরুষ সাক্ষী রাখবে, যদি দুইজন পুরুষ না থাকে তবে একজন পুরুষ ও দুইজন স্ত্রীলোক, স্ত্রীলোকের একজন ভুল করলে তাদের একজন অপরজনকে স্মরণ করিয়ে দিবে। সাক্ষীদের যখন ডাকা হবে তখন তারা যেন যেতে অস্বীকার না করে। ছোট হোক বা বড় হোক মেয়াদসহ লিখতে তোমরা কোনরূপ বিরক্ত হয়ো না। আল্লাহর নিকট এটা ন্যায্যতর ও প্রমাণের জন্য দৃঢ়তর এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়ার নিকটতর।” ২৮২
২৮২.সূরা বাকারা: ২৮২
একটা আর্থিক লেনদেনের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কুরআন শরীফের দীর্ঘতম সূরার এই দীর্ঘতম আয়াতটা পড়লে তা বুঝা যায়-এর প্রতিটা শব্দ ব্যাখ্যাযোগ্য। এখান থেকে কয়েকটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় বের করা যায়-
ক. ঋণ, ধার, বিনিয়োগ আর্থিক লেনদেন নগদ ব্যতীত অন্য যে কোন রূপেই হোক তা লিখিত চুক্তির আকারে হতে হবে।
খ. চুক্তির শর্ত থাকবে, মেয়াদ নির্দিষ্ট থাকবে, দিন তারিখ থাকবে এবং সাক্ষী থাকবে।
গ. লিখার বিষয়টা ঋণগ্রহীতা ঠিক করবে অর্থাৎ ঋণদাতার শর্তাবলী ঋণ গ্রহীতার কাছে গ্রহণীয় হতে হবে।
ঘ. লিখিত চুক্তিপত্রে কোন অন্যায্য শর্ত চাপিয়ে দেয়া যাবে না।
ঙ. লিখা লিখতে রাজী হবে এই কারণে যে আল্লাহ তাকে লেখাপড়ার জ্ঞান দিয়েছেন।
চ. চুক্তিপত্র লিখার সময় এতটুকু সতর্ক থাকবে যাতে ঋণদাতা ও গ্রহীতার কোন বিষয়বস্তু যেন বাদ না যায়। এ কাজে যেন আল্লাহকে ভয় করে।
ছ. ঋণগ্রহীতা অশিক্ষিত হলে চুক্তিপত্রের শর্ত চাপিয়ে দেয়ার মত কোন বিষয় না হয় সেজন্য সে প্রয়োজনে পেশাদার কোন ব্যক্তির সাহায্য নিবে।
জ. সাক্ষীগণ আস্থাশীল ও স্মরণকারী হবেন। ঋনদানকালে যেন কোন বিষয় ভুলে না যান।
ঝ. সাক্ষীদের তলব করা মাত্র যেন হাযির হতে পারেন এবং অনুপস্থিত থাকার মত অজুহাত তালাশ না করেন।
ঞ. চুক্তিপত্র বিস্তারিত হলে কোন পক্ষ যেন বিরক্ত না হয়।
ইসলাম আর্থিক কাজে চুক্তিতে দুজন নারী সাক্ষীর প্রসঙ্গে বলেছেন তারা বিস্মৃতিপ্রবণ এবং চুক্তির বিষয় ভুলে থাকার আশংকা আছে তাই দুজনের একজন যেন অপর জনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আর্থিক লেনদেনের মত বিষয়বস্তু আমাদের সমাজে পুরুষরাই সম্পন্ন করেন। ব্যক্তিগত কিংবা ব্যাংক বীমার মতো প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লেনদেনে খাপলা বাঁধে না এমন ঘটনা খুবই কম। সময়মত টাকা পরিশোধের সংস্কৃতি সর্বত্রই দুর্বল ফলে এগুলো নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও হয়। এখন আদালতে এ রকম একটা ঘটনা ঘটলে পুরুষ যত দ্রুত হাযির হতে পারবে এবং নির্ভয়ে বিচারকের সামনে ঘটনার বর্ণনা দিতে পারবে নারী সংসার, বাচ্চা ও চাকুরী থাকলে সেগুলো সামাল দিয়ে কোর্টে হাযিরার দিন হয়তো যেতে পারবে না। তাছাড়া এই মামলা যে কত বছর চলে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। ফলে একজন মহিলাকে এরূপ একটা জটিল পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার সুবিধা দেওয়াই সমাজ ও সংসারের জন্য কল্যাণ।
আল্লাহপাকের সবচেয়ে বড় হল নারীদের প্রতি মাসেই একটা প্রাকৃতিক অসুস্থতার সম্মুখীন হতে হয়। তখন নারী তার স্বাভাবিক কাজকর্ম কমিয়ে দেয়, আল্লাহও তার বন্দেগীতে ছাড় দেন, তার জন্য নামায, রোযাও স্থগিত করে দেন। তার স্মৃতি পূর্ণভাবে কাজ করে না, মেজাজের ভারসাম্য থাকে না এবং শারীরিক শক্তি সামর্থও হ্রাস পায়। এ সময় তাকে যদি কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় তখন তার জন্য সেটা অবশ্যই সুবিচার হয় না। এটা কি নারীর প্রতি আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ নাকি তার সম্মানের জন্য হানিকর? সাক্ষী হওয়া না হওয়ার সাথে তার মর্যাদার সম্পর্ক কি? নারীবাদীরা কি তাদের প্রতি
স্রষ্টার অনুগ্রহকেও মানহানিকর ভাবেন?
____________________
স্রষ্টার অনুগ্রহকেও মানহানিকর ভাবেন?
ফিকাহবিদগণ সাধারণভাবে সকলেই একমত যে সমাজে এমন কিছু অপরাধ সংঘটিত হয় যার শাস্তি মৃদ্যুদন্ড। এসব বিচার কাজে সাক্ষীর ভূমিকার উপর একজন লোকের ফাঁসি কিংবা জীবন রক্ষা পায়। এজন্য সাক্ষীকে ঘটনার সত্যতা বর্ণনার জন্য কেবল সত্য বলাই যথেষ্ট হয় না বরং ঘটনার হুবহু বর্ণনা এবং একইসাথে কে কোন পর্যায়ে কতটুকু জড়িত তারও হুবহু আদালতে উপস্থাপন করতে হয়। একই ধরনের অপরাধ যেমন চুরি, অপহরণ, ধর্ষন, মদ্যপান ও মিথ্যা অপবাদ আরোপের বিচার কাজে নারীর সাক্ষী একমাত্র নারী, কোন পুরুষ সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চত হয়-এমতাবস্থায় কেবলমাত্র সাক্ষীর অভাবে বিচার হবে না এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই সাক্ষী গ্রহণ করতে হবে।
কুরআন ও হাদীস নারীর সাক্ষ্যদান অগ্রহণযোগ্য বলেনি বরং তাকে তার মাসিক অসুস্থতা সাংসারিক ঝামেলা, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব, শিশু থাকলে তাকে দুগ্ধপান এসব প্রতিকূলতা ঠেলে কোর্টে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সাক্ষী হিসাবে যাওয়া সহজ বিষয় নয়-এজন্য সাক্ষ্যদানের বিষয়ে তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তার সাক্ষ্য দানের অভাবে একজন মজলুম ব্যক্তির বিচারকাজ শুধু তখন বিলম্বিত হবে না বরং বিপরীতও হতে পারে। দ্বিতীয়ত আর্থিক লেনদেনের অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতা সাধারণ অপরাধের মাত্রার চেয়েও গুরুতর। এখানেও নারীর দুর্বলতার কারণে তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সাক্ষী যদি হতেই হয় তাহলে তার একজন সহযোগী সাথে নিতে বলা হয়েছে মাত্র। এখন এটাকে গাণিতিক নিয়মের বাধ্যকাধকতা ভেবে যে কোন সামাজিক বিষয়বস্তুর সাক্ষ্যদান থেকে বিরত রাখা ইনসাফ হবে না। একজন শিক্ষিত মহিলার সাক্ষ্য যে কোন একজন অথর্ব, অযোগ্য, অশিক্ষিত মূর্খের চেয়ে বরং বেশি গ্রহণযোগ্য।
নারীদের সাক্ষ্য কেন পুরুষের অর্ধেক?
____________________
নারীদের সাক্ষ্য কেন পুরুষের অর্ধেক?
আল্লাহ পাক নারীদের সাক্ষ্যদানের বিষয়ে তাদের একটা দুর্বলতার কথা বলেছেন যে তারা বিস্মৃতিপ্রবণ। ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা পুরুষের বেলায়ও তো ঘটতে পারে। একথা স্বীকার করতেই হবে কোন ঘটনার বিচার সংক্রান্ত বিষয়েই কেবল সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয়। সাক্ষ্যদানের যথার্থতার উপরই নির্ভর করে বিচার কতটুকু সুষ্ঠু হবে। আর এই সাক্ষ্যদান একজনকে অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও তাকে খালাস করে দিতে পারে আবার নিরপরাধীকে আমৃত্যু হাজতবাস করাতে পারে। ব্যাপারটা একদিকে জটিল অন্যদিকে সময়ক্ষেপনও বটে। আর আইন আদালতের বাজারী পরিবেশে একজন পুরুষ যতখানি দৃঢ়তার সাথে দিনের পর দিন বছরের পর বছর হাজিরা দেয়ার সক্ষমতা রাখে নারীর পক্ষে তা মোটেও সম্ভব নয়।
এখানে কোনভাবেই নারীকে হেয় করা হয়নি বরং তার প্রতি এহসানই করা হয়েছে। নারীরা বিদ্যা ও প্রজ্ঞায় পুরুষের চেয়ে কম, আজকাল এমন কথা বেওকুফরাই বলতে পারে। কারণ মাশাআল্লাহ তারা চিকিৎসা বিদ্যা কি বিজ্ঞান শিক্ষা কি নভোচারী কি বৈমানিক সব ক্ষেত্রেই পুরুষের সমান দক্ষতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। বরং যখন এসএসসি ও এইচএসসি রেজাল্ট বের হয় তখন এ প্লাস পাশের সংখ্যায় ছাত্রীরা ছাত্রদের থেকে এগিয়ে থাকে। এই দক্ষতা ও এই জ্ঞান মেয়েদেরকে আল্লাহই দিয়েছেন। কুরআনের এই আয়াত আমাদের বলে দিচ্ছে যে চলমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন মুসলিম নারীর পক্ষে যোগ্য ও যথার্থ সাক্ষদান সম্ভব নয়। বিশেষ করে আর্থিক ও অপরাধমূলক বিষয়ে। তবে এখানে কোথাও বলা হয়নি একজন নারীর সাক্ষ্য অকার্যকর বা বাতিল। বলা হয়েছে অন্যজন তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে যদি পূর্বজন ভুলে যায় তবে দ্বিতীয়জন হবেন সাহায্যকারী ও সহগামী।
সম্পদে অর্ধেক দিয়ে আল্লাহ কি মেয়েদের ঠকিয়েছেন?
____________________
সম্পদে অর্ধেক দিয়ে আল্লাহ কি মেয়েদের ঠকিয়েছেন?
আল্লাহ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কারো উপর জুলুম করেন না। আপাতদৃষ্টিতে আল কুরআনে সম্পদ বণ্টনের আইন নিয়ে আধুনিককালের নারীবাদীরা অত্যন্ত সোচ্চার এবং কেউ কেউ এই আইন অর্থাৎ কুরআনের এই বিধান নারীদের প্রতি চরম অবিচার এমন ধুয়া তুলে নারীদের পুরুষের সমান হিস্যা নির্ধারণের দাবী করেন, আল্লাহ বলেন-لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِএক পুরুষের অংশ দুই নারীর সমান। ২৮৩
২৮৩.সূরা নিসা : ১১
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে কয়েকটা বিষয় আমাদের পরিষ্কার ধারণা প্রয়োজন।
ক. একথা সর্বজনস্বীকৃত যে মুসলিম পুরুষের উপর ইসলাম যে ধরনের দায়িত্ব কর্তব্য আরোপ করে নারীর উপর তেমনটা নয়। পুরুষকে তার রোজগারের জন্য বাইরে যেতে হয়। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদাগুলি মিটানো তার উপর ফরয। স্ত্রীও বাইরে যেতে পারেন তবে তার আয়ে পুরুষ ভাগ বসাতে পারবে না। তার আয় তার নিজস্ব যদি তিনি পরিবারে খরচ করেন তবে তা ছাদাকা, ফরয দায়িত্ব নয়।
খ. পরিবারের চাহিদা অনেক। পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আত্মীয় স্বজনের মেহমানদারী, কারো বিপদে আপদে সাক্ষাত এসব হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া সমস্যা পুরুষকেই মোকাবেলা করতে হয়। নারী এসব দায়িত্ব থেকে মুক্ত। মেহমান স্ত্রীর পক্ষের হলে বরং খরচের মাত্রা একটু বেশীই থাকে, মাঝে মধ্যে বাজেটেও ঘাটতি পড়ে।
গ. পুরুষ যদি সংসারের খরচাদি সামাল দিতে অপারগ ও অসমর্থ হয় তবে এর জন্য পরিবারের আর কেউ নয় তাকেই সমাজের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধরের কাছে কর্জের জন্য ধর্ণা দিতে হয় এবং এই খরচ তাকেই আয় করে পরিশোধ করতে হয়। স্ত্রী এক্ষেত্রে স্বামীকে সাহায্য করলে এটাও ছাদাকা, তার দায়িত্বে অন্তুর্ভুক্ত নয়।
ঘ. বিয়ের সময় স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে আর্থিক নিরাপত্তা ‘মোহর’ পেয়ে থাকে যা নগদে মানসম্মত পরিমাণে পরিশোধ করার নিয়ম। এটা পুরুষের উপর ফরয। এই অর্থে স্বামী কোন ভাগ বসাতে পারে না। বাকী রাখারও বিধান নেই। আমাদের সমাজে এর পূর্ণ হক আদায় কেউ করে না বলে বাকীর রেওয়াজ চালু হয়েছে। মোহরের অর্থ নারী ব্যাংকে জমা করতে পারে, নিজে ব্যবসা চালাতে পারে কিংবা কোথাও বিনিয়োগও করতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন। পুরুষ এখানে কোন হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে না।
ঙ. মেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে শুধু পিতার সম্পদই নয় স্বামী, দাদা ও বৈপিত্রেয় ভাই থেকেও সম্পদ লাভ করে। শুধু পিতার সম্পত্তিতে ভাই অপেক্ষা অর্ধেক পাবে। এর সাথে বাকী সম্পদ যোগ করলে তা কি ভাই এর সম্পদ থেকে বেশী হচ্ছে না? আল্লাহ অত্যন্ত ইনসাফগার, তিনি ভালো জানেন কার হাতে কতটুকু সম্পদ দিলে সমাজের স্থিতি বিদ্যমান থাকবে। পরিবারে এর চেয়ে বেশী সম্পদ নারীর হাতে পড়লে তার রক্ষণাবেক্ষণ, উৎপাদন, ভাগ বণ্টন, সরকারী খাজনা মিউটিশান এসব ঝামেলার কারণে তিনি হয়তো তা নিজের নিয়ন্ত্রণ থেকেই হারিয়ে ফেলবেন।
চ. পাশ্চাত্য সমাজ ভিন্ন আমাদের সমাজে প্রতি পরিবারেই এই সংস্কৃতি চালু আছে যে, পুরুষ কোন সম্পত্তি কিনলে আগে স্ত্রীকে খুশি করে। স্ত্রীর নামে ব্যাংক জমা, ব্যবসায় লাইসেন্স, প্লট ফ্ল্যাট সবই। এসব যে ভালবাসার টানে হয় সব ক্ষেত্রে তা নয়। অনেক সময় সম্পদ লুকানোর চেষ্টায়ও এমন করা হয়। তাহলে স্ত্রী সে ভালো লোকেরই হোক বা মন্দ লোকের সম্পদ কিন্তু তার নামেই।
এরপরও নারীবাদীরা বলবেন উত্তরাধিকার নীতিতে সমতা আনা প্রয়োজন। নারীরা অর্ধেক পেয়ে ঠকছে? চোখ বুজে হিসাব কষে দেখুন আপনার কব্জায় সম্পদ বেশী না আপনার স্বামীর কব্জায়?
তারপরও যুক্তির বিচারে না হোক অন্তত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আল্লাহর সুবিজ্ঞ ও ইনসাফপূর্ণ বণ্টননীতিতে আমাদের কল্যাণ রয়েছে। একথা মানতে হবে যদি এই বণ্টন আল্লাহ নিজ দায়িত্বে করে না দিতেন তাহলে প্রতিটা পরিবারেই পরিবার কর্তার মৃত্যুর আগেই সম্পত্তি নিয়ে মারামারি হতো। পরিবারের শান্তি শৃঙ্খলা ভাই-বোনের বন্ধন সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতো। এজন্য আল্লাহ বলেন-
آبَآؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
তোমাদের পিতা ও সন্তানদের মধ্যে কে তোমাদের নিকটতর তা তোমরা জানো না। এটাই আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। ২৮৪
২৮৪.সূরা নিসা : ১১
স্বামীর জন্য খরচ করার সাওয়াব
____________________
স্বামীর জন্য খরচ করার সাওয়াব
যে কোন দান-সদকারই সাওয়াব রয়েছে। বিশেষত অভাবী স্বামীর জন্য স্ত্রীর খরচ করায় বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। হাদীসে এসেছে-
عن زينب فقلت بلالا سل لنا رسول الله صلى الله عليه وسلم هل يجزى عنى ان اتصدق على زوجى وايتام فى حجرى من الصدقة وقلنا لاتخبر بنا قلت فدخل فساله فقال من هى ؟ قال زينب قال اي الزيانب هى قال هي امرءة عبد الله فقال نعم يكون لها اجر القرابة واجر الصدقة“
হযরত যয়নব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে, আমি হযরত বেলাল (رضي الله عنه) -এর নিকটে বললাম যে, আমার জন্যে -এর নিকটে জিজ্ঞেস করুন যে, আমার স্বামী এবং তার সন্তানাদির জন্যে অর্থ সম্পদ খরচ করলে আমি কি সাওয়াব পাব? আর আমার কথা বলো না। যয়নব (رضي الله عنه) বলেন, তিনি গেলেন এবং মহানবী তাকে জিজ্ঞেস করলেন কে খরচ করছে? বললেন, যয়নব। তখন মহানবী জিজ্ঞেস করলেন, কোন যয়নব? জবাবে বললেন, আবদুল্লাহর স্ত্রী। নবী করীম ইরশাদ করলেন হ্যাঁ। সে দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে। প্রথমত আত্মীয়তার পারষ্পরিক সম্পর্কের, দ্বিতীয়ত সদকার।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, বিদায় হজ্জের সময় রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, “হে নারীর দল! সদকা কর। চাই তা অলঙ্কার থেকে হোক না কেন। তোমাদের নারীদের অধিক সংখ্যক জাহান্নামে যাবে। তখন যয়নব এগিয়ে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, আমার স্বামী গরিব! আমি কি তাকে দিতে পারব? নবী করীম বললেন, এমনটি করলে তুমি দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে।” ২৮৫
২৮৫.মুজমায়া, খণ্ড. ৩; পৃষ্ঠা, ১২২
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (رضي الله عنه) ছিলেন যয়নব (رضي الله عنه) -এর স্বামী। তিনি ছিলেন গরিব আর স্ত্রী ছিলেন সম্পদশালিনী। আবার ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) -এর পূর্বের স্ত্রীর সন্তানও ছিল। আর তাকে লালনপালনও করতেন যয়নব রা। এ কারণেই যয়নব (رضي الله عنه) চিন্তা করলেন যে, সেতো ঘরেরই লোক! তার জন্য খরচ করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে কি? এ কারণেই তিনি মহানবী (ﷺ) ’র নিকটে জিজ্ঞেস করতে বলেছিলেন। প্রতিউত্তরে নবী করীম (ﷺ) বলেছিলেন, শুধু সাওয়াবই নয়; বরং দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে। এর দ্বারা জানা যায় যে, নারী যদি তার স্বামীর জন্য কিংবা গৃহের কোনো কর্মে নিজ অর্থ সম্পদ খরচ করে তবে তার জন্যে দ্বিগুণ সাওয়াব রয়েছে। এমনিভাবে সৎসন্তানের জন্যেও খরচ করলে দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে।
কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয় যে, বর্তমানে সৎসন্তানের সাথে অত্যন্ত জঘন্য আচরণ করা হয়ে থাকে। তার হক নষ্ট করা হয়, তাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়। নিজের সন্তানের তুলনায় তাকে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না। যা খুবই খারাপ বিষয়। সৎসন্তানদেরকে কষ্ট দেয়া কবীরা গুনাহ। বিশেষ করে এর মধ্যে যেসব নারীরা লিপ্ত, কাল কেয়ামতে এসব নারীকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। তাই নিজ সন্তান থেকেও তাদের সাথে অধিক উত্তম আচরণ করা প্রয়োজন।
স্বামীর হক আদায়ের পরিমাণ
____________________
স্বামীর হক আদায়ের পরিমাণ
স্বামীর কতটুকু হক আদায় করলে স্ত্রী জান্নাতের পথ লাভ করতে পারবে, তা সত্যিই একটি ভাবনার বিষয়। হাদীসে এ প্রসঙ্গে এসেছে-
عن ابى سعيد الخدرى رضى الله عنه قال اتى رجل بابنته الى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال ان ابنتى هذه ابت ان تتزوج فقال لها رسول الله صلى الله عليه وسلم اطيعى اباك فقالت والذى بعثك بالحق لا اتزوج حتى تخبرنى ما حق الزوج على زوجته ؟ قال حق الزوج على زوجته لو كانت به قرحة فلحستها او انتشر منخراه صديدا اودما ثم ابتلعته ماادت حقه قالت والذى بعثك بالحق لا اتزوح ابدا فقال النبى صلى الله عليه وسلم لاتنكحو هن الاباذنهن
“হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র নিকট এক ব্যক্তি নিজের কন্যাকে নিয়ে হাজির হলেন এবং বললেন যে, এ আমার কন্যা। সে বিবাহ করতে অস্বীকার করছে। নবী করীম কন্যাটিকে বললেন, তুমি তোমার পিতার অনুগত হও। মেয়েটি বলল ঐ সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন! আমি ঐ পর্যন্ত বিবাহ করব না যতক্ষণ পর্যন্ত আমার জানা না হবে যে, স্ত্রীর উপর স্বামীর হক কী? জবাবে নবী করিম বললেন, “স্বামীর হক হলো, যদি স্বামীর কোন স্থানে জখম হয় তবে স্ত্রী তা চুষে নেয় অথবা স্বামীর নাক থেকে পুঁজ রক্ত প্রবাহিত হয় আর স্ত্রী যদি তা পান করে তবুও স্বামীর হক আদায় হবে না।” (এসব দ্বারা স্বামীর খেদমত ও ভালোবাসার প্রতি গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে পান করা উদ্দেশ্য নয়। কারণ পুঁজ ও রক্ত নাপাক)। এতদশ্রবণে সে বলল, “ঐ সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্যাসহ প্রেরণ করেছেন! আমি বিবাহ করব না।” (কারণ, আমার দ্বারা এমন হক আদায় করা সম্ভব হবে না)। এ কথার পর নবী করীম বললেন, মহিলাদের অনুমতি ব্যতীত তাদেরকে বিবাহ করো না। ২৮৬
২৮৬.তারগীব, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৫
এই হাদীসের বর্ণনার দ্বারা বোঝা যায় যে, কোনো স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর হক পুরোপুরি আদায় করা সম্ভব নয়। স্ত্রী যেন কখনো এমনটি মনে না করে যে, আমি তো অমুখ খেদমত করে দিয়েছি। এতে হক আদায় হয়ে গিয়েছে। মূলত কোনোভাবেই স্বামীর হক আদায় হবে না। তাই তার খেদমত করতেই থাকবে।
হাদীসের অংশ ‘মহিলাদের অনুমতি ব্যতীত তাদেরকে বিবাহ করো না’ দ্বারা এ কথাও প্রকাশ হয়ে গেল যে, কোনো কারণবশত যদি মহিলারা বিবাহে অমনোযোগী হয়, তবে বিবাহ না করাটা মহিলাদের নিজস্ব ব্যাপার। এ সময় তার প্রতি বলপ্রয়োগ করা উচিত নয়।
নারীর ফেতনা ও বনি ইসরাঈল
____________________
নারীর ফেতনা ও বনি ইসরাঈল
নারীর ফেতনা সবচেয়ে ভয়ংকর ফেতনা। হাদীসে এসেছে-
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ من النِّسَاء
“হযরত উসামা বিন যায়েদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, আমি আমার পর পুরুষের জন্য নারী সম্প্রদায় অপেক্ষা অধিক ফেতনার জিনিস আর কিছুই রেখে গেলাম না।” ২৮৭
২৮৭.বুখারী, হাদীস নং ৫০৯৬, মিশকাত, পৃষ্ঠা ২৬৭
স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের অন্তর নারীর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ফলে তাদের কারণেই তারা হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে যায় এবং তাদের কারণেই যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে পড়ে। আর এতদ্ব্যতীত অধিকাংশ নারী পুরুষদেরকে পার্থিব সম্পদের দিকে আকৃষ্ট করায়। আর দুনিয়ার আকর্ষণ ও মহব্বতের চেয়ে অন্য কোনো বস্তু ক্ষতিকারক হতে পারে না। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, দুনিয়ার মহব্বতই সকল গুনাহর উৎস। হাদীসে এসেছে-
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: ্রإِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللَّهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِي النِّسَاء
“হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, দুনিয়া মধুময় এবং সবুজের সমারোহে ভরপুর। আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে পূর্ববর্তীদের উত্তরসূরীরূপে প্রেরণ করেছেন। আর এতে করে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা নিতে চেয়েছেন যে, তোমরা কিরূপ আমল কর। অতএব, তোমরা দুনিয়ার মোহ হতে বেঁচে থাক এবং নারীদের ছলনা হতে বেঁচে থাক। কেননা বনি ইসরাঈলের মধ্যে সর্বপ্রথম নারী সংক্রান্ত ফেতনা আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।”
দুনিয়া মধুময় সবুজের সমারোহ। মূলত মধু বা মিষ্টি স্বাভাবিক সুস্বাদু আর সবুজ জিনিস দৃশ্যত ভালো মনে হয়। তাই দুনিয়া-প্রীতি হতে বেঁচে থাকা উচিত। কেননা তা ধ্বংসশীল।
হাদীসে বলা হয়েছে, ‘নারীদের থেকে বেঁচে থাক।’ অর্থাৎ নারীদের মনতুষ্টির জন্য পার্থিব সম্পদের দিকে ঝুঁকে পড়ো না।
হাদীসে বলা হয়েছে যে, বনি ইসরাঈলের মধ্যে সর্বপ্রথম ফেতনা নারীদের কারণেই ঘটেছিল। আল্লামা তীবী (رحمة الله) বলেন, বনি ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তি ছিল। তার ভ্রাতুষ্পুত্র তার আপন মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। চাচা এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ভ্রাতুষ্পুত্র তাকে হত্যা করল। এ ঘটনা সম্পর্কেই সূরায়ে বাকারা তথা গাভীর কাহিনী অবতীর্ণ হয়েছে।
মুজাহেরে হক গ্রন্থে বাহরুল উলুমের উদ্ধৃতি দিয়ে বনি ইসরাঈলের সর্বপ্রথম ফেতনার ঘটনা নিম্নরূপ বর্ণনা করা হয়েছে-
হযরত মুসা আ -এর যুগে বলয়াম ইবনে বাউর নামী জনৈক ব্যক্তি বড়ই বুযুর্গ ছিলেন। তিনি ছিলেন ‘মুস্তাজাবুদ্দাওয়াত’ তথা তার দোয়া কবুল করা হতো। তার ইসমে আজম জানা ছিল। যখন হযরত মুসা আ সিরিয়া রাজ্যে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বনু কিনয়ানের নিকটে অবস্থান করলেন, তখন বলয়াম সম্প্রদায় তার নিকট এসে বলল যে, ‘হযরত মুসা আ অনেক সৈন্যবাহিনী সহকারে আমাদেরকে হত্যা করার জন্য এবং আমাদেরকে এ দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য এসেছেন। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করুন, যাতে তিনি এখান থেকে চলে যান।’ জবাবে বলয়াম বললেন, ‘আমি যা কিছু জানি তোমরা তা জান না। আল্লাহর নবী এবং মুুমিনদের বিরুদ্ধে আমি কিভাবে বদদোয়া করি? যদি আমি বদদোয়া করি তবে আমার দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই ধ্বংস হয়ে যাবে।’ কিন্তু তার সম্প্রদায় তাকে অনেক চাপ দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলল। ফলে বলয়াম বললেন, ‘আমি আল্লাহর দরবারে ইস্তেখারা করব, কী হুকুম হয় দেখব।’ বলয়াম ইস্তেখারা ব্যতীত কোনো কাজ করতেন না। ইস্তেখারা করলে স্বপ্নে দেখতে পেলেন যে তাকে বলা হলো, ‘হে বলয়াম! তুমি নবী ও মুমিনের বিরুদ্ধে বদদোয়া করো না।’ বলয়াম তার সম্প্রদায়কে উক্ত স্বপ্ন প্রকাশ করল। অতঃপর তার সম্প্রদায় তার জন্য হাদিয়া তোহফা নিয়ে আসল এবং অনেক আবেদন ও চাপে অতিষ্ঠ করে তুলল এবং কান্নাকাটি করল।
এক পর্যায়ে তাকে ফেতনায় জড়িয়ে ফেলল। বলয়াম বদদোয়ার উদ্দেশ্যে নিজ গাধার উপর সাওয়ার হয়ে হিসবান নামক পর্বতে ছুটে গেলেন। এই পর্বত ছিল মুসা (আ)-এর বাহিনীর নিকটে। তিনি সেদিকে ছুটে গেলেন। পথিমধ্যে তার গাধা একাধিকবার মাটিতে লুটে পড়তে লাগল। আর সে অনেক প্রহার করে গাধাকে উঠাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমে গাধা বলে উঠল, “ধ্বংস হে বলয়াম! তুমি কি দেখছ না যে, ফেরেশতাগণ আমার সামনে এসে আমাকে বাধা দিচ্ছে!”
এবার বলয়াম গাধা রেখে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের উপর উঠল এবং দোয়া করল। তবে দোয়ার মধ্যে যে খারাপ বাক্য বনি ইসরাঈলের বিরুদ্ধে মুখ থেকে বের করার ইচ্ছা করল তা আল্লাহর কুদরতে বনি ইসরাঈলের স্থলে বলয়াম সম্প্রদায়ের নামেই মুখ থেকে বের হয়ে পড়ল।
তার সম্প্রদায়ের লোকেরা বলল যে, ‘আমাদের উপর বদদোয়া করছ?’ জবাবে বলয়াম বলল, ‘এটি আমার অনিচ্ছায়। আল্লাহ এরূপে বের করাচ্ছেন’ পরবর্তীতে বলয়ামের জিহ্বা তার মুখ থেকে বের হয়ে বক্ষদেশে এসে পড়ল। বলয়াম বলল,“আমার তো দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই ধ্বংস হলো। তোমরা একটি কৌশল অবলম্বন কর। তাহলো, তোমাদের নারীদেরকে ফ্যাশন হালে সুসজ্জিত করে কিছু জিনিস তাদের হাতে দিয়ে ঐ বস্তুগুলো বিক্রির বাহানায় বনি ইসরাঈল বাহিনীতে প্রেরণ কর এবং নারীদেরকে বলে দিবে যে, বনি ইসলাঈলের কোনো লোক তাদের কাউকে ডাকলে যেন সাড়া দেয়। যদি তাদের একজনও যেনায় লিপ্ত হয় তবে তাতে তোমাদের সংকট নিরসন হয়ে যাবে।”
বলয়াম সম্প্রদায় তাই করল। অগণিত সুন্দরী ফ্যাশনী নারী বনি ইসরাঈলের বাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ল। এদের মধ্যে একজনের নাম ছিল কুসসি বিনতে সুর। সে বনি ইসরাঈলের সর্দার যমযম ইবনে ছিমালুমের সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিল। যমযম তাকে দেখে তার রূপের উপর আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। তার হাত ধরে হযরত মুসা (আ)-এর নিকট নিয়ে গেল এবং বলল, “এই মহিলা কি আমার জন্য হারাম?” হযরত মুসা (আ) বললেন, “হ্যাঁ, কখনোই তার নিকট যেও না।”
যমযম বলল, “আমি আপনার এই হুকুমের বাধ্য হতে পারছি না।” অতঃপর সে উক্ত নারীকে তাঁবুর ভিতরে নিয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হলো। আল্লাহ তায়ালা তার এ অপরাধের কারণে বনি ইসরাঈলের সৈন্যদের উপর মহামারি প্রেরণ করেন। ফলে কিছু সময়ের মধ্যেই সত্তর হাজার বনি ইসরাঈল ধ্বংস হয়ে যায়। হযরত হারুন আ.-এর পুত্র ফাহাস এই সংবাদ পেয়ে নিজ অস্ত্র দিয়ে যমযমের তাঁবুর মধ্যে ঢুকে যমযম এবং উক্ত নারীকে হত্যা করলেন। আর বললেন, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এ ব্যক্তির গুনাহের কারণে ধ্বংস করছেন। তখনই মহামারি চলে গেল। বলা বাহুল্য, এ ঘটনাটিই হাদীসে বর্ণিত নারীদের কারণে বনি ইসরাঈলের সর্বপ্রথম ফেতনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দারিদ্র্যের ভয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ
____________________
দারিদ্র্যের ভয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ
কুরআন মাজীদে দারিদ্র্যের ভয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
ولا تقتلوا اولادكم خشية املاق نحن نرزقهم واياكم ان قتلهم كان خطئا كبيرا
“তোমরা অভাবের ভয়ে তোমাদের সন্তান-সন্তাতিদেরকে হত্যা করো না, আমিই তাদেরকে ও বিশেষত তোমাদেরকেও রিযিক দান করি। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা মহা গুরুতর পাপ।” ২৮৮
২৮৮.সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩১
অনেকে বলে থাকেন যে, পুরুষ ও স্ত্রীর মিলনের ফলে যে বস্তুটি সৃষ্টি হয়, তা প্রথম চার মাসের মধ্যে নষ্ট করা ইসলামে নিয়ম রয়েছে, তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু আজকাল ডাক্তারগণ পুরুষের শুক্রকীট স্ত্রীলোকের ডিম্বকোষের সাথে মিলিত হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন। লক্ষণীয় যে, যেহেতু দুটি বস্তুকে মিলিত হতে দেয়া হচ্ছে না, তাই কোনো কিছু নষ্ট করার প্রয়োজন হচ্ছে না। এখন আমাদের জানা উচিত যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ কী পদ্ধতিতে করা হচ্ছে এবং কখন কতটুকু করা চলে-এটা কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে আদৌ বিচার্য বিষয় নয়।
এখানে বিচার্য বিষয় হচ্ছে, একটা মৌলিক বিশ্বাস এবং তা হচ্ছে আল্লাহকে পালনকর্তা হিসাবে মান্য করা হবে কি না? কুরআন শরীফে এ কথাটিই বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে- ‘তোমরা গরিব হয়ে যাবে বা খাদ্য সংস্থান করতে পারবে না এ ভয়ে সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদের খাদ্য সংস্থান করব এবং তোমাদেরও।’ এ থেকেই নীতিগতভাবে জন্মহ্রাসের বিরুদ্ধে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠে। অন্যথায়, স্বাস্থ্যগত কারণে অর্থাৎ যদি সন্তান ধারণ করাতে মায়ের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে, পিতা কিংবা মাতা এমন কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত থাকে যার কারণে সন্তানেরও রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে স্বামী-স্ত্রীর পারষ্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে জন্মনিরোধ ব্যবস্থা অবলম্বন করার অনুমতি ফিকাহবিদগণ দিয়েছেন। তাই বলে একে একটা পদ্ধতি হিসাবে সকলের জন্যই গ্রহণ করা অনুমোদনযোগ্য নয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কেবল এ পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। বিশেষ কারণ ছাড়া এ পদ্ধতি গ্রহণ অর্থই দাঁড়ায় আল্লাহর ‘রবুবিয়ত’ বা পালনবাদকে চ্যালেঞ্জ করা। এ দুঃসাহস কোনো মুসলমানের পক্ষেই করা উচিত হবে না।
জন্মনিয়ন্ত্রণ আমাদের সমাজে ক্রমেই ভাইরাস হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বিবাহ-শাদির আলোচনা সামনে আসলেই প্রায় ছেলেমেয়েরা ভাবতে থাকে- বিয়ের পর বাচ্চা নিবে নাকি কয়েক বছর পরে নিবে! বাসর ঘরে যাওয়ার আগেই মনে মনে স্থির করে নেয়, বাচ্চা নিবে নাকি নিবে না। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই পাকাপোক্ত করা হয়। সেজন্য বাসর রাতের পূর্বেই জন্মনিয়ন্ত্রণ তথা পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে পাত্র-পাত্রীর শরয়ী জ্ঞান থাকা উচিত।
আমাদের দেশে প্রচলিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি দু’ধরনের। যথা:
১. অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, ২. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
জন্মনিয়ন্ত্রণের অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হলো আযল করা, অণ্ডকোষ কর্তন করা, জরায়ু কর্তন করা, গর্ভপাত করা। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জন্মনিয়ন্ত্রণ হলো পিলবড়ি খাওয়া, কনডম ব্যবহার করা, কপাটি, ভ্যাসেকটমি, লাইগেশন করা ইত্যাদি।
ইসলামী শরীয়ত শুধুমাত্র শর্তসাপেক্ষে সাময়িক সময়ের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের অনুমতি প্রদান করেছে, জন্মরোধন নয়। শারীরিকভাবে দুর্বল এমন নারীর জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের অনুমতি রয়েছে, যে গর্ভধারণ করলে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। কিংবা গর্ভ এসে গেলে দুগ্ধপোষ্য শিশুর দুধ থেকে বঞ্চিত হয়ে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়া বা স্ত্রীর স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকলে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ দ্বীনদার চিকিৎসকের পরামর্শক্রমেই কেবল জায়েয, নতুবা নয়। তবে যদি অভাব-অনটন কিংবা দাদিদ্র্যের ভয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে এর দ্বারা প্রকারান্তরে আল্লাহ তায়ালার রাজ্জাকিয়্যাতের (একমাত্র রিজিকদাতা) গুণের ওপর সন্দেহ পোষণ করা হয়ে থাকে। এজন্য তা হারামের পর্যায়ভুক্ত।
পরকীয়া প্রেম
____________________
পরকীয়া প্রেম
এক ভদ্র বিবাহিত যুবকের ঘটনা লিখেছেন শায়খ আলী তানতাবী (رحمة الله) । তিনি লিখেন যে, ঐ যুবক ঘটনাক্রমে এক সুন্দরী যুবতির প্রেমের ফাঁদে পড়ে। বেচারির স্বামী প্রবাসী। একমাত্র সন্তানের বয়স চার বছর। টগবগে যৌবন তার উছল উছল করে। কিন্তু স্বামীবিহীন কামনার ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ে বালির সাথে মিলিয়ে যায়। স্কুলের শিক্ষক যুবকের দেহ জুড়ে তারুণ্য ঠিক পড়ছে। সে বিবাহ করেছে বছর দুয়েক আগে। এই বিবাহিত যুবক-যুবতির মাঝে গড়ে ওঠে মন দেয়া-নেয়া। তাদের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গড়ায় যে, একে অন্যকে ছাড়া চলে না। মেয়েটি বিবাহিত যুবকটিকে বলে, ‘আচ্ছা! এভাবে লুকোচুরি করে আর কতদিন চলবে? আমি যে তোমাকে ছাড়া একদণ্ড থাকতে পারি না। আমি তোমার সাথে সুখের ঘর বাঁধতে চাই।’ জবাবে যুবক বলল, তাহলে দিন-তারিখ ঠিক করে বিয়ে সম্পন্ন করে ফেললেই তো হয়। যুবকের আগ্রহ দেখে যুবতি তার পূর্বেকার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার প্রস্তাব দেয়। যুবকও তার কথায় সায় দেয়। কিন্তু সে পড়ে এক অন্যরকম বিপদে। কারণ স্ত্রীকে তো আর এমনিতেই তালাক দেয়া যায় না। তার কোনো না কোনো দোষের অজুহাতেই তো তাকে তালাক দিতে হবে। কিন্তু সে স্বীয় স্ত্রীকে তালাক দেয়ার মতো কোনো দোষ খুঁজে পায় না। একজন সচ্চরিত্রা স্ত্রীকে তালাক দিতে তার বিবেকে চরমভাবে বাঁধে।
এবার মহিলা বলে, ‘যদি তুমি নিজে তালাক দিতে না চাও; তাহলে মেয়েটির প্রতি নানা ধরনের দোষ চাপাতে থাক। মেজাজ খারাপ করাসহ তাকে গালিগালাজ করতে থাক। তাহলে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সে নিজে নিজেই চলে যাবে।’
যুবতির এই ফন্দি যুবকের মনে ধরে। সে প্রেমিকার কথা আমলে নেয়। প্রতিদিনের মতো আজো বাড়ি এসে ভাত খেতে বসে। কিন্তু মাথায় যে শয়তান ঘর করেছে! তার কাঁধে যে সওয়ার হয়েছে পরকীয়ার ভূত! সে খেতে বসেই বলতে থাকে, কী রেঁধেছ? ভাত ফুটেনি। তরকারি সিদ্ধ হয়নি। লবণ বেশি হয়েছে। ঝাল হয়নি। তরকারির রং না হলে খাওয়া যায়? আজকের ভাতে পোড়া গন্ধ লাগছে। ডালটা টক কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাড়িতে এলে বিছানাপত্র অগোছালো দেখি কেন? আঙিনাটা পরিষ্কার দেখতে পাই না কেন? প্যান্ট কীভাবে পরিষ্কার করেছ? দাগটা ওঠেনি কেন?
যুবক যত ত্রুটির কথাই বলে, স্ত্রী সমস্ত কথায় ডান কান দিয়ে শুনে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়। একদিনের ঘটনা। যুবক বাহির থেকে এসে কোন দোষই খুঁজে পাচ্ছে না। দেখে আঙিনায় একটা কুকুর শুয়ে আছে।
স্ত্রী বলে, ‘তোমাকে নিয়ে সংসার করা বড়ই কঠিন হয়ে পড়েছে। কুকুরটা আঙিনায় শুয়ে আছে। তাকে একটা বালিশ পর্যন্ত দাওনি। আমার বাড়িতে কি বালিশের অভাব?’
জবাবে আল্লাহভীরু স্ত্রী তার স্বামীকে বলে যে, ‘হে আমার স্বামী! আপনার কী হয়েছে? আপনার মধ্যে হঠাৎ পরিবর্তন এলো কীভাবে? আপনি আল্লাহকে ভয় করুন। কারণ আল্লাহকে ভয়কারীর সঙ্গে তিনি থাকেন।’ কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তারা আল্লাহকে ভয় কর, ঠিক যতটুকু ভয় তাঁকে করা উচিত ততটুকু। তাঁর কাছে আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ ২৮৯
২৮৯.সূরা ইমরান, আয়াত ১০২
কিন্তু চোর শোনে কি আর ধর্মের কথা? যুবকের মাথায় যে পরকীয়ার নরকীয়া পুরোদস্তর আছর করে আছে। তাই এখন তার কাছে কোনো সত্যই সত্য মনে হয় না। অবশেষে সে ধর্মপ্রাণ মহিলাটিকে তালাক দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।
কপালে তিলক ব্যবহারের কুফল
____________________
কপালে তিলক ব্যবহারের কুফল
কপালে তিলক পরাটা কোনো কোনো নারী ফ্যাশন মনে করে থাকে। বিশেষত যুবতি, তরুণীদের মাঝে এর প্রকোপ অধিক হারে লক্ষ্য করা যায়। এ কথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা চলে যে, কপালে সিঁদুর বা তিলক পরা বিধর্মী বিবাহিত সারীর সংস্কৃতি বা প্রতীক। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অনেক মুসলমান নারীর মধ্যেও কপালে তিলক পরার ব্যাধি আছে। তারা ভেবে থাকে যে, কপালে তিলক না দিলে জাতে ওঠা যায় না। এটা যেন গর্বের প্রতীক তাদের।
আজকাল নানা রঙের তিলক বাজারে পাওয়া যায়। মেয়েদের গায়ের শাড়ি কিংবা অন্যান্য পোশাকের সাথে মিলিয়ে তিলক ব্যবহার করে। অথচ তা বেদ্বীনদের ধর্মীয় রীতির অনুসরণ। সে কারণে তা সম্পূর্ণ হারাম।
নবী করীম ইরশাদ করেছেন- من تشبه بقوم فهو منهم‘যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে।’ ২৯০
২৯০.সুনানু আবি দাউদ, হাদীস নং ৪০৩১
কথিত রূপপূজারী ফ্যাশনবাদী নারীদের মনে সংশয় জাগে, এই চাঁদনিমুখে কারো কুদৃষ্টি পড়বে না তো! তাই তারা ‘বদ-নজর’ থেকে রক্ষার জন্যে চেহারায় একখানা ‘তিলকচিহ্ন’ বসিয়ে দেয়। এই তিলক চিহ্নের নামই ‘বিউটি স্পট’। এই তিলক চিহ্ন নাকি সৌন্দর্যও বাড়াল আবার কুদৃষ্টিকেও প্রতিহত করল।
পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা কি ঘুর্ণাক্ষরেও ভেবে দেখেছি যে, এই কি মুসলিম নারীর জীবন? তুচ্ছ এই দু’দিনের পান্থশালা! যেসব মুসলিম নারী দিবানিশি সৌন্দর্য চর্চায় নিমজ্জিত তারা যেন মনেই করতে পারে না যে, নামাজ-রোযাও তার কাজ। তারা ভেবেই দেখে না যে, তাকে এই জীবন ও অর্পিত কর্তব্য সম্পর্কে একদা জবাবদিহি করতে হবে হরফে হরফে।
তাছাড়া যারা সৌন্দর্যের তিলক এঁকে পথে-প্রান্তরে, পার্কে, মার্কেটে ঘুরে বেড়ায় আর তাদের প্রতি হাজার বছরের রূপতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থাকে রূপপাগল যে পুরুষের দল; তাদের উভয় শ্রেণি সম্পর্কে রাসূলে কারীম (ﷺ) অভিশাপ করেছেন এভাবে-
لعن الله الناظر والمظور اليه
‘ঘুরে ঘুরে রূপদর্শনকারী পুরুষ আর রূপ প্রদর্শনকারী নারীদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার লানত হোক।’ ২৯১
২৯১.গাযযুল বাছার, পৃষ্ঠা ১৫ পৃ.
আমেরিকার এক বিখ্যাত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ তার দীর্ঘজীবনের গবেষণায় বলেন, যে কোনো কেমিক্যাল জাতীয় রং শরীরের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষত স্পর্শকাতর কোনো স্থানে যদি এ জাতীয় রঙের ব্যবহার হয় তবে এর শরীরে চর্ম জাতীয় রোগ বাসা বাঁধে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সারের মতো বড় ধরনের রোগও হয়ে থাকে। মেয়েরা কপালে সাধারণত যে তিলক ব্যবহার করে থাকে তা অনেক কেমিক্যালযুক্ত বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ। আর কপাল হলো মুখের একটা অংশ এবং মুখ হলো শরীরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থান। এটি নারীর সৌন্দর্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং কেউ যদি কপালে সর্বদা তিলক ব্যবহার করে আর এটি যদি তার ত্বকের সাথে এডজাস্ট না হয় তবে এলার্জিসহ যে কোনো চর্ম রোগ দেখা দিতে পারে। এমনকি ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগও তার মুখে, কপালে বাসা বাঁধতে পারে।
বিশেষত ৮ থেকে ২৫ বছর বয়সের মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি বেশি আশঙ্কা হয়ে থাকে। আমাদের উচিত যথাসম্ভব এ জাতীয় কেমিক্যাল শরীরে ব্যবহার থেকে বেঁচে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করা।
মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসাইল
____________________
মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসাইল
শরীয়তের বিভিন্ন বিধি-বিধান নারী-পুরুষ সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে প্রকৃতিগতভাবে কিছু বিষয়ে নারীদের জন্য ভিন্ন বিধান রয়েছে। এখানে কেবল নারীদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু বিধান আলোচনা করার প্রয়োস পাচ্ছি। আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতি সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্যে। আর ইবাদতের জন্য পাক-পবিত্র হওয়া শর্ত। আল্লাহ পবিত্র, কুরআন পবিত্র, মক্কা মদীনা পবিত্রস্থান এমনকি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র বিবিগণও পবিত্র। একারণে এদের নামের ও আলোচনার পূর্বে ‘পবিত্র’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
আল্লাহ পবিত্র এবং পবিত্রতা অর্জনকারীকে তিনি পছন্দ করেন। কিছু ইবাদত আছে যা নাপাকী অবস্থায় করা যায় না। যেমন- নামায, কুরআন স্পর্শ ও বায়তুল্লাহ’র তাওয়াফ। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- وان كنتم جنبا فالطهروا যদি তোমরা অপবিত্র থাক তবে ভালোভাবে পবিত্র হবে। ২৯২
২৯২.সূরা মায়িদা, আয়াত- ৬
পবিত্রতা অর্জনের প্রাথমিক স্তর হল- উযূ। নামায ও কুরআন মাজীদ স্পর্শ ও তিলাওয়াতের জন্য উযূ আবশ্যক। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য উযূর নিয়ম এক ও অভিন্ন।
উযূর ফরয
____________________
উযূর ফরয
উযূর ফরয চারটি। ১. সমস্ত মুখমণ্ডল একবার ধোয়া। অর্থাৎ মাথার চুলের গোড়া থেকে থুত্নীর নীচ পর্যন্ত এবং এক কানের লতি থেকে অপর কানের লতি পর্যন্ত পুরো মুখমণ্ডল ভালোভাবে ধোয়া। ২. উভয় হাতের কনুইসহ একবার ধোয়া, ৩. মাথার এক চতুর্থাংশ পরিমাণ একবার মাসেহ করা ও ৪. উভয় পা গ্রন্থিসহ একবার ধোয়া। উল্লেখিত অঙ্গসমূহের কোনো অংশ ধোয়া না হলে কিংবা পানি না পৌঁছলে উযূ হবেনা এবং ঐ উযূ দ্বারা আদায়কৃত ইবাদতও শুদ্ধ ও কবুল হবে না।
গোসল
____________________
গোসল
গোসল আরবি শব্দ। অর্থ সমস্ত শরীর ধোয়া। শরীয়তের পরিভাষায় পবিত্রতা ও আল্লাহর নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে পবিত্র পানি দ্বারা সমস্ত শরীর ধোয়াকে গোসল বলা হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী পুরুষরা কী কী কারণে গোসল ফরয হয় এবং গোসলের ফরয কী কী তা জানে না। ফলে তারা গোসল করেও সারা জীবন নাপাক থাকে।
গোসল ফরয হওয়ার কারণ
____________________
গোসল ফরয হওয়ার কারণ
১. ইহতিলাম: সহবাস ব্যতিরেকে কামভাবসহ পুরুষ বা মহিলার বীর্য বের হলে, স্পর্শ দ্বারা হোক, দেখার দ্বারা হোক, স্বপ্নদোষ দ্বারা হোক, হস্তমৈথুন দ্বারা হোক, শোয়া অবস্থায় হোক কিংবা জাগ্রত অবস্থায় হোক গোসল করা ফরয। ২৯৩
২৯৩.ফাতোয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড ১, পৃ. ১৬ - ১৭
২. স্ত্রী সহবাস: স্ত্রী সহবাস করলে নারী-পুরুষ উভয়ের উপর গোসল ফরয হয়। বীর্য বের হোক বা না হোক। আর সহবাস সাব্যস্ত হবে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ নারীর যৌনি পথে প্রবেশ করলে। তখন বীর্যপাত না হলেও গোসল ফরয হবে। স্ত্রী সহবাসের সাথে সাথে গোসল করা উত্তম। গোসল না করার কারণে যদি নামায কাযা হয়ে যায় তাহলে গুনাহগার হবে।
৩. হায়েয বন্ধ হয়ে গোসল করে পবিত্রতা অজর্ন করা ফরয।
৪. নিফাস বন্ধ হলেও গোসল করা ফরয।
হায়িয
____________________
হায়িয
মহিলাদের হায়িয প্রকৃতিগতভাবেই হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّىَ يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ
তারা আপনাকে হায়িয সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন, তা অপবিত্র ও আবর্জনাযুক্ত অবস্থা। কাজেই তখন স্ত্রীদের থেকে তোমরা দূরে থাকবে এবং তাদের কাছে গমন করবেনা, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়। অতঃপর তারা যখন পবিত্র হবে, তখন তাদের নিকট গমন করবে, ঠিক সেভাবে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিয়েছেন। যারা অধিক পরিমাণ তাওবা করে এবং পবিত্রতা অবলম্বন করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। ২৯৪
২৯৪.সূরা বাকারা, আয়াত: ২২২
মহিলাদের যৌনপথ দিয়ে সাধারণত তিন ধরনের রক্ত বের হয়ে থাকে।
১. সেইরক্ত, যা অসুখ বিসুখ বা রোগের কারণে বের হয়ে থাকে। এ রক্ত সাধারণত নয় বছর বয়সের পূর্ব থেকে বের হয়ে কিংবা এমন দিন বা বয়সে বের হয় যখন মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। এ ধরনের রক্তকে ‘ইস্তিহাযা’ বা কুরক্ত বলা হয়।
২. হায়িয, ঋতু বা মাসিকের রক্ত।
৩. নিফাসের রক্ত যা সন্তান প্রসবের পর বের হয়।
মহিলা বালিগ হওয়ার পর স্বভাবগতভাবে তাদের জরায়ু থেকে রোগ ব্যাধির কারণ ব্যতিরেকে যে রক্ত নির্গত হয়, একে শরীয়তের পরিভাষায় হায়িয বলে।
হায়িয হওয়ার বয়স কমপক্ষে নয় বছর। এর পূর্বে যদি কোনো বালিকার রক্তস্রাব হয় তাহলে তা হায়িয বলে গণ্য হবে না। সাধারণত পঞ্চান্ন বছর পর্যন্ত মহিলাদের হায়িয হয়ে থাকে। এর পরে রক্তস্রাব হলে একে হায়িয বলে গণ্য করা হবে না। তবে এ বয়সে রক্তের রং যদি গাঢ় লাল হয় অথবা কালচে লাল হয় তাহলে তা হায়িয বলে গণ্য হবে।২৯৫
২৯৫.ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড ১, পৃ. ৩৬
হায়িযের সময়কাল কমপক্ষে তিনদিন তিনরাত এবং উর্ধ্বে দশদিন দশরাত। এর কম বেশি হলে তা হায়িয বলে গণ্য হবে না বরং একে বলা হয় ইস্তিহাযা; যা রোগের কারণে হয়ে থাকে। এর বিধান হায়িযের বিধানের ব্যতিক্রম।
কোনো মহিলার যদি ঋতুকালের নির্ধারিত সময়সীমা থেকে থাকে অতঃপর কখনো যদি সে নির্ধারিত সময়কালের চাইতে বেশি দিন ঋতুকাল চলতে থাকে, তবে সর্বোচ্চ দশদিন পর্যন্ত হায়িয ধরা হবে। যেমন কোনো মহিলার যদি নির্ধারিত তিনদিন ঋতুকাল চলে অতঃপর হঠাৎ একবার চারদিন রক্ত দেখে, তবে ধরে নিতে হবে তার সাধারণ নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে। তার এই চতুর্থ দিনের রক্তও হায়িয বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে তিনদিন হলো তার সাধারণ নিয়ম আর চতুর্থ দিন হলো নিয়মের পরিবর্তন। এভাবে সাধারণ নিয়মের অধিক হলেও দশদিন পর্যন্ত হলে হায়িয হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু দশদিনের পরও যদি রক্ত দেখা দেয় তাহলে গত মাসে কতদিন রক্ত এসেছিল তা দেখতে হবে। যতদিন গতমাসে রক্ত এসেছিল, ততদিন হায়িয ধরবে বাকী দিনগুলো ইস্তিহাযা।
ঋতুর মুদ্দতকালে কোনো একদিন যদি রক্ত দেখা না যায়, তবুও সে দিনটি ঋতুকালের মধ্যে গণ্য হবে। যেমন প্রথম দিন রক্ত দেখা গেল কিন্তু দ্বিতীয় দিন দেখা গেলনা, এভাবে ঋতুচলাকালে মাঝে মধ্যে যদি রক্ত দেখা না যায়, তবুও সেদিনগুলো ঋতুকালের মধ্যে গণ্য হবে।
নিফাস
____________________
নিফাস
সন্তান প্রসবের পর নারীর জরায়ু থেকে যে রক্ত বের হয় তাকে নিফাস বলে। সুতরাং কোনো মহিলা যদি সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান বের করে নেয় এবং তার জরায়ু থেকে রক্ত নির্গত না হয়, তবে সে নেফাসী বলে গণ্য হবে না। নিফসের রক্ত সংক্রান্ত বিধান ও তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কোনো মহিলা যদি যমজ সন্তান প্রসব করে, তবে নিফাসের মুদ্দত গণনা শুরু করতে হবে প্রথম সন্তান প্রসবের পর থেকে।
নিফাসের মুদ্দত
____________________
নিফাসের মুদ্দত
নিফাসের সর্বনিম্ন সময়সীমা নির্ধারিত নেই। সুতরাং সন্তান প্রসবের পর পরই যদি রক্ত বন্ধ হয়ে যায় কিংবা সন্তান প্রসবের পর কোনো রক্তই নির্গত না হয়, তা হলে ধরে নিতে হবে তার নিফাসের সময়সীমা শেষ। তবে নিফাসের সর্বোচ্চ মুদ্দত হলো চল্লিশ দিন। নিফাসের সময়সীমার মধ্যে মাঝে-মধ্যে রক্ত নির্গত না হলেও তা নিফাসের দিন বলে গণ্য হবে। গর্ভপাত হওয়ার অবস্থায় সন্তানের অঙ্গগঠন হয়ে থাকলে যে স্রাব আসে তা নিফাসের রক্ত বলে গণ্য হবে।
হায়িয ও নিফাসের আহকাম
____________________
হায়িয ও নিফাসের আহকাম
হায়িয ও নিফাসের দিনগুলোতে নামায আদায় করা নিষিদ্ধ এবং তার কাযাও আদায় করতে হবে না। এভাবে ঋতুকালীন সময়ে রোযা রাখাও নিষিদ্ধ, তবে তা পরে কাযা করতে হবে।
হায়িয ও নিফাসের সময় মসজিদে প্রবেশ এবং কা’বা ঘরের তাওয়াফ করা নিষেধ। কুরআন তিলাওয়াত করাও নিষিদ্ধ। তবে যদি এক আয়াত থেকে কম হয কিংবা কিরআতের নিয়ত না থাকে বরং দোয়া বা শোকরিয়া আদায় করতে গিয়ে আয়াতাংশ উচ্চারণ করতে পারবে।
হায়িয ও নিফাসের সময় কুরআন স্পর্শ করা জায়েয নেই, এমনকি কোনো বস্তু বা স্থানে কুরআনের পূর্ণ এক আয়াত লিখা থাকলে তাও স্পর্শ করা জায়েয নেই। তিলাওয়াতে সিজদা ও সিজদায়ে শুকরও আদায় করা আবশ্যক নয়। হায়িয নিফাসের সময় স্ত্রী সহবাস হারাম। এ ছাড়া বাকী সব বৈধ। হায়িয-নিফাস বন্ধ হলে গোসল করা ফরয।
ইস্তিহাযা
____________________
ইস্তিহাযা
হায়িয-নিফাসের রক্ত ছাড়া মেয়েদের গুপ্তাঙ্গ হতে রক্ত নির্গত হলে তার নাম ইস্তিহাযা। কোনো মহিলার যদি দীর্ঘদিন ধরে রক্ত নির্গত হয়, তখন মহিলার প্রতি মাসে স্বাভাবিক মাসিকের সময়টাকে ঋতুকালীন সময় বলে গণ্য করা হবে। কোনো মেয়ের যদি প্রথমবার মাসিক শুরু হয়ে থাকে এবং তার মাসিকের স্বাভাবিক কোন মিয়াদকাল নির্দিষ্ট না হয়ে থাকে, তবে মাসিকের সর্বোচ্চ মুদ্দত তথা দশদিন পর্যন্ত নিজেকে ঋতুবতী গণ্য করবে। বাকী দিনগুলোতে মহিলা নিজেকে ‘মুস্তাহাযা’ বা কুরক্তের রোগী মনে করবে।
ইস্তিহাযা রোগীর পবিত্র হওয়ার পদ্ধতি
____________________
ইস্তিহাযা রোগীর পবিত্র হওয়ার পদ্ধতি
মুস্তাহাযা রোগী একবার গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করা জরুরি। হায়িযের মুদ্দত শেষ যখন বুঝবে কিংবা অনুভব করবে, তখন সে পবিত্রতা অর্জন করবে। কোনো কোনো ফকীহ’র মতে এরূপ মহিলা প্রত্যেক নামাযে নতুন উযূ করা আবশ্যক। অপর দলের মতে মুস্তাহাব। অর্থাৎ মহিলা ইচ্ছা করলে প্রত্যেক নামাযের জন্য উযূ করতে পারে ইচ্ছা করলে এক উযূতে সব নামায পড়তে পারে। বুখারী, মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বলেন, ফাতিমা বিনতে আবি হুবাইশ (رضي الله عنه) নবী করিম ’র নিকট এসে আবেদন করলেন, “আমি ইস্তিহাযা বা কুরক্তের রোগী। সবসময় রক্ত বের হয়, কখনো পবিত্র হইনা। এমতাবস্তায় আমি কি নামায ত্যাগ করব?” উত্তরে তিনি বললেন, না। নামায ত্যাগ করবে না, কারণ তা অন্য কোনো শিরা বা উপশিরা থেকে আগত রক্ত, হায়িয নয়। সুতরাং যে ক’দিন হায়িযের রক্ত নির্গত হবে, কেবল সে ক’দিনই নামায ত্যাগ করবে। আর যখন হায়িয বন্ধ হয়ে যাবে, তখন শরীর থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলে নামায পড়বে।” আবু দাউদের বর্ণনায় একথাটি বেশী আছে যে, “এবং প্রত্যেক নামাযের জন্য উযূ করবে।”
ইস্তিহাযা রোগীর করণীয়
____________________
ইস্তিহাযা রোগীর করণীয়
ইস্তিহাযা রোগীর করণীয় হলো- উযূ করার পূর্বে স্বীয় গুপ্তাঙ্গ ভালোভাবে ধুয়ে শক্তভাবে নেকড়া বেঁধে নিবে। তারপর উযূ করে বিলম্ব না করে নামায আদায় করে নিবে।
ইস্তিহাযা রোগীর আহকাম
____________________
ইস্তিহাযা রোগীর আহকাম
ইস্তিহাযা রোগী নামায, রোযা, কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন স্পর্শ, মসজিদে প্রবেশ, ই’তিকাফ, বায়তুল্লাহ’র তাওয়াফ এবং সহবাস করা বৈধ। এ রোগীর বিধান হলো ফোঁটা ফোঁটা পেশাব নির্গত হওয়া এবং নাক দিয়ে রক্ত পড়ার রোগীর বিধানের ন্যায়। যেসব ফকীহগণ এসময় নামায পড়াকে ঐচ্ছিক বিষয় মনে করেছেন, তাদের মতে এ অবস্থায় সহবাস করা বৈধ নয়। পক্ষান্তরে যারা মনে করে ইস্তিহাযা অবস্থায় মহিলারা আইনগতভাবে পবিত্র থাকে এবং নামায পড়াও আবশ্যক, তাদের মতে এ সময় সহবাস করা বৈধ।
হায়িয-নিফাসের আরো কতিপয় বিধান
____________________
হায়িয-নিফাসের আরো কতিপয় বিধান
হায়িয যদি পূর্ণ দশ দিন এবং নিফাস পূর্ণ চল্লিশ দিন পর বন্ধ হয় আর নামাযের সময় যদি তাকবীরে তাহরীমা পর্যন্ত থাকে তবে ঐ ওয়াক্তের নামায তার উপর ফরয হবে। গোসল করে পবিত্র হয়ে কাযা করবে। আর যদি এতটুকু সময় না থাকে, তবে তার উপর ঐ ওয়াক্তের নামায ফরয হবে না।
অনুরূপভাবে হায়িয থেকে দশ দিন পূর্ণ হওয়ার পর পবিত্র হলে এবং রাতের এতটুকু অংশ যদি বাকী না থাকে যাতে একবার ‘আল্লাহু আকবর’ বলতে পারবে, তবে ঐ দিনের রোযা তার উপর ওয়াজিব নয়। আর যদি দশ দিনের পূর্বে এবং এতটুকু পরিমাণ সময় আছে যাতে সুবহি সাদিকের পূর্বে গোসল করে কাপড় পরিধান করে ‘আল্লাহু আকরব’ বলার সময় থাকে, তবে রোযা তার উপর ফরয হবে। যদি গোসল করে নয় তবে উত্তম, আর যদি গোসল নাও করে তাহলে গোসল করা ব্যতিত রোযার নিয়ত করে নিবে এবং সকালে গোসল করে নিবে। যদি এতটুকু সময় না থাকে তবে তার উপর পরের দিনের রোযা ফরয হবে না। তবে রোযাদারের ন্যায় থাকা আবশ্যক।
রোযা অবস্থায় হায়িয-নিফাস আরম্ভ হলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। হায়িয-নিফাস অবস্থায় স্ত্রী সহবাস হারাম। এ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস হালাল মনে করা কুফুরী। হাদিস শরীফে আছে-
مَنْ أَتَى حَائِضًا، أَوِ امْرَأَةً فِي دُبُرِهَا، أَوْ كَاهِنًا، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ
যে ব্যক্তি ঋতুবতীর সাথে সংগম করল, কিংবা স্ত্রীর পেছনের রাস্তা দিয়ে সংগম করল, সে মুহাম্মদের উপর অবতীর্ণ বিধানের সাথে কুফুরী করল। ২৯৬
২৯৬.ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, মুসনাদ, ইমাম তিরমিযী, তিরমিযী শরীফ ও ইমাম নাসাঈ, নাসাঈ শরীফ
আর কেউ যদি এ অবস্থায় সংগম করা হারাম জেনেও সংগম করে তবে সে বড় গুনাহগার হবে এবং তাওবা করা তার উপর ফরয। যদি সংগম হায়িয আসার কালে করে, তবে এক দীনার আর হায়িযের শেষ কালে করলে অর্ধেক দীনার সাদকা করা মুস্তাহাব।
পূর্ণ দশ দিন সমাপ্ত হলে রক্ত বন্ধ হওয়া মাত্র গোসল করা ব্যতিত সংগম করা বৈধ। তবে মুস্তাহাব হলো গোসল করার পর সংগম করা।
দশ দিন পূর্ণ হওয়ার পূর্বে যদি রক্ত বন্ধ হয়, তবে গোসল না করা পর্যন্ত অথবা রক্ত বন্ধ হওয়ার সময়কালীন নামাযের ওয়াক্ত অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পূর্বে সংগম করা জায়েয নেই।
নির্ধারিত সময়সীমা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই যদি রক্ত বন্ধ হয়ে যায় তাহলে গোসল করলেও সংগম বৈধ হবে না, যতদিন পর্যন্ত নির্ধারিত সময়সীমা পূর্ণ না হয়। যেমন কারো নির্ধারিত সময়সীমা ছয় দিন ছিল, কিন্তু এবার পাঁচ দিনেই রক্ত আসা বন্ধ হয়ে গেল, তখন তার বিধান হলো সে গোসল করে নামায আরম্ভ করে দিবে কিন্তু সংগম করার জন্য আরো একদিন অপেক্ষা করা ওয়াজিব। ২৯৭
২৯৭.মুফতি আমজাদ আলী (رحمة الله) (১৩৬৭ হি.) বাহারে শরীয়ত, খণ্ড ২, পৃ. ৯০-৯১
কনের মাসিক অবস্থায় বিয়ে পড়ানোতে কোনো সমস্যা নেই। তবে সমস্যা হবে বাসররাতে স্বামীর সহবাস করতে। যেহেতু এসময় সহবাস করা নিষেধ ও মহাপাপ।
সংগমের সময় স্বামী স্তববৃন্ত চুষতে গিয়ে স্ত্রীর দুধ যদি স্বামীর মুখে চলে যায়, তাহলে স্ত্রী স্বামীর দুধ মা হয়ে যায় না এবং স্ত্রী স্বামীর উপর হারাম হয় না। হারাম হওয়ার জন্য শর্ত হলো দুধপান দুধপান বয়সের ভেতরে হতে হবে। আর তা হলো দু’বছর। এ সময় সন্তানের জন্য দুধ হলো প্রধান খাদ্য। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ
জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধপান করাবে, যদি কেউ দুধপান করার সময় পূর্ণ করতে ইচ্ছা করে। ২৯৮
২৯৮.সূরা বাকারা, আয়াত: ২৩৩
স্ত্রী সহবাসের পর মহিলারা গোসলের পূর্বে ঘরের প্রয়োজনীয় কাজ কর্ম করতে পারবে, তবে যতদ্রুত সম্ভব গোসল করে নেওয়া উত্তম। কারণ পরে ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাছাড়া হঠাৎ এমন প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে, যাতে গোসল করা জরুরি।
গোসলের পর প্রসাবদ্বার থেকে বীর্য বের হলে তা উত্তেজনাবশত নয়; বরং তা কোনোভাবে ভেতরে আটকে থাকা বীর্য। সুতরাং তাতে পুনরায় গোসল করা ওয়াজিব নয়। প্রস্রাবের ন্যায় তা পুনরায় ধুয়ে ফেলে উযূ করলেই যথেষ্ট।
একই রাতে স্ত্রীর সাথে একাধিক বার সংগম করলে কিংবা একাধিক স্ত্রীর সাথে সংগম করলে প্রতিবার সংগম করার পর গোসল করা উচিত। গোসল করা সম্ভব না হলে অন্তত উযূ করে নেওয়া দরকার।
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الخُدْرِيِّ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:إِذَا أَتَى أَحَدُكُمْ أَهْلَهُ، ثُمَّ أَرَادَ أَنْ يَعُودَ، فَلْيَتَوَضَّأْ بَيْنَهُمَا وُضُوءًا
হযরত আবু সাঈদ খুদুরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, যখন তোমাদের কেউ নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাস করে, অতঃপর আবার তা করতে ইচ্ছা রাখে, সে যেন মাঝখানে উযূ করে। ২৯৯
২৯৯.ইমাম মুসরিম (رحمة الله) (২৬১ হি.), সহীহ মুসলিম, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৪৯
সাধারণত স্বামী-স্ত্রী রাতের বেলায় মিলন করে ঘুমায় আর ভোর বেলা কিংবা সকাল বেলা উঠে গোসল করে। এক্ষেত্রে মিলনের পর ঘুমানোর পূর্বে গোসল করে নেওয়া উচিত। অথবা ঘুমানোর পূর্বে পুরুষাঙ্গ ধুয়ে পরিষ্কার করে উযূ করে ঘুমাবে।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: ذَكَرَ عُمَرُ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ تُصِيبُهُ الْجَنَابَةُ مِنَ اللَّيْلِ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রتَوَضَّأْ وَاغْسِلْ ذَكَرَكَ، ثُمَّ نَمْ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (رضي الله عنه) একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র কাছে আরয করলেন, রাতে তিনি জানাবতে পতিত হন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বললেন, তখন তুমি উযূ করবে এবং তোমার পুরুষাঙ্গ ধুয়ে ফেলবে, অতঃপর ঘুমাবে। ৩০০
৩০০.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৪৯
জানাবত অবস্থায় যদি খাবার খেতে হয়, তাহলে উযূ করে খাবে।
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ جُنُبًا فَأَرَادَ أَنْ يَأْكُلَ أَوْ ينَام تَوَضَّأ وضوءه للصَّلَاة
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন জানাবত অবস্থায় থাকতেন, আর এ অবস্থায় খাবার বা ঘুমানোর ইচ্ছা করলে তিনি নামাযের ন্যায় উযূ করতেন। ৩০১
৩০১.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৪৯
স্ত্রী সংগমের পর রাতে হোক বা দিনে হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোসল করে পবিত্র হয়ে যাওয়া উচিত। কারণ হায়াত-মাউতের কোনো গ্যারান্টি নেই। নাপাকী অবস্থায় মৃত্যুও হতে পারে। তাছাড়া নাপাকী ব্যক্তির ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করেনা।
عَنْ عَلِيٍّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: لَا تدخل الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ صُورَةٌ وَلَا كَلْبٌ وَلَا جنب
হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না সে ঘরে যাতে রয়েছে ছবি, কুকুর ও নাপাকী ব্যক্তি। ৩০২
৩০২.আবু দাউদ ও নাসাঈ, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৫০
عَنْ عَمَّارِ بْنِ يَاسِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ثَلَاثٌ لَا تَقْرَبُهُمُ الْمَلَائِكَةُ جِيفَةُ الْكَافِرِ وَالْمُتَضَمِّخُ بِالْخَلُوقِ وَالْجُنُبُ إِلَّا أَن يتَوَضَّأ
হযরত আম্মার বিন ইয়াসার (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির কাছে রহমতের ফেরেশতা আসেনা। কাফেরের মৃতদেহ, খালুক ব্যবহারকারী ও নাপাকী ব্যক্তি কিন্তু সে যদি উযূ করে।৩০৩
৩০৩.আবু দাউদ, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৫০
মহিলাদের নামায ঘরে পড়াই উত্তম
____________________
মহিলাদের নামায ঘরে পড়াই উত্তম
মহিলাদের জন্য নিজের ঘরে নামায পড়াই উত্তম। এতেই তাদের জন্য অধিক সাওয়াব এবং এটিই তাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর বরং এটিই তাদের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মহিলাদেরকে মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করার চেয়ে গৃহে আদায় করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। হযরত উম্মে সালামা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- خير مساجد النساء قعر بيوتهن মহিলাদের সর্বোত্তম মসজিদ হলো তাদের নির্জন কক্ষ।৩০৪
৩০৪.আহমদ ও তাবরানী, সূত্র ফাতাওয়া ও মাসাইল ই. ফা. বা.
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) এবং ইবনে খোযায়মা (رحمة الله) হযরত উম্মে হুযায়েদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র এর নিকট আরয করেছিলাম- হে আল্লাহর রাসূল! আমার বড় সাধ আপনার পিছনে নামায পড়া। তিনি বললেন-
قد علمت انك تحبين الصلوة معى وصلاتك فر بيتك خير من صلاتك فى حجرتك وصلاتك فى حجرتك خير من صلاتك صلاتك فى دارك وصلاتك فى دارك خير من صلاتك فى مسجدى
“আমি জানি আমার পিছনে (মসজিদে জামাতে) নামায পড়া তোমার পছন্দনীয়, তবে তুমি ঘরের অভ্যন্তরীণ যে নামায পড়বে, তা ঐ নামাযের চেয়ে উত্তম যা ঘরের উন্মুক্ত জায়গায় পড়বে। ঘরের ভেতরে যে নামায পড়বে, তা ঐ নামাযের চেয়ে উত্তম, যা ঘরের আঙ্গিনায় পড়বে। ঘরের আঙ্গিনায় যে নামায পড়বে, তা ঐ নামায থেকে উত্তম, যা পড়বে আমার এ মসজিদে।” বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর হযরত উম্মে হুমায়েদ (رضي الله عنه) নিজ ঘরের নিভৃততম কোণে নিজের নামায পড়ার স্থান নির্ধারণ করে নেন এবং জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সেখানে নামায আদায় করেন। তাবরানী তাঁর আল মু’জামুল আওসাত গ্রন্থে হযরত উম্মে সালামা (رضي الله عنه) থেকে অনুরূপ হাদিস বর্ণনা করেছেন।
সুনানে আবু দাউদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
لَا تَمْنَعُوا نِسَاءَكُمُ الْمَسَاجِدَ، وَبُيُوتُهُنَّ خَيْرٌ لَهُنَّ
“তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বারণ করনা। কিন্তু তারা তাদের ঘরে নামায পড়াই তাদের জন্য কল্যাণকর। তাবরানী আল মু’জামুল কবীর গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন- “মহিলাদের সমস্ত নামাযের মধ্যে ঐ নামাযই আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক পছন্দ করেন, যা তারা নিজ ঘরে নিভৃততম কোণে পড়ে।”
মহিলারা পর্দা সহকারে কোনো অত্যাবশ্যকীয় কাজে ঘরের বাইরে গেলে এবং নামাযের সময় হলে এবং মসজিদে মহিলাদের জন্য নামায আদায় করার পৃথক ব্যবস্থা থাকলে সেখানে তারা নামায আদায় করতে পারে।
নারীর অলংকারের যাকাত
____________________
নারীর অলংকারের যাকাত
ইসলামে নারীদের জন্য স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যবহার করা বৈধ। এগুলো পরিধান করে তারা নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য কেবল স্বামীর সম্মুখে প্রকাশ করবে। ইসলামে নারী ধন-সম্পদের মালিক হতে পারে। সুতরাং তাদের ব্যবহৃত অলংকারাদির মালিক তারাই। আমাদের দেশে বিবাহে পাঁচ-দশ ভরি থেকে আরম্ভ করে একশ ভরি পর্যন্ত স্বামীর পক্ষ থেকে কনেকে প্রদান করা হয়। এগুলো নারী গ্রহণ করার পর থেকে নারীই এই সম্পদের মালিক। সুতরাং এর যাকাত তাকেই আদায় করতে হবে এবং যাকাত আদায় না করার যে শাস্তি কুরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে তা নারীই ভোগ করবে। স্ত্রীর সম্পদের যাকাত স্বামীর উপর আবশ্যক নয়। বিষয়টি অনেক মহিলা হয়তো জানেও না। আবার কেউ জানলেও যাকাত দেওয়ার বিষয়টাকে পাত্তাই দেয়না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ - يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ
যারা সোনা-রূপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা অর্থাৎ যাকাত দেয় না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপাল, পার্শ¦দেশ এবং পিঠে দাগ দেওয়া হবে। সেদিন বলা হবে, এটাই তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর। ৩০৫
৩০৫.সূরা তাওবা, আয়াত: ৩৪-৩৫
وَعَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ: أَنَّ امْرَأَتَيْنِ أَتَتَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِي أَيْدِيهِمَا سِوَارَانِ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ لَهُمَا: تُؤَدِّيَانِ زَكَاتَهُ؟ قَالَتَا: لَا. فَقَالَ لَهُمَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَتُحِبَّانِ أَنْ يُسَوِّرَكُمَا اللَّهُ بِسِوَارَيْنِ مِنْ نَارٍ؟ قَالَتَا: لَا قَالَ: فَأَدِّيَا زَكَاتَهُ
হযরত আমর বিন শোয়াইব তাঁর পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন, একদা দু’জন মহিলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র দরবারে উপস্থিত হয়। তাদের হাতে তখন দু’টি স্বর্ণের কংকন ছিল। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা কি এ অলংকারের যাকাত দাও? তারা বলল, না। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা কি পছন্দ কর, এই কংকনদ্বয় জাহান্নামের আগুনের হয়ে যাক? তারা বলল, না। তারপর তিনি বললেন, তাহলে তোমরা এগুলোর যাকাত দাও।৩০৬
৩০৬.তিরমিযী, পৃ. ১৩৮, নাসাঈ, পৃ. ৩৪৩, মিশকাত; পৃ.১৬০
عن اسماء بنت يزبد قالت دخلت انا وخالتى على النبى صلى الله عليه وسلم وعلينا اسورة من ذهب فقال لنا اتعطبان زكوته قالت فقلنا لا فقال اما تخافان ان يسوركما الله اسورة من اليار اديا زكوته
হযরত আসমা বিনতে ইয়াযিদ (رضي الله عنه) বলেন, একদা আমি এবং আমার খালা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র খেদমতে উপস্থিত হলাম। তখন আমাদের হাতে সোনার কংকন ছিল। তিনি বললেন, তোমরা কি এগুলোর যাকাত আদায় কর? আমরা বললাম, না, তখন তিনি বললেন তোমরা কি ভয় করোনা যে, আল্লাহ তোমাদের আগুনের কংকন পরিধান করাবেন? তোমরা এগুলোর যাকাত আদায় কর। ৩০৭
৩০৭.আত্তারগীব, খণ্ড, ১ পৃ. ৩১২
সোনা সাড়ে সাত তোলা এবং রৌপ্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা পরিমাণ কারো মালিকানায় এক বছর থাকলে যাকাত ওয়াজিব হয়। এগুলো ব্যবহৃত হোক কিংবা লকারে কিংবা আলমারিতে সংরক্ষিত হোক সর্বাবস্থায় যাকাত দিতে হবে। মহিলারা এ ব্যাপারে খুবই উদাসীন। যাকাত দেওয়াটা যদি ভারী মনে হয় তাহলে নিসাবের চেয়ে কম পরিমাণ রাখবে। তাহলে অন্তত আল্লাহর কঠিন শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
যাকাত আদায় না করার দুনিয়া, কবর ও পরকালের ভয়াবহ কঠিন শাস্তির ব্যাপারে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য কিতাবে লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যা পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে বর্ণনা করা হচ্ছে না।
হায়িয, ইসতিহাযা ও নিফাস
____________________
হায়িয, ইসতিহাযা ও নিফাস
মহিলাদের জন্য উপরিউক্ত তিনটি বিষয় জানা অতীব প্রয়োজনীয় বিধায়ইসলামিক ফাউণ্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘ফাতাওয়া ও মাসাইল’ গ্রন্থ থেকে এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে সন্নিবেশিত করা হলো।
হায়িযের আভিধানিক অর্থ হল প্রবাহিত হওয়া। শরী’আতের পরিভাষায় বালিগা মহিলার জরায়ু থেকে স্বাভাবিক নিয়মে মাসিক যে রক্তস্রাব হয় তাকে ‘হায়িয’ বলে।
আর অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক অবস্থায় কিংবা রক্তস্রাব সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার বয়সে উপনীত হওয়ার পর অথবা সন্তান প্রসবের পর কিংবা অসুস্থতা জনিত কারণে যদি রক্তস্রাব দেখা দেয় তাহলে তা হায়িয বলে গণ্য হবে না। ৩০৮
৩০৮.বদায়িউস্ সানায়ে ও শরহে বিকায়া
বালিকার বয়স নয় বছর পূর্ণ হওয়ার পর রক্তস্রাব হলে তা হায়িয বলে গণ্য হবে। এর কম বয়সে রক্তস্রাব হলে তা হায়িয বলে গণ্য হবে না। হায়িয সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার স্বাভাবিক বয়সসীমা হল পঞ্চাশ বছর এটাই বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মত। এরপর রক্তস্রাব হলে সাধারণত তা হায়িয বলে গণ্য হয় না। তবে কোন মহিলার পঞ্চাশ বছর বয়সের পরেও যদি তার অভ্যাস অনুযায়ী গাঢ় রক্তস্রাব হয় তা হায়িয বলে গণ্য হবে (আলমগীরী)।
রক্ত যখন যৌনাঙ্গের বর্হিভাগে প্রবাহিত হয় তখন থেকেই হায়িয শুরু হয়েছে বলে গণ্য হবে। যদি যৌনাঙ্গের মুখে কাপড়ের পট্টি থাকে যার কারণে রক্ত বর্হিভাগে প্রবাহিত হতে পারেনি এ অবস্থায় হায়িয শুরু হয়েছে বলে গণ্য হবে না। বরং যখন পট্টি খুলে ফেলা হবে তখন থেকেই হায়িয শুরু হয়েছে বলে গণ্য হবে (আলমগীরী)।
যদি কেউ রোযা অবস্থায় এরূপ করে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত যৌনাঙ্গের বর্হিভাগে রক্ত প্রবাহিত হওয়া রোধ করে রাখতে সক্ষম হয় তাহলে তার রোযা হয়ে যাবে এবং এ অবস্থায় তাকে নামাযও আদায় করতে হবে। ৩০৯
৩০৯.কিতাবুল ফিকহ আলা মাযাহিবিল আরবা’আ, ১ম খণ্ড
কোন হায়িযা মহিলা পট্টি লাগানোর পর খোলার সময় যদি তাতে রক্তের কোন দাগ দেখতে না পায় তাহলে যখন পট্টি লাগিয়ে ছিল তখন থেকেই নিজেকে হায়িয বন্ধ হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।
হায়িযের রক্ত লাল, কালো, হলুদ, কর্দমাক্ত, সবুজ মেটে রং এই ছয় রঙয়ের যে কোন রং হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পট্টি খোলার মুহুর্তে ভিজা অবস্থায় তাতে যে রঙটি পরিলক্ষিত হবে সে রঙটিই বিবেচ্য হবে। শুষ্ক হওয়ার পর যে রং ধারণ করে তা ধর্তব্য হবে না। অতএব পট্টি খোলার সময় যদি সাদা রং পরিলক্ষিত হয় আর শুকানোর পর যদি তা হলুদ রং ধারণ করে তাহলে তাকে সাদা বলেই গণ্য করা হবে এবং তা হায়িয বলে গণ্য হবে না। তবে পট্টি খোলার সময় লাল কিংবা হলুদ রঙ পরিলক্ষিত হলে এবং শুকানোর পর তা সাদা রং ধারণ করলে তাকে লাল বা হলুদ রং বলেই ধরা হবে। এবং তা হায়িয বলে গণ্য হবে। পরিবর্তিত রংটি ধর্তব্য হবে না। ৩১০
৩১০.আলমগীরী, ১ম খণ্ড
হায়িযের সময়সীমা
____________________
হায়িযের সময়সীমা
হায়িযের সর্বনিম্ন সময়সীমা হল তিনদিন তিনরাত। এবং সর্বোচ্চ সময় দশদিন দশরাত। খোলাসা গ্রন্থে এরূপই উল্লেখ রয়েছে।
এই সময়সীমা ছাড়া যদি রক্তস্রাব দেখা যায় তাহলে তা ‘ইসতিহাযা’ বলে গণ্য হবে। আমাদের দলীল হল আবূ উমামাহ্ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস :
قال النبى صلى الله عليه وسلم أقل ما يكون الحيض للجارية اللثيب والبكر جميعا ثلاثة أيام يكون من الحيض عشرة أيام وما زاد على العشرة فهو استحاضة
নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, অবিবাহিত ও বিবাহিত নির্বিশেষে সকল মহিলার হায়িযের সর্বনিম্ন সময় তিন দিন ও সর্বোচ্চ সময় দশ দিন হয়ে থাকে। দশ দিনের অতিরিক্ত যা হবে তা হবে ইস্তিহাযা। ৩১১
৩১১.আলমগীরী ও হিদায়া
কোন মহিলা যদি পূর্ব থেকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে হায়িয হওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত থাকে আর ঘটনাক্রমে কোন এক সময় যদি তার পূর্ব অভ্যাসের চেয়ে অধিক সময় রক্তস্রাব ঘটে তাহলে দশ দিন অতিক্রম করে না যাওয়া পর্যন্ত তা হায়িয বলে গণ্য হবে। যেমন কারো পূর্ব অভ্যাস ছিল তিনদিন কিন্তু কোন এক মাসে সে রক্তস্রাব দেখতে পেল চারদিন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, তার পূর্ব অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে চার দিনে পরিণত হয়েছে। এবং চারদিনেই হায়িয বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে পূর্ব অভ্যাস চারদিন থাকলে পরে পাঁচদিন পর্যন্ত রক্ত দেখলে পূর্ব অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে পাঁচ দিনে রূপান্তরিত হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে এবং পাঁচ দিনই হায়িয বলে গণ্য হবে। অনুরূপ অবস্থা দশ দিন পর্যন্ত চলবে। কিন্তু যখন রক্তস্রাব দশদিন অতিক্রম করে যাবে তখন একে ‘ইস্তিহাযা’ বলে মনে করতে হবে এবং তার পূর্ব অভ্যাসের উপর নির্ভর করতে হবে অর্থাৎ পূর্বে যতদিন হায়িয হত ততদিনই হায়িয বলে গণ্য হবে। এবং পূর্ব অভ্যাসের চেয়ে অতিরিক্ত যতদিন স্রাব হবে তা ‘ইস্তিহাযা’ বলে গণ্য হবে। ৩১২
৩১২.কিতাবুল ফিক্হ
তহুর বা পবিত্রাবস্থার সময়সীমা
____________________
তহুর বা পবিত্রাবস্থার সময়সীমা
দুই হায়িযের মধ্যবর্তী তহুর অর্থাৎ পবিত্রাবস্থার সর্বনিম্ন সময়সীমা পনের দিন। এবং তহুরের সর্বোচ্চ সময়সীমা নির্ধারিত নেই। এমনকি যদি কোন মহিলা বহু বছর রক্তস্রাব বিহীনভাবে অতিবাহিত করে তবে তাকে পরিত্রাবস্থার যেরূপ সময় কাটাতে হয় সেভাবেই কাটাতে হবে। এ ব্যাপারে ইমামগণের মত পার্থক্য নেই।
তবে যদি কোন মহিলার বালিগা হওয়ার সময় থেকে অনবরত রক্তস্রাব শুরু হয় তাহলে তাকে প্রতি মাসে দশদিন হায়িয ও বিশ দিন তাহুর গণ্য করতে হবে। আর যদি হায়িয ও তাহুরের পূর্ব নির্ধারিত কোন অভ্যাস থাকে তা হলে তাকে সেই অভ্যাস অনুযায়ী অনবরত রক্তস্রাবের সময় হায়িয ও তাহুর গণ্য করতে হবে। আর যদি কোন মহিলার অনবরত রক্তস্রাব শুরু হয় কিন্তু তার হায়িয ও তাহুরের বিষয়ে পূর্ব নির্ধারিত অভ্যাস ভুলে যায় এক্ষেত্রে সেই মহিলা তার অভ্যাসের ব্যাপারে গভীর চিন্তা ভাবনা করে তার দিনগুলি নির্ণয় করার চেষ্টা করবে। যদি এও সম্ভব না হয় তাহলে এমতাবস্থায় সেই মহিলার হায়িয ও তহুরের নির্ণয় জটিল বিধায় বিজ্ঞ আলিম থেকে জেনে নিবে। ৩১৩
৩১৩.আলমগীরী, ১ম খণ্ড
তাহুরে মুতাখাল্লাল বা অন্তবর্তীকালীন সাময়িক পবিত্রতা একটি পূর্ণাঙ্গ তহুরের সর্বনিন্ম সময়সীমা পনের দিন। অতএব যদি তাহুর অর্থাৎ স্রাববিহীন সময়ের পরিমাণ তিন দিন থেকে কম হয় তাহলে হানাফী ইমামদের সর্বসম্মত মত অনুসারে এই খণ্ডকালীন তাহুরকে হায়িযের অন্তর্ভুক্ত বলেই গণ্য করা হবে। কিন্তু অন্তবর্তীকালীন তাহুরের পরিমাণ যদি তিন দিন বা তার চেয়ে অধিক হয় এমন কি দশ দিনের অধিক হলেও তা পনের দিনের কম হলে ইমাম আবূ ইউসুফ (رحمة الله) -এর মতে এ তাহুরকে হায়িযের অন্তর্ভুক্ত বলেই গণ্য করা হবে। এটি মূলত ইমাম আবূ হানীফা (رحمة الله) -এর সর্বশেষ মত। এর উপরই ফাত্ওয়া।
কোন মহিলার হায়িযের পূর্ব অভ্যাস ছিল দশ দিন। তার হায়িয সাধারণত যে দিন শুরু হয় তার পূর্বদিন স্রাব দেখতে পেল, তারপর এগার দিন স্রাববিহীন অতিবাহিত করার পর পূনরায় সে স্রাব দেখতে পেল। এই অবস্থায় অন্তবর্তীকালীন স্রাববিহীন দিনগুলিকে স্রাবের অন্তর্ভুক্ত বলেই ধরা হবে। ফলে তার পূর্ব নির্ধারিত দশ দিন হায়িয বলে গণ্য হবে। অথচএই অবস্থায় সে তার হায়িযের প্রথম দিন স্রাব পাওয়া যায় অতপর দশদিন স্রাববিহীন অতিবাহিত হওয়ার পর আবার স্রাব দেখা দেয় তাহলে এ অবস্থায় হায়িযের সূচনা স্রাবের সাথে হলেও শেষ হবে স্রাববিহীন অবস্থা কিংবা যদি হায়িয শুরু হওয়ার নির্ধারিত দিনের পূর্বদিন স্রাব দেখতে পায় অতপর সেই দিন স্রাববিহীন অতিবাহিত করে তারপর আবার স্রাব দেখতে পায় তাহলে তার হায়িযের সূচনা পবিত্রাবস্থায় হবে। কিন্তু শেষ হবে স্রাব চলাকালীন সময়ে। ফাত্ওয়ায়ে হিন্দিয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি দুই প্রান্তের স্রাব ও মধ্যবর্তী তাহুরের সময় মিলে দশ দিনের বেশী না হয় তাহলে মহিলা প্রথম হায়িযওয়ালী হউক বা পূর্ব অভ্যাসে অভ্যস্ত হোক উভয়ের ক্ষেত্রেই দুই দিনের স্রাব ও মধ্যবর্তী পবিত্রতার সময় স্রাবের অন্তর্ভুক্ত হায়িয বলে গণ্য হবে। আর যদি দুই দিনের স্রাব ও মধ্যবর্তী তাহুর মিলে দশ দিন অতিক্রম করে তাহলে যাদের এইমাত্র হায়িযের সূচনা হয়েছে এমন মহিলাদের দশদিন হায়িয বলে গণ্য হবে। আর যাদের পূর্ব থেকে হায়িযের সময়ের পরিমাণ নির্ধারিত আছে তাদের বেলায় পূর্ব নির্ধারিত সময়ের সমপরিমাণ হায়িয বলে গণ্য হবে আর অবশিষ্ট স্রাববিহীন দিনগুলো তাহুর হিসাবে গণ্য হবে (আলমগীরী)।
যদি মধ্যবর্তী তাহুরের পরিমাণ পনের দিন কিংবা তার চেয়ে বেশী হয় তাহলে কোনক্রমেই তা স্রাবের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা যাবে না। বরং তখন তাকে একটি পূর্ণাঙ্গ তাহুর বলে গণ্য করা হবে। এমতাবস্থায় হায়িয বলে গণ্য করা সম্ভব হয় (অর্থাৎ যদি উভয় দিনের স্রাব পৃথক পৃথকভাবে তিন দিন বা তার চেয়ে দীর্ঘ হয়) তাহলে দুই দিনের স্রাবের দিনগুলোকে দু’টি পৃথক হায়িয বলে গণ্য করা হবে। আর যদি এক প্রান্তের স্রাবকে হায়িয বলে গণ্য করা সম্ভব হয় তাহলে তাই করা হবে (আলমগীরী)।
ইস্তিহাযা
____________________
ইস্তিহাযা
ইস্তিহাযা استحاضة শব্দটি ح + ي + ض ধাতু থেকে উদ্গত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ প্রবাহিত হওয়া।
শরীআতের পরিভাষায় ইস্তিহাযার সংজ্ঞা সম্বন্ধে আল্লামা ইব্ন নুজায়ম (رحمة الله) বলেন-
هو دم يسيل من العاذل من امرأة لداء بها
কোন রোগ ব্যধির কারণে কোন মহিলার গর্ভাশয়ের মুখে বিদ্যমান ব্যাগ থেকে যে রক্ত প্রবাহিত হয় একে ইস্তিহাযা বলে (মা‘আরিফুস্ সুনান)।
ফিক্হের কিতাবসমূহে ইসতিহাযার সংজ্ঞা বলা হয়,
هو دم نقص عن ثلثة أيام أو زاد على عشرة فى الحيض وعلى أربعين فى النفاس
হায়িযের ক্ষেত্রে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা কম অথবা দশ দিন দশ রাত অপেক্ষা বেশী এবং নিফাসের ক্ষেত্রে চল্লিশ দিনের বেশী রক্তস্রাব হলে একে ‘ইস্তিহাযা’ বলা হয় (শামী)।
যদি নয় বছরের কম বয়স্কা কোন মেয়ের রক্তস্রাব দেখা দেয় তবে তা ইস্তিহাযা বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে পঞ্চাশ বছরের পরও যদি কারো রক্তস্রাব দেখা দেয় এবং রক্তের রং যদি লাল বা কালো হয় তবে তা হায়িয বলে গণ্য হবে। আর যদি হলদে, সবুজ বা মেটে রংয়ের হয় তবে তা ‘ইস্তিহাযা’ বলে গণ্য হবে। অবশ্য পূর্বেও যদি কোন মহিলার হলদে, সবুজ, মেটে রং -এর স্রাব হওয়ার অভ্যাস থেকে থাকে তবে পঞ্চাশ বছরের পরও হায়িয বলে গণ্য হবে। কোন গর্ভবতী মহিলা যদি তার গর্ভের প্রথম অবস্থায় অথবা সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সময় বাচ্চা বের হওয়ার পূর্বে রক্ত দেখা দেয় তবে তা ‘ইস্তিাহাযা’ বলে গণ্য করা হবে (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)।
যে মহিলা তিন বা চার দিন হায়িয আসার অভ্যাস ছিল সে যদি কোন মাসে দশ দিনের অধিক রক্ত দেখতে পায় তবে অভ্যাসের দিনগুলো হায়িয হবে এবং বাকী দিনগুলো ইস্তিহাযা হবে (হিদায়া)।
বালিগ হতেই কোন মহিলার যদি দশ দিনের চেয়ে অধিক রক্তস্রাব হয় তবে দশ দিন হায়িয হবে আর বাকী দিনগুলো ইস্তিহাযা বলে গণ্য করা হবে (বাহরুর বাইক)। যদি কোন মহিলার প্রথমবারে রক্তস্রাব আরম্ভ হয়ে আর বন্ধ না হয় বরং একাধিক্রমে তা কয়েক মাস পর্যন্ত জারী থাকে তবে যে দিন থেকে রক্তস্রাব আরম্ভ হয়েছে যে দিন থেকে দশ দিন হায়িয এবং অবশিষ্ট বিশ দিন ‘ইস্তিহাযা’ হবে। এভাবে প্রত্যেক মাসে দশদিন হায়িয এবং বাকী বিশদিন ইস্তিহাযা ধরে নিতে হবে।
যদি কোন মহিলা এমন হয় যে, হায়িযের ব্যাপারে তার নির্ধারিত কোন অভ্যাস নেই। কোন মাসে চার দিন কোন মাসে সাত দিন আবার কোন মাসে দশ দিনও হয়েছে। এরূপ মহিলার যদি কোন মাসে দশ দিনের অধিক স্রাব দেখা দেয় তবে দেখতে হবে পূর্বের মাসে যে কতেক দিন হায়িয হয়েছিল এ মাসে সে ক’দিন হায়িয হবে। আর অবশিষ্ট দিনগুলো ‘ইস্তিহাযা’ হবে।
যদি কোন মহিলার এক বা দুই দিন রক্তস্রাব হওয়ার পর পনের দিন পাক থাকে এরপর আবার এক বা দুই দিন রক্তস্রাব হয় তবে সে যে পনের দিন পাক ছিল তা পবিত্রতার সময় হিসাবেই গণ্য হবে। কিন্তু এ পনের দিনের এদিক ওদিক যে দুই এক দিন রক্তস্রাব হয়েছে তা ইস্তিহাযা হিসাবে গণ্য হবে (শামী)।
এক দিন, দুই দিন অর্থাৎ কয়েক দিন রক্তস্রাব হয়ে যদি পাঁচ, সাত, দশ দিন অর্থাৎ পনের দিনের কম রক্ত বন্ধ থাকে এরপর পুরনারয় রক্ত দেখা দেয় তবে মধ্যখানের দিনগুলোর পবিত্রতার দিন হিসাবেই গণ্য বরং এ গুলোর স্রাবের দিন হিসাবেই গণ্য হবে। অতএব যে কতেক দিন হায়িয হওয়ার নিয়ম ছিল সে কয় দিন হায়িয হবে আর বাকী দিনগুলে ‘ইস্তিহাযা’ হবে। যেমন কোন মহিলার অভ্যাস ছিল চাঁদের ১ম, ২য় ও তৃতীয় দিন রক্তস্রাব হওয়া। একমাস এমন হল যে মাসের পহেলা তারিখে স্রাব এসে চৌদ্দ দিন রক্ত বন্ধ থাকল, ষোল তারিখে আবার রক্ত দেখা দিল এ অবস্থায় মনে করতে হবে যে, ষোল দিনই অনবরত তার স্রাব জারী ছিল। এ ষোল দিনের প্রথম তিন দিন হায়িয হবে এবং অবশিষ্ট তের দিন ইস্তিহাযা হিসাবে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে যদি চার, পাঁচ এবং ছয় এই তিন দিন রক্তস্রাব হওয়ার অভ্যাস থাকে তবে এই তিন দিন হায়িযের মধ্যে গণ্য হবে। যদিও এই দিনগুলোতে রক্ত দেখা যায় নি আর প্রথম তিন দিন ও পরের দশ দিন ইস্তিহাযা বলে বিবেচিত হবে। আর যদি কোন মহিলার কোন নির্ধারিত নিয়ম না থাকে বরং বালিগা হতেই ইস্তিহাযা হয়ে যায় তবে প্রথম দশ দিন হায়িয এবং বাকী ছয় দিন ‘ইস্তিহাযা’ হবে (বাহ্রুর রাইক)।
প্রসবান্তে যদি কোন মহিলার চল্লিশ দিনের অধিক রক্তস্রাব হয় এবং এটাই তার প্রথম প্রসব হয়ে থাকে তবে চল্লিশ দিন নিফাস হবে এবং অবশিষ্ট দিনগুলো ইস্তিহাযা হবে (হিদায়া)।
যদি পূর্বও সন্তান প্রসব হয়ে থাকে এবং নিফাসের ক্ষেত্রে তার নির্ধারিত কোন অভ্যাস থাকে তবে অভ্যাসের দিনগুলো নিফাস হবে এবং বাকী দিনগুলো হবে ‘ইস্তিহাযা’ (বাহরুর রায়িক)।
কোন মহিলার প্রসবান্তে ত্রিশ দিন রক্তস্রাব হওয়ার অভ্যাস ছিল এরূপ কোন মহিলা যদি প্রসবের পর চল্লিশ দিনের অধিক রক্ত দেখতে পায় তবে ত্রিশ দিন নিফাসের মধ্যে গণ্য হবে এবং বাকী দিনগুলো হবে ইস্তিহাযা (হিদায়া, ১ম খণ্ড)।
ইস্তিহাযা অবস্থায় নামায রোযার হুকুম
____________________
ইস্তিহাযা অবস্থায় নামায রোযার হুকুম
কারো নাক থেকে রক্ত প্রবাহিত হলে বা লাগাতার পেশাব হলে অথবা রক্ত বা বায়ু জারী থাকলে তাকে যে রূপ মা‘যূর বলে গণ্য করা হয় অনুরূপভাবে মুসতাহাযা মহিলাও শরী‘আতের দৃষ্টিতে মা‘যূর। ইস্তিহাযার কারণে নামায রোযা কিছুই ছাড়াতে হবে না। বরং নামায রোযা যথাসময়ে নিয়ম মাফিক আদায় করবে। এমনকি এ সময় স্ত্রী সহবাস করাও জায়িয আছে (আলমগীরী ১ম খণ্ড)।
ইস্তিহাযা ওয়ালী মহিলা প্রত্যেক নামাযের ওয়াক্তে নুতন অযূ করে এর দ্বারা ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং নফল সব নামায আদায় করতে পারবে। এমন কি কুরআন শরীফও পড়তে পারবে। এ ওয়াক্ত যতক্ষণ পর্যন্ত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার অযূও বাকী থাকবে। ওয়াক্ত চলে যাওয়ার পর অযূ ভঙ্গ হয়ে যাবে। অন্য নামাযের জন্য আবার নূতনভাবে অযূ করতে হবে (হিদায়া ও আলমগীরী)।
ইস্তিহাযা ওয়ালী মহিলা ফযরের নামাযের সময় যে অযূ করেছে এ দ্বারা সূর্যোদয়ের পর কোন অযূ করে থাকে তবে ঐ অযূ দ্বারা যুহরের নামায আদায় করতে পারবে। নুতন অযূ করতে হবে না। কিন্তু আসরের ওয়াক্ত আসলে নুতনভাবে অযূ করতে তবে (হিদায়া)।
ইস্তিহাযা রোগে আক্রান্ত মহিলা কোন ওয়াক্তে অযূ করার পর ঐ ওয়াক্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার অযূ বাকী থাকবে। কিন্তু এ সময় যদি অযূ ভঙ্গের অন্য কোন কারণ পাওয়া যায় তবে অযূ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
ইস্তিহাযা রোগে আক্রান্ত কোন মহিলা অযূ করে নফল নামায পড়তে আরম্ভ করে এক রাক‘আত আদায় করার পর যদি তার ওয়াক্ত খতম হয়ে যায় নামায ফাসিদ হয়ে যাবে। পরে সতর্কতার লক্ষে এর কাযা পড়তে হবে (আলমগীরী)।
ইস্তিহাযা মহিলা যদি কেন বাধন অথবা তুলা দ্বারা রক্ত বন্ধ করতে সক্ষম হয় অথবা অবস্থা যদি এমন হয় যে বসা অবস্থায রক্ত প্রবাহিত হয় না। কিন্তু দাঁড়ালে রক্ত প্রবাহিত হয় এক্ষেত্রে রক্তস্রাব বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা ওয়াজিব। এ অবস্থায় মা‘যূরের হুকুম তার জন্য প্রযোজ্য হবে না। অবশ্য হায়িয ওয়ালী মহিলার বিষয়টি এ থেকে ব্যতিক্রম (আলমগীরী)।
মুস্তাহাযা মহিলাও মাযূরের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। তাই এ ক্ষেত্রেও মাযূরের বিধান প্রযোজ্য হবে।
নিফাসের পরিচিতি
____________________
নিফাসের পরিচিতি
নিফাস ن + ف + س ধাতু হতে উদ্গত হয়েছে।শরী‘আতের পরিভাষায় সন্তান প্রসবের পর যে রক্তস্রাব হয় তাকে নিফাস বলে (হিদায়া)।
প্রসবের সময সন্তানের অর্ধেকের বেশী বের হওয়ার পর যে রক্তস্রাব হবে তা নিফাস হিসাবে গণ্য হবে। আর যদি অর্ধেকের কম বের হওয়ার পর রক্তস্রাব হয় তবে তা ইস্তিহাযা হবে নিফাস হবে না (আলমগীরী ও বাহরুর রাইক)।
যদি কোন মহিলার গর্ভপাত হয় এবং সন্তানের এক দু’টো অঙ্গ পরিষ্কারভাবে দেখা যায় তবে গর্ভপাতের পর যে রক্তস্রাব হবে তা নিফাস হিসাবে গণ্য হবে।
যদি সন্তানের কোন আকৃতি প্রকাশ না পায় শুধু মাংস পিণ্ড দেখা যায় তবে দেখতে হবে ইতিপূর্বে পনের দিন পাক ছিল কিনা এবং রক্তস্রাব কম পক্ষে তিন দিন তিন রাত জারী ছিল কিনা যদি এরূপ হয় তবে তা হায়িয হিসাবে গণ্য হবে এবং এ সময়ের নামায রোযা ছেড়ে দিতে হবে। আর যদি এরূপ না হয় তবে এ রক্তস্রাব ইস্তিহাযা হিসাবে গণ্য হবে (বাহরুর রাইক ও আলমগীরী)।
সন্তুন ভুমিষ্ট হওয়ার আগে ও পরে রক্তস্রাব হলে এবং সন্তানের কিছু অংশ প্রকাশ পেলে আগে আসা রক্ত হায়িয হবে না। অবশ্য পরে আসা রক্ত নিফাস বলে গণ্য হবে (আলমগীরী)।
যদি নাভি ফেটে সন্তান ভূমিষ্ট হয় তাহলে ক্ষত স্থান থেকে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার যে হুকুম তারও সে হুকুম হবে। নিফাসের হুকুম তার জন্য প্রযোজ্য হবে না। অবশ্য নাভির দিক থেকে সন্তান বের হওয়ার পর লজ্জাস্থান দিয়ে রক্তস্রাব হলে তা নিফাস বলে গণ্য হবে (আলমগীরী)।
অনুরূপভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পেট কেটে কোন মহিলার সন্তান প্রসব করানো হলে তার সেই অস্ত্রোপচার জনিত স্বাভাবিক ক্ষতরূপেই গণ্য হবে এবং ক্ষত সম্পর্কে শরীয়তের যে বিধিবিধান রয়েছে এক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য হবে। তবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের পর লজ্জাস্থান দিয়ে রক্ত নির্গত হলে তা নিফাস বলে গণ্য হবে।
যদি যমজ সন্তান হয় তবে প্রথম সন্তানের পর হতেই নিফাস ধর্তব্য হবে। একই গর্ভ থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে দুই সন্তান প্রসবিত হলে যমজ সন্তান বলে বিবেচিত হবে। কাজেই ছয় মাস অথবা তদপক্ষে বেশী সময়ের মধ্যে দুই সন্তান প্রসবিত হরে দু‘গর্ভ হতে জন্মগ্রহণ করেছে বলে গণ্য করা হবে। এবং নিফাসও দু’টি হবে (আলমগীরী)।
যদি কোন মহিলার প্রসবান্তে চল্লিশ দিনের অধিক রক্তস্রাব হয় এবং এটাই তার প্রথম প্রসব হয়, তবে চল্লিশ দিনই নিফাস হিসাবে গণ্য হবে। চল্লিশ দিন পুরা হওয়ার পর গোসল করে নামায পড়বে। আর যদি পূর্বে আরও সন্তান ভূমিষ্ট হয়ে থাকে এবং তার নিফাসের মুদ্দতের ক্ষেত্রে কোন নির্ধারিত নিয়ম থাকে তবে নিয়মের দিনগুলো নিফাস হবে এবং অবশিষ্ট দিনগুলো ইস্তিহাযা হবে (হিদায়া ও আলমগীরী)।
কোন মহিলার প্রসবান্তে ত্রিশদিন রক্তস্রাব হওয়ার অভ্যাস ছিল। কোন একবার সে যদি ত্রিশ দিনের পরেও রক্ত দেখতে পায় তবে সে অপেক্ষা করতে থাকবে। যদি চল্লিশ দিন পূর্ণ হওয়ার পর অথবা চল্লিশ দিনের মধ্যে রক্ত বন্ধ হয়ে যায় তবে সব কয় দিনই নিফাস হিসাবে গণ্য হবে। আর যদি চল্লিশ দিনের বেশী রক্তস্রাব হয় তবে ত্রিশ দিন নিফাসের মধ্যে গণ্য হবে। অবশিষ্ট দিনগুলো ‘ইস্তিহাযা’ হবে (আলমগীরী)।
চল্লিশ দিনের ভিতরে যদি দুইবার রক্তস্রাব হয় এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সময় রক্ত বন্ধ থাকে তবে ইমাম আবূ হানীফা (رحمة الله) -এর মতে এসময়টিও নিফাসের মধ্যে গণ্য হবে (আলমগীরী)।
ইমাম আবূ ইউসূফ (رحمة الله) -এর মতে কোন মহিলার যদি নিফাসের ক্ষেত্রে নির্ধারিত কোন অভ্যাস থাকে তবে একবার যদি এ অভ্যাসের ব্যতিক্রম ঘটে তাহলে তার অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে বলে গণ্য হবে। ৩১৪
৩১৪.আলমগীরী ১ম খণ্ড
Comments
Post a Comment