মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)

পরিচিতি ও উৎর্স
____________________
পরিচিতি ও উৎর্স
মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)
মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
[Bengali translation of Shaykh Tahirul Qadri’s book “Mawlid al-Nabi: Celebration and Permissibility (1st part). Translator: Kazi Saifuddin Hossain]
[উৎসর্গ: পীর ও মুর্শীদ হযরতুল আল্লামা সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী (رحمة الله)-এর পুণ্যস্মৃতিতে…]

অনুবাদকের আরয
____________________
অনুবাদকের আরয
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম,
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আ’লা রাসূলিহিল কারীম,
আম্মা বা’দ।
শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী সাহেব বর্তমান ইসলামী বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ও গণ্যমান্য আলেম-এ-দ্বীন। তাঁর সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার সুযোগ আমার নেই। তিনি অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা, যার মধ্যে ঈদে মীলাদুন্নবী (ﷺ)-বিষয়ক এই বইখানি অন্যতম। সর্ব-জনাব মুহাম্মদ ইমরান সুলাইমান ও ওয়াক্কাস আহমদ আমীন কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত এবং মিনহাজুল কুরআন ইন্টারন্যাশানাল কর্তৃক প্রকাশিত প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার এ বইটির বাংলা অনুবাদকর্মে আমি হাত দিয়েছি। আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব (ﷺ)-এর অসীলায় এবং আমার পীর ও মোর্শেদ (رحمة الله)-এর নেক-নজরে আমাকে কামিয়াব করুন, আমীন।
-কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী
____________________
শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী সাহেব ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের ঝং শহরের আউলিয়া-দরবেশ, আলেম-পণ্ডিত ও শিক্ষকদের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ধর্মীয় শিক্ষার হাতে খড়ি হয় ১২ বছর বয়সে, মাদ্রাসা আল-উলূম আল-শরীয়্যা নামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি মদীনাতুল মুনাওয়ারায় মহানবী (ﷺ)-এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (رضي الله عنه)’র আশীর্বাদধন্য বসতঘরেই অবস্থিত। ড: কাদেরী তাঁর পিতা ও সে সময়কার প্রসিদ্ধ উলামাদের কাছে ইসলামবিষয়ক বিভিন্ন শাস্ত্র ও আরবী বিদ্যা শিক্ষা করেন। ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে তিনি সারা ইসলামী বিশ্ব ঘুরে বেড়ান; মক্কা মুয়াযযমা, মদীনা মুনাওয়ারা, সিরিয়া, বাগদাদ, লেবানন, মাগরেব তথা পশ্চিমাঞ্চল, ভারত ও পাকিস্তানে অনেক প্রখ্যাত আলেমের অধীনে তিনি ধর্মবিদ্যা শিক্ষা করেন; আর তাঁদের কাছ থেকে হাদীসশাস্ত্র ও অন্যান্য ইসলামী আধ্যাত্মিক জ্ঞানের শাস্ত্রে প্রায় ৫০০ এজাযত ও সনদ লাভ করেন। এর মধ্যে রয়েছে এজাযতের একটি নজিরবিহীন, অনন্য ও মহাসম্মানিত সনদ যা তাঁকে চারজন শিক্ষকের মাধ্যমে সংযুক্ত করেছে সাইয়্যেদুনা শায়খ আবদুল কাদের জিলানী আল-হাসানী ওয়াল হুসাইনী আল-বাগদাদী (رحمة الله)’র পুত্র শায়খ আবদুর রাযযাক (رحمة الله)’এর সাথে, ‘ফুতুহাতে মক্কীয়্যা’ গ্রন্থপ্রণেতা শায়খুল আকবর মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী আল-দামেশকী (رحمة الله)’র সাথে এবং মিসরীয় মহান হাদীসশাস্ত্র বিশারদ ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله)’র সাথেও। অপর একটি সনদ দ্বারা তিনি কেবল একজন শিক্ষকের মাধ্যমে ইমাম ইউসূফ বিন ইসমাঈল নাবহানী (رحمة الله)’র সাথে যুক্ত রয়েছেন। তাঁর সনদগুলো তাঁরই দুইটি ‘সাবত’ তথা বিস্তারিত তালিকায় প্রকাশিত হয়েছে: ‘আল-জওয়াহির আল-বাহিরা ফীল্ আসানিদ আত্ তাহিরা’ এবং ‘আল-সুবূল আল-ওয়াহাবিয়্যা ফীল্ আসানিদ আল-যাহাবিয়্যা’।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ড: কাদেরী সাহেব ১৯৭০ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক প্রথম শ্রেণি (সম্মান) সনদ লাভ করেন। ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে ১৯৭২ সালে ইউনিভার্সিটি গোল্ড মেডাল-সহ এম,এ, এবং ১৯৭৪ সালে এল,এল,বি, পাশ করার পর তিনি ঝং জেলা কোর্টে আইন পেশার সাথে যুক্ত হন। তিনি ১৯৭৮ সালে লাহোরে চলে আসেন এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষকের পদে যোগ দেন; আর ইসলামী আইনশাস্ত্রে তাঁর ডক্টরেট-ও সম্পন্ন করেন। পরবর্তীকালে তাঁকে ইসলামী আইন বিভাগে অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয় এবং তিনি এল,এল,এম, পর্যায়ে ইসলামী আইন প্রণয়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ড: তাহিরুল কাদেরী সাহেব পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের এপেলেট শরীয়াহ বেঞ্চের আইনি উপদেষ্টা এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইসলামী পাঠ্যক্রম উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা পদেও দায়িত্ব পালন করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ইসলামী আইনজ্ঞ ও পণ্ডিতের সু্খ্যাতি অর্জন করেন এবং ইসলামী বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় একজন আলেমে দ্বীন হিসেবে পরিচিতি পান। অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা, গবেষক ও সুবক্তা ড: কাদেরী সাহেব প্রায় এক সহস্র পুস্তক প্রণয়ন করেছেন, যার মধ্যে চার’শ পঞ্চাশটিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে; আর তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আরবী, উর্দূ ও ইংরেজি ভাষায় ছয় সহস্রাধিক প্রভাষণও প্রদান করেছেন।
ইসলামের নামে আত্মঘাতী বোমা হামলা ও সন্ত্রাসবাদের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শায়খুল ইসলাম ড: তাহিরুল কাদেরী সাহেব একটি ঐতিহাসিক ফতোওয়া জারি করেন। এটাকে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করা হয়, কেননা এ-ই প্রথমবার যখন সন্ত্রাসের হোতাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের একটি সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ইসলামী ডিক্রী তথা ফতোওয়া এতো ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। ছয়’শ পৃষ্ঠাসম্বলিত মূল ফতোওয়াটি লেখা হয়েছিল উর্দূ ভাষায়, আর এতে বিধৃত হয়েছিল ব্যাপক গবেষণালব্ধ আল-কুরআনের বাণী, মহানবী (ﷺ)’র হাদীস, আসহাব-এ-কেরাম (رضي الله عنه)’এর মতামত ও বিশ্ববরেণ্য ইসলামী পণ্ডিতদের সর্বজনগৃহীত লেখনীসমূহ। এই ঐতিহাসিক গবেষণাকর্ম ইংরেজি ও ইন্দোনেশীয় ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে; অপরদিকে আরবী, নরওয়েজীয়, ড্যানিশ, হিন্দী ও অন্যান্য প্রধান প্রধান ভাষায় এর অনুবাদের কাজ চলছে। মিসরীয় জামেউল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী গবেষণা একাডেমী এই ফতোওয়ার ওপর একটি বিস্তারিত বিবরণ লিখেছে এবং এর প্রতিপাদন-ও করেছে।
ড: কাদেরী সাহেব মিনহাজুল কুরআন ইন্টারন্যাশানাল (এম,কিউ,আই) সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পদে দায়িত্বরত। এই সংস্থার শাখা ও সেন্টারগুলো বিশ্বের নব্বইটিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে আছে। শায়খ তাহিরুল কাদেরী সাহেব পাকিস্তানের লাহোর শহরে অবস্থিত মিনহাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অফ গভর্নরস্-এর সভাপতি; বিশ্ববিদ্যালয়টি পাকিস্তানের সরকারি সনদপ্রাপ্ত। এছাড়াও তিনি মিনহাজ শিক্ষা সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা, যে সংস্থাটি পাকিস্তানে ছয় শতাধিক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। ড: কাদেরী মিনহাজ কল্যাণ ফাউন্ডেশনেরও সভাপতি; যে সংস্থাটি সারা বিশ্বে মানবিক ও সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত।

মওলিদুন্নবী (ﷺ)
____________________
মওলিদুন্নবী (ﷺ)

আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
(হে রাসূল) বলুন: আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া (মহানবীকে তাদের মাঝে প্রেরণের মাধ্যমে); সেটারই ওপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত হতে শ্রেয়। [আল-কুরআন, ১০:৫৮; মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেব কৃত তাফসীরে নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ]
মহানবী (ﷺ)-এর হাদীস শরীফ –
আমি হলাম আমার পূর্বপুরুষ (পয়গম্বর) ইবরাহীম (عليه السلام)’এর দোয়া এবং পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام)’র প্রদত্ত শুভসংবাদ। (আমার ধরাধামে শুভাগমনের সময়) আমার মা তাঁর (পবিত্র দেহ মোবারক) হতে নূর (তথা আলো/জ্যোতি) প্রত্যক্ষ করেন যা শাম-দেশের অর্থাৎ সিরিয়ার প্রাসাদগুলো আলোকিত করে। [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল]

সূচিপত্র
____________________
সূচিপত্র
মুখবন্ধ
প্রথম অধ্যায়
মওলিদুন্নবী (ﷺ) ও ইসলামের বিভিন্ন নিদর্শন: সঠিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণের আলোকে
১.১ আল-কুরআনের প্রদর্শিত হেদায়াত হিসেবে ‘যিকরের’ তাৎপর্য
১.২ পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)’এর দ্বীন (ধর্ম)
পরিচ্ছেদ – ১
আম্বিয়া (عليه السلام)’র স্মরণে (যিকরে): পাঁচ ওয়াক্ত নামায
১.৩ ফজরের নামায: পয়গম্বর আদম (عليه السلام)’এর স্মরণে
১.৪ যোহরের নামায: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)’এর স্মরণে
১.৫ আসরের নামায: পয়গম্বর উযায়র (عليه السلام)’এর স্মরণে
১.৬ মাগরেবের নামায: পয়গম্বর দাউদ (عليه السلام)’এর স্মরণে
১.৭ ’এশার নামায: মহানবী (ﷺ)’র স্মরণে
পরিচ্ছেদ – ২
আম্বিয়া (عليه السلام)’র স্মরণে (যিকরে): হজ্জ্বের বিভিন্ন রীতি ও প্রথা
১.৮ এহরাম: হজ্জ্বে আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের পরিধেয় বস্ত্রের স্মরণে
১.৯ তালবিয়া: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) কর্তৃক হজ্জ্বের প্রতি আহ্বান ও তার উত্তরের স্মরণে
১.১০ তওয়াফ: আম্বিয়া (عليه السلام)’র সুন্নাহ (রীতিনীতি)’র স্মরণে
১.১১ রামল: মহানবী (ﷺ) ও সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)’এর দ্বারা অনুশীলিত তওয়াফ-পদ্ধতির স্মরণে
১.১২ ইদতিবা: সর্বশেষ নবী (ﷺ)’র সুন্নাহ
১.১৩ কালো পাথর চুম্বন: আল্লাহর প্রিয় বান্দার অনুশীলিত প্রথার স্মরণে
১: ১৪ মাক্বামে ইবরাহীম: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)’এর স্মরণে
১:১৫ সাফা ও মারওয়া’র সাঈ: হযরত মা হাজেরের সুন্নাহর স্মরণে
১:১৫.১ যমযম কূপ: নামের উৎপত্তির কারণ
১.১৬ আরাফাত, মুযদালিফা ও মিনা: পয়গম্বর আদম (عليه السلام)’এর স্মরণে
১.১৭ আরাফাত ও মুযদালিফায় আদায়কৃত নামাযের একত্রীভবন: মহানবী (ﷺ)’র সুন্নাহ
১.১৮ পশু কুরবানি: পয়গম্বর ইসমাঈল (عليه السلام)’এর স্মরণে
১.১৮.১ কুরবানির পশু: আল্লাহর চিহ্নগুলোর একটি
১.১৯ কঙ্কর নিক্ষেপ প্রথা: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)’এর সুন্নাহ
১.১৯.১ একটি আপত্তি
১.১৯.২ আপত্তির প্রতি আমাদের জবাব
দ্বিতীয় অধ্যায়
আনন্দ ও বিষাদময় ঘটনার স্মরণে
২.১ পয়গম্বর মূসা (عليه السلام)’র দিবসের স্মরণে
২.২ পয়গম্বর নূহ (عليه السلام)’এর দিবসের স্মরণে
২.৩ ইসলাম-ধর্মের পূর্ণতাপ্রাপ্তির দিবস: খুশি উদযাপনের দিন (ঈদ)
২.৪ আল-হিজর অতিক্রমকালে মহানবী (ﷺ)’র নির্দেশ
২.৪.১ আল-হিজরে অবস্থিত সামুদের কুয়ো হতে পানি পানে নিষেধাজ্ঞা
২.৪.২ পয়গম্বর সালেহ (عليه السلام)’এর মাদী উটের সাথে সংশ্লিষ্ট কুয়ো হতে জলপানসম্পর্কিত আদেশ
২.৪.৩ পয়গম্বর সালেহ (عليه السلام)’এর মাদী উটের স্মরণে
২.৪.৪ সামূদের প্রতি বিধানকৃত শাস্তি স্মরণকালে দুঃখ প্রকাশ
২.৪.৫ আল-হিজর অতিক্রমকালে মহানবী (ﷺ)’র নিজস্ব আমল
২.৪.৫.১ বিবেচনাযোগ্য বিষয়াবলী
২.৫ হস্তীবাহিনীর লোকদের প্রতি অবতীর্ণ শাস্তির স্মরণ এবং মুহাসসির উপত্যকা দ্রুত অতিক্রম
২.৬ হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) কর্তৃক ব্যক্ত অনুতাপ
তৃতীয় অধ্যায়
আম্বিয়া (عليه السلام)’র মওলিদের স্মরণ: একটি কুরআনী বিশ্লেষণ
৩.১ মওলূদের পটভূমি
৩.২ আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের স্মরণ: এক ঐশী-প্রথার চর্চা
৩.৩ আম্বিয়া (عليه السلام)’র মওলিদের তাৎপর্য
৩.৩.১ পয়গম্বর আদম (عليه السلام)’এর মওলিদ
৩.৩.২ পয়গম্বর মূসা (عليه السلام)’র মওলিদ
৩.৩.৩ মরিয়ম (عليه السلام)’এর মওলিদ
৩.৩.৪ পয়গম্বর ইয়াহইয়া (عليه السلام)’র মওলিদ
৩.৩.৫ পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام)’র মওলিদ
৩.৩.৬ মনোনীত জন – মহানবী (ﷺ)’র মওলিদ
৩.৪ আম্বিয়া (عليه السلام)’র মওলিদ হতে মহানবী (ﷺ)’র মওলিদের ধারাবাহিকতা
চতুর্থ অধ্যায়
মওলিদুন্নবী (ﷺ)’র সমর্থনে আল-কুরআনের দলিল
৪.১ কুরআন নাযেলের উদযাপন হতে দলিল
৪.১.১ লাইলাতুল কদরের রাত ও বেলাদত শরীফের রাতের মধ্যকার তুলনা
৪.২ কোনো নেয়ামত লাভের উদযাপন হতে দলিল
৪.৩ মুক্তি লাভের উদযাপন হতে দলিল
৪.৩.১ সভ্যতা জারি থাকার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিষয়
৪.৪ কোনো খোদায়ী আশীর্বাদ লাভে খুশি প্রকাশ করা আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের সুন্নাত
৪.৪.১ বিবেচনাযোগ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
৪.৫ মওলিদুন্নবী (ﷺ) উদযাপনের পক্ষে খোদায়ী আদেশ
৪.৫.১ ‘ক্বুল’ (বলুন) শব্দটির মধ্যে লুক্কায়িত কুরআনী দর্শন
৪.৫.১.১ আল্লাহতে বিশ্বাসের আগে রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের অপরিহার্যতা
 
৪.৫.১.২ ‘ক্বুল’ (বলুন) শব্দটির ব্যবহার দ্বারা খোদায়ী আজ্ঞার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বৃদ্ধি
৪.৫.২ মহানবী (ﷺ) হলেন আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া
৪.৫.২.১ একটি কৌতূহলোদ্দীপক বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়
৪.৫.২.২ কুরআন দ্বারা কুরআনের তাফসীর/ব্যাখ্যা
৪.৫.২.২.১ “এবং আল্লাহ-ই সবচেয়ে বেশি ফযল তথা অনুগ্রহশীল” মর্মে আয়াতটির অর্থ
৪.৫.২.২.২ বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থগুলোতে ‘ফযল’ শব্দটির অর্থ
৪.৫.২.২.৩ বিখ্যাত তাফসীরগুলোতে ‘ফযল’ ও ‘রহমত’ (করুণা) শব্দগুলোর অর্থ
৪.৫.২.২.৪ মৌ: আশরাফ আলী থানবীর অভিমত
৪.৫.৩ আমরা কেন ‘ফযল’ ও ‘রহমত’-প্রাপ্তি উদযাপন করবো তার বর্ণনা
৪.৫.৪ আয়াতটিতে (ঐশী আজ্ঞা) সীমিতকরণসূচক শব্দার্থ ব্যবহারের উদ্দেশ্য
৪.৫.৫ আয়াতোল্লিখিত ‘ফাবিযালিকা’ (সেটারই মধ্যে) কথাটি ব্যবহারের গূঢ়রহস্য
৪.৫.৬ ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে (ঐশীদানের প্রতি) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
৪.৫.৭ এই আয়াতে পাকে অনেক তাকিদমূলক শব্দের প্রয়োগ
৪.৫.৮ “তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়” মর্মে আয়াতটির তাফসীর (ব্যাখ্যা)
৪.৬ খোদায়ী মহা অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের নিদর্শন-ই মওলিদুন্নবী (ﷺ)’র উদযাপন
৪.৭ ঐশী করুণা ও আশীর্বাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কেন জরুরি?
৪.৮ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিভিন্ন প্রচলিত পদ্ধতি
৪.৮.১ খোদায়ী নেয়ামতের স্মরণ ও উল্লেখ (যিকর-তাযকেরা)
৪.৮.২ এবাদত ও বন্দেগী
৪.৮.৩ প্রাপ্ত আশীর্বাদের ঘোষণা প্রদান
৪.৮৩.১ এই আশীর্বাদের ঘোষণা আমরা কীভাবে দেবো?
৪.৮.৪ ঈদ-উৎসব হিসেবে পালন
পঞ্চম অধ্যয়
মওলিদুন্নবী (ﷺ)’র সমর্থনে হাদীসের দলিল
৫.১ ‘এয়াওমে আশুরা’ (মহররমের ১০ তারিখ) পালনের দলিল
৫.১.১ পয়গম্বর মূসা (عليه السلام)’র দিবসটি উদযাপন
৫.১.২ মহানবী (ﷺ) কর্তৃক ওই দিবসটি পালন মূসা (عليه السلام)’র সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতার কারণেই
৫.১.৩ ইহুদীদের ‘এয়াওমে আশুরা’কে ঈদ উৎসব হিসেবে পালন
৫.১.৪ মওলিদুন্নবী (ﷺ)’র পক্ষে ইমাম আসকালানী (رحمة الله)’র প্রামাণিক দলিল
৫.২ পয়গম্বর নূহ (عليه السلام)’এর দিবস উদযাপনের পক্ষে দালিলিক প্রমাণ
৫.৩ কা’বা শরীফের আচ্ছাদন পরিবর্তন দিবস পালনের প্রামাণ্য দলিল
৫.৪ দ্বীন-ইসলামের পূর্ণতাপ্রাপ্তি দিবসকে ঈদ হিসেবে উদযাপনের দলিল
৫.৫ জুমুআ’ দিবসের মাহাত্ম্য: পয়গম্বর আদম (عليه السلام)’এর সৃষ্টি হয় এদিনে
৫.৫.১ জুমুআ’ দিবস: (রাসূল-দ:-এর প্রতি) সালাওয়াত ও সালাম প্রেরণের দিন
৫.৬ পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام)-এর জন্মস্থানের গুরুত্ব ও এর যেয়ারত
৫.৭ মহানবী (ﷺ) নিজের বেলাদত-দিবস উদযাপন করেন রোযা পালনের মাধ্যমে
৫.৮ মহানবী (ﷺ) নিজের বেলাদত-দিবস উদযাপন করেন পশু কুরবানীর মাধ্যমে
৫.৯ মহানবী (ﷺ)’র ধরাধামে শুভাগমনে খুশি প্রকাশ করায় এক কাফেরের শাস্তি লাঘব
৫.৯.১ কেন এক কাফেরের শাস্তি লাঘব করা হয়েছে?
৫.৯.২ একটি আপত্তি ও তার জবাব
৫.৯.৩ একটি সতর্কতামূলক উপদেশ
ষষ্ঠ অধ্যায়
মওলিদুন্নবী (ﷺ) উদযাপনের ব্যাপারে মুহাদ্দেসীন-এ-কেরাম ও ইমামবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি
৬.১ হুজ্জা আল-দীন ইমাম মুহাম্মদ বিন যুফার (৪৯৭-৫৬৫ হিজরী)
৬.২ শায়খ মুঈন আল-দীন উমর বিন মুহাম্মদ আল-মাল্লা (জন্ম: ৫৭০ হিজরী)
৬.৩ ইবনে আল-জাওযী (৫১০-৫৭৯ হিজরী)
৬.৪ আবূ আল-খাত্তাব বিন দিহইয়া আল-কালবী (৫৪৪-৬৩৩ হিজরী)
৬.৫ শামস আল-দীন আল-জাযারী (বেসাল: ৬৬০ হিজরী)
৬.৬ ইমাম আবূ শামা (৫৯৯-৬৬৫ হিজরী)
৬.৭ ইমাম সদর আল-দীন মাওহুব বিন উমর আল-জাযারী (বেসাল: ৬৬৫ হিজরী)
৬.৮ ইমাম যাহির আল-দীন জা’ফর আল-তাযনাতী (বেসাল: ৬৮২ হিজরী)
৬.৯ ইবনে তাইমিয়্যা (৬৬১-৭২৮ হিজরী)
৬.১০ ইমাম আবূ আবদ-আল্লাহ বিন আল-হাজ্জ আল-মালেকী (বেসাল: ৭৩৭ হিজরী)
৬.১১ ইমাম শামস আল-দীন আল-যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হিজরী)
৬.১২ ইমাম কামাল আল-দীন আল-আদফাউয়ী (৬৮৫-৭৪৮ হিজরী)
৬.১৩ তকী আল-দীন আবূ আল-হাসান আল-সুবকী (৬৮৩-৭৫৬ হিজরী)
৬.১৪ ইমাদ আল-দীন বিন কাসীর (৭০১-৭৭৪ হিজরী)
৬.১৪.১ আবূ সাঈদ আল-মুযাফফর (সুলতান গাযী সালাহউদ্দীনের ভগ্নিপতি) কর্তৃক উদযাপিত মওলিদুন্নবী (ﷺ)
৬.১৫ বুরহান আল-দীন বিন জামা’আ (৭২৫-৭৯০ হিজরী)
৬.১৬ যাইন আল-দীন বিন রাজাব আল-হাম্বলী (৭৩৬-৭৯৫ হিজরী)
৬.১৭ ওলী আল-দীন আবূ যুর’আ আল-ইরাক্বী (৭৬২-৮২৬ হিজরী)
৬.১৮ শামস আল-দীন মুহাম্মদ আল-দিমাশকী (৭৭৭-৮৪২ হিজরী)
৬.১৯ ইবনে হাজর আল-আসকালানী (৭৭৩-৮৫২ হিজরী)
৬.২০ ইমাম শামস আল-দীন আল-সাখাবী (৮৩১-৯০২ হিজরী)
৬.২১ ইমাম জালাল আল-দীন আল-সুয়ুতী (৮৪৯-৯১১ হিজরী)
৬.২২ শিহাব আল-দীন আবূ আল-আব্বাস আল-কসতলানী (৮৫১-৯২৩ হিজরী)
৬.২৩ নাসির আল-দীন বিন আল-তাব্বাখ
৬.২৪ জামাল আল-দীন বিন আবদ্ আল-রাহমান অাল-তাত্তানী
৬.২৫ ইমাম ইউসূফ বিন আলী বিন যারিক্ব আল-শামী
৬.২৬ মুহাম্মদ বিন ইউসূফ আল-সালেহী আল-শামী (বেসাল: ৯৪২ হিজরী)
৬.২৭ ইবনে আল-হাজর আল-হায়তামী আল-মক্কী (৯০৯-৯৭৩ হিজরী)
৬.২৮ মুহাম্মদ বিন জার আল্লাহ বিন যাহিরা আল-হানাফী (বেসাল: ৯৮৬ হিজরী)
৬.২৯ কুতুব আল-দীন আল-হানাফী (বেসাল: ৯৮৮ হিজরী)
৬.৩০ মোল্লা আলী ক্বারী (ইন্তেকাল: ১০১৪ হিজরী) কৃত গবেষণা
৬.৩১ মোজাদ্দেদে আলফে সানী (৯৭১-১০৩৪ হিজরী)
৬.৩২ ইমাম আলী বিন ইবরাহীম আল-হালাবী (৯৭৫-১০৪৪ হিজরী)
৬.৩৩ শায়খ আবদ আল-হক্ব মুহাদ্দীস আল-দেহেলভী (৯৫৮-১০৫২ হিজরী)
৬.৩৪ ইমাম মুহাম্মদ আল-যুরকানী মালেকী (১০৫৫-১১২২ হিজরী)
৬.৩৫ শাহ আবদ আল-রাহীম আল-দেহেলভী (১০৫৪-১১৩১ হিজরী)
৬.৩৬ শায়খ ইসমাঈল আল-হাক্কী (১০৬৩-১১৩৭ হিজরী)
৬.৩৭ শাহ ওলী আল্লাহ মুহাদ্দীস আল-দেহেলভী (১১১৪-১১৭৪ হিজরী)
৬.৩৮ শাহ আবদ আল-আযীয মুহাদ্দীস আল-দেহেলভী (১১৫৯-১২৩৯ হিজরী)
৬.৩৯ আবদ আল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আবদ আল-ওয়াহহাব আল-নজদী (১১৬৫-১২৪২ হিজরী)
৬.৪০ শাহ আহমদ সাঈদ মুজাদ্দেদী আল-দেহেলভী (ইন্তেকাল: ১২৭৭ হিজরী)
৬.৪১ মুফতী মুহাম্মদ এনায়াত আহমদ আল-কাকাওরাউয়ী (১২২৮-১২৭৯ হিজরী)
৬.৪২ আহমদ আলী সাহারানপুরী (ইন্তেকাল: ১২৯৭ হিজরী)
৬.৪৩ সাইয়্যেদ আহমদ বিন যাইনী আল-দাহলান মক্কী (১২৩৩-১৩০৪ হিজরী)
৬.৪৪ আবদ্ আল-হাই লাখনৌভী (১২৬৪-১৩০৪ হিজরী)
৬.৪৫ নওয়াব সিদ্দীক হাসান খাঁন ভূপালী (মৃত্যু: ১৩০৭ হিজরী)
৬.৪৬ হাজ্বী এমদাদউল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (১২৩৩-১৩১৭ হিজরী)
৬.৪৭ নওয়াব ওয়াহিদুজ্জামান (ইন্তেকাল: ১৩৩৮ হিজরী)
৬.৪৮ ইউসূফ বিন ইসমাঈল আল-নাবহানী (১২৬৫-১৩৫০ হিজরী)
৬.৪৯ ড: মুহাম্মদ ইকবাল (১২৯৪-১৩৫৭ হিজরী)
৬.৫০ আশরাফ আলী থানবী (১২৮০-১৩৬২ হিজরী)
৬.৫১ মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানবী (জন্ম: ১৩৪১ হিজরী)
৬.৫২ মুফতী মুহাম্মদ মাযহারউল্লাহ আল-দেহেলভী
৬.৫৩ শায়খ মুহাম্মদ রেযা আল-মিসরী সাহেবের গবেষণা
৬.৫৪ দেওবন্দী মৌলভীদের সর্বসম্মত মত
৬.৫৫ মুসলিম বিশ্বে মওলিদুন্নবী (ﷺ) উদযাপনের ইতিহাস
৬.৫৫.১ মক্কা মোয়াযযমায় মওলিদ উদযাপন
৬.৫৫.১.১ মক্কায় চাক্ষুস সাক্ষীদের বিবরণ
৬.৫৫.২ মদীনা মোনাওয়ারায় মওলিদ উদযাপন
৬.৫৫.৩ মিসর ও পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মওলিদ উদযাপন
৬.৫৫.৪ কাওস এলাকায় মওলিদ উদযাপন
৬.৫৫.৫ আন্দালূসিয়া (স্পেন) ও রোমে মওলিদ উদযাপন
৬.৫৫.৬ ভারত উপমহাদেশে মওলিদ উদযাপন
৬.৫৬ মওলিদ-বিষয়ক তাৎপর্যপূর্ণ লেখনীসমগ্র

মুখবন্ধ
____________________
মুখবন্ধ
পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের মাঝে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন মহানবী (ﷺ)-এর আশীর্বাদধন্য ও ঐতিহাসিক বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমন উপলক্ষে খুশি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অভিব্যক্তি-ই হচ্ছে মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন। এটা এমনই এক প্রশংসনীয় আমল (ধর্মীয় অনুশীলন), যা দ্বারা এমন কি আবূ লাহাবের মতো একজন কাফের-ও উপকার পেয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বেলাদত উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করায় আবূ লাহাবের মতো কট্টরপন্থী কাফেরের শাস্তি যদি প্রতি সোমবার লাঘব করা হয়, তাহলে সেই (মু’মিন) মুসলমানের ক্ষেত্রে কী পুরস্কার বরাদ্দ রয়েছে যিনি সারা জীবন এই দিনটি উদযাপন করে আসছেন?
সৃষ্টির সেরা খোদ মহানবী (ﷺ)-ই নিজের বেলাদত দিবস সোমবারকে সম্মান করতেন। (আল্লাহর প্রতি) শুকরিয়া জানানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই দিনটিতে রোযা রাখতেন, কেননা এই দিনেই তিনি পৃথিবীবাসীর কাছে পরিচিত হয়েছিলেন। এ কাজ করে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের খোদায়ী আদেশ-ই পালন করেছিলেন মাত্র, যেহেতু তাঁর সম্মানিত অস্তিত্বের উপলক্ষেই বিশ্বজগতের সব কিছু সৃষ্টি করা হয়েছিল।
মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন তাতে অংশগ্রহণকারীদের অন্তরে মহাসম্মানিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উৎসাহ যোগায়, যা অন্তরে (তাঁর সান্নিধ্য লাভের) আকাঙ্ক্ষার অনুভূতি জাগ্রত করে। শরীয়ত অনুযায়ী তাঁর প্রতি সালাওয়াত পাঠের আমলটি ব্যাপক সওয়াবের উৎস, আর তাই উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মওলিদ’কে উপকারী আমল হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
মীলাদের সমাবেশগুলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সীরাহ (জীবনী) মোবারকের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত ও তাঁর প্রতি ভালোবাসা নতুন করে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই কারণেই মওলিদের মাহফিলে অন্তর্ভুক্ত থাকে মহানবী (ﷺ)-এর নবুওয়্যতের অনুকরণীয় আদর্শ, তাঁরই গুণাবলী, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মো’জেযাসমূহের তাযকেরা (স্মরণার্থে আলোচনা) এবং বিবরণ। মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মহানবী (ﷺ)-এর মহব্বত ও সান্নিধ্য অর্জন এবং প্রত্যেক মু’মিন মুসলমানের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সত্তা তথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে তাঁদের আত্মিক সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ়ীকরণ। এটা আপনাআপনি-ই শরীয়তের মূল লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করে। তাঁর গুণাবলী ও পূর্ণতাকে স্বীকার করলে কারো অন্তরে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রেসালাতের প্রতি ঈমান মজবুত হয়। মহানবী (ﷺ)-কে সম্মান প্রদর্শন হচ্ছে ঈমানের সর্বপ্রথম মৌলিক প্রয়োজনীয় শর্ত।
মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর মাধ্যমে প্রকাশিত খুশি, (আল্লাহ’র) যিকিরের মাহফিল অনুষ্ঠান ও মহানবী (ﷺ)-এর শানে না’ত-কসীদা-সেমা’ আবৃত্তি, এর পাশাপাশি মানুষের মাঝে খাবার পরিবেশন, এসব-ই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি পদ্ধতি। মহানবী (ﷺ)-কে আমাদের মাঝে প্রেরণ করে মহান আল্লাহতা’লা আমাদেরকে তাঁরই অশেষ, অফুরন্ত রহমত-বরকত-নেয়ামত (মানে আশীর্বাদ) লাভে হক্বদার করেছেন; আর তাই তিনি আমাদের এই সর্বাধিক সেরা পুরস্কারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
আল্রাহতা’লা যেমন রমযান মাসকে কুরআন নাযেলের কারণে অন্যান্য মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ করেছেন, ঠিক তেমনি রবিউল আউয়াল মাসটিও আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে এ মর্মে যে এই মাসে কুরআন মজীদ যিনি আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, সেই মহান সত্তা এই ধরাধামে শুভাগমন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আশীর্বাদধন্য বেলাদত দ্বারাই এই মাসটি অন্যান্য সব মাসের চেয়ে অধিকতর পুণ্যময় হয়েছে।
বস্তুত যে রাতে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (ﷺ)-এর বেলাদত হয়, সেটা লাইলাতুল ক্বদরের রাতের চেয়েও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। রাইলাতুল ক্বদরে সর্বপ্রথম আল-কুরআন ও ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়। কিন্তু হুযূর পূর নূর (ﷺ), যাঁর অন্তরে আল-কুরআন নাযেল হয়, তিনি না হলে আমরা কোনো ঐশী শাস্ত্রলিপি পেতাম না, লাইলাতুল ক্বদর-ও পেতাম না, কিংবা খোদ দ্বীন ইসলাম-ও পেতাম না। এসব নেয়ামত হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমেই কেবল অর্জিত হয়েছে। অতএব, তাঁর বেলাদতের রাতটি লাইলাতুল ক্বদরের রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
আল্লাহতা’লা মানবজাতির প্রতি তাঁর অগণিত ও সীমাহীন রহমত-বরকত ও নেয়ামত দান করেছেন। এসব আশীর্বাদ অসংখ্য এবং এগুলো চিরকাল বর্ষিত হতে থাকবে। প্রতিটি নেয়ামত অপর যে কোনো নেয়ামতের মতোই বড়। এতদসত্ত্বেও সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা নিজের আশীর্বাদগুলো সম্পর্কে গর্ব করেন না। তিনি আমাদের স্বাদগ্রহণের জন্যে আহার্যের এক বিশাল তালিকা মঞ্জুর করেছেন, কিন্তু তিনি তাঁর এই দান স্মরণ করেন না। তিনি আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের পানীয় দ্রব্য দ্বারা সতেজ রেখেছেন, কিন্তু নিজের এই দান সম্পর্কে কোনো গর্ব তিনি করেন না। রাত ও দিনের আবর্তমান চক্রের সুবাদে আমাদের সময় সুনিয়ন্ত্রিত হওয়ার দরুন আমরা বিশ্রাম নিতে পারি এবং জীবনের নানা চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হই; আসমান, জমিন ও দরিয়া, এসব কিছুকেই আমাদের অধীনস্থ করে দেয়া হয়েছে; আমাদেরকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা আল্লাহতা’লার সেরা সৃষ্টি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে এবং সম্মান ও মর্যাদা-ও মঞ্জুর করা হয়েছে, কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর এসব দান স্মরণ না। আমাদেরকে পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা আশীর্বাদধন্য করা হয়েছে; এই বিশ্বজগতের বিশাল ও বিস্তৃত প্রান্তসীমা হতে আরম্ভ করে আমাদের অন্তর্নিহিত সত্তার গভীরে এমন নেয়ামত আমাদের প্রতি মঞ্জুর করা হয়েছে, যা আমাদের মস্তিষ্কের উপলব্ধিরও অতীত; অথচ বিশ্বজগতের প্রভু (’রাব্বুল ‘আলামীন’) হওয়া সত্ত্বেও সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর এ অনুগ্রহ ও আশীর্বাদের গর্ব করেন না। তবে বিশ্বমানবতার জন্যে এমন এক আশীর্বাদ আল্লাহ পাক মঞ্জুর করেছেন, যাঁর খাতিরে তিনি প্রকাশ্য ও স্পষ্টভাবে নিজের করুণা, আশীর্বাদ ও অনুগ্রহের কথা স্মরণ করেন। তিনি ঈমানদার মুসলমানদেরকে এব্যাপারে সচেতন করেছেন এই বলে:
“নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি যে তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর (খোদার) আয়াতসমূহ পাঠ করেন, আর তাদেরকে কিতাব (আল-ক্বুরআন) ও হিকমত (ইসলামী আধ্যাত্মিক জ্ঞান) শিক্ষা দান করেন, অথচ তারা (ঈমানদার মুসলমানবৃন্দ) নিশ্চয় এর আগে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল” [আল-ক্বুরআন, ৩:১৬৪; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله) কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]
দ্বীন-ইসলামে আল্লাহতা’লার প্রতি তাঁরই প্রদত্ত আশীর্বাদের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা খেদমতের একটি নিদর্শন মাত্র। এর যৌক্তিকতা আল-ক্বুরআনে উল্লেখিত হয়েছে এভাবে –
“এবং স্মরণ করো, যখন তোমাদের রব্ব শুনিয়ে দিলেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে আমি তোমাদেরকে আরো অধিক দান করবো এবং যদি অকৃজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি কঠোর” [আল-ক্বুরআন, ১৪:৭]।
এই আয়াতটি ব্যাখ্যা করে যে খোদাতা’লার নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ফলশ্রুতিতে আরো অতিরিক্ত আশীর্বাদ লাভ সম্ভব হয়। খোদায়ী নেয়ামতের প্রতি শুকরিয়া আদায় করাটা এই উম্মতের জন্যে খাস বা সুনির্দিষ্ট নয়, বরং এটা পূর্ববর্তী উম্মাতগুলোর প্রতিও আরোপ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বনূ ইসরাঈল (ইহুদী) সম্প্রদায় যে আশীর্বাদের কারণে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর ওপরে আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিল এবং ফেরাউনের জুলুম-অত্যাচার হতে মুক্তি পেয়েছিল, সেটা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে:
“এবং স্মরণ করো, যখন আমি তোমাদেরকে ফের‘আউনী সম্প্রদায় থেকে নিষ্কৃতি দান করেছি, যারা তোমাদেরকে মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিতো, তোমাদের পুত্রদেরকে যবেহ করতো আর তোমাদের কন্যাদেরকে জীবিত রাখতো; এবং এর মধ্যে তোমাদের রব্বের পক্ষ থেকে এক মহা ‘বালা’ নিহিত ছিল (অথবা ছিল এক মহা পুরস্কার)” [আল-ক্বুরআন, ২:৪৯]।
এই আয়াতে করীমা ব্যাখ্যা করে যে দাসত্ব থেকে মুক্তি এমনই এক মহা নেয়ামত যার দরুন এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্যেও অত্যাবশ্যক হয়। এর থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, কোনো জাতির মুক্তি অর্জন খোদাতা’লারই দানকৃত একটা উপহার যেটার শোকর-গুজারী করা বাধ্যতামূলক। এই আয়াতটি সাক্ষ্য দেয় এ বাস্তবতার যে, সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে খোদায়ী নেয়ামতের মূল্যায়ন ও খুশি উদযাপন করা জরুরি, যাতে পরবর্তীকালে আগত প্রজন্মগুলো এই আশীর্বাদের মূল্য অনুধাবন করতে পারে এবং এর গুরুত্ব-ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।
মানুষ সাধারণতঃ সারা বছরই আল্লাহতা’লার আশীর্বাদগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে; তবুও সময়ের পরিক্রমণে সমগ্র উম্মাহকে আল্লাহর মঞ্জুরিকৃত কোনো তাৎপর্যপূর্ণ দিন আগমন করলে এর খুশির বহিঃপ্রকাশ আপনাআপনি সামষ্টিক উদযাপনে রূপ নেয়। কুরআন মজীদে বর্ণিত আছে যে বনূ ইসরাঈল বংশকে ফেরাউনের অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার পর এবং নীল-নদের স্রোত পার হয়ে নিরাপদে সিনাই উপত্যকায় তাদের প্রবেশের পর তারা মারাত্মক গরম আবহাওয়া ও খরা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, যার দরুন তাদেরকে ছায়া দেয়ার জন্যে মেঘ পাঠানো হয়। এটা এমন-ই এক আশীর্বাদ ছিল যে আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বিবৃত হয়:
“এবং (স্মরণ করো) আমি তোমাদের ওপর মেঘকে ছাউনি করেছি (তিহা উপত্যকায়), আর তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ ও ’সালওয়া’ অবতীর্ণ করেছি” [সূরা বাক্বারা, ৫৭ আয়াত]।
ক্বুরআন পাকের অনেক জায়গায় সুনির্দিষ্ট রহমত-বরকত সম্পর্কে উল্লেখ করার সময় (রহমত বর্ষণের) ওইসব দিনের স্মরণার্থে খুশি উদযাপন করার বিধান আল্লাহতা’লা জারি করেছেন। পয়গম্বর (عليه السلام)-মণ্ডলীর অনুশীলিত রীতিও ছিল এটাই। পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام) তাঁর উম্মতের জন্যে আসমানী খাদ্য-খাঞ্চা প্রার্থনাকালে আরয করেন এভাবে:
“মরিয়ম-তনয় ঈসা আরয করলেন, ‘হে আল্লাহ, হে আমাদের রব্ব! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে একটা খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন, যা আমাদের জন্যে ঈদ হবে – আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্যে; এবং আপনার কাছ থেকে (তা হবে) নিদর্শন” [আল-ক্বুরআন, ৫:১১৪]।
পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام)-এর বাস্তব উদাহরণের আলোকে ক্বুরআন মজীদের এই আয়াতটিতে আমাদের সামেনে একটি স্পষ্ট ধারণা ব্যক্ত করা হয়েছে এই মর্মে যে, খোদায়ী নেয়ামত (মানে ঐশী আশীর্বাদ) যে দিনে অবতীর্ণ হয় সেদিনটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিবস হিসেবে উদযাপিত হওয়া উচিত। আয়াতটি আরো ইঙ্গিত করে যে কোনো নির্দিষ্ট আশীর্বাদপ্রাপ্তি উপলক্ষে খুশি প্রকাশ শুধু সেসব মানুষ-ই করে থাকেন, যাঁরা ওই আশীর্বাদ যে পয়গম্বর (عليه السلام)-এর প্রতি মঞ্জুর হয়েছে তাঁর সাথে (আত্মিকভাবে) সংশ্লিষ্ট।
আল্লাহতা’লার নেয়ামতপ্রাপ্তির প্রতি খুশি প্রকাশের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি সাধারণ পদ্ধতি হলো, অন্য সবার সামনে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার আশীর্বাদগুলোর বিবরণ প্রদান করা। তাঁর প্রতি এভাবে শুকরিয়া জানানো কুরআন মজীদ হতেও প্রমাণিত, যেমনটি এরশাদ হয়েছে:
 
“এবং আপন রব্বের নি’মাতের খুব চর্চা করুন (হে রাসূল)!” [আল-কুরআন, ৯৩:১১]
প্রথমে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার দানকৃত নেয়ামত ও আশীর্বাদ স্মরণের ব্যাপারে আজ্ঞা জারি হয়, যেক্ষেত্রে ওই আশীর্বাদকে অন্তর ও জিহ্বা দ্বারা স্মরণ করা চাই; কিন্তু এই স্মরণ অন্য কারো জন্যে নয়, কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লারই জন্যে নির্দিষ্ট। অতঃপর এই আশীর্বাদটি উল্লেখ করার বিধান দেয়া হয়েছে, যার দরুন কেউ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে এই আশীর্বাদ সম্পর্কে প্রকাশ্যে উল্লেখ করেন এমনভাবে যাতে এর তাৎপর্য মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, এই স্মরণ (যিকর) একদিকে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার সাথে সংশ্লিষ্ট,অপরদিকে তা উল্লেখ করা (তাযকেরা) সৃষ্টির সাথে সংশ্লিষ্ট, যাতে অনেক মানুষ এই স্মরণ করার কাজে ব্যাপৃত হতে পারে। কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:
“সুতরাং আমার স্মরণ করো, আমিও তোমাদের চর্চা করবো, আর আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো এবং আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না।” [সূরা বাক্বারা, ১৫২ আয়াত]
আরেক কথায়, তোমরা আমার নেয়ামতগুলো (ব্যক্তি পর্যায়ে) স্মরণ করো না, বরঞ্চ এমন কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক পরিবেশে তা উল্লেখ করো যার দরুন মানুষেরাও তা শোনতে পায় এবং জানতে পারে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি বাড়তি পন্থা হচ্ছে ঈদের আকারে খুশি উদযাপন করা। পূর্ববর্তী উম্মতগুলো যেদিনটিতে কোনো বিশেষ নেয়ামত লাভ করতেন, সেদিনটি তারা ঈদ হিসেবে উদযাপন করতেন। কুরআন মজীদ হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর দোয়া সম্পর্কে বর্ণনা দেয় এভাবে:
“মরিয়ম-তনয় ঈসা আরয করলেন, ‘হে আল্লাহ, হে আমাদের রব্ব! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে একটা খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন, যা আমাদের জন্যে ঈদ হবে – আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্যে; এবং আপনার কাছ থেকে (তা হবে) নিদর্শন” [আল-ক্বুরআন, ৫:১১৪]।
এ আয়াতে খাদ্য-খাঞ্চার মতো একটি অস্থায়ী আশীর্বাদ লাভকে ঈদের দিন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এমন কি আজো খৃষ্টান সম্প্রদায় রোববারকে অশীর্বাদপ্রাপ্তির দিন হিসেবে পালন করে থাকেন। খাদ্য-খাঞ্চা প্রেরণের আশীর্বাদ কি কোনো পয়গম্বর প্রেরণের নেয়ামতের সমতুল্য? ওই ধরনের অগণিত আশীর্বাদ-ই তো আমাদের মহাসম্মানিত রহমত (করুণা) ও আশীর্বাদ হযরতে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের খাতিরে বিসর্জন দেয়া যেতে পারে।
সহীহ বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, জনৈক ইহুদী একবার হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-কে বলেন যে আল-কুরআনের [“আজ তোমাদের দ্বীন (ধর্ম)-কে তোমাদেরই জন্যে পূর্ণ করলাম”] আয়াতটি যদি তৌরাতে প্রকাশিত হতো, তাহলে ইহুদী সম্প্রদায় ওই দিনটিকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করতো। হযরত উমর (رضي الله عنه) এ কথার উত্তরে বলেন যে আয়াতটি কোন্ দিনে এবং কোথায় অবতীর্ণ হয়েছিল তা তাঁর স্মরণে আছে: সেটা ছিল আরাফাতের ময়দানে হজ্জ্বের দিন, অধিকন্তু শুক্রবার (উভয় দিন-ই ঈদস্বরূপ)। [আল-বুখারী কৃত সহীহ; কিতাবুল ঈমান, ‘ঈমানের বৃদ্ধি ও হ্রাস’ অধ্যায়, ১:২৫ #৪৫; মুসলিম কৃত সহীহ: কিতাব আল-তাফসীর, ৪:২৩১৩ #৩০১৭; আল-তিরমিযী প্রণীত আল-জামিউস্ সহীহ: আবওয়াব তাফসীর আল-কুরআন (কুরআন তাফসীরের অধ্যায়গুলো), অধ্যায়: ‘সূরা আল-মা’য়েদা’, ৫:২৫০ #৩০৪৩; এবং আল-নাসাঈ রচিত আল-সুনান: কিতাব আল-ঈমান, ‘ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি’ অধ্যায়, ৮:১১৪ #৫০১২]
একটি প্রশ্ন: যদি ধর্মকে পূর্ণতাদানের বাণী বহনকারী আয়াতে করীমা অবতীর্ণ হওয়ার দিনটি ঈদ হিসেবে গণ্য হতে পারে, তাহলে মানবতার চূড়ান্ত কল্যাণকারী যেদিন ধরাধামে শুভাগমন করেন সেদিনটি কেন ঈদ হিসেবে পরিগণিত হবে না? এই জিজ্ঞাসা শুক্রবার দিনের মর্যাদাময় বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের চিন্তার খোরাকও যোগায়।
মহানবী (ﷺ)-এর হাদীস শরীফেও উল্লেখিত হয়েছে যে তিনি তাঁর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমন দিবস উদযাপন উপলক্ষে ছাগল কুরবানী করতেন এবং এর গোস্ত অতিথিদের মাঝে বিতরণ করতেন। হযরত আনাস (رضي الله عنه)-এর মতানুযায়ী, আম্বিয়াকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর নবুওয়্যত ঘোষণার পর আকীকা (নবজাতক শিশুর জন্যে কৃত পশু কুরবানী) পালন করেন। ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (৮৪৯-৯১১ হিজরী সাল) এই রেওয়ায়াতটিকে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে প্রদর্শন করে যুক্তির অবতারণা করেন যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব হুযূরে পাকের (ﷺ) বেলাদতের সপ্তম দিনে তাঁর আকীকা পালন করেছিলেন, আর আকীকা জীবনে একবার পালন করাই আবশ্যকীয়। অতএব, এটা স্পষ্ট যে মহানবী (ﷺ)-এর আমলটি আকীকা ছিল না, বরঞ্চ তা ছিল আতিথেয়তা যা তিনি তাঁরই বেলাদতের স্মরণে পালন করেছিলেন। [এই গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো খোদায়ী আশীর্বাদ কল্পনা করা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। এ উপলক্ষে যে স্পষ্ট আনন্দ ও সুখ ব্যক্ত হয়েছে, তা ঐতিহাসিক বিবরণসমূহ হতে জানা যায়। নবুওয়্যতের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যবিষয়ক বইপত্রে এমন প্রচুর উদাহরণ বিদ্যমান, যেখানে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর মাহবূব (ﷺ)-এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমন উপলক্ষে আনন্দ ও সুখ অনুভব করেন।
যে বছর মহানবী (ﷺ)-এর পবিত্র বেলাদত শরীফ (মানে ধরাধামে শুভাগমন) হয়, সেই পুরোটা বছর জুড়ে অনেক আশ্চর্যজনক ও ব্যাখ্যার অতীত বাস্তব ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করা হয়। ওই আশীর্বাদধন্য (বেলাদতের) সময়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার বর্ষিত বিশেষ রহমত তথা করুণা, যার জন্যে সমগ্র বিশ্বজগত অধীর আগ্রহে শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত অপেক্ষারত ছিল, অবশেষে যখন সেই নির্ধারিত শুভমুহূর্ত উপস্থিত হলো তখন বিশ্বজগতের স্রষ্টা সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা এই ধরণীর বুকে প্রকাশ করলেন তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যমণিকে; আর তিনি (মহান প্রভু) এমন নূর (জ্যোতি) বিচ্ছুরণের প্রদর্শনী দিলেন যে পূর্ব হতে পশ্চিম দিগন্ত অবধি আলোয় আলোকিত হলো।
হযরত উসমান বিন আবি আল-আস্ (رحمة الله) বলেন যে তাঁর মা তাঁকে জানিয়েছিলেন:
“রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র বেলাদতের সময় আমি (মা) আমিনা’র কাছে উপস্থিত ছিলাম। ওই মুহূর্তে আমি দেখতে পেলাম তারকারাজি এতো কাছে চলে এসেছে যে (মনে হলো) সেগুলো বুঝি আমার ওপরই পতিত হবে। অতঃপর হুযূরে পাকের (ﷺ) বেলাদত শরীফ হলে (মা) আমিনা হতে এমন এক জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়, যার দরুন আমরা যে ঘরে ছিলাম সেটা এবং আশপাশের এলাকা আলোকিত হয়ে যায়। এমতাবস্থায়, আমি তাকিয়ে ওই নূর ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুই দেখতে পাইনি।” [ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী (رحمة الله) কর্তৃক নিজ ‘আল-আহাদ ওয়াল-মাসা’নী’ গ্রন্থে বর্ণিত, ৬:২৯ #৩২১০ (উম্মে উসমান বিন আবি আল-’আস হতে গৃহীত); আত্ তাবারানী (رحمة الله) কৃত ‘আল-মু’জাম আল্-কবীর’, ২৫:১৪৭ ও ১৮৬, #৩৫৫ ও ৪৫৭; আল-মাওয়ার্দী প্রণীত ‘আ’লম আল-নবুওয়্যাহ’, ২৪৭ পৃষ্ঠা; আত্ তাবারী রচিত ‘তারিখ আল-উমাম ওয়াল-মুলুক’, ১:৪৫৪; আল-বায়হাক্বী লিখিত ‘দালায়েল আল-নবুওয়্যা ওয়াল-মা’রিফা আহওয়াল সাহিব আল-শরী’আ’, ১:১১১; আবূ নু’য়াইম কৃত ‘দা’লায়েল আল-নবুওয়্যা’, ১৩৫ পৃষ্ঠা, #৭৬; ইবনে আল-জাওযী প্রণীত ‘আল-মুতাযাম ফী তারিখ আল-উমাম ওয়াল-মুলুক’, ২:২৪৭; ইবনে আসাকির রচিত ‘তারিখ দিমাশক আল-কবীর’, ৩:৭৯ ও ‘আল-সীরাহ অাল-নববীয়্যা, ৩:৪৬; ইবনে কাসীর লিখিত ‘আল-বেদায়া ওয়াল-নেহায়া, ২:২৬৪; আল-হায়সামী প্রণীত ‘মজমাউল যাওয়াঈদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়া’ইদ’, ৮:২২০; ইবনে রাজাব হাম্বলী কৃত ‘লাতা’ইফ আল-মা’আরিফ ফীমা লি-মাওয়াসিম আল-’আম মিন আল-ওয়াযা’ইফ, ১৭৩ পৃষ্ঠা; এবং আল-আসক্বালানী রচিত ‘ফাতহুল বারী’, ৬:৫৮৩]
আবূ উমামা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আপনার বিষয়টির আরম্ভ কীভাবে?” হুযূরে পূর নূর (ﷺ) উত্তর দেন, “আমি হলাম আমার (আদি)-পিতা হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)-এর দোয়া বা প্রার্থনার (জবাব) এবং হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর প্রদত্ত খোশ-খবরী (শুভসংবাদ)। (আমার বেলাদতের সময়) আমার মা (আমিনা) তাঁর (পবিত্র শরীর) থেকে নূরের বিচ্ছুরণ প্রত্যক্ষ করেন, যা সিরিয়া-রাজ্যের প্রাসাদগুলোকে আলোকিত করে।” [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল কর্তৃক নিজ ‘আল-মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণিত, ৫:২৬২ #২২৩১৫; ইবনে হিব্বান তাঁর ‘আল-সহীহ’, ১৪:৩১৩ #৬৪০৪ গ্রন্থে এসব কথার আলাদা একটি এসনাদ-সহ আরো দীর্ঘ একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেন; আল-বুখারীও নিজস্ব ‘আল-তারিখ অাল-কবীর‘, ৫:৩৪২ #৭৮০৭/১৭৩৬ পুস্তকে ভিন্ন এসনাদ-সহ আরো দীর্ঘ একটি রেওয়ায়াত লিপিবদ্ধ করেন; ইমাম বুখারী নিজস্ব ‘আল-তারিখ আল-আওসাত’, ১:১৩ #৩৩ বইয়ে পৃথক এসনাদ-সহ আরো দীর্ঘ একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেন; ইবনে আবি উসামা রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ২:৮৬৭ #৯২৭; আল-রুয়্যানী কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ২:২০৯ #১২৬৭; ইবনে আল-জা’দ প্রণীত ‘আল-মুসনাদ’, ৪৯২ #৩৪২৮; আল-তায়্যালিসী লিখিত ‘আল-মুসনাদ, ১৫৫ #১১৪০; আল-তারানী রচিত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর‘, ৮:১৭৫ #৭৭২৯; আল-তাবারানী কৃত ‘মুসনাদ আল-শা’মিয়্যীন’ ২:৪০২ #১৫৮২; আল-দায়লামী প্রণীত ‘আল-ফেরদাউস বি-মা’সউর আল-খিতাব’, ১:৪৬ #১১৩; আল-লালকাঈ লিখিত ‘এ’তেক্বাদ আহল আল-সুন্নাহ ওয়াল-জামা’আ, ১:৪২২-৩ #১৪০৪; আবূ নুয়াইম রচিত ‘হিলইয়া আল-আউলিয়া ওয়া তাবাক্বাত আল-আসফিয়া’, ৬:৯০; ইবনে আল-জাওযী কৃত ‘আল-মুনতাযাম ফী তারিখ আল-মুলুক ওয়াল-উমাম’, ২:২৪৮; ইবনে আসাকির প্রণীত ‘আল-সীরাহ আল-নববীয়্যা’, ১:১২৭; ইবনে কাসীর লিখিত ‘আল-বেদায়া ওয়াল-নেহায়া‘, ২:২৭৫, ৩০৬ ও ৩২২; আল-হায়সামী তাঁর রচিত ‘মজমা’ আল-যাওয়া’ঈদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়া’ঈদ’, ৮:২২২ গ্রন্থে বলেন যে ইমাম আহমদ (رحمة الله) এটা হাসান (সহীহ) তথা নির্ভরযোগ্য সনদ-সহ বর্ণনা করেছেন; এবং আল-সৈয়ুতী কৃত ‘কেফায়াত আল-তালেব আল-লাবিব ফী খাসায়েস আল-হাবীব’, ১:৭৯]
মা আমিনা (رضي الله عنه) তাঁর প্রিয় পুত্রের বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের সাথে সম্পর্কিত (অলৌকিক) ঘটনাবলীর ব্যাপারে বলেন:
সৃষ্টিকুল শিরোমণি প্রিয়নবী (ﷺ)-এর বেলাদত হলে তাঁর সাথে একটি নূর (জ্যোতি) এমনভাবে বিচ্ছুরিত হয়, যার দরুন পূর্ব হতে পশ্চিমে যা কিছু ছিল সবই আলোকিত হয়ে যায়। [সা’আদ কৃত ‘আল-তাবাক্বাত আল-কুবরা’, ১:১০২; ইবনে জাওযী প্রণীত ‘সাফওয়া আল-সাফওয়া’, ১:৫২; ইবনে আসাকির রচিত ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা’, ৩:৪৬; ইবনে কাসীর লিখিত ‘আল-বেদায়া ওয়াল-নেহায়া’, ২:২৬৪; ইবনে রাজাব হাম্বলী কৃত ‘লাতা’ঈফ আল-মা’আরিফ ফীমা’য়া লি-মাওয়াসিম আল-’আম মিন আল-ওয়াযা’ঈফ’, ১৭২ পৃষ্ঠা; আল-সৈয়ুতী প্রণীত ‘কেফা’য়াত আল-তা’লিব আল-লাবীব ফী খাসা’ইস আল-হাবীব’, ১:৭৯; এবং আল-হালাবী রচিত ‘ইনসা’ন আল-’উয়ূন ফী সীরা আল-আমীন আল-মা’মূন’, ১:৮৩]
অন্য এক রেওয়ায়াতে (বিবরণে) মা আমিনা (رضي الله عنه) নিজের জিসম মোবারক হতে এমন এক নূর বিচ্ছুরণের কথা উল্লেখ করেন, যার দরুন তিনি শাম দেশের বসরায় (বর্তমান ইরাকে) অবস্থিত প্রাসাদগুলো ও বাজার এলাকাগুলো প্রত্যক্ষ করেন; এমন কী তিনি সেখানে চলাচলকারী উটগুলোর গলাও দেখতে পান। [ইবনে সা’আদ কৃত ‘আল-তাবাক্বাত আল-কুবরা’, ১:১০২; আল-তাবারানী প্রণীত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ২৪:২১৪ #৫৪৫; ইবনে হিব্বান রচিত ‘আল-সহীহ’, ১৪:৩১৩ #৬৪০৪; আবদুর রাযযাক্ক লিখিত ‘আল-মুসান্নাফ’, ৫:৩১৮; আল-দারিমী কৃত ‘আল-সুনান’, ১:২০ #১৩; আল-শায়বানী প্রণীত ‘আল-আহা’দ ওয়াল মাসা’নী’, ৩:৫৬ #১৩৬৯; আল-হাকীম রচিত ‘আল-মুস্তাদরাক’, ২:৬৭৩ #৪২৩০; আল-হায়সামী নিজ ‘মজমা’ আল-যওয়াঈদ’ (৮:২২২) গ্রন্থে জানান যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও আল-তাবারানী এই বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন, আর ইমাম আহমদের বর্ণনার সনদ হচ্ছে হাসান সহীহ; আল-হায়সামী লিখিত ‘মাওয়া’রিদ আল-যামা’ন ইলা’ যাওয়া’ঈদ ইবনে হিব্বা’ন’, ৫১২ #২০৯৩; ইবনে এসহা’ক্ব রচিত ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা, ১:৯৭ ও ১০৩; ইবনে হিশা’ম কৃত ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা’, ১৬০; ইবনে আসীর প্রণীত ‘আল-কা’মিল ফী আল-তা’রীখ’, ১:৪৫৯; আল-তাবারী লিখিত ‘তা’রীখ আল-উমাম ওয়াল মুলূক’, ১:৪৫৫; ইবনে ’আসা’কির রচিত ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’, ১:১৭১-২; ইবনে ’আসা’কির কৃত ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’, ৩:৪৬৬ এবং ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা’, ৩:৪৬; ইবনে কাসীর প্রণীত ‘আল-বেদা’য়া ওয়াল-নেহা’য়া’, ২:২৬৪ ও ২৭৫; ইবনে রাজাব হাম্বলী লিখিত ‘লাতা’ঈফ আল-মা’আরিফ ফীমা লি-মাওয়া’সিম আল-’আম মিন আল-ওয়াযা’ঈফ’, ১৭৩ পৃষ্ঠা; আল-সৈয়ূতী রচিত ‘কেফা’য়াত আল-তা’লিব আল-লাবীব ফী খাসা’ইস আল-হাবীব’, ১:৭৮; আল-হালাবী কৃত ‘ইনসা’ন আল-’উয়ূন ফী সীরা আল-আমীন আল-মা’মূন’, ১:৮৩; এবং আহমদ বিন যাইনী দাহলা’ন মক্কী প্রণীত ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা’, ১:৪৬]
 
মুহাদ্দেসীন উলামাবৃন্দ (হাদীসশাস্ত্র বিশারদমণ্ডলী) ‘আশূরা’-এর হাদীসগুলোর সাহায্যে মওলিদুন্নবী (ﷺ) উদযাপনের বৈধতা প্রমাণ করেছেন। ‘এয়াওমে আশূরা’ ইহুদী সম্প্রদায় পালন করে থাকেন। এই দিনটিতে পয়গম্বর মূসা (عليه السلام) ও বনূ ইসরাঈল (ইহুদী সম্প্রদায়) ফেরাউনের উৎপীড়ন হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন। ফলে এটা তাঁদের স্বাধীনতা/মুক্তি দিবস, যা তাঁরা নিজেদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে রোযা রেখে উদযাপন করতেন। (মদীনায়) হিজরতের পরে মহানবী (ﷺ) মদীনাবাসী ইহুদীদের দ্বারা এই প্রথা অনুশীলিত হতে দেখে বলেন, “আমি তাদের চেয়ে পয়গম্বর মূসা (عليه السلام)-এর আরো ঘনিষ্ঠ (পয়গম্বর হওয়ার সূত্রে)।” এমতাবস্থায় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ও ‘এয়াওমে আশূরা’তে রোযা রাখা আরম্ভ করেন এবং তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-কেও তা অনুসরণ করতে আদেশ করেন। [আল-বুখা’রী কর্তৃক নিজ‘সহীহ’ গ্রন্থে বর্ণিত: কিতা’বুস্ সওম (রোযা-সংক্রান্ত বই), ‘এয়াওমে আশূরা’র রোযা’ অধ্যায়, ২:৭০৪ #১৯০০; আল-বুখারী লিখিত ‘সহীহ’: কিতাবুল আম্বিয়া (পয়গম্বরবৃন্দের বই), ‘আল্লাহর বাণী: মূসা (عليه السلام)-এর সংবাদ কি 

তোমাদের কাছে পৌঁছেছে?’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১২৪৪ #৩২১৬; আল-বুখারী কৃত ‘সহীহ’: কিতা’ব ফাযা’ইল আল-সাহা’বা (সাহাবাবৃন্দের সৎ গুণাবলীর বই), ‘মহানবী (ﷺ) মদীনায় তাশরীফ নিলে ইহুদীদের তাঁর কাছে আগমন’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১৪৩৪ #৩৭২৭; মুসলিম রচিত ‘সহীহ’: কিতা’ব আল-সিয়্যা’ম (রোযা-সংক্রান্ত বই), ‘এয়াওম আল-আশূরা’র রোযা’ অধ্যায়, ২:৭৯৫-৬ #১১৩০; আবূ দাউদ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতা’ব আল-সওম (রোযা-সংক্রান্ত বই), ‘এয়াওম আল-আশূরা’র রোযা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৩২৬ #২৪৪৪; ইবনে মা’জাহ রচিত কৃত ‘আল-সুনান: কিতাব আল-সিয়্যা’ম’ (রোযা-সংক্রান্ত বই), ‘এয়াওম আল-আশূরা’র রোযা’ শীর্ষক অধ্যায়, ১:৫৫২ #১৭৩৪; আহমদ ইবনে হাম্বল লিখিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৯১ ও ৩৩৬ #২৬৪৪ ও ৩১১২; এবং আবূ এয়া’লা প্রণীত ‘আল-মুসনাদ’, ৪:৪৪১ #২৫৬৭]   
এ বিষয়ে অসংখ্য বর্ণনা বিদ্যমান, যা থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে ইহুদীরা যদি তাদের পয়গম্বর (মূসা আলাইহিস্ সালাম)-এর বিজয় ও মুক্তিতে খুশি প্রকাশ করতে পারেন, তাহলে মুসলমান হিসেবে আমাদেরও মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর ব্যাপারে একই রকমের অনুভূতি প্রকাশ করা চাই, আর তা এ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিশ্বজগতের প্রতি খোদায়ী রহমত, অর্থাৎ, ঐশী করুণা (বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বিশ্বমানবতাকে অত্যাচার-অবিচার ও অন্যায় হতে মুক্তি দিতে ধরাধামে শুভাগমন করেছিলেন এই বিশেষ দিনে, যেমনটি আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:
“আর (তিনি) তাদের ওপর থেকে (তাদেরই অবাধ্যতাজনিত) ওই কঠিন কষ্টের বোঝা ও গলার শৃঙ্খল যা তাদের ওপর ছিল, তা নামিয়ে অপসারণ করবেন।” [আল-কুরআন, ৭:১৫৭]  
পরিশেষে, মহানবী (ﷺ)-এর বেলাদতের মাস সমাগত হলে কোনো ঈমানদার মুসলমানের কাছে পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় নেয়ামত (আশীর্বাদ) আর কী-ই বা হতে পারে, যখন তিনি অনুভব করেন এর তুলনায় অন্য যে কোনো সুখ একেবারেই অর্থহীন? প্রকৃত সুখ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশের মাঝে নিহিত। আমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো এর চেয়ে কম তাৎপর্যপূর্ণ আশীর্বাদপ্রাপ্তিতে কৃতজ্ঞতা ও খুশি প্রকাশ করতে বাধিত হয়েছিলেন, যে নেয়ামতগুলো ছিল কোনো বিশেষ স্থান বা কালের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। পক্ষান্তরে, এই অনন্ত, অফুরন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত তথা সর্বাধিক মহিমান্বিত রাসূল (ﷺ)-এর ধরণীতলে শুভাগমন হচ্ছে সবার জন্যে (ঐশী) করুণা ও কল্যাণের অবিরাম উৎস। অতএব, মুসলমানদেরকে এ উপলক্ষে আবেগ ও খুশির বহিঃপ্রকাশের পাশাপাশি অসীম কৃতজ্ঞতার প্রতিভূ-ও হতে হবে।
আল-কুরআন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় মানবজাতিকে তাদের প্রতি বর্ষিত আল্লাহতা’লার (খাস্) রহমত (করুণা), বরকত (আশীর্বাদ) ও দয়া তথা মহানবী (ﷺ)-কে শ্রদ্ধা ও সম্মান করার নির্দেশ দেয়, যিনি শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত আচ্ছন্নকারী অন্ধকার দূর করেন এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও পশুত্বর দেয়াল যা মানুষকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছিল, তা ভেঙ্গে চৌচির করে দেন। আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:
“এবং নিজেদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো, যখন তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ছিল; তিনি তোমাদের অন্তরগুলোতে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সুতরাং তাঁরই অনুগ্রহক্রমে তোমরা পরস্পর ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছো।” [আল-কুরআন, ৩:১০৩]   
এই ভগ্ন হৃদয়সমূহের জোড়া লাগানোর এবং বিশ্বমানবের সৌভ্রাতৃত্ব অর্জনের চমৎকার নজির ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। অতএব, মহান আল্লাহর মনোনীত জনের ধরাধামে শুভাগমন উপলক্ষে আনন্দ উদযাপন ও আল্লাহর প্রতি ঋণী হওয়ার অনুভূতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটা অন্য যে কোনো অর্জন বা প্রাপ্তির চেয়ে উম্মাহ’র জন্যে বেশি বাধ্যতামূলক হয়েছে।
মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

সঠিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণের আলোকে
____________________
প্রথম অধ্যায়
মওলিদুন্নবী (ﷺ) ও ইসলামের বিভিন্ন নিদর্শন: সঠিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণের আলোকে
আমাদের আকীদা-বিশ্বাস, ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ ও আধ্যাত্মিক জীবন যিকরের ধারণাকে ঘিরে আবর্তমান, যার অর্থ ‘স্মরণ করিয়ে দেয়া’, ‘স্মরণ করা’ এবং ‘স্মৃতিরক্ষামূলক কর্ম দ্বারা স্মরণীয় করে রাখা (বা উদযাপন করা)’। আমাদের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম ও লেনদেন, কথাবার্তা/ভাষণ, উপলব্ধি এবং আমাদের জীবনের সমস্ত বিষয়-ই সেই জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ যা আমরা অর্জন করেছি এবং নিজেদের মস্তিষ্কে সংরক্ষণ করেছি। এভাবে আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি ধাপ আমাদের স্মৃতিপটে অঙ্কিত হয়েছে, আর এই স্মৃতি-ই আমাদেরকে জীবন চলার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শন করছে। উদাহরণস্বরূপ, কারো সাথে আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি নির্ভর করে ওই ব্যক্তির সঙ্গে জড়িত আমাদের স্মৃতির ওপর; আর এরই ভিত্তিতে আমাদের আচার-ব্যবহার ও আচরণ গড়ে ওঠে। 
স্মৃতিশক্তি ছাড়া কোনো বিষয় সম্পর্কেই বিচার-বিবেচনা করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়; এমন কি আমরা শত্রু হতে মিত্রকে আলাদাভাবে চিনতেও সক্ষম নই। এমতাবস্থায় আমাদের জীবন একদম এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত। অতএব, আমাদের সজ্ঞান সচেতনতা আমাদেরই অন্তর্নিহিত স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভরশীল।







Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা