মিরাজুন্নবী(ﷺ)

মিরাজুন্নবী(ﷺ)

ভুমিকা ও লেখক পরিচিতি
____________________

ভূমিকা

সমস্ত প্রশংসা সুমহান আল্লাহতা’য়ালার জন্য যিনি সর্বপ্রথম কোন মাদ্দা বা উপাদান ব্যতিরেকেই তাঁর হাবিবের নূর মোবারক বা রূহ মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং হাবিবে খোদার নূর মোবারক দ্বারাই আল্লাহপাক কুলকায়েনাত সৃষ্টির সূচনা করেছেন। সুতরাং কুলকায়েনাতের সৃষ্টির মূল হলেন নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টির কোন মাদ্দা নেই, মাধ্যম নেই। তিনিই সকল সৃষ্টির মূল বা আসল। নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসংখ্য মু’জিযার মধ্যে মি’রাজশরীফ একটি অন্যতম মু’জিযা। বর্তমান যামানায় আল্লাহতা’য়ালার যাত-সিফাত নিয়ে একশ্রেণির লোক যেমন ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করছে, তেমনিভাবে নবীজির মি’রাজ নিয়েও সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। কেউ কেউ ওয়াজ-মাহফিলে ও বক্তৃতায় বলে থাকেন- ‘মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর হাবিব এমনভাবে আল্লাহর যাত বা সত্ত্বার সাথে মিশে গেছেন যেমন চিনি পানিতে মিশে যায়।’ এরূপ বলা সুন্নি আকিদার পরিপন্থী। এজন্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মি’রাজশরীফ সম্পর্কে আকিদাগত মাসআলাসমূহ ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাঠকের সামনে তুলে ধরলাম। যাতে পাঠক সমাজ এ বিষয়ের উপর বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। আমার এ পুস্তক প্রণয়নে যারা বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছেন তারা হলেন, সিরাজনগর ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা শেখ সিরাজুল ইসলাম আলকাদেরী, অত্র মাদ্রাসার আরবি প্রভাষক মাওলানা শেখ জুবাইর আহমদ রহমতাবাদী ও আমার স্নেহের বড়ছেলে অত্র মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা মুফতি শেখ শিব্বির আহমদ ও আমার মেঝ ছেলে লন্ডন প্রবাসী আলহাজ্ব মাওলানা শেখ জাবির আহমদ। উল্লেখ্য যে, যারা আমার পক্ষ থেকে তরিকতের খেলাফত পেয়েছেন তন্মধ্যে উপরোক্ত চারজনও এর অন্তর্ভুক্ত। যাদের আর্থিক সাহায্যে বইটি ত্বরিৎ প্রকাশ পেল তাদের দানের জন্য আল্লাহতা’য়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। বইটি প্রকাশে আরো যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য দোয়া করি। আল্লাহপাক যেন আমাদের সকলের নেকমকসুদ কবুল করেন। আমিন। বিহুরমতে সায়্যিদিল মুরসালিন।

গ্রন্থকার

লেখক পরিচিতিঃ

মি’রাজুন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

লেখকঃ পীরে তরিকত রাহনুমায়ে শরিয়ত উস্তাযুল উলামা মুহিউসসুন্নাহ সুলতানুল মোনাজিরীন হযরতুল আল্লামা অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা.জি.আ.)

প্রতিষ্ঠাতা:

সিরাজনগর গাউছিয়া জালালিয়া মমতাজিয়া ছুন্নীয়া ফাজিল মাদ্রাসা

গাউছিয়া খাজা গরীবে নাওয়াজ এতিমখানা ও কারিগরী প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স

গাউছিয়া দেওয়ানীয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা সিরাজনগর গাউছিয়া দারুল ক্বিরাত সিরাজনগর ।

আঞ্জুমানে ছালেকীন বাংলাদেশ নির্বাহী চেয়ারম্যান, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বাংলাদেশ। মোবাইল- ০১৭১১-৩২৭৮৪৯, ০১৭১১-৩২৯৩৩৬

প্রকাশনায়ঃ ডা. মোহাম্মদ ফারুক মিয়া

সচিব, আঞ্জুমানে ছালেকীন, হবিগঞ্জ

ডাইরেক্টর: দি ল্যাব এইড হাসপাতাল, হবিগঞ্জ

০১৭১২-৭৬৭১৬৪

প্রথম প্রকাশ ১২ নভেম্বর ২০১৬ইং

সর্বসত্ত্ব লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

বর্ণবিন্যাস মাওলানা মুহাম্মদ আবু তাহের মিছবাহ

শিক্ষক, সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসা

কাজী আজিজুল ইসলাম ০১৭৩৫-৮৭৭২৩৩

পরিবেশনায়ঃ মাওলানা নূরুল আবছার চৌধুরী (কাজির)

প্রভাষক, সিরাজনগর ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা

মাওলানা আমিনুর রহমান আফরোজ

সহকারী শিক্ষক, সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসা

হাফেজ মাওলানা আলমগীর হোসাইন

গ্রন্থাগারিক, সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসা

প্রচারেঃ আঞ্জুমানে ছালেকীন বাংলাদেশ এর পক্ষে কাতার প্রবাসী আলহাজ্ব মৌলভী মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন কমার্সিয়াল ব্যাংক অফ কাতার।

প্রাপ্তিস্থানঃ গাউছিয়া বুকস হাউস, তরাজ ম্যানশন, শ্রীমঙ্গল

মামুন রেজা লাইব্রেরি, নজির মার্কেট, হবিগঞ্জ

আ’লা হযরত করিমীয়া ছালামিয়া লাইব্রেরি শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ। ০১৭৩১-০১৯১৩৮ জাগরণ প্রকাশনী, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম ০১৮১৯-৮৬৯৫৭৬

আলমদিনা প্রকাশনী, ১০৫, শাহী জামে মসজিদ শপিং কমপ্লেক্স (২য় তলা) আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম।

হাদিয়া পঞ্চাশ টাকা

আর্থিক সহযোগিতায়

* মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ূম

* মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ

সর্বপিতা: মরহুম আলহাজ্ব মোহাম্মদ নূর মিয়া

গ্রাম: বড় বহুলা মোল্লাবাড়ি, উপজেলা ও জেলা: হবিগঞ্জ।

* আলহাজ্ব মোহাম্মদ আব্দুল হাই আলম ফুড গার্ডেন, কোর্ট স্টেশন রোড, হবিগঞ্জ ০১৭১২৬৩৮৫২৮

* আলহাজ্ব মোহাম্মদ লাল মিয়া

মোতালিব মিয়া এন্টারপ্রাইজ, নারায়ণগঞ্জ ঝালকুড়ি, সিদ্দিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।

* আলহাজ্ব মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম

যমুনা ইলেক্ট্রনিক্স, হবিগঞ্জ।

* মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া সাদ্দাম

প্রোঃ সাদ্দাম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ

পশ্চিম ভাদৈ, হবিগঞ্জ।

* আলহাজ্ব মোহাম্মদ আব্দুল হাই, নিজগাঁও, শায়েস্তাগঞ্জ।

* মোহাম্মদ মোস্তফা মিয়া (মস্তু) রিচি, হবিগঞ্জ।

* মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, রিচি, হবিগঞ্জ।

* আলহাজ্ব মোহাম্মদ আতাউর রহমান উত্তর মুলাইম, মৌলভীবাজার।

* per-e Tarikot Alhaz Moulovi Mohammed saifur Rahman Khan Kolifa, Sirajnagor Dorbar Shorif, Sreemongal 14. Ronald Road, Darnall Sheffield, s 9 4 RH

এপ ডেভেলাপমেন্টঃ সুমন মাহমুদ

মোবাইলঃ ০১৭১৭৮৯৭৪২৬

স্বশরিরে জাগ্রত অবস্থায় মি’রাজ
____________________
بسم الله الرحمن الرحيم نحمده ونصلى على رسوله الكريم 

মি’রাজশরীফ

স্বশরিরে জাগ্রত অবস্থায় মি’রাজ

========================
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সর্বসম্মত আকিদা হচ্ছে যে, আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মি’রাজ হয়েছিল জাগ্রত অবস্থায় স্বশরিরে। এ প্রসঙ্গে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ভাষ্যকার আল্লামা ওমর ইবনে আহমদ নাসাফি রহমতুল্লাহি আলাইহি ‘আকাইদে নাসাফি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-

المعراج لرسول الله صلى الله عليه وسلم فى اليقظة بشخسه الى السماء ثم الى ما شاء الله تعالى من العلى حق 

অর্থাৎ মি’রাজ হলো- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বশরিরে জাগ্রত অবস্থায় আসমানের দিকে, অতঃপর মহান আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী উপরের দিকে গমন হওয়া হক্ব বা সত্য। (শরহে আকাইদে নাসাফী ১৪৩ পৃষ্ঠা) উক্ত ইবারতের ব্যাখ্যায় আল্লামা তাফতাযানি রহমতুল্লাহ আলাইহি বলেন-

اى ثابت بالخبر المشهور حتى ان منكره يكون مبتدعا- 

অর্থাৎ রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মি’রাজ জাগ্রত অবস্থায় স্বশরিরে সম্পন্ন হওয়া মশহুর হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এমনকি তার অস্বীকারকারী নিঃসন্দেহে বিদয়াতি বা গোমরাহ। আল্লামা নাসাফি রহমতুল্লাহ আলাইহি এর উক্তি فى اليقظة (জাগ্রত অবস্থায়) এর ব্যাখ্যায় আল্লামা তাফতাযানি রহমতুল্লাহ আলাইহি বলেন-

اشارة الى الرد على من زعم ان المعراج كان فى المنام- 

অর্থাৎ গ্রন্থাকার (আল্লামা নাসাফি রহমতুল্লাহ আলাইহি) এর উক্তি فى اليقظة (জাগ্রত অবস্থা) বাক্যটি দ্বারা ঐসব ব্যক্তির আকিদাকে রদ্দ বা খ-ন করার দিকে ইশারা করেছেন, যারা বলে থাকে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মি’রাজ স্বপ্নযোগে হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, স্বপ্নযোগে মি’রাজের প্রবক্তাগণ তাদের দাবির পক্ষে যে তিনটি দলিল পেশ করে থাকে। সেই দলিলগুলোর জওয়াবসহ নিম্নে প্রদত্ত হলো-

দলিল- ১

روى عن معاوية انه سئل عن المعراج فقال كانت رويا صالحة- 

অর্থ: হযরত আমিরে মোয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তাঁকে মি’রাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, তিনি এর উত্তরে বললেন- উহা একটি ভালস্বপ্ন।

দলিল- ২

روى عن عائشة رضى الله تعالى عنها انها قالت ما فقد جسد محمد عليه السلام ليلة المعراج- 

অর্থ: হযরত আয়েশা সিদ্দিকাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন- মি’রাজের রাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহ মোবারক (আমার থেকে) পৃথক হয়নি।

দলিল- ৩

আল্লাহতা’য়ালার বাণী-

وما جعلنا الرؤيا التى ارينا الافتنة للناس- 

অর্থ: (হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমি যে দৃশ্য আপনাকে দেখিয়েছি তা কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্য। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত- ৬০) স্বপ্নযোগে মি’রাজ প্রবক্তাদের উপরোক্ত তিনটি দলিলের উত্তরে আল্লামা তাফতাযানি রহমতুল্লাহ আলাইহি বলেন-

بان المراد الرؤيا بالعين 

অর্থাৎ আয়াত ও হযরত মোয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদিসে الرؤيا এর মর্ম হচ্ছে চক্ষু মোবারক দ্বারা দেখা। আর হযরত আয়েশা সিদ্দিকাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা এর উক্তি ما فقد (দেহ মোবারক পৃথক হয়নি) এর মর্ম হচ্ছে-

ما فقد جسده عن الروح بل كان مع روحه وكان المعراج للروح والجسد جميعا- 

অর্থাৎ মি’রাজের রাতে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মোবারক থেকে রূহ মোবারক পৃথক হয়নি। বরং দেহ মোবারকের সাথে রূহ মোবারকও বিদ্যমান ছিল। এবং দেহ মোবারক ও রূহ মোবারক উভয়ের সমন্বয়ে মি’রাজ হয়েছিল।

(শরহে আকাইদে নাসাফি- ১৪৩ পৃষ্ঠা, নিবরাস- ২৯২ পৃষ্ঠা)

ইসরা ও মি’রাজের পার্থক্য
____________________
ইসরা ও মি’রাজের পার্থক্য

===================
রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই মোবারক নৈশ ভ্রমণ ও উর্ধ্বগমন যদিও ব্যাপক পরিভাষায় মি’রাজশরীফ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে কিন্তু মুহাদ্দিসীন ও মুফাসরিরীনদের পরিভাষায় রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত গমনকে ইসরা বলা হয়। কেননা কুরআনে পাকে আল্লাহতা’য়ালা ইহাকে ইসরা শব্দের দ্বারা বর্ণনা করেছেন। আর মসজিদে আকসা থেকে আসমানসমূহের দিকে উর্ধ্বগমনকে মি’রাজ বলা হয়। কেননা মি’রাজ বা উর্ধ্বগমন শব্দ বিশুদ্ধ হাদিসসমূহে বর্ণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘শরহে আক্বাইদে নসফী’ নামক কিতাবের ১৪৪ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ রয়েছে-

فالاسراء وهو من المسجد الحرام الى بيت المقدس قطعى ثبت بالكتاب والمعراج من الارض الى السماء مشهور ومن السماء الى الجنة اوالى العرش او غير ذلك احاد- 

অর্থাৎ اسراء ‘ইসরা’ মসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদে আকসা পর্যন্ত হচ্ছে কেতয়ী বা একিনী যা কিতাবুল্লাহ দ্বারা প্রমাণিত। আর معراج মি’রাজ- জমিন তথা মসজিদে আকসা হতে আসমানসমূহের উপর পর্যন্ত উর্ধ্বাগমন মশহুর হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তথা হতে বেহেশত অথবা আরশ পর্যন্ত তার উপর বিভিন্ন স্থানে উর্ধ্বগমন হলো খবরে ওয়াহিদ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। অনুরূপ শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী রহমতুল্লাহ আলাইহি ‘আশআতুল লুমআত’ নামক গ্রন্থের ৪র্থ খ- ৫২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

اسراء از مسجد حرام ست تامسجد اقصی ومعراج از مسجد اقصی ست تاآسماں- واسراء ثابت ست بنص قرآن ومنکر آں کافرست ومعراج باحادیث مشھورہ کہ منکرآں ضال ومبتدع ست- 

অর্থাৎ মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত হচ্ছে ইসরা। আর মসজিদে আকসা হতে আসমানসমূহ পর্যন্ত হচ্ছে মি’রাজ। ইসরা নসসে কুরআন তথা কুরআনের দলিল দ্বারা প্রমাণিত। তার অস্বীকারকারী কাফের এবং মি’রাজ মশহুর হাদিসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত। তাঁর অস্বীকারকারী গোমরাহ, বিদআতি ও পথভ্রষ্ট হবে। তদ্রুপ আল্লামা মোল্লা জিউন রহমাতুল্লাহ আলাইহি তাঁর ‘তাফসিরাতে আহমদীয়া’ নামক কিতাবের ৫০৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

ولذا قال اهل السنة باجمعهم ان المعراج الى المسجد الاقصى قطعى ثابت باللكتاب والى سماء الدنيا ثابت بالخبر المشهور والى ما فوقه من السموت ثابت بالاحاد فمنكر الاول كافر البتته ومنكر الثانى مبتدع مضل ومنكر الثالث فاسق- 

অর্থাৎ মসজিদে আকসা পর্যন্ত মি’রাজ কেতয়ী বা অকাট্য যা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত, আর দুনিয়ার আসমান পর্যন্ত হাদিসে মশহুর দ্বারা প্রমাণিত এবং আসমানসমূহ হতে তার উপর পর্যন্ত হাদিসে আহাদ দ্বারা প্রমাণিত। অতএব প্রথম স্তর অস্বীকারকারী অবশ্যই কাফের, আর দ্বিতীয় স্তর অস্বীকারকারী বিদআতি, মুদিল বা গোমরাহ এবং তৃতীয় স্তর অস্বীকারকারী ফাসেক হবে। শরহে আকাইদে নাসাফি গ্রন্থের ১৪৪ পৃষ্ঠায় ২ নম্বর পার্শ্বটীকায় উল্লেখ রয়েছে-

وفى كتاب الخلاصة من انكر المعراج ينظر ان انكر الاسراء من مكة الى بيت المقدس فهو كافر ولو انكر المعراج من بيت المقدس لا يكفر وذلك لان الاسراء من الحرام ثابت بالاية هى قطعية الدلالة والمعراج من بيت المقدس الى السماء ثبت بالسنة وهى ظنية الرواية- 

অর্থাৎ কিতাবুল খোলাসায় রয়েছে, মি’রাজশরীফকে যারা অস্বীকার করে তাদের ব্যাপারে লক্ষ্যণীয় যে, যদি ইসরা তথা মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত গমনকে কেউ অস্বীকার করে তবে সে কাফের হবে। আর যদি কেউ বায়তুল মুকাদ্দস থেকে মি’রাজ বা উর্ধ্বগমনকে অস্বীকার করে সে কাফের হবে না। (চরম গোমরাহ হবে।) কেননা মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ কুরআনশরীফের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। যা কেতয়ীয়ুত দালালত বা অকাট্য দলিল দ্বারা সাব্যস্ত। আর বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আসমানসমুহের দিকে উর্ধ্বগমন সুন্নাহ তথা মশহুর হাদিসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত যা জন্নী রেওয়ায়েত দ্বারা সাব্যস্ত। সারকথা মক্বাশরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত মি’রাজের এ অংশটুকুকে এনকার বা অস্বীকার করলে নিঃসন্দেহে কাফের হবে। মসজিদে আকসা থেকে আসমানের দিকে ঊর্ধ্বাগমনকে বলা হয় মি’রাজ। এটা মশহুর হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কেউ যদি মি’রাজশরীফের এ অংশটুকুকে এনকার বা অস্বীকার করে তবে সে কাফের হবে না বটে, কিন্তু অবশ্য বিদআতী বা পথভ্রষ্ট হবে। উপরুন্তু সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে আরশ পর্যন্ত অথবা জান্নাত পর্যন্ত কিংবা এতদ্ব্যতীত অন্যান্য বিভিন্ন স্থান পর্যন্ত যেগুলোতে আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হাবিবকে ভ্রমণ করিয়েছেন, এসব খবরে ওয়াহিদ দ্বারা প্রমাণিত। এগুলোকে অস্বীকার করলে শক্ত গোনাহগার হবে। মুদ্দাকথা হলো- মি’রাজুন্নবী তিনটি স্তরে বিভক্ত- 

১. মসজিদে হারাম হতে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত রাতের ভ্রমণ হলো ইসরা।

২. বায়তুল মুকাদ্দাস হতে আসমান হয়ে সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত ভ্রমণ হলো মি’রাজ।

৩. সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে ঊর্ধ্বগমনে ভ্রমণ হলো মি’রাজের তৃতীয় স্তর। এটাকে ই’রাজ বলা হয়ে থাকে।

কেউ কেউ বলেছেন- মি’রাজ জান্নাত পর্যন্ত হয়েছে, আর কেউ কেউ বলেছেন আরশ পর্যন্ত। কেউ কেউ বলেছেন- আরশের উপরে এবং কেউ কেউ বলেছেন- জগতের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত মি’রাজ হয়েছে।

(শরহে আকাইদে নাসাফী)

মি’রাজ শরীফের সূচনা
____________________
মি’রাজ শরীফের সূচনা

=================
রজনী দ্বিপ্রহর।ঘন অন্ধকারে আকাশ আচ্ছন্ন। নিস্তব্ধ নির্জন চারদিক।একটা অস্বাভাবিক গাম্ভীর্যে প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে আছে।সৃষ্টির সেরা মাহবুবে মতলক নূরনবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বা গৃহের চত্বরে ঘুমিয়ে আছেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন কে যেন তাঁকে ডাকছে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এতে মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখলেন, হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম শিয়রে দণ্ডায়মান। অদূরে ‘বোরাক’ নামক একটি অদ্ভূত জ্যোতির্ময় বাহন অপেক্ষা করছে। ডানা বিশিষ্ট অশ্বের মত রূপ, ক্ষিপ্র তার গতিবেগ।) মি’রাজ প্রসঙ্গে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লাহ শানুহু কালামে পাকের পনেরো পারা সূরায়ে বনী ইসরাইল প্রথম রুকুর মধ্যে এরশাদ করেন-

سبحان الذى اسرى بعبده ليلا من المسجد الحرام الى المسجد الاقصى الذى باركنا حوله لنريه من ايتنا انه هو السميع البصير- আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন আলাইহির রহমত ‘কানযুল ঈমান’ নামক কিতাবে উপরোক্ত আয়াতে কারিমার উর্দু তরজমা করেছেন-

پاکی ہے اسے جو اپنے بندے کو راتوں رات لے گیا مسجد حرام سے مسجد اقصا تک جس کے گرد اگرد ہم نے برکت رکھی کہ ہم اسے اپنی عظیم نشانیاں دکھائیں بیشک وہ سنتا دیکھتا ہے- 

তরজমা- পবিত্রতা তাঁরই (আল্লাহরই) জন্য। যিনি আপন বান্দাকে, রাতারাতি নিয়ে গেছেন, মসজিদে হারাম হতে মসজিদই আকসা পর্যন্ত, যার আশেপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই। নিশ্চয় তিনি শুনেন, দেখেন।’ চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী আলাইহির রহমত এর তরজমাই কুরআন ‘কানযুল ঈমান’ নামক কিতাবের তাফসির (হাশিয়া) ‘খাযাইনুল ইরফান’ নামক কিতাবে সদরুল আফাজিল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ নঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী আলাইহির রহমত উপরোক্ত আয়াতে কারিমার তাফসিরে উল্লেখ করেন- ‘সূরায়ে বনী ইসরাইল। এ সূরা মোবারকের অপর নাম ‘সূরা ইসরা এবং সূরায়ে সুবহানও বলা হয়ে থাকে। سبحان আল্লাহতা’য়ালার সত্ত্বা সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটি অক্ষমতা দূর্বলতা থেকে একেবারেই পূতঃপবিত্র। সেই আল্লাহ তাঁর মাহবুব মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মি’রাজের রাত্রিতে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। যার দূরত্ব চল্লিশ মনজিল, অর্থাৎ সোয়া এক মাসেরও অধিক পথ। শানে নুযুল: যখন কুল কায়েনাতের সরদার মাহবুবে মতলক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি’রাজের রাত্রে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও উন্নত স্তরসমূহে উপনীত হলেন, তখন কুল কায়েনাতের স্রষ্টা আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা সম্বোধন করলেন- ‘হে মুহাম্মদ! (মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ সকল মর্যাদা ও সম্মান আমি আপানাকে কেন দান করছি? উত্তরে মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরজি পেশ করলেন, এজন্য যে, আপনি আমাকে عبديت আবদিয়ত সহকারে (আপনার মাহবুব বান্দা হিসেবে) নিজের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন।’ এ প্রসঙ্গে এ বরকতময় আয়াতে কারিমা অবতীর্ণ হয়েছে। (খাযিন) الذى بركنا حوله لنريه من ايتنا (যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই) ধর্মীয় ও পার্থিব উভয় প্রকারের নিদর্শন। কেননা মসজিদে আকসা হলো পবিত্র ভূমি, আল্লাহতা’য়ালার পক্ষ থেকে ওহি অবতরণ স্থল, নবীগণ আলাইহিমুস সালাম এর ইবাদতের স্থান, তাঁদের অবস্থান স্থল এবং ইবাদতের কিবলা। এতদ্ব্যতীত অসংখ্য নদী, নহর ও গাছপালা দ্বারা ঐ ভূমি সবুজ-সজিব এবং ফল-মূলের আধিক্যের কারণে সুখ-স্বাচ্ছন্দের উত্তম স্থান। মি’রাজশরীফ ছরকারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক অনন্য মু’জিযা ও আল্লাহ জাল্লা শানুহুর এক মহান অনুগ্রহ। এ থেকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন পরিপূর্ণ নৈকট্যপ্রাপ্তির শান প্রকাশ পায়, যা আল্লাহতা’য়ালার কুল কায়েনাতের সৃষ্টিজগতে মাহবুবে মতলক নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো ভাগ্যে অর্জিত হয়নি। নবূয়তের দ্বাদশ সালে ছরকারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি’রাজ এর মত অনন্য মু’জিযা দ্বারা ধন্য হয়েছেন। মাস সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে, কিন্তু প্রসিদ্ধতম অভিমত হচ্ছে- ২৭ রজব নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মি’রাজশরীফ হয়েছিল। নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মি’রাজশরীফ জাগ্রত অবস্থায় শরির মোবারক ও রূহ মোবারক সহকারে সংঘটিত হয়েছে। অধিকাংশ মুসলমানগণের আকিদা বা দৃঢ় বিশ্বাস ইহাই। রাসূলে করিম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জলিল কদর সাহাবিদের মধ্যে এক বিরাট দল এ মতেরই ধারক। সুষ্পষ্ট ও সন্দেহাতীত অর্থ সংবলিত কুরআনশরীফের আয়াত ও হাদিসসমূহ থেকেও এ আকিদা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আশ শায়খ মুহাক্বিক আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত (বেলাদত ৯৫৮ হিজরি, ওফাত ১০৫২ হিজরি) তদীয় مدارج النبوة ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ কিতাবের প্রথম জিলদের ১৯০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

تحقیق آنست کہ محمول است برقصۂ معراج گفت بندۂ مسکین ثبتہ اللہ فی مقام الصدق والیقین کہ اشارت قول سبحانہ لنريه من اياتنا بمعراج است یعنی مسجد اقصی بروتا ازانجا بسموات بردہ آیات را بنماید چہ ارادت آیات وظھور غایت کرامات ومعجزات در سموات بود ومقتصر بنود برانچہ واقع شدہ در مسجد اقصی وبرون مسجد اقصی مبداء آنست در ایجہت ذکرکرد مسجد اقصی را ودر واقع اگردر منام می بود استبعاد نمیکردند آنرا کفار ودرفتنہ نمی افتادند ضعفای مومنین ونیز وقوع وقائع وقضایا خارج از حصر واحصا غیر متعارف ست در نوم- 

ভাবার্থ: মিসকীন বান্দা (গ্রন্থকার মুহাক্বিক শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত) বলেন- আল্লাহ সুবহানাহু ও তা’য়ালার নূরানী ফরমান- لنريه من ايتنا ‘যাতে আমি তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই।’ এ আয়াতে কারিমার দ্বারা মি’রাজের রাতের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুদ্দাকথা হলো এই যে, মসজিদে আকসা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়, এমনকী তথা হতে আকাশম-লে নিয়ে গিয়ে সকল নিদর্শনসমূহকে দেখানো হয়। কারণ নিদর্শনসমূহকে প্রদর্শিত করা এবং চুড়ান্ত অলৌকিকত্ব ও কারামতকে প্রকাশিত করা আকাশম-লে হয়েছিল এবং মসজিদে আকসায় যা কিছু ঘটেছিল এর উপরই কেবল সীমাবদ্ধ ছিল না। মসজিদে আকসা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, উহা এ মি’রাজের প্রারম্ভিক স্থান ছিল। সে হিসেবে কালামেপাকে মসজিদে আকসাকে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে ঘটনা যদি স্বপ্নযোগে হতো তো কাফেররা এ মি’রাজকে অসম্ভব বলে ধারণা করত না এবং দূর্বলমনা ঈমানদারগণ বিভ্রান্তির মধ্যে পতিত হতো না। মুফতিয়ে বাগদাদ আল্লামা সৈয়দ মাহমুদ আলুসি হানাফি বাগদাদী আলাইহির রহমত (ওফাত ১২৭০ হিজরি) তদীয় তাফসিরে روح المعانى ‘রুহুল মা’য়ানী’ নামক কিতাবের পঞ্চম জিল্দ (১৫ পারা বৈরুত ছাপা) ১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

ذكر العلائى فى تفسيره انه كان للنبى عليه الصلوة والسلام ليلة الاسراء خمسة مراكب الاول البراق الى بيت المقدس الثانى المعراج منه الى السماء الدنيا الثالث اجنحة الملائكة منها الى السماء السابعة الرابع جناح جبريل عليه السلام منها الى سدرة المنتهى الخامس الرفرف منها الى قاب قوسين- 

ভাবার্থ: আল্লামা আলাঈ আলাইহির রহমত স্বীয় তাফসিরে উল্লেখ করেছেন, নিঃসন্দেহে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য ইসরার রজনীতে পাঁচ প্রকার বাহন ছিল। প্রথমত: বোরাক, তা দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত গমন। দ্বিতীয়ত: তথা হতে (বায়তুল মুকাদ্দাস) দুনিয়ার আসমান পর্যন্ত ঊর্ধ্বারোহন। তৃতীয়ত: তথা হতে (প্রথম আসমান) সাত আসমান পর্যন্ত ফেরেশতাগণের ডানা দ্বারা। চতুর্থত: তথা হতে সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের ডানা দ্বারা। পঞ্চমত: তথা হতে قاب قوسين কা’বা কাউসাইন পর্যন্ত রফরফ দ্বারা। আল্লামা আলুসি বাগদাদী আলাইহির রহমত উক্ত কিতাবের ১০ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ করেছেন-

وذكر مولانا عبد الرحمن الدشتى ثم الجامى ان المعراج الى العرش بالروح والجسد والى ما وراء ذلك بالروح فقط- 

অর্থাৎ ‘মাওলানা আব্দুর রহমান দাশতী ও আল্লামা মুল্লা জামি আলাইহির রহমত তাঁরা উভয়ে উল্লেখ করেছেন, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মি’রাজশরীফ হয়েছে, স্বশরিরে রূহ মোবারক ও শরির মোবারক উভয়টি সহকারে আরশে আজিম পর্যন্ত। অপরদিকে আরশে আজিমের উপরে শুধুমাত্র রূহানি মি’রাজ হয়েছিল।’ অতঃপর তিনি আরো উল্লেখ করেন-

ولم اقف على مسند له من الاثار وكانه لاحظ ان العروج فوق العرش بالجسد يستدعى مكانا- وقد تقرر عند الحكماء ان ما وراء العرش لا خلا ولاملاوبه تنهى الامكته وتنقطع الجهات- 

ভাবার্থ: আছার (হাদিসের একটা প্রকার) থেকে এ প্রসঙ্গে কোন সনদ বা সূত্র আছে বলে আমি অবগত নই। আর শারিরিকভাবে বা স্বশরিরে আরশের উপরে ঊর্ধ্বারোহন হওয়ার মত সেখানে কোন অংশ নেই। কেননা আরশের উপরে স্বশরিরে ঊর্ধ্বারোহনের জন্য সেখানে মাকান বা স্থানের দাবি জরুরি হয়ে পড়ে। হুকামা বা বিজ্ঞজনের বক্তব্য হচ্ছে, আরশ ব্যতীত (আরশের উপরে) এমন এক অবস্থা যা খালিও নয় এবং পরিপূর্ণও নয়, বরং এখান হলো মাকানের শেষ প্রান্ত এবং এখানে দিক বলতে কিছুই নেই।’ ফলকথা আরশের উপরের এমন এক অবস্থা যা খালিও নয় এবং ভরাও নয়। যেখানে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম বলতে কিছুই নেই। এখানে হলো মাকানের শেষ প্রান্ত। সুতরাং আরশের উপরে স্বশরিরে মি’রাজ বা ঊর্ধ্বারোহণ সম্ভবপর নয়। এজন্য বলা হয়েছে, আরশের উপরের মি’রাজ হলো হাবিবে খোদার রূহ মোবারকের মি’রাজ। উপরে দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে-

১. নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মি’রাজশরীফ জাগ্রত অবস্থায় শরির মোবারক ও রূহ মোবারক উভয়টি সহকারে সংঘটিত হয়েছে আরশ পর্যন্ত।

২. মি’রাজশরীফের প্রথম স্তর মসজিদে আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত (বোরাক দ্বারা গমন) কুরআনশরীফের কেতয়ী আয়াতে কারিমা দ্বারা প্রমাণিত।

৩. মি’রাজশরীফের দ্বিতীয় স্তর বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত বোরাক দ্বারা প্রথম আসমান মশহুর হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।ফেরেশতাগণের ডানার দ্বারা সপ্তম আকাশ পর্যন্ত এবং তথা হতে জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের ডানা দ্বারা সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত।

৪. মি’রাজশরীফের তৃতীয় স্তর হলো সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে আরশ বা কা’বা কাউসাইন পর্যন্ত রফরফ দ্বারা ভ্রমণ খবরে ওয়াহিদ দ্বারা প্রমাণিত।

৫. মি’রাজশরীফের চতুর্থ স্তর হলো আরশের উপরে শুধুমাত্র রূহ মোবারক এর সফর। কারণ আরশ ব্যতীত, আরশের উপর-

(لا خلا ولاملاوبه تنتهى الامكنة وتنقطع الحهات- روح المعاننى) 

এর এমন এক অবস্থা খালিও নেই, ভরাও নেই, মাকানের শেষপ্রান্ত যেখানে দিকসমূহ কর্তিত। ফলকথা হলো উত্তর দক্ষিণ পূর্ব ও পশ্চিম বলতে কোন দিকই নেই এবং খালিও নয় পরিপূর্ণও নয়। অর্থাৎ কোন মাকান নেই। মি’রাজশরীফের চতুর্থ স্তর, আরশের উপরের যে তত্ত্ব দেয়া হয়েছে তা আল্লামা আলুসি বাগদাদী, মাওলানা আব্দুর রহমান দাশতী ও মুল্লা জামি আলাইহিমুর রহমত তাঁদের তাহকিকাতের আলোকে দেয়া হয়েছে।

আল্লাহর একান্ত সান্বিধ্যে
____________________
আল্লাহর একান্ত সান্বিধ্যে

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা সূরা নজমের ৭ ও ৮ নং আয়াতে এরশাদ ফরমান-

ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى 

অর্থাৎ: অতঃপর তিনি নিকটবর্তী হলেন, আরো নিকটবর্তী হলেন, অতঃপর দুই ধনুকের দুরুত্ব পরিমাণ ব্যবধান রইল এর চেয়েও আরো কম। (উজুব ও ইমকানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে আল্লাহর বন্দেগির মাধ্যমে উলুহিয়ত তথা আল্লাহর দরবারে উবুদিয়তের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত হলেন)। এ প্রসঙ্গে আল্লামা মুহাক্বিক শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত مدارج النبوة ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ নামক কিতাবের প্রথম জিলদের ২০৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

وبایدد انست کہ این ثم دنى فتدلى کہ مذکور شداست ومعبر بقاب قوسین او ادنی گشت ومذکوراست دراحادیث معراج غیر ثم دنی فتدلی کہ مذکوراست در سورۂ والنجم کہ ان نسبت برویت و قرب جبرئیل است بقول مختار وسباق وسیاق آیۃ نیز ظاھر است دران وبعضے برویت وقرب پرور دگار تعالی وتقدس نیز حمل کردہ اند چنانکہ در کتب تفسیر مذکورست الخ 

ভাবার্থ: ‘জেনে রাখা প্রয়োজন মি’রাজ সংক্রান্ত আয়াতে কারিমা ثم دنى فتدلى ‘সুম্মা দানা ফাতাদাল্লা’ অতঃপর সেই জ্যোতি নিকটবর্তী হয়, তারপর আরো সন্নিকটে নেমে আসে, এর ব্যাখ্যা قاب قوسين যখন সেই জ্যোতি আর প্রেমাস্পদের মাঝখানে মাত্র দুই ধনুকের ব্যবধান থেকে যায় বরং এর চেয়েও কম। এ আয়াতে কারিমা মি’রাজের হাদিসসমূহে বর্ণিত হয়েছে এবং ইহা সূরা-ই আন নজমে যা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা بقول مختار গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী উহার সম্বন্ধ হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এর দিদার ও তাঁর সাথে নৈকট্যতার প্রতি করা হয়েছে। আর পবিত্র আয়াতে কারিমার পূর্বাপর বাহ্যিক গতিধারাও ইহাই। কোন কোন মুফাসসির আল্লাহতা’য়ালার দিদার এবং তাঁর সাথে নৈকট্যলাভের অর্থও করেছেন, যেমন তাফসিরের কিতাবসমূহে বর্ণনা করা হয়েছে।’ মুহাক্বিক শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমতের উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা আয়াতে কারিমার অর্থ হবে- ১. গ্রহণযোগ্য মত بقول مختار অনুযায়ী জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মূল আকৃতির দিদার ও তাঁর সাথে নৈকট্যতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ২. কোন কোন মুফাসসির আল্লাহ তা’য়ালার দিদারও তাঁর সাথে নৈকট্যলাভের অর্থ করেছেন। এমতাবস্থায় আয়াতে কারিমার ভাবার্থ হবে, আল্লাহতা’য়ালা হলেন স্রষ্টা এবং হাবিবে খোদা হলেন তাঁরই বেনজির বেমিসাল সৃষ্টি, যার তুলনা সৃষ্টিজগতে নেই। অপরদিকে আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন অজুব এবং তাঁর হাবিব হচ্ছেন ইমকান। অজুব ও ইমকানের নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে উলুহিয়ত ও উবুদিয়তের যথাযথ মর্যাদায় হাবিবে খোদা সেখানে অধিষ্টিত হলেন। আর চর্মচক্ষু মোবারক দ্বারা আল্লাহর দিদারে ধন্য হলেন। অন্যথায় অজুব ও ইমকানের মধ্যে ইত্তেহাদ বা উভয়ে এক হয়ে যাওয়া কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহতা’য়ালা কোন কিছুর সাথে একীভূত হওয়া অথবা কোন বস্তুর মধ্যে হুলুল বা অনুপ্রবেশ হওয়া থেকে পবিত্র। গাউসুল আ’জম শায়খ সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী রাদিয়াল্লাহু আনহু এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। (তাফসিরে আল জিলানী) আল কামুসুল মুহিত গ্রন্থকার আল্লামা মাজদুদ্দিন মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব ফিরুজাবাদী রহমতুল্লাহ আলাইহি সংকলিত

تنوير المقباس من تفسير ابن عباس 

‘তানভীরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবনে আব্বাস’ নামক গ্রন্থে সূরা নজমের উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রাইসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৮ হিজরি) এর বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন-

(فاستوى) جبريل فى صورته التى خلقه الله عليها ويقال فاستوى فى صورة خلق حسن (وهو بالافق الاعلى) بمطلع الشمس ويقال فى السماء والسابعة ( ثم دنى) جبريل الى محمد صلى الله عليه وسلم ويقال محمد الى ربه (فتدلى) فتقرب (فكان قاب قوسين) من قسى العرب (او ادنى) بل ادنى بنصف قوس- 

তরজমা: অতঃপর জিব্রাইল আমিন স্বীয় আসলি সুরতে প্রকাশ হলেন অথবা অর্থ এই যে, উত্তম আকৃতি ও অবয়বে প্রকাশ হলেন, এমতাবস্থায় যে, তিনি পূর্বদিগন্তে ছিলেন। অথবা অর্থ এই যে, সপ্ত আকাশের কিনারায় ছিলেন। অতঃপর জিব্রাইল আমিন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী হলেন। কেউ কেউ বলেছেন- অর্থ এই যে, হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরওয়ার দিগারে আলমের নিকটবর্তী হলেন, যে নৈকট্যের কারণে দুই ধনুকের সমান দূরুত্ব অবশিষ্ট ছিল বরং অর্ধ্ব ধনুকের দূরুত্ব অবশিষ্ট ছিল।’ তানভীরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবনে আব্বাস’ এ কিতাবের ভাষ্য অনুযায়ী স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-

ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى 

এ আয়াতে কারিমার ভাবার্থ হলো- জিব্রাইল আমিন হাবিবে খোদার নিকটবর্তী হয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন- হাবিবে খোদা আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছেন। প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহর নিকটও নেই দূরও নেই। সুতরাং আল্লাহর হাবিব আল্লাহর নিকটে এসেছেন এর ভাবার্থ হলো- আল্লাহর হাবিব উবুদিয়তের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় মর্যাদায় অধিষ্টিত হয়ে আল্লাহর দিদারে ধন্য হয়েছেন। এছাড়া নবী বংশের অমূল্য রত্ন গাউসে রাব্বানী ইমামে ছামদানী সাইয়্যিদ মহিউদ্দিন আব্দুল কাদির জিলানী (ওফাতশরীফ ৭১৩ হিজরি) তদীয় تفسير الجيلانى ‘তাফসিরে আল জিলানী’ নামক কিতাবের পঞ্চম জিল্দ ৭৮ পৃষ্ঠায় ثم دنى فتدلى ‘সুম্মা দানা ফাতা দাল্লা’ এ আয়াতে কারিমার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন-

(ثم دنى) وتقرب الى ربه (فتدلى) النجم) وتعلق به سبحانه نوع تعلق ولحوق الى حيث (فكان) قرب ما بينهما (قاب قوسين) اى مقدار قوسى الوجوب والامكان الحافظين لمرتبتى الالوهية والعبودية (او ادنى) النجم: واقرب منهما الفناء حصة الناسوت مطلقا فى حصة اللاهوت- 

ভাবার্থ: ‘অতঃপর তিনি নিকটবর্তী হলেন অর্থাৎ তিনি তাঁর রবের নৈকট্য অর্জন করলেন। অতঃপর আরো নিকটবর্তী হলেন। (সূরায়ে নজম আয়াত- ৮) আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার বিশেষ ধরনের সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত হলেন এবং যথাসাধ্য নিকটবর্তী হলেন। অর্থাৎ দুই ধনুকের দূরুত্ব বরাবর নিকটবর্তী হলেন। দুই ধনুকের দূরুত্ব পরিমাণ তথা অজুব ও ইমকানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে আল্লাহর বন্দেগির মাধ্যমে উলুহিয়ত বা আল্লাহর দরবারে উবুদিয়তের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত হলেন।’ জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন واجب الوجود ‘ওয়াজিবুল অজুদ’ বা অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বধারী, অবিনশ্বর। যার আরম্ভ নেই শেষও নেই। সবসময় ছিলেন বরং সময় যখন ছিল না, তখনও তিনি ছিলেন, এখনও আছেন, চিরকালই থাকবেন, যার কোন অন্ত নেই। যিনি অসীমের অসীম। যার কোন লয়, ক্ষয় ও ধ্বংশ নেই। তিনিই হচ্ছেন صمد ‘সামাদ’ বা অমুখাপেক্ষী। অপরদিকে ছরকারে কায়েনাত তাজেদারে মদিনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন ممكن الوجود ‘মমকিনুল অজুদ’ এবং محتاج الى الله একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার দিকেই মুহতাজ বা মুখাপেক্ষী। যেহেতু নূরনবী হচ্ছেন মমকিন বা সম্ভাব্য অস্তিত্বের অধিকারী এবং আল্লাহ হচ্ছেন অজুব বা অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের অধিকারী। মমকিন বা সম্ভাব্য, উজুব বা অবশ্যম্ভাবী যাতেপাকের সাথে মিশতে পারে না, কেননা এটা উলুহিয়ত বা আল্লাহর গুণে গুনান্বিত হওয়ার মধ্যে গণ্য হয়ে পড়ে। (মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী দ্র:) আল্লাহতা’য়ালার যাতে কারিমা হচ্ছে نور حقيقى নূরে হাকিকী বেনজির বেমিসাল নূর, নূরে মতলক। অর্থ হচ্ছে منور ‘মুনাওইর’ নূর সৃষ্টিকারী। আসমান, জমিন, চন্দ্র, সূর্য, আরশ, করছি, লৌহ, কলম, এককথায় কুল কায়েনাতের স্রষ্টা। হাসান আবু আলীয়া ও দাহহাকসহ এবং একজামাত মুফাসসিরীনে কেরামের অভিমত এর উপর রয়েছে।

আল্লামা রাগেব ইস্পাহানির লিখিত ‘আল মুফরাদাত’ নামক কিতাবের ৫০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-

وسمى الله تعالى نفسه نورا من حيث انه هو المنور- قال: (الله نور السموات والارض) 

অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা স্বীয় নাফস বা যাতকে নূর বলে নামকরণ করেছেন এ মর্মে যে, এ নূরের অর্থ হলো منور ‘মুনাওইর’ বা আলোদানকারী। আল্লাহতা’য়ালা এরশাদ করেছেন আল্লাহ আসমান ও জমিনের নূর দানকারী।’ অর্থাৎ আল্লাহ হচ্ছেন হাকিকী নূর আর নবী হচ্ছেন তাখলিকী বা সৃষ্ট নূর। আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হেকমতে কামেলার দ্বারা এ নূর মোবারককে সৃষ্টি করে, এর সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহর যাত কারিমার দিকে রেখেছেন। এজন্য বলা হয় আল্লাহর যাত কর্তৃক নবীর যাত সৃষ্টি। ষষ্ঠ শতাব্দীর পঞ্চম মুজাদ্দিদ আল্লামা ইমাম গাজ্জালি আলাইহির রহমত (ওফাত ৫০৫ হিজরি) ‘মিশকাতুল আনওয়ার’ নামক একখানা কিতাব প্রণয়ন করেছেন এবং কুরআন সুন্নাহর দলিল আদিল্লাহর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন আল্লাহতা’য়ালাই একমাত্র নূর, নূরে হাকিকী, নূরে মতলক, আল্লাহর যাত হলো নূর এবং আল্লাহ ছাড়া সবই مظلم ‘মুজলিম’ বা অন্ধকার। আল্লাহ যাকে নূর দান করেছেন তিনিই একমাত্র নূর নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। আল্লাহর হাবিব নিজেই এরশাদ করেছেন-

اول ما خلق الله نورى 

সর্ব সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহতা’য়ালা আমি নবীর নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং আল্লাহর হাবিব হচ্ছেন আল্লাহতা’য়ালার সৃষ্ট নূর। আর তিনি হচ্ছেন জিনসে বশর বা মানব জাতিতেই এসেছেন। অর্থাৎ তিনি নূরানী মানব। এ সম্পর্কে শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত তদীয় مدارج النبوة নামক কিতাবের ১ম খণ্ড পবিত্র কোরআনের আয়াতে কারিমা উল্লেখ করেছেন-

لقد جاء كم رسول من انفسكم عزيز عليه ما انتم حريص عليكم باالمؤمنين رؤوف رحيم- 

অনুবাদ: নিশ্চয় তোমাদের নিকট তাশরিফ এনেছেন তোমাদের জিনস বা যাত থেকে ঐ রাসূল যার নিকটতোমাদের কষ্ট বড়ই কষ্টদায়ক মনে হয়, যিনি তোমাদের কল্যাণ কামনা করে থাকেন। এবং মু’মিনদের প্রতি বড়ই দয়া ও মেহেরবানী প্রদর্শন করে থাকেন। (সূরা তাওবা, আয়াত ১২৮) এ আয়াতের তাফসিরে ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ কিতাবের ৭৮-৭৯ পৃষ্ঠায় তিনি বলেন-

بتحقیق آمد شمارا پیغمبری ازذاتھای شما واز جنس شما کہ می شناسید- 

অর্থাৎ নিঃসন্দেহে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের যাত ও তোমাদের জিনস থেকে এসেছেন। অপরদিকে আল্লাহতা’য়ালার যাতে কারিমা ও তাঁর ৮টি সিফাতে কামেলা قديم ‘কাদিম’ যার কোন আরম্ভও নেই শেষও নেই। আল্লাহতা’য়ালা সবসময় ছিলেন, যখন সময় ছিল না তখনও ছিলেন, সবসময় থাকবেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত তদীয় ‘এহইয়ায়ে উলুমিদ্দীন’ নামক কিতাবের প্রথম জিলদের ৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

وهو الان على ما عليه كان وانه بائن عن خلقه بصفاته ليس فى ذاته- 

অর্থাৎ ‘তিনি (আল্লাহ) আদিতে যেমনি ছিলেন, এখনও তিনি তেমনিই আছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির নিকট গুণ দ্বারা প্রকাশ, অস্তিত্ব বা জাত দ্বারা নয়।’

চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী (আলাইহির রহমত) তদীয় الدولة المكية بالمدة الغيبية ‘আদদৌলাতুল মক্বিয়া ফি মাদ্দাতিল গাইবিয়া’ নামক কিতাবের ৩০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

وذاته سبحانه وتعالى غيرمتناهية وصفاته غيرمتناهيات وكل صفة منها غيرمتناهية وسلاسل الاعداد غيرمتناهية وكذا ايام الابد وساعاته واناله- 

ভাবার্থ: ‘আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার যাত বা সত্ত্বা غيرمتناهية সীমাবদ্ধতা হতে পবিত্র (অসীম)। তেমনি তাঁর صفات সিফাত বা গুণাবলীও সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত। তন্মধ্যে আবার প্রতিটি صفة সিফত বা গুণ সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত অর্থাৎ আল্লাহতা’য়ালার যাত ও সিফাতসমূহ বা গুণাবলী গায়ের মুতানাহী বা অসীম যার কোন সীমা নেই। অপরদিকে এগুলোর গণনার ধারাবাহিকতা অসীম। এককথায় আল্লাহ হচ্ছেন وجود وجوب অজুদে উজুব বা অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বধারী। যার কোন আরম্ভ নেই, শেষও নেই, ক্ষয়, লয়, পরিবর্তন, পরিবর্ধন হওয়া অসম্ভব ও হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা ব্যতীত অজুদে উজুব বা অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের অধিকারী আর কেউই নেই। অপরদিকে গোটা মাখলুকই হচ্ছে আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। আর মাহবুবে মতলক হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন اكمل الخلق على الاطلاق পরিপূর্ণ সৃষ্টি। যার নূর বা রূহ মোবারক আল্লাহতা’য়ালার সর্বপ্রথম কোন উপাদান বা মাদ্দা ছাড়াই নিজ কুদরতে কামেলা বা হেকমতে কামেলার দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং নবী হচ্ছে ইমকান বা মমকিনুল অজুদ। ফলকথা আল্লাহ হচ্ছেন الوجوب উজুব এবং নবী হচ্ছেন الامكان ইমকান। এজন্য গাউসেপাক রাদিয়াল্লাহু আনহু ইরশাদ করেন-

مقدار قوسى الوجوب والامكان الحافظين لمرتبتى الالوهية والعبودية- 

অর্থাৎ দুই ধনুকের দূরুত্ব পরিমাণ তথা অজুব ও ইমকানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে (আল্লাহ নিরাকার এবং নবী হচ্ছেন সাকার। আল্লাহ হচ্ছেন শ্রষ্টা এবং নবী হচ্ছেন আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্ট নূর। আল্লাহ হচ্ছেন معبود ‘মাবুদ’ নবী হচ্ছেন عابد আবিদ আল্লাহর বন্দেগি করলেওয়ালা) উলুহিয়ত ও উবুদিয়তের স্ব-স্ব মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে, হাবিবে খোদা আল্লাহর বন্দেগির মাধ্যমে উলুহিয়ত বা আল্লাহর নিকট উবুদিয়তের অধিক মর্যাদায় অধিষ্টিত হলেন। এককথায় নবী আলাইহিস সালাম সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় আল্লাহর নৈকট্য লাভে আল্লাহতা’য়ালার দিদারে ধন্য হলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু মমকিনুল অজুদ, যার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, ক্ষয়, লয় হওয়া সম্ভব। উজুব ও ইমকানের মধ্যে ইত্তেহাদ ও হুলুল হওয়া অসম্ভব। সুতরাং নবী মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর যাতের সঙ্গে মিশে গেছেন অথবা আল্লাহ ও রাসূল উভয় اتحاد ইত্তেহাদ বা এক হয়ে গেছেন এরূপ আকিদা রাখা কুফুরি ও শিরকি বৈ কিছুই নয়। কেউ কেউ ওয়াজ মাহফিলে ও বক্তৃতায় বলে থাকেন- ‘মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর হাবিব এমনভাবে আল্লাহর সত্ত্বার সাথে মিশে গেছেন যেমন চিনি পানিতে মিশে যায়।’ এরূপ আকিদা ঈমান বিধ্বংশী আকিদা, এসব আকিদাহ যেন আমাদের মধ্যে না থাকে সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আরো কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রদত্ত হলো- ১. মুনতাখাবাত আয মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী নামক গ্রন্থের ২৭৬ পৃষ্ঠায়, ৬৭ নম্বর মাকতুবে উল্লেখ রয়েছে-

او تعالی با ھیچ چیز متحذ نشود وھیچ چیز باوے متحد نگردد و نیز ھیچ چیز دروے تعالی حلول نکند اوتعالی درھیچ چیز حلول نشود وتبعض وتجروی در جناب قدس اوتعالی مجالست وترکیب وتحلیل دران حضرت جل شانہ ممنوع ست الخ 

ভাবার্থ: হযরত উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র একাদশ শতাব্দীর দশম মুজাদ্দিদ শায়খ আহমদ সিরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমত (ওফাত ১০৩৪ হিজরি) বলেন- ‘আল্লাহতা’য়ালা কোন বস্তুর সাথে একীভূত হন না এবং কোন বস্তু তাঁর সাথে এক হয়ে যায় না। আল্লাহ তা’য়ালা কোন বস্তুর ভিতর অনুপ্রবেশ করেন না এবং কোন বস্তুও আল্লাহর ভিতরে অনুপ্রবেশ করতে পারে না।আল্লাহ তা’য়ালার জন্য খণ্ড- ও অংশ হওয়া অসম্ভব। তারকিব বা সংমিশ্রণ, তাহলিল বা দ্রবীভূত হওয়া তাঁর পাক জাতে মামনুউ বা নিষিদ্ধ।’ উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতা’য়ালার সত্ত্বার সাথে কেউ মিশতে পারবে না। সুতরাং চিনি যেমন পানিতে মিশে যায় তেমনি আল্লাহর রাসূল মি’রাজশরীফে আল্লাহর সত্ত্বার সাথে মিশে গেছেন এ আকিদা ঈমান বিধ্বংশী আকিদা।

২. হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় مكتوبات امام ربانى ‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ নামক কিতাবের তৃতীয় জিলদের ১২২ নং মকতুবে করেছেন-

آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم بھی اس جاہ وجلال اور اس بلندی شان کے با وجود ہمیشہ ممکن ہیں اور ہرگز امکان سے باہر نہیں آسکتے اور نہ واجب سے مل سکتے کیونکہ یہ الوھیت سے متصف ہونے کو مستلزم ہے اور تعالی اس سے بلند ھے کہ کوئ اسکا شریک اور برابری کرنے والا ہو- دع ما ادعتہ النصاری فی نبیھم واحکم بما شئت مدحا فیہ واحتکم 

ভাবার্থ: হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ শান শওকতের ও কুলকায়েনাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সবসময় (চিরকালই) তিনি হচ্ছেন ممكن ‘মমকিন’ বা সম্ভাব্য। নিশ্চয় নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ممكن ‘মমকিন’ বা সম্ভাব্য হতে নিস্কৃতি লাভ করেননি এবং আল্লাহতা’য়ালা যিনি واجب الوجود ‘ওয়াজিবুল ওজুদ’ বা অবশ্যম্ভাবী জাতে পাকের সাথে তিনি মিলিত হতে পারেন না, এ জন্য যাতে উলুহিয়াতের (আল্লাহর) সাথে মিলিত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহতা’য়ালা তাঁর সমকক্ষ ও শরিক হওয়া হতে তিনি অতি উচ্চ ও পবিত্র। কহিল নাছারা যাহা স্বীয় নবীর পরে কহিও না তোরা তাহা মম নবী বরে। মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমতের উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- ক. আল্লাহ হচ্ছেন ওয়াজিবুল ওজুদ বা অবিনশ্বর, অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের অধিকারী। যাকে উজুব বলা হয়ে থাকে। খ. নবী হচ্ছেন ممكن الوجود বা সম্ভাব্য অস্তিত্বের অধিকারী যাকে ইমাকানও বলা হয়ে থাকে। গ. হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ আল্লাহর সকল সৃষ্টিজগতই ইমকান। ইমকান কস্মিনকালেও অজুব বা আল্লাহতা’য়ালার যাতের সাথে মিশতে পারে না। কেননা ইমকান আল্লাহর যাতের সাথে মিশার অর্থ হলো উলুহিয়ত স্বীকার করা অনিবার্য হয়ে পরে। সুতরাং প্রকৃত অর্থে নবী আল্লাহর যাতের সঙ্গে মিশে গেছেন যেমন চিনি পানিতে মিশে যায় এরূপ বলা তাওহিদী আকিদার পরিপন্থী। ৩. চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী আলাইহির রহমত ‘সিলাতুস সাফা ফি নুরিল মোস্তফা’ নামক কিতাবে লিখেছেন-

اللہ عز وجل حصے اور ٹکرے اور کسی کے ساتھے متحد ہو جانے یاکسی میں حلول فرمانے سے پاک و منزہ ہے حضور سید عالم صلی اللہ علیہ وسلم خواہ کسی شئ کو جزء ذات الھی خواہ کسی مخلوق کو عین ونفس ذات ماننا کفر ہے- 

ভাবার্থ: মহান আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা অংশ, টুকরো এবং কোন কিছুর সাথে একীভূত হওয়া অথবা কোন বস্তুর মধ্যে হুলুল বা অনুপ্রবেশ হওয়া থেকে পবিত্র। হুজুর সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনকী কোন বস্তুকে আল্লাহর যাতের অংশ এমনকী কোন সৃষ্টিকে প্রকৃত জাত ও নফসে যাতে এলাহি মানা বা আকিদা রাখা কুফুরি। ইমামে আহলে সুন্নাত আ’লা হযরতের উপরোক্ত বক্তব্যের দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতায়ালার যাতে কারিমা এমন একটি নূর যার কোন উদাহরণ বা মিসাল নেই। বেনজির বেমিসাল নূর, নূরে হাকিকী, যে নূরের অংশ হয় না, ভাগ হয় না, টুকরো হয় না, লাল, হলুদ, সবুজ এককথায় সৃষ্টির মধ্যে যার কোন তুলনা নেই। মোটকথা আল্লাহর নূর হলো নূরে হাকিকী এবং রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূর হলো নূরে তাখলিকী বা আল্লাহর সৃষ্ট নূর। আ’লা হযরতের এ ফতওয়ার আলোকে বুঝা গেল যে, মি’রাজ রজনীতে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার সাথে হাবিবে খোদা একীভূত হওয়া বা মিশে যাওয়া অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর যাতের মধ্যে হুলুল বা অনুপ্রবেশ করা, এরূপ আকিদা নিঃসন্দেহে কুফুরি।

মুদ্দাকথা হলো হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর যাত বা সত্ত্বার সাথে মিশে গেছেন এ আকিদা রাখা কুফুরি। একটি প্রবাদ রয়েছে- নূরে নূরে মিল গিয়া হায় ওয়াসতা মে পর্দা নিহি। এধরনের কথা বলা যাবে না। ‘মুন্তাখাবাত আজ মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ নামক কিতাবের ১৪৯ পৃষ্ঠায় (মাকতুব নং ২৬৬) উল্লেখ রয়েছে-

اوتعالی قدیم وازلی است وغیر اورا قدیم وازلیت ثابت نبود جمیع ملتیں بریں حکم اجماع فرمودہ اند وہر کسیکہ بقدم و آزلیت غیر حق جل وعلا قائل گشتہ است تکفیر او نمودہ اند- 

অর্থাৎ আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা কাদিম ও আজলি অর্থাৎ অনাদি ও অনন্ত, যার আরম্ভও নেই এবং শেষও নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে কেদাম ও আজলিয়ত বা অনাদি অনন্ত বলে আকিদা রাখা যাবে না। এর উপরই সকল মুসলমানগণের ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদি কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে কেদাম ও আজলিয়ত বা অনাদি অনন্ত বলে আকিদা পোষন করে তবে সে কাফের হয়ে যাবে। উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- একমাত্র আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লাই قديم وازلى কাদিম ও আজলি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কাদিম ও আজলি বলে আকিদা পোষণ করলে নিঃসন্দেহে কাফের সাব্যস্থ হবে। সারকথা হলো- আল্লাহ হচ্ছেন কাদিম ও আজলি, নবী হচ্ছেন তুলনাবিহীন হাদেছ, আল্লাহ হচ্ছেন وجوب নবী হচ্ছেন امكان ইমকান। ইহাই হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা। ৪. ‘তাফসিরে হাসান বসরী’ নামক কিতাবের পঞ্চম জিলদের ৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- 

قوله تعالى : (ثم دنا فتدلى) الاية ১৫৬৫- حدثنا عبد الرزاق عن معمر عن الحسن وقتادة فى قوله (ثم دنا فتدلى): قالا هو جبرائيل عليه السلام- حاشيه (১) عبد الرزاق ص ১৪৪- الف الاسناد صحيح 

ভাবার্থ: হযরত হাসান বসরী রাদিয়াল্লাহু আনহু সহিহ ইসনাদ সংবলিত হাদিসশরীফের মাধ্যমে উল্লেখ করেন আল্লাহর কালাম ثم دنا فتدلى ‘সুম্মা দানা ফাতাদাল্লা’ এ আয়াতে কারিমার অর্থ হলো- হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর হাবিবের নিকটবর্তী হলেন। আল্লামা আশ শায়খ ইসমাইল হক্বী বরসয়ী আলাইহির রহমত (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) তদীয় تفسير روح البيان ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতাবের নবম জিলদের ২১৭ পৃষ্ঠায়- ثم دنا فتدلى فكان قاب قوسين এ আয়াতে কারিমার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন- 

وفى معالم التنزيل معنى قوله كان بين جبرئيل ومحمد عليهما السلام مقدار قوسين انه كان بينهما مقدار ما بين الوتر والقوس كأنه غلب القوس على الوتر وهذا اشارة الى تأكيد القرب- 

ভাবার্থ: তাফসিরে মুয়ালিমুত তানযিল এ উপরোক্ত আয়াতে কারিমার ভাবার্থ বর্ণনা করা হয়েছে, হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম হাবিবে খোদার নিকটবর্তী হলেন। অর্থাৎ হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম ও হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে দুই ধনুকের দূরুত্ব বরাবর দূরত্ব ছিল। ফলকথা অধিক নিকটবর্তী হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।’ উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো- ثم دنا فتدلى الخ ‘সুম্মা দানা ফাতাদাল্লা’ এ আয়াতে কারিমার অর্থ হলো হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম হাবিবে খোদার নিকটবর্তী হলেন।

অনুরূপ ‘নাসিমুর রিয়াজ ফি শরহে শিফা কাজী আয়াজ’ নামক কিতাবের প্রথম জিলদের ২১৭ পৃষ্ঠায় আল্লামা আহমদ শিহাবুদ্দিন খুফফাজী মিশরী আলাইহির রহমত (বেলাদত ৪৩১ হিজরি, ওফাত ৫৪৪ হিজরি) উল্লেখ করেছেন-

(والقرب والدنو) لقوله تعالى (ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى) على القول بان الضمير النبى صلى الله عليه وسلم وليس هذا قربا مكانيا ان كان المرادبه من القرب من الله تعالى لاستحالة المكان والجهة على الله وقد ذكر فى الاية على سبيل المدح فالاول فى قوله تعالى (فكان قاب قوسين او ادنى) والثانى فى قوله تعالى (ثم دنى) فهما متغائران هنا أو هو عطف تفسير- 

ভাবার্থ: ‘কুরব বা সান্বিধ্য ও দুনুউ বা নিকটবর্তী হওয়া’ এ সম্পর্কে আল্লাহতা’য়ালার এরশাদ-

ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى 

অর্থাৎ‘ হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর হাবিবের নিকটবর্তী হলেন। কেউ কেউ বলেছেন হাবিবে খোদা আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি আল্লাহর দরবারে নৈকট্য অর্জন করেছেন। নৈকট্যের কারণে দুই ধনুকের সমান দূরুত্ব অবশিষ্ট ছিল বরং অর্ধ্ব ধনুকের দূরুত্ব অবশিষ্ট ছিল। যদি ধরে নেওয়া হয় আল্লাহর হাবিব আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছেন, এমতাবস্থায় ‘কুরব’ বা নিকটবর্তী হওয়া কুরবে মাকান অর্থ নেয়া যাবে না। কেননা আল্লাহর জন্য মাকান ও দিক সবকিছুই অসম্ভব। আয়াতে কারিমার মধ্যে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা শুধুমাত্র হাবিবে খোদা যে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় এর ইঙ্গিত বহন করে। এখানে কুরব বা নিকটতম হওয়া কুরবে মাকান নয় বরং কুরবে মুদহে বা নবীকে যে আল্লাহ কামালে মুহব্বত করেছেন তারই নিদর্শন। এককথায় মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর হাবিব আল্লাহর দরবারে অধিক নৈকট্য লাভ করেছেন এবং কপালের চোখ মোবারক দ্বারা নিরাকার আল্লাহর দিদারে ধন্য হয়েছেন। মোদ্দাকথা হলো قاب قوسين او ادنى এর মধ্যে যে নৈকট্যের বর্ণনা রয়েছে, সুফিগণ তাকে ‘ফানায়ে তাম’ পূর্ণ ফানা বলে ব্যক্ত করেছেন। এতে নবীর শান যে সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় তারই প্রমাণ।

মি’রাজ ঈমানের কষ্টি পাথর
____________________
মি’রাজ ঈমানের কষ্টি পাথর

====================
ঈমানদারের জন্য মি’রাজের ঘটনা ঈমানের একটি কষ্টিপাথর। যে ব্যক্তি আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার যাত বা সত্ত্বা, সিফাত বা আল্লাহর গুণাবলী, অসীম জ্ঞান ও কুদরত মহাত্ম্য ও প্রজ্ঞার প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান রাখে এবং হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়ত ও রিসালাত, সততা এবং সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় মর্যাদাকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে। সে ব্যক্তি মি’রাজুন নবীর মতো সত্য ঘটনা বা এ জাতীয় অলৌকিক বিষয়াবলী কখনই অস্বীকার করতে পারে না। যখন কুরআন ও সুন্নায় তার সুষ্পষ্ট ও দ্বার্থহীন বর্ণনা রয়েছে। নবুয়তের কাল থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেক যুগের সকল মুসলমান মি’রাজ এর মত একটি অতুলনীয় মু’জিযাকে কুটিল ব্যাখ্যা ছাড়াই স্বীকার করে আসছেন

বায়তুল মুকাদ্দাস
____________________
বায়তুল মুকাদ্দাস

=============
হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে হারাম থেকে বোরাক যোগে বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছেন এবং বোরাককে মসজিদের দরওয়াজার থাম্বার সাথে বেঁধে রাখেন, বর্তমানে যাকে বাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলা হয়ে থাকে। এরপর মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামায আদায় করেন। খুব সম্ভব এ দু’রাকাত নামায তাহিয়্যাতুল মসজিদ এর নামায ছিল। এ স্থানে ফেরেশতাগণ উপস্থিত হন এবং হযরত আদম আলাইহিস সালাম হতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকল নবীগণ উপস্থিত হন। তাঁরা আল্লাহতা’য়ালার হাম্দ ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত ও সালাম পেশ করেন। এমতাবস্থায় সকলেই হাবিবে খোদার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দান করেন। তারপর আযান ও একামতের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইমামতিতে সকল আম্বিয়া ও ফেরেশতাগণ জামাত সহকারে নামায আদায় করেন। উলামায়ে কেরামদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, এ নামায নফল ছিল নাকি ফরয। যদি ফরয হয়ে থাকে ইশার নামায অথবা ফজরের নামায। হাদিসশরীফের পূর্বাপর ধারা হতে স্পষ্টত বুঝা যায় যে, বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত শুভাগমন করা ঊর্ধ্বগগনে গমনের পূর্বে ছিল, তা হলে এ নামায হবে ইশার নামায। আর যদি এ ঘটনা ঊর্ধ্বজগত হতে অবতরণের পর হয়, তাহলে হবে ফজরের নামায। কেউ কেউ এ মতের উপরই বেশি জোর দিয়েছেন। কেননা রাসূলে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল শ্রেষ্ঠত্ব ও বরকতসমূহ নিয়ে অবতরণ করলেন, তখন সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এর উপর হাবিবে খোদার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে প্রকাশ করার জন্য এ নামায আদায় করেছিলেন। শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত শায়খ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছির যিনি হাদিস ও তাফসিরের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতগণের একজন খ্যাতনামা পন্ডিত ছিলেন, তার রেফারেন্স দিয়ে এ মাসআলার এভাবে সমাধান দিয়েছেন যে, রাসূলে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঊর্ধ্বাকাশে গমনের পূর্বে এবং পরে উভয় অবস্থায় নবীগণের সাথে নামায আদায় করেছেন। (মাদারিজুন নবুয়ত) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদ হতে বাইরে তাশরিফ আনয়ন করলেন, তখন জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এক পেয়ালা শরাব ও এক পেয়ালা দুধের হাদিয়া পেশ করে আরজ করলেন- যে পিয়ালা ইচ্ছা মাহবুবে খোদা পান করতে পারেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধের পিয়ালাকে পছন্দ করলে, জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বললেন- আপনি ফিতরাতকে গ্রহণ করেছেন। এ স্থানে ইসলাম ও উহার উপর প্রতিষ্টিত থাকাকে ফিতরাতের মর্ম গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ছরকারে কায়েনাত আলাইহিস সালাম ইসলামের নিদর্শন ও দৃঢ় প্রত্যয়কেই গ্রহণ করেছেন। দুগ্ধপান ইসলামের নিদর্শন। হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদিস বর্ণিত আছে যে, দু’পিয়ালা আনয়ন করা হয়, একটি দুধের এবং অপরটি মধুর পেয়ালা। এক রেওয়ায়েতে রয়েছে, তিন পিয়ালা আনয়ন করা হয়, দুধ-পানি ও শরাবের পিয়ালা। এ রেওয়ায়েতে মধুর উল্লেখ নেই। যা হোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধ গ্রহণ করা পছন্দ করেছেন। সিদরাতুল মুন্তাহায় পৌঁছার পরই এ সকল পেয়ালা আনয়ন করা হয়। হাফিজ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছির আলাইহির রহমত এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

(মাদারিজুন নবুয়ত)

শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ কিতাবে উল্লেখ করেন- বর্ণিত আছে, আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহিম, হযরত মুসা, হযরত দাউদ, হযরত সুলায়মান এবং হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালাম প্রমূখ নবীগণকে যে সকল শ্রেষ্ঠ কারামত ও অলৌকিকত্বসমূহ দান করেছিলেন তাঁরা সকলে এর শোকরিয়া আদায় করার জন্য আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লাহর দরবারে তাঁরই প্রশংসায় বিমূঢ় হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন, এ ক্ষমতা আল্লাহপাকই তাদেরকে দান করেছিলেন। আল্লাহর হাবিব তখন আল্লাহর নি’য়ামতের শোকরিয়া আদায় করতে গিয়ে বলেছেন-

الحمد لله الذى ارسلنى رحمة للعلمين بشيرا ونذيرا للناس اجمعين وانزل على الفرقان فيه تبيان كل شئ وجعل امتى وسطا وجعل امتى هم الاولون وهم الاخرون وشرح لى صدرى ووضع عنى وزرى ورفع لى ذكرى وجعلنى فاتحا وخاتما- 

অনুবাদ: সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহতা’য়ালার জন্যে যিনি আমাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত এবং সকল মানুষের জন্য সুসংবাদ দানকারী ও ভয় প্রদর্শনকারী করে প্রেরণ করেছেন। আর আমার উপর এমন মহা-বিজ্ঞানময় কুরআন অবতরণ করেছেন যার মধ্যে সকল বস্তুর বর্ণনা উজ্জ্বলতম রূপে করা হয়েছে। আমার উম্মতগণকে মধ্যমপন্থী উম্মত বানানো হয়েছে। আর আমার উম্মতগণকে পরিগণিত করিয়েছেন যে, উহারাই প্রথম এবং উহারাই শেষ হবে এবং আমার জন্য আমার বক্ষ মোবারককে উম্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং আমার বোঝাকে বিদূরিত করে দিয়েছেন এবং আমার জন্য আমার জিকিরকে সমুন্নত করে দিয়েছেন এবং আমাকে বিজয়ী বানিয়েছেন এবং আমাকে সর্বশেষ নবী উপাধীতে ভূষিত করেছেন অর্থাৎ নবুওয়তের ধারায় আমিই সর্বশেষ নবী। (আমার পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী নেই)। এ বর্ণনাদানের পর হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম বললেন-

بهذا افضلكم محمد 

হে নবী! এ কারণে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।

সিদরাতুল মুন্তাহা
____________________
সিদরাতুল মুন্তাহা

=============
সাত আসমানের বিস্ময়কর ও বিরল বিষয়াবলী এবং আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লাহর নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুন্তাহায় পৌঁছেন। সিদরাতুল মুন্তাহা হচ্ছে একটি কুলবৃক্ষ এবং সৃষ্টির জ্ঞানের শেষ প্রান্ত। তাফসিরে রুহুল মা’য়ানী’ নয় নম্বর খ- ২৭ পারা ৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-

(عند سدرة المنتهى) هى شجرة نيق عن يمين العرش فى السماء السابعة على المشهور وفى حديث اخرجه احمد ومسلم والترمذى وغيرهم فى السماء السادسة نبقها كقلال هجر واوراقها مثل اذاب الفيلة يسير الراكب فى ظلها سبعين عاما لايقطعها- 

ভাবার্থ: ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ হলো একটি কুলবৃক্ষ। আরশের বামদিকে সপ্ত আকাশে অবস্থিত। এ অভিমতই হলো প্রসিদ্ধ। ইমাম আহমদ, ইমাম মুসলিম এবং ইমাম তিরমিজি প্রমূখ হাদিস বিশারদগণ রেওয়ায়েত করেছেন, সিদরাতুল মুন্তাহা হলো ষষ্ঠ আকাশে অবস্থিত। এ গাছের পাতা হলো হাতির কর্ণের মত। এ পাতার ছায়াতলে একজন আরোহী ৭০ বৎসর পর্যন্ত চলতে থাকলেও এর ছায়ার পরিধি শেষ হবে না।’ উপরোক্ত উভয় রেওয়ায়েতের মধ্যে এভাবে তাতবিক বা সামঞ্জ্য স্থাপন করা সম্ভব যে, ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ এর মূলভিত্তি হলো সপ্তম আকাশে এবং উহার ডাল-পালা ষষ্ঠ আকাশে। উক্ত বৃক্ষের তিন প্রকারের গুণ রয়েছে। এক, উহার ছায়া অনেক দীর্ঘ। দ্বিতীয় হলো উহার স্বাধ বড় মজার। তৃতীয় হলো, উহার গন্ধ বড় সুমধুর। আল্লামা সৈয়দ মাহমুদ আলুছি আল বাগদাদী আলাইহির রহমত (ওফাত ১২৭০ হিজরি) اذ يغشى السدرة ما يغشى এ আয়াতে কারিমার তাফসিরে তদীয় روح المعانى ‘রুহুল মায়ানী’ নামক কিতাবের নবম জিল্দ ২৭ পারা ৫১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

واخرج عبد بن حميد عن سلمة قال: استأذنت الملائكة الرب تبارك وتعالى ان ينظروا الى النبى صلى الله عليه وسلم فأذن لهم فغشيت الملائكة السدرة لينظروا اليه عليه الصلوة والسلام وفى حديث رأيت على كل ورقة من ورقها ملكا قائما يسبح الله تعالى- 

ভাবার্থ: হযরত আবদ ইবনে হামিদ হযরত সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, ফেরেশতাগণ আল্লাহতা’য়ালার শাহানশাহী দরবারে হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখার অনুমতি প্রার্থনা করলে, আল্লাহতা’য়ালা তাঁদেরকে অনুমতি প্রদান করলেন। অতঃপর সকল ফেরেশতাগণ সিদরাতুল মুন্তাহায় অবস্থান নিয়ে হাবিবে খোদার দর্শনের জন্য সিদরাতুল মুন্তাহাকে আচ্ছাদিত করে নূরনবীর দিদারে ধন্য হলেন। অন্য এক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে- হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি সিদরা বা কুলবৃক্ষের প্রত্যেক পাতায় পাতায় একেকজন ফেরেশতা দেখেছি, যারা দাঁড়িয়ে ‘সুবহানাল্লাহ!সুবহানাল্লাহ!পাঠ করছেন।

সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে প্রবাহিত নদীসমূহ
____________________
সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে প্রবাহিত নদীসমূহ

===================
সিদরাতুল মুন্তাহা হতে চারটি নদী প্রবাহিত হয়েছে- যথা দুইটি বাইরে এবং দুইটি ভিতরে। ভিতরের দুটি জান্নাতে প্রবাহিত আর বাইরের দুইটিকে নীল ও ফোরাত নদী বলা হয়ে থাকে। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদিস হতে জানা যায় যে, এ চারটি নদীই জান্নাত হতে প্রবাহিত হয়ে থাকে। নীল, ফোরাত, সায়হান ও জায়হান।

হাউজে কাউছার
____________________
হাউজে কাউছার

============
ইবনে আবি হাতিম হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত এক হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, রাসূলে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সপ্তম আকাশ হতে বের হয়ে আসেন, তখন এক নদী প্রত্যক্ষ করেন। যা ইয়াকুত ও যবরজাদ পাথরের টুকরার উপর প্রবাহমান। আর উহার পিয়ালা স্বর্ণ, রৌপ্য, ইয়াকুত, মুক্তা, এবং যবরজাদের প্রস্তুতকৃত। আর উহার পানি দুধের চেয়েও অধিক সাদা এবং মধুর চেয়েও অধিক মিষ্টি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- হে জিব্রাইল এ গুলি কি? জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আরজ করলেন- ইহা হলো حوض كوثر ‘হাউজে কাউছার’ এ মহান নিয়ামত আল্লাহতা’য়ালা আপনাকে দান করেছেন।

নহরে রহমত
____________________
নহরে রহমত

=========
হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস শরীফে রয়েছে- জান্নাতে যে নদী প্রবাহিত হয়েছে, যাকে سلسبيل ‘সালসাবিল’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। উহা হতে দুইটি নদী বের হয়েছে। একটির নাম كوثر ‘কাউছার’ দ্বিতীয়টির নাম نهر رحمت ‘নহরে রহমত’। ইহা সেই রহমতের দরিয়া, যখন শাফায়াতের উসিলায় পাপী ব্যক্তি, পাপের শাস্তি ভোগ করার পর দোযখে জ্বলে পুড়ে কাল অবস্থায় বের হয়ে আসবে, তখন সেই দরিয়ায় অবগাহন করবে এবং তৎক্ষণাৎ সজিব হয়ে যাবে।

বায়তুল মা’মুর
____________________
বায়তুল মা’মুর

===========
"সিদরাতুল মুন্তাহা" যা নূরের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত। স্বর্ণের পাখি ও পতঙ্গের ন্যায় প্রত্যেক পাতায় পাতায় একেকজন করে ফেরেশতা রয়েছে। উক্ত স্থানের প্রশংসা করা ও গুণাবালী বর্ণনা করা ধারণা ও বিবেকশক্তির ঊর্দ্ধে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, এ স্থানেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শরাব, দুধ ও মধুর পেয়ালা পেশ করা হয়। হাবিবে খোদা দুধকে গ্রহণ করেন। অতঃপর بيت المعمور ‘বায়তুল মা’মুর’ উদ্ভাসিত হয়ে উঠে এবং উহার পর্দা উঠিয়ে নেয়া হয়। হাদিসশরীফের শব্দ এরূপ-

ثم رفع الى البيت المعمور 

অতঃপর আমাকে বায়তুল মা’মুরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সিদরাতুল মুন্তাহা এবং বায়তুল মা’মুরের মধ্যে অনেক জগত ছিল এবং উহা সম্বন্ধে অবগত হওয়ার শক্তি ছিল না। সুতরাং উহার সকল পর্দাকে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিব্য জ্ঞান ও চক্ষু মোবারকের দর্শনের সম্মুখে উহাকে আনয়ন করা হয়। আর হাবিবে খোদা অতি উত্তমরূপে দেখে নেন। বায়তুল মা’মুরের অবস্থান কা’বা গৃহের একদম সোজা উপরের দিকে। এমনকি যদি পৃথিবীর বুকে উহার পতন হওয়াকে ধরে নেয়া হয়, তবে কা’বা গৃহের উপর এসে উহা পতিত হবে। ইহা সেই গৃহ, যাকে আদম আলাইহিস সালামের জন্য তার পৃথিবীতে অবতরণের পর প্রেরণ করা হয়। অতঃপর হযরত আদম আলাইহিস সালামের পর উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আকাশম-লে উহার মর্যাদা ও সম্মান এরূপ, যেরূপ পৃথিবীতে কা’বা গৃহের সম্মান। ফেরেশতারা উহার তাওয়াফ করে থাকেন। প্রতিদিন সত্তরহাজার ফেরেশতা বায়তুল মা’মুরের জিয়ারত উপলক্ষে আগমন ও প্রত্যাগমন করে থাকেন। তাঁরা দ্বিতীয়বার কখনও তাওয়াফের জন্য আগমন করার সুযোগ নেই। এভাবে প্রত্যহ আগমন ও প্রত্যাগমন করে থাকেন। যেদিন হতে বায়তুল মা’মুর সৃষ্টি করা হয়েছে, সেদিন হতেই এ অবস্থা শুরু হয়েছে। আর অনন্তকাল পর্যন্ত এরূপ অবস্থা বিদ্যমান থাকবে। ইহা আল্লাহতা’য়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ কুদরতের নিদর্শন। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে এমন এক বিঘত পরিমাণ স্থানও নেই যেখানে ফেরেশতাগণ সিজদার জন্য স্বীয় কপাল রাখে নাই। এমনকী নদ-নদীসমূহের এক বিন্দু পানিও নেই, যার উপর কোন ফেরেশতাকে নিয়োগ করা হয় নাই।

নহরে হায়াত
____________________
নহরে হায়াত

=========
বর্ণিত আছে যে, আকাশে একটি নদী রয়েছে যাকে নহরে হায়াত বলা হয়ে থাকে। হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম প্রত্যেকদিন উহাতে অবগাহন করেন এবং যখন বের হয়ে আসেন, তখন তাঁর চুল ও পাখাসমূহ ঝাড়া দিয়ে থাকেন। উহা হতে সত্তরহাজার পানির ফোঁটা ঝরে থাকে এবং প্রত্যেক ফোঁটা দ্বারা আল্লাহতা’য়ালা একটি করে ফেরেশতা সৃষ্টি করে থাকেন। এ সকল ফেরেশতা প্রত্যহ ‘বায়তুল মা’মুর’ এ নামায পড়েন। একবার নামায আদায় করার পর পুনরায় তাদেরকে এ মসজিদে এসে নামায পড়ার সুযোগ হয় না।

(মাওয়াহিবে লাদুনিয়া)

আরশের ডান দিকে নূরের নহর
____________________
আরশের ডান দিকে নূরের নহর

======================
আল্লাহতা’য়ালার এরশাদ

يخلق ما لا تعلمون 

‘যা তোমরা জাননা উহা সৃষ্টি করা হয়’ এ আয়াতের তাফসিরে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি আলাইহির রহমত উল্লেখ করেন- হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, আরশের ডানদিকে নূরের একটি নহর (নদী) রয়েছে, যা সপ্তআকাশ, সপ্তস্তবক জমিন এবং সাত সমুদ্রের সমতুল্য। হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম প্রতিদিন অতি প্রত্যুষে আগমন করে তাতে অবগাহন করেন। আর স্বীয় জ্যোতির উপর আরো জ্যোতি বৃদ্ধি করে থাকেন এবং স্বীয় সৌন্দর্যকে অত্যুজ্জ্বল করে থাকেন। যখন জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তাঁর পাখাসমূহ ঝেড়ে থাকেন, তখন আল্লাহতা’য়ালা তাঁর প্রত্যেক ফোঁটা হতে কয়েক হাজার ফেরেশতা সৃষ্টি করে থাকেন। এ ধারা কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। অন্য এক রেওয়ায়েতে রয়েছে, যে সকল ফেরেশতা তথা আল্লাহতা’য়ালার তাসবিহ পাঠ করে থাকেন। তাঁর প্রত্যেক তাসবিহ হতেও আল্লাহতা’য়ালা ফেরেশতা সৃষ্টি করে থাকেন।

দিদারে এলাহি
____________________
দিদারে এলাহি

==========
যখন সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহতা’য়ালার বড় বড় নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা শেষ করলেন, তখন বিশেষ নৈকট্যতার সাথে করুণা ও সান্বিধ্য লাভের মূহূর্ত ঘনিয়ে আসে এবং সর্বশেষ সীমায় উপনীত হন এবং সকল বস্তু হতে পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটে, তখন তিনি একা রয়ে গেছেন। কোন ফেরেশতাও নেই মানুষও নেই। এখনও এমন সত্তরটি নূরানী পর্দা রয়ে গেল যে, এক পর্দা দ্বিতীয় পর্দার সমতুল্য নয়। রেওয়ায়েত দ্বারা জানা যায় প্রত্যেক নূরানী পর্দার ঘনত্ব পাঁচশত বৎসরের পথ ছিল। এখনও তা অতিক্রম করা বাকি রয়েছে। নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহতা’য়ালার সাহায্য সহানুভূতির দ্বারা উক্ত পথ অতিক্রম করেন। ঐ সময় এক বিশেষ ধরনের বিচলিত ও ভয় এবং আল্লাহতা’য়ালার মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্বের সম্মূখীন হন। আহব্বানকারী আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ন্যায় আওয়াজ দ্বারা আহব্বান করা হয় যে-

قف يا محمد فان ربك يصلى 

হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি দাঁড়ান, নিশ্চয় আপনার প্রভূ সালাত প্রেরণ করছেন। অর্থাৎ এ সালাতের অর্থ দরূদ বা আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হাবিবের উপর রহমত বর্ষণ করছেন, তাঁর প্রশংসা করছেন। হাবিবে খোদা স্তম্বিত হলেন যে, আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর আওয়াজ কোথা হতে আসল। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত আওয়াজ হতে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেন এবং যে ভয়ভীতির সঞ্চার হয়ে ছিল তা দূরীভূত হয়ে গেল। এরপর মহিমান্বিত আল্লাহতা’য়ালার দরবার হতে আহব্বান আসে যে-

ادن يا خير البرية ادن يا احمد ادن يامحمد 

হে সৃষ্টিজীবের সর্বশ্রেষ্ঠ, নিকটে আসুন, হে আহমদ নিকটে আসুন, হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটবর্তী হোন। অতঃপর আল্লাহতা’য়ালা আমাকে তার নিকটবর্তী করলেন এবং আমি অতি নিকটবর্তী হয়ে গেলাম যে স্বয়ং আল্লাহতা’য়ালা এরশাদ করেন-

ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى 

অতঃপর আল্লাহতা’য়ালার নূরের তজল্লী নিকটবর্তী হয়, তারপর আরো সন্নিকটে নেমে আসে। তখন সেই তজল্লী এবং হাবিবে খোদার মাঝখানে মাত্র দুই ধনুক ব্যবধান থেকে যায় বরং এর চেয়েও কম। গাউসেপাক তাফসিরে আল জিলানীতে উল্লেখ করেন- দুই ধনুকের দূরুত্ব পরিমাণ তথা অজুব ও ইমকানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে উলুহিয়ত ও উবুদিয়তের মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে উবুদিয়তের অধিক মর্যাদায় অধিষ্টিত হলেন। এখানে কুরব বা নিকটতম হওয়া ‘কুরবে মাকান’ নয় বরংقرب مدح ‘কুরবে মদহে’ অর্থাৎ আল্লাহতা’য়ালা হাবিবে খোদাকে কামালে মহব্বত করেছেন, তারই নিদর্শন। মোদ্দাকথা হলো মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর হাবিব আল্লাহর দরবারে অধিক নৈকট্যলাভ করেছেন এবং কপালের চোখ মোবারক দ্বারা নিরাকার আল্লাহর দিদারে ধন্য হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ‘নাছিমুর রিয়াজ’ এর এবারত নিম্নে প্রদত্ত হলো-

(والقرب والدنو) لقوله تعالى (ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى) على القول بان الضمير للنبى صلى الله عليه وسلم وليس هذا قربا مكانيا ان كان المرادبه من القرب من الله تعالى لاستحالة المكان والجهة على الله وقد ذكر فى الاية على سبيل المدح- 

অর্থাৎ যদি ধরে নেয়া হয় আল্লাহর হাবিব আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছেন, এমতাবস্থায় ‘কুবব’ বা নিকটবর্তী হওয়া ‘কুরবে মাকান’ অর্থ নেয়া যাবে না, কেননা আল্লাহর জন্য মাকান ও দিক সবকিছুই অসম্ভব। আয়াতে কারিমার মধ্যে যা বর্ণনা করা হয়েছে, তা শুধুমাত্র হাবিবে খোদা যে, আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় এর ইঙ্গিত বহন করে। এখানে ‘কুরব’ বা নিকটতম হওয়া কুরবে মাকান নয় বরং قرب مدح ‘কুরবে মদহে’ অর্থাৎ হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লার দরবারে অধিক নৈকট্য লাভ করেছেন, যে নৈকট্য কুল সৃষ্টির মধ্যে অন্য কারো ভাগ্যে জুটেনি। ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ প্রথম জিলদের ২০৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-

وپر سید ازمن پروردگار من چیزی پس نتوا نسیم الخ 

ভাবার্থ: আমার প্রভূ আমার নিকট কিছু জিজ্ঞাসা করেন, তখন আমার মধ্যে এতটুকু ইলিম বা জ্ঞান ছিল না যে, আমি উহার উত্তর দিতে সক্ষম হই। ঐ সময় আল্লাহতা’য়ালা তাঁর কুদরতের দ্বারা তাঁর রহমত আমার স্কন্দ মোবারকের মধ্য দিয়ে আমার বক্ষ মোবারকে পৌঁছিয়ে দেন, ফলে আমি উহার শীতলতাকে আমার বক্ষ পটে অনুধাবন করি। ঐ সময় আমাকে اولين واخرين পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল প্রকারের ইলিম বা জ্ঞান দান করা হয় এবং বিভিন্ন প্রকারের ইলিম শিক্ষাও দিয়ে থাকেন। মি’রাজ রজনীতে তিন প্রকারের ইলিম আল্লাহ তাঁর হাবিবকে দান করেছেন। তন্মধ্যে একপ্রকারের জ্ঞান বা ইলিম এমন ছিল, যা কারো নিকট প্রকাশ না করার জন্য হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট হতে অঙ্গীকার লওয়া হয়, যেহেতু ঐ ইলিম হুজুরপাক ছাড়া অন্য কারো সহ্য করার ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান- এক প্রকার ইলিম এমন ছিল, যা কারো নিকট প্রকাশ না করার জন্য আমার নিকট হতে অঙ্গীকার নেয়া হয়, যেহেতু আমি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সহ্য করার ক্ষমতা নেই।

علمی بودکہ عھد گرفت ازمن کتمان آنراکہ باھیچکس نگویم وھیچکس طاقت برداشت ندارد جز من- 

এক প্রকার ইলিম এমন যা প্রকাশ করা ও গোপন রাখার অধিকার আমাকে দেয়া হয়েছে।

وعلمی دیگر بود کہ مخیر گردا نید در اظھار وکتمان آن 

এবং আরো এক প্রকারের ইলিম হলো যা আমার উম্মতের আম-খাস সকলের মধ্যে প্রচার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

وعلمی بود کہ امر کرد مرابہ تبلیغ آن بخاص وعام از امت من – مدارج النبوۃ 

১/২০৩

এ প্রসঙ্গে নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি আলাইহির রহমত তদীয় تفسير الدر المنثور ‘তাফসিরে দুররে মনসুর’ নামক কিতাবের সপ্তম খ- ৬৪৭ পৃষ্ঠায় ‘তাফসিরে ইবনে জারির তাবারি’ থেকে উল্লেখ করেন-

واخرج ابن جرير عن ابن عباس قال: قال صلى الله عليه وسلم: رأيت ربى فى احسن صورة فقال لى: يا محمد هل تدرى فيم يختصم الملاء العلى؟ فقلت: لا يا رب- فوضع يده بين كتفى فوجدت بردها بين ثديى فعلمت ما فى السماء والارض- فقلت: يا رب فى الدرجات والكفارات ونقل الاقدام الى الجماعات وانتظار الصلوة بعد الصلوة فقلت: يا رب انك اتخذت ابراهيم خليلا وكلمت موسى تكليما وفعلت وفعلت- فقال: الم اشرح لك صدرك؟ الم اضع عنك وزرك؟ الم افعل بك؟ الم افعل؟ فأقضى الى باشياء لم يؤذن لى ان احد ثكموها- فذلك قوله (ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى فاوحى الى عبده ما اوحى ما كذب الفؤاد ما رأى) فجعل نور بصرى فى فؤادى فنظرت اليه بفؤادى- 

ভাবার্থ: ইবনে জরির তাবারি আলাইহির রহমত হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিনা করেন, তিনি বলেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরানী ফরমান, হাবিবে খোদা বলেন- আমি আমার রবকে আহসান সুরত, তথা- উত্তম গুণে গুণান্বিত অবস্থায় দেখেছি। অতঃপর আমার রব আমাকে বললেন- يا محمد হে (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!) অর্থাৎ চরম প্রশংসিত সত্ত্বা। তুমি কি জান মালায়ে আ’লা তথা ঊর্ধ্বজগতে শীর্ষস্থানীয় ফেরেশতাগণ, কি কি বিষয় নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত? তখন আমি উত্তরে বললাম- হে আমার রব! না (আমি এ বিষয়ে অবগত নই) অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁর রহমতের হাত তথা বিশেষ শক্তি ও ক্ষমতা আমার দু’কাঁধের মধ্যখানে স্থাপন করলেন, যার শীতলতা আমার বক্ষে অনুভব করলাম-

فعلمت ما فى السموات والارض 

অতঃপর আমি আসমানসমূহ ও জমিনসমূহে যা কিছু আছে, সব বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হলাম এবং আমি বলতে লাগলাম, হে রব! উচ্চ পর্যায়ের ফেরেশতাগণ দারাজাত, কাফফারাত, পায়ে হেঁটে জুমুয়ার নামাযে গমন, এক নামাযের পর অন্য নামাযের ফজিলত সম্পর্কে বিতর্ক করছেন। এরপর আমি আরো বললাম- হে আমার রব, নিশ্চয় আপনি হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে খলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং হযরত মুসা আলাইহিস সালামের সাথে কালাম করেছেন এবং আপনি তা করেছেন, তা করেছেন।’ উত্তরে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা বললেন- (হে হাবিব) আমি কি আপনার বক্ষ মোবারক উন্মোচন করিনি? আমি কি আপনার থেকে আপনার বোঝা অপসারণ করিনি? (আমি কি আপনার জন্য তা করিনি?) আল্লাহর হাবিব এরশাদ করেন- অতঃপর আল্লাহপাক আমাকে এমন কতগুলি গোপন বস্তুর তত্ত্ব জ্ঞান দান করলেন যা কারো কাছে প্রকাশ করতে আমাকে অনুমতি প্রদান করেননি। (এভাবে আরো কতগুলি জ্ঞান দান করলেন যা প্রকাশ করার অনুমতি দিলেন) নিম্নে ইবনে জরির তাবারি এর এবারত প্রদত্ত হলো-

فأقضى الى باشياء لم يؤذن لى ان احد ثكموها- فذلك قوله ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى فاوحى الى عبده ما اوحى

মি’রাজ রজনীতে বিশেষ ইলিম
____________________
মি’রাজ রজনীতে বিশেষ ইলিম

=======================
শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহমতুল্লাহ আলাইহি তদীয় মাদারিজুন নবুয়ত নামক কিতাবের ১ম জিলদের ১০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

يس- والقران الحكيم- انك لمن المرسلين- على صراط المستقيم- وذلك فضل الله يوتيه من يشاء- والله ذو الفضل العظيم- وفرمود فاوحى الى عبده ما اوحى- بتمامۂ علوم ومعارف وحقائق وبشارات واشارات واخبار واثار وکرامات وکمالات کہ در حیطہ این ابھام داخل است- وہمہ را شامل ازکثرت وعظمت اوست کہ مبہم آورد وبیان نکرد اشارت بآنکہ جزء علم علام الغیوب وسول محبوب بدان محیط نتواند شد مگر انچہ آنحضرت بیان کردہ یا انچہ از مقابلہ ومحاذات روح اقدس وی بربواطن بعضے از اکمل اولیا بشرف اتباع وی مستعد ومشرف اندفتہ واللہ اعلم- 

অর্থাৎ হে সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! বিজ্ঞানময় কুরআনের কসম, নিঃসন্দেহে আপনি রাসূলগণের মধ্যে অন্যতম, আপনি সিরাতে মুস্তাকিম বা সোজা পথের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইহা একমাত্র আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ ও করুণা, আল্লাহতা’য়ালা যাকে ইচ্ছা করেন, তা দান করে থাকেন। তিনিই শ্রেষ্ঠ করুণার আধার। তারপর এরশাদ করেন-

فاوحى الى عبده ما اوحى 

অতঃপর তাঁর খাস মাহবুব বান্দার উপর অর্থাৎ ছরকারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ওহি অবতরণ করেন, যা কিছু অবতীর্ণ করেছেন। সর্বপ্রকারের ইলিম বা জ্ঞান (تمام علوم) معارف حقائق তত্ত্বজ্ঞান। بشارات সুসংবাদواشارات ইশারা ও اخبار সংবাদ اثار নিদর্শনাবলী ও كرامات কারামাত كمالات এবং ঐ সকল কামালাত যা অনুল্লেখের পর্যায়ে রয়েছে সকলই ইহার অন্তর্ভুক্ত এবং উহার প্রত্যেক আধিক্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব ও ইহার শামিল। কেননা এ স্থানে مبهم বা অনির্দিষ্ট অর্থবোধক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য উক্ত ইশারা বা ইঙ্গিতের ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়নি।

আরশে অবতরণ
____________________
আরশে অবতরণ

============
হাবিবে খোদা এরশাদ করেন, এরপর আমার জন্যে সবুজ রঙের রফরফ বিছানা নির্ধারণ করা হয়। যার জ্যোতি সূর্যের জ্যোতির চেয়েও প্রখর ছিল। উহা হতে আমার চক্ষুদ্বয়ের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হতে লাগল। আমাকে উক্ত রফরফের উপর উপবেশন করা হল। অতঃপর রফরফ আমাকে নিয়ে রওয়ানা হল। অবশেষে আরশ পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম। এরপর এমন এক বিরাট বস্তু দেখতে পেলাম, যা বর্ণনা করার শক্তি কোন ভাষায় সম্ভবপর নয়। তারপর আরশ হতে এক ফোঁটা এসে আমার জিহ্বার উপর পতিত হল। আমি উহার স্বাধ আস্বাধন করলাম। যা কোন ব্যক্তি কখনও উহার চেয়ে অধিক স্বাধ আস্বাধন করে দেখে নাই। এতে আমার আওয়াল ও আখের এর সকল বিষয়ের ইলিম বা জ্ঞান অর্জিত হলো এবং আমার অন্তর জ্যোতির্ময় হয়ে গেল। আর আরশের নূর দ্বারা আমার চক্ষুকে ঢেকে দেয়া হলো, ঐ সময় আমি সকল বস্তুকে নিজ অন্তর দ্বারা অবলোকন করি এবং নিজের পশ্চাতেও এরূপ দেখতে থাকি যেরূপ সম্মুখে দেখতাম। উল্লেখ্য যে, ‘রফরফ’ নরম বিছানাকে বলা হয়ে থাকে। যা মূল্যবান রেশম ইত্যাদি দ্বারা তৈরি করা হয়। (মাদারিজুন নবুয়াত) স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন-

ما زاغ البصر وما طغى 

মি’রাজ রজনীতে হাবিবে খোদার না চক্ষু মোবারক বিভ্রম হয়েছিল। আর না চক্ষু মোবারক লক্ষভ্রষ্ট হয়েছিল।’ এ আয়াতে কারিমার তাফসিরে আশ শায়খ মুহাক্বিক আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত তদীয় ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ নামক কিতাবের প্রথম জিলদের ২০৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

چنانچہ فرمودوی سبحانہ ما زاغ البصر وما طغی چنانچہ بندگان خاص در حضرت ملوک میکنند واین کمال است کہ جزء اکمل بشر وسید رسل را صلوات اللہ وسلامہ میسر نیست ۔۔۔ لھذا رسانیدہ شد بتمامۂ مرادات مراتب ودرجات کہ اقصی واعلا آن رویت حق است تعالی وتقدس فیما اقام اللہ اعلا مقامات اہل صحووا ارباب تمکین است الخ- 

ভাবার্থ: আল্লাহর কালাম ما زاغ البصر وما طغى (মা জাগাল বাছারু ওয়ামা তাগা) না চক্ষু বিভ্রম হয়েছিল আর না চক্ষু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল) যেরূপভাবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিগণ বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে থাকেন। ইহা এমন كمال বা পূর্ণত্ব যা اكمل بشر বা পূর্ণত্ব ও পরিপূর্ণ মানুষ যিনি সকল রাসূলের সরদার সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আর কেউই লাভ করতে পারেনি। মানুষের সাধারণ স্বভাব হলো এই যে, যখন সে কোন উচ্চস্তরে আরোহন করে এবং ঐ উচ্চস্তর সম্পর্কে জ্ঞানাহরণ করে থাকে, তখন আরো মর্যাদা লাভের আকাঙ্খা করে থাকে। বস্তুত যখন মুসা আলাইহিস সালাম মুনাজাত ও কথা বলার স্তরে উন্নীত হন, তখন তিনি বারি তা’য়ালার দিদারের আকাঙ্খা প্রকাশ করেন। এটা তাঁর এক প্রকার ইচ্ছে ছিল। কারণ নৈকট্যতার স্তরে পৌঁছলে শরাফতের খেয়াল বিদুরিত হয়ে যায়। কিন্তু মাহবুবে মতলক সকল নবীদের সরদার সৈয়দে আলাম যখন নৈকট্যতার স্তরে উপনীত হন, তখন তার সকল প্রাপ্য পূর্ণ করে দেয়া হয় এবং শুধু ঐ স্থান ছাড়া যে স্থানে তিনি উপনীত হয়েছিলেন, অন্য কোন বস্তুর প্রতি নিজ চক্ষু মোবারক ও অন্তরচক্ষু দ্বারা লক্ষ্য করে কিছুর আশা আকাঙ্খাও করেননি। তিনি সকল স্তর ও শ্রেণির সকল মনজিল অতিক্রম করেছিলেন। তন্মধ্য হতে সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ স্তর হল দিদারে এলাহি। আর উহা সেই মাকাম, যাতে আল্লাহতা’য়ালা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিষ্ঠিত করেন।’ উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চক্ষু মোবারক দ্বারা আল্লাহর দিদার লাভে ধন্য হয়েছেন।

হাদিসের নামে একটি বানোয়াট কাহিনী- ১
____________________
পরিশিষ্ট

হাদিসের নামে একটি বানোয়াট কাহিনী- ১

======================
জাল হাদিসটি নিম্নরূপ-

ان الله قبض من نور وجهه قبضة ونظر اليهم فعرفت وذلقت فخلق الله من كل نقطة نبيا وان القبضة كانت هى النبى صلى الله عليه وسلم 

অর্থাৎ আল্লাহতা’য়ালা নিজের চেহারা থেকে একমুষ্টি নূর পৃথক করে উক্ত নূরের প্রতি দৃষ্টি করার পর উহা হতে তীক্ষè আলো বিশিষ্ট অনেকগুলো ঘামের ফোঁটা বের হলো, তৎক্ষণাৎ আল্লাহতায়ালা এ ঘামের প্রতিটি ফোঁটা থেকে একেকজন নবী সৃষ্টি করলেন এবং আল্লাহতা’য়ালা চেহারা থেকে পৃথক করা উক্ত মুষ্টি নূরই হলেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ প্রসঙ্গে ইমাম আল্লামা মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল বাকী জারকানী মালেকী আলাইহির রহমত তদীয় الزرقانى ‘যারকানী’ নামক কিতাবের প্রথম খ- ২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করে এ রেওয়ায়েত সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন নিম্নে হুবহু তা প্রদত্ত হলো-

واما ما ذكر ان الله قبض من نور وجهه قبضة ونظر اليهم فعرقت وذلقت فخلق الله من كل نقطة نبيا وان القبضة كانت هى النبى صلى الله عليه وسلم ........................... فقال الحافظ ابو العباس احمد بن تيمية فى فتاويه ونقله الحافظ ابن كثير فى تاريخه واقره كل ذلك كذب مفترى باتفاق اهل العلم بحديثه- 

ভাবার্থ: উল্লেখ রয়েছে যে, আল্লাহতা’য়ালা স্বীয় চেহারার নূর হতে এক মুষ্টি নূর পৃথক করে উক্ত নূরের প্রতি দৃষ্টি করার পর উহা হতে তীক্ষè আলো বিশিষ্ট অনেকগুলো ঘামের ফোঁটা বের হলো। তৎক্ষণাৎ আল্লাহতা’য়ালা এ ঘামের প্রতিটি ফোঁটা থেকে এক একজন নবী সৃষ্টি করলেন এবং আল্লাহতায়ালার চেহারা হতে পৃথক করা উক্ত মুষ্টি নূরই হলেন আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম.................। এ জাতীয় কথাগুলো সম্পর্কে আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে তাইমিয়া তাঁর ফাতাওয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং হাফিজ ইবনে কাছির রহমতুল্লাহ আলাইহি তাঁর তারিখ বা ইতিহাস গ্রন্থেও বর্ণনা করেছেন এবং তিনি (ইবনে কাছির রহমতুল্লাহ আলাইহি) এ বর্ণনাকে আপত্তিকর বলে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন- সকল মুহাদ্দিসীনে কেরামের ঐকমত্যে এ সমস্ত বর্ণনা, অমূলক, মিথ্যা ও বানোয়াট। উপরোক্ত মিথ্যা বানোয়াট ঘটনা দ্বারা কয়েকটি কুফুরি স্পষ্টভাবে সাব্যস্ত হয়- ১. আল্লাহতা’য়ালা নিজেই তাঁর চেহারা মোবারকের নূর থেকে একমুষ্টি নূর পৃথক করে নবী বানালেন। (নাউজুবিল্লাহ) এতে প্রমাণিত হলো- আল্লাহ শরির ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশিষ্ট। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সৃষ্টির মাদ্দা বা উপাদান হলো আল্লাহর চেহারা থেকে পৃথক করা একমুষ্টি নূর। যা আল্লাহর সত্ত্বার অংশ। এটা সুষ্পষ্ট কুফুরি। কেননা আল্লাহতা’য়ালা শরির বিশিষ্ট হওয়া, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হওয়া, আকৃতি বিশিষ্ট হওয়া বা মাদ্দা হওয়া থেকে পাক ও পবিত্র। এ সম্পর্কে গাউসেপাক ‘সিররুল আসরার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-

فالحق منزه عن الصورة والمادة وخواس والاجسام 

অর্থাৎ প্রকৃত সত্য কথা হলো আল্লাহতা’য়ালা আকৃতিবিশিষ্ট হওয়া, মাদ্দা বা উপাদান হওয়া এবং বিশেষ শরির বিশিষ্ট হওয়া থেকে পুতঃপবিত্র।

উল্লেখ্য যে, হাফিজ ইবনে তাইমিয়া উলামায়ে আহলে সুন্নাত এর মতে বিতর্কিত ব্যক্তি। তার বিভিন্ন আকিদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পরিপন্থী রয়েছে। তবে হাফিজ ইবনে কাসির রহমতুল্লাহ আলাইহি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। এজন্য সুন্নি উলামায়ে কেরামগণ হাফিজ ইবনে কাসির রহমতুল্লাহ আলাইহি সম্পর্কে কোনরূপ বিরূপ মন্তব্য করেননি। শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমতসহ অন্যান্য উলামায়ে কেরামগণ তাঁর ইলমি খেদমত ও অবদানের ব্যাপারে পঞ্চমুখ। শায়খ দেহলভী তাঁর মাদারিজুন নবুয়ত গ্রন্থে ১ম খ- ১৯৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

بعد آزان در نظر آمد کہ شیخ کبیر عماد الدین بن کثیروی ازا اعاظم علمای حدیث وتفسیراست الخ 

অর্থাৎ অতঃপর আমার দৃষ্টিতে শায়খে কবির ইমাদুদ্দিন ইবনে কাছির, যিনি হাদিস ও তাফসির শাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ উলামায়ে কেরামদের মধ্যে অন্যতম সুপন্ডিত ছিলেন।

২. এ মিথ্যা ও বানোয়াট ঘটনা আল্লাহর কালামের পরিপন্থী ليس كمثله شئ ‘আল্লাহতা’য়ালার কোন মিসাল বা উদাহরণ নেই। তাফসিরে কবির নামক কিতাবের পনেরো পারার ১৫ পৃষ্ঠায় এ আয়াতের কারিমার তাফসিরে উল্লেখ রয়েছে-

(المسئلة الاولى) احتج علماء التوحيد قديما وحديثا بهذه الاية فى نفى كونه تعالى جسما مركبا من الاعضاء والاجزاء وحاصلا فى المكان والجهة وقالوا لوكان جسما لكان مثلا لسائر الاجسام فيلزم حصول الامثال والاشباه له- وذلك باطل بصريع قوله تعالى (ليس كمثله شئ) الخ 

ভাবার্থ: নবীন ও প্রবীন তাওহীদপন্থী উলামায়ে কেরামগণ আল্লাহতা’য়ালা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোগে জিসিম বা শরির বিশিষ্ট নন মর্মে অত্র আয়াতে কারিমা দ্বারা দলিল প্রদান করেছেন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হলে স্থান দিক হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে, তারা বলেন- যদি তিনি (আল্লাহ) শরির বিশিষ্ট হন যেরূপ অন্যান্য শরির বিশিষ্টগণের মধ্যে বিদ্যমান আছে, তা হলে তার সাথে অন্যের মতো বা সাদৃশ্য হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে, এ সকল ধ্যান ধারনা স্পষ্ট বাতিল। কারণ আল্লাহতায়ালার অমীয় বাণী ليس كمثله شئ ‘লাইসা কা মিসলিহী শাইয়ুন’ অর্থাৎ তিনি কোন বস্তুর মত নহেন। উপরোক্ত এবারত দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো আল্লাহতায়ালা নিরাকার তাঁকে সাকার বলে আখ্যায়িত করা ঈমান বিধ্বংসী আকিদা। আল্লাহপাক যেন আমাদের সকলকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকাইদের উপর অটল থাকা এবং মরণপর্যন্ত ইস্তেকামত থাকার তাওফিক দান করেন। যাতে আমরা ঈমানের সাথে ইহজগত ত্যাগ করাতে পারি।। আমিন। বিহুর মতে সায়্যিদিল মুরসালিন।

একটি অবাস্তব ঘটনা- ২
____________________
একটি অবাস্তব ঘটনা- ২

=================
কিছু সংখ্যাক বিভ্রান্ত লোক ওয়াজের নামে একটি অবাস্তব ঘটনা বর্ণনা করে থাকে। ঘটনাটি মুলতান নিবাসী মৌলভী মিয়া আব্দুল্লাহ লিখিত, মোস্তাফায়ী প্রেস থেকে মুদ্রিত, দলিলুল এহসান নামক গ্রন্থের ৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি হচ্ছে নিম্নরূপ-

کہ روزی پیغمبر صلی اللہ علیہ وسلم در مسجد مدینہ منورہ نشستہ بودند وباتمامی اصحابان صغار وکبار وعظ وحدیث شریف بیان میفرمودند کہ وحی جبرئیل علیہ السلام در خدمت پیغمبر صلی اللہ علیہ وسلم درآمد پیغمبر صلی اللہ تعالی علیہ وسلم ازسبب بیان حدیث ووعظ بطرف وحی علیہ السلام متوجہ نشدند ووحی علیہ السلاو دردل خود وسوسہ وکدرت بسیار در خاطر کردند گفت عجب ست کہ کلام ربانی ازجانب باری تعالی بہ آنحضرت میرسانم الحال بمن التفات نہ کردند ہون وقت حضرت راازروے کشت باطنی معلوم ومفہوم شدکہ بخاطر جبرئیل علیہ السلام کدرت گزشت پس جبرئیل علیہ السلام را نزدخود طلبیدہ پر سید کہ اے اخی جبرئیل کلام ربانی از کدام مقام بگوش میرسد گفت یا رسول اللہ بالاۓ عرش ایک قبۂ نورست بمثل حجرہ دران جایک سوراخ ست از انجا بگوش من آواز میرسد حضرت رسول علیہ السلام فرمود باز نزدآں قبہ برد ازان جاخبر گرفتہ زدوبمن برساں لکین اندرون قبہ نروی چون مہتر جبرئیل علیہ السلام بموجب فرمودہ رسول صلی اللہ علیہ وسلم بازرفت واندرون قبہ در آمد چہ بیند کہ اندرون قبہ نور محمد صلی اللہ علیہ وسلم ست وحضرت خود نشستہ اندو الحال مہتر جبرئیل علیہ السلام بازبہ جلدی پرواز فرمود وبرزمین ودر ونیمود چہ بیند کہ رسول خدا صلی اللہ علیہ وسلم در ہمون مکان باصحابان درحدیث ووعظ مشغول اند جبرئیل علیہ السلام از معائنہ این حال متعحب فرمایند وحیران گشت وشرمنا کہ شدہ گفت کہ اۓ خدایا از من خطا شدہ ما رامعاف فرمایند- 

অর্থাৎ ‘একদা পয়গাম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীশরীফে বসে ছোট বড় অনেক সাহাবায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে ওয়াজ নসিহত এবং হাদিসশরীফ বর্ণনা করতে ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম ওহি নিয়ে আগমন করলে পয়গাম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াজ নসিহত এবং হাদিস বর্ণনায় লিপ্ত থাকার কারণে জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম অসন্তুষ্ট ও মনক্ষুন্ন হয়ে বললেন- আশ্চর্য! আল্লাহর পক্ষ থেকে কালামে রব্বানী এসেছে, আর আ’হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য মনস্ক হয়ে রইলেন। তখনই পয়গাম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কশফে বাতিনী দ্বারা জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মনক্ষুন্ন হওয়ার ব্যাপারটি বুঝতে পেরে তাঁকে নিকটে ডেকে শান্তনার বাণী শুনালেন- হে ভাই জিব্রাঈল- বলতো, কালামে রাব্বানী কোন জায়গা থেকে তোমার কর্ণকুহরে পৌঁছে? জিব্রাঈল আমিন উত্তরে বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরশের উপরে কক্ষের মত একটি নূরের গম্বুজ আছে, যাতে একটি ছিদ্র রয়েছে, ঐ স্থান থেকে আমার কানে আওয়াজ পৌঁছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন- তুমি কার থেকে এ সংবাদ গ্রহণ করে থাকো? আল্লাহর হাবিবের ফরমান মোতাবেক জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আবার আরশের উপর গিয়ে দেখলেন- সেই নূরের গম্বুজের ভিতরে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম উপবিষ্ট রয়েছেন। তৎক্ষণাৎ সম্মানিত দূত হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম জমিনে পুনরায় ফিরে এসে দেখলেন রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ স্থানেই সাহাবায়ে কেরামগণকে নিয়ে হাদিস ও ওয়াজ নসিহতে মশগুল রয়েছেন। হযরত জিব্রাঈল চাক্ষুসভাবে এ অবস্থা দেখে হতবাক ও লজ্জিত হয়ে বললেন- হে খোদা! আমি ভুল করেছি, আমাকে মাফ কর।’

উপরোল্লেখিত ঘটনাটি লিখে আ’লা হযরত আল্লামা আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী রহমতুল্লাহ আলাইহি এর নিকট প্রেরণ করে, ঘটনাটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতে সঠিক কী না তা জানতে চাওয়া হয়। এতে আ’লা হযরত বেরলভী রহমতুল্লাহ আলাইহি যে সবিস্তার জওয়াব প্রদান করেছেন, তা السنية الانيقه فى فتاوى افرقه ‘আস সান্নিয়াতুল আনিকা ফি ফাতাওয়া-ই আফ্রিকা’ নামক কিতাবের ৫৫ থেকে ৬০ পৃষ্ঠাব্যাপী উল্লেখ রয়েছে । এর সারসংক্ষেপ হলো নিম্নরূপ-

১) جو اس حکایت سے نکلتے ہیں اسکے ظاہر سے جو عوام جہال کے خیال میں آے وہ تو صاف صاف حضور اقدس صلی اللہ تعالی علیہ وسلم کو معاذ اللہ خدا کہنا ہے اس کے کفر صریح ہونے میں شک کیا ہے – حضور اقدس صلی اللہ تعالی علیہ وسلم نے ہزاروں طرح جس کا انسداد فرمادیا ہے- 

অর্থাৎ এ বর্ণিত ঘটনার বাহ্যিক অর্থ থেকে সাধারণ মূর্খ মানুষের কাছে বোধগম্য হয় যে, এটাতো পরিস্কার ভাষায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খোদা বলা। নাউবুবিল্লাহ। যা কুফুরি হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্নভাবে তার প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছেন।

(ফাতাওয়া-ই আফ্রিকা ৫৭ পৃষ্ঠা)

২)جان بوجھکر متجاہل ہیں وہ تواس حکایت کے یہی معنی لیں گے کہ قرآن خود حضور کا کلام ہے فوق العرش وہی خدا ہیں اور زمین پروہی محمد جیسے بعض جھوٹے متصوفہ زندیق وبے دین کہا کرتے ہیں توصریح کفرکی غلیظ نجاست میں سننا اور نصرانی سے بدتر نصرانی بنناہے جو اسکا معتقد ہو بلکہ جو اسے جائز ہی رکھے یقینا قطعا کافر مرتدہے (فتاوی افریقہ) 

অর্থাৎ জেনে বুঝে যে সমস্ত জাহিল মূর্খ লোক, এ বর্ণিত ঘটনার এরূপ অর্থ গ্রহণ করে যে, কুরআন স্বয়ং রাসূলের বাণী। আরশের উপর তিনি খোদা আর জমিনের উপর তিনি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), যেমন কতেক মিথ্যুক, ভ-সুফি এবং ধর্মবিমূখ ব্যক্তিরা বলে থাকে। এটাতো স্পষ্ট কুফুরি, মারাত্মক নাপাক এবং খ্রিস্টানদের ভ্রান্ত আকিদাকেও হার মানায়। যে ব্যক্তি এরূপ বিশ্বাস করে এবং তা বৈধ মনে করে, সে তো নিঃসন্দেহে কাফির ও মুরতাদ।

(ফাতাওয়া-ই আফ্রিকা ৫৮ পৃষ্ঠা)

৩)البتہ یہ واقعہ صرف بے ثبوت ہی نہیں بلکہ یقینا غلط ہے محال ہے کہ جبرئیل امین علیہ الصلاۃ والتسلیم وحی لائیں اور حضور اقدس صلی اللہ علیہ السلام التفات نہ فرمایئں- 

অর্থাৎ এ বর্ণিত ঘটনা শুধু অবাস্তবই নয় বরং নিশ্চিত ভুল এবং محال বা অসম্ভব যে, হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম ওহি নিয়ে এসেছেন আর নবী সাল্লাল্লাহু অমনযোগী ছিলেন।

(ফাতাওয়া-ই আফ্রিকা ৫৯ পৃষ্ঠা)

৪)البتہ یہ واقعہ غلط باطل ہے بغیر رد کۓ اسکا بیان حرام ہے واللہ تعالی اعلم (فتاوی افریقہ) 

অর্থাৎ অবশ্যই এ বর্ণিত ঘটনাটি বাতিল ও ভুল। তা বর্ণনা করা হারাম। এটা প্রত্যাখ্যানযোগ্য। আল্লাহতা’য়ালাই সর্বজ্ঞ।

(ফাতাওয়া-ই আফ্রিকা ৬০ পৃষ্ঠা)

মোদ্দাকথা হলো- আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা আহমদ রেজা খাঁন রহমতুল্লাহ আলাইহি এর জবাব থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- দলিলুল এহসান নামক গ্রন্থে বর্ণিত উপরিলিখিত ঘটনাটি মিথ্যা, বানোয়াট এবং ঈমান বিধ্বংসী। এ সমস্ত ঘটনা বলা এবং শোনা হারাম। সুন্নি মুসলমান এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

একখানা হাদিসে কুদসি ও এর ব্যাখ্যা- ৩
____________________
একখানা হাদিসে কুদসি ও এর ব্যাখ্যা- ৩

=======================
মুবহাম ও মুতাশাবিহাত সংক্রান্ত একখানা হাদিসে কুদসি, যেমন-

خلقت محمدا من نور وجهى 

‘খালাকতু মুহাম্মাদান মিন নূরী ওয়াজহী’ এর শাব্দিক অর্থ হলো- আমি (আল্লাহ) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার চেহারার নূর দ্বারা সৃষ্টি করেছি। এ শাব্দিক অর্থের উপর ভিত্তি করে কিছু সংখ্যাক বিভ্রান্ত লোক আল্লাহর শরির, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা শরিরে বিভিন্ন অংশ সাব্যস্ত করার অপচেষ্টা করে। যা বিভিন্ন মুহকাম আয়াতের স্পষ্ট অর্থের ব্যতিক্রম হয়। আল্লাহর শানে এরূপ ব্যতিক্রম অর্থ সাব্যস্ত করলে ঈমান হারা হওয়ার আশঙ্খা রয়েছে। তবে আলোচ্য হাদিসে কুদসির প্রকৃত মর্ম কি হবে, এ সম্পর্কে নবী বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র গাউসুল আজম শায়খ সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় سرالاسرار ‘সিররুল আসরার’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন-

قال الله تعالى فى الحديث القدسى (خلقت محمدا من نور وجهى) والمراد من الوجه الذات المقدس المتجلية فى صفات الارحمية كما قال الله تعالى فى الحديث القدسى: (سبقت رحمتى على غضبى) وقال الله تعالى لنبيه : (وما ارسلناك الا رحمة للعالمين) سورة الانبياء- وقال الله تعالى: قد جاء كم من الله نور وكباب مبين) سورة المائده وقال الله تعالى فى الحديث القدسى (لولاك لما خلقت الافلاك) 

ভাবার্থ: হাদিসে কুদসীতে আল্লাহতা’য়ালা এরশাদ করেছেন-

خلقت محمدا من نور وجهى 

হাদিসে উল্লেখিত الوجه ‘আল ওয়াজহু’ দ্বারা মুরাদ বা মর্ম হচ্ছে الذات المقدسة المتلجلية فى صفات الارحمية অর্থাৎ ‘وجه’ দ্বারা আল্লাহর পবিত্র যাত বা সত্ত্বা বুঝানো হয়েছে, যা অসীম করুণার গুণাবলীতে জ্যোতিস্কমান। যেমন- আল্লাহতা’য়ালা অন্য হাদিসে কুদসিতে এরশাদ করেছেন-

سبقت رحمتى على غضبى 

অর্থাৎ আমার রহমত গযবের উপর অগ্রগামী। আর আল্লাহতা’য়ালা নবীজিকে সম্বোধন করে ফরমান-

وما ارسلناك الا رحمة للعلمين 

অর্থাৎ আমি আপনাকে সারা জগতের রহমত করে পাঠিয়েছি। (সূরা আম্বিয়া) আল্লাহতা’য়ালা আরো এরশাদ করেন-

قد جاء كم من الله نور وكتاب مبين 

অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক সম্মানিত নূর এবং এক উজ্জ্বল কিতাব এসেছে। (সূরা মায়েদা) অন্য এক হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতা’য়ালা আরো এরশাদ করেছেন-

لو لاك لما خلقت الافلاك 

অর্থাৎ যদি আমি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে নভোম-ল ও ভূম-ল কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’ যে সমস্ত বিভ্রান্তকারী লোক আয়াতে মুতাশাবিহাত, আয়াতে মুবহামাত ও মুতাশাবিহাত অর্থবোধক হাদিসে কুদসি ও হাদিসে রাসূল উল্লেখ করে আল্লাহতা’য়ালার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যেমন- হাত, পা, চেহারা, চক্ষু ইত্যাদি সাব্যস্ত করে তারা চরম বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত রয়েছে। কেননা আল্লাহতা’য়ালার শানে এরূপ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাব্যস্ত করা আয়াতে মুহকাম এর খেলাফ বা পরিপন্থী। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সঠিক আকিদা হলো-

منزه عن الجسمية 

অর্থাৎ আল্লাহতা’য়ালা শরিরবিশিষ্ট হওয়া থেকে পুতঃপবিত্র। এ সম্পর্কে গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু সিররুল আসরার কিতাবে উল্লেখ করেছেন-

فالحق منزه عن الصور والمادة وخواص الاجسام- 

অর্থাৎ প্রকৃত কথা হলো আল্লাহতা’য়ালা আকার, উপাদান, বিশেষ আকৃতি বা শরিরবিশিষ্ট হওয়া থেকে পবিত্র। শাফী মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হাফিজ শামসুদ্দিন মুহাম্মাদ বিন আহমদ রহমতুল্লাহ আলাইহি (ওফাত ৭৪৯ হিজরি) তদীয় ازالة الشبهات ‘এযালাতুশ শুবহাত’ নামক কিতাবের ৫৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

ومنها: صفة الوجه وقد ذكره فى ايات كثيرة- فاذا اردت (ان) تعلم ان حقيقة مظهره من الصورة- فاعلم ان حقيقة من غمام الشريعة- بارق نور التوحيد 

ভাবার্থ: কোরআনে কারিমের অনেক আয়াতে আল্লাহতা’য়ালার صفة الوجه উল্লেখ রয়েছে। তুমি যখন এর প্রকৃত মর্ম উদঘাটন করতে চাও তখন তুমি শরিয়তের নীতিমালা অনুযায়ী এর মর্ম উদঘাটন করবে। যাতে আল্লাহর একত্বাবাদের নূরের ঝলক উদ্ভাসিত হয়। মুদ্দাকথা হলো- আয়াতে সিফাত বা হাদিসে মুতাশাবিহাত এগুলোর মুরাদ বা মর্ম উদঘাটন করার ক্ষেত্রে আল্লাহর যাত-সিফাত ও শান-মানে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা বা জটিলতা না আসে সেক্ষেত্রে পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। নচেৎ গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট, এমনকি ঈমান হারা হওয়ার আশঙ্খা রয়েছে।

স মা প্ত

=====================


Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা