জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ
জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ–১
মাওলানা আবুল কাশেম মুহাম্মদ ফজলুল হক
টেক্সট রেডীঃ মুহাম্মদ আব্দুল খালেক
জামায়াতে ইসলামী অর্থ ইসলামী দল। নামটা বড় সহজ-সরল সুন্দর। অনুসন্ধিৎসু যে কেউই প্রাথমিক নজরে এ নামটা গিলে নেবে। এ নামের কেরামতিতে কেউ যদি সেই দলেই ঢুকে পড়ে তবে তা ঐ দলের প্রতি এ নামের মধুর তোহফা ছাড়া আর কি বলা যাবে। ভারতবর্ষের ধর্মভীরু মুসলমানদের জন্য এ রকম একটা সহজ-সরল নামই দরকার ছিল।
সাধারণত ইসলামী দল বলতে যা বুঝায় তা হল, এমন একটা দল যার সকল কিছুই ইসলামসম্মত হবে এবং সে অর্থে প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব এ দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তার সহযোগিতা করা। কিন্তু বাস্তবতা অনেকাংশেই ভিন্ন। জামায়াতে ইসলামী তার জন্ম থেকে যতটা না রাজনৈতিক কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি বিতর্কিত হয়েছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এত সুন্দর নাম নিয়ে এ দলটি তার পথচলার প্রতি মুহূর্ত বিতর্কিত হল কেন? কি বাংলাদেশ, কি পাকিস্তান, কি ভারত -এ দলটি যেখানেই গেছে, সেখানেই তার কপালে বিতর্কের কালো দাগ পড়েছে। মুসলিম মনীষীদের কেউ বলছে এটা বিভ্রান্ত দল, কেউ বলছে অনৈসলামিক দল।
বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে প্রায়শই ইসলামী গবেষকদের পক্ষ থেকে বক্তব্য আসে যে, জামায়াতে ইসলামী কোন ইসলামী দল নয়। আমি বিনা কারণে কাউকে দোষী বলার পক্ষে নই। আবার দোষীকে দোষী না বললে অপরাধ ঢালপালা মেলে সত্যের অপমৃত্যু ঘটায়। আক্বীদা-বিশ্বাসে কথায় ও কাজে ইসলামের পূর্ণ প্রকাশ হলে তো কাউকে অনৈসলামিক বলা মহা অন্যায়। কিন্তু তার ব্যতিক্রম হলে যে আর রক্ষা নেই।
ইসলামী নাম নিয়ে যদি কোন দল বা ব্যক্তির আক্বীদা-বিশ্বাসে কথা ও কাজে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু থাকে, তবে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য তা বড় বেশি ভয়ঙ্কর।
তাই সঙ্গতকারণেই জামায়াতে ইসলামীর ভেতর বাস্তবতা জানা ও প্রকাশ করা আমাদের সবার জন্যই প্রয়োজন। আলোচ্য প্রবন্ধে জামায়াতের সাহিত্য দিয়েই আমরা জামায়াতকে মূল্যায়ন করার প্রয়াস পাব।
- ১ -
ব্যভিচারকারী পুরুষ ও নারীর জন্য ইসলাম ধর্ম যে শাস্তির বিধান দিয়েছে তা আম মানুষেরও জানা আছে। একশ' বেত্রাঘাত। এ শাস্তি কোরআনের বিধান। আর কোন সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শাস্তি ইসলামে আশি বেত্রাঘাত। এই শাস্তিবিধান শাশ্বত এবং স্পষ্ট। এটাকে পরিবর্তন করার কোন সুযোগ নেই। সর্বকালের সর্বজায়গায়ই এ বিধান প্রযোজ্য হবে। এটা আল্লাহর আইন। মুসলমান হিসেবে আল্লাহর সকল বিধানকে ন্যায়সঙ্গত বলে বিশ্বাস করা আমাদের ঈমানের অপরিহার্য দাবি। আল্লাহর কোন বিধানকে অন্যায় বলে অভিহিত করলে বা বিশ্বাস করলে তাকে মুসলমান বলা যায় না। এ কথা বলার পর আমি জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদূদী সাহেবের একটি বক্তব্য উপস্থাপন করতে চাই এবং তা হল: যাঁহাঁ মিয়ারে আখলাক ভি ইতনা পুছ্ত হো কেহ্ নাজায়েয তা'আল্লুক্বাত কো কুছ বহুত মা'য়ূব না সমঝা জাতা হো এয়সী জাগাহ্ যেনা আওর ক্বযফ কি শর'ঈ হদ জারী করনা বেলাশুবাহ্ যুলম হ্যায়।-তাফহীমাত : ১ম খণ্ড : ২৮১ পৃ.
"যে স্থানে চরিত্রের মাপকাঠি এতই নিম্নমানের যে, অবৈধ সম্পর্ককে কোন দোষই মনে করা হয় না, এমন জায়গায় যেনা ও মিথ্যা অপবাদের ইসলামী শাস্তি প্রয়োগ করা নিঃসন্দেহে জুলুম।"
প্রিয়পাঠক, উপরিউক্ত উদ্ধৃতিটি মি. মওদূদী সাহেবের, যিনি জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা। জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিতে আল্লাহর আইন প্রয়োগ করা যদি জুলুম হয়, অন্যায় হয়, তবে কার আইন প্রয়োগ করলে ন্যায় হবে। এক মুখে আল্লাহর আইন প্রয়োগ করাকে জুলুম আখ্যা দিয়ে অন্য মুখে আল্লাহর আইন কায়েম করার স্লোগান দেয়াকে কেউ যদি মুনাফিক্বী বলে, তবে তাতে তাকে দোষ দেয়া যায় না।
সম্মানিত পাঠক, যেনা ও অপবাদের এ শাস্তি পবিত্র কোরআন কোন একটি এলাকা বাদ দিয়ে অন্য এলাকার জন্য বা কোন পরিস্থিতি বাদে ভিন্ন পরিস্থিতির জন্য নির্দিষ্ট বা নিষিদ্ধ করেনি। মওদূদী সাহেব যে স্থানের কথা বলেছেন সেখানকার জন্য নতুন কোন বিধান তার কাছে নাযিল হয়েছে কি না তা তিনিই ভাল বলতে পারবেন। কোরআনের অবারিত নির্দেশ বাস্তবায়ন করাকে জুলুম বলে আখ্যা দিলে তাকে আর মুসলমান বলা যায় কি না তার সিদ্ধান্ত পাঠকরা নিতে নিশ্চয় ভুল করবেন না। তবে জিজ্ঞাসা হল, ঐ স্থানে ইসলামের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআন মজীদের এ বিধান প্রয়োগ করা যদি জুলুম বলে ধরে নেয়া হয়, তবে ঐ স্থানের জন্য মওদূদী সাহেবের দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই ন্যায়সঙ্গত বিকল্প আরেকটি বিধান আছে। প্রশ্ন হল, সেই বিকল্প বিধানটি কোন্ ধর্মগ্রন্থের? পবিত্র কোরআনের বিকল্প বিধান প্রয়োগ করা জামায়াতে ইসলামীর কাজ হলে তা তো মধুর বোতলে বিষ মেশানোর মতই হবে।
বক্তব্যটা এতই ধারালো যে, আলোচনার গতি এতটুকুতেই থামানো যাচ্ছে না। কারণ পবিত্র কোরআনের বিধান প্রয়োগ করাকে জুলুম বলা হচ্ছে। আমি যদি জিজ্ঞেস করি, এখানে জালিম ও মাজলূম কে? এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ জালিম ও মাজলূমের সাথে ইসলাম ধর্মে পৃথক পৃথক অনেক বিধানাবলী সংশ্লিষ্ট আছে। মওদূদী সাহেবের বক্তব্যে উক্ত স্থানে যেনা ও অপবাদের শাস্তি প্রয়োগ করা জুলুম হলে এ ক্ষেত্রে জালিম হয় তো মহান আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন হবেন (না'ঊযু বিল্লাহ) নতুবা হবেন প্রয়োগকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। জুলুম করা অন্যায়, ঘৃণ্য ও কবীরা গুনাহ্ এ কথা আমরা সবাই জানি, এর কোনটাই আল্লাহ শানে বলা যাবে না। আল্লাহ কোন অন্যায় করেন না, কোনরূপ ঘৃণার কাজও করেন না। সর্বোপরি আল্লাহকে জালিম বললে যে আর মুসলমানিত্বই থাকে না। কারণ আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেছেন, "এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের উপর জুলুম করেন না" (সূরা আলে ইমরান : ১৮২)। আচ্ছা ধরে নেয়া যাক, মওদূদী সাহেবের উদ্দেশ্য আল্লাহকে জালিম বলা নয়, বরং ঐ স্থানে যিনি এ বিধানটি প্রয়োগ করেছেন তিনি। তা হলে ওই স্থানে কোরআনের বিধান প্রয়োগকারী সে ব্যক্তি জালিম এবং জালিম হওয়ার কারণে সে অন্যায়কারী, অপরাধী, ধিক্কৃত, ঘৃণার পাত্র, কবীরা গুনাহকারী ইত্যাদি। তাহলে কি কোরআনের বিধান প্রয়োগ করার কারণেই সে অপরাধী? কোরআনের বিধান প্রয়োগ করার কারণে সে গুনাহ্গার? কোরআনের বিধান প্রয়োগ করার কারণে সে ঘৃণার পাত্র? কোরআনের বিধান প্রয়োগ করার কারণে সে জালিম? আপনার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে কেউ যদি অপরাধী সাব্যস্ত হয় তবে নির্দেশদাতা হিসেবে আপনিও কিন্তু সেই অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ পাক হলেন নির্দেশদাতা আর সেই নির্দেশ প্রয়োগ করার কারণে আমি হলাম অপরাধী! কি বলবেন মওদূদী সাহেব! অপরাধের দায় ভার আল্লাহর উপর চাপিয়ে দেবেন কি না? যার কথায় পরোক্ষভাবে আল্লাহপাক অপরাধী সাব্যস্ত হন, তিনি জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মিস্টার মওদূদী। এবার আসা যাক, মজলূমের আলোচনায়। মজলূমের ক্ষেত্রে অপশন একটাই, আর তা হল, যার উপর ওই বিধান প্রয়োগ করা হয়েছে তিনি। মওদূদী সাহেবের ভাষায় যে স্থানে চরিত্রের মাপকাঠি এতটাই নিম্নমানের যে সেখানে অবৈধ সম্পর্ককে কোনরূপ ত্রুটি মনে করা হয় না, সে জায়গায় কেউ যদি যেনা করে এবং কোরআনের বিধান মোতাবেক তার উপর যেনার শাস্তি প্রয়োগ করা হয়, তবে যেনাকারী ব্যক্তি জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতার দৃষ্টিতে মজলূম হবে। হাদীসে আছে মজলূমের দু'আর মাঝে এবং আল্লাহর মাঝে কোন দেয়াল বা পর্দা নেই অর্থাৎ তার দু'আ সরাসরি কবূল। তাহলে তো যেনা করে গো বেচারার মর্যাদা এতই বেড়ে গেল যে, দু'আ করলেই আল্লাহর দরবারে কবূল হয়ে যায় (না'ঊযু বিল্লাহ্! আস্তাগফিরুল্লাহ!)।
সম্মানিত পাঠক, বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করার মত মানসিকতা নিয়ে নয়। নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে মিস্টার মওদূদী সাহেবের কথাটিকে বিবেকের আলোতে আরো একবার পরীক্ষা করুন। সন্তানের কল্যাণকামী বাবা আদরের সন্তানকে কোন কাজের নির্দেশ দিলে সন্তান যদি সেই নির্দেশকে জুলুম বলে আখ্যা দেয়, তবে তা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেআদবী বলে ধরে নেয়া হয়। কারণ তাতে বাবার মনে কষ্ট লাগবে। এখানে কোন বাবার আদেশ নয়, স্বয়ং আহকামুল হাকিমীন রব্বুল আলামীনের নির্দেশকে জুলুম বলা হয়েছে। আসলে আদবের শিক্ষা মানুষের জীবনকে সুন্দর করে। বেআদবী মানুষকে ধ্বংস করে -তা কথায় হোক আর কাজে। ওস্তাদের সাথে কথা বলার আগে যেমন কিভাবে কথা বলতে হবে, তার আদব শিখতে হয়, তেমনি আল্লাহ্ পাকও প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের শানে কথা বলার পূর্বেও পরিপূর্ণ আদব নিয়ে বলতে হবে। নয় তো দুনিয়া-আখিরাত উভয়ই শূন্য।
চলবে-
জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ-২
চোখে ভালো দেখলেও আপনি কানে কম শোনেন। একথার অর্থ আপনি চোখে ভাল দেখেন কিন্তু কানে কোন ত্রুটি আছে বা হয়েছে বিধায় ভালভাবে শুনতে পারেন না। অর্থাৎ আপনার অপরিপূর্ণ শ্রবণশক্তি। সহজ এ কথাটি বুঝতে রবি ঠাকুরের যোগ্যতার বিদ্যান হতে হয় না। একবার একটি ইসলামিক গবেষণা সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত 'বাংলাদেশে ইসলামী অনুশাসনঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা' শীর্ষক সেমিনারে আমি উপস্থিত ছিলাম। আলোচকদের কেউ একজন প্রবন্ধের সমালোচনা করে বললেন, 'প্রবন্ধটি' সমস্যার কথা পরিপূর্ণভাবে বললেও সম্ভাবনার দুয়ার পুরোপুরি খোলেনি। কথা এতটুকুই বলা ছিল। আলোচনাকারী আর যায় কই! কিছুটা আধুনিক জামায়াতী ওই প্রবন্ধকার তেড়ে উঠলেন অগ্নিমূর্তিতে। রাগে, ক্ষোভে টম এন্ড জেরীর মত ফুঁসে উঠলেন তিনি। গো বেচারা আলোচক নিজের বক্তব্যে বরফ ঢেলেও সেমিনারের প্রাণ রক্ষা করতে পারেননি। সমালোচনার আঘাতে আহত প্রবন্ধকারের অসহিষ্ণুতা একরকম প্রায় গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলার মতই শেষ করে দিল সাজানো সেই সেমিনারটিকে। অতিথিদের একজন ছিলাম আমিও। খাবার টেবিলে বসে না খেয়ে উপবাস করে আসার মত বক্তব্য না দিয়ে ফিরে আসতে খুবই খারাপ লাগছিল। তারপরও বাঁচা গেল। কারণ, অতিথির চেয়ারে বসে প্রবন্ধটি শুনে বক্তব্যে বলার জন্য আমিও যে কয়টি সমালোচনার পয়েন্ট মেমোরী কার্ডে বিন্যস্ত করেছিলাম, ভাগ্যিস যে সেমিনারের অপমৃত্যুতে শেষ পর্যন্ত আমার আর বক্তব্য দেয়া হয়নি! নয়ত একজন সুন্নী আলোচক হিসেবে আমার সমালোচনা তার গায়ে সাঁপের উপর বেজীর কাঁমড়ের মত অনুভূত হত এবং সেক্ষেত্রে আমিই হতাম তার বিষাক্ত প্রধান টার্গেট। 'প্রবন্ধটি সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে যথেষ্ট নয়'- এই ছিল সমালোচনা। তাতেই প্রবন্ধকারের গায়ে আগুন লেগে গেল। উল্লিখিত প্রবন্ধের জন্য আলোচকের এই সমালোচনা যথাযথ কি না সে প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, প্রবন্ধকারের রাগান্বিত হওয়া নিয়ে। আলোচকের সমালোচনা এই যে, প্রবন্ধে সম্ভাবনার কথা একেবারেই অনুপস্থিত; বরং তার দাবি হল, তাতে সম্ভাবনার কথা আছে তবে তা পরিপূর্ণ নয়। আর আলোচকারী সমালোচনা করেছেন প্রবন্ধের কিন্তু আগুন লাগল প্রবন্ধ যিনি লিখেছেন ঐ জামায়াতী লেখকের গায়ে!
দর্শক শ্রোতা, আমার প্রথম প্রবন্ধে আমি বলেছিলাম অহেতুক কাউকে অভিযুক্ত করা আমার কাজ নয়। একথাটি আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়ে আপনাদেরকে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদুদী সাহেবের একটি বক্তব্য শুনাতে চাই। তবে বক্তব্যটি শোনার আগে ঐ সেমিনারের কথাটি আরও একবার স্মরণ করুন। মি. আবুল আলা মওদুদী লিখেছেন, 'কুরআনে কারীম নাযাত কে লিয়ে নেহী, বলকে হেদায়াত কে লিয়ে কা-ফী হ্যাঁ।' তাফহীমাত ১ম খণ্ড, ৩১৬ পৃষ্ঠা। অর্থ: 'কুরআন নাযাতের জন্য নয় বরং হেদায়তের জন্য যথেষ্ট। ব্যাকরণের জটিলতা থেকে অবমুক্ত করলে উপরিউক্ত বক্তব্যের সহজ সরল অনুবাদ হবে নিম্নরূপ :
১. পবিত্র কুরআন হেদায়তের জন্য যথেষ্ট।
২. পবিত্র কুরআন নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয়।
সম্মানিত পাঠক, বক্তব্যটি আরও একবার লক্ষ্য করুন। মনে করুন, বাংলাদেশ টেলিভিশন বা অন্য কোন প্রচার মিডিয়ায় যদি এরকম একটি নিউজ আসে যে, জামায়াতে ইসলামী মানুষকে পরিপূর্ণ ইসলাম শিক্ষা দিতে পারে না বা যথেষ্ট নয়; অথবা জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব বা সংগঠন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়, তাহলে তো পরদিনই বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হয়েছে বলে প্রথম যে মিছিলটি হবে তা হবে জামায়াতের। বিটিভিকে অপরাধীর কাঠগড়ার দাঁড় করানোর জন্য নিজামীদের প্রথম কাজ হবে আদালতে মামলা ঠুকে দেয়া। অথচ পবিত্র কুরআনকে নাজাতের জন্য যথেষ্ট নয় বলার কত যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পরও জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে কোন শাস্তি হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের বিবেকের কাছে একটি প্রশ্ন করি। পবিত্র কুরআন নাযাতের জন্য যথেষ্ট বললে তার জন্য সম্মান হবে না কি নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয় বললে? আমার বিশ্বাস, বর্ণমালা শিক্ষা গ্রহণকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররাও একথাই বলবে যে, কুরআন শরীফ নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয় বললে পবিত্র কুরআনকে অসম্মান করা হয়। আপনারাও নিশ্চয় একমত হবেন। যদি তাই হয়, পবিত্র কুরআন নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয় বললে যদি কুরআনটিকে অসম্মান করা হয়, তবে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদুদী সাহেবই হবে পবিত্র কুরআনের অবমাননাকারী এবং জামায়াতে ইসলামী হবে তার সেই শিক্ষা বাস্তবায়ন করার কপট ঠিকাদার। সালমান রুশদী 'দ্যা স্যাটানিক ভার্সেস' লিখে পবিত্র কুরআনকে অসম্মান করার কারণে জামায়াতে ইসলামী প্রতিবাদ করেছিল। অথচ সেই জায়ায়াতে ইসলামী আপন ঘরেই যে সালমান রুশদীকে প্রতিপালন করছে! ইদানিংকালে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিজাতীয় লেখকেরা প্রায়ই পবিত্র কুরআন সম্বন্ধে অবমাননাকর কথা লিখে চলেছে। তাদেরকে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতার ভাবশিষ্য বললে অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না। আল কুরআনের আলো ঘরে ঘরে জ্বালো-এটা জামায়াতের কমন শ্লোগান। কুরআন নাযাতের জন্য যথেষ্ট না হলে কুরআনের আলো পরিপূর্ণ হবে কিভাবে? আর কুরআনের আলো অপরিপূর্ণ হলে আলোর পরিপূর্ণতার জন্য অন্য কোন ধর্মগ্রন্থ থেকে আলো ধার নিতে হবে তা মওদুদী সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তবে মওদুদী সাহেব কুরআনের অপরিপূর্ণ আলো নিয়ে কবরে গেলেন নাকি অন্য ধর্মগ্রন্থের আলো ধার নিয়ে পরিপূর্ণ আলোকিত! হয়ে প্রস্থান করলেন সে কথা জানতে আমার খুবই উৎসাহ জাগছে। পবিত্র কুরআনের প্রতি অবমাননাকর কিছু বলে মুসলমান হওয়া বা থাকা যায় কিনা তার সিদ্ধান্ত পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী আলোচনায় গেলাম।
কুরআন নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয়' পবিত্র কুরআন সম্পর্কে এ রকম কথা কোন সাহাবী, তাবেঈ বা তাবে'তাবেয়ী বলছেন বলে আমার জানা নেই। পবিত্র কুরআনের কোনও আয়াতেও এরকম কোন কথা বলা হয়নি। মওদুদী সাহেব যেভাবে বলেছেন সেভাবে কোনও হাদীসেও নেই। তবে হাদীসকে পরিত্যাগ করার জন্য শুধু কুরআনের কথা বলে তাদেরকে ভ্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আবু দাউদ শরীফের সহীহ্ হাদীসে। পূর্ববর্তী কেহই কুরআন সম্পর্কে যে কথা বলেন নি এমন একটা কথা বলে মি. মওদুদী নিজেকে জাহির করতে চাইলেন কিনা কে জানে। কুরআন নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয়- কুরআন সম্পর্কে এ রকম রায় প্রদান করার মত আদালতের বিচারক হিসেবে মি. মওদুদীকে নিয়োগ দিয়েছে কে? কুরআন আল্লাহর কালাম। এটা নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয় বললে তার অর্থ হয় আল্লাহর এই পবিত্র কালাম মানুষের নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয়। মানবতার নাযাত দিতে যথেষ্ট নয় এমন কথাগুলো আল্লাহপাক নাযিল করলেন যা মওদুদী ব্যতিত জমিনের নিচে কোন মানুষ তো দূরের কথা, স্বয়ং সাহেবে কুরআন তথা আমাদের নবীর চোখে পর্যন্ত ধরা পড়েনি। বড় সাংঘাতিক কথা! শেক্সপিয়ারের উপন্যাস নয়-মওদুদীর পরীক্ষাগার পবিত্র কুরআনের ডায়াগনসিস হয়ে ফাইনাল রিপোর্ট বের হল 'কুরআন নাযাতের জন্য নয়'। তবে কেন এমন হল! আল্লাহ পাকের সকল গুণাবলীই তো পরিপূর্ণ। তবে কেনইবা তিনি এমন একটা গাইড লাইন আমাদেরকে দিলেন যা আমাদেরকে রক্ষা করতে যথেষ্ট নয়? স্রষ্টার কাছে এর কৈফিয়ত তলব করার সাহস মওদুদী ছাড়া আর কারো আছে বলে আমার মনে হয় না!
'কুরআন নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয়' - এ কথার অর্থ নাযাতের পরিপূর্ণতার জন্য বা পরিপূর্ণভাবে নাযাত দেয়ার ক্ষেত্রে কুরআন অন্য কিছুর মুখাপেক্ষী। পরিপূর্ণ নাযাতের যাবতীয় তথ্য উপাত্ত কুরআনে নেই। মি. মওদুদীর একথার বিপরীতে কুরআনের ঘোষণা হল 'তিবইয়ানান লিকুল্লি শাঁই'। অর্থাৎ কুরআনে সকল কিছুর বিশদ ব্যাখ্যা আছে। তার অর্থ, অন্য সকল ইস্যুর ন্যায় মানবতার মুক্তির তথা নাযাতের সকল তথ্য-উপাত্ত ও বিশদ ব্যাখ্যা পবিত্র কুরআনে আছে। আর মি. মওদুদীর মতে পবিত্র কুরআন আমাদের নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয়। তাহলে পরিপূর্ণ নাযাতের জন্য আর কি কি প্রয়োজন তা নির্ধারণ করে মওদুদী সাহেব কুরআনে তা সংযোজন করে দিলেই পারেন। এ যুগের তসলিমা নাসরিনরা পবিত্র কুরআনের সম্পাদনার দাবি তুলে মওদুদীর রেখে যাওয়া এজেন্ডা বাস্তবায়নের মহৎ! দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। 'কুরআন আমাদের নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয়' জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদুদীর এ রকম বক্তব্য হজম করেও বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বিভিন্ন সভা সমাবেশে বলে বেড়ায় কুরআন আমাদের মুক্তির সনদ। এ রকম সাংঘর্ষিক বক্তব্যকে প্রতারণা ছাড়া আর কি বলা যায়? মওদুদী সাহেবের কথায় আবারও ফিরে আসি। কুরআন আমাদের হেদায়তের জন্য যথেষ্ট, নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয়। তার মানে কুরআনের মাধ্যমে একজন মানুষ পরিপূর্ণ ও চুড়ান্ত হেদায়াত লাভ করে চুড়ান্ত মুক্তি নাও পেতে পারে। কুরআনের মাধ্যমে হেদায়ত পাওয়া মানে আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত লাভ করা। পাঠক, আপনারাই বলুন, আল্লাহপাক যাকে চুড়ান্ত হেদায়াত দান করেন এবং তা পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে তবে তাঁর মুক্তির জন্য আর কি প্রয়োজন? আল্লাহর চুড়ান্ত হেদায়াতের পর চুড়ান্ত মুক্তি হবে না? তাহলে কি আল্লাহ পাক হেদায়াত দান করেন, কুরআন যাকে হেদায়াত দান করে এই হেদায়াত তার মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়?? 'কুরআনে কারীম নাযাত কে লিয়ে নেহী বলকে হেদায়াত কে-লিয়ে কাফী হ্যায়।'
মানে, পবিত্র কুরআনের আলোকে পরিপূর্ণ হেদায়াত লাভ করার পরও চূড়ান্ত নাযাত পাওয়া হল না। কুরআনের চুড়ান্ত হেদায়াতের পরও যদি চূড়ান্ত মুক্তি পাওয়া না যায় তবে চুড়ান্ত মুক্তির জন্য কুরআনের সাথে আর প্লাস করতে হবে তার জবাব দেয়ার দায়িত্ব মওদুদী সাহেবের। ভাবে সাবে মনে হয় অংকটা এমনযে, কুরআন প্লাস জামায়াতে ইসলামী ইকুয়াল টু চুড়ান্ত মুক্তি!!! আল্লাহ প্রদত্ত পবিত্র কুরআনকে হেদায়াতের জন্য যথেষ্ট নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয় বলা ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, ইসলামের দর্শন হল চূড়ান্ত হেদায়াতের মাধ্যমেই মানুষের চূড়ান্ত নাযাত নিশ্চিত হয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, তাঁরা তাঁদের প্রভুর পক্ষ থেকে হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁরাই চুড়ান্তভাবে সফলকাম। [সূরা বাক্বারা, আয়াত-৫]
কুরআনের মাধ্যমে হেদায়াত পাওয়া মানেই আল্লাহর হেদায়াত লাভ করা। আল্লাহর চুড়ান্ত হেদায়াত লাভ করেও যদি তা নাযাতের জন্য যথেষ্ট না হয় তবে এই ব্যর্থতার দায়ভার মি. মওদুদী কার কাঁধে চাপাবেন তা তিনিই ভাল জানেন। আমরা শুধু দু'হাত তুলে আল্লাহর শানে এই রকম নির্লজ্জ কথা বলা থেকে তাঁরই পবিত্র দরবারে পানাহ কামনা করছি। তিনি আমাদের রক্ষা করুন।
কেউ হয়ত বলতে পারেন, কুরআনে কারীম নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয় মওদুদীর এ কথার অর্থ হল নাযাতের জন্য কুরআনের সাথে সুন্নাহর দিক নির্দেশনাও প্রয়োজন; অথবা অর্থ এই যে, কুরআনের সাথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সুপারিশ নাযাতের জন্য অপরিহার্য। মি. মওদুদী এই অর্থে যদি কুরআনকে নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয় বলে থাকেন, তবে এই একই অর্থে কুরআনকে হেদায়াতের জন্য যথেষ্ট বলা যাবে না। অথচ তিনি তা বলেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা ছাড়া বা পবিত্র হাদীসের নির্দেশনা ব্যতীত কুরআন কারীম হেদায়াতের জন্য যথেষ্ট হলে একই কারণে তা নাযাতের জন্যও যথেষ্ট নয় বলতে হবে। উপরন্তু মওদুদীদের হলুদ চশমায় মানবতার শাফায়াতকারী নবীকে পরের কল্যাণ-অকল্যাণ করাতো দূরের কথা নিজের কল্যাণ-অকল্যাণ করার ক্ষমতাও রাখে না। সে রকম নির্বিকার একজন মানুষের মত দেখায়। (নাউযুবিল্লাহ)।
পাঠক, সেমিনারের কথা এতক্ষণ বেবাক ভুলে ছিলাম। বেছারা আলোচক তাঁর বক্তব্যে প্রবন্ধকারের প্রবন্ধ সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে যথেষ্ট নয় বলার কারণে আধুনিক জামায়াতী লেখক আহত বাঘের মত বেসামাল হয়ে সেমিনারের বক্ষ বিদারণ করে শেষ করে দিলেন। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদুদী কর্তৃক মহাপরাক্রমশালী মহাজ্ঞানী রাব্বুল আলামীনের প্রদত্ত ত্রিশ পারা সম্বলিত বিরাট এই প্রবন্ধ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে নাযাতের জন্য যথেষ্ট নয় বলার পরও জামায়াতে ইসলামীর হার্ট এটাক তো দূরের কথা থার্ম মিটার দিয়ে কেউ জামায়াতের সাধারণ মেডিকেল চেকআপও করল না!!! আরেকটি রিদ্দার যুদ্ধের জন্য দৃঢ়চেতা আরেকজন আবু বকর সিদ্দিকের পূর্ণরার্ভিভাবের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা!!!
[চলবে]
জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ-৩
পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের জন্য এই লেখাটি যখন লিখছি তখন সফর মাস। রমজান মাসের যে আবেগ তা যেমন শা'বান মাসের কাছে পাওয়া যায় না। তেমনি সফর মাসের আবেগ দিয়ে রবিউল আউয়ালের তৃষ্ণা মেটে না। রবিউল আউয়ালের জন্য রবিউল আউয়ালে লিখলেই বোধ হয় লেখাটি রবিউল আউয়ালের মত হত। এ কথাগুলো বলছি রবিউল আউয়াল আমাদেরকে আল্লাহর পুরো সৃষ্টিকে যা দিয়েছে তাতে জীবনের সর্বোচ্চ আবেগটাকে যদি রবিউল আউয়ালের জন্য নিবেদন না করি তবে তার হক আদায় হবে না। সাধারণভাবে রবিউল আউয়ালকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করার যোগ্যতা আমাদের আছে বলে আমি মনে করি না। তার উপর আবার অপূর্ণ আবেগ নিয়ে লিখতে বসে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। তাই আজকের এই লেখার শুরুতেই রবিউল আউয়ালকে জানাচ্ছি সশ্রদ্ধ সালাম, সুবহে সাদিককে সশ্রদ্ধ সালাম, পবিত্র সোমবার দিনকে সশ্রদ্ধ সালাম, সালাম সেই সূর্যের প্রতি যাকে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা আকাশের সূর্য থেকেও শ্রেয়তর বলে বিশ্বাস করতেন। সালাম সেই আলোর প্রতি, যা পাহাড় পর্বতের বাধা পেরিয়ে মা আমিনাকে পারস্যের রাজ প্রসাদ দেখিয়ে দিয়েছিল। বিবি মরিয়ম আলাইহিস্ সালাম দুনিয়া ত্যাগ করে বেহেশতবাসী হয়েছিলেন হাজার বছর আগে। মা আছিয়া আলায়হিস্ সালামও বেহেস্তী নে'মতের সুধায় আচ্ছন্ন। সেই নে'মতের মোহময়তা ত্যাগ করে তারা মা আমিনার জীর্ণ কুটিরে এলেন কি প্রয়োজনে। জিব্রাইল আমীনের আজকের ডিউটি কোথায়? আসমানে নয়- মারওয়া পাহাড়ের ঠিক কয়েক গজ পূর্ব দিকের পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি ঘরকে কেন্দ্র করে সৌদি সরকারের অবজ্ঞা আর অবহেলায় সেই ঘরের ভেতরে এবং বাইরের ময়লা আবর্জনা দেখে আশেকে রাসুল বুক ফাটা কান্নায় জিব্রাইল আমীনের কাছেই অভিযোগ করবে, "যেখানে আপনি ডিউটি করলেন সে দিন, আজ সে জায়গায় অবস্থা এমন বেহাল দশা কেন? লক্ষ লক্ষ ফেরেস্তা আসমান থেকে জমীনে তাশরীফ আনলেন যে ঘরের প্রটোকল মেনটেইন করার জন্য সেই ঘরের প্রতিও আমার সশ্রদ্ধ সালাম আর অকৃত্রিম ভালবাসা। ফেরেস্তা জগতের আজ অন্য রকম এক দিন। অন্য দিনের তুলনায় আজকে আসমানের নিরাপত্তা কঠোর করা হয়েছে অনেক বেশী। সাজানো হয়েছে এমনভাবে যে, মনে হয় এ এক নতুন আসমান। কা'বা শরীফ তাওয়াফরত আবদুল মুত্তালিব হঠাৎ তাওয়াফ বন্ধ করে দৌঁড়ে মা আমিনার কুটিরে এলেন যাকে দেখতে, দূর আসমানের জোহরা ইত্যাদি তারকারাজি সময়ের ফাঁকে ফাঁকে দেখে গেছে চুপটি মেরে। রোম সম্রাটদের অহংকারবোধের প্রধান উপাদান সুউচ্চ চৌদ্দটি মিনার ভেঙ্গে পড়ে যার সম্মানে, তিনি রোম সাম্রাজ্যের কোন রাজকীয় পরিবারে নয়- পাহাড় ঘেরা আমিনার ঘরের দুলাল। আজ এমন দিন যে দিনে সুবহে সাদিকের পরে সারা জাহানের রাজা বাদশাহগণ রাজদরবারে এসে তাদের সিংহাসনগুলোকে সিজদারত অবস্থায় পেয়েছিলেন। মূর্তিপূজারীরা সব সময় যে মূর্তিদের সাজদা করত আজ সেই মূর্তিগুলোই অন্য কারো সম্মানে সাজদা করছে। সারা দুনিয়ার বনের পশুদের উপচে পড়া আনন্দ আজ। মাশরিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত একে অন্যের কাছে আপন আপন ভাষায় যার সুসংবাদ পৌঁছে দেয়ার অনন্য দায়িত্ব আজ পালন করল বনের পশুরা। ভাব দেখে মনে হয় ইনি বুঝি তাদের সবচেয়ে আপনজন, সবার চেয়ে কাছের জন। সাগর এবং নদীর জলজপ্রাণিগুলো দূর-দূরান্তে ছুটছে বিদ্যুৎ গতিতে। আজ তাদের অন্য কিছু শুনার অপেক্ষা নেই। সারা জীবন যে সোনালী দিনক্ষণের অপেক্ষায় ছিল কাঙ্ক্ষিত সেই দিনের আজ শুভ আগমন। বিদ্যুৎগতিতে দিক-বিদিক ছুটছে সেই খুশি বিতরণের জন্য। আমিনার দুলালের শুভ পদার্পণ স্থল ভাগে আর জলভাগের জলজ প্রাণীদের খুশীর জোয়ার পানির জোয়ারকেও হার মানাচ্ছে। এই আনন্দের আমেজ তাদেরকে দিল কে? আজ বাতাসের মুখে যা আকাশের কণ্ঠেও একই কথা। পাখির মুখে যে গুঞ্জন একই কারণে সাগরের নাচন। আজ যে কারণে ফুলের হাসি একই কারণে মালিকও খুশী। আজ মাটির উপরে যার বার্তা মাটির নিচেও তার কথা। গাছের দোলা, মাছের নাচন, পশুদের আনন্দ আর শিরকের পতন-এ সবই আল্লাহর বন্ধুর শুভ পদার্পণের কারণে। পবিত্র সেই চরণযুগলে আমার সশ্রদ্ধ সালাম।
বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে এমন একটি দিন ছিল, যে দিন পৃথিবীর কোথাও কন্যা সন্তান জন্ম নেয়নি। হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম সম্মান ও শ্রদ্ধাভরে দাঁড়িয়ে যে দিনের কথা আপন উম্মতকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, খৃষ্টপূর্ব এক হাজার বছর পূর্বে ইয়েমেনের বাদশা বাইতুল্লাহ শরীফ জেয়ারত শেষে ফেরার পথে মদীনার সুগন্ধি পেয়ে রাজমুকুট ত্যাগ করে চারশত আলেমসহ মোট এক হাজার সঙ্গী নিয়ে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন যে দিনের জন্য এবং সর্বশেষ মৃত্যুর পূর্বে পাথরের উপর নবীর শাফায়াত ও করুণা ভিক্ষা করে প্রেম ভরা হৃদয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন যে দিনের কাছে, আমি সে দিনকে সশ্রদ্ধ সালাম করছি। হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম যে কথা বলে গেলেন, শীষ আলাইহিস্ সালাম বললেন একই কথা। হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম একই ঘোষণা দিলেন। তারপর সর্ব হযরত মূসা-ঈসা-ইব্রাহীম-ইসহাক-ইয়াকুব-ইউনুস-ইয়ূসুফ আলাইহিমুস্ সালাম সহ সকল নবী-রাসুল অভিন্ন সেই দিনের কথাই বললেন, এটা সেই দিন যে দিন ক্রীতদাসী সুয়াইবার হৃদয়ের ভালবাসার মোহময় আকর্ষণে তার মুনীব কাফের আবু লাহাবকেও আদিষ্ট করে সুয়াইবাকে মুক্তি দিতে বাধ্য করেছিল! আজ এই ভাগ্য বঞ্চিত ক্রীতদাসীর পরম আনন্দের দিন। আমি সে দিনের প্রতি আমার গভীর ভালবাসা নিবেদন করছি। সে দিন আকাশ-বাতাস-তরু-লতা সব কিছু মহা আনন্দে অবগাহন করে যে সুর তুলেছিল নজরুল তার অনুবাদ করেছেন এইভাবে-
তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে
মধু পূর্ণিমার সেথা চাঁদ দোলে
যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে
তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে।
এটা শুধু মানুষের আনন্দ নয়। আজকে মহান স্রষ্টারও আনন্দের দিন। কারণ আপন বন্ধুকে সৃজন করেছিলেন সবার আগে। কিন্তু না পাঠিয়ে নিজের কাছেই রাখলেন এবং তার পূর্বে নবীদের পাঠালেন প্রধান অতিথির শুভাগমনের বার্তা প্রচার করার জন্য। এত শ্রম, এত সময়, এত নবী, এত ঘোষণা, এত প্রস্তুতি, এত সাজসজ্জা, এত আয়োজন শুধু ঐ দিনের জন্য যে দিন স্রষ্টা তাঁর বন্ধুকে উম্মতের কাছে পাঠাবেন উম্মতের কাণ্ডারী ও দরদী হিসেবে। সেই দিনের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ সালাম।
প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার আমাদেরকে হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম এর কথা বলে যায়। হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম এর মুক্তির কথা প্রতিবছর একবার বলে যায় দশই মহররম। আর কিয়ামতের দিন যার সামিয়ানার নীচে হযরত আদম আলাইহিস্ সালামসহ সকল নবী রসূল আশ্রয় গ্রহণ করবেন বার রবিউল আউয়াল তারই আগমনের কথা আমাদেরকে বলে যায়। তাই এই দিনের কোন তুলনা হয় না।
শুক্রবার দিনকে নবী ঈদের দিন বলেছেন, কারণ এদিন হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম এর শুভাগমনের দিন। আর ১২ রবিউল আউয়াল সকল নবীর শ্রেষ্ঠ নবীর শুভাগমনের দিন। সুতরাং শুক্রবার যে সোমবারের কাছে বড্ড রকমের ঋণী হয়ে আছে! সোমবারের প্রতি সে কারণে আমার সশ্রদ্ধ সালাম। নবীর উম্মত হিসেবে নবীর শুভাগমনের দিনকে আমি কি অশ্রদ্ধা করব?? তাহলে তো নবীকেই অশ্রদ্ধা করা হবে। ২৭ রমজানকে অশ্রদ্ধা করা যেমন কোরআনকে অশ্রদ্ধা করা। যে নবীর সম্পৃক্ততার কারণ রওজায়ে পাকের মাটির মর্যাদা আরশে আজীম এবং কা'বা শরীফ থেকেও মর্যাদাবান হয়ে যায় সেই নবীর সাথে সম্পৃক্ততার কারণে ১২ রবী'উল আউওয়ালের মর্যাদা কি হতে পারে!! বার রবী'উল আউওয়ালকে তাই আমার হৃদয় ভরা ভালবাসা আর বিনীত সালাম।
প্রতি সোমবার রোজা পালন করে উম্মতের দরদী নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন নিজের শুভাগমনকে সম্মান করিয়ে দেখিয়েছেন, উদযাপন করেছেন এবং কালের অজানা গন্তব্যে ঈদে মিলাদুন্নবীর বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছেন। মানবতার নবী নিজেই যেখানে তাঁর মীলাদকে সম্মান করেছেন সেখানে তাকে অসম্মান করার আমি কে? রাহমাতুল্লিল আলামীনের শুভাগমন সোমবার দিনকে যে অনেক কিছু দিয়েছে তার প্রমাণ হিসেবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই রোযা পালন করে তার মর্যাদার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। সাহাবা যুগ থেকে শুরু করে হক্কানী এমন কোন আলেম ছিলেন না যারা সোমবার দিনকে সম্মান করেননি। সোমবারকে সম্মান করা মানে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম'র মীলাদ শরীফকে সম্মান করা। উপরন্তু বিশ্বের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে কেরাম পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অসংখ্য কিতাব রচনা করে গেছেন এবং নিজেরাও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তা পালন করেছেন। অথচ এই পবিত্র ও পূণ্যময় আমলটিকে মুশরিকদের পৌরাণিকবাদের সাথে তুলনা করে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদুদী কি লিখেছেন দেখুন : 'আর অন্য দিকে কোনো তত্ত্বগত দলীল প্রমাণ ছাড়াই ঐ সব নেক লোকদের জম্ম মৃত্যু.... সম্পর্কে পৌত্তলিক মুশরিকদের পৌরাণিকদের সঙ্গে সর্বক্ষেত্র সামঞ্জস্যশীল একটি পৌরাণিকবাদ তৈরি করা হয়েছে।
[ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন-৬ (অনুদিত)]
এখানে কয়েকটি অংশের প্রতি পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করব :
১. কোনো তত্ত্বগত দলীল প্রমাণ ছাড়া।
২. সর্ব ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যশীল।
৩. পৌরাণিকবাদ তৈরি করা হয়েছে।
ভাষার জটিল মারপ্যাঁচ থেকে আসুন আলোচ্য বক্তব্যটিকে অবমুক্ত করি।
১. মিলাদ সম্পর্কে নাকি কোনো তত্ত্বগত দলীল প্রমাণ নেই।
২. মিলাদ পালন করা নাকি পৌত্তলিক মুশরিকদের পৌরাণিকবাদের সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং এটা পৌরাণিকবাদেরও নাকি একটি অংশ।
প্রশ্ন হল যারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদুন্নবী পালন করেন তারা কি মুশরিক, না মুসলমান? মি. মওদুদীর ধারণা মোতাবেক এটা পৌত্তলিক মুশরিকদের পৌরাণিকবাদের সাথে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। মিলাদুন্নবী পালন করা যদি মুশরিকদের পৌরাণিকমতবাদ হয় তবে প্রশ্ন হল আমাদের প্রিয় নবী রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রতি সোমবার রোযা পালন করে কি পৌত্তলিক মুশরিকদের পৌরাণিকবাদের চর্চা করেছেন, না কি ইসলাম ধর্মের কাজ করেছেন? সোমবারের রোযা পালনের কারণ হিসেবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই যেখানে তাঁর জন্ম তথা শুভাগমন এর বিষয়টি উল্লেখ করেছেন সেখানে জন্ম-আবির্ভাব পালন করাকে পৌরাণিকবাদের সাথে তুলনা করে বিশ্বের মুসলমানদের কাছে রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে মি. মওদুদী কি মেসেজ দিতে চান? জন্ম-মৃত্যু পালন করা যদি পৌত্তলিক মুশরিকদের পৌরাণিক মতবাদ হয় তবে নিজের জন্মদিন সোমবারের রোযা পালন করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইসলামবাদ করলেন, না পৌরাণিকবাদ? তাহলে কি ইসলামের নবী, আল্লাহর প্রেরিত নবী যিনি মানুষকে পৌত্তলিকতা পরিত্যাগ করতে সারা জীবন সংগ্রাম করলেন তিনিই কি না পৌত্তলিক মুশরিকদের পৌরাণিকবাদের চর্চা করলেন? আর চৌদ্দশ বছর পর সেই পৌরাণিকবাদ থেকে ইসলামকে মুক্ত করতে মওদুদীর মত মহাপুরুষকে (!) আসমান থেকে (!) নাযিল হতে হল!!
আসলে কথা হল, জন্ম দিন পালন করা নিয়ে। মিলাদুন্নবী পালন করা কি-এই হল প্রশ্ন। কিভাবে পালন করবেন এ হল দ্বিতীয় প্রশ্ন। আপনি যদি মওদুদীদের মত বলেন যে, কোনভাবেই মিলাদুন্নবী পালন করা যাবে না, তবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সোমবারের রোযার কারণ হিসেবে তার শুভাগমনের বিষয়টি উল্লেখ না করে অন্য কিছু উল্লেখ করতেন। রোযা পালন করার কারণ হিসেবে শুভাগমনের বিষয়টি উল্লেখ করার অর্থ তিনি নিজেই মিলাদকে সম্মান করেছেন, উদযাপন করেছেন এবং মওদুদী সাহেবদের আক্বীদা 'মীলাদুন্নবী কোনভাবেই পালন করা যাবে না। যা আলোচ্য হাদীসের বিপরীত। এটাতে পৌরাণিকবাদের সাথে তুলনা করাকে তাই সহস্রাব্দের সেরা ধৃষ্টতা বললেও কম বলা হবে।
পাঠক, আমাদের প্রিয় নবী রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমন কতটুকু তাৎপর্যবহ? এই আগমন যে আল্লাহর প্রিয়তম মাহবুবের, এই আগমন সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির। তিনি আসবেন বলেই তো অন্য সকল নবী পাঠানো হয়েছে। তার শুভাগমনের কথা প্রচার করা প্রত্যেক নবীর দায়িত্বের অংশ ছিল। তিনি এলেন বলেই আজ মুসলমানের ঘরে পবিত্র কুরআন। তার আগমন না হলে মসজিদ হত না, মসজিদে আযান হত না, নামাজ হত না। তার পবিত্র চোখের প্রণোদনের জন্যই উদ্ভিদ জগৎকে সবুজ দিয়ে সাজানো হয়েছে। সমস্ত নবীর সামষ্টিক মর্যাদার অনেক ঊর্ধ্বে যাঁর মর্যাদা এটা তার শুভাগমন। তিনি যখন মাকামে মাহমুদে উপবিষ্ট হবেন তখন সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা নবীরাও নিচে অবস্থান করবেন। এটা তাঁরই শুভাগমন। যিনি কিয়ামতের দিন আরশের উপরে রাব্বুল আলামীনের ডান পাশে বসার সৌভাগ্য অর্জন করবেন এটা তাঁর শুভাগমন। তাঁর শুভাগমনের কি কোনই মূল্য নেই আমাদের কাছে। তাঁর শুভাগমন কি অন্য দশ জনের জন্মের মত সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়ার মত জন্ম মাত্র? আমাদের মায়ায় যিনি পৃথিবীতে এলেন তার আগমনের দিনটি আমাদের স্মৃতি থেকে আমরা বিলীন করে দেব? নবীর ওফাতের পর আবু বকর সিদ্দিক নবীকে নিয়ে যখন রওজায়ে পাকে নামলেন, দেখলেন, নবীর পবিত্র ঠোঁট মোবারক নড়ছে। আদবের সাথে মুখের কাছে কান লাগিয়ে শুনুলেন হায়াতুন্নবী তখনও মৃদু মধুর আওয়াজে উম্মতের জন্য কাঁদছেন। সেই দরদী নবীর পবিত্র শুভাগমনের দিনটিকে উদযাপন করাক মওদুদী সাহেবরা পৌত্তলিক পৌরাণিকবাদের সাথে তুলনা করে যে মহান (!) দায়িত্ব পালন করে গেলেন তার জন্য নিন্দা করার ভাষাও মুসলমানদের জানা নেই।
লেখক : বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ-৪
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত বলতে তিনি ছাড়া তার পরবর্তী সবাইকেই বুঝায়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সবাই তাঁর উম্মত। তাদের মধ্যে যারা ঈমানদার তারা উম্মতে ইযাবাহ্ এবং যারা ঈমান আনেনি তাদেরকে বলা হয় উম্মতে দাওয়াহ্। সাহাবী, তাবে'ঈন, তাবয়ে তাবেঈন, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফক্বীহ, আদীব, গাউস, কুতুব, আবদাল, আওতাদ, অলী-বুযুর্গ সবাই তাঁর উম্মতের সারিতে অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের উম্মতের মধ্যে কেউ মুহাদ্দিস, কেউ মুফাসসির, কেউ ফক্বীহ, কেউ আদীব, কেউ দার্শনিক। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিআল্লাহু আনহুর জন্য প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি দু'আ করেছেন বলে উম্মতের মধ্যে তিনি তরজুমানুল কোরআন বলে খেতাব লাভ করেছেন। অন্য সাহাবীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে উম্মতে মুসলিমা তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাসসির বলে মেনে নিয়েছেন। যেমনটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস'ঊদ রদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ফিক্বহের ক্ষেত্রে। তবে সাহাবীদের সকলেই তাফসীর বিশারদ ছিলেন। কেউ কারো থেকে কম নন, একজন থেকে অন্যজন বেশি।
পবিত্র কোরআন যেহেতু কুলহীন মহাসাগরের মত, সে কারণে প্রত্যেক সাহাবীই আপন আপন জায়গায় পবিত্র কোরআনের অগাধ জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন, যা তাঁরা অর্জন করেছেন সাহেবে কোরআন স্বয়ং রসূলে মাকবূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে। সাহেবে কোরআনের প্রথম ছাত্র সাহাবায়ে কেরাম। কোরআনের তাফসীর পরিপূর্ণভাবে অবগত ছিলেন স্বয়ং রসূলে মাকবূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। বরং তিনি ছিলেন জীবন্ত কোরআন। তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্মই ছিল পবিত্র কোরআনের বাস্তব তাফসীর, যা খুব কাছ থেকে অবলোকন করতে পেরেছেন সাহাবায়ে কেরাম। সে কারণে পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যা সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম- এর পর পরই নির্ভর করতে হবে সাহাবায়ে কেরামের উপর। বরং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা পেতে হলে সাহাবীদের উপর নির্ভর করতেই হবে এবং তাঁদের কাছ থেকেই তা গ্রহণ করতে হবে। এভাবে সাহাবীদের থেকে তাবে'ঈ এবং তাঁদের কাছ থেকে তাবয়ে তাবে'ঈনগণ এবং তার পরবর্তী প্রত্যেক যুগের আলিমদের থেকে তাফসীর গ্রহণ করেছেন। এই কারণেই প্রতিটি তাফসীরেই কোন আয়াতে করীমার তাফসীর করার সময় তার পূর্ববর্তী আলিমদের রেফারেন্স টেনে আনা হয়, যা সাহাবা-এ কেরাম পর্যন্ত প্রলম্বিত; আসলে এটা একটা অপরিহার্য বিষয়। কারণ যদি প্রশ্ন করা হয়, যে কোরআন বুঝার জন্য বা তাফসীর বুঝার জন্য কি প্রয়োজন?
তাহলে সাহাবায়ে কেরামকে বাদ দিয়ে বা আমলে না এনে পবিত্র কোরআন বুঝা সম্ভবই নয়। আরো একটু ব্যাপকভাবে বলতে হয়। মনে করুন, অনারবী একজন লোক, সে বাঙ্গালী হোক আর জাপানী হোক, তিনি যদি পবিত্র কোরআন বুঝতে চান, তবে তাকে সর্বপ্রথম আরবী ভাষার চর্চা করতে হবে এবং এ জন্য তাকে আরবী ভাষাবিদদের কাছ থেকে অথবা তাঁদের প্রণীত আরবী অভিধান থেকে আরবী ভাষা শিখতে হবে। তার মানে পবিত্র কোরআন বুঝার জন্য সর্বপ্রথম কাজ হল আরবী ভাষাবিদদের দ্বারস্থ হওয়া, তাদের কাছ থেকে শেখা। আর এ জন্য তাঁদের উপর আস্থা রাখতে হবে।
'সফর' আর 'নফর' এর অর্থ ও পার্থক্য কি তা বুঝতে হলে একজন বাঙ্গালীকে 'কামূস' খুলতে হবে, যেতে হবে আল্লামা ফিরোজাবাদীর কাছে। ফিরোজাবাদীদের দ্বারস্থ না হয়ে বা তাঁদেরকে নির্ভরযোগ্য মনে না করে কোরআনের ঐ দু'শব্দ সফর নফরের অর্থ ও পার্থক্য রবী ঠাকুরের সাহিত্যে পাওয়া যাবে না। 'আকীমুস সালাত' -এর অর্থ বুঝতে হলে 'তাজুল আরূছ' অভিধানের সবক নিতে হবে। আল্লামা জুবায়দীদের কাছে ভাষা না শিখে কোরআন পড়তে গেলে ইকামতে সালাত অর্থ ইকালাতে সালাত বা নামায উৎখাত করা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আসলে এটা শুধু আরবী ভাষার ক্ষেত্রেই নয়। যেকোন ভিনদেশী ভাষা শেখার প্রথম ধাপ হল ভাষাবিদদের দ্বারস্থ হওয়া ও তাদের প্রণীত অভিধান পাঠ পর্যালোচনা করা। পবিত্র কোরআন যেহেতু আরবী ভাষায় অবতীর্ণ, সেহেতু কোরআন শরীফ বুঝার জন্য অবশ্যই নির্ভরযোগ্য আরবী ভাষাবিদদের প্রণীত আরবী অভিধানের সাহায্য নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত পবিত্র কোরআনের মূল তাফসীর বা ব্যাখ্যা হল হাদীস তথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর মূখনিঃসৃত বাণী, যা মুহাদ্দিসীনে কেরামের সৌজন্যে প্রাপ্ত। বুখারী শরীফ ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সঙ্কলন। নবীযুগের অনেক বছর পরে তাঁর জন্ম হওয়ার কারণে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কোন হাদীস পাওয়ার জন্য তাঁকে কমপক্ষে তিন জন মুহাদ্দিস বর্ণনাকারীর মাধ্যমে পেতে হয়েছে। বর্ণিত কোন হাদীস সঠিক বা নির্ভরযোগ্য হতে হলে ঐ তিনজন বর্ণনাকারী মুহাদ্দিস নির্ভরযোগ্য হওয়া শর্ত। এভাবে পুরো বুখারী শরীফ আমাদের নিকট তখনই গ্রহণযোগ্য হবে, যখন তার হাজার হাজার বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসগণের গ্রহণযোগ্যতা আমাদের কাছে প্রশ্নাতীত হবে এবং আল্লাহ্ তা'আলার অপার মহিমায় তা-ই আছে। বর্ণনাকারী হাজার হাজার মুহাদ্দিস প্রশ্নাতীতভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বলেই বুখারী শরীফ সর্বজন গৃহীত। পক্ষান্তরে কেউ যদি বলে বুখারী শরীফের বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসগণ গ্রহণযোগ্য নয়, তা হলে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, বুখারী শরীফ তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সহজ ভাষায় এভাবে বলতে হবে, যে হাদীসের বর্ণনাকারী যাবতীয় বৈশিষ্ট্যে নির্ভরযোগ্য তবে ঐ হাদীসও গ্রহণযোগ্য হবে এবং যে হাদীসের বর্ণনাকারী হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গুণাবলীর কোন অংশে বা পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়, তবে সে হাদীসের মানও সে আলোকেই নিরূপিত হবে। এবার আমরা এভাবে বলতে পারি, হাদীসের মাধ্যমে কোরআনের তাফসীর করতে গেলে মুহাদ্দিসগণের নির্ভরযোগ্যতার স্বীকৃতি আগে দিতে হবে। তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা অস্বীকার করলে যেহেতু হাদীসই নির্ভরযোগ্য থাকে না; সুতরাং সে হাদীস দিয়ে পবিত্র কোরআনের তাফসীর করা যাবে না।
তৃতীয়ত হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে শুরু করে প্রত্যেক যুগেই পবিত্র কোরআনের তাফসীরগ্রন্থ লিখা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সঠিক অর্থ অনুধাবনের জন্য সময়কে আলোকিত করা সে সকল তাফসীর গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করা অপরিহার্য। তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে রূহুল বয়ান, তাফসীরে রূহুল মা'আনী, তাফসীরে কুরতুবী'র মত নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থসমূহ আমলে না এনে কেউ তাফসীরে হাত দেয়া মানে হবে, অদ্ভুত! উটের পিঠে চড়ে মৃত্যুপুরীর অজানা গন্তব্যে চলা।
পবিত্র কোরআনের অর্থ বুঝার জন্য আরো অনেক মৌলিক বিষয়ের জ্ঞান থাকা দরকার যা এখানে বলা প্রাসঙ্গিক নয়। সঙ্গত কারণে আমি শুধু অভিধানবেত্তা, মুহাদ্দিস ও তাফসীর বিশারদদের প্রসঙ্গ আলোচনায় আনলাম এবং বক্তব্যের মূল সারাংশ এই যে, পবিত্র কুরআন বুঝার জন্য আরবী অভিধান পড়তে হবে, যার জন্য অভিধানবেত্তাদের উপর নির্ভর করতে হবে; হাদীসের বিশাল সম্ভার জানা থাকতে হবে এবং এ জন্য মুহাদ্দিসীনে কেরামদেরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে হবে এবং নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থগুলোর উপর গভীর দৃষ্টি রাখার জন্য তাফসীর বিশারদদের গ্রহণ করতে হবে।
এবার জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদূদীর ধারালো এবং ঝাঁঝালো একটা বক্তব্য লক্ষ্য করুন:
"উম্মতকে তামাম ফুক্বাহা, মুহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন আওর আইম্মায়ে লুগাত কো সা-কিতুল ই'তেবার ক্বরার দে-না তা কেহ্ মুসলমান কোরআনে মাজীদ কো সমঝনে কেলিয়ে উন্ কি তরফ রজূ- না করে-।"
অর্থাৎ: উম্মতের সকল ফক্বীহ্, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও (আরবী) ভাষাবিদদের বিবেচ্যহীন মনে করতে হবে, যাতে মুসলমান পবিত্র কোরআন বুঝতে গিয়ে তাদের প্রতি মনোনিবেশ না করে।"
তরজুমানুল কোরআন মনসবে রেসালাত: ১৫ পৃষ্ঠা
প্রিয় পাঠক মি. মওদূদীর উপরের বক্তব্যটি আরো একবার পড়ুন। উম্মত বলতে সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষকেই সাধারণত বুঝানো হয়ে থাকে, যা আমরা আগেই বলেছি। উম্মতের ফক্বীহ, মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরের মধ্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব, হযরত ওমর, হযরত ওসমান, হযরত আলী, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত ইবনে মাস'ঊদ, হযরত ইবনে ওমর, হযরত আয়েশা, হযরত মুযাহিদ, হযরত ইমাম আবূ হানিফা , হযরত ইমাম শাফে'ঈ, হযরত ইমাম মালেক, হযরত ইমাম আহমদ, হযরত ইমাম বুখারী, হযরত ইমাম মুসলিম, হযরত ইমাম তিরমিযী, হযরত ইমাম নাসাঈ, হযরত ইমাম আবূ দাঊদ, হযরত ইমাম ইবনে মাযাহ, হযরত বড়পীর আবদুল কাদের জীলানী, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী, হযরত মুজাদ্দেদী আলফেসানী, হযরত ইমাম তাবারী, হযরত ইমাম ইবনে কাসীর, হযরত ইমাম কুরতবী রদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু -এক কথায় সবাই উম্মতের মধ্যে শামিল। তাঁরা সবাই পবিত্র কোরআন নিয়ে কম বেশি কাজ করেছেন। তবে এই কাজ করতে গিয়ে তাঁরা এমনকি অপরাধ করলেন যার কারণে কোন মুসলমান কোরআন বুঝার ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি দৃষ্টি না দেয়ার পরামর্শ দিলেন মি. মওদূদী!
'সাকেতুল ইতেবার' শব্দটি একটি পারিভাষিক শব্দ। কোন ব্যক্তির ব্যাপারে এই ব্যবহার হলে এই অর্থ দাঁড়ায় যে, তার কথার কোন মূল্যই নেই বা তিনি কোন কথা বললে তা গ্রহণ করা যাবে না। আর ঠিক এই শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে উম্মতের সকল ফক্বীহ্, মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরের ব্যাপারে। তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, পবিত্র কোরআনের অর্থ বা তাফসীর বা অন্য কোন বিষয়ে হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু 'র কথার কোনও মূল্য নেই, হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু 'র কথার কোনও দাম নেই, হযরত ওসমান রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথার কোন মূল্য দেয়া যাবে না, হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্য গ্রহণ করা যাবে না। হযরত ইমাম আবূ হানিফা, হযরত ইমাম শাফে'ঈ, হযরত ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ এদের কোন দাম নেই। কোরআন বুঝার ক্ষেত্রে ইমাম বুখারী, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম ইবনে মাজাহদের কথার কোনও মূল্য নেই। তাঁরা সবাই 'সাকেতুল ইতেবার'।
সাহাবা-এ কেরামসহ তাবৎ পৃথিবীর ফক্বীহ, মুহাদ্দিস ও তাফসীর বিশারদদের প্রসঙ্গে এমন অপবিত্র কথা আলোচনা করার রুচিবোধ আমার নেই। কিন্তু তারপরও বাধ্য হয়ে এ কথাগুলো লিখতে হচ্ছে এ কারণে যে, একটি ইসলামী দলের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম করতে চান তার মুখের অপবিত্র বক্তব্য এটা! দেখুন, মওদূদী সাহেবের সাথে জমি-জমা বা টাকা-পয়সা নিয়ে আপনাদের মত আমারও কোন বিরোধ নেই। তবে কেন তার সাথে আমার বিরোধ? কত মায়ের সন্তান আজ মওদূদীর নাম শুনলে মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানায়, কত শিক্ষিতজনেরা মওদূদীর আদর্শকেই ইসলাম বলে বিশ্বাস করে, স্কুল কলেজের কত ছাত্র আজ মওদূদীর মিছিলের সক্রিয় সদস্য। তাদের প্রতি আমার আক্রোশ নেই, অনুকম্পা রয়েছে।
একবার ভাবুন তো, সিদ্দীক্ব-এ আকবর হযরত আবূ বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে মূল্যহীন ঘোষণা করে যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্লোগান বাতাসে ভাসছে, সে ইসলামের বাড়ি কোথায়? ফারূক্ব-এ আ'যম হযরত ওমর, হযরত ওসমান যুন্নূরাঈন, আসাদুল্লাহিল গালিব হযরত মাওলা আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমকে 'সাকেতুল ইতেবার' মনে করে আমাদেরকে কোন পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? বুখারী-মুসলিম-তিরমিযী-আবূ দাউদ-নাসাঈ-ইবনে মাজাহদের অবমূল্যায়ন করে সাকেতুল ইতেবার মনে করে মওদূদীর অপবিত্র কলম কাকে মূল্যায়ন করতে শিখেছে?
আমি জামায়াতের আদর্শে বিশ্বাসী ভাইদের নিরপেক্ষভাবে মওদূদী সাহেবের উক্ত বক্তব্যটি লক্ষ করার অনুরোধ জানাই। পবিত্র কোরআন বুঝার জন্য মি. মওদূদী চার শ্রেণীর লোককে সাকেতুল ইতেবার মনে করা জরুরি বলে বিশ্বাস করতেন এবং মানুষদেরকেও তার সবক প্রদান করেছেন: ১. উম্মতের সকল মুহাদ্দিস, ২. উম্মতের সকল ফক্বীহ্, ৩. উম্মতের সকল মুফাসসির এবং ৪. উম্মতের সকল (আরবী) ভাষাবিদ।
জামায়াতের সকল সদস্যের কাছে আমার প্রশ্ন উপরিউক্ত চার শ্রেণীভুক্ত লোকদের বাদ দিয়ে এমন কোন আলাদীনের চেরাগ আছে, যার দ্বারা কোরআনে কারীম বুঝা সম্ভব? সাহাবীদের মধ্যে অসংখ্য ফক্বীহ, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির সাহাবী ছিলেন। তামাম ফক্বীহ্, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির বলতে যেহেতু তাঁদেরকেও বুঝায়, সেহেতু খুব আগ্রহ নিয়েই জামায়াত সদস্যদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন করতে মনে চায়, জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা মওদূদী সাহেবের এই বক্তব্যের সাথে একমত কি-না। যদি না হন তবে এ রকম অপবিত্র বক্তব্য দেওয়ার কারণে মি. মওদূদী সাহেবের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কি তা জাতির সামনে স্পষ্ট করে প্রকাশ করা দরকার বলে আমি মনে করি, যা বিগত পাঁচ যুগেও আমরা পাইনি। বরং জামায়াতের সাহিত্যে মওদূদীকে ১৪০০ বছরের ইতিহাসে একমাত্র সফল মুজাদ্দিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার অর্থ জামায়াতে ইসলামী মওদূদীর বক্তব্যের সাথে একমত। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে খাঁটি মুসলমানদের আজ এ কথা বলার সময় এসেছে, যেই দলে সিদ্দীক্ব-এ আকবর হযরত আবূ বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কোন মূল্য নেই, ফারূক্ব-এ আ'যম হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কোন মূল্য নেই, হযরত ওসমান ও হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা'র দাম নেই, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ফক্বীহদের কোন মূল্য নেই, সেটা কোন মুসলমানদের দল হতে পারে না। আজ থেকে আট-নয় বছর আগে সেক্যুলার রাজনীতিতে বিশ্বাসী এক লোককে বলতে শুনেছি, 'জামায়াতে ইসলামী'তে সবই আছে, তবে ইসলাম নেই। মি. মওদূদীর উপরিউক্ত বক্তব্য পড়ে আমার কাছে ওই ব্যক্তির কথাটি সঠিকই মনে হচ্ছে।
এক্ষণে মি. মওদূদী সাহেবকে একটি প্রশ্ন করা খুবই সমীচিন মনে করি। উম্মতের এমন একজন লোক ছিলেন, যিনি একাধারে মুহাদ্দিস, ফক্বীহ্ ও মুফাসসির। তাঁর নাম হযরত যায়দ ইবনে সাবিত রদ্বিয়াল্লাহু আনহু। তাঁকেও মওদূদী সাহেব নিশ্চয়ই 'সাকেতুল ইতেবার' তথা অগ্রহণযোগ্য বা অবিবেচ্য মনে করেন। তাঁকে যদি সাকেতুল ইতেবার মনে করা হয়, তবে পবিত্র কোরআনও সাকেতুল ইতেবার তথা অগ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে। কারণ হযরত যায়দ ইবনে সাবিত রদ্বিয়াল্লাহু আনহু'র হাতেই পবিত্র কোরআন মাজীদ সংগৃহীত ও সঙ্কলিত হয়েছে। মওদূদী সাহেবের কাছে হযরত যায়দ ইবনে সাবিত রদ্বিয়াল্লাহু আনহু সাকেতুল ইতেবার হওয়ার কারণে তাঁরই হাতে সংগৃহীত ও সঙ্কলিত কোরআন যেহেতু অনিবার্যভাবেই 'সাকেতুল ইতেবার' হয়ে যায়; আর সাকেতুল ই'তিবার কোন কিতাব কোন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ হতে পারে না।
সেহেতু প্রশ্ন হল, মওদূদী সাহেবের প্রতিষ্ঠিত 'জামায়াতে ইসলাম'র ধর্মগ্রন্থের নাম কি!!! আসলে মওদূদীর বক্তব্যে এই যুগের সালমান রুশদী ও তাসলীমা নাসরিনদের প্রতিচ্ছায়াই দেখা যায়!
এ ছাড়া সকল মুহাদ্দিস 'সাকেতুল ইতেবার' হলে বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফসহ হাদীস শরীফের সকল কিতাবই তো 'সাকেতুল ইতেবার' হয়ে যায়। হায়! আফসোস!! বদ নসীব!!! জামায়াতের ভাগ্যে বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফসহ সিহাহ্ সিত্তাহর কোন কিতাবই নেই। সা'ঈদীর মাহফিলে এই কারণেই হয়তো কোন তাফসীর বা হাদীসের কিতাবের রেফারেন্স থাকে না। আর যেই দলে তামাম মুহাদ্দিস, ফক্বীহ ও মুফাসসির 'সাকেতুল ইতেবার' সেই দলে সাঈদীর মত লোকেরা মুফাসসির হতেই পারে! এবং এই একই কারণে জামায়াতের প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে এ পর্যন্ত দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মত কিছু চাটুকার এবং কামাল জাফরীর মত কিছু দালাল ব্যতীত কোন হক্কানী আলিমের সমর্থন জামায়াতের ভাগ্যে জোটেনি।
কারণ, জামায়াতের ঘরে সাহাবী থেকে শুরু কোন অলি-গাউস-কুতব, মুহাদ্দিস, মুফাসসিরই জায়গা পায় নি। তাদের হলুদ চশমায় মি. মওদূদী ছাড়া পরিপূর্ণ ঈমানদারই বা কোথায়? ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ভারত থেকে প্রকাশিত জামায়াতের মাসিক পত্রিকা 'জিন্দেগী'তে জামায়াতের এক সদস্য লিখেছেন, 'জামায়াতের সাহিত্য পড়ে আমার মধ্যে যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, তাতে এখন আমি সাহাবাদের পরে আজ পর্যন্ত মওদূদী সাহেব ব্যতীত অন্য কাউকেই পরিপূর্ণ ঈমানদার মনে করি না।" আস্তাগফিরুল্লাহ্! ঐ একই পত্রিকায় একই ব্যক্তি আরো লিখেছেন, "আমি খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর মতাদর্শকে ভুল মনে করি। উম্মতের বড় বড় প্রসিদ্ধ মনীষীরা পরিপূর্ণ ঈমানদার কি-না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।" পাঠক, এই হল জামায়াতের আসলরূপ!
জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ-৫
সব কিছুরই একটা নেগেটিভ এবং পজেটিভ দিক আছে। ভাষা প্রয়োগ, পরিপ্রেক্ষিত, অঙ্গভঙ্গী ইত্যাদির আলোকে সহজেই বুঝা যায় এ কথাটা নেগেটিভ না পজেটিভ। মনে করুন, কারো ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি কেমন? আপনার জবাবটা যদি এমন হয়, হ্যাঁ তিনি খুব ভালো' তাহলে যা বুঝাবে, আপনার উত্তরটা যদি হয় এমন, 'যা দেখি তাতে তো ভালোই মনে হয়।' তাহলে নিশ্চয়ই এটুকু অন্য রকম বুঝাবে। এই 'অন্য রকমটাকেই নেগেটিভ বলা হয়। প্রথম জবাবে যেমন 'ভালো' দ্বিতীয় উত্তরেও ভালো। তবে প্রথমবারের ভালো আলোয় আলোকিত কিন্তু দ্বিতীয়বারের 'ভালো'য় আড়ালেও যেন 'অদ্ভুত' আঁধার এক। আসলে কোন প্রকার চরিত্র নেগেটিভ না পজেটিভ গুণীজনদের কাছে তা বুঝা যতটা সহজ বুঝানো ততটা সহজ নয়। শরবতের মধ্যে মিষ্টির অস্তিত্ব যেমন অনুভব করা যায় অথচ তা দেখানো যায় না। কথার মধ্যেও দু'টি চরিত্রের যে কোন একটি চরিত্র অনুভব করা যায় কিন্তু তা সহজে বুঝানো যায় না। তবে ঐ কথার বিচার করতে হলে তার চরিত্রটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। নতুবা সে বিচার সঠিক হবে না। 'রায়েনা' একটি আরবি শব্দ। তার একটি ভালো অর্থ এবং একটি খারাপ অর্থ আছে। ঐ শব্দটি এক সময় নবীজীর জন্য মুসলমান অমুসলমান সকলেই ব্যবহার করত। তবে মুসলমান যাঁরা এ শব্দ ব্যবহার করতেন তারা পজেটিভ অর্থেই ব্যবহার করতেন। কিন্তু কাফেরদের অঙ্গভঙ্গী এবং পরিপ্রেক্ষিত এ কথার জানান দিচ্ছিল যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম'র শানে তারা এ শব্দটিকে নেগেটিভ অর্থে ব্যবহার করছে যা আল্লাহ পাকের কুদরতী রাডারে ধরা পড়েছে! ব্যাস, বিকল্প হিসেবে 'উনজুরনা' শব্দের তালিম দিয়ে মুসলমানদের উপর অনন্তকালের জন্য এ শব্দ ব্যবহার করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই হল শব্দের নেগেটিভ চরিত্রের কুফল। মোবাইল ফোন প্রথম যখন বাংলাদেশে আসে মনে করুন তখনকার কোন গ্রাম্য কিশোর যদি তার বন্ধুকে; এই শুন, আমার আব্বুর এখন মোবাইল আছে! মানে গ্রামের হাজারো বাবার হাতে যা নাই আমার বাবার হাতে তা আছে বলাই উদ্দেশ্য। কিন্তু তাঁর মুখের উপরই ওই বন্ধু যদি বলে দেয়; 'হ্যাঁ, আমার ভাইয়ার হাতেও ক্রিং ক্রিং বাজে। এই ক্রিং ক্রিং অর্থ মোবাইল আছে এবং এর চরিত্র হলে নেগেটিভ। অর্থাৎ দ্বিতীয় বন্ধুর বাবার মোবাইলের একক কৃতিত্বকে অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে। আহলে সুন্নাতের ওলামায়ে কেরাম, 'রাহমাতুল্লিল আলামীন হওয়ার একক গৌরব যখন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর জন্য বিশ্বাস ও প্রচার করতে অভ্যস্ত ঠিক তখনই হুমায়ুন আহমদের নাটকের সৎ মায়ের নেগেটিভ চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ভারতের মৌঃ রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ফতোয়ায়ে রশীদিয়ায় লিখে বসল, 'রাহমাতুল্লিল আলামীন' আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম'র একক বৈশিষ্ট্য নয়; বরং তিনি ব্যতীত অন্যদের ক্ষেত্রেও 'রাহমাতুল্লিল আলামীন' বলা যাবে। অর্থাৎ নবীজীর শান মান মর্যাদার ক্ষেত্রে সুন্নীরা পজেটিভ এবং ওয়াহাবীদের গুরু রশীদ আহমদের মানসিকতা হল নেগেটিভ। তাদের আরেকজন গুরুর নাম মৌঃ আশরাফ আলী থানভী। অন্তর ভরা প্রেম নিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ওলামায়ে কেরাম যখন প্রিয় নবী রাসুলে মকবুল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ইলমে গায়েব তথা খোদা প্রদত্ত অদৃশ্য জ্ঞান আছে বলে আশেকানা মতামত প্রদান করল ঐ আশরাফ আলী থানভী তখন বলে উঠল; ঐ রকম জ্ঞান তো পাগল ছাগল, জীব-জন্তু তথা শুকুর-কুকুরেরও আছে। (হিফজুল ঈমান) নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর অদৃশ্য জ্ঞানকে যারা শুকুর-কুকুরের জ্ঞানের সাথে তুলনা করে-রুচিপূর্ণ পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে হয়ত পারছি না-নয়ত এদেরকে-শুকুর কুকুরের বাচ্চা বললেই আমার কাছে ভাল লাগত। কারণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি আমাদের যে অনিঃশেষ ঈমানী দায়বদ্ধতা আছে।।
আমাদের ছোট বয়সে যখন গ্রামে থাকতাম তখন স্কুলে সাইকেল প্রতিযোগিতা হত। হিরো সাইকেলের প্রতিযোগিতা। কারণ বিভিন্ন কোম্পানির সাইকেল হলে এমনটি বলার সুযোগ আছে যে, অমুকের সাইকেল ঐ কোম্পানীর হওয়ায় রেজ ভালো, তাই সে উইন করেছে। তাই একই কোম্পানির সাইকেল হলে আর সে কথা বলার অবকাশ নাই। তারপরও হিংসাপরায়ন প্রতিযোগী পরাজয়ের আগুনে পুড়ে বলে ফেলত; আরে না জুনাব আলী ছোকরা ঐ বাম সাইডে ছিল যেখানে ঘাষ বিহীন শুকনো এটেল মাটির সমান মাঠ ছিল। আমি ছিলাম ডান পাশে যেখানে বালু মাটির উপর ঘাসে ভরা মাঠ ছিল। তাই জুনাব আলীর ছোকরার সাথে আমি পারিনি। আমার মত ডান পাশের বালুর উপর ঘাসের মাঠে আসলে ঐ জুনাব আলীর পোলার সাইকেলের কচ্ছপগতি দেখে গ্যালারির দর্শকদের হাসিতে পেটের চামড়া ব্যথা হয়ে যেত। অর্থাৎ পরাজয় আর হিংসার প্রাবাল্য এতই বেশি যে, সাইকেলের উপর গতিমান নওজোয়ান বিজয়ী ব্যক্তির কৃতিত্বকে যে কোন অবস্থায় মেনে নিতে পারছে না বিধায় সাইকেলের নিচে নির্জীব মাটিতে কৃতিত্ব দিয়ে প্রতিহিংসার অগ্নিগ্রহণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। মানে এটা এটেল মাটির বিজয়। জুনাব আলীর ছেলের কৃতিত্ব নয়। পাঠক সাইকেল প্রতিযোগিতা তাজা গল্পটি ভুলে না যেতেই আরেকটি গল্পের ভাষা শুনুন-প্রথমে উর্দুতে তারপর বাংলায়- "নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কো আরব মে জু যবরদস্ত কামিয়াবী হাসেল হুয়ী ইস্ কি ওযাহ্ এহী তু থি কেহ্ আফ্ কো আরব মে বেহ্তরীন ইনসানী মাওয়াদ মিল্ গিয়া থা। আগার খোদা নাখাস্তাহ্ আফ কো বোদে, কমহিম্মত যঈফুল ইরাদা আওর না কাবেলে ইতেমাদ লোঁগো কি ভীড় মিল্ জাতী তু কিয়া ফেরভি উহ্ নাতায়েজ নিকাল সেকতে থে?
উর্দু ভাষার গল্প ছিল এটি। এবার বাংলা ভাষায় গল্পটি লক্ষ করুনঃ 'আরব দেশে নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর যে সুবিশাল সফলতা অর্জিত হয়েছে তা একমাত্র আরব দেশে তিনি যোগ্য মানব শক্তি পেয়েছেন বলেই সম্ভব হয়েছে। আল্লাহ না করুন, তিনি যদি (তদস্থলে) কাপুরুষ, ভীতু, দুর্বল মানসিকতা সম্পন্ন এবং অনির্ভরযোগ্য লোকদের সমাগম পেতেন তবে কি অবশেষে এমন ফলাফল পাওয়া যেত?
এই ছিল উর্দু গল্পের বাংলা অনুবাদ। সাইকেল প্রতিযোগিতার গল্পটি ভুলে না গেলেই ভাল হয়। কারণ প্রতিহিংসু মানুষের কাছে জীবন্ত বীরের চেয়ে অসাড় এটেল মাটির কৃতিত্বই বেশি। নেগেটিভ এবং পজেটিভ এর যে জটিল অনুশীলনীর আলোচনা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে তাও এই গল্পটির চরিত্র বুঝাবার জন্যই। গল্পটির চরিত্র আমাদেরকে যে সবক প্রদান করছে তা হল, ইসলামের সুমহান বিজয়ের পেছনে যত কৃতিত্ব তা মোটেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর নয়; তা আরব দেশের ঐ যোগ্য লোকদের। কারণ তাদের স্থলে যদি দুর্বল কাপুরুষ লোকদের সমাগম হত তবে কখনই নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই সফলতা অর্জন করতে পারতেন না। এটাই হল ঐ গল্পকারের আক্বীদা ও বিশ্বাস। মানে সাইকেল চালক প্রতিযোগীর পাওনা জিরো-কৃতিত্ব সব ঐ নির্জীব এটেল মাটির।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সফল- এই কথা বলতে বেচারা গল্পকারের কলিজার নার্ভগুলো ছিড়ে যাচ্ছে বলেই গোবেচারা বাধ্য হয়ে ইসলাম প্রচারের পুরো কৃতিত্ব জাহেলিয়াতের অন্ধ মানুষগুলোকে হেবা করে দিয়েছেন। কি আর করা, জাহেলিয়াতের মানুষগুলোকে 'বেহ্তরীন ইনসানী মাওয়াদ' না বললে যে ইসলাম প্রচারের সফলতা ও কৃতিত্বের সম্মানটুকু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষে চলে যায়!
গল্পকার জীবন গেলেও এই সম্মানটুকু উনাকে দিতে নারাজ!! সেজন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান ও গৌরবের মালা আরবের অন্ধকার যুগের মানুষদের গলায় পরিয়ে দিলেন!!!
প্রিয় পাঠক, ঐতিহাসিকগণ ইসলাম পূর্ব জাহেলী যুগের মানুষগুলোকে মানুষরূপী পশুর সাথে তুলনা করেছেন। যে মানুষগুলোকেই গল্পকার 'বেহ্তর' তথা উত্তম বললেন। কিন্তু কেন? কারণ, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সম্মান না দেয়ার জন্য এই রকম গল্পকাররা জাহেলী যুগের মানুষদেরই নয় শুধু- জানোয়ারকেও মহামানব বানাতে প্রস্তুত আছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে অসম্মান করাই তাদের অন্তরের অগ্নিদহনের মহৌষধ। 'বেহ্তরীন ইনসানী মাওয়াদ' ছিল বলেই এই সফলতা। 'বেহ্তরীন ইনসানী মাওয়াদ' না হলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম চাইলেও বা চেষ্টা করলে ঐ সফলতা অর্জন করতে পারতেন না। প্রশ্ন হল, 'বেহ্তরীন ইনসানী মাওয়াদ' না হয়ে যদি দুর্বল, কাপুরুষ লোকজন হত তবে আল্লাহ পাক চাইলে উত্তম সফলতা পাওয়া যেত কিনা। গল্পকার নিশ্চয়ই বলবেন হ্যাঁ। পাওয়া যেত। কারণ, আল্লাহ চাইলে সব কিছুই হয়। তাহলে প্রশ্ন হল বেহতরীন ইনসানী মাওয়াদের ক্ষেত্রে যে সফলতা পাওয়া গিয়েছে সেখানে আল্লাহ পাকের ইচ্ছা বা চাওয়া-পাওয়া ছিল কি না। যদি ছিল না বলেন তাহলে তো গল্পকারের ধর্মই থাকে না! কারণ আল্লাহর সিদ্ধান্তের বাইরে কোন কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করা কুফরী। আর যদি হ্যাঁ বলেন, তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, সেখানে আল্লাহর ইচ্ছাই কি মূখ্য ছিল না ঐ বেহতরীন ইনসানী মাওয়াদদের ভূমিকা। তাঁদের ভূমিকাকে মুখ্য বললেও গল্পকারের ধর্ম চিতাস্থলে চলে যাবে। তাহলে সর্বশেষ কথা ঐ দাঁড়াল যে, সেখানে আল্লাহর ইচ্ছাই মুখ্য ছিল। তাহলে সেক্ষেত্রে বেহতরীন ইনসানী মাওয়াদের জায়গায় আল্লাহর মেহেরবাণীতে এই সফলতা অর্জিত হয়েছে বললে ভাল হত না? কারণ, আল্লাহ পাকের ইচ্ছা না হলে যে ঐ বেহতরীন ইনসানী মাওয়াদরা শত চেষ্টা করলেও কিছু হয় না। এবং যদি তাই হয় তবে তো আল্লাহর ইচ্ছা হলে ঐ দুর্বল, কাপুরুষ ও দুর্বল মানসিকতার লোকদেরকে দিয়েও আরও বড় সফলতা আসতে পারে। নবী-অলীদের কোন কাজ করার ক্ষমতা সাব্যস্ত করা যাদের দৃষ্টিতে শিরক এবং সে কারণেই তারা এই বলে ফতোয়া প্রদান করে যে, যা কিছু হয় তার সবই আল্লাহর ক্ষমতা বলে হয়- আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ কোন কিছু করার ক্ষমতা রাখে না- সেই ধরণের গল্পকাররাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সফলতার সম্মানটুকু না দেয়ার জন্য আল্লাহর সেই ক্ষমতার কথা বেবাক ভুলে গিয়েছেন এবং যেখানে আল্লাহ ছাড়া কোন নবী-অলির জন্য কোন কাজ করার ক্ষমতাকে শিরক বলেন সেখানে নিজেরাই নবীদের থেকে অনেক নিম্নস্তরের লোকদের জন্য অর্থাৎ বেহতরীন ইনসানী মাওয়াদদের জন্য বিরাট সফলতার কাজটি করার ক্ষমতা মেনে নিলেন!!! ইস্ বড় সর্বনাশ হয়ে গেল! নবীর ক্ষমতায়নের শিরক থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে গল্পকার নবীর গোলামকে আল্লাহর শরিক বানিয়ে দিল! গোলাম থেকে যে মুনিব ভাল গল্পকার কেন যে তা বুঝতে পারল তাই ভাবনার বিষয়! গল্পকারকে নিয়ে এত কথা হল অথচ গল্পকারের নামটাই বলা হল না এখনও বড্ড দেরী হয়ে গেল। তাই শেষ করার আগে গল্পকারের নামটা বলে দেওয়া জরুরি। ঐ গল্পকারের নাম মি. আবুল আলা মওদুদী যিনি জামায়াতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা। উক্ত গল্পটি তার কিতাব তাহরীকে ইসলামী কি আখরাকী বুনিয়াঁদের ১৭ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত।
জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ-৬
হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তাওরাতের একটি কপি নিয়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, এটা পবিত্র তাওরাত একথা বলেই হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু উক্ত তাওরাত থেকে পড়তে শুরু করলেন। হযরত ওমর যতই পড়ছিলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র চেহারার রং ততই পরিবর্তিত হতে লাগল। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সে দিকে খেয়াল করছিলেন না। রাগের আতিশয্যে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র চেহারার পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পেরে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলে উঠলেন ওমর, তুমি তো বরবাদ হতে চলেছ, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর চেহারাই পাকের দিকে তাকিয়ে দেখ। একথা শুনে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পবিত্র চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করেই সাথে সাথে আরয করতে লাগলেন, আমি আল্লাহ পাকের নিকট তাঁর অসন্তুষ্টি ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর অসন্তুষ্টি থেকে পরিত্রাণ কামনা করছি। আমরা আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে এবং বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে সানন্দে গ্রহণ করেছি। অতঃপর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, "ধরে নাও যদি কখনও হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম তোমাদের কাছে আসে, আর আমাকে বাদ দিয়ে তোমরা হযরত মুসা আলাইহিস্ সালামের অনুসরণ কর তবে নিশ্চয়ই তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, এই যুগেও যদি হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম আসে এবং আমার নবুওয়াত পায় তবে আমার অনুসরণ না করে হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম এর গত্যান্তর থাকবে না। [দারেমী শরীফ, মেশকাত শরীফ পৃষ্ঠা-৩২]
উপরিউক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা স্পষ্টই বুঝা গেল, আমাদের নবী রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর উপর ঈমান না এনে তাঁকে স্বীকৃতি না দিয়ে অন্য কোন নবীর উপর ঈমান আনলেও তাতে ঈমানদার হওয়া যায় না তথা হেদায়ত পাওয়া যায় না বরং তাতে সে বেঈমানই থেকে যায়। কারণ রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই হলেন কুফর এবং ঈমান এ দুয়ের কষ্টিপাথর। যারা তাঁকে মানে তাঁরা ঈমানদার এবং যারা মানে না তারা বেঈমান। বুখারী শরীফের হাদীসে তাই বলা হয়েছে 'মুহাম্মদুন ফরকুন নাইনান নাস' অর্থাৎ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই হলেন মানুষের মধ্যে পার্থক্যকারী। অর্থাৎ তার স্বীকৃতিদাতারা হবেন ঈমানদার এবং তাকে অস্বীকৃতি প্রদানকারীদের বলা হবে বেঈমান। তাঁকে স্বীকার না করে অন্য নবীগণের স্বীকৃতি দিলেও সে ঈমানদার হবে না বরং বেঈমানই থেকে যাবে। আর বেঈমানের জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নাম। পবিত্র কুরআনে সূরা আলে ইমরানের ৮৮ নং আয়াতে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন বলেন, 'তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী, তাদের শাস্তি হাল্কা বা সহজ করা হবে না।'
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! উপরিউক্ত হাদীস শরীফ ও পবিত্র কুরআনের আয়াতের আলোকে আমরা যা বুঝতে পারলাম তা হলে কোন ব্যক্তি আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর স্বীকৃতি না দিয়ে অন্য নবীগণের উপর ঈমান আনলেও সে বেঈমানই থেকে যাবে এবং তার জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নাম। তার শাস্তি হালকা করা হবে না। কুরআন ও হাদীসের কথা শুনার পরে এবার জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি: মওদুদীর ভাষণ শুনুন- বরাবরের মত প্রথমে উর্দুতে এবং পরে বাংলায় 'জো লোগ্ জেহালত ও নাবিনায়ী কে বাইছ রাসূলে আরাবী কি ছাদাকাত কে ক্বায়েল নেহী হ্যাঁ, মগর আম্বিয়ায়ে ছাবেকীন পর ঈমান রাখতে হ্যাঁয় আওর ছালাহ্ ও তাকওয়া কি জিন্দেগী বছর করতে হ্যায় উন কো আল্লাহ কি রহমত কা ইতনা ইচ্ছা মিলেগা কেহ্ উনকি ছাজা মে তাযকীক হো জায়েগী।' [তাফহীমাত ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৮]
'যারা মূর্খতা ও অন্ধত্বের কারণে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সত্য বলে স্বীকার করে না। তবে পূর্ববর্তী নবীগণের উপর ঈমান রাখে এবং পরিশুদ্ধ ও তাক্বওয়ার জীবন যাপন করে তারা আল্লাহর রহমতের এতটুকু হিস্সা লাভ করবে যা দ্বারা তাদের শাস্তি হাল্কা হয়ে যাবে।
প্রিয় পাঠক, মওদুদীর উল্লিখিত কথাটির ধার অত্যন্ত ভয়ংকর আমার মনে হয় এবং আমি বিশ্বাস করি তার এই বক্তব্য পড়ার পর কোন সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তি জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করতে পারে না। তাই মওদুদীর এই বক্তব্যটিকে আমি কয়েকটি অনুচ্ছেদে আলোচনা করতে চাই :
প্রথমত : ইতিপূর্বে পবিত্র কুরআনের আলোকে ও পবিত্র হাদীসের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সত্য বলে বিশ্বাস না করে অন্যান্য নবীদের উপর ঈমান আনলেও কাউকে মুসলমান বলা যাবে না এবং সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। তার শাস্তি কখনো হবে না। অথচ মওদুদীর বক্তব্য তার উল্টো। অর্থাৎ তার মতে তার শাস্তি হালকা করা হবে! (নাউযুবিল্লাহ্)
দ্বিতীয়ত : ইসলাম ধর্মে কোন বেঈমানকে মুত্তাক্বী বলা যায় না। কারণ তাকওয়ার সম্পর্ক আমলের সাথে। একজন লোক ঈমান গ্রহণ করার পর যখন নেক আমল করতে থাকে তখন তাঁর তাকওয়া অর্জিত হয় এবং তাঁর আমলগুলো আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। সে কারণেই পবিত্র কুরআনের সূরা ইউনুসের ৬৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ পাক ঈমান গ্রহণ করার পর তাকওয়া অর্জন করার কথা বলেছেন। সুতরাং বুঝা গেল, তাকওয়ার সম্পর্ক ঈমানের সাথে। ঈমান না থাকলে তাকওয়ার প্রশ্নই আসে না। এটাই ইসলাম ধর্মের মৌলিক নীতি। তবে মওদুদীর ধর্ম এর বিপরীত। তার ধর্মে নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সত্য বলে বিশ্বাস না করেও তাকওয়ার জিন্দেগী বসর করা যায়। (মুত্তাকী হিসেবে জীবন যাপন করা যায়)। মওদুদীর ধর্মের নতুন পরিভাষা এটা। মুত্তাকী কাফের বা বেঈমান পরহেজগার। এ রকম পরিভাষা শুনে চিড়িয়াখানার বানরও হাসবে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন বেঈমানকে বা কাফেরকে কেউ মুত্তাকী বলেছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সত্য বলে স্বীকার না করেও যদি তাকওয়া অর্জন করা যায় তবে এটা তো ইহুদি, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য মুত্তাকী হওয়ার সহস্রাব্দের সেরা সিকাউন্ট অফার! মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যিনি ইসলাম ধর্মের নবী তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন না করেও যারা মুত্তাকী হতে চায় তারাতো অতিসত্বর জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদুদীর সাথে যোগাযোগ করে বেঈমান হয়ে যাবে। আল্লাহ তাদেরকে হেফাজত করুন! প্রিয় পাঠক, বিধর্মীরা এমন নোসখা পেলে সিএনএন অথবা বিবিসিতে প্রচার করার জন্য তৎপর হবে না তো?
তৃতীয়: মওদুদীর উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে বুঝা যায়; আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সত্য বলে বিশ্বাস না করেও তাকওয়া অর্জন করা যায় এবং আল্লাহর রহমত পাওয়া যায়। বাহ্ কি চমৎকার মওদুদী ধর্ম! তার মতে নবীকে অবিশ্বাস করা তাকওয়া অর্জন করা ও রহমত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে না। এটা হল শতাব্দির সেরা কৌতুক! মহান রাব্বুল আলামীন আপন হাবীবকে পৃথিবীতে পাঠালেন এবং সমগ্র সৃষ্টিকে তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ফরজ করে দিলেন। অথচ সেই নবীকে বিশ্বাস না করলেও আল্লাহ পাক কাউকে রহমত দিয়ে দেবেন! কাউকে মুত্তাকী বানিয়ে দেবেন!! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের অর্থাৎ যেখানে কাফেরের পরিপূর্ণ শাস্তি পাওয়া অবধারিত বিধান সেখানেও একটি বিশেষ কারণে শাস্তির মাত্রা হালকা করে দেয়া হবে মর্মে হাদীস শরীফে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রশ্ন হল কি সেই বিশেষ কারণ? মি. মওদুদীও একটি বিশেষ প্রক্ষাপটে আযাব হালকা হওয়ার তথ্য দিয়েছে। মওদুদীর প্রদর্শিত সেই কারণই কি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত? না মোটেই নয়। বরং বলতে পারেন বিষয়টি পুরোপুরি উল্টো। তাই তা তার মনগড়া। শাস্তি হালকা করণ মর্মে মওদুদীর প্রদর্শিত কারণের ঠিক বিপরীত বিষয়ের উল্লেখ আছে হাদীসে পাকে। লক্ষ্য করুন, মওদুদীর বক্তব্য হল, অপরাপর নবীগণের উপর ঈমান এনে তাকওয়ার জীবন নির্বাহ করলে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর উপর ঈমান না আনলেও শাস্তি হালকা হয়। সংক্ষেপে বলতে পারি, মওদুদীর মতে শাস্তি হালকা করা হবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সাথে অসংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও। পক্ষান্তরে হাদীসের ভাষ্যমতে জাহান্নামে কাফেরদের শাস্তি হালকা করণের ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর তাও একমাত্র আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সংশ্লিষ্টতার কারণে। আবু লাহাব ও আবু তালেবের ক্ষেত্রে শাস্তি হালকা করণের কথা বুখারী শরীফে আছে এবং তা আবু লাহাবের ক্ষেত্রে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের পৃথিবীতে শুভাগমনের কারণে আনন্দের কারণে আর আবু তালেবের ক্ষেত্রে কাফেরদের আক্রমণ থেকে নবী পাককে নিরাপদ করার কারণে। অর্থাৎ উভয়টিই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণেই। তাহলে বিষয়টা দাঁড়ায় এরকম, জাহান্নামে কাফেরদের আযাব হালকা করার কারণ- ইসলামের মতে নবীর সংশ্লিষ্টতা আর মওদুদীর মতে নবীর সাথে অসংশ্লিষ্টতা! মহানবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর উপর ঈমান আনা ফরজ করেছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামীন। সূরা ফাতাহর ১৩নং আয়াতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর উপর কেউ ঈমান না আনলে তাকে কাফের আখ্যায়িত করে তার জন্য জ্বলন্ত আগুনের শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। এমন কাফের বেঈমানকে রহমত প্রদান করলে অথবা তার শাস্তি হালকা করে দিলে প্রকারান্তরে প্রতিশ্রুতি যেমন ভঙ্গ করা হয়। সাথে সাথে নবীকেও অপমান করা হয়। অথচ আল্লাহ পাক নবীকে অপমান করবেন না মর্মে সূরা তাহরীমের ৮নং আয়াতে এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না মর্মে অসংখ্য আয়াতে ঘোষণা দিয়েছেন। দুই বন্ধুর একজনকে উপেক্ষা করে দ্বিতীয় বন্ধুর কাছে করুনা কামনা করা নির্লজ্জ বেহায়া মানুষের কাজ। মূলত আমার বন্ধুকে যে অবজ্ঞা করবে আমি কখনই তাকে পুরস্কৃত করব না। কারণ, তাতে আমার বন্ধুকে অপমান করা হয়। আল্লাহ পাকও তাঁর প্রিয় হাবীবকে উপেক্ষা করলে কাউকে পুরুস্কৃত করবে না। এটাই শেষ এবং চূড়ান্ত কথা।
চতুর্থত : সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! এবার একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলব। ইসলামের মৌলিক নীতিমালা এই যে, কাফের তথা বেঈমান যত ভাল কাজই করুক না কেন- তার ভাল কাজের বদলা সে পৃথিবীর জীবনেই ভোগ করে নেয়। এখানেই তার শেষ। আখিরাতে তার কোন প্রতিদান সে পাবে না। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী। জাহান্নামে তার জন্য নির্ধারিত শাস্তি পরিপূর্ণভাবেই সে পাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত এবং অসংখ্য হাদীস ইসলামের এ বিষয়টিকে মৌলিক নীতিমালার মর্যাদা দিয়েছে। তবে হাদীসের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি থেকে এ মহান সত্যটিও প্রমাণিত যে একটি বিশেষ কারণে ব্যতিক্রম হিসেবে ওই অপরটিকে বিশেষ বিবেচনায় আনা হয়েছে মাত্র।
মোটকথা, আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের হিস্সা পেতে এবং আযাব থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর উপর ঈমান আনার আবশ্যকীয়তাকে অস্বীকার করার জো নেই। প্রিয় পাঠক, এই হল জামায়াতে ইসলামীর তথাকথিত ইসলামের নমুনা! আমি আমার লেখার ৫ম সিরিজে বলেছিলাম, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সম্মান না দেয়ার জন্য যত ধরণের বাহানা বা অভিনয় দরকার তার সবই করতে মওদুদী সাহেব প্রস্তুত। মাফ করবেন, রাজনীতিক আলোচনা হিসেবে নয়- সাম্প্রতিক বিষয় বলেই উল্লেখ করছি, আমাদের দেশে গত কয়েক মাস থেকে 'মাইনাস টু' নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি 'মাইনাস টু' বলতে যা বুঝি তা হল, দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে রাজনীতি। তবে মওদুদী সাহেবের উক্ত বক্তব্য পড়ে কেউ যদি তার মাইনাস ওয়ান এর এজেন্ডার ধারণা গ্রহণ করে তবে তা অসঠিক হবে বলে মনে হয় না। কারণ, মওদুদীর বক্তব্যে অপরাপর সকল নবীর কথাই আছে- একজন ব্যতীত। কারণ তার মতে, তাক্ওয়া, রহমত ও আযাবে হ্রাস প্রাপ্তির জন্য অন্যান্য নবীগণের উপর ঈমান ও তাদের শরীয়ত মতে আমল করা যথেষ্ট, আমাদের নবীর উপর ঈমান তাঁর শরীয়তের উপর আমল করা জরুরী নয়। নাউযুবিল্লাহ। এখানেও তাহলে বিগ হেডলাইনটা হবে এরকম। আমাদের দেশীয় রাজনীতির বর্তমান এজেন্ডা হল 'মাইনাস টু' তথা দুই নেত্রী বিহীন রাজনীতি আর জামায়াতে ইসলামীর চিরস্থায়ী এজেন্ডা হল মাইনাস ওয়ান তথা রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিহীন ইসলাম। আমার বিশ্লেষণের যথার্থতার প্রমাণ বুঝার জন্য মওদুদীর বক্তব্যটি আরও একবার পড়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ-৭
বাম লেখক বদরুদ্দীন উমর লিখেছিল, বেতঝড়ের ভেতর থেকে বুঁ বুঁ করে মৌমাছিদের বেরিয়ে আসতে দেখলে বুঝতে হবে, তোমার ঢিলটা সুনির্দিষ্ট জায়গায়ই আঘাত করেছে। অপরিচিত নাম্বার থেকে জামায়াতে ইসলামীর অপরিচিত সদস্যরা মাঝে মধ্যে আমাকে যে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে তাতে বদরুদ্দীন উমরের কথাই মনে পড়ছে আমার। কোন লেখার জন্য কাউকে হুমকি দেয়া আদর্শিক দুর্বলতার প্রমাণ। তরজুমানের শ্রদ্ধেয় মনসুর ভাই ফোনে আমাকে বলেছেন, জামায়াতের কেউ কেউ প্রশ্ন করছে, আমি জামায়াত-সাহিত্য থেকে যে রেফারেন্সগুলোর দিচ্ছি, সেগুলো সঠিক কি-না। আমি মনে করি, এটা আমার প্রাথমিক সফলতা। কারণ, রেফারেন্সগুলোর বিষয়বস্তু ও ভাষা দেখে ওই সকল প্রশ্নকারীর মনে প্রশ্ন জেগেছে এ রকম জঘন্য কথা জামায়াত-সাহিত্যে আছে কি-না! এ রকম প্রশ্নকারীর সংখ্যা যত বাড়বে ততই তা আমার জন্য সুখকর হবে। বলতে পারেন, জামায়াতের সকল কর্মী-সমর্থক যদি এ রকম একটা প্রশ্ন করত যে, আপনি যে রেফারেন্সগুলো উল্লেখ করছেন এ গুলো অথেন্টিক কি-না, তবে আমি আমার চূড়ান্ত সফলতার খুব কাছাকাছি পৌঁছে যেতাম। কারণ, তখন পাঠকের কাছে আমার আরো বলার সুযোগ হত, আসুন! যে রেফারেন্সগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো যদি অসত্য হয়, তবে আসুন এ রকম বদ-আক্বীদাসম্পন্ন জামায়াতে ইসলামীকে সবাই পরিত্যাগ করি।
আসলে বাতিলদের এটা একটা বড় আলামত। তাদের মুরুব্বীদের রেখে যাওয়া বিষাক্ত কাজ ও বক্তব্যগুলো বলা হলে তাদের গায়ে আগুন জ্বলে উঠে। এ যুগের বাতিলদের এটা ব্যতিক্রমী অভ্যাস। কারণ, পৃথিবীতে সাধারণ রীতি হল, আমি যাকে ভালবাসব তার সকল কাজ ও কথার সাথেই আমার প্রেমের মধুর সম্পর্ক থাকবে এবং যতবারই আমাকে তা শুনানো হবে ততবারই আমি তা শুনতে চাইব। কিন্তু বাতিলদের দেখছি, একটু আলাদা।
রামগঞ্জ এক মাহফিলে মওদূদীর একটা বক্তব্য উদ্ধৃত করার সাথে সাথেই হুঙ্কার শুরু হল প্যান্ডেলের নিচে 'বিপ্লব' 'বিপ্লব'। আমি যে দল সমর্থন করব, তার আক্বীদা-বিশ্বাস যদি নির্ভেজাল না হয়, তবে তা আমি করতে যাব কেন? আর আমার অজান্তে যদি সে দলে কোন ভুল থেকে থাকে এবং কোন মাধ্যমে আমি তা জানতে পারি, তবে সর্বপ্রথম ঐ মাধ্যমটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চেষ্টা করব ঐ দলের সেই আক্বীদা-বিশ্বাস পরিবর্তন করে তদস্থলে সঠিক আক্বীদা প্রতিস্থাপন করার। তা যদি সম্ভব না হয় তবে দেরী না করে সে দল থেকে নিজেকে আলাদা করে নেয়া এবং এ ব্যাপারে অন্যদেরকে সতর্ক করাই হবে আমার মূল দায়িত্ব। পবিত্র কোরআনের ঘোষণাও তাই, "ফালা- তাক্ব'উদ বা'দায্ যিকরা মা'আল্ ক্বওমিয্ যোয়া-লিমীন।" জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ শিরোনামে আমার লেখার উদ্দেশ্যও তাই। ঈমান ও আক্বীদা বিধ্বংসী বিষয়গুলো সম্পর্কে মানুষের চেতনা জাগিয়ে তোলা। আমার এই লেখাগুলো পড়ার পর কেউ কেউ শুকরিয়া জ্ঞাপন করে আমাকে ফোন করেছেন।
মওদুদীর যে রেফারেন্সগুলো আমি 'কোড' করছি সেগুলোর নিয়্যলিটি ও অথেনটিসিটি নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কারণ, শতভাগ কনফার্ম হয়েই আমি এ গুলো আলোচনায় নিয়ে আসি।
আজকের এই লেখায়ও মওদূদীর একটি কিতাব থেকে একটি রেফারেন্স নিয়ে আলোচনা করব। কিতাবটি হল 'তাফহীমুল কুরআন'র বাংলা অনুবাদ। ওই কিতাবে ১৯তম খণ্ডের ২৮৭ পৃষ্ঠায় মওদূদী সূরা নসর এর তাফসীর করতে গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে লিখেছেন,
"আর তাঁর কাছে এ মর্মে দোয়া করুন যে, এই বিরাট কাজ করতে গিয়ে আপনি যে ভুল-ভ্রান্তি বা দোষ-ত্রুটি করেছেন তা তিনি যেন মাফ করে দেন।"
-[তাফহীমুল কোরআন, ১৯তম খণ্ড, ২৮৭ পৃষ্ঠা, সূরা নসর]
পাঠকবৃন্দ, মূল আলোচনায় যাবার আগে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার:
১. 'এই বিরাট কাজ বলতে মওদূদী ইসলাম প্রচারের সামগ্রিক কাজ বুঝিয়েছেন।
২. বক্তব্য থেকে বুঝা যায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে ভুল করেছেন বা দোষ করেছেন এতে মওদূদী সাহেবের কোন সন্দেহ নেই।
'এই বিরাট কাজ' মানে হল ইসলাম প্রচার এবং এতে 'ভুল-ভ্রান্তি' মানে ইসলাম প্রচারে ভুল-ভ্রান্তি। মওদূদী সাহেব এ মর্মে নিশ্চিত যে, ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের 'ভুল-ভ্রান্তি ও দোষ-ত্রুটি' হয়েছে। আর আমরা সকলেই জানি এবং মানি ইসলাম প্রচারের মূলভিত্তি ছিল পবিত্র কোরআন মজীদ। কোরআনের প্রচার মানে ইসলাম প্রচার এবং কোরআনের বাস্তবায়ন মানে ইসলামের বাস্তবায়ন। ইসলাম প্রচারের কাজে নবীজীর ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে মর্মে যেহেতু মি. মওদূদী নিশ্চিত, সেহেতু পবিত্র কোরআনের প্রচার ও বাস্তবায়ন কাজেও তার দৃষ্টিতে নিশ্চিত ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে এবং কোরআনের ভুল মানে ইসলামেরই ভুল। আর আল্লাহ পাক 'ভুল'কে মনোনয়ন দেন না। অথচ আল্লাহ্ বলেন, "ইসলাম নিশ্চয় আমার কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম।" ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক। মওদূদীর কথায় বুঝায়, পবিত্র কোরআনের প্রচারে নবীজী ভুল-ভ্রান্তি করেছেন। নবীজীর প্রচারিত কোরআন ভুল হলে সঠিক কোরআন কি মওদূদীর লিখিত 'তাফহীমুল কোরআন'? আল্লাহ্ পাক যেখানে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছেন, "যা-লিকাল কিতা-বু লা- রায়বা ফী-হ্" (এ কোরআন সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি ও সন্দেহের ঊর্ধ্বে )। সেখানে মওদূদীর অভিমত হল, কোরআনে ভুল আছে।
নবীজীর সমালোচনা করতে গিয়ে কোরআনকেও ছাড়লো না। তবে আমরা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখি, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেহেতু সকল ধরনের দোষ-ত্রুটি ও ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে সেহেতু তাঁর প্রচারিত পবিত্র কোরআনও ভুল-ভ্রান্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং সে সুবাদে ইসলাম ধর্মও ভুলহীন পবিত্র ধর্ম। মূলত কোরআন এবং ইসলাম তখনই নির্ভুল হবে, যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সকল ধরনের ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত বলে মেনে নেয়া হবে, অন্যথায় নয়। মওদূদীরা এ মহাসত্য বুঝতে পারেনি, বলেই নবীজীকে ভুলযুক্ত বলে কোরআনকে ভুলমুক্ত প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
প্রিয় পাঠক, এবার আমি মওদূদীর সাথে সাহাবাদের আক্বীদার তফাৎ তুলে ধরব। একটু আগে আপনারা দেখলেন, মওদূদীর মতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম'র দোষ-ত্রুটি ও ভুল-ভ্রান্তি ছিল। এবার প্রিয় নবীজীর একজন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত হাস্সান ইবনে সাবিত রদ্বিয়াল্লাহু আনহু 'র একটা কবিতার অংশ বিশেষ শুনুন, যে কবিতা সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ব্যাপকভাবে চর্চিত ছিল। হযরত হাস্সান ইবনে সাবিত রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
"খুলিক্বতা মুবাররাআম্ মিন কুল্লি 'আয়বিন
কাআন্নাকা ক্বদ খুলিক্বাত কামা তাশা-উ"
অর্থাৎ সকল প্রকারের ভুল-ভ্রান্তি ও দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র অবস্থায়ই আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমার মনে হয় আপনি যেমনটি চেয়েছেন আপনাকে সে রকমভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে।
পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি না হলে ওই পঙক্তিটির ভাবানুবাদ যা আমি আমার একটি না'তিয়া কালামে লিখেছি, তার অংশ বিশেষ এখানে উপস্থাপন করতে চাই,
সৃজিল তোমায় প্রভু তেমন করে
অনুপম যেমন তব মনে ধরে
রূপে নাহি কোন খুঁত দাগহীন দূত।
অরূপের গড়া তুমি মোহনীয় ফুল, অদ্বিতীয় ফুল।
পার্থক্যটা পরিস্কার। সাহাবাদের আক্বীদা হল নবীজী ত্রুটিমুক্ত আর মওদূদীর আক্বীদা হল ত্রুটিযুক্ত। আরো একটা বেআদবী মূলক কথার দিকে লক্ষ করুন, আমরা যখন কারো ব্যাপারে বলি যে, আপনার ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে। এ কথায় তাকে যে টুকু অভিযুক্ত করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি এবং সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়, যখন বলা হয়, আপনি ভুল-ভ্রান্তি করেছেন। কারণ, 'ভুল হওয়া' আর 'ভুল করা'র মধ্যে অনেক পার্থক্য। আফসোসের বিষয় হল, মওদূদী সরাসরি নবীর শানে বলেছে 'আপনি ভুল করেছেন।' নবীজীর শানে এটা শ্রদ্ধাহীন নির্মম ভাষা এবং এ রকম ভাষা ব্যবহার মওদূদীর পক্ষেই ব্যবহার করা সম্ভব।
সূরা নসরের তাফসীরে মওদূদী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভুল-ভ্রান্তি বা দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করেছেন। প্রশ্ন হল, সূরা নসরে আল্লাহ্ পাক নবীর ভুল হয়েছে মর্মে কোন কিছু বলেছেন কিনা; মোটেই না। একটা শব্দও ব্যবহার করেননি। তাহলে বিষয়টি এমন হল যে, আল্লাহ্ পাক যা বলেননি, মওদূদী তা বলে নবীকে অভিযুক্ত করার অপচেষ্টা করেছে। ব্যবহৃত ইস্তিগফার শব্দটি নবীর ক্ষেত্রে দোষ-ত্রুটি বা গুনাহ্ মাফ করার জন্য হয় না। কারণ, নবীগণ সকলেই নিষ্পাপ। সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহৃত হলে ইস্তিগফার মানে দোষ-ত্রুটি বা গুনাহ্ মাফ করার প্রার্থনা বুঝায়। মি. মওদূদীর যেহেতু নবীকে সাধারণ মানুষের মত মনে করার পুরনো অভ্যাস আছে, সে কারণেই নবীর ইস্তিগফারকে সাধারণ মানুষের ইস্তিগফারের সাথে তুলনা করে নবীর দোষ-ত্রুটি ও ভুল-ভ্রান্তি খুঁজে বের করেছেন। নবীর দোষচর্চা করা কোন ঈমানদারের আলামত নয়।
এবার কয়েকটি বাক্য সংক্ষেপে করি।
১. ভুল করা হলে কি বলে? =ভুল বা অসঠিক
২. যার মধ্যে ভ্রান্তি আছে, তাকে কি বলে? = ভ্রান্ত
৩. যিনি দোষ করেন, তাকে কী বলে?= দোষী
৪. যার মধ্যে ত্রুটি আছে, তাকে কি বলে? = ত্রুটিযুক্ত
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতার সাহিত্য এবং আক্বীদায় তাহলে আমাদের রসূল আকরম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম দোষী, ভ্রান্ত, ভুল এবং ত্রুটিযুক্ত!!! মওদূদী মুসলমান না বে-ঈমান? সর্বস্তরের মুসলমানদের বিচার করার সময় এসেছে। নবীকে ভ্রান্ত বলে যে দলের প্রতিষ্ঠাতা সে দলকে সঠিক দল বলার রুচি আমার নেই। বরং নবীর শানে এ রকম শব্দ শোনার রুচিবোধও আমার নেই।
মাকাল থেকে যেমন কমলার সুগন্ধি আশা করা যায় না, মওদূদীর কাছ থেকেও শানে রিসালাত আশা করা যায় না। এতদিন শুনতাম, নবীজীর গুণবাচক নাম আছে অনেক। আজকে মওদূদীর সাহিত্যে নবীজীর দোষবাচক নামের সন্ধান পাওয়া গেল!!! না'ঊযু বিল্লাহ!
'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্' এ পবিত্র কালেমা পড়েই অমুসলমান মুসলমান হয়। অর্থাৎ মুসলমান হতে হলে নবীকে 'মুহাম্মদ' মানতে হবে। 'মুহাম্মদ' শুধু নাম নয়, বরং নবীকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সকল মর্যাদার আকর। 'মুহাম্মদ' অতি প্রশংসিত। ঈমানদার হওয়া মানে নবীকে অতি প্রশংসিত মনে করা।
উপরিউক্ত কালেমা পড়ে মুসলমান হওয়ার অর্থই হল এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করা যে, আমি সর্বদা আমার নবীর প্রশংসা করব। কারণ, তিনি 'মুহাম্মদ' অর্থাৎ অত্যাধিক প্রশংসিত, দোষী ব্যক্তির প্রশংসা হয় না, ভ্রান্ত ব্যক্তিরও প্রশংসা হয় না। যাকে ভ্রান্ত বা দোষী বলা হয় তিনি 'মুহাম্মদ' হতে পারেন না। আবার যিনি 'মুহাম্মদ' তিনি দোষী হতে পারেন না, ভ্রানও হতে পারে না। যেহেতু মুসলমান হতে হলে এবং ঈমানদার হিসেবে থাকতে হলে নবীকে 'মুহাম্মদ' হিসেবে মানতে হবে, সেহেতু নবীকে দোষী বা ভ্রান্ত বলা কোন মুসলমানের কাজ হতে পারে না। কারণ, তাতে নবীকে 'মুহাম্মদ' বলে মানা হয় না। নবীকে দোষী বা ভ্রান্ত বলার অর্থ হল, যে কালেমা পড়ে মুসলমান হল সে কালেমার বিষয়বস্তু থেকে সরে আসা। নবীকে দোষী এবং ভ্রান্ত বলে মওদূদী সাহেব ইসলামের কালেমা থেকে সরে কোন্ কালেমার আবরণে লুকালেন অনাগত ভবিষ্যত সে আবরণ সরাবেই সরাবে।
জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ-৮
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তাদের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী করে নিয়েছে। তাদের দলের নামের মধ্যে বাংলাদেশ আগেও ছিল এখনও আছে। তবে পার্থক্য হল ইতিপূর্বে বাংলাদেশ ছিল পরে এখন এলো আগে। পেছনে থাকা কোন ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারে মারতে হলে তাকে বন্দুকের নলের সামনে আনতে হয়। জামায়াতে ইসলামী পেছন থেকে টেনে বাংলাদেশকে সে উদ্দেশ্যেই সামনে আনলো কি না কে জানে। পত্রিকায় দেখলাম, তারা নাকি বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমার কাছে এটা একটা সুখবর নয় বরং ভয়ংকর ঘটনা বলেই মনে হয়েছে। হলিউড বা বলিউডের পুরুষ খলনায়ক যখন বোরখা পরে তখন তাকে দেখতে পুরুষ নয়, মহিলার মতই মনে হয়। তার উপর মেকআপ করলে তো আর কথাই নেই। বোরখা পরা সেই মহিলা খলনায়ক সুযোগ এলেই বোরখা খুলে পরিপূর্ণ পুরুষ বনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ফেলে অনায়াসে। বোরখা পরা অবস্থায় ধারণকৃত সিসিটিভি ক্যামেরা তাকে মহিলা হিসেবেই শো করে। এই ঘটনাটি আমার কাছে ভয়ংকর এজন্য যে, এখনকার পত্র-পত্রিকা তথ্যগুলো সংরক্ষণ করে এক শতাব্দি পরে যদি কেউ বাংলাদেশের বর্তমান ইতিহাস লিখতে শুরু করে তবে তিনি অবশ্যই জামায়াতকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলই লিখবেন এবং জামায়াত কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আজকের এই স্বীকৃতি তখন প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চরম বিকৃতি হিসেবেই পরিগণিত হবে। কয়েকমাস আগেও যারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ব্যঙ্গ করে গৃহযুদ্ধ বলেছে, কয়েক মাস পরে এসেই সেই তারাই আবার মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকৃতি দিয়ে এক্কেবারে ভালো মানুষ হওয়ার অভিনয় করছে! এ রকম আচরণ জামায়াতীদেরই মানায় ভালো। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য এহেন হঠকারিতা একেবারে বেমানান। চট্টগ্রাম প্যারেড ময়দানে হাজার হাজার মানুষের মাহফিলে দরজা কণ্ঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে 'ইয়া নবী সালামু আলাইকা' বলে মীলাদ শরীফ পাঠকারী দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ক্যাসেট এখনও মানুষের ঘরে সংরক্ষিত আছে। অথচ মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ঐ সাঈদী এখন ফতোয়া দিচ্ছে মীলাদ কিয়াম বেদআত, হারাম নাজায়েজ!!! এরকম আচরণের বাণিজ্যিক নাম জামায়াতী চরিত্র! সকালে যা ভালো বিকেলে বলে কালো। সূরা বাকারার ১৪নং আয়াতের আলোকে সাঈদীদের এ ধরণের আচরণকে ভেজালহীন মুনাফেকী বলা চলে। সাঈদীদের জামায়াতী ধর্মে পবিত্র মীলাদ শরীফ এক সময় পূণ্যের কাজ ছিল আর এখন তা বর্জনীয় বেদআত। জামায়াতীরা যে ধর্ম চর্চা করে সে ধর্মটি তাঁদের এতই অনুগত যে, তাদের সামান্য ইশারায় ধর্মটি তার পূণ্যময় কাজকে পরিত্যক্ত গুনাহর কাজ বলে ঘোষণা দেয়। ইসলাম ধর্ম কিন্তু সে রকম নয়। কোন রক্তচক্ষুই এই ধর্মের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কোন বিধান পরিবর্তন করতে পারে না। তাই আল্লাহ পাক বলেন, লা তাবদীলা লিকালিমাতিল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের কোন পরিবর্তন নাই। আগে যা, এখনও তা এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। এটাও ইসলামের সত্যতার অন্যতম দলীল। কিন্তু জামায়াতী ধর্ম প্যারেড ময়দানে যা বলে পল্টনে বলে তার উল্টোটা। সিলেটে যা বলে কুমিল্লায় তার বিপরীত। আগে যা বলে পরে তার গরমিল। এক বছর আগে যা ছিল জায়েজ এখন তা হারাম। নারী নেতৃত্ব তাদের কাছে আগে ছিল হারাম এখন বড্ড আরাম। ক্ষনে ক্ষনে রূপ পরিবর্তন করার অসাধারণ দক্ষতা আছে জামায়াতে ইসলামীর। কিশোর বয়সে যখন গ্রামে থাকতাম তখন বাঁশ ঝড়ের কাছে সাপের খোলস পড়ে থাকতে দেখতাম। আর মধ্য বয়সে এসে জামায়াতে ইসলামীকে দেখছি সাপের মত রাজনীতি ও ধর্মের ক্ষেত্রে বারবার খোলস পরিবর্তন করতে। জামায়াতী রাজনীতির আরও কত রহস্য সামনে আছে কে জানে। যাক, এবার আসল কথায় আসি। রূপ পরিবর্তন করে নতুন রূপ গ্রহণ করার পুরাতন অভ্যাস থেকেই হয়তো মি. মওদুদী হাদীসের পুরাতন সম্ভার বাদ দিয়ে নতুন হাদীস খোঁজ করেছে। বিতাড়িত আলোচনায় যাবার পূর্বে আসুন, তানকীহাত-এ উদ্ধৃত মি. মওদুদীর একটি উক্তি লক্ষ্য করি-প্রথমে উর্দুতে এবং পরে বাংলায়- কুরআন ও ছুন্নতে রাসূল কি তা'লীম ছব পর মুক্বাদ্দাস হ্যাঁ।
মগর তাফসীর ও হাদীসকে কে পুরানে জখীরে ছে নেহী তানকীহাত পৃষ্ঠা: ১১৪
"কোরআন ও সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে সবার আগে। তবে তাফসীর ও হাদীসের পুরাতন ভাণ্ডার থেকে নয়।" পাঠকবৃন্দ, বুজুর্গানে দ্বীনের সমালোচনার ক্ষেত্রে সর্বকালের সর্বস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ চ্যাম্পিয়নের নির্বাচন হলে মওদুদীর নাম এক নম্বরে থাকবে। আলোচ্য কথাটিও তার এ রকম প্রমাণই বহন করে। পূর্ব যুগে যারা পবিত্র কোরআন ও হাদীসের উপর খেদমত করেছেন তাদের সেই সকল খেদমতের কোন দামই বুঝি মওদুদীর কাছে নেই। তার মতে কোরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত শিক্ষা সবার আগে গ্রহণ করতে হবে। তবে এ যাবৎকালে তাফসীর ও হাদীসের যত কিতাব লিখা হয়েছে পুরাতন সেই কিতাবগুলোতে কোরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত শিক্ষা নেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে কোরআনে কারীমের প্রকৃত শিক্ষা কোথা থেকে নিতে হবে? সুন্নাতে রাসূলের প্রকৃত শিক্ষা কোথা থেকে নিতে হবে। মুসলিম উম্মাহর কাছে এ দু'টি বড় প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্নের উত্তর মওদুদী খুব সহজেই সাজিয়ে রেখেছে এবং তা হল তাফহীমুল কোরআন। অর্থাৎ মওদুদীর লিখিত তাফহীমুল কোরআন ছাড়া এ যাবৎকালে লিখিত পৃথিবীর লক্ষাধিক তাফসীর গ্রন্থের কোনটিই পবিত্র কোরআনের সঠিক শিক্ষা দিতে পারে না! কোরআনের সঠিক শিক্ষা দিতে পারে একমাত্র তাফহীমুল কোরআন যার রচয়িতা জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদুদী! এই হল প্রথম প্রশ্নের উত্তর। তবে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর এত সহজ নয়। বরং অত্যন্ত কঠিন। কারণ ঐ প্রশ্নের মধ্যে পৃথিবীর সকল অন্ধকার লুকায়িত আছে। কেননা এক কবি তার প্রেমিকার কালো চুলকে বিদিশার অন্ধকার রাত্রির সাথে তুলনা করে পরিতৃপ্তিবোধ করেছেন এভাবে চুল তার কবেকার বিদিশার নিশা। তবে মওদুদীর কথা থেকে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় প্রশ্নের মধ্যে যে অন্ধকার লুকায়িত আছে তাকে জাহান্নামের অন্ধকারের সাথে তুলনা করলেও কম বলা হবে। সেই অন্ধকার আবিষ্কার করার জন্য মওদুদীর বক্তব্যের শেষাংশটি আরও একবার লক্ষ্য করুন-
"মগর তাফসীর ও হাদীসকে পুরানে জখীরে ছে নেহী"
অর্থাৎ তাফসীর ও হাদীসের পুরাতন ভাণ্ডার থেকে নয়।
সম্মানিত পাঠক, তাফসীরের পুরাতন ভাণ্ডার বাদ দিয়ে নতুনভাবে তাফসীর গ্রন্থ লেখা যাবে। কিন্তু হাদীসের পুরাতন ভাণ্ডার বাদ দিয়ে নতুন হাদীস তৈরি করা যায় না। কারণ, হাদীসের পুরাতন ভাণ্ডার বাদ দিয়ে নতুন হাদীস তৈরি করলে তাকে জাল হাদীস বলা হবে। তাহলে হাদীসের পুরাতন ভাণ্ডার বাদ দিয়ে কোন অজানা (!) উৎস থেকে সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছে মি. মওদুদী? এই অজানা উৎসটাই অন্ধকারে ভরা। নতুন হাদীসের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে একজন নতুন নবী আবিস্কারের জন্যই কি জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদুদীর এ প্রয়াস!
জামায়াতে ইসলামীর স্বরূপ-৯
বাইতুল মোকাররম মসজিদে মাওলানা সালাহ উদ্দীনের নিয়োগে নিজামী-সাঈদী-আমিনীদের কণ্ঠে হঠাৎ করেই মহাসাগরের তলদেশের নীরবতা নেমে আসল কেন? বাইতুল মুকাররাম এলাকায় সুন্নীরা নিঃশ্বাস ফেললেও যে আমিনীর চেঁচামেচিতে রাজধানীতে শব্দ দূষণ হত, সেই আমিনীর লালবাগ মাদরাসা হতে এখন মাছির ভোঁ ভোঁ শুনা যাচ্ছে নিজামীর ইমামতিতে আমিনীরা নীরবতা পালন করছে।
ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এ মান্নান যে বাহাউদ্দীনকে জন্ম দিয়েছিলেন মাওলানা সালাহ উদ্দীন বাইতুল মুকাররমের খতীব হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির পর আমার মনে হয়েছে এটা অন্য বাহাউদ্দীন! জামায়াতে ইসলামীর বিশ্বাসঘাতকতায়ই আমাদেরকে খাঁটি সোনার মত একজন বাহাউদ্দীনকে উপহার দিয়েছে। আসলে ইনকিলাব নামক বটবৃক্ষের মোটা ঢালটিই ছিল জামায়াতে ইসলামী। ওই ঢাল আপনভারে বৃক্ষটিকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু তা হয়নি। বরং ঢালটিই পৃথক হয়ে গেছে। মাওলানা এম এ মান্নানের বটবৃক্ষের মোটা ঢালটি গাছের যে অংশ থেকে পৃথক হয়েছে, সেখান থেকেই নতুন বাহাউদ্দীনের অঙ্কুর গজিয়েছে। তবে ততদিনে ঐ ঢালটি মোটা হয়েছিল অনেক।
গাছের আরও একটা বিষাক্ত ঢাল আছে। তা হল, ক্বওমী ওহাবী। তারা বাহাউদ্দীনকে সালাম করেও নিজামীদের ইমামতিতে রাজনীতি করে। এ এক বিস্ময়কর মিশেল! শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এ ঢালটি এখনও গাছ থেকে পৃথক হয়নি। বিষাক্ত এ ঢালটির কারণে মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে যান বাহাউদ্দীন। তারপরও অজানা আধ্যাত্মিকতায় তা কেটে যায়। তা সত্ত্বেও এই বাহাউদ্দীন এখনও ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করার মত যোগ্যতা অর্জন করেনি।
নিজামীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্বওমীরা যেদিন বাহাউদ্দীনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, সেদিন অন্য আরেকটা বাহাউদ্দীনের জম্ম হবে এবং ঐ বাহাউদ্দীনই অনাগতকালের সোনালী পাতায় ইতিহাস হয়ে থাকবে। ঐতিহাসিক সেই বাহাউদ্দীনের মাঝেই তখন আমরা ঐ মাওলানা এম এ মান্নানকে খুঁজে পাব, যে এম এ মান্নান ঢাকা মোহাম্মদপুরস্থ ক্বাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস ছিলেন।
প্রথম যে জুমায় ইমামতির কথা থাকলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শের আদলে চক্রান্তের কারণে মাওলানা সালাহ উদ্দীন যেতে পারেননি, সেদিনই বুঝেছিলাম কাজটা খুব একটা সহজ হবে না। সেদিনই মোবাইলে চ্যানেল আই'র উপস্থাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীর সাথে পরামর্শ করে সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং দু'এক দিন পরই তা করলাম। টিভি পত্রিকায় কভারেজও পাওয়া গেল। ঘুরে দেখলাম ময়দানে কাজ করার মত অনেকেই আছে। মাওলানা সালাহ উদ্দীনের প্রতি সাংবাদিকদের শ্রদ্ধার গভীরতা অনুভব করলাম। উপস্থিত এক সাংবাদিক আমাকে সেদিন বলেছিল, হুযূর, সালাহ্ উদ্দীন সাহেবের বিরোধীরা কারা এবং কেনই বা তারা বিরোধিতা করছে তা আমাদের জানা আছে। আসলেই এটা এক রহস্য। সুন্দর চেহারার সাদা দাড়িওয়ালা একজন সালাহ্ উদ্দিন যখন ঢাকা আলিয়ার মত ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসার অধ্যক্ষের চেয়ারে বসলেন, তখন তাদের কোন ক্ষতি হলো না। সেই চেয়ার থেকে উঠে যখন তিনি এক কিলোমিটার দূরে এসে মেহরাবে দাঁড়ালেন তখনই তাদের মাথায় মদমত্ততা।
পাঁচ কল্লি টুপি পরে যারা এসেছিল, তাদেরকে সবাই চেনে। কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় বলে "আপন স্বামীর নাম সবাই জানে লাজে কয় না।" এই টুপিওয়ালা কি করতে পারে তাও দেখা হল। জুতা হাতে মাথায় পাঁচ কল্লি টুপি পরে এই অপদার্থগুলো মিডিয়ার সহযোগিতায় পৃথিবীর কাছে ক্বওমী মাদ্রাসার বিজ্ঞাপন হয়ে থাকবে অনেক দিন। দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলিম দেশের সর্ববৃহৎ মসজিদে জুতা মারামারির যে দৃশ্য পৃথিবীবাসীকে ক্বওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা দেখাতে পারল, তাতে বিধর্মীরাও বাইতুল মুকাররমকে মসজিদ না বলে জুতা-জুতা খেলার স্টেডিয়াম বললেও বলতে পারে।
আমেরিকা প্রবাসী এক বাংলাদেশী আমাকে ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলেছে, হুযূর! জুতা মারামারির দৃশ্য দেখে বিধর্মীরা আমাদের সাথে উপহাস করছে। '৯৬'র হাসিনা আর ২০০৯ সালের হাসিনার মধ্যে একটা তফাৎ দেখল বাইতুল মুকাররাম। আমিনীরা স্টাম্প-এর বাইরে বল করে হাসিনাকে স্টাম্প ছেড়ে বলের লাইনে খেলতে বাধ্য করার কৌশলটি ঠিকই বুঝতে পেরেছে। দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নামা ব্যাটিংসে সফল শেখ হাসিনা। আমার এক ওস্তাদ বলতেন, ক্বওমীরা বলে কিন্তু বুঝে না। আউট স্ট্যাম্প বোলিং কৌশল হিসেবে যে শতখানেক ছাত্র আমিনীরা পাঠাল, বাইতুল মুকাররম মসজিদ থেকে বিতাড়িত হয়ে পরে রাস্তায় নামায আদায় করে তারা নতুন খতীব মাওলানা সালাহ উদ্দীনের উপকারই করে গেল। কিন্তু নির্বোধ ক্বওমীরা কি আদৌ তা বুঝে! তৃপ্তি ভরে সারা পৃথিবী দেখল, বাংলাদেশের পনের কোটি মানুষের মধ্যে এক-দেড়শ' মানুষ ছাড়া বাকি সবাই মাওলানা সালাহ উদ্দীনকে সমর্থন করে। তবে এক-দেড়শ' বিচ্ছিন্ন মানুষের বিরোধিতাকে মিডিয়া যে দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রচার করেছে তাতে আমার মনে হয়, মাওলানা সালাহ্ উদ্দীনের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। শেখ সা'দীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি আদব শিখেছেন কোথায়? তিনি বলেন, বেআদবের কাছ থেকে। অর্থাৎ বেআদব যা করে তার বিপরীতটাই হল আদব। এক-দেড়শ' মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে নামায পড়া যেখানে সালাহ উদ্দীন সাহেবের জন্য মিডিয়ার কাছে পজেটিভ নিউজের মূল্য পাওয়া দরকার ছিল, সেখানে নেগেটিভ নিউজ হয়েছে কিছু পত্রিকায়। অবশ্য ইনকিলাব ও জনকন্ঠ ব্যতিত্রুম।
পাঁচ কল্লিওয়ালা অপদার্থগুলো ভেবেছে সরকারের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সদস্যরা তাঁদের চেনেনা। এদের বিবেকের অন্ধকার বিদিশার অন্ধকার থেকেও আরও প্রগাঢ়তর। দিনের আলোতে বাদুর নাকি চোখে দেখে না। যে যুগে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে ছিন্নমূল সন্তানের বাবা-মা'র পরিচয় বের করা সম্ভব, সে যুগে পাঁচ কল্লি টুপি পরে নিজের পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করা ভণ্ডামি ছাড়া আর কী!
ইসলাম ধর্মে শর'ঈভাবে খুৎবা পাঠ ব্যতীত জুমার নামায যেখানে সম্পূর্ণ নিষেধ, সেখানে পাঁচ কল্লিওয়ালা মৌলভীটাকে দেখলাম খুৎবা দান ব্যতীত রাস্তায় জুমার নামায পড়ে, আবার টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে ইন্টারভিউ প্রদান করছে।
এ যেন বোকার সম্রাট!
ওহাবীরা সালাহ উদ্দীন ইস্যু নিয়ে অনেক ফায়েদা লুটছে বা চেষ্টা করছে। সালাহ উদ্দীন সাহেব আমাদেরকে টুয়েন্টি টুয়েন্টি খেলার সুযোগ দিয়েছিলেন। আমার মনে হয় আমরা তা পারিনি। এ লেখা যখন শেষ করতে বসলাম, তখন খবর পেলাম স্টেডিয়াম দখল করার জন্য চরমোনাই'র ওহাবীগুলো সর্পনৃত্য প্রদর্শন করছে।
জামায়াতে ইসলামীর কথায় আসি। চারদলীয় জোট সরকার থাকা অবস্থায় জামায়াত মুফতী আমিনীকে মুরীদ করে পাঁচ বছর ধরে লাগাতার ফয়েয বিতরণ করে যোগ্য শিষ্য বানিয়ে ছেড়েছে। মুরীদ যোগ্যতা অর্জন করেছে কি না, তা বুঝার জন্য জামায়াতে ইসলামী নীরবতার ষোলকলা পূর্ণ করে দেখছে, পাঁচ বছরে পড়ানো সবক মুফতী আমিনী বাইতুল মুকাররাম পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন করতে পারে কি না। বাহ্যিক নীরবতা দিয়ে জামায়াত একটা নতুন গেম তৈরি করেছে, যার দৃষ্টান্ত বিরল। এই গেমের উদ্যোক্তা জামায়াত, থার্ড আম্পায়ার মুফতী আমিনী, লেগ আম্পায়ার মুফতী নূরউদ্দীন, আরেক আম্পায়ার রাস্তায় নামাযের ইমামতিকারী মুফতী (!) আব্দুল্লাহ্। অন্ধকার রাতে বিজলী চমকালে বুঝতে হবে আসমানে মেঘ আছে। যে কোন সময় বৃষ্টি হতে পারে। সালাহ উদ্দীন সাহেবের নিয়োগও আমার বিবেচনায় সে রকমই। অনেকেই বলতে শুরু করেছে যে, সালাহ উদ্দীন সাহেবকে টিকাতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। আমি এমনটা মনে করি না। আমি মনে করি, বাবার হাত থেকে হাতুড়ি নিয়ে সামনের শক্ত কাঠটিতে প্রথম পেরেকটা মেরে আমি নিজেকে প্রমাণ করলাম, প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতে আরও পেরেক মারতে পারব। এটা শেষ নয়, বরং বাতিলের কফিনে এটা আমাদের প্রথম পেরেক। সালাহ উদ্দীনকে হারালেও তাই আমি হতাশ হব না। কারণ, সালাহ উদ্দীন সাহেব বাইতুল মুকাররমে গিয়ে আমাদের মধ্যে যে তৃষ্ণা জাগিয়েছেন (আল্লাহ্ না করুন!) কোন কারণে যদি তিনি সেখান থেকে বের হয়ে যান, তবে তাতে আমাদের সে তৃষ্ণা বাড়বে বৈ কমবে না। ছোট্ট ইনিংসে এতটুকু অর্জনই বা কম কি?
--------------- সমাপ্ত ---------------
Comments
Post a Comment