সৃষ্টিকর্তা ও সময়
সৃষ্টিকর্তা ও সময়
টেক্সট রেডীঃ মুহাম্মদ আব্দুল খালেক
নাস্তিকদ্বয় ও ঈমানদার ব্যক্তিগণের ঈমান মজবুত করতে উৎসর্গকৃত
সূচীঃ
∆ মহাবিশ্ব, সৃষ্টিকর্তার বিশালতার অনন্য নিদর্শন!
∆ বিবর্তনবাদ, অন্ধকারে ঢিল ছুড়ার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা!
∆ মানুষের শারীরিক গঠন এবং সৃষ্টিকর্তা!
∆ আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতসমূহ!
∆ সময়!
∆ উদাসীন মানুষ!
∆ সাধারণ কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তর
মহাবিশ্ব, সৃষ্টিকর্তার বিশালতার এক অনন্য নিদর্শন!
ছোট বড় অনেক দেশ নিয়ে আমাদের এই পৃথিবীটা সূর্য নামক তারার একটি গ্রহ। আমাদের পৃথিবীর মতো আরো ৮টি গ্রহ সৌর জগতের বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থান করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তেজস্ক্রিয় সূর্যটি গোটা পৃথিবীকে আলোকিত করে সেটি আমাদের এই পৃথিবীর চেয়ে তের লক্ষ গুণ বড়। একবার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গভীরভাবে ভাবুন তো, আগুনের মত এই গোলকটি আমাদের গোটা পৃথিবীর সমান নয়, একশটি পৃথিবীর সমান নয়, এক হাজার পৃথিবীর সমান নয়, এক লক্ষ পৃথিবীর সমান নয় বরং তের লক্ষ পৃথিবীর সমান যেটি কিনা ভয়ঙ্কর তেজষ্ক্রিয় বা বলা যায় আগুনের চেয়ে হাজার গুণ ভয়াবহ উত্তাপের। আর এই সূর্য হলো মহাবিশ্বের একটি ছোট তারকা। সূর্যের চেয়ে ছোট বড় কোটি কোটি তারকা আছে মহাবিশ্বে। যেমন বেটেলজিয়াস নামক তারাটি সূর্যের চেয়ে ছয়শো মিলিয়ন মাইল বড়ো। এরকম লক্ষ কোটি গ্রহ নক্ষত্র মিলে তৈরি হয়েছে আমাদের গ্যালাক্সী বা ছায়াপথ যার নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সী। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির পাশেই রয়েছে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সী আর এই এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সী মিল্কিওয়ের চেয়ে চারগুণ বড়। এরকম লক্ষ কোটি গ্যালাক্সী রয়েছে যা বিজ্ঞানীরা এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। আর এই সবগুলো গ্যালাক্সী মিলে তৈরি হয়েছে বিশ্বভ্রহ্মান্ড। যার ভিতরে রয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন গ্যালিক্সী। আর এই সবকিছু মিলে হচ্ছে আমাদের এই ইউনিভার্স। আবার এরকম লক্ষ কোটি ইউনিভার্স মিলে হয় মাল্টিভার্স। আবার এই মাল্টিভার্সগুলো নিয়ে তৈরি হয় সুপারভার্স। আমি তো কল্পনাও করতে পারছিনা, একবার ভাবুন তো এসবের কাছে আমাদের পুরো সৌরজগতটি একটি ধূলিকণার চেয়েও নগণ্য আর সবচেয়ে অবাক লাগে এই সবকিছু শূণ্যের উপর, নির্দিষ্ট নিয়মে সুসজ্জিতভাবে সবই ঘুরছে। অন্তর দিয়ে ভাবুন তো! যে মাটির উপর আপনি দাঁড়িয়ে আছেন সেই মাটি অর্থাৎ পুরো পৃথিবী একটি ফাঁকা জায়গা বা শূণ্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও পড়ে যাচ্ছে না, আবার অন্যান্য গ্রহগুলোর সাথে ধাক্কাও খাচ্ছে না। যে বিশাল সূর্যটি মাথার উপর দেখছেন সেটিও পড়ে যাচ্ছে না, কারো সাথে কারো সংঘর্ষ হচ্ছে না, সবাই একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যেই সুচারুরূপে তাদের লাইফ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা ইউনুসের ৫ নং আয়াতে বলেছেন-
هُوَ ٱلَّذِی جَعَلَ الشَّمۡسَ ضِيَآء وَٱلۡقَمَرَ نُورًا وَ قَدَّرَهُ ۥ مَنَازِلَ لِتَعلمُوَِاْ عَدَدَ ٱلسِّنِيينَ وَٱلۡحِسَابَ. مَاخَلَقَ ٱللَّهُ ذَالِكَ إِلَّا بِٱلۡحَقِّ. يُفَصِّلُ ٱلۡاَيَٰتِ لِقَوۡمٍ يَعۡلَمُونَ.
"তিনিই সূর্যকে করেছেন তেজষ্কর এবং চন্দ্রকে করেছেন জ্যোতীর্ময় এবং তাদের অবস্থান সমূহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যেন তোমরা বছরের গণনা ও সময়ের হিসাব ঠিকমত জানতে পারো। এসব তিনি নিরর্থক সৃষ্টি করেন নি। জ্ঞানীদের জন্য আল্লাহ এসব নিদর্শন প্রকাশ করে থাকেন"।
[আল-কুরআন, সূরাঃ ইউনুস, আয়াতঃ ৫]
আল্লাহ বলছেন যে তিনি প্রথম আসমানটিকে সাজিয়েছেন তারকারাজি দিয়ে, তাই আকাশে আমাদের যতদূর চোখ যায় আমরা শুধু তারার মেলাই দেখি। এই সবকিছুই প্রথম আসমানে। হাদিসে বর্ণিত আছে আমাদের এই বিশাল প্রথম আসমান দ্বিতীয় আসমানের চেয়ে এতটাই ছোট যে বিশাল সাহারা মরুভূমিতে একটি আংটি রাখলে ১ম আসমানটির আকার হবে ওই আংটির মতো এবং ২য় আসমান হবে সাহারা মরুভূমির আকার। একইভাবে আবার ৩য় আসমানের তুলনায় ২য় আসমান আংটি এবং ৩য় আসমান যথারীতি সাহারা মরুভূমির আকার। এভাবে ৭ আসমানের প্রত্যেক আসমান একে অপরের চাইতে এই নিয়মেই আকারে বড়। আর এই সাত আসমানের সৃষ্টিকর্তা হলেন আল্লাহ। তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা মূলকের ৩ নং হতে ৬ নং আয়াত পর্যন্ত বলেছেন-
তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন, তুমি করুণাময় আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন তফাৎ দেখতে পাবে না। আবার ফেরাও, কোন ফাটল দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বারবার তাকিয়ে দেখ, তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকেই ফিরে আসবে। আমি সর্বনিম্ন আকাশকে প্রদ্বীপমালা দ্বারা সু-সজ্জিত করেছি; সেগুলোকে শয়তানের জন্য ক্ষেপণাস্ত্র করেছি এবং প্রস্তুত করে রেখেছি তাদের জন্য জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি, যারা তাদের পালনকর্তাকে অস্বীকার করেছে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি। সেটা কতই না নিকৃষ্ট স্থান।"
[আল-কুরআন, সূরাঃ মূলক, আয়াতঃ ৯ হতে ৬ পর্যন্ত।]
তাই একজন যুক্তিবাদী এবং চিন্তাশীল ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার এই বিশাল সৃষ্টি জগৎকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে এবং নিজেকে প্রশ্ন করবে- 'কে বানালো এই বিশাল সৃষ্টি জগৎ? কিভাবে এই সবকিছু একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে? কখনো কি সম্ভব এই সব কিছু নিজ নিজে সৃষ্টি হওয়া? তাদের মধ্যে এরকম একটি সুশৃঙ্খল নিয়মে চলার এই যে সিস্টেম তা কি কোন নিয়ন্ত্রণ কর্তা ছাড়া আপনা-আপনি সম্ভব? কখনোই নয়! অবশ্যই এসব কিছুর একজন সৃষ্টিকর্তা এবং নিয়ন্ত্রণ কর্তা রয়েছে। একজন সুগভীর জ্ঞানী ব্যক্তিমাত্রই অবশ্যই এসব নিয়ে চিন্তা করবে এবং সার্বিক বিবেচনা ও যুক্তির আলোকে অবশ্যই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে ইহকাল ও পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবে।
বিবর্তনবাদ,
অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা!
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, একজন নাস্তিক যদি বলে একগুচ্ছ এ্যামিবা থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তাহলে আমার প্রশ্ন এখনও তো হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, আলো, বাতাস, পানি এবং এ্যামিবাও আছে তারা কেন মানুষ হয় না? কেন আমরা দেখি না নারী-পুরুষের দৈহিক মিলন ব্যতীত যেখানে সেখানে মানুষ তৈরি হচ্ছে! আর এ্যামিবা থেকেই যদি মানুষ হয় তবে তাহলে কেন এ্যামিবা থেকেই কোটি কোটি মানুষ হচ্ছে না ! শুধু পিতা-মাতার মিলনের মাধ্যমেই কেন একটি নবজাতক জন্ম গ্রহণ করে! আপনি তো এই বিষয়ে একদম পরিষ্কারভাবে সম্মত যে, আপনি এসেছেন আপনার পিতা-মাতার মিলনে, একইভাবে আপনার পিতা-মাতাও এসেছেন আপনার দাদা-দাদী ও নানা-নানীর দৈহিক মিলনের ফলেই! এভাবে যদি আমরা পর্যায়ক্রমে পেছনে যেতে থাকি তবে দেখা যাবে যে সুদূর অতীতের যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী, কালের পর মহাকাল পার হয়ে এই দুনিয়ার অতীতে চলে যাওয়া সমস্ত মানুষ এবং বর্তমানে পৃথিবীতে অবস্থানরত সকল মানুষের আদি পিতা-মাতা মাত্র দুজন। আর পবিত্র কুরআনে এটাই স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, তারা হলেন পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী সকল মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (আলাইহিস্ সালাম) এবং আদি মাতা হযরত হাওয়া (আলাইহিস্ সালাম)। তর্কের খাতিরে যদি এমনও হয় যে, কোথাও নাম পরিচয়হীন একটি শিশু পড়ে থাকে তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানীও বা নাস্তিকও স্বীকার করবে না যে শিশুটি নিজে নিজে তৈরি হয়েছে বা এসেছে। সবাই সিদ্ধান্ত দেবে শিশুটি হয়ত কারো অবৈধ প্রণয়ের ফসল বা কোন কারণে শিশুটির মা শিশুটিকে ফেলে চলে গেছে। আবার বিবর্তনবাদের আরেক মত যে বানর থেকেই নাকি বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টি। যদি বানরই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষে পরিবর্তিত হয় তবে বর্তমান পৃথিবীতে যে কোটি কোটি বানর আছে তার একটিও কেন মানুষে পরিবর্তিত হচ্ছে না? আবার একই এ্যামিবা থেকে কি করে প্রাণীর বিভিন্ন প্রজাতি হলো? যেমন হাতী, ঘোড়া, বাঘ, বানর, সিংহ, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, উট, ভেড়া, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাখি ইত্যাদি লাখ লাখ প্রাণী জলে স্থলে কিভাবে বিচরণ করছে? একই পৃথিবীতে একই পরিবেশের প্রাণী জগতে কেন এই ভিন্নতা? গভীরভাবে ভাবলে এই বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এত ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর এই বিশাল সম্ভার কখনোই নিজে নিজে তৈরি হতে পারে না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই সব প্রাণীকূলের সবাইকে অধীন করে দিয়েছেন একটি প্রাণীর হাতে। অর্থাৎ পৃথিবীর সব প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে একটি প্রাণীই, সেটি মানবজাতি। আর মানুষকে এই ক্ষমতা দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা নিজেই। কারণ হলো মানুষের কাছ হতে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য এবং এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য মানবজাতি যাতে আল্লাহর বিশাল সৃষ্টিজগৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা হা-মীম সাজদাহ এর ৫৩ নং আয়াতে বলেছেন-
আমি আমার নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করব বিশ্বজগতে এবং ওদের নিজেদের মধ্যে, ফলে ওদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে তা সত্য। এটা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার প্রতিপালক সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত?"
(আল-কুরআন, সূরা হা-মীম সাজদাহ, আয়াতঃ ৫৩।)
পরিশেষে এটা স্পষ্ট যে, একজন নাস্তিক কখনোই পরিষ্কার বলতে পারবে না যে, প্রথম মানুষ কিভাবে এসেছে, কিন্তু আস্তিকের কাছে এই বিষয়টি পরিষ্কার। তাহলে কেন আপনি গভীরভাবে চিন্তা করেন না এবং মুনাফেকী আর নাস্তিকতা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর দরবারে নিজেকে সঁপে দেন না (যদি আপনি নাস্তিক বা সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী হন)?
মানুষের শারীরিক গঠন এবং সৃষ্টিকর্তা
মানুষকে যদি কেউ তৈরি না-ই করত তাহলে মানুষের শারীরিক গঠন কেন এত পরিকল্পিতভাবে তৈরি? একবারও কি ভেবে দেখেছেন যে আপনার শরীরের ভেতরের মেশিনটি কত জটিল এবং কিভাবে কাজ করছে, যেমন ব্রেইন, হার্ট, কিডনী, লাংস, স্টম্যাক, লিভার ইত্যাদি? আচ্ছা ভেতরের কথা বাদই দিলাম, নিজের শরীরের বাইরের গঠনের কথা চিন্তা করুন। আপনার মুখের ভেতরটা একটা গর্ত বা গহবর এর মতো। আপনি সেই মুখ গহবর ব্যবহার করে খাবার খেলেন তারপর তা স্টম্যাকে গিয়ে পাচন প্রক্রিয়ায় খাবারের প্রয়োজনীয় অংশ শরীর নিয়ে নিল আর উচ্ছিষ্ট অংশ পায়ুপথে নিষ্কাশিত হয়ে বেরিয়ে এলো। আপনি যদি নিজে নিজেই তৈরি হতেন তবে আপনার পায়ুপথ নাই থাকতে পারত! পেট কেটে যদি উচ্ছিষ্ট অংশ বের করতে হতো তবে কতো সমস্যাই না হতো! আবার ভাবতে পারেন আপনার শরীরের জয়েন্টগুলোর কারণেই আপনি আপনার শরীরের বিভিন্ন অংশকে বাঁকাতে পারেন, ঘুরাতে পারেন, বিভিন্ন শেপে নিয়ে যেতে পারেন যেমন হাত, পা, মুখ ইত্যাদি। এবং এর কারণেই আপনি উঠা, বসা, হাঁটা, চলাফেরা করা, কাজ করা ইত্যাদি করতে পারেন। এখন কথা হলো যদি আপনি নিজে নিজেই সৃষ্টি হোন তাহলে আপনার কঙ্কালে বিভিন্ন অংশে জয়েন্টগুলো নাও থাকতে পারতো। আপনার বাহু, কনুই, কব্জি, কোমর, হাঁটু, পায়ের গোড়ালি, হাতের পায়ের আঙ্গুলের প্রায় চার অংশে বিভক্তি না থেকে আপনি ঠায় খুঁটির মতো সোজা-সাপ্টা হতে পারতেন। যার ফলে আপনি আপনার দেহটিকে, ভাঙ্গতে, বাঁকাতে বা মোচড়াতে পারতেন না! তাহলে ভাবুন তো! আপনার দেহটি কি একটি মাষ্টারপ্ল্যানেই তৈরি নয়? আপনি আপনার চোখ দুটি বন্ধ করে একবার গভীরভাবে ভাবুন তো! এই চোখ দুটি যদি না থাকত তাহলে কেমন হতো? আমাদের সুন্দরভাবে জীবন-যাপনের জন্য আল্লাহ চোখ, নাক, কান, ত্বক, জিহ্বা সহ প্রয়োজনীয় সকল অঙ্গ সুন্দরভাবে স্থাপন করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা মূলকের ২৩ নং আয়াতে বলেন-
"বলুন! তিনিই তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছেন এবং দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।"
(আল-কুরআন, সূরা মূলক, আয়াতঃ ২৩।)
সত্যিই! আল্লাহর তৈরি এই শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কত সুচারু এবং সুন্দরভাবে তৈরি তা আমরা কখনোই ভেবে দেখি না। হয়তোবা আল্লাহ এজন্যই হাজারে অথবা লক্ষ্যে একজনকে মানসিক বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা শারীরিক প্রতিবন্ধী করে মানুষকে শিক্ষা দেন যে যদি ওই প্রতিবন্ধী মানুষটির মতো যদি কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অভাব থাকতো! বর্তমানে আমরা যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে সুস্থভাবে বেঁচে আছি তাদের মধ্যে যদি আমরা কেউ অন্ধ, কানা, খোড়া, লুলা, পাগল, ভবঘুরে হতাম তবে কেমন হতো আমাদের জীবন? কেমন লাগতো আমাদের এই পৃথিবী? কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতো আমাদের প্রতিটি মূহুর্ত? একজন অপূর্ণ মানুষ হিসেবে কতটা মানসিক যন্ত্রণায় কাটতো আমাদের দিনগুলো? আল্লাহ তায়ালা হয়তোবা এই প্রতিবন্ধী মানুষগুলোকে পরকালে অনন্ত সুখের স্থানে জায়গা করে দিবেন আর এটি অবশ্যই সেই প্রতিবন্ধী মানুষের পিতা-মাতা এবং পুরো মানবজাতির জন্য শিক্ষা যাতে চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ তাদের এই স্বয়ং-সম্পূর্ণ শরীর যে মানুষের প্রতি আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ এই কথা চিন্তা করে মহান আল্লাহর কাছে শুকরগুজারী করতে পারে। এ ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন। পরিশেষে এটুকুই বলা যায় একজন মানুষ যদি পৃথিবীর সবকিছু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র তার নিজের দেহটিকে নিয়েই গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে তাহলে একজন যুক্তিশীল এবং প্রকৃত জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ নিশ্চিত হবেন যে অবশ্যই আমার সৃষ্টির পেছনে কারো হাত আছে; না হলে আমি কখনোই এত সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি হতাম না। মানবদেহ যে শক্তির উপর চলমান থাকে তাকে বলা হয় প্রাণ। একটি প্রাণ কিভাবে নিজে নিজে তৈরি হতে পারে? আবার একজন মানুষের মৃত্যুর পর সে প্রাণ আবার কোথায় যায় তার ব্যাখ্যাই বা কি? যদি আমি নিজে নিজেই তৈরি হতাম তবে আমার মধ্যে ২০৬টি হাড়ের যে সঠিক পরিমাপের সুন্দর বিন্যাস্ত কাঠামো বা কঙ্কাল সেটি না থেকে আমি একটি মাংসপিণ্ডে পরিণত হতে পারতাম। আমি লম্বা না হয়ে শামুকের মত পেঁচিয়ে গুটিয়ে গুটিয়ে চলার মত অবস্থা সম্পন্ন হতে পারতাম। আমার মধ্যে চিন্তা শক্তির এক বিশাল আঁধার বা আমার মস্তিষ্ক এত শক্তিশালী নাও হতে পারত। আমার মধ্যে হার্ট নামের এক আশ্চর্য পাম্প মেশিন যেটি ক্লান্তিহীনভাবে আমার সারা শরীরে রক্ত পাম্প করে যাচ্ছে সেটি অন্য রকমও হতে পারত। আমি যত রঙ্গের পানিই পান করি না কেন সব ধরণের পানি থেকে সব রঙ্গকে ছাকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্কাশিত করে শুধুমাত্র মূত্র নামের এক ধরনের তরল বর্জ্যে পরিণত করে দেহ থেকে বের করে দেয় যে অত্যাশ্চর্য্য জটিল ফাংশানের যন্ত্রটি তার নাম হলো কিডনী। আমি নিজে নিজে তৈরি হলে কিভাবে এরকম একটি জটিল এবং অটো প্রোগ্রাম সেট করে দেওয়া রোবটের মতো নিখুঁত কর্ম সম্পাদনকারী যন্ত্রের উপস্থিতি থাকতে পারে? এটা কি আশ্চর্য্য নয়? মানব জ্ঞানের অনেক উর্ধ্বে আমাদের দেহ নামের এই জটিল ফাংশানের শত জটিল মেশিনের সমন্বয়ে গঠিত এই মেগা মেশিন ফ্যক্টরিটি অবশ্যই কোন একজন মহাজ্ঞানী, মহাসূক্ষ্ম সৃষ্টিকারী, এক মহান ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা সৃষ্ট যার উপরে আর কোন ইঞ্জিনিয়ার নেই। আর তিনি হলেন সেই মহা মহিম স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা।
আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত সমূহ
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা আল জাসিয়াহ এর ১ থেকে ৫ নং আয়াতে বলেছেন-
"হা-মীম। মহা পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে এ কিতাব নাযিলকৃত। নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীনে মুমিনদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। আর তোমাদের সৃষ্টিতে এবং চতুর্দিকে যে জীবজন্তু ছড়িয়ে আছে তাতে নিদর্শনাবলী রয়েছে কওমের জন্য যারা নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন করে। আর রাত ও দিনের পরিবর্তনে, আল্লাহ আসমান থেকে যে রিযিক (পানি) বর্ষণ করেন তারপর তা দ্বারা পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর পুনরজ্জ্বীবিত করেন তাতে এবং বাতাসের পরিবর্তনে সে কওমের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে যারা বুঝে।"
(আল-কুরআন, সূরা আল-জাসিয়া, আয়াতঃ ১ থেকে ৫।)
সত্যিই আমরা কখনোই আল্লাহর দেয়া নেয়ামত গুণে শেষ করতে পারব না। ভীষণ তৃষ্ণার্ত অবস্থায় এক গ্লাস পানি পান করে কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এই পানির সৃষ্টিকর্তা কে? এই পানি যদি আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি না করতেন তাহলে কি অবস্থা হতো? উদ্ভিদ, জীবজন্তু, পশুপাখি, মানুষ প্রত্যেকের জন্য পানি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। আল্লাহ তায়ালা সূরা মূলকের ৩০ নং আয়াতে বলেন-
"বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে তোমাদেরকে সরবরাহ করবে পানির স্রোতধারা?"
(আল-কুরআন, সূরা মূলক, আয়াতঃ ৩০।)
ফলমূলগুলিকে দেখে আপনি চিন্তা করতে পারেন একই পানি দিয়ে আল্লাহর জমিনে কত স্বাদের, কত রকমের ফলমূল তৈরি করেছেন তিনি আবার সবগুলো ফল কত সুরক্ষিতভাবেই তৈরি। হাজারো ফলের মধ্যে শুধুমাত্র আমাদের নিত্য আহার্য্য কিছু ফল নিয়ে যেমন, আম, তরমুজ, আপেল, আঙ্গুর, ডালিম ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করুন। দেখুন, এই সমস্ত ফল-ফলাদীর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ফলগুলোর উপরে একটি খোসা বা আবরণ দিয়ে রেখেছেন যাতে ফলগুলো খাওয়া পর্যন্ত বাইরের সব ধরণের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষিত থাকে। মানুষের রিজিকের জন্য তিনি কত সুন্দর ফুড সিকিউরিটি নিশ্চিত করেছেন। আবার এই ফলের মধ্যে কত সুপরিকল্পিতভাবে ফলমূলগুলোর রি-প্রোডাকশনের জন্য স্থাপন করেছেন বীজ। যাতে বীজ বপনের মাধ্যমে সর্বকালের মানুষের সর্বসময়ের প্রয়োজন মেটাতে এগুলোর উৎপাদন অব্যাহত থাকে যুগের পর যুগ বা কেয়ামত পর্যন্ত। একবার ভাবুন তো! আমরা যে আজ আমটি, আপেলটি, আনারটি তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছি সেটি পৃথিবীর সূচনা লগ্নে শুধুমাত্র একটি গাছেই তো আল্লাহর হুকুমে ধরেছিল এবং বংশবিস্তারের মাধ্যমে এই ফলগুলো বা ফলের গাছগুলো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এবং পুণঃবপনের মাধ্যমে সবসময় এগুলোর উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এভাবে আপনি পৃথিবীর সবধরণের ফলমূল ও শাকসবজির কথা চিন্তা করতে পারেন। তাহলে ভাবুন তো! যদি এই ফলগুলো নিজে নিজেই তৈরি হতো তবে তার মধ্যে অনেক অসামঞ্জস্যতা বা অনেক অপূর্ণতা থাকতে পারতো। যদি ফল-ফলাদীগুলো আপনা আপনি প্রস্তুত হতো তবে শুধু এক জাতের ফল হলেই তো পারতো, ভাবুন তো! এত জাতের, এত স্বাদের, এত রঙ্গের কেন হলো? তরমুজের খোসা নাও থাকতে পারতো! যার ফলে তরমুজের রসটা মাটিতে গড়িয়ে পড়তে পারতো, ধূলোবালি লেগে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়তে পারতো! আবার বংশ বিস্তার না হওয়ার জন্য বীজের ব্যবস্থা না থাকলেও পারত। আপনি যদি সত্যিই একজন যুক্তিবাদী, বুদ্ধিমান এবং চিন্তাশীল ব্যক্তি হোন তাহলে সৃষ্টিকর্তাকে চেনার জন্য আপনার বেশি দূর যাওয়া লাগবে না। শুধুমাত্র পানি, মাটি, ফলমূল আর শাক-সবজির কথা চিন্তা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন। এগুলো কখনোই নিজে নিজে আসতে পারে না! এগুলোকে নিশ্চয়ই কোন একজন সুদক্ষ, মহাসূক্ষ্ম, সুচারু কারিগর তৈরি করেছেন। আর এই মহা কারিগর হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যার ক্ষমতার কথা আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের চিন্তা শক্তির বহু দূরে, বহু বাইরে!
সময়
এক ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ আছে তা বিশ্বাস করত না। একদা সেই নাস্তিক ব্যক্তি হযরত ইমাম আবু হানিফা (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি) এর সাথে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের ব্যাপারে যুক্তিতর্ক করার দিন তারিখ এবং সময় নির্ধারণ করল। কথামত নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে নাস্তিক ব্যক্তি এসে হযরত ইমাম আবু হানিফা (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি) এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল কিন্তু হযরত ইমাম আবু হানিফা (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি) নির্ধারিত সময়ের অনেক দেরিতে এসে পৌঁছালেন। নাস্তিক ব্যক্তি রেগে গিয়ে দেরি করার কারণ জিজ্ঞেস করলে হযরত ইমাম আবু হানিফা (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি) উত্তরে বললেন "নদীতে কোন নৌকা ছিল না, আমি নৌকার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে নদীর ধারে একটি গাছ নিজে নিজেই কেটে পড়ল এবং নিজে নিজেই চিরে তক্তা হলো। পরে আবার তক্তাগুলো আপনা-আপনি জোড়া লেগে একটি নৌকা তৈরি হলো। নৌকাটি কোন মাঝি বা বৈঠা ছাড়াই আমাকে নদী পার করে গন্তব্যে পৌঁছে দিলো। এজন্যই আমার কিছুটা দেরি হলো। নাস্তিক তার কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো আর বলল- "আপনার সাথে কি যুক্তিতর্ক করবো, আপনি তো একটা আস্ত পাগল! এটা কি কখনোই সম্ভব যে, কোন মিস্ত্রী ছাড়া, একটি গাছ আপনা আপনি চিড়ে নৌকা তৈরি হয়ে যাবে আবার সেই নৌকা আপনা আপনি ভেসে চলে আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে? আপনি সম্পূর্ণ, মিথ্যে , ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা বলছেন।" হযরত ইমাম আবু হানিফা (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি) বললেন- "এবার আপনি সঠিক রাস্তায় এসেছেন, এই সামান্য নৌকা বানাতে যদি একজন কারিগর লাগে তাহলে আমি, আপনি, এই পৃথিবী, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সহ এই বিশাল মহাবিশ্বের সবকিছু যেগুলো সবাই একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে একান্ত বাধ্যগতভাবে চলছে তাহলে এগুলো কিভাবে নিজে নিজেই চলে আসল? একবার গভীরভাবে ভাবুন তো! অবশ্যই এগুলোর ম্যকার বা কারিগর আছেন যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন এবং সুচারুরূপে পরিচালনা করে আসছেন।" এখন অনেক নাস্তিক প্রশ্ন করতে পারে 'যদি সবকিছুর একজন সৃষ্টিকর্তা সত্যিই থেকে থাকেন তাহলে সেই সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করল?' এক্ষেত্রে সেসব নাস্তিকের কাছে আমার প্রশ্ন হলো যদি সৃষ্টিকর্তাকে কেউ সৃষ্টি করে থাকেন তবে তিনি কি করে সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা হলেন? তিনি তো সৃষ্টি! তর্কের খাতিরে যদি বলি, যদি আল্লাহকে কেউ সৃষ্টি করে থাকেন তবে আল্লাহর সেই সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছেন? যদি তারও একজন সৃষ্টিকর্তা পাওয়া যায় তবে প্রশ্ন আসবে তাহলে সেই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছেন? এভাবে যদি আপনি প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন দাঁড় করাতে থাকেন তবে তার আর শেষ হবে না। বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যাবে। সুতরাং আপনাকে থামতেই হবে। সংক্ষেপে বলা যায় আল্লাহকে যদি কেউ সৃষ্টি করেই থাকেন বা আল্লাহ যদি কারো সৃষ্টি হয়েই থাকেন তাহলে তো আল্লাহ আর সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা থাকলেন না। সুতরাং কথা দাঁড়ায় যাকে কেউ সৃষ্টি করেনি তিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আর যিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনিই অর্থাৎ সেই মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই পবিত্র কুরআনের সূরা ইখলাসে তার পরিচয় সুনিশ্চিত করে বলেছেন-
"বলুন! তিনি আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়, তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তার সমতুল্য কেউ নেই।"
(আল-কুরআন, সূরাঃ ইখলাস।)
আর একটি বিষয় হলো আল্লাহ মহাবিশ্বের পাশাপাশি সময়কেও সৃষ্টি করেছেন। আমরা সময় দ্বারা আবদ্ধ বলেই আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আছে। আর তাই আমরা ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আল্লাহকেও আমাদের মধ্যে যে সময়ের একটি গন্ডি সেই সময়ের আবর্তে ফেলে চিন্তা করি। কিন্তু তিনি সময়ের অনেক উর্ধ্বে। উদাহরণস্বরূপ বর্তমানে জগতে সবচেয়ে গতি হচ্ছে আলোর। আলো প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার বেগে ছুটে। ধরুন ১ কি. মি. আপনার হেঁটে যেতে সময় লাগল ১ ঘন্টা। আর এক ব্যক্তি সেই একই রাস্তা যদি গাড়িতে যায় তবে তার সময় লাগল হয়ত ১০ মিনিট। অন্য আরেকজন ব্যক্তি যদি সেই একই রাস্তা বিমানে যায় তবে হয়ত সময় লাগবে ধরুন ১ মিনিট। এখন যদি কেউ সেই একই রাস্তা আলোর গতিতে পাড়ি দেয় তাহলে তার ক্ষেত্রে কত সময় লাগতে পারে? আসলে তার মোটেও সময় লাগবে না! কারণ যেখানে আলো মাত্র ১ সেকেন্ডে পাড়ি দেয় ৩ লক্ষ কিলোমিটার সেক্ষেত্রে আলোর গতিতে ১ কিলোমিটার পথ দিতে সময় লাগবে ১ সেকেন্ডের ৩ লক্ষ ভাগের ১ ভাগ যা আমাদের মস্তিষ্ক দ্বারা সময়ের কোন মুহুর্তকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমাদের নেই বা এক কথায় বলতে গেলে তাকে সময় বলে মনেই হবে না। এখন এই চার ব্যক্তি একই গন্তব্যে একই সময়ে একই স্থানে যাত্রা শুরু করে কিন্তু প্রত্যেকের গতির মান ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় একেক জনের কাছে সময়ের মান একেক রকম। এখানে দেখুন যে ব্যক্তিটি আলোর গতিতে ছুটেছে তার কাছে সময়ের মান একেবারে শুণ্য বা তার কাছে অতীত বর্তমান বা ভবিষ্যতের যে মানটা তার একবারে নামমাত্র বা নগণ্য। কারণ তার গতি ছিল এই জগতের সর্বোচ্চ গতি যা হলো আলোর গতি। আলোর গতিকে আমরা কল্পনা করতে পারি কিন্তু আল্লাহর গতি কি রকম হবে একবার কি ভেবে দেখেছেন? আল্লাহর গতি কি রকম তা কল্পনা করা বা ধারণ করার ক্ষমতা কি আমাদের মস্তিষ্কের আছে? সুতরাং এটাই ধরে নেওয়া যায় যে, আল্লাহর গতি আলোর গতির চাইতে কোটি কোটি গুণ বেশি এবং কত বেশি তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। সুতরাং যে সময়ের ব্যাপারে আমাদের যে একটি প্রাত্যহিক মানদণ্ড আছে তা আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ আল্লাহ সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত। যার কারণে সময় আল্লাহর কাছে স্থির। যার কারণে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। তার কাছে সময়ের মান সর্বদা একই রকম। আল্লাহ যেমন অদৃশ্য বায়ুকে সৃষ্টি করেছেন তেমনি সময়কেও সৃষ্টি করেছেন। আর এই পৃথিবীতে সময়ের মূল্য অনেক কারণ আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন চাহিদা দিয়ে। পাশাপাশি মানুষের চাহিদার সব উপকরণও তিনি এই পৃথিবীতে দিয়ে দিয়েছেন কিন্তু সংগ্রহ করার জন্য বেঁধে দিয়েছেন নির্দিষ্ট সময়। সময়ের আগে বা পিছে হলে তা ফলপ্রসূ হয় না। এ জন্যই সময় আমাদের কাছে অনেক মূল্যবান। উদাহরণস্বরূপ আমাদের যখন ক্ষিদে পায় তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের খাবার খেতে হয়, যদি নির্দিষ্ট সময়ে খাবার না খাই তবে আমাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করবে। যদি একটানা ৩০ দিন খাবার না খেয়ে থাকি তবে ৩০ দিন পর মারা যাবো। মারা যাওয়ার পর যদি আমাকে খাইয়ে দেওয়া হয় তবে তা আর কোন কাজে আসবে না। এই ৩০ দিনই হলো খাবার গ্রহণের নির্ধারিত সময়। এখন নির্ধারিত সময়ে খাবার গ্রহণের জন্য তার পূর্বেই আমাকে খাবার সংগ্রহ করে রাখতে হবে নিশ্চয়ই। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বা পুনরায় ক্ষিদে লাগার পূর্বেই আমি খাবার বা প্রয়োজনীয় টাকা সংগ্রহ করে না রাখি তবে আমি খাবার পাব না। একইভাবে আমাকে পরীক্ষায় পাশ করতে গেলে পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের সব পড়া পড়ে নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের পূর্বে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে না পারলে আমি পরীক্ষায় নিশ্চিতভাবে অকৃতকার্য হবো। আমি বিয়ে করে সংসারী হওয়ার পূর্বের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমাকে বিয়ে করার জন্য উপযুক্ত হতে হবে বা আয় রোজগার করে স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষনের সামর্থ্য অর্জন করতে না পারা পর্যন্ত আমি বিয়ে করতে পারব না। পাশাপাশি আমি বিয়ে করার জন্য একটি নির্দিষ্ট বয়স বা সময় নির্ধারিত রয়েছে, সেটি হলো যৌবনকাল যা হলো আমাদের বয়সের নির্দিষ্ট একটি সময়। আমি রোগাক্রান্ত হলে লক্ষণ দেখার সাথে সাথেই আমাকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। যদি আমি রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন না হই তবে রোগটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চিকিৎসা গ্রহণ না করার ফলে আমার মৃত্যু ঘটতে পারে। সুতরাং বলা যায় সবকিছুর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা আছে। তাই আমাদের সবকিছুর সাথে সময় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটু পর কি খাবো বা কি করব, অতীতে কি কাজ করেছি বা কত সম্পদ অর্জন করেছি, আর এখন কিছু একটা করছি, একটু পর তার ফল পাব। ধরুন আমার ডিউটিতে যেতে হবে, তার পূর্বেই ক্লান্তি দূর হওয়ার জন্য আরাম করছি। রান্না করছি, একটু পর খাবো অথবা আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে, দিন শেষে রাত আবার রাত শেষে দিন হচ্ছে, জন্মগ্রহণ করেছি, ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি, আবার মৃত্যুবরণ করবো। এইভাবে আমাদের জীবনের সবকিছু সময়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে সময়কে গতিশীল করেছে। এখন আপনি আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন যদি আপনাকে আলাদাভাবে সৃষ্টি করা হয়, আপনাকে যদি একটি নির্দিষ্ট বয়স দেওয়া হয়, ধরুন ৩৩ বছর বয়সের পর আপনি আর কখনো বৃদ্ধ হবেন না আর মৃত্যুও বরণ করবেন না। বা আবার যদি আপনাকে একটি নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য দেওয়া হয় যখন আপনি যতই খান মোটা হবেন না আবার শুকাবেনও না, কখনো অসুস্থ হবেন না। তাহলে যেহেতু আপনার একটা শরীরের অবস্থা এক ধরণের ফিঙ্ড হয়ে যাবে, একটা নির্দিষ্ট বয়সের, একটা নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যের কোন তারতম্য হবে না সেক্ষেত্রে কিন্তু সময়ের কোন মূল্য বা বিশেষ কোন ভ্যালূ থাকবে না। অথবা আপনার ক্ষেত্রে আপনি সময়কে স্থির বলতে পারেন। আবার ধরুন আপনার জন্য সকল প্রকারের খাদ্য সামগ্রী এমনভাবে প্রস্তুত আছে যে আপনি যতই খান না কেন কখনো শেষ হবে না আবার এসব খাদ্য সামগ্রীর জন্য আপনাকে কোন পরিশ্রমও করতে হবে না সেক্ষেত্রেও যেহেতু আপনার খাবারের ব্যাপারে আপনাকে অতীত নিয়ে চিন্তা করতে হবে বা ভবিষ্যতের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হবে না সেহেতু তখনও আপনার কাছে সময় ভ্যালূলেস থাকবে বা সময় এক প্রকার স্থির থাকবে। আবার আপনি যতই খান না কেন আপনাকে কখনো টয়লেট যেতে হবে না, আরামের একটা ঢেকুর আসলেই টয়লেটের যাওয়ার কাজ হয়ে যাবে, সুন্দর একটা আলোকোজ্জ্বল নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ফিক্সড থাকবে। বড় বড় প্রাসাদ, বিশাল জায়গা, নদ-নদী, ঝর্ণাধারা, ফলমূল, সুন্দরী হুর-নারীরা স্ত্রী রূপে আপনার জন্য প্রস্তুত থাকবে যা কখনও শেষ হবে না। আপনি শুধু সবার সাথে খোশ-গল্পে মেতে থাকবেন আর কোটি কোটি অফুরন্ত নেয়ামত ভোগ করতে থাকবেন। ভবিষ্যতে কি করব বলে কিছুই থাকবে না। সব সময় একই রকম। এবং কখনোই আপনার মধ্যে এক ঘেয়েমি আসবে না বরং জান্নাতের সমস্ত নিয়ামতকে আপনি নতুন রূপে, নতুন বিস্ময়ে, নতুন স্বাদে, নতুন আলোকে শুধুই উপভোগ করতে থাকবেন এবং মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমাকে শুধুই নতুনভাবে অবলোকন করতে থাকবেন। তখন সময়ের কোন ভ্যালূই থাকবে না। গভীরভাবে চিন্তা করলে সময়কে স্থির মনে হবে। আর এরকম অকল্পনীয় নেয়ামত পূর্ণ জীবনোপকরণ সৃষ্টিকর্তা রেখেছেন চিরস্থায়ী অনন্তকালের জান্নাতে। আর সেখানে হয়তোবা সৃষ্টিকর্তা সময়কে স্থির করে দেবেন অর্থাৎ কোন নেয়ামত শেষ হবে না আবার সবকিছু একই রকম থাকবে তাই হয়ত বা সময়ের চিন্তা মাথায়ই আসবে না। আর এ বিষয়ে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। আসলে আল্লাহকে নিয়ে অথবা তার অসীম বিশালতা ও ক্ষমতার কথা আমরা ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কখনও চিন্তা করতে পারব না। ঠিক একটি শক্তিশালী রোবটের মত। আপনার তৈরি একটি শক্তিশালী রোবট যেমন আপনার সব কাজ করে দিতে পারলেও আপনার অস্তিত্বের কথা চিন্তা করতে পারে না ঠিক তেমনি আমরা আল্লাহর সৃষ্টি হয়ে এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের বেশি আল্লাহকে নিয়েও চিন্তা করতে পারব না। তাই একজন বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী চিন্তাশীল ব্যক্তির কাজ হবে এই মহান আল্লাহকে মেনে নিয়ে তার ইবাদত করে পরকালে চিরস্থায়ী জান্নাত নিশ্চিত করা। আর উদাসীন অভাগারা হাজার যুক্তি পেলেও কখনও তার সৃষ্টিকর্তাকে মেনে নেবে না। আবার নিজের মৃত্যু থেকে বা নিজের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। শুধু অহংকার নিয়ে কিছুদিন বেঁচে থেকে এই দুনিয়ার পরীক্ষায় ফেল করে জাহান্নামের রাস্তা পরিষ্কার করবে।
উদাসীন মানুষ
হে মানুষ!
Comments
Post a Comment