সৈয়দ আহমদ

মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর আন্দোলনের সাথে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর গোপন যোগাযোগ

সোলায়মান আযহার -এর স্বীকৃতি

টেক্সট্ রেডীঃ মুহাম্মদ আব্দুল খালেক

সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর আক্বিদা সংক্রান্ত বিষয়ে এবং আন্দোলন সম্পর্কে জানতে হলে তার দীর্ঘ হজ্বের সফর সম্পর্কে জানা থাকা উচিত। তিনি ইসমাঈল দেহলভীসহ ৭৫০ লোকের বিরাট কাফেলা নিয়ে হজ্ব করতে যান ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে। দীর্ঘ ৪ বছর আরবে অবস্থান করে ১৮২০ খৃষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন। এই দীর্ঘ সময় তিনি কী করেছিলেন? কোথায় গিয়েছিলেন? কার সাথে দেখা করেছিলেন? কার সাথে মিলিত হয়েছিলেন? কার নিকট থেকে ওহাবী আন্দোলনের শিক্ষা ও পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন? -সে সম্পর্কে স্বয়ং সউদী বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ কর্তৃক সমর্থিত ও প্রকাশিত আরবী গ্রন্থ "শেখ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব" গ্রন্থে বিস্তারিত বিবরণ লেখা আছে।

সুলায়মান আযহারের স্বীকৃতিঃ
শেখ আব্দুল গফুর আত্তার কর্তৃক আরবীতে লিখিত এবং শেখ আহমদ সাদেক খলীল কর্তৃক উর্দূতে অনূদিত উক্ত গ্রন্থের "মুখবন্ধ" লিখেছেন সৈয়দ ভক্ত আহলে হাদীস নেতা মুহাম্মদ সুলায়মান আযহার ১৩৯৫ হিজরী শাবান মাসে। উক্ত "মুখবন্ধ" -এ তিনি লিখেছেন- "বেরলভী উলামাগণ (আ'লা হযরত) হিন্দুস্তানী মুজাহিদগণের ওহাবী চিন্তাধারার কারণে তাদেরকে ওহাবী বলে প্রচার করেছেন এবং এর কারণ স্বরূপ বলেছেন যে, "হজ্বের সফরে গিয়ে সৈয়দ আহমদ ও শাহ ইসমাঈল দেহলভী ওহাবী আক্বায়েদ হিন্দুস্তানে আমদানী করেছেন"।

তিনি (সোলায়মান) আরো বলেছেন- আমাদের (আহলে হাদীস কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ ওলামারা বলেছেন-বেরেলীপন্থীদের এই দাবী সঠিক নয়। কিন্তু আমি (সুলায়মান আযহার) আরবের ওহাবী আন্দোলন ও ভারতের সৈয়দ আহমদ বেরলভী আন্দোলনের মধ্যে সাদৃশ্য ও পরস্পর সহযোগিতার বিষয়টি একেবারে অস্বীকার করতে পারি না। কেননা, দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী আন্দোলন সমূহের মধ্যে সমমনা আন্দোলন হতে প্রেরণা ও নীতিমালা গ্রহণ করার রীতি স্বীকৃত। সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও শাহ ইসমাঈল দেহলভী ১৮২২ খৃষ্টাব্দে (১৮১৬) কাফেলা নিয়ে হজ্ব করতে গিয়েছিলেন। ঐ বছরের সমাবেশটি ছিল বিরাট ঐতিহাসিক গুরুত্ববহনকারী সমাবেশ। কারণ, ঐ সমাবেশে সৈয়দ আহমদ বেরলভী, শাহ ইসমাঈল দেহলভী, মাওলানা আব্দুল হাই ও বাংলার তিতুমীর (যা পরে হাজী শরীয়ত উল্লাহর আন্দোলনে একীভূত হয়ে গিয়েছিল) এবং মরক্কোর সিন্নুসী আল-কবির উপস্থিত ছিলেন। সুমাত্রার ওহাবী আন্দোলনের নেতাও ঐ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। সুমাত্রার ওহাবী নেতাদের সাথে সৈয়দ আহমদের অতি গোপন আলাপও হয়েছিল।

এই গোপন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কারণেই ১৮২৩ইং সালটি সুমাত্রার ওহাবী আন্দোলনের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা, সুমাত্রা ও ভারতের ওহাবী আন্দোলনের মধ্যে বিষ্ময়কর মিল ছিল। উভয় দেশের ওহাবী আন্দোলনের আক্বিদা, বিশ্বাস, চিন্তাধারা, উদ্দেশ্য- এমনকি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কর্মসূচীর মধ্যেও আশ্চর্যজনক মিল ছিল। কর্ম পদ্ধতির মিল- পাহাড়ী উপজাতীয় অঞ্চলে ঘাঁটি করা, রাত্রে আক্রমণ পরিচালনা করা, গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ করা, নিজ নেতার জন্য অতি উচ্চ ধর্মীয় উপাধি গ্রহণ করা ও ধর্মীয় সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী মনে করা- ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে উভয় আন্দোলনের মধ্যে মিল ছিল।

সুমাত্রার ওহাবী আন্দোলনের নেতা মুহাম্মদ সাব্বাব -এর উপাধি ছিল "আমিরুল মো'মেনীন"। উভয় দেশের একই পদ্ধতিতে আন্দোলন করার দ্বারা বুঝা যায় যে, সৈয়দ আহমদের ওহাবী আন্দোলন ও সুমাত্রার মুহাম্মদ সাব্বাব -এর ওহাবী আন্দোলনের মধ্যে কর্ম পদ্ধতির ঐক্য ছিল।

আর একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৈয়দ আহমদ বেরলভীর পক্ষে হিন্দুস্তানের প্রতিনিধি হেকিম এরাদত হোসাইন সব সময় মক্কায় অবস্থান করতেন দূত হিসেবে- যেন বিভিন্ন মুসলিম দেশের আন্দোলনরত দলগুলোর সাথে গোপনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষা করা যায়।

"এতেও আমার (সুলায়মান আযহার) কোন সন্দেহ নেই যে, আরবীয় সংস্কারক মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর মতবাদে সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও শাহ ইসমাঈল দেহলভী অনুপ্রাণিত ও দীক্ষিত হয়েছিলেন। তারা উভয়ে আরবে অবস্থানকালে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর আন্দোলন সম্পর্কে যথেষ্ট খাপড়া করেছিলেন। বিপ্লবী আন্দোলনের এটাই নিয়ম।

আর ঐ হজ্বের সফরেই হিন্দুস্তানী ওহাবী নেতারা আরবের বহু ওহাবী উলামাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ কথাও সত্য যে, সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদীর আক্বিদার মধ্যে যথেষ্ট মিল ছিল। কেননা, তারা উভয়ে ছিলেন লা মাযহাবী -তথা সরাসরি কোরআন ও হাদিসের অনুসারী"। (শেখ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব, "মুখবন্ধ" পৃষ্ঠাঃ ৭-১০)

মুখবন্ধের অনুবাদঃ সুন্নী গবেষণা কেন্দ্র

উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করলো করা?

-অধ্যক্ষ হাফেয এম. এ. জলিল

ভূমিকাঃ ইতিহাস পাঠে জানা যায়- উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন আউলিয়ায়ে কেরাম। হযরত খাজা গরীব নওয়াজ (রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি) ইসলাম প্রচার করেছেন হিন্দুস্তানে ৫৮৬ হিজরী হতে ৬৩২ হিজরী পর্যন্ত মোট ৪৬ বছর। তাঁর হাতে ৯০ লক্ষ লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। খাজা বাবার আগমনের ২ বৎসরের মাথায় ৫৮৮ হিজরী মোতাবেক ১১৯২ খৃষ্টাব্দে খাজা বাবার স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে ঘোর রাজ্যের অধিপতি সুলতান মুহাম্মদ ঘোরী দিল্লী আক্রমণ করে তারাঈনের যুদ্ধে রাজা পৃত্থিরাজকে পরাজিত ও নিহত করে দিল্লী দখল করেন এবং উপমহাদেশে স্থায়ী মুসলিম রাষ্ট্র কায়েম করেন ও খাজা বাবার হাতে বায়াআত গ্রহণ করেন। উক্ত রাষ্ট্র ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৬৬৬ বৎসর দিল্লীতে কায়েম ছিল। উল্লেখ্য যে, খাজা গরীব নওয়াজ (রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি) এবং তাঁর অনুসারী সকলেই ছিলেন হানাফী এবং সুন্নী। খাজা গরীব নওয়াজের পর সিলেট জয় করে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন হযরত শাহজালাল (রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি) ও তাঁর সঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ায়ে কেরাম। এটা চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের ঘটনা। হযরত শাহজালাল ও তাঁর সঙ্গী এবং নব দিক্ষীত অনুসারী মুসলমানরা সবাই ছিলেন হানাফী ও সুন্নী। এভাবে গোটা পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা হানাফী ও সুন্নী মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন। অবশ্য মুঘল যুগে ইরানীয় আমির উমারাদের প্রভাবে নগন্য সংখ্যক শিয়ার উদ্ভব লক্ষ করা যায়। এই ব্যতিক্রম ছাড়া মোটামোটিভাবে গোটা ভারত উপমহাদেশে সুন্নীদেরই প্রাধান্য ছিল। ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে প্রথমে চালু হয় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায়। আস্তে আস্তে ইংরেজ শাসন সম্প্রসারিত হতে থাকে। একশত বৎসর পর ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ দেখা দিলে ইংরেজরা তা কঠোর হস্তে দমন করে এবং ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ্কে গদীচ্যুত করে দিল্লী দখল করে নেয়। বাহাদুর শাহ্কে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠিয়ে ইংরেজরা মুসলমানদের উপর অকথ্য জুলুম ও নিপীড়ন চালাতে থাকে। সে সময় সুন্নী উলামায়ে কেরাম ও তাদের অনুসারীরা বাহাদুর শাহের পক্ষে বিদ্রোহ করেছিলেন বলে ইংরেজরা সুন্নী নেতা আল্লামা ফজলুল হক খায়রাবাদীকে বন্দী করে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত করে এবং অন্যান্য সুন্নী উলামায়ে কেরামকে ফাঁসিতে লটকায়। প্রাণের ভয়ে সুন্নী মুসলমানরা আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দ হতে ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ৯০ বৎসর কাল সুন্নী মুসলমানদের জন্য বড়ই দূর্দিন ছিল। এই সুযোগে এই ৯০ বৎসর কালে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে দুটি বাতিল ফের্কার সৃষ্টি হয়। একটি হলো ওহাবী ফের্কা, অন্যটি হলো কাদিয়ানী ফের্কা। ওহাবী মতবাদের প্রথম আমদানী হয়েছিল ১৮১৬-২০ খৃষ্টাব্দে। এই সময় ছৈয়দ আহমদ বেরলভী ও ইসমাইল দেহলভী বিরাট হজ্ব কাফেলা নিয়ে মক্কা শরীফ গমন করেন এবং ৪ বৎসর কাল মক্কা মদিনা ও নজদ ভ্রমণ করে ওহাবী মতবাদ গ্রহণ করে ভারতে ১৮২০ খৃষ্টাব্দে প্রত্যাবর্তন করেন। তারা উভয়ে "আওর মোহাম্মদীয়া তরিকা" নাম দিয়ে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদীর ওহাবী মতবাদ প্রচার করতে থাকেন এবং তরিকায়ে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া, মোজাদ্দেদীয়া আওর মোহাম্মদীয়া-এর উপর বায়আত গ্রহণ করতে শুরু করেন। ইসমাইল দেহলভী আপন পীর ছৈয়দ আহমদ বেরলভীর নির্দেশেও এজাযতক্রমে সিরাতে মোস্তাকীম, তাকভিয়াতুল ঈমান, ইযাহুল হক ও একরোজী নামক ঈমান বিধ্বংসী কিতাবাদী রচনা করতে শুরু করেন। তাকভিয়াতুল ঈমান কিতাবকে সমর্থন করে পরবর্তীতে মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী সাহেব তাঁর বিখ্যাত কিতাব জখিরায়ে কারামত রচনা করেন। উল্লেখ্য যে, মাওলানা কারামত আলী সাহেব এবং ইসমাইল দেহলভী- উভয়েই ছৈয়দ আহমদ বেরলভীর মুরিদ এবং পরস্পর পীরভাই ছিলেন। জৌনপুরী সাহেব তাকভিয়াতুল ঈমান সম্পর্কে লিখেন- "যার ঘরে তাকভিয়াতুল ঈমান মওজুদ আছে, তার ঘরে প্রকৃত ঈমানও মৌজুদ আছে"। (জাখিরায়ে কারামত)

যাক, ভারতে কুখ্যাত ওহাবী নজদী আক্বিদা ও মতবাদ প্রথম আমদানী করে ইসমাঈল বেরলভী ও তার কথিত পীর ছৈয়দ আহমদ বেরলভী। এ সম্পর্কে একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলীল আমার হস্তগত হয়েছে। দলীলটি হচ্ছে- সউদ ওহাবী বা বাদশাহ্ ফয়সালের সমর্থিত এবং রয়াল প্রেস ও প্রকাশনা কর্তৃক মুদ্রিত একটি কিতাব- নাম "শেখ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদী"। গ্রন্থটি আরবীতে লেখা। উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ আছে- "হিন্দুস্তানের ছৈয়দ আহমদ বেরেলী ১৮১৬ খৃষ্টাব্দ হতে ১৮২০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে আরবে অবস্থান করে ওহাবী মতবাদ গ্রহণ করেন এবং নিজ দেশে গিয়ে তা প্রচার করেন"। উক্ত গ্রন্থে ইবনে ওহাব নজদীর মতবাদ গ্রহণকারী ও প্রচারকারী বিভিন্ন দেশের খলিফাদের একটি তালিকাও পেশ করা হয়েছে। যাদের খলিফা ও এজেন্ট ছিলেন ছৈয়দ আহমদ বেরেলী- তাদের সাক্ষ্য ও দাবীই ঐতিহাসিক বিচারে চুড়ান্ত বলে বিবেচিত। অন্যরা রাজনৈতিক কারণে ঘটনাকে ভিন্নরূপ দিয়েছে। "মকসুদুল মোমেনীন" -এর লেখক কাজী গোলামুর রহমান তাঁর"শাহজালাল" নামক গ্রন্থে তরিকায়ে মোহাম্মদীয়াকে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদীর তরিকা বলে উল্লেখ করেছেন। ছৈয়দ আহমদ বেরেলীর আক্বিদা সম্পর্কে মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী সাহেব তার জখিরায়ে কারামত গ্রন্থের ৩য় খন্ড বাবে শশম অধ্যায়ে লিখেন- "আমি এবং আমার পীর ছৈয়দ আহমদ বেরেলী উরস, ফাতেহা ও কবর পূজাকে (কবর যিয়ারত কে) হারাম, বিদআত ও শির্ক বলে মনে করি। এই কারণে লোকেরা আমাকে ও আমার পীরকে ওহাবী বলে"। (জখিরায়ে কারামত ৩য় খন্ড ৬ষ্ঠ অধ্যায়)। মাওলানা কারামত আলী সাহেবের স্বীকৃত দাবী অগ্রাহ্য করা যায় না। তাঁর দাবীতেই প্রমাণিত হয়- তাঁরা কী ছিলেন।

অনৈক্যের প্রথম পদক্ষেপ

ইসমাঈল দেহলভীর "তাকভিয়াতুল ঈমান"
ইসমাঈল দেহলভীর কুফরী আক্বিদার নমূনা চট্টগ্রাম মাসিক "তরজুমান" যিলহজ্ব ১৪১৯ হিজরী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত প্রবন্ধে মির্জা হায়রত দেহলভী ও জাফর থানেশ্বরীর বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসমাঈল দেহলভী ও তার পীর ইংরেজদের দালাল ছিল। সৈয়দ আহমদ বেরলভী কলকাতার বিভিন্ন মাহফিলে লোকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল- (১) "কেউ যদি ইংরেজদের উপর হামলা করে, তাহলে তা প্রতিহত করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ এবং তাদের গায়ে কোন আঁচড় লাগতে না দেয়া অবশ্য কর্তব্য"। (হায়াতে তৈয়্যেবা, পৃঃ ২৯৬) (২) "এমন সৎ ও নিরপেক্ষ ইংজের সরকারের বিরুদ্ধে কোন প্রকারের জেহাদই দূরস্ত নয়"? (তাওয়ারিখে আজিবা, পৃঃ ৭৩)। ইসমাঈল দেহলভী ও সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর সম্পর্কে উক্ত দু'টি মন্তব্য দুজন ওহাবী ঐতিহাসিকের। মির্জা হায়রত দেহলভী ও জাফর থানেশ্বরী দুজনই ওহাবী ও লা মাযহাবী আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলেন। সুতরাং তাদের মন্তব্যে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হচ্ছে যে, ইসমাঈল দেহলভী ও ছৈয়দ আহমদ বেরেলীর তথাকথিত জেহাদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছিল না- বরং তা ছিল পেশোয়ারের পাঠান সুন্নী মুসলমানদের বিরুদ্ধে। সেখানে ৫ বৎসর পর্যন্ত (১৮২৮-৩১ খৃষ্টাব্দ) ছৈয়দ আহমদ বেরেলী উপজাতীয় ইউসুফযায়ী সুন্নী পাঠানদের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধ করেছিল। (দেখুন তারিখে হাজারা এবং তারিখে নজদ ও হেজায প্রভৃতি গ্রন্থ)

ইসমাঈল দেহলভী (জন্ম ১৭৭৯ ইং মৃত্যু ১৮৩১ ইং)। সে যেসব বেদ্বীনী ও কুফরী আক্বিদা প্রচার করেছে- সেগুলো হুবহু ইবনে ওহাব নজদীর আক্বিদা এবং এর সংখ্যা ৭০ টি। যেমন (১) আল্লাহ তা'য়ালা যখন ইচ্ছা করেন- তখনই কেবল গায়েব বা অদৃশ্য বিষয় জানেন- আগে বা পরে নয়। (২) আল্লাহ স্থান ও কাল থেকে পবিত্র নহেন। (৩) মিথ্যা বলা আল্লাহর পক্ষে মূলতঃ অসম্ভব নয়। (৪) আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে কেরামকে শাফাআতকারী বলে বিশ্বাস করা শির্ক। (৫) নবীজীর জন্য ইলমে গায়েব ও হাযির-নাযির মানা শির্ক। (৬) রাসুল করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর ইচ্ছায় কিছুই হয় না। (৭) খোদার নিকট নবী ও রাসুলগণের সম্মান চামারের চেয়েও নিকৃষ্ট। (৮) নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) মরে, পঁচে- গলে মাটির সাথে মিশে গেছেন। (৯) নবীজীর রওযা মোবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা শির্ক। (১০) নামাযের মধ্যে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর খেয়াল করা গরু গাধার খেয়াল করার চাইতেও জঘণ্য- ইত্যাদি (দেখুন তাকভিয়াতুল ঈমান, রিসালা একরোজী, সিরাতে মোস্তাকীম)-। সুন্নী মুসলমানদের আক্বিদা ও বিশ্বাস এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসমাঈল দেহলভীর লেখনীর জোর ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও যাদুকরী। তাই কিছু লোক বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ১২৪০ হিজরীতে দিল্লীর শাহী মসজিদে ইসমাঈল দেহলভীর সাথে তার দুই চাচাতো ভাই শাহ ও শাহ মাখ্সুসুল্লাহ এবং ফজলে হক খায়রাবাদীর এক ঐতিহাসিক মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত মুনাযারায় ১৩টি আকায়েদ বিষয়ে পরাজিত হয়ে ইসমাঈল দেহলভী পলায়ণ করে জান বাঁচায়। এতে করে তার মতবাদ কিছু দিনের জন্য (১৮৩১-১৮৫৭) স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পর (১৮৫৭ ইং) যখন ফজলে হক খায়রাবাদী সহ অন্যান্য সুন্নী উলামাগণের উপর ইংরেজদের খড়গহস্ত নেমে আসে- সে সুযোগে উক্ত মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ইংরেজদের সহায়তায় ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেওবন্দী বুযুর্গরা সযত্নে ইসমাঈল দেহলভীর প্রচারিত আক্বিদাকে নতুন আঙ্গিকে পেশ করতে শুরু করেন। এভাবেই ভারতে মুসলমানদের মধ্যে আর একটি নতুন ফর্কার সৃষ্টি হয়- যার নাম ওহাবী ফের্কা। ওহাবী মতবাদ প্রচারের প্রথম ও প্রধান প্রতিষ্ঠান হলো দেওবন্দ মাদ্রাসা। (ওহাবী মতবাদ)

অনৈক্য সৃষ্টির দ্বিতীয় পদক্ষেপঃ

কাছেম নানুতবীর "তাহযীরুন্নাছ"
সিপাহী বিদ্রোহের ১০ বৎসর পর দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে। এর ৮৭ বৎসর পূর্বে ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দরসে নেজামী সুন্নী সিলেবাস অনুযায়ী। কোলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আল্লামা মাজদুদ্দীন সুন্নী হানাফী। উক্ত আলিয়া মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ৮৭ বৎসর পর প্রতিষ্ঠিত হয় দেওবন্দ খারেজী মাদ্রাসাটি। ভারতের উত্তর প্রদেশের (ইউ,পি) সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে কাছেম নানুতবী সাহেব উক্ত মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। বালাকোটের পরাজয়ের পর ওহাবী আন্দোলনের কেন্দ্ররূপে উক্ত মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইবনে ওহাব নজদীর কিতাবুত তাওহীদ ও ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত কিতাব 'তাকভিয়াতুল ঈমান' অনুসরণে উক্ত মাদ্রাসা হতে পরবর্তীকালে কতিপয় জঘন্যতম কিতাব লিখিত হয়। তন্মধ্যে কাছেম নানুতবী সাহেবের লিখিত "তাহযীরুন্নাছ: অন্যতম। উক্ত গ্রন্থটি তিনি রচনা করেন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ৭ বৎসর পর, অর্থাৎ- ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে। উক্ত গ্রন্থে খতমে নবুয়ত প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে তিনি কুরআন মজিদের সূরা আহযাবের- "মা-কানা মুহাম্মদুন আবা আহাদিম মির রিজালিকুম ওয়ালাকির রাছুলাল্লাহি ওয়া খাতামান নাবিয়্যীন"- আয়াতখানা উল্লেখ করে- "খাতামুন নাবিয়্যীন" -এর ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন- "খাতামুন নাবিয়্যীন" অর্থ হলো মূল নবী। অন্যান্য নবীগণ ছিলেন আরেজী বা- সাময়িক নবী। যারা খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থ "শেষ নবী" বলে- তারা জাহেল ও মূর্খ। নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আগে বা সর্বশেষে আসার মধ্যে কোন ফজিলত নেই। ফজিলত হলো মূল নবী হওয়ার মধ্যে। তাঁর পরে যদি এক হাজার নবীরও আগমন মেনে নেয়া হয়- তাতেও হুজুরের খতমে নবুয়তের মধ্যে কোনরূপ বেশকম হবে না"-(তাহযীরুন্নাছ)।

কাছেম নানুতবী সাহেব খাতামুন নাবিয়্যীনের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন- তা সমস্ত মোফাসসীরীনদের ব্যাখ্যার বিপরীত। পূর্ববর্তী সকলেই খাতামুন নাবিয়্যীনের অর্থ- করছেন- "শেষ নবী" হিসাবে। অসংখ্য হাদীস দ্বারা উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে- শেষ নবী বলে। কাছেম নানুতবী সাহেবের পথ অনুসরণ করেই ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নবুয়ত দাবী করে বসে এবং "খাতামুন নাবিয়্যীন" শব্দটির অর্থ করে "নবীগণের আংটি বা শোভা" বলে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবুয়ত দাবীর জন্য চার্জ করা হলে সে জানায়- মাওলানা কাছেম নানুতবী সাহেব তো তার "তাহযীরুন্নাছ" কিতাবে হুজুর (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর পরে এক হাজার নবীর আগমনের সম্ভাবনা স্বীকার করে নিয়েছেন। সুতরাং আমি একজন নবুয়ত দাবী করাতে দোষ হলো কোথায়? আরও তো ৯৯৯ জন দাবী করতে পারেন" (দেখুন কাদিয়ানীদের মাহযার নামা)।

মাওলানা কাছেম নানুতবী সাহেব এভাবে "খতমে নবুয়ত" -এর আক্বিদা ও বিশ্বাসের উপর এক প্রচন্ড আঘাত করে গেছেন তার গ্রন্থে। বাংলাদেশ ধর্মমন্ত্রণালয় কাদিয়ানীদের কুফরী সম্পর্কে ১৮ সদস্যের একটি ফতোয়া বোর্ড গঠন করেছিলেন- যার মধ্যে মোহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়বিয়া আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসাবে আমাকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। আমি আমার ফতোয়ায় কাদিয়ানীদের কুফরী আক্বিদা বর্ণনা করতে গিয়ে কাছেম নানুতবী সাহেবের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছি এবং যাচাই করে দেখার অনুরোধ করেছি। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে "খতমে নবুয়তের" বিরুদ্ধে প্রথম বীজ বপনকারী ছিলেন দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা কাছেম নানুতবী সাহেব। এখন তারা খতমে নবুয়ত আন্দোলন করছে তাহযীরুন্নাছেরই সেই ব্যাখ্যা মোতাবেক।

অনৈক্য তৃতীয় পদক্ষেপঃ ফতোয়ায়ে রশিদিয়া
আকাবেরীনে দেওবন্দ বলতে যে কয়জন মুরুব্বীকে বুঝায়- তাদের মধ্যে রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী অন্যতম। তিনি ১৩০১ হিজরী মোতাবেক ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দ ফতোয়ায়ে রশিদিয়া রচনা শুরু করেন এবং ১৩২৩ হিজরী মৃত্যুকাল পর্যন্ত সমাপ্ত করেন। উক্ত কিতাব মুসলমানদের আক্বিদা ও বিশ্বাসের উপর বিরাট আঘাত হানে এবং পৃথক কট্টরপন্থী একটি ওহাবী সম্প্রদায় সৃষ্টিতে বিরাট অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ তিনি উক্ত ফতোয়ার ৯২ পৃষ্ঠায় লিখেন- "আল্লাহর পক্ষে মিথ্যা বলা সম্ভব"- অর্থাৎ আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন। কুরআন মজিদ হলো আল্লাহর কালাম। মিথ্যা বলার সম্ভাবনা স্বীকার করলে তো স্বয়ং কুরআন মজিদই সন্দেহজনক হয়ে পড়ে। তিনি উক্ত ফতোয়ার ২য় খন্ড ৯ম পৃষ্ঠায় বলেন- "রাহমাতুল্লিল আলামীন" শব্দটি নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর একক বৈশিষ্ট্য নয়; বরং অন্যান্য অলী, নবী এবং হক্কানী রব্বানী আলেমগণও বিশ্বজগতের জন্য রহমত স্বরূপ ছিলেন" অথচ কুরআন মজিদে শুধু হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) কেই রাহমাতুল্লিল আলামীন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য কোন নবীর শানেও এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। তিনি বারাহীনে কাতেয়ায় একটি ফতোয়ায় নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর মিলাদ ও কিয়ামকে ব্যাঙ্গ করে কৃষ্ণ কানাইয়ার কীর্তনের সাথে তুলনা করেছেন এবং তাবারুককে শুকুরের মাংসের সাথে তুলনা করেছেন। রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী নবী দুশমনি ও নবী অবমাননার চূড়ান্ত করে ছেড়েছেন। তার অনুসারীরা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং দেশের ও জাতির মধ্যে ধর্মীয় কোন্দলের সৃষ্টি করছে। দেওবন্দী অনুসারীরা একটি পৃথক সম্প্রদায় সৃষ্টি করে রেখেছে- যাদেরকে ওহাবী সম্প্রদায় বলা হয়। এরা ঐক্য বিনষ্টকারী বিনষ্টকারী বিপথগামী সম্প্রদায়।

ঐক্য বিনষ্টকারী চতুর্থ পদক্ষেপঃ

খলিল আহমদ আম্বেটির "বারাহীনে কাতেয়া" গ্রন্থ
ওহাবীদের অন্যতম নেতা হলো দেওবন্দ মাদ্রাসার ৩য় মুরুব্বী খলীল আহমদ আম্বেটি। তার রচিত বিষাক্ত কিতাবের নাম "বারাহীনে কাতেয়া"। রচনাকাল ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দ। কাছেম নানুতবী ১০ বৎসর পর রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী ফতোয়ায়ে রশিদিয়া রচনা শুরু করে এবং তার ৩ বৎসর পর খলীল আহমদ আম্বেটি "বারাহীনে কাতেয়া" প্রকাশ করে। খলীল আহমদ আম্বেটি নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর খোদা প্রদত্ত ইলমে গায়েবের এত ঘোর বিরোধী ছিল যে, সে তার কিতাবের ৫১ পৃঃ (দেওবন্দ ছাপা) শয়তানের ইলমকে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর চেয়ে বিস্তৃত বলে উল্লেখ করেছে এবং বলেছে- "শয়তানের ব্যাপক ইলমের কথা কুরআন মজিদের অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত- কিন্তু নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর ব্যাপক ইলম প্রমাণ করার চেষ্টা করা শিরক নয় তো কোন্ ঈমানের অংশ?
(বারাহীনে কাতেয়া দেওবন্দ ছাপা পৃঃ ৫১)

খলীল আহমদ আম্বেটি উক্ত কিতাবের দেওবন্দ ছাপা ৩৬ পৃষ্ঠায় আরও উল্লেখ করেছে- "এক নেককার বান্দা (নিজে) স্বপ্নে ফখরে আলম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) কে দেখার সৌভাগ্য লাভ করে এবং নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) কে উর্দুতে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করে- এই ভাষা আপনি কি করে আয়ত্ত্ব করলেন? আপনি তো আরবী ভাষী! উত্তরে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বললেন- যখন থেকে দেওবন্দ মাদ্রাসার ওলামাদের সাথে আমার মোয়ামালা শুরু হয়েছে- তখন থেকেই এই উর্দু ভাষা আমার আয়ত্ত্ব হয়ে গেছে। (নাউযুবিল্লাহ)।
খলীল আহমদ আম্বেটির কথা দ্বারা প্রমাণিত হয়- তারা হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর উর্দু ভাষার ওস্তাদ- আর হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) হলেন শাগরিদ? (আস্তাগফিরুল্লাহ্)। আল্লাহ পাক বলেন- "হে প্রিয় রাসুল! আপনার অজানা সব ইলম আমিই শিক্ষা দিয়েছি"। (তাফসীরে জালালাইন, সূরা নিসা, ৫ম. পারা)। দেওবন্দী, ওহাবীদের মধ্যে খলীল আহমদ ছিল খুবই ধূর্ত ও বেয়াদব এবং সাথে সাথে মিথ্যুকও।

অনৈক্যের পঞ্চম পদক্ষেপঃ

আশরাফ আলী থানভীর "হিফ্জুল ঈমান" গ্রন্থ
আশ্রাফ আলী থানবী ছিলেন দেওবন্দ মাদ্রাসার ছাত্র ও ওহাবী বিশেষজ্ঞ আলেম। তিনি তিব্বী হাকিমও ছিলেন। তার "বেহেস্তি জেওর" কিতাবের একটি পূর্ণ খন্ডই তিব্বী হাকিমী চিকিৎসা সংক্রান্ত। যেহেতু তিনি হেকেমী চিকিৎসাও করতেন- তাই তার উপাধি দেয়া হয়েছে হাকিমুল উম্মত। মূলতঃ তিনি ছিলেন ওহাবী উম্মতের হেকিম। তিনি খাঁটি ধর্মের দেহে অপারেশন চালনাকারী। ধর্ম বিশ্বাসকে কেটেকুটে তিনি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। স্বার্থক নাম হাকিমুল উম্মত। তিনি যতদিন আপন পীর হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কী সাহেবের ছায়ায়ও তত্ত্বাবধানে ছিলেন, ততদিন ছিলেন ভাল এবং ঐ সময়ের লেখনীতে নবী প্রেম বিদ্যমান ছিল। যেমন নশরুত ত্বীব। হাজী সাহেব হিজরত করে মক্কা শরীফ চলে যাওয়ার পর তার আক্বিদায় পরিবর্তন দেখা দেয়। শেষের দিকের লিখিত বেহেস্তি জেওর ও হিফজুল ঈমান প্রভৃতি গ্রন্থ সমূহে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর শানে বেয়াদবীমূলক উক্তি ও পরস্পর বিরোধী মাসয়ালা মাসায়েল পরিলক্ষিত হয়! বেহেস্তি জেওর গ্রন্থে তিনি নিজের ৩৯টি কুফরী ও বাতিল আক্বিদা লিপিবদ্ধ করেছেন। আল্লামা হাশমত আলী রেজভী বেরেলী (রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি) উক্ত বাতিল কিতাবের খন্ডন করে "ইসলাহে বেহেস্তি জেওর" নামক একখানা গ্রন্থ লিখেছেন।

অধম নিবন্ধকার "ইসলাহে বেহেস্তি জেওর" নামে উহার অনুবাদ ও সংযোজনী লিখেছি। থানভী ভক্তদের আক্বিদা সংশোধনের জন্য অনুবাদখানা ফলদায়ক হবে বলে মনে করি। যাক, আমার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে- হিফজুল ঈমান।

উক্ত পুস্তিকাখানার রচনাকাল ১৯০১ ইং মোতাবেক ১৩১৯ হিজরী। এখন থেকে ঠিক ১০৩ বৎসর পূর্বে এবং কাছেম নানুতবীর "তাহযীরুন্নাছ" কিতাবের ২৭ বৎসর পরে। থানবী সাহেব হিফজুল ঈমান পুস্তিকায় নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর খোদা প্রদত্ত ইলমে গায়েবকে অস্বীকার করে এমন অবমাননাসূচক উক্তি করেছেন যে, যে কোন ঈমানদারের ঈমানী চেতনায় প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। থানবীর নিকট প্রশ্ন করা হয়েছিল- "নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) কে আল্লাহ পাক ইলমে গায়েব দান করেছেন বলে জনৈক যায়েদ মনে করে। তার উক্ত দাবী সঠিক কিনা? এই প্রশ্নের উত্তরে থানবী রেগে বলেন- "যায়েদের দাবীকৃত ইলমে গায়েব দ্বারা যদি সমস্ত ইলমে গায়েব বুঝানো হয়ে থাকে, তাহলে তা অসম্ভব। আর যদি কিছু কিছু ইলমে গায়েব বুঝানো হয়ে থাকে, তাহলে এতে হুজুর (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর এমন কি মাহাত্ম আছে? এমন ইলমে গায়েব তো যায়েদ, বকর, আমর, শিশু, পাগল- এমন কি সকল চতুষ্পদ জন্তুরও আছে"। (হিফজুল ঈমান, ৭ম পৃষ্ঠা) (নাউযুবিল্লাহ)। উল্লেখ্য, চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে গরু-গাধা, ছাগল -এমনকি কুকুরও রয়েছে। কিসের সাথে তুলনা দেয়া হলো? এধরণের থানবী কুফরী হতে খোদার কাছে পানাহ্ চাই।

আশ্রাফ আলী থানবীর উক্ত উক্তির সারমর্ম হচ্ছে-
১. তিনি নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)- এর খোদা প্রদত্ত ইলমে গায়েবকে স্বীকার করেন না।

২. যায়েদের দাবী মতে কিছু কিছু ইলমে গায়েব স্বীকার করে নিলেও রাসুল (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর একক বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম এতে প্রমাণিত হয় না।

৩. রাসুলের কিছু ইলমে গায়েবের ন্যায় এমন ইলমে গায়েব অন্যান্য সাধারণ মানুষ, শিশু, পাগল- এমনকি চতুষ্পদ জন্তুরও আছে। (নাউযুবিল্লাহ)।

পর্যালোচনা
নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর খোদা প্রদত্ত ইলমে গায়েব কুরআন মজিদের ৫টি অকাট্য আয়াত ও দলীল দ্বারা সুপ্রমাণিত। ইহা অস্বীকার করার অর্থ কুরআনকেই অস্বীকার করা। কুরআনকে অস্বীকার করা সরাসরি কুফরী। এই জন্যই মক্কা ও মদিনা শরীফের ৩৩ জন মুফতী ১৩২৪ হিজরী সনে আরও ৪জন সহ আশরাফ আলী থানভীকে নবীজীর শানে অপমানজনক উক্তির কারণে কাফের বলে ঘোষণা করেছেন। হিন্দুস্তানের ২৬৮ জন মুফতী উক্ত ফতোয়াকে সমর্থন করেছেন। সেই ফতোয়া এখনও বহাল আছে এবং আমি সহ অনেক আলেমের নিকটই মওজুদ আছে।

উপসংহার
উপমহাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান হানাফী ও সুন্নী ছিলেন। কিন্তু দেওবন্দ মাদ্রাসার মাধ্যমে ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দ হতে অদ্যাবধি অভিশপ্ত নজদী ওহাবী আক্বিদা প্রচার ও প্রসারের দ্বারা একটি নতুন ওহাবী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে- যার বয়স ২০০৪ সালে ১৩০ বৎসর হয়েছে। দেওবন্দী আক্বিদা প্রচারের উদ্দেশ্যে দেশে অসংখ্য খারেজী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়ে অগণিত ওহাবী আলেম জন্ম দিচ্ছে। এগুলোর নাম হচ্ছে কওমী মাদ্রাসা। আসলে এগুলো খারেজী মাদ্রাসা। এর মোকাবেলা করতে হলে সুন্নী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও সুন্নী উলামা পয়দা করার কোন বিকল্প পথ নেই। সেই সাথে সুন্নী উলামাদের কলমী ও কিতাবী জেহাদ জোরে সোরে চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠায় সংস্কারমূলক কাজ করে গেছেন শাহেনশাহে ছিরিকোট হযরতুল আল্লামা ছৈয়দ আহমদ শাহ (রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি) ও তাঁর সুযোগ্য খলিফা ও শাহ্জাদা রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত গাউছে জামান হযরতুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী ছৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ (রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি) । বর্তমানে চালাচ্ছেন হযরত তাহের শাহ্ (মাঃজিঃআঃ)। চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ও ঢাকার মোহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়বিয়া আলিয়া মাদ্রাসা সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠা ও সুন্নী আলেম পয়দা করার বিরাট কারখানা দুটি উক্ত যুগশ্রেষ্ঠ দুই অলীর দুটি শ্রেষ্ঠ অবদান। সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছার জন্য আল্লাহ পাক সবাইকে তৌফিক দিন।


--------------- সমাপ্ত ---------------



Comments

Popular posts from this blog

বালাকোট আন্দোলনের হাকীকত

সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জম্ম ও পরিচয়

মওদুদীর ভ্রান্ত আক্বিদা ও ইসলামী আক্বিদা